[একুশ শতকের প্রথম দশকে জার্মান দার্শনিক রায়েল ইয়েগ্গি-র Entfremdung বইটি প্রকাশিত হয়ে সাড়া ফেলেছিল। দার্শনিক ফ্রেডরিখ নয়হোউসার ২০০৭ সালে বইটির পর্যালোচনা করতে গিয়ে বলেছিলেন যে গত এক দশকে জার্মান দার্শনিক চর্চার মহল থেকে প্রকাশিত হওয়া বইগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উত্তেজনাপ্রদগুলোর মধ্যে এটি একটি। নয়হোউসার-এর অনুবাদে ইংরেজিতে Alienation নামে বইটির সংস্করণ প্রকাশিত হয় ২০১৪ সালে। এই ইংরেজি সংস্করণ থেকেই বাংলায় তর্জমা করে আমরা এখানে হাজির করছি। পত্রিকার এই সংখ্যায় রইল প্রথম কিস্তি। পত্রিকার পরবর্তী সংখ্যাগুলোতে পরবর্তী কিস্তিগুলো ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়ে চলবে বলে আশা করা যায়। --- বিপ্লব নায়ক, বাংলায় তর্জমাকার]
বিচ্ছিন্নতা (alienation) হল এক সম্পর্কহীনতার সম্পর্ক। খুবই সংক্ষিপ্ত ও বিমূর্ত সূত্রায়ণে এই প্রতিপাদ্যটিকেই আমি এখানে আমার ভাবনার সূচনাবিন্দু হিসেবে ধরছি। এই সূত্রায়ণ অনুযায়ী, বিচ্ছিন্নতা কোনো সম্পর্কের অনুপস্থিতিকে চিহ্নিত করে না, বরং তা নিজেই একটি সম্পর্ক। অবশ্য, তা একটি অপর্যাপ্ত সম্পর্ক হতে পারে। উল্টোদিকে, বিচ্ছিন্নতা অতিক্রম করা মানে নিজসত্তা ও জগতের সঙ্গে একাত্মতার এক অবিভেদীকৃত একাত্মতার অবস্থায় পৌঁছানো নয়; তা-ও বরং এক সম্পর্ক বিশেষ: উপযোজনের সম্পর্ক। বিচ্ছিন্নতার ধারণার আমার করা এই পুনর্নির্মাণের পিছনে কাজ করা মূল ভাবনাটি এইরকম: বিচ্ছিন্নতার ধারণাটিকে আরো একবার ফলপ্রসূ করে তোলার জন্য তার একটি বিধিবৎ (formal) বর্ণনা দেওয়া আমাদের দরকার। বিচ্ছিন্নতার সম্পর্কাদিতে কী থেকে একজন বিচ্ছিন্ন তার একটি পর্যাপ্ত সংজ্ঞা হাজির করার চেয়ে সম্পর্কটির চরিত্র কী তা সংজ্ঞায়িত করাই প্রয়োজন; উপযোজনের সম্পর্কগুলো কী বিবিধ উপায়ে অবিন্যস্ত হয়ে ওঠে তা নির্ণয় করার সুযোগ খুলে যায় বিচ্ছিন্নতার ধারণার মধ্য দিয়ে। এই উপযোজনের সম্পর্কগুলোকে উৎপাদক সম্পর্ক হিসেবে বোঝা দরকার, বোধা দরকার এমন খোলা প্রক্রিয়াদি হিসেবে যেখানে উপযোজনের মধ্যে সর্বদা প্রদত্ত বস্তুর সংহতরকণ ও রূপান্তরসাধন উভয়ই ঘটে থাকে। উপযোজনের এই চলনগতির থমকে যাওয়া ও অনুপলব্ধির ব্যর্থতাই হল বিচ্ছিন্নতা। এই ধারণাগুলোকে ব্যবহার করে বিচ্ছিন্নতার ওপারে কোনো আর্কিমিডিয় ভিত্তিবিন্দু অবলম্বন না করেও বিচ্ছিন্নতার প্রক্রিয়াদি সম্পর্কে একটি সুসমঞ্জস বর্ণনা দেওয়া সম্ভব।
বিচ্ছিন্নতার তত্ত্ব প্রায়শই যে দুটি সমস্যার সম্মুখীন হয়ে থাকে--- একদিকে তার সারবত্তাবাদ (essentialism) ও মানুষের সারবত্তা বা প্রকৃতি (বা ভালো জীবন সম্পর্কে বস্তগতভাবে নির্ণীত আদর্শ) সম্পর্কিত এক ধারণাকে ঘিরে তার প্রকৃষ্টতাবাদী (perfectionist) অভিমুখীনতা; আর অন্যদিকে পুনর্মিলিত হওয়ার আদর্শ, টানাপোড়েন-মুক্ত এক একাত্মতার আদর্শ, যা বিচ্ছিন্নতাবাদী সমালোচনার সামাজিক তত্ত্ব বা পরিচয় তত্ত্বের রূপ নেওয়ার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত হয়ে দেখা দেয়--- সেই সমস্যাদুটিকেও এভাবে এড়ানো সম্ভব বলে আমি দেখাতে চাইব। বিচ্ছিন্নতাকে জগৎ ও আত্মসত্তার উপযোজনে বিপর্যয় বা বাধাপ্রাপ্তির সম্পর্ক হিসেবে দেখলে মুক্তি ও বিচ্ছিন্নতার মধ্যে একটি আলোকসঞ্চারী যোগাযোগও দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। যে পরিমাণে মুক্তির একটি পূর্বশর্ত হল নিজের যে কোনো কাজ ও সেই কাজ করার পরিবেশ-অবস্থা নিজের করে নেওয়ার সক্ষমতা, সে পরিমাণেই মুক্তি উপলব্ধি করার একটি আবশ্যক পূর্বশর্ত হল বিচ্ছিন্নতা অতিক্রম করা।
আলোচনার এই অংশে আমি বিচ্ছিন্নতার ধারণা দিয়ে চিহ্নিত সমস্যা-পরিসরটিকে হাজির করতে চাইব। প্রথমে আলোচনা করব (১) বিচ্ছিন্নতা নামক ঘটনা-প্রতীতি (phenomenon) ও ধারণার বিবিধ মাত্রা নিয়ে, প্রাত্যহিক ভাষায় ও ধারণাটির দার্শনিক বিচারে উভয়তই কীভাবে বিচ্ছিন্নতা নিজেকে খুলেমেলে ধরে তা নিয়ে। এই আলোচনাকে আরো গভীরে নিয়ে যাওয়া হবে (২) বিচ্ছিন্নতার তাত্ত্বিক সূচনাবিন্দুগুলোর আরো নিবিড় বিবেচনার মধ্য দিয়ে এবং কীভাবে মার্কসের তত্ত্বায়ন ও হেইডেগারের অস্তিত্বগত সত্তাতত্ত্ববিদ্যা (existential ontology) উভয়ক্ষেত্রে সেগুলোয় পৌঁছানো হয়েছে তা দেখার মধ্য দিয়ে। সামাজিক দর্শনের একটি ভিত্তিমূলক ধারণা হিসেবে কাজ করার যে সম্ভাবনা এই ধারণাটির মধ্যে নিহিত আছে, এভাবে তা উন্মোচিত করার পরিপ্রেক্ষিতে এরপর (৩) ধারণাটির কাঠামো এবং সংযুক্ত সমস্যাবলী নিয়ে আলোচনা করা হবে। শেষত, (৪) ধারণাটিকে পুনর্নির্মাণ করা নিয়ে আমার অভিমতগুলো আমি ব্যক্ত করব।
১
বিচ্ছিন্নতার ধারণা ও ঘটনা-প্রতীতি:
‘নিজসৃষ্ট জগতে এক অপরিচিত আগন্তুক’
বিচ্ছিন্নতার ধারণাটি গোটা এক গুচ্ছ জড়ানো-প্যাঁচানো বিষয়াবলীকে নির্দেশ করে। বিচ্ছিন্নতা মানে অনাসক্তি ও অভ্যন্তরীণ বিভাজন, আবার তার মানে নিজের সাপেক্ষে এবং অভিজ্ঞতায় অনাসক্ত ও অপর হিসেবে ধরা দেওয়া এক জগতের সাপেক্ষে ক্ষমতাহীনতা ও সম্পর্কহীনতাও বটে। বিচ্ছিন্নতা হল অক্ষমতা--- অপর মানুষ, বস্তু, সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের অক্ষমতা এবং সেই সূত্রে (বিচ্ছিন্নতার তত্ত্বের মৌলিক স্বজ্ঞা অনুযায়ী) আপন সত্তার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের অক্ষমতা। একটি বিচ্ছিন্নকৃত (alienated) জগৎ একজন ব্যক্তিমানুষের কাছে নিজেকে অকিঞ্চিৎকর ও অর্থহীন হিসেবে হাজির করে, অনমনীয়তা বা আকিঞ্চনতায় দীর্ণ হিসেবে হাজির করে, এমন একটা জগৎ হিসেবে হাজির করে যা নিজস্ব আপন নয়, অর্থাৎ এমন এক জগৎ যেখানে কোনো ব্যক্তিমানুষ স্বচ্ছন্দ বোধ করতে পারে না, যে জগতের উপর ব্যক্তিমানুষ কোনো প্রভাবও ফেলতে পারে না। বিচ্ছিন্নকৃত এই বিষয়ী নিজের কাছেই নিজে অপরিচিত আগন্তুক হয়ে ওঠে, সে আর নিজে নিজ অভিজ্ঞতায় ‘সক্রিয় ক্ষমতাশালী বিষয়ী’ হিসেবে ধরা দেয় না, বরং অজ্ঞাত বলসমূহের হাতে ক্রীড়নক ‘নিষ্ক্রিয় বিষয়’ হিসেবে ধরা দেয়।১ তখনই বিচ্ছিন্নতার কথা বলা যেতে পারে যখন ‘ব্যক্তিমানুষেরা নিজেদের সক্রিয়তার মধ্যে নিজেদের খুঁজে পায় না’২, বা, (হেইডেগার যেভাবে উপস্থাপন করেছেন) নিজ স্থিতসত্তা(being)-র উপর যখন আর আমাদের নিজেদের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। বিচ্ছিন্নকৃত ব্যক্তিমানুষ হল (আ্যালেসডেয়ার ম্যাকিনটির-এর প্রথম দিকের সূত্রায়ন অনুযায়ী) ‘নিজসৃষ্ট জগতে এক অপরিচিত আগন্তুক’।৩
বিচ্ছিন্নতার ঘটনা-প্রতীতি
প্রথম দৃষ্টিপাতেও বোঝা যায় যে আমাদের আলোচ্য ধারণাটির ‘কিনারাগুলো ঝাপসা’। বিমূর্তকে মূর্ত বাস্তব বলে গণ্য করা (reification), কৃত্রিমতা (inauthenticity), অনাচার (anomie), ইত্যাদি ধারণাগুলোর সঙ্গে আলোচ্য ধারণাটির বংশগত সাদৃশ্য ও সমাপতন যেমন, তেমনই প্রাত্যহিক ও দার্শনিক উভয় ভাষারূপেই তার ধারণ করা বিবিধ অর্থগুলোর মধ্যে জটিল সম্পর্কাবলীও ধারণাটির ক্রিয়াক্ষেত্র সম্পর্কে আমাদের অবহিত করে। ধারণাটির ‘অভিজ্ঞতামূলক বিষয়বস্তু’ যদি বা তার মধ্যে পরিস্ফুট হয়ে ওঠা ইতিহাসগত ও সমাজগত অভিজ্ঞতাবলী দিয়ে পুষ্ট হয়,৪ একথাও সমানভাবে সত্য যে একটি দার্শনিক ধারণা রূপে বিচ্ছিন্নতার ধারণা ব্যক্তিমানুষ ও সমাজ-আন্দোলনে ধারণ করা আত্ম ও বিশ্ব সংক্রান্ত ব্যাখ্যাগুলোকে প্রভাবিত করেছে। এহেন ‘অপরিশুদ্ধ’ মিশ্রণই এক বিবিধ-বিচিত্র ঘটনা-প্রতীতি-ক্ষেত্রকে বিচ্ছিন্নতা নামক ধারণাটির সঙ্গে জুড়ে দিয়েছে।৫
বিচ্ছিন্নতার তত্ত্ব: ‘কালচেতনায় সংকট’
তাহলে বিচ্ছিন্নতা মানে কী? ‘মনে হয় যেনবা যখনই কিছু যা হওয়ার কথা তা হচ্ছে না, তখনই তিনি তাকে বিচ্ছিন্নতা বলে অভিহিত করছেন’৬--- এরিক ফ্রম সম্পর্কে রিচার্ড শ্যাচ্ট-এর করা এই মন্তব্য ফ্রম ছাড়াও অন্য বহুজন প্রায়শই যেভাবে এই ধারণাটি ব্যবহার করে থাকেন তার একটি উপযুক্ত ব্যাখ্যান হতে পারে। যতই বিবিধ-বিচিত্র এই ঘটনা-প্রতীতি হোক না কেন, তা অবশ্য বিচ্ছিন্নতা ধারণাটি সম্পর্কে একটি প্রাথমিক খসড়াচিত্র হাজির করে। বিচ্ছিন্নকৃত সম্পর্ক হল নিজের সঙ্গে, জগতের সঙ্গে ও অপরের সঙ্গে এক ধরনের খামতির সম্পর্ক। নির্লিপ্তি, অন্যকে যন্ত্রবৎ ব্যবহার করা, বিমূর্তকে মূর্ত বাস্তব বলে ধরে নেওয়া, অসংগতি, কৃত্রিমতা, নিঃসঙ্গ বিযুক্তি, অর্থহীনতা, অনুর্বরতা--- এই নানাভাবে প্রদত্ত সম্পর্ককে চরিত্রায়িত করা হল খামতিকেই নানা রূপে ধরতে চাওয়া। বিচ্ছিন্নতা ধারণাটির একটি বৈশিষ্ট্যমূলক চরিত্র হল যে তা কেবল ক্ষমতাহীনতা ও স্বাধীনতাহীনতার কথাই বলে না, আত্ম ও বিশ্বজগতের সঙ্গে সম্পর্কের এক স্বভাবগত খামতির কথাও বলে। (মার্কস যখন বিচ্ছিন্নতাকে জগৎ ও মানুষের ‘বাস্তবতার দ্বিগুণ ক্ষয়’ বলে বর্ণনা করেছিলেন, তখন তাঁর অভিপ্রেত দ্বৈত অর্থকে এভাবেই বোঝা উচিত বলে মনে হয়: অবাস্তব হয়ে ওঠার মধ্য দিয়ে ব্যক্তিমানুষের অভিজ্ঞতায় সে নিজে আর ‘কার্যকরী’ বলে মনে হয় না, আর, অবাস্তব হয়ে ওঠা জগৎও নির্লিপ্ত অর্থহীন হয়ে ওঠে।) এহেন আন্তর্সম্পর্কগুলোর জটিলতাই বিচ্ছিন্নতাকে আধুনিকতার সংকট নির্ধারণের কাজে মূল ধারণা করে তুলেছে এবং সমাজদর্শনেও অন্যতম ভিত্তিগত ধারণা হিসেবে জায়গা করে দিয়েছে।
সমকালীন চেতনাসংকটের একটি অভিব্যক্তি (হেগেল হয়ত এভাবেই বলতেন) হিসেবে বিচ্ছিন্নতা নিয়ে আধুনিক আলোচনা রুশো ও শিলার থেকে হেগেল হয়ে কিয়ের্কগার্ড ও মার্কস অবধি বিস্তৃত। আঠারো শতকের পর থেকে শিল্পায়ন-বিকাশের হাত ধরে মানুষের নিজের সঙ্গে ও জগতের সঙ্গে সম্পর্কের মধ্যে ‘অনিশ্চয়তা, খণ্ডিতকরণ ও আভ্যন্তরীণ বিভাজন’-এর বাড়বাড়ন্ত বোঝাতে ‘সভ্যতার সবচেয়ে বড় অসুখ’৭-এর স্বীকৃতি আদায় করে নেওয়া বিচ্ছিন্নতা একটি চালু লব্জে পরিণত হয়েছে। এহেন অসুখনির্ণয়কেই মার্কস তাঁর বিচ্ছিন্নতার তত্ত্বে ধারণ করে পুঁজিবাদের সমালোচনায় কাজে লাগিয়েছিলেন। আর, ‘আধুনিক মানুষের নিজ আবশ্যিক সংজ্ঞা বা উদ্দেশ্যময়তা খুইয়ে বসা’-কে ঘিরে আপন সত্তায় স্থিত হওয়া বলতে কী ও আপন সত্তাকে হারিয়ে ফেলা বলতেই বা কী এহেন অস্তিত্ববাদী প্রশ্নগুলো৮ কিয়ের্কগার্ডকে অনুসরণ করে ক্রমশ চেহারা পেয়েছে। এই পরম্পরা অনুযায়ী, নির্লিপ্তি ও চরম বাস্তুহীনতার অভিজ্ঞতা হল জগৎ এবং আত্মসত্তা ও জগতের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক বিষয়ে সত্তাতাত্ত্বিক (ontological) পরিসরের একটি ভুল-বোঝাবুঝি, তার চেয়ে কম কিছু নয়, যে ধারণার সঙ্গে মার্কসীয় নির্ধারণের বিবিধ অমিল সত্ত্বেও মিলের জায়গাও কিছু আছে। আধুনিক অবতারে বিচ্ছিন্নতার নির্ধারণসমূহ, যেমন ধরা যাক, সবসময় স্বাধীনতা, আত্মনির্ধারণ ও তা বাস্তবায়নে ব্যর্থতা নিয়ে ভাবিত। এইভাবে দেখলে, বিচ্ছিন্নতা কেবলমাত্র আধুনিকতার সমস্যা নয়, তা একটি আধুনিক সমস্যাও বটে।
বিচ্ছিন্নতার তত্ত্বের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
বিচ্ছিন্নতার আধুনিক তত্ত্বের একটি (অতি) সংক্ষিপ্ত ইতিহাস এভাবে দেওয়া যেতে পারে:
১
বিচ্ছিন্নতা শব্দটি রুশো-র লেখায় কোথাও ব্যবহৃত না হলেও, রুশো-র কাজের মধ্যে আমরা সেই সমস্ত মূল ধারণাকেই খুঁজে পাব যেগুলো অতীত ও বর্তমানের বিচ্ছিন্নতা সম্পর্কিত সমস্ত তত্ত্বায়ন (সমাজ-দার্শনিক অর্থে) অবলম্বন করেছে।৯ রুশো তাঁর ‘Discourse on the Origin of Inequality Among Men’ (১৭৫৫) বইটি শুরু করেছিলেন একটি চিত্তাকর্ষক প্রতিমা দিয়ে: ‘গ্লকাস-এর মূর্তি কাল, সমুদ্র ও ঝড়ের প্রকোপে ক্ষয়িত হতে হতে যেমন ঈশ্বরের চেয়ে হিংস্র জানোয়ারের কাছাকাছি চলে এসেছিল, মানবসত্তারও তেমনই অবস্থা। সমাজক্রোড়ে চির-পুনরাবৃত্ত হাজারো কারণে বদলাতে বদলাতে, জ্ঞান ও ভ্রান্তির পাহাড় অধিগ্রহণ করতে করতে, দেহের গঠনে ঘটে যাওয়া বদলের সূত্রে, আবেগ-উচ্ছ্বাসের লাগাতার ধাক্কায় মানবসত্তা বলতে গেলে এমনভাবে রূপ-বদল করেছে যে তাকে আর প্রায় চেনাই যায় না।’১০ রুশো এখানে যে রূপ-বদল বা রূপ-বিকৃতির কথা বলছেন, তা হল সমাজের দ্বারা মানুষের বিকৃতিসাধন: তার স্বভাবপ্রকৃতি যখন বিভাজিত হয়ে যায়, তার নিজের প্রয়োজনগুলো থেকে যখন সে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, সমাজের বশ্যতাকামী অধ্যাদেশসমূহের কাছে যখন তাকে আত্মসমর্পণ করতে হয়, স্বীকৃতি-অভিলাষী যে মানুষ তখন আত্ম-মূল্যের মাপ অপরদের মতামতের উপর নির্ভরশীল করে তোলে, তার সামাজিক সত্তা তখন কৃত্রিম বিকৃত রূপ ধারণ করে। সভ্য মানুষদের পারস্পরিক নির্ভরশীলতা, সমাজ-সংস্পর্শের মধ্য দিয়ে অবারিত অসীম হয়ে ওঠা প্রয়োজনসমূহ, আর অন্যকে দেখে নিজের দিক-দিশা নির্ণয় করার অভ্যাস মানুষের মধ্যে আধিপত্য ও দাসত্বের জন্ম দেয়, খাঁটি স্বকীয়তার ক্ষয় ঘটিয়ে (স্ব-)বিচ্ছিন্নতার জন্ম দেয়--- অন্যভাবে বললে, এমন এক অবস্থার জন্ম দেয় যা স্বয়ংসম্পূর্ণতা প্রদানকারী স্বাধীন অকৃত্রিম প্রকৃতিরূপের সম্পূর্ণ বিরোধী।
দুটি আপাতবিরোধী ভাবনা রুশো-র চিন্তাকে বিচ্ছিন্নতার তত্ত্বক্ষেত্রে প্রভাবশালী করে তুলেছে: প্রথমত, নিজের সঙ্গে ও স্বপ্রকৃতির সঙ্গে নির্বিঘ্ন বোঝাপড়ার চাহিদা যথার্থতা (authenticity)-র আধুনিক আদর্শ হিসেবে বিকশিত হওয়া, আর দ্বিতীয়ত, সামাজিক চুক্তি-র প্রধান কর্তব্য হিসেবে রুশো-র দ্বারা সূত্রায়িত সামাজিক স্বাধীনতার ভাবনা। রুশো যদিবা ‘Second Discourse’-এ সামাজিকীকরণের (তাঁর বিবেচনায়) সম্পূর্ণ নঙর্থক প্রভাবগুলোর বিচ্ছিন্নকৃত চরিত্র বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছেন, তিনিই আবার ‘Social Contract’-এ বিচ্ছিন্নকৃত নয় এমন সামাজিকীকরণের এমন আদর্শ রূপ উদ্ভাবন করেছেন। রুশোর চিন্তার মধ্যে কাজ করতে থাকা টানাপোড়েনগুলোকে অস্বীকার না করেও তাঁর উপরোক্ত দুটি ভাবনার মধ্যে যোগসূত্র এভাবে বর্ণনা করা যায়: যথার্থ সত্তায় স্থিতি (authentic selfhood) এবং সমাজের মধ্যে যে ফাঁকের কথা রুশো অত বাকপটুতার সাথে তুলে ধরেছিলেন, তা তাঁর নিজের পূর্বানুমানসমূহ অনুযায়ীই এমন এক অমীমাংসিত আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের জন্ম দেয় যার সমাধান একমাত্র হতে পারে এমন শর্ত প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে যেখানে ব্যক্তিমানুষেরা নিজেদের অভিজ্ঞতায় তাদের আপন বলে বোধ করবে এমন সামাজিক প্রতিষ্ঠানাদির মধ্যেই বাস করে। একদিকে যেমন রুশো-বর্ণিত বিচ্ছিন্নকৃত মানুষ যে মাত্রায় অপরদের সঙ্গে সম্পর্কস্থাপন করে সেই মাত্রাতেই নিজেকে খুইয়ে বসে: প্রাকৃতিক মানুষ ‘নিজের মধ্যে বাঁচে; সমাজমুখী মানুষ সর্বদা নিজের বাইরে বাঁচে’১১; অন্যদিকে তেমনই, মানুষ একমাত্র সমাজের মধ্য দিয়েই নিজেকে ফিরে পেতে পারে। প্রকৃতির নিজ আত্মসম্পূর্ণতার অবস্থা--- এবং তারই সঙ্গে অন্যদের থেকে স্বাধীন ও বিচ্ছিন্ন থাকার স্বাধীনতা--- পুনর্প্রতিষ্ঠার জন্য যেহেতু অতি কড়া মূল্য চুকোতে হয় (যেমন, যুক্তি ও বিবেচনা-পুনর্বিবেচনা করার ক্ষমতার মতো বিশেষভাবে মনুষ্যোচিত গুণ হারানোর মূল্য)১২, তাই বিচ্ছিন্নতার সমস্যার সমাধান সামাজিক বন্ধন ছিঁড়ে ফেলার মধ্যে থাকতে পারে না, বরং সামাজিক বন্ধনগুলোর রূপান্তরসাধনের মধ্যেই থাকতে পারে। সামাজিকীকৃত ব্যক্তিমানুষদের মধ্যে যে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা বিচ্ছিন্নতাপ্রদ হিসেবে অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, তা কোন ভাবনা অনুযায়ী রূপান্তর করে নেওয়া প্রয়োজন, তা ‘Social Contract’-এ বিধৃত হয়েছে। ভাবনাটি হল এমন এক সমাজ-সমিতি গঠন যেখানে প্রতিটি ব্যক্তিমানুষ তার সমস্ত অধিকারকে সমাজের কাছে বন্ধক রেখে ‘আবার আগের মতো স্বাধীন’ হয়ে উঠেছে। যা একসময় ছিল বিচ্ছিন্নতাপ্রদ ভিন্নতা, তা রূপান্তরিত হল ‘নিজ আপন আইন’-এর কাছে বশ্যতাস্বীকার। রুশো-র চিন্তা তাই তাঁর অনুগামীদের দুটি ভিন্ন দিকে চালিত করেছে। এক দিকে যেমন রুশো (বিশেষত ‘রুশোবাদী মতবাদ’) মানে বিচ্ছিন্নতাবাদী সমালোচনার অবিরত পুনরাবর্তিত রূপ যা ‘সর্বজনীন’-এর থেকে মুখ ঘুরিয়ে অবিকৃত প্রকৃতি বা আদিম স্বয়মসম্পূর্ণতার আদর্শ অবলম্বন করে এবং সমাজমুখীনতা ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানাদিকে মজ্জাগতভাবে বিচ্ছিন্নকৃত বলে গণ্য করে; অন্যদিকে তেমনই রুশো কেবল কান্ট-এর স্বায়ত্তশাসনের ধারণারই নয়, স্বাধীনতার সামাজিক চরিত্র বিষয়ে হেগেল-এর ধারণারও প্রেরণা হিসেবে কাজ করে।
২
‘সর্বজনীনের মধ্যে আত্মোপলব্ধি’-র ধারণা অবশ্য অবশেষে হেগেল-এর হাতেই রূপ পেয়েছিল। হেগেল-এর ধারণামতেও বিচ্ছিন্নতা হল আধুনিকতার অন্যতম চরিত্রবৈশিষ্ট্য--- আধুনিক চেতনার খণ্ডায়ন, টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়ার মুখে দাঁড়িয়ে থাকা এক ‘সভ্য সমাজ’ (civil society)-এর মধ্যের সম্পর্কসমূহে ‘বিশেষ’ ও ‘সর্বজনীন’-এর জোড় খুলে আলাদা হয়ে যাওয়া, এসব তার লক্ষণ; কিন্তু হেগেল এই সমস্যার মূলকেন্দ্র সমাজের মধ্য দিয়ে ব্যক্তিমানুষের আত্মসত্তা খুইয়ে ফেলার মধ্যে অবস্থিত বলে চিহ্নিত করার বদলে ব্যক্তিমানুষ ও সমাজের মধ্যবর্তী ফাটলে অবস্থিত বলে চিহ্নিত করেছেন। হেগেল-এর বিবেচনামতে, বিচ্ছিন্নতা (বা আভ্যন্তরীণ বিভাজন) হল সমাজজীবনের একটি ঘাটতি বিশেষ (Sittlichkeit), ‘সমাজজীবনে নৈতিক সর্বজনীনতার হানি’ (sittlicher Allgemeinheit)। এই পরিপ্রেক্ষিতে, নৈতিকতার বিচারে সন্তুষ্টিদায়ক এক সমাজের ধারণা প্রাগাধুনিক জনগোষ্ঠীদের সহজাত প্রকৃত-পর্যাপ্ত নৈতিক সংহতির (যেমন, গ্রাগাধুনিক গ্রিক polis-এর সংহত নৈতিক জীবন) উপর নির্ভরশীল নয়, বরং সামাজিক সংহতির এমন এক রূপের উপর নির্ভরশীল যা ‘ব্যক্তিমানুষের বিশেষত্বের অধিকার’-এর প্রতি সুবিচার করতে পারে। হেগেল যে অণুবাদ (atomism) বর্জন করেছিলেন, তা এই ধারণার উপর ভিত্তি করে যে ব্যক্তিমানুষেরা ব্যতিক্রমহীনভাবে সর্বদা সম্পর্কাবলীর মধ্যে নিমজ্জিতরূপেই নিজেদের খুঁজে পায়,১৩ এই সম্পর্ক-নিমজ্জনের উপলব্ধিই (বিবিধ অর্থে) তাদের স্বাধীনতার শর্তাবলী হিসেবে কাজ করে।
রুশো-র দ্বারা উপস্থাপিত সমস্যাগুলো নিয়ে যখন হেগেল বিবেচনা করতে বসলেন, তিনি রুশো-র সূচনাবিন্দুটিকে রূপান্তরিত করে নিলেন এইভাবে: তিনি ধরে নিলেন যে স্বাধীনতা মানে নৈতিক সমাজজীবন (Sittlichkeit) আর নৈতিক সমাজজীবন মানে স্বাধীনতা; আমাদের নিজেদের ব্যক্তিবিশেষ হিসেবে স্ব-উপলব্ধি করা সর্বপ্রথম সম্ভবপর হয়ে ওঠে যে সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কল্যাণে, সেই সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে এবং মাধ্যমেই আমরা স্বাধীন হয়ে উঠি। তখনও অণুবাদী স্তরে রয়ে যাওয়া রুশো-র যথার্থতা (authenticity)-র আদর্শ প্রতিস্থাপিত হল এমন এক দৃষ্টিকোণ দিয়ে যা নৈতিক সমাজজীবনের প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে ব্যক্তিমানুষদের একাত্মতাবোধের মধ্যেই আত্মোপলব্ধির অবস্থান চিহ্নিত করল। যদিও হেগেল-এর তত্ত্ব আত্মসম্পূর্ণতা হিসেবে বর্ণিত স্বাধীনতার আদর্শকে অতিক্রম করতে উদ্যোগী, তবুও তা কান্ট-এর আত্মনির্ধারণের ধারণাকে অন্তর্ভুক্ত করে নিতে চায়: তার লক্ষ্য হল সেই সমস্ত শর্তাবলী নির্ধারণ করা যা সামাজিক প্রতিষ্ঠানাদির মধ্যে ‘নিজেকে ফের খুঁজে পাওয়া’ সম্ভবপর করে তুলবে। হেগেল-কথিত ‘Bildung’-এর ধারণা এমন এক প্রক্রিয়ার কথা বলে যার মধ্য দিয়ে ব্যক্তিমানুষেরা তাদের প্রাথমিক পর্বের নির্ভরতার সম্পর্কগুলোর বৃত্তের বাইরে বের হওয়ার পথ তৈরি করে, বের হয়ে আসে এবং তাদের সামাজিক সম্পর্কাবলী, যা তাদের ‘নিজত্ব’-এর শর্তাবলীও বটে, সেই সামাজিক সম্পর্কাবলীকেই নিজস্ব আপন করে নেয়।১৪
৩
বিচ্ছিন্নতার তত্ত্বের হেগেল-পরবর্তী দুটি ধারা কিয়ের্কগার্ড ও মার্কস-এর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এঁরা দুজনে হেগেল-এর প্রকল্পের দুটি ভাষ্য অবলম্বন করেছেন যা মানবপ্রকৃতি সম্পর্কে একটি নির্দিষ্ট ধারণাকে সূচনাবিন্দু হিসেবে ধরে নিয়েছে।১৫ সন্দেহ নেই যে উনিশ শতকের শেষার্ধে এসে ‘বাস্তব অস্তিত্ব’ ও ‘বাস্তবের সক্রিয় মানুষ’-এর উপর যে জোর পড়েছিল, তা তাঁদের দুজনকে দুটি ভিন্ন অভিমুখে চালিত করেছিল: মার্কস-এর চিন্তার অর্থনীতি অভিমুখে বাঁক নেওয়া এবং কিয়ের্কগার্ড-এর চিন্তায় মানব-অস্তিত্বের নৈতিক মাত্রাবলী নিয়ে উদ্বেগ একে অপরের বৈপরীত্য তৈরি করেছিল। আভ্যন্তরীণ বিভাজন, নির্লিপ্তি, নিজসত্তা ও জগতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হওয়া--- এই সমস্যাবলীর উপর বিচ্ছিন্নতার তত্ত্ব যেভাবে মনোনিবেশ করেছিল তা উভয় দার্শনিককেই ব্যবহারিক উপযোজন-এর প্রসঙ্গাভিমুখে ঠেলে দিয়েছিল। কিয়ের্কগার্ড ‘নিজসত্তা হয়ে ওঠা’ (becoming oneself)-কে নিজ আপন সক্রিয়তা ও নিজ আপন ইতিহাস উপযোজন করার সাপেক্ষে বুঝেছিলেন--- ‘নিত্য ব্যবহারে আপনাকে মুঠোয় ধরা’-র এমন এক প্রক্রিয়া হিসেবে দেখেছিলেন যা বিজাতীয় বলরাজির দ্বারা উদ্ভূত যা কিছু তার উপর সক্রিয়ভাবে দখল কায়েম করবে। ঠিক তেমনই, মার্কস-এর ভাবনায় আমরা পাই বিশ্বের উৎপাদনশীল উপযোজনের ভাবনা যেখানে আত্মসত্তা অ-বিচ্ছিন্নকৃত অস্তিত্বের আদর্শরূপ হিসেবে কাজ করে।
সমকালীন বুর্জোয়া সমাজের প্রথানুগত্য-চাপিয়ে-দেওয়ার প্রবণতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে একজন ‘স্বতন্ত্র মানুষ’ (singular human being) হয়ে ওঠা হল কিয়ের্কগার্ড-এর নৈতিক আদর্শ। অন্যদিকে, মার্কস এগিয়েছেন মানুষের নিজ আপন মানবিক অন্তর্বস্তু উপযোজনের ভাবনাকে ধরে, যা আবার ‘প্রজাতি-স্থিতসত্তা’ (species-being) উপযোজনার পরিপ্রেক্ষিতে ভাবা হয়েছে (প্রজাতি-স্থিতসত্তা বা species-being মূলগতভাবে ফয়েরবাখ-এর দ্বারা প্রবর্তিত একটি ধারণা, যা হেগেল-উত্থাপিত নৈতিকতার বিচারে সন্তুষ্টিদায়ক সমাজজীবন বা Sittlichkeit-এর একটি স্বাভাবিকীকৃত সংস্করণ হিসেবে বোঝা যেতে পারে)। সুতরাং, বিচ্ছিন্নতার অস্তিত্ববাদী সমালোচনা-ধারার সূচনা ও প্রান্তিক বিন্দু উভয়ই হেগেল-মার্কস সমালোচনাধারার থেকে গুরুত্বপূর্ণভাবে আলাদা: হেগেল-মার্কস সমালোচনাধারায় যেখানে বিচ্ছিন্নতাকে বোঝা হচ্ছে সমাজজগৎ থেকে বিচ্ছিন্নতা হিসেবে, সেখানে অস্তিত্ববাদী সমালোচনাধারায় বারোয়ারি সমাজজগতের মধ্যে নিমজ্জনকেই বিচ্ছিন্নতার উৎস হিসেবে ধরা হয়েছে এই বোঝাবুঝির মধ্য দিয়ে যে সমস্তরীয় করে তোলার মধ্য দিয়ে সংজ্ঞাত এক বারোয়ারি জগতে পড়ার মধ্য দিয়ে (কিয়ের্কগার্ড) বা ‘মান্য সমষ্টিবর’ (das Man--- হেইডেগার)-এর শাসনাধীন হওয়ার মধ্য দিয়ে বিষয়ীর যথার্থতা হানি হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও বিচ্ছিন্নতার এই দুই সমালোচনাধারার মধ্যে বহু সাধারণ ছেদবিন্দুও বর্তমান (আর তা কেবল তাদের গ্রহণ-বর্জনের ইতিহাসের নিরিখেই নয়): হেগেল-এর আভ্যন্তরীণ বিভাজন সংক্রান্ত নির্ধারণ এই সিদ্ধান্তের দিকে নিয়ে যায় যে সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানাদির মধ্যে ব্যক্তিমানুষেরা নিজেদের আবার খুঁজে পেতে পারে না; ১৮৪৪ সালের পাণ্ডুলিপিতে মার্কস-এর বিচ্ছিন্নতা সম্পর্কিত বিশ্লেষণ দাবি করছে যে বিচ্ছিন্নকৃত শ্রমের মধ্যে থেকে আমরা আমাদের নিজেদের সক্রিয়তা, ক্রিয়াজাত উৎপাদ এবং যৌথ উৎপাদনের শর্তাবলী কোনোকিছুই উপযোজন করতে পারি না; বিচ্ছিন্নতার অস্তিত্ববাদী ধারা প্রসূত ধারণা নির্দেশ করে সেই কাঠামোগত বাধাগুলোর দিকে যেগুলো ব্যক্তিমানুষদের কাছে জগৎকে তাদের নিজেদের আপন বলে বোঝার ক্ষেত্র অন্তরায় হয়ে ওঠে, সেই জগৎকে আকার দেওয়ার বিষয়ী হিসেবে নিজেদের মনে করার ক্ষেত্রেও অন্তরায় হয়ে ওঠে।
৪
বিশ শতকে পাশ্চাত্যের মার্কসবাদ (Western Marxism)-এর বিভিন্ন ধারা-উপধারায় বিচ্ছিন্নতার আলোচনা (এবং সেই সূত্রে মার্কস-এর চিন্তার সামাজিক-দার্শনিক পরম্পরা) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এর মধ্যে দিয়ে সমাজ-সমালোচনার এমন এক আদর্শস্থাপক মান (normative dimension) হাজির হওয়ার সম্ভাবনা খুলে গিয়েছিল যা বিকশিততম পুঁজিবাদ সম্পর্কে সমালোচনাত্মক তত্ত্ব নির্মাণে মৌলিক গুরুত্বের ভূমিকা পালন করতে পারে। সেই ১৯২০ সালেই, মার্কস-এর ১৮৪৪ সালের পাণ্ডুলিপির বিচ্ছিন্নতা বিষয়ক বিবরণ তখনও তাঁর অজানা,১৬ তখনই গিয়র্গ লুকাচ তাঁর ‘Reification and the Consciousness of the Proletariat’ নামক বিখ্যাত প্রবন্ধে পণ্য-ভক্তিবাদ (commodity fetishism) সম্পর্কিত মার্কস-এর আলোচনাকে বিস্তৃত করে বিচ্ছিন্নতা এবং বিমূর্তকে মূর্ত বাস্তব বলে গণ্য করা (alienation and reification) সংক্রান্ত তত্ত্বে পৌঁছেছিলেন।১৭ এই তত্ত্বায়নে তাঁর কেন্দ্রীয় সম্পাদ্য ছিল যে ‘পণ্য রূপের সর্বজনীনতা’ আধুনিক সমাজের স্বাতন্ত্র্যসূচক বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছে, এর যুক্তিগত বিস্তারের মধ্য দিয়ে বিমূর্তকে মূর্ত বাস্তব বলে গণ্য করার তত্ত্বই আধুনিক পুঁজিবাদী সমাজ ও তার সমস্ত অভিব্যক্তির তত্ত্ব হয়ে ওঠে। লুকাচের উপর ম্যাক্স ওয়েবার-এর যুক্তিসিদ্ধকরণের তত্ত্ব (theory of rationalization) এবং গিয়র্গ সিম্মেল-এর বস্তুরূপান্তরকরণ (Versachlichung/ objectification) সংক্রান্ত নির্ধারণ প্রভাব ফেলেছিল। সেই প্রভাবের ফলে মার্কস-এর থেকে তিনি কিছুটা আলাদা ধারণা পোষণ করেছিলেন যখন তিনি নির্লিপ্তি, বস্তুরূপান্তরকরণ, পরিমাণ সূচক মাপে মাপা (quantification) এবং বিমূর্তায়ন-এর মতো ঘটনা-প্রতীতিগুলোকে এমনই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেছিলেন যা পুঁজিবাদী বাজার অর্থনীতি ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক বুর্জোয়া সমাজের সমস্ত সম্পর্ক ও অভিব্যক্তিরূপের নির্ধারক চরিত্রবৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছে। ওয়েবার লোহার খাঁচার প্রতিমায় বোঝাতে চেয়েছিলেন কীভাবে আমলাতান্ত্রিকতায় বাঁধা পুঁজিবাদী সমাজে মানুষ বন্দি হয়েছে; সিম্মেল বলেছিলেন এক ‘বিয়োগান্ত সংস্কৃতি’ (tragedy of culture)-র কথা যেখানে মানুষের স্বাধীনতার উৎপাদগুলোই এমন স্বাধীন বস্তুগত অস্তিত্ব ধারণ করে নেয় যা মানুষের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে মানুষের ঘাড়ে চেপে বসে; সিম্মেলই বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছিলেন কীভাবে অর্থ-মাধ্যম অর্থনীতি (money economy)-র বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে স্বাধীনতা তার সমস্ত অর্থ হারিয়েছে--- লুকাচ তাঁর সমসময়ে প্রতীয়মান ঘটনা-প্রতীতিগুলোর মধ্যে এই সমস্তকিছুই মূর্তভাবে ফুটে উঠতে দেখছিলেন। মার্কসবাদী ও অস্তিত্ববাদী ভাবনাকল্পগুলোর ছেদবিন্দু হয়ে ওঠাই লুকাচের চিন্তাধারার স্বাতন্ত্র্যদায়ী বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছিল,১৮ আর সহজেই বোঝা যায় যে এই তাত্ত্বিক মিশ্রণ সমালোচনাত্মক তত্ত্ব (Critical Theory)-র পরবর্তী বিকাশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল, এমনকি আজও বিচ্ছিন্নতার ধারণার বিভিন্ন রূপভেদ বোঝার জন্য তা একইরকম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে আছে।১৯
টীকা
১। ইজরায়েল ও মাস, Der Begriff Entfremdung।
২। হাবেরমাস, Erlauterungen zur Diskursethik, পৃঃ ৪৮।
৩। ম্যাকিনটায়ার, Marxism, পৃঃ ২৩।
৪। ‘অভিজ্ঞতামূলক বিষয়বস্তু’ (experiential content) অভিব্যক্তিটি আমি নেগট ও ক্লুগ, Offentlichkeit und Erfahrung -থেকে ধার করেছি। এর মধ্য দিয়ে, সেইসব ধারণাকে বোঝানো হচ্ছে যা অভিজ্ঞতা অর্জন সম্ভবপর করে তোলে এবং, ঘুরিয়ে আবার, এই ধারণার মধ্যেই প্রাণসঞ্চার করে।
৫। রেমন্ড গেউস, Gluck und Politik, পৃঃ ৫৬-এ যেমন বলেছেন, সমস্ত কৌতূহলপ্রদ দার্শনিক ধারণাই ‘অপরিশুদ্ধ’।
৬। শ্যাচ্ট, Alienation, পৃঃ ১১৬।
৭। নিকোলাস, Hegel’s Theorie der Entfremdung, পৃঃ ২৭।
৮। দেউনিস্যেন, Selbstverwirklichung und Allgemeinheit।
৯। রুশো-র ব্যাখ্যাকারদের মধ্যে এ নিয়ে কোনো মতের ভিন্নতা নেই। যেমন, হানস বার্ত-এর বর্ণনায় রুশো হলেন ‘avant la lettre’ ‘বিচ্ছিন্নতার তাত্ত্বিক’ (বার্ত, Wahrheit und Ideologie, পৃঃ ১০৫) । আর, ব্রোনিস্লাভ ব্যাকজকো-র মতে, ‘(বিচ্ছিন্নতা নামক এই) হেগেলিয়-মার্কসিয় শব্দবন্ধটি একেবারে খাপেখাপে এঁটে যায় সেই অবস্থার সঙ্গেই যা রুশো কোনো নাম না দিয়েই অনবরত বর্ণনা করে গেছেন’ (ব্যাকজকো, Rousseau, পৃঃ ২৭) ।
১০। রুশো, The Discourses, পৃঃ ১২৪।
১১। রুশো, The Discourses, পৃঃ ১৮৭।
১২। ফ্রেডরিখ নয়হোউসার তাঁর Foundations of Hegel’s Social Theory বইয়ের ৫৫-৮১ পৃষ্ঠায় রুশো-র চিন্তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এই বিষয়টি অত্যন্ত জোরের সাথে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
১৩। সামাজিক দর্শনে ‘অণুবাদ’ (atomism) বিষয়ক আলোচনার জন্য দ্রষ্টব্য: টেলর, What’s Wrong with Negative Liberty, পৃঃ ২১১-২২৯।
১৪। আমি এখানে সমকালীন সমাজের একটি সমস্যা হিসেবে হেগেল-এর বিচ্ছিন্নতা সম্পর্কিত বিচার নিয়ে কথা বলছি। অন্যদিকে, তাঁর বিচ্ছিন্নতা সম্পর্কিত দার্শনিক ধারণাটি এমন এক কাঠামো প্রদর্শন করে যা মার্কস-এর ধারণাকেও প্রভাবিত করেছে, তা হল এইরকম: বিচ্ছিন্নতা হল আত্মা (Spirit)-র আত্মবিচ্ছিন্নতা, যার ফলে সে নিজের উৎপাদ-কে নিজের বলে চিনতে পারে না। বিবেচনার এই স্তরে, বিচ্ছিন্নতার ধারণাটিকে বাধ্যতামূলকভাবে নিন্দাকর বা আদর্শস্থাপক কোনোভাবেই প্রয়োগ করা হয় না। হেগেল-এর বিচ্ছিন্নতার তত্ত্বের বিবিধ দিক দেখার জন্য দ্রষ্টব্য: নিকোলাস, Hegel’s Theorie der Entfremdung।
১৫। ল্যয়িথ, From Hegel to Nietzsche, পৃঃ ১৩৫-১৩৯।
১৬। ১৮৪৪ সালের পাণ্ডুলিপি সর্বপ্রথম ১৯৩২ সালে Marx-Engels-Gesamtausgabe-তে প্রকাশিত হয়েছিল এবং সেই সময়ে হারবার্ট মারকুস সোৎসাহে তা গ্রহণ ও প্রচার করেছিলেন, কারণ তাঁর মনে হয়েছিল যে অবশেষে এর মধ্য দিয়ে মার্কস-এর রাজনৈতিক অর্থনীতির সমালোচনা এবং বিপ্লবের তত্ত্বের দার্শনিক ভিত্তিমূল হিসেবে কাজ করা চিন্তাগুলো প্রকাশ্যে এল।
১৭। লুকাচ, History and Class Consciousness।
১৮। স্বয়ং লুকাচ এই মর্মে ১৯৬৭ সালে মন্তব্য করেছিলেন: ‘সেই সময়ে বইটির অভিঘাত ও বর্তমানে বইটির প্রাসঙ্গিকতা বিচার করতে হলে আমাদের এমন একটি সমস্যাকে বিচারে আনতে হবে যা খুঁটিনাটি অন্যান্য সমস্ত প্রশ্নের থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এই সমস্যাটি হল বিচ্ছিন্নতার প্রশ্ন, যাকে, মার্কস-এর পর এই প্রথমবার, পুঁজিবাদের বিপ্লবী সমালোচনার কেন্দ্রীয় প্রশ্ন হিসেবে গণ্য করা হল।… প্রশ্নটা অবশ্য তখন বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছিল।’ (লুকাচ, History and Class Consciousness, পৃঃ xxii) হেইডেগার-এর Being and Time (১৯২৭)-এর প্রকাশ এবং যুদ্ধপরবর্তী ফরাসি মহলের আলাপ-আলোচনা উভয়কে উল্লেখ করার মধ্য দিয়ে এবং এহেন পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে: ‘মানুষের বিচ্ছিন্নতা হল আমাদের যুগের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা এবং সব ধরনের আলোচকরাই--- বুর্জোয়া বা সর্বহারা, ডান বা বাম--- তা এখন স্বীকার করে থাকেন’ (লুকাচ, History and Class Consciousness, পৃঃ xxii), লুকাচ নিজে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা সম্পর্কিত অস্তিত্ববাদী আলোচনার নিবিড় সম্পর্কের দিকে ইঙ্গিত করেছেন।
১৯। যুক্তিসঙ্গতভাবেই হাবেরমাস-এর প্রয়াস, যার মধ্য দিয়ে তিনি সমালোচনাত্মক তত্ত্ব (Critical Theory)-কে জ্ঞাপনক্রিয়ার দৃষ্টিকোণ থেকে পুনর্সংজ্ঞায়িত করে নতুন ভিত্তির উপর দাঁড় করাতে প্রয়াসী হয়েছেন, তা বিমূর্তরে মূর্ত বাস্তব বলে গণ্য করার প্রবণতার তত্ত্বকেও পুনর্সূত্রায়িত হওয়ার দিকে নিয়ে গিয়েছে: সেভাবে জীবনবিশ্ব (life-world)-এর উপনিবেশকরণের সম্পাদ্য মার্কস-পরবর্তী সমালোচনাত্মক তত্ত্বের একটি কেন্দ্রীয় স্বজ্ঞাকে রূপান্তরিত করে দিচ্ছে।
[পরবর্তী অংশ পরের সংখ্যায়]
বাংলা তর্জমা- বিপ্লব নায়ক