ভূমিকা
যেহেতু আমরা জানি যে প্রচুর কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন হয়, আর সে নিয়ে মামলা-মোকদ্দমা করারও কোনো মানে হয় না, তাই প্রথমেই বলে নেওয়া ভালো যে বিপ্লবী আন্দোলন বলতে আমি কী বোঝাতে চাইছি। আমার বোঝাবুঝি অনুযায়ী, বর্তমান যুগে বিপ্লবী আন্দোলন নামের যোগ্য হতে হলে একটি আন্দোলনের আবশ্যিকভাবে দুটি চরিত্রবৈশিষ্ট্য থাকতে হবে। প্রথম চরিত্রবৈশিষ্ট্য হলো এই যে তা পুঁজিবাদকে উৎখাত করে অ-পুঁজিবাদী ব্যবস্থা গঠন করতে চায়। দ্বিতীয় চরিত্রবৈশিষ্ট্য হলো এই যে পুঁজিবাদী রাষ্ট্র, জাতিরাষ্ট্র-এর মতো শাসনরূপ ও শাসনকাঠামো ধ্বংস করে রাষ্ট্রহীন স্বশাসন গড়ে তুলতে চায়। এই দুটি কাজ মাঠে-ময়দানে ফলিতভাবে করার পর্যায়ে যে যদি বস্তুগত কারণে না থাকে, তাহলেও সে সেই পর্যায়ে যাওয়ার চেষ্টাটাকেই তার প্রধান কাজ করে তোলে। এখন, বিপ্লবী আন্দোলন বলতে এই যা আমি বুঝি, তা বর্তমানে আমার সমাজে চারদিকে দৃষ্টি ঘুরিয়েও খুঁজে পাই না। বিপ্লবী নামধারী পদ্মলোচনরা তাঁদের স্বঘোষিত বিপ্লবী রাজনীতির চর্চায় ভয়ঙ্কর ব্যস্ত, তাঁদের প্রায় নাওয়া-খাওয়ার সময় নেই, কিন্তু তাঁরা তো কেবল রাষ্ট্রীয় শাসকমহলের তৈরি করে দেওয়া সামাজিক জ্ঞাপনব্যবস্থার মাধ্যমে বৈদ্যুতিন গতিতে প্রচারিত অ্যাজেন্ডাগুলো নিয়েই তুরুক-নাচ নেচে যাচ্ছেন, অ-পুঁজিবাদী ব্যবস্থা গঠন বা রাষ্ট্রহীন স্বশাসনের ব্যবস্থা নিয়ে তাঁদের মুখ থেকে আর কোনো কথাবার্তা শোনা যায় না। আমি তাই ধরে নিয়েছি যে বিপ্লবী রাজনীতি আজ রোগশয্যায় মরণাপন্ন হয়ে উঠেছে। আর তাই তার আরোগ্য কামনা ও পুনরুজ্জীবনের ভাবনা আমায় অধিকার করে বসেছে। সেই কিছু ভাবনাই এখানে হাজির করতে চলেছি।
তবে বলে রাখা ভালো যে এ কোনো ইস্তাহার লেখার চেষ্টা নয়, নেহাতই আলাপ-আলোচনা, তর্ক-বিতর্কের জন্য কিছু ভাবনাকে এগিয়ে দেওয়া। আমি তেমন কোনো ডিগ্রিধারী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নই যে বিপ্লবী আন্দোলনের রোগের নিখুঁত নির্ধারণ ও অভ্রান্ত ব্যবস্থাপত্র প্রদান আমি করে দেব, তেমন কোনো অভিপ্রায়ও আমার নেই। আমার ভাবনাগুলো যে আংশিক, অভিজ্ঞতার সীমাবদ্ধতায় সীমাবদ্ধ, আমার নিজস্ব প্রবণতা-পক্ষপাতের কারণে নিখাদ বিষয়গত নয়, সে আমি বিলক্ষণ জানি। তবু আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে নিজ ভাবনাসীমার বাইরে অপর ভাবনাক্ষেত্রগুলো দেখতে পাওয়ার আশাতেই এই অসম্পূর্ণ ভাবনাগুলো হাজির করছি। পাঠকের ভাবনা ও প্রতিক্রিয়ার অভিমুখেই চেয়ে আছি।
১
পরিবর্তমান প্রেক্ষাপটে সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলন- উদ্যোগের অনেক প্রথাগত পদ্ধতি ও অভ্যাসই গতায়ু অকেজো ভঙ্গিসর্বস্বতায় পর্যবসিত হয়েছে। মতবাদিক জ্ঞান-নির্ভর যেসব প্রয়াস উপর থেকে (রাষ্ট্র দখল করে, নতুন রাষ্ট্র কায়েম করে বা সচেতন অগ্রণী বাহিনীকে বিষয়ী করে তুলে) আদর্শ সমাজ গড়ে তুলতে চেয়েছে সেগুলো প্রত্যেকটাই পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের সাধারণ ব্যবস্থার মধ্যেই সোপানতান্ত্রিক সমাজ শাসন-প্রশাসনের বিকল্প রূপ হিসেবে শেষাবধি থিতু হয়েছে। কল্পিত ও প্রবর্তিত পরিবর্তন-পরিকল্পনার বিভ্রমাত্মক ও ক্ষতিকর প্রকৃতি এভাবে ক্রম-উন্মোচিত হয়ে চলেছে। কিন্তু প্রশ্নটা এখন আর কেবল মুক্ত মানবসমাজ গড়া যাবে কি যাবে না তার প্রশ্ন নয়, প্রশ্নটা এখন আরো বড় আকার ধারণ করে পৃথিবীতে মানব সমাজের অস্তিত্ব টিকবে কিনা সেই প্রশ্নে রূপান্তরিত হয়েছে। জড়-উৎপাদন বৃদ্ধি করে চলার চিরঅতৃপ্ত তাড়নায় মানুষ যেভাবে পৃথিবীর বাস্তুতন্ত্রকে সীমাহীন নিষ্কাশন ও বর্জ্য-পুঞ্জীভবনের ঘায়ে ভঙ্গুর বিপন্ন করে তুলেছে, বিভিন্ন প্রাণী-প্রজাতির জীবনধারণের পরিবেশ ধ্বংস করে তা তাদের নিশ্চিহ্ন করে দিতে দিতে চলেছে, স্বয়ং মানুষের বাঁচার পরিবেশও আর কতদিন কতোটা অঞ্চলে টিকে থাকবে তা আশু প্রশ্ন হয়ে উঠেছে। এই আশু বিপন্নতাবোধ নিয়ে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে থাকা বিভিন্ন জনগোষ্ঠী নিজ নিজ স্বজ্ঞা, শক্তি ও দিশামুখ অনুযায়ী যা ভাবছে-বলছে-করছে, সেই স্বতঃক্রিয়ার বহুবিভিন্ন পথরাজির জালকে শাসন বা নিয়ন্ত্রণ করার কোনও ভান না করে প্রতিরোধ-প্রতিকারের কার্যকরী কোনো বুনট গড়ে তোলা যায় কি? এই প্রশ্নটাই এখন নাছোড়বান্দা হয়ে উঠেছে।
কোনো বদ্ধচিন্তার কুঠুরি বা কোনো মতবাদের মধ্যে নিজেদের আবদ্ধ করে ফেললে মুশকিল। বদ্ধচিন্তা বা মতবাদ সাধারণত সক্রিয়তার পথপ্রদর্শক হিসেবে যাত্রা শুরু করে শেষাবধি একটি অনমনীয় কর্তৃত্ববাদী বন্দিকুঠুরিতে রূপান্তরিত হয়। তেমন কিছুতে নিজেদের আবদ্ধ না করে যদি প্রতিনিয়ত নিজেদের পরিবর্তন করতে করতে যাওয়া যায়, পরিবর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে এবং বিবিধ অন্যান্য গোষ্ঠী ও সংগঠনের সঙ্গে নিবিড় মিথষ্ক্রিয়া থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেদের বক্তব্য-ভাবনা-আচরণ সমৃদ্ধতর করতে করতে যাওয়া যায়, অপরদের কথা শোনার উৎসাহে ঘাটতি না পরে, অপরদের থেকে শেখায় আত্মম্ভরীতা বাধা হয়ে না দাঁড়ায়, আর প্রতি পদক্ষেপেই স্বাস্থ্যকর আত্মসমালোচনা করতে করতে যাওয়া যায়, তাহলে হয়তো চলার পথ কোনো মতবাদের অন্ধকুঠুরিতে গিয়ে মুখ গুঁজবে না। কেউ কেউ হয়তো যাকে মতবাদিক নীতিকাঠামোর প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা স্বরূপ গিরগিটির মতো রঙ পাল্টানো বলে গালি দেবেন, তা আসলে প্রাণময়তা, নমনীয়তা, অর্গলহীনতা ও পরিবর্তনে সক্ষমতারই নানা অভিব্যক্তি হতে পারে। তা বলে এ নিছক প্রয়োগবাদ বা সুযোগ বুঝে যখন যেমন খুশি করার সুবিধাবাদীতা হয়ে উঠলে সর্বনাশ। জীবনাচরণের কিছু নীতিকে আঁকড়ে ধরে থাকা--- নৈতিক নিষ্ঠা--- না থাকলে গভীরে শিকড় ছড়ানো, খোলামেলা অপরবৎসল স্থিতসত্তা থেকে উৎসারিত শক্তিই বা পাওয়া যাবে কোথায়? তাই এ হলো এক জীবনশৈলী গড়ে তোলার প্রশ্ন, নিছক কোনো আন্দোলন গড়ে তোলার প্রকৌশল আয়ত্ত করে নেওয়ার প্রশ্ন নয়।
ইওরোপের উনিশ শতককে ‘মতবাদের শতক’ বললে অত্যুক্তি হয় না। এই শতকেই আদর্শ সমাজ গঠনের অভিপ্রায় বিভিন্ন মতবাদের রূপ ধরেছে এবং রাজনৈতিক চর্চার পরিসরে আধিপত্য কায়েম করেছে। ক্রমশ সেই শতকের গণ্ডী ছাড়িয়ে ও ইওরোপের সীমানা ছাপিয়ে তা বিস্তৃত হয়েছে। এই মতবাদিক রাজনৈতিক চর্চায় ‘বিপ্লবী অগ্রণী’ হলো মূল বিষয়ী। ‘বিপ্লবী অগ্রণী’ মাত্রেই নিজেদের নেতৃত্বদায়ী-নির্দেশদায়ী অবস্থান বজায় রাখার জন্য বাতিকগ্রস্তের মতো বদ্ধপরিকর। যে কোনো উপায়েই হোক না কেন ‘জনগণ’-এর মাথার উপর নিয়ন্ত্রক হিসেবে তাদের থাকতেই হবে। আর তাদের সবসময়ই তাড়াহুড়ো লেগে আছে। প্রতিশ্রুত ভূমিতে— সাধারণত যার অর্থ রাষ্ট্রক্ষমতা দখল— তাদেরই সবার আগে পৌঁছতে হবে। তারা ভাবে যে একবার রাষ্ট্রক্ষমতার দখল নিতে পারলে, তারপর তারা তাদের বিপ্লবী প্রকল্পের রূপায়ণে জনগণকে নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে। ভবিষ্যৎ যখন ‘বিপ্লবী অগ্রণী’-দের মতবাদ-নির্ণীত প্রক্রিয়া অনুসরণের পথে প্রযুক্তি-ব্যবস্থাপনার শক্তি দিয়ে ছককাটা নকশার বাস্তব হয়ে ওঠা ছাড়া আর কিছু নয়, সেই পথপ্রবর্তকরা তখন যেমন একদিকে তাদের অভিপ্রায়ের অনিবার্যতার মোহে নিজেদের পরম ক্ষমতাশালী বলে মনে করতে থাকে, নিজেদের মতবাদিক অভিপ্রায়কেই ইতিহাসের অভিপ্রায় বলে অমোঘ জ্ঞান করে, তেমনই নতুন প্রযুক্তি ও নতুন রাষ্ট্র-পদ্ধতির একীভূতকরণের মধ্য দিয়ে সর্বাত্মকতাবাদী শাসকের দৃষ্টিভঙ্গি রপ্ত করে বসে। মরা আলোয় ধূসর সে প্রান্তরে প্রতিটি মানুষই যেন প্রযুক্তির দ্বারা প্রযুক্তির জন্য উৎপাদিত বস্তু। জড়-উৎপাদন বৃদ্ধি, আরো বৃদ্ধি, অনন্ত বৃদ্ধির নিমিত্তই যেন মানুষের অস্তিত্ব। পরিস্থিতি একবার এই দ্রুতি নিয়ে নিলে মতবাদের দাবদাহে জীবন শুকিয়ে আসে, মানুষের রক্তমাংসগত সব অনুভূতি-আকাঙ্ক্ষা-বিস্ময়-বেদনা প্রতিস্থাপিত হয় নীরস উপাত্তের সারবদ্ধ সারণির দ্বারা, মানুষের অস্তিত্বগত সমস্ত যাত্রা এক নির্মীত অমরত্বে স্থানু হয়ে যায়। দেহপট শূন্য করে চেতনাকে বহিঃস্থ জ্ঞানরূপ দেওয়ার কাজ যত সম্পন্ন হয়, ততই নজরদারি চক্ষু ও উপাত্ত-সংস্কৃতির দাপট বাড়ে। ভবিষ্যতের জাঁকালো বিজ্ঞাপনে চাপা পড়ে যায় সমস্ত ভবিষ্যকল্পনা। এভাবে যখন মানুষ কেবল মতবাদিক অভিপ্রায় পূরণের হাতিয়ারে পরিণত হয়, এই উপযোগিতা-তত্ত্বকেই ন্যায়পরতার নয়া সংহিতার চেহারায় হাজির হয়। জড়প্রযুক্তি-উৎসারিত উন্নতি-প্রগতি-র অভিপ্রায় যাতে মেটে, তাই-ই সত্য, যথার্থ ও যথোচিত: অভিপ্রায়ের অভিপ্রায় যখন এভাবে আত্ম-প্রত্যাভূতি উৎপন্ন করে চলে, সত্যও তখন আর আদি থাকে না, অভিপ্রায়ই আদি হয়ে ওঠে, অভিপ্রায়ই তখন সত্য উৎপাদন করে চলে, সত্য-অসত্যের বিরোধ উবে গিয়ে উত্তর-সত্য আবির্ভূত হয়। একমেবাদ্বিতীয়ম মানদণ্ড হাজির করে চলা, তীক্ষ্ণ ও হিংস্র নজরদারি কায়েম করা, শৃঙ্খলায় বিন্যস্ত ও অধীনস্থ করা এবং অভিভাবকসুলভ উপদেশ দেওয়া--- এই চার রণকৌশলের সংযোগে নয়া সর্বাত্মকতাবাদী শাসনের কোষগ্রন্থিগুলো কাজ করতে থাকে।
এর বিপরীতে দাঁড়িয়ে, সর্বাত্মকতাবাদের কোষগ্রন্থিগুলোকে নির্মূল করতে করতে এগোনোর ভাবনা নিয়ে যে কোনো গোষ্ঠীস্তরে রাজনৈতিক চর্চা করতে হলে যে কোনো কাজের কাজের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমহীনভাবে সকলের মতের ঐক্য গঠনের চেষ্টা ও শ্লথতমের গতিতে হাঁটা ছাড়া বোধহয় উপায় নেই। যে পরিস্থিতিই হোক না কেন, অল্প কয়েকজন নেতার দল কোনো গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়ে নেবে এমনটা হতে দিলে হবে না। তার ফলে, সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়া ধীরগতি ও জটিল হয়ে উঠতে পারে, লম্বা কুণ্ডলী-পাকানো আলোচনা-পরামর্শের উপর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে, কিন্তু সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘু নির্ণয়ের ভোটগ্রহণ পদ্ধতির মধ্য দিয়ে তাকে দ্রুত করার কোনো চেষ্টা করা মোটেই উচিত হবে না যেহেতু সেই পদ্ধতি সর্বদাই বিজয়ী ও বিজিত, সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘুর অমীমাংসিত অবশেষ রেখে যায়। গণভোট, আস্থাভোট বা নির্বাচনের ব্যালট বাক্স নানারকম লুকানো প্রভাবাধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণের কবলে থাকে তো বটেই, তাছাড়াও এই পূর্বানুমানের উপর দাঁড়িয়ে থাকে যে ভোটাধীন বিষয়টির উপর সবাই একইরকম সাধারণ বোঝাবুঝিতে আছে এবং ভোটদাতাদের সবার মনোভাবও মূলগতভাবে সদৃশ, যা ভোটের মধ্য দিয়ে নির্মিত ‘গণতান্ত্রিক ঐক্যমত’-কে সম্ভব করে তোলে। কিন্তু বাস্তব জগতে স্বার্থ, উপলব্ধি, মনোভাব, ও স্বরের বহুত্বে সঞ্জাত বহুল পার্থক্য সম্পর্কে পূর্ণভাবে সচেতন হয়ে উঠলে ওই পূর্বানুমানগুলো ভুল প্রমাণিত হয়। এই সচেতনতা নিয়েই সবার রাজি হওয়া পথে হাঁটার সময় মন্থরগতি শ্লথদের গতির সঙ্গে গতি মিলিয়ে হাঁটার চেষ্টা করলে শ্লথরাও আশা করা যায় তাদের দিক থেকে নিজেদের গতি বাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে পারে, কিন্তু সামগ্রিকভাবে তাড়াহুড়ো করার প্রবণতা বিসর্জন না দিলে এ সম্ভব নয়।
২
যে কোনো রাজনৈতিক ক্রিয়ার ক্ষেত্রেই ক্ষমতা সম্পর্কে ধারণা একটা নির্ধারক ভূমিকা পালন করে থাকে। ক্ষমতা কার হাতে আছে আর ক্ষমতা কার হাতে আনতে চাই যে সম্পর্কে সিদ্ধান্ত প্রকট বা প্রচ্ছন্ন রূপে রাজনৈতিক ক্রিয়াকে চালিত করে থাকে। সাধারণত ধরে নেওয়া হয় যে ক্ষমতা রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলির পরিচালক ব্যক্তি/গোষ্ঠী/শ্রেণি-র হাতে ন্যস্ত থাকে এবং সমাজ-পরিবর্তনের জন্য রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর তাই অপর ব্যক্তি/গোষ্ঠী/শ্রেণি-র দখল কায়েম করা চাই। এই ধারণা যেমন ক্ষমতাকে রাষ্ট্রীয়-প্রাতিষ্ঠানিক উৎসমূলে কেন্দ্রীভূত বলে ধরে নেয়, তেমনই তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ-প্রতিবাদকে ওই ক্ষমতাবৃত্তের বাইরে থেকে ওই বৃত্তকে ভেঙে বৃত্ত দখল বা নিজ বৃত্ত গঠনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাহীন থেকে ক্ষমতাপন্নে উৎক্রমণের যাত্রা বলে মনে করে। সংখ্যালঘুর স্বার্থবাহীদের হাত থেকে সংখ্যাগুরুর স্বার্থবাহীদের হাতে ক্ষমতা নিয়ে আসার অভিপ্রায় দিয়ে সে নিজ যাথার্থ্য প্রতিপন্ন করে।
একশো বছরেরও বেশি সময়কাল জুড়ে আমূল সমাজ-পরিবর্তনে উৎসাহীরা অগ্রণী বিপ্লবী কর্মীদের (vanguard) উপর নির্ভরশীল এক বিপ্লব-সংঘটন-প্রক্রিয়ার ধারণার অংশ হিসেবে রাষ্ট্রের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছে। লেনিনের সময় থেকেই ব্যাপকভাবে ধরে নেওয়া হয়েছে যে (অবশ্য লেনিনের লেখায় কেবলমাত্র এই কথাই বলা আছে তা নয়, অন্য যা কিছু বলা আছে তা লেনিনবাদীদের সাধারণ ধারণার স্তরে তেমন গুরুত্ব পায়নি) আলোকপ্রাপ্ত এক দল বিপ্লবী জনগণের জন্য ‘স্বর্গরাজ্য’-টির নকশা তৈরি করে জনগণকে নেতৃত্ব দিয়ে সেখানে পৌঁছে দেবে। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সংগ্রাম হয়ে উঠবে রাষ্ট্রকে দখল করার লক্ষ্যে সংগ্রাম, বিপ্লবী রাষ্ট্রের জন্য সংগ্রাম। এই পরম্পরার মধ্যে বেড়ে উঠে আমরা ধরে নিয়েছিলাম যে রাষ্ট্র কেবলমাত্র এমনই এক যন্ত্র যাকে যন্ত্রধারী যা নির্দেশ দেয় সে তা-ই করে। কে (কোন পার্টি বা শ্রেণি) তাকে পরিচালনা করছে, তার উপর দাঁড়িয়েই কেবল রাষ্ট্র ফ্যাসিবাদী বা বিপ্লবী বা গণতান্ত্রিক হয়।
আজ আমাদের স্বীকার করতে হবে যে, সবচেয়ে হিংস্র একনায়কত্ব বা সবচেয়ে মার্জিত শুদ্ধতম গণতন্ত্র, যে রূপই জাতি-রাষ্ট্র ধারণ করুক না কেন, তা জনগণের উপর আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে জনগণকে পুঁজির সেবায় নিয়োজিত করারই একটি কাঠামো থেকে যায়। আধুনিক রাষ্ট্রই হল সমষ্টিগত পুঁজিপতির আদর্শ রূপ। এই চরিত্রবলে সবচেয়ে হাল আমলের ‘গণতান্ত্রিক’ প্রতিষ্ঠানসমূহ নিয়ে রাষ্ট্রকাঠামো গড়লেও তা একটি একনায়কত্ব রূপেই (পুঁজির একনায়কত্ব রূপে) কাজ করে। তাই পুঁজি-বিরোধী সংগ্রামে প্রতিটি পদক্ষেপেই রাষ্ট্রকে প্রতিরোধ করতে হয়। এই একই বিচার থেকে, রাষ্ট্রকে দখল করা বা রাষ্ট্রের সঙ্গে সহযোগিতা করার যে কোনো কার্যক্রম মূলগতভাবে পুঁজিবাদী উৎপাদন-সম্পর্ক ভিত্তিক সমাজব্যবস্থারই বিকল্প ব্যবস্থাপত্র প্রস্তুত করার ভার নেওয়া ছাড়া আর কিছু নয়। পুঁজিবাদ অতিক্রম করে যাওয়া যদি বিপ্লবীদের মূল লক্ষ্য হয়, তাহলে সংক্রামক মহামারীর মতো জ্ঞান করে এই রাষ্ট্রকে দখল করে ব্যবহার করা বা রাষ্ট্রের সঙ্গে সহযোগদিতা করার যে কোনো প্রবণতাকে এড়িয়ে যেতে হবে। সংগ্রামের বিজয়মুহূর্তে রাষ্ট্রের সঙ্গে সমস্ত সংযোগ ঝেড়ে ফেলে রাষ্ট্রীয় যন্ত্রটিকেই সম্পূর্ণত ধ্বংস করতে হবে।
ক্ষমতা দখল করার বামপন্থী বাতিক দুটি পথে আত্ম-ধ্বংসের দিকে ঠেলে নিয়ে যায়। প্রথম ও সবচেয়ে স্পষ্ট পথটি হল পচন ও অপচারের পথ। এর ফলে ক্ষমতা হাতে এলেই নৈতিক সংবেদনশীলতা অন্তর্হিত হয়। সংগ্রামের সময়কার উচ্চ আদর্শগুলো ক্রমে দ্রবীভূত হয়ে মিলিয়ে যায়। ক্ষমতা-দখল লক্ষ্যপূরণের মাধ্যম না থেকে স্বয়ং লক্ষ্য হয়ে ওঠে। এই বিন্দুতে দাঁড়িয়ে, যে কোনো পথই ন্যায়সংগত বলে মনে হতে থাকে— বিশ্বাসভঙ্গ, দালালি-মোসায়েবি, কুকর্মের অংশ হওয়া, যে কোনো ধরনের অপরাধ, অসততা, অব্যাহতিই যুক্তির মুখোশ এঁটে গ্রহণীয় হয়ে ওঠে— সংক্ষেপে বললে, ন্যায়পরতার অভাব রূঢ় চূড়ান্ত রূপ ধারণ করে।
কিন্তু আত্ম-ধ্বংসের আর এক ধরনের পথও আছে যা সচরাচর আড়ালে থেকে যায়, কিন্তু যার সংক্রমণ ঘটে আরো দ্রুত ও আরো ব্যাপকভাবে। সেই পথ হলো এইরকম: ক্ষমতাকাঠামোর চুড়োর দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে, কেবল তা-ই নয়, সেই চুড়ো থেকেই আমরা সবকিছু দেখছি বলে ভেবে নিয়ে আমরা আমাদের পরিপ্রেক্ষিত হারিয়ে ফেলি বা খুইয়ে বসি। রাষ্ট্রক্ষমতা করায়ত্ত করার আগ্রহ থেকে আমরা রাষ্ট্রের মতো চিন্তা করতে শুরু করি। রাজনৈতিক তত্ত্ব ও চর্চার এক দীর্ঘ পরম্পরা এই উপর থেকে দেখা-র সঙ্গে আমাদের অভ্যস্ত করে তোলে— যেনবা ইতিমধ্যেই আমরা ওই উপরে অবস্থান করছি— জনগণকে একটি জড়পিণ্ড হিসেবে বিবেচনা করা, নিজেদের জ্ঞান-কলা-কৌশলের বলে সেই জড়পিণ্ডকে চালিত করা সম্ভব বলে ভেবে বসা, জনগণের অভিভাবকত্বের দায় কাঁধে তুলে নেওয়া এবং বেঁধে দেওয়া পথে চলতে বেগড়বাঁই করছে দেখলেই শাসন করে বা শাস্তি দিয়ে জনগণকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করার চেষ্টা করা--- রাষ্ট্রের ভূমিকাকে আমরা আত্মীকরণ করে নিতে শুরু করি। জাঁকালো সব তত্ত্ব আর রাজকীয় সব পরিকল্পনার স্রোতে রাজনৈতিক কল্পনাকে ভাসিয়ে দিয়ে বাস্তব সম্পর্কে সব বোধ আমরা হারিয়ে বসি। সমাজ-রূপান্তরের কাজে দায়বদ্ধ বহু যোদ্ধাকর্মীই সমাজ বিষয়ক এমন এক সামগ্রিকতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গিকে তঁাদের কাজের ভিত্তি করেন, যার মধ্যে আদর্শ সমাজব্যবস্থার বর্ণনা এবং প্রত্যেকের জন্য অনুসরণীয় বিপ্লবী কর্মসূচীর সূত্রায়ণ থাকবেই থাকবে। কিন্তু রূপান্তরকারী ক্রিয়ার ওই রকম কোনো দৃষ্টিভঙ্গির উপর ভিত গাড়ার দরকার পড়ে না; বরং পক্ষান্তরে, সামগ্রিকতাবাদী বয়ানের পীড়নতন্ত্রের থেকে আমূল বিচ্ছেদ সূচিত না বলে জনগণের নিজস্ব প্রাণশক্তি সৃষ্টিশীলতার প্রকাশ ঘটতে পারে না।
রাষ্ট্রকাঠামোর শীর্ষেই হোক, বা অজ কোনো গঞ্জে ক্ষুদ্রতম কোনো প্রশাসনিক পদে আসীন হোক, ক্ষমতার স্বাদ পাওয়া মানুষরা কেমন যেন উন্মত্ত বিকারগ্রস্ত হয়ে ওঠে। একই রকম উন্মত্ত বিকার ভর করে তাদের উপর যারা ক্ষমতার জন্য লড়াই করে। কারণ, শেষাবধি, ক্ষমতা হল একটি সম্পর্ক; তা এমন কোনো জড়বস্তু নয় যা বিতরণ করা যায়, যা কারো অনেক আছে আর কারো নিতান্তই অভাব, যা ছিনিয়ে নেওয়া বা জিতে নেওয়া যায় আর কোনো হাতিয়ারের মতো বিবিধ উদ্দেশ্যপূরণে ব্যবহার করা যায়। ক্ষমতা জাতি-রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণের সম্পর্কজাল ফুটিয়ে তোলে। যেজন ক্ষমতাচুড়োর দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে ক্ষমতা দখলের চেষ্টাই করে চলে, আধিপত্যের জীবাণু তার দেহেও সংক্রামিত হয় এবং সে তার নিজের ঘনিষ্ঠ সহযোদ্ধাদের উপরও বিনা দ্বিধায় ও বিনা সংকোচে ক্ষমতা খাটিয়ে চলে, যেহেতু তাঁর ‘মহান অভিপ্রায়’ পূরণের জন্য কোনো পন্থাকেই তিনি অন্যায় বলে মনে করেন না এবং তঁার চারপাশের মানুষজন তো তঁার লক্ষ্য-অর্জনের পথে হয় রসদ নয়তো বাধা বৈ আর কিছু নয়।
ক্ষমতার বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে ক্ষমতাকেই অনুকরণ-অনুসরণ করতে থাকার এই কানাগলির মধ্যে ঢোকার পরিবর্তে বামপন্থীদের পরিচয়-নির্ধারক হওয়া উচিত এহেন সংগ্রাম যা এমন সামাজিক সম্পর্কের জন্ম দিতে পারে যেখানে ওইরকম ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত কারও কোনো স্থান নেই— এমন সব নতুন সামাজিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে যার মধ্যে ক্ষমতার কোনো চুড়ো-বাঁধা প্রাতিষ্ঠানিক নির্মাণ নেই, তা কেবল সম্মানের স্বাধীন-স্বকীয় অভিব্যক্তি হিসেবেই অস্তিত্বশীল; আর তলা থেকে সাধারণ মানুষদের দ্বারাই গড়ে তোলা সেসব সম্পর্ক, উপর থেকে কোনো আলোকপ্রাপ্ত অগ্রণীর গড়া নয়।
আমাদের অনেকের ধারণামতেই ক্ষমতা এমনকিছু যা বাধা, দমন ও নিষেধাজ্ঞার মধ্য দিয়ে কাজ করে। এই ধারণামতে ক্ষমতা হলো এমনকিছু যা প্রকৃত বাস্তবতাকে আড়াল করতে চায়, স্বতঃস্ফূর্ততায় বেড়ি পড়ায়, সত্যের ঢেকে রাখে, মিথ্যাকে জাহির করতে চায়, জ্ঞানের উৎপাদন বন্ধ বা অন্তত বিকৃত করে। আর এর মধ্য দিয়ে ক্ষমতা স্বাভাবিক আকাঙ্ক্ষাকে অবদমন করে, মিথ্যা বা কৃত্রিম চেতনা জাগায়, জ্ঞানহীনতার পৃষ্ঠপোষণা করে। সত্য-স্বাভাবিকতা-স্বতঃস্ফূর্ততা ক্ষমতার প্রতিপক্ষ, তাই অবদমন-নিষেধাজ্ঞা অস্বীকার করে সত্যকে তুলে ধরা, সত্যকে প্রতিষ্ঠা করাই হলো প্রকৃত বাস্তবতার অবিকৃত চেতনাধারীদের করণীয় প্রতিরোধ। সুতরাং ক্ষমতা ও প্রতিরোধকে এখানে একটি নঙর্থক><সদর্থক বিরোধের মধ্য দিয়ে দেখা হয়ে থাকে। ক্ষমতা নঙর্থক কারণ তা সত্য, জ্ঞান, স্বতঃস্ফূর্ততার অবদমনকারী বা খণ্ডনকারী, আর প্রতিরোধ সদর্থক কারণ তা সত্য, জ্ঞান, স্বতঃস্ফূর্ততাকে বাধামুক্তভাবে প্রতিষ্ঠা করে। এই অর্থেই প্রতিরোধ ক্ষমতার বহিঃস্থ বস্তু, তার অস্তিত্ব ক্ষমতার বিপরীতে পৃথক বা আলাদা।
কিন্তু ক্ষমতাকে কেবলমাত্র এই নঙর্থক অস্তিত্ব দিয়ে দেখা কি ঠিক? ক্ষমতা তো কেবলমাত্র সত্য, জ্ঞান ও স্বতঃস্ফূর্ততাকে অবদমন বা খণ্ডন করে না, তা সত্য, জ্ঞান ও স্বতঃস্ফূর্ততা উৎপাদনও করে। একটি প্রতর্কের সত্যাসত্য বিচার করার পদ্ধতি ও দৃষ্টিভঙ্গি, জ্ঞানের বিষয় কী হবে এবং কাকে জ্ঞান বলে স্বীকার করা হবে, কোন প্রবৃত্তিগুলোকে স্বাভাবিক বলে ধরা হবে ও সেই সূত্রে স্বতঃস্ফূর্ততা বলে কাকে মান্যতা দেওয়া হবে— এই সবই ক্ষমতাসম্পর্ক দ্বারা প্রভাবিত হয়। অভিভাবকীয় ক্ষমতা, শৃঙ্খলাদায়ক ক্ষমতা ও জৈবক্ষমতা (জন্ম-মৃত্যুর মধ্য দিয়ে জৈবিক উৎপাদন-পুনরুৎপাদন, সামাজিক উৎপাদন প্রক্রিয়ার অঙ্গীভূত করে জনসমষ্টিকে উৎপাদিকা শক্তি হিসেবে রক্ষণাবেক্ষণ করা— এহেন জৈবিক প্রক্রিয়াসমূহের ব্যবস্থাপনার আশু লক্ষ্য নিয়ে হাজির হওয়া ক্ষমতা-প্রকৌশল)— সামাজিক ক্ষমতার এই সবকটা রূপের অধীনেই সত্য, জ্ঞান ও স্বতঃস্ফূর্ততা উৎপাদনের নিজস্ব প্রকৌশলসমূহ ও প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। সুতরাং সত্য, জ্ঞান ও স্বতঃস্ফূর্ততার প্রতর্ক হাজির করা, তা যতই প্রতিস্পর্ধী চরিত্রের হোক না কেন, তাকে আমরা একলপ্তে ক্ষমতাবলয়ের বাইরের একটি ক্রিয়া হিসেবে ধরে নিতে পারি না। বরং তা ক্ষমতাবলয়ের মধ্যে, ক্ষমতাসম্পর্কের মধ্যস্থতায়, ক্ষমতার প্রকৌশল ব্যবহারের মধ্য দিয়েই সম্পাদিত একটি কাজ। ক্ষমতা কেবল অবদমন ও নিষেধাজ্ঞা আরোপের মধ্য দিয়ে কাজ করে না, নিরাপত্তা, সমৃদ্ধি ও উৎপাদনশীলতা সৃষ্টির মধ্য দিয়েও কাজ করে, মান্যতা উৎপাদন করে। একটি আধিপত্যবাদী প্রতর্ক আরোপ করার মধ্য দিয়ে কেবল নয়, বহু পরস্পরবিরোধী প্রতর্কের প্রতিস্থাপনের মধ্য দিয়েও সে কাজ করে (যেমন জৈবক্ষমতা জীবনকে নিরাপত্তা দেওয়া ও গণহত্যা সংঘটিত করার পরস্পরবিরোধী প্রতর্ককে যুগপৎভাবে ব্যবহার করে চলে)। প্রতিরোধ তাই ক্ষমতার বহিঃস্থ নয়। প্রতিরোধ ও ক্ষমতা এমনভাবে কুস্তির প্যাঁচে পরস্পরের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে যা নব নব কৌশল উদ্ভাবনের পথে একে অপরকে উত্তেজিত, উৎসাহিত করতে থাকে। ক্ষমতার জাল জুড়ে প্রতিরোধবিন্দু তৈরি হতে থাকে।
ক্ষমতা ও প্রতিরোধকে একে অপরের বাইরে ও একে অপরের বিরোধী হিসেবে স্থাপনের আর একটি তাৎপর্য থাকে: অবদমনকারী, নিষেধাজ্ঞা-আরোপকারী ক্ষমতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে অবদমিত সত্যটিকে উপলব্ধি ও উদ্ধার করে তুলে ধরছেন যিনি, তিনি সর্বজনীন পথপ্রদর্শক হিসেবে ক্ষমতার বাইরে ও প্রতিরোধের ভিতরে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি সত্যদ্রষ্টা বুদ্ধিজীবী হিসেবে, প্রতিরোধের নেতা হিসেবে ক্ষমতাধিপত্য-মুক্ত এক ভবিষ্যতে পৌঁছানোর পথ সাধারণজনের সামনে হাজির করছেন ও সেই পথে সাধারণজনকে শামিল করছেন। প্রতিরোধের সদর্থক বলয়ের মধ্যে তিনি প্রধান পুরুষ। এই প্রধান পুরুষের ভূমিকায় কোনও দার্শনিক থাকতে পারে, রাজনীতিবিদ থাকতে পারে, আবার কোনও বিপ্লবী মতবাদ বা মতবাদ-চালিত বিপ্লবী পার্টিও থাকতে পারে। তার মধ্য দিয়ে এই প্রতিরোধের বলয়েও একটি ধাপবন্দি কাঠামো তৈরি হয় যেখানে সর্বোচ্চ ধাপে স্থিত এই প্রধান পুরুষের কাছে নিচের ধাপে স্থিত সাধারণজনকে প্রতিরোধের স্বার্থে আত্মসমর্পণ করতে হয়। এই ধাপবন্দি কাঠামোও তার স্বকীয় শৃঙ্খলাদায়ক ক্ষমতার জন্ম দেয়। শৃঙ্খলাদায়ক ক্ষমতার সমস্ত প্রকৌশল (যেমন, বিপ্লবী শৃঙ্খলার সংহিতাকরণ, শৃঙ্খলা ও মতবাদের শুদ্ধতা রক্ষার্থে নজরদারি, শৃঙ্খলাভ্রষ্ট বা মতবাদভ্রষ্টদের শাস্তিদান বা বিতাড়ন, ইত্যাদির বিভিন্ন প্রকৌশল) এই ধাপবন্দি কাঠামোর উপর থেকে নিচ অবধি সমস্ত সম্পর্ককে নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে। এভাবে ক্ষমতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার নামে আরেকটি ঠাসবুনট ক্ষমতার ক্ষেত্রই তৈরি হয়।
এভাবে প্রতিরোধের নামে ক্ষমতার অপর একটি ঠাসবুনট ক্ষেত্র গড়ে তোলা এড়াতে গেলে আমাদের স্বীকার করে নিতেই হবে যে মহান ‘বিরোধী আন্দোলনের’ কোনো একমেবাদ্বিতীয়ম গতিপথ নেই, নিটোল সত্তা বিশিষ্ট এমন কোনো বিদ্রোহ থাকতে পারে না যা সমস্ত বিদ্রোহের উৎস হিসেবে কাজ করতে পারে, নেই বিপ্লবের কোনো আগমার্কা খাঁটি নিয়ম। অর্থাৎ প্রতিরোধের বিন্দুগুলোকে কোনো মতবাদ বা মহান নেতৃত্বের নেতৃত্ব দিয়ে দৃঢ় বন্ধনে বেঁধে অপর একটি ধাপবন্দি ক্ষমতার ক্ষেত্রনির্মাণ যদি আমরা না চাই, তাহলে সবসময় খেয়াল রাখতে হবে যে:
এহেন অ-লঘুকরণযোগ্য প্রতিরোধবিন্দুগুলোর পরস্পর-সচেতন সংহিতাকরণের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাধিপত্য ভেঙে নতুন সমাজ পার্থক্যকে সম্মান করা সমতার দিকে হয়তো যেতে পারে, কিন্তু প্রশ্নটা এখানে কার হাত থেকে কার হাতে ক্ষমতা নিয়ে আসা হবে তা নয়, প্রশ্নটা হলো ধাপকাটা সোপানতান্ত্রিক ক্ষমতারূপের পরিবর্তে একই তলে অবৈরী সম্পর্কে বিন্যস্ত ক্ষমতাবৃত্তসমূহের নৈরাষ্ট্রীয় পরিসর নির্মাণ করার।
৩
যে কোনো প্রতিনিধিত্বমূলক ব্যবস্থায় প্রতিষ্ঠানসমূহকে রূপ দেওয়ার ও পরিচালনা করার জন্য প্রতিনিধিবর্গকে নির্বাচিত করে দেওয়ার পদ্ধতি যতই নিখুঁত করে সাজানো যাক না কেন, খেয়ালে রাখা দরকার যে প্রতিষ্ঠানগুলোর ‘শীর্ষদেশ’-এ গণতন্ত্রের বসত নয়, গণতন্ত্রের বসত একমাত্র সর্বসাধারণের মাঝেই হতে পারে। চুড়ো তুলে গড়া ক্ষমতায় নির্বাচিত প্রতিনিধিদের উপর বিশ্বাস উৎপাদনের নানা কৌশল (যেমন স্বল্প মেয়াদে নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি, প্রতিনিধিদের উপর নজরদারি ব্যবস্থা, কৈফিয়ত চাওয়ার ব্যবস্থা, ইত্যাদি)-এর মধ্য দিয়ে প্রশাসনিক বৈধতা নির্মীত হয় অবশ্যই, কিন্তু সর্বসাধারণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের কোনো সুযোগ থাকে না। গোষ্ঠীজীবনগত যে সাধারণ অভ্যাস ও সংস্কৃতি সামাজিক পরিসরে কাঠামোকৃত ক্ষমতাকে রূপ দেওয়ার প্রক্রিয়াতেই সেই কাঠামোয় প্রাণ, অর্থ ও সারবস্তু সঞ্চারিত করে, সেই গোষ্ঠীগত অভ্যাস-সংস্কৃতির সাধারণ বলের জমিতে নেমে যাতে সর্বসাধারণ নিজেরাই প্রত্যক্ষ ও সচেতন ভাবে নিজেদের আঞ্চলিক প্রশাসন স্বাধীনভাবে নিজেরাই সবার অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে চালাতে পারে, সেই সুযোগ ও চর্চা বিকশিত করার মধ্য দিয়েই প্রকৃত অর্থে গণতন্ত্র বিকশিত হতে পারে।
‘গণতান্ত্রিক’ জাতি-রাষ্ট্রের বিকল্প হিসেবে প্রস্তাবিত কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক নকশার প্রতি আনুগত্যে নিজেদের অভিপ্রায় বা ভাবনাধারা বেঁধে ফেলার পরিবর্তে উপলব্ধি করা উচিত যে ‘সামগ্রিকভাবে সমাজ’ (সমাজের সাধারণ চালচিত্র)-কে কোনো সামাজিক ইনজিনিয়ারিং প্রকল্প বা তাত্ত্বিক নকশা মাফিক ঢেলে গড়ার চেষ্টা মারফত তৈরি করা যায় না, তা সবসময় বহু বিভিন্ন মানুষদের উদ্যোগ, বল ও স্বজ্ঞাচালিত ক্রিয়ার বহুত্বের ফল হিসেবেই ফুটে ওঠে। সমাজতাত্ত্বিক-রাজনৈতিক জ্ঞানের কল্পনাশক্তি অবশ্যই প্রয়োজনীয়, কিন্তু তার মানে কিছু জ্ঞানী নেতার হাতে সবকিছু ছেড়ে দেওয়া নয়। সমাজ-রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে নতুন আদল দেওয়ার ভাবনায় ও চর্চায় সর্বসাধারণের--- বিশেষ করে এতদিন যাদের বাদ দিয়ে আসা হয়েছে, অংশ নিতে দেওয়া হয়নি, তাদের সকলের--- নিজ স্বজ্ঞা ও অভিজ্ঞতা নিয়ে পূর্ণ প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণটাই প্রকৃত জরুরী।
নিজ কৌমসত্তায় দৃঢ়মূল যৌথতা-ঘন সংস্কৃতি থেকে নিজেদের ‘মুক্ত’ করে কোনো ‘সর্বজনীন’ মতবাদ বা মূল্যবোধ আঁকড়ে ধরার ‘ধর্মনিরপেক্ষ’, ‘উদারতাবাদী’ বিচ্ছিন্নতায় ফোঁপরা হয়ে রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতির (বা সংস্কৃতিহীনতার) রুগ্ন শিখণ্ডীতে পরিণত হওয়ার মধ্য দিয়ে মানুষ যেমন স্বপরিচয়হীন হয়ে ওঠে, সত্তাশূন্যতায় আক্রান্ত হয়, তেমনই রাষ্ট্রীয় ক্রীড়নক হয়ে থাকা ব্যতিরেকে অন্য কোনো প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক স্বতঃক্রিয়ায় অপারগ হয়ে ওঠে। নিজেদের আপন কৌম সংস্কৃতি ও লোকসমাজে গভীরভাবে প্রোথিত থাকলে তবেই আশু আঞ্চলিক ক্ষেত্রে যৌথ রাজনৈতিক চর্চার পরিসরে নিজ স্বতঃক্রিয়ার জোরে হাজির থাকা যায়, বিশ্বজনীন ভাবনাচিন্তাগুলোর সঙ্গেও গ্রহণ-বর্জন-পরিমার্জনের স্বাধীন সম্পর্ক গড়ে তোলা যায়। যৌথ জীবনের নীতিনির্ধারণ ও নীতিপ্রয়োগে প্রত্যেকের পূর্ণ প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের স্বার্থে রাজনৈতিক ক্রিয়ার এই আঞ্চলিকীকরণ (localization) তাই বিশ্বজনীনতাবাদ ও আঞ্চলিকতাবাদ উভয়ের থেকেই মৌলিকভাবে আলাদা। এটা কোনো মতবাদ নয়। ‘একটাই বিশ্ব’ স্লোগান তুলে যারা এক বিধ্বংসী সমসত্ত্বতা (পুঁজিবাদী অর্থনীতি ও রাষ্ট্রীয় রাজনীতির হিংস্র সমসত্ত্বতা) আরোপ করতে উদগ্রীব, সেই বর্তমান শাসককুলের বেঁধে দেওয়া কাঠামো অস্বীকার করে এহলো নতুনের জন্ম দেওয়ার এক অনির্দিষ্ট পথে যাত্রা। এই যাত্রা এমন এক সম্পূর্ণ নতুন বিশ্ব সৃষ্টির আকাঙ্ক্ষায় প্রাণিত যেখানে বহু বিভিন্ন বিশ্ব পরস্পরকে আলিঙ্গন করে থাকতে পারবে। সম্পদ ভাগ-বিতরণের খেলায় নিজের জন্য আরো বড় ভাগ দখল করার যে অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক দাবিদাওয়ার ঘেরাটোপ, অথবা নিছক সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের ঘেরাটোপ, তা ছাড়িয়ে গিয়ে বহু বিবিধ সংস্কৃতির জন্য উন্মুক্ত প্রান্তর নির্মাণের এক মহাকাব্যিক রূপান্তরসাধনের পথে হাঁটার আহ্বান এই আঞ্চলিকীকরণ হাজির করে। তা কেবল এক নিমন্ত্রণ মাত্র, কোনো উপদেশদান বা নির্দেশদান নয়। তা ধর্মোপদেশ নয়, জ্ঞানদানও নয়, কেবল একটি ইশারা মাত্র।
অস্বীকার করার কিছু নেই যে বর্তমান পরিস্থিতিতে (পুঁজিবাদী অর্থনীতি ও রাষ্ট্রীয় রাজনীতি যেখানে অন্তত তিন শতাব্দী জুড়ে সমসত্ত্বতা আরোপের প্রবণতা কমবেশি সাফল্যের সঙ্গে প্রযুক্ত করে যেতে পেরেছে) যে কোনো আঞ্চলিক বাস্তবতাই বিশ্বজনীন নানা বল ও প্রক্রিয়ার সঙ্গে মিথষ্ক্রিয়ায় বাধ্য হওয়ার কারণে প্রত্যক্ষভাবে বিশ্বজনীন হতেও বাধ্য। কৌমে দৃঢ়মূল বিষয়ীরা যেভাবে চায় ও যেভাবে পারে সেভাবে সম্পূর্ণত আঞ্চলিক বিষয়াদিতে গভীরভাবে নিমজ্জিত থাকা ও পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মোকাবিলা করতে গেলেও সমস্ত কাছে-দূরের অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে পরস্পর-বিজড়ন পরস্পর-সম্পৃক্তি ও পরস্পর-নির্ভরশীলতারও মোকাবিলা করতে হয়। এই ধরনের সচেতনতাই পুঁজিবাদের বিশ্বজনীন প্রকল্পের নয়া-উদারনৈতিক ধাঁচা নিয়ে অসন্তুষ্টজনেদের অনেককে পাল্টা বিশ্বজনীনতার নকশা ভাবতে প্ররোচিত করেছে ও করে চলেছে। এই প্ররোচণা সম্পর্কেও সজাগ থেকে প্রতিহত করতে হবে। সমস্ত রকম প্রতিরোধের পূর্ণ গ্রন্থনা, বিক্ষুব্ধজনেদের মধ্যে বিস্তৃত সংযোগ তৈরি, সমস্ত বিদ্রোহকে স্বাতন্ত্র বজায় রেখেই পাশাপাশি জড়ো করা--- এই সমস্ত কিছুই করণীয়, কিন্তু তার মানে এই নয় যে সমস্ত সংগ্রামকে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নির্ধারণকারী একটাই সংজ্ঞা, একটাই বিশ্বাস-স্লোগান-মতবাদের অধীনস্থ করতে হবে। বিশ্বজুড়েই পুঁজির কাছে ক্রমাগত পরিত্যাজ্য বর্জ্যে পরিণত হচ্ছে নতুন নতুন বিভিন্ন মানুষদের স্তর: তাদের সহায়-সম্বল কেড়ে নেওয়া হচ্ছে, যাপন-পরিবেশ ধ্বংস করা হচ্ছে, অস্তিত্বকে শিকড়হীন শূন্যতায় ভাসিয়ে দেওয়া হচ্ছে--- বিবিধ এই বিক্ষুব্ধজনেরা সবাই মিলে এক আগামী বিশ্বের নির্মাণ তখনই সম্ভব যখন সেই আগামী বিশ্ব তার অন্তর্গত বহু বিশ্বের সমস্ত পার্থক্যকে সম্মান জানিয়ে সমাদরে আলিঙ্গন করতে পারার চরিত্র অর্জন করতে পারবে। অতীতে উপনিবেশবাদের ছল হিসেবে কাজ করে এসেছে এবং আজও হিংসা-তাণ্ডবে নজিরবিহীন হয়ে ওঠা রাষ্ট্রীয় জাতীয়তাবাদের বেশ কিছু আগ্রাসী মৌলবাদী রূপকে পুষ্ট করে চলেছে ‘একটাই বিশ্ব’ (এবং তারই অন্তর্বর্তীকালীন রূপ হিসেবে ‘এক রাষ্ট্র—এক জাতি—এক ভাষা—এক ধর্ম—এক সংস্কৃতি—এক অর্থব্যবস্থা’) নির্মাণ করার স্লোগান। এহেন যত বিভীষিকা-প্রকল্পকে চিরতরে কবর দেওয়ার সময় এসে গেছে।
৪
বর্তমান আধিপত্যবাদী বিশ্বপ্রকল্পটি প্রকৃতিগতভাবে অর্থনৈতিক: পৃথিবীর প্রত্যেকটি পুরুষ ও মহিলাকে তা তার জাদুদণ্ডের গুঁতোয় এমন এক homo economicus (অর্থনীতি -নির্মীত অর্থনীতি-চালিত মানুষ)-এ পরিণত করতে চায় যা পাশ্চাত্যে উদ্ভূত সম্পত্তিবাগিশ প্রতিযোগিতাবাগিশ ব্যক্তি-এককের সমরূপ, যা পঁুজিবাদ (ও রাষ্ট্রীয় সমাজবাদের বিভিন্ন সংস্করণেরও) সামাজিক ভিত্তি হিসেবে কাজ করতে পারে এবং সেমত ব্যবস্থার সমাজসম্পর্ক সংজ্ঞায়নে নির্ধারক হয়ে উঠতে পারে। এর মধ্য দিয়ে সমস্ত অস্তিত্বগত প্রশ্নকে অর্থনীতির অঙ্কে (জড় উৎপাদন, সঞ্চয় ও ভোগ-এর সাপেক্ষে) বিনির্মাণ করে জীবনকে উৎপাদন বৃদ্ধি-পরিকল্পনার অন্তহীন অলাতচক্রে নিছক জ্বালানী-রসদে পরিণত করা হয়। আধ্যাত্মিক যে কোনো বিষয়, অস্তিত্বের উৎসমুখী যে কোনো টান, যে কোনো আস্তিত্বিক স্বজ্ঞা--- এহেন সবকিছুকে বিদ্রূপ করে, তুচ্ছ করে, অবৈধ ঘোষণা করে কেবলমাত্র জড়-উৎপাদন-মুখী জ্ঞান-প্রকৌশলকেই আধুনিক ও প্রগতিশীল আখ্যায় বৈধতাপ্রদান করা হয়। এই জ্ঞান-প্রকৌশলের পিঠে চড়ে অন্ধকার অতীত থেকে আলোকিত ভবিষ্যতে পাড়ি দেওয়ার সুনির্দিষ্ট নিশ্চিত পথসন্ধান হাজির করা হয়, বলা হয় যে এই পথ বেয়ে মানুষের সমাজ ইতিহাসের আবর্ত পেরিয়ে অবশেষে তার চূড়ান্ত গন্তব্যে পৌঁছতে পারবে। বৈজ্ঞানিক মতবাদের রূপ ধরে তর্ক-বিতর্কের ঊর্ধ্বে সর্বশক্তিমান সত্য হিসেবে তা নিজেকে দাবি করে। এই মতবাদ-চালিত ও মতবাদ-নির্ধারিত অস্তিত্ব যখন মতবাদিক বিশ্বাস ও রাষ্ট্রীয় আরোপণ দুইয়ের চাপে সর্বময় হয়ে বসে, জীবনকে তখন অবধারণযোগ্য এক উৎপাদনপ্রক্রিয়ার আদলেই দেখা হতে থাকে। সমস্ত চকিত উপলব্ধি, বিস্ময়, অভাবনীয়তা, নতুনের অনাহূত আত্মপ্রকাশকে আপদ বলে চিহ্নিত করে নিশ্চিহ্ন করার অধিবিদ্যা হাজির করা হয়। অথচ জীবন তো চকিত উপলব্ধি, বিস্ময়, অভাবনীয়তা ও নতুনের অনাহূত আত্মপ্রকাশের মধ্য দিয়েই নিজেকে প্রকাশ করে, ফলে, মতবাদিক জ্ঞান-প্রকৌশলের দালানকোঠায় জীবনকে নেহাতই খিল-আঁটা দরজার বাইরে ওত-পেতে-থাকা অনাহূত আপদ বলেই জ্ঞান করা হয়। সবসময় তাই ধরে-কষে শৃঙ্খলায় বাঁধা ও আপদ-দমনের এত বিস্তারিত আয়োজন, সর্বজ্ঞানী মতবাদধারী বিশেষজ্ঞদের নির্দেশ মাফিক জীবন ও বাস্তবতাকে বিন্যাস-পুনর্বিন্যাস করে নেওয়ার জন্য অস্তিত্বের প্রতিটি পরতকে এভাবে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে বাঁধার প্রাণঘাতী চেষ্টা দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হতে থাকে।
আধুনিকতাগর্বী এই যুক্তিনির্মীত, যুক্তিবৈধ, যুক্তিসর্বস্ব অতিযৌক্তিকতার শাসন যা অতিদর্পে ঘোষণা করে বসে যে নিজ দেহতন্ত্রকে তা অধিবিদ্যা-অতিকথা-পরাবাস্তবতার সংক্রমণ থেকে সর্বাংশে মুক্ত করে ইতিহাস-সোপানের চূড়ান্ত ধাপে এসে উপনীত হয়েছে, তা কি এযাবৎ ইতিহাসে সবচেয়ে নিবিড় অতিকথা-অধ্যুষিত অধিবিদ্যা-শাসিত যুগ নয়? কী অর্থে এই যুগ অতিকথা-অধ্যুষিত, অধিবিদ্যা-শাসিত? এই অর্থে নয় যে সে পিছুটানের ঘোরে অতীত কথায় নিমজ্জিত, তা সে নয়। এই অর্থেও নয় যে জড় প্রযুক্তিকে আলাদীনের প্রদীপ ভেবে বসে সে তার মায়াবন্ধনের চোরাবালিতে ডুবতে বসেছে, যদিও এ কথা ভয়ঙ্করভাবেই সত্য। তা এই অর্থে যে প্রযুক্তির বলে অসম্ভব কিছু নেই বলে ঠাউর করা অধিবিদ্যাকে সর্বাত্মক চেহারা দান করে সে প্রযুক্তি-পুজোকেই যুগের নির্ধারক বৈশিষ্ট্য করে তুলে সেই পুজোর বলিকাঠে বাকি সমস্তকিছুকে বলিপ্রদত্ত করেছে। তাই সত্য ও স্থিতির প্রত্যাভূতি হিসেবে, সৃষ্টিশীলতা ও কল্পনার ভিত্তি হিসেবে সে একমেবাদ্বিতীয়ম প্রযুক্তি-ঈশ্বরকেই প্রতিষ্ঠিত করেছে। মানুষ সহ প্রকৃতির সমস্তকিছুকে কেবলমাত্র প্রাযুক্তিকতার সম্ভাব্যতার শর্তে রূপান্তরিত করেছে। অন্ধকার চরাচরে প্রযুক্তির সম্পূর্ণ নিঃশর্ত প্রত্যাভূতির বহ্নিমান শিখা ঘিরে যন্ত্রনৃত্যের পাকে ঘোরাই এখানে মানুষের একমাত্র বৈধ ক্রিয়া।
এমতাবস্থায় রাষ্ট্র পরিণত হয়েছে বিভিন্ন বাণিজ্যিক সত্তার পিণ্ডে, যার মধ্যে প্রতিটি বাণিজ্যিক সত্তাই তার নিজের পণ্যটি বিক্রয়ের জন্য বিজ্ঞাপনে ও নিজ স্বার্থ চরিতার্থ করার প্রয়াসে মত্ত। এই বাণিজ্যিক পিণ্ড শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চাকরি প্রভৃতির আদলে ‘কল্যাণ’ বা ‘সমৃদ্ধি’ উৎপাদন করে। নির্ধারিত উপযুক্ত মুহূর্তগুলোয় রাজনৈতিক দলগুলো তাদের উপর বাজি ধরা লোকজনদের সবাইকে জড়ো করে কতিপয় অধিকর্তামণ্ডলী নির্বাচন করিয়ে নেয়। বাজারে বাজি ধরে থাকা এই সত্তাগুলোর মধ্যে এখন কেবল (জাতীয় বা বহুজাতিক) বেসরকারি বাণিজ্য সংস্থাগুলোই নেই, তার সঙ্গে আছে বিভিন্ন কাজে নিযুক্ত পেশাদারদের (যেমন, শিক্ষাকর্মী বা স্বাস্থ্যকর্মীদের) বড় বড় পেশাগত সমিতি, যারা তাদের নিজ আর্থিক স্বার্থ চরিতার্থ করতে গিয়ে এই বাণিজ্যসর্বস্ব ব্যবস্থাটিকেই আরো শক্তপোক্ত করে চলেছে কারণ এই ব্যবস্থাই তাদের পদসম্মান ও উচ্চ-রোজগারের বন্দোবস্ত করার পাশাপাশি নিয়ন্ত্রণের বেড়িতেও বেঁধে রেখেছে।
অর্থনৈতিক বৃদ্ধির উপর সামাজিক প্রচেষ্টা কেন্দ্রীভূত করা হলে প্রকৃতই তা কী করে চলেছে তার থেকে চোখ ফিরিয়ে রাখা হয় । প্রকৃত প্রস্তাবে তা অল্প কিছুজনের আরো বেশি প্রাচুর্যের জন্য সাধারণজনের আরো আরো দুর্গতি এবং প্রাকৃতিক জগতের আরো আরো ধ্বংস ডেকে আনে। পুঁজিবাদী উৎপাদনচক্রের বৈশিষ্ট্যমূলক নিয়ম হলো এই যে পুঁজিকে অনির্দিষ্টভাবে বেড়ে যেতেই হবে কারণ যে পুঁজি বাড়ে না তার মৃত্যু হয়। এই নিয়ম যা কেবল পুঁজির ক্ষেত্রেই খাটে, তাকে এক বদ্ধসংস্কার করে তুলে যদি জগতের সবকিছুর সাধারণ নিয়ম হিসেবে সর্বজনীন চেহারা দেওয়া হয়, অর্থনীতিবাদীরা যা করে থাকেন, তাহলে তা কেবল বিপর্যয়ই ডেকে আনতে পারে। এই অনমনীয় যুক্তিকাঠামো গোটা সমাজের ঘাড়ে চেপে বসলে তা মানবসমাজের সঙ্গে তার প্রাকৃতিক ভিত্তির স্থিতিস্থাপক সম্পর্কে চওড়া ফাটল ধরিয়ে অস্তিত্বকেই বিলুপ্তির সম্ভাবনার মুখে এনে দাঁড় করায়। কেন একথা বলা হচ্ছে তা একটু ভেঙে দেখা যাক। বন্যপশু সংরক্ষণ নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক অ-সরকারি সংগঠন (NGO) ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ড (WWF) তার ২০১২ সালে প্রকাশিত ‘লিভিং প্ল্যানেট’ প্রতিবেদনে বলছে যে তৎকালীন পৃথিবীর উৎপাদন, উচ্ছিষ্ট-বর্জন এবং ব্যবহৃত বস্তু ও পরিষেবার সংকুলানের জন্য আমরা দেড়খানা পৃথিবীর বাস্তুসংস্থানিক (ecological) সম্পদ ব্যবহার করছিলাম। অর্থাৎ, পৃথিবীর মানুষ উৎপাদন ও ভোগের জন্য যে পরিমাণ সম্পদ ব্যয় করছিল তা সেই সময়কালে দেড়খানা পৃথিবী হলে তবে পুনরুৎপাদিত হয়ে ভারসাম্যে আসতে পারে। জাতিসংঘের পরিসংখ্যানবিদদের খুব কমিয়ে করা হিসাবও বলছে যে বর্তমান ভোগ ও উৎপাদনের প্রবণতা অব্যাহত থাকলে ২০৩০ সালে আমরা এমন জায়গায় পৌঁছে যাব যখন আমরা দুখানা পৃথিবীর সম্পদ ব্যয় করব। সুতরাং ইতিমধ্যেই আমরা ভোগ ও উৎপাদনের এমন একটা স্তরে বিরাজ করছি যেখানে খুব দ্রুত আমরা বাস্তুসংস্থানিক সম্পদকে নিঃস্ব করে তোলার মধ্য দিয়ে প্রাকৃতিক ভারসাম্য ধ্বংস করে চলেছি। আর উৎপাদন ও ভোগ বৃদ্ধির হারে ‘বৈষম্য’ ঘুচিয়ে তা ‘সর্বজনীন’ করে তোলার ‘স্বপ্ন’ সাকার হলে কী অবস্থা হবে? উত্তর আমেরিকার মানুষের গড় ভোগের হার যদি ধরা হয়, তাহলে গোটা পৃথিবীর মানুষ সেই হারে ভোগ করতে শুরু করলে সাড়ে চারটে পৃথিবীর বাস্তুসংস্থানিক সম্পদ নিঃশেষিত হতে থাকবে। বাস্তুসংস্থানিক সম্পদ ব্যবহারের এই অমিতব্যয়ীতা প্রাকৃতিক ভারসাম্য ধ্বংসের যে সর্বনাশা প্রক্রিয়ায় লাগাতার দ্রুতি সংযোগ করে চলেছে, তার চিহ্ন গোটা পৃথিবীর শরীরে আজ এমনভাবে ফুটে উঠেছে, যা থেকে চোখ ঘুরিয়ে রাখা আর সম্ভব নয়। জঙ্গলের ধ্বংস, জীবাশ্ম জ্বালানীর অতি-ব্যবহারের ফলে বাতাসে জমা কার্বন ও অন্যান্য তাপসঞ্চয়কারী গ্যাস থেকে এনেছে নজিরবিহীন উষ্ণায়ন। পৃথিবীর দুই মেরুতে দ্রুত হারে বরফ গলে সেখানকার প্রাণীদের জীবন-সংকট ডেকে আনার সঙ্গে সঙ্গে গোটা পৃথিবীর সমুদ্রের জলস্তর বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে বিস্তীর্ণ দ্বীপ ও উপকূল অঞ্চলকেও ডুবিয়ে দিতে বসেছে। হিমালয়ের হিমবাহগুলোও ক্রম-সঙ্কুচিত হচ্ছে--- ক্রমে তা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলে বরফের গলন পোষিত নদীগুলোর শুকিয়ে যাওয়া বিস্তীর্ণ উপত্যকা জুড়ে মানুষের জীবিকা ও জীবনধারণের উপায় ধ্বংস করে দেবে। ঋতুচক্র এবং আবহাওয়াও পাল্টে যাচ্ছে এমনভাবে যা বহু প্রজাতির জীবের প্রাণধারণের জন্য প্রয়োজনীয় অবস্থা ধ্বংস করে তাদের বিলুপ্তির দিকে ঠেলে দিচ্ছে, মানুষের কৃষিকাজকেও চরম অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিয়েছে। আমাদের জীবনে, আমাদের চারদিকের পরিবেশে, আমাদের চারপাশের গাছপালা-জীবজন্তু-পোকামাকড়দের জীবনেও নিত্য আরো অসংখ্য রূপে এই সংকট ও বিপর্যয় ফুটে উঠছে। ফলে, মানুষ যদি এমন এক জীবপ্রজাতি রূপেই থিতু হতে না চায় যে প্রকৃতির প্রভু হিসেবে নিজেকে ধার্য করে, প্রকৃতির মধ্যে অন্যান্য প্রাকৃতিক উপাদানের সঙ্গে নিবিড় বৈচিত্র্যময় বাঁধনে বাঁধা তার অস্তিত্বকে অস্বীকার করে, অন্ধ ঔদ্ধত্যে ভোগসম্পদ পুঞ্জীকরণের মধ্য দিয়ে প্রাকৃতিক ভারসাম্যের ধ্বংস, বিভিন্ন জীবপ্রজাতির ধ্বংস এবং শেষাবধি নিজের ভবিষ্যৎ প্রজন্মেরও ধ্বংস ডেকে আনে, তাহলে নিরন্তর উৎপাদনবৃদ্ধি-ভোগবৃদ্ধির বদ্ধসংস্কারকে অবিলম্বে ত্যাগ করতে হবে, উৎপাদনের লাগাতার বিকাশের মধ্য দিয়ে উন্নত সমাজ গড়ার ভাবনাকে তেজস্ক্রিয় আবর্জনার মতো ক্ষতিকর বলে বুঝে নিতে হবে।
এখন জরুরী হয়ে উঠেছে আমাদের নিজেদের মাত্রাবোধ ফিরে পাওয়া। এই মাত্রাবোধ সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানেরই একটা রূপ, যা আমাদের লোকসমাজের স্বজ্ঞার মধ্যেই আমরা পেতে পারি। ‘অতি ছোটো হয়ো না, ছাগলে মুচড়ে খাবে; অতি বড়ো হয়ো না, ঝড়ে পড়ে যাবে’—এ কথা কী আমরা ছোটবেলা থেকেই মাঠে-ঘাটে হাটে-বাটে মুখে-মুখে উচ্চারিত হতে শুনিনি? বিরাট থেকে আরো বিরাট করে সম্পদের পাহাড় তৈরির অন্ধ নেশায় যে সমাজব্যবস্থা অপচয়, ধ্বংস ও অবিচারের ধ্বস বইয়ে গোটা প্রাকৃতিক জগতকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়ে দায়িত্বহীনতার অভিযোগে আজ কাঠগড়ায়, তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সাহস ও সুবুদ্ধি জড়ো করে আমরা সামাজিক উন্নয়নের মরীচিকার পিছনে ছুটে অপ্রয়োজনীয়কে প্রয়োজনীয় করে তোলা বন্ধ করতে পারি, অর্থনৈতিক বৃদ্ধিকে ঈশ্বররূপে পুজো করার সংস্কার চিরতরে ত্যাগ করতে পারি।
ঋণাত্মক বৃদ্ধির হার বা সংকোচনের হারের উপযোগিতা নিয়ে গুরুত্ব সহকারে ভেবে দেখার সময় এখন হয়েছে, সময় হয়েছে বিশদ ভাবে ভাবার যে কোন কোন বৃদ্ধিকে এখনো আমরা উৎসাহিত করে যেতে চাই। যেমন ধরা যাক, উৎপাদনের যে ক্ষেত্রগুলো অনেক কম শক্তিনিবিড় (energy-intensive) এবং প্রকৃতির নিজস্ব উৎপাদনচক্রের সঙ্গে সুসমঞ্জস হওয়ার কারণে প্রাকৃতিক সম্পদ নিঃশেষ করে না আর ক্ষতিকর বর্জ্যেরও পুঞ্জীভবন ঘটিয়ে চলে না--- তাদের বেশিরভাগটাই আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যের উপর নির্ভর করে নানা বৈচিত্র্যপূর্ণ রূপে লোকসমাজে ছড়িয়ে আছে। সেগুলো স্বভাবগতভাবেই ছোটো মাপে (small scale) বাঁধা, নিখাদ প্রয়োজন মেটানোর সঙ্গে যুক্ত, ভোগজমকের সঙ্গে যুক্ত নয়। পুঁজিবাদী ‘উন্নয়ন ভাবনা’ এই উৎপাদনরূপগুলোকে ‘পশ্চাৎপদ’ গালি দিয়ে ক্রমশ কোণঠাসা করে নিশ্চিহ্ন করে দিতে উদ্যোগী। আজ আবার নতুন করে সেইসব ক্ষেত্রগুলোর সঞ্জীবন ও বৃদ্ধি দরকারি হতে পারে। পাশাপাশি, বড়ো মাপের (large scale) করপোরেট উৎপাদনক্ষেত্রগুলোকে সংকুচিত করা দরকার হতে পারে। তার মানে দাঁড়াবে অদক্ষ দৈত্যাকার বাণিজ্য-প্রতিষ্ঠানগুলোকে মদত না যুগিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠের উৎপাদনী সক্ষমতার প্রসারণে মনোনিবেশ করা। মোট জাতীয় উৎপাদনের পতন--- তা অর্থনীতিবিদদের দুঃস্বপ্ন হতে পারে, কিন্তুতা বেশির ভাগ মানুষের জীবনে আশীর্বাদ হয়ে উঠতে পারে।
বৃদ্ধি নিয়ে যে উন্মত্ততা বিরাজমান, তা এবার বন্ধ করা দরকার। কিছু বস্তুর বৃদ্ধি পেতে হবে এবং কিছুকে অবশ্যই সংকুচিত করতে হবে। আমাদের জীবনযাপন সংক্রান্ত সক্ষমতা আর আমাদের জীবনের স্বশাসন বৃদ্ধি পাক। যে যে পরিসরে আমরা আমাদের স্বাধীনতা ও স্বউদ্যোগ চর্চা করতে পারি, সেই পরিসরগুলো প্রসারিত হোক। প্রতিটি মানুষ এবং প্রতিটি সংস্কৃতি যেভাবে ভালো ভাবে বাঁচা বলতে কী তা নির্ধারণ করে, সেই ভাবেই ভালো ভাবে বাঁচার বহু বিবিধ সুযোগ ও উপায় বৃদ্ধি পাক। আর এই সমস্ত বৃদ্ধিকে সম্ভবপর করে তোলার জন্য আমাদের ঘাড়ের উপর চেপে থাকা প্রাতিষ্ঠানিক নিবন্ধীকৃত অর্থনীতির নিপীড়ক পাষাণভার কমিয়ে হালকা করা যাক, একইসঙ্গে যা যা সকলের ভালো ভাবে বাঁচার পরিপন্থী বা যা যা প্রকৃতিকে ধ্বংস করে চলেছে সেসব কমানো যাক।
অফুরন্ত বৃদ্ধির জন্য অন্ধ লালসার আগুন জ্বালিয়ে রাখতে অগ্নিহোত্রীর ভূমিকা পালন করে যন্ত্রপ্রযুক্তি সম্পর্কে এক ধরনের মোহ যা চরিত্রগতভাবে এক প্রকার অসুস্থ কামোত্তেজনা বৈ আর কিছু নয় (যে অর্থে মার্কুই দি সাদ বলেছিলেন যে চরম কামোত্তেজনা চরম হিংসাত্মক ঘটনা ঘটানোর মধ্য দিয়ে তার নিবৃত্তি খোঁজে আর জর্জ বাতাইয়ের বিশ্লেষণ অনুযায়ী কামোত্তেজনা প্রাকৃতিক সীমা পেরিয়ে অসীমে মিশে যাওয়ার ক্ষণিক অনুভূতির মধ্য দিয়ে চিরায়ত হওয়ার ধর্মীয় অনুভূতি লাভ করতে চায়)। আশু সংকট সম্পর্কে উপলব্ধি এবং তার প্রতিক্রিয়ায় স্বতঃক্রিয়া করার ক্ষমতা এর ফলে আর থাকে না। প্রকৃতির স্বাভাবিক স্বরাট চক্রকে ধ্বংস করে তারপর আবার বিজ্ঞান-প্রযুক্তির ক্ষমতা খাটিয়ে অঙ্ক কষে প্রকৃতির ‘পুনরুৎপাদন’-এর বন্দোবস্ত করার নানা ‘ইঞ্জিনিয়ারিং’ ছকের কথা প্রযুক্তিবাদীরা বলে থাকেন বটে, তবে তাও মানুষের পক্ষে অলীক কল্পনা বৈ আর কিছু নয়। কারণ, মানুষ তার চেতনালব্ধ ‘জ্ঞান’ নিয়ে যতই আহ্লাদিত ও আত্মগর্বী হোক না কেন, সেই ‘জ্ঞান’ কখনোই গোটা প্রকৃতির (যার নেহাতই একটা ক্ষুদ্র অংশ সে) সমস্ত প্রক্রিয়া ও বিপাকক্রিয়াকে মনুষ্যনির্মিত কোনো যন্ত্রের কর্মপ্রণালীর মতো করে ছকে ফেলতে পারবে না। ফলে ধ্বংসকৃত প্রকৃতিকে পুনর্নির্মাণ করা বা বিকল্প ‘প্রকৃতি’ নির্মাণ করে নেওয়া যন্ত্রপ্রযুক্তির সাহায্যে কখনোই সম্ভব নয়। মনুষ্যনির্মীত যন্ত্রপ্রযুক্তি-গঠিত কৃত্রিম পরিবেশে যদি মানুষকে আশ্রয় নিতে হয়, তা মানুষের স্থিতসত্তা ধ্বংস করে মানুষকে যন্ত্রের নিষ্প্রাণ অনুকরণকারীতেই পরিণত করবে মাত্র। তাই, জ্ঞান ও প্রযুক্তির বলে প্রকৃতির প্রভু হয়ে বসার মিছে ঔদ্ধত্য ত্যাগ করে প্রকৃতির অংশ হয়ে অন্যান্য প্রাকৃতিক উপাদানের সঙ্গে সুষম সম্পর্ক পুনর্স্থাপন করা ও সমষ্টিগত ভরনপোষণের উদ্দেশ্যে সীমায়িত উৎপাদনে ফিরে যাওয়াই কি শ্রেয় নয়? বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের অবিসংবাদী রাজপাট কল্পনা করার বদলে জ্ঞানের সহজাত সীমাবদ্ধতার কথা খেয়ালে রাখাটাই কি কাম্য নয়? আর তা হলে বিভিন্ন বিষয়ে মার্কামারা বিশেষজ্ঞদের জ্ঞানের আধিপত্যের বিরুদ্ধেও আমাদের প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। কেন্দ্রীভূত ধাপে বাঁধা জ্ঞান-উৎপাদন কাঠামোর চুড়োয় বসে থাকা বিশেষজ্ঞকুলের সবজান্তাপনাকে অগ্রাহ্য করে লোকসমাজের বিস্তীর্ণ বৈচিত্র্যময় প্রাঙ্গনে লোক-অভিজ্ঞতা ও স্বজ্ঞার মধ্যে বয়ে চলা জ্ঞানের নানা নিরহংকারী ধারাকেও অন্তত সমান গুরুত্ব দিয়ে জ্ঞানচর্চার মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। ধাপে-বাঁধা কেন্দ্রীভূত জ্ঞান-উৎপাদন কাঠামোটিকে ভেঙে জ্ঞানের সীমা সম্পর্কে সচেতন এমন এক চর্চা ফিরে পেতে হবে যা প্রকৃতির অংশ হিসেবে মানুষের অস্তিত্বের সীমাগুলো সম্পর্কে সচেতনা কোনো অন্ধ লালসার বশে খুইয়ে বসবে না।
৫
পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্র (বা বলা ভালো, বাস্তবে অস্তিত্বশীল সমাজতন্ত্র, অর্থাৎ রুশ ও চিনা কম্যুনিজম)--- এই দুইয়ের মধ্যে মতবাদিক বিবাদের ফাঁদে আমরা গত ১০০ বছর যাবৎ আটকা পড়ে ছিলাম, চিন্তা করা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। গুটিকয় সমাজতন্ত্রী পূর্বধারণাকে আঁকড়ে ধরে থেকে আমরা বিদ্যমান ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনকামী সমালোচনাগুলোকে পচে শক্তিহীন হয়ে যেতে দিয়েছি। প্রকৃত প্রস্তাবে পুঁজিবাদকে প্রশ্নের মুখে ফেলার শক্তি হারিয়েছি। এভাবে বাস্তব রাজনীতিকে প্রভাবিত করার সক্ষমতা হারিয়ে ফেলে আমরা শেষ দুই থেকে তিন প্রজন্মের চিন্তার উপর কোনো প্রভাব ফেলতে পারিনি। বাস্তবে অস্তিত্বশীল সমাজতন্ত্রও কড়া রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণাধীন ধাপকাটা সমাজে জড়-উৎপাদন-বৃদ্ধির যজ্ঞ বসিয়ে পুঁজিবাদেরই আরেক সংস্করণে পরিণত হয়েছে এবং পুঁজিবাদ বনাম সমাজতন্ত্র মতবাদিক বিবাদের বিষয়গুলোকে পুঁজিবাদের চৌহদ্দির মধ্যেই পরিভাষাগত কিছু পার্থক্য নিয়ে কোন্দলের ব্যাপার করে তুলেছে। এই ফাঁদ কেটে বেরিয়ে আসতে না পারলে পুঁজিবাদ-বিরোধী বাস্তব রাজনৈতিক চর্চা সম্ভব নয়।
মিশেল ফুকো বিশ শতকের শেষভাগে দাঁড়িয়ে আবেদন করেছিলেন, ‘রাজনৈতিক ক্রিয়াকে সব ধরনের অদ্বৈতবাদী ও সর্বাত্মকতাবাদী ভ্রম-বাতুলতা থেকে মুক্ত করো’ (মিশেল ফুকো-র লেখা ‘Preface’, জিল দেল্যুজ ও ফেলিক্স গুয়াতারি রচিত Anti-Oedipus: Capitalism and Schizophrenia, মিনিয়াপোলি: ইউনিভার্সিটি অফ মিনিয়াপোলি প্রেস, ১৯৮৩, পৃষ্ঠা: xiii)। পুঁজিবাদকে যদি আমরা এমনই এক একীভূত সমসত্ত্ব ব্যবস্থা হিসেবে ভেবে নিই যা কিনা গোটা সামাজিক পরিসরকে ছেয়ে ফেলেছে, সবকিছু যার সাপেক্ষে বিন্যস্ত এবং কিছুই যাকে এড়িয়ে যেতে পারে না, তাহলে তা এমন এক অদ্বৈতবাদী ও সর্বাত্মকতাবাদী ভ্রম-বাতুলতা হবে যা পুঁজিবাদ-বিরোধী যে কোনো সংগ্রামকে পুঁজিবাদের চৌহদ্দির মধ্যেই বিকল্প খুঁজে বেড়ানোয় পর্যবসিত করে রাখবে। পুঁজিবাদ বিরোধিতা করার নামে আমরাই পুঁজিবাদকে সর্বত্রগামী ও সর্বশক্তিমান করে রাখব। অথবা তার প্রতিক্রিয়ায় এমন এক পক্ষাঘাত-সঞ্চারী দৃষ্টিভঙ্গি চাউর হবে যে পুঁজিবাদ নামক এই বিশ্ব-ব্যবস্থাকে হয় পুরোটা একসাথে ভেঙে ফেলতে হবে আর নয়তো ভাঙাই যাবে না। রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে এই অসম্ভব প্রকল্পটি উঠে আসবে যে গোটা বিশ্বের সর্বহারাকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে: একমাত্র তাদের সংগঠিত, ঐক্যবদ্ধ, সমসত্ত্ব বলই পুঁজিবাদের সর্বাত্মক একটি শক্তিকে পরাজিত করতে পারে।
এই তাত্ত্বিক পরম্পরা ও রাজনৈতিক চর্চায় শিক্ষিত ও দীক্ষিত বাম-মহল সবসময় যেন একটা ভূতের সঙ্গে পাঞ্জা কষে চলেছে, বা অন্যভাবে বললে, পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে প্রকৃত সংগ্রামটিকে ধারাবাহিকভাবে মুলতবী রাখতে রাখতে চলেছে, কারণ তাদের কল্পনায় যে দৈত্যের চেহারা তারা ধরে নিয়েছে, তার মুখোমুখি লড়াই করার মতো যথেষ্ট শক্তি কখনোই আর তারা জড়ো করে উঠতে পারল না (লেনিনবাদী-ট্রটস্কিবাদী-স্তালিনবাদী-মাওবাদী নানা শুম্ভনিশুম্ভ এর উদাহরণ), বা সেই দৈত্যের পুরীতে ট্রয়ের ঘোড়া পাঠানোর কৌশলগুলোও নিতান্তই দৈত্যপুরীতে নতুন অলঙ্কার সংযোজন ছাড়া আর কিছু করে উঠতে পারলো না (সমাজ-গণতন্ত্রী নামে সংস্কারের পথে বিপ্লবের পথিকরা এর উদাহরণ)। তাদের দেখার চোখই তাদের ব্যর্থতার অন্যতম বড়ো কারণ। এই চোখের অসুখের কথাটা একটু ভেঙে বোঝার চেষ্টা করা যাক।
এই দৃষ্টিরোগীরা সমাজব্যবস্থার বিভিন্ন রূপকে এমন এক বিবর্তনবাদী মতবাদের শৃঙ্খলায় বেঁধে দেখেন যেখানে উৎক্রমণের একটি পূর্বনির্দিষ্ট ক্রম অনতিক্রম্য নিয়তির মতো গেঁড়ে বসে আছে। প্রশ্নাতীত এক ছকে ফেলে ছাড়া তাঁরা কিছু বুঝতে পারেন না। তাঁদের ছক অনুযায়ী যে কোনো সমাজব্যবস্থা তিনটি খোপের মধ্যে পড়বে--- হয় তা প্রাকপুঁজিবাদী এবং সেই সুবাদে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় রূপান্তরিত হওয়াই তার অবধারিত গতি, নয় তা পুঁজিবাদী এবং তার পরিপূর্ণ অন্তর্গত বিকাশের মধ্য দিয়ে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের ভিত্তি তৈরির দিকে তার গতি, আর নয়তো তা পুঁজিবাদী ভিত্তি পূর্ণ বিকাশের উপর দাঁড়িয়ে সমাজতন্ত্রের দিকে উত্তরণের পথের পথিক। খুঁটিয়ে দেখলে দেখা যাবে যে এখানে তিনটে খোপই পুঁজিবাদের সঙ্গে যুক্ত। প্রথম খোপটি পুঁজিবাদে পরিণত হওয়ার মধ্য দিয়ে তার ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে, দ্বিতীয় খোপটি পুঁজিবাদের অভ্যন্তরীণ বিকাশকে অর্গলমুক্ত বাধাহীন করার মধ্য দিয়ে তার ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে এবং তৃতীয় খোপটি পুঁজিবাদের গড়ে দেওয়া বস্তুভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে সেখানে থমকে যাওয়া বিকাশকে অগ্রণী চেতনার বলে সমাজ-ব্যবস্থাপনার মাদ্যমে ফের অন্তহীন বিকাশের দিকে ঠেলে দেয়। পুঁজিবাদের তৈরি বস্তুভিত্তির উপর দাঁড়ানো এই অন্তহীন বিকাশের প্রশ্ন কীভাবে প্রকৃতির অংশ হিসেবে মানুষের সীমা সম্পর্কে অচেতন হয়ে লাগামছাড়া ধ্বংস-বিপর্যয়-বিনাশ-এর পথ তৈরি করে তা আমরা আগে আলোচনা করেছি। এখন অন্য আরেকটা দিক খেয়াল করা যাক। এই তিনটে খোপের ছককে অনুসরণ করা আসলে পুঁজিবাদের বৈশিষ্ট্যমূলক বিচাররীতি (অর্থাৎ মোট পণ্য উৎপাদন দিয়ে সম্পদ বিচার করা, পণ্যোৎপাদন ব্যবস্থার উৎপাদনী শক্তি দিয়ে মানবসমাজের সামগ্রিক অগ্রগতি বিচার করা, সেই উৎপাদন বৃদ্ধিকে উপরের দিকে ঠেলতে ঠেলতে অসীম করে তোলার আকাঙ্ক্ষার মধ্য দিয়েই উন্নততর সমাজ গঠন সম্ভব বলে নির্ধারণ করা) দিয়েই পুঁজিবাদ-পূর্ব অতীত, পুঁজিবাদের বর্তমান ও পুঁজিবাদোত্তর ভবিষ্যৎ এই তিনখণ্ডে সমগ্র কালপর্যায়কে ভেঙে ফেলেছে এবং এক পর্যায়ের সঙ্গে আরেক পর্যায়ের যোগাযোগটিও নির্ধারণ করেছে। বাস্তবে অস্তিত্বশীল সমাজতন্ত্র তাই হয়ে উঠতে পেরেছে রাষ্ট্রীয় শক্তির বল্গাহীন প্রয়োগের মাধ্যমে পুঁজিবাদের গতিশীলতাকেই আরো তীব্র করার কৌশল। আর অন্যদিকে তা যে কোনো অ-পুঁজিবাদী অস্তিত্বমান সমাজরূপকে পুঁজিবাদের প্রাক-ইতিহাসের রেশ বলে পুঁজিবাদে রূপান্তরিত হওয়ার সঙ্গে অমোচনীয় গতিতে যুক্ত করে একমাত্র পুঁজিবাদ-বিকাশের জন্যই কার্যকরী বলে চিহ্নিত করেছে। এইভাবে এই দৃষ্টিরোগ স্থান-কালের অনন্ত পরিসর জুড়ে পুঁজিবাদকে দেখার এক অদ্বৈতবাদী সর্বাত্মকতাবাদী ভ্রমবাতুলতার প্রকোপ বাড়িয়ে তুলেছে। এই রোগের দাসত্ব না করে এই রোগ থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার চেষ্টা আমাদের করতে হবে।
এই চেষ্টার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলো পুঁজিবাদকে এমন এক শাসনপ্রণালী হিসেবে চিনে নেওয়া যা মার্কসের সময় থেকে প্রায়োগিকভাবে বর্ণিত কিছু সামাজিক উৎপাদন-সম্পর্ক [শ্রমশক্তির পণ্যে রূপান্তরিত হওয়া; উৎপাদিত বস্তুর পণ্যচরিত্র ধারণ করা; পুঁজি-নিয়ন্ত্রিত বিচ্ছিন্নকৃত শ্রমের মধ্য দিয়ে শ্রমিকের বিচ্ছিন্নতা (alienation) তৈরি হওয়া প্রথমত, তার শ্রমের উৎপাদ থেকে, দ্বিতীয়ত, তার নিজের ক্রিয়া থেকে, তৃতীয়ত, তার প্রজাতি-স্থিতসত্তা (species-being) থেকে, এবং চতুর্থত, অন্যান্য মানুষদের থেকে; গোটা জগৎ-প্রকৃতি হলো নিজের থেকে বিচ্ছিন্ন ব্যবহার-নিমিত্ত কোনো বস্তু: এহেন বস্তুরূপান্তরকরণ (reification) গেঁড়ে বসা; বিনিময় মূল্যকেই একমাত্র মূল্যরূপ হিসেবে ধরে নেওয়া; ইত্যাদি] দ্বারা চিহ্নিত। যেসব সমাজে এই শাসন-প্রণালী আধিপত্য স্থাপন করে, সেখানেও এমন বিপুল পরিসর থেকে যায় যেখানে পুঁজিবাদী উৎপাদন-সম্পর্কগুলো রাজ করে না। সেখানে এই স্বতন্ত্র পরিসরগুলো সীমায়িত চরিত্রের এবং আধিপত্যকারী শাসনপ্রণালীর দ্বারা আক্রান্তও বটে, কিন্তু এই পরিসরগুলোই এমন প্রতিরোধের গ্রন্থি হিসেবে কাজ করতে পারে যেখান থেকে ঘটমান অভ্যুত্থান ক্রমাগত প্রণোদিত ও সংগঠিত হতে থাকে, নতুন উৎপাদন-সম্পর্কও জন্ম নেওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়।
যেমন ধরা যাক, ভারত নামে চিহ্নিত আমাদের এই ভূখণ্ডে এমন বহু জনজাতি পাওয়া যাবে যারা জঙ্গলের মধ্যে আহরণভিত্তিক উৎপাদনপ্রক্রিয়ায় নিযুক্ত থেকেই জীবন যাপন করে। সম্পদ সম্পর্কে বোধ, জীবনের পূর্ণতা সম্পর্কে বোধ কোনোটাই তাদের পণ্য-নির্ভর বিনিময়-মূল্য-নির্ভর নয়। এগুলো অ-পুঁজিবাদী পরিসর, প্রাক-পুঁজিবাদী পরিসর নয়। অর্থাৎ, এই জঙ্গলগুলোকে কেটে পুঁজিবাদী খনিজ-উত্তোলন শিল্প বসিয়ে সেখানে এদের শ্রমিকে পরিণত করতে হবে এমন কোনো একমেবাদ্বিতীয়ম প্রগতিসূত্র যেমন নেই, তেমনই এদের আহরণভিত্তিক উৎপাদনপ্রক্রিয়াকে জোর করে ধ্বংস করে প্রথমে স্থায়ী চাষ ও তারপর বাণিজ্যিক চাষ বসাতে হবে তারও কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। এই অ-পুঁজিবাদী পরিসরগুলো তাদের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ প্রাকৃতিক পরিবেশে প্রকৃতির সঙ্গে এক বিশেষ বিপাকক্রিয়ার মদ্য দিয়ে স্ফূরিত। পুঁজিবাদ নামক কোনো সর্বজনীন ব্যবস্থার প্রাক-অবস্থা তা নয়। এর মানে এই নয় যে এই অ-পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটিকে স্থির-স্থাণু রূপে দেখা হচ্ছে, গতিকে অস্বীকার করা হচ্ছে। এই অ-পুঁজিবাদী ব্যবস্থা অবশ্যই গতিময়, কিন্তু পুঁজিবাদমুখী কোনো অনিবার্য গতিপথে তা বাঁধা পড়ে নেই। তার মধ্যের গতির বিভিন্ন গতিমুখ আছে, বিভিন্ন দিকে বিকশিত হওয়ারই সম্ভাবনা আছে, কোনো একটি দিকই পূর্বনির্ধারিত ও অনিবার্য নয়। এই বহুমুখী সম্ভাবনা নিয়ে কীভাবে তা বিকশিত হবে তা কোনো সর্বজনীন মতবাদ দিয়ে নির্ধারণ করে দেওয়া যায় না, তা প্রতিটা মুহূর্তে তার অন্তর্গত মানুষদের রাজনৈতিক স্বতঃক্রিয়ার ফলস্বরূপ অভাবিতপূর্ব নতুন মোড় নিতে পারে। এহেন অ-পুঁজিবাদী পরিসর বহু ও বিভিন্ন। কেন্দ্রীভূত সোপানতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নজরদারি-শৃঙ্খলারোপ-দমনপীড়নের জগদ্দলের তলায় চাপা পড়ে যাতে সেগুলোর অন্তর্গত মানুষদের রাজনৈতিক স্বতঃক্রিয়ার পরিসরটি শুকিয়ে না যায়, তার জন্য বরং আমাদের ভাবার অনেককিছু আছে। ভাবার আছে যে কীভাবে কেতাসর্বস্ব গণতন্ত্রের একশিলা রাষ্ট্রীয় কারাগার তৈরি করার বদলে এমন এক আমূল গণতন্ত্রের পরিসর নির্মাণ করা যায় যেখানে এই বিবিধ-বিভিন্ন অ-পুঁজিবাদী পরিসরগুলোর মানুষরা তাদের নিজস্ব স্বজ্ঞা ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে রাজনৈতিক স্বতঃক্রিয়ার মুক্ত মঞ্চ পায় এবং একে অপরের পার্থক্যকে সম্মান দিয়েই পাশাপাশি দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে তর্ক-বিনিময়-শেখা-র প্রক্রিয়া সজীব রাখতে পারে।
৬
আমূল গণতন্ত্র দাবি করে যে জনগণের ক্ষমতার মানে সত্যিসত্যিই জনগণের সেই ক্ষমতার চর্চা করা। ব্যাপারটা হলো গণতান্ত্রিকভাবে জীবন যাপন করার—জনগণ নিজ ক্ষমতা চর্চা করতে পারে এমন সাংস্কৃতিক, প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক মঞ্চের মধ্য দিয়ে প্রাত্যহিক যাপনে গণতন্ত্রকে বলবৎ করার। এর জন্য কোনো ধরাবাঁধা বা সার্বজনিক নিখুঁত ধাঁচা তৈরি সমভব নয়, কোনো অগ্রণী বিশেষজ্ঞমণ্ডলীর পরিকল্পনা অনুযায়ী এ হওয়ার নয়, বরং তেমন চেষ্টা করলে মাঠে-ময়দানের মানুষদের থেকে এক ধরনের বিচ্ছিন্নতা তৈরি হওয়া অবশ্যম্ভাবী এবং সেই বিচ্ছিন্নতাই ক্রমশ এহেন উপর-থেকে-ভাবা ব্যবস্থাকে একটি গণবিচ্ছিন্ন শাসনযন্ত্রে পরিণত করে কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রের অংশ করে তুলবে। বিভিন্ন জনগোষ্ঠী তাদের নিজস্ব স্বজ্ঞা-কল্পনা-অভিজ্ঞতা-পরম্পরার উপর নির্ভর করে নিজেরাই এই স্বশাসনের মঞ্চগুলো গড়ে তুললে তবেই তা আমূল গণতন্ত্রের প্রাথমিক ভিত্তি স্থাপন করতে পারে। আমাদের দেশে আদিবাসী জনজাতিদের গ্রামগুলোয় নিজেদের সমাজ-প্রশাসনের জন্য ষোলো আনার সভা, বয়স্কদের সভা, কেবাঙ ইত্যাদি নানা নামে যে সভাগুলো চালু আছে, প্রাক-ঔপনিবেশিক আমলে বাংলার গ্রামে গ্রামে চণ্ডীমণ্ডপের সভাগুলো যে ভূমিকা পালন করতো সেগুলোর নানা সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে, কিন্তু সেগুলো দেখায় যে গ্রামবাসীদের নিজেদের উদ্যোগে আঞ্চলিক ভিত্তিতে স্বশাসনের মঞ্চ গড়ে তোলার মতো যথেষ্ট উপাদান লোক-অভিজ্ঞতার মধ্যে আছে। কেন্দ্রীভূত চুড়ো-করে-বাঁধা রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে লোকসমাজ একটি বিকল্প হিসেবে হাজির হয় কারণ তা রাজনৈতিক চর্চায় ক্রিয়া ও স্থানের ঐক্য ফিরিয়ে আনতে পারে (অর্থাৎ নিজের ভিটে-মাটি-গ্রামে দাঁড়িয়েই রাজনৈতিক ক্রিয়ায় অংশ নিতে পারে, সেজন্য তার নিজের পরিবেশ ছেড়ে শহরের বাবুদের দফতরি পরিবেশে গিয়ে জল থেকে তোলা মাছের অবস্থায় পড়তে হয় না) এবং গ্রামের প্রান্তিকতম মানুষটিও এমন একটা কাঠামো পেয়ে যায় যার মধ্যে সে নিজ ক্ষমতাকে রাষ্ট্রের হাতে সমর্পণ না করে নিজেই প্রয়োগ-চর্চা করতে পারে। তাই যে কোনো এক প্রকার লোকসমাজ-ভিত্তিক যৌথ অধিকারের ব্যবস্থাই আমাদের ভবিষ্যৎ। এমনই লোকসমাজ-ভিত্তিক যৌথতার আকাঙ্ক্ষা থেকে সমাজতন্ত্র প্রাথমিক বেগ সঞ্চয় করেছিল (স্মরণ করুন ফরাসী বিপ্লবের সময়ের বিপ্লবী কাউন্সিলগুলোকে, পারি কমিউনকে, ১৯১৭-র পেত্রোগ্রাদে ফেব্রুয়ারি পরের কয়েক মাসের ফ্যাক্টরি কমিটি ও সোভিয়েতগুলোকে), কিন্তু তা রাষ্ট্রীয়-সমবায়করণবাদ ও আমলাতন্ত্রে পরিণত হয়ে নিজেই নিজেকে ধ্বংস করেছে।
প্রকৃতপক্ষে, রাজনৈতিক চর্চায় ক্রিয়া ও স্থানের মধ্যে সম্পর্ক খুব গভীর। কোনো একটি স্থানের, কোনো একটি লোকসমাজের অংশভাগী হওয়ার পরিচয় বহন না করাই হলো আধুনিক ‘গণপিণ্ড’ সমাজগুলোর সাধারণীকৃত বৈশিষ্ট্য। এই গণপিণ্ডের মধ্যে ব্যক্তি নিজেকে কার্যকরী করার সক্ষমতা হারিয়ে ফেলে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে অভিপ্রায়পূর্ণ ভাবে সক্রিয় হওয়ার শক্তি হারিয়ে ফেলে। এই গণপিণ্ড সমাজ প্রতিটি ব্যক্তিকে নিজ স্বাধীন অভিব্যক্তি প্রকাশের সুযোগ না দিয়ে মানুষকে সংখ্যা ও আয়তন দিয়ে মাপার যোগ্য জড়বস্তুর সমতুল করে তোলে; বিপুল উপাত্তসম্ভারে প্রতিটি মানুষ একটি উপাত্ত মাত্র--- তার অস্তিত্ব থেকে তার পরিচয় সবই কিছু বিমূর্ত সংখ্যা হয়ে (রোল নম্বর, রেজিস্ট্রেশন নম্বর, আইডেন্টিফিকেশন নম্বর, আধার কার্ড নম্বর, প্যান কার্ড নম্বর) রাষ্ট্রীয় পঞ্জির কোনো সারণিতে আরো কোটি কোটি এহেন সংখ্যার সঙ্গে ফারাকহীন হয়ে মিশে গেছে। ভোটার কার্ড নম্বর অনুযায়ী নির্দিষ্ট ব্যবধানে ভোট দিয়ে আসাই তার একমাত্র বৈধ রাজনৈতিক সক্রিয়তা। মূর্ত মানবঅস্তিত্বকে ধ্বংস করে এভাবে এক সারণিবদ্ধ সংখ্যার বিমূর্ত শূন্যতায় পরিণত করা আধুনিক প্রযুক্তি-সমাজকে ভেঙে লোকসমাজে ফিরে যেতে না পারলে আমূল গণতন্ত্র সম্ভব নয়।
লোকসমাজের স্তরে গণতন্ত্রকে সুসংহত ও আরো গভীর করার পাশাপাশি দেশের রাজনৈতিক কাঠামো পুনর্গঠন করার জন্য বিচারবিভাগীয় ও সাংবিধানিক প্রক্রিয়াগুলোকেও পুনর্বিচার করা প্রয়োজন। দেশের রাজনৈতিক কাঠামো পুনর্গঠনে দুটি দিকে খেয়াল রাখা অত্যন্ত জরুরী:
প্রতিনিধিত্বের ফঁাসে জনগণের ক্ষমতাকে বিসর্জন দেওয়ার বদলে ক্ষমতার পরিসরকে আরো বিস্তৃত করে প্রয়োগে নিয়ে আসার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের ক্ষমতাকে তা ক্রমশ সংকুচিত করতে করতে যেতে পারে। রাষ্ট্রক্ষমতার বিপরীতে একটি ভারসাম্য রক্ষাকারী ওজন হিসেবে এই স্বশাসনের ব্যবস্থা রূপগ্রহণ করছে না, তা বরং রাষ্ট্রক্ষমতাকে নিষ্প্রয়োজন করে দেওয়ার জন্যই নিজ ক্ষমতার বৃত্তকে আরো গভীর করছে এবং তারই মতো অন্য স্বশাসনের বৃত্তগুলোর সঙ্গে বিনিময়-বোঝা-শেখা-র সম্পর্কগুলো আরো বিস্তৃত করছে। স্বশাসনের রাষ্ট্র- নিরপেক্ষ স্বাধীন সত্তামূলক ভাবনায়, আমূল গণতন্ত্র, জনগণের ক্ষমতা ও স্বশাসন অভিন্ন।
৭
আমূল গণতন্ত্রের বীজগুলোকে সংগ্রহ করে মাটি প্রস্তুত করে তা রোপণ করা, পরিচর্যা করে তাকে ফুলে-ফলে পল্লবিত করে তোলা--- এ কাজ করার জন্য মানুষ সংগঠিত হয়ে উঠবে কীভাবে? সংগঠিত ভাবে সেই কাজ চালিয়ে নিয়ে যাবেই বা কীভাবে? এক পর্যায় থেকে আরেক পর্যায়ে উৎক্রমণের জন্য প্রয়োজনীয় নতুন নতুন জ্ঞান, কৌশল, অভিজ্ঞতা-সার-এর যোগান প্রক্রিয়াটাই বা চলবে কীভাবে? এই প্রশ্নগুলোই সবকিছুর পরে আবারও অনেককে কোনো না কোনো নেতা, মতবাদ ও সাংগঠনিক যন্ত্রের নেতৃত্বদায়ী ক্ষমতার উপর ভরসা করার পথে ঠেলে দেয়। কিন্তু নেতা, মতবাদ, সাংগঠনিক যন্ত্রের ক্ষমতায় মানুষদের সংগঠিত হওয়ার অভিজ্ঞতা বারবার কী ফল ফলিয়েছে তা ভুলে যাওয়া ঠিক হবে না। কোনো এক নেতা, মতবাদ বা সাংগঠনিক যন্ত্রকে ঘিরে তৈরি সংগঠিত হওয়ার প্রক্রিয়া মানুষদের সমসত্ত্বতায় লঘুকৃত এমন সব একক অণুতে পরিণত করে যা সংগঠনযন্ত্রের চাপে ‘গণপিণ্ড’-এ পরিণত হয়। সেই কেন্দ্রস্থিত নেতা, মতবাদ বা সাংগঠনিক যন্ত্রই এই গণপিণ্ডকে সংসক্তি ও অভিমুখ প্রদান করে, একই সঙ্গে মতবাদিক অভিপ্রায় অনুযায়ী কাজে লাগানোর উপযোগী করে তোলে… আর মেশিনগানের চাঁদমারিও করে তোলে। এই একক অণুগুলোর নিজেদের সক্ষমতায় সংগঠিত থাকার শক্তি থাকে না, তারা যেন তাসের ঘর যা বাতাসের ঝাপটাতেই ভেঙে পড়ে। তাস বা বিলিয়ার্ড বলের মতোই সমসত্ত্বতায় লঘুকৃত অণুদের সমবায় স্বরূপ গণপিণ্ড বা রাজনৈতিক পার্টিগুলো নিজ কাঠামো বজায় রাখতে পারে কেবলমাত্র তখনই যখন কোনো বাইরের বল (নেতা, মতবাদ বা সাংগঠনিক যন্ত্রের রূপে) তাদের সংসক্তি ও একতা প্রদান করে। এইরূপ সংসক্তি প্রত্যেকটি মানুষের (নেতাদের ছাড়া) স্বাধীন রাজনৈতিক স্বতঃক্রিয়ার পরিপন্থী, বা বলা ভালো যে তা এই স্বাধীন রাজনৈতিক স্বতঃক্রিয়ার শক্তি-সম্ভাবনাগুলোকেই নিজস্ব শৃঙ্খলাদায়ক ক্ষমতার কারাগারে বন্দী করে শুকিয়ে মারে। অন্যদিকে, আমূল গণতন্ত্র গড়ে তোলার আন্দোলন সম্ভবই নয় যদি না প্রতিটি মানুষের স্বাধীন রাজনৈতিক স্বতঃক্রিয়ার শক্তি-সম্ভাবনাগুলো ক্রমবিকশিত হয়। এই ক্রমবিকাশের পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে কীভাবে, যা আবার সংসক্তি এবং সংগঠিত হওয়ার প্রয়োজনও মেটাতে পারে? লোকসমাজ-ঘনিষ্ঠ মানুষদের স্বশাসনের মঞ্চগুলো যদি এমনভাবে গড়ে ওঠে যেখানে প্রতিটি মানুষ বাস্তব সামাজিক সম্পর্কজালের গ্রন্থি হিসেবেই একে অপরের সঙ্গে যুক্ত এবং কৌমসমাজ বা সাধারণ গোষ্ঠী-র অনুরূপ চরিত্রধারী সংঘে সংগঠিত, তাহলে সংসক্তি ভিতর থেকেই তৈরি হয়: তাদের স্বজ্ঞা, আচার,সাধারণ অভিপ্রায় এবং ধারণা-দিগন্তই তাদের সংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ করে রাখে, আর অন্যান্য সমগোত্রীয় সংঘগুলোর সঙ্গে তাদের মিথষ্ক্রিয়া এমন অনুভূমিক জোট গড়ে তুলতে পারে যার সংসক্তিও নিজেদের ভিতর থেকেই উৎপন্ন হয়।
নতুন রাজনৈতিক প্রয়াস যখন উদ্দেশ্য ও উপায়ের মধ্যে বিযুক্তি ঘটায় না, অভিপ্রেত লক্ষ্যের রূপকে যখন নিজ সংগ্রামের রূপের মধ্যে বহন করে চলে, যখন নেতা-মতাদর্শ-সংগঠনযন্ত্র দ্বারা চালিত গণপিণ্ডের রূপে ক্রিয়া করার বদলে স্বশাসিত গোষ্ঠীদের স্বেচ্ছামিলন রূপে ক্রিয়া করে, তখন সেই প্রয়াস নেতৃত্বদানের নিজস্ব স্বকীয় উপায় ও পদ্ধতিও তারা তৈরি করে নিতে পারে। প্রথমত, এমন বিক্ষুব্ধ মানুষজন এহেন প্রয়াসে সামিল হয় যারা নিজেদের অভিজ্ঞতার ঠেলায় আধিপত্যকারী যুক্তি ও নিশ্চয়তাগুলোর আমূল সমালোচক হয়ে ওঠে, যা এক ধরনের মোহভঙ্গ রূপে প্রতিভাত হয়: যে ‘সত্য’-গুলো কিছুদিন আগেও তাদের শাসন করেছে, সেই ‘সত্য’-গুলোতেই তখন আর তারা বিশ্বাস করতে পারে না, সবকিছুকেই যেন তারা অস্বীকার করতে চায়। দ্বিতীয়ত, তাদের নিজস্ব সমাজবুননের ভিতর থেকেই তখন তাদের নিজস্ব বুদ্ধিজীবীরা উৎপন্ন হতে থাকে। তারা ক্ষমতার খাসকামরার বুদ্ধিজীবী (cabinet intellectuals) নয়, তারা তাদের কৌমসমাজে শিকড় চারিয়ে বেড়ে ওঠা প্রোথিত বুদ্ধিজীবী (embodied intellectuals), চরিত্রগতভাবেই তারা ভিন্ন। তারা তাদের স্বকীয় অভিব্যক্তির মধ্য দিয়ে আধিপত্যকারী ক্ষমতাগ্রন্থনার যৌক্তিকতা বিধানকারী যুক্তি-প্রমাণ-সাধারণীকরণগুলোকে ধ্বংস করে বর্তমান সময়ের স্থিতিজাড্য ও অবরোধগুলোকে উন্মোচিত করে দেয়, প্রতিনিয়তই তারা চলমান, কোনো অভিমুখ তাদের জানা নেই, কাল তারা কী ভাববে তাও তাদের অজানা কারণ বর্তমানেই তাদের মনোযোগ অতি-নিবদ্ধ। আমূল গণতন্ত্র গড়ে তোলার অভিযান রূপ থেকে রূপান্তরে তাদের হাত ধরেই এগোবে।
মে, ২০২৫