ভূমিকা
১৮৮৭ সালে নিৎশে ‘নৈতিকতার কুলজিশাস্ত্র প্রসঙ্গে’ (On the Genealogy of Morals) লেখেন। একটি ভূমিকা ও তিনটি প্রবন্ধ নিয়ে নাতিদীর্ঘ একটি বই। সেই বইয়ের দ্বিতীয় প্রবন্ধটি বাংলা তর্জমায় এখানে উপস্থিত করা হয়েছে। ১৮৮৭ সালে নিৎশের বয়স ছিল তেতাল্লিশ। আর প্রায় এক বছর পরেই তিনি মানসিক সুস্থতা হারিয়ে সন্দর্ভ রচনার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলবেন। তাই নিৎশের লেখকজীবনের শেষ পর্যায়ের কাজ এই বইটি। তবে শুধু এই কারণেই নয়, বইটি লেখার সময় নিজের এযাবৎ চিন্তানুশীলনের একটি সারসংক্ষেপিত রূপ হাজির করার তাগিদও যেহেতু নিৎশের মধ্যে কাজ করেছিল, তাই এই বইটিকে তাঁর ভাবনার পরিপক্ক রূপের একটি প্রকাশ হিসেবেও ধরা হয়। এই বইটি লেখার সময় নিৎশের মধ্যে যে তাগিদ কাজ করছিল তা সংক্ষেপে একটু দেখে নেওয়া যাক।
ঠিক এর আগেই প্রকাশিত হয়েছিল নিৎশে-র ‘ভালো ও মন্দ পেরিয়ে’ (‘Beyond Good and Evil’) বইটি, যা নিয়ে নিৎশের উচ্চ প্রত্যাশা ছিল। ঘনিষ্ঠজনেদের কাছে নিৎশে আশা প্রকাশ করেছিলেন যে অবশেষে তাঁর এই বইটি ডিনামাইট বিস্ফোরণের মতো সমকালীন ভাবনাচিন্তার জগতকে তছনছ করে দেবে। কিন্তু তাঁর প্রত্যাশা মেটেনি। পূর্বে প্রকাশিত অন্যান্য বইয়ের মতো এইটিও সমকালীন পাঠকমহলে প্রায় কোনো প্রতিক্রিয়াই জাগাতে পারেনি। বই প্রকাশনার অর্থ নিজে যুগিয়ে নিৎশের অর্থনৈতিক সঙ্গতিতেও টান পড়েছিল। বন্ধু ওভারবেক-কে ১৮৮৭ সালে লেখা চিঠিতে লেখা চিঠিতে নিৎশে বলেছিলেন: ‘ভালো ও মন্দ পেরিয়ে’ বইটি ছাপা হওয়ার পর দেদার ভাবে বিলোনো সৌজন্য সংখ্যার মধ্যে মাত্র পাঁচ ভাগের এক ভাগ ক্ষেত্রে প্রাপ্তিস্বীকারের স্বীকৃতিটুকু এসেছে, মাত্র ১১৪ খানি কপি বিক্রি হয়েছে, তা থেকে যা পাওয়া গেছে তা বই ছাপায় তাঁর করা খরচের কণামাত্রও উশুল করেনি। এই খরচের একটি হিসেবও সেখানে তিনি দিয়েছিলেন: তিনি ১০০ থেলার খরচ করেছিলেন ‘জরাথুষ্ট্র’ চতুর্থ খণ্ডের ছাপার জন্য, ৩০০ থেলার ‘ভালো ও মন্দ পেরিয়ে’ ছাপার জন্য, আরআরো ১৫০ থেলার অন্যান্য পুরানো কাজের পরিবর্ধিত পরিমার্জিত সংস্করণ ছাপার জন্য।
এই আশাভঙ্গ নিৎশেকে তাঁর পরিকল্পনা বদল করার দিকে নিয়ে গেল। তিনি আগে ভেবেছিলেন যে ‘ভালো ও মন্দ পেরিয়ে’-র মধ্য দিয়ে অতীত ও বর্তমান চিন্তাভাবনার জগৎ সম্পর্কে তাঁর বিশ্লেষণ-সমালোচনা একটা পূর্ণতায় এসে পৌঁচেছে, তাঁর জীবনের একটি পর্বও চূড়ান্ত বিন্দুতে উপনীত হয়েছে, এর মধ্য দিয়ে তিনি উপনীত হয়েছেন তাঁর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্যে, যে কর্তব্য হল ‘ভবিষ্যতের দর্শন’ হাজির করা। এই গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য সমাপনেই তিনি তাঁর বাকি জীবন ব্যয় করবেন ঠিক করে নতুন বইয়ের পরিকল্পনা শুরু করেছিলেন, যার নাম ভেবেছিলেন ‘ক্ষমতার অভিপ্রায়’ (The Will to Power)। কিন্তু আশাভঙ্গের পরে তিনি তাঁর পূর্ব পরিকল্পনা থেকে সরে এসে ‘ভালো ও মন্দ পেরিয়ে’ বইয়ে উপস্থাপিত বিষয়কে আবারও নতুনভাবে হাজির করার সিদ্ধান্ত নেন। সেই সিদ্ধান্তের ফসল ‘নৈতিকতার কুলজিশাস্ত্র’ (On the Genealogy of Morals)। বইটির লেখনীতে তিনি বাদানুবাদপূর্ণ বিতর্ক (polemic)-এর ধরনটিকে ক্ষুরধার করতে চেয়েছিলেন যাতে তা পাঠকের বিশ্বাস ও ভাবনার জগতকে নির্লিপ্ততার কুঠুরিতে গুটিয়ে থাকতে না দেয়, আর অন্যদিকে বইটির প্রথম সংস্করণে উপনাম হিসেবে ব্যবহৃত ‘প্রসারণ ও বিশদীকরণ’ (‘expansion and elaboration’) পদবন্ধের মধ্য দিয়ে এটিও স্পষ্ট যে তিনি এখানে তাঁর বিশ্লেষণ-সমালোচনাকে ফের একটি চূড়ান্ত পূর্ণতায় হাজির করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন।
১৮৮৭ সালের ১০ জুলাই থেকে ৩০ জুলাই-য়ের মধ্যে ‘নৈতিকতার কুলজিশাস্ত্র প্রসঙ্গে’ বইটির মূল অংশ লেখা হয়। ১৮৮৭ সালের ১৬ নভেম্বর, আবারও নিৎশের নিজের খরচে বইটির প্রথম জার্মান সংস্করণ প্রকাশিত হয়। পাঠক-প্রতিক্রিয়া এবারও খুব না পেলেও, ডিসেম্বরের শেষে তিনি লেখেন: ‘এখন আমি মধ্য দুপুরে দাঁড়িয়ে: একটা দরজা বন্ধ হল আর আরেকটা এখন খুলল’ --- খুলে যাওয়া নতুন দরজাটা হল ভবিষ্যতের দর্শন ‘ক্ষমতার অভিপ্রায়’-এর দিকে যাওয়ার দরজা।
অচিরেই মানসিক অসুস্থতার কবলে লেখনীশক্তি হারানোর ফলে নিৎশের জীবনে সেই মধ্য দুপুরেই রাত নেমে এসেছিল। ‘ক্ষমতার অভিপ্রায়’-এর কাজ শেষ করে বইয়ের আকার তিনি দিয়ে এতে পারেননি। তবে তাঁর এই বই শুধু তাঁর জন্য নয়, পরবর্তী বহু চিন্তকদের জন্যও পুরোনো দরজা বন্ধ করে নতুন দরজা খুলে দিয়ে আসছে আজও। সংক্ষেপে সেইরকম একটি দিকের কথা আলোচনা করা যাক যা এখানে তর্জমা করা দ্বিতীয় প্রবন্ধটির ক্ষেত্রেও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
তর্জমা করা প্রবন্ধটির ১২ নম্বর অংশে নিৎশে বলছেন:
একটি বিশেষ বস্তুর উৎপত্তি কী থেকে ঘটল এবং সেই বস্তুর চূড়ান্ত উপযোগিতাটি কী, অর্থাৎ, উদ্দেশ্যসমূহের এক কাঠামোয় তার বিন্যাস ও প্রকৃত ব্যবহারটি কী— এই দুটি যে একে অপরের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা; কোনো এক ভাবে অস্তিত্বধারণ করে তার বর্তমান অবস্থায় পৌঁছেছে যে বস্তু তা যে তার উপর অধিষ্ঠিত ক্ষমতার দ্বারা বারংবার নতুন নতুন প্রেক্ষিত থেকে নতুন করে ব্যাখ্যাত হবে, নতুনভাবে উপযোজিত হবে, পুনর্সংগঠিত হয়ে নতুন উদ্দেশ্যে পুনর্বহাল হবে; জৈব জগতে সমস্ত ঘটনাই যে ক্ষমতায় পর্যুদস্ত করা ও প্রভুত্ব স্থাপন করার মধ্য দিয়ে কাজ করে এবং অন্যদিকে যে কোনো ক্ষমতায় পর্যুদস্ত করা ও প্রভুত্ব স্থাপন যে এমন এক পুনর্ব্যাখ্যা বা পুনর্সমন্বয়ের মধ্য দিয়ে কাজ করে যা ততোবধি কার্যকরী ‘বোধবুদ্ধি’ ও ‘উদ্দেশ্য’-কে অস্পষ্ট করে দেয় বা পুরোপুরি মুছেই দেয়— এই যে মূলতত্ত্বগুলোয় কত না কঠিন পথে আমরা পৌঁছেছি এবং না পৌঁছে উপায় নেই, যে কোনো ধরনের ইতিহাস নির্মাণে এদের থেকে গুরুত্বপূর্ণ মূলতত্ত্ব আর কিছু হতে পারে না।
ইতিহাস নির্মাণের এই দৃষ্টিভঙ্গি নিৎশের জীবৎকালে না হলেও, বিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে আজ অবধি নিৎশীয় কুলজিশাস্ত্র (Genealogy)-কে সমালোচনাত্মক বুদ্ধিচর্চার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান করে তুলেছে। এই কুলজিশাস্ত্র কোনো ঐতিহাসিক বস্তুর উৎস খোঁজার নামে এমন কোনো অন্তর্বস্তু (essence)-র সন্ধান করে না যার উদ্বোধন, প্রস্ফুটন ও ক্রমবিকাশের মধ্য দিয়ে ইতিহাস নির্মিত হয়। ক্রমবিকাশের একরৈখিক পথে অন্তর্বস্তুর ক্রমশ নিজেকে পূর্ণতর রূপে হাজির করার প্রয়াস হিসেবে ইতিহাস নির্মাষের যে সমস্ত আয়োজন, সেগুলো বর্তমানকে বা বর্তমানে আভাসিত ভবিষ্যৎ কোনো বর্তমানতাকে সমস্ত অতীতের বিকাশপ্রক্রিয়ার চূড়ান্ত লক্ষ্য হিসেবে হাজির করে। সেই সূত্রে বিকাশের নিয়মকে সূত্রবদ্ধ করে তার অনিবার্যতা প্রতিপাদন করার চেষ্টা করে। নিৎশীয় কুলজিশাস্ত্র এহেন কোনো বিকাশপ্রক্রিয়া, তার একরৈখিকতা, তার অনিবার্যতা এই সমস্ত কিছুকেই পরিহার করে। যে কোও ঐতিহাসিক বস্তুর অর্থ-তাৎপর্য-উপযোগিতা যে কোনো সন্ততা বজায় না রেখে বারবার ক্ষমতা-অভিপ্রায়ের টানাপোড়েনে পুনর্নির্মিত হতে হতে যায়, আকস্মিকতাই তার বৈশিষ্ট্য, পূর্ব থেকে নির্ধারণ করা তা অসম্ভব--- এই তত্বকেই নিৎশে মূলতত্ত্বে স্থান দিয়েছেন। ১৯৭১ সালে রচিত ‘নিৎশে, কুলজিশাস্ত্র, ইতিহাস’ (Nietzsche, Genealogy, History) নামক প্রবন্ধে এই বিষয় নিয়ে আলোচনার শেষে মিশেল ফুকো-র বলা কয়েকটি কথা এখানে প্রণিধানযোগ্য। ফুকো বলেছিলেন যে ১৮৭৪ সালে ‘জীবনের জন্য ইতিহাসের ব্যবহার ও অপব্যবহার’ (The Use and Abuse of History for Life) প্রবন্ধে নিৎশে ইতিহাস নির্মাণের তিনটি ধরনকে চিহ্নিত করেছিলেন: প্রথমত যে ধরন অতীত স্মারকের দিকে ভক্তি নিয়ে চেয়ে থাকে, দ্বিতীয়ত যা অতীত থেকে টানা কোনো সন্ততাকে রক্ষা করতে চায়, আর তৃতীয়ত যা সমালোচনার দৃষ্টিতে অতীতের অন্যায়গুলোকে কাঠগড়ায় তুলে বর্তমান মানুষের উপলব্ধ কোনো সত্য-ন্যায়-কে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। জীবনের সদর্থক ও সৃজনশীল ক্ষমতার পক্ষ নিয়ে তখন নিৎশে ইতিহাস-নির্মাণের এই তিনটে রূপেরই সমালোচনা করেছিলেন। ফুকোর মনে হয়েছে যে ‘নৈতিকতার কুলজিশাস্ত্র প্রসঙ্গ’-তে এসে নিৎশের কুলজিশাস্ত্র শুধু সমালোচনার স্তর পেরিয়ে এই তিনটে রূপের রূপান্তরসাধনের মধ্য দিয়ে নতুন রূপকে হাজির করছে, যেখানে অতীত স্মারকের প্রতি ভক্তি রূপান্তরিত হচ্ছে শানিত ব্যঙ্গ-বিদ্রূপে, অতীত থেকে তুলে আনা সন্ততা রূপান্তরিত হচ্ছে সুব্যবস্থিত বিচ্ছিন্নকরণে, আর বর্তমান মানুষের মুঠোয় ধরা সত্য-ন্যায়-এর ধারণা দিয়ে অতীত অন্যায়ের সমালোচনা রূপান্তরিত হচ্ছে সেই খোদ মানুষের বিনাশসাধনে, যে মানুষ জ্ঞানের অভিপ্রায় সুলভ অন্যায়ের মধ্য দিয়ে জ্ঞান রক্ষা করতে চায়।
এখানে তর্জমা করা প্রবন্ধটিতে আমরা এই নিৎশীয় কুলজিশাস্ত্রের মূলসূত্রগুলোর উচ্চারণের পাশাপাশি তার প্রয়োগকেও প্রত্যক্ষ করব। দায়বদ্ধতা, ব্যক্তিক সার্বভৌমত্ব, দোষ, শাস্তি, বিবেকদংশন, পাপ, পাপমুক্তির অসম্ভাব্যতা, ইত্যাদি ধারণার কুলজি নির্মাণের মধ্য দিয়ে খ্রিস্টান নৈতিকতার উপর এখানে আক্রমণ হেনেছেন নিৎশে। কেবল তৎকালীন খ্রিস্টান নৈতিকতাকে নয়, বর্তমান যেকোনো পাঠকের বহু স্থিরবিশ্বাস ও প্রশ্নাতীত করে রাখা ধারণাকেই বিপন্ন করে তুলতে পারে এই আক্রমণ।
পরিশেষে একটি কথা। তর্জমাটি মূল জার্মান থেকে করা হয়নি, জার্মান ভাষায় তেমন জ্ঞান আমার নেই। অনুবাদটি করা হয়েছে মূল জার্মানের ইংরেজি অনুবাদ থেকে। দুটি ইংরেজি অনুবাদ--- একটি কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস দ্বারা প্রকাশিত সি ডিয়ের্থে কৃত অনুবাদ, ও অন্যটি রিচার রিসোর্সেস পাবলিকেশন দ্বারা প্রকাশিত আয়ান জনস্টন কৃত অনুবাদকে পাশাপাশি রেখে এবং এই বইটি নিয়ে বিভিন্নজনের আলোচনাকে মাথায় রেখে মূল ভাষা থেকে অনুবাদ না করতে পারার সমস্যাটিকে যতটা কমানো যায় তার চেষ্টা করেছি। ভাষান্তরের প্রচেষ্টা ভিন্ন দুটি সাংস্কৃতিক পরিবেশে উদ্ভূত ভিন্ন দুটি ভাষার প্রতিমা-লক্ষণা-কল্পনার মধ্যে মিল-বিনিময় তৈরি করে একে অপরের কাছে পৌঁছানোর যে আন্তরিক হলেও শেষত অসম্ভব প্রচেষ্টা, তা শেষাবধি মূলের থেকে একটা দূরত্বে থামিয়ে দেবেই, তবু বর্তমান অনুবাদকের অপারগতা যদি সেই দূরত্ব আরো বাড়িয়ে থেকে থাকে, তাহলে আন্তরিকভাবেই আমি ক্ষমাপ্রার্থী।
বিপ্লব নায়ক
মে, ২০২৪
১
অঙ্গীকার করার অধিকারসম্পন্ন এক জীবের প্রতিপালন— এই আপাতবিরোধী দায়িত্বটাই কি মানুষদের সাপেক্ষে প্রকৃতি নিজ ঘাড়ে তুলে নেয়নি? মানুষদের আসল সমস্যাটাও কি এটাই নয়?... এই সমস্যা যে বড় মাত্রায় সমাধিত হতে পেরেছে তা আরো আশ্চর্যজনক ঠেকবে এমন যে কারও কাছে যে কিনা এই অঙ্গীকারকরণের বিপরীতে ক্রিয়াশীল বিস্মরণপ্রবণতাকে কদর করতে জানে। অগভীর মানুষরা ভাবে যে বিস্মরণপ্রবণতা হল নেহাতই এক প্রকার জাড্য-বল, কিন্তু আসলে তা নয়। অধিকত বরং তা দমন করার এমনই এক সক্রিয় সক্ষমতা যা সর্বোচ্চ অর্থেই সদর্থক। যখন কেবল আমরা একাই যাপন করি, অনুভব করি এবং নিজেদের মধ্যে শুষে নিতে থাকি (যাকে আমরা মানসিক আহার-প্রক্রিয়া বলতে পারি), তখন কী ঘটে চলে তা সম্পর্কে যে আমরা ততটুকুই অবহিত থাকি যতটা আমরা অবহিত আমাদের দৈহিক পুষ্টিগ্রহণের হাজারমুখী প্রক্রিয়া (তথাকথিত দৈহিক আহার) সম্পর্কে, সে কেবল ওই বিস্মরণপ্রবণতা রূপী সক্রিয় সক্ষমতার কারণেই। সচেতনতার জানালা-দরজাগুলো তখনকার জন্য বন্ধ থাকে; আমাদের কৃত্যকারী ইন্দ্রিয় ও অঙ্গগুলোর ছায়াচ্ছন্ন জগৎ পরস্পরের পক্ষে ও বিপক্ষে যেভাবে কাজ করতে থাকে, তার শ্রমযন্ত্রণা ও কোলাহল সেই দরজা-জানালা ভেদ করে প্রবেশ করে না; সেখানে বিরাজ করে অল্প নীরবতা, সচেতনতার শূন্যাবস্থা: যাতে আবারও নতুনের জন্য, সর্বোপরি মহত্তর কর্ম ও আধিকারিকদের জন্য, শাসন-বিচারের জন্য, এগিয়ে ভাবার জন্য, কর্তব্য নির্ধারণের জন্য (কারণ আমাদের জৈব অবয়বটি কতিপয়ের শাসনে অভ্যস্ত) ফাঁকা জায়গা তৈরি হয়। অর্থাৎ, আগেই যা বলেছি, সক্রিয় বিস্মরণপ্রবণতা মনস্তাত্ত্বিক শৃঙ্খলা, প্রশান্তি ও শিষ্টাচারের প্রহরী হিসেবে জনৈক দ্বারিকের মতো কাজ করে বলে বলা যায়। সুতরাং আমরা দেখতে পাই যে বিস্মরণপ্রবণতা না থাকলে আনন্দাবস্থা, চিত্তসুখ, আশা, গর্ব থাকত না, বর্তমান বলেও কিছু থাকত না। যে মানুষের মধ্যে এই দমন ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ঠিকমতো কাজ করছে না, সে অজীর্ণ-রোগগ্রস্তের সঙ্গে তুলনীয় (আর শুধু তুলনীয়ই নয়)— সর্বরিক্ত হয়ে সে ‘েশষ’ হয়ে যায়।... এখন এই যে বিশেষ প্রাণীটি আবশ্যিকভাবেই বিস্মরণপ্রবণ, যার মধ্যে বিস্মরণপ্রবণতা একটি বল বা সবল স্বাস্থ্যের রূপ হিসেবে বর্তমান, তার মধ্যেই বিপরীত একটি সক্ষমতাও বংশগতভাবে পরিপুষ্ট হয়েছে। সেই বিপরীত সক্ষমতা হলো স্মৃতি, যার প্রভাবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিস্মরণপ্রবণতা নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়— বিশেষত, সেই সব ক্ষেত্রে নিষ্ক্রিয় হয়ে যায় যেখানে প্রতিজ্ঞা করার দরকার হয়। কোনোমতেই এ কেবল মনে একবার খোদাই হয়ে যাওয়া কোনও ধারণাকে আর কখনো বিসর্জন দিতে না পারার নিষ্ক্রিয় অক্ষমতা নয়। কোনো এক সময়ে করা কোনো প্রতিজ্ঞা যা আর নিষ্পন্ন করা যাচ্ছে না, কেবলমাত্র তেমন কোনো বদহজমের বিষয়ও এ নয়। বরং এ এমন এক সক্রিয় ইচ্ছা যা সেই বিষয়টি থেকে আর কখনো মুক্ত হতে চায় না, কোনো এক বিশেষ মুহূর্তের অভিপ্রায়ের প্রতি লাগাতার নাছোড় আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে যায়, তা যেন নিজ অভিপ্রায়ের প্রকৃত স্মৃতি, যার ফলে সেই আদি “আমি চাই”, “আমি করব” ও তার প্রকৃত নিষ্পাদনের মাঝে অপরিচিত নতুন বস্তু, পরিস্থিতি, এমনকি অভিপ্রেত ক্রিয়া-র গোটা জগৎ প্রক্ষিপ্ত হলেও দ্বিতীয় কোনো ভাবনা ঠাঁই পায় না, অভিপ্রায়ের দীর্ঘ প্রলম্বিত শৃঙ্খলে কোনও ছেদ ঘটে না। কিন্তু এর জন্য বেশ কিছু পূর্বশর্ত প্রয়োজন। ভবিষ্যৎকে এভাবে সংগঠিত করার জন্য মানুষকে প্রথমে নিশ্চয়ই আবশ্যক ঘটনাকে আকস্মিক ঘটনা থেকে আলাদা করা শিখতে হয়েছিল, আরো শিখতে হয়েছিল কীভাবে কার্য-কারণ সম্বন্ধিত করে ভাবতে হয়, দূরবর্তী ঘটনাকে বর্তমানে ঘটমানের মতো করে দেখতে হয়, আন্দাজ করতে হয়, অভিপ্রেত লক্ষ্য নির্দিষ্ট করতে হয় এবং নিশ্চিতভাবে লক্ষ্যে পৌঁছানোর উপায় করতে হয়, নকশা অনুসরণ ও হিসাবনিকাশের সাধারণ সক্ষমতা গড়ে তুলতে হয়— আর এসবের জন্য মানুষ আবশ্যিকভাবে প্রথমে নিজেই এমন হয়ে ওঠে যার পূর্বাভাস সম্ভব, যা নির্দিষ্ট নিয়মাবলীতে বাঁধা, এমনকি তার নিজের কল্পনাও সেখানেই সদাস্থবির, তবেই অবশেষে সে প্রতিজ্ঞা করার উপযুক্ত আচরণ করতে সমর্থ হয়—নিজেকে সে ভবিষ্যতের জন্য বন্ধক রাখতে পারে!
২
এই ক্রমবিকাশের দীর্ঘ পথ ধরেই দায়বোধের উৎপত্তি। আমরা ইতিমধ্যেই দেখেছি যে প্রতিজ্ঞা করতে পারে এমন প্রাণী প্রতিপালনের একটি শর্ত ও পূর্ব-প্রয়োজন হিসেবে সেই কাজের মধ্যেই নিহিত থাকে আরো নির্দিষ্ট একটি কাজ— যে কাজ হল সর্বাগ্রে আবশ্যিকভাবে একজন মানুষকে এমন মাত্রায় সমরূপ করে তোলা যাতে সে তারই মতো অনেকের মধ্যে একজন হিসেবে প্রথানুগ ও সেই কারণেই পূর্বাভাসযোগ্য হয়ে ওঠে। এতদসংযুক্ত যে বিপুল কর্তব্যটিকে আমি এর আগে ‘প্রত্যুষ: নৈতিকতার পূর্বসংস্কার সম্পর্কে কিছু ভাবনা’ (‘Daybreak: Thoughts on the Prejudices of Morality’, ১৮৮১) নামক রচনার ৯, ১৪ ও ১৬ নম্বর অংশে ‘প্রথানুগত্যের নৈতিকতা' বলেছিলাম, মানবপ্রজাতির অস্তিত্বের দীর্ঘতম পর্যায় অর্থাৎ গোটা প্রাগৈতিহাসিক যুগ জুড়ে নিজ সত্তার উপর একজন মানুষের আবশ্যিক সে কাজ যত ক্লেশ, উৎপীড়ন, একঘেয়েমি ও মূর্খতাই প্রকাশ করুক না কেন, তা তার অর্থ-তাৎপর্য ও মহৎ যাথার্থ্য লাভ করেছে এই থেকে যে প্রথানুগত্যের নৈতিকতা ও শক্ত সামাজিক বন্ধনের সাহায্যেই মানুষকে যথার্থ পূর্বাভাসযোগ্য করে তোলা হয়েছিল। এই বিরাট প্রক্রিয়ার শেষলগ্নের সেই বিন্দুতে এসে বরং দাঁড়ানো যাক যেখানে গাছে শেষাবধি ফল ধরেছে, সমাজ ও প্রথানুগত্যের নৈতিকতা উপায় হিসেবে যে লক্ষ্যের দিকে ধাবিত ছিল তা শেষাবধি উন্মোচিত করেছে: তখন আমরা সেই গাছের সবচেয়ে পরিপক্ক ফল হিসেবে সার্বভৌম ব্যক্তির দেখা পাব। এই সার্বভৌম ব্যক্তি কেবল তার নিজের সঙ্গেই তুলনীয়, নৈতিকতার ঊর্ধ্বে ওঠা স্বয়ংশাসিত ব্যক্তি হিসেবে সে প্রথানুগত্যের নৈতিকতা থেকে নিজেকে আবার আলগা করে নিয়েছে (কারণ ‘স্বয়ংশাসিত’ ও ‘নৈতিক’ শব্দদুটো পরস্পর-বহির্ভূত), সে নিজস্ব স্বাধীন টেকসই অভিপ্রায়ের অধিকারী, প্রতিজ্ঞা করার অধিকারী— আর তার প্রতিটি পেশীতে স্পন্দিত হচ্ছে এমনই এক সচেতনতা যা অবশেষে তার নিজ মধ্যে জীবন্ত রূপে মূর্ত হওয়া অস্তিত্ব নিয়ে গর্বিত, যা ক্ষমতা ও স্বাধীনতার এক প্রকৃত সচেতনতা, সাধারণভাবে মানুষ প্রজাতির চূড়ান্ত পূর্ণাবস্থায় পৌঁছতে পারার এক অনুভূতি যার মধ্যে তরঙ্গ খেলছে। স্বাধীন হয়ে ওঠা এই মানুষ, যে প্রকৃতই প্রতিজ্ঞা করার অধিকারী, স্বাধীন অভিপ্রায়সম্পন্ন এই প্রভু, এই সার্বভৌম ব্যক্তি— কীভাবে সে প্রতিজ্ঞা করার অনধিকারী ও নিজ থেকে প্রতিশ্রুতি দিতে অপারগ অপর সবকিছুর তুলনায় তার শ্রেষ্ঠত্বকে উপলব্ধি না করে থাকতে পারে, যখন সে জানে কতটা আস্থা, ভীতি ও সম্মান সে ‘উপযুক্ত কারণেই’ আদায় করে নিতে পেরেছে, আর কীভাবে নিজের উপর এই প্রভুত্ব অর্জনের সাথে সাথেই আবশ্যিকভাবে পরিস্থিতির উপর, প্রকৃতির উপর এবং হ্রস্বতর অভিপ্রায়সম্পন্ন অপর সব কম নির্ভরযোগ্য প্রাণীদের উপর তার প্রভুত্ব করার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে? টেকসই অদম্য অভিপ্রায়ের অধিকারী এই ‘স্বাধীন’ মানুষ, ওই অধিকারসূত্রেই তার নিজস্ব মূল্যবোধের মাপকাঠিও আয়ত্ত করে: নিজের থেকে চোখ তুলে সে অপরের দিকে তাকায় এবং শ্রদ্ধা বা ঘৃণা আরোপ করে। সার্বভৌম ব্যক্তির মতো আন্তরিকভাবে, ধীরেসুস্থে ও কদাকচ্চিৎ যে প্রতিজ্ঞা করে, বুঝেশুনে যে আস্থা জ্ঞাপন করে, আস্থাভাজনকে যে যথার্থই সম্মান করে, যে নিজের দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষায় আত্মবিশ্বাসী কারণ সে জানে যে সে নিজে মন্দভাগ্যের মুখে বা এমনকি নিয়তির দুর্বিপাকেও খাড়া থাকার মতো যথেষ্ট বলবান, সে যেমন তার নিজের মতো বলবান ও নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিদের (যারাও প্রতিজ্ঞা করার অধিকারী) সম্মান করতে বাধ্য, ঠিক তেমনই তার প্রয়োজন হবে অনধিকারী হয়েও যারা প্রতিজ্ঞা করতে যায় সেই লিকলিকে চর্মসার সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের পদাঘাত করার জন্য সদা পা দুটোকে তৈরি রাখা এবং মুখ থেকে কথা বেরোনোর পরক্ষণেই সেই কথার অন্যথা যারা করে, সেই মিথ্যুকদের সাজা দেওয়ার জন্য হাতের লাঠিটাকে সদা তৈরি রাখা। দায়িত্বশীলতার অসাধারণ বিশেষাধিকার সম্পর্কে এই গর্বিত বিদ্যা, এই বিরল স্বাধীনতা সম্পর্কে সচেতনতা, নিজের উপর ও নিয়তির উপর এই ক্ষমতার বোধ তার সহজ প্রবৃত্তি হয়ে উঠেছে, এমনকি আধিপত্যকারী প্রবৃত্তি হয়ে উঠেছে— এই আধিপত্যকারী প্রবৃত্তিকে যদি নাম দিতে হয়, তাহলে কী নাম সে দেবে? সন্দেহ নেই যে সার্বভৌম ব্যক্তি তার এই প্রবৃত্তিকে বিবেক নাম দিয়েছে।
৩
তার বিবেক?... প্রথমত, অনুমান করা যেতে পারে যে, ‘বিবেক’ নামক ধারণাটির যে সর্বোচ্চ, প্রায় ধাঁধিয়ে দেওয়া, রূপের মুখোমুখি আমরা এখানে হচ্ছি, ইতিমধ্যেই তা এক দীর্ঘ ইতিহাস ও পরিবর্তমান বিকাশ প্রক্রিয়া পার করে এসেছে। কথা দেওয়ার অধিকারী হওয়া, আর গর্বের সঙ্গে তা করা, আর নিজেকে নিজে ‘হ্যাঁ’ বলার অনুমতিপ্রাপ্ত হওয়া— আগেই বলেছি যে তা একটি পরিপক্ক ফল, কিন্তু তা একটি পরবর্তীকালের ফলও বটে— কারণ কত দীর্ঘ সময়কালই না এই ফলকে কঁাচা ও টক অবস্থায় গাছে ঝুলে থাকতে হয়েছিল! আর তার থেকেও দীর্ঘ সময়কাল এমন কোনও ফল দৃষ্টিগোচর হওয়াই অসম্ভব ছিল— তেমন ফল যে দেখা দেবে তা-ও কারও পক্ষে বলা সম্ভব ছিল না যদিও গাছের সর্বাংশ নিশ্চিতভাবেই সেই ফল ফলানোর অভিমুখে বেড়ে উঠছিল!— ‘মনুষ্যপ্রাণীর জন্য একটি স্মৃতি কীভাবে তৈরি করা যায়? এই অংশত অনুজ্জ্বল, অংশত দপদপ করে জ্বলা ক্ষণিক ধীশক্তির মধ্যে, বিস্মরণপ্রবণতার এই জ্যান্ত প্রতিমূর্তির মধ্যে কীভাবে স্মৃতির ছাপ মুদ্রিত করে দেওয়া যায় যাতে তা সর্বদা সক্রিয় থাকে?’... এই প্রাচীন সমস্যা তৎক্ষণাৎ কোনও নম্র-মৃদু সমাধান বা পদ্ধতির মধ্য দিয়ে যে সমাধিত হয়ে যায়নি, তা বলাই বাহুল্য। বরং বলা যায় যে মনুষ্যপ্রাণীর গোটা প্রাক-ইতিহাস জুড়ে এই স্মৃতি বিকশিত করার কৌশলের চেয়ে ভীতিপ্রদ ও ভয়ানক আর কিছু ছিল না। ‘স্মৃতি গেঁথে দেওয়ার জন্য আমরা পুড়িয়ে খোদাই করে দিই; যা কখনো যন্ত্রণা দেওয়া থেকে বিরত হয় না, তা-ই কেবল স্মৃতিতে থেকে যায়’— পৃথিবীর সবচেয়ে পুরানো (দুর্ভাগ্যবশত সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ীও বটে) মনস্তত্ত্বের একটি প্রধান মূলনীতি হল এটাই। এমনকি আমরা এটাও বলতে পারি যে পৃথিবীর সর্বত্র আজও মানুষের জীবনে এই ভয়শ্রদ্ধা, ভাবগাম্ভীর্য, রহস্য ও অবসাদের রঙে ছেয়ে আছে, সেই সন্ত্রাসের কিছু না কিছু এখনও কার্যকরী— প্রাচীনতর সময়ে মানুষ যে ভয়ের থেকে প্রতিজ্ঞা করত, কথা দিত, শপথ নিত, সেই ভয় এখনও কাজ করে চলেছে। আমরা যখন ‘ভাবগম্ভীর’ হয়ে উঠি, তখন সেই অতীত, দীর্ঘতম গহনতম প্রচণ্ডতম অতীত আমাদের মধ্যে ভেসে ওঠে, আমাদের গায়ের উপর নিঃশ্বাস ফেলতে থাকে। মনুষ্যপ্রাণী যখন নিজের জন্য একটি স্মৃতি নির্মাণ করা প্রয়োজন বোধ করে, সর্বদা সেই নির্মাণকাজের অংশ হয়ে ওঠে রক্ত, শহিদ ও বলিদান, ভয়ঙ্করতম বলিদান ও মানত (যার মধ্যে আছে প্রথম সন্তানকে বলি দেওয়া), বীভৎসতম আত্মঅঙ্গছেদন (যেমন খোজাকরণ), ধর্মীয় পদ্ধতিসমূহের মধ্যে জায়গা করে নেওয়া নিষ্ঠুরতম আচারানুষ্ঠান (আর সব ধর্মই তার গহনতম ভিত্তিমূলে নিষ্ঠুরতার ব্যবস্থাবিশেষ)— সেই সমস্তকিছু যার উৎপত্তি মানুষের এহেন প্রবৃত্তি থেকে যা যন্ত্রণার মধ্যেই স্মৃতিনির্মাণের সহায়ক সবচেয়ে প্রখর উপায়ের সন্ধান পেয়েছিল। এক অর্থে দেখলে, সব রকমের কঠোর-সংযমতন্ত্রেরও অবস্থান এইখানেই: গুটিকয় ধারণাকে অলঙ্ঘ্য, সর্ববিরাজমান, অবিস্মরণীয়, ‘স্থির-নির্ধারিত’ করে তোলা যাতে গোটা স্নায়ুতন্ত্র ও বুদ্ধিবৃত্তীয় ব্যবস্থাকে এসব ‘স্থির-নির্ধারিত ধারণার’ দ্বারা সম্মোহিত করে ফেলা যায়— আর কঠোর-সংযমতান্ত্রিক কার্যপ্রণালী ও জীবনরূপের মধ্য দিয়ে এই স্থির-নির্ধারিত ধারণাগুলোকে অন্য বহুবিধ ধারণার সঙ্গে গা-ঘষাঘষি করার থেকে তুলে এনে ‘অবিস্মরণীয়তার বেদিতে’ প্রতিষ্ঠিত করা হয়। মনুষ্যজাতির ‘স্মৃতি’ যত খারাপ ছিল, ততই তার রীতি-নীতি-প্রথা বেশি ভয়ঙ্কর হয়ে দেখা দিয়েছে। বিস্মরণপ্রবণতাকে হারানোর জন্য ও সামাজিক সহবাসের গুটিকয় আদিম শর্ত সম্পর্কে সচেতনতা সদাজাগ্রত রাখার জন্য তাৎক্ষণিক অনুভূতি ও আকাঙ্খার দাস এই মানুষ কী পরিমাণ ঝঞ্ঝাট স্বীকার করত তা মাপার একটা মাপকাঠি বিশেষত দণ্ডদানের নিয়মগুলোর কঠোরতা/ নির্মমতা থেকে পাওয়া যায়। আমরা জার্মানরা মোটেই নিজেদের বিশেষরূপে নির্মম বা পাষাণহৃদয় মানুষ বলে মনে করি না, এমন তো আরো মনে করি না যে আমরা এমন অসাবধানী-বেহিসেবী যে কেবলমাত্র বর্তমানটুকু নিয়েই আমরা বাঁচি। কিন্তু একবার ফিরে দেখুন আমাদের পুরানো দিনের দণ্ডবিধির দিকে, বুঝতে পারবেন এই ধরায় ‘চিন্তকদের জাতি’ প্রজনন করতে কী পরিমাণ ঝঞ্ঝাট পোহাতে হয়। (‘চিন্তকদের জাতি’ বলতে আমি সেই ইউরোপীয় মানুষদের বোঝাচ্ছি যারা আজও আস্থা, গাম্ভীর্য, রুচিহীনতা ও ব্যবহারিকতায় সবার শীর্ষে এবং এই চরিত্রবৈশিষ্ট্যের জন্যই যে কোনো ধরনের রাজকর্মচারী প্রজনন করা যাদের বিশেষ অধিকারের মধ্যে পড়ে।) এইসব জার্মানরা নিজেদের অশিষ্ট মৌল প্রবৃত্তি ও অসংস্কৃত পাশবিকতার উপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করার তাড়নায় নিজেদের জন্য একটি স্মৃতি তৈরি করতে ভয়ঙ্কর সব উপায় ব্যবহার করেছিল: পুরানো দিনের জার্মান দণ্ডের কথা ভাবুন, যেমন, পাথর ছুঁড়ে মেরে হত্যা করা (লোককথায় এমনকি অপরাধী ব্যক্তির মাথার উপর জাঁতাকলের পাথর ফেলে হত্যা করার কথাও পাওয়া যায়), চাকার উপর চূর্ণবিচূর্ণ করা (দণ্ডবিধির জগতে এটি জার্মান বিশেষত্ব ও উদ্ভাবনীশক্তির একটি নজির!) শূলে বিদ্ধ করা, ঘোড়ার সঙ্গে দুই প্রান্ত বেঁধে দুদিকে ঘোড়া ছুটিয়ে টেনে দেহ ছিঁড়ে ফেলা বা ঘোড়ার খুরের তলায় মাড়িয়ে মেরে ফেলা (যাকে ‘কোয়ার্টারিং’ বলা হতো), তেল বা মদে অপরাধীর দেহ দিয়ে আগুনে ফুটানো (যা ১৪ ও ১৫ শতকেও করা হতো), ছাল ছাড়ানোর জনপ্রিয় বিধি (‘লম্বা সরু ফালিতে চামড়া ও মাংস কেটে নিতে থাকা’), বুক থেকে খুবলে মাংস কেটে নেওয়া, আর নিয়মভঙ্গকারীর দেহে আগাপাশতলা মধু মাখিয়ে সেই দেহ প্রখর রোদে মাছিদের মধ্যে ফেলে রাখা। এহেন দৃশ্যাবলী ও পদ্ধতির সাহায্যে মানুষ অবশেষে পাঁচ-ছয়টা ‘আমি করব না’-কে স্মৃতিতে গেঁথে দিতে পেরেছিল এবং স্মৃতিধারী জন সেই আদেশ বা নৈতিক সূত্র পালনের ‘কথা দিয়েছিল' সমাজের সুবিধা নিয়ে বাঁচার জন্য— আর এ-ই হল সত্য! এধরনের স্মৃতির সহায়তা নিয়েই মানুষ অবশেষে ‘যুক্তি’ মানতে শিখেছিল! কত না দাম চুকোতে হয়েছে মনুষ্যপ্রাণীর আভরণ ও সুবিধা রূপী এইসব যুক্তি, গাম্ভীর্য, আবেগ-নিয়ন্ত্রণ, চিন্তন নামক অবসাদাচ্ছন্ন ব্যবসাপত্তরকে আয়ত্ত করতে! এই সব ‘ভালো জিনিষ’-য়ের নিচে কত না রক্ত ও আতঙ্ক নিথর হয়ে আছে!...
৪
কিন্তু তাহলে অপরাধবোধ বা ‘বিবেকদংশন’ সংক্রান্ত সেই অপর অন্ধকারাচ্ছন্ন ব্যাপারাদির উদ্ভব কীভাবে হল?— এই প্রসঙ্গে আমাদের নৈতিকতার কুলজিকারদের কথায় ফেরা যাক। আমি আবারও বলব— বা ইতিপূর্বে এ বিষয়ে আমি কি কিছুই বলিনি?— যে তারা কোনও কাজের নয়। একটি নাতিদীর্ঘ মাত্র পর্ব জোড়া নিজস্ব ‘আধুনিক’ অভিজ্ঞতাই সম্বল তাদের। অতীত সম্পর্কে কোনও জ্ঞান তাদের নেই, তা অর্জনের কোনো অভিলাষও তাদের নেই। এই কাজের জন্য প্রয়োজনীয় ইতিহাস সম্পর্কে যে স্বজ্ঞা, তা ছাড়াই তারা নৈতিকতার ইতিহাস চর্চা করতে বসে। স্বভাবতই সেই চর্চায় এমন ফল ফলে যার সঙ্গে সত্যের খুব দূরাগত সম্পর্কও থাকে না। যেমন ধরা যাক, নৈতিকতার এহেন কুলজিকাররা কি এখনও অবধি দূরাগত স্বপ্নেও কখনও এটাকে নিজেদের ভাবনার বিষয় করে তুলেছে যে ‘অপরাধ’(জার্মানভাষায়: Schuld)-য়ের মতো একটি প্রধান নৈতিক অনুজ্ঞার ব্যুৎপত্তিগত উৎস হল ‘ঋণ’(জার্মানভাষায়: Schulden)-য়ের মতো একটি অতি জড়বাদী ধারণা? বা, দণ্ডব্যবস্থা বিকশিত হয়েছে ঋণশোধের উপায় হিসেবে, যার সঙ্গে ইচ্ছার স্বাধীনতা বা স্বাধীনতাহীনতা সম্পর্কিত কোনও পূর্বধারণারই কোনো যোগাযোগ নেই? আর এটাও কি কখনো ভেবে দেখেছে যে উল্টোদিকে, ‘মানুষ’ মানববিকাশের কোন উচ্চ বিন্দুতে পৌঁছে তবেই ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’, ‘দায়হীন’, ‘আপতিক’, ‘দায়পূর্ণ’ অভিধাগুলোর মধ্যে বিপরীতার্থক বিধায় আদিম পার্থক্যীকরণ করতে পারে, যা অনুযায়ী দণ্ড নির্দিষ্ট করা ও দেওয়ার কাজ বিকশিত হতে পারে? ‘অপরাধীর দণ্ড পাওয়া উচিত কারণ তার পক্ষে এ ভিন্ন অন্য আচরণও সম্ভব ছিল’— এই যে ধারণাটিকে আজ আপাতদৃষ্টিতে নেহাতই মামুলি, স্বাভাবিক ও অপরিহার্য বলে ধরে নিয়ে কীভাবে সাধারণ ন্যায়বোধ পৃথিবীতে উৎপন্ন হল তার ব্যাখ্যা হিসেবেও খাড়া করা হয়, সেই ধারণাটি আসলে বিচার করা ও সিদ্ধান্তগ্রহণের মানবপ্রক্রিয়ার এক সূক্ষ্ম-জটিল রূপ হিসেবে অনেক পরবর্তীকালে জন্ম নিয়েছিল। এই ধারণাটিকে পিছিয়ে নিয়ে গিয়ে যে একেবারে আদিলগ্নে বসাতে চায়, সে আসলে তার অপটু এঁটো আঙুলগুলো দিয়ে প্রাচীন মানুষদের মনস্তত্ত্বের মধ্যে অশোভন খোঁচাখুঁচি করে চলেছে। মানুষের ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘ পর্যায় জুড়ে দণ্ড মোটেই এই কারণে দেওয়া হতো না যে কুকর্মের প্রবর্তককে তার কর্মের জন্য দায়ী ঠাহর করা হতো; আর সেজন্যই কেবলমাত্র দোষীপক্ষকেই দণ্ডিত করা উচিত বলে মনে করা হতো না— ব্যাপারটা বরং অনেকটা এমন ছিল যেমনটা এখনও হয়ে থাকে যখন কোনও পিতা-মাতা তাদের সন্তানদের অনিষ্ট বা দুর্ভোগের কারণে জমে ওঠা রাগের তাড়নায় সেই সন্তানদেরই দণ্ড দিয়ে বসে, অপরাধীর উপর চেপে-রাখা রাগ ছিদ্রপথ খুঁজে বেরিয়ে আসে। কিন্তু এহেন ভাবনা যা মনে করে যে প্রতিটি ক্ষতির তুল্যমূল্য হিসেব করা যায় এবং সেই তুল্যমূল্য পরিশোধ বাস্তবত আদায়ও করে নেওয়া যায়, যদি বা কেবল অপরাধীকে যন্ত্রণাদানের মধ্য দিয়ে হয়, তা হলেও— রাগকে সংহত ও রূপান্তরিত করার এই আদিম, গভীর-সঞ্চারী এবং হয়ত বা এখন অচ্ছেদ্য হয়ে ওঠা ভাবনা, দণ্ডদান ও যন্ত্রণাদানের মধ্যে এহেন তুল্যমূল্য সম্পর্কস্থাপন, কোথা থেকে তার ক্ষমতা উৎপন্ন করে? এই প্রশ্নের জবাব আমি ইতিমধ্যেই দিয়েছি: তা ক্ষমতা উৎপন্ন করে ঋণদাতা ও ঋণগ্রহীতার মধ্যে চুক্তিবদ্ধ সম্পর্ক-রূপ থেকে, যা সাধারণভাবে ‘বৈধ বিষয়ী’-র ধারণার সমান পুরাতন এবং দ্রব্যসামগ্রী কেনা, বেচা, বিনিময়, বাণিজ্য ও অদল-বদলের মৌলিক রূপগুলোর থেকে উদ্ভূত।
৫
ইতিপূর্বে আমি যা বলেছি তা থেকে কেউ প্রাথমিক অনুমান করতে পারে যে এই চুক্তিবদ্ধ সম্পর্ককে স্মরণ করে আসলে সেইসব সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা বা অনুমোদন করা প্রাচীনতর মানুষজাতি সম্পর্কে বিবিধ প্রকার সন্দেহ ও বিরোধিতা জাগিয়ে তোলা হচ্ছে। নির্দিষ্ট এই মুহূর্তে মানুষ প্রতিজ্ঞা করে। এই মুহূর্তে পৌঁছেই প্রতিজ্ঞাকারী ব্যক্তির জন্য একটি স্মৃতি নির্মাণ করা প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে, যাতে, আন্দাজ করা যেতে পারে, রূঢ়তা, নিষ্ঠুরতা ও যন্ত্রণা জায়গা করে নিতে পারে। কোনো ব্যক্তির ঋণ-প্রত্যর্পণের প্রতিজ্ঞায় বিশ্বাসযোগ্যতা উৎপন্ন করতে, তার প্রতিজ্ঞাকে আন্তরিকতা ও পবিত্রতার প্রত্যাভূতি অর্পণ করতে, তার নিজের বিবেকবোধে ঋণ-প্রত্যর্পণকে একটি অবশ্যকর্তব্য বা দায় হিসেবে গেঁথে নিতে, সেই ব্যক্তি ঋণদাতার সঙ্গে চুক্তিতে অঙ্গীকার করে যে ঋণখেলাপী হলে সে এমনকিছু ঋণদাতার হাতে সমর্পণ করতে বাধ্য থাকবে যা তখনও তার মালিকানাধীন বা ক্ষমতাধীন, যেমন, তার দেহ বা তার নারী বা তার স্বাধীনতা বা এমনকি তার জীবন (বা, কোনো কোনো ধর্মীয় ব্যবস্থায়, তার পরমানন্দ, তার আত্মার পরিত্রাণ, শেষাবধি এমনকি তার কবরের শান্তিও, যেমনটা ঘটত মিশরে, যেখানে ঋণখেলাপী ঋণগ্রহীতার মৃতদেহ তার কবরেও ঋণদাতার কবল থেকে রেহাই পেত না— আর মিশরীয়দের কাছে বিশেষ করে এই মৃত্যুপরবর্তী কবরের শান্তি বেশ গুরুত্ব পেত)। ঋণখেলাপী ঋণগ্রহীতার দেহের উপর ঋণদাতা নানা ধরনের অসম্মান ও নির্যাতন আরোপ করতে পারত, যার মধ্যে অন্যতম ছিল ঋণের পরিমাণের সমানুপাতিক বলে ধার্য দেহের অংশ কেটে নেওয়া। আর এই সমানুপাতিক হিসেব করার সূত্র ধরে অনেক দিন আগে থেকেই সর্বত্র ব্যক্তিবিশেষের হাত-পা বা অন্য দেহাংশের কর্তিত বিভিন্ন পরিমাণের সঙ্গে অনাদায়ী ঋণের বিভিন্ন পরিমাণের সমতুল্যতার খুঁটিনাটি গণনার বীভৎস বৈধ মান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আর এর থেকে আরো এক পা এগিয়ে, প্রতিষ্ঠিত বিধি বা আইন সম্পর্কে মুক্ততর ধারণার উদাহরণস্বরূপ রোমের আইনের দ্বাদশ সারণিতে আজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছিল যে ঋণদাতারা ঋণখেলাপীর দেহের অংশ কতটা বেশি বা কম কেটে নিচ্ছে তা দিয়ে কিছু যায় আসে না: ‘বেশি বা কম কেটে নিলে তা কোনো অপরাধ বলে ভাবা উচিত নয়' (লাতিনে: ‘si plus minusve secuerunt, ne fraude esto.’)। এই গোটা ক্ষতিপূরণ-পদ্ধতিটির অতি বিকট যুক্তি সম্পর্কে কিছুটা ধারণা করার চেষ্টা করা যাক। এখানে সমতুল্যতা নিষ্পন্ন করা হচ্ছে এভাবে: প্রত্যক্ষ ক্ষতিপূরণের কোনো সুবিধার বদলে (অর্থাৎ, সোনা, জমিজমা বা অন্য কোনো ধরনের সম্পত্তির বদলে), ঋণদাতাকে এখানে প্রত্যর্পণ ও পরিশোধ হিসেবে এক প্রকার আমোদ দেওয়া হচ্ছে— সেই আমোদ হল এক ক্ষমতা-হারানো ব্যক্তির উপর নিশ্চিন্তে নিজ ক্ষমতা জাহির করার আমোদ, ‘কেবলমাত্র নিশ্চিন্তে অন্যায় করার মজা আস্বাদন করার জন্যই অন্যায় করা' (লাতিনে: de fair le mal pour le plaisir de le faire)-র আমোদ, লঙ্ঘন করার আমোদ। সামাজিক সম্মানের ধাপবন্দি কাঠামোয় ঋণদাতার অবস্থান যত তলার দিকে ও অসম্মানকর হবে, তার কাছে এই আমোদ ততই আরো লোভনীয় ও কাঙ্খিত হয়ে উঠবে, আর উচ্চতর সমাজ-সম্মানের পূর্বাস্বাদন হিসেবে তা তার রসনাকে মাতাল করে তুলবে। ঋণখেলাপীকে ‘দণ্ড’ দেওয়ার মধ্য দিয়ে ঋণদাতারা প্রভুদের অধিকার-বৃত্তে অংশ নেয়। শেষাবধি সেও একবারের জন্য হলেও সেই উচ্চ-সম্ভ্রান্ত-সুলভ অনুভূতির মালিক হয় যা অপর কোনো ব্যক্তিকে তার থেকে ‘নিচু’ বলে গণ্য করে তার সঙ্গে মন্দ ব্যবহার করার অধিকারী হিসেবে নিজেকে গরীয়ান করে তোলে। যদি দণ্ডদান কার্যকরী করা বা বলপ্রয়োগের ঘটনাটি কোনো ‘প্রাধিকারী’-র হাতে স্থানান্তরিত হয়ে গিয়ে থাকে, ঋণদাতা নিদেনপক্ষে ঋণখেলাপীকে ঘৃণিত ও অত্যাচারিত হতে দেখার মধ্য দিয়ে তুষ্টি ও আমোদ লাভ করে। এইভাবে ক্ষতিপূরণের মধ্যে নিষ্ঠুরতার আদেশ ও নিষ্ঠুরতার অধিকার নিয়ে তৈরি এক ব্যবস্থা কাজ করে চলে।
৬
কর্তব্য-বাধ্যবাধকতার নিয়মাবলীর এই জমিতেই ‘দোষ’, ‘বিবেকবোধ’, ‘কর্তব্য’, ‘দায়ের পবিত্রতা’ সুলভ নৈতিক ধারণাগুলো জন্ম নিয়েছে— পৃথিবীর যে কোনো মহৎ বস্তুর মতো তাদের জন্মপ্রক্রিয়াও দীর্ঘ সময়কাল জুড়ে আগাপাশতলা রক্তের দ্বারা সিঞ্চিত হয়েছে। আর এটাও কি আমরা বলতে পারি না যে এই ভাবনাজগৎ তার গহন প্রদেশে কখনোই রক্ত ও নিপীড়নের কটু গন্ধ থেকে পুরোপুরি মুক্ত হতে পারে নি (এমনকি প্রবীণ ইমানুয়েল কান্টের সবরকম চেষ্টা সত্ত্বেও, তাঁর নিঃশর্ত অনুজ্ঞা (categorical imperative)-র গায়েও নিষ্ঠুরতার দুর্গন্ধ লেগে আছে)? তাছাড়াও ‘দোষ' ও ‘দুর্ভোগের' ধারণাদুটো যে অদ্ভুতভাবে গিঁট পাকিয়ে আছে, যে গিঁট খোলা এখন হয়ত অসাধ্য হয়ে উঠেছে, সেই গিঁটটাও এই ভাবনাজগতেই প্রথম পাকানো হয়েছিল। আবারও প্রশ্নটি করা যাক: দুর্ভোগ কী পরিমাণে ‘ঋণখেলাপীর' দায়শোধ হতে পারে? তা সেই পরিমাণেই হতে পারে যে পরিমাণে কারো দুর্ভোগ ঘটানো সর্বোচ্চ মাত্রার আনন্দ এনে দিতে পারে, যে পরিমাণে ঋণখেলাপে ক্ষতিগ্রস্ত উত্তমর্ণ সেই ক্ষতি ও ক্ষতিজাত ক্লেশের শোধ হিসেবে দুর্ভোগ সৃষ্টি করার এমন এক অসাধারণ আনন্দ লাভ করে যা হয়ে ওঠে প্রকৃত উদযাপন সম, সেই উদযাপন ততই মহার্ঘ্য হয়ে ওঠে যত তা উত্তমর্ণের সামাজিক মান ও অবস্থানের পরিপন্থী হয়। আমি এখানে অনুমানের উপর দাঁড়িয়েই কথা বলছি, কারণ এহেন ভূগর্ভস্থ বস্তুর ভিত্তি উন্মোচন করা হতবুদ্ধিকর হওয়া ছাড়াও বেশ কঠিন কাজ বটে। আর এসবের মাঝে স্থূলভাবে ‘প্রতিশোধ নেওয়ার' বাসনাকে বসাতে চাইলে অন্তর্দৃষ্টি উদ্ভাসিত হওয়ার বদলে ধোঁয়াশাচ্ছন্নই হবে (প্রতিশোধের ধারণাও বস্তুত আমাদের একই সমস্যার মুখে এনে ফেলবে: ‘অন্য কারো দুর্ভোগ ঘটানো কীভাবে আমাদের তৃপ্তিবোধ এনে দিতে পারে?’) প্রবীণতর মানবসমাজে মহৎ আনন্দ উদযাপনে নিষ্ঠুরতার যে কতটা ভূমিকা ছিল, বস্তুত তাদের প্রতিটি উপভোগেই যে নিষ্ঠুরতার উপাদান মিশে থাকত, বা, অন্যতর পরিপ্রেক্ষিত থেকে দেখলে, নিষ্ঠুরতার চাহিদা তাদের মধ্যে যে কতটা অকপট ও সরল ছিল, কীভাবে তারা তার বৈশিষ্ট্যস্বরূপ ‘নিঃস্বার্থ দ্বেষ' (বা স্পিনোজার ভাষায় sympathia malevolens)-কে মূলগতভাবে একটি স্বাভাবিক মনুষ্যচরিত্রবৈশিষ্ট্য বলে মনে করত এবং তাই তাদের বিবেক তাতে সাড়ম্বরে সায় দিত—আমাদের (আমাদের বলতে আমি আধুনিক মানুষদের বোঝাচ্ছি) গৃহপোষ্যসুলভ শিষ্টতা ও ততোধিক ভণ্ডামি জনীত প্রকোপের ফলে আমরা তা কল্পনাও করতে পারব না। গভীরতর অন্তর্ভেদী কোনো দৃষ্টি হয়ত আজও মানুষের উল্লাস উদযাপনের এই প্রাচীনতম ও মৌলিকতম রূপটিকে আন্দাজ করতে পারে। উচ্চতর সংস্কৃতির গোটা ইতিহাস জুড়ে কীভাবে ক্রমবর্ধমান হারে নিষ্ঠুরতার আধ্যাত্মিকীকরণ ও তার উপর ‘দেবত্ব-আরোপ' হয়ে চলেছে (এবং কীভাবে তা তাৎপর্যপূর্ণভাবে সেই সংস্কৃতির অঙ্গীভূত হয়ে গেছে) সেই দিকে ‘বিয়ন্ড গুড অ্যান্ড ইভিল’ বইয়ে (২২৯) (বা তারও আগে ‘ডেব্রেক’ বইয়ে ১৮, ৭৭, ১১৩ অংশে) আমি সাবধানতার সঙ্গে অঙ্গুলিনির্দেশ করেছিলাম। খুব বেশি দিন আগের কথা নয় যখন প্রাণদণ্ডদান, নিপীড়ন, বা খুঁটিতে বেঁধে আগুনে পোড়ানোর মতো আয়োজন ছাড়া সম্ভ্রান্তবংশীয়দের বিবাহ-অনুষ্ঠান বা উৎসবের কথা কেউ ভাবতেই পারত না। একইভাবে, এমন কোনো সম্ভ্রান্ত গার্হস্থ্য ছিল না যেখানে এমন মানুষের পর্যাপ্ত যোগান নেই যাদের উপর মানুষ নিশ্চিন্তে তাদের দ্বেষপূর্ণ নিষ্ঠুর গালিগালাজ বর্ষণ করতে পারে (উদাহরণ হিসেবে ধরা যেতে পারে ডাচেসের সভায় ডন কিহোতের কথা; আজকালকার দিনে ডন কিহোতে গোটাটা পড়তে পড়তে আমাদের জিভ তেঁতো হয়ে যায়, সহনশক্তির রীতিমতো পরীক্ষা দিতে হয়। আর তার মধ্য দিয়ে আমরা তার লেখক ও তার সমসাময়িকদের কাছে অচেনা-অজানা বিদেশী হয়ে উঠি— সমসাময়িকরা এই বইটিকে কোনো বিবেকদংশন ছাড়াই সবচেয়ে মজার বই হিসেবে পড়ত, হাসতে হাসতে তারা প্রায় মারা পড়ত।)। কাউকে ভুগতে দেখলে মনে বেশ ফুর্তি জন্ম নেয়, সেই ভোগান্তি নিজে হাতে সৃষ্টি করতে পারলে ফুর্তি আরো বৃদ্ধি পায়— শুনতে কটু হতে পারে, কিন্তু এ হল এক পুরোনো, শক্তিশালী এবং মানবীয়, অতি মাত্রায় মানবীয়, অন্যতম মুখ্য নীতি; যার সঙ্গে হয়ত মনুষ্যপূর্ব বানররাও দ্বিমতপোষণ করবে না। লোকে বলে যে অদ্ভুততম নিষ্ঠুরতা উদ্ভাবনে মনুষ্যপূর্ব বানররা পরবর্তী মানুষদের অনেক কীর্তিই পূর্বানুমান করতে শুরু করেছিল, যাকে বলে একটা ‘মহড়া’ কায়েম করেছিল। মানুষের ইতিহাসের সবচেয়ে পুরোনো ও সবচেয়ে দীর্ঘ বৃত্তান্ত আমাদের শেখায় যে নিষ্ঠুরতা ছাড়া কোনো উদযাপন হতে পারে না— আর তাই দণ্ডদান ঘিরেও এত উদযাপনের ঘটা!
৭
আমাদের যত নৈরাশ্যবাদীরা তাদের জীবনের প্রতি ক্লান্তিকে উগরে দেওয়ার জন্য যে কর্কশ বেসুরো জাঁতাকল ঘুরিয়ে চলে, আমার এইসব ভাবনা দিয়ে সে পেষাইযন্ত্রে মশলা জোগানোর কোনো ইচ্ছাই আমার নেই। বরং তার বিপরীতে আমি খুব স্পষ্ট করে বলতে চাই যে যখন অবধি মানুষ তার নিষ্ঠুরতা নিয়ে লজ্জিত হয়ে ওঠেনি, তখনও আমাদের আজকের এই নৈরাশ্যবাদী-অধ্যুষিত পৃথিবীর চেয়ে জীবন অনেক বেশি আনন্দময় ছিল। মানুষের সামনে মানুষের লজ্জা যত বৃদ্ধি পেয়েছে, ততই মানুষের মাথার উপর আকাশে দুর্যোগের কালো মেঘ ঘনিয়েছে। মানুষদের ইতিহাসে সবচেয়ে ক্রূর যুগগুলো কিন্তু ক্লান্ত নৈরাশ্যবাদী চালচলন, জীবনের ধাঁধায় অনাস্থা এবং জীবন সম্পর্কে বিরাগ প্রসূত বরফশীতল অস্বীকার দিয়ে চিহ্নিত ছিল না। এই চিহ্নগুলো হল পাঁকের উদ্ভিদ। পুতুপুতু করা ও নীতিবাগীশ হাবভাব— যার কল্যাণে ‘মানুষ’-রূপী জন্তু অবশেষে তার সমস্ত প্রবৃত্তি সম্পর্কেই লজ্জা পেতে শিখল— সেই পঙ্কিল জলাভূমি যত জন্ম নিয়েছে, তত এই পাঁকের উদ্ভিদগুলোও প্রথম প্রকাশ্যে মাথাচাড়া দিয়েছে। ‘দেবদূত’ (এরচেয়ে কটু শব্দ ব্যবহার থেকে আপাতত বিরত থাকলে) হয়ে ওঠার তাড়নায় মানুষ এমন বিগড়ানো পেট ও লোমশ জিভের অধিকারী হয়ে উঠতে চেয়েছে যা জীবসুলভ আনন্দ ও সরলতাকে ঘৃণ্য করে তোলার সঙ্গে সঙ্গে জীবনকেও বিস্বাদ করে তোলে— ফলত যখন সে মাঝেমধ্যে নিজের সামনে দাঁড়ায় তখন নাক টিপে ধরে পাদ্রী তৃতীয় ইনোসেন্টের১ অনুগামী হয়ে নিজের ন্যক্কারজনক দিকগুলোর তালিকা (“নোংরা-অশ্লীলতার মধ্য দিয়ে গর্ভে আগমন, ঘেন্নাজনকভাবে মায়ের দেহে পুষ্ট, অপবিত্র সব বস্তু থেকে বিকশিত, ভয়াবহ দুর্গন্ধযুক্ত, থুতু-মুত-বিষ্ঠা নিঃসৃত রসস্বরূপ”) তৈরি করে সেসবের নিন্দা-সমালোচনায় ডুব দেয় । আজ, যখন অস্তিত্বের বিরুদ্ধে যুক্তি বা তার সবচেয়ে গুরুতর প্রশ্নচিহ্ন হিসেবে সবসময় সবার আগে দুর্ভোগকে হাজির করা হয়, তখন সেই সময়কে স্মরণ করা মঙ্গলকর যখন মানুষদের বিচারধারা ছিল এতটাই অন্যরকম যে মানুষের দুর্ভোগ প্রণোদন না করে তারা পারত না, দুর্ভোগের মধ্যে প্রথম শ্রেণির জাদু প্রত্যক্ষ করত এবং তার মধ্যেই বেঁচে থাকার জন্য প্রকৃষ্ট প্রলোভন খুঁজে পেত। ক্ষীণমনাদের জন্য সান্ত্বনা হিসেবে বলা যাক যে হয়ত তখন যন্ত্রণাবোধ আজকালকার তুলনায় কম ছিল। অন্তত একজন ইউরোপীয় চিকিৎসক জনৈক নিগ্রোর (তিনি সেই নিগ্রোকে প্রাগৈতিহাসিক মানুষের এক নিদর্শন ধরে নিয়েছিলেন) গুরুতর আভ্যন্তরীণ প্রদাহের চিকিৎসা করতে গিয়ে এহেন সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন— যে প্রদাহ একজন সবলদেহের ইউরোপীয়কেও চূড়ান্ত কাতর করে তুলবে, তা সেই নিগ্রোর উপর তেমন প্রভাব বিস্তার করতে পারে নি। (যন্ত্রণার প্রতি স্পর্শকাতরতার একটি লেখচিত্র যদি আঁকা যায়, তাহলে উচ্চতর সমাজ-সংস্কৃতির প্রথম দশ হাজার বা এক লাখ সদস্যদের পেরিয়ে যাওয়া মাত্র তা উল্লেখজনকভাবে পড়তে শুরু করবে। আর আমার অন্তত এই নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে একজন মাত্র সুশিক্ষিত হিস্টিরিয়াগ্রস্ত রমণীর একটি যন্ত্রণাপূর্ণ রাতের তুলনায় আজ পর্যন্ত বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের কারণে ছুরিচালনায় ছিন্নভিন্ন করা সমস্ত পশুর সর্বমোট যন্ত্রণার পরিমাণ নগণ্যতায় ধর্তব্যের মধ্যেই আসে না।) নিষ্ঠুরতার মধ্য দিয়ে আনন্দপ্রাপ্তির সম্ভাবনাকেও যে অন্তর্হিত হতে হবে তেমনও বোধহয় খুব দরকার নেই। কেবল যে মাত্রায় যন্ত্রণা আজকাল বেশি কষ্ট দেয় সেই মাত্রায় একপ্রকার ঊর্ধ্বপাতন বা সূক্ষ্মতাপ্রদান করে নিলেই হল; বা, অন্যভাবে বললে, কল্পনার জগৎ বা আধ্যাত্মিক জগতের ভাষায় তার অনুবাদ করে এমন সব অনিন্দনীয় নামে তাকে হাজির করলেই হল যাতে সবচেয়ে সূক্ষ্ম কপটাচারী বিবেকেও কোনও সন্দেহের উদ্রেক না হয় (‘বিয়োগান্ত দয়া' এমন একটি নাম; আরেকটি এমন নাম হল ‘ক্রুশকাঠের জন্য নসতালজিয়া')। দুর্ভোগের ক্ষেত্রে মানুষকে যা ক্রুদ্ধ করে তোলে, তা স্বয়ং দুর্ভোগ নয়, তা হল দুর্ভোগের অর্থহীনতা। কিন্তু এহেন অর্থহীন দুর্ভোগ সাধারণভাবে খ্রিস্টানদের ক্ষেত্রে অমিল— যারা পরিত্রাণের গোটা এক গোপন কলকব্জা দুর্ভোগের মধ্য দিয়ে কাজ করছে বলে ব্যাখ্যা করে, আর অমিল প্রাচীন কালের অকপট মানুষদের ক্ষেত্রে— যারা বুঝত কীভাবে দর্শকের দৃষ্টিকোণ থেকে বা দুর্ভোগ-সৃষ্টিকারীর দৃষ্টিকোণ থেকে সমস্ত দুর্ভোগের ব্যাখ্যা করতে হয়। লুকানো, অনাবিষ্কৃত ও সাক্ষীবিহীন দুর্ভোগ যাতে আর বিশ্বে না থাকে, মানুষ যাতে সততার সঙ্গেই তাকে অস্বীকার করতে পারে, তার জন্য উচ্চ থেকে নীচ সমস্ত স্তরেই ঈশ্বর ও অন্তর্বর্তী অস্তিত্ব উদ্ভাবন করা তখন প্রায় আবশ্যক হয়ে উঠেছিল — সংক্ষেপে বললে, উদ্ভাবিত হয়েছিল এমন সব অস্তিত্ব যা লুকানো জায়গাগুলোতেও চরে বেড়ায়, অন্ধকারের মধ্যেও দেখতে পায় এবং কোনো আগ্রহোদ্দীপক যন্ত্রণার প্রদর্শনীকে সে তার নজর এড়িয়ে যেতে দেয় না। কারণ এহেন উদ্ভাবনের সাহায্যে মানবজীবন বুঝতে পারল ও তারপর থেকে বুঝে এসেছে কীভাবে চালাকি করে নিজেকে যথার্থ প্রতিপন্ন করতে হয়, কীভাবে তার ‘অমঙ্গল'-এরও যাথার্থ্য প্রতিপাদন করে নিতে হয়। আজকাল হয়ত ওই একই উদ্দেশ্যে অন্যরকম কিছু কার্যকরী উদ্ভাবন (যেমন, জীবনকে ধাঁধা হিসেবে হাজির করা, জীবনকে জ্ঞানের সমস্যা হিসেবে হাজির করা) করে নেওয়াই বিধেয়। ‘প্রতিটি অমঙ্গল এক ঝলকে ঈশ্বরের যাথার্থ্য প্রতিপন্ন করে যায়'— এভাবেই প্রাগৈতিহাসিক অনুভবের যুক্তি বেজে উঠত— আর তা কি কেবল প্রাক-ইতিহাসেই সীমাবদ্ধ? নিষ্ঠুর প্রদর্শনীর সহায় হিসেবে ঈশ্বরকে কল্পনা করা— এই আদিম ভাবনারূপটি এমনকি আমাদের ইউরোপীয় মানবমহলেও কত না ব্যাপকভাবে সঞ্চারিত হয়ে আছে! এ বিষয়ে ক্যালভিন বা লুথারের মতো মানুষদের কাছ থেকেও উপদেশ নেওয়া যেতে পারে।২ যাই হোক না কেন, এমনকি আদি গ্রিকরাও তাদের ঈশ্বরদের খুশি করার জন্য নিষ্ঠুরতার আনন্দের চেয়ে বেশি উপাদেয় কোনো জলখাবারের সন্ধান জানত না। উপর থেকে দৃষ্টিক্ষেপ করে হোমারের ঈশ্বররা যখন মানুষদের পরিণাম দর্শন করছিলেন, তখন তঁাদের কী অভিব্যক্তি হোমার ফুটিয়ে তুলেছিলেন? ট্রয়ের যুদ্ধ ও সমরূপ বিয়োগান্ত সন্ত্রাসগুলোর মধ্যে কী চূড়ান্ত বোধ কাজ করেছিল? এ নিয়ে বিন্দুমাত্র কোনো সন্দেহ থাকতে পারে না: তাদের ভাবা হয়েছিল ঈশ্বরদের জন্য উদযাপন হিসেবে: আর যে মাত্রায় এইসব ক্ষেত্রে অন্যন্য মানুষদের তুলনায় কবি অনেক বেশি ঈশ্বরতুল্য, সেই মাত্রায় কবিদের জন্য উৎসব হিসেবেও।... তার পরের যুগে গ্রিক নৈতিকতার দার্শনিকরাও ঈশ্বরের দৃষ্টিকে অন্য কোনোভাবে কল্পনা করেন নি: সেখানেও সেই দৃষ্টি উপরমহল থেকে ধার্মিকদের নৈতিক সংঘাত, নায়কোচিত কীর্তি ও আত্মঅঙ্গহানির উপর ন্যস্ত: ‘কর্তব্যবদ্ধ হারকিউলিস' তখন সজান্তেই প্রদর্শনীমঞ্চে উন্মুক্ত। কোনো দর্শকের উপস্থিতি ছাড়া এই অভিনেতৃকুলের নৈতিক উৎকর্ষের কল্পনা করা অসম্ভব। শুরুতে তৎকালীন ইউরোপের প্রেক্ষিতে কল্পিত ‘মুক্ত অভিপ্রায়'-য়ের এহেন সাহসী ও সাংঘাতিক দার্শনিক উদ্ভাবন, যা ভালো-মন্দ প্রসঙ্গে মানুষদের সম্পূর্ণ স্বতঃস্ফূর্ত প্রকৃতির কথা হাজির করেছিল, তা নিশ্চয়ই মানুষদের প্রতি, বা, মানবিক গুণের প্রতি ঈশ্বরদের আগ্রহ যে কখনই নির্বাপিত হতে পারে না, সর্বোপরি তা প্রতিষ্ঠা করতেই তৈরি হয়েছিল? এই পার্থিব রঙ্গমঞ্চে প্রকৃত অভিনব বস্তু, প্রকৃতই অশ্রুতপূর্ব উৎকন্ঠা, জটিলতা বা বিপর্যয়ের খামতি পড়তে পারে না। সম্পূর্ণ পূর্বনির্ধারিত হিসেবে কল্পিত এক জগৎ ঈশ্বরদের কাছে এতই পূর্বাভাসলগ্ন হয়ে পড়ত যে অচিরেই তা তঁাদের কাছে একঘেয়ে হয়ে উঠত— তাই ঈশ্বরের সুহৃদ এই দার্শনিককুল যথোচিত কারণেই তাদের ঈশ্বরদের কাছে তেমন পূর্বনির্ধারিত জগৎ পেশ করেন নি। মানবসমাজের গোটা প্রাচীন পর্বই ‘দর্শক মহোদয়'-য়ের প্রতি সংবেদনশীল বিবেচনায় পূর্ণ, যথার্থই সর্বসাধারণের পরিসরে ধৃত যথার্থই দৃষ্টিগ্রাহ্য এক জগতের আকাঙ্ক্ষা তাদের ছিল যেখানে নাটকীয় অভিনয় ও উৎসব ছাড়া সুখ অকল্পনীয়। আর, আগেই যেমন বলেছি, বড় মাপের দণ্ডদানের সঙ্গে কত না উদযাপন জড়িয়ে থাকে!
৮
আমাদের অনুসন্ধানের পথে আবার ফিরে আসা যাক। আমরা দেখেছি যে বিক্রেতা এবং ক্রেতার সম্পর্ক, ঋণদাতা ও ঋণীর সম্পর্ক— এহেন সবচেয়ে পুরানো ও সবচেয়ে আদিম ব্যক্তিসম্পর্কের মধ্যে অপরাধবোধ ও ব্যক্তিগত দায়বোধের উৎস নিহিত আছে। তার মধ্য দিয়েই সর্বপ্রথম মানুষ একজন আরেকজনের বিপক্ষে নিজেকে খাড়া করল, এক ব্যক্তিবিশেষ অপর এক ব্যক্তিবিশেষের সাপেক্ষে নিজেকে মাপতে চাইল। এই সম্পর্কের কোনো না কোনো দিক এখনও ভাস্বর হয়ে ওঠেনি এমন নীচু স্তরে এখনও আছে এমন কোনো সমাজসভ্যতা আমরা এখনও খুঁজে পাইনি। দাম ঠিক করা, মূল্য মাপা, সমতুল্যতা ভেবে বের করা, জিনিষপত্র বিনিময় করা— এসব ক্রিয়া মানুষের প্রথমতম ভাবনাচিন্তার এতটা জুড়েই বিরাজ করেছিল যে এক অর্থে বলা যায়, চিন্তাভাবনা মানেই হল এই। এখানেই বিচক্ষণতার সবচেয়ে পুরানো রূপটি বেড়ে উঠেছিল; কল্পনা করা যায় যে এখানেই প্রথম পরিস্ফুট হয়ে উঠেছিল মানুষের আত্মগর্ব, অন্যান্য প্রাণীর থেকে শ্রেষ্ঠতার বোধ। ‘man’ (লাতিনে ‘manas’) শব্দটি এখনো এই আত্মবোধের রেশ প্রত্যক্ষভাবে প্রকাশ করে চলেছে: মানুষ নিজেকে এমন এক অস্তিত্ব হিসেবে বর্ণনা করে যে ‘সহজাত প্রবৃত্তিগতভাবেই হিসাবী প্রাণী’ হওয়ার কারণে মূল্য নির্ধারণ করে, পরিমাপ করে থাকে। বেচা ও কেনা, তাদের সমস্ত মনস্তাত্ত্বিক লক্ষণ নিয়ে, যে কোনো ধরনের সামাজিক সংগঠন বা মণ্ডলীর থেকে পুরোনো বলে মনে হয়। ব্যক্তিগত আইনি অধিকারের প্রাথমিক রূপের মধ্য থেকে মুকুলিত হতে থাকা বিনিময়, চুক্তি, অপরাধ, আইন, দায় ও দায়শোধের বোধগুলোকে তারাই সবচেয়ে অমার্জিত ও প্রাচীন সমাজকাঠামোগুলোর মধ্যে সমতুল সমাজকাঠামোর সঙ্গে সম্পর্কবিস্তারের সাপেক্ষে প্রথম চালান করেছিল, সেইসঙ্গে চালান করেছিল পরিমাপ করা, হিসাব করা এবং ক্ষমতার সঙ্গে ক্ষমতার তুলনা করার অভ্যাস। এই পরিপ্রেক্ষিত ক্রমে চোখে সয়ে গিয়েছিল; আর শুরু হওয়া কঠিন কিন্তু একবার শুরু হওয়ার পর অনমনীয়ভাবে একই দিকে ধাবমান— প্রাচীন মানুষদের এই অপটু চিন্তনবৈশিষ্ট্য সহযোগে অচিরেই এহেন বিপুল সাধারণীকরণে উপনীত হয়েছিল যে: ‘প্রতিটি বস্তুর নিজস্ব দাম হয়, যে কোনো দামই মিটিয়ে দেওয়া যায়’। এটাই হয়ে দাঁড়িয়েছিল ন্যায়পরতার সবচেয়ে পুরোনো ও সবচেয়ে সরল নৈতিক তত্ত্ব, পৃথিবীর সমস্ত ‘উত্তম চরিত্র’, ‘শুদ্ধতা’, ‘সু অভিপ্রায়’ ও ‘বৈষয়িকতা’ এখান থেকেই উৎপত্তিলাভ করেছিল। ক্ষমতায় মোটামুটি সমান এমন জনেদের একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কস্থাপন, দায়শোধের মাধ্যমে একে অপরের সঙ্গে ‘বোঝাপড়ায় আসা’, আর কম ক্ষমতাবানদেরও নিজেদের মধ্যে কোনো না কোনো বোঝাপড়ায় আসতে বাধ্য করা— সেই প্রাথমিক পর্বে ন্যায় মানে ছিল এটাই।
৯
লোকসমাজকে সব সময় প্রাক্-ইতিহাসের মাপকাঠিতে মাপা হয় (এমনই এক প্রাক্-ইতিহাস যা সব সময়েই উপস্থিত আছে বা সব সময়েই ফিরে আসতে পারে) আর এই লোকসমাজের সঙ্গে তার সদস্যদের সম্পর্কও ঋণদাতা-ঋণগ্রস্তের গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তিমূলক সম্পর্কের তারে বাঁধা হয়ে থাকে। জনসমূহ একটি লোকসমাজের মধ্যে বাস করে। তারা লোকসমাজে থাকার সুবিধা ভোগ করে (আর কতই না বিবিধ সে সুবিধা! আজকাল মাঝেমধ্যে আমরা তাকে কম মূল্য দিয়ে থাকি); তারা নিরাপত্তা পায়, যত্ন পায়, শান্তি ও বিশ্বাসের বাতাবরণ পায়, আঘাত ও শত্রুতা সম্পর্কে লোকসমাজ-বহির্ভূত কোনো মানুষকে ‘শান্তিবিহীন’ যাপনে যে যন্ত্রণা ও শঙ্কা বয়ে চলতে হয় সেসব থেকে তারা নিস্তার পায়— যেকোনো জার্মান বোঝে Elend (দুঃখ) ও elend (অপর দেশ) আসলে কী অর্থ বহন করে— আর এই যন্ত্রণা-শঙ্কা-র কবল এড়াতে কীভাবেই না জনসমূহ লোকসমাজের প্রতি আনুগত্যের প্রতিজ্ঞা করে এবং তার সঙ্গে কর্তব্য ও বাধ্যবাধকতার সম্পর্কে বাঁধ পড়ে! এর ব্যতিক্রম হলে তার কী দশা হয়? নিশ্চিন্ত থাকা যেতে পারে যে ঠকে যাওয়া ঋণদাতা হিসেবে লোকসমাজ এমন ব্যবস্থা নেবে যাতে তার পাওনা যথাসম্ভব উসুল করে নেওয়া যায়। ব্যতিক্রমী হওয়ার অপরাধী যে আশু ক্ষতি ঘটিয়েছে তা এখানে গৌণ। প্রধান কথা হল, আইনভঙ্গকারী হল সর্বোপরি একজন ‘ভঙ্গকারী’, সমগ্রের সঙ্গে তার চুক্তি সে ভঙ্গ করেছে, সমগ্রের কাছে করা প্রতিজ্ঞা সে ভঙ্গ করেছে, সেতাবধি লোকসামাজিক জীবনের যে সুবৈশিষ্ট্য ও সুবিধাসমূহের ভাগ সে পেয়েছে তার প্রতিদান দিতে সে অস্বীকার করেছে। সেই অর্থে সে তাকে দেওয়া সুবিধা ও অগ্রিম যে শোধ করেনি, কেবল তাই নয়, উপরন্তু সে তার ঋণদাতাকে আক্রমণও করেছে। সুতরাং সেই মুহূর্ত থেকে এই অকৃতজ্ঞ খাতককে সুসামগ্রী ও সুবিধাসমূহ থেকে যুক্তিসঙ্গতভাবেই বঞ্চিত করা হবে, কেবল তাই নয়, এইসব সুসামগ্রীর কদর কী তা তাকে বারবার স্মরণ করিয়ে দেওয়া হবে। আঘাতপ্রাপ্ত ঋণদাতা হিসেবে লোকসমাজের ক্রোধ তাকে পূর্ববর্তী রক্ষাবেষ্টনী সরিয়ে আইনের আশ্রয়চ্যুত বন্য অবস্থায় নিক্ষেপ করবে। লোকসমাজ তাকে ঠেলে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে দেবে— এখন তার উপর যে কোনো রূপ শত্রুতাপূর্ণ আঘাত অনুমোদিত হয়ে উঠবে। সাংস্কৃতিক আচরণের এই পর্যায়ে ‘দণ্ডদান’ কেবল সেই আচরণেরই এক প্রতিলিপি যা সাধারণত যুদ্ধে পরাভূত ও নিরস্ত্র করা ঘৃণিত শত্রুর সঙ্গে করা হয়, যার ক্ষেত্রে সমস্ত আইনি অধিকার ও রক্ষাকবচ তো বটেই, দয়া পাওয়ার অধিকারও বাতিল বলে ধরা হয়। সুতরাং এ হল যুদ্ধের অধিকার, সমস্ত নির্মমতা নৃশংসতা সহযোগে বিজিতকে পীড়ন করে বিজয় উদযাপনের অধিকার। তাই ইতিহাসে যে সকল রূপ ধরে দণ্ডদান আবির্ভূত হয়েছে, তা সবই স্বয়ং যুদ্ধ (যুদ্ধসম ধর্মীয় পদ্ধতি বলিদানকে তার অন্তর্ভুক্ত ধরে) থেকে উপজাত।
১০
কোনো লোকসমাজ যত বেশি ক্ষমতা অর্জন করতে থাকে, ততই তা আর তার ব্যক্তি সদস্যদের অপরাধকে অত গুরুতর বলে বিবেচনা করে না, যেহেতু সেসব অপরাধ আর আগের মতো তার সার্বিক অস্তিত্বের পক্ষে বিপজ্জনক বা অব্যবস্থিতকারী বলে গণ্য করার কারণ থাকে না। অপরাধীকে আর ‘সমাজবহির্ভূত করে’ বাইরে ছুঁড়ে ফেলা হয় না, আগের মতো আর একই মাত্রায় তার উপর জনরোষ উগরে দেওয়া মঞ্জুর করা হয় না— বরং সেই জনরোষ থেকে, বিশেষ করে প্রত্যক্ষত ক্ষতিগ্রস্তদের রোষ থেকে তাকে সাবধানে আড়াল করে তাকে রক্ষাপ্রদ জিম্মায় নেওয়া হয়। ফৌজদারি আইনের পরবর্তী বিকাশে ক্রমশ আরো স্পষ্টতর ভাবে এই ছাপগুলো ফুটে উঠতে থাকে: অপরাধের দ্বারা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্তদের ক্রোধের সঙ্গে সমঝোতা করা, তার মধ্য দিয়ে ঘটনাটিকে আঞ্চলিকভাবে সীমাবদ্ধ করে ফেলা এবং গণ্ডগোল ছড়িয়ে পড়ে অনেকের তাতে জড়িয়ে পড়া রোধ করা, সমমূল্য চুকানোর উপায় খুঁজে বের করে গোটা ব্যাপারটায় ইতি টানা, সর্বোপরি ক্রমবর্ধমান স্বচ্ছতা নিয়ে এই বাসনার হাজির হওয়া যে প্রতিটি অপরাধকর্মেরই কোনো না কোনো ভাবে মূল্য চুকিয়ে দেওয়া সম্ভব, আর তার মধ্য দিয়ে, অন্তত কিছুটা মাত্রায় হলেও, অপরাধী ও তার অপরাধকে একে অপরের থেকে আলাদা করা। লোকসমাজের ক্ষমতা ও আত্মবিশ্বাস যদি বাড়তে থাকে, ফৌজদারী বিধিও ক্রমেই নরম হতে থাকে। আর যখনই লোকসমাজ দুর্বল হয়ে পড়ে বা গভীর বিপন্নতা বোধ করে, তখনই আবার কঠোরতর ফৌজদারী বিধিগুলো সামনে উঠে আসে। ‘ঋণদাতা’ সর্বদা সেই মাত্রাতেই আরো মানবিক হয় যে মাত্রায় সে নিজে আরো ধনী হয়ে ওঠে। শেষাবধি তার সম্পদের পরিমাণও মাপা হয় কতটা ক্ষতি সে অবলীলাক্রমে সহ্য করে নিতে পারে তা দিয়ে। নিজ ক্ষমতা সম্পর্কে আত্মবিশ্বাসী এমন লোকসমাজ কল্পনা করা অসম্ভব নয় যা তার নিজ অপরাধীদের দণ্ড ছাড়াই ছেড়ে রাখার সম্ভ্রান্ততম বিলাসিতা ভোগ করতে পারে। সেই সমাজ তখন বলতে পারে: ‘আমার পরজীবীদের নিয়ে আমার মাথাব্যথার কী আছে? তারা বেঁচে-বর্তে সমৃদ্ধ হোক গে যাক, তা সহ্য করার মতো যথেষ্ট শক্তি আমার আছে!’… ‘সমস্তকিছুর মূল্য চোকানো যায়, সমস্তকিছুর মূল্য চোকাতেও হবে’ বলে যে ন্যায়বিচারের শুরু হয়েছিল তা এখন চোখ বুজিয়ে মূল্য চোকানোয় অপারগ ব্যক্তিকে পার পেয়ে যেতে দিয়ে নিজের শেষ ডেকে আনে— যেভাবে পৃথিবীর সমস্ত উত্তম বস্তু নিজেকে লোপ করার মধ্য দিয়ে নিজের শেষ ডেকে আনে। আমরা জানি যে নিজের এই আত্মবিলোপকে ন্যায়বিচার একটা সুন্দর নাম দিয়েছে, সে নাম হল ‘দয়া’। না বললেও চলে যে দয়া সবচেয়ে ক্ষমতাশালী মানুষেরই অধিকারের মধ্যে পড়ে, বা, আরো ভালো করে বললে, আইনের সীমা ছাপিয়ে গিয়ে তার এই অধিকার।
১১
সদ্য প্রকাশিত কিছু লেখায় সম্পূর্ণ আলাদা একটি জায়গায় ন্যায়পরতার উৎস খোঁজার প্রয়াস সম্পর্কে সমালোচনাত্মক-বিচারমূলক একটি মন্তব্য এখানে করা যাক। সম্পূর্ণ আলাদা এই জায়গাটি হল রেসসেন্টিমেন্ট৩। মনস্তত্ববিদদের যদি আদৌ এই রেসসেন্টিমেন্ট বিষয়টি নিয়ে খুঁটিয়ে চর্চা করার কোনো ইচ্ছা থেকে থাকে, তাহলে আগে তঁাদের কর্ণকুহরের উদ্দেশ্যে একটি কথা বলি: আজকালকার দিনে রেসসেন্টিমেন্ট নামক এই উদ্ভিদটি লতায়-পাতায় সবচেয়ে বেশি পল্লবিত হয়ে ওঠে নৈরাষ্ট্রবাদী (anarchists) ও ইহুদি-বিরোধীদের মধ্যে; তাছাড়া, ভিন্ন সুবাসধারী হলেও বেগুনি ফুলের মতোই তা সর্বদা আড়াল-করা লুকোনো জায়গাতেই পাপড়ি মেলে। আর অনুরূপ উৎস থেকে বাধ্যতামূলকভাবে অনুরূপ বস্তুই যেহেতু উৎসারিত হয়ে থাকে, তাই অবাক হওয়ার কিছু নেই যে ওই দুই মহল থেকেই বারবার ন্যায়পরতার নামে প্রতিশোধস্পৃহাকে পবিত্র রূপে তুলে ধরার প্রয়াস দেখা যায়— যেনবা আহত বোধ করে আঘাত পুষে রাখার মধ্য দিয়েই মূলত ন্যায়পরতার বিকাশ সম্পন্ন হয়— আর তার মধ্য দিয়ে দেখা যায় প্রতিশোধের ধারণা ব্যবহার করে সাধারণভাবে সব রকমের প্রতিক্রিয়ামূলক আবেগের মাথায় গৌরবমুকুট পরানোর বিলম্বিত উদ্যোগ। এই শেষোক্ত বিষয়টি নিয়ে ব্যক্তিগতভাবে আমার বিরাগ সবচেয়ে কম। জীববিদ্যাসম্বন্ধীয় গোটা সমস্যাটার কথা ধরলে (যার সাপেক্ষে ওইসব আবেগগুলোর গুরুত্বকে এখনও অবধি খাটো করে দেখা হয়ে থাকে) এর মধ্য দিয়ে এমনকি উপকার হয় বলেও আমার মনে হয়। শুধু যে বিষয়টি আমি এখানে নজরে আনতে চাইছি তা হল: এই রেসসেন্টিমেন্টের ভাবমূল থেকেই বৈজ্ঞানিক ন্যায়পরতার প্রতি এই নয়া ঝোঁক জন্ম নেয় (যা ঘৃণা, বিদ্বেষ, বিরক্তিবোধ, সন্দেহ, হিংসা ও প্রতিশোধের পক্ষপাতী হয়)। এই তথাকথিত ‘বৈজ্ঞানিক ন্যায়পরতা’ উবে গিয়ে মুহূর্তমধ্যে প্রাণান্তিক শত্রুতা ও বিদ্বেষভাবের সুরকে জায়গা করে দেয় যখনই তা জীববিদ্যাগতভাবে ওইসব প্রতিক্রিয়ামূলক আবেগের তুলনায় অনেক বেশি গুরুত্বসম্পন্ন এমন এক দল অপর আবেগের মুখোমুখি হয় যা স্বভাবতই বৈজ্ঞানিকভাবে নিরূপিত হওয়ার ও মর্যাদা পাওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার আদায় করে নিয়েছে: যেমন, প্রভুত্বের আকাঙ্ক্ষা, দখল/অর্জন করার আকাঙ্ক্ষা, ইত্যাদির মতো যথার্থই সক্রিয় নানা আবেগ (ই ড্যুরিঙ-এর ‘দি ভ্যালু অফ লাইফ: এ কোর্স ইন ফিলজফি’ গোটা বইটাই এক্ষেত্রে উদাহরণ)৪। সাধারণভাবে এই প্রবণতার বিরুদ্ধে আপাতত এইটুকুই থাক। কিন্তু ড্যুরিঙ-এর একক মূলনীতি যে ন্যায়ের স্বদেশ খুঁজতে হলে আমাদের প্রতিক্রিয়ামূলক অনুভূতির দেশেই যেতে হবে, তা নিয়ে আরো কিছু বলা দরকার। সত্যের কদর করতে হলে এই মূলনীতিটিকে অবিনীতভাবে উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দাঁড় করিয়ে অন্য এক মূলনীতি খাড়া করা ছাড়া উপায় নেই: ন্যায়ের আদর্শ দ্বারা শেষতম যে অঞ্চল অধিকৃত হতে পারে তা হল প্রতিক্রিয়ামূলক আবেগের দেশ! সত্যিই যদি এমনটা ঘটে যে ন্যায়পরায়ণ কোনো ব্যক্তি তাকে আহত করা অন্য কোনো ব্যক্তির প্রতিও ন্যায়বান থাকে (শুধুমাত্র শীতল, সংযত, অচেনা ও প্রতিক্রিয়াহীন থাকে না; যেহেতু ন্যায়বান থাকা সর্বদাই একটি সদর্থক মনোভাব বিশেষ), যেমন গভীরসঞ্চারী তেমনই সদয় সেই ন্যায়পরায়ণ বিচারকারী চোখের মহৎ স্বচ্ছ বৈষয়িকতা ব্যক্তিগত আঘাত, পরিহাস ও অবিশ্বাসের চকিত আক্রমণের মুখেও অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যায় না, তাহলে তা এই ধরায় সম্ভাব্য সর্বোচ্চ মাপের উৎকর্ষ ও প্রকৃষ্টতার পরিচয়— তা সচরাচর আশা করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না, অন্তত সহজেই তাতে বিশ্বাস করে নেওয়া ঠিক হবে না। নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে সবচেয়ে ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তিদের ক্ষেত্রেও গড়বিচারে শত্রুতা-দ্বেষ-বক্রোক্তির অল্পবিস্তর মাত্রাই ক্ষিপ্ত করে তোলা ও চোখ থেকে ন্যায়পরায়ণতার আলো মুছে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট হয়ে ওঠে। প্রতিক্রিয়া-চালিত ব্যক্তির তুলনায় সক্রিয়, আগ্রাসী, বহিঃপ্রসারিত ব্যক্তিরাই এখনও ন্যায়ের দিকে শত পা এগিয়ে আছে। একজন প্রতিক্রিয়া-চালিত ব্যক্তি যেমন একটি বস্তুকে ভুল ও পক্ষপাতদুষ্ট ভাবে বিচার করে থাকে, সক্রিয়, আগ্রাসী, বহিঃপ্রসারিত ব্যক্তির তা প্রয়োজন হয় না। সেই জন্যই চিরকাল একজন স্বতঃপ্রবৃত্ত ব্যক্তি তুলনায় বেশি সাহসী ও সম্ভ্রান্ততর মানুষ হিসেবে উৎকৃষ্টতর বিবেকবোধ ও স্বাধীনতর দৃষ্টিভঙ্গীর অধিকারী হয়ে এসেছে। উল্টোদিকে, ‘বিবেকদংশন’-এর উদ্ভাবন কোন ধরনের বিবেকে ঘটেছে তাও আমরা এখন অনুমান করতে পারি— তা ঘটেছে রেসসেন্টিমেন্ট বিশিষ্ট ব্যক্তির বিবেকে! অবশেষে, ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেখা যাক: আইনকানুন বলবৎকরণের গোটা প্রক্রিয়া এবং তার আবশ্যিক প্রয়োজনীয়তা এখনও অবধি পৃথিবীতে কোন ক্ষেত্রে সহজ-সাবলীল বলে প্রতীত হয়েছে? তা কি প্রতিক্রিয়া-চালিত মানুষদের ক্ষেত্রেই নয়? না, মোটেই তা নয়। বরং তা সাবলীল হয়েছে সক্রিয়, বলবান, স্বতঃস্ফূর্ত ও আগ্রাসী মানুষদের ক্ষেত্রেই। পূর্বোল্লিখিত বিক্ষুব্ধ প্রচারক মহোদয় (যিনি নিজের সম্পর্কে একবার এই স্বীকারোক্তি জ্ঞাপন করেছিলেন: ‘প্রতিশোধ নেওয়ার মতবাদ আমার সমস্ত কাজ ও প্রচেষ্টাকে ন্যায়ের লাল সুতোয় গেঁথে রেখেছে।’) ক্ষুব্ধ হলেও না বলে উপায় নেই যে ইতিহাসগতভাবে বিচার করলে এই পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত আইনকানুন প্রতিক্রিয়া-চালিত অনুভবের বিরুদ্ধে সক্রিয় ও আগ্রাসী ক্ষমতাবলীর সেই সংগ্রামেরই প্রতিনিধি, যে সংগ্রাম প্রতিক্রিয়া-চালিত করুণ রসের বাড়াবাড়ি নিবৃত্ত বা প্রশমিত করায় কিছু শক্তি ব্যয় করে তাকে এক প্রকার বোঝাপড়ায় আসতে বাধ্য করে। ন্যায় যেখানে চর্চিত হয়, যেখানে ন্যায়কে তুলে ধরা হয়, সেখানেই আমরা দুর্বলতর ক্ষমতার সাপেক্ষে তার উপরে দাঁড়িয়ে থাকা সবলতর এমন ক্ষমতাকে (গোষ্ঠী বা ব্যক্তি যাই হোক না কেন) দেখতে পাই যা দুর্বলতরের মধ্যে রেসসেন্টিমেন্টের মূঢ় আক্রোশ নিবৃত্ত করার উপায় সন্ধান করে। এই উপায়সন্ধান নানাভাবে হতে পারে, যেমন: অংশত হতে পারে রেসসেন্টিমেন্ট উদ্রেককারী বিষয়বস্তুটিকে প্রতিশোধের কবলের বাইরে টেনে আনার মধ্য দিয়ে, অংশত হতে পারে প্রতিশোধের জায়গায় শান্তি-শৃঙ্খলার শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়াইকে প্রতিস্থাপিত করে, অংশত হতে পারে ক্ষতিপূরণের কথা তুলে তার প্রস্তাব হাজির করে বা বিশেষ ক্ষেত্রে তা বাধ্যতামূলক করে তুলে, আবার অংশত হতে পারে ক্ষতি বা আঘাতের সমমূল্য পরিপোষকের বিধান তৈরি করে— এমন কোনো উপায় অবলম্বন করেই এহেন কোনো খাতে স্থায়ীভাবে রেসসেন্টিমেন্টকে প্রবাহিত করে দেওয়া হয়। সর্বোচ্চ ক্ষমতা বৃহত্তর সংখ্যক শত্রুতা ও বিদ্বেষের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত যে উপাদান স্থাপন ও নির্বাহ করে— যথেষ্ট শক্তিসঞ্চয় করার পর যা করাই সর্বদা ক্ষমতার ধর্ম— তা হল আইনকানুন প্রতিষ্ঠা করা। আইনকানুন মানে সেই সর্বোচ্চ ক্ষমতার দৃষ্টিকোণ থেকে সাধারণভাবে কী অনুমোদিত ও বৈধ এবং কী নিষিদ্ধ ও অবৈধ তার আদেশবোধক ব্যাখ্যা। আইনকানুন প্রতিষ্ঠার পর প্রাধিকারীরা ব্যক্তি-একক বা গোষ্ঠীর স্বেচ্ছাচারী ও আগ্রাসী যে কোনো কাজকে আইনকানুনের অবমাননা হিসেবে গণ্য করে, স্বয়ং সর্বোচ্চ ক্ষমতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হিসেবে চিহ্নিত করে এবং তাদের অধীনস্থ থাকা মানুষজনের দৃষ্টিকে সেইসব বেনিয়ম দ্বারা সংঘটিত আশু ক্ষতি থেকে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে শেষ বিচারে প্রতিশোধলিপ্সার উল্টোপথে কাজ করে, কারণ প্রতিশোধলিপ্সা কেবলমাত্র ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষের দৃষ্টিকোণকেই মান্যতা দেয়। এখন থেকে ক্রিয়াকর্মকে সর্বদা ব্যক্তিনিরপেক্ষভাবে বিচার করার জন্য দৃষ্টি প্রশিক্ষিত হতে থাকে, এমনকি স্বয়ং ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষের দৃষ্টিও তার ব্যতিক্রম হয় না (যদিও ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষের দৃষ্টির প্রশিক্ষণ সবার শেষে সম্পন্ন হয়, যা আমি আগেও বলেছি)। সুতরাং, আইনকানুন প্রতিষ্ঠা হওয়ার পরেই কেবলমাত্র ‘ন্যায়’ ও ‘অন্যায়’-য়ের অস্তিত্ব থাকতে পারে (ড্যুরিঙ যেমনটা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন, তেমনটা নয়; ক্ষতিকর ক্রিয়ার সংঘটন-মুহূর্ত থেকেই ‘ন্যায়’ ও ‘অন্যায়’-এর অস্তিত্ব থাকে না)। তাই সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন করে শুধু ন্যায় ও অন্যায় শব্দদুটো নিয়ে আলোচনা করার কোনো মানে হয় না। ক্ষতিকর, পীড়াদায়ক, শোষণকারী, ধ্বংসাত্মক— এগুলিকে ‘অন্যায়’ বলে দেগে দেওয়া যায় না, যে পরিমাণে জীবন আবশ্যিকভাবে সেই পথ ধরেই কাজ করে, অর্থাৎ, তার মৌল বৃত্তিতে জীবন ক্ষতি করে, পীড়া দেয়, শোষণ করে, ধ্বংস করে এবং এই সমস্ত বৃত্তির থেকে বিযুক্ত করে জীবনকে কল্পনাও করা যায় না। এর চেয়ে বিরক্তিকর কিছুও আমাদের স্বীকার না করে উপায় নেই; আমাদের স্বীকার করতে হবে যে সর্বোচ্চ জীববিদ্যক দৃষ্টিকোণ থেকে ন্যায়পরতার শর্তাবলী সর্বদাই কেবল ব্যতিক্রমমূলক শর্ত হতে পারে, ক্ষমতার উপর অধিষ্ঠিত যে মৌলিক বাঁচার অভিপ্রায় তার উপর আংশিক সীমাবন্ধন ছাড়া তা কার্যকরী হতে পারে না; এই অভিপ্রায়ের সামূহিক উদ্দেশ্য স্বরূপ যে বিশেষ উপায়াদি, অর্থাৎ, ক্ষমতার বৃহত্তর একক তৈরির উপায়াদি, তাদের অধীনস্থ হিসেবেই কেবল তা হতে পারে। সার্বভৌম ও সর্বজনীন রূপে যদি কোনো আইনকানুনের তন্ত্র কল্পিত হয়, যদি ধরে নেওয়া হয় যে ক্ষমতা জটের মধ্যেকার সংগ্রামের উপায় না হয়ে তা হল সাধারণভাবে সমস্ত সংগ্রামের বিরুদ্ধে এক উপায়, যেমনটা ড্যুরিঙ-এর কম্যুনিস্ট বাগাড়ম্বরে প্রত্যেকটি অভিপ্রায়কে অন্য সমস্ত অভিপ্রায়ের সঙ্গে সমান হিসেবে ধরে নেওয়ার মধ্য দিয়ে করা হয়েছে, তাহলে তা জীবনের বৈরী এক নীতি হয়ে উঠবে, মনুষ্যপ্রাণীদের ধ্বংসকারী ও দ্রবীভূতকারী হয়ে উঠবে, তা হবে মনুষ্যপ্রাণীর ভবিষ্যতের উপর এক হন্তারক আক্রমণ, অগোচরে শূন্যতা অভিমুখে এক যাত্রা।
১২
দণ্ডদানের উৎপত্তি ও উদ্দেশ্য— এমন দুটি সমস্যা যা পৃথক বা পৃথক হওয়া উচিত— তা নিয়ে আরেকটা কথায় এখন আসা যাক। দুর্ভাগ্যবশতঃ, এই দুটি বিষয়কে সাধারণত এক করে দেখা হয়ে থাকে। নৈতিকতার পূর্ববর্তী কুলজিকাররা প্রসঙ্গটির মোকাবিলা কীভাবে করেছেন? যেমন তাঁরা সর্বদা করে এসেছেন তেমন সরলভাবেই করেছেন। তাঁরা দণ্ডদানের পিছনে প্রতিশোধ বা নিবর্তনের মতো কোনো না কোনো ‘উদ্দেশ্য' খুঁজে বের করেছেন এবং তারপর অতি সরলভাবে সেই উদ্দেশ্যটিকেই দণ্ডদানের উৎপত্তিমূলক কারণ হিসেবে সবের গোড়ায় স্থাপন করেন— ব্যাস, তঁাদের কাজ শেষ। কিন্তু আইনের উৎপত্তির ইতিহাস নির্মাণে একমাত্র সবার শেষেই ব্যবহৃত হতে পারে ‘আইনের উদ্দেশ্য' সম্পর্কিত ধারণা। একটি বিশেষ বস্তুর উৎপত্তি কী থেকে ঘটল এবং সেই বস্তুর চূড়ান্ত উপযোগিতাটি কী, অর্থাৎ, উদ্দেশ্যসমূহের এক কাঠামোয় তার বিন্যাস ও প্রকৃত ব্যবহারটি কী— এই দুটি যে একে অপরের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা; কোনো এক ভাবে অস্তিত্বধারণ করে তার বর্তমান অবস্থায় পৌঁছেছে যে বস্তু তা যে তার উপর অধিষ্ঠিত ক্ষমতার দ্বারা বারংবার নতুন নতুন প্রেক্ষিত থেকে নতুন করে ব্যাখ্যাত হবে, নতুনভাবে উপযোজিত হবে, পুনর্সংগঠিত হয়ে নতুন উদ্দেশ্যে পুনর্বহাল হবে; জৈব জগতে সমস্ত ঘটনাই যে ক্ষমতায় পর্যুদস্ত করা ও প্রভুত্ব স্থাপন করার মধ্য দিয়ে কাজ করে এবং অন্যদিকে যে কোনো ক্ষমতায় পর্যুদস্ত করা ও প্রভুত্ব স্থাপন যে এমন এক পুনর্ব্যাখ্যা বা পুনর্সমন্বয়ের মধ্য দিয়ে কাজ করে যা ততোবধি কার্যকরী ‘বোধবুদ্ধি’ ও ‘উদ্দেশ্য’-কে অস্পষ্ট করে দেয় বা পুরোপুরি মুছেই দেয়— এই যে মূলতত্ত্বগুলোয় কত না কঠিন পথে আমরা পৌঁছেছি এবং না পৌঁছে উপায় নেই, যে কোনো ধরনের ইতিহাস নির্মাণে এদের থেকে গুরুত্বপূর্ণ মূলতত্ত্ব আর কিছু হতে পারে না। কোনো দেহাঙ্গের (বা আইনী প্রতিষ্ঠানের, বা সামাজিক প্রথার, বা রাজনৈতিক আচারের, বা বিশেষ শিল্পশৈলীর, বা ধর্মীয় পদ্ধতির) উপযোগিতাকে আমরা যত ভালোভাবেই হৃদয়ঙ্গম করে থাকি না কেন, তার মধ্য দিয়ে তখনও আমরা কোনোভাবেই তার উৎপত্তি সম্পর্কিত কোনো ধারণায় পৌঁছতে পারি না—এ কথা বয়োজ্যেষ্ঠদের কানে যতই বেয়াড়া বা অপ্রিয় শোনাক না কেন! স্মরণাতীত কাল থেকে মানুষ বিশ্বাস করে আসছে যে প্রদর্শনযোগ্য উদ্দেশ্যর মধ্য দিয়ে, বা একটি বস্তু, আকার বা প্রতিষ্ঠানের উপযোগিতার মধ্য দিয়ে, তার উৎপত্তির কারণ বোঝা যায়— যেমন, চোখের উৎপত্তি হয়েছে দেখার জন্য, হাতের উৎপত্তি হয়েছে কিছু আঁকড়ে ধরার জন্য। সুতরাং মানুষ ভেবে নিয়েছে যে দণ্ডদানেরও উৎপত্তি হয়েছে দণ্ডদান করার জন্য। কিন্তু সমস্ত উদ্দেশ্য, সমস্ত উপযোগিতা কেবল এমত চিহ্ন ছাড়া আর কিছু নয় যা কোনো এক ক্ষমতার অভিপ্রায় তার চেয়ে কম ক্ষমতাশালীর উপর প্রভুত্ব কায়েম করার মধ্য দিয়ে নিজ কার্যসিদ্ধির অর্থ হিসেবে সেই অধীনের উপর দেগে দিয়েছে। আর এই প্রক্রিয়াবশত কোনো বস্তু, দেহাঙ্গ বা আচারের গোটা ইতিহাসকেই দেখা যায় অনবরত বদলে যাওয়া ব্যাখ্যা ও সমন্বয়-চিহ্নের ধারাবাহিক শিকল হিসেবে— সেই শিকলে পরিস্থিতি বিশেষে অনির্ধারণীয় আকস্মিকতার মধ্য দিয়ে পূর্ববর্তীর জায়গায় পরবর্তীর উদয় ঘটছে। সুতরাং, কোনো বস্তু, আচার বা দেহাঙ্গের ‘বিকাশ’-এর মধ্যে নির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্যাভিমুখে প্রগতির কোনো ব্যাপার নেই, ক্ষমতা ও সম্পদের ন্যূনতম ব্যয়ের মধ্য দিয়ে যুক্তিবদ্ধ হ্রস্বতম পথে প্রগতিসাধনের ব্যাপার তো আরোই নেই— বরং আছে ক্ষমতাধীন করার উদ্দেশ্য নিয়ে সেই বস্তুর উপর কাজ করতে থাকা কমবেশি নিগূঢ়, কমবেশি পরস্পর-স্বাধীন নানা প্রক্রিয়া এবং তার প্রতিক্রিয়ায় আত্মরক্ষার্থে ঘটাতে চাওয়া নানা আকার-বদল, প্রতিরোধ, এমনকি সফল প্রতিবিধানও। আকার হল তরল; অবশ্য ‘অর্থ’ (‘meaning’) আরো বেশি তরল।... এমনকি প্রতিটি ব্যক্তি-প্রাণীবিশেষের মধ্যেও এর অন্যথা হয় না: সমগ্রের প্রতিটি আবশ্যিক বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বিশেষ দেহাঙ্গের ‘অর্থও’ বদলাতে থাকে— কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেই দেহাঙ্গের আংশিক ধ্বংস বা সংখ্যাগত হ্রাস (যা অন্তর্বর্তীকালীন কাঠামোর বিলুপ্তির মধ্য দিয়েও হতে পারে) ক্রমবর্ধমান ক্ষমতা ও পরোৎকর্ষের চিহ্ন হতে পারে। আমি যা বলতে চাইছি তা হল: উপযোগিতার আংশিক ক্ষয়, অবনমন ও অধোগতি, অর্থ ও উদ্দেশ্যমূলকতা হানি, বা, সংক্ষেপে, মৃত্যুও প্রকৃত প্রগতির মধ্যেই পড়ে, যা সর্বদা বৃহত্তর ক্ষমতার জন্য অভিপ্রায় ও তার উপায় হিসেবে রূপ ধারণ করে এবং প্রচুর সংখ্যক ক্ষুদ্রতর ক্ষমতার বিনিময়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে। এমনকি প্রগতির পথে এক পা ‘অগ্রগমন'-এর জন্য কী কী সব বলিদান করতে হয়েছে তার পরিমাণ দিয়ে সেই অগ্রগমনের দৈর্ঘ্য মাপা যেতে পারে। তুলনায় বেশি শক্তিশালী মানুষের এক প্রজাতির স্বার্থে গণহারে মানুষকে বলিদান দেওয়াও প্রগতির পথে এক পা অগ্রগতি হতে পারে।... ইতিহাসনির্মাণের প্রণালী সংক্রান্ত এই গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টিকোণের উপর আমি আরো বেশি করে নজর টানতে চাইছি যেহেতু তা মূলগতভাবে বর্তমানে বিরাজমান নিয়মবিধি ও রুচির পরিপন্থী। যা কিছু ঘটমান তার মধ্যে ক্ষমতার অভিপ্রায়ের তত্ত্বের ক্রিয়াশীলতা দেখার বদলে বর্তমানে বিরাজমান এই নিয়মবিধি ও রুচি যুক্তিবদ্ধ সম্ভাব্যতার তত্ত্বকেই, এমনকি যান্ত্রিক অর্থহীনতার আতিশয্যের সীমা ছুঁয়েও, আঁকড়ে থাকতে চায়। যে শাসন করে বা শাসন করতে চায়, তার প্রতি শত্রুতার যে গণতান্ত্রিক মানসবৈশিষ্ট্য, শাসকদের ঘৃণা করার যে আধুনিক মনোভাব (অপবস্তুর জন্য একটি অপশব্দ তৈরি করার রীতি), তা ধীরে ধীরে নিজেকে রূপান্তরিত করে এমন এক আধ্যাত্মিকতার বেশ ধারণ করেছে যা সর্বোচ্চ আধ্যাত্মিকতা হিসেবে পায়ে পায়ে সেঁধিয়ে যাচ্ছে আজকালকার কঠোরতম, আপাতদৃষ্টিতে সবচেয়ে বস্তুনিষ্ঠ, বিজ্ঞান গবেষণার মধ্যেও, আর তা হতে দেওয়া হচ্ছে। কার্যত, আমার মনে হয় যে ইতিমধ্যেই এই প্রবণতা সমগ্র শারীরবৃত্তি ও জীবনোপলব্ধির উপর প্রভুত্ব কায়েম করেছে, আর স্পষ্টতই তা ক্ষতিকর হয়েছে কারণ তা প্রকৃত ক্রিয়ার মৌলিক ধারণাটিকেই বিসর্জন দিয়েছে। উল্টোদিকে, এই মানসবৈশিষ্ট্যের চাপে আমরা ‘অভিযোজন’-কে সামনে ঠেলে এনেছি, যা নেহাতই এক দ্বিতীয় ক্রমের ক্রিয়া বা নেহাতই একটি প্রতিক্রিয়া। এর ফলে এমনকি জীবনকেও সংজ্ঞাত করা হয়েছে বহিঃস্থ পরিস্থিতির সঙ্গে সদা উদ্দেশ্যমূলক অন্তঃস্থ অভিযোজন হিসেবে (হারবার্ট স্পেনসার)।৫ কিন্তু জীবন, জীবনের ক্ষমতার অভিপ্রায় সম্পর্কে সম্পূর্ণ ভুল ধারণাই তা প্রচার করে। যে স্বতঃস্ফূর্ত, আগ্রাসী, বহিঃপ্রসারিত, পুনর্ব্যাখ্যাকারী, পুনর্নির্দেশকারী, আকারদায়ক ক্ষমতাবলীর প্রভাবে তৎপরবর্তীতে অভিযোজন ঘটে, সেই ক্ষমতাবলীর অগ্রগণ্যতাকে তা উপেক্ষা করে যায়। এর মধ্য দিয়ে তা অস্বীকার করতে চায় প্রাণীর নিজের মধ্যেকার সেই সর্বোচ্চ বৃত্তিসমূহের শাসনকারী ভূমিকাকে, কেবলমাত্র যাদের মধ্য দিয়েই বাঁচার অভিপ্রায় সক্রিয় সৃজনশীল রূপে প্রকাশিত হয়। স্পেনসারের ‘প্রশাসনিক সর্বধ্বংসবাদ’-এর জন্য তঁার যে সমালোচনা হাক্সলি৬ করেছিলেন তা আমাদের মনে রাখা উচিত। কিন্তু বিষয়টি এখানে কেবল ‘প্রশাসনিক’ গণ্ডীতেই সীমাবদ্ধ নয়...
১৩
আমাদের আলোচ্য বিষয়, অর্থাৎ, দণ্ডদানের কথায় ফিরে আসা যাক। দণ্ডদানের দুটি দিক আমাদের আলাদা করতে হবে: প্রথম দিকটির মধ্যে আছে তার আপেক্ষিক স্থিতিকাল, কীভাবে তা নির্বাহিত করা হচ্ছে, তার কার্যক্রম, তৎসংক্রান্ত ‘নাটক', প্রক্রিয়াগত কঠোর অনুক্রম; আর দ্বিতীয় দিকটি হল তার তারল্য, অর্থাৎ এবংবিধ কার্যক্রমের পরিণতকরণের সঙ্গে যুক্ত অর্থ, উদ্দেশ্য ও প্রত্যাশা। ইতিহাসনির্মাণের পদ্ধতি সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গিগুলো নিয়ে সদ্য যে আলোচনা আমরা করেছি তার সাপেক্ষে দেখলে এই বিষয়ে আমরা ধরে নিতে পারি যে স্বয়ং কার্যক্রমটি দণ্ডদান হিসেবে তার ব্যবহৃত হওয়ার তুলনায় বেশ কিছুটা পুরোনো এবং এই যে কার্যক্রমটি ভিন্ন অর্থ বহন করে দীর্ঘদিন ধরেই চালু ছিল, তাতে দ্বিতীয় দিকটিকে (অর্থাৎ দণ্ডদানের তারল্যের দিকটিকে) পরবর্তী কোনো সময়ে বাইরে থেকে প্রবিষ্ট করিয়ে ব্যাখ্যা রচনা করা হয়েছে। সংক্ষেপে বললে, নৈতিকতা ও আইনকানুনের কুলজি রচনাকারী আমাদের সরলমতি কুলজিকাররা সবাই এখনও অবধি যেভাবে ধরে নিয়েছেন যে দণ্ডদানের জন্যই এসব কার্যক্রম উদ্ভাবন করা হয়েছিল (ঠিক যেমন পূর্ববর্তী মানুষরা ভেবেছিলেন যে আঁকড়ে ধরার উদ্দেশ্যেই হাতের উদ্ভাবন হয়েছিল), তা ঠিক নয়। এখন দণ্ডদানের এই তারল্যের দিকটিকে ধরলে, সাম্প্রতিক সাংস্কৃতিক আবহে (ধরা যাক, সমসাময়িক ইউরোপের আবহে) দণ্ডদানের ‘অর্থ’-এর কথা ধরলে দেখা যাবে যে ‘দণ্ডদান’-এর ধারণা কোনো একটি অর্থকে হাজির করে না, বরং বহু অর্থের সংশ্লেষ হাজির করে। দণ্ডদানের এতাবধি ইতিহাস, বা সাধারণভাবে বিভিন্ন উদ্দেশ্যে দণ্ডদানের ব্যবহার, শেষ অবধি এমন এক এককে নিবন্ধীকৃত হয়ে যায়, যা জট ছাড়িয়ে ভেঙে বিশ্লেষণ করা দুরূহ এবং তার কোনোরূপ সংজ্ঞা নির্ধারণও একেবারেই অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। (আজ যেমন স্পষ্টভাবে বলা অসম্ভব যে কেন আমরা আসলে দণ্ড দিয়ে থাকি। এমন যে কোনো ধারণা যা একটি গোটা প্রক্রিয়ার সারসংক্ষেপ চিহ্নতান্ত্রিকতার মধ্য দিয়ে ধারণ করছে, তা সংজ্ঞা-নির্মাণের যে কোনো প্রচেষ্টাকেই এড়িয়ে যায়। যার কোনো ইতিহাস নেই কেবলমাত্র তারই সংজ্ঞা-নির্মাণ সম্ভব।) তুলনামূলক প্রাথমিক পর্যায়ে বরং সেই নানা ‘অর্থের’ সংশ্লেষের জট ছাড়ানো এবং এমনকি সমন্বয়সাধনও সহজতর থাকে। প্রতিটি আলাদা আলাদা ক্ষেত্রে অর্থ-সংশ্লেষের বিভিন্ন উপাদানগুলো কীভাবে তাদের যোজ্যতা পরিবর্তন করে তদনুযায়ী পুনর্বিন্যস্ত হয়, যাতে অচিরেই কোনো কোনো উপাদান সামনে উঠে এসে বাকি সব উপাদানের উপর আধিপত্য বিস্তার করে, এমনকি পরিস্থিতি বিশেষে কোনো একটি উপাদান (দণ্ডদানের ক্ষেত্রে যেমন নিবর্তনমূলক উদ্দেশ্য) অন্য সমস্ত উপাদানের উপরে উঠে শিরোধার্য বলে মনে হতে থাকে— তা ওই তুলনামূলক প্রাথমিক পর্যায়েই তখনও দেখা সম্ভব হলেও হতে পারে। দণ্ডদানের মর্ম কতটা অনিশ্চিত, বিলম্বিত ও আপতিক এবং একই কার্যক্রম কীভাবে মৌলিকভাবে ভিন্ন ভিন্ন উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত, ব্যাখ্যাত ও সমন্বিত হতে পারে, সেই সম্পর্কে অন্তত কিছু ধারণা পাওয়ার জন্য অসংলগ্নভাবে মনে আসা এই উদাহরণগুলোকেই দেখা যাক: বিপজ্জনক কাউকে আটকানোর জন্য, আর কোনো বিপদ ঘটার আগেই তা আটকানোর জন্য দণ্ড; ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির ক্ষতির খেসারত কোনো না কোনো ভাবে (এমনকি আবেগগত ক্ষতিপূরণ রূপেও হতে পারে) আদায় করার উপায় হিসেবে দণ্ড; সুস্থিতি বিঘ্নকারী কোনো ঘটনা যাতে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে ব্যাপকতর উপদ্রব না তৈরি করতে পারে সেই জন্য তাকে বিচ্ছিন্ন করে সীমাবদ্ধ করে রাখার উপায় হিসেবে দণ্ড; দণ্ডদানের অধিকারী প্রাধিকারসমূহ সম্পর্কে ভীতি সঞ্চার করার জন্য দণ্ড; আইনভঙ্গকারী এতাবধি যেসব সুবিধা ভোগ করে এসেছে তার খেসারত হিসেবে দেওয়া দণ্ড (যেমন যখন তাকে খনিতে দাস হিসেবে শ্রম করতে বাধ্য করার মধ্য দিয়ে উপযোগী করে তোলা হয়); অপজাত অংশকে কেটে বিদায় করার জন্য দণ্ড (কেটে বিদায় করা অংশটি পরিস্থিতি বিশেষে একটি গোটা শাখাও হতে পারে, যেমন আমরা চীনা আইনে পাই, আর এক্ষেত্রে দণ্ডকে ব্যবহার করা হয় একটি জাতির শুদ্ধতা রক্ষার জন্য বা বিশেষ একটি সামাজিক আদর্শকে টিকিয়ে রাখার জন্য); যে শত্রুকে অবশেষে পর্যুদস্ত করা গেছে, তার উপর অত্যাচার ও অপমান বর্ষণের জন্য দণ্ডদানকে উৎসব রূপে হাজির করা; দণ্ডিতজনের তথাকথিত ‘সংস্কারসাধন' হিসেবে ও দণ্ডদানের সাক্ষী অন্যদের মধ্যে শিক্ষা হিসেবে এক প্রকার বিবেকবোধ তৈরি করার উপায় হিসেবে দণ্ড; ক্ষমতাসীনদের তৈরি শর্ত মতো সাম্মানিক আরোপ স্বরূপ দণ্ডদান যা প্রতিশোধের আতিশয্য থেকে দুষ্কৃতিকে রক্ষা করে; যে মাত্রায় ক্ষমতাশালী পরিবারগুলো এখনও প্রতিশোধ নেওয়াকে তাদের বিশেষ একটি অধিকার হিসেবে মনে করে আঁকড়ে ধরে থাকে, সেই মাত্রায় প্রতিশোধের স্বাভাবিক চালের সঙ্গে আপসরফা হিসেবে দণ্ড; যুদ্ধঘোষণা হিসেবে দণ্ড, আবার, শান্তি-শৃঙ্খলা-আইনকানুন-প্রাধিকারের শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ হিসেবে দণ্ড, যেখানে চুক্তিভঙ্গকারী, শান্তিভঙ্গকারী, বিদ্রোহী বা বিশ্বাসঘাতক হিসেবে লোকসমাজের বিপদ বলে চিহ্নিতের বিরুদ্ধে জনতা যুদ্ধের সূত্রে হাজির হওয়া উপায়সমূহ দিয়ে লড়াই করে।
১৪
অবশ্যই উপরের তালিকাটি সম্পূর্ণ নয়। সন্দেহাতীত ভাবেই সমস্ত ধরনের উপযোগী উদ্দেশ্যমূলকতার অতিরিক্ত ভার দণ্ডদানের কাঁধে চাপানো হয়, তা এ কারণেই যাতে লোকে দণ্ডদানের সবচেয়ে অত্যাবশ্যক দিক বলে ধরে নেওয়া যায় এমন এক ঘোষিত উপযোগিতার সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারে— আর বর্তমানে বিভিন্ন কারণে দণ্ডদানে আস্থা দুর্বল হয়ে উঠলেও তার মধ্যেই সবচেয়ে শক্তিশালী অবলম্বন খুঁজে নিতে পারে। দোষী পক্ষের মধ্যে দোষীভাব জাগ্রত করার জন্য দণ্ডদান মূল্যবান বলে মনে করা হয়। ‘বিবেকদংশন’ নামক মানসদৈহিক প্রতিক্রিয়া তৈরির প্রকৃত হাতিয়ারের সন্ধান লোকে দণ্ডদানের মধ্য দিয়েই করে থাকে। কিন্তু তা করার মধ্য দিয়ে সমসময়ে তো বটেই, এমনকি মানুষের দীর্ঘতম ইতিহাস, তার প্রাক-ইতিহাস জুড়েও আরো বেশি করে লোকে বাস্তবতা ও মনোবিদ্যা উভয়কেই ভুলভাবে আত্মস্থ করে আসছে। যথার্থ বিবেকদংশন অতি বিরল বস্তু, বিশেষত দাগী অপরাধী ও কয়েদীদের মধ্যে তো বটেই। বিবেকেদংশন তৈরি করার মতো ঘুণপোকা যে কারাগার বা সংশোধনাগারের মাটিতে বংশবিস্তার করার উপযুক্ত পরিবেশ পায় না সে কথা যে কোনো সৎ পর্যবেক্ষকই না মেনে পারেন নি, যতই তা তঁাদের আকাঙ্ক্ষা বা প্রত্যাশার বিপরীত হোক না কেন। সাধারণভাবে, দণ্ডপ্রাপ্তি মানুষকে কঠিন ও শীতল করে তোলে, সংকীর্ণ করে তোলে, বিযুক্তির বোধকে আরো বাড়িয়ে দেয় এবং প্রতিরোধ ক্ষমতাকে আরো শক্তিশালী করে তোলে। দণ্ড যদি বা দণ্ডিতের জীবনীশক্তিকে চূর্ণবিচূর্ণ করে আত্মগ্লানি ও চূড়ান্ত অবসাদের হীনতায় নামিয়ে আনে, সে ফলাফল দণ্ডের বৈশিষ্ট্যমূলক শুষ্ক নিরাশ গাম্ভীর্যমণ্ডিত সাধারণ ফলের চেয়ে নিশ্চিতভাবেই বেশি অপ্রীতিকর। তাছাড়া, আমরা যদি মানুষের প্রাক-ইতিহাসের হাজার হাজার বছরগুলোকে বিবেচনার মধ্যে আনি, দ্বিধাহীন ভাবে সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায় যে দণ্ডদান নিজেই অপরাধবোধ তৈরি হওয়ার মুখে সবচেয়ে শক্তিশালী বাধা হিসেবে কাজ করেছে— অন্তত দণ্ডের বলি যারা হয়েছে তাদের ক্ষেত্রে তো বটেই। বিচার-বিভাগীয় ও নির্বাহিক প্রক্রিয়া সামনে থেকে দেখার অভিজ্ঞতাই কীভাবে একজন দাগী অপরাধীর মনে তার নিজ কর্মকে, কর্মের চরিত্রকে, স্বাভাবিকভাবে তিরস্কারযোগ্য বলে গণ্য করায় বাধা হয়ে দাঁড়ায় তার গুরুত্বও কিছু কম নয়। অপরাধী দেখতে পায় যে তার কৃতকর্মের মতো ঠিক একই ধরনের কর্ম— যেমন, চরবৃত্তি, মিথ্যাভাষণ, ঘুষ আদানপ্রদান, ফঁাদে ফেলা, তদন্ত-বিচার-শাস্তিনির্ণয়-য়ের বিভিন্ন ধাপে পুলিশ ও মকদ্দমা-চালকদের ছল-চাতুরি-পূর্ণ কর্মশৈলী— ন্যায়বিচারের সেবার নামে করা হচ্ছে এবং তারপর তা বিবেকবোধসম্পন্ন বলেও অভিনন্দিত হচ্ছে; চুরি-ডাকাতি, নিপীড়ন, দুর্ব্যবহার, কয়েদ করা, অত্যাচার, খুন সবকিছুই নীতিসঙ্গত ভাবে করে যাওয়া হচ্ছে ঠান্ডা মাথায়, ন্যূনতম কোনো আবেগতাড়িত হওয়ার দোহাই ছাড়াই; বিচারকরাও এই সব কর্মকে বিনা প্রশ্নে বর্জনীয় বা নিন্দাযোগ্য বলছেন না, কেবল বিশেষ ক্ষেত্রে বিশেষ উদ্দেশ্যে সম্পাদিত হলে তবেই ও সব কর্মকে অপরাধ বলে ঘোষণা করছেন। আমাদের এই পৃথিবীর সমস্ত লতা-পাতা-উদ্ভিদের মধ্যে সবচেয়ে গা-ছমছমে ও চিত্তাকর্ষক যে ‘বিবেকদংশন’ লতা, তা এমন মাটিতে জন্মায় না। অতীতের সবচেয়ে দীর্ঘ পর্যায় জুড়ে ‘দোষী পক্ষ’ বলে কোনো বস্তুকে চিহ্নিত ও মোকাবিলা করার কথা বিচারকদের বা এমনকি দণ্ড-নির্বাহকারীদের চেতনাতেও উদয় হয়নি। বরং তারা এমন কারো মোকাবিলা করেছে যে যেনবা নিয়তির এক দায়িত্বজ্ঞানহীন টুকরোর মতো কোনও ক্ষতি ডেকে এনেছে। আর দণ্ডিত মানুষটিও তার উপর এক টুকরো নিয়তির মতো নেমে আসা এই দণ্ডকে গ্রহণ করেছে পূর্বানুমান করা যায় না এমন এক চকিত দুর্যোগ হিসেবে; হঠাৎ পতন বা পাথরধ্বসে চাপা পড়ার মতো ভয়ঙ্কর প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখে যেমন বিরুদ্ধে লড়াই করার আর কোনো উপায় থাকে না, তাই ‘অন্তর্বেদনা’-রও অবকাশ থাকে না, দণ্ডও তেমনই দণ্ডিতের মধ্যে কোনো ‘অন্তর্বেদনা’ জাগায় নি।
১৫
স্পিনোজা একদা এই বিষয়ে বেশ অস্বস্তিকর রকম সচেতন হয়ে উঠেছিলেন (যা কুনো ফিশার-এর মতো তঁার ব্যাখ্যাকারদের যারপরনাই বিরক্তি উৎপাদন করেছে এবং তাঁরা এ ব্যাপারে স্পিনোজাকে বিপুল মাত্রায় ভুল বুঝেছেন)। একদিন বিকেলে স্মৃতির মতো কিছু (ঠিক কী তা কেই বা জানে?) তঁার মনে উদয় হয় এবং তঁার মনকে একটি প্রশ্নে তোলপাড় করে তোলে। প্রশ্নটি হল: সবাই যার গুণ গায় সেই বিবেকদংশন-এর কতটা কী তঁার নিজের মধ্যে এখনও অবশিষ্ট আছে? তিনি ভালো ও মন্দ সূচক ধারণাসমূহকে মানুষের আজগবী কল্পনার জগতে নির্বাসিত করেছেন, ‘সবকিছুর মধ্যেই ঈশ্বর সুযুক্তি মেনে (sub ratione boni) কাজ করে’ বলে দাবি করে যে ঈশ্বরনিন্দুকরা তাদের বিরুদ্ধে উচ্চমেজাজে তঁার ‘মুক্ত' ঈশ্বরের সম্মান রক্ষা করতে চেয়েছেন (‘তবে তো ঈশ্বরকে নিয়তির অধীন হতে হয়, যে দাবির চেয়ে বড় অসংগতি আর কিছু হতে পারে না’), সেই তঁার নিজের ক্ষেত্রে বিবেকদংশন বলে কী অবশিষ্ট থাকতে পারে? স্পিনোজার বিবেচনায় জগৎ তো বিবেকদংশন-এর উদ্ভাবনের পূর্বে অস্তিত্বমান নিষ্পাপ সরলতার অবস্থায় প্রত্যাবর্তন করেছে। তাহলে সেমতাবস্থায় বিবেকদংশন-এর কী গতি হয়েছে? শেষাবধি স্পিনোজা নিজেকে উত্তর দিয়েছিলেন: ‘আনন্দ (gradium)-এর বিপরীত হল দুঃখ, যার সঙ্গে জুড়ে আছে সমস্ত পূর্ব-প্রত্যাশার বিপরীতে ঘটে যাওয়া কোনো অঘটনের প্রতিবিম্ব’ (এথিকস-III, প্রোপোজিশন-XVIII)। স্পিনোজার মতো একই সুরে মন্দে প্ররোচনা দেওয়ার অপরাধে দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা হাজার হাজার বছর ধরে বোধ করে এসেছে যে তাদের ‘অপরাধ'-এর কথা বলতে হলে বলতে হয় যে ‘অপ্রত্যাশিত কোনো অঘটন ঘটে গেছে’, এমনটা নয় যে ‘আমার ও কাজ করা উচিত হয়নি’— তারা দণ্ডের কাছে আত্মসমর্পণ করে এসেছে যেমনভাবে কেউ কোনো রোগ, দুর্ভাগ্য বা মৃত্যুর কাছে আত্মসমর্পণ করে, তা করেছে এমনই দ্রোহমুক্ত ভয়হীন অদৃষ্টবাদের সঙ্গে যার উদাহরণ আজও রুশদের মধ্যে টিকে আছে আর সেজন্যই রুশরা আমাদের মতো পশ্চিমাদের তুলনায় অনেক সহজে জীবনের সঙ্গে এঁটে উঠতে পারে। সেই অতীত কালে, অপরাধ বলে চিহ্নিত কাণ্ডটির যদি বা কোনো সমালোচনা হতো, পরিণামদর্শিতার দিক থেকেই সেই সমালোচনা উঠত। দণ্ডদানের আবশ্যিক প্রভাবটিও প্রশ্নাতীতভাবে পরিণামদর্শিতা বাড়ানো ও স্মৃতির প্রসারণ ঘটানোর সাপেক্ষেই সবচেয়ে বেশি করে ভাবা হতো যাতে তার পরে কেউ আরো সাবধানতা, আরো অবিশ্বাস ও আরো গোপনীয়তা নিয়ে, বহু বিষয়ে নিজেদের নির্দিষ্ট অতি-দুর্বলতা সম্পর্কে আরো সচেতন থেকে যে কোনো কাজে অবতীর্ণ হয়, একভাবে বললে, নিজেকে কাঠগড়ায় তুলে বিচার করার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। সাধারণভাবে বলা যায় যে দণ্ডদানের মধ্য দিয়ে মানুষ ও অন্য প্রাণীদের মধ্যে ভীতি বাড়ানো যায়, পরিণামদর্শিতায় শান দেওয়া যায় এবং ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষায় নিয়ন্ত্রণের বেড়ি পড়ানো যায়। সেই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে দণ্ডদান মানুষকে পোষ মানাতে পারে, কিন্তু তাকে ‘আরো ভালো’ মানুষ করে তুলতে পারে না— বরং উল্টোটাই বেশি যাথার্থ্যের সঙ্গে বলা যেতে পারে। (লৌকিক প্রজ্ঞা বলে যে ‘আঘাত মানুষকে পরিণামদর্শী করে তোলে', কিন্তু যে মাত্রায় তাকে পরিণামদর্শী করে তোলে, সেই মাত্রাতেই তাকে আরো খারাপ করে তোলে। সৌভাগ্যবশত, প্রায়শই একইসঙ্গে তা মানুষকে নির্বোধও করে তোলে।)
১৬
এখন ‘বিবেকদংশন'-এর উৎস বিষয়ে আমার নিজের প্রাথমিক ও অস্থায়ী অনুমানটি হাজির করা আর এড়িয়ে যাওয়া যায় না। তার দিকে পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করা অবশ্য সহজ নয়, আর তা পাঠকের কাছ থেকে বিস্তারিত বিবেচনা ও ধৈর্য্যপূর্ণ প্রশ্রয় দাবি করে। আমার বিবেচনায় বিবেকদংশন হল এক গভীর অসুখ। এই গভীর অসুখে মানুষকে আক্রান্ত হতে হয় তার এতদিনকার অভিজ্ঞতার মধ্যে সবচেয়ে মৌলিক পরিবর্তনের চাপে, যে পরিবর্তনের মুখোমুখি সে হয় যখন শেষাবধি সে নিজেকে সমাজ ও শান্তির ঘেরাটোপের মধ্যে বন্দি রূপে আবিষ্কার করে। জলের প্রাণীরা বাধ্যতামূলকভাবে ডাঙার প্রাণী হয়ে ওঠা আর নয়তো নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার চাপের মুখে পড়ে যে অবস্থার মধ্য দিয়ে গিয়েছিল, মানুষ নামক বন্যতা-যুদ্ধ-প্রব্রজন-অভিযান-এর মধ্যে বেড়ে ওঠা অর্ধ-জন্তুদেরও নিশ্চয়ই তেমনই অবস্থার মধ্যে পড়তে হয়েছিল যখন হঠাৎই তাদের সমস্ত প্রবৃত্তিকে অবমূল্যায়িত করে ‘নাকচ’ করা হয়েছিল। আগে জল যে আশ্রয় দিত, তার বদলে সেই সময় থেকে জলজ প্রাণীরা পায়ে হেঁটে ‘নিজেরাই নিজেদের বহন করতে’ বাধ্য হয়েছিল। এক ভয়ঙ্কর ভার তাদের উপর চেপে বসেছিল। সরলতম কাজটা করতেও তারা অস্বস্তিতে পড়ছিল। এই নতুন অজানা জগতের মোকাবিলা করার কাজে তাদের পুরানো পথপ্রদর্শকরা— প্রভুত্বকারী সেই সব অচেতন প্রবৃত্তি যা তাদের নিরাপদে পথ দেখিয়ে নিয়ে যেত— তখন আর তাদের সঙ্গ দিচ্ছিল না। ফলে ভাবা, ভেবে সিদ্ধান্তে পৌঁছানো, হিসেব করা, কার্য-কারণ মেলানো ছাড়া এই অভাগাদের আর কোনো সম্বল ছিল না, তাদের সবচেয়ে অনুর্বর ও সবচেয়ে ভ্রমপ্রবণ যন্ত্র ‘চেতনা’-ই তাদের অধিকার করে নিয়েছিল! আমার মনে হয় যে পৃথিবীতে আর কখনো তেমন দুঃখ ঘনিয়ে ওঠেনি, অস্বাচ্ছন্দ্যের গুরুভার আর কখনো তেমন ভাবে পিষে মারেনি। তবে তাই বলে তো সেই পুরোনো প্রবৃত্তিগুলো চকিতেই তক্ষুণি তাদের দাবি ছেড়ে দেয়নি! কেবলমাত্র সেই পুরোনো প্রবৃত্তিদের নির্দেশ পালন অনেক কঠিন ও কদাচ সম্ভব হয়ে উঠেছিল। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে, প্রবৃত্তিগুলো বাধ্য হয়েছিল অন্তরালবর্তী সন্তুষ্টির নতুন উপায় খুঁজে নিতে। যে প্রবৃত্তিরই বহিঃস্রাব রুদ্ধ হয়ে যায়, তা মুখ ঘুরিয়ে ভিতর দিকে ক্ষরণ ঘটাতে থাকে— এই প্রক্রিয়াকেই আমি মানুষের অভ্যন্তরীকরণ (Verinnerlichung) বলে অভিহিত করেছি। এর থেকেই প্রথম জন্ম হয়েছিল তার যাকে মানুষ পরে ‘আত্মা' নাম দিয়েছিল। গোটা অভ্যন্তরীণ জগৎ— শুরুতে যা এতই পাতলা ছিল যেনবা তা চামড়ার দুটি স্তরের মধ্যে টানটান করে বিছানো— ক্রমে তা নিজেকে বিস্তৃত ও পরিবর্ধিত করে এমন প্রস্থ-গভীরতা-উচ্চতা অর্জন করেছে যে মানুষ যা আগে বাইরের পৃথিবীতে ক্ষরণ করে দিত তার বহিঃপথ পুরোপুরি আটকে দিয়েছে। যে ভয়প্রদ দুর্গ-ব্যবস্থার বর্ম দিয়ে পুরোনো সেই স্বাধীনতার প্রবৃত্তি থেকে রাষ্ট্রীয় সংগঠনগুলো নিজেদের রক্ষা করেছিল— সেই দুর্গব্যবস্থার মধ্যে সবার উপরে আছে দণ্ডদান— তারই ফলে বন্য, স্বাধীন, প্রব্রজ্যমান মানুষদের প্রবৃত্তিগুলো পিছনে ঘুরে স্বয়ং মানুষের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। শত্রুতা ও নিষ্ঠুরতা, পিছে তাড়া, আক্রমণ, পরিবর্তন বা ধ্বংস করার আনন্দ— এমন সবকিছুই মুখ ঘুরিয়ে সেমত প্রবৃত্তিধারীদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। এই হল ‘বিবেকদংশন'-এর সূত্রপাত। বাইরের শত্রু ও বিরোধিতার অভাবে যে মানুষটি পীড়াদায়ক সংকীর্ণতা ও নিয়মাবদ্ধ আচারের মধ্যে আটকে পড়ল, সে অসহিষ্ণুভাবে নিজেই নিজেকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করল, নিজেই নিজেকে দোষী সাব্যস্ত করে শাস্তি দিল, নিজেই নিজেকে কুরে কুরে খেল, বিপর্যস্ত হয়ে উঠে নিজেই নিজের ক্ষতিসাধন করল— যাকে ‘পোষ’ মানাতে চাওয়া হয়েছিল, খাঁচার শিকগুলোয় গা ঘষে ঘষে যে তার ছালচামড়া তুলে ফেলল, রিক্ত যে অভাগা বন্যতা ফিরে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষার দগদগানিতে পাগল, বাধ্য হয়ে যে তার নিজের আত্মকেই এক অভিযান, নিপীড়নকক্ষ ও অনিশ্চিত বিপজ্জনক বন্যতা রূপে নির্মাণ করে নিল— সেই বোকা, কাঙাল ও হতবুদ্ধি কয়েদীই ‘বিবেকদংশন'-এর উদ্ভাবক হয়ে উঠল। আর এই উদ্ভাবকের মধ্য দিয়েই সবচেয়ে বড় ও সবচেয়ে অদ্ভুত রোগটির প্রবর্তন হল, যে রোগ থেকে এখনও এই বর্তমানেও মানুষ সেরে উঠতে পারেনি। সে রোগ হল মানুষের কারণে, নিজের কারণে নিজে রোগে ভোগা। এ হল তার প্রাণীসুলভ অতীত থেকে জোর করে তাকে বিচ্ছিন্ন করার ফল, অন্ধের মতো লাফ দিয়ে নতুন পরিস্থিতি ও জীবনশর্তে পতনের ফল, তদবধি যে সমস্ত পুরোনো প্রবৃত্তির উপর তার ক্ষমতা, আনন্দ, ভীতিসঞ্চারক দক্ষতা নির্ভর করত সেই সব প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণার ফল। একই সঙ্গে যোগ করা যাক যে, অন্যদিক থেকে দেখলে, মুখ ঘুরিয়ে নিজেই নিজের বিরোধী হয়ে ওঠা এমন এক প্রাণী-আত্মার এই পৃথিবীতে আবির্ভাবের মধ্য দিয়ে পৃথিবীর পরিস্থিতিকেই মৌলিকভাবে বদলে দেওয়া অভিনব, নিগূঢ়, অশ্রুতপূর্ব, প্রহেলিকাময়, পরস্পর-বিরুদ্ধ ও ভবিষ্যৎপূর্ণ এক বস্তুর উদ্ভব হয়েছিল। বস্তুত, যে নাটকের সূচনা তখন হওয়ার পর এখনও পর্যন্ত অন্তহীনভাবে অভিনীত হয়ে চলেছে— এতটাই সূক্ষ্ম, বিস্ময়কর ও কূটাভাসপূর্ণ তার জাঁকালো প্রদর্শনী যে তুচ্ছ কোনো নক্ষত্রে দর্শকহীন বোধহীনতায় তাকে নিঃশেষ হয়ে যেতে দেওয়া যায় না— সে নাট্য-প্রদর্শনীর রসগ্রহণের জন্য স্বর্গীয় দর্শকগণ আবশ্যক হয়ে উঠেছে! হেরাক্লিটাস৭ যে ‘মহান শিশু’-র কথা বলেছিলেন, জিউস বা দৈব যে নামেই তাকে অভিহিত করা হোক না কেন, তার খেলতে বসা পাশায় সবচেয়ে অপ্রত্যাশিত ও সবচেয়ে উত্তেজক ছক্কার চালগুলোর মধ্যে অন্যতম হিসেবে তখন থেকেই মানুষ অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়েছে। মানুষ নিজেই নিজের জন্য এক প্রকার আগ্রহ, চাপা উত্তেজনা, আশা, বুঝি বা প্রায় এক নিশ্চয়তা এমনভাবে চাগাড় দিয়ে তুলছে, যেন বা সে মহৎ কোনো কিছুর পূর্বঘোষণা, প্রস্তুতিপর্ব, যেন বা মানুষ স্বয়ং কোনো পৌঁছানোর জায়গা নয়, বরং মানুষ বুঝি মহৎ কোথাও পৌঁছানোর পথ মাত্র, খণ্ডোপাখ্যান মাত্র, একটা সেতু, মহান বুঝি বা কোনো অঙ্গীকার...
১৭
বিবেক দংশনের উৎপত্তি সম্পর্কে উপরোক্ত অনুমানের পিছনে কিছু পূর্বানুমান কাজ করছে। প্রথমত, এখানে ধরে নেওয়া হয়েছে যে এই পরিবর্তন ক্রমিক বা ঐচ্ছিক ছিল না এবং নবোদ্ভূত পরিস্থিতিতে মানিয়ে নেওয়ার জন্য জৈবিক বিকাশ রূপে তা নিজেকে হাজির করেনি, বরং তা হাজির হয়েছে এমনই এক ছেদ, উল্লম্ফন, চাপিয়ে দেওয়া বাধ্যবাধকতা ও অখণ্ডনীয় বিপর্যয় রূপে, যার বিরুদ্ধে কোনো সংগ্রাম, এমনকি কোনো রেসসেন্টিমেন্ট-ও গড়ে উঠতে পারেনি। দ্বিতীয়ত, ধরে নেওয়া হয়েছে যে তদবধি অশৃঙ্খলিত ও আকারহীন এক জনসমষ্টিকে নির্দিষ্ট আকারে বাঁধার অভিযোজন প্রক্রিয়া যেমন হিংসাত্মক ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সূচিত হয়েছিল, তেমনই হিংসাত্মক ক্রিয়াসমূহের মধ্য দিয়েই পরিণতি লাভ করেছে— ফলত আদিতম ‘রাষ্ট্র’ এক ভয়ঙ্কর উৎপীড়নমূলক ব্যবস্থা হিসেবে, নিপীড়নকারী ও সহানুভূতিহীন এক যন্ত্র হিসেবে রূপ পরিগ্রহ করেছিল, আর সেভাবেই তা কাজ করে গেছে যতক্ষণ না অর্ধ-জন্তু জনসাধারণ-রূপী কঁাচামালকে ঠেসে মেখে বাধ্যে পরিণত করা শুধু নয়, একটা নির্দিষ্ট আকারও তাদের দেওয়া গেছে। আমি যে এখানে ‘রাষ্ট্র’ কথাটি ব্যবহার করেছি, তা দ্বারা কাদের নির্দেশ করা হচ্ছে তা স্বয়ংসিদ্ধ: স্বর্ণাভ কেশ ও বর্ণ বিশিষ্ট শিকারী জন্তুর এক দঙ্গল, জয়ী ও প্রভুদের জাত, যারা যুদ্ধচালনার জন্য সংগঠিত এবং সংগঠনী ক্ষমতার অধিকারী, যারা কোনো চিন্তা না করেই অধীনস্থ জনসমষ্টির উপর তাদের হিংস্র থাবা নামিয়ে আনে— সেই অধীনস্থ জনসমষ্টি সংখ্যায় অনেক বেশি হতে পারে, কিন্তু তখনও তারা আকারহীন ও যাযাবরী চরিত্রধারী। পৃথিবীতে ‘রাষ্ট্র' বাস্তবত এভাবেই তার যাত্রা শুরু করেছিল। ‘চুক্তি'-র মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের উদ্ভবের যে আজগবী গল্প ফঁাদা হয়ে থাকে, আশা করি এই আলোচনার মধ্য দিয়ে তার অবসান ঘটানো গেছে। যে মানুষ আদেশ করতে পারে, প্রকৃতিগতভাবেই সে ‘প্রভু’, তার কাজে-কর্মে-ইশারায় হিংসাই ফুটে ওঠে — চুক্তি করা দিয়ে তার কী বা যায় আসে! তেমন প্রাণীদের সঙ্গে আমরা কোনো চুক্তি কষাকষি করতে পারি না। দৈবের মতোই তারা আবির্ভূত হয়, কোনো কারণ-যুক্তি-বিবেচনা-প্রসঙ্গ ছাড়াই । বজ্রাঘাতের মতোই তাদের উপস্থিিত— এতই ভীতিপ্রদ, এতই চকিত, এতই সন্দেহের অতীত এবং এতই ‘আলাদা’ যে ঘৃণাটুকুরই কেবল উদ্রেক হয় না। প্রবৃত্তিগতভাবে আকার সৃষ্টি করা ও আকার চাপিয়ে দেওয়াই তাদের কাজ। শিল্পীদের মধ্যে তারাই সবচেয়ে কম স্ব-ইচ্ছা ও সচেতনতা দ্বারা চালিত— যেখানে তারা আবির্ভূত হয় অচিরেই সেখানে নতুন কিছু হাজির হয়, এমনই এক ক্ষমতা-কাঠামো প্রাণ পায় যার মধ্যে সমস্ত অংশ ও বৃত্তিকে চিহ্নিত করে সহযোজিত করা আছে, যে সমগ্রতার সাপেক্ষে নিজ ‘অর্থ’-কে উৎপন্ন করে না নিলে কোনো বস্তুরই সেখানে ঠঁাই নেই। এইসব মানুষরা, যারা জন্মগত সংগঠক, তাদের মধ্যে অপরাধবোধ, দায়বোধ ও বিবেচনা যে কী সে সম্পর্কে কোনো ধারণাই কাজ করে না। শিল্পীসুলভ ভয়প্রদ আত্ম-অহমিকা এদের অধিকার করে থাকে, ব্রোঞ্জের মতো বহির্দৃষ্টিপাতের প্রকোপে তা সবসময় সকল কাজে নিজ যুক্তি প্রতিপাদন করে নিতে জানে, ঠিক যেমন জন্মদাত্রী মা তার সন্তানের মধ্যে করে থাকে। শুরু থেকেই সুস্পষ্ট যে তাদের মধ্যে ‘বিবেকদংশন’ বেড়ে ওঠে নি, কিন্তু এই ঘৃণার লতা তাদের বিহনেও বেড়ে উঠতে পারত না। এই ঘৃণার লতা বেড়ে উঠতে পারত না যদি না তাদের শৈল্পিক হিংসাবৃত্তির হাতুড়ি-ঘায়ে বিপুল পরিমাণ স্বাধীনতা পৃথিবী থেকে অপসারিত-নির্বাসিত হয়ে, বা অন্তত দৃষ্টির বাইরে বেরিয়ে গিয়ে লীন হতে বাধ্য হতো। স্বাধীনতাকাঙ্ক্ষী ক্ষমতাশালী প্রবৃত্তিগুলোকে যখন লীন রূপ ধারণে বাধ্য করা হয়— আমরা ইতিমধ্যেই দেখেছি কীভাবে বিতাড়িত, অবদমিত, অভ্যন্তর-বন্দি হওয়ার মধ্য দিয়ে শেষাবধি কেবলমাত্র নিজের বিরুদ্ধে ক্ষরিত হয়ে নিজেকে ক্ষয় করার সক্ষমতাটুকুকেই আঁকড়ে ধরে— আর তা-ই এবং কেবলমাত্র তা-ই হল বিবেকদংশন-এর সূচনাবস্থা।
১৮
এই গোটা প্রক্রিয়া শুরু থেকে অতি ন্যক্কারজনক ও যন্ত্রণাকর বলেই একে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা থেকে সাবধান হওয়া উচিত। মূলগতভাবে, এ হল সেই একই সক্রিয় বল যা আরো জাঁকালো মাত্রায় ক্ষমতার কারিগর ও সংগঠকদের মধ্যে কাজ করে এবং রাষ্ট্রকে গড়ে তোলে। কেবলমাত্র এই বিশেষ ক্ষেত্রে তা আরো অভ্যন্তরীণ, আরো ক্ষুদ্র, আরো সংকীর্ণচেতা, পিছন দিকে মুখ ফিরিয়ে (গ্যেটে-র ভাষায় বললে) ‘হৃদয়ের গোলকধাঁধা'-র মধ্যে সেঁধানো, যা নিজের জন্য বিবেক দংশন সৃষ্টি করে এবং স্বাধীনতার প্রবৃত্তিকে (বা আমার নিজের ভাষায় বললে, ক্ষমতার অভিপ্রায়কে) খারাপ বলে প্রতিপন্ন করে। পার্থক্য কেবল এখানেই যে এই বলের আকারদায়ক ও লঙ্ঘনকারী চরিত্র এই বিশেষ ক্ষেত্রে স্বয়ং সেই ব্যক্তিকেই নিজের লক্ষ্যবস্তু করে তোলে, যেখানে আরো নজরকাড়া জাঁকালো ক্ষেত্রে তা অপর ব্যক্তি বা অপরাপর ব্যক্তিদের লক্ষ্যবস্তু করে। আপন সত্তার এই চোরা লঙ্ঘন, নিষ্ঠুরতার এই শৈলী— কড়া, প্রতিরোধী, ক্লেশভোগী পদার্থ হিসেবে নিজেকে রূপ দেওয়ার এই আমোদ— সেই পদার্থের মধ্যে দহনচিহ্ন রূপে একটি অভিপ্রায়, একটি সমালোচনা, একটি দ্বন্দ্ব, একটি ঘৃণা, একটি প্রত্যাখ্যানকে দেগে দেওয়ার নিজ-বিরুদ্ধে-বিভাজিত-সত্তার এই ভয়ানক আমুদে কাজ, যা দুঃখভোগ তৈরির আমোদ পেতেই কেবল নিজেকে দুঃখভোগ করায়— আদর্শ কল্পিত ঘটনাবলীর আবশ্যিক গর্ভাধার হিসেবে সক্রিয় বিবেকদংশনের এই অবশেষে দৃষ্টিগ্রাহ্য হওয়া রূপ, যেমনটা আমরা আগেই অনুমান করেছি, সৌন্দর্য ও সদর্থকতার অদ্ভুত এক প্রাচুর্য রূপে, সুন্দরের অভূতপূর্ব সাধারণ ধারণা রূপে প্রতিভাত হয়। কারণ, কী বা আর ‘সুন্দর' হবে যদি না তার বিপরীত ইতিমধ্যেই নিজ কদর্যতা সম্পর্কে আত্মসচেতন হয়ে নিজের কাছে নিজে ঘোষণা করে দেয় যে ‘আমি কদর্য'? এই ইঙ্গিতটি বোঝার পর আর অন্তত এই কূটাভাসকে অতটা হতবুদ্ধিকর মনে হবে না যে কীভাবে আত্মস্বার্থহীনতা, আত্ম-প্রত্যাখ্যান, আত্মবলি সুলভ স্ববিরোধী ধারণাগুলো আদর্শ ও সুন্দরকে চিহ্নিত করতে পারে। আর তা ছাড়াও একটা জিনিষ নিয়ে আমরা নিঃসংশয় হতে পারি— অন্তত আমার তো এ নিয়ে আর কোনো সংশয় নেই— যে, আত্মস্বার্থহীন, নিজেকে প্রত্যাখ্যান করা, নিজেকে বলি দেওয়া ব্যক্তি যে আমোদ অনুভব করে, সে আমোদ নিষ্ঠুরতার কুঠুরির অন্তর্গত। আত্ম-অহমিকাহীনতা কীভাবে কখন একটি নৈতিক গুণ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে এবং কোন মাটিতে সেই নৈতিকতা শিকড় বিস্তার করে পল্লবিত হয়ে উঠেছে: কীভাবে কেবল বিবেকদংশন ও আত্মনিগ্রহ করার অভিপ্রায়ই তাকে মূল্যবান করে তুলেছে— সে সম্পর্কে আপাতত এই অবধিই থাক।
১৯
কোনো সন্দেহ নেই যে বিবেকদংশন একটি পীড়া, কিন্তু তা পীড়া সেই অর্থেই যে অর্থে গর্ভধারণও একটি পীড়া। কোন দশায় এই পীড়া তার সবচেয়ে ভয়ানক ও সবচেয়ে সম্ভ্রম-আদায়কারী শিখরবিন্দু স্পর্শ করেছে দেখা যাক— তাহলে আমরা দেখতে পাব শুরুতে কী আসলে তাকে এই জগতে ডেকে আনল। তা দেখতে গেলে অবশ্য প্রচুর সহিষ্ণুতা প্রয়োজন এবং প্রথমে আবার আমাদের পূর্বালোচিত একটি দৃষ্টিকোণে ফিরে যেতে হবে। দেওয়ানী বিধিব্যবস্থায় ঋণগ্রহীতা ও ঋণদাতার মধ্যে যে সম্পর্কটিকে আমি ইতিপূর্বে বিশদে পর্যালোচনা করেছি, তা অতি উল্লেখনীয় ও সন্দেহজনক ঐতিহাসিক উপায়ে এমন এক সম্পর্কের মধ্যে পুনর্ব্যাখ্যাত হয়েছে যা আমাদের আধুনিক মানুষদের পক্ষে অনুধাবন করা নিদারুণ সমস্যাজনক— সেই সম্পর্ক হল বর্তমানে জীবিত মানুষজন এবং তাদের মৃত পূর্বপুরুষদের মধ্যে সম্পর্ক। জনজাতিদের আদিম সমবায়মূলক সমাজে— আমরা প্রাগৈতিহাসিক সময়ের কথা বলছি— বর্তমানে জীবিত প্রজন্ম সবসময়ই তাদের পূর্ববর্তী প্রজন্মদের প্রতি, বিশেষ করে সর্বপ্রথম যাঁরা সেই জনজাতিগোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তঁাদের প্রতি, এক বিধিবদ্ধ কর্তব্য-কৃতজ্ঞতা স্বীকার করত (এবং তা কেবলমাত্র ভাবপ্রবণতার বিষয় ছিল না, নিছক ভাবপ্রবণতাগত কর্তব্য-কৃতজ্ঞতার বোধ মানবজাতির অস্তিত্বের দীর্ঘতম পর্যায় জুড়েই সাধারণভাবে অনুপস্থিত ছিল বলে দাবি করলে তা অযৌক্তিক হবে না)। এখানে প্রভাববিস্তারকারী বিশ্বাসটা ছিল এই যে তাদের পূর্বপুরুষদের বলিদান ও অর্জনের ভিত্তিতেই কেবল তাদের জনজাতিগোষ্ঠী অস্তিত্বলাভ করেছে— আর তাই তাদের নিজেদেরও বলিদান ও অর্জনের মধ্য দিয়েই সেই পূর্বপুরুষদের কাছে ঋণশোধ করতে হবে। এর মধ্য দিয়ে এমন একটি ঋণ স্বীকার করে নেওয়া হতো যা উত্তরোত্তর বাড়তেই থাকে কারণ পূর্বপুরুষরা ক্ষমতাধর আত্মা হিসেবে তাদের চলমান অস্তিত্বের মধ্য দিয়ে কখনই জনজাতিগোষ্ঠীটিকে নিত্যনতুন সুবিধা দেওয়ায় ও ক্ষমতা যোগানোয় বিরত হয় না। এ কি তারা ‘স্বেচ্ছাপ্রবৃত্ত' ভাবে করে? সেই অপরিপক্ক ও ‘আধ্যাত্মিকতায় দীন' যুগে তো অবশ্য স্বেচ্ছাপ্রবৃত্তি বলে কিছু হতে পারে না! জীবিতরা মৃত পূর্বপুরুষদের কী প্রতিদান দিতে পারে? কিছু বলি (প্রথম প্রথম খুব স্থূলভাবে পুষ্টি হিসেবে কল্পিত), কিছু উৎসব, কিছু ভজনপীঠ, কিছু সম্মানচিহ্ন এবং সর্বোপরি বাধ্যতা— কারণ পূর্বপুরুষদের কীর্তি হিসেবে সব আচারপ্রথাই তাদের সংবিধি ও নির্দেশ হয়ে ওঠে। জীবিতরা কি কখনো মৃত পূর্বপুরুষদের যথেষ্ট দিয়ে উঠতে পারে? এই সন্দেহ থেকেই যায় এবং ক্রমশ বাড়তে থাকে। মাঝেমধ্যেই তাই বাধ্যতামূলকভাবে এমন এক বিপুল পাইকারী অঙ্গীকারমোচন প্রয়োজন হয়ে পড়ে যা ‘ঋণদাতা'-র প্রতি ঋণশোধ হিসেবে অতিশয় (যেমন, প্রথম সন্তানকে বলি দেওয়ার কুখ্যাত প্রথা, রক্ত— মানুষের রক্ত— উৎসর্গ)। সেই জনজাতিগোষ্ঠী ধারাবাহিকভাবে যত নিজেকে আরো জয়যুক্ত, আরো স্বাধীন, আরো সম্মানিত ও আরো ভয়প্রদ হিসেবে দেখতে পায়, অর্থাৎ, যত তার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, সরাসরি সেই অনুপাতেই আবিশ্যকভাবে পূর্বপুরুষদের প্রতি তার ঋণগ্রস্ততার বোধ, পূর্বপুরুষদের প্রতি ভয়, বিশেষ করে পূর্বপুরুষদের ক্ষমতাকে ভয় বাড়তে থাকে। এর অন্যথা হয় না! অন্যদিকে, জনজাতিগোষ্ঠীর পতনমুখী প্রতিটি পদক্ষেপের সঙ্গে, দুর্বিপাকের সকল অবস্থা, আপজাত্যের সকল লক্ষণ এবং বিলুপ্তির ক্রমবর্ধমান আশঙ্কার সঙ্গে সঙ্গে জনজাতিগোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা পূর্বপুরুষদের প্রতি ভয় বরং ধারাবাহিকভাবে কমতে থাকে এবং প্রতিষ্ঠাতা পূর্বপুরুষদের প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা ও ক্ষমতাধর উপস্থিতি সম্পর্কে মানসপ্রতিমাটিও ক্রম-সংকুচিত হতে থাকে। যুক্তির এই স্থূল রূপকে যদি আমরা তার চূড়ান্ত উপসংহার অবধি অনুসরণ করি, তাহলে দেখব যে সবচেয়ে ক্ষমতাশালী জনজাতিগুলোর পূর্বপুরুষরাই নিশ্চয় ক্রমবর্ধমান ভয়ের উদ্ভট কল্পনার দৌলতে ক্রমশ বিপুলাকৃতি ধারণ করতে করতে ঐশ্বরিক রহস্যের তমসায় প্রবেশ করে এমন অকল্পনীয় হয়ে ওঠে যে শেষাবধি তারা অপরিহার্যভাবে ঈশ্বরে রূপান্তরিত হয়। এই ভয়ের উৎস থেকে উৎপত্তির মধ্যেই খুব সম্ভবত ঈশ্বরের মূল নিহিত আছে!... আর যদি কারো মনে হয় যে এর সঙ্গে অবশ্যই ‘ভক্তি থেকেও উৎক্ষিপ্ত' হওয়ার কথা যোগ করা উচিত, মানবজাতির দীর্ঘতম পর্যায়, অর্থাৎ প্রাগৈতিহাসিক পর্যায়ের জন্য তা মোটেই সঠিক হবে না। মধ্যবর্তী পর্যায়ের জন্য, যে পর্যায়ে সম্ভ্রান্ত জনজাতিগুলোর বিকাশ ঘটেছিল, যারা ইতিমধ্যে তাদের মধ্যে সুস্পষ্ট হয়ে ওঠা সম্ভ্রান্ত বৈশিষ্ট্যগুলোকে তাদের প্রতিষ্ঠাতা পূর্বপুরুষ (নায়কগণ, ঈশ্বরগণ)-দের প্রতি সুদসহ ঋণশোধ হিসেবে নিবেদন করেছিল, তাদের বেলায় ওই ভক্তিতে উৎসের কথা ঠিক হতে পারে। কোন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ঈশ্বরকুল সম্ভ্রান্ত ও মর্যাদামণ্ডিত হয়ে উঠেছিল (যা অবশ্য ‘পবিত্র' হয়ে ওঠার সমার্থক নয়) তা আমরা পরে আরেকবার ফিরে দেখব। এখন আপাতত অপরাধবোধের সম্যক বিকাশের এই পথটি ধরে তার উপসংহার-বিন্দুর দিকে যাওয়া যাক।
২০
ইতিহাসপাঠ আমাদের দেখায়, রক্ত-সম্বন্ধ ভিত্তিক ‘গোষ্ঠীসমাজ’ সংগঠনের পতনের মধ্য দিয়ে কোনো ভাবেই ঈশ্বরদের কাছে ঋণী থাকার বোধ অন্তর্হিত হয়নি। জনজাতির সম্ভ্রান্তদের কাছ থেকে মানুষ যেমন ‘ভালো ও মন্দ’ সম্পর্কিত ধারণাসকল (এবং তার সঙ্গে পদমর্যাদার ধাপবন্দি সোপান তৈরি করার মৌলিক মনস্তাত্ত্বিক প্রবণতা) উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছে, ঠিক একই রকম ভাবে জনজাতিগোষ্ঠী ও তার পরিবর্ধিত পরিবারের ঈশ্বরকুল, অপরিশোধিত ঋণের চাপ ও সেই চাপ থেকে রেহাই পাওয়ার আকুতিরও উত্তরাধিকারী হয়েছে। (সেই অসংখ্য দাস ও চুক্তিতে-বাঁধা মানুষজন যারা বাধ্যতার চাপেই হোক অথবা হীন আনুগত্য ও অনুকরণপ্রবণতার জন্যই হোক, প্রভুদের ঈশ্বরপরায়ণ ধর্মপদ্ধতিতে অভিযোজিত হয়েছে; তাদের মধ্য দিয়েই এই উত্তরাধিকার উপছে উঠে সর্বদিক ভাসিয়ে দিয়েছে।) বহু হাজার বছর ধরে ঈশ্বরের কাছে ঋণগ্রস্ত থাকার অনুভূতি বাড়তে থেকেছে; কার্যত পৃথিবীতে যে হারে ঈশ্বরের ধারণা ও ঈশ্বরানুভূতি বৃদ্ধি পেতে পেতে উচ্চতায় পাড়ি দিয়েছে, তার সঙ্গে সমানুপাতিক হারেই এই ঈশ্বরের কাছে ঋণগ্রস্ততার বোধও বেড়েছে। (জনজাতিগোষ্ঠীদের মধ্যে যুদ্ধবিগ্রহ, জয়, মিটমাট, বৃহত্তরের মধ্যে ক্ষুদ্রতরের বিলীন হয়ে যাওয়া, প্রতিটি বড়সড় জাতিগত সংশ্লেষের মধ্য দিয়ে জনতার বিভিন্ন অংশের পদমর্যাদার ধাপবন্দি কাঠামোয় বিন্যাস চূড়ান্ত হওয়ার পূর্ববর্তী সকল প্রক্রিয়া— এই গোটা ইতিহাস দর্পণে ধরা আছে ঈশ্বরকুলের জট-পাকানো কুলজিশাস্ত্রের মধ্যে, ঈশ্বরকুলের যুদ্ধ-বিজয়-পুনর্মিলন বর্ণনাকারী গাথার মধ্যে। সার্বিক সাম্রাজ্য অভিমুখে প্রগতিযাত্রা সর্বদা সার্বিক ঈশ্বরকুল প্রতিষ্ঠার দিকেও প্রগতিযাত্রা বটে। এর সঙ্গে যোগ করা যায় যে স্বাধীন সম্ভ্রান্তদের উৎখাত করে স্বেচ্ছাচারী স্বৈরতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা সর্বদা কোনো না কোনো ধরনের একেশ্বরবাদের পথ তৈরি করে।) তাই এতাবধি সর্ববৃহৎ ঈশ্বর হিসেবে খ্রিস্টীয় ঈশ্বরের আগমন পৃথিবীতে ঋণগ্রস্ততার অনুভূতিকে এতাবধি তার সর্বোচ্চ মাত্রায় নিয়ে গেছে। যদি ধরে নেওয়া হয় যে ধীরে হলেও এখন আমরা তার বিপরীত অভিমুখে চলতে শুরু করেছি, খ্রিস্টীয় ঈশ্বরে বিশ্বাসের অনমনীয় অধোগতির সঙ্গে সঙ্গে খুব সম্ভবত অপরাধবোধ-সচেতনতাতেও ইতিমধ্যেই বলার মতো হ্রাস ঘটে থাকবে। আর এই প্রত্যাশাও আমরা ফেলে দিতে পারি না যে নিরীশ্বরবাদের চূড়ান্ত ও সম্পূর্ণ বিজয়লাভ মানুষকে তার উৎপত্তি-সূত্র বা আদি হেতু (causa prima)-র প্রতি ঋণগ্রস্ত থাকার গোটা বন্ধন থেকে মুক্ত করবে। নিরীশ্বরবাদ এবং এক প্রকার দ্বিতীয়বারের অপাপবিদ্ধ সরলতা পরস্পর অনুগামী।
২১
‘অপরাধবোধ’ ও ‘দায়বোধ’-এর মতো ধারণার সঙ্গে ধর্মীয় অনুমানসমূহের যোগাযোগ বিষয়ে একটি সংক্ষিপ্ত খসড়া মুখবন্ধ এখানে হাজির করলাম। প্রকৃত বাস্তবে যেভাবে এই ধারণাগুলোর নৈতিকীকরণ সম্পন্ন হয় (তাদের অবদমন করে বিবেকবোধের রূপ দেওয়া হয়, বা আরো যথাযথ ভাবে বললে, ঈশ্বরের ধারণার সঙ্গে বিবেক-দংশনের জটিল মিথষ্ক্রিয়া ঘটে) সে বিষয়টিকে সচেতনভাবেই আমি এখনও অবধি সরিয়ে রেখেছি। ঠিক এর আগের অংশের শেষদিকে এমনকি আমি এভাবে আলোচনা করেছি যেনবা এই নৈতিকীকরণ প্রক্রিয়া বলে কিছু নেই, আর তাই ‘ঋণদাতা’-রূপী ঈশ্বরে বিশ্বাসের পূর্বসিদ্ধান্তগুলো ভেঙে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ওই ধারণাগুলোরও যেন বা আবশ্যিকভাবে অবসান ঘটে চলে। কিন্তু ভীষণ ভয়ানক রকম ভাবেই তথ্য অন্য কথা বলে। ঋণ ও অবশ্যকর্তব্য-র ধারণাগুলোর নৈতিকীকরণ এবং তাদের অবদমনের মধ্য দিয়ে বিবেকদংশন তৈরি হওয়ার প্রক্রিয়া প্রকৃত বাস্তবে সদ্য-বর্ণিত বিকাশগতি স্তব্ধ করে দিতে নতুবা তার অভিমুখ বিপরীতমুখে ঘুরিয়ে দিতে চেষ্টা করে। তখন, নিরাশাবাদের প্রকোপে ঋণশোধের চূড়ান্ত কোনো কিস্তির সম্ভাব্যতা চিরতরে অস্বীকার করতে হয়, এক লৌহনির্মিত অসম্ভাব্যতায় ধাক্কা খেয়ে দৃষ্টি আবার মরীয়াভাবে ছিটকে ফিরে আসে, ‘ঋণ’ ও ‘অবশ্যকর্তব্য’-র ওই ধারণাগুলোকে মুখ ফিরিয়ে দাঁড় করাতে হয়। কিন্তু দাঁড় করাতে হয় কার বিরুদ্ধে? সন্দেহাতীতভাবেই প্রথমত সেই ‘ঋণগ্রস্ত’-র বিরুদ্ধে যার মধ্যে এখন থেকে বিবেকদংশন পাকাপাকিভাবে গেঁড়ে বসে, কুরে কুরে খায়, এতটাই ব্যাপ্তি ও গভীরতা জুড়ে প্রবালকীটের মতো ছড়িয়ে পড়ে যে ঋণশোধের অসম্ভাব্যতার কারণে প্রায়শ্চিত্তরূপী কৃচ্ছ্রসাধন থেকে বেরিয়ে আসাও অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায় (‘শাশ্বত দণ্ডভোগ')— শেষ পর্যন্ত অবশ্য ‘ঋণ’ ও ‘অবশ্যকর্তব্য’-এর ওই ধারণাগুলো এমনকি ‘ঋণদাতা’-র বিরুদ্ধেও রুখে দাঁড়ায়। এই বিষয়ে মানুষকে তখন মানবপ্রজাতির আদি হেতু (causa prima) নিয়ে ভাবতে হয়, ভাবতে হয় মানবপ্রজাতির সূচনা নিয়ে, তাদের অভিশপ্ত পূর্বপুরুষদের নিয়ে (‘আদম’, ‘আদি পাপ’, ‘অভিপ্রায়ের স্বাধীনতা না থাকা’), বা ভাবতে হয় সেই প্রকৃতিকে নিয়ে যার গর্ভে মানুষের জন্ম এবং যার মধ্যেই এখন অমঙ্গলের সার নিহিত বলে ধরে নেওয়া হয়েছে (‘প্রকৃতিকে অসুররূপে দেখা’), বা সহজাতভাবেই মূল্য-বিহীন হয়ে থাকা অস্তিত্ব নিয়ে সাধারণ চিন্তায় ডুবতে হয় (যেমন, ধ্বংসাত্মক তাড়নায় অস্তিত্ব থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া, শূন্যতার অভিলাষ, অস্তিত্বের বিকল্প হিসেবে তার ‘বিপরীত'-এর জন্য আকাঙ্ক্ষা, বৌদ্ধ মতবাদ, বা তারই মতো আর কিছু)— যতক্ষণ না অবধি বলিপ্রদত্ত মানবপ্রজাতিকে সাময়িক স্বস্তিদান করতে পারে এমন কূটাভাস-জারিত ভীতিপ্রদ কৌশলের মুখোমুখি হঠাৎই সে হয়ে যায় খ্রিস্টান মতবাদের সেই ওস্তাদের প্যাঁচের মধ্য দিয়ে: মানুষদের অপরাধের জন্য ঈশ্বরই স্বয়ং নিজেকে বলি দিলেন, ঈশ্বর নিজেকে বলি দিয়ে নিজের ঋণশোধ করছেন, অনুদ্ধারনীয় হয়ে ওঠা মানুষকে উদ্ধার করতে পারে একমাত্র যে ঈশ্বর সেই ঋণদাতাই ঋণগ্রস্তের হয়ে নিজেকে বলি দিচ্ছেন প্রেমের টানে (মানুষ কি এও বিশ্বাস করতে পারে?), তঁার অধমর্ণদের প্রতি প্রেমের টানে!...
২২
এই সবের মধ্য দিয়ে এবং এই সবের আড়ালে আসলে কী ঘটে চলছিল পাঠক হয়ত ইতিমধ্যেই তা আন্দাজ করে নিয়েছেন: আত্ম-নিপীড়নের অভিপ্রায়ের মতো পশুদের অবদমিত নিষ্ঠুরতাকে মানুষ নিজের ভিতরে নিয়ে নিজের বিরুদ্ধেই প্রয়োগ করেছিল, পোষ মানানোর জন্য ‘রাষ্ট্র’-এর মধ্যে বন্দি করেছিল, নিজেকে ছিন্ন-বিদীর্ণ করার জন্য বিবেকদংশন আবিষ্কার করেছিল, যন্ত্রণা দেওয়ার অভিপ্রায়ের স্বাভাবিকতর ক্ষরণের পথ রুদ্ধ হয়ে যাওয়ার পর তার বদলে এই বিবেকদংশন-সম্পন্ন মানুষ আত্ম-নিপীড়নকে বীভৎসতম ক্লেশ ও হিংস্রতার শিখর অবধি টেনে নিয়ে যাওয়ার উপায় হিসেবে ধর্মীয় পূর্বানুমানসমূহকে আঁকড়ে ধরেছিল। ঈশ্বরের প্রতি অপরাধ: এই ধারণাই হয়ে উঠল তার নিপীড়নের হাতিয়ার। তার নিজের ভিতরের বাস্তব ও অলঙ্ঘ্য জান্তব প্রবৃত্তিসমূহের চূড়ান্ত বিপরীত হিসেবে খাড়া করা যায় এমন এক আবিষ্কার হিসেবে সে ‘ঈশ্বর’-এর শরণাগত হয়েছিল। জান্তব প্রবৃত্তিগুলোকে সে ঈশ্বরের বিরুদ্ধে করা অপরাধ হিসেবে (‘প্রভু’, ‘পিতা’, আদি পূর্বপুরুষ ও জগৎ-সূচনা-র বিরুদ্ধে শত্রুতা, বিরুদ্ধাচার, বিদ্রোহ হিসেবে) ব্যাখ্যা করেছিল। ‘ঈশ্বর’ ও ‘শয়তান’-এর দ্বন্দ্ব নিয়ে সে চিন্তিত হয়ে উঠেছিল। নিজের প্রতি, প্রকৃতির প্রতি, প্রাকৃতিকতা ও নিজ অস্তিত্বের আকঁাড়া বাস্তবতার মুখে ‘না’ বলে ছুঁড়ে দেওয়া প্রতিটি অস্বীকারকে সে ঈশ্বরের প্রতি ‘হ্যাঁ’ বলে স্বীকারে পরিণত করেছিল। সেই ঈশ্বর যেনবা অস্তিত্বধারী, যেনবা জীবন্ত, পরমানন্দ স্বরূপ। সেই ঈশ্বর কখনো বিচারক, কখনো ফঁাসুড়ে, কখনো বা নাগালছাড়া অসীম চিরস্থায়ী যাতনা, নরক, দণ্ড ও অপরিমেয় অপরাধের মূর্তি। এই আধ্যাত্মিক নিষ্ঠুরতার মধ্যে এমন এক অভিপ্রায়ের বাতুলতা নিহিত আছে যা তুলনাহীন: একজন মানুষের অভিপ্রায় নিজেকে এতটাই অপরাধী ও তিরস্কারযোগ্য সাব্যস্ত করে বসে যে তার কোনো প্রায়শ্চিত্ত হয় না, নিজেকে দণ্ডিত বলে কল্পনা করার তার এমনই অভিপ্রায় যে দণ্ড কখনই তার অপরাধের জন্য যথেষ্ট হয়ে ওঠে না। বস্তুসমূহের মৌল ভিত্তিকে দণ্ড ও অপরাধের সমস্যার আদলে ঢেলে এমনভাবেই বিষিয়ে তোলে সে অভিপ্রায় যে ‘স্থিরীকৃত ভাবনা’-র এই গোলকধাঁধাঁ থেকে নিষ্ক্রমণের পথ আর থাকে না, ‘পূত-পবিত্র ঈশ্বর’-এর এমন এক আদর্শ রূপ খাড়া করে যার মুখোমুখি হয়ে নিজের চূড়ান্ত অপদার্থতাই কেবল প্রমাণিত হতে থাকে। হায় রে মানুষ, কী উন্মত্ত বিষণ্ন জীব সে হয়ে উঠেছে! কী ভাবনাই না তার মাথায় গেঁড়ে বসেছে! কার্যে পশু হওয়া থেকে যে মুহূর্তে তাকে কিছুমাত্র আটকানো হয়, সেই মুহূর্তেই কী পরিমাণ অপ্রাকৃতিকতা, অর্থহীনতার কী প্রকোপ, চিন্তার কী পাশবিকতাই না তার মধ্যে ফুটে বেরোয়!... এসব অত্যন্ত কৌতুহলোদ্দীপক হতে পারে, কিন্তু এসবের মধ্যে অন্ধকার অবসাদাচ্ছন্ন অস্থির-করে-তোলা বিষণ্নতাও জমে থাকে, ফলে এই অতল গহ্বরের থেকে জোর করে দৃষ্টি সরিয়ে নিতে মানুষ বাধ্য হয়। নিঃসন্দেহে এ এক রোগ, এযাবৎ যত রোগ মানুষদের মধ্যে মারীর আকার ধারণ করেছে, তার মধ্যে সবচেয়ে ভয়প্রদ এ রোগ। এখনও যার শ্রবণক্ষমতা অবশিষ্ট আছে (কিন্তু আজকাল আর মানুষের সেই কানও নেই!) সে শুনতে পায় কীভাবে এই নিপীড়ন ও বাতুলতার রাত্রির মধ্যে উৎসুকতম পরিতৃপ্তি ও প্রেমের মধ্য দিয়ে মুক্তি-র আর্তরব বেজে ওঠে, ভয়ে শিউরে উঠে অজেয় ভয়ের প্রকোপে ঘুরে দাঁড়ায়... কত না ভয়ানক কিছু জমে উঠেছে মানুষের অন্দরে!... পৃথিবী পাগলাগারদে পরিণত হয়েছে সে যে অতি বহুকাল হয়ে গেল!
২৩
‘পবিত্র ঈশ্বর’-এর উদ্ভব সম্পর্কে উপরোক্ত মন্তব্যগুলোই যারপরনাই যথেষ্ট বলে মনে হয়। ঈশ্বর-উদ্ভাবন যে নিজে থেকেই আবশ্যিকভাবে এহেন অধঃপতিত কল্পনায় চালিত করে না, সে কথা সত্যি হলেও তাকে অজুহাত করে অস্বীকার করা যায় না যে গত কয়েক হাজার বছর ধরে মানুষের নিজেকেই ক্রুশে তুলে নিজেকে ক্ষতবিক্ষত করার অভ্যাসে ইউরোপ যেরূপ বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠেছে, তার থেকে অনেক উপকারী উপায়ে ঈশ্বর-উদ্ভাবনকে ব্যবহার করা যায়। সৌভাগ্যবশত, প্রাচীন গ্রিক ঈশ্বরদের দিকে তাকালেই আমরা তা বুঝতে পারব। প্রাচীন গ্রিক ঈশ্বররা ছিল সেইসব সম্ভ্রান্ততর মানুষদের প্রতিবিম্ব, যারা অনেক বেশি নিজেরা নিজেদের শাসন করতে পারত, যাদের মধ্যে মনুষ্য-অভ্যন্তরের জন্তুটি দেবতার মতো করেই নিজেকে দেখত,আর তাই নিজের বিরুদ্ধে আক্রোশে নিজেকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করত না! দীর্ঘতম সময় জুড়ে প্রাচীন গ্রিকরা ওই ‘বিবেকদংশন’-কে দূরে সরিয়ে রাখার জন্য এবং নিজেদের মনস্তাত্ত্বিক স্বাধীনতা উপভোগ করার পথ খোলা রাখার জন্যই তাদের ঈশ্বরদের ব্যবহার করে এসেছে। তাই খ্রিস্টধর্ম যেভাবে ভগবানকে ব্যবহার করে, তার বিপরীত ছিল তাদের উপলব্ধি। আর এ ব্যাপারে এই উজ্জ্বল সিংহ-হৃদয় গ্রিকরা তাদের শিশুসুলভ মন নিয়ে অনেক দূর পথ পাড়ি দিয়েছিল। স্বয়ং হোমার-বর্ণিত জিউস-এর মতো একজন প্রাধিকারী মাঝে মধ্যেই তাদের বুঝিয়ে দিতে চাইতেন যে নিজেদের জন্য সবকিছুকে বড় বেশি সহজ করে ফেলছে তারা। এজিস্থাসের মতো বেশ নিকৃষ্ট এক ব্যাপারে বলতে গিয়ে এক জায়গায় জিউস বলছেন:
‘অবাক কাণ্ড! কীভাবে যে এই নশ্বর জীবগুলো ঈশ্বরদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলে! এর থেকে অদ্ভুত আর কী হতে পারে! তারা দাবি করে যে অমঙ্গল নাকি কেবল আমাদের, অর্থাৎ ঈশ্বরদের, কাছ থেকেই আসে, অথচ নির্বোধের মতো তারা নিজেরাই, এমনকি নিয়তির বিপরীতে গিয়েও, নিজেদের দুর্ভোগ ডেকে আনে।’৮
কিন্তু একই সঙ্গে আমরা দেখতে-শুনতে পাই যে এমনকি এই অলিম্পিয়াবাসী দর্শক-বিচারক-ও মোটেই এতে বিরক্ত নন এবং তিনি নশ্বর জীবগুলোকে পাপী বলেও ভাবছেন না— তাদের নিকৃষ্ট কাজগুলো নিয়ে কেবল তঁার খেদোক্তি: ‘কী নির্বোধ এই নশ্বরগুলো’— আর সবচেয়ে শক্তিশালী ও সবচেয়ে সাহসী যুগের গ্রিকরাও নিজেদের সম্পর্কে স্বীকার করতে দ্বিধা করত না যে বহু খারাপ ও সাংঘাতিক ব্যপারের পিছনেই ‘নির্বুদ্ধিতা’, ‘মূঢ়তা’, ‘মাথার কিঞ্চিৎ গোলমাল’ কাজ করে থাকে— অর্থাৎ, বিষয়টা পাপের নয়, নির্বুদ্ধিতার! বোঝা গেল কি?... এমনকি এই মাথার কিঞ্চিৎ গোলমালও ছিল এক সমস্যা: ‘কী করে যে তা সম্ভব হয়? আমরা, যারা সম্ভ্রান্ত-বংশীয়, সুখী, সফল ও গুণবান মানুষ, আমাদের মাথায় কোত্থেকে এসে যে তা ভর করে?’— বহু শত বছর ধরে সম্ভ্রান্ত গ্রিকরা নিজেকে এই প্রশ্ন করেছে যখনই বোধাতীত কোনো বীভৎসতা বা বলাৎকার তাদের কোনো সতীর্থকে কলুষিত করেছে। শেষ অবধি সে মাথা ঝঁাকিয়ে বলেছে, ‘কোনো না কোনো ঈশ্বর নিশ্চয়ই তাকে পথভ্রষ্ট করেছে,’— এ হল বিশেষভাবেই প্রাচীন-গ্রিক-সুলভ এক সিদ্ধান্ত। এইভাবে তখন ঈশ্বররা এমনকি নিকৃষ্টতম বিষয়েও মানুষের দায়লাঘবের উপায় হয়ে উঠত। ঈশ্বররা অমঙ্গলের উৎস হিসেবে কাজ করত— আর একই সঙ্গে নিজেদের উপর, দণ্ডদান নয়, তার চেয়েও যা উদার, সেই অপরাধের দায়স্বীকার করে নিত।
২৪
তিনটে প্রশ্নচিহ্ন দিয়ে এই আলোচনায় দাঁড়ি টানব ঠিক করেছি। আপনি হয়ত আমাকে প্রশ্ন করতে পারেন, ‘এখানে কি কোনো আদর্শ গড়ে তোলা হচ্ছে, নাকি কোনো আদর্শ ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ করা হচ্ছে?’... কিন্তু আপনি কি কখনো ভেবে দেখেছেন প্রতিটি আদর্শ নির্মাণ করতে গিয়ে এই পৃথিবীতে সর্বদা কী চড়া দাম চুকানো হয়েছে? কী পরিমাণ বাস্তবতাকে প্রতিনিয়ত দুর্নামের ভাগী ও অপব্যাখ্যাত হতে হয়েছে, কত না মিথ্যাকে পূত-পবিত্র করে তোলা হয়েছে, কত না বিবেক দূষিত হয়েছে, কী পরিমাণ ‘ঈশ্বর’ বলিপ্রদত্ত হয়েছে প্রতিবার প্রতিটি আদর্শ নির্মাণের জন্য? একটি ঈশ্বরপীঠ নির্মাণ করতে গেলে একটি ঈশ্বরপীঠ ধ্বংস করতে হয়— এই হল নিয়ম— এ নিয়মের একটাও ব্যতিক্রম কি আপনি দেখাতে পারবেন? আমরা, আধুনিক মানুষরা হাজার হাজার বছর ধরে বিবেকের নিষ্ঠুর ব্যবচ্ছেদ ও জান্তব আত্মনিপীড়নের উত্তরাধিকার বহন করে চলেছি। সেই কাজেই আমরা সব চেয়ে লম্বা সময় হাত পাকিয়েছি, আমরা তাকে এক শিল্পের স্তরে তুলে নিয়ে গেছি; রুচির এই দূষণকে আমরা যারপরনাই মার্জিত করে তুলেছি। বড় বেশি কালপর্যায় জুড়ে মানুষ তার প্রাকৃতিক প্রবৃত্তিকে ‘পাপের চোখে’ দেখেছে, যার ফলে তার মধ্যে তা অবশেষে ‘বিবেকদংশন’-এর সঙ্গে পাক খেয়ে বোনা হয়ে গেছে। এখন এর উল্টো পথে হাঁটা একেবারেই যে অসম্ভব তা নয়— কিন্তু তার জন্য যা দরকার, যেমন, যা আমাদের প্রবৃত্তি, প্রকৃতি ও জান্তবতার বিরুদ্ধে যায়, জীবনের ওপারে কী আছে তা নিয়ে যত উচ্চাকাঙ্ক্ষা, বা সংক্ষেপে, জীবনের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন হয়ে পৃথিবীকে গালি দেওয়ার পূর্বতন যত আদর্শ, সেইসবকিছুকে প্রকৃতি-বিরুদ্ধ ঝোঁক বলে চিহ্নিত করে তার সঙ্গে বিবেকদংশনকে যমজ রূপে গণ্য করা— তা করার মতো যথেষ্ট শক্তি কার থাকতে পারে? সেই প্রত্যাশা ও দাবি নিয়ে আজ আমরা কার শরণাপন্ন হতে পারি?... এ কাজে অবশ্য ভালো মানুষ বলে পরিচিতরা আমাদের বিরুদ্ধাচারণ করবেন, তা ছাড়াও অবশ্য বিরুদ্ধাচারণ করবেন তঁারা যাঁরা আরামভোগী, পরিতৃপ্ত, অসার দাম্ভিক, অতি-উৎসাহী অথবা ক্লান্ত।... কিন্তু যে কঠোরতা ও উচ্চাড়ম্বরের ভনিতা নিয়ে আমরা নিজেরা নিজেদের সঙ্গে আচরণ করে থাকি তা নিয়ে সেইসব জনকে বিবেচনা করতে দেওয়ার মতো গভীরভাবে অপমানজনক ও তুচ্ছতাদায়ক আর কী-ই বা হতে পারে? আর তার বিপরীতে, যে মুহূর্তে আমরা সমস্ত জগতের মতো নিজেদের প্রকৃতিকে অনবরুদ্ধ করে গোটা জগতের মতোই আচরণ করি, সেই মুহূর্তে গোটা জগৎ কত না আন্তরিক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে আমাদের জড়িয়ে নেয়! আজ এই নির্দিষ্ট ইতিহাসক্ষণে যে ধরনের মন-মানসিকতার প্রাদুর্ভাব প্রত্যাশিত— যুদ্ধ ও বিজয় লালিত সেই মন-মানসিকতা যা জয়লাভ, ঝুঁকি, বিপদ এমনকি যন্ত্রণাকেও অবশ্য-প্রয়োজনীয়তায় পরিণত করেছে— তার থেকে আলাদা ধরনের মন-মানসিকতা প্রয়োজন আমি যে লক্ষ্যের কথা বলছি তা অর্জন করার জন্য। তার জন্য দরকার সমস্ত অর্থেই পর্বতোচ্চ তীক্ষ্ণ বায়ুতে শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়ার ক্ষমতা, দুর্দান্ত শীতে বরফে ও পাহাড়ে ছকহীন পরিভ্রমণ… এমনকি তার জন্য দরকার এমন এক গরিমময় বিদ্বেষপরায়ণতা, জ্ঞানের এমন এক স্ব-সচেতন অভিপ্রায়ময়তা যা কেবল তুমুল সুস্বাস্থ্যেই সম্ভব। সহজ ও আন্তরিক ভাবে বললে, তেমন এক তুমুল সুস্বাস্থ্যই আসলে দরকারি!... এই ইতিহাসক্ষণে কি তা আদৌ সম্ভব?... আজ না হোক, কোনো না কোনো সময়ে, আজকের এই ছাতা-পড়া আত্মবিশ্বাসহীন বর্তমানের চেয়ে আরো ক্ষমতাশালী কোনো সময়ে, মহান প্রেম ও মহান ঘৃণা বুকে নিয়ে সেই পরিত্রাতা মানুষ আমাদের মধ্যে আসবেই; প্রতিটি প্রান্তিক রেখা থেকে, প্রতিটি সীমার ওপার থেকে সেই সৃজনশীল আত্মা তার নিজ চালিকাশক্তির জোরে অনবরত ঠেলে সরে আসবে; লোকে যাকে বাস্তবতা ছেড়ে পলায়ন বলে ভ্রম করবে তার সেই বিচ্ছিন্নতা আসলে বাস্তবতার মধ্যে নিমজ্জন, সমাধিগ্রহণ ও পরিশোষণ ছাড়া কিছু নয়, যাতে সেই সমাধি থেকে আবার যখন সে আলোয় বেরিয়ে আসবে, সে এই বাস্তবতার পরিত্রাণ বয়ে আনবে, পূর্বতন আদর্শ দ্বারা আরোপিত সকল অভিশাপ থেকে মুক্তি বয়ে আনবে। পূর্ব আদর্শ এবং তার থেকে আবশ্যিকভাবে জন্ম নেওয়া তুমুল ঘৃণা, শূন্যতার অভিপ্রায় ও ধ্বংসবাদ, এই সবের বন্ধন থেকে আমাদের মুক্ত করবে সেই যে ভবিষ্যতের মানুষ, দ্বিপ্রহরের সেই মহৎ সিদ্ধান্তগ্রহণ-মুহূর্তে সে যখন অভিপ্রায়কে বন্দিদশা থেকে আবার মুক্ত করবে, পৃথিবীকে তার উদ্দেশ্যমূলকতা ফিরিয়ে দেবে, মানুষকে তার আশা ফিরিয়ে দেবে, সেই প্রতি-খৃস্ট, প্রতি-ধ্বংসবাদী, ঈশ্বর ও শূন্যতাকে জয় করে আসা সেই বিজেতা— কোনো না কোনো মুহূর্তে তাকে আসতেই হবে...
২৫
কিন্তু কী যে আমি বকে যাচ্ছি! যথেষ্ট হয়েছে। আজ এই পর্যায়ে এখন আর একটা কাজই আমার পক্ষে সমীচীন, তা হল চুপ করে যাওয়া। অন্যথায় ভ্রান্ত দর্প দ্বারা চালিত হয়ে এমনকিছু ভান করে বসব, যা কেবলমাত্র অনেক তরুণতর কেউ, ‘আরো ভবিষ্যতের' কেউ, আমার চেয়ে আরো অনেক ক্ষমতাশালী কেউ করতে পারে— যা কেবল জরাথুস্ট্র, ঈশ্বরহীন জরাথুস্ট্রই৯ করতে পারে...
টীকা-টিপ্পনী
১। পাদ্রী তৃতীয় ইনোসেন্ট (১১৬১–১২১৬ খৃস্টাব্দ) মধ্যযুগের ইউরোপের একজন গুরুত্বপূর্ণ ও ক্ষমতাশালী পাদ্রী ছিলেন। বন্ধনীর মধ্যে উদ্ধৃতিটি তঁার একটি বিখ্যাত উক্তি।
২। জন ক্যালভিন (১৫০৯–১৫৬৪) ছিলেন খ্রিস্টীয় প্রটেস্টান্ট ধারার একজন অতি গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী ধর্মতত্ত্ববিদ, তঁার অনুসারী ধর্মচর্চা ক্যালভিনবাদের জন্ম দিয়েছিল। মার্টিন লুথার (১৪৮৩–১৫৪৬) ছিলেন একজন জার্মান মঠধারী সন্ন্যাসী, রোমান ক্যাথলিক চার্চের সর্বময় কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে তঁার প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে প্রটেস্টান্ট ধর্মসংস্কার আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল।
৩। ressentiment (রেসসেন্টিমেন্ট): ফরাসি ভাষার এই শব্দটিকে নিৎশে যেভাবে ব্যবহার করেছেন, তার মধ্য দিয়ে এটি মনোবিদ্যার পরিভাষায় পাকাপাকি জায়গা করে নিয়েছে এবং বিভিন্ন ভাষার শব্দভান্ডারে প্রবেশ করেছে। ইংরেজি ভাষার মেরিয়াম-ওয়েবস্টার অভিধানে ressentiment শব্দটিকে সংকলিত করে তার অর্থ নির্দেশ করা হয়েছে এভাবে: ‘deep-seated resentment, frustration, and hostility, accompanied by a sense of being powerless to express these feelings directly’। সুতরাং শব্দটির অর্থের মধ্যে বিদ্বেষ, নৈরাশ্য ও শত্রুতার ভাব এবং সেই ভাবের সরাসরি প্রকাশ হতে না পারা মিশে আছে।
৪। ই ড্যুরিঙ (১৮৩৩– ১৯২১): জার্মান দার্শনিক ও অর্থনীতিবিদ।
৫। হারবার্ট স্পেনসার (১৮২০– ১৯০৩): ইংরেজ দার্শনিক। বিবর্তনের ধারণাকে একটি প্রগতিশীল সামাজিক প্রক্রিয়া হিসেবে ইনি হাজির করেছিলেন।
৬। থমাস হাক্সলি (১৮২৫– ১৮৯৫): চার্লস ডারউইনের বিবর্তনবাদের তত্ত্বকে জনপ্রিয়ভাবে প্রচার করায় অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন।
৭। হেরাক্লিটাস (৫৪০– ৪৭৫ খৃস্ট পূর্বাব্দ): সক্রেটিস-পূর্ব গ্রিসের একজন গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক। ইফেসাস-য়ে জন্ম, তঁার রচনার মধ্যে কেবলমাত্র ‘প্রকৃতি প্রসঙ্গে’-র খণ্ডিত অংশই কালের গ্রাস থেকে রক্ষা পেয়েছে। তঁার মত ছিল যে সমস্ত প্রাকৃতিক বস্তু ও ঘটনার মূলে রয়েছে আগুন, যা মহাজাগতিক চলমান প্রক্রিয়ার আবশ্যিক নিয়ম মেনে চির-পরিবর্তনশীল।
৮। হোমারের ওডিসি মহাকাব্যের সূচনায় অলিম্পিয়াবাসী অন্যান্য ঈশ্বরদের কাছে জিউস এই মন্তব্যটি করেছেন। এজিস্থাস ক্লিটেমেনসট্রাকে প্রেমে প্রলুব্ধ করেছিলেন, তারপর ক্লিটেমেনসট্রার স্বামী আগামেমনন ট্রোজান যুদ্ধ শেষে বাড়ি ফিরলে দুজনে মিলে তাকে হত্যা করেন। হোমারের বয়ান অনুযায়ী, ঈশ্বরেরা আগে থেকেই এজিস্থাসকে এই কাজ না করার জন্য সতর্ক করে দিয়েছিল।
৯। জরাথুস্ট্র: প্রাচীন পারস্য দেশের সাধক ও ধর্মপ্রবক্তা ছিলেন জরাথুস্ট্র। নিৎশে এই জরাথুস্ট্র নামটি ব্যবহার করেছেন ‘দাস স্পোক জরাথুস্ট্র’ (১৮৮৩–১৮৮৫ সালের মধ্যে লেখা) বইয়ে তঁার নিজের দর্শন-ভাবনা- উপস্থাপনা-নাট্যের প্রধান চরিত্র হিসেবে।