বাঙালি সত্তা – জাতিরাষ্ট্রের মৌলবাদের কালে তার নিশ্চয়তার অবসান কল্পে একটি অনাগরিক অনৈতিহাসিক আখ্যান প্রচেষ্টা

লিখেছেন:সাদাত মজুমদার
বাঙালি কে? এ প্রশ্ন উৎস সহ মান্য বিবিধ সাংস্কৃতিক ও নৃতাত্ত্বিক কুল লক্ষন মিলিয়ে নির্দিষ্ট ভুগোলে বদ্ধ জাতি নামক পশ্চিম-দত্ত অত্মপরিচিতির মীমাংসার জন্য নয় (যদিও সকল সাংস্কৃতিক ও নৃতাত্ত্বিক বোঝাপড়া পশ্চিম দত্ত, তথাপি সে কারণে নয়)।

বাঙালি কে?                                                         

এ প্রশ্ন উৎস সহ মান্য বিবিধ সাংস্কৃতিক ও নৃতাত্ত্বিক কুল লক্ষন মিলিয়ে নির্দিষ্ট ভুগোলে বদ্ধ জাতি নামক পশ্চিম-দত্ত অত্মপরিচিতির মিমাংসার জন্য নয় (যদিও সকল সাংস্কৃতিক ও নৃতাত্ত্বিক বোঝাপড়া পশ্চিম দত্ত, তথাপি সে কারণে নয়)। সমকালে কর্তিত যে ভুভাগে ভারত নামের জাতি-রাষ্ট্রের আবাস যেথায় প্রচুর অঢেল ভাষা-সংস্কৃতির বাস ও যেথায় উন্নয়ন নামক সর্ব ক্লান্তি ও রোগ হর পশ্চিমা বিশল্যকরণীর ভাগ নিয়ে উহাদের মধ্যে নিত্য দ্বন্দ্ব সে ভূমে বাঙালি পরিচিতিকে নবতর সংহত করে ঐ বিশল্যকরনীর ‘যথাযথ’ ভাগের তরে যুদ্ধে নামার জন্য এ প্রশ্ন নয়। মধ্যযুগ থকে কোম্পানির কাল পেড়িয়ে নাগরিকের ভারতকে আধুনিকতায় মহিত করা সাম্রাজ্যের কাল পর্যন্ত এ প্রশ্নের যত সহজ এবং প্রায় সর্বমান্য উত্তর সুলভ ছিল আজ তা একেবারেই সম্ভব নয়। অবশ্য সাম্রাজ্যের কালেই এহেন উত্তর কালের দংশনে সাতছিরকুট্টি হতে থাকে এবং দেশভাগ নামক ‘মিমাংসা’ পূর্বক দুটি জাতি-রাষ্ট্রের শিতল ছায়া তলে বাঙালির অদ্যাবধি রক্তক্ষরণ অব্যাহত থাকে; এক পাড়ে এক বৃহৎ জাতি-রাষ্ট্রে সর্বভারতীয় হয়ে আত্মবিলপের পথে হেঁটে নিজস্ব সত্তা-সংস্কৃতির বিসর্জনে ও অন্য পাড়ে ধর্ম-ভাইএর হাতে প্রভুত মাশুল দিয়ে ও ভুল শুধরে ‘বাঙালি জাতি’ (যে জাতিত্বের অবলম্বন বলতে বাংলা ভাষ সংস্কৃতি ও তাকে ছাপিয়ে অবাঙালি ইসলাম এখানে ভাষা-অবলম্বনে ‘স্বাধীন’ ভাবে জাতি গঠনের পরম ঊষা লগ্নে চট্টগ্রামের চাকমার দাবি করেছিলে ‘আমরা বাঙ্গালি নই, আমরা চাকমা। ভাষা অবলম্বনে সদ্য স্বাধীন জাতি কাছে এমত অসঙ্গত দাবির জন্য তাঁদের চড়া মূল্য দিতে হয়েছিল যা অতি সাফল্যের সঙ্গে বিস্মৃতির পাতাল-ঘরে চালান করা গেছে কিন্তু তাঁদের তরফে জাতি-রাষ্ট্রের আজও অমোচনীয় মাথা ব্যথ্যা হয়ে থাকা ঠেকান যায়নি) হয়ে ওঠার পথে সে যেন বা আত্মবিলোপে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। ও পাড়ে নির্দিষ্ট ভুগোলে বদ্ধ বিবিধের উপস্থিতিহীন ফলে প্রতিযোগিতা শূণ্য অনিঃশেষ জাতি-রাষ্ট্র গঠন কালে (সাধারণ ভাবে বলা যায়, ভারতীয় উপমহাদেশে জাতি গঠন এক আধুনিক তান্ত্রিক বা কাপালিকের অসুস্থ সাধনা, ফলে সিদ্ধি চির অধরা সুতরাং তান্ত্রিকদের পক্ষে বাধ্যত তা চালিয়েই যেতে হয়) আর এপাড়ে বাঙালির সর্বভারতীয় হয়ে ওঠার আত্মবিলোপকালিন পর্বে দুই পাড়েই সে আত্মপ্রশ্নে নারাজ (যে আত্মপ্রশ্নে রেনেসাঁ কালে বরং সে অনেক বেশী স্বচ্ছল ও অংশত মিমাংসা সফলও বটে) ফলে সে আজ অনেক দিনের দীর্ণ-দল পশ্চিম যাত্রী, মুগ্ধ যথা অরুপ পানে ধায়। ইন্টারনেট কালে ভুগোল যখন ইতিহাস হয়ে গেছে, যখন কাল আর স্থানে বদ্ধ নয়, ব্যক্তি-সত্তা আর কেবলই ভাষ-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নির্মিত নয় এবং ব্যক্তি ও তাঁর গোষ্টীকে জাতি-রাষ্ট্র সহ তাহার বিবিধ সম্পূরক মৌলবাদে জাড়িয়ে ও জড়িয়ে নেওয়ার প্রখর মধ্য দিনে কোন ভাষা-সংস্কৃতির পক্ষেই কি ভূতপূর্ব থেকে যাওয়া সম্ভব নাকি তাকেও বাধ্যত হয়ে উঠতে হয় অ-ভুতপূর্ব? সেই উপনিবেশিক আধুনিকতার আদি পর্ব থেকেই বাঙালি্র পক্ষে আর ভুতপূর্ব থাকা সম্ভব হচ্ছিল না, তার অভুতপূর্ব শঙ্করত্ব প্রাপ্তির শুরু এই পর্বে। অতঃপর পশ্চিমা তন্ত্র সকলের স্ব ও পরনির্ভর গ্রহন বর্জন পূর্বক বর্ণহিন্দুর ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের কাঠামোর মধ্যেই তার জায়মান শঙ্করায়ন শুরু এবং এই আঁধার বিনাশি পর্বই অচিরে নাম পেল ‘বাংলার রেনেসাঁ’ যাহা উহার কাঠামোগত কারণেই মুসলিম ও দলিত উদাসীন, (কখনো বিদ্বেষিও বটে) এবং চেতনার তল্লাট জুড়ে আদিবাসী স্রেফ নেই-হয়ে রইল। উপনিবেশ সৃষ্ট নব নাগরিকের এই আলোকছটার অতি সীমিত বৃত্ত-মধ্য মধ্যবিত্ত যে খণ্ডিত বর্ণ বাঙালি তাই অচিরেই বাঙালির মান্য পরিচিতি ও সত্তার দাবি নিয়ে উপস্থিত হল। স্বাভাবিক ক্রমে ভগ্নাংশের দাপট যাহা কিছুবা উপনিবেশ পুষ্ট কিছুবা স্বসৃষ্ট অচিরাত প্রশ্নবিদ্ধ হতে থাকল – আলোকছটা প্রাপ্ত বর্ণ হিন্দুর কাছে প্রথমত বাঙালি মুসলিমের এবং সাম্রাজ্য আরো সংহত হলে বাঙালি ‘নিম্নবর্ণের’ অমর্যাদা ও উত্থান-অসম্ভবতার কারণে। সকল পক্ষের অনমনিয়তা, পারস্পরিক বোঝাপড়ার অক্ষমতা ক্রমে সকলকে অসেতুসম্ভব দূরত্বে স্থাপন করল উৎসে রইল উপনিবেশের শিক্ষা – জাতি, রাষ্ট্র, উন্নয়ন ও প্রতিনিধিত্ব মূলক গণতন্ত্রের প্রত্যয় যাহা পশ্চিমি, একরোখা একমেটে অদৈত্ব অসহিষ্ণু। এবং এ সকল মান্য মাপকাঠিতেই বাঙালির ভগ্নাংশ সকল নিজেদের গড়েপিঠে নিতে উদ্যোগী হল। ইতিপূর্বে বাঙ্গালির পরিচিতি ও সত্তার অবলম্বন ছিল ভাষা, বিশ্বাস, সংস্কার, গুরুকুলের মত দেশিয় বর্গ এবং এসবের সুত্রে সে অবিচ্ছেদ্দ্য আত্ম ও অপর নিয়ে স্থানে বদ্ধ তথাপি সর্বজনিন, মধ্যযুগীয় তথাপি জায়মান, লৌকিকে মান্যবরাধিন তথাপি বিদ্রহো-সক্ষম, লিখন ও পাঠে অক্ষম তথাপি স্মৃতি-শ্রতিতে অতীত ধারণে ও তার চলিষ্ণু ব্যাখ্যায় সক্ষম। এ সবই ছিল তার জন্মের জড়ুল যাহা পশ্চিমের জাতি ধারণার ছকে আটে না ও পশ্চিমের চশমায় পাঠযোগ্যও নহে। পশ্চিম-মান্যতা ক্রমে তার হাড়ের অন্তর্গত হলে সে ঐ পশ্চিমা জাতি প্রত্যয়ে, যাহা একমাত্রিক পরিচিতির ছকে বদ্ধ, খুঁজে পেলে মুক্তির দিশা সঙ্গে হিন্দু, মুসলমান, অচ্ছুত্য/দলিত বিবিধ পরিচিতির গর্তকে নিজ নিজ আবাস ও সত্তার পরিধি জানল। ঘুচে গেল আত্ম ও অপর নিয়ে তার চির অবিনস্ত প্রাত্যহিক। জাতি হয়ে ওঠার ‘সোজা পথের’ ধাঁধায় সে আজ স্ববশহারা, আত্মপ্রশ্নে নারাজ অথবা অস্বচ্ছল, আবিশ্বের সমসত্ত্ব মধ্যবিত্তের অংশ হয়ে এবং হয়ে উঠতে চেয়ে সে আজ সত্তার শিকড় চ্যুত এবং জাতি-রাষ্ট্র অধ্যুষিত পৃথিবীতে এক পরিপাটি বিশ্ব নাগরিক। এবং কাফের, ম্লেচ্ছ, অচ্ছুত্য নিয়ে এক অদৈত্ব নয় তথাপি অখণ্ড বাঙালি সত্তার হদিশে সে না সচেষ্ট না পড়শিকে না-জানা না-ছোয়ার যম যাতনা তার বোধ-বিশ্বের অন্তর্গত। ও পাড়ে জাতি গঠনে অদৈত্ববাদি হয়ে আর এ পাড়ে এক বৃহৎ জাতি গর্ভে বিলিন হয়ে বাঙালি আজ জাতি-রাষ্ট্রের তরফে যথাক্রমে খাদক ও তার খদ্য। ভিন্ন ভিন্ন পথে জাতি ধারণায় ও জাতি-রাষ্ট্রে উদ্ধারহীন ভাবে জড়িয়ে গিয়ে সে আজ হা-ক্লান্ত সম্পূর্নত সৃজন-অক্ষম। আগে যে বলা হয়েছিল দেশভাগ নামক ‘মিমাংসা’ পূর্বক দুটি জাতি-রাষ্ট্রের শিতল ছায়া তলে তার অদ্যাবধি রক্তক্ষরণ অব্যাহত থাকে – তার কারণ কি তবে জাতি ও আধুনিকতা ও রাষ্ট্রের মিলিত মৌলবাদের কাছে সে স্ব-উদ্দ্যোগে বলি প্রদত্ত? পড়শিকে না-জানা না-ছোয়ার যম যাতনা না হোক, এক অস্পষ্ট অসম্পূর্নতার বোধ তার অন্তঃকরনে সদা বাহিত তথাপি সে অভিষ্টহীন, অস্তিত্বের ভার ও বেদনা রিক্ত, ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার চ্যুত ফলত অন্যন্যোপায় সে আজ অনেক দিনের পশ্চিম ও তার আধুনিকতা সর্বস্ব।

জাতি, রাষ্ট্র ও উহাদের সমমনা সহযোগী বিবিধ মৌলবাদের মধ্য যামিনীতে অদৈত্ব নয় তবে অখণ্ড ও সদা জায়মান বাঙালি সত্তার প্রযোজনিয়তা ও সম্ভাবতার তালাশের হেতু রাজনৈতিক – জাতি, রাষ্ট্র, উহাদের সমমনা সহযোগী বিবিধ মৌলবাদের বাহির দেশে যে হাটখোলা নামের গোষ্টী-উর্দ্ধ মনোভূমি যাহা চিরহরিৎ চির সজল চির উর্ব্বর যাহা যুথের ও এককের তথায় আবাস ও মুক্তি খোঁজার তাগিদ, তেমন হাটখোলাতেই কেবল সকল অপরই আত্মগত অপর ফলে বাধ্যত অবিরত হননের ক্লান্তি ও দুস্থতা ও গ্লানি থেকে মানুষ মুক্তি পায়। এ ক্লান্তি, দুস্থতা, গ্লানি কি কেবলই কালের চহ্নবাহী? এ সকলের সাংস্কৃতিক রাজনৈতিক কুল লক্ষন খানিক সময় ও ভাষা-সাংস্কৃতিক গোষ্টী চিহ্নত খানিক মানব অস্তিত্ত্বের অনিবার্যতা, এক প্রকার নিয়তি, ইতিহাসে উহারা ক্ষনিক ‘সমাধানের’ আশা ছলনা জাগিয়ে আজও চিরজীবি। মানব অস্তিত্ত্বের অনিবার্য যে ক্লান্তি; দুস্থতা, গ্লানি তা মোচনের যজ্ঞ বহু মনিষার হাতে ছেড়ে, কাল ও গোষ্টী চিহ্নিত সকল ক্লান্তি, দুঃস্থতা, গ্লানির সমকালীন কোন বোঝাপড়া, যাহা বাঙালির যাহা বেদনার যাহা বিরহীর যাহা চাতকের যাহা মিলন প্রয়াসীর, গড়ে তোলার এক আখ্যান প্রচেষ্টা যাহা অসম্পূর্ন যাহা জাতি পরিচয়-বদ্ধ নহে যাহা ভাষা-সাংস্কৃতিক সত্তার বহুত্ব চিহ্নিত যাহা অনাগরিক অনৈতিহাসিক প্রাকৃতজনের, যাহা গ্রহিষ্ণু এবং জায়মান। এ পথেই কেবল পশ্চিম-দত্ত জাতি পরিচয়ে অন্তর্গত অনিবার্য হিংসা ও হননের ক্লান্তি, দুঃস্থতা, গ্লানির থেকে উদ্ধার সম্ভব।

 

 

সাম্রাজ্যের তাগিদ ও আধুনিকায়নের পথে    

সিপাহী বিদ্রহো উত্তর রানীর হাতে চলে যাওয়া সুতরাং বাধ্যত ও স্বেচ্ছায় আধুনিকায়নের-পথে-হাঁটা ভারত না-দেখা রামমোহন রায় কোম্পানির কালেই এক অসাধারণ পরিবর্তনকে চিহ্নিত করতে পেরে ছিলেন, ‘From a careful survey and observation of the people and inhabitants of various parts of the country, and in every condition of life. I am of the opinion that the peasants and villagers who reside at a distance from large towns and head stations and courts of law, are as innocent, temperate and moral in their conduct as the people of any country whatsoever; and the further I proceed towards the North and West (away "from British India”), the greater the honesty, simplicity and independence of character I meet with.’ (citied in Ashis Nandy’s The Romance of the State, p-22)। পুরো উপনিবেশ পর্বে রবীন্দ্রনাথ, গান্ধী এবং কতিপয় সাহিত্যিক ছাড়া কেউ এ নব্য সত্য অবধাবন করতে পারেন নি অথবা এমন চরিত্র বদলকেই সমাজপতিরা কাম্য ঠাওরেছিলেন ফলে সাম্রাজ্যের কাম্য ব্যবস্থা ও পরিবর্তন সহযোগি হলেন। ফলে যা দাঁড়াল নিজেদের পরিবর্তনে নাগরিক শিক্ষিতজন ক্ষান্ত হলেন না, এবং তা সম্ভবও ছিলনা; জাতীয়তাবাদের প্রযোজনে সকল ভারতবাসিকে এই পরিবর্তন সহযোগী করে নিতে চাইলেন, সহায় হয়ে ছিল সাম্রাজ্যের প্রশিক্ষন ও তাহার ‘উদারতা’। এ সাধনার প্রাপ্তি হল সাম্রাজ্য দত্ত পরিচয় ভিত্তিক জাতীতাবাদের বিষ বৃক্ষ এবং প্রকাশ থাক পশ্চম-দত্ত জাতি পরিচয়ে নারাজ ভারত-আত্মা আজও শ্রুশষার অপেক্ষায়, অমোচনীয় আশায় অন্তর্জলির ঘাটে শ্বাস লয় – উহার শেষ শ্বাসের আশা তাড়িত হিমবাহী আধুনিকেরা সাক্ষী থাকে ও সাক্ষ্য রাখে। হায়, উহারা জানে না এ আশা মহার্ঘ তথাপি অনার্য্যের, এ আশা নাগরিক শিক্ষিতের তথাপি অসংস্কৃতের, এ আশা বংশগত তথাপি চাষার; চরাচর আজও কুসুমের উষ্ণতা চিহ্নিত প্রাকৃতজনের। এ মত প্রাকৃতজনের সত্তার এক আখ্যান নির্মান এ প্রচেষ্টা।   

উপনিবেশে বাঙালী বর্ণ হিন্দুরাই পশ্চিমা আধুনিকতার সঙ্গ সুধা পানের প্রথম সুযোগ পায় ও দ্বিধা-দ্বন্দ্ব নিয়ে পানও করে তা। আঠারো শতকে কালাপানি পেরোনর নিষিদ্ধতা ও সামাজিক কলঙ্ক উনিশ শতকে এসে শুধু বৈধতা পায় না পরম কাঙ্খিত হয়ে ওঠে যা আজও ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকলে কাছে সব পেয়েছির দেশ। তখন ঠিক সাম্রাজ্যের প্রযোজনে নয়, কোম্পানির লুটের প্রযোজনে চিরস্থায়ী ব্যবস্থার কল্যাণে তার বর্ণ ব্যবস্থার সহায়ক অর্থনীতি ও সামাজিক হেজেমনি পাকাপোক্ত হয়ে যায় সেই ১৭৯৩ থেকেই, এবং এই অসামান্য মধুক্ষরা চিরস্থায়ী ব্যবস্থা কোম্পানি থেকে সাম্রাজ্য পেরিয়ে স্বাধীন ভারতে এসে বদলাল। এই জমিদারি কিন্তু অচিরেই বর্ণহিন্দুকে আত্মরম্ভিতায় ভরা এক কুয়োর ব্যঙ করল, রায়ত-নিংড়ে পাওয়া তার পূঁজি খাটানোর জায়গা বিশেষ কিছু ছিলনা ফলে উপচে পড়া ধন ভোগে ও লালসায় মুক্তি পেল, সঙ্গে অনেকেই শিক্ষা প্রসার ও রেনেসাঁ-কল্পে শ্রম ও অর্থ দান করলেন, তার রেনেসাঁ নামক সামাজিক মন্থন জাত আত্মপ্রশ্ন আত্মপ্রসারনকে, যদিচ এ ছিল অগভীর ও সীমিত, নগর-বৃত্তে আটকে রাখল। যদিও নাগরিক বৃত্তে-বদ্ধ তথাপি এ ঘটনার এক অশেষ তাৎপর্য এই যে পশ্চিমের আধুনিক সাহিত্য, বিজ্ঞান, দর্শন ও  বিবিধ সামাজিক, রাজনৈতিক ধারণা-বিশ্বের সঙ্গে পরিচয় ঘটে এবং এ পরিচয় সাম্রাজ্যের তত্ত্বাবধানে ঘটে ফলে বাঙালির এই পর্বের শঙ্করায়নে পাশ্চাত্যের ভাগ নিরবধি প্রধান হল, প্রাচ্য পরিধিতে এবং কখনো তার বাইরে রয়ে গেল। চিরস্থায়ী ব্যবস্থার বিকট বৈষম্য ও অমর্যাদাকর সামাজিকতা স্বত্বেও ভাষা-সংস্কৃতির আঞ্চলিক এমনকি জেলাগত বৈচিত্র্য ও তৎ জাত স্বাভিমানের ধর্ম ও কিয়দাংশে বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই সমান শরীক, ফলে সামাজিক অবস্থানের তর-তম নিয়েও এক অখণ্ড বাঙালি সত্তার অবকাশ ছিল, অবশ্য সে বাংলা ও বাঙালি নগর-বৃত্তের বাইরে ছিল ফলে রামমোহন কথিত ‘(away "from British India”), the greater the honesty, simplicity and independence of character’ তার চরিত্রের অন্তর্গতও ছিল। তথাপি সর্বাংশে অসাম্প্রদায়িক বাংলার এ পর্ব প্রাকৃতজনের না ছিল সহায়ক না তাঁহাদের নাগালের মধ্যে ঘটে চলা এক কাম্য ঘটনা।

বিপুল ভৌগলিক, কৃষি ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য নিয়ে উপনিবেশ পর্বেই বাঙালি (মূলত নাগরিক বর্ণ হিন্দুরা) আধুনিকতা ও অসাম্প্রদায়িকতাকে পশ্চিমি শিক্ষার সার বলে চিনল যদিও সেসব আয়ত্ব করার স্বদেশী কৃত-কৌশল তাঁর ছিল না। কিন্তু তাঁরও ছিল আত্ম ও অপরকে জড়িয়ে সাংস্কৃতিক সত্তার কয়েক শতকের ঐতিহ্য যাহা আদ্যান্ত ধর্ম সিক্ত তথাপি অসাম্প্রদায়িক। সাম্রাজ্য পোষিত আধুনিকতার অভিঘাতে তাঁর সত্তার এ দেশজ স্ব-ভাব প্রাকৃতজনে সীমাবদ্ধ হল এবং সমাজপতিরা জানল অসাম্প্রদায়িকতা পুঁথি পাঠে আয়ত্ব করতে হয়। তাঁর প্রাত্যহিক ও দেশ ভাবনা পশ্চিমা পুঁথি চালিত হলে স্বাধীনতা আন্দোলনের রাজনৈতিক ভিত্তি বলতে তার পূঁজি হল পশ্চিমের পাঠশালায় শেখা জাতীয়তাবাদ এবং পশ্চিমের তন্ত্র মতে প্রথমত বঙ্গে জাতীয়তাবাদের আখ্যান ব্যখ্যান রচনা করতে গিয়ে সে রাজনৈতিক হিংসা চিনল ও মানল, সঙ্গে ঘরের আত্মগত মুসলিমকে জাতীয়তাবাদের অসহযোগী অপর হিসাবে চিহ্নিত করল, অচিরে জাতীয়তাবাদ ও রাজনৈতিক হিংসার সুত্রে তার এক নব প্রাপ্তি সাম্প্রদায়িকতার উদ্ভব ও প্রসার এই সময়েই ঘটে। বর্ণ হিন্দুর আধিপত্য এবং তার কাছে নিত্য পাওনা অমর্যাদা থেকে মুক্তি খুজতে বাঙালি মুসলিমও ঐ পশ্চিমেরই জাতীয়তাবাদকে শীরধার্য করল, উভয় তরফের যুগ্ম তালে সঙ্গে সাম্রাজ্যের সংগতে উভয় উভয়কে নতুন করে চিনল – উভয় উভয়ের আর আত্মগত অপর নয়, বাইরের অপর যার সঙ্গে সহাবস্থান অসম্ভব যে অসদভাব কালক্রমে প্রাকৃতজনকেও বেশ কিছু দূর সিক্তও করবে; পরিণতিতে অখণ্ড বাঙালি সত্তার গঙ্গা প্রাপ্তি এবং দেশভাগ। একমাত্র ঐতিহাসিক সুশোভন সরকারই ভবিষ্যৎ দ্রষ্টার মতন দেশভাগের প্রশ্নে উৎসাহিত কলকাতায় লিগের ছাত্র নেতাদের সাবধান করে ছিলেন ‘আজ যাদের সঙ্গে যাচ্ছো কাল তাদের বিরুদ্ধে লড়তে হবে’। ’৫২-র ভাষা আন্দোলন সাক্ষী পাঁচবছর লেগেছিল এই সতর্কতা সত্যি হতে। বর্ণ হিন্দুদের এমত চেতাবনি দেবার বা শোনার লোক তখন ছিল না। ধর্মকে একমাত্র পরিচয় করে দেশভাগ বাঙালী সত্তার গভীর ক্ষতি করে যায় যার থেকে জাতি-রাষ্ট্রের হাত ধরে কোন বাংলাই আজও পরিত্রাণ পায়নি এবং অনুমোদিত পরিচয়ে বদ্ধ জাতি-রাষ্ট্রের হাত ধরে তা সম্ভবও নয়। দুপাড়েই এই জাতি-রাষ্ট্রের সাধনায় ক্রমে সে তাঁর ‘...... the honesty, simplicity and independence of character’ হারাতে থাকল।

পূর্ব-প্রস্তুতি-অসম্ভব-দেশভাগ উত্তর এপারে বাঙালী চর্চিত উদাসীনতায়, ওপারে ‘স্বাধীনের’ (’৭১-এর ভারত-সহায় ‘মুক্তিযুদ্ধ’ নামক বাঙালি মুসলিমের {আপামর নয়} জন্য ফলদায়ী ঘটনাকে বা বলা ভাল নিজ নব পাক-ভূমি প্রাপ্তির [যা আবার প্রায় সকল সংখ্যালঘুর জন্য অবর্তমান পাকিস্তানের চলমান বাস্তব হয়ে যাওয়া ছাড়া আর কিছু নয়] অধুনা ওদেশ এ নামেই ডাকা হয়, মুক্তি নামক ঘটনাকে এমত সম্ভো্ধন কি যৌথের নির্জ্ঞানে টিকে থাকা কোন অবমূল্যায়নকে চিহ্নিত করে? তবে তার তাৎপর্য কি এই যে এ সম্ভোধনে তাঁর অনুধারনিয় আত্ম-অবমাননা রয়ে গেল?) পর আত্মঘাতী অপর-আগ্রাসনে (যে অপর বিভাগ উত্তর পাক-পর্বেও ছিল আত্ম-সংলগ্ন অবিচ্ছেদ্য, বাঙালি জাতীয়তাবাদের নামে জতি-রাষ্ট্র গড়তে গিয়ে হিন্দু দমন ও উচ্ছেদে-সাফল্য তাঁকে জানিয়ে গেল বর্ণ নির্বিশেষে হিন্দু মানে হনন যোগ্য অপর। আদ্যান্ত কৃষি নির্ভর একটি ছোট দেশে পশ্চিমের পাঠ মিলিয়ে আধুনিক উন্নয়ন যজ্ঞের সাধনায় নিখাদ দূর্নীতি ও দলনে সিদ্ধ এক নিরঙ্কুশ সমসত্ত্ব ‘জাতি’ হয়ে উঠল, কয়েক শতকের গড়ে ওঠা তাঁর সমন্বয়ি সাংস্কৃতিক সত্তা আধুনিক ইসলামিক সংবিধানের নিজে চাপা পড়ল যদিও তা আজও স্পন্দমান এবং বাঙালি মুসলিম জাতি-রাষ্ট্রের মাথা ব্যথ্যার কারণ) চির পঙ্গুত্বের দিকে যাত্রায় যেন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। পশ্চিমের পাঠশালায় জাতি-রাষ্ট্র, আধুনিকতা ইত্যাদিকার পাঠ নিতে নিতে বর্ণ হিন্দু বাঙালী পশ্চিমের সাপেক্ষে নিজের ‘ক্ষুদ্রতা’, ‘হীনতা’, ‘অযোগ্যতা’ চিনতে শিখেছিল, শিখেছিল ইতিহাস নির্দিষ্ট পুণ্য ধর্ম নিরপেক্ষ জাতি-রাষ্ট্রই তার ভবিতব্য যে শিক্ষা তাঁর অমর হল। এই পশ্চিমা জাতি-রাষ্ট্রের আদর্শকে সামনে রেখে উপনিবেশে প্রস্তুতি পর্বে সে নিজের রাজনৈতিক আত্মতা গঠন করতে গিয়ে নিজের সত্তা থেকে দলিত ও মুসলিমদের বাদ দিয়ে ফেলল। কতিপয় ব্যক্তি বাদে বর্ণ হিন্দু সকল বুঝল না সে আসলে নিজ আধিপত্য কায়েম রাখার জন্য লড়ছে, তার রাজনৈতিক আত্মতা কত দুস্থ ও সঙ্কীর্ণ হয়ে যাচ্ছে, ভাষা-সংস্কৃতি বাবদ তার প্রজন্ম বাহিত আত্মগত অপরকে সে রক্তাক্ত করে চলেছে, তাঁদের বাদ দিচ্ছে। অন্য পক্ষে ঐ একই পাঠশালা থেকে জাতীয়তাবাদের পাঠ নিয়ে হিন্দুর মতই জাতি-রাষ্ট্র কামী মধ্যবিত্ত শহুরে মুসলিম নিজেকে ‘বিশুদ্ধ’ করতে গিয়ে একই ভাবে তার কয়েক শতাব্দীর আত্মগত অপর হিন্দুর থেকে নিজেকে আলাদা করতে উদ্যোগী হল। কয়েক দশকের নবীশ পর্ব শেষে আজ সে নির্জলা (নির্দ্বন্দ্বও কি?) মুসলিম। দেশভাগ হেতু শিক্ষিত বর্ণ হিন্দুদের মূলত স্বেচ্ছায় ভিটে ছাড়ার ফলে ও বাংলা রাতারাতি হিন্দু হেজেমনি শূন্য হয়ে গেল যার জন্য বাঙালি মুসলিমের কোন অবদান নেই, ঐ হেজেমনিকে চ্যালেঞ্জ করে সে মাথা তোলেনি বরং হিন্দু শূণ্যতার তাৎক্ষণিক ‘সুফল’ ভোগে সে হিন্দু দলন ও উচ্ছেদে দক্ষ হয়ে উঠল; ফলে ক্ষমতা ও সত্তায় সে অদ্বৈত – লা শরিক হয়ে উঠল, যার ক্ষয় ও দুঃস্থতা আজ প্রকট। তিন টুকরো হয়ে যাওয়া উপমহাদেশে নিখাদ নিরেট পশ্চিমা জাতি হয়ে উঠতে রাজনৈতিক ভাবে সে আজ সবচে সফল ফলত হিংসা তার অনিবার্য অন্তর্গত, এক ভাষিকের (monolingual) এক রঙা মূলত ধর্মীয় সত্তার অগভীরতা ও দুঃস্থতা তার এক প্রকট বর্তমান ও নিয়তি। ’৪৭-এর স্বাধীনতা তার স্বোপার্জিত ছিল না, ’৭১-এ ‘মুক্ত’ হওয়ার সশস্ত্র ঘটনায় তার ভূমিকা প্রান্তিক। জাতি হয়ে উঠতে চির অমোচনীয় এহেন ‘অক্ষমতার’ এই ইতিহাসকে সে এখনো সামলাতে শেখেনি (পশ্চিমা পাঠ্যে তা সম্ভবও নয়) এবং তা তার মর্মপীড়ার স্থায়ী কারণও বটে।

এ পীড়ার এক মলম সরকারী পৃষ্ঠপোষণয় চলমান জনশ্রুতি ’৩০ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা’। (এখানে এক মজার, যদিও করুণ মিল উল্লেখ থাকঃ উপমহাদেশে বাকি দুই জাতি-রাষ্ট্রের নিজস্ব ‘পিতা’ প্রথম থেকেই বর্তমান, বাংলাদেশ ছিল পিতৃহীনা এক এতিম, তাঁর ছিল বঙ্গবন্ধু [দেশবন্ধুর অনুকরণে কি? হায়, ফের হিন্দু নকল/অনুষঙ্গ!], কিছু কাল হয় তিনি ‘জাতির পিতায়’ [বাকিদের সঙ্গে তাল মিলিয়া? না কি গেরস্থের মত জাতিরও কল্যাণ-অকল্যাণ আছে না! রাষ্ট্রপুঞ্জে সকলে, সদলে যখন জীঙ্ঘাসিবে তখন কি সত্যকামের মত আজ শুধুই কোন মাতৃ নাম উচ্চারণ সম্ভব হেসে? [উল্লেখ থাক ‘মুক্তিযুদ্ধ’ নামক ঘটনা-কালীন ’৭১-রে সমর সেনের, নিজ অফিসে বসে, জনৈক বঙ্গবন্ধু ভক্ত সম্মুখে উক্তি/উবাচ ‘বঙ্গ বৃষভ’, উনি অবশ্য আহত ভক্তকে দেখে সামলে বলেছিলেন ‘দেখুন সামনের রাস্তায় ষাঁড় যাচ্ছে’, বাকশাল (স্তালিন-রাজের সৃষ্টিশীল বঙ্গীয় সংস্করণ ভিন্ন কিছু নয়) উত্তর বাংলাদেশ এবং অব্যাহত হিন্দু বিতারণ তখনো ওপাড়ে/এপারে কারুর দুঃস্বপ্নে নেই। বঙ্গবন্ধু/জাতির পিতা/বঙ্গ বৃষভের স্মৃতিতে রয়েছে জেলে ওঁকে যারা যত্ন নিতেন/বাঁচিয়ে ছিলেন তাঁর সকলেই হন বর্ণ হিন্দু বলা ভাল উহারা নিজদেগেরে ফরিদপুরবাসি জানিতেন এবং অসুস্থ তাঁকে জেলাজ আত্মজন জ্ঞান করিতেন {জ্ঞান ঘোষ, ইত্যাদি} উপমহাদেশের ধর্ম নিরপেক্ষতার এ জেলাজ-রূপ পশ্চিমের পাঠে নাই, আর এক উদাহরণ বরিশালের সতিন সেন – উপনিবেশিক আধুনিকতার সন্তান, বর্ণ হিন্দু, এবং বরিশালের হিন্দু, মুসলিম, নমঃশুদ্র, মুচি, মেথর, ডোম নির্বিশেষে সতিন-দা এবং যাবতীয় হিন্দুয়ানা, কখনো বা উগ্র হিন্দুয়ানা সত্ত্বেতেও সতিন-দা, সতিন-দা [কোন অবস্থাতেই তা আজকের হিন্দুত্বের সুদূরতম পূর্ব পুরুষ নয়, প্রকৃত পক্ষে সতিন সেন সেই নিখুঁত ব্যর্থ বর্ণ হিন্দু ব্যক্তি-উদাহরণ যার মধ্যে শতাব্দীর পুঞ্জীভূত রক্ত-ঘাম-ক্ষুধা-তৃষ্ণা স্বার্থ্যহীন নিখাদ দেশপ্রেমের মূর্তি ধরে আবার যা আধিপত্য হারিয়ে উগ্র ও অসংলগ্ন হয়ে ওঠে। এই উগ্রতা ও অসংলগ্নতার উৎসে কি ওঁর নিজের কাছে নিজের বর্ণ চেতনা যার সামাজিক ও রাজনৈতিক তাৎপর্য রাতারাতি শেষ হয়েগিয়েছিল? ফলত সত্তার এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ হারিয়ে ক্রমে ভূমি চ্যুত আবার নিজ বরিশাল নামের ‘দেশ’কে অস্বীকার করে দেশভাগ মেনে নিতে না পাড়ায় সে স্বদেশ ছাড়তে নারাজ, ফলে দেশভাগ উত্তর সতিন সেনদের অধিকাংশের জীবন হয়ে ওঠে মানসিক ক্ষতিপূরণের ক্রিয়াকর্ম, যার পরিণতি পাক এবং স্বাধীন উভয় পর্বে সে সমাজ, রাজনীতি, সংস্কৃতিতে কোন গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে অক্ষম হয়ে রইল [তাজিয়ার পথ নিয়ে একক ভাবে এবং অযৌক্তিক গোঁয়ার্তুমি করে সতিন সেন রাতারাতি মুসলিমদের কাছে ’৪৭-এর পর ‘ওঁদের লোক’ হয়ে গিয়েছিলেন, যদিও আলাদা করে ওঁর প্রতি শ্রদ্ধার ঘাটতি কখনই হয়নি, আগের মতই হ্যাঁ বরিশালের সব হেঁশেলে সব দাওয়ায় ও দাওয়াতে ওঁর ঠাই বাঁধা ছিল; অনেক পরের এক বর্ণ হিন্দু মহিলার দেশের স্মৃতির মধ্যে এক উজ্জ্বল ঘটনা ‘সতিনদারে রাইন্দা খাওয়াইছি’, উনি অবশ্য সুভাষ বোসকে এক সকালে নিজের হাতে চা-জলখাবার দেবার সৌভাগ্য ধন্যা, এবং এই ঘটনা উপলক্ষে বাড়িতে নতুন কাপ-ডিশও আনা হয়েছিল]। এখন তাই যদি হয় তবে কি বর্ণ হিন্দু, অন্তত চিরস্থায়ির সুফলভোগি নব উত্থিত বাঙালির, যাবত সৃজনশীলতা ক্ষমতা ও প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সম্পর্কিত, অবশ্যই উজ্জ্বল কতিপয় ব্যতিক্রম সহ? শেষে দুপাড়েই ভিন্ন ভিন্ন কারণে ও প্রগতিনিষ্টদের তত্ত্বাবধানে সম্পুর্নত সৃজনশীলতা শূন্য তার অবলম্বন হল আত্মপ্রম (narcissism), সতিন সেনদের অপভ্রংশ শতক পেরিয়ে চির জীবি হল? এসবই অবশ্য বঙ্গ বর্ণ পুরুষ সম্পর্কে সত্য ও কিছু তার অনুমান, তার নারীর ‘প্রগতি’ ও ‘উন্নয়ন’ কিছু ভিন্ন ধারায় বইলো। দেশভাগের হেতু বঙ্গ বর্ণ জনের এই narcissistic injury গভীর সত্য না হলে বঙ্গ জনের তুলনাহীন সমষ্টিগত করুণ পরিণতির আখ্যান রচিত হলনা কেন সমকালেই, এক মাত্র তাৎপর্যপূর্ণ কাজ নিমাই ঘোষের ১৯৫০-এ নির্মিত ছিন্নমূল এবং তাও দুঃস্থতার আখ্যানে শেষ হয়, বর্ণ হিন্দুর তরে আত্মপ্রশ্ন মেলে ধরে না। হিন্দু মুসলিম মিলিয়ে বাংলায় মান্টোর দেখা মিললনা যে বঙ্গের রক্তপাত আগুনহীন ‘গ্রাম পতন’কে, সহস্রাব্দের যূথের নিজ হাতে শেকড় কেটে ভেসে পড়াকে, তার যন্ত্রনা তার অসুস্থতাকে সমকালেই লিপিবদ্ধ করে রাখবে যা চিহ্নিত করে স্বরচিত মূলছেদকে সে বোঝাপড়ায় অতি গভীরভাবে অক্ষম ও পরাঙ্খমুখ। তার এক নিশ্চিত কারণ বাধ্যত ও আচমকা ক্ষমতার শরিকিয়ানার দাবি বাধ্যত মেটাতে গিয়ে বঙ্গ জনের বর্ণ চেতনায় এক গভীর আঘাত যা তাঁকে এক রকম রাতারাতি ঐতিহ্যের অবলম্বন হারা করে দিল, দেশভাগের ক্ষত তার কোন মতাদর্শে কি ‘শিল্প’ চর্চায় ঘুচলোতো নাই, বরং তা অন্তর্শীলা হল]; ঢাকা জেল থেকে সতিন সেনের মরদেহ আসলে স্টিমার ঘাটে মানুষ আছড়ে পরে! উপনিবেশে এবং উপনিবেশ-উত্তর ভারতে ধর্মিয় সহনশীলতার কারণে যেটুকু যা মিশ্রিত ও নির্মল ভারতীয়ত্ব/বাঙালিয়ানা ছিল, রাজনীতিতে পশ্চিমের প্রগতি, উন্নয়ন, ধর্ম নিরপেক্ষতার ব্যাখ্যাকে শিরোধার্য করে তা উবে গেল, ঠাকুর-বয়াতি-বাউল-ফকির-দরবেশ সকল প্রাত্যহিক থেকে পুঁথি ও বাৎসরিকে স্থান লয়। যা হোক, শেষ কথা উপমহাদেশে কোন জাতি-রাষ্ট্রকেই আজ মাতৃহীন বলা গেলেও আর পিতৃহীন বলা যাবে না ফলত সম্পূর্নত এতিম কেউই নয়।   

পিতৃ-অন্বেষণ অবশ্য প্রাক্তন উপনিবেশ সকলে এক প্রকার অনিবার্যই ছিল (প্রগতি-পথের অভ্রান্ত নিশ্চয়তার দিশারি লেনিনের ফলিত মার্ক্সবাদে এ হেন অনিবার্যতার/ইতিহাস নির্দিষ্টতার হদিশ নাই)। উনি, প্রকাশ থাক বাকি দুই পিতার তুল্য নিজেকে আমৃত্যু গণতান্ত্রিক রাখতে পারেন নি, নবীন জাতির স্ব-ঘোষিত একতম পরিচালক-রক্ষকের ভূমিকায় নিজেকে নব জন্ম দিয়েছিলেন, পরিণতিতে সপরিবারে প্রকাশ্যে খুন [প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ একদলীয় শাসন বাকশালের কালে ওনাকে বলেছিলেন, ‘আপনাকে তো শান্তিপূর্ন পথে সরানর পথ রাখলেন না’ এবং নিজে ওনার রাজনৈতিক সঙ্গ ত্যাগ করেছিলেন। তৃতীয় বিশ্বে তখনও জাতি-রাষ্ট্র নামক আমদানিকৃত নড়বড়ে সামাজিক কাঠামোয় ব্যক্তির একতম অধিশ্বর হয়ে ওঠাকে সামলাতে কৌমের দ্রোহ? ফলত ব্যবস্থার মধ্যে ফের কি কৌমের, এক্ষেত্রে, অনুপ্রবেশ? তৃতীয় বিশ্বে এখনও সজীব এবং অস্তগামী কৌমের সম্মতি-হীন ব্যক্তির উত্থান অবৈধ কি? উনি কিন্তু নিজ শাসন পর্বেও বাংলা নামের দেশ জুড়ে হিন্দু উচ্ছেদ/বিতারণ নিয়ে রা কারেননি নি, ‘স্বাধীনের’ আগেও না এবং পরেও না। যা হোক বাংলাদেশ ও তাঁর পিতা সম্পর্কে এ বঙ্গে এসব আষ্টানি কথা বলা পাপ কর্ম বিধায়ে ক্ষমা প্রার্থনা পূর্বক ইহা বিধৃত হইল। আর এক কথা এ পিতার সুপুত্রী কিন্তু আঢে বহরে পিতার থেকে বহুগুন স্বৈরাচারী এবং স্বদেশ ধ্বংসী এবং জনারণ্যে প্রবল ঘৃনিত তথাপি তাঁকে মসনদ চ্যুত করার মত কোন গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তুলতে ওদেশের বিরোধীরা একান্তই ব্যর্থ এবং অদ্যাবধি অক্ষমও বটে। আজ ও বাংলা বসে আছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের স্যাংসন নামক বরাভয়ের আশ্বাসে। এ বঙ্গের কোন প্রগতিনিষ্ট ও বামেরা জানে কি তাঁর ঘরের দোরে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের এহেন জনস্বীকৃত ও পরম কাঙ্খিত মঙ্গলময় রূপ? এ কি কৃষি প্রধান প্রাক্তন উপনিবেশের আধুনিক জাতি-রাষ্ট্র হয়ে ওঠার এক অনিবার্য নিয়তি? ‘capital is plunder’ এ সত্য ও বাংলার জন্য দিনের আলোর ন্যায় – সেই হিন্দুর সম্পত্তি লুন্ঠন পূর্বক বড়লোক/মধ্যবিত্ত হওয়া থেকে আজকের সবচেয়ে বড় অন্নদাতা পোশাক শিল্প সকলই দাঁড়িয়ে আছে অভ্যন্তরিন লুন্ঠনের উপর; হিন্দু নিধন/উচ্ছেদ জাত অপর দলনের দক্ষতা আজ মুক্তি পাচ্ছে ঘরের স্বধর্মী বিরোধী দলনে। এবং ওদেশে ভারত আজ অনেক দিনের স্বৈরাচারের দোসর হেতু এক সর্বমান্য ঘৃণিত প্রতিবেশী। ও বাংলাকে সাধ্যমত দোহনের প্রায় চিরস্থায়ী ব্যবস্থা এ পাড়ে সাধারণ্যে এক প্রকার অজান সঙ্গে পিতৃ কি মাতৃ সুত্রে প্রাপ্ত ও পাড় বাংলা নিয়ে বর্ণ সুধিজনের ‘রোম্যান্টিকতা’ যদিও অটুট। প্রগতিনিষ্ট এবং সকল বঙ্গ বর্ণ বামেদের হিসেবি নিঃশব্দতা ও বাংলার বিশেষত মধ্যবিত্ত মুসলিমকে হিন্দু নিয়ে সংশয়ি ও সতর্ক করে রেখেছে। ভারতের অব্যাহত দোহন ক্রিয়া নিয়ে এ পাড়ের বিকট নিঃশব্দতা হিংসা ও জাতি-রাষ্ট্রের জয় এবং বাঙালির খণ্ডিত সত্তার নিশ্চয়তা যা দেশভাগ দিয়ে সম্পূর্ন করা যায় নি তাই আজ জাতি-রাষ্ট্র ও পুঁজি পোষিত আধুনিক উন্নয়ন দিয়ে ধর্ম নিরপেক্ষ পথে সম্ভব করা যাচ্ছে]।   

দেশভাগ দুই বাংলাকেই ভিন্ন ভিন্ন অর্থে হীন করে দিয়েছে এই উপমহাদেশে। বিভাগ-কালীন বাংলায় পাজ্ঞাব তুল্য কোন দাঙ্গা বা গণ-নিধন হয়নি, খুচরো ব্যক্তিগত হানাহানি বাদ দিলে। এই দাঙ্গা-হীনতার এক নিশ্চিত কারণ মুসলিমদের তরফে দাঙ্গা করার মত সম্পন্নতা, রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা/সংগঠন কিছুই ছিল না। অবশ্যই কৃষি সমাজের স্বাভাবিক সম্প্রীতিও এক কারণ সঙ্গে খেয়াল রাখা যাক তখন হিন্দু ও মুসলিমের মধ্যে সামাজিক অবস্থান সুতরাং ক্ষমতার পার্থক্য আসমান-জমিন ফলে সহসাই বাঙালি মুসলিমের পক্ষে হনন উদ্যত হয়ে ওঠা সম্ভব ছিল না; সাধারণের পক্ষে খুন, উচ্ছেদ, দমনের হিংস্রতা রপ্ত করা সময় সাপেক্ষ –উপমহাদেশের সকল দাঙ্গা সাক্ষী দাঙ্গার জন্য যে ঘৃনা, বিদ্বষের প্রযোজন তাকে ধর্ম, জাতি, মতাদর্শ প্রভিতির মুক্তি কি সাম্যের নামে সংগঠিত ভাবে লালন-পালন করতে হয়। আদি পর্বে ক্ষীণতনু বাঙ্গালি মসলিম এ কর্মে এবং কিছু বা নাচারও ছিল, বিশেষত পায়ের মুসলিমরা। তাঁর জাতি-রাষ্ট্র যত ধর্মের ভিত্তিতে সংহত হল এ কর্মে তত সে দক্ষ হয়ে উঠল। তবে ’৫০ পর্যন্ত উদ্বাস্তুরা যে প্রধানত বর্ণ হিন্দু তার কারণ মুসলিমদের সম্পন্ন বর্ণ হিন্দুর উপর আগ্রাসন নয়, বরং বর্ণ হিন্দুদের এমত প্রত্যয় যে মুসলিম শাসনে থাকা যাবে না, পাকিস্তান মানে নিজের কাছে সে মনি হারা ফনি। সম্পূর্ণত স্বেচ্ছায় দেশ ছাড়া বর্ণ হিন্দু উদ্বাস্ত হল বটে কিন্তু সাম্প্রদায়িক হয়ে উঠল না, স্বেচ্ছায় দেশ ছাড়ার ফলে তা সম্ভবও ছিল না। ’৫০ প্যাটেলের কলকাতায় উসকানিমূলক বক্তৃতার ফলে এ বাংলায় অবাঙালি মুসলিম বিরোধী দাঙ্গার প্রতিক্রিয়ায় সরকারী পৃষ্ঠপোষণয় সংগঠিত দাঙ্গা দিয়ে ও বাংলায় শুরু হয় হিন্দু নির্যাতন, বিতারণ যা আজও অব্যাহত। শুরু হয় ও বাংলার বাঙালী মুসলিমের অসাম্প্রদায়িক চেতনার অন্তর্জলি যাত্রা। আজ সে বাংলার নিজস্ব সমন্বয়ী ঘরানার ইসলাম নয় মধ্য প্রাচ্যের ‘বিশুদ্ধ’ ইসলাম অন্তপ্রান।

এবঙ্গের হিন্দুদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন হলো। বর্ণ হিন্দুর যে বিরাট অংশ উপসত্ত্বভোগী ছিল তাকে একরকম রাতারাতি উপার্জন সক্ষম হতে হলো, তার যাবতীয় নিশ্চয়তা, নিরাপত্তা, সামাজিক প্রতিষ্ঠা ঘুচে গেল। ছুৎ-অচ্ছুতের বিচারের সামর্থ্য সে হারালো, না কোন শিক্ষা বা রাজনীতির কল্যাণে নয়। স্রেফ টিকে থাকার জন্য আচমকা প্রবল প্রতিযোগিতায় পরে আর উদ্বাস্তু স্রোতে প্রতিবেশী নির্বাচনের ‘স্বাভাবিক’ অধিকার হারিয়ে সে বই থেকে প্রাত্যহিকে নেবে বর্ণ নিরপেক্ষ (ধর্মে তত নয়) হতে শিখল, না বলা ভাল এক রকম বাধ্য হল।

অখণ্ড বাংলায় মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণী ছিল অতীব ক্ষীণতনু এবং হিন্দু মধ্য শ্রেণীর মতন, ভালোমন্দ মিশিয়ে, কয়েক পুরুষের অর্জিত আধুনিক সাংস্কৃতিক পূঁজিও তার ছিল না। এ বাংলার দুর্ভাগ্য মুসলিম মধ্য শ্রেণীর শিক্ষিত, সংবেদনশীল, নেতৃত্ব দানে সক্ষম অংশের প্রায় পুরটাই ভুল উন্মাদনায় বা আতঙ্কে ওপারে চলে গেলেন এবং একই ভাবে ’৫০-এর দাঙ্গার পর। যারা রয়ে গেলেন তাদের এক ক্ষুদ্র অংশ সাম্প্রদায়িক হানাহানি ঠেকাতে ব্যর্থ হয়ে সমাজ জীবন থেকে বিদায় নিলেন, বাকিরা ধর্ম নিরপেক্ষ মসিহাদের তত্বাবধানে একমাত্রিক পরিচিতির রাজনীতিতে ঢুকে নিরাপত্তা খুঁজে নিলেন। পরিণতিতে পাওয়া গেল পাঁচ দশকের বেশি পর সাচার কমিটির রিপোর্ট যাকে হিমঘরে পাঠাতে ধর্মনিরপেক্ষ কি বামেরা কিছুমাত্র সময় নেয়নি।

এ বঙ্গে রাজনীতি, সংস্কৃতির মূল ধারায় মুসলিমের নিরঙ্কুশ অনুপস্থিতি কোথাও কোন অসম্পূর্ণতা কি সংকট-বোধ তৈরি করল না। একথা অবশ্য বর্ণ/বর্গ নির্বিশেষে নারী, দলিত ও আদিবাসীদের জন্য সমানভাবে সত্য। পরিচিতি সত্তার রাজনীতিতে ঢুকে মুসলিমরা জাতি-রাষ্ট্রের জন্যে কোন সমস্যা হলনা বরং সহায়কই হলেন। জাতীয়তাবাদ, জাতি-রাষ্ট্র, ধর্ম, আত্মপরিচয়, দুনিয়া জোরা নিপীড়িতের মুক্তির আশ্বাসদাতা মার্ক্সবাদ, কি তার সর্ব্বোচ্চ সফল ফলিত রূপ ধর্ষকামী স্তালিনতা কোন কিছু নিয়েই সে জড়িতও নয় প্রশ্নসঙ্কুলও নয়। ফলে ’৪৭ উত্তর এবঙ্গের যাবতীয় সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক পরিবর্তনের সে না শরিক না সুফল-ভোগী। আর যা দুঃখের ও বাংলার মুক্তি আন্দোলন নিয়ে এ বাংলার মুসলিমরা আদৌ উদ্বেলিত হয়নি যেমনটা হিন্দুরা, মূলত বর্ণ হিন্দু/উদ্বাস্তুরা হয়েছিলেন (উদীয়মান বাংলাদেশের জন্য এপারের বর্ণ বাবুদের উদ্বেলিত হওয়ার একটি নিশ্চিত কারণ দেশভাগের ইতিহাসে থেকে গিয়েছিল, যে দেশভাগে দুপাড়ের বর্ণ বাবুদের অবদান প্রমাণিত। নিজ গুণে দেশ হারানোর মলমের প্রযোজন তাঁর নির্জ্ঞানে ছিলই, ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ’ তাঁকে সেই সুযোগ দিয়েছিল। যদিও ১ কোটি উদ্বাস্তুর ৯০% ছিল হিন্দু তবুও এ ছিল এক ধর্ম নিরপেক্ষ সুযোগ বাঙালি মুসলিমের সঙ্গে একাত্ম বোধ করার, সে সুযোগের সদ্ব্যবহার করে এপারের বর্ণ বাবুরা চির আত্ম শ্লাঘার পূঁজি ও দেশভাগে অবদান রাখার আত্মগ্লানি মোচনও করেছিল। এহেন নির্জ্ঞান তাড়িত প্রেমালিঙ্গন মনে হয় সমকালের এক ঠোঁট কাটা মানুষ বুঝেছিলেন – ‘আমাদের ছেলেরা কবিতা লিখিবে বলিয়া তোমাদের ছেলেরা গুলি খাইয়া দাঁতছরকুটে পরিয়া থাকুক’। প্রসঙ্গত গোলাম মূর্শিদের অভিজ্ঞতা; এক জাতীয় কাগজের দপ্তরে সাময়িক কাজের সুযোগে নিত্য মুসলিম বিদ্বেষ হজম করতে হত, যদিও তা এক ব্যক্তির তরফে কিন্তু অন্যেরা তার বিরোধীতাও করেনি; অবশ্য উনি এবং ওনার মত মানুষদের সব মিলিয়ে ৯ মাসের মত এদেশ বাসের অভিজ্ঞতা ভালই। শুভ ঊষা লগ্নে বঙ্গ জনের জাতীয়তাবাদে যেমন মুসলিম সত্তার কোন লেশ ছিল না, যেন তারই সম্পূরক হয়ে ও বাংলায় জাতি-রাষ্ট্রের রাজনীতি, সংস্কৃতিতে হিন্দু প্রায় সম্পূর্ণত অনুপস্থিত। তার এক নিশ্চিত কারণ হিন্দু বিতারণ (এই হিন্দু উচ্ছেদের নির্মম আখ্যান ধরা আছে হাসান আজিজুল হকের ছোট গল্পে আর তনভির মোকাম্মেলের চলচ্চিত্র ‘চিত্রা নদীর তীরে’, এসবই ব্যক্তির অভিজ্ঞতা হয়ে থেকে যায়, যেখানে কৌম কি নিম্নবর্ণ নিতান্তই গরহাজির, তা কি  অভিজ্ঞতা আর সামর্থ্যের অভাবে?) আর তথাকথিত মুক্তিযুদ্ধ কি ওপাড়ের মুসলিমকে শেকড় চ্যুত করে দিয়েছে? সত্তার অসম্পূর্ণতার বোধশূন্য করে রেখেছে? অপরের সঙ্গে সহাবস্থানে অক্ষম করে রেখেছে? ও বাংলার রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতিতে হিন্দুর দৃশ্যত অনুপস্থিতি কোন অসম্পূর্ণতা বোধের জন্ম দিচ্ছে কি? হিন্দুর সংখ্যাল্পতা এতই প্রকট ও বিকট তাতে অপরহীনতার অসম্পূর্নতা বোধের জন্ম কি স্বাভাবিকক্রমে সম্ভব? সহাবস্থান ছাড়া নিছক ভাষা-সাহিত্য-ইতিহাস পাঠে প্রাপ্ত অপর কি কখন আত্মগত হতে পাড়ে? আজ বাঙালির খণ্ডিত সত্তা কি সেই পশ্চিমা তন্ত্র মতে জাতি গঠনের স্বাভাবিকতা নয়?

আশার এই যে ওপাড়ে রবি-গান এবং লোকগান মধ্যবিত্তের এখনো গ্রাহ্য সাংস্কৃতিক পূঁজি, তার সত্তার অচ্ছেদ্দ। তবে এপথে কি ধরাছোঁয়ার বাইরের এক অপর ও অতীতকে নিষ্ফল ভাবে ধরে রাখা? প্রাত্যহিকে সহাবস্থানের বাইরে কি অপর উন্মুখ, অপর সহিষ্ণু হওয়া যায়? (’৯০ দশকে শঙ্খ ঘোষের বাংলাদেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা স্মরণ করা যাকঃ চট্টগ্রামে গেছেন, একটি ‘উন্নত’ স্কুল ও ছাত্রাবাস দেখে ফিরছেন। পথে এক ছাত্রের সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে; ‘কাল আমাদের ওঁদের সঙ্গে খেলা আছে’, ‘ওঁরা কারা?’ , ‘ওঁরা হিন্দু’, ‘তবে তোমরা কি?’, ‘আমরা তো বাঙালি’। কবির উপলব্ধি শতক শুরুতে যে বৃত্ত টানা শুরু হয়েছিল [শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্তে ‘কাল বাঙালি ও মুসলমানদের মধ্যে ফুটবল খেলা’] সে বৃত্ত আজ সম্পূর্ণ হল। মনোজ মিত্রের নাটক অবলম্বনে ও বাংলায় নাটক হলে লেখা হয় বিদেশী গল্প অবলম্বনে। ও বাংলার আন্তর্জাতিক মানের সাহিত্যের কথা এ বাংলা প্রায় জানে না। ও বাংলার তৌকির আহমেদের সিনেমা অজ্ঞাতনামা তৃতীয় বিশ্বের জাতি-রাষ্ট্র, উন্নয়ন প্রভৃতি ঝাড়ফুঁকে ব্যক্তি মানুষ কি ভাবে নাম-গোত্রহীন উড়ো খৈ হয়ে যায় তার অত্যন্ত মর্মদন্তু, দামী ও সফল শিল্প ভাষ্য, টলি-বলি-হলি সকল প্রভাব মুক্ত, এপারে যার কোন সাড়া পরেনি। ওঁর রূপকথার গল্প-ও মনোযোগ দাবি করে, তবে তা শহিদুল জহিরের গল্পের ছায়াই থেকে যায়, ওঁর তুল্য স্বাবলম্বী বাঙালি চলচ্চিত্র ভাষ্য হয়ে ওঠে না। অথবা ধরা যাক গুজরাটে গণ নিধনের প্রেক্ষাপটে নন্দিনী দাশের সিনেমা ফিরাক। এমন সব ছবি এপারে হয় না কেন?

তৌকির আহমেদের ক্ষেত্রে বলা যায় শিল্পীর মন জগতের ব্যক্তিগত রসায়ন জানা নেই বলে আপাতত তা বাদ দিয়ে দেশ-কালগত যে বোঝাপড়া শিল্পীকে তাগিদ পাঠায় এক্ষেত্রে তা ওপাড়ে জাতি-রাষ্ট্র হয়ে ওঠার রক্তাত্ব প্রক্রিয়া এখনো কৌম সত্তা গিলে নিতে পারেনি, রক্তাত্বতা সজীব ও প্রক্রিয়াটি এখনো প্রস্তরীভূত হয়ে গণ-মানসে জাতি-রাষ্ট্রের স্বাভাবিকতায় পরিণত হয়নি বলে মৃত অজ্ঞাতনাম মানুষ নিয়ে রাষ্ট্রের বিধি-বধ্য আইনি সংলাপে দায় ঝারা তথাপি তাঁদের নিয়ে জীবিত নাম-গোত্রহীনদের অসহায় বেদনার অবিরাম ভার শিল্পে পরিণতি পাচ্ছে? ফিরাক কেন সম্ভব হয় না? এপারের বর্ণ বাবুরা লোক ও কালোত্তরে পৌঁছে গেছেন বলে মাটি পৃথিবীর ধুল-বালি তাঁদের চেতনা আবিল করে না? না কি ঋত্বিক-উবাচই ঠিক – মেড়া লড়ে খুঁটির জোড়ে। যা হোক দুপাড়েই এক রকম স্বাভাবিকতায় ও যেন প্রাকৃতিক নিয়মের মত ধর্ম ভিত্তিক জাতি পরিচয়ের বৃত্ত নিত্যই সম্পূর্ণ হয়ে চলেছে, এ মিথ্যা হলেও বাস্তব হয়ে উঠছে – এ হল উপনিবেশে প্রভুর দান আধুনিক জাতি-রাষ্ট্রের নিখাদ বদান্যতা)। তবে দুপাড়েই যে কৌম জীবন এখনো অস্তিত্বশীল, বিশেষত ওপাড়ে, তা স্পষ্ট। তা কি পূঁজি ও প্রযুক্তির গ্রাসে গ্রাম সমাজ এখনো সম্পূর্ণ উন্নয়ন-বিধ্বস্ত গণ-পিণ্ডে পরিণত হয়নি সঙ্গে সত্তার অনেকান্ত বৈচিত্র্যের সহাবস্থানের কারণে ঐতিহ্যের রেশ টেনে কৌম বাঁধন টিকে আছে বলে (এখানে ও বাংলার এক উল্লেখযোগ্য সমাজ-জোড়া সজীবতা লক্ষ করা যাক – ও বাংলার প্রতিটি জেলার মানুষের নিজ ভাষা লোকব্যবহারে আজও জীবন্ত এবং জেলাগত ভাষা-সংস্কৃতি-ভুগোলের স্বাভিমান নিয়ে সকলেই স্বোচ্চার যা এ বাংলায় কদাচ দৃষ্ট নহে। কলকাতা যাহা সম্পূর্নত উপনিবেশ সৃষ্ট ও তাহার প্রাক্তন রাজধানী তাহার ভাষা, সংস্কৃতি সমগ্র পশ্চিমবঙ্গকে গ্রাস করে রেখেছে। যদিও ঢাকার ‘মান্য’ বাংলা ভাষিকরা অন্যদের নিয়ে হাসাহাসি করেন তথাপি তা জেলাজ স্বাভিমানে কিছুমাত্র টোল ফেলতে পাড়ে নি বরং জেলার মানুষজন কদাচ মান্যতা দিলেও তাহার শহুরে ভাষা ও সম্পন্নতা নিয়ে সংশয়ী, প্রায়শই প্রত্যাখ্যানে প্রস্তুত।) কিন্তু অনুপস্থিত/উচ্ছেদিত অপরহীন কৌম সত্তা কি আধুনিকতার না হোক জাতি-রাষ্ট্রের গর্ভে সহজে বিলীন-যোগ্য নয়? এ বাংলায় হিন্দুত্বের ঠেলায় পড়ে ধর্ম নিরপেক্ষ বাবুরা ‘ওঁদের’ নিয়ে আজ ভাবছেন, কিন্তু একই ভাবে হিন্দুর প্রাত্যহিকে ‘ওঁদের’ স্থায়ী অনুপস্থিত কোন অভাব বোধ কি অপর সহিষ্ণুতা/উন্মুখতা জন্ম দিচ্ছে না। প্রমাণিত যে র‍্যাডক্লিফের নয়, দুপাড়ের বর্ণ বাবুদের টানা খড়ির যে গণ্ডি তা কি শতক পেরনোর আগেই অভেদ্য পাঁচিল হয়ে গেল – এবং তা একই সঙ্গে মনে ও ভূমে? 

দেশভাগ ও বাংলার বাঙালী মুসলিমের জন্যে আপাতভাবে আশীর্বাদ স্বরূপ যার আত্মধ্বংসি রূপ আজ অতি প্রকট। ’৪৭ থেকে ’৫০ পর্যন্ত ও বাংলায় হিন্দু বিরোধী উল্লেখযোগ্য কোন দাঙ্গা হয়নি, এমনকি গ্রামের শিক্ষিত, সম্পন্ন হিন্দুদের বেশ কিছু ক্ষেত্রে থেকে যাওয়ার জন্যে বলেছেও বটে (এমন অভিজ্ঞতা কিন্তু নিম্নবর্ণের নেই। নিঃসন্দেহে সম্প্রীতি সহ শ্রেণী ঐক্যের নজির। নিম্নবর্ণ তো চিরকাল প্রায় নিয়ম মাফিক সামান্য ব্যতিক্রম বাদে সম্পদ-হীন, নিজের ভিটেটুকু ছাড়া, প্রবল ধর্ম বিশ্বাসী, যা কিনা আবার পরিধি-বদ্ধ নয় ও পরিশ্রমী। এক পর্যায়ে বাংলার সমন্বয়ী লোকায়ত ইসলামের এরা প্রায় সকলেই শরিক, তাঁদের উচ্ছেদের কারণ তো অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক হতে পারেনা। বিশুদ্ধ ইসলামের প্রসার ছাড়া আর কি ব্যাখ্যা হয় না কি বর্ণ হিন্দুর কাছে শেখা ‘ছোটলোকের’ অসম্মান জারি রাখা?)। বাঙালী মুসলমানের এহেন অসাম্প্রদায়িক চরিত্র কিন্তু বেশিদিন টিকলো না। সময় সাপেক্ষে কোন স্বাভাবিক মধ্য শ্রেণীর উদ্ভব হলো না, যা হলো তা প্রকৃতপক্ষে বর্ণ হিন্দুর ফেলে আসা বিপুল সম্পত্তির (একথাও স্বীকার্য যে হিন্দুর বিপুল সম্পত্তিও আদতে আইন ও ব্যবস্থা সহায় এক প্রকার দখলদারি, কখনও বা লুণ্ঠনও বটে, এবং হিন্দুর সম্পত্তি দখল বাঙালি মুসলিমের বিশুদ্ধ গা-জোয়ারি উৎসে লোভ ও সাম্প্রদায়িকতার তাড়না) দখলদারির ফলে রাতারাতি এক ভুঁইফোঁড়, বিত্তে যত সাংস্কৃতিক পূঁজি কি রাজনৈতিক বোধে তত সম্পন্ন নয়, এক মধ্য শ্রেণীর উদ্ভব। ’৪৭ থেকে ’৫০ পর্যন্ত নির্বিবাদে হিন্দুর ফেলে যাওয়া অনুপার্জিত বিপুল সম্পত্তির মালিকানা তাঁকে আত্মিক দুঃস্থ করে তাঁর অসাম্প্রদায়িক চরিত্র কেড়ে নিল। আরো যা দুঃখের নেতারা তা বুঝলেন না, অন্যথায় ’৫০ থেকে ছেদহীন বর্ণ/বর্গ নির্বিশেষে হিন্দু নির্যাতন কি বিতারণের কোন অর্থনৈতিক কি রাজনৈতিক কারণ নেই। উপনিবেশ যে ভাবে তার প্রভুকে বিকৃত করে রাখে, অপরাধী করে রাখে, বোঝা-গ্রস্ত করে রাখে বাংলাদেশে হিন্দুদের কলোনাইজ করে ও বাংলার বাঙালী মুসলিমের আজ সেই দশা হয়েছে। এই বিকার, এই অপরাধবোধের মলম তার কাছে তীব্র ইসলামি-করণ, যা বাংলার চিরায়ত সমন্বয়ি লোকায়ত ইসলামের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন গোত্রের। যে বাঙালী সত্তার বিকাশের দাবিতে ও বাংলার স্বাধীন উত্থান তা আজ মধ্য প্রাচ্যের ইসলামের অনুকরণের জন্যে জান কবুল আর মান কবুল, সে আজ নিজ দায়িত্বে বাঙালী সত্তার বিসর্জন দিচ্ছে। ওদেশের ইসলাম এদেশের হিন্দুত্বের নিখুঁত প্রতিচ্ছবি (রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী মিতা হকের মৃত্যুতে রবীন্দ্র সঙ্গীত বাজান হলে ইউটিউবে ওঁর সম্পর্কে ইতর মন্তব্যে ভরে যায়; কোন ব্যক্তির মৃত্যুতে এমন মন্তব্য করা ভারত কেন কোন সভ্যতা-সংস্কৃতির অঙ্গ নয় এবং এ উপমহাদেশ জুড়ে তা আজ অকম্পে ঘটে যেতে পারে, প্রকাশ্যে তার বিরোধিতা হয় না)। ওপারের হিন্দু এপারের মুসলিমের মতন ধর্ম ভিত্তিক পরিচিতির রাজনীতিতে ঢুকে নিরাপত্তা খুঁজছে। 

এ বাংলায় মুসলিমের বাঙালী সত্তা চ্যুত না হোক প্রান্তিক্তম হয়ে যাওয়ার তর্কাতিত ভাবে সবচেয়ে বড় প্রমাণ বাঙালীর বড় সিদ্ধি যেখানে সেই সাহিত্যে এখনও পর্যন্ত তার ক্ষীণতর উপস্থিতি এবং ক্ষীণতম সিদ্ধি। ওপার বাংলায় সৈয়দ ওয়ালি ঊল্লাহর থেকে সাম্প্রতিক শহিদুল জহির-এর মতো কোন সাহিত্যিক এ বাংলায় জন্মায়নি। নিছক আর্থসামাজিক কারণে নয়, মসিহাদের তত্বাবধানে বেঁচে থাকা, বেড়ে ওঠার ফলে সে গভীর আত্মক্ষয়ের স্বীকারও বটে। আর কিছু না হোক রবীন্দ্রনাথকে সে এখনও পর্যন্ত অর্জন করে উঠতে পারে নি। কতিপয় ব্যক্তি বাদ দিলে বর্ণ হিন্দুদের সম্পর্কেও এ কথা প্রযোজ্য ঠিকই। কিন্তু তা মুসলিমদের জন্যে অনেক বেশি আত্মঘাতী হয়েছ, কারণ না পড়ে, না জেনে, না বুঝে ওর সঙ্গে জড়িয়ে পরা, আর কিছু না হোক, ওর ভবিষ্যৎ-বাণীকে সত্য প্রমাণ করে, ওর গানের সঙ্গে সহবাস মধ্যবিত্ত বর্ণ হিন্দু একরকম রীতি, রেওয়াজ (যদিও তা আত্মতা নির্মাণের প্রশ্নে যত না তার থেকে অনেক বেশি ওঁর ঘোর অপছন্দের জিনিষ গন্ডিবদ্ধ জাতি ধারণার সূত্রে)। তবুও অনস্বীকার্য যে রবীন্দ্রনাথের সূত্রে হিন্দু মধ্যবিত্তের যে-টুকুনই যা অর্জন, এ পাড়ের বাঙালী মুসলিমের সম্পর্কে তা একেবারেই বলা যাচ্ছে না। বাংলা সাহিত্য বিশেষত রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তার সংশয়, বিমুখতা, দীনতা আত্মতা গঠনে তাকে পরবশ করে চিরদুঃস্থ করে রেখেছে।

ও বাংলায় এক অতি ক্ষুদ্র অংশের নিষ্ঠা ভরে রবীন্দ্র-চর্চা, বিশেষত তা যদি শেষ পর্যন্ত সম্পূর্ণ রবীন্দ্রনাথকে আত্মগত করার চেষ্টা হয়ে ওঠে, আশা জাগায়, এ বাংলায় যার বিশেষ অভাব। সনজীদা খাতুন, ওয়াহিদুল হকের উত্তরসূরিরা হয়তো একদিন হানাহানির ইতিহাস পেরিয়ে বাঙালির জন্য প্রধানত ও আপাতত রবীন্দ্র-আশ্রয়ে আত্মতা গঠনের নতুন দিশা দেখাবেন (গান্ধীতে পৌছতে সীমানা, বর্ণ, লিঙ্গ ও ধর্ম নিরপেক্ষভাবে বঙ্গ জনের আরো বহু প্রজন্ম লাগিবে এবং তা প্রথমত রবীন্দ্র-সৃষ্টির পাড়হীন বিশালতাকে সংবেদন ও উপলব্ধিতে নিতে ও দ্বিতীয়ত পশ্চিম অগ্রাহ্যপূর্বক গান্ধীর যাপন ও রাজনীতির অদ্বৈত-লিঙ্গ চেতনা নিজ সত্তার অন্তর্গত করে নিতে)। ও বাংলায় ছায়ানটের লক্ষ্য স্বরূপ গণউদ্দ্যোগে রবীন্দ্র সঙ্গীত চর্চায় নিবেদিত (আজ ও বাংলায় জামাত ও হেপাজতের রমরমার কালে যারা অকম্প দীপ শিখা)। ছায়ানটকে নিয়ে ওয়াহিদুল হকের গান্ধী-রবীন্দ্র তুল্য বিবেচনা ও সঙ্কট-বোধ নজরে নেওয়া দরকার, যা পরবর্তীকালে বাম সংস্কৃতির পথিকৃৎ-রা যথার্থ বলে স্বীকার করেছিলেন। প্রথম থেকেই ছায়ানটের অবলম্বন রবীন্দ্রনাথ, কখনোই আধুনিক গণ সঙ্গীত নয়। পাক আমলে ওবাঙালায় তুমুল বাঙালি সত্তা-সাংস্কৃতিক জাগরণে সফল ছায়ানট পাক-ভূমে বাঙালি সত্তা-পরিচিতি গঠনে যে ভূমিকা রেখেছে তার দ্বিতীয় উদাহরণ নেই। প্রধানত রবীন্দ্র-আশ্রয়েই আধুনিক বাঙালি সত্তা সৃজন সম্ভব – এ বোধ পশ্চিম প্রেরিত নয়, দেশজ। এ হেন সত্তার সঙ্কট-বোধ ও উত্তরনের শ্রম সাধ্য চর্চা অবশ্য ‘স্বাধীন’ হবার পর পশ্চিমা উন্নয়নের অর্থনীতি ও রাজনীতির কারণে ধীরে বদলে গেল মধ্য-প্রাচ্য প্রেরিত ও ‘স্ব’দেশিকরণ জাত এক মাত্রিক ধর্ম পরিচয়ের আশ্রয়ে জাতি গঠনের উন্মত্ত আত্মঘাতী বিভীষিকায় (এ ঘোর ঘটনা পশ্চিমা পুঁথি মাফিক বা উহার মর্মরিত বাস্তবা স্বরূপ ধর্ম নিরপেক্ষ স্তালিন, মাও ও ফ্রাঙ্কোর গণনিধোনী রাজ, তথাপি অথবা সেই কারণেই জাতি-রাষ্ট্রগত প্রাণ প্রগতিপরায়ন ও পাঁচনামিগণের সৌজন্যে ইহা ভারতভূমে শ্রবণ ও দৃশ্য গোচর নহে। বাবুরা black life matters-এ আছেন, কিন্তু chakma and hindu and christan and urdu speaking lifes matter নৈ নৈ চ, উহা না পশ্চিম অনুমোদিত না নিজ জাতি-রাষ্ট্রের তরে প্রযোজনিয় কিছু )।

বিভাগ-উত্তর পাক পর্বে ওপাড়ে বাঙালির মূলত মুসলিম মধ্যবিত্তের সঙ্কট-বোধ প্রথমত সত্তার সঙ্কট-বোধ, এ সঙ্কট-বোধ মুসলিম মধ্যবিত্তকে চরিত্রে কূপমণ্ডূক বা পশ্চিম মুখি করেনি, শেকড় সন্ধানী করেছিল যা শতক পূর্বে বর্ণ হিন্দুর এক ক্ষুদ্র অংশে উপনিবেশ পর্বে পশ্চিম ও তার আধুনিকতাকে সামলাতে দেখা গিয়েছিল। আর ‘ভুল’ দেশকে নিজভূমি জ্ঞানে থেকে যাওয়া ও নিমিষে প্রান্তিক হয়ে যাওয়া বর্ণ হিন্দু সঙ্কট বোধ একই সঙ্গে অস্তিত্ত্বের, অসম্মানের ও সত্তার। উহাদের এক বড় অংশের সত্তার অবলম্বন স্বরূপ বর্ণ দাপট ঘুচল বটে ইসলামের ছত্রছাওয়া ক্রমে গাঢ হলে বাঙালির এক অপভ্রংশ রূপে পরিণতি পেল। বিভাগ-উত্তর এপারে উদ্বাস্তু স্রোত জাত সঙ্কট-বোধ স্রেফ অস্তিত্বের, সত্তার নয়, আজও নয়, ফলে সে আত্মপ্রশ্নে, আত্মনিরিক্ষণে অক্ষম। সীমানা নিরপেক্ষ ভাবেই বর্ণ জন নির্দ্বিধায় দেশভাগ চেয়ে ছিল, এর পরিণতি তাঁর সুদূরতম দুঃস্বপ্নে ছিল না, নিজেকে না চেনার এ দুঃস্থতার হাত থেকে উদ্ধার আজও মরীচিকা। এ সঙ্কট-বোধ তার চরিত্রের কারণে এবং পাঁচনামি বাম ও প্রগতি-নিষ্ঠদের তৎপরতায় দ্রুত পশ্চিমপরায়ন ও প্রগতি-নিষ্ঠ হয়ে ক্ষমতা সাধনায় মগ্ন হল এবং শেকড়হীনের আত্মতা গঠনের দুঃস্থতা তার চির ছায়াসঙ্গি হল। দুপাড়ে সঙ্কটবোধের চারিত্র্য-ভিন্নতার পিছে ধর্ম, সম্পদের মালিকানা, দেশ-কালের ভিন্নতায় আধুনিকতার অভিঘাতের ভিন্নতা কাজ করেছে। যে রাজনীতির পূঁজি শুধু অস্তিত্বের সঙ্কট-বোধ, সত্তা চিন্তা থেকে নিজেকে দূরে রাখে তা শেষ হয় প্রশিক্ষিতের ব্যবস্থা-বাধ্যতায়, এ কোন ইতিহাস নির্দিষ্ট অভ্রান্ত নিশ্চয়তার কথা নয়, বিকার-গ্রস্থের অন্তর্দিষ্টিহীনতার অনিবার্যতা অথবা অন্তর্দিষ্টিহীনের বিকার অনিবার্য। দেশভাগ জনিত বঙ্গ বর্ণ জনের সঙ্কট বোধ তাৎক্ষনিক ভাবে তাঁর রাজনীতিতে শুধু নয় তাঁর সৃষ্টিতেও অনুপস্থিত। পাঞ্জাবে রক্ত, আগুন, উচ্ছেদের মধ্যে বসে সাদাত মান্টো মানুষের সমকালের যন্ত্রণা, দুঃস্থতার সাক্ষ্য ধরে রাখেন বা রাখতে পারেন তা বাঙলায় সম্ভব হয় নি (মান্টো কি উপমহাদেশের সেই একতম মানুষ যাকে দেশভাগ সৃষ্টি ও ধ্বংস করেছে? মান্টো কি সেই মানুষ যার পক্ষে টোবা টেক সিং কি ঠান্ডা গোস্ত চেনাজানা হয়ে গেলে আর বেঁচে থাকা সম্ভব হয় না? মান্টো কি মাকে গণ ধর্ষিতা হতে দেখে ছিন্নভিন্ন অপাপবিদ্ধ কৈশরের আত্মহত্যা? মান্টো কি সেই শেষ স্বক্ষর যাহা উপমহাদেশের লুপ্ত কৌমার্য চিহ্নিত? মান্টো কি কৌমের হয়ে ব্যক্তির তরফে হাড়-মজ্জায় জালিয়ে রাখা সেই হোমাগ্নি যার পরশ মাথায় নিয়ে তাবত মানুষ চির হিংসা দ্বেষ মুক্ত হয়, হতে পারে?)। মান্টো-জন্ম সম্ভব হয় কি কেবল কৌমের চেতনা জুড়ে বর্ণ পরিচয়ের চির অনুপস্তিতিতে? বাঙলার মানুষ পাঞ্জাবের মত রক্ত, আগুন দেখেনি, বাবুরা বর্ণ চেতনায় নহে ধর্ম চেতনায় নহে নিরঙ্কুশ দাপট চেতনায় দেশভাগ চেয়ে স্বেচ্ছায় দেশ-কাল-ভিটে ছেড়ে ছিলেন এবং তার মূল্য দিতে হল ভারতভূমে সর্বার্থে দাপটহারা চির প্রান্তিক থেকে। স্বীকার থাকুক ইহা শিবিরে বিভক্ত সকল প্রগতিপরায়ন পাঁচনামিদিগের (সকলে জাত্যাংশে বর্ণ) হোমানল তুল্য শিরোধার্য ইতিহাসের অট্টহাস নহে, যাহা উহাদিগের প্রগতি মূলক ধর্মগ্রন্থ সমুহের সার, ইহা বর্ণাশ্রিতের শ্রম বিমুখতা সহ পশ্চিমা ইতিহাসকে ধরাছোঁয়া নির্মাণ বিনির্মাণ সম্ভবা দেবী জ্ঞানে উহার সহিত প্রণয় ও কেলি ও প্রণামের পরিণতি, সে দেবী চির চঞ্চলা লক্ষ্মী সম উপরুন্ত দেশভাগের পূর্বেই স্বচেষ্টায় (কেলি ও প্রণামে অতিষ্ট্য হইয়া কি?) ততদিনে তিনি তাহাদিগের নাগালের বাহিরে এবং ইতিহাসে নহে লিপিবদ্ধ ঘটনা এই যে সীমানা পেড়িয়ে সকল আহ্লাদী আত্ম-ধারণা নিমিষে ভেঙ্গে গেল এবং যে সঙ্কটে পরলেন তাতে আত্মপ্রশ্নের কোন অবকাশ রইলোনা এবং আজও তা সত্য। কেন? ঐতিহ্য নির্বাচনে ভুল অথবা উপনিবেশকতার অনুমোদিত দ্রোহে ভেসে ইতিমধ্যে শেকড় চ্ছিন্ন, আত্মপ্রশ্নে বাবুদিগের আজন্মের অনভ্যাস হেতু আরোগ্যের বর্তমানে হাজিরা দেওয়া অসম্ভব বলে? পিতা ও পিতার চির প্রণম্য প্রগতির পশ্চিমা উপপাদ্যসকল দ্রোহে নিবাদিত প্রাণ বাবুদিগের একতম সার ও সম্ভার এবং এ দ্রোহ বিলাসে আত্মপ্রশ্নের কোন অবকাশ নেই বলে?  

নিমাই ঘোষ ও ঋত্বিক ঘটকের ছবি যতই মূলত হিন্দু বাঙালির আত্মশ্লাঘার বিষয় হোক, বিনা কারণে অবশ্যই নয়, তা কিন্তু মধ্যবিত্তের দেশ হারানোর বিধুর সন্তাপেই শেষ হয়, দেশভাগ উত্তর উদ্বাস্তু জনের পক্ষে অদৃষ্টপূর্ব আধুনিকতাকে সামলাতেই ফুরিয়ে যায়; দেশভাগ নিয়ে বর্ণ জনের আত্ম-ছলনার রীতি, কলোনী জীবনে কৌমের ক্ষয়, আত্মপ্রসারণের ও আত্মমিমাংসার প্রকট অভাব কিছুই ধরা পড়েনা। এ কি বর্ণ জনের দেশ নিয়ে শেকড়হীন রোমান্টিকতা অথবা ‘দেশ হারানোর’ ক্ষতিপূরণ বাবদ ক্যাথারসিস? প্রথম বঙ্গ ভাগ কালে কিন্তু আত্ম-ছলনা থেকে আত্মপ্রসারণ, আত্মমিমাংসার হদিশ রবীন্দ্রনাথে ছিল, যা অন্য প্রসঙ্গে বলা ওঁর ভাষায় আমরা ‘বহন করিলাম, বাহন করিলাম না’। ছায়ানটের মত কিছু এ বাংলায় হয় নি, যা অতীব তাৎপর্যপূর্ণ এবং ও বাংলায় রবীন্দ্রনাথের গানে সিদ্ধি অর্জন করা মানুষ এ বাংলা থেকে ঢের বেশি। প্রকৃতি পক্ষে এ বাংলায় অকাল প্রয়াত রমা মণ্ডলের পর রবীন্দ্রনাথের গানে শিল্প সিদ্ধি আর কোন শিল্পীর নেই, এ-ঘটনা দু-বাংলার মধ্যশ্রেনির, যদিও এক ছোট অংশের, সত্তা সম্পর্কে যথেষ্ট উচ্চকিত ও অর্থবহ ঘোষণা। তবে দুই বাংলা জুড়ে রবীন্দ্র-চর্চা, ব্যক্তি বিশেষ বাদে, আজও নিতান্তই সারহীন, স্বাবলম্বনহীন, মানুষটাকে আত্মগত করার দিক-দিশা-সাধনা সব পক্ষেই অনায়ত্ত রয়ে গেছে।

(এখানে বাংলার বর্ণ হিন্দুর পশ্চিমি আধুনিকতা আত্মস্থ করা বা সামলানোর মিল-অমিল নিয়ে দুটি ব্যক্তি অভিজ্ঞতা নজরে নেওয়া আজ নিতান্তই প্রযোজন এবং তা এই কারণে যে সমকালের আধুনিকতা ও জাতি-রাষ্ট্র উভয়ের যৌথ মৌলবাদের মোকাবিলায় এঁদের কোন টিকে থাকা তাৎপর্য আছে কি না, তা কোন কাজে আসে কিনা বুঝতে। সমর সেন তিন পুরুষের প্রথিত যশ, প্রতিষ্টিত তত কিছু নয়, নাগরিক এবং বামপন্থায় আস্থাশীল, তা তখনো স্তালিনিয় রেশ টেনে চলা সোভিয়েত বাসের পরও অক্ষুণ্ণ, তুমুল একাডেমিক সাফল্য, তারুন্যেই কবি খ্যাতি, বাংলা ইংরেজি দুভাষায় যেন জন্মদত্ত দক্ষতা, শিল্প ভাবনা ও চর্চায়, রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক বিশ্বাসে, জীবন যাপনে নিখাদ আধুনিক, এবং কোন অর্থেই প্রতিষ্ঠাকামি নয়, নিজ বিশ্বাস যাপনের জন্য নিঃশব্দে মূল্য ধরে দিতে প্রস্তুত এবং তা জীবনভর দিয়েছিলেনও। কমলকুমার মজুমদার দুই পুরুষের নাগরিক, পারিবারিক যশহীন, একাডেমিক সাফল্য বলতে পাঠশালা পলাতক, ঘোষিত মতে আধুনিকতা বিরোধী না হলেও বিমুখ তো বটেই, নিজেকে বর্ণ হিন্দু জ্ঞান করা এবং তা নিয়মিত জাহির করা, যা বেশ কিছুটা সজ্ঞানে প্রদর্শনকামি তথা প্রগতিশীলদের চিমটি কাটা স্বরুপ, শিল্প ভাবনা ও চর্চায় দেশজ রূপ/সংস্কারে বিশ্বাসী ও সন্ধানী। বাংলা সাহিত্য ও লোকসংস্কৃতির চর্চায় যে অবদান রাখেন তা হয়ে ওঠে বিলিয়মান যুথের শেষ সংবেদনশীলতা ও স্বাক্ষর যা আজ যে কোন আধুনিকের পক্ষে আত্মস্থ কি অনুশীলন প্রায় অসম্ভব। সমর সেনের মত উনিও নিজ বিশ্বাস যাপনের তরে জীবনভর নিঃশব্দে চড়া মূল্য চুকিয়ে ছিলেন এবং সমর সেনের মতই এই জেনেই যে স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়, এবং এ বাবদ স্বচ্ছন্দে বলা যায় ওঁরা দুজনেই বুন রমানাথের অন্তত এ বাংলায় শেষ প্রতিনিধি। কেউ কোন দিন রাজবাড়িতে দাঁতের মাজন বেচতে যাননি এবং উভয়ের কাছেই একা আগুনই কেবল শ্রদ্ধাভাজন। এক গভীর অমিল রাজনৈতিক ভাবনায়; সমর সেন যেখানে স্পষ্টত প্রথাগত বাম, প্রযোজনে হিংসাশ্রিতেরও সমর্থক; সোভিয়েত বাস পর্বে তখনও জনস্মৃতিতে স্তালিনের সশ্রদ্ধ উপস্থিতিতে স্বস্তি কি উৎসাহিত বোধ করেন। কমলকুমার সেখানে রাজনীতি উদাসীন এবং স্পষ্টত হিংসা বিমুখ, উনি সম্ভবত সত্তরের কলকাতায় একমাত্র বুদ্ধিজীবি যিনি রাজনৈতিক বন্দী মুক্তি কমিটির আবেদনে স্বাক্ষর করতে আপত্তি করেন এবং স্নেহভাজনদের অনুরোধ প্রত্যাখান করে তাঁদের ধারণাকে বিপাকে ফেলেন। সত্তরের কলকাতার সমাজ-রাজনৈতিক আবহাওয়ায় এমন সই-অস্বীকার প্রতিক্রিয়াশীলতার পরাকাষ্ঠা এবং উনি অনড় ছিলেন, কারণ যাদের মুক্তি দাবি করা হচ্ছে তাঁরও তো হিংসা ও হত্যায় জড়িত; আর উনি ব্যক্তি হত্যা কি রক্তাত্ব উত্থানের, হিংসার বিরোধী যে ভাবে বিরোধী মানুষকে দমন শোষণের। উভয়েই নিজস্ব ভাষা চিহ্নিত; সমর সেনের ভাষা ব্যক্তি নাগরিকের, সমকালের এবং কমলকুমারের ভাষা শেষ পর্যন্ত হয়ে দাঁড়ায় এক লুপ্ত-প্রায় যূথের ‘লুপ্ত পুজাবিধি’ পুনরুধারের সচেতন চেষ্টা বা সমূলে আধুনিকতা প্রত্যাখ্যান। ওঁদের বিশ্বাসের বিপরিত মুখিতা এক জায়গায় এসে মিলেছিল, তা হল রবীন্দ্রনাথ, বলা ভাল রবীন্দ্রনাথকে ঠিক প্রত্যাখ্যানে না-হলেও সমকালে তত কিছু প্রাসঙ্গিক জ্ঞান না-করা। প্রকাশ থাক দুজনেরই পরবর্তিকালের বাঙালির ঠাকুরকে দেখা ও শোনার সুযোগ হয়েছিল। বিশ্বভারতী প্রসঙ্গে সমর সেনের উক্তি, ‘আমরা বলতাম বিশ্ব বা রথী’ বা ‘মহন্তের যত সমালোচনা হয় তত ভাল’। অবশ্যই তা ভাল, কিন্তু কেন বিশ্বভারতী ‘বিশ্ব বা রথী’ বা কেন ‘মহন্ত’ তা নিয়ে বিস্তারে যাননা, কেবল উক্তিই করেন। কমলকুমারের রবীন্দ্রনাথ নিয়ে বক্তব্যও উক্তিতেই আটকে থাকে, দেশি মদের আসরের শেষে নবীনদের বলে ওঠেন, ‘কাল তো তোমাদের অনেক কাজ, দেবেনবাবুর ছোটছেলের জন্মদিন’, এছাড়াও ‘ঠাকুর’ ‘প্রত্যাখ্যানের’ উক্তির বিবিধ জনশ্রুতি আছে। ওঁর লেখাপত্র থেকে অনুমান করা যায় তা মূলত ভাষা সংস্কার এবং আধুনিকতা নিয়ে। সমর সেনের ক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়া অনেক সামগ্রিক। কিন্তু চিন্তা ও সংবেদনশীলতা ও অভিজ্ঞতার দুই বিপরিত অবস্থানে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথ নিয়ে প্রতিক্রিয়া চরিত্র্য ঠিক কি রকম? 

সমর সেনের ক্ষেত্রে বলা যায় ওঁর প্রতিক্রিয়া বিশুদ্ধ পশ্চিমাগত আধুনিকের, বামের; যেখানে স্বাদেশিকতার স্থান নেই বা স্বল্প, ফলে যে রবীন্দ্রনাথ পশ্চিমেই পশ্চিমের চাঁপা পড়া অন্য সত্তাকে আত্মস্থ করার প্রযোজন বোধ করেন আমাদের স্বাদেশিকতার নবায়নের জন্য এবং তা করেও দেখান, যিনি স্বদেশের জন্য পশ্চিম উদ্ভাবিত প্রগতির একতম বিশ্বজনীনতা অস্বীকার করেন, দেশেজ আধুনিকতার মূর্ত রূপ হয়ে ওঠেন তাঁকে প্রগতির একতম পশ্চিমা বিশ্বজনীনতায় বিশ্বাসীর পক্ষে প্রত্যাখ্যান ছাড়া বিকল্প কিছু থাকে কি? এমন বিশ্বাসীরা কিন্তু আধুনিকতার উপনিবেশিক রূপ ও প্রাক্তন উপনিবেশে তার টিকে থাকা তাৎপর্য নিয়ে সচেতন নন।

অন্য দিকে কমলকুমারের ‘প্রত্যাখ্যান’ ওঁর শিল্প ভাবনা ও চর্চা ভিত্তিক অনুমান সাপেক্ষ। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য ভাবনা ও ভাষা সংস্কারের, বলা ভাল রবিন্দ্র-সৃষ্টি, অনুমান করা যায় কমলকুমারের কাছে যতই বিস্তৃত সুরম্য স্থাপত্যই হোক উহাতে প্রসারিত উঠন সহ আটচালার শান্তি, মাধ্যুর্য ও ক্ল্যাসিসিজম নাই, এ সৃষ্টিতে উনি প্রাচীন বাংলার দাঢ্য পাননা, যা বঙ্কিমে লভ্য (‘বঙ্কিমের কমা পর্যন্ত ভালাবাসি’), যা বিদ্যাসাগরে লভ্য, তৎ সহ লোকশিল্প চর্চা (উনি ব্যক্তিগত উদ্যোগে লোকশিল্প চর্চায় গভীর ভাবে যুক্ত ছিলেন, গ্রাম থেকে গ্রামে লোকশিল্পের সন্ধানে ঘুরেছেন, কখন সংগ্রহ করেছেন, এবং প্রবন্ধে লোকশিল্প চর্চার যে স্বাক্ষর রেখে যান তা একই সঙ্গে অ্যাকাডেমিক চর্চা ও মূলধারার স্বদেশ সন্ধানের বাইরের চেতনা, উহা ভক্তি ও ভাবের প্রাধান্য-চিহ্নিত এবং এক ভিন্নতর ব্যক্তিগত স্বদেশ হাজির করেন; উল্লেখ্য উক্তি, ‘তোমরা যাহাকে কিউরিও বলে আমি উহাকে গৃহদেবতা জ্ঞান করি’) সূত্রে উনি লোকায়তে বদ্ধ যে লোকোত্তরের সন্ধান পান রবীন্দ্রনাথে এসে তা কি ওঁর কাছে আধুনিকের বায়বীয় লোকোত্তর হয়ে যায়? তাই পরিত্যাজ্য? এক দিকে উপনিবেশিকতা ও আধুনিকতার যে সচেতনতা ব্যক্তিকে ‘বিশুদ্ধ’ স্বদেশ সন্ধানে তাগিদ পাঠায় পশ্চিমের নির্বাচিত আধুনিকতা পান হেতু রবীন্দ্রনাথে তেমন ‘বিশুদ্ধ’ স্বদেশ গড়হাজির অপর দিকে পশ্চিমি আধুনিকতার যে প্রগতিমূলক অভিঘাত সমর সেনের কাছে কাম্য বোধ হয় তা রবীন্দ্রনাথে অনুপস্থিত, সুতরাং তিনি আধুনিক ও বিশুদ্ধ স্বদেশির কাছে বাধ্যত পরিত্যাজ্য। এক ব্যক্তি রসায়ন ও সৃষ্টি রহস্য দেখে নাওয়া যাক; যে বঙ্কিমের কমা পর্যন্ত ভালাবাসা যায় ও যিনি বাংলা গদ্যে দাঢ্যের উৎস ও স্রোত তাঁহার হিন্দু ধর্ম কিন্তু মাধব সর্বস্ব ব্যক্তি কমলকুমারের সম্পূর্ন্ত বিপরীতে অবস্থান করে; কমলকুমারের হিন্দুয়ানা যেখানে ফুটিফাটা, কেন্দ্র কি পরিধিহীন, শেষে ব্যক্তি ও কৌমের ব্যখ্যা সাপেক্ষ চলিষ্ণু, যার কাছে পশ্চিমা আধুনিকতার অকাম্য অভিঘাত সামলাতে ওঁর হিন্দুয়ানা এবং তার সাহিত্যে, যাহাতে ক্ল্যাসিসিজমের বাস, ফিরে যাওয়াই যথেষ্ট, হিন্দু ধর্মের লোকায়ত হিন্দুয়ানা ছাড়া অন্য কোন রূপ কি তার রাজনৈতিক ব্যবহার ওঁর কাছে বৈধ নয়; ওঁর কৃষ্ণ কখনই রাঁধা কি গোপি সঙ্গ ছাড়া নয়, রাস ও লিলা মগ্ন ভিন্ন পৌরুষ দীপ্ত সংগঠক তিনি কখনোই নন যা বঙ্কিমের কৃষ্ণের একমাত্র পরিচয়, হিন্দু ধর্মকে উনি সেমিটিক করে গড়ে নিতে চান আর এখানেই বঙ্কিম হোয়ে ওঠেন পশ্চিম নির্মিত, কখনোই পশ্চিমের উত্তর হয়ে উঠতে পারেননা; বঙ্কিমের প্রতি সকল শ্রদ্ধা ও ভালবাসা সহ কমলকুমার স্থিত থাকেন ওঁর নিজের ধর্মবোধে ফলে কখনোই পশ্চিম নির্মিত নন, বরং ঐ ধর্মবোধের কারণেই নিজ সাহিত্যে ও প্রবন্ধে পশ্চিমের অকাম্য অভিঘাতের মুখে স্বদেশী উত্তরের কিছু আভাষ রেখে যেতে পারেন। ব্যক্তি ও তার সৃষ্টির নিশ্চয় ব্যখ্যা সম্ভব কিন্তু তারা কেউই কদাচ কোন ব্যকরণ জাত নহে, ব্যক্তির তরফে আত্মতা গঠনে স্বাধীনতাই প্রথমিক ও শর্তহীন – এ কথা এই জন্য যে ডেপুটি বঙ্কিম যে টুকু স্বাধীনতা পান বা পশ্চিমের অকাম্য প্রভাব মুক্ত হয়ে নিজের জন্য তৈরি করে নিতে পারেন বা তাতে ব্যর্থ হন তার বিপরীতে আনাগরিক কমলকুমার কিন্তু সমকালের আধুনিকের জন্য নির্ধারিত বৃত্তের বাইরে, হয়ে ওঠেন স্বাধীন ও সম্পূর্নত স্বরচিত। পশ্চিমের উত্তর হতে গিয়ে বঙ্কিম ধর্মাশ্রয়ে পশ্চিমের প্রতিচ্ছবি হয়ে ওঠেন ঠিকই যেখানে আত্মতা গঠনে মুসলিম কিছু আত্মগত অপর নয়, রেখে যান আধুনিক আগ্রাসী সহিংস হিন্দুত্বের আদি বীজ, আবার আধুনিকের কাছে যিনি ‘ঘটিরাম ডেপুটি’, তিনি কিন্তু আধুনিক বাংলা গদ্যের এক স্রষ্টাও বটে। পশ্চিমের অভিঘাতে যে নব্য মধ্যশ্রেণির উদ্ভব হয় তাঁদের শেকড় চ্ছিন্ন, অনুকরণ সর্বস্ব, পরজীবী যে জীবন তার নিখুঁত, নিখাদ ভাষ্য রেখে যান যা আজও বঙ্গ বর্ণ জনের স্বস্তি ও শ্লাঘা নাশক সত্য; বাবু – এই ছোট প্রবন্ধটি, যাহা পশ্চিম প্রেরিত নহে, যাহা আত্মছলনার রীতিকে চিহ্নিত ও অস্বীকার করে তাহা কিন্তু এক স্বদেশ-কাতর দেশজের পক্ষেই সম্ভব হয়। বঙ্গ বর্ণ জনের স্বস্তি ও শ্লাঘা নাশক এই প্রবন্ধটি বামবাবুরা স্কুল পাঠ্য থেকে বাদ দিয়েছিলেন, প্রমাণ রেখেছিলেন আত্মদর্শনে ঘোর অরুচির। এবং এ নিয়ে কোন শিবিরেই কোন বিতর্ক কি প্রতিবাদের নজির নেই, যেন প্রাকৃতিক নিয়মের মত খসে গেছে। বঙ্গ বর্ণ জন কি নিজেকে ক্রমে উপনিবেশিকতার বাইরে স্বভূমি কি স্বাচ্ছন্দ বোধ শূন্য করে তুলেছে?  

আজ উপনিবেশিক অভিজ্ঞতা ও গান্ধী-রবীন্দ্রনাথের পশ্চিম মোকাবিলার পুনঃমূল্যায়নে তর্কাতিতভাবে বলা যায় সমর সেন নিঃসন্ধেহে ব্যবস্থা নির্মিত কিন্তু কোন অবস্থাতেই ব্যবস্থা বাধ্য নন এবং তার জন্য মূল্য দিতে প্রস্তুত এবং অবাধ্য হওয়ার মূল্য চুকিয়েও ছিলেন। এই ব্যবস্থা নির্মিত হওয়ার জন্য সমর সেনের সৃষ্টি ও কর্ম ও বিরোধীতা ব্যবস্থার পক্ষে সহন সীমার মধ্যেই থেকে যায়, ফলে তার তাৎপর্য অচিরে ফুরায়, যদিও ওঁর সততা, নিষ্ঠা, ব্যবস্থা বাধ্য হতে অস্বীকারের তাৎপর্য অক্ষুণ্ণ থাকে। অন্য দিকে সার্কাস প্রশিক্ষিতের কাছে কমলকুমার তার যাবত সৃষ্টি ও যাপন নিয়ে এক ধাঁধা থেকে যান, কারণ যে সাহিত্য ও সাহিত্য বোধ ও স্বদেশ পাঠ হাজির করেন বা ব্যবস্থার বারদুয়ারি থেকে যায় ফলে তা প্রশিক্ষিতের পক্ষে ওঁর আজও টিকে থাকা অক্ষুণ্ণ তাৎপর্য পাঠ অসম্ভব করে তোলে এবং থেকে যান পাঠ্যের অন্তর্গত করা অসম্ভব হয়েই। এর কারণ কি ওঁর উপমহাদেশে টিকে থাকা উপনিবেশিকতার সচেতনতা, বলতেই হয় যার অভাব সমর সেনের মধ্যে প্রকট? শ্রেনীমুক্তি ও প্রগতির তরে পশ্চিমের ছত্রছায়াকে বিশ্বজনিন জ্ঞান করা ও কেবল তাকেই মান্যতা দেওয়ার ফলে স্বদেশ সন্ধান সমর সেনরা প্রাসঙ্গিক জ্ঞান করেন না? তাই কি আধুনিকের কাছে কমলকুমার প্রত্নলিপি সম, পশ্চিমি ব্যকরণের ছক বদ্ধ নন? এখানেই কি ওঁর সৃষ্টির টিকে থাকা অক্ষুণ্ণ তাৎপর্য? আর এখানেই কি সমর সেনরা সমকালিন প্রশিক্ষিত, ব্যবস্থা বাধ্যের, শহুরে বে.স. পাঁচনামিগণ সহ, কাছে বোধ্য, শিরোধার্য, ব্যবহার্য? ফলে সমর সেনদের বাৎসরিক ‘কাজ’ও প্রাতিষ্ঠানিক উজ্জ্বলতা এবং স্থায়িত্বও সম্পন্ন।

অপর দিকে কমলকুমার বড়ই একাকী, এ শহরে এ উপনিবেশে কমলকুমার চির অনাগরিক আগুন্তুক, হাজির হন বহু যুগের ওপার থেকে আর এ যুগকে ঘরে ফেরার তাগিদ দেন (বললে ভুল হবে কি, রাজনীতিতে গান্ধী যেমত বা?)। এবং সে ডাক দুরতম অর্থেও পিছুটান নয়; এ হল সমকালের বিকার ও দুঃস্থতা সর্বস্ব আধুনিকতার প্রতিকল্পে এক স্মৃতি-ধৃত ও সংবেদনে পাওয়া এক বাংলাকে হাজির করা যার অবলম্বে অন্তত শহরজন স্বরচিত, স্বাবলম্বি হয়, আজও তা হতে পাড়ে। এসব সাতপাঁচ কারণে মানুষটা ব্যবস্থা বাধ্যের কাছে অবোধ্য এবং বেঁচে থেকেন প্রতিষ্ঠান বিরোধী যদিচ স্বরচিত ও স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার দায়হীন শহরে ওঁর সঙ্গ-ধন্য কতিপয় খোকনসোনাদিগের স্মৃতি ধৃত উক্তি সংকলনে ও তাঁকে নিয়ে বোধশূন্য উচ্ছাসে, যথা বিখ্যাত সমিকরণ কমলকুমার কলমকুমার, বঙ্কিম চন্দ্র বাংলা উপন্যসের পিতামহ হলে কমলকুমার তার পিতা। নজরের বাইরে থেকে যায় আধুনিককে নিয়ে ওঁর অতি যর্থাত ও মৌল প্রশ্ন, ‘সে… আপনকার স্বরচিত?’। বর্ণ জন এই মৌল প্রশ্নের না স্বেচ্ছায় সম্মুখিন না উত্তর-সক্ষম। এখন পর্যন্ত মানুষটাকে শ্রদ্ধা নিয়ে শ্রম-সচ্ছল ও সফল বোঝাপড়ার নজির বাংলায় সামান্য। সমর সেন ও কমলকুমারের মজুমদার উভয়েরই নিঃসংশয়ে বলা যায় যথাক্রমে পশ্চিমকে মান্য জ্ঞান করা ও তার বিরুদ্ধে বিশুদ্ধ স্বদেশ খোঁজা শেষ হয় গান্ধী-রবীন্দ্রনাথকে সমকালে প্রাসঙ্গিক জ্ঞান না করায়, কারণ উপমহাদেশে এই দুই ভগীরথ যারা স্ববশে স্বদেশে স্থিত, পশ্চিমকে প্রত্যাখ্যান না করেও তার উপনিবেশিকতা ও তার দেশে দেশে সভ্যতার অভিযাত্রার বাইরে থাকেন ও ঘটান দুই সংস্কৃতির সংশ্লেষ, সুতরাং কোন এক দিক থেকে এঁদের বোঝাপড়া ব্যর্থ ও অনিবার্য প্রাসঙ্গিক জ্ঞান না-করায় শেষ হয়। আজ পর্যন্ত সীমানা নিরপেক্ষ ভাবেই বঙ্গ জনের বিদ্যা চর্চা প্রশ্নহীন প্রণাম বা ব্যাখ্যাহীন প্রত্যাখ্যানে শেষ হয়, সংশ্লেষ এদিগরে ভাসুর ভাদ্রবৌ সম্পর্কের ন্যয় অবৈধ, পাপ কর্ম – ইহাই উপনিবেশিকতার এক অশেষ দান – আর কে না জানে উহাতে বিরত থাকাই শাস্ত্র ও সভ্যতা সম্মত)।

আবার ও বাংলায় কেউ আর ভারত বলে না, পশ্চিমের মত ভারত ওদেশে ইন্ডিয়া। এ কি হাজার হাজার বছরে ভারতীয় সভ্যতা থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে নিজেকে দেখতে চাওয়া? এ ভাবে জোর খাটিয়ে নাড়ি কেটে আত্মতা গড়ে নেওয়া আদতে অপর-সহিষ্ণুতা, অপর-উন্মুখতা ঘুচিয়ে দুঃস্থতার ঘরদোর হয়ে উঠছে না কি? (ও বাংলার ‘ওঁরা’ কি জানে গত শতকে যদিচ বর্ণ হিন্দুর দুঃস্থ বঙ্গানুদৃত পশ্চিমা আধুনিকতা যাহাতে রক্ত ও পুঁজ সম পরিমাণ, ফলত তাঁরও ছিল এক দেশজ রূপ যাহা ধর্ম নিরপেক্ষ নহে বটে কিন্তু অনেকাংশে অপর সচেতন ও সহিষ্ণু এবং প্রজন্ম বাহিত অপর-আত্মগত করার সামর্থ্যে চিহ্নিত, বাঙালির সে উজ্জ্বল অর্জন জলাঞ্জলি দিয়ে ‘উহারা’ হয়ে উঠছেন একেশ্বরবাদী হয়ে ওঠার তাদিগ সম্পন্ন এবং পশ্চিমা তন্ত্র মতে ধর্ম নিরপেক্ষ, আধুনিক ও উন্নয়নগত প্রাণ এক ভাষিক এক ধর্মের এক জাতি এবং নামত বাঙালি নয় - বাংলাদেশী; এবং তাঁর বাঙালি সমাজকে অবাঙালি ইসলামিকরণ কি আঠারো-উনিশ শতকের আধুনিক পশ্চিমকে সামলাতে সতী দাহের সমর্থক ও উদ্যোগীদের নির্জ্ঞানে অনুকরন? এ কর্মে নিজ ধর্ম ও সত্তার বিশুদ্ধতা রক্ষিত হয়?)। এ বাংলায় বাঙালির চোখ খুললে বা মুদলে তাৎক্ষনিক পরিপ্রেক্ষিত বহু ভাষিক, বহু সাংস্কৃতিক ভারত, সে হাটেই তাকে নিজেকে চিনে নিতে, গড়ে নিতে হয় বলে সে এখনো ঠিক একমাত্রিক নয়। আজ ও বাংলার এক দুঃস্থতা সে ভারতীয় বৈচিত্র্য হারা, একমেটে, ঝরোখা আটা; তবে তারও আছে দুয়ার ঠেললে নিদেন হাজার বছরের স্মৃতি-সত্তা-সৃষ্টির অতুল বৈভব, যাহা সমন্বয়ির যাহা লোকায়তের, যাহা হিংস্রাশিত নহে, অধুনা যা কবন্ধ মূর্তি যথা – খুমাতেছে? সশ্রম নিষ্ঠায় প্রাণ সঞ্চারের অপেক্ষায়?  

এ দেশে জাতীয়তাবাদ, জাতি-রাষ্ট্ররে রাজনীতিতে আপাদ মাথা জড়িয়ে গিয়ে ধর্ম নিরপেক্ষ প্রগতি-নিষ্ঠ কি স্তালিনপরায়নরা যেভাবে নিজেদের জন্য মুসলিমের মসিহারা ভূমিকা ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারেন না, ওই একই কারণে ও বাংলার ইসলামি-করণের বিরুদ্ধে কথা বলেন না। ও বাংলায় এক হিসাবে ১৯৬৩ – ২০১৩ পর্যন্ত ১.৩ কোটি হিন্দু দেশ ছেড়েছে। এই স্রোত আজও অব্যাহত, এবং তা অব্যাহতই থাকবে। ও বাংলা কি অচিরেই হিন্দু শূন্য হবে? কিন্তু CAA অনুযায়ী ২০১৪-এর পর যারা এসেছে বা আসবে তাদের তো এদেশে ঠাই হবে না, কি হবে তাদের যাদের সংখ্যা ২০১৫ তে ১.৭ কোটি? বাঙালী সত্তার কথা বলে যে দেশের উদ্ভব তা আজ প্রতিবাদ প্রতিরোধ-হীন ভাবে মধ্য প্রাচ্যের কাঠ মোল্লাদের দখলে চলে যাচ্ছে। আর যা মজার ওই নিয়ে ওদেশে প্রশ্ন উঠলেও এদেশে কথা বলা যাবে না, হিন্দুত্ব প্রশ্রয় পাবে। বাঙালী সত্তার অন্তর্জলি যাত্রার মূল্যে হিন্দুত্বকে ঠেকাতে হবে? সে নিশ্চয়তা হিন্দুত্ব বিরোধী বাবুরা দিতে পারবেন তো? ও বাংলা থেকে অব্যাহত হিন্দুর স্রোত এ বাংলার জনবিন্যাস বদলে দিচ্ছে, জন ঘনত্ব বাড়িয়ে দিচ্ছে, সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি হিন্দুত্ব নিরপেক্ষ ভাবেই বদলে দিচ্ছে। ধর্ম নিরপেক্ষ সরকার তৎপর হলে দাঙ্গা ঠেকাতে পারে কিন্তু সরকারী ব্যবস্থাপনায় সাম্প্রদায়িকতার প্রসার ঠেকানো যায় না। কাল যদি এ বাংলায় দাবী ওঠে ও যার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে, ও বাংলায় হিন্দু নির্যাতন, বিতারণ ঠেকাতে ও বাংলার বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নিতে হবে তার জন্যে কিন্তু নিম্নবর্ণের/বর্গের সমর্থনের জমি প্রস্তুত হয়ে রয়েছে, (আদি পর্বের স্বেচ্ছা-উদ্বাস্তুর মত ‘দেশ’ নিয়ে মেদুর স্মৃতি কাতরতায় তাঁর আক্ষেপ শেষ হবার নয়, সে কিন্তু অত্যাচারিত, তাকে উৎখাত করা হয়েছে, তাঁর ক্রোধ ছাই চাপা আগুন হয়ে আছে) তাকে ভারতের সংবিধান, ধর্ম নিরপেক্ষতার বুলি দিয়ে, ঠেকানো যাবে তো? 

’৫১ সেন্সাস অনুযায়ী ও বাংলায় ২০.০৫% হিন্দু, আজ ওদেশের প্রধানমন্ত্রীর কথা অনুযায়ী ৯%, প্রকৃতপক্ষে আরো কম। এই হিংস্রতার বিরোধীতা করার থেকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধীতা (বাবুরা এহেন সাম্রাজ্যবাদের কুশ-পুতুল পোড়ানোর পবিত্র নিত্য কৃত্যের সময় কোন দিন ভুলেও বলেননি মার্কিন সভ্যতা নামক জাদু ও বাস্তবতা দাঁড়িয়ে আছে কয়েক কোটী আদিবাসীকে সফলভাবে খুন করে। সে কি পৃথিবীর প্রথম ও সফল গণহত্যার ইতিহাস পাঠের শ্রম স্বীকারে অক্ষমতা? সে কি নিহতেরা আদিবাসী বলে? সে কি বাবুদের নির্জ্ঞানে মার্কিন ‘সভ্যতার’ হাতছানি এড়ানো সম্ভব হয় নি বলে? সে কি নামে নামে যমে টানের মত এক গণহত্যার কথা বলতে গিয়ে আর আর মুক্তি দাতাদিগের গণ অত্যাচার ও গণহত্যা কথা উঠে পড়তে পারে বলে? সে কি উন্নয়ন ও ইতিহাসের পূর্ব নির্দিষ্ট স্তর পেরতে গণহত্যা পবিত্র মতাদর্শ সকলে অনুমোদিত বলে? এখন শুধু মনে পড়ে গত শতকের এক বাংলা গল্পে ধৃত নিরুপায় এক কৃষক-যূথের পক্ষে ক্রোধের নিয়ন্ত্রনহীন ও বাধ্যত মুক্তি হিসাবে ব্যক্তি হত্যা অন্তে যূথ-প্রবীণ ইয়াসিনের নিঃশব্দ প্রার্থনার লেখক কৃত অনুমান ‘যেন প্রার্থনা করছে মানুষের সঙ্গে ইতিহাসের দূরত্ব প্রান্তর প্রান্তর হয়’ (কমলকুমার মজুমদারের কয়েদখানা), খুনের ইতিহাসের সঙ্গে মানুষের দূরত্ব তবে প্রান্তর প্রান্তর না হলে প্রান্তর জোড়া সভ্যতা নামক ঊষরতার শেষ নেই!), রঙ নির্বিশেষে গণহত্যা নিয়ে চর্চিত নিরপেক্ষতা, নিঃশব্দতা নিয়ে এদেশে ধর্ম নিরপেক্ষতা রক্ষা এবং তা বাঙালি সত্তা বিসর্জনের মূল্যে! তেমন ধর্ম নিরপেক্ষতা রক্ষা কিভাবে আর কেন বড় হয়ে ওঠে? এবং তাতে কোরে কি দুই বাংলার মানুষ স্ব-নির্বাচিত কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন পথে বাঙালী সত্তা হারিয়ে বিলোপে যাচ্ছে না? এক জায়গায় মসিহা রূপে অথবা মসিহাদের ছত্রছায়ায় আর এক জায়গায় ইসলামের দাপট দেখিয়ে, তার কি হবে? মুসলিমকে ছাড়া হিন্দুত্ব ঠেকানো কি হিন্দুকে ছাড়া ইসলামি-করণ ঠেকানো সেই তো জাতি-রাষ্ট্রের ‘ভালোদের’ মসিহারূপ! এই মসিহাদের তত্বাবধানেই তো বাংলা তার নিজস্ব সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য হারাচ্ছে, সহনশীলতা হারাচ্ছে, দুপাড়েই অদ্বৈতবাদী হয়ে উঠছে তারই বা কি হবে? এখানে একটা দরকারি কথা ভারতে হিন্দুত্ব হিন্দুদের জন্য যত ক্ষতিকারক মুসলিম মৌলবাদ মুসলিমদের জন্য তারও বেশি ক্ষতিকারক। মুসলিম মৌলবাদ মুসলিমদের অনেক গভীর এবং নির্ভরযোগ্য ভাবে ধর্মভিত্তিক একমাত্রিক পরিচয়ের গর্তে ঠেলে দেবে, তার ভুল আগ্রাসন, বিচ্ছিন্নতা বাড়বে – যা হিন্দুত্বের একান্ত কাম্য। হিন্দুত্বের সৃষ্ট মুসলিম স্টিরিওটাইপ জনমানসে আরো গভীরে যাবে।

দু-পাড়েই বাবুরা পারস্পরিক হানাহানির পাথুরে ইতিহাস সম্বল করে বসে আছেন। দু-পক্ষই পরস্পরের পাপের হিসাবে বড় বেশি দক্ষ। স্মৃতির ‘সত্য’ নির্ণয়ে পশ্চিমা ধর্ম নিরপেক্ষ কৃত-কৌশলে সকলেই অধুনা বেশ দঢ়। কিন্তু উভয়ের মানসে স্মৃতির বিষ কি ভাবে কাজ করে চলেছে বা তার থেকে কি ভাবে আরোগ্যের বর্তমানে হাজির হওয়া যায় তা নিয়ে কেউই উদ্যোগী হতে অক্ষম এবং মনে হয় নারাজও বটে।

 

বঙ্গীয় মুক্তিদাতার নব্য ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র অথবা ধর্ম নিরপেক্ষ স্তালিনপরায়নতা

বাঙালি বামুন-কায়েত-বদ্যি পুরুষ সকল মানবের যে সব সদ গুন, যথা, নীচতা, ক্রূরতা, প্রতিশোধ পরায়ণতা, শঠতা, লোভ ও ক্ষমতার জন্য অনৈতিকতা, তীব্র অসহিষ্ণুতা, কূপমণ্ডুকতা, দ্বিচারীতা, হিংসা ছাড়া সৃজন-সামর্থ্য-হীনতা, অন্যের প্রশ্নশীল সৃজনশীলতা দেশের ও দলের ভালোর নামে দমন করার ক্ষমতা, শৃঙ্খলার নামে শৃঙ্খলপরায়নতা, গোপন লাম্পট্য ইত্যাদি মহর্ষি স্তালিনের মানবিক গুনসকল যারা মতাদর্শ রূপে ধর্মীয় নিষ্ঠায় ধর্ম নিরপেক্ষতা ও প্রগতিশীলতার নামে পালন করেন তাদের স্তালিনপরায়ন বলে। তাদের চরিত্রের নাম তখন স্তালিনপরায়নতা। এই সকল গুনের একত্র নাম স্তালিনতা। এই ধর্ম নিরপেক্ষ মৌলবাদ অথবা স্তালিনপরায়নতায় আত্মবিলোপ বাঙালি বর্ণ হিঁদু সুধী জনের নিজ চরিত্র সাজ্যুয্য হেতু সহজে সম্ভব হয়ে ছিল এবং আজও তা সকল বঙ্গ বামের পরিচয় চিহ্ন। অথচ উপনিবেশ পর্ব জুড়ে সে কিন্তু স্তালিন সম অদ্বৈত্ববাদি কি আদ্যান্ত হিংস্রাশয়ি ছিল না, উপনিবেশে পশ্চিম এবং তার আধুনিকতা যত প্রগাড় হয়েছে ঠিক সেই অনুপাতেই বঙ্গ বর্ণ জন স্তালিনপরায়ন হয়ে উঠেছে। মানব মুক্তির তরে তাঁর কাছে স্তালিনপরায়নতা নির্বিকল্প পথ ও পাথেয়। অনস্বীকার্য এ সব গুন বর্ণ হিন্দুর একচেটিয়া নয়, কিন্তু মহর্ষির এসব মানবিক গুনের সঙ্গে বর্ণ হিঁদুর চরিত্র ও স্বভাবজ নৈতিকতার সাযুজ্যের কারণেই কি শিবির নির্বিশেষে তার বামপন্থা সকল প্রশ্ন-হীনভাবে স্তালিনপরায়ণ? এ ছিল আধুনিকতার ব্যক্তি কেন্দ্রীক উন্নয়নের হিংস্রতাকে শ্রেণী মুক্তির নামে শোধন করে নেওয়া। উপনিবেশে স্বাধীনতা নামক ঘটনা উপনিবেশিক সভ্যতার অভিযাত্রাকে স্থায়ী করে গেলে এবং দেশভাগ ব্যক্তিকে কৌমের স্মৃতি-সত্তা হারা করে গেলে ক্ষমতার সঙ্গে যুঝতে লেনিনের-হাতে-সফল-মার্ক্সবাদ নামক ধর্ম নিরপেক্ষ ক্ষমতা তন্ত্রের সাধনা স্বদেশে পরবাসী হয়ে যাওয়া বঙ্গ বর্ণ জনের একাংশের কাছে মুক্তির দিশা হয়ে ওঠে। এমন দিশার মধ্যে সহজে মিলে যায় ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের ও আবিশ্বের নিঃস্বজনের মুক্তিদাতার দাবি – সে দাবি নিজ ভূমিকার যথার্থতার, ইতিহাস নামক পূর্ব নির্দিষ্ট সিঁড়ি ভাঙ্গার অনিবার্যতা, চিরকালিন মুক্তির তরে ‘সাময়িক’ হিংসার অনিবার্যতা এবং শেষে দল ও মতাদর্শ নামক তন্ত্রের সাধনায় মতান্ধ মৌলবাদী কৌম-চ্ছিন্ন ব্যক্তির নির্নন্তন উৎপাদন ইত্যাদি। ফলিত মার্ক্সবাদ নামক তুমুল সফল ঘটনা যে উপনিবেশিক সভ্যতার অভিযাত্রার নিছক আরোপিত শ্রেনীরূপ, সমান হিংস্র, বিশ্ব-প্রাণধ্বংসী উন্নয়নের একই রথ তা ক্ষেত্রজের বোধে না আসাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেক্ষেত্রে দেশভাগ উত্তর ভারত জুড়ে বাম উত্থান ঘটল না কেন? শিবিরে বিভক্ত হয়ে আত্মক্ষয়ের পথে আঞ্চলিক মসিহা রয়ে গেল কেন?

এ বঙ্গের ক্ষেত্রে বর্ণ বাম জনের শিবির নির্বিশেষে দেশভাগ উত্তর এত মরিয়া, হিংস্র, ‘ধর্ম নিরপেক্ষ’ স্তালিনপরায়ন হয়ে ওঠার মূলে কি সাভারকর-মানসিকতা, যা শতাব্দীর শুরুতে ব্যক্তি ইংরেজ হত্যায় স্বাধীনতায়র পথ খুজেছিল এবং স্বাধীনতার ঠিক পরে উহার ষোলোকলা পূর্ণ করতে গান্ধী খুনে বাধ্যত অনন্যোপায় এবং আদ্যান্ত পশ্চিম প্রেরিত হবার কারণে রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধী আজও পাঠে অক্ষম? এঁরা এত তুমুল পশ্চিমা আধুনিক, রাষ্ট্রবাদী এবং সহিংস, ন্যুনতম মত পার্থক্যে শিবির নির্বিশেষে চরম অসহিষ্ণু, হননোদ্দত কেন? এঁরা ঠিক ঘোষিত ভাবে জাতি-রাষ্ট্রের সাধনায় ছিলেন না এবং এ দেশের জন্য তার সমস্যা নিয়েও উদাসীন ছিলেন ও আজ চিন্তন সদিচ্ছা, সামর্থ্য শূন্য, সঙ্গে এ বোধরিক্ত ছিলেন যে তাঁদের রাজনীতি এবং বিরোধীতা জাতিয়তাবাদ ও জাতি-রাষ্ট্রের অনুমোদিত বৃত্তেই বদ্ধ। এঁরা বরং লেনিনিয় প্রজ্ঞা-সিদ্ধ শ্রেনী রাষ্ট্র নিয়ে ভাবিত এবং ভারতী সমাজ মনে কেন্দ্রহীন বহুত্বের নির্দ্বন্দ্ব, প্রযাসহীন প্রহনযোগ্যতা এদের এক কেন্দ্রীয়, স্থির অভ্রান্ত মতাদর্শ ভিত্তিক দল সর্বস্ব রাজনীতিকে প্রান্তিক করে রাখছিল, মুক্তি যাঁদের ‘প্রযোজন’ তাঁরা ছিলেন উদাসীন/বিমুখ। উদ্বাস্তু স্রোত বামেদের কিছু ভিত্তি দিল যদিও উদ্বাস্তু আন্দোলন প্রথম থেকে বহু দলীয় এবং বামেদের গ্রহণযোগ্যতাও একচেটিয়া ছিল না, প্রকৃতি পক্ষে উদ্বাস্তু আন্দোলন উদ্বাস্তুদের হাতেই ছিল যার সঙ্গে দল নিজেকে খাপ খাওয়াতে বাধ্য হয়েছিল অবশ্য নিজ সৃজনশীলতায় সে আন্দোলনকে সম্পূর্নত দল-বৃত্তে বদ্ধ করে নিতে পেরেছিল। দেশভাগ বর্ণ হিন্দুকে স্বদেশ হার করেছিল, কিন্তু শুরুতে জাতপাত বিবেচনা হারা করতে পারেনি, উদ্বাস্তু আন্দোলন এবং সরকারী তরফে ত্রাণ ও পুনর্বাসনে জাত পরিচয়ের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল সুতরাং বৈষাম্য অটুট ছিল। এই স্তালিনপরায়ন বর্ণ জন উপনিবেশিক সভ্যতার আদর্শ সন্তান, প্রগতি অন্ত প্রাণ; স্বদেশ চর্চায়, ব্যক্তি বিশেষ বাদে অনীহা ও অক্ষমতা; ‘মুক্তির’ হদিশে নিজস্ব ভ্যাটিকান-অন্ধতা এসবের সঙ্গে ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র যেভাবে আদি পর্বে উপনিবেশিক আধুনিক সভ্যতাকে আত্মস্থ করে নিজেকে টিকিয়ে রাখল তার সঙ্গে মিল আছে, মিল নেই আদি পর্বে এই ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র আধুনিকতাকে মোকাবিলা করতে গিয়ে যেটুকু যা আত্মপ্রসারণ ঘটাল বা সৃষ্টিশীলতা দেখাল তার সঙ্গে। এর এক কারণ কি বঙ্গ বর্ণ জনেরা তখনো কৌমের স্মৃতি-সত্তা হারা নয়, ফলে নিজস্ব সাংস্কৃতিক শেকড়হীন ও পূঁজি শূন্য নয়? পুঁজির সার্বিক দাপটের পূর্বেই সাংস্কৃতিক বোঝাপড়া অংশত সম্ভব হয়েছিল, যা অন্য ভাষা-সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী ক্ষেত্রে বঙ্গ বর্ণ জনের মত প্রযোজ্য নয়?

স্তালিন-ভক্ত বা পার্টি সর্বস্ব কিন্তু কিছু মাত্র স্তালিনপরায়ণ নয় এমন মানুষ সব দলে সামান্য হলেও ছিলেন, ব্যতিক্রমহীন ভাবে তারা কেউই নেতা নন যদিও পার্টি ও পরার্থে নিবেদিত প্রাণ এবং তা নিঃস্বার্থে। শুরুতে স্থানীয় স্থরে এরা সংখ্যা গুরু হলেও ক্রম বিলীয়মান প্রজাতি হয়ে প্রায় ’৭০-এর গোড়া পর্যন্ত টিকে ছিলেন। ঠিক একই ভাবে ধর্ম নিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদী মহল্লায় কথায়-কাজে, জীবনযাপনে যারা গান্ধী অনুগামী তারা চির-প্রান্তিক। আমাদের রাজনীতি ও দলীয় কাঠামোর মধ্যে এমন কিছু ছিল এবং আজও আছে যাতে এই মানুষেরা চিরকাল সমানভেবে প্রান্তিক থেকে গেলেন – সমাজে ও দলে।

সব কিসিমের বঙ্গ বর্ণ বামেরা ’৭০-এর দশক পর্যন্ত এবঙ্গে টিকে থাকা মূলত বর্ণ হিন্দুর ধ্বংসপ্রায় কৌম সত্তার শেষ অবশিষ্ট উদারতা-আদর্শবাদীতার সুফল ভোগ করেছে, প্রতিদান বলতে শ্রেনী মুক্তির নামে হিংসার প্রসার ও তার প্রাতিষ্ঠানিকতা। উত্তর-আধুনিকরা এর উত্তরে আধুনিকতার নিজস্ব অসুস্থার (pathology of modernity) যে কথা বলেন তা দিয়ে সমস্যার সবটা ধরা পড়ে কি? বরং এভাবেও কি দেখা যায় যে বর্ণ হিন্দুর ব্রাহ্মণ্যতান্ত্রিক মন-মানসিকতার সঙ্গে পুঁজির উৎপাদন রীতি, মালিকানার ‘ন্যায্যতা’ আর আধুনিকতার অনন্যতা ও বর্জনের দাবি ও যুক্তির চরিত্রগত সাযুজ্য তার সহায় হয়েছিল? সে ক্ষেএে পুঁজির উৎপাদন রীতি ও ধর্ম নিরপেক্ষ ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদী সংস্কৃতি কে আমাদের ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের সঙ্গে মিলিয়ে দেখার প্রযজোন থাকছে। এদেশে পশ্চিমা ধর্ম নিরপেক্ষ বা ‘শ্রেণী-আশ্রিত’ স্তালিনপরায়ন রাজনীতি সব ধরনের সংখ্যালঘু সত্তাকে অনেক কাল হল গিলে নিতে পেড়েছে। প্রকৃত পক্ষে সেই সাম্রাজ্যের কাল থেকেই রবীন্দ্রনাথ-গান্ধী বাদে সব বিরোধীতাই ব্যবস্থা-সহায়ক বিরোধীতা, এটাই এদেশে সকল বিরোধীতার একতম মডেল। সব ধরনের সংখ্যালঘু সত্তার বিরোধীতা, ‘শ্রেণী সংগ্রাম’ শেষ হয়েছে ব্যবস্থা-সহায়ক/ ক্ষমতায় অংশগ্রহণের দাবিতে যা কম-বেশী পেয়ে তারা ক্ষান্ত হয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ-গান্ধীর মত বিরোধীতা ও বিকল্পের স্বদেশী সিদ্ধির উদাহরণ থাকা সত্ত্বেও উপনিবেশ সৃষ্ট রাজনীতি সংস্কৃতি ও অর্থনীতির টিকে থাকা মেরুদণ্ড ভেঙে দেবার অহিংস, সৃষ্টিশীল রাজনীতি, সংস্কৃতি তৈরি হল না কেন? সংক্ষেপে আধুনিকতা ও ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের সহবাসে জন্ম নিল যে হাঁসজারু মেটে ফিরিঙ্গি তাঁর পক্ষে শ্রমাশ্রিত মেধা অর্জন ও নিষ্ঠা ভরে স্বদেশ চর্চা ও সকল স্বার্থে সকল অর্থে মুক্তির দিক-দিশা নির্নয় সম্ভব নয়। বাঙালির জন্য এর সঙ্গে আর এক নিশ্চিত কারণ দেশভাগ যা নিয়ে আজও বাংলা ভাষায় বিস্তৃত চর্চা হয়নি এবং যার মূল্য নিত্যই দুপরের সকল বাঙালিকে মেটাতে হচ্ছে।

এবঙ্গের যথার্থভাবেই (এবং ওঁদের সাধের পশ্চিম প্রেরিত নির্মম ইতিহাসের শপথ নেওয়া ও সে ইতিহাসের অনুমোদন ক্রমেই) অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাওয়া বাম আন্দোলনকে পেছন ফিরে দেখলে যা স্পষ্ট হয় তা হলো ভ্যাটিকান নির্বিশেষে অনুগামীদের স্বদেশ নিয়ে বোঝাপড়ার সঙ্কীর্ণতা, রাজনৈতিক সৃজনশীলতার অভাব, নির্জ্ঞানে ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের ফল্গুধারা শেষ পর্যন্ত স্তালিনপরায়নাতায় পরিণতি পাওয়া, আবার নেহেরুর আদর্শে মুসলিম ও নিম্নবর্ণের মসিহা হয়ে ওঠা। স্ব স্ব ভ্যাটিকান অনুপ্রাণিত এরা উপমহাদেশে জাতীয়তাবাদ, জাতি গঠনের মত অস্বাভাবিক কর্ম যার স্বাভাবিক পরিণতি ধর্ম ভিত্তিক দ্বি-জাতি তত্ত্ব, দেশভাগ, ভারতে জাতি-রাষ্ট্রের আসম্ভবতার সমস্যা, সংখ্যালঘু, দলিত, মহিলা, শিশু, পরিবেশ এসব প্রশ্ন নিয়ে ভাবতে নারাজ ও অক্ষম। আদতে দেশভাগ ও বিবিধ কারণে ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে চ্যুত বঙ্গীয় বর্ণ হিন্দু মধ্য শ্রেণীর পুরুষের লুপ্ত হেজেমনির জন্যে ক্যাথারসিস ছিল বামপন্থাসকল। আজ বিশ্বায়নের হাত ধরে বর্ণ হিন্দু মধ্য শ্রেণীর বর্তমান প্রজন্মের এই ক্যাথারসিসের প্রয়োজন ফুরিয়েছে ফলে বামেরাও অপ্রাসঙ্গিক হয়ে চলেছে। স্ব স্ব ভ্যাটিকানকে প্রশ্ন করতে না পারা এবং ‘আপনকার স্বরচিত’ ও স্ববশ হতে না পারার মূল্যে নিজেদেরকে এরা প্রত্ন-প্রাণী করে তুলল। 

কখনো উদাসীনতা, বিমুখতা নিখাদ হত্যার নামান্তর। আজন্ম তুমুল আন্তর্জাতিকতার চূড়ামণি বর্ণ হিন্দু প্রগতিপরায়ন বাঙালির গান্ধীর ক্ষেত্রে ভূমিকা এ রকম গোএের হত্যাকারীর। আর তার রবীন্দ্র-প্রেম নিখাদ আত্মরতির, কখনো আত্মপ্রতিষ্ঠার পরাকাষ্ঠা, অন্যদের শিক্ষণীয়। এই দুই ভারতীয় চিরহরিৎ বনস্পতি নিয়ে তার চির উদাসীনতা আর অনন্ত আত্মরতির উৎসে স্তালিনপরায়নতা ছাড়া আর কি আছে? এর সঙ্গে কি কোনরকম সম্পর্ক আছে তার ও-বাংলা নিয়ে উদাসীনতার? আজ ও-বাংলায় মধ্য প্রাচ্যের তুল্য ইসলামি-করণের যজ্ঞ চলছে, তা নিয়ে বিশেষত হিন্দু নির্যাতন, বিতারণ নিয়ে তার উদাসীনতাকে একরকম হিংস্রতাই বলা যায়। ও-বাংলায় তুমুল ইসলামি-করণ কি হিন্দু নির্যাতন, বিতারণ নিয়ে কথা বলা অঘোষিত ভাবে এ-বাংলায় নিষিদ্ধ, যুক্তি খুবিই স্পষ্ট – হিন্দুত্ব প্রশ্রয় পাবে। দুপাড়ে দেখা হলে ’৭১-এর ‘মুক্তিযুদ্ধ’ নিয়ে ঢ়ে-কুর তোলাই একতম রীতি। বিবিধ প্রগতিশীল গোষ্ঠতে গত শতকে বিশ্ব মানবের মুক্তি দাতা মহর্ষি স্তালিনের গুলাগ আর গণহত্যা নিয়ে কথা বলা বারণ ছিল, একই যুক্তি – মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ সুযোগ নেবে। পরিণতি তামাদি হয়ে শেষে ঐ পুঁজি কোলেই আশ্রয় নেওয়া। হিংসা, গণ-অত্যাচার, গণহত্যা নিয়ে নীরবতা চরম অনৈতিক এবং দুঃস্থতার অভ্রান্ত ও অনুদ্ধারনিয় শ্রেষ্ঠ লক্ষণ। 

দুপাড়েই বাঙালি আজ আরো একবার পশ্চিম মুখি – এপারের মক্কা অযোধ্যা, ওপাড়ের কাশী মধ্য-প্রাচ্য। দুপরেই বাঙালি সত্তা বিসর্জনে সে যেন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। স্বদেশী ইতিহাস-হীন হয়ে আধুনিকতাশ্রয়িতায় এর সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা হয় না। বরং বর্ণ হিন্দুর মন-মানসিকতায় অটুট থেকে যে ভাবে পশ্চিমা আধুনিকতাকে সে একদা আত্মগত করেছিল তা এক রকম সৃজনশীলতাই বলা যায় (না কি সাম্রাজ্যের কাছে হেরে, তার সঙ্গে বাধ্য হয়ে তাল মিলিয়ে নিছক বাইরের প্রলেপ?)। বর্ণ হিন্দু বাঙালি কি বইয়ে লেখা সেই চিরন্তন হিন্দু যে চিরনমনিয় এবং চির-অপরিবর্তনীয়? তা হলে তো তার স্বাভাবিকভাবে আজকের হিন্দুত্বকে উপেক্ষা করার কথা, কিন্তু তা তো হচ্ছে না। তবে কি উত্তর ভারতীয় হিন্দুত্বরে আধুনিকতা বাঙালি বর্ণ হিন্দুর আদি আধুনিকতা কে গিলে নিছে? কি ভাবে তা সম্ভব হচ্ছে? আধুনিকতার শামলা গায়ে চড়ানো সময় যে হিংসা ও হিংস্রতাকে সে ক্রমে ধর্ম নিরপেক্ষ প্রতিযোগিতায় বদলে নিতে শিখে ছিল সেই চাপা পড়া অর্ধ-সত্তা কি আজ ঘরের মাঝে পশ্চিমা হিন্দুত্বের ছত্রছাওয়ায় ‘শক্র’ খুঁজে মুক্তি পাছে? এক্ষেএে কিন্তু দেশভাগ তাকে শিকড় ছিন্ন করে পথ দেখিয়েছে। দেশভাগ ওপাড়ের মুসলমানকে ঠাঁই নাড়া না করেও শিকড় হীন করে দিয়েছে। একদা হিন্দু আধিপত্যে চাপা পড়া তার অর্ধ-সত্তা কি একই ভাবে আজ ঘরের মাঝে শক্র খুঁজে মুক্তি পাছে? ও-পাড়ে সমাজ জুড়ে তীব্র ইসলামি-করণ কি পশ্চিমা আধুনিকতার কাছে হেরে তার উত্তর হয়ে দেখা দিচ্ছে সঙ্গে তাঁর ’৫০ উত্তর অব্যাহত হিন্দু বিরোধী হিংসা ঢাকার তাগিদ? জাতি-রাষ্ট্রের আবেদন অস্বীকার করে থেকে যয়া ঘরের হিন্দুকে প্রয়োজন মত হনন কি উচ্ছেদে রত সে কি আধুনিকতার মৌলবাদকে ধর্মীয় মৌলবাদ দিয়ে ঠেকাতে চাইছে? হানা-হানির পথেই তবে সফল জাতি-রাষ্ট্র সম্ভব হয়? হায়, দুপাড়েই বাবুদের ভাবা প্র্যাকটিস আর হয়ে উঠল না! দুপরেই বিবিধ মৌলবাদের সামনে রিকেটি শিশুর মতো সে; দাঁত ছড়-কুটে পড়ে থাকা মুক্তিযোদ্ধার ভূমিকায়। এছাড়া গতি নেই কোন?

প্রসঙ্গগত প্রকাশ থাক ১৯৩৫ সালে এক বাঙালির গান্ধী নিয়ে ভবিষ্যৎবানী তুল্য পর্যবেক্ষণ 'Is Gandhi a nationalist?' He was, after all, more of an internationalist, and more intimately tied to the poor peoples' cause to be a 'nationalist', in the usual sense of the term. But for the sake of India's freedom, there had come about an alliance between the radical Gandhi and the nationalist forces; and as Gandhi became more and more radical in action, the nationalist forces would tend to drop away from his company’. (স্পন্দমান এ পৃথীবি যার হৃদয় তাঁর পক্ষে কি কোন অবস্থায় কোন অর্থে জাতীয়তাবাদী হওয়া সম্ভব?) নির্মল কুমার বোসের এই ভবিষ্যৎ বানী সত্য করতে আধুনিক জাতীয়তাবাদী ধর্ম নিরপেক্ষরা ১৩ বছর সময় নিয়ে ছিলেন। রাজনৈতিক বৃত্তের বাইরে থাকা ওঁনার পক্ষে কি ভাবে সম্ভব হয়েছিল এমন প্রফেসি করা? এ কি শুধুই বুদ্ধি-বিচার? নিজের দেশ-কালে কি ভাবে নিঃস্বার্থ ফলে অবিবাদি লিপ্ত থাকলে মাথার ভিতর এক বোধ, অস্থির মধ্যে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ চেতনার জন্ম হয় এ হল তার উদাহরণ। হায়, শুধু রবীন্দ্রনাথ নয়, প্রাকৃত বাঙালি জনেরও তবে পশ্চিমা আধুনিকতার বাইরে নিজস্ব চেতনা বলে কিছু ছিল! মূলত স্তালিনপরায়নদের তত্ত্বাবধানে বাঙালির প্রগতি-নিষ্ঠতার ইতিহাস তার এই নিজস্ব চেতনা, দেশ-কালে জুড়ে লিপ্ত থাকার রীতি-রেওয়াজ হারানোর ইতিহাস। আজ আমাদের রাজনীতিকে হতে হবে এই লুপ্ত চেতনা আর দেশ-কাল জুড়ে সংলিপ্তি ও স্বাদেশীকতা পুনরুদ্ধারের ব্রত। 

জাতি-রাষ্ট্রের একটি রাজ্যে ক্ষমতা সাধনার সরকারী ঠিকাদারির প্রতিযোগিতায় নেবে ও দীর্ঘকাল জিতে বঙ্গ বর্ণ সরকারী বামেরা হিন্দুত্বের জন্য একটি কাজ সাফল্যের সঙ্গে সেরে রেখেছেন যার ফসল আজ হিন্দুত্ব রোজ ঘরে তুলছে। তিন দশকের বেশি লেনিন মূর্তির পাদদেশে নিত্যই নিয়ম করে আছড়ে পরেছে তুমুল আন্তর্জাতিকতাবাদের ঢেউ আর ঠিক সমান ভাবে বাঙালির, বিশেষত শহর-গ্রামের মধ্যশ্রেনির, মন-জীবন ও ধারনা-জগতকে ক্রমে দখল নিয়ে পার্টি সর্বস্ব/নির্ভর করে ক্রম সঙ্কুচিত করে গেছে, নির্মাণ করে গেছে প্রশ্নহীন, ব্যবস্থা বাধ্য গেরস্থ, যার মন-জগতে উন্নয়নের জড়িবুটি বেচতে আজ হিন্দুত্বকে কোন অসুবিধায় পড়তে হচ্ছেনা, কোন মৌলিক প্রশ্ন তাকে সামলাতে হচ্ছেনা, বরং ক্ষেত্র যেন প্রস্তুত। ক. পু.-এর কর্তব্য নিষ্ঠ, রুল বুক মেনে চলা, ‘ডাকাত ধরায় দক্ষ’ কর্মবীর স্বর্গত রুনু গুহ নিয়গীকে এস. আই থেকে বাম বাবুরা ডি. সি করেছিলেন, পুলিশ হেপাজতে বন্দীর উপর অত্যাচার করার কারণে অত্যাচারিতদের ওঁর বিরুদ্ধে মামলা করার অনুমতি দেননি; পদোন্নতি ও খুনি রক্ষার এমন নজির দ্বিতীয় নেই, ক্ষমতার সাধনায় হিংসাকে রাজনীতির মান্য ভাষা, দুনীতিকে নিখাদ বিকেন্দ্রীয় করে গণকে নিজ তন্ত্রোপযোগী পিণ্ড করে নিয়ে সূর্য অস্ত যাবার দুঃস্বপ্ন মুক্ত ছিলেন। প্রবীণ মারাংবুরু সকল দক্ষ ছিলেন প্রশ্ন থামাতে আর ভয় ও রক্ত-মূল্যে ‘শান্তি-স্তিতি’ বজায় রাখিতে। ৭৭-এ ভোট জয় ৭৮-৭৯-এর মরিচঝাপি দিয়ে অক্ষয় মোক্ষ পৌঁছয়, ঘরের উদ্বাস্তুদের ভোট কুড়োতে বাইরে থাকতে বাধ্য হওয়া উদ্বাস্তুদের উজ্জ্বল আশ্বাস দিয়ে শেষে কত মানুষ খুন করেছিলেন? বানতলায় ধর্ষণান্তে খুনের পর কবিতার মত উক্তি, ‘এরকম হয়েই থাকে’; প্রশ্ন, এ উক্তিতে বাবুরা কি দুঃখ তাড়িয়ে ছিলেন?

‘…an invisible force was crushing him. He could feel its weight, its hypnotic power; it was forcing him to think as it wanted, to write as it dictated. This force was inside him; it could dissolve his will and cause his heart to stop beating (. . .) Only people who have never felt such a force themselves can be surprised that others submit to it. Those who have felt it, on the other hand, feel astonished that a man can rebel against it even for a moment – with one sudden word of anger, one timid gesture of protest.’ এ মহর্ষি স্তালিনের এক ভক্তের উপলব্ধি, যদিচ এক রুশ উপন্যাসে বিধৃত তথাপি এ নিকষ একতম নির্মম সত্যের অতি দক্ষ নির্মাতার নাম স্তালিন। দুনিয়া জোরা ফলিত মার্ক্সবাদ ও ধর্মীয় মৌলবাদের এ হল সাধারণ সৃষ্টিশীলতা (ভারতীয় সংবিধানের মধ্যে একটি রাজ্যে এমন স্তালিন শাসন জারি রাখতে পেরেছিলেন সরকারী পাঁচনামিগণ, এখানে শুধু দল নয় মতাদর্শটিরও দমনমূলক সাফল্য স্বীকার্য) এবং জাতীয়তাবাদ, জাতি-রাষ্ট্রের স্বাভাবিক পরিণতি গিয়ে দাঁড়ায় ব্যক্তির তরফে এই ভয়কে ‘স্বেচ্ছায়’ আত্মস্থ করণ যা শেষে তাঁকে আত্ম দমনে ও আত্ম সঙ্কোচনে নিয়োজিত রাখা। হিংসা ও সর্বগ্রাসী আধিপত্যবাদ হিন্দুত্ব ও শিবিরে বিভক্ত পাঁচনামি সম্প্রদায়ের কাছে সমানভাবে বৈধ, ফলে উহারা হয় মাত্রাগত পার্থক্য নিয়ে চরিত্রগত ভাবে এক কাতারের প্রাণী। আজকের হিন্দুত্বের মত পাঁচনামি সকলেও বেঁচে ছিল অপর-দলনে আর পুলিশ সহায়তায় রক্ত-তৃষার মৃত-সঞ্জীবনীর অব্যাহত যোগানে; ৩৪ বছর রাজ্যপাট চালিয়ে পশ্চিম প্রেরিতা ডাকিনী সকলের প্রস্থান আর এক সমধর্মী, সম যোনিজ যোগিনীর বঙ্গে প্রবেশকে মসৃণ করে গেছে। আজ ভোট কুড়নোর খেলায় হিন্দুত্বের সঙ্গে সকল বিরোধীদের তফাত শুধু রঙেতে ও ধ্বনিতে; আধুনিকতা, ধর্মীয় ও ধর্ম নিরপেক্ষ মুক্তিতন্ত্র ও জাতি-রাষ্ট্রের হিংসা, আধুনিক উন্নয়নের অনিবার্য হিংসা, বৈষম্য ও অনৈতিকতার সকলেই সমান সহায়ক ও স্বদেশ চেতনায় এবং রাজনৈতিক ভাবনায় একই ভাবে পশ্চিম প্রেরিত ও সম দুঃস্থতায় অনুদ্ধারনিয়।

গত শতকের বাঙালির (আর এক না কি শেষ?) ‘উজ্জ্বল উদ্ধার’ ভাবের পাগল কতিপয় বর্ণ হিন্দু পুতুল পূজারি বালক সকল (সামান্য কিছু বালিকা সহ, যদিও তাঁরা শ্রেণী শত্রুর রক্তে হাত রাঙিয়ে ছিলেন বলে জানা যায় না) শ্রেনী মুক্তির তরে গেরিলা জীবন অসম্পূর্ণ রেখে সেই যে ঘরে ফিরলেন মনে হয় আজও পথের হদিশে কোন প্রত্নলিপী উদ্ধারে নিজেদের নিয়োজিত রেখেছেন (দুর্ভাগ্য IT-র কল্যাণে, শ্রীকাকুলামে সোদপুর মুক্তাঞ্চল ঘোষিত কি সোদপুরে শ্রীকাকুলাম মুক্তাঞ্চল ঘোষিত হওয়া আর সম্ভব নয়, সম্ভব নয় এ সকল মুক্তাঞ্চল ঘোষনা উদযাপন উপলক্ষে শ্রেনীশত্রুর রক্তে হাত রাঙিয়ে চা-সিঙ্গারা খাওয়া – ইহা একটি সত্য ঘটনা)। সে কি চেয়ারম্যান সাহেবের শেষ নির্ভুল, পুণ্য আঁখরগুলি? না কি ইংরেজির মধ্যস্থততা ছেড়ে মূল জার্মানে মার্ক্স পাঠ? বর্ণাশ্রিতের শ্রমসাশ্রয়িতা ছেড়ে তবে কি খোকন সকল নীরবে ও অলক্ষ্যে শ্রমাশ্রিত হলেন! সফল পাঠান্তে পথের হদিশ সহ নিশ্চয় ফের শ্রেণী মুক্তির তরে পথ-সেনার ভূমিকায় দেখা যাবে। তত দিন না হয় বিদ্যা-বুদ্ধিতে উজ্জ্বল সেই সব ক্রান্ত দর্শী উহাদিগের ‘আত্মত্যাগের’ স্মৃতি স্মরণের বমন ক্রিয়া বাংলা ভাষায় চালু থাকুক, দেশভাগ উত্তর গেরস্থের নিরাপদ ক্যাথারসিসের প্রযোজন মনে হয় এবঙ্গে ফুরাবার নয়। একটি প্রশ্নঃ বঙ্গ-জনারণ্যে যে স./বে.স. পাঁচনামিগণ সংক্ষেপে মাকু/নকু নামে সংবোধিত হয় তার তাৎপর্য কি অপদার্থা হেতু অপ্রসঙ্গিকতা সঙ্গে চালাকি সর্বস্বতা হেতু অসন্মাননিয়?  

‘আমরা তো অন্য রকম’ এহেন আত্মশ্লাঘায় কলি. ও তৎ সংলগ্ন আত্ম-আদুরে স./বে.স. পাঁচনামি সহ সকল প্রগতি-নিষ্ঠের ও দল-উদাসীন ও ধর্ম নিরপেক্ষ প্রভূত ডিগ্রিধারী ও নিত্য ‘পেপার’ বিয়ান বুদ্ধিজীবী বাবু/বিবিদিগের অবদানও স্মরণযোগ্য, আজও তাঁরা দস্যি যথা নিত্যই ‘কথায় কাটে কথার প্যাঁচ’, সান্ধ্য চ্যানেলে ও জাতীয় দৈনিকে ছাপানো অক্ষরে। অবশ্য এও তো ঠিক যে বঙ্গ বর্ণ বাবুরা মত-পথ নির্বিশেষে পশ্চিমা আধুনিকতার ক্ষেত্রজ বলে ভাব ও ভবের ভারসাম্য রক্ষায় দঢ় এবং সময় মত কোন জগত বেছে নিতে হবে সে নাড়ি জ্ঞানে টনটনে, কিন্তু পশ্চিম কোথায় এঁদের শিকড় ছিন্ন, বিকার গ্রস্থ করে রেখেছে সে বোধে পৌঁছান বাবুদের আর হল না। শিবির নির্বিশেষে পাঁচনামি ও প্রগতিপরায়ন সকল আজ পশ্চিমের নকল পূর্বক স্বোপার্জিত দুঃস্থতায় দাঁত ছরকুটে পড়ে থাকা মুক্তিযোদ্ধা। প্রায় শতক-জোড়া রবীন্দ্র-গান্ধী বিমুখতা আর লেনিন-স্তালিন-মাও প্রভৃতি মহর্ষিগণের গণহত্যা ও গুলাগ ও নির্মিত মন্বন্তর-অন্ধতার মূল্য না চুকিয়ে কোন পাড়ের বঙ্গ জনের আরোগ্য অসম্ভব। কখনো কি মানব সত্তা নিজ বিকারের এক পর্যায়ে গিয়ে আত্মশোধনে মন দেয়, প্রায় প্রাকৃতিক নিয়মের মত? আজ কি অন্তত বাঙালির জন্য সীমানা নিরপেক্ষ ভাবেই তেমন আত্মশোধনের ডাক এসেছে? ফেরালে জঙ্গি পুতুল – মার আর মরো? আর সাড়া দিলে স্ববশে সদলে আধুনিকতার কানাগলি এড়িয়ে, জাতি-রাষ্ট্রের কাঁটাতার পেড়িয়ে প্রাকৃতজনের স্বকালই তখন সীমানাহীনা স্বদেশ? তখন শুধুই প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবন জুড়ে? তখন শুধুই কবিতার দিনকাল, পদাবলির ওমে জড়ানো সন্ধ্যা-সকাল?   

তেমন বিশ্ব-যোগের হাটখোলায় পৌঁছাতে ফিরতে হবে নতুন করে শুধু মার্ক্সে নয়, আমাদের নিজস্ব ঐ দুই চিরহরিৎ বনস্পতির কাছেও। ‘দুই বনস্পতি মধ্যে রাখে ব্যবধান’ এবং এক্ষেএে তা চরিএগত, উপমহাদেশে উপনিবেশ পর্বে ভাষা-সংস্কৃতি-ব্যক্তিগত প্রেক্ষাপটের এত প্রভেদ এবং চিন্তা ও মৌলিক সৃজনশীলতার ভিন্ন ক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে পারস্পরিক গভীর ঐক্য-শ্রদ্ধা-মালিন্যহীন বন্ধুত্বের দ্বিতীয় দৃষ্টান্ত নেই; আরও যা বনস্পতি ও চিরহরিৎ বলেই সকল মৌলবাদের দূষণ মুক্ত। এদের বোঝাপড়া ছাড়া না ধর্মীয় মৌলবাদ না স্তালিনপরায়নতা (যা চরিএে ধর্ম নিরপেক্ষ আধুনিক মৌলবাদ ছাড়া কিছু নয়) না আত্মধ্বংসী আধুনিক উন্নয়ন কোন কিছুর থেকে মুক্তি নেই – না ব্যক্তির না ভারতীয় সমাজের। তবে প্রশ্ন থাকে কোন গণ-পিণ্ড হয়ে যাওয়া সমাজের (mass society) পক্ষে (বাদল সরকাররে অসামান্য সংলাপে গণ-সমাজের চরিএ নিখুঁত ভাবে ধরা আছে – সক্কলে করে যা – স-ব্ব-আ-ই করে তাই) আজ কি এসব দেশ-কাল ছাপানো মানুষদের নতুন করে উপলব্ধি, অর্জন করা সম্ভব? গণ-পরিসরে (public sphere) এদের আত্মগত করার পথ ও পদ্ধতির উদ্ভাবন করাই আজকের রাজনৈতিক সৃজনশীলতা। এ কাজ শুধু নতুন সংঘ নির্মাণে হাবার নয়। ব্যক্তির স্বাধীন দরকারে একাকী ব্রত এক্ষেএে প্রাথমিক – ব্রত ভাসাও জলে, এসো ব্রত ভাসাই জলে, আর খেয়াল রাখা যাক একাজে ‘কেবলই মেধা নয়, কেবলই হৃদয় নয়’।

‘আর সকলে মিথ্যা বলে বলুক, ক’এক জনের কাছে আমরা সত্য চাই। আর সকলে ভ্রান্ত করে করুক, ক’এক জনের কাছে আমরা ব্রত চাই’ 

একটি অতি দরকারি তথ্যঃ এ বঙ্গে এমন কোন নিষিদ্ধ পল্লী নেই যেখানে মুসলিম মেয়ে/মহিলারা নিজেদের মুসলিম নাম নিয়ে বাঁচে, ‘কাজ’ করে। বাধ্যতামূলক ভাবে তাঁদের হিন্দু নাম নিতে হয়। এই উপমহাদেশে কোথাও এমন নজির নেই। এ কি বঙ্গ জনের ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র সম্পর্কে কিছু বলে? উপনিবেশবাদও কি ভারতে এত গভীরভাবে সফল? বর্ণ নির্বিশেষে বঙ্গ জন কি সত্যিই অন্য রকম নয়?

অবশেষে

সম্প্রতি জনৈক ইংরেজ বর্নিত স্বদেশবাসীর শঙ্করত্বের চিত্র এই রকমঃ ‘Being British is about driving a German car to an Irish pub for a Belgian beer, then travelling home, grabbing an Indian curry or a Turkish kebab on the way, to sit on Swedish furniture and watch American shows on a Japanese TV. And most British thing of all? Suspicion of anything foreign.’ কোন ভাষা সাংস্কৃতিক গোষ্টীর জন্য এ কি জগৎ জোড়া উন্নয়নের ভবিতব্য নয়? বাঙালি মধ্যবিত্ত কি এ পথেই তার অখণ্ড সত্তা ফিরে পাবে? এমন আত্মঘাতী সাধনায় কাঁটাতারের দুপাড়েই সে নিবেদিত প্রান। প্রকাশ থাক এ উন্নয়নের বাইরে পড়ে থাকা প্রাকৃতজনের ভবিষ্যৎ কল্পনার আজও বাইরে। আশা সে তাঁর ভাষা সংস্কৃতির বৈচিত্র নির্মিত সত্তা চিহ্নিত হয়েই বিশ্ব নাগরিক হবে।  

 

0 Comments
Leave a reply