আগেও আমি বারবার জোর দিয়ে বলেছি, স্বেচ্ছাচারী শাসন, উৎপীড়ন ও একনায়কতন্ত্রের মতো আমাদের জানা রাজনৈতিক পীড়নের বিভিন্ন রূপের তুলনায় সর্বাত্মকতাবাদ কেবলমাত্র আরও অনেক কঠোর নয়, সেগুলোর সঙ্গে তার মৌলিক পার্থক্য আছে। সর্বাত্মকতাবাদ যেখানেই ক্ষমতা দখল করে, সেখানেই সম্পূর্ণ অভিনব সব রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান তৈরি করে নেয় এবং সেই দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও আইনী সমস্ত পরম্পরা ধ্বংস করে দেয়। বিশেষ যে জাতীয় পরম্পরা বা আধ্যাত্মিকতার সূত্র থেকেই তার মতবাদিক উৎস হোক না কেন, সর্বাত্মকতাবাদী শাসন সর্বদা শ্রেণিগুলোকে রূপান্তরিত করে গণপিণ্ডে; পার্টি-ব্যবস্থাকে সুচতুরভাবে প্রতিস্থাপিত করে এক পার্টির একনায়কত্ব দিয়ে নয়, বরং গণ-আন্দোলন দিয়ে; ক্ষমতাকেন্দ্রকে স্থানান্তরিত করে সেনা থেকে পুলিশে; আর খোলাখুলিভাবে জগতজোড়া আধিপত্য কায়েমের অভিপ্রায় দিয়ে চালিত বিদেশনীতি জারি করে। আজকের দিনের সর্বাত্মকতাবাদী শাসনগুলো এক-পার্টি-ব্যবস্থা থেকে বিকশিত হয়েছে; যখনই তা প্রকৃত সর্বাত্মকতাবাদী হয়ে উঠেছে, তখনই এমন এক মূল্যবোধতন্ত্র অনুযায়ী তা কাজ করতে শুরু করেছে, যা উপলব্ধি করা, বিচার করা বা যার কার্যবিধির গতিমুখ অনুধাবন করা কোনওটাই আর পরম্পরাগত কোনও আইনী, নৈতিক বা সাধারণজ্ঞানের উপযোগিতাবাদী ধ্যানধারণা দিয়ে সম্ভব নয়।
যদি একথা সত্যি হয় যে আমাদের শতকের সংকট বলে সাধারণত যা পরিচিত, তার ইতিহাস পুনর্বিচার করে ও তার রাজনৈতিক লক্ষণাগুলোকে বিশ্লেষণ করে সর্বাত্মকতাবাদের উপাদানসমূহকে চিহ্নিত করা সম্ভব, তাহলে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছানো অবশ্যম্ভাবী যে বাইরের কোনও বিপদের ফল এই সংকট নয়, তা কেবলমাত্র জার্মানি বা রাশিয়ার আগ্রাসী বিদেশনীতির ফল নয়, আর স্তালিনের মৃত্যুর মধ্য দিয়েও তার শেষ হবে না, যেমন তা নাৎসি জার্মানির পতনের মধ্য দিয়ে শেষ হয় নি। এমনকি এও হতে পারে যে আমাদের সময়ের প্রকৃত সংকটচিহ্নগুলো তাদের যথার্থ রূপ ধারণ করবে— নিষ্ঠুরতম রূপ তা নাও হতে পারে— কেবলমাত্র তখনই যখন সর্বাত্মকতাবাদ অতীতের বিষয় হয়ে গেছে।
এই সূত্রে ভাবতে গেলে প্রশ্ন ওঠে, যে সর্বাত্মকতাবাদী শাসন একদিকে এই সংকটের মধ্য থেকে জন্ম নিয়েছে, আবার অন্যদিকে যা এই সংকটের সবচেয়ে সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট উপসর্গ হিসেবে উঠে এসেছে, তা কি কেবলমাত্র একটি সাময়িক কাজ-চালানোর জন্য ব্যবস্থা? তা কি তার সাংগঠনিক উপায় ও সন্ত্রাসের অস্ত্র ধার করেছে উৎপীড়ন, স্বেচ্ছাচার বা একনায়কতন্ত্রী শাসনের পরিচিত রাজনৈতিক অস্ত্রাগার থেকে? উদারনৈতিক বা রক্ষণশীল, জাতীয়তাবাদী বা সমাজতন্ত্রী, প্রজাতন্ত্রী বা রাজতন্ত্রী, প্রভুত্ববাদী বা গণতান্ত্রিক— এহেন প্রথাগত রাজনৈতিক শক্তিগুলোর কিছু নিন্দনীয়, হয়তো বা আপতিক, ব্যর্থতার জন্যই কি তার জন্ম হয়েছে? না কি সত্যকে খুঁজতে হবে এইসবের উল্টোদিকে? বুঝি বা সর্বাত্মকতাবাদী শাসনের প্রকৃতি বলে কিছু হয়, সর্বাত্মকতাবাদী শাসনের একটি অন্তঃসার আছে, যার নিরিখে তাকে সংজ্ঞায়িত করা যায় ও প্রাচীন দর্শনের কাল থেকে পাশ্চাত্য ভাবনায় জ্ঞাত ও স্বীকৃত শাসনের বিভিন্ন রূপের সঙ্গে তুলনামূলক আলোচনা করা যায়। যদি শেষটিই সত্য হয়, তাহলে সর্বাত্মকতাবাদী সংগঠন ও কর্মপদ্ধতির অভিনব ও অভুতপূর্ব রূপের ভিত্তি হতে হবে মানুষের এমন কোনও মৌলিক অভিজ্ঞতা যা একসঙ্গে বাস করা ও সার্বজনিক বিষয় নিয়ে ভাবার মধ্য দিয়ে অর্জিত হয়। সর্বাত্মকতাবাদী আধিপত্যের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক অভিব্যক্তি খুঁজে পাচ্ছে এমন কোনও মৌলিক মানব অভিজ্ঞতা যদি থেকে থাকে, তাহলে সর্বাত্মকতাবাদী শাসনরূপের অভিনবত্বের কথা মনে রাখলে তাকে এমনই এক অভিজ্ঞতা হতে হবে যা, যে কোনো কারণেই হোক, আগে কখনও সমাজ-রাজনীতির ভিত্তি হিসাবে কাজ করে নি ও যার সাধারণ মেজাজ— অন্য সমস্ত দিক থেকে পরিচিত হলেও— পরিব্যপ্ত হয়ে লোকশাসনের কাজকে এর আগে পরিচালনা করে নি।
চিন্তার ইতিহাসের নিরিখে বিচার করলে অবশ্য তা খুবই অসম্ভব বলে মনে হয়। কারণ, মানুষ আজ অবধি যে যে শাসনরূপের অধীনে থেকেছে, তার সংখ্যা অতি অল্প, একদম শুরুর দিকেই সেসবের আবিষ্কার হয়ে গিয়েছিল, গ্রিকরা তার বর্গীকরণও করে ফেলেছিল এবং এই সব শাসনরূপ অস্বাভাবিক রকমে দীর্ঘজীবি প্রমাণিত হয়েছে। প্লেটো থেকে কান্ট অবধি প্রায় আড়াই হাজার বছরে মৌলিক ধারণার এই যে সূত্রায়ন প্রায় অপরিবর্তিত থেকেছে, তা অনুসরণ করলে সর্বাত্মকতাবাদী শাসনকে উৎপীড়নের একটি আধুনিক রূপ হিসেবে ব্যাখ্যা করতে হয়, বলতে হয় যে তা এমন এক নিয়মহীন শাসন যেখানে একজন ব্যক্তির হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়। আমাদের পরম্পরায় উৎপীড়নের চিহ্নায়ক হিসেবে আমরা একদিকে নিয়মের বাঁধনমুক্ত স্বেচ্ছাচারী ক্ষমতাকে শাসকদের স্বার্থে শাসিতদের বিরুদ্ধে প্রযুক্ত হতে দেখেছি আর অন্যদিকে ভয়কেই—শাসিতদের নিয়ে শাসকের ভয় আর জনগণের ভয় শাসককে— মূল কর্মনীতি হয়ে উঠতে দেখেছি।
সর্বাত্মকতাবাদী শাসনকে অভুতপূর্ব বলার পরিবর্তে আমরা এটাও বলতে পারি যে রাজনৈতিক দর্শনে শাসনের অন্তঃসার নির্ণয় যে সমস্ত বিকল্প কল্পনার উপর নির্ভরশীল— যেমন, নিয়মসংগত ও নিয়মহীন শাসনের মধ্যে বিকল্প, যথেচ্ছাচারী ও আইনী ক্ষমতার মধ্যে বিকল্প — সর্বাত্মকতাবাদী শাসন সে সবকিছু বাতিল করে দিয়েছে। এর আগে পর্যন্ত প্রশ্নাতীত বলে ধরে নেওয়া নিয়মসংগত শাসন ও আইনী ক্ষমতা যেমন সহগামী, তেমনই নিয়মহীন শাসন ও স্বেচ্ছাচারী ক্ষমতাও অবিচ্ছেদ্য। কিন্তু সর্বাত্মকতাবাদী শাসন আমাদের সামনে একটা সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের শাসনের অভিজ্ঞতা নিয়ে এসেছে। এটা সত্য যে সর্বাত্মকতাবাদী শাসন সমস্ত সদর্থক নিয়মকে লঙ্ঘন করে, এমনকি তা তার নিজের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত নিয়ম হলেও (যার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উদাহরণ ১৯৩৬-এর সোভিয়েত সংবিধান), বা যা বিলোপ করার প্রয়োজন তেমন অনুভূত হয়নি তেমন নিয়ম হলেও (যেমনটা ঘটেছিল ওয়েইমার সংবিধানের ক্ষেত্রে, যা নাৎসি সরকার কখনোই বিলোপ করে নি)। কিন্তু সে যেমন নিয়মসংগত ভাবে কাজ করে না, ঠিক তেমনই সে স্বেচ্ছাচারীও নয়, কারণ সে দাবি করে যে সমস্ত সদর্থক নিয়ম উৎসারিত হয় প্রকৃতি বা ইতিহাসের যে নিয়ম থেকে, সেই প্রকৃতি বা ইতিহাসের নিয়মকেই সে দৃঢ়ভাবে ও ছলচাতুরিহীনভাবে মেনে চলে।
সর্বাত্মকতাবাদী শাসন নিজের সম্পর্কে এই উদ্ভট অথচ আপাত-অকাট্য দাবি করে যে সদর্থক নিয়ম প্রাধিকারের যে উৎস থেকে বৈধতা অর্জন করে সে সেই উৎসেরই অনুবর্তী এবং সেইসূত্রে মোটেই বিধিহীন নয়, অন্য যে কোনো ধরনের শাসনরূপের চেয়ে সে মানবোর্ধ্ব শক্তিগুলোকে অনেক বেশি মান্য করে চলে এবং মোটেই স্বেচ্ছাচারী নয়, বরং সে প্রকৃতির নিয়ম বা ইতিহাসের নিয়ম মেনে চলার জন্য যে কোনও ব্যক্তির আশু জৈবিক স্বার্থ বলি দিতে সম্পূর্ণভাবে প্রস্তুত এবং কখনোই কোনো ব্যক্তির স্বার্থে ক্ষমতা প্রয়োগ করে না। যেহেতু সে উৎসমূলের দ্বারা অনুপ্রাণিত হওয়ার কারণে ছোটোখাটো বৈধতার প্রশ্নকে উপেক্ষা করতে পারে, তাই কোনও সদর্থক নিয়মের তোয়াক্কা না করে চলার তার এই চলনকেই এক উচ্চতর রূপের বৈধতা বলে সে দাবি করে। সর্বাত্মকতাবাদী নিয়মানুবর্তীতা ভান করে যে পৃথিবীতে ন্যায়ের শাসন প্রতিষ্ঠা করার এক পথ সে আবিষ্কার করেছে, যা সদর্থক আইনের বৈধতার দ্বারা কখনওই সম্ভব হতো না। গোটা জগতের পরিচালকস্বরূপ যে ‘প্রাকৃতিক নিয়ম’, বা, মানব ইতিহাসের মধ্য দিয়ে ব্যক্ত পবিত্র নিয়ম, বা, আচার ও পরম্পরার মধ্য দিয়ে প্রকাশিত মানুষের মনোভঙ্গির সাধারণ নিয়ম— ন্যায়-অন্যায়ের যে প্রমিত রূপের মধ্যেই সদর্থক নিয়ম তার প্রাধিকারের নিজস্ব উৎসকে রূপান্তরিত করুক না কেন, তা অনিবার্যভাবে সাধারণীকৃত এবং অগুন্তি পূর্বনির্ধারণ-অসম্ভব ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য হতে হয়, যার ফলে প্রতিটি মূর্ত নির্দিষ্ট ক্ষেত্রের বিশেষ ঘটনাবলী কোনও না কোনওভাবে তাতে অধরা থেকে যায়; এই কারণে বৈধতা ও ন্যায়পরতার মধ্যে ফারাক সর্বদাই অসেতুসম্ভব হয়।
বৈধতাকে অস্বীকার করে ও জগতের উপর ন্যায়ের প্রত্যক্ষ শাসন প্রতিষ্ঠা করার ভান করে সর্বাত্মকতাবাদী নিয়মানুবর্তীতা ইতিহাসের নিয়ম বা প্রকৃতির নিয়মকে ব্যক্তি-আচরণের ন্যায়-অন্যায়ের কোনও প্রমিত রূপে তর্জমা না করেই প্রয়োগ করে। ব্যক্তিমানুষের আচরণের কোনও তোয়াক্কা না করেই সে মানবপ্রজাতির উপর সরাসরি সেই নিয়ম আরোপ করে। সব সর্বাত্মকতাবাদী শাসনের জগৎব্যাপী প্রতিষ্ঠিত হওয়ার চাহিদার পিছনে কাজ করে এই বিশ্বাস যে সঠিকভাবে প্রযুক্ত হলে প্রকৃতির নিয়ম বা ইতিহাসের নিয়ম তার অন্তফল হিসেবে মানবপ্রজাতিকে উৎপাদন করে। সর্বাত্মকতাবাদী নীতি দাবি করে যে সে মানব প্রজাতিকে সেই সব নিয়মের সক্রিয় সার্থক বাহকে রূপান্তরিত করে, অন্যথায় সেই সমস্ত নিয়মের সামনে মানুষের নিশ্চেষ্ট অনিচ্ছুক আত্মসমর্পণ ছিল অনিবার্য। সর্বাত্মকতাবাদী শাসনগুলোর দানবীয় অপরাধের মধ্য দিয়ে তাদের সঙ্গে সভ্য জগতের যোগসূত্র ছিন্ন হওয়া যদি সত্য হয়, তাহলে এও সত্য যে ওইসব অপরাধের কারণ সরল আগ্রাসী মনোভাব নয়, নির্মমতা নয়, যুদ্ধপরিস্থিতি বা বিশ্বাসঘাতকতাও নয়, বরং তার কারণ হল সেই ‘consensus iuris’ [লাতিন পদ, যার অর্থ: ন্যায় কী– সেই বিষয়ে সাধারণ মতৈক্য, এরপর থেকে আমরা একে ন্যায় সম্পর্কে সাধারণ মতৈক্য বলব]-এর সচেতন লঙ্ঘন, যে ন্যায় সম্পর্কে সাধারণ মতৈক্য, সিসেরোর মতে, একটি জনগোষ্ঠীকে গঠন করে ও যা, আধুনিক কালে, এমনকি যুদ্ধপরিস্থিতিতেও, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভিত্তিপ্রস্তর হিসেবে অটল থেকে সভ্যজগতকে গঠন করে। নৈতিক বিচার ও আইনানুগ শাস্তি উভয়েরই প্রাকশর্ত ন্যায় সম্পর্কে সাধারণ মতৈক্যের মৌলিক স্বীকৃতি; ন্যায় সম্পর্কে সাধারণ মতৈক্যে সম্মতিদান করেছে বলেই দোষীর বিচার করা যায়, এমনকি ঈশ্বর-কথিত নিয়মগুলোও তখনই মানুষের মহলে কার্যকরী হতে পারে যখন মানুষ তা কর্ণগোচর করেছে ও তাতে সম্মতি দিয়েছে।
সর্বাত্মকতাবাদের সঙ্গে অন্যান্য আইনী ধারণার মৌলিক পার্থক্য এখানে পরিস্ফুট হয়। সর্বাত্মকতাবাদী শাসনপ্রণালী এক গুচ্ছ আইনকে আর এক গুচ্ছ আইন দিয়ে প্রতিস্থাপিত করে না, নিজস্ব কোনও ন্যায় সম্পর্কে সাধারণ মতৈক্য প্রতিষ্ঠা করে না, কোনও বিপ্লবের মধ্য দিয়ে নতুন রূপের বৈধতাও তৈরি করে না। সমস্তকিছু, এমনকি তার নিজের তৈরি সদর্থক আইনকেও সে যেভাবে অগ্রাহ্য করে চলে, তা দেখায় যে সে ন্যায় সম্পর্কে কোনও সাধারণ মতৈক্য ছাড়াই চলতে পারে, তা সত্ত্বেও আইনহীনতা, স্বেচ্ছাচার ও আতঙ্কের উৎপীড়নের অবস্থায় তাকে পড়তে হয় না। তা ন্যায় সম্পর্কে সাধারণ মতৈক্য ছাড়া চলতে পারে কারণ মানুষের ক্রিয়া বা ইচ্ছা থেকে আইনের সিদ্ধিকে মুক্ত করার প্রতিশ্রুতি তা দেয়, স্বয়ং মানবজাতিকেই আইনের প্রতিরূপ করে তোলার দাবি করে সে জগতে ন্যায়প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেয়।
প্রাচীন কাল থেকে বৈধতা ও ন্যায়পরতার মধ্যে যে অসংগতি আইন বিষয়ক চিন্তার ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি করেছে, সেই অসংগতিকে নাকচ করে যেনবা মানুষ ও আইনের মধ্যের এই অভেদপ্রতিষ্ঠা জমাট বাঁধে। এই অভেদপ্রতিষ্ঠার সঙ্গে সেই lumen naturale [লাতিন শব্দ, যার অর্থ: ঐশ্বরিক বা অলৌকিক কোনও ক্ষমতার সাহায্য ছাড়াই সাধারণ মানুষের যে বোঝা ও ভাবার ক্ষমতা] বা বিবেকের স্বরের কোনও সাদৃশ্য নেই, যার মধ্য দিয়ে ius naturale [লাতিন শব্দ, যার অর্থ: প্রাকৃতিক নিয়ম] বা ঈশ্বরের আদেশের ঐতিহাসিক উন্মোচনের প্রাধিকারী উৎস হিসেবে প্রকৃতি বা ধর্মতত্ত্ব স্বয়ং মানুষের মধ্যেই তার প্রাধিকার প্রতিষ্ঠা করে। তা কখনওই মানুষকে আইনের চলমান প্রতিরূপ করে তোলে নি, বরং সম্মতি ও বাধ্যতার দাবিদার হিসেবে মানুষের থেকে পৃথক অস্তিত্ব বজায় রেখেছে। প্রকৃতি বা ধর্মতত্ত্বকে সদর্থক আইনের প্রাধিকারের উৎস হিসেবে স্থায়ী ও চিরায়ত বলে ভাবা হতো, সদর্থক আইন ছিল পরিস্থিতি অনুযায়ী পরিবর্তনশীল, কিন্তু আরও দ্রুত পরিবর্তনশীল মানবক্রিয়ার সাপেক্ষে তার স্থায়িত্ব ছিল আপেক্ষিক, আর তার প্রাধিকারের উৎসের চিরায়ত উপস্থিতি থেকেই তা এই স্থায়িত্ব লাভ করত। তাই, প্রাথমিকভাবে, মানুষের সদাপরিবর্তনশীল চলনের স্থিতিস্থাপক রূপেই সদর্থক আইন বানানো হয়েছিল। সর্বাত্মকতাবাদী ব্যাখ্যা অনুযায়ী সমস্ত আইন চলনগতির আইন হয়ে উঠেছে। নাৎসিরা যখন প্রকৃতির নিয়মের কথা বলে, বা বলশেভিকরা যখন ইতিহাসের নিয়মের কথা বলে, তখন প্রকৃতি বা ইতিহাস কোনওটাই নশ্বর মানুষের ক্রিয়া বিষয়ক প্রাধিকারের স্থিতিস্থাপক উৎস থাকে না, তারা স্বয়ং চলনগতি হয়ে দাঁড়ায়। মানুষের প্রকৃতির নিয়ম প্রকাশিত হয় জাতির নিয়মের মধ্য দিয়ে— নাৎসিদের এই বিশ্বাসের পিছনে আছে ডারউইনের এই ভাবনা যে মানুষ এমন এক প্রাকৃতিক বিকাশপ্রক্রিয়া উপজাত যার শেষ বর্তমান প্রজাতিতে নাও হতে পারে। একইভাবে, ইতিহাসের নিয়ম প্রকাশিত হয় শ্রেণিসংগ্রামে— বলশেভিকদের এই বিশ্বাসের পিছনে আছে এই মার্কসীয় ধারণা যে সমাজ হল এমন এক বৃহৎ ঐতিহাসিক চলনের ফল যা তার নিজের গতির নিয়মে ধাবমান ঐতিহাসিক সময়ের সেই শেষ মুহূর্ত অবধি, যে মুহূর্তে পৌঁছে ইতিহাস নিজেকে ধ্বংস করে ফেলবে।
মার্কস কথিত ইতিহাসের পথ ও ডারউইন কথিত প্রকৃতির পথ— এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য প্রায়শই চিহ্নিত করা হয়েছে, সাধারণভাবে ও সঠিকভাবেই মার্কসের পক্ষে বিচার গেছে। কিন্তু তা হয়ত আমাদের ভুলিয়ে দিয়েছে ডারউইনের তত্ত্বের প্রতি কী বিপুল সদর্থক আগ্রহ মার্কসের ছিল। মার্কসের বৌদ্ধিক কৃতিত্বের সর্বোচ্চ প্রশংসা হিসেবে এঙ্গেলস তো তঁাকে ‘ইতিহাসের ডারউইন’ ছাড়া অন্য কিছু বলার কথা ভাবতে পারেন নি।১ প্রকৃত কৃতিত্বের বিচারে নয়, বরং তঁাদের মৌলিক দর্শন তুলনা করলে দেখা যায় যে শেষ অবধি তাঁদের প্রস্তাবিত ইতিহাসের চলন ও প্রতৃতির চলন অভিন্ন। ডারউইন প্রকৃতির মধ্যে বিকাশের যে ধারণা প্রবর্তন করেছিলেন, অন্তত জীববিদ্যার ক্ষেত্রে প্রকৃতির চলন বৃত্তাকার নয় বরং অনন্ত প্রগতির দিশায় ধাবমান একরৈখিক বলে তিনি যে নির্বন্ধ হাজির করেছিলেন, তার অর্থ কার্যত এই যে প্রকৃতিকেও ইতিহাসের অন্তর্গত করে ফেলা হচ্ছে, প্রকৃতির জীবনকেও ইতিহাসগত বলে বিবেচনা করা হচ্ছে। যোগ্যতমের টিকে থাকার ‘প্রকৃতির নিয়ম’ এবং সবচেয়ে প্রগতিশীল শ্রেণির শেষ অবধি টিকে থাকার মার্কসীয় নিয়ম— দুটোই সমভাবে ইতিহাসের নিয়ম এবং সমপরিমাণেই জাতিবিদ্বেষী মতাদর্শের দ্বারা ব্যবহারযোগ্য। অন্যদিকে, মার্কসীয় ধারণায় ইতিহাসের চালিকাশক্তি হিসেবে যে ‘শ্রেণিসংগ্রাম’-কে চিহ্নিত করা হয়েছে, তা কেবলমাত্র উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের বহির্প্রকাশ, যে উৎপাদিকা শক্তির উৎস আবার মানুষের শ্রমশক্তি। মার্কসের দৃষ্টিতে, শ্রম ঐতিহাসিক বল নয়, শ্রম এমন এক প্রাকৃতিক-জৈবিক বল যা ‘প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের বিপাকক্রিয়ার’ মধ্য দিয়ে মুক্তি পায় এবং যার মাধ্যমে মানুষ তার ব্যক্তিজীবন সংরক্ষিত করে ও তার প্রজাতির পুনরুৎপাদন ঘটায়।২ মার্কস ও ডারউইন, উভয়ের তত্ত্বেই যে বিকাশের ধারণা নির্ধারক ভূমিকা পালন করেছে, তা স্পষ্ট বুঝেছিলেন বলেই এঙ্গেলস এই দুইজনের মৌলিক ধারণার মধ্যে সাযুজ্য চিহ্নিত করেছিলেন। গত শতকের (উনিশ শতক) মাঝামাঝি যে বিপুল বৌদ্ধিক পরিবর্তন ঘটেছিল, তার প্রভাবে যে কোনো কিছুকে তার বর্তমানতায় না দেখে কোনও দূরতর অভিমুখে বিকাশের প্রক্রিয়ার অন্তর্গত মধ্যবর্তী কোনো স্তর হিসেবে সঙ্গতিপূর্ণভাবে বর্তমানকে ব্যাখ্যা করা চালু হয়েছিল। সেই বিকাশের চালিকাশক্তি রূপে প্রকৃতি না ইতিহাস– কাকে চিহ্নিত করা হবে, তুলনায় তা ছিল অপ্রধান। এই মতবাদিক প্রেক্ষাপটে ‘নিয়ম’ শব্দটির মানে বদলে গিয়েছিল— আগে তার মানে ছিল স্থিতির এমন একটি কাঠামো যার মধ্যে মানুষের ক্রিয়া ও চালচলন ঘটে থাকে, এখন স্বয়ং চলনগতির ধর্মই তার মানে হয়ে দাঁড়াল।
মতবাদের ব্যবস্থাপত্র অনুসরণ করে যেসব সর্বাত্মকতাবাদী রাজনীতিগুলোর উত্থান হয়েছিল, এই চলনগতির প্রকৃত ধর্মকে তারা ততটাই উন্মোচিত করতে পেরেছিল, যতটা স্পষ্টতায় তারা দেখাতে পেরেছিল যে এই প্রক্রিয়া অন্তহীন। বেঁচে থাকার অযোগ্য ও ক্ষতিকর সমস্তকিছু নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া যদি প্রকৃতির নিয়ম হয়, তাহলে ক্রমাগত নতুন নতুন ক্ষতিকর ও বাঁচার অযোগ্য পদার্থ খঁুজে নিতে না পারলে প্রকৃতি স্বয়ং শেষ হয়ে যাবে। শ্রেণিসংগ্রামের মধ্য দিয়ে কোনও কোনও শ্রেণির ‘শুকিয়ে মরে যাওয়া’ যদি ইতিহাসের নিয়ম হয়, তাহলে সর্বাত্মকতাবাদী শাসকদের শাসনের মধ্য দিয়ে ‘শুকিয়ে মরার’ জন্য নিত্য নতুন মৌলিক শ্রেণি উঠে না আসলে মানুষের ইতিহাসই শেষ হয়ে যাবে। অন্যভাবে বললে, যে ‘হত্যার নিয়ম’ প্রয়োগ করে সর্বাত্মকতাবাদী আন্দোলন ক্ষমতা দখল ও অনুশীলন করে, এমনকি গোটা মানবজাতিকে তার শাসনাধীন করে ফেলার পরও তো সেটাই তার চলনবিধি হয়ে থাকবে।
বিধিসংগত শাসন বলতে এমন এক রাষ্ট্র বোঝায় যেখানে অপরিবর্তনীয় ius naturale [লাতিন শব্দ, যার অর্থ: প্রাকৃতিক নিয়ম] বা ঈশ্বরের চিরায়ত আদেশাবলীকে ন্যায়-অন্যায়ের আদর্শে রূপান্তরিত ও কার্যকরী করার জন্য সদর্থক নিয়মাবলীর প্রয়োজন হয়। Ius naturale বা ঈশ্বরের আদেশ কেবলমাত্র এই প্রমিতিকৃত আদর্শাবলী বা প্রত্যেক দেশের সদর্থক নিয়মাবলীর মাধ্যমেই রাজনৈতিক বাস্তবতা লাভ করতে পারে। সর্বাত্মকতাবাদী রাষ্ট্রে সদর্থক নিয়মাবলীর এই ভূমিকা সর্বাত্মক সন্ত্রাস দিয়ে পূরণ করা হয় । ইতিহাস অথবা প্রকৃতির চলনের নিয়ম বাস্তবায়িত করার জন্য এই সর্বাত্মক সন্ত্রাস ব্যবহার করা হয়। সদর্থক আইন যেমন আইনলঙ্ঘন কী তা সংজ্ঞায়িত করলেও আইনলঙ্ঘনের থেকে স্বাধীন অস্তিত্ব নিয়ে থাকে— কোনও সমাজে অপরাধের অনস্তিত্ব আইনকে প্রয়োজনাতিরিক্ত করে দেয় না, বরং, আইনের সম্পূর্ণ শাসনকেই চিহ্নিত করে— তেমনই, সর্বাত্মকতাবাদী শাসনে সন্ত্রাস বিরোধিতাকে দমন করতে ব্যবহৃত হলেও কেবলমাত্র বিরোধিতা দমন করার উপায় হিসেবেই থাকে না। সন্ত্রাস সর্বাত্মক হয়ে ওঠে যখন তা সমস্ত বিরোধিতা নিরপেক্ষ হয়ে ওঠে, সন্ত্রাসের শাসন সর্বোচ্চ রূপ ধারণ করে যখন তার পথে আর কোনও বাধা-বিরোধিতা থাকে না। বিধিবদ্ধতা যদি হয় অন-অত্যাচারী শাসনের অন্তর্বস্তু, তাহলে সর্বাত্মকতাবাদী আধিপত্যের অন্তর্বস্তু হল সন্ত্রাস।
সন্ত্রাস হল চলনবিধির উপলব্ধি, তার মূল লক্ষ্য হল প্রকৃতির বল বা ইতিহাসের বলকে স্বতঃস্ফূর্ত মানবক্রিয়ার দ্বারা কোনওভাবে বাধাপ্রাপ্ত হতে না দিয়ে মানবপ্রজাতির মধ্য দিয়ে সেই বলের বাধাহীন দ্রুতযাত্রা সংঘটিত করা। প্রকৃতপক্ষে, প্রকৃতি বা ইতিহাসের বলকে নিরুদ্ধ করার জন্য মানুষকে ‘স্থিতিশীল’ করাই হল সন্ত্রাসের অভিপ্রায়। স্বয়ং চলনগতির নিয়মই মানবপ্রজাতির সেই শত্রুদের চিহ্নিত করে দেয় যাদের বিরুদ্ধে লাগামহীন সন্ত্রাস জারি করতে হবে। ইতিহাসের অথবা প্রকৃতির, শ্রেণির অথবা জাতির এই ‘প্রকৃত শত্রুদের’ নিকেশ করার প্রক্রিয়ায় বিরোধিতা বা শত্রু-চিহ্নিতদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশের কোনও স্বতক্রিয়া এখানে অনুমোদনীয় নয়। ‘নিকৃষ্ট জাতির’ বিরুদ্ধে, ‘বেঁচে থাকার অযোগ্য’ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে, ‘মুমূর্ষু শ্রেণি ও ক্ষয়িুষ্ণ মানবগোষ্ঠীর’ বিরুদ্ধে রায় দিয়ে দিয়েছে যে ‘প্রাকৃতিক’ বা ‘ঐতিহাসিক’ প্রক্রিয়া, সেই প্রক্রিয়ার পথে বাধাস্বরূপ যে, সে-ই দোষী; তাই আলাদাভাবে ‘দোষী’ বা ‘নির্দোষ’ ধারণা হয়ে দাঁড়ায় অর্থহীন। সন্ত্রাস এই রায় কার্যকরী করে, আর তার বিচারসভায় সংশ্লিষ্ট সকলেই বিষয়ীগতভাবে নির্দোষ: নিহত ব্যক্তিটি নির্দোষ ব্যবস্থাকাঠামোর বিরুদ্ধে গিয়ে নিষ্ক্রিয়তার জন্য আর ঘাতকরা নির্দোষ কারণ তারা তো প্রকৃতপক্ষে হত্যা করে নি, কোনও এক উচ্চতর নৈর্ব্যক্তিক ন্যায়পীঠের দ্বারা ঘোষিত মৃত্যুদন্ডকেই কার্যকরী করেছে কেবল। শাসকদেরও দাবি এই নয় যে তারা ন্যায়পর বা বিচক্ষণ, তাদের দাবি যে তারা কেবল ঐতিহাসিক বা প্রাকৃতিক নিয়মকেই কার্যকরী করে চলেছে; তারা আইন প্রয়োগ করছে না, বরং নিয়মের নৈর্ব্যক্তিক চলনের প্রবাহপথ বাধা-মুক্ত করছে। নিয়ম যদি হয় প্রকৃতি বা ইতিহাসের মতো মানবসমাজের ঊর্ধ্বে অবস্থিত কোনও বলের চলন-নিয়ম, তাহলে সন্ত্রাস হল নিয়মানুগত।
কোনো মানবগোষ্ঠী বা ব্যক্তির মঙ্গল নয়, সমগ্র মানবজাতিকেই এক ছঁাচে ঢেলে গড়ে তোলা যার চরম লক্ষ্য, সেই চলনগতির নিয়ম কার্যকরী করার উপায় যখন হয় সন্ত্রাস, তখন তা প্রজাতির দোহাই দিয়ে ব্যক্তিদের নিশ্চিহ্ন করে, ‘সমগ্র’-এর দোহাই দিয়ে ‘অংশ’-দের নাশ করে। মানবসমাজের ঊর্ধ্বে বলে বিবেচিত এই প্রকৃতির/ইতিহাসের বলের নিজস্ব শুরু ও শেষ আছে, ফলে প্রতিটি ব্যক্তিমানুষের জীবনগত প্রকৃত নতুন শুরু বা শেষের দ্বারা তা বাধাগ্রস্ত হয়।
নতুন মানুষের জন্মের দ্বারা অবিরত অস্থির-আলোড়িত হতে থাকে যে মানবসমাজ, তার মধ্যে সীমারেখা টানা ও জ্ঞাপনপ্রণালী গড়ে তোলার জন্য সাংবিধানিক শাসনের সদর্থক নিয়ম গড়ে তোলা হয়। প্রতিটি নতুন জন্মের সঙ্গে জগতে একটি নতুন সূচনা হয়, একটি নতুন জগতের সম্ভাবনা সূচিত হয়। নিয়মের স্থৈর্য নির্ভর করে সমস্ত মানবিক বিষয়ের অপরিবর্তিত চলনের উপর, যতক্ষণ মানুষের জন্ম ও মৃত্যু ঘটছে ততক্ষণ তা এই অপরিবর্তনীয়তায় স্থির হতে পারে না। নিয়মসমূহ যেমন প্রতিটি নতুন সূচনার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ নতুন ও অভাবিত কিছুর সম্ভাবনাকে সীমার মধ্যে বেঁধে রাখার কাজ করে, আবার তেমনই চলনধারার স্বাধীনতাকেও নিশ্চিতি দেয়। মানুষের রাজনৈতিক অস্তিত্বে সদর্থক আইনের বেড়াবেষ্টনির অবস্থান মানুষের ইতিহাসগত অস্তিত্বে স্মৃতির অবস্থানের অনুরূপ: তা একটি সার্বজনীন জগতের পূর্ব-অস্তিত্বকে সুনিশ্চিত করে, প্রতিটি প্রজন্মের নিজস্ব জীবনকাল অতিক্রমকারী অবিচ্ছিন্নতার বাস্তবতাকে সুনিশ্চিত করে, সমস্ত নতুন সূচনাকে শুষে নিয়ে পুষ্টিলাভ করে।
সর্বাত্মক সন্ত্রাসকে খুব সহজেই অত্যাচারী শাসনের সঙ্গে এক করে দেখার ভুল করা হয় কারণ তার প্রাথমিক পর্বে সর্বাত্মকতাবাদী শাসন একটি অত্যাচারী শাসনের মতোই আচরণ করে ও মনুষ্যসৃষ্ট নিয়মের সীমারেখাগুলোকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়। কিন্তু সর্বাত্মক সন্ত্রাস কোনো অরাজকতাকে অনির্দিষ্টভাবে বিরাজ করতে দেয় না, সকলের সঙ্গে সকলের যুদ্ধের অভিমুখ তো তৈরি করেই না, এমনকি সকলের বিরুদ্ধে কোনও একক ব্যক্তির স্বেচ্ছাচারী ক্ষমতার চন্ডমূর্তি হিসেবেও বিরাজ করে না। ব্যক্তি-মানুষদের মধ্যে জ্ঞাপনের সীমারেখা ও প্রণালীগুলোকে সে এমন এক লৌহবন্ধনী দিয়ে প্রতিস্থাপিত করে যা এত আঁটসাটভাবে ধরে রাখে যে বিপুলমাত্রিক এক অদ্বৈত মনুষ্যমূর্তির মধ্যে ব্যক্তি-মানুষদের বহুবাচকতা যেন বা অদৃশ্য হয়ে যায় । মানুষের একে অন্যের মধ্যের নিয়মের বেড়াবেষ্টনী দেওয়া এলাকাগুলোই যেহেতু স্বাধীনতার প্রাণধারণের এলাকা, তাই অত্যাচারী শাসনের মতোই সর্বাত্মক সন্ত্রাসও মানুষের একে অন্যের মধ্যের নিয়মের বেড়াগুলোকে ধ্বংস করার জন্য মানুষের স্বাধীনতা হরণ করে, স্বাধীনতার প্রাণময় রাজনৈতিক বাস্তব রূপটিকে ধ্বংস করে। অত্যাচারী শাসনের এই পুরোনো অস্ত্রটি ব্যবহার করে সর্বাত্মক সন্ত্রাস, কিন্তু একইসঙ্গে সে অত্যাচারী শাসনের ফেলে রেখে যাওয়া আতঙ্ক-সন্দেহ-ভরা নিয়মহীন অপার বিজনপ্রদেশটিকেও ধ্বংস করে। অত্যাচারী শাসনের ফেলে রেখে যাওয়া বিজনপ্রদেশ, অবশ্যই, আর স্বাধীনতার প্রাণধারণের উপযোগী থাকে না, তা সত্ত্বেও তা তার অধিবাসীদের জন্য আতঙ্ক-চালিত চলন ও সন্দেহ-তাড়িত ক্রিয়ার কিছু অবকাশ ফেলে রাখে।
সর্বাত্মক সন্ত্রাস মানুষকে একে অপরের বিরুদ্ধে পিষ্ট করার মধ্য দিয়ে মানুষের একে অপরের মধ্যের পরিসরকে ধ্বংস করে। তার লৌহবন্ধনীতে পিষ্ট অবস্থার তুলনায় এমনকি অত্যাচারী শাসনের মরুভূমিকেও, যে পরিমাণে সেখানে তবু কিছু ক্রিয়ার অবকাশ অবশিষ্ট থাকে, স্বাধীনতার সুনিশ্চয়তা বলে মনে হয়। সর্বাত্মকতাবাদী শাসন স্বাধীনতাকে খর্ব করে, অত্যাবশ্যক স্বাধীনতাসমূহকে ধ্বংস করে, কিন্তু কেবল তাই-ই নয়। অন্তত আমাদের সীমাবদ্ধ অভিজ্ঞতা অনুযায়ী, সর্বাত্মকতাবাদী শাসন মানুষের মন থেকে স্বাধীনতার প্রতি ভালোবাসা মুছে দিতেও সক্ষম হয়। কিন্তু সেখানেই শেষ নয়। সর্বাত্মকতাবাদী শাসন চলনক্ষমতাকে ধ্বংস করে কারণ মানুষের একে অপরের অন্তর্বর্তী পরিসর ধ্বংস হয়ে গেলে চলন সম্ভব হয় না, আর এই পরস্পরের মধ্যে চলনক্ষমতাই হল স্বাধীনতার একমাত্র আবশ্যক পূর্বপ্রয়োজনীয়।
যে সর্বাত্মক সন্ত্রাস সর্বাত্মকতাবাদী শাসনের অন্তঃসার, তার অবস্থান মানুষের পক্ষেও নয়, বিপক্ষেও নয়। প্রকৃতি অথবা ইতিহাসের বলের নিজস্ব চলন ত্বরান্বিত করার এক অতুলনীয় উপায় যোগানোর অভিধাতেই তার উৎপত্তি। এই প্রকৃতি বা ইতিহাসের বলের গতি তার নিজস্ব নিয়ম অনুযায়ী এগোয়, এবং দীর্ঘমেয়াদী বিচারে এর পথ কেউ রোধ করতে পারে না, মানুষের ইচ্ছাশক্তি বা ক্রিয়া যতো শক্তিশালী বাধাই তৈরি করুক না কেন শেষাবধি তার চেয়েও শক্তিশালী হিসেবে নিজেকে প্রতিপন্ন করে এই গতির বল। কিন্তু এর গতি মন্দীভূত হতে পারে এবং মানুষের স্বাধীনতা অবধারিতভাবে এই মন্দীভবন ঘটায়, যা এমনকি সর্বাত্মকতাবাদী শাসকদের দ্বারাও পুরো আটকানো সম্ভব নয়। পুরো আটকানো সম্ভব নয় এই কারণে যে সর্বাত্মকতাবাদী শাসকরা যতই স্বাধীনতাকে অপ্রাসঙ্গিক ও অনির্দিষ্ট বলে ভাবুক না কেন, স্বাধীনতা এই ঘটনার সঙ্গে অভিন্ন যে নতুন মানুষ জন্ম নিয়ে চলেছে, প্রতিটি মানুষই একটি নতুন সূচনা, প্রতিটি মানুষের মধ্যে দিয়েই আবার নতুন করে জগতের সূচনা ঘটে চলেছে। সর্বাত্মকতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে মানুষের জন্ম ও মৃত্যু ঘটে চলার ঘটনাকে উচ্চতর বলের ক্রিয়াপথে একটি বিরক্তিকর বাধা হিসাবেই একমাত্র দেখা যেতে পারে। প্রাকৃতিক বা ঐতিহাসিক চলনগতির বাধ্য সেবক হিসেবে সন্ত্রাসের দায়িত্ব তাই স্বাধীনতার মূর্ত রূপকে ব্যবস্থা থেকে উৎপাটিত করার মধ্য দিয়েই শেষ হয় না, তার কাজ থেকে যায় স্বাধীনতার যে মূল উৎস জন্ম ও নতুন সূচনার মনুষ্যক্ষমতার মধ্যে নিহিত, সেই মূল উৎসকে উৎপাটিত করা। সন্ত্রাসের লৌহবন্ধনী মানুষের বহুত্বকে ধ্বংস করে এবং বহু থেকে সেই এক-কে গড়ে তোলে যে এক সর্বদা এমনভাবে কাজ করতে সফল যেন বা সে স্বয়ং ইতিহাস বা প্রকৃতির গতিরই অংশ। সেই লৌহবন্ধনীর মধ্যে এমন এক উপায় গড়ে ওঠে যা ইতিহাস বা প্রকৃতির বলের চলনকে কেবলমাত্র বাধামুক্তই করে না, এমনভাবে তাকে ত্বরান্বিতও করে যা নিজে থেকে হওয়া অসম্ভব। ব্যবহারিক দিক থেকে এর অর্থ হল এই যে সন্ত্রাস কালবিলম্ব না করে সেই মৃত্যুপরোয়ানাগুলো কার্যকরী করে যা প্রকৃতি ঘোষণা করেছে ‘বেঁচে থাকার অনুপযুক্ত’ জাতিদের/ব্যক্তিবর্গের উপর বা ইতিহাস ঘোষণা করেছে ‘মুমূর্ষু শ্রেণিদের’ উপর— সেই পরোয়ানা লাগু হওয়ার প্রকৃতিগত বা ইতিহাসগত ধীর পদ্ধতির জন্য অপেক্ষা করার আর দরকার পড়ে না।
এভাবে গতি যখন স্বয়ং শাসনের অন্তর্বস্তু হয়ে ওঠে, তখন রাষ্ট্রনীতির একটি বহু পুরাতন সমস্যা যেন বা পূর্বে আলোচিত বিধি ও ন্যায়পরতার মধ্যে অসংগতির সমাধানের অনুরূপ একটি সমাধানে পৌঁছয়। আমরা যদি বিধিসংগতিকে শাসনের অন্তঃসার বলে সংজ্ঞায়িত করি এবং নিয়ম বা আইনকে মানুষের সামাজিক ক্ষেত্রে স্থিতিস্থাপক বল হিসেবে বুঝি (বস্তুত যা করা হয়ে আসছে সেই যখন থেকে প্লেটো তঁার ‘Laws’-এ সীমার দেবতা জিউসকে স্মরণ করেছিলেন), তাহলে রাষ্ট্রের চলনে নাগরিকদের সক্রিয়তা সমস্যা হিসেবে উঠে আসতে বাধ্য। বিধিসংগতি সক্রিয়তার সীমানির্ধারণ করে, কিন্তু সক্রিয়তাকে উৎসাহিত করে না। স্বাধীন সমাজসমূহে নিয়ম/আইন/বিধির মহত্ব এবং জটিলতা এখানেই যে তা কী করণীয় নয় তা চিহ্নিত করে সবসময়, কী করণীয় তা বলে না। সেই প্লেটোর সময় থেকেই রাষ্ট্রের অন্তঃসার সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে তার চিরস্থায়ীত্বের দিকে নজর রেখে, আর যদি বা শুধু এই কারণটিকেই ধরা হয়, সে জন্যই আমরা রাষ্ট্রের অন্তঃসারের মধ্যে রাষ্ট্রের আবশ্যক কোনো চলনকে খুঁজে পাব না। একটি শাসনের ভালো দিকের নিশ্চিততম পরিচয় হিসেবে যেন বা তার স্থায়ীত্বকালকেই তুলে ধরা হয়। এমনকি মন্তেস্কুর কাছেও অত্যাচারী শাসন যে খারাপ তার সর্বোচ্চ প্রমাণ হল এই যে কেবলমাত্র অত্যাচারী শাসনই তার ভিতর থেকে ধ্বংস হতে বাধ্য, নিজের পতন নিজেই ডেকে আনতে বাধ্য, যেখানে অন্য সমস্ত ধরনের শাসন তার বাইরের ঘটনাবলীর অভিঘাতে ধ্বংস হয় । সুতরাং মন্তেস্কু যাকে ‘সক্রিয়তার নীতি’ বলেছেন, তা শাসনরূপের সংজ্ঞায়নের জন্য দরকার হয়ে পড়ে । এই ‘সক্রিয়তার নীতি’ শাসনের বিভিন্ন রূপ অনুযায়ী নিজে বিভিন্ন রূপ নিয়ে রাষ্ট্র ও নাগরিক উভয়কেই একইভাবে সামাজিক ক্রিয়ায় উৎসাহিত করে এবং বিধিসংগতির নঙর্থক মাপকাঠিকে ছাপিয়ে গিয়ে সামাজিক ক্রিয়া বিচার করার অন্য মাপকাঠি হাজির করে। রাজতন্ত্রে সম্মান, প্রজাতন্ত্রে গুণ ও অত্যাচারী শাসনে আতঙ্ক— মন্তেস্কু দিশারী নীতি ও সক্রিয়তা বিচারের মাপকাঠির উদাহরণ হিসাবে এইগুলির উল্লেখ করেছেন।
সমস্ত মানুষ যেখানে ‘এক মানুষ’-এ পরিণত হয়েছে, সমস্ত ক্রিয়া যেখানে প্রকৃতি বা ইতিহাসের চলনকে ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে চালিত, যেখানে প্রতিটি পদক্ষেপ আসলে প্রকৃতি-প্রদত্ত বা ইতিহাস-প্রদত্ত মৃত্যুপরোয়ানা কার্যকরী করা, অর্থাৎ যেখানে চলনগতিকে অবারিত রাখতে সন্ত্রাসের উপর সম্পূর্ণ ভরসা রাখা যায়, তেমন এক নিখুঁত সর্বাত্মকতাবাদী শাসনের ক্ষেত্রে তার নিজের অন্তঃসার ছাড়া আর কোনও সক্রিয়তার নীতিরই প্রয়োজন হয় না। তথাপি যতক্ষণ না সর্বাত্মকতাবাদী শাসন পৃথিবী জয় করে ফেলছে এবং লৌহবন্ধন এঁটে প্রতিটি মানুষকে ‘এক মানুষ’ করে তুলছে , ততক্ষণ অবধি গতির নীতি হিসেবে (ক্রিয়ার নীতি হিসেবে নয়) এবং শাসনের অন্তঃসার হিসেবে সন্ত্রাসের যৌথ ভূমিকা উপলব্ধ হতে পারে না। সাংবিধানিক শাসনে মানুষের ক্রিয়াকে উৎসাহিত করতে ও পথ দেখাতে বিধিসংগতি যেমন যথেষ্ট নয়, ঠিক তেমনই সর্বাত্মকতাবাদী শাসনে মানুষের আচরণকে উৎসাহিত করতে ও পথ দেখাতে সন্ত্রাসই যথেষ্ট নয়।
সর্বাত্মকতাবাদী আধিপত্য এখনও অন্যান্য শাসনরূপের সঙ্গে নাগরিকদের সার্বজনীন আচরণবিধি ভাগ করে নিলেও, সঠিক অর্থে, তার এমন কিছুর দরকার পড়ে না, এমন কিছুকে সে ব্যবহারও করতে পারে না, কারণ, সে মানুষের ক্রিয়া করার ক্ষমতাকেই ধ্বংস করে দিতে চায়। সর্বাত্মক সন্ত্রাসের পরিবেশে আচরণবিধির উপদেষ্টা হিসেবে আতঙ্কও আর কাজ করতে পারে না, কারণ, সন্ত্রাস তার শিকারদের কাজ বা ভাবনার ব্যক্তিগত হিসাব করে না, কেবলমাত্র নৈর্ব্যক্তিক প্রাকৃতিক বা ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার বস্তুগত প্রয়োজনের নিরিখে বিচার করে। সর্বাত্মকতাবাদ-শাসিত পরিবেশে আতঙ্ক সম্ভবত আগের যে কোনো শাসনরূপের তুলনায় অনেক বেশি ছড়িয়ে পড়ে, কিন্তু, যখন আতঙ্ক-তাড়িত ক্রিয়ার দ্বারা আতঙ্কসূচক বিপদটিকে এড়ানো অসম্ভব হয়ে ওঠে, তখন আতঙ্কও তার কার্যকরী উপযোগিতা হারিয়ে ফেলে। শাসনের পক্ষাবলম্বনকারী ও শাসনের প্রতি সহানুভূতিশীলদের ক্ষেত্রেও একই কথা সত্য, কারণ, সর্বাত্মক সন্ত্রাস কেবলমাত্র তার শিকারদেরই বস্তুগত প্রয়োজনের নিরিখে বাছে না, সে শিকারী ঘাতকদেরও বাছে ব্যক্তিগত বিশ্বাস বা সহানুভূতির প্রতি একইরকম যথাসম্ভব সম্পূর্ণ নির্লিপ্ততা নিয়ে। সোভিয়েত রাশিয়া ও তার অনুগামী দেশগুলোর ‘মহান শুদ্ধিকরণ অভিযান’-এর সময় থেকেই নথিভুক্ত হয়ে চলেছে কীভাবে ক্রিয়ার চালিকাশক্তির জায়গা থেকে দৃঢ় দোষপ্রমাণ ক্রমশ অপসারিত হয়ে চলেছে । দোষপ্রমাণ দৃঢ় করা কখনওই সর্বাত্মকতাবাদী শিক্ষার উদ্দেশ্য নয়, বরং তার উদ্দেশ্য হল তার সম্ভাব্য সমস্ত উপায়গুলোকে ধ্বংস করা। এস. এস. ট্রুপের জন্য বাছাই প্রক্রিয়ায় খাঁটি বস্তুগত মাপকাঠি চালু করা ছিল হিমলারের বিরাট সাংগঠনিক উদ্ভাবন: তিনি প্রার্থীদের বাছাই করতেন কেবলমাত্র তাদের আলোকচিত্র দেখে খাঁটি জাতিগত দৈহিক বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে, প্রকৃতিই স্বয়ং নির্ধারণ করে দিত কাদের মেরে ফেলতে হবে, উপরন্তু, কাদের ঘাতক হিসেবে প্রশিক্ষিত করে তুলতে হবে।
যে রাষ্ট্রে সন্ত্রাস আর কেবলমাত্র ভয় দেখানোর উপায় না থেকে অপরিহার্য উপাদান হয়ে ওঠে, সেখানে আচরণ-জগতের গুণ, সম্মান, ভয় সুলভ কোনো আচরণবিধিমূলক নীতিই আর রাষ্ট্রপরিচালনার জন্য কার্যকরী বা আবশ্যক হয় না। তার পরিবর্তে, সেই রাষ্ট্র জনপরিসরে এমন এক নীতি প্রতিষ্ঠা করে যা মানুষের সক্রিয়তার ইচ্ছা ধ্বংস করে দিয়ে সেই চলনবিধি উপলব্ধির আকাঙ্খা জাগিয়ে তোলে যে চলনবিধি অনুসারে সন্ত্রাস কার্যকরী হয় ও সমস্ত ব্যক্তির ভবিতব্য যার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।
সর্বাত্মকতাবাদী-শাসনাধীন একটি দেশের অধিবাসীরা যেহেতু প্রকৃতির বা ইতিহাসের নৈর্ব্যক্তিক প্রক্রিয়ার মধ্যে নিক্ষিপ্ত হয় এবং সেই প্রক্রিয়ার চলন ত্বরান্বিত করার বিধায় আটক হয়, তাই তারা সেই প্রকৃতির বা ইতিহাসের প্রক্রিয়ার অন্তর্গত নিয়মের শিকার বা শিকারীই কেবল হতে পারে। আজ যারা অনাকাঙ্খিত ব্যক্তি, জাতিগোষ্ঠী, মুমূর্ষু শ্রেণির সদস্য বা ক্ষয়িুষ্ণ মানুষকে সরিয়ে দিচ্ছে, প্রক্রিয়াটির বিবর্তনে আগামীকাল তাদের উপরই কোপ নেমে আসতে পারে। সর্বাত্মকতাবাদী শাসনের দরকার তার প্রজাদের এমন এক আচরণবিধিতে অভ্যস্ত করে তোলা যাতে তারা প্রত্যেকেই শিকার ও শিকারীর ভূমিকায় সমানভাবে মানিয়ে নিতে পারে। কার্যনীতি হিসাবে এই দ্বিমুখী প্রস্তুতি মতবাদকে প্রতিস্থাপন করে।
------------
মতবাদ (ইডিওলজি)— বিভিন্ন ‘...বাদ', যা কোনো একটি কেন্দ্রীয় প্রতিজ্ঞা/প্রস্তাব-এর উপর ভিত্তি করে যুক্তিবিস্তারের মাধ্যমে অনুগামীদের জন্য বস্তু ও ঘটনাবলীর সন্তোষজনক ব্যাখ্যা করে দিতে পারে— তার গুরুত্ব অতি সাম্প্রতিককালের বিষয়, তার আগে বহু যুগ ধরে তার ভূমিকা ছিল উপেক্ষনীয়। একমাত্র পিছন ফিরে দেখে বিচার করার সুযোগ থেকেই আমরা তার মধ্যে এমন কিছু উপাদান আবিষ্কার করতে পারি যা তাকে সর্বাত্মকতাবাদী শাসনের জন্য এমন উপযোগী করে তুলেছে। মতবাদের বিপুল রাজনৈতিক সম্ভাবনা হিটলার ও স্তালিনের আগে আবিষ্কৃত হয় নি।
‘মতবাদ’ পরিচিত তার বৈজ্ঞানিক চরিত্রের জন্য: তা দার্শনিক বিচারের ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক সিদ্ধান্তসমূহের সঙ্গে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির যোগ ঘটায় এবং বৈজ্ঞানিক দর্শন হিসেবে নিজেকে হাজির করে। ‘ইডিওলজি’ শব্দটার মধ্যেই যেনবা এই প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত রয়েছে যে প্রাণী যেভাবে ‘জুলজি’(প্রাণীবিদ্যা)-র বিষয়বস্তু, ঠিক তেমনভাবেই মত-ও বিজ্ঞানের বিষয়বস্তু হয়ে উঠতে পারে। ‘জুলজ’তে ‘লজি’-র মতো ‘ইডিওলজি'-র ‘লজি’-প্রত্যয়টিও নির্দেশ করে ‘লোগোই’(logoi)-কে, অর্থাৎ, বিষয়-অন্বিষ্ট বৈজ্ঞানিক বিবৃতিকে। যদি তা সত্য হতো, তাহলে মতবাদ প্রকৃতই এক ছদ্মবিজ্ঞান ও ছদ্মদর্শন হতো, একইসঙ্গে বিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতা ও দর্শনের সীমাবদ্ধতা, উভয়কেই সে লঙ্ঘন করে যেত। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে তাহলে ঈশ্বরবাদ (ডীইজম) হতো ঈশ্বরের মত আলোচনাকারী মতবাদ এবং যে ধর্মতত্ত্বীয় বৈজ্ঞানিক বিধায় ঈশ্বর এক উন্মোচিত বাস্তব, সেই বৈজ্ঞানিক উপায় নিয়ে ভাবনাই এক্ষেত্রে দর্শন। (ঈশ্বরকে প্রদত্ত বাস্তবের উন্মোচন হিসেবে না ধরে ধর্মতত্ত্ব যদি ঈশ্বরকে একটি মত/ধারণা হিসেবে বিচার করে, তাহলে তা সেই প্রাণিবিদ্যার মতো উন্মাদ হবে যে প্রাণিবিদ্যা প্রাণীদের বস্তুগত অনুভূতিগ্রাহ্য অস্তিত্ব সম্পর্কেই অনিশ্চিত।) সত্যের এ একটি অংশ মাত্র। ঈশ্বরিক প্রত্যাদেশকে যদি বা তা অস্বীকার করে, তার পরও ঈশ্বরবাদ (ডীইজম) ঈশ্বর নামক মত/ধারণা-কে বৈজ্ঞানিক বিবৃতি বলে দাবি করেই ক্ষান্ত হয় না, সেই বৈজ্ঞানিক সূত্র ব্যবহার করে জগতের গতিপথ ব্যাখ্যা করতে প্রবৃত্ত হয়। জাতিবাদ-এ জাতি, ঈশ্বরবাদ-এ ঈশ্বর, ইত্যাদি— বিভিন্ন ‘..বাদ’-সমূহের কেন্দ্রে স্থিত এইরকম মত/ধারণাগুলো কখনোই মতবাদের বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে নি এবং ‘..লজি’ প্রত্যয়টিও কখনওই সরলভাবে ‘বৈজ্ঞানিক’ বিবৃতিসমূহের গ্রন্থনা হয়ে ওঠে নি।
মতবাদ (ইডিওলজি) কী, তা আক্ষরিকভাবেই তার নামে প্রকাশিত: মতবাদ হলো একটি মত/ধারণা সঞ্জাত যুক্তি। ইতিহাস তার বিষয়বস্তু, ইতিহাসের উপর মত/ধারণা প্রয়োগ করা হয়, প্রয়োগের উদ্দেশ্য বর্তমান সম্পর্কে বিবৃতির গ্রন্থনা নয়, প্রয়োগের উদ্দেশ্য হল নিয়ত পরিবর্তনশীল এক প্রক্রিয়ার ক্রম-উন্মোচন নির্দেশ করা। মতবাদ ঘটনাপ্রবাহকে বিচার করে এমনভাবে যেনবা ঘটনাবলী সেই মতবাদের ‘মত/ধারণা’-র যুক্তিনিষ্ঠ ব্যাখ্যার ‘নিয়ম’-এর অনুসারী। মতবাদ দাবি করে যে তা সমগ্র ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার রহস্যকে জানে— অতীতের গোপন কথা, বর্তমানের জটিলতা, ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা, সবকিছুই তার কাছে তার স্বকীয় মত/ধারণা-র অন্তর্গত যুক্তিবুননের জোরে জ্ঞাত/উন্মোচিত।
মতবাদ কখনোই অস্তিত্বের অত্যাশ্চর্যে আগ্রহী নয়। মতবাদ ইতিহাস-আশ্রয়ী, পরিবর্তমানতা (becoming) ও লুপ্ত হওয়া নিয়ে আগ্রহী, সংস্কৃতির উত্থান-পতন নিয়ে আগ্রহী, যদিও কোনো না কোনো ‘প্রকৃতির নিয়ম’ দিয়েই তা ইতিহাসকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে। জাতিবাদ-এর জাতি শব্দটা বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানক্ষেত্র হিসেবে মানবজাতি সম্পর্কে কোনও খাঁটি কৌতূহলের সূচক নয়, বরং তা এমন একটি ‘মত/ধারণা’-র সূচক যা দ্বারা ইতিহাসের চলনকে সুসমঞ্জস প্রক্রিয়া হিসেবে ব্যাখ্যা করা যায়।
প্লুটো কথিত মানসচক্ষে ধরা পড়া চিরায়ত অন্তঃসার বা কান্ট কথিত যুক্তির নিয়ামক নীতি— মতবাদের ‘মত/ধারণা’ এর কোনোটাই নয়, মতবাদের ‘মত/ধারণা’ হল ব্যাখ্যা করার একটি হাতিয়ার। মতবাদ দাবি করে যে ইতিহাস কোনও মত/ধারণা-র আলোয় তৈরি দৃশ্য নয় [যা হলে বলা যেত যে ইতিহাসকে এমন এক আদর্শায়িত অনন্তকালের মূল্যাধীন (sub specie) করে দেখা হচ্ছে যে আদর্শায়িত অনন্তকাল নিজে ঐতিহাসিক চলনের ঊর্ধ্বে], বরং ইতিহাস হল মতবাদ দ্বারা গণনযোগ্য একটি বস্তু। এই গণনের কাজে ‘মত/ধারণা’ উপযুক্ত হয়ে উঠেছে তার অন্তর্গত ‘যুক্তি’-র শক্তিতে, যে যুক্তি আবার ‘মত/ধারণা’-র উপজাত ফল এবং সম্পূর্ণত তার অন্তঃস্থ বলেই ক্রিয়াশীল। জাতিবাদ মনে করে যে জাতি-র ধারণার মধ্যেই চলন অন্তর্নিহিত আছে, তেমনই ঈশ্বরবাদ মনে করে যে ঈশ্বরের ধারণার মধ্যেই চলন অন্তর্নিহিত আছে।
ইতিহাসের চলন ও মত/ধারণা-র যুক্তিপ্রক্রিয়া একে অন্যের অনুরূপ বলে ধরা হয়, যার ফলে, যা-ই ঘটুক না কেন, তা মত/ধারণা-র যুক্তিকে অনুসরণ করছে বলেই ধরা হয়। অবশ্য, যুক্তির জগতে একমাত্র সম্ভবপর চলন হল একটি প্রতিজ্ঞা/প্রস্তাব থেকে যুক্তিবিস্তারের মাধ্যমে অবরোহমূলক সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ার চলন।
পূর্বপক্ষ থেকে বিরোধীপক্ষ হয়ে সংশ্লেষে যাত্রা, যে সংশ্লেষ আবার হয়ে ওঠে পরবর্তী যাত্রার পূর্বপক্ষ— এই প্রক্রিয়ানুগ যে দ্বান্দ্বিক যুক্তি, তাও মতবাদের অধীনস্থ হলে আর নীতিগতভাবে আলাদা থাকে না; প্রথম পূর্বপক্ষ হয়ে ওঠে তার প্রতিজ্ঞা/প্রস্তাব এবং মতবাদিক ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে দ্বান্দ্বিক চাতুরী ব্যবহার করে তথ্যগত বিরোধকে একটি সামগ্রিক সুসমঞ্জস চলনের ধাপ/স্তর হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়।
যুক্তিকে যখন ভাবনাপ্রক্রিয়ার উপর প্রয়োজনীয় নিয়ন্ত্রণ হিসেবে নয়, বরং চিন্তার চলনবিধি হিসেবে ‘মত/ধারণা’-য় প্রয়োগ করা হয়, তখন সেই ‘মত/ধারণা’ একটি প্রতিজ্ঞা/প্রস্তাব-এ রূপান্তরিত হয়। সর্বাত্মকতাবাদী যুক্তিবিন্যাসের মধ্যে সুবিখ্যাতভাবে কার্যকরী হয়ে ওঠার অনেক আগে থেকেই বিভিন্ন মতবাদিক বিশ্বব্যাখ্যা যুক্তিকে এইভাবে কাজে লাগিয়েছে। আগাপাশতলা নঙর্থক এই যুক্তির পীড়ন সমস্ত বিরোধিতার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে এমনভাবে ‘কার্যকরী’ হয়ে ওঠে যে একটি সম্পূর্ণ চিন্তাধারা হাজির করে জোর করে তা মনের উপর চাপিয়ে দেওয়া যায় এবং সিদ্ধান্তগ্রহণকে কেবলমাত্র যুক্তিপ্রয়োগের উপজাত ক্রিয়া হিসেবে সীমাবদ্ধ করে দেওয়া যায়। এই যুক্তিপ্রয়োগের প্রক্রিয়ার আর নতুন কোনও ‘মত/ধারণা’ দ্বারা বিঘ্নিত হওয়ার অবকাশ থাকে না (নতুন কোনও ‘মত/ধারণা’ হয়ে ওঠে ভিন্ন একটি প্রতিজ্ঞা/প্রস্তাব, যার আনুষঙ্গিক ফলসমূহও সম্পূর্ণ ভিন্ন), নতুন কোনও অভিজ্ঞতাও তাকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করাতে পারে না। মতবাদসমূহ সর্বদা ধরে নেয় যে একটি ‘মত/ধারণা’-ই যথেষ্ট তার প্রতিজ্ঞা/প্রস্তাব থেকে সম্প্রসারের মাধ্যমে সবকিছু ব্যাখ্যা করার জন্য; এই অবরোহমূলক যুক্তিবিস্তারের সুসমঞ্জস প্রক্রিয়ার মধ্যেই যেহেতু সবকিছু বোঝা সম্ভব তাই নতুন কোনও অভিজ্ঞতারও আর নতুন কিছু শেখানোর থাকে না। দার্শনিক চিন্তনের অবশ্যম্ভাবী নিরাপত্তাহীনতার বদলে একটি মতবাদের সর্বাত্মক ব্যাখ্যান ও Weltanschauung (জীবনদৃষ্টি) গ্রহণ করার বিপদ যত না নির্বিশেষভাবে অমার্জিত সদা-অবিশ্লেষণী অনুমান গ্রহণ করার বিপদ, তার থেকে বেশি মানুষের চিন্তনের সক্ষমতার মধ্যে অন্তর্নিহিত স্বাধীনতার বদলে এমন এক যুক্তির বন্দীশিকল গ্রহণ করার বিপদ, যে বন্দীশিকল দ্বারা মানুষ নিজে নিজেকে যে কোনও বাইরের ক্ষমতার হিংস্রতম পীড়নের থেকেও আরও হিংস্রভাবে পীড়ন করতে পারে।
উনিশ শতকের Weltanschauungen ও মতবাদসমূহ নিজে থেকেই সর্বাত্মকতাবাদী ছিল না এবং বিশ শতকে জাতিবাদ ও কম্যুনিজম নির্ধারক মতবাদ হয়ে উঠলেও নীতিগতভাবে তারা কোনও অংশে অন্যদের থেকে বেশি সর্বাত্মকতাবাদী ছিল না, তারা নির্ধারক হয়ে উঠেছিল কারণ তাদের মৌলিক ভিত্তি অভিজ্ঞতার যে উপাদানের উপর গড়ে উঠেছিল— একটির ক্ষেত্রে বিশ্ব-আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জাতিদের মধ্যে সংগ্রাম ও অন্যটির ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের জন্য শ্রেণিদের মধ্যে সংগ্রাম— সেইগুলি অন্যান্য মতবাদের মৌলিক ভিত্তির থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। ফলে তাদের উপর সর্বাত্মকতাবাদী আন্দোলনের নিয়ন্ত্রণ কায়েম হওয়ার আগেই অন্য সমস্ত মতবাদের সাপেক্ষে জাতিবাদ ও কম্যুনিজমের মতবাদিক জয় নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল। অন্যভাবে বললে, সমস্ত মতবাদের মধ্যেই সর্বাত্মকতাবাদী উপাদান থাকে কিন্তু সর্বাত্মকতাবাদী আন্দোলনই একমাত্র সেই উপাদানের পূর্ণ বিকাশ ঘটায়, আর সেই জন্যই এই বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে যে কেবলমাত্র জাতিবাদ ও কম্যুনিজমই চরিত্রগতভাবে সর্বাত্মকতাবাদী। কিন্তু সত্য হল এটাই যে সব মতবাদেরই প্রকৃত চরিত্রে সর্বাত্মকতাবাদী আধিপত্য প্রতিষ্ঠার যন্ত্র চালনার ভূমিকা পালনের সক্ষমতা রয়েছে।
প্রথমত, সর্বাত্মক ব্যাখ্যা হাজির করার তাগিদে যে কোনও মতবাদের প্রবণতা হল অস্তিত্বমান বর্তমানের ব্যাখ্যা না করে যা পরিবর্তমান, জন্ম নিচ্ছে বা লুপ্ত হচ্ছে, তার ব্যাখ্যা করা। সর্বদা তারা ভাবিত কেবলমাত্র চলনের উপাদান নিয়ে, অর্থাৎ, সাধারণভাবে যাকে ইতিহাস বলা হয়ে থাকে, তা নিয়ে। মতবাদ সর্বদা ইতিহাসের দিকে মুখ করে থাকে, এমনকি জাতিবাদের মতো ক্ষেত্রে যখন যেন বা তা প্রকৃতির প্রতিজ্ঞা/প্রস্তাব থেকে উৎসারিত হয়, তখনও তা প্রকৃতিকে ব্যবহার করে কেবলমাত্র ঐতিহাসিক বিষয় ব্যাখ্যার জন্য এবং ব্যাখ্যার মাধ্যমে সেই ঐতিহাসিক বিষয়কে প্রাকৃতিক বিষয়ে পরিণত করার জন্য। অতীতের সর্বাত্মক ব্যাখ্যা, বর্তমান সম্বন্ধে সর্বাত্মক জ্ঞান ও ভবিষ্যতের নির্ভরযোগ্য পূর্বাভাস— এই তিনের সমন্বয়ে সর্বাত্মক ব্যখ্যান ঐতিহাসিক ঘটনা ব্যাখ্যার অঙ্গীকার করে। দ্বিতীয়ত, এই দিক থেকে, এমনকি সদ্যঘটিত কোনও বিষয় সম্পর্কে চিন্তনেও মতবাদিক চিন্তন আর অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করে না, অভিজ্ঞতার থেকে আর নতুন কিছু তার শেখার থাকে না। সুতরাং পঞ্চেন্দ্রিয় দিয়ে অনুভূত বাস্তবতা থেকে মুক্ত হয়ে মতবাদিক চিন্তা সমস্ত ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুর পিছনে লুকোনো এমন এক ‘অধিক সত্য’ বাস্তবতার উপর জোর দেয় যা ওই লুকোনো অবস্থান থেকে বস্তুর উপর আধিপত্য করতে থাকে এবং যা সম্পর্কে কেবলমাত্র এক ষষ্ঠেন্দ্রিয় মাধ্যমেই সচেতন হওয়া যায়। এই ষষ্ঠেন্দ্রিয় জন্ম নেয় ওই মতবাদ থেকে বা ওই মতবাদে বিশেষ দীক্ষা গ্রহণ থেকে। এই দীক্ষা দিয়ে ‘রাজনৈতিক কর্মী’ তৈরির বিশেষ উদ্দেশ্যে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে, যেমন নাৎসিদের Ordensburgen (উচ্চপদস্থ নাৎসি সেনা-আধিকারিক প্রশিক্ষণের প্রতিষ্ঠান) বা কমিন্টার্ন ও কমিনফর্মের মতবাদিক বিদ্যালয়গুলো। সর্বাত্মকতাবাদী আন্দোলনের সংগঠিত প্রচারকাজ অভিজ্ঞতা ও বাস্তবতা থেকে চিন্তাকে বিচ্ছিন্ন করতে ব্যবহৃত হয়, সর্বজনস্তরে অনুভূতিগ্রাহ্য ঘটনার মধ্যে এক গোপন অর্থ অনুপ্রবিষ্ট করতে সচেষ্ট হয় এবং প্রতিটি রাজনৈতিক পদক্ষেপের পিছনে এক গোপন উদ্দেশ্যের অস্তিত্বের সন্দেহ জাগিয়ে তোলে। ক্ষমতাসীন হওয়ার পর সর্বাত্মকতাবাদী আন্দোলন তার মতবাদিক প্রস্তাবনার ছঁাচে বাস্তবতাকে ঢেলে সাজাতে উদ্যোগী হয়। শত্রুতার ধারণা প্রতিস্থাপিত হয় ষড়যন্ত্রের ধারণা দিয়ে, ফলে এমন এক মানসিকতার উদ্ভব হয় যেখানে বাস্তবতা— বাস্তব শত্রুতা বা বাস্তব বন্ধুত্ব— কেবলমাত্র অন্তরালে থাকা কিছুর চিহ্ন হিসেবে কাজ করা ছাড়া অর্থহীন হয়ে পড়ে।
তৃতীয়ত, বাস্তবতা বদলে দেওয়ার ক্ষমতা মতবাদের নেই, তাই কিছু বিন্যাসপদ্ধতির মধ্য দিয়ে তা অভিজ্ঞতা থেকে চিন্তার বিচ্ছিন্নতা ঘটায়। মতবাদিক চিন্তা তথ্যসমূহকে এমন এক আদ্যন্ত যুক্তিনিষ্ঠ প্রক্রিয়ায় সাজিয়ে নেয় যা একটি অনুমান হিসাবে ধরে নেওয়া প্রতিজ্ঞা/প্রস্তাব থেকে শুরু করে অবরোহমূলক পদ্ধতির বিন্যাসে অন্য সমস্ত কিছুকে প্রতিপাদিত করে। অর্থাৎ, তা এমন সুসমঞ্জস ভঙ্গিতে এগোয় যা বাস্তবতার জগতে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। যুক্তিবদ্ধতার পথে বা দ্বন্দ্বমূলকতার পথে, যে পথেই এই প্রতিপাদন পদ্ধতি এগোক না কেন, তা বক্তব্য উপস্থাপনার এক সুসমঞ্জস পদ্ধতি হাজির করে, কারণ, স্থিরীকৃত পদ্ধতির অনুসারী হয়ে চিন্তা করে বলেই তা দাবি করতে পারে যে মানব-অভিজ্ঞতার নাগালছাড়া প্রাকৃতিক বা ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার চলনকেও সে বুঝতে সক্ষম। ‘বৈজ্ঞানিকভাবে’ প্রতিষ্ঠিত চলনধারাকে যৌক্তিকভাবে বা দ্বান্দ্বিকভাবে অনুকরণ করার মধ্য দিয়ে মন বোধ অর্জন করে এবং এই অনুকরণ-প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই সেই চলনধারার সঙ্গে অখণ্ড অস্তিত্ব ধারণ করে। চলনের উপাদান এবং বাস্তবতা ও অভিজ্ঞতা থেকে বিচ্ছিন্নতার উপাদান— মতবাদের এই দুই পূর্বোক্ত উপাদানেরই অনুরূপ হল নিত্য যৌক্তিক অবরোহের প্রকারবিশেষ হিসেবে মতবাদিক যুক্তিতর্ক। কারণ, প্রথমত, তার চিন্তার চলন অভিজ্ঞতা থেকে উৎসারিত না হয়ে স্ব-উৎসারিত হয়, আর দ্বিতীয়ত, অভিজ্ঞতালব্ধ বাস্তবতার থেকে গৃহীত বস্তুটিকেও সে তৎপরবর্তী কোনও অভিজ্ঞতার ছোঁয়াচ-বাঁচানো স্বতঃসিদ্ধ প্রতিজ্ঞা/প্রস্তাব-এ রূপান্তরিত করে নেয়। তার যাত্রারম্ভের বিন্দুসূচক প্রতিজ্ঞা/প্রস্তাব প্রতিষ্ঠা করে ফেলার পর মতবাদিক চিন্তা তার প্রক্রিয়ায় আর কোনও ব্যাঘাত ঘটানোর অবকাশ অভিজ্ঞতাকে দেয় না, বাস্তবতার থেকে শিক্ষা নেওয়ারও আর তার কিছু থাকে না।
উভয় সর্বাত্মকতাবাদী শাসকই তঁাদের বিশেষ মতবাদকে অনুগামীদের জন্য নিজস্ব সন্ত্রাসী আন্দোলন-বিন্যাসের হাতিয়ার হিসেবে রূপ দেওয়ার জন্য চূড়ান্ত আন্তরিকতার সঙ্গে যে উপায় অবলম্বন করেছিলেন, তা আপাতভাবে খুবই সরল ও সাদাসিধে: একজনের গর্ব ছিল তঁার ‘হিমশীতল যুক্তিবাদিতা’-র গুণ, অন্যজনের গর্ব ছিল ‘তঁার নিজস্ব দ্বন্দ্বতত্ত্বের নির্দয়তা’। আর তঁারা মতবাদিক অনুমানকে যৌক্তিক সামঞ্জস্যের যে চরমসীমায় ঠেলে নিয়ে গিয়েছিলেন— মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত মানুষ সমন্বিত ‘মুমূর্ষু শ্রেণি’ বা ‘বেঁচে থাকার যোগ্যতাহীন জাতিদের' নিশ্চিহ্নকরণ— তা তঁাদের মতবাদিক বৃত্তের বাইরে থেকে দেখলে অসম্ভব উদ্ভট ও ‘আদিম’ বলে মনে হতে পারে। যিনি স্বীকার করবেন যে ‘মুমূর্ষু শ্রেণি’ বলে বস্তু আছে, কিন্তু সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারবেন না যে সেই শ্রেণির সদস্যদের মেরে ফেলা উচিত, বা, যিনি বেঁচে থাকার অধিকারের সঙ্গে জাতিপরিচয়ের সংযোগ স্বীকার করবেন, কিন্তু ‘অযোগ্য জাতিদের’ মেরে ফেলার সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারবেন না, তঁারা নিতান্তই নির্বোধ বা ভীতু। সর্বাত্মকতাবাদী আন্দোলন বা সর্বাত্মকতাবাদী রাষ্ট্রের গোটা কাঠামোর শিরা-উপশিরায় কর্তব্য-নির্দেশক হিসেবে এই কড়া যৌক্তিকতা প্রবাহিত হচ্ছে। এ একান্তভাবেই হিটলার ও স্তালিনের অর্জন এবং এই কারণেই তঁারা তঁাদের নিজ নিজ আন্দোলনের ভাবনা-চিন্তা-প্রচারে একটা নতুন চিন্তা যোগ না করেও সর্বোচ্চ গুরুত্বের মতবাদিক নেতা হিসেবে স্বীকৃত হওয়ার যোগ্য।
এই দুই নেতা আর তঁাদের মতবাদের ‘মত’-টিকে নিয়ে আগ্রহী ছিলেন না, সে মত যাই হোক না কেন, শ্রেণিসংগ্রাম ও শ্রমিকদের শোষণ বা জাতিসংগ্রাম ও জার্মান মানুষদের যত্ন, তঁাদের আগ্রহ ছিল সেই মত থেকে যে যৌক্তিক প্রক্রিয়া গঠন সম্ভব তা নিয়ে— এইখানেই এই দুইজন তঁাদের পূর্বসূরিদের থেকে আলাদা। স্তালিন বলেছিলেন, বক্তব্যের মধ্যের ভাবনা নয়, বক্তব্য উপস্থাপনার কুশলতাও নয়, বক্তব্যের ‘যুক্তির অপ্রতিরোধ্য শক্তিই সম্পূর্ণভাবে দখল করে নিত [লেনিনের] শ্রোতাদের।’ ভাবনা/মত জনগণকে অধিকার করলে যে শক্তির জন্ম হয় বলে মার্কস ভেবেছিলেন, আবিষ্কৃত হলো যে সেই শক্তি ভাবনা/মত-এর নিজের মধ্যে নেই, আছে সেই যুক্তিপ্রক্রিয়ার মধ্যে যা ‘অতি শক্তিশালী শুঁড়ের মতো সবদিক থেকে তোমায় পেঁচিয়ে ধরে, যার কবল ছিঁড়ে নিজেকে মুক্ত করার শক্তি তোমার নেই, হয় তার কাছে আত্মসমর্পণ কর, আর নয়ত চূড়ান্ত পরাজয়ের জন্য প্রস্তুত হও।’৩ দুর্যোগের মুখে যখন মতবাদিক লক্ষ্য প্রতিষ্ঠা— তা শ্রেণিহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা হোক বা প্রভু জাতির শাসন প্রতিষ্ঠা— বিপন্ন হয়, তখনই এই শক্তি আত্মপ্রকাশ করতে পারে। আত্মপ্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়ায় আবেদনের মধ্য দিয়ে জনগণকে আকর্ষণ করার পর্যায়ে মতবাদগুলির মৌলিক ভিত্তি যা ছিল— শ্রমিক-শোষণের অবসান বা জার্মানির জাতীয় আকাঙ্খা— তা ধীরে ধীরে প্রক্রিয়াটির গ্রাসে লুপ্ত হয়: ‘হিমশীতল যুক্তিবিস্তার’ ও ‘যুক্তির অপ্রতিরোধ্য শক্তি’-র প্রকোপে বলশেভিক শাসনে শ্রমিকরা হারায় এমনকি সেই অধিকারগুলোকেও যা জারতন্ত্রী নিপীড়নেও তাদের হারাতে হয় নি, আর জার্মান জনগণকে ভোগ করতে হয় এমন এক যুদ্ধ-অভিজ্ঞতা যা জার্মান জাতির অস্তিত্ব বজায় রাখার ন্যূনতম প্রয়োজনগুলোকেও আর বিন্দুমাত্র রেয়াত করে নি। কোনও প্রচণ্ড নেতার আত্মস্বার্থে বা ক্ষমতালিপ্সায় করা বিশ্বাসঘাতকতা নয়, এটা সর্বাত্মকতাবাদী রাজনীতিরই চরিত্র যে রাজনৈতিক ‘মত’টি (ইতিহাসের নিয়ম হল শ্রেণিসংগ্রাম বা প্রকৃতির নিয়ম হল জাতিদের সংগ্রাম) যে মতবাদিক প্রকৃত অন্তঃসার (শ্রমিকশ্রেণি বা জার্মান জাতি) থেকে প্রথম উৎসারিত হয়, ‘মত’টির প্রতিষ্ঠাদানকারী যুক্তির গ্রাসে সেই অন্তঃসার অবশেষে লুপ্ত হয়।
মন্তেস্কুর কার্যনীতির বদলে শিকার-শিকারী সম্পর্কের যে প্রস্তুতি-প্রশিক্ষণ সর্বাত্মকতাবাদের কাঙ্খিত, তা মতবাদের (জাতিবাদের বা দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের) নিজমধ্যে নেই, তা আছে সেই মতবাদের সহজাত যুক্তিশৃঙ্খলায়। হিটলার ও স্তালিন উভয়েরই খুব প্রিয় এহেন সবচেয়ে প্রবর্তক প্রস্তাব হল: তুমি ক বলতে পার না, যদি না তুমি খ ও গ বল,... এভাবে শৃঙ্খলা বিস্তৃত খুনে বর্ণমালার শেষতম বর্ণ অবধি। এখানেই বুঝি বা যুক্তিশৃঙ্খলার জবরদস্তিকারী শক্তির উৎস নিহিত, আমাদের নিজেদের স্ব-বিরুদ্ধাচারণ করার ভয় থেকেই তার জন্ম। বলশেভিক শুদ্ধিকরণ তার শিকারদের দিয়ে যে মাত্রায় তাদের না-করা অপরাধকে কবুল করিয়ে নিতে পেরেছিল, তা প্রধানত এই মৌলিক ভীতিকে ব্যবহার করে এবং তার প্রস্তাবটি ছিল এইরকম: ‘ইতিহাস হল একটি শ্রেণিসংগ্রাম, এই প্রতিজ্ঞা/প্রস্তাব-এ আমরা একমত। শ্রেণিসংগ্রামে পার্টির ভূমিকা সম্বন্ধেও আমরা একমত। সুতরাং এটা জানা যে, ঐতিহাসিকভাবে বললে, পার্টি সর্বদা সঠিক। (ট্রটস্কি-র ভাষায়, ‘আমরা কেবলমাত্র পার্টির সাথে এবং পার্টির দ্বারাই সঠিক হতে পারি, কারণ সঠিক হওয়ার আর কোনো রাস্তা ইতিহাস আমাদের দেয় নি।’) এই ঐতিহাসিক মুহূর্তে, ইতিহাসের নিয়ম অনুযায়ীই, কিছু অপরাধ সংঘটিত হতে চলেছে, যেগুলোকে ইতিহাসের নিয়ম সম্পর্কে সচেতন পার্টি দণ্ডিত না করে পারে না। দণ্ডিত করতে হলে অপরাধের জন্য অপরাধী প্রয়োজন। এটা হতে পারে যে পার্টি অপরাধগুলো সম্পর্কে জানলেও অপরাধীদের সন্দেহাতীতভাবে জানে না; কিন্তু অপরাধীদের সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার থেকে অপরাধগুলোকে দণ্ডিত করা বেশি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এইসব দন্ডদান ছাড়া ইতিহাস এগোতে পারবে না, ইতিহাসের এগোনোর পথে বাধা মাথা তুলবে। সুতরাং, তুমি অপরাধ করে থাকো বা পার্টি তোমায় অপরাধীর ভূমিকা নিতে নির্দেশ দিক— উভয় ক্ষেত্রেই, তুমি বস্তুগতভাবে পার্টির শত্রুতে পরিণত হয়েছ। যদি তুমি অপরাধ স্বীকার না কর, তাহলে তুমি পার্টিকে, এবং পার্টির মধ্য দিয়ে ইতিহাসকে, সহায়তা করতে অস্বীকার করছ এবং সেই সুবাদে প্রকৃত শত্রুতে পরিণত হয়েছ।’ প্রস্তাবটির জবরদস্তিমূলক শক্তি এইখানে: যদি তুমি অস্বীকার কর, তাহলে তুমি স্ববিরোধিতা করছ এবং এই স্ববিরোধিতার মধ্য দিয়ে তোমার গোটা জীবনকে অর্থহীন করে তুলছ; তুমি যে ‘ক’-টি বলেছ, তার থেকে যুক্তিশৃঙ্খলা অনুসারে ‘খ’ ও ‘গ’-এর তাৎপর্যের মধ্য দিয়ে তা তোমার গোটা জীবনের উপর আধিপত্য বিস্তার করছে।
সর্বাত্মকতাবাদী শাসকদের এখনও দরকার পড়ে সীমিত সংখ্যক মানুষকে সমাবেশিত করতে, এই প্রয়োজনে তাদের আয়ুধ সেই বাধ্যবাধকতা যার মাধ্যমে আমরা নিজেরাই নিজেদের বাধ্য করি। এই অন্তর্গত বাধ্যবাধকতা হল যুক্তিশৃঙ্খলার উৎপীড়ন, যার বিরুদ্ধে আর কিছুই দাঁড়াতে পারে না কেবলমাত্র মানুষের নতুন করে শুরু করার মহান ক্ষমতা ছাড়া। একটি অন্তহীন প্রক্রিয়া হিসেবে যুক্তির কাছে মনের বশ্যতার মধ্য দিয়ে, চিন্তার জন্মের জন্য তার উপর নির্ভরশীল হওয়ার মধ্য দিয়ে যুক্তিশৃঙ্খলার উৎপীড়নের শুরু হয়। এই বশ্যতার মধ্য দিয়ে মানুষ তার অন্তরের স্বাধীনতা বিসর্জন দেয়, ঠিক যেমন কোনও বাইরের উৎপীড়নের কাছে মাথা নোওয়ানোর মধ্য দিয়ে সে তার চলনের স্বাধীনতা বিসর্জন দেয়। মানুষের অন্তরের ক্ষমতা হিসেবে স্বাধীনতা নতুন করে শুরু করার ক্ষমতার সঙ্গে অভিন্ন, ঠিক যেমন একটি রাজনৈতিক বাস্তবতা হিসেবে স্বাধীনতা মানুষে-মানুষে অন্তর্বর্তী ক্ষেত্রে চলনের প্রসারের সঙ্গে অভিন্ন। প্রথম ধাপে যুক্তি বা উপপাদনের কোনও ক্ষমতা থাকে না কারণ প্রারম্ভকে একটি প্রতিজ্ঞা/প্রস্তাব আকারে যুক্তিশৃঙ্খলা পূর্বানুমান করে। প্রত্যেক নতুন মানুষের জন্মের সঙ্গে যাতে একটি নতুন সূচনা না হয়, তা নিশ্চিত করতে যেমন সন্ত্রাস দরকার হয়, তেমনই, যুক্তিশৃঙ্খলার আত্মপীড়নকারী শক্তি সংহত করা হয় যাতে কেউ চিন্তা করতে শুরু না করে— যে চিন্তা করার ক্রিয়া সকল মানবক্রিয়ার মধ্যে সবচেয়ে মুক্ত ও সবচেয়ে খাঁটি হিসাবে উপপাদনের বাধ্যতামূলক প্রক্রিয়ার সম্পূর্ণ বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকে। ইতিহাস বা প্রকৃতির যে আদি-অন্ত-হীন চলনের উপাদান হিসেবে মানুষকে গণ্য করা হয়, সেই মহৎ চলনের অঙ্গীভূত রূপে সংহত হতে মানুষের নিজস্ব ইচ্ছাশক্তিকে কোনো সর্বাত্মকতাবাদী শাসন যত বাধ্য করতে পারে, ততই সেই শাসন নিজেকে নিরাপদ করতে পারে।
একদিকে সর্বাত্মক সন্ত্রাস সঞ্জাত বাধ্যবাধকতা, যা বিচ্ছিন্ন মানুষের দঙ্গলকে তার লৌহমুষ্ঠিতে একসঙ্গে পিষে রাখে, সেই মানুষদের জগতকে বিজনপ্রদেশ করে তোলে; আর অন্যদিকে যুক্তিবদ্ধ উপপাদনের আত্মপীড়নকারী শক্তি, যা প্রতিটি ব্যক্তিকে তার একাকীত্বের কারাগারে অন্য সবার বিরুদ্ধে সন্দেহে-শত্রতায় প্রস্তুত-প্রশিক্ষিত করে তোলে— একে অপরের উপর নির্ভরশীল ও একে অপরের মধ্যে আদানপ্রদান বজায় রাখা এই দুই উপাদান সন্ত্রাস-চালিত শাসনকে গতিশীল করে ও গতিশীল রাখে। ঠিক যেমন তার প্রাক-সর্বাত্মক কেবলমাত্র উৎপীড়ক অবতারে সন্ত্রাস মানুষে-মানুষে সমস্ত সম্পর্ক ধ্বংস করে দেয়, ঠিক তেমনই মতবাদিক চিন্তার আত্মবাধকতা বাস্তবতার সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ককে ধ্বংস করে দেয়। মানুষ যখন তার সহমানুষদের সঙ্গে সংস্পর্শ হারায়, বাস্তবতার সঙ্গেও সংস্পর্শ হারায়, তখন প্রস্তুতি সম্পূর্ণ হয়। কোনো স্থিরবিশ্বাস নাৎসি বা কোনো স্থিরবিশ্বাস কম্যুনিস্ট সর্বাত্মকতাবাদী শাসনের আদর্শ প্রজা নয়, বরং সেই আদর্শ প্রজা হল এমন মানুষ যার কাছে তথ্য ও গল্পের মধ্যবর্তী ফারাক (অর্থাৎ অভিজ্ঞতার বাস্তবতা) ঘুচে গেছে, সত্য ও মিথ্যার ফারাকও (অর্থাৎ চিন্তার মানও) ঘুচে গেছে।
-----------
এই আলোচনার শুরুতে যে প্রশ্নটি তুলেছিলাম, এখন সেখানে ফিরে যাব। প্রশ্নটি হল: যে শাসনরূপের অন্তঃসার হলো সন্ত্রাস ও কর্মনীতি হল মতবাদিক চিন্তার যুক্তিশৃঙ্খলা, সেই শাসনরূপের শিরা-ধমনীর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত মানুষের সহবাসের মৌলিক অভিজ্ঞতা কী রকম হয়? রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার বিবিধ রূপে এর আগে যে এমন যৌগ ব্যবহৃত হয় নি, তা স্পষ্ট। তা সত্ত্বেও, যে মৌলিক অভিজ্ঞতার উপর এর ভিত্তি, তা নিশ্চয়ই মানুষ-সম্পর্কিত ও মানুষের জানা, কেন না এই ‘অভুতপূর্ব’ রাজনৈতিক কাঠামোটিও মানুষের তৈরি এবং কোনও না কোনওভাবে মানুষের চাহিদাকেই মেটাচ্ছে।
প্রায়শই বলা হয়ে থাকে যে সন্ত্রাস সেই সমস্ত মানুষদের উপরই সম্পূর্ণ শাসন কায়েম করতে পারে যারা নিজেদের মধ্যে একে অপরের বিরুদ্ধে বিভাজিত, আর তাই সমস্ত উৎপীড়ক শাসনের প্রাথমিক প্রচেষ্টা হয় মানুষদের এভাবে বিভাজিত ও বিচ্ছিন্ন একক করে তোলা। বিচ্ছিন্নকরণ যেমন সন্ত্রাসের প্রারম্ভবিন্দু হতে পারে, তা যেমন অবশ্যই সন্ত্রাসের সবচেয়ে উর্বর ক্ষেত্র, তেমনই তা সন্ত্রাসের ফলাফলও বটে। ঐতিহাসিক বিচারে এই বিচ্ছিন্নকরণ প্রাক-সর্বাত্মক যুগের বস্তু, অনুর্বরতা হল এর শনাক্তি-চিহ্ন; যে মাত্রায় একসঙ্গে ‘সুসম্বদ্ধ ভাবে ক্রিয়াশীল’ (বার্ক) মানুষের থেকেই ক্ষমতা উৎসারিত হয়, সে মাত্রায় বিচ্ছিন্ন মানুষ ক্ষমতাহীন।
উৎপীড়ক শাসনের বৈশিষ্ট্য রূপে বিচ্ছিন্নতা ও অনুর্বরতা, অর্থাৎ ক্রিয়াশীল হওয়ার মৌলিক অক্ষমতাকে সবসময় দেখা গেছে। উৎপীড়ক শাসনে মানুষের মধ্যে পারস্পরিক রাজনৈতিক সংস্পর্শ ছেদ করে দেওয়া হয়, ক্রিয়াশীল হওয়ার ও ক্ষমতার্জনের সক্ষমতাকে অকেজো করে দেওয়া হয়। কিন্তু মানুষের মধ্যে সব সংস্পর্শকেই ছেদ করে দেওয়া হয় না, মানুষের সব সক্ষমতাকেই অকেজো করে দেওয়া হয় না। ব্যক্তিগত জীবনের গোটা পরিধি— অভিজ্ঞতালাভ, উদ্ভাবন ও চিন্তার সক্ষমতা সমেত— অটুট থাকে। অন্যদিকে, আমরা জেনেছি যে সর্বাত্মক সন্ত্রাসের লৌহবন্ধন ব্যক্তিগত জীবনের তেমন কোনও পরিধি অটুট রাখে না এবং সর্বাত্মকতাবাদী যুক্তির আত্মপীড়ন মানুষের ক্রিয়ার সক্ষমতাকে যতটা নিশ্চিতভাবে ধ্বংস করে, ঠিক ততটা নিশ্চিতভাবেই ধ্বংস করে মানুষের অভিজ্ঞতা-অর্জন ও চিন্তা করার সক্ষমতাকেও।
রাজনৈতিক পরিধিতে যাকে বিচ্ছিন্নতা বলা হয়, সামাজিক মেলামেশার পরিধিতে তাকে বলা হয় একাকীত্ব। বিচ্ছিন্নতা ও একাকীত্ব এক নয়। আমাকে বিচ্ছিন্ন করা হতে পারে— অর্থাৎ, এমন এক পরিস্থিতির মধ্যে আমি পড়তে পারি যেখানে কোনওভাবে ক্রিয়াশীল হওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব কারণ আমার সঙ্গে ক্রিয়া করার মতো আর কেউ নেই— কিন্তু সে পরিস্থিতি আমাকে একাকী নাও করতে পারে; পক্ষান্তরে, আমি একাকী হয়ে যেতে পারি— অর্থাৎ, এমন এক পরিস্থিতিতে আমি পড়তে পারি যেখানে সমস্ত মানবসঙ্গ আমাকে ত্যাগ করেছে বলে আমার ব্যক্তিগত বোধ হতে পারে— কিন্তু আমি বিচ্ছিন্ন নাও হতে পারি। বিচ্ছিন্নতা হলো সেই কোণঠাসা অবস্থা যেখানে মানুষ নিজেকে আবিষ্কার করে যখন তাদের জীবনে সাধারণ চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে একসঙ্গে ক্রিয়া করার রাজনৈতিক পরিধি ধ্বংস হয়ে যায়। তবুও, ক্ষমতার্জনের ও ক্রিয়াশীলতার সক্ষমতার জন্য ক্ষয়কারক হলেও, বিচ্ছিন্নতা মানুষের তথাকথিত ফলদায়ক ক্রিয়াসকলকে কেবলমাত্র অটুটই রাখে না, সেসবের জন্য কখনও তা দরকারিও হয়ে ওঠে। যে মাত্রায় মানুষ homo faber, সে মাত্রায় সে নিজের কাজ দিয়ে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করতে চায়, অর্থাৎ সাময়িকভাবে রাজনৈতিক পরিধি ত্যাগ করতে চায়। উদ্ভাবন (poiesis, বস্তু-নির্মাণ), যা একদিকে যেমন ক্রিয়া (praxis)-র থেকে আলাদা, অন্যদিকে তেমনই নিছক শ্রমের থেকেও আলাদা, তা সবসময়েই সাধারণ উদ্বেগের থেকে কিছুটা বিচ্ছিন্নতাতেই সংঘটিত হয়, কারিগরি বা শৈল্পিক— যাই-ই তার প্রেরণা হোক না কেন। বিচ্ছিন্ন অবস্থায় মানুষ জগতের সঙ্গে মানব-প্রকরণ রূপে সংযুক্ত থাকে; মানব সৃষ্টিশীলতার প্রাথমিক রূপ হল জগতে নিজস্ব কিছু যুক্ত করার সক্ষমতা, সেই প্রাথমিক রূপকেই যখন ধ্বংস করে দেওয়া হয়, তখনই বিচ্ছিন্নতা অসহনীয় হয়ে ওঠে। তা ঘটতে পারে এমন এক জগতে যার প্রধান মূল্যবোধসমূহ শ্রমের দ্বারা আদিষ্ট, অর্থাৎ যেখানে সমস্ত মানবক্রিয়াকেই রূপান্তরিত করা হয়েছে শ্রমদানে। সেই পরিস্থিতিতে কেবলমাত্র বেঁচে থাকার জন্য শ্রমের ডাহা প্রয়াস অবশিষ্ট থাকে এবং মানব-প্রকরণ হিসেবে জগতের সঙ্গে সম্পর্ক লুপ্ত হয়। স্বতক্রিয়ার রাজনৈতিক পরিধিতে জায়গা হারানো বিচ্ছিন্ন মানুষকে ত্যাগ করে যায় বস্তুজগতও, homo faber হিসেবে স্বীকৃতি না দিয়ে তাকে দেখা হয় এমন এক animal laborans (পুনরাবৃত্তিমূলক শ্রমে বদ্ধ পশু) রূপে যার প্রয়োজনীয় ‘প্রকৃতির সঙ্গে বিপাকক্রিয়া’ নিয়ে আর কারও মাথাব্যথা নেই। তখন বিচ্ছিন্নতা পরিণত হয় একাকীত্বে। বিচ্ছিন্নকরণের উপর ভিত্তি করে উৎপীড়ন সাধারণত মানুষের উৎপাদনী সক্ষমতাকে অটুট রাখে, ‘শ্রমদানকারীদের’ উপর উৎপীড়ন (যেমন, প্রাচীন কালে দাসদের উপর শাসন) অবশ্য নিজে থেকেই হয়ে দাঁড়ায় কেবলমাত্র বিচ্ছিন্ন নয়, একাকীত্বে নির্বাসিত মানুষদের উপর শাসন, আর তাই সর্বাত্মকতাবাদী হয়ে ওঠার প্রবণতা তার মধ্যে থাকে।
বিচ্ছিন্নতা কেবল জীবনের রাজনৈতিক পরিধিকে প্রভাবিত করে, একাকীত্ব সেখানে সমগ্র মানবজীবনকেই প্রভাবিত করে। সমস্ত উৎপীড়নমূলক শাসনের মতো সর্বাত্মকতাবাদী শাসনও টিকতে পারে না জীবনের ব্যক্তিগত পরিধিকে ধ্বংস না করে, অর্থাৎ, বিচ্ছিন্ন করার মধ্য দিয়ে মানুষের রাজনৈতিক সক্ষমতাকে ধ্বংস না করে। কিন্তু শাসনের একটি রূপ হিসাবে সর্বাত্মকতাবাদী শাসনের অভিনবত্ব এখানেই যে সে এই বিচ্ছিন্নকরণেই সন্তুষ্ট নয়, সঙ্গে সঙ্গে সে ব্যক্তিগত জীবনকেও ধ্বংস করে দেয়। সে ভিত্তি স্থাপন করে একাকীত্বের উপর, জগতে আর অংশ না নিয়ে গুটিয়ে যাওয়ার উপর, অর্থাৎ, এমন এক মানব অভিজ্ঞতার উপর যা এতাবৎ ইতিহাসে চরমতম ও দুঃসহতম।
সন্ত্রাসের সাধারণ ভূমি, সর্বাত্মকতাবাদী শাসনের অন্তঃসার, মতবাদ ও যুক্তিবদ্ধতার অন্তঃসার, তাদের শিকার ও শিকারীর প্রস্তুতিপ্রক্রিয়া স্বরূপ যে একাকীত্ব, তা নিবিড়ভাবে যুক্ত শিকড়সমেত উৎপাটিত হওয়া ও নিষ্প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ার দশার সঙ্গে। এই অবস্থা আধুনিক মানুষের উপর অভিশাপ হিসেবে নেমে এসেছে শিল্প বিপ্লবের শুরু থেকে, তীব্র হয়ে উঠেছে উনিশ শতকের শেষে সাম্রাজ্যবাদের উত্থানের মধ্য দিয়ে, আর গেঁড়ে বসেছে আমাদের সমসাময়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ও সামাজিক পরম্পরার ভাঙনের পথ ধরে। শিকড়সমেত উৎপাটিত হওয়ার মানে জগতে ঠঁাইহীন হয়ে যাওয়া, অন্য কারও কাছে স্বীকৃতি ও পরিচয়-নিশ্চিতি না থাকা; নিষ্প্রয়োজনীয় হয়ে যাওয়ার মানে আর জগতের অংশভুক্তই না থাকা। নিষ্প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ার প্রাথমিক অবস্থা হতে পারে শিকড় সমেত উৎপাটিত হওয়া, ঠিক যেমন একাকীত্বের প্রাথমিক অবস্থা হতে পারে (কিন্তু হবেই যে তা নয়) বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া। একাকীত্বের সাম্প্রতিক ঐতিহাসিক কারণসমূহ ও রাজনীতিতে তার নতুন ভূমিকা বিচারে না এনে আমরা যদি কেবলমাত্র একাকীত্বকেই বিচার করি, তাহলে দেখব যে একদিকে যেমন এককীত্ব মানব অবস্থার মৌল প্রয়োজনগুলোর পরিপন্থী, অন্যদিকে তেমনই তা প্রতিটি মানবজীবনের একটি মৌলিক অভিজ্ঞতাও বটে। কোনো মানুষের বস্তুগতভাবে ইন্দ্রিয়মাধ্যমে গ্রাহ্য জাগতিক অভিজ্ঞতাও নির্ভর করে অন্য মানুষের সঙ্গে সংস্পর্শের উপর, ইন্দ্রিয় চালনা ও নিয়ন্ত্রণ করা কাণ্ডজ্ঞানের উপর, যে কাণ্ডজ্ঞান ছাড়া আমরা প্রত্যেকে নিজ নিজ ইন্দ্রিয়প্রদত্ত উপাত্তের উপরই কেবল নির্ভরশীল হয়ে পড়তাম, বিচ্ছিন্নভাবে যে উপাত্ত মোটেই ভরসা ও বিশ্বাসের উপযোগী নয়। কেবলমাত্র আমাদের কান্ডজ্ঞান আছে বলেই, অর্থাৎ, এই জগতে কেবল একক মানুষ নয়, বহুবচনান্তে মানুষ আছে বলেই আমরা আমাদের প্রত্যক্ষ ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতার উপর ভরসা করতে পারি। তবুও, শুধুমাত্র এই কথাটাই যদি আমরা স্মরণ করি যে একদিন আমাদের এই জগত ছেড়ে চলে যেতে হবে, তার পরও এই জগত আগের মতোই চলতে থাকবে, এই জগতের অনবচ্ছেদের জন্য আমরা নিষ্প্রয়োজনীয়, তাহলেই আমরা একাকীত্ব বোধ করব, সমস্তকিছু ও সমস্তজন দ্বারা পরিত্যক্ত হওয়ার অনুভূতি বোধ করব।
একাকীত্ব নির্জনতা নয়। নির্জনতার জন্য সঙ্গীহীন হয়ে একা হতে হয়, কিন্তু অন্য বহুজনের সান্নিধ্যমধ্যেই একাকীত্বের বোধ সবচেয়ে তীব্র হয়ে দেখা দেয়। কূটাভ্যাসমূলক মেজাজে করা কিছু বিচ্ছিন্ন মন্তব্যকে যদি আমরা বিচারের বাইরে রাখি— যেমন, কাটো-র মন্তব্য (সিসেরো দ্বারা উদ্ধৃত, De Re Publica, I, ১৭): numquam minus solum esse quam cum solus esset, ‘একা থাকার সময়ের থেকে কম একা সে আর কখনও হয় নি’, বা, ধরা যাক, ‘নির্জন থাকার সময়ের থেকে কম একাকী আর কখনও সে হয় নি’— তাহলে মনে হয় যে গ্রীক উৎসের মুক্তিপ্রাপ্ত দাস দার্শনিক এপিকটেটাস-ই প্রথম একাকীত্ব ও নির্জনতার মধ্যে পার্থক্য করেছিলেন। তিনি হঠাৎই এই আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন, একাকীত্ব বা নির্জনতা কোনোটাই তঁার মূল উৎসাহের বিষয় ছিল না, তিনি উৎসাহী ছিলেন পরম স্বাধীন হওয়া অর্থে একা হওয়া (monos) নিয়ে। এপিকটেটাস-এর মতে (Dissertationes, বুক ৩, পরিচ্ছেদ ১৩), একাকী মানুষ (eremos) পরিবেষ্টিত হয়ে থাকে অন্যদের দ্বারা, যাদের সঙ্গে সে কোনও সংস্পর্শ স্থাপন করতে পারে না অথবা যাদের শত্রুতার মুখোমুখি তাকে হতে হয়। অন্যদিকে, নির্জন মানুষ একা আর তাই সে ‘নিজের সঙ্গ ভোগ করে’ কারণ মানুষ ‘নিজের সঙ্গে কথা বলতে’ সক্ষম। অন্যভাবে বললে, নির্জনতায় আমি ‘একা আমি’ আছি, নিজসত্তার সঙ্গে আছি, আর তাই এক মধ্যে দুই হয়ে আছি। আর, একাকীত্বে আমি প্রকৃতই একা, অন্য সবার দ্বারা পরিত্যক্ত। নিখঁুতভাবে বললে, সকল চিন্তা করার কাজই নির্জনতায় করা হয় এবং আমি ও আমার সত্তার মধ্যে কথোপকথন রূপে করা হয়। কিন্তু এই একের মধ্যে দুইয়ের কথোপকথন সহ-মানুষদের জগতের সঙ্গে সংস্পর্শ হারিয়ে ফেলে না, কারণ চিন্তার কথোপকথন আমি আমার যে সত্তার সঙ্গে চালাচ্ছি, তার মধ্যেই সেই সহ-মানুষদের প্রতিনিধিত্ব আছে। নির্জনতার সমস্যা হলো এই যে এই একের-মধ্যে-দুই-এর আবার অপরকে প্রয়োজন হয় এমন এক অর্জনের জন্য যা স্ব-শনাক্তিকে সুস্পষ্ট ও স্বতন্ত্র করে প্রতিষ্ঠা দেয়। স্ব-শনাক্তির অনুমোদনের জন্য স্ব সম্পূর্ণত অন্যের উপর নির্ভরশীল, অপরের সঙ্গ পরম আশীর্বাদ রূপে নির্জন মানুষদের আবার ‘সমগ্র’ করে তোলে, সর্বদা দ্ব্যর্থবাচক থাকতে হয় যে চিন্তার কথোপকথনে তার থেকে উদ্ধার করে এনে অবিনিময়যোগ্য ব্যক্তির একক স্বরে কথা বলতে পারা স্ব-শনাক্তি-কে পুনর্প্রতিষ্ঠিত করে।
নির্জনতা একাকীত্ব হয়ে উঠতে পারে। তা হয় যখন নিজে থেকেই স্ব তার সত্তার দ্বারা পরিত্যক্ত হয়। নির্জন মানুষরা একাকীত্বের খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে থাকে যখন তারা তাদের দ্বিত্ব, দ্ব্যর্থবোধকতা ও দ্বিধা থেকে উদ্ধারকারী অপর-সঙ্গের আশীর্বাদ থেকে বঞ্চিত হয়। ইতিহাস বিচার করলে মনে হয় যে এই বিপদ নজরে পড়ার মতো ও ইতিহাসে নথিভুক্ত হওয়ার মতো যথেষ্ট বড় হয়ে উঠেছে উনিশ শতকে এসে। তা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়ে ওঠে যখন, যে দার্শনিকদের জন্য নির্জনতাই জীবনের পথ এবং কর্মের পরিবেশ, তারাও সন্তুষ্ট থাকতে পারল না যে ‘দর্শন কেবলমাত্র অল্প কিছু জনের জন্যই’ এবং সজোরে অভিযোগ করতে লাগল যে তাদের কেউ ‘বোঝে' না। দৃষ্টান্তস্বরূপ উল্লেখ করা যায় সেই মন্তব্যকে যা মৃত্যুশয্যায় হেগেল করেছিলেন বলে প্রচারিত,যা তঁার পূর্ববর্তী কোনও মহান দার্শনিকের ক্ষেত্রে ভাবা দুষ্কর ছিল: ‘একজনকে বাদ দিলে কেউ আমায় বোঝে নি, আর সেই একজনও আমায় ভুল বুঝেছে।’ অন্যপক্ষে, সবসময়ই এই সম্ভাবনা থেকে যায় যে একজন একাকী মানুষ নিজেকে খুঁজে পাবে এবং নির্জনতার চিন্তাশীল কথোপকথন শুরু করবে। তাই ঘটেছে বলে মনে হয় নিৎশের ক্ষেত্রে যখন তিনি সিলস মারিয়াতে ‘জরাথুস্ট্র’ রচনা করছেন। দুটি কবিতায় (‘Sils Maria’ ও ‘Aus hohen Bergen’) তিনি একাকী মানুষের শূন্য আশা ও রিক্ত অপেক্ষার কথা বলেন যতক্ষণ না হঠাৎ—
তখন দুপুর, যখন এক হলো দুই...
ঐক্যবদ্ধ বিজয়ের নিশ্চয়তা নিয়ে আমরা পালন করলাম
সব ভোজ-উৎসবের সেরা ভোজ-উৎসব;
বন্ধু জরাথুস্ট্র, অতিথিদের অতিথি, তখন এলেন।
(um Mittag war’s, da wurde Eins zu Zwei…
Num feiern wir, vereinten Siegs gewiss,
Das Fest der Feste;
Freund Zarathustra kam, der Gast der Gaste!)
যে স্ব-সত্তা নির্জনতায় উপলব্ধ হয়, কিন্তু যার স্ব-শনাক্তিকরণ কেবলমাত্র সমকক্ষ জনেদের আস্থাশীল ও আস্থাযোগ্য সঙ্গের দ্বারাই অনুমোদিত হয়, সেই স্ব-সত্ত্বাকে খোয়ানোই একাকীত্বকে এত অসহনীয় করে তোলে। সেই অবস্থায় মানুষ তার চিন্তার দোসর হিসেবে নিজের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলে এবং যে কোনও অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য জগতের উপর যে প্রাথমিক বিশ্বাস প্রয়োজন, সেই বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। স্ব-সত্তা ও জগত, চিন্তা করার সক্ষমতা ও অভিজ্ঞতা অর্জনের সক্ষমতা— একইসঙ্গে উভয়কেই সে হারিয়ে বসে।
মানবমনের একমাত্র যে সক্ষমতা স্ব-সত্তাকে ছাড়া, অপরকে ছাড়া, জগতকে ছাড়া নিরুপদ্রবে কাজ করে যেতে পারে এবং যে অভিজ্ঞতা বা চিন্তাশীলতা কারও উপরই নির্ভর করে না, তা হল প্রাথমিক প্রতিজ্ঞা/প্রস্তাবকে স্বতঃসিদ্ধ ধরে নিয়ে যুক্তিবদ্ধ সিদ্ধান্তগ্রহণের পদ্ধতি। অকাট্য প্রমাণের প্রাথমিক নিয়মাবলী, দুই যোগ দুই চার হওয়ার সত্যবাদ— এ সমস্ত বিকৃত হয় না চূড়ান্ত একাকীত্বের পরিবেশেও। পারস্পরিক আস্থা হারানোর পরও, সাধারণ জগতে অভিজ্ঞতা অর্জন করা, বাঁচা ও পথ চিনে নেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় কাণ্ডজ্ঞান হারানোর পরও যে ‘সত্য’-র উপর মানুষ আস্থা রাখতে পারে, তাই-ই হল একমাত্র ভরসাযোগ্য সত্য। কিন্তু এই ‘সত্য’ শূন্যগর্ভ, বা, আদৌ কোনও সত্যই তা নয়, কারণ তা কোনওকিছুকেই উন্মোচিত করে না। (আধুনিক কিছু যুক্তিবিদদের মতো যুক্তিসঙ্গতিকে সত্য বলে সংজ্ঞায়িত করা আসলে সত্যের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করা।) সুতরাং, একাকীত্বের পরিবেশে স্বতঃসিদ্ধটি কেবলমাত্র বুদ্ধিবৃত্তির একটি উপায় হয়ে না থেকে বহুপ্রসবা হয়ে উঠতে শুরু করে, নিজস্ব ‘চিন্তা’-র সূত্র গড়ে তুলতে থাকে। লুথার (নির্জনতা ও একাকীত্ব বিষয়ে যাঁর অভিজ্ঞতা সম্ভবত আর কারও চেয়ে কম নয় এবং যিনি একদা বলার সাহস করেছিলেন যে ‘একজন ঈশ্বর আবশ্যক কারণ মানুষ এমন একজনকে চায় যার উপর সে ভরসা করতে পারে’) একসময় বাইবেল-উক্তি— ‘মানুষের একা থাকা ভালো নয়’—এর উপর একটি স্বল্প-পরিচিত মন্তব্যে খেয়াল করেছিলেন যে আপাত-অলঙ্ঘনীয় দৃঢ়বদ্ধ স্বতঃসিদ্ধ ও যুক্তিবদ্ধতা দ্বারা চিহ্নিত যুক্তিপ্রক্রিয়ার সঙ্গে একাকীত্ব সম্পর্কিত: লুথার বলেছিলেন যে একজন একাকী মানুষ ‘এক বস্তু থেকে অনুমানে অন্য বস্তুতে পৌঁছে যায় এবং সবকিছুকে সবচেয়ে খারাপ অবধি ভেবে নিয়ে যায়।’৪ সর্বাত্মকতাবাদী আন্দোলনগুলোর বিখ্যাত চরমপন্থার সঙ্গে প্রকৃত বিপ্লবপন্থার কোনো সম্পর্ক নেই, বরং এই চরমপন্থার নির্যাস হল ‘সবকিছুকে সবচেয়ে খারাপ অবধি ভেবে নিয়ে যাওয়া’, যে অবরোহমূলক ভাবনাপ্রক্রিয়া ব্যতিক্রমহীনভাবে সবচেয়ে খারাপে গিয়েই সর্বদা পৌঁছয়।
যে একাকীত্ব একদা ছিল সাধারণত বৃদ্ধাবস্থার মতো প্রান্তিক সামাজিক অবস্থায় সহ্য করতে হওয়া প্রান্তিক অভিজ্ঞতা, তা আমাদের শতকে এসে ক্রমবর্ধমান হারে জনগণের প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতা হয়ে দাঁড়িয়েছে— এটাই অ-সর্বাত্মক জগতে সর্বাত্মকতাবাদী আধিপত্যের অধীনতার জন্য মানুষকে প্রস্তুত করে তুলছে। সর্বাত্মকতাবাদ মানুষকে যে দয়াহীন প্রক্রিয়ার মধ্যে তাড়িয়ে নিয়ে গিয়ে সংগঠিত করে, তা দৃশ্যত বাস্তবতা থেকে আত্মঘাতী পলায়নের মতো দেখায়। কাউকে যেখানে বিশ্বাস করা যায় না, কোনও কিছুর উপর যেখানে ভরসা রাখা যায় না, তেমন এক বিশ্বে ‘হিমশীতল যুক্তিবাদিতা’ বা ‘সবদিক থেকে পেঁচিয়ে ধরা' দন্দ্বতত্ত্বের ‘অতি শক্তিশালী শুঁড়’-কেই মনে হয় শেষ সম্বল। অপরদের যঙ্গে যত সম্পর্কের বাইরে একজন মানুষের স্ব-শনাক্তিকে যেনবা প্রত্যয়িত করে যেসব দ্বন্দ্ব, কড়াকড়ি করে তাদের এড়িয়ে চলতে হওয়ার মধ্য দিয়ে ঘটে চলা আভ্যন্তরীণ পীড়ন ছাড়া এ কিছু নয়। তা মানুষকে সন্ত্রাসের লৌহবন্ধনীর মাপ অনুযায়ী এঁটে খাপ খাইয়ে দেয় এমনকি তার নিঃসঙ্গ মুহূর্তগুলোতেও এবং নিঃসঙ্গ বন্দীত্বের চূড়ান্ত অবস্থা ছাড়া আর কখনোই তাকে নিজের মতো থাকতে দেয় না। মানুষের একে অপরের মাঝের সমস্ত পরিসরকে ধ্বংস করার মাধ্যমে, একে অপরের বিরুদ্ধে পেষণ করার মাধ্যমে তা বিচ্ছিন্নতার সৃজনশীল সম্ভাবনাগুলোকেও ধ্বংস করে দেয়। গোটা প্রক্রিয়ার প্রারম্ভক প্রতিজ্ঞা/প্রস্তাব বিসর্জন দিলে আর কোনো দাঁড়ানোর জায়গা থাকবে না— এই আশঙ্কার মধ্যে একাকীত্বের অবরোহমূলক যুক্তিনির্মাণকে মহিমান্বিত করে তুলে ও তাতে প্রশিক্ষিত করে তুলে একাকীত্ব থেকে নির্জনতায় যাত্রার ও যুক্তিনির্মাণ থেকে চিন্তায় পৌঁছনোর ক্ষীণ সম্ভাবনাটুকুকেও তা নিশ্চিহ্ন করে দেয়। উৎপীড়নের সঙ্গে এই প্রক্রিয়াকে তুলনা করলে মনে হয় যেন বা এমন এক উপায় উদ্ভাবিত হয়েছে যার মধ্য দিয়ে স্বয়ং মরুকে জঙ্গম করে তুলে মানব-অধ্যুষিত জগতের প্রতিটি বিন্দু ছেয়ে দেওয়ার মতো মরুঝড় জাগিয়ে তোলা যায়।
আমাদের অস্তিত্ব বর্তমানে যে রাজনৈতিক ক্ষেত্রের অধীন, তা এই বিধ্বংসী মরুঝড়ে বিপন্ন। এ বিপদ এক স্থায়ী জগত প্রতিষ্ঠা হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনার বিপদ নয়। উৎপীড়নমূলক শাসনের মতোই সর্বাত্মকতাবাদী শাসনও নিজমধ্যে নিজের ধ্বংসের বীজ বহন করে। ভয় ও ভয়ের উৎসস্বরূপ অপারগতা যেমন মানুষকে রাজনৈতিক স্বতক্রিয়ার বিপরীত অবস্থানে নিক্ষেপ করা রাজনীতি-বিরোধী মনোবৃত্তি, ঠিক তেমনই, একাকীত্ব এবং তার উপজাত যৌক্তিক-মতবাদিক অবরোহ পদ্ধতিতে সবচেয়ে খারাপ সিদ্ধান্তে পেঁৗছনোর মনোবৃত্তি এমন একটি সমাজবিরোধী অবস্থানকে চিহ্নিত করে এবং এমন মনোবৃত্তি লালন করে যা মানুষের একসঙ্গে বাঁচার সব অভ্যাসকে ধ্বংস করে দেয়। তা ছাড়া, ব্যক্তি-এককের অনির্দিষ্ট উৎপীড়ক অভিপ্রায় দ্বারা শাসিত জনেদের অসংগঠিত অপারগতার তুলনায় সংগঠিত একাকীত্ব অনেক বেশি বিপজ্জনক। সে বিপদ এই যে তা আমাদের জানা জগতকে ধ্বংস করে দিতে উদ্যত— সর্বত্র যেন আমাদের জানা জগত শেষ হয়ে যাচ্ছে— এই শেষ থেকে কোনও নতুন প্রারম্ভকে উঠে দাঁড়ানোর সময়টুকুও থাকছে না।
ভবিষ্যদবাণী হিসাবে কম কার্যকরী ও আরও কম উপশমকারী বিবেচনাগুলোকে সরিয়ে রাখলেও এ বাস্তবতা থেকেই যায় যে আমাদের সময়ের সংকট ও তার কেন্দ্রীয় অভিজ্ঞতা এমন একটি সম্পূর্ণ নতুন শাসনরূপকে সামনে নিয়ে এসেছে যা এখন থেকে একটি প্রবল সম্ভাব্যতা ও সদা-হাজির বিপদ হিসেবে আমাদের সঙ্গে থেকে যাবে, ঠিক যেমন রাজতন্ত্র, প্রজাতন্ত্র, উৎপীড়ক শাসন, একনায়কতন্ত্র ও স্বেচ্ছাচারী শাসনের মতো ইতিহাসের বিভিন্ন মুহূর্তে বিভিন্ন মৌলিক অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে জন্ম নেওয়া শাসনরূপগুলো তাদের সাময়িক পরাজয় পেরিয়েও মানুষের সঙ্গে থেকে গেছে ।
কিন্তু এই সত্যও রয়ে যায় যে ইতিহাসে প্রতিটি শেষই আবশ্যিকভাবে একটি নতুন শুরুকে ধারণ করে; যে অঙ্গীকার, যে একমাত্র ‘বার্তা’ সেই শেষের পক্ষে আদৌ তৈরি করা সম্ভব তা আরেকটি শুরুই। যে কোনও শুরু ঐতিহাসিক ঘটনা হয়ে ওঠার আগে মানুষের সর্বোচ্চ সক্ষমতা রূপে থাকে, রাজনৈতিকভাবে তা মানুষের স্বাধীনতার সঙ্গে অভিন্ন। Initium ut esset homo creates est—‘মানুষের সৃষ্টি হয়েছিল যাতে একটা শুরু সূচিত হয়’, অগাস্টিন বলেছিলেন।৫ প্রতিটি নতুন জন্মেই এই শুরুর নিশ্চয়তা বর্তমান; বস্তুত তা বর্তমান প্রতিটি মানুষের মধ্যেই।
টীকা
১. মার্কসের শবাধার কবর দেওয়ার সময়ে বক্তৃতায় এঙ্গেলস বলেছিলেন, ‘ডারউইন যেমন জৈব জীবনের বিকাশের নিয়ম আবিষ্কার করেছেন, মার্কস তেমনই আবিষ্কার করেছেন মানব ইতিহাসের বিকাশের নিয়ম।’ কম্যুনিস্ট ম্যানিফেস্টোর ১৮৯০-এর সংস্করণের এঙ্গেলস-কৃত ভূমিকায় একই ধরনের মন্তব্য পাওয়া যায় এবং Ursprung der Familie-র ভূমিকায় এঙ্গেলস আবারও ডারউইনের বিবর্তনের তত্ত্ব ও মার্কসের উদ্বৃত্ত মূল্যের তত্ত্বকে পাশাপাশি উল্লেখ করেছেন।
২. ‘প্রকৃতি দ্বারা আরোপিত একটি চিরন্তন আবশ্যকীয়তা, যা ছাড়া মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যে কোনও বিপাকক্রিয়া সম্ভব নয়, আর তাই কোনও জীবনও সম্ভব নয়।’— শ্রম সম্পর্কে মার্কসের এই ধারণার জন্য দ্রষ্টব্য ক্যাপিটাল, ১ম খন্ড, চ্যাপ্টার ১ ও ৫। উদ্ধৃত অংশটি চ্যাপ্টার ১, সেকশন ২ থেকে উদ্ধৃত।
৩. ১৯২৪-এর ২৮শে জানুয়ারি দেওয়া স্তালিনের বক্তৃতা; লেনিন, সিলেক্টেড ওয়ার্কস, ভল্যুম-১, পৃঃ ৩৩, মস্কো, ১৯৪৭ থেকে উদ্ধৃত। খেয়াল করা যেতে পারে যে বিংশ পার্টি কংগ্রেসে তঁার বিধ্বংসী বক্তৃতায় ক্রুশ্চেভ স্তালিনের যে অল্প কয়েকটি গুণের প্রশংসা করেছিলেন, তার অন্যতম হলো স্তালিনের যুক্তিপরায়নতা।
৪. ‘Ein solcher (sc. einsamer) Mensch folgert immer eins aus dem andern und denkt alles zum Argsten.’ Erbauliche Schriften-থেকে: ‘Warum die Einsamkeit zu fliehen?’।
৫. De Civitate Dei, বুক ১২, পরিচ্ছেদ ২০।