ওসিপ ম্যান্ডেলস্টাম: কবির নিয়তি

লিখেছেন:ওসিপ ম্যান্ডেলস্টাম, নাদেঝদা ম্যান্ডেলস্টাম
কবির দায়, কবির নিয়তি কীভাবে একটা মানুষের জীবনে নির্ধারক হিসেবে কাজ করতে পারে? কীভাবে এক কবির কবিতা তাঁর জীবৎকালে রাষ্ট্রীয় কোপে মূলত ছাপা না হলেও তাঁর মৃত্যুর পরে রাষ্ট্রীয় গণ্ডীকে চ্যালেঞ্জ করে গড়ে ওঠা পাঠকদের নিজস্ব নেটওয়ার্কের মধ্য দিয়ে আবার জীবিত হয়ে উঠতে পারে? ওসিপ ম্যান্ডেলস্টাম বোধহয় তার সবচেয়ে উজ্জ্বল নিদর্শন। অথচ বাংলা ভাষার পাঠকরা তাঁর সঙ্গে এখনও তেমনভাবে পরিচিতই হয়ে ওঠেননি। পরিচয়ের প্রাথমিক সূত্রপাত ঘটানোর জন্যই এই অনুবাদ-প্রচেষ্টা।

ওসিপ ম্যন্ডেলস্টামের জন্ম ওয়ারসঅ শহরে ১৮৯১ সালে, মৃত্যু স্তালিনের গুলাগ-এ বন্দি হিসেবে ১৯৩৮ সালে। আখমাতোভা, পাস্তেরনাক, সিয়েতেভা-র মতো বহু সমকালীন কবি তাঁকে সমকালের শ্রেষ্ঠ কবির স্বীকৃতি দিলেও সোভিয়েত আমলে তাঁর লেখা তেমনভাবে প্রকাশিত হয়নি। স্তালিনিয় সমবায়ীকরণের নীতির প্রত্যক্ষ ফল হিসেবে সোভিয়েত দেশের গ্রামাঞ্চলে, বিশেষ করে ইউক্রেনে যখন কৃষকরা না খেতে পেয়ে গণহারে মৃত্যুবরণ করছে, তখন ম্যান্ডেলস্টাম স্তালিন-বিরোধী কবিতা লিখে পরিচিতদের মধ্যে পাঠ করেছিলেন। সেইজন্য তাঁকে এরপর থেকে নির্বাসনে অথবা গুলাগে বন্দি হিসেবে কাটাতে হয়েছিল। তাঁর সঙ্গী সহধর্মিণী নাদেঝদা ম্যান্ডেলস্টামের লেখা ও তাঁর নিজের কিছু কবিতার অনুবাদের মধ্য দিয়ে এই কবির সঙ্গে একটা প্রাথমিক পরিচয় তৈরির উপযোগ এখানে করা হল।

আত্মসত্তা

নাদেঝদা ম্যান্ডেলস্টাম

(বাংলা তর্জমা ও টীকা: বিপ্লব নায়ক)

এখন আমার সামনে এক নতুন কাজ, আর কীভাবে তা নিয়ে এগোবো আমি নিশ্চিত নই। আগে ব্যাপারটা ছিল কত-না সহজ-সরল: আমার কাজ ছিল ম-এর কবিতাগুলো সংরক্ষণ করা আর আমাদের জীবনে কী ঘটেছিল তার গল্প বলা। ঘটনাগুলো ছিল আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। অন্য যে কোনো বন্দীর স্ত্রীর মতো, অন্য যে কোনো স্তোপিয়াতনিৎসা-র মতো বা কোনো নির্বাসনদণ্ডে দণ্ডিতের মতো, আমি কেবল আমার সমসময় নিয়ে ভেবে যেতাম, এই প্রশ্নটাই আমার মাথায় তোলপাড় করত: কীভাবে এসব ঘটতে পারে? কীভাবে এমন দশা আমাদের হল? এসব নিয়ে ভাবতে ভাবতে আমি নিজের কথা ভুলে যেতাম, ব্যক্তিগতভাবে আমার উপর কী ঘটে চলেছে ভুলে যেতাম, এমনকি এটাও খেয়াল থাকত না যে আমি অন্য কারো জীবন নিয়ে লিখছি না, আমার নিজের জীবন নিয়েই লিখছি। অবশ্য আমার ক্ষেত্রে যা ঘটেছে তা কোনো ব্যতিক্রমী ঘটনা নয়। আমার মতো অগুন্তি নারী গোটা দেশে ঘুরে বেড়াচ্ছিল--- ত্রস্ত বোবা কিছু জীব, কারো সন্তান আছে কারো নেই, ভীরুভাবে যতটা সম্ভব তাদের করণীয় করে চলার চেষ্টায় রত, তারইসঙ্গে অনবরত ‘নিজেদের যোগ্যতামান-এ উন্নতি’ ঘটিয়ে চলায় ব্যস্ত। এই যোগ্যতামান উন্নত করার একমাত্র পথ ছিল ‘পাঠচক্র’-এ যোগ দিয়ে বছরের পর বছর ধরে স্তালিন লিখিত ‘চতুর্থ অধ্যায়’ গলাধঃকরণ করার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া, সেই গল্প সমেত যে কীভাবে বানররা  ডান থেকে বাম-কে আলাদা করতে শেখার মধ্য দিয়ে হোমো সেপিয়েন্স-এ পরিণত হয়েছিল (যে বিকাশ অবশ্য কিছু মাত্রায় ভিটামিন ও প্রোটিন-সমৃদ্ধ খাবার পাওয়ার সহায়তায় হয়েছিল, আমাদের বেলা অবশ্য তা বলা বাড়তি হবে)। যাই হোক না কেন, আমাদের অন্তত হাতে কাজ ছিল, আর মরীয়া হয়ে সেই কাজটুকুকেই আমরা আঁকড়ে থাকতাম, তা হাতছাড়া হলে আর কিছুই যে থাকবে না…। মধ্য এশিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার এক সহকর্মী, যাঁর অবস্থা বেশ ভালো বলেই আমার মনে হতো--- নিজে একা থাকার মতো একটা বাসস্থান তাঁর ছিল, একদিন রাতে যখন পাঠচক্র সেরে আমরা হেঁটে ঘরে ফিরছি, আমাকে একান্তে বললেন যে প্রতি বছর শরৎকালে তাঁর মধ্যে ‘পার্টি-ইতিহাস: সংক্ষিপ্ত পাঠ’ এবং ‘প্রকৃতির দ্বন্দ্ব’ আবারো করে পড়ার অদম্য তাগিদ জেগে ওঠে কারণ এই পাঠ তাঁকে সামনের নতুন বছরের বিদ্যাচর্চা-সংক্রান্ত কর্তব্য নিষ্পন্ন করার শক্তি যোগায়। তাঁর বয়স পঞ্চাশ হয়ে গিয়েছিল এবং তিনি আতঙ্কে ভুগছিলেন যে তাঁকে ‘অবসর’ দিয়ে দেওয়া হতে পারে। তখন ক্রুশ্চেভ-পূর্ববর্তী যুগ, যখন অবসরকালীন ভাতা-র অস্তিত্ব ছিল কেবল কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ, সুতরাং তাঁর এহেন ‘গভীর তাগিদ’-এর কারণ খুব দুর্বোধ্য নয়। আমারও সামনে সেই একই ভবিতব্য পড়ে ছিল: অবসরের বয়স এগিয়ে এলে তখনও যদি চাকরিকালের শেষ অবধি কাজ করে যাওয়ার মতো সৌভাগ্য অটুট থাকে, তাহলে ‘অদম্য তাগিদে’ দর্শনপাঠে নিরত থাকা যাতে আমাদের শাসকদের প্রজ্ঞা হজম করার নিরন্তর চেষ্টা আমার মধ্য দিয়ে ফুটে ওঠে। সেই মহিলা এবং আমার মধ্যে পার্থক্য শুধু একটাই: যাই হোক না কেন আমার মৃত্যুর সময় আমার হাতে একটি বার্তাসমেত মুখবন্ধ বোতল থাকবে ঢেউয়ে ভাসিয়ে যাওয়ার জন্য, আর ওই মহিলার সব কটা বোতলই ফাঁকা, যেগুলোও আবার সে কোনো দুর্দিনে দু-পয়সা কামানোর আশায় জমিয়ে রাখছে। কিছুদিনের মধ্যে কী ঘটতে চলেছে তার কোনো পূর্বাভাস তখন ছিল না, ফলে আমাদের আশায় বুক বাঁধার মতোও কিছু ছিল না। তখন যেন আমরা এমন এক শাসনের কেবলমাত্র সূচনাপর্বে অবস্থান করছি, যে শাসন ঐতিহাসিকভাবে হাজার বছর চলার কথা, যে সময়কাল আমাদের নিজেদের জীবনকালের তুলনায় অনন্তগুণ বড়।

তবু তো আমার মতো লোকেদের ভাগ্যবান বলতে হবে কারণ তাদের জেলখানায় পোরা হয়নি। ‘স্বাধীনতা’-র মধ্যে বাস করার অভিজ্ঞতা পূর্ণ হতে হতে আমি তখন সর্বদাই কাঁটাতারের প্ছনে থাকা মানুষগুলোর কথা ভাবতাম। এই জন্যই আমি নিজেকে নিয়ে ভাবতে পারতাম না, কেবল অন্যদের কথাই মাথায় ঘুরত--- সেই অন্যদের কথা যারা চলে গেছে, কোনোদিনও আর ফিরবে না, যারা হয়ত মনে মনে এখনও ফিরে আসার আশাকে বাঁচিয়ে রাখে, কিন্তু সেই দিন দেখা অবধি যারা বেঁচে থাকবে না। প্রতিবার যখন নতুন সব গ্রেফতারের কানাঘুষো কানে এসে পৌঁছাত, নিজেরই তাজা ক্ষতে আবার যেন কেউ নুন ঘষে দিত। ওইরকম সাধারণ দুর্দশা ও বিপর্যয়ের আবহাওয়ার মধ্যে ‘আমি’ শব্দটাই মানে হারিয়ে বসেছিল, শব্দটি যেন লজ্জার, শব্দটি যেন অবাঞ্ছিত হয়ে উঠেছিল। সবাই যখন একই ভাগ্যের ভাগীদার, কে আর তখন নিজের দুর্ভাগ্য নিয়ে নালিশ করার সাহস পায়? মনে পড়ছে কীভাবে একবার--- তখন ইতিমধ্যেই ‘নতুন যুগ’ শুরু হয়ে গেছে--- আমি যখন নিষিদ্ধ-করা রেডিও-স্টেশনগুলোর একটা শুনছিলাম১০, সেখানে কাকতালীয়ভাবে এমন একজনের লেখা বইয়ের অংশ পাঠ করা হচ্ছিল যে একটি বন্দিশিবিরে বন্দি থাকার পর, যতদূর মনে পড়ছে, পোল-দের সঙ্গে১১ ছাড়া পেয়েছিল। পঠিত অংশটিতে অন্তত সেই ব্যক্তির মূল বলার কথা ছিল: তাদের স্পর্ধা হয় কী করে যে সকলের মধ্যে থেকে তার মতো একজন মানুষকে নিজ ভিটে-ঘর থেকে ছিঁড়ে নিয়ে, সাজানো সংসার ও মায়ের সান্নিধ্য থেকে উচ্ছিন্ন করে এমন এক বীভৎস বন্দিশালায় নিক্ষেপ করার, পূতিগন্ধময় এক পাটাতনে রাতের পর রাত শুতে বাধ্য করার...! শুনতে শুনতে মেজাজ হারিয়ে আমি ওই বিরক্তিকর ঘ্যানঘ্যানানি থামাতে রেডিও বন্ধ করে দিয়েছিলাম: লোকটা নিজেকে ভাবে কী! বাধ্যতামূলক শ্রম খাটতে সে যেতে চায় না, তাই তো? এ কথা অতি সত্য যে বিশ শতকের বন্দিশিবিরগুলোকে ‘বাধ্যতামূলক শ্রম’-এর নামে চালানো অত্যধিক মোলায়েম হয়ে যাবে, আর বিশ্বের কেউই বন্দিশিবির বা গ্যাস-চেম্বারে স্বেচ্ছায় ঢুকতে চাইবে না। কিন্তু এই লোকটা তো কেবল নিজের সম্পর্কেই বলে চলেছে…। ‘পশ্চিমী’ দেশগুলো দেখেছিলাম তাকে নিয়ে হইচই শুরু করে দিয়েছিল। 

এমনকি একবার আখমাতোভা১২-র সঙ্গেও তার ‘আমি’ শব্দের ব্যবহার নিয়ে আমার ঝগড়া লেগে গিয়েছিল। আখমাতোভা তার কবিতার প্রথম-লাইন-সূচক-তালিকা থেকে একটা নির্দিষ্ট কবিতা খুঁজে দিতে বলেছিল, সেইসূত্রে কোনোকিছু না ভেবেই সে মন্তব্য করেছিল যে তার বেশিরভাগ কবিতাই ‘আমি’ শব্দটা দিয়ে শুরু। তার এই মন্তব্যে খেপে গিয়ে আমি বলতে শুরু করেছিলাম যে এই নিজেকে নিয়ে ভাবনা হল তার সবচেয়ে বড় দোষ। তার স্পর্শকাতরতা সত্ত্বেও আখমাতোভা নিজের স্বপক্ষে কিছু বলার তখন চেষ্টা করেনি--- ‘আমি’ শব্দটাকে আমি যে এত দৃঢ়ভাবে লজ্জাকর ও অবাঞ্ছিত বলে মনে করি, তা তাকে হতচকিত করে দিয়েছিল। সে নিজেও হয়ত কখনও নিজের বিরুদ্ধে এহেন বিতৃষ্ণার মধ্যে দিয়ে গিয়েছিল। যাই হোক না কেন, কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি নিজের ক্ষোভ-উদ্গীরণ স্তিমিত করে সামলে উঠেছিলাম; প্রথমত, অন্য কোনো কবির চেয়ে বেশি ‘আমি’ দিয়ে শুরু কবিতা আখমাতোভার নেই, আর, লিরিকাল কাব্যের থেকে ব্যক্তিগত আর কী-ই বা হতে পারে! তাছাড়া কী পৌনঃপুনিকতায় ‘আমি’ শব্দটি হাজির হচ্ছে কেবল তা দিয়ে নয়, কোনো ব্যক্তির রচনার সাধারণ মর্ম দিয়েই বিচার হবে স্রষ্টা কতটা ‘আত্মঅহং’-এর ক্ষতিকর প্রভাবে প্রভাবিত। আর আজ যখন আমাদের এই যুগ হয়ে উঠেছে কত না বিপুল হারে গণহত্যা ও মৃত্যুশিবিরের ব্যাপকতার যুগ, তখন নিজের স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব ও প্রকৃত স্বনির্ণয়-বোধ ধরে রাখতে পারা কি রীতিমতো কৃতিত্বেরই বিষয় নয়? এই বিপর্যস্ত সময় তো কেবল ‘আপনি বাঁচলে বাপের নাম’ গোছের বদ্ধ ব্যক্তিত্ববাদের চাষ করে, ব্যক্তির আপন মূল্যের প্রকৃত বোধ তো এখানে সহজলভ্য নয়!

আত্মসত্তা সম্পর্কে প্রকৃত বোধের এই হানি নিয়ে আমাদের যুগের গর্বিত হওয়ার কিছু নেই, তা তার একটি অসুস্থতার লক্ষণ। নিজেকে এবং আমার চারদিকের মানুষজনকে লক্ষ্য করার মধ্য দিয়ে এই রোগের চিহ্নগুলোকে আমি চিনতে শিখেছি। আত্মপরিচয় হারিয়ে বসা মানুষ দুই ধরনের হয়। একটা ধরন হল যারা আমার মতো নির্লিপ্তি-নিষ্ক্রিয়তায় নিমজ্জিত হয়ে কেবল ‘কালের বোঝাকে ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলতে’ চায়। নিজ গহন অভ্যন্তরে তারা প্রায়শই এমন এক ভবিষ্যৎ অবধি টিকে থাকার মরীয়া আশা পোষণ করে যখন তারা আবার তাদের হারানো আত্মসত্তা ফিরে পাবে--- যা তখনই একমাত্র সম্ভব যখন প্রকৃত মূল্যবোধগুলো আবার নিজেদের ফিরে পায়। এ ধরনের মানুষদের গোটা জীবনটাই তাই প্রতিশ্রুত ভূমির প্রথম রেখা ফুটে ওঠার আশায় দিগন্তে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বসে থাকা। এতাবৎ অবধি যদিও আমাদের গ্রহে তেমন কোনো প্রতিশ্রুত ভূমির অস্তিত্ব ছিল না, থাকবেও না কোনোদিন, তবু তাদের দৃষ্টি এর থেকে সরবার নয়। নিজের কান নিজেই মুলে এই ‘অপেক্ষা করার রোগ’ থেকে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টায় আমি কখনো কখনো অতিবাহিত যুগের অবসরপ্রাপ্ত ভৃত্যদের সঙ্গে নিজের তুলনা করতাম। তারাও নিজেদের গুপ্ত আস্তানায় (আমাদের মাপে বেশ আরামপ্রদ বলতে হবে) বসে বসে বিশের দশক বা--- অধিকাংশ ক্ষেত্রে--- তিরিশ ও চল্লিশের দশক ফিরে আসার কামনা করে চলেছে যাতে তারা আবার ‘শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে’ গত পনেরো বছর ধরে ‘অতিরিক্ত বেশি কথা বলতে’ শেখা মানুষগুলোকে আবার ঘাড় ধরে যথাস্থানে ফিরিয়ে দিতে পারে।১৩ এই গুণধরদের স্বপ্ন সত্য হওয়ার সম্ভাবনা অবশ্যই আমার স্বপ্ন সত্য হওয়ার সম্ভাবনার চেয়ে অনেক বেশি; তাদের বিবেচনায় ব্যক্তিমানুষের স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্বের ধারণা সবসময়েই অর্থহীন ছিল, আর তাদের অভিপ্রেত শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পারলে, একবার তাদের গুপ্তচরদের কাছ থেকে আমার অস্তিত্ব সম্পর্কে জানতে পারলেই অবিলম্বে সে অস্তিত্বে ইতি টেনে দেবে। যদিও, কে জানে, আমি হয়ত টিকে যেতেও পারি--- কারণ তারা হয়ত সাম্প্রতিক ইতিহাস নিয়েই বেশি উৎসাহী, আর আমি যেহেতু এখন আর কোনো কাজ করি না, কোথাও আমি পরিপাটী সজ্জা ভেঙে থ্যাঁতলানো বুড়ো আঙুলের মতো বিসদৃশ ভাবে বেরিয়ে থাকি না।

আত্মপরিচয়হীনতার দ্বিতীয় ধরন এর থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এই রোগ তাদেরই ঘাড়ে চেপে বসে যাদের বিবেচনায় ‘আত্মসত্তা’ হল নিছকই এমন এক আপতিক ও ক্ষণস্থায়ী পড়ে-পাওয়া-চোদ্দ-আনা যার প্রতিটি বিন্দু নিঙড়ে যতটা পারা যায় আমোদ উশুল করে নিতে হবে: সময় থাকতে তো জীবনকে উপভোগ করে নিতে হবে! তেমন সব মানুষদের কাছে ‘আত্মসত্তা’ হল এক মজার খেলনা, তা যেন জীবিত বস্তু সম্পর্কে এক উপাদেয় সচেতনতা, অন্ধ বিবর্তনের কৌতুকাভাসে রক্তমাংসে সেঁধিয়ে দেওয়া এক আমোদ-লালসা। তাই তাদের জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল নিজেকে বাঁচানো: যে যা খুশি অবলম্বন করে কেবল নিজের স্বার্থ রক্ষা করে যায়। আপতনে সিদ্ধ এক পৃথিবীতে কারোরই কোনোকিছুর প্রতি দায়বদ্ধতা নেই, তোমার সমস্ত কাজ ও তোমার সমসময়কে নিয়ে তুমি তো খাদের পেটে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।

‘আত্মসত্তা’ হারিয়ে ফেলা তাই হয় নিজেকে মুছে ফেলার দিকে ঠেলে দেয় (যেমনটা আমার ক্ষেত্রে হয়েছে), অথবা আত্মকেন্দ্রিকতা ও নিজেকে জাহির করার চূড়ান্ত মাত্রায় পৌঁছানো আকাঁড়া ব্যক্তিসর্বস্বতাবাদের রূপ নেয়। বাহ্যিক লক্ষণগুলোয় পার্থক্য থাকতে পারে, কিন্তু রোগ সেই একই: প্রকৃত ব্যক্তিত্বের মৃত্যু। আর উভয়ক্ষেত্রে অন্তর্লীন কারণটিও হল এক: সমস্ত সামাজিক বন্ধনগুলো ছিন্ন হয়ে যাওয়া। এখন প্রশ্নটা হল যে কীভাবে তা ঘটে? আমরা আমাদের নিজেদের চোখের সামনে তা ঘটতে দেখেছি। পরিবার, বন্ধুবৃত্ত, শ্রেণি, স্বয়ং সমাজ--- এহেন সকল মধ্যবর্তী সমাজ-সংযোগ আচম্বিতে অদৃশ্য হয়ে গিয়ে প্রত্যেকে বিচ্ছিন্ন একা আর তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জীবন-মৃত্যু-র সমস্ত ক্ষমতাকে মুঠোয় ধরা রহস্যময় বলের অধিকারী মহান ‘রাষ্ট্র’। লোকমুখের কথায় এর সারসংক্ষেপ একটি শব্দ দিয়েই হয়ে যায়: ‘লুবিয়াঙ্কা’১৪। এই দেশে আমরা যা প্রত্যক্ষ করেছি, তা যদি গোটা ইউরোপ জুড়ে ঘটমান এক প্রক্রিয়ার অংশ হয় মাত্র, তাহলে একথা বলতে হবে যে এমন তীব্র ও অবিমিশ্র রূপে আমাদের যুগের এই সাধারণ রোগটির প্রকোপ আমরা প্রদর্শন করেছি যে রোগটির কোনো নিরাময় বা প্রতিবিধান খুঁজতে হলে আমাদের অভিজ্ঞতাটিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বিচার করতেই হবে। যে যুগে প্রধান বুলি হল ‘প্রত্যেক মানুষ কেবল নিজের তরে’, সেখানে ব্যক্তিসত্তার মৃত্যু অনিবার্য। ব্যক্তিসত্তা বাইরের বড় পৃথিবীটার উপর নির্ভরশীল, নিজের পড়শিদের উপর নির্ভরশীল। অপরের সাপেক্ষেই তা নিজেকে সংজ্ঞাত করে এবং অপর সকলের স্বাতন্ত্র্য উপলব্ধি করার মধ্য দিয়েই নিজের স্বাতন্ত্র্য সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে। একজন ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী তার চারপাশের অন্যদের থেকে নিজেকে আলাদা বলে চিহ্নিত করে সমাজে একটি বিশেষ স্থান অধিকারের জন্য লড়াই করেন, অথবা নেহাতই বিশেষ ভাগ বা রেশন--- তাঁর জীবনের প্রহর বা দিনগুলোও যার অন্তর্গত হতে পারে--- তার অধিকারের জন্য লড়াই করেন। ধরা হতো যে প্রতিটি ক্ষেত্রেই তোমার রেশন তোমার প্রদান করা পরিষেবার উপরই কড়াকড়িভাবে নির্ভর করবে, আর আমাদের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদীদের নিজেদের প্রদেয় বস্তুর মূল্য ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখাতে কতই না চমকদার পন্থা অবলম্বন করতে হতো! যতই না খারাপ তাদের কাজের ফল হোক না কেন, তারা সর্বদা আগে থেকে অজুহাতের কাঁদুনি গেয়ে প্রশ্রয়ভিক্ষা করে রাখত, বিদ্যমান ব্যবস্থার জন্য সব দায় অস্বীকার করে রাখত আর পরিস্থিতির শিকার হওয়ার ‘অসহায়তা’ তুলে ধরত। প্রকৃত প্রস্তাবে অবশ্য এত অজুহাত-কাঁদুনি গেয়ে প্রশ্রয়ভিক্ষার দরকার ছিল না, পাপ নামক ধারণাটিকেই যে ‘ভাববাদী’ চিন্তাভ্রম হিসেবে বাতিল ঘোষণা করা হয়েছিল! আমাদের এই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদীরা, সংবেদনহীন মৃত আত্মস্বার্থ চরিতার্থতা ঘিরেই যাদের যত চিন্তাভাবনা, তারাই আমাদের সোভিয়েত সমাজের সবচেয়ে উপরে সবচেয়ে নজরকাড়া অংশ হিসেবে জাঁকিয়ে বসেছিল। তলাকার নিষ্ক্রিয় হতবুদ্ধি জনতা--- যার মধ্যে আমিও একজন--- এই মুষ্টিমেয় ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদীদের আড়ালে পড়ে কীভাবে পুরোপুরি অন্ধকারে মিশে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল তা বেশ বিস্ময়ের বিষয় বটে।

ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী ও নিষ্ক্রিয়-হতবুদ্ধি--- এই উভয় প্রকার মানুষরাই নিজেদের ‘আত্মসত্তা’ খুইয়ে বসার মধ্য দিয়ে সুস্থ-স্বাভাবিক অস্তিত্বের জন্য--- যাকে আমরা ‘সংস্কৃতি’ বলে থাকি, তার জন্য--- যা প্রয়োজন সবই হারিয়ে বসেছিল। কেবলমাত্র প্রবলভাবে অনিশ্চিত ব্যক্তিগত পরিত্রাণের জন্য কে বা পরম্পরা নিয়ে মাথা ঘামাতে চায়? পরিত্যক্ত ও অকেজো হয়ে পড়ে থাকা ‘আত্মসত্তা’-র ধারণা নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হওয়ার কারণই বা কী থাকতে পারে?... তা কেবল শ্বাসরুদ্ধ পায়ে-দলা অবস্থায় নিজ মূল্যহীন স্বীকৃতিহীন নিষিদ্ধ অবস্থান সম্পর্কে সচকিত হয়ে এখানে-ওখানে সংকোচে গড়িমসি করে বেড়ায়। সলঝেনিৎসিন-এর মতোই, আমিও কখনো কখনো অপ্রত্যাশিতভাবে লোহার শিকে বেঁধানো মাংস-কাবাব পেয়ে যাই১৫, আর মূর্ত বাস্তব হিসেবে তা আঁকড়ে ধরি, প্রায় যেন বা তা আমার প্রাপ্য রেশন, অনার্জিত বলেই আরো মধুর। কিন্তু সাধারণভাবে ধরলে, নিজ ‘আত্মসত্তা’-র জন্য খরচ করার মতো সময় আমার ছিল না, আমার সবটুকু সময়-ই ‘তারা’ এবং ‘আমরা’-র জন্য নিবেদিত ছিল, আর অন্তর্গত এক বেদনা তীব্রতম হৃদরোগের চেয়েও তীক্ষ্ণতায় বেজে চলত। আত্মসত্তা হারিয়ে ফেললে জীবনের অর্থও উবে যায়। বালককালে ম. এই অগোছালো কিন্তু অদ্ভুত কথাগুলো লিখেছিল: ‘যদি এই জীবনের কোনো অর্থ না থাকে, তাহলে জীবন নিয়ে কথা বলারও কোনো অর্থ হয় না।’… বাকি অন্যদের থেকে খুব কিছু বেশি জীবন বা জীবনের অর্থ কোনোটাই আর আমার ছিল না। কিন্তু আমরা বেশির ভাগই অন্য কারও অস্তিত্বের দ্বারা, কোনো এক ‘তুমি’-র ভাবনায়, বেঁচে গিয়েছিলাম। কোনোঅর্থের বদলে আমার জীবনে একটা মূর্ত উদ্দেশ্য ছিল: ‘তুমি’ বলে যে পুরুষটিকে আমি ভাবতাম, তার সমস্ত চিহ্ন মুছে দিতে ‘ওদের’ আমি কখনোই দেব না, তার কবিতা আমি বাঁচিয়ে রাখব। এই কাজে আমার এক সহযোগী ছিল, সে হল আখমাতোভা। টানা আঠারো বছর--- বন্দিশিবিরে অন্তরীণ থাকার জন্যও বেশ লম্বা সময়--- নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে আমরা কাটিয়েছি, কোনো মহল থেকে কারো সহায়তা আমরা পাইনি, আমাদের দুজনেরই প্রিয় যে নাম তা জোরে উচ্চারণ করার সাহসও আমাদের ছিল না, কেবল যখন আমরা দুজন ছাড়া আর কেউ নেই, তার লেখা একগুচ্ছ কবিতার উপর ঝুঁকে পড়ে উত্তেজনায় কাঁপছি, তখন কেবল ফিসফিসিয়ে আমরা তার নাম উচ্চারণ করতাম। অবশেষে যখন আশার প্রথম চিহ্নগুলো দেখা দিতে শুরু করল, আখমাতোভা বারবার বলত, ‘ওসিয়ার জন্য সবকিছু ঠিক আছে, নাদিয়া।’ এর মধ্য দিয়ে সে বোঝাতে চাইত যে ম.-এর লেখা আবার লোকে পড়ছে। ‘সামিজদাত১৬-এর গুরুত্ব উপলব্ধি করতে আমার কিছুটা সময় লেগেছিল, ম.-এর লেখা যে ছাপা হচ্ছে না তা নিয়ে আমি হতাশ হয়ে পড়ছিলাম, কিন্তু আখমাতোভা-র কাছে তারও জবাব ছিল, সে বলত: ‘গুটেনবার্গ-পূর্ববর্তী যুগে১৭ আমরা বাস করছি’, বা, ‘ওসিয়া-র কোনো ছাপাখানা দরকার হয় না’। ধীরে ধীরে আমিও বুঝতে পারলাম কত না সত্যি ছিল তার কথাগুলো: কবিতা এমনই এক অধরা বস্তু যাকে না পারা যায় লুকিয়ে রাখতে, না পারা যায় তালাচাবি এঁটে আটকে রাখতে। হঠাৎই চারদিকে গজিয়ে ওঠা আগ্রহী নতুন পাঠককুলের কাছে পৌঁছানোর রহস্যময় অলিগলিগুলো প্রথমে কবিতাই ফাটল ধরিয়ে তৈরি করেছে, তারপর গদ্য তাকে অনুসরণ করেছে। যখন পাঠক পাওয়ার আর কোনো আশাই প্রায় অবশিষ্ট ছিল না, তখন একেবারে অপ্রত্যাশিতভাবেই এই নতুন পাঠকরা আবির্ভূত হল। তারা শিখে নিল তাদের যা দরকার তা বেছে নিতে, আর তাদের হাতে-তুলে-নেওয়া কবিতা তাদের রূপান্তর ঘটিয়ে সঠিক রাস্তায় এগিয়ে দিল।

ম.-এর লেখা বই শেষ ছাপা হয়েছে তা প্রায় চল্লিশ বছর হয়ে গেল১৮, আর তার এযাবৎ প্রকাশিত নয়টি বইয়ের মোট মুদ্রণসংখ্যা তিরিশ হাজারের বেশি হবে না। কিন্তু যেসব লেখকদের লেখাপত্র আজ নেশাদ্রব্যের মতো বাজার ছেয়ে দিয়ে সবচেয়ে বেশি বিক্রিত হচ্ছে, বাস্তবে ম. তাদের চেয়ে অনেক বেশি জলজ্যান্ত হয়ে আছে। যে সমস্ত কবিতাকে একদা পায়ে মাড়িয়ে চিরতরে মুছে ফেলা হয়েছিল যেনবা, সেইসব কবিতাগুলোরই ফের পুনর্জন্ম নিয়ে ফিরে আসার ঘটনা দেখে আখমাতোভার বিস্ময়ের অন্ত ছিল না। সে সবসময় বলত, ‘কবিতা যে এত দীর্ঘজীবী হতে পারে তা আমরা কখনো ভাবিনি। আমাদের যৌবনে কবিতা যা বলে আমরা ভেবেছিলাম তা ভুল প্রমাণিত হয়েছে।’ কবিতা যে কী তা পুরোপুরি হয়ত আমরা তখনও বুঝিনি, কিন্তু তার কিছু ঝলক অবশ্যই আমরা তখন পেয়েছিলাম। যে দীর্ঘ বছরগুলো ধরে আমরা ম.-এর কবিতাগুলো সংরক্ষণ করে রাখার চেষ্টা করে গেছি, তখন আশা করার মতো সাহস হয়নি হয়ত, কিন্তু এই বিশ্বাস আমরা কখনো হারাইনি যে কবিতাগুলোর পুনর্জন্ম একসময় না একসময় হবেই। এই বিশ্বাসই আমাদের চলার শক্তি যুগিয়েছে। কবিতার স্থায়ী মূল্য এবং পবিত্র নৈতিক চরিত্রে আস্থাই ছিল তার মূল কথা। স্বজ্ঞাপ্রণোদিতভাবেই আমরা বোধহয় বুঝেছিলাম যে কবির ভাগ্য একমাত্র সময়ের হাতেই নির্ধারিত হতে পারে, আর তাই, আমাদের মরে গেলে চলবে না, সামগ্রিকভাবে বিশ্বের কাছে মূল্যায়নের জন্য কবির কাজকে হাজির করে যেতে হবে। এখন যখন সেই কাজ সমাধিত হয়েছে, ভবিষ্যতে কী ঘটবে তা আর আমাদের হাতে নেই। আমরা কেবল আস্থা রেখে আশা করে যেতে পারি। আমি নিজে কখনো ম. এবং আখমাতোভার কবিতায় আস্থা হারাইনি। আমাদের সেই ব্যক্তিত্বরহিত পৃথিবীতে, যেখানে যা কিছু মানবিক তারই কন্ঠরুদ্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, একমাত্র কবি-ই নিজ ‘আত্মসত্তা’ রক্ষা করতে পেরেছিল আর তাই তার কন্ঠস্বরই এখনও কান পাতলে শোনা যায়।

আত্মসত্তা হারানোর--- বা ব্যক্তিত্ব খুইয়ে বসার--- দুটি রূপের পার্থক্য ছিল এই যে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদীরা ব্যক্তিত্বের মধ্যে ধারিত সমস্ত মূল্যবোধকে অস্বীকার করত, আর অন্য যারা অসাড় নিষ্ক্রিয়তায় নিমজ্জিত হয়ে নিজেদের ব্যক্তিত্বকে সর্বত অবদমিত করে রাখলেও আপনার মধ্যে অন্তঃস্থ স্বাধীনতার ছোট একটা ফুলকি বজায় রেখেছিল, তারা নিজেদের কিছু মূল্যবোধ আঁকড়ে ধরে থাকত। বেশিরভাগ মানুষের মধ্যেই সেই স্মৃতি ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে এলেও, ক্ষীণ স্মৃতিটুকুই যথেষ্ট ছিল জীবনের কঠোর বাস্তবতার তাড়নায় সর্বস্ব খুইয়ে বসা থেকে বাঁচার জন্য।

সামিজদাত মাধ্যমে আজকাল ম.-এর কবিতা কত সংখ্যায় প্রচারিত ও পঠিত হয় তা বলা অসম্ভব, কিন্তু খুব সম্ভবত সে সংখ্যা তরুণতর প্রজন্মদের কবিতার প্রচারসংখ্যা থেকে অনেক বেশি। এই ধারণা এদিক থেকেও সমর্থিত হয় যে সাম্প্রতিক সময়ে ম.-এর যে একটিমাত্র ছোট বই ‘দান্তে বিষয়ক সংলাপ’১৯ পুনর্মুদ্রিত হয়েছিল, তার সব কপিই তৎক্ষণাত বিক্রি হয়ে গিয়ে বইয়ের দোকানগুলোয় শেষ হয়ে গিয়েছিল। নিজেদের চোখের সামনে আমরা এই নতুন পাঠকদের আবির্ভূত হতে দেখেছি, কিন্তু কীভাবে যে তা সম্ভব হল তা বোঝা একদম অসম্ভব। এটুকুই কেবল বলা যায় যে তা সমস্ত রকম প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েই ঘটেছে। গোটা শিক্ষাব্যবস্থাটাই এহেন পাঠকদের আবির্ভাব আটকাতে সাজানো হয়েছিল। কিছু কবির নাম একেবারে চেপে রাখা হয়েছিল, আর বাকি কিছু কবিকে গণজ্ঞাপনমাধ্যমে ও পার্টির ডিক্রিতে নিন্দা-ভর্ৎসনা করা হতো--- তাদের স্মৃতিটুকুও মুছে দেওয়ার সংকল্প নিয়ে জারি হওয়া সেই বিপুল প্রচেষ্টা পেরিয়ে তাদের টিকে থাকাটা অসম্ভব বলে মনে হতে শুরু করেছিল। আর তখনই, হঠাৎ, সবকিছু বদলে গেল, সামিজদাত উঠে এল। কেউ জানে না কে এই সামিজদাত প্রথম শুরু করেছিল, কীভাবে তা তার কাজ করে চলে তা-ও আমাদের বোধের অগম্য, কিন্তু বাস্তবে তা অস্তিত্বমান এবং তার পাঠকদের প্রকৃত চাহিদা তা মিটিয়ে চলেছে।

এই পাঠকরা কারা তা জানতে পারলে আমি খুব খুশি হব। তাদের গুণমানের উপর আমি খুব ভরসা করতে পারি না, কারণ যুক্তিবাদ-ঘাঁটা এমন শিশুখাদ্য খাইয়ে তাদের বড় করা হয়েছে যা যুক্তিযুক্তভাবে চিন্তা করার ক্ষমতাটাকেই পঙ্গু করে দেয়--- প্রতিটি ভাবনাকে হাজারো উপায়ে বিকৃত করে তবে তাদের কাছে পৌঁছতে দেওয়া হয়েছে। এখন এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে যে গড়পড়তা পাঠক নতুন ভাবনার দিকে ফিরেও তাকাতে চায় না কারণ যাকিছু নতুন তাকেই সন্দেহের চোখে দেখতে অভ্যস্ত করে তোলা হয়েছে। অতি দীর্ঘ কাল কেটে গেছে যখন তার চোখে ঠুলি পরিয়ে রাখা হয়েছিল, আসল ভাবনা বলে নকল সব হাবিজাবি তার হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল। এখনও সে আসল-নকলে বিভেদ করতে না পেরে প্রতিক্রিয়াবশত অপর চরমবিন্দুর দিকে ঢলে পড়ছে: তার অপরিপক্ক যুক্তিবিস্তার-প্রক্রিয়ার গণ্ডীর বাইরের যে কোনো কিছুর দিকেই আকর্ষিত হচ্ছে। যা তারা বোঝে না, তারই সমাদর করে, ‘অযৌক্তিক’ বা ‘বিষয়ীগত’ বলে একটা আখ্যাও সেঁটে দেয় তার গায়ে, কিন্তু তাদের চিন্তার বর্গগুলো এমন দোমড়ানো-মোচড়ানো চেহারা ধারণ করেছে যে ওইসব আখ্যা দিয়ে তারা যে ঠিক কী বোঝাতে চাইছে তা বোঝা দুষ্কর। তারা ‘বিষয়ী’ এবং ‘বিষয়’-কে এমন দুটি স্পর্শনীয় ত্রিমাত্রিক ধারণা বলে অতিসরলীকরণ করে বসে আছে যার সঙ্গে ওই ধারণাদুটির সাধারণ অর্থের কোনো সম্পর্কই নেই: তাদের ধারণামতে ‘বিষয়’ একটা টেবিলের উপর পড়ে থাকে আর ‘বিষয়ী’ তা ফালাফালা করে কাটে, ঠিক যেমন ‘ষাট দশকের কোনো মানুষ’২০ ব্যাঙ চিরে ফালা করত। তাছাড়াও তারা কল্পনা করে নেয় যে ‘বিষয়গত’ জগতের মধ্য দিয়ে যেতে হলেও ‘বিষয়ী’-কে কোনো না কোনোভাবে নিজের বাইরে বেরিয়ে এসে তবেই সেই জগতকে বুঝতে হয়। ‘বিষয়ী’ হল ক্ষুদ্র, ‘বিষয়’ বৃহৎ--- আর তা থেকেই বুঝি বা উভয়ের অন্য সমস্ত বৈশিষ্ট্য উৎসারিত হয়!... বস্তুকে দেখার এহেন অতিসরলীকৃত দৃষ্টিভঙ্গি সেই শিক্ষাব্যবস্থার ফসল যা দৃষ্টবাদী জগাখিচুড়ি সেবন করিয়ে আমাদের বয়স্কতর প্রজন্মের মাথা খেয়েছে। সেই প্রজন্ম আবার তার পরবর্তী প্রজন্মকেও তা চামচে করে গিলিয়েছে। আর তার বিপর্যয়কর ফলই এখনও আমরা তরুণতর প্রজন্মের মধ্যে দেখতে পাচ্ছি: যে শিশুখাদ্য তাদের খাওয়ানো হয়েছিল তা তাদের রক্তে মিশে গিয়ে বিষক্রিয়া করে যাচ্ছে। বাস্তবতা সম্পর্কে এমনই এক আদিম ভয় তাদের শাসন করে চলেছে, সেই শাসনে তারা এমনই পরাভূত, যে, বাস্তবতার মধ্যে কোনো অর্থ বা যুক্তিগত যোগাযোগ অনুসন্ধানের ক্ষমতা তাদের নেই। সবচেয়ে বড় কথা, যুক্তিসঙ্গত চিন্তা কোন্ সিদ্ধান্তে উপনীত করে দেবে তা নিয়ে তারা ভয়ার্ত, আর তাই তা এড়িয়ে চলতেই অভ্যস্ত। জনগণের বিপুল সিংহভাগ কেবল বাস্তবতার উপরিতল দিয়ে পিছলে সরে যেতে পারলেই খুশি, বাস্তবতার ভিতরে প্রবেশ করে বোঝাবুঝি করার যে কোনো চেষ্টা তারা সযত্নে এড়িয়ে চলে।

মানবপ্রজাতির ইতিহাসে সবচেয়ে বুদ্ধিদীপ্ত মানুষদের একজন একদা বলেছিলেন যে চিন্তা যখন শুকিয়ে যায়, শব্দরা তার জায়গা দখল করে বসে। শব্দ খুব সহজেই অর্থপূর্ণ চিহ্ন থেকে নেহাতই এক সংকেতে রূপান্তরিত হতে পারে, আর এক গুচ্ছ শব্দ তখন এমন এক সারশূন্য  সূত্রে পরিণত হয় যার মধ্যে জাদুমন্ত্রে ধারিত সারটুকুও আর থাকে না। আমরা তখন ধরাবাঁধা বাক্যবন্ধ বিনিময় করতে থাকি, এটুকুও খেয়াল করি না যে কোনো প্রাণবন্ত অর্থই আর তাদের মধ্যে অবশিষ্ট নেই। অর্থ যে কী তা-ও তখন আমাদের মতো কাঁপুনি-ধরা অভাগা জীবেদের বোধের অগোচর; যে জগতে যুক্তির আর কোনো ঠাঁই মেলে না সেখান থেকে অর্থ তখন উবে গেছে। তা তখনই আবার ফিরে আসতে পারে যদি মানুষরা আবার নিজ বোধ ফিরে পায় এবং তাদের ফের মনে পড়ে যায় যে সবকিছুর জন্য, বিশেষ করে নিজের আপন সত্তার জন্য মানুষকেই জবাবদিহি করতে হবে।

কিন্তু এসব সত্ত্বেও, পাঠকদের গুণমান যা-ই হোক না কেন, পাঠকরাই চূড়ান্ত বিচারক। এই পাঠকদের জন্যই আমি ম.-এর কবিতা এতদিন আগলে রেখেছিলাম আর তাদের হাতেই আজ আমি তা তুলে দিয়েছি। আর এখন, এই যে দীর্ঘ পর্বের মধ্য দিয়ে আমরা জীবনযাপন করে চলেছি, সেখানে এক অদ্ভুত প্রক্রিয়া ঘটতে শুরু করেছে: কবিতার একটা বই হাতে নিয়ে অর্ধমনস্কভাবে পাতা ওলটাতে ওলটাতে তার নিজের অগোচরেই পাঠক ধীরে ধীরে ভিজে উঠছে, ক্রমশ তা তার ভিতরের অসাড় হয়ে থাকা সুপ্ত সত্তাগুলোকে নাড়িয়ে দিচ্ছে, জাগিয়ে দিচ্ছে, আবার প্রাণবন্ত করে তুলছে, কবিতার ছোঁয়া পুনরুজ্জীবন ঘটিয়ে চলেছে। এই বিক্ষেপণ, পরস্পরের মধ্যে প্রবেশ করে ছড়িয়ে যাওয়ার এই প্রক্রিয়া কিছু মানুষকে অন্তত নিজ বোধে ফিরিয়ে আনছে এবং অভিশপ্ত জাড্যের কবল ভেঙে বেরোতে শক্তি যোগাচ্ছে। অন্যান্য দেশে কেমন তা আমি জানি না, কিন্তু আমার এই দেশে কবিতা নিরাময়, সুশ্রুষা ও জীবন ফিরিয়ে দেওয়ার কাজ করছে; কবিতার ভিতরের শক্তিসুধা পান করার সক্ষমতা এদেশের মানুষ এখনও হারায়নি। এখানে কবিতার জন্য মানুষকে হত্যাও করা হয়--- সম্মান জানানোর এর থেকে বড় চিহ্ন আর কী হতে পারে!--- কারণ এখনও মানুষ কবিতা দিয়ে বেঁচে থাকতে পারে। যদি আমার এই চিন্তা সঠিক হয়, যে কবিতাগুলোকে আমি এতদিন আগলে বাঁচিয়ে রেখেছি সেগুলো যদি মানুষের কিছু কাজে লাগে, তাহলে বুঝব যে আমি আমার জীবনটাকে অপচয় করিনি; সেই মানুষটি যে ছিল আমার অপর সত্তা আর সেই সব মানুষ যাদের মানবিক প্রবৃত্তি কবিতার ছোঁয়ায় জাগ্রত হয়, তাদের প্রতি আমার যে কর্তব্য ছিল তা আমি করতে পেরেছি। যদি তা-ই হয়, তবে আমার জন্য হয়তো পূর্বনির্ধারিত হয়ে থাকা কর্তব্যটিকে বুঝে নিতে আমার ভুল হয়নি।

এই যে আমি ভাবতে শুরু করেছি আমার জন্য কর্তব্য নির্ধারিত ছিল কিনা, ভাবতে শুরু করেছি কতটা ভালোভাবে আমি সে কর্তব্য নিষ্পন্ন করতে পারলাম, এই ভাবনাগুলোই নিশ্চিতভাবে জানান দিচ্ছে যে আমি আমার ‘আত্মসত্তা’ ফিরে পেতে শুরু করেছি। এর আগে আমার প্রথম বইটা২১ লেখার সময় আমি নিজেকে সেখান থেকে বাদ দিয়ে রেখেছিলাম। তা কোনো সচেতন উদ্দেশ্য ছাড়াই নেহাত স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে ঘটেছিল: তখনও আসলে আমার কোনো অস্তিত্ব ছিল না। তখনই আমার জীবন ফিরে এল যখন আমার প্রধান কর্তব্যটি নিষ্পন্ন হয়েছে। স্পষ্টতই, আমার ‘আত্মসত্তা’, দুমড়ে-মুচড়ে গেলেও, টিকে ছিল এবং নিজের মতো নিশ্বাস ফেলার ছোটো একটা পরিসর পেলেই নিজেকে ফিরে পাওয়ার মতো অবস্থায় ছিল--- বিশেষ করে বুড়ো বয়সে যখন অতীত বছরগুলোর যন্ত্রণা মিলিয়ে না গেলেও এক প্রকার মনের শান্তি অর্জিত হয়, তখন তা আরো সক্রিয় হয়ে ওঠে। আরো পরবর্তী কোনো পর্যায়ে হয়তো যন্ত্রণা সব মুছে গিয়ে বার্ধক্যপীড়িত আত্মতুষ্টি সব ছেয়ে দেয়--- কিন্তু আমি এখনও সেই পর্যায়ে পৌঁছইনি। ওই পর্যায়ে চলে গেলে আর লেখা যাবে না--- শব্দ ও চিন্তা উভয়ই যন্ত্রণার দ্বারা জারিত হয়, যন্ত্রণাই বাস্তবতার বোধ তীক্ষ্ণ করে তোলে, জগতের প্রকৃত যুক্তিকাঠামোকে উন্মোচিত করে। যে সৃজনশীল উপাদান জীবনকে গড়ে তোলে ও লালন করে এবং ঠিক তার বিপরীত মৃত্যু ও ধ্বংসের যে বলগুলো কোনো না কোনো কারণে প্রথম দৃষ্টিতে অতি যুক্তিসঙ্গত, লোভনীয়, হয়তো বা অপ্রতিরোধ্য বলে মনে হয়--- এই দুইয়ের মধ্যে পৃথকীকরণ যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যাওয়া ছাড়া করা যায় না। এখন আমি আমার যন্ত্রণা তীক্ষ্ণভাবে অনুভব করছি এবং এখন আমি কেবল আমার নিজের বিষয়েই লিখব, যদিও কার্যত আরো অনেক কিছুই সেখানে চলে আসবে। আসলে আমার নিজেকে নিয়ে যতটা না, তার থেকে অনেক বেশি আমার জীবন যাপন করার পথে জমে ওঠা টুকরো টুকরো অভিজ্ঞতার সঞ্চয় নিয়ে আমি বেশি ভাবিত। এখন এই গোটা সঞ্চয় নেড়েচেড়ে দেখতে দেখতে মনে হচ্ছে যে এর মধ্য দিয়ে বেশ কিছু বিষয় সম্পর্কে আরো ভালো বোঝাবুঝিতে হয়তো আমি পৌঁছতে পারব। এই জীবন যদি আমাদের জন্য প্রদত্ত হয়, তাহলে নিশ্চয়ই তার কোনো অর্থ থাকবে--- যদিও আদপে এই ভাবনাটিকেই প্রবীণ-নবীন নির্বিশেষে আমার জানা সবাইকে নাকচ করে আসতে দেখেছি গোটা জীবনকাল জুড়ে। ‘বৈজ্ঞানিক’ দৃষ্টিভঙ্গির প্রলোভন-ফাঁদে পা দিয়ে তারা স্পষ্ট-নির্দিষ্ট প্রমাণ হাজির করা যায় না এমন সবকিছু থেকেই মুখ ঘুরিয়ে থেকেছে। গাণিতিক চরিত্রের যুক্তিবাদকে তারা আদর্শ হিসেবে ফলাও করত, যদিও, দুর্ভাগ্যক্রমে, সেই আদর্শের প্রতি অনুরাগও কেবল মুখের কথার আস্ফালনেই সীমাবদ্ধ ছিল। হাতুড়ে বাগাড়ম্বরকারীরা যেসব ছদ্মবৈজ্ঞানিক তত্ত্ব খাড়া করে তার দায় তো বিজ্ঞানের উপর বর্তায় না, আর যেসব বস্তু কখনোই তোমার নাগালে ধরা দেয় না তাদের অর্থ নিয়ে মাথা ঘামানোরই বা কী আছে?

নবীন বয়সে জীবনের অর্থ সম্পর্কিত প্রশ্নটিকে চাপা দিয়ে প্রধান হয়ে উঠেছিল জীবনের লক্ষ্য নির্দিষ্ট করার জন্য অনুসন্ধান। এটা এতই চালু রেওয়াজ যে এখনো এই দুইয়ের মধ্যে খুব পার্থক্য করা হয় না। আমাদের নবীনকালের সেই বছরগুলোয় বিপ্লবী তরুণ-তরুণীরাই জীবনের লক্ষ্যের প্রশ্নটিকে সজোরে তুলত এবং তাদের কাছে এর উত্তরও ছিল একটাই: গোটা মানবজাতির জন্য সুখের দিন নিয়ে আসা। আজ আমরা জানি সেই লক্ষ্যের পিছনে ছোটা কোন বিবরে এনে আমাদের উপনীত করেছে। লক্ষ্য নির্ধারণ করার বিপরীতে জীবনের অর্থ সম্পর্কিত সমস্যা নিয়ে নবীন বয়সে খুব কম লোকই মাথা ঘামায়, যেহেতু কেবলমাত্র ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার নিক্তিতেই তা অনুধাবন করা যায় এবং আপনার আপন পূর্বনির্ধারণের সঙ্গেও তা মিলেমিশে থাকে। তাই সাধারণত প্রবীণ বয়সে এসেই মানুষ এই বিষয়ে ভাবতে শুরু করে--- আর তা-ও সেইসব মানুষরাই যারা নিজের অতীত জীবনের দিকে ফিরে তাকিয়ে মৃত্যুর জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে তোলে, বলা বাহুল্য যে বেশিরভাগ লোকই তা করে না।

খুবই উচ্চকিত কিছু গুণের অধিকারী নয় এমন মানুষের সাপেক্ষে ‘পূর্বনির্ধারণ’ শব্দটির ব্যবহার হয়তো বাহুল্য হয়ে যাবে। এভাবে বরং ভাবা ভালো যে ব্যাপারটা হল জীবনের পথ জুড়ে যে সহস্র ভুল পদক্ষেপ বা ভুল দিকে মোড় নেওয়ার সম্ভাবনা ছড়িয়ে আছে, তার মধ্য থেকে সচেতন অভিপ্রায় খাটিয়ে সঠিক পথটি বেছে নেওয়া। পিছন ফিরে তাকিয়ে এমন বোধ হতে পারে যে তোমার পেরিয়ে আসা পথটি পূর্বনির্ধারিত ছিল, কিন্তু সেই গোটা পথ জুড়েই তো এমন হাজার হাজার মোড় ও বাঁক ছিল যেখানে তুমি সম্পূর্ণ আলাদা যাত্রাপথ বেছে নিতে পারতে। আমাদের জীবন নিয়ে আমরা যা করি তা কিছুটা মাত্রায় সামাজিক শর্তাধীনতায় আবদ্ধ যেহেতু আমরা প্রত্যেকেই বিশেষ একটি ইতিহাস-মুহূর্তের বাসিন্দা, কিন্তু অনিবার্যতার শাসন তো আমাদের এই ইতিহাস-স্থানাঙ্ক-নির্দাষ্ট পরিসরের মধ্যেই আবদ্ধ--- তার বাইরে এলেই তো সবকিছু আমাদের ইচ্ছা-অভিপ্রায়-এর উপর নির্ভর করে। স্বাধীনতা তাই সীমাহীন, আর এমনকি আপনার আপন ‘আত্মসত্তা’ বা ব্যক্তিত্বও এমনকিছু নয় যা ‘পূর্বপ্রদত্ত’ বা চিরদিনের জন্য নির্দিষ্ট, বরং তা গোটা জীবনপথ জুড়ে বেশিরভাগটাই বেছে নেওয়া মোড় বা বাঁকের উপর নির্ভর করে বদলাতে বদলাতে আকার নিতে নিতে যায়।

কেবলমাত্র বিশেষ গুণের অধিকারী যারা--- সাধারণত কাব্যিক প্রবণতার চেয়ে দার্শনিক প্রবণতা যাদের বেশি--- তারাই তরুণ বয়সে জীবনের অর্থ নিয়ে ভেবে থাকে। এই বিষয়ে ম.-এর যে কথাগুলো এই অধ্যায়ে আগে উদ্ধৃত করেছি, তা তার একটি খসড়া লেখার অংশ হিসেবেই থেকে গেছে, কখনো কোনো চূড়ান্ত লেখার অঙ্গীভূত হয়নি। ম. জীবনকে গ্রহণ করেছিল তা যেরকম ঠিক সেরকমভাবেই, জীবনের বিবিধ ধন সম্পর্কে সে তীব্রভাবে সচেতন ছিল। তার কারণ আমার মনে হয় সে একদম শুরুতেই সে তার কাব্যকুশলতার গুণকে একটি পূর্বনির্ধারণ হিসেবে দেখেছিল। একদম শুরুর দিকে লেখা, তবে সবেমাত্র প্রকাশিত হওয়া তার কিছু লেখায় এর নিদর্শন পাওয়া যায়:

তার হৃদয় যেন মেঘে মোড়া

আর দেহমাংস পাথরের ভেক ধরেছে

যতক্ষণ না ঈশ্বর তার কবির নিয়তি ব্যক্ত করে।

গানের জন্য যেমন, তেমন যুদ্ধের জন্যও প্রস্তুত

সে আছে গোপন সংকেতের অপেক্ষায়

আর তার শব্দগুলোর নেহাত পরস্পর জোড়-বাঁধা

বিবাহবন্ধনের পবিত্রতায় বিন্যস্ত হয়।

এই পূর্বনির্ধারণ নিয়ে ম.-এর কোনো সন্দেহ ছিল না এবং পরবর্তী অদৃষ্টের মতো একেও সে একইরকম সহজভাবে নিয়েছিল--- বরং বলা যায়, যে শান্ত নিশ্চয়তার সঙ্গে সে কবি হিসেবে নিজের কাজ গ্রহণ ও নির্বাহ করেছিল, তা-ই তার পরবর্তী অদৃষ্টকে ডেকে এনেছিল। পেশাদার লেখককূল, শিল্প-সাহিত্যের উচ্চ পুরোহিতের আসনে অধিষ্ঠিত যারা, তারা এতে যারপরনাই খেপে গিয়েছিল। এই দেশে তো বটেই, যে কোনো দেশে যেখানে ব্যক্তিগত ও নিজস্ব বিষয় হিসেবে নির্মিত সাহিত্যকে নীতিগতভাবে নিষিদ্ধ বলে ধরা হয়ে থাকে, সেখানেই ম.-এর সঙ্গে সাহিত্যিক প্রতিষ্ঠানের বিরোধ বাঁধা অনিবার্য, আর সেমত প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বিরোধ সর্বদাই রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ ডেকে আনে। তবু তারা হয়তো ম.-কে সহ্য করে নিতে পারত যদি ম. অন্তত তাদেরই মতো নিজ গুরুত্বকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে প্রদর্শনী লাগিয়ে রাখত, জাঁকজমকের চেয়ে মোহিনী শক্তি আর কীসের আছে!  কিন্তু সাহিত্য ভাঙিয়ে ওই জমকের জগতে জায়গা কেনা নিয়ে ম.-এর বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না। অন্য নানা কাজে সে অতি ব্যস্ত ছিল। বইপত্র, মানুষজন, কথোপকথন, দৈনিক ঘটনা, এমনকি কেরোসিন বা রুটির জন্য দোকানে ছোটার মতো হীন কাজ, এসব দিয়েই তার প্রতিদিনের প্রতিটা মুহূর্ত পুরো ভরে থাকত।… আমার মতো হালকা মাথার মানুষও তার অদূরদর্শিতা দেখে অবাক হয়ে যেত। আর সময়টাতো খুব অনুকূল ছিল না।

 

 

টীকা

১। নাদেঝদা ম্যান্ডেলস্টাম: ওসিপ মান্ডেলস্টাম-এর স্ত্রী। স্তালিন জমানায় যখন ওসিপ ম্যান্ডেলস্টাম-কে ‘মুছে ফেলা’-র প্রক্রিয়া শুরু হল, কবির সঙ্গে কবিপত্নী হিসেবে তিনিও নির্বাসিত জীবন কাটিয়েছেন, গুলাগ-এ বন্দি অবস্থায় কবির মৃত্যুর পরও সেই নির্বাসিত জীবন প্রলম্বিত হয়েছে। সোভিয়েত কর্তৃপক্ষের নাগাল এড়িয়ে ওসিপ ম্যান্ডেলস্টামের লেখাপত্রের পাণ্ডুলিপি তিনিই লুকিয়ে রেখে সংরক্ষিত করেছিলেন, এমনকি বহু কবিতা কেবল স্মৃতিতে হুবহু ধরে রেখেছিলেন। স্তালিন জমানা অবসানের পর সুযোগ এলে সেগুলো প্রকাশের উদ্যোগও নিয়েছেন। মূলত তাঁর জন্যই পরবর্তী প্রজন্মের কাছে ওসিপ ম্যান্ডেলস্টামের লেখা এতটা অক্ষতভাবে পৌঁছতে পেরেছে। ১৯৭২ সালে তিনি একটি স্মৃতিবিবরণ লেখেন, যা ১৯৭৪ সালে ইংরেজি অনুবাদে (অনুবাদক: ম্যাক্স হেওয়ার্ড) ‘Hope Abandoned’ নামে প্রকাশিত হয় (অ্যাথেনিয়াম পাবলিশার্স, নিউ ইয়র্ক, ১৯৭৪)। সেই বইয়ের প্রথম অধ্যায়টিই এখানে বাংলা তর্জমায় হাজির করা হল।

২। এখানে আগাগোড়া লেখিকা ওসিপ ম্যান্ডেলস্টাম-কে ‘ম.’ (‘M’) বলে উল্লেখ করে গেছেন।

৩। স্তোপিয়াতনিৎসা: আক্ষরিক অর্থে ‘একশো-পাঁচ-ওলা’। স্তালিনের সোভিয়েত ইউনিয়নে এর মানে ছিল সেই সমস্ত দণ্ডিত লোকজন যাদের যে কোনো বড় শহরের ১০৫ কিলোমিটারের মধ্যে বাস করা নিষিদ্ধ। ওসিপ ম্যান্ডেলস্টাম এই দণ্ডে দণ্ডিত ছিলেন।

৪। চতুর্থ অধ্যায়: স্তালিনের লেখা ‘সোভিয়েত ইউনিয়নের কম্যুনিস্ট পার্টির ইতিহাস: সংক্ষিপ্ত পাঠ’ (১৯৩৮) বইয়ের দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ বিষয়ক অধ্যায়।

৫। তাসখন্দ-এর বিশ্ববিদ্যালয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় লেখিকাকে সেখানে পড়ানোর কাজে পাঠানো হয়েছিল।

৬। ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস-এর ‘Dialectics of Nature’।

৭। তখন সোভিয়েত ইউনিয়নে খালি বোতল ফেরত দিলে কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে যে জমা (টাকা) ফেরত পাওয়া যেত, তা অতি দরিদ্রদের জন্য উপার্জনের একটা পথ হয়ে উঠেছিল।

৮। ১৯৫৩ সালে ক্রুশ্চেভের দ্বারা স্তালিননীতির সমালোচনা এবং নিস্তালিনীকরণের ডাকের পূর্বাভাস তখনও ছিল না এটাই লেখিকা বলছেন।

৯। ‘নতুন যুগ’ বলতে লেখিকা ক্রুশ্চেভের আমল শুরু হওয়ার কথা বলছেন।

১০। বিদেশ থেকে রুশ ভাষায় সম্প্রচার করা রেডিও স্টেশন, যেমন: দি ভয়েস অফ আমেরিকা, বি বি সি, রেডিও লিবার্টি, ইত্যাদি।

১১। ১৯৩৯ সালে হিটলার-স্তালিন বোঝাপড়া অনুযায়ী নাজি জার্মানি পশ্চিমদিক থেকে এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন পুবদিক থেকে আক্রমণ করে পোল্যান্ডকে আধাআধি নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয়। তখন পূর্ব পোল্যান্ডের উপর সোভিয়েত দখলদারি চলার সময় বহু পোল্যান্ডবাসী, অর্থাৎ, পোল-দের গ্রেফতার করে বন্দিশিবিরে চালান করা হয়। ১৯৪১ সালে আবার মিত্রশক্তি-জোটের অংশ হিসেবে নাজি জার্মানির বিরুদ্ধে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের লড়াইয়ে সোভিয়েত বাহিনির হয়ে যুদ্ধে লড়ার শর্তে অনেক পোল-কে বন্দিশিবির থেকে ছেড়ে দেওয়া হয় ও জেনারেল অ্যান্ডার্স-এর বাহিনিতে নিয়োগ করা হয়।

১২। আখমাতোভা: আনা আখমাতোভা (১৮৮৯-১৯৬৬), মূল নাম আনা আন্দ্রেইয়েভনা গোরেংকো, বিশ শতকের রুশ কবিতার সেন্ট পিটার্সবার্গ ধারার অন্যতম প্রধান কবি। স্তালিনীয় সন্ত্রাসে তাঁর প্রথম স্বামী কবি নিকোলাই গুমিলইয়োভ ও পরবর্তী স্বামী গবেষক নিকোলাই পুনিন প্রাণ হারান। তাঁর প্রথম দিকের কবিতায় নারী-পুরুষের সম্পর্কের টানাপোড়েন এবং নারীর স্বতন্ত্র কন্ঠস্বর অপূর্ব শিল্পরূপ পেয়েছিল। তারপর স্তালিনী সন্ত্রাস ক্রমশ গেঁড়ে বসার পর তাঁর কবিতা এই সন্ত্রাসের কালো ছায়ায় ঢাকা সোভিয়েত সমাজ এবং এই সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ চেষ্টাকে ভাষা দিয়ে গেছে। ১৯২৫ থেকে ১৯৫২ সাল অবধি আখমাতোভাকেও কোনো লেখা প্রকাশের অনুমতি দেওয়া হয়নি, রাষ্ট্রের চোখে সন্দেহজনক ব্যক্তি হিসেবে কড়া নজরদারি ও দেশের মধ্যেই নির্বাসন দণ্ডে দণ্ডিত হয়ে থাকতে হয়। তিনি ওসিপ ম্যান্ডেলস্টাম ও নাদেঝদা ম্যান্ডেলস্টাম-এর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সহযোগী ছিলেন। ওসিপ ম্যান্ডেলস্টাম স্তালিনের গুলাগ-এ অন্তর্হিত হয়ে যাওয়ার পরও নাদেঝদা ম্যান্ডেলস্টামের সঙ্গে তাঁর সখ্য-সহযোগিতায় ছেদ পড়েনি। তাঁর পুত্রকেও যখন গ্রেফতার করে গুলাগ-এ চালান করা হয়, আখমাতোভা তখন তাঁর পুত্রের মুক্তির জন্য মরীয়া হয়ে স্তালিনের উদ্দেশ্যে কিছু স্তুতিমূলক কবিতা লিখে রাষ্ট্রের সঙ্গে একটা বোঝাপড়া করতে চেয়েছিলেন, তবে তা কতটা সফল হয়েছিল সে প্রশ্ন থেকেই যায়।

১৩। ‘…অতিবাহিত যুগের অবসরপ্রাপ্ত ভৃত্যদের… যথাস্থানে ফিরিয়ে দিতে পারে।’: অতিবাহিত যুগ বলতে লেনিন-স্তালিন যুগের কথা বলা হচ্ছে, আর গত পনেরো বছর বলতে ক্রুশ্চেভের নিস্তালিনীকরণ ঘোষণার পরবর্তী ১৫ বছর। অতিবাহিত যুগের অবসরপ্রাপ্ত ভৃত্য বলতে লেনিন-স্তালিন-পন্থী কম্যুনিস্ট নেতা-প্রশাসক-দের বোঝানো হয়েছে।

১৪। লুবিয়াঙ্কা: মস্কো-স্থিত সোভিয়েত গুপ্ত-পুলিশ-এর প্রধান দপ্তর এবং রাজনৈতিক বন্দিদের জেলখানা।

১৫। এখানে সলঝেনিৎসিন-এর ‘ক্যানসার ওয়ার্ড’ বইয়ের ৩৫ নম্বর অধ্যায়ের উল্লেখ করা হয়েছে। আত্মজীবনীমূলক উপন্যাসের ওই অধ্যায়ে উপন্যাসের প্রধান চরিত্র হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর তাসখন্দ-এর রাস্তায় অপ্রত্যাশিতভাবে শিকে-বেঁধানো মাংস-কাবাব উপহার পায়।

১৬। সামিজদাত (samizdat): রুশ শব্দ, যার আক্ষরিক অর্থ হল ‘স্ব-প্রকাশনা’। শব্দটা সোভিয়েত রাষ্ট্রীয় প্রকাশনা সংস্থা বোঝাতে ব্যবহৃত ‘গোসিজদাত’ শব্দটার ব্যাঙ্গাত্মক জোড়শব্দ হিসেবে তৈরি হয়েছিল। ১৯৬০-এর দশক থেকে রাষ্ট্রীয় সর্বাত্মকতার বিরোধীরা সরকারি সেন্সরশিপের কারণে অপ্রকাশিত থাকা বিভিন্ন সাহিত্যকর্ম, প্রবন্ধ, সমালোচনাত্মক লেখা টাইপ করে হাতে হাতে বিলি-বন্টন করার ‘আন্ডারগ্রাউন্ড নেটওয়ার্ক’ চালু করে। ক্রমশ তা জনপ্রিয়তা অর্জন করে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। দীর্ঘদিন নিষিদ্ধ থাকার পর ওসিপ ম্যান্ডেলস্টামের কবিতাও এই সামিজদাত মাধ্যমে আবার পঠিত হতে শুরু করে।

১৭। গুটেনবার্গ-পূর্ববর্তী যুগ মানে ছাপাখানা চালু হওয়ার আগের যুগ।

১৮। ওসিপ ম্যান্ডেলস্টাম-এর বই তাঁর জীবিতাবস্থায় শেষ ছাপা হয় ১৯২৮ সালে, যখন তাঁর ইতিপূর্বে প্রকাশিত দুটি কবিতার বই ‘Stone’ এবং ‘Tristia’ একত্রিত করে ‘কবিতাগুচ্ছ’ নামে ছাপা হয়। শেষবারের মতো তাঁর কবিতা ছাপা হয় ১৯৩২ সালে, যখন তাঁর তিনটি কবিতা Literary Gazette-এ ছাপা হয়। নাদেঝদা ম্যান্ডেলস্টাম এখানে ১৯২৮-এর কথাই উল্লেখ করেছেন বলে মনে হয়।

১৯। ১৯৬৭ সালে মস্কায় ওসিপ ম্যান্ডেলস্টাম-এর ‘দান্তে বিষয়ক সংলাপ’ ৩৫,০০০ কপি ছাপা হয়েছিল, এখানে তার কথা বলা হচ্ছে।

২০। ‘ষাট দশকের কোনো মানুষ’ বলতে ১৮৬০ দশকের রুশ বিপ্লবী বুদ্ধিজীবীদের ইঙ্গিত করা হয়েছে, যাদের প্রতিনিধিস্বরূপ হিসেবে আমরা ১৮৬২ সালে প্রকাশিত ইভান তুর্গেনেভ-এর ‘পিতা ও পুত্র’ উপন্যাসের বাজারভ চরিত্রটিকে ধরতে পারি।

২১। নাদেঝদা ম্যান্ডেলস্টাম এখানে তাঁর ‘প্রথম বই’ বলতে ১৯৭০ সালে প্রকাশিত ওসিপ ম্যান্ডেলস্টামের জীবনের শেষ চার বছরের স্মৃতির বিবরণ সম্বলিত বই ‘Hope Against Hope: A Memoir’ (রুশ থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ: ম্যাক্স হেওয়ার্ড, প্রকাশক: অ্যাথেনিয়াম পাবলিশার্স, নিউ ইয়র্ক)-এর কথা বলেছেন।

 

 

ওসিপ ম্যান্ডেলস্টামের কবিতার অনুবাদ

(বাংলা তর্জমা ও টীকা: বিপ্লব নায়ক)

স্বর্ণসূর্যসম এই সেই চাকতি—

পবিত্র এক মুহূর্ত— শূন্যে দণ্ডায়মান—

হাতে ধরা আপেলের মতো সময়ধৃত পৃথিবী

এখানে কেবল গ্রিক উচ্চারণ শোনা যায়।

 

ঈশ্বরাভিপ্রায় সেবাসন্নিষ্ঠায় তুঙ্গ,

গোল চূড়ার আলো জুলাইতে উজ্জ্বল,

ভরা বুকে সময়ের বাইরে দাঁড়িয়ে আমরা হাহুতাশ করি

অন্তহীন সেসব প্রান্তরের জন্য যেখানে সময় স্থির-নিশ্চল।

 

চিরন্তন দ্বিপ্রহরের মতো এই ইউখারিস্টপরব—

পাত্র থেকে পান করে সবাই, খেলা করে আর গলা ছেড়ে গায়,

সকলের চোখের সামনে ঈশ্বরের পাত্র

বাঁধহীন উল্লাসে নিজেকে উপুড় করে দেয়।

 

 

১। ইউখারিস্ট: খ্রিস্টানদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান যেখানে মদ ও রুটি পবিত্র করে নিয়ে ভোজন করা হয়।

 

 

জীবনরূপী সাইকি যখন পারসিফোনের খোঁজে

একটি সবুজ শাখা আর হাদেসের শঙ্কা সঙ্গী করে

ভূগর্ভস্থ স্বচ্ছ অরণ্যে অবতরণ করল,

একটা অন্ধ দোয়েল তার পায়ের নীচে পড়ল।

 

সেই চঞ্চলার চারদিকে ভিড় করে এল ভূতের দল,

নবাগতের কাছে প্রার্থনা পেশ করতে তাদের তর সয় না,

ক্ষয়-ধরা দুর্বল হাত পাকিয়ে সামনে তুলে ধরে তারা,

ভ্রম আর নিরাশায় টইটম্বুর।

 

আত্মা হল নারীদের মতো আর প্রেম তাদের সামান্য তুচ্ছতা:

কেউ আয়না তুলে ধরে, শিস দেয়, আতর ছড়ায়:

উপরে চেপে থাকা আর্তস্বরের পত্রহীন অরণ্য থেকে

শুকিয়ে যাওয়া বিলাপ বৃষ্টিগুঁড়ির মতো ঝরে পড়ে।

 

ছত্রভঙ্গ ভিড়ে কোথায় শুরু বুঝে না পেয়ে

আত্মা স্বচ্ছ তাপসকুঞ্জ চিনে নিতে পারে না,

আয়নার উপর শ্বাস ফেলে আর অপেক্ষা করে কখন

কুয়াশাঘেরা খেয়া-পারানির জন্য তাম্রমুদ্রাটি তুলে দিতে হবে।

 

 

 

১। সাইকি: গ্রিক-রোমান পুরাকথার চরিত্র। প্রেমের শর নিক্ষেপকারী দেবতা কুপিড-এর স্ত্রী। কুপিড-এর মা প্রেমের দেবী ভেনাস-এর ঈর্ষা ও রোষের বলি হয়ে সাইকি কুপিডের থেকে বিচ্ছিন্ন হন এবং ভেনাস তাকে ভূগর্ভস্থ মরলোকে পারসিফোনের কাছ থেকে সৌন্দর্য-পেটিকা নিয়ে আসতে পাঠান। এই জন্য তিনি ভূগর্ভস্থ মরলোকে অবতরণ করেন।

২। পারসিফোন: জিউস ও ডিমিতারের কন্যা, ইনি উর্বরতার দেবী। পাতাল মরলোকের অধীশ্বর ও জিউসের ভাই হাদেস এঁকে অপহরণ ও ধর্ষণ করেন ও পাতাল মরলোকে আটকে রাখেন। কেবল বসন্তের সময় ইনি পাতাল ছেড়ে উঠতে পারেন।

৩। হাদেস: পাতাল মরলোকের অধীশ্বর, জিউসের ভাই।

৪। সাইকি-র মরলোকে অবতরণের সময় তাকে মুখে করে তিনটে তাম্রমুদ্রা নিয়ে যেতে বলা হয়েছিল, মরলোকে ঢোকা ও বেরোনোর সময় নদী পার হওয়ার খেয়ার পারানি হিসেবে।

 

 

 

প্রোসেরপিনার ভ্রমরদলের অনুজ্ঞা মতো

এক ফোঁটা মধু ও এক ফোঁটা সূর্য

আমার এই অঞ্জলিপুট থেকে নিয়ে আনন্দিত হও।

 

আর কখনও নোঙর-খোলা তরী ভাসানো হবে না,

পশমসজ্জিত ছায়াকে চেনা হবে না,

বিষন্ন জীবনভীতি কাটিয়ে ওঠাও আর হবে না:

 

ক্ষুদ্র ভ্রমরদের মতো অস্পষ্ট ও কম্পমান

মৌচাক ছেড়ে বেরোতেই মৃত্যুকোলে ঢলে পড়া

সেই রাত্রিকালীন চুম্বনগুলোই কেবল পড়ে আছে।

 

রাত্রির স্বচ্ছ সমীরে সেগুলো ঝিকমিক করে,

তাইগা-র ভৌতিক অরণ্যে তারা ঘর বাঁধে,

পুদিনা, মৌচাক আর কালপরিসর ভক্ষণ করে।

 

মধুকে সূর্যে রূপান্তরিত করতে করতে মরা

শুকিয়ে যাওয়া ক্ষুদ্র ভ্রমর দিয়ে গাঁথা এই মালা---

আমার এ বন্য উপহার গ্রহণ করে আনন্দিত হও।

 

 

১। প্রোসেরপিনা: পারসিফোন-য়ের আরেক নাম। আগের কবিতার ২ নং টীকা দ্রষ্টব্য।

২। তাইগা: সাইবেরিয়ার অরণ্য। জার আমল থেকে সোভিয়েত আমল--- রাষ্ট্রের দ্বারা দণ্ডিতদের এই মানব-বসবাসের প্রতিকূল স্থানেই নির্বাসনে পাঠানো হতো। লেনিন-স্তালিন আমলের কুখ্যাত লেবার-ক্যাম্পগুলোর অনেকগুলোই ছিল এই অঞ্চলে।

 

 

স্বাধীনতার গোধূলি

 

এস এখন তবে স্বাধীনতার গোধূলি উদযাপন করা যাক,

উদযাপন করা যাক প্রাক-বড়দিন মহান গোধূলি-উৎসব।

ফুটতে থাকা রাত্রিজল-সাগরে

ডুবতে থাকা অরণ্যভার টান দেয়

আর এই মৃত বছরগুলোয় ঊর্ধ্বে উদয় হয়ে

ওহে সূর্য, তুমি বিচারসভা বসিয়ে আমাদের শাসন করছ।

 

জনগণের নেতাদের সাশ্রুনয়নে বহন করা

নিয়তি-নির্দিষ্ট বোঝা উদযাপন করা যাক।

ক্ষমতার গোধূলিকালীন বোঝা

উদযাপন করা যাক কারণ তা বড় মূল্যবান।

হৃদয় ও সময় যদি তোমার থাকে, ওহে প্রহরী,

তোমার জাহাজ ডোবার কালে তুমি ঠিক টের পাবে।

 

দোয়েলদের বেঁধে আমরা যুদ্ধ-বাহিনীতে

পরিণত করেছি, আর এখন

সূর্য নজরে আসে না, কেবল চারদিকে

বস্তুরা ঝিকমিক করে, গুঞ্জন করে আর বেড়ে ওঠে,

ছেয়ে যাওয়া গোধূলির ঘন জালের ভিতর দিয়ে

সূর্য দেখতে পাই না, পৃথিবী বয়ে যায়।

 

তবু আমরা চেষ্টা করব: বিপুল দিক-নিয়ন্ত্রক চাকাটিকে

অদক্ষ গোঙানির মধ্য দিয়েও যদি ঘোরানো যায়।

পৃথিবী বয়ে যায়। শক্তি সঞ্চয় কর, অলস হয়ো না,

লাঙল চালানোর মতো সাগরকে দুভাগ কর। নতজানু হও,

লিথিয় প্রকোপ মাঝে আমরা স্মরণ করব

দশটি স্বর্গের মূল্যে আমরা পৃথিবী পেয়েছি।

 

 

১। লিথিয়: গ্রিক পুরাকথায় বর্ণিত হাদেস-এর নদীর নাম লিথ। এই নদী অতীতকে ভুলিয়ে দেয়। সেই অর্থে ‘লিথিয় প্রকোপ’ বললে অতীত-বিস্মরণের প্রকোপ বোঝানো হয়।

 

 

ভয়াল উচ্চতায় দাঁড়িয়ে ভ্রাম্যমান অগ্নি,

ওভাবে কি তারা ঝিকমিক করে, নাকি ও চোখের ভুল?

স্বচ্ছ তারা, ভ্রাম্যমাণ অগ্নি,

তোমার ভাই, পেট্রোপোল, আজ মরণাপন্ন।

 

ভীতিপ্রদ উচ্চতায় সব পার্থিব স্বপ্ন পুড়ে খাক

আর সবুজ এক তারা উড়ে যায়।

ওহে পৃথিবী ও স্বর্গের সোদর, তুমি যদি তারা হও,

তোমার ভাই, পেট্রোপোল, আজ মরণাপন্ন।

 

ভীতিপ্রদ উচ্চতায় বিরাট এক জাহাজ

ডানা মেলে উড়ছে।

জাঁকালো বিপদে পড়েছ তুমি সবুজ তারা,

তোমার ভাই, পেট্রোপোল, আজ মরণাপন্ন।

 

নেভা-র উপর সমাগত স্বচ্ছ বসন্ত অন্ধকার হয়ে গেছে।

অমরত্বের মোম গলে পড়ছে যেন সে কাঁদছে।

ওহে, তুমি যদি তারা হও, পেট্রোপোল, ফিরে তাকাও!

তোমার ভাই, পেট্রোপোল, আজ মরণাপন্ন।

 

 

১। পেট্রোপোল: গ্রিক ভাষায় ‘পেট্রো’ মানে পাথর আর ‘পোলিস’ মানে শহর, এই দুইকে সংযুক্ত করে পেট্রোপোল-এর অর্থ দাঁড়ায় ‘পাথরের শহর’।

২। ভীতিপ্রদ উচ্চতায় বিরাট এক জাহাজ ডানা মেলে উড়ছে: ১৯২১ সালে সেন্ট পিটার্সবার্গ সংলগ্ন ক্রনস্টাড বন্দর-শহরের নাবিক, জলসেনা, শ্রমিক ও নাগরিকরা বিদ্রোহ করেছিল বলশেভিকদের বিরুদ্ধে। বলশেভিকদের একচেটিয়া ক্ষমতাদখলের বিরোধিতা করে সোভিয়েত ক্ষমতার গণতান্ত্রিকীকরণ ছিল তাদের দাবি। বলশেভিকদের নেতৃত্ব এই বিদ্রোহ নৃশংসভাবে দমন করে। ১৯১৭-র রুশ বিপ্লবের সমস্ত উজ্জ্বল সম্ভাবনার কফিনে সেটাই বুঝি শেষ পেরেক, তারপর থেকে ক্ষমতার কেন্দ্রীভূতকরণের পথে লৌহমুষ্টি রাষ্ট্র-নির্মাণের একমুখী গতিই অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠল। বিরাট জাহাজের ডানা মেলে ওড়া--- এই রূপকের মধ্য দিয়ে ম্যান্ডেলস্টাম এই ক্রনস্টাড নৌবিদ্রোহের দিকেই ইঙ্গিত করেছেন বলে মনে হয়, নেভার তীরে স্বচ্ছ বসন্তের অন্ধকার হয়ে যাওয়া এবং অমরত্বের মোম অশ্রু হয়ে গলে পড়ার রূপকও এই ইঙ্গিত জোরালো করছে।

২। নেভা: নেভা নদীর তীরেই সেন্ট পিটার্সবার্গ শহর অবস্থিত। 

                                             

 

 

দোয়েল

 

কী যে বলতে চেয়েছিলাম ভুলে গেছি।

অন্ধ দোয়েল ছায়া-প্রাসাদের দিকে উড়ে যায়

তার ছেঁটে দেওয়া ডানায় খেলা করে ছায়া-কারুকাজ।

অনেক নীচে বিস্মরণ মাঝে কারা যেন রাত্রির গান গায়।

 

চির-অমলিন ফুল আর ফোটে না। শোনা যায় না পাখির গান।

রাত্রির ঘোড়ার পাল ঢাকা থাকে স্বচ্ছ আচ্ছাদনে

শূন্য মাকু সাঁতার কাটে শুকনো খাঁড়িতে

এমনকি ঘাসফড়িংরাও হারানো শব্দ শুনতে পায় না।

 

ধীরে বেড়ে ওঠে, যেন পর্দা, বা দেবালয় বুঝি,

আন্তিগোনে চকিত পাগলপারা টাল খেয়ে

অন্ধ দোয়েলের মতো আমার পায়ের কাছে এসে পড়ে

সবুজ শাখা-প্রশাখা সমেত, ভারাক্রান্ত নম্রতায় ছায়াময়।

 

হায়, যদি না ফিরতে হতো এই দৃষ্টিভেদ্য দু-হাতের কলঙ্কে

আর ক্রমপ্রস্ফুটিত পরিচিতির উত্তল উল্লাসে!

ক্রন্দনরত সব এওনিড, কুয়াশা, বাজনদারি

আর মুখ-ভেঙচানো অপচ্ছায়াদের আমি ভয় পাই।

 

নশ্বররা পারে কেবল ভালোবেসে খুঁজে ফিরতে,

তাই করতলে ঝরে পড়ে ধ্বনি,

কিন্তু কী যে বলতে চেয়েছিলাম আমি ভুলে গেছি,

নিষ্ফলা চিন্তাগুলো শুধু একগুঁয়ে প্রাসাদে ফিরে আসে।

 

ছায়াগুলো ঘুরে ফিরে একই কথা বলে না কি:

বান্ধবী, আন্তিগোনে, দোয়েল...

আর ঠোঁটের উপর কালো বরফের মতো এখনও পুড়ছে

তল থেকে উঠে আসা ভারাক্রান্ত নম্রতা বেজে-ওঠার স্মৃতি।

 

 

১। আন্তিগোনে: গ্রিক পুরাকথার চরিত্র রাজা ঈদিপাসের কন্যা আন্তিগোনে। ঈদিপাসের মৃত্যুর পর থিবস-এর রাজা তখন আন্তিগোনের কাকা ক্রেওন। থিবস-এর রাজক্ষমতা দখলের যুদ্ধে আন্তিগোনের দুই ভাই ইটিওক্লেস ও পলিনিসেস যুদ্ধরত দুই পক্ষের অংশ হিসেবে পরস্পরের মুখোমুখি হয় এবং সম্মুখযুদ্ধে পরস্পরকে হত্যা করে। রাজা ক্রেওন তঁার পক্ষাবলম্বী ইটিওক্লেসকে দেশপ্রেমী আখ্যা দিয়ে গৌরবের সঙ্গে সমাহিত করার নির্দেশ দেন। অন্যদিকে, পলিনিসেসকে দেশের প্রতি বিশ্বাসঘাতক আখ্যা দিয়ে তার অন্ত্যেষ্টির আচার নিষিদ্ধ করে পশুপাখিদের ছিঁড়ে খাওয়ার জন্য লাশ ভাগাড়ে ফেলে রাখার নির্দেশ দেন। রাজার নির্দেশ অমান্য করার সাহস গোটা থিবসে কেবল আন্তিগোনেই দেখায়। আন্তিগোনে রাজনির্দেশ অমান্য করে আচারমতো পলিনিসেস-এর শবের উপর ধুলো ছড়িয়ে সৎকার করে। রাজা আন্তিগোনেকে বন্দি করে তিলে তিলে যন্ত্রণাকর মৃত্যুর দিকে নিয়ে যাওয়ার মৃত্যুদণ্ড দেয়। এর মধ্য দিয়ে গোটা থিবস জুড়ে দুঃসময় নেমে আসে, রাজা ও তার পরিবারও তার বলি হয়।

২।এওনিড: অবিনশ্বরতা-গর্বী সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর দেবপুরুষের প্রকাশরূপ বা প্রতিনিধি।

 

এরই জন্য আমি তোমার বাহুডোর শিথিল করেছি—

এরই জন্য তোমার নোনতা ভিজে ঠোঁট ফেলে এসেছি—

এই আধা-ঘুমন্ত সর্বনাশে যতই ঘেন্না ধরুক না কেন

নগরের ঘুম ভাঙা অবধি এই অ্যাক্রোপোলিসে অপেক্ষা করতে হবে।

 

ঘোর অন্ধকারে এজিয়ানরা তাদের অশ্ব প্রস্তুত করে,

ফাটল ও ছেদগুলোয় ধারালো ফলা দিয়ে আক্রমণ শানায়,

এখানে রক্তঝরার শুকনো শব্দ কানে লেগেই থাকে,

এখানে তোমার কোনো মর্মর নেই, কোনো মূর্তি নেই, দৃষ্টিতে তুমি নেই।

 

কোন্ স্পর্ধায় যে ভেবেছিলাম তুমি আমার কাছে ফিরে আসবে!

কোনো হুঁশিয়ারি ছাড়াই ত্বরায় কেন যে সব ছেড়ে এলাম!

মোরগ তখনও সকালের গান গায়নি, পাহাড়গুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি,

কাঠের কাঠামোয় পড়েনি তখনও কুঠারাঘাত।

 

কাঠের দেওয়ালে বৃক্ষরস জেগে উঠেছে স্বচ্ছ অশ্রুবিন্দুর মতো,

শহর তার অরণ্যঢাকা পাঁজরা আগুন দিয়ে পরখ করছে,

শিরা-ধমনী উপছানো জীবনবৃত্তীয় রক্ত খোলা কলে বয়ে যায়,

পাঁকে ডুবন্ত মৎস্যকন্যারা আর্তরবে তিনবার মানুষদের ডেকেছিল।

 

কোথায় আমার প্রিয় ট্রয়? কোথায় সেই প্রাসাদ, সেই নারীমহল?

রাজা প্রিয়াম-এর উজ্জ্বলরঙা পাখি-খাঁচা এখন ভেঙে পড়ে আছে

শুকনো বৃষ্টির মতো কাঠের তির ঝরে চলে আর

তিরের ছিন্নভিন্ন দঙ্গল আবার বাদামঝাড়ের মতো উপরে ধেয়ে ওঠে।

 

শেষ তারাচূর্ণের দংশন যন্ত্রণাহীনতায় নিভে যাবে,

ছাইরঙা দোয়েলের মতো সকাল জানালার কঁাচে এসে টোকা দেবে,

আর খড়ের গাদায় ঘুমভাঙা ষাঁড়ের মতো ধীর পা ফেলে

দিন চলে যাবে মর্মর তুলে, আলো যাবে তার পিছুপিছু।

 

 

১। অ্যাক্রোপোলিস: প্রাচীন গ্রিক শহরের দুর্গপ্রাকারে বেষ্টিত অংশ বা পাহাড়ের উপরদিকে কড়া পাহারায় থাকা শহরের অংশ। বিশেষ করে, প্রাচীন আথেনস শহরের এইরূপ অংশ অ্যাক্রোপোলিস নামে খ্যাত ছিল।

২। এজিয়ান: প্রাচীন গ্রিসে দেবরাজ জিউস-এর বর্ম যাঁদের রক্ষা করছে সেই আথেনস-বাসীদের এজিয়ান বলা হতো।

৩। ট্রয়: গ্রিক পুরাকথার শহর। এই শহরের রাজা ছিলেন প্রিয়াম। সেরা সুন্দরী হেলেন তঁার স্বামী মেনেলস-কে ত্যাগ করে প্রেমিক ট্রয়ের রাজপুত্র পারি-র সাথে এই ট্রয় শহরে পালিয়ে আসেন, যার সূত্র ধরে গ্রিকদের সঙ্গে ট্রয়বাসীদের যুদ্ধ শুরু হয়। সেই ট্রোজান যুদ্ধে ট্রয়ের পতন হয়।

৪। রাজা প্রিয়াম: ট্রয়ের রাজা।

 

দুধসাদা দেমাকী চন্দ্রাতপের তলায়

মলিন পায়রা-খাঁচা তৈরি করেছে আইজাক,

সেখানে ধর্মাধ্যক্ষের ক্রুশ-দণ্ডে মলিন স্তব্ধতা বিব্রত,

বায়ুর স্তরান্তরে হৃদয় মাপা যায়।

 

রিকুইয়েম-এর শতাব্দীপ্রাচীন আত্মা পাক খায়,

অতঃপর শবাচ্ছাদন বস্ত্রের সমারোহ জমকালো,

জেনেসারিয় নিশায় লেন্ট-সপ্তাহে জেলেদের

জরাজীর্ণ খাড়া-জাল, উচ্চরবে কে যেন কাঁদছে।

 

ঊষ্ণ বেদিতে জ্বলে ধোঁয়ার রক্তিমাভা,

অতঃপর পাদরী-কন্ঠে অনাথ-কান্না ডুকরে ওঠে,

রাজকীয় এক পুরুষ: তার কঁাধের উপর

নির্মল তুষার আর নিষ্ঠুর পাষাণখণ্ড।

 

বহু শতাব্দীর ঝড়ঝাপটা সহে আসা সোফি ও পিটারের

মহৎ সব ক্যাথিড্রাল, বাতাস ও আলোর ভঁাড়ার,

সার্বজনীন মঙ্গলের বীজঘর

আর নিউ টেস্টামেন্ট-এর শস্যভাটি।

 

সমস্যাদীর্ণ কঠোর বছরগুলোয়

আত্মারা শান্তিতে তোমায় সঙ্গ দেয় না,

বিপর্যয় নেকড়ের মতো শিকার-পরিধি বাড়াতে থাকে,

আরো বহু শতাব্দী এর কোনো ব্যত্যয় হবে না।

 

সেই দাস মুক্ত যে একদা ভয়কে জয় করেছিল

আর পরিমাপের ঊর্ধ্বে উঠে বেদনার পথে

শীতার্ত ভাঁড়ারে গভীর শস্যভাণ্ডে

সম্যক পূর্ণ বিশ্বাসের বীজ সঞ্চয় করেছিল।

 

 

১। আইজাক: ইহুদি, খ্রিস্টান ও ইসলাম ধর্মীয় পুরাকথার একজন প্রধান চরিত্র। আব্রাহাম ও সারাহ্-র ছেলে, বারোটি ইজরায়েলি জনজাতির পিতৃব্য।

২। রিকুইয়েম: মৃত ব্যক্তির আত্মার তৃপ্তির কামনায় স্তব।

৩। জেনেসারিয়: বাইবেলে লুক ও ম্যাথু-র গসপেলে কথিত প্রাচীন জনপদ।

৪। লেন্ট: যিশুর উপবাস স্মরণে খ্রিস্টানদের চল্লিশ দিনব্যাপী বাৎসরিক উপবাস।

৫। নিউ টেস্টামেন্ট: বাইবেল-য়ের তুলনায় অর্বাচীন অংশ।

 

 

 

অশ্বনাল সন্ধানী

(একটি পিণ্ডারিয় খণ্ডাংশ)

 

অরণ্য দেখে আমরা বলি:

এ হল জাহাজ-মাস্তুলের জঙ্গল,

গোলাপি পাইনগুলো

প্রায় মাথা অবধি জটাজুট-ভার থেকে মুক্ত,

ঝড় উঠলে

বিক্ষুব্ধ বৃক্ষহীন বাতাসে নিঃসঙ্গ ইতালিয় পাইনের মতো

তাদেরও গোঙানি উঠবে;

ঝড়ের লোনা লাথিতে দুলে ওঠা জাহাজপাটার ওলন-দড়ি সামাল দিতে চাইবে।

আর নাবিক,

পরিসরকামী লাগামহীন আকাঙ্খার তাড়নায়

ভঙ্গুর জ্যামিতিবেত্তা যন্ত্রগুলো সিক্ত পরিখার মধ্য দিয়ে টেনে নিয়ে গিয়ে

পৃথিবীর হৃদয়ের টানে উত্তাল হয়ে ওঠা সমুদ্রপৃষ্ঠকে

মাপে বাঁধতে চাইবে।

 

জাহাজের পাটাগুলোর মধ্য দিয়ে উজিয়ে আসা

আলকাতরায় মেশানো অশ্রুর গন্ধ নাকে নিয়ে,

সমীহের চোখে

পেরেকে আঁটা পাটার ফরমায়েশি দেওয়ালগুলো দেখতে দেখতে—

যে দেওয়াল বেথলেহেম-এর সেই শান্তিস্নিগ্ধ ছুতারের হাতে তৈরি নয়,

বরং নাবিক-সুহৃদ দীর্ঘ পরিক্রমার পিতা সেই অন্য ছুতারের কাজ—

আমরা বলি:

গর্দভের শিরদাঁড়ার মতো অস্বস্তি নিয়ে

তারাও একদিন পৃথিবীর মাটিতে দাঁড়িয়েছিল,

তাদের মাথা ভুলে গিয়েছিল তাদের শিকড়ের কথা,

বিখ্যাত পর্বতগাত্রে দাঁড়িয়ে,

মিঠে বর্ষার তলে এক চিমটে নুনের বিনিময়ে

তাদের মহান ভার লাঘব করার জন্য তারা

স্বর্গের কাছে নিষ্ফলা অনুনয় করেছিল।

 

কোথা থেকে শুরু করা যায়?

সবকিছু দুলছে, ফাটল ধরছে সবখানে,

উপমায় ভারী বাতাস কেঁপে কেঁপে উঠছে।

কোনো শব্দই অন্যের চেয়ে উত্তম নয়,

ভূতল থেকে ভেসে আসে রূপকদের গর্জানি,

আর পাখিদের উজ্জ্বল পালক দিয়ে চূড়ান্ত সহ্যসীমায় বাঁধা

হালকা-পলকা দুচাকার রথগুলো

দৌড়প্রতিযোগিতায় রুদ্র বিজয়প্রত্যাশীদের গুঁতোয়

টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়েছে।

 

যে পুরুষ নামের গুণ গেয়ে গান গায় সে পায় তিন বর;

যে গান নামখচিত

তা বাকিদের চেয়ে দীর্ঘজীবী—

আর নারীর ললাটবন্ধনী তাকে অন্যদের থেকে আলাদা করে,

ঘেঁষে আসা পুরুষের গায়ের

বা ক্ষমতাধর পশুর পশমের

বা নেহাতই করতলে পিষ্ট গন্ধ-লতার

তীব্র বুদ্ধিনাশা গন্ধে অচেতন হয়ে পড়া থেকে রক্ষা করে।

 

কখনও বাতাস হয়ে ওঠে জলের মতো ঘন কালো,

আর জ্যান্ত সবকিছু তাতে মাছের মতো সাঁতার কাটে

সেই ঘন, স্থিতিস্থাপক, ঈষদুষ্ণ বলয়

পাখনায় কেটে কেটে—

সে স্ফটিকে ঘোড়ার হ্রেষা বাজে, রথচক্র ঘোরে,

প্রতি রাতে নিয়েয়রা-র ভিজে কালো মাটিতে

শাবল, ত্রিশূল, কোদাল, লাঙল পরিখা কাটে।

বাতাসও মাটির মতো ঘন-সন্নিবদ্ধ—

সেখান থেকে বেরোনো যায় না আর ঢোকাও দুরূহ।

 

গাছেদের মধ্যে সবুজ গোলক হয়ে মর্মরধ্বনি বয়ে চলে;

মৃত পশুদের শিরদাঁড়া দিয়ে ডাংগুলি খেলে শিশুরা,

আমাদের যুগের দুর্বল কালপরম্পরা শেষ হয়ে এল বলে।

অতীত সবকিছুর জন্য তোমায় ধন্যবাদ:

আমি নিজেই ভুল করেছিলাম, হিসাবে গণ্ডগোল হয়েছিল।

ফাঁপা, ছাঁচে ফেলা, ত্রিশঙ্কু

সুবর্ণগোলকের মতো বেজে উঠেছিল এই যুগ।

প্রতিটি ছোঁয়ায় তা উত্তর দিত ‘হ্যাঁ’ অথবা ‘না’,

ঠিক যেমন কোনো শিশু উত্তর দেয়:

‘আমি তোমায় আপেলটা দেব’ বা ‘আমি তোমায় আপেলটা দেব না’,

আর উচ্চারিত স্বরের আকার ধারণ করে তার মুখ।

 

ধ্বনি এখনও বেজে চলেছে, যদিও ধ্বনির উৎস এখন গত।

ধুলোয় লুটানো ঘোড়া নাকে-মুখে ফেনা তুলে গোঙায়,

তবু তার ঘাড়ের তীক্ষ্ণ খিলান

এখনও টান টান পায়ে দৌড়প্রতিযোগিতার স্মৃতি ধরে রাখে—

তখনকার স্মৃতি যখন তার পা কেবল চারটিই ছিল না,

বরং রাস্তায় পাথর যতগুলো ঠিক ততগুলোই ছিল,

আর তাতে চার দফায় পুনরায় নতুন শক্তি ভরে নিত

আগুনে গতিতে মাটিকে আঘাত করার সাথে সাথে।

 

তাই,

যে সন্ধানী অশ্বনাল খুঁজে পায়,

সে যত্ন করে ধুলো ঝেড়ে নিয়ে

তারপর পশম দিয়ে পালিশ করে চকচকে করে তোলে,

তারপর

দরজার আড়কাঠের উপর তা ঝুলিয়ে দেয়,

যেন তা সেখানে বিশ্রাম পায়:

পাথরে আঘাত করে তাকে আর কখনও স্ফুলিঙ্গ জাগাতে হবে না।

যে মানুষ-ঠোঁটের

আর কিছু বলা অবশিষ্ট নেই

তা শেষ উচ্চারিত শব্দটির আকার ধারণ করে থাকে,

আর ঘরে পৌঁছানোর পথে

ভরে আনা কলস থেকে

অর্ধেক জল পড়ে গিয়ে ফঁাকা হয়ে গেলেও

বাহক হাত পূর্ণভার অনুভব করে যেতে থাকে।

 

আমি এখন যা বলছি তা আমি বলছি না,

মাটিচাপা থেকে পাথর হয়ে ওঠা গমদানার মতো তা খুঁড়ে তোলা হয়েছে।

কেউ কেউ

তাদের মুদ্রার উপর সিংহ খোদাই করে,

আবার কেউ

কারো মস্তক খোদাই করে;

তবু তামা, সোনা বা ব্রঞ্জের টুকরোগুলো

মাটির তলায় চাপা পড়ে সমমর্যাদার হয়ে যায়।

কাল তাতে কামড় বসিয়ে দাঁত শানায়, দাঁত ভাঙে।

সময় আমাকে তেমনই মুদ্রার মতো কাটে,

আমার জন্য এখন আর আমার যথেষ্টাংশ অবশিষ্ট নেই।

 

(১৯২৮)

 

 

১। পিণ্ডার: প্রাচীন গ্রিক কবি। প্রাচীন গ্রিসের শহর-রাষ্ট্রগুলোর শাসক পরিবারদের মধ্যে প্রশস্তিকাব্য-রচয়িতা হিসেবে পিণ্ডারের খুব কদর ছিল। বিভিন্ন শহর-রাষ্ট্রগুলোয় যে বিবিধ প্রতিযোগিতা, শারীরিক কসরত ও খেলার আসর (বিশেষ করে ঘোড়ায় টানা রথের দৌড় প্রতিযোগিতা) অনুষ্ঠিত হতো, তাতে বিজয়লাভকারী শাসক-পরিবার-সদস্যদের জয় উদযাপনের জন্য পিণ্ডারকে প্রশস্তিকাব্য রচনার বরাত দেওয়া হতো এবং রচনাশেষে ভালো পরিমাণ পারিশ্রমিকও দেওয়া হতো। পিণ্ডার-রচিত প্রশস্তিকাব্যগুলো প্রাচীন গ্রিসের বড় বড় প্রাসাদ ও ক্রীড়াঙ্গনগুলোয় জনসমাবেশের মধ্যে পাঠ করা হতো। পৃষ্ঠপোষণা পাওয়ার এই পরিপ্রেক্ষিত থেকে পিণ্ডারকে ম্যান্ডেলস্টামের বিপরীতই বলতে হবে, কারণ ম্যান্ডেলস্টাম তঁার সময়ের রাষ্ট্র ও শাসকদের কাছ থেকে পৃষ্ঠপোষণা পাননি তো বটেই, বরং নিন্দা-অবজ্ঞা-অবদমন পেয়েছেন। অন্য এক দিক থেকে অবশ্য পিণ্ডারের সময় ও ম্যান্ডেলস্টামের সময় তুলনীয় হতে পারে। দুইজন কবিই তঁাদের সমসময়ে বিপুল ঐতিহাসিক পালাবদল, যুদ্ধ, ক্ষমতার উত্থান-পতন ও সামাজিক-রাজনৈতিক মন্থনের সাক্ষী হয়েছিলেন। পিণ্ডারের সমকালীন গ্রিস ছিল সমাজমর্যাদা ও বংশগৌরবের ভিত্তিতে ক্ষমতার আসনকে টলিয়ে তুলনায় গণতান্ত্রিক শহর-রাষ্ট্র ব্যবস্থার পত্তনের মঞ্চ যেখানে শাসকপরিবাবদের মধ্যে হিংস্র প্রতিযোগিতা, হানাহানি, উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে ইতিহাস-নাট্য অনুষ্ঠিত হচ্ছিল। আর ম্যান্ডেলস্টামের সময় হল প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিকায় রুশ জারতন্ত্রের পতন, অক্টোবর বিপ্লব, বলশেভিক শাসনের পত্তন, স্তালিনিয় সর্বাত্মকতাবাদের উত্থানের কাল। পিণ্ডার তঁার সমসময়ের উত্থান-পতনের ঢেউকে দক্ষ নাবিকের মতো সামলে সফল কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা বজায় রাখতে পেরেছিলেন। কিন্তু ম্যান্ডেলস্টামের নৌকা ঝড়ে ভেঙে পড়েছিল। লোকচক্ষুর আড়ালে স্তালিনিয় বন্দিশিবিরে অনাহারে দুর্দশায় ক্ষয়ে ক্ষয়ে জীবনের সঙ্গে শেষ বোঝাপড়া সাঙ্গ করে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছিল। রুশবিপ্লব পরবর্তী নতুন সমাজ গঠনের আশা-আকাঙ্খার মুখ থুবড়ে পড়া নিয়ে লেখা এই কবিতাটির উপনাম হিসেবে ‘একটি পিণ্ডারিয় খণ্ডাংশ’ ব্যবহার করা এই আনুষঙ্গিক বৈপরীত্যগুলো নিয়ে ব্যঞ্জনাময় হয়ে ওঠে। কবিতায় ব্যবহৃত ঘোড়া, ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা ও অশ্বনালের অনুষঙ্গও পিণ্ডারিয় প্রশস্তিকাব্যের প্রাচীন গ্রিসের রাজপুরুষদের রথ-দৌড় প্রতিযোগিতার আবহে ব্যবহৃত হয়েছে।

২। বেথলেহেম-য়ের সেই শান্তিস্নিগ্ধ ছুতার: যিশুর পিতা।

৩। নাবিকদের বন্ধু দীর্ঘ পরিক্রমার পিতা সেই অন্য ছুতার: গ্রিক পুরাকথার চরিত্র ও হোমার-য়ের ‘ওডিসি’-র নায়ক ওডিসিয়াস, দক্ষ নাবিক ছাড়াও জাহাজনির্মাতা ও ছুতার হিসেবেও যাঁর দক্ষতা সুবিদিত ছিল। ট্রোজান যুদ্ধ থেকে তঁার ঘরে ফেরার যাত্রাপথের দীর্ঘ পরিক্রমা পশ্চিমী ভাবনাজগতে বহু অতিকথা ও ব্যঞ্জনার জন্ম দিয়েছে।

৪। নিয়েয়রা: গ্রিক পুরাকথার চরিত্র। এই নারী তার পুত্রের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন।

১০

তোমাকে যা বলব একেবারে

সোজাসাপটা:

তা সবই তোষামুদে, শেরি ব্র্যানডি,

সোনা আমার!

 

যে স্থান হেল্লিনের জন্য ছিল

সৌন্দর্য্যে উদ্ভাসিত,

সেখানে এখন কৃষ্ণগহ্বর থেকে

কলঙ্ক মুখ ভ্যাংচায়।

 

গ্রিকরা ঢেউ পেরিয়ে হেলেনকে

হরণ করেছিল,

আর তাই আমার ঠোঁটে লেগে থাকে

লবণাক্ত সমুদ্রফেনা।

 

আমার ঠোঁটে লেপে থাকে

শূন্যতা,

আমায় আঙুল তুলে শাসায়

নিদারুণ দারিদ্র্য।

 

ওহে তবে, অতএব, ফুঁকে দাও, চলে যাও—

আমার কিছুই যায় আসে না—

দেবদূতী মেরী, ককটেল পান কর,

গোগ্রাসে আকন্ঠ!

 

তোমাকে যা বলব একেবারে

সোজাসাপটা—

তা সবই তোষামুদে, শেরি ব্র্যানডি,

দেবদূতী আমার!

 

 (১৯৩১)

 

 
   

 

১। হেল্লিন: গ্রিক পুরাকথা অনুযায়ী গ্রিকজাতির আদিপুরুষ।

২। হেলেন: গ্রিক পুরাকথার চরিত্র। জুপিটার ও লেডার কন্যা। বিশ্বশ্রেষ্ঠা সুন্দরী হেলেন তঁার স্বামী মেনেলস-কে ত্যাগ করে তঁার প্রেমিক ট্রয়ের রাজপুত্র পারি-র সাথে এই ট্রয় শহরে পালিয়ে আসেন, যার সূত্র ধরে গ্রিকদের সঙ্গে ট্রয়বাসীদের যুদ্ধ শুরু হয়। সেই ট্রোজান যুদ্ধে ট্রয়ের পতন হয়।

 

 

১১

একদা ছিল এক ইহুদি সংগীতজ্ঞ,

নাম আলেকজান্ডার গেরসোভিচ।

সে খাঁটি হীরার মতো

শুবার্ট-য়ের মধ্যে তুরপুন দিয়ে গর্ত কাটতে পারত।

 

আর হৃদয় উজিয়ে ঊষা থেকে গোধূলি

খুঁটিনাটিসহ রপ্ত করা

একটিই চিরন্তন সোনাটা

বারবার চোখ বুজে বাজিয়ে যেত।

 

কেন? আলেকজান্ডর গেরসোভিচ,

বাইরে আঁধার ঘনিয়েছে...

ক্ষান্ত হও, আলেকজান্ডর গেরসোভিচ,

কী বা এসে যায়, কিছুই তো বদলাবে না...

 

ওসব সেই ইতালিয় মেয়েটির জন্যই ছেড়ে দাও না কেন,

সে না হয় শুবার্টের পিছনে উড়ে বেড়াক

তার ছোট্ট সরু স্লেড চড়ে

তখনও মচমচে থাকা তুষারের উপর।

 

আমার সঙ্গীত-কপোতকে নিয়ে

মরতে আমার ভয় নেই,

কিন্তু ওখানে— কাকের পশমী কোটের মতো—

আমাকেও তো আলনা থেকে ঝুলিয়ে রাখা হবে।

 

আর কিছু নেই, আলেকজান্ডর গেরসোভিচ,

বহু দিন আগে বোনা এই স্বর...

ক্ষান্ত হও আলেকজান্ডর গেরসোভিচ,

কী বা এসে যায়, কিছুই তো বদলাবে না...

 

(১৯৩১)

 

 
   

 

১। শুবার্ট: অস্ট্রিয়াবাসী ধ্রুপদসঙ্গীত-রচয়িতা। জীবনকাল: ১৭৯৭-১৮২৮।

২। সোনাটা: পশ্চিমী ধ্রুপদী সঙ্গীতের একটি রূপ যা সাধারণত শুধু পিয়ানো বা পিয়ানো এবং ভায়োলিনে বাজানো হয়, যেখানে দুটি থিমকে হাজির করে ক্রমশ বিস্তারিত ও পুনরাবৃত্ত করা হয়।

 

 

১২

এখনও আমি পরমপিতার পর্যায়ের কেউ নই,

এখনও আমি আধা-শ্রদ্ধাস্পদ বয়সসীমা ছাড়াই নি,

এখনও লোকে রাস্তার কোন্দলের ভাষায়

এক ছটাক বিবেচনা ছাড়াই

আমার পিছনে আমাকে গাল দেয়:

—অমুক তমুক কোথাকার!— ঠিক আছে বাবা, ক্ষমা চেয়ে নিই,

কিন্তু গহনতলে আমি একবিন্দু বদলাই না...

 

পৃথিবীর সঙ্গে তোমার বন্ধন নিয়ে যখন তুমি ভাবো,

নিজেকেই কি নিজে বিশ্বাস করতে পারো: কত না অর্থহীন সব!

অন্য কারও বাসঘরে মাঝরাতে ঢোকার চাবি,

পকেটে রুপোর আধুলি,

আর গুণ্ডাদলগুলোর লড়াই নিয়ে তৈরি সিনেমার এক খণ্ডাংশ...

 

কুকুরছানার মতো আমি টেলিফোনের দিকে ছুটে যাই

যখনই তা উন্মত্তের মতো বেজে ওঠে—

ওপার থেকে কেউ পোল ভাষায় বলে ‘জিকুজে, পানি!’—

অথবা দূর থেকে ভেসে আসে কোনো মেদুর ভৎর্সনা

বা কোনো বৃথা অঙ্গীকার।

 

তুমি ভাবতেই থাকো: বড়দিনের ঝলক আর আতসবাজির মধ্যে

কোনটা পছন্দ করতে নিজেকে প্রশিক্ষিত করে তোলা যায়—

কোমর বেঁধে গুছিয়ে হয়ত নেমেও পড়বে— কিন্তু খেয়াল রেখো,

সবশেষে কেবল বিভোল-বিহ্বলতা আর কর্মহীনতাই পড়ে থাকে—

যাও, তাদের পুড়িয়েই আলো জ্বালাও!

 

দেঁতো হাসি হেসে, পরিমিত ভানে সেজে

সুন্দর-চুল-বিশিষ্ট বেতখণ্ডটি নিয়ে বাইরে বের হই,

সরু গলিগুলোয় সোনাটা বাজতে শুনি,

প্রতিটা বিক্রেতার বিপণির সামনে দাঁড়িয়ে ঠোঁট চাঁটি,

তোরণতলের কাদাপাঁকে দাঁড়িয়ে বইগুলোর পাতা ওলটাই,

বাঁচি না, তবুও বাঁচতে থাকি।

 

বেরিয়ে আমি চড়ুই আর প্রতিবেদকদের কাছে যাব,

রাস্তার আলোকচিত্রীদের কাছে যাব,

আর পাঁচ মিনিটের মধ্যে, বালতি থেকে বেলচার মতো,

শাহ পর্বতের লাইল্যাক শঙ্কুর নীচে

নিজ প্রতিকৃতি ফিরে পাব।

 

অথবা অন্যথায়, কাজের নির্দেশ পালনে আমি উদ্যোগী হব

ধোঁয়াভরা ঘিঞ্জি ভূগর্ভস্থ কামারায়

যেখানে নির্মল সৎ চীনারা

লাঠি দিয়ে ভিজা ময়দার তাল সামলায়,

কার্ডের সরু ফালা নিয়ে খেলে,

আর ইয়াংজের চড়ুইদের মতো ভদকা পান করে।

 

আমি ভালবাসি পথে নামা রঙিন সাজের ট্রামগাড়ি

আর অ্যাসট্রাকান কাভিয়ারের মতো অ্যাসফাল্ট

যা খড়ের চাদরে মোড়া

অস্তি-র বোতল-ঝুড়ির মতো,

আর লেনিন প্রকল্প নির্মাণ শুরু করতে ব্যবহৃত

উটপাখির পালকের ঠেসগুলো।

 

জাদুঘরগুলোর চমৎকার গুহায় আমি প্রবেশ করি,

যেখানে কাসচেই-য়ের রেমব্রান্টগুলো ফুলে ওঠে

কর্দোভান চামড়ার দীপ্তি আয়ত্ত করে;

টিশিয়ান-এর আঁকা শিংযুক্ত পাদরিদের মুকুটগুলো অবাক হয়ে দেখি,

আর অবাক হয়ে দেখি তিনতোরেতোর ছবিতে হাজার হাজার টিয়া

ভঁাড়েদের বহুবর্ণ পোষাক পড়ে ক্যাঁচক্যাঁচ করে...

 

আর কী নিদারুণভাবেই না এসব বন্ধন আমি ছিঁড়তে চাই,

নিজ বিষয়ের ঘনিষ্ঠ হতে চাই, সত্য উচ্চারণ করতে চাই,

কুজ্ঝটিকায়, আগুনে, সরাসরি নরকে নিক্ষেপ করতে চাই নিরাশার ঘোর,

কারও হাত ধরতে চাই: দয়া করো—

বলতে চাই— তুমি আর আমি একইদিকে ধেয়ে চলেছি...

 

 (১৯৩২)

 

১৩

মস্কোয় মধ্যরাত

 

মস্কোয় মধ্যরাত। এই বৌদ্ধ গ্রীষ্ম অতি চমৎকার।

চটাপট পদশব্দে রাস্তগুলো ছড়িয়ে পড়ে সরু সরু লোহার চটিতে।

 

কালো বসন্ত-গণ্ডীতে গাছের সারিগুলো পরম সুখী,

এমনকি রাতেও মস্কো থিতিয়ে যায় না।

 

ঘোড়ার খুরের তলা থেকে যখন শান্তি ছিটকে বেরোয়,

তুমি বলবে— যুদ্ধাভ্যাস করার মাঠের কোথাও

বিম ও বম, দুই ভাঁড়, তাদের আস্তানা গেড়েছে,

তাদের চিরুনি আর হাতুড়ি নিয়ে কাজে লেগে পড়েছে।

প্রথমে শুনতে পাবে মাউথ অরগান,

তারপর শিশুদের ছোট পিয়ানো—

ডো-রে-মি-ফা

আর সো-ফা-মি-রে-ডো...

 

অল্প বয়সে এক সময় ছিল যখন আমি বের হতাম

গরম গামকোট চাপিয়ে

সারি দেওয়া গাছের মাঝে চওড়া পথে,

যেখানে জিপসিশিশুর কাঠি-পা স্কার্টের লম্বা ঝালরে ধাক্কা মারে,

যেখানে গ্রেফতার হওয়া ভালুকগুলো দুলকি চালে ঘুরে বেড়ায়—

প্রকৃতির চিরায়ত মেনশেভিক এরা,

উপছে ওঠে চেরি-লরেলের গন্ধ...

কোথায় যাওয়ার কথা ভেবে যে তুমি বেরিয়েছ!

এখন আর কোনও চেরি-লরেল নেই...

 

রান্নাঘরের ঘড়ির অতিরিক্ত দোল-খাওয়া

দোলকদণ্ডটি আমি কড়া করে এঁটে নেব।

সময়ের গায়ের পশম অদ্ভুত রকম রুক্ষ্ম,

কিন্তু তবুও আমি তাকে তার লেজ আঁকড়ে বাগে আনতে পছন্দ করি:

যাই হোক না কেন, উড়ানের জন্য তো আর তাকে দোষ দেওয়া যায় না,

যদিও তা আমাদের কিঞ্চিৎ প্রতারণা করে বলে আমার অনুমান।

 

পিছু হঠ! ভিখারিপনা ছাড়! অভিযোগের ঘ্যানঘ্যানানি ছাড়! চুপ কর!

কাঁদুনি বন্ধ কর!

র‍্যাজনোচিনতসি-রা কি তাদের ফাটা জুতো দাপিয়ে গেল

এই ভেবে যে আমি এখন তাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারি!

পদাতিক সেনার মতো আমরা মরব,

তবু লোভ, দৈনিক শ্রম বা মিথ্যার মহিমাকীর্তন আমরা করব না!

 

প্রাচীন স্কট-কথা থেকে একটা-মাত্র মাকড়সা-জাল পড়ে আছে—

মৃত্যুর পর তা দিয়ে সামরিক পতাকার মতো আমাকে মুড়ে দিও,

পুরোনো বন্ধু, এসো আমরা যব-এর শোকে পান করি—

উলটে দাও!

 

ঠাসা ও ক্ষয়ধরা সিনেমাহলগুলো থেকে

নিষ্প্রাণ ভিড় বেরিয়ে আসছে, যেন ক্লোরোফর্মে জারিত।

কী রেখাসর্বস্ব তারা!

কী নিদারুণ তাদের শ্বাসবায়ুর অভাব!

 

সময় হয়েছে তোমার জানার যে আমিও এখনকারই একজন,

মস্কো-গারমেন্ট-কমবাইন-এর যুগের লোক আমি,

দেখো না আমার জামার রোম কেমন খাড়া হয়ে আছে,

কেমন ভাবেই না আমি কথা বলি, কত সদর্পেই না আমার পা পড়ে!

এ যুগ থেকে আমাকে ছিঁড়ে আলাদা করার চেষ্টা করেও দেখো না কেন!

তোমার নিজেরই ঘাড় মটকাবে বলে রাখছি!

 

যুগের সঙ্গে আমি কথা বলি, কিন্তু সত্যিই কি তার

সত্তা শণ-নির্মিত, সত্যিই কি তার

জন্ম হয়েছিল চাদরের উল্টো পিঠে,

যেমন কোনও তিব্বতী গুম্ফায় কোনও কোঁচকানো ক্ষুদ্র পশু

নিজেকে আঁচড়ায়, তারপর দস্তায় মোড়া পাত্রে ঝঁাপিয়ে পড়ে—

মারিয়া ইভান্না, অন্য কিছু আমাদের দেখাও!

 

তুমি হয়ত অসন্তুষ্ট হবে— তবু শুনে রাখ:

শ্রমের এক-প্রকার লাম্পট্য আমাদের রক্তে ঢুকে গেছে।

 

সবে আলো ফুটছে। বাগানগুলো গুঞ্জন করছে সবুজ তারবার্তার মতো।

রেমব্রান্ট-এর সঙ্গে দেখা করতে এসেছে রাফায়েল।

তঁার আর মোৎজার্ট-এর অতি প্রিয় ছিল মস্কো

পিঙ্গলবর্ণ চোখ আর গ্রীষ্ম মাদকতার জন্য।

 

আর বায়ুবাহিত ডাকের মতো

অথবা কৃষ্ণসাগরীয় পেলব বিষ-সাপের মতো

বায়ুবাহন চেপে এক ফ্ল্যাটঘর থেকে

আরেক ফ্ল্যাটঘরে বয়ে যায় বাতাস

যেন উচ্ছল ছাত্ররা জুয়াখেলায় মেতে উঠেছে...

 

(১৯৩২)

 

 

১। মেনশেভিক: বিশ শতকের প্রথমের রুশ সোশাল ডেমোক্রেটিক পার্টির একটি অংশ। অপর অংশ বলশেভিকদের সঙ্গে রাশিয়ার বিপ্লবের কৌশল প্রসঙ্গে এদের মতভেদ-বিতর্ক ছিল। ১৯১৭ সালে বলশেভিকরা ক্ষমতাদখল করার পর ক্রমশ এদের উপর নিপীড়ন নেমে আসে, বিপ্লববিরোধী বলে চিহ্নিত করে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের মাধ্যমে এদের দমন করা হয়।

২। র‍্যাজনোচিনতসি: ‘র‍্যাজনোচিনতসি’ শব্দটি প্রথম সতেরো শতকে রুশ সাম্রাজ্যের আইন-সংহিতায় ব্যবহার করা হয় আইনি মানে-মর্যাদায় ও সামাজিক অবস্থানে তলাকার বৃত্তিজীবী মানুষদের বোঝাতে। তাদের কর দিতে হতো। আঠারো শতকের মাঝামাঝি এদের অধিকাংশই কৃষিজীবীতে পরিণত হয়, সাইবেরিয়া-য় মনুষ্যবসত স্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। পরবর্তীকালে সাধারণ মানুষের মুখের ভাষায় র‍্যাজনোচিনতসি বলতে বোঝাত অনভিজাত কুলের এমন লোকজন যারা উপরতলার কাছে আবেদন-নিবেদনের মাদ্যমে সামাজিক আভিজাত্য অর্জন করে নিতে চায়। এই ১৯৩২ সালেই স্তালিনের ‘সমবায়িকীকরণ’ (collectivization) প্রক্রিয়া তুঙ্গে উঠেছিল, যে প্রক্রিয়ার ফলে প্রায় পঞ্চাশ লাখ কৃষককে সোভিয়েত দেশ জুড়ে (বিশেষ করে ইউক্রেন থেকে) উৎখাত হয়ে সাইবেরিয়ায় নির্বাসিত হতে হয়। সাংকেতিকভাবে ম্যান্ডেলস্টাম বোধহয় এদের কথাই বলছেন।

৩। ‘প্রাচীন স্কট-কথা থেকে একটামাত্র মাকড়সা-জাল’: স্কটল্যান্ডের প্রাচীন লোককথায় এক রাজার কথা আছে যে যুদ্ধে হেরে রাজত্ব হারিয়ে পালানোর সময় এক পাহাড়ের এক গুহায় আত্মপোগন করে, সেখানে এক মাকড়সার জাল বুনে শিকার ধরা দেখার পর যুদ্ধের নতুন কৌশল তার মাথায় আসে এবং সে সেই কৌশলে যুদ্ধ করে আবার রাজত্ব পুনরুদ্ধার করে।

৪। যব: বাইবেলের এক সচ্চরিত্র মানুষ, নিয়তির আকস্মিক বিপর্যয়ে যে তার প্রিয় পরিবার-পরিজন, সম্পদ, সবকিছু হারায়।

৫। মারিয়া ইভান্না: মারিয়া ইভান্না হ্রুসেভস্কায়া (১৮৬৮-১৯৪৮) ইউক্রেনের মেয়ে। জার শাসনের পতনের পর ইউক্রেনে ১৯১৭ সালে প্রথম যে ইউক্রেনীয় জাতীয়তাবাদী স্বশাসন প্রতিষ্ঠা হয়, সেই ইউক্রেনীয় কেন্দ্রীয় রাদা (সংসদ)-এর সদস্য হন এবং ইউক্রেনীয় জাতীয় থিয়েটারের কোষাধ্যক্ষের দায়িত্ব নেন। এই কেন্দ্রীয় রাদা-য় প্রেসিডেন্ট ছিলেন ইউক্রেনীয় ইতিহাসবিদ মিখাইলো হ্রুসেভস্কি, যিনি ছিলেন মারিয়ার স্বামী। বলশেভিকদের নেতৃত্বাধীন বাহিনীর আক্রমণে এই কেন্দ্রীয় রাদা-র পতন হওয়ার পর ১৯১৯ সালে স্বামী ও পরিবারের সঙ্গে তিনি দেশ ছেড়ে নির্বাসনবাসে যেতে বাধ্য হন। ১৯২৪ সালে আবার ইউক্রেনে ফিরে আসতে পারেন, কিন্তু ১৯৩৮ সালের পর থেকে তাঁর এবং তাঁর পরিবারের অন্যান্যদের বিরুদ্ধে ইউক্রেনীয় জাতীয়তাবাদী সংগঠনসমূহের সোভিয়েত-বিরোধী কার্যকলাপে সহায়তা করার অভিযোগে রাষ্ট্রীয় নজরদারি, নিপীড়ন জোরদার হয়।

 

 

১৪

আজ তুমি মস্কো নদীতে কড়ে আঙুল ডুবিয়ে নিয়ে

ক্রেমলিনের লুঠেরাদের

ছবি আঁকতে পারো। কী সুন্দরই না

ওই পেস্তার ঘাঁটিগুলো—

এমনকি তুমি সেখানে জোয়ার বা জইদানাও ছড়াতে পার!

আর এদের পাশে কাকে যেন শিশু মনে হয়?

সেই ‘ইভান দি গ্রেট’-কে—

তাঁর বেঢপ-বিশাল ঘন্টা-মিনারের মতোই

নির্বুদ্ধিতার চিরস্মারক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে

আমাদের এই যুগ। তাকে বিদেশে পাঠাতে পারো,

শিক্ষাদীক্ষা চুকিয়ে আসুক। অবশ্য কীই বা হবে?... যাচ্ছেতাই!

 

চারটি ধোঁয়ার চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে মস্কো নদী,

আর আমাদের সামনে গোটা শহরটা খুলে যায়—

স্নায়ী কলকারখানা আর শহরতলীর

বাগান সব। ঠিক যেন

বিরাট এক কনসার্ট পিয়ানোর

গাঢ় লাল কাঠের ঢাকনা তুলে

ধ্বনিসৃজক গহনে ডুব দেওয়া, তাই না?

শ্বেতরক্ষীবাহিনীর মরদরা, তোমরা কি তা দেখেছ?

তোমরা কি মস্কো-পিয়ানোর ধ্বনি শুনেছ? কু, কু, কু!

 

আমার মনে হয়, অন্যান্য প্রতিটি সময়ের মতো,

তুমি হে সমসময়, জারজ... শিশু যেমন

প্রাপ্তবয়স্কদের পিছু পিছু ভাঁজ-পরা জলে প্রবেশ করে,

মনে হয় আমিও তেমন ভবিষ্যতে প্রবেশ করছি

যদিও তা দেখার জন্য হয়ত বেঁচে থাকব না।

 

খেলার মাঠে দাগ-কাটা পরিখায় সেঁধানো

তরুণদের সঙ্গে আমি আর মানিয়ে চলতে পারি না।

কোনও মোটরসাইকেলের হুঙ্কার-সংকেতে জেগে উঠে

ভোরে আর বিছানা ছেড়ে লাফিয়ে উঠি না,

মুরগিদের ঠ্যাঙের উপর দাঁড়ানো কঁাচ-প্রাসাদগুলোর গায়ে

আমার ক্ষীণতম ছায়াটুকুও আর ফেলব না।

 

প্রতিদিন আমার শ্বাসপ্রশ্বাস আরও কষ্টকর হয়ে উঠছে,

যাই হোক না কেন, আর দেরি করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়—

কারণ মানুষ ও রেসের ঘোড়ার কলজেই কেবল

দৌড়প্রতিযোগিতার আনন্দ নিতে জন্ম নেয়...

 

কিন্তু ফাউস্ত-য়ের শয়তান— শুকনো, সুসংরক্ষিত—

আবারও একবার বুড়োটার কলজের খাঁচায় ঝঁাপিয়ে পড়ে,

তাগাদা দেয় খানিক নৌকাবিহারে যাওয়ার জন্য,

চড়ুই পর্বতের দিকে হাত নাড়ার জন্য,

বা ট্রামে চেপে মস্কোর মধ্য দিয়ে দমছুট ছুটে আসার জন্য...

মস্কোর অবশ্য আজ এসবের জন্য কোনও সময় নেই:

তার ঘাড়ে আজ শিশুপালিকার দায়দায়িত্ব—

চল্লিশ হাজার শিশুদোলার মাঝে সে ছুটে বেড়াচ্ছে,

একাই কেবল, হাতে শণের নুড়ি।

 

(১৯৩২)

 

১। ইভান দি গ্রেট: ১৪৬৫ থেকে ১৫০৫ অবধি রাশিয়াকে শাসন করা এই ইভান ভ্যাসিলিয়েভিচ প্রথম ‘জার’ উপাধি গ্রহণ করেন। মস্কোর প্রিন্স হিসেবে ক্ষমতায় বসার পর ক্রমশ নভগোরদ রিপাবলিক, ত্বের অঞ্চল দখল করে তিনি রুশ সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন করেন। রুশ আধিপত্যবাদী মানসিকতায় তিনি অন্যতম আদি নায়কের আসনে অধিষ্ঠিত।

২। মস্কো ক্রেমলিন কমপ্লেক্সের ভিতর একটি গির্জার মিনার, ৮১ মিটার উঁচু, এটাই ক্রেমলিনের সবচেয়ে উঁচু কাঠামো, ৬ মিটার লম্বা ২০০ টন ওজনের একটি ঘন্টা এখানে লাগানো আছে। ইভান দি গ্রেটের সময় তৈরি। ১৯১৮ সালে সোভিয়েত প্রশাসন এই মিনারে ঘন্টা বাজা বন্ধ করে দিয়ে গির্জা উঠিয়ে ছুতোরমিস্ত্রীদের কারখানা বসায়।

৩। শ্বেতরক্ষীবাহিনী: রুশ-বিপ্লবোত্তর ক্ষমতা দখলের জন্য জারি গৃহযুদ্ধে বলশেভিক-নেতৃত্বাধীন গোষ্ঠীর বিরোধী গোষ্ঠী হিসেবে যারা লড়েছিল তারা শ্বেতরক্ষীবাহিনী হিসেবে পরিচিত।

 

0 Comments
Leave a reply