একটি মৃত্যুর বিবরণ

লিখেছেন:বিপ্লব নায়ক
ট্রাঙ্ক রোডের ধারে বন্ধ ধাবায় স্বাধীনতা দিবসের রাতে বারো বছরের একটা ছেলে মারা যাচ্ছে...

গলির দুইপাশে দুটো বাড়ি। একটা হুবহু অন্যটার নকল। গলি থেকে উঠে যাওয়া তিনটে সিঁড়ি, শ্যাওলা ছোঁয়া, কয়েকজায়গায় ঢালাই খসে যাওয়া, ইঁটের কালো ও লালে মেশা চামড়া বার হওয়া। ধুলোর আস্তরণ একদিক থেকে আরেকদিকে সরে যায়। তার উপর সদর দরজা— বহু পুরানো কাঠের কালো ফ্রেম, দুটো পাল্লা, প্রতি পাল্লায় তিনটে চৌখাপ্পা, তা মধ্য দিয়ে ঠেলে বেরিয়ে আসা সুগঠিত স্তূপ, যেন বা ভরন্ত স্তন এক একটা, প্রতি খোপে দুটো। ফ্রেমের মাথায় অর্ধবৃত্তাকার সাদা কঁাচের প্রেক্ষাপটে এক কালো পরী, স্তনহীন, ডানার উড়ানভঙ্গিমার টানে খুলে আসছে বসন। দরজা পেরিয়ে একতলার বড় মহল, বুদ্ধের ধ্যানমগ্ন রূপ যেন, নষ্ট বীর্যের শোকালাপ যেন। তার পাশ কাটিয়ে লাফ দিয়ে দিয়ে সিঁড়ি, তার বুকে পুরোনো কার্পেট ঘাস ও মাটির মতো প্রাকৃতিক হয়ে উঠছে ক্রমশ, এক পাশে হলুদ দেওয়াল চঁুইয়ে পড়া কালো সময়কে স্থিরচিত্রে বেঁধে ফেলেছে, অন্যপাশে বেঁটে বেঁটে থাম কালো মেয়ের নিতম্বরূপী। এসব টপকে দুতলার বাহিরঘর ও দালান, লাল রঙের আধিপত্য, দেওয়াল-ঢাকা-কাগজ ফরাস পর্দা বিছানা-চাদর টেবিল-ঢাকা এ সমস্ত কিছুর মধ্য দিয়ে এবং আরও কিছু সব কিছুর মধ্য দিয়ে অত্যুজ্জ্বল লাল একইরকম। অবাধ উল্লাসমুখরতায় আকর্ষণ-আকাঙ্খা-তীব্রতার ঘনীভূত উদ্বেগ সমস্ত যৌন অনুভূতিকে নিঃসাড় করে আগুনের শিখার মতো লেলিহান এই যৌনগন্ধী রঙে। এ দালান শেষে পুনর্বার সিঁড়ি, অন্ধকার, নিকষ, গর্ভস্থ গন্ধ মাখা, বাতাস ভিজে ও ভারী যেন বা এখনই মেঘ তৈরী হয়ে ঝরে পড়বে ঋতুস্রাব। দুপাশে হাত বাড়ালেও কিছু স্পর্শে আসে না। সটান ধাক্কা ফিকে-অন্ধকার টিনের দরজায়, তার নিচের ফঁাক গলে খোলা ছাদের আভাস। দুটি বাড়ির মধ্যেরই যাত্রাপথ এইরূপ। হুবহু একরকম। কিন্তু পার্থক্য আছে বাড়ির বাসিন্দাদের মধ্যে। একটায় রাখা হয় নয় থেকে বাইশ বছর বয়সী বেশ্যাদের। বাইশ পেরিয়ে গেলে, বা পেশার ধকলে তার আগেই বুড়িয়ে গেলে চালান করা হয় পাশের বাড়িতে। এখন তার দিদি থাকে এক বাড়িতে আর মা আরেক বাড়িতে।

ওই দুই বাড়ি, ওই আয়নার প্রতিফলনের মতো প্রতিসম যাত্রাপথ থেকে তার মায়ের এক বাবুর মধ্যস্থতায় তার ঠঁাই হয়েছিল বুকখোলা ট্রাঙ্ক রোডের ধারে এই ধাবায় খোরাকীতে পোষা কাজের ছেলে হিসেবে। ওই ছবি সে মনে টেনে আনে যখনই কোনো না কোনো কারণে তার মনকে বশ করার দরকার হয়, এ তার জীবনকে বহন করার জন্য স্বকীয় অভিযোজন। এখন অবশ্য ছবিটা আপনা হতেই তার উপর হামলে পড়েছে। এখন ছেলেটা মারা যাচ্ছে।

এই বিশেষ বারো বছর বয়সী ছেলেটা বেদম মার খেতে খেতে মরছিলো। পুরুষ্টে মুষ্টি পরপর এসে পড়ছিল তার পেটের উপর। মুষ্টির মাংসল আঙুল, তাতে লটকানো গ্রহপ্রকোপ সামলানো পাথর সমেত সব পেতলের আংটি, একটি বুঝি বা সোনারও, ক্রমাগত তার বুক ও পেটের উপর দুরমুশ করছিল। তার দম বার করে দিচ্ছিল। বিচির ওপর সোজাসুজি কষে একটা লাথি পড়ল। ভয়ংকর যন্ত্রণাকর কিছু যেন তার দেহের প্রতিটা কোষে আটকে গেছে, তাকে উগড়ে দিতে গেলে বুঝি বা তার অসীম সংখ্যক ধারালো কোণগুলোর ছেঁচড়ানিতে প্রতিটা কোষ থেকে অংশবিশেষ ছিঁড়ে আসবে। তারপর এক প্রচন্ড নিঃশব্দ বিস্ফোরণ ঘটে গেল তার দেহমধ্যে। মুক্তি। হৃদপিন্ড উগড়ে দিল রক্ত, তোড়ে বেরিয়ে এল তার মুখ দিয়ে। আর সেই রক্তের সঙ্গে বেরিয়ে এল একটা অশোকচক্র, এনামেলের, তার উপর রুপোর জল করা, গোলাকার, পরিধিতে চব্বিশটা খাঁজ। ছেলেটা মারা গেল। তাকে খুন করা ষন্ডা আকৃতির এলাকার দাদা বিরক্তিভরে তার পাঞ্জাবির হাতায় ছিটকে লাগা রক্তের দিকে তাকাল। পাঞ্জাবির সাদা বহর কলুষিত হওয়ার ক্ষোভে ছেলেটার তলপেটে কষে একটা শেষ লাথি মারল। শেষবারের মতো ছিটকে উঠলো দেহটা, তারপর ক্রমশ মৃতদেহের নিয়মে দেহটি শক্ত হয়ে উঠতে থাকল।

ছেলেটার মৃতদেহটা উল্টে পিছনের হাফপ্যান্টটা নামিয়ে তার পোঁদটাকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে তার পোঁদের ফুটোটা অস্বাভাবিক রকমের বড় এবং ছড়ানো। অবশ্য এটাই স্বাভাবিক। কারণ, গত তিন বছর ধরে সুখচর গির্জার কাছে বি টি রোডের ধারের এই ধাপার পেছনের ঘরটিতে লরি ড্রাইভার থেকে শুরু করে এলাকার ছোট-মেজ-বড় নেতাদাদারা তাকে উপুড় করে শক্তপোক্ত তক্তপোশের উপর চেপে ধরে হরেক সাইজের উত্থিত জাগ্রত বাঁড়া দিয়ে তার পিছন মেরেছে। তিন বছর প্রতিদিন সকালে উঠে ধাপায় গ্লাস-প্লেট এগিয়ে দেওয়া, তুলে নেওয়া, পরিষ্কার করার সময় টনটনে ব্যথা যখন পোঁদের ফুটো থেকে মগজ অবধি চাগাড় দিচ্ছে, তখন সবচেয়ে কম ব্যথা জাগিয়ে কীভাবে হাঁটাচলা করা যায়, তার একটা অনুপম কায়দা সে অভ্যাসবশতঃ রপ্ত করে নিয়েছিল। তারপর তার চোখে পড়েছিল যে তারই মতো সামনের দিকে অল্প ঝুঁকে, হাঁটুদুটো অল্প ভেতরের দিকে চেপে হাঁটাচলা করে তারই মতো তারই বয়সী অন্য দুজন বেয়ারাও। অর্থাৎ, সে যে এভাবে হাঁটবে, তাও খুবই স্বাভাবিক, অভিযোজন বিশেষ।

ওই ধাপার পাশেই তিনতলা ক্লাবঘর, খেয়ালী সংঘ-এর। সেখানে রাজনৈতিক নেতাদের যাতায়াত আছে, কোনো এক অনুষ্ঠানে একবার রাজ্যপালও এসেছিল। এলাকার বিভিন্ন ভোটের ঝামেলা মেটানোর লোক-লস্কর-মেশিনারি এখানে লালিত পালিত হয়। সেই খেয়ালী সংঘ এবার স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের বিশেষ কর্মসূচী নিয়েছিল। জলসা, কন্ঠীদের সুর বিলাপ, জগঝম্প তো প্রতিবারই হয়, এবার ছিল বিশেষ আরো কিছু অনুষ্ঠান। তা হলো শহরের নামী বুদ্ধিজীবীদের সেজেগুজে বসে স্বাধীনতার স্বরূপ নিয়ে ভাবগম্ভীর আলোচনা, পাক্কা চার ঘন্টা। এবং তার পরে এলাকার মেজনেতা সেকেন্ডারী শিক্ষকের লেখা এক গীতিআলেখ্য যেখানে গান্ধী-নেহরু-সুভাষ হাততালি দিয়ে নেচে নেচে ব্রিটিশ তাড়াবে। ধাবার বারোবছর বয়সী তিনজনকে গান্ধী, নেহরু ও সুভাষ বানানো হয়েছিল। তাদের বিশেষ অভিযোজনজাত ভঙ্গিতে তারা মঞ্চে ঘুরছিল। এই ছেলেটিকে নেতাজী বানানো হয়েছিল। নেতাজীর পোষাকটা তার বেশ পছন্দ হয়ে গিয়েছিল, বিশেষ করে টুপিটা, যার কপালে একটা অশোকচক্র লাগানো ছিল, আলো পড়ে ঝিকমিক করছিল। লোভে পড়ে গিয়েছিল। অনুষ্ঠান শেষে, পোষাক ছেড়ে ফেরত দেওয়ার সময় সে লুকিয়ে চক্রটা ছিঁডে় নিয়েছিল। সে ভেবেছিল চক্রটা সত্যি রুপোর।

সেদিন তাদের ছিল ধাবার কাজ থেকে ছুটি। তবু রাতে ঠিক মদে টইটম্বুর সেজ গোছের এক আঞ্চল-নেতা, যে আবার ক্লাবের পরিচালনা কমিটিরও সদস্য, টলমলিয়ে এসে ধাবার পেছনের ঘরের তক্তপোষে তাকে ঠেসে ধরল, ‘আজ শালা নেতাজীর গাঁড় মেরে ছাড়বো...’। তার এতোদিনের অভিযোজন যে কোথায় ধ্বসে গেল, সে উপুড় হয়ে শোয়ার বদলে ছিটকে বেরিয়ে এসে বলতে লাগল, ‘আজ ছুটি, আজ হবে না...’। প্রত্যাখ্যাত হয়ে অমল রাগে জ্বলতে থাকে সেজ নেতা। প্রথমে পয়সার লোভ দেখায়, তারপর হুমকি, তারপর দুহাতে তাকে ঠেসে ধরে, ‘শালা আজ মেরেই ফেলব... চুরি করবে, কাজ করবে না... শালা বার কর কোথায় অশোকচক্র...’। ছেলেটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়, তার চুরি ধরা পড়ে গেছে জেনে ভয়ও পেয়ে যায়। ক্ষ্যাপা ষাঁড়ের গুঁতোর মতো একটা ঘুঁষি এসে পড়ে তার পেটে, বাঁকিয়ে দেয় তার দেহটাকে। মুহূর্তের মধ্যে অশোকচক্রটা প্যান্টের পকেট থেকে বার করে মুখে পুরে দেয়, গিলে নেওয়ার চেষ্টা করে। এলোপাথাড়ি ঘুঁষি এসে পড়ছে বুকে, মুখে, পেটে। গলায় আটকে জ্বলতে থাকে ভারতরাষ্ট্রের অগ্রগতির চিহ্ন।

মে, ২০১৪

0 Comments
Leave a reply