হিংসা প্রসঙ্গে

লিখেছেন:হানা আরেন্ট, বাংলা তর্জমা- বিপ্লব নায়ক
রাজনৈতিক উপায় হিসেবে হিংসা এই আলোচনার বিষয়। ১৯৬৮ সালের বিশ্বজোড়া রাজনৈতিক টালমাটালের পরিপ্রেক্ষিতে হানা আরেন্ট এই সন্দর্ভ রচনা করেছিলেন। সমসাময়িকতা ছাপিয়ে রাজনৈতিক দর্শনের একটি ধ্রুপদী আলোচনা হিসেবে এটি এখন সাধারণভাবে স্বীকৃত। মূল ইংরেজি থেকে বাংলায় তর্জমা করে এখানে লেখাটি রাখা হল।

লেনিনের ভবিষ্যদবাণী মিলে গেছে। বিশ শতক হয়ে উঠেছে যুদ্ধ ও বিপ্লবের শতক। আজকাল হিংসাকে যুদ্ধ ও বিপ্লবের সাধারণ হর হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাই বিশ শতক হয়ে উঠেছে হিংসার শতকও। এই বিশ শতকের প্রেক্ষাপটে গত কয়েক বছরের ঘটনাবলী ও বিতর্ক যে সব চিন্তাকে উসকে দিয়েছে তা নিয়েই এই লেখা। বর্তমান পরিস্থিতির অবশ্য আর একটি দিকও আছে— আগে থেকে যার ভবিষ্যদবাণী কেউ না করলেও যা অন্তত সমমাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। হিংসার হাতিয়ারসমূহের প্রযুক্তিগত বিকাশ এখন যে মাত্রা ছুঁয়েছে তাতে সেসবের ধ্বংসাত্মক শক্তি প্রয়োগ করার জন্য উপযুক্ত বলে কোনো রাজনৈতিক লক্ষ্যকেই আর গণ্য করা চলে না, সশস্ত্র বিরোধে তাদের বাস্তব ব্যবহারের যুক্তিও হয় না। এর ফলে স্মরণাতীত কাল ধরে আন্তর্জাতিক বিবাদে চূড়ান্ত ও ক্ষমাহীন মধ্যস্থ হিসাবে কাজ করে আসা যুদ্ধবিগ্রহের আকর্ষণ ও কার্যকারিতাও আর আগের মতো নেই। আমাদের সভ্যতার শিখরমহলে বিচরণকারী মহাক্ষমতাধরদের মধ্যে ‘দিব্যপ্রকাশ’-স্বরূপ যে দাবাখেলা চলছে, তার নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে এই: ‘যদি কোনও একপক্ষ জেতে, তাহলে তা দুপক্ষেরই বিনাশ ডেকে আনবে’— অতীতের কোনও যুদ্ধক্রীড়ার সঙ্গেই এর আর কোনও সাদৃশ্য নেই। যুদ্ধের ক্ষেত্রে একমাত্র ‘যুক্তিসঙ্গত’ লক্ষ্য হতে পারে প্রশমন, বিজয়লাভ নয়। যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি হিসেবে নয়, অস্ত্রপ্রতিযোগিতার যৌক্তিকতাও এখন শান্তি নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে প্রশমন ত্বরাণ্বিত করার জন্য উপযোগিতা থেকেই একমাত্র উৎপন্ন হতে পারে। এ অবস্থানের সন্দেহাতীত বাতুলতা থেকে আমরা নিজেদের মুক্ত করতে পারি কীভাবে— এ প্রশ্নের উত্তর অবশ্য নেই।

ক্ষমতা, বল বা শক্তি-র থেকে পৃথক হিংসা যেহেতু সর্বদা অস্ত্রের উপর নির্ভরশীল (এঙ্গেলস যা বহু পূর্বে চিহ্নিত করেছিলেন), তাই প্রযুক্তি-বিপ্লব বা হাতিয়ার-নির্মাণকলায় বিপ্লব যুদ্ধবিগ্রহের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে দেখা গেছে। ‘উপায় ও লক্ষ্য’ বর্গটি হিংসাত্মক ক্রিয়ার সারবস্তুকে শাসন করে । মানব বিষয়ে প্রযুক্ত হলে এই উপায় ও লক্ষ্য বর্গের প্রধান বৈশিষ্ট্য হয়ে ওঠে এইরকম: উপায়কে সঙ্গত করে তোলার জন্য লক্ষ্যকে ব্যবহার করা হয়, বা, লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য অবলম্বন করা উপায়ের দ্বারাই লক্ষ্য পরাভূত হয়। মানুষের স্বতক্রিয়ার পরিণতির কোনও নির্ভরযোগ্য পূর্বাভাষ করা সম্ভব নয়, যেমনটা পূর্বনির্ধারিত লক্ষ্যের দ্বারা দৃঢ়-নির্ধারিত ক্রিয়ার ক্ষেত্রে করা সম্ভব। তাই, ভবিষ্যৎ পৃথিবীর জন্য প্রতিশ্রুত কোনো রাজনৈতিক লক্ষ্যের চেয়ে কী উপায় গ্রহণ করা হচ্ছে লক্ষ্যপূরণের জন্য, তা অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক।

মানুষের যে কোনো স্বতক্রিয়ার ফলই ক্রিয়াকারীর নিয়ন্ত্রণাধীন নয়। কিন্তু তা ছাড়াও হিংসাত্মক ক্রিয়ার মধ্যে একটি অতিরিক্ত অনির্দিষ্টতা আছে— যুদ্ধক্ষেত্র ছাড়া মানবক্রিয়ার আর কোনও ক্ষেত্রেই সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্যের ভাগ্যদেবী এমন চূড়ান্ত ভূমিকায় অবতীর্ণ হন না। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে সন্দিগ্ধ চোখে ‘অক্রম ঘটনা’ রূপে পরিগণিত করার মধ্য দিয়ে এই সম্পূর্ণ অভাবিতের আবির্ভাবকে এড়ানো যায় না, কোনও গেম থিওরি, পূর্বানুকরণ বা পূর্বপরিকল্পনা দিয়ে তা দূর করা যায় না। এক্ষেত্রে অনিশ্চয়তাই সব, এমনকি পূর্বনির্ধারিত কোনও পরিস্থিতিতেও পরস্পর ধ্বংসের নিশ্চয়তা চূড়ান্ত নয়। ধবংসের হাতিয়ার ক্রম-নিখুঁত ক্রম-উন্নত করতে যারা লেগে পড়ে আছে, প্রযুক্তির বিকাশের এমন এক স্তরে তারা এখন পৌঁছে গেছে যেখানে তাদের মজুত করা উপায় অর্থাৎ যুদ্ধ-উপকরণের দৌলতেই তাদের লক্ষ্য অর্থাৎ যুদ্ধবিগ্রহ অন্তর্হিত হতে বসেছে— প্রচ্ছন্ন শ্লেষের সঙ্গে নিছক এই ঘটনাই কি স্মরণ করিয়ে দেয় না যে হিংসার দুনিয়ায় প্রবেশমাত্র কী সর্বাচ্ছন্নকারী অনির্দিষ্টতাই ভবিতব্য হয়ে ওঠে। তাহলে যুদ্ধবিগ্রহ এখনও আমাদের সঙ্গে রয়েছে কেন? মানব প্রজাতির গোপন মৃত্যু-অভীপ্সা আছে বলে? মানুষের আক্রমণাত্মক প্রবৃত্তি অদম্য বলে? নিরস্ত্রীকরণের সঙ্গে যুক্ত সামাজিক-অর্থনৈতিক বিপদ গুরুতর বলে? শেষেরটি বেশি সম্ভাব্য বলে মনে হলেও এর কোনটিই যুদ্ধবিগ্রহ টিকে থাকার মূল কারণ নয়। মূল কারণ খুব সরল। তা হল এই যে আন্তর্জাতিক বিষয়াবলীতে যুদ্ধবিগ্রহ রূপী চূড়ান্ত মধ্যস্থের কোনও বিকল্প এখনও রাজনীতির মঞ্চে জায়গা করে নিতে পারেনি। সঠিকভাবেই কী হব্স বলেন নি যে ‘অসি বিনা চুক্তিপত্র কেবল মসিলিপি’?

আর এই বিকল্প প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা ততক্ষণ নেই যতক্ষণ জাতীয় স্বাধীনতা (অর্থাৎ বিদেশি শাসন থেকে মুক্তি) ও রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বকে (অর্থাৎ বৈদেশিক বিষয়ে নজরদারির বাইরে সীমাহীন ক্ষমতা) এক করে দেখা হচ্ছে। (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেই অল্প কয়েকটি দেশের একটি যেখানে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের একটি যথাযথ পৃথগীকরণ অন্তত তত্ত্বগতভাবে সম্ভব ছিল যতক্ষণ না প্রজাতন্ত্রের ভিত তাতে টলে যাচ্ছে। সংবিধান অনুযায়ী বৈদেশিক চুক্তি দেশের আইনের অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং, জাসটিস জেমস উইলসন ১৭৯৩ সালে যেমন বলেছিলেন,‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে সার্বভৌমত্ব কথাটাই সম্পূর্ণ অজানা’। কিন্তু ইউরোপিয় জাতি-রাষ্ট্রের রাজনৈতিক কাঠামো থেকে উঠে আসা ধারণা ও ভাষার পরম্পরা থেকে স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে এমন পরিষ্কার মাথায় বিভাজন টানার দিন বহুদিন হল অতীত হয়ে গেছে। মার্কিন বিপ্লবের ঐতিহ্য এখন বিস্মরণের গর্ভে। ভালো হোক বা মন্দ হোক, মার্কিন শাসনব্যবস্থা যেনবা তার পৈতৃক সম্পত্তি অধিকার করার ভঙ্গিমায় এখন ইউরোপিয় উত্তরাধিকারের মধ্যেই প্রবেশ করেছে। সে দুর্ভাগ্যজনকভাবে অচেতন যে ইউরোপিয় ক্ষমতার পতনশীলতার পূর্বলক্ষণ ও সহলক্ষণ যে রাজনৈতিক দেউলিয়াপনা তা হল এই জাতি-রাষ্ট্রের দেউলিয়াপনা এবং জাতি-রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের ধারণারও এই দেউলিয়াপনা দিয়েই তৈরি।) অনুন্নত দেশগুলোর বৈদেশিক বিষয়াবলীতে যুদ্ধ যে হিংসার মাধ্যমে রাজনীতির ধারাবাহিকতার পুরোনো চেহারায় এখনও শেষ কথা হয়ে আছে, তার দ্বারা যুদ্ধের অকার্যকারিতা খণ্ডন হয় না। এতেও কোনও সান্ত্বনা নেই যে যুদ্ধ করার বিলাসিতা এখন দেখাতে পারে কেবল পারমাণবিক অস্ত্র-হীন জৈব অস্ত্র-হীন ছোট ছোট দেশগুলোই। এ তো আর কারও অজানা নয় যে এখনও বিশ্বের যে সব জায়গায় ‘বিজয় অর্জনের কোনও বিকল্প নেই’ প্রবাদটি তার বিশ্বাসযোগ্যতা ভালোমাত্রায় বজায় রেখেছে, সেরকম কোথাও থেকেই এই যুদ্ধ নামক প্রসিদ্ধ অক্রম ঘটনাটি ঘটার সম্ভাবনা প্রবল।

এই পরিস্থিতিতে যেভাবে সরকার-প্রশাসনে গত কয়েক দশক জুড়ে বিজ্ঞানমনস্ক ভাবনার জিম্মাদারদের মর্যাদা ক্রমবর্ধমান, তার চেয়ে বেশি ভয়ের বিষয় আর খুব কমই হতে পারে। সমস্যা এখানে নয় যে এই বিজ্ঞানমনস্ক ভাবনার জিম্মাদাররা ‘অভাবিতকে ভাবার’ মতো যথেষ্ট ঠান্ডা মাথার লোক নয়, সমস্যা এখানে যে তারা আদৌ ভাবেই না। ভাবার মতো একটা প্রাচীনপন্থী অ-গণকযন্ত্রীভূত ক্রিয়াকে প্রশ্রয় দেওয়ার চেয়ে তারা কিছু অনুমানলব্ধ ঘটনাপুঞ্জের ফলাফল হিসাবনিকাশ করে, প্রকৃত ঘটনাবলীর সাপেক্ষে সেসব অনুমান যাচাইয়ের কোনও উপায় ছাড়াই। ভবিষ্যৎ ঘটনাবলীর এহেন অনুমানসিদ্ধ নির্মাণে সর্বক্ষেত্রে যে যৌক্তিক ত্রুটিটি দেখা যায় তা একই রকম: শুরুতে যা একটি অনুমানলব্ধ প্রকল্প হিসেবে ধরে নেওয়া হয় (সূক্ষ্মতার স্তরভেদ অনুযায়ী বিকল্পহীনভাবে বা বিকল্প সমেত), গুটিকয় অনুচ্ছেদ পরেই তা সাধারণত আপনা আপনিই একটা ‘বাস্তব ঘটনা’ হিসেবে পরিগণিত হতে থাকে, যার ফলে একই রকমের ‘না-ঘটনা’-র সারি জন্ম নিতে থাকে আর সমস্ত প্রক্রিয়ার নিখাদ অনুমানভিত্তিক চরিত্রটি সুবিধাজনকভাবে ভুলে যাওয়া হয়। বলার অপেক্ষা রাখে না যে এ বিজ্ঞান পদবাচ্য নয়, এ হল ছদ্ম-বিজ্ঞান, এ হল (নোয়াম চমস্কি-র ভাষায়) ‘সমাজবিজ্ঞান ও চেষ্টিতবিজ্ঞান দ্বারা তাৎপর্যপূর্ণ বৌদ্ধিক সারসম্পন্ন বিজ্ঞানগুলোর উপরিভাগের কিছু বৈশিষ্ট্যকে অন্ধ অনুকরণের মরীয়া চেষ্টা’। রিচার্ড এন গুডউইনের সাম্প্রতিক একটি পর্যালোচনা প্রবন্ধ এহেন বহুবিধ আত্মম্ভরি ছদ্ম-বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের ‘অচেতন খেয়াল’-কে চিহ্নিত করার বিরল গুণ দেখিয়ে বলেছে: ‘এ ধরনের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত তত্ত্বায়নের বিরুদ্ধে গভীরতম (এবং স্পষ্টতম) অভিযোগ তার সীমাবদ্ধ ব্যবহারযোগ্যতা নিয়ে নয়, বরং তার বিপদ নিয়ে, কারণ ঘটনাবলী সম্বন্ধে যে বোঝাবুঝি ও ঘটনাপ্রবাহের উপর যে নিয়ন্ত্রণ আমাদের অনায়ত্ত, তা আমাদের হাতের মুঠোয় বলে এক বিভ্রান্তির জন্ম দেয় এই ধরনের তত্ত্বায়ন।’

‘ঘটনা’-র সংজ্ঞাই হল এই যে তা বাঁধাধরা নিয়মমাফিক প্রক্রিয়া বা পদ্ধতিতে ছেদ ঘটায়। ভবিষ্যদবক্তাদের স্বপ্ন সত্য হতে পারে একমাত্র এমন এক জগতে যেখানে কখনওই কোনও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে না। বর্তমানের স্বয়ংক্রিয় প্রক্রিয়া ও পদ্ধতির অভিক্ষেপণ ছাড়া ভবিষ্যৎ-বলা তো আর কিছু নয়। মানুষ যদি কোনও স্বতক্রিয়া না করে এবং অপ্রত্যাশিত কোনও কিছুই যদি না ঘটে, তাহলে প্রত্যাশানুযায়ী যা ঘটা সম্ভবপর তা-ই হল এই অভিক্ষেপণ। এই অভিক্ষেপণ অর্থাৎ ভবিষ্যৎ-বলা একটা কাঠামোর মধ্যে নিজের চলাচলকে সীমাবদ্ধ করে নিজেই নিজ প্রমাণ উৎপন্ন করে, আর সেই কাঠামোটির বাধ্যতামূলক ধ্বংসসাধনের মধ্য দিয়েই সংঘটিত হয় ভালো বা মন্দের জন্য কোনও স্বতক্রিয়া এবং যে কোনও দুর্ঘটনা। (‘রাষ্ট্রনায়কদের পরিণামদর্শিতাকে বহুল পরিমাণে ছাপিয়ে যায় অপ্রত্যাশিতের উর্বরতা’— হালকা ছলে করা প্রুঁধোর এই মন্তব্য সৌভাগ্যবশত আজও সত্য। বলা যায় যে রাষ্ট্রনায়কদের পরিণামদর্শিতার চেয়েও বহুলভাবে বিশেষজ্ঞদের হিসাবকে ছাপিয়ে যায় এই অপ্রত্যাশিতের উর্বরতা।) এহেন অপ্রত্যাশিত, অদৃষ্টপূর্ব ও ভবিষ্যদবাণী-অসম্ভব ঘটনাবলীকে ‘অক্রম ঘটনা’ বা ‘অতীতের শেষ নাভিশ্বাস’ আখ্যায় দেগে অপ্রাসঙ্গিক ঘোষণা করে সুবিখ্যাত ‘ইতিহাসের আঁস্তাকুড়’-এ নির্বাসিত করা হল সবচেয়ে পুরানো কৃৎকৌশল। এই পুরানো কৌশল নিঃসন্দেহে তত্ত্বকে পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে, কিন্তু তার বিনিময়ে তা তত্ত্বকে বাস্তব থেকে দূরে আরো দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়। এহেন তত্ত্ব বাস্তবত দৃশ্যমান নানা বর্তমান প্রবণতা থেকে সাক্ষ্য সংকলিত করে বিশ্বসযোগ্য আকারে নিজেকে হাজির করে। কিন্তু তার চেয়েও বিপদের কথা হল এই যে তাদের অন্তর্গত সামঞ্জস্যের জোরে এহেন তত্ত্ব এক মোহনিদ্রাজনক প্রভাব বিস্তার করে। যে মানসিক অঙ্গের দ্বারা মানুষ অনুভব করে, উপলব্ধি করে, বাস্তবের মোকাবিলা করে ও তথ্যসন্নিষ্ট হয়, সেই কাণ্ডজ্ঞানকে এহেন তত্ত্ব ঘুমে অবশ করে রাখে।

——————

ইতিহাস ও রাজনীতি নিয়ে যারা চিন্তা করেন, তাদের কারোরই জানতে বাকি নেই যে মানবকাণ্ডে হিংসা সর্বদা কী বিপুল ভূমিকা পালন করেছে। তাই প্রথম বিবেচনায় আশ্চর্য লাগা স্বাভাবিক যে হিংসাকে পৃথকভাবে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা কেন এত বিরল। (‘এনসাইক্লোপেডিয়া অফ দি সোশাল সায়েন্সেস’-এর সাম্প্রতিকতম সংস্করণে ‘হিংসা’-কে এমনকি একটি লিপিবদ্ধকরণের বিষয় হিসেবেও গণ্য করা হয় নি।) বোঝা যায় যে হিংসা ও তার যথেচ্ছাচারকে কী পরিমাণে স্বতঃসিদ্ধ বলে ধরে নেওয়া হয়েছে আর তাই তা নিয়ে আলোচনা অবহেলিত হয়েছে— সকলের কাছেই যা বিতর্কাতীতভাবে সুস্পষ্ট কে-ই বা আর তা প্রশ্ন করে পরীক্ষা করতে যায়? মানবকাণ্ডে যারা সর্বময়ভাবে হিংসাকেই দেখে, হিংসা ছাড়া আর কিছুই দেখতে পায় না, তারা স্থিরনিশ্চিত থেকেছে যে ‘হিংসা সবসময় অবিন্যস্ত, তা গুরুতর নয়, নির্দিষ্টও নয়’ (রেনান), অথবা, ঈশ্বর সর্বদা বৃহত্তর বাহিনীর সঙ্গেই থাকে। হিংসা বা ইতিহাস প্রসঙ্গে আর কিছু তাদের বলার নেই। অতীতের নথিপত্র খুঁড়ে অর্থসন্ধানীর কাছে হিংসা একটি প্রান্তীয় প্রতীত বিষয় বলে মনে হওয়া যেন অবশ্যম্ভাবী। যুদ্ধকে ‘অপর উপায়ে রাজনীতির ধারাবাহিকতা’ আখ্যা দেওয়া ক্লসউইৎজ-ই হোক বা ‘অর্থনৈতিক বিকাশের দ্রুতিসঞ্চারক’ বলে হিংসাকে সংজ্ঞায়িত করা এঙ্গেলস-ই হোক, সবাই জোর ফেলেন হিংসাত্মক ক্রিয়ার পূর্বতন কোনও রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতার উপর। তাই খুব সম্প্রতিও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পড়ুয়ারা বিশ্বাস করে চলেছে যে ‘কোনও সামরিক সিদ্ধান্ত যদি জাতীয় ক্ষমতার গভীরতম সাংস্কৃতিক উৎসের সঙ্গে বেমানান হয়, নিশ্চিতভাবেই তা স্থিতিশীল হতে পারে না’, অথবা, যেখানেই, এঙ্গেলস-এর ভাষায়, ‘একটা দেশের ক্ষমতাকাঠামো তার অর্থনৈতিক বিকাশের বিরোধিতায় দাঁড়ায়’, সেখানেই হিংসার সমস্ত উপায় সমেত রাজনৈতিক ক্ষমতা পরাজিত হয়।

যুদ্ধ ও রাজনীতির আন্তঃসম্পর্ক এবং হিংসা ও ক্ষমতা বিষয়ে এই পুরানো নিশ্চয়তাগুলো আজ অচল হয়ে গেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসানে শান্তি আসেনি, এসেছে ঠান্ডা যুদ্ধ, প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সামরিক ব্যবস্থা, শিল্পোৎপাদন ও শ্রমের মিলিত গূঢ় কাঠামো। এঙ্গেলস বা ক্লসউইৎজ-এর উনিশ শতকীয় সূত্রাবলীর চেয়ে অনেক বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে যখন কেউ ‘সমাজের প্রধান কাঠামোগত বল হিসাবে যুদ্ধ করার শক্তিকে’ চিহ্নিত করে, বা, ‘অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপত্র, রাজনৈতিক দর্শনসমূহ ও আইনকাঠামো যুদ্ধব্যবস্থার সেবা করে ও তারই বিস্তার হিসাবে কাজ করে’ বলে মতজ্ঞাপন করে, বা, ‘যুদ্ধই হল সেই মৌলিক সামাজিক ব্যবস্থা যার অভ্যন্তরে সামাজিক সংগঠনের অন্যান্য অধীনস্থ প্রণালীগুলোর বিরোধ এ শলাপরামর্শ চলতে থাকে’ বলে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। ‘রিপোর্ট ফ্রম আয়রন মাউন্টেন’-এর বেনামী লেখক এক সরল উলটপালট করে প্রস্তাব করেছেন যে ‘কূটনীতি (বা রাজনীতি বা অর্থনৈতিক ব্যবস্থা)-র বিস্তার যুদ্ধ’ হওয়ার বদলে আসলে শান্তিই হল অপর উপায়ে যুদ্ধের ধারাবাহিকতা। কিন্তু এই সরল উলটপালটের চেয়েও বেশি সিদ্ধান্তমূলক হল যুদ্ধ-প্রকৌশলের বাস্তব বিকাশ। রুশ পদার্থবিদ সাখারভ বলেছেন, ‘কোনও তাপীয়-পরমাণু যুদ্ধকে (ক্লসউইৎজের সূত্রানুযায়ী) অপর উপায়ে রাজনীতির ধারাবাহিকতা বলে গণ্য করলে তা সার্বিক আত্মহত্যার উপায়ের সামিল হবে।’

এছাড়াও আরো কিছু কিছু বিষয় আমাদের জানা আছে, যেমন: ‘কয়েক মুহূর্তের মধ্যে অল্প কিছু অস্ত্র জাতীয় ক্ষমতার অন্য সমস্ত উৎসকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে’;১০ ‘এমন সব জীবাণু-অস্ত্র তৈরি আছে যা গুটিকয় ব্যক্তির হাতে... যুদ্ধ-পরিস্থিতির ভারসাম্য বদল করে দেওয়ার’ শক্তি এনে দিয়েছে এবং এহেন জীবাণু-অস্ত্র তুলনায় এত কম খরচসাপেক্ষ যে ‘পরমাণু অস্ত্র মজুদে অক্ষম জাতিরাষ্ট্রের’ পক্ষেও তা তৈরি করা সম্ভব;১১ ‘কয়েক বছরের মধ্যেই’ যন্ত্র (রোবট) সেনার দল মানব সেনার ব্যবহার সেকেলে করে দেবে’;১২ আর, শেষত, প্রথানুগ যুদ্ধে বৃহৎ ক্ষমতাধর ধনী দেশগুলোর তুলনায় গরিব দেশগুলোর বিপদ অনেক কম নেহাত তাদের ‘বিকাশের অভাব’-এর কল্যাণে কারণ প্রযুক্তিগত শ্রেষ্ঠত্ব ‘সম্পদ হওয়ার বদলে আপদ হয়ে দাঁড়ায়’ গেরিলা যুদ্ধের ক্ষেত্রে।১৩ এই অস্বস্তিকর নতুনত্বগুলোর যোগফল ক্ষমতা ও হিংসার মধ্যে সম্পর্কটিকে সম্পূর্ণ উল্টিয়ে দিয়েছে এবং ক্ষুদ্র ও বৃহৎ ক্ষমতাধরদের মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রেও একটি ভবিষ্যৎ উলটপালটের ইঙ্গিত দিয়ে যাচ্ছে। আর কিছুদিনের মধ্যেই হয়ত কোনও দেশের করায়ত্ত হিংসার মজুদ দিয়ে সেই দেশের শক্তির কোনও নির্ভরযোগ্য হিসাব করা যাবে না, বা অন্যভাবে বললে, বহুল পরিমাণে ক্ষুদ্রতর ও দুর্বলতর শক্তির হাতে পরাভব ও ধ্বংসের সম্ভাবনার বিরুদ্ধে তা কোনওরকম নিশ্চিতি হিসেবে কাজ করবে না। এর সঙ্গে বিপজ্জনক সাদৃশ্য আছে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অন্যতম প্রাচীনতম একটি অন্তর্দৃষ্টির, তা হল: ক্ষমতার মাপ সম্পদ-প্রাচুর্য দিয়ে হয় না, সম্পদের প্রাচুর্য ক্ষমতায় ক্ষয় ধরাতে পারে, বিশেষ করে কোনও প্রজাতন্ত্রের সুস্বাস্থ্যের জন্য সম্পদ-প্রাচুর্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এই অন্তর্দৃষ্টিটি ভুলে যাওয়া হয়েছে বলেই তা মিথ্যা হয়ে যায় নি। বিশেষত এই সাম্প্রতিক সময়ে যুদ্ধোপকরণাদির সম্পদ-প্রাচুর্যের প্রসঙ্গেও প্রযোজ্য হয়ে উঠে তার সত্য নতুন মাত্রা নিয়ে হাজির হয়েছে।

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পরিসরে উপায় হিসেবে হিংসা যত অনর্ভিরযোগ্য ও অনিশ্চিত হয়ে উঠছে, ততই তার খ্যাতি ও আকর্ষণ বৃদ্ধি পাচ্ছে ঘরোয়া পরিসরে, বিশেষ করে বিপ্লব সংঘটনের পরিকল্পনায়। নব বাম (নিউ লেফ্ট)-দের শক্তিশালী মার্কসবাদী বাগ্মিতা সম্পৃক্ত হয়ে পড়ছে মাও ৎসে-তুঙ ঘোষিত সম্পূর্ণ অ-মার্কসবাদী বিশ্বাস ‘বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস’-র ক্রম প্রভাববৃদ্ধির সঙ্গে। নিশ্চিতভাবেই মার্কস ইতিহাসে হিংসার ভূমিকা সম্বন্ধে সচেতন ছিলেন, কিন্তু তঁার কাছে সেই ভূমিকা ছিল অপ্রধান। হিংসা নয়, পুরানো সমাজের অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্বই পুরানো সমাজের অবসান ঘটায় বলে মার্কস বিবেচনা করেছিলেন। নতুন সমাজের নির্গমনের পূর্বে আকস্মিক হিংসাত্মক ঘটনাবলী ঘটলেও তা সেই নির্গমনের কারণ নয়, মার্কস এর তুলনা টেনেছিলেন গর্ভযন্ত্রণার সঙ্গে, যা জৈব জন্মদানের পূর্বে ঘটে কিন্তু যা কখনওই জৈব জন্মদানের কারণ নয়। একইভাবে মার্কস রাষ্ট্রকে শাসকশ্রেণির আজ্ঞাধীন হিংসার হাতিয়ার হিসেবে গণ্য করেছিলেন, কিন্তু শাসকশ্রেণির প্রকৃত ক্ষমতা হিংসার দ্বারা গঠিত বা হিংসার উপর নির্ভরশীল বলে গণ্য করেন নি। শাসকশ্রেণির প্রকৃত ক্ষমতা সমাজে শাসকশ্রেণি দ্বারা নির্বাহিত ভূমিকা, বা আরো নির্দিষ্ট করে বললে, উৎপাদন-প্রক্রিয়ায় তার নির্বাহিত ভূমিকার দ্বারা সংজ্ঞাত বলে মার্কস মনে করেছিলেন। প্রায়শই দেখা গেছে, এবং কখনও কখনও নিন্দিতও হয়েছে, যে মার্কসের উপদেশের প্রভাবে বিপ্লবী বাম (রিভলুশনারি লেফ্ট) হিংসাত্মক উপায় ব্যবহার বর্জন করেছে। ‘শ্রমিকশ্রেণির একনায়কত্ব’— যা মার্কসের লেখায় খোলাখুলিভাবে দমনমূলক চরিত্রসম্পন্ন— এসেছে বিপ্লব-পরবর্তী পর্যায়ের ভাবনায় রোমের একনায়কত্বের মতো কড়াকড়িভাবে সীমিত সময়ের একটি ব্যবস্থা হিসেবে। নৈরাষ্ট্রবাদী কিছু ছোট ছোট দলের ঘটানো ব্যক্তি-সন্ত্রাসের অল্পসংখ্যক কিছু ঘটনা বাদ দিলে রাজনৈতিক হত্যা মূলত ডানপন্থীদের কীর্তি ছিল, আর সশস্ত্র অভ্যুত্থান ছিল সামরিক বাহিনীর বিশেষত্ব। বামদের প্রত্যয় ছিল: ‘সমস্ত রকমের ষড়যন্ত্র অকার্যকরী এবং ক্ষতিকরও বটে। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বা ইচ্ছামতো যে বিপ্লব করা যায় না তা খুব ভালো জানা আছে। বিপ্লব সর্বত্র ও সর্বদা আবশ্যিকভাবেই এমন পরিস্থিতির ফল যা কোনও বিশেষ পার্টির বা শ্রেণির ইচ্ছাশক্তি ও নেতৃত্বশক্তি নিরপেক্ষ।’ (এঙ্গেলস)১৪

তত্ত্বের স্তরে কয়েকটি ব্যতিক্রম ছিল। বিশ শতকের গোড়ায় জর্জেস সরেল মার্কসবাদের সঙ্গে বের্গসনের ‘জীবনের দর্শন’-কে মেলানোর চেষ্টা করেছিলেন। তার ফল যা দাঁড়িয়েছিল তা সূক্ষ্মতার অনেক নিম্নস্তরে হলেও অধুনা সার্ত্রের করা অস্তিত্ববাদের সঙ্গে মার্কসবাদের মিশ্রণের সঙ্গে অদ্ভুতভাবে সাদৃশ্যগামী। সরেল শ্রেণিসংগ্রামকে সামরিক অভিধায় ভেবেছিলেন, কিন্তু তা সত্ত্বেও সাধারণ ধর্মঘটের বিখ্যাত অতিকথার চেয়ে হিংসাত্মক কিছুর প্রস্তাবনা তিনি করেননি। আজকের দিনে তো সাধারণ ধর্মঘট অহিংস রাজনীতির তূণের একটি অস্ত্র হিসেবেই বিবেচিত হয়। পঞ্চাশ বছর আগে এই পরিমিত প্রস্তাব দেওয়ার জন্যই তঁাকে এমনকি ‘ফ্যাসিবাদী' বলেও চিহ্নিত করা হয়েছিল, লেনিন ও রুশ বিপ্লবের প্রতি তঁার সাগ্রহ সমর্থনও সে অপবাদ মুছতে পারেনি। সম্প্রতিও সার্ত্র ‘সরেল-এর ফ্যাসিবাদী কথাবার্তা’-র উল্লেখ করেছেন। আর উল্লেখ করেছেন কোন লেখায়? সে লেখার শিরোনাম ‘হিংসা প্রসঙ্গে ভাবনাচিন্তা’, যা সার্ত্র লিখেছেন ফ্রানজ ফ্যানন-এর ‘দি রেচেড অফ দি আর্থ’ বইয়ের ভূমিকা হিসাবে, যেখানে ফ্যানন-এর হাজির করা যুক্তি-তর্ক-কে নিষ্পত্তিতে পৌঁছানোর অভীপ্সায় হিংসাকে গরিমান্বিত করার মাত্রায় সার্ত্র সরেলকে— এমনকি ফ্যাননকেও— ছাপিয়ে গেছেন। বোঝা যায় যে হিংসার প্রশ্নে মার্কস-এর সঙ্গে তঁার মৌলিক মতপার্থক্য বিষয়ে সার্ত্র কত অসচেতন, বিশেষ করে যখন সার্ত্রকে বলতে দেখি: ‘মানুষ নিজেকে পুনর্নির্মাণ করছে... অবদমন-অসম্ভব হিংসার মাধ্যমে’; ‘দুনিয়ার দীনদুঃখী (রেচেড)-রা’ ‘মানুষ হয়ে উঠতে পারে’ কেবলমাত্র ‘অন্ধ উগ্রচণ্ডী’ বহিঃপ্রকাশের মধ্য দিয়ে। এই ধারণাগুলো উল্লেখযোগ্য আরো এই কারণে যে মানুষের নিজ হয়ে ওঠা বা নিজেকে সৃষ্টি করার ধারণা হেগেলিয় ও মার্কসীয় চিন্তাধারার ঐতিহ্যপথে প্রবাহিত হয়ে সমস্ত বামপন্থী মানবতাবাদের ভিত্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু হেগেলের ধারণা অনুযায়ী, মানুষ নিজেকে ‘সৃষ্টি’ করে চিন্তার মাধ্যমে।১৫ অন্যদিকে মার্কস, যিনি হেগেলের ‘ভাববাদ’-কে উল্টিয়ে দাঁড় করিয়েছিলেন, তঁার ধারণায়, মানুষ নিজেকে ‘সৃষ্টি’ করে সেই শ্রমের মাধ্যমে যে শ্রম হল প্রকৃতির সঙ্গে বিপাকক্রিয়ার মানবীয় রূপ। অবশ্যই যুক্তি-তর্ক হাজির করা যায় যে মানুষের নিজেকে সৃষ্টি করার সব ধরনের ধারণার মধ্যেই সাধারণভাবে আছে মানবীয় অবস্থার তথ্যানুগত্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ— প্রজাতির সদস্য হিসেবেই হোক বা ব্যক্তি হিসেবে হোক, নিজ অস্তিত্বের জন্য মানুষ তার নিজের কাছে ঋণী নয়, এর থেকে স্পষ্ট কি আর কিছু হতে পারে? এই যুক্তিতে বলা যেতে পারে যে এই বিশেষ অ-ঘটনা কোন বিশেষ ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ঘটার কথা ভাবা হয়েছে, তা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ সার্ত্র-হেগেল-মার্কস-এর মধ্যেকার সাধারণ ভাবনাটি কী তার থেকে। কিন্তু তা সত্ত্বেও অস্বীকার করা যায় না যে চিন্তা করা ও শ্রম করার মতো শান্তিপূর্ণ ক্রিয়ার সঙ্গে যে-কোনো হিংসাত্মক ক্রিয়ার ফারাক সাগর-সমান। পূর্বোল্লিখিত ভূমিকায় সার্ত্র লিখেছেন: ‘ইউরোপিয় কোনও মানুষকে গুলি করে হত্যা করা এক ঢিলে দুটো পাখি মারার সামিল... (তার মধ্য দিয়ে) পাওয়া যায় একটি ব্যক্তির শব ও আরেকটি ব্যক্তির মুক্ত অস্তিত্ব।’ মার্কস কোনদিনই এমন একটা বাক্য লিখতে পারতেন না।১৬

সার্ত্রকে উদ্ধৃত করে আমি দেখাতে চেয়েছি যে বিপ্লবীদের চিন্তাভাবনা হিংসার দিকে বাঁক নেওয়ার এই ঝোঁকের অভিনবত্ব এমনকি তাদের প্রতিনিধিস্থানীয় মুখর মুখপত্রেরও খেয়াল এড়িয়ে যেতে পারে,১৭ কিন্তু যেহেতু এ কেবল চিন্তার ইতিহাসে একটি বিমূর্ত ধারণার বিষয় নয়, তাই একে খেয়াল করা আরো জরুরী। (চিন্তা প্রসঙ্গে ‘ভাববাদী’ ধারণাকে উল্টে দাঁড় করালে কেউ শ্রম প্রসঙ্গে ‘বস্তুবাদী’ ধারণায় পৌঁছতে পারে, কিন্তু কখনওই হিংসার ধারণায় পৌঁছতে পারে না।) নিঃসন্দেহে এই অভিনব ঝোঁকের একটা নিজস্ব যুক্তির চলন আছে, যে যুক্তির চলন অভিজ্ঞতা থেকে উৎসারিত, আর সে অভিজ্ঞতা আগের কোনো প্রজন্মের জানা ছিল না।

নব বাম (নিউ লেফ্ট)-এর ভাবাবেগ, ভরবেগ ও বিশ্বাসযোগ্যতা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে আধুনিক যুদ্ধাস্ত্রের অতিপ্রাকৃতিক ও আত্মহত্যাপ্রবণ বিকাশের সঙ্গে। পরমাণু বোমার ছায়ায় বেড়ে ওঠা প্রথম প্রজন্ম এরা। উত্তরাধিকারসূত্রে পিতা-মাতার প্রজন্মের কাছ থেকে তারা পেয়েছে রাজনীতির মধ্যে ফৌজদারী হিংসার ব্যাপক অনুপ্রবেশের অভিজ্ঞতা। উচ্চ বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয়ে পাঠের সময় তারা জেনেছে রাজনৈতিক বন্দী-শিবির, হত্যা-শিবির, গণহত্যা ও গণপীড়নের কথা।১৮ তারা জেনেছে যে ‘প্রথাগত' যুদ্ধাস্ত্রে সীমাবদ্ধ রাখলেও এখনকার যুদ্ধ অসামরিক মানুষজনদের পাইকারি হারে হত্যা ছাড়া অসম্ভব। প্রথম প্রতিক্রিয়ায় তারা সমস্ত রকম হিংসার প্রতি বিতৃষ্ণ হয়েছিল, কোনো না কোনো ধরনের অহিংসার রাজনীতির পক্ষ নিয়েছিল অবধারিতভাবে। সেই পথে নাগরিক অধিকারের আন্দোলনের ক্ষেত্রে বিপুল সাফল্যের পর এসেছিল ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন, যা জনমত নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ সূত্র হিসেবে এখনও কাজ করে চলেছে। কিন্তু এ কথা আর গোপন নেই যে তারপর পরিস্থিতি বদলে গেছে, ‘অহিংসা’ অবলম্বনকারীরা এখন ক্রমাগত পিছু হটছে। এমনটাও নয় যে কেবলমাত্র ‘চরমপন্থী’-রাই হিংসার মহিমাকীর্তনের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে এবং ফ্যানন-কথিত আলজেরিয় কৃষকদের মতো আবিষ্কার করেছে যে ‘কেবলমাত্র হিংসাই হল ফলপ্রসূ পথ’।১৯

নব উগ্রপন্থীদের নানাভাবে ভৎর্সনা করা হয়েছে ‘নৈরাষ্ট্রবাদী’, ‘ধ্বংসকামী’, ‘লাল ফ্যাসিস্ট’, ‘নাজি’ বা সঙ্গততরভাবে ‘লুডাইট যন্ত্র-চূর্ণকারী’ বলে। ছাত্রছাত্রীরাও পাল্টা একইরকম অর্থহীন স্লোগান তুলেছে ‘পুলিশ-রাষ্ট্র’, ‘শেষ পর্যায়ের পঁুজিবাদের গুপ্ত ফ্যাসিবাদ’ ও সঙ্গততরভাবে ‘উপভোক্তা সমাজ’-এর বিরুদ্ধে।২১ উগ্রপন্থা অবলম্বনকারী ছাত্রছাত্রীদের দোষবিচার করতে গিয়ে একাধিক সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক কারণের কথা তুলে আনা হয়েছে, যেমন: আমেরিকায় বলা হচ্ছে শৈশব-কৈশোরে লালনপালনে অতিরিক্ত আশকারার কথা; জার্মানি ও জাপানের ক্ষেত্রে বলা হচ্ছে অতিরিক্ত ক্ষমতা-আস্ফালনের বিরুদ্ধে বিস্ফোরক প্রতিক্রিয়ার কথা; পূর্ব ইউরোপে স্বাধীনতার অভাবের কথা আর পশ্চিম ইউরোপে স্বাধীনতার আতিশয্যের কথা; ফ্রান্সে বলা হচ্ছে সমাজতত্ত্বের পড়ুয়াদের জন্য নিয়োগের বিপত্তিজনক অভাবের কথা আর আমেরিকায় প্রায় সমস্ত ক্ষেত্রে নিয়োগ-সম্ভাবনার প্রাচুর্যের কথা। এক একটি আঞ্চলিক ক্ষেত্রের সীমার মধ্যে এগুলোর কিছু বিশ্বাসযোগ্যতা থাকতে পারে, কিন্তু ছাত্রছাত্রীদের বিদ্রোহ যে বিশ্বজুড়ে প্রতীয়মান তা বিবেচনা করলে এগুলো পরস্পর বিরোধিতার মধ্য দিয়ে অর্থহীন হয়ে ওঠে। বিশ্বজুড়ে আন্দোলনগুলোর কোনও সামাজিক সাধারণ হর নির্ধারণ অসম্ভব হলেও সর্বত্র এই প্রজন্ম সাধারণ কিছু চরিত্রবৈশিষ্ট্য দেখাচ্ছে। এই সাধারণ চরিত্রবৈশিষ্ট্যগুলো হল: নিখাদ সাহস, হতবাক করে দেওয়ার মতো স্বতক্রিয়ার প্রবণতা, পরিবর্তনের সম্ভাব্যতায় একই রকম হতবাককারী আস্থা।২২ কিন্তু এই চরিত্রবৈশিষ্ট্যগুলোই ঘটনাবলীর কারণ নয়। বিশ্বের নানা প্রান্তে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ঘটা এই অপ্রত্যাশিত ঘটনাবলীর প্রকৃত কারণ খুঁজতে গেলে খুবই সুস্পষ্ট ও সম্ভবত সবচেয়ে প্রভাবশালী একটি বিষয় বিবেচনায় আসতে বাধ্য। তা হল: ‘প্রযুক্তির অগ্রগতি’ একের পর এক ঘটনায় সরাসরি বিপর্যয়ের কারণ হয়ে ওঠা।২৩ এই প্রজন্মে যে বিজ্ঞান শেখা ও শেখানো হচ্ছে তা নিজ প্রযুক্তির বিপর্যয়জনক ফল আটকাতে বা বিপরীত কিছু করতে অপারগ। কেবল তাই নয়, এ বিজ্ঞান বিকাশের এমন এক স্তরে পৌঁছেছে যেখানে ‘যা-ই করা হোক না কেন, তাকে যুদ্ধের কাজে লাগানো হবে’।২৪ (সেনেট-সদস্য ফুলব্রাইট বলেছেন যে সরকার-পোষিত গবেষণা-প্রকল্পের উপর নির্ভরশীল হয়ে ওঠার মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের উপর সাধারণ মানুষের প্রত্যয়ের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।২৫ সন্দেহ নেই যে যুদ্ধ-কেন্দ্রীক গবেষণা ও তৎসংক্রান্ত সমস্ত উদ্যোগ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে কঠোরভাবে বিযুক্ত করাই তাদের ন্যায়পরতার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এমন আশা করা ছেলেমানুষি হবে যে তা করলেই আধুনিক বিজ্ঞানের চরিত্র পাল্টে যাবে বা যুদ্ধ-উদ্যোগ বাধাপ্রাপ্ত হবে। এই বিযুক্তির ফলে যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মানের অবনতি হবে না, তা-ও জোর দিয়ে বলা যায় না।২৬ নিশ্চিতভাবে কেবল এইটুকুই বলা যায় যে এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সরকারি অনুদান বন্ধ হয়ে যাবে না। ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনলজি-র জেরম লেটভিন সম্প্রতি ইঙ্গিত করেছেন, ‘আমাদের পোষণ না করে সরকারের কোনও উপায় নেই’।২৭ ঠিক তেমনই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোরও উপায় নেই সরকারি অনুদান গ্রহণ না করে। এর অর্থ এটাই হতে পারে যে ‘বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে শিখতে হবে কীভাবে আর্থিক অনুদানকে নির্বীজিত করা যায়’ (হেনরি স্টিল কোম্যাজার)। আধুনিক সমাজে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্ষমতা যে বিপুল হারে বৃদ্ধি পেয়েছে তা খেয়ালে রাখলে এই নির্বীজিতকরণের কাজ কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। সংক্ষেপে বললে, অপ্রতিরোধ্য হিসেবে প্রতীয়মান প্রকৌশল ও যন্ত্রের দ্রুত বৃদ্ধি ও বিস্তার কেবল নির্দিষ্ট কিছু শ্রেণিকে বেকারত্বে নিক্ষেপের আশঙ্কা নিয়ে আসছে না, তার চেয়ে অনেক বড় প্রেক্ষাপটে গোটা জাতিসমূহের, এমনকি গোটা মানবজাতির অস্তিত্বকেই বিপন্ন করে তুলছে।

তিরিশোর্ধ্বদের তুলনায় এখনকার নতুন প্রজন্মের কাছে অন্তিম সেই মহাপ্রলয়ের আশঙ্কা অনেক বেশি সম্ভবপর মনে হচ্ছে— তা স্বাভাবিক তাদের তারুণ্যের কারণে নয়, বরং তাদের জীবনের প্রথম চূড়ান্ত অভিজ্ঞতার কারণে। (আমাদের কাছে যা কেবল একটি সমস্যা, তরুণদের রক্তমাংসের মধ্যে তা সেঁধিয়ে বসেছে।)২৮ ‘পঞ্চাশ বছর পরে তুমি বিশ্বকে কেমন দেখতে চাও?’ বা ‘আজ থেকে পাঁচ বছর পর তোমার জীবন তুমি কেমন হোক তুমি চাও?’— এমন সরল দুটি প্রশ্নের মুখোমুখি হলে এই প্রজন্মের যে কোনও সদস্যের উত্তর হয়ত শুরু হবে এভাবে: ‘যদি তখনও কোনও বিশ্ব টিঁকে থাকে...’ বা ‘যদি তখনও আমি বেঁচে থাকি...’। জর্জ ওয়াল্ড-এর ভাষায়: ‘আমাদের সামনে এখন এমন এক প্রজন্ম যারা কোনওভাবেই নিশ্চিত নয় যে তাদের সামনে কোনও ভবিষ্যৎ আছে।’২৯ আর স্পেন্ডার বলেছেন: ‘ভবিষ্যৎ হল বর্তমানের গর্ভে পোঁতা এমন এক পূর্বনিয়ন্ত্রিত বোমা যার বিস্ফোরণের মুহূর্তের সময় গোনা শুরু হয়ে গেছে।’ প্রায়শই এ প্রশ্ন করা হয় যে এ প্রজন্ম কারা? তার উত্তর এভাবে দিতে লোভ হয়: যারা এই বিস্ফোরণ মুহূর্তের প্রহর গোনা শুনতে পাচ্ছে তারাই এ প্রজন্ম। আর যদি সেই অন্য প্রশ্নটি ওঠে যে কারা এদের সম্পূর্ণ অস্বীকার করছে? তাহলে উত্তরটা হতে পারে এরকম: যারা বাস্তবটা কেমন জানে না বা জানলেও মানতে চাইছে না।

ছাত্রছাত্রীদের বিদ্রোহ একটা বিশ্বজোড়া প্রতীত বিষয়। কিন্তু তার বহিঃপ্রকাশের ক্ষেত্রে দেশ থেকে দেশে, এমনকি এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে বিস্তর ফারাক আছে। বিশেষ করে ফারাক আছে হিংসার চর্চার ক্ষেত্রে। যেখানে ভিন্ন প্রজন্মের মধ্যে সংঘাত অনুভবযোগ্য গোষ্ঠী-স্বার্থের সংঘাতের সঙ্গে যুগপৎ হয়নি, সেখানে হিংসা প্রধানত তত্ত্ব ও বাগ্মিতার স্তরেই সীমাবদ্ধ থেকেছে । এর উল্লেখযোগ্য উদাহরণ জার্মানি, যেখানে পাঠদানকক্ষের উপছে পড়ার সঙ্গে স্বত্বাধিকারী শিক্ষক-অধ্যাপকদের কায়েমী স্বার্থ যুক্ত ছিল। আমেরিকায় যেখানে যেখানে প্রশাসনিক ভবনের দখল, ধর্ণার মতো প্রকৃত অর্থে অহিংস কর্মসূচিতে পুলিশ ও পুলিশি নৃশংসতা নাক গলিয়েছে, সেখানে সেখানেই ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলন গুরুতরভাবে চরমপন্থী রূপ নিয়েছে। ‘ব্ল্যাক পাওয়ার’ আন্দোলনের আবির্ভাবের মধ্য দিয়েই বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনগুলোয় গুরুতর হিংসা প্রবেশ করেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট শিক্ষাগত যোগ্যতা ছাড়াই ভর্তি করা হয়েছিল যে কৃষ্ণাঙ্গ ছাত্রছাত্রীদের, তারা কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি হিসেবে একটা স্বার্থ-গোষ্ঠী রূপে নিজেদের সংগঠিত করেছিল। শিক্ষার মান অবনমিত করার সঙ্গে তাদের স্বার্থ জড়িয়ে ছিল। শ্বেতাঙ্গ বিদ্রোহীদের চেয়ে অনেক সতর্ক থাকলেও প্রথম থেকেই (এমনকি কর্ণেল বিশ্ববিদ্যালয় ও নিউ ইয়র্ক সিটি কলেজের ঘটনার আগে থেকেই) এটা স্পষ্ট ছিল যে হিংসা তাদের কাছে কোনও তত্ত্ব বা বাগ্মিতার ব্যাপার নয়। তাছাড়া, যেখানে পশ্চিমের দেশগুলোর কোথাও ছাত্রছাত্রীদের বিদ্রোহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে গণসমর্থনের ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারে না এবং হিংসার পথ নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সরাসরি বিরোধিতার মুখে পড়ে, সেখানে কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রদায়ের সংখ্যালঘিষ্ঠ হলেও একটা বড় অংশ কৃষ্ণাঙ্গ ছাত্রছাত্রীদের কথায় ও কাজে হিংসার পথ নেওয়ার সমর্থনে এসে দাঁড়িয়েছিল।৩০ কৃষ্ণাঙ্গ হিংসাকে বোঝার জন্য এক প্রজন্ম আগের শ্রমিক হিংসার সঙ্গে তুলনা করা যায়। যতদূর আমি জানি, একমাত্র স্টটন লিন্ড-ই শ্রমিক হাঙ্গামা ও ছাত্রছাত্রীদের বিদ্রোহের মধ্যে সরাসরি তুলনা টেনেছেন।৩১ কিন্তু যেভাবে শিক্ষাজগতের প্রতিষ্ঠান-কর্তারা শ্বেতাঙ্গ বিদ্রোহীদের এমনকি নৈতিক ও নিঃস্বার্থ দাবিগুলোর থেকে বোধরহিত ও অবিবেচক কৃষ্ণাঙ্গ বিদ্রোহীদের দাবি মেনে নেওয়ার দিকে ঝোঁক দেখাচ্ছেন, তাতে মনে হয় যে তঁারা প্রজন্মপূর্বের শ্রমিক হিংসার অনুষঙ্গ টেনেই ভাবছেন।৩২ শিক্ষাজগতের এই প্রতিষ্ঠান-কর্তারা অহিংস অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রের পন্থার চেয়ে হিংসা ও স্বার্থের মিশেলের মুখোমুখি হতেই বেশি স্বস্তি বোধ করেন। অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তাব্যক্তিদের কৃষ্ণাঙ্গ দাবিদাওয়ার সামনে নত হওয়ার প্রবণতাকে শ্বেতাঙ্গ সম্প্রদায়ের অপরাধবোধ দিয়েও অনেকসময় ব্যাখ্যা করা হয়েছে। কিন্তু আমার মনে হয় যে তার চেয়ে সম্ভাব্য ব্যাখ্যা হল ‘রিপোর্ট অন ভায়োলেন্স ইন আমেরিকা’ শীর্ষক সরকারি প্রতিবেদনের এই সিদ্ধান্ত যে ‘বলপ্রয়োগ ও হিংসার পিছনে যখন ব্যাপক জনসমর্থন থাকে তখন তা সমাজকে নিয়ন্ত্রণ ও প্রবর্তনার কৌশল হিসেবে সফল হয়ে উঠতে পারে’। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসক, কর্তৃপক্ষ ও অছি পরিষদ এই সিদ্ধান্তের বিতর্কাতীত সত্যতা সম্বন্ধে অন্তত অর্ধসচেতন তো বটেই।৩৩

ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলনের দ্বারা ঘটানো হিংসাকে নিঃসংশয়ে গৌরবান্বিত করার নতুন ধারার একটি অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য আছে। ফানন দ্বারা উদ্বুদ্ধ নব উগ্রপন্থীদের বাগ্মিতার তাত্ত্বিক উপস্থাপনা আসলে বিভিন্ন ধরনের মার্কসবাদের উচ্ছিষ্টের এক বিষম খিচুড়ি ছাড়া কিছু নয়। যে কোনওদিন সরাসরি মার্কস ও এঙ্গেলস পড়েছে, তার কাছে এই খিচুড়ি চূড়ান্ত বিভ্রান্তিকর বলে মনে হতে বাধ্য। যে প্রত্যয় ‘শ্রেণিহীন অলসদের’ উপর আস্থা রাখে, বিশ্বাস করে যে ‘বিদ্রোহ তার শহুরে বর্শামুখ খুঁজে পাবে লুম্পেনপ্রোলেতারিয়েতের মধ্যে’ আর ‘গ্যাংস্টাররা জনগণকে পথ দেখাবে’, সেই মতবাদকে কি কোনোভাবে মার্কসবাদ বলা যায়?৩৪ সার্ত্র তঁার শব্দপ্রয়োগের কুশলতা ব্যবহার করে এই নব বিশ্বাসের প্রকাশভঙ্গিকে মান্যরূপ দিয়েছেন। ফাননের বইয়ের জোরে তিনি এখন বিশ্বাস করেন: ‘আকিলিস-এর বল্লমের মতো হিংসা তার আঘাতে সৃষ্ট ক্ষতের উপশমও করতে পারে’। হায় রে, তা যদি সত্য হতো, আমাদের প্রায় সমস্ত অমঙ্গলের সর্বরোগহর বটিকা হতো প্রতিশোধ আদায়! সোরেল-কথিত ‘সাধারণ ধর্মঘট’-এর অতিকথা যতটা বিমূর্ত এবং বাস্তব থেকে যতটা দূরবর্তী ছিল, আকিলিস-এর বল্লমরূপী হিংসার অতিকথা তার থেকেও অনেক বেশি। ‘সম্মানের সঙ্গে অনাহারও শ্রেয় দাসত্ব করে রুটি খাওয়ার চেয়ে’— ফাননের এহেন অতিশয়োক্তির সঙ্গে এ অতিকথা সমস্তরের। এ বক্তব্য খণ্ডন করার জন্য কোনো ইতিহাস বা তত্ত্বের অবতারণা করার প্রয়োজন হয় না, মানবদেহে ঘটমান প্রক্রিয়ার নিতান্ত উপর-উপর পর্যবেক্ষণই এর মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে যথেষ্ট। কিন্তু যদি ফানন বলতেন যে সম্মানের সঙ্গে খাওয়া রুটি শ্রেয় দাসত্বে খাওয়া মিষ্টান্নের চেয়ে, তাহলে তঁার বাগ্মিতার বর্শামুখই তো ভোঁতা হয়ে যেত।

হিংসার উদ্গাতাদের এহেন দায়হীন অতিশয়োক্তিপূর্ণ বক্তব্য (আমি এখানে প্রতিনিধিস্থানীয় বক্তব্যই উদ্ধৃত করেছি, যদিও এটা মাথায় রাখা দরকার যে এই উদ্গাতাদের মধ্যে ফাননই বাস্তবতার সবচেয়ে নিকটবর্তী) বিদ্রোহ-বিপ্লব সম্বন্ধে আমাদের যা জানা আছে তার পরিপ্রেক্ষিতে দেখলে, তাৎপর্যহীন ও ক্ষণস্থায়ী কিছু মেজাজি কথাবার্তা হিসেবে এসবকে গুরুত্ব না দেওয়ার কথা মনে হতে পারে। অভূতপূর্ব ঘটনাপর্যায়ের মুখোমুখি হয়ে মানসিক ভাবে তা বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা না থাকায় আবেগের সততা সত্ত্বেও এমনকিছু ভাবনা-চিন্তা-আবেগকে এরা পুনরুজ্জীবিত করছে যাদের কবল থেকে বিপ্লবকে চিরতরে মুক্ত করার আশা মার্কস করেছিলেন— এমনটাও মনে হতে পারে। যাদের উপর হিংসা করা হয়, তারা যে পাল্টা হিংসা করার স্বপ্ন লালন করে; নিপীড়িতরা যে নিপীড়কের আসনে ‘কোনও একদিন নিজেদের স্থাপন করার’ স্বপ্ন দেখে; গরিবরা যে ধনীদের সম্পত্তিলাভের স্বপ্ন দেখে; উৎপীড়িত যে স্বপ্ন দেখে ‘কোনও একদিন শিকার ও শিকারীর ভূমিকা উল্টে যাবে’; যে কোনও রাজত্বে সবার পদানত সবার তলার মানুষটা স্বপ্ন দেখে এমন এক পাল্টা রাজত্বের যেখানে ‘সবার তলার জন থাকবে সবার উপরে আর সবার উপরের জন থাকবে সবার তলায়’— এ নিয়ে কি কোনওদিন কোনও সন্দেহ ছিল?৩৫ বরং মার্কস দেখাতে চেয়েছিলেন এ স্বপ্ন কোনওদিন সত্যি হয় না।৩৬ দাসবিদ্রোহের বিরলতা ও লাঞ্ছিত-বঞ্চিতদের অভ্যুত্থানের বিরলতা তো কুখ্যাত, যে বিরল কয়েকটি ক্ষেত্রে তা ঘটেছিল সেক্ষেত্রেও তা সেই ‘উন্মত্ত উগ্রচণ্ডা’ রূপ ধারণ করেছিল যা স্বপ্নপূরণকে সবার দুঃস্বপ্নে পরিণত করেছিল। যত দূর জানা আছে, কোনও ক্ষেত্রেই এইসব ‘অগ্নুৎপাতী’ বিস্ফোরণের বল, সার্ত্রের কথা মতো, ‘তাদের উপর ন্যস্ত চাপের সমান’ হয়নি। জাতীয় মুক্তির আন্দোলনকে এহেন বিস্ফোরণের আদলে দেখা তাদের কবর খোঁড়ার সামিল। এছাড়াও তথ্য সাক্ষ্য দেয় যে সম্ভাবনা কম হলেও যদি কখনও বিস্ফোরণ কোনওভাবে জয়ী হয়ে যায়, তাহলেও তা ব্যবস্থাকে বদলাতে পারে না, বদলায় কেবল সেই ব্যবস্থার কর্তাব্যক্তিদের মুখ। শেষত, ‘তৃতীয় বিশ্বের ঐক্য’ বলে এক বস্তুকে অনুমান করে নিয়ে তার ভিত্তিতে নি-উপনিবেশিকরণ যুগের নতুন স্লোগান হিসেবে (সার্ত্র-সূত্রায়িত) ‘সমস্ত অল্প বিকশিত দেশের আদিবাসীরা এক হও’ ঘোষণা করা হবে মার্কসের নিকৃষ্টতম বিভ্রমের পুনরাবৃত্তি করা, এবং তাও আরো বর্ধিত মাপে ও অনেক কম যাথার্থ্যের সঙ্গে। তৃতীয় বিশ্ব কোনও বাস্তবতা নয়, তৃতীয় বিশ্ব একটি মতবাদ।৩৭

——————

প্রশ্ন অবশ্য থেকেই যায় যে হিংসার নব প্রবক্তাদের এতজন কেন মার্কসের দেওয়া শিক্ষার সঙ্গে তাদের নির্ধারক অসঙ্গতি বিষয়ে অসচেতন? প্রশ্নটা এভাবেও করা যায় যে তারা কেন একগুঁয়ে রোখ নিয়ে সেসব ধারণা ও মতবাদকে আঁকড়ে থাকে যা তথ্য-ঘটনা দ্বারা ইতিমধ্যেই অপ্রমাণিত এবং যা তাদের নিজেদের ঘোষিত রাজনীতির সঙ্গেও স্পষ্টতই অসমঞ্জস? নতুন আন্দোলন একটি সদর্থক রাজনৈতিক স্লোগানকে সামনে নিয়ে এসেছে, তা হল অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রের দাবি। এই দাবি গোটা বিশ্বজুড়ে অনুরণিত হয়ে পুব ও পশ্চিমের বিদ্রোহগুলোর সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ সাধারণ সার হয়ে উঠেছে। বিপ্লবী পরম্পরার সর্বোৎকৃষ্ট উপাদান গণমন্ত্রণাসভা ব্যবস্থায় (কাউন্সিল সিস্টেম) এই দাবির উৎস। আঠারো শতক পরবর্তী সমস্ত বিপ্লবের একমাত্র খাঁটি উপবৃদ্ধি হিসেবে গণমন্ত্রণাসভা ব্যবস্থা দেখা দিয়েছে, যদিও এখনও অবধি সর্বদাই তা শেষাবধি পরাজিত হয়েছে। কিন্তু কথায় ও সারবস্তুতে এর অভিমুখী কোনও লক্ষ্যের কথা মার্কস ও লেনিনের দেওয়া শিক্ষায় পাওয়া যায় না কারণ দুজনেই এর বিপরীতে এমন এক সমাজ অভিমুখে লক্ষ্যস্থির করেছিলেন যে সমাজে রাষ্ট্রের শুকিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গণক্রিয়া ও গণকর্মসূচিতে অংশ নেওয়ার প্রয়োজনও শুকিয়ে যাবে।৩৮ আজকের বিশ্বে পশ্চিমের প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রগুলো এমনকি তাদের নিছক প্রতিনিধিত্বমূলক বৃত্তিও খোয়াতে বসেছে বিপুলাকার পার্টি-যন্ত্রগুলোর দাপটে, যে পার্টি-যন্ত্রগুলো তাদের কর্তা-কুশীলবদের ‘প্রতিনিধিত্ব’ করে, এমনকি পার্টি-সদস্যদেরও প্রতিনিধিত্ব করে না। অন্যদিকে পুবের একদলীয় আমলাতন্ত্র বা বুরোক্রেসিগুলো নীতিগতভাবেই প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থাকে খারিজ করেছে। এই দুইয়ের বিরুদ্ধে নব বামদের উচ্চারণ বাগাড়ম্বরের ভারে অস্পষ্ট অস্ফুটোচ্চারণের মতো। তাত্ত্বিক ক্ষেত্রে তাদের অদ্ভুত ভীরু আড়ষ্ঠতার জন্যই নব বামদের এই অবস্থা। চর্চাক্ষেত্রে বলিষ্ঠ সাহসিকতার পাশে এই ভীরু আড়ষ্ঠতার মতো বেমানান আর কী হতে পারে!

অতীতের কাছে বেমানান বশ্যতাস্বীকারের এই আবহে আরও আশ্চর্যজনক হয়ে ওঠে নব বামদের এই অসচেতনতা যে তারা খেয়ালই করছে না তাদের বিদ্রোহের নৈতিক চরিত্র কীভাবে মার্কসবাদী বাগ্মিতার সঙ্গে খাপ খায় না। বর্তমান আন্দোলনের সবচেয়ে নজরটানা চরিত্র হল তার নিঃস্বার্থপরতা। পিটার স্টেইনফেল ‘কমনউইল’-য়ে প্রকাশিত তঁার ‘ফরাসি বিপ্লব ১৯৬৮’ নামক প্রবন্ধে যথার্থভাবেই বলেছেন: ‘যেভাবে পিগ্যু সরবোন মানদারিনেট-কে উপহাস করে সূত্র হাজির করেছিলেন যে সামাজিক বিপ্লব হয় নৈতিক হবে আর নয়তো কিছুই নয়, তাতে তিনি সাংস্কৃতিক বিপ্লবের যোগ্য পৃষ্ঠপোষক হতে পারতেন।’ সন্দেহ নেই যে প্রতিটি বিপ্লবী আন্দোলনেই এমন কিছু নিঃস্বার্থ ব্যক্তি নেতৃত্ব দেন যারা সহানুভূতি ও ন্যায়প্রতিষ্ঠার আবেগ দ্বারা চালিত হন— মার্কস ও লেনিন-এর ক্ষেত্রেও একথা প্রযোজ্য। কিন্তু আমরা জানি যে মার্কস অত্যন্ত কার্যকরীভাবে এসব ‘আবেগ-উচ্ছ্বাসের’ উপর নীতিগত নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন। আজ যদি আধিপত্যকারী প্রতিষ্ঠান নৈতিক প্রস্তাবনাকে ‘আবেগ-উচ্ছ্বাসে ভেসে যাওয়া’ বলে নাকচ করে, তাহলে তা বিদ্রোহীদের চেয়ে মার্কসবাদী মতবাদের ঘনিষ্ঠতর হবে। মার্কস ‘নিঃস্বার্থ’ নেতৃত্বের প্রশ্নটি সমাধান করেছেন সেই নেতৃত্বকে মানবেতিহাসের চূড়ান্ত স্বার্থের প্রতিনিধিত্বকারী ‘আগুয়ান’ (ভ্যানগার্ড) হিসাবে কল্পনা করে নিয়ে।৪০ এতৎসত্ত্বেও সেই ‘আগুয়ানদের’ প্রথমে শ্রমিকশ্রেণির ভবিষ্যৎ-কল্পনা-বিহীন মাটিঘেঁষা স্বার্থের পক্ষাবলম্বন করতে হয় এবং শ্রমিকশ্রেণির সঙ্গে নিজেদের একাত্ম করতে হয়— কেবলমাত্র তাই-ই তাদের সমাজের বাইরে একটা শক্তপোক্ত দাঁড়াবার জায়গা করে দেয়। আর এই জায়গাতেই আধুনিক বিদ্রোহীদের খামতি থেকে গেছে শুরু থেকে এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনের বাইরে বেরিয়ে মরীয়া অনুসন্ধানের পরও তাদের মিত্র মেলেনি। সব দেশেই শ্রমিকদের বিরোধিতাপূর্ণ মনোভাব প্রাধান্যবিস্তার করেছে।৪১ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও যে ‘ব্ল্যাক পাওয়ার’ আন্দোলন নিজ জনসমষ্টি অর্থাৎ কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে তুলনামূলক গভীর শিকড় ছড়িয়েছিল এবং তাই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও দাবি আদায়ের দরকষাকষিতে তুলনামূলক বেশি শক্তিধর ছিল, তার অন্তর্গত ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে সহযোগিতার সম্পর্ক গঠনের সমস্ত প্রয়াস বিফলে যাওয়া ছিল শ্বেতাঙ্গ বিদ্রোহীদের তিক্ততম হতাশার কারণ। (‘ব্ল্যাক পাওয়ার’-এর মানুষজন ‘নিঃস্বার্থ’ শ্বেতাঙ্গ নেতাদের জন্য সর্বহারার ভূমিকা পালন করতে অস্বীকার করার মধ্য দিয়ে বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছিল কিনা তা অবশ্য অন্য প্রশ্ন।) অবাক হওয়ার নয় যে যুব আন্দোলনের পুরানো পীঠস্থান জার্মানিতেই ছাত্রছাত্রীদের একটা গোষ্ঠী তাদের দলে ‘সমস্ত সংগঠিত যুবগোষ্ঠীদের’ সামিল করার প্রস্তাব করছে এখন,৪২ যে প্রস্তাবের অবাস্তবতা সন্দেহাতীত।

শেষাবধি এই সব অসঙ্গতির ব্যাখ্যা কীভাবে খাড়া করা হবে সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত নই, কিন্তু আমার সন্দেহ হয় যে একটি বিশেষ উনিশ শতকীয় মতবাদের প্রতি এহেন আনুগত্যের গভীরতর কারণ জড়িয়ে আছে ‘প্রগতি’-র ধারণার সঙ্গে। এই ‘প্রগতি’-র ধারণা বিভিন্ন ধরনের ‘বাম’-দের মধ্যে উদারনীতিবাদ, সমাজবাদ ও কম্যুনিজমের ভাবনার সাধারণ সূত্র হিসেবে কাজ করলেও বিশ্বাসযোগ্যতা ও সূক্ষ্মতার বিচারে সবচেয়ে প্রভাবশালী রূপ ধারণ করেছিল মার্কস-এর লেখনীতে। (উদারনীতিবাদ দুটো বিপরীত বিষয়কে একসঙ্গে মেলাতে চেয়েছে। প্রথমটি হল ‘প্রগতি’-র প্রতি অ-দোদুল্যমান আনুগত্য। আর দ্বিতীয়টি হল, যেসব মার্কসীয় ও হেগেলিয় শব্দবন্ধ-ধারণা ‘ইতিহাস’-কে মহিমান্বিত করে ‘প্রগতি’-র ন্যায্যতা উৎপাদন করে ও নিশ্চিতিপ্রদান করে, সেইসবে কড়া আপত্তি। এই অসঙ্গতিই উদারনৈতিক চিন্তার বর্মে দুর্বলতম স্থান।)

মানবজাতিকে একটি সমগ্র হিসেবে ধরে, তার ‘প্রগতি’ বলে যে এক বস্তু আছে— এ ধারণা সতেরো শতকের আগে অজানা ছিল, আঠারো শতকের পণ্ডিতমহলে একটা সাধারণ মতামত হিসেবে তা গড়ে উঠেছিল, আর উনিশ শতকে তা প্রায় সর্বজনগ্রাহ্য একটা মতবাদ হয়ে উঠেছিল। কিন্তু এর প্রথম দিকের রূপ আর শেষাবধি গ্রহণ করা রূপের মধ্যে চূড়ান্ত পার্থক্য আছে। সতেরো শতকের সবথেকে ভালো প্রতিনিধি হিসাবে নেওয়া যায় পাসকাল ও ফন্তেনেলে-কে। তঁারা শতকের পর শতক ধরে জ্ঞানের সঞ্চয়সাধনের সাপেক্ষে ‘প্রগতি’-কে ভেবেছিলেন। আঠারো শতকে ‘প্রগতি’ শব্দটির অর্থ দাঁড়ায় ‘মানবজাতির শিক্ষিতকরণ' (লেসিঙ-এর Erziehung des Menschengeschlechts), যার পরিসমাপ্তি ঘটবে মানুষের প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে ওঠার মধ্য দিয়ে। সেই অর্থে ‘প্রগতি’ অন্তহীন ছিল না। আর এই সূত্রেই ইতিহাসের পরিসমাপ্তি হয়ে উঠতে সক্ষম এক মুক্তির জগৎ হিসেবে শ্রেণিহীন সমাজকে কল্পনা করার মার্কসীয় ধারণা— যা খ্রিস্টধর্মের মৃত্যুপরিণামতত্ত্ব বা ইহুদিধর্মের ঈশ্বরপ্রেরিত পরিত্রাতার তত্ত্বের অধর্মীয় রূপান্তর হিসেবে প্রায়শই ব্যাখ্যাত হয়ে থাকে— এখনও প্রকৃত প্রস্তাবে ‘আলোকিত হওয়ার যুগের’ (‘এজ অফ এনলাইটেনমেন্ট'-এর) চিহ্ন বহন করে চলেছে। উনিশ শতকের শুরু থেকে অবশ্য এমন সব অন্তসীমার ভাবনা পরিত্যক্ত হয়েছে। যেমন, প্রুধোঁর ভাষায়, গতি হল ‘আদি মৌলিক বস্তু’ (‘le fait primitif’) এবং ‘একমাত্র গতির নিয়মাবলীই চিরন্তন’। এই গতির কোনও শুরু নেই, কোনও শেষও নেই: ‘Le movement est; voila tout!’ মানুষ সম্পর্কে কেবল বলা যায় যে ‘জন্ম থেকেই আমরা আরো নিখুঁত হতে হতে যেতে পারি, কিন্তু সম্পূর্ণ নিখুঁত হওয়া কখনোই সম্ভব নয়’।৪৩ ইতিহাসজুড়ে প্রগতির অনাদিঅনন্ত নিরবচ্ছিন্নতার ধারণার প্রত্যয়গত নিশ্চিতি এসেছে হেগেলের থেকে ধার নেওয়া মার্কসের এই চরম উদ্ভাবনীক্ষমতাসম্পন্ন প্রস্তাবনা থেকে যে প্রতিটি পুরানো সমাজ নিজ মধ্যে তার পরবর্তী সমাজের বীজ ধারণ করে, ঠিক যেমন প্রতিটি প্রাণী নিজ সন্তানের বীজ ধারণ করে। আর যেহেতু কল্পনা করা হয় যে এই প্রগতিমুখী গতি বিপরীত বলের সংঘাত থেকে উৎসারিত, তাই যে কোনও ভিন্নগতিকেই ‘আবশ্যক কিন্তু সাময়িক পশ্চাদপসরণ’ হিসেবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব।

সন্দেহ নেই যে শেষ বিচারে কেবলমাত্র একটি রূপকের উপর ভিত্তি করে নির্মিত নিশ্চিতি কোনও মতবাদ নির্মাণের মজবুততম ভিত্তি হতে পারে না। কিন্তু দুঃখের কথা যে দর্শনের অন্য বহু মহান মতবাদের মতো মার্কসবাদও এভাবেই নির্মিত। অন্যান্য মতবাদগুলোর সঙ্গে তুলনামূলক বিচারে অবশ্য ইতিহাস সম্পর্কে ধারণার ক্ষেত্রে মার্কসবাদের বড় সুবিধার বিষয়টা স্পষ্ট হয়ে যায়। ইতিহাস সম্পর্কে বিবিধ অন্যান্য ধারণা— যেমন, ‘চিরন্তন পুনরাবৃত্তি'-র তত্ত্ব, সাম্রাজ্যের উত্থান-পতনের ঢেউয়ের তত্ত্ব, প্রকৃতার্থে অসংযুক্ত ঘটনাবলীর এলোমেলো অনুক্রমের তত্ত্ব— প্রত্যেকটির সমর্থনেই সমভাবে প্রমাণসংগ্রহ ও যাথার্থ্য-প্রতিষ্ঠা সম্ভব, কিন্তু তাদের কোনওটার মধ্য দিয়েই ঐতিহাসিক সময়ের সমরৈখিকতা ও প্রগতির অনবচ্ছিন্নতার তেমন কোনও নিশ্চিতি পাওয়া যায় না, যা মার্কসবাদ থেকে পাওয়া যায়। এই ক্ষেত্রে মার্কসবাদের একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী মনে হয় সেই প্রাচীন ধারণা যেখানে সূচনায় এক স্বর্ণযুগের কল্পনা করা হয়েছে এবং তার থেকেই পরবর্তী সবকিছু উৎসারিত বলে ধরে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই শেষোক্ত ধারণা যে নিশ্চিতি দেয়, তা নিরবচ্ছিন্ন পতনের নিশ্চিতি, যা মোটেই সুখদায়ক নয়। অবশ্য এ কথাও সত্য যে এহেন স্বস্তিকর নিশ্চিতি যে ‘অধিকতর ভালো জগতে পৌঁছানোর জন্য আমাদের কেবল সম্মুখপানে কুচকাওয়াজ করে চললেই চলবে, আর তাছাড়া অন্যথাও কিছু হতে পারে না’— এরও কিছু বিষাদজনক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে। প্রথমত, ‘মানবজাতির সাধারণ ভবিষ্যৎ’ ব্যক্তিমানুষকে কিছুই দিতে পারে না কারণ ব্যক্তিমানুষের একমাত্র নিশ্চিত ভবিষ্যৎ হল মৃত্যু। আর একে উপেক্ষা করে যদি কেবল সাধারণীকরণের স্তরেই ভাবনাকে সীমাবদ্ধ রাখা হয়, তাহলেও ‘প্রগতি’-র বিরুদ্ধে এই বিতর্কাতীত প্রস্তাবনা থেকে যায় যে (হারজেন-এর ভাষায়) ‘মানব-প্রগতি হল সময়ানুক্রমিক অন্যায্যতার এক রূপ যেহেতু পরবর্তী কালে আগতরা তাদের পূর্ববর্তীদের শ্রমের দ্বারা লাভবান হতে পারে সম পরিমাণ মূল্য না চুকিয়েই’,৪৪ বা, (কান্ট-এর ভাষায়) ‘সর্বদাই এর মতো হতবুদ্ধিকর আর কিছু হতে পারে না যে... পূর্ববর্তী প্রজন্ম যেনবা তাদের কষ্টসাধ্য দায়িত্ব পালন করে চলেছে কেবলমাত্র তাদের পরবর্তী প্রজন্মের স্বার্থে... আর কেবলমাত্র সর্বশেষ প্রজন্মেরই হবে (সর্বসম্পূর্ণ) আবাসে বাস করার সৌভাগ্য।'৪৫

এই অসুবিধাগুলোকে খেয়াল করার ঘটনা বেশ বিরল। আর এগুলোকে বিপুলভাবে ছাপিয়ে গেছে একটি প্রচন্ড সুবিধা, যা হল: ‘প্রগতি’ কেবলমাত্র অতীতকেই অনবচ্ছিন্ন সময়প্রবাহের নিরবচ্ছিন্নতা বজায় রেখে ব্যাখ্যা করে না, তা ভবিষ্যৎ-গমন ক্রিয়ার নির্দেশক হিসেবেও কাজ করে। হেগেলকে উল্টিয়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে মার্কস এটা আবিষ্কার করেছিলেন: মার্কস ইতিহাসদ্রষ্টার দৃষ্টির দিক পরিবর্তন করে দিলেন, অতীতের দিকে দৃষ্টি দেওয়ার বদলে ইতিহাসদ্রষ্টা এখন দৃঢ় বিশ্বাসের সঙ্গে ভবিষ্যতের মধ্যে দৃষ্টিনিক্ষেপ করল। ‘এখন আমাদের কী করণীয়’— এই সদা-অস্বস্তিকর প্রশ্নের উত্তর সহজে হাজির করে দেয় ‘প্রগতি’। সবচেয়ে নিচের স্তরে সে উত্তরটি হল: যা আমাদের আছে তাকেই আরো ভালো, আরো বড় ইত্যাদি করে তোলা যাক। (আমাদের সমসাময়িক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক তত্ত্বে ‘ক্রমিক বৃদ্ধি’-র উপর উদারপন্থীদের দৃঢ় বিশ্বাস, প্রথম দৃষ্টিতে অযৌক্তিক ঠেকলেও, এই ধারণার উপর নির্ভরশীল।) আর ‘বাম’-দের সূক্ষ্মতর স্তরে উত্তরটি হল: বর্তমান দ্বন্দ্বগুলোকে বিকশিত কর তাদের সহজাত সংশ্লেষের অভিমুখে। উভয় ক্ষেত্রেই আমরা আশ্বস্ত হই যে সম্পূর্ণ নতুন বা সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটতে পারে না, একমাত্র ঘটতে পারে যা আমাদের জ্ঞাত বিষয়সমূহেরই ‘আবশ্যিক’ ফল।৪৬ কতটাই না আশ্বস্ত করে হেগেলের এই কথাগুলো যে ‘যা ইতিমধ্যেই ছিল তা ব্যতিরেকে অন্য কোনও কিছুই আবির্ভূত হতে পারে না।’৪৭

বলার অপেক্ষা রাখে না যে এই শতকে (বিশ শতকে) সমস্ত অভিজ্ঞতা আমাদের অবিরত সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। তাই আমাদের অভিজ্ঞতার ঘোর বিরুদ্ধাচারণ করা সত্ত্বেও এই ধারণা ও মতবাদগুলো বাস্তবতাকে দৃষ্টির বাইরে রেখে এক স্বস্তিদায়ক কাল্পনিক বা ছদ্ম-বৈজ্ঞানিক ঘেরাটোপের আশ্রয় তৈরি করে দেওয়ার জন্য জনপ্রিয়। এই শতকের সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ঘটনাবলীর অন্যতম হল কেবলমাত্র নৈতিক বিবেচনা দ্বারা অনুপ্রাণিত ছাত্রছাত্রীদের বিদ্রোহ। এই যে প্রজন্ম তাদের পূর্বজদের মতোই ‘নিজের-ভাগ-বুঝে-নেওয়া’ গোছের সমাজ-রাজনৈতিক তত্ত্বের রকমফের দ্বারা প্রশিক্ষিত হয়েছে, তারাই আমাদের উদ্দেশ্যমূলক নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে, বা বলা ভালো তার সীমাবদ্ধতা বিষয়ে এমন কিছু শিক্ষা দিয়ে গেল যা আর ভুলে না যাওয়াই মঙ্গল। মানুষকে ‘উদ্দেশ্যমূলকভাবে নিয়ন্ত্রণ’ করা যায় শারীরিক পীড়ন, অত্যাচার বা অভুক্ত রাখাকে হাতিয়ার করে। তথাকথিত ‘মুক্ত’ সমাজেও মানুষের মতামতকে যথেচ্ছ আকার দেওয়া যায় কেবলমাত্র উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সংগঠিত ভুল তথ্য জ্ঞাপন বা ‘লুকানো প্ররোচকদের’ মাধ্যমেই নয়, বরং দূরদর্শন, বিজ্ঞাপন ও অন্য নানা মনস্তাত্ত্বিক উপায়েও। দুঃখের বিষয় যে বাস্তবতা দ্বারা তত্ত্বের খণ্ডন দীর্ঘসূত্রী ও অনিশ্চিত একটি প্রক্রিয়া। ‘উদ্দেশ্যমূলক নিয়ন্ত্রণ’-এ আসক্ত যারা, অর্থাৎ যারা তার উপরই ভরসা করে ও যারা তাকে অতিরিক্ত ভয়-সমীহ করে, তারা কেউই দিনশেষে পাখিদের বাসায় ফেরা খেয়াল করে না। [তত্ত্ব বিস্ফোরিত হয়ে উদ্ভটত্বে পরিণত হওয়ার একটা সুন্দর উদাহরণ ঘটেছিল বার্কলেতে সম্প্রতি ‘গণ উদ্যান’ (‘পিপলস পার্ক’) সংক্রান্ত ঝঞ্ঝাটের সময়। পুলিশ ও ন্যাশনাল গার্ড যখন রাইফেল, খোলা বেয়নেট, হেলিকপটার থেকে বর্ষানো ‘রায়ট গ্যাস’ সমভিব্যাহারে নিরস্ত্র ছাত্রছাত্রীদের আক্রমণ করল, তখন আক্রান্ত ছাত্রছাত্রীদের অতি অল্পজনই ‘চোখা চোখা কিছু সম্ভাষণ ব্যতিরেকে অন্য কিছু আক্রমণকারীদের দিকে ছুঁড়েছে’। পুলিশ ও ন্যাশনাল গার্ডের কিছু উর্দিধারী খোলাখুলি তাদের ‘শত্রু’-দের প্রতি সৌভ্রাতৃত্বের মনোভাবাপন্ন হয়ে পড়েছিল, একজন তো তার হাতের অস্ত্র ছুঁড়ে ফেলে চিৎকার করে উঠেছিল, ‘এ আর আমি সহ্য করতে পারছি না’। এ কী ঘটল? আমাদের এই আলোকপ্রাপ্তির যুগে একে তো কেবল পাগলামো বলেই ব্যাখ্যা করা যায়: ‘তাকে সাত তাড়াতাড়ি মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছিল এবং সেখানে তার রোগ চিহ্নিত হয়েছিল “অবদমিত হানাদারি প্রবৃত্তি”-র প্রকোপ হিসেবে’।]৪৮

আমাদের সমসময়ের অন্ধবিশ্বাসের মেলায় প্রগতি-বিশ্বাস নিঃসন্দেহে একটি গুরুতর ও জটিলতর উপাদান।৪৯ প্রধানত প্রকৃতিবিজ্ঞানের বিস্ময়কর বিকাশের কারণেই ‘সীমাহীন প্রগতি’-র উপর উনিশ শতকীয় অন্ধবিশ্বাস সর্বজনগ্রাহ্যতা লাভ করেছে। আধুনিক যুগের উত্থানের পর থেকে প্রকৃতিবিজ্ঞান বিশ্বব্রক্ষ্মাণ্ডের বিশালতা ক্রম-আবিষ্কারের অন্তহীন অভিযানকে ভবিতব্য করে তোলার মধ্য দিয়ে কার্যত বিশ্বব্রক্ষ্মাণ্ড-বিজ্ঞান হয়ে উঠেছে। পৃথিবী এবং পার্থিব প্রকৃতির মধ্যে সীমাবদ্ধ না থাকলেই যে বিজ্ঞান ‘অন্তহীন প্রগতি’-র অধীনস্থ হয়ে উঠবে তা নিশ্চিত নয়। কিন্তু এটা নিশ্চিত যে মানবসত্তার বিবিধ সৃষ্টি নিয়ে কঠোরভাবে বৈজ্ঞানিক যে মানববিদ্যাচর্চা (তথাকথিত Geisteswissenschaften) তার শেষ ঘনিয়ে এসেছে। বহু বিদ্যাচর্চা ক্ষেত্রেই এখন কেবল অধীত বিষয়ের পাঠ ও শিক্ষাই সম্ভব, কিন্তু সেসব ক্ষেত্রে মৌলিক গবেষণাকর্মের জন্য অন্তহীন ও বোধহীন দাবি এমন পরিস্থিতি তৈরি করেছে যে হয় ক্রমাগত ছোট হয়ে আসা বিষয়পরিধিতে ক্রমাগত আরও বেশি বেশি জানার বিখ্যাত পথ নিখাদ অপ্রাসঙ্গিকতার মরুভূমিতে হারিয়ে যাচ্ছে আর নয়তো এমন এক ছদ্ম-পাণ্ডিত্যের ভান তৈরি করছে যা প্রকৃত প্রস্তাবে জ্ঞানের বিষয়বস্তুকেই ধ্বংস করছে।৫০ উল্লেখনীয় যে তরুণদের বিদ্রোহ, যে মাত্রায় তা নিখাদ নৈতিকতা বা রাজনীতি দ্বারা চালিত নয়, সে মাত্রায় তা বিরোধিতার বর্শামুখ তাক করেছে পাণ্ডিত্য ও বিজ্ঞানের দিকে, যা উভয়ই, বিভিন্ন কারণে হলেও, তাদের চোখে বিষম সন্দেহের বস্তু। আর এমনটা হতেই পারে যে সত্যি সত্যিই আমরা এমন এক সন্ধিক্ষণে পৌঁছে গেছি, যখন থেকে বিজ্ঞান ও পাণ্ডিত্যের ফল কেবল ধ্বংসাত্মকই হবে। বিজ্ঞানের প্রগতি আর মানবজাতির প্রগতি (যে অর্থেই তা বলা হোক না কেন) যুগপৎ নয়। তাছাড়াও বিজ্ঞানের প্রগতি এখন মানবজাতির ইতি ডেকে আনতে পারে, ঠিক যেমন পাণ্ডিত্যের আরো প্রগতি ধ্বংস করতে পারে ঠিক যা যা বিদ্যাচর্চাকে একদিন গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছিল। অন্যভাবে বললে, যে বিপর্যয়কারী দ্রুত পরিবর্তন-প্রক্রিয়ার বাঁধন আমরা খুলে দিয়েছি, তার মূল্যায়নকারী মান-ধারণা হিসেবে ‘প্রগতি’ আর যথোপযুক্ত নয়।

আমাদের আলোচনার বিষয় যেহেতু ‘হিংসা’, একটা সম্ভাব্য ভুল-বোঝাবুঝির বিষয়ে সতর্ক থাকা ভালো। ইতিহাসকে যদি আমরা এমন এক নিরবচ্ছিন্ন সময়প্রবাহ হিসাবে দেখি যেখানে ‘প্রগতি’ অবধারিত তাহলে ‘যুদ্ধ ও বিপ্লব’-রূপী হিংসাকেই একমাত্র সম্ভাব্য যতি বলে মনে হতে পারে। তা যদি সত্য হতো, অর্থাৎ, মানবজাতির ইতিহাসের স্বয়ংক্রিয় প্রক্রিয়ায় যতি টানতে সক্ষম একমাত্র ক্রিয়া যদি হিংসার চর্চাই হতো, তাহলে হিংসার প্রচারকগণ তাদের সপক্ষে একটা গুরুত্বপূর্ণ যুক্তি পেয়ে যেতেন। (যতদূর জানি, তাত্ত্বিক আলোচনায় এহেন যুক্তি কখনও টানা হয় নি, কিন্তু গত কয়েক বছরে ছাত্রছাত্রীদের ছেদ-টানা কার্যকলাপ এই বিশ্বাসকে ভিত করেই গড়ে উঠেছে বলে আমার মনে হয়েছে।) নিছক আচরণের প্রতিতুলনায় যে কোনও স্বতক্রিয়ার ভূমিকাই হল এমন এক প্রক্রিয়ায় ছেদ/যতি টানা যা অন্যথায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে ও তজ্জন্যই ভবিষ্যদবাণী-নির্ধারিত ভাবে চলতে থাকত।

পূর্বোক্ত অভিজ্ঞতাসমূহের প্রেক্ষিতেই আমি রাজনৈতিক ক্ষেত্রে হিংসার প্রশ্নটিকে নিয়ে আলোচনা করতে চাই। তা খুব সহজসাধ্য নয়। ষাট বছর আগে সোরেল বলেছিলেন, ‘হিংসা সম্পর্কিত প্রশ্নসমূহ এখনও খুব অস্পষ্ট হয়ে আছে’।৫১ এখনও সেই পরিস্থিতি বিরাজ করছে। নিজ গুরুত্বেই গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রতীত বিষয় হিসেবে হিংসাকে গণ্য করার ক্ষেত্রে সাধারণ অনীহার কথা আমি আগে উল্লেখ করেছি, এখন তা আরও সুনির্দিষ্ট করার জন্য ব্যাখ্যা প্রয়োজন। একটি প্রতীত বিষয় হিসেবে ক্ষমতাকে নিয়ে আলোচনাগুলো যদি আমরা খেয়াল করি, খুব সহজেই আমরা দেখতে পাব যে বাম থেকে ডান পর্যন্ত সমস্ত রাজনৈতিক তাত্ত্বিকরা এই ব্যাপারে একমত যে ক্ষমতার কুখ্যাততম আতিশয্যের প্রকাশ ছাড়া হিংসা আর কিছু নয়। সি রাইট মিলস-এর মতে, ‘সমস্ত ধরনের রাজনীতিই হল ক্ষমতার জন্য সংগ্রাম আর ক্ষমতার শেষ কথা হল হিংসা’। মিলস-এর এই মতের মধ্যে প্রতিধ্বনিত হতে শুনি ম্যাক্স ওয়েবার-এর তৈরি রাষ্ট্রের সংজ্ঞা: ‘(রাষ্ট্র হল) হিংসা, অর্থাৎ, তথাকথিত আইনসিদ্ধ হিংসার উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত মানুষদের উপর মানুষদের শাসন’। ৫২ এই ঐকমত্য বেশ অস্বাভাবিক, কারণ, রাজনৈতিক ক্ষমতা আর ‘হিংসার সংগঠন’-এর মধ্যে সমীকরণ তখনই টানা যায় যখন শাসকশ্রেণির করায়ত্ত নিপীড়নের হাতিয়ার হিসেবে রাষ্ট্র সম্পর্কে মার্কসীয় বিচারকে অনুসরণ করা হয়। তাই একবার দেখে নেওয়া যাক সেই সমস্ত লেখকদের যারা রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রীয় বিধিব্যবস্থা ও প্রতিষ্ঠানসমূহকে কেবলমাত্র কোনও অন্তর্নিহিত বল (বা বলসমূহের) অধীনস্থ প্রকাশস্বরূপ দমনমূলক উপরিকাঠামো হিসাবে দেখেননি। যেমন ধরা যাক বারট্রাণ্ড ডি জুভেনেল-এর কথা। তার ‘পাওয়ার’ গ্রন্থটি এ বিষয়ে সাম্প্রতিক সন্দর্ভগুলোর মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে প্রভাবশালী এবং সবচেয়ে কৌতুহলোদ্দীপকও বটে। তিনি লিখেছেন, ‘যুগপ্রবাহের ক্রম-উন্মোচন নিরীক্ষণকারী যে কোনও ব্যক্তির কাছে যুদ্ধ উপস্থিত হয় রাষ্ট্রের এমন এক কার্যকলাপ হিসেবে যা রাষ্ট্রের অন্তঃসারের সঙ্গে সংসৃষ্ট’।৫৩ তা হলে প্রশ্ন ওঠে যে যুদ্ধের অবসান কী রাষ্ট্রেরও অবসান ঘটাবে? রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সম্পর্কে হিংসার অবসান কি ক্ষমতার অবসান ঘটাবে?

উত্তরটা বোধহয় নির্ভর করছে ক্ষমতা বলতে আমরা কী বুঝি তার উপর। ‘ক্ষমতা’-কে বলা হচ্ছে ‘শাসন করার একটি হাতিয়ার’, যেখানে ‘আধিপত্য করার প্রবৃত্তি’-ই ‘শাসন’-এর উৎস।৫৪ সার্ত্রের কথা মনে ভেসে ওঠে যখন জুভেনেল-এর লেখায় পড়ি: ‘অন্যের উপর নিজ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা ও নিজের আদেশ পালনে অন্যকে বাধ্য করা মানুষকে অতুলনীয় আনন্দ দেয়, তার মধ্য দিয়েই মানুষ নিজের মনুষ্যত্বকে অনুভব করতে পারে।’৫৫ ভলতেয়ার বলেছিলেন, ‘নিজের খেয়ালমতো অন্যকে কাজ করতে বাধ্য করানোতেই ক্ষমতার উৎপত্তি’। ক্লসউইৎজ যুদ্ধের সংজ্ঞানির্মাণ করেছিলেন এইভাবে: যুদ্ধ হল ‘নিজ ইচ্ছা অনুযায়ী প্রতিপক্ষকে কাজ করতে বাধ্য করার উদ্দেশ্যে সংগঠিত হিংসা’। যুদ্ধের এই ক্লসউইৎজ কৃত সংজ্ঞাকে স্মরণ করিয়ে ম্যাক্স ওয়েবার বলেন যে ক্ষমতা সেখানেই হাজির হয় যেখানে ‘অন্যের বাধা অতিক্রম করে নিজ ইচ্ছাকে প্রতিষ্ঠা করার’ সুযোগ আসে। আবার স্ত্রাউজ-হুপি বলেন যে, ‘মানুষের উপর মানুষের ক্ষমতা’-ই হল ক্ষমতার সার।৫৬ জুভেনেল-এ প্রত্যাবর্তন করলে আমরা পাই: ‘আদেশ জারি করা ও তার মান্যতা পাওয়া: এছাড়া কোনও ক্ষমতার অস্তিত্ব থাকতে পারে না, আর অন্য কিছু আবশ্যক নয়... যা আবশ্যক, ক্ষমতার সেই সারবস্তু হল আদেশ জারি।’৫৭ ক্ষমতার সারবস্তু যদি হয় আদেশের কার্যকারিতা, তাহলে, বন্দুকের নল যে ক্ষমতার উৎস, সেই ক্ষমতার চেয়ে বড় ক্ষমতা আর কিছু হতে পারে না। তখন বলা দুষ্কর হয়ে ওঠে ‘আইনরক্ষক পুলিসের আদেশের সঙ্গে বন্দুকবাজের আদেশ কীভাবে আলাদা’। (শেষ উদ্ধৃতিটি আলেকজান্ডার পাসেরঁ দেন্দ্রিভ-এর ‘দি নোশন অফ দি স্টেট’ নামের গুরুত্বপূর্ণ বই থেকে নেওয়া। আমার জানার মধ্যে ইনিই একমাত্র লেখক যিনি হিংসা ও ক্ষমতার মধ্যে পার্থক্য করার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন: ‘আইনানুগভাবে বল প্রয়োগের ঘটনা কীভাবে বলের নিজস্ব গুণ বদলে দেয় এবং মানবসম্পর্ক বিষয়ক একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ছবি আমাদের সামনে হাজির করে, তা নির্ণয় করতে হলে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে ক্ষমতা ও বল-এর মধ্যে পার্থক্য করা যায় কিনা, ও গেলে কীভাবে’ কারণ ‘সীমাচিহ্নিত হলে বল আর বল থাকে না’। লিখিত সাহিত্যে সবচেয়ে সূক্ষ্ম ও চিন্তাশীল এই পার্থক্যীকরণও অবশ্য বিষয়ের মূলে পৌঁছয় না। পাসেরঁ দেন্দ্রিভের বোঝাবুঝিতে ক্ষমতা একটি ‘গুণান্বিত’ বা ‘প্রাতিষ্ঠানিকীকৃত বল’। অন্যভাবে বললে, পূর্বোক্ত লেখকরা যেখানে হিংসাকে সংজ্ঞায়িত করেছেন ক্ষমতার ঘোরতম প্রকাশ হিসাবে, সেখানে পাসেরঁ দেন্দ্রিভ হিংসাকে সংজ্ঞায়িত করেছেন প্রশমিত ক্ষমতার একটি ধরন হিসাবে। শেষ বিচারে, ব্যাপারটা একই।)৫৮ বারট্রাণ্ড ডি জুভেনেল থেকে মাও ৎসে তুঙ— ডান থেকে বাম অবধি সবাই ‘ক্ষমতার প্রকৃতি’-র মতো রাজনৈতিক দর্শনের একটি মৌলিক প্রশ্নে কি এভাবে সহমত হয়ে যেতে পারে!

আমাদের রাজনৈতিক চিন্তার পরম্পরায় এই সংজ্ঞাগুলোর বেশ গ্রহণযোগ্যতা আছে। এদের উৎস সার্বভৌম ইউরোপিয় জাতি-রাষ্ট্রের উত্থানের সহগামী পরম ক্ষমতা সম্বন্ধীয় সেই পুরানো ধারণা থেকে যার সর্বপ্রথম ও এতাবধি সর্বোত্তম মুখপাত্র হলেন ষোল শতকের ফ্রান্সের জাঁ বোদাঁ ও সতের শতকের ইংলন্ডের থমাস হব্স। তাছাড়া, সেই প্রাচীন গ্রিক সভ্যতার সময় থেকে মানুষের উপর মানুষের শাসন বোঝাতে ব্যবহৃত পদগুলোর সঙ্গেও এই সংজ্ঞাগুলোর মিল আছে— যেমন, একের শাসন বোঝাতে ‘মনার্কি’, মুষ্টিমেয়র শাসন বোঝাতে ‘অলিগার্কি’, সর্বোত্তমদের শাসন বোঝাতে ‘অ্যারিস্টোক্রেসি’, ও বহুর শাসন বোঝাতে ‘ডেমোক্রেসি’। আজ এর সঙ্গে যোগ করা উচিত আধিপত্যের সাম্প্রতিকতম ও সম্ভবত ভয়ঙ্করতম রূপ: ‘বুরোক্রেসি’ (আমলাতন্ত্র)। এই আমলাতন্ত্র হল সংস্থাকরণের জটিল জালে জড়িয়ে এমন এক শাসন যেখানে কোনও মানুষকে— এক বা সর্বোত্তম, মুষ্টিমেয় বা বহু, কাউকেই— শাসক হিসেবে চিহ্নিত করা সম্ভব হয় না এবং সেই অর্থে প্রকৃতই একে বলা যায় যে এ কোনও মানুষের দ্বারা শাসন নয়। (যে শাসক কারো কাছে জবাবদিহি করার দায় স্বীকার করে না, রাজনৈতিক চিন্তার পরম্পরা অনুযায়ী আমরা তার শাসনকে ‘উৎপীড়ক স্বেচ্ছাচার’ বা ‘টিরানি’ বলি। এই ‘কোনও মানুষের দ্বারা শাসন নয়’ হল সবচেয়ে প্রকট উৎপীড়ক স্বেচ্ছাচার, কারণ এক্ষেত্রে যার কাছ থেকে জবাবদিহি চাওয়া যাবে এমন কেউ নেই। এই পরিস্থিতিতে দায়ভাগ নির্দিষ্ট কোনো অংশে বা ভাগে চিহ্নিত করা যায় না, শত্রুকে চিহ্নিত করা হয় অসম্ভব। সাম্প্রতিক বিশ্বজোড়া বিদ্রোহী অস্থিরতার পিছনে এই পরিস্থিতিই কাজ করছে। এই বিদ্রোহী অস্থিরতার বিশৃঙ্খল প্রকৃতি ও বাঁধভাঙা প্লাবনের মতো চেহারাও এই পরিস্থিতির দান।) এই প্রাচীন শব্দতালিকা আশ্চর্যজনকভাবে প্রত্যয়িত ও সুরক্ষিত হয়েছে হিব্রু-খ্রিস্টান পরম্পরায়, বিশেষত সেই পরম্পরার ‘আইন বিষয়ক আদেশবোধক ধারণা’-র সঙ্গে সংযুক্তির মধ্য দিয়ে। এই ধারণা ‘রাজনৈতিক বাস্তববাদী’-দের তৈরি নয়, তা ঈশ্বরের ‘অনুশাসনের’ এমন এক বহু প্রাচীন প্রায়-স্বয়ংক্রিয় সাধারণীকরণের ফল, যে সাধারণীকরণ ‘আদেশ ও বাধ্যতার সরল সম্পর্ক’-কে আইনের সারবস্তু হিসেবে যথেষ্ট বলে মনে করে।৫৯ তারপর, মানুষের প্রকৃতি সম্পর্কে আরো আধুনিক বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক বিশ্বাসও এই আইনি ও রাজনৈতিক পরম্পরাকে আরো শক্তপোক্ত করেছে। সাম্প্রতিক বহু ‘বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার’ মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি হিসেবে আধিপত্য করার প্রবণতা ও আক্রমণ করার প্রবণতাকে চিহ্নিত করেছে। এই ‘বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার’-এর পূর্বসূরি ছিল একই বক্তব্যবাহী বহু দার্শনিক উক্তি। জন স্টুয়ার্ট মিল বলেছিলেন, ‘সভ্যতার প্রথম পাঠ হল বাধ্য হওয়া’। তিনি দুই ধরনের প্রবণতার কথা বলেছিলেন: ‘দুই ধরনের প্রবণতা... প্রথমটি হল অপরের উপর ক্ষমতা খাটানোর আকাঙ্খা, দ্বিতীয়টি হল... নিজেদের উপর অপরের ক্ষমতা যাতে না খাটে তার আকাঙ্খা।’৬০ নিজেদের অভিজ্ঞতার উপর ভরসা রাখলে আমাদের না জানার কোনো কারণ নেই যে, কোনও একজন শক্তিধর মানুষের দ্বারা শাসিত হওয়ার ও তার প্রতি বাধ্য থাকার একান্ত আকাঙ্খা, অর্থাৎ, আত্মসমর্পণের আকাঙ্খা মানব মনোবিক্ষণে ‘ক্ষমতা খাটানোর আকাঙ্খা’-র তুলনায় অন্তত সমপরিমাণে সুস্পষ্ট। ‘যে পারে হতে বাধ্য/ শাসন করতে সে কত না যোগ্য’— এই যে প্রবাদ বিভিন্ন চেহারায় সব জাতির মধ্যে সব শতকেই চালু ছিল বলে মনে হয়৬১, তা বোধহয় মনোবিক্ষণের জগতের একটা সত্যের দিকে নির্দেশ করে। সে সত্য হল এই যে ক্ষমতা খাটানোর আকাঙ্খা ও আত্মসমর্পণের আকাঙ্খা পরস্পর-সংযুক্ত। আবার জন স্টুয়ার্ট মিল-এর কথা ব্যবহার করে বলা যায়: ‘উৎপীড়ক স্বেচ্ছাচারতন্ত্রের কাছে সহজ আত্মসমর্পণ মোটেই সবসময় চূড়ান্ত নিষ্ক্রিয়তা থেকে ঘটে না’। অপরদিকে, অন্যের বাধ্যতা মানার প্রবল অনিচ্ছার সঙ্গেই প্রায়শ জুড়ে থাকে আদেশ করা বা অন্যের উপর আধিপত্য খাটানোর প্রতি প্রবল অনীহা। ইতিহাসের দিকে চোখ রেখে বলা যায় যে জন স্টুয়ার্ট মিল কথিত মনোবিদ্যার ভিত্তিতে দাস অর্থনীতির প্রাচীন প্রতিষ্ঠানসমূহের ব্যাখ্যা অসম্ভব। এই দাস অর্থনীতির প্রকাশ্য উদ্দেশ্য ছিল নাগরিকদের গৃহস্থালির কাজের বোঝা থেকে মুক্ত করে এমন এক গণ পরিসরের জীবনে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেওয়া যেখানে প্রত্যেক অংশগ্রহণকারীই সমান। অপরকে আদেশ করা ও অপরের উপর শাসন করার চেয়ে মধুর যদি আর কিছু না-ই থাকত, পরিবারের কর্তারা তাহলে কখনওই তঁাদের গৃহস্থালির পরিসর ছেড়ে বেরতেন না।

প্রাচীনত্বে ও কালোত্তীর্ণতায় সমগোত্রীয় অন্য একটি পরম্পরা ও তদসংলগ্ন শব্দসম্ভারও অবশ্য আছে। আথেনের নগর-রাষ্ট্র যখন তাদের সংবিধানকে ‘আইসোনোমি’ (নাগরিকদের সম অধিকারের বিধি) বলেছিল, বা, রোমানরা তাদের শাসনব্যবস্থাকে ‘সিভিটাস’ (আইনের সূত্রে একীভূত নগরবাসী) বলেছিল, তাদের বিবেচনায় ক্ষমতা ও আইনের এমন এক ধারণা ছিল যার সারবস্তু আদেশ জারি ও বাধ্যতার সম্পর্কের উপর নির্ভরশীল নয় এবং যা ‘ক্ষমতা’ ও ‘শাসন’ সমার্থক বলে মনে করে না, ‘আইন’ ও ‘আদেশ’-কেও সমার্থক মনে করে না। আঠারো শতকের বিপ্লবের কুশীলবরা এই উদাহরণগুলোকেই পুনরুদ্ধার করেছিলেন যখন তঁারা প্রাচীনকালের লেখ্যাগার তন্নতন্ন করে ঘেঁটে ‘রিপাবলিক’ (প্রজাতন্ত্র) নামের এমন এক শাসনরূপের ধারণা উপস্থিত করেছিলেন যেখানে জনগণের ক্ষমতার উপর ভিত্তি করে দাঁড়ানো শাসন অবসান ঘটাবে ও প্রতিস্থাপিত করবে এমন ‘মানুষদের উপর মানুষদের শাসন’-কে যাকে তারা ‘দাসসুলভ ব্যবস্থা’ বলে পরিত্যাজ্য মনে করত। কিন্তু দুঃখের কথা যে তারা তখনও ‘বাধ্যতা’-র কথা বলত— জনৈক মানুষের (বা কিছু মানুষদের) প্রতি বাধ্যতার বদলে তারা বলত আইনের প্রতি বাধ্যতার কথা। আইনের প্রতি বাধ্যতা বলতে তারা বোঝাত সেই সমস্ত আইনের প্রতি সমর্থন যে সমস্ত আইন নাগরিকদের সম্মতির উপর দাঁড়িয়ে তৈরি হয়েছে।৬২ সে সমর্থন কখনোই প্রশ্নহীন নয়, আর, বিশ্বস্ততার প্রশ্নে তা কখনোই সেই ‘প্রশ্নহীন বাধ্যতা’-র সমগোত্রীয় হতে পারে না, ছুরি দেখিয়ে পকেটমারি করা বা বন্দুক হাতে ব্যাঙ্ক-ডাকাতি করার সময় যে প্রশ্নহীন বাধ্যতা দুর্বৃত্ত তৈরি করে। যে কোনও দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোকে ক্ষমতা দেয় সে দেশের জনগণের সমর্থন; তাদের সূচনার সময় সমস্ত আইন প্রণয়নে যে গণ ঐকমত্য কাজ করেছিল তার থেকেই এই সমর্থন উৎসারিত। প্রতিনিধিত্বমূলক শাসনব্যবস্থায় ধরে নেওয়া হয় যে জনগণের উপর শাসনকারীদের জনগণ শাসন করবে। সমস্ত রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ও প্রদর্শনই ক্ষমতার জড়ীভূতকরণ; যে মুহূর্তে জনগণের প্রাণময় ক্ষমতা আর তার খুঁটি হিসেবে কাজ করে না, সেই মুহূর্তেই তারা প্রাণ হারায় ও পচনে আক্রান্ত হয়। এই কথাই ম্যাডিসন বুঝিয়েছিলেন যখন তিনি বলেছিলেন: ‘সব শাসনব্যবস্থাই মতামতের উপর নির্ভরশীল’। এ কথা গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে যেমন সত্য, রাজতন্ত্রের ক্ষেত্রেও তেমনই সত্য। (জ্যুভেনেল যেমন বলেছিলেন: ‘সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন কেবলমাত্র গণতন্ত্রেই ক্রিয়াশীল বলে ধারণা পোষণ করা এক আজগবী বিভ্রম ছাড়া আর কিছু নয়। অন্য যে কোনও শাসনব্যবস্থার তুলনায় এক একক ব্যক্তিত্ব হিসেবে একজন রাজার ক্ষেত্রে সমাজের সাধারণ সমর্থন আরো বেশি প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে।’৬৩ এমনকি সবার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে শাসন করে যে স্বেচ্ছাচারী উৎপীড়ক, তারও হিংসাত্মক ক্রিয়া সম্পাদনায় সহযোগীর দরকার হয়, যতই অত্যল্প সংখ্যায় হোক না কেন।) শাসনব্যবস্থায় ক্ষমতাদানকারী মতামতের শক্তি নির্ভর করে সংখ্যার উপর, ‘তা তার সঙ্গে সংযুক্তজনেদের সংখ্যার সঙ্গে সমানুপাতিক’।৬৪ এই বিচার থেকেই মন্তেস্কু সিদ্ধান্তে এসেছিলেন যে স্বেচ্ছাচারী উৎপীড়ন হল সবচেয়ে হিংসাত্মক কিন্তু সবচেয়ে কম ক্ষমতাসম্পন্ন শাসনরূপ। বস্তুতপক্ষে, ক্ষমতা ও হিংসার মধ্যে অন্যতম সবচেয়ে সুস্পষ্ট পার্থক্য এটাই যে ক্ষমতা সর্বদা সংখ্যার প্রয়োজন বোধ করে, কিন্তু হিংসা কিছুটা দূর অবধি সংখ্যা ছাড়াই চলতে পারে কারণ হিংসা যন্ত্র-সরঞ্জামের উপর নির্ভর করতে পারে। একটি অবিধিবদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন, অর্থাৎ, সংবিধানহীন একটি গণতন্ত্র অবশ্যই সংখ্যালঘিষ্ঠের অধিকার দমনে ভয়ঙ্কর হতে পারে এবং হিংসার কোনো বহির্চিহ্ন ছাড়াই সমস্ত বিরোধিতাকে শ্বাসরোধ করে মারতে ভয়ানক কার্যকরী হতে পারে; কিন্তু তার মানে এই নয় যে হিংসা ও ক্ষমতা একই বস্তু।

ক্ষমতার চরম রূপ হল একের বিরুদ্ধে সবাই, আর, হিংসার চরম রূপ হল সবার বিরুদ্ধে এক। হিংসার এই চরম রূপ যন্ত্র-সরঞ্জামের শক্তি ছাড়া সম্ভব নয়। তাই মাঝেমধ্যেই প্রচারিত হওয়া এই দাবি খুবই ভ্রান্তিজনক যে একটা নিরস্ত্র ক্ষুদ্র সংখ্যালঘিষ্ঠ অংশ হিংসাত্মক উপায়ে— চিৎকার, গোলমাল ইত্যাদি উপায়ে— বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনের এমন সব বড় বত্তৃতাসভা পণ্ড করে দিচ্ছে যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ স্বাভাবিক শিক্ষাদান প্রক্রিয়ার পক্ষে ছিল। (জার্মানির এক বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্প্রতি এমনও ঘটেছে যে একাকী একজন ‘প্রতিবাদী’ কয়েক শ ছাত্রছাত্রীর মধ্যে এমন অদ্ভুত সাফল্য লাভ করেছে।) এইসব ক্ষেত্রে আসলে যা ঘটে তা আরো গুরুতর। স্পষ্টতই সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ তাদের ক্ষমতা প্রয়োগ করে প্রতিবাদীদের বিরত করতে অস্বীকার করে। প্রাতিষ্ঠানিক পাঠচর্চার প্রক্রিয়া ভেঙে পড়ে কারণ স্থিতাবস্থার পক্ষে নিষ্ক্রিয় হাত তোলার চেয়ে বেশি কিছু কেউ করতে চায় না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন আসলে ‘বিপুল নেতিবাচক ঐক্য’-র বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আছে, যে কথা স্টিফেন স্পেন্ডার অন্য এক প্রসঙ্গে বলেছেন। এর থেকে এটাই প্রমাণ হয় যে জনমতসমীক্ষার মাথা-গোনা হিসাব যা আন্দাজ দেয়, তার থেকে অনেক বেশি সম্ভাবনাপূর্ণ ক্ষমতা সংখ্যালঘিষ্ঠের পক্ষে থাকতে পারে। প্রতিবাদী ছাত্র/ছাত্রী ও অধ্যাপকের মধ্যে চিৎকারের লড়াইয়ের মজা নেহাত দর্শক হিসেবে উপভোগ করছে যে সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ, তারা ইতিমধ্যেই সংখ্যালঘিষ্ঠের সম্ভাবনাপূর্ণ মিত্রে পরিণত হয়েছে। (ব্যাপারটা বুঝতে একটা কল্পনার আশ্রয় নেওয়া যেতে পারে। কল্পনা করুন যে হিটলারের উত্থানের ঠিক আগের জার্মানির এক বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন বা অল্প কয়েকজন নিরস্ত্র ইহুদি ছাত্র/ছাত্রী একজন ইহুদি-বিদ্বেষী অধ্যাপকের বক্তৃতা এভাবে পন্ড করার চেষ্টা করলে তাদের কী পরিণতি হতো, তাহলেই বুঝতে পারবেন যে ‘ক্ষুদ্র সংখ্যালঘিষ্ঠ চরমপন্থী’ বলে চেঁচামেচি কত বাস্তববিরোধী।)

——————

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের করুণ হাল ফুটে ওঠে যখন দেখি যে পারিভাষিক শব্দাবলীর ব্যবহার ‘ক্ষমতা’, ‘শক্তি’, ‘বল’, ‘প্রাধিকার’ ও শেষত ‘হিংসা’-র মতো গুরুত্বপূর্ণ শব্দগুলোর শব্দার্থে কোনো তফাৎ করে না। অথচ এই শব্দগুলো সবই আলাদা আলাদা প্রতীত বিষয়কে নির্দেশ করে, আর তা না করলে তাদের পৃথক অস্তিত্বেরও কোনো মানে থাকে না। (ডেন্ত্রিভ-এর ভাষায়: ‘শক্তি, ক্ষমতা, প্রাধিকার— বর্তমান কথনস্বভাবে এইসব শব্দ সঠিক ভাবার্থে প্রয়োগের উপর খুব বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় না; এমনকি সর্বোত্তম ভাবুকরাও কখনও কখনও বিনা বিচারে এগুলো ব্যবহার করে থাকেন। তা সত্ত্বেও ধরে নেওয়া সমীচীন হবে যে শব্দগুলো ভিন্ন ভিন্ন গুণকে চিহ্নিত করে আর তাই যত্নের সঙ্গে বিচার-বিবেচনা করেই তাদের ব্যবহার করা উচিত...এগুলোর সঠিক ব্যবহার কেবল যুক্তিসিদ্ধ ব্যাকরণের বিষয় নয়, তা ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতেরও বিষয়।’৬৫) শব্দগুলোকে সমার্থক হিসেবে ব্যবহার করলে কেবল ভাষিক অর্থের প্রতি বধিরতার যথেষ্ট গুরুতর অক্ষমতাই প্রদর্শন করা হয় না, শব্দগুলোর নির্দেশ করা বাস্তবতাকেও দৃষ্টির অগোচর করে দেওয়া হয়। এহেন পরিস্থিতি আবার নতুন করে সংজ্ঞা হাজির করতে উসকে দেয়, সে উসকানিতে কিছুটা সাড়াও আমি দেব, কিন্তু তবু চিহ্নিত করা দরকার যে এ কেবল অসতর্ক কথন-অভ্যাসের ব্যাপার নয়। এই আপাত গোলনঘ্যাঁটের পিছনে এমন এক স্থিরনিশ্চিত বিশ্বাস কাজ করে যা সমস্ত তফাৎকে খুব বেশি হলে তুচ্ছ জ্ঞান করে। এই স্থিরনিশ্চিত বিশ্বাস অনুযায়ী চিরায়ত প্রশ্ন হল, কে কাকে শাসন করছে? ক্ষমতা, শক্তি, বল, প্রাধিকার, হিংসা— তার চোখে সমস্তই হয়ে দাঁড়ায় মানুষের উপর শাসন চালানোর জন্য মানুষের ব্যবহৃত উপায়, আর, তাদের কার্যকারিতা একইরকম গণ্য হওয়ার কারণে তারাও সমার্থক হিসেবে বিবেচিত হতে থাকে। আধিপত্যের কারবারের মধ্য দিয়ে গণপরিসরের ক্রিয়াকর্মকে লঘুকৃত করার এ অভ্যাস যখন বর্জন করা যাবে, কেবলমাত্র তখনই মানবক্রিয়ার পরিসরের এই মৌলিক উপাত্তগুলো তাদের প্রকৃত প্রভেদবৈচিত্র্য নিয়ে আবির্ভাব, বা পুনরাবির্ভাব করবে।

বর্তমান আলোচনার প্রাসঙ্গিকতায় প্রয়োজনীয় উপাত্তগুলো এভাবে বিন্যস্ত করা যেতে পারে:

ক্ষমতা কেবল ক্রিয়া করার মানবিক সক্ষমতার সঙ্গেই যুক্ত নয়, তা যৌথ ক্রিয়া বা একযোগে ক্রিয়া করার সক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত। ক্ষমতা কখনোই কোনো ব্যক্তিবিশেষের সম্পত্তি নয়, তা একটি গোষ্ঠীর সম্পত্তি এবং যতক্ষণ সেই গোষ্ঠী একসঙ্গে থাকে ততক্ষণই তার অস্তিত্ব। যখন আমরা বলি যে ‘সে ক্ষমতায় আছে’, তখন আমরা প্রকৃত অর্থে বোঝাই যে সে ক্ষমতা প্রদত্ত হয়েছে কিছু সংখ্যক মানুষের দ্বারা তাদের নামে ক্রিয়া করার জন্য। যে মুহূর্তে ক্ষমতার উৎসভূমি হিসেবে কাজ করা গোষ্ঠী অদৃশ্য হয়, ক্ষমতা-প্রদত্ত ব্যক্তির ক্ষমতাও অদৃশ্য হয় (potestas in populo, অর্থাৎ, ক্ষমতা থাকে জনগণের মধ্যে, জনগণ বিহনে ক্ষমতা অসম্ভব)। চালু কথায় আমরা যখন ‘ক্ষমতাশালী ব্যক্তি’ বা ‘ক্ষমতাশালী ব্যক্তিত্ব’ বলি, ‘ক্ষমতা’ কথাটা রূপকার্থে ব্যবহৃত হয়, প্রকৃত অর্থে আমরা ‘শক্তি’ বোঝাতে চাই।

শক্তি সুনির্দিষ্টভাবে একক বস্তু বা ব্যক্তিবিশেষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। তা সেই বস্তু বা ব্যক্তিবিশেষের চরিত্রে নিহিত এমন এক বৈশিষ্ট্যকে নির্দেশ করে যা মূলগতভাবে অপর বস্তু বা ব্যক্তি নিরপেক্ষ হলেও কেবলমাত্র অপর বস্তু বা ব্যক্তির সঙ্গে তুলনা বা সম্পর্কযাপনের মধ্য দিয়েই প্রতীয়মান হয়ে ওঠে। সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যক্তিবিশেষের শক্তিও বহুর দ্বারা যে কোনো সময় পরাভূত হতে পারে। ‘এক’-এর শক্তিকে নস্যাৎ করার উদ্দেশ্যে ‘বহু’-ও প্রায়শই জোট বাঁধে, যেহেতু শক্তির চরিত্র বিশেষভাবেই গোষ্ঠী-নিরপেক্ষ। প্লেটো থেকে নিৎশে বিভিন্নজনের লেখায় ‘এক’-এর বিরুদ্ধে ‘বহু’-র এই প্রায় প্রবৃত্তিগত শত্রুতা বিদ্বেষঘটিত বলে বা শক্তিমানের প্রতি দুর্বলের ঈর্ষা দ্বারা চালিত বলে চিহ্নিত হয়েছে। কিন্তু এই মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা মূল বিষয়কে ছুঁতে পারে না। গোষ্ঠীর প্রকৃতি ও তার ক্ষমতার প্রকৃতির মধ্যেই নিহিত আছে শক্তির গোষ্ঠী-নিরপেক্ষ চরিত্রের বিরুদ্ধাচরণ।

বল শব্দটিকে প্রাত্যহিক কথনে আমরা প্রায়ই হিংসার সমার্থক হিসেবে ব্যবহার করি, বিশেষত যদি সে হিংসা পীড়নের উপায় হিসেবে কাজ করে। কিন্তু পারিভাষিক ব্যবহারে ‘বল’ শব্দটি প্রকৃতির বল, ঘটনাপরম্পরার বল (la force des choses, বস্তুর বল)-এর মতো ব্যবহারের মধ্য দিয়ে প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া বা সামাজিক আন্দোলনের দ্বারা উন্মোচিত তেজকে চিহ্নিত করার জন্য সংরক্ষিত থাকা উচিত।

বিবেচনাধীন শব্দগুলোর মধ্যে প্রাধিকার শব্দটির সঙ্গে সবচেয়ে দুর্জ্ঞেয় প্রতীত বিষয় যুক্ত, তাই এই শব্দটিও সবচেয়ে বেশি অপব্যবহৃত হয়।৬৬ প্রাধিকার ব্যক্তিবিশেষে আরোপিত হতে পারে এবং ব্যক্তিগত প্রাধিকার হতে পারে, যার উদাহরণ পিতা-মাতা ও তার সন্তান এবং শিক্ষক ও ছাত্রের সম্পর্কের মধ্যে দেখা যায়। আবার প্রাধিকার কোনো প্রতিষ্ঠান বা করণে আরোপিত হতে পারে, যার উদাহরণ রোমের সেনেট (auctorirtas in senatu, প্রাধিকার আইনসভার) বা চার্চের উচ্চাবচ ধাপবন্দি করণ (মাতাল ধর্মযাজকও বিবিধ দণ্ড-নিষ্কৃতি প্রদান করার অধিকারী!)। এর নির্ণায়ক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মান্যকারীদের পক্ষ থেকে বিনা প্রশ্নে মান্যতা দান, যেখানে জোর-জবরদস্তি বা প্রবর্তনার দরকার হচ্ছে না। ( একজন পিতা তঁার প্রাধিকার হারান যখন তিনি সন্তানকে প্রহার করেন বা তার সঙ্গে তর্কে প্রবৃত্ত হন, অর্থাৎ যখন তিনি সন্তানের সঙ্গে স্বেচ্ছাচারী উৎপীড়কের মতো ব্যবহার করেন অথবা সন্তানকে নিজের সমান বলে গণ্য করেন।) প্রাধিকার বজায় রাখার জন্য প্রয়োজন হয় ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা করণের মর্যাদা। তাই প্রাধিকারের সবচেয়ে বড় শত্রু হল অবমাননা, প্রাধিকারের ভিতে ক্ষয় ধরানোর নিশ্চিততম উপায় হল ব্যঙ্গের হাসি।৬৭

শেষত, হিংসা। আগেই বলেছি যে হিংসার বৈশিষ্ট্য হল তার যন্ত্রসরঞ্জাম-নির্ভর চরিত্র। প্রতীত বিষয় হিসেবে হিংসা ‘শক্তি’-র নিকটবর্তী, কারণ অন্য যে কোনো যন্ত্রসরঞ্জামের মতো হিংসার যন্ত্রসরঞ্জামও প্রাকৃতিক শক্তিকে বহুগুণ বর্ধিত করার উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয় এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে বিকাশের শেষ স্তরে গিয়ে প্রাকৃতিক শক্তির প্রতিস্থাপক হয়ে ওঠে।

বোধহয় এখানে বলে রাখা প্রয়োজনীয় যে উপরোক্ত স্বাতন্ত্রীকরণ খেয়ালখুশি মতো করা না হলেও এবং বাস্তব জগৎ থেকেই আহরণ করা হলেও তার মাধ্যমে প্রতীত বিষয়গুলোকে বাস্তব জগতে প্রবেশ-প্রস্থান-অসম্ভব আঁটোসাটো খোপে বেঁধে ফেলা অসম্ভব। তাই, সংগঠিত লোকসমাজে প্রাতিষ্ঠানিকীকৃত ক্ষমতা প্রায়শই প্রাধিকারের বেশ ধারণ করে দেখা দেয়, তাৎক্ষণিক প্রশ্নহীন মান্যতা দাবি করে এবং তাকে ছাড়া কোনো সমাজই চলতে পারে না। (সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রকৃত প্রাধিকার যদি এমনভাবে ভেঙে পড়ে যে এমনকি গৌণ আনুষ্ঠানিক চেহারাতেও তা অকার্যকরী হয়ে ওঠে, তাহলে কী হতে পারে তা নিউ ইয়র্ক-এর একটা ছোট ও এতাবধি বিচ্ছিন্ন ঘটনা দেখিয়ে দেয়। রেলপথে একটা ছোট ত্রুটির— একটা কামরার দরজা কাজ না করার— পরিণতি হয় পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি যাত্রীর বিক্ষোভে রেল-যাতায়াত চারঘন্টার জন্য পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাওয়া, কারণ পরিবহণ কর্তৃপক্ষ রেলযাত্রীদের ট্রেন ছেড়ে নেমে আসতে বললে তারা তা করতে অস্বীকার করে।)৬৮ আমরা পরে আরো দেখব যে হিংসা ও ক্ষমতার সংমিশ্রণের মতো সহজলভ্য আর কিছু হতে পারে না, আবার অন্যদিকে, হিংসা ও ক্ষমতার নিজ নিজ স্বতন্ত্র নিখাদ রূপ, যা তাদের চরম রূপও বটে, সবচেয়ে ঘন ঘন দেখা যায়। এর থেকে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় না যে প্রাধিকার, ক্ষমতা ও হিংসা সব একই বস্তু।

অবশ্য অস্বীকার করার উপায় নেই যে শাসনব্যবস্থার ক্ষমতার ( যা ক্ষমতার একটা বিশেষ ক্ষেত্র মাত্র) আলোচনায় ‘আদেশ জারি ও বাধ্যতা’-র নিরিখে ক্ষমতাকে ভাবা যেতে পারে এবং সেইসূত্রে ক্ষমতা ও হিংসাকে এক করে দেখার প্রলোভন বেশ জোরালো হয়ে ওঠে। হিংসাকে বাস্তবত ক্ষমতার পূর্ব-প্রয়োজন হিসেবে গণ্য করা হয় যেহেতু বৈদেশিক বা দেশীয় ক্ষেত্রে বিদেশী সেনা বা দেশীয় অপরাধীদের আক্রমণের মুখে ক্ষমতাকাঠামোকে অটুট রাখার জন্য হিংসাকেই শেষ আশ্রয় ভাবা হয়। আর তাই ভাবা হয়, কাগুজে বাঘের পরিণতি এড়ানোর জন্য যে মখমলের দস্তানা দিয়ে লৌহমুষ্ঠিকে ঢেকে রাখতে হয়, সেই কপট বহিরাবরণই হল ক্ষমতা। খুঁটিয়ে বিচার করলে অবশ্য এই ধারণার বিশ্বাসযোগ্যতা টেঁকে না। আমাদের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে তত্ত্ব ও বাস্তবতার মধ্যে ফঁাক সবচেয়ে ভালো দৃষ্টিগোচর হতে পারে ‘বিপ্লব’ শব্দ দিয়ে চিহ্নিত প্রতীত বিষয়টির মধ্য দিয়ে।

বিশ শতকের শুরু থেকেই বিপ্লবের তাত্ত্বিকরা বলে আসছেন যে শাসনতন্ত্রগুলোর একচেটিয়া কবজায় থাকা অস্ত্রসম্ভারের ধ্বংসাত্মক শক্তির ক্রমবর্ধমান হারের সঙ্গে সমানুপাতে বিপ্লবের সম্ভাবনা তাৎপর্যপূর্ণভাবে কমছে।৬৯ সফল ও ব্যর্থ বিপ্লবের অসাধারণ তালিকা সমন্বিত গত সত্তর বছরের (১৯০০–১৯৬৯) ইতিহাস অবশ্য অন্য কথা বলে। বিপ্লব-তাত্ত্বিকদের মতানুযায়ী ক্রমশ বেশি বেশি করে ‘অসম্ভব’ হয়ে ওঠা এই কাণ্ড সম্ভব করার চেষ্টায় নেমেছিল যারা, তারা কি পাগল ছিল? পূর্ণ সাফল্যের কথা যদি না-ও ধরা হয়, তাহলেও সাময়িক সাফল্যগুলোকেই বা কীভাবে ব্যাখ্যা করা যাবে? আসলে একদিকে রাষ্ট্রের কবজায় থাকা হিংসার উপায় আর অন্যদিকে বিয়ারের বোতল, মলোটভ ককটেল বা সাধারণ বন্দুকের মতো যেসব হিংসার উপায় জনগণ নিজেরা জোগাড় করতে পারে— এই দুইয়ের মধ্যে ব্যবধান সবসময়েই এত বিস্তর যে প্রযুক্তি-প্রকৌশলের উন্নতিতে আপেক্ষিক পরিবর্তন হয় ইতরবিশেষ। ‘কীভাবে বিপ্লব করতে হয়’ গোছের পাঠ্যপুস্তকে বিরোধ থেকে ষড়যন্ত্র, প্রতিরোধ থেকে সশস্ত্র অভ্যুত্থান— এভাবে ধাপে ধাপে এগোনোর নানা ‘শিক্ষা’ দেওয়া হয়; কিন্তু সেই সব শিক্ষাই এহেন ভ্রান্ত ধারণার উপর দাঁড়িয়ে থাকে যে বিপ্লব ‘গড়ে তোলা যায়’। হিংসার সঙ্গে হিংসার প্রতিদ্বন্দ্বিতা হলে শাসক সরকারের প্রাধান্য অবিসংবাদিতভাবেই থাকবে, কিন্তু এই প্রাধান্য ততক্ষণই টেঁকে যতক্ষণ শাসক সরকারের ক্ষমতার ভিত্তি অটুট থাকে, অর্থাৎ, যতক্ষণ তার জারি করা আদেশ মান্যতা পায় এবং পুলিশ ও সেনা তার আদেশে অস্ত্র ব্যবহার করতে প্রস্তুত থাকে। যখন এই ভিত্তি আর অটুট থাকে না, পরিস্থিতির বদল ঘটে চকিতে, বিদ্রোহ তখন আর দমন করা যায় না। কেবল তাই নয়, অস্ত্রেরও হাতবদল ঘটে কখনও কখনও কয়েক ঘন্টার মধ্যে, যেমন ঘটেছিল হাঙ্গেরির বিপ্লবে। (ভিয়েতনামে এত বছর ধরে অর্থহীন যুদ্ধ চালানোর পর মার্কিনীদের তা জানা থাকা উচিত, কারণ বিপুল রুশ সহায়তা পাওয়ার আগে অবধি ভিয়েতনামের জাতীয় মুক্তি বাহিনী মার্কিনীদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি অস্ত্র দিয়েই।) সরকারের ক্ষমতার ভিত্তিতে ফাটল ধরে ভেঙে পড়ার পরই কেবল ‘সশস্ত্র অভ্যুত্থান’-এর কথা বলা যায়। অবশ্য, সশস্ত্র অভ্যুত্থানের অনেক সময়েই আর দরকার পড়ে না, বা, যখন তা ঘটে তখন তার আর দরকার থাকে না। জারি করা আদেশ যখন মান্যতা পায় না, হিংসার উপায়ও তার কার্যকারিতা হারায়। এই আদেশ মানা বা না মানা আদেশ-জারি ও বাধ্যতার বাঁধা সম্পর্ক দিয়ে নির্ধারিত হয় না, বরং নির্ধারিত হয় জনমত ও কতজন সেই মত ধারণ করছে তা দিয়ে। হিংসার পিছনে থাকা ক্ষমতার উপরই আসলে সমস্ত কিছু নির্ভর করে। ক্ষমতার যে চকিত নাটকীয় ভেঙে-পড়া বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ঘটে, তা এক ঝলকে উন্মোচিত করে দেয় কীভাবে আইন/শাসক/প্রতিষ্ঠান-এর প্রতি বাধ্যতা আসলে সমর্থন ও সম্মতির বহির্প্রকাশ।

ক্ষমতা যেখানে ভেঙে পড়েছে, বিপ্লব সেখানে সম্ভব, কিন্তু নিশ্চিত নয়। এমন বহু উদাহরণ আমাদের জানা যেখানে সম্পূর্ণ ক্ষমতাহীন শাসনব্যবস্থা অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে দীর্ঘকাল যেহেতু তাদের শক্তিকে পরীক্ষার মুখে ফেলে দুর্বলতা উন্মোচিত করে দেওয়ার মতো কেউ হাজির হয় নি অথবা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে পরাজিত হওয়ার দুর্ভাগ্য তারা এড়াতে পেরেছিল। কেবলমাত্র মুখোমুখি সংঘাতেই ভেঙে পড়ার প্রক্রিয়া বাইরে বেরিয়ে আসে এবং সেমতাবস্থায় যখন ক্ষমতা রাস্তায় পড়ে থাকে, তখন তেমন পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত একদল মানুষের প্রয়োজন হয় যারা রাস্তায় পড়ে থাকা ক্ষমতাকে হাতে তুলে নিয়ে কঁাধে দায়িত্ব তুলে নিতে পিছপা হবে না। সম্প্রতি আমরা দেখেছি কীভাবে ফরাসি ছাত্রছাত্রীদের তুলনায় নিরীহ, অন্তর্বস্তুতে অহিংস বিদ্রোহই যথেষ্ট প্রমাণিত হল ফ্রান্সের গোটা রাজনৈতিক ব্যবস্থার ঠুনকোপনা উন্মুক্ত করে দিতে আর তরুণ বিদ্রোহীদের অবাক চোখের সামনে গোটা ব্যবস্থাটা হুড়মুড় করে ধ্বসে পড়ল। অসচেতনভাবে হলেও বিদ্রোহীরা রাজনৈতিক ব্যবস্থাটাকে পরীক্ষার মুখে ফেলে দিয়েছিল। বিদ্রোহী ছাত্রছাত্রীদের উদ্দেশ্য ছিল বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থার অচলায়তনটায় ধাক্কা দেওয়ার, অথচ ধ্বসে পড়ল সরকারি ক্ষমতাব্যবস্থা তার পার্টি-আমলাতন্ত্রকে সঙ্গে নিয়ে: ‘উচ্চাবচ ধাপবন্দি সব কাঠামো পড়ল ভেঙে’ (‘une sorte de disintegration de toutes les hierarchies’)।৭০ ঠিক যেন পাঠ্যপুস্তকে বর্ণিত বিপ্লবী পরিস্থিতি!৭১ অথচ বিপ্লব আর হল না কারণ ছাত্রছাত্রীরা তো বটেই, অন্য আর কেউও প্রস্তুত ছিল না রাস্তায় পড়ে থাকা ক্ষমতাকে হাতে তুলে নেওয়ার দায়িত্ব কঁাধে নিতে। কেউ ছিল না, অবশ্যই সেই দ্য গল ছাড়া। দ্য গল-এর সেনাদের প্রতি আবেদন, মাসসু ও অন্যান্য সেনাপ্রধানদের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য জার্মানি যাত্রা, কানোসা-য় পদযাত্রা— পরিস্থিতির গভীরতাকে বছরখানেক আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলীর মধ্যে আর কেনোকিছুই এগুলোর থেকে বেশি চিহ্নিত করে না। কিন্তু দ্য গল যা চেয়েছিলেন ও পেয়েছিলেন তা হুকুম-বাধ্যতা নয়, তা হল সমর্থন। আর যে উপায়ে তিনি তা পেয়েছিলেন তা হুকুমজারির উপায়ে নয়, বরং ছাড়দানের মাধ্যমে।৭২ হুকুমজারি-ই যদি যথেষ্ট হতো, তাহলে তঁাকে পারি শহর ছেড়ে নড়তে হতো না।

কেবলমাত্র হিংসার উপায়ের উপরই নির্ভরশীল, এমন শাসনের অস্তিত্ব কোনোদিনই ছিল না। এমনকি নিপীড়নকে মূল হাতিয়ার করে শাসন করে যে সর্বাত্মকতাবাদী শাসকরা, তাদের ক্ষমতার জন্যও একটা ভিত্তি দরকার হয়— গুপ্ত পুলিশ ও চরচক্র সেই ভিত্তি। হিংসার তুলনায় ক্ষমতা তাই অগ্রগণ্য। এই মৌলিক অগ্রগণ্যতা একমাত্র তখনই বদলাতে পারে যদি মানুষদের উপর পূর্বকথিত কোনোভাবেই নির্ভরশীল নয় এমন যন্ত্র-সেনা কোনোদিন তৈরি হয় যাদের বোতাম টিপে নিয়ন্ত্রণ করার  মাধ্যমে একজন মানুষ যাকে খুশি ধ্বংস করতে পারে। স্বেচ্ছাচারী নিপীড়নেরও সবচেয়ে বড় যে উদাহরণ আমাদের জানা, সেই সংখ্যাগুরু ক্রীতদাসদের উপর দাসমালিকদের শাসনও নিপীড়নের শ্রেষ্ঠতর উপায়ের উপর নির্ভর করত না, নির্ভর করত দাসমালিকদের সংগঠিত জোট রূপী ক্ষমতার শ্রেষ্ঠতর সংগঠনের উপর।৭৩ অপর কারও সমর্থন বিহনে কোনও ব্যক্তিএকক সফলভাবে হিংসা ব্যবহার করার মতো ক্ষমতাশালী হতে পারে না। তাই, সংখ্যাগরিষ্ঠের ঐক্যমতের চাপে নিরস্ত হতে চায় না যে ব্যক্তিএককরা, সমাজস্তরে ‘অপরাধী’ বা ‘দ্রোহী’ বলে চিহ্নিত সেই মানুষদের বিরুদ্ধে ক্ষমতার চূড়ান্ত অবলম্বন হয় হিংসা। আর পুরোদস্তুর যুদ্ধবিগ্রহের ক্ষেত্রে ভিয়েতনামেই তো আমরা দেখেছি হিংসার উপায়প্রাচুর্যে বিরাট শক্তি কীভাবে অকার্যকরী হয়ে উঠতে পারে এমন প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে যাদের অস্ত্রশস্ত্র অনেক কম হলেও যারা সুসংগঠিত হওয়ার কারণেই অনেক বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন। গেরিলা যুদ্ধের ইতিহাস থেকেও এই শিক্ষা নেওয়া সম্ভব, অন্তত নেপোলিয়নের তদবধি অপরাজিত বাহিনীর স্পেনে পরাজিত হওয়ার সময় থেকে তো বটেই।

কিছুক্ষণের জন্য ধারণা সংক্রান্ত পরিভাষায় মনোনিবেশ করা যাক। যে কোনো শাসনব্যবস্থার অন্তঃসার হল ক্ষমতা। সে অন্তঃসার হিংসা নয়। হিংসার বৈশিষ্ট্যই হল এই যে তা হাতিয়ার-নির্ভর বা যন্ত্র-নির্ভর। অন্য যে কোনো উপায়ের মতোই, উপায় হিসেবে হিংসারও যথার্থতা প্রতিপন্ন হওয়ার প্রয়োজন হয় যে লক্ষ্যে সে পরিচালিত সেই লক্ষ্যের দ্বারা। অন্যকিছুর দ্বারা যার যথার্থতা প্রতিপন্ন করার প্রয়োজন হয়, তা কোনোকিছুর অন্তঃসার হতে পারে না। যুদ্ধের অবসান (দ্ব্যর্থবোধকভাবেই ‘অবসান’ কথাটাকে ধরে) হল শান্তি বা বিজয়; কিন্তু ‘শান্তির অবসান কী’ এ প্রশ্নের কোনো উত্তর হয় না। শান্তি একটি পরম বিষয়, যদিও নথিবদ্ধ ইতিহাসে যুদ্ধবিগ্রহের ইতিহাস প্রায় সবসময়েই শান্তির পর্যায়ের থেকে দীর্ঘ হয়েছে। ক্ষমতাও ওই একই বর্গভুক্ত। বলা যায় যে ক্ষমতা নিজেই নিজের যথার্থতা উৎপন্ন করে। (এর মধ্য দিয়ে অবশ্য অস্বীকার করা হচ্ছে না যে পূর্বনির্ধারিত লক্ষ্য অর্জনের উদ্দেশ্য নিয়ে বিভিন্ন সরকার তাদের নীতি প্রণয়ন করে ও স্বীয় ক্ষমতা প্রয়োগ করে। কিন্তু যা সমস্ত ধরনের লক্ষ্যের পূর্ববর্তী ও যা সমস্ত ধরনের লক্ষ্য অনস্তিত্বে ঘুচে যাওয়ার পরও টিকে থাকে, তা হল ক্ষমতা। তাই ক্ষমতা নিছক কোনো নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর উপায় নয়, ক্ষমতা তার চেয়ে অনেক বেশি কিছু। আসলে, ‘উপায় ও লক্ষ্য’ নিয়ে ভাবা ও ক্রিয়া করা কোনো জনগোষ্ঠীর পক্ষে সম্ভবপর হয়ে ওঠে যে শর্ত পূরণের মধ্য দিয়ে, সেই বিশেষ শর্তটি হল ক্ষমতা।) শাসনব্যবস্থা মূলগতভাবে ক্ষমতার সংগঠিত ও প্রতিষ্ঠানিকীকৃত রূপ হওয়ার কারণে ‘শাসনব্যবস্থা কী’ প্রশ্নটি নিরর্থক। ওই প্রশ্নের উত্তরে যদি বলা হয় যে তা ‘মানুষের একসঙ্গে বাঁচার উপায়’, তাহলে তা আরো বহু প্রশ্নের জন্ম দেবে। আর যদি বলা হয় যে তা ‘সুখ বাড়ানোর উপায়’, ‘শ্রেণিহীন সমাজ অর্জনের উপায়’ বা অন্য কোনও রাজনৈতিক অভিপ্রায় রূপায়নের উপায়, তবে তা বিপজ্জনক রকমের ইউটোপিয় হবে কারণ অকপট আন্তরিকতার সঙ্গে লক্ষ্য অর্জনের চেষ্টা শেষাবধি কোনও এক ধরনের স্বেচ্ছাচারী নিপীড়ক শাসনব্যবস্থায় গিয়ে পৌঁছবে।

ক্ষমতা যেহেতু যে কোনো রাজনৈতিক জনগোষ্ঠীর অস্তিত্বের মধ্যেই নিহিত, তাই তার যথার্থতা প্রতিপাদনের প্রয়োজন হয় না, প্রয়োজন হয় বৈধতার। ‘বাধ্যতা’ ও ‘সমর্থন’-কে এক করে দেখার ভ্রমের মতোই ভ্রান্তিকর হল ‘যথার্থতা’ ও ‘বৈধতা’-কে সমার্থক হিসেবে ব্যবহার করার চালু রেওয়াজ। মানুষেরা একত্রিত হয়ে সমন্বিতভাবে ক্রিয়া করার মধ্য দিয়ে ক্ষমতার জন্ম হয় কিন্তু ক্ষমতার বৈধতা উৎপন্ন হয় পরবর্তী কোনও ক্রিয়ার তুলনায় প্রাথমিক একত্রিত হওয়ার মধ্য দিয়েই। প্রশ্নের মুখে পড়লে বৈধতা আত্মপক্ষ সমর্থন করে অতীতের নিদর্শন টানার মধ্য দিয়ে, অন্যদিকে যথার্থতা প্রতিপাদন হয় ভবিষ্যৎ-মধ্যস্থ কোনো লক্ষ্যের সঙ্গে সম্পর্কস্থাপনের মধ্য দিয়ে। হিংসার যথার্থতা প্রতিপাদন সম্ভব, কিন্তু কখনোই তা বৈধতা লাভ করে না। আর যথার্থতা প্রতিপাদনের বিশ্বাসযোগ্যতা ততই ক্ষয় পায় যত তার কাঙ্খিত লক্ষ‍্য সুদূর ভবিষ্যতে সরে যেতে থাকে। আত্মরক্ষার্থে হিংসার ব্যবহারকে কেউ প্রশ্ন করে না কারণ সেক্ষেত্রে বিপদটি কেবল সুস্পষ্ট নয়, তা বর্তমানও বটে এবং উপায়ের যথার্থতা উৎপাদনকারী লক্ষ্যটিও একান্ত আশু।

প্রতীত বিষয় হিসেবে পৃথক হলেও ক্ষমতা ও হিংসা সাধারণত একযোগে দেখা দেয়। তাদের পরস্পর-সংযুক্ত করলে আমরা দেখেছি যে ক্ষমতাই প্রাথমিক ও নির্ধারক উপাদান হিসেবে কাজ করে। অবশ্য ব্যাপারটা সম্পূর্ণ আলাদা যদি ক্ষমতা ও হিংসাকে তাদের খাঁটি অবিমিশ্র চেহারায় বিচার করা হয়— যেমন ধরা যাক বিদেশী আগ্রাসন ও দখলদারির ক্ষেত্রে। আমরা আলোচনা করেছি যে হিংসার মাধ্যমে মানুষের উপর মানুষের আধিপত্য হিসেবে শাসনব্যবস্থাকে বোঝার উপরই হিংসা ও ক্ষমতার বর্তমানে চালু সমীকরণ দাঁড়িয়ে আছে। কোনও বিদেশী আক্রমণকারীর পক্ষে এমন কোনো দেশের উপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা সহজতর হয় যেখানে দেশের সরকার/শাসনব্যবস্থা ক্ষমতাহীন এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার চর্চায় জাতি অনভ্যস্ত। অন্য সমস্ত ক্ষেত্রে দখলদার আক্রমণকারীকে খুবই কঠিন পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হয় এবং সে অনতিবিলম্বে চেষ্টা করে তার আধিপত্যকে সমর্থন করতে পারে ক্ষমতার এমন কোনো দেশীয় ভিত্তি অর্থাৎ কোনও কুইসলিঙ সরকার প্রতিষ্ঠা করতে। খাঁটি অবিমিশ্র অবস্থায় হিংসা ও ক্ষমতার পরস্পর সংঘাতের আদর্শ উদাহরণ হল রুশ কামানবাহিনীর বিরুদ্ধে চেকোশ্লোভাকিয়ার জনগণের সম্পূর্ণ অহিংস প্রতিরোধ। সেরকম ক্ষেত্রে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। খেয়াল রাখতে হবে যে হিংসা সংখ্যা বা জনমতের উপর নির্ভর করে না, নির্ভর করে যন্ত্রোপকরণের উপর। আগেই বলেছি যে অন্যান্য হাতিয়ারের মতো হিংসার উপরকণও মানুষের দৈহিক শক্তিকে কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়। হিংসার বিরোধিতা কেবলমাত্র ক্ষমতা দিয়ে করলে অচিরেই দেখা যায় যে বিরোধীপক্ষে মানুষ দাঁড়িয়ে নেই, দাঁড়িয়ে আছে মানুষ-সৃষ্ট এমন যন্ত্রোপকরণ যাদের অমানবিকতা ও ধ্বংসক্ষমতা যত বিরোধ বাড়ে ততই বাড়তে থাকে। হিংসা সবসময়েই ক্ষমতাকে ধ্বংস করে দিতে পারে। বন্দুকের নল সেই সবচেয়ে কার্যকরী হুকুমের উৎস যে হুকুম সবচেয়ে দ্রুত ও সবচেয়ে নিখুঁত বাধ্যতাকে নিশ্চিত করতে পারে। বন্দুকের নল কখনোই ক্ষমতার উৎস হতে পারে না।

হিংসা ও ক্ষমতার মধ্যে সরাসরি সংঘর্ষের ফল প্রায় সংশয়াতীত। গান্ধীর অহিংস প্রতিরোধের সফল ও অত্যন্ত ক্ষমতাধর কৌশল যদি উপনিবেশ-শাসক ইংলন্ডের বদলে অন্য কোনো শত্রুর বিরুদ্ধে প্রযুক্ত হতো, যেমন স্তালিনের রাশিয়া, হিটলারের জার্মানি বা এমনকি দ্বিতীয়-বিশ্বযুদ্ধ-পূর্ব জাপানের শাসকদের বিরুদ্ধে, তাহলে নি-উপনিবেশকরণের পরিবর্তে ফলাফল হতো বেপরোয়া গণহত্যার মুখে আত্মসমর্পণ। অবশ্য ইংলন্ড যে ভারতে ও ফ্রান্স যে আলজেরিয়ায় সংযম দেখিয়েছিল, তার পিছনে যথেষ্ট কারণ ছিল। নিখাদ হিংসার দ্বারা শাসন সেখানেই জারি হতে পারে যেখানে ক্ষমতা আর অবশিষ্ট নেই। অভ্যন্তরীণ ও বহির্ক্ষেত্রে রুশ সরকারের ক্ষমতার ক্রমসংকোচনই চেকোশ্লোভাকিয়ার সংকটে তার প্রযুক্ত ‘সমাধান’-এর মধ্য দিয়ে ফুটে বেরিয়েছে; ঠিক যেমন ইউরোপিয় ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদের ক্ষমতার ক্রমসংকোচন ফুটে বেরিয়েছিল নি-উপনিবেশকরণ ও বেপরোয়া গণহত্যার বিকল্পের মধ্য দিয়ে। হিংসা দিয়ে ক্ষমতাকে প্রতিস্থাপন করলে জয় হতে পারে, কিন্তু সে জয়ের জন্য কড়া দাম চুকোতে হয়। সে দাম কেবল বিজিতরাই চুকোয় না, বিজয়ীও তা চুকোয় নিজ ক্ষমতার ধ্বংসের মধ্য দিয়ে। বিজয়ী যদি নিজ দেশে সাংবিধানিক সরকারের সুবিধা ভোগ করে, তাহলে তা আরও বেশি করে সত্য হয়। হেনরি স্টিল কোম্যাজার সঠিকভাবেই বলেছেন: বিশ্বব্যবস্থা ও বিশ্ব শান্তিকে ক্রমশ দুর্বল করে ধ্বংস করতে চাইলে তার জন্য অবশ্যপ্রয়োজনীয় হল প্রথমে আমাদের নিজেদের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্বল করতে করতে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাওয়া।’৭৪ ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদের যুগে শাসকজাতির দেশের সরকারের উপর ‘অধীনস্থ জাতিদের উপর আরোপিত শাসনরূপের’ ব্যুমেরাঙ-প্রভাব পড়ার (লর্ড ক্রোমার উত্থাপিত) বহুচর্চিত আশঙ্কার মূল কথা ছিল এই যে দূর দূর দেশে হিংসার মাধ্যমে শাসন শেষাবধি ইংলন্ডের শাসনব্যবস্থাকেও প্রভাবিত করবে যার ফলে শেষতম ‘অধীন জাতি’ হবে স্বয়ং ইংরেজরা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর গ্যাস-আক্রমণের সাম্প্রতিক ঘটনা এই ব্যুমেরাঙ-প্রভাবের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। বার্কলেতে কেবল কঁাদানে গ্যাসই ব্যবহার করা হয়নি, তার সঙ্গে ব্যবহার করা হয়েছে সেই কুখ্যাত গ্যাসটিও যা ‘ভিয়েতনামে মার্কিন সেনা ব্যবহার করেছিল গেরিলা যোদ্ধাদের লুকানোর স্থান থেকে ঠেলে বের করে আনতে এবং তার পর যা জেনেভা কনভেনশন দ্বারা নিষিদ্ধ করা হয়েছিল’। রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সেপাইরা ওই গ্যাসের প্রভাব-নাশক মুখোশ পরে গোটা অঞ্চলটাকে ঘিরে দাঁড়িয়েছিল এবং একজনকেও সেখান থেকে বেরোতে দেয়নি। অনেক সময় বলা হয়ে থাকে যে অক্ষমতাই হিংসার জনক। নৈতিক ও দৈহিক বিচারে স্বাভাবিক জোরসম্পন্ন ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে অন্তত একথা মনস্তাত্ত্বিকভাবে সম্পূর্ণ সত্য। রাজনৈতিকভাবে বললে বলতে হয় যে ক্ষমতাহানির ফলেই ক্ষমতাকে হিংসা দিয়ে প্রতিস্থাপন করার প্রলোভন জাগে (১৯৬৮-তে শিকাগোয় অনুষ্ঠিত ডেমোক্রেটিক পার্টির কনভেনশন চলাকালীন দূরদর্শনের পর্দায় আমরা তা প্রত্যক্ষ করেছিলাম৭৫) আর স্বয়ং হিংসাই অক্ষমতার জন্ম দেয়। ক্ষমতার সমর্থন ছাড়া যেখানে হিংসা কাজ করে, ক্ষমতা যেখানে কোনও সংযমের গণ্ডীতে হিংসাকে বাঁধতে পারে না, সেখানে উপায় ও লক্ষ্যের সুবিদিত উলটপালট ঘটে গেছে। উপায়, অর্থাৎ, ধ্বংসের উপায় তখন লক্ষ্যকে নির্ধারণ করে, যার ফল হয় ক্ষমতার সার্বিক ধ্বংসসাধন।

হিংসা যেখানে আধিপত্য রক্ষায় ব্যবহৃত হয়, সেখানেই সবচেয়ে স্পষ্ট হয়ে দেখা দেয় ক্ষমতার উপর হিংসার বিজয়লাভের এই আত্মপরাভবী প্রবণতা। এই প্রক্রিয়ার অতিপ্রাকৃত সাফল্য ও চূড়ান্ত ব্যর্থতা সম্পর্কে পূর্ববর্তী যে কোনো প্রজন্মের থেকে আমাদের অভিজ্ঞতা বোধহয় বেশি। হিংসা আর সন্ত্রাস এক নয়। সন্ত্রাস হল সেই শাসনরূপ যা উদ্ভূত হয় যখন হিংসা স্বীয় সমস্ত ক্ষমতা ধ্বংস করে ফেলার পরও সরে যায় না, বরং সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে রাখে। দেখা যায় যে সন্ত্রাসের কার্যকারিতা প্রায় সম্পূর্ণত নির্ভর করে সামাজিক খণ্ডিতকরণের মাত্রার উপর। সমস্ত ধরনের সংগঠিত বিরোধিতার অবসানের পরই সন্ত্রাস পূর্ণশক্তিতে লাগু হতে পারে। খণ্ডিতকরণ (যে আতঙ্কপূর্ণ অভিজ্ঞতা তা বয়ে আনে, তার তুলনায় ‘খণ্ডিতকরণ’ একটি নেহাতই বিবর্ণ বিদ্যায়তনিক শব্দ) বজায় থাকে ও তীব্রতর হয় চরদের সর্বব্যাপী অস্তিত্বের মধ্য দিয়ে। চর সর্বত্র বিদ্যমান হয়ে ওঠে। কেবল পুলিশের পোষা বেতনভূক পেশাজীবী ‘চর’ নয়, সংসর্গে আসা যে কোনো মানুষই চরগিরি করতে পারে। নজরদার পুলিশী রাষ্ট্রের এহেন পূর্ণ-বিকশিত রূপ কীভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় ও কীভাবে তা কাজ করে— বা বলা ভালো, কীভাবে তার শাসনপরিধিতে তা অন্য সবকিছুকে অকেজো করে দেয়— তা এখন জানা সম্ভব আলেকজান্ডার সলঝেনিৎসিন-এর ‘দি ফার্স্ট সার্কেল’ থেকে, যে বইয়ে স্তালিন জমানার অস্তিত্বের সংশয়াতীতভাবে সর্বশ্রেষ্ঠ নথিবদ্ধকরণ হাজির হয়েছে এবং সম্ভবত বিশ শতকের সাহিত্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি হিসাবে তা টিকে থাকবে।৭৬ সন্ত্রাসের ভিত্তিতে সর্বাত্মকতাবাদী আধিপত্য এবং হিংসার ভিত্তিতে উৎপীড়ক শাসন/ একনায়কতন্ত্র— এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য এই যে সর্বাত্মকতাবাদী আধিপত্য কেবল তার শত্রুদেরই দমন করে না, বন্ধু এবং সমর্থকদেরও দমন করে কারণ সে ভয় পায় যে কোনো ক্ষমতাকে, এমনকি তার বন্ধুদের ক্ষমতাকেও। সন্ত্রাসের চূড়ান্ত মুহূর্ত এসে উপস্থিত হয় যখন পুলিশী রাষ্ট্র তার নিজের সন্তানদেরই গিলে খেতে থাকে, যখন গতকালের ঘাতক-জল্লাদ আজকের শিকারে পরিণত হয়। সেই চূড়ান্ত মুহূর্তেই সমস্ত ক্ষমতা নিঃশেষিত হয়। রাশিয়ার নি-স্তালিনীকরণের বহু বিশ্বাসযোগ্য ব্যাখ্যা এখন হাজির হয়েছে। আমার মতে সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য ব্যখ্যা এটাই যে স্তালিনীয় কৃত্যকারীরা নিজেরা উপলব্ধি করেছিল যে বিদ্রোহের বিরুদ্ধে সর্বশ্রেষ্ঠ রক্ষাকবচ স্বরূপ এই শাসনব্যবস্থায় বিদ্রোহের কোনো ভয় না থাকলেও, তা ক্রমশ গোটা দেশটাকেই পক্ষাঘাতগ্রস্থ করে দেবে।

এখনও অবধি করা আলোচনার একটা সারসংক্ষেপ করে নেওয়া যাক। ক্ষমতা আর হিংসা এক নয়— কেবল এই কথাটাই রাজনৈতিকভাবে যথেষ্ট নয়। ক্ষমতার বিপরীত হল হিংসা— একটির শাসন যেখানে নিখাদ, সেখানে অন্যটির অস্তিত্বই থাকে না। ক্ষমতা বিপন্ন হলে হিংসা দেখা দেয়। তারপর হিংসা যদি নিজের মতো করে বিকশিত হয়, ক্ষমতার বিলোপ ঘটে। এর থেকে সিদ্ধান্ত টানা যায় যে হিংসার বিপরীতে অহিংসাকে রাখা ঠিক নয়, অহিংস ক্ষমতার কথা একটি অতিরেক। হিংসা ক্ষমতাকে ধ্বংস করে, হিংসা কোনোভাবেই ক্ষমতা তৈরি করে না। হেগেল ও মার্কস বিরাট আস্থা রেখেছিলেন ‘নেতিকরণের দ্বান্দ্বিক শক্তি’-র উপর। ‘নেতিকরণের দ্বান্দ্বিক শক্তি’-র ধারণা অনুযায়ী, বিপরীতরা একে অপরকে ধ্বংস করে না, বরং, মসৃণভাবে একে অপরে বিকশিত হয়, কারণ দ্বন্দ্ব বিকাশকে পক্ষাঘাতগ্রস্ত করার বদলে ত্বরান্বিত করে। হেগেল ও মার্কসের এই আস্থা দাঁড়িয়ে আছে বহু পুরানো এক দার্শনিক পূর্বধারণার উপর। সেই পূর্বধারণা হল: ভালোর অভাবসূচক প্রকাশধারা ছাড়া মন্দ আর কিছু নয়, মন্দ থেকেও ভালো বেরিয়ে আসতে পারে; অর্থাৎ, অন্যভাবে বললে, তখনও অবধি লুক্কায়িত ভালোর এক ক্ষণস্থায়ী অভিব্যক্তি হল মন্দ। এহেন কালজয়ী ধারণা এখন বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। হেগেল বা মার্কস সম্বন্ধে কোনোদিন কিছু শোনেনি এমন মানুষজনও এই ধারণা পোষণ করে এই সরল কারণে যে তা আশা যোগায়, ভয় দূর করে। কিন্তু সে আশা ছলনাময়ী, ন্যায়সঙ্গত ভয়কে তা দূর করে। এর মধ্য দিয়ে আমি মন্দ ও হিংসার মধ্যে কোনো সমীকরণ তৈরি করছি না, কেবল জোর ফেলতে চাইছি এ কথায় যে হিংসার বিপরীত হল ক্ষমতা, আর সেই বিপরীত, অর্থাৎ ক্ষমতা থেকে হিংসা উদ্ভূত নয়। হিংসা যা সেইভাবেই তাকে বোঝার জন্য হিংসার শিকড় ও হিংসার প্রকৃতি নিয়ে আলোচনা করা দরকার।

 

হিংসার কারণ ও প্রকৃতি নির্ধারণ করার জন্য সমাজবিজ্ঞানীদের নানা গবেষণা প্রকল্পে বৃত্তিদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এখন বন্যার মতো টাকা ঢালছে; এ বিষয়ক বইয়ের মহাপ্লাবন বয়ে চলেছে; ‘বায়োলজিস্ট’, ‘ফিজিওলজিস্ট’, ‘ইথোলজিস্ট’ ও ‘জুলজিস্ট’-দের মতো লব্ধপ্রতিষ্ঠ প্রকৃতিবিজ্ঞানীরা যৌথভাবে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে মানব আচরণের ‘আগ্রাসী প্রবণতা’-র ধাঁধা সমাধানের চেষ্টায় নেমেছে, এমনকি এ বিষয়কে কেন্দ্র করে বিজ্ঞানের এক নতুন শাখা ‘পোলেমোলজি’ নাম নিয়ে সদ্য জন্ম নিয়েছে। এহেন সময়ে হিংসার কারণ ও প্রকৃতি নিয়ে আমার কিছু বলতে যাওয়া হয়ত এক প্রগলভ দাম্ভিকের কাজ বলে গণ্য হতে পারে। কিন্তু তা সত্ত্বেও দুটো কারণে (বা অজুহাতে) হিংসার কারণ ও প্রকৃতি নির্ধারণের প্রচেষ্টা আমি এখানে করব।

প্রথমত, প্রাণিতত্ত্ববিদদের কাজের অধিকাংশ আমাকে মুগ্ধ করলেও আমি ভেবে পাই না যে আমাদের সমস্যার ক্ষেত্রে তার ভূমিকা কী হতে পারে। জনগণ যে নিজ মাতৃভূমি রক্ষার জন্য লড়াই করে তা জানার জন্য কি আমাদের পিঁপড়ে, মাছ ও বানরদের ‘গোষ্ঠী-এলাকা রক্ষার’ প্রবৃত্তি আবিষ্কার করার প্রয়োজন আছে? নাকি ইঁদুরদের উপর অত্যাচার করে পরীক্ষা করার প্রয়োজন আছে একথা বোঝার জন্য যে অতিরিক্ত ঠাসাঠাসি বিরক্তি ও আগ্রাসনমনস্কতার জন্ম দেয়? কোনও বড় শহরের ঘিঞ্জি বস্তি এলাকায় একটা গোটা দিন কাটালেই তো এ নিয়ে আর কোনও সন্দেহ থাকার কথা নয়। আমার অবাক লাগে ও আনন্দও পাই যখন দেখি যে কিছু প্রাণী মানুষের মতোই আচরণ করে, কিন্তু তা দিয়ে কি কোনও মানব-আচরণের যথার্থতা প্রতিপাদন করা যায় অথবা নিন্দা করা যায়? আমার বোধগম্য হয় না কিছু প্রাণিপ্রজাতি অনেকটা মানুষের মতোই আচরণ করে এমনটা বোঝার বদলে আমাদের বুঝতে বলা হয়: ‘গোষ্ঠীবদ্ধভাবে এলাকানির্ভর প্রজাতিদের মতোই মানুষ আচরণ করে।’৭৭ (অ্যাডল্ফ পোর্টম্যানকে অনুসরণ করে বলা যায় যে প্রাণিজগতের আচরণ বিষয়ে নবলব্ধ জ্ঞান মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে পার্থক্য ঘুচিয়ে দিচ্ছে না, কেবল দেখাচ্ছে যে ‘আমরা যতটা ভাবতাম তার থেকে আমাদের আরো অনেক বেশি আচরণ অন্যান্য প্রাণীদের মধ্যেও দেখা যায়।’৭৮) প্রাণিমনস্তত্ত্বের উপর নরত্বারোপের ঝোঁক ‘বর্জন’ করার পর (সত্যিই কতটা বর্জন করা গেছে তা অবশ্য অন্য প্রশ্ন) এখন মানুষকে অন্য প্রাণীর সমরূপ দেখানোর উল্টো ঝোঁকের কোনও মানে হয় কি?৭৯ কোনও সন্দেহ থাকতে পারে কি যে অন্য প্রাণীর উপর নরত্বারোপ ও মানুষের উপর অন্য-প্রাণিত্বারোপ আসলে আচরণবিজ্ঞানের একই ভুলের দুই পিঠ? তাছাড়া, মানুষকে প্রাণিজগতের অংশ বলে বিবেচনা করলেই কি মানুষের আচরণের আদর্শনীতি অন্য প্রাণিজগতের আচরণের আদলে গড়ে তুলতে হবে? আমার সন্দেহ হয় যে সমস্যার উৎস আসলে খুব সহজ একটা জায়গায়: অন্য প্রাণিপ্রজাতি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা-গবেষণা করা সহজতর, তা কেবল এই মানবিক বিবেচনা থেকে নয় যে মানুষদের খাঁচায় পুরে পর্যবেক্ষণ চালানো শোভনীয় নয়, তা এই জন্যও যে পর্যবেক্ষণাধীন মানুষ প্রতিরোধ হিসেবে নানা ছলনা গড়ে তোলে যা পর্যবেক্ষক মানুষদের ক্ষেত্রে অতি সমস্যাজনক।

দ্বিতীয়ত, সামাজিক ও প্রাকৃতিক বিজ্ঞান উভয়ের গবেষণালব্ধ ফল দেখিয়ে হিংসাত্মক আচরণকে যতটা ‘স্বাভাবিক’ প্রতিক্রিয়া হিসেবে হাজির করা হয়, অন্যথায় ততটা স্বাভাবিকতা তাদের বরাদ্দ করতে আমরা অভ্যস্ত নই। আক্রমণাত্মক মনোভাবকে একটা ‘প্রবৃত্তিগত প্রতিক্রিয়া’ হিসেবে সংজ্ঞাত করা হয় এবং বলা হয় যে পুষ্টিগ্রহণ ও কামের প্রবৃত্তি ব্যক্তি ও প্রজাতির জীবনপ্রক্রিয়ায় যে বৃত্তিগত ভূমিকা নির্বাহ করে, আক্রমণাত্মক মনোভাব বা হিংসাও প্রকৃতিজগতে সেই একই ভূমিকা পালন করে। কিন্তু সত্যিই কি তাই? পুষ্টিগ্রহণ ও কামের প্রবৃত্তি সক্রিয় হয়ে ওঠে একদিকে বাধ্যতাসূচক শরীরী প্রয়োজনের উস্কানিতে ও অন্যদিকে বহিঃস্থিত উত্তেজকের উপস্থিতিতে। কিন্তু প্রাণিজগতে আক্রমণাত্মক প্রবৃত্তি তেমন কোনও উস্কানির উপর নির্ভরশীল নয়, বরং তার উল্টো: উস্কানির অভাবই আপাতভাবে প্রবৃত্তি-নৈরাশ্য ও ‘অবদমিত’ আক্রমণ-প্রবণতা ডেকে আনে, যা, মনস্তত্ত্ববিদদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, বাঁধ খাড়া করে ‘শক্তি’-কে বেঁধে রাখে এবং সে বাঁধ শেষমেষ ভেঙে পড়লে বিপদ আরো বাড়ে। (তুলনীয়ভাবে বলতে হয়, যেনবা ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা কমার অনুপাতে মানুষের ক্ষুধার ‘অনুভূতি’ বৃদ্ধি পাবে।)৮০ এই ব্যাখ্যা অনুযায়ী, উস্কানিবিহীন হিংসা স্বাভাবিক, এবং যদি তা আত্মসংরক্ষণের মৌলিক ভূমিকা বিহনে নিজ যৌক্তিকতা হারায়, তাহলে তা ‘অযৌক্তিক’ হয়ে ওঠে আর বলা যায় যে এই কারণেই মানুষ অন্য প্রাণীদের চেয়ে বেশি ‘পাশবিক’ হয়ে উঠতে পারে। (লেখাপত্রে আমাদের সবসময় নেকড়েদের উদারমনস্ক আচরণের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়, বলা হয় যে তারা পরাজিত শত্রুদের হত্যা করে না।)

এইসব অতিসাম্প্রতিক ‘আবিষ্কারসমূহে’ ‘শক্তি’ ও ‘বল’-এর মতো পদার্থবিদ্যার বর্গকে প্রাণিবিদ্যা/জীববিদ্যা-র উপাত্তের উপর এমনভাবে আরোপ করে দেওয়া হয় যা ভুল ধারণার জন্ম দেয়। জীববিদ্যা/ প্রাণিবিদ্যা-য় বর্গগুলো অর্থহীন হয়ে ওঠে যেহেতু এক্ষেত্রে তাদের কোনও পরিমাপ সম্ভব নয়।৮১ তাছাড়াও সন্দেহ হয় যে এই সাম্প্রতিকতম আবিষ্কারগুলোর ভিত্তিমূলে ওত পেতে আছে মানুষের প্রকৃতি বিষয়ে প্রাচীনতম এক সংজ্ঞা: ‘যুক্তিচালিত প্রাণী’ (animal rationale) বলে মানুষের এই সংজ্ঞায়ন অনুযায়ী অন্য প্রাণিপ্রজাতি থেকে আমাদের পার্থক্য কেবলমাত্র আমাদের যুক্তিবদ্ধতার অতিরিক্ত গুণের জন্যই। এই প্রাচীনতম অনুমানকে নির্বিচারে নিজ প্রারম্ভবিন্দু হিসেবে ধরে নিয়ে আধুনিক বিজ্ঞান তাকে আরও টেনে নিয়ে গিয়ে ‘প্রমাণ’ হাজির করেছে যে প্রাণিজগতের কিছু প্রজাতির সঙ্গে মানুষের সব ধর্মই এক, মানুষের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত কেবল তার যুক্তিবিস্তারের সামর্থ্য, যে অতিরিক্ত সামর্থ্য মানুষকে অন্যদের তুলনায় বেশি বিপজ্জনক করে তুলেছে। এই ‘যুক্তি’ ব্যবহার করেই আমরা বিপজ্জনক রকমের ‘অযৌক্তিক’ হয়ে উঠি কারণ এই যুক্তি হল ‘প্রবৃত্তিচালিত আদিমানুষ সত্তার’ ধর্ম।৮২ বিজ্ঞানীরা অবশ্য সচেতন যে মানুষের হাতিয়ার-নির্মাতা চরিত্রই সেই সমস্ত দূরপাল্লার অস্ত্রের উদ্ভাবন করেছে যা তাকে প্রাণিজগতে স্বাভাবিক ‘প্রাকৃতিক’ সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করতে সক্ষম করে তুলেছে, আর হাতিয়ার-নির্মাণ খুবই জটিল এক ‘মানসিক’ ক্রিয়া।৮৩ তাই মানুষের প্রবৃত্তির ‘জীবন-সঞ্চারক ভূমিকা’ যখন শেষ হয়ে যায়, বিজ্ঞানের ডাক পড়ে সেগুলোর নিরাপদ বহির্প্রকাশের রাস্তা খুঁজে দিয়ে নিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের মাধ্যমে যুক্তির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া প্রশমন করার জন্য। আচরণের মানদণ্ড নির্ধারণ করা হয় অন্য প্রাণিপ্রজাতির মধ্য থেকে, যেখানে মানবযুক্তির হস্তক্ষেপ জৈবিক প্রবৃত্তির ভূমিকাকে ধ্বংস করে দেয় নি। আর এখন মানুষ ও না-মানুষ প্রাণীর মধ্যে পার্থক্যকে আর, সঠিক অর্থে বললে, ‘যুক্তি’ (মনুষ্যরূপী প্রাণীর lumen naturale অর্থাৎ স্বাভাবিক দ্যুতি) বলেও ধরা হয় না, ধরা হয় ‘বিজ্ঞান’ বলে, যে ‘বিজ্ঞান’ হল পূর্বোক্ত সব মানদণ্ড ও তাদের প্রয়োগকৌশলের সমষ্টি। এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী সেসব মানুষের কাজকর্ম অযৌক্তিক ও পাশবিক বলে ধরা হবে যারা বিজ্ঞানীদের কথা মেনে চলতে অস্বীকার করবে বা বিজ্ঞানীদের সর্বশেষ ‘আবিষ্কারগুলো’ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকবে না। এই সমস্ত তত্ত্ব ও তাদের লক্ষণাসমূহের বিপরীতে দাঁড়িয়ে এ আলোচনার পরবর্তী অংশে আমি দেখাতে চাইব: মানবতাবাদীদের মধ্যে প্রচলিত অর্থে বা বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব দ্বারা নির্দিষ্ট অর্থে, যে অর্থেই ‘পাশবিক’ ও ‘অযৌক্তিক’ বিশেষণদুটোকে ধরা হোক না কেন, হিংসা পাশবিক নয়, অযৌক্তিকও নয়।

 হিংসা প্রায়ই সাধারণত ক্রোধ থেকে দেখা দেয়। ক্রোধ অবশ্যই অযৌক্তিক ও শারীরিক রোগবিশেষ হতে পারে, কিন্তু তা তো অন্য যে কোনও আবেগ সম্পর্কেই বলা যায়। আজ আর সন্দেহ থাকতে পারে না যে এমন পরিবেশ তৈরি করা যায় যা মানুষের অবমানবিকীকরণ ঘটায়, যেমন, কনসেনট্রেশন ক্যাম্প, বন্দিশিবির, নিপীড়ন, দুর্ভিক্ষ। কিন্তু তার মানে এই নয় যে তেমন পরিস্থিতিতে মানুষ পশু হয়ে ওঠে। আর তেমন পরিস্থিতিতে অবমানবিকীকরণের স্পষ্টতম চিহ্ন ক্রোধ বা হিংসা নয়, স্পষ্টতম চিহ্ন হল ক্রোধ ও হিংসার নিখাদ অনুপস্থিতি। ক্রোধ কোনওভাবেই দুঃখ-দুর্দশার স্বতঃক্রিয় প্রতিক্রিয়া নয়। কোনও নিরাময়-অসম্ভব রোগের বিরুদ্ধে বা ভূমিকম্পের মতো কোনও দুর্যোগের বিরুদ্ধে মানুষ ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে না। অপরিবর্তনীয় বলে মনে হয় এমন যে কোনও সামাজিক অবস্থার বিরুদ্ধেই মানুষ ক্রুদ্ধ হয় না। যখন সন্দেহের অবকাশ দেখা যায় যে পরিস্থিতির পরিবর্তন করা সম্ভব কিন্তু তা করা হচ্ছে না, কেবল তখনই ক্রোধ মাথাচাড়া দেয়। আমাদের ন্যায়পরতার বোধ যখন আহত হয়, তখনই আমাদের প্রতিক্রিয়া হয় ক্রোধ। আর কেবলমাত্র ব্যক্তিগত ক্ষতি বা অনিষ্টের কারণেই ন্যায়পরতা আহত হয় না— এর প্রমাণ পাওয়া যাবে বিপ্লবের গোটা ইতিহাস জুড়ে, যেখানে ব্যতিক্রমহীনভাবে সমাজের উপরতলার কিছু সদস্য নিচেরতলার নিপীড়িত ও নির্যাতিতদের সঙ্গে সমব্যথী হয়েছে ও নিপীড়িত-নির্যাতিতদের বিদ্রোহে নেতৃত্বও দিয়েছে। নিদারুণ পরিস্থিতি বা ঘটনার মুখোমুখি হিংসা অবলম্বনের প্রলোভন বিপুল, কারণ হিংসাত্মক উপায় স্বভাবগতভাবেই তাৎক্ষণিক ও দ্রুতক্রিয়। সুবিবেচিত লয়ে কাজ করা ক্রোধ ও হিংসার স্বভাববিরুদ্ধ, কিন্তু সেজন্যই ক্রোধ ও হিংসা অযৌক্তিক হয়ে যায় না। বরং উল্টোদিকে ব্যক্তির বা গোষ্ঠীর জীবনে এমন বহু পরিস্থিতি আসে যখন হিংসাত্মক ক্রিয়ার দ্রুততাই একমাত্র যথোপযুক্ত প্রতিষেধক হতে পারে। এমনটা নয় যে তা আমাদের চাপমুক্ত করে, টেবিলে ঘুঁষি মেরে বা দরজা আছড়ে বন্ধ করে যেমন হয়। ব্যাপারটা এই যে কোনো কোনো পরিস্থিতিতে ন্যায়পরতার দাঁড়িপাল্লাকে সমান-সমান করার একমাত্র উপায় হয়ে দাঁড়ায় হিংসা, অর্থাৎ, যুক্তিতর্ক ছাড়া, কথাবার্তা ছাড়া, ফলবিচার না করেই কাজ করা। (আদর্শ উদাহরণ হলো বিলি বাড, যে তার বিপক্ষে মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া লোকটাকে আঘাত করে মেরে ফেলেছিল।) এই দিক থেকে ক্রোধ এবং সর্বদা না হলেও কখনও কখনও তার সহগামী হিংসা ‘স্বাভাবিক’ মানব-আবেগের অন্তর্ভুক্ত এবং তাদের থেকে মানুষকে ‘সারিয়ে তোলা’ একান্তই অবমানবিকীকরণ বা খোজাকরণের সামিল। ন্যায়পরতার তাগিদে নিজের হাতে আইন তুলে নেওয়ার এই ক্ষেত্রগুলো যে সভ্যগোষ্ঠী-নির্মিত সংবিধানের বিরোধে দাঁড়ায় তা অনস্বীকার্য, কিন্তু মেলভিল রচিত মহান কাহিনিতে তাদের যে রাজনীতি-বিরোধী চরিত্র সু-অভিব্যক্ত তা থেকে প্রমাণ হয় না যে তারা অমানবিক বা ‘নেহাত’ আবেগসর্বস্ব।

আবেগের অনুপস্থিতিই যুক্তিশীলতার কারণ নয়, এমনকি তার ইন্ধনও নয়। অসহনীয় বিয়োগান্তক পরিস্থিতির মুখে ‘নিরাসক্তি’ ও ‘প্রশান্তি’ বজায় রাখা ‘নিতান্ত ভীতিপ্রদ’,৮৪ কার্যত তখন তা নিয়ন্ত্রণের ফল নয়, বরং উপলব্ধির অভাব ও বোধের অভাবের ফল। যথাযথ প্রতিক্রিয়া জানাতে হলে প্রথমত তো তাকে ‘বিচলিত’ হতে হবে। ‘আবেগসর্বস্ব হওয়ার’ বিপরীত ‘যুক্তিশীল হওয়া’ নয়, যে অর্থেই তা ধরা হোক না কেন। একদিকে যেমন বিচলিত হতে না পারা একটি শারীরিক রোগবিশেষ, অন্যদিকে তেমনই আবেগসর্বস্ব ভাবপ্রবণতা হলো অনুভূতির বিকৃতি। ক্রোধ ও হিংসা অযৌক্তিক হয়ে ওঠে যখন তা মূলের বিরুদ্ধে চালিত না হয়ে প্রতিকল্পের বিরুদ্ধে চালিত হয়— আর আমার আশঙ্কা যে ঠিক এই প্রতিকল্পের বিরুদ্ধে চালনা করার উপদেশই মানুষের আক্রমণমনস্কতা নিয়ে ভাবিত মনস্তত্ত্ববিদ ও রাজনৈতিক-তাত্ত্বিকরা দেন এবং বৃহত্তর সমাজের কোনো কোনো মেজাজ ও চিন্তাহীন মনোভাবের সঙ্গে তা খাপ খেয়ে যায়। যেমন, দেখা যাচ্ছে যে কৃষ্ণাঙ্গদের ক্ষোভের প্রতিক্রিয়ায় শ্বেতাঙ্গ উদারপন্থীদের নতুন কেতা হয়ে উঠেছে ‘আমরা সবাই দোষী’ ঘোষণা করা আর এই স্বীকারোক্তিতে যারপরনাই খুশি ‘ব্ল্যাক পাওয়ার’ এক যুক্তিরহিত ‘কৃষ্ণাঙ্গ ক্রোধ’ উশকে দিচ্ছে। যখন সবাই দোষী হয়, তখন আসলে কেউই দোষী হয় না। প্রকৃত দোষীদের চিহ্নিতকরণ এড়িয়ে যাওয়ার সবচেয়ে ভালো উপায় হল সকলের সম্মিলিত দোষ ঘোষণা করা। আর তখন অপরাধের বিপুল মাত্রাই তা নিয়ে নিষ্ক্রিয় থাকার সবচেয়ে ভালো অজুহাত হয়ে দাঁড়ায়। এছাড়াও, উক্ত ক্ষেত্রে এ হয়ে দাঁড়ায় জাতিবিদ্বেষকে একটি উচ্চতর ও অবোধ্যতর পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে সমস্ত কিছুকে বিপজ্জনকভাবে গুলিয়ে দেওয়া। কৃষ্ণাঙ্গ ও শ্বেতাঙ্গদের মধ্যে প্রকৃত বিচ্ছেদ কোনওভাবেই প্রশমিত হয় না গোষ্ঠীগত নির্দোষতা ও গোষ্ঠীগত দোষের মধ্যে আরো সমন্বয়-অসাধ্য এক বিরোধের আদলে তার রূপকল্পনার মধ্য দিয়ে। ‘সব শ্বেতাঙ্গ মানুষ দোষী’— এ কথা কেবলমাত্র এক বিপজ্জনক অর্থহীনতাই নয়, তা এক পাল্টা জাতিবিদ্বেষও। আর এই পাল্টা জাতিবিদ্বেষ কৃষ্ণাঙ্গ জনগণের অত্যন্ত বাস্তব ক্ষোভ ও যুক্তিশীল আবেগকে কার্যকরীভাবে অযৌক্তিকতার মধ্যে ঠেলে দেয় ও বাস্তব থেকে পালানোর জায়গা তৈরি করে।

তাছাড়া, ‘চিন্তিত’-রা (engages) কেন ‘ক্রুদ্ধ’-য়ে (enrages) পরিণত হয়, ইতিহাস থেকে সেই কারণগুলো অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে যে সবার আগে অন্যায়পরতা আসবে না, সবার আগে আসবে কপটতা (হিপোক্রেসি)। ফরাসি বিপ্লবের শেষ পর্বে রোবসপিয়েরের কপটতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ কীভাবে ‘স্বাধীনতার স্বেচ্ছাচার’-কে সন্ত্রাসের রাজ (রেইন অফ টেরর)-য়ে পরিণত করল তা এতটাই সুবিদিত যে এখানে আবার তা আলোচনা করা নিরর্থক, কিন্তু খেয়ালে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে কপটতার বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা হয়েছিল রোবসপিয়েরের বহু আগেই, সেই ফরাসি নীতিকারদের যুগ থেকে যারা কপটতাকে নিকৃষ্টতম দোষ আখ্যা দিয়ে বলেছিল যে এই দোষ চূড়ান্ত আধিপত্য বিস্তার করেছে ‘সু-সমাজে’, যা তার কিছুদিন পর থেকেই ‘বুর্জোয়া সমাজ’ নামে পরিচিত হয়েছিল। প্রসিদ্ধ লেখকদের মধ্যে খুব কমজন ‘হিংসার জন্যই হিংসা’-কে গরিমাণ্বিত করেছেন। কিন্তু যে অল্প কয়েকজন তা করেছেন— যেমন: সোরেল, পারেতো, ফানন— তারা বুর্জোয়া সমাজের প্রতি প্রথাগত বামেদের তুলনায় গভীরতর ঘৃণা দ্বারা চালিত হয়েছেন এবং প্রধানত সহানুভূতি ও ন্যায়পরতার তীব্র আকাঙ্খা দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে বুর্জোয়া সমাজের নৈতিক মানদণ্ডের থেকে প্রথাগত বামেদের তুলনায় আরো বৈপ্লবিক বিযুক্তি ঘটিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ও খোলা রাস্তায় আজ যে হিংসা দেখা যাচ্ছে, তার পিছনে শক্তিশালী অভিপ্রায় হিসেবে কাজ করছে অনেককিছু, যেমন: শত্রুর মুখ থেকে কপটতার মুখোশ টেনে ছেঁড়া, সরাসরি হিংসার আশ্রয় না নিয়েও যে জটিল কলকব্জা-কৌশলের সাহায্যে শত্রু তার শাসন বজায় রেখেছে তার আবরণ উন্মোচন করা, ধ্বংস হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি নিয়েও সক্রিয়তাকে ইন্ধন দেওয়া যাতে সত্য উন্মুক্ত হয়।৮৫ এই হিংসা তাই যুক্তিরহিত নয়। মানুষের বাস যেহেতু বাহ্য লক্ষণের দুনিয়ায় এবং মানুষের দুনিয়াদারি যেহেতু বহির্প্রকাশের উপর নির্ভরশীল, তাই যুক্তিপূর্ণ আচরণের মাধ্যমে কপটতার অহমিকা মোকাবিলা করা যায় না (কপটতা তো সেই কৌশলী ছল নয়, যে ছল সময়মতো স্বীকার করে নেওয়া হয়)। কথার উপর নির্ভর করা যায় তখনই যখন এই নিশ্চিতি থাকে যে কথার উদ্দেশ্য কিছু লুকিয়ে রাখা নয়, বরং কিছু উন্মোচন করা। যুক্তিবিস্তারের পিছনে লুকোনো স্বার্থচিন্তা যত না ক্রোধ উদ্রেক করে, তার চেয়ে বেশি ক্রোধ উদ্রেক করে যুক্তিবিস্তারের ভান। যুক্তিকে যখন ফঁাদ হিসেবে ব্যবহার করা হয়, যুক্তির ব্যবহার মানে তখন যৌক্তিকতা নয়, ঠিক যেমন আত্মরক্ষার্থে বন্দুক ব্যবহার করা ‘অযৌক্তিক’ নয়। কপটতার বিরুদ্ধে এই হিংসাত্মক প্রতিক্রিয়া নিজ বিচারে যতই ন্যায়সঙ্গত হোক, তা অস্তিত্বের যুক্তি হারায় যখন তা নির্দিষ্ট লক্ষ্য সামনে রেখে কৌশলরচনা করতে যায়, যে মুহূর্তে তা ‘যৌক্তিক’ হয়ে ওঠার চেষ্টা করে সেই মুহূর্তেই তা ‘অযৌক্তিক’ হয়ে ওঠে। এই মুহূর্তটি উপস্থিত হয় যখন সংঘাতের কোনও পর্বে প্রতিক্রিয়া পরিণত হয় স্বতক্রিয়ায় এবং নিহিত উদ্দেশ্য খাড়া করার মনস্তাত্ত্বিক প্রক্রিয়ার হাত ধরে শুরু হয় সন্দেহভাজনদের চিহ্নিত করার কাজ।৮৬

——————

আগেই বলেছি যে হিংসার কার্যকারিতা সংখ্যার উপর নির্ভর করে না— মেশিনগান হাতে একজনই পারে কয়েকশ সুসংগঠিত মানুষের সঙ্গে পাল্লা দিতে। কিন্তু সমষ্টিগত হিংসার মধ্য দিয়েই হিংসার সবচেয়ে বিপজ্জনক আকর্ষণীয় চরিত্রগুলো ফুটে ওঠে। তা এ জন্য নয় যে সংখ্যাবৃদ্ধি নিরাপত্তা দেয়। সামরিক ক্রিয়ায় ও বিপ্লবী ক্রিয়ায় ‘প্রথম যে মূল্যবোধ বিনষ্ট হয় তা হল ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ’।৮৭ ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের পরিবর্তে দেখা যায় সুতীব্র অনুভূতির এমন এক সমষ্টিলগ্নতা যা অন্য যে কোনও ব্যক্তিগত বা সামাজিক বন্ধুত্বের তুলনায় স্বল্পস্থায়ী হলেও অনেক বেশি শক্তিশালী।৮৮ অপরাধমূলক বা রাজনৈতিক, যে কোনও ধরনের বেআইনি উদ্যোগে উদ্যোগী গোষ্ঠী/দল নিজ নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য আবশ্যিক করে তোলে যে হিংসার সমষ্টিতে অন্তর্ভুক্ত হতে ইচ্ছুককে অন্তর্ভুক্তির জন্য ‘এমন কোনও একটা অপরিবর্তনীয় ক্রিয়া করতে হবে’ যা সম্মানিত সমাজের সঙ্গে তার যোগসূত্র কেটে দেবে, ফেরার পথ রাখবে না। একবার যে অন্তর্ভুক্ত হয়, সে এক তীব্র উত্তেজক নেশার ঘোরে প্রবেশ করে। সেই নেশা হলো ‘হিংসার চর্চা, যা গোষ্ঠীভুক্তদের একটা সমগ্র রূপে একসঙ্গে বেঁধে রাখে, প্রতিটি ব্যক্তি হয়ে ওঠে ঊর্ধ্বোত্থিত হিংসা রূপী মহান জীবদেহের এক একটি প্রত্যঙ্গ’।৮৯

সদ্যউদ্ধৃত এই কথাগুলো ফাননের। এই কথাগুলো যে বহুজ্ঞাত প্রতীত বিষয়ের ইঙ্গিতবাহী, তা হল উদারতম ও নিঃস্বার্থতম ক্রিয়াকে প্রাত্যহিকীতে পরিণত করা যুদ্ধক্ষেত্রের ভ্রাতৃত্ববন্ধন। সমস্ত সমতাবিধানকারীর মধ্যে সবচেয়ে ক্ষমতাশালী হল মৃত্যু, বিশেষ করে যখন তা এক রাজনৈতিক ভূমিকা পালন করে। প্রকৃত অর্থেই মরণের মুখোমুখি হওয়ার মধ্য দিয়ে হোক বা নিজ মরণশীলতা সম্পর্কে অন্তরে জাগ্রত সচেতনতার মধ্য দিয়ে হোক, মৃত্যু-অভিজ্ঞতার মতো রাজনীতি-বিরোধী অভিজ্ঞতা বোধহয় আর কিছু নেই। যে কোনও রাজনীতিরই শর্ত হল সহনাগরিকদের সঙ্গ ও বাহ্যপ্রকাশের জগতে উপস্থিতি; অন্যদিকে, মৃত্যুর অর্থ হল বাহ্যপ্রকাশের জগত থেকে বিদায় নেওয়া ও সহনাগরিকদের সঙ্গত্যাগ। মানব-অভিজ্ঞতার নিরিখে নিঃসঙ্গতা ও অক্ষমতার চূড়ান্ত অবস্থা হল মৃত্যু। কিন্তু সমষ্টিগত ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে মৃত্যুকে মুখোমুখি করলে মৃত্যুর চেহারা পাল্টে যায়, মনে হয় যেন বা মৃত্যু-সান্নিধ্যের মতো আর কোনও কিছুই আমাদের এত তীব্র জীবন-অভিজ্ঞতার শরিক করতে পারে না। আমাদের অভিজ্ঞতার কেন্দ্রস্থানটি দখল করে বসে এই বিরল বোধ যে আমার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে গড়ে উঠছে আমার গোষ্ঠী/দলের অমরত্বের সম্ভাবনা এবং শেষ বিচারে আমার প্রজাতির অমরত্বের সম্ভাবনা। যেনবা, তার ব্যক্তি-সদস্যদের অবিরাম মৃত্যু দিয়ে পুষ্ট প্রজাতির অমর জীবন ‘ঊর্ধ্বোত্থিত’ হচ্ছে। যেনবা, প্রকৃত জীবন হল এই প্রজাতির জীবন এবং হিংসার চর্চার মধ্য দিয়েই সেই প্রকৃত জীবন বাস্তবায়িত হচ্ছে।

কেবলমাত্র ভাবপ্রবণতা বলে একে বিচার করলে ভুল হবে। মানব-অবস্থার একটি নজরকাড়া বৈশিষ্ট্য এখানে যথাযথ অভিজ্ঞতারূপ লাভ করছে। আমাদের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিত অবশ্য অন্য। সেই পরিপ্রেক্ষিত থেকে দেখলে, সন্দেহাতীত মৌলিক বলসম্পন্ন এই অভিজ্ঞতা কখনোই পর্যাপ্ত প্রাতিষ্ঠানিক ও রাজনৈতিক অভিব্যক্তি লাভ করেনি এবং রাজনৈতিক দর্শনে সমতাবিধানকারী হিসেবে মৃত্যু প্রায় কোনও ভূমিকা পালন করেনি, যদিও মানুষের মরণশীলতা— প্রাচীন গ্রিকদের ভাষায়, মানুষ যে মরণশীল এই তথ্য— রাজনৈতিক ক্রিয়ার পিছনে সক্রিয় সবচেয়ে শক্তিশালী প্রণোদনা হিসেবে কাজ করে গেছে সেই দর্শন-পূর্ব যুগের রাজনৈতিক ভাবনায়। তখন মৃত্যুর নিশ্চয়তাই মানুষকে কথায় বা কাজে অবিনশ্বর প্রসিদ্ধি সন্ধানে চালিত করত এবং সম্ভাব্য অবিনশ্বর এক রাষ্ট্রকাঠামো প্রতিষ্ঠার কাজে প্রণোদনা যুগিয়েছিল। সুতরাং, মৃত্যুর নিয়ে আসা সমতাবিধান এড়িয়ে কিছু মাত্রায় মৃত্যুহীনতা প্রদানকারী বিশিষ্টতায় পলায়নের এক উপায় ছিল রাজনীতি। (হবস্-ই একমাত্র রাজনৈতিক দার্শনিক যাঁর কাজে মৃত্যু, হিংস্র মৃত্যুর ভীতি আকারে, গুরুত্বপূর্ণ স্থান নিয়েছিল। কিন্তু হবস্-এর বিবেচনায় মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে সমতা নির্ধারক হয় নি। তিনি ভেবেছিলেন, প্রতিটা মানুষের মধ্যে আছে হত্যা করার সমান সক্ষমতা— এই সম-সক্ষমতার ভয়ই মানুষকে প্রবর্তিত করে প্রকৃতির রাজ্যে রাষ্ট্রমণ্ডলীর বাঁধ তুলে নিজেদের বেঁধে রাখতে।) যাই হোক না কেন, এযাবৎ কোনও রাষ্ট্রকাঠামো মৃত্যুর সামনে সমতার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে আমার জানা নেই। ইতিহাসে যে ‘সুইসাইড স্কোয়াড’-গুলোর সন্ধান মেলে, তারা এই মৃত্যুর সামনে সমতার নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত ও তাই ‘ব্রাদারহুড’ নামে স্ব-নামাঙ্কিত হলেও, তাদের কখনোই রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে গণ্য করা যায় না। তবে এ কথা সত্য যে, সমষ্টিগত হিংসা যে দৃঢ় ভ্রাতৃত্ববোধ গডে় তোলে তা বহু চিন্তাশীল মানুষের মনেও এই আশা জাগিয়ে তুলেছিল যে হিংসাশ্রয়ী সংগঠনগুলোর মধ্যে থেকেই বুঝিবা ‘নতুন মানুষ’ গড়ে উঠবে, যাদের নিয়ে গড়ে উঠবে নতুন লোকসমাজ। কিন্তু এহেন ‘ব্রাদারহুড’ কেবল জীবনহানি বা অঙ্গহানির আশু বিপদসম্ভাবনার মুখেই বাস্তবায়িত হয় বলে এর চেয়ে ক্ষণস্থায়ী মানবসম্পর্ক আর কিছু হয় না, তাই সে আশা অচিরেই কুহকে পরিণত হয়েছে।

এবার অন্য একটা দিক দেখা যাক। ফানন-এর হিংসার প্রশংসা শেষ হয়েছে এই মন্তব্য দিয়ে যে, হিংসাত্মক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে মানুষ উপলব্ধি করে ‘জীবন এক অন্তহীন যোঝাযুঝি’ ও হিংসা জীবনেরই উপাদান। বেশ বিশ্বাসযোগ্য শোনায় না কি এ কথা? মানুষ কি সর্বদা মৃত্যুকে ‘চিরশান্তি’ বলে অভিহিত করে নি আর তাই থেকেই কি বোঝা যায় না যে জীবন মানেই সংগ্রাম ও অশান্তি-অস্থিরতা? প্রশান্তি কি জীবনহীনতা বা পচনেরই স্পষ্ট বহির্প্রকাশ নয়? যে তারুণ্য আমাদের কাছে পরিপূর্ণভাবে বাঁচার সমার্থক, হিংসাত্মক ক্রিয়া কি সেই তারুণ্যেরই বৈশিষ্ট্য নয়? সুতরাং জীবনপ্রশস্তি ও হিংসার প্রশস্তি কি একই নয়? অন্তত সোরেল এমনটাই ভেবেছিলেন ষাট বছর আগে। ইউরোপিয় শ্রেণিসংগ্রামের পিছু হটার স্পষ্ট চিহ্ন দেখে তিনি স্পেঙ্গলার-এর আগেই ‘পাশ্চাত্যের পতন’-এর ভবিষ্যদবাণী করেছিলেন। তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন: শ্রেণিসংগ্রামে নিজ ভূমিকা পালন করার শক্তি বুর্জোয়া হারিয়ে ফেলেছে; তাই ইউরোপকে রক্ষা করা যাবে একমাত্র যদি প্রলেতারিয়েতকে দিয়ে হিংসার ব্যবহারের মাধ্যমে শ্রেণিপার্থক্যকে আবার জোরালোভাবে হাজির করা যায় ও তার মধ্য দিয়ে বুর্জোয়ার লড়াকু মনোভাবকে আবার জাগিয়ে তোলা যায়।৯০

সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে জীবনবলের এক বহির্প্রকাশ, বিশেষত জীবনের সৃজনীশক্তির প্রকাশ হিসেবে হিংসার প্রশস্তিগাথা কনরাড লোরেঞ্জ-এর আক্রমণমনস্কতার জীবন-সঞ্চারক ভূমিকা আবিষ্কারের অনেক আগে থেকেই রচিত হয়ে গিয়েছিল। বার্গসন কথিত ‘এলান ভিটাল’ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে সোরেল ‘উৎপাদক’-দের জন্য এমন এক ‘সৃজনশীলতার দর্শন’ গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন যা তঁার বিচারে পরজীবী বুদ্ধিজীবীদের ও উপভোক্তা সমাজকে তীব্র বিরোধিতাপূর্ণ তর্ক-বিতর্কের লক্ষ্যমুখ করবে। সোরেল তঁার লেখায় ‘বুর্জোয়া’-র যে প্রতিমা গড়ে তুলেছিলেন তা প্রশান্ত, আত্মসন্তুষ্ট, ভণ্ড, আমোদপ্রমোদে নিমজ্জিত, ক্ষমতার অভিলাষহীন এমন এক জীব যে পঁুজিবাদের প্রতিনিধি হওয়ার বদলে পঁুজিবাদের শেষ পর্যায়ের বিকৃতির উপজাত ফল। আর তঁার চোখে বুদ্ধিজীবীদের তত্ত্বসমূহ কোনও ‘অভিলাষের প্রকাশ’ হওয়ার বদলে কেবলই ‘কিছু বানানো কাঠামো’।৯১ এই বুর্জোয়া ও বুদ্ধিজীবীদের বিরুদ্ধে আশার বাহক হিসেবে সোরেল তৈরি করেছেন ‘শ্রমিক’-দের প্রতিমা। সোরেলের চোখে শ্রমিকরা ‘উৎপাদক’ হিসেবে ‘উৎপাদনের উন্নতিসাধনের জন্য প্রয়োজনীয় নৈতিক গুণ’ সৃষ্টি করবে, ‘শেয়ারহোল্ডারদের আড্ডা হয়ে ওঠা পার্লামেন্টগুলোকে’ ধ্বংস করবে,৯২ এবং ‘পুরোনো সভ্যতার উপর দিয়ে এক অপ্রতিরোধ্য ঢেউ বয়ে যাওয়ার’ সময়ে ‘প্রগতির প্রতিমা’-র বিরুদ্ধে ‘সর্বাত্মক অনর্থপাত’-এর প্রতিমা তুলে ধরবে।৯৩ খুব একটা নতুন নয় তঁার তুলে ধরা এমন ‘নতুন মূল্যবোধগুলো’, সেগুলো হল: মর্যাদাবোধ; খ্যাতি ও গৌরবের আকাঙ্খা বা ঘৃণা ও প্রতিশোধস্পৃহা থেকে মুক্ত সংগ্রামী মানসিকতা এবং বস্তুগত সুবিধার প্রতি উদাসীনতা। যাই হোক না কেন, সেসব গুণাবলী ‘বুর্জোয়া সমাজ’-য়ে লক্ষ্যণীয়ভাবে অনুপস্থিত।৯৪ ‘সমস্ত সংগঠিত সেনাদলে স্বাভাবিকভাবে বিকশিত হওয়া মূল্যবোধের প্রতি আবেদন জানিয়ে সামাজিক যুদ্ধ দূর করতে পারে সেই সমস্ত কু-অনুভূতিগুলোকে যাদের বিরুদ্ধে নৈতিকতা অকার্যকরী। একটিমাত্র কারণ হলেও... আমার বিবেচনায় এই কারণটিই যথেষ্ট হিংসার পক্ষাবলম্বনের জন্য।’৯৫

বিমূর্ত হিংসার গরিমাকীর্তন করতে কোন অভিপ্রায় মানুষকে চালনা করে তা নিয়ে বহু কিছু শেখা যায় সোরেল থেকে, আর আরো বেশি শেখা যায় তঁার আরো মেধাবী ইতালিয় সমসাময়িক এবং ফরাসি অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ভিলফ্রেডো পারেতো-র কাছ থেকে। এই দুজনের তুলনায় হিংসার চর্চার সঙ্গে অনেক বেশি নিবিড় যোগাযোগ ছিল ফাননের এবং ফাননের উপর সোরেলের গভীর প্রভাব ছিল। ফানন সোরেল-ব্যবহৃত বর্গগুলোকেই ব্যবহার করে গেছেন, এমনকি তখনও যখন সেসব তঁার নিজ অভিজ্ঞতার সঙ্গে খাপ খায়নি।৯৬ বিপ্লবের উপাদান হিসেবে হিংসাকে প্রাধান্য দিতে সোরেল ও পারেতোকে প্রভাবিত করেছিল যে নির্ধারক অভিজ্ঞতা তা হলো ফ্রান্সের দ্রেইফুস কাণ্ড। পারেতোর ভাষায়, সেই সময় তারা ‘অবাক হয়ে দেখেছিলেন যে (দ্রেইফুস-পন্থীরা) তাদের বিরোধীদের বিরুদ্ধে সেই দুর্বৃত্তসুলভ পদ্ধতিই প্রয়োগ করছে যার যারপরনাই নিন্দা তারা আগে করেছিল’।৯৭ সেই সন্ধিক্ষণে তারা উপলব্ধি করেছিলেন ‘প্রতিষ্ঠান’ কী (যাকে তখন ‘ব্যবস্থা’ বলা হতো)। আর এই উপলব্ধি তাদের হিংসাত্মক সক্রিয়তার বন্দনারচনায় প্রবৃত্ত করেছিল। পারেতোর ক্ষেত্রে অবশ্য শ্রমিকশ্রেণি সম্পর্কে নিরাশাও ইন্ধন যুগিয়েছিল। (পারেতোর মনে হয়েছিল যে জাতিরাষ্ট্রের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিসরে শ্রমিকদের দ্রুত অঙ্গীভূতকরণের প্রকৃত ফল দাঁড়াচ্ছে ‘বুর্জোয়া ও শ্রমিক জনগণের মধ্যে এক মৈত্রী’ যা শ্রমিকদের ‘বুর্জোয়াকরণ’ ঘটাচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে, পারেতোর মতে , এক নতুন ব্যবস্থার জন্ম হচ্ছে যাকে তিনি ‘প্লুটো-ডেমোক্রেসি’ নামে অভিহিত করেছেন। প্লুটোক্রেসি হলো বুর্জোয়া রাজ, ডেমোক্রেসি হলো শ্রমিক রাজ, আর এই দুইয়ের এক সঙ্কর মিশ্র রূপ হলো প্লুটো-ডেমোক্রেসি।) সোরেল শ্রমিকশ্রেণির উপর মার্কসীয় আস্থা ধরে রেখেছিলেন এই যুক্তিতে: শ্রমিকরা হল সমাজের একমাত্র সৃজনশীল উপাদান, অর্থাৎ, উৎপাদক; আর মার্কস অনুযায়ী মানুষের উৎপাদনীশক্তির বন্ধন মুক্ত করতে তারা বাধ্য; সমস্যা কেবল এইখানে যে কার্যক্ষেত্রে ও জীবনযাপনে একটা সন্তোষজনক স্তর অর্জন করলেই তারা আর প্রোলেতারিয়ান না থাকার ও বিপ্লবী ভূমিকা পালন না করার গোঁ ধরে।

আর একটি বিষয় সোরেল ও পারেতোর দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে অপরিসীম বিপর্যয় ঘটিয়েছিল, যদিও তা বহির্প্রকাশে পূর্ণতা লাভ করেছিল তাদের মৃত্যুর বেশ কয়েক দশক পরে। আধুনিক বিশ্বে উৎপাদনশীলতার যে বিপুল বৃদ্ধি ঘটেছে, তা কোনওভাবেই শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতা বাড়ার কারণে ঘটেনি, বরং, প্রযুক্তির বিকাশের কারণেই ঘটেছে। আর এই প্রযুক্তির বিকাশ শ্রমিকশ্রেণি বা বুর্জোয়া কারও উপর নির্ভর করেনি, নির্ভর করেছে বৈজ্ঞানিকদের উপর। সোরেল ও পারেতোর বহু ঘৃণা-অবজ্ঞার পাত্র এই বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় হঠাৎই অন্যতম প্রান্তীয় সামাজিক গোষ্ঠীর অবস্থান থেকে উঠে এসে নয়া অভিজাত উচ্চবর্গ হয়ে উঠল, তাদের কাজ কয়েক দশকের মধ্যে মানবজীবনকে এমনভাবে বদলে দিল যে তাকে আর চেনাই যায় না এবং এর মধ্য দিয়ে তারা সমাজের চলায় অপরিহার্য হয়ে উঠল। এই নয়া অভিজাত উচ্চবর্গের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়নি বা এখনও হয়নি নানা কারণে। কিন্তু ড্যানিয়েল বেল-এর মতো এমনটা মনে হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে যে ‘শেষপর্যন্ত কেবল সর্বসেরা মেধাই নয়, সামাজিক সম্মান ও সামাজিক পদের গোটা কাঠামোটাই বুদ্ধিজীবী ও বৈজ্ঞানিক সম্প্রদায়ের মধ্যে শিকড় গেড়ে দাঁড়িয়ে থাকবে’।৯৮ পুরোনো শ্রেণিকাঠামোর গোষ্ঠীদের তুলনায় এই নব উচ্চবর্গের সদস্যরা অনেক বেশি ছড়ানো-ছিটানো আর সাধারণ স্বার্থের বাঁধনও তুলনায় অনেক শিথিল, ফলত তাদের নিজেদের সংগঠিত করার তাগিদ তেমন নেই এবং ক্ষমতা সংক্রান্ত সমস্ত ব্যাপারেই অভিজ্ঞতা অনেক কম। তাছাড়া, বিপ্লবী পরম্পরা সহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক পরম্পরার বাঁধনে নিবিড়ভাবে বাঁধা থাকার কারণে অতীতের চিন্তার বর্গগুলোকে এরা আরো নাছোড়ভাবে আঁকড়ে থাকে, যা বর্তমানকে বুঝতে ও বর্তমানে নিজ ভূমিকা নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। আমাদের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সবচেয়ে বিদ্রোহীদেরও অতীত-কাতরতা দেখলে মায়া হয় যখন তারা ‘প্রকৃত’ বিপ্লবী তৎপরতার জন্য সমাজের সেইসব গোষ্ঠীদের মুখ চেয়ে থাকে যারা উপভোগী সমাজের মসৃণ চলনগতি বিঘ্নিত হওয়ার ফলে নিজেদের কিছু হারানোর ভয়ের সঙ্গে সমানুপাতেই বিপ্লবী তৎপরতার বিরুদ্ধাচারণে আরো মরীয়া হয়ে ওঠে। সমাজের প্রকৃত নতুন সম্ভাব্য বিপ্লবী শ্রেণি হয়তো বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে গড়ে উঠবে এবং এখনও অবধি অনুপলব্ধ তাদের সম্ভাব্য ক্ষমতা বিপুল, বুঝিবা মানবপ্রজাতির মঙ্গলের পক্ষে অতিরিক্ত পরিমাণে বিপুল।৯৯ মঙ্গল বা অমঙ্গল নিয়ে যুক্তিসঙ্গত এ আশা বা আশঙ্কা অবশ্য এখনও নেহাতই একটি অনুমান।

যাই হোক না কেন, এই প্রসঙ্গে সোরেলীয় সংস্করণে বার্গসন ও নিৎশে-র জীবনদর্শনের অদ্ভুত পুনরুজ্জীবন আগ্রহোদ্দীপক বিষয় বটে। আমরা দেখছি কী পরিমাণে হিংসা, জীবন ও সৃজনশীলতার এই পুরানো মিশ্রণ বর্তমান প্রজন্মের বিদ্রোহী মানসিকতার মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে। সন্দেহ নেই যে সর্বধ্বংসকারী যন্ত্র বানিয়ে পৃথিবীর সব প্রাণের ধ্বংস ডেকে আনার সম্ভাবনা অতি বাস্তব হয়ে ওঠার প্রতিক্রিয়াতেই জীবনযাপনের নিছক বহির্বাস্তবতার উপর জোর ফেলা ও তদনুযায়ী জীবনের সর্বোচ্চ গরিমাময় প্রকাশ হিসেবে রতিক্রিয়ার উপর জোর ফেলা ঘটছে। কিন্তু এই জীবনগরিমার প্রস্তাবকরা আত্মোপলব্ধির উদ্দেশ্যে যে সব চিন্তার বর্গ ব্যবহার করছেন, সেগুলো মোটেই নতুন নয়। জীবনের ‘সৃজনশীলতা’-র প্রতিমায় সমাজের উৎপাদনশীলতাকে দেখা অন্তত মার্কসের সময়কাল থেকে চলে আসছে, হিংসাকে জীবনসঞ্চারক শক্তি হিসেবে বিশ্বাস করা অন্তত নিৎশের সময়কাল থেকে চলে আসছে, আর সৃজনশীলতাকে মানুষের সর্বোচ্চ শ্রেয় হিসেবে ভাবা বার্গসনের সময় থেকে চলে আসছে।

জীববিদ্যা ছেনে হিংসার পক্ষে সমর্থন তৈরির আপাত অভিনব প্রয়াসও রাজনৈতিক চিন্তার পুরোনো পরম্পরার সবচেয়ে অনিষ্টকর উপাদানগুলোর সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত। যে প্রথাগত ধারণা ক্ষমতা ও হিংসাকে এক করে দেখে, তা মনে করে যে ক্ষমতার চরিত্র হল বিস্তারকামী। ক্ষমতার ‘অভ্যন্তরে আছে নিরন্তর বৃদ্ধির চাহিদা’ আর ‘ক্ষমতা সৃজনশীল কারণ নিরন্তর বৃদ্ধির প্রবৃত্তি তার মজ্জাগত’।১০০ জৈবিক প্রাণিজগতে যেমন যে কোনও কিছু হয় বৃদ্ধি পায় আর নয়তো ক্ষয়িত হয়ে মৃত্যুপথে যায়, ঠিক তার সঙ্গে মিলিয়েই মানবকাণ্ডের জগতে ধরে নেওয়া হয় যে ক্ষমতা কেবলমাত্র বিস্তারলাভের মধ্য দিয়েই নিজেকে ধরে রাখতে পারে, নতুবা তার সংকোচন ও মৃত্যু/বিনাশ ঘটে। ক্যাথরিন দি গ্রেট-এর পারিষদবর্গ রুশদেশে এক প্রবাদ চালু করেছিল: ‘যার বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে গেছে, তাতেই পচন ধরেছে’। বলা হতো যে স্বেচ্ছাচারী নিপীড়ন চালানোর জন্য রাজারা খুন হয়নি, খুন হয়েছে নিজ দুর্বলতার জন্য। জনগণ বধমঞ্চ বেঁধেছিল অত্যাচারীকে নৈতিক শাস্তিপ্রদানের জন্য নয়, বরং তার দুর্বলতার জৈবিক দণ্ড রূপে। তাই ‘কেবলমাত্র বাইরে থেকে দেখলেই মনে হবে’ যে বিপ্লবগুলো প্রতিষ্ঠিত ক্ষমতার বিরুদ্ধে চালিত হয়েছে, প্রকৃত বিচারে বিপ্লবের ‘ফল হল ক্ষমতাকে এক নতুন শক্তি ও ভারসাম্য প্রদান ও ক্ষমতার বিকাশের পথে দীর্ঘদিন ধরে জমে ওঠা বাধাগুলোর অপসারণ’।১০১ ফানন যখন হিংসাত্মক ক্রিয়ার মধ্যে ‘সৃজনশীল উন্মাদনা’ খুঁজে পান, তখন তিনি এই পরম্পরা ধরেই এখনও ভেবে চলেন।১০২

যে পরম্পরা রাজনৈতিক বিষয়ে জৈবিক প্রতিমা অনুসারী ভাবনায় ক্ষমতা ও হিংসাকে জীবগত অনুষঙ্গে ব্যাখ্যা করে, আমার মনে হয় তার চেয়ে বিপজ্জনক আর কিছু হতে পারে না। আজ এই পরম্পরা ধরেই হিংসার সাধারণ গুণিতক হিসাবে জীবন ও জীবনের তথাকথিত ‘সৃজনশীলতা’-কে হাজির করা হচ্ছে এবং সৃজনশীলতার দোহাই দিয়ে হিংসাকে সমর্থন করা হচ্ছে। সাম্প্রতিক নানা আলোচনা, বিশেষ করে দাঙ্গা নিয়ে আলোচনা এহেন জৈবিক প্রতিমার ব্যবহারে এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে আছে। যেমন, ‘রুগ্ন সমাজ’-এর ধারণা: দাঙ্গা এখানে রোগের লক্ষণ, ঠিক যেমন জ্বর কোনও শারীরিক রোগের লক্ষণ। এসব শেষাবধি হিংসাকেই ইন্ধন যোগায়। তাই যখন ‘আইনশৃঙ্খলা’ পুনর্প্রতিষ্ঠার উপায় নিয়ে হিংসাত্মক পথের প্রস্তাবক ও অহিংস পথের প্রস্তাবকের মধ্যে বিতর্ক হয়, তখন মনে হয় যেনবা দুই চিকিৎসক বিতর্ক করছে তাদের চিকিৎসাধীন রোগীর উপর শল্যচিকিৎসা বনাম ওষুধ দিয়ে চিকিৎসার তুলনামূলক উপযোগিতা নিয়ে। রোগীর রোগ যত গুরুতর প্রতিপন্ন হয়, শল্যচিকিৎসক ততই শেষ কথা বলার হকদার হয়। তাছাড়া, যতক্ষণ অ-রাজনৈতিক জীবগত অনুষঙ্গ ব্যবহার করে কথা চালানো হবে, হিংসার গরিমাকীর্তনকারীরা ততক্ষণই এই অনস্বীকার্য তথ্যের দোহাই দিয়ে চলবেন যে প্রকৃতির সংসারে বহমান প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় ধ্বংস ও সৃষ্টি একে অপরের পরিপূরক। এই দোহাই টেনে বলা হয় যে অস্তিত্বরক্ষার লড়াই ও হিংসায় মৃত্যু যেমন প্রাণিজগতে জীবনধারার বহমানতা রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয়, ঠিক তেমনই গোষ্ঠীগত হিংসাত্মক ক্রিয়া মানবপ্রজাতির যৌথজীবনের এক অতি স্বাভাবিক পূর্ব-প্রয়োজন। গোষ্ঠীগত হিংসাত্মক ক্রিয়ার সহজাত আকর্ষণের সঙ্গে এভাবে একপ্রকার নির্মিত স্বাভাবিকতা মিশিয়ে দেওয়া হয়।

জৈবিক প্রতিমার প্রতারক বিশ্বাসযোগ্যতায় আচ্ছন্ন হওয়ার বিপদ বিশেষ গুরুতর হয়ে ওঠে জাতি-প্রশ্নে। শ্বেতাঙ্গ বা কৃষ্ণাঙ্গ জাতিবাদ নিজস্ব সংজ্ঞার মধ্যেই হিংসাকে ধারণ করে কারণ তা অভিযুক্ত করে এমন এক প্রাকৃতিক-জৈবিক উপাত্তকে— কালো চামড়া বা সাদা চামড়া— যার বদল কোনও প্রবর্তনা বা ক্ষমতাপ্রয়োগের মধ্য দিয়েই সম্ভব নয়। একমাত্র যা কেউ করতে পারে তা হল সুযোগ বুঝে সেই চামড়ার মানুষদের ঝাড়ে-বংশে ধ্বংস করা। জাতি আর জাতিবাদ আলাদা। জাতি জীবনের একটি উপাত্ত, জাতিবাদ জীবনের উপাত্ত নয়, জাতিবাদ হলো একটি মতবাদ। জাতিবাদ-প্ররোচিত ক্রিয়া কোনও প্রতিবর্তী ক্রিয়া নয়, বরং তা হল ছদ্মবৈজ্ঞানিক তত্ত্বের উপর দাঁড় করানো উদ্দেশ্যমূলক ক্রিয়া। দুই জাতির মধ্যে সংঘর্ষে হিংসা যে হন্তারক রূপ ধারণ করে তা ‘অযৌক্তিক’ নয়, তা জাতিবাদের যৌক্তিক ও যুক্তিসঙ্গত পরিণাম। জাতিবাদ বলতে এখানে দুই পক্ষের কিছু নেহাত অস্পষ্ট বিদ্বেষভাবনার কথা আমি বলছি না, বলছি একটা সুগঠিত সুস্পষ্ট মতবাদিক কাঠামোর কথা। স্বার্থ ও মতবাদের সঙ্গে সংযুক্ত না থাকলে বিদ্বেষভাব ক্ষমতার চাপে পিছু হটতে পারে, যেমন ঘটেছে সম্পূর্ণ অহিংস ও অত্যন্ত সফল নাগরিক অধিকারের আন্দোলনে। (‘১৯৬৪-র মধ্যে... অধিকাংশ মার্কিনীদেরই বিশ্বাস জন্মেছিল যে অধীনস্থ করে রাখা অন্যায়, আর তার চেয়ে কম মাত্রায় হলেও, পৃথক করে রাখাও অন্যায়।’১০৩) কিন্তু বয়কট, ধর্ণা ও বিক্ষোভ-প্রদর্শন দক্ষিণপ্রদেশে বৈষম্যকারী আইন ও অধ্যাদেশ বাতিল করতে সফল হলেও বড় শহরের সামাজিক পরিস্থিতিতে তা সম্পূর্ণ ব্যর্থ ও অকার্যকরী বলে প্রমাণিত হয়েছিল। একদিকে কৃষ্ণাঙ্গদের বস্তি(ঘেটো)গুলোয় বিরাজ করা নিদারুণ অভাব, অন্যদিকে শ্বেতাঙ্গ নিম্নআয়সম্পন্ন গোষ্ঠীগুলোর বাসস্থান ও শিক্ষা সংক্রান্ত চাহিদার প্রবল স্বার্থ— বড় শহরকেন্দ্রগুলোর সামাজিক পরিস্থিতির এই দুটো দিক আছে। বয়কট, ধর্ণা, বিক্ষোভপ্রদর্শনের মতো কর্মসূচী এই সামাজিক পরিস্থিতিকে বে-আব্রু করে খোলা রাস্তায় এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল যেখানে এই স্বার্থগুলোর সমন্বয়-অসম্ভব মৌলিক চরিত্র বিপজ্জনকভাবে প্রকাশিত হয়ে পড়েছিল।

এতদসত্ত্বেও আজকালকার হিংসা, কৃষ্ণাঙ্গ দাঙ্গা ও শ্বেতাঙ্গদের প্রতিক্রিয়া এখনও জাতিবিদ্বেষী মতবাদের খুনে যুক্তিকাঠামোর অভিব্যক্তি হয়ে ওঠে নি। (সম্প্রতি সঠিকভাবেই বলা হয়েছে যে দাঙ্গাগুলো ‘প্রকৃত দুঃখ-কষ্ট-অভিযোগের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ বিশেষ’,১০৪ ‘বাস্তব সংযম এবং বাছবিচার করে কাজ করা বা... যুক্তিসঙ্গতি তাদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক।’১০৫ পাল্টা প্রতিক্রিয়ার ক্ষেত্রেও একথা অনেকটাই প্রযোজ্য। সমস্ত ভবিষ্যদ্বাণীকে ব্যর্থ করে এই প্রতিক্রিয়া এখনও হিংসাত্মক রূপ ধারণ করে নি। কিছু স্বার্থগোষ্ঠী যুক্তিপূর্ণভাবেই তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে যে বাজেভাবে পরিকল্পিত সংযুক্তিকরণ নীতির ফলে উৎপন্ন ভোগান্তি নীতি-প্রণেতাদের কিছুই সহ্য করতে হচ্ছে না, মূল্য চোকানোর সব দায় তাদের মতো সাধারণের ঘাড়েই চাপানো হচ্ছে।১০৬) কিন্তু বিপদ ঘনিয়ে আসছে। যেহেতু হিংসা সর্বদা নিজ যথার্থতা প্রতিপাদন করতে চায়, তাই রাস্তার হিংসা বাড়তে থাকলে তা ক্রমশ নিজ যথার্থতা প্রতিপাদন করার জন্য একটা সত্যিকারের জাতিবৈষম্যবাদী মতবাদ তৈরি করে ফেলবে। যেমন, জেমস ফরমান-এর ইস্তাহারে কৃষ্ণাঙ্গ বর্ণবৈষম্যবাদ নগ্নরূপে হাজির হয়েছে । সম্ভবত তা গত বছরকয়েকের বিশৃঙ্খল দাঙ্গাগুলোর কারণ নয়, বরং সেসবের প্রতিক্রিয়া। তা অবশ্যই একটা সত্যিকারের হিংসাত্মক শ্বেতাঙ্গ প্রতিক্রিয়া উসকে দিতে পারে, যার সবচেয়ে বড় বিপদ হবে শ্বেতাঙ্গদের পূর্বসংস্কারগুলোর পুরোদস্তুর বর্ণবৈষম্যবাদী মতবাদে রূপান্তরসাধন, যার ফলস্বরূপ ‘আইনশৃঙ্খলা’ নেহাতই এক কপট মুখোশে পর্যবসিত হবে। সেই (এখনও অবধি দূর-সম্ভাব্য) ক্ষেত্রে দেশের জনমতের আবহাওয়া এমন দুর্যোগপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে যে নাগরিকদের সিংহভাগ এক পুলিশ-রাষ্ট্রের অদৃশ্যমান সন্ত্রাসের মূল্যেও রাস্তাঘাটের আইনশৃঙ্খলা মোতায়েন করতে মত দেবে। অত্যন্ত নিষ্ঠুর ও অত্যন্ত দৃশ্যমান পুলিশের যে পাল্টা প্রতিক্রিয়া আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি, পুলিশ-রাষ্ট্রের তুলনায় তা কিছুই নয়।

স্বার্থের সংঘাতের ক্ষেত্রে যুক্তি-তর্ক-আচরণ যুক্তিসঙ্গতির রেয়াত করেনা। ‘আলোকপ্রাপ্ত স্বার্থচিন্তা’-র ধর্মবিশ্বাস— আক্ষরিক অর্থবাহী সংস্করণেই হোক বা তুলনায় তর্কচতুর মার্কসীয় সংস্করণেই হোক— অবিরত যত বাস্তবের দ্বারা অপ্রমাণিত হয়েছে, তেমনটা বোধহয় আর কোনও ক্ষেত্রে হয়নি। কিছু অভিজ্ঞতার সঙ্গে কিছু চিন্তাভাবনার যোগ বিপরীতক্রমে এই শিক্ষাই দেয় যে স্বার্থচিন্তা ও আলোকপ্রাপ্তি প্রকৃতিগতভাবেই বিপরীতগামী। এর উদাহরণ প্রাত্যহিক জীবনের ভাড়াটিয়া ও বাড়িওয়ালার আশু স্বার্থের সংঘাত থেকেও দেওয়া যায়। আলোকপ্রাপ্ত স্বার্থ একটা বাড়িকে মানব-বসবাসের উপযুক্ত করে তোলায় আগ্রহী হবে, কিন্তু বহুক্ষেত্রেই বাড়িওয়ালার উচ্চহারে মুনাফা করার স্বার্থচিন্তা ও ভাড়াটিয়ার ভাড়া কম রাখার স্বার্থচিন্তা তার সঙ্গে মিলবে না ও তার বিরুদ্ধে গিয়ে দাঁড়াবে। আলোকপ্রাপ্তির মুখপাত্র হিসেবে ধরে নেওয়া যেতে পারে যে মধ্যস্থ বিচারককে, তিনি হয়ত সাধারণ স্বার্থ বিধান করার চেষ্টা করবেন এভাবে যে দীর্ঘকালীন বিচারে বাড়িটির স্বার্থই হল বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটিয়ার প্রকৃত স্বার্থ। কিন্তু এই সাধারণ স্বার্থ বিধানের হিসাবের বাইরে থেকে যায় সময়ের প্রশ্নটি, যা সংযুক্ত সকলপক্ষের কাছেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। স্বার্থচিন্তা নিজেকে নিয়ে আগ্রহী, আর সেই ‘নিজ’ মৃত্যুলাভ করতে পারে, বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে পারে বা বাড়ি বেচে দিতেও পারে। পরিস্থিতির পরিবর্তমানতার জন্য, চূড়ান্ত বিচারে নশ্বরতা-নির্দিষ্ট মানব-অবস্থার জন্য ‘নিজ’-স্থিত আত্ম দীর্ঘমেয়াদী স্বার্থের প্রেক্ষিতে বিচার করতে অপারগ, এমন এক বিশ্বের স্বার্থ সে অনুভব করতে পারে না যে বিশ্ব অধিবাসীর লয়ের পরও বজায় থাকে। একটা বাড়ির ক্রমক্ষতি বহু বছরের ব্যাপার; ভাড়াবৃদ্ধি বা মুনাফার হারের নিম্নগতি আজ-কাল-পরশুর ব্যাপার। কিছু প্রয়োজনীয় অদলবদল করে নিলে এ ব্যাপার প্রযোজ্য হয় শ্রমিক-ম্যানেজমেন্ট সংঘাত ও অন্যান্য তুলনীয় ক্ষেত্রেও। ‘প্রকৃত’ স্বার্থের জন্য যখন নিজ-স্বার্থকে জায়গা ছেড়ে দিতে বলা হয়, নিজ স্বার্থের থেকে আলাদা বিশ্ব স্বার্থের কথা বলা হয়, নিজ স্বার্থ তখন উত্তর দেয়: ‘জামা কাছের, কিন্তু চামড়া তো আরো কাছের’। এ হল মানুষের ব্যক্তিগত জীবনের সম্ভাব্য অস্তিত্বকাল ও বারোয়ারি জগতের সম্ভাব্য অস্তিত্বকালের মধ্যে অসঙ্গতির প্রতিফল— যুক্তিসঙ্গত না হলেও তা বাস্তবসম্মত তো বটেই, উন্নতচেতা না হলেও পর্যাপ্ত তো বটেই। জনগণের বারোয়ারি পরিসর নিয়ে তিলমাত্র ধারণা যার নেই, সে অহিংস আচরণ করবে ও স্বার্থের ব্যাপারে যুক্তিসঙ্গত তর্ক-বিচার করবে, এমনটা ভাবা বাস্তবোচিত নয়, যুক্তিসঙ্গতও নয়।

——————

হিংসা যেহেতু প্রকৃতিগতভাবে একটি উপায়, তাই তা সে মাত্রাতেই যৌক্তিক, যে মাত্রায় তা তার যথার্থতা উৎপাদনকারী লক্ষ্যে পৌঁছতে কার্যকরী। আর স্বতক্রিয়ার ক্ষেত্রে ক্রিয়ার চূড়ান্ত ফল সম্পর্কে আগে থেকে কোনও নিশ্চয়তাই সম্ভব নয়। তাই হিংসা একমাত্র তখনই যৌক্তিক হতে পারে যখন তা স্বল্পমেয়াদী লক্ষ্য দ্বারা পরিচালিত হয়। ইতিহাসরচনা, বিপ্লব, প্রগতি বা প্রতিক্রিয়া— এমন কোনও মহৎ উদ্দেশ্যসাধনই হিংসার দ্বারা সম্ভব নয়, হিংসা কেবল ক্ষোভকে নাটকীয় রূপ দিয়ে জনগণের মনোযোগ আকর্ষণ করে নিতে পারে। ‘থিয়েটার অফ আইডিয়াজ’-য়ে হিংসার ন্যায়পরতা নিয়ে বিতর্কে কোনর ত্রু্নস ওব্রায়েন আঠারো শতকের কৃষকসমাজের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকারী উইলিয়াম ওব্রায়েনকে উদ্ধৃত করে যেমন বলেছিলেন: কখনও কখনও ‘সংযমের কথা কানে ঢোকানোর জন্যই হিংসা একমাত্র উপায় হয়ে দাঁড়ায়’। সম্ভাব্যকে অর্জন করার জন্য অসম্ভবের দাবি তোলা সবসময় ক্ষতিকারক নয়। হিংসার প্রবর্তকপুরুষরা যা-ই বলুক না কেন, হিংসা যত না বিপ্লবের হাতিয়ার, তার চেয়ে অনেক বেশি সংস্কারের হাতিয়ার। ফ্রান্সের আদ্যিকালের শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কারের নেপোলিয়ন-পরবর্তী যুগের সবচেয়ে পরিবর্তনকামী আইন ভূমিষ্ঠই হতো না ছাত্রছাত্রীরা দাঙ্গা না করলে; কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়েও সংস্কার প্রবর্তনের কথা কেউ ভাবত না যদি না বসন্তে দাঙ্গা ঘটত;১০৭ আর এও অনস্বীকার্য যে পশ্চিম জার্মানিতে ‘বিরুদ্ধমতধারী সংখ্যালঘিষ্ঠদের অস্তিত্বই স্বীকার করা হয় না যতক্ষণ না তারা হিংসা উসকে দিচ্ছে’।১০৮ সন্দেহ নেই যে ‘হিংসা ফল দেয়’, কিন্তু সমস্যা হল যে সে ফলের কোনও ঠিকঠিকানা নেই— তা আত্মার পাঠ প্রবর্তন ও সোয়াহিলি ভাষায় পাঠদান হতে পারে আবার প্রকৃত সংস্কারও হতে পারে। হিংসা ও বিভেদের কৌশল যেহেতু কেবল স্বল্পমেয়াদী লক্ষ্যের নিরিখেই অর্থপূর্ণ, তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোর মতোই বেশি সম্ভবপর হল প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের দ্বারা অর্থহীন ও ক্ষতিকর দাবিসমূহ মেনে নেওয়া (যেমন, প্রয়োজনীয় যোগ্যতা ছাড়াই ছাত্রভর্তি, অস্তিত্বহীন বিষয়ে পাঠদানের ব্যবস্থা, ইত্যাদি), যদি সেসব ‘সংস্কার’ লাগু করা তুলনামূলক সহজ হয়। এই স্বল্পমেয়াদী সংস্কারের সম্ভবপরতা যত, কাঠামোগত পরিবর্তনের তুলনামূলক দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্যপূরণের সম্ভবপরতা মোটেই তত নয়।১০৯ তাছাড়া, হিংসা সচেতনভাবে স্বল্পমেয়াদী লক্ষ্যপূরণের এক অ-চরমপন্থী কাঠামোয় সীমাবদ্ধ থাকলেও, তার বিপদ থেকেই যায়। লক্ষ্যকে ছাপিয়ে উপায়ের সর্বময় হয়ে ওঠা হল সেই বিপদ। লক্ষ্য দ্রুত অর্জিত না হলে, পরাজয়ই একমাত্র ফল হয় না, তার সঙ্গে সঙ্গে গোটা রাষ্ট্রব্যবস্থায় হিংসাচর্চার অনুপ্রবেশ ঘটে। স্বতক্রিয়াকে উল্টে ফিরিয়ে নেওয়া যায় না আর পরাজয়ের পর পরাজয়-পূর্ব অবস্থায় ফেরা তো সবসময়েই দুঃসাধ্য। সমস্ত স্বতক্রিয়ার মতো হিংসার চর্চা রূপী স্বতক্রিয়াও পৃথিবীকে বদলে দেয়, কিন্তু সে বদল মন্দের দিকে, পৃথিবীকে আরো হিংসাজর্জর করে তোলার দিকে সে বদল।

সবশেষে সোরেল ও পারেতোর ‘যথাবিহিত ব্যবস্থার নিন্দা’ প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক। বারোয়ারি জীবনের পরিসরের যত আমলাতান্ত্রিক সংস্থাকরণ হবে, হিংসার আকর্ষণও তত বাড়তে থাকবে। চূড়ান্ত বিকশিত একটি আমলাতান্ত্রিক সংস্থাকৃত ব্যবস্থায় এমন কেউ অবশিষ্ট থাকে না যার সঙ্গে তর্ক করা যায়, যার কাছে ক্ষোভ জানানো যায়, যার উপর জনক্ষমতার চাপ দেওয়া যায়। বিশেষ কোনও ব্যক্তি দ্বারা পরিচালিত না হলেই কোনও শাসন শাসনহীনতা হয়ে যায় না; সবাই যেখানে সমানভাবে ক্ষমতাহীন, কোনও স্বেচ্ছাচারী উৎপীড়কের অনুপস্থিতিতেই সেখানে স্বেচ্ছাচারী উৎপীড়ন কায়েম হয়— তাই আমলাতান্ত্রিক সংস্থাকরণ এমন একটি শাসনরূপ যেখানে প্রত্যেকের রাজনৈতিক স্বাধীনতা ধ্বংস হয়েছে, প্রত্যেকের স্বতক্রিয়ার শক্তি ধ্বংস হয়েছে। বিশ্বজুড়ে ছাত্রবিদ্রোহগুলোর গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল এই যে সর্বত্রই তা শাসনকারী আমলাতন্ত্রকে তার নিশানা করেছে। এর থেকেই ব্যাখ্যা পাওয়া যায় আপাতদৃষ্টিতে অস্বস্তিকর এই অসঙ্গতির যে পূর্ব জার্মানির বিদ্রোহ কথা বলার স্বাধীনতা ও ভাবনার স্বাধীনতার সেই অধিকারগুলোর জন্যই লড়ছে, পশ্চিম জার্মানির তরুণ বিদ্রোহীরা যেগুলোকে ঘৃণাভরে অপ্রাসঙ্গিক বলে ঘোষণা করেছে। মতবাদের স্তরে বিচার করতে গেলে সবকিছু গুলিয়ে যেতে বাধ্য। কিন্তু সে বিহ্বলতা এড়ানো সম্ভব যদি আমরা এই সুস্পষ্ট ঘটনার স্তর থেকে শুরু করি যে সর্বত্র, এমনকি যেখানে এখনও ভাবনার ও কথা বলার স্বাধীনতা অটুট আছে সেখানেও, বিশাল পার্টি-যন্ত্রগুলো সফল হয়েছে নাগরিকদের স্বরকে নাকচ করে দিতে। পুবের বিদ্রোহীরা রাজনৈতিক স্বতক্রিয়ার জন্য প্রাথমিক প্রয়োজন হিসেবে ভাবনা ও কথা বলার স্বাধীনতা আদায় করতে চাইছে। পশ্চিমের বিদ্রোহীরা এমন পরিস্থিতিতে আছে যেখানে এই প্রাথমিক প্রয়োজন মেটাই স্বতক্রিয়ার পথ খুলে দিতে পারছে না, স্বাধীনতার অর্থপূর্ণ চর্চার ক্ষেত্র তৈরি করতে পারছে না। তাদের কাছে তাহলে কী প্রয়োজনীয় বলে মনে হচ্ছে? জেনস লিটেন নামক এক জার্মান ছাত্র এই প্রয়োজনকে যথাযথভাবে প্রকাশ করেছে ‘praxisentzug’ অর্থাৎ ‘অভ্যাস-প্রত্যাহার’ কথাটার মধ্য দিয়ে।১১০ গোটা আধুনিক যুগ ধরে এক দীর্ঘ জটিল ইতিহাস-পরিক্রমার মধ্য দিয়ে শাসনব্যবস্থা পরিণত হয়েছে প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানে, প্রজাতন্ত্র পরিণত হয়েছে আমলাতান্ত্রিক সংস্থাকরণে এবং তার ফলস্বরূপ বারোয়ারি পরিসরের অত্যন্ত অমঙ্গলজনক সংকোচন ঘটে গেছে। গত একশ বছরে এই প্রক্রিয়া অসামান্য দ্রুতি অর্জন করেছে পার্টি-আমলাতন্ত্রের উত্থানের মধ্য দিয়ে। (সত্তর বছর আগে পারেতো চিহ্নিত করেছিলেন: ‘স্বাধীনতা... যা বলতে আমি ক্রিয়ার পারঙ্গমতাকে বোঝাচ্ছি, একমাত্র দুর্বৃত্তদের ছাড়া আর সবার জন্য তা প্রতিদিন সংকুচিত হতে হতে চলেছে তথাকথিত মুক্ত গণতান্ত্রিক দেশগুলোয়’।)১১১ স্বতক্রিয়ার বৃত্তিই মানুষকে রাজনৈতিক জীব করে তোলে। এই বৃত্তিই মানুষের পক্ষে সম্ভবপর করে তোলে সমগোত্রীয়দের সঙ্গে সমবেত হওয়া, একযোগে কাজ করা ও এমন উদ্যোগ/ উদ্দেশ্যসাধনের অংশ হওয়া যা হয়ত নিজে থেকে তার মনে কখনো আসত না, হৃদয়বাসনা জাগত না, যদি না নতুন কিছুতে প্রবৃত্ত হওয়ার গুণ উপহার হিসেবে তার অধিকারে না থাকত। দার্শনিকভাবে বললে, স্বতক্রিয়া হলো সদাজায়মান-অবস্থার মানবিক প্রকাশ। আমরা প্রত্যেকে জন্মের কল্যাণে পৃথিবীতে প্রবেশ করি নতুন সূচনা রূপে, তাই আমাদের পক্ষে নতুন কিছু শুরু করা সম্ভব। জন্মগ্রহণের ঘটনা ব্যতিরেকে আমাদের পক্ষে নতুনকে জানা সম্ভব হতো না, স্বতক্রিয়া নেহাত আচরণ বা সংরক্ষণ-এর গণ্ডিতে আটকে থাকত। ভাষা ছাড়া এহেন আর কোনও বৃত্তি নেই যা অন্যান্য প্রাণীপ্রজাতিদের থেকে মানুষের এমন আমূল স্বাতন্ত্র্য রচনা করে দেয়। যুক্তি বা সচেতনতাও এমন স্বাতন্ত্র্য রচনা করে না। স্বতক্রিয়া ও নতুন কিছুর শুরু একই নয়, তবে তারা পরস্পর নিবিড় সম্পর্কে বাঁধা।

জৈবিকপ্রক্রিয়ার মধ্য থেকে চয়ন করা কোনো রূপক দিয়ে সৃজনশীলতার কোনো ধর্ম পর্যাপ্তভাবে প্রকাশ করা যায় না। মৃত্যু যে মাত্রায় বিনাশ ধারণ করে, জন্মগ্রহণ বা জন্মদান সে মাত্রাতেই নব সৃজন ধারণ করে— যে চিরপুনরাবর্তক ঘূর্ণনের মধ্যে যেনবা হতবাক বিস্ময়ে সমস্ত সপ্রাণ বস্তু আবদ্ধ, তারই দুটি পৃথক পর্যায় মৃত্যু ও জন্ম। হিংসা বা ক্ষমতা কোনও প্রাকৃতিক প্রতীত বিষয় নয়, অর্থাৎ, জৈবিকপ্রক্রিয়ার কোনও অভিব্যক্তি নয়। হিংসা ও ক্ষমতা মানব বিষয়াদির মধ্যে রাজনৈতিক পরিসরের অন্তর্ভুক্ত। এই রাজনৈতিক পরিসরের নির্ধারক মানবিক গুণের নিশ্চিতি তৈরি হয় মানুষের স্বতক্রিয়ার বৃত্তি ও নতুন সূচনা করার সক্ষমতার মধ্য দিয়ে। আর আধুনিক যুগের প্রগতি এই মানবিক বৃত্তিরই সবথেকে বেশি ক্ষতি করেছে। আমাদের তৈরি হওয়া বোঝাবুঝি অনুযায়ী প্রগতির মানে হল বৃদ্ধি, অর্থাৎ, বেশি থেকে আরো বেশি, বড় থেকে আরো বড়-র দিকে বিরামহীন যাত্রা। একটা দেশ জনসংখ্যায় ও বস্তুসম্পত্তিতে যত বড় হয়ে উঠবে, ততই বাড়তে থাকবে প্রশাসনের প্রয়োজনীয়তা এবং সেই সঙ্গেই বাড়তে থাকবে প্রশাসকদের বেনামী ক্ষমতা। চেকোশ্লোভাকিয়ায় স্বাধীনতা নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষার তুঙ্গমুহূর্তের দিনগুলোয় চেক লেখক পাভেল কোহুট তার লেখায় একজন ‘মুক্ত নাগরিক’-এর সংজ্ঞা দিয়েছিলেন ‘সহশাসক নাগরিক’ হিসেবে। সাম্প্রতিককালে পশ্চিমী দেশগুলোয় ‘অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র’ নিয়ে বহু আলোচনা হয়েছে, সেই ‘অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র’-র চেয়ে বেশি বা কম কিছু কোহুট বলেননি। অবশ্য কোহুট যোগ করেছিলেন যে আজকের বিশ্বে সবচেয়ে জরুরী হয়ে উঠেছে এক ‘নতুন উদাহরণ স্থাপন’ যা পৃথিবীটাকে তার গড়িয়ে চলার পথ থেকে নতুন দিকে বাঁকাবে। কী সেই গড়িয়ে চলার পথ? ‘পরবর্তী হাজার বছর হয়ে উঠতে পারে অতি-সুসভ্য বাঁদরদের যুগ’ বা ‘মুরগি/ইঁদুরে পরিণত মানুষদের’ যুগ; তাদের ‘অভিজাত’ শাসকের ক্ষমতার উৎস হবে ‘বুদ্ধিজীবী সহযোগীদের বুদ্ধিদীপ্ত পরামর্শ’, যারা সত্যিসত্যিই মনে করে যে ‘থিঙ্ক ট্যাঙ্কের সদস্যরাই চিন্তাবিদ আর যন্ত্রগণক ভাবতে সক্ষম’ এবং ‘পরামর্শদাতারা অবিশ্বাস্যভাবে বিশ্বাসের অমর্যাদা করে মানবিক লক্ষ্য ধাবন করার পরিবর্তে যন্ত্রমগজে অভাবিতরূপে রূপান্তরিত হয়ে আসা সম্পূর্ণ বিমূর্ত সমস্যাবলী নিয়ে মশগুল থাকবে’।১১২

হিংসার সাম্প্রতিক গরিমাকীর্তনের অধিকাংশই আধুনিক বিশ্বে স্বতক্রিয়ার প্রবৃত্তির পুঞ্জীভূত নৈরাশ্যের প্রতিক্রিয়া হলেও হিংসার দ্বারা এই নতুন উদাহরণ সৃষ্টি করা সম্ভব নয়। এ কথা সত্য যে কৃষ্ণাঙ্গ বস্তিএলাকার দাঙ্গায় বা বিদ্যাঙ্গনের বিদ্রোহে ‘অংশগ্রহণকারীদের মনে হয় যেনবা একসঙ্গে কিছু করার দুর্লভ অভিজ্ঞতা হচ্ছে।’১১৩ জানি না এ ঘটনাগুলো নতুন কিছুর— নতুন উদাহরণের— সূচনা নাকি বিলুপ্ত হতে বসা মানববৃত্তির মৃত্যুযন্ত্রণার প্রকোপ! বর্তমান ‘সুপারপাওয়ার’-রা নিজ নিজ বৃহত্তের দানবীয় ভারে যেভাবে ন্যুব্জ ভারাক্রান্ত হয়ে আছে, তাতে মনে হয় যে ‘নতুন উদাহরণ’-এর প্রতিষ্ঠা হতে হলে হবে কোনও ছোট দেশে বা ‘সুপারপাওয়ার’-গুলোর গণসমাজের কোনও ছোট সুসংজ্ঞাত শাখা অংশে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে এক ভাঙনপ্রক্রিয়া— গণপরিষেবা, বিদ্যালয়, পুলিশ, ডাক সরবরাহ, জঞ্জাল সংগ্রহ, পরিবহণ ইত্যাদির ক্রমক্ষয়; শহরগুলোয় যাননিয়ন্ত্রণের সমস্যা ও পথদুর্ঘটনায় মৃত্যুর লাফিয়ে বাড়তে থাকা হার; বায়ু ও জলের দূষণ— এ সবই গণসমাজের চাহিদার অনিয়ন্ত্রিত আকার নেওয়ার প্রত্যক্ষ ফল। এই ভাঙনপ্রক্রিয়ায় দ্রুতি সঞ্চার করছে আর একটি সহগামী প্রক্রিয়া, যা হল বিভিন্ন পার্টি-ব্যবস্থার যুগপৎ অবনমন। এই পার্টি-ব্যবস্থাগুলোর সবকটারই কমবেশি সাম্প্রতিককালে উৎপত্তি হয়েছে পশ্চিমের জাতিরাষ্ট্রগুলোর বৃহৎ জনসংখ্যার রাজনৈতিক চাহিদা পূরণের জন্য। ‘সবার স্থান সংকুলান হবে ঘরে এমন জায়গা নেই’ (জন সেলডেন) যুক্তিতে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র সম্ভবপর নয় সাব্যস্ত করে এই পার্টি-ব্যবস্থাগুলোর লক্ষ্য প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার চালানো। অন্যদিকে, পুবের দেশগুলোয় এই পার্টি-ব্যবস্থার উদ্ভব হয়েছে বিস্তৃত অঞ্চলের উপর প্রশ্নহীন স্বেচ্ছাচারী শাসন-নিয়ন্ত্রণকে কার্যকরীভাবে লাগু করার মধ্য দিয়ে। বৃহদাকার বয়ে আনে নিরাপত্তা নিয়ে দুশ্চিন্তা। ছোট দেশগুলো ছাড়া আর সর্বত্রই ক্ষমতার কাঠামোতে ফাটল ধরছে ও সে ফাটল ক্রমশ আরো চওড়া হচ্ছে। ভাঙনের সূত্রপাত নিশ্চিতভাবে চিহ্নিত করা সম্ভব না হলেও এখন স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে ও পরিমাপও করা যাচ্ছে কীভাবে আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোর শক্তি ও স্থিতিস্থাপকতা বিশ্বাসহন্তারকভাবে ক্ষয় পাচ্ছে, ছিদ্রসংকুল হয়ে উঠছে ও সেসব ছিদ্র দিয়ে ক্ষয়িত অংশ ঝরে পড়ছে।

তাছাড়া, সাম্প্রতিককালে কৌতূহলপ্রদ এক নতুন ঘরানার জাতীয়তাবাদের উত্থান হয়েছে যাকে সাধারণত একটি ডানপন্থী ঝোঁক হিসাবে দেখা হয়, কিন্তু যা সম্ভবত তার থেকে বেশি ‘বৃহদাকার’-এর বিরুদ্ধে বিশ্বজুড়ে ক্রমবর্ধমান রাগ ও বিরক্তির অভিব্যক্তি। পূর্বতন সময়ে জাতীয়তাবাদ একীভূত সমগ্র হিসাবে ‘জাতি/জাতিরাষ্ট্র’-র উপর রাজনৈতিক ভাবাবেগের ভরকেন্দ্র স্থাপন করে বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর ঐক্যসাধন করতে চাইত। এখন দেখছি নৃগোষ্ঠীগত পরিচয়ের উপর ভিত্তি করা জাতীয়তাবাদ সবচেয়ে পুরানো ও সবচেয়ে সুপ্রতিষ্ঠিত জাতিরাষ্ট্রগুলোকেও ভিতর থেকে ভেঙে দেওয়ার উপক্রম করেছে। স্কট এবং ওয়েলশ, ব্রেটন ও প্রভেনকাল— যেসব নৃগোষ্ঠীর সফল পরিশোষণ ছিল জাতিরাষ্ট্রের উত্থানের অবিসংবাদিত পূর্বশর্ত, আজ বিচ্ছিন্নতাবাদের দিকে ঝুঁকে তারা লন্ডন ও পারি-র কেন্দ্রীভূত সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করছে। এমনই এক সময়ে, ‘বৃহদাকার’-এর ভারে কেন্দ্রীভূতকরণ যখন নিজ নিরিখেই অনিষ্টকর হয়ে উঠেছে, তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অন্ধের মতো ঝঁাপ দিচ্ছে প্রশাসনের কেন্দ্রীভূতকরণের দিকেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একদা যুক্তরাষ্ট্রীয় নীতির উপর ক্ষমতার বিভাজনের ভিত্তিতে গঠিত হয়েছিল এবং এই বিভাজনকে মর্যাদা দিয়েই শক্তিসঞ্চয় করেছিল। আজ সমস্ত ‘প্রগতিশীল’ শক্তির বিপুল হর্ষধ্বনি ও উৎসাহদানের মধ্য দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘কেন্দ্রীভূত প্রশাসন’ গড়ে তোলার নতুন পরীক্ষানিরীক্ষায় ঝঁাপ দিয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার জোর খাটিয়ে রাজ্য সরকারগুলোকে খর্বিত করছে আর কেন্দ্রীয় নির্বাহিক ক্ষমতা আইনসভার (কংগ্রেশনাল) ক্ষমতাকে খর্বিত করছে।১১৪ এই সফলতম ইউরোপিয় উপনিবেশটি মনে হয় তার পূর্বেকার ইউরোপিয় প্রভু-দেশগুলোর পতনভাগ্যের অংশীদার হতে শশব্যস্ত হয়ে উঠেছে, তার আদি সংবিধানপ্রণেতারা যে ভুলগুলো সংশোধন করতে চেয়েছিল সেই ভুলগুলো পুনরাবৃত্তি করার তাড়াহুড়ো লেগেছে।

কেন্দ্রীভূতকরণের প্রশাসনিক সুবিধা বা অসুবিধা যাই হোক না কেন, তার রাজনৈতিক ফলশ্রুতি সর্বদা এক: ক্ষমতার একচেটিয়াকরণের মধ্য দিয়ে ক্ষমতার সমস্ত উৎসের শুকিয়ে পাথর হয়ে যাওয়া। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একদা ক্ষমতার মহৎ বহুত্বের ভিত্তি এবং পারস্পরিক নজরদারি ও ভারসাম্যরক্ষার ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আজ সেখানে ক্ষমতার কাঠামোগুলো ভেঙে পড়ছে, আর শুধু তাই নয়, আপাতভাবে অক্ষত ও মুক্তপ্রকাশক্ষম ক্ষমতা তার প্রভাব ও কার্যকারিতা হারাচ্ছে। ক্ষমতার ক্ষমতাহীনতার কথা বলা আজ আর কোনও সরস কূটাভ্যাস নয়। ১৯৬৮-তে সেনেট-সদস্য ইউজিন ম্যাককার্থির ‘কাঠামোপরীক্ষা’-গত ধর্মযুদ্ধ সাম্রাজ্যবাদী অভিযানের বিরুদ্ধে জনরোষের আগল খুলে দিয়েছিল, সেনেট-এ বিরোধিতা ও খোলা রাস্তায় বিরোধিতার মধ্যে যোগসূত্র তৈরি হয়েছিল, অন্তত সাময়িক নীতির পরিবর্তন ঘটাতে তা বাধ্য করেছিল এবং দেখিয়ে দিয়েছিল যে কী দ্রুততায় তরুণ বিদ্রোহীদের সিংহভাগ কাঠামোর সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা কাটিয়ে উঠতে পারে, কাঠামোকে ধ্বংস করার বদলে কীভাবে প্রথম সুযোগেই কাঠামোকে আবার কার্যকরী করার কাজে ঝঁাপিয়ে পড়তে পারে। তারপরও, সেই ক্ষমতাকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিতে পারে পার্টি-আমলাতন্ত্র, যে পার্টি-আমলাতন্ত্র সমস্ত পরম্পরার বিরুদ্ধে গিয়ে জনগণের অপ্রিয় আমলাতান্ত্রিক সংস্থাকরণের এক কুশীলবকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী করার জন্য নির্বাচনে পরাজয়ও শ্রেয় মনে করে। (রিপাবলিক পার্টির কনভেনশনে প্রার্থী মনোনয়নের নির্বাচনে নিক্সনের কাছে রকফেলারের হার তুলনীয়।)

ক্ষমতার অক্ষমতার সহজাত দ্বন্দ্বগুলো আরো বহু উদাহরণ থেকে দেখানো যায়। আধুনিক বিজ্ঞানে যা সম্ভবত আমেরিকার সবচেয়ে লক্ষ্যণীয় অবদান, সেই দলগত বিজ্ঞানগবেষণার কাজের বিপুল কার্যকারিতা দিয়ে জটিলতম প্রক্রিয়াকে নিখুঁতভাবে নিয়ন্ত্রণ করে আমরা চন্দ্রাভিযানকে সপ্তাহশেষের ভ্রমণের চেয়েও নিরাপদ করে তুলতে পারি, অথচ পৃথিবীর তথাকথিত ‘বৃহত্তম’ শক্তিটি একটা যুদ্ধে ইতি টানতে অসহায়ভাবে ক্ষমতাহীন, পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম একটা দেশে সংঘটিত সেই যুদ্ধ সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের জন্যই তর্কাতীতভাবে অমঙ্গলজনক হলেও। আমরা বুঝিবা এমন এক অলীক জাদুর মায়াবন্ধনে বাঁধা পড়েছি যা ‘অসম্ভব’-কে করার শক্তি যুগিয়েছে ‘সম্ভব’-কে করার ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে, অভাবিত অসাধারণ কীর্তিস্থাপনে বলীয়ান করেছে প্রাত্যহিক সাধারণ প্রয়োজনগুলো মেটানোর শক্তি কেড়ে নিয়ে। কেবলমাত্র ‘আমরা করতে পারি’-র সঙ্গে যুক্ত হওয়ার বদলে ক্ষমতা যদি ‘আমরা করতে চাই’ ও ‘আমরা করতে পারি’ এই উভয়ের সঙ্গেই যুক্ত না হয়, তাহলে অস্বীকার করার উপায় থাকে না যে আমাদের ক্ষমতা ক্ষমতাহীন হয়ে গেছে। বিজ্ঞানের ঘটানো অগ্রগতির সঙ্গে ‘আমি করতে চাই’-এর কোনও যোগ নেই। বিজ্ঞান নিজের অনমনীয় নিয়মাবলী অনুসরণ করে, তা অনুযায়ী যা করতে পারি তা করতে বাধ্য করে ফলশ্রুতির বিচার নিরপেক্ষভাবে। ‘আমরা করতে চাই’ ও ‘আমরা করতে পারি’ কি পরস্পরের সঙ্গ ত্যাগ করেছে চিরতরে? পঞ্চাশ বছর আগে ভালেরি কি যথার্থই বলেছিলেন: ‘on peut dire que tout ce que nous savons, c’est-a-dire tout ce que nous pouvons, a fini par s’opposer a ce que nous sommes’ (বলা যায় যে কিছুই আমরা জানি না, অর্থাৎ, যা কিছু করতে আমরা সক্ষম তা চূড়ান্তভাবেই আমাদের অস্তিত্বরূপের বিরোধিতা করছে)?

আমরা জানি না এর মধ্য দিয়ে কোথায় আমরা পৌঁছব। কিন্তু আমরা জানি, বা, আমাদের জানা উচিত যে ক্ষমতার প্রতিটি হ্রাস হিংসাকে খোলাখুলি আহ্বান জানায়, কেবলমাত্র যদি এই কারণেও হয় যে আঙুলের ফাঁক গলে ক্ষমতার চুঁইয়ে পড়ে যাওয়া দেখলে, শাসকই হোক বা শাসিতই হোক, অপসৃয়মান ক্ষমতাকে হিংসা দিয়ে প্রতিস্থাপিত করার লোভ সহজে এড়াতে পারে না।

 

 

টীকা

১। নিজেল ক্যালডার, আনলেস পিস কাম্স (১৯৬৮, নিউ ইয়র্ক) বইয়ের ১০৯ পৃষ্ঠায়: হার্ভে হুইলার, দি স্ট্র্যাটেজিক ক্যালকুলেটরস।

২। এঙ্গেলস, Herr Eugen Duhrings Umwalzung der Wissenschaft (১৯৭৮), দ্বিতীয় খণ্ড, তৃতীয় অধ্যায়।

৩। জেনেরাল আঁদ্রে ব্যিউফ্রে যেমন ‘ব্যাটেলফিল্ডস অফ দি নাইন্টিন এইট্টিজ'-য়ে বলেছেন: ‘আণবিক যুদ্ধাস্ত্র প্রশমনের আওতার বাইরেই’ কেবল আজ যুদ্ধ হতে পারে; প্রথাগত যুদ্ধবিগ্রহের বিভীষিকাকে কোনও অংশে খাটো না করেও বলা যায় যে ইতিমধ্যেই এই প্রথাগত যুদ্ধের মধ্যেও পারমাণবিক যুদ্ধের স্তরে চড়ে যাওয়ার আশঙ্কা সেঁধিয়ে গেছে। (১-য়ে উদ্ধৃত ক্যালডার-এর বই, ৩ পৃষ্ঠা)

৪। র‍্যান্ড করপোরেশন ও অন্যান্য থিঙ্কট্যাঙ্ক-দের বিচারপ্রক্রিয়ার উপর লেখা প্রহসন, ‘রিপোর্ট ফ্রম দি আয়রন মাউন্টেনস’ বিবিধ ‘গুরুগম্ভীর’ বিচার-বিশ্লেষণের তুলনায় তার ‘শান্তির খাদে ভীতু উঁকি’-র জন্য বাস্তবের অনেক কাছাকাছি। তার প্রধান সওয়াল হল এই: আমাদের সমাজের চলনপ্রক্রিয়ায় যুদ্ধ এতই আবশ্যকীয় যে আমাদের সমস্যাবলী মোকাবিলায় তার থেকেও খুনে কোনও উপায় আবিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধকে বিলোপ করার সাহস আমাদের নেই। এ সওয়াল একমাত্র তাদেরই অবাক করতে পারে যারা ইতিমধ্যেই ভুলে যেতে সমর্থ হয়েছে কী পরিমাণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ মহামন্দা-জাত বেকারত্বের সংকট সমাধান করেছিল, বা যারা সুবিধা বুঝে এড়িয়ে যেতে চায় বা তর্ক করে আড়াল করতে চায় কী পরিমাণ গুপ্ত বেকারত্ব চাপা দেওয়া আছে বিভিন্ন ধরনের পালকের তোষকের তলায়।

৫। নোয়াম চমস্কি, আমেরিকান পাওয়ার অ্যান্ড দি নিউ ম্যান্ডারিনস (১৯৬৯), নিউ ইয়র্ক। ১৯৬৮-র ১৭-ই ফেব্রুয়ারির ‘দি নিউ ইয়র্কার’ পত্রিকায় প্রকাশিত থমাস সি সিলিঙ-এর ‘আর্মস অ্যান্ড ইনফ্লুয়েন্স’ পুস্তকের রিচার্ড এন গুডউইন কৃত পর্যালোচনা।

৬। যুদ্ধ ও যুদ্ধশাস্ত্র নিয়ে অবশ্য বিপুল পরিমাণ সাহিত্য আছে, কিন্তু তা হিংসার উপকরণ নিয়েই আলোচনা করে, হিংসাকে নিয়ে নয়।

৭। এঙ্গেলস, প্রাগুক্ত, দ্বিতীয় খণ্ড, চতুর্থ অধ্যায়।

৮। হুইলার, প্রাগুক্ত, ১০৭ পৃষ্ঠা; এঙ্গেলস, প্রাগুক্ত।

৯। আন্দ্রেই ভি সাখারভ, প্রগ্রেস কো-এগজিসটেন্স অ্যান্ড ইনটেলেকচুয়াল ফ্রিডম, নিউ ইয়র্ক, ১৯৬৮, ৩৬ পৃষ্ঠা।

১০। হুইলার, প্রাগুক্ত।

১১। নিজেল ক্যালডার, প্রাগুক্ত, ২৩৯ পৃষ্ঠা: দি নিউ ওয়েপনস।

১২। নিজেল ক্যালডার, প্রাগুক্ত, ১৬৯ পৃষ্ঠা: এম ডবলু থ্রিঙ, রোবটস অন দি মার্চ।

১৩। নিজেল ক্যালডার, প্রাগুক্ত, ২৯ পৃষ্ঠা: ভ্লাদিমির দেদিজের, দি পুওর ম্যানস পাওয়ার।

১৪। প্রথমদিকের এঙ্গেলসের এই উক্তি ১৮৪৭-য়ে লেখা একটি পাণ্ডুলিপিতে পাওয়া যায়। এইটি আমার নজরে আনার জন্য আমি জেকব ব্যারিয়নের কাছে কৃতজ্ঞ: জেকব ব্যারিয়ন, হেগেল উণ্ড ডাই মার্ক্সিসটিস্চে স্ট্যাটস্লেহরে, বন, ১৯৬৩।

১৫। তাৎপর্যপূর্ণভাবে হেগেল এই পরিপ্রেক্ষিতে ‘sichselbstproduzieren’-এর কথা বলেছেন। দ্রষ্টব্য: Vorlesungen uber die Geschichte der Philosophie, হফমেইস্টের কর্তৃক সম্পাদিত, লিপজিগ, ১৯৩৮, ১১৪ পৃষ্ঠা।

১৬। মার্কস ও এঙ্গেলস-এর ‘জার্মান ইডিওলজি’ (১৮৪৬) গ্রন্থের ফয়েরবাখের উপর অংশের এই অনুচ্ছেদটি ইংলন্ডের হাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বি সি পারেখ আমার নজরে এনেছেন, যা সম্পর্কে এঙ্গেলস নিজে পরবর্তীকালে লিখেছিলেন: ‘শেষ করা অংশ... এটাই প্রমাণ করে যে সেই সময় অর্থনৈতিক ইতিহাস সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান কত অসম্পূর্ণ ছিল’। অনুচ্ছেদটি এইরকম: ‘কম্যুনিস্ট সচেতনতা গণহারে উৎপাদনের জন্য... গণহারে মানুষের পরিবর্তনসাধন জরুরী, যে পরিবর্তনসাধন কেবলমাত্র একটা ব্যবহারিক আন্দোলন অর্থাৎ একটা বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ঘটতে পারে। শাসকশ্রেণিকে অন্য কোনও উপায়ে উৎখাত করা অসম্ভব, কিন্তু কেবলমাত্র এই কারণেই বিপ্লব জরুরী নয়, তা জরুরী এই কারণেও যে শাসকশ্রেণিকে উৎখাত করছে যে শ্রেণি, সেও কেবলমাত্র একটা বিপ্লবের মধ্য দিয়েই শতাব্দীপ্রাচীন ক্লেদ থেকে নিজেকে মুক্ত করে নতুন সমাজ প্রতিষ্ঠা করার যোগ্য হয়ে উঠতে পারে।’ (আর পাস্কাল প্রকাশিত সংস্করণ, নিউ ইয়র্ক, ১৯৬০, xv পৃষ্ঠা ও ৬৯ পৃষ্ঠা থেকে উদ্ধৃত।) এমনকি এই মার্কসবাদ-পূর্ব বক্তব্যেও মার্কস-এর অবস্থানের সঙ্গে সার্ত্রের অবস্থানের পার্থক্য সুস্পষ্ট। মার্কস এখানে ‘গণহারে মানুষের পরিবর্তনসাধন’ ও ‘সচেতনতার গণহারে উৎপাদনের’ কথা বলছেন, একটা বিচ্ছিন্ন হিংসাত্মক ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে একটা ব্যক্তিমানুষের মুক্তির কথা বলছেন না। (মূল জার্মান বয়ানের জন্য দেখুন:Marx/Engels Gesamtausgabe, ১৯৩২, I. Abteilung , পঞ্চম খণ্ড, ৫৯ পৃষ্ঠার পাদটীকা।)

১৭। নয়া বাম (নিউ লেফ্ট)-দের মার্কসবাদ থেকে অসচেতন সরে যাওয়ার ঘটনা সঙ্গতভাবেই কেউ কেউ খেয়াল করেছেন। এই প্রসঙ্গে বিশেষ করে দ্রষ্টব্য ছাত্র-আন্দোলন নিয়ে সাম্প্রতিক কিছু মন্তব্য, যেমন: ১৯৬৮-র ৫-ই ডিসেম্বর নিউ ইয়র্ক রিভিউ অফ বুকস্-য়ে লিওনার্ড সাপিরোর মন্তব্য এবং লা রিভলুশন ইনট্রুভেবল (পারি, ১৯৬৮)-তে রেমণ্ড আরন-য়ের লেখা। এই দুজনেই হিংসার উপর নতুন ঝোঁককে এক ধরনের পশ্চাদগমন হিসেবে দেখেছেন। আরন দেখেছেন মার্কস-পূর্ববর্তী ইউটোপিয় সমাজবাদের দিকে পশ্চাদগমন হিসেবে আর সাপিরো দেখেছেন নেচায়েভ ও বাকুনিনের রুশ নৈরাষ্ট্রবাদের দিকে পশ্চাদগমন হিসেবে। সাপিরো বলেছেন: নেচায়েভ ও বাকুনিন ‘সমাজ ও গোষ্ঠীকে একসঙ্গে বাঁধার ঐক্যসূত্র হিসেবে হিংসার গুরুত্ব নিয়ে অনেক কিছু বলেছিলেন এবং সেসব বলেছিলেন জাঁ পল সার্ত্র ও ফ্রানজ ফানন-য়ের লেখায় এই একই ধরনের ভাবনা প্রকাশ পাওয়ার এক শতাব্দী আগে।' সমসুরে আরন লিখেছেন: ‘Les chantres de la revolution de mai croient depasser le marxisme… ils oublient un siècle d’historie’ (১৪ পৃষ্ঠা)। মার্কসবাদী নয়, এমন কারও কাছে এহেন উল্টোযাত্রার মধ্যে আপত্তির কিছু থাকতে পারে না, কিন্তু যে সার্ত্র নিজে লিখেছেন: ‘Un pretend ‘depassement’ du marxisme ne sera au pis qu’un retour au premarxisme, au mieux que la redecouverte d’une pensee deja continue dans la philosophie qu’on a cru depasser’ (Critique de la raison dialectique (পারি, ১৯৬০)-গ্রন্থের ‘Question de methode’, ১৭পৃষ্ঠা), তার ক্ষেত্রে এ ভীষণ আপত্তিজনক বটে। (খেয়াল করার মতো বিষয় যে সার্ত্র ও আরন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হওয়া সত্ত্বেও এবিষয়ে সম্পূর্ণ একমতাবলম্বী। এর থেকে আন্দাজ করা যায় যে মার্কসবাদী ও অ-মার্কসবাদী উভয় মহলের চিন্তাতেই ইতিহাস সম্পর্কে হেগেলিয় ধারণা কী পরিমাণে আধিপত্য বিস্তার করে আছে।) ‘ক্রিটিক অফ ডায়ালেক্টিক রিজন’-য়ে স্বয়ং সার্ত্র তঁার হিংসার পক্ষ নেওয়ার একটা হেগেলিয় ব্যাখ্যা হাজির করেছেন। তঁার যুক্তিবিস্তারের প্রারম্ভবিন্দু হল: বর্তমান ইতিহাসে ‘ক্রিয়া ও নৈতিকতার মানিখিয় ভিত্তি নির্ধারিত হয় প্রয়োজন ও অভাব দিয়ে’ এবং ‘বর্তমানে অভাবের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত সত্যের প্রকাশ ঘটতে পারে শ্রেণিদের মধ্যে শত্রুতামূলক সংঘাতের মধ্য দিয়েই’। ‘সকলের জন্য যথেষ্ট নেই’ যে জগতে, সেখানে প্রয়োজনের তাড়নাতেই ঘটছে আক্রমণ। এ পরিস্থিতিতে হিংসা আর কোনও প্রান্তীয় প্রতীত বিষয় নয়। ‘হিংসা ও প্রতিহিংসার মধ্যে আকস্মিকতা থাকতে পারে, সে আকস্মিকতা সত্ত্বেও তা আবশ্যিক। অমানবিকতাকে ধ্বংস করার যে কোনও প্রয়াসের আবশ্যক ফল হল এই যে প্রতিপক্ষের মধ্যে প্রতিমানবের অমানবিকতাকে ধ্বংস করার মধ্য দিয়ে আমি কেবল তার অন্তঃস্থ মানুষের মানবিকতাকেই ধ্বংস করতে পারি এবং তার অমানবিকতাকে নিজের মধ্যে উপলব্ধি করতে পারি। খুন করা, পীড়ন করা বা দাস করে রাখার মধ্য দিয়ে... আমার লক্ষ্য তার স্বাধীনতাকে দমন করা— এ এক বিজাতীয় বল।’ এমন পরিস্থিতি যেখানে ‘প্রত্যেকে উদ্বৃত্ত, পরস্পরের কাছে প্রত্যেকেই প্রয়োজনাতিরিক্ত’, তার উদাহরণ হিসেবে সার্ত্র বলেছেন গণযানের জন্য যাত্রীদের সারবন্দি অপেক্ষা-সারির কথা, যেখানে সারিতে অপেক্ষারত মানুষরা ‘একে অপরের কাছে পরিমাণগত অনুক্রমের একটা সংখ্যা ছাড়া আর কিছুই নয়’ এবং এর থেকে সার্ত্র সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে ‘পারস্পরিকভাবে তারা একে অপরের অন্তর্জগতের মধ্যে কোনও সম্বন্ধ স্থাপন করতে অস্বীকার করে’। তারপর আবার এর থেকে সিদ্ধান্ত টানা হয়েছে যে এই চর্চাভ্যাস হলো ‘অপরত্বের নেতিকরণ, এবং অপরত্ব নিজেই একটা নেতিকরণ’— সমাদর করার মতো এক অন্তর্সিদ্ধান্ত, যেহেতু ধরে নেওয়া আছে যে নেতিকরণের নেতিকরণ একটি সত্যাপন। এই যুক্তিবিস্তারের মধ্যের ত্রুটি আমার কাছে স্পষ্ট। ‘মনোযোগ না দেওয়া’ এবং ‘অস্বীকার করা’-র মধ্যে দুস্তর ফারাক, তেমনই ফারাক ‘অপরের সঙ্গে সম্বন্ধ স্থাপন করতে অস্বীকার করা’ ও অপরের ‘অপরত্বের নেতিকরণ করা’-র মধ্যে। আর এই তাত্ত্বিক ‘নেতিকরণ’ থেকে ‘খুন করা, পীড়ন করা, দাস করে রাখা’-য় পৌঁছতে যে কোনও সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষকে দুস্তর দূরত্ব পেরোতে হবে।  এখানে অধিকাংশ উদ্ধৃতি নেওয়া হয়েছে আর ডি ল্যাইঙ ও ডি জি কুপার-এর ‘রিজন অ্যান্ড ভায়োলেন্স: এ ডিকেড অফ সার্ত্রেজ ফিলসফি, ১৯৫০–১৯৬০’ (লন্ডন,১৯৬৪) থেকে, যা ন্যায়সঙ্গত বলেই মনে হয় কারণ সার্ত্র ওই বইয়ের ভূমিকা লিখতে গিয়ে লিখেছেন: ‘J’ai lu attentivement l’ouvrage que vous avez bien voulu me confier et j’ai eu le grand plaisir d’y trouver un expose tres fidele de ma pensee’।

১৮। ‘যাদের আমরা ঘৃণা করতে শিখেছি, সেই “ভালো জার্মান”-দের মতো হাল হওয়া’ আটকানোই প্রকাশ্য বিদ্রোহের অন্যতম চালিকাশক্তি বলে নোয়াম চমস্কি সঠিকভাবেই চিহ্নিত করেছেন।

১৯। ফ্রানজ ফানন, দি রেচেড অফ দি আর্থ (১৯৬১), গ্রোভ প্রেস সংস্করণ, ১৯৬৮, ৬১ পৃষ্ঠা। আমি এই বইটিকে ব্যবহার করছি কারণ বর্তমান ছাত্রছাত্রীদের প্রজন্মের উপর এর প্রভাব বিপুল। ফাননের অনুরাগীদের তুলনায় অবশ্য ফানন নিজে হিংসা বিষয়ে অনেক বেশি সন্দিহান। উক্ত বইটির ‘হিংসা প্রসঙ্গে’ শীর্ষক প্রথম অধ্যায়টিই বোধহয় ব্যাপকভাবে পঠিত হয়েছে। ফানন নিজে অবশ্য সচেতন যে: ‘বিমিশ্র ও সর্বাত্মক নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে যদি অবিলম্বে সংগ্রাম লাগু করা না হয়, তাহলে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে তা অবধারিতভাবে গোটা আন্দোলনকে পরাজয়ের বিবরে ঠেলে দেবে।’ (উক্ত বই, ১৪৭ পৃষ্ঠা)

ছাত্রআন্দোলনে হিংসার সাম্প্রতিক অনেক কিছু জানা যায় জার্মান সংবাদ-পত্রিকা ‘ডের স্পিজেল’ (১০ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৯)-য়ের জিওয়াল্ট থেকে এবং ধারাবাহিক ‘মিট ডেম লাতেইন আম এণ্ডে’ (নং ২৬ ও ২৭, ১৯৬৯) থেকে।

২০। আন্দোলনকারীরা প্রকৃতই মিশ্র চরিত্রের। বিপ্লবী ছাত্ররা সহজেই জোট বাঁধছে ছঁাটাই-পরিত্যক্তদের সঙ্গে, হিপি ও ড্রাগ-আসক্তদের সঙ্গে, এমনকি মানসিক ব্যাধিগ্রস্তদের সঙ্গেও। পরিস্থিতিকে জটিলতর করে তুলেছে প্রতিষ্ঠিত ক্ষমতাবানদের সংবেদনহীনতা। এই সংবেদনহীনতা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে অপরাধ ও রীতিবহির্ভূত-র মধ্যে অতীব গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু প্রায়শই সূক্ষ্ম পার্থক্য করতে। ধর্ণা বা প্রতিষ্ঠানভবনের দখল নেওয়া মোটেই এক নয় আগুন লাগিয়ে দেওয়া বা সশস্ত্র অভ্যুত্থানের সঙ্গে, এবং তাদের মধ্যে পার্থক্য কেবল মাত্রাগত নয়। (হারভার্ড-য়ের ‘বোর্ড অফ ট্রাস্টিজ’-য়ের জনৈক সদস্য সম্প্রতি মতপ্রকাশ করেছেন যে ছাত্রদের দ্বারা বিশ্ববিদ্যালয়ের দখল নেওয়া হল ফার্স্ট ন্যাশনাল ব্যাঙ্কের কোনও শাখার উপর রাস্তার ক্ষিপ্ত জনতার আক্রমণের সমান। তঁার এই মত ভ্রান্ত খুব সহজ একটা কারণে: বিশ্ববিদ্যালয় রূপ সম্পত্তির ব্যবহার আইনের দ্বারা বাঁধা হলেও এবং ছাত্রছাত্রীরা সেই আইনের বাইরে গিয়ে তা দখল করলেও ছাত্রছাত্রীরা নিজেরা সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের অংশ এবং শিক্ষকবর্গ ও বিদ্যালয়-প্রশাসকদের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর তাদেরও সমান অধিকার আছে।) আরো উদ্বেগের বিষয় হল যে শিক্ষকবর্গ ও শিক্ষাঙ্গন-প্রশাসকদের মধ্যে (যেমন নিউ ইয়র্ক সিটি কলেজ ও কর্ণেল ইউনিভার্সিটিতে) প্রকৃত বিদ্রোহীদের তুলনায় ড্রাগ-আসক্ত ও অপরাধমনস্কদের প্রতি অনেক নরম মনোভাব ব্যক্ত করার ঝোঁক দেখা যাচ্ছে। সেই ১৯৬১ সালেই জার্মান সমাজবিজ্ঞানী হেলমুট স্কেলস্খি (Der Mench in der wissenschaftlichen Zurlisation, Koln & Opladen) একপ্রকার ‘আধিবিদ্যক ধ্বংসকামনা’-র কথা বলেছিলেন। তা বলতে তিনি বুঝিয়েছিলেন ‘বৈজ্ঞানিক-প্রকৌশলগত পুনরুৎপাদনের সমগ্র মানবিক প্রক্রিয়া’-র সামাজিক ও আত্মিক নাকচের বৈপ্লবিক প্রক্রিয়ার কথা, অর্থাৎ ‘বৈজ্ঞানিক সভ্যতার উদীয়মান জগতকে’ পরিত্যাগ করার কথা। এই মনোভাবকে ‘ধ্বংসকামনা’ আখ্যা দেওয়া এক পূর্বানুমানের উপর দাঁড়িয়ে আছে। সেই পূর্বানুমান হলো আধুনিক বিশ্বকেই একমাত্র সম্ভবপর বিশ্ব বলে ধরে নেওয়া। তরুণ বিদ্রোহীরা ঠিক এই পূর্বানুমানটিকেই প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। অবশ্য আরও অর্থপূর্ণ হয় যদি সেলডন উওলিন ও জন স্খার (সূত্র: প্রাগুক্ত) মতো উল্টোদিকে ঘুরিয়ে আমরা বলি: ‘প্রতিষ্ঠিত ও সম্ভ্রান্তরা আজ গভীরতম ধ্বংসকামী নেতিকরণের পথ নিতে তৈরি বলে মনে হচ্ছে; ভবিষ্যতের বাহক নিজেদের সন্তানদের নেতিকরণের মধ্য দিয়েই ভবিষ্যতের এই নেতিকরণ; এটাই বর্তমানে সবচেয়ে বড় বিপদ।’ ‘দি পাবলিক ইন্টারেস্ট’-য়ের বিশেষ সংখ্যা ‘দি ইউনিভার্সিটিজ, ফল, ১৯৬৮’-য়ে ‘স্টুডেন্ট পাওয়ার অ্যাট বার্কলে’ শীর্ষক লেখায় নাথান গ্লেজার লিখেছেন: ‘বিপ্লবী ছাত্ররা... আমাকে অনেক বেশি লুডাইট যন্ত্র-চূর্ণকারীদের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে, যত না স্মরণ করাচ্ছে সেই সমাজতন্ত্রী ট্রেড ইউনিয়নপন্থীদের কথা যারা শ্রমিকদের জন্য নাগরিকত্ব ও ক্ষমতা অর্জন করেছিল।’ এই স্মরণ করিয়ে দেওয়া থেকে গ্লেজার সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে গিবনিউ ব্রেজিনস্কি (Zbigniew Brzezinski) বোধহয় সঠিক যখন তিনি (কলম্বিয়া প্রসঙ্গে একটি লেখায়, ১লা জুন ১৯৬৮-র দি নিউ রিপাবলিক) লেখেন: ‘বিপ্লব প্রায়শই হয় অতীতের শেষ মরণ-খিঁচুনি আর তাই বিপ্লবের বদলে বিপ্লব নামধারী প্রতিবিপ্লবকেই কি আমরা সংঘটিত হতে দেখছি না?’ সাধারণত রক্ষণশীল বলে পরিচিত দুই লেখকের ক্ষেত্রে এহেন যে কোনও মূল্যে সম্মুখপানে কুচকাওয়াজ করে যাওয়ার পক্ষপাতী হওয়া কি বেশ অপ্রত্যাশিত নয়? আরও অপ্রত্যাশিত নয় কি যে গ্লেজার উনিশ শতকের সূচনার ইংলন্ডের উৎপাদনশিল্পের যন্ত্র আর বিশ শতকের মাঝে এসে বিকশিত যন্ত্র-প্রকৌশলের মধ্যে বিপুল ও নির্ধারক চরিত্রের পার্থক্যগুলো সম্পর্কে অসচেতন? পারমাণবিক শক্তির আবিষ্কার, যান্ত্রিকীকরণ, মাত্রাতিরিক্ত জনস্ফীতি ও তার অবধারিত ফলস্বরূপ গণ অনাহার, বায়ুদূষণ ইত্যাদির ডেকে আনা বিবিধ ওষুধ— বিশ শতকের মাঝের এসব যন্ত্র-প্রকৌশল আপাতভাবে উপকারী মনে হলেও প্রকৃত প্রস্তাবে ধ্বংস ডেকে আনছে।

২১। বর্ণনামূলক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হলে ‘উপভোক্তাদের সমাজ’ অভিধাটি অর্থবহ হতে পারে। ‘মুক্ত উৎপাদকদের সমাজ’, ‘সমাজের উৎপাদিকা শক্তির মুক্তি’ — এই দুই মার্ক্সীয় বিভ্রম অবশ্য এই অভিধার পিছনে ক্রিয়াশীল। উক্ত মুক্তি বাস্তবে সম্পাদিত হয়েছে বিপ্লবের দ্বারা নয়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দ্বারা। তাছাড়া, যে সমস্ত দেশ বিপ্লবের মধ্য দিয়ে গেছে, সেখানে এই মুক্তি ত্বরান্বিত হয়নি, বরং গুরুতর শ্লথগতি হয়েছে। উপভোক্তার ক্রিয়ার এই নিন্দা দাঁড়িয়ে আছে উৎপাদনের ক্রিয়াকে আদর্শায়িত করার উপর এবং তার সঙ্গে উৎপাদনশীলতা ও সৃষ্টিশীলতাকে পুজো করার পুরানো রেওয়াজের উপর। ধ্বংস করার ‘আনন্দ এক সৃষ্টিশীল আনন্দ’— বটেই তো, যদি কেউ বিশ্বাস করে যে ‘শ্রমের আনন্দ’ সৃষ্টিশীল, যন্ত্রের সাহায্য ছাড়া সরল হাতিয়ার দিয়ে করা যায় এমন প্রায় একমাত্র যে ‘শ্রম’ অবশিষ্ট থাকে তা হল ধ্বংস করা, যদিও সে কাজও যন্ত্র আরো দক্ষতার সঙ্গে করতে পারে।

২২। ছোট ও তুলনামূলক নিরীহ উদ্যোগগুলোর মধ্যে স্বতক্রিয়ার ক্ষুধাকে বিশেষভাবে খেয়াল করা যায়। কাফেটেরিয়া, ভবন ও মাঠের কর্মচারীদের শিক্ষাঙ্গন-কর্তৃপক্ষ আইনী ন্যূনতমের চেয়েও কম মাইনে দিচ্ছিল, ছাত্রছাত্রীরা তার বিরুদ্ধে সফলভাবে ধর্মঘট চালিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকানায় থাকা একটা ফঁাকা জমিকে ‘জনগণের প্রমোদ-উদ্যানে’ রূপান্তরিত করার লড়াইয়ে নামার বার্কলের পড়ুয়াদের সিদ্ধান্ত স্বতক্রিয়ার ক্ষুধা হিসেবেই গণ্য হওয়া উচিত, যদিও তা কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে এতাবধি সবচেয়ে নিকৃষ্ট প্রতিক্রিয়া বের করে এনেছে। বার্কলের ঘটনা থেকে বিচার করলে মনে হয় যে এমন তথাকথিত ‘অরাজনৈতিক’ স্বতক্রিয়াই বিপ্লবী অগ্রবাহিনীর পাশে ছাত্রছাত্রীদের ঐক্যবদ্ধ করে তোলে। ‘ছাত্রছাত্রীদের ভোটের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি অংশগ্রহণ হওয়া একটি গণভোটে অংশ নেওয়া ১৫ হাজারের মধ্যে ৮৫ শতাংশই ভোট দিয়েছিল ফঁাকা জমিটা জনগণের প্রমোদ-উদ্যান হিসাবে ব্যবহারের জন্য।’ এ বিষয়ে খুব ভালো প্রতিবেদন হল: ১৯জুন ১৯৬৯ তারিখের ‘নিউ ইয়র্ক রিভিউ অফ বুকস’-য়ে প্রকাশিত শেলডন উওলিন ও জন স্খার লেখা বার্কলে: ‘দি ব্যাটেল অফ পিপলস্ পার্ক’।

২৩। যেখানে পূর্বদৃষ্টান্ত বা পূর্বসাদৃশ্য কিছু নেই, সেখানেও তা খুঁজে-পেতে হাজির করা; ঘটমান ঘটনার উপর-উপর বর্ণনাতেই প্রতিবেদন রচনার কাজ শেষ করা, অর্থাৎ, তা নিয়ে ভাবার কাজ এড়িয়ে যাওয়া— এই প্রবণতাগুলো সাম্প্রতিক বিভিন্ন আলোচনায় দস্তুর হয়ে উঠেছে, আর মুখে বলা হচ্ছে যে অতীতের থেকে, বিশেষত দুই বিশ্বযুদ্ধ মধ্যবর্তী সময়পর্যায় থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। এই ধরনের পলায়নপরতা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত স্টিফেন স্পেন্ডারের পূর্বোদ্ধৃত প্রতিবেদনটি। এই চমৎকার বিচক্ষণ প্রতিবেদনের বিষয় বর্তমান ছাত্রআন্দোলন। স্টিফেন স্পেন্ডার এই প্রজন্মের সেই অল্প কয়েকজনের একজন যারা মেজাজ, পদ্ধতি, চিন্তা ও স্বতক্রিয়ার পার্থক্য বোঝার জন্য যথেষ্ট পরিমাণে বর্তমানের প্রতি সংবেদনশীল ও নিজ যৌবন সম্পর্কেও স্মৃতিধর। (‘চল্লিশ বছর আগের অক্সব্রিজ, হারভার্ড, প্রিন্সটন ও হাইডেলবার্গের ছাত্রছাত্রীদের থেকে আজকের ছাত্রছাত্রীরা সম্পূর্ণ আলাদা।’— ১৬৫ পৃষ্ঠা) বিশ্বের ও মানুষের ভবিষ্যৎ নিয়ে ছিনিমিনি খেলার বদলে যারা তা নিয়ে প্রকৃতই উদ্বিগ্ন, তারা স্পেন্ডারের মনোভাবের সহগামী হবেন। (প্রাগুক্ত লেখায় উওলিন ও স্খার বিভিন্ন প্রজন্মের মধ্যে সেতু হিসাবে ‘একই নিয়তির গ্রাসে পতিত হওয়ার বোধের পুনরুজ্জীবনের’ কথা বলেছেন, এই ভয়ের কথা বলেছেন যে ‘বৈজ্ঞানিক অস্ত্র সমস্ত প্রাণকে ধ্বংস করে দিতে পারে, প্রযুক্তি শহুরে মানুষদের ক্রমবর্ধমান হারে বিকৃত করে চলবে ঠিক যেমনভাবে তা পৃথিবীর অবনমন ঘটিয়েছে, আকাশকে ধূসর করেছে’, আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে ‘শিল্পোৎপাদনের “অগ্রগতি” আগ্রহোদ্দীপক কাজের সম্ভাবনাকে ধ্বংস করবে, সবচেয়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজগুলো ছাড়া বাকি সব সমাজের পরম্পরাগত বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতির শেষ চিহ্নটুকুও যোগাযোগব্যবস্থার “উন্নতির” মাধ্যমে মুছে দেবে’।) সমাজবিজ্ঞানীদের তুলনায় পদার্থবিদ ও প্রাণিবিদদের ক্ষেত্রে তা বেশি স্বাভাবিক বলে মনে হলেও সমাজবিজ্ঞানীদের তুলনায় পদার্থবিদ ও প্রাণিবিদরা বিদ্রোহে সামিল হয়েছে অনেক ধীর লয়ে। সুইজারল্যান্ডের বিখ্যাত প্রাণিবিদ অ্যাডলফ পোর্টম্যান বিভিন্ন প্রজন্মের মধ্যে পার্থক্যকে তরুণ ও বয়স্কদের মধ্যে সংঘাতের সঙ্গে খুব কমই সম্পর্কযুক্ত বলে মনে করেছেন, তিনি বরং এই পার্থক্যকে পরমাণু বিজ্ঞানের উত্থানের সঙ্গে একই সূত্রে বাঁধা বলে ভেবেছেন এবং বলেছেন: ‘বিশ্বপরিস্থিতি সম্পূর্ণই নতুন... অতীতের সবচেয়ে শক্তিশালী বিপ্লবের সঙ্গেও এর তুলনা হয় না।’(Manipulation des Menchen als Schicksal und Bedrohung, জুরিখ, ১৯৬৯) আর নোবেল প্রাইজ বিজেতা জর্জ ওয়াল্ডও সঠিকভাবেই খেয়াল করিয়েছেন যে ‘(শিক্ষকরা তাদের ছাত্রছাত্রীদের) অস্বস্তির কারণ বোঝে, হয়ত ছাত্রছাত্রীদের থেকে বেশিই বোঝে, আর তাছাড়া তারা তার ভাগিদারও বটে’।(৪ঠা মার্চ ১৯৬৯, ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি-তে প্রদত্ত ভাষণ)

২৪। ১৮-ই মে ১৯৬৯ তারিখের নিউ ইয়র্ক টাইমস ম্যাগাজিনে জেরোম লেটভিন।

২৫। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বর্তমান রাজনীতিকিকরণ সঠিকভাবেই নিন্দিত হয়েছে। এই রাজনীতিকিকরণের দায় চাপানো হয়েছে বিদ্রোহী ছাত্রছাত্রীদের উপর। ছাত্রছাত্রীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছে যে প্রতিষ্ঠিত ক্ষমতার শৃঙ্খলে দুর্বলতম গ্রন্থি হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে তারা আক্রমণের নিশানা করেছে। এটা পুরোপুরি সত্য যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো টিকে থাকবে না যদি ‘বুদ্ধিবৃত্তিগত নিরাসক্তি ও সত্যের নিঃস্বার্থ অনুসন্ধান’-য়ের অবসান ঘটে। আরো উদ্বেগের বিষয় হল এই যে সামাজিক চাপ ও রাজনৈতিক ক্ষমতা থেকে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ থাকার উপর যে বিশ্ববিদ্যালয়-প্রতিষ্ঠানের সমাজ-রাজনৈতিক ভূমিকা নির্ভরশীল, সেই প্রতিষ্ঠানগুলো অবলুপ্ত হলে সভ্য সমাজও টিকে থাকবে না। নিজ নিজ অধিকারে রীতিসিদ্ধ দুটি গুণগতভাবে পৃথক প্রতীত বিষয় হল ক্ষমতা ও সত্য এবং তাদের অনুসরণ দুটি প্রতীতিগতভাবে পৃথক জীবনধারার জন্ম দেয়। ‘আমেরিকা ইন দি টেকনোট্রনিক এজ’ (এনকাউন্টার, জানুয়ারি ১৯৬৮) প্রবন্ধে গিবনিউ ব্রেজিনস্কি এই বিপদটিকে খেয়াল করেছেন, কিন্তু হয় তিনি এ ব্যাপারে হাল ছেড়ে দিয়েছেন আর নয়তো এ নিয়ে অতটা চিন্তিত নন। তিনি বিশ্বাস করেন যে টেকনোট্রনিকস (আণবিক প্রযুক্তির প্রকৌশল) এমন এক ‘সুপারকালচার’ (মহাসংস্কৃতি) আবাহন করে আনবে যেখানে নেতৃত্ব থাকবে ‘সংগঠনমুখী প্রয়োগপ্রবণ বুদ্ধিজীবী’-দের হাতে। (বিশেষ করে দেখুন নোয়াম চমস্কির সাম্প্রতিক সমালোচনাত্মক বিশ্লেষণ ‘অবজেকটিভিটি অ্যাণ্ড লিবারেল স্কলারশিপ’ প্রবন্ধ, সূত্র: প্রাগুক্ত।) তা যদি হতে চলেছে বলে ধরেও নেওয়া হয়, তাহলেও সবচেয়ে সম্ভবপর হল এই যে যাদের আগে ‘প্রকৌশলী আমলা’ (টেকনোক্র্যাট) বলা হতো, সেই নতুন প্রজাতির বুদ্ধিজীবীরা নেতৃত্ব হাতে নিয়ে এক উৎপীড়ক স্বেচ্ছাচারতন্ত্র জারি করবে যা এক সামগ্রিক অনুর্বরতার যুগকে আবাহন করে আনবে। যাই হোক না কেন, মূল বিষয়ে ফিরে এলে বলতে হয় যে ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলনের দ্বারা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতিকিকরণের আগেই প্রতিষ্ঠিত ক্ষমতাধররা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতিকিকরণ ঘটিয়েছিল এবং তা কেবল সামরিক গবেষণার মধ্য দিয়ে নয়। হেনরি স্টিল কোমাজের সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘নিয়োগ-নিয়ন্ত্রক সংস্থা’ হিসাবে ভৎর্সনা করেছেন (দি নিউ রিপাবলিক, ২৪শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৮)। ‘কল্পনাকে যতই বিস্তৃত করা হোক না কেন, মারণগ্যাস উৎপাদক ডাও কেমিকাল কোম্পানি, নৌসেনা মেরিনস বা গুপ্তচরসংস্থা সি আই এ-কে নিশ্চয়ই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বলা যায় না’ বা তারা সত্যের অনুসন্ধানে রত বলে দাবি করা যায় না। আর নগরপাল জন লিন্ডসেও প্রশ্ন তুলেছিলেন: কোন অধিকারে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ‘বস্তুস্বার্থ অন্বেষণ থেকে বিযুক্ত বিশেষ প্রতিষ্ঠান হিসাবে নিজেদের দাবি করে যখন জমি-বাড়ি নিয়ে দরের ফাটকায় তারা নিজেদের আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে এবং মার্কিন সেনার ভিয়েতনাম হানার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত নানা প্রকল্পের পরিকল্পনা-পরিচালনায় নিজেদের নিযুক্ত করেছে?’ (নিউ ইয়র্ক টাইমস, দি উইক ইন রিভিউ, ৪ঠা মে ১৯৬৯) বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘সমাজের মস্তিষ্ক’ বা ‘ক্ষমতাকাঠামোর মস্তিষ্ক’ বলে ভাবা এক বিপজ্জনক ও অহংসর্বস্ব অর্থহীনতা ছাড়া আর কিছু নয়, কেবলমাত্র যদি এই কারণেও হয় যে সমাজ কোনও ‘শরীর’ নয়, মস্তিষ্কের প্রশ্ন তো পরের কথা। ভুল বোঝাবুঝি এড়ানোর জন্য আরো কয়েকটা কথা বলা দরকার। স্টিফেন স্পেন্ডার-এর সঙ্গে আমি একমত যে ছাত্রছাত্রীদের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ধ্বংস করা নির্বুদ্ধিতার কাজ হবে (যদিও একমাত্র তারাই তা কার্যকরীভাবে করতে পারে এই সহজ কারণে যে তা করার মতো যথেষ্ট সংখ্যাবল ও প্রকৃত ক্ষমতা তাদের আছে) কারণ বিশ্ববিদ্যালয়প্রাঙ্গণগুলোই তাদের একমাত্র সম্ভবপর প্রকৃত ভিটে। ‘বিশ্ববিদ্যালয় না থাকলে ছাত্রছাত্রীও থাকবে না।’ (২২পৃষ্ঠা, প্রাগুক্ত) কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ছাত্রছাত্রীদের ভিটে ততক্ষণই যতক্ষণ সমস্ত বিকৃতি ও কপটতা সত্ত্বেও তা সমাজের সেই একমাত্র স্থান হবে যেখানে ক্ষমতাই শেষ কথা বলে না। সাম্প্রতিক পরিস্থিতির বিপদ এইখানে যে হয় ছাত্রছাত্রীরা আর নয়তো (বার্কলে-তে যেমন) প্রতিষ্ঠিত কর্তৃপক্ষ বল্গাহীন আধিপত্য বিস্তারে উদ্যোগী হয়েছে, যা বাস্তবায়িত হলে তরুণ বিদ্রোহীরা (প্রিন্সটনের অধ্যাপক রিচার্ড এ ফক-এর ভাষায়) ‘বিপর্যয়ের নকশা’-কে কেবল শেষ আঁচড়টি টেনে সম্পূর্ণ করবে।

২৬। মৌলিক গবেষণার কাজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে ধারাবাহিকভাবে শিল্পোৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত গবেষণাগারে স্থানান্তরিত হওয়া এ ব্যাপারে বিশেষ করে খেয়াল করার মতো।

২৭। প্রাগুক্ত।

২৮। স্টিফেন স্পেন্ডার, দি ইয়ার অফ দি ইয়ঙ রিবেলস, নিউ ইয়র্ক, ১৯৬৯, ১৭৯ পৃষ্ঠা।

২৯। ২২শে মার্চ ১৯৬৯ তারিখের ‘দি নিউ ইয়র্কার’ পত্রিকায় জর্জ ওয়াল্ড।

৩০। ৪ ঠা মে, ১৯৬৯ তারিখের ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস, দি উইক ইন রিভিউ’-তে প্রকাশিত নিবন্ধে ফ্রেড এম হেচিঞ্জার লিখেছেন: ‘বিশেষত কৃষ্ণাঙ্গ ছাত্রছাত্রীদের দাবিদাওয়া যেহেতু অন্তর্বস্তুগতভাবে ন্যায্য..., তাই তা সাধারণভাবে সহানুভূতি আকর্ষণ করেছে।’ এই প্রসঙ্গে উল্লেখনীয় যে জেমস ফরমানের ‘ম্যানিফেস্টো টু দি হোয়াইট খ্রিস্টান চার্চেস আ্যান্ড দি জিউইজ সিনাগগস ইন দি ইউনাইটেড স্টেটস অ্যান্ড অল আদার রেসিস্ট ইনস্টিটিউশনস’ গণহারে পঠিত ও বিতরিত হয়ে ‘ছাপার যোগ্য খবর’ হয়ে উঠলেও তা কোথাও ছাপা হয়নি, যতক্ষণ না ১৯৬৯-এর ১০ই জুলাই তারিখের নিউ ইয়র্ক রিভিউ অফ বুকস-এ অবশেষে ভূমিকাটি বাদ দিয়ে বাকি ইস্তাহারটি ছাপা হয়। এই ইস্তাহারের অন্তর্বস্তু সন্দেহাতীতভাবে একটি অর্ধ-অশিক্ষিত আজগবী ভাবনা, আন্তরিক চিন্তাশীলতা থেকে শত যোজন দূরে তার অবস্থান, কিন্তু তা নেহাত রসিকতা নয়। আর এও এখন কোনও গোপন কথা নয় যে কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রদায় বেশ মেজাজের সঙ্গে এহেন কল্পনাবিভ্রমকে প্রশ্রয় দিচ্ছে। প্রাধিকারীদের ভীত হয়ে ওঠার কারণ বোঝা যায়, কিন্তু তাদের ভাবনার নিদারুণ দীনতা বোঝা দুষ্কর ও ক্ষমার অযোগ্য। শ্রীমান ফরমান ও তার অনুগামীরা যদি ব্যাপক জনসমাজের মধ্য থেকে কোনও বিরোধিতার মুখোমুখি না হয়, এমনকি তাদের তুষ্টার্থে কিছু অর্থবরাদ্দও পেয়ে যায়, তাহলে আর কোনো সন্দেহ থাকে কি যে এমন একটা কর্মসূচী রূপায়নের দিকে তাদের ঠেলে দেওয়া হবে যাতে তাদের নিজেদের বিশ্বাসও সুস্থিত নয়?

৩১। ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’-কে পাঠানো ৯ই এপ্রিল ১৯৬৯ তারিখের এক চিঠিতে লিন্ড কেবল ‘ধর্মঘট ও ধর্ণার মতো অহিংস ব্যাঘাত ঘটানোর ঘটনা’ উল্লেখ করেছেন, বিশের দশকে তোলপাড় ফেলা শ্রমিকশ্রেণির হিংসাত্মক হাঙ্গামার কথা এড়িয়ে গেছেন। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন যে এই কৌশলসমূহ ‘শ্রম-পঁুজির দ্বন্দ্বে এক প্রজন্ম ধরে গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয়ে আসার পরও... বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে কেন গ্রহণযোগ্য হবে না?... কোনো কারখানায় কোনো ইউনিয়ন সংগঠককে বরখাস্ত করা হলে তার সঙ্গীরা তো অন্যায় বরখাস্তের অভিযোগের নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত কাজ করতে অস্বীকার করে।’ এখান থেকে বোঝা যায় যে লিন্ড বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে এমন এক ধারণা গ্রহণ করেছেন যেখানে বুঝিবা অছি পরিষদ বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিক, বিশ্ববিদ্যালয়-কর্তৃপক্ষকে তারা নিয়োগ করেছে তাদের সম্পত্তি দেখভাল ও ব্যবস্থাপনার কাজে, কর্তৃপক্ষ আবার শিক্ষক ও অধ্যাপকদের কর্মচারী হিসাবে নিয়োগ করেছে ছাত্রছাত্রী-রূপী ক্রেতাদের কাছে পরিষেবা বিক্রির জন্য। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের অছি পরিষদের সদস্য ও প্রশাসকদের মধ্যেও এহেন ধারণা বিরল নয়। কিন্তু বাস্তব এই ধারণার অনুরূপ নয়। পঠনপাঠনের প্রাতিষ্ঠানিক জগতে বিরোধ যতই সূচিমুখ হয়ে উঠুক না কেন, তা কখনওই পরস্পরবিরোধী স্বার্থ ও শ্রেণিযুদ্ধের বিষয় হয়ে উঠতে পারে না।

৩২। কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিক অধিকার আন্দোলনের নেতা বেয়ার্ড রাস্টিন-ই এ প্রসঙ্গে যা বলার বলে দিয়েছেন: মহাবিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের উচিত ‘কৃষ্ণাঙ্গ ছাত্রদের নির্বোধ দাবির সামনে আত্মসমর্পণ বন্ধ করা’; ‘সমাজের এক অংশের অপরাধবোধ ও মর্ষকাম যদি অন্য অংশকে ন্যায়ের নামে বন্দুক ধরার অনুমতি দেয়’, তবে ভুল হবে; ‘সংযুক্তিকরণের ধাক্কায় বেসামাল হয়ে’ কৃষ্ণাঙ্গ পড়ুয়ারা ‘সহজ সমাধানের পথ’ খুঁজছে; তাদের আসলে দরকার এমন ‘প্রশিক্ষণ’ যাতে তারা ‘প্রাথমিক অঙ্ক কষা ও সঠিক বাক্য লেখার যোগ্যতা অর্জন করতে পারে’। (২৮শে এপ্রিল ১৯৬৯ তারিখের ‘ডেইলি নিউজ’-য়ে উদ্ধৃত) সমাজের নৈতিক ও বুদ্ধিচর্চার দুরবস্থার কী নিদারুণ প্রতিফলন! আর এমনই অবস্থা যে নেহাত সাধারণ জ্ঞান প্রসূত এই কথাগুলো বলার জন্যও এখন রীতিমতো সাহসী হতে হয়। আশঙ্কা হয় যে পাঁচ থেকে দশ বছরের মধ্যে ‘সোয়াহিলি’ (উনিশ শতকের একটি অ-ভাষা, বান্টু উপভাষার সঙ্গে আরব শব্দভাণ্ডার থেকে বিপুল ঋণের এক দো-আঁশলা মিশ্রণ যা হাতির দাঁত ও দাসের কারবার করা ক্যারাভানগুলোয় কথিত হতো, এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা, ১৯৬১, দ্রষ্টব্য), ‘আফ্রিকার লিখিত সাহিত্য’ ও এমন নানা অস্তিত্বহীন বিষয়ে ‘শিক্ষা’ পরিণত হবে শ্বেতাঙ্গ মানুষদের পাতা আরেকটি ফঁাদে, যে ফঁাদ কৃষ্ণাঙ্গদের যথেষ্ট শিক্ষা অর্জন করা আটকাতে চায়।

৩৩। ৬-ই জুন ১৯৬৯ তারিখের ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’-য়ে উদ্ধৃত ‘ন্যাশনাল কমিশন অন দি কজেস অ্যান্ড প্রিভেনশন অফ ভায়োলেন্স’-য়ের প্রতিবেদন দ্রষ্টব্য।

৩৪। ফ্যানন, প্রাগুক্ত, যথাক্রমে ১৩০, ১২৯ ও ৬৯ পৃষ্ঠা।

৩৫। ফ্যানন, প্রাগুক্ত, ৩৭ পৃষ্ঠার পাদটীকা, ৫৯ পৃষ্ঠা।

৩৬। এহেন অসার স্বপ্নের এক ধ্রুপদী উদাহরণ হলো জেমস ফরমানের পূর্বোক্ত ইস্তাহার (‘ন্যাশনাল ব্ল্যাক ইকনমিক ডেভেলপমেন্ট কনফারেন্স'-য়ে গৃহীত) যা চার্চ ও সিনাগগগুলোর কাছে পেশ করা হয়েছিল ‘শোষিত হওয়া, উচ্ছন্নে যাওয়া, পাশবিক অত্যাচার হত্যা ও শাস্তির শিকার হওয়ার পর প্রাপ্য ক্ষতিপূরণ আদায়ের শুরু’ হিসাবে। ফরমান-এর বক্তব্য অনুযায়ী, ‘বিপ্লবের নিয়মাবলী বলে যে সবচেয়ে যারা নিপীড়িত তারাই বিপ্লব করবে’ এবং তাদের চূড়ান্ত লক্ষ হবে ‘নেতৃত্ব হাতে তুলে নেওয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অস্তিত্বময় সমস্তকিছুর উপর সর্বাত্মক নিয়ন্ত্রণ জারি করা।... সেদিন চলে গেছে যখন আমাদের দ্বিতীয় সারিতে ঠেলে দিয়ে শ্বেতাঙ্গ ছেলেরা চূড়া দখল করে থাকত।’ এই লক্ষ্যপূরণের জন্য ‘বলপ্রয়োগ ও বন্দুকের শক্তি দিয়ে উপনিবেশ-প্রভুদের পতন ঘটানো সহ উপযোগী যে কোনও উপায় গ্রহণীয়।’ আর ফরমান যখন একদিকে তঁার পিছনে সমবেত না হওয়া সম্প্রদায়ের হয়ে ‘যুদ্ধঘোষণা’ করছেন, ‘শ্বেতাঙ্গদের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগবাটোয়ারা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান’ করছেন আর দাবি করছেন যে ‘এদেশের শ্বেতাঙ্গদের... স্বেচ্ছায় মেনে নিতে হবে কৃষ্ণাঙ্গদের শাসন’, তখন একই সঙ্গে একই নিশ্বাসে আহ্বান জানাচ্ছেন ‘ক্ষমতা দখল করতে যদি হাজার বছরও লাগে, ততদিন সমস্ত খ্রিস্টান ও ইহুদিরা যেন ধৈর্য, সহিুষ্ণুতা, সহমর্মিতা ও অহিংসা চর্চা’ করে।

৩৭। দুই বৃহৎ ক্ষমতার মাঝে ফেঁসে যাওয়া জার্মানির ছাত্রছাত্রীদের পূর্ব ও পশ্চিম উভয় জার্মানি সম্পর্কেই মোহভঙ্গ ঘটেছে সমানভাবে এবং ‘অবশ্যম্ভাবীভাবেই তারা অনুসরণ করার জন্য তৃতীয় কোনও মতবাদ খুঁজে নিচ্ছে মাও-য়ের চীন থেকে বা কাস্ত্রোর কিউবা থেকে'। (স্পেন্ডার, প্রাগুক্ত, ৯২ পৃষ্ঠা) মাও-কাস্ত্রো-চে গুয়েভারা- হো চি মিন-দের প্রতি তাদের আহ্বান যেন অন্যতর বিশ্ব থেকে রক্ষাকর্তার আবির্ভাবের বন্দনার ছদ্ম-ধর্মীয় সাম-গান। যুগোশ্লাভিয়া যদি আর একটু দূরে বা নাগালের আরো কিছুটা বাইরে হতো, তাহলে তারা টিটোকেও এভাবেই আহ্বান করত। কৃষ্ণাঙ্গদের ‘ব্ল্যাক পাওয়ার’ আন্দোলনের ব্যাপারটা অবশ্য আলাদা। অস্তিত্বহীন ‘তৃতীয় বিশ্বের ঐক্য’-র প্রতি তাদের মতবাদিক অঙ্গীকার কেবলমাত্র ভাবসর্বস্ব অর্থহীনতা নয়। কৃষ্ণাঙ্গ– শ্বেতাঙ্গ দ্বি-বিভাজনে তারা সুস্পষ্টরূপে আগ্রহী, যদিও সে মনোভাব নিছকই এমন এক স্বপ্নবিশ্বে পলায়ন যেখানে বিশ্বের জনসংখ্যার বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ কৃষ্ণাঙ্গ।

৩৮। মার্কস ও লেনিন উভয়ের ক্ষেত্রেই একই অসঙ্গতির অভিযোগ তোলা যায় বলে মনে হয়। মার্কস কি ১৮৭১-এর পারি কম্যুন-এর মহিমাকীর্তন করেননি আর লেনিন কি চাননি ‘সোভিয়েতের হাতে সমস্ত ক্ষমতা’? কিন্তু মার্কস-এর ভাবনায় কম্যুন বিপ্লবী কার্যক্রমের জন্য একটি ক্ষণস্থায়ী উপকরণের অধিক কিছু নয়। মার্কস-এর কথায়, কম্যুন ছিল ‘শ্রেণিশাসনের... অর্থনৈতিক ভিত্তিকে উপড়ে ফেলার জন্য ব্যবহার্য বলবর্ধ্বক যন্ত্র' আর সঠিকভাবেই এঙ্গেলস তাকে সমরূপে ক্ষণস্থায়ী সর্বহারার একনায়কতন্ত্রের সঙ্গে যুগপৎ বলে ঘোষণা করেছিলেন। (কার্ল মার্কস ও ফ্রেডরিক এঙ্গেলস-এর ‘সিলেক্টেড ওয়ার্কস’, লন্ডন, ১৯৫০, প্রথম খণ্ডে সংকলিত ‘দি সিভিল ওয়ার ইন ফ্রান্স’, যথাক্রমে ৪৭ ও ৪৪০ পৃষ্ঠা)। লেনিনের ক্ষেত্রে বিষয়টি আরো জটিল। তা সত্ত্বেও, লেনিনই সোভিয়েতগুলোকে ক্ষমতাহীন করে পার্টির হাতে সমস্ত ক্ষমতা তুলে দিয়েছিলেন।

৩৯। স্পেন্ডার (প্রাগুক্ত, ১১৪ পৃষ্ঠা) যেমন বলেছেন, ‘নৈতিক আবেগ হল তাদের বিপ্লবী ধারণা।’ নোয়াম চমস্কি (প্রাগুক্ত, ৩৬৮ পৃষ্ঠা) তথ্য দিয়েছেন: ‘(১৯৬৭-র) ২০শে অক্টোবর জাস্টিস ডিপার্টমেন্টে দাখিল হওয়া হাজারখানেক সেনাদলে যোগের আবেদনের বেশিরভাগ এসেছে এমনজনেদের কাছ থেকে যারা সুযোগ থাকলেও সেনায় যোগদান এড়িয়ে যেতে চায়নি কেবলমাত্র তাদের থেকে কম সুবিধাপন্নদের ভাগ্য ভাগ করে নেওয়ার জন্য।’ বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজে সেনায় যোগদান বিরোধী বিভিন্ন বিক্ষোভ ও ধর্ণাগুলোর ক্ষেত্রেও একই কথা সত্য। অন্য দেশেও পরিস্থিতি অনুরূপ। ‘ডের স্পিজেল’ যেমন জার্মানির গবেষণা-সহায়কদের হতাশাজনক ও অবমাননাকর পরিস্থিতি বর্ণনা করেছে এইভাবে: ‘Angesichts dieser Verhaltnisse nimmt es geradezu wunder, dass die Assistenten nicht in der vordersten Front der Radikalen stehen' (২৩শে জুন, ১৯৬৯, ৫৮পৃষ্ঠা) গল্পটা সবজায়গাতেই একরকম: স্বার্থকেন্দ্রীক গোষ্ঠীরা বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগ দেয় না।

৪০। এহেন মার্কসবাদীরা (বা ভূতপূর্ব মার্কসবাদীরা) শিক্ষকের (মার্কস-এর) এক টুকরো লেখা ছেড়ে আসতেও কী ধরনের অসুবিধায় পড়ে তার অন্যতম ভালো উদাহরণ হল জার্মানির সবচেয়ে চিন্তাশীল ও তীক্ষ্ণধী সমাজবিজ্ঞানীদের অন্যতম যুরগেন হাবেরমাস। তঁার সাম্প্রতিক লেখায় (Technik dnd Wissenschaft als ‘Ideologie’, ফ্রাঙ্কফুর্ট, ১৯৬৮) তিনি বহুবার উল্লেখ করেছেন যে ‘শ্রেণিসংগ্রাম ও মতবাদের মতো মার্কসীয় তত্ত্বের কিছু নির্ধারক ধারণাকে এখন আর নির্দ্বিধায় (umstandlos) প্রয়োগ করা যায়না।’ আন্দ্রেই ডি শাখারভের পূর্বোদ্ধৃত প্রবন্ধের সঙ্গে তুলনা করলে বোঝা যায় যে পূর্ব জার্মানির পরীক্ষানিরীক্ষার বিপর্যয়ের পরিপ্রেক্ষিত থেকে যারা ‘পঁুজিবাদ’-কে বিচার করছেন, তাদের পক্ষে ক্ষয়প্রাপ্ত তত্ত্ব ও স্লোগানকে ত্যাগ করা তুলনায় অনেক সহজ।

৪১। মনে হয় চেকোস্লোভাকিয়া একটি ব্যতিক্রম। যে সংস্কার-আন্দোলনের সামনের সারিতে লড়াই করেছে ছাত্রছাত্রীরা, তাতে অবশ্য সামিল হয়েছিল শ্রেণিনির্বিশেষে গোটা জাতিই। মার্কসবাদী ধাঁচার সঙ্গে মেলার পক্ষে চেকোশ্লোভাকিয়ার ছাত্রছাত্রীরা (আর হয়ত ইওরোপের সব পুব দেশের ছাত্রছাত্রীরাই) অতিরিক্ত বেশি জনসমর্থন পেয়েছে জনসমাজ থেকে।

৪২। ১০-ই ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ তারিখের ‘ডের স্পিজেল’-য়ে প্রকাশিত খ্রিস্টোফ এহমান-এর সাক্ষাৎকার দ্রষ্টব্য।

৪৩। পি জে প্রুধোঁ, যথাক্রমে ফিলোজফি দু প্রগ্রেস (১৮৫৩), ১৯৪৬, পৃষ্ঠা: ২৭–৩০, ৪৯ ও ডি লা জাস্টিস (১৮৫৮), ১৯৩০, ১, পৃষ্ঠা: ২৩৮। এছাড়াও, উইলিয়াম এইচ হারবোল্ড, প্রগ্রেসিভ হিউম্যানিটি ইন দি ফিলজফি অফ পি জে প্রুধোঁ, রিভিউ অফ পলিটিকস, জানুয়ারি ১৯৬৯ দ্রষ্টব্য।

৪৪। ফ্রাঙ্কো ভেনতুরির ‘রুটস অফ রিভোলুশনস’ (নিউ ইয়র্ক, ১৯৬৬) গ্রন্থের ইসাইয়া বার্লিন লিখিত ভূমিকা থেকে আলেকজান্ডার হারজেন-য়ের উদ্ধৃতিটি নেওয়া হয়েছে।

৪৫। ‘দি ফিলজফি অফ কান্ট’ গ্রন্থের মডার্ণ লাইব্রেরি সংস্করণে ‘আইডিয়া ফর এ ইউনিভার্সাল হিস্ট্রি উইথ কসমোপলিটন ইনটেন্ট’, তৃতীয় প্রিন্সিপাল।

৪৬। এই অবস্থানের সুস্পষ্ট ভ্রান্তিগুলো নিয়ে চমৎকার আলোচনা পাওয়া যাবে জুন ১৯৬৮-র ‘কমেন্টারি’-তে রবার্ট এ নিসবেট-এর লেখা ‘দি ইয়ার ২০০০ অ্যান্ড অল দ্যাট’ লেখায় ও সেই পত্রিকারই সেপ্টেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত উক্ত লেখার এক বদমেজাজি সমালোচনায়।

৪৭। হেগেল, প্রাগুক্ত, ১০০ পৃষ্ঠার পাদটীকা।

৪৮। ঘটনাটির মন্তব্যহীন প্রতিবেদন আছে উওলিন ও স্খার, প্রাগুক্ত সূত্রে। ২-রা জুন, ১৯৬৯ তারিখের ‘নিউজউইক’-এ পিটার বার্নস লিখিত প্রতিবেদন ‘অ্যান আউটক্রাই: থটস অন বিয়িং টিয়ারগ্যাসড’-ও দ্রষ্টব্য।

৪৯। স্পেন্ডার (প্রাগুক্ত, ৪৫ পৃষ্ঠা) তঁার প্রতিবেদনে বলেছেন যে পারি-র মে আন্দোলনের সময় ফরাসি ছাত্রছাত্রীরা ‘“উৎপাদনশীলতা” (rendement), “প্রগতি”-র মতো তথাকথিত ছদ্মবলের মতবাদকে শর্তহীনভাবে অস্বীকার করেছে’। অন্তত ‘প্রগতি’-র কথা ধরলে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাপারটা এখনও তেমন নয়। এখনও ‘প্রগতিশীল’ ও ‘পশ্চাদগামী’ বল, ‘প্রগতিশীল’ ও ‘পশ্চাদগামী’ সহনশীলতা ইত্যদি কথাবার্তা আমাদের ঘিরে রেখেছে।

৫০। কেবল অপ্রয়োজনীয় নয়, উপরন্তু অনিষ্টকর এহেন উদ্যোগের চমৎকার কিছু উদাহরণ এডমণ্ড উইলসন লিখিত ‘দি ফ্রুটস অফ দি এম এল এ’ (নিউ ইয়র্ক, ১৯৬৮)-তে পাওয়া যাবে।

৫১। জর্জেস সোরেল, রিফ্লেকশনস অন ভায়োলেন্স, প্রথম সংস্করণের ভূমিকা (১৯০৬), নিউ ইয়র্ক, ১৯৬১, ৬০ পৃষ্ঠা।

৫২। সি রাইট মিলস, দি পাওয়ার এলিট, নিউ ইয়র্ক, ১৭১ পৃষ্ঠা ও ম্যাক্স ওয়েবার, পলিটিকস অফ ভোকেশন (১৯২১) গ্রন্থের প্রথম দিকের অনুচ্ছেদগুলোয় আছে। বাম-দের সঙ্গে তঁার সহমতের বিষয়ে ওয়েবার সচেতন ছিলেন বলে মনে হয়। এই প্রসঙ্গে তিনি ব্রেস্ট-লিতভস্ক-য়ে ট্রটস্কির মন্তব্য ‘প্রতিটি রাষ্ট্রই হিংসার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত’ উদ্ধৃত করেছেন এবং মন্তব্য যোগ করেছেন: ‘অবশ্যই তা সঠিক’।

৫৩। পাওয়ার: দি ন্যাচারাল হিস্ট্রি অফ ইটস গ্রোথ (১৯৪৫), লন্ডন, ১৯৫২, ১২২ পৃষ্ঠা।

৫৪। প্রাগুক্ত, ৯৩ পৃষ্ঠা।

৫৫। প্রাগুক্ত, ১১০ পৃষ্ঠা।

৫৬। কার্ল ভন ক্লসউইৎজ, অন ওয়ার (১৮৩২), নিউ ইয়র্ক, ১৯৪৩, প্রথম অধ্যায়; রবার্ট স্ত্রাউজ-হুপি, পাওয়ার অ্যান্ড কমিউনিটি, নিউ ইয়র্ক, ১৯৫৬, ৪ পৃষ্ঠা; ম্যাক্স ওয়েবার-এর উদ্ধৃতি— ‘Macht bedeutet jede Chance, innerhalb einer sozialen Beziehung den eigenen Willen auch gegen Widerstand durchzusetzen’— স্ত্রাউজ-হুপি থেকে নেওয়া হয়েছে।

৫৭। কোন লেখকের লেখা থেকে উদাহরণ নেওয়া হল, তাতে কিছু যায় আসে না, তাই আমি উদাহরণগুলো বেছেছি কোনও বাছবিচার না করেই। এর বিরোধী স্বর খুবই বিরল। যেমন, আর এম ম্যাকইভার বলেছেন: ‘দমনমূলক ক্ষমতা রাষ্ট্রের একটি নির্ণায়ক বৈশিষ্ট্য হতে পারে, কিন্তু তা তার সারবস্তু নয়... বলপ্রয়োগই রাষ্ট্রকে গড়ে তোলে না।’ (দি মডার্ন স্টেট, লন্ডন, ১৯২৬, ২২২–২২৫ পৃষ্ঠা) এই পরম্পরা যে কত শক্তিশালী তা বোঝা যায় একে এড়ানোর জন্য রুশোর প্রচেষ্টার ফল দেখে। বিনা শাসনের এক সরকার সম্পর্কে ভাবতে গিয়ে তিনি সর্বাধিক বলতে পেরেছিলেন: ‘une forme d’association… par laquelle chacun s’unissant a tous n’obeisse pourtant qu’a lui-meme’। এখানেও আদেশ জারি ও তার মান্যতার উপর জোর অপরিবর্তিত থেকে গেছে।

৫৮। ‘দি নোশন অফ দি স্টেট, অ্যান ইনট্রোডাকশন টু পলিটিকাল থিয়োরি’ প্রথম ইতালিয় ভাষায় প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬২ সালে। এর ইংরেজি সংস্করণ কেবলমাত্র লেখককৃত অনুবাদ নয়, বরং পরিবর্ধিত চূড়ান্ত রূপ, যা অক্সফোর্ড প্রকাশনা থেকে ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত হয়। উদ্ধৃত অংশগুলো ওই সংস্করণের ৬৪, ৭০ ও ১০৫ পৃষ্ঠায় আছে।

৫৯। পূর্বোক্ত, ১২৯ পৃষ্ঠা।

৬০। কনসিডারেশনস অন রিপ্রেজেনটেটিভ গভর্নমেন্ট (১৮৬১), লিবারাল আর্টস লাইব্রেরি, ৫৯ ও ৬৫ পৃষ্ঠা।

৬১। জন এম ওয়ালেস, ডেসটিনি হিজ চয়েস: দি লয়ালিজম অফ অ্যান্ড্রু মার্ভেল, কেমব্রিজ, ১৯৬৮, ৮৮–৮৯ পৃষ্ঠা। এই উদ্ধৃতি আমার নজরে আনার জন্য আমি গ্রেগরি ডেসজার্দিন-এর কাছে কৃতজ্ঞ।

৬২। কোনও আইন তার লঙ্ঘনকারীদের জন্য যে শাস্তি নির্ধারণ করে, তা তার সারবস্তু না হলেও, প্রকৃতার্থে সেই নাগরিকদের কথা বিবেচনা করে নিরূপিত, যে নাগরিকরা আইনের প্রতি সমর্থন বজায় রেখেও নিজ নিজ ক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম ঘটাতে চায়। সব চোরই আশা করে যে সরকার তার চুরি করে পাওয়া ধন রক্ষা করবে। কেউ কেউ এটা খেয়াল করিয়েছেন যে আদিকালের আইনব্যবস্থাগুলোয় লঙ্ঘনকারীদের শাস্তির কোনওরূপ সংস্থান ছিল না। (জ্যুভেনেল, প্রাগুক্ত, ২৭৬ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য) আইনলঙ্ঘনকারীদের জনসমাজের বাইরে নির্বাসিত বা একঘরে করা হতো; আইনলঙ্ঘনের মাধ্যমে লঙ্ঘনকারী নিজেকে সেই আইনসমূহ দিয়ে সংগঠিত গোষ্ঠীর বাইরে নিয়ে চলে যেত।

 ‘আইনের জটিলতা, এমনকি রাষ্ট্রীয় আইনেরও জটিলতা’ বিবেচনা করে পাসেরঁ ডেন্দ্রিভে চিহ্নিত করেছেন: ‘অবশ্যই এমন আইন আছে যা “নির্দেশসূচক” হওয়ার বদলে “উপদেশমূলক”, যা “ওপর থেকে চাপানোর” বদলে “সাধারণ্যে গৃহীত” হয়, এবং যার লঙ্ঘনদণ্ড কোনও “উচ্চ ক্ষমতাধরের” বলপ্রয়োগে সম্ভব নয়।’ তিনি ‘কোনও খেলার নিয়ম, সমিতি বা সংঘের নিয়ম, চার্চ-এর নিয়ম’-এর সঙ্গে এই ধরনের আইনগুলোর সাযুজ্য টেনেছেন । ‘অপর কারও জন্য না হলেও আমার জন্য এ নিয়ম প্রযোজ্য’— এই ভাবনা থেকেই এই নিয়ম কেউ মেনে নেয়।

খেলার নিয়ম-এর সঙ্গে আইনের পাসেরঁ ডেন্দ্রিভ-কৃত এই তুলনা আরও কিছুটা বিস্তৃত করা যায় বলে আমার ধারণা। এহেন নিয়মের মূল বিষয় এটা নয় যে আমি একে স্বেচ্ছায় মেনে নিচ্ছি বা তাত্ত্বিকভাবে এর ন্যায্যতা স্বীকার করে নিচ্ছি, মূল বিষয় এখানে যে একে মেনে না নিলে আমি খেলায় অংশ নিতেই পারব না; আমার খেলায় অংশগ্রহণের ইচ্ছাই আইন মেনে নেওয়ার প্রবর্তনা হিসেবে কাজ করে। আর যেহেতু মানুষদের অস্তিত্ব কেবলমাত্র বহুত্বেই সম্ভব, খেলায় অংশগ্রহণের ইচ্ছা তাই বেঁচে থাকার ইচ্ছার সমরূপ। প্রতিটি মানুষের জন্ম হয় এমন সমাজে যেখানে পূর্ব থেকেই আইনের অস্তিত্ব আছে এবং এই আইন তাকে ‘মেনে নিতে’ হয় প্রথমত এই কারণে যে নাহলে সে জগতের মহান খেলায় অংশ নিতে পারবে না। বিপ্লবীদের মতো আমি এই খেলার নিয়মের পরিবর্তন করতে চাইতে পারি; কিন্তু নীতিগতভাবে নিয়মের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা নিছক ‘অবাধ্যতা’ নয়, তা আসলে মানবসমাজে অংশগ্রহণ করতেই অস্বীকার করা। ভ্রান্তি হিসেবে সাধারণত এক উভয়সংকট দেখা দেয় যা হল: হয় আইন পরম ন্যায্য এবং তার বৈধতা নিশ্চিত করার জন্য এক অমর ঐশ্বরিক আইনকর্তার দরকার হয়ে পড়ে, আর নয়তো আইন নেহাতই এক আদেশ যার পিছনে রয়েছে কেবল হিংসার উপর রাষ্ট্রের একচেটিয়া অধিকার। সব আইনই যত না ‘নির্দেশসূচক’, তার চেয়ে অনেক বেশি ‘উপদেশমূলক’ এবং তারা মানবক্রিয়াদি নিয়ন্ত্রণ করে, ঠিক যেমন খেলার নিয়ম নিয়ন্ত্রণ করে খেলাকে। আর আইনের বৈধতার চূড়ান্ত নিশ্চিতি ধরা আছে প্রাচীন রোমান এই প্রবাদবাক্যে: Pacta sunt servanda (প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা উচিত)।

৬৩। প্রাগুক্ত, ৯৮ পৃষ্ঠা।

৬৪। দি ফেডেরালিস্ট, নং ৪৯।

৬৫। প্রাগুক্ত, ৭ পৃষ্ঠা। ১৭১ পৃষ্ঠাও দ্রষ্টব্য যেখানে ‘নেশন’ ও ‘ন্যশনালিটি’ শব্দদ্বয়ের সঠিক অর্থ আলোচনা করতে গিয়ে তিনি যথার্থভাবেই বলেছেন: ‘এত ভিন্ন ভিন্ন বিবিধ অর্থের জঙ্গলে পথ দেখাতে পারেন ভাষাতাত্ত্বিক ও ইতিহাসবিদরা। তাদের কাছেই সাহায্য প্রার্থনা করতে হবে।’ আর প্রাধিকার (অথরিটি) ও ক্ষমতা (পাওয়ার)-এর মধ্যে তফাৎ করার জন্য তিনি অবলম্বন করেছেন সিসেরোর এই উক্তি: potestas in populo, auctoritas in senatu (ক্ষমতা জনগণের, প্রাধিকার আইনসভার)।

৬৬। ‘প্রাধিকারবাদী (অথোরিটারিয়ান) শাসন’ হয়, কিন্তু নিশ্চিতভাবেই তার সঙ্গে স্বেচ্ছাচারী উৎপীড়ক শাসনের, একনায়কতন্ত্রের বা সর্বাত্মকতাবাদী শাসনের কোনও মিল নেই । ‘প্রাধিকারবাদী শাসন’ অভিধার রাজনৈতিক তাৎপর্য ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনার জন্য দ্রষ্টব্য: আমার ‘বিটুইন পাস্ট অ্যান্ড ফিউচার: এক্সেরসাইজেস ইন পলিটিকাল থট’ (নিউ ইয়র্ক, ১৯৬৮) গ্রন্থের ‘হোয়াট ইজ অথরিটি’ শীর্ষক অধ্যায় ও বিস্তৃত গ্রন্থপঞ্জী সংযুক্ত কার্ল-হেঞ্জ ল্যুবকে-র মূল্যবান পাঠ ‘অক্টোরিটাস বেই অগস্তিন’ (স্টুটগার্ট, ১৯৬৮)।

৬৭। প্রাগুক্ত সূত্রে উওলিন ও স্খার সঠিকভাবেই বলেছেন: ‘বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, প্রশাসকমহল ও অধ্যাপকমহল একইসঙ্গে বহু ছাত্রদের কাছে মর্যাদা খুইয়েছে বলেই নিয়ম ভাঙা হচ্ছে।’ তাঁরা সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন: ‘প্রাধিকার যখন বিদায় নেয়, ক্ষমতার প্রবেশ ঘটে।’ এই সিদ্ধান্তও সত্য, কিন্তু আমার আশঙ্কা, তঁারা যে অর্থে বলেছেন, সে অর্থে নয়। ক্ষমতার প্রবেশ প্রথম ঘটেছিল বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয়ে, সে ক্ষমতা ছাত্রছাত্রীদের ক্ষমতা যা নিঃসন্দেহে যে কোনও বিদ্যাচর্চা-প্রাঙ্গনেই সবচেয়ে শক্তিশালী ক্ষমতা নেহাত ছাত্রছাত্রীদের সংখ্যাধিক্যের জোরেই। এই ক্ষমতাকে ভাঙার জন্যই কর্তৃপক্ষ হিংসার পথ নিয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের পক্ষে অহিংস উপায়ে ক্ষমতার মোকাবিলা করা অতি কঠিন কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো আবশ্যিকভাবে প্রাধিকারের উপর প্রতিষ্ঠিত একটি প্রতিষ্ঠানে তার জন্য মর্যাদা প্রয়োজনীয়। রাষ্ট্র ও চার্চ-এর বিযুক্তিকরণের মধ্য দিয়ে কেবলমাত্র প্রাধিকারের উপর ভরসা করতে হওয়ার আগে অবধি ক্যাথলিক চার্চ যেমন করত, আজকের বিশ্ববিদ্যালয়ও তাই করছে— নিরাপত্তার জন্য রাষ্ট্রীয় হিংসার বাহিনী পুলিশকে ডেকে পাঠাচ্ছে। একমাত্র যে ধর্মনিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠানের প্রাধিকারের ভিত্তি এখনও টিকে আছে, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের কঠিনতম সংকটকাল যে চার্চের কঠিনতম সংকটকালের অনুরূপ হবে, তা বোধহয় শুধুমাত্র এক অদ্ভুত সমাপতন নয়। চার্চের সংকট সম্পর্কে হাইনরিখ ব্যোল-এর নির্ণয়— ‘তথাকথিত চিরায়ত স্থিতিশীলতা ছিল যার, সেই “আদেশপালনের নিশ্চিতি”-র পরমাণুর ক্রমান্বয়ী বিস্ফোরণ’— থেকে উভয়েরই উৎস নির্ধারণ করা সম্ভব হতে পারে (‘Es wird immer spatter’, Antwort an Sacharow, জ্যুরিখ, ১৯৬৯)।

৬৮। ৪-ঠা জানুয়ারি ১৯৬৯ তারিখের নিউ ইয়র্ক টাইমস, ১ ও ২৯ পৃষ্ঠা।

৬৯। ফ্রানজ বোর্কেনু যেমন স্পেন-বিপ্লবের পরাজয় নিয়ে ভাবতে গিয়ে বলেছেন: ‘পূর্ববর্তী বিপ্লবগুলোর সঙ্গে বিপুল বৈপরীত্য তৈরি করে একটি বিষয়ের আবির্ভাব ঘটেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোর আগে অবধি প্রতিবিপ্লব সাধারণত নির্ভর করত প্রতিক্রিয়াশীল ক্ষমতাগুলোর সমর্থনের উপর, যা প্রকৌশলগত ও বৌদ্ধিক বিচারে বিপ্লবী বলসমূহের তুলনায় নিকৃষ্ট ছিল। ফ্যাসিবাদের আবির্ভাব তা বদলে দিয়েছে। এখন থেকে প্রতিটি বিপ্লবকেই তদানীন্তন সবচেয়ে আধুনিক, সবচেয়ে দক্ষ ও সবচেয়ে নির্দয় যন্ত্রশক্তির আক্রমণের মোকাবিলা করতে হবে। এর তাৎপর্য হলো এই যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিকাশমান বিপ্লবের যুগ এখন অতীত।’ প্রায় তিরিশ বছর আগে এটা লেখা হয়েছিল (দি স্প্যানিশ ককপিট, লন্ডন, ১৯৩৭, অ্যান আরবর, ১৯৬৩, ২৮৮-২৮৯ পৃষ্ঠা) এবং সম্প্রতি চমস্কি তা সমর্থনযোগ্য বলে উদ্ধৃত করেছেন (প্রাগুক্ত, ৩১০ পৃষ্ঠা)। চমস্কির মতে, ‘কেবলমাত্র যদি আমরা “ফ্যাসিবাদ”-এর জায়গায় “উদার সাম্রাজ্যবাদ” (লিবারাল ইমপেরিয়ালিজম) বসিয়ে নিই’, তাহলে ভিয়েতনামের গৃহযুদ্ধে মার্কিনী ও ফরাসি হস্তক্ষেপ বোর্কেনুর পূর্বাভাসের যথার্থতাকেই প্রমাণিত করছে। কিন্তু আমার মনে হয় শেষোক্ত উদাহরণটি বরং তার উল্টোকথাই প্রমাণ করেছে।

৭০। রেমণ্ড আরন, La Revolution Introuvable, ১৯৬৮, ৪১ পৃষ্ঠা।

৭১। স্টিফেন স্পেন্ডার (প্রাগুক্ত, ৫৬পৃষ্ঠা) অবশ্য অন্যমত পোষণ করেন: ‘বিপ্লবী পরিস্থিতির তুলনায় অনেক বেশি প্রত্যক্ষ হয়ে উঠেছিল অবিপ্লবী পরিস্থিতি।’ ‘খোশমেজাজের পরিস্থিতিতে বিপ্লব হওয়ার কথা ভাবা দুষ্কর’ হতে পারে, কিন্তু বিপ্লবের সূচনাপর্বের ভ্রাতৃসংহতির উল্লাস-উন্মাদনার সময় তো তেমন খোশমেজাজের পরিস্থিতিই বিরাজ করে!

৭২। দ্য গল-এর যাত্রার উদ্দেশ্য বিতর্কিত। ঘটনাপরম্পরার সাক্ষ্য থেকে মনে হয় যে সেনাবাহিনীর সমর্থনের জন্য যে দাম তঁাকে দিতে হয়েছিল তা হল তঁার শত্রুদের গণসমাজে পুনর্প্রতিষ্ঠার সুযোগ, যেমন, জেনেরাল সালান-কে ক্ষমাপ্রদান, বিদোউল-এর প্রত্যাবর্তন এবং ‘আলজেরিয়ার অত্যাচারী' হিসাবে খ্যাত কলোনেল ল্যাচেরয়-এরও প্রত্যাবর্তন। কী দরকষাকষি হয়েছিল খুব একটা জানা নেই। তবে আন্দাজ করা যায় যে ‘ভের্দুন-এর বিজেতা’ বলে মহিমান্বিত করে পেত্যাঁ-র পুনর্বাসন ও তার থেকেও যা গুরুত্বপূর্ণ, যাত্রাশেষে ফিরেই কম্যুনিস্ট পার্টির উপর তথাকথিত ‘les evenements’-এর (ঘটনাবলীর) দায় চাপিয়ে দ্য গল-এর অবিশ্বাস্য মিথ্যাভাষণ হলো এই দরকষাকষির ফল। ঈশ্বর জানেন যে কম্যুনিস্ট পার্টি ও ট্রেড ইউনিয়নগুলোকে ‘les evenements’-এর (ঘটনাবলীর) জন্য সরকারের যদি ভৎর্সনা করার কিছু থাকে তবে তা কেবল এই জন্য যে যথেষ্ট চেষ্টা করেও তারা ঘটনাবলীর ঘটে যাওয়াকে আটকাতে পারেনি!

৭৩। প্রাচীন গ্রিসে ‘পলিস’ (polis) ছিল এইরকমই এক ক্ষমতার সংগঠন, যার প্রধান গুণ সম্পর্কে জেনোফোন বলেছিলেন: এর মধ্য দিয়ে দাস ও অপরাধীদের বিরুদ্ধে নাগরিকরা একে অন্যের দেহরক্ষী হিসাবে কাজ করতে পারত যাতে কোনও নাগরিককেই হিংসার বলি না হতে হয়। (হিয়েরো, IV,৩)

৭৪। ৬-ই এপ্রিল ১৯৬৮ তারিখের ‘দি নিউ রিপাবলিক’-এ ‘ক্যান উই লিমিট প্রেসিডেনসিয়াল পাওয়ার?’

৭৫। অপরাধমূলক ঘটনার তদন্ত অসমাধিত থাকার ক্রমবর্ধমান হার আশঙ্কাজনক। তার ফল কি কেবল অপরাধমূলক ঘটনার হারের চমকপ্রদ বৃদ্ধি, নাকি পুলিশের ক্রমবর্ধমান নৃশংসতাও তার ফল? সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে জে এডগার হুভার রচিত ‘ইউনিফর্ম ক্রাইম রিপোর্টস ফর দি ইউনাইটেড স্টেটস’ (ফেডেরাল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশনস, ইউনাইটেড স্টেটস ডিপার্টমেন্ট অফ জাস্টিস, ১৯৬৭)। তাতে হদিশ দেওয়া নেই কত সংখ্যক তদন্ত প্রকৃতার্থে সমাধানে পৌঁছেছে, কেবলমাত্র কিছু ‘গ্রেফতার’ দিয়ে চেপে রাখা হয়নি। কিন্তু ‘সারসংক্ষেপ’ অংশে উল্লেখ করা হয়েছে যে অপরাধমূলক ঘটনার তদন্তের পুলিশ কর্তৃক সমাধান ১৯৬৭ সালে ৮% হ্রাস পেয়েছে। অপরাধমূলক ঘটনার ২১.৭% (বা ২১.৯%) কেবল ‘গ্রেফতার’ দিয়ে সমাধিত হয়েছে, আর সেগুলোর মধ্যেও মাত্র ৭৫% কোর্টে উঠেছে, যারও মধ্যে আবার মাত্র ৬০% ক্ষেত্রে অভিযুক্ত শেষাবধি দোষী সাব্যস্ত হয়েছে! এই পরিস্থিতিতে অপরাধমূলক ঘটনার বৃদ্ধিই স্বাভাবিক। যে কারণেই পুলিশের কার্যকারিতার এহেন নিম্নগতি হোক না কেন, পুলিশের ক্ষমতার হ্রাস স্পষ্ট প্রতীয়মান এবং এই ক্ষমতাহ্রাসের সঙ্গে সঙ্গেই নৃশংসতা বৃদ্ধি আরো সম্ভবপর হয়ে ওঠে। অপরাধীদের ধরার কাজটা অনভ্যাসে পরিণত করে ফেলা পুলিশদের নৃশংসতার শিকার হচ্ছে ছাত্রছাত্রী ও অন্যান্য বিক্ষোভপ্রদর্শনকারীরা।

অন্য সব দেশের সঙ্গে এই পরিস্থিতির তুলনা মুশকিল কারণ বিভিন্ন দেশে উপাত্তনির্মাণে সংখ্যাতত্ত্বের ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। তা বিবেচনায় রেখেও মনে হয় যে অপরাধমূলক ঘটনার অসমাধিত তদন্তের হারবৃদ্ধি সাধারণ প্রতীত বিষয় হলেও, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো উদ্বেগজনক শিখরে তা আর কোথাও পৌঁছয়নি। যেমন, অপরাধমূলক ঘটনার তদন্তের সমাধানের হার পারি-তে ১৯৬৭-তে ৬২% থেকে ১৯৬৮-তে ৫৬%-তে হ্রাস পেয়েছে, জার্মানিতে ১৯৫৪-তে ৭৩.৪% থেকে ১৯৬৭-তে ৫২.২%-তে হ্রাস পেয়েছে এবং সুইডেনে ১৯৬৭-তে ওই হার হলো ৪১%। (দ্রষ্টব্য: ৭-ই এপ্রিল ১৯৬৭ তারিখের ‘ডের স্পিজেল’-য়ে প্রকাশিত ‘ডয়েশচে পোলিজেই’।)

৭৬। সলঝেনিৎসিন মূর্ত ও বিশদ ভাবে দেখিয়েছেন কীভাবে স্তালিনের পদ্ধতিসমূহ যুক্তিসঙ্গত অর্থনৈতিক বিকাশের সমস্ত প্রচেষ্টাকে ধ্বংস করেছিল। এরপর অন্তত এই চালু অতিকথাটি আর কেউ আউড়াবেন না যে ‘দেশের দ্রুত শিল্পায়নের মূল্য হিসাবে ঘটেছিল স্তালিনিয় সন্ত্রাস ও মানবজীবন ধ্বংস।’ রাশিয়ায় দ্রুত অর্থনৈতিক অগ্রগতি স্তালিনের মৃত্যুর পর ঘটেছিল, কিন্তু তারপরও এটা চোখ এড়িয়ে যেতে পারে না যে পশ্চিমী দেশগুলোর তুলনায় তো বটেই, এমনকি রাশিয়া-অনুগামী দেশগুলোর অনেকের তুলনায়ও রাশিয়া এখনও পেছিয়ে আছে। রাশিয়ার মানুষদের ভিতরেও, কখনও যদি বা এ নিয়ে কোনও বিভ্রম তৈরি হয়ে থাকে, আজ আর তা নেই। তরুণ প্রজন্ম, বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অভিজ্ঞতাসম্পন্নরা, ভালোই জানে যে ১৯৪১ সালের রাশিয়া পরাজয়ের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেয়েছিল প্রায় অলৌকিকভাবে, আর এ অলৌকিকতা নিহিত ছিল এই নিষ্ঠুর সত্যে যে দেশি শাসকদের তুলনায় বিদেশি আক্রমণকারীরা ছিল আরো খারাপ। জাতীয় জরুরী অবস্থাকালীন পরিস্থিতির চাপে দেশীয় শাসকের পুলিশি সন্ত্রাস পিছু হটতে বাধ্য হয়েছিল, তার ফলে চাপমুক্ত সাধারণ মানুষ আবার জোটবদ্ধ হতে পেরেছিল এবং বিদেশি আক্রমণকারীদের হারানোর মতো যথেষ্ট ক্ষমতা তৈরি করতে পেরেছিল। এই সাধারণ মানুষই যখন যুদ্ধশেষে বন্দিশিবির থেকে বেরল বা দখল বজায় রাখার দায়িত্ব সেরে ফিরল, তখনই দেশি শাসকরা দ্রুতই তাদের আবার লম্বা সময়ের জন্য পাঠিয়ে দিল লেবার ক্যাম্পে বা রাজনৈতিক বন্দিশিবিরে যাতে তাদের ‘মুক্ত থাকার অভ্যাস’ থেকে মুক্ত করা যায়। যুদ্ধের সময় মুক্তির আস্বাদ পাওয়া ও যুদ্ধের পরে সন্ত্রাসের স্বাদ পাওয়া এই প্রজন্মই বর্তমানে উৎপীড়ক শাসনব্যবস্থাকে প্রশ্ন করছে।

৭৭। নিকোলাস টিনবারজেন, অন ওয়ার অ্যান্ড পিস ইন অ্যানিম্যালস অ্যান্ড ম্যান, সায়েন্স ১৬০: ১৪১১ (২৮-শে জুন, ১৯৬৮)।

৭৮। জ্যুরিখ থেকে ১৯৫৩ সালে প্রকাশিত ‘Das Tier als soziales Wesen’-র ২৩৭-২৩৮ পৃষ্ঠায়: ‘Wer sich in die Tatsachen vertieft… der wird feststellen, dass vie neuen Einblicke in die Differenziertheit tierischen Treibens uns zwingen, mit allzu einfachen Vorstellungen von hoheren Tieren ganz entschieden aufzuraumen. Damit wird aber nicht etwa— wie zuweilen leichthin gefolgert wird— das Tierische dem Menschlichen immer mehr genahert. Es zeigt sich lediglich, dass viel mehr von dem, was wir von uns selbst kennen, auch beim Tier vorkommt.’

৭৯। দ্রষ্টব্য: এরিখ ভন হোলস্ট, Zur Verhaltensphysiologie bei Tieren und Menschen, Gessamelte Abhandlungen, I, Munchen, ১৯৬৯, ২৩৯ পৃষ্ঠা।

৮০। এই সিদ্ধান্তের অবান্তরতাকে মোকাবিলা করার জন্য একটি পৃথগীকরণ নিয়ে আসা হয়েছে— আক্রমণমনস্কতার মতো অন্তর্জনিষ্ণু স্বতঃস্ফূর্ত প্রবৃত্তির থেকে ক্ষুধার মতো প্রতিক্রিয়াজাত প্রবৃত্তির পৃথগীকরণ। কিন্তু সহজাত আবেগ নিয়ে কোনো আলোচনায় স্বতঃস্ফূর্ততার থেকে প্রতিক্রিয়ার পৃথগীকরণের কোনও অর্থ হয় না। যথার্থভাবে বললে, প্রকৃতিজগতে কোনও স্বতঃস্ফূর্ততা নেই, প্রকৃতিজগতের বিবিধ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যে জটিলতম উপায়ে মানুষ সহ সমস্ত প্রাণী অভিযোজিত, সেই জটিলতম উপায়ের অভিব্যক্তি হলো প্রবৃত্তি বা নোদনা।

৮১। কনরাড লোরেনজ-এর ‘অন অ্যাগ্রেসন’ (নিউ ইয়র্ক)-এর অনুমাননির্ভর চরিত্র স্পষ্ট হয়ে ওঠে আলেকজান্ডার মিতসেরলিচ সম্পাদিত আক্রমণমনস্কতা ও অভিযোজনের উপর ‘Bis hierher und nicht weiter. Ist die menschliche Aggression unbefriedbari (Munchen, ১৯৬৮)’ নামক আগ্রহোদ্দীপক প্রবন্ধসংগ্রহ থেকে।

৮২। ভন হোলস্ট, প্রাগুক্ত, ২৮৩ পৃষ্ঠা: ‘Nicht weil wir Verstandeswesen, sondern weil wir ausserdem ganz urtumliche Tniebwesen sind, ist unser Dasein im Zeitalter der Technik gefahrdet.’

৮৩। যুদ্ধবিশারদ (পোলেমোলজিস্ট)-রা মনে করেন যে দূরপাল্লার অস্ত্র মানুষের আক্রমণাত্মক প্রবৃত্তিকে এমন পরিমাণে অর্গলমুক্ত করে দিয়েছে যে মানবপ্রজাতির রক্ষাকবচস্বরূপ নিয়ন্ত্রণগুলোও এখন অকার্যকরী হয়ে পড়েছে (দ্রষ্টব্য: টিনবারজেন, প্রাগুক্ত)। সেই দূরপাল্লার অস্ত্রকেই আবার অটো ক্লাইনবার্গ (ফিয়ারস অফ আ সাইকোলজিস্ট, ক্যালডার, প্রাগুক্ত, ২০৮ পৃষ্ঠা) এই ইঙ্গিতের বাহক হিসাবে দেখেছেন যে ‘যুদ্ধের প্রবর্তনা হিসেবে ব্যক্তির আক্রমণমনস্কতা আর কোনও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে না।’ এ কথা অনুসরণ করে কেউ বলতে পারে যে সেনারা হত্যাকারী নয়, আর যারা হত্যাকারী, অর্থাৎ ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণমনস্ক, তারা সম্ভবত ভালো সেনা হতে পারে না!

৮৪। এখানে আমি নোয়াম চমস্কি-র (প্রাগুক্ত, ৩৭১ পৃষ্ঠা) একটি বাক্যকে ব্যবহার করেছি, যিনি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ‘দৃঢ়মনস্কতা ও ছদ্মবিজ্ঞানের মুখোশ’ এবং তার পিছনে লুকিয়ে থাকা বৌদ্ধিক ‘শূন্যতা’-কে উন্মোচিত করেছেন বিশেষত ভিয়েতনাম যুদ্ধ সংক্রান্ত বিতর্কগুলোয়।

৮৫। ‘এস ডি এস-এর প্রকাশনাগুলো পড়লে দেখা যাবে যে তারা প্রায়শই কর্তৃপক্ষের হিংসাকে মুখোশের আড়াল থেকে বের করে আনার উদ্দেশ্যে হিংসার মাধ্যমে পুলিশকে প্ররোচিত করার কৌশল সুপারিশ করেছে।’ স্পেন্ডার (প্রাগুক্ত, ৯২ পৃষ্ঠা) মন্তব্য করেছেন যে ‘এই ধরনের হিংসা এমন এক দ্ব্যর্থক রূপ গ্রহণ করে যেখানে উশকানিদাতা একই সঙ্গে আক্রমণকারী ও আক্রান্তের ভূমিকা নিচ্ছে।’ কপটতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ বেশ কিছু বিপদকে প্রশ্রয় দেয় যা সম্পর্কে আমি সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ করেছি ‘অন রিভোলিউশন’ (নিউ ইয়র্ক, ১৯৬৩, ৯১–১০১ পৃষ্ঠা) বইটিতে।

৮৬। কিছু জার্মান ছাত্রগোষ্ঠী সম্প্রতি এমন তত্ত্বায়ন করেছে যা কেউ সুস্থমস্তিষ্কে করতে পারে বলে ভাবা দুষ্কর। তারা তত্ত্বায়ন করেছে: সরকারকে ‘খোলাখুলি হিংসা প্রয়োগ’ করতে বাধ্য করতে পারলে তবেই বিদ্রোহীরা ‘যথেষ্ট উপায়ের মাধ্যমে লড়াই করে এই মল-সম সমাজ (scheissgesellschaft)-কে ধ্বংস করতে পারবে’। (১০-ই ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ তারিখের ‘ডের স্পিজেল’-এর ৩০ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত।) ১৯৩০-এর দশকে কম্যুনিস্ট মহলে এক আজগবি তত্ত্ব চাউর হয়েছিল, যা হল: ফ্যাসিবাদের জয় ফ্যাসিবিরোধীদের পক্ষে আদতে ভালো। এই কম্যুনিস্ট আজগবির (বৌদ্ধিকভাবে না হলেও) ভাষাগতভাবে নিকৃষ্ট এই অধুনা সংস্করণটি হয় নেহাত মিথ্যা অভিনয়, ‘বিপ্লবী’ কপটতারই যা এক রূপবিশেষ, আর নয়ত ‘বিশ্বাসীদের’ রাজনৈতিক মুর্খামির দ্যোতক। পার্থক্য কেবল এখানে যে চল্লিশ বছর আগে কেবল নির্বোধ তত্ত্বায়ন নয়, স্তালিনের উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে হিটলারের পক্ষ নেওয়ার কৌশল এহেন আজগবি তত্ত্বের জন্ম দিয়েছিল। সন্দেহের অবকাশ নেই যে জার্মান ছাত্রদের ঝেঁাক তত্ত্বায়নের দিকে যত বেশি, রাজনৈতিকভাবে ভাগ্যবান অনান্য দেশের ছাত্রদের তুলনায় রাজনৈতিক সক্রিয়া ও বিচারদক্ষতায় খামতি ততই বেশি। এতেও সন্দেহ নেই যে ‘বুদ্ধিদীপ্ত ও গুরুত্বপূর্ণ মগজদের বিচ্ছিন্নকরণ’ অন্য যেকোনো জায়গার থেকে জার্মানিতে অনেক বেশি প্রকট, মেরুকরণ অনেক বেপরোয়া এবং প্রত্যাঘাতের প্রতীত বিষয় ছাড়া স্বদেশের রাজনৈতিক আবহাওয়ার উপর প্রভাবও প্রায় শূন্য। এক্ষেত্রে সদ্য-অতীতের দায় সম্পর্কে আমি স্পেন্ডার (‘দি বার্লিন ইয়ুথ মডেল’, প্রাগুক্ত সূত্র)-এর সঙ্গে একমত যে ছাত্রদের ‘কিছুটা রাগ ও বিরক্তির চোখে দেখা হয়, কেবলমাত্র তাদের হিংসাত্মক আচরণের কারণেই নয়, বরং এই কারণেও যে তারা সদ্য-অতীতের স্মারক... তাড়াহুড়ো করে বোজানো কবর থেকে উঠে আসা প্রেতের মতো চেহারা তাদের।’ এ সবকিছু বোঝা ও বলার পরও অস্বস্তি কাটে না যখন এই অদ্ভুত ঘটনা দেখা যায় যে অন্যান্য দেশের জাতীয়তাবাদী বা সাম্রাজ্যবাদী নীতির সোচ্চার বিরোধিতায় যারা কুখ্যাতভাবে চরমপন্থী সেই নব বাম গোষ্ঠীগুলোও নিজদেশে ওডের-নেইস রেখার স্বীকৃতি বিষয়ে আন্তরিক কোনও উদ্যোগ গ্রহণ করে না। অথচ এই ওডের-নেইস রেখা জার্মানির বিদেশনীতির একটি প্রামাণ্য বিষয় এবং হিটলার-রাজের পরাজয়ের পরবর্তী পর্যায়ে জার্মান জাতীয়তাবাদের পরশপাথর।

৮৭। ফানন, প্রাগুক্ত, ৪৭ পৃষ্ঠা।

৮৮। জে গ্লেন গ্রে-র ‘দি ওয়ারিয়রস’ (নিউ ইয়র্ক, ১৯৫৯) এ বিষয়ে সবচেয়ে সংবেদনশীল ও শিক্ষনীয়। হিংসার চর্চায় উৎসাহী সবার এই বই পড়া উচিত।

৮৯। ফানন, প্রাগুক্ত, যথাক্রমে ৮৫ ও ৯৩ পৃষ্ঠা।

৯০। সোরেল, প্রাগুক্ত, দ্বিতীয় অধ্যায়: ‘অন ভায়োলেন্স অ্যান্ড দি ডেকাডেন্স অফ দি মিডিল ক্লাসেস’।

৯১। প্রাগুক্ত, ‘ভূমিকা, ড্যানিয়েল হালেভি-কে চিঠি’, iv।

৯২। প্রাগুক্ত, সপ্তম অধ্যায়: ‘দি এথিকস অফ দি প্রডিউসারস’, I।

৯৩। প্রাগুক্ত, চতুর্থ অধ্যায়: ‘দি প্রলেতারিয়ান স্ট্রাইক’, II।

৯৪। প্রাগুক্ত, বিশেষত পঞ্চম অধ্যায়, III ও তৃতীয় অধ্যায়: ‘প্রেজুডিসেস এগেইনস্ট ভায়োলেন্স’ III দ্রষ্টব্য।

৯৫। প্রাগুক্ত, পরিশিষ্ট ২: ‘অ্যাপলজি ফর ভায়োলেন্স’।

৯৬। বারবারা ডেমিঙ তঁার ‘অন রেভোলিউশন অ্যান্ড ইকুইলিব্রিয়াম’ শীর্ষক অহিংস সক্রিয়তার জন্য আর্জিতে সম্প্রতি এটি জোর দিয়ে সামনে এনেছেন। ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৮-র ‘লিবারেশন’-এ প্রথম প্রকাশিত হওয়ার পর এই আর্জি পুনর্মুদ্রিত হয়েছে ‘রেভোলিউশন: ভায়োলেন্ট অ্যান্ড নন-ভায়োলেন্ট’ বইতে। সেখানে ৩ পৃষ্ঠায় তিনি ফানন সম্পর্কে বলেছেন: ‘আমার স্থিরবিশ্বাস যে ফাননকে উদ্ধৃত করে অহিংসার পক্ষেও সওয়াল করা যায়... (যদি) ফাননের লেখায় যতবার “হিংসা” শব্দটি এসেছে, ততবার তাকে “বিপ্লবী আপসহীন সক্রিয়তা” দিয়ে প্রতিস্থাপিত করে দেওয়া হয়। খুব অল্প কিছু অনুচ্ছেদ ছাড়া সর্বত্রই এই প্রতিস্থাপন সম্ভব বলে আমার মনে হয়। যে সক্রিয়তার আর্জি তিনি জানিয়েছেন তা বিনা অসুবিধাতেই অহিংস সক্রিয়তা হতে পারে।’ আমার আলোচনার ক্ষেত্রে আরো জরুরী হল এই যে ডেমিঙ ক্ষমতা ও হিংসার মধ্যে পার্থক্যীকরণ করার চেষ্টাও করেছেন এবং চিহ্নিত করেছেন যে ‘অহিংস প্রতিরোধ’-এর অর্থ ‘বলপ্রয়োগ করা... এমনকি যাকে নিছক শারীরিক বল বলা হয়, তাও’ (৬ পৃষ্ঠা)। শারীরিক নিগ্রহ করা থেকে বিরত থাকা এই প্রতিরোধকারী বলের প্রকৃত মূল্য অবশ্য তিনি সঠিকভাবে নিরূপণ করেন নি যখন তিনি বলেছেন যে এর মধ্য দিয়ে ‘বিপক্ষের মানবাধিকারকে সম্মান দেওয়া হয়’। এর মধ্য দিয়ে বিপক্ষের জীবনরক্ষার অধিকারকেই কেবল সম্মান করা হয়, অন্য কোনও মানবাধিকারকে কার্যত সম্মান করা হয়না। একই কথা অবশ্য তাদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য যারা ‘ব্যক্তির বিরুদ্ধে হিংসা’-র পরিবর্তে ‘বস্তুর বিরুদ্ধে হিংসা’-র সওয়াল করে।

৯৭। জুন, ১৯৬৮-র ‘দি আমেরিকান পলিটিকাল সায়েন্স রিভিউ’-তে প্রকাশিত এস ই ফাইনার-এর শিক্ষাপূর্ণ প্রবন্ধ ‘পারেটো অ্যান্ড প্লুটো ডেমোক্রেসি: দি রিট্রিট টু গ্যালাপাগোস’ থেকে উদ্ধৃত।

৯৮। ১৯৬৭ সালের ৬ নম্বর ‘দি পাবলিক ইন্টারেস্ট’-য়ে প্রকাশিত ‘নোটস অন দি পোস্ট-ইন্ডাস্ট্রিয়াল সোসাইটি’।

৯৯। ড্যানিয়েল বেল সতর্ক হলেও আশাবাদী এই কারণে যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার ভিত্তি হল এমন ‘তাত্ত্বিক জ্ঞান, যার অনুসন্ধান, পরীক্ষা ও সংহিতাবদ্ধকরণ ঘটে নিঃস্বার্থ পদ্ধতিতে’ (প্রাগুক্ত)। সম্ভবত এই আশাবাদ ততক্ষণই যথার্থ যতক্ষণ বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিবিদরা ক্ষমতার বিষয়ে অনুৎসাহী থাকে এবং কেবল সামাজিক পদমর্যাদা নিয়েই ভাবিত হয়, অর্থাৎ যতক্ষণ তারা শাসন-প্রশাসনের কাজ করে না। ‘ইতিহাস, মনস্তত্ত্ব বা সমাজতত্ত্ব কোনওটাই নতুন ম্যানডারিনদের শাসনের দিকে আশা নিয়ে তাকিয়ে থাকার অবকাশ আমাদের দিচ্ছে না’— নোয়াম চমস্কির এই নৈরাশ্যবাদ বাড়তি হলেও হতে পারে কারণ কোনও পূর্ব ইতিহাস এখনও তৈরি হয়নি। কিন্তু ক্ষমতাসীন যে কোনো সরকারের হয়ে কাজ করার এহেন নিন্দার্হ নিয়মানুবর্তিতা প্রদর্শনকারী বৈজ্ঞানিক ও বুদ্ধিজীবীরা আদতে মেধাজীবী হতে পারেননি, সমাজ-মই আরোহণে উদগ্রীব হয়েছেন। নোয়াম চমস্কি সঠিকভাবেই প্রশ্ন করেছেন: ‘সাধারণভাবে বললে, কী এমন আছে যার ভিত্তিতে ধরা যায় যে জ্ঞান ও প্রকৌশল সম্পন্নতার দাবিতে যারা শাসন করতে চায় ক্ষমতাব্যবহারের নিরিখে তাদের শাসন কম বিপজ্জনক হবে সম্পদ বা অভিজাত উৎসের দাবিতে যারা শাসন করে তাদের থেকে?’ (প্রাগুক্ত, ২৭ পৃষ্ঠা) যুক্তিসঙ্গতভাবে এর অনুসারী প্রশ্নগুলোও চলে আসে: কী এমন ভিত্তি আছে যার উপর দাঁড়িয়ে ধরা যায় যে ‘প্রাকৃতিক উপহার’ অর্থাৎ মগজদক্ষতার উপর দাঁড়ানো মেধাজীবীদের শাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ দমন বেশি বিপজ্জনক হবে না, বেশি হিংসাত্মক হবে না সেইসব পূর্ববর্তী শাসকদের তুলনায়, যাদের শাসনে নির্যাতিতদের অন্তত এইটুকু সান্ত্বনা ছিল যে কোনও ‘প্রাকৃতিক’ অক্ষমতা বা দোষ তার নির্যাতনভোগের কারণ নয়? এমনটাই কি অধিক সম্ভাব্য নয় যে মেধাজীবীদের শাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ নিজ-মধ্যে ধারণ করবে জাতিগত শত্রুতার খুনে চরিত্র, যা নেহাত শ্রেণিসংঘাতের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন চরিত্রের? সেমতাবস্থায় শাসক-শাসিতের পার্থক্য অপরিবর্তনীয় ‘প্রাকৃতিক উপাত্তের’ যুক্তিতে বাঁধা হবে, যার থেকে মুক্তির একমাত্র যুক্তিগ্রাহ্য উপায় হবে উচ্চতর মেধার সবাইকে হত্যা করা। সেমত কাঠামোয় সুবিধাহীনদের সংখ্যাধিক্য হবে অপরিমেয় এবং ধাপবন্দি কাঠামোর এক ধাপ থেকে উচ্চতর ধাপে ওঠার সম্ভাবনা হবে প্রায় শূন্য। সেহেন অবস্থায় জননায়ক ও জননেতাদের থেকে উদ্ভূত বিপদ কি এতই বড় হয়ে উঠবে না যে ‘মেধাজীবী শাসকরা’ স্বেচ্ছাচারী নিপীড়ন ও অত্যাচারকে বল্গাহীন করতে বাধ্য হবে?

১০০। জুভেনেল, প্রাগুক্ত, যথাক্রমে ১১৪ ও ১২৩ পৃষ্ঠা।

১০১। প্রাগুক্ত, ১৮৭ ও ১৮৮ পৃষ্ঠা।

১০২। ফানন, প্রাগুক্ত, ৯৫ পৃষ্ঠা।

১০৩। রবার্ট এম ফোগেলসন, ভায়োলেন্স অ্যাজ প্রোটেস্ট। ১৯৮৮-তে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমি অফ পলিটিকাল সায়েন্স-এর কার্যবিবরণী ‘আরবান রায়টস: ভায়োলেন্স অ্যান্ড সোসাল চেঞ্জ’-য়ে সংকলিত।

১০৪। প্রাগুক্ত।

১০৫। প্রাগুক্ত। আরও দ্রষ্টব্য: একই সংকলনে অ্যালান এ সিলভার-এর লেখা নিবন্ধ ‘অফিসিয়াল ইন্টারপ্রিটেশন অফ রেসিয়াল রায়টস’।

১০৬। ২১-শে অক্টোবর ১৯৬৮-র নিউজউইক-য়ে স্টিউয়ার্ট আলসপ তঁার অনুভবী প্রতিবেদনে দেখিয়েছেন: ‘ওয়ালেসের পুরুষদের পক্ষে সংযুক্তিকরণের নীতির নামে নিজ সন্তানদের বাজে স্কুলে পাঠাতে অস্বীকার করা সংকীর্ণমনা আচরণ হতে পারে, কিন্তু অস্বাভাবিক কোনওভাবেই নয়। আর অস্বাভাবিক নয় যে সে তার বউয়ের নিগৃহীত হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে চিন্তিত হবে বা তার সবে-ধন-নীলমণি বাড়িটার দখলিস্বত্ব হারানোর ভয়ে চিন্তিত হবে।’ তিনি জর্জ ওয়ালেস-এর বক্তৃতার সবচেয়ে কার্যকরী অংশটাও উল্লেখ করেছেন: ‘কংগ্রেস(আইনসভা)-এর ৫৩৫ জন সদস্য আছে উদারপন্থীরা সহ, তাদের বহুজনেরই সন্তান আছে। জানেন কি তাদের মধ্যে কতজন তাদের সন্তানদের পাবলিক স্কুলে পড়তে পাঠায়? মাত্র ছয়জন!’ বাজেভাবে পরিকল্পিত সংযুক্তিকরণ নীতির আরেকটি বড় উদাহরণ নিল ম্যাক্সওয়েল সম্প্রতি প্রকাশ করেছেন ৮ আগস্ট ১৯৬৮-র ‘ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল'-য়ে। দক্ষিণের রাজ্যগুলোকে স্কুল-সংযুক্তিকরণে ‘উৎসাহিত’ করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার বিচ্যুতির জন্য শাস্তিস্বরূপ বরাদ্দ তহবিল কমিয়ে দেওয়ার নিদান ঘোষণা করেছে। একটি ক্ষেত্রে এর জন্য দুই লাখ ডলার বাৎসরিক সাহায্য আটকে রাখা হয়েছিল। ‘তার মধ্যে এক লাখ পঁচাত্তর হাজার ডলার সরাসরি কৃষ্ণাঙ্গদের স্কুলের জন্য বরাদ্দ ছিল... শ্বেতাঙ্গরা দ্রুত পঁচিশ হাজার ডলার খাজনা সংগ্রহ করে নিজেদের ঘাটতি মিটিয়ে নিয়েছিল।’ সংক্ষেপে, কৃষ্ণাঙ্গদের শিক্ষায় সাহায্য করার নামে যা করা হচ্ছে তা কৃষ্ণাঙ্গদের চালু স্কুলব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে আর শ্বেতাঙ্গদের স্কুলের উপর তেমন কোনও প্রভাবই ফেলছে না।

১০৭। ৪ মে ১৯৬৯ তারিখের ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এর ‘দি উইক ইন রিভিউ’-তে ফ্রেড হেচিনজার-এর প্রতিবেদন: ‘যেমন ধরা যাক, কলম্বিয়াতে গত বছরের অভ্যুত্থানের আগে প্রেসিডেন্টের দপ্তরে ছাত্রজীবন ও শিক্ষকদের বসবাসব্যবস্থার উপর দুটি প্রতিবেদনের উপর পড়ে পড়ে ধুলো জমা হচ্ছিল।’

১০৮। ১০ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ তারিখের ‘ডের স্পিজেল’-এর ২৭ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত রুডি ডুৎস্কের উক্তি। ১৯৬৮-র বসন্তে রুডি ডুৎস্কের উপর আক্রমণের পর গুন্টার গ্রাস-ও একই রকম বক্তব্য রেখেছিলেন। গুন্টার গ্রাস জোর ফেলেছিলেন হিংসা ও সংস্কারের মধ্যে সম্পর্কের উপর:‘যুবদের প্রতিবাদ- আন্দোলন অপর্যাপ্ত ভিত্তির উপর দাঁড়ানো গণতন্ত্রের ভঙ্গুরতাকেউন্মুক্ত করে দিয়েছে। এটা নিশ্চয়ই যুবআন্দোলনের একটি সাফল্য, কিন্তু এই সাফল্য কোনদিকে আমাদের নিয়ে যাবে তা অনিশ্চিত, হয় তা দীর্ঘদিন ধরে বরাদ্দ সংস্কারকে বাস্তবায়িত করবে... আর নয়তো... বর্তমানে বিরাজমান অনিশ্চয়তা কপট প্রবর্তকপুরুষদের জন্য সম্ভাবনাময় বাজার ও ফোকটে বিজ্ঞাপনের ব্যবস্থা করে দেবে।’ সূত্র: ‘স্পিক আউট!’ (নিউ ইয়র্ক, ১৯৬৯), ‘ভায়োলেন্স রিহ্যাবিলিটেটেড’।

১০৯। এখানে আলোচনা করা সম্ভব নয় এমন একটি অন্য প্রশ্ন হল, কী মাত্রায় গোটা বিশ্ববিদ্যালয়ব্যবস্থা এখনও নিজের সংস্কারসাধন করতে সক্ষম। আমার মনে হয় এ প্রশ্নের কোনও সাধারণ উত্তর হতে পারে না। ছাত্রবিদ্রোহ একটি বিশ্বজনীন ঘটনা হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ব্যবস্থাগুলো মোটেই সমরূপ নয় এবং তাদের মধ্যে পার্থক্য কেবল এক দেশ থেকে আরেক দেশে নয়, এক প্রতিষ্ঠান থেকে আরেক প্রতিষ্ঠানেও বর্তমান। তাই এ সমস্যার যে কোনও সমাধান আবশ্যিকভাবে আঞ্চলিক পরিস্থিতি থেকে উঠে আসতে হবে এবং সেই পরিস্থিতির সঙ্গে মানানসই হতে হবে। তাই কোনো কোনো দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংকট প্রসারিত হয়ে দেশের সরকারের সংকটের চেহারা নিতে পারে, জার্মানির পরিস্থিতি আলোচনা করতে গিয়ে ‘ডের স্পিজেল’ (২৩ জুন ১৯৬৯) যেমনটা অনুমান করেছিল।

১১০। পশ্চিম জার্মানির ছাত্রছাত্রী মহলের বিতর্কে মতবাদিক ভাষণ ও কপট-ভাষণের কুজ্ঝটিকাময় ঘোর অস্বচ্ছ আবহাওয়ায় এসব বিষয় নিয়ে কোনো স্পষ্ট আলোচনার সুযোগই পাওয়া যায় না। কার্যত, গুন্টার গ্রাসের ভাষায়: ‘মুখের কথায় অতি বিপ্লবী এই সম্প্রদায় সবসময় খুঁজে চলেছে এবং খুঁজে নিচ্ছে পালাবার পথ’। জার্মান ছাত্রছাত্রী ও নয়া বামের অন্য সদস্যদের মধ্যে এই প্রবণতা বিশেষ করে লক্ষ করা যায় ও তা দেখে ক্রোধের সঞ্চার হয়। একজন তরুণ ইতিহাসবিদ তাদের সম্পর্কে যে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে তা গুন্টার গ্রাস উদ্ধৃত করেছেন এইভাবে: ‘কোনওকিছুই তাদের জানা নেই অথচ তারা সবই জানে’। হান্স মাগনাস এনজেনসবার্জার সাধারণ জার্মান মতামতকেই ব্যক্ত করেছেন যখন তিনি বলেছেন যে চেকোশ্লোভাকিয়ার মানুষদের সমস্যা হল যে ‘তাদের মানস-দিগন্ত অতি সংকীর্ণ এবং রাজনৈতিক অন্তর্বস্তু অতি কৃশ’। (সূত্র: গুন্টার গ্রাস, প্রাগুক্ত, ১৩৮–১৪২ পৃষ্ঠা) এহেন মূর্খতা ও প্রগলভতার তুলনায় পূর্ব জার্মানিতে বিদ্রোহীদের মধ্যে বিরাজমান আবহাওয়া অনেক তাজা ও স্বস্তিকর, যদিও সেজন্য তাদের যে মূল্য চুকোতে হয়েছে তা ভাবলে শিউরে উঠতে হয়। জান কাভান নামের এক ছাত্রনেতা লিখেছে: ‘আমার পশ্চিমের বন্ধুরা প্রায়শই আমায় বলে যে আমরা কেবলমাত্র বুর্জোয়া-গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছি। কিন্তু সব শুনেও পঁুজিবাদী স্বাধীনতা আর সমাজতান্ত্রিক স্বাধীনতার মধ্যে প্রভেদ নির্ণয় আর আমার দ্বারা সম্ভব হয়না’। (র‍্যামপার্টস, সেপ্টেম্বর ১৯৬৮) এমনটা ধরে নেওয়া যায় যে সে ‘প্রগতিশীল হিংসা’ ও ‘অবদমনমূলক হিংসা’-র মধ্যে প্রভেদনির্ণয় করতেও একইরকম সমস্যায় পড়বে। অবশ্য প্রায়ই যেমন দাবি করা হয়ে থাকে, তেমন সিদ্ধান্ত করাও ভুল হবে যে পশ্চিমের দেশগুলোর মানুষদের স্বাধীনতা নিয়ে কোনও ন্যায়সঙ্গত অভিযোগ নেই। সন্দেহ নেই যে খুব স্বাভাবিকভাবেই ‘পশ্চিমের ছাত্রছাত্রীদের প্রতি চেকদের মনোভাব ঈর্ষার রঙে রাঙানো’ (ছাত্রছাত্রীদের একটা পত্রিকা থেকে স্পেন্ডার কর্তৃক উদ্ধৃত, স্পেন্ডার, প্রাগুক্ত, ৭২ পৃষ্ঠা), কিন্তু এও সত্য যে রাজনৈতিক হতাশার কিছু কম নৃশংস কিন্তু অত্যন্ত নির্ধারক অভিজ্ঞতা তাদের নেই।

১১১। পারেতোর উক্তি, ফিনার, প্রাগুক্ত থেকে উদ্ধৃত।

১১২। দ্রষ্টব্য: গুন্টার গ্রাস ও পাভেল কোহুট, Briefe uber die Grenze, হামবুর্গ, ১৯৬৮, সথাক্রমে ৮৮ ও ৯০ পৃষ্ঠা। আন্দ্রেই ডি শাখারভ, প্রাগুক্ত।

১১৩। হারবার্ট জে গানস, দি ঘেটো রেবেলিয়নস অ্যান্ড আরবান ক্লাস কনফ্লিক্ট, আরবান রায়টস, প্রাগুক্ত।

১১৪। হেনরি স্টিল কোমাজের-এর গুরুত্বপূর্ণ নিবন্ধ, ৭৪ সংখ্যক টীকা দ্রষ্টব্য।

 

 

 

 

1 Comments
  • avatar
    http://boyarka-inform.com/

    31 December, 2024

    Woah! I'm really digging the template/theme of this site. It's simple, yet effective. A lot of times it's difficult to get that "perfect balance" between superb usability and visual appeal. I muzt say that you've done a great job with this. Additionally, the blog loads very quick for me on Firefox. Exceptional Blog! http://boyarka-inform.com/

Leave a reply