কথার কথা, অনেক কথা

লিখেছেন:বিপ্লব নায়ক
শব্দ-কথা-ভাষা অর্থনির্দিষ্টতার গণ্ডীতে বাঁধা পড়ে কীভাবে, আবার স্বভাবগতভাবেই কীভাবে অর্থ-অনির্দিষ্টতায় মুক্তি খোঁজে, তা নিয়ে একটি ভাবনা।

 

 

 

কুবলাই খাঁ-র দরবারে অভিযাত্রী মার্কো পোলো।

কুবলাই--- আমাকে যেসব গল্প তুমি শোনাও, পশ্চিমে ফিরে গিয়ে তোমার দেশের লোকেদের কাছে কি এই সমস্ত গল্পই পুনরাবৃত্ত করবে?

মার্কো--- আমি যা বলি, আমার মতো করে বলি, কিন্তু শ্রোতা সেই শব্দগুলোই ধরে রাখে যেগুলো তার প্রত্যাশা মেটায়। জগতের যে বর্ণনায় আপনি দয়াপরবশ কর্ণপ্রদান করেন তা এক বস্তু; আর অন্য বস্তু হবে সেসব বর্ণনা যা আমার ফিরে যাওয়ার পরের দিন আমার বাড়ির বাইরের রাস্তায় গন্ডোলার মাঝি ও জাহাজের খালাসিদের মুখে মুখে ঘুরবে; এবং আরো অন্যতর হবে তা যা হয়তো আমি আমার জীবন-সায়াহ্নে বর্ণনা করব, যদি জেনোয়ার দস্যুরা আমাকে বন্দি করে নিক্ষেপ করে এমন কোনো জেলঘরে যেখানে অপর কোনো গল্পলিখিয়েও বন্দি। কথকের স্বর গল্পকে নিয়ন্ত্রণ করে না, গল্পকে নিয়ন্ত্রণ করে শ্রোতার কান।

কুবলাই--- কখনো কখনো আমার মনে হয় যেন বা আমি জাঁকালো, রুচিহীন, বাঁচার অযোগ্য এক বর্তমানে বন্দি, মানবসমাজের সমস্ত ছঁাচ এখানে অস্তিত্বের এমন এক চরমবিন্দুতে পৌঁছে গেছে যে তাদের আর নতুন কোনো আকার ধরার ক্ষমতা নেই। তোমার স্বর যেনবা বহু দূর থেকে আমার কাছে এসে পৌঁছয়। তোমার স্বরে আমি শুনতে পাই অদৃশ্য সেসব কারণ যা শহরদের বাঁচিয়ে রাখে, আর যে কারণে হয়তো তারা মরে যাওয়ার পরও আবার কখনো বেঁচে উঠবে।

(ইতালো কালভিনো, ইনভিজিবিল সিটিজ, বাংলা তর্জমা বর্তমান লেখকের)

কথা নিয়ে উদ্দেশ্যমূলক ক্রিয়া যে গর্ভ তৈরি করে, সেই গর্ভের অন্তর্গত জলে ভাষাব্যবস্থার ভ্রূণাবস্থা থেকে পূর্ণ রূপ গ্রহণের খেলা চলে। সে উদ্দেশ্যমূলক ক্রিয়া কেমন? তা কি সচেতনতা-চালিত? না তা নয়। বাচনকর্ম মূলত উদ্দেশ্যমূলক ক্রিয়া। কিন্তু বাচনের ভাষা নির্মাণ বা বাচনের ভাষা বাছাই বক্তার সচেতনতা-প্রযুক্ত ক্রিয়ার সীমায় বদ্ধ থাকে না, সে সীমা ছাড়িয়ে বহুদূর ছড়িয়ে যায়। ভাষারূপের অর্থ-নির্দিষ্ট অবয়ব-দৃঢ়তা বক্তার বাচন তৈরি করে না, বাচন তৈরি হয় বক্তার তাৎক্ষণিকতার স্ফূরণের মধ্য দিয়ে। বক্তার স্থিতসত্তা-পরিস্থিতি-র বিশেষত্ব, যার একটা অংশমাত্রই তার সচেতনতায় ধারিত, তার মধ্য দিয়েই এই তাৎক্ষণিকতার স্ফূরণ। ফলে ভাষার কোনো ভাষাতাত্ত্বিক নির্দিষ্ট-নির্মিত-রূপ বাচনের স্থায়ী কাঠামো হতে পারে না। বাচন গড়ে ওঠে ভাষাচিহ্নকে পরিবর্তনশীল করে নিয়ে, পরিবর্তনশীল অবস্থান-পরিস্থিতির সাপেক্ষে অভিযোজনীয় করে নিয়ে। এ হলো বক্তার অবস্থান। আর শ্রোতার অবস্থান? শ্রবণ এবং শ্রুত বাচনের অর্থনির্মাণ আর একটি উদ্দেশ্যমূলক ক্রিয়া। সে ক্রিয়াসমাপনের ভিত্তি শ্রোতার তাৎক্ষণিকতার স্ফূরণ। শ্রোতা তার নিজের স্থিতসত্তা-পরিস্থিতি ও নিজ স্থিতসত্তার বিশেষত্ব অনুযায়ী বাচন-অন্তর্গত কথাবস্তুর অর্থ নিরূপণ করে। শ্রোতার গৃহীত তাৎপর্য ও বক্তার উদ্দিষ্ট তাৎপর্য অবধারিতভাবে যে মিলবে তা নয়। অর্থাৎ শ্রোতার অবস্থান থেকেও ভাষাচিহ্ন পরিবর্তনশীল, পরিবর্তনশীল স্থিতসত্তা-পরিস্থিতি সাপেক্ষে অভিযোজনীয়। শ্রোতা কোনো বাচনকে বোঝে বাচনের কোনো একক স্থিরীকৃত অর্থ চেনার মধ্য দিয়ে নয়, বরং কোনো একটি নির্দিষ্ট বাচনের অর্থ নির্দিষ্ট পরিপ্রেক্ষিত অনুযায়ী নির্মাণ করে নিয়ে। আমরা কখনোই এমন কোনো শব্দ শুনি না যার অর্থ ধ্বনি-কাঠামোর দ্বারা বা ব্যাকরণ-কাঠামোর দ্বারা অপরিবর্তনীয় রূপে বস্তুগতভাবে নির্ধারিত। আমরা শুনি এমনকিছু যা সত্য অথবা যা মিথ্যা, যা ভালো অথবা যা মন্দ, যা গুরুত্বপূর্ণ অথবা যা গুরুত্বহীন, যা আনন্দের অথবা যা বিষাদের,...। আবেগ ও অভ্যাসের উতরোল ফেনিল বিস্তারে শব্দ-কথা-ভাষা-র ছায়া পড়ে। সে ছায়া ঢেউয়ের গায়ে কাঁপে, ভাঙে, জোড়ে, অর্থপূর্ণ হয়ে ওঠে, বা অর্থের ওপারে থেকে যায়। এই স্বাভাবিকতার বাইরে বেরিয়ে শব্দকে সর্বজনীন অর্থ ও গণবোধ্যতা প্রদান করতে পারে কেলাসীভূত অভ্যাস ও একশিলা মতবাদ। শব্দের অর্থ করা বা শব্দে সাড়া দেওয়ার উদ্দেশ্যমূলক ক্রিয়া সর্বজনীনভাবে সমরূপ হতে পারে কেবলমাত্র অভ্যাস ও মতবাদের গণ্ডিতে বাঁধা সদা-স্বচ্ছ-দেশ-এর নিবন্ধীকৃত নাগরিক হয়ে ওঠার মধ্য দিয়ে। অভ্যাস ও মতবাদের গণ্ডিতে বাঁধা দেশে নিবন্ধনকর্মটি চলে কীভাবে? বা কীভাবে তা চলার মধ্য দিয়ে সর্বজনীনতা নির্মিত হয়? নিমজ্জিত অতীতের জেগে থাকা কিছু পথরেখার উপর চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক।

১৭৩৫ সালে সুইডেনের প্রকৃতিবিজ্ঞানী কার্ল লিনিয়স প্রকাশ করলেন তঁার গ্রন্থ ‘দি সিস্টেম অফ নেচার’ (প্রকৃতির ব্যবস্থা-কাঠামো)। এই গ্রন্থে লিনিয়স বিশদীকৃত করলেন পৃথিবীর সমস্ত উদ্ভিদকে শ্রেণি-বিন্যস্ত করার অভিনব পদ্ধতি। সমসাময়িক কালে বিকল্প আরো কিছু পদ্ধতি প্রস্তাবিত হয়, লিনিয়সের পদ্ধতির ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়ে কিছু আলোচনাও হয়, কিন্তু শেষাবধি লিনিয়সের পদ্ধতি ইওরোপের বিদ্বৎমহলে সাধারণ সর্বজনগ্রাহ্যতা লাভ করে। এই পদ্ধতিতে পৃথিবীর সমস্ত উদ্ভিদকে ২৪-টি ,পরবর্তীকালে যা বাড়িয়ে করা হয় ২৬-টি, মৌলিক শ্রেণিতে বিন্যস্ত করা হয় তাদের পুনরুৎপাদন অঙ্গ যথা পরাগকেশর, গর্ভকেশর ইত্যাদির গঠনের বিচারে। আরো চারটে দৃশ্যমান বৈশিষ্ট্যকে ব্যবহার করা হয় শ্রেণিবিন্যাসে প্রত্যেকের আপেক্ষিক অবস্থান সুনির্দিষ্ট করতে, সেগুলো হলো ঃ সংখ্যা, আকার, অবস্থান ও তুলনামূলক আয়তন। লিনিয়স দাবি করেছিলেন যে পৃথিবীর সমস্ত উদ্ভিদ, ইওরোপীয়দের কাছে তখনও অবধি যা জানা, শুধু তাই নয়, যা অজানা তাও, এই একক শ্রেণিবিন্যাসের মধ্যে ধারণ করা যাবে এবং উদ্ভিদজগতের (বা সঠিকভাবে বললে, উদ্ভিদজগৎ সম্পর্কিত মানবধারণা-র) বিশৃঙ্খলা দূর করে এই পদ্ধতি শৃঙ্খলাস্থাপন করবে। ১৭৫১ সালে প্রকাশিত ‘ফিলোজফিয়া বোটানিকা’ (উদ্ভিদবিদ্যার দর্শন) এবং ১৭৫৩ সালে প্রকাশিত ‘স্পেসিস প্ল্যানটারাম’ (উদ্ভিদের প্রজাতি) গ্রন্থের মধ্য দিয়ে লিনিয়স এই পদ্ধতিকে আরো পরিমার্জিত করেন। উদ্ভিদজগতের বাইরে জীবজগৎ ও খনিজদ্রব্য সমূহ বর্ণনারও তুলনীয় পদ্ধতি প্রস্তাব করেন। ইওরোপের বিভিন্ন অঞ্চলের নিজস্ব কথ্য/ লেখ্য ভাষার ঊর্ধ্বে উদ্ভিদজগৎ বর্ণনার এই নতুন ভাষাকে আঞ্চলিকতা-নিরপেক্ষ রূপ দিতে লিনিয়স সচেতনভাবে ফিরে যান ধ্রুপদী লাতিন ভাষার ব্যবহারে।

লিনিয়সের তৈরি করা এই বর্ণনা-তালিকার নিজস্ব চেহারা গতিহীন বিমূর্ত হলেও এই তালিকা নির্মাণে উদ্যোগ তৎকালীন ইউরোপীয়দের বিশ্ব-সমীক্ষায় বৈপ্লবিক গতি সঞ্চার করেছিল, ইউরোপীয় জ্ঞান-উৎপাদন প্রক্রিয়াকে মূর্তভাবে পাল্টে দিয়েছিল। ১৭৭১ সালে এক সহকর্মীর উদ্দেশ্যে লিনিয়সের লেখা থেকে জানা যায়:

আমার ছাত্র স্পারম্যান সদ্য উত্তমাশা অন্তরীপের উদ্দেশ্যে জলপথে রওনা দিয়েছে। আমার আরেকজন ছাত্র থুনবের্গ ওলন্দাজ রাষ্ট্রদূতগণের সঙ্গী হয়ে রওনা দেবে জাপানে। ওরা দুজনেই সুযোগ্য প্রকৃতিবিজ্ঞানী। তরুণ গিমেলিন এখনও পারস্যে আর আমার বন্ধু ফ্ল্যাক এখন টারটারিতে। মেহিকোতে উদ্ভিদবিদ্যা সম্বন্ধীয় চমৎকার সব আবিষ্কার করে চলেছে মুটিস। ট্র্যানকুয়েবারে প্রচুর নতুন জিনিষ খুঁজে পেয়েছে ক্যোনিগ। সুরিনামে রোল্যান্ডার যে সমস্ত উদ্ভিদ খুঁজে পেয়েছিল তার উপর প্রকাশনা তৈরি করছেন অধ্যাপক ফ্রিস। ফোরস্কাল-এর আরবদেশে করা আবিষ্কারসমূহ কিছুদিনের মধ্যেই কোপেনহাগেন-এর ছাপাখানায় পৌঁছে যাবে। (মেরি লুই প্র্যাট লিখিত গ্রন্থ ‘ইমপেরিয়াল আইজ’-এর পৃঃ২৭-এ উদ্ধৃত।)

ইউরোপের উপনিবেশবিস্তার কার্যক্রমের ডাল-পালা ছেয়ে প্রস্ফুটিত হয়ে উঠছে জ্ঞান-উৎপাদনের এক আন্তর্জাতিক কার্যক্রম। পরিবহণ, তথ্য সংগ্রহ, তথ্য সংরক্ষণ, পর্যবেক্ষণ, ছাপাখানা সংক্রান্ত প্রযুক্তির বিস্তার ও তার পঁুজিবাদী উৎপাদনক্ষেত্র এর মধ্য দিয়ে প্রসারিত হলো। পাশাপাশি, জ্ঞান-উৎপাদন সংক্রান্ত এক নতুন উৎপাদন পদ্ধতিও মূর্ত রূপ ধারণ করল। এই মূর্ত রূপটিকে একটু বিশদে বিচার করা যাক।

শ্রেণি-প্রণালী তৈরির একক পদ্ধতির মধ্য দিয়ে পৃথিবীব্যাপী বিপুল বৈচিত্র্যময় জীবকুলকে প্রতিনিধিত্বমূলক এক ভাষার খাপে এঁটে ফেলা হলো। এই ভাষা বিশৃঙ্খলা কাটিয়ে শৃঙ্খলা তৈরি করছে। এই ভাষার দর্শনদৃষ্টি অনুযায়ী উপছে যাওয়া বিপুল বৈচিত্র্য মানেই বিশৃঙ্খলা, আর বিশৃঙ্খলা মানেই ক্ষতিকর কারণ তা মানবমানসের ভাষাকাঠামোয় প্রকৃতির প্রতিনিধিত্বমূলক রূপ নির্মাণকে সবসময় অসম্পূর্ণতায় বিনীত করে রাখে। এই ক্ষতিকর অশুভকে অতিক্রম করে এই ভাষা ঋদ্ধিমান ও সর্বোৎকৃষ্ট জ্ঞানের উপযোগী হতে পারে এমন এক শৃঙ্খলা-কাঠামো তৈরি করার মধ্য দিয়ে যা জ্ঞাত-অজ্ঞাত সবকিছুকে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ রূপে বেঁধে ফেলবে, যা হবে সমগ্র প্রকৃতির প্রতিনিধিত্বমূলক রূপ, যে রূপকে চেতনায় ধারণ করার মাধ্যমে মানুষ সমগ্র প্রকৃতিকে নিজ-নির্মিত জ্ঞানের মুঠোয় বেঁধে ফেলবে। প্রকৃতির অজ্ঞেয়তা বা দুর্বোধ্যতাকে পরাজিত করে মানবজ্ঞানের ক্ষমতা-উল্লাস বেজে উঠবে সেই ভাষায়। এই ভাষাচেতনায় প্রকৃতিজ বস্তু ও তার প্রতিনিধিত্বমূলক মানব-নির্মিত ভাষারূপের মধ্যে দূরত্বকে ধ্বংস করা হয়, এ দুইয়ের বিভিন্নতাকে অস্বীকার করে দুই-কে সম করে দেওয়া হয়। ফলে শেষাবধি প্রকৃতিজ বস্তু উধাও হয়ে গিয়ে কবরের উপর কবরফলকের মতো  পড়ে থাকে কেবল মানব-নির্মিত ভাষারূপ--- তার অর্থ সর্বজনীন, তার দ্যোতনা অপরিবর্তনীয়। এই জ্ঞানোৎপাদন-প্রক্রিয়া জ্ঞানকে আত্মম্ভরী করে তোলে, যার সে ছায়া সেই প্রকৃতির হন্তারক করে তোলে, শেষাবধি হয়তো বা অন্ধ ঔদিপাউস হওয়াই তার নিয়তি। কায়াহীন ছায়া বিজ্ঞানের ভেক ধরে সন্নিবিষ্ট ছায়া-কায়া রূপে এক ভৌতিক উপস্থিতি কায়েম করে।

এই ভাষারূপ সমস্ত প্রকৃতিজ বস্তুকে সংকুচিত করে আনে পর্যবেক্ষণযোগ্য বা পরিমাপযোগ্য সসীম সংখ্যক বৈশিষ্ট্যের সমাহারে এবং তারপর ওই বৈশিষ্ট্যসমূহের সাপেক্ষেই নির্মাণ করে চলে শ্রেণিপ্রণালী, যে শ্রেণিপ্রণালীর মধ্যেই ওইসব বস্তুসমূহের সমগ্রতা ধারিত বলে ধরে নেওয়া হয়। প্রাণীবিজ্ঞানীরা ঠিক করে দেন উদ্ভিদ ও প্রাণী শ্রেণিপ্রণালীকরণের জন্য ব্যবহার্য বৈশিষ্ট্য, নৃতত্ত্ববিদরা ঠিক করে দেন বিভিন্ন মানবসমাজরূপ শ্রেণিপ্রণালীকরণের জন্য ব্যবহার্য বৈশিষ্ট্য, অর্থনীতিবিদরা নির্ধারিত করে দেন বিভিন্ন উৎপাদনব্যবস্থা শ্রেণিপ্রণালীকরণের জন্য ব্যবহার্য বৈশিষ্ট্য, চিকিৎসাশাস্ত্রবিদরা নির্দিষ্ট করে দেন বিভিন্ন মানবদেহের শ্রেণিপ্রণালীকরণের জন্য ব্যবহার্য বৈশিষ্ট্য, ভাষাতাত্ত্বিকরা নির্ধারিত করে দেন বিভিন্ন ভাষার শ্রেণিপ্রণালীকরণের জন্য ব্যবহার্য বৈশিষ্ট্য ..... চলতেই থাকে, চলতেই থাকে.....শবাধারের পর শবাধার জমে ওঠে। তথাকথিত বিশেষজ্ঞদের হাতেই যেনবা সমস্ত ভাষিক ক্রিয়ার লাগাম। অগণিত সাধারণ মানুষের যেনবা সেই জ্ঞানপণ্ডিত বিশেষজ্ঞদের অনুকরণ-অনুসরণ, এবং তা-ও অক্ষমভাবে, করে যাওয়া ছাড়া, ভাষাব্যবহারে সেই অভিজাতকুলের দাসবৃত্তি করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই!

ইউরোপ-জাত এই জ্ঞানোৎপাদন প্রক্রিয়া তার জন্মমুহূর্তে ছিল বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন মানবসমাজরূপের বিভিন্ন জ্ঞানোৎপাদন প্রক্রিয়ার অন্যতম একটি মাত্র। কিন্তু এই বিশেষ জ্ঞানোৎপাদন প্রক্রিয়ার দোসর ছিল পঁুজিবাদী উৎপাদন পদ্ধতি, যার শিরায় বইছে অন্তহীন প্রসারণ-প্রবণতা। ফলত ঔপনিবেশিক রাজদণ্ডের সহায়তায় এই জ্ঞানোৎপাদন প্রক্রিয়া বিশ্বের অন্যান্য সমাজরূপের জ্ঞানোৎপাদন প্রক্রিয়াকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে নিজেকে প্রসারিত করতে থাকে। নিজস্ব ভাষাচেতনা-অন্তর্গত ক্ষমতা-উল্লাস ঔপনিবেশিক রাজদন্ডের সহায়তায় প্রকাশিত হয় অন্য বিভিন্ন সমস্ত জ্ঞানোৎপাদন প্রক্রিয়াকে ‘অনুন্নত’, ‘পশ্চাৎপদ’ আখ্যা দিয়ে নিজ-প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। নিজেকে কেন্দ্রে রেখে, নিজ-নির্মিত বিবর্তন-প্রণালীর শীর্ষে রেখে সে গোটা বিশ্বের বিপুল বৈচিত্র্যময় জ্ঞানচেতনাসমূহের বিশৃঙ্খলায় শৃঙ্খলা আরোপ করার প্রক্রিয়া নেয়। ইউরোপীয় মাপের সমসত্বতা আরোপের আন্তর্জাতিক ঐক্য-শৃঙ্খলার অংশ হওয়ার মধ্য দিয়ে ক্ষয়প্রাপ্ত হতে থাকে বিভিন্নতা, অপরতা। ইউরোপীয় দৃষ্টি তার নিজস্ব জ্ঞানোৎপাদন চর্চার ভাষায় শুষে নিতে থাকে অসম সমস্ত ক্ষেত্র/অবস্থান। একইসঙ্গে মূর্ত চেহারা নিতে থাকে সামাজিক রূপগত এক একশিলা স্থাপত্য। সেই স্থাপত্য নিয়ে কিছু কথা বলা যাক।

ইতিহাসের বিবৃতি একটি নির্মাণ— এমন এক মুখের আদলে মুখোশ নির্মাণ, যে মুখ কায়াসদৃশ কিছু অবশেষ রেখে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। বহু মুখোশ কি বহুত্বগুণে মুখের হয়ে-ওঠা-র প্রতিনিধিত্ব করতে পারে? কালক্রমে প্ররোচণাকারী শক্তির ক্রমপরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মুখোশেরও ক্রমপরিবর্তন ঘটে। মুখ থাকে না, অথচ বহু মুখোশ থাকে।

পঁুজির তথাকথিত ‘প্রাথমিক সঞ্চয়’ ঘটেছিল বহু উৎপাদককে তাদের উৎপাদনের উপায়ের মালিকানা থেকে বিযুক্ত করে, প্রকৃতির সঙ্গে সরল প্রত্যক্ষ সম্পর্ক স্থাপন করে জীবন-পুনরুৎপাদনের আচার ক্রমশ অসম্ভব করে তুলে, ফলস্বরূপ এক বিপুল ‘উদ্বৃত্ত জনসংখ্যা’ তৈরি করে। এই হরণকার্য ছিল উৎপাদনপ্রক্রিয়ার উপর পঁুজির নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার একটা দিক। অন্য দিকটা ছিল এই আবশ্যকীয়তা যে বিপুল ‘উদ্বৃত্ত জনসংখ্যা’-র ক্রোধ, ক্ষোভ, মরিয়া-বাঁচার-চেষ্টা-কে তার অনিয়ন্ত্রিত পরিশুদ্ধতায় সমাজজীবন নিয়ন্ত্রণকারী শক্তি হয়ে উঠতে দেওয়া যাবে না, বরং তাকে শৃঙ্খলিত (বা শৃঙ্খলাবদ্ধ) করতে হবে, হত-শুদ্ধ করতে হবে যাতে পঁুজিবাদী উৎপাদন-শৃঙ্খলের মধ্যে শ্রমক্ষমতার বিক্রেতা হিসেবে ‘উদবৃত্ত জনসংখ্যা’ নির্দিষ্ট ভূমিকা নেয় এবং পঁুজিবাদী বন্টন-শৃঙ্খলে মজুরীটুকু হাতে নিয়ে পণ্যচাহিদা-তাড়িত হয়ে বাজারে ক্রেতা হয়ে এসে দাঁড়ায়। সুতরাং বিপুল হরণকার্য চালানোর পাশাপাশি বিপুল জনগণকে পঁুজির চাহিদামতো সামাজিক আচার-আচরণ-চেতনায় পুনর্শিক্ষিত, শৃঙ্খলাবদ্ধ করা ছিল একটা বড়ো কাজ। এই কাজের সঙ্গে যুক্তভাবেই শিল্পপঁুজি সমাজকে বদলে নিয়েছিল ক্রমাগত, জন্ম দিয়েছিল নতুন সামাজিক প্রতিষ্ঠানের, রূপান্তরিত করে নিয়েছিল কিছু পুরানো প্রতিষ্ঠান, ক্রমান্বয়ে একটি জৈবিক সমগ্র হিসেবে জন্ম নিয়েছিল পঁুজিবাদী সমাজ । পঁুজির শৃঙ্খলাস্থাপনের এই ইতিবৃত্ত.....

ইতিবৃত্তের বিশদ বিশদীকরণের মধ্য দিয়ে মুখসদৃশ মসৃণ চামড়ার মুখোশ-নির্মাণ হেন মায়াসৃজন এ আলোচনার উদ্দেশ্য নয়। ছায়াচ্ছন্ন ঠাসবুনানির যে অংশ হঠাৎ বিদ্যুৎ-চমকে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে সেগুলোই দেখতে দেখতে চলা যাক।

আঠারো শতকের প্রথম ভাগ। জেরেমি বেন্থাম খুব চিন্তিত। তঁার মতে গ্রেট ব্রিটেনের শাস্তিদানের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাটি খুবই অদক্ষ। পঁুজির প্রাথমিক সঞ্চয়ের প্রক্রিয়ার দ্বারা জীবিকা ও জীবনধারণের রসদ থেকে উৎপাটিত বিপুল জনসংখ্যাকে ‘ভবঘুরে’ বলে দেগে দিয়ে জেলে পুরে, বারংবার জেলে পুরে, মৃত্যুদন্ড হেঁকে, মৃত্যুদন্ড ‘মকুব’ করার ‘মহানুভবতা’-র ছলে গরু-ছাগলের মতো জাহাজের ডেকে ঠেসে দ্বীপান্তরে পাঠিয়ে শাস্তিদানের যে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাটি— বেন্থামের মতে তা অত্যন্ত অদক্ষ, কারণ শাস্তিপ্রাপ্তদের শাস্তিভোগটা ঘটছে বাকিদের দৃষ্টির বাইরে, দূর কোনো দ্বীপে বা দেশে তাদের অবস্থা/দুরবস্থা বাকিদের কাছে থেকে যাচ্ছে মূলত অজানা, ফলত, শাস্তিপ্রাপ্তদের শাস্তিভোগ নিরীক্ষণ করার মধ্য দিয়ে বাকিদের যে ‘শিক্ষা’ হয়— বাধ্যত শৃঙ্খলাপরায়ন হওয়ার শিক্ষা, ক্ষমতার কাছে আত্মসমর্পণের শিক্ষা--- তা থেকে যাচ্ছে দুর্বল। অন্যদিকে, গ্রেট ব্রিটেনের মধ্যেই এই বিপুল-সংখ্যকের শাস্তিপ্রদান সংঘটিত করার জন্য আরো কারাগার, আরো রক্ষী, আরো নিপীড়ন-পরিকাঠামো বজায় রাখার খরচও রাষ্ট্রের কাছে দুর্বহ। এই টানাপোড়েন যখন বেন্থাম সাহেবের মাথায় বৌদ্ধিক সমাধান চেয়ে পাক কাটছে, তখন তঁার ভাইয়ের দেখে আসা ফ্রান্সে সেনা-প্রশিক্ষণের উপায় থেকে যেন তিনি উত্তরের আভাস খুঁজে পেলেন। তঁার ভাবনায় একটা কাঠামোর অবয়ব মূর্ত হয়ে উঠল। তিনি সেই অবয়বের নাম দিলেন panopticon, নামকরণের ক্ষেত্রে সাহেবের লাতিন-অনুরাগের অনুগামী না হয়ে আমরা তাকে ‘আ-দৃশ্যমান’ বলতে পারি। ‘আ-দৃশ্যমান’ সমাজের বুকে বিস্তার-নির্মাণের এক জৈবিক কৌশল, সে বিস্তার বিবিধ হতে পারে, যেমন, ভৌগোলিক বিস্তার, সামাজিক-মনস্তাত্ত্বিক বিস্তার, সাংগঠনিক বিস্তার.......

প্রথম বিচারে ‘আ-দৃশ্যমান’ একটি স্থাপত্য। একটি গোলাকার প্রাসাদ/কারখানা/জেলখানা। ছোটো ছোটো আলাদা করা সারি-দেওয়া কুঠুরি তার পরিধি বরাবর, যে কুঠুরিগুলোর একটা থেকে আরেকটা দেখা যায় না, কোনোরকম যোগাযোগ স্থাপন করা যায় না। বৃত্তাকার বিস্তারের কেন্দ্রে নজরদারি-মিনার। কেন্দ্রস্থলের মিনার থেকে পরিধির সব কুঠুরির ভিতর স্পষ্ট দেখা যায়, কিন্তু মিনারটির গঠন এমন যে পরিধি-স্থিত কোনো কুঠুরি থেকে মিনারের অভ্যন্তরস্থ কিছু দৃশ্যমান হয় না।

দ্বিতীয় বিচারে ‘আ-দৃশ্যমান’ হলো কুঠুরি-স্থিত ক্ষমতাধীনদের একটি নির্দিষ্ট মনস্তত্ত্ব-অধীনতা, যা উপরোক্ত স্থাপত্য-উপজাত। প্রতিটি কুঠুরির বাইরের দিকে একটি জানালা এবং বিপরীতে ভিতরের দিকে, নজরদারি মিনারের দিকে, আরেকটি জানালা, যাতে আলোর প্রবাহ অবারিত হতে পারে, আর এই অবারিত আলোর প্রবাহে বন্দি কুঠুরিবাসী এক ব্যক্তি-একক। সে জানে যে মিনার-স্থিত ক্ষমতার প্রতিনিধির চোখে তার প্রতিটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ক্রিয়াও দৃশ্যমান, ফলত বিচারকের দৃষ্টির সামনে প্রতি মুহূর্তে সে উন্মুক্ত। তার জানার উপায় নেই কোনো একটি নির্দিষ্ট মুহূর্তে মিনারে ক্ষমতার প্রতিনিধি উপস্থিত আছে কি না বা থাকলেও তার বিশেষ কুঠুরিটিকেই লক্ষ্য করছে কি না। তাই প্রতি মুহূর্তেই সে ক্ষমতার প্রতিনিধির নজরাধীনে থাকতে পারে— এই সম্ভাবনা তার মধ্যে এমন মনস্তত্ত্বের জন্ম দেয় যে প্রতি মুহূর্তেই সে নজরবন্দি। এই নজরবন্দিত্বের মনস্তত্ত্ব প্রতি মুহূর্তে তাকে বাধ্য করে নিজেই নিজের উপর লাগাম পরিয়ে রাখতে, ক্ষমতার বিধানমতে যা শৃঙ্খলা তা নিজের উপর আরোপ করতে। ফলত কুঠুরিবন্দি ব্যক্তি-এককের ব্যক্তিত্ব দ্বি-বিভাজিত হয়ে যাচ্ছে: একটি ভাগ ক্ষমতা-নিয়োজিত পাহারাদারের অংশ হয়ে গিয়ে অপর ভাগের উপর ক্ষমতার শৃঙ্খলা আরোপ করছে।

তৃতীয় বিচারে ‘আ-দৃশ্যমান’ হলো ক্ষমতার অদৃশ্য হয়ে যাওয়া। মিনার-স্থিত ক্ষমতার প্রতিনিধির দৈহিক/বস্তুগত উপস্থিতি আর প্রয়োজনীয় হচ্ছে না। ক্ষমতার প্রতিনিধি দৈহিক/বস্তুগত-ভাবে অনুপস্থিত থাকলেও তার নজরদারি কুঠুরি-বন্দি ব্যক্তি-এককদের উপর আরোপিত থাকছে ওই সমস্ত ব্যক্তি-এককদের দ্বি-বিভাজিত ব্যক্তিত্বের পাহারাদার অংশের ক্রিয়াশীলতার মধ্য দিয়ে। বলা যায় যে ক্ষমতা নিজেকে অদৃশ্য করে ফেলল, বা ক্ষমতাধীনের সত্তার মধ্যেই নিজের একটা ঘাঁটি বসিয়ে ফেলল। অন্যভাবে বলা যায় যে ক্ষমতা নিজেকে চরম বিকেন্দ্রীকরণের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাধীন প্রত্যেক ব্যক্তি-এককের ব্যক্তিসত্তার মধ্যে সেঁধিয়ে গিয়ে, ক্ষমতাধীনদের ব্যক্তিত্বের বিভাজন ঘটিয়ে, সেই বিভাজন-জাত একটি অংশকে নিজের নিযুক্ত শৃঙ্খলারক্ষকে পরিণত করল।

এই ‘আ-দৃশ্যমান’ কীভাবে প্রয়োগ করা যেতে পারে সে সম্পর্কে বেন্থাম লিখেছিলেন: ‘নীতিবোধ পাল্টাতে— স্বাস্থ্য সংরক্ষণ করতে— শিল্পোৎপাদন তেজীয়ান করতে— নির্দেশ প্রচার করতে— সরকারী খরচ কমাতে— অর্থনীতিকে মজবুত ভিত্তিতে স্থাপন করতে— ‘পুওর ল’-এর গর্ডিয়াসের গেরো না কেটেই খুলে ফেলতে— এ সবই সম্ভব কেবলমাত্র স্থাপত্যবিষয়ক এই সরল ভাবনার দ্বারা’; এবং সেইজন্য তিনি একে বলেছিলেন ‘রাষ্ট্রপরিচালনার এক নতুন ও মহত্তম হাতিয়ার.....’। (মিশেল ফুকো-র ‘ডিসিপ্লিন অ্যান্ড পানিশ– দি বার্থ অফ প্রিজন’ গ্রন্থের ২০০ ও ২০৬ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত।)

বেন্থামের এই ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’-সুলভ ‘ইউরেকা’-ধ্বনি নতুন এক যুগের আবাহনসঙ্গীত, যে যুগে নির্ঝরের গতি-সাবলীলতা মানবজীবনের বাঁধাবন্ধহীন বিকাশ ও উচ্ছ্বাসের রূপকল্প হওয়ার পরিবর্তে আবর্তনশীল পঁুজির অবিরাম সঞ্চয়নপ্রকল্পের রূপকল্প। পশ্চিম ইওরোপ জুড়ে এই নির্ঝরযাত্রার তাগিদ তখন এতোটাই প্রভাববিস্তারকারী যে ১৭৮৯ সালে সেতাবৎ ইতিহাসের বৃহত্তম রোমান্স ফরাসী বিপ্লব সংগঠিত হওয়ার পর দুই বছর যেতে না যেতেই ১৭৯১ সালে সে রোমান্সের জারণক্ষেত্র ফরাসী প্রজাতন্ত্র আ-দৃশ্যমানতার তাত্ত্বিক বেন্থামকে সাম্মানিক আজীবন ফরাসি নাগরিকত্বে ভূষিত করল (ইংরেজদের সঙ্গে ফরাসিদের সম্পর্কের স্পর্শকাতরতার পশ্চাদপটেও যা কম আশ্চর্যের নয়!)। ‘সাম্য, ভ্রাতৃত্ব, স্বাধীনতা’-র স্বপ্ন ইউরোপীয় সামন্ততন্ত্রের কাঠামো ভাঙার জন্য প্রয়োজনীয় ও যথেষ্ট হলেও, তার প্রয়োজনে তৎপরবর্তী সমাজকাঠামো নির্ণয় ও নির্মাণের জন্য ছিলো অপারগ। সে অপারগতা মেটানোর একটা সমাধান সূত্র বুঝি এই ‘আ-দৃশ্যমান’ স্থাপত্যভাবনা। পঁুজির অন্তহীন পুঞ্জীভবনকে কেন্দ্রীয় অভিপ্রায় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার প্রক্রিয়ায় সামাজিক কাঠামোর যে জৈবিক রূপ ক্রমশ রূপগ্রহণ করছিল, শেষ বিচারে আ-দৃশ্যমান তারই সাংকেতিক অভিব্যক্তি।

শিক্ষার বিষয়বস্তু ক্রমবিভাজিত হয়ে কুঠুরিবদ্ধ হল, বিভিন্ন স্তরের শিক্ষার্থীকে ক্রমবিভাজিত করে (উদ্দিষ্ট শিক্ষার বিষয় অনুযায়ী, প্রাপ্ত শিক্ষার স্তর অনুযায়ী, কৌলীন্য অনুযায়ী) কুঠুরিবদ্ধ করা হল, সামগ্রিক নজরদারির জন্য নির্দিষ্ট পাঠক্রম ও সাধারণ পরীক্ষাব্যবস্থা নির্মাণ, তত্ত্বাবধায়ক কেন্দ্রীয় সংস্থা নির্মাণ হল। ‘আ-দৃশ্যমান’-এর ‘কেন্দ্রস্থিত ক্ষমতা-র নজরসীমার মধ্যে বিন্যস্ত বিভাজিত কুঠুরিবদ্ধতার কাঠামো’-ধৃত এই শিক্ষাব্যবস্থা এর আগের বহু শতাব্দী ধরে প্রচলিত বিভিন্ন শিক্ষাব্যবস্থার তুলনায় সম্পূর্ণ ভিন্ন রূপ ও অন্তর্বস্তু নিয়ে হাজির হল।

রোগের সংজ্ঞানির্ণয়, রোগের চিহ্ন নির্ণয়, চিকিৎসা ও প্রতিষেধক ব্যবস্থার নতুন রূপের মধ্য দিয়ে মানবদেহকে ও দৈহিক সমস্ত প্রক্রিয়াকে বেঁধে ফেলা হল আ-দৃশ্যমান নজরে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রতি অন্ধভক্তি যাকে প্রশ্নাতীত করে তুলল।

জনগণনা, নাগরিক-সম্বন্ধীয় যাবতীয় তথ্যের পঞ্জীকরণ, এবং তার উপর ভিত্তি করে সমাজ-পরিচালনা সংক্রান্ত যাবতীয় সিদ্ধান্তকে কেন্দ্রস্থিত (তথাকথিত তথ্যাভিজ্ঞ, বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত) গুটিকয়ের হাতে কেন্দ্রীভূত করার প্রবনতা রাজনৈতিক ক্ষেত্রকে আ-দৃশ্যমান স্থাপত্যের আদলে গড়ে তুলল ।

সামাজিক উৎপাদনের প্রতিটা স্তরে উৎপাদকদের উপর বিস্তৃত হতে লাগল আ-দৃশ্যমান নজর, যা ক্রমে ব্যবস্থাপনা (ম্যানেজমেন্ট)-বিজ্ঞান ও নজরদারি প্রযুক্তির বিস্ফোরণ ঘটালো।

ঔপনিবেশিক ব্যবস্থার প্রসার ও ক্রমপ্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে ঔপনিবেশিক শাসন-অধীনস্থদের কাছে দস্তুর হয়ে দাঁড়াল ঔপনিবেশিক প্রভুদের বিচারক-দৃষ্টির সামনে নিজস্ব জীবন-পরম্পরা-সংস্কৃতিকে কাঠগড়ায় তুলে, নিজস্ব অস্তিত্বকে ঘৃণা করে, ধ্বংস করে, প্রভু-সভ্যতার অনুকরণ করা। এও এক আ-দৃশ্যমান-নির্মাণ।

আ-দৃশ্যমান-এর পরিধিস্থিত কুঠুরিবন্দিরা ক্রমশ নিজেদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতার দেওয়াল শাশ্বত ধরে নিয়ে নিজেদের স্বাভাবিক যূথবদ্ধতা খুইয়ে ফেলতে থাকে। ক্ষমতার কেন্দ্রের সঙ্গে তার সম্পর্কের মধ্য দিয়েই সমগ্রতায় পৌঁছানো ও সেই সমগ্রতার মধ্য দিয়েই বিশ্বজনীনতা লাভ সম্ভব বলে মনে করতে থাকে।

সমাজস্থাপত্যের এহেন বিস্তার দ্বারা নির্ধারিত হয় বাচননির্মাণ ও বাচনের অর্থনির্মাণ। একটি নাটকের সমস্ত চরিত্রকে উহ্য করে দিলে যেমন নাটকের সংলাপের অর্থলোপ ঘটে, তেমনই যে কোনো বাচন কার দ্বারা কার প্রতি উদ্দিষ্ট তা বিচারে না আনলে তার গঠন ও অর্থনির্মাণ প্রক্রিয়া অসম্ভব। যেমন রুডইয়ার্ড কিপলিঙ নির্মিত ‘শ্বেত পুরুষদের বোঝা’ (white men’s burden) বাচনটির অর্থনির্মাণ সম্ভব নয় যদি না আমরা বিবেচনা করি যে এইটি ইওরোপীয় উপনিবেশ-বিস্তারকারী প্রভুদের বাচন উপনিবেশের শাসিতদের উদ্দেশ্য করে। বাচনের বক্তা ও উদ্দিষ্ট যেহেতু আ-দৃশ্যমান কাঠামোর সমাজস্থাপত্যের কোনো না কোনো স্থানাঙ্কে নিজেদের অবস্থানের দ্বারা সম্পর্কিত, তাই বাচন-নির্মাণ ও বাচনের অর্থনির্মাণের মধ্যে খেলা করে আ-দৃশ্যমান-গত ক্ষমতার সংলাপ।

এছাড়াও, সমাজের বহুবিধ ভাষারূপের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও আ-দৃশ্যমানতা জন্ম নেয়। যেমন ধরা যাক, জন্ম নেয় এক বিশেষজ্ঞ ভাষা (বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, দর্শন, অর্থনীতি, সমাজবিজ্ঞান, রাষ্ট্রতত্ত্ব, সমালোচনা তত্ত্ব সমস্ত ক্ষেত্রে)--- জ্ঞানের পুরোহিততন্ত্রে উচ্চবর্গীয়দের যার উপর অধিকার, সাধারণবর্গের দৃষ্টি যার ভিতর সেঁধায় না, অথচ সাধারণবর্গ তাদের চর্চা ও চেতনার উপর যার শ্রেষ্ঠত্ব ও আধিপত্য স্বাভাবিক বলে মেনে নেয়।

লিনিয়স বা বেন্থামকে ইতিহাসনির্মাতা হিসেবে উপস্থিত করা এখানে উদ্দেশ্য নয়, ইতিহাসের অসন্ততা বিন্দুর অন্যতম প্রকাশচিহ্ন হিসেবে ব্যবহার করতে চাওয়া মাত্র। কথিত অসন্ততা বিন্দুর আরো বহু প্রকাশচিহ্ন নির্ণয় সম্ভব, তবে তা বর্তমান আলোচনার অভীষ্ট নয়। এই দুই প্রকাশচিহ্নকে ধরে আলোচনাবিস্তারের মধ্য দিয়ে অভ্যাস ও মতবাদের যে পরিবেশের মধ্য থেকে আমাদের বাচন-নির্মাণ প্রক্রিয়া সংঘটিত হয়, তার একটা প্রতিনিধিত্বমূলক রূপ গড়ে তোলার প্রয়াস নেওয়া হয়েছে মাত্র। খেয়ালে রাখার যে এই রূপটি আধিপত্য-বিস্তারকারী রূপ। আধিপত্য-বিস্তারকারী রূপের অস্তিত্বই নির্দেশ করে আধিপত্য বিস্তার করার ক্রিয়ার প্রয়োজনীয়তার, যা আবার নির্দেশ করে এমন বহু অপর রূপের অস্তিত্ব, যাদের উপর আধিপত্য-বিস্তারের ক্রিয়া সমাপন হয়। ফলত আধিপত্য-বিস্তারকারী রূপ কখনোই অপর সমস্ত রূপকে নিঃশেষিত করে নিজেকে একমাত্র হিসেবে স্থাপন করতে পারে না। যে কোনো আধিপত্য-বিস্তারের ক্রিয়া তার বিপরীতে যে প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয় তার মধ্য দিয়ে অভিযোজন ঘটতে থাকে অপর রূপ সমূহের। শব্দকে পূর্ণতা ও বোধ্যতা দেয় অভ্যাস ও মতাদর্শের পরিবেশ। ফলত শব্দের অর্থনির্মাণ ও বোধ্যতাস্থাপনের ক্রিয়ার মধ্যে কাজ করতে থাকে এই আধিপত্য-বিস্তারকারী রূপ ও অপর রূপসমূহের অসংখ্য প্রতিরোধবিন্দু। মিশেল ফুকো-র কথা ধার করে বলা যায়:

প্রতিটি প্রতিরোধ একটি বিশেষ ঘটনা: সম্ভবপর প্রতিরোধ, প্রয়োজনীয় প্রতিরোধ, সম্ভাবনাহীন প্রতিরোধ; প্রতিরোধ যেগুলো স্বতঃস্ফূর্ত বা অপরিশীলিত বা নিঃসঙ্গ বা কয়েকজনের দ্বারা পরিকল্পিত বা অনিয়ন্ত্রিত বা হিংসাত্মক; আবার অন্যতর প্রতিরোধ যেগুলো আপসমুখী বা স্বার্থচালিত বা আত্মবলিদানমুখী; সংজ্ঞার্থে তারা কেবল ক্ষমতা-সম্পর্কের কৌশলক্ষেত্রের মধ্যেই অস্তিত্বধারণ করতে পারে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে এগুলো শুধুমাত্র এমনই প্রতিক্রিয়া বা ছিটকে ওঠা যা শেষ বিচারে বুনিয়াদী আধিপত্যের সাপেক্ষে নিষ্ক্রিয়তাসর্বস্ব ও পরাজয়-নিশ্চিত এক তলদেশ তৈরি করে। হাতে গোনা কয়েকটা অসমসত্ত্ব নীতি থেকে প্রতিরোধ উদ্ভূত হয়না, আবার এমন কোনও প্রলোভন বা অঙ্গীকার থেকেও হয়না যা বাধ্যতামূলকভাবেই অধরা থাকবে। ক্ষমতার সাপেক্ষে প্রতিরোধ হল বেজোড় পদ; ক্ষমতার মধ্যে লঘুকরণ-অসম্ভব বিপরীত হিসেবে তারা আকীর্ণ। আর সেজন্যই প্রতিরোধের বিন্যাস নিয়মহীন: সময় ও পরিসরের জমিতে প্রতিরোধের বিন্দু, গ্রন্থি ও অধিশ্রয়ণগুলো পরিবর্তনশীল ঘনতায় ছড়ানো, সময়বিশেষে তা ব্যক্তিবর্গ বা গোষ্ঠীদের কোনো এক সুনির্দিষ্ট পন্থায় সংহত করে, কোনো নির্দিষ্ট দেহবিন্দু বা জীবনমুহূর্ত বা আচরণাবলীকে প্রজ্জ্বলিত করে তোলে। তাহলে কি কোনো মহান বিপ্লবী ভাঙন হতে পারে না, হতে পারে না কোনও বিপুল দ্বি-বিভাজন? কখনো কখনো হতে পারে। কিন্তু বেশিরভাগ সময়েই যা ঘটে তা হল প্রতিরোধের অস্থিতিশীল ও ক্ষণস্থায়ী বিন্দুসমূহ, যেগুলো সমাজে ফাটল তৈরি করে, ফাটলগুলো অনবরত অবস্থান পাল্টাতে পাল্টাতে প্রতিষ্ঠিত ঐক্যে ভাঙন ধরায় ও নিত্যনতুন গোষ্ঠীগঠন ঘটায়, ব্যক্তির নিজের মধ্যেও গর্ত খুঁড়ে, টুকরোয় কেটে আবার পুনর্গঠন করে দেহে ও মনে লঘুকরণ-অসম্ভব অঞ্চল চিহ্নিত করে দিয়ে যায়। ক্ষমতা-সম্পর্কের জাল যেমন বিশেষ যন্ত্রাদি বা প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে আসলে সীমাবদ্ধ না হয়েও বহমানতায় তাদের মধ্যে নিবিড় বুনটের রূপ ধারণ করে, রাষ্ট্র যেভাবে ক্ষমতা-সম্পর্কগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক সংহতকরণের উপর নির্ভর করে, ঠিক তেমনই প্রতিরোধের বিন্দুগুলোর ঝঁাক সামাজিক স্তরবিন্যাস ও ব্যক্তিদের ঐক্য পেরিয়ে বহমান থাকে। আর সন্দেহ নেই যে এহেন প্রতিরোধের বিন্দুগুলোর কৌশলী সংহিতাকরণ বিপ্লবকে সম্ভব করে তোলে। (মিশেল ফুকো-র মূল ফরাসি থেকে রবার্ট হার্লে কর্তৃক ইংরেজিতে অনূদিত ‘দি উইল টু নলেজ: দি হিস্ট্রি অফ সেক্সুয়ালিটি, ভলুম-১’, পেঙ্গুইন বুকস, ১৯৯৮, পৃষ্ঠা: ৯৪। বঙ্গানুবাদ বর্তমান লেখকের করা।)

শব্দের অর্থনির্মাণ ও বোধ্যতাস্থাপনের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে ভাষা-পরিসর, আর সেই পরিসরে আকীর্ণ ক্ষমতা ও প্রতিরোধের বিন্দুগুলো এই ক্ষমতা/প্রতিরোধ প্রক্রিয়ার সঙ্গেই অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত। সমষ্টির মধ্যে বোধ্যতা উৎপাদন করতে গেলে ভাষাকে কিছু নিয়ম তৈরি করতেই হয়। লুডভিগ উইটগেনস্টাইন ভাষার এই নিয়মগুলোকে খেলার নিয়মের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। যেমন ধরা যাক, দাবা খেলতে বসা দুজন দাবাড়ু যদি দাবা খেলার একগুচ্ছ নিয়ম জেনে ও মেনে না বসেন, তাহলে খেলাটাই হওয়া সম্ভব নয়। তেমনই, ভাষা ব্যবহার করে সংযোগস্থাপনে অভিপ্রায়ী দুজন বা বহুজন যদি কথাচিহ্ন থেকে চিহ্নিতে, ভাষা থেকে জগতে উৎক্রমণের একগুচ্ছ নিয়ম জেনে ও মেনে ভাষা-খেলায় অংশ না নেন, তাহলে ভাষা-খেলাটাই হবে না, অর্থাৎ সংযোগস্থাপনটাই হবে না। সুতরাং নিয়ম অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু নিয়ম খেলার অধীনে থাকবে নাকি অতি-নিয়ম (super-rule) হয়ে উঠে খেলাকে তার অধীনস্থ করে তুলবে, সেটাই প্রশ্ন। এই প্রশ্নটাকে আরেকটু ভেঙে দেখা যাক। ধরা যাক ফুটবল খেলার কথা। ঘাসের জাজিমে ঢাকা মসৃণ মাঠে যে নিয়মে খেলা হবে, বৃষ্টির মাঝে বা বৃষ্টির পরে আঠালো কাদায় ঢাকা মাঠে সে নিয়মে খেলা হবে না; বড় মাঠে যে নিয়মে খেলা হবে, ছোট মাঠে সে নিয়মে হবে না; দশজনের দুটো দলের মধ্যে যে নিয়মে খেলা হবে, পাঁচজনের দুটো দলের মধ্যে সে নিয়মে হবে না; কেবলমাত্র অপর দলকে পরাজিত করতেই ব্যগ্র দুটি দলের মধ্যে যে নিয়ম-কড়াকড়ি মেনে খেলা হবে, পরস্পরের সান্নিধ্যের আনন্দে মশগুল দুটি দলের মধ্যে সে নিয়ম-কড়াকড়ি মেনে খেলা হবে না; দুটি পেশাদার দলের মধ্যে প্রদর্শনী ম্যাচ যে নিয়মে খেলা হবে, কাপড়ের পুঁটলি পাকিয়ে বল তৈরি করে এক চিলতে জমিতে খেলতে নামা ছোকরাদের মধ্যে সে নিয়মে খেলা হবে না; ইত্যাদি, ইত্যাদি। খেলার এই প্রতিটি রূপভেদেই নিজস্ব কিছু নিয়মের আমদানি অবশ্যম্ভাবী, আর সেই নিয়ম অংশগ্রহণকারীদের উপরই নির্ভর করবে। তা যেমন পূর্বনির্ধারিত রীতির অনুসারী হতে পারে, আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে অংশগ্রহণকারীদের তাৎক্ষণিক ঐক্যমতের ভিত্তিতে অভিনবও হতে পারে। খেলার পরিসর জুড়ে বৈচিত্র্যময় রূপের সাপেক্ষে নিয়মের এহেন নমনীয়তা যখন উপস্থিত থাকে, তখন নিয়ম নিয়মই থাকে, অতি-নিয়ম হয়ে ওঠে না, আর তা তখন খেলার প্রক্রিয়ার অধীনেই থাকে। কিন্তু এই বিভিন্ন রূপের মধ্যে কোনো একটি রূপ, অর্থাৎ ধরা যাক, ঘাসঢাকা বড় মসৃণ মাঠে কেবলমাত্র অপরদলকে পরাজিত করতে উদগ্রীব দুই পেশাদার দশজনার দলের মধ্যে খেলার রূপটাকে একমাত্র মান্য রূপ ধরে নিয়ে তার নিয়মকানুনই ফুটবল খেলার একমাত্র নিয়মকানুন বলে যখন ঘোষণা করা হয়, তখন নিয়ম অতি-নিয়ম হয়ে ওঠে। কারণ এই নির্ধারণ কেবলমাত্র একটি ছাড়া খেলার বাকি অন্য সমস্ত রূপগুলোকে নাকচ করে, অবমূল্যায়িত করে এবং ধ্বংস বা নিষিদ্ধ করার দিকে এগিয়ে যায়। এই রূপকের সঙ্গে তুলনা টেনে বলা যায় যে ভাষা-খেলার ক্ষেত্রেও অতি-নিয়ম জন্ম নেয় যখন কথাচিহ্ন থেকে চিহ্নিতে, ভাষা থেকে জগতে উৎক্রমণের কোনো একটি বিশেষ খেলারূপ থেকে জাত বিশেষ নিয়মগুলোকেই সাধারণ ও সর্বময় বলে প্রতিষ্ঠা করা হয়, অন্যান্য রূপজাত নিয়মগুলোকে ভ্রান্ত বা অশুদ্ধ বলে অবমূল্যায়িত, ধ্বংস বা নিষিদ্ধ করতে চাওয়া হয়। এই আধিপত্যবিস্তারকারী অতি-নিয়মের সঙ্গে যুযুধান বিবিধ নিয়মের সংঘাতরেখা বরাবর প্রতিরোধের বিন্দুগুলো জেগে ওঠে। এবং জেগে ওঠে, জেগে থাকে কেবল সামাজিক-রাজনৈতিক স্তরে নয়, ব্যক্তিক স্তরেও।

বৃহদারণ্যক উপনিষদে একটা গল্প আছে। গল্পের চরিত্র চারজন: ব্রক্ষ্মা, দেবতা, অসুর ও মানুষ। ব্রক্ষ্মার দ্বারা সৃষ্ট হয়ে তাঁরই সৃষ্ট জগতে নিজেদের মতো করে বেশ কিছুদিন অস্তিত্বযাপন করার পর দেবতা, অসুর ও মানুষ তাদের সৃষ্টিকর্তা ব্রক্ষ্মার কাছে হাজির হল ‘কী করিতে হইবে’ জানার জন্য। ব্রক্ষ্মা তাদের নিরাশ করলেন না। একে একে তিনজনকেই আলাদা করে বললেন, ‘দ’। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন তাঁর উপদেশ বোধগম্য হয়েছে কিনা। তিনজনেই বলল যে বোধগম্য হয়েছে এবং সন্তুষ্ট মনে ফিরে গেল। কিছুদিন পর ব্রক্ষ্মা আবার এই তিনজনকে ডেকে পাঠালেন আলাদা আলাদা করে এবং জিজ্ঞাসা করলেন: ‘বুঝেছ তো বললে, কী বুঝেছ বল দেখি!’ তিনজনই বেশ সুনিশ্চিতভাবে উত্তর দিল। তিনজনের উত্তর এরকম:

দেবতা--- দ মানে দমন করো।

অসুর--- দ মানে দয়া করো।

মানুষ--- দ মানে দান করো।

ব্রক্ষ্মা বুঝলেন যে তিনজনই ঠিকই বুঝেছে।

গল্পটা এই অবধিই। এবার দেখা যাক গল্পটা থেকে আমরা কী বুঝতে পারি।

ব্রক্ষ্মা একটি কথা বলেছেন: ‘দ’। দেবতা, অসুর ও মানুষ সেই কথার অর্থনির্মাণ নিজেদের নিজেদের মতো করে করেছেন, বা নিজেদের স্থিতসত্তা অনুযায়ী করেছেন। এভাবে কথাটির তিনটি অর্থ উৎপন্ন হয়েছে, অর্থাৎ, তিনরূপ স্থিতসত্তা অনুযায়ী তিনটি ভিন্ন অর্থ। কথার বাচক ব্রক্ষ্মা তাঁর কথা কী অর্থগ্রহণ করল তা নিয়ে কৌতূহলী, কিন্তু তিনটি ভিন্ন অর্থের কোনোটিকেই তিনি নাকচ করলেন না, অর্থাৎ, তাঁর উচ্চারিত কথা যে শ্রোতাদের স্থিতসত্তা অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন অর্থসম্পন্ন হওয়াই স্বাভাবিক, তা যেন তাঁর জানাই ছিল। এবার দেখা যাক দেবতা, অসুর ও মানুষের স্থিতসত্তাগত কোন বৈশিষ্ট্য তাঁদের এই অর্থনিরূপণের মধ্য দিয়ে ব্যক্ত হচ্ছে।

দেবতা দ-এর মানে করেছেন ‘দমন করো’। এর পিছনে তার স্থিতসত্তার কী বৈশিষ্ট্য কাজ করছে? এ প্রশ্নের উত্তরও নানারকম হতে পারে। যেমন মনে করা যেতে পারে যে দেবতা স্বভাবগতভাবেই দমন করতে চায়, অপর সবকিছুকে নিজ অধীনে এনে নিজমতে শ্রেয় জগৎ তৈরি করতে ও বজায় রাখতে চায়। তাই তার স্ব-প্রকৃতির অনুমোদন নির্মাণ করে নেওয়ার প্রক্রিয়ায় অপরকে দমন করার অনুজ্ঞা হিসেবে সর্বস্রষ্টার কথার অর্থোৎপাদন করেছে। আবার অন্যরকমভাবেও ভাবা যেতে পারে। যেমন, ধরা যেতে পারে যে দেবতারা বিলাসে-ব্যসনে-ভোগে-কামে আগ্রাসী ও অপরিমিত হয়ে উঠেছিল, এই অপরিমিতিকে দমন করে পরিমিত করার উপদেশ হিসেবেই সর্বস্রষ্টার কথার অর্থ তারা নিরূপণ করেছে--অর্থাৎ নিজেদের স্ব-প্রকৃতিতে একটি অভাব পূরণ করা বা বেলাগামকে লাগাম পরানোর আকাঙ্ক্ষার দিক থেকেই এই অর্থোৎপাদন হয়েছে। এখন কোন দিক থেকে আমরা ভাববো, তা নির্ভর করছে দেবতাদের স্থিতসত্তাকে আমরা কীরূপে কল্পনা করছি (হ্যাঁ, অপর কারো স্থিতসত্তা আমরা কল্পনাই কেবল করতে পারি, যে যাপন আমার নয়, ফলত কখনোই যা সামূহিকতায় আমার কাছে উন্মোচিত নয়, সেই যাপনের ভিত্তিমূলে থাকা স্থিতসত্তা কখনোই আমার পুরোপুরি জানার জন্য উন্মোচিত হতে পারে না), তার উপর। দেবতাদের স্থিতসত্তার মূল সুর আধিপত্যাকাঙ্ক্ষা ও তার যৌক্তিকতা নির্মাণ, নাকি, অপরিমিতির নিশির টানে ভুগে পরিমিতির অভাববোধ--- যে কল্পনাটিকে আমি বেছে নেব, সেই অনুযায়ী কথার অর্থোৎপাদন এবং স্থিতসত্তার মধ্যে সম্পর্কটিকেও আমি নির্দিষ্ট করব।

কেবল দেবতা নয়, অসুর ও মানুষের অর্থোৎপাদনের ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। অসুর স্থিতসত্তাগতভাবেই দয়াবান, তাই সে তার প্রকৃতির অনুমোদন উৎপাদন করার প্রক্রিয়ায় সর্বস্রষ্টার কথার অর্থনিরূপণ করল; নাকি দেবতাদের আক্রমণের মুখে বিপন্নতায় তার স্থিতসত্তা ছেয়ে আছে, তাই দেব-হিংসাকে অনৈতিক প্রতিপন্ন করতে সর্বস্রষ্টার কথার অর্থনিরূপণ করল; নাকি হিংস্রতাই তার স্থিতসত্তার স্বাভাবিক প্রকাশ, তাই নিজ প্রকৃতির অভাব/গহ্বর পুষিয়ে উত্তরণের আকাঙ্ক্ষা থেকে সর্বস্রষ্টার কথা থেকে একটি উপদেশার্থ দোহন করে নিল--- এই নানা বিকল্পের কোনটি আমরা গ্রহণ করব তা নির্ভর করছে অসুরের স্থিতসত্তাকে আমরা কীভাবে কল্পনা করছি তার উপর। মানুষও যে ‘দ’-এর অর্থ করল ‘দান করো’, তা কি মানুষের স্থিতসত্তাগত প্রকৃতিতে দানশীলতার প্রাচুর্য্যের জন্য, নাকি দানশীলতার অভাবের জন্য?

ফলে আমরা এক দিগন্ত-ছেয়ে-থাকা অনির্দিষ্টতার সম্মুখীন হচ্ছি। ভাষা অবশ্যই সংকেত। কিন্তু সেই সংকেতের গ্রহীতা কীভাবে তার অর্থ উৎপাদন করে, সেই অর্থোৎপাদনে গ্রহীতার যে স্থিতসত্তা ক্রিয়া করে--- মাত্রাহীন একটি সংকেতকে রঙ-রসে পরিপূর্ণ করে বহুমাত্রিক রূপ দেয়--- সেই স্থিতসত্তাই বা তার নিজ প্রকৃতিজ কোন অাদলে সেই রূপ নির্মাণ করে, তা সেই প্রক্রিয়াসমূহের বাইরে দাঁড়ানো কোনো পর্যবেক্ষকের পক্ষে জানা, বা, এমনকি, নির্দিষ্টরূপে আন্দাজ করাও অসম্ভব। শব্দ বা কথার তাই কোনো নির্দিষ্ট অর্থ হয় না, অর্থোৎপাদন প্রক্রিয়াও তাই কোনো নির্দিষ্ট নিয়মাবলী দিয়ে বাঁধা যায় না। বারোয়ারী জগতের মধ্যে মুখোমুখি হওয়া বাচক ও গ্রাহক, তাদের সদাচঞ্চল পারস্পরিক সম্পর্ক-প্রত্যাশা-টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে নিজ নিজ সদাচঞ্চল স্থিতসত্তা সঞ্চারিত ক্রিয়ায় যেভাবে স্বতঃক্রিয়ায় সম্বন্ধিত হয়ে ওঠে, কথার অর্থ তার মধ্য দিয়েই নির্মীত হওয়ার প্রক্রিয়ায় থাকে। এই প্রক্রিয়ায় স্থিতসত্তা এবং বারোয়ারি বহির্জগত যেহেতু উভয়ই অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত, তাই প্রক্রিয়াটি একইসঙ্গে দার্শনিক ও রাজনৈতিক, ব্যক্তিক ও সামাজিক।

আবার ব্যক্তি তো নিজের সঙ্গেও কথা বলে, এমন ব্যক্তি যে আ-দৃশ্যমান-এর স্থাপত্যভুক্ত করে নিজের আত্মসত্তাকে নজরদার ও নজরবন্দি রূপ দুই দ্বৈতসত্তায় ভেঙে ফেলেনি। বারোয়ারি জগৎ থেকে আপেক্ষিক দূরত্বে নিজ নির্জনতার এক বলয়ে প্রবেশ করে নিজের সঙ্গে নিজের কথা বলা তখন জ্ঞানের হাত ছেড়ে স্বজ্ঞার হাত ধরে চলে। হানা আরেন্ট বলবেন যে বারোয়ারি জগৎ থেকে এই সাময়িক বেরিয়ে আসা আবার নিজ বোধে উদ্দীপ্ত হয়ে বারোয়ারি জগতে ফিরে স্বতঃক্রিয়া করার জন্যই; পশ্চাদপসরণ বা পলায়ন নয়, এ সমাজজীব হিসেবে নিজেকে নিজের নবায়ন। নিজের সঙ্গে নিজের কথা বলার ভাষা চির-জায়মান, কোনো বদ্ধ রূপে বেঁধে তাকে ভাবা সম্ভব নয়, তার অর্থবোধকতাও চির-অনিশ্চিত, চিরচঞ্চল। একটা উদাহরণ নিয়ে দেখা যাক।

ধরা যাক জীবনানন্দ দাশের ‘আকাশলীনা’ কবিতাটি:

সুরঞ্জনা, অইখানে যেয়োনাকো তুমি;

বোলোনাকো কথা অই যুবকের সাথে;

ফিরে এসো সুরঞ্জনা:

নক্ষত্রের রূপালি আগুন ভরা রাতে;

 

ফিরে এসো এই মাঠে, ঢেউয়ে;

ফিরে এসো হৃদয়ে আমার;

দূর থেকে দূরে আরো দূরে

যুবকের সাথে তুমি যেয়োনাকো আর।

 

কী কথা তাহার সাথে? তার সাথে!

আকাশের আড়ালে আকাশে

মৃত্তিকার মতো তুমি আজ:

তার প্রেম ঘাস হয়ে আসে।

 

সুরঞ্জনা,

তোমার হৃদয় আজ ঘাস:

বাতাসের ওপারে বাতাস---

আকাশের ওপারে আকাশ। 

সুরঞ্জনার সঙ্গে এ কবির সংলাপ। সুরঞ্জনা কবির প্রেমাস্পদ। কিন্তু এ কোনো প্রকাশ্য বা বারোয়ারি জগতে উচ্চারিত সংলাপ নয়, কারণ, প্রথম দুটো লাইনে প্রাত্যহিক জগতে শোনা যায় এমন অসহিষ্ণু নিষেধাজ্ঞার পরই বচন সরে এসেছে এমন এক অ-প্রাত্যহিক জগতে যেখানে শব্দ বা কথাগুলোর অর্থ অনির্দিষ্ট ও কুয়াশাচ্ছন্ন হয়ে উঠেছে। এ ভাষায় প্রেমাস্পদকে শাসন করা যায় না, এ ভাষা অনির্বচনীয়কে হাতড়ে আত্ম, অপর ও প্রেম সম্পর্কে নতুনতর এক উপলব্দির দিকে যেতে পারে। নক্ষত্রের রূপালি আগুন ভরা রাত, মাঠ, ঢেউ--- তা-ই নাকি কবির হৃদয়, প্রেমাস্পদের জন্য সাজিয়ে তোলা ঘর--- কেন শব্দ তার অর্থ-নির্দিষ্টতা ছেড়ে এমন রূপক-অনির্দিষ্টতার রূপ ধরে? তা বোধহয় ভাষার সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করার জন্যই। গভীর নিরীক্ষণে আমরা যখন এমন কোনো প্রতীতির আদল ফুটে উঠতে দেখি যা পূর্ববর্তী কোনো বর্ণনার সঙ্গে মেলে না, পূর্বনির্দিষ্ট কোনো অর্থের সঙ্গেও মেলে না, তখন কোনো তৈরি শব্দ বা উপমা তো তার জন্য থাকে না। অথচ তেমন কোনো প্রতীতিকে নিজের কাছে অবয়ব দিতে গেলেও তো শব্দ-কথায়-রঙে-রূপে বেঁধে আদল দিতে হবে--- তাই পরিচিত শব্দকে অর্থ-নির্দিষ্টতা থেকে বিচ্ছিন্ন করে জায়মান নতুন অর্থে ব্যবহার করা চাড়া তখন আর কোনো উপায় থাকে না। আর এই বৈশিষ্ট্যের কারণেই তা হয়ে ওঠে অন্তর্গত সংলাপ, যে সংলাপের অর্থ স্পষ্টতায় কেবল নিজের কাছেই প্রতীয়মান হতে পারে। অথচ সুরঞ্জনা যুবকের সঙ্গে দূর থেকে দূরে পাড়ি দিয়েছে, কবির আড়ালে থাকা কোনো আকাশতলে মাটির মতো উর্বর হয়ে উঠেছে, নতুন প্রেম ঘাসের মতো তাকে ছেয়ে দিয়েছে--- এতো সুরঞ্জনাকে দোষারোপ বা গঞ্জনা করা নয়, এতো বিস্ময়াবিষ্ট হয়ে অরূপকে রূপ মেলতে দেখা, যদিও সেই রূপ-উদ্ভাস নিজের অভিপ্রায় বা আকাঙক্ষার বিপরীত! বাতাসের ওপারে বাতাসের মতো, আকাশের ওপারে আকাশের মতো তা কবির স্পর্শের অতীত, বারোয়ারি জগতে কেবল বিচ্ছিন্নতার যন্ত্রণাই বাস্তব হয়ে উঠবে, কেবল অন্তর্জগতে চলবে এক অন্তহীন বহুমুখী সংলাপ: যন্ত্রণা, ক্ষোভ, ফিরে আসার আর্তি, আবার তারই সঙ্গে অপার বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকা। সাধারণীকরণ করতে দেখলেই আমার এখন সন্দেহ হয়, তবু অংশত সাধারণীকরণ করে বলি, যে কোনো নিজের সঙ্গে নিজের কথা বলার চরিত্রগত বৈশিষ্ট্যগুলোই এরকম: শব্দ-কথা-র অর্থনির্দিষ্টতা এখানে যথেষ্ট হয় না; অর্থনির্দিষ্টতার গণ্ডি ভেঙে সদাজায়মান অনির্দিষ্টতার রূপালি আগুন সেখানে জ্বলে; অরূপকে রূপ দেওয়ার যন্ত্রণায় ভাষা বিকৃত হয়ে উঠতে থাকে; জ্ঞানের সিংহাসন থেকে নয়, স্বজ্ঞার গ্রন্থি থেকে শব্দ-কথা-সংলাপ উৎসারিত হতে থাকে; আর বহু বিপরীত (এমনকি হদ্দ বিপরীত) সম্ভাবনায় চরাচর ছেয়ে যায়।

 

 

0 Comments
Leave a reply