ভেটকিকে ‘ভেটকি’ নাম কে দিয়েছিল, কেন দিয়েছিল, জানি না— হয়তো বা সে নাম দেওয়ার মধ্যে অবজ্ঞা বা বদ রসিকতা মিশে ছিল, কিন্তু সে সবকে হেলায় উপেক্ষা করে ঐ নামকে সদাহাস্যময়ভাবে বহন করত যে, তার চাপা পড়ে যাওয়া নামটা ছিল সিদ্ধার্থ দাস। তার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ১৯৯০ সালে। আমার বয়স তখন কুড়ির দিকে ধাবমান আর ভেটকি তখন চল্লিশের শেষ কোঠায়। ভেটকি তাই আমার ‘ভেটকিদা’। আমি তখন যুবক আর ভেটকিদা চিরযুবক। কিছু কিছু সম্পর্ক যেমন প্রমিত ব্যাকরণ মেনে হয় না, ভেটকির সঙ্গে আমার সম্পর্কটিও তেমনই নিপাতনে সিদ্ধ হয়ে তরতরিয়ে বেড়ে উঠেছিল। সূচনায় ছিল ‘কবিতা’ ও ‘শক্তি চট্টোপাধ্যায় ' যোগ— কীভাবে তা কিছু বলি। সেই বছরই প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হয়েছি আর যুক্ত হয়ে পড়েছি কলেজচত্বরে ‘কবিতার কাছে’ নামে একটি উৎসবের আয়োজনে। বহু কবি কবিতা পড়তে এসেছেন, এসেছেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়ও। শক্তি সবে তঁার প্রথম কবিতার কয়েক লাইন পড়েছেন, এমন সময় অভাবিতভাবে বিদ্যুৎ-আলো নিভে গেল, সবাই হতচকিত। অন্ধকার সভাঘরের পিছন দিক থেকে জোনাকির মতো একটা আলো ধেয়ে চললো মঞ্চের দিকে, সঙ্গে পুরুষকন্ঠে জড়ানো উচ্চারণ: “শক্তিদা দাঁড়াও, আলো নিয়ে যাচ্ছি।” অচিরেই মঞ্চে পৌঁছে সে কন্ঠের অধিকারী শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ঘাড়ের উপর দিয়ে একটা ছোট টর্চের জোনাকিসুলভ আলো কবির হাতে ধরা কাগজের উপর ফেলে বলে উঠল, “শক্তিদা, পড়।” সে মুহূর্তেই আবার বিদ্যুৎ-আলো ফিরে আসায় দেখা গেল কবির পাশে দন্ডায়মান অতি সাধারণ জামা-প্যান্ট পরা এক খর্বাকৃতি চেহারা— কালো ফ্রেম চশমার পিছনে চোখদুটো বড় আর গোল গোল, ক্ষয়াটে দাঁতের আগল উপছে পানের পিক গড়াচ্ছে গালে, পাতলা হয়ে আসা চুল এদিক ওদিক ছড়ানো। সেই প্রথম ভেটকিদাকে দেখা, এটাই ছিল ভেটকিদার সাধারণ চেহারা।
অচিরেই ভেটকিদার সঙ্গে আলাপ জমে উঠল, কারণ তার চোখে আমার পরিচয় তখন এইভাবে বিশেষত্বমণ্ডিত যে ‘যারা শক্তিকে প্রেসিডেন্সিতে এনেছে, এ তাদের একজন’। প্রেসিডেন্সির প্রমোদদার ক্যান্টিনে, গাড়িবারান্দায় বা কোয়াড্রাঙ্গেল-এ সকাল থেকে সন্ধ্যা ভেটকির অবারিত যাতায়াত ছিল। বহুজনের ঘাড়ে হাত রেখে, প্রায় একপ্রকার তার কঁাধ ধরে ঝুলতে ঝুলতে, ভেটকি যাতায়াত করত, বহু আড্ডায় অযাচিতভাবে গা-ঘেঁষে বসে পড়ত। তার আর আমার মধ্যে একটা বিষয়ে মিল হয়ে গিয়েছিল— আমাদের দুজনের হাতেই তখন অফুরন্ত সময়। রাজনৈতিক জীবনের প্রারম্ভিক উচ্ছ্বাসে আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষ ত্যাগ করে ‘শ্রেণিচ্যুত ' আর ভেটকিও তার কলেজ স্ট্রিট মোড়ের চশমার দোকানটার ঝঁাপ খুলে দিয়ে সে দোকানের কাজকারবার কোনো অদৃশ্য শক্তির হাতে সঁপে দিয়ে কলেজচত্বরে বিচরণরত। ফলত একে অপরের সান্নিধ্যের জন্য আমাদের কোনো সময়াভাব হতো না। ভেটকিদার স্বভাব ছিল ক্ষয়ে যাওয়া দাঁতে দাঁত ঘষে অদ্ভুত একটা শব্দ তৈরি করা, আর সে শব্দের আবহেই তার জড়ানো উচ্চারণ বোধ্য শব্দও তৈরি করত। ভেটকিদার কাছে শোনা যেত কখনও শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের গল্প, কখনও বিনয় মজুমদারের গল্প, কখনও বা তুষার রায় বা শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় বা আয়ান রশিদ খানের গল্প। সে সব গল্প কোনোটাই ভনিতাবশে কথকের নিজের ঢোল নিজে পেটানোর পর্যায়ভুক্ত হত না, বরং ব্যক্তিমানুষদের কিছু অনাড়ম্বর মুহূর্ত হাজির করত। এই সমস্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে ভেটকিদা নিবিড় নেশাতুর সময় কাটিয়েছে খালাসিটোলায় বারদুয়ারীতে অথবা অন্য কোনো পানশালায়— সে সবের ছটাও লেগে থাকত ভেটকিদার গল্পে। আবার কখনও ভেটকিদা হঠাৎ কিছু কবিতার লাইন আউড়ে জিগ্যেস করে বসত: “বল তো কার লেখা?” না পারলে খ্যা খ্যা করে খুব একচোট হেসে কবির নাম বলত জাঁক করে। এমনই সব বলা লাইনের মধ্যে যেটা ভেটকিদার খুব প্রিয় ছিল, ভেটকিদা বহুবার বলেছিল, এখনও চোখ বুজে পিছু ফিরে তাকালে ভেটকিদার গলায় যে লাইনগুলো কানে বাজে, তা হল:
কাল থেকে ঠিক বদলে যাব
দেখে রাখিস তোরা,
বলতে বলতে ঘুমিয়ে পড়ল
অশ্বমেধের ঘোড়া।
(কিছু শব্দ এদিক ওদিক হয়ে থাকতে পারে।)
এইরকমই একদিন ভেটকিদা হঠাৎ জিগ্যেস করে বসল: “‘তোমাকে নিয়ে আমি বাংলাদেশ যাব '– বল তো কার লেখা?” অনেক ভেবেও বলতে পারলাম না। খ্যা খ্যা করে হেসে খুব একচোট পানের পিক ছিটিয়ে ভেটকি বলল: “সিদ্ধার্থ দাস।” বোঝা গেল যে চাপা-পড়া নামে লালিত পরিচয়ে ভেটকিদার কিছু চাপাপড়া জীবনবৃত্তান্ত আছে।
ভেটকিকে নিয়ে আমার মনে নানা বিস্ময়রেখা তৈরি হতো। যেমন ধরা যাক, আমি তখন অ্যাকাডেমিক কেরিয়ার জলাঞ্জলি দেওয়াকে মহান কর্তব্য হিসাবে ধরে জপছিলাম। এই মহান পথ থেকে কত বিচিত্র উপায়ে পদস্খলন ঘটে অর্থ-মান-যশের মোহিনী মায়ায় ভুলে, তা নিয়ে এক গায়ে-কঁাটা-দেওয়া আশঙ্কা ছিল। এর পাশে ভেটকি ছিল এক অলীক মানুষ। এমন একজন মানুষ যার কোনো উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই, মান-যশ বিষয়ে যার কোন হুঁশই নেই। সে কীভাবে নিজের জীবনে আত্মপরিচয় নির্মাণ করে, আত্মপ্রয়োজনীয়তা নির্মাণ করে, তার সুখ-দুঃখ বোধগুলো কীভাবে কাজ করে, তার জীবনাচরণ কীভাবে সামাজিকতার উপর স্থিত হয়— এসব প্রশ্নের উত্তর উপলব্ধি আমার সাধ্যে কুলাতো না, দস্তয়েভস্কির সঙ্গে ভেটকিদার পরিচয় হলে দস্তয়েভস্কি হয়ত এইসব প্রশ্নের নিরসন করে ভেটকিদার চরিত্রঅঙ্কন করতে পারতেন।
রূপ, যশ, সমাজগ্রাহ্য গুণ— এ কোনকিছুই ভেটকিদার ছিল না, কিন্তু ভেটকিদার যা ছিল অফুরান, তা হল জীবনের আনন্দ। এ এক কূটাভাসই হয়ত বা। কলেজ স্ট্রিটের প্রতিটা দোকানদার যাকে অবজ্ঞাভরে পরিহাস করে মাতাল পরিচয়ে চিনত, যার ন্যূনতম কোনো সামাজিক সম্মান ছিল না, যার পানশালার ‘বিখ্যাত’ বন্ধুরাও তাকে বন্ধুত্বের কোনো প্রকাশ্য স্বীকৃতি দিয়েছে বলে জানা নেই, সেই ব্যক্তিটির মধ্যেই অফুরান জীবনের আনন্দ! সদাহাস্যময়, চিরঊষ্ণ এক হৃদয়ের স্পর্শ তার প্রতিটা আচরণে! না কি, এখানে কোনো গভীর অদৃশ্য নেতিকরণ কাজ করছে? আসলে কি ভেটকিদার অন্তঃস্থলে জমাটবাঁধা কোনো বেদনার আকর ছিল, যে বেদনা এত স্পর্শকাতর, এত গভীর যে তার মুখোমুখি হওয়া যায় না, তা প্রকাশ করাও যায় না, তাই তার থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখতে রাখতে বিকল্প প্রকাশভঙ্গি গড়ে ওঠে অনাবিল এক চিরহাস্যময়তায়? এমনই কোনো নেতিকরণ কাজ করত কি ভেটকিদার মধ্যে? তল পাই নি, দস্তয়েভস্কি হয়ত পেতে পারতেন।
মাঝেমধ্যে ভেটকিদার ব্যক্তিজীবনের কিছু ডুবে থাকা আভাসকে ভেসে উঠতে দেখেছি। ভেটকিদার মুখেই শুনেছি যে সে সংস্কৃত স্কুলে পড়ত, অষ্টম কি নবম শ্রেণী হবে, তখন সে সংস্কৃত কলেজের এক ছাত্রীর প্রেমে পড়ে যায়। সে প্রেম কি প্রকাশিত হয়েছিল, হলে তার প্রতিক্রিয়া কি হয়েছিল— জানি না, ভেটকির অতল তল থেকে তা আর ভেসে ওঠে নি। তার কিছুদিন পরেই ভেটকিদার প্রথাগত পড়াশোনায় ইতি পড়ে গিয়েছিল, কবিতা ও নেশার যুগলবন্দী তার জীবনকে সর্বব্যপ্তভাবে অধিকার করে নিয়েছিল— তার সঙ্গেও কি এই প্রেমপর্বের কোনো যোগাযোগ ছিল?— জানি না। তবে ভেটকিদাকে পরে বহুবার বহু মেয়ের প্রেমে পড়তে দেখেছি। প্রেসিডেন্সি কলেজের বহু ছাত্রীর সঙ্গে তার আলাপচারিতা ছিল নানা মাত্রায়, তাদের অনেককে ভেটকিদার ‘ভালো লেগেছে’— কারো জন্য তার ‘বুকে বড় ব্যথা’ হয়েছে— কিন্তু সে সব প্রেম বড় কুঁকড়ে থাকা, অনাগ্রাসী, ব্যর্থতাবিলাসী আর অগোচরে জেগে উঠে অগোচরেই মিলিয়ে যেতে অভ্যস্ত।
ভেটকিদার বাড়ি ছিল তার অদ্ভুত চশমার দোকানের কাছেই মহাত্মা গান্ধী রোডের গায়ে দোতলায়। ভেটকিদার মা ছিলেন স্কুলের শিক্ষিকা, দাদা চার্টার্ড ইঞ্জিনিয়ার, পরবর্তীকালে বৌদি হয়ে যিনি আসেন তিনি এক কলেজের শিক্ষিকা। একাধিকবার সে বাড়িতে গিয়েছি। সে বাড়ির পরিবেশে ভেটকিদার অবস্থান বেশ অভাবনীয়।
যতদিন ভেটকিদাকে দেখেছি, সন্ধ্যার পর থেকে তার দিনলিপি ছিল স্থিরীকৃত। সে সময় বাংলা অথবা বিলাতি সুরায় নিমজ্জনের সময়। বেশিরভাগ সময় সে তার বাড়িতে ঘরে বসেই এ তপস্যায় রত হত, তবে মাঝেমধ্যে সে বাইরেও নানা কাণ্ড ঘটিয়ে বসত। এমন এক কাণ্ডের কথা বলি। একদিন সকাল সাড়ে নয়টা-দশটা নাগাদ কফি হাউসের সামনের রাস্তা দিয়ে প্রেসিডেন্সির গেটের দিকে হেঁটে যাচ্ছি কলেজে ঢুকব বলে। কফি হাউসের সিঁড়ির দরজার আড়াল থেকে ভেটকিদা বেরিয়ে এসে আমার ঘাড়ে হাত দিয়ে পিছু পিছু চলল। গেটে পৌঁছতেই দারোয়ান জনিদা তার বিশাল বপু দুলিয়ে তেড়ে এলো ভেটকিদার নামে হিন্দুস্থানি গালাগালের ফোয়ারা ছুটিয়ে। খ্যা খ্যা করে হেসে ভেটকিদা তাকে পাশ কাটিয়ে ছুটে কলেজের মধ্যে মিলিয়ে গেল। রাগে জ্বলতে থাকা জনিদার কাছ থেকে জানা গেল যে সেইদিন সকালে ভেটকি এক মহা অনর্থ ঘটিয়েছে। কাকভোরে স্নান সেরে রোজের মতো জনিদা খালি গায়ে গামছা পরে সূর্যের দিকে জোড়হাত করে চোখ বুজে সূর্যস্তব করছিল। উত্তরপ্রদেশের নিষ্ঠাবান ব্রাক্ষ্মণের সেই পবিত্র মুহূর্তটিতেই ভেটকিদা সারারাত খালাসিটোলায় নেশা করে বাড়ি ফিরছিল। ফুটপাথ তখন টলছিল। জনিদার পবিত্র মূর্তি দেখে ভেটকিদার মনে কী যে এক অপূর্ব প্রেম জেগে ওঠে— তার টানে ভেটকিদা পিছন থেকে গিয়ে জনিদার বিশাল ভুঁড়ি দুইহাতে জড়িয়ে ধরে পানের পিক গড়ানো, ভুরভুরে মদের গন্ধ ছড়ানো মুখ জনির মুখে লাগিয়ে সশব্দে চুমো লাগায়। চোখ বন্ধ করে সূর্যস্তবরত জনিদা অপবিত্রতার এই অকস্মাৎ আক্রমণে হতবাক অবস্থা কাটিয়ে যতক্ষণে ক্রোধে ফেটে পড়ছে, ততক্ষণে ভেটকিদা তার খ্যা খ্যা হাসি ছড়িয়ে একছুটে কফি হাউসের সিঁড়ির তলায় আত্মগোপন করেছে। সেখানে লুকিয়েই সে এতক্ষণ এই পবিত্রতাহানি কাণ্ডের স্মৃতিরোমন্থন করছিল। আমাকে আসতে দেখে আমার আড়াল নিয়ে এসে জনিদার ক্রোধানলে আরেকটু ঘৃতাহুতি দিয়ে গেল।
এমন বহু ঘটনা হয়ত আরো বহুজনের মনে আছে।
কলেজজীবনের শেষকালে একদিন ভেটকিদাকে নিয়ে এলাম আমার বাড়িতে। কলেজ থেকে আমার বাড়ি বহু দূর— গড়িয়ায় ৫নম্বর বাসগুমটির কাছে। শিয়ালদা থেকে ভেটকিকে নিয়ে ৪৫নম্বর বাসে উঠলাম। ভেটকি কিছুতেই বাসের পাদানি ছেড়ে উঠবে না। কন্ডাক্টরকে বলে দিল যে চিন্তা নেই, কন্ডাক্টরের কাজ সেই করে দিচ্ছে। এরপর প্রায় দেড়ঘন্টা জুড়ে ভেটকিদা বাসের পাদানি থেকে ঝুলে বাসের গায়ে চাপড় মারতে মারতে ‘গড়িয়া পাঁচ’, ‘গড়িয়া পাঁচ’ বলে চেঁচাতে লাগল— তাকে থামায় কার সাধ্য! তারপর আমার বাড়িতে ঢুকেই আমার মার সামনে ধপ করে বসে পড়ে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম। এত বয়স্ক একজন মানুষকে (প্রায় মায়ের সমবয়স্ক) এমনভাবে প্রণাম করতে দেখে মা তো ভ্যাবাচ্যাকা। তারপর আমার ঘরে ঢুকে ধপ করে মেঝেতে বসে পড়ে এমনভাবে বইয়ের আলমারিতে হেলান দিল যে আলমারির পাল্লার কঁাচ ফেটে টুটিফাটা। বিন্দুমাত্র অপ্রস্তুত হল না ভেটকিদা— যেন খুব একটা মজার কাণ্ড ঘটে গেছে এমনভাবে উপছে উঠল সেই চিরাচরিত খ্যা খ্যা হাসি।
ভেটকিদার সাবলীল বিচরণের আর একটা ক্ষেত্র ছিল কলেজস্ট্রিটে তৎকালীন তৃতীয় ধারার (কংগ্রেস ও সরকারী বাম উভয়ের বিরোধী) রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর মিছিল বা অন্যান্য প্রকাশ্য কর্মসূচী। এই সব সংগঠনগুলোর প্রায় সবার সঙ্গেই তার মুখ-চেনা বা তার থেকে বেশি চেনা ছিল, আর তাদের মিছিলে সে বিনা আমন্ত্রণে যেনবা নিজ অধিকারেই সেঁধিয়ে যেত। কয়েক পা হেঁটে, স্লোগানে গলা মিলিয়ে আবার বেরিয়ে আসত। কংগ্রেস বা সরকারী বামেদের মিছিলে কখনো কিন্তু সে সেঁধাত না।
ভেটকিদার কাছ থেকে নানা বই ব্যক্তিগত উপহার পেয়েছি— শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাস, বিনয় মজুমদার বা শক্তি চট্টোপাধ্যায় বা পৃথ্বীশ গঙ্গোপাধ্যায় বা আয়ান রশিদ খানের কবিতার বই— প্রথম সাদা পাতায় অদ্ভুত আঁকাবাঁকা অক্ষরে লেখা: ‘ভাই বিলুকে— ভেটকি’।
পরের দিকে ভেটকিদার জীবনের শেষ কয়েক বছর ওর সঙ্গে অত ঘনঘন আর দেখা হত না কারণ কলেজস্ট্রিটে আমার যাওয়া কমে গিয়েছিল। তখন ভেটকির দেহ অতি ভেঙে পড়েছে, আর কেমন যেন মনে হতো যে ভেটকিদাকে যেন বিষন্নতা গ্রাস করছে— তার জীবনের অফুরান আনন্দ তবে কি ফুরিয়ে এল? মনে হতো যে আমাদের সময়ে প্রেসিডেন্সির বহু ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে যেমন তার আলাপচারিতা ও মেশামেশির অবাধ ক্ষেত্র ছিল, তেমন ক্ষেত্র বুঝি আর নেই। প্রেসিডেন্সির নতুন ছেলেমেয়েদের মধ্যে সে বুঝি বা আর তেমন বন্ধু খুঁজে পাচ্ছে না। ভেটকিদার বদল না কি প্রেসিডেন্সির পরিবেশের বদল— কী তার কারণ? সম্ভবত দ্বিতীয়টাই কারণ।
ভেটকি মারা গেছে, তবে আমি তার মৃতদেহ দেখি নি, তার শবদাহ দেখি নি। তাই একভাবে ভেটকি এখনও আমার কাছে জীবিত কলেজ স্ট্রিটের সবচেয়ে বর্ণময় চরিত্র হিসেবে। কলেজজীবনে আমার সবচেয়ে বড় পাওনাগুলোর অন্যতম ভেটকির বন্ধুত্বলাভ। মানবজীবন ও মানবপ্রকৃতি যে কী বহুমাত্রিক রহস্য ধারণ করে অতল অপার রূপে থইথই চেহারা নিতে পারে ভেটকিদা আমাকে তার ইঙ্গিত দিয়েছিল। সে রূপের পুরো জরিপ করতে পারি নি, হয়তো দস্তয়েভস্কির মতো কেউ তা পারতেন।
নভেম্বর, ২০১৪