সম্পর্কহীনতার সম্পর্ক: সামাজিক দর্শনের একটি ধারণার পুনর্নির্মাণ

লিখেছেন:রায়েল ইয়েগ্গি, বাংলা তর্জমা- বিপ্লব নায়ক
বিচ্ছিন্নতা (Alienation) নামক দার্শনিক ধারণাটির উৎস, অধোগতি ও পুনর্নির্মাণ প্রচেষ্টা সূচক একটি আলোচনা।

[একুশ শতকের প্রথম দশকে জার্মান দার্শনিক রায়েল ইয়েগ্গি-র Entfremdung বইটি প্রকাশিত হয়ে সাড়া ফেলেছিল। দার্শনিক ফ্রেডরিখ নয়হোউসার ২০০৭ সালে বইটির পর্যালোচনা করতে গিয়ে বলেছিলেন যে গত এক দশকে জার্মান দার্শনিক চর্চার মহল থেকে প্রকাশিত হওয়া বইগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উত্তেজনাপ্রদগুলোর মধ্যে এটি একটি। নয়হোউসার-এর অনুবাদে ইংরেজিতে Alienation নামে বইটির সংস্করণ প্রকাশিত হয় ২০১৪ সালে। এই ইংরেজি সংস্করণ থেকেই বাংলায় তর্জমা করে আমরা এখানে হাজির করছি। পত্রিকার এই সংখ্যায় রইল প্রথম কিস্তি। পত্রিকার পরবর্তী সংখ্যাগুলোতে পরবর্তী কিস্তিগুলো ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়ে চলবে বলে আশা করা যায়। --- বিপ্লব নায়ক, বাংলায় তর্জমাকার]

বিচ্ছিন্নতা (alienation) হল এক সম্পর্কহীনতার সম্পর্ক। খুবই সংক্ষিপ্ত ও বিমূর্ত সূত্রায়ণে এই প্রতিপাদ্যটিকেই আমি এখানে আমার ভাবনার সূচনাবিন্দু হিসেবে ধরছি। এই সূত্রায়ণ অনুযায়ী, বিচ্ছিন্নতা কোনো সম্পর্কের অনুপস্থিতিকে চিহ্নিত করে না, বরং তা নিজেই একটি সম্পর্ক। অবশ্য, তা একটি অপর্যাপ্ত সম্পর্ক হতে পারে। উল্টোদিকে, বিচ্ছিন্নতা অতিক্রম করা মানে নিজসত্তা ও জগতের সঙ্গে একাত্মতার এক অবিভেদীকৃত একাত্মতার অবস্থায় পৌঁছানো নয়; তা-ও বরং এক সম্পর্ক বিশেষ: উপযোজনের সম্পর্ক। বিচ্ছিন্নতার ধারণার আমার করা এই পুনর্নির্মাণের পিছনে কাজ করা মূল ভাবনাটি এইরকম: বিচ্ছিন্নতার ধারণাটিকে আরো একবার ফলপ্রসূ করে তোলার জন্য তার একটি বিধিবৎ (formal) বর্ণনা দেওয়া আমাদের দরকার। বিচ্ছিন্নতার সম্পর্কাদিতে কী থেকে একজন বিচ্ছিন্ন তার একটি পর্যাপ্ত সংজ্ঞা হাজির করার চেয়ে সম্পর্কটির চরিত্র কী তা সংজ্ঞায়িত করাই প্রয়োজন; উপযোজনের সম্পর্কগুলো কী বিবিধ উপায়ে অবিন্যস্ত হয়ে ওঠে তা নির্ণয় করার সুযোগ খুলে যায় বিচ্ছিন্নতার ধারণার মধ্য দিয়ে। এই উপযোজনের সম্পর্কগুলোকে উৎপাদক সম্পর্ক হিসেবে বোঝা দরকার, বোধা দরকার এমন খোলা প্রক্রিয়াদি হিসেবে যেখানে উপযোজনের মধ্যে সর্বদা প্রদত্ত বস্তুর সংহতরকণ ও রূপান্তরসাধন উভয়ই ঘটে থাকে। উপযোজনের এই চলনগতির থমকে যাওয়া ও অনুপলব্ধির ব্যর্থতাই হল বিচ্ছিন্নতা। এই ধারণাগুলোকে ব্যবহার করে বিচ্ছিন্নতার ওপারে কোনো আর্কিমিডিয় ভিত্তিবিন্দু অবলম্বন না করেও বিচ্ছিন্নতার প্রক্রিয়াদি সম্পর্কে একটি সুসমঞ্জস বর্ণনা দেওয়া সম্ভব।

বিচ্ছিন্নতার তত্ত্ব প্রায়শই যে দুটি সমস্যার সম্মুখীন হয়ে থাকে--- একদিকে তার সারবত্তাবাদ (essentialism) ও মানুষের সারবত্তা বা প্রকৃতি (বা ভালো জীবন সম্পর্কে বস্তগতভাবে নির্ণীত আদর্শ) সম্পর্কিত এক ধারণাকে ঘিরে তার প্রকৃষ্টতাবাদী (perfectionist) অভিমুখীনতা; আর অন্যদিকে পুনর্মিলিত হওয়ার আদর্শ, টানাপোড়েন-মুক্ত এক একাত্মতার আদর্শ, যা বিচ্ছিন্নতাবাদী সমালোচনার সামাজিক তত্ত্ব বা পরিচয় তত্ত্বের রূপ নেওয়ার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত হয়ে দেখা দেয়--- সেই সমস্যাদুটিকেও এভাবে এড়ানো সম্ভব বলে আমি দেখাতে চাইব। বিচ্ছিন্নতাকে জগৎ ও আত্মসত্তার উপযোজনে বিপর্যয় বা বাধাপ্রাপ্তির সম্পর্ক হিসেবে দেখলে মুক্তি ও বিচ্ছিন্নতার মধ্যে একটি আলোকসঞ্চারী যোগাযোগও দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। যে পরিমাণে মুক্তির একটি পূর্বশর্ত হল নিজের যে কোনো কাজ ও সেই কাজ করার পরিবেশ-অবস্থা নিজের করে নেওয়ার সক্ষমতা, সে পরিমাণেই মুক্তি উপলব্ধি করার একটি আবশ্যক পূর্বশর্ত হল বিচ্ছিন্নতা অতিক্রম করা।

আলোচনার এই অংশে আমি বিচ্ছিন্নতার ধারণা দিয়ে চিহ্নিত সমস্যা-পরিসরটিকে হাজির করতে চাইব। প্রথমে আলোচনা করব (১) বিচ্ছিন্নতা নামক ঘটনা-প্রতীতি (phenomenon) ধারণার বিবিধ মাত্রা নিয়ে, প্রাত্যহিক ভাষায় ও ধারণাটির দার্শনিক বিচারে উভয়তই কীভাবে বিচ্ছিন্নতা নিজেকে খুলেমেলে ধরে তা নিয়ে। এই আলোচনাকে আরো গভীরে নিয়ে যাওয়া হবে (২) বিচ্ছিন্নতার তাত্ত্বিক সূচনাবিন্দুগুলোর আরো নিবিড় বিবেচনার মধ্য দিয়ে এবং কীভাবে মার্কসের তত্ত্বায়ন ও হেইডেগারের অস্তিত্বগত সত্তাতত্ত্ববিদ্যা (existential ontology) উভয়ক্ষেত্রে সেগুলোয় পৌঁছানো হয়েছে তা দেখার মধ্য দিয়ে। সামাজিক দর্শনের একটি ভিত্তিমূলক ধারণা হিসেবে কাজ করার যে সম্ভাবনা এই ধারণাটির মধ্যে নিহিত আছে, এভাবে তা উন্মোচিত করার পরিপ্রেক্ষিতে এরপর (৩) ধারণাটির কাঠামো এবং সংযুক্ত সমস্যাবলী নিয়ে আলোচনা করা হবে। শেষত, (৪) ধারণাটিকে পুনর্নির্মাণ করা নিয়ে আমার অভিমতগুলো আমি ব্যক্ত করব।

বিচ্ছিন্নতার ধারণা ও ঘটনা-প্রতীতি:

‘নিজসৃষ্ট জগতে এক অপরিচিত আগন্তুক’

বিচ্ছিন্নতার ধারণাটি গোটা এক গুচ্ছ জড়ানো-প্যাঁচানো বিষয়াবলীকে নির্দেশ করে। বিচ্ছিন্নতা মানে অনাসক্তি ও অভ্যন্তরীণ বিভাজন, আবার তার মানে নিজের সাপেক্ষে এবং অভিজ্ঞতায় অনাসক্ত ও অপর হিসেবে ধরা দেওয়া এক জগতের সাপেক্ষে ক্ষমতাহীনতা ও সম্পর্কহীনতাও বটে। বিচ্ছিন্নতা হল অক্ষমতা--- অপর মানুষ, বস্তু, সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের অক্ষমতা এবং সেই সূত্রে (বিচ্ছিন্নতার তত্ত্বের মৌলিক স্বজ্ঞা অনুযায়ী) আপন সত্তার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের অক্ষমতা। একটি বিচ্ছিন্নকৃত (alienated) জগৎ একজন ব্যক্তিমানুষের কাছে নিজেকে অকিঞ্চিৎকর ও অর্থহীন হিসেবে হাজির করে, অনমনীয়তা বা আকিঞ্চনতায় দীর্ণ হিসেবে হাজির করে, এমন একটা জগৎ হিসেবে হাজির করে যা নিজস্ব আপন নয়, অর্থাৎ এমন এক জগৎ যেখানে কোনো ব্যক্তিমানুষ স্বচ্ছন্দ বোধ করতে পারে না, যে জগতের উপর ব্যক্তিমানুষ কোনো প্রভাবও ফেলতে পারে না। বিচ্ছিন্নকৃত এই বিষয়ী নিজের কাছেই নিজে অপরিচিত আগন্তুক হয়ে ওঠে, সে আর নিজে নিজ অভিজ্ঞতায় ‘সক্রিয় ক্ষমতাশালী বিষয়ী’ হিসেবে ধরা দেয় না, বরং অজ্ঞাত বলসমূহের হাতে ক্রীড়নক ‘নিষ্ক্রিয় বিষয়’ হিসেবে ধরা দেয়।তখনই বিচ্ছিন্নতার কথা বলা যেতে পারে যখন ‘ব্যক্তিমানুষেরা নিজেদের সক্রিয়তার মধ্যে নিজেদের খুঁজে পায় না’, বা, (হেইডেগার যেভাবে উপস্থাপন করেছেন) নিজ স্থিতসত্তা(being)-র উপর যখন আর আমাদের নিজেদের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। বিচ্ছিন্নকৃত ব্যক্তিমানুষ হল (আ্যালেসডেয়ার ম্যাকিনটির-এর প্রথম দিকের সূত্রায়ন অনুযায়ী) ‘নিজসৃষ্ট জগতে এক অপরিচিত আগন্তুক’।

বিচ্ছিন্নতার ঘটনা-প্রতীতি

প্রথম দৃষ্টিপাতেও বোঝা যায় যে আমাদের আলোচ্য ধারণাটির ‘কিনারাগুলো ঝাপসা’। বিমূর্তকে মূর্ত বাস্তব বলে গণ্য করা (reification), কৃত্রিমতা (inauthenticity), অনাচার (anomie), ইত্যাদি ধারণাগুলোর সঙ্গে আলোচ্য ধারণাটির বংশগত সাদৃশ্য ও সমাপতন যেমন, তেমনই প্রাত্যহিক ও দার্শনিক উভয় ভাষারূপেই তার ধারণ করা বিবিধ অর্থগুলোর মধ্যে জটিল সম্পর্কাবলীও ধারণাটির ক্রিয়াক্ষেত্র সম্পর্কে আমাদের অবহিত করে। ধারণাটির ‘অভিজ্ঞতামূলক বিষয়বস্তু’ যদি বা তার মধ্যে পরিস্ফুট হয়ে ওঠা ইতিহাসগত ও সমাজগত অভিজ্ঞতাবলী দিয়ে পুষ্ট হয়, একথাও সমানভাবে সত্য যে একটি দার্শনিক ধারণা রূপে বিচ্ছিন্নতার ধারণা ব্যক্তিমানুষ ও সমাজ-আন্দোলনে ধারণ করা আত্ম ও বিশ্ব সংক্রান্ত ব্যাখ্যাগুলোকে প্রভাবিত করেছে। এহেন ‘অপরিশুদ্ধ’ মিশ্রণই এক বিবিধ-বিচিত্র ঘটনা-প্রতীতি-ক্ষেত্রকে বিচ্ছিন্নতা নামক ধারণাটির সঙ্গে জুড়ে দিয়েছে।

  • ভাষিক ব্যবহার অনুসারে, একজন সেই মাত্রাতেই আত্মসত্তা থেকে বিচ্ছিন্ন যে মাত্রাতে সে তার ‘প্রকৃত’ সত্তা অনুসারী আচরণ না করে ‘মেকী’ বা ‘কৃত্রিম’ আচরণ করে, বা যে মাত্রায় সে ‘নিজের আপন’ নয় বা সেভাবে অভিজ্ঞতালব্ধ নয় এমন আকাঙ্ক্ষার দ্বারা তাড়িত হয়। তখন সেই জন (রুশো-র সমালোচনাত্মক বিধানের নির্ণয় মোতাবেক) ‘অপরের অভিমত-বৃত্তে’ জীবন কাটায়, ‘নিজসত্তার বৃত্তে’  জীবনযাপন করে না। এই ধারণা অনুযায়ী, ভূমিকা-নির্দিষ্ট আচরণ ও আনুগত্যবাদ বিচ্ছিন্নকৃত বা কৃত্রিম আচরণের উদাহরণ। আবার, পণ্যভোগ-নেশার সমালোচকরা যে ‘মিথ্যা প্রয়োজন’-এর কথা বলে থাকেন, তা-ও এই বিচ্ছিন্নতা রূপে তত্ত্বায়িত করা ঘটনা-প্রতীতি-ক্ষেত্রের অন্তর্গত।
  • সেইসব সম্পর্ককেই বিচ্ছিন্নকৃত বলে বর্ণনা করা হয় যেগুলোয় কোনো ব্যক্তি সেই সম্পর্কগুলোর খাতিরেই প্রবেশ করে না, যেগুলোর সঙ্গে সে নিজে ‘একাত্মতা’ বোধ করে না। কেবলমাত্র সময় নির্বাহ করে যাওয়ার ভাবনা নিয়ে থাকা শ্রমিক, উদ্ধৃতি-পঞ্জীতে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে প্রকাশনার পর প্রকাশনা করে যাওয়া বিদ্যাচর্চক, এক মুহূর্তের জন্য দর্শনীর পরিমাণের চিন্তা থেকে মুক্ত না হতে পারা চিকিৎসক--- এরা প্রত্যেকেই তাদের কৃত্য কাজের থেকে বিচ্ছিন্ন। আর কেউ যদি নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে কোনো বন্ধুত্বকে লালন করে, তাহলে সে বন্ধু-বলে-ভাবা ব্যক্তিটির সঙ্গে একটি বিচ্ছিন্নকৃত সম্পর্ক পালন করছে।
  • নিজ সামাজিক ব্যাপৃতির সঙ্গে কোনো ব্যক্তিমানুষের অসংলগ্নতার কথাও বিচ্ছিন্নতা বলে বলা হতে পারে। এই অর্থে কোনো একজন নিজের জীবনসঙ্গীর থেকে বিচ্ছিন্নকৃত হতে পারে, নিজের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্নকৃত হতে পারে, বা নিজের উৎস-স্থান, গোষ্ঠীসমাজ, সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল থেকে বিচ্ছিন্নকৃত হতে পারে। আরো নির্দিষ্ট করে বললে, একজন ব্যক্তিমানুষ যখন তার বাস-পরিমণ্ডলের সামাজিক বা রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ‘নিজস্ব আপন’ বলে আঁকড়ে ধরতে পারে না ও একাত্মতাবোধ করতে পারে না, তখন আমরা বিচ্ছিন্নতার কথা বলে থাকি। সামাজিক নিঃসঙ্গতা বা ব্যক্তিগত একান্ততার জন্য মাত্রাতিরিক্ত গরজও বিচ্ছিন্নতার উপসর্গ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। কিছুটা কল্পনারঙিন করে বললে, বিচ্ছিন্নতাকে ‘শিকড়হীনতা’ ও ‘গৃহহীনতা’-র প্রকাশ হিসেবে কখনো কখনো ধরা হয়ে থাকে, যে অর্থে বিচ্ছিন্নতার উৎপত্তিস্থল হিসেবে রক্ষণশীল সংস্কৃতি-সমালোচকরা আধুনিক জীবনের জটিলতা বা পরিচয়হীনতাকে বা কেবলমাত্র গণজ্ঞাপনমাধ্যমের অক্ষিকাচের ভেতর দিয়ে দৃষ্ট বিশ্বের ‘কৃত্রিমতা’-কে চিহ্নিত করে থাকেন।
  • মানুষদের নিজেদের মধ্যে এবং বাকি বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্কগুলোর নির্ব্যক্তিকরণ (depersonalization) ও বিমূর্তকে মূর্ত বাস্তব বলে গণ্যকরণ (reification) বিচ্ছিন্নকৃত বলে গণ্য করা হয়ে থাকে যে মাত্রায় সে সম্পর্কগুলো আর প্রত্যক্ষভাবে কাজ করে না, বরং ধরা যাক, অর্থ (money)-এর মধ্যস্থতার মধ্য দিয়ে কাজ করে, যে মাত্রায় সে সম্পর্কগুলো ‘মূর্ত’ না হয়ে ‘বিমূর্ত’ হয়, অবিচ্ছেদ্য না হয়ে বিনিময়যোগ্য বস্তু হিসেবে জাহির হয়। বাজারী বিনিময়ের বস্তু ছিল না এমন ক্ষেত্র বা বস্তুর পণ্যায়ন এই অর্থে বিচ্ছিন্নতার উদাহরণ হয়। সমমূল্যতার সম্পর্কাবলীর (যেভাবে থিওডোর অ্যাডোর্নো তা হাজির করেছেন) অধীনস্থ বুর্জোয়া সমাজ বস্তুদের ও মানুষদের স্বতন্ত্রতাকে ধ্বংস করে, তাদের বিশেষত্ব ও বিকল্পহীনতাকে ধ্বংস করে--- এই দাবি মার্কসবাদের গণ্ডীর বাইরেও বিচ্ছিন্নতা সম্পর্কিত সমালোচনাত্মক আলোচনায় তোলা হয়ে থাকে।
  • গ্যেটে-র সমসময়েই অন্যতম চালু ধারণা হিসেবে বিচ্ছিন্নতা বলতে বোঝাত ‘সমগ্র মানবসত্তা’-র হানি, বিশেষীকৃত শ্রম-বিভাজনের জন্য ঘটা ক্রিয়ার খণ্ডিতকরণ ও সংকোচন এবং একইসঙ্গে তার ফলে ঘটা মানুষের সক্ষমতা ও প্রকাশ-সম্ভাবনা অনুপলব্ধ থেকে যাওয়া। কেবলমাত্র যন্ত্রের একটি নাটবল্টুতে পরিণত হওয়া বিচ্ছিন্নকৃত শ্রমিকের ব্যক্তিসত্তা ধ্বংস হয় এবং তার কাজ দাঁড়ায় এমন এক বৃহত্তর প্রক্রিয়ার মধ্যে সংকীর্ণ আংশিক কিছু ভূমিকা পালন করে চলা, যে বৃহত্তর প্রক্রিয়ার সমগ্রটা কখনোই তার দৃষ্টিগোচর হয় না এবং যার উপর তার কোনো নিয়ন্ত্রণও থাকে না।
  • সেই সমস্ত সম্পর্কাবলীকে বিচ্ছিন্নকৃত বলে বর্ণনা করা যায় যার মধ্যে প্রতিষ্ঠানগুলোই সর্বক্ষমতাধর হিসেবে দেখা দেয় বা যেখানে ব্যবস্থাগত বাদ্ধতার বাঁধনে স্বাধীন ক্রিয়ার কোনো অবকাশ থাকে না। এই অর্থে ধরলে, বিচ্ছিন্নতা বা বিমূর্তকে মূর্ত বাস্তব বলে ধরে নেওয়া (reification) এমন এক অবস্থার কথা বোঝায় যেখানে সম্পর্কগুলো সেগুলোর গঠনকারীদের থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীন অস্তিত্ব (Verselbstandigung) ধারণ করে তাদের মাথায় চেপে বসে ছড়ি ঘোরাতে থাকে। কোনো ‘প্রাণহীন দাম্পত্য’ এই অর্থেই বিচ্ছিন্নতার ঘটনা-প্রতীতি হয়ে ওঠে, ঠিক যেমন আধুনিক গণতন্ত্রগুলোর কিছু কিছু প্রশাসনিক পর্যদও তার উদাহরণ: জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্রের আমলাতান্ত্রিক ‘লোহার খাঁচা’ বা অর্থনৈতিক বাধ্যতার বাঁধনে স্বাধীন ক্রিয়ার সম্ভাবনা লোপাট করে দেওয়া তেমনই কিছু নিদর্শন।
  • ‘অসংগতি’ (‘absurd’)-কেও বিচ্ছিন্নতা নামে চিহ্নিত ঘটনা-প্রতীতি-পরিবারের একটি সদস্য হিসেবে ধরা যেতে পারে। ফ্রানজ কাফকা, স্যামুয়েল বেকেট ও আলবেয়ার কামু দ্বারা সৃষ্ট চরিত্রগুলো সেই সমস্ত সাহিত্যগত ব্যক্তিচরিত্রের সবচেয়ে বিখ্যাত উদাহরণ যারা সম্পূর্ণ বিযুক্তি ও অর্থহীনতার অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছে।

বিচ্ছিন্নতার তত্ত্ব: ‘কালচেতনায় সংকট’

তাহলে বিচ্ছিন্নতা মানে কী? ‘মনে হয় যেনবা যখনই কিছু যা হওয়ার কথা তা হচ্ছে না, তখনই তিনি তাকে বিচ্ছিন্নতা বলে অভিহিত করছেন’--- এরিক ফ্রম সম্পর্কে রিচার্ড শ্যাচ্ট-এর করা এই মন্তব্য ফ্রম ছাড়াও অন্য বহুজন প্রায়শই যেভাবে এই ধারণাটি ব্যবহার করে থাকেন তার একটি উপযুক্ত ব্যাখ্যান হতে পারে। যতই বিবিধ-বিচিত্র এই ঘটনা-প্রতীতি হোক না কেন, তা অবশ্য বিচ্ছিন্নতা ধারণাটি সম্পর্কে একটি প্রাথমিক খসড়াচিত্র হাজির করে। বিচ্ছিন্নকৃত সম্পর্ক হল নিজের সঙ্গে, জগতের সঙ্গে ও অপরের সঙ্গে এক ধরনের খামতির সম্পর্ক। নির্লিপ্তি, অন্যকে যন্ত্রবৎ ব্যবহার করা, বিমূর্তকে মূর্ত বাস্তব বলে ধরে নেওয়া, অসংগতি, কৃত্রিমতা, নিঃসঙ্গ বিযুক্তি, অর্থহীনতা, অনুর্বরতা--- এই নানাভাবে প্রদত্ত সম্পর্ককে চরিত্রায়িত করা হল খামতিকেই নানা রূপে ধরতে চাওয়া। বিচ্ছিন্নতা ধারণাটির একটি বৈশিষ্ট্যমূলক চরিত্র হল যে তা কেবল ক্ষমতাহীনতা ও স্বাধীনতাহীনতার কথাই বলে না, আত্ম ও বিশ্বজগতের সঙ্গে সম্পর্কের এক স্বভাবগত খামতির কথাও বলে। (মার্কস যখন বিচ্ছিন্নতাকে জগৎ ও মানুষের ‘বাস্তবতার দ্বিগুণ ক্ষয়’ বলে বর্ণনা করেছিলেন, তখন তাঁর অভিপ্রেত দ্বৈত অর্থকে এভাবেই বোঝা উচিত বলে মনে হয়: অবাস্তব হয়ে ওঠার মধ্য দিয়ে ব্যক্তিমানুষের অভিজ্ঞতায় সে নিজে আর ‘কার্যকরী’ বলে মনে হয় না, আর, অবাস্তব হয়ে ওঠা জগৎও নির্লিপ্ত অর্থহীন হয়ে ওঠে।) এহেন আন্তর্সম্পর্কগুলোর জটিলতাই বিচ্ছিন্নতাকে আধুনিকতার সংকট নির্ধারণের কাজে মূল ধারণা করে তুলেছে এবং সমাজদর্শনেও অন্যতম ভিত্তিগত ধারণা হিসেবে জায়গা করে দিয়েছে।

সমকালীন চেতনাসংকটের একটি অভিব্যক্তি (হেগেল হয়ত এভাবেই বলতেন) হিসেবে বিচ্ছিন্নতা নিয়ে আধুনিক আলোচনা রুশো ও শিলার থেকে হেগেল হয়ে কিয়ের্কগার্ড ও মার্কস অবধি বিস্তৃত। আঠারো শতকের পর থেকে শিল্পায়ন-বিকাশের হাত ধরে মানুষের নিজের সঙ্গে ও জগতের সঙ্গে সম্পর্কের মধ্যে ‘অনিশ্চয়তা, খণ্ডিতকরণ ও আভ্যন্তরীণ বিভাজন’-এর বাড়বাড়ন্ত বোঝাতে ‘সভ্যতার সবচেয়ে বড় অসুখ’-এর স্বীকৃতি আদায় করে নেওয়া বিচ্ছিন্নতা একটি চালু লব্জে পরিণত হয়েছে। এহেন অসুখনির্ণয়কেই মার্কস তাঁর বিচ্ছিন্নতার তত্ত্বে ধারণ করে পুঁজিবাদের সমালোচনায় কাজে লাগিয়েছিলেন। আর, ‘আধুনিক মানুষের নিজ আবশ্যিক সংজ্ঞা বা উদ্দেশ্যময়তা খুইয়ে বসা’-কে ঘিরে আপন সত্তায় স্থিত হওয়া বলতে কী ও আপন সত্তাকে হারিয়ে ফেলা বলতেই বা কী এহেন অস্তিত্ববাদী প্রশ্নগুলো কিয়ের্কগার্ডকে অনুসরণ করে ক্রমশ চেহারা পেয়েছে। এই পরম্পরা অনুযায়ী, নির্লিপ্তি ও চরম বাস্তুহীনতার অভিজ্ঞতা হল জগৎ এবং আত্মসত্তা ও জগতের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক বিষয়ে সত্তাতাত্ত্বিক (ontological) পরিসরের একটি ভুল-বোঝাবুঝি, তার চেয়ে কম কিছু নয়, যে ধারণার সঙ্গে মার্কসীয় নির্ধারণের বিবিধ অমিল সত্ত্বেও মিলের জায়গাও কিছু আছে। আধুনিক অবতারে বিচ্ছিন্নতার নির্ধারণসমূহ, যেমন ধরা যাক, সবসময় স্বাধীনতা, আত্মনির্ধারণ ও তা বাস্তবায়নে ব্যর্থতা নিয়ে ভাবিত। এইভাবে দেখলে, বিচ্ছিন্নতা কেবলমাত্র আধুনিকতার সমস্যা নয়, তা একটি আধুনিক সমস্যাও বটে।

বিচ্ছিন্নতার তত্ত্বের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

বিচ্ছিন্নতার আধুনিক তত্ত্বের একটি (অতি) সংক্ষিপ্ত ইতিহাস এভাবে দেওয়া যেতে পারে:

বিচ্ছিন্নতা শব্দটি রুশো-র লেখায় কোথাও ব্যবহৃত না হলেও, রুশো-র কাজের মধ্যে আমরা সেই সমস্ত মূল ধারণাকেই খুঁজে পাব যেগুলো অতীত ও বর্তমানের বিচ্ছিন্নতা সম্পর্কিত সমস্ত তত্ত্বায়ন (সমাজ-দার্শনিক অর্থে) অবলম্বন করেছে। রুশো তাঁর ‘Discourse on the Origin of Inequality Among Men’ (১৭৫৫) বইটি শুরু করেছিলেন একটি চিত্তাকর্ষক প্রতিমা দিয়ে: ‘গ্লকাস-এর মূর্তি কাল, সমুদ্র ও ঝড়ের প্রকোপে ক্ষয়িত হতে হতে যেমন ঈশ্বরের চেয়ে হিংস্র জানোয়ারের কাছাকাছি চলে এসেছিল, মানবসত্তারও তেমনই অবস্থা। সমাজক্রোড়ে চির-পুনরাবৃত্ত হাজারো কারণে বদলাতে বদলাতে, জ্ঞান ও ভ্রান্তির পাহাড় অধিগ্রহণ করতে করতে, দেহের গঠনে ঘটে যাওয়া বদলের সূত্রে, আবেগ-উচ্ছ্বাসের লাগাতার ধাক্কায় মানবসত্তা বলতে গেলে এমনভাবে রূপ-বদল করেছে যে তাকে আর প্রায় চেনাই যায় না।’১০ রুশো এখানে যে রূপ-বদল বা রূপ-বিকৃতির কথা বলছেন, তা হল সমাজের দ্বারা মানুষের বিকৃতিসাধন: তার স্বভাবপ্রকৃতি যখন বিভাজিত হয়ে যায়, তার নিজের প্রয়োজনগুলো থেকে যখন সে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, সমাজের বশ্যতাকামী অধ্যাদেশসমূহের কাছে যখন তাকে আত্মসমর্পণ করতে হয়, স্বীকৃতি-অভিলাষী যে মানুষ তখন আত্ম-মূল্যের মাপ অপরদের মতামতের উপর নির্ভরশীল করে তোলে, তার সামাজিক সত্তা তখন কৃত্রিম বিকৃত রূপ ধারণ করে। সভ্য মানুষদের পারস্পরিক নির্ভরশীলতা, সমাজ-সংস্পর্শের মধ্য দিয়ে অবারিত অসীম হয়ে ওঠা প্রয়োজনসমূহ, আর অন্যকে দেখে নিজের দিক-দিশা নির্ণয় করার অভ্যাস মানুষের মধ্যে আধিপত্য ও দাসত্বের জন্ম দেয়, খাঁটি স্বকীয়তার ক্ষয় ঘটিয়ে (স্ব-)বিচ্ছিন্নতার জন্ম দেয়--- অন্যভাবে বললে, এমন এক অবস্থার জন্ম দেয় যা স্বয়ংসম্পূর্ণতা প্রদানকারী স্বাধীন অকৃত্রিম প্রকৃতিরূপের সম্পূর্ণ বিরোধী।

দুটি আপাতবিরোধী ভাবনা রুশো-র চিন্তাকে বিচ্ছিন্নতার তত্ত্বক্ষেত্রে প্রভাবশালী করে তুলেছে: প্রথমত, নিজের সঙ্গে ও স্বপ্রকৃতির সঙ্গে নির্বিঘ্ন বোঝাপড়ার চাহিদা যথার্থতা (authenticity)-র আধুনিক আদর্শ হিসেবে বিকশিত হওয়া, আর দ্বিতীয়ত, সামাজিক চুক্তি-র প্রধান কর্তব্য হিসেবে রুশো-র দ্বারা সূত্রায়িত সামাজিক স্বাধীনতার ভাবনা। রুশো যদিবা ‘Second Discourse’-এ সামাজিকীকরণের (তাঁর বিবেচনায়) সম্পূর্ণ নঙর্থক প্রভাবগুলোর বিচ্ছিন্নকৃত চরিত্র বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছেন, তিনিই আবার ‘Social Contract’-এ বিচ্ছিন্নকৃত নয় এমন সামাজিকীকরণের এমন আদর্শ রূপ উদ্ভাবন করেছেন। রুশোর চিন্তার মধ্যে কাজ করতে থাকা টানাপোড়েনগুলোকে অস্বীকার না করেও তাঁর উপরোক্ত দুটি ভাবনার মধ্যে যোগসূত্র এভাবে বর্ণনা করা যায়: যথার্থ সত্তায় স্থিতি (authentic selfhood) এবং সমাজের মধ্যে যে ফাঁকের কথা রুশো অত বাকপটুতার সাথে তুলে ধরেছিলেন, তা তাঁর নিজের পূর্বানুমানসমূহ অনুযায়ীই এমন এক অমীমাংসিত আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের জন্ম দেয় যার সমাধান একমাত্র হতে পারে এমন শর্ত প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে যেখানে ব্যক্তিমানুষেরা নিজেদের অভিজ্ঞতায় তাদের আপন বলে বোধ করবে এমন সামাজিক প্রতিষ্ঠানাদির মধ্যেই বাস করে। একদিকে যেমন রুশো-বর্ণিত বিচ্ছিন্নকৃত মানুষ যে মাত্রায় অপরদের সঙ্গে সম্পর্কস্থাপন করে সেই মাত্রাতেই নিজেকে খুইয়ে বসে: প্রাকৃতিক মানুষ ‘নিজের মধ্যে বাঁচে; সমাজমুখী মানুষ সর্বদা নিজের বাইরে বাঁচে’১১; অন্যদিকে তেমনই, মানুষ একমাত্র সমাজের মধ্য দিয়েই নিজেকে ফিরে পেতে পারে। প্রকৃতির নিজ আত্মসম্পূর্ণতার অবস্থা--- এবং তারই সঙ্গে অন্যদের থেকে স্বাধীন ও বিচ্ছিন্ন থাকার স্বাধীনতা--- পুনর্প্রতিষ্ঠার জন্য যেহেতু অতি কড়া মূল্য চুকোতে হয় (যেমন, যুক্তি ও বিবেচনা-পুনর্বিবেচনা করার ক্ষমতার মতো বিশেষভাবে মনুষ্যোচিত গুণ হারানোর মূল্য)১২, তাই বিচ্ছিন্নতার সমস্যার সমাধান সামাজিক বন্ধন ছিঁড়ে ফেলার মধ্যে থাকতে পারে না, বরং সামাজিক বন্ধনগুলোর রূপান্তরসাধনের মধ্যেই থাকতে পারে। সামাজিকীকৃত ব্যক্তিমানুষদের মধ্যে যে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা বিচ্ছিন্নতাপ্রদ হিসেবে অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, তা কোন ভাবনা অনুযায়ী রূপান্তর করে নেওয়া প্রয়োজন, তা ‘Social Contract’-এ বিধৃত হয়েছে। ভাবনাটি হল এমন এক সমাজ-সমিতি গঠন যেখানে প্রতিটি ব্যক্তিমানুষ তার সমস্ত অধিকারকে সমাজের কাছে বন্ধক রেখে ‘আবার আগের মতো স্বাধীন’ হয়ে উঠেছে। যা একসময় ছিল বিচ্ছিন্নতাপ্রদ ভিন্নতা, তা রূপান্তরিত হল ‘নিজ আপন আইন’-এর কাছে বশ্যতাস্বীকার। রুশো-র চিন্তা তাই তাঁর অনুগামীদের দুটি ভিন্ন দিকে চালিত করেছে। এক দিকে যেমন রুশো (বিশেষত ‘রুশোবাদী মতবাদ’) মানে বিচ্ছিন্নতাবাদী সমালোচনার অবিরত পুনরাবর্তিত রূপ যা ‘সর্বজনীন’-এর থেকে মুখ ঘুরিয়ে অবিকৃত প্রকৃতি বা আদিম স্বয়মসম্‌পূর্ণতার আদর্শ অবলম্বন করে এবং সমাজমুখীনতা ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানাদিকে মজ্জাগতভাবে বিচ্ছিন্নকৃত বলে গণ্য করে; অন্যদিকে তেমনই রুশো কেবল কান্ট-এর স্বায়ত্তশাসনের ধারণারই নয়, স্বাধীনতার সামাজিক চরিত্র বিষয়ে হেগেল-এর ধারণারও প্রেরণা হিসেবে কাজ করে।

‘সর্বজনীনের মধ্যে আত্মোপলব্ধি’-র ধারণা অবশ্য অবশেষে হেগেল-এর হাতেই রূপ পেয়েছিল। হেগেল-এর ধারণামতেও বিচ্ছিন্নতা হল আধুনিকতার অন্যতম চরিত্রবৈশিষ্ট্য--- আধুনিক চেতনার খণ্ডায়ন, টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়ার মুখে দাঁড়িয়ে থাকা এক ‘সভ্য সমাজ’ (civil society)-এর মধ্যের সম্পর্কসমূহে ‘বিশেষ’ ও ‘সর্বজনীন’-এর জোড় খুলে আলাদা হয়ে যাওয়া, এসব তার লক্ষণ; কিন্তু হেগেল এই সমস্যার মূলকেন্দ্র সমাজের মধ্য দিয়ে ব্যক্তিমানুষের আত্মসত্তা খুইয়ে ফেলার মধ্যে অবস্থিত বলে চিহ্নিত করার বদলে ব্যক্তিমানুষ ও সমাজের মধ্যবর্তী ফাটলে অবস্থিত বলে চিহ্নিত করেছেন। হেগেল-এর বিবেচনামতে, বিচ্ছিন্নতা (বা আভ্যন্তরীণ বিভাজন) হল সমাজজীবনের একটি ঘাটতি বিশেষ (Sittlichkeit), ‘সমাজজীবনে নৈতিক সর্বজনীনতার হানি’ (sittlicher Allgemeinheit)। এই পরিপ্রেক্ষিতে, নৈতিকতার বিচারে সন্তুষ্টিদায়ক এক সমাজের ধারণা প্রাগাধুনিক জনগোষ্ঠীদের সহজাত প্রকৃত-পর্যাপ্ত নৈতিক সংহতির (যেমন, গ্রাগাধুনিক গ্রিক polis-এর সংহত নৈতিক জীবন) উপর নির্ভরশীল নয়, বরং সামাজিক সংহতির এমন এক রূপের উপর নির্ভরশীল যা ‘ব্যক্তিমানুষের বিশেষত্বের অধিকার’-এর প্রতি সুবিচার করতে পারে। হেগেল যে অণুবাদ (atomism) বর্জন করেছিলেন, তা এই ধারণার উপর ভিত্তি করে যে ব্যক্তিমানুষেরা ব্যতিক্রমহীনভাবে সর্বদা সম্পর্কাবলীর মধ্যে নিমজ্জিতরূপেই নিজেদের খুঁজে পায়,১৩ এই সম্পর্ক-নিমজ্জনের উপলব্ধিই (বিবিধ অর্থে) তাদের স্বাধীনতার শর্তাবলী হিসেবে কাজ করে।

রুশো-র দ্বারা উপস্থাপিত সমস্যাগুলো নিয়ে যখন হেগেল বিবেচনা করতে বসলেন, তিনি রুশো-র সূচনাবিন্দুটিকে রূপান্তরিত করে নিলেন এইভাবে: তিনি ধরে নিলেন যে স্বাধীনতা মানে নৈতিক সমাজজীবন (Sittlichkeit) আর নৈতিক সমাজজীবন মানে স্বাধীনতা; আমাদের নিজেদের ব্যক্তিবিশেষ হিসেবে স্ব-উপলব্ধি করা সর্বপ্রথম সম্ভবপর হয়ে ওঠে যে সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কল্যাণে, সেই সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে এবং মাধ্যমেই আমরা স্বাধীন হয়ে উঠি। তখনও অণুবাদী স্তরে রয়ে যাওয়া রুশো-র যথার্থতা (authenticity)-র আদর্শ প্রতিস্থাপিত হল এমন এক দৃষ্টিকোণ দিয়ে যা নৈতিক সমাজজীবনের প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে ব্যক্তিমানুষদের একাত্মতাবোধের মধ্যেই আত্মোপলব্ধির অবস্থান চিহ্নিত করল। যদিও হেগেল-এর তত্ত্ব আত্মসম্পূর্ণতা হিসেবে বর্ণিত স্বাধীনতার আদর্শকে অতিক্রম করতে উদ্যোগী, তবুও তা কান্ট-এর আত্মনির্ধারণের ধারণাকে অন্তর্ভুক্ত করে নিতে চায়: তার লক্ষ্য হল সেই সমস্ত শর্তাবলী নির্ধারণ করা যা সামাজিক প্রতিষ্ঠানাদির মধ্যে ‘নিজেকে ফের খুঁজে পাওয়া’ সম্ভবপর করে তুলবে। হেগেল-কথিত ‘Bildung’-এর ধারণা এমন এক প্রক্রিয়ার কথা বলে যার মধ্য দিয়ে ব্যক্তিমানুষেরা তাদের প্রাথমিক পর্বের নির্ভরতার সম্পর্কগুলোর বৃত্তের বাইরে বের হওয়ার পথ তৈরি করে, বের হয়ে আসে এবং তাদের সামাজিক সম্পর্কাবলী, যা তাদের ‘নিজত্ব’-এর শর্তাবলীও বটে, সেই সামাজিক সম্পর্কাবলীকেই নিজস্ব আপন করে নেয়।১৪

বিচ্ছিন্নতার তত্ত্বের হেগেল-পরবর্তী দুটি ধারা কিয়ের্কগার্ড ও মার্কস-এর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এঁরা দুজনে হেগেল-এর প্রকল্পের দুটি ভাষ্য অবলম্বন করেছেন যা মানবপ্রকৃতি সম্পর্কে একটি নির্দিষ্ট ধারণাকে সূচনাবিন্দু হিসেবে ধরে নিয়েছে।১৫ সন্দেহ নেই যে উনিশ শতকের শেষার্ধে এসে ‘বাস্তব অস্তিত্ব’ ও ‘বাস্তবের সক্রিয় মানুষ’-এর উপর যে জোর পড়েছিল, তা তাঁদের দুজনকে দুটি ভিন্ন অভিমুখে চালিত করেছিল: মার্কস-এর চিন্তার অর্থনীতি অভিমুখে বাঁক নেওয়া এবং কিয়ের্কগার্ড-এর চিন্তায় মানব-অস্তিত্বের নৈতিক মাত্রাবলী নিয়ে উদ্বেগ একে অপরের বৈপরীত্য তৈরি করেছিল। আভ্যন্তরীণ বিভাজন, নির্লিপ্তি, নিজসত্তা ও জগতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হওয়া--- এই সমস্যাবলীর উপর বিচ্ছিন্নতার তত্ত্ব যেভাবে মনোনিবেশ করেছিল তা উভয় দার্শনিককেই ব্যবহারিক উপযোজন-এর প্রসঙ্গাভিমুখে ঠেলে দিয়েছিল। কিয়ের্কগার্ড ‘নিজসত্তা হয়ে ওঠা’ (becoming oneself)-কে নিজ আপন সক্রিয়তা ও নিজ আপন ইতিহাস উপযোজন করার সাপেক্ষে বুঝেছিলেন--- ‘নিত্য ব্যবহারে আপনাকে মুঠোয় ধরা’-র এমন এক প্রক্রিয়া হিসেবে দেখেছিলেন যা বিজাতীয় বলরাজির দ্বারা উদ্ভূত যা কিছু তার উপর সক্রিয়ভাবে দখল কায়েম করবে। ঠিক তেমনই, মার্কস-এর ভাবনায় আমরা পাই বিশ্বের উৎপাদনশীল উপযোজনের ভাবনা যেখানে আত্মসত্তা অ-বিচ্ছিন্নকৃত অস্তিত্বের আদর্শরূপ হিসেবে কাজ করে।

সমকালীন বুর্জোয়া সমাজের প্রথানুগত্য-চাপিয়ে-দেওয়ার প্রবণতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে একজন ‘স্বতন্ত্র মানুষ’ (singular human being) হয়ে ওঠা হল কিয়ের্কগার্ড-এর নৈতিক আদর্শ। অন্যদিকে, মার্কস এগিয়েছেন মানুষের নিজ আপন মানবিক অন্তর্বস্তু উপযোজনের ভাবনাকে ধরে, যা আবার ‘প্রজাতি-স্থিতসত্তা’ (species-being) উপযোজনার পরিপ্রেক্ষিতে ভাবা হয়েছে (প্রজাতি-স্থিতসত্তা বা species-being মূলগতভাবে ফয়েরবাখ-এর দ্বারা প্রবর্তিত একটি ধারণা, যা হেগেল-উত্থাপিত নৈতিকতার বিচারে সন্তুষ্টিদায়ক সমাজজীবন বা Sittlichkeit-এর একটি স্বাভাবিকীকৃত সংস্করণ হিসেবে বোঝা যেতে পারে)। সুতরাং, বিচ্ছিন্নতার অস্তিত্ববাদী সমালোচনা-ধারার সূচনা ও প্রান্তিক বিন্দু উভয়ই হেগেল-মার্কস সমালোচনাধারার থেকে গুরুত্বপূর্ণভাবে আলাদা: হেগেল-মার্কস সমালোচনাধারায় যেখানে বিচ্ছিন্নতাকে বোঝা হচ্ছে সমাজজগৎ থেকে বিচ্ছিন্নতা হিসেবে, সেখানে অস্তিত্ববাদী সমালোচনাধারায় বারোয়ারি সমাজজগতের মধ্যে নিমজ্জনকেই বিচ্ছিন্নতার উৎস হিসেবে ধরা হয়েছে এই বোঝাবুঝির মধ্য দিয়ে যে সমস্তরীয় করে তোলার মধ্য দিয়ে সংজ্ঞাত এক বারোয়ারি জগতে পড়ার মধ্য দিয়ে (কিয়ের্কগার্ড) বা ‘মান্য সমষ্টিবর’ (das Man--- হেইডেগার)-এর শাসনাধীন হওয়ার মধ্য দিয়ে বিষয়ীর যথার্থতা হানি হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও বিচ্ছিন্নতার এই দুই সমালোচনাধারার মধ্যে বহু সাধারণ ছেদবিন্দুও বর্তমান (আর তা কেবল তাদের গ্রহণ-বর্জনের ইতিহাসের নিরিখেই নয়): হেগেল-এর আভ্যন্তরীণ বিভাজন সংক্রান্ত নির্ধারণ এই সিদ্ধান্তের দিকে নিয়ে যায় যে সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানাদির মধ্যে ব্যক্তিমানুষেরা নিজেদের আবার খুঁজে পেতে পারে না; ১৮৪৪ সালের পাণ্ডুলিপিতে মার্কস-এর বিচ্ছিন্নতা সম্পর্কিত বিশ্লেষণ দাবি করছে যে বিচ্ছিন্নকৃত শ্রমের মধ্যে থেকে আমরা আমাদের নিজেদের সক্রিয়তা, ক্রিয়াজাত উৎপাদ এবং যৌথ উৎপাদনের শর্তাবলী কোনোকিছুই উপযোজন করতে পারি না; বিচ্ছিন্নতার অস্তিত্ববাদী ধারা  প্রসূত ধারণা নির্দেশ করে সেই কাঠামোগত বাধাগুলোর দিকে যেগুলো ব্যক্তিমানুষদের কাছে জগৎকে তাদের নিজেদের আপন বলে বোঝার ক্ষেত্র অন্তরায় হয়ে ওঠে, সেই জগৎকে আকার দেওয়ার বিষয়ী হিসেবে নিজেদের মনে করার ক্ষেত্রেও অন্তরায় হয়ে ওঠে।

বিশ শতকে পাশ্চাত্যের মার্কসবাদ (Western Marxism)-এর বিভিন্ন ধারা-উপধারায় বিচ্ছিন্নতার আলোচনা (এবং সেই সূত্রে মার্কস-এর চিন্তার সামাজিক-দার্শনিক পরম্পরা) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এর মধ্যে দিয়ে সমাজ-সমালোচনার এমন এক আদর্শস্থাপক মান (normative dimension) হাজির হওয়ার সম্ভাবনা খুলে গিয়েছিল যা বিকশিততম পুঁজিবাদ সম্পর্কে সমালোচনাত্মক তত্ত্ব নির্মাণে মৌলিক গুরুত্বের ভূমিকা পালন করতে পারে। সেই ১৯২০ সালেই, মার্কস-এর ১৮৪৪ সালের পাণ্ডুলিপির বিচ্ছিন্নতা বিষয়ক বিবরণ তখনও তাঁর অজানা,১৬ তখনই গিয়র্গ লুকাচ তাঁর ‘Reification and the Consciousness of the Proletariat’ নামক বিখ্যাত প্রবন্ধে পণ্য-ভক্তিবাদ (commodity fetishism) সম্পর্কিত মার্কস-এর আলোচনাকে বিস্তৃত করে বিচ্ছিন্নতা এবং বিমূর্তকে মূর্ত বাস্তব বলে গণ্য করা (alienation and reification) সংক্রান্ত তত্ত্বে পৌঁছেছিলেন।১৭ এই তত্ত্বায়নে তাঁর কেন্দ্রীয় সম্পাদ্য ছিল যে ‘পণ্য রূপের সর্বজনীনতা’ আধুনিক সমাজের স্বাতন্ত্র্যসূচক বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছে, এর যুক্তিগত বিস্তারের মধ্য দিয়ে বিমূর্তকে মূর্ত বাস্তব বলে গণ্য করার তত্ত্বই আধুনিক পুঁজিবাদী সমাজ ও তার সমস্ত অভিব্যক্তির তত্ত্ব হয়ে ওঠে। লুকাচের উপর ম্যাক্স ওয়েবার-এর যুক্তিসিদ্ধকরণের তত্ত্ব (theory of rationalization) এবং গিয়র্গ সিম্মেল-এর বস্তুরূপান্তরকরণ (Versachlichung/ objectification) সংক্রান্ত নির্ধারণ প্রভাব ফেলেছিল। সেই প্রভাবের ফলে মার্কস-এর থেকে তিনি কিছুটা আলাদা ধারণা পোষণ করেছিলেন যখন তিনি নির্লিপ্তি, বস্তুরূপান্তরকরণ, পরিমাণ সূচক মাপে মাপা (quantification) এবং বিমূর্তায়ন-এর মতো ঘটনা-প্রতীতিগুলোকে এমনই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেছিলেন যা পুঁজিবাদী বাজার অর্থনীতি ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক বুর্জোয়া সমাজের সমস্ত সম্পর্ক ও অভিব্যক্তিরূপের নির্ধারক চরিত্রবৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছে। ওয়েবার লোহার খাঁচার প্রতিমায় বোঝাতে চেয়েছিলেন কীভাবে আমলাতান্ত্রিকতায় বাঁধা পুঁজিবাদী সমাজে মানুষ বন্দি হয়েছে; সিম্মেল বলেছিলেন এক ‘বিয়োগান্ত সংস্কৃতি’ (tragedy of culture)-র কথা যেখানে মানুষের স্বাধীনতার উৎপাদগুলোই এমন স্বাধীন বস্তুগত অস্তিত্ব ধারণ করে নেয় যা মানুষের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে মানুষের ঘাড়ে চেপে বসে; সিম্মেলই বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছিলেন কীভাবে অর্থ-মাধ্যম অর্থনীতি (money economy)-র বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে স্বাধীনতা তার সমস্ত অর্থ হারিয়েছে--- লুকাচ তাঁর সমসময়ে প্রতীয়মান ঘটনা-প্রতীতিগুলোর মধ্যে এই সমস্তকিছুই মূর্তভাবে ফুটে উঠতে দেখছিলেন। মার্কসবাদী ও অস্তিত্ববাদী ভাবনাকল্পগুলোর ছেদবিন্দু হয়ে ওঠাই লুকাচের চিন্তাধারার স্বাতন্ত্র্যদায়ী বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছিল,১৮ আর সহজেই বোঝা যায় যে এই তাত্ত্বিক মিশ্রণ সমালোচনাত্মক তত্ত্ব (Critical Theory)-র পরবর্তী বিকাশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল, এমনকি আজও বিচ্ছিন্নতার ধারণার বিভিন্ন রূপভেদ বোঝার জন্য তা একইরকম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে আছে।১৯

 

টীকা

১। ইজরায়েল ও মাস, Der Begriff Entfremdung।

২। হাবেরমাস, Erlauterungen zur Diskursethik, পৃঃ ৪৮।

৩। ম্যাকিনটায়ার, Marxism, পৃঃ ২৩।

৪। ‘অভিজ্ঞতামূলক বিষয়বস্তু’ (experiential content) অভিব্যক্তিটি আমি নেগট ও ক্লুগ, Offentlichkeit und Erfahrung -থেকে ধার করেছি। এর মধ্য দিয়ে, সেইসব ধারণাকে বোঝানো হচ্ছে যা অভিজ্ঞতা অর্জন সম্ভবপর করে তোলে এবং, ঘুরিয়ে আবার, এই ধারণার মধ্যেই প্রাণসঞ্চার করে।

৫। রেমন্ড গেউস, Gluck und Politik, পৃঃ ৫৬-এ যেমন বলেছেন, সমস্ত কৌতূহলপ্রদ দার্শনিক ধারণাই ‘অপরিশুদ্ধ’।

৬। শ্যাচ্ট, Alienation, পৃঃ ১১৬।

৭। নিকোলাস, Hegel’s Theorie der Entfremdung, পৃঃ ২৭।

৮। দেউনিস্যেন, Selbstverwirklichung und Allgemeinheit।

৯। রুশো-র ব্যাখ্যাকারদের মধ্যে এ নিয়ে কোনো মতের ভিন্নতা নেই। যেমন, হানস বার্ত-এর বর্ণনায় রুশো হলেন ‘avant la lettre’ ‘বিচ্ছিন্নতার তাত্ত্বিক’ (বার্ত, Wahrheit und Ideologie, পৃঃ ১০৫) । আর, ব্রোনিস্লাভ ব্যাকজকো-র মতে, ‘(বিচ্ছিন্নতা নামক এই) হেগেলিয়-মার্কসিয় শব্দবন্ধটি একেবারে খাপেখাপে এঁটে যায় সেই অবস্থার সঙ্গেই যা রুশো কোনো নাম না দিয়েই অনবরত বর্ণনা করে গেছেন’ (ব্যাকজকো, Rousseau, পৃঃ ২৭) ।

১০। রুশো, The Discourses, পৃঃ ১২৪।

১১। রুশো, The Discourses, পৃঃ ১৮৭।

১২। ফ্রেডরিখ নয়হোউসার তাঁর Foundations of Hegel’s Social Theory বইয়ের ৫৫-৮১ পৃষ্ঠায় রুশো-র চিন্তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এই বিষয়টি অত্যন্ত জোরের সাথে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

১৩। সামাজিক দর্শনে ‘অণুবাদ’ (atomism) বিষয়ক আলোচনার জন্য দ্রষ্টব্য: টেলর, What’s Wrong with Negative Liberty, পৃঃ ২১১-২২৯।

১৪। আমি এখানে সমকালীন সমাজের একটি সমস্যা হিসেবে হেগেল-এর বিচ্ছিন্নতা সম্পর্কিত বিচার নিয়ে কথা বলছি। অন্যদিকে, তাঁর বিচ্ছিন্নতা সম্পর্কিত দার্শনিক ধারণাটি এমন এক কাঠামো প্রদর্শন করে যা মার্কস-এর ধারণাকেও প্রভাবিত করেছে, তা হল এইরকম: বিচ্ছিন্নতা হল আত্মা (Spirit)-র আত্মবিচ্ছিন্নতা, যার ফলে সে নিজের উৎপাদ-কে নিজের বলে চিনতে পারে না। বিবেচনার এই স্তরে, বিচ্ছিন্নতার ধারণাটিকে বাধ্যতামূলকভাবে নিন্দাকর বা আদর্শস্থাপক কোনোভাবেই প্রয়োগ করা হয় না। হেগেল-এর বিচ্ছিন্নতার তত্ত্বের বিবিধ দিক দেখার জন্য দ্রষ্টব্য: নিকোলাস, Hegel’s Theorie der Entfremdung।

১৫। ল্যয়িথ, From Hegel to Nietzsche, পৃঃ ১৩৫-১৩৯।

১৬। ১৮৪৪ সালের পাণ্ডুলিপি সর্বপ্রথম ১৯৩২ সালে Marx-Engels-Gesamtausgabe-তে প্রকাশিত হয়েছিল এবং সেই সময়ে হারবার্ট মারকুস সোৎসাহে তা গ্রহণ ও প্রচার করেছিলেন, কারণ তাঁর মনে হয়েছিল যে অবশেষে এর মধ্য দিয়ে মার্কস-এর রাজনৈতিক অর্থনীতির সমালোচনা এবং বিপ্লবের তত্ত্বের দার্শনিক ভিত্তিমূল হিসেবে কাজ করা চিন্তাগুলো প্রকাশ্যে এল।

১৭। লুকাচ, History and Class Consciousness।

১৮। স্বয়ং লুকাচ এই মর্মে ১৯৬৭ সালে মন্তব্য করেছিলেন: ‘সেই সময়ে বইটির অভিঘাত ও বর্তমানে বইটির প্রাসঙ্গিকতা বিচার করতে হলে আমাদের এমন একটি সমস্যাকে বিচারে আনতে হবে যা খুঁটিনাটি অন্যান্য সমস্ত প্রশ্নের থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এই সমস্যাটি হল বিচ্ছিন্নতার প্রশ্ন, যাকে, মার্কস-এর পর এই প্রথমবার, পুঁজিবাদের বিপ্লবী সমালোচনার কেন্দ্রীয় প্রশ্ন হিসেবে গণ্য করা হল।… প্রশ্নটা অবশ্য তখন বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছিল।’ (লুকাচ, History and Class Consciousness, পৃঃ xxii) হেইডেগার-এর Being and Time (১৯২৭)-এর প্রকাশ এবং যুদ্ধপরবর্তী ফরাসি মহলের আলাপ-আলোচনা উভয়কে উল্লেখ করার মধ্য দিয়ে এবং এহেন পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে: ‘মানুষের বিচ্ছিন্নতা হল আমাদের যুগের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা এবং সব ধরনের আলোচকরাই--- বুর্জোয়া বা সর্বহারা, ডান বা বাম--- তা এখন স্বীকার করে থাকেন’ (লুকাচ, History and Class Consciousness, পৃঃ xxii), লুকাচ নিজে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা সম্পর্কিত অস্তিত্ববাদী আলোচনার নিবিড় সম্পর্কের দিকে ইঙ্গিত করেছেন।

১৯। যুক্তিসঙ্গতভাবেই হাবেরমাস-এর প্রয়াস, যার মধ্য দিয়ে তিনি সমালোচনাত্মক তত্ত্ব (Critical Theory)-কে জ্ঞাপনক্রিয়ার দৃষ্টিকোণ থেকে পুনর্সংজ্ঞায়িত করে নতুন ভিত্তির উপর দাঁড় করাতে প্রয়াসী হয়েছেন, তা বিমূর্তরে মূর্ত বাস্তব বলে গণ্য করার প্রবণতার তত্ত্বকেও পুনর্সূত্রায়িত হওয়ার দিকে নিয়ে গিয়েছে: সেভাবে জীবনবিশ্ব (life-world)-এর উপনিবেশকরণের সম্পাদ্য মার্কস-পরবর্তী সমালোচনাত্মক তত্ত্বের একটি কেন্দ্রীয় স্বজ্ঞাকে রূপান্তরিত করে দিচ্ছে। 

 

মার্কস ও হেইডেগার:

বিচ্ছিন্নতা-সমালোচনার দুই ভাষ্য

এখানে আমি মার্কস ও হেইডেগার নিয়ে আরো কিছুটা বিশদে আলোচনা করব। তাঁদের দুজনকে আমি বিচ্ছিন্নতা-সমালোচনার ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এমন দুই ভাষ্যের উৎস হিসেবে ধরব যে দুটি ভাষ্য তাদের ফলিত প্রভাবের নিরিখে বহু-বিবিধ-ভাবে একে-অপরে সমাপতিত হয়ে আছে। ‘প্রদত্ত জগত সংক্রান্ত ছদ্ম-তত্ত্ববিদ্যা (pseudo-ontology)’-র বিরুদ্ধে উদ্দিষ্ট মার্কস ও হেইডেগারের বিচ্ছিন্নতা-সমালোচনা--- তাদের নিজ নিজ ভিন্ন ধারণা-ভিত্তি সত্ত্বেও--- জগৎ ও আত্মসত্তার সঙ্গে আধুনিক ব্যক্তিমানুষের বিমূর্তায়িত অথচ মূর্ত ভ্রমে গণ্য (reified) সম্পর্কের আধিপত্য ও তারই সঙ্গে উপস্থিত হওয়া ‘মানুষের বস্তুতে রূপান্তরকরণ’ এবং তজ্জাত এহেন পরিস্থিতি যেখানে মানুষ জগৎকে তাদের নিজেদের জগৎ-সৃষ্টিকারী ক্রিয়ার ফল হিসেবে দেখার বদলে স্থির-প্রদত্ত হিসেবে দেখে, সেসব নিয়ে নির্দিষ্টভাবে আলোচনা করেছে। এই দুই অবস্থানের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্যটিকেও যদি আমরা বিচার করি--- যে পার্থক্যের অন্যতম সূত্রপাত হিসেবে আমরা মার্কস-এর স্পষ্ট-নির্দিষ্ট উৎপাদন-দৃষ্টান্তের উপর জোর ফেলা এবং হেইডেগার-এর ‘জগৎ-মধ্যে-স্থিতসত্তা’ (‘being-in-the-world’) সম্পর্কিত বোঝাবুঝির ফারাককে চিহ্নিত করতে পারি--- তাহলে তা বিচ্ছিন্নতার ধারণাটি পুনর্নির্মাণ করার জন্য মূল্যবান রসদ আমাদের যোগাতে পারে।

মার্কস: শ্রম ও বিচ্ছিন্নতা

১৮৪৪ সালের ‘অর্থনৈতিক ও দার্শনিক পাণ্ডুলিপি’-তে মার্কস বিচ্ছিন্নকৃত শ্রম স্বরূপ ‘জাতীয়-অর্থনৈতিক ঘটনা’-র চারটি ফল আলাদা করে বলেছিলেন: বিচ্ছিন্নকৃত শ্রম শ্রমিককে বিচ্ছিন্ন করে প্রথমত, তার শ্রমের উৎপাদ থেকে, দ্বিতীয়ত, তার নিজের ক্রিয়া থেকে, তৃতীয়ত, যাকে মার্কস ফয়েরবাখ-কে অনুসরণ করে প্রজাতি-স্থিতসত্তা (species-being) বলেছেন, তা থেকে, এবং চতুর্থত, অন্যান্য মানুষদের থেকে। সুতরাং, নিজের সঙ্গে ও জগতের সঙ্গে (তা সমাজজগৎ হোক বা প্রকৃতিজগৎ হোক) যে সম্পর্ক একজনের থাকে, বা থাকা উচিত, তার অগোছালো হয়ে যাওয়াকেই আমরা বিচ্ছিন্নতা বলে বুঝতে পারি। আর তার বিপরীতে, উৎপাদনের মাধ্যমে জগৎকে উপযোজন করার একটি নির্দিষ্ট উপায় হিসেবে অবিচ্ছিন্নকৃত শ্রম হল আত্মসত্তা, জগৎ ও অন্যদের সঙ্গে একটি যথার্থ সম্পর্ক বিকশিত করতে পারার অন্যতম প্রাকশর্ত।

উপরোক্ত এই সংক্ষিপ্ত বিবৃতির মধ্যেই আমরা মার্কস-এর বিচ্ছিন্নতা সম্পর্কিত ধারণার দুটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক চিহ্নিত করতে পারি। প্রথম দিকটি হল: উপযোজন (appropriation) ও বিচ্ছিন্নাবস্থার বৈপরীত্য দুটি সমস্যার মধ্যে এমন একটি যোগসম্পর্ক হাজির করে যা মোটেই স্ব-প্রতীয়মান নয়; সমস্যাদুটি হল একদিকে জগতের অর্থহানি (loss of meaning), ক্ষয়, অর্থহীনতা এবং অন্যদিকে জগতের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে অপারগতা বা ক্ষমতাহীনতা। দ্বিতীয়ত, মানুষ ও জগতের মধ্যে সম্পর্কহীনতার সমস্যাকে মার্কস যে নির্দিষ্ট মোচড়টি দিয়ে হাজির করেছেন, তা আমরা এই কেন্দ্রীয় পাঠবস্তুটিতে দেখতে পাই: বিচ্ছিন্নতার কেলেঙ্কারিটা হল এই যে তা হল সত্তা দ্বারা নির্মিত বস্তু থেকেই সত্তার বিচ্ছিন্নতা। নেহাতই যা আমাদের নিজেদের  ক্রিয়া ও ক্রিয়ার উৎপাদ--- আমাদের নিজেদেরই উৎপন্ন করা সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও সম্পর্কাদি--- সেগুলোই বিচ্ছিন্ন বিজাতীয় শক্তিতে পরিণত হয়েছে। চার্লস টেলর-কে অনুসরণ করে কেউ একে বলতে পারে এমন এক ‘প্রমিথিয়-অভিব্যক্তিবাদী’ (‘Promethean-expressivist’) মোচড় যা হেগেল-এর বিশ্বাত্মা (Spirit)-র ‘বহিঃকরণ-ছাঁচ’ (‘externalization-model’) ও ফয়েরবাখ-এর অভিক্ষেপ সম্পর্কিত ধারণা থেকে ধার করে এনে মার্কস বহিঃকরণ সমস্যার নিজস্ব ব্যাখ্যায় প্রযুক্ত করেছিলেন।

পরবর্তী আলোচনায় আমি প্রথমে মার্কস দ্বারা আলোচিত বিচ্ছিন্নতার মাত্রাগুলি, তাঁর বিচ্ছিন্নতা ধারণার অন্তঃবস্তু ও ঋদ্ধি সমেত, পরীক্ষা করব। তার পরে মার্কস-এর নৃতত্ত্ব বা মানবপ্রকৃতি সম্পর্কিত তত্ত্বের সাপেক্ষে শ্রম সম্পর্কিত ধারণাটিকে স্পষ্ট করব, যা মার্কস-এর বিচ্ছিন্নতা ধারণার উৎপাদনবাদী বাঁক নেওয়া সম্পর্কে আলোচনা করার প্রেক্ষাপট তৈরি করে দেবে।

বিচ্ছিন্নতার নানা মাত্রা

মার্কস যাকে বিচ্ছিন্নতা বলে তত্ত্বায়ন করেছেন, আত্মসত্তা ও জগতের সঙ্গে সম্পর্কে সেই খামতির দুটি মাত্রাকে আমরা চিহ্নিত করতে পারি। প্রথম মাত্রাটি হল: নিজের কাজের সঙ্গে এবং যাদের সঙ্গে সেই কাজ করা হচ্ছে তাদের সঙ্গে অর্থপূর্ণভাবে একাত্মবোধ করার অপারগতা। আর দ্বিতীয় মাত্রাটি হল: নিজে যা করছি তার উপর নিজের নিয়ন্ত্রণ হাসিল করার অপারগতা--- অর্থাৎ, ব্যক্তিগতভাবে বা সমষ্টিগতভাবে নিজ ক্রিয়ার বিষয়ী হয়ে ওঠার অপারগতা। বিষয় (object) থেকে, নিজ ক্রিয়ার উৎপাদ থেকে বিচ্ছিন্নতা মানে একই সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলা এবং অধিকারচ্যুত হওয়া: বিচ্ছিন্নকৃত শ্রমিক (তার শ্রমশক্তির বিক্রেতা রূপে) নিজে যা উৎপাদন করে তা আর তার নিয়ন্ত্রণে থাকে না, তার অধিকারীও সে হয় না। তার উৎপাদ এমন এক বাজারে গিয়ে বিনিময় হয়, যে বাজার তার নিয়ন্ত্রণে নেই, সেখানে বিনিময়ের শর্তাবলীও সে নিয়ন্ত্রণ করে না। বিচ্ছিন্নতার তাৎপর্য এটাও যে বিষয় (object)-টি তার কাছে খণ্ডিত রূপেই দেখা দেবে: বিশেষজ্ঞীকরণ (specialization) ও শ্রম-বিভাজন দ্বারা নির্ধারিত পরিস্থিতিতে কাজ করা একজন শ্রমিকের উৎপাদের সমগ্রটার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক তৈরি হয় না। অ্যাডাম স্মিথ কথিত সেই বিখ্যাত আলপিনের উৎপাদনপ্রণালীর মতো কোনো উৎপাদনকার্যের কোনো একটি বিশেষজ্ঞীকৃত উপাংশে নিযুক্ত শ্রমিকের  কোনো সম্পর্ক থাকে না উৎপাদের সর্বশেষ রূপটির সঙ্গে, সে উৎপাদ যতই ক্ষুদ্র হোক না কেন। অন্যভাবে বললে, তার বিশেষ শ্রম--- আলপিন তৈরিতে তার নির্দিষ্ট অবদান--- অর্থপূর্ণ সমগ্রের মধ্যে তাকে কোনো স্থান করে দেয় না, তাৎপর্যপূর্ণ কোনো সংহতির অন্তর্গত সে হয় না।

ক্ষমতাহীনতা ও অর্থহানি (বা অর্থক্ষয়)-এর এই একই যুগল শ্রমিকের নিজের কাজ থেকে বিচ্ছিন্নতাকেও চিহ্নিত করে। বিচ্ছিন্নকৃত শ্রম একদিকে হল অমুক্ত ক্রিয়া, তা হল এমন শ্রম যা করতে বাধ্য হতে হয়েছে এবং বাধ্য থেকে যা করতে হয়েছে। বিচ্ছিন্নকৃত শ্রমিক শ্রমকার্যে নিজে যা করছে তার নিয়ন্ত্রক নয়। বাইরে থেকে আসা নির্দেশের অধীন হওয়ার ফলে তার শ্রম অপরের দ্বারা নির্ধারিত, বা, স্বধর্মজাত নয়। ‘সে যদি নিজ কাজকে একটি অমুক্ত কাজ হিসেবে বিবেচনা করে, তাহলে সে আসলে কাজটিকে অন্য কোনো মানুষের অধীন হয়ে আধিপত্য ও জবরদস্তির কবলে বাধ্যত করতে হয়েছে বলে মনে করে।’ আর ক্ষমতাহীন হওয়ার কারণেই শ্রমিকটি যে প্রক্রিয়ার অংশ, সেই প্রক্রিয়ার সমগ্রটি তার কাছে অস্বচ্ছ থেকে যায়, গোটা সেই প্রক্রিয়াটিকে সে বুঝতে পারে না, নিয়ন্ত্রণও করতে পারে না। একইসঙ্গে, বিচ্ছিন্নকৃত শ্রমের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল এই যে উৎপাদের খণ্ডিতকরণের পরিপূরক হিসেবে শ্রমকার্যের খণ্ডিতকরণ ও অবনমন-অবমূল্যায়ন ঘটতে থাকে। তাই মার্কস স্বয়ং শ্রমকার্যের একঘেয়েমি ও সীমাবদ্ধ চরিত্রকে বিচ্ছিন্নতাপ্রসূত বলে মনে করে বলেছেন: ‘তা মানুষকে যতটা বিমূর্ত করা যায় তা করে তোলে, একটা কুঁদকলের সমান করে তোলে এবং আধ্যাত্মিক ও শারীরিক বিকটত্বে রূপান্তরিত করে’ (মার্কস, Comments on James Mill)। অন্যদের থেকে বিচ্ছিন্নতা, সহযোগিতার সামাজিক সম্পর্কজগৎ থেকে বিচ্ছিন্নতা আরো দুটি মাত্রা ধারণ করে। প্রথমত, বিচ্ছিন্নকৃত শ্রমকার্যে নিযুক্ত শ্রমিক আরো অনেকের সঙ্গে যুক্তভাবে যা করে তার উপর তার নিজের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। আর দ্বিতীয়ত, বিচ্ছিন্নকৃত শ্রমপ্রক্রিয়ায় অপরাপর অন্যরা তার সাপেক্ষে, যাকে বলা যায়, ‘কাঠামোগতভাবেই নিস্পৃহ’।

মার্কস-এর তত্ত্বের একটি কৌতূহলোদ্দীপক ও অতি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল এই যে মার্কস কেবল শ্রমশক্তির ক্রেতাদের দ্বারা শ্রমিকদের যন্ত্রে রূপান্তরকরণেরই সমালোচনা করেননি, তার মধ্য দিয়ে শ্রমিক নিজ আত্মসত্তার সঙ্গে যে যান্ত্রিক সম্পর্কে বাঁধা পড়ে, তারও সমালোচনা করেছেন। মার্কস-এর দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, বিচ্ছিন্নতা-আক্রান্ত পরিস্থিতিতে একজন শ্রমিক নিজ সত্তার সঙ্গে ও নিজ শ্রমের সঙ্গে যে যান্ত্রিক সম্পর্ক তৈরি করে (বা তৈরি করতে বাধ্য হয়), তা অতি সমস্যাপূর্ণ, বা আরো জোরালো ভাষায় বললে, নেহাতই ‘অমানবিক’। বিচ্ছিন্নকৃত শ্রমের বিচ্ছিন্নকারী দিকটি হল এই যে তার কোনো স্বপ্রণোদিত উদ্দেশ্য থাকে না, তা স্বনির্ধারিত স্বার্থে প্রযুক্ত হয় না। বিচ্ছিন্নকৃত ভাবে করা কাজ বলতে এমন কাজই বোঝায় যা লক্ষ্যসাধনের জন্য করা হয় না, বরং কেবলমাত্র একটি উপায় হিসেবে করা হয়। আর সেই সূত্র ধরেই কোনো কাজ করতে প্রযুক্ত বা সেই কাজ থেকে আহৃত সক্ষমতাগুলোকেও--- ফলত নিজ সত্তাকেও--- লক্ষ্যের চেয়ে বরং উপায় হিসেবেই দেখা হয়। অন্যভাবে বললে, যে কাজ সে করছে, তার সঙ্গে কোনো একাত্মতাবোধ সে করে না। যন্ত্রে রূপান্তরকরণ নিজ গতিতে তীব্রতা অর্জন করে সার্বিক অর্থহীনতায় পরিণত হয়: মার্কস যখন বলেন যে বিচ্ছিন্নতার অধীনে জীবন নিজেই একটি উপায়মাত্রে পরিণত হয় (‘জীবন নিজেই হাজির হয় কেবলমাত্র জীবনের একটি উপায় হিসেবে’)--- যা লক্ষ্য হওয়া উচিত তা-ই একটি উপায়ের চরিত্রবৈশিষ্ট্য ধারণ করে বসে--- তখন মার্কস একটি সম্পূর্ণ অর্থহীন ঘটনা বর্ণনা করছেন, বা এভাবেও বলা যায়, অর্থহীনতার কাঠামোটাকেই বর্ণনা করছেন। ভিন্নভাবে সূত্রায়িত করলে বলা যায়, মার্কস মনে করেন যে লক্ষ্যের এই সীমাহীন প্রত্যাগতি অর্থহীনতায় গিয়ে শেষ হয়। এই দিক থেকে দেখলে মার্কস একজন আরিস্ততলপন্থী: এমন একটি লক্ষ্য থাকতে হবে যা নিজে কোনোভাবেই কোনো উপায় হয়ে উঠবে না।

এভাবে আমারা এই ধারণার বিভিন্ন স্তরগুলো দেখতে পারি: বিচ্ছিন্নকৃত জনের নিজের উৎপাদিত বস্তুর উপর কোনো অধিকার থাকে না (আর সেই সূত্রেই সে অধিকারচ্যুত ও শোষিত হয়); সে যা করছে তার উপর কোনো নিয়ন্ত্রণ তার থাকে না, তা নির্ধারণ করার ক্ষমতাও তার থাকে না (আর সেই সূত্রেই যে ক্ষমতাহীন এবং অমুক্ত); একইসঙ্গে, সে নিজের কাজের মধ্য দিয়ে নিজেকে উপলব্ধি করতে পারে না আর তাই এমন অর্থহীন, জীর্ণ, যান্ত্রিক সম্পর্কসমূহে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে যে নিজেকেও ভিতরে ভিতরে হাজারো ভাগে বিভক্ত হয়ে যেতে হয়। এই ধরনের বিচ্ছিন্নতার বিপরীতে মার্কস যে ‘প্রকৃত উপযোজন’-এর কথা বলেছেন তা এমন এক সম্পন্নতার কথা বলে যা কেবল সম্পত্তি-মালিকানা সংস্থানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়।১০ এই ‘প্রকৃত উপযোজন’-এর অর্থ কোনো কিছুর উপর অধিকার কায়েম করা, ক্ষমতা অর্জন করা এবং অর্থ খুঁজে পাওয়া। সুতরাং, যাকে আমরা উত্তম জীবন সম্পর্কে মার্কস-এর ধারণা বলে অভিহিত করতে পারি, তার মধ্যে এমন এক আত্মোপলব্ধির ভাবনা রয়েছে যা আত্মসত্তা ও জগতের সঙ্গে একটি একাত্মতাবোধক উপযোজক সম্পর্ক স্থাপনের মধ্য দিয়ে সম্ভব হয়ে উঠতে পারে।১১

মার্কস-এর শ্রম-নৃতত্ত্ব

এই উপযোজন ও বিচ্ছিন্নতার ধারণার ভিত্তিমূল শ্রম সম্পর্কে মার্কস-এর দার্শনিক ধারণার মধ্যে প্রোথিত। মার্কস-এর বিবেচনায় শ্রমই হল জগতের সঙ্গে মানুষের দৃষ্টান্তমূলক সম্পর্ক, আর তাঁর ধারণামতে, শ্রম হল আবশ্যিক মানবক্ষমতাকে বহিঃস্থকরণ করে দেওয়া বস্তুরূপ। খুব সংক্ষেপে বললে, ‘আবশ্যিক মানবক্ষমতা’, যা মানুষের অভিপ্রায়, লক্ষ্য ও সামর্থ্য সম্বলিত, তা শ্রমের মধ্য দিয়ে বহির্জগতে একটি বস্তু হিসেবে হাজির হওয়ার মাধ্যমেই বস্তুগত হয়ে ওঠে বা বস্তুরূপ ধারণ করে। প্রকৃতির সঙ্গে বিপাকীয় বিনিময়ের একটি প্রক্রিয়া হিসেবে গণ্য করলে, শ্রম করার সামর্থ্য একইসঙ্গে জগৎ ও মানুষ উভয়কেই রূপান্তরিত করতে থাকে। মানুষ একটি একক ক্রিয়ার মধ্য দিয়েই নিজেকে ও নিজের জগৎকে উৎপাদন করে। তার জগৎ উৎপাদন করতে গিয়ে মানুষ নিজেকে উৎপাদন করে, আবার নিজেকে উৎপাদন করতে গিয়ে জগৎ উৎপাদন করে। আর, যে পরিমাণে এই প্রক্রিয়া সফল হয়, সেই পরিমাণেই সে বস্তুগত জগৎ এবং স্বয়ং নিজেকে নিজ আপন করে তোলে। অর্থাৎ, সে নিজেকে (নিজের অভিপ্রায় ও সামর্থ্যকে) নিজের কাজকর্ম ও তাতে উৎপন্ন ফলের মধ্য দিয়েই চিনতে পারে এবং তার নিজের দ্বারা উৎপাদিত বস্তুদের সঙ্গে এই সম্পর্কের মধ্য দিয়েই আত্মসত্তাকে চিহ্নিত করে। সুতরাং, তার নিজ ক্রিয়ার দ্বারা উৎপাদিত জগতের সঙ্গে উপযোজনমূলক সম্পর্কের মধ্য দিয়েই সে নিজেকে উপলব্ধি করতে পারে। এই অর্থেই মার্কস-এর মতে শ্রম, তবে তা বিচ্ছিন্নকৃত নয় এমন শ্রম, হল মানুষের আবশ্যিক চরিত্রবৈশিষ্ট্য।১২ অন্যান্য পশুদের থেকে পৃথক করে যা মানুষকে মানুষ করে তুলেছে তা হল এই যে সে সচেতনভাবে সামাজিক সহযোগিতার মধ্য দিয়ে নিজেকে ও নিজের জগৎকে গড়ে নিতে পারে, এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সে আত্মোপলব্ধি করে এবং নিজেকেও উৎপাদন করে চলে এই মূর্ত অর্থে যে শ্রম করা ও জগৎ গড়ে তোলার অনুপাতেই সে নিজের সামর্থ্য, অনুভব ও চাহিদাকেও বিকশিত করে চলে।

বিচ্ছিন্নতার ধারণাক্ষেত্রে একটা মোক্ষম প্যাঁচ এখানে হাজির হয়: শ্রমের সূত্র ধরে আত্মসত্তা ও জগতের সঙ্গে সফলভাবে স্থাপিত সম্পর্ককে যদি আমরা এমন একটি প্রক্রিয়া হিসেবেই দেখি যা আবশ্যিক মানবক্ষমতাগুলোর বহিঃস্থকরণ, বস্তুতে রূপান্তরকরণ ও উপযোজন ঘটায়, যা আসলে স্বয়ং নিজের শ্রমক্ষমতার বস্তুরূপান্তরিত রূপের সঙ্গে একটি উপযোজনমূলক সম্পর্কের নামান্তর, তাহলে বিচ্ছিন্নতাকে এই প্রক্রিয়ার অন্তর্গত একটি ব্যর্থতা হিসেবেই গণ্য করতে হয়, এমন একটি ব্যর্থতা যা সেই বহিঃস্থকরণ ঘটার পর আবার ফিরে আসার পথ আটকে দেয়। যে বিষয়ী এই বহিঃস্থকরণ ঘটিয়েছে তার কাছে আবার বহিঃস্থকরণ করা বিষয়টি ‘ফিরিয়ে দেওয়ার’ যে একরকম ‘পুনরুদ্ধার-ব্যবস্থা’, সেই ব্যবস্থার ব্যর্থতা হিসেবেই একে চিহ্নিত করা যায়। উৎপাদক কোনোকিছু উৎপাদন করার মধ্য দিয়ে বহির্জগতে নিজের বহিঃস্থকরণ ঘটায়, নিজেকে ও নিজের আবশ্যিক ক্ষমতাকে বস্তরূপ দেয়, এবং তারপর সেই উৎপাদের মধ্য দিয়ে নিজেকে ও নিজের ক্ষমতাকে আবার উপযোজন করে। উৎপাদনকার্যকে মানুষের প্রজাতি-ক্রিয়ার আয়না বলার সুবিদিত রূপকের মধ্য দিয়ে আসলে এটাই বলা হয়ে থাকে। এই রূপকটিকে ধরে আলোচনা করলে বলা যায় যে, বহিঃস্থকরণ ঘটার পর পুনরায় ফিরে আসা--- বিচ্ছিন্নতা অতিক্রম করা--- ঘটতে পারে যখন আয়নার প্রতিবিম্বটির সঙ্গে প্রতিফলিত বস্তুর নিখুঁত সাযুজ্য রক্ষা হচ্ছে। উল্টোদিকে, বিচ্ছিন্নতা হল বহিঃস্থকৃত নিজের আবশ্যিক ক্ষমতা পুনর্বার উপযোজন করায় বাধাপ্রাপ্ত হওয়া, আয়নার প্রতিবিম্বে নিজেকে চিনতে না পারা, বা অন্যভাবে বললে, আয়নায় একটি বিকৃত প্রতিবিম্ব তৈরি হওয়া।১৩ শ্রম ও বহিঃস্থকরণের এই আদল এবং তার অনুষঙ্গী ভাবনাকাঠামো--- অর্থাৎ, অন্তঃস্থ একটি পরিকল্পনার বহিঃস্থ বস্তুরূপধারণ সংক্রান্ত ভাবনাকাঠামো--- বেশ কিছু কারণেই সমস্যাজনক।১৪ আমাদের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণটি হল এই যে, উপরোক্ত ধারণামতে, উপযোজন সবসময় ইতিপূর্বেই অস্তিত্বশীল কোনো বস্তুর পুনঃ-উপযোজনের মধ্য দিয়েই ঘটতে পারে। শ্রম সম্পর্কে যে ধারণা-আদল এই ধারণাকাঠামোর মধ্যে নিহিত, তা এমন সম্ভাবনাকে স্থান দেয় না যাতে বিচ্ছিন্নতা দ্বারা বিকৃত না হয়েও বিভিন্ন ক্রিয়া নিয়ন্ত্রণের বাইরে আপন গতি নিয়ে নিতে পারে, বা, বিভিন্ন সম্পর্ক, স্বকৃত হলেও, সবসময় সম্পূর্ণ স্বচ্ছ ও নিজ নিয়ন্ত্রণাধীন না-ও থাকতে পারে। 

বিচ্ছিন্নতার এই প্রমিথিয় (Promethean) ব্যাখ্যা যদি এই অনুমানের উপর দাঁড়িয়ে থাকে যে উৎপাদকের নিজ ক্রিয়াকর্মই একটি পরকীয় (alien) শক্তির রূপ ধরে তার মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়, তাহলে তার মানে দাঁড়ায় এই যে যা পরকীয় তা একসময় নিজ আপন ছিল এবং বিচ্ছিন্নতা হল আসলে যা একসময় নিজ নিয়ন্ত্রণে ছিল ও এখনও নিয়ন্ত্রণেই থাকার কথা ছিল (যেহেতু তা আমাদের নিজ ক্রিয়ারই ফল), তেমন কোনোকিছুর উপর নিজ নিয়ন্ত্রণ খুইয়ে বসা। যা পরকীয়ে পরিণত হয়েছে বা বিচ্ছিন্ন বহির্বস্তুতে পরিণত হয়েছে তা আসলে আমাদেরই তৈরি করা কিন্তু হাজির হচ্ছে প্রদত্ত (যেনবা প্রকৃতি দ্বারা প্রদত্ত এবং আমাদের অভিপ্রায়ের অধীন নয়) বস্তু হিসেবে। ফয়েরবাখ কৃত ধর্মীয় অভিক্ষেপের সমালোচনা এবং হেগেল-এর বিশ্বাত্মা (Spirit) সম্পর্কীয় ধারণা দ্বারা প্রভাবিত এই বিচ্ছিন্নতার ধারণাকাঠামো মার্কস-এর লেখায় ১৮৪৪-এর ‘অর্থনৈতিক ও দার্শনিক পাণ্ডুলিপি’-র আগে থেকেই পাওয়া যায় (যেমন, ‘ইহুদি প্রশ্ন প্রসঙ্গে’, ও ‘হেগেলিয় ন্যায় দর্শনের সমালোচনা’-এ) যখন তিনি সামাজিক সম্পর্কের ‘বিগ্রহসম চরিত্র’-এর কথা বারবার উল্লেখ করেন, যার মধ্য দিয়ে তিনি বোঝাতে চান যে সামাজিক সম্পর্কগুলো আমাদের দ্বারা তৈরি হওয়ার পর স্বাধীন অস্তিত্ব গ্রহণ করে আমাদের বিরুদ্ধেই রুখে দাঁড়ায়, আর এই মূলসুর ‘পুঁজি’ গ্রন্থে ‘পণ্যের বিগ্রহরূপ চরিত্র’ (fetish character of commodities) -এর রূপকনির্মাণের মধ্যেও আবার হাজির হয়েছে। একান্তই যা আপন তা বিচ্ছিন্ন পরকীয় রূপ ধরে হাজির হওয়ার এই মূলসুর ‘রাজনৈতিক অর্থনীতির সমালোচনা’-তে আপাতদৃষ্টিতে প্রাকৃতিক সম্পর্কগুলোর সামাজিক চরিত্র উন্মোচনকারী ‘বিপ্রকৃতিস্থকারী’ (denaturalizing) সমালোচনার মধ্য দিয়েও প্রলম্বিত হয়েছে।

এই প্রেক্ষিতেই বিচ্ছিন্নতার অস্তিত্ববাদী সমালোচনা এবং মার্কসীয়-হেগেলীয় সমালোচনার মধ্যের সমান্তরালগুলোকে চিহ্নিত করা সবচেয়ে সহজ: ‘বস্তুরূপান্তরের ভ্রান্তি’ (objectivation mistake)১৫--- যেখানে নিজেদের তৈরি করা কিছুকে ভুল করে প্রদত্ত হিসেবে ধরে নেওয়া হয়--- চিহ্নিত করা হেইডেগার-এর বিচ্ছিন্নতা-সমালোচনারও কেন্দ্রীয় বিষয়। মার্কস-এর সঙ্গে পার্থক্য এখানে যে হেইডেগার জগতের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ককে উৎপাদনের সম্পর্ক হিসেবে দেখেন না। শ্রমের মধ্য দিয়ে জগৎ উৎপাদিত হওয়ার ধারণা থেকে শুরু করার বদলে, হেইডেগার শুরু করেছেন পূর্বস্থ ‘জগৎ-মধ্যে-স্থিতসত্তা’ (being-in-the-world)-র বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে, যা তাঁকে নিয়ে গেছে এমন একটি জায়গায় যাকে হয়ত অনুশীলনের পূর্ববর্তিতা সংক্রান্ত মার্কসীয় প্রস্তাবের একটি অস্তিত্ববাদী সংস্করণ বলে গণ্য করা যায়।

হেইডেগার: জগৎ ও বস্তরূপান্তরে পরকীয়সাধন

হেইডেগারের ধারণাকাঠামোয় বস্তুরূপান্তরে পরকীয়সাধন (alienating reification)-কে জগতের সঙ্গে এমন একটি সম্পর্ক হিসেবে বোঝা যেতে পারে যা বস্তুনিষ্ঠকরণের মধ্য দিয়ে মূর্ততায় পৌঁছতে চায়। হেইডেগারের পরিভাষায় বললে, তা হল একরূপ ব্যর্থতা যা দুটি ব্যর্থতার সংযোগে তৈরি হয়: ‘হাতের-কাছে-প্রস্তুত’ (ready-to-hand)-কে ‘হাতের-কাছে-উপস্থিত’ (present-at-hand) হিসেবে ধরার ব্যর্থতা, এবং, ব্যবহারিক অনুষঙ্গ হিসেবে না নিয়ে জগতকে কিছু প্রদত্তের সমষ্টি হিসেবে বোঝার ব্যর্থতা।১৬

বস্তুনিষ্ঠকরণ (objectification) বা বস্তুরূপান্তরে পরকীয়সাধনের যে সমালোচনা হেইডেগার করেছেন, তার পশ্চাদপট হিসেবে জগৎ-মধ্যে-স্থিতসত্তা সম্পর্কে তাঁর বিশ্লেষণ কাজ করেছে। হেইডেগারের মৌলিক স্বজ্ঞাটি সংক্ষেপে এভাবে হাজির করা যেতে পারে: জগৎ এমন কিছু নয় যা আমাদের কাছে প্রদত্ত, আমরা জ্ঞানবৃত্তি ও স্বতঃক্রিয়ার মাধ্যমে তার সঙ্গে সম্পর্কসাধনের আগে থেকেই তা অস্তিত্বমান নয়। ‘জীবনযাপনকারী’ প্রাণী হিসেবে আমরা সবসময় জগতের মধ্যেই বিচরণ করে থাকি, ইতিমধ্যেই সর্বদা জগতের মধ্যে কোনো না কোনো ক্রিয়া করতে থাকি, ইতিমধ্যেই সর্বদা আমরা ব্যবহারিকতায় তার সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে থাকি।১৭ এই ধারণাকাঠামো অনুযায়ী, বস্তুদের মধ্যে সম্পর্কাবলীর সংগ্রহই জগৎ নয়, এমনকি সেইসমস্ত বস্তুদের সমগ্রও জগৎ নয়, হেইডেগারের ভাষায়: ‘সত্তাসমূহের সমগ্র’ জগৎ নয়। অস্তিত্ববাদী সত্তাতত্ত্ববিদ্যার বিচারে জগৎ হল এমন একটি অনুষঙ্গ যা তার সঙ্গে আমাদের ব্যবহারিক লেনদেন-এর মধ্য দিয়ে আবির্ভূত হয় এবং আমাদের ব্যবহারিক ‘জগৎ-নির্মাণের’ মধ্য দিয়ে ফুটে ওঠে। হেইডেগার পরিবেশ (Umwelt) সম্পর্কে নিজ ধারণাকে স্পষ্ট করেছেন ‘সরঞ্জাম’ (das Zeug) নিয়ে তাঁর বিখ্যাত বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে: হাতুড়ি-পেটানোর জন্য আমরা হাতুড়ি ব্যবহার করে থাকি, এই হাতুড়ি-পেটানো কেদারা তৈরি করার কাজে লাগতে পারে, যে কেদারা আবার আমাদের (বা অন্য কারো) বসার জন্য কাজে লাগে। এহেন আন্তর্সম্পর্কের অনুষঙ্গে একটি জগৎ উন্মোচিত হয়, এখানে যেমন কারিগরি দ্বারা চিহ্নিত এমন এক জীবন-জগৎ খুলে যাচ্ছে যার সঙ্গে সম্বন্ধিত হলেই (অর্থাৎ, হাতুড়ি ব্যবহার করলেই, বা কেদারায় বসলেই) তার মধ্যে নিমজ্জিত হতে হয়। এভাবে ফুটে-ওঠা জগৎ নানা অর্থপূর্ণ সম্পর্ক দিয়ে তৈরি: কেবলমাত্র এই জগতের অনুষঙ্গেই ‘হাতুড়ি-পেটানো’-র মতো কাজের হাতিয়ার হিসেবে হাতুড়ির অস্তিত্ব নির্ণীত ও বোধগম্য হয়ে ওঠে।

‘হাতের-কাছে-উপস্থিত’ এবং ‘হাতের-কাছে-প্রস্তুত’--- এই দুইয়ের মধ্যে হেইডেগার যে পার্থক্য টেনেছেন তা জগতের সঙ্গে সম্পর্কসাধনের দুটি উপায়ের মধ্যে পার্থক্য হিসেবে বোঝা যেতে পারে এবং বস্তুনিষ্ঠকরণ ও বিচ্ছিন্নতার সমস্যা আলোচনায় তা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কোনো একটি জগতের অনুষঙ্গ ধরে যে বস্তু আমাদের কাছে হাজির হয়, আমাদের কাছে তার অস্তিত্ব কর্মসম্পাদনে ‘হাতের-কাছে-প্রস্তুত’ (ভূমিকা ও তাৎপর্যের পূর্ববর্ণিত অর্থে)। ‘হাতের-কাছে-প্রস্তুত’ কোনো বস্তু ‘কোনোকিছুর জন্য ভালো এবং কিছু না কিছু করতে তা ব্যবহার করা হয়।’১৮ এর উল্টোদিকে, জগতের কোনো বস্তু তখনই আমাদের কাছে ‘হাতের-কাছে-উপস্থিত’ বলে মনে হয় যখন আমরা তাকে এই ব্যবহারিক অনুষঙ্গ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখি, বা, যখন আমরা গোটা জগতটাকেই আমাদের নিজেদের থেকে আলাদা ও বিচ্ছিন্ন কিছু বলে ধরে নিই, এমন কিছু বলে ধরে নিই যা আমাদের মাথার উপর আমাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আছে পূর্বপ্রদত্ত বস্ত হিসেবে (যাকে প্রভাবিত করার কোনো ক্ষমতা আমাদের নেই)।১৯ এভাবে হেইডেগার এই (একটা নির্দিষ্ট মাত্রায়) প্রয়োগবাদী (pragmatist) প্রস্তাব হাজির করেন যে জিনিসসকল নেহাতই কিছু বস্তু নয়, তারা নেহাতই হাতের-কাছে-উপস্থিত অর্থে ‘উপস্থিত’ নয়। জীবনক্রিয়ায় তারা হাতের-কাছে-প্রস্তুত, প্রয়োগ-ব্যবহারের মধ্য দিয়েই কোনো একটি জগতের অনুষঙ্গে তারা তাৎপর্যমণ্ডিত হয়ে ওঠে। হাতের-কাছে-উপস্থিত এবং হাতের-কাছে-প্রস্তুত তাই দুই ভিন্ন ধরনের বস্তুর চরিত্রবৈশিষ্ট্য নয়, এমনকি জগতের বা জগতমধ্যের জিনিসসকলের প্রতি সম্ভাব্য দুই ধরনের মনোভঙ্গিও নয়। (এমনটা ভাবলেও ভুল হবে যে যতক্ষণ আমি হাতুড়িটাকে ব্যবহার করছি ততক্ষণ সেটা হাতের-কাছে-প্রস্তুত, আর যখন এক কোণে পড়ে আছে তখন সেটা হাতের-কাছে-উপস্থিত। এমনকি যখন আমি একটি ব্যবহারের মধ্যে না থাকা হাতুড়ির কথাও ভাবি, তখন কেবলমাত্র হাতের-কাছে-প্রস্তুত হওয়ার ভিত্তিতেই তাকে ভাবতে পারি; কোনো উপায়ে হাতের-কাছে-প্রস্তুত হওয়ার সুবাদেই, বা, কোনো একভাবে আমার ব্যবহারযোগ্য হওয়ার সুবাদেই তার অস্তিত্ব আমার কাছে নির্দিষ্ট হয়ে ওঠে।) হাতের-কাছে-প্রস্তুত জিনিসকে হাতের-কাছে-উপস্থিত হিসেবে বোঝে এবং জগতকে হাতের-কাছে-উপস্থিত-এর সমাহার রূপে গণ্য করে এমন দৃষ্ঠিভঙ্গি ভ্রান্ত, বা আরো সঠিকভাবে বললে, বস্তুরূপান্তরের মধ্য দিয়ে পরকীয়সাধনকারী। আর এই দৃষ্টিভঙ্গি ও তার অনুবর্তী ভুল-বোঝাবুঝি গুলোকে লাগাতার সমালোচনা করার প্রচেষ্টা হিসেবেই আমরা হেইডেগারের ‘স্থিতসত্তা ও সময়’ (‘Being and Time’) ও পরবর্তী কাজগুলোকে দেখতে পারি।

এই ভুল-বোঝাবুঝির দুটো দিক আছে। প্রথমত, যে বস্তুগুলো নিয়ে আমরা কাজ করছি আর যে জগতে আমরা বাস করছি, উভয়কেই ভুলভাবে বোঝা হয় (যেনবা সেগুলো নেহাতই প্রদত্ত কিছু, খেয়াল করা হয় না যে দ্বিতীয়টি আমাদেরই জগৎ, আমরাই তাকে জগৎ রূপে আকার দিয়েছি)।২০ ‘ক্রিয়ার ব্যবহারিক অনুষঙ্গের সমষ্টি’ (আর্নস্ট তুগেনধাত) হিসেবে জগতের ব্যবহারিক চরিত্র এই বস্তুনিষ্ঠকারী ভ্রান্তির ‘আড়ালে ঢাকা পড়ে যায়’। দ্বিতীয়ত, আমরা বুঝতে ব্যর্থ হই যে জগতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটা কী বা কীভাবে আমরা এই জগতের মধ্যে (যাকে বলা যায়) আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকি: এমন ভ্রান্তি তৈরি হয় যেনবা আমরা এই জগৎ-নির্মাণকারী ব্যবহারিক অনুষঙ্গের বাইরে থেকে ক্রিয়া করতে সক্ষম, যেনবা এই জগতের মধ্যে জড়িয়ে থাকার বদলে এই জগতকে বাইরে থেকে নিরীক্ষণ করার অবস্থানে আমরা আছি, যেনবা জগৎ-মধ্যে-স্থিতসত্তা-র কাঠামো থেকে ‘উলঙ্গ’ বিষয়ী রূপে আমরা নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে নিতে পারি। হেইডেগাররের ভাষায়: ‘এমনটা নয় যে মানুষ প্রথমে ‘উপস্থিত হয়’ এবং তারপর একটি অতিরিক্ত হিসেবে ‘জগৎ’-অভিমুখী (যে জগৎ সে নিজেই নিজেকে মাধেমধ্যে প্রদান করে থাকে) স্থিতসত্তার সম্পর্কের মাধ্যমে ‘পায়’। অস্তিত্ব (Dasein) কখনও কোনোভাবেই এমন কোনো বস্তু নয় যা জগৎ-মধ্য অবস্থা থেকে স্বাধীন ও যার মধ্যে কখনও কখনও জগৎ-অভিমুখী ‘সম্পর্ক’ স্থাপনের ঝোঁক তৈরি হয়। জগৎ-মধ্যে-স্থিতসত্তা রূপে অস্তিত্ব (Dasein) যা, কেবলমাত্র তার কারণেই জগৎ-অভিমুখী সম্পর্ক সম্ভবপর হয়ে ওঠে।’২১ সুতরাং আত্মসত্তা ও জগৎ--- দুইয়ের সঙ্গেই আমাদের সম্পর্ক সমানভাবেই আদি।

অদ্বৈতবাদ এবং অনুশীলনের অগ্রাধিকার--- এই দুটি ভাবনাবিন্দুই বিচ্ছিন্নতার অবস্থা-নির্ণয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। হেইডেগারের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, জগৎ হল এমন একটি কাঠামো যা তার খিলানতলে বিষয়ী ও বিষয় উভয়কেই ধরে রাখে।২২ সত্তাতত্ত্ববিদ্যক বিচারে একসাথে বিদ্যমান দুটি দিককে পৃথক করে ফেলাই হল বিচ্ছিন্নতা।

আবার বিচ্ছিন্নতাকে অপ্রামাণিকতা (inauthenticity) হিসেবেও দেখা যায়। হেইডেগারের অস্তিত্ববাদী সত্তাতত্ত্ববিদ্যার পটভূমিতে বিচ্ছিন্নতার যে দ্বিতীয় মাত্রাটিকে সামনে আনা হয়েছে, তা আত্মসত্তার নিজের সঙ্গে সম্পর্ক, অর্থাৎ, নিজ অস্তিত্ব (Existenz)-এর সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে ভাবিত। এখানেও এক ধরনের ভুল-বোঝাবুঝি ঘটতে পারে, যেমন, আত্মসত্তা ও জগতের প্রতি ভ্রান্তিমূলক বস্তুনিষ্ঠকারক মনোভাব গড়ে উঠতে পারে। মোদ্দা কথায় বললে, নিজের জীবন নিজেকেই পরিচালনা করতে হবে বুঝে নিয়ে যে নিজসত্তার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলে না, সে নিজেকে বস্তুরূপান্তরের মাধ্যমে সেই মাত্রাতেই পরকীয় করে তোলে যে মাত্রায় নিজ জীবনযাপন-অনুশীলন নিজ সিদ্ধান্ত দিয়ে চালিত করার অভিপ্রায় সে ত্যাগ করে। উপলব্ধির এই ব্যর্থতা--- এই ‘অপ্রামাণিকতার পদ্ধতিগত অন্ধত্ব’২৩--- আবার অস্তিত্ববাদী দর্শনে অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি ধারণাগত পার্থক্য ধরতে না পারার কারণে ঘটে: পার্থক্যটি হল অস্তিত্ব (Existenz) এবং হাতের-কাছে-উপস্থিত স্থিতসত্তার মধ্যে পার্থক্য, বা, সার্ত্র-এর ভাষায়, সারমর্ম (essence) এবং অস্তিত্বের মধ্যে পার্থক্য।

এই পার্থক্য টানার মধ্য দিয়ে Dasein, বা আমাদের অস্তিত্ব (Existenz)-কে জগতে সাধারণ বস্তুর স্থিতসত্তার ধরণ থেকে আলাদা করা হয়। হেইডেগার যখন বলেন: Dasein ‘অন্য সমস্ত সত্তার (ein Seiendes) মধ্যে নিছক আরেকটি সত্তা নয়’, বরং ‘অন্য সমস্ত সত্তার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা কিছু’, তখন Dasein-এর যে বৈশিষ্ট্যমূলক চরিত্রের দিকে তিনি আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে চান (আগেই কিয়ের্কগার্ড যা অনুমান করেছিলেন), তা হল, Dasein এমন এক ‘সত্তা’ যার ক্ষেত্রে ‘তার নিজ স্থিতসত্তাতেই সেই স্থিতসত্তা একটি বিচার্য বিষয়’। এমনটা নয় যে Dasein নিছকই ‘উপস্থিত’, হেইডেগারের ভাষায়, তা ‘তার হয়ে উঠতে হবে যে স্থিতসত্তা’ তারও অধিকারী। মানুষদের অস্তিত্বমান হওয়া মানে কেবল বেঁচে থাকা নয়, তারা তাদের নিজেদের জীবনের অধিকারী যে জীবন তাদের যাপন করতে হবে, এবং উপলব্ধি করা ও মূল্য দেওয়ার মধ্য দিয়ে তারা এই জীবনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলে। তারা নিছকই এটা বা ওটা করতে থাকে না, যা তারা করে তার সঙ্গে তারা (প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ) সম্পর্ক বোধ করে। ব্যক্তির আত্মসম্পর্কের এই বিবরণ বস্তরূপান্তরে পরকীয়সাধনের সমালোচনায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং তা দাঁড়িয়ে আছে অস্তিত্ব (Existenz) এবং হাতের-কাছে-উপস্থিত স্থিতসত্তার মধ্যে বিরোধের উপর। যখন আমরা অস্তিত্বগতভাবে (existierend) নিজেদের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে উঠি, তখন সেই সম্পর্ক নিজেদের এমনভাবে দেখে না যেনবা তা জগতে নেহাত একটি প্রদত্ত বস্তু হিসেবে উপস্থিত। আমরা আমাদের জীবনক্রিয়ার মধ্য দিয়ে--- অর্থাৎ, যা আমরা চাই এবং যা আমরা করি, তার মধ্য দিয়ে--- নিজেদের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে উঠি। আমার যে ‘আমার যা হয়ে উঠতে হবে সেই স্থিতসত্তা’ আছে, তার মানে এই যে নেহাতই একটা হাতের-কাছে-উপস্থিত বস্তু হিসেবে আমি অস্তিত্বমান নই, বরং, আমাকে আমার নিজের জীবন যাপন করতে হবে, নিজেকেই তা পরিচালনা করতে হবে। অন্য আরো অনেক কিছুর মতো এর মানে এটাও যে নিজের জীবনকে নিজের সিদ্ধান্ত দিয়েই চালিত করতে হবে, বা, তুগেনধাত-এর ভাষায়, ‘ব্যবহারিক প্রশ্নগুলোর’ মুখোমুখি হয়ে চলতে হবে।

এই পটভূমিতে এবার আমরা হেইডেগারের শব্দভাণ্ডার দিয়ে সূত্রায়িত করা যায়, আত্মবিচ্ছিন্নতার এমন দুটি দিককে আরো নিখুঁতভাবে চিহ্নিত করতে পারি: নিজেকে একটি প্রদত্ত বস্তুতে পরিণত করা এবং নিজের কাজেকর্মে সর্বদা অপরের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেওয়া, এই দুটোই বিচ্ছিন্নতার সূচক। একদিকে যেমন সে উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয় যে সে নিজেই নিজের জীবন পরিচালনা করছে, অন্যদিকে, তার জীবন যে তাকে নিজেকেই পরিচালনা করতে হবে এমন বোধও তার হয় না।

  • অস্তিত্ব (Existenz) এবং হাতের-কাছে-উপস্থিত স্থিতসত্তার মধ্যে পার্থক্য করতে না পারা এমন এক ‘পতিতাবস্থা’ তৈরি করে যেখানে বস্তুরূপ ধারণ করাই স্থিতাবস্থার আদর্শ রূপ বলে ধরে নেওয়া হয়, যাকে ‘অস্তিত্বের অপরিহার্যকরণ’-ও বলা যায়। সেই ক্ষেত্রে Dasein ‘তার নিজ স্থিতসত্তাকে বস্তুদের স্থিতসত্তার সঙ্গে এক করে দেখে’।২৪ সার্ত্র তাঁর বিখ্যাত অপবিশ্বাসের বিশ্লেষণে নিজেকে বস্তুতে পরিণত করার একটি চমৎকার উদাহরণমূলক (যদিবা হয়ত লিঙ্গবিদ্বেষী) দৃষ্টান্ত দিয়েছেন:২৫ জনৈক তরুণী তার পাণিপ্রার্থীর প্রস্তাবের উত্তরে পাণিপ্রার্থীর মুঠোয় ধরা তার হাতটিকে সরিয়ে নেয় না, মুঠোতেই ধরা থাকতে দেয়, কিন্তু সে তা করে নিষ্ক্রিয় ও উদাসীন ভাবে, যেনবা সে তার পাণিপ্রার্থীর প্রস্তাব খেয়ালই করেনি; সেই তরুণীর হাত আর তার নিজের অংশ নয়, সেই তরুণী যা করছে তার মধ্যে আর সে নিজে উপস্থিত নেই, অর্থাৎ, তার নিজের ক্রিয়াতেই সে আর কোনো অংশ নিচ্ছে না। সার্ত্র-র ব্যাখ্যা অনুযায়ী, তরুণীটি যে ‘নিষ্ক্রিয়ভাবে’ নিজেকে একটি বস্তুতে পরিণত করেছে তার অর্থ এটাই দাঁড়ায় যে সে দায় অস্বীকার করছে, সে দায় তার করা কাজের দায় হোক, বা, তার প্রতি যা ঘটছে তাতে তার প্রতিক্রিয়ার দায় হোক। এই পরিপ্রক্ষিতে, পতিতাবস্থা মানে বুঝতে ব্যর্থ হওয়া যে আমরা যা করি তার মধ্যে (সর্বদা ইতিমধ্যেই) আমরা নিজেদের ব্যবহারিকভাবে সক্রিয় করি বা পরিচালনা করি, নানা বিকল্প আমাদের সামনে থাকে এবং বিকল্প বেছে নেওয়ার মধ্য দিয়েই আমরা নিজেরা সিদ্ধান্ত নিই। অতএব, (হেইডেগারের অপ্রামাণিকতা অর্থেই হোক, বা সার্ত্র-র অপবিশ্বাস অর্থেই হোক) আত্ম-বিচ্ছিন্নতা মানে উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হওয়া যে প্রত্যেকেরই একান্ত নিজের জীবন আছে পরিচালনা করার জন্য এবং অনিবার্যভাবেই সর্বদা ইতিমধ্যে প্রত্যেকে তা পরিচালনা করে চলে।
  • দ্বিতীয় একটি অর্থে আত্ম-বিচ্ছিন্নতা বোঝায় যে কোনো ব্যক্তি তার নিজের জীবন যে সে নিজে পরিচালনা করছে সেটাই কেবল বোঝে না তাই নয়, সঙ্গে সঙ্গে এটাও বোঝে না যে নিজসত্তাকেও সে-ই পরিচালনাকরে, বা, নিজসত্তার যাপন তার-ই পরিচালনা করার কথা।২৬ হেইডেগার যখন ‘অন্য কারও দ্বারা নিজের জীবনের প্রতিনিধিত্ব হওয়ার অসম্ভবতা’ বোঝার ব্যর্থতার কথা বলেন--- যা আমাদের জীবন পরিচালনাক্ষেত্রে নিজেদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের অন্যতম মাত্রা নির্ধারণ করে--- তাকে কিয়ের্কগার্ড-এর ‘ব্যক্তিমানুষ হয়ে ওঠা’-র প্রকল্পের আরেক সংস্করণ হিসেবে বুঝে নেওয়া যায়। হেইডেগারের প্রস্তাবনায় অপ্রামাণিকতা স্বরূপ (আত্ম-)বিচ্ছিন্নতার এই মাত্রাটি তৈরি হয় ‘অপরদের মধ্যে পতিত হওয়ার’, ‘বারোয়ারি আমরা-র জগৎ’ (‘public we-world’)২৭-এ পতিত হওয়ার এবং ‘তাদের’ (das Man) দ্বারা ‘বস্তুসমূহের ব্যাখ্যারূপ’-এর মধ্য দিয়ে। কোনো সন্দেহ নেই যে ‘সঙ্গ-জগৎ’ (Mitwelt), অর্থাৎ, অপরদের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া সামাজিক জগৎ, হেইডেগারের বিশ্লেষণে জগতের-মধ্যে-স্থিতসত্তা-র সাধারণ ধারণার মতো একইরকম মৌলিক গুরুত্বের স্থান নিয়ে আছে: কোনো ব্যক্তি নিজের অস্তিত্বকে আবশ্যিকভাবে জগতের ভিতর থেকেই বুঝতে পারে, বর্তমান পরিপ্রক্ষিতে যার অর্থ হল এই যে জগতের বারোয়ারি ব্যাখ্যার সাপেক্ষেই বুঝতে পারে। আবার অন্যদিকে, সামাজিক জগৎই হল অপ্রামাণিকতা ও আত্ম-বিচ্ছিন্নতার কারণ। ‘প্রায়শ ও অধিকত Dasein যখন নিজ আত্মরূপ নয়’২৮, সেই পরিস্থিতির উৎস হিসেবে হেইডেগার চিহ্নিত করেছেন এই প্রকৃতাবস্থাকে যে আমরা সবসময় বারোয়ারিভাবেই অস্থিত্বধারণ করি, আমরা বাধ্য হই বারোয়ারি ব্যাখ্যার ভিতরেই নিজেদের বুঝে নিতে।

এই ধারণাগুলো অপ্রামাণিকতা এবং ভিন্নতার এক সূক্ষ্ম রূপের এমন এক চেহারা হাজির করে যা (এই ব্যাখ্যা-কাঠামো অনুযায়ী) অপরদের সঙ্গে সবসময় মানিয়ে নেওয়ার বা প্রথানুগ হওয়ার চেষ্টা করে যায়। ‘তাদের অনুরূপ স্থিতসত্তা রীতি’ (Seinsweise des Man)-ই হল আত্মসত্তা হারিয়ে ফেলার (যাকে হেইডেগার অপ্রামাণিকতা বলেছেন) উৎস। যে মাত্রায় এই ভাবনাকে সাধারণভাবে সামাজিকতার বলয় সম্পর্কে একটি বিরূপ বর্ণনা হিসেবে বুঝে নেওয়া যায়,২৯ তা সামাজিক আন্তর্সম্পর্কের এমন এক চরিত্র উদ্ঘাটন করে যা একইসঙ্গে প্রথানুসরণ ও আত্মপরিচয়হীনতা দিয়ে চিহ্নিত--- অর্থাৎ, এমন এক পরিবেশ-পরিস্থিতির দ্যোতক যেখানে প্রত্যক্ষভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া ও মূল্যায়ন করার ক্রিয়া ঘটে না, বরং সবার কী সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত ও কীভাবে মূল্যায়ন করা উচিত তা যেন স্বতঃসিদ্ধ রূপে পূর্বনির্ধারিত হয়ে থাকে। ‘Dasein-এর প্রাত্যহিকতায় বেশির ভাগ জিনিসের প্রবর্তক যে বিষয়ীসত্তা তার সম্পর্কে “সে কোনো ব্যক্তি নয়” ছাড়া আর কিছু বলা যায় না।’৩০ এটাও এক ধরনের আধিপত্যাধীন হয়ে ওঠা: আমরা ‘অপরের অধীনতা’-য় পতিত হই, কিন্তু একইসঙ্গে অপরের আধিপত্যাধীন হওয়া এবং আত্ম-‘আধিপত্য’ (বা আত্ম-শাসন)-এর মধ্যে এক অদ্ভুত দোলনগতিও চলতে থাকে, যার ব্যাখ্যা হিসেবে অপর তারা (‘das Man’)-র আধিপত্যাধীন এই বিষয়ীর আত্মপরিচয়হীন ও স্থায়িত্বহীন চরিত্রকে চিহ্নিত করা যায়। অপর ‘তারা’ (‘das Man’) ‘ এই জন নয়, ওই জনও নয়, নিজে নয়, কোনো ব্যক্তিবর্গ নয়, এমনকি তাদের সবার সমষ্টিও নয়’।৩১ তাই এই বর্ণনার মধ্যেও বিচ্ছিন্নতা-সমালোচনার একটি উপাদান নিহিত আছে: আমাদের নিজেদের তৈরি করা জিনিসই ঘুরে এসে আমাদের উপর পরকীয় বস্তু হিসেবে প্রভাব বিস্তার করে, ‘আমরা নিজেরাই’ পরিচয়হীন ‘কেউ-না’ হয়ে যাই যারা আর নিজেদেরই তৈরি করা জগতের জন্য না পারি আর দায় নিতে, না আমাদের আর কোনোভাবে দায়বদ্ধ করে তোলা যায়। ‘আদিতে আর কারো উপস্থিতি থাকে না’। একইসঙ্গে অবশ্য সম্পর্কগুলোও বস্তুতে রূপান্তরিত হয়ে পরকীয় হয়ে ওঠে, যেনবা এছাড়া আর অন্যকিছু হওয়ার সম্ভাবনা তাদের মধ্যে ছিল না। এই কারণেই ‘das Man’--- হানা আরেন্ট যাকে ‘rule by nobody’ (‘অস্তিত্বহীনের দ্বারা শাসন’) বলেছেন---  তাকে ঠিক সেই কাঠামোটিরই বর্ণনা হিসেবে গণ্য করা যায় যে কাঠামোটির সন্ধান বিচ্ছিন্নতা বিষয়ে আমরা করে চলেছি: সামাজিক ক্ষমতা রূপে ‘das Man’ স্বাধীন অস্তিত্ব ধারণ করে বসেছে এবং তার জন্যই ব্যক্তিমানুষরা আর ‘নিজেদের সক্রিয়তার মধ্যে নিজেদের আবার খুঁজে পায় না’।৩২

 

টীকা

১। লুসিয়েন গোল্ডমান, Lukacs and Heidegger, পৃঃ ১১৬।

২। এরিক ফ্রম, Marx’s Concept of Man।

৩। মার্কস, ‘Economic and Philosophic Manuscripts’। এই পাঠ্যগুলো নিয়ে বিশদ ও অতি নির্দেশপূর্ণ ব্যাখ্যার জন্য দ্রষ্টব্য: ওয়াইল্ডট, Die Anthropologie des jungen Marx।

৪। মার্কস নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে চার্লস টেলর ‘প্রমিথিয় অভিব্যক্তিবাদ’-এর কথা বলেছেন। এর মধ্য দিয়ে তিনি যা গুরুত্ব সহকারে হাজির করতে চেয়েছেন তা হল এই যে মার্কস এখানে বিরোধে সদামগ্ন দুটি বিষয়ের মধ্যে সমন্বয়সাধন করতে চেয়েছেন। বিষয়দুটি হল: অভিব্যক্তির প্রয়োজনীয়তা এবং আকারদায়ক ক্ষমতার উপর আধুনায় জোর পরার সঙ্গে যুক্ত জগৎ নিয়ে আধুনিক মোহমুক্তি (টেলর এভাবেই সমস্যার সূত্রায়ন করেছেন)। এই অভিব্যক্তিবাদ প্রমিথিয় কারণ তা কোনো (প্রদত্ত) মহাজাগতিক শৃঙ্খলা বা ঈশ্বরিক অভিপ্রায় নিয়ে ভাবিত নয়, বরং মানুষের সৃষ্টির মধ্য দিয়েই নিজেকে অভিব্যক্ত করতে পারা নিয়ে ভাবিত। এই প্রসঙ্গে দ্রষ্টব্য: চার্লস টেলর, Hegel, পৃঃ ৫৫৯ এবং পূর্বোক্ত।

৫। মার্কস, ‘Economic and Philosophic Manuscripts’, খণ্ড ৩, পৃঃ ২৭৮-২৭৯।

৬। ডানিয়েল ব্রুডনি সম্মিলিত হওয়ার কম্যুনিস্ট ধরনকে ‘কাঠামোগত বন্ধুত্ব’ হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন (ব্রুডনি, Die Rechtfertigung), এখানে আমি সেই ব্যাখ্যার দিকেই ইঙ্গিত করেছি।

৭। মার্কস, ‘Economic and Philosophic Manuscripts’, খণ্ড ৩, পৃঃ ২৭৬।

৮। বলা যেতে পারে যে যান্ত্রিকীকরণ (instrumentalization)-এর বিরুদ্ধে কান্ট-এর নিষেধাজ্ঞাকে এভাবে আরো প্রসারিত করে আত্মসত্তার সঙ্গে সম্পর্কও তার অন্তর্গত করে দেওয়া--- অর্থাৎ, নিষেধাজ্ঞাটির একটি নৈতিক ব্যাখ্যান হাজির করা--- আধিপত্য এবং অর্থহীনতার অভিসৃতি সম্ভবপর করে তোলে।

৯। ‘শ্রমের উৎপাদ যদি শ্রমিকের না হয়, যদি তা একটি পরকীয় ক্ষমতা রূপে শ্রমিকেরই বিরুদ্ধে এসে দাঁড়ায়, তা হতে পারে একমাত্র এই কারণেই যে সেই উৎপাদ শ্রমিক ছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তির সম্পদে পরিণত হয়েছে। শ্রমিকের সক্রিয়তা যদি তার নিজের পীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তবে তা নিশ্চয়ই অন্য কারো জীবনে সুখ ও আনন্দের উপকরণ হয়ে উঠেছে’ মার্কস, ‘Economic and Philosophic Manuscripts’, খণ্ড ৩, পৃঃ ২৭৮। এখানে বিচ্ছিন্নতার কারণ ঢুঁড়তে গিয়ে আধিপত্যের সম্পর্ককে একটি উৎস হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে, যাকে আরো ব্যাপ্ততায় দেখলে, কাঠামোগত আধিপত্যের একটি সম্পর্ক রূপে চিহ্নিত করা যায়।

১০। মার্কসীয় বিচ্ছিন্নতা-তত্ত্ব এবং তার মধ্যে নিহিত সম্পদের ধারণা নিয়ে বিশদ ও সমালোচনাত্মক আলোচনার জন্য দ্রষ্টব্য: গিয়র্গ লোহমান, Indifferenz und Gesselschaft।

১১। ডানিয়েল ব্রুডনি, Die Rechtfertigung, পৃঃ ৩৯৫-৪২৩।

১২। আরিস্ততেলিয় ভঙ্গিমায়, শ্রমকে একটি মানুষের বৈশিষ্ট্যমূলক ক্রিয়া হিসেবে ধরা হয়ে থাকে কেবলমাত্র সেই মাত্রাতেই যে মাত্রায় তা প্রাকৃতিক প্রয়োজন বা প্রাকৃতিক দায় দ্বারা পুরোপুরি নির্ধারিত হয় না। সুতরাং মার্কস যাকে মানবশ্রমের বৈশিষ্ট্যমূলক চরিত্র বলছেন, তা কেবল এতেই সীমাবদ্ধ নয় যে মানবশ্রম প্রবৃত্তিচালিত হওয়ার বদলে পরিকল্পিত, বরং তা এও দাবি করে যে মানুষ ‘সৌন্দর্য্যের বিধি অনুসারে বস্তু নির্মাণ করে’। মার্কস যখন দাবি করেন যে বিচ্ছিন্নকৃত শ্রমে শ্রমিক তার মানব-ভূমিকায় পশু এবং পশু-ভূমিকায় মানুষ হয়ে ওঠে: ‘যা পশু তা মানুষ হয়ে দাঁড়ায়, আর যা মানুষ তা পশু হয়ে দাঁড়ায়’ (মার্কস, ‘Economic and Philosophic Manuscripts’, খণ্ড ৩, পৃঃ ২৭৫)--- তখন তার ব্যাখ্যাও আমাদের একইভাবে করে নিতে হয়।

১৩। যে মাত্রায় এই ভাবনাকাঠামো জগৎ-কে কেবলমাত্র আত্মসত্তারই একটি বহিঃস্থকরণ হিসেবে ভেবে নেয়, সেই মাত্রাতেই মার্কস সম্পর্কে হানা আরেন্ট-এর সমালোচনা পুরোটাই অ-যথার্থ নয়। এই বিষয়টি আমি বিশদে আলোচনা করেছি এই বইটিতে: রায়েল ইয়েগ্গি, Welt und Person।

১৪। এই সমস্যাগুলো নিয়ে সবচেয়ে বিশদ ও নির্দেশপূর্ণ আলোচনার জন্য দ্রষ্টব্য: আর্নস্ট মাইকেল ল্যাঙ, Das Prinzip Arbeit।

১৫। রেমন্ড গেউস, The Idea of a Critical Theory, পৃঃ ১৪।

১৬। হেইডেগার নিজে যেভাবে বস্তরূপান্তরের মধ্য দিয়ে পরকীয়সাধন (reification)-এর বিষয়টিকে উল্লেখ করেছেন, তা প্রমাণ করে যে বর্তমান আলোচনায় তিনি প্রাসঙ্গিক:

অনেক দিন ধরেই এটা জানা আছে যে প্রাচীন সত্তাতত্ত্ববিদ্যা ‘বস্তু-ধারণা’ (‘thing-concepts’) নিয়ে কাজ করে এবং ‘বস্তুরূপান্তরে পরকীয়সাধনকারী চেতনা’ (‘reifying consciousness’)-এর বিপদ থেকেই যায়। কিন্তু এই ‘বস্তুরূপান্তরে পরকীয়সাধনকারী’ কথাটার তাৎপর্য কি? কোথায় তার উদ্রেক ঘটে? স্থিতসত্তা কেন আমাদের ঘনিষ্ঠতর হাতের-কাছে-প্রস্তুত-এর সাপেক্ষে ‘অনুভূত’ না হয়ে হাতের-কাছে-উপস্থিত-এর সাপেক্ষেই ‘প্রায়শ’ ‘অনুভূত’ হয়ে থাকে? এই বস্তুরূপান্তরে পরকীয়সাধন সর্বদা কেন তার আধিপত্য জারি করতে ফিরে ফিরে আসে? ‘চেতনা’-র স্থিতসত্তার কাঠামো হিসেবে বস্তুরূপান্তরে পরকীয়সাধন যদি অনুপযুক্তই হয়, তাহলে তার সদর্থক উপযুক্ত কাঠামোটাই বা কী?

হেইডেগার, Being and Time, পৃঃ ৪৮৭

লুকাচ এবং হেইডেগার-এ বিচ্ছিন্নতা এবং বস্তুরূপান্তরে পরকীয়সাধন-এর সমস্যাদ্বয়ের মধ্যে স্পর্শবিন্দুগুলো নিয়ে আলোচনার জন্য দ্রষ্টব্য: লুসিয়েন গোল্ডমান, Lukacs and Heidegger।

১৭। এর মধ্য দিয়ে পরম্পরাগত দর্শন ও পরম্পরাগত সত্তাতত্ত্ববিদ্যা (চেতনার দর্শন)-এ ব্যক্ত জগতের ধারণা থেকে পৃথক একটি ধারণা ব্যক্ত করা হচ্ছে। ওই পরম্পরা যেভাবে ‘বিষয়ী’-র জগতের সঙ্গে সম্বন্ধিত হওয়ার প্রক্রিয়াকে বোঝে, তার থেকে ভিন্নতর এক বোঝাবুঝিও হাজির করা হচ্ছে।

১৮। থমাস রেন্টশ, Martin Heidegger, Das Sein und der Tod: Eine kritische Einfuhrung, পৃঃ ১২২।

১৯। হেইডেগারের ধারণামতে, হাতের-কাছে-উপস্থিত প্রণালীই জগৎ সম্পর্কে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের বোঝাবুঝি এবং আমাদের প্রাত্যহিক বোঝাবুঝি, উভয়ের মধ্যেই চারিয়ে থাকে। এর ফলে এই উভয়ই সংশ্লিষ্ট বস্তুদের হাতের-কাছে-প্রস্তুত চরিত্রকে স্পষ্ট করতে পারে না এবং আনাড়ির মতো নিজের ও জগতের মধ্যে একটা দেওয়াল খাড়া করে।

২০। বিষয়ীই জগৎ-কে নির্মাণ করে--- নেহাত এই দাবিটিই হেইডেগার এখানে করছেন না। ‘আমরা একইসঙ্গে জগতের প্রভু, আবার, জগতের দাস’, অর্থাৎ, আমরা এমন একটা জগতের ভিত্তিতেই নিজেদের বুঝতে পারি, যে জগৎ আবার ইতিমধ্যেই হাজির বা প্রদত্ত নয়।

২১। হেইডেগার, Being and Time, পৃঃ ৮৪।

২২। হেইডেগার, Being and Time, পৃঃ ৫৭।

২৩। বারবারা মেরকের, ‘Konversion statt Reflexion’।

২৪। বারবারা মেরকের, ‘Konversion statt Reflexion’, পৃঃ ২১৭।

২৫। জাঁ পল সার্ত্র, Being and Nothingness।

২৬। বস্তু এবং তার চরিত্র বিচারের (ontic) মাত্রা এবং সত্তাতত্ত্ববিদ্যার (ontological) মাত্রার মধ্যে পার্থক্য হিসেবে বারবারা মেরকের একে বুঝতে চেয়েছেন এভাবে: ‘যে দুটি ভিন্ন উপায়ে স্থিতসত্তা ভুল পথে যায়, আর যে দুটি উপায় ভিন্ন হলেও একে অপরকে ভিত্তিপ্রদান করার সম্পর্ক বজায় রেখে চলে। একদিকে সত্তাতত্ত্বগত ধোঁয়াশা, যেমন ধরা যাক, অস্তিত্ব (Existenz)-এর নিজেকে একটি বস্তুপদার্থ হিসেবে ব্যাখ্যা করা, আর অন্যদিকে বস্তু ও তার চরিত্র বিচারের ব্যর্থতা, যার বৈশিষ্ট্য হল স্বাধীনতার অভাব, প্রামাণিকতার অভাব ও উপযুক্ততার অভাব।’ (বারবারা মেরকের, ‘Konversion statt Reflexion’, পৃঃ ২১৭)

২৭। হেইডেগার, Being and Time, পৃঃ ১৬৫।

২৮। হেইডেগার, Being and Time, পৃঃ ১৫১।

২৯। হেইডেগার নিয়ে চর্চায় এটি একটি বিতর্কিত বিষয় হয়ে আছে। এই প্রসঙ্গে আরো অন্য অনেকের মতো,  জন হগল্যান্ড, রবার্ট দ্রেয়ফুস এবং রবার্ট ব্রানডন-দের মধ্যে ‘das Man’-এর নিন্দামূলক বনাম গঠনমূলক ব্যাখ্যা নিয়ে বিতর্ক দ্রষ্টব্য।

৩০। হেইডেগার, Being and Time, পৃঃ ১৬৫।

৩১। হেইডেগার, Being and Time, পৃঃ ১৬৪।

৩২। য়ুরগেন হাবেরমাস, Erlauterungen zur Diskursethik।

 

[পরবর্তী অংশ পরের সংখ্যায়]

বাংলা তর্জমা- বিপ্লব নায়ক

0 Comments
Leave a reply