[একুশ শতকের প্রথম দশকে জার্মান দার্শনিক রায়েল ইয়েগ্গি-র Entfremdung বইটি প্রকাশিত হয়ে সাড়া ফেলেছিল। দার্শনিক ফ্রেডরিখ নয়হোউসার ২০০৭ সালে বইটির পর্যালোচনা করতে গিয়ে বলেছিলেন যে গত এক দশকে জার্মান দার্শনিক চর্চার মহল থেকে প্রকাশিত হওয়া বইগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উত্তেজনাপ্রদগুলোর মধ্যে এটি একটি। নয়হোউসার-এর অনুবাদে ইংরেজিতে Alienation নামে বইটির সংস্করণ প্রকাশিত হয় ২০১৪ সালে। এই ইংরেজি সংস্করণ থেকেই বাংলায় তর্জমা করে আমরা এখানে হাজির করছি। পত্রিকার এই সংখ্যায় রইল প্রথম কিস্তি। পত্রিকার পরবর্তী সংখ্যাগুলোতে পরবর্তী কিস্তিগুলো ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়ে চলবে বলে আশা করা যায়। --- বিপ্লব নায়ক, বাংলায় তর্জমাকার]
বিচ্ছিন্নতা (alienation) হল এক সম্পর্কহীনতার সম্পর্ক। খুবই সংক্ষিপ্ত ও বিমূর্ত সূত্রায়ণে এই প্রতিপাদ্যটিকেই আমি এখানে আমার ভাবনার সূচনাবিন্দু হিসেবে ধরছি। এই সূত্রায়ণ অনুযায়ী, বিচ্ছিন্নতা কোনো সম্পর্কের অনুপস্থিতিকে চিহ্নিত করে না, বরং তা নিজেই একটি সম্পর্ক। অবশ্য, তা একটি অপর্যাপ্ত সম্পর্ক হতে পারে। উল্টোদিকে, বিচ্ছিন্নতা অতিক্রম করা মানে নিজসত্তা ও জগতের সঙ্গে একাত্মতার এক অবিভেদীকৃত একাত্মতার অবস্থায় পৌঁছানো নয়; তা-ও বরং এক সম্পর্ক বিশেষ: উপযোজনের সম্পর্ক। বিচ্ছিন্নতার ধারণার আমার করা এই পুনর্নির্মাণের পিছনে কাজ করা মূল ভাবনাটি এইরকম: বিচ্ছিন্নতার ধারণাটিকে আরো একবার ফলপ্রসূ করে তোলার জন্য তার একটি বিধিবৎ (formal) বর্ণনা দেওয়া আমাদের দরকার। বিচ্ছিন্নতার সম্পর্কাদিতে কী থেকে একজন বিচ্ছিন্ন তার একটি পর্যাপ্ত সংজ্ঞা হাজির করার চেয়ে সম্পর্কটির চরিত্র কী তা সংজ্ঞায়িত করাই প্রয়োজন; উপযোজনের সম্পর্কগুলো কী বিবিধ উপায়ে অবিন্যস্ত হয়ে ওঠে তা নির্ণয় করার সুযোগ খুলে যায় বিচ্ছিন্নতার ধারণার মধ্য দিয়ে। এই উপযোজনের সম্পর্কগুলোকে উৎপাদক সম্পর্ক হিসেবে বোঝা দরকার, বোধা দরকার এমন খোলা প্রক্রিয়াদি হিসেবে যেখানে উপযোজনের মধ্যে সর্বদা প্রদত্ত বস্তুর সংহতরকণ ও রূপান্তরসাধন উভয়ই ঘটে থাকে। উপযোজনের এই চলনগতির থমকে যাওয়া ও অনুপলব্ধির ব্যর্থতাই হল বিচ্ছিন্নতা। এই ধারণাগুলোকে ব্যবহার করে বিচ্ছিন্নতার ওপারে কোনো আর্কিমিডিয় ভিত্তিবিন্দু অবলম্বন না করেও বিচ্ছিন্নতার প্রক্রিয়াদি সম্পর্কে একটি সুসমঞ্জস বর্ণনা দেওয়া সম্ভব।
বিচ্ছিন্নতার তত্ত্ব প্রায়শই যে দুটি সমস্যার সম্মুখীন হয়ে থাকে--- একদিকে তার সারবত্তাবাদ (essentialism) ও মানুষের সারবত্তা বা প্রকৃতি (বা ভালো জীবন সম্পর্কে বস্তগতভাবে নির্ণীত আদর্শ) সম্পর্কিত এক ধারণাকে ঘিরে তার প্রকৃষ্টতাবাদী (perfectionist) অভিমুখীনতা; আর অন্যদিকে পুনর্মিলিত হওয়ার আদর্শ, টানাপোড়েন-মুক্ত এক একাত্মতার আদর্শ, যা বিচ্ছিন্নতাবাদী সমালোচনার সামাজিক তত্ত্ব বা পরিচয় তত্ত্বের রূপ নেওয়ার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত হয়ে দেখা দেয়--- সেই সমস্যাদুটিকেও এভাবে এড়ানো সম্ভব বলে আমি দেখাতে চাইব। বিচ্ছিন্নতাকে জগৎ ও আত্মসত্তার উপযোজনে বিপর্যয় বা বাধাপ্রাপ্তির সম্পর্ক হিসেবে দেখলে মুক্তি ও বিচ্ছিন্নতার মধ্যে একটি আলোকসঞ্চারী যোগাযোগও দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। যে পরিমাণে মুক্তির একটি পূর্বশর্ত হল নিজের যে কোনো কাজ ও সেই কাজ করার পরিবেশ-অবস্থা নিজের করে নেওয়ার সক্ষমতা, সে পরিমাণেই মুক্তি উপলব্ধি করার একটি আবশ্যক পূর্বশর্ত হল বিচ্ছিন্নতা অতিক্রম করা।
আলোচনার এই অংশে আমি বিচ্ছিন্নতার ধারণা দিয়ে চিহ্নিত সমস্যা-পরিসরটিকে হাজির করতে চাইব। প্রথমে আলোচনা করব (১) বিচ্ছিন্নতা নামক ঘটনা-প্রতীতি (phenomenon) ও ধারণার বিবিধ মাত্রা নিয়ে, প্রাত্যহিক ভাষায় ও ধারণাটির দার্শনিক বিচারে উভয়তই কীভাবে বিচ্ছিন্নতা নিজেকে খুলেমেলে ধরে তা নিয়ে। এই আলোচনাকে আরো গভীরে নিয়ে যাওয়া হবে (২) বিচ্ছিন্নতার তাত্ত্বিক সূচনাবিন্দুগুলোর আরো নিবিড় বিবেচনার মধ্য দিয়ে এবং কীভাবে মার্কসের তত্ত্বায়ন ও হেইডেগারের অস্তিত্বগত সত্তাতত্ত্ববিদ্যা (existential ontology) উভয়ক্ষেত্রে সেগুলোয় পৌঁছানো হয়েছে তা দেখার মধ্য দিয়ে। সামাজিক দর্শনের একটি ভিত্তিমূলক ধারণা হিসেবে কাজ করার যে সম্ভাবনা এই ধারণাটির মধ্যে নিহিত আছে, এভাবে তা উন্মোচিত করার পরিপ্রেক্ষিতে এরপর (৩) ধারণাটির কাঠামো এবং সংযুক্ত সমস্যাবলী নিয়ে আলোচনা করা হবে। শেষত, (৪) ধারণাটিকে পুনর্নির্মাণ করা নিয়ে আমার অভিমতগুলো আমি ব্যক্ত করব।
১
বিচ্ছিন্নতার ধারণা ও ঘটনা-প্রতীতি:
‘নিজসৃষ্ট জগতে এক অপরিচিত আগন্তুক’
বিচ্ছিন্নতার ধারণাটি গোটা এক গুচ্ছ জড়ানো-প্যাঁচানো বিষয়াবলীকে নির্দেশ করে। বিচ্ছিন্নতা মানে অনাসক্তি ও অভ্যন্তরীণ বিভাজন, আবার তার মানে নিজের সাপেক্ষে এবং অভিজ্ঞতায় অনাসক্ত ও অপর হিসেবে ধরা দেওয়া এক জগতের সাপেক্ষে ক্ষমতাহীনতা ও সম্পর্কহীনতাও বটে। বিচ্ছিন্নতা হল অক্ষমতা--- অপর মানুষ, বস্তু, সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের অক্ষমতা এবং সেই সূত্রে (বিচ্ছিন্নতার তত্ত্বের মৌলিক স্বজ্ঞা অনুযায়ী) আপন সত্তার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের অক্ষমতা। একটি বিচ্ছিন্নকৃত (alienated) জগৎ একজন ব্যক্তিমানুষের কাছে নিজেকে অকিঞ্চিৎকর ও অর্থহীন হিসেবে হাজির করে, অনমনীয়তা বা আকিঞ্চনতায় দীর্ণ হিসেবে হাজির করে, এমন একটা জগৎ হিসেবে হাজির করে যা নিজস্ব আপন নয়, অর্থাৎ এমন এক জগৎ যেখানে কোনো ব্যক্তিমানুষ স্বচ্ছন্দ বোধ করতে পারে না, যে জগতের উপর ব্যক্তিমানুষ কোনো প্রভাবও ফেলতে পারে না। বিচ্ছিন্নকৃত এই বিষয়ী নিজের কাছেই নিজে অপরিচিত আগন্তুক হয়ে ওঠে, সে আর নিজে নিজ অভিজ্ঞতায় ‘সক্রিয় ক্ষমতাশালী বিষয়ী’ হিসেবে ধরা দেয় না, বরং অজ্ঞাত বলসমূহের হাতে ক্রীড়নক ‘নিষ্ক্রিয় বিষয়’ হিসেবে ধরা দেয়।১ তখনই বিচ্ছিন্নতার কথা বলা যেতে পারে যখন ‘ব্যক্তিমানুষেরা নিজেদের সক্রিয়তার মধ্যে নিজেদের খুঁজে পায় না’২, বা, (হেইডেগার যেভাবে উপস্থাপন করেছেন) নিজ স্থিতসত্তা(being)-র উপর যখন আর আমাদের নিজেদের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। বিচ্ছিন্নকৃত ব্যক্তিমানুষ হল (আ্যালেসডেয়ার ম্যাকিনটির-এর প্রথম দিকের সূত্রায়ন অনুযায়ী) ‘নিজসৃষ্ট জগতে এক অপরিচিত আগন্তুক’।৩
বিচ্ছিন্নতার ঘটনা-প্রতীতি
প্রথম দৃষ্টিপাতেও বোঝা যায় যে আমাদের আলোচ্য ধারণাটির ‘কিনারাগুলো ঝাপসা’। বিমূর্তকে মূর্ত বাস্তব বলে গণ্য করা (reification), কৃত্রিমতা (inauthenticity), অনাচার (anomie), ইত্যাদি ধারণাগুলোর সঙ্গে আলোচ্য ধারণাটির বংশগত সাদৃশ্য ও সমাপতন যেমন, তেমনই প্রাত্যহিক ও দার্শনিক উভয় ভাষারূপেই তার ধারণ করা বিবিধ অর্থগুলোর মধ্যে জটিল সম্পর্কাবলীও ধারণাটির ক্রিয়াক্ষেত্র সম্পর্কে আমাদের অবহিত করে। ধারণাটির ‘অভিজ্ঞতামূলক বিষয়বস্তু’ যদি বা তার মধ্যে পরিস্ফুট হয়ে ওঠা ইতিহাসগত ও সমাজগত অভিজ্ঞতাবলী দিয়ে পুষ্ট হয়,৪ একথাও সমানভাবে সত্য যে একটি দার্শনিক ধারণা রূপে বিচ্ছিন্নতার ধারণা ব্যক্তিমানুষ ও সমাজ-আন্দোলনে ধারণ করা আত্ম ও বিশ্ব সংক্রান্ত ব্যাখ্যাগুলোকে প্রভাবিত করেছে। এহেন ‘অপরিশুদ্ধ’ মিশ্রণই এক বিবিধ-বিচিত্র ঘটনা-প্রতীতি-ক্ষেত্রকে বিচ্ছিন্নতা নামক ধারণাটির সঙ্গে জুড়ে দিয়েছে।৫
বিচ্ছিন্নতার তত্ত্ব: ‘কালচেতনায় সংকট’
তাহলে বিচ্ছিন্নতা মানে কী? ‘মনে হয় যেনবা যখনই কিছু যা হওয়ার কথা তা হচ্ছে না, তখনই তিনি তাকে বিচ্ছিন্নতা বলে অভিহিত করছেন’৬--- এরিক ফ্রম সম্পর্কে রিচার্ড শ্যাচ্ট-এর করা এই মন্তব্য ফ্রম ছাড়াও অন্য বহুজন প্রায়শই যেভাবে এই ধারণাটি ব্যবহার করে থাকেন তার একটি উপযুক্ত ব্যাখ্যান হতে পারে। যতই বিবিধ-বিচিত্র এই ঘটনা-প্রতীতি হোক না কেন, তা অবশ্য বিচ্ছিন্নতা ধারণাটি সম্পর্কে একটি প্রাথমিক খসড়াচিত্র হাজির করে। বিচ্ছিন্নকৃত সম্পর্ক হল নিজের সঙ্গে, জগতের সঙ্গে ও অপরের সঙ্গে এক ধরনের খামতির সম্পর্ক। নির্লিপ্তি, অন্যকে যন্ত্রবৎ ব্যবহার করা, বিমূর্তকে মূর্ত বাস্তব বলে ধরে নেওয়া, অসংগতি, কৃত্রিমতা, নিঃসঙ্গ বিযুক্তি, অর্থহীনতা, অনুর্বরতা--- এই নানাভাবে প্রদত্ত সম্পর্ককে চরিত্রায়িত করা হল খামতিকেই নানা রূপে ধরতে চাওয়া। বিচ্ছিন্নতা ধারণাটির একটি বৈশিষ্ট্যমূলক চরিত্র হল যে তা কেবল ক্ষমতাহীনতা ও স্বাধীনতাহীনতার কথাই বলে না, আত্ম ও বিশ্বজগতের সঙ্গে সম্পর্কের এক স্বভাবগত খামতির কথাও বলে। (মার্কস যখন বিচ্ছিন্নতাকে জগৎ ও মানুষের ‘বাস্তবতার দ্বিগুণ ক্ষয়’ বলে বর্ণনা করেছিলেন, তখন তাঁর অভিপ্রেত দ্বৈত অর্থকে এভাবেই বোঝা উচিত বলে মনে হয়: অবাস্তব হয়ে ওঠার মধ্য দিয়ে ব্যক্তিমানুষের অভিজ্ঞতায় সে নিজে আর ‘কার্যকরী’ বলে মনে হয় না, আর, অবাস্তব হয়ে ওঠা জগৎও নির্লিপ্ত অর্থহীন হয়ে ওঠে।) এহেন আন্তর্সম্পর্কগুলোর জটিলতাই বিচ্ছিন্নতাকে আধুনিকতার সংকট নির্ধারণের কাজে মূল ধারণা করে তুলেছে এবং সমাজদর্শনেও অন্যতম ভিত্তিগত ধারণা হিসেবে জায়গা করে দিয়েছে।
সমকালীন চেতনাসংকটের একটি অভিব্যক্তি (হেগেল হয়ত এভাবেই বলতেন) হিসেবে বিচ্ছিন্নতা নিয়ে আধুনিক আলোচনা রুশো ও শিলার থেকে হেগেল হয়ে কিয়ের্কগার্ড ও মার্কস অবধি বিস্তৃত। আঠারো শতকের পর থেকে শিল্পায়ন-বিকাশের হাত ধরে মানুষের নিজের সঙ্গে ও জগতের সঙ্গে সম্পর্কের মধ্যে ‘অনিশ্চয়তা, খণ্ডিতকরণ ও আভ্যন্তরীণ বিভাজন’-এর বাড়বাড়ন্ত বোঝাতে ‘সভ্যতার সবচেয়ে বড় অসুখ’৭-এর স্বীকৃতি আদায় করে নেওয়া বিচ্ছিন্নতা একটি চালু লব্জে পরিণত হয়েছে। এহেন অসুখনির্ণয়কেই মার্কস তাঁর বিচ্ছিন্নতার তত্ত্বে ধারণ করে পুঁজিবাদের সমালোচনায় কাজে লাগিয়েছিলেন। আর, ‘আধুনিক মানুষের নিজ আবশ্যিক সংজ্ঞা বা উদ্দেশ্যময়তা খুইয়ে বসা’-কে ঘিরে আপন সত্তায় স্থিত হওয়া বলতে কী ও আপন সত্তাকে হারিয়ে ফেলা বলতেই বা কী এহেন অস্তিত্ববাদী প্রশ্নগুলো৮ কিয়ের্কগার্ডকে অনুসরণ করে ক্রমশ চেহারা পেয়েছে। এই পরম্পরা অনুযায়ী, নির্লিপ্তি ও চরম বাস্তুহীনতার অভিজ্ঞতা হল জগৎ এবং আত্মসত্তা ও জগতের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক বিষয়ে সত্তাতাত্ত্বিক (ontological) পরিসরের একটি ভুল-বোঝাবুঝি, তার চেয়ে কম কিছু নয়, যে ধারণার সঙ্গে মার্কসীয় নির্ধারণের বিবিধ অমিল সত্ত্বেও মিলের জায়গাও কিছু আছে। আধুনিক অবতারে বিচ্ছিন্নতার নির্ধারণসমূহ, যেমন ধরা যাক, সবসময় স্বাধীনতা, আত্মনির্ধারণ ও তা বাস্তবায়নে ব্যর্থতা নিয়ে ভাবিত। এইভাবে দেখলে, বিচ্ছিন্নতা কেবলমাত্র আধুনিকতার সমস্যা নয়, তা একটি আধুনিক সমস্যাও বটে।
বিচ্ছিন্নতার তত্ত্বের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
বিচ্ছিন্নতার আধুনিক তত্ত্বের একটি (অতি) সংক্ষিপ্ত ইতিহাস এভাবে দেওয়া যেতে পারে:
১
বিচ্ছিন্নতা শব্দটি রুশো-র লেখায় কোথাও ব্যবহৃত না হলেও, রুশো-র কাজের মধ্যে আমরা সেই সমস্ত মূল ধারণাকেই খুঁজে পাব যেগুলো অতীত ও বর্তমানের বিচ্ছিন্নতা সম্পর্কিত সমস্ত তত্ত্বায়ন (সমাজ-দার্শনিক অর্থে) অবলম্বন করেছে।৯ রুশো তাঁর ‘Discourse on the Origin of Inequality Among Men’ (১৭৫৫) বইটি শুরু করেছিলেন একটি চিত্তাকর্ষক প্রতিমা দিয়ে: ‘গ্লকাস-এর মূর্তি কাল, সমুদ্র ও ঝড়ের প্রকোপে ক্ষয়িত হতে হতে যেমন ঈশ্বরের চেয়ে হিংস্র জানোয়ারের কাছাকাছি চলে এসেছিল, মানবসত্তারও তেমনই অবস্থা। সমাজক্রোড়ে চির-পুনরাবৃত্ত হাজারো কারণে বদলাতে বদলাতে, জ্ঞান ও ভ্রান্তির পাহাড় অধিগ্রহণ করতে করতে, দেহের গঠনে ঘটে যাওয়া বদলের সূত্রে, আবেগ-উচ্ছ্বাসের লাগাতার ধাক্কায় মানবসত্তা বলতে গেলে এমনভাবে রূপ-বদল করেছে যে তাকে আর প্রায় চেনাই যায় না।’১০ রুশো এখানে যে রূপ-বদল বা রূপ-বিকৃতির কথা বলছেন, তা হল সমাজের দ্বারা মানুষের বিকৃতিসাধন: তার স্বভাবপ্রকৃতি যখন বিভাজিত হয়ে যায়, তার নিজের প্রয়োজনগুলো থেকে যখন সে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, সমাজের বশ্যতাকামী অধ্যাদেশসমূহের কাছে যখন তাকে আত্মসমর্পণ করতে হয়, স্বীকৃতি-অভিলাষী যে মানুষ তখন আত্ম-মূল্যের মাপ অপরদের মতামতের উপর নির্ভরশীল করে তোলে, তার সামাজিক সত্তা তখন কৃত্রিম বিকৃত রূপ ধারণ করে। সভ্য মানুষদের পারস্পরিক নির্ভরশীলতা, সমাজ-সংস্পর্শের মধ্য দিয়ে অবারিত অসীম হয়ে ওঠা প্রয়োজনসমূহ, আর অন্যকে দেখে নিজের দিক-দিশা নির্ণয় করার অভ্যাস মানুষের মধ্যে আধিপত্য ও দাসত্বের জন্ম দেয়, খাঁটি স্বকীয়তার ক্ষয় ঘটিয়ে (স্ব-)বিচ্ছিন্নতার জন্ম দেয়--- অন্যভাবে বললে, এমন এক অবস্থার জন্ম দেয় যা স্বয়ংসম্পূর্ণতা প্রদানকারী স্বাধীন অকৃত্রিম প্রকৃতিরূপের সম্পূর্ণ বিরোধী।
দুটি আপাতবিরোধী ভাবনা রুশো-র চিন্তাকে বিচ্ছিন্নতার তত্ত্বক্ষেত্রে প্রভাবশালী করে তুলেছে: প্রথমত, নিজের সঙ্গে ও স্বপ্রকৃতির সঙ্গে নির্বিঘ্ন বোঝাপড়ার চাহিদা যথার্থতা (authenticity)-র আধুনিক আদর্শ হিসেবে বিকশিত হওয়া, আর দ্বিতীয়ত, সামাজিক চুক্তি-র প্রধান কর্তব্য হিসেবে রুশো-র দ্বারা সূত্রায়িত সামাজিক স্বাধীনতার ভাবনা। রুশো যদিবা ‘Second Discourse’-এ সামাজিকীকরণের (তাঁর বিবেচনায়) সম্পূর্ণ নঙর্থক প্রভাবগুলোর বিচ্ছিন্নকৃত চরিত্র বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছেন, তিনিই আবার ‘Social Contract’-এ বিচ্ছিন্নকৃত নয় এমন সামাজিকীকরণের এমন আদর্শ রূপ উদ্ভাবন করেছেন। রুশোর চিন্তার মধ্যে কাজ করতে থাকা টানাপোড়েনগুলোকে অস্বীকার না করেও তাঁর উপরোক্ত দুটি ভাবনার মধ্যে যোগসূত্র এভাবে বর্ণনা করা যায়: যথার্থ সত্তায় স্থিতি (authentic selfhood) এবং সমাজের মধ্যে যে ফাঁকের কথা রুশো অত বাকপটুতার সাথে তুলে ধরেছিলেন, তা তাঁর নিজের পূর্বানুমানসমূহ অনুযায়ীই এমন এক অমীমাংসিত আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের জন্ম দেয় যার সমাধান একমাত্র হতে পারে এমন শর্ত প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে যেখানে ব্যক্তিমানুষেরা নিজেদের অভিজ্ঞতায় তাদের আপন বলে বোধ করবে এমন সামাজিক প্রতিষ্ঠানাদির মধ্যেই বাস করে। একদিকে যেমন রুশো-বর্ণিত বিচ্ছিন্নকৃত মানুষ যে মাত্রায় অপরদের সঙ্গে সম্পর্কস্থাপন করে সেই মাত্রাতেই নিজেকে খুইয়ে বসে: প্রাকৃতিক মানুষ ‘নিজের মধ্যে বাঁচে; সমাজমুখী মানুষ সর্বদা নিজের বাইরে বাঁচে’১১; অন্যদিকে তেমনই, মানুষ একমাত্র সমাজের মধ্য দিয়েই নিজেকে ফিরে পেতে পারে। প্রকৃতির নিজ আত্মসম্পূর্ণতার অবস্থা--- এবং তারই সঙ্গে অন্যদের থেকে স্বাধীন ও বিচ্ছিন্ন থাকার স্বাধীনতা--- পুনর্প্রতিষ্ঠার জন্য যেহেতু অতি কড়া মূল্য চুকোতে হয় (যেমন, যুক্তি ও বিবেচনা-পুনর্বিবেচনা করার ক্ষমতার মতো বিশেষভাবে মনুষ্যোচিত গুণ হারানোর মূল্য)১২, তাই বিচ্ছিন্নতার সমস্যার সমাধান সামাজিক বন্ধন ছিঁড়ে ফেলার মধ্যে থাকতে পারে না, বরং সামাজিক বন্ধনগুলোর রূপান্তরসাধনের মধ্যেই থাকতে পারে। সামাজিকীকৃত ব্যক্তিমানুষদের মধ্যে যে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা বিচ্ছিন্নতাপ্রদ হিসেবে অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, তা কোন ভাবনা অনুযায়ী রূপান্তর করে নেওয়া প্রয়োজন, তা ‘Social Contract’-এ বিধৃত হয়েছে। ভাবনাটি হল এমন এক সমাজ-সমিতি গঠন যেখানে প্রতিটি ব্যক্তিমানুষ তার সমস্ত অধিকারকে সমাজের কাছে বন্ধক রেখে ‘আবার আগের মতো স্বাধীন’ হয়ে উঠেছে। যা একসময় ছিল বিচ্ছিন্নতাপ্রদ ভিন্নতা, তা রূপান্তরিত হল ‘নিজ আপন আইন’-এর কাছে বশ্যতাস্বীকার। রুশো-র চিন্তা তাই তাঁর অনুগামীদের দুটি ভিন্ন দিকে চালিত করেছে। এক দিকে যেমন রুশো (বিশেষত ‘রুশোবাদী মতবাদ’) মানে বিচ্ছিন্নতাবাদী সমালোচনার অবিরত পুনরাবর্তিত রূপ যা ‘সর্বজনীন’-এর থেকে মুখ ঘুরিয়ে অবিকৃত প্রকৃতি বা আদিম স্বয়মসম্পূর্ণতার আদর্শ অবলম্বন করে এবং সমাজমুখীনতা ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানাদিকে মজ্জাগতভাবে বিচ্ছিন্নকৃত বলে গণ্য করে; অন্যদিকে তেমনই রুশো কেবল কান্ট-এর স্বায়ত্তশাসনের ধারণারই নয়, স্বাধীনতার সামাজিক চরিত্র বিষয়ে হেগেল-এর ধারণারও প্রেরণা হিসেবে কাজ করে।
২
‘সর্বজনীনের মধ্যে আত্মোপলব্ধি’-র ধারণা অবশ্য অবশেষে হেগেল-এর হাতেই রূপ পেয়েছিল। হেগেল-এর ধারণামতেও বিচ্ছিন্নতা হল আধুনিকতার অন্যতম চরিত্রবৈশিষ্ট্য--- আধুনিক চেতনার খণ্ডায়ন, টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়ার মুখে দাঁড়িয়ে থাকা এক ‘সভ্য সমাজ’ (civil society)-এর মধ্যের সম্পর্কসমূহে ‘বিশেষ’ ও ‘সর্বজনীন’-এর জোড় খুলে আলাদা হয়ে যাওয়া, এসব তার লক্ষণ; কিন্তু হেগেল এই সমস্যার মূলকেন্দ্র সমাজের মধ্য দিয়ে ব্যক্তিমানুষের আত্মসত্তা খুইয়ে ফেলার মধ্যে অবস্থিত বলে চিহ্নিত করার বদলে ব্যক্তিমানুষ ও সমাজের মধ্যবর্তী ফাটলে অবস্থিত বলে চিহ্নিত করেছেন। হেগেল-এর বিবেচনামতে, বিচ্ছিন্নতা (বা আভ্যন্তরীণ বিভাজন) হল সমাজজীবনের একটি ঘাটতি বিশেষ (Sittlichkeit), ‘সমাজজীবনে নৈতিক সর্বজনীনতার হানি’ (sittlicher Allgemeinheit)। এই পরিপ্রেক্ষিতে, নৈতিকতার বিচারে সন্তুষ্টিদায়ক এক সমাজের ধারণা প্রাগাধুনিক জনগোষ্ঠীদের সহজাত প্রকৃত-পর্যাপ্ত নৈতিক সংহতির (যেমন, গ্রাগাধুনিক গ্রিক polis-এর সংহত নৈতিক জীবন) উপর নির্ভরশীল নয়, বরং সামাজিক সংহতির এমন এক রূপের উপর নির্ভরশীল যা ‘ব্যক্তিমানুষের বিশেষত্বের অধিকার’-এর প্রতি সুবিচার করতে পারে। হেগেল যে অণুবাদ (atomism) বর্জন করেছিলেন, তা এই ধারণার উপর ভিত্তি করে যে ব্যক্তিমানুষেরা ব্যতিক্রমহীনভাবে সর্বদা সম্পর্কাবলীর মধ্যে নিমজ্জিতরূপেই নিজেদের খুঁজে পায়,১৩ এই সম্পর্ক-নিমজ্জনের উপলব্ধিই (বিবিধ অর্থে) তাদের স্বাধীনতার শর্তাবলী হিসেবে কাজ করে।
রুশো-র দ্বারা উপস্থাপিত সমস্যাগুলো নিয়ে যখন হেগেল বিবেচনা করতে বসলেন, তিনি রুশো-র সূচনাবিন্দুটিকে রূপান্তরিত করে নিলেন এইভাবে: তিনি ধরে নিলেন যে স্বাধীনতা মানে নৈতিক সমাজজীবন (Sittlichkeit) আর নৈতিক সমাজজীবন মানে স্বাধীনতা; আমাদের নিজেদের ব্যক্তিবিশেষ হিসেবে স্ব-উপলব্ধি করা সর্বপ্রথম সম্ভবপর হয়ে ওঠে যে সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কল্যাণে, সেই সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে এবং মাধ্যমেই আমরা স্বাধীন হয়ে উঠি। তখনও অণুবাদী স্তরে রয়ে যাওয়া রুশো-র যথার্থতা (authenticity)-র আদর্শ প্রতিস্থাপিত হল এমন এক দৃষ্টিকোণ দিয়ে যা নৈতিক সমাজজীবনের প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে ব্যক্তিমানুষদের একাত্মতাবোধের মধ্যেই আত্মোপলব্ধির অবস্থান চিহ্নিত করল। যদিও হেগেল-এর তত্ত্ব আত্মসম্পূর্ণতা হিসেবে বর্ণিত স্বাধীনতার আদর্শকে অতিক্রম করতে উদ্যোগী, তবুও তা কান্ট-এর আত্মনির্ধারণের ধারণাকে অন্তর্ভুক্ত করে নিতে চায়: তার লক্ষ্য হল সেই সমস্ত শর্তাবলী নির্ধারণ করা যা সামাজিক প্রতিষ্ঠানাদির মধ্যে ‘নিজেকে ফের খুঁজে পাওয়া’ সম্ভবপর করে তুলবে। হেগেল-কথিত ‘Bildung’-এর ধারণা এমন এক প্রক্রিয়ার কথা বলে যার মধ্য দিয়ে ব্যক্তিমানুষেরা তাদের প্রাথমিক পর্বের নির্ভরতার সম্পর্কগুলোর বৃত্তের বাইরে বের হওয়ার পথ তৈরি করে, বের হয়ে আসে এবং তাদের সামাজিক সম্পর্কাবলী, যা তাদের ‘নিজত্ব’-এর শর্তাবলীও বটে, সেই সামাজিক সম্পর্কাবলীকেই নিজস্ব আপন করে নেয়।১৪
৩
বিচ্ছিন্নতার তত্ত্বের হেগেল-পরবর্তী দুটি ধারা কিয়ের্কগার্ড ও মার্কস-এর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এঁরা দুজনে হেগেল-এর প্রকল্পের দুটি ভাষ্য অবলম্বন করেছেন যা মানবপ্রকৃতি সম্পর্কে একটি নির্দিষ্ট ধারণাকে সূচনাবিন্দু হিসেবে ধরে নিয়েছে।১৫ সন্দেহ নেই যে উনিশ শতকের শেষার্ধে এসে ‘বাস্তব অস্তিত্ব’ ও ‘বাস্তবের সক্রিয় মানুষ’-এর উপর যে জোর পড়েছিল, তা তাঁদের দুজনকে দুটি ভিন্ন অভিমুখে চালিত করেছিল: মার্কস-এর চিন্তার অর্থনীতি অভিমুখে বাঁক নেওয়া এবং কিয়ের্কগার্ড-এর চিন্তায় মানব-অস্তিত্বের নৈতিক মাত্রাবলী নিয়ে উদ্বেগ একে অপরের বৈপরীত্য তৈরি করেছিল। আভ্যন্তরীণ বিভাজন, নির্লিপ্তি, নিজসত্তা ও জগতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হওয়া--- এই সমস্যাবলীর উপর বিচ্ছিন্নতার তত্ত্ব যেভাবে মনোনিবেশ করেছিল তা উভয় দার্শনিককেই ব্যবহারিক উপযোজন-এর প্রসঙ্গাভিমুখে ঠেলে দিয়েছিল। কিয়ের্কগার্ড ‘নিজসত্তা হয়ে ওঠা’ (becoming oneself)-কে নিজ আপন সক্রিয়তা ও নিজ আপন ইতিহাস উপযোজন করার সাপেক্ষে বুঝেছিলেন--- ‘নিত্য ব্যবহারে আপনাকে মুঠোয় ধরা’-র এমন এক প্রক্রিয়া হিসেবে দেখেছিলেন যা বিজাতীয় বলরাজির দ্বারা উদ্ভূত যা কিছু তার উপর সক্রিয়ভাবে দখল কায়েম করবে। ঠিক তেমনই, মার্কস-এর ভাবনায় আমরা পাই বিশ্বের উৎপাদনশীল উপযোজনের ভাবনা যেখানে আত্মসত্তা অ-বিচ্ছিন্নকৃত অস্তিত্বের আদর্শরূপ হিসেবে কাজ করে।
সমকালীন বুর্জোয়া সমাজের প্রথানুগত্য-চাপিয়ে-দেওয়ার প্রবণতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে একজন ‘স্বতন্ত্র মানুষ’ (singular human being) হয়ে ওঠা হল কিয়ের্কগার্ড-এর নৈতিক আদর্শ। অন্যদিকে, মার্কস এগিয়েছেন মানুষের নিজ আপন মানবিক অন্তর্বস্তু উপযোজনের ভাবনাকে ধরে, যা আবার ‘প্রজাতি-স্থিতসত্তা’ (species-being) উপযোজনার পরিপ্রেক্ষিতে ভাবা হয়েছে (প্রজাতি-স্থিতসত্তা বা species-being মূলগতভাবে ফয়েরবাখ-এর দ্বারা প্রবর্তিত একটি ধারণা, যা হেগেল-উত্থাপিত নৈতিকতার বিচারে সন্তুষ্টিদায়ক সমাজজীবন বা Sittlichkeit-এর একটি স্বাভাবিকীকৃত সংস্করণ হিসেবে বোঝা যেতে পারে)। সুতরাং, বিচ্ছিন্নতার অস্তিত্ববাদী সমালোচনা-ধারার সূচনা ও প্রান্তিক বিন্দু উভয়ই হেগেল-মার্কস সমালোচনাধারার থেকে গুরুত্বপূর্ণভাবে আলাদা: হেগেল-মার্কস সমালোচনাধারায় যেখানে বিচ্ছিন্নতাকে বোঝা হচ্ছে সমাজজগৎ থেকে বিচ্ছিন্নতা হিসেবে, সেখানে অস্তিত্ববাদী সমালোচনাধারায় বারোয়ারি সমাজজগতের মধ্যে নিমজ্জনকেই বিচ্ছিন্নতার উৎস হিসেবে ধরা হয়েছে এই বোঝাবুঝির মধ্য দিয়ে যে সমস্তরীয় করে তোলার মধ্য দিয়ে সংজ্ঞাত এক বারোয়ারি জগতে পড়ার মধ্য দিয়ে (কিয়ের্কগার্ড) বা ‘মান্য সমষ্টিবর’ (das Man--- হেইডেগার)-এর শাসনাধীন হওয়ার মধ্য দিয়ে বিষয়ীর যথার্থতা হানি হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও বিচ্ছিন্নতার এই দুই সমালোচনাধারার মধ্যে বহু সাধারণ ছেদবিন্দুও বর্তমান (আর তা কেবল তাদের গ্রহণ-বর্জনের ইতিহাসের নিরিখেই নয়): হেগেল-এর আভ্যন্তরীণ বিভাজন সংক্রান্ত নির্ধারণ এই সিদ্ধান্তের দিকে নিয়ে যায় যে সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানাদির মধ্যে ব্যক্তিমানুষেরা নিজেদের আবার খুঁজে পেতে পারে না; ১৮৪৪ সালের পাণ্ডুলিপিতে মার্কস-এর বিচ্ছিন্নতা সম্পর্কিত বিশ্লেষণ দাবি করছে যে বিচ্ছিন্নকৃত শ্রমের মধ্যে থেকে আমরা আমাদের নিজেদের সক্রিয়তা, ক্রিয়াজাত উৎপাদ এবং যৌথ উৎপাদনের শর্তাবলী কোনোকিছুই উপযোজন করতে পারি না; বিচ্ছিন্নতার অস্তিত্ববাদী ধারা প্রসূত ধারণা নির্দেশ করে সেই কাঠামোগত বাধাগুলোর দিকে যেগুলো ব্যক্তিমানুষদের কাছে জগৎকে তাদের নিজেদের আপন বলে বোঝার ক্ষেত্র অন্তরায় হয়ে ওঠে, সেই জগৎকে আকার দেওয়ার বিষয়ী হিসেবে নিজেদের মনে করার ক্ষেত্রেও অন্তরায় হয়ে ওঠে।
৪
বিশ শতকে পাশ্চাত্যের মার্কসবাদ (Western Marxism)-এর বিভিন্ন ধারা-উপধারায় বিচ্ছিন্নতার আলোচনা (এবং সেই সূত্রে মার্কস-এর চিন্তার সামাজিক-দার্শনিক পরম্পরা) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এর মধ্যে দিয়ে সমাজ-সমালোচনার এমন এক আদর্শস্থাপক মান (normative dimension) হাজির হওয়ার সম্ভাবনা খুলে গিয়েছিল যা বিকশিততম পুঁজিবাদ সম্পর্কে সমালোচনাত্মক তত্ত্ব নির্মাণে মৌলিক গুরুত্বের ভূমিকা পালন করতে পারে। সেই ১৯২০ সালেই, মার্কস-এর ১৮৪৪ সালের পাণ্ডুলিপির বিচ্ছিন্নতা বিষয়ক বিবরণ তখনও তাঁর অজানা,১৬ তখনই গিয়র্গ লুকাচ তাঁর ‘Reification and the Consciousness of the Proletariat’ নামক বিখ্যাত প্রবন্ধে পণ্য-ভক্তিবাদ (commodity fetishism) সম্পর্কিত মার্কস-এর আলোচনাকে বিস্তৃত করে বিচ্ছিন্নতা এবং বিমূর্তকে মূর্ত বাস্তব বলে গণ্য করা (alienation and reification) সংক্রান্ত তত্ত্বে পৌঁছেছিলেন।১৭ এই তত্ত্বায়নে তাঁর কেন্দ্রীয় সম্পাদ্য ছিল যে ‘পণ্য রূপের সর্বজনীনতা’ আধুনিক সমাজের স্বাতন্ত্র্যসূচক বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছে, এর যুক্তিগত বিস্তারের মধ্য দিয়ে বিমূর্তকে মূর্ত বাস্তব বলে গণ্য করার তত্ত্বই আধুনিক পুঁজিবাদী সমাজ ও তার সমস্ত অভিব্যক্তির তত্ত্ব হয়ে ওঠে। লুকাচের উপর ম্যাক্স ওয়েবার-এর যুক্তিসিদ্ধকরণের তত্ত্ব (theory of rationalization) এবং গিয়র্গ সিম্মেল-এর বস্তুরূপান্তরকরণ (Versachlichung/ objectification) সংক্রান্ত নির্ধারণ প্রভাব ফেলেছিল। সেই প্রভাবের ফলে মার্কস-এর থেকে তিনি কিছুটা আলাদা ধারণা পোষণ করেছিলেন যখন তিনি নির্লিপ্তি, বস্তুরূপান্তরকরণ, পরিমাণ সূচক মাপে মাপা (quantification) এবং বিমূর্তায়ন-এর মতো ঘটনা-প্রতীতিগুলোকে এমনই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেছিলেন যা পুঁজিবাদী বাজার অর্থনীতি ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক বুর্জোয়া সমাজের সমস্ত সম্পর্ক ও অভিব্যক্তিরূপের নির্ধারক চরিত্রবৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছে। ওয়েবার লোহার খাঁচার প্রতিমায় বোঝাতে চেয়েছিলেন কীভাবে আমলাতান্ত্রিকতায় বাঁধা পুঁজিবাদী সমাজে মানুষ বন্দি হয়েছে; সিম্মেল বলেছিলেন এক ‘বিয়োগান্ত সংস্কৃতি’ (tragedy of culture)-র কথা যেখানে মানুষের স্বাধীনতার উৎপাদগুলোই এমন স্বাধীন বস্তুগত অস্তিত্ব ধারণ করে নেয় যা মানুষের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে মানুষের ঘাড়ে চেপে বসে; সিম্মেলই বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছিলেন কীভাবে অর্থ-মাধ্যম অর্থনীতি (money economy)-র বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে স্বাধীনতা তার সমস্ত অর্থ হারিয়েছে--- লুকাচ তাঁর সমসময়ে প্রতীয়মান ঘটনা-প্রতীতিগুলোর মধ্যে এই সমস্তকিছুই মূর্তভাবে ফুটে উঠতে দেখছিলেন। মার্কসবাদী ও অস্তিত্ববাদী ভাবনাকল্পগুলোর ছেদবিন্দু হয়ে ওঠাই লুকাচের চিন্তাধারার স্বাতন্ত্র্যদায়ী বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছিল,১৮ আর সহজেই বোঝা যায় যে এই তাত্ত্বিক মিশ্রণ সমালোচনাত্মক তত্ত্ব (Critical Theory)-র পরবর্তী বিকাশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল, এমনকি আজও বিচ্ছিন্নতার ধারণার বিভিন্ন রূপভেদ বোঝার জন্য তা একইরকম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে আছে।১৯
টীকা
১। ইজরায়েল ও মাস, Der Begriff Entfremdung।
২। হাবেরমাস, Erlauterungen zur Diskursethik, পৃঃ ৪৮।
৩। ম্যাকিনটায়ার, Marxism, পৃঃ ২৩।
৪। ‘অভিজ্ঞতামূলক বিষয়বস্তু’ (experiential content) অভিব্যক্তিটি আমি নেগট ও ক্লুগ, Offentlichkeit und Erfahrung -থেকে ধার করেছি। এর মধ্য দিয়ে, সেইসব ধারণাকে বোঝানো হচ্ছে যা অভিজ্ঞতা অর্জন সম্ভবপর করে তোলে এবং, ঘুরিয়ে আবার, এই ধারণার মধ্যেই প্রাণসঞ্চার করে।
৫। রেমন্ড গেউস, Gluck und Politik, পৃঃ ৫৬-এ যেমন বলেছেন, সমস্ত কৌতূহলপ্রদ দার্শনিক ধারণাই ‘অপরিশুদ্ধ’।
৬। শ্যাচ্ট, Alienation, পৃঃ ১১৬।
৭। নিকোলাস, Hegel’s Theorie der Entfremdung, পৃঃ ২৭।
৮। দেউনিস্যেন, Selbstverwirklichung und Allgemeinheit।
৯। রুশো-র ব্যাখ্যাকারদের মধ্যে এ নিয়ে কোনো মতের ভিন্নতা নেই। যেমন, হানস বার্ত-এর বর্ণনায় রুশো হলেন ‘avant la lettre’ ‘বিচ্ছিন্নতার তাত্ত্বিক’ (বার্ত, Wahrheit und Ideologie, পৃঃ ১০৫) । আর, ব্রোনিস্লাভ ব্যাকজকো-র মতে, ‘(বিচ্ছিন্নতা নামক এই) হেগেলিয়-মার্কসিয় শব্দবন্ধটি একেবারে খাপেখাপে এঁটে যায় সেই অবস্থার সঙ্গেই যা রুশো কোনো নাম না দিয়েই অনবরত বর্ণনা করে গেছেন’ (ব্যাকজকো, Rousseau, পৃঃ ২৭) ।
১০। রুশো, The Discourses, পৃঃ ১২৪।
১১। রুশো, The Discourses, পৃঃ ১৮৭।
১২। ফ্রেডরিখ নয়হোউসার তাঁর Foundations of Hegel’s Social Theory বইয়ের ৫৫-৮১ পৃষ্ঠায় রুশো-র চিন্তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এই বিষয়টি অত্যন্ত জোরের সাথে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
১৩। সামাজিক দর্শনে ‘অণুবাদ’ (atomism) বিষয়ক আলোচনার জন্য দ্রষ্টব্য: টেলর, What’s Wrong with Negative Liberty, পৃঃ ২১১-২২৯।
১৪। আমি এখানে সমকালীন সমাজের একটি সমস্যা হিসেবে হেগেল-এর বিচ্ছিন্নতা সম্পর্কিত বিচার নিয়ে কথা বলছি। অন্যদিকে, তাঁর বিচ্ছিন্নতা সম্পর্কিত দার্শনিক ধারণাটি এমন এক কাঠামো প্রদর্শন করে যা মার্কস-এর ধারণাকেও প্রভাবিত করেছে, তা হল এইরকম: বিচ্ছিন্নতা হল আত্মা (Spirit)-র আত্মবিচ্ছিন্নতা, যার ফলে সে নিজের উৎপাদ-কে নিজের বলে চিনতে পারে না। বিবেচনার এই স্তরে, বিচ্ছিন্নতার ধারণাটিকে বাধ্যতামূলকভাবে নিন্দাকর বা আদর্শস্থাপক কোনোভাবেই প্রয়োগ করা হয় না। হেগেল-এর বিচ্ছিন্নতার তত্ত্বের বিবিধ দিক দেখার জন্য দ্রষ্টব্য: নিকোলাস, Hegel’s Theorie der Entfremdung।
১৫। ল্যয়িথ, From Hegel to Nietzsche, পৃঃ ১৩৫-১৩৯।
১৬। ১৮৪৪ সালের পাণ্ডুলিপি সর্বপ্রথম ১৯৩২ সালে Marx-Engels-Gesamtausgabe-তে প্রকাশিত হয়েছিল এবং সেই সময়ে হারবার্ট মারকুস সোৎসাহে তা গ্রহণ ও প্রচার করেছিলেন, কারণ তাঁর মনে হয়েছিল যে অবশেষে এর মধ্য দিয়ে মার্কস-এর রাজনৈতিক অর্থনীতির সমালোচনা এবং বিপ্লবের তত্ত্বের দার্শনিক ভিত্তিমূল হিসেবে কাজ করা চিন্তাগুলো প্রকাশ্যে এল।
১৭। লুকাচ, History and Class Consciousness।
১৮। স্বয়ং লুকাচ এই মর্মে ১৯৬৭ সালে মন্তব্য করেছিলেন: ‘সেই সময়ে বইটির অভিঘাত ও বর্তমানে বইটির প্রাসঙ্গিকতা বিচার করতে হলে আমাদের এমন একটি সমস্যাকে বিচারে আনতে হবে যা খুঁটিনাটি অন্যান্য সমস্ত প্রশ্নের থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এই সমস্যাটি হল বিচ্ছিন্নতার প্রশ্ন, যাকে, মার্কস-এর পর এই প্রথমবার, পুঁজিবাদের বিপ্লবী সমালোচনার কেন্দ্রীয় প্রশ্ন হিসেবে গণ্য করা হল।… প্রশ্নটা অবশ্য তখন বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছিল।’ (লুকাচ, History and Class Consciousness, পৃঃ xxii) হেইডেগার-এর Being and Time (১৯২৭)-এর প্রকাশ এবং যুদ্ধপরবর্তী ফরাসি মহলের আলাপ-আলোচনা উভয়কে উল্লেখ করার মধ্য দিয়ে এবং এহেন পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে: ‘মানুষের বিচ্ছিন্নতা হল আমাদের যুগের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা এবং সব ধরনের আলোচকরাই--- বুর্জোয়া বা সর্বহারা, ডান বা বাম--- তা এখন স্বীকার করে থাকেন’ (লুকাচ, History and Class Consciousness, পৃঃ xxii), লুকাচ নিজে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা সম্পর্কিত অস্তিত্ববাদী আলোচনার নিবিড় সম্পর্কের দিকে ইঙ্গিত করেছেন।
১৯। যুক্তিসঙ্গতভাবেই হাবেরমাস-এর প্রয়াস, যার মধ্য দিয়ে তিনি সমালোচনাত্মক তত্ত্ব (Critical Theory)-কে জ্ঞাপনক্রিয়ার দৃষ্টিকোণ থেকে পুনর্সংজ্ঞায়িত করে নতুন ভিত্তির উপর দাঁড় করাতে প্রয়াসী হয়েছেন, তা বিমূর্তরে মূর্ত বাস্তব বলে গণ্য করার প্রবণতার তত্ত্বকেও পুনর্সূত্রায়িত হওয়ার দিকে নিয়ে গিয়েছে: সেভাবে জীবনবিশ্ব (life-world)-এর উপনিবেশকরণের সম্পাদ্য মার্কস-পরবর্তী সমালোচনাত্মক তত্ত্বের একটি কেন্দ্রীয় স্বজ্ঞাকে রূপান্তরিত করে দিচ্ছে।
২
মার্কস ও হেইডেগার:
বিচ্ছিন্নতা-সমালোচনার দুই ভাষ্য
এখানে আমি মার্কস ও হেইডেগার নিয়ে আরো কিছুটা বিশদে আলোচনা করব। তাঁদের দুজনকে আমি বিচ্ছিন্নতা-সমালোচনার ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এমন দুই ভাষ্যের উৎস হিসেবে ধরব যে দুটি ভাষ্য তাদের ফলিত প্রভাবের নিরিখে বহু-বিবিধ-ভাবে একে-অপরে সমাপতিত হয়ে আছে। ‘প্রদত্ত জগত সংক্রান্ত ছদ্ম-তত্ত্ববিদ্যা (pseudo-ontology)’১-র বিরুদ্ধে উদ্দিষ্ট মার্কস ও হেইডেগারের বিচ্ছিন্নতা-সমালোচনা--- তাদের নিজ নিজ ভিন্ন ধারণা-ভিত্তি সত্ত্বেও--- জগৎ ও আত্মসত্তার সঙ্গে আধুনিক ব্যক্তিমানুষের বিমূর্তায়িত অথচ মূর্ত ভ্রমে গণ্য (reified) সম্পর্কের আধিপত্য ও তারই সঙ্গে উপস্থিত হওয়া ‘মানুষের বস্তুতে রূপান্তরকরণ’২ এবং তজ্জাত এহেন পরিস্থিতি যেখানে মানুষ জগৎকে তাদের নিজেদের জগৎ-সৃষ্টিকারী ক্রিয়ার ফল হিসেবে দেখার বদলে স্থির-প্রদত্ত হিসেবে দেখে, সেসব নিয়ে নির্দিষ্টভাবে আলোচনা করেছে। এই দুই অবস্থানের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্যটিকেও যদি আমরা বিচার করি--- যে পার্থক্যের অন্যতম সূত্রপাত হিসেবে আমরা মার্কস-এর স্পষ্ট-নির্দিষ্ট উৎপাদন-দৃষ্টান্তের উপর জোর ফেলা এবং হেইডেগার-এর ‘জগৎ-মধ্যে-স্থিতসত্তা’ (‘being-in-the-world’) সম্পর্কিত বোঝাবুঝির ফারাককে চিহ্নিত করতে পারি--- তাহলে তা বিচ্ছিন্নতার ধারণাটি পুনর্নির্মাণ করার জন্য মূল্যবান রসদ আমাদের যোগাতে পারে।
মার্কস: শ্রম ও বিচ্ছিন্নতা
১৮৪৪ সালের ‘অর্থনৈতিক ও দার্শনিক পাণ্ডুলিপি’-তে মার্কস বিচ্ছিন্নকৃত শ্রম স্বরূপ ‘জাতীয়-অর্থনৈতিক ঘটনা’-র চারটি ফল আলাদা করে বলেছিলেন: বিচ্ছিন্নকৃত শ্রম শ্রমিককে বিচ্ছিন্ন করে প্রথমত, তার শ্রমের উৎপাদ থেকে, দ্বিতীয়ত, তার নিজের ক্রিয়া থেকে, তৃতীয়ত, যাকে মার্কস ফয়েরবাখ-কে অনুসরণ করে প্রজাতি-স্থিতসত্তা (species-being) বলেছেন, তা থেকে, এবং চতুর্থত, অন্যান্য মানুষদের থেকে।৩ সুতরাং, নিজের সঙ্গে ও জগতের সঙ্গে (তা সমাজজগৎ হোক বা প্রকৃতিজগৎ হোক) যে সম্পর্ক একজনের থাকে, বা থাকা উচিত, তার অগোছালো হয়ে যাওয়াকেই আমরা বিচ্ছিন্নতা বলে বুঝতে পারি। আর তার বিপরীতে, উৎপাদনের মাধ্যমে জগৎকে উপযোজন করার একটি নির্দিষ্ট উপায় হিসেবে অবিচ্ছিন্নকৃত শ্রম হল আত্মসত্তা, জগৎ ও অন্যদের সঙ্গে একটি যথার্থ সম্পর্ক বিকশিত করতে পারার অন্যতম প্রাকশর্ত।
উপরোক্ত এই সংক্ষিপ্ত বিবৃতির মধ্যেই আমরা মার্কস-এর বিচ্ছিন্নতা সম্পর্কিত ধারণার দুটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক চিহ্নিত করতে পারি। প্রথম দিকটি হল: উপযোজন (appropriation) ও বিচ্ছিন্নাবস্থার বৈপরীত্য দুটি সমস্যার মধ্যে এমন একটি যোগসম্পর্ক হাজির করে যা মোটেই স্ব-প্রতীয়মান নয়; সমস্যাদুটি হল একদিকে জগতের অর্থহানি (loss of meaning), ক্ষয়, অর্থহীনতা এবং অন্যদিকে জগতের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে অপারগতা বা ক্ষমতাহীনতা। দ্বিতীয়ত, মানুষ ও জগতের মধ্যে সম্পর্কহীনতার সমস্যাকে মার্কস যে নির্দিষ্ট মোচড়টি দিয়ে হাজির করেছেন, তা আমরা এই কেন্দ্রীয় পাঠবস্তুটিতে দেখতে পাই: বিচ্ছিন্নতার কেলেঙ্কারিটা হল এই যে তা হল সত্তা দ্বারা নির্মিত বস্তু থেকেই সত্তার বিচ্ছিন্নতা। নেহাতই যা আমাদের নিজেদের ক্রিয়া ও ক্রিয়ার উৎপাদ--- আমাদের নিজেদেরই উৎপন্ন করা সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও সম্পর্কাদি--- সেগুলোই বিচ্ছিন্ন বিজাতীয় শক্তিতে পরিণত হয়েছে। চার্লস টেলর-কে অনুসরণ করে কেউ একে বলতে পারে এমন এক ‘প্রমিথিয়-অভিব্যক্তিবাদী’ (‘Promethean-expressivist’) মোচড় যা হেগেল-এর বিশ্বাত্মা (Spirit)-র ‘বহিঃকরণ-ছাঁচ’ (‘externalization-model’) ও ফয়েরবাখ-এর অভিক্ষেপ সম্পর্কিত ধারণা থেকে ধার করে এনে মার্কস বহিঃকরণ সমস্যার নিজস্ব ব্যাখ্যায় প্রযুক্ত করেছিলেন।৪
পরবর্তী আলোচনায় আমি প্রথমে মার্কস দ্বারা আলোচিত বিচ্ছিন্নতার মাত্রাগুলি, তাঁর বিচ্ছিন্নতা ধারণার অন্তঃবস্তু ও ঋদ্ধি সমেত, পরীক্ষা করব। তার পরে মার্কস-এর নৃতত্ত্ব বা মানবপ্রকৃতি সম্পর্কিত তত্ত্বের সাপেক্ষে শ্রম সম্পর্কিত ধারণাটিকে স্পষ্ট করব, যা মার্কস-এর বিচ্ছিন্নতা ধারণার উৎপাদনবাদী বাঁক নেওয়া সম্পর্কে আলোচনা করার প্রেক্ষাপট তৈরি করে দেবে।
বিচ্ছিন্নতার নানা মাত্রা
মার্কস যাকে বিচ্ছিন্নতা বলে তত্ত্বায়ন করেছেন, আত্মসত্তা ও জগতের সঙ্গে সম্পর্কে সেই খামতির দুটি মাত্রাকে আমরা চিহ্নিত করতে পারি। প্রথম মাত্রাটি হল: নিজের কাজের সঙ্গে এবং যাদের সঙ্গে সেই কাজ করা হচ্ছে তাদের সঙ্গে অর্থপূর্ণভাবে একাত্মবোধ করার অপারগতা। আর দ্বিতীয় মাত্রাটি হল: নিজে যা করছি তার উপর নিজের নিয়ন্ত্রণ হাসিল করার অপারগতা--- অর্থাৎ, ব্যক্তিগতভাবে বা সমষ্টিগতভাবে নিজ ক্রিয়ার বিষয়ী হয়ে ওঠার অপারগতা। বিষয় (object) থেকে, নিজ ক্রিয়ার উৎপাদ থেকে বিচ্ছিন্নতা মানে একই সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলা এবং অধিকারচ্যুত হওয়া: বিচ্ছিন্নকৃত শ্রমিক (তার শ্রমশক্তির বিক্রেতা রূপে) নিজে যা উৎপাদন করে তা আর তার নিয়ন্ত্রণে থাকে না, তার অধিকারীও সে হয় না। তার উৎপাদ এমন এক বাজারে গিয়ে বিনিময় হয়, যে বাজার তার নিয়ন্ত্রণে নেই, সেখানে বিনিময়ের শর্তাবলীও সে নিয়ন্ত্রণ করে না। বিচ্ছিন্নতার তাৎপর্য এটাও যে বিষয় (object)-টি তার কাছে খণ্ডিত রূপেই দেখা দেবে: বিশেষজ্ঞীকরণ (specialization) ও শ্রম-বিভাজন দ্বারা নির্ধারিত পরিস্থিতিতে কাজ করা একজন শ্রমিকের উৎপাদের সমগ্রটার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক তৈরি হয় না। অ্যাডাম স্মিথ কথিত সেই বিখ্যাত আলপিনের উৎপাদনপ্রণালীর মতো কোনো উৎপাদনকার্যের কোনো একটি বিশেষজ্ঞীকৃত উপাংশে নিযুক্ত শ্রমিকের কোনো সম্পর্ক থাকে না উৎপাদের সর্বশেষ রূপটির সঙ্গে, সে উৎপাদ যতই ক্ষুদ্র হোক না কেন। অন্যভাবে বললে, তার বিশেষ শ্রম--- আলপিন তৈরিতে তার নির্দিষ্ট অবদান--- অর্থপূর্ণ সমগ্রের মধ্যে তাকে কোনো স্থান করে দেয় না, তাৎপর্যপূর্ণ কোনো সংহতির অন্তর্গত সে হয় না।
ক্ষমতাহীনতা ও অর্থহানি (বা অর্থক্ষয়)-এর এই একই যুগল শ্রমিকের নিজের কাজ থেকে বিচ্ছিন্নতাকেও চিহ্নিত করে। বিচ্ছিন্নকৃত শ্রম একদিকে হল অমুক্ত ক্রিয়া, তা হল এমন শ্রম যা করতে বাধ্য হতে হয়েছে এবং বাধ্য থেকে যা করতে হয়েছে। বিচ্ছিন্নকৃত শ্রমিক শ্রমকার্যে নিজে যা করছে তার নিয়ন্ত্রক নয়। বাইরে থেকে আসা নির্দেশের অধীন হওয়ার ফলে তার শ্রম অপরের দ্বারা নির্ধারিত, বা, স্বধর্মজাত নয়। ‘সে যদি নিজ কাজকে একটি অমুক্ত কাজ হিসেবে বিবেচনা করে, তাহলে সে আসলে কাজটিকে অন্য কোনো মানুষের অধীন হয়ে আধিপত্য ও জবরদস্তির কবলে বাধ্যত করতে হয়েছে বলে মনে করে।’৫ আর ক্ষমতাহীন হওয়ার কারণেই শ্রমিকটি যে প্রক্রিয়ার অংশ, সেই প্রক্রিয়ার সমগ্রটি তার কাছে অস্বচ্ছ থেকে যায়, গোটা সেই প্রক্রিয়াটিকে সে বুঝতে পারে না, নিয়ন্ত্রণও করতে পারে না। একইসঙ্গে, বিচ্ছিন্নকৃত শ্রমের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল এই যে উৎপাদের খণ্ডিতকরণের পরিপূরক হিসেবে শ্রমকার্যের খণ্ডিতকরণ ও অবনমন-অবমূল্যায়ন ঘটতে থাকে। তাই মার্কস স্বয়ং শ্রমকার্যের একঘেয়েমি ও সীমাবদ্ধ চরিত্রকে বিচ্ছিন্নতাপ্রসূত বলে মনে করে বলেছেন: ‘তা মানুষকে যতটা বিমূর্ত করা যায় তা করে তোলে, একটা কুঁদকলের সমান করে তোলে এবং আধ্যাত্মিক ও শারীরিক বিকটত্বে রূপান্তরিত করে’ (মার্কস, Comments on James Mill)। অন্যদের থেকে বিচ্ছিন্নতা, সহযোগিতার সামাজিক সম্পর্কজগৎ থেকে বিচ্ছিন্নতা আরো দুটি মাত্রা ধারণ করে। প্রথমত, বিচ্ছিন্নকৃত শ্রমকার্যে নিযুক্ত শ্রমিক আরো অনেকের সঙ্গে যুক্তভাবে যা করে তার উপর তার নিজের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। আর দ্বিতীয়ত, বিচ্ছিন্নকৃত শ্রমপ্রক্রিয়ায় অপরাপর অন্যরা তার সাপেক্ষে, যাকে বলা যায়, ‘কাঠামোগতভাবেই নিস্পৃহ’।৬
মার্কস-এর তত্ত্বের একটি কৌতূহলোদ্দীপক ও অতি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল এই যে মার্কস কেবল শ্রমশক্তির ক্রেতাদের দ্বারা শ্রমিকদের যন্ত্রে রূপান্তরকরণেরই সমালোচনা করেননি, তার মধ্য দিয়ে শ্রমিক নিজ আত্মসত্তার সঙ্গে যে যান্ত্রিক সম্পর্কে বাঁধা পড়ে, তারও সমালোচনা করেছেন। মার্কস-এর দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, বিচ্ছিন্নতা-আক্রান্ত পরিস্থিতিতে একজন শ্রমিক নিজ সত্তার সঙ্গে ও নিজ শ্রমের সঙ্গে যে যান্ত্রিক সম্পর্ক তৈরি করে (বা তৈরি করতে বাধ্য হয়), তা অতি সমস্যাপূর্ণ, বা আরো জোরালো ভাষায় বললে, নেহাতই ‘অমানবিক’। বিচ্ছিন্নকৃত শ্রমের বিচ্ছিন্নকারী দিকটি হল এই যে তার কোনো স্বপ্রণোদিত উদ্দেশ্য থাকে না, তা স্বনির্ধারিত স্বার্থে প্রযুক্ত হয় না। বিচ্ছিন্নকৃত ভাবে করা কাজ বলতে এমন কাজই বোঝায় যা লক্ষ্যসাধনের জন্য করা হয় না, বরং কেবলমাত্র একটি উপায় হিসেবে করা হয়। আর সেই সূত্র ধরেই কোনো কাজ করতে প্রযুক্ত বা সেই কাজ থেকে আহৃত সক্ষমতাগুলোকেও--- ফলত নিজ সত্তাকেও--- লক্ষ্যের চেয়ে বরং উপায় হিসেবেই দেখা হয়। অন্যভাবে বললে, যে কাজ সে করছে, তার সঙ্গে কোনো একাত্মতাবোধ সে করে না। যন্ত্রে রূপান্তরকরণ নিজ গতিতে তীব্রতা অর্জন করে সার্বিক অর্থহীনতায় পরিণত হয়: মার্কস যখন বলেন যে বিচ্ছিন্নতার অধীনে জীবন নিজেই একটি উপায়মাত্রে পরিণত হয় (‘জীবন নিজেই হাজির হয় কেবলমাত্র জীবনের একটি উপায় হিসেবে’)৭--- যা লক্ষ্য হওয়া উচিত তা-ই একটি উপায়ের চরিত্রবৈশিষ্ট্য ধারণ করে বসে--- তখন মার্কস একটি সম্পূর্ণ অর্থহীন ঘটনা বর্ণনা করছেন, বা এভাবেও বলা যায়, অর্থহীনতার কাঠামোটাকেই বর্ণনা করছেন। ভিন্নভাবে সূত্রায়িত করলে বলা যায়, মার্কস মনে করেন যে লক্ষ্যের এই সীমাহীন প্রত্যাগতি অর্থহীনতায় গিয়ে শেষ হয়। এই দিক থেকে দেখলে মার্কস একজন আরিস্ততলপন্থী: এমন একটি লক্ষ্য থাকতে হবে যা নিজে কোনোভাবেই কোনো উপায় হয়ে উঠবে না।৮
এভাবে আমারা এই ধারণার বিভিন্ন স্তরগুলো দেখতে পারি: বিচ্ছিন্নকৃত জনের নিজের উৎপাদিত বস্তুর উপর কোনো অধিকার থাকে না (আর সেই সূত্রেই সে অধিকারচ্যুত ও শোষিত হয়);৯ সে যা করছে তার উপর কোনো নিয়ন্ত্রণ তার থাকে না, তা নির্ধারণ করার ক্ষমতাও তার থাকে না (আর সেই সূত্রেই যে ক্ষমতাহীন এবং অমুক্ত); একইসঙ্গে, সে নিজের কাজের মধ্য দিয়ে নিজেকে উপলব্ধি করতে পারে না আর তাই এমন অর্থহীন, জীর্ণ, যান্ত্রিক সম্পর্কসমূহে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে যে নিজেকেও ভিতরে ভিতরে হাজারো ভাগে বিভক্ত হয়ে যেতে হয়। এই ধরনের বিচ্ছিন্নতার বিপরীতে মার্কস যে ‘প্রকৃত উপযোজন’-এর কথা বলেছেন তা এমন এক সম্পন্নতার কথা বলে যা কেবল সম্পত্তি-মালিকানা সংস্থানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়।১০ এই ‘প্রকৃত উপযোজন’-এর অর্থ কোনো কিছুর উপর অধিকার কায়েম করা, ক্ষমতা অর্জন করা এবং অর্থ খুঁজে পাওয়া। সুতরাং, যাকে আমরা উত্তম জীবন সম্পর্কে মার্কস-এর ধারণা বলে অভিহিত করতে পারি, তার মধ্যে এমন এক আত্মোপলব্ধির ভাবনা রয়েছে যা আত্মসত্তা ও জগতের সঙ্গে একটি একাত্মতাবোধক উপযোজক সম্পর্ক স্থাপনের মধ্য দিয়ে সম্ভব হয়ে উঠতে পারে।১১
মার্কস-এর শ্রম-নৃতত্ত্ব
এই উপযোজন ও বিচ্ছিন্নতার ধারণার ভিত্তিমূল শ্রম সম্পর্কে মার্কস-এর দার্শনিক ধারণার মধ্যে প্রোথিত। মার্কস-এর বিবেচনায় শ্রমই হল জগতের সঙ্গে মানুষের দৃষ্টান্তমূলক সম্পর্ক, আর তাঁর ধারণামতে, শ্রম হল আবশ্যিক মানবক্ষমতাকে বহিঃস্থকরণ করে দেওয়া বস্তুরূপ। খুব সংক্ষেপে বললে, ‘আবশ্যিক মানবক্ষমতা’, যা মানুষের অভিপ্রায়, লক্ষ্য ও সামর্থ্য সম্বলিত, তা শ্রমের মধ্য দিয়ে বহির্জগতে একটি বস্তু হিসেবে হাজির হওয়ার মাধ্যমেই বস্তুগত হয়ে ওঠে বা বস্তুরূপ ধারণ করে। প্রকৃতির সঙ্গে বিপাকীয় বিনিময়ের একটি প্রক্রিয়া হিসেবে গণ্য করলে, শ্রম করার সামর্থ্য একইসঙ্গে জগৎ ও মানুষ উভয়কেই রূপান্তরিত করতে থাকে। মানুষ একটি একক ক্রিয়ার মধ্য দিয়েই নিজেকে ও নিজের জগৎকে উৎপাদন করে। তার জগৎ উৎপাদন করতে গিয়ে মানুষ নিজেকে উৎপাদন করে, আবার নিজেকে উৎপাদন করতে গিয়ে জগৎ উৎপাদন করে। আর, যে পরিমাণে এই প্রক্রিয়া সফল হয়, সেই পরিমাণেই সে বস্তুগত জগৎ এবং স্বয়ং নিজেকে নিজ আপন করে তোলে। অর্থাৎ, সে নিজেকে (নিজের অভিপ্রায় ও সামর্থ্যকে) নিজের কাজকর্ম ও তাতে উৎপন্ন ফলের মধ্য দিয়েই চিনতে পারে এবং তার নিজের দ্বারা উৎপাদিত বস্তুদের সঙ্গে এই সম্পর্কের মধ্য দিয়েই আত্মসত্তাকে চিহ্নিত করে। সুতরাং, তার নিজ ক্রিয়ার দ্বারা উৎপাদিত জগতের সঙ্গে উপযোজনমূলক সম্পর্কের মধ্য দিয়েই সে নিজেকে উপলব্ধি করতে পারে। এই অর্থেই মার্কস-এর মতে শ্রম, তবে তা বিচ্ছিন্নকৃত নয় এমন শ্রম, হল মানুষের আবশ্যিক চরিত্রবৈশিষ্ট্য।১২ অন্যান্য পশুদের থেকে পৃথক করে যা মানুষকে মানুষ করে তুলেছে তা হল এই যে সে সচেতনভাবে সামাজিক সহযোগিতার মধ্য দিয়ে নিজেকে ও নিজের জগৎকে গড়ে নিতে পারে, এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সে আত্মোপলব্ধি করে এবং নিজেকেও উৎপাদন করে চলে এই মূর্ত অর্থে যে শ্রম করা ও জগৎ গড়ে তোলার অনুপাতেই সে নিজের সামর্থ্য, অনুভব ও চাহিদাকেও বিকশিত করে চলে।
বিচ্ছিন্নতার ধারণাক্ষেত্রে একটা মোক্ষম প্যাঁচ এখানে হাজির হয়: শ্রমের সূত্র ধরে আত্মসত্তা ও জগতের সঙ্গে সফলভাবে স্থাপিত সম্পর্ককে যদি আমরা এমন একটি প্রক্রিয়া হিসেবেই দেখি যা আবশ্যিক মানবক্ষমতাগুলোর বহিঃস্থকরণ, বস্তুতে রূপান্তরকরণ ও উপযোজন ঘটায়, যা আসলে স্বয়ং নিজের শ্রমক্ষমতার বস্তুরূপান্তরিত রূপের সঙ্গে একটি উপযোজনমূলক সম্পর্কের নামান্তর, তাহলে বিচ্ছিন্নতাকে এই প্রক্রিয়ার অন্তর্গত একটি ব্যর্থতা হিসেবেই গণ্য করতে হয়, এমন একটি ব্যর্থতা যা সেই বহিঃস্থকরণ ঘটার পর আবার ফিরে আসার পথ আটকে দেয়। যে বিষয়ী এই বহিঃস্থকরণ ঘটিয়েছে তার কাছে আবার বহিঃস্থকরণ করা বিষয়টি ‘ফিরিয়ে দেওয়ার’ যে একরকম ‘পুনরুদ্ধার-ব্যবস্থা’, সেই ব্যবস্থার ব্যর্থতা হিসেবেই একে চিহ্নিত করা যায়। উৎপাদক কোনোকিছু উৎপাদন করার মধ্য দিয়ে বহির্জগতে নিজের বহিঃস্থকরণ ঘটায়, নিজেকে ও নিজের আবশ্যিক ক্ষমতাকে বস্তরূপ দেয়, এবং তারপর সেই উৎপাদের মধ্য দিয়ে নিজেকে ও নিজের ক্ষমতাকে আবার উপযোজন করে। উৎপাদনকার্যকে মানুষের প্রজাতি-ক্রিয়ার আয়না বলার সুবিদিত রূপকের মধ্য দিয়ে আসলে এটাই বলা হয়ে থাকে। এই রূপকটিকে ধরে আলোচনা করলে বলা যায় যে, বহিঃস্থকরণ ঘটার পর পুনরায় ফিরে আসা--- বিচ্ছিন্নতা অতিক্রম করা--- ঘটতে পারে যখন আয়নার প্রতিবিম্বটির সঙ্গে প্রতিফলিত বস্তুর নিখুঁত সাযুজ্য রক্ষা হচ্ছে। উল্টোদিকে, বিচ্ছিন্নতা হল বহিঃস্থকৃত নিজের আবশ্যিক ক্ষমতা পুনর্বার উপযোজন করায় বাধাপ্রাপ্ত হওয়া, আয়নার প্রতিবিম্বে নিজেকে চিনতে না পারা, বা অন্যভাবে বললে, আয়নায় একটি বিকৃত প্রতিবিম্ব তৈরি হওয়া।১৩ শ্রম ও বহিঃস্থকরণের এই আদল এবং তার অনুষঙ্গী ভাবনাকাঠামো--- অর্থাৎ, অন্তঃস্থ একটি পরিকল্পনার বহিঃস্থ বস্তুরূপধারণ সংক্রান্ত ভাবনাকাঠামো--- বেশ কিছু কারণেই সমস্যাজনক।১৪ আমাদের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণটি হল এই যে, উপরোক্ত ধারণামতে, উপযোজন সবসময় ইতিপূর্বেই অস্তিত্বশীল কোনো বস্তুর পুনঃ-উপযোজনের মধ্য দিয়েই ঘটতে পারে। শ্রম সম্পর্কে যে ধারণা-আদল এই ধারণাকাঠামোর মধ্যে নিহিত, তা এমন সম্ভাবনাকে স্থান দেয় না যাতে বিচ্ছিন্নতা দ্বারা বিকৃত না হয়েও বিভিন্ন ক্রিয়া নিয়ন্ত্রণের বাইরে আপন গতি নিয়ে নিতে পারে, বা, বিভিন্ন সম্পর্ক, স্বকৃত হলেও, সবসময় সম্পূর্ণ স্বচ্ছ ও নিজ নিয়ন্ত্রণাধীন না-ও থাকতে পারে।
বিচ্ছিন্নতার এই প্রমিথিয় (Promethean) ব্যাখ্যা যদি এই অনুমানের উপর দাঁড়িয়ে থাকে যে উৎপাদকের নিজ ক্রিয়াকর্মই একটি পরকীয় (alien) শক্তির রূপ ধরে তার মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়, তাহলে তার মানে দাঁড়ায় এই যে যা পরকীয় তা একসময় নিজ আপন ছিল এবং বিচ্ছিন্নতা হল আসলে যা একসময় নিজ নিয়ন্ত্রণে ছিল ও এখনও নিয়ন্ত্রণেই থাকার কথা ছিল (যেহেতু তা আমাদের নিজ ক্রিয়ারই ফল), তেমন কোনোকিছুর উপর নিজ নিয়ন্ত্রণ খুইয়ে বসা। যা পরকীয়ে পরিণত হয়েছে বা বিচ্ছিন্ন বহির্বস্তুতে পরিণত হয়েছে তা আসলে আমাদেরই তৈরি করা কিন্তু হাজির হচ্ছে প্রদত্ত (যেনবা প্রকৃতি দ্বারা প্রদত্ত এবং আমাদের অভিপ্রায়ের অধীন নয়) বস্তু হিসেবে। ফয়েরবাখ কৃত ধর্মীয় অভিক্ষেপের সমালোচনা এবং হেগেল-এর বিশ্বাত্মা (Spirit) সম্পর্কীয় ধারণা দ্বারা প্রভাবিত এই বিচ্ছিন্নতার ধারণাকাঠামো মার্কস-এর লেখায় ১৮৪৪-এর ‘অর্থনৈতিক ও দার্শনিক পাণ্ডুলিপি’-র আগে থেকেই পাওয়া যায় (যেমন, ‘ইহুদি প্রশ্ন প্রসঙ্গে’, ও ‘হেগেলিয় ন্যায় দর্শনের সমালোচনা’-এ) যখন তিনি সামাজিক সম্পর্কের ‘বিগ্রহসম চরিত্র’-এর কথা বারবার উল্লেখ করেন, যার মধ্য দিয়ে তিনি বোঝাতে চান যে সামাজিক সম্পর্কগুলো আমাদের দ্বারা তৈরি হওয়ার পর স্বাধীন অস্তিত্ব গ্রহণ করে আমাদের বিরুদ্ধেই রুখে দাঁড়ায়, আর এই মূলসুর ‘পুঁজি’ গ্রন্থে ‘পণ্যের বিগ্রহরূপ চরিত্র’ (fetish character of commodities) -এর রূপকনির্মাণের মধ্যেও আবার হাজির হয়েছে। একান্তই যা আপন তা বিচ্ছিন্ন পরকীয় রূপ ধরে হাজির হওয়ার এই মূলসুর ‘রাজনৈতিক অর্থনীতির সমালোচনা’-তে আপাতদৃষ্টিতে প্রাকৃতিক সম্পর্কগুলোর সামাজিক চরিত্র উন্মোচনকারী ‘বিপ্রকৃতিস্থকারী’ (denaturalizing) সমালোচনার মধ্য দিয়েও প্রলম্বিত হয়েছে।
এই প্রেক্ষিতেই বিচ্ছিন্নতার অস্তিত্ববাদী সমালোচনা এবং মার্কসীয়-হেগেলীয় সমালোচনার মধ্যের সমান্তরালগুলোকে চিহ্নিত করা সবচেয়ে সহজ: ‘বস্তুরূপান্তরের ভ্রান্তি’ (objectivation mistake)১৫--- যেখানে নিজেদের তৈরি করা কিছুকে ভুল করে প্রদত্ত হিসেবে ধরে নেওয়া হয়--- চিহ্নিত করা হেইডেগার-এর বিচ্ছিন্নতা-সমালোচনারও কেন্দ্রীয় বিষয়। মার্কস-এর সঙ্গে পার্থক্য এখানে যে হেইডেগার জগতের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ককে উৎপাদনের সম্পর্ক হিসেবে দেখেন না। শ্রমের মধ্য দিয়ে জগৎ উৎপাদিত হওয়ার ধারণা থেকে শুরু করার বদলে, হেইডেগার শুরু করেছেন পূর্বস্থ ‘জগৎ-মধ্যে-স্থিতসত্তা’ (being-in-the-world)-র বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে, যা তাঁকে নিয়ে গেছে এমন একটি জায়গায় যাকে হয়ত অনুশীলনের পূর্ববর্তিতা সংক্রান্ত মার্কসীয় প্রস্তাবের একটি অস্তিত্ববাদী সংস্করণ বলে গণ্য করা যায়।
হেইডেগার: জগৎ ও বস্তরূপান্তরে পরকীয়সাধন
হেইডেগারের ধারণাকাঠামোয় বস্তুরূপান্তরে পরকীয়সাধন (alienating reification)-কে জগতের সঙ্গে এমন একটি সম্পর্ক হিসেবে বোঝা যেতে পারে যা বস্তুনিষ্ঠকরণের মধ্য দিয়ে মূর্ততায় পৌঁছতে চায়। হেইডেগারের পরিভাষায় বললে, তা হল একরূপ ব্যর্থতা যা দুটি ব্যর্থতার সংযোগে তৈরি হয়: ‘হাতের-কাছে-প্রস্তুত’ (ready-to-hand)-কে ‘হাতের-কাছে-উপস্থিত’ (present-at-hand) হিসেবে ধরার ব্যর্থতা, এবং, ব্যবহারিক অনুষঙ্গ হিসেবে না নিয়ে জগতকে কিছু প্রদত্তের সমষ্টি হিসেবে বোঝার ব্যর্থতা।১৬
বস্তুনিষ্ঠকরণ (objectification) বা বস্তুরূপান্তরে পরকীয়সাধনের যে সমালোচনা হেইডেগার করেছেন, তার পশ্চাদপট হিসেবে জগৎ-মধ্যে-স্থিতসত্তা সম্পর্কে তাঁর বিশ্লেষণ কাজ করেছে। হেইডেগারের মৌলিক স্বজ্ঞাটি সংক্ষেপে এভাবে হাজির করা যেতে পারে: জগৎ এমন কিছু নয় যা আমাদের কাছে প্রদত্ত, আমরা জ্ঞানবৃত্তি ও স্বতঃক্রিয়ার মাধ্যমে তার সঙ্গে সম্পর্কসাধনের আগে থেকেই তা অস্তিত্বমান নয়। ‘জীবনযাপনকারী’ প্রাণী হিসেবে আমরা সবসময় জগতের মধ্যেই বিচরণ করে থাকি, ইতিমধ্যেই সর্বদা জগতের মধ্যে কোনো না কোনো ক্রিয়া করতে থাকি, ইতিমধ্যেই সর্বদা আমরা ব্যবহারিকতায় তার সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে থাকি।১৭ এই ধারণাকাঠামো অনুযায়ী, বস্তুদের মধ্যে সম্পর্কাবলীর সংগ্রহই জগৎ নয়, এমনকি সেইসমস্ত বস্তুদের সমগ্রও জগৎ নয়, হেইডেগারের ভাষায়: ‘সত্তাসমূহের সমগ্র’ জগৎ নয়। অস্তিত্ববাদী সত্তাতত্ত্ববিদ্যার বিচারে জগৎ হল এমন একটি অনুষঙ্গ যা তার সঙ্গে আমাদের ব্যবহারিক লেনদেন-এর মধ্য দিয়ে আবির্ভূত হয় এবং আমাদের ব্যবহারিক ‘জগৎ-নির্মাণের’ মধ্য দিয়ে ফুটে ওঠে। হেইডেগার পরিবেশ (Umwelt) সম্পর্কে নিজ ধারণাকে স্পষ্ট করেছেন ‘সরঞ্জাম’ (das Zeug) নিয়ে তাঁর বিখ্যাত বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে: হাতুড়ি-পেটানোর জন্য আমরা হাতুড়ি ব্যবহার করে থাকি, এই হাতুড়ি-পেটানো কেদারা তৈরি করার কাজে লাগতে পারে, যে কেদারা আবার আমাদের (বা অন্য কারো) বসার জন্য কাজে লাগে। এহেন আন্তর্সম্পর্কের অনুষঙ্গে একটি জগৎ উন্মোচিত হয়, এখানে যেমন কারিগরি দ্বারা চিহ্নিত এমন এক জীবন-জগৎ খুলে যাচ্ছে যার সঙ্গে সম্বন্ধিত হলেই (অর্থাৎ, হাতুড়ি ব্যবহার করলেই, বা কেদারায় বসলেই) তার মধ্যে নিমজ্জিত হতে হয়। এভাবে ফুটে-ওঠা জগৎ নানা অর্থপূর্ণ সম্পর্ক দিয়ে তৈরি: কেবলমাত্র এই জগতের অনুষঙ্গেই ‘হাতুড়ি-পেটানো’-র মতো কাজের হাতিয়ার হিসেবে হাতুড়ির অস্তিত্ব নির্ণীত ও বোধগম্য হয়ে ওঠে।
‘হাতের-কাছে-উপস্থিত’ এবং ‘হাতের-কাছে-প্রস্তুত’--- এই দুইয়ের মধ্যে হেইডেগার যে পার্থক্য টেনেছেন তা জগতের সঙ্গে সম্পর্কসাধনের দুটি উপায়ের মধ্যে পার্থক্য হিসেবে বোঝা যেতে পারে এবং বস্তুনিষ্ঠকরণ ও বিচ্ছিন্নতার সমস্যা আলোচনায় তা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কোনো একটি জগতের অনুষঙ্গ ধরে যে বস্তু আমাদের কাছে হাজির হয়, আমাদের কাছে তার অস্তিত্ব কর্মসম্পাদনে ‘হাতের-কাছে-প্রস্তুত’ (ভূমিকা ও তাৎপর্যের পূর্ববর্ণিত অর্থে)। ‘হাতের-কাছে-প্রস্তুত’ কোনো বস্তু ‘কোনোকিছুর জন্য ভালো এবং কিছু না কিছু করতে তা ব্যবহার করা হয়।’১৮ এর উল্টোদিকে, জগতের কোনো বস্তু তখনই আমাদের কাছে ‘হাতের-কাছে-উপস্থিত’ বলে মনে হয় যখন আমরা তাকে এই ব্যবহারিক অনুষঙ্গ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখি, বা, যখন আমরা গোটা জগতটাকেই আমাদের নিজেদের থেকে আলাদা ও বিচ্ছিন্ন কিছু বলে ধরে নিই, এমন কিছু বলে ধরে নিই যা আমাদের মাথার উপর আমাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আছে পূর্বপ্রদত্ত বস্ত হিসেবে (যাকে প্রভাবিত করার কোনো ক্ষমতা আমাদের নেই)।১৯ এভাবে হেইডেগার এই (একটা নির্দিষ্ট মাত্রায়) প্রয়োগবাদী (pragmatist) প্রস্তাব হাজির করেন যে জিনিসসকল নেহাতই কিছু বস্তু নয়, তারা নেহাতই হাতের-কাছে-উপস্থিত অর্থে ‘উপস্থিত’ নয়। জীবনক্রিয়ায় তারা হাতের-কাছে-প্রস্তুত, প্রয়োগ-ব্যবহারের মধ্য দিয়েই কোনো একটি জগতের অনুষঙ্গে তারা তাৎপর্যমণ্ডিত হয়ে ওঠে। হাতের-কাছে-উপস্থিত এবং হাতের-কাছে-প্রস্তুত তাই দুই ভিন্ন ধরনের বস্তুর চরিত্রবৈশিষ্ট্য নয়, এমনকি জগতের বা জগতমধ্যের জিনিসসকলের প্রতি সম্ভাব্য দুই ধরনের মনোভঙ্গিও নয়। (এমনটা ভাবলেও ভুল হবে যে যতক্ষণ আমি হাতুড়িটাকে ব্যবহার করছি ততক্ষণ সেটা হাতের-কাছে-প্রস্তুত, আর যখন এক কোণে পড়ে আছে তখন সেটা হাতের-কাছে-উপস্থিত। এমনকি যখন আমি একটি ব্যবহারের মধ্যে না থাকা হাতুড়ির কথাও ভাবি, তখন কেবলমাত্র হাতের-কাছে-প্রস্তুত হওয়ার ভিত্তিতেই তাকে ভাবতে পারি; কোনো উপায়ে হাতের-কাছে-প্রস্তুত হওয়ার সুবাদেই, বা, কোনো একভাবে আমার ব্যবহারযোগ্য হওয়ার সুবাদেই তার অস্তিত্ব আমার কাছে নির্দিষ্ট হয়ে ওঠে।) হাতের-কাছে-প্রস্তুত জিনিসকে হাতের-কাছে-উপস্থিত হিসেবে বোঝে এবং জগতকে হাতের-কাছে-উপস্থিত-এর সমাহার রূপে গণ্য করে এমন দৃষ্ঠিভঙ্গি ভ্রান্ত, বা আরো সঠিকভাবে বললে, বস্তুরূপান্তরের মধ্য দিয়ে পরকীয়সাধনকারী। আর এই দৃষ্টিভঙ্গি ও তার অনুবর্তী ভুল-বোঝাবুঝি গুলোকে লাগাতার সমালোচনা করার প্রচেষ্টা হিসেবেই আমরা হেইডেগারের ‘স্থিতসত্তা ও সময়’ (‘Being and Time’) ও পরবর্তী কাজগুলোকে দেখতে পারি।
এই ভুল-বোঝাবুঝির দুটো দিক আছে। প্রথমত, যে বস্তুগুলো নিয়ে আমরা কাজ করছি আর যে জগতে আমরা বাস করছি, উভয়কেই ভুলভাবে বোঝা হয় (যেনবা সেগুলো নেহাতই প্রদত্ত কিছু, খেয়াল করা হয় না যে দ্বিতীয়টি আমাদেরই জগৎ, আমরাই তাকে জগৎ রূপে আকার দিয়েছি)।২০ ‘ক্রিয়ার ব্যবহারিক অনুষঙ্গের সমষ্টি’ (আর্নস্ট তুগেনধাত) হিসেবে জগতের ব্যবহারিক চরিত্র এই বস্তুনিষ্ঠকারী ভ্রান্তির ‘আড়ালে ঢাকা পড়ে যায়’। দ্বিতীয়ত, আমরা বুঝতে ব্যর্থ হই যে জগতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটা কী বা কীভাবে আমরা এই জগতের মধ্যে (যাকে বলা যায়) আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকি: এমন ভ্রান্তি তৈরি হয় যেনবা আমরা এই জগৎ-নির্মাণকারী ব্যবহারিক অনুষঙ্গের বাইরে থেকে ক্রিয়া করতে সক্ষম, যেনবা এই জগতের মধ্যে জড়িয়ে থাকার বদলে এই জগতকে বাইরে থেকে নিরীক্ষণ করার অবস্থানে আমরা আছি, যেনবা জগৎ-মধ্যে-স্থিতসত্তা-র কাঠামো থেকে ‘উলঙ্গ’ বিষয়ী রূপে আমরা নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে নিতে পারি। হেইডেগাররের ভাষায়: ‘এমনটা নয় যে মানুষ প্রথমে ‘উপস্থিত হয়’ এবং তারপর একটি অতিরিক্ত হিসেবে ‘জগৎ’-অভিমুখী (যে জগৎ সে নিজেই নিজেকে মাধেমধ্যে প্রদান করে থাকে) স্থিতসত্তার সম্পর্কের মাধ্যমে ‘পায়’। অস্তিত্ব (Dasein) কখনও কোনোভাবেই এমন কোনো বস্তু নয় যা জগৎ-মধ্য অবস্থা থেকে স্বাধীন ও যার মধ্যে কখনও কখনও জগৎ-অভিমুখী ‘সম্পর্ক’ স্থাপনের ঝোঁক তৈরি হয়। জগৎ-মধ্যে-স্থিতসত্তা রূপে অস্তিত্ব (Dasein) যা, কেবলমাত্র তার কারণেই জগৎ-অভিমুখী সম্পর্ক সম্ভবপর হয়ে ওঠে।’২১ সুতরাং আত্মসত্তা ও জগৎ--- দুইয়ের সঙ্গেই আমাদের সম্পর্ক সমানভাবেই আদি।
অদ্বৈতবাদ এবং অনুশীলনের অগ্রাধিকার--- এই দুটি ভাবনাবিন্দুই বিচ্ছিন্নতার অবস্থা-নির্ণয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। হেইডেগারের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, জগৎ হল এমন একটি কাঠামো যা তার খিলানতলে বিষয়ী ও বিষয় উভয়কেই ধরে রাখে।২২ সত্তাতত্ত্ববিদ্যক বিচারে একসাথে বিদ্যমান দুটি দিককে পৃথক করে ফেলাই হল বিচ্ছিন্নতা।
আবার বিচ্ছিন্নতাকে অপ্রামাণিকতা (inauthenticity) হিসেবেও দেখা যায়। হেইডেগারের অস্তিত্ববাদী সত্তাতত্ত্ববিদ্যার পটভূমিতে বিচ্ছিন্নতার যে দ্বিতীয় মাত্রাটিকে সামনে আনা হয়েছে, তা আত্মসত্তার নিজের সঙ্গে সম্পর্ক, অর্থাৎ, নিজ অস্তিত্ব (Existenz)-এর সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে ভাবিত। এখানেও এক ধরনের ভুল-বোঝাবুঝি ঘটতে পারে, যেমন, আত্মসত্তা ও জগতের প্রতি ভ্রান্তিমূলক বস্তুনিষ্ঠকারক মনোভাব গড়ে উঠতে পারে। মোদ্দা কথায় বললে, নিজের জীবন নিজেকেই পরিচালনা করতে হবে বুঝে নিয়ে যে নিজসত্তার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলে না, সে নিজেকে বস্তুরূপান্তরের মাধ্যমে সেই মাত্রাতেই পরকীয় করে তোলে যে মাত্রায় নিজ জীবনযাপন-অনুশীলন নিজ সিদ্ধান্ত দিয়ে চালিত করার অভিপ্রায় সে ত্যাগ করে। উপলব্ধির এই ব্যর্থতা--- এই ‘অপ্রামাণিকতার পদ্ধতিগত অন্ধত্ব’২৩--- আবার অস্তিত্ববাদী দর্শনে অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি ধারণাগত পার্থক্য ধরতে না পারার কারণে ঘটে: পার্থক্যটি হল অস্তিত্ব (Existenz) এবং হাতের-কাছে-উপস্থিত স্থিতসত্তার মধ্যে পার্থক্য, বা, সার্ত্র-এর ভাষায়, সারমর্ম (essence) এবং অস্তিত্বের মধ্যে পার্থক্য।
এই পার্থক্য টানার মধ্য দিয়ে Dasein, বা আমাদের অস্তিত্ব (Existenz)-কে জগতে সাধারণ বস্তুর স্থিতসত্তার ধরণ থেকে আলাদা করা হয়। হেইডেগার যখন বলেন: Dasein ‘অন্য সমস্ত সত্তার (ein Seiendes) মধ্যে নিছক আরেকটি সত্তা নয়’, বরং ‘অন্য সমস্ত সত্তার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা কিছু’, তখন Dasein-এর যে বৈশিষ্ট্যমূলক চরিত্রের দিকে তিনি আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে চান (আগেই কিয়ের্কগার্ড যা অনুমান করেছিলেন), তা হল, Dasein এমন এক ‘সত্তা’ যার ক্ষেত্রে ‘তার নিজ স্থিতসত্তাতেই সেই স্থিতসত্তা একটি বিচার্য বিষয়’। এমনটা নয় যে Dasein নিছকই ‘উপস্থিত’, হেইডেগারের ভাষায়, তা ‘তার হয়ে উঠতে হবে যে স্থিতসত্তা’ তারও অধিকারী। মানুষদের অস্তিত্বমান হওয়া মানে কেবল বেঁচে থাকা নয়, তারা তাদের নিজেদের জীবনের অধিকারী যে জীবন তাদের যাপন করতে হবে, এবং উপলব্ধি করা ও মূল্য দেওয়ার মধ্য দিয়ে তারা এই জীবনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলে। তারা নিছকই এটা বা ওটা করতে থাকে না, যা তারা করে তার সঙ্গে তারা (প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ) সম্পর্ক বোধ করে। ব্যক্তির আত্মসম্পর্কের এই বিবরণ বস্তরূপান্তরে পরকীয়সাধনের সমালোচনায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং তা দাঁড়িয়ে আছে অস্তিত্ব (Existenz) এবং হাতের-কাছে-উপস্থিত স্থিতসত্তার মধ্যে বিরোধের উপর। যখন আমরা অস্তিত্বগতভাবে (existierend) নিজেদের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে উঠি, তখন সেই সম্পর্ক নিজেদের এমনভাবে দেখে না যেনবা তা জগতে নেহাত একটি প্রদত্ত বস্তু হিসেবে উপস্থিত। আমরা আমাদের জীবনক্রিয়ার মধ্য দিয়ে--- অর্থাৎ, যা আমরা চাই এবং যা আমরা করি, তার মধ্য দিয়ে--- নিজেদের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে উঠি। আমার যে ‘আমার যা হয়ে উঠতে হবে সেই স্থিতসত্তা’ আছে, তার মানে এই যে নেহাতই একটা হাতের-কাছে-উপস্থিত বস্তু হিসেবে আমি অস্তিত্বমান নই, বরং, আমাকে আমার নিজের জীবন যাপন করতে হবে, নিজেকেই তা পরিচালনা করতে হবে। অন্য আরো অনেক কিছুর মতো এর মানে এটাও যে নিজের জীবনকে নিজের সিদ্ধান্ত দিয়েই চালিত করতে হবে, বা, তুগেনধাত-এর ভাষায়, ‘ব্যবহারিক প্রশ্নগুলোর’ মুখোমুখি হয়ে চলতে হবে।
এই পটভূমিতে এবার আমরা হেইডেগারের শব্দভাণ্ডার দিয়ে সূত্রায়িত করা যায়, আত্মবিচ্ছিন্নতার এমন দুটি দিককে আরো নিখুঁতভাবে চিহ্নিত করতে পারি: নিজেকে একটি প্রদত্ত বস্তুতে পরিণত করা এবং নিজের কাজেকর্মে সর্বদা অপরের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেওয়া, এই দুটোই বিচ্ছিন্নতার সূচক। একদিকে যেমন সে উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয় যে সে নিজেই নিজের জীবন পরিচালনা করছে, অন্যদিকে, তার জীবন যে তাকে নিজেকেই পরিচালনা করতে হবে এমন বোধও তার হয় না।
এই ধারণাগুলো অপ্রামাণিকতা এবং ভিন্নতার এক সূক্ষ্ম রূপের এমন এক চেহারা হাজির করে যা (এই ব্যাখ্যা-কাঠামো অনুযায়ী) অপরদের সঙ্গে সবসময় মানিয়ে নেওয়ার বা প্রথানুগ হওয়ার চেষ্টা করে যায়। ‘তাদের অনুরূপ স্থিতসত্তা রীতি’ (Seinsweise des Man)-ই হল আত্মসত্তা হারিয়ে ফেলার (যাকে হেইডেগার অপ্রামাণিকতা বলেছেন) উৎস। যে মাত্রায় এই ভাবনাকে সাধারণভাবে সামাজিকতার বলয় সম্পর্কে একটি বিরূপ বর্ণনা হিসেবে বুঝে নেওয়া যায়,২৯ তা সামাজিক আন্তর্সম্পর্কের এমন এক চরিত্র উদ্ঘাটন করে যা একইসঙ্গে প্রথানুসরণ ও আত্মপরিচয়হীনতা দিয়ে চিহ্নিত--- অর্থাৎ, এমন এক পরিবেশ-পরিস্থিতির দ্যোতক যেখানে প্রত্যক্ষভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া ও মূল্যায়ন করার ক্রিয়া ঘটে না, বরং সবার কী সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত ও কীভাবে মূল্যায়ন করা উচিত তা যেন স্বতঃসিদ্ধ রূপে পূর্বনির্ধারিত হয়ে থাকে। ‘Dasein-এর প্রাত্যহিকতায় বেশির ভাগ জিনিসের প্রবর্তক যে বিষয়ীসত্তা তার সম্পর্কে “সে কোনো ব্যক্তি নয়” ছাড়া আর কিছু বলা যায় না।’৩০ এটাও এক ধরনের আধিপত্যাধীন হয়ে ওঠা: আমরা ‘অপরের অধীনতা’-য় পতিত হই, কিন্তু একইসঙ্গে অপরের আধিপত্যাধীন হওয়া এবং আত্ম-‘আধিপত্য’ (বা আত্ম-শাসন)-এর মধ্যে এক অদ্ভুত দোলনগতিও চলতে থাকে, যার ব্যাখ্যা হিসেবে অপর তারা (‘das Man’)-র আধিপত্যাধীন এই বিষয়ীর আত্মপরিচয়হীন ও স্থায়িত্বহীন চরিত্রকে চিহ্নিত করা যায়। অপর ‘তারা’ (‘das Man’) ‘ এই জন নয়, ওই জনও নয়, নিজে নয়, কোনো ব্যক্তিবর্গ নয়, এমনকি তাদের সবার সমষ্টিও নয়’।৩১ তাই এই বর্ণনার মধ্যেও বিচ্ছিন্নতা-সমালোচনার একটি উপাদান নিহিত আছে: আমাদের নিজেদের তৈরি করা জিনিসই ঘুরে এসে আমাদের উপর পরকীয় বস্তু হিসেবে প্রভাব বিস্তার করে, ‘আমরা নিজেরাই’ পরিচয়হীন ‘কেউ-না’ হয়ে যাই যারা আর নিজেদেরই তৈরি করা জগতের জন্য না পারি আর দায় নিতে, না আমাদের আর কোনোভাবে দায়বদ্ধ করে তোলা যায়। ‘আদিতে আর কারো উপস্থিতি থাকে না’। একইসঙ্গে অবশ্য সম্পর্কগুলোও বস্তুতে রূপান্তরিত হয়ে পরকীয় হয়ে ওঠে, যেনবা এছাড়া আর অন্যকিছু হওয়ার সম্ভাবনা তাদের মধ্যে ছিল না। এই কারণেই ‘das Man’--- হানা আরেন্ট যাকে ‘rule by nobody’ (‘অস্তিত্বহীনের দ্বারা শাসন’) বলেছেন--- তাকে ঠিক সেই কাঠামোটিরই বর্ণনা হিসেবে গণ্য করা যায় যে কাঠামোটির সন্ধান বিচ্ছিন্নতা বিষয়ে আমরা করে চলেছি: সামাজিক ক্ষমতা রূপে ‘das Man’ স্বাধীন অস্তিত্ব ধারণ করে বসেছে এবং তার জন্যই ব্যক্তিমানুষরা আর ‘নিজেদের সক্রিয়তার মধ্যে নিজেদের আবার খুঁজে পায় না’।৩২
টীকা
১। লুসিয়েন গোল্ডমান, Lukacs and Heidegger, পৃঃ ১১৬।
২। এরিক ফ্রম, Marx’s Concept of Man।
৩। মার্কস, ‘Economic and Philosophic Manuscripts’। এই পাঠ্যগুলো নিয়ে বিশদ ও অতি নির্দেশপূর্ণ ব্যাখ্যার জন্য দ্রষ্টব্য: ওয়াইল্ডট, Die Anthropologie des jungen Marx।
৪। মার্কস নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে চার্লস টেলর ‘প্রমিথিয় অভিব্যক্তিবাদ’-এর কথা বলেছেন। এর মধ্য দিয়ে তিনি যা গুরুত্ব সহকারে হাজির করতে চেয়েছেন তা হল এই যে মার্কস এখানে বিরোধে সদামগ্ন দুটি বিষয়ের মধ্যে সমন্বয়সাধন করতে চেয়েছেন। বিষয়দুটি হল: অভিব্যক্তির প্রয়োজনীয়তা এবং আকারদায়ক ক্ষমতার উপর আধুনায় জোর পরার সঙ্গে যুক্ত জগৎ নিয়ে আধুনিক মোহমুক্তি (টেলর এভাবেই সমস্যার সূত্রায়ন করেছেন)। এই অভিব্যক্তিবাদ প্রমিথিয় কারণ তা কোনো (প্রদত্ত) মহাজাগতিক শৃঙ্খলা বা ঈশ্বরিক অভিপ্রায় নিয়ে ভাবিত নয়, বরং মানুষের সৃষ্টির মধ্য দিয়েই নিজেকে অভিব্যক্ত করতে পারা নিয়ে ভাবিত। এই প্রসঙ্গে দ্রষ্টব্য: চার্লস টেলর, Hegel, পৃঃ ৫৫৯ এবং পূর্বোক্ত।
৫। মার্কস, ‘Economic and Philosophic Manuscripts’, খণ্ড ৩, পৃঃ ২৭৮-২৭৯।
৬। ডানিয়েল ব্রুডনি সম্মিলিত হওয়ার কম্যুনিস্ট ধরনকে ‘কাঠামোগত বন্ধুত্ব’ হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন (ব্রুডনি, Die Rechtfertigung), এখানে আমি সেই ব্যাখ্যার দিকেই ইঙ্গিত করেছি।
৭। মার্কস, ‘Economic and Philosophic Manuscripts’, খণ্ড ৩, পৃঃ ২৭৬।
৮। বলা যেতে পারে যে যান্ত্রিকীকরণ (instrumentalization)-এর বিরুদ্ধে কান্ট-এর নিষেধাজ্ঞাকে এভাবে আরো প্রসারিত করে আত্মসত্তার সঙ্গে সম্পর্কও তার অন্তর্গত করে দেওয়া--- অর্থাৎ, নিষেধাজ্ঞাটির একটি নৈতিক ব্যাখ্যান হাজির করা--- আধিপত্য এবং অর্থহীনতার অভিসৃতি সম্ভবপর করে তোলে।
৯। ‘শ্রমের উৎপাদ যদি শ্রমিকের না হয়, যদি তা একটি পরকীয় ক্ষমতা রূপে শ্রমিকেরই বিরুদ্ধে এসে দাঁড়ায়, তা হতে পারে একমাত্র এই কারণেই যে সেই উৎপাদ শ্রমিক ছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তির সম্পদে পরিণত হয়েছে। শ্রমিকের সক্রিয়তা যদি তার নিজের পীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তবে তা নিশ্চয়ই অন্য কারো জীবনে সুখ ও আনন্দের উপকরণ হয়ে উঠেছে’ মার্কস, ‘Economic and Philosophic Manuscripts’, খণ্ড ৩, পৃঃ ২৭৮। এখানে বিচ্ছিন্নতার কারণ ঢুঁড়তে গিয়ে আধিপত্যের সম্পর্ককে একটি উৎস হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে, যাকে আরো ব্যাপ্ততায় দেখলে, কাঠামোগত আধিপত্যের একটি সম্পর্ক রূপে চিহ্নিত করা যায়।
১০। মার্কসীয় বিচ্ছিন্নতা-তত্ত্ব এবং তার মধ্যে নিহিত সম্পদের ধারণা নিয়ে বিশদ ও সমালোচনাত্মক আলোচনার জন্য দ্রষ্টব্য: গিয়র্গ লোহমান, Indifferenz und Gesselschaft।
১১। ডানিয়েল ব্রুডনি, Die Rechtfertigung, পৃঃ ৩৯৫-৪২৩।
১২। আরিস্ততেলিয় ভঙ্গিমায়, শ্রমকে একটি মানুষের বৈশিষ্ট্যমূলক ক্রিয়া হিসেবে ধরা হয়ে থাকে কেবলমাত্র সেই মাত্রাতেই যে মাত্রায় তা প্রাকৃতিক প্রয়োজন বা প্রাকৃতিক দায় দ্বারা পুরোপুরি নির্ধারিত হয় না। সুতরাং মার্কস যাকে মানবশ্রমের বৈশিষ্ট্যমূলক চরিত্র বলছেন, তা কেবল এতেই সীমাবদ্ধ নয় যে মানবশ্রম প্রবৃত্তিচালিত হওয়ার বদলে পরিকল্পিত, বরং তা এও দাবি করে যে মানুষ ‘সৌন্দর্য্যের বিধি অনুসারে বস্তু নির্মাণ করে’। মার্কস যখন দাবি করেন যে বিচ্ছিন্নকৃত শ্রমে শ্রমিক তার মানব-ভূমিকায় পশু এবং পশু-ভূমিকায় মানুষ হয়ে ওঠে: ‘যা পশু তা মানুষ হয়ে দাঁড়ায়, আর যা মানুষ তা পশু হয়ে দাঁড়ায়’ (মার্কস, ‘Economic and Philosophic Manuscripts’, খণ্ড ৩, পৃঃ ২৭৫)--- তখন তার ব্যাখ্যাও আমাদের একইভাবে করে নিতে হয়।
১৩। যে মাত্রায় এই ভাবনাকাঠামো জগৎ-কে কেবলমাত্র আত্মসত্তারই একটি বহিঃস্থকরণ হিসেবে ভেবে নেয়, সেই মাত্রাতেই মার্কস সম্পর্কে হানা আরেন্ট-এর সমালোচনা পুরোটাই অ-যথার্থ নয়। এই বিষয়টি আমি বিশদে আলোচনা করেছি এই বইটিতে: রায়েল ইয়েগ্গি, Welt und Person।
১৪। এই সমস্যাগুলো নিয়ে সবচেয়ে বিশদ ও নির্দেশপূর্ণ আলোচনার জন্য দ্রষ্টব্য: আর্নস্ট মাইকেল ল্যাঙ, Das Prinzip Arbeit।
১৫। রেমন্ড গেউস, The Idea of a Critical Theory, পৃঃ ১৪।
১৬। হেইডেগার নিজে যেভাবে বস্তরূপান্তরের মধ্য দিয়ে পরকীয়সাধন (reification)-এর বিষয়টিকে উল্লেখ করেছেন, তা প্রমাণ করে যে বর্তমান আলোচনায় তিনি প্রাসঙ্গিক:
অনেক দিন ধরেই এটা জানা আছে যে প্রাচীন সত্তাতত্ত্ববিদ্যা ‘বস্তু-ধারণা’ (‘thing-concepts’) নিয়ে কাজ করে এবং ‘বস্তুরূপান্তরে পরকীয়সাধনকারী চেতনা’ (‘reifying consciousness’)-এর বিপদ থেকেই যায়। কিন্তু এই ‘বস্তুরূপান্তরে পরকীয়সাধনকারী’ কথাটার তাৎপর্য কি? কোথায় তার উদ্রেক ঘটে? স্থিতসত্তা কেন আমাদের ঘনিষ্ঠতর হাতের-কাছে-প্রস্তুত-এর সাপেক্ষে ‘অনুভূত’ না হয়ে হাতের-কাছে-উপস্থিত-এর সাপেক্ষেই ‘প্রায়শ’ ‘অনুভূত’ হয়ে থাকে? এই বস্তুরূপান্তরে পরকীয়সাধন সর্বদা কেন তার আধিপত্য জারি করতে ফিরে ফিরে আসে? ‘চেতনা’-র স্থিতসত্তার কাঠামো হিসেবে বস্তুরূপান্তরে পরকীয়সাধন যদি অনুপযুক্তই হয়, তাহলে তার সদর্থক উপযুক্ত কাঠামোটাই বা কী?
হেইডেগার, Being and Time, পৃঃ ৪৮৭
লুকাচ এবং হেইডেগার-এ বিচ্ছিন্নতা এবং বস্তুরূপান্তরে পরকীয়সাধন-এর সমস্যাদ্বয়ের মধ্যে স্পর্শবিন্দুগুলো নিয়ে আলোচনার জন্য দ্রষ্টব্য: লুসিয়েন গোল্ডমান, Lukacs and Heidegger।
১৭। এর মধ্য দিয়ে পরম্পরাগত দর্শন ও পরম্পরাগত সত্তাতত্ত্ববিদ্যা (চেতনার দর্শন)-এ ব্যক্ত জগতের ধারণা থেকে পৃথক একটি ধারণা ব্যক্ত করা হচ্ছে। ওই পরম্পরা যেভাবে ‘বিষয়ী’-র জগতের সঙ্গে সম্বন্ধিত হওয়ার প্রক্রিয়াকে বোঝে, তার থেকে ভিন্নতর এক বোঝাবুঝিও হাজির করা হচ্ছে।
১৮। থমাস রেন্টশ, Martin Heidegger, Das Sein und der Tod: Eine kritische Einfuhrung, পৃঃ ১২২।
১৯। হেইডেগারের ধারণামতে, হাতের-কাছে-উপস্থিত প্রণালীই জগৎ সম্পর্কে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের বোঝাবুঝি এবং আমাদের প্রাত্যহিক বোঝাবুঝি, উভয়ের মধ্যেই চারিয়ে থাকে। এর ফলে এই উভয়ই সংশ্লিষ্ট বস্তুদের হাতের-কাছে-প্রস্তুত চরিত্রকে স্পষ্ট করতে পারে না এবং আনাড়ির মতো নিজের ও জগতের মধ্যে একটা দেওয়াল খাড়া করে।
২০। বিষয়ীই জগৎ-কে নির্মাণ করে--- নেহাত এই দাবিটিই হেইডেগার এখানে করছেন না। ‘আমরা একইসঙ্গে জগতের প্রভু, আবার, জগতের দাস’, অর্থাৎ, আমরা এমন একটা জগতের ভিত্তিতেই নিজেদের বুঝতে পারি, যে জগৎ আবার ইতিমধ্যেই হাজির বা প্রদত্ত নয়।
২১। হেইডেগার, Being and Time, পৃঃ ৮৪।
২২। হেইডেগার, Being and Time, পৃঃ ৫৭।
২৩। বারবারা মেরকের, ‘Konversion statt Reflexion’।
২৪। বারবারা মেরকের, ‘Konversion statt Reflexion’, পৃঃ ২১৭।
২৫। জাঁ পল সার্ত্র, Being and Nothingness।
২৬। বস্তু এবং তার চরিত্র বিচারের (ontic) মাত্রা এবং সত্তাতত্ত্ববিদ্যার (ontological) মাত্রার মধ্যে পার্থক্য হিসেবে বারবারা মেরকের একে বুঝতে চেয়েছেন এভাবে: ‘যে দুটি ভিন্ন উপায়ে স্থিতসত্তা ভুল পথে যায়, আর যে দুটি উপায় ভিন্ন হলেও একে অপরকে ভিত্তিপ্রদান করার সম্পর্ক বজায় রেখে চলে। একদিকে সত্তাতত্ত্বগত ধোঁয়াশা, যেমন ধরা যাক, অস্তিত্ব (Existenz)-এর নিজেকে একটি বস্তুপদার্থ হিসেবে ব্যাখ্যা করা, আর অন্যদিকে বস্তু ও তার চরিত্র বিচারের ব্যর্থতা, যার বৈশিষ্ট্য হল স্বাধীনতার অভাব, প্রামাণিকতার অভাব ও উপযুক্ততার অভাব।’ (বারবারা মেরকের, ‘Konversion statt Reflexion’, পৃঃ ২১৭)
২৭। হেইডেগার, Being and Time, পৃঃ ১৬৫।
২৮। হেইডেগার, Being and Time, পৃঃ ১৫১।
২৯। হেইডেগার নিয়ে চর্চায় এটি একটি বিতর্কিত বিষয় হয়ে আছে। এই প্রসঙ্গে আরো অন্য অনেকের মতো, জন হগল্যান্ড, রবার্ট দ্রেয়ফুস এবং রবার্ট ব্রানডন-দের মধ্যে ‘das Man’-এর নিন্দামূলক বনাম গঠনমূলক ব্যাখ্যা নিয়ে বিতর্ক দ্রষ্টব্য।
৩০। হেইডেগার, Being and Time, পৃঃ ১৬৫।
৩১। হেইডেগার, Being and Time, পৃঃ ১৬৪।
৩২। য়ুরগেন হাবেরমাস, Erlauterungen zur Diskursethik।
৩
বিচ্ছিন্নতা-সমালোচনার কাঠামো ও নানা সমস্যা
এখনও অবধি যা আলোচনা করা হয়েছে, সেখানে বিচ্ছিন্নতা একটি ব্যাখ্যামূলক নকশা, এমন একটি ধারণা যার সাহায্যে কেউ (ব্যক্তির সাপেক্ষে বা গোষ্ঠীর সাপেক্ষে) আত্ম এবং বিশ্বের সঙ্গে নিজ সম্পর্ক অনুধাবন ও গ্রন্থন করে থাকে। এহেন একটি ব্যাখ্যামূলক নকশা যখন আমাদের এমন অবস্থায় এনে ফেলে যে জগতের কিছু বৈশিষ্ট্য তার মাধ্যমে ছাড়া আর অন্য কোনোভাবে বোধ, বিচার বা বোঝা আমাদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে ওঠে, তখনই তা ফলদায়ক হয়ে ওঠে। বিচ্ছিন্নতার মতো ধারণার গুণ হলো এই যে কিছু কিছু প্রতীতি (phenomena)-কে ‘একসঙ্গে’ দেখা (বা একসঙ্গে ভাবা) তার মধ্য দিয়ে সম্ভবপর হয়ে ওঠে--- অর্থাৎ, প্রতীতিগুলোর মধ্যে এমন দৃশ্যমান যোগাযোগ স্থাপন করা সম্ভবপর হয়ে ওঠে যা অন্যথায় দৃশ্যমান হয়ে উঠতো না। আর, কিছু কিছু দিক থেকে বিচ্ছিন্নতা-সমালোচনা প্রতীতিসমূহকে তাদের সাধারণভাবে চালু বর্ণনার বিপরীতে গিয়ে বস্তুত অন্যভাবে বর্ণনা করে।
এখনও অবধি বিচ্ছিন্নতার যে ধারণা আমি আলোচনা করেছি, তার লক্ষণ ধরে আলোচনায় এখন ঢোকা যাক।
অর্থহানি ও ক্ষমতাহানি
প্রথমত, বিচ্ছিন্নতার ধারণা তার নিজের মধ্যে দুটি পৃথক কিন্তু পরস্পর-বিজড়িত নিদান ধারণ করে। তাদের একটি হলো ক্ষমতাহানি-র নিদান, আমাদের নিজেদের সাপেক্ষে এবং আমাদের কাছে অপর হিসেবে হাজির হতে থাকা জগতের সাপেক্ষে উভয়তই, যা আমরা বিচ্ছিন্নকৃত অবস্থায় অনুভব করে থাকি: বিচ্ছিন্নকৃত সম্পর্ক হলো সেগুলোই যা বিষয়ী হিসেবে আমাদের ক্ষমতার হানি ঘটায়। আর অন্যটি হলো অর্থহানি-র নিদান, যা আমাদের কাছে অপর হিসেবে হাজির হতে থাকা জগতের বৈশিষ্ট্য হয়ে ওঠে, এবং একইসঙ্গে সেই জগতের সঙ্গে সম্পর্ক ও নিজের সঙ্গে নিজের সম্পর্কেরও বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করে। বিচ্ছিন্নকৃত জগৎ হলো অর্থহীন জগৎ, যে জগতকে আমরা আর একটি অর্থপূর্ণ সমগ্র হিসেবে অনুভব করতে পারি না। তাই বিচ্ছিন্নতা একইসঙ্গে অসমতা--- নিজের বৈশিষ্ট্যসমূহ অপর কিছুর দ্বারা নির্ধারিত হওয়া--- এবং আবশ্যকীয় বৈশিষ্ট্য বা অভিপ্রায়ের সম্পূর্ণ অনুপস্থিতি বোঝায়। তাছাড়াও, বিচ্ছিন্নতা বলে বর্ণিত প্রতীতিটির অন্যতম মূল লক্ষণ বোধহয় এটাই যে তার মধ্যে এই দুটি সমস্যা--- ক্ষমতার ক্ষমতাহীনতায় পরিণত হওয়া এবং জগতে অর্থপূর্ণ নিযুক্তি খুইয়ে বসা--- পরস্পর-বিজড়িত হয়ে থাকে।
এখন, এই দুটি বিষয়ের মধ্যে আন্তর্সম্পর্কটি মোটেই স্বয়ংসিদ্ধ নয়। নিজের কাজের উপর ক্ষমতা বা নিয়ন্ত্রণ না থাকলে কি একটি অর্থপূর্ণ জগতে নিমজ্জিত হয়ে থাকা অসম্ভব? আরো সাধারণভাবে বললে, নিজে ছাড়া অন্য কারো দ্বারা নির্ধারণ করে দেওয়া একটি সম্পর্কে কি বিচ্ছিন্নকৃত না হয়ে থাকা সম্ভব নয়? এই প্রশ্নগুলো স্বাধীনতা এবং অর্থপূর্ণতার মধ্যের সম্পর্ক বিষয়ক এবং আত্মনির্ধারণ ও আত্মোপলব্ধি একে অপরের গঠনে জড়িত কি না তা সন্ধান করে। ভিত্তি হিসেবে কাজ করা প্রস্তাবটিকে এভাবে সূত্রায়িত করা যায়: একমাত্র এমন একটি জগৎ যাকে আমি ‘আমার নিজের’ করে নিতে পারি--- এমন এক জগৎ (যাকে আত্মসাৎ করে নেওয়ার মধ্য দিয়ে) যার সঙ্গে নিজেকে সনাক্ত করতে পারি--- কেবল তার মধ্যেই আমি আত্মনির্ধারিত ভাবে ক্রিয়াশীল হতে পারি। (আর, একই সূত্র ধরে বললে, যে সনাক্তিকরণ আত্মনির্ধারিতভাবে ঘটে, তাকেই কেবল সফল সনাক্তিকরণ রূপে গণ্য করা যায়।) এই ভাবে বুঝলে, বিচ্ছিন্নতার ধারণাটি সেই সমস্ত শর্তগুলোকে চিহ্নিত করতে চায় যার অধীনে একজন নিজেকে বিষয়ী হিসেবে, নিজের ক্রিয়ার নিজেই প্রভু হিসেবে, উপলব্ধি করতে পারে।
এই প্রস্তাবের নানা লক্ষণা আছে। এমনকি, বিচ্ছিন্নতার স্বাধীনতা-প্রদানকারী নিদানের সঙ্গে রক্ষণশীল নিদানের পার্থক্যটাও এভাবে বুঝে নেওয়া যায়: স্বাধীনতা-প্রদানকারী নিদান ব্যক্তি-একক-দের নিজেদের প্রকাশ করা ও সৃষ্টি করার ক্ষমতার উপর জোর ফেলে, অন্যদিকে, রক্ষণশীল নিদান কোনো একটি প্রদত্ত অর্থপূর্ণ ক্রমবিন্যাসের সঙ্গে সংযোগ হারিয়ে ফেলার উপর জোর ফেলে। কীভাবে সমস্যাটিকে চিহ্নিত করা হবে, সে বিষয়ে অবশ্য আমার বোঝাবুঝি হলো এই যে প্রাক-আধুনিক অ-বিচ্ছিন্নকৃত নানা অবস্থার প্রতি (যেমন ধরা যাক, সামন্ততান্ত্রিক সম্পর্কাবলীর অর্থপূর্ণ ক্রমবিন্যাসের প্রতি) স্মৃতিকাতর আকাঙ্ক্ষার এখানে স্থান নেই; তাছাড়া যে রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গি বিচ্ছিন্নতার উৎস খুঁজতে গিয়ে আধুনিক স্বাধীনতার অত্যধিক চাহিদাযুক্ত প্রয়োজনীয়তা এবং সামাজিক বন্ধনের অভাবকে চিহ্নিত করে, তাও আর বিশ্বাসযোগ্য নয়। অন্যভাবে বললে, বিচ্ছিন্নতার রক্ষণশীল সমালোচনা (আধুনিক) স্বাধীনতাকেই বিচ্ছিন্নতার কারণ হিসেবে ধরে নেয়, অন্যদিকে, স্বাধীনতা-প্রদানকারী সমালোচনা বিচ্ছিন্নতাকে স্বাধীনতাহীনতার একটি রূপ হিসেবে দেখে।
একইসঙ্গে অপর এবং আপনের-আপন: কাঠামোগত অসমতা
দ্বিতীয়ত, বিচ্ছিন্নতা যদি এক প্রকার ক্ষমতাহীনতা ও অনুর্বরতা হয়, তাহলে বিচ্ছিন্নতার তত্ত্বকে সোজাসাপটা আধিপত্যবাদী সম্পর্কের চেয়ে আরো আলাদা কিছু এবং আরো বেশি কিছু নিয়ে ভাবতে হবে। যা থেকে আমরা বিচ্ছিন্ন, সবসময়ই তা একইসঙ্গে অপর ও আপনের-আপন। বিচ্ছিন্নকৃত সম্পর্কে আমরা জটিলভাবে ভুক্তভোগী ও অপরাধী উভয়ই। যে জন কোনো একটা ভূমিকার মধ্যে বা মাধ্যমে বিচ্ছিন্নকৃত হয়ে পড়ছে, যুগপৎভাবে সে-ই কিন্তু সেই ভূমিকাটি পালন করে চলেছে; যে জন অপরা আকাঙ্ক্ষার দ্বারা তাড়িত হচ্ছে, যুগপৎভাবে সে-ই কিন্তু সেই আকাঙ্ক্ষা পোষণ করছে--- পরিস্থিতির জটিলতা বুঝতে আমরা ব্যর্থ হবো যদি এখানে আমরা কেবলমাত্র অভ্যন্তরভুক্ত-করে-নেওয়া-বাধ্যতা বা মনস্তাত্ত্বিক-পাকে-পড়া দিয়েই ব্যাখ্যা করতে চাই। যে সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো অনমনীয় ও অপর হয়ে আমাদের মুখোমুখি দাঁড়ায়, যুগপৎভাবে তারা আমাদের দ্বারাই নির্মীত। সেমতাবস্থায় আমরা (যৌথভাবে) যা করে চলি, তা নির্ধারণ বা নিয়ন্ত্রণ আমরা করি না (আর এটাই বিচ্ছিন্নতার নিদানের একটি নির্দিষ্ট দিক)। এরিক ফ্রম বিশদভাবেই একথা হাজির করেছেন এভাবে:
(বুর্জোয়া মানুষ) বৃহত্তম ও সবচেয়ে বিস্ময়কর বস্তুদের দিয়ে এক জগৎ উৎপাদন করে; কিন্তু এগুলোই, তার নিজের এই সৃষ্টিগুলোই, অপর ও ভয়-প্রদর্শক রূপে তার মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়; যদিও সে-ই তাদের সৃষ্টি করেছে, তবু সে নিজে তাদের প্রভু না হয়ে বরং আজ্ঞাবাহক হয়ে ওঠার বোধ অনুভব করে। গোটা বস্তুজগৎটাই এমন এক দানবাকৃতি বিরাট যন্ত্রের চেহারা নেয় যা তার জীবনের লয় ও ছন্দ নির্দেশ-নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে। তার নিজের হাতের যে কাজগুলো তার নিজের সেবা ও সুখবর্ধনের উদ্দেশ্যে নির্বাহিত হয়েছিল, সেগুলোই এমন এক জগৎ তৈরি করে বসে, যে জগৎ থেকে সে বিচ্ছিন্ন, যে জগতকে মেনে বিনীত অনুর্বর অস্তিত্ব যাপন করে যাওয়া ছাড়া তার আর গত্যন্তর থাকে না।১
বিচ্ছিন্নতামূলক সম্পর্কে যখন অনুর্বরতার বোধ তৈরি হয়, তখন বাধ্যতামূলকভাবে এমন কোনো বাস্তব ক্ষমতা--- কোনো কর্তা--- না-ও থাকতে পারে যে এই অনুর্বরতার অবস্থাটি তৈরি করেছে। বিচ্ছিন্নতার তত্ত্বের পরিচিত রূপকে যদি আমরা ধরি--- সে হেইডেগার-এর ‘তারা’ (‘They’) হোক, বা মার্কস-এর পুঁজিবাদ-বিশ্লেষণ--- তা কাঠামোগত অসমতার বা বস্তুতে-রূপান্তরিত সম্পর্কসমূহের আধিপত্যবাদী চরিত্রের এমন সূক্ষ্ম রূপ নিয়ে ভাবিত যা ব্যক্তিরূপী ক্রিয়াকর্তার উপরে ও বিরুদ্ধে এক জ্যান্ত উপস্থিতি হয়ে ওঠে। অন্যভাবে যদি সূত্রায়িত করা হয়, তাহলে বিচ্ছিন্নতার ধারণা নিরাসক্তি ও আধিপত্য-এর মধ্যে এমন এক যোগসূত্র হাজির করে যা আরো ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন হয়ে ওঠে। যে বস্তু, পরিস্থিতি, তথ্য-এর সঙ্গে বিচ্চিন্নকৃত অবস্থায় আমাদের আর কোনো সম্পর্ক থাকে না, আমাদের প্রতি সেগুলোর নিরাসক্তি তাৎপর্যহীন নয়, সেগুলো ওই নিরাসক্তির সম্পর্কের মধ্য দিয়ে এবং মাধ্যমেই আমাদের উপর আধিপত্য ফলিয়ে থাকে।২
সম্পর্কহীনতার সম্পর্ক
তৃতীয়ত, বিচ্ছিন্নতা কেবল অপরত্ব বা অদ্ভুতত্ব নয়। শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত কাঠামো দেখায় যে বিচ্ছিন্নতার অর্থ নেহাত সংযোগহীনতা বা সম্পর্কহীনতা নয়। বিচ্ছিন্নতা নিজেই একটি সম্পর্ক, যদি বা সে সম্পর্ক খামতিযুক্তও হয়। যে বস্তুগুলোর থেকে আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে উঠতে পারি, তারা কেবল এই অর্থেই আমাদের অপর নয় যে তারা আমাদের অপরিচিত, আমাদের সঙ্গে সম্পর্কহীন বা আমাদের সম্পর্কে নিস্পৃহ। দানিয়েল ব্রুডনি যেমন মার্কসকে নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন:
মঙ্গলগ্রহ, মঙ্গলগ্রহনিবাসী বা মঙ্গলগ্রহের কোনো বস্তুকে কেউ অস্বচ্ছ বা অপর বলে মনে করতে পারে, কিন্তু সেসব থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্নকৃত বলে হাজির করা বেশ অসঙ্গতই হবে যদি না তাদের সঙ্গে স্বচ্ছতার ও আপন হওয়ার কোনো সম্পর্কে কেউ কখনো থেকে থাকে বা থাকার কথা হয়তোবা থেকে থাকে।৩
সুতরাং, বিচ্ছিন্নতা এক বিশেষ ধরনের সম্পর্কহীনতাকে বোঝায়: বাস্তবে যার সঙ্গে আমরা সংসৃষ্ট, তার থেকে বিযুক্তি বা বিচ্ছেদ; বা, একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত দুটি বস্তুর মধ্যে সংযোগ কেটে যাওয়া। কোনোকিছুর থেকে বিচ্ছিন্নকৃত হওয়া মানে বাস্তবত যার মধ্যে আমি জড়িত হয়ে আছি বা থকার কথা, যার সঙ্গে আমি সম্পর্কিত হয়ে আছি বা হয়ে থাকারই কথা, তেমনকিছুর থেকেই অনতিক্রম্য দূরত্ব তৈরি হওয়া।
Entfremdung ও Entäuβerung কথাদুটো নিজে থেকেই কিছু ছবি হাজির করে: স্বাভাবিকতায় যা একসঙ্গে সংসৃষ্ট, এমন বস্তুদের বিচ্ছিন্নকরণ; যথাসঙ্গতভাবে যাদের সমতানে থাকার কথা, তাদের মধ্যে নিস্পৃহতা বা বৈরিতার সম্পর্ক তৈরি হওয়া--- এমন ইঙ্গিত উঠে আসে।৪ যদি কেউ যুক্তিসঙ্গতি, তত্ত্ববিদ্যা ও ঐতিহাসিকতার দিক থেকে পূর্বতন একটি সম্পর্ক পূর্বানুমান করে নেয়, তাহলেই কেবল বিচ্ছিন্নতাকে একটি সম্পর্কহানি হিসেবে বোঝা সম্ভবপর হয়ে ওঠে। ধারণাটির কাঠামোগত দিক থেকে এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে বিচ্ছিন্নতার নিচে অবস্থিত সম্পর্ক বা যোগসূত্রটি অস্তিত্বমান হওয়া উচিত, যদি বা দৃশ্যত তা আর অস্তিত্বমান না-ও হয়। ধরা যাক, যখন আমরা বলি যে কেউ তার পরিবার থেকে বিচ্ছিন্নকৃত হয়ে গেছে, আমরা শুধু এটাই পূর্বানুমান করে নিই না যে সে সবসময় পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল না, আমরা এটাও বোঝাতে চাই যে সে কোনো একভাবে এখনও তার পরিবারেরই সদস্য, বা, এমনকি, পরিবারের সঙ্গে বাস্তব যাপনে তার যে সম্পর্কই তৈরি হয়ে থাকুক না কেন, তা নিরপেক্ষভাবেই সে পরিবারের সদস্য। সুতরাং, যে বস্তু বা সম্পর্ক থেকে কেউ বিচ্ছিন্নকৃত হয়ে পড়েছে, সেগুলোই আবার রহস্যজনকভাবে দাবি করতে থাকে যে অপর হয়ে উঠলেও এখনও তার ‘আপনের-আপন’-ই রয়ে গেছে: ‘তারা তো তোমারই, মন্দের ভালো, কিন্তু প্রকৃতই তোমার আর নয়: তারা তোমার, কিন্তু তুমি তাদের থেকে বিচ্ছিন্নকৃত।’৫ এই বিবেচনাগুলো বিচ্ছিন্নতা ধারণার একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্যকে স্পষ্ট করে তোলে: বিচ্ছিন্নতা কোনো সম্পর্কহীনতা বা কেবল সম্পর্কের অনুপস্থিতি নয়, বিচ্ছিন্নতা হলো এক বিশেষ ধরনের সম্পর্ক। বিচ্ছিন্নতা সম্পর্কের অনুপস্থিতি বোঝায় না, তা সম্পর্কের গুণবাচক দিককে নির্দেশ করে। আপাতবৈপরীত্য রেখে সূত্রায়ন করলে বলতে হয়, বিচ্ছিন্নতা হলো সম্পর্কহীনতার সম্পর্ক।
একটি নিদানতাত্ত্বিক ধারণা রূপে বিচ্ছিন্নতা
ঠিক এই শেষ কথাটাতেই একটি সমস্যার উদয় হয়: সম্পর্কহীনতার সম্পর্ক হিসেবে বিচ্ছিন্নতা যদি এমন এক সম্পর্কের অবসান, বা সে সম্পর্কের প্রতি নিরাসক্ত হয়ে ওঠা বোঝায়, যে সম্পর্ক তা সত্ত্বেও অস্তিত্বমান, তাহলে যোগসূত্রটি কি এখনও বাস্তবত টিকে আছে, প্রকৃত প্রস্তাবে তার কি অবসান ঘটেনি? নাকি তা এমনটা বোঝাচ্ছে যে, আপাতদৃষ্টিতে অপর বলে প্রতিভাত হলেও, তার অস্তিত্ব টিকে থাকা উচিত, এই সহজ কারণে যে (যেমন ধরা যাক) পরিবারের সবাই একসঙ্গেই থাকে? আমরা যখন কোনো একটি পরিস্থিতিকে বিচ্ছিন্নকৃত অভিধায় চিহ্নিত করি, আমরা কি পরিস্থিতিটির বর্ণনা করছি, নাকি সমালোচনা করছি? আমরা কি কোনো একটি অবস্থার বর্ণনা করছি, নাকি একটি স্বাভাবিকতার মানদণ্ড প্রতিষ্ঠা করতে চাইছি? বিচ্ছিন্নতা ধারণার অদ্ভূত বৈশিষ্ট্য হলো এই যে তা ওই দুটোই করতে চায়--- হয়তোবা দুটোর মধ্যে পার্থক্যটাকেই ঘুচিয়ে দিতে চায়।৬ একটি নিদানতাত্ত্বিক (diagnostic) ধারণা হিসেবে, বিচ্ছিন্নতা একইসঙ্গে মানস্থাপক ও বর্ণনাত্মক উভয়ই। অসুস্থতা-র মতো শব্দ যেভাবে (রিচার্ড শ্যাখট যেমন বলেছেন) নিদানতাত্ত্বিক ফলাফলগুলোকে এক বিশেষ ধরনের প্রতীতি রূপে শ্রেণিবদ্ধকরণ করার মধ্য দিয়ে কাজ করে, ঠিক সেভাবেই বিচ্ছিন্নতাও একটি ব্যাখ্যাত্মক নকশা যার সাহায্যে আমরা জগতের বিশেষ কিছু প্রতীতিকে একইসঙ্গে আবিষ্কার, ব্যাখ্যা ও মূল্যায়িত করতে পারি। বারনার্ড উইলিয়ামস-এর কথা ধার করে বলা যায়, বিচ্ছিন্নতা ঘারণাটি একটি ‘গাঢ় নৈতিক ধারণা’ (‘thick ethical concept’)।৭ একটি পরিস্থিতিকে বিচ্ছিন্নতাসূচক বলে বর্ণনা করা মানে সেই পরিস্থিতির একটি মূল্যায়ন হাজির করা, বা, অন্যভাবে বললে, সেই মূল্যায়নটি নেহাত বর্ণনার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়নি, বরং তা বর্ণনার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছে। এর মানে অবশ্য এমনটা নয় যে এই ধরনের কোনো বর্ণনা বা মূল্যায়ন কোনো পূর্বানুমানের উপর দাঁড়িয়ে থাকে না। ‘তোমায় অসুস্থ দেখাচ্ছে’ মন্তব্যটির সঙ্গে বাধ্যতামূলকভাবে ‘আর অসুস্থ হওয়া (তোমার জন্য) খারাপ’ জোড়ার দরকার পড়ে না, ভিত্তিমূলক পূর্বানুমানগুলো দ্বারাই সেই যোগসূত্র স্পষ্ট হয়ে যায়: যেমন ধরা যাক, স্বাস্থ্য ও অসুস্থতা সম্পর্কে এক ধরনের ধারণা এবং অসুস্থতার চেয়ে যে সুস্বাস্থ্য বেশি কাম্য এই বোধ সেই যোগসূত্র আপনা থেকে তৈরি করে দেয়। এখন প্রশ্ন করা যেতে পারে যে একইরকমভাবে বিচ্ছিন্নতার ধারণাটিও তার পিছনে থাকা নৈতিক পূর্বানুমানগুলোর উপর নির্ভর করে কিনা। এই পিছনে থাকা নৈতিক পূর্বানুমানগুলো সেই ধরনের ধারণাগুলো দিয়ে তৈরি যা নির্ধারণ করে যে কাম্য হওয়া সত্ত্বেও কী অনুপস্থিত, আর এই বিচ্ছিন্নকৃত অবস্থায় কী ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে যায় বা কী অনার্জিত থেকে যায়। পরিবারের উদাহরণটিতে ফিরে এলে বলা যায়: আমি যে একদা আমার পরিবারের সঙ্গে বাঁধা ছিলাম এবং অবিসংবাদিতভাবে সেখান থেকেই যে আমার উৎপত্তি, তা থেকে কীভাবে এমন কোনো সিদ্ধান্ত অবধারিত হয় যে ওই পরিবারের সঙ্গেই আমার এর পরেও বাঁধা থাকা উচিত? ‘বাস্তবতই’ একটি সম্পর্ক থাকার দাবি কি তাহলে স্বাভাবিকতার মানদণ্ড নির্ধারণকারী একটি চরিত্র ধারণ করে বসে না? মূলগত বন্ধনের প্রতি কোনো আবেদন--- যেমন ‘তারা তো তোমার বাবা-মা’--- কি তবেই অনস্বীকার্য হয়ে ওঠে না যদি তা পরিবার বলতে কী বোঝায় সে-সম্পর্কিত কিছু ভাগ-করে-নেওয়া অনুমানের উপর দাঁড়িয়ে থাকে? বা, অন্যভাবে বললে: যদি কেউ আর তর্ক না বাড়িয়ে ওই মূলগত বন্ধনের প্রতি আবেদন মেনে নেয়, তা এইজন্যই যে সম্পর্কের (যে সম্পর্ক পরিবারের সঙ্গে আমার আছে বা নেই) সংজ্ঞা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে স্বাভাভিকতার মানদণ্ড নির্ণয়কারী রঙে রাঙানো থাকে।
একটি বিচ্ছিন্নকৃত সম্পর্কের সম্পর্কসূচক চরিত্রটিই যদি প্রতিটি ক্ষেত্রে বিতর্কযোগ্য হয়, তাহলে তার সদ্য উল্লিখিত পিছনে-থাকা স্বাভাবিকতা-নির্ণয়কারী অনুমানগুলো কীভাবে বোঝা হবে বা ন্যায়সঙ্গত বলে হাজির করা হবে, তার উপরই বিচ্ছিন্নতা-ধারণার সমস্যাপূর্ণ চরিত্র ও তার পুনর্গঠনের সম্ভাবনা চূড়ান্তরূপে নির্ভর করে।
যদি কেউ আরো খুঁটিয়ে বিচ্ছিন্নতার পূর্বালোচিত উদাহরণগুলোকে বিচার করে, তাহলে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে প্রতিটিই এমন কিছু ধারণা বা অনুমানের উপর দাঁড়িয়ে আছে যেগুলো মোটেই স্বয়ংসিদ্ধ নয়: যখন কেউ স্বয়ং নিজের থেকে বিচ্ছিন্নকৃত হয়ে পড়ে, তখন আসলে কার থেকে বা কী থেকে সে বিচ্ছিন্ন হয়? কোন মানদণ্ড দিয়ে প্রকৃত প্রয়োজন (genuine needs) চেনা যাবে? অন্তর্দেশে বিভাজনের কথা যখন বলা হয়, তখন তার বিপরীতে অবিভাজিত ঐক্যরূপের বিষয়টি আমরা ঠিক কীভাবে বুঝবো? একটি পূর্ণ মানুষ বা পূর্ণবিকশিত ব্যক্তিত্ব হতে হলে ঠিক কী কী সক্ষমতা নিজমধ্যে বিকশিত করা দরকার? ব্যক্তিগতকৃত নয় এমন সম্পর্কগুলোর মধ্যে নিহিত বদ্ধতামোচনের সম্ভাবনা এবং তাদের বৈশিষ্ট্যসূচক অনাসক্তি--- সেসব চরম অবহেলা করেই কি ব্যক্তিত্বের আদর্শ ও আশু-প্রত্যক্ষতার আদর্শ গড়ে ওঠেনি, যার উপর নির্ভর করেই আবার বস্তুতে-রূপান্তরকরণ-এর সমালোচনা দাঁড়িয়ে আছে? জটিল সামাজিক-অর্থনৈতিক সংগঠনের দ্বারা চিহ্নিত একটি সমাজে সামাজিক সম্পর্কগুলোকে বিচ্ছিন্নকারী ও বস্তুরূপান্তরে-পরকীয়সাধনকারী বলে করা সমালোচনা নিজে যে স্বচ্ছতা ও সৃষ্টিক্ষমতার আদর্শরূপের উপর দাঁড়িয়ে আছে তা কি সমপরিমাণেই বিভ্রমাত্মক নয়? সুতরাং, স্বচ্ছতা ও পুনর্মিলনের যে আদর্শ অবিচ্ছিন্নকৃত মানুষ ও অবিচ্ছিন্নকৃত সমাজের ধারণার সঙ্গে বাঁধা পড়ে আছে, তা যেমন সমস্যাপূর্ণ, বিচ্ছিন্নতার ধারণার ঘাড়ে চেপে বসে থাকা অপরিহার্যতাবাদও (essentialism) ঠিক একইভাবে সমস্যাপূর্ণ।
বিচ্ছিন্নতা-সমালোচনার সমালোচনা
সেই রুশো থেকে শুরু হয়ে বিচ্ছিন্নতাকে যদি মানুষদের প্রকৃতি এবং তাদের সমাজজীবনের মধ্যে জন্ম নেওয়া অসঙ্গতি হিসেবে ভাবা হয়ে আসা থাকে, তাহলে অবধারিতভাবেই বিচ্ছিন্নকৃত অবস্থা থেকে অবিচ্ছিন্নকৃত অবস্থায় ফিরে আসার মানে দাঁড়ায় সেই অন্তর্বস্তুতে, অর্থাৎ, মানুষের প্রকৃতিতে বা আদি অভিপ্রায়ে ফিরে আসা। সেক্ষেত্রে বিচ্ছিন্নতার সমালোচনা সর্বদাই প্রকৃত মানব-অস্তিত্বের এমন এক (বিষয়গতভাবে প্রোথিত) চেহারা বা অভিপ্রায় পূর্বানুমান করে নিতে বাধ্য, যার থেকে বিচ্ছিন্নকৃত অবস্থায় আমরা দূরে সরে গেছি। কোনোকিছু আর কোনোকিছু থেকে বিচ্ছিন্নকৃত হয়ে আছে বা হয়ে গেছে বললে এটা বোঝানো হয় যে প্রকৃত অর্থে ‘আপনের-আপন’ স্বরূপ এমনকিছু একটা আছে যার থেকে বিচ্ছিন্নকরণ ঘটেছে। বিচ্ছিন্নতার মানে যদি হয় ‘মানুষের অস্তিত্ব এবং অন্তর্বস্তুর মধ্যে দ্বন্দ্ব’ (তরুণ মার্কস-এর সূত্রায়ন অনুযায়ী), তাহলে বিচ্ছিন্নতাকে কেবলমাত্র ‘যা হওয়া সমীচীন নয়’ বলার থেকে বরং যা এক অর্থে ‘নেই ’, তা-ই বলা উচিত। ‘প্রতিভাত রূপ’ (‘appearance’)--- বিচ্ছিন্নকৃত অবস্থা--- তাহলে, বলতে হয়, যুক্তি ও তত্ত্ববিদ্যার দিক থেকে ‘ভুল’। আর একবার যদি বিচ্ছিন্নতাকে আমরা এমন এক দ্বন্দ্ব হিসেবে ধরে নিই যা কোনো মধ্যবর্তী ইতিহাস-পর্যায়ে নিজেকে প্রকাশ করে, তাহলে ইতিহাস (বিচ্ছিন্নতার প্রগতিযাত্রার মঞ্চ হিসেবে) বিচ্ছিন্নকৃত অবস্থা অতিক্রম ও পুনর্মিলনের দিকে ঠেলে নিয়ে চলে বলে বলতে হয়। যে কোনো ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্নতার সমাধান ইতিহাসের একটি দর্শনের মধ্য দিয়ে খুঁজে পাওয়ার হেগেলিয় কৌশলকে আমরা এভাবেই বুঝতে পারি, যার চিহ্ন মার্কস-এর মধ্যেও সহজেই খুঁজে পাওয়া যায়। বিচ্ছিন্নতাকে ‘আত্মতার বাইরে স্থিত সত্তা’ বলে ঠাহর করে বিচ্ছিন্নতা অতিক্রম করাকে ‘আত্মতার কাছে ফিরে আসা’ বলে নির্দিষ্ট করার মানে দাঁড়ায় বিচ্ছিন্নতাকে এমনকিছু ভেবে বসা ‘যার নিজের মধ্যেই নিজেকে অতিক্রম করে যাওয়ার কলকৌশল লাগানো আছে’।৮
সুতরাং, বিবিধ দিক থেকেই বিচ্ছিন্নতার তত্ত্ব সমালোচনার মুখে পড়ে। আলথুজার যখন মার্কস-এর ‘মানববাদ’ (‘humanism’) এবং তার মধ্যে থাকা বিষয়ীর আত্ম-স্বচ্ছতা ও স্ব-নির্দেশিত ক্ষমতার আদর্শকে সমালোচনা করলেন--- আর তার মধ্য দিয়ে মার্কসবাদের অভ্যন্তরীণ একটা অবস্থান থেকেই বিচ্ছিন্নতার ধারণাকে অস্বীকার করলেন--- তখন থেকেই অপরিহার্যতাবাদের সমালোচনা দর্শনচর্চায় ‘সাধারণ জ্ঞান’-এ পরিণত হয়েছে।৯ উপরন্তু, আজ আর কেউ হেগেলিয় ইতিহাস-দর্শন-এ বিস্তারিত যুক্তিধারাকে সমর্থন করবে না, ঐতিহাসিক বিকাশের সেই আদর্শ ছাঁচে বাঁধা উদ্দেশ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করবে না। এমনকি যদি কেউ সেই ইতিহাস-দর্শনকে কিছুটা কাটছাঁট করে এমন একটা দৃষ্টিভঙ্গি প্রস্তাব করে যেখানে ভালো জীবনের তত্ত্বের একটি উপাদান হিসেবে বিচ্ছিন্নতা-ধারণাকে রাখা হয়েছে, তাহলে সে-ও অভিভাবকত্ববাদ পোষণ করার অভিযোগে বিদ্ধ হতে পারে।
মূলগতভাবে দুটি সমকালীন অবস্থান বিচ্ছিন্নতার তত্ত্বসমূহের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আছে: একটি হলো রলস (Rawls)-অনুগামী দার্শনিক উদারতাবাদের পরম্পরা, যা ভালো জীবনের বিষয়মূলক ধারণাকে পরিহার করে; আর অন্যটি হলো বিষয়ীর উত্তর-কাঠামোবাদী (poststructuralist) সমালোচনা, যা বিচ্ছিন্নতা-তত্ত্বের পূর্বানুমান হিসেবে হাজির হওয়া বিষয়ীর ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলে।
বিষয়ানুগত্যবাদ, অভ্রান্ততাবাদ, অভিভাবকত্ববাদ
উদারতাবাদী তত্ত্বের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে বিচ্ছিন্নতা-সমালোচনার একটি দিককে অন্য আর সব দিকের চেয়ে বেশি সমস্যাযুক্ত বলে মনে হয়: ভালো জীবন বলতে কী তা ব্যাখ্যা করার এমন কিছু বিষয়গত মানদণ্ডের উপর যেনবা বিচ্ছিন্নতার তত্ত্বগুলো নির্ভর করে থাকে যেগুলো ব্যক্তিমানুষের ‘সার্বভৌমত্ব’-এর নাগালের বাইরে। বিচ্ছিন্নতা-তত্ত্বের বহু সংস্করণের এহেন প্রবণতার উদাহরণ হারবার্ট মার্কুস তুলে ধরেছিলেন তাঁর One Dimensional Man বইটিতে--- যে বই ১৯৬০ ও ১৯৭০-এর দশকে ‘নয়া বাম’ (‘New Left’)-দের বিচ্ছিন্নতা-সমালোচনায় গুরুত্বপূর্ণ প্রণোদন জুগিয়েছিলো--- যখন উদারতাবাদী আপত্তির কোনো তোয়াক্কা না করে তিনি শিল্পোৎপাদন-ভিত্তিক ধনী সমাজগুলোর সদস্যদের বৈশিষ্ট্য হিসেবে সামাজিক সম্পর্কগুলোর সঙ্গে একীভূত হয়ে যাওয়া ও তা দিয়েই পরিচয় গড়ে ওঠার প্রবণতা ক্রমশ তীব্রতর হতে থাকার সাপেক্ষে বিচ্ছিন্নতার নিদানের বৈধতা প্রতিপন্ন করেছিলেন:
এইমাত্র আমি ইঙ্গিত করেছি যে বিচ্ছিন্নতার ধারণা প্রশ্নের মুখে পড়ে যায় যখন ব্যক্তিমানুষরা তাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া অস্তিত্ব দিয়েই স্বশনাক্তির চিহ্নগুলো গড়ে তোলে এবং তার মধ্যেই নিজেদের বিকাশের পরিসর ও সন্তুষ্টি খুঁজে পায়। অথচ, এই বাস্তবতা আসলে বিচ্ছিন্নতার একটি আরো অগ্রবর্তী পর্যায়। বিচ্ছিন্নতা এখন পুরোটাই বিষয়গত হয়ে উঠেছে; বিচ্ছিন্নকৃত বিষয়ীকে গিলে নিয়েছে তার বিচ্ছিন্নকৃত অস্তিত্ব।১০
বিষয়গতভাবে বিচ্ছিন্নকৃত সম্পর্কগুলোর সঙ্গে একীভূত হয়ে যাওয়া মানুষদের বিষয়ীগত সন্তুষ্টি হলো, মার্কুস-এর ভাষায়, ‘এমন এক ভ্রান্ত চেতনা যা নিজ ভ্রান্তি সম্পর্কে সম্পূর্ণ অচেতন।’১১ তার মধ্য দিয়ে অবশ্য বিচ্ছিন্নতার তত্ত্ব বিচ্ছিন্নতাকে যেনবা অনপনেয় করে তোলে।
তাই মনে হতে পারে যে বিচ্ছিন্নতা-ধারণা এমন এক অভ্রান্ততাবাদী নীতিতত্ত্বের অংশ যা, ব্যাপকার্থে, এই অনুমানের উপর দাঁড়িয়ে থাকে যে মনুষ্যপ্রকৃতির সহজাত একগুচ্ছ বৃত্তি--- যাকে ‘অভিপ্রায়’ বলা যায় এবং যা উপলব্ধ হওয়া কাম্য--- চিহ্নিত করার মধ্য দিয়ে মানুষদের জন্য বিষয়গতভাবে কী ভালো তা নির্ধারণ করে ফেলা যায়। কিন্তু, আধুনিক নৈতিকতার ভিত্তিভূমি ও সমাজের উদারতাবাদী ধারণার মৌলিক প্রতিজ্ঞা যদি এই ধারণা হয় যে ‘প্রতিটি ব্যক্তিমানুষ কীভাবে তার জীবন যাপন করবে তা তার নিজের উপরই ছেড়ে দেওয়া উচিত’১২ এবং প্রতিটি ব্যক্তিমানুষের নিজ জীবন ব্যাখ্যা করার সার্বভৌম ক্ষমতা আছে, তাহলে অভ্রান্ততাবাদী বিষয়গত আদর্শের উপর ভিত্তি করা যেকোনো বিচ্ছিন্নতা-তত্ত্ব যেনবা সেই মৌলিক প্রতিজ্ঞাগুলোকে বর্জন করে অভিভাবকত্ববাদী সবজান্তার চেহারায় হাজির হয়। এই শেষোক্ত প্রবণতাধারীর কাছে (যা হারবার্ট মার্কুস-এর ক্ষেত্রেও সত্য বলে মনে হয়), বিষয়গতভাবে ভালো বা কল্যাণকর এমন কিছু থাকা সম্ভব যা বিষয়ীর করা মূল্যায়নে সেভাবে ধরা দিচ্ছে না। একই সূত্র ধরে, দুর্ভোগের বিষয়ীগত বোধ তৈরি না হলেও কোনো একটি জীবনরূপকে বিচ্ছিন্নকৃত বা ভ্রান্তিসর্বস্ব বলে সমালোচনা করা চলে। কিন্তু, যে অর্থে বিচ্ছিন্নতার আদলটিকে এখানে আঁকা হয়েছে, সেই অর্থে কোনো একজন কি নিজের মধ্যে সে সম্পর্কে কোনো বোধ তৈরি হওয়া ব্যতিরেকেই নিজের থেকে বিচ্ছিন্নকৃত হয়ে যেতে পারে? আমরা কি বলতে পারি যে কোনো একজন তার নিজের আকাঙ্ক্ষা থেকে বিচ্ছিন্নকৃত, ভ্রান্ত (বিচ্ছিন্নকৃত) প্রয়োজন দ্বারা চালিত, বিচ্ছিন্নকৃত এক জীবনরূপে বদ্ধ, যদি সেই ব্যক্তি দাবি করে যে সে ঠিক সেই জীবনটিই যাপন করছে যা সে নিজে চায়? বিচ্ছিন্নতার নিদানের ক্ষেত্রে তাই প্রশ্ন ওঠে যে ব্যক্তিবিশেষের বিষয়ীগত মূল্যায়ন বা পছন্দের বিপরীতে দাঁড়িয়ে তা নাকচ করতে পারে এমন কোনো বিষয়গত রোগনিরূপন-প্রমাণ কি আদৌ হতে পারে?
এ এমন এক উভয়সংকট যা সমাধান করা কঠিন। একদিকে, বিচ্ছিন্নতা-ধারণা (এবং এখানেই অন্যান্য দুর্বলতর সমালোচনাত্মক ধারণার থেকে তা আলাদাও বটে) যে কোনো ব্যক্তিবিশেষের প্রাথমিক মূল্যায়ন ও পছন্দগুলোকে সমালোচনার এমন এক গভীরতর মাত্রার সামনে দাঁড় করায় (বা এক সমালোচক প্রাধিকারের মুখোমুখি দাঁড় করায়) যা সেই ব্যক্তিবিশেষদের নিজেদের নিশ্চিতোক্তির সংশোধনের কাজ করতে পারে। আবার অন্যদিকে, এহেন এক সমালোচনাত্মক সংশোধনের যাথার্থ্য প্রতিপন্ন করা সহজ নয়: ব্যক্তিবিশেষদের মূল্যায়ন ও পছন্দকে নাকচ করে দিতে পারে এমন বিষয়গত সূচক কি কিছু হতে পারে?১৩
এই প্রসঙ্গে প্রায়শই মনুষ্যপ্রকৃতি সম্পর্কে যেসব যুক্তিবিস্তারের আশ্রয় নেওয়া হয়ে থাকে, এমনকি তাদের মধ্যে সবচেয়ে পদ্ধতিগতভাবে পরিশীলিত ‘সূক্ষ্ম’ যুক্তিবিস্তারের ক্ষেত্রেও, এই সমস্যা দেখা দেয় যে মনুষ্যপ্রকৃতি সম্পর্কিত একটি ধারণা থেকে স্বাভাবিকতার মানদণ্ড আহরণ করে তা সর্বজনীন হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার ঝোঁক এসে পড়ে।১৪ যদি এটা ধরেও নেওয়া যায় যে গতানুগতিক অর্থে এমনকিছু আছে যা সমস্ত মানুষে তাদের প্রাকৃতিক জৈব গঠনের কারণে এক, আর যদি মনুষ্যজীবনের সেই সাধারণ মৌলিক পূর্বানুমানগুলো (যেমন, সমস্ত মানুষের বাঁচার জন্য পুষ্টি দরকার বা কিছু আবহাওয়াগত পরিস্থিতি দরকার) থেকে গতানুগতিক অর্থে কিছু সাধারণ কার্যকরী চাহিদার সিদ্ধান্তে পৌঁছানো হয়, তাহলেও এই মৌলিক শর্তাবলী স্রেফ বেঁচে থাকার বাইরে মানুষদের নিজেদের জীবন যাপন করার ক্ষেত্রে খুব কম-ই তাৎপর্য বহন করে। অন্যদিকে, মনুষ্যপ্রকৃতিকে যে মাত্রায় একটি নির্দিষ্ট বিষয়বস্তুর ধারক বলে চিহ্নিত করে (সাংস্কৃতিকভাবে নির্দিষ্ট) কোনো একটি জীবনরূপের প্রাসঙ্গিক করে তোলার চেষ্টা করা হয়, সেই মাত্রাতেই সংশ্লিষ্ট দাবি ও সিদ্ধান্তগুলো আরো বেশি করে বিতর্কযোগ্য ও বিরোধিতাযোগ্য হয়ে উঠতে থাকে। মনুষ্যপ্রকৃতিকে কীভাবে আমরা একটা সংজ্ঞার গণ্ডীতে ধরে ফেলব, যখন অত্যাশ্চর্য নমনীয়তা ও পরিবর্তনশীলতা স্বয়ং মনুষ্যপ্রকৃতির অংশ রূপে প্রতিভাত হয়?১৫ আর মনুষ্যজীবনের বহু বিভিন্ন ও বিচিত্র রূপের মধ্য থেকে কীভাবেই বা কোনো রূপকে প্রকৃতই মনুষ্যপ্রকৃতি-অনুসারী বলে আমরা আলাদা করে নিতে পারি, বিশেষত যখন বিচ্ছিন্নকৃত বলে সমালোচিত নানা জীবনরূপও বহু মানুষদের দ্বারা কোনো না কোনো ভাবে বিকশিত, উপস্থাপিত ও যাপিত হয়ে চলেছে?১৬
বিচ্ছিন্নতা এবং বিষয়ীর সমালোচনা
দ্বিতীয় যে অবস্থান বিচ্ছিন্নতা-সমালোচনাকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করায় বা আগাপাশতলা বাতিল করে তা হলো--- ব্যাপকার্থে বললে--- উত্তর-কাঠামোবাদ এবং তার মধ্যে থাকা বিষয়ীর সমালোচনা। মিশেল ফুকো বিচ্ছিন্নতার বিভিন্ন ধারণা ও তা থেকে মুক্তির ভাবনাকে সরাসরি নিশানা করে আক্রমণ শানান যখন একটি সাক্ষাৎকারে তিনি মন্তব্য করেন:
মুক্তির ধারণা নিয়ে সবসময়ই আমার কোনো না কোনো সন্দেহ থেকে গেছে, কারণ সেই ধারণাকে কোনো পূর্ব-সতর্কতা সহ আলোচনা করা হয় না এবং নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে রেখেও আলোচনা করা হয় না, এই বিপদ থেকেই যায় যে তার মধ্য দিয়ে কেউ আবার এমন এক মনুষ্যপ্রকৃতি বা ভিত্তির কল্পনায় ফিরে যাবে যা কিনা কতিপয় ঐতিহাসিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রক্রিয়ার কারণে লুকিয়ে ফেলা হয়েছে, বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে বা বন্দি করা হয়েছে দমনমূলক কলকৌশলের মধ্যে এবং দমনমূলক কলকৌশলের দ্বারা। এই পূর্বানুমান অনুযায়ী, কেবলমাত্র যা প্রয়োজন তা হলো এইসব দমনমূলক শৃঙ্খলকে ভেঙে ফেলা, আর তাহলেই মানুষ তার আত্মসত্তার সঙ্গে পুনর্মিলিত হয়ে যাবে, নিজ প্রকৃতিকে পুনরাবিষ্কার করবে, নিজ উৎসের স্পর্শ ফিরে পাবে এবং নিজের সঙ্গে একটি পূর্ণাঙ্গ ও সদর্থক সম্পর্ক পুনর্প্রতিষ্ঠা করতে পারবে।১৭
এখানে ফুকো কেবল মনুষ্যপ্রকৃতির প্রতি অপরিহার্যতাবাদী আবেদন-নিবেদনকেই আক্রমণ করছেন না, বিচ্ছিন্নতা-সমালোচনার ভিত্তি হিসেবে কাজ করা বিষয়ীভাবের ধারণাটিকেই পরিহার করছেন। সরাসরি বিচ্ছিন্নতা-তত্ত্বের বিরুদ্ধে নিজেকে দাঁড় করিয়ে ফুকো দাবি করছেন যে (তিনি যাকে বলছেন) দমনের পূর্বানুমান আগে থেকেই ‘ক্ষমতার গণ্ডীর বাইরে’ থাকা এক বিষয়ীর ধারণা করে নেয়, এমন এক বিষয়ী যে কিনা সামাজিক ক্ষমতামণ্ডলীর বাইরে ‘নিজের জন্যই’ অবিচ্ছিন্নকৃতভাবে অস্তিত্বমান, অার সামাজিক ক্ষমতামণ্ডলীই তাকে গঠন করে এবং দমনও করে। এহেন দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে ফুকো যে ‘ক্ষমতার উৎপাদনশীলতা’-র তত্ত্ব প্রস্তাব করছেন, তা মূলগতভাবে প্রশ্ন তুলে দেয় যে ভিতর থেকে বাহির, ‘আপনের-আপন’ থেকে অপর, সমাজগঠন থেকে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, ইত্যাদির মধ্যে ফারাক টানা আদৌ সম্ভব কিনা। আলথুজার-এর ‘বিষয়ীকরণ’ (‘subjectivization’) তত্ত্বের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তিনি ভেবেছেন যে বিষয়ী হলো ‘ক্ষমতা’-র (‘ক্ষমতা’-কে এখানে আর সার্বভৌম ক্ষমতার আদলে ভাবা হচ্ছে না) তরফ থেকে ‘হস্তক্ষেপ’ (‘interpellation’)-এর ফল বা প্রভাব। এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী বলতে হয় যে, বিষয়ী যদি একইসঙ্গে ক্ষমতার নিয়মাবলীর অধীন ও সেই নিয়মাবলী দ্বারাই (একটি আকাঙ্ক্ষাবান ও ক্রিয়াশীল বিষয়ী রূপে) নির্মীত হয়, তাহলে, বিচ্ছিন্নতা-সমালোচনার জন্য প্রয়োজনীয় আত্ম ও অপরের মধ্যে পার্থক্য করা, দমনমুক্ত (বা অবিকৃত) বিষয়ী এবং দমনমূলক (বা বিকৃতকারী) ক্ষমতার মধ্যে পৃথকীকরণ করা আর সম্ভবপর নয়। কোনো স্বশাসিত বিষয়ীর স্বাভাবিকতার মানদণ্ড, যা স্বকর্মের প্রবর্তক হিসেবে তার নিজের কাছে সম্পূর্ণ স্বচ্ছতা নিয়ে হাজির, তা আদৌ হতে পারে কিনা, প্রশ্ন ওঠে সেটা নিয়েও। বিচ্ছিন্নতা-সমালোচনা যেনবা তার মান হারিয়ে বসে, বা, অন্যভাবে বললে, বিচ্ছিন্নতা গঠনপ্রক্রিয়াগত ও অনিবার্য হয়ে ওঠে। জুডিথ বাটলার তাই (স্পষ্টতই বিষন্ন স্বরে) বলে ওঠেন ‘সামাজিকতার মধ্যে নিহিত’ এক অপ্রতিরোধ্য ‘প্রাথমিক ও সূচনামূলক বিচ্ছিন্নতা’-র কথা:
নিজের আপন স্থিতসত্তাতে জুতে থাকার বাসনার কারণেই প্রয়োজন হয়ে ওঠে মূলগতভাবেই যা আপনের-আপন নয় এমন এক অপরদের জগতের কাছে আত্মসমর্পণ (এই আত্মসমর্পণ পরবর্তী কোনো সময়ে গিয়ে ঘটে না, বরং এই আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়েই বাসনাটির উৎপত্তি, রূপ নেওয়া ও সম্ভবপর হয়ে ওঠা ঘটে)। কেবলমাত্র অপরতায় জুতে থাকার মধ্য দিয়েই কেউ নিজের ‘আপন স্থিতসত্তা’-য় জুতে থাকতে পারে। আমরা নিজেরা কখনও তৈরি করি নি এমন সব শব্দবন্ধের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকার কারণে আমরা বিভাগ-নাম, নাম, পরিভাষা ও শ্রেণি-নামগুলোয় একটা মাত্রায় জুতে থাকার মধ্য দিয়ে সামাজিকতার মধ্যে নিহিত এক প্রাথমিক ও সূচনামূলক বিচ্ছিন্নতায় জুতে থাকি।১৮
টীকা
১। এরিক ফ্রম, ‘Zum Gefϋhl der Ohnmacht’, পৃঃ ১৮৯।
২। মাইকেল থিউনিসেন যেভাবে হেগেল-কে ব্যাখ্যা করেছেন, তা অনুযায়ী ‘নিস্পৃহতার সম্পর্ক হলো অবগুন্ঠিত আধিপত্যের সম্পর্ক’। (থিউনিসেন, Sein und Schein, পৃঃ ৩৬২-র পাদটীকা)। লোহমান এই প্রস্তাবটিকে তাঁর মার্কস-আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত করেছেন: লোহমান, Indifferenz und Gesselschaft.
৩। ব্রুডনি, Marx’s Attempt to Leave Philosophy, পৃঃ ৩৮৯।
৪। উড, Karl Marx, পৃঃ ৩।
৫। হোন্ডেরিখ, ‘Alienation’, পৃঃ ২১ দ্রষ্টব্য।
৬। উদাহরণস্বরূপ, রিচার্ড বার্নস্টাইন ঠিক এই অস্পষ্টতাটিকেই মার্কস-এর বিচ্ছিন্নতা-তত্ত্বের জোর ও সম্ভাবনার দিক বলে মনে করেছেন, যা হেগেল-কে অনুসরণ করে ‘যা আছে’ এবং ‘যা হওয়া উচিত’ তার মধ্যের দ্বিধাবিভক্তিকে অতিক্রম করতে চেয়েছে: ‘মার্কস তাঁর নিজস্ব ধরনে ‘প্রদত্ত-এর অতিকথা’-কে আক্রমণ করছেন--- আক্রমণ করছেন এই ধারণাকে যে যা আশু অর্থে আমাদের জ্ঞানে প্রদত্ত এবং যা আমাদের দ্বারা নির্মীত, অনুমিত বা ব্যাখ্যাত, তার মধ্যে স্পষ্ট প্রভেদরেখা টানা যায়।’ বার্নস্টাইন, Praxis and Action, পৃঃ ৭২।
৭। উইলিয়ামস, Ethics and the Limits of Philosophy দ্রষ্টব্য। উইলিয়ামস তথ্য ও মূল্যবোধের মধ্যে ফারাক অতিক্রম করার অভিপ্রায়ে হাজির করা তাঁর প্রস্তাবগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে এই গাঢ় ধারণাগুলোকে নিয়ে আলোচনা করেছেন (পৃঃ ১২৯, ১৪৩ ও অন্যত্র)।
৮। ফুর্থ, Phänomenologie der Enttäuschungen, পৃঃ ৪৫।
৯। জ্ঞানতাত্ত্বিক ভাঙন (epistemological break) সংক্রান্ত আলথুজার-এর তত্ত্ব দ্রষ্টব্য।
১০। হারবার্ট মার্কুস, One-Dimensional Man, পৃঃ ১১।
১১। হারবার্ট মার্কুস, One-Dimensional Man, পৃঃ ১২।
১২। তুগেনধাত, ‘Antike und Moderne Ethik’, পৃঃ ৪৬।
১৩। জীবনের গুণগত মান সংক্রান্ত বিষয়ীগত ও বিষয়গত সূচক সম্পর্কিত আলোচনার সারসংক্ষেপের জন্য দ্রষ্টব্য: গোসপাথ ও ইয়েগ্গি, ‘Standards der Lebenspualität’।
১৪। সম্ভবত এই অবস্থানের সবচেয়ে বিশিষ্ট প্রস্তাবক হলেন মার্থা নসবম। দ্রষ্টব্য: মার্থা নসবম, Creating Capabilities ও অন্যান্য।
১৫। মার্কস আমাদের নিজেকে পরিবর্তন করা এবং আমাদের জগতকে পরিবর্তন করার সক্ষমতার কারণে মনুষ্যপ্রকৃতির ইতিহাসবদ্ধতাকে স্পষ্টতই খেয়াল করেছিলেন। এই কারণেই, মার্কস-এর সামাজিক দর্শন অভ্রান্ততাবাদী কিনা, সেই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া প্রথমে যা মনে হয়, তার চেয়ে অনেক বেশি কঠিন।
১৬। মনুষ্যপ্রকৃতি সম্পর্কে কোনো তত্ত্বকে প্রোথিত করা যায় কিনা এবং তার মধ্য দিয়ে সামাজিক দর্শনকে একটি ‘নৃতাত্ত্বিক’ ভিত্তির উপর দাঁড় করানো যায় কিনা, এই অমীমাংসিত ও সর্বদা প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন নিয়ে আমি সিদ্ধান্তমূলক কিছু বলতে চাই না। আমার ভাবনার পথ অন্যদিকে। সামাজিক দর্শন প্রোথিত করার বিভিন্ন বিকল্প নিয়ে আলোচনার জন্য দ্রষ্টব্য: হনেথ, ‘Pathologies of the Social’, পৃঃ ৩-৪৮।
১৭। মিশেল ফুকো, ‘The Ethics of the Concern for Self’, পৃঃ ২৮২।
১৮। জুডিথ বাটলার, The Psychic Life of Power, পৃঃ ২৮।
৪
নিজেকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখা: বিচ্ছিন্নতা ধারণাটির পুনর্নির্মাণ
আমার নিজের দাবি হলো এই যে আজকের দিনে বিচ্ছিন্নতার সমালোচনাকে আর কড়া অাবশ্যকতাবাদী বা আধিবিদ্যক পূর্বানুমানসমূহের উপর দাঁড় করানো যায় না, আর তা করার কোনো দরকারও নেই।১ তাছাড়া, সেই সমালোচনার পরিপূর্ণতাবাদী বা পিতৃতান্ত্রিক যুক্তির উপর ভরসা করারও কোনো দায় বা দরকার নেই। বিচ্ছিন্নতা-সমালোচনার সমৃদ্ধ সামাজিক ও নৈতিক মাত্রাকে তার সঙ্গে প্রায়শই সংযুক্ত হয়ে থাকা নৈর্ব্যক্তিকতাবাদী ব্যাখ্যামূলক নকশা ব্যতিরেকেই বোধ্য করে তোলা যায়। আর, চূড়ান্ত কোনো সুসঙ্গতি বা সমন্বয়ে ফিরে যাওয়ার নিশ্চয়তা, নিজেকে নিজে পুরোপুরি স্বচ্ছভাবে দেখতে পায় এমন কোনো ব্যক্তি-এককের ধারণা, বা আত্ম ও জগতকে পুরোপুরি দেখতে ও নিয়ন্ত্রিত করতে পারার কোনো বিভ্রম--- এর কোনোটার উপর নির্ভর না করেই বিচ্ছিন্নতা-ধারণার সমালোচনাত্মক ক্ষমতাকে কাজে লাগানো সম্ভব।২ বিচ্ছিন্নতার সমস্যাকে দেখার পরিপ্রেক্ষিত তখনই আর আগ্রহোদ্দীপক থাকে না যখন তা আত্মসত্তার সঙ্গে বা জগতের সঙ্গে ব্যক্তিদের এক পূর্বপ্রতিষ্ঠিত সুসঙ্গতি বা মসৃণ ‘একত্ব’-কে পূর্বধারণা হিসেবে ধরে নেয়; বরং যখন তা এই দরনের সম্পর্কের অনুমানগুলোকে বিরোধমুক্ত বলে ধরে না নিয়ে ক্রমাগত প্রশ্ন করতে থাকে তখনই তা ফলদায়ক হয়ে ওঠে। নিজের জীবন যাপন করার মধ্যে হাজির হতে থাকা ব্যাঘাত-বিশৃঙ্খলাগুলোর উৎসের উপর মনোনিবেশ করে তা আত্ম ও জগতের সঙ্গে সফলভাবে সম্পর্কস্থাপনের শর্তগুলোকে চিহ্নিত করে দিতে থাকে এবং তুলনামূলক জবরজঙহীন কিন্তু আধেয়পূর্ণ ভাষায় তা হাজির করাও সম্ভবপর হয়ে ওঠে।
তখন এমন দাঁড়াতে পারে যে বিচ্ছিন্নতা-ধারণার কাজই হলো বিভিন্ন অতৃপ্তিকর বিকল্পের মধ্যে মধ্যস্থতা করা, যেমন: নৈতিক বিষয়ীবাদ ও বৈষয়িকতাবাদের মধ্যে, উত্তম জীবন সম্পর্কিত নৈতিক ধারণাবলী সজোরে হাজির করা বা তা করা থেকে বিরত থাকার মধ্যে, স্বয়ংশাসনের ধারণা ত্যাগ করা এবং বিষয়ীকতার ভ্রান্ত ধারণা আঁকড়ে থাকার মধ্যে। সুতরাং, তখন বিচ্ছিন্নতার ধারণা কোনো জোরদার সারগর্ভ নৈতিকতার তত্ত্ব হাজির করতে পারলো কি না তা দিয়ে তার শক্তি বিচার করা হবে না। বরং, তেমন কোনো চূড়ান্ত সারগর্ভ অধিবিদ্যায়-প্রোথিত নৈতিক মূল্যের দোহাই না পেড়েই তা জীবনের বিভিন্ন রূপকাঠামোগুলোর আধেয়কে সমালোচনা করতে পারছে কিনা, সেটাই তার শক্তির পরিচায়ক হবে। এমন কোনো এক বিষয়ী যে কি না একীভূত এবং আগেভাগেই সমস্ত ক্ষমতার অধিকারী, তা পূর্বানুমান হিসেবে ধরে না নিয়েই আত্ম ও জগতের সঙ্গে সম্পর্কিত হওয়ার বিভিন্ন উপায় বিশ্লেষণ করার সম্ভাবনাও সেই ধারণার শক্তি হবে। অবিচ্ছিন্নকৃত জীবনকে তখন আর সুসঙ্গতিতে ফিরে যাওয়া জীবন বলে ধরে নেওয়া হবে না, সুখী জীবন বা উত্তম জীবন বলেও ধরে নেওয়া হবে না। তার পরিবর্তে, নিজে নিজের জীবন অতিবাহিত করার একটি উপায়কে, নিজে নিজেকে উপযোজন করার একটি উপায়কে--- অর্থাৎ, আত্মসত্তা এবং যে সমস্ত সম্পর্কের মাঝে জীবন অতিবাহিত হয় (আত্মসত্তাকে লালন করে ও আদল দেয় যেসব সম্পর্ক) সেইসবের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করার একটি উপায়কে অবিচ্ছিন্নকৃত হওয়া বলে গণ্য করা হবে।
কী নয়, কীভাবে--- অভিপ্রায়ের কার্যকরী ক্ষমতা বিষয়ে তুগেনধাত-এর ধারণা
একটি আধুনিক নৈতিকতার তত্ত্ব দাঁড় করানোর সমস্যা বিষয়ে আর্নস্ট তুগেনধাত যে সমস্ত ভাবনাচিন্তা করেছেন, এখন আমি সেগুলো নিয়ে আলোচনায় ঢুকতে চাই, কারণ আমার মনে হয় যে তা আবশ্যকতাবাদ ও পরিপূর্ণতাবাদের আরোপ কাটিয়ে বিচ্ছিন্নতার তত্ত্বকে পুনর্নির্মাণের কাজে সহায়ক হবে।
সুখ (উত্তম জীবন)-এর প্রকৃতি নিয়ে প্রাচীনকালের অনুসন্ধানকে আধুনিক অবস্থায় আদৌ পুনর্সূত্রায়িত করা সম্ভব কিনা সেই সমস্যা তুগেনধাত তাঁর ‘প্রাচীনকালের ও আধুনিককালের নৈতিকতা’ লেখায় তুলে ধরেছেন। উত্তম জীবন সম্পর্কে যে কোনো আধুনিক অনুসন্ধানকে যেমন একদিকে এই দৃষ্টিভঙ্গিকে বিচারে রাখতে হবে যে তার হাজির করা উত্তরগুলো ‘সংশ্লিষ্টজনেদের স্বশাসন ও সেই সূত্রেই ব্যাখ্যাকারী সার্বভৌমত্ব অস্বীকার করতে পারে না’, তেমনই অন্যদিকে তার পদ্ধতি হতে হবে এমন যা ‘মানুষের কোনো নির্দিষ্ট প্রতিপাদন-অসাধ্য ছবি’-র প্রতি নিজ আনুগত্য না ঘোষণা করে বসে।৩ আবার অপর দিকে, আধুনিক নৈতিকতার তত্ত্বকে যদি প্রাচীন নৈতিকতার ব্যাখ্যাকারী আধেয় পুনরুদ্ধার করতে হয়, তাহলে তাকে এমন এক বিষয়গত নির্ণায়ক চিহ্নিত করতে হবে যা ‘কোনো ব্যক্তির বর্তমানে বা ভবিষ্যতে ভালো থাকার বাস্তব অনুভূতি নিরপেক্ষ ভাবে তার ভালো বা খারাপ থাকার’ একটা নির্ধারণ হাজির করতে পারে। সুতরাং, এমন নির্ণায়ক দরকার যা কোনো ব্যক্তির আকাঙ্ক্ষা বা পছন্দের লেজুড়বৃত্তি করবে না, আবার অন্যদিকে সেই ব্যক্তির ব্যাখ্যাকার হিসেবে সার্বভৌমত্ব এবং আত্মনির্ধারণের আধুনিক আদর্শকেও নাকচ করবে না। এখানে তুগেনধাত যে সমাধান হাজির করেছেন, তা হলো: মনস্তাত্ত্বিক স্বাস্থ্যের একটি আকারগত ধারণা বিকশিত করা। তিনি শুরু করেছেন তাঁর বিবেচনায় সমস্যাহীন এক সংজ্ঞা থেকে, যা হলো ‘কার্যকরী সক্ষমতা’-র সাপেক্ষে শারীরিক স্বাস্থ্যের েকটি সংজ্ঞা। সেই সংজ্ঞা থেকে শুরু করে তিনি মনস্তাত্ত্বিক স্বাস্থ্য বলতে ‘অভিপ্রায় করার কার্যকরী সক্ষমতা’-র একটি ধারণা তৈরি করেছেন, এবং তা ব্যাহত হওয়ার সম্ভাবনাগুলোকে নিয়েও আলোচনা করেছেন।৪ তাঁর নির্ধারিত এই নির্ণায়ককে তুগেনধাত বাধ্যতাপীড়িত আচরণের একটি উদাহরণের সাহায্যে বিশদ করেছেন: বাধ্যতা দ্বারাই যে অভিপ্রায় চালিত তা ব্যাহত বলে বলা যায়, আর সেই সূত্রেই তার কার্যকরী সক্ষমতাও বিঘ্নিত। এর মধ্য দিয়ে এমন এক দৃষ্টিকোণ হাজির হয় যা একদিকে যেমন বিষয়ীর অভিপ্রায়ের মধ্যে অন্তর্নিহিত, অন্যদিকে আবার অনিশ্চিত অমূল্যায়িত পছন্দ যে অর্থে বিষয়ীগত সে অর্থে তা বিষয়ীগত নয়। ‘এইভাবে আমরা আমাদের কাম্য সেই দৃষ্টিকোণে পৌঁছতে পারি যা আমাদের অভিপ্রায়ের বিষয়ীগত লক্ষ্যের উপর নির্ভরশীল না হয়েও অভিপ্রায় করার পরিপ্রেক্ষিত থেকেই নিজ অধিকার/ক্ষমতা আহরণ করে। অভিপ্রায়কারী (পছন্দ করে নেওয়ার স্বাধীনতা যার আছে) প্রাণী হিসেবে সবসময় আমরা মুক্তভাবে বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রটাকে সীমাহীন করে তুলতে চাই।’৫ ‘অভিপ্রায় করার কার্যকরী সক্ষমতা ব্যাহত’ হচ্ছে কিনা তার মাপকাঠি প্রশ্ন করে যে আমাদের অভিপ্রায় করাটা আমাদের নিজেদের নিয়ন্ত্রণেই রয়েছে কিনা। এই মাপকাঠি হাজির করার মধ্য দিয়ে তুগেনধাত বিষয়ীগত ও বিষয়গত অবস্থানের মাঝামাঝি একটা জায়গাকে খুঁজে নিয়েছেন। সেই জায়গাটিকে কেউ ‘সীমায়িত বিষয়ীবাদ’-ও বলতে পারে।৬
আধুনিক পিতৃত্ববাদ-বিরোধিতা এবং আরো সারগর্ভ নৈতিকতা তত্ত্বের মধ্যের বিরোধ অতিক্রম করার জন্য একটি শুরুর বিন্দু আমরা এখান থেকে পাই: কী আমার জন্য ভালো তা কি সবসময় (পিতৃত্ববাদ-বিরোধিতার দিক থেকে) আমার ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গির উপর নির্ভর করে, আমি বস্তুত তা চাই কি না তার উপরেই নির্ভর করে? এই দৃষ্টিভঙ্গিকে অবশ্য এভাবে সীমায়িত করে নিতে হবে যে, যে ইচ্ছা ব্যক্ত হচ্ছে, তা ‘প্রকৃত ইচ্ছা’ হতে হবে, ভিতরের কোনো বাধ্যতার অধীন হলে হবে না। আমার সেই ইচ্ছায় আমায় স্বাধীন হতে হবে; নিজের অভিপ্রায়ের উপর আমার নিজের নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে, তবেই তাকে আমার নিজের ইচ্ছা বলা যাবে। প্রথমত, এই নির্ণায়কটি আকারগত চরিত্রের: তা অভিপ্রায় করার ক্রিয়াটির কীভাবে সংক্রান্ত প্রশ্ন তোলে, কী সংক্রান্ত প্রশ্ন নয়। অর্থাৎ, কোনো নির্দিষ্ট কিছুর প্রতি অভিপ্রায় ব্যক্ত আমি না-ই করতে পারি, বরং, আমি যে অভিপ্রায় করছি তা যেন স্বাধীন ও আত্মনিয়ন্ত্রিত ভাবে করতে পারি। তাই কোনো ‘প্রকৃত অভিপ্রায়ের বস্তু’ চিহ্নিত করার প্রয়োজন হচ্ছে না, বরং, প্রয়োজন হচ্ছে নিজের সত্তার সঙ্গে, নিজের অভিপ্রায়ের সঙ্গে, অভিপ্রেত বস্তুর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হওয়ার এক বিশেষ ধরন। তুগেনধাত-এর কথায়, ‘আমরা প্রকৃতই কী অভিপ্রায় করি, তা আমাদের অভিপ্রায়ের লক্ষ্যবস্তুর উপর নির্ভর করে না, বরং কীভাবে অভিপ্রায় করছি তার উপর নির্ভর করে।’৭ দ্বিতীয়ত, এই নির্ণায়কটি অভ্যন্তরীণ: অভিপ্রায় করা ক্রিয়ার কার্যকরী সক্ষমতা, স্বয়ং সেই ক্রিয়ার দ্বারা উপস্থাপিত দাবি হলো এই নির্ণায়ক। যখন আমি বলি, ‘আমার যা অভিপ্রায় তা করতে যেন আমি সক্ষম হই’, তখন তার মধ্যে নিশ্চয়ই এই কথাটিও থাকে যে ‘স্বাধীনভাবে অভিপ্রায় করার সক্ষমতা আমার চাই।’
বিচ্ছিন্নতার সমস্যার যে বর্ণনা আমি দিয়েছি, তাকে এই অভিপ্রায় করার ধারণার সঙ্গে এভাবে সংযুক্ত করা যেতে পারে: বিচ্ছিন্নতার উদাহরণগুলোকে স্ব-ইচ্ছার সামনে বাধা বিসেবে বোঝা যেতে পারে, আর সেই সূত্রেই, আরো ব্যাপকতায় সাধারণভাবে ধরলে, আত্ম এ বিশ্বের সঙ্গে ব্যক্তিদের সম্পর্কগুলোর মধ্যে বাধা রূপে ধরা যেতে পারে। নিজে নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকার যে ধারণা তুগেনধাত হাজির করেছেন, তার সাহায্যে বিচ্ছিন্নতার উদাহরণগুলোকে আসলে আত্ম ও বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্কস্থাপনের ব্যাহত রূপ বলে পুনর্বিবেচনা করা যেতে পারে। এইভাবে, বিচ্ছিন্নতার সমস্যাটি স্বাধীনতার সমস্যার সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে যায়।
স্বাধীনতা ও বিচ্ছিন্নতা
বিচ্ছিন্নতাকে স্বাধীনতাহানির এক বিশেষ রূপ বলে গণ্য করা যায় বলে আমার ধারণা। ইসাইয়া বার্লিন যাকে সদর্থক স্বাধীনতা বলে চিহ্নিত করেছেন, তার সামনে বাধাস্বরূপ এই বিচ্ছিন্নতা।৮ স্বাধীনতাকে এইভাবে চিহ্নিত করার অতি বিতর্কিত প্রসঙ্গটিকে যথাসম্ভব সংক্ষেপে উপস্থাপনা করতে গেলে বলতে হয়, এই অর্থে চিহ্নিত স্বাধীনতা বাইরে থেকে কাজ করা জোর-জবরদস্তির অনুপস্থিতির কথা (কেবলমাত্র নঙর্থকভাবে) বলে না, বরং (সদর্থকভাবে) মূল্যবান লক্ষ্য বাস্তবায়িত করার সক্ষমতার কথা বলে। যেভাবে ইসাইয়া বার্লিন তা বর্ণনা (এবং সমালোচনাও) করেছেন, সেই অর্থে সদর্থক স্বাধীনতা বিবিধ তাৎপর্য নিয়ে হাজির হয়:
কোনো একজন ব্যক্তি মানুষের নিজেই নিজের প্রভু হওয়ার আকাঙ্ক্ষা থেকেই ‘স্বাধীনতা’ শব্দটির সদর্থক অর্থ উদ্ভূত হয়। আমি আকাঙ্ক্ষা করতে থাকি যে আমার জীবন ও সব সিদ্ধান্ত আমার উপরই নির্ভর করবে, আমার বাইরে থেকে কাজ করা কোনো বলের উপর নির্ভর করবে না। আমি যেন আমার নিজের হাতেই চালিত হই, অপর কোনো মানুষের অভিপ্রায় দ্বারা যেন চালিত না হই। আমার আকাঙ্ক্ষা যে আমি বিষয়ী হবো, বিষয় নয়; আমার নিজের যুক্তি ও সচেতন উদ্দেশ্যই আমাকে চালনা করবে, বাইরে থেকে প্রভাব-খাটানো কোনো হেতু আমাকে চালনা করতে পারবে না। আমি একজন কেউ হয়ে উঠতে চাই, কোনো কেউ না হয়ে থাকতে চাই না। আমি নিজে ক্রিয়ার কর্তা হতে চাই--- নিজের সিদ্ধান্ত যেন নিজেই নিতে পারি, অপরের সিদ্ধান্তের মুখ চেয়ে যেন না থাকতে হয়, যেন আত্মনির্দেশিত হতে পারি, বহিঃস্থ প্রকৃতি বা অন্য মানুষজন যেন আমায় বস্তু পশু বা দাসের মতো তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াতে না পারে। নিজের লক্ষ্য ও কর্মপন্থা নিজে নির্ধারণ ও বাস্তবায়ন করতে না পারা মনুষ্যভূমিকা পালনে অক্ষম একজনের মতো যেন আমি বাইরের তাড়নায় না ছুটে মরি।… সর্বোপরি, একজন চিন্তাকারী অভিপ্রায়কারী সক্রিয় প্রাণী হিসেবে আমি নিজের সম্পর্কে সচেতন হতে চাই, নিজের পছন্দের দায় নিজেই নিতে চাই এবং তা নিজের ধারণা ও উদ্দেশ্য অনুযায়ী ব্যাখ্যা করতে পারতেও চাই। যে মাত্রায় এসব কিছু হয়ে উঠেছে বলে আমি বোধ করি, সে মাত্রাতেই আমি নিজেকে স্বাধীন বলে অনুভব করি, আর যে মাত্রায় তা হয়ে ওঠে না, সে মাত্রাতেই আমি দাসত্ববন্ধন অনুভব করি।৯
সদর্থক স্বাধীনতার এই বিভিন্ন মাত্রা যতোই অপ্রণালীবদ্ধ ও অনিরুপিত হোক না কেন, গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো এই যে সদর্থক স্বাধীনতার ধারণাগুলো সবসময় স্বাধীন জীবনকে অবিচ্ছিন্নকৃত জীবন এবং অবিচ্ছিন্নকৃত জীবনকে স্বাধীন জীবন বলে গণ্য করে।১০ রবার্ট পিপিন যেমন বলেছেন, কেবলমাত্র তেমন কাজ ও অভিপ্রায় যেগুলোকে আমি ‘আমার কারণে ঘটিত বা আমার বলে নিজের সঙ্গে… যুক্ত করতে পারি’ সেগুলোই হলো ‘স্বাধীনতার উদাহরণ’।১১ এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে, নিছক একটা বস্তু না হয়ে মনুষ্যপ্রাণী হওয়ার অর্থ হলো নিজের অভিপ্রায় ও কাজের উৎস হিসেবে নিজেকে চিহ্নিত করা, তার দায় নিজে নেওয়া আর (সেই সূত্রেই) তার মধ্যে নিজেকে দেখতে পাওয়া।
বিচ্ছিন্নতার ধারণাটিকে এভাবে বুঝলে, তা নিজের স্বতঃক্রিয়া ও আকাঙ্ক্ষাগুলোকে (বা, আরো সাধারণভাবে বললে, নিজের জীবনকে) নিজের আত্মসত্তার সঙ্গে ‘সংযুক্ত করার’ বিষয় হয়ে ওঠে, সেগুলো ‘নিজ আত্মসত্তার কারণেই উদ্ভূত’ বলে গণ্য করার বিষয় হয়ে ওঠে, বা সেগুলোকে ‘নিজের আপনার’ করে নেওয়ার বিষয় হয়ে ওঠে। আর এইসব সম্পর্কগুলোকে প্রভাবিত করতে থাকা বিবিধ বাধাবিপত্তিগুলো নিয়ে তা ভাবতে শুরু করে। একজন ব্যক্তিমানুষ সবসময় ‘আত্মসত্তার সঙ্গে যুক্ত’ ভাবে থাকে না, শুরু থেকেই নিজের ক্রিয়া ও আকাঙ্ক্ষাগুলো সবসময় নিজের আপনার হয়ে ওঠে না, আর চারপাশের প্রাকৃতিক ও সামাজিক জগতের সঙ্গে নিজের সম্পর্কগুলোও সমপরিমাণে ব্যবস্থাপক ও আক্রান্ত রূপ নিতে থাকে। সদর্থক সূত্রায়নের মধ্য দিয়ে বিচ্ছিন্নতার বিভিন্ন মাত্রাগুলোর স্পষ্টীকরণ আমাদের নিজেদের জীবনকে নিজের আপনার করে তোলার (আর সেই সূত্রেই স্বাধীনভাবে নিজ জীবন যাপন করার) শর্তগুলোকে নির্দিষ্টভাবে অনুধাবন করতে সাহায্য করে। এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী, যথেষ্ট পরিমাণ মূল্য নিরূপিত হয়ে ওঠে যে জীবনে সেটাই অবিচ্ছিন্নকৃত জীবন নয়, বরং যে জীবন একটি নির্দিষ্ট অবিচ্ছিন্নকৃত উপায়ে যাপিত হচ্ছে সেটাই অবিচ্ছিন্নকৃত জীবন। তাই, এখানে বিচ্ছিন্নতা সমালোচনার প্রকল্প আর এই বিশ্বাসের বিরোধিতা করে না যে প্রত্যেকের তার নিজের আপনার জীবন যাপন করতে পারা উচিত। বরঞ্চ, বিচ্ছিন্নতা প্রদানকারী প্রতিবন্ধকতাগুলোর অনুপস্থিতি এবং প্রতিবন্ধকতাহীনভাবে আত্ম ও জগতে উপযোজনের সম্ভাবনা স্বাধীনতা ও আত্মনির্ধারণের একটি পূর্বশর্ত হয়ে ওঠে।
উপযোজন-সম্পর্কের বাধাপ্রাপ্ত রূপ হিসেবে বিচ্ছিন্নতা
এইভাবে তাহলে নিজের জীবনকে নিজে উপযোজন করার উপায়গুলোই হয়ে ওঠে স্বাধীনতা ও বিচ্ছিন্নতা এই দুইয়ের সমস্যাঞ্চলে ভাবনার কেন্দ্রীয় বিষয়। আত্মসত্তার সঙ্গে এবং জগতের সঙ্গে সম্পর্কগুলো প্রতিষ্ঠা করার উপায়, আত্মসত্তা ও জগতের সঙ্গে মোকাবিলা করার উপায়, আর, আত্মসত্তা ও জগতকে নিজ নিয়ন্ত্রণে পাওয়ার উপায়--- এইগুলোকে ঘিরেই উপযোজনের ধারণার প্রসার। এহেন সম্পর্কক্ষেত্রে বাধা বা বিঘ্ন হিসেবে হাজির হওয়া বিচ্ছিন্নতা মানে: বিবিধ সেইসব উপায় যার মধ্য দিয়ে আত্মসত্তা ও জগতের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে ওঠা ঘটে, অর্থাৎ উপযোজনের যে প্রক্রিয়া, তা বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে কিনা, বা, ভেঙে পড়ছে কিনা সেই বিচার। তুগেনধাত যেমন উত্তমকে আকারগত রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন, সেভাবেই বিচ্ছিন্নতা নামক প্রতীতিটির বিশ্লেষণ মনোযোগ নিবদ্ধ করে কীভাবে আত্ম ও জগতের সঙগে সম্পর্কিত হয়ে ওঠার প্রক্রিয়াটি নির্বাহিত হচ্ছে তার উপর, অভিপ্রায় করার ক্রিয়াটি কী অর্জন করতে প্রয়াসী তার উপর এখানে মনোযোগ কেন্দ্রীভূত নয়। সুতরাং বিচ্ছিন্নতাকে এখানে বুঝে নেওয়া যায় উপযোজনের ক্রিয়াগুলোর বাধা-বিচ্যুতি (বা, অভাব-বিচ্যুতি-যুক্ত উপযোজন চর্চা) হিসেবে। বিচ্ছিন্নতা কাটিয়ে ওঠা যদি একটি সফল উপযোজন সম্পর্কের মধ্য দিয়েই প্রতিভাত হয়, তাহলে এই সফলতার প্রাকশর্তগুলো নিয়ে অনুসন্ধান চালানোই তো যথেষ্ট, কী আর প্রয়োজন পড়ে থাকে সেই সম্পর্কের মাথায় এক উদ্দেশ্যবাদী তত্ত্বের গুরুঠাকুর বসানোর বা সম্পূর্ণ পরিণামে পৌঁছানোর কোনো প্রত্যাভূতি তৈরি করার? আর সেইসঙ্গেই এমন বাধ্যবাধকতাগুলোও আর থাকে না যে এই প্রক্রিয়াকে বাধ্যবাধকতার সূত্রে বেঁধে বুঝতে হবে, বা এমন কোনো অন্তঃসারের পুনরুদ্ধার হিসেবে বুঝতে হবে যে অন্তঃসার প্রক্রিয়া-শুরু-র পূর্বেই সংজ্ঞায়িত করে স্থিরীকৃত করে দেওয়া হয়েছিলো।
উপযোজন ক্রিয়ার বাধা-বিচ্যুতির উপর মনোযোগ নিবদ্ধ করার কিছু গুরুত্বপূর্ণ ফলশ্রুতি আছে যা আরেকবার আমাদের প্রারম্ভিক উদাহরণগুলোয় ফিরে গেলে বোঝা যাবে। একজন ‘সম্পূর্ণ মানুষ’-এর নিজ অন্তঃসারের সাপেক্ষে কী কী সক্ষমতা বিকশিত করা উচিত তা সংজ্ঞায়িত করতে বসার বদলে বিচ্ছিন্নতার বিশ্লেষণ যদি স্বার্থ ও সক্ষমতার বিকাশপ্রক্রিয়ায় ঘটতে থাকা বাধা-বিচ্যুতিগুলোর উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে, তাহলে, মেকি বিচ্ছিন্নকৃত আকাঙ্ক্ষার থেকে আসল আকাঙ্ক্ষাকে আলাদা করার গুলিয়ে-যাওয়া কূটাভাসের আবর্তে না ঘুরে বিচ্ছিন্নতার তত্ত্ব অভিপ্রায় মূর্তায়ন ও আকাঙ্ক্ষা দানা বাঁধার বিভিন্ন উপায় ও পরিস্থিতিকে বিশ্লেষণ করতে পারে। আর, তখন, নৈতিক ও সামাজিক জীবনের (Sittlichkeit) সারগর্ভ আদর্শের ছাঁচে সামাজিক সম্পর্ককে পুনর্নির্মাণ করার বদলে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে সেই পরিস্থিতিগুলোকে বোঝা যে পরিস্থিতির অধীনে সামাজিক চর্চাগুলো নির্বাহিত ও কাঠামোকৃত হয়ে চলেছে।
উপযোজনের সম্পর্কগুলোর উপর মনোযোগী পন্থার জন্য গুরুত্বপূর্ণ কিছু সূচক হলো:
উপযোজন
কোনো কিছু উপযোজন করা মানে কী?১২ উপযোজনের ধারণাটা যদি আত্ম ও জগতের মধ্যে বা ব্যক্তি এবং বস্তুর মধ্যে (সে বস্তু আধ্যাত্মিক বা জাগতিক যা-ই হোক না কেন) কোনো একটি নির্দিষ্ট সম্পর্ককে বোঝায়, তাহলে সেই সম্পর্কটির চেহারা কী রকম, তার নির্দিষ্ট চরিত্র এবং কাঠামোই বা কী রকম? বিবিধ দিক এর মধ্যে এসে মেলে, আর সবে মিলে ধারণাটির আবেদন ও সম্ভাবনা গড়ে তোলে। কোনো বিষয় শুধুমাত্র শেখা বলতে যা বোঝায়, তার বিপরীতে উপযোজন বলতে এর উপর জোর দেওয়া হয় যে কোনো কিছুকে কেবল নিষ্ক্রিয়ভাবে গ্রহণ করা হচ্ছে না বরং সক্রিয়ভাবে করে দেখার মধ্য দিয়ে স্বাধীনভাবে আত্মস্থ করা হচ্ছে। কোনো বিষয়ের মধ্যে কেবল তাত্ত্বিক অন্তর্দৃষ্টি লাভের বিপরীতে, মনঃসমীক্ষণের প্রক্রিয়ার সঙ্গে তুলনীয় এই ‘করে দেখা’-র মধ্য দিয়ে কাজ করা উপযোজন-প্রক্রিয়ার তাৎপর্য হচ্ছে এই যে, ব্যক্তি তার জ্ঞানের সঙ্গে মোকাবিলায় নামতে পারে, জ্ঞান তার হাতে থাকা অন্যতম ব্যবহার্য উপায় বৈ আর কিছু নয় এবং প্রকৃতপক্ষে বাস্তবত জ্ঞানের উপর তার নিয়ন্ত্রণ থাকে। আর কোনো ভূমিকাকে উপযোজন করা মানে কেবলমাত্র সেই ভূমিকা পালনে সমর্থ হওয়ার থেকে আরো বেশি কিছু: বলা যায় সেই ভূমিকার সঙ্গে একাত্ম বোধ করাও। যখন কোনোকিছুকে আমরা উপযোজন করি, তখন তা আর আমাদের বাইরের কিছু হয়ে থাকে না। কোনোকিছুকে নিজের আপনার করে নেওয়ার মধ্য দিয়ে তা কোনো একভাবে আমাদের আত্মসত্তার অংশ হয়ে ওঠে। এ যেন কোনো একভাবে উপযোজিত বস্তুর সঙ্গে আত্মসত্তাকে মিশিয়ে দেওয়া, বাহিরের ভিতরে প্রবেশ, আপনার আপন করে নেওয়া বস্তুটির সঙ্গে এক ফলদায়ক ও গঠনমূলক মিথষ্ক্রিয়া। যা উপযোজিত হচ্ছে তা উপযোজন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অপরিবর্তিত থাকে না। তাই, যেমন ধরা যাক, বারোয়ারি পরিসরকে উপযোজন করা মানে কেবল তাদের ব্যবহার করা নয়। সেখানে বা তা দিয়ে আমরা যা করি তার মধ্য দিয়ে সেই পরিসরের উপর একটা ছাপ ফেলি, একটা চিহ্ন দেগে দিই, উপযোজনমূলক ব্যবহারের মধ্য দিয়ে তাদের এমনভাবে রূপান্তরিত করি যাতে তা ব্যবহৃত হওযার মধ্য দিয়ে এক নির্দিষ্ট রূপ ধারণ করে (কেবলমাত্র কায়িক রূপের কথা বলা হচ্ছে না), আর এভাবেই আমরা তাকে আপনার আপন করে তুলি। যদিও এই উপযোজনের ধারণাটির অনেকগুলো শিকড়ের মধ্যে একটা শিকড় সম্পত্তিসম্পর্কের ধারণার মধ্যে প্রোথিত আছে, তবু, নিছক মালিকানার বিপরীতে তা এমন এক বিশেষ প্রক্রিয়াগত গুণের কথা বলে যা কোনো কিছুর উপর আগে অধিকার স্থাপন করার বাস্তব ক্রিয়াটিকে সংঘটিত করে। সেই হিসেবে, উপযোজন হলো অধিকার দখলের একটি বিশেষ উপায়।১৩ কোনোকিছু উপযোজন করার মধ্য দিয়ে ব্যক্তি তার ব্যক্তিগত চিহ্নটিকে তার উপর মুদ্রিত করে দেয়, নিজস্ব গুণ ও প্রবণতা তার মধ্যে পুরে দেয়। এর মানে বলো এই যে, কোনোকিছু আমাদের মালিকানায় থারতে পারে, কিন্তু তাকে আমাদের আপনার আপন করে তোলা হয়তো ঢের বাকি পড়ে রয়েছে।
অতএব বলা যায় যে উপযোজন-সম্পর্কের অনেকগুলো চরিত্রবৈশিষ্ট্য আছে: উপযোজন হলো চর্চার একটি রূপ, জগতের সঙ্গে কার্যকরীভাবে সম্বন্ধিত হয়ে ওঠার একটি উপায়। তা এমন এক ধরনের অন্তর্প্রবেশ, আত্তীকরণ ও অভ্যন্তরীণকরণের কথা বলে যার মধ্য দিয়ে উপযোজিত বস্তুটি একইসঙ্গে পরিবর্তিত, আদলীকৃত ও গঠিত হতে থাকে। এই ভাবনাকাঠামোয় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় (যা মার্কস-এর কাছেও খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিলো) তার এই অন্তর্প্রবেশ ও আত্তীকরণ সূচক কাঠামোর ফল: উপযোজনের সম্পর্ক সর্বদা তার দুইদিকে থাকা দুটি মেরুরই রূপান্তর ঘটাতে ঘটাতে যায়। উপযোজনের প্রক্রিয়ায় উপযোজিত বস্তু ও উপযোজনকারী উভয়েই রূপান্তরিত হয়। অন্তর্ভুক্তিকরণ (উপযোজনমূলক আত্তীকরণ) প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যে নিজের অন্তর্ভুক্ত করে নেয় সে-ও আর অপরিবর্তিত থাকে না। এই বিষয়টিকে গঠনবাদী দিক থেকেও এভাবে দেখা যেতে পারে: যা উপযোজিত হচ্ছে তা উপযোজন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই গঠিত হচ্ছে, যে সূত্র ধরে বলা যায়, যা উপযোজিত হচ্ছে তার অস্তিত্ব উপযোজন প্রক্রিয়া ব্যতিরেকে থাকে না। (কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা অতিপ্রত্যক্ষ, যেমন: জনসমাজের অধিকারভুক্ত না হলে কোনো পরিসরই বারোয়ারী পরিসর নয়, এমনকি সামাজিক ভূমিকারও তখনই অস্তিত্ব আছে যখন তা অনবরত পুনঃপুনঃ উপযোজিত হয়ে চলেছে।)
এর মধ্য দিয়ে এই ধারণাটির সম্ভাবনা ও বিশেষ বৈশিষ্ট্য দৃষ্টিগোচর হয়ে ওঠে: কোনোকিছু উপযোজন করার সম্ভাব্যতা একদিকে যেমন বিষয়ীর ক্ষমতা--- ক্রিয়া করার ক্ষমতা, রূপ দেওয়ার ক্ষমতা, উপযোজিত জগতের উপর নিজ অর্থপূর্ণ মুদ্রাচিহ্ন দেগে দেওয়ার ক্ষমতা--- জানান দেয় (সামাজিক ভূমিকা বা ক্রিয়ার যেকোনো সফল উপযোজন বা তাকে বিস্তৃত করে নিজের জীবনের সঙ্গে সাধারণভাবে উপযোজনমূলক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ব্যক্তি নিজে নিজের জীবনের রচয়িতা হয়ে ওঠে এবং আত্মনির্ধারণের ধারণার কাছাকাছি পৌঁছয়); তেমনই অন্যদিকে এই উপযোজনের প্রক্রিয়া সর্বদা একটি প্রদত্ত, পূর্বঅস্তিত্বমান অন্তর্বস্তুর সঙ্গে বাঁধা, আর সেই সুবাদেই তার এমনন এক স্বাধীন অর্থ ও চলনগতি আছে যা কোনো বিষয়ীর পক্ষেই সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয় (যে কারণে, ধরা যাক, কোনো ভূমিকাকে তখনই উপযোজন করা সম্ভব যখন একটি পূর্বঅস্তিত্বমান ধাঁচা বা আচার-যৌগ হিসেবে তাকে ‘খুঁজে’ পাওয়া যায়, তাকে নতুন করে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে, কিন্তু শূন্য থেকে তাকে উদ্ভাবন করা যায় না। যে সমস্ত দক্ষতা আমরা উপযোজন করে থাকি, সেগুলোও সফলতার শর্তের দ্বারা সীমায়িত, আর, আমাদের নিজেদের জীবনযাপনও এমন নানা পরিবেশ-পরিস্থিতির উপর নির্ভরশীল যাদের উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আমাদের কখনোই থাকে না।)। উপযোজনের ধারণার মধ্যে তাই নানা আগ্রহসঞ্চারী টানাপড়েন কাজ করে: পূর্বপ্রদত্ত বস্তু বনাম সৃজিত বস্তুর টানাপড়েন, প্রদত্ত বস্তুর উপর অধিকার স্থাপন বনাম নবসৃজনের টানাপড়েন, বিষয়ীর সার্বভৌমত্ব বনাম বিষয়ীর নির্ভরশীলতার টানাপড়েন। আর এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্কটি হলো কোনোকিছুর অপরত্ব এবং তা নাগালসীমার মধ্যে থাকা বা না-থাকার সম্পর্ক: উপযোজনের বিষয়গুলো কখনোই পুরোদস্তুর অপর নয়, আবার কখনোই একেবারে আপনার আপন নয়। মাইকেল থিউনিসেন যেমন বলেছেন, ‘যা একন্তই আমার আপনার আপন, তাকে আবার উপযোজন করার কোনো প্রয়োজন তো নেই, আবার যা একান্তই অপর, তাকে উপযোজন করতে আমি কখনোই পারি না।’১৪ এখানে মার্কস-এর সঙ্গে পার্থক্য সূচিত হয়। মার্কস উপযোজনের কথা ভেবেছিলেন পুনঃউপযোজনের একটি ধাঁচা অবলম্বন করে। তার বিপরীতে আমি এখানে উপযোজন ও বিচ্ছিন্নতার যে চলনগতির কথা প্রস্তাব করছি তা উপযোজনের ধারণাটিকেই নতুন করে ভেবে নিতে চায়। এই নতুন করে ভাবার মধ্য দিয়ে তা অপর-কে উপযোজনের ধাঁচার মধ্যে আবার জায়গা করে দিতে চায় এবং সেই ধাঁচার আমূল রূপান্তরকরণের মধ্য দিয়ে উপযোজনের বাধ্যবাধকতাবাদী ধারণার বাইরে বের হতে চায়। সেই সুবাদে উপযোজন এমন এক স্থায়ী রূপান্তর-প্রক্রিয়া হয়ে উঠবে যেখানে উপযোজিত বিষয়টি তার উপযোজনের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই প্রথম সৃষ্ট হচ্ছে, শূন্য থেকে সৃষ্টির (creation ex nihilo) অতিকথার উপর তাকে ভর করতে হচ্ছে না। এমন এক সম্পর্ক যেখানে আমরা কোনোকিছুর সঙ্গে যুগপতভাবে আবদ্ধ, আবার বিযুক্তও বটে; যেখানে উপযোজিত বিষয়টি অপর এবং আপনার আপন উভয়ই বটে--- এভাবে উপযোজনকে বুঝে নেওয়া হলে তার কিছু গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্য উপযোজন-ধারণার সঙ্গে যুক্ত মুক্তি/উত্তরণ ও বিচ্ছিন্নতার ধারণাসমূহের মধ্যেও ফুটে ওঠে। ইতিমধ্যেই যে জগৎ আপনার আপন নয়, তাকে আপনার আপন করে নেওয়া; জগৎ ও নিজের জীবনের উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আছে বলে ধরে নেওয়া থেকে শুরু না করেই জগতকে ও নিজের জীবনকে একটা কাঠামো প্রদান করতে চাওয়া--- এগুলোর মধ্য দিয়েই তখন জগৎ ও আত্মসত্তার সফল উপযোজনের আকাঙ্ক্ষা কাজ করবে।
পুনর্গঠনের পদ্ধতি ও প্রকল্প
এখনও অবধি যে রূপরেখা আমি এঁকেছি, তার ভিত্তিতে বিচ্ছিন্নতা-ধারণাকে পুনর্গঠন করার প্রকল্পের একটি সংক্ষিপ্ত পরিলেখ হাজির করা যায় এভাবে:
১। যে পন্থা আমি অবলম্বন করেছি তার পদ্ধতিগত ও আকারগত অভিমুখ, অর্থাৎ, উপযোজন প্রক্রিয়ার ‘কীভাবে’ প্রশ্নটির উপর অভিনিবেশ করা, তা বিষয়ানুগত্যবাদী নৈতিকতা তত্ত্বের থেকে ছেদের সূচনা করে। উত্তম জীবন সম্পর্কিত একটি কড়া বিষয়ানুগত্যবাদী তত্ত্বের উপর ভর করার বদলে আমার পুনর্গঠনপ্রচেষ্টা ভিত গেঁথেছে এমনকিছু ভাবনার উপর যাকে হয়তো সীমায়িত বিষয়ীভাববাদ বলা যেতে পারে। একদিকে যেমন বিচ্ছিন্নতার নিদানে ব্যক্তিই (তার বিষয়ীগত অবস্থাবলী ও আকাঙ্ক্ষাসমূহ) চূড়ান্ত নির্ণায়কবিন্দু হিসেবে কাজ করছে, অন্যদিকে তেমনই তার প্রাথমিক মূল্যায়নগুলোকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করানোও সম্ভব হচ্ছে।
২। আত্মসত্তা ও জনগোষ্ঠী বিষয়ক বাধ্যবাধকতাবাদী ধারণাগুলোকে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে এহেন ভাবনাগুলো দিয়ে যে কীভাবে অভিপ্রায় করার ক্রিয়া সংঘটিত হয় ও কীভাবে তা বাধাগ্রস্ত বা ব্যাহত হতে পারে। এই প্রতিস্থাপনের মধ্য দিয়ে ‘মানবপ্রকৃতিকে উপলব্ধি করার’ ভাবনার উপর নির্ভরশীল কড়া ধাঁচের বাধ্যবাধকতাবাদী ধারণার থেকে ছেদ ঘটানো হয়েছে। আমাদের বিচার্য বিষয় হলো মানুষের কাজ ও অভিপ্রায়ের অস্তিত্বগত ক্রিয়াসমূহ, আমরা মানুষের কোনো ‘অন্তঃসারগত’ রূপ বিচার করছি না।
৩। এভাবে সূত্রায়িত বিচ্ছিন্নতার নিদান যেহেতু আত্মসত্তা ও জগতের মধ্যে সফল সম্পর্কস্থাপনের ক্ষেত্রে বাধাবিঘ্নের উৎসগুলোকেই তার সূচনাবিন্দু হিসেবে ধরে, তাই তা সর্ব প্রান্তেই অবারিত এবং পুনর্মিলনের কোনো বদ্ধ সুষম ধাঁচার উপর নির্ভরশীল নয়। যদিও এটা বলাই যায় যে বাধাবিঘ্ন ঘটার কথা বললে তো তার পূর্বস্থ কোনো বাধাহীন সফল সংঘটনের কথা পূর্বানুমান করে নেওয়াই হয়, তবু এই ক্ষেত্রে অনুসৃত পন্থা (যা এই সাপেক্ষে ‘নঙর্থকতাসূচক’) তার গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলোয় কোনো এক সফল মানব অস্তিত্বের সদর্থক-আবেদনবহুল ছবি আঁকার ক্ষেত্রে খুবই কুন্ঠিত ও সংযত।
৪। অভিজ্ঞতা ও পরীক্ষানিরীক্ষা-র মতো ধারণাগুলোর উপর জোর ফেলার কারণে এখানে বিচ্ছিন্নতা-সমালোচনা একটি সব-প্রান্ত-অবারিত প্রক্রিয়ার অংশ, যে প্রক্রিয়া চালানো কালেই সাফল্য ও ব্যর্থতার সূচকগুলোকে চিহ্নিত করে বদলে ফেলা সম্ভব। এই দিক থেকে দেখলে, বিচ্ছিন্নতা যতো না কোনো সফল পুনর্মিলিত আদর্শাবস্থা থেকে ‘পতন’, তার থেকে অনেক বেশি পরীক্ষানিরীক্ষাসূচক অস্তিত্বগত নানা প্রক্রিয়ার ব্যাহত হওয়ার বা ভেঙে পড়ার ঘটনা। বিচ্ছিন্নতা-ধারণার এহেন বোঝাবুঝি কী আমাদের ‘আপনার আপন’ তা নিয়ে কোনো পূর্বসিদ্ধান্ত করে নেওয়ার বদলে সবসময় তার সমস্যাগুলোকে বিচার করতে চায়, বা অন্যভাবে বললে, বিচ্ছিন্নতার সম্পর্ক ও সম্পর্কহীনতা উভয়কেই সর্বদা বিরোধের মুখে ফেলে বিচার করতে চাওয়া হয়।
অন্তর্নিহিত সমালোচনা-প্রক্রিয়া ও সাংস্কৃতিক আত্মোপলব্ধি
বিচ্ছিন্নতা-সমালোচনা করার সময় আমরা ঠিক কী ধরনের সমালোচনা-প্রক্রিয়ায় ব্যাপৃত হচ্ছি? আর কোথা থেকেই বা এই প্রক্রিয়া তার মানদণ্ডগুলোকে আহরণ করে?
বিচ্ছিন্নতা-সমালোচনাকে আমরা এক ধরনের অন্তর্নিহিত সমালোচনা হিসেবে বুঝে নিতে পারি। সংক্ষেপে বললে, তা এমন এক সমালোচনা যা বিচার্ষ বিষয়ী বা জীবনরূপকে সেইসব সূচক ধরেই বিচার করে যে সূচকগুলো সেই বিষয়ী বা জীবনরূপই হাজির করেছে বা সেই বিষয়ী বা জীবনরূপের মদ্যেই যেগুলো অন্তর্নিহিত হয়ে আছে। সমালোচনা এবং সমালোচনার বিষয়ের মধ্যে এখানে দুই ধরনের টানাপড়েন সম্ভব। বস্তুগত ও সামাজিক জগৎ এবং তার প্রতিষ্ঠানসমূহের স্তরে বিচ্ছিন্নতা-সমালোচনা কিছু অসঙ্গতিকে চিহ্নিত করে, যেমন: স্বাধীনতার আধুনিক আদর্শগুলোর দাবি এবং তাদের প্রকৃত বাস্তবায়নের মধ্যে অসঙ্গতি, বা অন্যভাবে বললে, (স্বসৃষ্ট) সম্পর্কাদির সাপেক্ষে নিয়ন্ত্রণ বা আদেশচালিত করার আদর্শ ক্ষমতা এবং বাস্তব ক্ষমতাহীনতার মধ্যে অসঙ্গতি। আবার অন্যদিকে, একজন ব্যক্তির নিজ আত্মসত্তার সঙ্গে সম্পর্কের স্তরে আর এক টানাপড়েন কাজ করে। সেই টানাপড়েন হলো: একদিকে বিষয়ীদের (আমাদের নিজেদের বা অন্যদের) দায়পূর্ণ কর্তা রূপে নিরীক্ষা করার সময় যে সব গুণ (বাধ্যতামূলকভাবেও বলা যেতে পারে) তাদের আছে বলে আমরা ধরে নিই, আর অন্যদিকে আত্মসত্তার সঙ্গে বিচ্ছিন্নকৃত সম্পর্কের সঙ্গে সংযুক্তভাবে দায়পূর্ণ কর্তার ভূমিকা পালনের সক্ষমতা যেভাবে ব্যাহত হয়--- এই দুইয়ের মধ্যে টানাপড়েন। ইসাইয়া বার্লিনের করা সদর্থক স্বাধীনতার বর্ণনায় যদি আমরা ফিরে যাই, তাহলে বলা যায়: এই টানাপড়েনের অন্দরে আসলে কাজ করে চলেছে (দায়পূর্ণ, সক্রিয়) মানুষদের গুণ এবং (নিষ্ক্রিয়, ‘অপরের দ্বারা চালিত’) বস্তুর গুণের মধ্যে পার্থক্য। এই পার্থক্য কোনো বাইরের (কর্তার আত্মধারণার বাইরের) সূচক থেকে উৎপন্ন হচ্ছে না, বা, মানবপ্রকৃতি সম্পর্কে কোনো নির্দিষ্ট ছবির উপর ভর করেও টানা হচ্ছে না; বরং এই পার্থক্য (পূর্বে আলোচিত অর্থে) একার্থে নিজেকে একজন ব্যক্তি রূপে বোঝার তাৎপর্যেরই অভ্যন্তরীণ এক বিষয়।
এই পাঠচর্চায় যে সমালোচনাত্মক অনুসন্ধান আমি করতে চেয়েছি, তার পরিধি ও গ্রাহ্যতা নিয়েও প্রশ্ন তুলে দেয় বিচ্ছিন্নতা-ধারণার উপর এই পদ্ধতিগত তত্ত্বচিন্তা। আমার করা দাবি মতো বিচ্ছিন্নতার নিদানকে যদি একটা অন্তর্নিহিত সমালোচনা হিসেবেই দেখা যায়, সেই সমালোচনার পরিধি কতোটাই বা বিস্তৃত হতে পারে যদি, আপাতদৃষ্টিতে যেমনটা মনে হয়, অন্তর্নিহিত হওয়ার কারণেই সর্বদা পরিসরের অংশীদারত্ব আবশ্যক হয়ে পড়ে? এভাবে অন্তর্নিহিত পন্থার পন্থী হলে বিচ্ছিন্নতা-সমালোচনা কতোটা সর্বজনীন হয়ে উঠতে পারে? বিচ্ছিন্নতা-সমালোচনা ইতিহাসগতভাবে ও প্রণালীগতভাবে উভয় বিচারেই যদি আধুনিকতা (স্বাধীনতার আধুনিক ধারণা)-র অভ্যন্তরীণ নানা দ্বন্দ্ব বা ব্যক্তিত্বের অভ্যন্তরীণ নানা সম্ভাব্য টানাপড়েনের দিকে ইঙ্গিত করে থাকে, তাহলে তা কি একটি নির্দিষ্ট নৈতিকতা ও সংস্কৃতির আদলে বাঁধা ‘ব্যক্তি’-র ধারণা এবং ‘স্বাধীনতা’-রও একটি নির্দিষ্ট সংস্কৃতি-প্রভাবিত ব্যাখ্যার উপর নির্ভর করছে না? তখন তাহলে বিচ্ছিন্নতা-সমালোচনা হয়ে ওঠে স্বাধীনতা ও আত্মনির্ধারণের মূল্যবোধকে কেন্দ্রে রেখে গড়ে ওঠা আধুনিক সংস্কৃতির সমালোচনাত্মক মূল্যায়নমূলক আত্ম-ব্যাখ্যার একটি উপাদান।
এই বিচ্ছিন্নতা-সমালোচনার (ও একই সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা নিদানের) ধারণার সাংস্কৃতিক আপেক্ষিকতা নিয়ে আপত্তি তোলা অমূলক নয়। মানবপ্রকৃতি সম্পর্কে একটি লব্ধ ধারণাকে সূচনাবিন্দু করে এগোনো তত্ত্বের সর্বজনীন আধেয়র সঙ্গে তুলনা করলে, আমি যেভাবে বিচ্ছিন্নতা-সমালোচনাকে পুনর্গঠন করেছি, তার পরিধি অত্যন্ত সীমাবদ্ধ বলেই মনে হবে। এমনকি যখন তা অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব বা ব্যর্থতার দিকে ইঙ্গিত করার জন্য গভীর ব্যাখ্যার পদ্ধতি অবলম্বন করে, তখনও তার পরিধি একটি নির্দিষ্ট অংশীদারত্বাধীন জীবনরূপের পরিসরেই সীমায়িত থাকে, সেই আশু পরিপ্রেক্ষিত ছাপিয়ে তা বাইরে বেরোতে পারে না। অবশ্য এখনই খুব পরিষ্কার নয় যে এই আপত্তি কতোটা ওজনদার। এই নিয়ে ভাবতে গিয়ে জোসেফ রাজ-কে অনুসরণ করার প্রলোভনও থেকে যায়, যখন তিনি এসব আপত্তিকে আমল না দিয়ে ব্যক্তিগত স্বশাসনের মূল্য সম্পর্কে দাবি করেছিলেন:
ব্যক্তিগত স্বশাসনের মূল্য একটি জীবন-সত্য। যেহেতু আমরা এমন এক সমাজে বাস করি যার সমাজরূপগুলো বেশ ভালো মাত্রাতেই ব্যক্তিগত পছন্দের উপর নির্ভর করে, আর যেহেতু আমাদের বেছে নেওয়ার জন্য বিকল্পগুলো কী আমাদের সমাজে আছে তা দ্বারা সীমাবদ্ধ, আমরা ঋদ্ধি অর্জন করতে পারি একমাত্র যদি আমরা সফলভাবে স্বশাসিত হতে পারি।১৫
এহেন অন্তর্নিহিত মূল্যবোধের উপর দাঁড়িয়ে থাকা কোনো সমালোচনা-প্রক্রিয়ার বৈধতা তৎসংযুক্ত নির্দিষ্ট জীবনরূপের প্রভাববলয় বাস্তবে কতদূর ছড়িয়ে আছে তার উপরই নির্ভর করে। আর সবসময়ই সেই পরিধি সেসব মূল্যবোধের প্রত্যক্ষ বাস্তব স্বীকৃতির ক্ষেত্রের পরিধির থেকে বড়ো হবে। তাই এই অর্থে অন্তর্নিহিত কোনো সমালোচনা-প্রক্রিয়াকে এভাবেও বুঝে নেওয়া যায় যে তা নির্দিষ্ট জীবনরূপের সঙ্গে বাঁধা চর্চাগুলোর নিহিতার্থ ও পরিণতিগুলোকে খুলে-মেলে ধরে যখন সেই জীবনরূপের অংশীদাররা সেই নিহিতার্থগুলো সম্পর্কে সচেতন না-ও হতে পারে। আর এভাবেও বুঝে নেওয়া যায় যে অন্তর্নিহিত সমালোচনা-প্রক্রিয়া আসলে কোনো একটি জীবনরূপের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বগুলোকে খুলে-মেলে ধরে যাতে তা সেই জীবনরূপ অতিক্রম করে তার বাইরের কিছুর দিকে ইঙ্গিত করতে থাকে।
টীকা
১। ‘আধিবিদ্যক’ শব্দটি আমি এখানে সমকালীন লিখন-অভ্যাসে চালু হয়ে যাওয়া (অবশ্যই সীমাবদ্ধ) নিন্দাসূচক অর্থেই ব্যবহার করেছি। এই অর্থে তা (কখনও কখনও অস্পষ্টভাবে হলেও) এমন কিছু ‘চূড়ান্ত মূল্যবোধ’-এর দিকে নির্দেশ করে যা প্রত্যক্ষ জগতের বিপরীতে অপ্রত্যক্ষ উৎসের সাপেক্ষে নিজ যাথার্থ্য প্রতিপাদন করে থাকে।
২। ‘নিজেকে পুরোপুরি নিজে নিয়ন্ত্রণ করা’ (über sich verfügen können) –এই অভিব্যক্তিটি আর্নস্ট তুগেনধাত-এর কাছ থেকে ধার করা।
৩। আর্নস্ট তুগেনধাত, Antike und Moderne Ethik, পৃঃ ৫০।
৪। আর্নস্ট তুগেনধাত, Antike und Moderne Ethik, পৃঃ ৫৫।
৫। আর্নস্ট তুগেনধাত, Antike und Moderne Ethik।
৬। উদাহরণস্বরূপ: হোলমার স্টেইনফাথ, Orientierung am Guten।
৭। আর্নস্ট তুগেনধাত, Antike und Moderne Ethik, পৃঃ ৫৫ ও তার পরে।
৮। স্টিভেন লিউকস যেভাবে মার্কসের তত্ত্বের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতার ধারণাকে সম্পর্কিত করে দেখেছেন, তা এই পরিপ্রেক্ষিতে তাৎপর্যপূর্ণ: “মার্কস অবশ্যই বহু সংখ্যক দুরবস্থার কারণ হিসেবে পুঁজিবাদকে চিহ্নিত করেছেন, সেই দুরবস্থাগুলোর মধ্যে আছে: শ্রেণি-আধিপত্য ও শ্রেণি-শোষণ, সম্পদ ও শক্তির অপচয়, অযৌক্তিকতা, অদক্ষতা, দারিদ্র্য, অধঃপতন আর দুর্দশা। অবশ্য, ‘বিচ্ছিন্নতা’ পুঁজিবাদের অধীনে প্রকট হয়ে ওঠা সেই দিকগুলোকে চিহ্নিত করে যেগুলো স্বাধীনতাহীনতার জন্ম দেয়, যেগুলোর উচ্ছেদ মানুষের মুক্তি এনে দেবে। অন্য যে দুরবস্থাগুলোর কথা উল্লেখ করেছি, অবশ্যই তা স্বাধীনতাহীনতার সঙ্গে সম্পর্কহীন নয়, কিন্তু বিচ্ছিন্নতাই ‘প্রকৃত স্বাধীনতা’-র পথে মূল বাধাগুলোকে চিহ্নিত করে।” (স্টিভেন লিউকস, Marxism and Morality, পৃঃ ৮০-র পাদটীকা)
৯। ইসাইয়া বার্লিন, Four Essays on Liberty, পৃঃ ১৩১।
১০। রেমন্ড গয়েস, Auffassungen der Freiheit--- এই পরিপ্রেক্ষিতে দ্রষ্টব্য, যেখানে তিনি এই সমস্যাগুলোর সমাধানের দিকে যাওয়ার জন্য একটি শিক্ষণীয় প্রচেষ্টা করেছেন।
১১। রবার্ট পিপপিন, Naturalness and Mindedness, পৃঃ ১৯৪।
১২। লেখার এই অংশে হাজির করা আমার ভাবনাগুলো আমি অন্যত্র বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেছি: রায়েল ইয়েগ্গি, Aneignung braucht Fremdheit।
১৩। এটা সুবিদিত যে জন লক উপযোজনের প্রক্রিয়াটিকে বুঝেছিলেন কোনোকিছুর সঙ্গে ‘নিজের হাতের শ্রম’ মিশে যাওয়ার প্রক্রিয়া হিসেবে এবং তাকেই তিনি মালিকানার বৈধতার ভিত্তি করেছিলেন।
১৪। মাইকেল থিউনিসেন, Produktive Innerlichkeit, পৃঃ ২৩।
১৫। জোসেফ রাজ, The Morality of Freedom, পৃঃ ৩৯৪।
বাংলা তর্জমা- বিপ্লব নায়ক