ফুকো-পাঠে ক্ষমতা/প্রতিরোধ

লিখেছেন:বিপ্লব নায়ক
মিশেল ফুকোর তত্ত্ব ও বিশ্লেষণের গতিপথ ধরে যাজকীয় ক্ষমতা থেকে পারহেসিয়া অবধি একটি যাত্রা। একইসঙ্গে প্রতিরোধের রূপ-প্রকরণ-পরিসরের অস্তিত্ব ও সম্ভাবনাকে বুঝতে চাওয়া হয়েছে।

১। ক্ষমতা প্রসঙ্গে

মিশেল ফুকোর করা ক্ষমতার বিশ্লেষণ ইউরোপের ইতিহাস, বিশেষ করে ফ্রান্স সমেত পশ্চিম ইউরোপের ইতিহাস পাঠের উপর ভিত্তি করে নির্মিত। তা ফুকো সচেতনভাবেই করেছেন। তিনি কোনও ইতিহাস-বিযুক্ত, বিশেষ সমাজরূপ-বিযুক্ত বিমূর্ততার স্তরে তাঁর বিশ্লেষণকে উপস্থাপিত করতে চাননি। তাই ফুকোর ক্ষমতা-বিশ্লেষণকে পাঠ করার প্রস্তুতি হিসেবে প্রথমে l তাঁর এই বিশেষ ভিত্তির দিকটিতে নজর ফেলা যাক।

আদি বাইবেল-য়ে জনসমষ্টির রাজনৈতিক সংগঠনের দুটি ধাঁচার উল্লেখ পাওয়া যায়। একটি হল বাবিলনের প্রথম রাজা নিমরড-য়ের শাসনব্যবস্থা ও অপরটি হল ইজরায়েলের প্রথম গোষ্ঠীনেতা আব্রাহামের নেতৃত্বদানের যাজকীয় ব্যবস্থা। নিমরড মানুষ শিকার করে নিজ শাসনভুক্ত করে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন, নিজেকে ঈশ্বর বলে মনে করেন। অন্যদিকে, যেভাবে কোনও মেষপালক তার ভেড়ার পালের যত্ন নেয়, সেভাবে আব্রাহাম তঁার গোষ্ঠীর হিতসাধনায় কাজ করে যান ঈশ্বরের প্রতিস্পর্ধী হিসেবে নয়, বরং ঈশ্বরের আজ্ঞাবাহক হিসেবে। মানুষদের আটক করে, হিংসা ও হত্যার মধ্য দিয়ে ত্রাস সঞ্চার করে এবং নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করে কীভাবে নিজ পরিকল্পনামতো অপরদের কাজ করিয়ে নেওয়া যায় সেটাই নিমরডের পদ্ধতি। আটক করা মানুষদের বাধ্য করা হয় এমন এক নগরকাঠামো গড়ে তুলতে যা সেই মানুষদের কারাগারে পরিণত হয়। শাসকের অভিপ্রায় পূরণের জন্য সম্পদের এমন এক কেন্দ্রীভবন ও পুঞ্জীভবন তা ঘটায় যার শিখর স্বর্গকে ছুঁতে চায়। অন্যদিকে গোষ্ঠীনেতা ও গোষ্ঠীপালক আব্রাহাম তঁার গোষ্ঠীর প্রতিটি সদস্যকে ভালোবাসেন, প্রতিটি সদস্য সম্পর্কে খুঁটিনাটি খোঁজখবর রাখেন, প্রত্যেককে তিনি নাম ধরে সম্বোধন করেন, সকলের সামনে দাঁড়িয়ে উৎকৃষ্ট চারণভূমির সন্ধানে যাত্রায় নেতৃত্ব দেন, কোনও সদস্য আহত হলে তার ক্ষত নিজ হাতে শুশ্রুষা করেন, ক্লান্তদের নিজ কাঁধে বহন করেন, পথভ্রষ্ট হয়ে হারিয়ে যাওয়াদের খুঁজে বের করে আবার গোষ্ঠীতে ফিরিয়ে আনেন, দিনরাত এক করে প্রহরা দেন, নিজের প্রাণ বাজি রেখে নেকড়ের আক্রমণ থেকে গোষ্ঠীকে রক্ষা করেন।

শাসনপ্রণালীর এই বাইবেলীয় দুটি ধাঁচা শাসনের কু ও সু সম্পর্কে ধারণা নির্মাণ করে এসেছে দীর্ঘকাল। নিমরডের শাসন কুশাসন ও আব্রাহামের শাসন সুশাসন। একের বিপরীতে অপরটি স্থাপিত। ১৬৪০–১৬৫০ সালের ইংল্যান্ডের গৃহযুদ্ধের সময় ‘লেভেলারস’-দের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বিপ্লবী সাম্যবাদী আন্দোলন দেখা দিয়েছিল। সেই আন্দোলনের সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রচারক জন লিলবার্ন ১৬৪৯ সালে লেখা তাঁর প্রচারপুস্তকে সর্বাত্মক ক্ষমতার দাবিদার শাসক অলিভার ক্রমওয়েলের সমালোচনা করেছিলেন ‘ক্ষমতাশালী নরশিকারী নিমরড’-য়ের সঙ্গে তুলনার মধ্য দিয়ে। এর অনেক পরে ইউরোপে তথাকথিত আলোকপ্রাপ্তির যুগে জাঁ জাক রুশো তাঁর ‘এমিলি’ গ্রন্থে আলোচনা করেন হিংসা-সন্ত্রাসের বলে স্থায়ী আইনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা যায় কি না। তখনও তিনি এই হিংসা-সন্ত্রাসের শাসনের প্রথম উদাহরণ হিসেবে নিমরডের শাসনের উল্লেখ করেন। জন লিলবার্ন ক্রমওয়েলের শাসনের বিপরীতে মুক্ত মাানুষের সাম্যবাদী সমাজের কথা ভেবেছিলেন। রুশো ভেবেছিলেন হিংসা-সন্ত্রাস বিহীন এক সমাজে স্বাধীনভাবে সংগঠিত পারস্পরিক চুক্তির ভিত্তিতে সংগঠিত আইনের শাসন। নিমরড-ধাঁচার সন্ত্রাসী শাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তাঁরা সুশাসনের রূপ মূর্ত করতে চেয়েছিলেন।

মেষপালের সর্বহিতাকাঙ্খী পালনকর্তার আদলে তৈরি আব্রাহাম-সুলভ সুশাসনের ধারণা ও রূপ থেকেই ইউরোপে আধুনিক শাসনব্যবস্থার একটি মৌল উপাদান জন্ম নিয়েছে বলে মিশেল ফুকো চিহ্নিত করেছেন। সেই উপাদানটিকে তিনি ‘যাজকীয় ক্ষমতা’ (pastoral power) নাম দিয়েছেন। ফুকো-র বিশ্লেষণ থেকে যাজকীয় ক্ষমতার তিনটি বৈশিষ্ট্য উঠে আসে: প্রথমত, তা একটি গতিশীল বা পরিবর্তনশীল বিবিধতা-সম্পন্ন গোষ্ঠীর উপর প্রযুক্ত হয় (ভেড়ার পালের সঙ্গে তুলনীয়), দ্বিতীয়ত তা মূলগতভাবে সর্বহিতসাধনের অভিপ্রায় ঘোষণা করে (ভেড়ার পালের দেখভাল করার সঙ্গে তুলনীয়), আর তৃতীয়ত তা গোষ্ঠীর মধ্যের প্রতিটি ব্যক্তিকে ব্যক্তিপরিচয়ে আলাদা নজরে রাখে (পালের প্রতিটি মেষকে জানা ও নজরে রাখার সঙ্গে তুলনীয়)।

যাজকীয় ক্ষমতার বুনট ইউরোপের সমাজের উপর প্রথম বিস্তৃত হয়েছিল প্রাতিষ্ঠানিক খ্রিস্টান ধর্মের বিভিন্ন সমাজ-সম্পর্ক ও প্রতিষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। চার্চ-য়ের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও পদাধিকারীরা ঈশ্বরের প্রতিনিধি জনগণের দেখভালকারী মেষপালক হিসেবে রাজতন্ত্রের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্কবন্ধনে হাজির হয়েছিল। ‘কনফেশন’-য়ের মধ্য দিয়ে এই ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধির কাছে প্রতিটি ব্যক্তির নিজেকে ‘উন্মুক্ত’ রাখা ছিল রীতি। ‘কনফেশন’ নামক ক্রিয়া বহুস্তরবিশিষ্ট— এক স্তরে তা দোষস্বীকার বা পাপস্বীকার, আরেক স্তরে তা ‘স্বাভাবিকতা’ বলে চিহ্নিত আচরণ থেকে বিচ্যুতি স্বীকার, আরও এক স্তরে তা ব্যক্তিঅস্তিত্বের সমস্ত আড়াল তুলে দিয়ে মেষপালকের কাছে নিজেকে আত্মসমর্পণ করার মধ্য দিয়ে আশ্রয় প্রার্থনা। এই প্রকৌশলের মধ্য দিয়ে মেষপালক যেমন তার পালের প্রতিটি মেষ সম্পর্কে জানা ও নজর রাখার কাজ করতে পারে, তেমনই প্রতিটি মেষও স্বাভাবিকতার বিধিবদ্ধতার প্রতি অনুগত থেকে পালের নিারাপত্তাবলয়ের মধ্যে নিজেকে রাখতে পারে। সেই রোমান সাম্রাজ্যের শাসনবলয়ের মধ্যেই খ্রিস্টিয় ধর্মীয় পদাধিকারী কার্ডিনাল বেলারমাইন লিখেছিলেন:

নিজ দায়িত্বে থাকা পালকে রক্ষা করতে প্রতিটি মেষপালকের তিন ধরনের ক্ষমতা থাকা দরকার। প্রথমটি হল তার পালের ভেড়ীদের যাতে শিকার না করতে পারে তার জন্য নেকড়ের উপর ক্ষমতা। দ্বিতীয়টি হল যাতে ভেড়ীদের কোনওরকম ক্ষতি না করতে পারে তার জন্য ভেড়াদের উপর ক্ষমতা। আর তৃতীয়টি হল প্রয়োজনীয় চারণক্ষেত্র প্রদান করার জন্য সাধারণভাবে সমস্ত ভেড়া ও ভেড়ীদের উপর ক্ষমতা।

সুতরাং ঈশ্বরের কাছ থেকে মেষপালকের দায়িত্বপ্রাপ্ত চার্চের পদাধিকারীদের মনুষ্যগোষ্ঠীরূপী নিজ মেষপালকে রক্ষণাবেক্ষণ করতে হলে দস্তুরমতো যে ভূমিকা পালন করতে হবে তা হল: ১। সেই সমস্ত নেকড়ে-মানুষদের চিহ্নিত করতে হবে যারা তার পাল থেকে কোনও ভেড়ীকে শিকার করে নিয়ে যেতে পারে এবং সেই নেকড়ে মানুষদের উপর এমন নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে হবে বা এমনভাবে দমন করতে হবে যাতে তারা তাদের শিকারের কাজ চালাতে না পারে; ২। ভেড়াদের উপর এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ কায়েম রাখতে হবে যাতে ভেড়ীদের কোনও ক্ষতি তারা না করতে পারে; ৩। মনুষ্যরূপী ভেড়া ও ভেড়ীদের উপর এমন সাধারণ নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে হবে যা কাজকর্ম, আচরণ ও বিচরণের পরিসরগুলো চিহ্নিত করে দিয়ে স্বাভাবিকতার মাপ তৈরি করে দেয়। এই চিহ্নিত পরিসর ও স্বাভাবিকতার মাপের বাইরে যারা তারা নেকড়ে-মানুষ, আর তার বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার প্রবণতাধারীরা হল সংক্রামক রোগের বাহক ভেড়া। নেকড়ে-মানুষদের নিকেশ করতে হবে বা সমাজপরিসরের বাইরে নির্বাসিত করতে হবে, আর সংক্রামক রোগবাহকদের পাল থেকে বিচ্ছিন্ন করে হয় চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ-স্বাভাবিক করে তুলতে হবে আর তা সম্ভব না হলে রোগ ছড়ানো আটকাতে তাদেরও নিকেশ করতে হবে।

এই নেকড়ে-মানুষ ও রুগ্ন ভেড়ারাই ক্রমশ ‘হেরেটিক’ অর্থাৎ ধর্মদ্রোহী হিসেবে চিহ্নিত হয়ে রাষ্ট্র ও চার্চের যুগল আক্রমণের মুখে পড়েছিল। রোমান ক্যাথলিক ধর্মমতের বিরুদ্ধবাদীদের খুঁজে বের করে নিকেশ করার অভিযান ‘ইনকুইজিশন’-য়ের রূপ ধরে মধ্যযুগের ইউরোপে ছড়িয়ে পড়েছিল। তার অসংখ্য উদাহরণের মধ্য থেকে একটিকে দেখা যাক। ১৩২৯ সালে অধুনা ফ্রান্সের অন্তর্গত কারকাসোন অঞ্চলের অধিবাসী সিমোঁ রোলাঁ-কে ‘ইনকুইজিশন’-য়ের মুখে দাঁড় করানো হয় এই অভিযোগে যে পোপেরা বারবার যেসব ত্রুটি ও কু-প্রবণতাকে ধর্মদ্রোহের নামান্তর বলে চিহ্নিত করেছেন সেসব তঁার মধ্যে দেখা গেছে এবং সাবধান করে দেওয়ার পরও তিনি শুধরাননি। ‘ইনকুইজিশন’-য়ের বিচারের পর যে বিধান ঘোষিত হয় তা এইরকম:

আমরা, পিলফোর্ট, পামিয়েরস-য়ের বিশপরা ঈশ্বরের কৃপাবলে ঘোষণা করছি... সংক্রামক রোগবাহী ভেড়ার মতো পালের বাকি ভেড়াদের মধ্যেও তুমি রোগ ছড়িয়ে দিতে পার এই আশঙ্কায় আমরা তোমাকে অনমনীয় ধর্মদ্রোহী হিসেবে চিহ্নিত করছি এবং সেই হিসেবে সামাজিক আধিকারিকদের হাতে শাস্তিদানের জন্য তুলে দিচ্ছি।

জনসমক্ষে সবার সামনে উদাহরণ তৈরি করতে এই ধর্মদ্রোহীদের পুড়িয়ে অথবা পাথর ছুঁড়ে মেরে হত্যা করা হত। আর কার্ডিনাল বেলারমাইন তাঁর লেখায় ভেড়ীদের নিরাপত্তা নিয়ে বিশেষ উদ্বেগ প্রকাশ করলেও ধর্মদ্রোহী হিসেবে ‘ডাইনি’ আখ্যা দিয়ে অসংখ্য নারীকেও হত্যা করা হয়েছিল। মধ্যযুগের সেই ইতিহাস লিখতে গিয়ে বিশিষ্ট ফরাসি ইতিহাসকার জুল মিশেলেত লিখেছেন:

সেই নারী, যে প্রাচ্যে তার সিংহাসনে বসে মানুষকে লতাপাতার গুণাগুণ ও তারাদের গতিপথ সম্পর্কে জ্ঞান দিয়েছিল, সেই নারী, যে ডেলফির তেপায়া টেবিলের উপর আলোর ঈশ্বরের দ্যুতি গায়ে মেখে তার সামনে আনত বিশ্বকে দৈববাণী উপহার দিত, সেই নারীকেই হাজার বছর পরে জনতা বুনো জন্তুর মতো তাড়া করে শিকার করছে, বারোয়ারি আনাচেকানাচে তাকে ঢুঁড়ে বের করে অপমানিত করছে, সন্ত্রস্ত করছে, পাথর ছুঁড়ে মারছে, জ্বলন্ত কয়লার উপর নিক্ষেপ করে মারছে!

এই হতভাগীদের জন্য ধর্মগুরুদের জোগাড় করা জ্বালানী কাঠ, জনতার নিক্ষিপ্ত গালমন্দ আর বাচ্চা ছেলেপুলেদের ছোঁড়া পাথরও যেন কুলিয়ে উঠছে না। নিষ্ঠুরতমা বলে তকমা দিয়ে কবিও শিশুর মতো তার গায়ে আরও একটা পাথর ছুঁড়ে মারছে। কোনওভাবেই অবশ্য সর্বসময়ের জন্য সেই নারীকে বৃদ্ধা ও নোংরা-কুরূপা হিসেবে কল্পনা করা সম্ভব হচ্ছে না। ‘ডাইনি’ শব্দটি শুনলেই চোখের সামনে ‘ম্যাকবেথ'-য়ের ভীতিপ্রদ বৃদ্ধাদের ছবি ভেসে ওঠে। কিন্তু নিষ্ঠুর দমনপ্রক্রিয়া থেকে বিপরীত শিক্ষাই উঠে আসে— অসংখ্য নারীকে তারুণ্য ও সৌন্দর্যে উজ্জ্বল হওয়ার কারণেই মরতে হয়েছে।...

প্রকৃতির পুজারী এই নারীদের মধ্যে ধর্মগুরুরা কী বিপদ দেখতে পেয়েছেন, কী প্রতিযোগিতার আশঙ্কায় ভীত হয়েছেন যে এত ঘৃণা উগরে দেওয়ার আসর তঁারা বসিয়েছেন! অতীতদিনের ঈশ্বরদের থেকে এই নারীরা আলাদা ঈশ্বরদের কল্পনা করেছেন। অতীতদিনের শয়তানের নিকটবর্তী ভবিষ্যতের শয়তানকে আমরা এই নারীদের মধ্যে উদিত হতে দেখছি।৩

জুল মিশেলেত-য়ের ইতিহাসবর্ণনা থেকে আমরা দেখি যে এই তথাকথিত ডাইনিরা চার্চের দ্বারা অনুমোদিত নয় এমন প্রথাগত জ্ঞান (বিশেষ করে রোগ-জরা ও তার চিকিৎসা বিষয়ে) এবং জীবনাচরণ-বিশ্বাসমতের ভাণ্ডারী ও অনুশীলনকারী ছিল। চার্চ তার বেঁধে দেওয়া স্বাভাবিকতার পরিধি থেকে এইসব জ্ঞান-রীতি-চর্চাকে নির্মূল করার জন্যই ওই ভয়াবহ ডাইনিশিকার অভিযান পরিচালনা করেছিল।

এই নেকড়ে-মানুষ শিকার, সংক্রামক রোগবাহী ভেড়া শিকার ও ডাইনিশিকার কেবল ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে তাদের দমনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, গোষ্ঠীর মধ্যে যুদ্ধেরও রূপ নিয়েছিল। অধুনা ফ্রান্সের উত্তরাঞ্চল অধুনা ফ্রান্সের দক্ষিণাঞ্চলের বিরুদ্ধে ১৩ শতকের গোড়ায় এক রক্তক্ষয়ী ‘ক্রুসেড' অর্থাৎ ধর্মযুদ্ধ শুরু করেছিল যা প্রায় পাঁচ দশক জুড়ে চলেছিল। এই ধর্মযুদ্ধের ঘোষিত লক্ষ্য ছিল ‘ক্যাথার’ নামক ধর্মদ্রোহী জনগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করা। ক্যাথার নামে চিহ্নিত দক্ষিণের অধিবাসীরা রোমান ক্যাথলিক ধর্মমতের অনুসারী ছিল না, ধর্মমতের সঙ্গে সঙ্গে তারা ভাষা, সমাজরীতি ও জীবনাচরণেও আলাদা ছিল। এই পৃথকত্বই চিহ্নিত করা হল ধর্মদ্রোহ বলে। পাঁচ দশক জোড়া রক্তাক্ত যুদ্ধের পরে ক্যাথাররা নিশ্চিহ্ন হল, তাদের স্বাধীন অঞ্চল স্বাধীনতা হারিয়ে উত্তরের কাপেশিয়ান রাজার হস্তগত হল, রোমান ক্যাথলিক ধর্মের আধিপত্য নিরঙ্কুশ হল। আর তার সঙ্গে সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষদের গোটা সংস্কৃতিটাই লুপ্ত হল।

মধ্যযুগীয় ইউরোপের ইতিহাসপথে যাজকীয় ক্ষমতারূপের এই আত্ম-উন্মোচনপর্বে অপর বা বিরোধীকে চিহ্নিত করা (সেই অপর বা বিরোধী ব্যক্তিমানুষ হতে পারে, মনুষ্যগোষ্ঠী হতে পারে, আবার স্বাভাবিকীকরণের গণ্ডির বাইরের জ্ঞান-ধারণা-আচরণও হতে পারে) এবং তাকে নিশ্চিহ্ন বা সমাজ-বহির্ভূত করার শিকারী প্রক্রিয়া দেখিয়ে দেয় যে নিমরড ধাঁচার শিকার-মনোবৃত্তি ও সন্ত্রাসের মাধ্যমে শাসনের তথাকথিত বিপরীতটিও তার বহিঃস্থ কোনও উপাদান নয়, বরং সেই ‘বিপরীত’-টিকেও যাজকীয় ক্ষমতারূপ নিজমধ্যেই ধারণ করে। সর্বহিতাকাঙ্খী মেষপালক ও সন্ত্রাসী শিকারী পৃথক দুটি অস্তিত্ব নয়, একই অস্তিত্বের মধ্যে মিশে থাকে, পৃথক দুটি মুখ নয়, একই মুখের দুটি অভিব্যক্তি।

ক্রমশ যাজকীয় ক্ষমতা অনুশীলনের কৌশল ও পদ্ধতিতে পরিবর্তন ঘটেছে। সর্বহিতাকাঙ্খার বিষয়গুলিতে পরজাগতিক বিবেচনার চেয়ে ইহজাগতিক বিবেচনার গুরুত্ব বেড়েছে— স্বাস্থ্য, ধনসম্পদে সচ্ছলতা, দুর্ঘটনা-দুর্যোগ থেকে নিরাপত্তা গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হয়ে উঠেছে। তা কেন্দ্র করে চার্চের সঙ্গে সংযুক্ত ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানাদির জায়গায় একগুচ্ছ সামাজিক প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়েছে। এই সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষা, পরিবার-কল্যাণ, কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্যপরিষেবা প্রদান সংক্রান্ত নিয়ামকগুলোকে ধরে ব্যক্তি ও জনগোষ্ঠী সম্পর্কে তথ্যসংগ্রহ, স্বাভাবিকতার বিধি নির্মাণ ও আরোপ এবং অস্বাভাবিকতাকে চিহ্নিত করে তাকে সমাজবিচ্ছিন্ন করা ও নিকেশ করার কৌশল ও পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছে, প্রয়োগ করেছে। তার হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে জ্ঞান ও নৈতিকতার নতুন মাপকাঠি, নতুন প্রমিতকরণ। ফুকো দেখিয়েছেন যে আঠারো শতকে এসে যখন চার্চের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের জীবনীশক্তি খুইয়ে বসেছে, তখনই কিন্তু এই সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বুনট গোটা সমাজে ছড়িয়ে পড়ে যাজকীয় ক্ষমতারূপকে আগের যে কোনও সময়ের থেকে বহুগুণ বৃদ্ধি ও বিস্তার এনে দিয়েছে। এই নতুন আদলের বিস্তৃত ক্ষমতারূপকে ফুকো শৃঙ্খলাদায়ক ক্ষমতা (disciplinary power) নাম দিয়েছেন।

যাজকীয় ক্ষমতার উৎসরূপ থেকে শৃঙ্খলাদায়ক ক্ষমতায় বিকাশের পথে যে সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো মূল ভূমিকা পালন করেছে, তাদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে ফুকো পুলিশ নামক প্রতিষ্ঠানটিকে চিহ্নিত করেছেন। সতেরো শতকে ইউরোপে বিপুল সংখ্যক মানুষকে ‘দরিদ্র’, ‘অলস’ বা ‘ভবঘুরে’ হওয়ার জন্য আটক করা, বন্দি করে রাখা বা কর্তৃপক্ষ-নির্ধারিত কাজ করতে বাধ্য করার আয়োজন হয়। এলিজাবেথ-জমানার ইংল্যান্ডে তৈরি হওয়া দরিদ্র আইন (Poor Laws) ছিল এর সূচনা। ফ্রান্সেও ১৬৫৬ সালে প্রথম ‘সাধারণ হাসপাতাল’ (General Hospital) নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয় আটক করা দরিদ্র-অলস-ভবঘুরেদের একজায়গায় বন্দি করে রাখার জন্য। সমাজ ঢুঁড়ে তাদের আটক করে এনে হাসপাতালে বন্দি করার কাজ করার জন্য তৈরি হয় পুলিশ বাহিনী। জুল মিশেলেত এই সময়কার ফ্রান্সের ইতিহাস লিখতে গিয়ে লিখেছেন:

দরিদ্রদের শিকার করে আনা হতো। পুলিশ সমস্ত উপায় খাটিয়ে দরিদ্রদের ঢুঁড়ে বের করে আটক করে নিয়ে এসে জড়ো করত— কুখ্যাত সব অত্যাচারের মাধ্যমে সন্ত্রস্ত করে তোলাও এই সমস্ত উপায়ের অন্যতম ছিল।

পারি শহরে পোস্টার পড়েছিল যে ভিক্ষা করা নিষিদ্ধ, নিষেধাজ্ঞা অমান্যকারীদের চাবুক মেরে শাস্তি দেওয়া হবে। পরবর্তীকালে এই বরাদ্দ শাস্তির বদল ঘটেছিল। মহিলাদের নির্বাসিত করা হতো আর পুরুষদের ধরে নিয়ে গিয়ে রাজার বিভিন্ন জাহাজে বদ্ধ শ্রমিক হিসেবে খাটানো হতো। শহরের রাস্তায় ঘুরে ভিক্ষুকদের শিকার করার এই কাজও প্রধানত পুলিশের এক্তিয়ারভুক্ত ছিল।

দরিদ্র, অলস, ভবঘুরে বা ভিক্ষুকদের এভাবে অপরাধী বলে দেখার চোখ তখনও সমাজের সবার তৈরি হয়নি। বিশেষত যখন এই হতভাগ্যদের একটা বড় অংশই গ্রাম-গঞ্জ-শহরে তাদের প্রথাগত জীবন-জীবিকার উপায় থেকে উৎখাত হয়ে এই অবস্থায় উপনীত হয়েছে, তখন তাদের প্রতি সাধারণ মানুষদের এক ধরনের সহানুভূতিও ছিল। আর ভবঘুরে জীবনকে অনেকে আলাদা রকমের কিন্তু সম্মানীয় এক জীবনাচরণ বলেই দেখত। তাই অনেকে পুলিশের হাত থেকে এই হতভাগ্যদের আড়াল করার জন্য আশ্রয় দিত, পুলিশ গ্রেফতার করতে গেলে বাধা দিত। এমনকি পারি সহ বেশকিছু শহরে সাধারণ হাসপাতালের উপর দলবেঁধে হামলা চালিয়ে আটক করে রাখা মানুষদের মুক্ত করার চেষ্টাও হয়েছিল বেশ কয়েকবার। এই অবস্থায় পুলিশের হাত শক্ত করতে প্রশাসন থেকে পুলিশবাহিনীর সদস্যদের জন্য আলাদা ব্যাজ, হেলমেট, অস্ত্র ইত্যাদির ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তাছাড়া দারিদ্র্যের অবসান ঘটিয়ে উন্নত সমাজ গড়ার জন্য কেন এই দরিদ্র-অলস-ভবঘুরে-ভিখারীদের শিকার জরুরী, প্রশাসন কীভাবে হাসপাতালে তাদের খাওয়া জুগিয়ে বা কাজ করতে বাধ্য করে ‘উদার হৃদয়ের’ পরিচয় দিচ্ছে তা প্রচার করা হয়েছিল।

আঠারো শতকেও এই দরিদ্রশিকার চলছিল পুরোদমে:

১৭২৪ সালে রাজার জারি করা নির্দেশের পর একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি ঘটে চলেছিল বা আরও ভয়ানক দৃশ্য তৈরি হচ্ছিল... বিরাট বিরাট সব শিকার-অভিযান বিপুল সংখ্যক ভিখারী আর ভবঘুরেদের হাসপাতালে এনে জড়ো করছিল... পুরানো ঘিঞ্জি নোংরা হাসপাতালগুলোয় তাদের ঠেসে পোরা হচ্ছিল। কন্ট্রোলার জেনেরাল দোদুন হাসপাতালগুলোর সুপারিন্টেনডেন্টদের উদ্দেশ্যে নির্দেশিকা জারি করেছিলেন: ‘ওগুলোকে সব খড়ের উপর শোয়ার ব্যবস্থা কর, আর রুটি ও জল খেতে দাও, তাহলে আরও কম জায়গায় ওদের আঁটানো যাবে।’

ইউরোপের সমাজের এই দরিদ্রশিকারের পাশে রেখে আর একটি শিকারের কাজকেও আমাদের দেখতে হবে। তা হল এই ইউরোপিয় দেশগুলোরই প্রশাসনের পৃষ্ঠপোষকতায় সেই দেশগুলোর নাবিক-বণিকদের চালানো দাস-শ্রমিক শিকার। এই দ্বিতীয় শিকারটি চলছিল আফ্রিকায়, ক্যারিবিয় দ্বীপপুঞ্জে, উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকায় উপনিবেশ স্থাপনের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। এই প্রক্রিয়ায় সেই সমস্ত উপনিবেশের আদি জনজাতিদের হত্যা করা হয়েছিল, সম্পদ লুন্ঠন করা হয়েছিল এবং বিপুল সংখ্যক মানুষকে ইউরোপিয় উদ্যোগপতিদের অধীনে দাসশ্রমিক হিসেবে কাজ করতে বাধ্য করা হয়েছিল। কার্ল মার্কস এই প্রক্রিয়াকেই ‘পুঁজির আদিম পুঞ্জীভবন’ (Primitive accumulation of Capital) বলেছেন। বিপুল সম্পদ কেন্দ্রীভবনের পাশাপাশি এর মধ্য দিয়ে বিপুল মানুষের একটি শ্রমবাহিনী ও উদ্বৃত্ত শ্রমভাণ্ডার তৈরি করা হয়েছিল যা পশ্চিম ইউরোপে পুঁজিবাদ বিকাশের ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছিল।

ফুকো মনে করিয়ে দিয়েছেন যে আঠারো শতকে দরিদ্রশিকারের পাশাপাশি পুলিশের আরও কিছু করণীয় কাজ ছিল। সেগুলো হল: শহরে বিবিধ প্রাত্যহিক যোগানের কাজ, হস্তশিল্প ও বাণিজ্যে নির্ধারিত মান-ব্যবস্থা বজায় রাখার কাজ, ইত্যাদি। সুতরাং দরিদ্রশিকারের বিপুল কর্মসূচীর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে ছিল গোটা জনগোষ্ঠীকে শিল্পোৎপাদনের নয়া ব্যবস্থার প্রয়োজন ও চাহিদা অনুযায়ী গড়েপিটে নেওয়ার কাজ, সমাজজীবনকে এভাবে সাজিয়ে নেওয়ার কাজ যাতে শিল্পোৎপাদন প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন নির্দিষ্ট ভূমিকায় মানিয়ে নেওয়া ছাড়া সাধারণ মানুষের আর গত্যন্তর না থাকে। সমাজের এই গড়ে উঠতে থাকা ছকের বাইরে দাঁড়িয়ে অস্তিত্বযাপন করতে গেলেই তাকে শিকারের লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠতে হবে, ঠিক যেমন আগের যুগে ‘নেকড়ে-মানুষ’ বা ‘সংক্রামক রোগবাহী ভেড়া’-দের হতে হতো। এই বিবর্তিত যাজকীয় ক্ষমতারূপটি সমাজের আইনি বিধিব্যবস্থার থেকে পৃথকভাবে গড়ে উঠে একসময় তার সঙ্গে মিলে গেল। ফুকোর পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী:

ভবঘুরে, ভিখারী আর অলসদের ঢুঁড়ে শিকার করার এই পুলিশি বাছাই, বহিষ্কার ও বন্দি করার অনুশীলন বিচারবিধি ও আইনি চর্চাক্ষেত্রের বাইরে থেকে চলছিল।... তারপর উনিশ শতকের গোড়ায় এসে সামাজিক বাছাই প্রক্রিয়ার কার্যকরীকরণের এই পুলিশি ধাঁচা বিচারবিভাগীয় চর্চার মধ্যে অঙ্গীভূত করে নেওয়া হল কারণ নেপোলিয়ন-জমানার রাষ্ট্রে পুলিশ, বিচারব্যবস্থা ও কারা-প্রতিষ্ঠানগুলো পরস্পর সংযুক্ত হয়ে উঠেছিল।

শৃঙ্খলাদায়ক ক্ষমতার প্রকৌশলের বিকাশ ও সমাজজুড়ে মান্যতা পাওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল কুষ্ঠের মতো সংক্রামক রোগের মহামারী আটকানোর জন্য উদ্ভাবিত কৌশল। কুষ্ঠরোগীদের চিহ্নিত করে সাধারণজনের থেকে বিচ্ছিন্ন সাধারণ বসতি থেকে দূরে তাদের জন্য নির্দিষ্ট পৃথক এলাকায় নির্বাসিত করার কৌশল প্রয়োগের স্বার্থে এমন সব ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল যাদের মধ্য দিয়ে একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক অঞ্চলকে বিভিন্ন ভাগে ভেঙে নজরদারি ও তথ্যসংগ্রহ করা যায়, অধিবাসীদের প্রাত্যহিক জীবনের উপর তত্ত্বাবধান-তদারকি করা যায়, প্রতিটি অধিবাসীকে ব্যক্তিরূপে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, জীবনযাপনের খুঁটিনাটি নিয়েও সিদ্ধান্তগ্রহণের প্রক্রিয়াকে কেন্দ্রীভূত করে উচ্চতর কর্তৃপক্ষের এক্তিয়ারভুক্ত করা যায়। প্রকৃত বা কল্পিত নানা মহামারীর বিরুদ্ধে নিরাপত্তালাভের তাড়না থেকে মহামারী মোকাবিলার বিশেষ পরিস্থিতির উদ্ভাবন এই ব্যবস্থাগুলো ক্রমশ সাধারণ নাগরিক অভ্যাসে পরিণত হতে থাকে। ফুকোর ভাষায়:

একই সঙ্গে প্রকৃত ও কল্পিত নানা বিশৃঙ্খলার রূপ হিসেবে মহামারী এবং রোগনিয়ামক ও রাজনৈতিক শৃঙ্খলা পরস্পর সম্বন্ধযুক্ত হয়ে আসত। এই শৃঙ্খলাদায়ক কলকৌশলগুলোর পশ্চাদপটে অতিমারী, বিদ্রোহ, অপরাধ, ভবঘুরেবৃত্তি, বিতাড়ন-নির্বাসন, বিশৃঙ্খলার আবর্তে মানুষের আসা-যাওয়া বাঁচা-মরার অস্থির করে দেওয়া স্মৃতি বারবার ফিরে ফিরে আসত।...

কুষ্ঠরোগীদের সংক্রামক রোগের শিকার বলে গণ্য কর, তাদের আটকে রাখার জন্য তৈরি পৃথগাবাসের বিশৃঙ্খল পরিসরে শৃঙ্খলার সূক্ষ্ম খণ্ডীকরণ আরোপ কর, তার সঙ্গে যুক্ত কর ক্ষমতার জন্য যথাযথ বিশ্লেষণাত্মক বিস্তারণের পদ্ধতি, যাকে বাতিল করা হয়েছে বা বাদ দেওয়া হয়েছে, তাকে ব্যক্তিপরিচয়ে সীমাবদ্ধ কর, কিন্তু এই ছঁাটাই বা বাদ দেওয়ার প্রক্রিয়াকে চিহ্নিত করার জন্যই ব্যক্তিপরিচয়ে সীমাবদ্ধ করার প্রক্রিয়াগুলোকে ব্যবহার কর— শৃঙ্খলাদায়ক ক্ষমতা উনিশ শতকের গোড়া থেকে মনোরোগীদের হাসপাতালে, জেলখানায়, সংশোধনাগারে, অনুমোদিত বিদ্যালয়ে এবং কিছুটা মাত্রায় সাধারণ হাসপাতালে নিয়মিতভাবে এই কাজই করে এসেছে।

দুর্ভোগ ডেকে আনা ‘বিশৃঙ্খলা’ থেকে পরিত্রাণের উপায় হিসেবে শৃঙ্খলাদায়ক ক্ষমতা গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠে মান্যতা আদায় করে নিয়ে নানা সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বিস্তৃতিলাভ করে। তত্ত্বাবধায়ক কর্তৃপক্ষের নজরদারি দৃষ্টির সামনে সমাজের প্রতিটি আনাচ-কানাচ উন্মুক্ত করে দেওয়া, নিচ থেকে উপরে তথ্যের প্রবাহ ও উপর থেকে নিচে নির্দেশ-প্রত্যাদেশের প্রবাহ বজায় রাখা, নির্দেশপালন নিশ্চিত করা, ইত্যাদির প্রয়োজনে যে প্রকৌশল জন্ম নিয়েছিল তার একটি আদর্শ ধাঁচা হিসেবে ফুকো ১৭৯১ সালে জেরেমি বেন্থামের একটি প্রস্তাবকে উদ্ধার করে হাজির করেছেন। জেরেমি বেন্থামের এই প্রস্তাবটি প্রথম নজরে একটি স্থাপত্য-নকশা। বেন্থাম তার নাম দিয়েছিলেন ‘প্যানঅপটিকন’। নকশাটিতে প্রহরী ও প্রহরাভুক্তদের স্থানিক বিস্তারণের এক বিশেষ কৌশলের মধ্য দিয়ে অবিচ্ছিন্ন প্রহরাকে সহজ ও সম্ভব করে তুলতে চাওয়া হয়েছে। বৃত্তাকার একটি পরিসরের কেন্দ্রে নজরদারি-মিনার, যেখানে প্রহরী অবস্থান করবে। আর বৃত্তটির পরিধি বরাবর এক সারি কুঠুরি, যেখানে প্রহরাভুক্তরা অবস্থান করবে। পাশাপাশি কুঠুরিগুলো একে অপরের থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন, এক কুঠুরি থেকে অন্য কোনও কুঠুরি দেখা যায় না। কুঠুরির দুই দেওয়ালে, বৃত্তের বাইরের দিকে ও বৃত্তের ভিতরের দিকে, দুটি খোলা জানালা যা দিয়ে আলোর যাতায়াত কুঠুরির মধ্য দিয়ে অবারিতভাবে চলতে পারে ও তার ফলে কেন্দ্রস্থ নজরদারি মিনারের জানালা থেকে কুঠুরির মধ্যের ব্যক্তির সমস্ত চলাচল প্রহরীর চোখে ধরা পড়ে। নজরদারি মিনারের জানালাগুলো এমনভাবে নির্মিত যে ভিতর থেকে বাইরে দেখা যায়, কিন্তু বাইরে থেকে ভিতরে দেখা যায় না। অর্থাৎ, প্রহরীরা সবকটা কুঠুরির প্রহরাভুক্তদের দেখতে পেলেও, কোনও কুঠুরি থেকেই মিনারের ভিতরটা দেখা যাবে না। সুতরাং মিনারে দৈহিকভাবে কোনও প্রহরী উপস্থিত না থাকলেও প্রত্যেক প্রহরাভুক্তই ভাবতে থাকবে যে প্রহরী হয়ত উপস্থিত আছে এবং তার উপরই নজর রাখছে। এই বোধ থেকে প্রহরাভুক্ত বাস্তব প্রহরীর অনুপস্থিতিতেও তার উপস্থিতি বোধ করতে থাকবে এবং নিজের উপর নিজে থেকেই শৃঙ্খলা আরোপ করে রাখবে। জেরেমি বেন্থাম এই নকশাকে কেবল অপরাধীদের উপর নজর রাখার জন্য জেলখানার স্থাপত্য হিসেবে ভাবেননি। চিকিৎসাকেন্দ্রে রোগীদের উপর নজর রাখা, কারখানায় শ্রমিকদের উপর নজর রাখা, সরকারী নির্দেশ বলবৎ করতে প্রশাসকের দ্বারা সাধারণ নাগরিকদের উপর নজর রাখা— এমন সমস্ত নজরদারিই কম লোক দিয়ে ও কম খরচে করার সাধারণ উপায় হিসেবে তিনি এই প্রস্তাবটি রেখেছিলেন। ফুকোর মতে, প্যানঅপটিকন হল:

অনুশীলনের একটি সাধারণিকরণযোগ্য ধাঁচা, মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের সাপেক্ষে ক্ষমতাসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করার একটি উপায়।... ক্ষমতার কলকৌশলকে একটি নকশাচিত্রের মাধ্যমে এখানে একটা আদর্শ রূপে হাজির করা হয়েছে।... আসলে এটা হল রাজনৈতিক প্রকৌশলের এমন এক সাধারণ বিমূর্ত চিত্র যা তার বিশেষ মূর্ত ব্যবহারগুলি থেকে বিযুক্ত করেই ধরতে হবে।...বহুদিকে বহুভাবে এর প্রয়োগ ঘটতে পারে।

বেন্থামের নকশাচিত্রের হুবহু অনুকরণ করে কোনও জেলখানা-হাসপাতাল-কারখানা-বিদ্যালয় তৈরি না হলেও এই নকশাকে ঘিরে চিন্তা-ভাবনা-আলোচনা-অনুশীলন সেইসব প্রকৌশলগুলোর উদ্ভব ও প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করেছে যাদের মধ্য দিয়ে প্রাত্যহিক নাগরিক জীবনের উপর অবিচ্ছিন্ন প্রশাসন ও নিয়ন্ত্রণ সম্ভবপর হয়ে উঠেছে। ফুকোর পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী:

দুটো ধাঁচার মধ্যে বিরোধ থেকে বিভিন্ন ধরনের এক সারি দ্বন্দ্ব উৎপন্ন হয়েছিল: ধর্মীয় দ্বন্দ্ব (ধর্মান্তরকরণকেই কি সংশোধনের মূল উপাদান হতে হবে?), অর্থনৈতিক দ্বন্দ্ব (কোন পদ্ধতিতে খরচ সবচেয়ে কম?), চিকিৎসাগত দ্বন্দ্ব (প্রহরাভুক্তদের প্রত্যেককে একে অপরের থেকে ও অন্যদের থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে রাখলে তা কি তাদের মানসিক রোগীতে পরিণত করবে?), স্থাপত্যগত ও প্রশাসনিক দ্বন্দ্ব (সবচেয়ে নিশ্ছিদ্র নজরদারি কোন ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে নিশ্চিত করা যেতে পারে?)। সন্দেহ নেই যে এইজন্যই বিতর্ক অত প্রলম্বিত হয়েছিল। কিন্তু সেই বিতর্কের কেন্দ্রস্থলে বিরাজ করে যা তাকে চালিত করছিল, তা হল আটক করে রাখার সেই বনেদি অভিপ্রায়, যা হল: কর্তৃপক্ষের তদারকির মধ্যে থেকে ঘটছে না বা উচ্চাবচ ধাপবন্দি কাঠামো অনুযায়ী সাজানো নয় এমন সমস্ত সম্পর্কে দাঁড়ি টেনে বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিকে জোর করে গণ্ডির মধ্যে বেঁধে রাখা।

উচ্চাবচ ধাপবন্দি কাঠামো অনুসারী নির্ধারিত সম্পর্কের গণ্ডিতে ব্যক্তি-অস্তিত্বকে বেঁধে জীবনাচরণকে নিরাপদ, স্বাভাবিক ও ফলপ্রসূ বলে যত প্রতিষ্ঠা করা গেছে, শৃঙ্খলাদায়ক ক্ষমতা ততই নতুন নতুন পরিসর অধিকার করে সর্বাত্মক হয়ে উঠেছে।

ধ্রুপদী রাজতন্ত্রে ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা রাজা ও রাজন্যবর্গই ছিল উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত হয়ে সর্বদৃশ্যমান। পরম সার্বভৌম ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবে ইহজগতের সার্বভৌম রাজার অধিকার (প্রজাদের পালনের অধিকার এবং একইসঙ্গে প্রয়োজনবোধে বধেরও অধিকার) নির্ধারণই ছিল জ্ঞানের বিষয়। প্রজারা ছিল আলোকবৃত্তের বাইরে ছায়াচ্ছন্ন পৃথগীকরণ-অযোগ্য এক পিণ্ড। শৃঙ্খলাদায়ক ক্ষমতার পরিসর এর ঠিক বিপরীত। এখানে ক্ষমতার কেন্দ্রস্থিত প্রহরী-কর্তৃপক্ষ ছায়াচ্ছন্ন মিনারে দৃষ্টির অগোচর। তীব্র আলো অবিচ্ছিন্ন দৃশ্যমানতায় ভাস্বর করে রাখতে চায় প্রহরীভুক্ত জনতাকে। পিণ্ডরূপে নয়, ব্যক্তি হিসেবে প্রত্যেককে তার অস্তিত্বের প্রতিটি মুহূর্তের বিশেষত্ব দিয়ে চিহ্নিত করে রাখতে চায়। সেইজন্য সমস্ত বিষয়ে সমস্ত সময়ে তথ্যসংগ্রহ, তথ্যের সারণিবদ্ধকরণ, তথ্যবিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে নিরন্তর সূক্ষ্ম থেকে আরো সূক্ষ্ম বিভাজিকা রেখা টেনে বস্তুর বিভাজন এবং সেই বিভাজন অনুযায়ী তদারকি-নজরদারি-পরিচর্যার পৃথক ব্যবস্থাপনা তৈরির মধ্য দিয়েই এখন জ্ঞানচর্চার গতিপথ পাতা। জ্ঞানের বিষয়ী মানুষ, জ্ঞানের বিষয়ও মানুষ। জনতাকে ব্যক্তি-অস্তিত্বে বিচ্ছিন্ন করা ও নজরদারির অন্তর্গত করার রাজনৈতিক প্রকৌশলগুলোর অগ্রগতি ঘটল এই রাজনৈতিক সমস্যাটিকে রাজনৈতিক প্রতর্কের গণ্ডির বাইরে নিয়ে গিয়ে বিজ্ঞানের তথাকথিত নিরপেক্ষ প্রতর্কের অন্তর্ভুক্ত করার মধ্য দিয়ে। উনিশ শতকের শুরুতে ইউরোপে গড়ে ওঠা নতুন ধরনের হাসপাতাল-জেলখানা-সংশোধনাগারগুলো অপরাধ, অপরাধ-মানসিকতা ও অপরাধী বিষয়ে একটি জ্ঞানশাখা নির্মাণের গবেষণাগার হয়ে উঠল। বৈজ্ঞানিক মনস্তত্ত্ববিদ্যার জন্ম হল এর মধ্য দিয়ে। আর রাজনৈতিক সমস্যাটি পরিণত হয়ে গেল প্রশিক্ষিত বিশেষজ্ঞদের বৈজ্ঞানিক নির্ধারণের বিষয়ে। নির্ণয় করা হল যে হাসপাতাল-জেলখানা-সংশোধনাগারে বন্দি মানুষরা বিভিন্ন ধরনের ‘অস্বাভাবিকতা’-র শিকার, তাদের স্বাভাবিকীকরণের জন্য চিকিৎসা বা সংশোধন-প্রচেষ্টা চালাতে হবে ‘বৈজ্ঞানিক’ মতে। ব্যক্তি-অস্তিত্বে বিচ্ছিন্ন করে নজরদারির মধ্যে বন্দি করে রাখার বিবিধ বিধানের ‘অস্বাভাবিকতা সংশোধনের’ ক্ষেত্রে ব্যর্থতা যখনই প্রকট হয়ে উঠত, তখনই আরো কড়া বিচ্ছিন্নতা ও আরো কড়া নজরদারি সংশোধনী হিসেবে প্রস্তাবিত হতো। ফুকোর পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী:

সাধারণ চিকিৎসা ও মনোরোগ চিকিৎসায় স্বাভাবিকতার তদারকি করার চর্চা গেঁড়ে বসল যা ওই স্বাভাবিকতা-আরোপকে এক ধরনের বৈজ্ঞানিকতার চরিত্র দান করল। বিচারবিভাগও এর সমর্থনে আইনি যুক্তি তৈরি করে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তার সহায় হল।১০

সুস্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও সম্পদবৃদ্ধির জন্য আদর্শ ‘বৈজ্ঞানিক’ ব্যবস্থা হিসেবে এক নিরপেক্ষ নৈর্ব্যক্তিকতার পোষাকে শৃঙ্খলাদায়ক ক্ষমতার আদ্যন্ত রাজনৈতিক চেহারাটি ঢাকা পড়ল। তার ফলে ‘রাজা/রাজন্য— প্রজা’ বা ‘যাজক— শরণাগতের’ মতো গুটিকয় স্পষ্ট সম্পর্কের বদলে অসংখ্য স্পষ্ট বা অস্পষ্ট, সুগঠিত বা জায়মান সম্পর্করাজির রূপ ধরে শৃঙ্খলাদায়ক ক্ষমতা কাজ করতে থাকে। সরকার/প্রশাসন— জনতা, কর্তৃপক্ষ— সভ্য/সদস্য, ব্যবস্থাপক— কর্মী, চিকিৎসক— রোগী, শিক্ষক— ছাত্র এমন তুলনামূলক স্পষ্ট সম্পর্কগুলোর সাথে জড়িয়ে বা গায়ে-গায়ে লেগে থাকে তুলনায় অস্পষ্ট বিবিধ সম্পর্ক, যেমন: বিশেষজ্ঞ— সাধারণজন, জ্ঞানোৎপাদক— জ্ঞানগ্রাহী, প্রশিক্ষিত— প্রশিক্ষণহীন, অগ্রসর— পশ্চাৎপদ, সুস্থ— রোগগ্রস্ত, স্বাভাবিক— অস্বাভাবিক, ইত্যাদি। ক্ষমতার চর্চা এখানে কেবল একটি বা কয়েকটি নির্ধারক সম্পর্কের গ্রন্থিপথ ধরে প্রবাহিত হয় না, বহুবিধ ও বহুবিক্ষিপ্ত গ্রন্থিপথ ধরে প্রবাহিত হয়ে এক বিস্তৃত জালের চেহারা নেয়। সেই জালের বুনট হয়ত বিশেষ কিছু প্রতিষ্ঠান বা কাঠামোর (যেমন, রাষ্ট্র, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান) নিকটাঞ্চলে বেশি ঘন ও আঁটো হয়ে ওঠে, কিন্তু সর্বত্রই তা প্রসারিত থাকে। এমনকি প্রহরাভুক্ত মানুষদের মগজও তার বাইরে থাকতে পারে না। প্যানঅপটিকন নকশার কুঠুরির বাসিন্দারা প্রহরীমিনারে প্রহরী উপস্থিত না থাকলেও ভাবতে থাকে যে প্রহরীর চোখ তার উপর রয়েছে, ফলে নিজেই নিজেকে শৃঙ্খলার বাঁধনে বেঁধে রাখে। এখানে প্রহরীভুক্তের ব্যক্তিসত্ত্বার একটি খণ্ডিত অংশই কি প্রহরীর কাজ করে না? প্রহরী কি প্রহরীভুক্তের অন্তঃস্থ হয়ে যায় না? সেভাবেই শৃঙ্খলাদায়ক ক্ষমতার পরিসরের মধ্যে বিশেষজ্ঞ জ্ঞান বা বিজ্ঞান কি আমাদের মগজের মধ্যে বসেই প্রহরা চালিয়ে যায় না? ফলে ক্ষমতাধর ও ক্ষমতাহীন এমন সহজ কোনও বিভাজনকে অসম্ভব করে দেওয়ার মধ্য দিয়ে এই ক্ষমতারূপ সহজ কোনও দ্বিপাক্ষিক বৈরিতার পথ ধরে তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধকে অকার্যকরী করে তোলে।

আঠারো শতকের শেষদিক ও উনিশ শতকের গোড়া থেকে শৃঙ্খলাদায়ক ক্ষমতার সাধারণ কাঠামোর মধ্যেই আরেক ক্ষমতারূপের উদ্ভব ফুকো চিহ্নিত করেছেন। জনসংখ্যা-বিস্ফোরণ ও পুঁজিবাদী শিল্পায়নের গতি এমন এক ক্ষমতার চাহিদা জন্ম দিয়েছিল যা কেবল ব্যক্তির ব্যক্তি-অস্তিত্বকে শৃঙ্খলায়িত করবে না, সমষ্টিগতভাবে জনসমষ্টিকেও নজরদারি, স্বাভাবিকীকরণ ও প্রমিতকরণের প্রক্রিয়ার মধ্যে বাঁধতে পারবে। সেই ক্ষমতারূপকে ফুকো ‘জৈবক্ষমতা’ (Biopower) নাম দিয়েছেন। এই ক্ষমতারূপ এমন কিছু প্রকৌশল জারি করার মধ্য দিয়ে সক্রিয় হল যা ব্যক্তির দেহের স্বতন্ত্রীকরণ করে তার উপর প্রযুক্ত হওয়ার বদলে সাধারণ জৈবিক প্রক্রিয়াসমূহের উপর প্রযুক্ত হল। জন্ম-মৃত্যুর মধ্য দিয়ে জৈবিক উৎপাদন-পুনরুৎপাদন, সামাজিক উৎপাদন প্রক্রিয়ার অঙ্গীভূত করে জনসমষ্টিকে উৎপাদিকা শক্তি হিসেবে রক্ষণাবেক্ষণ করা— এহেন জৈবিক প্রক্রিয়াসমূহের ব্যবস্থাপনার আশু লক্ষ্য নিয়ে তা হাজির হল। রাষ্ট্রীয় স্তরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান, গণকল্যাণ তহবিল, বীমা-প্রতিষ্ঠান ইত্যাদির মতো একগুচ্ছ রাষ্ট্রীয় স্তরের নিচেরতলার সামাজিক প্রতিষ্ঠান দ্রুত বংশবিস্তার করে এই ক্ষমতারূপের প্রবাহপথের জাল সমাজজুড়ে ছড়িয়ে দিল। জন্মহার, মৃত্যুহার সহ গণস্বাস্থ্যের নানা সূচক ও উৎপাদিকা হার পরিমাপের নানা সূচক তৈরি করে তার সাপেক্ষে নিরন্তর তথ্যসংগ্রহের পরিসংখ্যানগত কাজ, তা বিশ্লেষণ করে সাধারণ গতি নির্ণয়, ‘বৈজ্ঞানিক’ পূর্বাভাস ঘোষণা, নির্ধারিত সমষ্টিগত লক্ষ্যের সঙ্গে তার তুলনা করে বৈজ্ঞানিক বিধানপত্র রচনা ও সমষ্টির স্তরে সেই বিধান প্রয়োগ করার উপায় উদ্ভাবন— এর মধ্য দিয়ে জ্ঞানের বিষয় ও রূপও নতুনভাবে নির্ধারিত হল। এককথায় বললে, শৃঙ্খলাদায়ক ক্ষমতাকাঠামোর মধ্যেই এমন এক জৈবিক ও রাষ্ট্রিক কাঠামো স্ফূরিত হল যা জৈবিক নিয়ামকের কাজ করতে পারে।

ইউরোপে জৈবিক প্রক্রিয়াসমূহের উপর নজরদারি, নিয়ন্ত্রণ ও প্রমিতকরণের এই ক্ষমতারূপ প্রতিষ্ঠার সঙ্গে যুগপৎভাবে সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে বিবর্তনবাদ প্রধান হয়ে উঠল। ব্যক্তি হিসেবে দেখার চেয়ে প্রজাতি হিসেবে দেখার উপর জোর পড়ার পাশাপাশিই বিবর্তনবাদ এমন এক তত্ত্বকাঠামো হাজির করল যেখানে বিভিন্ন প্রজাতিকে বৈচিত্র্য ও পার্থক্যের আনুভূমিক বিস্তারে না দেখে ক্রমবিকাশের উচ্চাবচ ধাপবন্দি কাঠামোর উল্লম্ব বিস্তারে ফেলে দেখাই মান্যতা পেল। ক্রমবিকাশের প্রায় সরলরৈখিক ধারায় অগ্রগতির বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন প্রজাতি অবস্থিত ধরে নিয়ে অগ্রগামিতা-পশ্চাৎপদতার একটি ক্রমবিন্যস্ত সারণি নির্মিত হল। নির্মিত সেই সারণি অনুযায়ী ইউরোপের প্রধান জনগোষ্ঠীগুলো ও তাদের সমাজব্যবস্থা সবচেয়ে অগ্রগামী আর বাকি গোটা বিশ্বের বিবিধ বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠী ও তাদের সমাজব্যবস্থাগুলো সবই পিছিয়ে পড়া, অবিকশিত বা বিকাশ-অর্জনে ব্যর্থ। এর সঙ্গে যুক্ত ছিল বিভিন্ন প্রজাতিদের মধ্যে অস্তিত্বরক্ষার সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তুলনায় কম সমর্থ প্রজাতিদের বিনাশ ও অগ্রবর্তীদের আধিপত্যের মধ্য দিয়ে ‘প্রাকৃতিক বাছাই প্রক্রিয়া’ সম্পন্ন হওয়ার তত্ত্ব। ফলে ইউরোপের প্রধান জাতিগুলোর উপনিবেশ বিস্তারের হিংস্র অভিযান, আমেরিকা মহাদেশের আদি মানবগোষ্ঠীদের হত্যা করে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া, আফ্রিকা মহাদেশ জুড়ে হত্যা বা দাসে পরিণত করার ভয়ংকর অভিযান, অস্ট্রেলিয়া ও এশিয়া মহাদেশে ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠা ও এই সবের মধ্য দিয়ে পৃথিবী জুড়ে মানবসমাজের বিবিধ রূপের বৈচিত্র্য ও পার্থক্যকে দুরমুশ করে নিজেদের সমাজরূপ-সংস্কৃতির একরঙা বিবর্ণ আকিঞ্চনতায় সবকিছু ঢেকে দেওয়ার প্রক্রিয়া সবই ‘প্রাকৃতিক বাছাই প্রক্রিয়া’ হিসেবে এক বৈজ্ঞানিক নৈর্ব্যক্তিকতা-নিরপেক্ষতার মুখোশ পরে নিল। অপর সমস্ত বৈচিত্র্য ধ্বংস করে নিজ আধিপত্য প্রতিষ্ঠার এক নিদারুণ রাজনৈতিক প্রতর্ক মুখোশ পরে জীববিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞানের সাধারণ প্রতর্ক হিসেবে মর্যাদার আসন দখল করল।

ইউরোপের নিজের সমাজের মধ্যেও প্রজাতিগত ধাপবন্দি কাঠামো নির্মাণের এই জৈবক্ষমতাগত কৌশল গভীর ছাপ ফেলল। তার একটি বড় উদাহরণ হিসেবে আমরা ইহুদিবিদ্বেষের রূপান্তরকে দেখতে পারি। ইহুদিবিদ্বেষের ইতিহাস অনেক পুরানো। বিদ্বেষপোষণকারীরা তাদের বিদ্বেষের কারণ হিসেবে সেই পুরাকালে যিশুর সময়ে ইহুদিদের ধর্মীয়-রাজনৈতিক ভূমিকা বা আরও সম্প্রতিতে তাদের করসংগ্রাহক বা সুদখোর মহাজন হিসেবে ভূমিকার দিকেই আঙুল তুলত। কিন্তু উনিশ ও বিশ শতকে এই ইহুদিবিদ্বেষের রূপ পাল্টে গেল। ইহুদিরা যা করে বা সমাজে ইহুদিদের যা ভূমিকা, তা এখন আর ইহুদিবিদ্বেষের প্রধান কারণ নয়, এখন একজন ইহুদি যে ভূমিকাই পালন করুক না কেন, কেবলমাত্র ইহুদি হওয়ার জন্যই সে বিদ্বেষের পাত্র। অর্থাৎ, সে ব্যক্তিগতভাবে কী, বা সে কী করে বা করেছে, তার জন্য নয়, তার প্রজাতিগত পরিচয়ের জন্যই সে বিদ্বেষের পাত্র। আর প্রজাতিগতভাবে চিহ্নিত বিদ্বেষের পাত্র জনগোষ্ঠীকে নির্মূল করতে হবে প্রজাতিগতভাবেই— যে ভাবনা তার চূড়ান্ত রূপে পৌঁছেছিল জার্মান নাজিদের পরিকল্পিত ‘অন্তিম সমাধান’-য়ে সমস্ত ইহুদিদের হত্যা করার প্রকল্পের মধ্য দিয়ে। সোভিয়েত রাশিয়াতেও স্তালিনি শাসনে তাতার, চেচেন, জার্মান, ইউক্রেনিয়, ইহুদি ইত্যাদি বিভিন্ন অ-রুশ জনজাতির মানুষদের বাসভূমি থেকে বলপূর্বক উচ্ছেদ করা, নজরবন্দি শিবিরে জড়ো করা ও সন্ত্রাসে বেঁধে রাখার মধ্য দিয়ে এর রূপ আমরা দেখেছি। বিশ শতকে আবির্ভূত হওয়া সর্বাত্মকতাবাদী (totalitarian) রাষ্ট্রের এই দুই রূপ— ফ্যাসিবাদী রূপ ও কম্যুনিস্ট রূপ— বিদ্বেষী জাতিবাদকে তার চূড়ান্ত সীমায় নিয়ে গিয়ে প্রকাশ করেছিল, কিন্তু তার মানে এই নয় যে অন্যান্য ইউরোপিয় রাষ্ট্ররূপগুলো বিদ্বেষী জাতিবাদ থেকে মুক্ত ছিল। বরং উদারনৈতিক থেকে সর্বাত্মকতাবাদী সবধরনের রাষ্ট্রগুলোই জাতিরাষ্ট্র হিসেবে জৈবক্ষমতার প্রকৌশলসমূহ অনুশীলনের মধ্য দিয়ে বিদ্বেষী জাতিবাদকেই তার ভিত্তি করেছিল। এর হাত ধরেই ভিনদেশী শ্রমিকদের প্রতি বিদ্বেষ, অপর ধর্মগোষ্ঠীর প্রতি বিদ্বেষ, উদ্বাস্তু সমস্যা ও উদ্বাস্তু-বিদ্বেষ, রাষ্ট্রহীন ত্রিশঙ্কু জনগোষ্ঠীর উদ্ভব ও তাদের প্রতি বিদ্বেষ নতুন চেহারা নিয়ে দেখা দিয়েছে ও ক্রমাগত তীব্র হয়ে উঠেছে। কোনও অঞ্চলের অধিবাসীদের বা শরণার্থীদের নাগরিকত্ব পরিচয় নির্ধারণ করা বা খণ্ডন করা, চিহ্নিত অ-নাগরিকদের তাড়িয়ে দেওয়া বা প্রাণে মেরে ফেলা যে কোনো রাষ্ট্রের ‘স্বাভাবিক’ অধিকার হয়ে উঠেছে। ‘জাতীয়’ জীবনের উন্নতি ও অগ্রগতির যুক্তির বাঁধনে রাষ্ট্র এই কাজে তার ‘আইনি নাগরিকদের’ সমর্থন ও অংশগ্রহণও নিশ্চিত করে তুলতে পারছে। ফুকোর পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী:

একদিকে রয়েছে এই ধারণা যে রাষ্ট্র তার নিজস্ব প্রকৃতি ও নিজস্ব চরমাবস্থার অধিকারী। অন্যদিকে আছে এই ধারণা যে মানুষ যে মাত্রায় উদ্বৃত্ত শক্তি উৎপাদন করে, যে মাত্রায় সে একটি জীবিত, কর্মরত ও বাঙ্ময় জীব, যে মাত্রায় সে একটি সমাজের অংশ এবং যে মাত্রায় সে একটি নির্দিষ্ট পরিবেশের মধ্যের একটি জনসমষ্টির অংশ, সেই মাত্রাতেই সে রাষ্ট্রের ক্ষমতার প্রকৃত বিষয় হয়ে ওঠে। এই দুই ধারণার মধ্য থেকে ব্যক্তি-মানুষের জীবনে রাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান হস্তক্ষেপ ঘটতে আমরা দেখি। এই ধরনের রাজনৈতিক ক্ষমতার সমস্যাবলীতে জীবন ক্রমশ আরও গুরুত্বের স্থান পেতে থাকে; তার ফলাফল হিসেবে সবচেয়ে সূক্ষ্ম রাজনৈতিক প্রকৌশলের সাহায্যে মানুষের এক ধরনের পাশবিকীকরণ সম্পন্ন করা হয়। মানববিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান-গুলোর সম্ভাবনা যেমন বিকশিত হতে থাকে, পাশাপাশি তেমনই জীবনরক্ষার সম্ভাবনা ও গণহত্যা সংঘটনের সম্ভাবনা যুগপৎভাবে ইতিহাসের মঞ্চে আবির্ভূত হয়।১১

জৈবক্ষমতা ও তৎসংযুক্ত বিদ্বেষী জাতিবাদ কেবলমাত্র রাষ্ট্রের শাসন-নিপীড়ন চালানোর একটি জোরালো হাতিয়ার নয়, গণস্তরে প্রতিটি মানুষের আত্মপরিচয়নির্মাণ ও অপরের সঙ্গে সম্পর্ক নির্ধারণের ক্ষেত্রে তা একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক। এই প্রসঙ্গে ইহুদিনিধনের যুক্তি হিসেবে হিটলারের করা একটি উক্তিকে সামনে রেখে আলোচনা করা যাক। উক্তিটি হিটলার করেছিলেন অন্তরঙ্গ মহলে, তাঁর সহকর্মীদের কাছে। উক্তিটি এইরকম:

ইহুদিদের নিছক অস্তিত্বটাই ধ্বংসাত্মক প্রকৃতির। বহু ইহুদি নিজেরা এ সম্পর্কে সচেতন নয়। কিন্তু কেউ যদি জীবনকে ধ্বংস করে, তাহলে সে নিজেই নিজেকে মৃত্যুর হাতে তুলে দেয়, তাই ইহুদিদের ক্ষেত্রেও এখানে কোনও ব্যতিক্রম হবে না। বিড়াল যখন ইঁদুর ধরে খায়, তখন বিড়াল বা ইঁদুর কাউকেই কি কোনও দোষ দেওয়া যায়?১২

এখানে একটি জনগোষ্ঠীর, অর্থাৎ ইহুদিদের, কোনও কাজ বা ভূমিকাকে চিহ্নিত করার প্রয়োজন পড়েনি, তাদের অস্তিত্বটাকেই সমাজ-সভ্যতা ও জীবনের জন্য ধ্বংসাত্মক হিসেবে বিপজ্জনক বলে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং সেই জন্য তারা নিজেই নিজেদের মৃত্যুর কারণ বলে ঘোষণা করে দেওয়া হয়েছে। একেবারে জৈবক্ষমতার ছঁাচে তৈরি কথা। তার পরের কথাটি আরও চমকপ্রদ। এখানে ইহুদিদের ইঁদুরের সঙ্গে আর ইহুদি-শিকারীদের বিড়ালের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। ইঁদুর-শিকার যেমন বিড়ালের জৈবিক প্রবণতা, ইহুদি-শিকারও তেমন জার্মানদের জৈবিক প্রবণতা, তাই এই নিয়ে কোনও নীতি-নৈতিকতার বিচার অর্থহীন! এহেন মনোভাবকে কেবলমাত্র হিটলার-সুলভ বা ফ্যাসিবাদ-সুলভ বলে গণ্য করা ঠিক হবে না, কারণ হিটলার-পতনের পরও বহু স্বঘোষিত অ-ফ্যাসিবাদী বা ফ্যাসিবাদবিরোধীও এই চোখেই তাঁদের অপরকে দেখেন। সেই অপর ইহুদি হওয়ার বদলে কখনও ‘সন্ত্রাসবাদী’, কখনও ‘দেশদ্রোহী’, কখনও মুসলিম, আবার কখনও নেহাতই কোনও সংখ্যালঘু বা অপর জনগোষ্ঠীর মানুষ। জৈবক্ষমতার যুক্তি অপরকে ধ্বংস করা বা হত্যা করাকে এমন এক স্বাভাবিক জৈবিক প্রক্রিয়া হিসেবে তুলে ধরে যার মধ্য দিয়ে নিজ জনগোষ্ঠীর জীবন ও সভ্যতার জীবনীশক্তিকে আরও তেজিয়ান করে তোলা যায়, নাছোড় সমস্যাগুলোর মূল উপড়ে ফেলা যায়। এই রূপ ধরে জৈবক্ষমতার যুক্তিপ্রণালী জ্ঞান ও কাণ্ডজ্ঞান হিসেবে শাখা বিস্তার করে।

ক্ষমতার এই বিভিন্ন রূপ— সার্বভৌম ক্ষমতা, যাজকীয় ক্ষমতা, শৃঙ্খলাদায়ক ক্ষমতা, জৈবক্ষমতা— বিশ্লেষণ করার সময় ফুকো প্রতিটি রূপেরই উদ্ভব ও বিকাশকে চিহ্নিত করতে চেয়েছেন, কিন্তু তিনি কোনও বিবর্তনমূলক ধারায় তাদের বাঁধেননি, সেই ভাবে কোনও বিবর্তনমূলক ধারা তৈরির তিনি বিরোধীও বটে। বর্তমান সময়ের ইউরোপিয় ঘরানার সমাজের দিকে তাকালে আমরা জৈবক্ষমতা ও শৃঙ্খলাদায়ক ক্ষমতার প্রাধান্য দেখতে পেলেও যাজকীয় ক্ষমতা ও সার্বভৌম ক্ষমতার বিভিন্ন রূপকেও খুঁজে পাব। অর্থাৎ, বিষয়টি এমন নয় যে বিবর্তনের ধারায় একটি ক্ষমতারূপ আরেকটি ক্ষমতারূপ দ্বারা প্রতিস্থাপিত হচ্ছে। বরং এভাবে দেখা যেতে পারে যে বিবর্তন ও বিকাশের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ক্ষমতার বুনট আরও ঠাসবুনট হচ্ছে, আরও জটিল হচ্ছে।

এহেন জটিল, ঠাসবুনট ক্ষমতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধের প্রশ্নটাকে তাহলে আমরা কীভাবে দেখব? ফুকোই বা কীভাবে দেখেছেন? এবার আলোচনা সেইদিকে ঘোরানো যাক।

২। প্রতিরোধ প্রসঙ্গে

ফুকোর একটি সংহত সূত্রায়ণ সামনে রেখে এই প্রসঙ্গে আলোচনা শুরু করা যাক। ফুকোর মতে:

যেখানে ক্ষমতা, সেখানেই প্রতিরোধ। তবু, বা বলা ভালো, সেইজন্যই, ক্ষমতার সাপেক্ষে প্রতিরোধ কখনই বহিঃস্থ নয়। তার মানে কি এই যে সর্বদাই ক্ষমতার ‘অভ্যন্তরে' থাকতে হয়, তাকে ‘এড়ানোর’ কোনও পথ নেই, তার সাপেক্ষে ‘বহিঃস্থ’ বলে কিছু হয়না কারণ যে কোনও অবস্থাতেই তার নিয়মের অধীন থাকতে হয়? বা, এমনটা কি বলতে হবে যে, যুক্তিবন্ধনের ছল যেমন ইতিহাস, ইতিহাসের ছল তেমন ক্ষমতা, শেষাবধি সর্বদাই সে জয় হাসিল করে? কিন্তু তা হলে তো ক্ষমতা-সম্পর্কগুলোর কঠোরভাবে সম্পর্ক-সাপেক্ষ চরিত্রকে ভুল বোঝা হবে। ক্ষমতা-সম্পর্কের প্রতিপক্ষ, সহায় ও বাঁটের ভূমিকা পালন করে যে প্রতিরোধ-বিন্দুর বহুত্ব, তার উপর ক্ষমতা-সম্পর্কের অস্তিত্ব নির্ভরশীল। ক্ষমতার জালের সর্বত্রই এহেন প্রতিরোধবিন্দু বর্তমান। সুতরাং মহান ‘প্রত্যাখ্যানের’ কোনও একমেবাদ্বিতীয়ম গতিপথ নেই, নিটোল সত্ত্বা বিশিষ্ট এমন কোনও বিদ্রোহ থাকতে পারে না যা সমস্ত বিদ্রোহের উৎস হিসেবে কাজ করতে পারে, নেই বিপ্লবের কোনও খাঁটি নিয়ম। তার পরিবর্তে আছে প্রতিরোধসমূহের বহুত্ব। প্রতিটি প্রতিরোধ একটি বিশেষ ঘটনা: সম্ভবপর প্রতিরোধ, প্রয়োজনীয় প্রতিরোধ, সম্ভাবনাহীন প্রতিরোধ; প্রতিরোধ যেগুলো স্বতঃস্ফূর্ত বা অপরিশীলিত বা নিঃসঙ্গ বা কয়েকজনের দ্বারা পরিকল্পিত বা অনিয়ন্ত্রিত বা হিংসাত্মক; আবার অন্যতর প্রতিরোধ যেগুলো আপসমুখী বা স্বার্থচালিত বা আত্মবলিদানমুখী; সংজ্ঞার্থে তারা কেবল ক্ষমতা-সম্পর্কের কৌশলক্ষেত্রের মধ্যেই অস্তিত্বধারণ করতে পারে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে এগুলো শুধুমাত্র এমনই প্রতিক্রিয়া বা ছিটকে ওঠা যা শেষ বিচারে বুনিয়াদী আধিপত্যের সাপেক্ষে নিষ্ক্রিয়তাসর্বস্ব ও পরাজয়-নিশ্চিত এক তলদেশ তৈরি করে। হাতে গোনা কয়েকটা অসমসত্ত্ব নীতি থেকে প্রতিরোধ উদ্ভূত হয়না, আবার এমন কোনও প্রলোভন বা অঙ্গীকার থেকেও হয়না যা বাধ্যতামূলকভাবেই অধরা থাকবে। ক্ষমতার সাপেক্ষে প্রতিরোধ হল বেজোড় পদ; ক্ষমতার মধ্যে লঘুকরণ-অসম্ভব বিপরীত হিসেবে তারা আকীর্ণ। আর সেজন্যই প্রতিরোধের বিন্যাস নিয়মহীন: সময় ও পরিসরের জমিতে প্রতিরোধের বিন্দু, গ্রন্থি ও অধিশ্রয়ণগুলো পরিবর্তনশীল ঘনতায় ছড়ানো, সময়বিশেষে তা ব্যক্তিবর্গ বা গোষ্ঠীদের কোনও এক সুনির্দিষ্ট পন্থায় সংহত করে, কোনও নির্দিষ্ট দেহবিন্দু বা জীবনমুহূর্ত বা আচরণাবলীকে প্রজ্জ্বলিত করে তোলে। তাহলে কি কোনও মহান বিপ্লবী ভাঙন হতে পারে না, হতে পারে না কোনও বিপুল দ্বি-বিভাজন? কখনও কখনও হতে পারে। কিন্তু বেশিরভাগ সময়েই যা ঘটে তা হল প্রতিরোধের অস্থিতিশীল ও ক্ষণস্থায়ী বিন্দুসমূহ, যেগুলো সমাজে ফাটল তৈরি করে, ফাটলগুলো অনবরত অবস্থান পাল্টাতে পাল্টাতে প্রতিষ্ঠিত ঐক্যে ভাঙন ধরায় ও নিত্যনতুন গোষ্ঠীগঠন ঘটায়, ব্যক্তির নিজের মধ্যেও গর্ত খুঁড়ে, টুকরোয় কেটে আবার পুনর্গঠন করে দেহে ও মনে লঘুকরণ-অসম্ভব অঞ্চল চিহ্নিত করে দিয়ে যায়। ক্ষমতা-সম্পর্কের জাল যেমন বিশেষ যন্ত্রাদি বা প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে আসলে সীমাবদ্ধ না হয়েও বহমানতায় তাদের মধ্যে নিবিড় বুনটের রূপ ধারণ করে, রাষ্ট্র যেভাবে ক্ষমতা-সম্পর্কগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক সংহতকরণের উপর নির্ভর করে, ঠিক তেমনই প্রতিরোধের বিন্দুগুলোর ঝঁাক সামাজিক স্তরবিন্যাস ও ব্যক্তিদের ঐক্য পেরিয়ে বহমান থাকে। আর সন্দেহ নেই যে এহেন প্রতিরোধের বিন্দুগুলোর কৌশলী সংহিতাকরণ বিপ্লবকে সম্ভব করে তোলে।১৩

ফুকোর উপস্থাপনার এই ঘন সংবদ্ধ রূপের অন্তর্গত কিছু কিছু দিককে একটু ছড়িয়ে মেলে দেখা যাক। প্রথমত ক্ষমতার জটিল ঠাসবুনট বুনন সমাজব্যাপী হওয়ার মানে এই নয় যে প্রতিরোধ অসম্ভব বা প্রতিরোধের পরিসর ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে। বরং ঠিক তার বিপরীতটাই ফুকোর বক্তব্য। ক্ষমতা যতটা ব্যাপ্ত, প্রতিরোধও ততটাই ব্যাপ্ত: যেখানে ক্ষমতা, সেখানেই প্রতিরোধ। কিন্তু প্রতিরোধকে তিনি ক্ষমতার সাপেক্ষে বহিঃস্থ বলে মনে করেন না। অর্থাৎ, ক্ষমতার বাইরে থেকে ক্ষমতার বিরোধকারী কোনও বস্তু প্রতিরোধ নয়। এই খণ্ডনের মধ্য দিয়ে ফুকো আসলে ক্ষমতা ও প্রতিরোধ সম্বন্ধে বহুপ্রচল একটি ধারণাকে খণ্ডন করতে চাইছেন, যে ধারণাকে তঁার ‘যৌনতার ইতিহাস’ বইয়ে তিনি ‘অধিকারক্ষেত্রীয়-প্রতার্কিক’ (juridico-discursive) ধারণা বলে আখ্যাত করেছেন।১৪ ফুকোর ধারণাকে বোঝার জন্য যে ধারণাকে তিনি খণ্ডন করছেন তাকে প্রথমে বোঝা যাক।

এই ধারণামতে ক্ষমতা এমনকিছু যা বাধা, দমন ও নিষেধাজ্ঞার মধ্য দিয়ে কাজ করে। প্রকৃত বাস্তবতাকে সে আড়াল করতে চায়, স্বতঃস্ফূর্ততায় বেড়ি পড়াতে চায়, সত্যের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে মিথ্যাকে জাহির করতে চায়, জ্ঞানের উৎপাদন বন্ধ করতে বা অন্তত বিকৃত করতে চায়। আর এর মধ্য দিয়ে ক্ষমতা স্বাভাবিক আকাঙ্ক্ষাকে অবদমন করে, মিথ্যা বা কৃত্রিম চেতনা জাগায়, জ্ঞানহীনতার পৃষ্ঠপোষণা করে। সত্য-স্বাভাবিকতা-স্বতঃস্ফূর্ততা ক্ষমতার প্রতিপক্ষ, তাই অবদমন-নিষেধাজ্ঞা অস্বীকার করে সত্যকে তুলে ধরা, সত্যকে প্রতিষ্ঠা করাই হল প্রতিরোধ।

এই ধারণায় ক্ষমতা ও প্রতিরোধকে একটি নঙর্থক><সদর্থক বিরোধের মধ্য দিয়ে দেখা হয়। ক্ষমতা নঙর্থক কারণ তা সত্য, জ্ঞান, স্বতঃস্ফূর্ততার অবদমনকারী বা খণ্ডনকারী, আর প্রতিরোধ সদর্থক কারণ তা সত্য, জ্ঞান, স্বতঃস্ফূর্ততাকে বাধামুক্তভাবে প্রতিষ্ঠা করে। এই অর্থেই প্রতিরোধ ক্ষমতার বহিঃস্থ বস্তু, তার অস্তিত্ব ক্ষমতার বিপরীতে পৃথক বা আলাদা।

কিন্তু ক্ষমতা সম্পর্কে ফুকোর বিশ্লেষণ থেকে আমরা দেখি যে ক্ষমতাকে কেবলমাত্র এই নঙর্থক অস্তিত্ব দিয়ে দেখা ঠিক নয়। ক্ষমতা কেবলমাত্র সত্য, জ্ঞান ও স্বতঃস্ফূর্ততাকে অবদমন বা খণ্ডন করে না, তা সত্য, জ্ঞান ও স্বতঃস্ফূর্ততা উৎপাদনও করে। একটি প্রতর্কের সত্যাসত্য বিচার করার পদ্ধতি ও দৃষ্টিভঙ্গি, জ্ঞানের বিষয় কী হবে এবং কাকে জ্ঞান বলে স্বীকার করা হবে, কোন প্রবৃত্তিগুলোকে স্বাভাবিক বলে ধরা হবে ও সেই সূত্রে স্বতঃস্ফূর্ততা বলে কাকে মান্যতা দেওয়া হবে— এই সবই ক্ষমতাসম্পর্ক দ্বারা প্রভাবিত হয়। যাজকীয় ক্ষমতা, শৃঙ্খলাদায়ক ক্ষমতা ও জৈবক্ষমতা— ক্ষমতার সবকটা রূপের অধীনেই এই সত্য, জ্ঞান ও স্বতঃস্ফূর্ততা উৎপাদনের নিজস্ব প্রকৌশলসমূহ ও প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। সুতরাং সত্য, জ্ঞান ও স্বতঃস্ফূর্ততার প্রতর্ক হাজির করা, তা যতই প্রতিস্পর্ধী হোক না কেন, তাকে আমরা একলপ্তে ক্ষমতাবলয়ের বাইরের একটি ক্রিয়া হিসেবে ধরে নিতে পারি না। বরং তা ক্ষমতাবলয়ের মধ্যে, ক্ষমতাসম্পর্কের মধ্যস্থতায়, ক্ষমতার প্রকৌশল ব্যবহারের মধ্য দিয়েই সম্পাদিত একটি কাজ। ক্ষমতা কেবল অবদমন ও নিষেধাজ্ঞা আরোপের মধ্য দিয়ে কাজ করে না, নিরাপত্তা, সমৃদ্ধি ও উৎপাদনশীলতা সৃষ্টির মধ্য দিয়েও কাজ করে, মান্যতা তৈরি করে। একটি আধিপত্যবাদী প্রতর্ক আরোপ করার মধ্য দিয়ে কেবল নয়, বহু পরস্পরবিরোধী প্রতর্কের প্রতিস্থাপনের মধ্য দিয়েও সে কাজ করে (যেমন জৈবক্ষমতা জীবনকে নিরাপত্তা দেওয়া ও গণহত্যা সংঘটিত করার পরস্পরবিরোধী প্রতর্ককে যুগপৎভাবে ব্যবহার করে)। প্রতিরোধ তাই ক্ষমতার বহিঃস্থ নয়। প্রতিরোধ ও ক্ষমতা এমনভাবে কুস্তির প্যাঁচে পরস্পরের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে যা নব নব কৌশল উদ্ভাবনের পথে একে অপরকে উত্তেজিত, উৎসাহিত করতে থাকে। ক্ষমতার জাল জুড়ে প্রতিরোধবিন্দু ছড়িয়ে থাকে।

ক্ষমতা ও প্রতিরোধকে একে অপরের বাইরে ও একে অপরের বিরোধী হিসেবে স্থাপনের আর একটি তাৎপর্য থাকে। অবদমনকারী, নিষেধাজ্ঞা-আরোপকারী ক্ষমতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে অবদমিত সত্যটিকে উপলব্ধি ও উদ্ধার করে তুলে ধরছেন যিনি, তিনি সর্বজনীন পথপ্রদর্শক হিসেবে ক্ষমতার বাইরে ও প্রতিরোধের ভিতরে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি সত্যদ্রষ্টা বুদ্ধিজীবী হিসেবে, প্রতিরোধের নেতা হিসেবে ক্ষমতাধিপত্য-মুক্ত এক ভবিষ্যতে পৌঁছানোর পথ সাধারণজনের সামনে হাজির করছেন ও সেই পথে সাধারণজনকে শামিল করছেন। প্রতিরোধের সদর্থক বলয়ের মধ্যে তিনি প্রধান পুরুষ। এই প্রধান পুরুষের ভূমিকায় কোনও দার্শনিক থাকতে পারে, রাজনীতিবিদ থাকতে পারে, আবার কোনও বিপ্লবী মতবাদ বা মতবাদ-চালিত বিপ্লবী পার্টিও থাকতে পারে। তার মধ্য দিয়ে এই প্রতিরোধের বলয়েও একটি ধাপবন্দি কাঠামো তৈরি হয় যেখানে সর্বোচ্চ ধাপে স্থিত এই প্রধান পুরুষের কাছে নিচের ধাপে স্থিত সাধারণজনকে প্রতিরোধের স্বার্থে আত্মসমর্পণ করতে হয়। এই ধাপবন্দি কাঠামোও তার স্বকীয় শৃঙ্খলাদায়ক ক্ষমতার জন্ম দেয়। শৃঙ্খলাদায়ক ক্ষমতার সমস্ত প্রকৌশল (যেমন, বিপ্লবী শৃঙ্খলার সংহিতাকরণ, শৃঙ্খলা ও মতবাদের শুদ্ধতা রক্ষার্থে নজরদারি, শৃঙ্খলাভ্রষ্ট বা মতবাদভ্রষ্টদের শাস্তিদান বা বিতাড়ন, ইত্যাদির বিভিন্ন প্রকৌশল) এই ধাপবন্দি কাঠামোর উপর থেকে নিচ অবধি সমস্ত সম্পর্ককে নিয়ন্ত্রণ করে। এভাবে ক্ষমতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার বদলে একটি ঠাসবুনট ক্ষমতার ক্ষেত্রই তৈরি হয়।

এভাবে প্রতিরোধের নামে ক্ষমতার অপর একটি ঠাসবুনট ক্ষেত্র গড়ে তোলাকে প্রতিরোধ করতেই ফুকো বলেছেন যে মহান ‘প্রত্যাখ্যানের’ কোনও একমেবাদ্বিতীয়ম গতিপথ নেই, নিটোল সত্ত্বা বিশিষ্ট এমন কোনও বিদ্রোহ থাকতে পারে না যা সমস্ত বিদ্রোহের উৎস হিসেবে কাজ করতে পারে, নেই বিপ্লবের কোনও খাঁটি নিয়ম। অর্থাৎ প্রতিরোধের বিন্দুগুলোকে কোনও মতবাদ বা মহান নেতৃত্বের নেতৃত্ব দিয়ে দৃঢ় বন্ধনে বেঁধে অপর একটি ধাপবন্দি ক্ষমতার ক্ষেত্রনির্মাণ তিনি নাকচ করতে চেয়েছেন। তার পরিবর্তে তিনি জোর দিয়েছেন প্রতিরোধবিন্দু বা প্রতিরোধমুহূর্তগুলোর বহুত্ব ও বিবিধতার উপর, সাধারণ কোনও নিয়মে যে তাদের বাঁধা যায় না তার উপর এবং ক্ষমতাসম্পর্কের কৌশলক্ষেত্রের মধ্যে তাদের লঘুকরণ-অযোগ্যতার উপর। এহেন প্রতিরোধবিন্দুগুলোর কৌশলী সংহিতাকরণের মধ্য দিয়েই বিপ্লব সম্ভব হয় বলে ফুকো মনে করেন, কিন্তু সেই সংহিতাকরণের কৌশল আবশ্যিকভাবেই শৃঙ্খলাদায়ক ক্ষমতা বা জৈবক্ষমতার প্রকৌশলের অনুকরণ বা অনুগমন হলে হবে না।

এখানে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক খেয়ালে আনা যেতে পারে। তা হল সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন ও জৈবক্ষমতার মধ্যে যোগাযোগ সম্বন্ধে ফুকোর কিছু মন্তব্য। তিনি এই মন্তব্যগুলো করেছিলেন ১৯৭৬ সালে কলেজ-দি-ফ্রঁাস-য় জৈবক্ষমতা বিষয়ে বক্তৃতার মধ্যে।১৫ সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন উনিশ শতকের শেষভাগে তার সামরিক যুদ্ধকৌশল নির্ধারণের ক্ষেত্রে আঠারো শতক থেকে বিকশিত ও প্রতিষ্ঠিত জৈবক্ষমতার কলকৌশলগুলোকে কোনোরকম পূনর্মূল্যায়ন না করেই স্বয়ংসিদ্ধ রূপে গ্রহণ করেছিল বলে তিনি বলেছিলেন। একের বিরুদ্ধে এক পরিস্থিতিতে সম্মুখসমরে প্রতিপক্ষকে মোকাবিলা করা, দৈহিক লড়াই করা, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রতিপক্ষকে হত্যার চেষ্টা, ইত্যাদির যৌক্তিকতা ও কৌশল নির্মাণের ক্ষেত্রে যুদ্ধের অধিকার, খুনের অধিকার, ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকরী করার অধিকার সম্বন্ধে যে ধারণা ও কৌশলগুলোকে ব্যবহার করা হয়েছিল তা জৈবক্ষমতাবলয়ের বিদ্বেষী জাতিবাদের ধারণা ও কৌশলগুলোরই পুনরাবৃত্তি। ব্লাঁকিবাদ, কম্যুন ও নৈরাষ্ট্রবাদকে এই বিচারে তিনি জাতিবাদী চরিত্রের বলে চিহ্নিত করেছেন। সমাজতন্ত্রের মধ্য দিয়ে অর্থনৈতিক অবস্থার যে রূপান্তরসাধনের (মালিকানা ব্যবস্থার রূপান্তর, উৎপাদন ও বন্টন সম্পর্কের রূপান্তর) কথা বলা হয় তার জন্য বিদ্বেষী জাতিবাদের প্রয়োজন হয় না অথচ লক্ষ্য অর্জনের জন্য সামরিক কৌশল নির্ধারণে বিদ্বেষী জাতিবাদ নির্মিত কৌশল আঁকড়ে ধরে জাতিবাদী এক ক্ষমতাক্ষেত্রে প্রবেশ করা হয়। উনিশ শতকের শেষভাগের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন সম্পর্কে ফুকোর এই সমালোচনা বিশ শতকে সর্বাত্মকতাবাদী রাষ্ট্রের চেহারা নেওয়া সোভিয়েত রাশিয়া ও তার অনুগামীদের পথটিকে বিচার করার ক্ষেত্রেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে আরও গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন এর মধ্য দিয়ে উঠে আসে। যুদ্ধের অধিকার, খুনের অধিকার, ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকরী করার অধিকারের যৌক্তিকতা ও কৌশল নির্ধারণ করাকে যেভাবে ফুকো জৈবক্ষমতাবলয়ের বিদ্বেষী জাতিবাদের কৌশলের চিন্তাহীন পুনরাবৃত্তি বলেছেন, তার মধ্য দিয়ে কি ফুকো আদপে হিংসাকে রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে ব্যবহার করা নিয়েই প্রশ্ন তুলে দিচ্ছেন না? প্রতিরোধের কৌশল হিসেবে হিংসাকে গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে জৈবক্ষমতার যুগে কেবলমাত্র প্রতিরোধের নামে অপর একটি ক্ষমতাক্ষেত্রই নির্মাণ করা হয়, এমন একটি ধারণাতেই কি আমরা পৌঁছে যাচ্ছি না? এইদিক থেকে হানা আরেন্ট-য়ের রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে হিংসা সম্পর্কে বিশ্লেষণের১৬ খুব কাছাকাছি মনে হয় ফুকো অবস্থান করছেন। সেই অবস্থানটি হল: রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে হিংসাবলম্বনের পথ নিজ চরিত্রগুণেই এমন কিছু ক্ষমতাসম্পর্ক আরোপ করার মধ্য দিয়ে কাজ করে, যে ক্ষমতাসম্পর্কগুলো প্রতিষ্ঠিত ক্ষমতার প্রকৌশলসমূহের প্রসারণের নতুন দরজা খুলে দেয়।

এই সমস্ত বিবেচনা ফুকোর ভাবনাকে এমন একটা জায়গায় নিয়ে গেছে যেখান থেকে তিনি ক্ষমতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধকে কোনও মতবাদ বা কোনও অলঙ্ঘনীয় নীতি চালিত দৃঢ়বদ্ধ আন্দোলনের রূপে না দেখে একটি ‘জীবনযপনের শিল্প’ হিসেবে দেখতে চেয়েছেন। দেল্যুজ ও গুয়াতারির ‘অ্যান্টি-ঈদিপাস’ বইয়ের ভূমিকা লিখতে গিয়ে ১৯৭৬ সালে তাই তিনি লেখেন:

...ইতিমধ্যে বর্তমান বা ক্রম আসন্ন সমস্ত ধরনের ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধাচরণ করে জীবনযাপনের শিল্পকে আমি কয়েকটি আবশ্যকীয় নীতির সঙ্গে যুক্ত বলে সারসংকলন করব:

  • একমেবাদ্বিতীয়ম হওয়ার দাবি করে এমন সব ধরনের সর্বাত্মকতার ভ্রম-বাতুলতা থেকে রাজনৈতিক ক্রিয়াকে মুক্ত কর।
  • নিয়ত বিস্তারলাভ, অপরাপরকে পাশাপাশি স্থাপন করা ও পৃথককরণের মধ্য দিয়ে ক্রিয়া, ভাবনা ও কামনাকে বিকশিত কর। অধীনস্থের শৃঙ্খলে বিন্যাস বা পিরামিডের চেহারার ধাপবন্দি কাঠামো পরিহার কর।
  • আইন, সীমা, নির্বীজকরণ, অভাব, ছায়া-গহ্বর ইত্যাদির মতো পুরানো নঙর্থক প্রতীতি, যেগুলোকে এতাবধিকাল ক্ষমতার একটি রূপ ও বাস্তবকে পাঠ করার উপায় হিসেবে পবিত্র জ্ঞান করা হয়েছে, তাদের প্রতি বশ্যতা কাটিয়ে ওঠ। সদর্থক ও বহুত্বব্যঞ্জক প্রতীতি পছন্দ কর, দৃঢ়নির্মিত কাঠামোর বদলে গতিশীল ব্যবস্থাপনা পছন্দ কর। বিশ্বাস কর যে যা সৃজনশীল তা যাযাবরী চরিত্রের, তা কখনই স্থাণু হতে পারেনা।
  • এমনটা ভেব না যে মিলিটান্ট হতে গেলে দুঃখী বিরসবদন হতে হয়। এমনকি অতি ঘৃণ্য বীভৎসার বিরুদ্ধে সংগ্রামের সময়েও নয়। বাস্তবের সঙ্গে কামনার সংযোগরেখাই বিপ্লবী বলের অধিকারী (বিবিধ রূপে প্রতিমূর্তিকরণের পশ্চাদগমন বিপ্লবী বলের অধিকারী নয়)।
  • একমেবাদ্বিতীয়ম সত্যের উপর রাজনৈতিক চর্চার ভিত স্থাপন করার বাসনায় চিন্তাশক্তি অপব্যয় কোরো না। অপর চিন্তাধারাকে ফঁাপা দূরকল্পনা হিসেবে হেয় করার জন্য রাজনৈতিক সক্রিয়তার অপব্যয় কোরো না। চিন্তাশক্তিকে আরও তীব্র করার জন্য রাজনৈতিক চর্চাকে ব্যবহার কর। রাজনৈতিক ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে হস্তক্ষেপের কাজে ক্ষেত্র ও রূপের বহুত্ববিধান করার জন্য বিশ্লেষণকে ব্যবহার কর।
  • দর্শনে সংজ্ঞাত ব্যক্তিসত্তার ‘অধিকারবলী’ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার দাবি রাজনীতির কাছে কোরো না। ব্যক্তিসত্তা ক্ষমতার হাতে নির্মিত। যা প্রয়োজন তা হল বহুত্বকরণ, বিবিধ সমবায় ও স্থানান্তরকরণের মধ্য দিয়ে ‘ব্যক্তিসত্তাকে নাকচ করা’। ধাপবন্দি কাঠামোর বিভিন্ন ধাপে বিন্যস্ত ব্যক্তিসত্তাদের জৈব ঐক্যবন্ধন হিসেবে যেন কোনও গোষ্ঠী কাজ না করে, বরং ব্যক্তিসত্তা নাকচের প্রক্রিয়াকে যেন অনবরত বহমান রাখা যায়।
  • ক্ষমতার আসক্তিতে ডুবে যেও না।

ফুকোর হাজির করা এই সাতটি ‘আবশ্যকীয় নীতি' যেমন প্রতিরোধকে নঙর্থক থেকে সদর্থক প্রতীতির দিকে ফেরাতে চাইছে, একমুখী দিশার নামে একমেবাদ্বিতীয়মতার দাবিদার মতবাদের পশ্চাদগমনের পরিবর্তে বহুত্ব, বহুমুখীনতা ও অপরের সংসর্গসুখে বিস্তৃত করতে চাইছে, তেমনই ব্যক্তিমানুষের সামনে বিবিধ সমবায় ও স্থানান্তরকরণের মাধ্যমে ব্যক্তিসত্তা নাকচের মধ্য দিয়ে নিরন্তর উৎক্রমণের এক পথ হাজির করছে। তা যত না কোনও রাজনৈতিক আন্দোলনের কৌশল, তার থেকে বেশি জীবনযাপনের কৌশল। ক্ষমতাধিপত্য বিরোধী জীবনযাপনের শিল্প নিয়ে ফুকোর এই ভাবনা প্রলম্বিত হয়েছিল ‘পারহেসিয়া’ নিয়ে তাঁর অনুসন্ধানী বিশ্লেষণে, যা ১৯৮১ থেকে ১৯৮৪ সালে তঁার মৃত্যু অবধি কলেজ-দি-ফ্রাঁস-য় তাঁর পরিচালিত পাঠক্রম ও তাঁর বক্তৃতাবলীর বিষয় হয়ে উঠেছিল।১৭ এবার তাই ফুকোর জীবনের অন্তিমপর্বের এই বিশ্লেষণগুলোর দিকে নজর ফেরানো যাক।

‘পারহেসিয়া’ সংক্রান্ত বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ফুকো চোখ ফিরিয়েছিলেন খ্রিস্টপূর্ব গ্রিক ও রোম সভ্যতার প্রাচীনযুগে ও খ্রিস্টধর্মের প্রত্যুষকালে ‘সিনিক’ (cynic) দার্শনিকদের চিন্তাধারা ও জীবনপ্রণালীর দিকে। ‘সিনিক’ দার্শনিকরা সাধারণভাবে পরিচিত অর্থ ও বিলাসব্যসনের প্রতি তঁাদের ঘৃণার জন্য, সমস্তকিছুর তীব্র সমালোচনা হাজির করার জন্য, যে কারণে তঁাদের অসূয়ক বা ছিদ্রান্বেষী হিসেবেও গণ্য করা হয়ে থাকে। ফুকোর উদ্ধার করা ইতিহাস অনুযায়ী ‘সিনিক’-দের আদি পরম্পরাকে আমরা এভাবে দেখতে পারি: খৃস্টপূর্ব পঞ্চম শতকে গ্রিক সাহিত্যে, বিশেষ করে ইউরিপিদিসের নাটকগুলোর মধ্যে প্রথম সদর্থক অর্থে ‘সিনিক’ দর্শনের আবির্ভাব হয়, তার পরবর্তীকালে গ্রিক শহরের নাগরিকসভায় ও রাজার প্রতিস্পর্ধী রাজনৈতিক পারহেসিয়ার মধ্য দিয়ে তা বিস্তৃত হয়, তারপরে ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির পারস্পরিক ক্রিয়ায় নৈতিক বা সক্রেতিয় পারহেসিয়া হিসেবে দেখা দেয়, খ্রিস্টান ধর্মের প্রত্যুষকালে ঈশ্বরের সঙ্গে এক মুখোমুখি প্রত্যক্ষ সম্পর্ক গড়ে তোলার উপায় হিসেবে খ্রিস্টিয় পারহেসিয়ায় রূপান্তরিত হয়। ‘পারহেসিয়া’ একটি গ্রিক শব্দ। ফুকো তার মানে করেছেন ‘সাহসী (বা ভয়মুক্ত) সত্যভাষণ’ হিসেবে। এই সাহসী বা ভয়মুক্ত সত্যভাষণ কেবল অপ্রিয় বা অসুবিধাজনক কোনও সত্যোপলব্ধিকে ভাষা দেওয়াতেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং জনসমক্ষে তা বলা, সেই বলার দায় স্বীকার করা, নিজ জীবনাচরণের মধ্য দিয়ে তা প্রয়োগ করা, তার জন্য মূল্য চুকানো ও তাকে নিজ অস্তিত্বের ভরকেন্দ্র করে তোলা। এই সমগ্রটা নিয়েই পারহেসিস, যেখানেই তা নিছক ভাষণ (rhetoric)-য়ের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। তাই পারহেসিস একজন সিনিক-য়ের গোটা জীবনচর্যাকে কয়েকটি আবশ্যকীয় বৈশিষ্ট্যে চিহ্নিত করত। ফুকো এই বৈশিষ্ট্যগুলোকে এভাবে চিহ্নিত করেছেন:

১। যে কোনও স্থানিক বা প্রাতিষ্ঠানিক বদ্ধতাকে এড়িয়ে নিয়ত গতিময়তা ও পরিবর্তনশীলতার গুণে জীবন একটি অবিরাম উৎক্রান্তি যাত্রা।

২। সিনিক-য়ের দেহ আবরণহীন, আভরণহীন, সম্পদহীন, উলঙ্গপ্রায়রূপে অনাবৃত। তঁারা ‘অনাবৃত জীবন’-য়ের বাহক। সেটাই তাঁদের স্বাধীনতার ভিত্তি। শৃঙ্খলা দেহকে ক্রমবর্ধমান উপযোগের মাধ্যম হিসেবে গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে একটি শৃঙ্খলিত উৎপাদনশীল দেহ গড়ে তোলে, ঠিক তার বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে সিনিক-য়ের অশৃঙ্খলায়িত দেহ।

৩। সত্যভাষণের জন্য সিনিক তার সাহসিকতা বা ভয়মুক্তিকে চরম সীমা অবধি ঠেলে নিয়ে যায় যেখানে রূঢ়তা ও অবিমৃশ্যকারিতার একচুল দূরত্বে হয়ত সে দাঁড়িয়ে থাকে। শৃঙ্খলা যেরকম বাধ্য, নিরাপত্তাভাবনা-সর্বস্ব সমাজজীব উৎপাদন করতে চায়, ঠিক তার বিপরীত মেরুতে পৌঁছানোই সিনিকের জীবন-অভিযানের লক্ষ্য।

৪। সিনিকদের জীবন একটি নিরন্তর সংগ্রাম। সেই সংগ্রাম নিজের বিরুদ্ধে, আবার নিজের জন্যও। সেই সংগ্রাম অপরের বিরুদ্ধে, আবার অপরের জন্যও। সার্বভৌম জীবনের দার্শনিক ধারণাটি ব্যক্তির নিজের উপর এমন এক প্রভুত্বের কথা বলে যা নিজেকে উপভোগ করা ও অন্যকে সহায়তা করার উপযোগী হয়ে ওঠে। সার্বভৌম জীবনের এই দার্শনিক ধারণাটির বিপরীতে সিনিকের জীবনভাবনা বিস্তৃত হয়।

৫। সিনিকদের মূল অভিপ্রায় হল নিয়ম, অভ্যাস, রীতি ও আইন ভেঙে ফেলা। কিছু দার্শনিক নিয়ম বা সূত্রাবলীর অনুসরণের মধ্য দিয়ে প্রকৃত জীবন বা সত্য জীবন আয়ত্ত করা সম্ভব বলে সে মনে করে না। প্রতিনিয়ত অপর কিছুতে উৎক্রমণের মধ্য দিয়েই সিনিকরা প্রকৃত জীবন বা সত্য জীবনকে অস্তিত্বযাপনে মূর্ত করে তুলতে চায়।

পারহেসিয়ার এই যে বৈশিষ্ট্যগুলো ফুকো চিহ্নিত করেছেন তা ক্ষমতাধিপত্যবিরোধী জীবনশিল্পের একটা উদাহরণ তুলে ধরে। ‘কারেজ অফ ট্রুথ’ বক্তৃতামালার শুরুতে ফুকো বলেছিলেন:

বিষয়ী ও সত্যের মধ্যে সম্পর্কাদি নিয়ে আমার করা বিশ্লেষণে সর্বদা হাজির থাকা মূল ভাবনাটি হল: ক্ষমতাসম্পর্কসমূহ নিয়ে ভাবনা এবং বিষয়ী ও সত্যের মধ্যে পারস্পরিক ক্রিয়ায় ক্ষমতাসম্পর্কাদির ভূমিকা নিয়ে ভাবনা। পারহেসিয়া নিয়ে আমার পাঠকাজ আমাকে সেই মূল ভাবনার আরও কিছুটা ঘনিষ্ঠ করে তুলেছে।১৮

পারহেসিয়া থেকে ফুকো কি তাহলে শৃঙ্খলাদায়ক ক্ষমতা ও জৈবক্ষমতার বুনটের মধ্যে প্রতিরোধবিন্দুগুলোর সংহিতাকরণের একটি উপায় আহরণ করতে চেয়েছেন? বিষয়টি অবশ্যই এমন সোজাসাপটা নয় যে পারহেসিয়া নিছক অনুকরণ করার কথা তিনি ভেবেছেন, কারণ অন্য সময়ে, অন্য সমাজে, অন্য ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে বিকশিত হওয়া কোনো রূপ যে বর্তমান সময়, সমাজ ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের কোনো সমস্যার সমাধান হতে পারে না তা তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় হুবার্ট দ্রেইফুস ও পল রেনবোর-র এক প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন:

দ্রেইফুস, রেনবো: প্রাচীন গ্রিকরা একটি আকর্ষণীয় ও বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প হাজির করে বলে কি আপনি মনে করেন?

ফুকো: না! প্রাচীন গ্রিসে আমি কেনও বিকল্প খুঁজছি না। আজকের কোনও সমস্যার সমাধান আপনি অন্য সময়ে অন্য মানুষদের দ্বারা উত্থাপিত সমস্যার সমাধানের মধ্য দিয়ে কখনোই পাবেন না। খেয়াল করবেন যে আমি যা করতে চাই তা কখনোই সমাধানসমূহের ইতিহাস রচনা নয়, আর সেই কারণেই ‘বিকল্প’ শব্দটিকে গ্রহণ করতে পারি না। আমি যা করার চেষ্টা করি তা হল সমস্যা-সন্দেহ-প্রশ্নাবলীর কুলজিশাস্ত্র (genealogy) রচনা করা। আমার বলার বিষয় এ নয় যে সবকিছুই খারাপ, বরং আমার বলার বিষয় হল যে সবকিছুই বিপজ্জনক। খারাপ আর বিপজ্জনক ঠিক এক জিনিস নয়। যখন সবকিছুই বিপজ্জনক, তখন আমাদের আশু অর্থেই কিছু করার থাকে। সুতরাং আমার অবস্থান আমাকে সবকিছুর প্রতি হতশ্রদ্ধা-অনীহা-উদাসীনতার দিকে নিয়ে যায় না, বরং অনাশাচারী অতি-সক্রিয়তার দিকে নিয়ে যায়।...১৯

এর মধ্য দিয়ে যেমন এটা স্পষ্ট হয় যে পারহেসিস কোনও অনুকরণের জন্য তুলে ধরা ছক নয়, তেমনই আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও উঠে আসে, যা হল, সমালোচনা-বিরোধিতার মধ্য দিয়ে খারাপ অবস্থা থেকে উন্নততর বা আরও ভালো অবস্থায় যাওয়ার কোনও দীর্ঘসূত্রী প্রক্রিয়া এ নয়, এ হল বিপন্নের আশু অতি-সক্রিয়তা। ক্ষমতাকে প্রতিরোধ করার মধ্য দিয়ে উন্নত সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার কোনও মতবাদিক প্রয়াসের আলোচনা এখানে হচ্ছে না। ক্ষমতাসম্পর্ক বিপজ্জনক, ক্ষমতাসম্পর্ক আমাদের আশু অস্তিত্বকে আক্রমণ করছে, বিপন্ন করছে। তাই সেই আক্রান্ত বিপন্নতার জায়গা থেকে, আশু অতি-সক্রিয়তার পথেই প্রতিরোধ। পারহেসিয়া যেমন একইসঙ্গে ভয়মুক্তভাবে ঝুঁকি নেওয়ার মধ্য দিয়ে অস্তিত্বকে বিপন্ন করে, আবার নতুন অস্তিত্ব নির্মাণেরও চেষ্টা করে, স্থাণু-স্থবিরকে ভেঙে ছিটকে বেরতে চায়, তা বিপদের মুখে দাঁড়িয়ে থাকার বোধ থেকেই উৎসারিত হতে পারে। গ্রিক সিনিকদের পৃথিবীর সঙ্গে শৃঙ্খলাদায়ক ক্ষমতা ও জৈবক্ষমতার বুনটের মধ্যে অস্তিত্বধারী মানুষের পৃথিবী আলাদা। বিপদবোধ আলাদা। ছিটকে বের হওয়ার অতি-সক্রিয়তার রূপও তাই আলাদা। উনিশ শতকের শেষভাগে নোবেলের ডিনামাইট আবিষ্কারের সময় থেকে আজকের পরমাণু অস্ত্র, জৈব অস্ত্রের প্রতুলতা অবধি এসে জীবন-ধ্বংসকারী শক্তি যে রূপ নিয়েছে, শিল্পদূষণের মধ্য দিয়ে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট ও বাস্তুতন্ত্রের ক্ষয় জীবনের প্রাকৃতিক প্রাগশর্তগুলোকেই যেভাবে ধ্বংস করে দিচ্ছে, আক্রান্ত-বিপন্নতার মাত্রা আজ পূর্ববর্তী যে কোনও সময়ের থেকে অনেক গভীর, অনেক ব্যাপক হয়ে উঠেছে। জীবনঅস্তিত্ব বাজি রেখে পারহেসিয় অতি-সক্রিয়তা শৃঙ্খলাদয়ক ক্ষমতা ও জৈবক্ষমতার বুনটে কীভাবে ফালা দিতে পারে তা এই গভীর-ব্যাপক বিপদের মুখে অভ্যাস-রীতি-নিয়ম-আইন-ভাঙা জীবনশৈলীর পরিসরেই বুঝি নতুনভাবে উদ্ভাবিত হতে হবে।

ফুকোর সদ্য-উদ্ধৃত উক্তিটির শেষ বাক্যের একটি শব্দকে খেয়াল করা যাক। অতি-সক্রিয়তার বিশেষণ হিসেবে তিনি ‘অনাশাচারী’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। (মূল ইংরেজিতে শব্দটি ছিল: ‘pessimistic’, যার বঙ্গানুবাদ সাধারণত ‘নৈরাশ্যবাদী’ বা ‘নিরাশাবাদী’ হিসেবে করা হয়। কিন্তু ‘নৈরাশ্যবাদী’ বা ‘নিরাশাবাদী’ বললে আশাকে নাকচ করে নিরাশাকে সর্বময় করার যে বোধ তৈরি হয়, ফুকোর কথায় সেই অর্থ নেই। তিনি কোনও নির্মিত আশা বা আশাবাদকে তঁার সক্রিয়তার ভিত্তি করতে চান না— এই অর্থটি ধরতেই আমি বঙ্গানুবাদ হিসেবে অপ্রচলিত শব্দ ‘অনাশাচারী’ ব্যবহার করেছি।) অর্থাৎ, ক্ষমতা-প্রতিরোধকারী সক্রিয়তার ভিত্তি হিসেবে যে কোনো ধরনের আশাবাদের বিপরীতে অনাশাচারকেই ফুকো গ্রহণ করছেন। এর তাৎপর্য কী তা একটু খুলেমেলে দেখা যাক।

আশা-নির্মাণ বা আশাবাদকে ক্ষমতা-প্রতিরোধকারী সক্রিয়তার ভিত্তি সাধারণত দুইভাবে করা যায়—১। মৌলিক কোনো গুণ বা স্বভাবের প্রকাশ হিসেবে প্রতিরোধকে ‘স্বাভাবিকতা’ হিসেবে দেখা, আর, ২। শেষ বিচারে প্রতিরোধের জয় নিশ্চিত বলে প্রতিপন্ন করা।

প্রথমটিতে, অর্থাৎ প্রতিরোধকে স্বাভাবিক প্রতিপন্ন করার কাজ নানা উপায়ে হতে পারে। তার একটা প্রধান উপায় হল মানুষ সম্পর্কে একটা আদর্শ ধারণা নির্মাণ করা বা কোনো এক আদর্শ গুণের অধিকারী হল মানুষ এভাবে দেখা। যেমন: মানুষের স্বাভাবিক চাহিদা (ও অধিকার) হল স্বাধীনতা, মানুষের স্বাভাবিক চাহিদা (ও অধিকার) হল সাম্য, অবদমন ও হিংসা মানুষের প্রকৃতিজ স্বভাবের বিরোধী, সহযোগিতা মানুষের স্বাভাবিক চরিত্র,...— এমন নানা নির্ধারণের মধ্য দিয়ে প্রতিপন্ন করা হয় যে ক্ষমতাসম্পর্ক হল মানুষের স্বাভাবিকতা-বিরোধী একটি আরোপ আর প্রতিরোধ হল স্বাভাবিকতার অভিব্যক্তি। এর মধ্য দিয়ে এই আশা সঞ্চারিত হয় যে ভয়-ভীতি বা আরোপিত বাধ্যতা অতিক্রম করতে পারলে ক্ষমতা-প্রতিরোধই মানুষের স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ত ক্রিয়া। ফুকো এই আশাবাদ নাকচ করেছেন। ক্ষমতার বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে আদর্শ মানুষের ধারণা, কোনটা স্বাভাবিক আর কোনটা স্বাভাবিক নয় সেই ধারণা, কোনটি প্রকৃতিসিদ্ধ আর কোনটা প্রকৃতিবিরুদ্ধ সেই ধারণা নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক পরিস্থিতিতে নির্দিষ্ট সমাজের ক্ষমতাপ্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নির্মিত হয়। ক্ষমতা মানুষের মধ্যে কেবল অবদমিত-আক্রান্ত বোধই গড়ে তোলে না, নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধির বোধও গড়ে তোলে। সুতরাং ইতিহাস-নিরপেক্ষ সমাজ-নিরপেক্ষ কোনো আদর্শ মানুষের রূপ বা মানুষের আদর্শ গুণের রূপ যেমন হয় না, তেমনই মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে কেবল ক্ষমতার বিরোধে দাঁড়ায় না, মানুষ ক্ষমতার আসক্তিতে মজেও যায়।

দ্বিতীয় উপায়টিতে, অর্থাৎ, প্রতিরোধের চূড়ান্ত জয় নিশ্চিত তা প্রতিপন্ন করতে সাধারণত কিছু সামাজিক-ঐতিহাসিক সাধারণ নিয়মকে হাজির করা হয়। সে নিয়ম এমন হতে পারে: ‘কিছু মানুষকে কিছু দিনের জন্য ভুল বোঝানো যেতে পারে, কিন্তু সব মানুষকে সব দিনের জন্য ভুল বুঝিয়ে রাখা যায় না’। আবার তা বিস্তারিত মতবাদ নির্মিত এমন নিয়ম হতে পারে: ‘ঐতিহাসিক সমাজবিকাশের নিয়মে পুঁজিবাদের অবসান ও সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা অনিবার্য’। প্রথম উদাহরণটিতে, অর্থাৎ শেষ অবধি সত্যের জয়ের নিশ্চয়তা কল্পনায় নিজ আকাঙ্খাকে নিয়মের রূপে হাজির করা বা সত্য-মিথ্যা নিরূপণে জনসমষ্টির এক শেষ বিচারে নিখুঁত সক্ষমতাকে কল্পনা করার দৌর্বল্য ছাড়াও আর একটি সমস্যা আছে। সেই সমস্যা হল সত্যের একটি স্বয়ম্ভূ অস্তিত্ব কল্পনা করা। সত্যের এই স্বয়ম্ভূ অস্তিত্বের কল্পনাকে ফুকো নাকচ করেছেন যখন তঁার বিশ্লেষণ স্পষ্ট করে তুলেছে কীভাবে সমাজের ক্ষমতাপ্রক্রিয়ার অন্তর্ভুক্ত জ্ঞানোৎপাদন প্রক্রিয়া প্রতিনিয়ত ‘সত্য’ উৎপাদন করে চলে। আর দ্বিতীয় উদাহরণটিতে সামাজিক-ঐতিহাসিক নিয়মের যে ইতিহাস-বিমূর্ত সমাজরূপ-বিমূর্ত সাধারণ রূপ হাজির হয়, তা এই ঐতিহাসিকতাকে ঢেকে রাখে যে বিশেষ এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত ও সমাজরূপের সন্ধিক্ষণে (পুঁজিবাদের উদ্ভব ও দ্রুত বিস্তারের সন্ধিক্ষণে) সমাজবিকাশের নিয়ম এইভাবে প্রতিভাত হয়েছিল। জৈবক্ষমতার বিস্তার আজ যখন প্রাকৃতিক-বাস্তুতান্ত্রিক সংকটের মধ্য দিয়ে মানুষের জীবন-অস্তিত্ব সমাজ-অস্তিত্বকেই আশু ধ্বংসের সম্ভাবনার মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে, তখন সমাজবিবর্তনের ওইরকম আশাবাদী ব্যাখ্যান আজ কি আর স্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছে? বা অন্যদিক থেকে দেখলে, অ-ইউরোপিয়, অ-পুঁজিবাদী তথাকথিত আদিম আদিবাসী সমাজের কোনো মানুষ কি এহেন সমাজবিবর্তনের নিয়ম, যার যাত্রার মহান রথচক্রের তলে তার নিজের সমাজরূপ চূর্ণ পিষ্ট হওয়া আবশ্যিক, তাকে প্রকৃতি-নির্দিষ্ট বলে বিমূর্তায়ন করতে পারে? শৃঙ্খলাদায়ক ক্ষমতা ও জৈবক্ষমতা এহেন বিবর্তনের নিয়মকেই তো তার প্রকৌশল হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। তাই এহেন নিয়ম দিয়ে আশাবাদের ভিত্তি তৈরি করে তার উপর প্রতিরোধকে স্থাপন করলে সেই প্রতিরোধের বিন্দু ক্ষমতাকে আরও বিস্তৃত করার নতুন পথই তৈরি করে দেয় বোধহয়।

সুতরাং ফুকো আশাবাদের কোনওরকম ভিত্তির উপর প্রতিরোধী সক্রিয়তাকে স্থাপন করতে চাননি। তঁার প্রতিরোধ-পরিকল্পনায় ‘আমরা করব জয় নিশ্চয়’— এমন কোনও নিশ্চয়তা নেই, সত্য ও প্রাকৃতিক নিয়মের কবজকুণ্ডলী আমাদেরই বাহুতে বাঁধা— এমন কোনও আত্মশক্তির বোধ নেই। ক্ষমতা যে প্রতিরোধের বিন্দুগুলোকে তার সহায় বা বাঁট হিসেবে ব্যবহার করে সেই সচেতনতা আছে, আবার প্রতিরোধের বিন্দুকে ক্ষমতার লঘুকরণ-অসম্ভব বিপরীত করে তোলার নিত্য তাগিদ আছে। পার্থক্য, বহুত্ব, অপরতার সঙ্গে নিত্য বিনিময় ও সহাবস্থানের মধ্য দিয়ে স্বাভাবিকীকরণ-বিরোধী, নিয়মানুগকরণ-বিরোধী এক জীবনশৈলী নবায়নের কাজ নিরন্তর জারি রাখার অতি-সক্রিয়তা আছে। ফুকোর মধ্যে থেকে কেউ যদি প্রতিরোধের কোনও সাধারণ তত্ত্ব বা নিয়ম নিঙড়ে বের করতে চায়, সে নিশ্চিতভাবেই হতাশ হবে। আবার আন্যদিকে, কেউ যদি ক্ষমতাসম্পর্কের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের জীবনশৈলী সৃজনের পরিসরটিকে বহুত্বে, বিবিধতায়, উপলব্ধির সূক্ষ্মতায় ও তীব্রতায় আবিষ্কার করতে চায়, ফুকোর মধ্য দিয়ে সে তার প্রবেশপথ খুঁজে পাবে।

মিশেল ফুকো তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিচর্চাকে প্রতিরোধচর্চার একটি অঙ্গ হিসেবেই নিয়েছিলেন। তঁার ব্যক্তিজীবন ও সমাজজীবনও ছিল প্রতিরোধচর্চার নিরন্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষা-ক্ষেত্র। বর্তমান উপস্থাপনার পরিসরে তার বিশদ আলোচনা সম্ভব নয়, কিন্তু তাঁর সক্রিয়তার সঙ্গে তঁার তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত ছিল বলেই সেই আলোচনা পুরো এড়িয়ে যাওয়াও সম্ভব নয়। তাই তাঁর সামাজিক জীবনের কয়েকটি প্রতিরোধক্রিয়ার কথা আলোচনার মধ্য দিয়ে প্রতিরোধ প্রসঙ্গে আলোচনা আপাতত শেষ করব:২০

তুনিসিয়া

১৯৬৬ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৬৮ সালের অক্টোবর অবধি উত্তর আফ্রিকার তুনিসিয়ায় ফুকো শিক্ষকতার পেশায় নিযুক্ত হয়ে বাস করেছিলেন। সেই সময় হাবিব বুরগুইবা ছিলেন তুনিসিয়ার শাসক। অত্যাচারী বুরগুইবা-সরকারের বিরুদ্ধে তুনিসিয়ার ছাত্রদের আন্দোলন তুঙ্গে উঠেছিল। মার্কসবাদী রাজনীতিতে অনুপ্রাণিত ছাত্ররা রাষ্ট্রীয় সেনা-পুলিশের হাতে শারীরিক নিগ্রহ, আট-দশ এমনকি চোদ্দ বছর অবধি কারাবাস ও মৃত্যুর সম্ভাবনাকেও তোয়াক্কা না করে বড় বড় গণবিক্ষোভে অংশ নিচ্ছিল। এই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা শিক্ষক ফুকোর মনে বড় ছাপ ফেলেছিল। ফুকো বলেছেন যে তুনিসিয়ায় তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে রাজনীতি করা মানে কেবল রাজনৈতিক তত্ত্ব আলোচনার জট পাকানো ও জট ছাড়ানো নয় (যেমনটা ফ্রান্সের মার্কসবাদী মহল সম্পর্কে তাঁর ধারণা হয়েছিল), বরং রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা মানে এমন একটা অস্তিত্বযাপন যা নির্দিষ্ট কিছু সমস্যাকে সমাধানের প্রয়াসে ব্যক্তিজীবন-ব্যক্তিনিরাপত্তা-কে বাজি রেখে সোৎসাহে বিপদের মুখোমুখি হয়। এই রাজনৈতিক অস্তিত্বযাপন তিনি কেবল দর্শক বা বিশ্লেষক হিসেবে দেখেননি, তাতে তিনি নিজেও অংশ নিয়েছিলেন। গণবিক্ষোভে অংশ নেওয়া, গ্রেফতার হওয়া ছাত্রদের জন্য আইনি সাহায্য সংগঠিত করা, কারাবন্দি ছাত্রদের মুক্তির জন্য জাতীয়-আন্তর্জাতিক চাপ তৈরির চেষ্টা করা— এসব তো ছিলই, এছাড়াও তিনি তাঁর নিজের বাসভবনের বাগানে একটি রোনিও কোম্পানির মুদ্রণযন্ত্র লুকিয়ে স্থাপন করেছিলেন, যাতে ছাত্ররা নিষিদ্ধ সরকারবিরোধী রাজনৈতিক প্রচারপত্র ছাপা ও বিলি করার কাজে সরকারি নজরদারি এড়িয়ে তাঁর বাড়িকে ব্যবহার করতে পারে। শেষাবধি সরকার-বিরোধী আন্দোলনে সম্পৃক্তির জন্য সরকারের রোষ এড়াতে তিনি তুনিসিয়া ছাড়তে বাধ্য হন।

‘জি আই পি’ ও অন্যান্য

১৯৬৮ সালের শেষদিকে ফুকো ফ্রান্সে ফেরেন। ফ্রান্সের মে-১৯৬৮-র আন্দোলন তখন সমাজের রাজনৈতিক চালচিত্র বদলে দিয়েছে। পাগল, মানসিক বিকারগ্রস্ত, অপরাধী ইত্যাদি তকমা দিয়ে সমাজে অপরদের কন্ঠরোধ করা ও দমনমূলক নজরদারি ব্যবস্থায় আটকে রাখার বিরুদ্ধে ফুকো ও তাঁর সঙ্গীরা আগে থেকেই যা বলছিলেন, তা এই বদলে যাওয়া চালচিত্রে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে। এই পরিবেশের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করার জন্য ফুকো আরো বেশ কিছুজনের সঙ্গে মিলে ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ‘জি আই পি’ (পুরো নামের অর্থ: জেলখানা সম্বন্ধে তথ্য উপস্থাপক গোষ্ঠী) নামে একটি সংগঠন তৈরি করেন। এই সংগঠনের উদ্দেশ্য ছিল রাষ্ট্র-আরোপিত ‘সুরক্ষাবলয়’ ভেদ করে জেলখানার মানুষদের নিজেদের কথা ব্যক্ত করার সুযোগ ও পরিসর তৈরি করে দেওয়া। এর পরের দুই বছর এই সংগঠনের হয়ে জেলখানার ভিতরে যোগাযোগ করা, সাক্ষাৎকার নেওয়া, জেলখানার রীতি-বিধি-আইনকানুনের পুঙ্খানুপুঙ্খ সমালোচনা তৈরি করা, গণপ্রচারপত্র তৈরি করা ও তা ছাপিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে বিলি করা, জনমত গড়ে তোলা, সংবাদমাধ্যমে প্রকাশের জন্য প্রেস-রিলিজ প্রস্তুত করা ও তা প্রকাশের বন্দোবস্ত করা ফুকোর দৈনিক কাজের অংশ হয়ে উঠেছিল। বুদ্ধিজীবী, রাজনৈতিক কর্মী, অধিকার আন্দোলনের কর্মী ও সাধারণ মানুষ— সব মহলের অনেক মানুষ এই আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। ফুকো ছিলেন এই আন্দোলনের সবচেয়ে তৎপর কর্মী ও সবচেয়ে পরিচিত হয়ে ওঠা মুখ। ফুকোর বাসাঘরটি হয়ে উঠেছিল এই আন্দোলনের অঘোষিত প্রধান দপ্তর। কিন্তু ফুকো নিজেকে ‘নেতা’ হিসেবে হাজির করেননি। ফুকো কেন, এই আন্দোলনের কোনও নেতাই ছিল না। ফুকো ও তাঁর সঙ্গীরা অত্যন্ত সচেতন ছিলেন যাতে কাজের সুবিধার দোহাই দিয়ে একটি ধাপবন্দি সাংগঠনিক কাঠামো না গড়ে ওঠে এবং কিছুজন সাংগঠনিক আমলায় না পরিণত হন। পূর্বজীবনে ফরাসি কম্যুনিস্ট পার্টির মধ্যে তঁার হওয়া সাংগঠনিক আমলাতান্ত্রিকতার করুণ অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি এড়িয়ে কীভাবে আন্দোলন-সংগঠনের কাজ চালানো যায়, সেই পরীক্ষা-নিরীক্ষার একটা উর্বর ক্ষেত্র তৈরি হয়েছিল এই দুই বছর। জি আই পি-র মূল কাজ ছাড়াও এই সময়পর্যায়ে ফুকো একাধিক নাগরিক অনুসন্ধান কমিটি গড়ে তুলেছিলেন পুলিশি অত্যাচারের তথ্যপ্রতিষ্ঠা করার জন্য, যেমন: সাাাংবদিক অ্যালাঁ জবেরকে পুলিশের মারধোর করা নিয়ে, প্রান্তনিবাসী আরব তরুণ জেলালি বেন আলির পুলিশের হাতে আরব বসতি এলাকার রাস্তায় খুন হওয়া নিয়ে, ইত্যাদি। ১৯৭২ সালের ডিসেম্বর মাসে জি আই পি নিজেকে ভেঙে দেয় এই যুক্তিতে যে জেলখানার ভিতরের চাপা পড়া কন্ঠস্বরকে বাইরে প্রকাশ করার তার উদ্দিষ্ট কাজ সম্পন্ন হয়েছে। ফুকো ও তাঁর সহযোগীরা এরপরও রাষ্ট্রীয় দণ্ডের বিরুদ্ধে তঁাদের প্রতিবাদ তোলার কাজ চালিয়ে যান। তেমন দুটি উদাহরণ হল: ১। স্পেনের একনায়কতন্ত্রী ফ্যাসিবাদী শাসক ফ্রাঙ্কো ১৯৭৫-য়ের সেপ্টেম্বরে বাস্ক প্রদেশের ফ্যাসিবাদবিরোধী স্বশাসনকামী কিছু রাজনৈতিক কর্মীকে জেলে শ্বাসরোধ করে হত্যা করার হুকুম দেয়, তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে জনসমক্ষে বিবৃতি পাঠ করার জন্য ফুকো মাদ্রিদে যান, ২। ১৯৭৭ সালের নভেম্বরে পশ্চিম জার্মানীতে রাষ্ট্রদ্রোহী বলে চিহ্নিত হয়ে ফ্রান্সে রাজনৈতিক আশ্রয় নেওয়া আইনবিদ ক্লাউস ক্রসাঁকে পশ্চিম জার্মানির হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ফরাসি সরকার, তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে বিক্ষোভপ্রদর্শনে অংশ নেন ফুকো, সেখানে ফরাসি পুলিশের লাঠির ঘা তাঁর বুকের হাড়ে চিড় ধরিয়ে দিয়েছিল। এই গোটা অভিজ্ঞতাপর্ব শৃঙ্খলাদায়ক ক্ষমতা ও জৈবক্ষমতার বিশ্লেষণ ও রাজকতা (governmentality)-র ধারণায় পৌঁছানোর তত্ত্বযাত্রার প্রেক্ষাপট হিসেবে কাজ করেছে।

ইরানের পালাবদল

১৯৭৮ সালে ফুকো দুইবার ইরানে যান সেখানকার ঘনায়মান আন্দোলন প্রত্যক্ষ করে ইতালিয় পত্রিকা ‘কোরিয়ের ডেলা সেরা’-তে প্রতিবেদন লেখার জন্য। ফুকোর লিখিত এই প্রতিবেদনগুলোই রাজনৈতিকভাবে সবচেয়ে বিতর্কিত। ইরানে শাহ-য়ের রাজতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে গণবিদ্রোহের সূচনা হয়েছিল ১৯৭৭-য়ের অক্টোবরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের প্রতিবাদ-প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে। ১৯৭৮ সালের গোড়ার দিকে তা ইসলামিক ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিবাদে যোগ দেওয়ার মধ্য দিয়ে ছড়িয়ে পড়ে এবং ওই বছরের শেষের দিকে বিশাল বড় বড় প্রতিবাদী গণসমাবেশ রাস্তায় নেমে আসে। কিছু কিছু সমাবেশে কুড়ি লাখের বেশি মানুষ জড়ো হয়েছিল। রাষ্ট্রীয় সেনাবাহিনী বিভিন্ন অংশ প্রতিবাদী মানুষদের দ্বারা ঘেরাও হয়ে পড়ে। গণবিক্ষোভের পাশাপাশি তার সমর্থনে নাগরিকদের খোলা চিঠি, আবেদন, হরতাল, সাধারণ ধর্মঘটের প্লাবন দেখা যায়। এর চাপে ১৯৭৯-র জানুয়ারিতে শাহ ক্ষমতা ছেড়ে ইরান ত্যাগ করতে বাধ্য হন, আর ফেব্রুয়ারিতে পনের বছর ধরে দেশের বাইরে নির্বাসিত ধর্মীয় নেতা আয়াতোল্লাহ খোমেইনি দেশে ফিরে নতুন শাসন প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগ নেন। ১৯৭৮-য়ের সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৭৯-র মে-র মধ্যে ইরানের আন্দোলন নিয়ে ফুকোর একসারি প্রতিবেদন ও সাক্ষাৎকার ইতালিয়, ফরাসি ও ফারসি পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়। জৈবক্ষমতা যে জনসমষ্টিকে ধাপবন্দি ক্ষমতাকাঠামোর শৃঙ্খলায় বাঁধতে চাইছে, সেই জনসমষ্টি শৃঙ্খলাছেঁড়া বিপ্লবী ভূমিকা কীভাবে নিতে পারে তার উদাহরণ হিসাবে ইরানের আন্দোলন ফুকোকে আকৃষ্ট করেছিল। তঁার প্রতিবেদন ও সাক্ষাৎকারে তিনি ইরানের বিদ্রোহের তাৎপর্যকে পশ্চিমী অভিজ্ঞতার দুটি বিপর্যয়ের পরিপ্রেক্ষিতে দেখতে বলেছিলেন। এই দুটি বিপর্যয় হল: ১। পশ্চিমী আলোকপ্রাপ্তি (enlightenment)-র আদর্শ থেকে গড়ে ওঠা ‘ভালো বা উন্নত সমাজ’ সম্বন্ধে ধারণা যার পরিণতি দাঁড়িয়েছে শিল্প-পুঁজিবাদের উত্থানের মধ্য দিয়ে ‘সবচেয়ে রূঢ়, সবচেয়ে বন্য, সবচেয়ে স্বার্থপর, সবচেয়ে অসৎ ও সবচেয়ে দমনমূলক সমাজের’ প্রতিষ্ঠা, আর ২। মার্কসীয় বস্তুবাদ ও যুক্তিবাদের নীতি গ্রহণের অভিজ্ঞতা যা সর্বাত্মক ক্ষমতাধিপত্য প্রতিষ্ঠার উপযোগী এমন রাজনৈতিক ব্যবস্থা, সমাজ-সংগঠন ও অর্থনৈতিক কলকৌশলের জন্ম দিয়েছে যাকে আমরা আজ নিন্দা করতে ও বর্জনীয় বলে স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছি। পশ্চিমী এই দুই অভিজ্ঞতাকে অনুসরণ না করাকে তিনি তাই ইরানের সীমাবদ্ধতা হিসেবে না দেখে ইরানের নতুন সম্ভাবনা হিসেবে দেখেছেন। ফুকোর মতে:

নতুনভাবে শুরু করার সাহস আমাদের থাকতে হবে। মতবাদমূলক সমস্ত নীতি আমাদের ছাড়তে হবে। অবদমনের উৎস হিসেবে কাজ করেছে এমন সমস্ত নীতিকে এক এক করে ধরে তাদের বৈধতা যাচাই করতে হবে। রাজনৈতিক চিন্তার দিক থেকে দেখলে আমরা এখন আদিবিন্দু শূন্যতে দাঁড়িয়ে আছি। অন্য এক রাজনৈতিক চিন্তা, অন্য এক রাজনৈতিক কল্পনা আমাদের গডে় তুলতে হবে আর তার মধ্য দিয়ে ভবিষ্যতের ছবি আবার নতুন করে আঁকতে হবে। আমি একথা বলছি কারণ আমি বোঝাতে চাই যে কোনও পশ্চিমী মানুষই, যদি বুদ্ধিবৃত্তিচর্চায় তিনি কিছুটা অন্তত নিষ্ঠাবান হন, ইরান সম্পর্কে— যে ইরান জাতি একাধিক সামাজিক, রাজনৈতিক ইত্যাদি ক্ষেত্রে অন্ধগলির শেষে এসে দাঁড়িয়েছে, সেই ইরান সম্পর্কে— কী শুনছেন ও কী জানছেন সে বিষয়ে নির্বিকার থাকতে পারেন না। একই সঙ্গে এখানে আমরা তাদের পাচ্ছি যারা সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠন সম্পর্কে এক পৃথক ধারায় চিন্তা করার ধারাকে হাজির করার জন্য সংগ্রাম করছেন। তা এমন এক ধারা পশ্চিমী দর্শন থেকে যা কিছু ধার করেনি, পশ্চিমী অধিকারক্ষেত্রীয় ও বিপ্লবী ভিত্তি থেকেও কিছু ধার নেয়নি। অন্য ভাবে বললে, তারা ইসলামি শিক্ষার উপর দাঁড়িয়ে একটি নতুন বিকল্প হাজির করার চেষ্টা করছেন।২১

সুতরাং ফুকো এখানে ভাবনাগত ও অভিজ্ঞতাগত ভাবে অপরের সক্রিয়তা থেকে পশ্চিমী বদ্ধ পরম্পরার বাইরে বের হওয়ার প্রস্থানপথের হদিশ পাওয়ার প্রত্যাশা করেছিলেন। ইরান আন্দোলনের অবসানের পর আয়াতোল্লাহ খোমেইনির নেতৃত্বে সংকীর্ণ ইসলাম ধর্মকেন্দ্রীক শৃঙ্খলাদায়ক শাসন কায়েম হওয়ার মধ্য দিয়ে সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি, ফুকো যে সম্ভাবনার কথা ভেবেছিলেন তা মূর্ত হয়নি।

পোল্যন্ডের সলিডারিটি

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পোল্যান্ড একদিকে নাজি ও অন্যদিকে সোভিয়েত দখলদারি ও সর্বাত্মকতাবাদী (totalitarian) শাসনের ভয়ংকর হিংসাত্মক রূপ দেখেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পোল্যান্ডে সোভিয়েত রাষ্ট্র দ্বারা নিয়ন্ত্রিত কম্যুনিস্ট শাসন আরোপিত হয়েছিল। ১৯৫০, ১৯৬০ ও ১৯৭০-য়ের দশকে এই চাপিয়ে দেওয়া শাসনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন রকম নাগরিক প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল। ১৯৭০ দশকের মাঝবরাবর এসে অহিংস প্রতিরোধের নানা কৌশল উদ্ভাবনের মধ্য দিয়ে এই প্রতিরোধ নতুন মাত্রা ও নতুন ব্যাপ্তি অর্জন করেছিল। এই নয়া প্রতিরোধ আন্দোলনই ১৯৮০ সালে ‘সলিডারিটি’ আন্দোলনের জন্ম দেয়। ১৯৮০ সালের আগস্ট মাসে শ্রমিকরা প্রথম ‘সলিডারিটি’ গঠন করেন। গোড়ায় তাকে একটি ট্রেড ইউনিয়ন হিসেবে হাজির করলেও অচিরেই তা সমাজের সমস্ত স্তরের মানুষের সম্পূর্ণ অহিংস প্রতিবাদ-প্রতিরোধের মঞ্চ হয়ে ওঠে এবং সংগঠনের থেকেও বেশি একটি সামাজিক গণআন্দোলনের চরিত্র গ্রহণ করে। তুঙ্গমুহূর্তে এর সদস্যসংখ্যা ১ কোটি ছুঁয়েছিল। এক-পার্টি কম্যুনিস্ট শাসন বা কম্যুনিস্ট-নিয়ন্ত্রিত আংশিক গণতন্ত্রের পরিবর্তে পূর্ণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গঠনই ছিল সলিডারিটি আন্দোলনের অভিপ্রায়। কম্যুনিস্ট শাসকরা প্রথমে এই আন্দোলনকে ভিতর থেকে দুর্বল করে তুলে ভেঙে দেওয়ার নানা কৌশল গ্রহণ করেছিল, যার মধ্যে ছিল: নেতাদের বেছে আলাদা করে সুযোগসুবিধা ও পদক্ষমতা দিয়ে শাসনকাঠামোর অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়া এবং তাদের সামনে রেখে হামলা চালিয়ে আন্দোলনে সমবেতজনেদের মনোবল ভেঙে দেওয়া। কিন্তু এই কৌশল ব্যর্থ হয়। সলিডারিটি আন্দোলন আরও শক্তিসঞ্চয় করতে থাকে। সোভিয়েত রাষ্ট্রনেতারা তঁাদের অনুগত পোল শাসকদের উপর চাপ তৈরি করেন আন্দোলন দমনের জন্য চূড়ান্ত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য। ১৯৮১ সালের ১৩ই ডিসেম্বর সেই চূড়ান্ত ব্যবস্থাগ্রহণের কথা ঘোষণা করেন পোল শাসকরা। সেই চূড়ান্ত ব্যবস্থার পোল নাম হল ‘স্ট্যান উওজেননি’, বাংলা ভাষায় যার মানে ‘যুদ্ধপরিস্থিতি’। এই যুদ্ধপরিস্থিতি ঘোষণার মধ্য দিয়ে সামরিক শাসন কায়েম করা হয়। অহিংস সলিডারিটি আন্দোলনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সেনা লেলিয়ে দেওয়া হয়। প্রথম সপ্তাহেই সশস্ত্র পুলিশ গুলি চালিয়ে শ্রমিকদের হত্যা করে। নির্বিচার ধরপাকড়, জেলে আটকে রেখে অত্যচার চালানো, সলিডারিটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা, কোনওরকম প্রচার যাতে সলিডারিটি না চালাতে পারে তার জন্য রাষ্ট্রীয় নজরদারি ও দমন ব্যবস্থাকে অতি-সক্রিয় করা— এককথায়, সামরিক শাসনের পেষণযন্ত্রে সলিডারিটির কন্ঠরুদ্ধ করে পিষে মারার কাজ শুরু হয়।

ফ্রান্সে তখন সমাজতান্ত্রিক পার্টির নেতৃত্বে সরকার নবনির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় বসেছে। সেই নতুন সরকার পোল্যান্ডের সামরিক শাসন ঘোষণাকে সেই দেশের আভ্যন্তরীণ বিষয় বলে অজুহাত দিয়ে এই নিয়ে কোনও অবস্থান নেওয়া এড়িয়ে যেতে চাইল। ফুকো তীব্র প্রতিবাদ করলেন। সমাজতত্ত্ববিদ পিয়ের বোর্দ-র সঙ্গে যুক্তভাবে তিনি ‘না রাখা কথা’ (Missed Appointments) নামে একটি বিবৃতি প্রকাশ করলেন। সেই বিবৃতিতে তঁারা বললেন যে সোভিয়েত রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ নির্দেশে সোভিয়েত রাষ্ট্রের অনুগত শাসকবর্গ ও সেনা ব্যবহার করে পোল্যান্ডের ব্যাপক জনগণের রাজনৈতিক অভিপ্রায়ের অভিব্যক্তি সলিডারিটি আন্দোলন দমন করাকে পোল্যান্ডের ‘আভ্যন্তরীণ বিষয়’ তকমা দেওয়া এমন এক মিথ্যাচার যা রাজনৈতিক সুবিধাবাদিতাকে প্রশ্রয় দেয় আর রাজনৈতিক আদর্শনিষ্ঠাকে বিসর্জন দেয়, সুতরাং ফ্রান্সের যে রাজনীতিবিদরা নিজেদের ‘সমাজতান্ত্রিক’ বলে দাবি করেন তঁারা যেন নিজেদের রাজনৈতিক আদর্শ জলাঞ্জলি দেওয়ার এই সুবিধাবাদিতার পুরানো পথ অনুসরণ না করে আদর্শনিষ্ঠ একটি অবস্থান নেন এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে যথার্থ ভূমিকা পালনের চেষ্টা করেন। ফ্রান্সের সমাজের বিভিন্ন স্তরের বহু মানুষ— বিখ্যাত জন থেকে সাধারণ জন— এই বিবৃতিতে তঁাদের সই যোগ করতে থাকেন, একাধিক সংবাদপত্রে প্রথম পাতায় তা ছাপা হয়, তৎকালীন জনপ্রিয় এক অভিনেতা গণসম্প্রচারমাধ্যমে তা পাঠ করেন এবং তারপর এই বিষয়ে ফুকোর সাক্ষাৎকার সম্প্রচারিত হয়। সমাজতান্ত্রিক পার্টির কিছু নেতা এর জন্য ফুকোকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করে ‘পাগল’ বা ‘ভাঁড়’ বলে গালি দিলেও ক্রমশ সংগঠিত হতে থাকা জনমতের চাপে ফরাসি সরকার তার ‘নিরপেক্ষ’ অবস্থান কিছুটা বদলাতে বাধ্য হয়: সামরিক শাসনে পর্যুদস্ত পোল নাগরিকদের জন্য আপৎকালীন সাহাস্যদানের ব্যবস্থা নেয়, ফরাসি প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবিত পোল্যান্ড সফর বাতিল করে।

কেবল সরকারি স্তরেই নয়, নাগরিক স্তরেও সলিডারিটি সম্পর্কে ঘটনা-তথ্যাবলী হাজির করা ও সমর্থন সংগঠিত করার কাজে ১৯৮১ সালের শেষ থেকে গোটা ১৯৮২ সাল জুডে় ফুকো পূর্ণমাত্রায় আত্মনিয়োগ করেন। ফরাসি শ্রমিক সংগঠন ‘ফ্রেঞ্চ ডেমোক্রেটিক কনফেডারেশন অফ লেবার’ এবং পারি শহরের সলিডারিটি কমিটির সঙ্গে মিলে সলিডারিটি আন্দোলনের বিভিন্ন তথ্য, বিশ্লেষণ, দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরার জন্য গণপ্রচারযোগ্য পুস্তিকা-প্রচারপত্র তৈরি করা, সমর্থনব্যঞ্জক ব্যাজ তৈরি করে তা নিজে পরা ও অন্যদের মধ্যে বিলি করা— এই ধরনের সমস্ত কাজে সাধারণ কর্মীর মতো তিনি অংশ নেন। তিনি বারবার জোর দিয়ে বলেন যে সলিডারিটির কন্ঠকে স্তব্ধ হয়ে যেতে দেওয়া যাবে না, তার জন্য যা যা করা সম্ভব তা করতে হবে। ১৯৮২ সালের সেপ্টেম্বরে ‘ডক্টরস অফ দি ওয়ার্লড’ নামে একটি সংগঠনের উদ্যোগে পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারশ-তে সামরিক শাসনে ভুক্তভোগীদের সাহায্য পৌঁছে দিতে একটি ‘হিউম্যানেটেরিয়ান ক্যারাভান’ যাত্রার আয়োজন করা হয়। সেই যাত্রার অন্যতম সংগঠক ও অংশগ্রহণকারী ছিলেন ফুকো।

খেয়াল করার মতো বিষয় যে এই সময়পর্যায়েই ফুকো পারহেসিয়া নিয়ে তাঁর অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণে রত ছিলেন। সোভিয়েত রাষ্ট্র নির্দেশিত পোল সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে, ফরাসি রাজনীতিবিদদের সুবিধাবাদিতার বিরুদ্ধে ‘ভয়মুক্ত সত্যভাষণ’ যেন বাস্তবেও একটি পারহেসিয় মুহূর্ত তৈরি করেছিল।

৩। বর্তমান পাঠপরিপ্রেক্ষিত প্রসঙ্গে

ক্ষমতা/প্রতিরোধ বিষয়ে পাঠপ্রক্রিয়াকে ফুকো প্রতিরোধমূলক জীবনশৈলী যাপনের অংশ করেছেন। ফুকো তাই অবশ্যম্ভাবী ভাবে তাঁর পাঠকদের পাঠকাজকেও এমন এক দিকে ঠেলে দেন যেখানে পাঠবস্তুর পাশাপাশি পাঠকের বিশেষ ঐতিহাসিক-সামাজিক প্রেক্ষিতে প্রতিরোধের কাজ ও সম্ভাবনাকে বিচারের মধ্যে নিয়ে আসতে হয়। আবার, ফুকো কোনও ইতিহাস-নিরপেক্ষ সমাজ-নিরপেক্ষ তত্ত্ব হাজির করেননি, সচেতনভাবে তিনি তাঁর নিজের পশ্চিম-ইউরোপীয় পরিপ্রেক্ষিতকে সামনে রেখেই তত্ত্ব-বিশ্লেষণ করেছেন। ফলে ভারতীয় কোনও পাঠককে ফুকো পড়তে গেলে সমান্তরালভাবে অন্তত দুটি প্রক্রিয়া চালাতে হয়— ১। ফুকোর পশ্চিম-ইউরোপীয় পরিপ্রেক্ষিতটিকে বোঝা, ২। নিজস্ব ভারতীয় পরিপ্রেক্ষিতের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী মিল-অমিল বা সমতা-পার্থক্যের জায়গাগুলোকে চিহ্নিত করে স্বতন্ত্রভাবে ভাবা। এই উপস্থাপনার প্রথম দুটি ভাগে প্রথম প্রক্রিয়াটিকে অনুসরণ করা হয়েছে। উপস্থাপনার এই তৃতীয় ভাগে আমরা দ্বিতীয় প্রক্রিয়াটি নিয়ে কিছু কথা বলব। এই দ্বিতীয় প্রক্রিয়াটি প্রতিটি পাঠকের নিজস্ব চিন্তাপ্রক্রিয়া, সৃজন ও চর্চার বিষয়। তাই এই নিয়ে সামগ্রিক আলোচনা হাজির করা নয়, বরং যাত্রাশুরুর কিছু পথ চিহ্নিত করাই এখানে আমাদের অভিপ্রায় হবে।

ভারতীয় উপমহাদেশের একজন হিসেবে আমরা এমন এক সমাজে আজ বাস করছি যেখানে ক্ষমতাসম্পর্কগুলো শৃঙ্খলাদায়ক ক্ষমতা ও জৈবক্ষমতার ছাঁচে ক্রমশ আরও পোক্তভাবে ঢালাই হয়ে চলেছে। পশ্চিম ইউরোপে যাজকীয় ক্ষমতার যে উৎস থেকে এই ছাঁচের উদ্ভব ফুকো চিহ্নিত করেছেন, ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে সেই একই উৎস কাজ করেছে এমনটা নয়। এখানে রাজতন্ত্রের যুগে সার্বভৌম ক্ষমতার যে রূপ ছিল ইউরোপীয় যাজকীয় ক্ষমতারূপের সঙ্গে তা প্রধানত মেলে না— প্রাতিষ্ঠানিক খ্রিস্টান ধর্ম পশ্চিম ইউরোপে যে ক্ষমতাকাঠামো তৈরি করেছিল, ভারতীয় উপমহাদেশে ধর্মের তেমন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ ছিল না। আমাদের ইতিহাসে তাই শৃঙ্খলাদায়ক ক্ষমতার উৎস হিসেবে ঔপনিবেশিক শাসনতন্ত্রকেই ধরতে হবে বলে মনে হয়। এই উপমহাদেশে ঔপনিবেশিক শাসনের পোক্ত রূপটা ব্রিটিশ উপনিবেশ বিস্তারকারীদের হাত ধরে তৈরি হয়েছিল। পশ্চিম ইউরোপে বিকাশমান শৃঙ্খলাদায়ক ক্ষমতাসম্পর্কের শাসনরূপটি ঔপনিবেশিক শোষণের বিশেষ তীব্রতায় জারিত করে ব্রিটিশ শাসকরা এখানে কায়েম করেছিল। সমাজরূপ ও জ্ঞানের একটি ধাপবন্দি কাঠামো তৈরি করে তার শীর্ষে ইউরোপীয় জ্ঞান ও সমাজরূপকে স্থাপন করে,‘শীর্ষ’-কে অনুকরণই শাসিতদের উপরে ওঠার নিয়ম বলে প্রতিষ্ঠা করেছিল। নজরদারি, পুলিশরাজ ও নিয়মানুগকরণের প্রকৌশল সমাজজুড়ে কায়েম করেছিল। উপমহাদেশের বিবিধ জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি ও জ্ঞানের বহুত্ব এবং বিবিধতা ধ্বংস হয়েছিল। জৈবক্ষমতাসুলভ জনসমষ্টি-নিয়ন্ত্রণ, পরিমিতকরণ ও বিদ্বেষী জাতিবাদের চাষও হয়েছিল। বিশ শতকের মাঝামাঝি ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটলেও, তাদের প্রবর্তিত ছঁাচে ঢেলেই ‘স্বাধীন’ শাসনতন্ত্রগুলো নির্মিত হয়েছিল। সমাজসম্পর্কে, মানসিকতায় ও জ্ঞানচর্চাতেও ঔপনিবেশিক খোয়ারি প্রলম্বিত হয়ে কোনও বুনিয়াদি বদল ঘটতে দেয়নি। এরসঙ্গে আরেকটি সমস্যার তীব্রতা ও জটিলতা ক্রমশ বেডে়ছে। হিন্দু ও মুসলমানদের সম্প্রদায়গতভাবে একে অন্যের বিদ্বেষপরায়ণ অপর করে তুলে একে অপরের সঙ্গে ঔপনিবেশিক শাসনের প্রসাদলাভের প্রতিযোগিতায় ও পরস্পরের শত্রুতায় যাতে ব্রিটিশ শাসকদের অনুগত মুখাপেক্ষী করে রাখা যায় তার বিবিধ কৌশল ঔপনিবেশিক শাসনকালে প্রযুক্ত হয়েছিল। ব্রিটিশ শাসকদের বিদায়কালে ভারত ও পাকিস্তান রূপে দুটি বিদ্বেষপরায়ণ রাষ্ট্র তৈরি হওয়ার মধ্য দিয়ে তা পাকাপোক্ত হয়েছে। আর তারপরে এই হিন্দু-মুসলমান পরস্পর বিদ্বেষ জৈবক্ষমতাসুলভ বিদ্বেষী জাতিবাদের সবচেয়ে উর্বর উৎসভূমি হিসেবে কাজ করছে। এই উৎসভূমি থেকেই ভারতে মুসলমান-বিদ্বেষী হিন্দু সাম্প্রদায়িক রাজনীতি এবং বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে হিন্দু বিদ্বেষী মুসলমান সাম্প্রদায়িক রাজনীতি একে অপরকে ইন্ধন জুগিয়ে ক্রমশ নিজ নিজ ভূখণ্ডে সমাজ-রাজনীতিতে নির্ণায়ক শক্তি হয়ে উঠেছে। এই বিশেষত্ব ও বৈশিষ্ট্যগুলো নিয়েই ভারতীয় উপমহাদেশে শৃঙ্খলাদায়ক ক্ষমতা ও জৈবক্ষমতার আদলটিকে বুঝতে হবে ও তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করতে হবে।

একশ বছরেরও বেশি সময় ধরে ভারতীয় উপমহাদেশে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের ধারা প্রবাহিত আছে। বিভিন্ন কম্যুনিস্ট পার্টি ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের সমাজতান্ত্রিক পার্টি আঞ্চলিকভাবে সংসদীয় রাজনীতি-বলয়ের ভিতরে ও বাইরে উপস্থিত আছে। এই পার্টিগুলোর মতবাদিক গঠন, ধাপবন্দি কাঠামোয় বিন্যাস ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার মোহবন্ধনে আবদ্ধতা অতি প্রকট। বিভিন্ন শাসিত-নিপীড়িত বর্গের, এমনকি শ্রমিক ও কৃষকদের প্রতিরোধবিন্দুগুলোর কার্যকরী সংহিতাকরণের বদলে তারা প্রতিরোধের উপর শৃঙ্খলাদায়ক ক্ষমতার নিয়মোচিতকরণ ও পরিমিতকরণের শাসন আরোপ করার উপায় হয়ে ওঠার মধ্য দিয়ে ক্ষমতার বাঁট বা হাতল হিসেবেই প্রধানত কাজ করছে। সুতরাং এই ধারার বাইরে বেরিয়ে সমাজজোড়া প্রতিরোধবিন্দুগুলোর কার্যকরী সংহিতাকরণের বিকল্প উপায় নির্ধারণ করতে হবে, সৃজন করতে হবে।

পারহেসিয় প্রতিরোধের উদাহরণ নিয়ে আলোচনা করার জন্য ফুকো ইউরোপীয় আদিযুগের খৃস্টপূর্ব পঞ্চম শতকের গ্রিক সিনিকদের থেকে শুরু করেছেন। আমাদের ইতিহাসের আদিযুগের দিকে ফিরে তাকিয়ে আমাদের সংস্কৃতিতে এর তাৎপর্য নিয়ে ভাবা জরুরী। খৃস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে ভারতীয় উপমহাদেশ জুড়ে গণরাজ্যগুলো যখন ক্ষয়ের মুখে ও রাজতন্ত্রের উত্থান ঘটছে, তখন গৌতম বুদ্ধ যে রাজনৈতিক ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন (গণরাজ্যগুলোর ক্ষয়রোধের চেষ্টা করা, গণশাসনের সংহিতাকরণ করার প্রয়াস)২২, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের প্রত্যুষকালে ভিক্ষুরা যে সমাজযাপন ও জীবনযাপন চর্চা করেছিল, তা বিশ্লেষণের মধ্য দিয়েও পারহেসিয়ার রূপকে বোঝার চেষ্টা করা জরুরী। আর পারহেসিয়াকে ব্যক্তি বা ক্ষুদ্র গোষ্ঠীচর্চার বিষয় করে না রেখে ক্ষমতাবিরোধী গণাআন্দোলনের স্তরে তার প্রয়োগ কীভাবে করা যায় তা নিয়ে মহাত্মা গান্ধী সত্যাগ্রহ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছিলেন, তার বিশ্লেষণ ও পুনর্মূল্যায়নও জরুরী।

ক্ষমতা/প্রতিরোধ বিষয়ে ফুকো-পাঠ-কে প্রতিরোধের জীবনশৈলীর দিকে প্রসারিত করতে আগ্রহী পাঠক নিশ্চিতভাবেই নিজ সমাজ-ইতিহাস-বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে এই পাঠের পারস্পরিক ক্রিয়া ঘটানোর আরও নানা পথ সৃজন করে নেবেন। সেই পাঠক-সক্রিয়তায় প্রাথমিক সহায়ক হিসেবে ভূমিকা নিতে পারলে এই উপস্থাপনার অভিপ্রায় পূর্ণ হবে।

 

জুলাই-আগস্ট, ২০২১

 

সূত্রনির্দেশ

১। গ্রিগয়ের চ্যামায়ু-র মূল ফরাসি রচনা থেকে স্টিভেন রেন্ডাল কর্তৃক ইংরেজিতে অনূদিত ‘ম্যানহান্টস: এ ফিলজফিকাল হিস্ট্রি' (প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০১২) বইয়ের তৃতীয় অধ্যায়ে উদ্ধৃত। বঙ্গানুবাদ বর্তমান লেখকের করা।

২। গ্রিগয়ের চ্যামায়ু-র মূল ফরাসি রচনা থেকে স্টিভেন রেন্ডাল কর্তৃক ইংরেজিতে অনূদিত ‘ম্যানহান্টস: এ ফিলজফিকাল হিস্ট্রি' (প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০১২) বইয়ের তৃতীয় অধ্যায়ে উদ্ধৃত। বঙ্গানুবাদ বর্তমান লেখকের করা।

৩। জুল মিশেলেট-য়ের মূল ফরাসি রচনা থেকে এল জে ট্রটার কর্তৃক ইংরেজিতে অনূদিত ‘দি উইচ অফ দি মিডল এজেস’ (সিম্পকিন, মার্শাল অ্যান্ড কোম্পানি, ১৮৬৩) বইয়ের ভূমিকা অংশ। বঙ্গানুবাদ বর্তমান লেখকের করা।

৪। জুল মিশেলেট, L’Histoire de France। গ্রিগয়ের চ্যামায়ু-র মূল ফরাসি রচনা থেকে স্টিভেন রেন্ডাল কর্তৃক ইংরেজিতে অনূদিত ‘ম্যানহান্টস: এ ফিলজফিকাল হিস্ট্রি' (প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০১২) বইয়ের সপ্তম অধ্যায়ের শুরুতে উদ্ধৃত। বঙ্গানুবাদ বর্তমান লেখকের করা।

৫। লয়সেলেউর, Les Crimes et les Peines dans l’Antiquite et dans les temps modernes, গ্রিগয়ের চ্যামায়ু-র মূল ফরাসি রচনা থেকে স্টিভেন রেন্ডাল কর্তৃক ইংরেজিতে অনূদিত ‘ম্যানহান্টস: এ ফিলজফিকাল হিস্ট্রি’ (প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০১২) বইয়ের সপ্তম অধ্যায়ে উদ্ধৃত। বঙ্গানুবাদ বর্তমান লেখকের করা।

৬। মিশেল ফুকো, ফুকো লাইভ (সেমিওটেক্সট, নিউ ইয়র্ক, ১৯৯৬), পৃষ্ঠা:৮৪।

৭। মিশেল ফুকো-র মূল ফরাসি রচনা থেকে অ্যালান সেরিডান কর্তৃক ইংরেজিতে অনূদিত ‘ডিসিপ্লিন অ্যান্ড পানিশ: দি বার্থ অফ দি প্রিজন’ (ভিনটেজ/র‍্যান্ডম হাউজ, ১৯৭৯), পৃষ্ঠা: ১৯৮, ১৯৯। বঙ্গানুবাদ বর্তমান লেখকের করা।

৮। মিশেল ফুকো-র মূল ফরাসি রচনা থেকে অ্যালান সেরিডান কর্তৃক ইংরেজিতে অনূদিত ‘ডিসিপ্লিন অ্যান্ড পানিশ: দি বার্থ অফ দি প্রিজন’ (ভিনটেজ/র‍্যান্ডম হাউজ, ১৯৭৯), পৃষ্ঠা: ২০৫। বঙ্গানুবাদ বর্তমান লেখকের করা।

৯। মিশেল ফুকো-র মূল ফরাসি রচনা থেকে অ্যালান সেরিডান কর্তৃক ইংরেজিতে অনূদিত ‘ডিসিপ্লিন অ্যান্ড পানিশ: দি বার্থ অফ দি প্রিজন’ (ভিনটেজ/র‍্যান্ডম হাউজ, ১৯৭৯), পৃষ্ঠা: ২৩৯। বঙ্গানুবাদ বর্তমান লেখকের করা।

১০। মিশেল ফুকো-র মূল ফরাসি রচনা থেকে অ্যালান সেরিডান কর্তৃক ইংরেজিতে অনূদিত ‘ডিসিপ্লিন অ্যান্ড পানিশ: দি বার্থ অফ দি প্রিজন’ (ভিনটেজ/র‍্যান্ডম হাউজ, ১৯৭৯), পৃষ্ঠা: ২৯৬। বঙ্গানুবাদ বর্তমান লেখকের করা।

১১। মিশেল ফুকো, ক্যালিফোর্নিয়ার পালো অল্টো স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে প্রদত্ত ভাষণ, ১৯৭৯-র অক্টোবর। বঙ্গানুবাদ বর্তমান লেখকের করা।

১২। অ্যাডল্ফ হিটলার, মোনোলোগ ইম ফ্যুহরার-হাউপ্টকোয়ারতিয়ের, ১৯৪১-১৯৪৪ (হামবুর্গ: এ.ক্রাউস, ১৯৮০), পৃষ্ঠা: ১৪৮। বঙ্গানুবাদ বর্তমান লেখকের করা।

১৩। মিশেল ফুকো-র মূল ফরাসি থেকে রবার্ট হার্লে কর্তৃক ইংরেজিতে অনূদিত ‘দি উইল টু নলেজ: দি হিস্ট্রি অফ সেক্সুয়ালিটি, ভলুম-১’ (পেঙ্গুইন বুকস, ১৯৯৮), পৃষ্ঠা: ৯৪। বঙ্গানুবাদ বর্তমান লেখকের করা।

১৪। মিশেল ফুকো-র মূল ফরাসি থেকে রবার্ট হার্লে কর্তৃক ইংরেজিতে অনূদিত ‘দি উইল টু নলেজ: দি হিস্ট্রি অফ সেক্সুয়ালিটি, ভলুম-১’ (পেঙ্গুইন বুকস, ১৯৯৮), পৃষ্ঠা: ৮২।

১৫। মিশেল ফুকো, ‘সোসাইটি মাস্ট বি ডিফেন্ডেড’, পৃষ্ঠা: ২৬২-২৬৩। বক্তৃতাটি এই বইয়ে ‘জৈবক্ষমতা’ শীর্ষক অধ্যায়ে অনুবাদ করা হয়েছে।

১৬। হানা আরন্ট, ‘অন ভায়োলেন্স’, ১৯৭২। বাংলা ভাষার পাঠকের জন্য: হানা আরন্ট, হিংসা প্রসঙ্গে (সম্পাদনা ও অনুবাদ-বিপ্লব নায়ক), অন্যতর পাঠ ও চর্চা, ২০১৯।

১৭। ১৯৮১ থেকে ১৯৮৪ সাল অবধি মিশেল ফুকোর দেওয়া এই বক্তৃতামালা ইংরেজি অনুবাদে পাওয়া যায় এই বইগুলোয়: ১। দি হেরমেনিউটিকস অফ দি সাবজেক্ট, প্যালগ্রেভ ম্যাকমিলান, ২০০৫, ২। দি গভর্নমেন্ট অফ সেল্ফ অ্যান্ড আদারস, প্যালগ্রেভ ম্যাকমিলান, ২০১০, ৩। দি কারেজ অফ ট্রুথ, প্যালগ্রেভ ম্যাকমিলান, ২০১১। এছাড়াও ১৯৮৩ সালে এই একই বিষয়ে বার্কলের ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটিতে ফুকো একটি ইংরেজিতে বক্তৃতামালা দেন, যা ২০০১ সালে সেমিওটেক্সট(ই) থেকে ‘ফিয়ারলেস স্পিচ' নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। এই বইগুলোর ভিত্তিতেই এখানে আলোচনা করা হয়েছে।

১৮। মিশেল ফুকো, দি কারেজ অফ ট্রুথ, প্যালগ্রেভ ম্যাকমিলান, ২০১১, পৃষ্ঠা: ৮। বঙ্গানুবাদ বর্তমান লেখকের করা।

১৯। হুবার্ট এল দ্রেইফুস এবং পল রেনবো, মিশেল ফুকো: বিয়ন্ড স্ট্রাকচারালিজম অ্যান্ড হেরমেনিউটিকস (দ্বিতীয় সংস্করণ), দি ইউনিভার্সিটি অফ শিকাগো প্রেস, ১৯৮৩, পৃষ্ঠা: ২৩১-২৩২। বঙ্গানুবাদ বর্তমান লেখকের করা।

২০। আগ্রহী পাঠক এই বিষয়ে বিশদ আলোচনার জন্য এই বইটি পড়তে পারেন: মার্সেলো হফম্যান, ফুকো অ্যান্ড পাওয়ার: দি ইনফ্লুয়েন্স অফ পলিটিকাল এনগেজমেন্ট অন থিয়োরিজ অফ পাওয়ার, ব্লুমসবারি, ২০১৪।

২১। আফারি ও অ্যান্ডারসন, ফুকো অ্যান্ড দি ইরানিয়ান রেভলুশন বইয়ের ১৮৪ পৃষ্ঠায় মিশেল ফুকোর সঙ্গে বকির পারহাম-য়ের কথোপকথন থেকে উদ্ধৃত। বঙ্গানুবাদ বর্তমান লেখকের করা।

২২। এই বিষয়ে বিশদ আলোচনা এখানে করা গেল না। উৎসাহী পাঠকদের এ বিষয়ে বিশদ জানার জন্য ধর্মানন্দ কোসম্বীর এই বইগুলো পড়তে অনুরোধ করব: ১। ধর্মানন্দ কোসম্বী, ভগবান বুদ্ধ, মূল মারাঠি থেকে বঙ্গানুবাদ: চন্দ্রোদয় ভট্টাচার্য, সাহিত্য অকাদেমি, ১৯৮০, ২। ধর্মানন্দ কোসম্বি, দি এসেনশিয়াল রাইটিংস, সম্পাদনা ও ইংরেজিতে অনুবাদ: মীরা কোসম্বি, পার্মানেন্ট ব্ল্যাক, ২০১০, পৃষ্ঠা: ২৪৩-৩১৫, ৩২৭-৪০৮।

 

 

0 Comments
Leave a reply