বর্তমান ভারতে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির যে প্রচার-প্রসার দেখা যাচ্ছে, সমালোচকদের অধিকাংশই তাকে মৌলবাদের একটি রূপ বলে চিহ্নিত করে থাকেন। একে মৌলবাদ বলার পিছনে যুক্তিটা এই যে তা প্রাচীন ভারতীয় পুরাণ ও ধর্মগ্রন্থের সম্ভার থেকে স্বনির্বাচিত (ও নিজেদের মতো করে মতবাদিক আদলে বাঁধা) একটি ক্ষুদ্র অংশকে গৌরব ও পবিত্রতার পরাকাষ্ঠা হিসেবে তুলে ধরে তার থেকে যে কোনো রকম বিচ্যুতিকে অন্যায় বলে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে। ‘মৌলবাদ’ শব্দটি ইংরেজিতে ‘Fundamentalism’-এর রূপ ধরে বিশ শতকের আমেরিকায় রক্ষণপন্থী প্রোটেস্টান্ট আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে আদলে জন্ম নিয়েছিল, তার সঙ্গে এই অতীতের একটি স্থিরীকৃত করে নেওয়া রূপকে বর্তমানের সমস্ত ‘বিচ্যুতি’ সরিয়ে ভবিষ্যতের জন্য পাকা করে প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াসের দিকটা মিলে যায়। কিন্তু মেলেও না আরো অনেক কিছু। যেমন ধরা যাক, বর্তমান ভারতে হিন্দুত্ববাদীরা যেরকম একটি সর্বাত্মকতাবাদী (totalitarian) রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে, তা বিশ শতকের মার্কিনী প্রোটেস্টান্ট রক্ষণশীলদের সঙ্গে তেমন মেলে না, যতটা মেলে বিশ শতকের জার্মানির নাৎসি ফ্যাসিবাদের সঙ্গে। শুধু রাষ্ট্রীয় আদলের রূপকল্পনাই নয়, বর্তমান হিন্দুত্ববাদীদের হিন্দু-প্রজাতি-স্বপরিচয়-নির্মাণ ও তার শ্রেষ্ঠত্ব কল্পনাও নাৎসিদের আর্য-শ্রেষ্ঠত্ব কল্পনার আদলে তৈরি। হিন্দুত্ববাদীদের আদি প্রতিষ্ঠাতারা (গোলওয়ালকার, হেডগেওয়ার, সাভারকর) বিশ শতকের প্রথমার্ধে যে হিটলারের গুণগ্রাহী ছিলেন এবং হিটলারের ‘মেইন কাম্ফ’ বইটি যে এখনও হিন্দুত্ববাদী অনুশীলনে প্রবেশিকা-প্রস্তুতিতে একটি অবশ্যপাঠ্য বই হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে তা এই সমস্ত মিলের কারণেই। ফলত দেখা যাচ্ছে যে, অধুনা ভারতের মৌলবাদী চিন্তার সবচেয়ে আধিপত্যকারী রূপটির মধ্যে সর্বাত্মকতাবাদী রাজনীতি-কল্পনা বাসা গেড়ে আছে। এই আলোচনায় যেহেতু আমরা মৌলবাদী রাজনীতির রূপসন্ধান ও তার বিকল্প অনুসন্ধানের কাজেই নিরত থাকব, তাই আলোচনা শুরু করা যাক সর্বাত্মকতাবাদের প্রসঙ্গ থেকে।
সর্বাত্মকতাবাদ (Totalitarianism) কী?
জার্মানিতে নাৎসি-শাসন ও সোভিয়েত রাশিয়ায় স্তালিন-শাসন — এই দুই সমকালীন ঐতিহাসিক ঘটনা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে হানা আরেন্ট সর্বাত্মকতাবাদের ধারণা সামনে এনেছিলেন। তঁার মতে এই দুটি শাসন ইউরোপের ইতিহাসে তার আগে পরিচিত বিভিন্ন শাসনরূপ— রাজতন্ত্র, একনায়কতন্ত্রী স্বেচ্ছাচার, উৎপীড়নমূলক শাসন, প্রজাতন্ত্র— কোনোটির সঙ্গেই মেলে না, সুতরাং এই দুই ঐতিহাসিক ঘটনাকে বোঝার জন্য শাসনরূপ সম্পর্কে পুরানো ধারণাগুলো আর যথেষ্ট নয়, নতুন ধারণা গড়ে তোলা প্রয়োজন। সর্বাত্মকতাবাদের ধারণার মধ্য দিয়ে আরেন্ট সেই নতুন ধারণা গড়ে তোলার পথে এগিয়েছেন। আবার, নাৎসি-শাসন ও স্তালিন-শাসন সমরূপীয় অভিন্ন নয়, নাৎসি-শাসন যেখানে ইউরোপিয় ইতিহাসে ইহুদিদের বিশেষ অবস্থান ও ইহুদি-বিদ্বেষের দীর্ঘ ধারাকে ব্যবহার করে জাতি-শ্রেষ্ঠত্বের চুন-সুরকি দিয়ে তার শাসনের ইমারত খাড়া করেছিল, স্তালিন-শাসন সেখানে শোষণহীন সমাজের লক্ষ্যে শ্রমিকশ্রেণির আন্দোলনের নীতি ও কৌশলকে ব্যবহার করেছিল তার শাসনরূপের যুক্তি গড়ে তুলতে। সুতরাং, দুই ভিন্ন ঐতিহাসিক উৎস থেকে রসদ সংগ্রহ করা এই দুই শাসনরূপের মধ্যে সাধারণ বিষয়টিই বা কী? আরেন্ট-এর বিবেচনায় এই সাধারণ বিষয়টি হল মতবাদের কেন্দ্রীয় ভূমিকা। সাধারণত এই দুই শাসনের কোনো একটির বা দুটিরই সমালোচক যারা, তঁারা এই দুই শাসনে সংগঠিত সন্ত্রাসকে— কনসেনট্রেশন ক্যাম্প, গুলাগ, এস. এস বাহিনী বা গুপ্ত পুলিশের সন্ত্রাসকে— বা এই দুই শাসনের প্রধান মুখ হিসাবে পরিচিত হিটলার বা স্তালিনের ক্ষমতালিপ্সা ও স্বেচ্ছাচারকে কাঠগড়ায় তোলেন। কিন্তু কনসেনট্রেশন ক্যাম্প বা গুলাগের প্রকট রূপ অবসিত হওয়ার পরও, হিটলার ও স্তালিনের মৃত্যুর পরও সমাজ থেকে কি সর্বাত্মকতাবাদী শাসনের প্রবণতা/সম্ভাবনা মুছে যায়? আরেন্ট-এর উত্তর: না, যায় না। যায় না কারণ এই দুই শাসনে মতবাদ (Ideology) যে ভূমিকা নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছিল, সেই ভূমিকা তার পরেও অব্যাহত আছে দ্বিতীয়-বিশ্বযুদ্ধোত্তর-আধুনিক-জগতে, আর তাই সর্বাত্মকতাবাদী শাসনের প্রবণতা/সম্ভাবনাও সেজন্যই অটুট আছে।
হানা আরেন্ট-এর মতে, মতবাদের নির্ধারক বৈশিষ্ট্য হলো যুক্তিশৃঙ্খলার সুসামঞ্জস্য, যার দ্বারা তা সমস্ত অতীত থেকে সমস্ত ভবিষ্যৎ ব্যাখ্যা করতে পারার দাবি করে। উদাহরণ ধরে আরেন্টের এই ধারণাকে কিছুটা খুলে-মেলে দেখা যাক। কোনো মানবগোষ্ঠীর জাতিগত স্ব-শনাক্তি নির্মাণ, অন্যদের সাপেক্ষে বৈশিষ্ট্য ও পার্থক্যের বোধ, এমনকি অন্যদের সাপেক্ষে শ্রেষ্ঠতার আত্মাভিমান নিজে থেকেই মতবাদ নয়। যখন এই সমস্ত থেকে পুষ্টি আহরণ করে গড়ে ওঠে এমন এক সুসমঞ্জস যুক্তিশৃঙ্খলা যা ইতিহাসের শুরু থেকে শেষ অবধি বিস্তারকে শ্রেষ্ঠতর জাতির অন্য জাতির উপর আধিপত্য নির্মাণের প্রক্রিয়া হিসেবে ব্যাখ্যা করে এবং নিকৃষ্টতর জাতিদের অবলুপ্তি বা শ্রেষ্ঠতর জাতিতে বিলীন হয়ে যাওয়াকেই ইতিহাসের অবধারিত গতি হিসেবে হাজির করে, তখন তা মতবাদ হয়ে ওঠে। নাৎসিরা এমন মতবাদকেই অস্ত্র করেছিল, কিন্তু নাৎসিদের পরিধির বাইরেও, বিশেষ করে জাতীয়তাবাদী নানা মহলে, আজকের পৃথিবীতেও এই মতবাদ অসংখ্য সংস্করণে বর্তমান। একইরকমভাবে, শ্রমিকশ্রেণির সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, শোষণ-আধিপত্য থেকে তার মুক্তির উপায় নির্ধারণ ও শ্রেণিসংগ্রামের নীতি-কৌশল নির্ণয় নিজে থেকেই মতবাদ নয়। যখন এই সমস্তকে অধীনে রেখে গড়ে ওঠে এমন এক অমোঘ যুক্তিশৃঙ্খল যা আদ্যন্ত ইতিহাসকে শ্রেণিসংগ্রামের প্রক্রিয়া হিসেবে ব্যাখ্যা করে ও শ্রেণিশত্রু দমনকেই অগ্রগতির পথ হিসেবে চিহ্নিত করে, তখন তা মতবাদ হয়ে ওঠে। স্তালিন এই মতবাদকে অস্ত্র করেছিলেন, কিন্তু স্তালিন বা স্তালিনপন্থী ছাড়া আরো অনেকের তূণীরেই এই অস্ত্র শোভা পায়। আবারও, মানুষের বস্তগত চাহিদার বৃদ্ধি, বস্তুগত চাহিদা মেটানোর জন্য বস্তুগত উৎপাদনের বৃদ্ধি, প্রকৌশল প্রয়োগ নিজে থেকেই মতবাদ নয়। কিন্তু অবিরত বস্তুগত চাহিদার বৃদ্ধি এবং বস্তুগত উৎপাদনের বৃদ্ধি যখন ইতিহাসের আদ্যন্তবিস্তৃত নিয়ামক গতি হিসেবে চিহ্নিত হয়, প্রকৌশল-পুজো হয়ে ওঠে সর্বাধিপত্যবিস্তারকারী এবং ইতিহাসের এই গতির পথ বাধামুক্ত করার জন্য প্রাকৃতিক পরিসরের অন্য সমস্ত কিছুকে নির্বিচারে ভোগ-ধ্বংস-আত্মসাৎ-যোগ্য বলে নির্ধারণ করা হয়, সমস্ত মানবক্রিয়ার মধ্যে ভোগেচ্ছা-তাড়িত জড় সঞ্চয়নকেই একমাত্র স্বাভাবিক আদর্শ হিসেবে তুলে ধরা হয়, তখন তা মতবাদ হয়ে ওঠে। পশ্চিম ইউরোপের জঠরে জন্ম নিয়ে বিশ্বগ্রাস করতে উদ্যত পঁুজিবাদের অতি সহযোগী সহচর এই মতবাদ। গোটা বিশ্বপ্রকৃতির আদ্যন্ত সমস্ত প্রক্রিয়া বুঝতে পারা, তার মূলসূত্র নির্ণয় করা ও সেই মূলসূত্র প্রয়োগ করে আবার সেই সমস্ত প্রক্রিয়ার নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠা--- নিজ জ্ঞান নিয়ে মানুষের এই চরম অহংবোধের সবচেয়ে অন্ধ আগ্রাসী রূপ এই মতবাদ। আর মতবাদের খুব গা গেঁষেই থাকে মৌলবাদ। নির্ণীত মতবাদটিকে তার আদি রূপে রক্ষা ও প্রয়োগ করার আকুতিই মৌলবাদের আদল নিয়ে বসে।
মতবাদ কী করে? মতবাদ আদ্যন্ত মানব-ইতিহাসকে একটি একমুখী গতি হিসেবে হাজির করে, অর্থাৎ, মানব-ইতিহাস যেনবা একটি অপরিবর্তনীয় লক্ষ্য অভিমুখে সদা ধাবিত। সেই লক্ষ্য হতে পারে শ্রেষ্ঠতম জাতির পরিচালনাধীনে সমগ্র মানবসমাজের সংগঠন, অথবা, শ্রেণির বিনাশের মধ্য দিয়ে শ্রেণিহীন সমাজ-গঠন, অথবা, জড়-উৎপাদনী শক্তির অন্তহীন বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে ভোগকে অসীম করে তোলা। মানুষ ও মানবসমাজ ইতিহাসের এই একমুখী লক্ষ্যে ধাবিত গতিপথের কোনো একটি বিন্দুতে অবস্থিত। মানুষের কোনো ক্ষমতা নেই এই গতিপথকে বদল করার। সেইদিক থেকে সে চূড়ান্ত ক্ষমতাহীন। অন্য এক দিক থেকে মানুষ আবার অসীম ক্ষমতাসম্পন্ন হয়ে উঠতে পারে। সে অসীম ক্ষমতাসম্পন্ন হয়ে উঠতে পারে যদি ইতিহাসের গতির নিয়মটিকে উপলব্ধি করে সেই গতির অভিমুখে অনুঘটকের কাজ করে। ইতিহাসের গতির অভিমুখে অনুঘটক হিসেবে ক্রিয়াশীল মানুষের অসীম ক্ষমতা এই জন্যই যে অপর-উপলব্ধি-সম্পন্ন যে কোনো মানুষ বা মানবগোষ্ঠীর বিরোধিতার মুখে তার জয় শেষ বিচারে অনিবার্য, ইতিহাসের অমোঘ গতিই সেই অনিবার্যতা উৎপাদন করছে। ফলে, অপর-উপলব্ধি-সম্পন্ন যে কোনো মানুষ বা মানবগোষ্ঠীকে পরাজিত-পরাভূত করতে যে কোনো পথ অবলম্বনই ন্যায়সঙ্গত, কারণ তা ইতিহাসের নৈর্ব্যক্তিক গতিরই পথ। জাতি-শ্রেষ্ঠতা প্রতিষ্ঠেচ্ছু নাৎসি, শ্রেণিশত্রুর বিনাশ চাওয়া কম্যুনিস্ট বা উৎপাদনশক্তির বিকাশ অবাধ করতে চাওয়া পঁুজিবাদী এইভাবেই তার সর্বশক্তিমানতাকে উপলব্ধি করে।
এই সর্বশক্তিমানতার প্রত্যয় গড়ে ওঠে সর্বদিক-বদ্ধ এক চিন্তা-পদ্ধতির মধ্য দিয়ে। এই পদ্ধতি সর্বদিক-বদ্ধ কারণ তা গৃহীত এক প্রথম সিদ্ধান্ত বা প্রথম প্রস্তাবের উপর ভিত্তি করে অবরোহমূলক যুক্তিবিস্তারের মাধ্যমে সমস্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব বলে মনে করে। সমস্ত ঐতিহাসিক ও জাগতিক সত্যের অদ্বৈত উৎস এই প্রথম সিদ্ধান্ত হতে পারে শ্রেষ্ঠতম জাতির গোটা মানবসমাজকে নিজের আদলে গড়েপিটে নেওয়ার অধিকার/দায়িত্ব বা প্রতিক্রিয়াশীল শ্রেণিদের দমন করে প্রগতির পথ বাধামুক্ত করার প্রগতিশীল শ্রেণির অধিকার/দায়িত্ব বা মানবিক-অমানবিক সমস্ত সম্পদকে জড় উৎপাদনের ক্রমাগত বৃদ্ধির যজ্ঞে জোর খাটিয়ে সামিল করার অধিকার/দায়িত্ব, বা এমনই অন্য কিছু। অনন্ত অতীত থেকে অনন্ত ভবিষ্যৎ অবধি ইতিহাসপ্রক্রিয়ার চালিকাশক্তিকে একটি প্রথম সিদ্ধান্ত বা প্রথম প্রস্তাবের মধ্যে ধরে ফেলার এই প্রত্যয় চিন্তাকে এক আপাত-লৌহকঠিন কঁাচের ঘরে এক অদ্ভূত নিরাপত্তাবোধে আত্মমগ্ন করে তোলে কারণ তা অনবরত নতুন নতুন মানব-অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে অভাবিত নতুনের মুখোমুখি হয়ে অনবরত সিদ্ধ জ্ঞান-বিশ্বাসকে পাল্টে নতুনকে বরণ করে নেওয়ার অস্থিতিকে অস্বীকার করে। আদ্যন্ত ইতিহাসপ্রক্রিয়া সম্পর্কে চরম সত্যকে মুঠোয় ধরে ইতিহাসের চালক হওয়ার খোয়ারি-আচ্ছন্ন দৃষ্টিতে তার অধিগত প্রথম সিদ্ধান্ত বা প্রথম প্রস্তাব থেকে বিস্তৃত সুসমঞ্জস সুশৃঙ্খল অবরোহমূলক যুক্তিবিস্তারের বাইরে কোনো সত্য থাকতে পারে না। এই অবরোহমূলক যুক্তিবিস্তারের বাইরে যা, তাই-ই হলো ভ্রম, মিথ্যা মায়া, বিকৃতি। ফলে সেই-ই একমাত্র সত্য, অপর সব কিছু ভ্রম, অপর সবকিছু ক্ষতিকারক; তাই অপর সবকিছুকে খণ্ডন করে, ধ্বংস করে নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠাই হলো সত্যের প্রতিষ্ঠা, ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা। অপর সম্পর্কে এই হিংসাত্মক বৈরী মনোভাব একদিকে যেমন চরম সত্যের ধারক হিসেবে তার নিরাপত্তাবোধ থেকে উৎসারিত, ঠিক তেমনই তা ওই নিরাপত্তাবোধকে যেন-তেন প্রকারেণ রক্ষা করার মরীয়া প্রচেষ্টাও বটে। মানব-অভিজ্ঞতা অনির্ণীত নতুন কিছুকে সামনে তুলে আনলেই তা তার আপাত-লৌহকঠিন কঁাচের ঘরকে সন্ত্রস্ত করে তোলে, তাই অনির্ণীত নতুন সমস্ত কিছুকে মিথ্যা বা ভ্রমের স্তরে অবনমিত করতে না পারলে, ধ্বংস করতে না পারলে তার নিরাপত্তা নিয়ে সে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে থাকে। অবদমিত বিপন্নতাবোধ থেকেই সে সদা আগ্রাসী। এইভাবে সে নিজেকে বিযুক্ত করে ফেলে মানব-অভিজ্ঞতা থেকে। তার জ্ঞানের উৎস তার সবদিক-বদ্ধ চিন্তাপ্রক্রিয়া; নতুন নতুন মানব-অভিজ্ঞতা তাকে কলুষিতই করতে পারে কেবলমাত্র, অন্তর্ঘাতই ঘটাতে পারে কেবলমাত্র অনির্ণীত কোনো নতুনকে জন্ম দেওয়ার মধ্য দিয়ে। মতবাদিক চিন্তা তাই মানব-অভিজ্ঞতা-প্রক্রিয়ার বিরোধী, আর নিজেকে সর্বাত্মক করে তোলার আগ্রাসনে সে মানব-অভিজ্ঞতা-প্রক্রিয়াটাকেই ধ্বংস করতে চায়। অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে অনবরত জন্ম নেওয়া অনির্ণীত নতুনের জন্য সে উন্মুক্ত নয়, বরঞ্চ তার অধিগত চরম সত্যের থেকে উৎসারিত অবরোহমূলক যুক্তিশৃঙ্খলায় হয় অভিজ্ঞতাকে সুসমঞ্জসভাবে এঁটে যেতে হবে আর নয়তো সেই অন্তর্ঘাতী অভিজ্ঞতাকে মিথ্যা বলে মুছে দিয়ে তার জায়গায় সুসমঞ্জস সত্যকে নির্মাণ করতে হবে। এভাবেই তার মৌলবাদী চলন বিস্তার পায়।
মানব-অভিজ্ঞতা-প্রক্রিয়াকে ধ্বংস করতে চাওয়া এই মৌলবাদী প্রক্রিয়া মানব-প্রকৃতিকেই ধ্বংস করে। এটিই সর্বাত্মকতাবাদের নির্ণায়ক ও সবচেয়ে ভয়ংকর চরিত্র। মানুষ তখনই মুক্ত যখন প্রতিটি মানুষের নিজের অনন্য অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে নতুন কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর ক্ষমতা থাকে এবং যে কোনো সময়েই নতুন কোনো সূচনা ঘটানোর ক্ষমতা থাকে। মতবাদিক লৌহবন্ধন মানব-অভিজ্ঞতা-প্রক্রিয়াকে ধ্বংস করে মতবাদিক অবরোহমূলক যুক্তিপ্রক্রিয়ায় চিন্তাকে বন্দী করার মধ্য দিয়ে এই নতুন সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর ও নতুন সূচনা ঘটানোর ক্ষমতাকে ধ্বংস করে। প্রত্যেকটি মানুষের মানব-অভিজ্ঞতার অনন্যতা ও বিভিন্নতা যেহেতু স্বীকৃত হয় না, তাই মানুষের মধ্যের বিভিন্নতাও সন্দেহের চোখে দেখা হয়। সমস্ত মানুষকে মতবাদ-নির্মিত এক আদর্শ মানুষের আদলে নিজেকে বিলীন করে দিতে হয়, নইলে তার বিভিন্নতার জন্য সে অস্বাভাবিক, রুগ্ন, বিকৃতমনস্ক বা সমাজবিরোধী হিসাবে চিহ্নিত হয় এবং রাষ্ট্র ও প্রশাসনের প্রশ্নাতীত অধিকার জন্মে যায় তাকে জোর খাটিয়ে, শাস্তি দিয়ে বা চিকিৎসা করে স্বাভাবিকতার আদলে বন্দী করার।
মানবজমিন ধ্বংস
মানুষের অস্তিত্বের দুটি পরস্পর-সমন্বিত দিক আছে। একটি দিক হল পশু-প্রজাতি হিসাবে তার প্রাণ সংরক্ষণ ও পুনরুৎপাদনের জন্য জৈবিক চাহিদা পূরণ, যে দিকটিকে মার্কস-কথিত ‘প্রকৃতির সঙ্গে বিপাকক্রিয়া’ (metabolism with nature) বলা যায়। অন্য দিকটি হল প্রাকৃতিক বিশ্বের উপরে সর্বদা নতুন কিছু সৃষ্টি করে যোগ করার মাধ্যমে মানুষের নিজসৃষ্ট একটা জগৎ গড়ে তোলা।
প্রথম দিকটির মধ্য দিয়ে মানুষ প্রকৃতির বৃদ্ধি ও বিনাশের বৃত্তাকার চক্রের পরাভূত, তার সমস্ত শ্রম পুনরাবৃত্তিমূলক, ক্ষণস্থায়ী চাহিদা মিটিয়ে সে শ্রমের ফসল শেষ হয়ে যায়, সে শ্রম পুনঃ পুনঃ পুনরাবৃত্ত করতে হয়, ধ্বংস ও মৃত্যু অমোঘ হিসেবে তাকে আচ্ছাদন করে রাখে। সে তখন নেহাতই পুনরাবৃত্তিমূলক শ্রমে বদ্ধ পশু।
দ্বিতীয় দিকটির মধ্য দিয়ে মানুষ পুনরাবৃত্তিকে ভেঙে নতুন কিছু স্থাপন করতে চায়, বৃদ্ধি ও বিনাশের চক্র পেরিয়ে তার সৃষ্টির অমরত্ব স্থাপন করতে চায়, ধ্বংস ও মৃত্যুর অমোঘতাকে অতিক্রম করে যেতে চায়। পুনরাবৃত্তি-ভাঙা এই নতুন কিছু সৃষ্টির চরিত্রই প্রতিটা মানুষকে অনন্য করে তোলে, প্রজাতিগত সমরূপীয় পরিচয় পেরিয়ে ব্যক্তি-অস্তিত্বের পরিসর তৈরি করে। এই দ্বিতীয় দিকটির মধ্য দিয়েই মানুষ রচনা করে প্রাকৃতিক বিশ্বের উপরে তার নিজসৃষ্ট জগৎ, নিজসৃষ্ট পরিসর, যা মানুষের স্বতন্ত্র অস্তিত্বক্ষেত্রটিকে চিহ্নিত করে, যা বিহনে আকাঁড়া প্রকৃতির আচ্ছন্নকারী শক্তিনিচয় মানুষকে জৈবিক চাহিদার ঘূর্ণাবর্তে খড়কুটোর মতো ঘুরিয়ে মারে।
তাই, মানুষ সম্পূর্ণত মানুষ হতে পারে না যদি প্রাকৃতিক বিশ্বের উপরন্তু একটি মানুষ-সৃষ্ট জগতও তার অস্তিত্বক্ষেত্র হিসেবে না থাকে।
এই মানুষ-সৃষ্ট জগত, যা তৈরি হয় মানুষের নতুনকে জন্ম দেওয়ার সৃষ্টিকাজের মাধ্যমে, তা মানুষের মধ্যে হাজির হয়ে যেমন মানুষে-মানুষে বৈচিত্র্য, স্বাতন্ত্র, বিভিন্নতাকে ফুটিয়ে তোলে, তেমনই তার মধ্য দিয়েই ‘এক-অভিন্ন-মানুষ’-পরিচয় থেকে মুক্তি পাওয়া বিভিন্ন মানুষদের মধ্যে পারস্পরিকতা ও সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এইভাবেই তৈরি হয় মানুষদের মধ্যে এমন এক পরিসর যার মধ্যে ব্যক্তি-মানুষেরা বিচরণের ক্ষেত্র পায়, বিভিন্ন অবস্থান থেকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণে তাদের সাধারণ জগতকে নিরীক্ষণ করতে পারে, সেসবের আদানপ্রদান ও বিনিময়ের মধ্য দিয়ে বাস্তবতা সম্পর্কে এমন এক যৌথ উপলব্ধিতে পৌঁছতে পারে যা এককভাবে কারও একার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই একসঙ্গে মুক্ত মানুষ হিসেবে বাঁচার পূর্বশর্ত হল নিজেদের মধ্যে মানুষ-সৃষ্ট এমন একটি জগৎ থাকা।
সর্বাত্মকতাবাদ ও তার মৌলবাদী চলন এই জগতটিকে ধ্বংস করে। ইতিহাস বা প্রকৃতির গতি হিসেবে একটি অপরিবর্তনীয় নিয়মকে হাজির করার মধ্য দিয়ে সর্বাত্মকতাবাদ মানুষের সমস্ত ক্রিয়াকে সেই নিয়মের বাধ্যতামূলক অনুশীলনে পরিণত করতে চায়। নিয়মাবদ্ধ পুনরাবৃত্তিমূলক ক্রিয়ার শৃঙ্খলিত পরিসরে মানব-ক্রিয়াক্ষেত্রকে বাঁধতে চায়। স্বাতন্ত্র্য, বৈচিত্র্য, বিভিন্নতা— এই সবকিছুকে শৃঙ্খলে বেঁধে এক অভিন্ন আদর্শ মানুষের অবয়বে ঠেসে পুরতে চায়। এইভাবে সে মানবঅস্তিত্বের নতুনকে-জন্ম-দেওয়া সৃষ্টিকাজের সম্ভাবনাগুলোকে ধ্বংস করে । নতুনকে জন্ম দেওয়া সৃষ্টিকাজের সম্ভাবনা ধ্বংস হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ধ্বসে পড়ে তার মধ্য দিয়ে তৈরি মানুষ-সৃষ্ট জগৎ, যা ছিল ব্যক্তি-মানুষদের মধ্যে বিচরণের পরিসর। ফলে স্বাতন্ত্র্য-বিভিন্নতা-বৈচিত্র্য হারানো মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ে সমরূপীয় এক পশু-প্রজাতি পরিচয়ের মধ্যে এবং আবর্তিত হতে থাকে কেবলমাত্র জৈবিক চাহিদার দাসত্ববৃত্তির প্রাকৃতিক-শক্তিনিচয়-নিয়ন্ত্রিত অপঘূর্ণিতে।
মানুষের সচেতনতায় বাস্তবতা প্রতীয়মান হয়ে উঠতে পারে কেবলমাত্র মানুষদের মধ্যেকার মানবজমিনে মুক্তমনা, সক্রিয় ও সৃষ্টিশীল অংশগ্রহণ-প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। মানবজমিনটিও মানুষদের মধ্যেকার পরিসরে গড়ে ওঠে প্রতিটি মানুষের নতুনকে সর্বসমক্ষে হাজির করার তাগিদে করা সৃষ্টিশীল কাজের মধ্য দিয়ে, সমস্ত বিবিধ বিভিন্ন নতুনকে ধারণ করার মধ্য দিয়ে। নতুনের আবির্ভাবের জন্য নিজেকে সদা উন্মুক্ত রেখে, হাজির হওয়া নতুনের মধ্য দিয়ে বিবিধ দৃষ্টিভঙ্গির বিভিন্নতা-বৈচিত্র্য-বিশিষ্টতা অনুভব করে ও নিজের দৃষ্টিকোণ-অবস্থানকে তার আপেক্ষিকতায় অবস্থিত করে যখন কেউ আন্তর্মানুষ পরিসরে সহজ ও স্বাভাবিক হয়ে উঠতে পারে, তখনই কেবল সে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ-অবস্থান-জাত বহুমাত্রিকতায় বস্তুকে দেখতে পায়; এককভাবে, বা বিভিন্নতা-বৈচিত্র্য অস্বীকারকারী মতবাদের অদ্বৈত দৃষ্টিকোণ থেকে মানুষ কেবল সেই বস্তুর একমাত্রিক এক ছায়াকেই দেখে। বস্তুকে বহুমাত্রিকতায় দেখার মধ্য দিয়েই বাস্তবতা প্রতীয়মান হয়। ফলে মতবাদিক দৃষ্টিভঙ্গির একমাত্রিক দৃষ্টিতে বাস্তবতা প্রতীয়মান হয় না, মতবাদে আচ্ছন্ন মানুষ বাস্তবতা থেকে বিযুক্ত হয়ে এক মৌলবাদী প্রহেলিকার মাত্রাহীন জগতে বাস করে। একাকীত্বই হয় মানব-অস্তিত্বের সাধারণ অবস্থা।
চিন্তা করা হল মানুষের নিজের সঙ্গে নিজের অন্তর্গত কথোপকথন। সে কথোপকথন সাঙ্গ হয় বারোয়ারি জগৎ থেকে কিছুটা দূরত্বে, কিন্তু বারোয়ারি জগৎ থেকে বিচ্ছিন্নতায় নয়। মানুষদের মধ্যেকার যে মানবিক ক্ষেত্র বিভিন্ন মানুষের হাজির করা বিভিন্নতা, বৈচিত্র্য, বিশিষ্টতা-র সমন্বয়ে পারস্পরিকতার প্রসার গড়ে তোলে, সেই বারোয়ারি জগতে অংশগ্রহণ থেকেই উৎসারিত হয় মানুষের নিজের অন্তর্গত কথোপকথন। নিজের সঙ্গে নিজের এই অন্তর্গত কথোপকথন চালাতে গেলে বারোয়ারি জগৎ থেকে সাময়িক বিযুক্তি দরকার হয়, কিন্তু এই সাময়িক বিযুক্তিতে সংঘটিত চিন্তার নতুন সৃষ্টিকর্মটি সম্পূর্ণ হয় তাকে আবার সেই বারোয়ারি জগতের মধ্যে অপরের অনুধাবনের জন্য হাজির করার মধ্য দিয়েই। সব সৃষ্টিশীল কাজের জন্যই প্রয়োজন বারোয়ারি জগৎ থেকে বিচ্ছিন্নতা না ঘটিয়েই বারোয়ারি জগৎ থেকে সাময়িক বিযুক্তি। এই বিযুক্তিকে আমরা নির্জনতা বলতে পারি। মানুষদের মধ্যেকার মানবিক ক্ষেত্রে মানুষের অংশগ্রহণ-প্রক্রিয়ারই অংশ এটি। বারোয়ারি জগতে বিভিন্ন বিচিত্র বহুর বিন্যাসের মধ্য দিয়ে যে যাত্রা মানুষের কাছে বাস্তবতাকে ফুটিয়ে তোলে, সেই যাত্রার অংশ এই নির্জনতা।
অন্যদিকে, একাকীত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় মানুষদের মধ্যে মানবিক ক্ষেত্র, বারোয়ারি জগতের ধ্বংস বা শুকিয়ে যাওয়ার উপর দাঁড়িয়ে। এক দ্বিমাত্রিক বিচ্ছিন্নতায় মানুষের আচ্ছন্ন হওয়ার মধ্য দিয়ে মানুষদের মধ্যেকার মানবজমিন বা বারোয়ারি জগৎ ধ্বংস হয় বা শুকিয়ে যায় । এই দ্বিমাত্রিক বিচ্ছিন্নতার একটি মাত্রা হলো প্রাকৃতিক জৈবিক চাহিদার ছদ্ম-প্রসারণে নির্মিত ছদ্ম-প্রকৃতিতে বন্দী হয়ে মানুষদের মধ্যে মানবজমিন গঠনকারী বারোয়ারী গঠনকাজ থেকে বিচ্ছিন্নতা, আর দ্বিতীয় মাত্রাটি হলো মানুষদের মধ্যে পারস্পরিকতার ক্ষেত্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ‘পড়শিহীন স্ব’-এর মধ্যে বন্দীত্ব। এই দ্বিমাত্রিক বিচ্ছিন্নতার অভিঘাতে অস্তিত্বের পতিত অবস্থায় মানুষ জৈবিক চাহিদা নিবৃত্তকারী পুনরাবৃত্তিমূলক শ্রম ছাড়া অন্য কোনো কাজের সক্ষমতা হারায়। অনুকরণ, অনুসরণের মধ্য দিয়ে পুনরাবৃত্তিমূলক বৃত্তিই তার অস্তিত্বের সমগ্র হয়ে দাঁড়ায়। নতুনকে জন্ম দিতে অপারগ সৃষ্টিশীলতার শূন্যতায় ভাসমান এই অস্তিত্ব তখন অতিমানবিক কোনো প্রাকৃতিক/ঐতিহাসিক নিয়মের অপরিবর্তনীয় যুক্তিশৃঙ্খলার অবলম্বন খোঁজে। সেই অপরিবর্তনীয় প্রাকৃতিক/ঐতিহাসিক নিয়মের যুক্তিশৃঙ্খলার অনুসরণকারী/বলবৎকারী হিসেবে এক ছদ্মশক্তির অনুভব তাদের অক্ষমতার বোধকে ঢেকে দেয়। প্রাকৃতিক/ঐতিহাসিক নিয়ম নির্ভর এই ছদ্মশক্তির জোরে তারা সমস্ত মানবজমিনের ঊর্ধ্বে, প্রাকৃতিক-বাস্তুতান্ত্রিক বা পারস্পরিক প্রসারে মানবসৃষ্ট সমস্ত সীমার ঊর্ধ্বে নিজেদের সর্বশক্তিমান বলে গণ্য করতে শুরু করে। তাদের যুক্তিশৃঙ্খলাকে বলবৎ করতে যেনবা যে কোনো কিছুই করা সম্ভব, যে কোনো উপােয়ই করা সম্ভব। একমেবাদ্বিতীয়ম প্রাকৃতিক/ঐতিহাসিক নিয়মের অশ্বমেধযাত্রার সৈনিক এই যুক্তিশৃঙ্খল-পূজারীরা তাদের নির্ধারণসীমার বাইরে অপর বা ভিন্ন যা কিছু, তাকেই মনে করে অস্তিত্বের অনধিকারী, যার উপর আধিপত্য কায়েম করা বা মুছে দেওয়াই হল প্রকৃতি/ইতিহাস-নির্ধারিত কর্তব্য। সমস্ত বৈচিত্র্য ধ্বংস করে, বহুত্ব ধ্বংস করে সমরূপতার বিজনপ্রদেশ নির্মাণ— এই পথে সে তার অস্তিত্বের একাকীত্বের আদলে মানববিশ্ব নির্মাণ (বা ধ্বংস) করতে চায়।
মানবজমিন ধ্বংস করা এই সর্বাত্মকতাবাদ-মৌলবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ বা বিকল্প-নির্মাণের কি কোনো উপায় আছে? এই উপায় নিয়ে ভাবতে গেলে আমাদের জোর দিতে হবে মানুষদের (বহু, বিভিন্ন, বিচিত্র মানুষদের; কোনো এক মতবাদ-সংজ্ঞায়িত সমরূপীয় ধাঁচার মানুষের নয়) অভিজ্ঞতার বহুত্বের উপর ভর করা, সেই বহুত্বের স্বাধীন স্বপ্রকাশ ও স্ববিকাশের দ্বারা পুষ্ট মানুষদের মুক্ত পারস্পরিক ক্রিয়ার উপর; অর্থাৎ বহুত্বের রাজনীতির উপর।
বহুত্বের রাজনীতি
জগৎ যেহেতু বহু, বিভিন্ন, বিচিত্র মানুষদের নিয়ে গঠিত; কোনো মতবাদ-সংজ্ঞায়িত সমরূপীয় ধাঁচার মানুষ নিয়ে গঠিত নয়; মানুষদের মধ্যের পারস্পরিকতার প্রসার হিসেবে বিন্যস্ত বারোয়ারি ক্ষেত্রে তাই সবসময় অভাবনীয় নতুন কিছুর মুখোমুখি হওয়া ও তার প্রতিক্রিয়ায় নিজে অভাবিত নতুন কিছু করা মুক্ত মানুষের স্বাভাবিক অভিজ্ঞতা হওয়ার কথা। বৈচিত্র্য, বিভিন্নতা, বহুত্ব-এর প্রতিটির সমান মর্যাদায় সহাবস্থান ও স্বাধীন বিকাশকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে একে অপরের মধ্যে অবারিত যাতায়াত-আদানপ্রদান ও মুক্ত ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নতুনের হাজির হওয়ার পথ উন্মুক্ত রাখা— এমন স্বতঃক্রিয়াই বহুত্বের রাজনীতির ভিত্তি হতে পারে।
মতবাদিক আচ্ছন্নতা কাটিয়ে প্রকৃতি-শাসন বা ইতিহাস-নির্মাণের মোহ থেকে মুক্ত হলে তবেই তো এই মুক্ত স্বতঃক্রিয়া সম্ভব। যে ঘটনা ঘটে গেছে, বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে তার যতটা যেভাবে দেখা যায়, সেই অনুযায়ী ইতিহাসের বিভিন্ন আখ্যান তৈরি হয়, যা গল্প-বলার সমতুল্য। গল্পের মধ্য দিয়ে মুছে-যাওয়া-বাস্তবতার একটা প্রতিবিম্বই হাজির হয় কেবল, আকাঁড়া সেই বাস্তবতা ফিরে হাজির হয় না। প্রতি মুহূর্তেই মানুষের অপ্রত্যাশিত নতুন কিছু করার ক্ষমতার জন্য ইতিহাসও প্রতি মুহূর্তে নতুন বাঁক নেওয়ার সম্ভাবনা নিয়েই থাকে, মতবাদিক রেল-লাইন ধরে সে চলে না। তাই ইতিহাসের গতিধারা ও গন্তব্যের সম্পর্কে শেষ কথাটি জেনে নিয়ে ইতিহাস-নির্মাতা হওয়া মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। একইভাবে প্রকৃতির উপর প্রভুত্বস্থাপন করে মানুষের প্রয়োজন অনুযায়ী যে কোনোভাবে প্রকৃতি-পরিবেশকে পরিবর্তন করে নেওয়াও সম্ভব নয়। মতবাদিক মত্ততা সঞ্জাত ‘মানুষের পক্ষে সবকিছু সম্ভব'-বোধের ঘোর কাটিয়ে উঠে উপলব্ধি করা দরকার যে প্রকৃতির সঙ্গে বিপাকক্রিয়ায় মানুষদের অবস্থান কিছু প্রাকৃতিক-বাস্তুতান্ত্রিক সীমা দ্বারা চিহ্নিত, মানুষের সৃষ্টিকাজ সেই সীমার মধ্যেই চলতে পারে, সীমালঙ্ঘন করা যে কোনো সৃষ্টিপ্রচেষ্টা দ্বায়িত্বহীন ধ্বংসকান্ডে রূপান্তরিত হয়। প্রকৃতি/ইতিহাসের নিয়ম অনুযায়ী প্রগতির একমাত্র পথের দিশারী হওয়ার মতবাদিক আত্মশ্লাঘা থেকে নিরাময় পেলে বহুত্ব বা অপরতাকে যে কোনো মূল্যে ধ্বংস করে সমরূপতা প্রতিষ্ঠা করার মৌলবাদী পাগলা-জগাই-পনা থেকেও নিরাময় মেলে বোধ হয়। বহুত্ব, বৈচিত্র্য, বিভিন্নতাকে মানুষদের মধ্যের বারোয়ারি ক্ষেত্রের আবশ্যিক উপাদান হিসেবে বুঝে নিয়ে মানুষদের মধ্যের পারস্পরিকতার প্রসারে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ ও অবস্থানের মধ্যে যাতায়াতের মাধ্যমে বাস্তবতাকে উপলব্ধি করা ও নতুন কোনো সূচনার জন্য স্বতঃক্রিয়া করা— এভাবে মতবাদ-নির্মীত একাকীত্বের বিজনপ্রদেশের বাইরে নতুন মানব-যৌথতা ও পারস্পরিকতার দেশ নির্মাণের রাজনীতি সূচিত করা যায় হয়তো। এই স্বতঃক্রিয়ার মধ্য দিয়েই গড়ে তোলা সম্ভব এমন রাজনৈতিক কাঠামো যা মানুষদের বিভিন্নতা ও বৈচিত্র্যকে ধারণ করে প্রতিটি মানুষের অধিকারকে সমানভাবে স্বীকৃতি দিতে পারে।
প্রতিটি মানুষের সমানাধিকারের ভিত্তিতে রাজনৈতিক কাঠামো তৈরির লক্ষ্য অবশ্য মানুষের রাজনৈতিক ইতিহাসে বহু পুরানো একটি বিষয়। প্রতিটি মানুষের সমানাধিকার লক্ষ্য ও নীতি হিসেবে ঘোষিত হয়েও মানবেতিহাসে রাজনৈতিক সংগঠনে তা বারবার লঙ্ঘিত হয়েছে, সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্য নিয়ে সূচিত রাজনৈতিক ব্যবস্থা এক অংশের চরম আধিপত্য ও অন্য অংশের চরম অধিকারহীনতার মধ্যে গিয়ে শেষ হয়েছে বারবার। সমানাধিকার প্রতিষ্ঠায় বারবার কেন এই ব্যর্থতা? ঈশ্বরের সন্তান হিসেবে সব মানুষ সমান— কখনও এই ধর্মীয় স্বতঃসিদ্ধের মাধ্যমে মানুষদের সমানাধিকারকে অলঙ্ঘনীয় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা হয়েছে, কখনও বা ধর্মীয় স্বর থেকে মুক্ত করে সমানাধিকারকে একটি প্রাকৃতিক স্বতঃসিদ্ধ রূপে অলঙ্ঘনীয় করে তুলতে চাওয়া হয়েছে। কিন্তু কোনোভাবেই সমানাধিকার অলঙ্ঘনীয় করে তোলা যায় নি। তাই মনে হয় যে কোনো ধর্মীয় বা প্রাকৃতিক অলঙ্ঘনীয় সত্য হিসেবে ঘোষণা করার জোরে মানুষদের অধিকার এবং সমানাধিকারকে রাজনৈতিক কাঠামোয় স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠা করা যায় না। মানুষদের মধ্যের বারোয়ারি জগতে পারস্পরিক বোঝাপড়ার সম্পর্কের মধ্য দিয়ে মানুষরা একে অপরকে অধিকার দেয় এবং সমানাধিকার তখনই প্রতিষ্ঠিত হতে পারে যখন মানুষদের মধ্যের সমস্ত ভিন্নতা, বৈচিত্র্য, স্বাতন্ত্র্য সমগুরুত্বের বলে গৃহীত হয়, অর্থাৎ বহুত্বকে স্বাভাবিক বলে ধরা হয়। বারোয়ারি জগতের এই পারস্পরিক বোঝাপড়া এমন নয় যে তা একবার সম্পন্ন হলে অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থায়ী চেহারা নিয়ে নেয়, বরং এই বোঝাপড়া ক্ষণিক ও ভঙ্গুর। বারোয়ারি ক্ষেত্রে অনবরত অপ্রত্যাশিত নতুনের মুখোমুখি হতে হতে প্রতিনিয়ত নতুন করে এই বোঝাপড়াকে নবীকৃত করতে করতে যেতে না পারলে, এ বোঝাপড়া ভেঙে পড়বেই এবং মানুষদের অধিকার ও সমানাধিকার লঙ্ঘিত হবে। ফলে, কোনো রাজনৈতিক মতবাদের সাহায্যে মানুষদের অধিকার ও সমানাধিকারকে প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে তা ভেঙে পড়তে বাধ্য, মানুষদের অধিকারের ও সমানাধিকারের অধিষ্ঠান বারোয়ারি জগতে মানুষদের এমন এক বিশেষ ধরনের রাজনৈতিক সক্রিয়তার মধ্য দিয়ে প্রতিনিয়ত পুনঃনবীকৃত হতে হতে চলে যা বহুত্বকে স্বাভাবিক ও শ্রেয় হিসাবে গণ্য করে অপরাপরের মধ্যে বোঝাপড়া গড়ে তোলে। তাই প্রতিনিয়ত মৌলবাদী প্রবণতার বিপরীতে দাঁড়িয়ে নিয়ত পরিবর্তমান বহুত্বের রাজনীতির চর্চা উন্মুক্ত রাখতে পারলে, তার উপজাত একটি গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু ভঙ্গুর সম্পর্ক হিসেবে সবার সমানাধিকার রূপগ্রহণ করতে পারে।
মানুষদের অপ্রত্যাশিত নতুন কিছু ভাবা ও করার শক্তিই এই রাজনীতির জীবনীশক্তি রূপে, সে রাজনীতির বোধহয় কোনো নির্দেশাবলী বা ইস্তাহার সম্ভব নয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও দুটো বিষয় হয়তো এখানে নির্ধারক গুরুত্ব নিয়ে হাজির হয়। সেই দুটি বিষয় হল ক্ষমা ও অঙ্গীকার— অতীতকে ক্ষমা করে দিয়ে আবার নতুন সূচনা ঘটানোর নমনীয়তা এবং ভবিষ্যতের জন্য অঙ্গীকার করে তা রক্ষা করার দৃঢ়তা। ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, হিংসা-প্রতিহিংসা যে অন্তহীন আবর্তে মানবক্রিয়াকে বদ্ধ করে ফেলতে পারে; সে বদ্ধতা মানুষদের মধ্যে অপরাপরের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ আচরণ চক্রাকারে বাড়িয়ে নিয়ে গিয়ে অপরকে ধ্বংস করার অন্ধ তাড়নায় মানুষকে বন্দী করে ফেলতে পারে; এই অন্ধচক্র থেকে বেরিয়ে এসে নতুন সূচনা হতে পারে ক্ষমার মধ্য দিয়ে। ক্ষমার জন্য প্রয়োজন পারস্পরিক সম্মানবোধ, ভিন্ন বা অপরদের মধ্যে এমন এক ধরনের ঘনিষ্ঠতা বা বন্ধুতা যা স্বীকার করে যে এই সমস্ত ভিন্ন বা অপর একসঙ্গে একটি বারোয়ারি জগতের স্রষ্টা ও ভাগিদার। এই পারস্পরিক সম্মানবোধের উপর দাঁড়িয়েই ভবিষ্যতের জন্য একে অপরের কাছে অঙ্গীকার করা যায় এবং সেই অঙ্গীকার রক্ষার যৌথ উপায় স্বরূপ রাজনৈতিক কাঠামো গড়ে তোলা যায়। ক্ষমা ও অঙ্গীকাররক্ষা এখানে ব্যক্তিমানুষের কোনো চারিত্রগুণ নয়, ক্ষমা ও অঙ্গীকার এখানে মানুষদের মধ্যের বারোয়ারি ক্ষেত্রে তাদের রাজনৈতিক সক্রিয়তার একটি ধরন। মানুষের মন-মানসিকতার কোনো সংস্কারের মধ্য দিয়ে তা আসে না, বরং আসে বারোয়ারি ক্ষেত্রে এক বিশেষ ধরনের রাজনৈতিক সক্রিয়তার মধ্য দিয়ে। ক্ষমা, পারস্পরিক সম্মানবোধ ও পারস্পরিক অঙ্গীকারগঠনের মধ্য দিয়ে মানুষরা সেই রাজনৈতিক কাঠামো গড়ে তুলতে পারে যা সর্বাত্মকতাবাদের বিরুদ্ধে তাদের আশ্রয় দিতে পারে, মৌলবাদী বিজনপ্রদেশ বিস্তারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে।
আরেকটা বিষয়ও পুনশ্চ হিসেবে বলে রাখা সমীচীন হবে। পারস্পরিক সম্মানবোধের বদলে অপরের প্রতি বিদ্বেষ যেমন সর্বাত্মকতাবাদী সন্ত্রাসের জন্ম দেয়, তেমন অপরের প্রতি অনুকম্পা-তাড়িত অপরের-মঙ্গল-করার-চেষ্টাও সর্বাত্মকতাবাদী সন্ত্রাসের জন্ম দিতে পারে। দ্বিতীয় বিষয়টি হয়ত সাধারণ ধারণার বিরোধী বলে ঠেকতে পারে, তাই কিছুটা ব্যাখ্যা করা যাক। অপরের অধিকারহীনতা বা দুর্গতি দেখে অনুকম্পা-তাড়িত হয়ে তাদের হয়ে অধিকার আদায় করে দেওয়া, তাদের উপর অত্যাচারীদের দমন করে তাদের অত্যাচারমুক্ত করা সেই অনুকম্পার পাত্র অপরদের রাজনৈতিক সক্রিয়তায় অপারগ বলে হীনতার চোখে দেখে ও রাজনৈতিকভাবে নিষ্ক্রিয় করে রাখে। আবারও, এই অন্যায়কে ন্যায় করার অনুকম্পা-জাত উদ্দেশ্যকে মহত্ত্বের আসনে বসিয়ে সেই উদ্দেশ্যসাধনের জন্য যে কোনো পন্থা অবলম্বনকে ন্যায়সঙ্গত বলে মনে করে। ফলে কোনোরকম সন্ত্রাস লাগু করতেই তার আর বাধা থাকে না। যে কোনো আবেগ-তাড়িত রাজনীতিই তাই সন্দেহের পাত্র। অপরাপরের পারস্পরিক সম্মানবোধ ও সমতার উপর দাঁড়িয়ে বারোয়ারি ক্ষেত্রে সম-অংশগ্রহণ ও সক্রিয়তার রাজনীতিতে মঙ্গলসাধনের আবেগ নেই, আছে কেবল আত্ম ও অপরকে সমসম্মানভাগী করে অস্তিত্বযাপনের চাহিদা।
উপসংহার
যুদ্ধ, মৃত্যুশিবির, পরিত্যক্ত শরণার্থীদের অবমানুষে রূপান্তরিত হওয়া, পারমাণবিক ধ্বংসশক্তির আস্ফালন, বিচ্ছিন্নতায় একাকীত্বে মানব-অস্তিত্বের বন্দীত্ব, অন্তহীন ভোগবাদের আধিপত্যে মানুষদের মধ্যের বারোয়ারি ক্ষেত্র শুকিয়ে যাওয়া, রাষ্ট্র-রাজনীতিতে সর্বাত্মকতাবাদী উপাদানের ক্রমবৃদ্ধি, মৌলবাদের সর্বগ্রাসী বিস্তার— আধুনিকতার এই সমস্ত সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলো আধুনিক বিশ্ব জুড়ে বহুত্বের রাজনীতির পরিসর গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তাটাকেই অনবরত হাজির করে চলেছে। আধুনিকতার বিভিন্ন রোগলক্ষণ উগ্র জাতীয়তাবাদী, মৌলবাদী, হিংসাত্মক রাজনীতির নানা রূপ ধরে মানবজমিন ধ্বংসের কাজটিকে আরো ত্বরাণ্বিত করে চলেছে। ভারতে হিন্দুত্ববাদীদের সর্বাত্মকতাবাদী-মৌলবাদী রাজনীতিও এই রোগাক্রান্ত আধুনিকতারই লক্ষণ, কোনো অতীত ভারতের প্রেতাত্মা তা নয়। যেভাবে তা আধিপত্য বিস্তার করে চলেছে, তার পথে সংসদীয়-নির্বাচন-চৌহদ্দীতে কোনো বেড়া তুলে আটকানো যাবে না, যাচ্ছেও না। প্রকৃত বিকল্পের সন্ধানে বহুত্বের রাজনীতির ভাবনা-অনুশীলনের উপযোগী মানবজমিন পতিত হয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করে নতুন চাষে সবুজ করে তোলার চেষ্টা শুরু হয়েছে হয়তো কোথাও, শুরু হবে হয়তো কোথাও, আমাদেরই মধ্যে, আত্ম এবং অপরের মধ্যের তারকাঁটার বেড়াগুলোকে উপড়ে দিয়ে, সেই পথেই হয়তো আবার বিজনপ্রবাস-বন্দীত্ব থেকে মুক্তিও দেখা দেবে…