১
ক্রম-উষ্ণায়ন, জলদূষণ, বায়ুদূষণ, মাটির উর্বরতা ক্ষয়, জৈব বৈচিত্র্যের মড়ক, বাস্তুতান্ত্রিক ভারসাম্য বিনাশ, সামুদ্রিক জলস্তর বৃদ্ধি, যুদ্ধ-হিংসা-বিপর্যয়ে ভিটেহারা ক্লিষ্ট শরণার্থীদের অন্তহীন উদ্ভব, অপরিচিত মহামারীর প্রাদুর্ভাব: পুঁজিবাদী বিশ্বে এগুলোই এখন বর্তমানতা। আর এই বর্তমানতায় দাঁড়িয়ে অন্ধ হয়ে প্রলয় বন্ধ করার তন্ত্রচর্চা করলে অন্য কথা, নইলে বিমূঢ় ভয় অথবা তিক্ত নিরাশা দিগন্ত ছেয়ে দেয়। প্রকৃতি ও অন্যান্য পশুদের থেকে নিজেকে আলাদা করে, শ্রেষ্ঠতম জ্ঞান করে, ঈশ্বরের আদলে নিজেকে ঢেলে নিয়ে, যবে থেকে মানুষ নিজ জ্ঞানবুদ্ধির জোরে অন্য সমস্ত প্রাণ ও প্রকৃতিকে নিজ প্রয়োজন সাধনে নিজ নিয়ন্ত্রণে বাঁধার চেষ্টা করে চলেছে, সেই দীর্ঘ সময়পর্যায়ে এহেন সর্বব্যাপী বিপর্যয় বুঝি এমন করে তাকে আর কখনো চক্রব্যূহে বাঁধেনি, তার জ্ঞানকুশলতার গরিমা আর কোনো অস্তিত্বগত সমস্যার মুখে বুঝি এতো ঠুনকো বোধ হয়নি। চোরাবালির মধ্যে পড়ে যত সে হাত-পা ছোঁড়ে ততই যেন সে আরো ডুবে যায়: প্রকৃতির বিপর্যয়ের কোনো এক খণ্ডকে সমগ্র থেকে বিযুক্ত করে যত সে তার জ্ঞান-বিজ্ঞানের নির্মিত বিচারকুঠুরিতে ঢুকিয়ে প্রতিবিধান বের করে আনে, সে প্রতিবিধানের প্রয়োগ আবার নতুন কোনো অসঙ্গতি ও বিপর্যয়ের পথ করে দেয়; জাতি-রাষ্ট্রের পাকা দালান বেঁধে তার চারদিকে প্রহরী বসিয়ে যত ভিটেমাটি নিশ্চিন্ত করতে চায়, ততই একে অপরের প্রতি সন্দেহ-অবিশ্বাস-ঘৃণা তাকে রুগ্ন করে তোলে, যুদ্ধ-হিংসার বিষময় আবর্ত আরো ফেনিয়ে ওঠে। গত শতাধিক কাল জুড়ে পুঁজিবাদের বাঁধন ছিঁড়ে সুস্থতর সমাজে উৎক্রমণের প্রচেষ্টাগুলো শত আবেগ, দুঃসাহস, অভিযানপ্রিয়তা সত্ত্বেও ব্যর্থ হওয়ার মধ্য দিয়ে প্রমাণ করে গেছে যে এই বাঁধনগুলো চিনতে অসম্পূর্ণতা ও ভুল থেকে যাচ্ছে, বাঁধনের কয়েকটা দড়িদড়া কাটলেও মূল বাঁধন তাই দীর্ঘজীবীই হচ্ছে। যেমন ধরা যাক, বুর্জোয়া শ্রেণির শাসনই কি কেবল আমাদের পুঁজিবাদের সঙ্গে বেঁধে রেখেছে, উন্নত প্রযুক্তি চালিত বৃহৎ শিল্পোৎপাদন ব্যবস্থার উপভোক্তা হিসেবে আত্মস্থ করে নেওয়া নিরন্তর চাহিদাবৃদ্ধি, নিরন্তর ভোগবৃদ্ধির অন্তরস্থ শিকলগুলো কি আরো বিকল্পহীনভাবে আমাদের পুঁজিবাদের শরণাশ্রয়ী করে তোলেনি? ফলে, ঐতিহাসিক কোনো সন্ধিক্ষণে, বুর্জোয়াদের হাত থেকে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ খসে গেলেও, পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্তিতিতেও বিকাশ-উন্নয়ন-আধুনিকতার পশ্চাদ্ধাবনই কি, সাময়িক ছদ্মপরিচয়ের আড়ালে হলেও, পুঁজিবাদের অনবচ্ছিন্নতা বজায় রাখেনি? পুঁজিবাদ থেকে নিষ্ক্রমণ তাই কেবল রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল বা নতুন রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার ব্যাপার নয়, এমনকি তা দ্বারা নির্ধারিতও নয়। রাজনৈতিক শাসনকাঠামো দখল বা নতুন গড়ে তোলার থেকে অনেক গভীর ও ব্যাপ্ত যে কাজ, অর্থাৎ জীবনযাপনের ধরন পাল্টানোর মধ্য দিয়ে চাহিদা ও ভোগের তুলাদণ্ডে জীবনকে মাপার ধারণাগুলোকে পরিত্যাগ করার কাজ, সে কাজ রাজনৈতিক রাষ্ট্রক্ষমতা বদলের মধ্য দিয়ে আবশ্যিকভাবে হয়ে যায় না, এমনকি তার সূচনাও আবশ্যিকভাবে হয়ে যায় না। রাষ্ট্র-ক্ষমতাকে কেন্দ্রে রেখে সমাজবিপ্লবের প্রকল্পগুলো চাহিদা-ভোগ-উৎপাদন বাড়ানোর প্রগতি-বাঘের পিঠে সওয়ার হয়ে শেষাবধি সেই বাঘের পেটেই সাবাড় হয়েছে। তাই চাহিদা –ভোগ-উৎপাদন-এর ক্রমবৃদ্ধি দিয়ে বাঁধা প্রগতির চালচিত্রটি নিয়ে সংশয়ী বিচার-বিবেচনায় যাওয়া যাক।
২
প্রয়োজনকে সব প্রশ্নের ঊর্ধ্বে বলে ধরা হয়ে থাকে, বিশেষ করে যদি সে প্রয়োজনকে মৌলিক প্রয়োজন (basic needs) বা প্রাথমিক প্রয়োজন (fundamental needs) বলে চিহ্নিত করে দেওয়া হয়। সমস্ত মানুষের মৌলিক বা প্রাথমিক প্রয়োজন মেটানোর জন্য পরিকল্পনাকে প্রশ্নাতীতভাবেই সু অভিপ্রায় বলে মেনে নেওয়া হয়, মঙ্গলকর বা হিতকর বলে গণ্য করা হয়। সমাজসেবী প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন থেকে শুরু করে ‘গণকল্যাণকামী’ রাষ্ট্র এই লক্ষ্যই ঘোষণা করে। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বিপ্লবের স্বপ্ন দেখা মানুষরাও ধরে নেন যে এটাই প্রাথমিক কর্তব্য যা ক্ষমতাসীনরা বহু কুম্ভীরাশ্রু বিসর্জন করলেও কখনোই পালন করবে না, তাই বিপ্লবের মধ্য দিয়েই তা পালন করতে হবে। অবিসংবাদী পূর্বসিদ্ধান্ত হয়ে ওঠা এই ধারণাকে প্রশ্ন করার মধ্য দিয়েই আমাদের সংশয়ী বিচার শুরু করা যাক।
মানুষের স্বাভাবিক জীবনাচরণ যা যা ছাড়া সম্ভব নয়, বিচারের শুরুতে সেগুলোকেই আমরা তার মৌলিক বা প্রাথমিক প্রয়োজন বলে ধরে নিতে পারি। এবার কিছু উদাহরণ দেখা যাক। নিঃশ্বাসপ্রশ্বাসের জন্য বায়ু ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না। তাহলে বায়ু কি একটি মৌলিক বা প্রাথমিক প্রয়োজন? সাধারণভাবে আমরা এখনো বায়ুকে মৌলিক বা প্রাথমিক প্রয়োজনের অন্তর্ভুক্ত হতে দেখি নি। কারণ, পৃথিবীর যে প্রাকৃতিক পরিবেশে মানুষ প্রজাতির উদ্ভব হয়েছে, সেই পরিবেশের অংশ হওয়ার মধ্য দিয়ে মানুষের শ্বাসপ্রশ্বাসের বায়ুর সংস্থান প্রাকৃতিকভাবেই হয়ে এসেছে। বায়ুর কোনো অভাব যতদিন অনুভূত হয়নি, মৌলিক বা প্রাথমিক প্রয়োজন হিসেবে তার চিহ্নিতকরণও হয়নি। কিন্তু যখন এই অভাব তৈরি হয়? যেমন ধরা যাক অভূতপূর্ব শিল্পদূষণে বিপর্যস্ত চীনের সাংহাইয়ের মতো কিছু শহরে হাল আমলে প্রায়ই বায়ুদূষণ এমন মাত্রায় পৌঁছয় যে মানুষের স্বাভাবিক শ্বাসপ্রশ্বাস অসম্ভব হয়ে ওঠে, অক্সিজেন-মাস্ক ছাড়া চলা যায় না। আমাদের দেশের রাজধানী দিল্লির বায়ুর অবস্থাও এর কাছাকাছি পৌঁছতে চলেছে। এই অবস্থায় যারা পড়েছেন, তাদের জন্য অক্সিজেন-মাস্ক একটি মৌলিক প্রয়োজন বা প্রাথমিক প্রয়োজন হয়ে উঠেছে বলা যায়। অর্থাৎ, স্বাভাবিকভাবে যা ছিল ঢের প্রচুর, তার এমন অভাব যখন তৈরি হয় যা আর স্বাভাবিকভাবে মেটা সম্ভব নয়, তখন সেই অভাবমোচনের প্রসঙ্গ ঘিরেই একটি মৌলিক প্রয়োজন বা প্রাথমিক প্রয়োজন সৃষ্টি হয়। উৎপাদনবৃদ্ধির পূজারী যে নগরব্যবস্থা শতমুখে জীবাশ্ম-জ্বালানী গিলে চলেছে সে যখন বায়ুদূষণের মধ্য দিয়ে শ্বাসগ্রহণের বায়ুকে বিরল করে তোলে, তখন তার এই ধ্বংসকার্য অক্সিজেন-মাস্ক-কে একটি মৌলিক বা প্রাথমিক প্রয়োজন হিসেবে সৃষ্টি করে। এই অবস্থায় গণহিতকর বলে কোন রাজনৈতিক সক্রিয়তাটিকে আমরা গণ্য করব--- যে সক্রিয়তা এই অভাবটিকেই চিরস্থায়ী ও চিরবাড়ন্ত করে রেখে তা লাঘবের জন্য অক্সিজেন-মাস্ক-এর উৎপাদন ও বন্টন বাড়াতে চাইবে, নাকি সেই সক্রিয়তা যা অভাব তৈরির পিছনে কাজ করা মানুষের প্রজাতিগত ও সভ্যতাগত অনাচারগুলোকে চিহ্নিত করে প্রকৃতির মধ্যে স্বাভাবিক ভারসাম্যে ফিরে গিয়ে, ঢের প্রচুর বায়ুর পূর্বাবস্থায় ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করবে?
পূর্বোক্ত উদাহরণটিতে যেমন আমরা দেখলাম যে মৌলিক প্রয়োজন বা প্রাথমিক প্রয়োজনের তৈরি করা হয় প্রকৃতি-পরিবেশের ভারসাম্যের মধ্যে থিতু অবস্থান ধ্বংস করে একটি অভাব সৃষ্টি করার মধ্য দিয়ে, তা কি এই বিশেষ ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, নাকি এর মধ্যে সাধারণ কোনো দিক আছে? এই প্রশ্নটি মাথায় নিয়ে আমরা অন্যতর একটি উদাহরণ বিবেচনা করার দিকে যাই।
বর্তমানে ভারতবর্ষ নামে চিহ্নিত এই ভৌগোলিক ভূখণ্ডটিতে স্মরণাতীত কাল ধরে বিভিন্ন আদিবাসী জনজাতির বাস। পাহাড়, নদী, জঙ্গল সমন্বিত বৈচিত্র্যময় পরিবেশ-প্রকৃতির অংশ হিসেবে বহু হাজার বছর ধরে বৈচিত্র্যময় জীবন-সংস্কৃতির পরম্পরা বহন ও সৃজন করে তারা তথাকথিত ‘আধুনিক যুগ’-এর সূচনাপর্বে হাজির হয়েছিল। খাদ্য, পরিধেয়, বাসস্থানের সংস্থান নদী, পাহাড় বা জঙ্গলের পরিবেশ-প্রকৃতি থেকেই আহরণ করার গোষ্ঠীগত আচার তাদের জীবনকে প্রকৃতির স্বাভাবিক বিপাকক্রিয়ার অংশ হয়ে থাকার বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত রূপে বিন্যস্ত করেছিল। জঙ্গল থেকে সংগ্রহ, পশুপালন ও পশু-কীট-পতঙ্গের সঙ্গে সুসমঞ্জস সহবাস, মাটির উর্বরতা পুনরুৎপাদনের প্রয়োজন সম্পর্কে সচেতন সীমায়িত আবর্তনমূলক কৃষির নানা পদ্ধতি ছিল তাদের বাঁচার উপায়। প্রকৃতির প্রাচুর্য্য নিয়ে বিস্ময়, প্রকৃতিকে ধাত্রী হিসেবে কল্পনা করা, বিপর্যয়ে-বিপদে প্রকৃতির রোষ কল্পনা করে তা নিয়ে আতঙ্কিত হয়ে সেই রোষ মেটানোর নানা উপায় কল্পনা করা নিয়ে ছিল তাদের চিন্তাজগৎ। একজন মানুষ জন্মালে প্রকৃতির উদারতা ও তার পূর্বপুরুষদের রেখে যাওয়া পরম্পরাই তার প্রয়োজন মেটায়, তার বিকাশের সহায়ক হয়--- প্রয়োজন ও বিকাশ নিয়ে এমনটাই তাদের ভাবনার ধারা। সেখানে প্রকৃতি থেকে মেটে না এমন অভাব ও তাই তা মেটানোর জন্য প্রকৃতির সীমা ছাড়ানো অন্তহীন বস্তু-উৎপাদনের প্রয়োজনীয়তার কোনো বোধ সাধারণভাবে নেই।
তথাকথিত ‘আধুনিক যুগ’-এ প্রবেশকালে এই আদিবাসী জনজাতিদের উপর নেমে এল এক সর্বগ্রাসী ছিনিয়ে–নেওয়ার আক্রমণ। যে জঙ্গল, পাহাড়, নদীকে তারা ‘সর্বসাধারণের অধিকারভুক্ত’ বলে ধরে এসেছে, ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসকরা তা সবই ছিনিয়ে নিয়ে গাছ কেটে কাঠের কারবার, পাহাড় কেটে খনিজের কারবার, বিশাল বিশাল এলাকা জুড়ে বাণিজ্যিক চাষ শুরু করল। সর্বজনীন ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত বা জনগোষ্ঠীর সমষ্টিগত অধিকারভুক্ত প্রাকৃতিক জীবনাধার থেকে পাহাড়, জঙ্গল, নদী পরিণত হল সরকার-প্রশাসন ও ব্যবসায়ী উদ্যোগীদের মালিকানাভুক্ত কাঁচামালের ভাণ্ডারে। অধিকার-হারানো আদিবাসী জনজাতিদের দীর্ঘযুগ ধরে পরিপক্ক হয়ে ওঠা প্রকৃতিলগ্ন জীবনাচার অসম্ভব করে তোলা হল। যেসব জঙ্গলে তারা জঙ্গলসংগ্রহে যেত, সেখানে তাদের প্রবেশ নিষেধ, যেসব জমিতে সীমায়িত আবর্তনমূলক কৃষির নানা বৈচিত্র্যময় ধারা তারা গড়ে তুলেছিল সেসব ক্রমশ কোম্পানী বা ব্যক্তির মালিকানাভুক্ত হয়ে বাণিজ্যিক চাষের পীঠ…--- এভাবে জনজাতিদের খাদ্য-বস্ত্র বাসস্থানের সংস্থান করার নিজস্ব আত্মনির্ভর উপায়গুলোকে ধ্বংস করা শুরু হল। এই ধ্বংসকার্য আজও চলেছে, ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসন অবসানে তার কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি, আধুনিকতাবাদী উন্নয়ন-পূজারী শাসকরা এই ঔপনিবেশিকতা বহাল রেখে দিয়েছে।এর মধ্য দিয়ে বিপুল সংখ্যক মানুষের খাদ্য-জীবিকা-বস্ত্র-বাসস্থান সংস্থানের উপায় ছিনিয়ে নেওয়া হল এবং সেসবের ‘অভাব’ নির্মাণ করা হল। আর এই ছিনিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেই তৈরি করা ‘অভাব’ মেটানোর বাণিজ্যিক-অর্থনীতি-প্রসূত সম্ভাব্য উপায়গুলোকে রাষ্ট্র-প্রশাসন-বাজারের মাধ্যমে ও নিয়ন্ত্রণে লাগু করার কথাকে ব্যক্তির মৌলিক অধিকার বা প্রাথমিক অধিকারের আপাত-কল্যাণকর জড়োয়ার সাজে হাজির করা হল। প্রকৃতির মধ্যে অন্যান্য প্রাকৃতিক উপাদানের সঙ্গে যে সম্পর্কে ন্যস্ত থাকার দীর্ঘ বিকশিত পরম্পরার মধ্য দিয়ে এই জনজাতিরা স্বরাট ও স্বনির্ভর ভাবে তাদের জীবনের প্রয়োজন মেটাতে পারত, সেই সম্পর্ক থেকে তাদের ছিঁড়ে এনে বাণিজ্য-অর্থনীতির কবলে ফেলে রাষ্ট্র-প্রশাসন-ব্যবসায়ীদের মুখাপেক্ষী করে তোলার চরম হিংসাত্মক প্রক্রিয়াটিই আড়াল করা হল এই ভূষণে সাজিয়ে যে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, জীবিকা তাদের মৌলিক বা প্রাথমিক অধিকার এবং রাষ্ট্র-প্রশাসন-ব্যবসায়ী-ব্যবস্থাপকদের দায়িত্ব তা মেটানোর উপায় হাজির করা। সুতরাং এই ক্ষেত্রেও আমরা দেখছি যে স্বাভাবিক প্রকৃতিজ সম্পর্ক ধ্বংস করার মধ্য দিয়ে অভাব তৈরি করার উপরই মৌলিক বা প্রাথমিক অধিকারের ধারণার আবির্ভূত হওয়া ও তা মেটানোর উপায় হিসেবে অধিকারধারীদের সরকার-প্রশাসন-ব্যবসায়ী-ব্যবস্থাপকদের উপর নির্ভরশীল করে তোলার প্রক্রিয়া ঘটে।
মানুষ যেখানে প্রকৃতিজ স্বাভাবিক সম্পর্কে লগ্ন থেকে জীবনোপকরণ সমষ্টিগত অধিকার হিসেবেই পেতে অভ্যস্ত ছিল, তার সেই সমাজ ধ্বংস করে প্রতিটি মানুষকে ব্যক্তি-একক করে, ব্যক্তি হিসেবে প্রাথমিক বা মৌলিক অধিকারের অধিকারী করে, তা পূরণের জন্য বাজারের বিপণি বা রাষ্ট্র-প্রশাসনের বিতরণীর উপর একান্ত নির্ভরশীল করে তোলার মধ্য দিয়ে বাজার-রাষ্ট্র-প্রশাসন-এর আধিপত্যাধীনে ব্যবসায়িক সম্পর্কের ধাপকাটা উচ্চাবচ কাঠামোয় সবাইকে কষে বাঁধা যায়, পণ্য-সম্পর্ক বিকাশ ও বিস্তৃতির অতি উপযোগী ক্ষেত্র নির্মিত হয়।
এরপর শুরু হয় পণ্য-বিজ্ঞাপনের মায়াজাল বিস্তার। প্রকৃতিলগ্ন আত্মনির্ভর যৌথ জীবনযাপনে অপারগ হয়ে ওঠা ও বিচ্ছিন্ন ব্যক্তি হিসেবে বাজারের উপর নির্ভরশীল হয়ে ওঠা মানুষের মনে যত রকম ভাবে নিরাপত্তাহীনতা, ঈর্ষা, লোভ, লালসা উসকে দেওয়া যায় পণ্য-বিজ্ঞাপনের মধ্য দিয়ে তা করা হয়, নিরন্তর নতুন করে অভাববোধ ও নতুন প্রয়োজনের উদ্ভব হতে থাকে। ক্রমাগত গভীর হতে থাকা অন্তর্লীন এক হীনতাবোধে আক্রান্ত ব্যক্তি আগ্রাসী ভোগজমকের মধ্য দিয়ে বিজ্ঞাপিত আদর্শটিকে অনুকরণ করার মরীয়া চেষ্টায় পণ্যনির্মাতা ও পণ্যবিক্রেতাদের হাতে নিজ জীবনশৈলী সঁপে দিয়ে বাইরে চমকদার ও ভিতরে নিঃস্ব হয়।
আরো যা হয়, তা এই একুশ শতকে এসে অতি সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে, তা হল নিদারুণ প্রাকৃতিক বিপর্যয়। সেই দিকটায় এবার দেখা যাক।
প্রকৃতিলগ্ন জীবন-সংস্কৃতির পরম্পরায় থিতু ভরণপোষণের জন্য সীমায়িত উৎপাদনে সন্তুষ্ট জনজাতিদের চেতনায় প্রাকৃতিক প্রাচুর্য্য সম্পর্কে বোধ কী রূপ ধারণ করত তা আগে বলেছি। তাদের সমষ্টিগত অধিকার ধ্বংসের মধ্য দিয়ে প্রকৃতিকে যখন ব্যবসায়ের জন্য ক্রমবর্ধমান উৎপাদনের হোতা রাষ্ট্র-প্রশাসন-ব্যবসায়ী-ব্যবস্থাপকদের মালিকানাভুক্ত করা শুরু হল, প্রকৃতি সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গিও পাল্টে গেল। মানুষ তখন আর প্রকৃতির অন্যান্য উপাদানের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্কে বাঁধা প্রকৃতিরই একটি অংশ নয়, বিভাজনরেখা টেনে প্রকৃতি ও মানুষকে আলাদা করা হল। সর্বময় কর্তার আদলে মানুষ প্রভু, মানুষ নিয়ন্ত্রক, আর প্রকৃতি তার বাইরে স্থিত তার ব্যবহার ও উপভোগের জন্য প্রদত্ত কাঁচামালের ভাণ্ডার বিশেষ। মানুষ তার উদ্যোগ-ক্ষিপ্রতা-জ্ঞান-বুদ্ধি-প্রযুক্তি শানিয়ে এই ভাণ্ডারকে যত দ্রুত যত উৎপাদনশীলভাবে নিঙড়ে নিয়ে বস্তু-উৎপাদন ও উপভোগ বাড়াতে পারবে, ততই সম্পদ বাড়বে। উৎপাদন যেহেতু আর ভরণপোষণের সীমায়িত গণ্ডিতে গণ্ডিবদ্ধ নয়, বরং ব্যবসায়ীদের বাণিজ্যবিস্তারের সীমাহীন করে আঁকা পরিকল্পনা দিয়ে চালিত, ফলে প্রকৃতি নামক ভাণ্ডারটিকে নিঙড়ে উৎপাদনের হার দ্রুত থেকে দ্রুততর করার মধ্যেই সর্বমোক্ষ নিহিত বলে ঘোষিত হল। পণ্যোৎপাদনকারী পুঁজিবাদী উৎপাদনপ্রক্রিয়ার এই তুমুল নিষ্পেষণে প্রাকৃতিক ভারসাম্য লঙ্ঘিত হওয়ার ইঙ্গিত নানা দিক থেকেই ফুটে উঠছিল প্রথম থেকেই। বাণিজ্যিক কৃষির নিষ্পেষণে মাটির উর্বরতা কমতে থাকা প্রথম নিজেকে জানান দিয়েছিল । কাঠের বাণিজ্য এবং বাণিজ্যমুখী উৎপাদনে কাঁচামাল হিসেবে কাঠের যোগানের জন্য জঙ্গল-ধ্বংসের নানা কুপ্রভাবও ফুটে উঠেছিল। খনিজ পদার্থ ও জৈব জ্বালানী উত্তোলনের সঙ্গে যুক্ত বাস্তুতন্ত্র-ধ্বংসের দুর্যোগ ছড়িয়ে পড়ছিল। কিন্তু প্রকৃতির উপর প্রভুত্ব কায়েম করে প্রগতি আবাহনের পথের পথিকরা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও সুপ্রয়োগের বলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে বলে নিশ্চিন্ত ছিলেন। মাটির উর্বরতার বিকল্প হিসেবে রাসায়নিক সার, কাঠের বিকল্প হিসেবে জৈব জ্বালানী ও প্লাস্টিক, খনিজ পদার্থের বিকল্প হিসেবে কৃত্রিমভাবে সংশ্লিষ্ট বস্তু: এধরনের সমাধান দিয়েই ক্রমবর্ধমান উৎপাদনের পরিকল্পনাকে টেকসই করার বিধান জারী হয়েছিল। একুশ শতকে এসে অবশ্য তা নেহাতই অলীক দিবাস্বপ্ন বলে প্রমাণ হতে আর বাকি নেই। একসময়ের সমস্যা-সমাধানকারী হিসেবে বন্দিতরাই এখন সমস্যাকে আরো গভীর ও ব্যাপ্ত করে প্রায় অসমাধানযোগ্যতার দুয়ারে পৌঁছে দিয়েছে। রাসায়নিক সার মাটির উর্বরতা-হ্রাসকে আরো দ্রুত ও গভীর করে তুলেছে, নানা বিষময় প্রভাবও বিস্তৃত করেছে পরিবেশে ও খাদ্যে, প্লাস্টিকের বহুল ব্যবহার জৈবচক্র ব্যাহত করে ভয়ঙ্কর দূষণ ও বাস্তুতন্ত্রের ক্ষয় নিয়ে এসেছে, জৈব জ্বালানীর দহনক্রিয়া উপজাত কার্বন-পুঞ্জ বায়ুমণ্ডলে জমে বিশ্ব-উষ্ণায়নের প্রাণধ্বংসী পাককে আরো পোক্ত করছে। প্রকৃতি-লুন্ঠনকারী রূপ-রূপান্তরে উৎপাদনের ক্রমবৃদ্ধিকে বজায় রেখে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির বলে টেকসই ভবিষ্যৎ গড়া সম্ভব নয়। প্রকৃতির স্বাভাবিক স্বরাট চক্রকে ধ্বংস করে তারপর আবার বিজ্ঞান-প্রযুক্তির ক্ষমতা খাটিয়ে অঙ্ক কষে প্রকৃতির ‘পুনরুৎপাদন’-এর বন্দোবস্ত করার নানা ‘ইঞ্জিনিয়ারিং’ ছকের কথা কেউ কেউ বলে থাকেন বটে, তবে তাও মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ, মানুষ তার চেতনালব্ধ ‘জ্ঞান’ নিয়ে যতই আহ্লাদিত ও আত্মগর্বী হোক না কেন, সেই ‘জ্ঞান’ কখনোই গোটা প্রকৃতির (যার নেহাতই একটা ক্ষুদ্র অংশ সে) সমস্ত প্রক্রিয়া ও বিপাকক্রিয়াকে মনুষ্যনির্মিত কোনো যন্ত্রের কর্মপ্রণালীর মতো করে ছকে ফেলতে পারবে না। প্রকৃতির প্রভু হয়ে বসার মিছে ঔদ্ধত্য ত্যাগ করে প্রকৃতির অংশ হয়ে অন্যান্য প্রাকৃতিক উপাদানের সঙ্গে সুষম সম্পর্ক পুনর্স্থাপন করা ও সমষ্টিগত ভরনপোষণের উদ্দেশ্যে সীমায়িত উৎপাদনে ফিরে যাওয়াই কি তবে সর্বপ্রাণ ধ্বংস করতে উদ্যত এই আবর্ত থেকে বেরিয়ে আসার অনোন্যপায় পথ?
অনোন্যপায় পথ হিসেবে একে মেনে নিতে বাধা হয়ে দাঁড়ায় প্রয়োজন ও চাহিদা সম্পর্কে বর্তমান ধারণাগুলো। প্রয়োজন ও চাহিদা তো কেবল প্রকৃতিলগ্ন সমষ্টিগত জীবনায়োজন আহরণের উপায় ও সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে জীবনোপকরণের অভাব তৈরি করে ব্যক্তিস্তরে মৌলিক বা প্রাথমিক প্রয়োজন প্রতিষ্ঠার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, সীমাহীন উৎপাদনবৃদ্ধির সম্ভাব্যতার রূপকথার পিঠে চড়ে, ভোগের চাহিদাও অসীম হয়ে উঠেছে, প্রয়োজনেরও কোনো সীমা নেই। প্রতিটি ব্যক্তির জন্য একটি সেলফোন, প্রতিটি পরিবারের জন্য একটি ব্যক্তিগত যান, বিদ্যুৎশক্তির সীমাহীন যোগান, ভোগ্যবস্তু ও উচ্ছিষ্টের স্তূপ বাড়িয়ে চলা পণ্যপূজক যাপন--- বিকাশ-প্রগতি-আধুনিকতার নামে এগুলোর মতো আরো কতকিছুকেই তো আমরা প্রয়োজনের স্বতঃসিদ্ধতায় নিত্য আত্মস্থ করে নিয়ে চলেছি। সেই কারণেই প্রকৃতিলগ্ন যাপনে সমষ্টিগত ভরনপোষণের সীমায় উৎপাদন ও ভোগকে সীমায়িত করার প্রসঙ্গ আমাদের আত্মস্থ করে নেওয়া এই স্বতঃসিদ্ধের বিপরীতে দাঁড়িয়ে অসম্ভব এক রোমান্টিকতা হিসেবে নিমেষে প্রত্যাখ্যাত হয়ে যায়। আমাদের এই প্রয়োজনের স্বতঃসিদ্ধগুলো তৈরি করেছে বিকাশ-প্রগতি-আধুনিকতা সম্পর্কিত যে ধারণামণ্ডলী, সেই ধারণামণ্ডলীর দাসত্ব থেকে মুক্তি খোঁজার উদ্দেশ্য নিয়ে আমরা তার উদ্ভব নিয়ে আলোচনায় যাব। তবে তার আগে আর একটা কথাও বলে নেওয়া ভালো।
মানুষের বেঁচে থাকার জন্য কী প্রয়োজন তা কি প্রশ্নাতীতভাবে নির্ধারিত হতে পারে? তা তো নির্ভর করে বেঁচে থাকার ক্রিয়াটি কীভাবে সমাধিত হচ্ছে তার উপর। সমস্ত মানুষের জন্য একটাই প্রয়োজনের তালিকা মৌলিক বা প্রাথমিক বা স্বতঃসিদ্ধ বলে চিহ্নিত করতে হলে সমস্ত মানুষ আসলে একইরকমভাবে বাঁচবে বলে ধরে নেওয়া হয়। এই ধরে নেওয়াটা আপাতদৃষ্টিতে সকল মানুষকে সমান করার বৈষম্যনাশী প্রগতিশীল রাজনীতির প্রতিজ্ঞা বলে মনে হলেও, তা কি বহু বিভিন্ন ধরনের মানুষের বহু বিভিন্ন পরিবেশে স্বাভাবিকভাবেই বহু বৈচিত্র্যময় জীবনযাপন ক্রিয়াকে একটাই মান্য পরিমিত রূপ দিয়ে প্রতিস্থাপিত করার প্রভুত্ববাদী প্রচেষ্টা নয়? পুঁজিবাদও কী এভাবেই ‘উন্নত জীবনযাপন’-এর সর্বজনীন আদর্শ তৈরি করার মধ্য দিয়েই তার পণ্যোৎপাদনের পসরাকে প্রতিনিয়ত প্রাথমিক প্রয়োজনের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে চলছে না? একইরকম উপাদান দিয়ে তৈরি একইরকম আদলের বাড়িতে থাকতে হবে, একইরকম খাবার খেতে হবে, একইরকম পোষাক পরতে হবে, একইরকম প্রসাধনী ব্যবহার করতে হবে, একইরকম জ্ঞাপন-আমোদ-প্রমোদ ব্যবস্থা ব্যবহার করতে হবে--- এই একইরকমভাবে বাঁচার টানে কি মানুষদের বহু বিবিধ বৈচিত্র্যময় জীবন-আয়োজন বিসর্জিত হয়ে পণ্য-ব্যবহার-প্রধান পণ্যসম্পর্ক-প্রধান একমেটে জীবন-আয়োজনই অন্ধ বিবরের মতো সবকিছু গিলে নিচ্ছে না? তার ইশারাতেই কি তেজস্ক্রিয় হারে আমাদের প্রাথমিক চাহিদার ক্রমবৃদ্ধি পৃথিবীতে আমাদের সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক প্রাণী করে তোলেনি? সুতরাং পুঁজিবাদ থেকে নিষ্ক্রমণের উপায় খোঁজার নাম করে মানুষের প্রয়োজনকে প্রশ্নাতীত বিবেচনা করে সেই প্রয়োজন মেটানোর উপযোগী সমাজ গঠনের চিন্তা আবার আমাদের পুঁজিবাদের তৈরি অন্ধ বিবরেই এনে ফেলে না কি? সেই জন্যই ‘মানুষের প্রয়োজন’-কে ঐতিহাসিক পর্যায় জুড়ে নির্মিত হওয়ার সাপেক্ষে সমালোচনাত্মক বিশ্লেষণের দৃষ্টিতে বিচার করে নেওয়া দরকার।
৩
১৯৯২ সালে প্রথম প্রকাশিত উল্ফগ্যাঙ স্যাকস সম্পাদিত ‘The Development Dictionary: a guide to knowledge as power’ বইয়ে প্রয়োজন (Needs) সম্পর্কে লিখতে গিয়ে ইভান ইলিচ প্রয়োজনের যে ঐতিহাসিক কুলজি হাজির করেছিলেন, তা বিবেচনা করা যাক। ইভান ইলিচ বলেছিলেন, প্রত্নতাত্ত্বিকদের অনুমান ধরলে, তখনও অবধি পৃথিবীতে জীবন অতিবাহিত করা পূর্ণবয়স্ক মানুষদের সংখ্যা পাঁচশো কোটি (5 billion)-র বেশি হবে না। এই পাঁচশো কোটিকে দুটো ভাগে ভাগ করলে, তার ক্ষুদ্রতম ভাগটি জীবন যাপন করেছিল সেই আদি প্রস্তর যুগের গুহাচিত্র আঁকার সময় থেকে ১৯৩০-এর দশকের শেষদিকে পিকাসোর গুয়েরনিকা ছবি আঁকার সময়কালের মধ্যে। আর বাকি বৃহত্তম অংশটির জীবনযাপনকাল সেই গুয়েরনিকার সময় থেকে ১৯৯০-এর দশকের মধ্যে।
প্রথম ভাগ, অর্থাৎ আদি প্রস্তর যুগের গুহাচিত্র থেকে গুয়েরনিকা অবধি জীবন কাটানো মানুষদের প্রায় দশ হাজার প্রজন্ম বেশ কয়েক হাজার ভিন্ন ভিন্ন জীবনশৈলী অবলম্বন করে অসংখ্য ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় কথা বলে প্রাণধারণ করেছে। তুষার মানুষ বা গবাদি পালক, রোমান বা মোগল, নাবিক বা পরিযায়ী… বহু বিচিত্র ছিল তাদের জীবন। মনুষ্যত্বের ধারণা, প্রয়োজন ও সন্তুষ্টির ধারণা, কাঙ্খিত জীবনের ধারণা: এই সমস্তই কোদাল বা টেকো, কাঠ বা ব্রোঞ্জ বা লোহার তৈরি হাতিয়ারকে ঘিরে বহু ভিন্ন ভিন্ন রূপ ধারণ করেছিল। বহু বিভিন্ন রূপ ধারণ করা এই জীবন-সংস্কৃতিগুলোয় আবশ্যকীয়তার নিয়ম নির্দিষ্ট স্থান-কাল বিশেষে ভিন্ন ভিন্ন রূপক-প্রতিমা- লক্ষণায় উপলব্ধ হয়ে স্থান-কাল বিশেষে গোষ্ঠীজীবনকে স্বতন্ত্র আদলে বেঁধেছিল। সংস্কৃতির এই বিপুল বৈচিত্র্য দেখায় যে মানুষের চাহিদা ও প্রয়োজনীয়তাবোধ কতই না নমনীয়, কতই না বিভিন্ন বিচিত্র রূপ তা নিতে পারে, কল্পনা ও স্বজ্ঞা তাকে পূর্বনির্ধারিত সমস্ত আদলের বাইরে এনে বাঁধতে পারে। কিন্তু এই বহু বিভিন্ন রূপধারী আকাঙ্ক্ষা-উল্লাস-যাতনা-বেদনা-মনস্তাপ-হর্ষ-আতঙ্ক সত্ত্বেও আমাদের সেই পূর্বপুরুষদের মধ্যে জীবনযাপনে উন্নতির নামে প্রয়োজন বা চাহিদাকে সদাবর্ধমান রূপে অনন্তের মাত্রায় বাঁধা ও তা পূরণের জন্য বস্তুগত উৎপাদনকে অনবরত বাড়িয়ে যাওয়ার কোনো অভিপ্রায়কে প্রধান হয়ে উঠতে দেখা যায় না।
এই অভিপ্রায় গুয়েরনিকা-পরবর্তী বৃহত্তম অংশটির মধ্যেই প্রধান হয়ে উঠেছে, আধিপত্যের ক্রমবিস্তারের মধ্য দিয়ে অন্য সমস্ত বোধকে আচ্ছন্ন করে দিয়েছে। এই পরবর্তী বৃহত্তম অংশটিই বিদ্যুৎ শক্তি, সিনথেটিক পোষাক, জাঙ্ক-ফুড, বৈদ্যুতিন যন্ত্র, দ্রুতি ও দূর প্রমোদভ্রমণে আসক্ত। কারখানাজাত দ্রব্য ও পরিষেবার উপর আমূল নির্ভরতা, যে নির্ভরতাকেই তারা নাম দিয়েছে মৌলিক প্রয়োজন বা চাহিদা, প্রশ্নাতীতভাবে তাকে তারা মানুষের জীবনাকাঙ্ক্ষার একমেবাদ্বিতীয়ম প্রধান রূপের রাজ-সিংহাসনে বসিয়েছে। সেই রাজার শাসনে মানুষ চির-অতৃপ্ত, চির-অভাবী। পূর্বজ সংস্কৃতির বহুত্ব-বিভিন্নতা-বৈচিত্র্যকে অস্বীকার করে পশ্চিমী বৃহৎ শিল্পোৎপাদন ভিত্তিক সমাজরূপের গর্ভে জাত বিবর্তন-প্রগতি-বিকাশ-উন্নয়ন-এর ছককাটা নকশায় সমস্ত মানুষকেই তা চির-অভাবের মাত্রাগত মাপের নিরিখে ধাপকাটা এক একশিলা কাঠামোয় বাঁধতে চাইছে।
ইভান ইলিচের প্রস্তাবিত এই চাহিদার কুলজির গুয়েরনিকা-পরবর্তী অংশটির ইতিহাসগত রূপটিকে কিছুটা বিশদে বিবেচনা করা যাক, যেহেতু এই অংশের মধ্যেই মৌলিক/প্রাথমিক চাহিদা/প্রয়োজনকে অনৈতিহাসিক করে তুলে মানব-অভিপ্রায়ের একটি সর্বজনীন চরিত্র বলে দাবি করা হয়েছে। নির্দিষ্ট যে ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে মৌলিক বা প্রাথমিক চাহিদা বা প্রয়োজন বিশ শতকের মাঝ-বরাবর থেকে সামাজিক-রাজনৈতিক চিন্তার নিয়ামক হয়ে উঠেছে, সেই প্রক্রিয়ার প্রধান তিনটি উপাদানকে চিহ্নিত করা যায় এইভাবে:
এই তিনটি উপাদানকে একে একে বিচার করা যাক।
প্রথমে দেখা যাক মানুষের প্রয়োজন, ভোগ ও জাতীয় উৎপাদন মাপার হিসাব-প্রণালী কীভাবে প্রমিতিকৃত হল। ‘জীবনযাপনের মান’ (standard of living) ধারণাটি ম্যালথাস, রিকার্ডো, মার্কস-এর মতো ধ্রুপদী অর্থনীতিবিদদের পরম্পরাতেও হাজির ছিল। কিন্তু সেখানে তার মানে ছিল এমন এক ন্যূনতম রোজগার যা আর কমানো যায় না কারণ তার নীচে জীবনধারণ করা সম্ভব নয়। মার্কস শ্রমশক্তির মূল্য হিসেবে মজুরিকে সংজ্ঞাত করেছিলেন, তখন শ্রমিকদের জীবনযাপনের মান বজায় রাখতে দরকার যে রোজগার তাকেই শ্রমশক্তির মূল্য বলেছিলেন। তা নিখুঁত মাপযোগ্য ছিল না।
ইউরোপ ও আমেরিকায় বৃহৎ শিল্পোৎপাদনের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা সমাজব্যবস্থাগুলো গোটা বিশ্বজুড়ে চালানো ঔপনিবেশিক শোষণের পুঞ্জিত লুঠের উপর দাঁড়িয়ে নিজ অভ্যন্তরে সমাজের সমস্ত স্তরেই ভোগ-সচ্ছলতা ভালো রকম বাড়াতে পেরেছিল। তার মধ্য দিয়ে জীবনযাপনের মানের ক্রমোন্নয়ন সেই সমাজগুলোর সব মানুষের কাছেই নিত্য সূর্যোদয়ের মতোই প্রাকৃতিক ও অতি-স্বাভাবিক একটি ঘটনা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হল। অর্থনীতিবিদ্যাতেও ‘জীবনযাপনের মান’-এর মানে পাল্টাতে লাগল। প্রাণধারণ করার জন্য প্রয়োজনীয় ন্যূনতম রোজগারের বদলে একজন উপভোক্তার আকাঙ্ক্ষিত জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় রোজগারের অর্থ এর সঙ্গে যুক্ত হয় এবং তার ক্রম ঊর্ধ্বগতিই সুখ ও সমৃদ্ধির মাপকাঠি বলে চিহ্নিত হয়। এই নতুন অর্থে সমন্বিত হয়ে জীবনযাপনের ‘উন্নতি’-র আকাঙ্ক্ষিত মাত্রা উপস্থাপিত করার প্রয়োজনে ধারণাটিকে মাপজোখের মান্য মাপকাঠিতে বাঁধার উদ্যোগ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল।
তথাকথিত এই উন্নত বিশ্বে ১৯৩০ সালের মহামন্দা এবং তার ধাক্কায় কেইনসীয়-ধারণা-আশ্রিত ভোগে উদ্দীপনা যোগানোর রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতিসমূহ প্রশাসনিকতার সাধারণ নিয়ম হয়ে ওঠার মধ্য দিয়ে এই জীবনযাপনের মান মাপা প্রশাসনিক অর্থনীতির একটি কেন্দ্রীয় বিষয় হয়ে উঠল। এই বৃহৎ শিল্পোৎপাদন ভিত্তিক দেশগুলোর প্রশাসনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে গড়ে উঠল পরিসংখ্যান-গবেষণাকেন্দ্র। একই রাষ্ট্রভুক্ত সমাজের বিভিন্ন স্তরের জীবনযাপনের বাস্তবতা ও আকাঙ্ক্ষা মাপার জন্য কেবল নয়, বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে তুলনা টেনে আগু-পিছু নির্ধারণ করার জন্যও নানা পরিসংখ্যানগত মাপ হাজির হল। পাশাপাশি, সোভিয়েত রাশিয়ায় কায়েম হওয়া কড়া রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ ও পৃষ্ঠপোষকতায় অতি দ্রুত বৃহৎ শিল্পভিত্তিক সমাজব্যবস্থা গড়ার প্রশাসনিকতাও পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাসমূহের যৌক্তিকতা উৎপাদনকারী হিসেবে পরিসংখ্যান তৈরির উপর ভর করল।
এইসব দেশের শ্রমিকদের অর্থনৈতিক আন্দোলনের মধ্যেও মজুরীবৃদ্ধির দাবির যৌক্তিকতা প্রতিপাদনে জীবনযাপনের মান প্রকাশক বিভিন্ন পরিসংখ্যানগত মাপকেই বৈজ্ঞানিক তাই নিরপেক্ষ বলে ধরে নেওয়া হল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী বিশ্বে উদ্ভূত হল একটি রাষ্ট্রের অধীন অর্থনীতির মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন (GDP বা GNP) নামক মাপ, যা অনুযায়ী গোটা বিশ্বের সমস্ত দেশকে বিকাশের গাণিতিক মাপকাঠি অনুযায়ী সাজিয়ে ফেলার কাজ সম্পূর্ণ হল। কোনো একটি রাষ্ট্রের সীমানায় মোট পণ্য-উৎপাদন (পণ্য রূপে বস্তু ও পরিষেবা), নির্মিত পরিকাঠামো ও মুদ্রা সঞ্চিতির পরিমাণ দিয়ে এই মোট আভ্যন্তরীণ উৎপাদন (GDP) মাপা হয়। তা বাড়িয়ে যাওয়াকে সভ্যতার দৌড়পথে টিকে থাকার জন্য একটি অবশ্যকর্তব্য হিসেবে তুলে ধরে সীমাহীন ভোগ-উপভোগের স্বর্গরাজ্যে কে কত দ্রুত প্রবেশ করতে পারে তার প্রতিযোগিতাকেই সর্বজনীন বলে ঘোষণা করা হল। সেই প্রতিযোগিতায় উতরানোর প্রশিক্ষণ ও উদ্দীপনা জোগানোর জন্য আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের জালও বোনা হল।
এই বিষয়ে আরো বিচার-বিবেচনা এগোনোর আগে দ্বিতীয় ও তৃতীয় উপাদানদুটোর কথায় আসা যাক।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী তিরিশটি বছর (১৯৪৫—১৯৭৫) বৃহৎ শিল্পোৎপাদন ভিত্তিক দেশগুলো অভূতপূর্ব বিকাশের এক পর্যায়ের মধ্য দিয়ে গেল। সামরিক অস্ত্র উৎপাদনের বিপুল স্ফীতি, নগর-পরিকাঠামো নির্মাণে অভূতপূর্ব জোয়ার, খনিজ-তেল-ভিত্তিক পণ্য-অর্থনীতির বিপুল বিস্তার এই অভূতপূর্ব বিকাশের প্রধান চাবিকাঠি হলেও তা এই সব দেশের নাগরিকদের সামনেও সাধারণভাবে ভোগের মাত্রা বেশ কয়েক গুণ বাড়িয়ে নেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিল। ইউরোপ ও আমেরিকার ‘পুঁজিবাদী’ দেশগুলোর ‘কল্যাণব্রতী রাষ্ট্র’ (welfare state) ধাঁচা এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো ‘সমাজতান্ত্রিক’ দেশের রাষ্ট্রের দ্বারা নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত পরিকল্পনা-ব্যবস্থাপনার ধাঁচা--- এই দুই-ই পণ্য-উৎপাদনের বিপুল স্ফীতির মধ্য দিয়ে মানুষের ভোগ-উপভোগ বাড়ানোকেই মানবমুক্তির পথ হিসেবে হাজির করল, কে সেই পথে বেশি চিকণ ও দ্রুতগামী কেবল তাই নিয়ে তরজা ও প্রতিযোগিতা রইল। বিশ্বজুড়েই এমন এক প্রত্যাশা ছড়িয়ে পড়ল যে সর্বজনীন ভোগ-সচ্ছলতা প্রায় নাগালের মধ্যে এসে গেছে, বেঁধে দেওয়া পথ ধরে দ্রুত এগিয়ে মোড় ঘুরলেই তার সাক্ষাৎ অনিবার্য। ফলে কেবল এই ‘উন্নত’ দেশগুলোই নয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে প্রত্যক্ষ ঔপনিবেশিক শাসনের বাঁধন কেটে বেরিয়ে আসা তথাকথিত ‘তৃতীয় বিশ্ব’-এর দেশগুলোও এই সীমাহীন করে বস্তু-উৎপাদন বাড়ানোর মধ্য দিয়ে মানুষের ভোগ-উপভোগকে অসীমে নিয়ে যাওয়ার স্বর্গকেই নিজেদের ‘স্বাধীন বিকাশ’-এর লক্ষ্য করে নিল। এই বিকাশের অর্থনীতির পৌরোহিত্য করার জন্য বৃহৎ শিল্পোৎপাদন ভিত্তিক রাষ্ট্রগুলোর পৃষ্ঠপোষণায় আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনসমূহের মেলা বসে গেল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তখন পৃথিবীর সব দেশের মধ্যে পুঞ্জিত পুঁজির সবচেয়ে উঁচু পাহাড়ের উপর বসে আছে। পুঞ্জিত পুঁজি-পাহাড়ের এহেন উচ্চতা তখনকার পৃথিবীতে অদৃষ্টপূর্বও বটে। গোটা বিশ্ব-অর্থনীতিকে লাগাম পরিয়ে নিয়ন্ত্রণ করার উচ্চাশা নিয়ে জন্ম নেওয়া আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোও তার আঙিনাতেই গজিয়ে উঠছে। আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডার (IMF) ও পরবর্তীকালে বিশ্বব্যাঙ্কে রূপান্তরিত হওয়া প্রতিষ্ঠানের প্রধান দপ্তর মার্কিনদেশের রাজধানী ওয়াশিংটন ডি সি-তে। জাতিসংঘ (UN)-এর সভা বসে মার্কিনদেশের বাণিজ্যিক রাজধানী নিউ ইয়র্কে এবং তার চার্টারটিও মার্কিনী সংবিধানের প্রস্তাবনার আদলে তৈরি হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের রেখে যাওয়া ধ্বংসস্তূপের উপর দাঁড়িয়ে মার্কিন রাষ্ট্রই ঋণের থলি হাতে সর্বজনীন মহাজন হয়ে উঠেছে, আবার হিরোশিমা-নাগাসাকিতে প্রায় অকারণে পরমাণু বোমা ফেলে নিজের বিশ্বধ্বংসের ক্ষমতাসম্পন্ন অস্ত্রভাণ্ডারেরও বিজ্ঞাপন সেরে রেখেছে। জি ডি পি-র অঙ্কে মাপা অর্থনৈতিক উৎপাদনের হিসাবেও বিশ্বের মোট উৎপাদনের অর্ধেক তখন মার্কিন মুলুকেই হচ্ছে। ১৯৪৫-এ পরমাণু বোমা ফেলার নির্দেশ দেওয়া মার্কিন রাষ্ট্রপতি হ্যারি ট্রুমান ১৯৪৯ সালে নির্বাচিত হয়ে আবারও রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর তাঁর প্রথম সরকারি ভাষণে যুদ্ধোত্তর দশকগুলোর জন্য চারটি মূল নীতি ঘোষণা করলেন। তার প্রথম তিনটে হল: জাতিসংঘের পৃষ্ঠপোষকতা করে যাওয়া, ইউরোপে পুনর্গঠনের কাজ চালিয়ে যাওয়া এবং ন্যাটো (NATO, North Atlantic Treaty Organization) নামক জোট গঠন। এইগুলোর মধ্য দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে ইউরোপীয় রাষ্ট্রদের নিয়ে সামরিক জোট গঠন ও বজায় রাখার কৌশলই কাজ করছিল। কিন্তু চতুর্থ নীতিটির লক্ষ্য ইউরোপ ছিল না, তার লক্ষ্য ছিল ইউরোপের রাষ্ট্রগুলোর এতদিনকার ঔপনিবেশিক শাসন ভেঙে বেরিয়ে আসতে থাকা লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা ও এশিয়ার দেশগুলো। ট্রুমানের নিজের কথাতেই সেই চতুর্থ নীতির কথা শোনা যাক:
চতুর্থত, আমাদের এমন এক সাহসী নতুন কর্মসূচী শুরু করতে হবে যা আমাদের বৈজ্ঞানিক অগ্রসরতা ও শিল্পোৎপাদনজনিত প্রগতির সুবিধাগুলোকে ঊন-বিকশিত (underdeveloped) অঞ্চলগুলোর উন্নয়ন ও বৃদ্ধির জন্য লভ্য করে তুলবে।
পৃথিবীর জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি দুঃখকষ্টের নিদারুণ অবস্থায় বাস করছে। তাদের খাদ্য অপর্যাপ্ত। তারা রোগের শিকার। স্থবির ও আদ্যিকালের তাদের অর্থনৈতিক জীবন। তাদের জন্য এবং আরো ধনী অঞ্চলগুলোর জন্য, উভয়ের জন্যই তাদের দারিদ্র্য একটি প্রতিবন্ধক ও বিপদ বিশেষ।
ইতিহাসে এই প্রথম, মানুষের মুঠোয় সেই জ্ঞান ও কুশলতা ধরা দিয়েছে যা ওইসব মানুষদের দুর্ভোগ মোচন করতে পারে।...
আমাদের দেশের বাণিজ্য, ব্যক্তিমালিকানাধীন পুঁজি, কৃষি ও শ্রমের সহযোগিতা নিয়ে এই কর্মসূচী অন্যান্য জাতিরাষ্ট্রের শিল্পোৎপাদন কার্যক্রমে প্রভূত বৃদ্ধি আনতে পারে এবং তাদের জীবনযাত্রার মানের প্রভূত উন্নতি ঘটাতে পারে।…
পুরোনো সাম্রাজ্যবাদ, যা ছিল বিদেশী মুনাফার জন্য শোষণ, তার কোনো স্থান আমাদের পরিকল্পনায় নেই। আমরা গণতান্ত্রিক ন্যায়-কারবারের ধারণার উপর দাঁড়ানো বিকাশের কর্মসূচী পরিকল্পনা করছি।
ঊন-বিকশিত (underdeveloped) বা ঊন-বিকাশ (underdevelopment) কথাগুলো এর আগে অবধি রাজনীতি বা অর্থনীতিতে চালু ছিল না। ট্রুমানের এই ঘোষণা দিয়ে শুরু মার্কিনী রাষ্ট্রীয় কর্মসূচীই তাকে অতি-প্রচলিত করে তুলল। এতদিন ধরে যে লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা ও এশিয়ার ভূখণ্ডের প্রাকৃতিক প্রাচুর্য্যকে লুঠ-ধ্বংস-তছনছ করে এইসব ধনী দেশগুলো ধনী হয়েছে, অপরিমিত বিলাস-ব্যসন-ভোগের পাট বসিয়েছে, সেই ভূখণ্ডগুলোই এখন দারিদ্র্য ও ঊন-বিকাশ নামক রোগের রোগী বলে চিহ্নিত হল। তার কারণ নাকি সেই সমস্ত অঞ্চলের মানুষদের অর্থনীতির স্থবির আদ্যিকালের চরিত্র, অর্থাৎ ইউরোপীয়-মার্কিনীদের মতো অনন্ত বৃদ্ধির পানে ধাওয়া শিল্পোৎপাদন, ভোগবিলাস ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য ধ্বংস তারা রপ্ত করেনি বলেই তারা পিছিয়ে। আর এই অনন্ত বৃদ্ধির পানে ধাওয়া শিল্পোৎপাদন, ভোগবিলাস ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য ধ্বংস করার যে প্রজ্ঞান-প্রকৌশল-মানসিকতা তারা গড়ে তুলেছে, তা-ই নাকি ইতিহাসে প্রথম মানুষের মুঠোয় আসা এমন জ্ঞান ও কুশলতা যা সব মানুষের দুর্ভোগ মোচন করতে পারে। উপনিবেশের পর উপনিবেশে জনজাতিদের প্রকৃতি থেকে আহরণের ও সীমায়িত উৎপাদনের অধিকারকে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে ধ্বংস করে, কোথাও কোথাও জনজাতিদের গণহারে খুন করে, ধনী দেশের যে পুঁজিপতিরা ব্যক্তিগত পুঁজি সঞ্চয় করেছে, বাণিজ্যের যে কাঠামো প্রতিষ্ঠা করেছে, তারাই নাকি এখন ঊন-বিকশিত দেশগুলোর বিকাশে সহযোগিতা করবে। অর্থাৎ, ঔপনিবেশিক শাসনের বন্ধন ছিঁড়ে মুক্ত হতে চাওয়া দেশগুলোর সামনে নিদান খাড়া করা হল যে তাদের ঊন-বিকাশ কাটিয়ে বিকশিত হয়ে উঠতে হবে এবং তার জন্য একমাত্র পথ হল মার্কিনী পথ অনুসরণ করে অনন্ত বৃদ্ধির পানে ধাওয়া শিল্পোৎপাদন প্রতিষ্ঠায় সর্বস্ব নিবেদন করা। মার্কিনীরাই যেহেতু তখন পুঞ্জিত পুঁজির সবচেয়ে উঁচু পাহাড়টার উপর বসে আছে, তাই তাদের জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও সমাজ-অর্থনৈতিক ধাঁচা অনুকরণ করে নিজেদের দেশে মার্কিন সমাজের প্রতিচ্ছবি গড়ে তোলাই হল দেশ-কাল-সমাজ-নির্বিশেষে সবার কাজ।
ঠান্ডা যুদ্ধের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে মার্কিনী এই বিকাশবটিকার সোভিয়েত সংস্করণও অচিরেই বাজারে এল। ব্যক্তি-মালিকানাধীন পুঁজির জায়গায় রাষ্ট্রীয় পুঁজি, বাজারের নিয়ন্ত্রণের বদলে রাষ্ট্র-নির্ধারিত পরিকল্পনার নিয়ন্ত্রণ, মার্কিনী (বা ইউরোপীয়) প্রজ্ঞান-প্রযুক্তি-প্রকৌশলের বদলে সোভিয়েত প্রজ্ঞান-প্রযুক্তি-প্রকৌশল--- এই কিছু হেরফের থাকলেও লক্ষ্য একই: লক্ষ্য হল যত দ্রুত সম্ভব উৎপাদন বৃদ্ধি ও প্রকৃতি-শোষণের বল্গাহীন অভিযাত্রার মধ্য দিয়ে নগরকেন্দ্রীক বৃহৎ শিল্পোৎপাদন ভিত্তিক কাঠামো প্রতিষ্ঠিত করা যায়।
বিকাশ ও উন্নয়ন শব্দদুটো এর মধ্য দিয়ে একটা নির্দিষ্ট অর্থ নিয়ে রাজনীতি-অর্থনীতিতে পরম প্রভাবশালী হয়ে উঠল। স্বপ্রকাশ, উন্মেষ, প্রস্ফুটনের যে নানা স্তরীয় অর্থ বিকাশ শব্দটির মধ্যে নিহিত ছিল, তা মুছে দিয়ে এই রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পরিভাষাটি কেবল একটিই মানে ধারণ করল, যা হল ইউরোপ-আমেরিকার বা সোভিয়েত ইউনিয়নের বৃহৎ শিল্পোদ্যোগ, পণ্যবাণিজ্য ও পণ্যপুজোর অনুকরণ করে নিজেদের ভেঙেচুরে বদলে ফেলা। প্রথম দুই বিশ্বের পিছু ধাওয়া করার তৃতীয় বিশ্বের এই অভিলাষ একের পর এক ঔপনিবেশিক শাসন থেকে বেরোনো দেশগুলোর জাতিরাষ্ট্র উন্নয়নী যজ্ঞের নামে শিরোধার্য করল।
১৯৮৯—১৯৯০ সালে এসে এই প্রক্রিয়া পর্বান্তরে প্রবেশ করল। ১৯৮৯ সালে ভেঙে পড়ল বার্লিনের দেওয়াল। ১৯৯০ সাল থেকে ভেঙে পড়তে শুরু করল সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পূর্ব ইউরোপের ‘সমাজতান্ত্রিক’ রাষ্ট্রগুলো। ঠান্ডা লড়াই শেষ, ‘কল্যাণব্রতী রাষ্ট্র’-এর ব্যবস্থাপনায় পণ্য-অর্থনীতির স্বরাট বিকাশ বনাম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নির্দেশনায় পরিকল্পনাধীন বিকাশের প্রতিযোগিতা শেষ, পণ্য-অর্থনীতির স্বরাট বিকাশই জয়ী ঘোষিত হল। জাতি-রাষ্ট্রগুলোর অর্থনৈতিক সীমানা ছিদ্রসঙ্কুল করে তুলে ‘মুক্তবাজারের বল’ নামধারী পণ্য অর্থনীতির আন্তর্জাতিক প্রবাহ সর্বত্রগামী হওয়ার সাধ ঘোষণা করল। আহ্লাদ করে এ পর্বের নাম দেওয়া হল ‘বিশ্বায়ন’। যে বিকাশ পরিকল্পনার ভার ছিল রাষ্ট্রের হাতে, তা এখন মূলত আন্তর্জাতিক ব্যাঙ্ক, লগ্নি-সংস্থা ও বাণিজ্য-নিয়ামক সংস্থাসমূহের হাতে ন্যস্ত হল। তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের বিপুল বিস্ফোরণ নতুন ধরনের আন্তর্জাতিক প্রশাসনিকতা সম্ভব করে তোলার পাশাপাশি বাজারের বিস্তার ও পণ্যভোগের হাতছানিকে প্রতিটি কোণে সেঁধিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে জীবনযাপন ও সংস্কৃতিকে আরো দ্রুত সমসত্ত্ব করে তুলতে লাগল। এস ইউ ভি, সেলফোন, বাতানুকূল যন্ত্র, বৈদ্যুতিন সরঞ্জাম গণ-ব্যবহারযোগ্য হয়ে উঠল।
এই ইতিহাস-প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই ভোগবৃদ্ধি ও বিকাশ সমার্থক হয়ে উঠেছে, আর তার পশ্চাদ্ধাবনই মানুষের জীবনে উন্নতি এনে দিতে পারে বলে অতিকথাটি কাণ্ডজ্ঞানের স্বাভাবিকতা পেয়ে বসেছে।
৪
বৃহৎ শিল্প কেন্দ্রীক অর্থনীতি এবং পণ্য-উপভোগবাদের জোড়া ফলার আক্রমণে সমস্ত ‘পশ্চাদপদতা’-কে ঝেঁটিয়ে বিদায় করে পৃথিবীর সমস্ত মানুষের জীবনযাত্রার মান হলিউডি বাণিজ্যিক সিনেমায় দেখানো ‘উন্নত’ জীবনযাত্রায় পৌঁছে দেওয়া যাবে কি না তা নিয়ে ১৯৮০ ও ১৯৯০ দশকের বিতর্কগুলো মূলত এই ‘বিকাশপথ’-এ এগোনোর সঠিক পন্থা নিয়ে বিতর্কের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। মার্কিন-নির্দেশিত পথে আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার/ বিশ্বব্যাঙ্ক, জাতিসংঘ ও ন্যাটো-র পৌরোহিত্য মেনে নেওয়া সঠিক পন্থা, নাকি, সোভিয়েত শিল্পায়নের রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত পরিকল্পনার পথে সোভিয়েত শিবিরের সাহায্য নিয়ে এগোনো সঠিক পন্থা। ১৯৮০ ও ১৯৯০-এর দশকে এই দুই পন্থারই বেশ কিছু বিরূপ প্রভাব ফুটে উঠছিল। মার্কিন-নির্দেশিত পথে বিভিন্ন দেশ যেভাবে আন্তর্জাতিক ব্যাঙ্ক ও বিনিয়োগকারীদের কাছে উন্নয়নী খাতে নেওয়া ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ে দেশের সমস্ত সম্পদ বন্ধক রাখা বা নীলামে চড়ানোর পাশাপাশি ‘কাঠামোগত পুনর্বিন্যাস’ (structural adjustment)-এর নামে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের (মূলত মার্কিনী বা ইউরোপীয় ব্যাঙ্ক ও বিনিয়োগকারীদের প্রতিনিধি) হাতেই অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক নীতি-নির্ধারণের ক্ষমতা তুলে দিতে বাধ্য হচ্ছিল, তা সেইসব দেশে বৈষম্যবৃদ্ধি, বিপুল অংশ সাধারণজনের নিঃস্বকরণ ঘটাতে ঘটাতে যাচ্ছিল। এই পথের কুপ্রভাবকে বাজার ও পুঁজির চাহিদাকে অনিয়ন্ত্রিত ভাবে কাজ করতে দেওয়ার মাশুল হিসেবে চিহ্নিত করে সমলোচকরা তা নিয়ন্ত্রণের নানা অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক কূটকৌশল নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছিলেন। আর সমালোচকদের একটা বড় অংশ সোভিয়েত শিবিরের দিকে নির্দেশ করে সমাধানের কথা বলছিলেন। কিন্তু সেই সোভিয়েত শিবিরেও স্বস্তি ছিল না। বাজার ও পুঁজিকে কড়া পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে শিল্পবিকাশ ও ভোগবৃদ্ধির পথে বশ করার শাসনদণ্ড যে রাষ্ট্রের হাতে তা সর্বাত্মকতাবাদী শাসক হয়ে উঠে গোটা সমাজজীবনকেই এমনভাবে নিয়মানুগ ও বাধ্য করে তুলতে উদ্যত হয়েছে, যে কোনো ব্যর্থতা স্বীকার এতটাই তার স্বভাববিরুদ্ধ যে সমস্ত সমালোচনাকে দমন করে সমস্ত ব্যর্থতাকে মতবাদ ও প্রচারের রোশনাইয়ে ঢেকে সাফল্য বলে জমকালো করে তুলছে, তা মুক্তি নয়, সাধারণজনের অধিকার হরণের মহাকাব্য রচনা করল। গণরোষ ও গণআন্দোলন প্রথমে পূর্ব ইউরোপের সোভিয়েত শিবিরকে ভেঙে ধূলিস্মাৎ করল, তারপর ভেঙে পড়ল সোভিয়েত ইউনিয়নও। সোভিয়েত সাহায্যে অভূতপূর্ব বিকাশের পোস্টার-বয় কিউবার অর্থনীতিও ঘোরালো সংকটের মুখে পড়ল তার অত্যধিক আমদানি-নির্ভরতা বা পর-নির্ভরতার জন্য। ফলে বিকাশ ও ভোগবৃদ্ধির পথ অনুসরণের এই পন্থাও ব্যর্থতারই বেশি জন্ম দিয়েছে, সেই ব্যর্থতা যখন আর ঢেকে রাখা যায়নি, তখন নির্দিষ্ট মতবাদপালনে কোথায় কী খামতি হয়েছে তা নিয়ে বাকবিতণ্ডা লেগেছে।
একুশ শতক অবশ্য এই বৃহৎ শিল্প কেন্দ্রীক অর্থনীতি ও পণ্যভোগবাদের সমস্যাগুলোকে এমনভাবে হাজির করে দিয়েছে যে পন্থা নিয়ে প্রশ্ন বা বিতর্ককে বাতুল করে মূল বিষয়টিকেই খোলাখুলি প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। অর্থাৎ, প্রশ্নটা এখন এরকম: পন্থা বা পদ্ধতি যাই হোক না কেন, বৃহৎ শিল্প কেন্দ্রীক অর্থনীতি ও পণ্যভোগবাদ কি পৃথিবী জুড়ে মানুষের অবস্থার উন্নতি আনতে পারে? প্রশ্নটা এভাবে হাজির হয়ে যাচ্ছে কেন তা আরেকটু ব্যাখ্যা করা যাক।
আরো বড় মাপে ফেঁদে, আরো শক্তি-নিবিড় (energy-intensive) করে বস্তু-উৎপাদন আরো বাড়িয়ে বৃহৎ শিল্প ও পণ্যভোগবাদের কাঠামোয় বিকাশ-উন্নতি-প্রগতির গল্প ফাঁদার পুরোহিতদের মহল থেকে হাজির হওয়া কিছু পরিসংখ্যান থেকেই শুরু করা যাক। বন্যপশু সংরক্ষণ নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক অ-সরকারি সংগঠন (NGO) ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ড (WWF) তার ২০১২ সালে প্রকাশিত ‘লিভিং প্ল্যানেট’ প্রতিবেদনে বলছে যে তৎকালীন পৃথিবীর উৎপাদন, উচ্ছিষ্ট-বর্জন এবং ব্যবহৃত বস্তু ও পরিষেবার সংকুলানের জন্য আমরা দেড়খানা পৃথিবীর বাস্তুসংস্থানিক (ecological) সম্পদ ব্যবহার করছিলাম। অর্থাৎ, পৃথিবীর মানুষ উৎপাদন ও ভোগের জন্য যে পরিমাণ সম্পদ ব্যয় করছিল তা সেই সময়কালে দেড়খানা পৃথিবী হলে তবে পুনরুৎপাদিত হয়ে ভারসাম্যে আসতে পারে। জাতিসংঘের পরিসংখ্যানবিদদের খুব কমিয়ে করা হিসাবও বলছে যে বর্তমান ভোগ ও উৎপাদনের প্রবণতা অব্যাহত থাকলে ২০৩০ সালে আমরা এমন জায়গায় পৌঁছে যাব যখন আমরা দুখানা পৃথিবীর সম্পদ ব্যয় করব। সুতরাং ইতিমধ্যেই আমরা ভোগ ও উৎপাদনের এমন একটা স্তরে বিরাজ করছি যেখানে খুব দ্রুত আমরা বাস্তুসংস্থানিক সম্পদকে নিঃস্ব করে তোলার মধ্য দিয়ে প্রাকৃতিক ভারসাম্য ধ্বংস করে চলেছি। আর সর্বজনীন বিকাশ-উন্নয়ন-প্রগতির ‘স্বপ্ন’ সাকার হলে কী অবস্থা হবে? উত্তর আমেরিকার মানুষের গড় ভোগের হার যদি ধরা হয়, তাহলে গোটা পৃথিবীর মানুষ সেই হারে ভোগ করতে শুরু করলে সাড়ে চারটে পৃথিবীর বাস্তুসংস্থানিক সম্পদ নিঃশেষিত হতে থাকবে। বাস্তুসংস্থানিক সম্পদ ব্যবহারের এই অমিতব্যয়ীতা প্রাকৃতিক ভারসাম্য ধ্বংসের যে সর্বনাশা প্রক্রিয়ায় লাগাতার দ্রুতি সংযোগ করে চলেছে, তার চিহ্ন গোটা পৃথিবীর শরীরে আজ এমনভাবে ফুটে উঠেছে, যা থেকে চোখ ঘুরিয়ে রাখা আর সম্ভব নয়। জঙ্গলের ধ্বংস, জীবাশ্ম জ্বালানীর অতি-ব্যবহারের ফলে বাতাসে জমা কার্বন ও অন্যান্য তাপসঞ্চয়কারী গ্যাস থেকে এনেছে নজিরবিহীন উষ্ণায়ন। পৃথিবীর দুই মেরুতে দ্রুত হারে বরফ গলে সেখানকার প্রাণীদের জীবন-সংকট ডেকে আনার সঙ্গে সঙ্গে গোটা পৃথিবীর সমুদ্রের জলস্তর বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে বিস্তীর্ণ দ্বীপ ও উপকূল অঞ্চলকেও ডুবিয়ে দিতে বসেছে। হিমালয়ের হিমবাহগুলোও ক্রম-সঙ্কুচিত হচ্ছে--- ক্রমে তা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলে বরফের গলন পোষিত নদীগুলোর শুকিয়ে যাওয়া বিস্তীর্ণ উপত্যকা জুড়ে মানুষের জীবিকা ও জীবনধারণের উপায়কে ধ্বংস করে দেবে। ঋতুচক্র এবং আবহাওয়াও পাল্টে যাচ্ছে এমনভাবে যা বহু প্রজাতির জীবের প্রাণধারণের জন্য প্রয়োজনীয় অবস্থা ধ্বংস করে তাদের বিলুপ্তির দিকে ঠেলে দিচ্ছে, মানুষের কৃষিকাজকেও চরম অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিয়েছে। আমাদের জীবনে, আমাদের চারদিকের পরিবেশে, আমাদের চারপাশের গাছপালা-জীবজন্তু-পোকামাকড়দের জীবনেও নিত্য আরো অসংখ্য রূপে এই সংকট ও বিপর্যয় ফুটে উঠছে।
ফলে, মানুষ যদি এমন এক জীবপ্রজাতি রূপেই থিতু হতে না চায় যে প্রকৃতির প্রভু হিসেবে নিজেকে ধার্য করে, প্রকৃতির মধ্যে অন্যান্য প্রাকৃতিক উপাদানের সঙ্গে নিবিড় বৈচিত্র্যময় বাঁধনে বাঁধা তার অস্তিত্বকে অস্বীকার করে, অন্ধ ঔদ্ধত্যে ভোগসম্পদ পুঞ্জীকরণের মধ্য দিয়ে প্রাকৃতিক ভারসাম্যের ধ্বংস, বিভিন্ন জীবপ্রজাতির ধ্বংস এবং শেষাবধি নিজের ভবিষ্যৎ প্রজন্মেরও ধ্বংস ডেকে আনে, তাহলে উৎপাদনবৃদ্ধি-ভোগবৃদ্ধির মধ্য দিয়ে কল্পিত বিকাশ-উন্নয়ন-প্রগতির পথ তাকে পরিহার করতেই হবে। বৃহৎ শিল্প গড়ার শক্তি-নিবিড় বাস্তুতন্ত্র-ধ্বংসী পথে পুঁজিবাদের উদ্ভব ও বিকাশের মধ্য দিয়ে চেহারা পাওয়া পণ্যভোগবাদী ‘উন্নত বিশ্ব’-এর আদলে গোটা বিশ্বকে গড়তে চাওয়ার বদলে প্রকৃতিলগ্ন বিকল্প জীবনাচার-সংস্কৃতি-সমাজরূপের অনুসন্ধান ও পুনর্নির্মাণ করতেই হবে।
উৎপাদন-বৃদ্ধি, ভোগবৃদ্ধি, বিকাশের মধ্যে সমীকরণ তৈরি করে হাজির হওয়া ধারণা ও জ্ঞানরূপগুলো এতটাই আজ সাধারণ ধারণা বা সাধারণ জ্ঞানের কুঠুরিতে সেঁধিয়ে জাঁকিয়ে রাজত্ব করছে যে এই কাজ নিঃসন্দেহে সহজসাধ্য নয়। পুঁজিবাদী বিকাশের বিরোধিতা করতে গিয়েও তাই পুঁজিবাদী ধারণা ও জ্ঞানরূপগুলোর খপ্পরেই নানা বিরোধিতার আয়োজন বন্দি হয়ে পড়ে। উনিশ ও বিশ শতকে পুঁজিবাদের উৎখাত করে নতুন সমাজে উত্তরণের জন্য যেসব আন্দোলন বিকশিত হয়েছিল, মার্কসবাদী সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন তার মধ্যে ব্যাপ্তিতে ও গুরুত্বে প্রধান। তাও এই খপ্পর থেকে বেরোনোর পথ দেখাতে পারেনি। মার্কসবাদী সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন যেভাবে সমাজ-গণতান্ত্রিক রূপ ধরে ইউরোপে কল্যাণকামী রাষ্ট্র পরিচালনাতেই নিজেকে নিঃশেষ করেছে এবং বিপরীতে কম্যুনিস্ট রূপ ধরে রাশিয়া ও চীনে সর্বাধিপত্যবিস্তারকারী এক পার্টির কুক্ষীগত করা রাষ্ট্রের সর্বাত্মক শাসন জারী করে উৎপাদন ও ভোগ বৃদ্ধিকেই মোক্ষ বলে হাজির করেছে, তা কোনো দিক থেকেই বিকল্প হাজির করে না। তা সত্ত্বেও কার্ল মার্কস পুঁজিবাদ, পণ্য ও পণ্যভোগবাদের যে বিশ্লেষণ ও সমালোচনা করে গেছেন, তা ওই দুই রূপ অভিযানের ব্যর্থতা দিয়ে নাকচ হয়ে যায় না, তা ওই দুই রূপ অভিযানের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত আবার আলাদা, এমনভাবেই আমাদের বিচার করতে হবে। সেই বিচারেই এখন এগোনো যাক।
৫
মার্কসবাদীদের কাম্য এমন একটা বিপ্লব যা পুঁজিবাদের মধ্যে চলতে থাকা উৎপাদনী শক্তির বিকাশকে পুঁজিবাদী (এবং স্থানবিশেষে প্রাক-পুঁজিবাদী) উৎপাদনী সম্পর্কের সঙ্গে বিরোধের ঘেরাটোপ থেকে মুক্ত করে তার অবারিত বিকাশের মুখ খুলে দিতে পারে। মার্কসবাদী তত্ত্ব বলে যে উৎপাদনী শক্তির এই অবারিত বিকাশ সমাজতান্ত্রিক সমাজের বস্তুগত ভিত্তি তৈরি করবে, যে ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে শেষাবধি নানা উত্তরণপর্ব পেরিয়ে সেই কাম্য সমাজে পৌঁছানো যাবে যেখানে প্রত্যেকে (সমাজকে) দেবে (অর্থাৎ উৎপাদনী শ্রম করবে) তার সাধ্য অনুযায়ী এবং নেবে (অর্থাৎ ব্যবহার্য বস্তু নেবে) তার চাহিদা অনুযায়ী। চাহিদার অন্তহীন বৃদ্ধির প্রবণতাকে এখানে সদর্থকভাবে দেখা হয় কারণ একদিকে যেমন তা উৎপাদিকা শক্তির অন্তহীন বিকাশের তাগিদকে ত্বরান্বিত করে, অন্যদিকে ব্যবহার্য বস্তুর প্রতুলতা মানব জীবন ও যাপনকে ঋদ্ধতর উন্নততর করে তোলে বলে মনে করা হয়।
কিন্তু উপরোক্ত ধারণাগুলো এখন বাস্তব সংকট পেকে ওঠার মধ্য দিয়ে প্রশ্নের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। পুঁজিবাদের মধ্যে চলা উৎপাদনী শক্তির বিকাশ গোটা বিশ্বের বস্তুগত উৎপাদনকে যে মাত্রায় তুলে নিয়ে গেছে সেখানে দুটো সংকটবিন্দু গভীর থেকে গভীরতর ক্ষতের আকার ধারণ করছে—
১) পৃথিবীর সমস্ত জৈব ও অজৈব উপকরণকে উৎপাদনের কঁাচামালে পরিণত করে তাদের নিষ্কাশন ও ব্যবহার আরো ব্যাপ্ত আরো দ্রুত করতে থাকার মধ্য দিয়ে বহু উপকরণকে তা নাটকীয় দ্রুততায় নিঃশেষিত করে ফেলার মুখে এনে দাঁড় করিয়েছে যা প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্রকে ক্ষয়গ্রস্থ করে ভেঙে পড়ার নজিরবিহীন বিপদের মধ্যে এনে ফেলেছে। এই হারে আর কয়েক দশক চললে পৃথিবীর বিস্তীর্ণ অঞ্চল যে কোনো রূপ প্রাণ ধারণের অযোগ্য পতিত অঞ্চলে পরিণত হবে, ক্রমে গোটা পৃথিবীই প্রাণ ধারণের অযোগ্য গ্রহে পরিণত হওয়ার দিকে এগোবে। কোনো মনুষ্যকল্পিত ‘উন্নততর বিজ্ঞান বা প্রযুক্তি’ এর অন্যথা করতে পারবে না কারণ প্রাণধারণের যোগ্য হয়ে ওঠার প্রাকৃতিক পরিবেশগত শর্তগুলো বহু বহু হাজার বছর ধরে জটিল প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছিল, কয়েক বছরে বা কয়েকশো বছরেও কৃত্রিম মনুষ্যকৃত উপায়ে তা গড়ে তোলা যায় না। সুতরাং পৃথিবীকে পতিতগ্রহে পরিণত করে মঙ্গলগ্রহে সমাজতন্ত্রের সংসার পাতার মূঢ় কল্পসুখকল্পনাকে যদি আমরা রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে হাজির না করতে চাই, তাহলে পুঁজিবাদে চলতে থাকা উৎপাদনী শক্তির বিকাশকে অবারিত করার আকাঙ্ক্ষা আমাদের বর্জন করতে হবে।
২) পঁুজিবাদে উৎপাদনী শক্তির বিকাশ শহরভিত্তিক বৃহৎ শিল্পোৎপাদনে (big industries/ large-scale industries) বস্তুগত উৎপাদনকে কেন্দ্রীভূত করে ও তার চাহিদামতো বনসম্পদ-প্রাণসম্পদ-খনিসম্পদ দখল-খনন-আহরণকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সেই প্রক্রিয়াজাত যে পরিমাণ বর্জ্য ক্রমবর্ধমান হারে বমন করে যাচ্ছে, তা-ও প্রকৃতি-পরিবেশের সংকট ঘনিয়ে তুলছে। উদাহরণস্বরূপ কার্বন নির্গমন ও তজ্জনিত বিশ্ব উষ্ণায়নের সমস্যার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। এই উৎপাদনী শক্তির বিকাশকে অব্যাহত রেখে কোনো প্রযুক্তি বা সংস্কার যে এই সমস্যার সমাধান করতে পারে না তা গত অর্ধশতক জুড়ে কার্বন নির্গমন নিয়ন্ত্রণের বিবিধ বেকার চেষ্টা ও কার্বন-ট্রেডিং নামক জালিয়াতির ছড়িয়ে পড়াই প্রমাণ করে।
পরিবেশ ও প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্র নিয়ে মার্কসের নিজের লেখার আমরা যতটুকু পাই, সেখানে তিনি বলেছিলেন যে পুঁজিবাদ মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যের জৈবিক সম্পর্কটিকে ভেঙে দিয়ে এক বিপাকীয় ফাটল (metabolic rift) তৈরি করে যা প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্রগত সংকটকে প্রযুক্তিনির্ভর সমাধানের চেষ্টার মাধ্যমে একটা ক্ষেত্র থেকে আরেকটা ক্ষেত্রে স্থানান্তরিতই করে মাত্র, সমাধান করতে পারে না, বরং ক্রমশ আরও গভীর করে তোলে। কিন্তু দ্বিতীয় বা তৃতীয় আন্তর্জাতিকের মান্য মার্কসবাদের সংস্করণে মার্কসের এইরূপ চিন্তাগুলি কোনো স্থান পায়নি। তার কারণ বোধহয় এই যে এই চিন্তা পুঁজিবাদের মধ্যে চলতে থাকা উৎপাদনী শক্তির বিকাশকে অবারিত করার অপর মার্কসীয় সিদ্ধান্ত সম্পর্কে সংশয়ের জন্ম দেয়। দ্বিতীয় ও তৃতীয় আন্তর্জাতিকের অভিপ্রেত ছিল যেহেতু এমন এক সংশয়-বর্জিত মার্কসবাদ যা অতিনিশ্চয়তার সঙ্গে প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর হাজির করে অনুসরণকারীকে ‘সর্ব-জ্ঞানের চূড়ান্ত ঘনরূপটির (বা বটিকাটির)’ অধিকারী হিসেবে সর্ব সংশয় থেকে মুক্তি দেয়, তাই তঁারা বিপাকীয় ফাটল সম্পর্কিত ধারণাকে নির্বাসন দিয়ে পুঁজিবাদের মধ্যে চলতে থাকা উৎপাদনী শক্তির অবারিত বিকাশের মাধ্যমে সমাজতন্ত্রের বস্তুভিত্তি গড়ার কর্তব্যকে প্রশ্নহীন করে হাজির করেছিলেন। যে লেনিনের নেতৃত্বাধীন রাশিয়াকে সাধারণত মার্কসবাদী তত্ত্ব প্রয়োগচর্চার সর্বোৎকৃষ্ট ঐতিহাসিক উদাহরণ হিসেবে গণ্য করা হয়, সেখানেও তাই পুঁজিবাদের মধ্যে চলতে থাকা উৎপাদনী শক্তির অবারিত বিকাশসাধনের উপর নিঃসংশয় জোর দেওয়া হয়েছিল, শহরকেন্দ্রীক বৃহৎ শিল্পোৎপাদনে বস্তুউৎপাদন কেন্দ্রীভূত করাকেই বিপ্লবী কর্তব্য হিসেবে ধার্য করা হয়েছিল, এমনকি পুঁজিবাদী দেশে বিকশিত উৎপাদন-ব্যবস্থাপনার উপায়কে (তৎকালীন বিশ্বে টেলরইজম নামে পরিচিত) প্রশ্নহীনভাবে অনুসরণ করার নির্দেশ জারি হয়েছিল। পুঁজিবাদের মধ্যে চলতে থাকা উৎপাদনী শক্তির বিকাশকে অবারিত করার কর্তব্য বর্জন করতে হলে তাই মার্কসবাদের মান্য বা প্রমিত রূপটিকেও ‘মার্কসবাদ সর্বশক্তিমান কারণ ইহা সত্য’– এই সুরক্ষাবলয়ের বাইরে বের করে এনে নির্দ্বিধ সমালোচনাত্মক বিচারের মধ্যে দিয়ে অন্যতর ভাবনার বিকাশের পথ খোলার চেষ্টা করা দরকার।
৬
মার্কসবাদী তত্ত্বে উৎপাদনী শক্তির অবারিত বিকাশের প্রয়োজনীয়তা হাজির করা হয় এদিক থেকে যে তা সমাজতান্ত্রিক সমাজের বস্তুগত ভিত্তি তৈরি করে, কেননা যার যেমন চাহিদা তাকে তেমন (ব্যবহার্য বস্তু) দিতে হলে উৎপাদনকে যে শিখর থেকে উচ্চতর শিখরে তুলে নিয়ে যাওয়া চাই তা উৎপাদনী শক্তির বিকাশকেও শিখর থেকে উচ্চতর শিখরে বিকশিত করা ছাড়া সম্ভব নয়। অর্থাৎ, আমাদের চাহিদা সীমাহীনভাবে বাড়তে হলে উৎপাদনী শক্তিকেও সীমাহীনভাবে বাড়তে হবে। আর আমাদের চাহিদা সীমাহীনভাবে বাড়া জরুরী কেন? কারণ মনে করা হয় যে চাহিদার বৃদ্ধি হল উন্নততর ও পূর্ণতর জীবন ও যাপনের লক্ষণ, বা অন্ততপক্ষে তার আকাঙ্ক্ষার লক্ষণ। এখন এই বিষয়টিকে বিচার করে দেখা যাক।
চাহিদার বৃদ্ধি মানে উন্নততর জীবনের জন্য আকাঙ্ক্ষা এবং তদনুযায়ী পরিমাণে ও রকমে ভোগ্যবস্তু আহরণ ও ব্যবহার বাড়ার মধ্য দিয়ে জীবন ও যাপনের মান উন্নততর হয়— সত্যিই কি তাই? ভোগ্যবস্তুর চাহিদা সেই ভোগ্যবস্তু পাওয়ার মধ্য দিয়ে শেষ হয়না, বরং ঘিয়ের ছিটে দেওয়া আগুনের মতো আরো তীব্র হয়ে ওঠে। একই ভোগ্যবস্তু আরো বা নতুনতর ভোগ্যবস্তুর জন্য অকাঙ্ক্ষা প্রকট হয়। ফলত তা কোনো আকাঙ্ক্ষাতৃপ্তির বোধে পৌঁছে দেয়না, বরং তা নিরন্তর ভোগবুভুক্ষার এক তাড়নাগ্রস্ত অতৃপ্ত অস্তিত্বে বেঁধে রাখে। সেই তাড়না জন্ম দেয় অসংখ্য বিকারের, যেমন, ভোগব্যয় মেটানোর জন্য যে কোনো ভাবে হোক উপার্জনবৃদ্ধির পিছনে ছুটে নিঃশেষিত হওয়ার বিকার, সংবেদনহীন ভোগপ্রদর্শনীর প্রদর্শন ও আস্ফালন দিয়ে আত্মগরিমা জাহির করার অসুখ, ইত্যাদি। এই তাড়নাগ্রস্ত অসুস্থ অস্তিত্বকে নিশ্চয়ই উন্নততর জীবন ও যাপন বলব না।
পুঁজিবাদের সঙ্গে এই তাড়নাগ্রস্ত অসুস্থ যাপনের কী সম্পর্ক তা নিয়ে মার্কস নানা ক্ষুরধার বিশ্লেষণ করে গেছেন। তার অন্যতম হল পণ্যভক্তিবাদ (commodity fetishism) নিয়ে তঁার আলোচনা। মার্কসের আলোচনা অনুসরণ করলে বলা যায় যে সমাজভুক্ত প্রত্যেক মানুষের জীবন অপরাপর মানুষদের সঙ্গে তার উৎপাদনী শ্রম ভাগ করে নেওয়ার সহযোগিতামূলক সম্পর্কের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু এই বাস্তব নির্ভরশীলতা আড়ালে চলে গিয়ে উপলব্ধির নাগালের বাইরে চলে যায় যখন পুঁজিবাদী সমাজে পণ্যবিনিময়-পণ্যআহরণের মধ্য দিয়ে গোটা সামাজিক সম্পর্ককে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠা মানুষ পণ্যকেই দেখতে শুরু করে তার একমাত্র প্রয়োজনের বস্তু হিসেবে এবং তা আহরণের জন্য অন্য পণ্য বা অর্থ নিজ দখলে পুঞ্জীভূত করাকেই যথেষ্ট মনে করে। এর মধ্য দিয়ে মানুষের সঙ্গে মানুষের বাস্তব সম্পর্ক আড়ালে চলে যায়, তা চেতনায় প্রতিস্থাপিত হয় পণ্যের সঙ্গে পণ্যের সম্পর্ক দিয়ে। পণ্যই জীবনের ও যাপনের উৎকর্ষের বা অপকর্ষের কারণ হিসেবে প্রতিভাত হতে থাকে।
এই পণ্যভক্তিবাদ পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিস্তৃতি ও গভীরতালাভের সঙ্গে সঙ্গে সর্বাত্মক আধিপত্য বিস্তার করে। সেই আধিপত্যের কাছেই চেতনাকে বন্ধক রাখা হয় না কি যখন ভোগ্যবস্তুর প্রতুলতা/অপ্রতুলতার উপর জীবন ও যাপনের উৎকর্ষ/অপকর্ষকে নির্ভরশীল বলে ভাবা হয়? যে সমাজতন্ত্রমুখী উত্তরণকালীন সমাজে পণ্যের বিলোপসাধনের প্রক্রিয়া সূচিত হওয়ার কথা, সেই সমাজে যখন জীবন ও যাপনের উন্নতির জন্য পুঁজিবাদের প্রতিষ্ঠিত পথেই বস্তু উৎপাদনকে আরো আরো বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে চাহিদা পূরণ ও সম্প্রসারণের কথা বলা হয়, পুঁজিবাদী দেশগুলোর সমস্তরে পৌঁছে তাকে ছাপিয়ে যাওয়ার লক্ষ্য ঘোষিত হয়, তখন সামাজিক সম্পর্ক ও জীবন সম্পর্কে পণ্যভক্তিবাদী মনোভাবের ধারাবাহিকতা কি পণ্যবিলোপের বিপরীত পথেই হাঁটে না?
তাছাড়া একটি বস্তুগত সীমার প্রশ্নও এই একুশ শতকে এসে অতি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। পশ্চিম ইউরোপ বা উত্তর আমেরিকার কোনো নাগরিকের এখন যে প্রাত্যহিক গড় ভোগ-চাহিদা, সেই মাপে পৃথিবীর বর্তমান সমস্ত মানুষকে তুলে আনতে হলে সেই চাহিদা পুরণের জন্য কঁাচামাল যোগান দিতে একটি পৃথিবী নয়, খান-দশেক পৃথিবী কয়েক দশকের মধ্যেই নিঃস্ব পতিতভূমিতে পরিণত হবে। সুতরাং চাহিদা ও ভোগবৃদ্ধির মধ্য দিয়ে সামূহিক জীবন ও যাপনের ‘উন্নতিসাধন’ বস্তুগতভাবেও অসম্ভব। বরং তার বিপরীতটাই বাধ্যতামূলক হয়ে উঠেছে। মানুষ যদি গোটা পৃথিবীর বাস্তুতন্ত্রকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে নিয়ে যাওয়া বিপজ্জনক অবিমৃষ্যকারী প্রজাতি হিসেবে নিজেদের যাত্রা শেষ না করতে চায়, তবে মানুষকে তার চাহিদা ও ভোগ বাড়ানোর বদলে ব্যাপকভাবে কমাতে হবে এবং ভোগবৃদ্ধির মধ্য দিয়ে সুখের আলেয়ার পশ্চাদ্ধাবন করার বদলে জীবনের উৎকর্ষ/অপকর্ষ সম্বন্ধে বিকল্প ধারণার সন্ধান করতে হবে। পৃথিবীর সমস্ত জৈব ও অজৈব উপাদান, সমস্ত অন্যান্য প্রাণীপ্রজাতি কেবল মানুষের বস্তু-উৎপাদনের কঁাচামাল হিসেবে মানুষের ভোগচাহিদা মেটানোর জন্যই উৎসর্গিত, এই স্থূল সংকীর্ণ কর্তৃত্ববাদী অহমিকা ছেড়ে মানুষকে প্রকৃতির অন্য সমস্ত বস্তু ও প্রাণের সঙ্গে নিজের জৈবিক সম্পর্কবন্ধনটিকে পুনরাবিষ্কার করতে হবে। কোনও এক কল্পসুখস্বর্গে (অর্থাৎ সমাজতন্ত্রে) পৌঁছানোর পর আপনা থেকেই (অর্থাৎ সমাজের অর্থনৈতিক ভিত্তির পরিবর্তনের ফলস্বরূপ) এই সব হয়ে যাবে এমন ছদ্মনিশ্চয়তা নিয়ে আমরা যদি কেবল ওই অর্থনৈতিক ‘উন্নতি’ বা পরিবর্তনসাধনেরই করণিকগিরি করি তাহলে কল্পসুখস্বর্গে পৌঁছানোর বদলে পুঁজিবাদের গর্ভেই চরকিপাক ঘুরে যাব। সুতরাং পুঁজিবাদের বিরোধিতা বা পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের যে কোনো প্রচেষ্টায় আজই পণ্যভক্তিবাদ ও মানুষের প্রজাতিগত অন্ধ অহংকারকে বর্জন করে বিকল্প ভাবনা-অবস্থানে পৌঁছানোর তাত্ত্বিক-ব্যবহারিক সংগ্রাম জারি করা দরকার। মান্য মার্কসবাদের স্থূল-বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি তার বস্তুবাদের দোহাই দিয়ে এসবকিছু নিয়েই মাথা ঘামাতে নারাজ। তাই মান্য মার্কসবাদ পুঁজিবাদ-বিরোধিতাকে কেবল একটি পার্টির কর্মসূচী নির্ধারণের পরিসরে সীমায়িত করে দিয়েছে, জীবন ও যাপনের বহুভঁাজ পরিসরে পুঁজিবাদ-বিরোধিতার সমস্ত অতি জরুরী প্রশ্নগুলোই ‘এখন বিবেচ্য নয়’–য়ের পর্যায়ে ঠেলে দিয়েছে। তাই তা এত যান্ত্রিক হয়ে উঠেছে। পুঁজিবাদ সম্পর্কে মার্কসের সমালোচনাত্মক বিচারে আমরা সর্বস্ব উজাড় করে দেওয়া আবেগের স্ফূরণ দেখতে পাই, অথচ তঁার নাম করে, তঁার উত্তরাধিকার বওয়ার আছিলায়, তঁার চিন্তার ‘বিশুদ্ধতা’ রক্ষার ছলে প্রচলিত ঘরানার মার্কসবাদীরা বিমূর্ত কিছু ধূসর ফরমুলার স্তোত্রকারী হিসেবে নিজেদের ক্রমশঃ এক মতবাদসর্বস্ব আচার-অনুষ্ঠান-পালনকারী প্রাণহীনতায় নিমজ্জিত করছে।
৭
মার্কসবাদের মতবাদিক গঠনকাঠামোয় সমাজবিকাশের ধারা বা ‘প্রগতি’ সম্পর্কে তত্ত্ব অন্যতম প্রধান খুঁটি হিসেবে বিরাজমান। এই তত্ত্বানুযায়ী সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গিকে হাজির করা যায় একটি সারণির আকারে। সারণিটি এইরকম:
অনুন্নত |
উন্নত |
প্রকৃতি |
সভ্যতা |
ইওরোপ-বহির্ভূত সভ্যতা |
ইওরোপীয় সভ্যতা |
বনাঞ্চল |
গ্রাম |
গ্রাম |
নগর |
অরণ্য/চারণভূমি |
কৃষিক্ষেত্র |
কৃষিক্ষেত্র |
কল-কারখানা |
শিকার-সংগ্রহজীবিকা/ পশুচারণ |
কৃষিকাজের অর্থনীতি |
কৃষিকাজের অর্থনীতি বনবাসী শিকারী/সংগ্রহজীবী কৃষক |
শিল্প-অর্থনীতি কৃষক শিল্পে নিযুক্ত শ্রমিক/ কর্মচারী/ আধিকারিক |
সারণির দুদিকের মধ্যে একদিককে ‘অনুন্নত’ আর অপরদিককে ‘উন্নত’ বলে নির্ধারণ করার মধ্য দিয়ে যেমন দুদিককে একটা আপেক্ষিক তুলনামূলক নিকৃষ্ট-প্রকৃষ্ট সম্পর্কে বাঁধা হয় (যেমন: সভ্যতার তুলনায় প্রকৃতি নিকৃষ্ট, ইওরোপীয় সভ্যতার তুলনায় ইওরোপ-বহির্ভূত সভ্যতা নিকৃষ্ট, ইত্যাদি), তেমনই কাঙ্খিত পরিবর্তন বা বিবর্তনের একটি ক্রমকে ‘স্বাভাবিক' হিসেবে হাজির করা হয় (যেমন: প্রকৃতির উপর নিয়ন্ত্রণ/আধিপত্য কায়েম করে সভ্যতায় ‘বিবর্তিত’ হওয়া, ইওরোপ বহির্ভূত সভ্যতা থেকে বিবর্তিত হয়ে ইওরোপীয় সভ্যতায় ‘উন্নত’ হওয়া ইত্যাদি)। এই পরিবর্তন বা বিবর্তনের একধরনের ক্রম হাজির হয়, যেমন:
ক্রমোন্নতির স্বাভাবিক ও স্বতঃসিদ্ধ ক্রম হিসেবে, অর্থাৎ যে কোনও সমাজের বিকাশের স্বাভাবিক নিয়ম হিসেবে এটি উপস্থিত হয়।
এই বিশ্ববীক্ষাকে এর ঐতিহাসিক উৎস বা জন্মসূত্রের সূত্রে আমরা ‘পাশ্চাত্য পুঁজিবাদী উন্নয়নী বিশ্ববীক্ষা’ বলতে পারি। পশ্চিম ইওরোপে তথাকথিত ‘শিল্পবিপ্লব’ ও পুঁজিবাদী শিল্পোৎপাদন কেন্দ্রীক সমাজের উদ্ভবের লগ্নে ষোল-সতের শতক জুড়ে এই বিশ্ববীক্ষা দানা বেঁধেছিল। প্রকৃতিকে কেবলমাত্র কঁাচামালের ভাণ্ডার হিসেবে গণ্য করে কীভাবে তা আরও দ্রুত ও আরও ব্যাপক ভাবে নিঙড়ে নিয়ে শিল্পোৎপাদন যজ্ঞকে অন্তহীন বিস্তারের পথে ঠেলে নিয়ে যাওয়া যায়, সেটাই হয়ে উঠেছিল চালিকাশক্তি। প্রথমে পশ্চিম ইওরোপের দেশগুলোর মধ্যের গ্রামীণ সংস্কৃতি এর ধাক্কায় ভেঙে পড়েছিল, গ্রামের মানুষ দলে দলে সর্বহারা, আশ্রয়হীন ভবঘুরে, হতদরিদ্রে পরিণত হয়েছিল আর তাদের সহায়সম্বল প্রকৃতির সমস্ত ধনকে নিঙড়ে, উপড়ে, পুঞ্জীভবন করে যন্ত্র-শিল্পোৎপাদনের ভিত পাতা হয়েছিল। তারপর এই পাশ্চাত্য দেশগুলির উপনিবেশ বিস্তারের মধ্য দিয়ে ক্রমে এই প্রক্রিয়া অন্যান্য মহাদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার আদিবাসী সমাজ-সংস্কৃতি নিশ্চিহ্ন করার কাজে ইওরোপীয় উপনিবেশ-বিস্তারকদের গোলা-বারুদ-বন্দুকের অপ্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি লাখ লাখ আদিবাসীদের ‘শিকার' করে জনজাতির পর জনজাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল। সেই মৃগয়াক্ষেত্রে পশ্চিম ইওরোপের প্রতিবিম্ব হিসেবে ‘নয়া আধুনিক সমাজের’ পাট বসিয়েছিল ইওরোপীয় দখলদাররা। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়েছে অস্ট্রেলিয়া মহাদেশে, আফ্রিকা মহাদেশে এবং ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপপুঞ্জে। মানুষ মারার অস্ত্রকে অত্যুন্নত করে ও মানুষ মারাকে নিঃসংকোচ হেলাফেলার কাজে পরিণত করে মহাদেশের পর মহাদেশে দখলদারি কায়েম করা এই পশ্চিমী ইওরোপীয়রা নির্ধারণ করলেন যে তঁাদের এই ‘সাফল্যের’ কারণ তঁাদের নিজ সভ্যতার সর্বোৎকৃষ্টতা। অর্থাৎ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকা ও অসংখ্য দ্বীপপুঞ্জের জনজাতিরা তঁাদের খুনে আক্রমণের সামনে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে এই কারণে যে সেই সব জনজাতিগুলো ছিল পশ্চাৎপদ, সেই সব জনজাতিদের সভ্যতা ছিল নিকৃষ্ট মানের। অর্থাৎ, পশ্চিমা ইওরোপীয়রা এই অসংখ্য মানুষকে খুন করে, মানবসমাজ-সভ্যতার এই অসংখ্য বৈচিত্র্যপূর্ণ রূপকে ধ্বংস করে আসলে সভ্যতার সর্বোৎকৃষ্ট রূপটাকেই প্রতিষ্ঠিত করার গুরুদায়িত্ব পালন করছেন! (এভাবে যুক্তিনির্মাণ করার মধ্য দিয়েই বুঝি কোনও খুনি স্বভাবঘাতক হয়ে ওঠে!)
এভাবে এক উচ্চাবচ ধাপবন্দি কাঠামোয় সাজিয়ে মানবসমাজ-সংস্কৃতির বিভিন্ন রূপকে দেখাটাকেই ‘স্বাভাবিক’ বলে হাজির করেছে এই বিশ্ববীক্ষা। এই নির্মিত ‘স্বাভাবিকতা’ অনুযায়ী পশ্চিম-ইওরোপীয় সমাজ-সংস্কৃতি উচ্চাবচ ধাপবন্দি কাঠামোর শীর্ষে অবস্থিত এবং অন্যান্য সমাজ-সংস্কৃতিগুলো ‘অনুন্নতি’-র বিভিন্ন চিহ্ন বহন করে তলাকার ধাপগুলোয় ক্রমবিন্যস্ত। আর এই ধাপবন্দি কাঠামোর গতিসূত্র হলো অনুন্নতি থেকে উন্নতির দিকে যাত্রা। ফলে অন্য সমস্ত সমাজ-সংস্কৃতি নিজেকে লোপ করার মধ্য দিয়ে পশ্চিম-ইওরোপীয় সমাজ-সংস্কৃতির অনুকরণে নিজেকে পুনর্বিন্যস্ত করবে, এটাই হলো নিয়ম। আর এই নিয়ম অনুযায়ী গতিকে ত্বরান্বিত করার জন্য কিছু গাজোয়ারি-খুনখারাপি-ধ্বংস-তাণ্ডব চালাতে হলে সংকোচের কিছু নেই কারণ লক্ষ্য যদি ঠিক থাকে, সেই লক্ষ্যে পৌঁছানোর উপায় নিয়ে সঠিক-বেঠিক আলোচনার কি কোনও মানে হয়? এই বিশ্ববীক্ষাকে জপের মালা করেই চলেছে কালাপাহাড়ি তাণ্ডব। বিভিন্ন আদি জনজাতির প্রকৃতিলগ্ন সমাজ-সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে, তাদের প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারের অধিকার খর্ব করে জল, জঙ্গল, জমি, মাটি, মাটির তলদেশ সমস্তকিছু গোষ্ঠীগত অধিকার বা গোষ্ঠীগত মালিকানা থেকে কেড়ে নিয়ে ব্যক্তিগত মালিকানা বা রাষ্ট্রীয় মালিকানার অধীনে দখল করা হয়েছে— যে ব্যক্তি বা রাষ্ট্র সেই সম্পদ নিঙড়ে বাণিজ্যিক পুঁজিবাদী উৎপাদন করতে উন্মুখ। পরিবর্তন বা বিবর্তনের যে চারটি ক্রমকে (ক্রম ১ থেকে ক্রম ৪) উপরে উল্লেখ করা হয়েছে তা এই লুন্ঠনেরই চারটি পথ। তথাকথিত সমাজতন্ত্র-অভিমুখী রাশিয়া বা চীনেও কৃষক ও অ-পুঁজিবাদী সমাজরূপে অভ্যস্ত বিভিন্ন জনজাতির উপর রাষ্ট্রীয় শক্তি ব্যবহার করে এই লুন্ঠন-নিশ্চিহ্নকরণ প্রক্রিয়া চলেছে।
মার্কস পুঁজিবাদের উৎপত্তি বর্ণনা করতে গিয়ে এই প্রক্রিয়াকে ‘আদিম পুঞ্জীভবন’ (primitive accumulation) বলে অভিহিত করেছিলেন। পুঁজি কেন্দ্রীভূত করার এই পদ্ধতি রুশ বিপ্লবের পর সমাজতন্ত্র গঠনের জন্যও এত গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়েছিল যে বলশেভিক অর্থনীতি-বিশেষজ্ঞ প্রিওব্রাঝেনস্কি তঁার মান্য বইয়ে ‘সমাজতান্ত্রিক আদিম পুঞ্জীভবন’ (socialist accumulation) নাম দিয়ে তা কীভাবে মূলত কৃষকদের সম্পদ রাষ্ট্রের অধীনে কেন্দ্রীভবন ও শিল্পপণ্যের তুলনায় কৃষিপণ্যের দামকে জোর করে নামিয়ে রাখার মধ্য দিয়ে হতে পারে তা আলোচনা করেছিলেন। পার্টির মধ্যে ক্ষমতার লড়াইয়ে পরাভূত হয়ে প্রিওব্রাঝেনস্কি পরবর্তীতে অবাঞ্ছিততে পরিণত হয়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য হলেও, তঁার ‘সমাজতান্ত্রিক আদিম পুঞ্জীভবনের’ নিদান অবাঞ্ছিত হয়নি। ১৯৩০-য়ের দশকে স্তালিনের নেতৃত্বে রুশ কম্যুনিস্ট পার্টি সোভিয়েত রাশিয়ার গ্রামাঞ্চলে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও লু্ন্ঠন বল্গাহীন করে কৃষিতে যে ‘সমবায়িকরণ’ (collectivisation) প্রক্রিয়া হাসিল করেছিল, তা এই ‘সমাজতান্ত্রিক পুঞ্জীভবন' তত্ত্বেরই প্রয়োগ বলা যায়।
ভারতীয় উপমহাদেশে প্রধানত ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসনের মধ্য দিয়ে এই ‘পাশ্চাত্য উন্নয়নী বিশ্ববীক্ষা’ ও তার লুঠের রাজ কায়েম হয়েছিল। এই শাসনের মধ্য দিয়ে এমন এক রাষ্ট্র, রাষ্ট্রীয় নীতি ও কলকৌশল, উন্নয়নী দিশা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, জ্ঞানচর্চা ও তার প্রয়োগের এমন এক পদ্ধতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যা ইংরেজ শাসকরা চলে যাওয়ার পরেও নিজেদের আধিপত্য বজায় রেখেছে। বিভিন্ন ধুয়োর জাতীয়তাবাদকে স্বাধীনতা-উত্তর ভারতীয় শাসকরা বা প্রভাবশালীরা নিজেদের হাতিয়ার করলেও উন্নয়নী বীক্ষায় তারা পাশ্চাত্য উন্নয়নী বিশ্ববীক্ষা-কেই প্রশ্নাতীত ও স্বাভাবিক বলে ধরে নিয়ে চলেছেন। কম্যুনিস্ট বা মার্কসবাদী মহলেও এই বিশ্ববীক্ষাকে প্রশ্নাতীত ও স্বাভাবিক বলে ধরে নিয়ে চলা হচ্ছে।
পুঁজিকে কেন্দ্রীভূত করার এই বিধ্বংসী প্রক্রিয়াকে মতবাদিক নির্ধারণের মাধ্যমে আপন করে নেওয়ার মধ্য দিয়ে প্রচলিত মার্কসবাদ পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিকল্প অনুসন্ধান ও গঠনের অনুশীলনের বদলে পুঁজিবাদী ব্যবস্থারই একটি অন্যতর রূপ নির্মাণের অনুশীলনে পরিণত হয়েছে।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে রুশ বিপ্লবী ভেরা জাসুলিচের চিঠির প্রত্যুত্তরে লেখা মার্কসের চিঠিতে আমরা মার্কসের এমন ভাবনার প্রকাশ দেখতে পাই যেখানে মার্কস বিপ্লবোত্তর রাশিয়ায় (তখনও রুশ বিপ্লব হয়নি) পশ্চিমী কেন্দ্রীভূত বৃহদায়তন শিল্পের পরিবর্তে কৃষকদের বিকেন্দ্রীভূত গ্রামীণ কমিউনগুলোর উপর ভিত্তি করে সমাজতন্ত্রের পথে এগোনোর সম্ভাবনার কথা বলেছিলেন। সুতরাং মার্কসের ভাবনায় পশ্চিমী পুঁজিবাদী উন্নয়নী বিশ্ববীক্ষার প্রভাবই কেবল ছিল না, তার দিকে সংশয়ী চোখে তাকানো অন্যতর উপাদানও ছিল। মার্কসবাদীরা অবশ্য মার্কসের ভাবনার এই সংশয়ী অনেকান্ততাকে উপেক্ষা করেই তাদের ‘বৈজ্ঞানিক মতবাদ’ নির্মাণ করেছে।
৮
মার্কসের চিন্তার অনেকান্ততাকে বিসর্জন দিয়ে মার্কসবাদের একশিলা-রূপী মতবাদিক গঠন তার সমাজ-গণতান্ত্রিক ও কম্যুনিস্ট এই উভয় রূপে থিতু হওয়ার মধ্য দিয়ে ক্রমশ পুঁজিবাদের প্রকৃত বিকল্প উপস্থাপনায় অপারগ হয়ে উঠেছে। তৃণমূলস্তরে ব্যাপক সাধারণজনের জীবন-জীবিকা-অস্তিত্ব যেখানে বিকাশ-উন্নয়ন-প্রগতির ধ্বংসলীলায় বিপন্ন, সেখানে স্বতঃস্ফূর্ত নানা প্রতিরোধের মধ্য দিয়ে অবশ্য এই একুশ শতকের গোড়ায় দাঁড়িয়ে মতবাদিক বৈকল্যের বাইরে বিকাশোন্মুখ বিভিন্ন বিকল্প ধারণা ও কর্মপন্থা ফুটে উঠছে। সেখানেই বোধহয় আগামীর প্রাণ স্পন্দিত হচ্ছে। আমরা এখন সেইদিকে মনোনিবেশ করব।
জাপাতিস্তা আন্দোলন, মেহিকো
১৯৯৪ সালের পয়লা জানুয়ারি মধ্যরাতে মেহিকো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার সরকারের স্বাক্ষরিত উত্তর আমেরিকা মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (North America Free Trade Agreement, সংক্ষেপে NAFTA) বলবৎ বলে ঘোষণা হয়। মেহিকোর তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি এই ঘোষণা করে বলেন যে এর মধ্য দিয়ে মেহিকো উন্নত প্রথম বিশ্বের মহলে প্রবেশ করতে চলেছে। মেহিকোর বিস্তীর্ণ অঞ্চলের খনিজ সম্পদকে দ্রুত অবাধ উত্তোলনের জন্য মার্কিনী ও কানাডার বড় বড় খনি-কোম্পানীগুলোর হাতে তুলে দেওয়া, খাদ্য ও কৃষিক্ষেত্রে বড় বাণিজ্য সংস্থাগুলোর অবাধ ব্যবসার সুযোগ করে দেওয়া সমেত বিকাশ-উন্নয়ন-প্রগতির আদর্শায়িত পদক্ষেপগুলো সব এই চুক্তির মধ্যে সামিল করা হয়েছিল, মেহিকোর রাষ্ট্রপতিও তাই উন্নত দেশ হয়ে ওঠার সেই আদর্শায়িত পথ নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে দ্রুত লক্ষ্যে পৌঁছানোর স্বপ্নবাণী আউড়েছিলেন।
মেহিকোর দক্ষিণ-পশ্চিম ভাগের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের আদিবাসী জনজাতিরা সরকার-পোষিত এই স্বপ্নে সামিল হয়নি। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে যে পাহাড়-জঙ্গল-নদী-মাটি ধাত্রীস্নেহে তাদের লালন-পালন করেছে, ব্যবসায়ী শক্তি ও রাষ্ট্রশক্তির ঝটিকা আক্রমণে সেই ধাত্রীঘর থেকে উচ্ছেদ হওয়ার সিঁদুরে মেঘ তাদের মনে ঘনিয়ে উঠেছিল। রাষ্ট্রপতির ঘোষণার পর দুই ঘন্টাও কাটেনি। তার মধ্যেই হাজার হাজার আদিবাসী ম্যাচেট (বিশেষ রকমের ভারী চওড়া ছুরি), ভারী গদা-র মতো পরম্পরাগত অস্ত্র ও অল্প কিছু বন্দুক নিয়ে বিস্ময়করভাবে সুসংবদ্ধ রূপে রাস্তায় নেমে আসে এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই চিয়াপাস অঞ্চলের প্রধান সাতটি জনপদ দখল করে নেয়। এই দখল অভিযানের প্রথম সংঘাতে চব্বিশ জন পুলিশ অফিসার ও অজানা সংখ্যক বিদ্রোহী আদিবাসীদের প্রাণ দিতে হয়েছিল।
চিয়াপাস অঞ্চলের দখল নেওয়া বিদ্রোহীরা ঘোষণা করেছিল যে তারা কেবল রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করছে না, তারা বিদ্রোহ করছে পাঁচশো বছর ধরে চলে আসা নিপীড়নের বিরুদ্ধে, চল্লিশ বছর ধরে চলে আসা ‘বিকাশ-উন্নয়ন’-এর বিরুদ্ধে। তাদের কেন্দ্রীয় স্লোগান ছিল: ‘Basta!’, স্থানীয় ভাষায় যার মানে ‘যথেষ্ট হয়েছে, আর নয়!’ নিজেদের দখল বজায় রেখে স্বশাসন জারী করার উদ্দেশ্যে তারা নিজেদের সংগঠনের নাম ঘোষণা করেছিল ‘জাপাতিস্তা জাতীয় মুক্তি বাহিনী’ (Ejecrito Zapatista de Liberacion Nacional, সংক্ষেপে EZLN)।
পরের দিনই মেহিকোর রাষ্ট্রপতি কার্লোস সালিনাস এই বিদ্রোহকে অস্ত্রবলে গুঁড়িয়ে দিতে বিপুল আক্রমণ শুরু করেন। ১৫,০০০ রাষ্ট্রীয় সেনা ফরাসী ট্যাঙ্ক, মার্কিনী হেলিকপ্টার ও সুইজারল্যান্ডের বিমানযান এবং অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ও যুদ্ধপ্রযুক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এই রাষ্ট্রীয় আক্রমণকারীরা হিংসোন্মত্ততায় কোনো খামতি রাখেনি। যুদ্ধে জড়িত নয় এমন নাগরিকদের উপরও যথেচ্ছ অত্যাচার, গুমখুন ইত্যাদি চলেছে আদিবাসীদের প্রতিবাদ করার শিরদাঁড়াটাকেই ভেঙে তুবড়ে দিতে। কিন্তু তা ভাঙা যায়নি। কয়েক দিনের মধ্যেই লাখে লাখে আদিবাসী মানুষ বিদ্রোহীদের সমর্থনে নেমে আসে সরকার ও রাষ্ট্রীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলে নিজেদের স্বশাসনকে মূর্ত করে তোলার জন্য। ‘বিকাশ নয়, উন্নয়ন নয়, চাই স্বাধীনতা, ন্যায় ও গণতন্ত্র’- এই হয়ে ওঠে কেন্দ্রীয় দাবি।
জাপাতিস্তা আন্দোলন নামে পরিচিত হয়ে ওঠা এই আন্দোলনের প্রতিনিধি হিসেবে EZLN-এর হাজির করতে থাকা অবস্থানগুলোও বিস্ময়কর কিছু ভাবনাকে সামনে নিয়ে আসে, যেমন:
রাষ্ট্রীয় আক্রমণ প্রতিরোধ ও স্বশাসন নির্মাণের এই অভিনব উদ্যোগ তৃণমূলস্তরে আদিবাসী জনজাতিদের স্বতঃস্ফূর্ত সার্বিক অংশগ্রহণের দরজা খুলে দিয়ে যে প্রাণশক্তি ও ঐক্যবদ্ধতার উদ্বোধন ঘটিয়েছিল, সেই শক্তির সামনে আগ্রাসী রাষ্ট্রশক্তিকে পিছু হটে নিজ আগ্রাসন অন্য পথে ধাবিত করানোর পরিকল্পনা করতে হয়েছে। যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে আলোচনার কথা ঘোষণা করে চিয়াপাসের জনজাতিদের সামনে বারবারই নানাভাবে তাদের স্বশাসনকে নানা কায়দায় বাধা ও অসুবিধার মধ্যে ফেলে আন্তর্জাতিক বাজার-অর্থনীতির উপর-জমককে উন্নয়নের টোপ হিসেবে হাজির করা হচ্ছে। আদিবাসী জনজাতিরা এখনও, এই তিরিশ বছর পরও, সেই টোপ প্রত্যাখ্যান করে নিজেদের স্বশাসনকে নানাভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে গড়ে তোলার পথেই রয়েছে, সেই পথে বন্ধুত্বপূর্ণ মত-বিনিময় ও সহায়তার জন্য বিশ্বের অন্যান্য আদিবাসী জনজাতি, পুঁজিবাদ-সমালোচক, পরিবেশবাদী, গণতন্ত্রাকাঙ্খী ও বিপ্লবীদের সঙ্গেও নিয়মিত যোগাযোগ গড়ে তোলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
বুয়েন ভিভির, বলিভিয়া-ইকুয়েদোর-পেরু
‘বুয়েন ভিভির’--- লাতিন আমেরিকায় আদিবাসী জনজাতি ও সাধারণ নাগরিকদের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ছড়িয়ে পড়া এই শব্দবন্ধটির বাংলা ভাষান্তর করতে চাইলে ‘ভালো ভাবে বাঁচা’ করা যেতে পারে, যদিও তা দিয়ে মূল শব্দবন্ধটির সঙ্গে যুক্ত বিবিধ তাৎপর্যকে কখনোই ধরা যাবে না। ইকুয়েদোরের আমাজন অঞ্চলের কিচওয়া জনজাতির বুদ্ধিজীবী-সমাজকর্মী মোনিকা চুজি, পেরুর জনজাতীয় সংস্কৃতি ও প্রকৃতিভাবনার প্রচারক গ্রিমালডো রেনগিফো এবং উরুগুয়ের গবেষক, তাত্ত্বিক ও আন্দোলনকর্মী এদুয়ার্দো গুদিনাস ২০১৯ সালে প্রকাশিত ‘Pluriverse: A Post-Development Dictionary’ বইতে বুয়েন ভিভির কী তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লিখেছিলেন:
‘বুয়েন ভিভির’ বা ‘ভালো ভাবে বাঁচা’ পদটি দক্ষিণ আমেরিকার পরিপ্রেক্ষিতস্থ এমন একগুচ্ছ ধারণা-ভাবনাকে প্রকাশ করে যাদের সাধারণ দিকটি হল বিকাশ-উন্নয়ন সহ আধুনিকতার কেন্দ্রীয় উপাদানগুলোকে আমূল প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে একইসঙ্গে তাদের নির্ধারণ করা সীমা পেরিয়ে গিয়ে বিকল্প হাজির করা। ভালো থাকা বা ভালো জীবন সংক্রান্ত পশ্চিমী বোঝাবুঝির সঙ্গে তার কোনো মিল নেই, তাকে কোনো মতবাদ বা সংস্কৃতি বলেও বর্ণনা করা যায় না। জ্ঞান, অনুভূতি ও আধ্যাত্মিকতার জগতে গভীরতর এক পরিবর্তনকে তা প্রকাশ করে, মানুষ ও না-মানুষদের মধ্যে সম্পর্ককে অন্য রূপসমূহে বোঝার এমন এক তত্ত্ববিদ্যক (ontological) সম্ভাবনা তা খুলে দেয় যা সমাজ ও প্রকৃতির মধ্যে আধুনিকতার টানা বিভাজনরেখা মানে না। নিত্য নির্মিত হতে থাকা এমন এক বহুত্বমুখী পদ বিভিন্ন স্থানে ও অঞ্চলে নির্দিষ্ট ভাবে মূর্ত হয়ে ওঠে। আদিবাসী জনজাতীয় নানা উপাদানের সঙ্গে আধুনিকতারই ভিতর থেকে উঠে আসা আধুনিকতার নানা সমালোচনার সঙ্করও করে চলে সে, এ বিষয়ে তার কোনো গোঁড়ামী নেই।
বলিভিয়া ও ইকুয়েদোরের রাষ্ট্র ১৯৯০ –এর দশকে বিকাশ-উন্নয়নের নামে যেভাবে বিপুলাকৃতি খনিপ্রকল্পের জন্য জনজাতিদের থেকে জমি কেড়ে নেওয়া এবং আমাজন জঙ্গল ধ্বংস করে খনিজ তেল উত্তোলনের পরিকল্পনা প্রয়োগ করতে নামে, তা প্রতিরোধ করার বিভিন্ন প্রচেষ্টা থেকেই ক্রমশ ‘বুয়েন ভিভির’ দানা বেঁধেছে। ২০১২ সালে ইকুয়েদোর-এর আদিবাসী-জনজাতীয় নেতা অ্যালবার্টো অ্যাকোস্তা-র দ্বারা করা সূত্রায়নের মধ্য দিয়ে তা একটি সংহত রূপ পায়। কিন্তু সংহত মানেই তা কোনো একশিলা রূপ নয়। বিভিন্ন জনজাতিদের নিজস্ব পরম্পরাগত জ্ঞান-বোধ-স্বজ্ঞা-কে পুনরুদ্ধার ও পুনর্প্রয়োগ করার প্রয়াস ‘বুয়েন ভিভির’-এর মধ্যে বিবিধ-বৈচিত্র্যময় ভাবনা- চিন্তার ধারাকে অন্তর্বুননে বুনে দিয়েছে। বলিভিয়ার আয়মারা জনজাতির সুমা কামানা (suma qamana), বলিভিয়ার গুয়ারানি জনজাতির নান্দে রেকো ও সুমাক কাওসে (nande reko, sumac kawsay), ইকুয়েদোরের কিচওয়া জনজাতির আলিন কাওসে (allin kawsay), ইকুয়েদোর ও পেরুর জনজাতিদের শুর ওয়ারাস (shur waras), চিলির মাপুচে জনজাতির কুমে মোরগেন (kume morgen)--- এমন নানা বৈচিত্র্যপূর্ণ রীতি-পরম্পরা ‘বুয়েন ভিভির’ নামের অধীনে মিলিত হয়েছে।
এই বহু বিচিত্রের মিলনে সাধারণ দিক হিসেবে উঠে এসেছে প্রগতির ধারণা ও একক সর্বজনীন ইতিহাসের ধারণার বিরোধিতা। উৎপাদনী শক্তির বিকাশের মাধ্যমে ক্রমোন্নত সমাজরূপে যাত্রার একরৈখিক প্রগতিপথে বিন্যস্ত করে ইতিহাস-নির্মাণের আধুনিক প্রবণতা তারা প্রত্যাখ্যান করে। ‘বুয়েন ভিভির’-এর অন্তর্গত বিভিন্ন ধারণা-পরম্পরা-স্বজ্ঞা-য় ইতিহাস-নির্মাণের নানা সমান্তরাল, অরৈখিক, বহুগুণিত ধারা কাজ করে। বিকাশ-উন্নয়ন নামক আধুনিক ধারণাটির মধ্যে নিহিত অর্থনৈতিক বৃদ্ধি নিয়ে বদ্ধসংস্কার, উপভোক্তাবাদ ও প্রকৃতিকে পণ্য করে তোলার প্রবণতার সমালোচনা করে তারা পুঁজিবাদী ঘরানা, সমাজতান্ত্রিক ঘরানা সহ সব ঘরানার বিকাশকেই বর্জন করতে চায়। ভোগের বৃদ্ধি ঘটানোর বদলে ভোগ যথাসম্ভব কমিয়ে একটা সীমার মধ্যে বেঁধে প্রকৃতির অন্যান্য জৈব-অজৈব উপাদানের সঙ্গে জীবন্ত বন্ধুত্বপূর্ণ অনাধিপত্যমূলক সম্পর্কে থিতু হওয়ার মধ্য দিয়ে তা ভালো ভাবে বাঁচার ক্রিয়াটি সম্পাদন করার কথা বলে। সেই দিক থেকে দেখলে, আধুনিকতা যেভাবে মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যে একটি অনতিক্রম্য বিভাজনরেখা টেনে মানুষের প্রয়োজন মেটানোর জন্যই প্রকৃতির অস্তিত্বের উপযোগিতাবাদী ধারণা তৈরি করেছে, ‘বুয়েন ভিভির’ তা প্রত্যাখ্যান করে। অ্যান্ডিস গিরিমালার আদিবাসী জনজাতিদের মধ্যে সমাজ সম্পর্কে ‘এয়ল্লু’ (ayllu) বলে একটি ধারণা প্রচলিত আছে। সেই ধারণায় কোনো একটি অঞ্চলের সমাজ শুধু সেখানকার মানুষদের নিয়ে তৈরি নয়, তা সেই স্থানের সমস্ত মানুষ ও না-মানুষ: পশু-পাখি-কীট-পতঙ্গ, গাছপালা, পাহাড়, নদী-ঝোরা, অশরীরী নানা আত্মা ইত্যাদির সমষ্টি--- মানুষ সেখানে প্রধান বা আধিপত্যকারীও নয়। অর্থাৎ, সমাজ সম্পর্কে ধারণাটা মানবকেন্দ্রীক নয়, বরং বিকেন্দ্রীভূত বাস্তুতান্ত্রিক। ‘বুয়েন ভিভির’ যেমন যেকোনো ধরনের ঔপনিবেশিক শাসনের বিরোধিতা করে, তেমনই জাতি-রাষ্ট্র গঠনের নামে পরিচয় ও সংস্কৃতির সমরূপতা আরোপ করে কেন্দ্রীভূত একশিলা উচ্চাবচ ধাপবন্দি রাজনৈতিক কাঠামোরও বিরোধিতা করে। তা বহু বিভিন্ন পরিচয়, পরম্পরা, জীবনধারা ও সংস্কৃতির এমন এক বন্ধুত্বপূর্ণ সমাবেশ চায় যা জ্ঞানের প্রতিটি পরম্পরাকে সমান মর্যাদা দেবে, সমরূপতা নির্মাণের কোনো তাগিদ যেখানে থাকবে না। ‘বুয়েন ভিভির’-এর অন্তর্গত বিভিন্ন ভাবনায় বলে যে ভালো ভাবে বাঁচার পথ বাজারী বিনিময় বা উপযোগিতা-কেন্দ্রীক সম্পর্কবিস্তারের মধ্য দিয়ে হয় না, তা হয় স্বার্থনিরপেক্ষ পারস্পরিকতা, পরিপূরকতা, সমষ্টিবদ্ধতার মধ্য দিয়ে। সেইদিক থেকে দেখলে, তা আধুনিকতা নির্মিত, আধুনিক সমাজের গঠনগত একক, অর্থনৈতিক স্বার্থ চালিত একক মানুষের বদলে অনাধুনিক, সমাজ-বাস্তুতন্ত্রের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কে বাঁধা মানুষের জীবনকেই কাম্য বলছে।
বলিভিয়া, ইকুয়েদোরের মতো অ্যান্ডিস গিরিমালা বরাবর স্থিত দেশগুলোর রাষ্ট্র যেভাবে বড় মাপের খনিজ ও জীবাশ্ম জ্বালানী উত্তোলনের বিকাশ-উন্নয়ন-বাদী পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নেমেছে, অ্যান্ডিস গিরিমালার আদিবাসী জনজাতিরা তাদের এই ‘বুয়েন ভিভির’-এর ভিত্তিতে তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ চালিয়ে যাচ্ছে। রাষ্ট্রপোষিত অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের হিংসাশক্তি দিয়ে সেই প্রতিরোধকে কাবু করতে না পেরে রাষ্ট্রগুলো এখন বিকল্প কৌশল নিয়েছে। তারা আদিবাসী জনজাতিদের প্রধান অস্ত্র ‘বুয়েন ভিভির’-কেই ছিনিয়ে নিয়ে নিজেদের অস্ত্রাগারে ভরতে চাইছে--- ইকুয়েদোরে সরকারি পার্টিগুলো ‘বুয়েন ভিভির’-এর এক নয়া সংজ্ঞা তৈরি করে তাকে ‘ইকুয়েদোরিয় সমাজতন্ত্রের’ একটা রূপ হিসেবে প্রতিপন্ন করে সেই সমাজতন্ত্রমুখী বিকাশের পথে নিজেদের পরিকৃৎ হিসেবে হাজির করার চেষ্টা করছে, বলিভিয়ার সরকারি পার্টিগুলো আবার ‘বুয়েন ভিভির’-কে ‘সর্বাত্মক বিকাশ’-এর একটি পথ বলে বর্ণনা করে বিকাশ-উন্নয়নকে তার অংশ বলে গেলানোর চেষ্টা করছে। বলা বাহুল্য, এর মধ্য দিয়ে ‘বুয়েন ভিভির’-এর প্রাণকেন্দ্রে বিকাশ-উন্নয়ন, অর্থনীতি-চালিত-মানুষ, উপভোক্তাবাদ, প্রকৃতি-বিচ্ছিন্নতার মতো আধুনিক নির্মাণগুলোকে ভেঙে অনাধুনিক বা উত্তর-আধুনিক প্রকৃতিলগ্ন জীবন গড়ার যে তাগিদটি কাজ করছে, সেই তাগিদটিকে ধ্বংস করে তাকে এমনভাবে রূপান্তরিত করে নেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে যাতে তাকে তার বিপরীতে পরিণত করা যায়, অর্থনৈতিক বৃদ্ধি কামী আধুনিক মানসিকতায় রূপান্তরিত করা যায়। বলিভিয়া-ইকুয়েদোরের সরকারি পার্টিগুলো ও তাদের ঘরানার বুদ্ধিজীবীদের এই আক্রমণের মুখেও আদিবাসী জনজাতির মানুষরা প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন। তাঁদের এই নিরন্তর প্রতিরোধ ও বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে তাঁদের সঙ্গে সহমর্মী-সহভাবুক-সহযোদ্ধা এমন অনেকজনের আলাপ ও সম্পর্ক তৈরি হয়ে যাচ্ছে যারা ইউরোপ ও আমেরিকার ‘উন্নত দেশ’ বলে খ্যাত আধুনিকতার গর্ভগৃহের ভিতর থেকেই আধুনিকতাকে প্রশ্ন করছেন নানাভাবে--- বিকাশের সমালোচক, অর্থনৈতিক নির্ধারণবাদের সমালোচক, সর্বজনীনতার সমসত্বতা-আরোপকারী প্রবণতার সমালোচক, প্রকৃতির উপর প্রভুত্বের বিরোধী, পুরুষপ্রভুত্বের বিরোধী, মানবকেন্দ্রীকতার বিরোধী--- এঁদের সঙ্গে ভাবনাচিন্তা ভাগ করে নেওয়ার প্রক্রিয়াও বিস্তৃত হচ্ছে। অ্যান্ডিস গিরিমালার উপজাতিদের ভালো ভাবে বাঁচা যে পিছিয়ে গিয়ে প্রস্তরযুগের জীবনে ফিরে যাওয়া নয়, বরং আধুনিকতার ভিতরে প্রকট হয়ে ওঠা সর্বধ্বংসী রোগের প্রকোপ কাটিয়ে অনাধুনিক বা উত্তর-আধুনিক এক নতুন সুস্থতায় পৌঁছানোর চেষ্টা, তা বোধহয় উপনিবেশ-শাসকদের উত্তরপুরুষরাও কেউ কেউ এখন বুঝতে শুরু করেছে।
আদিবাসী জনজাতিদের এই আন্দোলনগুলো আমাদের আধুনিকতা-চিহ্নিত রাজনৈতিক প্রকল্পগুলোর থেকে আরেক জায়গাতেও আলাদা। গণতন্ত্রবাদী, উদারনীতিবাদী বা কম্যুনিস্ট--- আধুনিকতা-চিহ্নিত যে কোনো রাজনৈতিক প্রকল্পই কমবেশি দীর্ঘ এক উৎক্রমণ-পর্ব (যে সময় সাধারণ মানুষকে নানা ‘ত্যাগ’ স্বীকার করতে হবে) পেরিয়ে কোনো এক ভবিষ্যৎ কালে অভীষ্ট লক্ষ্যে (যেখানে সাধারণ মানুষের আর কোনো দুঃখ থাকবে না) পৌঁছানোর কথা বলে, আর অভিজ্ঞতায় দেখা যায় যে ত্যাগ স্বীকারের খামতি হয় না, কিন্তু ভবিষ্যৎটা খালি পিছিয়ে পিছিয়ে দূরবর্তীই হতে থাকে। আদিবাসী জনজাতিরা কিন্তু এমন কোনো ভবিষ্যতের জন্য তাঁদের কাম্য সমাজটিকে তুলে রাখছে না, তারা এখনই এই পৃথিবীতেই তাদের কাম্য সমাজকে রূপ দিতে চাইছে; ভাবা, বাঁচা ও অপরের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার নতুন রূপ এখনই নিজেদের যাপনে মূর্ত করে তুলতে চাইছে। নতুনের নির্মাণ তাই তাদের চর্চায় কুণ্ডলী-পাকানো তাত্ত্বিক বিহ্বলতায় মূর্ছা পেয়ে বসে না, প্রাত্যহিক যৌথ যাপনে তত্ত্ব ও চর্চায় উন্মুখ হয়ে ওঠে। অপর সবাইকেও ডাক দিয়ে যায় নিজ স্বজ্ঞা অনুযায়ী নিজেদের মতো করে এই নতুন ভাবে বাঁচার উদ্যোগে সামিল হতে। জাপাতিস্তা আন্দোলনের দীর্ঘদিনের সহযাত্রী গুস্তাভো এস্তেভা ২০২৩ সালে প্রকাশিত তাঁর একটি লেখায় (The Ongoing Insurrection, in A Critique of Develoment and Other Essays, translated into English by Kathryn Dix) এই ডাক হাজির করে গেছেন এইভাবে:
জরুরী হয়ে উঠেছে আমাদের নিজেদের মাত্রাবোধ ফিরে পাওয়া। এই মাত্রাবোধ সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানেরই একটা রূপ, যা আমাদের জনসমাজের মধ্যেই আমরা পাই। অপচয়, ধ্বংস ও অবিচারের যে সমাজ গোটা প্রাকৃতিক জগতকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়ে দায়িত্বহীনতার অভিযোগে আজ কাঠগড়ায়, তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে, সাহস ও সুবুদ্ধি জড়ো করে, আমরা সামাজিক উন্নয়নের মরীচিকার পিছনে ছুটে অপ্রয়োজনীয়কে প্রয়োজনীয় করে তোলা বন্ধ করতে পারি, অর্থনৈতিক বৃদ্ধিকে ঈশ্বররূপে পুজো করার সংস্কার চিরতরে ত্যাগ করতে পারি।… যে উন্মত্ততা বিরাজমান, তা এবার বন্ধ করা দরকার। কিছু বস্তুর বৃদ্ধি পেতে হবে এবং কিছুকে অবশ্যই সংকুচিত করতে হবে। আমাদের জীবনযাপন সংক্রান্ত সক্ষমতা আর আমাদের জীবনের স্বশাসন বৃদ্ধি পাক। যে যে পরিসরে আমরা আমাদের স্বাধীনতা ও স্বউদ্যোগ চর্চা করতে পারি, সেই পরিসরগুলো প্রসারিত হোক। প্রতিটি মানুষ এবং প্রতিটি সংস্কৃতি যেভাবে ভালো ভাবে বাঁচা বলতে কী তা নির্ধারণ করে, সেই ভাবেই ভালো ভাবে বাঁচার বহু বিবিধ সুযোগ ও উপায় বৃদ্ধি পাক। আর এই সমস্ত বৃদ্ধিকে সম্ভবপর করে তোলার জন্য আমাদের ঘাড়ের উপর চেপে থাকা প্রাতিষ্ঠানিক নিবন্ধীকৃত অর্থনীতির নিপীড়ক পাষাণভার কমিয়ে হালকা করা যাক, একইসঙ্গে যা যা সকলের ভালো ভাবে বাঁচার পরিপন্থী বা যা যা প্রকৃতিকে ধ্বংস করে চলেছে সেসব কমানো যাক।
সমালোচনা ও বিকল্প জীবনাচরণ উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে বিকাশ-উন্নয়ন-প্রগতির আধিপত্যবাদী আক্রমণের প্রতিরোধ ও নতুনের সম্ভাবনা হাজির করার এই শক্তি মেহিকোর জাপাতিস্তা নামে পরিচিত হয়ে ওঠা জনজাতিগুলো বা অ্যান্ডিস গিরিমালার আদিবাসী জনজাতিদের মধ্যে সবচেয়ে সংহত ও রূপে প্রকাশ পাচ্ছে হয়ত, কিন্তু কোনোভাবেই এগুলো কোনো ব্যতিক্রম নয়। গোটা বিশ্বজুড়েই, সেই উপনিবেশ-বিস্তারের সময় থেকে এই বিশ্বায়নের সময় অবধি, বিকাশ-উন্নয়ন-প্রগতি-র আক্রমণের মুখে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের আদিবাসী জনজাতি তাদের নিজস্ব পরম্পরা-জীবনধারা-স্বজ্ঞার ভিত্তিতে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। কোথাও তাদের হার স্বীকার করে নিতে হয়েছে, কোথাও লড়াই চলছে এখনো। চিয়াপাস ও অ্যান্ডিসে লড়াইটা হয়ত সবচেয়ে নজরকাড়া জায়গায় পৌঁছতে পেরেছে। কিন্তু আমাদের পড়শী রাজ্য ওডিশায় নিয়মগিরির আদিবাসী জনজাতিরা যখন খনির জন্য পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে লড়লেন এই কিছুদিন আগে, তাঁরাও কি প্রগতি-বিকাশ-উন্নয়ন সমেত আধুনিকতার গোটা গপ্পোগাছাকে প্রত্যাখ্যান করেননি? তখন কি আমরা তাঁদের বিকল্প আনাধুনিকতাকে গুরুত্ব দিয়ে বোঝার চেষ্টা করেছি, নাকি আমাদের আধুনিকতাবাদী নানা রাজনৈতিক প্রকল্পে তাদের ব্যবহার করতে পারার বা না পারার উপযোগিতাবাদী হিসেব-নিকেশই কষে গেছি? কোনো শেষ কথা বলার আকাঙ্ক্ষা আমার নেই, তবু পরিশেষে নিজের এই উপলব্ধিটি নিবেদন করি: সভ্য মানুষকে তার উদ্ধত রুগ্ন ভোগোন্মাদ অস্তিত্বের অসুস্থতা সারিয়ে প্রাকৃতিক ভারসাম্যে ফিরে যেতে হলে তা কোনো আধুনিকতাবাদী রাজনৈতিক প্রকল্প দিয়ে হবে না, তার জন্য আধুনিকতাকে পেরিয়ে যেতে হবে, সেই পেরিয়ে যাওয়ার শক্তি-জ্ঞান-স্বজ্ঞা অনাধুনিক জনজাতিদের জীবনাচরণের দেউলে বসেই আমাদের শিখতে হবে, সমন্বিত করে তুলতে হবে অনাধুনিক রাজনৈতিক সক্রিয়তা।
-------------
[সমস্ত উদ্ধৃতাংশের বাংলা তর্জমা বর্তমান লেখকের করা।]