হাড় কাঁপানো শীতকে কিছুটা স্বস্তি দিয়ে উজ্জ্বল সূর্যালোক ইতিমধ্যে জেগে ওঠা শহরে ছড়িয়ে পড়েছে। দূরে, জেটির শেষে সমুদ্র আর আকাশ এক ঝলমলে আলোয় মিশে গেছে। ইভার্সের অবশ্য এসবের দিকে কোন খেয়াল ছিল না। তিনি বন্দরের প্রশস্ত রাস্তার এক ধার দিয়ে ধীরে ধীরে সাইকেল চালাচ্ছিলেন। সাইকেলের স্থির প্যাডেলে, তাঁর প্রসারিত পঙ্গু পা স্থিরভাবে বিশ্রাম নিচ্ছিল, অন্যটি রাতের আর্দ্রতায় ভিজে পিচ্ছিল রাস্তার শীর্ষদেশ আঁকড়ে ধরার জন্য লড়াই করছিল।
সাইকেল-সওয়ার এই লোকটি দেখতে রোগা, লিকলিকে। অব্যবহৃত ট্রামলাইনকে পাশ কাটিয়ে আর হ্যান্ডেলে মৃদু মোচড় দিয়ে ধেয়ে আসা দ্রুতগামী গাড়িগুলোকে পাশ দিয়ে তিনি মন্থরগতিতে এগিয়ে যাচ্ছিলেন, মাথা না তুলে। মাঝে মাঝে কাঁধে ঝোলানো ব্যাগকে তিনি কনুই দিয়ে পেছনে ঠেলে ঠিক করে নিচ্ছিলেন। এই ব্যাগেই ফার্নান্দ তাঁর জন্য টিফিন রেখেছিলেন। টিফিনের কথা মনে আসতেই মন ভরে উঠেছিল তিক্ততায়। দুটো পাউরুটির মাঝে তাঁর পছন্দ ছিল স্পেনীয় কায়দায় তৈরি ওমলেট বা তেলে ভাজা বীফস্টেক্। কিন্তু কপালে জুটেছে পাতলা ফিনফিনে সস্তার চিজ, যা একদম তাঁর নাপসন্দ।
এর আগে কারখানার রাস্তা তাঁর কাছে এত দীর্ঘ বলে কখনও মনে হয়নি।। নিশ্চিতই তাঁর বয়স হচ্ছে। যদিও চল্লিশ বছর বয়সে তাঁর গড়ন রোগাটে, লতানো গাছের ডালের মতো কমজোরি, তাও এই বয়সে কারোর পেশীই এত তাড়াতাড়ি গরম হয় না। মাঝে মাঝে, কাগজে খেলার পাতায় ত্রিশ বছর বয়সী কোন খেলোয়ারকে অভিজ্ঞ বা ঝানু হিসাবে উল্লেখ থাকলে অবিশ্বাসে তাঁর কাঁধ আপনি ঝাঁকুনি দিয়ে উঠত। 'সে যদি ঝানু হয়', তিনি ফার্নান্দকে বলতেন, 'তাহলে আমি কার্যত হুইলচেয়ারে বসে আছি।' যদিও তিনি মনে মনে জানতেন, রিপোর্টার সম্পূর্ণ নির্ভুল। ত্রিশে আসতে না আসতে একজন মানুষ তার অজান্তেই দম হারাতে শুরু করে। চল্লিশে তাঁর এখনও হুইলচেয়ারের প্রয়োজন নেই বটে, তবুও তাঁর যাত্রা সেই দিকেই। ঠিক সেই কারণেই কী শহরের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে যাওয়ার সময় সমুদ্রের দিকে তাকাতে এখন তাঁর মন চায় না? শহরের অপর প্রান্তে পিপে-শিল্পের কর্মশালা; সেখানেই তাঁর গন্তব্য।
বয়স যখন তাঁর বিশ তখন সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকতে তাঁর কখনও একঘেয়েমি বা ক্লান্তি আসত না। বরং সপ্তাহের শেষ দুটি দিন সৈকতে সময় কাটানোর জন্য তিনি মুখিয়ে থাকতেন; পঙ্গুত্ব সত্ত্বেও সাঁতার কাটতে খুব পছন্দ করতেন। তারপর বছর পেরিয়ে গেল। জীবনে আসল ফার্নান্দ, জন্ম হল ছেলের। সংসারের অভাব অনটন মেটাতে শুরু হল ওভারটাইম, শনিবার শনিবার কারখানায় যাওয়া। টুকিটাকি নানান কাজ রবিবারের দিনগুলোও খেয়ে ফেলতে লাগল। যে উন্মাদনায় ভরা সপ্তাহান্তের দিনগুলো তাঁকে তৃপ্ত করত, ধীরে ধীরে সেই অভ্যাস তিনি হারিয়ে ফেলতে লাগলেন। গভীর স্বচ্ছ জল, উষ্ণতা মাখানো রোদ, চঞ্চল মেয়েরা, শারীরিক জীবন—এ দেশে সুখ বলতে আর কীইবা ছিল! আর সেই সুখ তারুণ্যের সঙ্গে মিলিয়ে যেতে লাগল।
ইভার্স এখনও ভালবাসে সমুদ্রকে, তবে কেবল দিনের শেষে যখন সমুদ্রের জলে অন্ধকারের প্রলেপ পড়ে। কাজ থেকে ফিরে বাড়ির খোলা ছাদে বসে সমুদ্র দেখতে দেখতে সময় কাটাতে তাঁর ভারি ভালো লাগে–পরনে ইস্ত্রী করা শার্ট আর হাতে হিমশীতল স্থানীয় মদ। এর জন্য ফার্নান্দের প্রতি কৃতজ্ঞতায় তাঁর মন ভরে যায়। সন্ধ্যা নামে, আকাশ কোমল এবং মোলায়েম হয়ে ওঠে, ইভার্সের সঙ্গে কথা বলা প্রতিবেশীরা হঠাৎ তাদের কণ্ঠস্বর নিচু করে ফেলে। প্রতিটা মুহুর্তের সঙ্গে তাঁর যেন এক ধরনের ঐকতান তৈরি হয়; তবে মন খুশিতে ভরে ওঠে না কেঁদে ওঠে, তা তিনি বুঝে উঠতে পারেন না। রাত নামে। নিঃশব্দে আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেন। কীসের জন্য, তা তিনি জানেন না।
অথচ সকালে কাজে যাওয়ার বেলায় সমুদ্র তাঁকে একটুও আকর্ষণ করে না। যদিও অভ্যর্থনা জানানোর জন্য সমুদ্র্র সেখানেই থাকে, তবুও সন্ধ্যা পর্যন্ত তার দিক থেকে চোখ ফিরিয়েই রাখেন তিনি।
আজ সকালে যখন তিনি মাথা নিচু করে সাইকেল চালাচ্ছিলেন, তখন অন্য দিনের তুলনায় তাঁকে বেশি ভারাক্রান্ত মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল তাঁর বুকে যেন কিছু ওজন চেপে আছে। গত রাতে মিটিংয়ের পর যখন তিনি ফিরে এসে বললেন যে তাঁরা কাজে ফিরছেন, ফার্নান্দ সানন্দে বলেছিলেন: "তাহলে মালিক তোমাদের হপ্তা বাড়াচ্ছে?" কিন্তু মালিক হপ্তা বাড়াননি। ধর্মঘট ব্যর্থ হয়েছে।
ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত তড়িঘড়ি করে নেওয়া হয়েছিল। পুরো জোর লাগিয়ে ইউনিয়নও পাশে দাঁড়ায়নি। পনের জন কারিগরের ধর্মঘট, কীই বা হওয়ার ছিল! অন্যান্য পিপে কারখানার কারিগররাও তাঁদের সঙ্গ দেয়নি। এই দিকটাকেও ইউনিয়ন বিবেচনার মধ্যে এনেছে। আসলে ইউনিয়নকেও দোষ দেওয়া যায় না। ট্যাঙ্কার ও ট্যাঙ্কার-ট্রাক প্রস্তুতকারকদের প্রভাব-প্রতিপত্তির কারণে পিপে-শিল্পের কাজ মুখ থুবড়ে পড়ছিল। দিনে দিনে পারম্পরিক কারিগরি দক্ষতায় তৈরি পিপের সংখ্যা দ্রুত কমে আসছিল আর অন্যদিকে আধুনিক প্রযুক্তির হাত ধরে বিশালাকার ট্যাঙ্কারের উৎপাদন হু হু করে বেড়ে যাচ্ছিল। তার উপর, ইতিমধ্যে নির্মিত পিপে মেরামতের কাজ কারিগরদের বেচে থাকা কাজের অনেকটাই খেয়ে ফেলছিল। মালিকদের অবস্থাও ছিল সংকটে। যেকোনো উপায়ে তারা চাইছিল ব্যবসাটাকে লাভের মধ্যে রাখতে। তাই তারা নিয়েছিল সবচেয়ে সহজ পন্থা –বেতন না বাড়ানো। মুদ্রাস্ফীতি সত্ত্বেও পিপে-শিল্পের কারিগরদের এটা মেনে নেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। কীইবা করতে পারত তারা যখন খোদ শিল্পই ধ্বংশের মুখে দাঁড়িয়ে? আপনি যখন অনেকটা সময় ব্যয় করে কঠোর পরিশ্রম আর অধ্যবসায়ের মাধ্যমে কিছু একটা শিখলেন, মাঝপথে পেশা পরিবর্তন করতে আপনি পারবেন না।
একজন ভালো পিপে-কারিগর বিরল—উত্তলভাবে বাঁকা তক্তাগুলোকে লোহার বৃত্তাকার পাতের ঘেরের মধ্যে পাশাপাশি রেখে একসঙ্গে এঁটে এবং আগুনের সাহায্যে পাতের সঙ্গে একদম মাপে মাপে কষে ফেলতে হবে। কাঠের গুড়ো বা পাতলা ফালির ব্যবহার একান্তই নিষিদ্ধ। পাশাপাশি দুটো তক্তাকে এমনভাবে জুড়তে হবে যাতে হাওয়াও খেলতে না পারে। ইভার্স এটা জানত এবং এ নিয়ে তাঁর গর্ব ছিল।
পেশা বদলানো এমন কিছু বড় কথা নয়। তবে আপনি যা জানেন তা ছেড়ে দেওয়া, কারুশিল্পে আপনার দক্ষতা ছেড়ে দেওয়া মোটেও সহজ কথা নয়। আপনি দক্ষ অথচ আপনার কাজ নেই–এটা আপনি মেনে নিতে পারবেন না। আপনি হয়ত ভাববেন আপনার এটাই নিয়তি। তবে এটা মেনে নেওয়াও আপনার পক্ষে সহজ নয়। মনের মধ্যে উছলে-ওঠা কথা চেপে রাখা বা ঠিকমত ব্যক্ত করা– দুটোই আপনার পক্ষে কঠিন এবং ক্লান্তিকর লাগবে। জমে থাকা এই ক্লান্তি নিয়ে প্রতিদিন সকালে একই রাস্তা দিয়ে আপনি কাজে যাবেন–অবসাদ আপনাকে আপনিই ঘিরে ধরবে। আর এসব কিছু কীসের জন্যে–নিছক ঐটুকুর জন্য যা একান্তই তারা ঠিক করে দেবে।
তাই তাঁরা রেগে গিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে দু-তিনজন ইতস্তত করেছিলেন, কিন্তু মালিকের সঙ্গে প্রথম আলোচনার পরে তাঁদের মধ্যেও রাগ ছড়িয়ে পড়েছিল। মালিক তাঁদের স্পষ্টভাবে বলেছিলেন যে তাঁরা যা পাচ্ছে তা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকুক বা তাঁরা কাজ ছেড়ে চলে যেতে পারে। একজন মানুষ এভাবে কথা বলতে পারে না। "তিনি আমাদের কাছে কী আশা করেন?" এস্পোসিটো বলেছিলেন, "যে আমরা নত হয়ে পাছায় লাথি খাওয়ার জন্য অপেক্ষা করব?"
আদপে মালিক-মানুষটিকে খারাপ বলা যায় না। এই কারখানাটি তিনি তাঁর বাবার কাছ থেকে উত্তরাধিকারে পেয়েছিলেন। তিনি এই কারখানা চত্বরেই বড় হয়েছিলেন এবং বহুবছর ধরে প্রায় সমস্ত কারিগরদের বেশ ভালোভাবে জানতেন। কখনও কখনও কারখানায় তিনি তাঁদের সবাইকে তাঁর সঙ্গে জলখাবারের জন্য আমন্ত্রণ জানাতেন। কাঠের পাতলা পাতলা ফালি জ্বালিয়ে মাছ বা মাংস রান্না হত আর সঙ্গে থাকত অঢেল মদ। সত্যিই মালিক-মানুষটি দিলদরিয়া ছিলেন। নববর্ষ উপলক্ষে তিনি প্রত্যেক কারিগরকে পাঁচ বোতল সাবেকি মদ উপহার দিতেন। প্রায়শই, যখন তাঁদের মধ্যে কেউ অসুস্থ হয়ে পড়তেন বা বিয়ে বা ফার্স্ট কমিউনিয়নের মতো কোনও অনুষ্ঠান উদযাপন হত, তখন তিনি অর্থ-সাহায্য দিতেন। মেয়ের জন্ম উপলক্ষে তিনি কারিগরদের মাঝে চিনির প্রলেপ মাখানো কাঠবাদাম বিতরণ করেছিলেন। এমনকি দুই থেকে তিনবার তিনি ইভার্সকে তাঁর উপকূলীয় জমিদারিতে তাঁর সঙ্গে শিকারে যেতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।
কারিগরদের দক্ষতারও কদর করতেন তিনি; প্রায়শই বলতেন যে তাঁর বাবাও একজন শিক্ষানবিশ হিসাবে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন। কিন্তু তিনি কখনও কারিগরদের বাড়ি যেতেন না। তাই তাঁদের অবস্থা সম্পর্কে তাঁর কোনো ধারনা ছিল না। তিনি শুধু নিজের কথাই ভাবতেন; নিজেরটা ছাড়া আর কিছুই বুঝতেন না। তাঁর কোনো সিদ্ধান্তকে ঘিরে কোনও রকম আলোচনার ধার ধারতেন না তিনি–হয় মানো নাহলে কেটে পড়ো। তিনি যেমন ছিলেন আত্ম-কেন্দ্রিক তেমনি ছিলেন একগুঁয়ে। অবস্থানগত কারণেই একগুঁয়েপনার বিলাসিতার অবাধ স্বাধীনতা বা অধিকার ছিল তাঁর।
ইউনিয়নের আর কিছুই করার ছিল না। ফলে কারখানার গেটে তালা পড়ল। “এখানে অবস্থান করার ঝামেলায় যেও না। কারখানা বন্ধ থাকলে বরং আমারই টাকা বাঁচবে," মালিক বলেছিলেন। এই কথাটি ডাহা মিথ্যে এবং সহজেই উপেক্ষা করা যেত। কিন্তু ব্যাপারটা ঘটল একদম উলটো। কারণ মালিক কারিগরদের মুখের উপর এটাই বলতে চেয়েছিলেন যে তিনি আসলে কারিগরদের কাজ দিয়ে তাঁদের উপর কৃপা করছেন। এস্পোসিটো রাগে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং কোন রাখঢাক না করে মালিককে সটান বলে দেন যে তাঁর মধ্যে কোন পুরুষত্ব নেই। মালিকও ছিলেন রগচটা। খুব দ্রুত পরিস্থিতি হাতাহাতির পর্যায়ে নেমে যায়। ফলে তাঁদের দুজনকে একে অপরের থেকে আলাদা করতে হয়। কিন্তু ঘটনার প্রভাব পড়ে কারিগরদের উপর।
বিশ দিন হয়ে গেল, তাঁরা ধর্মঘটে। তাঁদের স্ত্রীরা মন খারাপ নিয়ে বাড়িতে বসে। দু-তিনজনের উৎসাহ তলানিতে। শেষ পর্যন্ত, ইউনিয়ন কারিগরদের প্রতিশ্রুতি দেয় যে তাঁরা ধর্মঘট শেষ করলে ইউনিয়ন মধ্যস্থতা করবে এবং ওভারটাইমের মাধ্যমে কারিগরদের হারানো দিনের টাকা পুনরুদ্ধার করবে। তাই কাজে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কারিগররা। একই সঙ্গে নিজেদের মধ্যে অনেক গালভরা শব্দের বিনিময়ে তাঁরা দৃঢ়তা দেখিয়ে বলেছেন যে বিষয়টি এখনও অমীমাংসিত এবং মালিককে তাঁর সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করতে হবে।
কিন্তু আজ সকালে পরাজয়ের গ্লানি মাখানো ক্লান্তি আর মাংসের বদলে চিজ – বেচে থাকা দৃঢ়তা ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছিল। সূর্য যতই উজ্জ্বল হয়ে উঠুক না কেন, সমুদ্র আর আশ্বাসের হাত বাড়িয়ে দিতে পারছিল না। ইভার্স একক প্যাডেলে চাপ দিলেন এবং তাঁর মনে হতে লাগল যে চাকার প্রতিটি আবর্তনর সঙ্গে তাঁর বয়স একটু একটু করে বেড়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পরেই তিনি কর্মশালায় পৌঁছবেন। কীভাবে সহকর্মী এবং মালিকের সঙ্গে চোখে চোখ রেখে কথা বলবেন? এই কথা মনে আসতেই তাঁর বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে উঠল।
ফার্নান্দ চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, "তোমরা এখন মালিককে কি বলবে?"
"কিছুই না।”
ইভার্স মাথা নেড়ে পা ছড়িয়ে সাইকেলে বসতে বসতে বলেছিলেন। তিনি তাঁর দাঁত চেপে ধরেছিলেন; তাঁর ছোট, কালো কুঁচকে যাওয়া মুখ শক্ত হয়ে গিয়েছিল।
“আমরা সবাই কাজে ফিরে যাচ্ছি। ব্যস।"
এখন তিনি সাইকেল চালাচ্ছিলেন। দাঁতে দাঁত চেপে থাকায় তাঁর চোয়াল শক্ত। মুখাবয়বে এমন এক বিষণ্ণতা, এমন এক চাপা রাগ, মনে হচ্ছিল আকাশও যেন অন্ধকারে ঢেকে যাচ্ছে।
সমুদ্র-ধারের প্রশস্ত রাস্তা ছেড়ে তিনি নেমে পড়লেন স্পেনীয় বস্তির স্যাঁতসেঁতে গলিতে। এই গলি ধরে আরেকটু এগোলে দেখা যাবে এখানে ওখানে ছড়ানো পুরনো লোহালক্করের স্তূপ, গাড়ী মেরামতের গ্যারাজ আর বিভিন্ন ছোট ছোট কর্মশালা বা কারখানা। এখানেই পাওয়া যাবে সেই কর্মশালাটি যেখানে ইভার্সরা কাজ করেন।
নিচু চালের এই কর্মশালার সম্মুখভাগে অর্ধেক মানুষ সমান উচ্চতা পর্যন্ত পাথরের দেয়াল উঠে গেছে; উপরের বাকিটা কাঁচের; আর এটিকে অবলম্বন করে ধাতব পাতের ঢেউতোলা ছাদ ঢালু হয়ে নেমে এসেছে বাইরের দিকে। গেট দিয়ে ঢুকেই দেখতে পাওয়া যাবে চার চালার ছাদের তলায় এখানে ওখানে ছড়ানো কিছু অকেজো বাতিল যন্ত্রপাতি এবং কয়েকটি ছোট-বড় পুরনো পিপে। ব্যবসা বেড়ে যাওয়ায় এই জায়গাটি এখন বাতিল। এই জায়গার শেষে মালিকের বাগান, তারপর মালিকের দোতলা বাড়ি, মাঝে টাইলস-মোড়া সরু পথ। বাড়িটি বড়, কিন্তু কদাকার; বাইরে দিয়ে সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলা পর্যন্ত। সিঁড়ির খিলানের গোটা কাঠামো ঘিরে হানিসাকলের ঘন লতানো গাছ। এর শোভায় বাড়িটি কিছুটা শ্রী ফিরে পেয়েছে।
পৌঁছে ইভার্স দেখলেন কর্মশালার গেট বন্ধ, সামনে নীরবে দাঁড়িয়ে একদল কারিগর। বহুবছর হয়ে গেল, তিনি এখানে কাজ করছেন। এই প্রথম দেখলেন কর্মশালার গেট বন্ধ। মালিক বোঝাতে চেয়েছেন যে রশির টানাটানিতে তাঁর দিকে পাল্লা ভারি। ঢেউ-খেলানো ছাদ যেখানে কিছুটা বাইরে বেড়িয়ে এসছে, তার নিচে পাথরের দেয়ালে সাইকেলটিকে হেলান দিয়ে ইভার্স গেটের দিকে এগিয়ে গেলেন। দূর থেকে তিনি এস্পোসিটো, মার্কো এবং সৈয়দকে দেখতে পেলেন। এস্পোসিটো লোকটি ছিলেন লম্বা এবং কালো। তাঁর সারা শরীরে কালো ঘন লোম। এই লোকটির কাজের জায়গা ঠিক তাঁর পাশে। মার্কো ছিলেন ইউনিয়ন-লিডার। তাঁর ধারালো মুখের গঠনে এক ধরনের মনটানা ব্যাপার রয়েছে। কারিগরদের মধ্যে সৈয়দ একমাত্র আরবী। সবাই নীরবে ইভার্সকে তাঁদের দিকে এগিয়ে আসতে দেখছিলেন। কিন্তু তাঁর পৌঁছনোর আগেই, তালা খোলার আওয়াজে গেটের দিকে চোখ ফেরালেন সবাই। সেখানে উপস্থিত ফোরম্যান ব্যালেস্টার। তালা খুলে তিনি কারিগরদের দিকে মুখ ঘুরিয়ে গেটটিকে লোহার রেলে আলতো করে ঠেলে দিলেন। ব্যালেস্টার সবচেয়ে পুরনো কারিগর। ধর্মঘটে যোগ না দেওয়ায় এস্পোসিটো তাঁকে বলেছিলেন–তিনি মালিকের স্বার্থ রক্ষা করছেন। নীরবে শুনেছিলেন তিনি।
এখন তিনি গেটে দাঁড়িয়েছিলেন। গাঢ় নীল কারখানার পোষাকে তাঁকে বলীষ্ঠ দেখাচ্ছিল। ইতিমধ্যেই জুতোজোড়া খুলে ফেলেছেন তিনি; খালি পায়ে (সৈয়দ ছাড়া, তিনিও খালি পায়ে কাজ করতেন) একে একে সব কারিগরদের কর্মশালার ভেতর যেতে দেখছিলেন। তাঁর ফ্যাকাশে দুটি চোখ রোদপোড়া তামাটে মুখের পটভূমিতে সমস্ত রঙ হারিয়ে ছিল। ঝুলে পড়া ঘন গোঁফের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মুখের ত্বকও ঝুলে পড়েছিল।
তাঁরা সবাই নীরব ছিলেন। হেরে ফিরতে হয়েছে বলে অপমানিত বোধ করছিলেন। নিজেদের নীরবতায় তাঁরা নিজেদের উপরেই চটে ছিলেন। কিন্তু নীরবতা যত বেশি দীর্ঘায়িত হচ্ছিল ততই তাঁরা এটি ভাঙতে অসমর্থ হচ্ছিলেন। তাঁরা ব্যালেস্টারের দিকে না তাকিয়ে কারখানার ভেতর একে একে ঢুকছিলেন। তাঁরা বুঝেছিলেন যে এইভাবে ভিতরে ঢোকাটা মালিকের আদেশে হয়েছে এবং ব্যালেস্টার তা পালন করছে মাত্র। তাঁর তিক্ত ও মনমরা মুখ তাঁদের বলে দিচ্ছল যে ঐ মুহূর্তে তাঁর ভেতরে কী চলছিল। একমাত্র ইভার্স তাকিয়েছিলেন ব্যালেস্টারের দিকে। ব্যালেস্টার তাঁকে বিশেষ পছন্দ করতেন; কোন কথা না বলে মাথা নেড়েছিলেন।
এখন তাঁরা সবাই গেটের ডানদিকের ছোট্ট লকার-রুমে। জায়গাটি কাঠের তক্তা দিয়ে ছোট ছোট খুপরিতে বিভক্ত; তক্তার দু’দিকে তালা লাগানো ক্যাবিনেট আর একদম শেষ খুপরির অন্য পাশে স্নানের একটা ছাট্ট খোলা জায়গা যার মেঝে মাটির।
কারখানার মাঝখানে ছড়িয়ে পড়ে ছিল ভিন্ন ভিন্ন স্তরের অসমাপ্ত কাজ। পড়ে ছিল একটি পিপে আগুনে পোড়ার প্রতীক্ষায়, যাতে লোহার পাত প্রস্থচ্ছেদ জুড়ে তাকে শক্ত করে এঁটে ধরে। আরেকদিকে পড়ে কয়েকটি শক্ত-পোক্ত কাঠের বেঞ্চ; যেগুলোর উপরিতলে ছিল ভিন্ন ভিন্ন আকারের গোলাকার ছিদ্র। পিপের তলদেশে মাপে মাপে লেগে যায় এমন একটি গোলাকার তল একটি ছিদ্রে আটকানো ছিল যাতে রেঁদা ফিরিয়ে, শিরিষ কাগজ ঘষে মসৃণ করা যায়। প্রবেশদ্বারের বাঁ পাশের দেয়াল ঘেঁষে সারিবদ্ধভাবে ছিল অনেকগুলি শক্ত-পোক্ত লম্বা টেবিল। যেগুলোর সামনে পড়ে ছিল কাঠের তক্তার স্তূপ। কাজ বন্ধ না থাকলে এগুলো রেঁদার ছোঁয়া পেয়ে ইতিমধ্যেই মসৃণ হয়ে যেত। ডানদিকে দেয়ালের কাছে দুটি শক্তিশালী বৈদ্যুতিক করাতের তেল মাখানো ফলাগুলো আলোয় চকচক করছিল।
এমন কিছু বেশি দিন আগের কথা নয়। কারিগরের সংখ্যা কমতে কমতে যে ক’জন পড়ে ছিল, সেই তুলনায় কর্মশালাটিকে বড্ড বেশি বড় লাগতে শুরু করেছিল। গ্রীষ্মকালে এর কিছু লাভ থাকলেও শীতে কষ্টকর হয়ে উঠেছিল। কিন্তু আজ, এই বিশাল জায়গা কেমন যেন খাঁ খাঁ করছে। অর্ধেক শেষ হওয়া কাজ এদিক ওদিক পড়ে রয়েছে। একটিমাত্র আংটায় পিপের বাঁকা তক্তাগুলো লেগে থাকায় ফুলের মতো দেখতে লাগছিল। যন্ত্রপাতির উপর, বেঞ্চের উপর, মোটরের উপর কাঠের গুঁড়োর পুরু আস্তরণ; দেখে মনে হয় কর্মশালাটি যেন অবহেলায় শেষের দিন গুনছে। এখন কারিগরদের পরনে কর্মশালার পোষাক, বহু ব্যবহারে জীর্ণ; প্যান্ট বিবর্ণ, জায়গায় জায়গায় তাপ্পি মারা। শূন্যতায় ভরা চারপাশে অস্বস্তি নিয়ে তাকালেন তাঁরা।
"তাহলে, এখন শুরু করা যাক?" সবার দিকে চোখ ফিরিয়ে ব্যালেস্টার বললেন।
একে একে সব কারিগর একটিও কথা না বলে নির্দিষ্ট কাজের জায়গায় চলে গেলেন। ব্যালেস্টার একে একে সবার কাছে গিয়ে কাজ নিয়ে নির্দেশ দিলেন। সবাই নীরবে তাঁর নির্দেশ পালন করতে উদ্যত হলেন।
শীঘ্রই তীক্ষ্ণ ঝনঝন শব্দ করে হাতুড়ির আঘাত পড়তে লাগল লোহার গোঁজে। পিপের উত্তল অংশের মধ্যে লোহার বৃত্তাকার পাত একদম মাপে মাপে এঁটে যেতে লাগল। তক্তার সঙ্গে রেঁদার ঘর্ষণ শুরু হল। কিন্তু কয়েক মুহূর্ত যেতেই যন্ত্রটি কর্কশ আর্তনাদ করে গাঁটে ফেঁসে গেল। এস্পোসিটো বৈদ্যুতিক করাত মেশিনের সুইচ টিপে দিলেন। ভোঁ ভোঁ করে ধারালো ফলক ঘুরতে শুরু করল। সৈয়দ করিগরদের কাছে তক্তার যোগান পৌঁছে দিচ্ছিলেন; আবার কাঠের খোসা আর ফেলে দেওয়া কাঠের টুকরো জ্বালিয়ে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছিলেন। এই আগুনের তাপে পিপে ফুলে লোহার আংটার সঙ্গে শক্ত বাঁধনে এঁটে যেত। যখন যোগানের ডাক পড়ত না, তিনি লোহার আংটার আলগা দু’প্রান্ত জুড়ে হাতুড়ির প্রচণ্ড আঘাতে রিপিট মারত। কাঠের খোসার পোড়া গন্ধে দোকান ভরে উঠেছিল। এস্পোসিটোর কাটা তক্তার উপর ইভার্স রেঁদা ঘষছিলেন। কাঠ পোড়ার পুরনো চেনা গন্ধে তিনি ধীরে ধীরে স্বস্তি ফিরে পাচ্ছিলেন। যদিও সবাই কাজ করে যাচ্ছিলেন নীরবে, তবুও একটু একটু করে গুমোটভাব কেটে উঞ্চতা ফিরে আসতে শুরু করেছিল। বড় বড় জানালা দিয়ে পরিষ্কার তাজা আলো ঢুকে গোটা চত্বরকে ভরিয়ে দিতে শুরু করেছিল। সোনালী সূর্যের আলোয় জমে থাকা ধোঁয়া নীলচে হয়ে উঠেছিল। এমনকি ইভার্সও একটি পোকার গুঞ্জন শুনতে পেড়েছিলেন।
এইরকম এক সময়ে দেয়ালের শেষ প্রান্তের দরজা খুলে দোরগোড়ায় দাঁড়ালেন মালিক লাসাল– রোগাটে গড়ন, গায়ের রং কালো, বয়স ত্রিশও পেরোয়নি। ঢিলেঢালা কর্মশালার পোষাকের উপরের অংশ খোলা, তলায় বাদামী গ্যাবার্ডিন স্যুট, ব্যক্তিত্ব সহজ সাবলীল। কাঠ কাঠ অস্থিসার মুখ। তবুও অমায়িক একটা ব্যাপার ছিল তাঁর মধ্যে। নিজের প্রতি আকর্ষণ জাগিয়ে তোলার এক অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল এই ভদ্রলোকের।
তবুও এখন তাঁকে কিছুটা বিব্রত দেখাচ্ছিল। তাঁর অভিবাদনে অন্যান্য দিনের মত উঞ্চতা ছিল না। অবশ্য কেউই অভিবাদনের উত্তর দেননি। হাতুড়ির শব্দে এক মুহূর্তের ছন্দপতন ঘটেছিল মাত্র। কিন্তু পরমুহূর্তেই আরও জোরে, আরও দ্রুত তালে হাতুড়ির আঘাত চালু হয়েছিল। লাসাল দ্বিধাগ্রস্ত পায়ে কিছুটা এগোলেন, তারপর ঘুরে ভ্যালেরির দিকে এগিয়ে গেলেন। মাত্র এক বছর হয়েছে, তিনি এখানে কাজ ঢুকেছেন। ইভার্স থেকে কয়েক ফুট দূরে, বৈদ্যুতিক করাতের কাছে একটি বড় পিপের তলদেশ লাগানোর কাজে ব্যস্ত ছিলেন। মালিক মনোযোগ দিয়ে তাঁর কাজ দেখছিলেন। কোন কথা না বলে ভ্যালেরি তাঁর কাজ করে যাচ্ছিলেন।
"ও ভাই, কেমন চলছে?” লাসাল বললেন।
যুবকটি হঠাৎ দিশেহারা হয়ে কী বলবেন, কী করবেন, কিছুই ঠাহর করতে পারলেন না; পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এস্পোসিটোর দিকে তাকালেন। ইভার্সের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য এস্পোসিটো তাঁর পেশিবহুল হাতে স্তূপিকৃত তক্তাগুলো তুলছিলেন তখন। কাজ করতে করতে তিনিও ভ্যালেরির দিকে তাকালেন। মালিককে কোনও উত্তর না দিয়ে ভ্যালেরি পুনরায় তাঁর কাজে মন দিলেন। কিংকর্তব্যবিমূঢ় লাসাল যুবকের সামনে কয়েক মুহূর্ত থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন; তারপর কাঁধ ঝাঁকিয়ে মার্কোর দিকে এগিয়ে গেলেন। মার্কো বেঞ্চের দু’পাশে দু’পা ফাঁক করে বসেছিলন; খুব যত্ন নিয়ে পিপের তলদেশের বেড় ঘষে ঘষে মসৃণ করছিলেন।
"হ্যালো, মার্কো," লাসাল চাটুকারিতা মেশানো কণ্ঠে বললেন।
মার্কো কোনও উত্তর দিলেন না। তলদেশের বেড়ে লেগে থাকা কাঠের আঁশ বাটালি দিয়ে খুঁড়ে বার করছিলেন।
"কি হয়েছে তোমাদের সবার?" লাসাল সব কারিগরদের দিকে মুখ ফিরিয়ে উচ্চস্বরে জিজ্ঞেস করলেন। “ঠিক আছে, আমরা সহমত হইনি। কিন্তু তাতে আমাদের একসঙ্গে কাজ করতে আটকায় কোথায়? তোমাদের এমন আচরণ করে কী লাভ?”
পিপের নিম্নদেশের গোলাকার সমতল অংশটিকে উল্লম্বভাবে বেঞ্চের উপর দাঁড় করাতে করাতে মার্কো নিজেও উঠে দাঁড়ালেন। হাতের তালু দিয়ে পার্শ্বতলের মসৃণতা যাচাই করার সময় তাঁর শ্রান্ত চোখে তৃপ্তির আভাস টের পাওয়া গিয়েছিল। তারপর তিনি নীরবে পাশের কারিগরের দিকে এগিয়ে গেলেন। তিনি উত্তল আকৃতির তক্তাগুলোকে একত্রিত করে পিপের আকার দেওয়ার কাজ করছিলেন। পুরো কারখানা জুড়ে হাতুড়ি আর বৈদ্যুতিক করাতের শব্দ ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছিল না।
"ঠিক আছে," লাসাল বললেন। “যখন তোমরা সবাই এটা কাটিয়ে উঠবে, তখন ব্যালেস্টারের মাধ্যমে আমাকে জানিও।” এই বলে তিনি ধীর পদক্ষেপে কর্মশালা ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। প্রায় একই সঙ্গে কর্মশালার শোরগোল ভেদ করে দুবার ঘণ্টি বেজে উঠল।
ব্যালেস্টার, যিনি সবেমাত্র সিগারেট ধরাতে বসেছিলেন, ধীরে ধীরে উঠে দেয়ালের শেষ প্রান্তের দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন। তাঁর বেরিয়ে যেতে হাতুড়ির আঘাতের শব্দ ধিমে হয়ে আসল। একজন কারিগর এমনকি কাজও বন্ধ করে দিয়েছিলেন। ঠিক তখনই ফিরে আসেন ব্যালেস্টার। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে তিনি সহজভাবে বললেন, “মার্কো এবং ইভার্স, মালিক তোমাদের দু’জনকে ডাকছেন।” ইভার্সের প্রথমে হাত ধোয়ার কথা মনে এসছিল; এই লক্ষ্যে অগ্রসর হওয়ার মাঝপথে মার্কো তাঁকে হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরলেন। ফলে ইভার্স খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে মার্কোর পেছন পেছন হাঁটা লাগালেন।
বাইরে, উঠোনের আলো এতই পরিষ্কার, এতই স্বচ্ছ ছিল যে ইভার্স তাঁর মুখে এবং অনাবৃত হাতে তা অনুভব করেছিলেন। অনতিদূরে একট সিঁড়ি উপরে উঠে গেছে যার খিলান জুড়ে হানিসাকলের লতানো গাছ, ইতিউতি দৃশ্যমান কয়েকটি সাদা-হলদে ফুল। তাঁরা দু’জনে সিঁড়ি বেয়ে উঠে একটি করিডোরে প্রবেশ করলেন; দেয়ালে ঝুলছিল অনেকগুলো শংসাপত্র। একটু এগোতে না এগোতে তাঁরা একটি বাচ্চার কান্না শুনতে পেলেন এবং সেই সঙ্গে শুনতে পেলেন লাসালের কণ্ঠস্বর: “ওকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দাও। তারপরও যদি অবস্থার উন্নতি না হয়, আমরা ডাক্তার ডাকব।”
ক্ষণিক পরেই লাসালকে করিডোরে দেখা গেল। দুই কারিগরকে নিয়ে আসবাবে এবং স্পোর্টস ট্রফিতে সাজানো ছোট্ট অফিস-ঘরে প্রবেশ করলেন তিনি। বলাবাহুল্য এই অফিস-ঘর তাঁদের অনেকদিনের চেনা; প্রথম দৃষ্টিতে আসবাবপত্রে লোকশিল্পের ঐতিহ্য প্রতীয়মান হলেও, একটু খুঁটিয়ে দেখলেই সেগুলোতে আধুনিক প্রযুক্তির হস্তক্ষেপ স্পষ্ট।
"বসুন," ল্যাসাল টেবিলের অন্য প্রান্তে তাঁর চেয়ারে বসতে বসতে বললেন। কিন্তু দু’জনই দাঁড়িয়ে রইলেন।
“আমি তোমাদের দু’জনকেই শুধু এখানে ডেকেছি, কারণ মার্কো, তুমি ইউনিয়নের প্রতিনিধি, আর ইভার্স, তুমি ব্যালেস্টারের পর আমার সবচেয়ে পুরনো কর্মচারী। ইতিমধ্যে যে আলোচনা আমাদের মধ্যে হয়েছে তার পুনরাবৃত্তি করতে চাই না, সেটার কিছু বাকিও নেই। তোমরা যা চাও তা আমি কখনোই দিতে পারব না। এই বিষয়ের নিষ্পত্তি হয়ে গেছে এবং আমরা সবাই এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে আবার কাজ শুরু করতে হবে। আমি দেখতে পাচ্ছি যে তোমরা সবাই আমার উপর রেগে আছ। এটি আমাকে কষ্ট দিচ্ছে। আমি যেমনটা অনুভব করছি ঠিক তেমনটাই তোমাদের বলছি। কিন্তু আমি শুধু আর একটা কথা বলতে চাই: আজ আমি তোমাদের সবার জন্য যা করতে পারছি না, এই ব্যবসাটি যখন আবার দাঁড়াবে, আবার লাভের মুখ দেখবে তখন আমি তা করতে পারব। তোমাদের বলতে হবে না, তার আগেই আমি তা করব। ততক্ষণ পর্যন্ত, এসো, একসাথে কাজ করার চেষ্টা করি।”
কথা বন্ধ করে কিছুক্ষণ মনে মনে কিছু ভাবলেন, তারপর দু’জনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কি বলো?”
মার্কো জানালার বাইরে তাকিয়েছিলেন। দাঁতে দাঁত চেপে ইভার্স কিছু বলতে চাইলেন, কিন্তু কিছু বলতে পারলেন না।
“শোনো,” লাসাল বললেন, “তোমরা সব মনের দরজা বন্ধ করে রেখেছ। তোমরা যখন আবার সম্বিত ফিরে পাবে, তখন আমি তোমাদের যা বললাম তা ভুলে যেও না।"
তিনি উঠে দাঁড়ালেন এবং এগিয়ে এসে মার্কোর দিকে হাত বাড়ালেন। হঠাৎ মার্কো ফ্যাকাশে হয়ে পড়লেন। এক মুহুর্তের জন্য তাঁর তীক্ষ্ণ, ধারালো মুখে এক ধরনের শয়তানি ফুটে উঠল এবং কোন কালক্ষেপ না করে মুখ ঘুরিয়ে দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। ইভার্সের মুখও ফ্যাকাশে হয়ে পড়েছিল। লাসাল ইভার্সের দিকে তাকালেন কিন্তু হাত বাড়ালেন না।
"জাহান্নমে যাও!" তিনি চিৎকার করে উঠলেন।
দুজনে যখন ফিরে এলেন, তখন বাকিরা টিফিন খাচ্ছিলেন। ব্যালেস্টার বাইরে গিয়েছিলেন। "লেগে থাকো"--সাদামাটাভাবে কেবল এই কথাটি বলে মার্কো তাঁর নির্দিষ্ট কাজের জায়গায় ফিরে গেলেন। রুটিতে কামড় দেওয়া থামিয়ে এস্পোসিটো মালিকের সঙ্গে তাঁদের কথোপকথনের বিষয়ে জানতে চাইলেন। ইভার্স বললেন যে বলার মত কোন কথাই মালিকর সঙ্গে তাঁদের হয়নি। এই বলে তিনি তাঁর কাঁধ-ঝোলানো ব্যাগ নিয়ে আবার নিজের কাজের টেবিলে ফিরে গেলেন। ব্যাগ থেকে টিফিন বার করে স্যান্ডউইচে সবেমাত্র কামড় বসাতে যাবেন, তিনি দেখতে পেলেন কাঠের খোসার গাদার উপর সৈয়দ চিত হয়ে শুয়ে আছেন। তাঁর চোখ আনমনে জানালার দিকে স্থির। আকাশের নিভে আসা আলোয় জানালার কাঁচ নীল হয়ে এসেছিল। ইভার্স তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন তিনি খাবার খেয়েছেন কিনা। সৈয়দ বললেন, তিনি ডুমুর খেয়েছেন। ইভার্স থামলেন। লাসালের সঙ্গে সাক্ষাতের পর থেকে যে অস্থিরতা তাঁকে কুরে কুরে খাচ্ছিল তা হঠাৎ উবে গেল এবং তার জায়গায় তিনি এক মনোরম উত্তেজনা অনুভব করলেন। স্যান্ডউইচকে দুই টুকরো করে নিজের জায়গা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। কিন্তু সৈয়দ প্রত্যাখ্যান করায় ইভার্স তাঁকে বললেন, আগামী সপ্তাহের মধ্যে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। "তখন খাওয়ানোর পালা তোমার," তিনি বলেছিলেন। সৈয়দ হাসলেন। স্যান্ডউইচের টুকরোতে কামড় বসালেন, নীরবে, এমনভাবে যেন তিনি ক্ষুধার্ত নন।
কাঠের খোসা আর ফালি জড়ো করে এস্পোসিটো আগুন জ্বালিয়ে নিলেন। একটি বোতলে করে নিয়ে আসা কিছু কফি একটি পুরনো পাত্রে ঢেলে গরম করলেন। ধর্মঘটের ব্যর্থতার কথা জানতে পেরে তাঁর মুদি কারখানার জন্য এটি পাঠিয়েছেন–তিনি বললেন। একটিমাত্র টিনের ক্যান, সেটি এক হাত থেকে অন্য হাতে চলে যেতে থাকে। প্রতিবার সেটি যখন এস্পোসিটোর কাছে ফিরে আসে, তিনি তাতে কফি ঢেলে দেন। খাবার খাওয়ার বেলায় সৈয়দ যতটা আনন্দ পেয়েছিলেন, তার চেয়ে ঢের বেশি পেয়েছিলেন কফি খাওয়ার বেলায়। এস্পোসিটো সরাসরি গরম পাত্র থেকে অবশিষ্ট কফি চুকচুক আওয়াজ করে এবং একই সঙ্গে গালাগাল দিতে দিতে পান করলেন। ঠিক তখনই ব্যালেস্টার সেখানে উপস্থিত হলেন এবং ইঙ্গিতে সমস্ত কারিগরদের কাজে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন।
যখন তাঁরা উঠে তাদের নথিপত্র এবং টিফিন বক্স গুছিয়ে ব্যাগে পুরছিলেন ঠিক সেই সময় ব্যালেস্টার তাঁদের মাঝে এসে দাঁড়ান। এক নিঃশ্বাসে তিনি বললেন, পরিস্থিতি যেমন সবার জন্য কঠিন তেমন তাঁর জন্যও কঠিন, কিন্তু তাই বলে বাচ্চাদের মতো আচরণ করার কোন মানে নেই, মুখ গোমড়া করে থেকেও কোন লাভ নেই।
কফির পাত্রটি হাতে ধরে এস্পোসিটো তাঁর দিকে ঘুরলেন। তাঁর লম্বা, রুক্ষ মুখ হঠাৎ উত্তেজনায় লাল হয়ে পড়েছিল। ইভার্স বুঝতে পেরেছিলেন তিনি কী বলতে চলেছেন–এবং সমস্ত কারিগর একই সঙ্গে একই সময় একই কথা ভাবছিলেন–যে তাঁরা মুখ গোমড়া করে ছিলেন না, তাঁদের মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, তাদের হয় সেই একই কম হপ্তা নিয়ে খুশী থাকতে হবে অথবা কাজ ছেড়ে চলে যেতে হবে, রাগ এবং অসহায়তা কখনও কখনও এতটা আঘাত করে যে তুমি চিৎকারও করতে পার না। তাঁরা তো মানুষ। এমন পরিস্থিতিতে বোকার মতো হাসতে তাঁরা পারবেন না। কিন্তু এস্পোসিটো এমন কিছুই বললেন না। তাঁর উত্তেজিত মুখ স্বাভাবিক হয়ে এল। তিনি ব্যালেস্টারের কাঁধে আলতো চাপ দিলেন। অন্যরাও তাঁদের কাজে ফিরে যেতে লাগলেন।
আবার হাতুড়ির শব্দ ধ্বনিত হতে লাগল। একটানা চেনা আওয়াজ ছাড়া গোটা কর্মশালা ভরে উঠেছিল ঘামে ভেজা পোষাক আর কাঠের খোসার মিশ্র গন্ধে। এস্পোসিটো টাটকা কাঠের চৌকো খণ্ডকে ধীরে ধীরে বিদ্যুতচালিত করাতের ধারালো ফলকের দিকে ঠেলে দিতে লাগলেন। খণ্ডটি ফলকের কামড় পেয়ে কাঠের মিহি গুঁড়ো ছেটাতে ছেটাতে দুটি খণ্ডে বিভক্ত হয়ে পড়তে লাগল। এস্পোসিটোর পেশিবহুল লোমশ হাতদুটি ঘূর্ণায়মান ফলকের দুপাশে খণ্ডটিকে শক্ত করে ধরে রেখেছিল। ক্রমশ ভেজা ভেজা কাঠের গুঁড়োর পুরু আস্তরণ হাতদুটি ঢেকে দিচ্ছিল। মাপসই ঢালু বেধের তক্তা মূল খণ্ডটি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে আসতে মোটরের ফাঁপা ভোঁ ভোঁ শব্দে গোটা চত্বর শূন্যতায় ভরে যাচ্ছিল।
সামনে ঝুঁকে রেঁদা ফেরাতে যাবেন, ঠিক তখন ইভার্স পিঠে এক ধরনের টান অনুভব করলেন। সাধারণত অনেকক্ষণ কাজের পর তাঁর ক্লান্তি আসে। এটা ঠিক যে দু-তিন সপ্তাহ তিনি কাজের বাইরে ছিলেন। বয়সের কথাও তাঁর মনে এল। এই বয়সে কায়িক শ্রম আরও কঠিন হয়ে পড়ে। তবে সূক্ষ্ম কাজের বেলায় কথা আলাদা। পিঠের ব্যথা বার্ধক্যের পূর্বাভাসও বটে। যে কাজে পেশীর ব্যবহার বেশি, সেই কাজ কিছুক্ষণ পরই বিরক্তিকর হয়ে ওঠে, অনেকটা যেন মৃত্যুর আগের অবস্থার মতো। সারাদিন অত্যধিক শারীরিক পরিশ্রম করে যখন আপনি রাতে ঘুমোবেন তখন সেই ঘুমও মৃত্যুসমান। ছেলেটি স্কুলশিক্ষক হতে চায়, বুদ্ধিমানের মতো সিদ্ধান্ত বটে; যারা কায়িক শ্রমের গুনগান করে তারা জানে না তারা কি সম্পর্কে কথা বলছে।
শ্বাস ফিরে পাওয়ার জন্য এবং এই উলটো-পালটা চিন্তা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য যখন ইভার্স সোজা হয়ে দাঁড়ালেন, ঠিক তখন আবার ঘণ্টি বেজে উঠল। অদ্ভুতভাবে একটানা বেজে যেতে থাকল; কখনো থেমে আবার কখনো শুরু হতো এলোমেলোভাবে। এভাবে ঘণ্টি বাজার শব্দ শুনে কারিগররা তাঁদের কাজ বন্ধ করে দেন। ব্যালেস্টার প্রথমে অবাক হয়ে ঘণ্টি বাজার শব্দ শুনতে থাকে। তারপর মনস্থির করে দরজার দিকে ধীর কদমে এগিয়ে যান। তিনি চলে যাওয়ার পর বেশ কিছু মুহূর্ত কেটে যায়; তারপর গিয়ে ঘণ্টি বন্ধ হয়। তাঁরা আবার কাজ শুরু করেন। কিন্তু পরমুহূর্তে দরজাটা আবার হঠাৎ হাট করে খুলে যায় এবং ব্যালেস্টার লকার-রুমের দিকে দৌড়ে যান। ক্যানভাসের জুতা আর জ্যাকেট পরে দ্রুত বেরিয়ে এসে ইভার্সকে বলেন, "বাচ্চার স্ট্রোক হয়েছে। আমি জার্মেইনকে ডেকে আনতে যাচ্ছি।” এই বলে তিনি মূল গেটের দিকে দৌড় লাগান। ডাঃ জার্মেইনের কোয়ার্টার খুব বেশি দূরে নয়; তিনিই কারখানার কারিগরদের স্বাস্থ্যের ব্যাপার-স্যাপার দেখেন ।
ইভার্স কোনো মন্তব্য ছাড়াই খবরটি সবাইকে জানিয়ে দিলেন। সবাই তাঁর চারপাশে জড়ো হয়ে একটু যেন হতবুদ্ধি হয়ে একে অপরের দিকে তাকাচ্ছিলেন। বৈদ্যুতিক মোটরের ফাঁপা শব্দ ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছিল না। "মনে হয় এমন কিছু হয়নি," তাঁদের একজন বললেন। তাঁরা আবার কাজের জায়গায় ফিরে গেলেন। কর্মশালাটি আবার আওয়াজে ভরে উঠল; কিন্তু কাজে একটা ঢিলেমি-ভাব, যেন অদৃষ্টের প্রতীক্ষায় অপেক্ষমান।
পনের মিনিট পর ব্যালেস্টার ফিরে এলেন, দেয়ালের একটি খুঁটিতে জ্যাকেট ঝোলালেন, তারপর কাউকে কিছু না বলে হন্তদন্ত হয়ে শেষের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। জানালা দিয়ে আসা আলো ক্রমে কমে এসছিল। বৈদ্যুতিক করাত কাঠে প্রথম কামড় বসাতে যাবে এমন সময় অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন শোনা গেল। শব্দটি ক্রমশ কাছে আসতে আসতে শেষ পর্যন্ত কর্মশালার বাইরে এসে থামল। তারপর চারিদিকে নিস্তব্ধতা।
কিছুক্ষণ পর ব্যালেস্টার ফিরে এলেন। সবাই তাঁকে ঘিরে ধরলেন। এস্পোসিটো বৈদ্যুতিক করাতের মোটর আগেই বন্ধ করে দিয়েছিলেন। ব্যালেস্টার বললেন, কাপড় ছাড়ার সময় বাচ্চা মেয়েটি এমনভাবে মুখ থুবড়ে পড়েছে যেন কেউ খুব জোরে পেছন থেকে ধাক্কা মেরেছে। “আপনি কি কখনও এমন কথা শুনেছেন?" মার্কো বললেন। ব্যালেস্টার না-সূচক মাথা নেড়ে কাজে যাবার ভাসাভাসা ইঙ্গিত দিলেন। ঘটনার ধারাবাহিকতায় তিনি যে প্রচণ্ড স্নায়বিক শক পেয়েছেন– তাঁর দিকে তাকালেই বোঝা যাচ্ছিল। আবার অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন শোনা গেল। তারপর কর্মশালায় নীরবতা। জানালা দিয়ে হলুদ আলো চুঁইয়ে চুঁইয়ে ঢুকছিল। কারিগরদের জটলা তখনও অব্যাহত। শুধু তাঁদের বিশ্রামপ্রাপ্ত রুক্ষ হাতগুলি কাঠের গুঁড়োয় ঢাকা তাঁদের পুরনো প্যান্টের পাশে আলগা ঝুলছিল।
বাকি দুপুরটা হেঁচড়ে হেঁচড়ে কেটে গেল। ক্লান্ত ইভার্স বুকে একটা ভারি ভারি ভাব অনুভব করলেন। তিনি কথা বলতে চাইছিলেন। কিন্তু তাঁর কিছুই বলার ছিল না। অন্যান্য কারিগরদের অবস্থাও ছিল একই রকম। তাঁদের থমথমে মুখে একই সঙ্গে বেদনা আর একধরনের জেদ লক্ষ করা যাচ্ছিল। কখনও কখনও "বিপর্যয়" শব্দটি ইভার্সের মধ্যে বাস্তব রূপ নিয়ে হাজির হয়–তবে কিছুক্ষণের জন্য–খুব দ্রুত হাওয়ায় মিলিয়ে যায়, যেমন বুদবুদ রূপ নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফেটে যায়। তিনি বাড়ি যেতে চাইছিলেন। আবার ফার্নান্দের সঙ্গে, ছেলের সঙ্গে থাকতে চাইছিলেন। খোলা ছাদে স্ত্রীর সঙ্গে সময় কাটাতে চাইছিলেন।
কর্মশালা বন্ধ করার সময় হয়ে গিয়েছিল–ব্যালেস্টার আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করে সবাইকে তা জানিয়ে দিলেন। মেশিনগুলো থেমে গেল। কোনো রকম তাড়াহুড়ো না করে কারিগররা জ্বলতে থাকা আগুন নিভিয়ে, জিনিসপত্রগুলো গুছিয়ে ঠিক ঠিক জায়গায় রেখে একে একে লকার-রুমে চলে গেলেন। সৈয়দের অবশ্য এখনও ছুটি হয়নি। তাঁকে কর্মশালা পরিস্কার করতে হবে; ছড়িয়ে থাকা কাঠের গুঁড়ো আর ধুলাবালি ঝাঁট দিয়ে, জল ছিটিয়ে ধুইয়ে দিতে হবে।
ইভার্স যখন লকার-রুমে পৌঁছলেন, তিনি দেখতে পেলেন–বিশালকায় লোমশ এস্পোসিটো ঝরনার তলায় সশব্দে সাবান ঘষে ঘষে স্নান করছেন। যৌনাঙ্গ লুকিয়ে রাখার জন্য সবসময় বাইরের দিকে পিঠ করে স্নান করতেন তিনি। এই লাজুকতার জন্য সবাই তাঁর পেছনে লাগতেন। সত্যিই, বিরাট ভাল্লুেকের মতো তাঁর শরীর–যৌনাঙ্গ লুকিয়ে রাখার সে কী আপ্রাণ চেষ্টা। কিন্তু আজ কেউ তাঁর পেছনে লাগেননি, পেছনে লাগার কথা মনেও আসেনি।
স্নান সেরে গামছাটাকে ল্যাঙ্গোটের মতো করে জড়িয়ে বেরিয়ে এলেন এসপোসিটো। তারপর একে একে সব কারিগর স্নান করতে লাগলেন। মার্কো শরীরের বিভিন্ন অংশে চাতি মেরে মেরে স্নান করছিলেন। ঠিক তখন, চাতি মারার শব্দ ছাপিয়ে লোহার চাকা ঘোরার ঘর-ঘর শব্দ শোনা গেল। সঙ্গে সঙ্গে কারখানার গেট ধীরে ধীরে খুলে গেল। লাসাল ভিতরে এলেন।
যে পোষাকে প্রথমে এসেছিলেন সেটিই এখনও তাঁর পরনে। তবে চুল আগের মতো পরিপাতি বিন্যস্ত নয়। তিনি দোরগোড়ায় থামলেন; বিস্তীর্ণ ফাঁকা জনশূন্য কর্মশালার দিকে তাকালেন। তারপর কয়েক ধাপ এগিয়ে লকার-রুমের দিকে তাকালেন।
এস্পোসিটো ল্যাঙ্গোট পরে এদিক ওদিক টহল দিচ্ছিলেন; হঠাৎ লাসালের একদম মুখোমুখি হয়ে পড়লেন। অর্ধ-উলঙ্গ থাকায় লজ্জায় মাথা কাটা যাওয়ার মতো অবস্থা তাঁর। কখনো বাঁ পায়ে, কখনো অন্য পায়ে ভর দিয়ে হালকা টলতে টলতে অস্বস্তিকর অবস্থা থেকে বেরোনোর নিস্ফল চেষ্টা চালিয়ে গেলেন। মার্কোর কিছু বলা উচিত–ইভার্স এরকমটা ভাবছিলেন। কিন্তু মার্কো তখন ঝরনার জলের ধারার আড়ালে অদৃশ্য। এস্পোসিটো তাড়াহুড়ো করে শার্ট পরতে যাবেন, এমন সময় লাসাল উচ্ছাসহীন কণ্ঠে সবাইকে 'শুভ রাত্রি' জানালেন এবং ধীর পদক্ষেপে ছোট দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন। যতক্ষণ ইভার্স ভেবে উঠতে পারতেন যে কারোর তাঁকে ডেকে আনা উচিত, ততক্ষণে দরজা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
ইভার্স হাত পা না ধুয়েই পোষাক পরে নিলেন। তিনিও সবাইকে শুভ-রাত্রি বললেন, কিন্তু তাঁর অভিবাদন উচ্ছাসে ভরা। একই উচ্ছাসে সবাই তাঁকে শুভ-রাত্রি জানালেন। তিনি দ্রুত বেরিয়ে তাঁর সাইকেলটি নিলেন। প্যাডেলে চাপ দিতেই আবার পিঠে টান অনুভব করলেন। তিনি এখন পড়ন্ত বিকেলে ব্যস্ত শহরের মধ্য দিয়ে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছিলেন।
ছায়ায় ঘেরা প্রশস্ত রাস্তা ধরে তিনি জোরে জোরে সাইকেল চালাচ্ছিলেন–বাড়ি পৌঁছনোর খুব তাড়া। স্নান সেরে খোলা ছাদে বসে সমুদ্র দেখতে মন আকুল হয়ে উঠেছিল। যদিও সমুদ্র তাঁর ঠিক পাশে, তাও সেদিকে তাঁর কোনো খেয়াল নেই। সকালের ঔজ্জ্বল্য হারিয়ে সমুদ্র এখন অনেকটা ফিকে। অসুস্থ ছোট্ট মেয়েটিও তাঁর সঙ্গে, সমুদ্রের মতো তাকে মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারছিলেন না তিনি।
বাড়ি পৌঁছে ইভার্স দেখলেন, তাঁর ছেলে স্কুল থেকে ফিরে ছবির বই পড়ছে। তাঁর স্ত্রী ফার্নান্দ তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন সবকিছু ঠিক আছে কিনা। কোন উত্তর না দিয়ে তিনি স্নান সারতে চলে গেলেন; তারপর খোলা ছাদে ছোট্ট দেয়ালের সামনে রাখা একটা বেঞ্চে বসলেন; মাথার ওপর ঝুলছিল কাঁচা জামা-কাপড়। আকাশ ক্রমশ আরো স্বচ্ছ হয়ে উঠছিল। রাস্তার ওপারে সমস্ত কমনীয়তা নিয়ে সন্ধ্যার সমুদ্র ছড়িয়ে ছিল। ফার্নান্দ স্থানীয় মদের বোতল, দুটো গ্লাস এবং ঠান্ডা জলের জগ নিয়ে এলেন। স্বামীর পাশে বসলেন। ইভার্স তাঁকে আজকের পুরো ঘটনা খুলে বললেন। তিনি তাঁর স্ত্রীর হাত এমনভাবে ধরেছিলেন যেমনটি তাঁরা তাঁদের বিয়ের প্রথম দিনগুলিতে করতেন।
কথা শেষ করে তিনি স্থির একই জায়গা বসে রইলেন। তিনি সমুদ্রের দিকে তাকালেন; ইতিমধ্যেই, দিগন্তের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত, গোধূলি ঝুপ করে নেমে পড়েছিল। “আহ! এটা তার দোষ!” তিনি বলেছিলেন। যদি তিনি আবার তরুণ হতেন, এবং ফার্নান্দও, তাঁরা সমুদ্রের ওপারে অনেক দূরে চলে যেতেন।