রাজনৈতিক ক্রিয়ার পরিসর

লিখেছেন:বিপ্লব নায়ক
হানা আরেন্টের তত্ত্ব-আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে সর্বাত্মকতাবাদের উৎস ও উপাদান, মতবাদ, রাজনৈতিক সক্রিয়তা ও বহুত্বের রাজনীতি নিয়ে আলোচনা।

সর্বাত্মকতাবাদের বিশ্লেষণ থেকে বহুত্বের রাজনীতি

হানা আরেন্ট: দেশ-কাল-চিহ্ন

হানা আরেন্ট-এর জন্ম ১৯০৬ খৃস্টাব্দে জার্মানির হানোভার শহরে আর বেড়ে ওঠা পূর্ব প্রুশিয়ার কোনিগস্বার্গ শহরে (যা এখন রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত)। তঁার পরিবারের সংস্কৃতিতে ইহুদি জাতি-শনাক্তি-চিহ্ন ধরে রাখার কোনও প্রয়াস ছিল না। ১৯৬৪-তে দেওয়া এক দূরদর্শন-সাক্ষাৎকারে আরেন্ট বলেছিলেন যে ইহুদি (জিউ) শব্দটি তঁার পরিবারের ভিতরে উচ্চারিত হতো না, রাস্তায় অন্য শিশুদের সঙ্গে খেলার সময় তাদের ইহুদি-বিদ্বেষী মন্তব্যের মধ্য দিয়ে প্রথম তঁার এই শব্দটির সঙ্গে পরিচয়— ইহুদি পরিচয় তঁার স্বেচ্ছায় গৃহিত বা পারিবারিক ধারায় প্রাপ্ত স্ব-শনাক্তি চিহ্ন নয়, ইহুদি-বিদ্বেষী পড়শিদের দ্বারা আরোপ করা পরিচয়।

হেইডেলবার্গ ও মারবার্গ-এর বিশ্ববিদ্যালয়ে তঁার পাঠগ্রহণ। যৌবনের গোড়ায় রাজনীতি নিয়ে তঁার কোনও উৎসাহ ছিল না। মার্টিন হেইডেগারের তত্ত্বাবধানে তঁার গবেষণা-সন্দর্ভের বিষয় ছিল ‘সন্ত অগস্টিনে প্রেম সম্পর্কিত ধারণা’— খৃস্টধর্মের এমন একটি রূপ নিয়ে আলোচনা যেখানে ঈশ্বরপ্রেমের আবশ্যকীয় পূর্বশর্ত হলো ইহজাগতিক সমস্ত কিছু ত্যাগ করা ও ইহজগৎ সম্পর্কিত ভাবনা থেকে মুক্ত হওয়া।

১৯২০-র দশকের শেষভাগে জার্মানিতে নাৎসিবাদের উত্থান রাজনীতি-উদাসী ভাবনাবিশ্ব থেকে আরেন্টকে হিঁচড়ে বের করে এনেছিল। রাজনৈতিক সংস্পর্শ এড়িয়ে থাকা তখন আর কোনও ইহুদি-পরিচয়ভুক্ত মানুষের পক্ষেই সম্ভব ছিল না। এর আগে অবধি রাজনীতির সঙ্গে যেমন, ইহুদিদের ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক জগতের সঙ্গেও আরেন্ট-এর ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শ ছিল না। নাৎসিবাদ যত শক্তি অর্জন করতে থাকে, আরেন্ট-এর এই সংস্পর্শও তত ঘনিষ্ঠ হতে থাকে। তিনি ক্রমশ স্থিরনিশ্চয় হন যে ‘যখন কাউকে ইহুদি হিসেবে আক্রমণ করা হচ্ছে, তখন ইহুদি হিসেবেই তার আত্মরক্ষা করা উচিত’। রাহেল ভার্নহাগেন-এর জীবনকে তিনি এই সময়ে যেভাবে পাঠ করেছিলেন তার মধ্যে হানা আরেন্ট-এর এই ভাবনাকে প্রতিফলিত হতে দেখা যায় । রাহেল ভার্নহাগেন উনিশ শতকের প্রথম ভাগে জার্মান রোমান্টিক ঘরানার নগর-সংস্কৃতির একটি পরিচিত ব্যক্তিত্ব ছিলেন। বার্লিনে রাহেল ভার্নহাগেন-এর সালোঁ ছিল অভিজাত ও বুদ্ধিজীবীদের পরিচিত মিলনক্ষেত্র। জীবনের একটা বড় অংশ জুড়ে ইহুদি পরিচয় ছাড়িয়ে জার্মান পরিচয়ে মিশে যাওয়ার চেষ্টা করে তাতে ব্যর্থ হওয়ার পর শেষাবধি আবার ইহুদি পরিচয়কে ও তার উপর আরোপিত করা বিভিন্ন নঙর্থক বৈশিষ্ট্যকে ইহুদি মানুষদের জৈবিক-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য হিসাবে স্বীকার করে নিয়ে নিজের স্ব-শনাক্তির ক্ষেত্রে সেই আরোপিত নির্মাণের কাছে আত্মসমর্পণ করার জন্য আরেন্ট তঁার সমালোচনা করেছিলেন । আরেন্ট-এর মতে যে ভুল রাহেল করেছিলেন তা সেইসময়ের ইউরোপে ইহুদিদের করা সাধারণ ভুল। সেই ভুল হল নিজেদের অবস্থানকে রাজনৈতিকভাবে না দেখা, অপর হিসাবে চিহ্নিত করে যে সমস্ত অধিকার থেকে তাঁদের বঞ্চিত করা হচ্ছে সে সম্পর্কে অসচেতন ও রাজনৈতিকভাবে নিষ্ক্রিয় থেকে অপরতাকে সাংস্কৃতিক-ধর্মীয় বিশেষত্ব হিসেবে মহিমান্বিত করা। এই আত্মঘাতী প্রবণতার বাইরে বেরিয়ে স্বতপ্রবৃত্ত রাজনৈতিক সচেতনতা ও সক্রিয়তা অর্জন করাই হয়ে ওঠে হানা আরেন্ট-এর ভাবনার মূল বিষয়। কিন্তু তা অর্জনের উপায় কী? আরেন্ট-এর মতে এই উপায় শুরু হতে পারে নিজের বাইরে বেরিয়ে অন্যদের সঙ্গে ভাগ করা জগতে প্রবেশ করে রাজনৈতিক বাস্তবতা সম্পর্কে সচেতন হওয়া ও অকপট প্রতিক্রিয়া করার মধ্য দিয়ে।

১৯৩৩ সালে হিটলার জার্মানির চ্যান্সেলর হওয়ার পর জার্মান কর্তৃপক্ষ হানা আরেন্টকে কিছুদিনের জন্য গ্রেফতার করে রাখে ইহুদিদের সাংগঠনিক কাজকর্ম বিষয়ে তথ্যসংগ্রহের উদ্দেশ্যে জিজ্ঞাসাবাদের অজুহাতে। এরপর আরেন্ট বাধ্য হন জার্মানি ত্যাগ করে ফ্রান্সে এসে উঠতে। ফ্রান্সের পারি শহরে ইহুদি শরণার্থীদের সাহায্যকারী একটি সংগঠনের মধ্যে তিনি কাজ করেন ইহুদি শিশু ও তরুণদের জার্মানি ছেড়ে প্যালেস্তাইনে আশ্রয় নেওয়ার প্রক্রিয়ার সহায়ক হিসেবে। ১৯৪০-এর গ্রীষ্মে জার্মানি ফ্রান্স আক্রমণ করার পর তিনি আবার জার্মান সেনার হাতে বন্দী হন। পিরেনিজ পর্বতের পদতলে গুরস নামক স্থানে এক কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে তঁাকে বন্দী করে রাখা হয়। তিনি সেখান থেকে পালাতে সমর্থ হন এবং ১৯৪১-এ আমেরিকায় আশ্রয় নেন।

আমেরিকায় হানা আরেন্ট-এর সক্রিয়তা দুইটি ধারায় প্রবাহিত হয়। একদিকে তিনি ইহুদিবিদ্বেষ ও নাৎসিবাদের বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে সর্বাত্মকতাবাদী শাসনের রূপ ও বৈশিষ্ট্য অনুসন্ধানে ব্রতী হন, যে কাজ ক্রমশ তঁার বিখ্যাত ‘সর্বাত্মকতাবাদের উৎপত্তি' (The Origins of Totalitarianism) বইয়ের রূপ গ্রহণ করে তারপর আরও গভীরতর অণ্বেষায় বিস্তৃত হয়। অন্যদিকে তিনি জার্মান ইহুদিদের পত্রিকা ‘আউফবাউ'-এ ১৯৪১ থেকে ১৯৪৫ অবধি ধারাবাহিকভাবে কলাম লেখার মধ্য দিয়ে নাৎসি-বিরোধী রাজনীতিতে ভূমিকা নিতে থাকেন। নাৎসিবাদের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ যুদ্ধে সামিল হতে ইহুদি সেনাবাহিনী গঠনের জন্য প্রচারে তিনি অত্যন্ত উৎসাহী ভূমিকা নেন। তঁার মতে এর মধ্য দিয়ে ইহুদিরা অন্যায়ের অসহায় উপভোক্তা হিসাবে অন্যের অনুকম্পার কাঙাল হয়ে না থেকে ইতিহাসের সক্রিয় চরিত্র হিসাবে মর্যাদা অর্জন করতে পারবে। তদানীন্তন ইহুদি রাজনীতির বেশ কিছু প্রভাবশালী ধারার বিরোধিতাও আরেন্ট দৃঢ়ভাবে করেছিলেন। যেমন, তিনি ধারাবাহিকভাবে বিরোধিতা করে গেছেন প্যালেস্তাইনে ইতিমধ্যেই বাসরত আরবদের অধিকারকে বিবেচনার মধ্যে না এনে সেখানে কেবলমাত্র ইহুদিদের রাষ্ট্র গঠন করার পরিকল্পনাকে। ক্ষমতাশালীদের পৃষ্ঠপোষকতায় আরবদের অধিকারকে পায়ের তলায় পিষে নিজেদের জন্য সুবিধা করে নেওয়ার পথের বদলে হানা আরেন্ট চেয়েছিলেন যে সমস্ত নিপীড়িত ও অধিকারহীনদের সাধারণ জগতে দাঁড়িয়ে ইহুদিরা আধিপত্যহীন নতুন জগৎ সৃষ্টির রাজনীতির স্রষ্টা হোক।

দ্বিতীয়-বিশ্বযুদ্ধোত্তর অন্ধকার সময়ে ইউরোপের আত্মম্ভরী সভ্যতা যখন ভিতর থেকে ভেঙে পড়ছে, সেই সময়ে দাঁড়িয়ে হানা আরেন্ট বারবার স্মরণ করেছেন সাধু অগস্টিনের একটি উক্তিকে। উক্তিটি সাধু অগস্টিনও করেছিলেন বহুদিন আগের এক অন্ধকার সময়ে ভেঙে পড়তে থাকা রোমান সভ্যতার ধ্বংসাবশেষে দাঁড়িয়ে। উক্তিটি হল: Initium ut esset homo creates est—‘মানুষের সৃষ্টি হয়েছিল যাতে একটা নতুন শুরু সূচিত হয়’। হানা আরেন্ট আশা করেছিলেন যে রাজনৈতিক সক্রিয়তার মধ্য দিয়ে সর্বাত্মকতাবাদের বাইরে এক নতুন মানব-অস্তিত্বের শুরু মানুষ করতে পারবে।

সর্বাত্মকতাবাদ (Totalitarianism) কী?

জার্মানিতে নাৎসি-শাসন ও সোভিয়েত রাশিয়ায় স্তালিন–শাসন — এই দুই সমকালীন ঐতিহাসিক ঘটনাকে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে আরেন্ট সর্বাত্মকতাবাদের ধারণাকে সামনে এনেছিলেন। তঁার মতে এই দুটি শাসন ইউরোপের ইতিহাসে তার আগে পরিচিত বিভিন্ন শাসনরূপ— রাজতন্ত্র, একনায়কতন্ত্রী স্বেচ্ছাচার, উৎপীড়নমূলক শাসন, প্রজাতন্ত্র— কোনোটির সঙ্গেই মেলে না, সুতরাং এই দুই ঐতিহাসিক ঘটনাকে বোঝার জন্য শাসনরূপ সম্পর্কে পুরানো ধারণাগুলো আর যথেষ্ট নয়, নতুন ধারণা গড়ে তোলা প্রয়োজন। সর্বাত্মকতাবাদের ধারণার মধ্য দিয়ে আরেন্ট সেই নতুন ধারণা গড়ে তোলার পথে এগিয়েছেন। আবার, নাৎসি-শাসন ও স্তালিন-শাসন সমরূপীয় অভিন্ন নয়, নাৎসি-শাসন যেখানে ইউরোপিয় ইতিহাসে ইহুদিদের বিশেষ অবস্থান ও ইহুদি-বিদ্বেষের দীর্ঘ ধারাকে ব্যবহার করে জাতি-শ্রেষ্ঠত্বের চুন-সুরকি দিয়ে তার শাসনের ইমারত খাড়া করেছিল, স্তালিন-শাসন সেখানে শোষণহীন সমাজের লক্ষ্যে শ্রমিকশ্রেণির আন্দোলনের নীতি ও কৌশলকে ব্যবহার করেছিল তার শাসনরূপ গড়ে তুলতে। সুতরাং, দুটি ভিন্ন ঐতিহাসিক উৎস থেকে রসদ সংগ্রহ করা এই দুই শাসনরূপের মধ্যে সাধারণ বিষয়টিই বা কী? আরেন্ট-এর বিবেচনায় এই সাধারণ বিষয়টি হল মতবাদের কেন্দ্রীয় ভূমিকা। সাধারণত এই দুই শাসনের কোনও একটির বা দুটিরই সমালোচক যারা, তঁারা এই দুই শাসনে সংগঠিত সন্ত্রাসকে— কনসেনট্রেশন ক্যাম্প, গুলাগ, এস. এস বাহিনী বা গুপ্ত পুলিশের সন্ত্রাসকে— বা এই দুই শাসনের প্রধান মুখ হিসাবে পরিচিত হিটলার বা স্তালিনের ক্ষমতালিপ্সা ও স্বেচ্ছাচারকে কাঠগড়ায় তোলেন। কিন্তু কনসেনট্রেশন ক্যাম্প বা গুলাগের প্রকট রূপ অবসিত হওয়ার পরও, হিটলার ও স্তালিনের মৃত্যুর পরও সমাজ থেকে কী সর্বাত্মকতাবাদী শাসনের প্রবণতা/সম্ভাবনা মুছে যায়? আরেন্ট-এর উত্তর: না, যায় না। যায় না কারণ এই দুই শাসনে মতবাদ (Ideology) যে ভূমিকা নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছিল, সেই ভূমিকা তার পরেও অব্যাহত আছে পশ্চিমী আধুনিকতায়, আর তাই সর্বাত্মকতাবাদী শাসনের প্রবণতা/সম্ভাবনাও অটুট আছে। [এই অটুট থাকার কথাটা আধুনিক সমাজ-অভিজ্ঞতাও নানাভাবে জানান দিয়ে যায়। যেমন ধরুন, পশ্চিমী সাহিত্যে সর্বাত্মকতাবাদী সমাজের আশঙ্কা যে দুটি বহু-পঠিত উপন্যাসের মধ্যে ফুটে উঠেছে, সেই দুটি হলো ১৯৩২-এ প্রকাশিত আলডস হাক্সলি-র ‘ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড’ এবং ১৯৪৯-এ প্রকাশিত জর্জ অরওয়েলের ‘নাইন্টিন এইটটি ফোর’। এই উপন্যাস দুটির আজকের পাঠকও তঁার পাঠ-অভিজ্ঞতাকে কেবলমাত্র ঐতিহাসিক কৌতূহলেই সীমাবদ্ধ রাখতে পারেন না, তঁার শিরদাঁড়ায় হিমস্রোত বইয়ে দিয়ে মগজে এ প্রশ্ন চলাচল করতে থাকে যে তঁার সমাজও কি এই সর্বাত্মকতাবাদের দিকেই এগিয়ে চলেছে, ঠিক যেমন কানাডার লেখিকা মার্গারেট অ্যাটউড ২০০৭ সালে ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড-এর একটি পুনর্মুদ্রিত সংস্করণের ভূমিকা লিখতে গিয়ে লিখেছিলেন:

আর বাস্তব জীবনে কত না কাছে এসে আমরা পৌঁচেছি সেই নীরস উপভোক্তা, অলস প্রমোদ-সন্ধানী, অন্তঃপরিসর ভ্রমণকারী ও পরিকল্পনা-নির্মিত আদেশপালনকারীদের সমাজের, যা এখানে হাজির করা হয়েছে?

হিটলার বা স্তালিন, কনসেনট্রেশন ক্যাম্প বা গুলাগ-এর পুনরাবৃত্তি সর্বাত্মকতাবাদের প্রসারের সবসময় আবশ্যকীয় হয়ে ওঠে না। এখন দেখা যাক মতবাদের এই বিশেষ ভূমিকায় আত্মপ্রকাশ বলতে আরেন্ট কী বোঝাতে চেয়েছেন।

আরেন্ট-এর মতে, মতবাদের নির্ধারক বৈশিষ্ট্য হলো যুক্তিশৃঙ্খলার সুসামঞ্জস্য, যার দ্বারা সে সমস্ত অতীত থেকে সমস্ত ভবিষ্যৎ ব্যাখ্যা করতে পারার দাবি করে। উদাহরণ নিয়ে আরেন্টের এই ধারণাকে কিছুটা খুলে-মেলে দেখা যাক। কোনও মানবগোষ্ঠীর জাতিগত স্ব-শনাক্তি নির্মাণ, অন্যদের সাপেক্ষে বৈশিষ্ট্য ও পার্থক্যের বোধ, এমনকি অন্যদের সাপেক্ষে শ্রেষ্ঠতার আত্মাভিমান নাজে থেকেই মতবাদ নয়। যখন এই সমস্ত থেকে পুষ্টি আহরণ করে গড়ে ওঠে এমন এক সুসমঞ্জস যুক্তিশৃঙ্খলা যা ইতিহাসের শুরু থেকে শেষ অবধি শ্রেষ্ঠতর জাতির অন্য জাতির উপর আধিপত্য নির্মাণের প্রক্রিয়া হিসেবে ব্যাখ্যা করে এবং নিকৃষ্টতর জাতিদের অবলুপ্তি বা শ্রেষ্ঠতর জাতিতে বিলীন হয়ে যাওয়াকেই ইতিহাসের অবধারিত গতি হিসেবে হাজির করে, তখন তা মতবাদ হয়ে ওঠে। নাৎসিরা এমন মতবাদকেই অস্ত্র করেছিল, কিন্তু নাৎসিদের পরিধির বাইরেও, বিশেষ করে জাতীয়তাবাদী নানা মহলে, এই মতবাদ অসংখ্য সংস্করণে বর্তমান। একইরকমভাবে, শ্রমিকশ্রেণির সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, শোষণ-আধিপত্য থেকে তার মুক্তির উপায় নির্ধারণ ও শ্রেণিসংগ্রামের নীতি-কৌশল নির্ণয় নিজে থেকেই মতবাদ নয়। যখন এই সমস্তকে অধীনে রেখে গড়ে ওঠে এমন এক অমোঘ যুক্তিশৃঙ্খল যা আদ্যন্ত ইতিহাসকে শ্রেণিসংগ্রামের প্রক্রিয়া হিসাবে ব্যাখ্যা করে ও শ্রেণিশত্রু দমনকেই অগ্রগতির পথ হিসেবে চিহ্নিত করে, তখন তা মতবাদ হয়ে ওঠে। স্তালিন এই মতবাদকে অস্ত্র করেছিলেন, কিন্তু স্তালিন বা স্তালিনপন্থী ছাড়া আরও অনেকের তূণীরেই এই অস্ত্র শোভা পায়। আবারও, মানুষের বস্তগত চাহিদার বৃদ্ধি, বস্তুগত চাহিদা মেটানোর জন্য বস্তুগত উৎপাদনের বৃদ্ধি, প্রকৌশল প্রয়োগ নিজে থেকেই মতবাদ নয়। কিন্তু অবিরত বস্তুগত চাহিদার বৃদ্ধি এবং বস্তুগত উৎপাদনের বৃদ্ধি যখন ইতিহাসের আদ্যন্তবিস্তৃত নিয়ামক গতি হিসেবে চিহ্নিত হয়, প্রকৌশল-পুজো হয়ে ওঠে সর্বাধিপত্যবিস্তারকারী এবং ইতিহাসের এই গতির পথ বাধামুক্ত করার জন্য প্রাকৃতিক পরিসরের অন্য সমস্ত কিছুকে নির্বিচারে ভোগ-ধ্বংস-আত্মসাৎ-যোগ্য বলে নির্ধারণ করা হয়, সমস্ত মানবক্রিয়ার মধ্যে ভোগেচ্ছা-তাড়িত জড় সঞ্চয়নকেই একমাত্র স্বাভাবিক আদর্শ হিসাবে তুলে ধরা হয়, তখন তা মতবাদ হয়ে ওঠে। পশ্চিম ইউরোপের জঠরে জন্ম নিয়ে বিশ্বগ্রাস করতে উদ্যত পঁুজিবাদের অতি সহযোগী সহচর এই মতবাদ। গোটা বিশ্বপ্রকৃতির আদ্যন্ত সমস্ত প্রক্রিয়া বুঝতে পারা, তার  মূলসূত্র নির্ণয় করা ও সেই মূলসূত্র প্রয়োগে ফিরে আবার সেই সমস্ত প্রক্রিয়াকে নিজ অভিপ্রায় মতো প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রিত করতে পারা--- নিজ জ্ঞান নিয়ে মানুষের এই চরম অহংবোধের সবচেয়ে অন্ধ আগ্রাসী রূপ এই মতবাদ।

মতবাদ কী করে? আরেন্ট-এর বিবেচনায়, মতবাদ আদ্যন্ত মানব-ইতিহাসকে একটি একমুখী গতি হিসেবে হাজির করে, অর্থাৎ, মানব-ইতিহাস যেনবা একটি অপরিবর্তনীয় লক্ষ্য অভিমুখে সদা ধাবিত। সেই লক্ষ্য হতে পারে শ্রেষ্ঠতম জাতির পরিচালনাধীনে সমগ্র মানবসমাজের সংগঠন, অথবা, শ্রেণির বিনাশের মধ্য দিয়ে শ্রেণিহীন সমাজ-গঠন, অথবা, জড়-উৎপাদনী শক্তির অন্তহীন বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে ভোগকে অসীম করে তোলা। মানুষ ও মানবসমাজ ইতিহাসের এই একমুখী লক্ষ্যে ধাবিত গতিপথের কোনো একটি বিন্দুতে অবস্থিত। মানুষের কোনও ক্ষমতা নেই এই গতিপথকে বদল করার। সেইদিক থেকে সে চূড়ান্ত ক্ষমতাহীন। অন্য এক দিক থেকে মানুষ আবার অসীম ক্ষমতাসম্পন্ন হয়ে উঠতে পারে। সে অসীম ক্ষমতাসম্পন্ন হয়ে উঠতে পারে যদি ইতিহাসের গতির নিয়মটিকে উপলব্ধি করে সেই গতির অভিমুখে অনুঘটকের কাজ করে। ইতিহাসের গতির অভিমুখে অনুঘটক হিসেবে ক্রিয়াশীল মানুষের অসীম ক্ষমতা এই জন্যই যে অপর উপলব্ধি সম্পন্ন যে কোনও মানুষ বা মানবগোষ্ঠীর বিরোধিতার মুখে তার জয় শেষ বিচারে অনিবার্য, ইতিহাসের অমোঘ গতিই সেই অনিবার্যতা উৎপাদন করছে। ফলে, অপর উপলব্ধি সম্পন্ন যে কোনও মানুষ বা মানবগোষ্ঠীকে পরাজিত-পরাভূত করতে যে কোনও পথ অবলম্বনই ন্যায়সঙ্গত, কারণ তা ইতিহাসের নৈর্ব্যক্তিক গতিরই পথ। জাতি-শ্রেষ্ঠতা প্রতিষ্ঠেচ্ছু নাৎসি, শ্রেণিশত্রুর বিনাশ চাওয়া কম্যুনিস্ট বা উৎপাদনশক্তির বিকাশ অবাধ করতে চাওয়া পঁুজিবাদী এইভাবেই তার সর্বশক্তিমানতাকে উপলব্ধি করে।

এই সর্বশক্তিমানতার প্রত্যয় গড়ে ওঠে সর্বদিক-বদ্ধ এক চিন্তা-পদ্ধতির মধ্য দিয়ে। এই পদ্ধতি সর্বদিক-বদ্ধ কারণ তা গৃহিত এক প্রথম সিদ্ধান্ত বা প্রথম প্রস্তাবের উপর ভিত্তি করে অবরোহমূলক যুক্তিবিস্তারের মধ্য দিয়েই সমস্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব বলে মনে করে। সমস্ত ঐতিহাসিক ও জাগতিক সত্যের অদ্বৈত উৎস এই প্রথম সিদ্ধান্ত হতে পারে শ্রেষ্ঠতম জাতির গোটা মানবসমাজকে নিজের আদলে গড়েপিটে নেওয়ার অধিকার/দায়িত্ব বা প্রতিক্রিয়াশীল শ্রেণিদের দমন করে প্রগতির পথকে বাধামুক্ত করার প্রগতিশীল শ্রেণির অধিকার/দায়িত্ব বা মানবিক-অমানবিক সমস্ত সম্পদকে জড় উৎপাদনের ক্রমাগত বৃদ্ধির যজ্ঞে জোর খাটিয়ে সামিল করার অধিকার/দায়িত্ব, বা এমনই অন্য কিছু। অনন্ত অতীত থেকে অনন্ত ভবিষ্যৎ অবধি ইতিহাসপ্রক্রিয়ার চালিকাশক্তিকে একটি প্রথম সিদ্ধান্ত বা প্রথম প্রস্তাবের মধ্যে ধরে ফেলার এই প্রত্যয় চিন্তাকে এক আপাত-লৌহকঠিন কঁাচের ঘরে এক অদ্ভূত নিরাপত্তাবোধে আত্মমগ্ন করে তোলে কারণ তা অনবরত নতুন নতুন মানব-অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে অভাবিত নতুনের মুখোমুখি হয়ে অনবরত সিদ্ধ জ্ঞান-বিশ্বাসকে পাল্টে নতুনকে বরণ করে নেওয়ার অস্থিতিকে অস্বীকার করে। আদ্যন্ত ইতিহাসপ্রক্রিয়া সম্পর্কে চরম সত্যকে মুঠোয় ধরে ইতিহাসের চালক হওয়ার খোয়ারি-আচ্ছন্ন দৃষ্টিতে তার অধিগত প্রথম সিদ্ধান্ত বা প্রথম প্রস্তাব থেকে বিস্তৃত সুসমঞ্জস সুশৃঙ্খল অবরোহমূলক যুক্তিবিস্তারের বাইরে কোনও সত্য থাকতে পারে না। এই অবরোহমূলক যুক্তিবিস্তারের বাইরে যা, তাই-ই হলো ভ্রম, মিথ্যা মায়া, বিকৃতি। ফলে সেই-ই একমাত্র সত্য, অপর সব কিছু ভ্রম, অপর সবকিছু ক্ষতিকারক; তাই অপর সবকিছুকে খণ্ডন করে, ধ্বংস করে নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠাই হলো সত্যের প্রতিষ্ঠা, ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা। অপর সম্পর্কে এই হিংসাত্মক বৈরী মনোভাব একদিকে যেমন চরম সত্যের ধারক হিসেবে তার নিরাপত্তাবোধ থেকে উৎসারিত, ঠিক তেমনই তা ওই নিরাপত্তাবোধকে যেন-তেন প্রকারেণ রক্ষা করার মরীয়া প্রচেষ্টাও বটে। মানব-অভিজ্ঞতা অনির্ণীত নতুন কিছুকে সামনে তুলে আনলেই তা তার আপাত-লৌহকঠিন কঁাচের ঘরকে সন্ত্রস্ত করে তোলে, তাই অনির্ণীত নতুন সমস্ত কিছুকে মিথ্যা বা ভ্রমের স্তরে অবনমিত করতে না পারলে, ধ্বংস করতে না পারলে তার নিরাপত্তা নিয়ে সে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে থাকে। অবদমিত বিপন্নতাবোধ থেকেই সে সদা আগ্রাসী। এইভাবে সে নিজেকে বিযুক্ত করে ফেলে মানব-অভিজ্ঞতা থেকে। তার জ্ঞানের উৎস তার সবদিক-বদ্ধ চিন্তাপ্রক্রিয়া; নতুন নতুন মানব-অভিজ্ঞতা তাকে কলুষিতই করতে পারে কেবলমাত্র, অন্তর্ঘাতই ঘটাতে পারে কেবলমাত্র অনির্ণিত কোনও নতুনকে জন্ম দিয়ে। মতবাদিক চিন্তা তাই মানব-অভিজ্ঞতা-প্রক্রিয়ার বিরোধী, আর নিজেকে সর্বাত্মক করে তোলার আগ্রাসনে সে মানব-অভিজ্ঞতা-প্রক্রিয়াটাকেই ধ্বংস করতে চায়। অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে অনবরত জন্ম নেওয়া অনির্ণীত নতুনের জন্য সে উন্মুক্ত নয়, বরঞ্চ তার অধিগত চরম সত্যের থেকে উৎসারিত অবরোহমূলক যুক্তিশৃঙ্খলায় হয় অভিজ্ঞতাকে সুসমঞ্জসভাবে এঁটে যেতে হবে আর নয়তো সেই অন্তর্ঘাতী অভিজ্ঞতাকে মিথ্যা বলে মুছে দিয়ে তার জায়গায় সুসমঞ্জস সত্যকে নির্মাণ করতে হবে। জর্জ অরওয়েলের ‘১৯৮৪'-র ‘মিনিস্ট্রি অফ ট্রুথ', ‘চিন্তা-পেয়াদা' (thought-police) এবং বাস্তবে নাৎসি জার্মানিতে, স্তালিন-শাসনের রাশিয়ায়, ম্যাকার্থি-জমানার আমেরিকায় ও আরও বহু ক্ষেত্রে এই চিন্তা-পেয়াদাদের নানা চেহারা, মতবাদের প্রয়োজন অনুযায়ী ‘সত্য' উৎপাদন করে অতীত ইতিহাসকে মুছে কল্পনা দিয়ে প্রতিস্থাপিত করার দাপট দেখায় কীভাবে মানব-অভিজ্ঞতা-প্রক্রিয়াকে ধ্বংস করার কাজ সংগঠিত হয়ে চলে।

আরেন্ট-এর মতে, এই মানব-অভিজ্ঞতা-প্রক্রিয়াকে ধ্বংস করা মানব-প্রকৃতিকেই ধ্বংস করে এবং এই চরিত্রটিই সর্বাত্মকতাবাদের নির্ণায়ক চরিত্র এবং সবচেয়ে ভয়ংকর চরিত্র। মানব-প্রকৃতি বলতে আরেন্ট বুঝিয়েছেন প্রতিটি মানুষের নিজের অনন্য অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে নতুন কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর ক্ষমতা এবং যে কোনও সময়েই নতুন কোনও সূচনা ঘটানোর ক্ষমতা। মতবাদিক লৌহবন্ধন মানব-অভিজ্ঞতা-প্রক্রিয়াকে ধ্বংস করে মতবাদিক অবরোহমূলক যুক্তিপ্রক্রিয়ায় চিন্তাকে বন্দী করার মধ্য দিয়ে এই নতুন সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর ও নতুন সূচনা করার ক্ষমতাকে ধ্বংস করে। প্রত্যেকটি মানুষের মানব-অভিজ্ঞতার অনন্যতা ও বিভিন্নতা যেহেতু স্বীকৃত হয় না, তাই মানুষের মধ্যের বিভিন্নতাও সন্দেহের চোখে দেখা হয়। সমস্ত মানুষকে মতবাদ-নির্মিত এক আদর্শ মানুষের আদলে নিজেকে বিলীন করে দিতে হয়, নইলে তার বিভিন্নতার জন্য সে অস্বাভাবিক, রুগ্ন, বিকৃতমনস্ক বা সমাজবিরোধী হিসাবে চিহ্নিত হয় এবং রাষ্ট্র ও প্রশাসনের প্রশ্নাতীত অধিকার জন্মে যায় তাকে জোর খাটিয়ে, শাস্তি দিয়ে বা চিকিৎসা করে স্বাভাবিকতার আদলে বন্দী করার। ১৯৮৪-তে সর্বাত্মকতাবাদী মতবাদ আরোপিত এই সমসত্ত্বতার এক ভয়ংকর ছবি ফুটে উঠেছিল জর্জ অরওয়েলের কলমে:

পার্টি যে আদর্শটি খাড়া করেছিল, তা অতিকায়, ভয়ানক ও চমকদার— ইস্পাত ও জমাটপিণ্ডের এক জগৎ, দৈত্যাকার যন্ত্র ও ভয়াবহ অস্ত্রের এক জগৎ— যোদ্ধা ও মতান্ধদের এক জাতি, যে যোদ্ধা ও মতান্ধরা বিশুদ্ধ ঐক্য বজায় রেখে কুচকাওয়াজ করে এগিয়ে যাচ্ছে, প্রত্যেকে একই ভাবনা ভাবছে আর একই বাঁধাবুলি চিৎকার করছে একই ছন্দে, অবিরতভাবে কাজ করে চলেছে, যুদ্ধ করে চলেছে, জয় করছে, নিগ্রহ করছে— একই মুখের তিরিশ কোটি মানুষ।

আরেন্ট-এর ধারণা অনুযায়ী এটাই হলো সর্বাত্মকতাবাদ যা চরম সত্যের অভিভাবকত্ব দাবিকারী মতবাদের সর্বাত্মক আধিপত্য কায়েমের মধ্য দিয়ে মানুষের মধ্যের বহুত্ব, বিভিন্নতা ও স্বতস্ফূর্ততাকে সর্বস্তরে দমন করে নির্ণীত নির্ধারিত এক আখ্যানের দাস করে তোলে মানুষকে। এই সর্বাত্মকতাবাদ মানব ইতিহাসের কিছু নির্দিষ্ট অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে বিকশিত উপাদানের সংহতিকরণের মধ্য দিয়েই আত্মপ্রকাশ করেছে। দেখা যাক এই উপাদানসমূহকে আরেন্ট কীভাবে চিহ্নিত করেছেন।

সর্বাত্মকতাবাদের উপাদান

আরেন্ট-এর মতে, সর্বাত্মকতাবাদের শাসনরূপ তার আগের ইতিহাসের সমস্ত শাসনরূপের তুলনায় অভিনব, কিন্তু তা গড়ে উঠেছে এমন কিছু উপাদানের বিস্ফোরক সমন্বয়ে, যে উপাদানগুলি পূর্ববর্তী ইতিহাসের গর্ভেই জন্ম নিয়ে ক্রমশ নির্ধারক চেহারা ধারণ করেছে। এই উপাদানগুলি হলো— জাতিবিদ্বেষ, বৃদ্ধির স্বার্থেই বৃদ্ধি-র অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক-সামাজিক প্রবণতা, পঁুজি ও উচ্ছেদিত/উৎপাটিত জনদঙ্গলের সম্পৃক্তি। পশ্চিম ইউরোপের বিশ্বজুড়ে উপনিবেশ- বিস্তার-অভিযানের মধ্য দিয়ে এই উপাদানগুলির বৃদ্ধি, পুষ্টি ও নির্ধারক রূপগ্রহণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছিল বলে আরেন্ট-এর ধারণা। ১৮৮০-র দশকে পশ্চিম ইউরোপের পঁুজিবাদী বৃদ্ধি সমন্বিত দেশগুলো যেভাবে উপনিবেশ স্থাপনের উদগ্র লালসা নিয়ে আফ্রিকার উপর শিকারী কুকুরের দঙ্গলের মতো ঝঁাপিয়ে পড়েছিল, তার মধ্য দিয়েই এই দুঃস্বপ্নের শুরু বলে আরেন্ট চিহ্নিত করেছেন।

পঁুজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে প্রাণভোমরা হিসেবে নিহিত আছে পঁুজির পুঞ্জীভবনের স্বার্থেই পুঞ্জীভবনের প্রবণতা (accumulation for accumulation’s sake)। মার্কসের পঁুজিবাদী অর্থনীতির বিশ্লেষণ তা সামনে তুলে এনেছিল। অর্থনৈতিক ব্যবস্থার এই প্রবণতা থেকে উৎসারিত হয়ে বা তার প্রতিফলিত রূপ হিসেবে এক নতুন ধরনের রাজনীতি প্রকট হয়ে উঠল, যে রাজনীতি ভৌগোলিক ভাবে বিস্তারের জন্য বিস্তারের তাড়না দ্বারা চালিত, পশ্চিম ইউরোপের শক্তিগুলোর উপনিবেশ বিস্তারের গলাকাটা প্রতিযোগিতা যার মূর্ত রূপ। উনিশ শতকের আগে অবধি ইউরোপের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো, অর্থাৎ জাতিরাষ্ট্রের রূপগুলো, এই বিস্তারের জন্য বিস্তারের রাজনীতিকে বাঁধ দিয়ে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রেখেছিল। উনিশ শতকে এসে সেই বাঁধ ভেঙে প্লাবন ঘটে গেল। পশ্চিম ইউরোপ থেকে ব্যবসায়ী পঁুজি বা উৎপাদনী পঁুজি জাতিরাষ্ট্রের সীমানা ছাড়িয়ে মহাদেশ ডিঙিয়ে যেখানে যেখানে বিনিয়োগক্ষেত্র খঁুজে নিয়েছে, সেই বিনিয়োগের নিরাপত্তা ও অনুকূল অবস্থা তৈরির জন্য অচিরেই সেখানে পশ্চিম ইউরোপিয় রাজশক্তিও তার দমন-পীড়ন-শাসনের হাতিয়ার নিয়ে হাজির হয়েছে--- এ ঘটনা উনিশ শতকের আগেও ঘটেছে । কিন্তু উনিশ শতকে এসে অর্থনৈতিক আধিপত্যের সঙ্গে রাজনৈতিক আধিপত্যের এই কার্য-কারণ সম্পর্ক ক্রমশ আলগা হতে হতে রাজনৈতিক আধিপত্য স্থাপন নিজে থেকেই একটি স্বয়ংসিদ্ধ তাড়না হয়ে দাঁড়ায়। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী অভিযানের জমিতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসক-অধিকর্তা ও গোপন এজেন্টদের দৃষ্টিভঙ্গি-মানসিকতার মধ্যেই এই প্রবণতার প্রথম উন্মেষ হয় বলে আরেন্ট চিহ্নিত করেছেন । এই শাসক-অধিকর্তা ও গোপন এজেন্টরা উন্নত জাতির প্রতিনিধি হিসেবে অপর সবার থেকে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের নির্মিত মোহে আচ্ছন্ন হয়ে যেন-তেন-প্রকারেণ নিজেদের রাজনৈতিক শাসন-আধিপত্য বিস্তার করাকে ইতিহাসের গতি ত্বরান্বিত করা বলে মনে করত। তাদের কল্পিত প্রগতি ত্বরান্বিত করার জন্য অপর জনগোষ্ঠী, অপর সংস্কৃতি, অপর সমাজকে বিলুপ্তির পথে ঠেলে দিতে সমস্তরকম হিংস্রতাই তাদের কাছে ছিল প্রগতিপন্থা। এই নতুন রাজনৈতিক চিন্তাধারাকেই আর্‌ন্ট ‘সাম্রাজ্যবাদী চরিত্র' (‘the imperialist character’) বলে চিহ্নিত করেছেন এবং বিশ শতকের সর্বাত্মকতাবাদী শাসকদের মধ্যে এর ধারাবাহিকতা লক্ষ্য করেছেন।

ঐতিহাসিক চরিত্ররূপের সাধারণ ধাঁচা হিসাবে আরেন্ট বহুসময় সাহিত্যিক চরিত্র ব্যবহার করেছেন। এইরকমই একটি চরিত্র হল জোসেফ কনরাডের ‘Heart of Darkness’ উপন্যাসের মূখ্য চরিত্র মিস্টার কুর্টজ, যাকে তিনি ‘সাম্রাজ্যবাদী চরিত্র'-র প্রতিনিধি হিসাবে ব্যবহার করেছেন। আফ্রিকার বেলজিয়াম-অধিকৃত কঙ্গো-র গভীরে হাতির দাঁত চালানকারী বাণিজ্যকেন্দ্রের নৃশংস নীতিবোধ-রহিত পরিচালক এই মিস্টার কুর্টজ। আরেন্ট-এর বিশ্লেষণ অনুযায়ী, মিস্টার কুর্টজরা তাদের উৎস ইউরোপিয় সমাজ থেকে উৎপাটিত হয়ে এমন এক সমাজে উৎক্ষিপ্ত হয়েছে যে সমাজের অপরতা তাদের বোধ-বুদ্ধির সীমার বাইরে এক বিপজ্জনক অজ্ঞেয় হিসেবে তাদের মুখোমুখি হয়েছে। তাদের বোধে এই অপর সমাজ সভ্যতার কোনও মূল্যবোধের উপযুক্ত নয়, তাই নিজ-স্বার্থ চরিতার্থতার জন্য কোনও মূল্যবোধের তোয়াক্কা না করে যে কোনো ধরনের হিংস্রতাই এখানে অনুমোদনীয়। ইউরোপের পঁুজিবাদী অর্থনীতি বিপুল পরিমাণ উদবৃত্ত মূল্য সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে এমন উদবৃত্ত মানুষও বিপুল পরিমাণে তৈরি করেছে যাদের সে উৎপাটিত করে উৎক্ষেপ করেছে প্রতিটি মহাদেশে। এই উৎক্ষিপ্ত জনদঙ্গলই যে কোনো প্রকারে অপর অজ্ঞেয় পরিবেশে টিকে থাকার জন্য সীমাহীন হিংসার মধ্য দিয়ে অপরকে ধ্বংস করে নিজ মানসপ্রতিমার মতো করে তাকে ঢেলে সাজিয়ে নিতে চেয়েছে। এরাই মিস্টার কুর্টজের দল। ইংরেজ রাজনীতিবিদ লর্ড ক্রোমার (১৮৪১–১৯১৭) এদের দিকে চোখ রেখেই ‘বুমেরাঙ প্রভাব’-এর আশঙ্কা করে বলেছিলেন: ‘...দূরদেশে হিংসার দ্বারা শাসন শেষ পর্যন্ত ইংল্যান্ডের শাসনব্যবস্থাকেও প্রভাবিত করবে... শেষ অধিকৃত জাতি (subject race) হবে ইংরেজরা নিজেরাই।’

মিস্টার কুর্টজদের হিংসার শাসন মানুষ সম্পর্কে ভাবনায় এক নয়া বিভাজন আমদানি করেছিল। এই বিভাজনের একদিকে ইউরোপিয় উপনিবেশ-শাসকরা, যারা সভ্যতা-সংস্কৃতির ‘প্রকৃত' রূপের ধারক হিসাবে প্রকৃত মানুষ পদবাচ্য, মানুষের অধিকারসমূহের কথা তাদের ক্ষেত্রেই খাটে। বিভাজনের অন্যদিকে অপর সমস্ত মানুষ, যারা অসভ্য, যাদের সংস্কৃতি জন্তু-জানোয়ারের সামিল, যাদেরকে তাই মানুষ পদবাচ্য বলেই ধরা অনুচিত, মানুষের অধিকার তাদের ক্ষেত্রে খাটে না। এইভাবে এক বিপুল জনগোষ্ঠীকে অব-মানুষে পরিণত করে তাদের হিংসাত্মকভাবে দমন করার, এমনকি গণহত্যা করারও যৌক্তিকতা উৎপাদনের প্রক্রিয়া মিস্টার কুর্টজদের বিশ্ববীক্ষার মধ্য দিয়ে জন্ম নিয়েছিল। আফ্রিকা, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও এশিয়া মহাদেশের যে বিপুল পরিমাণ আদিবাসী মানুষ ও তাদের সভ্যতা-সংস্কৃতি-জ্ঞান এই হিংসার মুখে বিলুপ্ত হয়েছে তা ইউরোপের জনসংখ্যা ও সভ্যতা-সংস্কৃতি-জ্ঞান থেকে সংখ্যায় ও ধারে-ভারে কয়েক গুণিতক হবে তাতে সন্দেহ নেই।

কিন্তু ক্রোমার-আশঙ্কিত বুমেরাঙ-প্রভাব কি সত্য হয়েছিল? আরেন্ট যেন এই বুমেরাঙ-প্রভাবকেই চিহ্নিত করেছেন বিশ শতকের ইউরোপে সর্বাত্মকতাবাদী শাসকদের হিংসাত্মক শাসন কায়েমের যৌক্তিকতা উৎপাদনী কৌশলে বিপুল পরিমাণ জনগোষ্ঠীকে অবমানুষে রূপান্তরিত করার প্রক্রিয়াকে চিহ্নিত করার মধ্য দিয়ে। নাৎসি জার্মানিতে ইউরোপের ইহুদি-বিদ্বেষী পরম্পরাকে ব্যবহার করে প্রথমে ইহুদি ও তার ধারাবাহিকতায় সব অনার্যদের অবমানুষে রূপান্তরিত করা হয় কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে গণহত্যার যৌক্তিকতা উৎপাদন করতে। স্তালিন জমানায় শ্রেণিশত্রু থেকে শুরু করে ক্রমশ সর্বশক্তিমান পার্টির কেন্দ্রীয় লাইনের সঙ্গে বিরোধাভাসযুক্ত যে কোনো অবস্থানে থাকা মানুষকে অবমানুষে পরিণত করে গুলাগের সন্ত্রাসী শাসনের যৌক্তিকতা উৎপাদন করা হয়েছিল। নাৎসি জার্মানিতে মনুষ্যত্ব, সভ্যতা ও অগ্রগতির একমাত্র ধারক ছিল আর্যজাতিভুক্তরা আর স্তালিনের রাশিয়ায় তা ছিল একমাত্র সর্বশক্তিমান পার্টির কেন্দ্রীয় লাইনের অনুগামীরা। ইতিহাসের বা প্রকৃতির বিবর্তনের অপরিবর্তনীয় একমুখী গতির চালক হিসেবে একাংশ মানুষকে বেশি-মানুষ করে তুলে অপরদের অবমানুষে পরিণত করার এই প্রক্রিয়া কি অবমানুষদের অবদমনের মূল্যে বেশি-মানুষদের মানবিক বিকাশের ক্ষেত্র প্রশস্ততর করে? আরেন্ট-এর বিবেচনায়, না, করে না। তা সামগ্রিকভাবেই সমস্ত মানুষের মানবিক বিকাশ ও স্ফূর্তির ক্ষেত্রকে ধ্বংস করে অবমানবিকতার এক কারাগার তৈরি করে। কীভাবে? আরেন্ট-এর সেই বিশ্লেষণের দিকে এবার চোখ ফেরানো যাক।

মানবিক ক্ষেত্রের ধ্বংস

আরেন্ট-এর মতে, মানুষের অস্তিত্বের দুটি সমন্বিত দিক আছে। একটি দিক হল পশু-প্রজাতি হিসাবে তার প্রাণ সংরক্ষণ ও পুনরুৎপাদনের জন্য জৈবিক চাহিদা পূরণ, যে দিকটিকে মার্কস-কথিত ‘প্রকৃতির সঙ্গে বিপাকক্রিয়া' (metabolism with nature) বলা যায় বলে তিনি মনে করেছেন। অন্য দিকটি হল প্রাকৃতিক বিশ্বের উপরে সর্বদা নতুন কিছু সৃষ্টি করে যোগ করার মাধ্যমে মানুষের নিজস্ব একটা জগৎ গড়ে তোলা।

প্রথম দিকটির মধ্য দিয়ে মানুষ প্রকৃতির বৃদ্ধি ও বিনাশের বৃত্তাকার চক্রের পরাভূত, তার সমস্ত শ্রম পুনরাবৃত্তিমূলক, ক্ষণস্থায়ী চাহিদা মিটিয়ে সে শ্রমের ফসল শেষ হয়ে যায়, সে শ্রম পুনঃ পুনঃ পুনরাবৃত্ত করতে হয়, ধ্বংস ও মৃত্যু অমোঘ হিসেবে তাকে আচ্ছাদন করে রাখে। কেবলমাত্র এই দিক থেকে বিচার করলে মানুষ হল animal laborans, অর্থাৎ পুনরাবৃত্তিমূলক শ্রমে বদ্ধ পশু। এই দিক থেকে প্রতিটি মানুষ মানুষ নামক পশু-প্রজাতির সমরূপীয় নিদর্শন, ব্যক্তিগত স্বাতন্ত্রের কোনও অস্তিত্ব এর মধ্যে নেই।

দ্বিতীয় দিকটির মধ্য দিয়ে মানুষ পুনরাবৃত্তিকে ভেঙে নতুন কিছু স্থাপন করতে চায়, বৃদ্ধি ও বিনাশের চক্রকে পেরিয়ে তার সৃষ্টির অমরত্ব স্থাপন করতে চায়, ধ্বংস ও মৃত্যুর অমোঘতাকে অতিক্রম করে যেতে চায়। পুনরাবৃত্তি ভাঙা এই নতুন কিছু সৃষ্টির চরিত্রই প্রতিটা মানুষকে অনন্য করে তোলে, প্রজাতিগত সমরূপীয় পরিচয়কে পেরিয়ে ব্যক্তিঅস্তিত্বের পরিসর সৃষ্টি করে, animal laborans-এর ঊর্দ্ধে মানুষকে করে তোলে homo faber। এই দ্বিতীয় দিকটির মধ্য দিয়েই মানুষ রচনা করে প্রাকৃতিক বিশ্বের উপরে তার নিজস্ব-সৃষ্ট জগৎ, নিজস্ব-সৃষ্ট পরিসর, যা মানুষের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব ক্ষেত্রকে চিহ্নিত করে, যার অবর্তমানে আছোঁয়া প্রকৃতির আচ্ছন্নকারী শক্তিনিচয় তাকে তার নিজস্ব জৈবিক চাহিদার ঘূর্ণাবর্তে খড়কুটোর মতো ঘুরিয়ে মারে।

তাই, আরেন্ট-এর মতে, মানুষ সম্পূর্ণত মানুষ হতে পারে না যদি প্রাকৃতিক বিশ্বের উপরন্তু একটি মানুষ-সৃষ্ট জগতও তার অস্তিত্বের ক্ষেত্র হিসাবে না থাকে।

এই মানুষ-সৃষ্ট জগত, যা তৈরি হয় মানুষের নতুনকে জন্ম দেওয়ার সৃষ্টিকাজের মাধ্যমে, তা মানুষের মধ্যে হাজির হয়ে মানুষে-মানুষে বৈচিত্র্য, স্বাতন্ত্র, বিভিন্নতাকে যেমন ফুটিয়ে তোলে, তেমনই তার মধ্য দিয়েই ‘এক অভিন্ন মানুষ'-পরিচয় থেকে মুক্তি পাওয়া বিভিন্ন মানুষের মধ্যে পারস্পরিকতা ও সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এইভাবেই তৈরি হয় মানুষদের মধ্যে এমন এক পরিসর যার মধ্যে ব্যক্তি-মানুষেরা বিচরণের ক্ষেত্র পায়, বিভিন্ন অবস্থান থেকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণে তাদের সাধারণ জগতকে নিরীক্ষণ করতে পারে, বাস্তবতা সম্পর্কে এমন এক যৌথ উপলব্ধিতে পৌঁছতে পারে যা এককভাবে কারও একার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই একসঙ্গে মানুষ হিসেবে বাঁচার পূর্বশর্ত হল নিজেদের মধ্যে মানুষ-সৃষ্ট এমন একটি জগৎ থাকা।

সর্বাত্মকতাবাদ এই জগতটিকে ধ্বংস করে। ইতিহাস বা প্রকৃতির গতি হিসেবে একটি অপরিবর্তনীয় নিয়মকে হাজির করার মধ্য দিয়ে সর্বাত্মকতাবাদ মানুষের সমস্ত ক্রিয়াকে সেই নিয়মের বাধ্যতামূলক অনুশীলনে পরিণত করতে চায়। নিয়মাবদ্ধ পুনরাবৃত্তিমূলক ক্রিয়ার শৃঙ্খলিত পরিসরে মানব-ক্রিয়াক্ষেত্রকে বাঁধতে চায়। স্বাতন্ত্র, বৈচিত্র্য, বিভিন্নতা— এই সমস্তকে শৃঙ্খলে বেঁধে এক অভিন্ন আদর্শ মানুষের অবয়বে সবাইকে ঠেসে পুরতে চায়। এইভাবে সে মানবঅস্তিত্বের নতুনকে-জন্ম-দেওয়া সৃষ্টিকাজের দিকটি ধ্বংস করে । নতুনকে জন্ম দেওয়া সৃষ্টিকাজের দিক ধ্বংস হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ধ্বসে পড়ে তার মধ্য দিয়ে তৈরি মানুষ-সৃষ্ট জগৎ, যা ছিল ব্যক্তি-মানুষদের মধ্যে বিচরণের পরিসর। ফলে স্বাতন্ত্র-বিভিন্নতা-বৈচিত্র্য হারানো মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ে সমরূপীয় এক পশু-প্রজাতি পরিচয়ের মধ্যে এবং আবর্তিত হতে থাকে কেবলমাত্র জৈবিক চাহিদার দাসত্ববৃত্তির প্রাকৃতিক শক্তিনিচয় নিয়ন্ত্রিত অপঘূর্ণিতে।

এইভাবে মানবিক ক্ষেত্রের ধ্বংসসাধনই হলো সর্বাত্মকতাবাদের সবচেয়ে বড় সন্ত্রাস। নাৎসি জার্মানিতে জৈবিকভাবে খাঁটি আর্যত্ব অভিমুখে অন্ধধাবন বা স্তালিনের রাশিয়ায় জড়-উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে অন্ধধাবন মানবিক ক্ষেত্রের ধ্বংসের এমনই দুটি উদাহরণ। কিন্তু হিটলার বা স্তালিনের সঙ্গে সঙ্গে তা পৃথিবী থেকে বিদায় নেয় নি। আরেন্ট-এর বিশ্লেষণ ইতিহাসের ওই দুটি নির্দিষ্ট ঘটনাকে বিচার থেকে শুরু হয়ে সর্বাত্মকতাবাদের চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করার মধ্য দিয়ে ক্রমশ এই উপলব্ধিতে এসে পেঁৗচেছে যে ইউরোপ-আমেরিকার বিশ শতকীয় আধুনিকতা সর্বাত্মকতাবাদী উপাদান ধারণ করে আছে। কীভাবে? এবার সেই দিকে দেখা যাক।

সর্বাত্মকতাবাদী আধুনিকতা

মানুষের চাহিদার ক্রমপ্রসারণ, আধুনিক প্রযুক্তির নিত্য অভিনবত্ব, পঁুজিবাদী উৎপাদনব্যবস্থার নিত্য প্রসারমানতা— এই সমস্তর মধ্য দিয়ে ইউরোপ-আমেরিকার বিশ-শতকীয় আধুনিকতা প্রাকৃতিক বিশ্বের ঊর্দ্ধে নিত্য নবীকৃত এক মানুষ-সৃষ্ট জগৎ গড়ে চলেছে না কি? ভোগ ও উৎপাদনের এই ক্রমপ্রসারমান জগৎ কি মানুষের স্বাধীনতার দিগন্তকে ক্রমপ্রসারিত করছে না? এই দুটি প্রশ্নেই আরেন্ট-এর উত্তর দুটি দৃঢ় ‘না!'। কেন আরেন্ট-এর এই উত্তর তা বোঝার চেষ্টা করা যাক।

 পঁুজিবাদী উৎপাদন-বন্টন একদিকে যেমন উৎপাদককে ব্যক্তিত্ব-রহিত প্রমিতিকৃত শ্রমশক্তির ধারক-এ পরিণত করে, অন্যদিকে তেমনই তার চাহিদাকে জৈবিক জড় চাহিদার মতো অন্তহীন পুনরাবৃত্তিমূলক করে তোলে। মানুষের চাহিদা ও ভোগের যে বিপুল প্রসারণ ঘটে, তা প্রাকৃতিক জৈবিক চাহিদার ছদ্ম-প্রসারণ হিসাবে এমন এক ছদ্ম-প্রাকৃতিক জগৎ তৈরি করে যা নিয়মাবদ্ধ পুনরাবৃত্তিমূলক ক্রিয়ার শৃঙ্খলিত পরিসরকে ক্রম-প্রসারিত করে অস্তিত্বের সবটুকু গ্রাস করতে চায়। এই প্রমিতিবদ্ধ চাহিদা, ভোগ ও তাদের থেকে উৎসারিত নিয়মাবদ্ধ পুনরাবৃত্তিমূলক ক্রিয়ার বাইরে যে কোনও বিভিন্নতা, বিরোধ, নতুনত্ব বা সৃষ্টিশীলতাকে সে সন্দেহের চোখে দেখে বিকৃতি, বেনিয়ম বা রোগ হিসাবে এবং শুদ্ধিকরণ বা নিরাময় প্রক্রিয়ার নামে সেগুলোকে দমন করে প্রমিতির শাসন আরোপ করতে চায়। এর ফলে মানব-অস্তিত্ব-এর যে অংশ নতুন কিছু হাজির করে বিভিন্নতা ও বৈচিত্র্যের মানবিক ক্ষেত্র গঠন করে, সেই অংশ ক্রমশ ক্ষয়প্রাপ্ত হয়, নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে থাকে। সমস্ত রঙ শুষে নিয়ে বিবর্ণ করে তোলা এই জগতে ছদ্ম-রামধনু হিসেবে দিগন্ত-প্রসারিত হয়ে থাকে প্রযুক্তির জাদুশক্তির মায়া। খর্বিত, প্রমিতিবদ্ধ, নিয়ম-শৃঙ্খলিত মানুষের মধ্যে সর্বশক্তিমান হয়ে ওঠার মায়া তৈরি করে প্রযুক্তি— যেনবা প্রযুক্তির নিত্য-নবীকৃত আয়ুধ হাতে মানুষ প্রকৃতির দ্বারা আরোপিত সীমাবদ্ধতাকে জয় করে অসীমে পাড়ি দিচ্ছে। এই মায়াই রূপান্তরিত হয় সেই মতবাদে যা অনন্ত অতীত থেকে অনন্ত ভবিষ্যৎ অবধি মানুষের ইতিহাসকে একটি একমুখী সরলরৈখিক বৃদ্ধি ও বিকাশের নিয়মবদ্ধ কুচকাওয়াজ হিসেবে হাজির করে বৃত্তায়িত পুনরাবর্তনমূলক অস্তিত্বে বন্দী মানুষকে অপ্রতিরোধ্য প্রগতির সওয়ারি হওয়ার ভ্রমে আচ্ছন্ন করে রাখে। নিত্য-নবীকৃত প্রযুক্তির প্রয়োগে জড়-উৎপাদন ও ভোগ অনবরত বাড়িয়ে যাওয়ার মাধ্যমে প্রগতিপরায়নতার ভাবনা এইভাবেই মতবাদ হিসাবে গেঁড়ে বসে। এই মতবাদিক আচ্ছন্নতা যে কেবলমাত্র সৃষ্টিশীলতা, বিভিন্নতা ও বৈচিত্রের মানবিক ক্ষেত্রের ধ্বংসকে আড়াল করে রাখে, তা নয়, প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের বিপাকক্রিয়াকেও সমাধানহীন সমস্যার মুখোমুখি এনে ফেলে: জড়-উৎপাদন ও ভোগের অনবরত প্রসারিত হতে থাকা আবর্তন মানুষের অস্তিত্বের প্রাগশর্ত প্রকৃতি-পরিবেশগত বাস্তুতন্ত্রকেই ধ্বংস করতে থাকে। পারমাণবিক শক্তি উৎপাদন, বিপুল পরিমাণ কৃত্রিম সাংশ্লেষিত (synthetic) বস্তুর উৎপাদন ও দূষণকারী বর্জ্য হিসাবে পুঞ্জীভবন, কার্বন-নির্গমন, ইত্যাদির মধ্য দিয়ে প্রকৃতি-পরিবেশে যে সমস্ত ধ্বংস-রূপান্তরের ধারা বেগবান হয়ে উঠেছে, তা যেমন মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে, তেমনই সরলরৈখিক প্রগতির অতিকথার জমকের আড়ালে ধ্বংসের দিকে উন্মাদযাত্রার আশঙ্কাও তৈরি করেছে। গত শতাব্দী জুড়ে এই লক্ষণগুলো ক্রমশ স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে ওঠা সত্ত্বেও প্রযুক্তিচালিত জড়-উৎপাদন ও ভোগের অনবরত বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে প্রগতি-মতবাদে আচ্ছন্নতার ঘোর কাটার কোনও লক্ষণ নেই। কেন নেই? বাস্তবতা তীব্র হয়ে উঠেও মানব-সচেতনতায় যথেষ্ট প্রতীয়মান হয়ে উঠছে না কেন? তার কারণ নিহিত আছে মানবিক ক্ষেত্রের ধ্বংসের মধ্যে।

আরেন্ট-এর মতে, মানুষের সচেতনতায় বাস্তবতা প্রতীয়মান হয়ে উঠতে পারে কেবলমাত্র মানুষদের মধ্যেকার মানবিক ক্ষেত্রে মুক্তমনা, সক্রিয় ও সৃষ্টিশীল অংশগ্রহণ-প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। মানবিক ক্ষেত্রটিও মানুষদের মধ্যেকার পরিসরে গড়ে ওঠে প্রতিটি মানুষের নতুনকে সর্বসমক্ষে হাজির করার তাগিদে করা সৃষ্টিশীল কাজের মধ্য দিয়ে, সমস্ত বিবিধ বিভিন্ন নতুনকে ধারণ করার মধ্য দিয়ে। নতুনের আবির্ভাবের জন্য নিজেকে সদা উন্মুক্ত রেখে,  হাজির হওয়া নতুনের মধ্য দিয়ে বিবিধ দৃষ্টিভঙ্গির বিভিন্নতা- বৈচিত্র্য-বিশিষ্টতা অনুভব করে ও নিজের দৃষ্টিকোণ-অবস্থানকে তার আপেক্ষিকতায় অবস্থিত করে যখন কেউ আন্তর্মানুষ পরিসরে সহজ ও স্বাভাবিক হয়ে উঠতে পারে, তখনই কেবল সে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ-অবস্থান-জাত বহুমাত্রিকতায় বস্তুকে দেখতে পায়; এককভাবে, বা বিভিন্নতা-বৈচিত্র্য অস্বীকারকারী মতবাদের অদ্বৈত দৃষ্টিকোণ থেকে মানুষ কেবল সেই বস্তুর একমাত্রিক এক ছায়াকেই দেখে। বস্তুকে বহুমাত্রিকতায় দেখার মধ্য দিয়েই বাস্তবতা প্রতীয়মান হয়। ফলে মতবাদিক দৃষ্টিভঙ্গির একমাত্রিক দৃষ্টিতে বাস্তবতা প্রতীয়মান হয় না, মতবাদে আচ্ছন্ন মানুষ বাস্তবতা থেকে বিযুক্ত হয়ে এক মতবাদিক প্রহেলিকার মাত্রারিক্ত জগতে বাস করে।

নাৎসি জার্মানি বা স্তালিনের রাশিয়ায় মতবাদের সন্ত্রাসে মানবিক ক্ষেত্র ধ্বংস করে বাস্তব থেকে মানুষকে বিযুক্ত করা হয়েছিল। আজও প্রযুক্তি-চালিত জড়-উৎপাদন ও ভোগের অনবরত বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে প্রগতির যে মতবাদ, তার একাধিপত্ব মানুষদের মধ্যে মানবিক ক্ষেত্র ধ্বংস করে দিয়েছে। এই মতবাদ তার নিজ দৃষ্টিকোণের থেকে পৃথক, বিপরীত বা ভিন্ন মানব-সমাজ সংগঠনের নানা অভিজ্ঞতা ও চর্চাকে নাকচ করার এক অভূতপূর্ব কৌশল কায়েম করেছে: অপর সবকিছুকেই তা প্রগতিযাত্রার ঐতিহাসিক পথে অতিক্রান্ত পূর্বমুহূর্ত হিসেবে প্রতিপন্ন করে তার নিজের দ্বারা প্রতিস্থাপিত হওয়ার ঐতিহাসিক অনিবার্যতাকে হাজির করেছে। ফলে, একদিকে যেমন অপর সবকিছুর উপর ধ্বংসাত্মক আগ্রাসন চালানোর অজুহাত পাকা হয়েছে, অন্যদিকে তেমন সেই মানবিক ক্ষেত্রটিও ধ্বংস হয়েছে যেখানে পঁুজিবাদী পুঞ্জীভবনের থেকে ভিন্ন, বিপরীত বা পৃথক সামাজিক-রাজনৈতিক সংগঠন প্রক্রিয়াদির মধ্যে জ্ঞানপূর্ণ যাতায়াতের মধ্য দিয়ে বাস্তবতা প্রতীয়মান হয়ে উঠতে পারে, পুনরাবৃত্তির ঘোর ভেঙে নতুন কিছু হাজির হতে পারে।

মতবাদিক ঘোরের এই বিজনপ্রদেশে চরম একাকিত্বই হয় মানব-অস্তিত্বের সাধারণ অবস্থা। দেখা যাক আরেন্ট কীভাবে এই একাকিত্বের বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন।

একাকীত্ব না বহুত্ব

আরেন্ট-এর অনুধাবনে নির্জনতা (solitude) ও একাকীত্ব (loneliness) এক নয়, একেবারেই আলাদা। আরেন্ট-এর করা এই পৃথগীকরণকে বোঝার চেষ্টা করা যাক।

 চিন্তা করা হল মানুষের নিজের সঙ্গে নিজের অন্তর্গত কথোপকথন। সে কথোপকথন সাঙ্গ হয় বারোয়ারি জগৎ (public realm) থেকে একটা দূরত্বে, কিন্তু বারোয়ারি জগৎ থেকে বিচ্ছিন্নতায় নয়। মানুষদের মধ্যেকার যে মানবিক ক্ষেত্র বিভিন্ন মানুষের হাজির করা বিভিন্নতা, বৈচিত্র্য, বিশিষ্টতা-র সমন্বয়ে পারস্পরিকতার প্রসার গড়ে তোলে, সেই বারোয়ারি জগতে অংশগ্রহণ থেকেই উৎসারিত হয় মানুষের নিজের অন্তর্গত কথোপকথন। নিজের সঙ্গে নিজের এই অন্তর্গত কথোপকথন চালাতে গেলে বারোয়ারি জগৎ থেকে সাময়িক বিযুক্তি দরকার হয়, কিন্তু এই সাময়িক বিযুক্তিতে সংঘটিত চিন্তার নতুন সৃষ্টিকর্মটি সম্পূর্ণ হয় তাকে আবার সেই বারোয়ারি জগতের মধ্যে অপরের অনুধাবনের জন্য হাজির করার মধ্য দিয়েই। সব সৃষ্টিশীল কাজের জন্যই প্রয়োজন বারোয়ারি জগৎ থেকে বিচ্ছিন্নতা না ঘটিয়েই বারোয়ারি জগৎ থেকে সাময়িক বিযুক্তি। এই বিযুক্তিকে আরেন্ট বলেছেন নির্জনতা। মানুষদের মধ্যেকার মানবিক ক্ষেত্রে মানুষের অংশগ্রহণ-প্রক্রিয়ারই অংশ এটি। বারোয়ারি জগতে বিভিন্ন বিচিত্র বহুর বিন্যাসের মধ্য দিয়ে যে যাত্রা মানুষের কাছে বাস্তবতাকে ফুটিয়ে তোলে, সেই যাত্রার অংশ এই নির্জনতা।

অন্যদিকে, একাকীত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় মানুষদের মধ্যে মানবিক ক্ষেত্র, বারোয়ারি জগতের ধ্বংস বা শুকিয়ে যাওয়ার উপর দাঁড়িয়ে। এক দ্বিমাত্রিক বিচ্ছিন্নতায় মানুষের আচ্ছন্ন হওয়ার মধ্য দিয়ে মানুষদের মধ্যেকার মানবিক ক্ষেত্র বা বারোয়ারি জগৎ ধ্বংস হয় বা শুকিয়ে যায় । এই দ্বিমাত্রিক বিচ্ছিন্নতার একটি মাত্রা হলো প্রাকৃতিক জৈবিক চাহিদার ছদ্ম-প্রসারণে নির্মিত ছদ্ম-প্রকৃতিতে বন্দী হয়ে মানুষদের মধ্যে মানবিক ক্ষেত্র গঠনকারী বারোয়ারী গঠনকাজ থেকে বিচ্ছিন্নতা, আর দ্বিতীয় মাত্রাটি হলো মানুষদের মধ্যে পারস্পরিকতার ক্ষেত্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ‘পড়শিহীন স্ব'-এর মধ্যে বন্দীত্ব। এই দ্বিমাত্রিক বিচ্ছিন্নতার অভিঘাতে অস্তিত্বের পতিত অবস্থায় মানুষ জৈবিক চাহিদা নিবৃত্তিকারী পুনরাবৃত্তিমূলক শ্রম ছাড়া অন্য কোনও কাজের সক্ষমতা হারায়। অনুকরণ, অনুসরণের মধ্য দিয়ে পুনরাবৃত্তিমূলক বৃত্তিই তার অস্তিত্বের সমগ্র হয়ে দাঁড়ায়। নতুনকে জন্ম দিতে অপারগ সৃষ্টিশীলতার শূন্যতায় ভাসমান এই অস্তিত্ব তখন অতিমানবিক কোনও প্রাকৃতিক/ঐতিহাসিক নিয়মের অপরিবর্তনীয় যুক্তিশৃঙ্খলার অবলম্বন খোঁজে। সেই অপরিবর্তনীয় প্রাকৃতিক/ঐতিহাসিক নিয়মের যুক্তিশৃঙ্খলার অনুসরণকারী/বলবৎকারী হিসেবে এক ছদ্মশক্তির অনুভব তাদের অক্ষমতার বোধকে ঢেকে দেয়। প্রাকৃতিক/ঐতিহাসিক নিয়ম নির্ভর এই ছদ্মশক্তির জোরে তারা সমস্ত মানবিক ক্ষেত্রের ঊর্ধ্বে, প্রাকৃতিক-বাস্তুতান্ত্রিক বা পারস্পরিক প্রসারে মানবসৃষ্ট সমস্ত সীমার ঊর্ধ্বে নিজেদের সর্বশক্তিমান বলে গণ্য করতে শুরু করে। তাদের যুক্তিশৃঙ্খলাকে বলবৎ করতে যেনবা যে কোনও কিছুই করা সম্ভব, যে কোনও উপােয়ই করা সম্ভব। একমেবাদ্বিতীয়ম প্রাকৃতিক/ঐতিহাসিক নিয়মের অশ্বমেধযাত্রার সৈনিক এই যুক্তিশৃঙ্খল-পূজারীরা তাদের নির্ধারণসীমার বাইরে অপর বা ভিন্ন সমস্ত কিছুকেই মনে করে অস্তিত্বের অনধিকারী, যার উপর আধিপত্য কায়েম করা বা মুছে দেওয়াই হল প্রকৃতি/ইতিহাস-নির্ধারিত কর্তব্য। সমস্ত বৈচিত্র্যকে ধ্বংস করে, বহুত্বকে ধ্বংস করে সমরূপতার বিজনপ্রদেশ নির্মাণ— এই পথে সে তার অস্তিত্বের একাকীত্বের আদলে মানববিশ্বকে নির্মাণ (বা ধ্বংস) করতে চায়।

সর্বাত্মকতাবাদী মতবাদ এই একাকীত্বে মানুষকে নিক্ষেপ করে এবং তাকে মতবাদ-নির্দেশিত সমরূপতায় প্রকৃতি ও ইতিহাসকে ভেঙে গড়ার কারিগরে পরিণত করে । প্রকৃতি/ইতিহাসের ঊর্ধ্বে স্থিত প্রকৃতি/ইতিহাসের নির্মাতার সর্বশক্তিমান ভূমিকার গরিমা-আরক তাকে অবশ-আচ্ছন্ন করে রাখে।

প্রকৃতি/ইতিহাসের মাথায় চড়ে বসা এই সর্বাত্মকতাবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ বা বিকল্প-নির্মাণের কি কোনো উপায় আছে? এই উপায় নিয়ে ভাবতে গিয়েই আরেন্ট জোর দিয়েছেন মানুষদের (বহু, বিভিন্ন, বিচিত্র মানুষদের; কোনও এক মতবাদ-সংজ্ঞায়িত সমরূপীয় ধাঁচার মানুষের নয়) অভিজ্ঞতার বহুত্বের উপর ভর করা, সেই বহুত্বের স্বাধীন স্বপ্রকাশ ও স্ববিকাশের দ্বারা পুষ্ট মানুষদের মুক্ত পারস্পরিক ক্রিয়ার উপর; অর্থাৎ বহুত্বের রাজনীতির উপর।

বহুত্বের রাজনীতি

মানবক্রিয়াকে বিশ্লেষণ করে আরেন্ট তিনভাগে ভাগ করেছেন। ভাগগুলি হল— জৈবিক-প্রাকৃতিক চাহিদা নিরসনের লক্ষ্যে পুনরাবৃত্তিমূলক কাজ (labour), পূর্বনির্ধারিত অপরিবর্তনীয় লক্ষ্যকে পাখির চোখ করে একমুখী কাজ (work), আর, বারোয়ারি জগতের পারস্পরিকতা সঞ্জাত স্বতক্রিয়া (action)। জগৎ যেহেতু বহু, বিভিন্ন, বিচিত্র মানুষদের নিয়ে গঠিত; কোনও মতবাদ-সংজ্ঞায়িত সমরূপীয় ধাঁচার মানুষ নিয়ে গঠিত নয়; মানুষদের মধ্যের পারস্পরিকতার প্রসার হিসেবে বিন্যস্ত বারোয়ারি ক্ষেত্রে তাই সবসময় অভাবনীয় নতুন কিছুর মুখোমুখি হওয়া ও তার প্রতিক্রিয়ায় নিজে অভাবিত নতুন কিছু করা মুক্ত মানুষের স্বাভাবিক অভিজ্ঞতা হওয়ার কথা। বৈচিত্র্য, বিভিন্নতা, বহুত্ব-এর প্রতিটির সমান মর্যাদায় সহাবস্থান ও স্বাধীন বিকাশকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে একে অপরের মধ্যে অবারিত যাতায়াত ও মুক্ত ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নতুনের হাজির হওয়ার পথ উন্মুক্ত রাখা— এমন স্বতক্রিয়া (action)-কেই আরেন্ট রাজনীতির ভিত্তি করতে চেয়েছেন।

মতবাদিক আচ্ছন্নতা কাটিয়ে প্রকৃতি-শাসন বা ইতিহাস-নির্মাণের মোহ থেকে মুক্ত হলে তবেই এই মুক্ত স্বতক্রিয়া সম্ভব। আরেন্ট-এর ভাবনায়, ইতিহাসের কেবল গল্পই বলা যায়, ইতিহাসের গতিধারা চিহ্নিত করে ভবিষ্যৎ বলা যায় না। যে ঘটনা ঘটে গেছে, বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে তার যতটা যেভাবে দেখা যায়, সেই অনুযায়ী ইতিহাসের বিভিন্ন আখ্যান তৈরি হয়, যা গল্প-বলার সমতুল্য। প্রতি মুহূর্তেই মানুষের অপ্রত্যাশিত নতুন কিছু করার ক্ষমতার জন্য ইতিহাসও প্রতি মুহূর্তে নতুন বাঁক নেওয়ার সম্ভাবনা নিয়েই থাকে, মতবাদিক রেল-লাইন ধরে সে চলে না। তাই ইতিহাসের গতিধারা ও গন্তব্যের সম্পর্কে শেষ কথাটি জেনে নিয়ে ইতিহাস-নির্মাতা হওয়া মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। একইভাবে প্রকৃতির উপর প্রভুত্বস্থাপন করে মানুষের প্রয়োজন অনুযায়ী যে কোনওভাবে প্রকৃতি-পরিবেশকে পরিবর্তন করে নেওয়াও সম্ভব নয়। মতবাদিক মত্ততা সঞ্জাত ‘মানুষের পক্ষে সবকিছু সম্ভব'-বোধের ঘোর কাটিয়ে উঠে উপলব্ধি করা দরকার যে প্রকৃতির সঙ্গে বিপাকক্রিয়ায় মানুষদের অবস্থান কিছু প্রাকৃতিক-বাস্তুতান্ত্রিক সীমা দ্বারা চিহ্নিত, মানুষের সৃষ্টিকাজ সেই সীমার মধ্যেই চলতে পারে, সীমালঙ্ঘন করা যে কোনো সৃষ্টিপ্রচেষ্টা দ্বায়িত্বহীন ধ্বংসকান্ডে রূপান্তরিত হয়। প্রকৃতি/ইতিহাসের নিয়ম অনুযায়ী প্রগতির একমাত্র পথের দিশারী হওয়ার মতবাদিক আত্মশ্লাঘা থেকে নিরাময় পেলে বহুত্ব বা অপরতাকে যে কোনও মূল্যে ধ্বংস করে সমরূপতা প্রতিষ্ঠা করার পাগলা-জগাই-পনা থেকেও নিরাময় মেলে বোধ হয়। বহুত্ব, বৈচিত্র্য, বিভিন্নতাকে মানুষদের মধ্যের বারোয়ারি ক্ষেত্রের আবশ্যিক উপাদান হিসাবে বুঝে নিয়ে মানুষদের মধ্যের পারস্পরিকতার প্রসারে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ ও অবস্থানের মধ্যে যাতায়াতের মাধ্যমে বাস্তবতাকে উপলব্ধি করা ও নতুন কোনও সূচনার জন্য স্বতক্রিয়া করা— এভাবে মতবাদ-নির্মীত একাকীত্বের বিজনপ্রদেশের বাইরে নতুন মানব-যৌথতা ও পারস্পরিকতার দেশ নির্মাণের রাজনীতি সূচিত করা যায় বলে আরেন্ট ভেবেছিলেন। এই স্বতক্রিয়ার মধ্য দিয়েই গড়ে তোলা সম্ভব এমন রাজনৈতিক কাঠামো যা মানুষদের বিভিন্নতা ও বৈচিত্র্যকে ধারণ করে প্রতিটি মানুষের অধিকারকে সমানভাবে স্বীকৃতি দিতে পারে। প্রতিটি মানুষের সমানাধিকারের ভিত্তিতে রাজনৈতিক কাঠামো তৈরির লক্ষ্য অবশ্য মানুষের রাজনৈতিক ইতিহাসে বহু পুরানো একটি বিষয়। তাই এই বিষয়ে আরেন্ট-এর বক্তব্যের মধ্যে স্বাতন্ত্র কিছু আছে কি না বিচার করা যাক।

প্রতিটি মানুষের সমানাধিকার লক্ষ্য ও নীতি হিসেবে ঘোষিত হয়েও মানবেতিহাসে রাজনৈতিক সংগঠনে তা বারবার লঙ্ঘিত হয়েছে, সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্য নিয়ে সূচিত রাজনৈতিক ব্যবস্থা এক অংশের চরম আধিপত্য ও অন্য অংশের চরম অধিকারহীনতার মধ্যে গিয়ে শেষ হয়েছে বারবার। সমানাধিকার প্রতিষ্ঠায় বারবার কেন এই ব্যর্থতা? ঈশ্বরের সন্তান হিসেবে সব মানুষ সমান— কখনও এই ধর্মীয় স্বতঃসিদ্ধের মাধ্যমে মানুষদের সমানাধিকারকে অলঙ্ঘনীয় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা হয়েছে, কখনও বা ধর্মীয় স্বর থেকে মুক্ত করে সমানাধিকারকে একটি প্রাকৃতিক স্বতঃসিদ্ধ রূপে অলঙ্ঘনীয় করে তুলতে চাওয়া হয়েছে। কিন্তু কোনওভাবেই সমানাধিকার অলঙ্ঘনীয় করে তোলা যায় নি। আরেন্ট-এর বক্তব্য এই যে কোনও ধর্মীয় বা প্রাকৃতিক অলঙ্ঘনীয় সত্য হিসেবে মানুষদের অধিকারকে এবং সমানাধিকারকে কোনও রাজনৈতিক কাঠামোয় স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠা করা যায় না। মানুষদের মধ্যের বারোয়ারি জগতে পারস্পরিক বোঝাপড়ার সম্পর্কের মধ্য দিয়ে মানুষরা একে অপরকে অধিকার দেয় এবং সমানাধিকার তখনই প্রতিষ্ঠিত হতে পারে যখন মানুষদের মধ্যের সমস্ত ভিন্নতা, বৈচিত্র্য, স্বাতন্ত্র্য সমগুরুত্বের বলে গৃহীত হয়, অর্থাৎ বহুত্বকে স্বাভাবিক বলে ধরা হয়। বারোয়ারি জগতের এই পারস্পরিক বোঝাপড়া এমন নয় যে তা একবার সম্পন্ন হলে অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থায়ী চেহারা নিয়ে নেয়, বরং এই বোঝাপড়া ক্ষণিক ও ভঙ্গুর। বারোয়ারি ক্ষেত্রে অনবরত অপ্রত্যাশিত নতুনের মুখোমুখি হতে হতে প্রতিনিয়ত নতুন করে এই বোঝাপড়াকে নবীকৃত করতে করতে যেতে না পারলে, এ বোঝাপড়া ভেঙে পড়বেই এবং মানুষদের অধিকার ও সমানাধিকার লঙ্ঘিত হবে। ফলে, কোনও রাজনৈতিক মতবাদের সাহায্যে মানুষদের অধিকার ও সমানাধিকারকে প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে তা ভেঙে পড়তে বাধ্য, মানুষদের অধিকারের ও সমানাধিকারের অধিষ্ঠান বারোয়ারি জগতে মানুষদের এমন এক বিশেষ ধরনের রাজনৈতিক সক্রিয়তার মধ্য দিয়ে প্রতিনিয়ত পুনঃনবীকৃত হতে হতে চলে যা বহুত্বকে স্বাভাবিক ও শ্রেয় হিসাবে গণ্য করে অপরাপরের মধ্যে বোঝাপড়া গড়ে তোলে। এখানেই আরেন্ট-এর স্বাতন্ত্র্য— কোনও মতবাদের শক্তি দিয়ে মানুষদের অধিকার ও সমানাধিকারকে তিনি স্বতঃসিদ্ধ রূপে প্রতিষ্ঠিত করতে চান নি, নিয়ত পরিবর্তমান বহুত্বের রাজনীতির চর্চার উপজাত একটি গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু ভঙ্গুর সম্পর্ক হিসেবে তাদের দেখেছেন।

আরেন্ট তঁার কাঙ্খিত বহুত্বের রাজনীতির চর্চার জন্য কোনও নির্দেশাবলী বা ইস্তাহার তৈরি করেন নি, হয়তো করতে চানও নি, কারণ নতুন মানুষদের অপ্রত্যাশিত নতুন কিছু ভাবা ও করার শক্তিকে তিনি যে রাজনীতির জীবনীশক্তি রূপে ভেবেছেন, সে রাজনীতির বোধহয় কোনও নির্দেশাবলী বা ইস্তাহার সম্ভবও নয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও আরেন্ট বহুত্বের রাজনীতির চর্চা প্রসঙ্গে দুটো বিষয়কে নির্ধারক গুরুত্ব দিয়ে হাজির করেছেন। সেই দুটি বিষয় হলো ক্ষমা ও অঙ্গীকার— অতীতকে ক্ষমা করে দিয়ে আবার নতুন সূচনা ঘটানোর নমনীয়তা এবং ভবিষ্যতের জন্য অঙ্গীকার করে তা রক্ষা করার দৃঢ়তা। ক্ষমা ও অঙ্গীকার— এই দুটি বিষয়কে আরেন্ট কী অর্থ ও তাৎপর্য নিয়ে ব্যবহার করেছেন তা নিয়ে বিশদ আলোচনা পরবর্তী অংশের জন্য স্থগিত রেখে মূল কিছু বিষয় আমরা এখানে বুঝে নিতে পারি। ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, হিংসা-প্রতিহিংসা যে অন্তহীন আবর্তে মানবক্রিয়াকে বদ্ধ করে ফেলতে পারে; সে বদ্ধতা মানুষদের মধ্যে অপরাপরের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ আচরণ চক্রাকারে বাড়িয়ে নিয়ে গিয়ে অপরকে ধ্বংস করার অন্ধ তাড়নায় মানুষকে বন্দী করে ফেলতে পারে; এই অন্ধচক্র থেকে বেরিয়ে এসে নতুন সূচনা হতে পারে ক্ষমার মধ্য দিয়ে। ক্ষমার জন্য প্রয়োজন পারস্পরিক সম্মানবোধ, ভিন্ন বা অপরদের মধ্যে এমন এক ধরনের ঘনিষ্ঠতা বা বন্ধুতা যা স্বীকার করে যে এই সমস্ত ভিন্ন বা অপর একসঙ্গে একটি বারোয়ারি জগতের স্রষ্টা ও ভাগিদার। এই পারস্পরিক সম্মানবোধের উপর দাঁড়িয়েই ভবিষ্যতের জন্য একে অপরের কাছে অঙ্গীকার করা যায় এবং সেই অঙ্গীকার রক্ষার যৌথ উপায় স্বরূপ রাজনৈতিক কাঠামো গড়ে তোলা যায়। খেয়াল করা যেতে পারে যে আরেন্ট ক্ষমা ও অঙ্গীকাররক্ষাকে ব্যক্তিমানুষের চারিত্রিক গুণ রূপে বিবেচনা করছেন না, ক্ষমা ও অঙ্গীকার মানুষদের মধ্যের বারোয়ারি ক্ষেত্রে তাদের রাজনৈতিক সক্রিয়তার একটি ধরন হিসেবেই বিবেচিত হচ্ছে; আরেন্ট মানুষের মন-মানসিকতার কোনও সংস্কারের কথা এখানে ভাবছেন না, তিনি বারোয়ারি ক্ষেত্রে এক বিশেষ ধরনের রাজনৈতিক সক্রিয়তার কথা বলছেন। ক্ষমা, পারস্পরিক সম্মানবোধ ও পারস্পরিক অঙ্গীকারগঠনের মধ্য দিয়ে মানুষরা সেই রাজনৈতিক কাঠামো গড়ে তুলতে পারে যা সর্বাত্মকতাবাদের বিরুদ্ধে তাদের আশ্রয় দিতে পারে, সর্বাত্মকতাবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে।

পারস্পরিক সম্মানবোধের বদলে অপরের প্রতি বিদ্বেষ যেমন সর্বাত্মকতাবাদী সন্ত্রাসের জন্ম দেয়, তেমন অপরের প্রতি অনুকম্পা-তাড়িত অপরের মঙ্গল করার চেষ্টাও সর্বাত্মকতাবাদী সন্ত্রাসের জন্ম দিতে পারে। দ্বিতীয় বিষয়টি হয়ত সাধারণ ধারণার বিরোধী বলে ঠেকতে পারে, তাই তা কিছুটা ব্যাখ্যা করা যাক। অপরের অধিকারহীনতা বা দুর্গতি দেখে অনুকম্পা-তাড়িত হয়ে তাদের হয়ে অধিকার আদায় করে দেওয়া, তাদের উপর অত্যাচারীদের দমন করে তাদের অত্যাচারমুক্ত করা সেই অনুকম্পার পাত্র অপরদের রাজনৈতিক সক্রিয়তায় অপারগ বলে হীনতার চোখে দেখে ও রাজনৈতিকভাবে নিষ্ক্রিয় করে রাখে। আবারও, এই অন্যায়কে ন্যায় করার অনুকম্পা-জাত উদ্দেশ্যকে মহত্ত্বের আসনে বসিয়ে সেই উদ্দেশ্যসাধনে যে কোনও পন্থা নেওয়া ন্যায়সঙ্গত বলে মনে করে। ফলে কোনওরকম সন্ত্রাস লাগু করতেই তার আর বাধা থাকে না। আরেন্ট তাই যে কোনও আবেগ-তাড়িত রাজনীতিকেই সন্দেহের চোখে দেখেছেন। অপরাপরের পারস্পরিক সম্মানবোধ ও সমতার উপর দাঁড়িয়ে বারোয়ারি ক্ষেত্রে সম-অংশগ্রহণ ও সক্রিয়তার রাজনীতিকেই তিনি কাম্য মনে করেছেন।

রাজনৈতিক কাঠামোর একটি আবশ্যিক উপাদান হলো বিধি (law)। সাধারণত বিধিকে দেখা হয় উচ্চতর কোনও আধিকারিকের প্রদত্ত নির্দেশ হিসাবে এবং এই বিধির মান্যতা নিশ্চিত করার জন্যও উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন প্রতিষ্ঠানের সংগঠনও আবশ্যক মনে করা হয়। অর্থাৎ মানুষদের মধ্যের বারোয়ারি ক্ষেত্রের সম্প্রসারণ হলেও বিধি-নির্মাতা ও বিধিপ্রয়োগ-নিশ্চয়তাকারীকে এই বারোয়ারি ক্ষেত্রের ঊর্ধ্বে একটি উচ্চতর ক্ষমতার আধার হিসাবে দেখা হয় এবং এর মধ্য দিয়ে কেন্দ্রীভূত চরিত্রের রাজনৈতিক কাঠামো উদ্ভূত হয়। আরেন্ট-এর বিধি সম্পর্কিত ভাবনা এই গতানুগতিক পথের বাইরে নতুন সূচনার দিকে যেতে চেয়েছে। বিধি নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে আরেন্ট ‘law’ শব্দটির ব্যুৎপত্তির দিকে নির্দেশ করেছেন। তিনি বলেছেন যে ‘law’ শব্দটি রোমান শব্দ ‘lex’-এর সঙ্গে ব্যুৎপত্তি-সূত্রে যুক্ত। রোমান শব্দটির অর্থ ‘যোগাযোগ’ বা ‘সম্পর্ক’ এবং মন্তেস্কুও শব্দটিকে এই রোমান অর্থের ভিত্তিকেই ব্যবহার করেছিলেন যখন তিনি বিধি-কে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন ‘সহানুভূতিশীল বা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক’ (rapport) হিসেবে। সহানুভূতিশীল বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক একটি কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার উচ্চাবচ রাজনৈতিক কাঠামোর ক্ষমতাসম্পন্ন উচ্চ আধিকারিক ও ক্ষমতারিক্ত সাধারণের মধ্যে হতে পারে না, তা হতে পারে বিকেন্দ্রীভূত আনুভূমিক রাজনৈতিক কাঠামোয় একই তলে দাঁড়ানো মানুষদের মধ্যে। তাই আরেন্ট-এর মতে, বিধি উৎপন্ন হতে পারে সেই সমস্ত মানুষদের পারস্পরিক বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে, যারা পারস্পরিক সম্মানবোধ ও সমতার উপর দাঁড়িয়ে বারোয়ারি ক্ষেত্রে সম-অংশগ্রহণ ও সক্রিয়তার রাজনীতির অংশীদার। সর্বাত্মকতাবাদী মতবাদ বারোয়ারি অংশগ্রহণের ক্ষেত্রকে ধ্বংস করে রাজনৈতিক কাঠামোকে ক্ষমতার চূড়ান্ত কেন্দ্রীভূত রূপে নিয়ে যায়, বহুত্বের রাজনীতির মাধ্যমে বিকেন্দ্রীভূত অংশগ্রহণমূলক রাজনৈতিক কাঠামো গড়ে মানুষদের মধ্যের বারোয়ারি ক্ষেত্রকে রক্ষা ও পুষ্ট করাই তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ হয়ে উঠতে পারে।

এই বারোয়ারি ক্ষেত্রে মানুষের মুক্তক্রিয়ার পরিবেশ গঠন ও রক্ষায় ক্ষমা ও অঙ্গীকারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা বিষয়ে আরেন্ট-এর বক্তব্যকে এবার কিছুটা বিশদে দেখা যাক।

ক্ষমা ও অঙ্গীকার

(ক্ষমা ও অঙ্গীকার—) এই দুই বৃত্তি পরস্পর-সংসৃষ্ট, যে পরিমাণে তাদের মধ্যে একটি, ক্ষমা, অতীতের যে সমস্ত কাজের ‘পাপ’ ডেমোক্লেজ-এর তরোয়ালের মতো নতুন প্রজন্মের মাথার উপর ঝোলে, সে সমস্ত কাজের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে বেরিয়ে আসে, আর অন্যটি, অঙ্গীকারের দ্বারা নিজেকে বদ্ধ করা, ভরসার দ্বীপ তৈরি করে অনিশ্চয়তার-সাগর-রূপী ভবিষ্যতে, যা ছাড়া মানুষদের মধ্যের সম্পর্কে কোনও রূপ দীর্ঘস্থায়িত্ব তো দূরের কথা, এমনকি নিরবচ্ছিন্নতাও সম্ভব হতো না।

অতীতে কৃত কাজের দায় থেকে ক্ষমার মাধ্যমে মুক্তি না পেলে প্রকৃত নতুন কিছু করা সম্ভব নয়, কারণ, তখন, সমস্ত কাজই হয়ে ওঠে কোনও এক আদি ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রবহমান বদ্লা নেওয়া। এই নিরবচ্ছিন্নতার বন্ধন আদি রূপে স্থিত কোনও ঘটনা/কাজ-এর প্রতিক্রিয়ার শৃঙ্খল প্রলম্বিত করে যাওয়ার চক্রব্যূহেই বন্দী করে মানুষকে। এই অভিশপ্ত অভিমন্যু-দশা মানুষের নতুন করে কিছু শুরু করার ক্ষমতাকে পক্ষাঘাতগ্রস্ত করে। ক্ষমা এই ব্যূহ ভেঙে নতুন করে শুরু করার ক্ষমতাকে শৃঙ্খলমুক্ত করে।

কিন্তু, কোনও এক আদি-রূপে-স্থিত ঘটনার দায়ের বন্ধন থেকে মুক্তি মানে কি সার্বিক দায়হীনতা? সার্বিক দায়হীনতা মানুষকে বারোয়ারি পরিসরে একে অপরের মধ্যে পারস্পরিক স্বার্থ সম্পর্কে সচেতনতা ও সম্মানদান থেকে বিযুক্ত করে। ফলে বারোয়ারি পরিসরটিই ধ্বংস হয়ে যায়। মানুষ নিক্ষিপ্ত হয় তার নিঃসঙ্গ সত্তার দ্বন্দ্ব ও সার্বিক অনিশ্চয়তার অন্ধকার প্রদক্ষিণ করার অনন্ত যাত্রায়। একমাত্র বারোয়ারি পরিসরে অপরের চোখে প্রতিফলিত নিজ পরিচয় যেমন স্ব-শনাক্তি সম্ভব করে তোলে, তেমনই অপর সম্পর্কে সচেতনতা, অপরের সঙ্গ ও অপরত্বকে সম্মান স্ব-অস্তিত্বের বাস্তবতা তৈরি করে। এই দুই-ই বারোয়ারি পরিসরের বহুত্বের উপর নির্ভরশীল। এই বহুত্বের পরিসরে অপরের কাছে অঙ্গীকারের মধ্য দিয়ে নিজেকে দায়বদ্ধ করে তোলা যায়, অস্তিত্বের বাস্তবতাকে ভবিষ্যতে প্রসারিত করা যায়।

ক্ষমা ও অঙ্গীকার তাই বিপরীত প্রবণতাযুক্ত— ক্ষমা নিরবচ্ছিন্নতাকে ছেদ করে, আর অঙ্গীকার নিরবচ্ছিন্নতা নির্মাণ করে। কিন্তু বিপরীত প্রবণতাযুক্ত হলেও এই দুই বৃত্তি পরস্পর-সংসৃষ্ট ভাবে মানুষদের মধ্যের বারোয়ারি পরিসরকে রক্ষা করে, মানুষের নতুন করে শুরু করার ক্ষমতাকে বন্ধনমুক্ত করে সক্রিয় করে তোলে।

ক্ষমা ও অঙ্গীকারের বৃত্তি এখানে মানুষদের মধ্যের বারোয়ারি পরিসরে একের সঙ্গে অপরের সম্পর্কের ভিত্তিতেই সংজ্ঞাত, তা প্রাথমিকভাবে ‘এক’-এর নিজেকে ক্ষমা করা বা নিজের কাছে অঙ্গীকার নয়। বারোয়ারি পরিসরের বহুত্বে প্রোথিত ‘এক’ যে পরিমাণে অপর বহুর কাছ থেকে ক্ষমা পায় ও অপর বহুর সঙ্গে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়, সে পরিমাণেই নিজেকে ক্ষমা করতে পারে ও নিজের কাছে নিজের অঙ্গীকারকে চিহ্নিত করতে পারে। ক্ষমা ও অঙ্গীকার তাই বহুত্বের পরিসর সঞ্জাত রাজনৈতিক বৃত্তি যা মানুষদের স্বতক্রিয়ার অবকাশ সৃষ্টি করে।

অপরদিকে, এহেন ক্ষমা ও অঙ্গীকার কেবলমাত্র এমন এক বারোয়ারি পরিসরেই সম্ভব যেখানে সমস্ত অপরাপর সমসম্মানে একে অপরের সঙ্গে সম্বন্ধিত। মতবাদিক নির্মাণের সর্বাত্মকতাবাদ যখন এই বারোয়ারি পরিসরকে ধ্বংস করে অগ্রগণ্যতার ধাপবন্দী কাঠামো তৈরি করে, মানুষের মুক্তক্রিয়াকে প্রতিস্থাপিত করে মতবাদ-চালিত ক্রিয়া দিয়ে, তখন এহেন ক্ষমা ও অঙ্গীকার অসম্ভব।

আবার, মানুষদের মধ্যেকার ক্ষেত্র নয় এমন ক্ষেত্রে, যেমন ধরা যাক, মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির বিপাকক্রিয়ার ক্ষেত্রে, এহেন ক্ষমা ও অঙ্গীকার অভাবনীয়। উদাহরণস্বরূপ, ধরা যাক আধুনিক বিজ্ঞান-প্রকৌশলের কথা। আধুনিক বিজ্ঞান-প্রকৌশল প্রকৃতির বিভিন্ন পদ্ধতি পর্যবেক্ষণ করা, অনুকরণ করা বা প্রাকৃতিক উপাদানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকাকে ছাপিয়ে গিয়ে এমন কিছু নির্মিত অপ্রাকৃতিক উপাদান ও পদ্ধতি প্রকৃতির মধ্যে অনুপ্রবিষ্ট করাচ্ছে, যা অনিয়ন্ত্রিত ও অখন্ডনীয় পরিবর্তনের প্রক্রিয়া লাগু করে দিচ্ছে। প্রকৃতির ছন্দকে ভেঙে নিত্যনতুন অভূতপূর্বতার এই উপস্থাপন অনিষ্টকারী বা বিনাশমুখী বলে প্রতিভাত হলেও তার অনিয়ন্ত্রিত ও অখণ্ডনীয় চরিত্র আর প্রত্যহারের অবকাশ রাখে না। সুতরাং এখানে ক্ষমা নতুন করে শুরুর ক্ষমতাকে জাগাতে পারে না, ক্ষমা এখানে অর্থহীন।

অন্য আর এক দিক থেকে বলা যায় যে ক্ষমা যেমন মানুষের নতুন কিছু করার ক্ষমতা অনর্গল করে দেয়, তেমন, অঙ্গীকার এমন বহু অপরাপরকে এক পরিসরে সমাবেশিত করে সমবেত ক্রিয়ার বিপুল শক্তির মুখ খুলে দেয়। এই সমবেত ক্রিয়া কোনও এক মতবাদ-প্রসূত দুর্দম ইচ্ছাশক্তি চালিত একই মুখ (মুখোশ)-দের একই বুলি গর্জানো কুচকাওয়াজ নয়। এই সমবেত ক্রিয়া মুক্ত-সম্বন্ধিত বহু অপরাপর মানুষদের, যাদের সাধারণ অভিপ্রায়ের মুহূর্ত জন্ম নিয়েছে অপরাপরের সঙ্গ-এর প্রতি অঙ্গীকার থেকে। বহুত্বের রাজনীতি প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে এই মুহূর্তগুলোতেই।

যুদ্ধ, মৃত্যুশিবির, পরিত্যক্ত শরণার্থীদের অবমানুষে রূপান্তরিত হওয়া, পারমাণবিক ধ্বংসশক্তির আস্ফালন, বিচ্ছিন্নতায় একাকীত্বে মানব-অস্তিত্বের বন্দীত্ব, অন্তহীন ভোগবাদের আধিপত্যে মানুষদের মধ্যের বারোয়ারি ক্ষেত্রের শুকিয়ে যাওয়া, রাষ্ট্র-রাজনীতিতে সর্বাত্মকতাবাদী উপাদানের ক্রমবৃদ্ধি— আধুনিকতার এই সমস্ত সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলো বহুত্বের রাজনীতির পরিসর গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তাকেই অনবরত হাজির করে যাচ্ছে। তাই আলোচনার পরবর্তী অংশে বর্তমান সময়ের ব্যবহারিক রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে বহুত্বের রাজনীতি চর্চার প্রশ্নটিকে কিছুটা বিশদে বিচার করা যাক।

 

রাজনীতির বহুত্ব ও বহুত্বের রাজনীতি চর্চা

রাজনীতির তিন ধরন

রাজনীতির বহুত্বকে তিনটি ধরনে ভাগ করে দেখা যেতে পারে। ধরন তিনটি হলো— প্রতিস্থাপনার রাজনীতি, বৈরিতার রাজনীতি ও বহুত্বের রাজনীতি। এই তিনটি ধরনের একটি প্রাথমিক বর্ণনা দিয়ে শুরু করা যাক।

১। প্রতিস্থাপনার রাজনীতি

প্রকৃত রাজনৈতিক ক্রিয়া হলো অন্যদের হয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া, অন্যদের হুকুম দিয়ে চালনা করা, অন্যদের উপর ক্ষমতা খাটানো এবং ঘটনাপরম্পরাকে প্রভাবিত করা।

‘পলিটিক্স অ্যাজ এ ভোকেশন' প্রবন্ধে সমাজতাত্ত্বিক ম্যাক্স ওয়েবার এমনটা বলেছেন। এই অর্থে, রাজনীতি হলো এমন এক ক্রিয়া যা (কর্ম)কর্তা করে অন্যদের উপর, সেই অন্যদের তার ক্ষমতাধীনে এনে চালিত করার জন্য এবং তার মধ্য দিয়ে ঘটনাপরম্পরাকে নিজ অভিপ্রায়-মুখে প্রভাবিত করার জন্য। (কর্ম)কর্তা এখানে ক্রিয়া করছে অন্যদের উপর, অন্যদেরকে নিয়ে। সেই অন্যরা চালিত হচ্ছে। সেই অন্যদের হয়ে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে সেই (কর্ম)কর্তা। অর্থাৎ, কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায় বা দায়িত্ব বা সুযোগ কোনওটাই অন্যদের নেই। এই অন্যরা যেন ঘটনাপরম্পরার ক্রীড়নক মাত্র; যে ঘটনাপরম্পরার গতিপথ, বেগ, দ্রুতি— সবই নির্ধারিত হচ্ছে (কর্ম)কর্তার রাজনৈতিক ক্রিয়ার দ্বারা। সুতরাং, এই ধারণা অনুযায়ী, রাজনৈতিক ক্রিয়া হলো বহুর ক্রিয়াশীল হওয়ার সক্ষমতাকে আত্মসাৎ করে এক-এর (কর্ম)কর্তা হয়ে ওঠা। এমতানুযায়ী, রাজনৈতিক ক্রিয়া সকলের কর্ম নয়, তা কেবলমাত্র বিশেষ কারও কারও কর্ম। সেই রাজনৈতিক ক্রিয়ার বিশেষ অধিকারীরাই হলেন পেশাদার রাজনীতিবিদ।

এখন প্রশ্ন হলো, বহুর ক্রিয়াশীল হওয়ার সক্ষমতাকে আত্মসাৎ করা সম্ভব কীভাবে, কীসের জোরে? বহু কেন নিজেদের নিষ্ক্রিয়তার বিধান মেনে নিয়ে একের হাতে, অর্থাৎ পেশাদার রাজনীতিবিদদের হাতে তার হয়ে ক্রিয়া করার অধিকার তুলে দেবে? একাধিক প্রক্রিয়ায় এই অধিকার আত্মসমর্পণ ঘটতে পারে।

প্রথমত তা ঘটতে পারে ‘প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র'-এর কাঠামো মেনে নিয়ে ‘বহু' তাদের ‘এক' প্রতিনিধিকে ‘রাজনৈতিক ক্রিয়া'-র জন্য নির্বাচিত করার মধ্য দিয়ে।

দ্বিতীয়ত তা ঘটতে পারে ‘মতবাদিক' গোষ্ঠী কাঠামোয় গোষ্ঠীর মতবাদের শ্রেষ্ঠ উপস্থাপক ‘অগ্রণী' ‘এক'-এর কাছে ‘বহু'-র নিজেদের ক্রিয়ার অধিকার আত্মসমর্পণ করার মধ্য দিয়ে।

তৃতীয়ত তা ঘটতে পারে স্বৈরতান্ত্রিক বা একনায়কতান্ত্রিক কাঠামোয় ‘সর্বশক্তিমান’ বা ‘উদ্ধারকর্তা’ হিসেবে হাজির হওয়া এক-এর দ্বারা বহুর ক্রিয়ার অধিকার আত্মসাৎ হওয়ার মধ্য দিয়ে।

আলোকপ্রাপ্ত বা অগ্রণী ‘এক’ ব্যক্তি/ গোষ্ঠী-প্রতিনিধি/ শ্রেণি-প্রতিনিধি/ জাতি-প্রতিনিধি এখানে তার রাজনৈতিক ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ‘দুনিয়াকে বদলায়’/ ‘সমাজকে বদলায়’/ ‘নতুন মানুষ গড়ে তোলে’/ ইত্যাদি। বাকি ‘বহু’-রা সেই (কর্ম)কর্তার ক্রিয়ার প্রেক্ষাপট, ধূসর নির্জীব হতমান তাদের অস্তিত্ব, তারা এই (কর্ম)কর্তা-র দ্বারা অবদমিত/ প্রতিনিধিকৃত/ গৌরবান্বিত/ লুন্ঠিত/ উপকৃত।

২। বৈরিতার রাজনীতি

প্রকৃত অর্থে বা নির্দিষ্ট অর্থে রাজনৈতিক ক্রিয়া হলো শত্রুর বিরুদ্ধে সংগ্রাম। ১০

‘দি কনসেপ্ট অফ দি পলিটিকাল' গ্রন্থে কার্ল স্মিট (Carl Schmitt) এমনটা বলেছেন। এই ধারণা অনুযায়ী ভাবলে, রাজনৈতিক ক্রিয়ার মানে হলো প্রথমত ‘শত্রু' নির্দিষ্ট করা, দ্বিতীয়ত ‘মিত্রশক্তি' নির্দিষ্ট করা, তৃতীয়ত শত্রুর বিরুদ্ধে সংগ্রাম-এর রণনীতি রণকৌশল নির্ধারণ করা, চতুর্থত সংগ্রামের বাস্তব কার্যক্রম পরিচালনা করা।

‘শত্রু' ও ‘মিত্রশক্তি' নির্দিষ্ট করার জন্য শ্রেণি/ জাতি/ সমরূপীয় গোষ্ঠী-পরিচয়/ লিঙ্গ/ যৌনপ্রবণতা নির্ধারক হিসাবে ব্যবহার করে বৈরিতামূলক অপর গড়ে তোলাই এই রাজনীতির ভিত্তি। এই ভিত্তির উপর গড়ে ওঠে বা এই ভিত্তির ক্রমসম্প্রসারণে রূপ নেয় এমন এক ‘ন্যায়পরতা’-র ধারণা যা শত্রুদমন, শত্রুবিনাশ ও নিজ আধিপত্য প্রতিষ্ঠাকে ‘স্বাভাবিক’ভাবে কাম্য (অর্থাৎ, বিচার-বিশ্লেষণের ঊর্ধে স্বাভাবিক সত্য) বস্তুতে পরিণত করে। আপোষ/ মিলন/ সংশ্লেষ অসম্ভব, এমন দুই আড়াআড়ি ভাবে বিভক্ত অংশে মানবসমাজকে ভেঙে চলমান যুদ্ধের আপতকালীন পরিস্থিতি চিরস্থায়ীভাবে উৎপাদন করাই এই রাজনীতির বীজভূমি। এই উৎপাদিত পরিস্থিতি এক এবং একমাত্র বাস্তবতা হিসেবে জারি করা হয়। সর্বতগামী ও সদাসঞ্চরণশীল এই যুদ্ধের যুক্তি ও চাহিদা অনুযায়ী বৈরী দুই প্রতিপক্ষের সমরূপীয় সুশৃঙ্খল আদল তৈরি করা হয়। এই নির্মিত আদলকে বাস্তবের সম্পূর্ণ রূপ হিসেবে প্রমিতিকৃত করা হয়। সমস্ত বৈচিত্র্য ও বহুত্ব অবধারিতভাবে যে অ-নিশ্চয় অ-নির্ধারিত অ-প্রমিত প্রসারের অঙ্গ, তাকে একটি সুনির্দিষ্ট নিয়ম-নিয়ন্ত্রিত পূর্বনির্ধারিত প্রমিত প্রসার দ্বারা প্রতিস্থাপিত করাই এই রাজনীতির কাজ। নিয়মশৃঙ্খলা-বদ্ধ সৈন্যসারি নির্মাণ ও পরিচালনার জন্য এখানে অত্যাবশ্যক হয়ে পড়ে ‘অগ্রণী' মুষ্টিমেয়র রাজনৈতিক ক্রিয়ার আকর্ষণশক্তি ও শোষণক্ষমতার বলে বহুর রাজনৈতিক স্বতক্রিয়ার সক্ষমতাকে আত্মসাৎ করা।

এই রাজনীতির বিশ্বে এক ও অপর অপরাপরকে দেখে সন্দেহ-অবিশ্বাস-এর কুয়াশার মধ্য দিয়ে, ষড়যন্ত্রের আশঙ্কার দিকে আড়চোখের দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে, ঠগীবৃত্তির পূর্বানুমানের আড়াল থেকে। এই দৃষ্টি-অভ্যাস ক্রমশ সর্বতোভাবে সবাইকে গ্রাস করে নেয়। দুটি মানুষের মধ্যবর্তী মানবিক ক্রিয়ার পরিসর কেবলমাত্র উদ্দেশ্যমূলক স্থির-নিশ্চিত-পূর্বধারণা-প্রসূত ক্রিয়ার মধ্যেই সংকুচিত হয়ে পড়ে এবং ক্রমশ শুকিয়ে যেতে থাকে। এক পক্ষাঘাত-বিস্তারকারী সন্দেহবাতিকগ্রস্ত নিঃসঙ্গতার খোলে আটকে পড়ে মানুষ।

৩। বহুত্বের রাজনীতি

স্বতক্রিয়া ও বাচন— উভয়েরই মৌলিক শর্ত হলো মানুষের বহুত্ব। সমতা ও পার্থক্য— মানুষের বহুত্বের এই দ্বিমুখী চরিত্র আছে। মানুষ যদি সমান না হতো, তাহলে তারা একে অন্যকে বা নিজেদের পূর্বপুরুষদের বুঝতে পারত না, ভবিষ্যতের জন্য পরিকল্পনা করতে পারত না, আর তাদের উত্তরপুরুষদের প্রয়োজনও আগে থেকে দেখতে পারত না। মানুষ যদি পৃথক না হতো, প্রতিটা মানুষ যদি অতীত, বর্তমান বা ভবিষ্যৎ অন্য সমস্ত মানুষের থেকে বিশিষ্ট না হতো, তাদের বাচন বা স্বতক্রিয়া দরকার হতো না নিজেদের বোধ্য করে তোলার জন্য। আশু অভিন্ন প্রয়োজন ও চাহিদা জ্ঞাপন করার জন্য ইশারা ও ধ্বনিই যথেষ্ট হতো।

—‘দি হিউম্যান কন্ডিশন' গ্রন্থে হানা আরেন্ট বলেছেন।

এই ধারণা অনুযায়ী, সমতা ও পার্থক্য-র দ্বিমুখী চরিত্র নিয়ে মানুষ সবসময়েই বহুবচনাত্মক। শ্রেণি/ জাতি/ ধর্ম/ লিঙ্গ/ যৌনপ্রবণতা/ গোষ্ঠীপরিচয়-এর ভিত্তিতে সমতার বিভিন্ন সাধারণ সূত্র গড়ে ওঠে বা বজায় থাকে, কিন্তু মানুষের জীবন-অভিজ্ঞতাকে তা কখনোই সমমাত্রিক সমসত্ত্বীয় করে দেয় না, যেজন্য প্রতিটি মানুষের মধ্যে পার্থক্য জীবিত থাকে।

সমতার কোনও বা কোনও কোনও সাধারণ সূত্র ধরে সমমাত্রিক সমসত্ত্বীয় দল পাকানো, প্রতিনিধিত্বের মধ্য দিয়ে বহুকে একের দ্বারা প্রতিস্থাপন ও ‘শত্রু><সহযোদ্ধা’-ছঁাচে অপরাপরের সঙ্গে সম্পর্কনির্ণয়ের মধ্য দিয়ে প্রতিস্থাপনার রাজনীতি ও বৈরিতার রাজনীতি কাজ করতে শুরু করে ও নির্মিত গোষ্ঠী/দল-এর অভ্যন্তরে পার্থক্যকে ছেঁচে ফেলতে চায়। এই পার্থক্য ছেঁচা সমসত্ত্বের আবহে ‘সমমাত্রিক সমসত্ত্বীয়' মানুষদের কিছু আশু অভিন্ন প্রয়োজন ও চাহিদাকে স্থিরীকৃত ও প্রমিত বলে ধরে নেওয়া হয়। ফলে, বহু-র মুক্তক্রিয়া ও বাচন, যার মধ্য দিয়ে প্রয়োজন ও চাহিদার বহুত্ব অবধারিতভাবে প্রকাশিত হয়, তা সীমায়িত/শৃঙ্খলিত/উৎখাত করার প্রবণতা প্রবল হয়। বহুর বাচন নয়, সমসত্ত্বীয়দের ইশারা ও সমবেতধ্বনিই এখানে দস্তুর। মানুষের মধ্যে জ্ঞাপনের আদল এখানে যেন এক জনসভার মতো, যেখানে মান্যতার মাচায় দাঁড়ানো এক বক্তার যন্ত্র-বর্ধিত স্বরের ঝাপটায় মাচার নীচের বহুর হাততালি বা হাত তুলে ধ্বনি তোলাই মান্য আচার। স্বতক্রিয়া ও বাচনের মৌলিক শর্ত এখানে লঙ্ঘিত হয়।

বহুত্বের রাজনীতি হলো এর উল্টো। বহুত্বের রাজনীতি মানুষের মধ্যে জ্ঞাপনের এমন এক আদল তৈরি করতে চায় যেখানে ‘বহু' সমাবেশিত এক সমতলীয় আলোচনাকক্ষে এবং সমতা ও পার্থক্য-র দ্বিমুখী চরিত্র নিয়ে বহুত্ব অবাধভাবে প্রকাশিত হতে পারে স্বতক্রিয়া ও বাচনের মধ্য দিয়ে। বহু মানুষ এখানে একে অন্যের সঙ্গে আছে, কোনও এক অন্যের জন্য নেই, কোনও এক অন্যের বিপক্ষেও নেই। অর্থাৎ বহু বিভিন্ন মানুষ এখানে পরস্পর-সম্পৃক্ততায় আছে। কারও জন্য নয়, অর্থাৎ, কারও প্রতিনিধি/ উদ্ধারকর্তা/ শত্রুবিনাশী-যুদ্ধে-সহযোগী হিসাবে নয়। আবার কারও বিপক্ষে নয়, অর্থাৎ, অপরতার বৈরিমূলক নির্ধারণ নিয়ে নয়। বিভিন্ন বিচিত্র বহু অপরাপরের পরস্পর সম্পৃক্ততা থেকে উৎসারিত স্বতক্রিয়া ও বাচনই বহুত্বের রাজনীতির ভিত্তি।

রাজনীতির এই যে তিন ধরন চিহ্নিত হলো, পারস্পরিক সম্বন্ধের বিচারে তাদের এইভাবে দেখা যায়:

(প্রতিস্থাপনার রাজনীতি<=>বৈরিতার রাজনীতি)><বহুত্বের রাজনীতি

এই তিন ধরনের রাজনীতির পরিসর নিয়ে এবার আলোচনা করা যাক।

প্রতিস্থাপনা ও বৈরিতার রাজনীতির পরিসর

তথাকথিত ‘আধুনিক সমাজ’-এ রাজনীতির পরিসর গঠনে আবশ্যিক হয়ে ওঠা কয়েকটি উপাদান হল— রাজনৈতিক দল/ উপদলের ব্যূহ, প্রতিনিধিত্বমূলক রাজনীতির ধারণা এবং ক্ষমতার বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ। এই সমস্ত উপাদানগুলির গঠনে ভাষা, বা আরও নির্দিষ্ট করে বললে ভাষিক ক্ষমতা বা সংকেত ও প্রতীক গঠনে নিয়ন্ত্রক ক্ষমতা নিবিড়ভাবে যুক্ত। জগৎ সম্পর্কে ধারণা উৎপাদন করা, বিদ্যমান ধারণার পরিবর্তনসাধন করা/ করতে চেষ্টা করা ও সেমত জগতের পরিবর্তনসাধনের প্রয়াস মানুষের চর্চার বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যাপৃত থাকলেও, রাজনীতির পরিসরেই তা সবচেয়ে প্রত্যক্ষ তাৎপর্য নিয়ে হাজির থাকে। ধারণা, প্রতি-ধারণা ও বিকল্প ধারণা-র এই মন্থনক্ষেত্রে বহু বিভিন্ন শব্দ, কথা, বাকরীতি, ভাষিক উপস্থাপনা-র পারস্পরিকতার পরিসরকে সোপানতান্ত্রিক আদলে ঢালাই করে সংকেত ও প্রতীক গঠনে নিয়ন্ত্রণ কায়েমের জন্য সংঘাত ভাষিক ক্ষমতাকে গঠন করে। আকর্ষণী-বুলি (স্লোগান), কর্মসূচী/ কর্মধারা/ নীতি (প্রোগ্রাম) ও বিবিধ ক্ষণভাষ্য (কমেন্টারি) নির্মাণের মধ্য দিয়ে রাজনীতির ক্ষেত্রের (কর্ম)কর্তারা অনবরত সংকেত/ প্রতীক/ প্রতিনিধিত্ব উৎপাদনে ব্যাপৃত হয়, যার মধ্য দিয়ে তারা জগৎ সম্পর্কে একটি নির্দিষ্ট ধারণা তৈরি করতে ও অন্যদের উপর আরোপ করতে চায়। স্ব-উৎপাদিত ধারণা অন্যদের উপর আরোপ করতে পারার সক্ষমতার উপর নির্ভর করে অন্যদের নিজের ‘অনুগামী’ হিসেবে বিন্যস্ত করতে পারার সাফল্য, বা এই অন্যদের ‘প্রতিনিধি’ (রিপ্রেজেন্টেটিভ) হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার সাফল্য। এই সাফল্যই প্রতিস্থাপনা বা বৈরিতা-র রাজনীতির পরিসরের (কর্ম)কর্তাদের ‘রাজনৈতিক পঁুজি' হিসাবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। রাজনীতির পরিসর কী পরিমাণে সোপানতান্ত্রিকতায় বাঁধা পড়বে ও (কর্ম)কর্তাদের আসন কী পরিমাণ ক্ষমতাধর হয়ে উঠবে তা এই রাজনৈতিক পঁুজির সঞ্চয়ন কী পরিমাণ ঘটছে, তার উপরই নির্ভর করে।১২

তথাকথিত আধুনিক সমাজে কর্মসূচী/ কর্মধারা/ নীতি, ক্ষণভাষ্য ও আকর্ষণী বুলি উৎপাদন করার ও উপস্থাপিত করার জন্য প্রয়োজনীয় উৎপাদন/উপস্থাপনার উপায় ক্রমশ ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর গোষ্ঠীর অধিকারে সীমায়িত হওয়ার প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে। যে যে উপপ্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এই প্রক্রিয়া বলবৎ হচ্ছে, তা হল:

১.জাতিরাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক আর্থিক-রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুচ্ছের মধ্য দিয়ে মান্য রাজনীতির একটি ক্রম-কেন্দ্রীভূত কাঠামো উৎপাদন করা;

২.মান্য সরকারি ভাষা হিসেবে জাতিরাষ্ট্রগুলোর অভ্যন্তরে কিছু আধিপত্যকারী ভাষার নির্ধারণ ও তার মাথার উপর আন্তর্জাতিক প্রযুক্তি-বাণিজ্য-কূটনীতি-র ভাষা হিসাবে ইংরেজির একাধিপত্য জারি ভাষার বিভিন্ন সামাজিক ব্যবহারক্ষেত্রগুলো থেকে বিপুল পরিমাণ ভাষাকে ঠেলে বের করে দিয়ে সেই সমস্ত বহিষ্কৃত ভাষার বাচকদের স্বভাষায় সামাজিক ক্রিয়া করা ক্রমশ অসম্ভব করে তোলা;

৩.সর্বজনের অংশগ্রহণমূলক কৌমভিত্তিক/ আত্মীয়তাভিত্তিক/ আঞ্চলিক সমাজ-প্রশাসনের বিভিন্ন রূপকে প্রতিনিধিত্বমূলক কেন্দ্রীভূত সমাজ-প্রশাসন দিয়ে প্রতিস্থাপিত করা।

এর ফলে ক্রমশ আরো বেশি বেশি মানুষের রাজনৈতিক স্বতক্রিয়ার অধিকার হরণ হয়ে যাচ্ছে ও তা ক্রম-কেন্দ্রীভূত হচ্ছে ‘পেশাদার রাজনীবিদ’-দের হাতে। এর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণভাবে গড়ে উঠছে আমলাতান্ত্রিক কাঠামো, পূর্ণ-সময়ের পেশাদার আধিকারিক (ফুল-টাইম অফিসিয়াল) সম্বলিত রাজনৈতিক দল(পার্টি)সমূহ। রাজনৈতিক ক্রিয়ার এই ক্রম-পেশাদারীকরণ ক্রমশ আরও বেশি বেশি মানুষের জন্য রাজনৈতিক স্বতক্রিয়া দুষ্কর করে তুলছে। অপরাপরের পরস্পর সম্পৃক্ততার পরিসরে স্বতন্ত্র ব্যক্তি হিসেবে রাজনীতির ক্ষেত্রে নিজস্ব স্বতন্ত্র মতকে নিয়ে অন্যদের সঙ্গে আদানপ্রদান, সমমতাবলম্বীদের সঙ্গে জোট বাঁধা ও জোটগত চর্চার গ্রাহ্য উপস্থিতি গড়ে তোলা প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে যদি না সে তার মতের স্বাতন্ত্র্য উপস্থাপন করার উদ্দেশ্য বিসর্জন দিয়ে পেশাদার রাজনীতিবিদদের আধিপত্যাধীন কোনও আমলাতান্ত্রিক কাঠামোর দলকে/ দলের নেতা-নেত্রীকে নিজের ‘প্রতিনিধি' হিসেবে ‘গ্রহণ' করে। এই গ্রহণের মধ্য দিয়ে তার মত/স্বর-এর স্বাতন্ত্র্য অবদমিত হয়ে উচ্চকিত এক অধিপতি মত/স্বর-এর মধ্যে বিলীন হয়ে যায় ও এভাবে অধিপতি স্বরের মধ্যে শোষিত হয়ে যাওয়াই তার রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় হতে পারার পূর্বশর্ত হয়ে ওঠে।

রাজনৈতিক পরিসরে পেশাদারিকরণ ও কেন্দ্রীভূত প্রতিষ্ঠানের সর্বব্যাপকতার মধ্য দিয়ে মানুষদের মধ্যের পার্থক্যকে যত নির্মিত সমসত্ত্বতার শাসনে অবদমিত করা হয়, ততই রাজনৈতিক ক্রিয়া হিসাবে মান্যতা পেতে থাকে সমসত্ত্ব বর্গ গঠন ও সেই বর্গের প্রতিনিধিস্বরূপ কতিপয় রাজনৈতিক (কর্ম)কর্তার ক্রিয়া। ব্যাপক বহুবিবিধ মানুষ হারায় রাজনৈতিক স্বতক্রিয়ার মাধ্যমে রাজনৈতিক পরিসরে আত্মপ্রকাশের অধিকার। বৈষম্যবহুল সোপানতান্ত্রিক সমাজে নিপীড়িত নিষ্পেষিত মানুষদের ক্ষেত্রে এই রাজনৈতিক স্বতক্রিয়ার অধিকার হারানো তীব্রতর আকার নেয়। এই সমস্ত মানুষদের ভাষা, বচন, লৌকিকতা-র সঙ্গে রাজনীতির পরিসরের স্থিরীকৃত মান্য ভাষা, বাচন,লৌকিকতা-র পার্থক্য তাদের ‘অসম্পূর্ণতা'/ ‘পশ্চাৎপদতা'/ ‘বিকৃতি'/ ‘নির্গুণতা' হিসেবে চিহ্নিত হয়। রাজনীতির কেন্দ্রীভূত প্রতিষ্ঠানগুলোর অলিন্দে হয় তারা নিষিদ্ধ হয়, নতুবা ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের জন্য চিহ্নিত হয়। এর ফলে আধিপত্যাধীন নিপীড়িত মানুষদের স্বতক্রিয়ার অধিকার অস্বীকৃত হয়। আধিপত্যবাদী ‘ভদ্র'/ মান্য ভাষা, বচন, লৌকিকতা নিয়ে গঠিত পেশাদার রাজনীতিকদের কেন্দ্রীভূত চরিত্রের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনও না কোনওটির কাছে নিজেদের রাজনৈতিক স্বতক্রিয়ার অধিকার গচ্ছিত রেখে তাদের প্রতিনিধিত্বের প্রতিস্থাপনায় আত্মসমর্পণ করা ছাড়া আধিপত্যাধীনদের আর কোনও সহজ উপায় থাকে না। আধিপত্যাধীন নিপীড়িত মানুষদের রাজনৈতিক প্রতিনিধি যেহেতু আধিপত্যকারী ‘ভদ্র'/ মান্য ভাষা, বাচন, লৌকিকতা অনুযায়ী নিজেকে হাজির করার প্রয়াসী হয়, সেই ‘ভদ্র'/ মান্য ভাষা, বাচন, লৌকিকতার সামাজিক অস্তিত্বই সেই প্রতিনিধিকে নির্মাণ করে নেয়। তার ফলে আধিপত্যাধীন নিপীড়িত মানুষদের সঙ্গে তার রাজনৈতিক প্রতিনিধির দূরত্ব বাড়তে থাকে, তাদের প্রতিনিধিরাই তাদের ‘দয়ার পাত্র'/ ‘নির্গুণ'/ ‘অকর্মণ্য' বলে দেখতে থাকে। এইভাবে আধিপত্যাধীন নিপীড়িত মানুষদের রাজনৈতিক মুক্তক্রিয়ার অধিকার হরণ সর্বাত্মক হয়।

রাজনৈতিক সক্রিয়তার আত্মসাৎকারী

বহুত্বের বিরুদ্ধে সমসত্ত্বতা, বহুর মুক্তক্রিয়ার বদলে বহুর সক্রিয়তার অধিকার বেদখলকারী কেন্দ্রীভূত চরিত্রের প্রতিষ্ঠানের ক্রিয়া, ভাষিক অগণতন্ত্র— এইসবের মধ্য দিয়ে প্রতিনিধিত্বমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থার কাঠামো কীভাবে সংরচিত হয় তা আমরা দেখলাম। এবার দেখা যাক সেই কাঠামোয় বহুর রাজনৈতিক সক্রিয়তাকে বেদখল করার মধ্য দিয়ে যেসব ‘প্রতিনিধি' রাজনৈতিক (কর্ম)কর্তা হিসাবে আবির্ভূত হয়, তাদের ক্রিয়াকর্ম সংঘটনের রূপ। এই ক্রিয়াকর্ম সংঘটন দ্বিস্তরীয় অভিযোজনের উপর নির্ভরশীল। অভিযোজনের প্রথম স্তরে কিছুজন একটি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় নিজেদের সংহত করার মধ্য দিয়ে একটি ‘দল' হিসেবে নিজেদের সংগঠিত করে। এই প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মধ্যে সাধারণত থাকে একটি স্থায়ী দফতর, আধিকারিকবর্গের একটি উচ্চাবচ নিবন্ধন ও তদ্বারা একটি আমলাতন্ত্রের গঠন। অভিযোজনের দ্বিতীয় স্তরে এই সংগঠন কিছু ‘নেতৃবর্গ'-এর উপর ‘মুখপাত্র' হওয়ার অধিকার ন্যস্ত করে। উচ্চাবচ আমলাতান্ত্রিক আবহে এই ন্যস্তকরণ সেই মুখপাত্র ও যাদের ‘মুখ' হিসেবে সে কাজ করছে, তাদের মধ্যে দূরত্ব ও বিভাজন তৈরি করে। এই দূরত্ব ও বিভাজন মুখপাত্রের নিজের মধ্যে ও যাদের সে ‘মুখ' তাদের মধ্যে এই ভরসার জন্ম দেয় যে মুখপাত্র স্বনির্ভরভাবে নিজ বুদ্ধি-চিন্তা-যোগ্যতা-গুণ অনুযায়ী এমন বক্তব্য/ প্রতিবেদন/ দাবি/ যুক্তি/ বাস্তবতার-পাঠ নির্ধারণ করতে পারে যা তার উপর অন্যদের আস্থা উৎপাদন করে তাকে অন্যদের প্রতিনিধি করে তোলে। ‘মুখপাত্র' হয়ে ওঠা অন্যদের নির্বাচনক্রিয়া নির্ধারিত ফলের পরিবর্তে নির্বাচিতের গুণ-নির্ধারিত ফল হিসেবে দেখা দেয়। নির্বাচকদের যৌথক্রিয়া প্রতিস্থাপিত হয় মুখপাত্রের বিশেষ গুণ দ্বারা সম্পন্ন ক্রিয়ার দ্বারা। এইভাবে কোনও ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ যখন অন্য ‘বহু'-র রাজনৈতিক ক্রিয়ার অধিকারকে আত্মসাৎ করে নিজেকে রাজনৈতিক পরিসরের (কর্ম)কর্তাদের মঞ্চে দৃশ্যমান করে তুলতে পারে, তখন সে তার মতো আরও অন্যান্য আত্মসাৎকারীদের সঙ্গে ‘রাজনৈতিক সংগ্রাম'-এ রত হয়। এই ‘রাজনৈতিক সংগ্রাম' চলে আকর্ষণী-বুলি/ কর্মসূচী/ নীতি/ ক্ষণভাষ্য উৎপাদনের প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে প্রতিনিধিত্বের ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করে তোলার লক্ষ্যে, অর্থাৎ অপরের রাজনৈতিক সক্রিয়তা আত্মসাৎ করার বৃত্তকে ক্রমপ্রসারিত করার লক্ষ্যে।

রাজনৈতিক দল (পার্টি) ও আমলাতন্ত্র যত প্রসার লাভ করে, রাজনৈতিক ভাষ্য নির্মাণ ও উপস্থাপনার ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ ততই সংকুচিত হতে থাকে। এই সংকোচনের মধ্য দিয়ে ‘বহু'-র রাজনৈতিক স্বতক্রিয়ার অধিকার আত্মসাৎকারী কতিপয় রাজনৈতিক (কর্ম)কর্তাদের ভাষ্য নির্মাণ ও উপস্থাপনা ক্রমশ বাস্তবে অস্তিত্বশীল বহুত্ব থেকে বিযুক্ত হয়ে নিজস্ব এক বিমূর্ত পারিভাষিক জগৎ গড়ে তোলে যা আবার আরও বেশি বেশি করে বহুর সক্রিয় অংশগ্রহণ অসম্ভব করে তোলে। আধিপত্যকারী ভাষার বাচক/ ব্যবহারকারী ছাড়া অন্য বহু বিবিধ ভাষার বাচক/ ব্যবহারকারীরা তো অংশগ্রহণে অপারগ ছিলই, এখন আধিপত্যকারী ভাষারও একটি বিশেষ পরিভাষা-বহুল নির্দিষ্ট মান্য রূপ আয়ত্ত করতে না পারলে অংশগ্রহণে অপারগতা নিশ্চিত হয়ে ওঠে। এইভাবে প্রতিনিধিত্বমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থা রাজনীতির ক্ষেত্রে মানুষদের অংশগ্রহণকে ক্রমাগত সংকুচিত করতে করতে সেই ক্ষেত্রকে কেবলমাত্র কিছু বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত পেশাজীবী রাজনীতিবিদদের কর্মক্ষেত্রে পরিণত করে। বহুবিধ বিভিন্ন মানুষদের স্বতক্রিয়ার ক্ষেত্র না হয়ে রাজনীতির পরিসর হয়ে ওঠে প্রশিক্ষিত পেশাজীবী রাজনীতিবিদ-আমলাদের চারণভূমি।

পেশাজীবী রাজনীতিবিদদের প্রশিক্ষণের কাজটিও চলে রাজনৈতিক দল (পার্টি) ও প্রতিষ্ঠানগুলোর আমলাতন্ত্রের মধ্যেই। রাজনৈতিক নেতা হয়ে ওঠার বিশেষ প্রকৌশলগত প্রশিক্ষণ ও চর্চা চলে, ঝাড়াই-বাছাই চলে ও নতুন ‘নেতা’-রা উঠে আসে। এই প্রশিক্ষণ ও ঝাড়াই-বাছাই-এ সফল হতে হলে ‘পেশাদার’ রাজনীতির বুলি-নির্মাণ কৌশল ভালোভাবে রপ্ত করতে হয়। পেশাদার রাজনীতির ক্ষেত্রে বুলি-নির্মাণ তার বহিঃস্থ মানবঅস্তিত্বের বহুত্ব থেকে বিযুক্ত নিজস্ব সংকীর্ণ পরিমণ্ডলের দ্বারা নির্ণীত। পেশাদার রাজনীতিকরা একে অপরের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় আবদ্ধ। তাই, তাদের বুলি-ক্ষণভাষ্য-সবই তাদের প্রতিপক্ষের বুলি-ক্ষণভাষ্যের সাপেক্ষে নির্মিত। তাই, একে অপরের সওয়াল-জবাব বিরোধ-বিসংবাদ করে গড়ে ওঠার মধ্য দিয়ে তা এমন এক কূটভাষ্যে পরিণত হয় যা ওই সংকীর্ণ গণ্ডীর বাইরের মানুষদের কাছে দুর্বোধ্য, এমনকি, অবোধ্যও হয়ে ওঠে। লোকচেতনায় প্রায় সমার্থক যে সমস্ত শব্দ, তাদের মধ্যে চুলচেরা বিভাজন নিয়ে চুলোচুলি (যা আসলে পেশাদার রাজনীতিবিদদের নিজেদের মধ্যে অবস্থানগত স্বাতন্ত্র্য ও শ্রেষ্ঠত্ব নির্মাণের প্রচেষ্টা) করার মধ্য দিয়ে মতবাদিক রাজনৈতিক পরিভাষা লোকচেতনার থেকে এক সম্ভ্রম-অনিশ্চয়তা-ভীতি-পূর্ণ দূরত্ব তৈরি করে। এই দূরত্ব পেশাদার রাজনীতিবিদদের জন্য স্বাতন্ত্র্য ও সম্মানচিহ্ন উৎপাদন করার সঙ্গে সঙ্গে লোকসাধারণের মধ্যে রাজনীতি ‘করা'-র ক্ষেত্রে নিজেদের ‘অক্ষমতা’/ ‘অযোগ্যতা’-র বোধও উৎপাদন করে। রাজনীতির ক্ষেত্র প্রতিনিধিত্বমূলক রাজনীতির আমলাতান্ত্রিক পরিসরে যত সংকুচিত হতে থাকে, রাজনৈতিক পরিভাষাও ততই লোকভাষা থেকে দূরে সরতে থাকে।

মতবাদিক হেরফের

প্রতিস্থাপনা ও বৈরিতার রাজনীতির কেন্দ্রীভূত থাকবন্দী পরিসরে মানুষকে বেঁধে রাখে মতবাদ। এই মতবাদ প্রকৃতি বা ইতিহাসের ‘গতির নিয়ম’-কে আবিষ্কার করার দাবি করে এবং তার আবিষ্কৃত সেই নিয়মকে মনুষ্যইচ্ছা-নিরপেক্ষভাবে চির-কার্যকর বলে দাবি করে। মতবাদ-উৎসারিত যুক্তিপরম্পরা অনুসারে মতবাদ-নির্মিত রাজনৈতিক পরিসরটি কোনও নির্মিতি নয়, বরং তা ‘প্রাকৃতিক' বা ‘স্বাভাবিক' এক অস্তিত্ব। পরে আমরা এই নিয়ে আরো আলোচনা করব। এখন আমরা প্রতিস্থাপনা ও বৈরিতার রাজনীতির এই মতবাদিক গঠনের প্রকাশ ইতিহাসে যে ভাবে ঘটেছে, তার কিছু রূপ বিচার করি। দু'টি প্রধান রূপকে চিহ্নিত করা যেতে পারে এইভাবে—

  • ঔপনিবেশিক শাসনের মতবাদ বা শ্রেষ্ঠের আধিপত্যাধিকারের মতবাদ,
  • পশ্চাৎপদের দ্রুত আগুয়ানের সমকক্ষ হয়ে ওঠার মতবাদ বা দ্রুত ঘাটতি পূরণের মতবাদ।

একটু ভেঙে দেখা যাক।

১। ঔপনিবেশিক শাসনের মতবাদ

  বা শ্রেষ্ঠের আধিপত্যাধিকারের মতবাদ

আমরা আগেই আলোচনা করেছি যে ইউরোপের পশ্চিমপ্রান্তে পঁুজিবাদী সমাজ-অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উদ্ভবের চালিকাশক্তি পঁুজির অসীম বিস্তারের চাহিদার সঙ্গে যমজ হিসেবে ভূক্ষেত্রে অসীম বিস্তারের রাজনীতি (বা বিস্তারের জন্যই বিস্তারের রাজনীতি)-র এক নতুন ঘনসংবদ্ধ রূপ জন্ম নিয়েছিল। পঁুজিবাদী কাঠামো প্রথম বিকশিত হওয়া কতিপয় দেশের বিশ্বজুড়ে ঔপনিবেশিক শাসন বিস্তার ও নিজদেশে ক্রম-কেন্দ্রীভূত চরিত্রের পঁুজিবাদী রাষ্ট্র গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে তার প্রকাশ ঘটেছিল। ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠীরা নিজেদের ‘জাতি' হিসাবে সবচেয়ে ‘অগ্রসর' হিসাবে স্ব-নির্ণয় করে অপর সবাইকে ‘অনগ্রসরতা', ‘অসভ্যতা', ‘বন্যতা'-র এক ‘নরক'-এ বিলীয়মান নিম্নগামী সোপানশ্রেণিতে বিন্যস্ত করে দেখেছিল। মানবসভ্যতার অগ্রগতির পথ হল এই সমস্ত অপরদের ভাষা-সমাজরূপ-সংস্কৃতি-র ক্রমক্ষয় ও বিলুপ্তি এবং তার জায়গায় ‘উন্নত’-দের ভাষা-সমাজরূপ-সংস্কৃতি-র প্রতিস্থাপনা— এই মতবাদিক নির্ণয় হাজির হয়েছিল। উপনিবেশ-বিস্তারক এই দেশগুলোর অভ্যন্তরে পঁুজিবাদী সমাজকাঠামোর প্রতিষ্ঠাপ্রক্রিয়ার অনুসারী ফল হিসেবে এক বিপুল ‘বাড়তি জনগোষ্ঠী' (surplus population) তৈরি হয়েছিল, ‘ভাগ্যান্বেষণকারী' হিসাবে যারা রাষ্ট্রীয় ঠেলায় গোটা বিশ্বের উপনিবেশগুলোয় ছড়িয়ে গিয়েছিল এবং ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রস্থাপনের মালমশলা হিসেবে কাজ করেছিল। এভাবে ঔপনিবেশিক ব্যবস্থার কেন্দ্র ও পরিধি উভয় জায়গাতেই এমন এক রাষ্ট্রব্যবস্থা ক্রম-শিলীভূত হয়ে ওঠে যা কতিপয় ‘উন্নত’ ‘অগ্রসর’ গোষ্ঠীর হাতে সমাজ-পরিচালনা, শাসন ও প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ ক্রম-কেন্দ্রীভূত করে আধিপত্য সুনিশ্চিত করে।

২। পশ্চাৎপদের দ্রুত আগুয়ানের সমকক্ষ হয়ে ওঠার মতবাদ

বা দ্রুত ঘাটতি পূরণের মতবাদ

এই মতবাদিক রূপের প্রকাশকে তিনটি ধরনে ভেঙে দেখা যেতে পারে। তিনটি ধরন হলো—

  • ফ্যাসিবাদী প্রকাশ
  • সাম্যবাদী প্রকাশ
  • জাতীয় বুর্জোয়া প্রকাশ

এই তিনটি রূপের সাধারণ জায়গাটা আগে দেখা যাক।

প্রথম সাধারণ জায়গা হলো এই নির্ণয় যে ‘উন্নত’ (অর্থাৎ, পঁুজিবাদী সামাজিক-অর্থনৈতিক কাঠামো প্রতিষ্ঠায় প্রাগ্রসর ও উপনিবেশ-বিস্তারক) দেশগুলোর আধিপত্যাধীনতা ‘অনুন্নত’ দেশগুলোর ‘উন্নতি’ ঘটাতে পারবে না বা ঘটাবে না; তাই, ‘উন্নত’ দেশগুলোর উপনিবেশ-বিস্তারক শক্তির প্রতিরোধ করে ‘অনুন্নত’ দেশগুলোকে স্বাধীন, স্ব-নিয়ন্ত্রিত পথে এগোতে হবে।

দ্বিতীয় সাধারণ জায়গা এই যে তিনটি রূপই এই মতবাদিক নির্ণয়ের উপর ভিত্তিশীল যে প্রকৃতি ও ইতিহাসের পটে ‘অগ্রগতি’-র পথরেখা বস্তুগত উৎপাদন (material production)-এর উৎপাদনী শক্তির বিকাশের মধ্য দিয়েই একমাত্র ঘটে। এই নির্ণয় অনুযায়ী, ‘অনুন্নত’ দেশগুলো ‘উন্নত’-দের সমকক্ষ হয়ে উঠতে পারে অতিদ্রুত নিজ দেশের বস্তুগত উৎপাদনের উৎপাদনী শক্তি বিকশিত করে উন্নত-দের স্তরে নিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে; বস্তুগত উৎপাদন ও বস্তুগত ভোগ (material consumption) দ্রুত বাড়ানোর জন্য আচার-ব্যবহার-অভ্যাস থেকে শুরু করে সামাজিক কাঠামোর আগাপাশতলার দ্রুত বলপূর্বক পরিবর্তন করার মধ্য দিয়ে; এবং এই বলপূর্বক পরিবর্তন প্রক্রিয়ার চালক রূপে একটি কেন্দ্রীভূত চরিত্রের শক্তিশালী রাষ্ট্রকে সর্বাত্মক ক্ষমতার অধিকারী করে তোলার মধ্য দিয়ে।

এই তিনটি রূপের মধ্যে পার্থক্য আছে বৈরিতা-নির্মাণে। যেমন, ফ্যাসিবাদী প্রকাশের রূপে (আদর্শ রূপ- ইতালিয় নাজি-দের মতবাদিক রূপ) বৈরিতা ‘সাম্রাজ্যবাদী’ (অগ্রসর, উপনিবেশ-বিস্তারক) জাতিদের সঙ্গে ‘সর্বহারা’ জাতির (‘proletarian nations’, অনগ্রসর জাতি); সাম্যবাদী প্রকাশের রূপে (আদর্শ রূপ- রুশ বা চিনা কম্যুনিজম) বৈরিতা সাম্রাজ্যবাদী বুর্জোয়াদের সাথে বিশ্ব সর্বহারার, আর জাতীয় বুর্জোয়া প্রকাশের রূপে বৈরিতা সাম্রাজ্যবাদী জাতি/ বুর্জোয়াদের ও তাদের দেশীয় এঁটুলিদের সঙ্গে স্বাধীনতাকামী জাতীয় বুর্জোয়ার।

এই তিনটি প্রকাশই দেশীয় আপামর মানুষ, এমনকি যাদের ভিত্তিতে সে তার স্ব-নির্ধারণ নির্মাণ করে, সেই জনগোষ্ঠীরও রাজনৈতিক স্বতক্রিয়ার যোগ্যতা/ কার্যকারিতা/ সক্ষমতা সম্পর্কে বিপুল সন্দিহান, বা প্রকৃতপক্ষে ভরসাহীন। এই সন্দেহ বা ভরসাহীনতা অবশ্য তাদের নিজের নিজের মতো করে। ফ্যাসিবাদীদের নির্ধারণ এই যে সর্বহারা জাতির সাধারণজন স্রোতোহীনতা-নিশ্চলতা-য় আবদ্ধ হয়ে এমনভাবে পশ্চাৎপদ মানসিকতায় প্রোথিত যে তাদের উজ্জীবিত করে জাতীয় গৌরবের উপলব্ধিতে উপনীত করার জন্য প্রাথমিকভাবে তাদের উপর এক ‘আলোকপ্রাপ্ত উপকারী স্বৈরতন্ত্র' কায়েম করা দরকার যা কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার প্রয়োগে ‘দ্রুত জাতীয় উন্নতি’ ঘটাতে পারবে। কম্যুনিস্টদের নির্ধারণ এই যে পঁুজিবাদী শাসন-শোষণে ন্যুব্জ ও বহুধা বিভক্ত বাস্তব শ্রমিকদের ‘শ্রমিকশ্রেণির সাধারণ শ্রেণিস্বার্থে’ অবিচল থেকে ক্রিয়াশীল থাকা সম্ভব হয় না, তাই তাদের ‘অগ্রবাহিনী’ হিসেবে ‘সচেতনতার আকর পার্টি’-কে তাদের হয়ে এই ক্রিয়া করতে হবে; এবং, এ কাজ পার্টি-কে করতে হবে প্রয়োজন পড়লে ‘বিভ্রান্ত, অস্বচ্ছ চিন্তার অধিকারী’ শ্রমিকসাধারণের ব্যাপক অংশের রাজনৈতিক অভিপ্রায়ের বিরুদ্ধে গিয়েও, প্রয়োজন পড়লে তাদের দমন করেও। জাতীয় বুর্জোয়া রূপকারদেরও নির্ধারণ এই যে পশ্চাদটানে আবদ্ধ ‘জাতি’-র দ্রুত উন্নতির জন্য দরকার কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার এক বিকাশকামী রাষ্ট্রের ‘উপকারী স্বৈরতন্ত্র’।

এই তিনটি রূপেই তাই সর্বসাধারণের রাজনৈতিক সক্রিয়তা আত্মসাৎকারী কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার শক্তিশালী রাষ্ট্রের আধিপত্যাধীন রাজনৈতিক পরিসর নির্মাণের প্রবণতা তৈরি হয়। বস্তুগত-উৎপাদন-ও-উপভোগ (consumption)-এর দ্রুত থেকে দ্রুততর বৃদ্ধিসাধনই ক্রমশ পাখির চোখ করে এই রূপগুলি মানবঅস্তিত্বকে ক্রমশ সংকটগ্রস্ত ও পতিত করে তুলতে থাকে, যা গণ-রাজনৈতিক স্বতক্রিয়ার সম্ভাবনাকে আরো দুর্বল করতে থাকে। একক শক্তিশালী ক্রিয়াকর্তা রাষ্ট্র (বা কোনও ‘অতিমানব’ রাষ্ট্রীয় নেতা বা পার্টি) বিশাল ও সর্বাত্মক রূপ নিয়ে সামনে হাজির হয়ে দৃষ্টি ও বোধকে এমনভাবে আচ্ছন্ন করে দেয় যে গণ-অন্তর্ভুক্ত প্রতিটি সাধারণজন ক্ষমতাহীন, ক্রিয়াকর্তব্যহীন ও একাকী হয়ে ওঠে, তার রাজনৈতিক স্বতক্রিয়ার সক্ষমতা পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়।

বহুত্বের রাজনীতি– পরিসর ও মুহূর্ত

বহুত্বের রাজনীতি একমাত্র সর্বসাধারণের স্বতক্রিয়ার মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেতে পারে। কিন্তু স্বতক্রিয়া বলতে কী বোঝানো হচ্ছে? সেইটাই প্রথমে আলোচনা করা যাক।

পৌনঃপুনিক বস্তু-উপভোগ (material consumption) মানবঅস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য অবশ্যপ্রয়োজনীয়। এই প্রয়োজন মেটানোর জন্য, অর্থাৎ উপভোগের বস্তু আহরণ বা উৎপাদন করার জন্য মানুষকে এক প্রকার ক্রিয়া করতে হয়, আমরা আগে দেখেছি যে আরেন্টের ভাষায় এই ক্রিয়া হল ‘শ্রম’ (‘labour’)। এই শ্রমের ফসল দ্রুত উপভুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে ধ্বংস হয়ে কেবল সাময়িকভাবেই প্রয়োজন মেটাতে পারে। পৌনঃপুনিক শ্রমের বাধ্যবাধকতা এসে পড়ে। ক্ষণস্থায়িত্বের মধ্য দিয়ে বিলীন হয়ে যাওয়ার উদ্বেগ ও পৌনঃপুনিকতা বজায় রাখার উদ্বেগ এর মধ্য দিয়ে মানবঅস্তিত্বের অন্তর্গত হয়। স্বতক্রিয়া বলতে এই শ্রমকে বোঝানো হচ্ছে না।

ক্ষণস্থায়িত্বের মধ্য দিয়ে বিলীন হয়ে যাওয়ার উদ্বেগ ও পৌনঃপুনিকতা বজায় রাখার উদ্বেগ অতিক্রম করার অভিপ্রায় নিয়ে মানুষ এমন কিছু সৃষ্টি করতে চাইতে পারে যে সৃষ্টির অস্তিত্ব (এবং তার মধ্য দিয়ে তার স্রষ্টার অস্তিত্বও) দীর্ঘস্থায়ী (বা চিরস্থায়ী) হতে পারে। মানুষের এমন ক্রিয়াকে বলা যাক ‘কীর্তি’ (আরেন্টের ভাষায় ‘work’)। প্রযুক্তি/প্রকৌশল উদ্ভাবনের মধ্য দিয়ে মানুষ যেমন পুনরাবৃত্তিমূলক শ্রমের ভার লাঘব করার চেষ্টা করে, তেমনই পৃথিবী/প্রকৃতি-র উপর দীর্ঘস্থায়ী/ চিরস্থায়ী মানবসৃষ্ট ছাপ তৈরি করতে চায়, যে ছাপ তাৎক্ষণিক উপভুক্তির মধ্য দিয়ে বিস্মরণে মিলিয়ে যাবে না। অক্ষয়-অস্তিত্ব উৎপাদনের লক্ষ্য নিয়ে দৃঢ়সংকল্প এই সৃষ্টিপ্রচেষ্টা, অর্থাৎ, কীর্তি-র মধ্য দিয়ে মানুষ জৈবিক-প্রাকৃতিক চাহিদা ও উপভোগের ক্ষণস্থায়িত্ব ও পৌনঃপুনিকতার কারাগার ভেঙে সার্বভৌম ‘সৃষ্টিকর্তা’-র অবস্থানে উঠতে চায়। স্বতক্রিয়া বলতে এই কীর্তিকেও বোঝানো হচ্ছে না।

দৃঢ়সংকল্প সৃষ্টি-আকাঙ্ক্ষার এই কীর্তি-পথে রাজনীতি বারবার পতিত হয়েছে। এই পতনের সবচেয়ে সর্বগ্রাসী চেহারা বিশ শতকে হাজির হয়েছে সর্বাত্মকতাবাদী রাজনীতির বিভিন্ন রূপ ধরে যেখানে প্রকৃতির গতির (দুর্বল জাতিদের পরাভব ও বিলুপ্তির মধ্য দিয়ে শ্রেষ্ঠ জাতির আদলে মানবজাতির পুনর্গঠনের তত্ত্ব), বা ইতিহাসের গতির (১।‘আগুয়ান’ সমাজের আদলে সমগ্র মানবসমাজকে পুনর্নির্মাণ করার জন্য ‘পশ্চাৎপদ’ সব সমাজকে ধ্বংস করা, বা, ২।‘প্রগতিশীল’ শ্রেণির হাতে সভ্যতার রথের রশি তুলে দেওয়ার জন্য ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ সমস্ত শ্রেণির দমন ও বিলোপ) মতবাদিক নির্মাণের উপর দাঁড়িয়ে স্থিরীকৃত নকশা অনুযায়ী ‘আদর্শ’ সমাজ/রাষ্ট্র গড়ে তোলার অভিযান পরিচালিত হয়েছে। ঔপনিবেশিক আধিপত্য বিস্তারের রাজনীতি, ফ্যাসিবাদী ও নাৎসি রাজনীতি, কম্যুনিস্ট সর্বাত্মকতাবাদী রাজনীতি ও স্বঘোষিত ‘গণের মুক্তিদাতা’-দের ‘উপকারী স্বৈরতন্ত্র’-এহেন বিভিন্ন রূপ ধরে প্রতিস্থাপনার রাজনীতি বা বৈরিতার রাজনীতি পৃথিবী জুড়ে দাপিয়ে বেড়িয়েছে । মানুষদের মধ্যের বহুত্বকে এক পরিকল্পিত সমরূপীয়তার লৌহবেষ্টনীতে পেষণ করে ‘আদর্শ’ এক ‘পশুখামার’ সৃষ্টির ভয়াবহ সন্ত্রাস ইতিহাসকে এক বিপর্যয় থেকে আরেক বিপর্যয়ে নিক্ষেপ করেছে।

শ্রম বা কীর্তি যদি স্বতক্রিয়া না হয়, তাহলে স্বতক্রিয়া কী? হানা আরেন্ট-এর একটি বক্তব্য বিবেচনা করা যাক—

কথা ও কাজের মাধ্যমে আমরা মানবজগতের মধ্যে নিজেদের সন্নিবেশিত করি। এই সন্নিবেশকরণ এক দ্বিতীয় জন্মের মতো, যার মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের মৌলিক শারীরিক উপস্থিতির নগ্ন ঘটনাকে স্বীকৃতি দিই ও নিশ্চিত করি। জৈবিক-প্রাকৃতিক চাহিদা নিরসনের লক্ষ্যে পুনরাবৃত্তিমূলক শ্রম যেমন অত্যাবশ্যকতা দ্বারা আমাদের উপর আরোপিত, এই সন্নিবেশকরণ তেমন কোনও অত্যাবশ্যকতা দ্বারা আরোপিত নয়। দৃঢ়সংকল্প কীর্তি যেমন উপযোগিতা দ্বারা চালিত, এই সন্নিবেশকরণ তেমন কোনও উপযোগিতা দ্বারা চালিত নয়। এই সন্নিবেশকরণ প্রেরণা পেতে পারে অপরদের উপস্থিতি থেকে, যে অপরদের সান্নিধ্যলাভের ইচ্ছা হয়তো আমরা পোষণ করি, কিন্তু কখনোই তা এর দ্বারা পূর্বনির্ধারিত নয়। আমাদের জন্মগ্রহণের মধ্য দিয়ে যে নতুন সূত্রপাত জগতে ঘটে এবং স্বতপ্রবৃত্তভাবে নতুন কিছু শুরু করার মধ্য দিয়ে যাতে আমরা সাড়া দিই, সেই নতুন সূত্রপাতের অভিঘাতে এই সন্নিবেশকরণ ঘটে। ১৩

অপরদের সান্নিধ্যলাভের অভিপ্রায় দ্বারা অনুপ্রাণিত স্বতপ্রবৃত্তভাবে নতুনের সূচনাকারী কথা ও কাজকে আরেন্ট স্বতক্রিয়া (action)-র ধরন হিসাবে ধরেছেন। এই কথা/কাজ-এর মধ্য দিয়ে মানুষ মানবজগতের মধ্যে নিজেকে সন্নিবিষ্ট করে। কিন্তু এ কথা কী ধরনের কথা? এ কাজ কী ধরনের কাজ? সেই দিকটাই আরেকটু বিশদে বিবেচনা করা যাক।

কথা নানারকম হতে পারে, যেমন—

  • ভাষণ, যার মধ্য দিয়ে অপরকে শোনাতে চাওয়া হয়, শুনতে চাওয়া হয় না;
  • নির্দেশ, যার মধ্য দিয়ে অপরকে চালনা করতে চাওয়া হয়, নিজ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চাওয়া হয়;
  • বিজ্ঞাপন, যার মধ্য দিয়ে সাজানো-গোছানো এক ‘আমি'-কে অভিসন্ধিমূলকভাবে হাজির করা হয়;
  • মোহনকথন, যার মধ্য দিয়ে অপরকে মোহাচ্ছন্ন করে নিজ বক্তব্যকে নিরঙ্কুশ করা হয়;
  • ছলকথন, যা মনের কথা নয় তা নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যসিদ্ধির জন্য বলা;
  • ইত্যাদি।

এমত সব কথাই কি স্বতক্রিয়া? না, এমত সব কথা স্বতক্রিয়া নয়। কারণ এই সমস্ত রকম কথা নিজ ও অপরের মধ্যে ক্ষমতার স্তর নির্মাণের উপযোগিতা দ্বারা নির্ধারিত। কথা তখনই স্বতক্রিয়া হয়ে উঠতে থাকে যখন তা নিজ ‘এক’-এর কোনও প্রকল্পিত মূর্তি হাজির করে ক্ষমতার থাক নির্মাণ করার বদলে সমতলীয় স্তরে অপরের সান্নিধ্যাকাঙ্খী হয়ে ওঠে; এক এবং অপরের মধ্যে ঔৎসুক্য ও বিস্ময়ে ভরা যাতায়াতের পথ হয়ে ওঠে।

তেমনই, সব কাজই স্বতক্রিয়া নয়। যে কাজ জৈবিক প্রয়োজন মেটানোর আবশ্যকীয়তা দ্বারা চালিত নয়, আবার, নির্দিষ্ট উপযোগিতার ভিত্তিতেও গৃহীত নয়, যে কাজ বহু বিবিধ অপরাপরের পারস্পরিক সান্নিধ্যের উপায় এবং উদযাপন, সেই কাজই স্বতক্রিয়া। অন্ন-বস্ত্র-হর্ম্য-র প্রয়োজন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনওভাবেই স্বতক্রিয়া মেটায় না। একক বা গোষ্ঠীগত কোনও পরিকল্পিত উদ্যোগের দৃঢ়সংকল্প পথে মানবঅস্তিত্বের ক্ষণস্থায়িত্বকে আতিক্রম করা কোনও কীর্তি স্থাপনের উদ্দেশ্যসাধন স্বতক্রিয়ার কর্ম নয়। অপরের সঙ্গাভিলাষী ‘এক’-এর বহু বিবিধ মানুষের বারোয়ারি পরিসরে ‘নিজ’-কে হাজির করার স্বউদ্যোগই স্বতক্রিয়া।

 মানুষ বা মানবতার কোনও একমেবাদ্বিতীয়ম নির্বিকল্প রূপ নেই। মানুষ বা মানবতা বহু, বিভিন্ন, বিচিত্র। এই বহু বিভিন্ন বিচিত্র যখন বারোয়ারি পরিসরে ‘নিজ’-কে নতুনভাবে হাজির করে স্বউদ্যোগে, বহুত্বের সন্নিবেশে জায়মান নতুনকে যাপন করে উৎসাহ ও বিস্ময় ভরে, তখন সেই মুক্তক্রিয়ার মধ্য দিয়ে হাজির হয় বহুত্বের রাজনীতির মুহূর্ত।

আনুষ্ঠানিকতাহীন স্বতঃস্ফূর্ত কথাবার্তা, দৃষ্টিভঙ্গির বিনিময়, আলোচনা, প্রবর্তনা— এই সমস্ত, যা বারোয়ারি পরিসরের বিষয়ে সার্বজনিক অস্তিত্ব-উদযাপনে বহু ও বিভিন্ন-র যৌথ উদ্যোগের উন্মেষ ঘটায়, তাই-ই বহুত্বের রাজনীতির মুহূর্তগুলোকে গড়ে তোলে। পশ্চিমী ইতিহাসের সারণিতে এমন কিছু বহুত্বের রাজনীতির মুহূর্ত হানা আরেন্ট উদাহরণস্বরূপ চিহ্নিত করেছিলেন। সেই মুহূর্তগুলো হলো—

  • অতিকথার কুয়াশায় আচ্ছন্ন প্রাচীন গ্রিক ‘পলিস’ (polis);
  • ১৭ শতকের আমেরিকার বিপ্লবের পথে জন্ম নেওয়া ‘টাউনসিপ' ও ‘টাউন হল মিটিং’;
  • ১৮ শতকের ফরাসি বিপ্লবের পথে জন্ম নেওয়া পারি শহরের ‘রিভলুশনারি মিউনিসিপাল কাউন্সিল’;
  • ১৯ ও ২০ শতকে ইউরোপে শ্রমিকশ্রেণির আন্দোলনের মধ্য থেকে জন্ম নেওয়া বিভিন্ন ‘কাউন্সিল’ ও ‘কম্যুন’;
  • ১৯৫৩ সালে রুশ সর্বাত্মকতাবাদী শাসনের বিরুদ্ধে হাঙ্গেরির গণঅভ্যুত্থানের মধ্যে জন্ম নেওয়া বিভিন্ন নাগরিক কাউন্সিল;
  • ইত্যাদি।১৪

এই সমস্ত ক্ষেত্রে সম্মিলিত মানুষ কী আলোচনা-বিচার-বিবেচনা করত এবং কীভাবে করত?

আরেন্ট-এর মতে, রাজনৈতিক স্বতক্রিয়ার বিষয়বস্তু রাজনীতি স্বয়ং। মুক্ত স্বতঃস্ফূর্ত আলোচনা, উপস্থাপনা ও প্রবর্তনার মুখ্য বিষয় আবশ্যিকভাবে হয়ে ওঠে এই আলোচনা, উপস্থাপনা ও প্রবর্তনা চালানোর মুক্ত পরিবেশ— সমসম্মানে অপরাপরের একে অন্যের সান্নিধ্যে আসা, একে অপরের দিকে নিজেদের প্রসারিত করা ও বহুত্বকে লালন করা— যাতে বজায় থাকে তার উপায় বন্দোবস্ত করা, কথোপকথন ও মতবিনিময়ের মধ্য দিয়ে স্বশাসন চালানোর উপায় প্রবর্তন করা ও নিত্য উত্থিত অদৃষ্টপূর্ব সংকটের মুখে প্রবর্তিত উপায়ের নবীকরণ ঘটানো।

বারোয়ারী পরিসরে নীতি নির্ধারণের ও ক্রিয়ার প্রশাসনিক, বিদ্যায়তনিক ও সোপানতান্ত্রিক সমস্ত পদ্ধতি রাজনৈতিক স্বতক্রিয়ার পরিপন্থী। রাজনৈতিক স্বতক্রিয়া সম্ভবপর হতে হলে প্রতিটি সাধারণ মানুষকে (যত ‘সাধারণ'-ই সেই সাধারণ মানুষ হোক না কেন, এমনকি যত ‘অব-সাধারণ'ও সে হোক না কেন) তার নিজের/নিজেদের অবস্থিতি সম্পর্কে নিজস্ব বোধ আলোচনা-সংলাপের পরিসরে হাজির করতে হবে, নীতি নির্ধারণের লক্ষ্যে নিজস্ব প্রস্তাব হাজির করতে হবে। এই অপরাপর বহু মতামত সমগুরুত্বের জায়গা থেকে হাজির হওয়া ও পারস্পরিক সান্নিধ্যে প্রবর্তিত হয়ে বারোয়ারি পরিসরের সার্বজনীন মঙ্গলের নীতিকে অভিব্যক্ত করার মধ্য দিয়েই বহুত্বের রাজনীতি মূর্ত হতে পারে। তা সম্ভবপর হয় না যখন প্রশাসনিক, বিদ্যায়তনিক বা সোপানতান্ত্রিক ক্ষমতাশীর্ষ নির্মাণ বারোয়ারি পরিসরকে বিকৃত করে এবং কেবলমাত্র সেই ক্ষমতাশীর্ষ থেকেই বারোয়ারি পরিসরের নীতি নির্ধারণের জন্য সমস্ত জ্ঞান-বোধ-মতামত যোগান হওয়া সম্ভবপর ও কাম্য বলে নির্ধারণ করে। এই নির্ধারণের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে বারোয়ারি পরিসরে সার্বজনিক অংশগ্রহণ/সক্রিয়তা-র প্রসারকে উন্মুক্ত রাখা ও প্রসারিত করাই রাজনৈতিক স্বতক্রিয়ার বিষয়। গোষ্ঠী/স্বার্থ/শ্রেণি-র প্রতিনিধিস্বরূপ কতিপয় জনের ক্রিয়া, যা বহুজনের/গণ-এর ক্রিয়ার অধিকার ও সক্ষমতাকে গ্রাস করার মধ্য দিয়ে নিজের ক্ষমতাকে নির্মাণ করে, তা রাজনৈতিক স্বতক্রিয়ার পরিপন্থী। রাজনৈতিক স্বতক্রিয়া একমাত্র সর্বশেষজন পর্যন্ত সর্বজনের স্বতক্রিয়ার অধিকার, সক্ষমতা ও বাস্তবতা প্রণোদন করা ও বজায় রাখার মধ্য দিয়েই উৎসারিত হতে পারে।

বহুত্বের অবস্থিতির উপর সমসত্ত্বসন্ধানী সাধারণীকরণের প্রমত্ততা জারি করে সমরূপীয় এক/একক কোনও অর্থনৈতিক-স্বার্থ/সামাজিক-স্বার্থ-র প্রকৌশলী নির্মাণ এবং বারোয়ারি পরিসরের উপর তা চাপিয়ে দেওয়া গণ-কে নির্ধারিত স্বার্থের সুতোয় বাঁধা কিছু পুতুলের দঙ্গলে পরিণত করতে চায়। তাই তাকে বহুত্বের রাজনীতির পরিসর ধ্বংস করতে হয়। রাজনৈতিক স্বতক্রিয়াকে তাই তার সঞ্চারণের পরিসর— বহুত্বের রাজনীতির পরিসর–কে রক্ষা করার জন্য যুযুধান থাকতে হয় সমসত্ত্বসন্ধানী সাধারণীকরণের যে কোনও প্রবণতার বিরুদ্ধে, সমরূপীয়তার যে কোনও প্রকৌশলী নির্মাণের বিরুদ্ধে। সমরূপীয়তায় অবধারণ-অযোগ্য বহুত্বের উপস্থিতি ছাড়া রাজনৈতিক স্বতক্রিয়া অসম্ভব।

বহুত্বের রাজনীতি তাই প্রতিটি মুহূর্তেই তার অস্তিত্ব নিয়ে ভাবিত, উদ্বিগ্ন। বহুত্বের রাজনীতি যুগ-জীবী নয়, তা মুহূর্ত-জীবী। আবার, বহুত্বের রাজনীতি প্রতি মুহূর্তের মধ্যে নতুনের সম্ভবপর হয়ে ওঠার অনুভবে বিস্ময়াবিষ্ট।

অহিংসা ও স্বতক্রিয়া

বিবিধ, এমনকি পরস্পর বিপরীত রাজনৈতিক প্রবণতা লক্ষ্যসাধনের উপায় হিসেবে অক্লেশে হিংসা অবলম্বন করে। আধিপত্যবাদী, জাতিগৌরবাকাঙ্খী, উপনিবেশবাদী, উপনিবেশ-বিরোধী, সমাজতন্ত্রী, সাম্যবাদী— এহেন বিভিন্ন মতবাদ দ্বারা চালিত রাজনৈতিক কর্তারা তঁাদের মতবাদিক আদলে সমাজকে রূপ দেওয়ার জন্য, অর্থাৎ নির্দিষ্ট লক্ষ্যে বদল ঘটানোর জন্য, হিংসার প্রয়োগকে স্বাভাবিক ও প্রশ্নাতীত বলে ধরতেই অভ্যস্ত। মতবাদিক বাগাড়ম্বরে অবশ্য এক হিংসার সঙ্গে আরেক হিংসার নানা প্রভেদ ও পার্থক্য হাজির করা হয়। যেমন– আধিপত্যবাদী হিংসা ও আধিপত্যবিরোধী হিংসা, স্বতঃপ্রণোদিত হিংসা ও হিংসার প্রতিক্রিয়ায় হিংসা, প্রতিবিপ্লবী হিংসা ও বিপ্লবী হিংসা, প্রতিক্রিয়াশীল হিংসা ও প্রগতিশীল হিংসা, ইত্যাদি। এর মধ্য দিয়ে এক হিংসার সঙ্গে আরেক হিংসার ন্যায্যতা অনুমোদনের ফারাক তৈরি করা হয়। যেনবা, মৌল বিষয় হিসেবে হিংসা কোনও প্রশ্ন-আলোচনার বস্তু নয়, কোন লক্ষ্যে তা নিয়োজিত সে নিয়ে প্রশ্ন-আলোচনা ও শ্রেয়তা-বিচার চলতে পারে। এহেন মতবাদিক বাগাড়ম্বরের তুরুপের তাস হল স্বতঃসিদ্ধ হিসাবে হাজির করা এই অনুমান যে— উপায়ের বিচার হয় তার লক্ষ্য দিয়েই। অর্থাৎ, লক্ষ্য যদি ন্যায্য হয়, তার জন্য যে কোনও উপায়ই অবলম্বন করা যায়। এভাবে রাজনৈতিক পরিসরের আলোচনায় হিংসার শ্রেয়তা নিয়ে আলোচনাকে অবান্তর প্রতিপন্ন করে আলোচনাকে আবদ্ধ করা হয় মতবাদের আখড়ায় এক মতবাদ বনাম অন্য মতবাদের বিতণ্ডায়, কারণ লক্ষ্য তো মতবাদেরই গর্ভপ্রসূত। যে মতবাদের আমরা পক্ষে, তার নামে হিংসারও পক্ষে। যে মতবাদের আমরা বিরুদ্ধে, তার নামে হিংসারও বিরুদ্ধে। আর নিজপক্ষের মতবাদের নামে হিংসার ওকালতি করার জন্য সঠিক লক্ষ্যে নিয়োজিত হিংসার নানা গুণকীর্তনও তৈরি হয়, হিংসাবলম্বনে সংশয়ীদের নানা দুর্বলতাও চিহ্নিত করা হয়। এহেন তত্ত্বপ্রণেতারা সু-মতবাদ-পোষিত হিংসার গুণ গেয়ে বলেন যে হিংসা হিংসাবলম্বনকারীর চরিত্র দৃঢ় করে/ শ্রেণি-অবস্থান দৃঢ় করে/ সংশয়জাল ছিন্ন করে একমুখী করে/ দ্বিধান্বিত অবস্থা কাটিয়ে অবিচলিত বিপ্লবী করে তোলে/ নিষ্ক্রিয়তা কাটিয়ে সক্রিয় করে তোলে/ ধর্মসংস্কার-ভাবালুতার পাঁক থেকে উঠিয়ে নির্মোহ সচেতনতার শক্ত জমিতে দাঁড় করায়... ইত্যাদি, ইত্যাদি।

অথচ, হিংসার উপাচারে মতবাদ-নির্ণীত ‘শিব’ গড়তে গিয়ে বাঁদর গড়ার নিদর্শনই ইতিহাসে ফিরে ফিরে আসে। স্বৈরতন্ত্রকে হিংসার ঝড়ে উপড়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ‘সাধু’ লক্ষ্য পর্যবসিত হয়েছে আরও গভীর স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠায়। হিংসা-অবদমনের ঔপনিবেশিক শাসনকে যারা হিংসাত্মক সংগ্রামে উৎপাটন করল, তারাই আবার উত্তর-ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রে হিংসা-অবদমনের পরিচালক হল। নিপীড়ন-অসাম্য-শোষণ-ভিত্তিক সমাজকে বিপ্লবী হিংসার মধ্য দিয়ে যারা রূপান্তর করতে চেয়েছিল, বিপ্লবোত্তর সমাজে তারা এমন সর্বাত্মকতাবাদী রাষ্ট্রের জন্ম দিল যা নিপীড়ন-শোষণ-অসাম্যকে নতুন শিখরে নিয়ে গেল। এমন তো আমরা কম দেখিনি। এই অভিজ্ঞতারই প্রতিফলন দেখি যখন পোল্যাণ্ডের ‘সলিডারিটি' আন্দোলনের অন্যতম মুখপাত্র আদম মিচনিক ১৯৮৫ সালে কারাগারবন্দী অবস্থায় লেখা এক চিঠিতে লেখেন:

ইতিহাসের শিক্ষা মাথায় রাখলে আমার সন্দেহ হয় যে ঝোড়ো আক্রমণে এখনকার বাস্তিলগুলোকে উড়িয়ে দিতে গেলে অজান্তেই আমরা নতুন নতুন বাস্তিলের পত্তন করব।... বিপ্লবী হিংসার সম্ভাব্য ফলাফল সম্পর্কে ঐতিহাসিক সচেতনতার গুরুত্ব মুক্তির সংগ্রামের যে কোনও পরিকল্পনায় খেয়াল রাখা উচিত। স্বাধীনতা সংগ্রামে লিপ্ত যে কোনও ব্যক্তিকে সন্ত্রাসের পথ কীভাবে ভিতর থেকে নষ্ট ও দূষিত করতে পারে তা স্বাধীনতার সংগ্রাম শামিল প্রত্যেকের খেয়াল রাখা উচিত।১৫

হিংসার পথ, সন্ত্রাসের পথ স্বাধীনতার/মুক্তির সংগ্রামে নিবেদিত ব্যক্তিকে কীভাবে ভিতর থেকে নষ্ট/দূষিত করে? কীভাবে স্বাধীনতা/মুক্তির শৃঙ্খলমোচনের বদলে নতুন শৃঙ্খলের জন্ম হয়? এই প্রশ্নগুলোর মুখোমুখি হতে গেলে মতবাদিক লক্ষ্য নিরপেক্ষভাবে মৌল রাজনৈতিক উপায় হিসেবে হিংসা-কে বিচারবস্তু করে তুলতে হয়। হানা আরেন্ট তা-ই করেছেন।

হিংসা প্রসঙ্গে হানা আরেন্ট-এর আলোচনার কেন্দ্রে আছে ‘ক্ষমতা’ সম্পর্কে ধারণা। সমাজ-রাজনীতির আলোচনায় ‘ক্ষমতা’ একটি বহুল ব্যবহৃত বর্গ হলেও, বিভিন্ন জন বিভিন্ন অর্থে তা ব্যবহার করেন। হানা আরেন্ট ক্ষমতা বর্গটিকে ব্যবহার করেছেন একটি নির্দিষ্ট অর্থে, যা হল:

ক্ষমতা কেবল ক্রিয়া করার মানবিক সক্ষমতার সঙ্গেই যুক্ত নয়, তা যৌথ ক্রিয়া বা একযোগে ক্রিয়া করার সক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত। ক্ষমতা কখনওই কোনো ব্যক্তিবিশেষের সম্পত্তি নয়, তা একটি গোষ্ঠীর সম্পত্তি এবং যতক্ষণ সেই গোষ্ঠী একসঙ্গে থাকে ততক্ষণই তার অস্তিত্ব। যখন আমরা বলি যে ‘সে ক্ষমতায় আছে’, তখন আমরা প্রকৃত অর্থে বোঝাই যে সে ক্ষমতা প্রদত্ত হয়েছে কিছু সংখ্যক মানুষের দ্বারা তাদের নামে ক্রিয়া করার জন্য। যে মুহূর্তে ক্ষমতার উৎসভূমি হিসেবে কাজ করা গোষ্ঠী অদৃশ্য হয়, ক্ষমতা-প্রদত্ত ব্যক্তির ক্ষমতাও অদৃশ্য হয়।১৬

এই ধারণা অনুযায়ী ক্ষমতার উৎস হল জনগোষ্ঠীর সক্রিয় সমর্থন যা কোনও ব্যক্তি/ব্যক্তিবর্গ/প্রতিষ্ঠানকে বারোয়ারি পরিসরের বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া ও ক্রিয়া করার অধিকার দেয়। এই সিদ্ধান্ত ও ক্রিয়ার কার্যকারিতা ও প্রভাবও নির্ভর করে জনগোষ্ঠীর গ্রহণশীলতা ও সহযোগিতার উপর। জনগোষ্ঠীর এই সমর্থন ও গ্রহণশীলতা যখন অসন্তুষ্টি, বিরোধিতা ও অসহযোগে পরিণত হতে থাকে, তখন ক্ষমতার উৎস শুকিয়ে আসে, বা ক্ষমতার ভিতে ক্ষয় ধরতে থাকে। ক্ষমতাপ্রাপ্তদের পায়ের তলায় যখন এভাবে ভিত নডে় ওঠে বা ভিত ধ্বসে যায়, তখন নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার জন্য ‘ক্ষমতা’কে হিংসা দিয়ে প্রতিস্থাপিত করার প্রবণতা তাদের মধ্যে দেখা দেয়।

হিংসা নির্ভর করে যন্ত্র ও যান্ত্রিকতার শক্তির উপর। অস্ত্রশক্তি, নজরদারি প্রযুক্তি, কারাগার, আমলাতন্ত্রের যান্ত্রিকতা— এসবের মধ্য দিয়ে জনগোষ্ঠীর অসন্তুষ্টি, বিরোধিতা, অসহযোগকে অবদমিত/নিষ্ক্রিয় করে ক্ষমতাভ্রষ্ট শাসক তার শাসনপ্রক্রিয়া বহাল রাখতে চায়।

এহেন ক্ষমতাভ্রষ্ট শাসকের শাসন অপসারণের সংগ্রাম হিংসার উপায় অবলম্বন করে গড়ে উঠলে সেই সংগ্রামও যন্ত্র ও যান্ত্রিকতার শক্তির উপর নির্ভর করে। রাষ্ট্রের অস্ত্রশস্ত্র, নজরদারি প্রযুক্তি, আমলাতান্ত্রিক যান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে বিরুদ্ধ-বাহিনীর পাল্টা অস্ত্রশস্ত্র, গোপনীয়তা ও দলীয় আনুগত্য/বাঁধুনির টক্কর চলে। দুই পক্ষই ব্যাপক জনগোষ্ঠীকে সন্দেহের চোখে দেখে, অসচেতন বা ভ্রান্ত চেতনায় আচ্ছন্ন বলে জনগোষ্ঠীর অবমূল্যায়ন করে এবং নিজেদের সেই অবমূল্যায়িত জনগোষ্ঠীর শিক্ষক/অভিভাবক হিসেবে ভাবে। এর ফলে দুই পক্ষই জনগোষ্ঠীর স্বতক্রিয়াকে দমন করে নিজেদের নির্দেশিত ক্রিয়ায় জনগোষ্ঠীকে বাধ্য অনুসরণকারী করে তুলতে চায়। ফলে এহেন টক্করের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসনে অধিষ্ঠিতের পরিবর্তন ঘটলেও নব অধিষ্ঠিতরা জনগোষ্ঠীর স্বতক্রিয়া, গ্রহণশীলতা ও সমর্থনের উৎস থেকে ক্ষমতা আহরণের পরিবর্তে যন্ত্র-যান্ত্রিকতার অভ্যস্ত পথেই নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে চায়। জনগণের স্বাধীনতার ঝাণ্ডা তুলে সংগ্রামের সাফল্য জনগণের জন্য নতুন স্বাধীনতা-হীনতায় পর্যবসিত হয়।

অন্যদিকে, হিংসার উপায় অবলম্বন না করে ক্ষমতাভ্রষ্ট শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম গড়ে উঠতে পারে অহিংস পথে। অহিংস পথের বৈশিষ্ট্য হিসাবে সাধারণভাবে দেখা যায় শাসনযন্ত্রের সঙ্গে অসহযোগ, আরো আরো বেশি মানুষের সমাবেশ, একযোগে স্বতক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ক্ষমতার নতুন উৎস সৃষ্টি করা। অস্ত্রশস্ত্র-আমলাতন্ত্রের যান্ত্রিক শক্তিকে পরাভূত করার সংগ্রাম চলে বিপুল সংখ্যক মানুষ একত্রিত হয়ে সৃষ্টিশীল সক্রিয়তার মধ্য দিয়ে স্বাধীন অস্তিত্বের বারোয়ারি পরিসরকে বিস্তৃত করা ও রক্ষা করার মধ্য দিয়ে। এর মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক পরিসরে মানুষদের একত্র হওয়ার ও একযোগে সক্রিয় হওয়ার নতুন নতুন আধার সৃষ্টি হয়। প্রত্যেকটি আধারই তার নিজস্ব সমাজ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সন্নিবেশিত জনগণের এক একটি নতুন উদ্ভাবন, মতবাদ-চালিত রাজনৈতিক ক্রিয়ার ধরাছোঁয়ার বাইরে। তারা হয়ত ক্ষণস্থায়ী হয়েছে, হিংসা-নির্ভর আক্রমণের সামনে বা মতবাদ-অন্ধ হিংসার সামনে তা টিকে থাকতে পারেনি, কিন্তু, হানা আরেন্ট যেমন বলেছেন, ‘পরবর্তী বিপ্লবের গোড়ায় আবার হয়ত তার পদধ্বনি শোনা যাবে’।

সুতরাং, হানা আরেন্টের বিবেচনা অনুযায়ী, রাজনৈতিক উপায় হিসেবে হিংসাকে পরিত্যাগ করে অহিংসাকে অবলম্বন করা সর্বসাধারণের স্বতক্রিয়ার ক্ষেত্র হিসেবে বারোয়ারি পরিসর গড়ে তোলা ও সজীব রাখার সঙ্গেই ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তা কোনো আদর্শ মতবাদিক বা নৈতিক অনুজ্ঞা নয়।

কয়েকটি উদাহরণ: গান্ধী থেকে জাপাতিস্তা

বিশ শতকের শুরুতে দক্ষিণ আফ্রিকার ট্রান্সভালে বর্ণবিদ্বেষী শাসনের বিরুদ্ধে মোহনদাস করমচঁাদ গান্ধীর নেতৃত্বে আইন-অমান্য আন্দোলন অহিংস আন্দোলনের ইতিহাসে একটি নতুন পর্যায়ের সূচনা করে। সেই আন্দোলনের অভিজ্ঞতা নিয়ে গান্ধী ভারতে ফিরে ভারতের ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে যে স্বরাজ অর্জনের লড়াই গড়ে তোলেন তা অহিংস আন্দোলনের পরীক্ষা-নিরীক্ষাকে বৃহত্তর পরিসরে বিস্তৃত করে। একদিকে সত্যাগ্রহ, অসহযোগ, আইন-অমান্য আন্দোলনের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের যন্ত্র-যান্ত্রিকতা-নির্ভর হিংসার বিরুদ্ধে নির্ভয়ে মাথা তুলে দাঁড়ানোর আত্মিক শক্তির উদ্বোধনের চেষ্টা ও অন্যদিকে গ্রামসমাজ পুনর্গঠনের মধ্য দিয়ে অপরাপরের সহযোগিতাভিত্তিক সমন্বয়ী সমাজ গঠনের চেষ্টা বিশ শতকের প্রথম চার দশকে অহিংস আন্দোলনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার তৈরি করে গেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর হিংসাদীর্ণ পরিস্থিতিতে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অন্তিম অঙ্কে সাম্প্রদায়িক হিংসা-অবিশ্বাস-দাঙ্গা যখন গান্ধী-অনুপ্রাণিত অহিংস আন্দোলনকে নস্যাৎ করে দিয়েছে, গান্ধী নিজেও যখন হিংসান্ধ ঘাতকের গুলিতে নিহত, গান্ধীর অন্যতম সহযোগী নির্মল কুমার বসু তখন লিখেছিলেন:

গান্ধীর শহিদ হওয়ার মধ্য দিয়ে যে অহিংসার আদর্শ বীজ হিসাবে উপ্ত হল, তা হয়ত আবার তরতাজা হয়ে নতুন জীবনে প্রস্ফুটিত হয়ে উঠবে কোনও একদিন, যখন আর সক্রেটিস ও গান্ধীর মতো ব্যক্তিবিশেষ তার নিঃসঙ্গ প্রতিনিধি থাকবেন না, বরং লাখ লাখ মানুষের সত্তার উদ্যানে ফুটে উঠে তা অশান্ত, অসুখী, ভীত-সন্ত্রস্ত মানবপরিবারে সান্ত্বনা ও শক্তি সঞ্চার করবে।১৭

অহিংস আন্দোলন সত্যি সত্যিই লাখ লাখ মানুষের সত্তার উদ্যানে বারবার নতুন হয়ে ফুটে উঠেছে। গান্ধীর অনুপ্রেরণায় অনুপ্রাণিত মার্টিন লুথার কিং-এর নেতৃত্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৪৫–১৯৭০ সালে নাগরিক অধিকার আন্দোলন, ১৯৬৮-তে চেকোশ্লোভাকিয়ায় গণতান্ত্রিক সমাজবাদের পরীক্ষানিরীক্ষা অঙ্কুরে দমন করার উদ্দেশ্যে চালিত সোভিয়েত সামরিক দখলদারির বিরুদ্ধে চেক নাগরিকদের গণ-প্রতিরোধ, পরবর্তীকালে ১৯৮০-র দশকে চেকোশ্লোভাকিয়ায় স্বৈরতন্ত্রের অবসান ঘটানো নাগরিক-প্রতিরোধ, পোল্যাণ্ডের ‘সলিডারিটি' আন্দোলন, বিশ শতকের শেষ দশকে সার্বিয়ায় ও বাল্টিক দেশে গণতন্ত্রের দাবিতে গণআন্দোলন যা একদা অপরাজেয় মনে হওয়া শাসকদের পতন ঘটিয়েছিল,... এভাবেই ইতিহাসের নতুন নতুন সন্ধিক্ষণে বিবিধ সমাজ-সময়-পরিবেশে অহিংস আন্দোলন বারবার রাজনৈতিক স্বতক্রিয়ার পরিসর নতুন করে নির্মাণ করেছে। একুশ শতকে ফিনান্স পঁুজির ধ্বংসাত্মক একাধিপত্যের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে লাখ লাখ মানুষের সমবেত ‘অকুপাই’ আন্দোলনও এই ধারায় নতুন প্রাণের স্পন্দন জাগিয়েছে। এই চলমান ধারাবাহিকতার মধ্যে ১৯৯৪ সাল থেকে বর্তমান সময় অবধিও ক্রিয়াশীল জাপাতিস্তা আন্দোলন মনে হয় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

সবথেকে চমকপ্রদ হল এই যে রাষ্ট্রীয় হিংসার সর্বাত্মক আক্রমণের মুখে সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রাম চালিয়ে যেতে বাধ্য জাপাতিস্তারা তাদের মুখপাত্র সাবকমান্ডান্ট মার্কোস-এর একাধিক বিবৃতির মধ্য দিয়ে বলে আসছে যে হিংসা নয়, অহিংসাই তাদের পথ। বিবিধ বিভিন্ন ভাবনার একসঙ্গে আলিঙ্গন করে থেকে স্বশাসন, স্বাধীনতা ও স্ববিকাশের যে পরিসর তারা নির্মাণ করতে চায়, সর্বসাধারণের স্বতক্রিয়াকেই তার ভিত্তিমূল করতে চায়, তার জন্য রাজনৈতিক উপায় হিসেবে অহিংসাই একমাত্র পথ। জাপাতিস্তাদের স্বশাসন গড়ে তোলার চর্চাপথ রাজনৈতিক উপায় হিসেবে অহিংসা অবলম্বনের নতুন ঐতিহাসিক নিদর্শন সৃষ্টি করে চলেছে।

পরিশেষে বলি, রাজনৈতিক সক্রিয়তা সম্পর্কিত তত্ত্ব ও ভাবনা আলোচনা রাজনৈতিক সক্রিয়তা থেকে কোনোরূপ বিচ্ছিন্নতায় ঘটতে পারে বলে মনে হয় না। তাই এই বইয়ের মাধ্যমে যদি পাঠকদের এবিষয়ে ভাবনা-বিরোধিতা-অনুভব-বিশ্লেষণের সঙ্গে একটা সেতু তৈরি হয়, রাজনৈতিক সক্রিয়তার অভিজ্ঞতার বিনিময় সূচিত হয়, তাহলে রাজনৈতিক চর্চার উপকরণ হিসেবে বইটি তার কর্তব্য পালন করতে পারছে বলে মনে করব।

 

টীকা

১. ই ইয়ং-ব্রুহেল, হানা আরেন্ট: ফর লাভ অফ দি ওয়ার্ল্ড, ইয়েল ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৮২, পৃষ্ঠা ১১।

২. ই ইয়ং-ব্রুহেল, হানা আরেন্ট: ফর লাভ অফ দি ওয়ার্ল্ড, ইয়েল ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৮২, পৃষ্ঠা ১০৯।

৩. হানা আরেন্ট, রাহেল ভার্নহাগেন: দি লাইফ অফ এ জিউয়িস ওম্যান (অনুবাদ: আর উইনস্টন ও সি উইনস্টন)।

৪. মার্গারেট কানোভান, হানা আরেন্ট: এ রিইনটারপ্রিটেশন অফ হার পলিটিকাল থট, কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৯২, পৃষ্ঠা ১০-১১।

৫. ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড-এর ২০০৭ সালের র‍্যানডম হাউস সংস্করণে মার্গারেট অ্যাটউড লিখিত ভূমিকা, পৃষ্ঠা xv।

৬. জর্জ অরওয়েল, নাইন্টিন এইটটি ফোর, রূপা পাবলিকেশনস, দিল্লি, ২০১০ সংস্করণ, পৃষ্ঠা-৭৪।

৭. হানা আরেন্ট-এর ক্রাইসিস অফ দি রিপাবলিক (হারমন্ডসওয়ার্থ, পেঙ্গুইন, ১৯৭২) গ্রন্থের ১৫৩ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত।

৮. হানা আর্‌ন্ট, দি হিউম্যান কন্ডিশন, ইউনিভার্সিটি অফ চিকাগো প্রেস, ১৯৯৮, পৃষ্ঠা-২৩২।

৯. ম্যাক্স ওয়েবার, পলিটিক্স অ্যাজ ভোকেশন (১৯১৯), (মূল জার্মান থেকে ইংরেজি অনুবাদ: এইচ. এইচ. গের্থ ও সি. রাইট মিলস), যা ১৯৪৬ সালে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস (নিউ ইয়র্ক) প্রকাশিত ‘ফ্রম ম্যাক্স ওয়েবার: এসেজ ইন সোসিওলজি' গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে।

১০.কার্ল স্মিট, দি কনসেপ্ট অফ দি পলিটিকাল, মূল জার্মান থেকে ইংরেজি অনুবাদ: জে. হার্ভে লোমেক্স, ইউনিভার্সিটি অফ চিকাগো প্রেস, ১৯৯৬।

১১. হানা আরেন্ট, দি হিউম্যান কন্ডিশন, ইউনিভার্সিটি অফ চিকাগো প্রেস, ১৯৯৮, পৃষ্ঠা- ১৭৫-১৭৬।

১২. ‘রাজনৈতিক পঁুজি'-র এই ধারণার জন্য আমি ফরাসি তাত্ত্বিক পিয়ের বোর্দে-র কাছে ঋণী। এই ধারণার উপস্থাপনায় পিয়ের বোর্দে কৃত আলোচনার জন্য দ্রষ্টব্য: পিয়ের বোর্দে, ল্যাংগুয়েজ অ্যান্ড সিম্বলিক পাওয়ার (মূল ফরাসি থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ- জিনো রেমন্ড ও ম্যাথু আদমসন), পলিটি প্রেস, ১৯৯১।

১৩.হানা আরেন্ট, দি হিউম্যান কন্ডিশন, ইউনিভার্সিটি অফ চিকাগো প্রেস, ১৯৯৮, পৃষ্ঠা- ১৭৬-১৭৭।

১৪.       দ্রষ্টব্য: হানা আরেন্ট, অন রিভলিউশন, ১৯৬৩।

১৫.আদম মিচনিক, লেটারস ফ্রম প্রিজন অ্যাণ্ড আদার এসেজ, ১৯৮৫, ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া প্রেস, পৃষ্ঠা- ৮৬, ৮৭।

১৬. হানা আরেন্ট, হিংসা প্রসঙ্গে (অন ভায়োলেন্স)।

১৭. নির্মল কুমার বসু, স্টাডিজ ইন গান্ধীজম, ২০১৯, দি এশিয়াটিক সোসাইটি, কলকাতা, পৃষ্ঠা-২৩৬।

 

[সমস্ত উদ্ধৃত অংশের বাংলা তর্জমা বর্তমান লেখকের করা।]

 

 

 

0 Comments
Leave a reply