চাঁদ উবাচ: আড্ডায় অনিরুদ্ধ লাহিড়ী, প্রসঙ্গ রাজনীতি

লিখেছেন:অনিরুদ্ধ লাহিড়ী
অনিরুদ্ধ লাহিড়ীর সঙ্গে একটি আড্ডা। রাজনীতি, কাজনৈতিক ক্রিয়া, সমাজ-বাস্তবতা এবং সমাজবদলের বাস্তবতা সম্পর্কে তাঁর জীবন-অভিজ্ঞতা-জাত বোধ উন্মোচনের একটি চেষ্টা।

 

 

ভূমিকা

অনিরুদ্ধ লাহিড়ীর সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচয় ছিলো না, কিন্তু তাঁর প্রবন্ধ-পাঠ ক্রমশ নিজ ভূমিকম্প-বিধ্বস্ত ভাবনাজগতে সিসমিক ফল্ট-লাইনের উপর যাপনপদ্ধতি তৈরির চেষ্টায় গুরুত্বপূর্ণ অবলম্বন হয়ে উঠছিলো। তাঁর গদ্য অতর্কিতে আচম্বিতে আক্রমণ শানায়, পাঠকের পূর্বনির্দিষ্ট প্রত্যাশা বা অভিপ্রায় ধ্বংস করে অভাবিত কোনো গহনপথে যাত্রা করিয়ে দেয়। এই যেমন ধরুন, কমলকুমার মজুমদার-এর জগতে প্রবেশের বাসনা নিয়ে তাঁর ‘পিতাপুত্র: দায়ভাগ ও ভবিতব্যতা’ প্রবন্ধ পাঠ করতে বসে কিছুটা এগোনোর পরই মুখোমুখি হতে হয়:

ঊনবিংশ শতককে অনেক সময় ইডিয়লজির শতক বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে। এই শতকেই, ব্যাঁদা (ফরাসি দার্শনিক জুলিয়াঁ ব্যাঁদা)-র মতে, প্রথম উদ্ভব ঘটলো এমন এক গোত্রের বুদ্ধিজীবীর যাঁরা মানুষের ট্রানসেনডেন্স বা উত্তরণকে শব্দটির অভিধা থেকে ছিঁড়ে দাঁড় করিয়ে দিলেন ব্যবহারিকের চৌহদ্দির মধ্যে: ফলে যা ছিল উত্তরণ--- তাই সুদূর, অতিমর্ত্য--- তা যেন গৃহী বনে তার দৈনন্দিনে অনুপ্রবিষ্ট হয়ে গেলো। যা ব্যবহারিক, অর্থাৎ দেশে এবং কালে কেবলমাত্র বস্তুগতভাবে উপস্থিত এবং বস্তুগত তাগিদের মধ্যে সন্নিবিষ্ট, তার অভ্যন্তরে গুঁজে দেবার ফলে উত্তরণের যেমন সংকোচন ঘটলো, অন্যদিকে ব্যবহারিক তেমনি হাঁ করে গ্রাস করে বসলো মানুষের বিশ্বনিখিলকে। উপরন্তু, ব্যবহারিক তার চূড়ান্ত পরিণতি পায় যে-জায়গাতে এসে মানবযূথ ভিন্ন ভিন্ন দাঙ্গাবাজ গোষ্ঠীতে সংহত, অর্থাৎ রাষ্ট্রশক্তির মর্যাদায় আসীন। এসব বুদ্ধিজীবীদের অনেকে তাই রাষ্ট্রশক্তির সর্বগ্রাসী তাৎপর্যের মধ্যে মানবনিয়তির ধারণাটিকে অঙ্গাঙ্গিভাবে জুড়ে দিলেন।… ফলে, ব্যাঁদার ভাষায়, উত্তরণের একটি স্থানান্তর বা ডিসপ্লেসমেন্ট ঘটলো, এবং সঙ্গে সঙ্গে অবনমনও। পূর্বে যা ছিলো মানবনিয়তির একটি নির্বিশেষ, তাত্ত্বিক সীমা, তাই অতিমর্ত্য এবং বাস্তবে অপ্রাপণীয়; পূর্বে মানবিক প্রচেষ্টাসমূহের মূল্যায়নের একটি নৈতিক নিরিখস্বরূপ, যা তার ব্যবহারিক জীবনের বাইরে দাঁড়িয়ে তার ইতিহাসকে তাৎপর্য জোগাতো; আজ, গৃহবলিভুক, উত্তরণের প্রকল্পটি বলা যায় যেন বুঝলো সে দৈনন্দিনের দানাপানি খেয়ে বেঁচেবর্তে আছে: ব্যবহারিকের অন্নদাস সে, তাই ছোটো মুখে আর বড়ো কথা তাকে মানায় না। উপরন্তু, সে ইচ্ছাটিও আর এখন তার মধ্যে টিকে থাকার কথা নয় খুব, কারণ রাষ্ট্রশক্তির তাঁবেতে আশ্রয় গ্রহণ করে সে, দেখা গেলো, ভিন্ন ভিন্ন রাষ্ট্রশক্তির মতোই জঙ্গি ও দাঙ্গাবাজ হয়ে উঠেছে।…

এখন, অনিরুদ্ধ লাহিড়ী পাঠ করতে যে বসেছে সেও নিশ্চিতভাবেই বুদ্ধিজীবী; রক্ষণশীল, লিবারাল বা সমাজবাদী যা-ই হোক না কেন, এই ব্যবহারিকের দানাপানি খাওয়া রাষ্ট্রবাদী হয়ে ওঠার অন্তর্ঘাতী অভিযোগ সে হালকাছলে টপকাবে কী করে; পাঠে নিষ্ঠাবান হতে গেলে তাকে তো আত্মসমালোচনায় অপরিকল্পিতভাবে ঢুকে পড়তেই হবে। আর অনিরুদ্ধ লাহিড়ী বারবার স্মরণ করিয়ে দেবেন যে আত্মসমালোচনা মানে আসলে আত্মতা গঠনের একটি সামাজিক-ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার সমালোচনা। সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে ‘একটি রাজনৈতিক ব্যক্তিসত্তার জন্ম ও মৃত্যু: সংশয়াণ্বিত স্মৃতিচারণ’ লিখতে বসে তিনি লিখছেন:

…সুভাষদাদের বিপ্লবী আত্মতা: সর্ষের মধ্যে থেকে গিয়েছিলো তাত্ত্বিক বিভ্রান্তির ভূত। পুনর্বার মনে করিয়ে দেওয়া যাক, কথাগুলি রূঢ়--- এবং সত্য। এই সত্যটি মাথায় রাখলে বোঝা সম্ভব তাঁদের বিপ্লবী আত্মতাগঠনের সর্বাপেক্ষা মৌলিক বৈশিষ্ট্যটি ঠিক কী: এই আত্মতা ছিলো ভিতর থেকে দীর্ণ। একদিকে তাঁদের রাজনৈতিক আদর্শের ধ্রুবতারা সোভিয়েত সমাজব্যবস্থার অন্তর্গত অমানবিক নিপীড়ন, সমাজবাদের দেশকালে ফলিত দুষ্টনষ্ট বাস্তবতা, বিষয়ে উদাসীন অমনস্কতা, ক্ষেত্রবিশেষে সুচতুর মন্ত্রগুপ্তি; অন্যদিকে, আমাদের দুঃস্থ ঔপনিবেশিক মানব-পরিস্থিতি বিষয়ে এঁদের সহৃদয় উদ্বেগ, সজাগ দায়িত্ববোধ।

আবার, কমলকুমারের ‘কয়েদখানা’ গল্পের শাজাদ চরিত্রটি, সমাজের তলাকার বর্গে দানা বাঁধা বিদ্রোহী চরিত্র, সম্পর্কে তিনি বিশ্লেষণ করছেন:

আত্মনির্মাণের সচেতন যে ব্যগ্র তাগিদ কমলকুমারের নায়কের ক্ষেত্রে কার্যকর, আত্মতার কেন্দ্র থেকে উৎসারিত হলেও পরিপার্শ্ব থেকে তাকে পুষ্টি জোগাচ্ছে কৌমে দৃঢ়মূল মানবিক ঘনত্ব…।

সুতরাং, আত্মতা-গঠনের দুটি পৃথক প্রক্রিয়ার, দুটি বিরুদ্ধ-প্রতিমার আভাস আসে যেন--- একটি মতবাদনির্ভর হয়ে উদ্বেগ-দায়িত্ববোধ সত্ত্বেও দেশীয় পরিপার্শ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন, আর অন্যটি দেশীয় পরিপার্শ্বেই স্থিত কৌমে দৃঢ়মূল মানবিক ঘনত্ব দ্বারা পুষ্ট। বুদ্ধিজীবী প্রথম প্রক্রিয়া থেকেই উদ্ভূত, কিন্তু সে কি তার জন্মপ্রক্রিয়া নাকচ করে দ্বিতীয় প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নতুন রূপে জন্ম নিতে পারে?

অনির্বাণ লাহিড়ীর প্রবন্ধ পাঠ করতে গিয়ে এহেন নানা প্রশ্নে ঢুকে পড়ে হাতড়ে বেড়াচ্ছিলাম আমি এবং আমার আরো কয়েকজন বন্ধু, যারা নিজেদের বেশ কয়েক দশকের রাজনৈতিক সক্রিয়তার অভিজ্ঞতাগুলোকেও পুনর্বিচার করার প্রক্রিয়ায় ছিলাম। মনে হচ্ছিলো যে অনিরুদ্ধ লাহিড়ীর সঙ্গে কথোপকথনে যেতে পারলে ভালো হতো, তাঁর এই ভাবনা ও প্রত্যয়গুলোয় পৌঁছানোর যাত্রাটা তাঁর মুখে শুনতে পারলে হয়তো আমাদেরও নিজেদের অনুসন্ধানগুলোর কিছু সহায়তা হতো। অনিরুদ্ধ লাহিড়ীর ফোন নম্বর জোগাড় করে তাঁকে ফোন করে বসলাম। বললাম যে তাঁর বাড়ি গিয়ে তাঁর সঙ্গে কিছু কথাবার্তা বলতে চাই। তিনি সরাসরি তাঁর বাড়ি যাওয়ার দিশা বলে দিলেন, বললেন রাস্তার মোড়ে পৌঁছে ‘চাঁদদা-র বাড়ি’ জিজ্ঞেস করলেই হবে, কারণ পাড়ার লোকেরা তাঁকে ওই নামেই চেনে কি না। প্রথমবার গিয়ে আমরা আমাদের প্রশ্নগুলো বললাম, তাঁর কাছ থেকে কী শুনতে চাইছি তা বললাম। উনি বললেন: কথাবার্তা তো হবে, কিন্তু আপনাদের ভাবনাচিন্তা আমি বুঝতে পারি এমন কোনো লেখা দিন। বুঝলাম, এটা বুঝিবা কথাবার্তা শুরু হওয়ার একটা শর্ত। সে সময়ে আমাদের চিন্তাভাবনা নিয়ে একটা খসড়া লেখা তৈরি করে আমরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছিলাম, সেই লেখাটাই পরের দিন চাঁদদাকে (হ্যাঁ, এই নামে ডাকলেই উনি স্বচ্ছন্দ বোধ করবেন বলেছিলেন) দিয়েছিলাম। (পরিশিষ্ট-এ সে লেখাটা দেওয়া হয়েছে।) কয়েকদিন পরে আবার যখন আমরা উপস্থিত হলাম, তিনি নিজে থেকেই ‘আড্ডা’ শুরু করলেন, বুঝতে পারলাম আমাদের লেখাটা এরমধ্যে খুঁটিয়ে পড়ে নিয়েছেন, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সেই লেখাটার প্রসঙ্গও টেনে আনছেন বলতে বলতে। মাঝে কয়েকদিনের ফাঁক রেখে মোট চারদিন আমরা এই আড্ডায় বসেছিলাম। ক্রমশ তিনি আমাদের আলোচনার ভিতর থেকে আরো ভিতরে টেনে নিয়ে যাচ্ছিলেন, কেবল শ্রোতা হয়ে থাকতে দিচ্ছিলেন না, নিজেদের ভাবনাগুলোও খোলাখুলি সামনে আনতে বাধ্য করছিলেন। কিন্তু পুরোটা জুড়ে আড্ডার সহজ পরিবেশ ক্রমশ ঘনিয়ে উঠছিলো। আড্ডা শেষ হয়নি। আমাদের বসার একটা পরবর্তী দিনও ধার্য ছিলো। কিন্তু তার আগেই হঠাৎ খবর পেলাম তিনি বাথরুমে পড়ে গিয়ে জ্ঞান হারিয়েছেন, কাউকে আর কোনো সুযোগ দেননি, মৃত্যুতে প্রবেশ করেছেন।

আড্ডা এমন একটা জিনিস যা কখনো সম্পূর্ণ হয় না, সময় ফুরিয়ে আসায় কোথাও একটা অনিচ্ছাসত্ত্বেও ইতি টানতে হয়। এইক্ষেত্রেও সেটাই হলো।

বিপ্লব নায়ক

আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

 

 

 

 

 

আড্ডাবিবরণী

 

 

 

অ.লা.: এটা তো ঠিক ইন্টারভিউ হচ্ছে না। আপনি প্রশ্ন করবেন আমি উত্তর দেব সেটা হলে ইন্টারভিউ হয়। সেদিকে না গিয়ে আমি বরং নিজের দিক থেকেই কথা বলি।

প্রশ্ন করলে আপনি হয়তো প্রশ্ন করবেন প্রথম জীবনের কী অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আমি বড়ো হয়েছি। আমি যে খুব বড়ো হয়েছি, তা তো হতে পারিনি, সাধারণ মানুষই থেকে গেছি। যাইহোক তাহলে শুরু করি।

আমি তো ওপার বাংলার লোক। আমাদের দেশ, আদি দেশ, ছিল অন্য জায়গায়। পাবনায়। কিন্তু আমি জন্মেছি রংপুরে। সেখানে আমার বাড়ি, মানে মফঃস্বলে খুব বড়ো বাড়ি। তো সে বাড়িতে ছোটবেলা থেকেই রাজনৈতিক আবহাওয়া ছিল। বাবা কমিউনিস্ট পার্টিতে ছিলেন। তাঁর বন্ধুবান্ধবরা সব আসত। যদিও আমাদের বাড়িতে আর কেউ সরাসরি পার্টি করেননি। আমার কাকা খুব কাছাকাছি ছিলেন কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টির মেম্বার ছিলেন বলে আমার মনে হয় না। তো বাড়িতে অনেক লোক আসতেন আর সেই সুবাদে অল্প বয়সেই অনেক কথা কানে আসত। তো নিজের বোঝাবুঝির মতো করে যা বুঝতাম সেটাই বুঝতাম। মনে আছে খুব অল্প বয়সে আমি বলতাম আমি কমিউনিস্ট নই। আমি ফরোয়ার্ড ব্লক। ফরোয়ার্ড ব্লক শব্দটা খুব ভালো লাগত। সবাই খুব অ্যাপ্রিসিয়েট করত হেসে মজা করেই।

তখন বা তার পরে দেশভাগের পরে এখানে চলে আসি। এ বাড়িতে নয়, অন্য একটা জায়গায়। ছোট্ট বাড়িতে ছিলাম। ফ্ল্যাটে। তখন মনে আছে অনেক বই দেখেছি, যেগুলো এখন আর দেখা যায় না। সব বই রাশিয়ার। সোভিয়েত রাশিয়া থেকে প্রকাশিত। পরে ধীরে ধীরে এইগুলো সম্পর্কে অনেক প্রশ্ন জেগেছিল। সেটা তখন হবার বয়স নয়। কিন্তু তার মধ্যে দেখতাম কমিউনিস্ট জোসেফ স্তালিনের অনেক বই ছিল। কিছুদিন আগে পর্যন্ত আমার দু-তিনটে বই ছিল, এখন খুঁজে পাইনা, কোথাও হারিয়ে গেছে হয়তো। তো অনেক বই নষ্ট হয়ে গেছে, তার মধ্যেই হয়তো হবে। তো একটা বই মনে আছে, ছবিটা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা ছবি। লেনিনের পাশে স্তালিন। দুজনের মধ্যে খুব একটা যেন গুরু-শিষ্য সম্পর্ক। যেন বড়ো ভাই-ছোটো ভাইয়ের সম্পর্ক। তো সেটার মধ্যে যে অনেকটাই ফাঁকি আছে সেটা পরে জেনেছি। তখন তো সেসব জানতাম না। তখন এরকমই বলা হতো। SUCI পার্টিতে যেমন এখন থাকে ৪-৫টা ফোটো: মার্ক্সের পাশে এঙ্গেলস, তার পাশে লেনিন, স্তালিন, তারপর মাও-জে-দঙ, এই যে পঞ্চমূর্তি, তখন সেগুলো স্বতঃসিদ্ধ ঠিক বলেই মনে করেছি। প্রশ্ন হয়তো ধীরে ধীরে উঠেছে।

তখন বাংলা-বিহার মার্জারের মুভমেন্টের সময়। আমি কোনোদিন রাজনৈতিক পার্টিতে ঢুকিনি, কিন্তু সেসময় ওই বয়সে একটা যোগাযোগ  ছিল। আলোচনা সভা ঠিক বলব না, একটা বক্তৃতা সভার কথা বলা যাক। সেখানে গিয়েছিলাম। সেটা এখান থেকে কাছেই। সাদার্ন মার্কেট বলে একটা বড়ো বাজার আছে, তার উপরে একটা লাইব্রেরি ছিল। কয়েক বছর আগেও গিয়েছিলাম, দেখলাম লাইব্রেরিটা আছে, কিন্তু জায়গাটা অনেকখানি কমে গেছে, লাইব্রেরিতে এখন যায়ও খুব কম লোক। উঠে হয়ত যায়নি, কিন্তু আগের সেই অবস্থা---  লোক যাতায়াত করছে, নানারকম চিন্তা-ভাবনা, আলোচনা হচ্ছে--- সেই পরিবেশটা বোধহয় আজ আর নেই। সেখানে ওই লাইব্রেরির পিছনে বড়ো একটা ছাদ ছিল, বাজারের ওপর ছাদ, সেখানে নানা সভা হতো। তেমনই এক সভায় বক্তৃতা দিতে কমিউনিস্ট পার্টির তরফ থেকে বা পরিচয় পার্টি-পত্রিকার তরফ থেকে এসেছিলেন গোপাল হালদার। আর এসেছিলেন অম্লান দত্ত: তিনি তো কমিউনিস্ট নন, আবার কংগ্রেস বা অন্য কোনো পার্টিরও নন, একজন অর্থনীতিবিদ। গোপাল হালদার খুব আবেগদীপ্তভাবে বললেন, সেইসময় খুব যেহেতু পরিচয় পত্রিকা পড়া আরম্ভ করেছি, নিয়মিত কিনতাম, গোপালদাদের খুব বিরাট জায়গা দিতাম। অম্লান দত্ত সম্পর্কে খুব একটা কিছু জানতাম না। কিন্তু লক্ষ্য করেছিলাম, অম্লান দত্তের যে বাচনভঙ্গী তাতে একটি বাক্য এমন ছিল না যেখানে গোড়ায় যা দিয়ে শুরু করেছেন, যদি বাক্যের অণ্বয় অনুযায়ী তা তার শেষে পৌঁছচ্ছে না; অর্থাৎ, বাক্য হিসেবে প্রতিটি বাক্য পূর্ণাঙ্গ বাক্য; কোনো একটি বাক্য পূর্ণাঙ্গ নয় বা বাক্যের মাঝখানে তিনি বাক্যটা পালটে অন্য জায়গায় চলে গেলেন, এরকম হয় নি। যেন চিন্তা করে ভেবে ধাপে ধাপে বলতেন, পরে ইংরেজি বক্তব্যও শুনেছি, ডিবেটও শুনেছি। সবই ওইরকম। কেটে কেটে এবং ধাপে ধাপে আলোচনা করতেন। থেমে থেমে বলতেন। ওনার বাচনভঙ্গীও অনেকটা ওরকমই ছিল। অপরদিকে, গোপাল হালদার যেন অনেকটা বেশি আবেগী, আবেগ বেশি ছিল, আবেগের সঙ্গে পরবর্তীতে যেটা মনে হয়েছে একটু চিন্তার ফাঁকিবাজিও হয়তো থাকতে পারে। সেটা অন্য প্রসঙ্গ। সেটা পরে একটুখানি বুঝেছিলাম।

ওইরকমই এক সময়ে দেশপ্রিয় পার্কে একটা সভা আয়োজন হয়েছিল, সেখানে জে বি এস হ্যালডেন বলতে এসেছিলেন। উনি বলে যাচ্ছিলেন, তাঁর ইংরেজি হয়তো অনেকেই বুঝবে না, অনেক সাধারণ লোকও তো সেখানে রয়েছে যারা ইংরেজি জানে না ভালো, তাই হ্যালডেনের বলার পাশাপাশি অনুবাদ করে বলে যাচ্ছিলেন তখনকার যুগান্তর পত্রিকার সম্পাদক বিবেকানন্দ মুখার্জী। বিবেকানন্দ মুখার্জীকে পরবর্তীকালে চিন-ভারত লড়াই বা যা-ই বলা যাক না কেন, সেই সময়ের পরে পরে কী চিঠি ছাপানো হয়েছিল সেজন্য সরিয়ে দেওয়া হয়, ভারতের ভূমিকা নিয়ে খানিক প্রশ্ন তোলা হয়েছিল সেই চিঠিটাতে। তো বিবেকানন্দ মুখার্জীর একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম যে, হ্যালডেন সাহেব একটু বলার পরে থামছেন, পরমুহূর্তে বিবেকানন্দ মুখার্জী সেটার অনুবাদ করে সঙ্গে সঙ্গে বলছেন। পরে মনে হয়েছে এটা সবসময় খুব সহজ নয়। হ্যালডেনের চেহারাটা (আমি চোখে কম দেখতাম) দূর থেকে বেশ অদ্ভূত লেগেছিল: অনেকখানি বড়ো চেহারা, মাথায় বেশ বিরাট টাক, মুখটাও খুব বড়ো, আর গেরুয়া রঙের বা ওই জাতীয় পাঞ্জাবি পরেছিলেন আর পাজামা। তারপর শুনলাম তিনি ওখান থেকেই চলে যাচ্ছেন জাপানে নিউক্লিয়ার আরমামেন্টের বিরুদ্ধে শান্তি আন্দোলনের জন্য। শান্তি আন্দোলন শুরু হয়েছিল পাগুয়াস বোধহয় শব্দটা--- নরওয়ে বা কাছাকাছি অঞ্চলের একটা ছোটো জায়গার নাম--- সেখান থেকে। সেই মুভমেন্টটা তখন শুরু হয়েছে বা হয় নি, বা হয়ে থাকতেও পারে। যেহেতু জাপান পরমাণু বোমার সরাসরি শিকার হয়েছে তাই উনি মনে করেছিলেন জাপানে সে সময়ের আন্দোলনে ছিল পরমাণবিক অস্ত্র মুক্ত এক পৃথিবীর কথা। এই আন্দোলনে পরে অনেক ইউরোপীয় যোগ দিয়েছিলেন, এমনকি এমন অনেকজন যারা পরবর্তীতে কমিউনিস্ট পার্টি ছেড়ে চলে এসেছেন কিন্তু শান্তি আন্দোলনের শরিক থেকে গিয়েছিলেন। যেমন, এ পি টমসন। প্রসঙ্গত এই আন্দোলন চলাকালীনই আমার পরে-আলাপ-হওয়া এক বন্ধু একটা বড়ো মিছিলে গিয়েছিল। সেই বোধহয় পারি থেকে শুরু হয়। সেই মিছিলে ভাবী স্ত্রীর সঙ্গে তার প্রথম দেখা হয়, সেও ইংরেজ এবং তারা ইংল্যান্ডে স্থায়ী বাসা বাঁধে। পরে এটা জেনে খুব মজা লেগেছিল। বন্ধুর নাম এখানে বলার দরকার দেখছি না। স্ত্রীর নামটি সম্ভবত এলিজাবেথ।

ওইরকম সময়ে একটি ছেলের সাথে আমার যোগাযোগ হয়, সে আমার চেয়ে কয়েক বছরের বড়ো। তখন কমিউনিস্ট পার্টির ছেলে-ছোকরা ইন্টেলেকচুয়ালদের একটা ঝোঁক ছিল হাতে একটা বই নিয়ে বের হওয়া। একটা বা দুটো। তারমধ্যে একটা বা দুটো প্যামফ্লেটও থাকতে পারে। বইটা এমনভাবে হাতে ধরা তারা হাঁটত যাতে তা লোকের চোখে পড়ে। এটা আমি অনেক জায়গায় দেখেছি। অনেকসময়ই সেই বইগুলো তারা পড়তো না। ওই ছেলেটিও সেরকম ছিল এবং আমার সঙ্গে আলাপ হওয়ার পরে (তখন আমার বাড়িতে বন্ধুরা আসত না,  বাড়িতে অনেকে থাকতেন বলে বাড়িতে জায়গা কম ছিল) আমাদের প্রথমদিককার কথাবার্তা-আলোচনা দরজার নীচে বা দরজায় দাঁড়িয়ে হতো। তারপর একসঙ্গে বের হতাম। লক্ষ্য করেছিলাম ব্যাপারটাকে খানিকটা রোমাঞ্চকর করে তোলার জন্যই সম্ভবত ও যদি এই সপ্তাহের বুধবারে দেখা হয়েছে হাজরা পার্কের মোড়ে, তো পরের দিন দেখা করতো প্রিয়া সিনেমার সামনে, তার পরের সপ্তাহে আবার আরেকটা জায়গায়। কারণ পুলিশ নাকি আমাদের ওপর চোখ রাখছে। আমার বয়স তখন ষোলো কি সতের। পুলিশের নিশ্চয়ই অনেক কাজ আছে, ফালতু অকারণ কোনো ব্যাপারে মাথা গলানোর কাজ পুলিশ করতো না নিশ্চয়ই, কারণ তাদের সময়ও নেই। আর পুলিশ বলতে কতজনই বা লোক, দেশের ১৬-১৭ বছরের ছেলেদের ওপর নজর রেখে পুলিশের লাভই বা কী। এগুলি সবই ও করতো ওই দেখা হওয়াগুলোকে একটু রোমাঞ্চকর করে তোলার জন্য। পরে মনে হয়েছিল ওগুলো তৎকালীন কমিউনিস্টদের একধরনের আত্মপ্রবঞ্চনা, আর আত্মপ্রবঞ্চনা তো শুধু নিজেকে ঠকিয়েই শেষ হয় না, পাশাপাশি লোকেদেরও ঠকাতে হয়। এরকম একটা ঝোঁক তখন  ছিল। কথাগুলো হয়তো খুব সিনিক্যাল শোনাচ্ছে। কিন্তু এটা আমার মোটামুটি বিশ্বাসে এসে গেছে এবং এটা থেকে এখন আর নড়ানো যাবে না।

আরেকটা জিনিস যা লক্ষ্য করতাম তা বলি। পার্টির রাশি রাশি ইস্তাহার বা ২৩ নং বা ২৪ নং দলিল: এগুলো আমি কোনোদিন পড়ে উঠতে পারিনি। সত্যি কথা বলতে, আমার ভীষণ ক্লান্তি লাগত, পড়তাম না। আমার সন্দেহ ওরাও বোধহয় পড়তো না। কিন্তু পৃথিবী তো লাল হওয়ার দিকে একটু একটু করে এগোচ্ছে আমরা সবাই জানতাম। তার তো বড়ো উদাহরণ রাশিয়া, পৃথিবীর এক-ষষ্ঠাংশ জায়গা যাদের হাতে রয়েছে, তারপর চীন, যেটা পৃথিবীর ওই এক-ষষ্ঠাংশ-এর মতো জনগণ রয়েছে, তারপর ভিয়েতনাম, তারপর কোরিয়া, তারপর নর্থ কোরিয়া। তো দেখা যাচ্ছে যে, কমিউনিজম এগোচ্ছে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই আর আমি যে সময়ের কথা বলছি সে সময়ে ইতিমধ্যেই ইউরোপটাকে ভাগ করে ফেলা হয়েছে। রাশিয়ার বৃত্তে যে দেশগুলো পড়ল সেগুলো কমিউনিস্ট থাকল আর তার বাইরে ফ্রি ইউরোপ: এভাবে ভাগ হয়ে গিয়েছে। এই ভাগাভাগি যে স্তালিনের দিক থেকে কতটা নিষ্ঠুরভাবে আরোপিত, তা পরে ক্রমশ জেনেছি। একটা বই পড়েছিলাম সেখানে লেখক ডকুমেন্ট দেখিয়েছিলেন, দেখিয়েই কথাবার্তা বলেছিলেন যে, গ্রীসে কমিউনিস্ট পার্টি যথেষ্ট জোরালো ছিল, এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে গ্রীসে বোধহয় একটা লিবারেশন লড়াই শুরু হয়েছিল। সেখানে স্তালিন কোনো সাহায্য পাঠায় নি কারণ তাঁর ও উইনস্টন চার্চিলের করা যে ভাগ-বাটোয়ারা তাতে গ্রীসটা রাশিয়ার দিকে পড়ে নি। তারফলে গ্রীসের কমিউনিস্টরা যে আশা করেছিল রাশিয়া থেকে সাহায্য পাওয়ার, সে সাহায্যটা আসে নি। এটা রাশিয়ার দিক থেকে চার্চিলের সঙ্গে কথা রাখা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু গ্রীসের জনগণের কাছে তা অভিপ্রেত ছিল না। এটা রাশিয়া আগেও করেছে। যখন পোল্যান্ডকে ভাগ করা হলো হিটলারের সময়ে,  যে পোলান্ডের কমিউনিস্ট পার্টি দেশের শাসকদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে, ভাগ-বাটোয়ারার সময় সেই কমিউনিস্টদের যারা রাশিয়ার ভাগে পড়া পোল্যান্ডে গিয়েছে বা রাশিয়ায় ঢুকে গিয়েছে, তাদের হিটলারের হাতে তুলে দেওয়া হলো, আর তাদের নিয়ে হিটলারের যা করার তাই করল। এইক্ষেত্রে স্তালিন ও তার সঙ্গীরা জানতো না কী হবে তা তো নয়, তারা জেনেই করেছে। তখন হিটলারকে খুশি রাখার দরকার ছিল।

এখন, যে রাজনৈতিক কারণে অনেক সমঝোতা আমরা করি বা খুব সৎ, আদর্শবাদী কমিউনিস্টরা করেন, তা কখনো কখনো মেনে নেওয়া যায় কারণ অনেকসময়ই ঠিক আদর্শের প্রতি মর্যাদা রাখতে গেলে ঝুঁকিটা যতদূর পর্যন্ত নেওয়া যায় ঝুঁকিটা যদি তার থেকে বেশি হয়ে যায় সেক্ষেত্রে সেটা একটা আত্মহত্যামূলক কাজ হয়ে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে কোনো কোনো জায়গায় আদর্শের সঙ্গে রফা খানিকটা করা উচিত, কিন্তু একই সঙ্গে এটাও ঠিক যে সেই আদর্শের সঙ্গে রফাটা হলো নিখাদ রফা-ই এবং তার চরিত্রটা কোনো গভীরতর বৈপ্লবিক চরিত্র যে নয় সেটা মনে রাখা দরকার। লেনিন যতটা যা বলেছেন, সেখানে লেনিনিস্ট কোনো বড়ো পশ্চাদগমনকে অগ্রগমন বলেন নি। যেটা তাঁর পরে ঘটে গেলো: বারেবারে পদক্ষেপ ভুল প্রমাণিত হওয়ার পর তাকে গভীরতর বৈপ্লবিক চরিত্র দান করে সঠিক প্রতিপন্ন করার চেষ্টা হলো।  ফলে মানুষের বোঝাবুঝির জায়গায় একটা বড়ো বেনোজল ঢুকিয়ে দেওয়া হলো। এটা আমদের মধ্যে ছিল। কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ খোলাচোখে অসত্য বা বানানো মনে হলেও তার মধ্যে গুরুতর সত্য অবশ্যই আছে বলে বিশ্বাস করার অভ্যাস তৈরি হলো। আত্মপ্রবঞ্চনার ট্রেনিং হলো এর মধ্য দিয়ে। কমবেশি সেটা কমিউনিস্টদের বাধ্যতামূলক হয়ে উঠেছিল। সুভাষ মুখোপাধ্যায় সম্পর্কে আমি যে লেখাটা লিখেছিলাম সেটা তো তুমি পড়েছ। এই কমিউনিস্ট চরিত্রদের কিন্তু একটা আত্মদীনতা আছে। এটা ঠিকই যে তারা দেশের কথা ভাবেনি এটা কিন্তু নয়। সেটা মিথ্যা বলা হবে। তারা প্রাণ দিয়েছে, লড়াই করেছে, তারা অনেক কষ্ট সহ্য করেছে পার্টির জন্য, আদর্শের জন্য, তাদের যে আদর্শ ভবিষ্যৎ তার জন্য। তাদের অনেকের বাড়িতেই অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে। এগুলো আমি নিজের চোখে দেখেছি, অনেক শুনেওছি। এবং অনেকেই ব্যক্তি হিসেবে অত্যন্ত মহাপ্রাণ ব্যক্তি ছিলেন।

আমি একটু বিষয় থেকে সরে এসে একটা কথাই বলব যে, যেমন যখন বিদ্রোহ ঘোষণা করে নকশাল আলাদা পার্টি গঠন হলো, তখন ময়দানে কানু সান্যাল পার্টির তরফ থেকে বক্তব্য রেখেছিলেন। কানু সান্যাল যে পরে আত্মহত্যা করলেন, তা কেন? দূর থেকে দেখে আমি যেটা বুঝেছিলাম, সরাসরি যোগাযোগের কোন প্রশ্নই নেই যোগাযোগ ছিলও না, প্রশ্নটা আমার মধ্যে তৈরি হয়েছিল। লোকে আত্মহত্যা করে কখন? একটা হচ্ছে হতাশা থেকে: এগোনোর আর পথ নেই পিছানোরও পথ নেই। এরকম জায়গায় ধরা পড়ে গেলে, ইঁদুর যখন ইঁদুরকলে আটকে যায়, ইঁদুর হয়তো আত্মহত্যা করেনা, কিন্তু মানুষ হয়তো করে। আমার নিজের ধারণা যে আত্মহত্যার একটা সম্মানীয় বিকল্প থাকা উচিত। আত্মহত্যা কিন্তু এই বোধ থেকে নয় যে আমি হেরে গেলাম। তা অন্য বোধ থেকে। নিজেকে আমি বিশ্বাস করি, সম্মান করি, সেই সম্মান আমি অটুট রাখতে চাই, আমার স্বাস্থ্য ভেঙে গেছে, আমরা যে রাজনীতি করেছি সে রাজনীতির কোন ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছি না এবং নেইও বোঝা যাচ্ছে, আর আমি সরকারি সাহায্য নিয়ে বেঁচে থাকব না; একটা কবিতার ভাষা ব্যবহার করছি: একটা অনুর্বর জীবন যাপন করা, যে জীবনের কোন মুখরতা নেই, সেই জীবন যাপন করা আমার কাছে আদর্শ নয়, আমি সেখানে জীবন থেকে সরে যাচ্ছি। ভয়ে পালিয়ে যাওয়া এ কিছুতেই নয়। জীবনটাই অর্থহীন হয়ে গেছে। ধরুন, একটা বেশ ভাবার মতো  উদাহরণ দিতে পারি। খুব শ্রদ্ধেয় উদাহরণ। একটা নয়, দুটো। খুব বড় মার্কসবাদী, মার্কসবাদী ঐতিহাসিক এবং বৈজ্ঞানিক, যাকে ইংরেজিতে বলি পলিম্যাথ, যার বিভিন্ন বিষয়ে প্রায়শ দক্ষতা ছিল, অজস্র পেপার লিখেছেন, সৎ আদর্শবাদী লোক, সেই ডি ডি কোশাম্বি, তাঁর পিতা ধর্মানন্দ কোশাম্বী ছিলেন বৌদ্ধ। ধর্মানন্দ কোশাম্বীর জীবনটাতে আমি ঢুকছি না--- তা নিয়ে তাঁর নিজের লেখা বইও আছে ‘নিবেদন’ বলে, ইংরেজিতে অনুবাদও হয়েছে তা--- উনি আত্মহত্যা করেন পালিয়ে যাওয়ার জন্য নয়। ওনার কাজ সমাপ্ত, ওনার ছেলে ডি ডি কোশাম্বী যথেষ্ট একটা বড় জায়গায় আস্তে আস্তে উঠছে, এইবার ভাঙা শরীর নিয়ে পৃথিবী থেকে আর কিছু নিতে চাই না, এই পৃথিবীকে আমি ফিরিয়েও আর কিছু দিতে পারছি না, এরকম অবস্থায় আত্মহত্যা অত্যন্ত সম্মানজনক বিকল্প। এবং সেটা যদি মানুষ করে তাহলে তাকে তা করার অধিকার দেওয়া উচিত। নিশ্চয়ই সে স্বেচ্ছায় নিষ্ক্রমণ চাইছে। তাকে তো পৃথিবীতে তার ইচ্ছা আছে কি নেই এটা জেনে কেউ ডেকে আনেনি, অতএব সে পৃথিবী থেকে যদি সত্যি সত্যি ভয় না পেয়ে, কোনো নায়কোচিত মনোভাব না নিয়ে, নিষ্ক্রমণ করে এবং তার কারণও তার নিজের কাছে রয়েছে, তবে সেই নিষ্ক্রমণকে আমরা সম্মান দিতে বাধ্য। এরকম আরো অনেক উদাহরণ রয়েছে। তার মধ্য থেকেই দ্বিতীয় উদাহরণ। ফরাসী বিরাট মাপের মানুষ, ওনার ভাই ছিলেন গণিতের লোক, ফরাসী ইহুদি, তো উনি নাজীদের বিরুদ্ধে ফরাসী প্রতিরোধে যোগ দিয়েছিলেন, ইংল্যান্ডে অভিবাসী হতে বাধ্য হন। তারপর টিউবারকিউলিসিস মানে যক্ষা রোগে আক্রান্ত হন। তাঁর নাম সিমোন ওয়েইল। তখন ওনার বিপুল প্রসিদ্ধি, পুরো ইউরোপ জুড়ে লোক, মানে চিন্তা-ভাবনার জগতের লোক, ওঁকে চেনে। ইংল্যান্ডে যখন থাকছেন, টিউবারকুলোসিস-এ আক্রান্ত হওয়ার কারণে তখন তাঁর যথেষ্ট খাদ্য দরকার। কিন্তু উনি ঠিক করে নিয়েছিলেন যে অকুপায়েড ফ্রান্সে রেশনে যতটুকু খাদ্য দেওয়া হচ্ছে তার এতটুকু বা এক ফোঁটা বেশি খাবার তিনি খাবেন না। তিনি জানতেন যে এর মানে হচ্ছে নিশ্চিত মৃত্যুকে মেনে নেওয়া, তিনি ওইটাই ঠিক করলেন এবং কেউ তাঁকে টলাতে পারল না, আর তিনি মারাও গেলেন। একে যদি আত্মহত্যা বলি, তবে তাই-ই। অবশ্য কানু সান্যালের ক্ষেত্রে ওরকম কিছু বলছি না। কিন্তু তাঁর ক্ষেত্রেও আমার মনে হয়েছিল যে উনি সম্মান বজায় রেখেই এই পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়ার চেষ্টা করছেন। যা করতে চেয়েছিলেন তা হয়নি, কোনো ভুল রাজনীতির পথে তাঁরা এগিয়েছিলেন, সেখান থেকে সরে গেলেন মৃত্যুর মধ্য দিয়ে।

এইরকম নকশালবাড়ি-ভিত্তিক রাজনীতিতে থেকে তারপর রাজনীতিটা অনেকাংশই ভুল ছিল এবং ফলপ্রসু ছিল না বলে এ পথ থেকে সরে যাওয়া আরেকজন লোককে আমি চিনতাম। সে আমার চেয়ে আরেকটু ছোটো। খুব ভালো ছাত্র। সে একটা বই লিখেছিল। সেও মার্কসবাদের ধাঁচার মধ্যে থেকেই লেখালেখি করত। সে পাকিস্তান জেলে যখন ছিল, তখন সেই জেলেই বইটা লেখে। আমার এক বন্ধুর খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে সে আমাকে বইটা ছাপানোর ব্যবস্থা করা যায় কিনা তার কথা বলে এবং আমি সুবর্ণরেখার ইন্দ্রনাথবাবুকে সে কথা বলেছিলাম, তাঁর সঙ্গে তখন আমার হার্দ্য সম্পর্ক ছিল। ছোটো করে বইটা তিনি ছাপান। তার নাম সুব্রত বসু। আসল নাম সুব্রত বসু নয়, পদবিটা পাল্টেছিলেন। আমাকে একদিন এসে বলল, এই রাজনীতিতে আমি আর থাকবো না। ও ত্রিপুরা অঞ্চল রাজনীতির কাজ করতো। ওর যারা সহকর্মী ছিল বা ওর নেতৃত্বে যারা রাজনীতি করছিল, তাদের ও বলল: দেখো, তোমাদের বয়স কম, তোমরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাও। ‘আমি এ জীবনের মধ্যে আর থাকব না’ বলে সরে এসেছিল। কোনোরকম ঢাক পেটানো নয়, কান্নাকাটি করা নয়, ‘অনেক কিছু করতে পারতাম, রাজনীতির জন্য হলো না’ বলে নিজেকে ট্রাজেডির হিরো করা নয়, ‘আমি অনেক ত্যাগ করে রাজনীতি করেছি, অতএব এখন আমায় দাও দাও দাও’ বলে দাবি করে বেড়ানোও নয়: একেবারেই ব্যক্তিগত জীবন যাপন করছে, যোগাযোগও করে না। যোগাযোগ করলেও সাড়া দেয় না কারণ অতীত জীবনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে চায় না।

যাই হোক, একটু অন্য কথায় চলে এলাম। আমি যেটা বলতে চাইছিলাম সেটা হচ্ছে: ওইভাবে বড়ো হয়ে, ওই যার সাথে বন্ধুত্বের মতো কিছু একটা হলো, কারো কারো সঙ্গে দেখা করাতো, ওই রকম সব ব্যাপারগুলো পরের দিকে হাস্যকর ভাবে অর্থহীন বলে মনে হতো। কিন্তু সরাসরি ভাবে না বলতে পারতাম না। ব্যাপারটা কোনো একভাবে গড়িয়ে চলতো। সম্পর্কটা শেষ হয়ে গেল ওর দিক থেকেই। সালটা ১৯৫৮ সাল। তখন ঠিক ওই পুজোর আগে আগে বোধ হয়, নোবেল প্রাইজ ডিক্লেয়ার করা হতো। সেই বছর নোবেল প্রাইজ পেয়েছিল রাশিয়া থেকে পাস্তেরনাক। তারপর যেটা হবার সেটা হলো, আপনারা সবাই তা জানেন। এখানকার কমিউনিস্টরা বইটা পড়ুক বা না পড়ুক, বিপ্লবী রাজনীতির বাজারে পক্ষ-বিপক্ষ চলে এলো। যেহেতু পাস্তেরনাক বাধ্য হন নোবেল প্রাইজটা প্রত্যাখ্যান করতে, এমন কথা বলা হচ্ছিল যে পাস্তেরনাক দালালি করতে গিয়েছিলেন, তাকে আটকে দেওয়া হয়েছে, ইত্যাদি। একদিন আমার সেই রাজনৈতিক বন্ধুর সঙ্গে পথে হাঁটছি, হঠাৎ তার পরিচিত একজনের সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়ায় দাঁড়িয়ে দু-কথা শুরু হয়েছিল। সেইজন বলে বসলো, ‘কী ব্যাপার? তোমাদের তো নোবেল প্রাইজের কী হলো?’ পাস্তেরনাকের পক্ষ নিয়ে তার বলা কথা সমর্থন করে আমার বন্ধুর সাথে একটু তর্ক করেছিলাম। সেই থেকেই আমি বিপ্লবের প্রতি আনুগত্যে ফেল করে গেলাম। ওই ছেলেটি আমার সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করলো এবং তারপর আর আমার সাথে দেখা করেনি। ওই একবার দুবার দেখা হয়ে গেলেও এড়িয়ে গেছে। তারপরে আর কোনো খবর রাখিনি। আমার দিক থেকেও আর কোনো যোগাযোগ ছিল না, কেননা তার বাড়ি আমি চিনতাম না এবং সে তার বাড়ির কোনো ঠিকানা দেয়নি। এগুলোতো সত্যিকারের হাস্যকর ব্যাপার। এর সঙ্গে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই। রাজনীতিকে এক ধরনের অর্থহীন রাজনীতিতে পরিণত করে সেটাই ওরা চর্চা করে যেত। সম্ভবত সে কোন কারখানাতেও কাজ করতো। কিন্তু ইন্টেলেকচুয়াল হিসেবে ইংরেজি বই সব সময় ব্যাগে বা হাতে রাখতো। জানিনা কারখানাতেও সেগুলো হাতে করে নিয়ে যেত কিনা। অন্যান্য শ্রমিকরা জানতো নিশ্চয়ই যে ও হচ্ছে পার্টি-করা-একজন। কোনো পার্টির ইউনিয়নের নেতা ছিল কিনা সেটাও আমি জানিনা। ও নিজের দিক থেকে কোনোদিন কিছু বলেনি। আমারটা তো ও সবটাই জানতো। এরপরে আমি ওইরকম সত্যিকারের রাজনৈতিক কোনো সংগঠনে আর থাকিনি।

কলেজে পড়ার সময় বেশকিছু বন্ধু-বান্ধব হয়েছে, তাদের মধ্যে অনেকেই বামপন্থী। কিন্তু অধিকাংশের ক্ষেত্রেই বামপন্থী মানে এই যে তারা বামপন্থী কথাবার্তা বলতো, আলাপ-আলোচনা করতো, নাটক নভেল পড়তো, নাটক হয়তো দেখতো এবং সিনেমা-টিনেমা দেখতো। তার বাইরে কোনো কমিটমেন্ট, মানে কোনো রাজনৈতিক পার্টিতে যোগ দেওয়া আমার বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যে কেউ করেনি। যারা কলেজে পড়তো তারা কলেজে হয়তো কোনো সংগঠনের সঙ্গে ছিল। তার মধ্যে এক বন্ধু,  যার সঙ্গে অন্যদের তুলনায় একটু বেশি ঘনিষ্ঠতা ছিল, সে পরে সিপিএম সম্পর্কে বিমুখ হয়ে ওঠে এবং এক সময় দেখলাম মমতার দিকে চলে গেল। সে নিয়ে আমার সাথে তর্ক হয়েছে পরে। এসব জায়গায় তর্ক করে কোনো লাভ হয় না। কারণ এটা মানুষের বিশ্বাসের জায়গা। তর্ক করলে সে তার বিশ্বাসকে আরো গভীর ভাবে আঁকড়ে ধরে।

আমার আরেক বন্ধু ইতিহাসের অধ্যাপক ছিলেন, এক বছর হলো মারা গিয়েছেন। সে হয়তো একসময় নকশালবাড়ি রাজনীতিকে সমর্থন করতো, যদিও একেবারে অন্ধের মত নয়, একেবারে খোলামনের ছিল তাও বলবো না। সেই সময় অনেকেই মমতার রাজনীতি একটা অল্টারনেটিভ হতে পারে ভেবে সেই রাজনীতিতে যোগ দিচ্ছে। তখন সে কলেজ থেকে রিটায়ার করে গেছে। কিন্তু যারা তখনও পড়াচ্ছে তাদের সাথে তার ভালো সম্পর্ক ছিল। মমতাকে সমর্থন করে তখন সে তার আগের অভ্যাসমতোই একটা ‘স্ট্যান্ড’ লেখে। আমার নিজের মনে হয়েছিল যে এটা এক ধরনের মমতার রাজনীতিকে সঠিক ভাবে না বোঝার ফল। জানিনা আপনারা কে কি মনে করেন, আমি মমতা সম্পর্কে গোড়া থেকেই সন্দিহান। তার যে অতীত লোকে জানে তার মধ্যে এমন কোনো জায়গা কিছু নেই যাতে মনে করা যেতে পারতো যে মমতা একটা সত্যি সত্যি বড় মাপের কাজের দিকে এগোবেন। সিপিএম অন্যায় করেছে, অনেক ক্ষেত্রে প্রচুর অন্যায় করেছে ঠিক, কিন্তু মমতা যে ন্যায় করবেন তা ভাবা যেতে পারে কীভাবে? যেমন স্কুলের চাকরি বিক্রি করার ব্যাপারটা পুরোনো, সিপিএমের আমলেও হয়েছে, তারাও অনেককে চাকরি দিয়েছে যারা হয়তো যোগ্য নয়। কিন্তু সরাসরি বাজারে দাঁড়িয়ে নিলামে চাকরি বিক্রি করার মতো ব্যাপারটা পরে দেখলাম মমতার আমলে ঘটেছে। সেই জায়গায় বোধ হয় সিপিএম-ও যায়নি।

সিপিএম আর মমতার তুলনামূলক বিচারে যাচ্ছি না। আমি শুধু বলছি  যে রাজনীতিতে এমন মুহূর্ত আসে যখন আমরা অনেক বড় বড় ভুল করি। আমি নিজে যেহেতু রাজনৈতিক পার্টি-সংগঠন করিনি সুতরাং আমি ভুল-ঠিক-এর যে কথা বলব তা হচ্ছে ওই পার্টি-সংগঠন-এর বাইরে থেকে আমি কোনটা ঠিক বা কোনটা ভুল বলে মনে করেছি সেই কথাই। যেমন, একসময় নকশালবাড়ি আন্দোলন দেখে মনে হচ্ছিল যে এর মধ্যে সম্ভাবনা কিছু আছে। এটা আমার পরে ভুল বলে মনে হয়েছে। ওই রাজনীতির সক্রিয় কর্মী দু-একজন, যেমন গৌতম ভদ্র, আমার বাড়িতে দু-একবার এসেছিল। গৌতম মারফত একজন ছেলেও আমার বাড়িতে এসেছিল। এই নিয়েই একটা ঘটনা মনে আছে, তা বলছি। আমার নিজের ধারণা আমার বাড়িতে বোধহয় সুশীতল রায়চৌধুরী সেল্টার নিতেন। আমি নিশ্চিতভাবে জানিনা, আর এখন তো জিজ্ঞাসা করার কোনো প্রশ্নই নেই। খুব সৌম্য চেহারা, ধুতি পাঞ্জাবি পরা, মাঝ বয়সী লোক, চেহারার মধ্যে একটা ভদ্র সুজন ভাব। তখন আমার কিছু বইপত্র থাকতো ওই মাঝের ঘরে। বইপত্রগুলো উনি খুব দেখতেন। সুশীতল বাবু যদি নাও হন পার্টির উপরের দিকের কোন একজন হবেন নিশ্চয়ই। সেই ভদ্রলোক আসার আগে আমার বাড়িতে মাঝে মাঝে সেল্টার নিতে আসতো গৌতমের পার্টির কেউ কেউ। সবাই তরুণ এবং সোমবার যদি X আসে তো শনিবার Y এলো, তারপর আবার মঙ্গলবার Z এলো। থাকবার জন্য এই জায়গাটা বিশ্বাসযোগ্য কিনা পরখ করতো হয়তো। তা একদিন সকালবেলায় পাম্প খারাপ হয়েছে, তখন ওদের যে ছেলেটি এসেছিল, সে নিচে নেমে গিয়ে পাম্পটা ঠিক করে দিল। বাবা এসব দেখে বলল, ‘তুমি তো দেখছি এসব কাজ-টাজ জানো, তোমাকে একটা ছোট কথা বলি। এখন প্রতিটি পাড়া, বিশেষ করে পাড়ার সরু গলি, সেখানে একেবারেই যে লোকে নজর করে না তা নয়। আমার বাড়িতে যারা আসে তাদের মধ্যে কেউ কেউ রাতে থাকে, বন্ধুবান্ধবও একজন দুজন আছে। বিশেষ করে দুজন বন্ধু। একজন বিবাহিত জীবনে দাম্পত্য কলহে জর্জরিত, তাই আমার বাড়িতে থাকে, অন্যজন বিয়েই করেনি, তার জীবনটাই অগোছালো। তাদের পাড়ার লোকেরা সবাই চেনে। কিন্তু এই বাড়িতে যদি প্রতিদিন একজন একজন করে নতুন লোক আসে, রাত্তিরে থাকে, তাহলে সেটা ওদের নজরে পড়তে পারে। তোমরা বাড়িটা ট্রাস্ট করবে কিনা বোঝার জন্য আসছো। সেটা তোমরা ঠিক করে নাও। যদি কারুর বা কেউ আসার দরকার বলে মনে করো সেই একজনই যেন আসে।’

এরকম আরেকটি ক্ষেত্রে দেখেছিলাম, একটা চিঠি এসেছে, বেনামী চিঠি, এমন একজন লোক লিখেছেন যিনি আমাদের পরিচিত, তিনি তাঁর হাতের লেখা গোপন রাখার জন্য ব্লক লেটারে লিখেছিলেন, একটা রুলার দিয়ে যদি A লিখি তাহলে তো হাতের লেখা ধরা পড়ে না। এইভাবেই A, B, C, D সবগুলোই ওইভাবে রাইট অ্যাঙ্গেলে লেখা। চিঠিটায় কোনো পরিচয় দেওয়া নেই, খুব কদর্য রুচিতে লেখা, কোনো কারণে তাঁর রাগ হয়েছিল, রাগটা এভাবে প্রকাশ করে দিলেন, যাতে আমি স্কুলের চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে বেরিয়ে আসি। মজা হচ্ছে পরে সেই লোকটার পরিচয় বুঝতে পেরেছিলাম। বোঝার কারণও ছিল--- সেই লোকটি নকশালবাড়ি রাজনীতিতে যোগ দিয়েছিল, এবং তাঁর একটি লেখা আমি আর আমার এক বন্ধু মিলে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলাম, সেই তর্জমা পুরোপুরি আমেরিকাতে তখন একটা জার্নাল বের হতো, নাম ছিল ‘প্রোগ্রেসিভ লেবার’, তাতে ছাপাও হয়েছিল। এবং ওঁর নামে নয়, ওঁর গোপন নামে। কিন্তু মজার কথা তার কয়েকদিন বাদে স্কুলের একজন ভদ্রলোক, তিনি পুরোনো সিপিএমের মেম্বার হয়তো ছিলেন না, কিন্তু সত্যপ্রিয় রায় শিক্ষকদের যে টিচার ইউনিয়ন তৈরি করেছিলেন তার মেম্বার ছিলেন, পরে সাউথ পয়েন্ট কর্তৃপক্ষ জানতে পারার পর তাকে বাধ্য করা হয় স্কুল ছাড়তে না হয় ইউনিয়ন ছাড়তে। উনি ইউনিয়ন ছেড়ে দেন এবং ততদিনে সত্যপ্রিয় রায় জীবিতও নেই। কিন্তু সিপিএম পার্টির সঙ্গে যোগাযোগটা ছিলই। উনি তাঁকে বলছেন, ‘আর তো সমস্যা নেই, আপনার তো বিরাট একটা লেখা বের হল, বিরাট জায়গায়।’ ভদ্রলোক চুপ করে থাকলেন। লেখাতে কিন্তু তিনি নামটা গোপন রেখেছিলেন, কিন্তু গোপন রাখতে গিয়ে যেটা করেছিলেন তা হলো ওনার নামের আগের দুটো অক্ষর দিয়ে একটা নাম তৈরি করেছিলেন অমুক গুপ্ত। আদ্যাক্ষর দুটো ওই ভদ্রলোক জানতেন B আর L। তার মানে পার্টি কতখানি খোঁজখবর রাখতো--- কে কোনখানে কার লেখা ছাপাচ্ছে, ব্যক্তিটি ঠিক কে--- পার্টির ভিতরে সেইসব খোঁজখবরগুলো ওরা ঠিক জোগাড় করে নিতো।

ওইরকম একটা সময়ে ওই ১৯৫৮, বা তার এক-দুই-বছর পরে আমার বাড়িতে এক ভদ্রলোক আসতেন: আমার আত্মীয়, তিনি ভ্রাম্যমান পুস্তক বিক্রেতা। তিনি বই নিয়ে আসতেন: ‘দেখো, কোন বই লাগবে’। আমি বললাম যে এই দুটো বই লাগবে, টাকাটা ভেঙে ভেঙে দেব। সেভাবেই দিতেন। ওনার আবার কলকাতার বামপন্থী কিছু ইনটেলেকচুয়ালদের সাথে আলাপ ছিল। উৎপল দত্ত, শম্ভু মিত্র থেকে থিয়েটার লাইনের শিল্পী, লেখক, সাহিত্যিকদের সাথে যোগাযোগ ছিল। একদিন আমাকে এসে বলল, তোমাকে নিয়ে যাব, আলাপ করিয়ে দেব। নিয়েও গেলেন। আমার ঠিক মনে পড়ছে না, কোন বাজার, কিন্তু একটা বাজারের ওপরে থাকতেন, তাঁর নাম নারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায়। জানি না, আপনারা হয়তো নাম শোনেননি। ওনার একটা বই আছে ‘বিপ্লবের সন্ধানে’ বলে। সম্ভবত কলেজ স্ট্রীটের একটা পাবলিশার্স আছে--- পুরানো দিনের রাজনৈতিক কর্মচারীদের টাকায় পাবলিকেশনটি হয়েছিল--- প্রোগ্রেসিভ পুস্তক বা র‍্যাডিক্যাল বুকস বা ওইরকম কিছু নাম। সেখান থেকে বইটা নতুন রিপ্রিন্ট করেছে। নারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে হীরেন মুখোপাধ্যায় তাঁর আত্মজীবনীতে একটা মজার কথা লিখেছিলেন। হীরেন মুখোপাধ্যায় নারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে বলেন যে, নারায়ণবাবু আপনি তো মোটামুটি আমাদের বিশ্বাসগুলোই অ্যাকসেপ্ট করেছেন, তাহলে আপনি কেন পার্টিতে জয়েন করছেন না? তখন নারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, ‘দেখুন মশাই, আপনি কি জানেন পুরোনো দিনে আমরা যখন ছোটো ছিলাম তখন হিন্দু সমাজে বলা হতো ২০ তে বুড়ি। যার বয়স ২২ বা ২৩ হয়েছে, অথচ কুমারী কন্যা, তার বিয়ে হতো না। আর যদি বা বিয়ে হতো, খুঁজে পেতে বর পাওয়া গেলো, তো সেই বরের বয়স হয়তো ৬৯ কি ৭২। ফলে যেটা হতো বিয়ের কিছুদিন বাদে বরটি মারা যেতো। বিয়ে না হওয়ার থেকে বিয়ে হয়েও যে বিবাহিত জীবনের সুখ খুব একটা পেতো তা নয়। কিন্তু একটা সুখ কম হলেও যা পেয়েছে, তা হলো বিয়ের আগে মাছ-মাংস খেতে পারতো। তো লাভের মধ্যে বিয়ে করে বিধবা হয়ে সেই মাছ-মাংস খাওয়াটা বন্ধ হয়ে গেল। আমি চাই না আমার সেটা হোক।’ হীরেন মুখার্জী জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনার মাছ-মাংস খাওয়া কেন বন্ধ হবে?’ তিনি বললেন, ‘খুব সহজ। আমি যতদিন পার্টিতে ঢুকছি না, ততদিন আপনারা বলবেন নারায়ণ বাবু আপনি কেন ঢুকছেন না। আমি ঢোকার পরদিন বলবেন আপনার এই বিচ্যুতি হয়েছে, ওই বিচ্যুতি হয়েছে। পার্টি থেকে বের করে দেবেন, আমি একঘরে হয়ে যাব। দরকারটা কী? আপনি এখন বলছেন শুনে যাবো। পার্টিতে না ঢুকলে আপনারা পরে বলবেন যে লোকটি যথেষ্ট সিরিয়াস নয়, কিন্তু কোনো বিচ্যুতির দোষ তো দিতে পারবেন না। আমি এভাবেই ঠিক আছি।’  তো আমাকে সেই নারায়ণবাবুর কাছে নিয়ে গেল। ভদ্রলোককে লক্ষ্য করলাম: একা থাকেন, ঘর ভর্তি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা, তার উপর ওঁর লেখা বিভিন্ন, ঘুপচি লেখা বই হিসেবে বেরিয়েছে তেমন না, উনি কবিতা-টবিতা লিখতে পারতেন--- ছড়া, রাজনৈতিক কবিতা। উনি বিড়ি খেতেন পয়সা বাঁচানোর জন্য। কিন্তু বিড়ি পিছু বারো-তেরোটা দেশলাই কাঠি নষ্ট করতেন। উনি ভুলে যেতেন যে বিড়িতে টান দিতে হয়, নাহলে বিড়ি নিভে যায়। বিড়ি প্রতি ১০-১৫টা কাঠিতে এক-একটা বিড়ি শেষ হতো। ওনার মধ্যেও আমি সেই ঝোঁকটা লক্ষ্য করেছিলাম যা আগে আমি সেই বেনামী চিঠিলেখকের মধ্যে দেখেছিলাম। সেই ঝোঁকটার কথায় এবার আসি।

চিঠিটা পাওয়ার পরে আমার মনটা খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল। চিঠিটা আমায় কে লিখল, কেন লিখল! কোনো কারণ ছাড়াই! এবং নিজের পরিচয় দিয়েছেন ‘ইয়োর এনিমি’ বলে। যার পরিচয়ই জানি না, সে আবার এনিমি কী! কথাটা বলাও যা না বলাও তাই। আমার কাছে উনি জবাবদিহি করেছেন। তো উনি জবাবটা কী পেলেন? উনি রাগটা প্রকাশ করলেন কিন্তু রাগটা যে কে প্রকাশ করল সে তো বুঝতে পারা গেলো না। তাতে আমার বিশেষ লাভ-ক্ষতিও কিছু হলো না, ওই একটু রাগ জাগা ছাড়া। তো বাবা পরেরদিন সকালে বললো, ‘তোমার চিঠিটা আমি দেখেছি। এটা এমন একজন লোক লিখেছে যার পার্টির ট্রেনিং, সে টেররিস্ট পার্টি হোক, কমিউনিস্ট পার্টি হোক, তা আছে। কারণ এটা আমাদেরও শিখতে হতো। কোনো চিঠি পাঠাতে গেলে--- যেকোনো চিঠি, খারাপ চিঠি হোক বা ভালো চিঠি--- যেটা হয়তো এমন এক জায়গায় পাঠাচ্ছি যেখানে একটু ঝুঁকি আছে অন্য কারোর হাতে পড়ার বা পুলিশের হাতে পড়ার--- সেক্ষেত্রে আমি যদি আমার পরিচয় গোপন রাখতে চাই, তাহলে আমি ব্লক লেটারে রাইট অ্যাঙ্গেলে লাইন টেনে টেনে কথাগুলো লিখব।’

এই ভদ্রলোকের মধ্যে যেটা লক্ষ্য করেছিলাম সেটা নরেনবাবুর মধ্যেও, তাঁরা নির্মমভাবে সর্বাত্মক এক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে সমস্ত বিষয়কে দেখেন। স্থির-নির্ধারিত  ধাপকাটা পথ বেয়ে মানুষ যে উন্নতির পথ ধরে এগোবে এবং সেই এগোনোর শেষটা হচ্ছে সমাজবাদ, সমাজবাদের পরের ধাপ কমিউনিজম--- এর কোনোরকম বিচ্যুতি বা ব্যত্যয় ঘটবে না। এটা যে একেবারেই ভুলভাবে ইতিহাসকে দেখা বা এমন এক ইতিহাস-দর্শন যা গোড়া থেকেই ভ্রান্ত, তা তাঁদের কোনোভাবেই ভাবানো সম্ভব ছিল না।  কোনো কোনো ব্যাপারে এমন কিছু লক্ষণ থাকতে পারে যা সব জায়গাতেই থাকবে--- যেমন, মানুষ যতক্ষণ না চাষবাস শিখছে ততক্ষণ গাছের ফল খেতে হবে বা পারলে হরিণ, বুনো শুয়োর বা খরগোশ শিকার করে খেতে হবে। সুতরাং আদিম সমাজে খাদ্য সংগ্রহের প্রক্রিয়াটি দেশে দেশে খুব আলাদা হবে না। যেটা আলাদা হবে সেটা হলো: ওই দেশে কী ফল পাওয়া যায় আর আমাদের দেশে আমরা কী ফল খেতে পারি, সেখানে কী জন্তু মারা যায় আর আমাদের দেশে কোন জন্তু মারতে পারি। আর হয়তো কোনো তফাৎ হবে না। কিন্তু তারপরেও যে সমাজের ক্রমোন্নয়নের পরপর ধাপ আছে এবং সেই ধাপ ধরে সম্পূর্ণ একই লাইনে মানুষ ও সমাজ এগোচ্ছে, এইরকম চিন্তাটা মার্কসবাদীদের গভীরে ঢুকে গিয়েছিল। তবে এটা শুধু ভারতবর্ষে নয়, দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের পরে মার্কসবাদ এই অবধারণবাদী পজিটিভ ঝোঁক জেঁকে বসে, যেটা অনেকেই মনে করে এঙ্গেলস মারফত ঢুকেছে এবং পরে লেনিন তা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। এ হলো সম্পূর্ণ দৃষ্টবাদী এক দৃষ্টিভঙ্গি যার মধ্যে নিশ্চয়ই অনেক কিছু ইনসাইট বা অন্তর্দৃষ্টি রয়েছে, কিন্তু তার বাইরে যে আরও অনেক কিছু বিশেষ ও সাধারণ বিষয় থেকে যেতে পারে তা সে একরোখাভাবে অস্বীকার করে বসে।

ইতালির একজন খুব বড়ো চিন্তক, নাম বেনেডেটো ক্রোচ (Benedetto Croce), তিনি অন্য দিক থেকে অন্য দিক থেকে চমৎকারভাবে কথাটা বলেছিলেন। তাঁর ওই লেখাগুলো সব বেরিয়েছিল বিদেশী পত্রিকায়, আমার এক বন্ধু বিদেশে ছিল, সে নিয়মিত পাঠাত, সাবস্ক্রাইব করে দিয়েছিল আমার নামে, তাই নিয়মিত পেতাম। সেই পত্রিকার সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ সংখ্যাগুলো আমার বাড়ি থেকে চুরি হয়ে গেছে। কারা চুরি করেছে এটা অনুমান করতে পারি, কিন্তু সেটা আর বলে কী হবে? ক্রোচ-এর লেখাগুলো ওই সূত্রে হারিয়ে গেছে। ক্রোচ মার্কসবাদের এক পরিমার্জিত রূপের কথা ভেবেছিলেন, এঙ্গেলসকেও তিনি জায়গা দিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন যে এঙ্গেলসকে বাদ দেওয়াটা ঠিক নয়। তার কারণ তিনি দেখিয়েছিলেন। সেই প্রসঙ্গে এখন যাচ্ছি না। তিনি শুধুমাত্র অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ার উপর জোর দিয়ে ইতিহাসের এক নির্ধারণবাদী আখ্যান তৈরি করার বিরোধিতা করেছিলেন। মার্কসবাদের একরকম কট্টর রিগোরাস অদ্বৈতবাদী (monist) ধরনের গ্রন্থন যা দাবি করে যে ব্যতিক্রমহীনভাবে সমস্ত সমাজ নির্দিষ্ট ধাপে ধাপে এগোবে সমাজবাদ লক্ষ্য করে, এবং সমাজবাদ অভ্রান্তভাবে শেষ হবে কমিউনিজমে--- এর মধ্যে বড়ো একটা চিন্তার ফাঁকিবাজি ও ভুল বোঝাবুঝি রয়েছে। ইতিহাসকে ঠিক মতো বোঝার চেষ্টা এতে নেই, ইতিহাসগতির যে ভিন্নতা ভিন্ন ভিন্ন দেশের ইতিহাস ভিন্ন ভিন্ন রূপ পাচ্ছে তা দেখার চেষ্টা নেই, সংস্কৃতিবলয়ের সঙ্গে উৎপাদনব্যবস্থার সম্পর্কের বহুমুখীনতার কারণে সংস্কৃতির পার্থক্য যে কতো রকম মৌলিক পার্থক্য তৈরি করতে পারে তা ঠিকভাবে বোঝার চেষ্টা নেই, কেবলমাত্র এক লঘুকরণবাদী (reductioist) সূত্র আঁকড়ে থাকার চেষ্টা আছে। এই ঝোঁকটা তখন সেই ভদ্রলোক ও নরেনবাবুর মধ্যে দেখেছিলাম। নিজেদের মধ্যেও ভীষণভাবে লক্ষ্য করেছিলাম।

নারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার যোগাযোগ আবশ্য বেশিদিন থাকে নি। কিছুদিন মাঝে মাঝে দেখা হয়েছে, ওঁর বাড়িতে আর আলাদা করে যাইনি, অন্য জায়গায় আলাদা করে দেখা হয়েছে। ওনার বাড়িটা ওই বাজারের উপর হওয়ার কারণেই আর আমি সেখানে যাই নি কখনো।

স্কুলের যে সহকর্মী ভদ্রলোক, তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ ছিল এবং তাঁর ওই লেখাটি অনুবাদ করেছি, তাঁর সাথে কথা বলেছি, উনি ততক্ষণে আবার পুরোপুরি চীনপন্থী হয়ে গেছেন। তাঁর মার্কসবাদ-এর ভাষ্য তখন তা দিয়ে নির্ধারিত, অফিসিয়াল কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে তাঁর যোগাযোগটাও তখন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। আমরা তখন এইসব নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতাম মাঝেমধ্যে, বই বের করতাম বা বই সংগ্রহ করার চেষ্টা করতাম--- সব বই পড়েছি এমন নয়। এটা ঘটনা যে মার্কস- লেনিন-এর ভলিউম ১,২,৩,৪ করে ৪০-৫০টা: আমি তার কোনোটিই পড়িনি। আলাদা করে তাঁদের দু-একটা লেখা পড়েছি। আমার নিজের ক্ষেত্রে, আমি নিজে লেনিনের লেখা পড়ে খুব অতৃপ্ত বোধ করতাম।

তখন অন্যরকম চিন্তার একটা জোয়ার উঠেছিল। সবজায়গায় নকশালবাড়ির আন্দোলনকে তখন গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু তখনই আমার দু-একটা বিষয়ে খটকা লেগেছিল। সবচেয়ে বড়ো খটকার জায়গা হচ্ছে এই যে, ভারতবর্ষে আজকে যদি আমাদের Protracted Civil War-এর কথা আমাদের বলতে হয়, তার সম্ভাব্যতা কতখানি সে বিষয়ে আমার খুব গভীর সন্দেহ ছিল। কারণ চিন দেশের সঙ্গে ভারতের অবস্থার সাযুজ্য কতখানি? দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগে চিনের যে অবস্থা, এমনকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরেও চিনের যে অবস্থা, তার সঙ্গে ভারতবর্ষের অবস্থা কি ১৯৬২, ১৯৭০, ১৯৯৫-৯৮ এই কোনো সময়কালেই মেলে? দুইনম্বর হচ্ছে, চিনের বিপ্লব যদি ভুল দিকেও এগিয়ে থাকে, বিপ্লবটি যে আদৌ সম্ভব হল তার একটা বড়ো কারণ হচ্ছে যে রাশিয়ার সঙ্গে তার একটা বিরাট কমন বর্ডার ছিল। চিন নিশ্চিন্ত ছিল যে রাশিয়া চিনকে আক্রমণ করবে না, জাপান করতে পারে। জলপথ দিয়ে পশ্চিমী দেশগুলো যদি আক্রমণ করে ভবিষ্যতে, আগেও করেছে, তাও চিনের ওই অঞ্চলে প্রভাব ফেলবে না। মাও-জে-দং যেখানে ঘাঁটি গেড়েছিলেন, চিনের সেই উত্তর-পূর্ব কোণে এক যদি রাশিয়া ঢুকতে পারে, তাছাড়া আর কারো ঢোকার পথ নেই। এই বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলো কি ভারতে মিলবে? তাছাড়াও, চিনের আভ্যন্তরীণ যে প্রশাসনিক নৈরাজ্য (administrative anarchy) ভারত সেই অ্যানার্কির জায়গায় পৌঁছয় নি। ভারতে অত্যন্ত সবল একটা সেনাবাহিনী আছে। সেনাবাহিনী যে সবসময় তার কাজে সফল হচ্ছে তা বলছি না, কিন্তু তার সঙ্গে মোকাবিলা করার জন্য যে ধরনের সামরিক প্রশিক্ষণ বা এমনকি গেরিলা ট্রেনিং পার্টির লোকেদের থাকার কথা, তা ভারতবর্ষে ছিল না।

কল্লোল (দাশগুপ্ত) যে বইটা লিখেছে তাতে একজায়গায় বলেছে, দীপক বিশ্বাস নামে একজনকে গুলি করে মেরে ফেলেছিল নকশাল-আন্দোলনের ছেলেপুলেরা। ওই দীপক নকশালদের খুব ঘনিষ্ট ছিল। ইনফ্যাক্ট, তার মাধ্যমেই পুলিশ জানতে পারে চারুবাবু কোথায় লুকিয়ে আছে। সে গল্প একেবারেই আলাদা। ও যে বিশ্বাসঘাতক ছিল তা নয়। কেন করতে বাধ্য হয়েছিল সেই কারণটা কল্লোল ওখানে লিখেছে, ভালো করেই সহানুভূতিপূর্ণভাবে লিখেছে খুব। এবং ওকে মারাটা যে সম্পূর্ণ অন্যায়, ভুল হয়েছিল সেটা বোঝাও যায়। ওই দীপক বিশ্বাসের লেখায় তার চিনে যাওয়ার অভিজ্ঞতার কথা আমরা পাই। চিনগামী সেই দলে মল্লিক, জঙ্গল সাঁওতাল এবং দীপক বিশ্বাস নিজে ছিলেন। তাদের মাও-জে-দং নাকি জিজ্ঞেস করেছিল, তোমরা যে ভাগচাষি বা জমি নেই এমন চাষিদের জন্য লড়াই করছো, তোমাদের পার্টিতে তাদের সংখ্যা কত? ওরা কোনো উত্তর দিতে পারেনি। ভারতবর্ষে তাদের সংখ্যার অনুপাত কত? কোনো উত্তর দিতে পারেনি। এর থেকে বোঝা যায় যে কোনোরকম প্রস্তুতি ছাড়াই বিপ্লব সংঘটনের কাজ শুরু হয়ে গিয়েছিল।

এটা ঠিক যে চারু মজুমদার নিজে খুব আদর্শবাদী লোক ছিলেন। নিজে অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন। তাঁর ছেলেমেয়েরাও তাদের বাবার পথ সম্পূর্ণ ভুল বলে মনে করে না। ছেলে-মেয়েরা যে খুব ভালো আছে তা নয়, কিন্তু তাদের নিজস্ব একটা আদর্শবোধ আছে। আরও যেটা অদ্ভুত লেগেছিল, অদ্ভুত বলব না, যেটা ভালো লেগেছিল তা হলো এই যে চারু মজুমদারের রাজনীতির ভুলভ্রান্তি যাই থাকুক, বউকে একসঙ্গে রেখে রাজনীতি করেছেন।  যখন চিন ভিয়েতনামকে আক্রমণ করেছে, বন্ধু, সহকর্মী, সে বলছিল, আমার আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে করছে। আন্তর্জাতিক স্তরে, ১০ বছর ধরে প্রথমে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে, তারপরে আমেরিকার বিরুদ্ধে, জাপানের বিরুদ্ধে যে দেশটা লড়াই করেছে সেই দেশটাকে চিন আক্রমণ করতে পারে--- সহযোদ্ধাদের মধ্যে সম্পর্ক এমনই ভঙ্গুর হতে পারে? পল পটের রাজনীতিটাই বা কী--- জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ মেরে ফেলে দিয়েছে। এটাই যদি মার্কসবাদ হয়, সমাজবাদ হয়, অধঃপতিত হতে হতে তা কোথায় এসে পৌঁচেছে?

আমার ব্যক্তিজীবনে খটকাগুলো কীভাবে শুরু হয়েছিল সেই কথায় আসা যাক। কমিউনিস্ট অভিধেয় যেসব ব্যক্তিরা আমার চারপাশে ছিলেন, তাঁদের মধ্যে আমার বাবা তো বটেই, তাঁরা কখনোই আমি রাজনীতি নিয়ে কী করছি না করছি তা নিয়ে কোনো কথা বলতেন না, বরং বললে একটা কথাই বলতেন যে বিশ্বাসটা যদি আমার ঠিক বলে মনে না হয়, তাহলে রাজনীতি করার মানে হয় না। বাবার বিশ্বাস ছিল উনি যে সময়ে বিক্ষুব্ধ হয়ে রাজনীতি থেকে সরে এসেছিলেন, সেই সময়ের আগে-পরে ভারতবর্ষে একটা বিপ্লবী পরিস্থিতির সম্ভাবনা ছিল। এই বিশ্বাসের কারণটাও উনি একবার বলেছেন, আমি শুনেছি, মানে বিস্তারিত আলোচনা করে বলেছেন এমন নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রচুর অস্ত্রসম্ভার নানা জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছিল, এখন আর সেটা হওয়া সম্ভব নয়। কৃষকদের মধ্যে এমন একটা ধারণা ও বোধ তৈরি হচ্ছিল যে নিজেদের জীবনটা পরিবর্তন করতে হবে, আর পরিবর্তন করতে গেলে সেই দায়িত্বটা নিজেদেরই নিতে হবে। কিন্তু সেটার বিস্তৃতি কতটা ছিল সেটা তো বাবার নিজের করা ধারণা, ওই বিশ্বাসটা একটু অতিরঞ্জিতই ছিল মনে হয়।

আমার সঙ্গে সেই সময় রাজনীতি-করা যে ছেলেটি নিয়মিত দেখা করতো, তা মাসে ওই একবার, দুইবার, বা তিনবার। নিয়মিত বলতে এরকমই। এবার যদি এক জায়গায় হলো তো পরেরবার অন্য জায়গায়। টিকটিকিরা নাকি আমাদের পিছনে লেগে থাকবে। এগুলোর মধ্যে যে আত্মপ্রবঞ্চনা--- নিশ্চিত আত্মপ্রবঞ্চনা--- আছে তা বুঝতে বেশিক্ষণ সময় লাগে না। এছাড়া অনেকসময়ই বিশেষ ধরনের ভাষা ব্যবহার লক্ষ্য করেছি যা আমার খুব ঠিক বলে মনে হতো না। এরমধ্যে একটা অন্য কথা বলে নিই। বাংলা সাহিত্যে কমিউনিস্ট চরিত্র বলতে একটি চরিত্রের কথা খুব মনে পড়ে। বুদ্ধদেব বসুর ‘তিথিডোর’ বলে একটা উপন্যাসে সম্ভবত পাঁচ বোন। ছোটো বোনটির বিয়ে হলো। গল্পের নায়িকা ওই ছোটো বোনটিই। বুদ্ধদেব বসু যেমন উপযুক্ত বলে মনে করেন, পাত্র সেই ধরনের। পাত্রটি কলেজের অধ্যাপক, ইংরেজি ভাষার অধ্যাপক এবং মেয়েটি ওর পড়ানো শুনে মুগ্ধ হয়ে যায় এবং প্রেমের সঞ্চার হয়। তার আগের বোনের বিয়ে হয়েছিল যে ভদ্রলোকের সঙ্গে তিনি ওই সময়কার সৌখিন কমিউনিস্ট, অত্যন্ত স্বার্থপর,  এবং তার সঙ্গে একটু অহংকারও তার চরিত্রের মধ্যে গেঁথে দেওয়া আছে। অর্থাৎ তিনি কখনও আত্মসমীক্ষা করে নিজের ভুলটাকে ভুল বলবেন এটা তার চরিত্রের মধ্যে তৈরিই হয় নি, কতকগুলি তৈরি করা বুলি সে আওড়ায়। যেমন ধরা যাক, রবীন্দ্রনাথের জীবনের শেষের দিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে লেখা কবিতাগুলোর মধ্যে একটা ছিল ‘দিকে দিকে নাগিনীরা ফেলিতেছে বিষাক্ত নিশ্বাস, শান্তির ললিত বাণী শুনাইবে পরিহাস’। এখানে রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিজীবনের যে বিশ্বাস, সেই বিশ্বাসভঙ্গ ফুটে উঠেছে। তাঁর আগের বিশ্বাসটি ছিল: ইউরোপ আমাদের জ্ঞান-বিজ্ঞান দিয়েছে, আধুনিক শিক্ষা দিয়েছে, আধুনিক অনুভব দিয়েছে, এনলাইনমেন্ট যাকে বলা হয়, হয়তো ভারতের সামান্য একটা অংশ তা পেয়েছে, কিন্তু সেই সামান্য অংশই পরবর্তীকালে ভারতবর্ষের সাধারণ মানুষের মধ্যে সেই উত্তরণটা ঘটাবে। রবীন্দ্রনাথের এই বিশ্বাস ভেঙে যাচ্ছে। এই ভেঙে যাওয়ার জন্যই তিনি হতাশা থেকে--- সেই হতাশার একটা বস্তুগত ভিত্তি অবশ্যই রয়েছে--- ওই কবিতাটি লিখছেন। কিন্তু ‘তিথিডোর’-এর ওই চরিত্রটি একজন কমিউনিস্ট পার্টির লোক হিসেবে, পার্টির লোক হয়তো না-ও হতে পারে, পার্টির সিমপ্যাথাইজারও হতে পারে, সেটা ঠিক স্পষ্ট করে বলা নেই, কিন্তু সে চাকরি-বাকরি করে, মোটামুটি উপার্জন ভালোই করে, একইসঙ্গে সে যেকোনো ব্যাপারে কোনো দায় নিতে হলে এড়িয়ে যাবে। রবীন্দ্রনাথের মতো বিশ্বাসের ভেঙে পড়ার মুখোমুখি সে কখনোই হবে না। এইরকম একটা ফাঁকিবাজ চরিত্রকে বুদ্ধদেব বসু কমিউনিস্ট হিসেবে দেখিয়েছেন। বুদ্ধদেব বসু অবশ্য যদি এমন দেখাতেন যে চরিত্রটি যথেষ্ট সাচ্চা হয়েও, আত্মদানে পিছপা না হয়েও এমন খামতির শিকার হতে পারে, তাহলে চরিত্রটা আরও মূল্যবান হতো। ধরা যাক একজনের কথা আমি বলতে পারি, রেবতী বর্মনের কথা। রেবতী বর্মনের জীবন আমি একটা বইয়ে পড়েছিলাম। সেসময় এমন বাংলা বই প্রচুর পাওয়া যেত। অবিভক্ত বাংলায় যে এন্ট্রাস পরীক্ষা হতো সেই এন্ট্রান্স পরীক্ষায় ফার্স্ট, সেকেন্ড হওয়া মানে এভারেস্টের চূড়ায় চড়ার মতো ছিল। এখন যেমন অঙ্কে অনেকেই ৯০ বা ৯২ পায়, তখন সেরকম ছিল না। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হতো এবং সে পরীক্ষায় সারা ভারতবর্ষ থেকে যারা পরীক্ষা দিত, তাদের মধ্যে কেউ অঙ্কে ১০০-র মধ্যে ৯০ পেয়েছে মানে ধরে নিতে হবে যে তার অঙ্কে মাথা বেশ ভালো,  তার প্রশিক্ষণ আছে এবং সে জানে কী করে কঠিন অঙ্ক প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়। এখন এটা একদম উঠে গিয়েছে। রেবতী বর্মন একদম অল্প বয়সে স্কুলে থাকতে থাকতেই টেররিস্ট পার্টিতে ছিলেন। সেইজন্য পরীক্ষা দিতে হয় নিজের স্কুল থেকে বেরিয়ে গিয়ে বাংলার অন্য জেলায় গিয়ে ব্যবস্থা করে। পরীক্ষায় তিনি ফার্স্ট হন। পরবর্তী সবকটা পরীক্ষাও তিনি তিনি পালিয়ে পালিয়ে দিয়েছেন। এবং প্রতিটি পরীক্ষাতেই তিনি প্রথম হয়েছেন। এই লোকটি গ্রেফতার হয়ে পরে আন্দামানে গিয়েছিলেন। আন্দামানের জেলে তিনি ‘ক্যাপিটাল’ হাতে পান এবং তা পড়েন। পরে এরকমও শুনেছি, পার্টির ভিতরকার লোকেদের মধ্যে যারা একটু পড়াশুনা করতেন তারা বলেছেন যে ওনার নোট-নেওয়া খাতা হাতে পেলে আমাদের সুবিধা হতো। কিন্তু তার পরবর্তীকালে উনি সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ অবস্থায় কাটান। এই যে ন্যাশানাল বুক এজেন্সি এটা ওনার টাকায় তৈরি, উনি ওনার যে বৃত্তির টাকা ছিল, NBA-এর জন্য সব টাকাটা দিয়ে দেন। এরপর তিনি মারা যান ত্রিপুরায়, শুধু মারা যান বললে পুরোটা বলা হয় না, সম্পূর্ণ একা মারা যান কুষ্ঠ রোগে ভুগে। কুষ্ঠ কী করে হল? কারণ খুব সহজ। জেলে স্বাস্থ্য-পরিবেশ ছিল অত্যন্ত খারাপ। আমি আরেকজনের কথাও জানি যার বাড়ির লোকেদের মধ্যেও ছোটোরা জানতো না যে তার কুষ্ঠ হয়েছে। তারও একই কারণে ওই জেল থেকে হয়েছিল। এবং তার একটা হাত অকেজো হয়ে গিয়েছিল। তার এক ভাই তখন কলকাতায় পড়াশুনা করছে। সে বলেছিল: আমি তখন পার্কে গিয়ে বসে শুধু কান্নাকাটি করি নিজের মনে, বারবার বলি যে দাদারই কেন কুষ্ঠ হতে হলো। পরে দেখা গেল সৌভাগ্যক্রমে সংক্রমণ ছড়ায় নি, ঠিকমতো চিকিৎসাও হয়েছিল এবং উনি সেরেও গিয়েছিলেন। একটা হাত চিরকালের জন্য সরু হয়ে গিয়েছিল, সে হাত দিয়ে কিছু করতে পারতেন না, অন্য হাতেই সব কাজ করতেন। তিনি সারাজীবন শুধু দিয়েই গেলেন। নিজের দিকে, পরিবারের দিকে তাকালেন না। বিয়ে-থা করলেন না, অকৃতদার থেকে গেলেন। এবং পার্টির চেনাশোনা যারা ছিল সবাই তাঁকে শ্রদ্ধা করত, তবু তিনি ধীরে ধীরে সরে গেলেন। এইসব মানুষদের আত্মবলিদান প্রশ্নাতীত। কিন্তু ব্যর্থতাই কী সব ছেয়ে দিলো না? আদর্শের যে উচ্চতার সঙ্গে কোনো জায়গায় হয়তো ভুল বিশ্বাস ছিল, কীভাবে সেই ভুল বিশ্বাসের সঙ্গে নিজ বুদ্ধিমত্তা মিলমিশ করতে পারছিল না, কোন জায়গায় আর উত্তীর্ণ হওয়া গেলো না, এই প্রশ্নগুলো তুলে অনুসন্ধানের সূত্রপাত করতে পারলে তাঁরা অবশ্যই একটা কঠিন কাজে হাত দিতে পারতেন। তা দেননি। এ কি একধরনের ফাঁকিবাজি হয়ে গেলো না?

তা বুদ্ধদেব বসু ‘তিথিডোর’ উপন্যাসে ওনার ইচ্ছা মতো একজন লোকসাজানো কমিউনিস্টকে দেখানোর বদলে যদি এমন কাউকে দেখানোর চেষ্টা করতেন যিনি কমিউনিস্ট পার্টির ভিতরে থেকে হোক বা বাইরে থেকে হোক, ওই আদর্শে বিশ্বাস করে তার জন্য মূল্য দিয়েছেন, একইসঙ্গে যিনি তার উল্টো দিকে এই বিশ্বাসটা ‘ওয়ার্থহোয়াইল’ ছিলো কিনা প্রশ্ন তুলে নিজে আত্মসমীক্ষা ও অন্তর্সমীক্ষা চালিয়ে গেছেন, তাহলে কী ব্যাপারটা অনেক কাজের হতো না? এখানে বুদ্ধদেব বসুও ফাঁকিবাজি করলেন।

অবশ্য একথাও সত্য যে বুদ্ধদেব বসু যেভাবে তাঁর উপন্যাসের চরিত্রটিকে এঁকেছিলেন, ঠিক তেমন চরিত্রের লোকও কমিউনিস্ট পার্টিতে ছিলো। আমার নিজের এমন একজনের সঙ্গে পরিচয় ছিলো। সেই ভদ্রলোক পড়াশুনায় খুব ভালো ছিলেন, খুবই ভালো ছাত্র ছিলেন। কিন্তু ব্যক্তিজীবনের ক্ষেত্রে যেখানে বলা হয় ফ্রয়েড এবং মার্কসকে একজায়গায় আনতে হবে, সেখানে আমার ধারণা তিনি তাঁর নিজের স্ত্রীকে--- ধারণা নয় এটা সত্যি কথা--- তার স্ত্রীর প্রতি তাঁর ব্যবহারে অত্যন্ত অসম ও নিঃসংশয় পুরুষপ্রভুত্ববাদী আধিপত্য প্রয়োগ করতেন। আমার নিজের চোখে তা দেখা। একইসঙ্গে তিনি অত্যন্ত হিসেবী ও স্বার্থপর ছিলেন এবং এইসব সংকীর্ণতাগুলোর সঙ্গে কমিউনিজম- মার্কসবাদ-কে মিলিয়েছেন নিজের মতো করে। তাঁর কমিউনিজম-মার্কসবাদ-এ বিশ্বাসের মধ্যে কোনো সত্যিকারের আত্মপ্রশ্ন অন্তর্প্রশ্ন ছিলো না, নিজের বিশ্বাসের মধ্যে ফাঁকিবাজির কারণে কোথাও সেই প্রশ্নগুলো করার ক্ষমতাটাও ছিলো না। আমার দেখা কমিউনিস্টদের মধ্যে এমন লোকদের সংখ্যাই অনেক বেশি। এবং অনেক বেশি হওয়ার একটা কারণও আছে বলে মনে হয়। কমিউনিস্টরা শুরুই করেন এই বিশ্বাস দিয়ে যে--- ওই একসময় কলকাতার দেওয়ালে দেওয়ালে লেখা হতো--- মার্কসবাদ সত্য। ‘মার্কসবাদ সত্য, অভ্রান্ত, কারণ ইহা বিজ্ঞান’ --- এইধরনের একটা কথা। দেখুন এই অতিনিশ্চয়তার কথা যে সাড়ম্বরে দেওয়ালে দেওয়ালে লিখেছে, এর কারণটা কী? এর কারণ আন্দাজ করার জন্য আমরা একটা ইংরেজি ‘ইডিয়ম’-এর সাহায্য নিতে পারি। ‘ইডিয়ম’-টা হচ্ছে ‘হুইসলিং ইন দ্য ডার্ক’। তার মানে হলো: একজন অন্ধকার পথে চলেছে, সে ভয় পেয়েছে, সে ওই হুইসেল দিতে দিতে নিজের সাথে নিজে কথা বলে--- বলে আরে ভয়ের কী আছে?  --- মানে নিজেকে একটা প্রবোধে দেওয়া যে, ভয় পেও না, ভয়ের কিছু নেই। এটাই হচ্ছে ‘হুইসলিং ইন দ্য ডার্ক’। পথ অন্ধকার হচ্ছিলো কারণ রাশিয়া টলে গেছে, চিনের সমাজতন্ত্রের কতখানি সমাজতন্ত্র আর কতখানি বেনোজল তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছিলো, আর চিনের সমাজবাদের মূল আদর্শটিও বা বস্তুগতভাবে সমাজবাদী আদর্শের কতখানি খাঁটি রূপ তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছিলো। প্রশ্ন প্রবল হচ্ছিলো ‘গ্রেট হ্যান্ড সভিনিজম’ নিয়েও। রাশিয়াতে যেমন লেনিন খুব সতর্কভাবে রুশ গ্রেট সভিনিজমের বিরুদ্ধে লিখেছিলেন এবং রুশ জাতীয়তা থেকে ভিন্ন যেসব জাতিসত্তা জারতন্ত্রী রাশিয়া থেকে সমাজতন্ত্রী রাশিয়ার অংশ হয়ে গেছে, তাদের মধ্যে থেকে অনেককে পার্টির ভিতরে এনেছিলেন। সবচেয়ে বড়ো উদাহরণ হল স্তালিন: তিনি জর্জিয়ান ছিলেন, তার মাতৃভাষা জর্জিয়ান ছিল। কিন্তু জোসেফ স্তালিন রাশিয়ার পার্টিতে ঢুকে জর্জিয়ানদের প্রতি ঠিক সেই আচরণটাই করলেন যা একজন জারিস্ট জেনারেল বা জারিস্ট হাই অফিসার-এর চেয়েও অনেক বেশি নিষ্ঠুর। কিন্তু এগুলোকে শুধু ভুল বললেই পার পেয়ে যাওয়া যায় না, ওই ভুলের জন্য এখন শুধু স্তালিন বা এমনকি লেনিনকে দোষ দিয়েও লাভ নেই, আরো উৎসমূলে গিয়ে খোঁজার দায় থেকেই যায়। যেমন ধরা যাক: পার্টির গঠনতন্ত্রের মধ্যে কি কোনো বড়ো ভুল হয়ে গিয়েছে, যে ধরনের ভুলের কথা একদম গোড়ার দিকে রোজা লুক্সেমবুর্গ বলেছিলেন? বিপ্লব-সংগঠনের এই পথটি যে পথে এগোচ্ছে সেই পথে কিন্তু ধীরে ধীরে নেতৃত্বটা একটি লোকের হাতে গিয়ে কেন্দ্রীভূত হয়ে যাচ্ছে। সেই নেতৃত্ব-কেন্দ্রীভবনের সঙ্গে সঙ্গে ‘অটোনমি’, ‘সেলফ-রাইট’ সব ভেঙে গুঁড়ো করে দেওয়া হচ্ছে; এবং নতুন কোনো ভাবনা বা মত হাজির করা বা প্রয়োগ করার সুযোগগুলোও কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। শুধু যেটা সাবসিটিউশন হবে লুক্সেমবুর্গ যে প্রতিস্থাপন বা সাবস্টিটিউশন-এর আশঙ্কা করেছিলেন তা তো মিলে গিয়েছে---  ক্লাসের বদলে পার্টি প্রতিস্থাপিত হচ্ছে, পার্টির ভিন্ন ভিন্ন ফ্র্যাকশনের মধ্যে একটি ফ্র্যাকশন, একটি ফ্র্যাকশনের মধ্যে একটি লিডার এবং পরবর্তীকালে একজন লিডারই সারা দেশের ভাগ্যনিয়ন্তা হয়ে উঠছে। ফল তো যা হবার তাই হলো।

চিন রাশিয়ার চাইতে তত্ত্বচর্চার দিকে থেকে মানে থিওরিটিক্যাল দিক থেকে অনেক পিছিয়ে ছিলো। মাও জীবনে কোনোদিন ‘ক্যাপিটাল’ পড়েন নি। কারণ ‘ক্যাপিটাল’ তখন চিনা ভাষায় অনুবাদই হয়নি। মাও যেটুকু রুশ ভাষা শিখেছিলেন, যেটুকু ইংরেজি জানতেন, তাতেও ‘ক্যাপিটাল’-এর তর্জমা পড়া মুশকিল। ইংরেজি অনুবাদও খুব সম্ভবত তাঁর কাছে গোড়ার দিকে পৌঁছয়নি। পরে হয়তো তিনি নাড়াচাড়া করে দেখএ থাকতেও পারেন। এখন এমন হতেই পারে যে এই ‘ক্যাপিটাল’ পড়া বা না পড়া দিয়ে খুব একটা তফাৎ হয় না। কিন্তু একথা তো অন্তত দাবি করা যায় না যে কেবলমাত্র তত্ত্বকার হিসেবে নয়, মার্কসবাদী তত্ত্বকার হিসেবেও শুধু চিনে নয় গোটা বিশ্বের নিরিখেই মাও মহান।

একটা মজার কথা মনে পড়ছে। একজন ভদ্রলোক, উনি তখন পোল্যান্ডে ছিলেন। উনি পোল্যান্ডের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন এবং উনি ছিলেন ট্রটস্কির গ্রুপের অংশ। রুশ বিপ্লবের পর বিপ্লবের জন্য ভ্রাতৃত্বমূলক সহযোগিতার কাজে রাশিয়ায় ছিলেন বেশ কয়েক বছর। পরে তাকে পালিয়ে চলে আসতে হয়। এটা তো রাশিয়ার মধ্যে বিপ্লবের পূর্ববর্তী সময় থেকে যারা কমিউনিস্ট ছিলেন তাদের অনেককেই এভাবে পালিয়ে আসতে হয়েছিলো ১৯৩৪ সালের পরে। ওনাকে কেউ জিজ্ঞাসা করেছিল: আপনি তো পড়াশুনা করেন, আপনি কি ‘দাস ক্যাপিটাল’ পড়েছেন? সে ভদ্রলোক নাকি উত্তর দিয়েছিলেন: দ্যাখো, আমি পড়িনি, কিন্তু আমি একজনকে চিনি, সে আরেকজনকে চেনে যে আরেকজনকে চেনে, সে নাকি পড়েছে। ‘দাস ক্যাপিটাল’ পড়ার ব্যাপারটা বোধহয় এইরকমই ছিল।

রোজা লুক্সেমবুর্গ নিজেই তো পোলিশ হলেও জার্মান ভাষায় লেখালেখি করতেন। এই বহুভাষিকতার দক্ষতাটা ইহুদিদের মধ্যে ভীষণ বেশি ছিল, ইউরোপে তাদের মধ্যেই মনে হয় সবচেয়ে বেশি। একজন ইহুদি পুরোনো ইউরোপে ১৯৩০-এর দশকের আগে হয়তো ইংল্যান্ডে থিতু হয়েছে (খুব কম ইহুদিই অবশ্য ইংল্যান্ডে থিতু হয়েছিল), তার ভাই-বোন কেউ থাকে জার্মানিতে, কেউ থাকে পোল্যান্ডে, কেউ থাকে হল্যান্ডে, কেউ থাকে রাশিয়ার পুবে বা পশ্চিমে, কেউ অন্য জায়গায়। ফলে তারা যখন একত্রিত হতো, যে ভাষায় তারা কথা বলতো, স্বাভাবিকভাবেই তা ভিন্ন ভিন্ন বহু ভাষার খিচুড়ি।

যে প্রসঙ্গে আসছিলাম তাতে ফেরা যাক। অবিশ্বাস এইভাবে শুরু হয়েছিল, বড়ো মাপের খটকা লেগেছিল। ব্যক্তি হিসেবে অমুক লোক ঠিক নয়, ব্যাপারটা ঠিক এমন নয়। ব্যক্তি খারাপ হতেই পারে। তা দিয়ে তো ব্যক্তি যে বিশ্বাসটা ধরে রেখেছে সে সম্পর্কে প্রশ্ন না-ও উঠতে পারে। বিশ্বাস সম্পর্কে প্রশ্ন কখন ওঠে? প্রথম যেটা হয়েছিলো, তা হলো আসলে স্তালিন কেমন মানুষ ছিলেন এবং স্তালিন জমানায় রাশিয়াতে কী হয়েছে, তার কিছু কিছু ঝলক সারা পৃথিবীর লোক জানতে পারলো ক্রুশ্চেভের ১৯৫৬ সালের বক্তৃতার মধ্য দিয়ে।১০ আমার নিজের ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে মনে আছে, আমি যে ক্রুশ্চেভের বক্তৃতাটা পড়েছিলাম তা নয়, কিন্তু বক্তৃতা নিয়ে নানা লেখাপত্র যা ছিলো সেগুলো পড়েছি। সেটা মোটামুটি জানি। কিন্তু তখনই অতকিছু জানতাম না। এটা বুঝলাম, যে বিরাট বিশ্বাসের মৌলিক কাঠামোয় একটা চিড় ধরে গেছে। ওইরকম মৌলিক কাঠামোয় যখন চিড় ধরে, চিড়টা কিন্তু ওই  যে কোনোরকমে জোড়া দেওয়া যায় না। কীসব রাসায়নিক আজকাল বেরিয়েছে না, কাচও জোড়া দেওয়া যায়, কিন্তু পাথর জোড়া দেওয়া যায় না। ওই বিশ্বাসের ধরনটা একশৈল প্রকৃতির, চিড় যদি ধরে তো পুরোটাই ভেঙে পড়তে চায়। মনে আছে আমি তখন একটা কবিতাও লিখেছিলাম— ভাগ্যিস এখন তা হারিয়ে গেছে--- সেখানে এরকম একটা কথা লিখেছিলাম: প্রাচীন স্ফিংক্স এইদিকে তাকিয়ে ছিল, পৃথিবীর মানুষের ভবিষ্যৎ পানে, রাশিয়া পানে, রাশিয়াতেই  তো মুক্তিসূর্য উঠছে, আর এখন স্ফিংক্স অত্যন্ত দুঃখে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তখনও ব্যাপারটা এরকম: বিশ্বাসের সারবত্তা হয়তো নেই বা হয়তো আছে, কিন্তু বিশ্বাসের নিশ্চিতিটা টলে গেছে। তখন আমার মতো একটা ১৫-১৬ বছরের ছেলের কাছে এর বেশি আর কী স্পষ্ট হবে? বইপত্রও অতো ছিলো না, তেমন কোনো পত্রপত্রিকা ছিল না। কিছু কিছু যারা কমিউনিস্ট পার্টির ভিতরকার লোক তারা খবর একটু বেশি পেতেন। কিন্তু সেখানেও সমস্যা ছিলো। যেমন ধরা যাক, ইংল্যান্ডে একটা পত্রিকা শুরু করেছিল ব্রিটিশ কমিউনিস্ট পার্টির কিছু তরুণ, পরে বিশাল পণ্ডিত লোকেরা তাদের হাত থেকে তা কেড়ে নিলেন। যাঁরা এই পত্রিকা শুরু করেছিলেন, কমিউনিস্ট পার্টির ভিতরকার মানুষ, তাঁদের মধ্যে জে ডি বার্নালের নাম করতে হয়। তাঁর সম্বন্ধে বলা হতো: ‘the most important Briton’। বার্নাল এমন ধরনের পদার্থবিজ্ঞানী ছিলেন যিনি নিজে কখনো পদার্থ বিজ্ঞানের ওপর নোবেল পুরস্কার পাননি কিন্তু তার আইডিয়া নিয়ে কাজ করে দু-তিনজন নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। তাঁর সম্বন্ধে শোনা যায় যে প্রথম কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন তিনি তাঁর প্রস্তাবিত গবেষণার বিষয়ে বলতে গিয়েছিলেন, তখন ইন্টারভিউ বোর্ডে থাকা পণ্ডিতজনেরা তাঁকে একটি প্রশ্ন করারও অবকাশ পায়নি, পুরো সময়টা তিনি কী বিষয়ে কাজ করতে চান এবং সেই বিষয়ের সম্ভাবনা কী, কেন ও কীভাবে সেই সম্ভাবনাটিকে রূপায়িত করতে হবে, তা তিনি বলে গিয়েছিলেন এবং বিশিষ্ট বড়ো বড়ো বৈজ্ঞানিকরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো তা কেবল শুনে গিয়েছিলো। তাঁর একটা বই আপনারা দেখে থাকতে পারেন: ‘সাইন্স ইন হিস্ট্রি’। তার বাংলা অনুবাদ করেছেন আশীষ লাহিড়ী। আমার আজকের বোঝাবুঝির উপর দাঁড়িয়ে এখন মনে হয় যে বইটার মধ্যে যাকে বলে ‘রিডাকশনিজম’ বা ‘ডিটারমিনিজম’, যার বাংলা আমি করেছিলাম ‘নির্ধারণবাদ’, যা সবকিছু আগে থেকে নির্ধারণ করা যায় এমন একটা প্রকট নির্ধারণবাদী ভ্রম কাজ করছে, এমনকি তাছাড়াও লেখার মধ্যে কিছু গণ্ডগোল আছে, কিন্তু ওঁর মতো বড়ো মাপের বৈজ্ঞানিক খুবই বিরল। উনি ব্রিটিশ কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে ছিলেন আর ছিলেন ঐতিহাসিকদের মধ্যে বেশ কয়েকজন বড়ো মাপের ঐতিহাসিক যাদের মধ্যে এ পি থম্পসন-এর নাম তো সর্বাগ্রে বলতে হয়। অক্সফোর্ডের সেই অধ্যাপক ক্রিস্টোফার হিল-ও ছিলেন, কিন্তু ক্রিস্টোফার হিলের থেকেও ঐতিহাসিক হিসেবে থম্পসন অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এঁদের মধ্যে প্রথম ওই ভিতরকার প্রশ্নগুলো উঠেছিলো এবং তাঁরা তখন নিজেদের মতো করে তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করছিলেন। সেই সময় হাঙ্গেরির ঘটনাটা ঘটল। তাঁরা অনেকেই পার্টি থেকে বেরিয়ে গেলেন। এটাই হচ্ছে তাঁদের পক্ষে, ওই যাকে বলে, ‘donkey’s last straw’: একটা গাধার পিঠে বোঝা চাপাতে চাপাতে তা এমন এক সংকটমুহূর্তে পৌঁছে গেল যে তারপর কোনো বোঝা নয়, কেবল এক টুকরো খড় চাপাতেই গাধার পিঠটা ভেঙে গেল। এক্ষেত্রে বিষয়টা অবশ্য অত ছোটোখাটো ছিলো না, খুবই দুঃখের সেই ইতিহাস। সেটা প্রথম সামনে উঠে এলো এই প্রশ্নগুলোর মধ্য দিয়ে: পূর্ব ইউরোপের ডেমোক্রেটিক রিপাবলিকগুলো কতোটা ডেমোক্রেটিক? কতটা তারা রিপাবলিক? এবং কতটা তারা নিজেরা নিজেদের যুক্তিচিন্তা অনুযায়ী কী করবে তা বেছে নিতে আর কতোটা পারে না? এই প্রশ্নগুলো তখন ইউরোপে উঠছিলো এবং ইউরোপের কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর মধ্যে অনেকেই চিন্তিত ও হতাশ হয়ে সব ব্যাপার কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলো না। অবশ্য প্রশ্ন ওঠা শুরু হয়েছিলো অনেক আগেই। সেকারণেই যারা ট্রটস্কিপন্থী তারা তার আগেই সরে এসেছিলেন কিন্তু তারা সরে গিয়েও সোভিয়েত রাষ্ট্রকে সাময়িকভাবে অধঃপতিত হলেও শ্রমিকশ্রেণির রাষ্ট্রই বলছেন, বলতে গিয়ে সঙ্গে সঙ্গে এটাও বলছেন যে ট্রটস্কির পথটাই ঠিক ছিল, তাহলে লেনিনের পথও ঠিক ছিল। লেনিনও যে সবসময় ঠিক ছিলেন না এটা কিন্তু ট্রটস্কিপন্থীরা অনেক পরে বলেছেন। একটা সময় অবধি তারা প্রশ্ন তুললেও মূলে গিয়ে ভাবতে চায়নি। এই বাঁধা কাঠামো ছেড়ে তারা বের হতে চায়নি যে  লেনিন বিপ্লবের প্রকৃত নিখুঁত দিশা দেখিয়েছিলেন এবং সেই ধারায় বিপ্লবের দিশাপ্রদর্শকের পদটা লেনিনের উত্তরসুরি হিসেবে ট্রটস্কিরই প্রাপ্য ছিল, তা থেকে ট্রটস্কিকে বঞ্চিত করেছেন স্তালিন, আর এ থেকেই সব সমস্যার উদয় ঘটেছে। ট্রটস্কি-ই যে প্রকৃত উত্তরাধিকারী তা হতেও পারে আবার নাও হতে পারে, কিন্তু সর্ষের মধ্যেই ভূত ছিল কিনা তা তো প্রশ্ন করে যাচাই করে নেওয়া দরকার।

আজকের বিশ্বে দাঁড়িয়ে এখন যেটা মনে হচ্ছে, সবচেয়ে বড়ো ও প্রাথমিক প্রশ্ন হলো এটাই যে মার্ক্সবাদের মূল ভিত্তিমূলক প্রতিজ্ঞাগুলো (premises) কী ঠিক আছে? তোমাদের লেখাটায়১১ এই প্রশ্নটা তোলা হয়েছে: মানুষকে যে প্রকট সুখবাদ-ভোগবাদ-এর দীক্ষা দেওয়া হয়, কেবল ভোগ করো--- ভোগ করো--- ভোগ করো, সারা পৃথিবীতে সেই অনুযায়ী যদি সমভাবে বণ্টন করতে হয়, এই বণ্টনের জন্য প্রয়োজনীয় ভোগ্যদ্রব্য কি পৃথিবীর প্রাকৃতিক রসদ দিয়ে করা সম্ভব? একটা পৃথিবীতে কুলোবে? দশটা পৃথিবীর রসদ হয়তো লাগবে। দশটা হোক, পনেরোটা হোক, বারোটা হোক, একটা পৃথিবীতে কুলোবে না। কিন্তু একটা পৃথিবীতেই তো আমাদের থাকতে হবে, ওইরকম কোনো কল্পবিজ্ঞানের জগতে চলে গেলে চলবে না যে মানুষ আবার নতুন করে অন্য গ্রহে কলোনী গড়বে, অন্য কোনো বাসযোগ্য পৃথিবীতে। পৃথিবীর সবচেয়ে কাছের কোনো বসবাসযোগ্য গ্রহ মানে আরেক পৃথিবী যদি পাওয়াও যায়, ধরা যাক ১০০-২০০ আলোকবর্ষ দূরে, মানব সমাজের একটা বড়ো অংশকে সেখানে স্থানান্তরিত করা কল্পবিজ্ঞানের পক্ষেও কল্পনা করা সম্ভব নয়। আমাদের এই পৃথিবীতেই থাকতে হবে। We are fated to live on this earth, the planet of ours. পুঁজিবাদ এখানে ঠিক কথা বলছে না সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু সেই পুঁজিবাদের কথা শুনেই তো আমরা প্রকৃতি-ধ্বংস আত্মধ্বংসের পথে অন্ধ নিয়তির পিছনে ধাওয়া করার মতো ছুটে চলেছি। পাহাড়ের ঢাল দিয়ে। ক্রমশই আমরা তলিয়ে যাওয়ার দিকে এগোচ্ছি। এটা এমন একটা জায়গায় এসে পৌঁচেছে যখন আর ফিরে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা আছে কিনা, থাকলে কতোটা, সেই প্রশ্ন উঠছে? এরকম জায়গায় এখন আমরা দাঁড়িয়ে আছি। সমাজবাদের কল্পস্বপ্নগুলো কী এই পরিস্থিতিতে কোনো পথ দেখাতে পারছে?

ভারতবর্ষ যখন সাম্প্রদায়িক দেশ ছিলো, সাম্প্রদায়িক দেশ বলতে আমি বিজেপি-র সাম্প্রদায়িক দ্বেষ-এর কথা বলছি না, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের পাশাপাশি সহাবস্থান ও মিশ্রণের দেশ বলছি, তেমন একটা সময়ে এখানে ইসলাম এসেছিলো, তখন অন্যান্য বাইরেকার দেশের বিভিন্ন জাতির মতো ভারতীয়রা তো পুরোপুরি ইসলামি হয়ে যায়নি, ইসলামি সংস্কৃতি ও ধর্মের জন্য একটা স্বতন্ত্র পরিচিতি-পরিসর তৈরি হয়েছিল। পোশাক একরকমই ছিল। দিনে দিনে কিছু ভারতীয়, বিশেষ করে উপরের দিকের সরকারি কর্মচারীরা আচার-আচরণ-বেশভূষায় ইসলামি কায়দা এলো। তারা অনেক জিনিস পড়তেন যা ভারতবর্ষের পরার চল ছিল না। প্রথম ইসলামিরা যেহেতু আরব দেশের পারস্য থেকে এসেছে, তারা তো অন্যরকমের পোষাক পরতেই অভ্যস্ত।

কিন্তু ভারতবর্ষের এই সাম্প্রদায়িক বৈচিত্র্যগত সহাবস্থান-সহনশীলতা ক্রমশ ক্ষয় পেয়েছে। কারণটা খুব সহজ। তার কারণটা হচ্ছে, আঠারো শতকের শেষ থেকে পশ্চিম ইউরোপের মূলত তিন-চারটি প্রধান ঔপনিবেশিক শক্তি--- ইংল্যান্ড সবচেয়ে বড়ো, তারপরে ফ্রান্স, তারপর স্পেন, পর্তুগাল তো আছেই--- এরা সারা পৃথিবীকে ইউরোপীয় ধারায় পশ্চিম ইউরোপের ছাঁচে ঢেলে ফেললো। যা কিছু আমরা এখন ব্যবহার করি, এমনকি শোয়া-বসার আসবাবপত্র, তা ভারতীয় জীবনের অংশ ছিল না। আর আজকে তো তা চূড়ান্ত জায়গায় পৌঁছে ‘বিশ্বায়িত গ্রাম’ (‘Global Village’) গড়ে তোলার দর্প জাহির করছে। গ্লোবালাইজেশনের ফলে আজ আমরা যে চা-টা খাই সেটা চিন দেশ থেকে এসেছে, কফি যেটা খাই সেটা ইজিপ্ট থেকে এসেছে, সফট ড্রিঙ্কস যেটা খাই সেটা মূলত আমেরিকা থেকে এসেছে, আমাদের বেশভূষা, খাওয়া-দাওয়া (যেমন বার্গার বড়োলোকরা তো খাচ্ছেই, গরিবরা যদিবা খেতে না পায়, খাওয়া তাদের অধিকার বলে ভাবছে) সব ব্যাপারেই আমরা পশ্চিমের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাচ্ছি। এই পরিস্থিতিতে, একজন কমিউনিস্ট পার্টির মেম্বার, যে মতবাদ-নির্ণীতভাবে আন্তর্জাতিকতাবাদে বিশ্বাসী, সে এই প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে কোনো অবস্থান নিতে পারে কি, নিলে তা কী ধরনের অবস্থান হবে?

ধরা যাক রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’ উপন্যাস। প্রথমে যখন গোরাকে দেখছি, সে উগ্র ভারতীয়, উগ্র হিন্দু, যদিও তার হিন্দুত্বের মধ্যে আত্মগর্ব থাকলেও তা আজকের বিজেপি-র হিন্দুত্ব নয়, কারণ সে ইসলামকেও শ্রদ্ধা করে। ইসলামের লৌকিক রূপ, মানে বাংলার মুসলমান গ্রাম সে দেখেছে, তাদের মধ্যে সম্প্রদায়গত ঐক্য অনেক বেশি, যা সে সম্মান করে। হিন্দুরা তাদের পড়শি মুসলমানদের সঙ্গে সহাবস্থান-সহযোগিতার মধ্য দিয়েই যে আপন শিকড়ের উপর আত্মদীপ্ত হতে পারে, এগুলো বোঝার মতো ক্ষমতা তার আছে। এরপর সে যখন ইউরোপের বিরুদ্ধে, পাশ্চাত্য ইংরেজ সমাজের বিরুদ্ধে কথা বলছে, তার মধ্যের ঘৃণা মানে কিন্তু গোটা ইউরোপীয় সভ্যতা-সংস্কৃতি সম্পর্কে ঘৃণা নয়, বরং তা তার স্বদেশী স্বশনাক্তিকরণকেই বেশি করে প্রতিষ্ঠা করছে। সেখানে যখন সে ধাক্কা খেলো এবং জানতে পারলো যে সে আদৌ জন্মসূত্রে হিন্দু নয়, হিন্দুত্বের অধিকার তাই নেই, কারণ তার বাবা আইরিশ আর মা ইংরেজ, পিতৃ-মাতৃ-সূত্রে সে খ্রিস্টান, হিন্দু বাড়িতে সে মানুষ হয়েছে মাত্র, তখন সেই ধাক্কা থেকে এতদিনের না-বোঝা-জিনিসটা সে এবার বুঝতে পারলো: সে বুঝলো যে তার আসল আত্মপরিচয়, মানে আত্মপরিচিতিকে উদার করা আত্মীয়তাবোধ, তা তখনই প্রতিষ্ঠা পাবে, তখনই সে সত্যিকারের ভারতীয় হয়ে উঠতে পারবে যখন এমন একটা মন্দিরে সে আশ্রয় পাবে, যেটা হিন্দুর জন্য খোলা, মুসলমানের জন্য খোলা, তেমনই খ্রিস্টানের জন্যও খোলা, সে মন্দিরের দ্বার সমস্ত মানুষের জন্য খোলা। এরকম মন্দির অবশ্য ভারতবর্ষে এখনও তৈরি হয়নি। কিন্তু গোরা সেই মন্দিরের কথা বলেছিল। সম্ভবত সে ‘মন্দির’ শব্দটাই ব্যবহার করেছিল।

এখন একজন কমিউনিস্টের কাছে প্রশ্নটা ঠিক এটা নয় যে কোন মন্দিরের দরজা তার কাছে খোলা থাকবে। নিজের জন্য মন্দিরের দরজা সে খোলা রাখতেও চায় না। কিন্তু সে যে কর্মপদ্ধতি বা দর্শনে বিশ্বাস করে সেই কর্মপদ্ধতি বা দর্শনের সঙ্গে তো ভারতীয়ত্ব যোগ করতে হবে। এখন এইখানে সে যেহেতু তার ভারতীয়ত্ব হিন্দুত্ব থেকে নেয়নি, সে ভারতীয়ত্বের দরজা মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সবার জন্যই খোলা। এরকম একটা সর্বজনীন ভারতীয়ত্বে সে বিশ্বাস করে এবং সরাসরি কোনো ধর্মের সঙ্গে সে নিজে যুক্ত নয়, কিন্তু অন্য ধর্মের লোকেদের নিজের ধর্ম পালন করবার, প্রয়োগ করার স্বাধীনতা সে দেবে, এইজন্যই সে নিজেকে কমিউনিস্ট বলে দাবি করে। এখন সমস্যাটা হলো, সে তার এই চিন্তাভাবনা নিয়ে যা লেখালেখি করছে তার বেশিরভাগটাই ইংরেজিতে। যদিবা সে ইংরেজিতে নাও লিখতে পারে, চিন্তাশক্তি কিন্তু সে ইংল্যান্ড থেকেই পাচ্ছে। যদিও মার্কসবাদের প্রধান যে ব্যক্তিটি, সেই মার্কস, তিনি নিজে ইংল্যান্ডের ছিলেন না, কিন্তু সাধারণত ভারতীয়রা যতটুকু যা মার্কসবাদ পড়েছে, ভুল হোক বা ঠিক হোক, মূলত তা ইংরেজি অনুবাদে পড়েছে, আসল লেখাও ইংরেজিতে যারা লিখেছে তাদের কাছ থেকে পেয়েছে। ভাষার সঙ্গে সাংস্কৃতিক শিকড় জড়িয়ে থাকে, ইংরেজি ভাষাও তার ব্যতিক্রম নয়। ফলে শিকড়লগ্নতার একটা সমস্যা কি থেকেই যায় না? আপামর মানুষের সঙ্গে যোগসূত্রে কি সমস্যা তৈরি হয় না?

অনেক পুরোনো দিনের কয়েকজন কমিউনিস্টদের কথা আমি জানি, তা কি আমি বলতে পারি? আমাদের বাড়িতে আমার বাবা কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন, তেভাগা আন্দোলনে১২ খুবই বড়ো ভূমিকা নিয়েছিলেন, কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টির কোনো ইতিহাসে তাঁর নাম থাকে না, কারণ তিনি জেল থেকে বের হওয়ার পরে পার্টি থেকে ইস্তফা দিয়েছিলেন। ওখানে তেভাগা আন্দোলনের কেন্দ্র ছিল ডোমার বলে একটা জায়গা। রংপুরে আমাদের বাড়ির সামনেই একটা বাড়িতে পার্টির কমিউন হয়েছিল। তখন আমার মা সেই কমিউনের কমরেডদের, কমিউনিস্ট পার্টিতে পরবর্তীকালে যারা অনেকেই খুব বড়ো বড়ো লিডার হয়েছিল, তাদের নানারকমভাবে সেবা করতো। বিশেষ করে মনে আছে ইন্দ্রজিৎ গুপ্তের কথা। ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত তখন সবে কেমব্রিজ থেকে ফিরেছেন, তাঁর বাবা খুবই নামকরা আইসিএস বিহারীলাল গুপ্ত বোধহয়, তার দাদাও চিফ সেক্রেটারি ছিলেন, এইরকম বাড়ির ছেলে সচরাচর ইউরোপের সম্পূর্ণ অ্যাংলিসাইজড কেমব্রিজ থেকে পাশ করে সবে এসেছেন, তিনি রাত্রে শুতেন বুট-মোজা পরে। এবং সবসময়ই ট্রাউজার পরে থাকতেন। স্বভাবতই রংপুরের যারা কমিউনিস্ট পার্টির কর্মকর্তা ছিলেন, তাদের অনেকেই ধুতি-পাঞ্জাবি, শার্ট এসবই পরতেন। সেখানে তিনি একেবারেই বেমানান ছিলেন। কিন্তু অন্যান্য আরও লিডার যাঁরা এসেছিলেন, তাঁরা অতখানি না হলেও, অনেকেই মাত্রাতিরিক্ত অ্যাংলিসাইজড। অনেকে হয়তো সেই অ্যাংলিসাইজড হওয়ার জন্য গর্ব করছেন না, ত্রুটি বলেই মেনে নিচ্ছেন, কিন্তু তাঁদের কিছু করারও ছিলো না। তাঁদের মধ্যে সবাই কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছেন তা নয়, কিন্তু যাঁরা যোগ দিয়েছেন তাঁরা ওই ইতিহাসটা নিয়েই যোগ দিয়েছেন। এরকম লোক কমিউনিস্ট পার্টির অনেকেই ছিলেন। তাঁরা যে ঠিক ভালো মেঠো বাংলা বলতে পারেন না, ইংরেজিতেই কথা বলেন বেশি, ইংরেজি পড়তেই অভ্যস্ত, এটার জন্য কেউ যে তাঁদের নিয়ে কোনো অভিযোগ করতেন এমনটা নয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এঁদের সঙ্গে জনগণের যোগসূত্রটা ঠিক কোন জায়গায়? এখানে মনে হয় প্রথমেই একটা কথা বলে নেওয়া ভালো: এঁরা কিন্তু লিডার হওয়ার জন্যেই জন্মেছিলেন। অর্থাৎ, এঁদের যে পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড, তাঁরা যেরকম পড়াশোনা করেছেন, তাতে এসব লোককে পার্টি পেলে পার্টিই কৃতার্থ বোধ করতো, ভাবতো যে বেশ বড়ো কাউকে পাওয়া গিয়েছে। যারা একদম তলা থেকে লড়াই করতে করতে সাধারণ মানুষের জীবন থেকে উঠে এসেছেন, তারাও এঁদের একটু সমীহই করতেন। এটা হওয়ারই কথা, কংগ্রেসেও একই জিনিস হতো। কমিউনিস্ট পার্টিকে যা আলাদা করেছিলো তা হচ্ছে যে তারা এই নিয়ে অন্তত গর্ব প্রকাশ করতো না যে আমি ইংরেজি ছাড়া কিছু বলতে পারি না, তারা হয়তো একটু লজ্জাই পেতো। যেমন ধরা যাক, জলিমোহন কল। জলিমোহন কল কলকাতায় মানুষ হয়েছে, তিনি বাংলা ভাষা মাতৃভাষার মতোই বলতেন, একইসঙ্গে তিনি কাশ্মীরের লোক, কিন্তু তিনি মূলত যে ভাষায় স্বাচ্ছন্দ্য ছিলেন সেটি ইংরেজি। তিনি কাজও করতেন সম্ভবত অফিসে, বড়ো চাকরি করতেন। তিনি বিয়ে করেছিলেন বাঙালি মহিলাকে। তিনি সাধারণ বাঙালি ঘরের মহিলা, অবশ্য কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন এবং সেই রাজনীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। এরকম তো অনেক কমিউনিস্ট পার্টির নেতা ছিলেন, শুধু বাংলায় নয়, ভারতের অন্যান্য জায়গাতেও, যাঁরা স্বামী-স্ত্রী দুজনেই পার্টি করেছেন। তার একটা বড়ো উদাহরণ--- ব্যাক্তিগতভাবে লোক খুব ভালো কী খারাপ আমি জানি না--- উষসী চক্রবর্তীর বাবা শ্যামল চক্রবর্তী এবং তাঁর স্ত্রী। দুজনে একইসঙ্গে পার্টি মেম্বার। তাঁদের কন্যা সেই সম্পর্কে লিখেছেন যে, বিয়ের পর একটা সময় এল যে, যখন স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে একজনকে বেছে নিতে হলো ঘর-সংসার দেখার দায়িত্ব। রাজনৈতিক জীবনের অবসান হলো স্বামীর নয়, স্ত্রীর। ওই বৈষম্য যে ছিল তা উষসী লিখেছে। কমিউনিস্ট পার্টিতে পশ্চিম বাংলায় বা বাংলাদেশে বা ভারতের অন্যত্রও  অনেকেই এরকম ছিলেন। প্রায় সবক্ষেত্রেই মেয়েদের, মানে স্ত্রীদের, সক্রিয় রাজনৈতিক চর্চা ছেঁটে ঘর-সংসার সামলানোর দায়িত্ব নিতে হতো। পার্টি কখনও এটা নিয়ে ভাবেনি বা পার্টি কখনও এটা নিয়ে প্রশ্ন করেনি।

আরেকটা জিনিস যেটা নিয়ে কমিউনিস্ট পার্টি প্রায়ই ভাবেনি, বা হয়তো ভেবে থাকতে পারে কিন্তু কম, ভাবনাকে লাশঘরে পাঠিয়ে দিয়েছে, গুমঘরে পাঠিয়ে দিয়েছে, তা হলো জাতপাতের সমস্যা। যখন উত্তর ভারতে জাতপাতের সমস্যা নিয়ে আন্দোলন হচ্ছে, তখন জ্যোতি বাবু কমিউনিস্ট পার্টির অতো বড়ো লিডার, তিনি খুব জোরের সঙ্গে বললেন, বাংলায় নাকি ‘কাস্টইজম’ নেই, ‘কাস্টের সমস্যা’ নেই। তাঁর একবারও মনে পড়লো না যে, বাংলার যে কোনো সরকারি অফিসে উপরের দিকের অফিসারদের মধ্যে মণ্ডল, নস্কর, হাতি, হাঁড়ি ইত্যাদি অসংখ্য পদবি কেন এতো বিরল। মেদিনীপুরেই তো এমন আরো অনেক পদবির কথা শুনি, তাদের সাথে হয়তো কেবলমাত্র বাবুদের বাড়ির কাজের লোক হিসেবেই আমাদের দেখা হয়ে। তারা কেউ কোনো বড়ো সরকারি অফিসে কাজ পায় না, পেলেও সম্মানজনক বড়ো পদে পায় না, বড়ো জোর বেয়ারা বা চাপরাশি বা ওই ধরনের কাজ করে থাকে। বড়ো ইউনিভার্সিটি ইদানিং খানিক পাল্টেছে, তা অন্য কথা, কিন্তু তখনও পর্যন্ত ইউনির্ভাসিটির বা কলেজের, এমনকি বিদ্যালয়েরও, উপরের ক্লাসের মাস্টারমশাইরাও এমন পদবিধারী হয় না। মাস্টারমশাইরা সবসময় সেনগুপ্ত, বন্দ্যোপাধ্যায়, মুখোপাধ্যায়, চৌধুরী, বোস--- হয়তো কোনো কোনো বারেন্দ্র ব্রাক্ষ্মণ থাকতে পারে, কিন্তু এরা কেউ কখনও হয় না। কেন হয় না? এখানে ‘কাস্টইজম’ কীভাবে কাজ করে? হয়তো উত্তর ভারতের মতো অতো নৃশংসভাবে কাজ করে না, কিন্তু কাজ তো করে। জ্যোতিবাবু মনে রাখেন নি যে, অত বড়ো একজন বৈজ্ঞানিক মেঘনাদ সাহা যখন ইডেন হিন্দু হোস্টেলে থাকতেন, ছাত্ররা তাঁর সঙ্গে এক টেবিলে খেতো না। এটা যদি ‘কাস্টইজম’ না হয়ে থাকে, তাহলে ‘কাস্টইজম’ জিনিসটা কী আমি জানি না। আর মেঘনাদ সাহা ‘মেঘনাদ সাহা’ ছিলেন বলেই তিনি অতো বড়ো জায়গায় অতো বড়ো কাজ করতে পেরেছেন। তাঁর মতো আরো অনেক প্রতিভাবান ব্যক্তি হয়তো গরিবের ঘরে জন্মেছে, কিন্তু সে গরিবের ঘর যদি সত্যিই গরিবের ঘর হয়, সেখানে বামুন হোক, কায়েত হোক, নমঃশূদ্র হোক, মুচি হোক, মেথর হোক, তারা কেউই কোনোদিন মাথা তুলে উঠতে পারেন নি। ওই একজন দুইজন ব্যতিক্রম বাদ দিয়ে। আম্বেদকর একজন ব্যতিক্রম। আম্বেদকর ‘আম্বেদকর’ হয়ে উঠতে পেরেছেন, তার জন্য তিনি অন্য রকম সহায়তা পেয়েছিলেন। না পেলে হতে পারতেন না। সুতরাং তুমি ওই কথাটা যখন বললে তখন বোঝা যায় যে পার্টির উপরের দিকের নেতারা কখনই এই প্রশ্ন তোলেন না যে, জ্যোতি বসু কেন বসু তার পদবি কেন বাউরি নয়। অথবা পার্টির কতজন নিচুজাত থেকে উঠে উপরের দিকের নেতা হয়েছিলেন? উপরের দিকে যেমন রাজচন্দ্র গোনাথ বা অমুক হেমব্রম বলে কাউকে কচ্চিৎ দেখা গেলেও সে তো দায়ে পড়ে টোকেন হিসেবে একজনকে বেছে নিয়ে একটু উপরে জায়গা করে দেওয়া। সাধারণভাবে এই পদ তারা পাননি এবং তাঁরা নিজেরাও সেটা জানেন, সচেতন থাকেন যে উপরস্থ কারও অনুগ্রহে বা দয়ায় এই সুযোগটা পেয়েছেন। এই তো হচ্ছে খোদ কমিউনিস্ট পার্টির অবস্থা!

এখানে আমি প্রশ্নটা আরেকটু অন্য জায়গায় নিয়ে যেতে চাই। কথাটা উঠেছিল, তোমরা আমার একটা লেখার (হুজুর মোহনগোপাল: অবনির্মাণের সাহিত্য নির্মাণ) থেকে তুলে প্রশ্ন করেছিলে, কমলকুমারের ‘কয়েদখানা’ গল্পের যে নায়ক শাজাদ, আর তার উল্টোদিকের যে খলনায়ক হুজুর মোহনগোপাল চৌধুরী বাহাদুর, তাদের সত্যটা কী আর অসত্যটা কী? আমি ওই লেখায় বলেছিলাম যে, কৌমের মধ্যে শাজাদের চরিত্রের শিকড়গুলো গাড়া আছে। সহজভাবে বলার চেষ্টা করা যাক। আসলে গরিব সমাজ কতখানি কৌম থেকে গেছে, ‘ট্রাইবাল কমিউনিটি’ থেকে গেছে সেটা খুব বড়ো কথা নয়। ট্রাইবাল কমিউনিটি হলে তো খুব ভালোই, কিন্তু শাজাদের সমাজ ঠিক ট্রাইবাল কমিউনিটি নয়। যে গ্রামের কথা, লোকেদের কথা কমলকুমার ওখানে বলছেন, তাদের মধ্যে ট্রাইবাল লোক যেমন আছে, তারাও কিন্তু অনেকটাই নন-ট্রাইবালদের সাথে মিশেছে। যে সাঁওতাল, সেও সাধারণত দিকুদের সঙ্গেই কাজকর্ম করে। এখন ট্রাইবাল এবং নন-ট্রাইবালদের মিশ্র গরিব সমাজের একদম নীচের তলায় যদি তাকাই, তাহলে সেখানে স্বাভাবিকভাবেই অবস্থার তারতম্য থাকতে পারে, কিন্তু অবস্থা মোটের ওপর এক, ওদের লড়াইটা এক। ওদের বেঁচে থাকার দুঃখ-কষ্টটাও এক ধরনের। তাদের সম্পর্কগুলো প্রত্যক্ষ যেহেতু এইধরনের সমাজকে আমরা বলে থাকি ফেস-টু-ফেস সোসাইটি, যেখানে প্রত্যেকে প্রত্যেককে মুখোমুখি চেনে। এমন কেউ নেই যে বাইরে থেকে এসেছে। বাইরে থেকে এসে থেকে গেছে বা থেকে গেলে, সেও তাদের একজন হয়ে গেছে। এই ফেস-টু-ফেস যোগাযোগের ব্যাপারটা সম্ভবপর হয়ে ওঠে ওদের সম্পর্কগুলোর মধ্যের নিবিড় ঘনিষ্ঠতা থেকে, ঘনত্ব থেকে, জীবনে যেভাবে ওরা অংশভাগী হয়, ভাগ করে নেয় দুঃখ-কষ্ট, পাওয়া-না-পাওয়ার বঞ্চনা, প্রাপ্তিযোগ যদি কিছু থেকে থাকে সেগুলো যেভাবে তারা ভাগ করে নিতে পারে, তার থেকে। যখন সমাজের অন্য মেরুতে, সেখানে সম্পদ পুঞ্জীভূত, সেখানে বিভাজন খুব স্পষ্ট, সেখানে মালিক হচ্ছে মালিক আর কর্মচারী হচ্ছে তার কর্মচারী আর কর্মচারীর নীচে যারা অধস্তন তারা আরও হতভাগ্য, সেখানে সম্পর্কগুলো খাড়াই বরাবর বিন্যস্ত। এখানে সম্পর্কের মধ্যে সেই ঘনত্ব আসার কথাই নয়। সুতরাং আত্মীয়তা গঠনের সাপেক্ষে শাজাদ যে আনুগত্য পাচ্ছে চারপাশের মানুষজনের কাছ থেকে, তার কারণ এটাই যে তারা জানে তাদের বেঁচে থাকা মরা সবই একসঙ্গে--- ওই হারি-জিতি-নাহি-লাজ--- একসঙ্গে লড়াই করতে হবে, লড়াই যদি না করি তাহলে আজকে আমার, কালকে তোমার, পরের দিন অমুকের জীবনে বড়ো বড়ো ক্ষতি নেমে আসবে। তারা যে সবসময় সৎ জীবনযাপন করেছে এমনটা কিন্তু নয়। যে অঞ্চলের কথা কমলকুমার লিখেছেন, সেখানে এইসব দরিদ্র মানুষেরা দল বেঁধে ডাকাতিও করে। কিন্তু ডাকাতি করে বলে তারা আইনের চোখে অপরাধী হতে পারে, কিন্তু আমরা জানি তারা ডাকাত নয়। তারা ডাকাতি করছে শুধুমাত্র তাদের বঞ্চনার জায়গায় কিছু একটা প্রাপ্তির জন্য। খুব মজার ব্যাপার আজকেই একটা ঘটল। আমাদের বাড়িতে নতুন যে মহিলা কাজ করছেন তাকে জিজ্ঞাসা করলাম তোমার স্বামী তো অনেকদিন আগেই মারা গিয়েছেন, প্রায় ৪০ বছর হয়ে গেলো, তোমার ছেলে-মেয়ে নেই? বললো, সবচেয়ে বড়ো মেয়ে, মেজো ছেলে, তারপর ছোটোটা হচ্ছে মেয়ে। তনু, মুকেশ আর ছোটোটা হচ্ছে সোমা। সোমার বয়স কতো? বললো, ৩৫। তার স্বামী যদি ৪০ বছর আগে মারা গিয়ে থাকে তাহলে ছোটো মেয়ে ৩৫ বছর বয়স হতে পারে না। তার মানে এই নয় যে ও কোনো অসতী নারী ছিল। আসলে ওর কাছে বয়সের এই হিসাবগুলো একটু গুলিয়ে গিয়েছে। সেটার চেয়েও বড়ো কথা যেটা বলতে চাইছিলাম, জিজ্ঞাসা করলাম, তোমার স্বামী কী করতেন? ও খুব নিস্পৃহ ও অম্লানভাবে বলল টিকিট ব্ল্যাক করত। আমি বললাম, টিকিট ব্ল্যাক করতো কোথায়? ভালো ভালো হিন্দি সিনেমা আসতো, মাড়ওয়াড়িরা বেশি দামে টিকিট কিনতে পারে, বিহারীরা অতো পারে না, বাঙালীরাও না, তাই বাংলা সিনেমায় খুব হতো না, অবশ্য 'কাশ্মীর কা কলি'-র মতো সিনেমা এলে সে বাঙালি কী অবাঙালি, মাড়োয়াড়ি কী অ-মাড়োয়াড়ি সবাই ব্ল্যাকে টিকিট কিনবেই। কাশ্মীরের ব্যাকগ্রাউন্ডে ছবি নিশ্চয়ই একটা মহান দৃশ্য-অভিজ্ঞতা হবে। যাইহোক টিকিট ব্ল্যাক করার কথা যখন সে বলছে, এরকম ভাবার কোনো কারণ নেই যে সে সত্যি সত্যি এই কাজকে খুব অন্যায় বলে ভাবে। এটা জীবনের একটা অংশ এবং টিকিট ব্ল্যাক করে সে বিরাট কোনো অপরাধ করছে না। 'আমি সিনেমাটা দেখতে চাই, আমি আগে পৌঁছই নি, আমার টাকা আছে, আমি দেখে নেব'--- পয়সাওয়ালাদের এই খাঁইটার সুযোগ সে নিচ্ছে, কারুর পেটে কিল মারছে না। এমন কোনো ঘটনা সে করছে যাতে অন্য লোকের বিরাট কোনো ক্ষতি হবে। বরং হয়তো অনেক ক্ষতি থেকে বাঁচিয়েও দিচ্ছে। যেমন ধরা যাক, মেনকাতে একটা সিনেমা দেখেছিলাম, আমার জীবনের প্রথম হিন্দি সিনেমা অপলাম চাপলাম গোছের কী একটা নাম, দেখার আগে আমাকে একজন বলেছিলেন 'dizzy height of absurdity’--- এই ধরনের সিনেমা দেখে আমরা যে কল্পিত জগতে বিহার করি, তা থেকে আমাকে যদি কেউ বঞ্চিত করে, তবে সে আমার উপকারই করছে। যাই হোক, বেশ মজাই লাগলো যে ও ওর স্বামী সম্পর্কে পরিষ্কারই বললো যে সে টিকিট ব্ল্যাক করত। টিকিট ব্ল্যাক করা আর ডাকাতি করা এক জিনিস তা বলছি না। কিন্তু যে গরিব মানুষ দল বেঁধে ডাকাতি করছে, সেই দল বেঁধে ডাকাতি করাটা ভয়ঙ্কর সামাজিক অপরাধ বলে তারা কখনওই ভাবে না, খুন করলে অন্য কথা। মানুষ খুন করা তো নিশ্চয়ই অপরাধ। আমি আবার শাজাদের কথায় ফিরে আসি, ফিরে আসি তার আত্মতার কথায়।১৩ সে ভয় পেয়ে গিয়েছে এবং বুঝতে পারছে ভয় পাওয়াটা ভুল, তাকে রুখে দাঁড়াতে হবে, সে জানতে পারছে তার পাশে অনেকে আছে রুখে দাঁড়াবার জন্য, সে বুঝতে পারছে তার বাবা যেহেতু এই লড়াই করেই এগিয়েছিল, বাবা তার মনের চোখের সামনে এসে দাঁড়াল এবং সে দেখলো যেন বাবা তাকে ধমক দিচ্ছে এবং সে ওই ভয়ের পথে হেঁটে হেঁটে গিয়ে একটা জায়গায় পৌঁছলো, একটা নির্দিষ্ট জায়গায় এসে পৌঁছালো, তার হৃদয়ের, তার মনের, তার চরিত্রের যে জায়গায় সে নিজের মধ্যে থেকেই নিজেকে তৈরি করে ভয়টাকে অতিক্রম করে এসে পৌঁচেছে। আসলে ভয়টাকে তো এভাবেই অতিক্রম করা সম্ভব। ভয় অতিক্রম করার জন্য তো তার মতো মানুষকে পুলিশের সাহায্য নিলে চলবে না। পুলিশ পাবে কোথায় আর পুলিশ তাকে সাহায্যই বা করবে কেন? ভয়েদের মধ্যে যদি কোনো ভুল ভয় থাকে, সেটা অতিক্রম করার একটিই পথ – আমাকে নিজেকেই সেই ভয়টার মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে, আমার নিজের আত্মতার শক্তি দিয়েই আমি ভয়ের সত্যতাকে অতিক্রম করবো। এটিই কমলকুমার দেখিয়েছেন। সেইজন্য শাজাদের আত্মতায় কৌমের যে অনুদান আছে বা কৌমের মধ্যেকার যে সম্পর্কের শক্তি আছে, যে ঘনত্ব নিবিড়তা কাজ করেছে, সেইটা উল্টোদিকে যে ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছে সেই  বাবুহুজুর মোহনগোপালের আত্মতার মধ্যে একেবারেই নেই। সে কোনোদিনই ঠিক গল্প শোনেনি, সাহসের গল্প শোনেনি বরং অপরাধের গল্প শুনেছে, কেড়ে নেওয়ার গল্প শুনেছে, নীচতার গল্প শুনেছে, সে নিজের মাথার মধ্যে সেই গল্পগুলোকেই সাজিয়েছে এবং সেই অনুপাতে, সেইভাবে, সেই আলোয় সে নিজেকে তৈরি করার চেষ্টা করেছে। যেটা আসলে নিজেকে তৈরি করা নয়, বরং নিজেকে তৈরি না করা। আমি এইভাবেই জিনিসটা বুঝেছিলাম।

বি.না.: তলাকার মানুষদের যে আন্দোলন, কমিউনিস্টরা তো তার কথাই বলে। গোটা সমাজকে মুক্ত না করে সর্বহারা শ্রমিকশ্রেণি নিজেকে মুক্ত করতে পারে না, কমিউনিস্ট ইস্তাহার তো একথাই বলে। সবথেকে নিচে পড়ে আছে যে শোষিত-বঞ্চিত অংশ, তাদের শোষণমুক্তির লড়াইয়েও সর্বহারা শ্রমিকশ্রেণি--- এবং তার অগ্রণী অংশ রূপে কমিউনিস্টরা--- নেতৃত্ব দেবে, প্রতিনিধিত্ব করবে, এমনভাবে তাদেরও সমাজের বিপ্লবী রূপান্তরের কাজের শরিক করে তুলবে: এটাই তো কমিউনিস্ট ইস্তাহারের তাত্ত্বিক ভাবনা। এই তাত্ত্বিক অভিপ্রায় সত্ত্বেও তাহলে গোলমালটা বাঁধে কোথায়? সবার নীচে যারা রয়েছে--- নীচু জাতের, নিপীড়িত জাতিসত্তার বা নিপীড়িত লিঙ্গপরিচয়ের মানুষজন, যা-ই হোক না কেন--- তাদের সঙ্গে কমিউনিস্ট আন্দোলনের বিচ্ছিন্নতা কী কেবল কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃবর্গের ভদ্রবিত্ত সামাজিক অবস্থানের সংকীর্ণতা-সীমাবদ্ধতার কারণেই ঘটেছে? তলাকার মানুষদের যে নিজস্ব সামাজিক গড়ন, সামাজিক বিশ্বাস-কল্পনা-ধ্যানধারণা, যৌথচেতনা এ লৌকিকতার নিজস্ব জগৎ--- তা কীভাবে তাদের আত্মতা-নির্মাণের উৎস হিসেবে কাজ করে, কীভাবে বিদ্রোহ-লড়াই সেই উৎস থেকেই রূপ গ্রহণ করে, নতুন উত্তরণের স্বপ্নও কীভাবে তার উপাদানেই সাকার হয়ে ওঠে: এইসব জানাবোঝার চেষ্টায় কমিউনিস্টরা যে এতো নিঃস্পৃহ রয়ে গেছেন, তার পিছনে কি তাঁদের ‘বৈজ্ঞানিক মতবাদ’-এর স্বয়ংসম্পূর্ণতা নিয়ে অতিবিশ্বাস কাজ করেনি? কমিউনিস্টরা তো এভাবেই ভেবে গেছেন যে তাঁরা সর্বহারাদের কাছে যাচ্ছেন চেতনার আলোর বাহক হিসেবে, সর্বহারাদের তাঁরা শিক্ষিত করবেন একটা বিজ্ঞানে, যে বিজ্ঞান হচ্ছে আন্দোলনের বিজ্ঞান, সমাজ গড়ার বিজ্ঞান, প্রগতির বিজ্ঞান। এভাবে শিক্ষিত করে তাদের বিপ্লবের বিষয়ী রূপে নির্মাণ করে নেবেন। সেই সর্বহারাদের বা তারও নীচে পড়ে থাকা মানুষজনদের যে নিজস্ব কৌম সমাজ আছে সেই 'পশ্চাৎপদতা'-র শিকড় থেকে ছিন্ন করে তাদের গড়ে তুলবেন 'আধুনিক' ভাবনায় সজ্জিত বিষয়ী হিসেবে। সুতরাং গোটা ভারতীয় সমাজটায় যে সর্বহারা আছে, কৃষক আছে, নিপীড়িত মানুষ আছে, দুঃখী মানুষ আছে, তাদের সবার সম্পর্কেই কমিউনিস্টদের সংবেদন-সহানুভূতি আছে, কমিউনিস্টরা তাদের 'তুলে আনতে' চায়, যেনবা তাদের কোনো নিজস্ব সত্তা নেই, বিকাশের নিজস্ব গতিপথ নেই, নেই কোনো ইতিহাস, নেই আন্দোলন-উত্তরণের স্বকীয় ঘরানা। কমিউনিস্ট মতবাদের স্বয়ংসম্পূর্ণতা নিয়ে এই অতিবিশ্বাসও কি বিচ্ছিন্নতা তৈরি করেনি?

অ.লা.: আপনি যেটা বলছেন সেটা অনেকটাই ঠিক। কিন্তু তার মধ্যে একটু ভুল থেকে যাচ্ছে, যা হলো এই যে, তলাকার মানুষদের কোনো ইতিহাস নেই, তাদের কোনো নিজস্ব ভেতরকার চৈতন্য নেই, তাদের মতো করে পৃথিবীটাকে দেখা-ভাবা-বোঝার সক্ষমতা নেই--- এটা কমিউনিস্টরা ভাবতেন বলে আমার মনে হয় না। যেটা তারা ভাবতেন বা ভাবেন তা হলো: এই চৈতন্যর মধ্যে একটুখানি ভুল জিনিস (বুর্জোয়া-পেটিবুর্জোয়া চিন্তা, অন্ধ প্রতিক্রিয়া, প্রগতিবিরোধী পশ্চাদগমনের ঝোঁক, ইত্যাদি) ঢুকে বসে আছে। সেইজন্যই আপনি যেটা বলছেন সেরকমভাবে তারা ভেবেছে যে বাইরে থেকে আমরা কমিউনিস্টরা এমন বৈজ্ঞানিকতা সমৃদ্ধ চৈতন্য তাকে দেবো যা ওইসব ভুল জিনিসকে হটিয়ে নতুন প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি তার মধ্যে রোপণ করবে এবং সেই নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েই সে সমাজকে দেখতে চিনবে ও সমাজকে পাল্টাবে। সোজা কথায় তারা নতুন মোড়কে পুরোনো প্রমিথিউজম-এর আখ্যান রচনা করতে চেয়েছিল: প্রমিথিউজ স্বর্গের দেবতাদের আগুন চুরি করে বা কেড়ে এনে মর্ত্যবাসীদের দেবে যাতে মর্ত্যবাসীরা মর্ত্যকে স্বর্গ হিসেবে গড়ে তুলতে পারে। তাই সাধারণ মানুষদের, গরীব মানুষদের--- সে কৌম হোক বা উপকৌম হোক, বেশিরভাগই তো ঠিক ট্রাইবাল নয়, তারা ট্রাইবাল থেকে ডি-ট্রাইবালাইজড হয়ে একদম নীচের ধাপে ঢুকে গেছে--- তাদের নিজেদের যৌথচেতনার ব্যাপারটা কমিউনিস্টদের কাছে এক বিরক্তিকর বিঘ্ন ছাড়া আর অন্য কোনোভাবে প্রতিভাত হতো না। তারা কোনোদিনই সার্বজনীন ছকের বাইরে বেরিয়ে বিশেষ-এর বিশেষত্বকে মেনে নিতে পারেনি। রাশিয়ার (বা পরবর্তী রুশবিরোধীদের ক্ষেত্রে চিনের) ক্যাটেগরির বাইরে বেরিয়ে সমাজকে বোঝা, সমাজ-পরিবর্তনের ধাঁচা বা রূপকে বোঝা, এটা তাদের কাছে কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়নি। সুতরাং কমিউনিস্টদের ওইটাই ছিল। এখনও আছে। তাদের এখানেই ব্যর্থতা। সেখানে প্রশ্নটা কিন্তু এটা নয় যে কমিউনিস্টরা কতখানি ‘ভারতীয়’, বরং বড়ো প্রশ্ন হচ্ছে যে তাদের কাজটা কী, তাদের সাথে জনগনের সম্পর্ক কী, সেই জনগনের কাছে তাদের কী শিখতে হবে, এইগুলো। এইগুলো তারা ঠিক মতো বুঝতে পারেনি। একটা কথা বলি, পরবর্তীকালে এদের মধ্যে যারা যারা মাওবাদের দিকে ঝুঁকেছিলেন, তারা মাওবাদের কাছ থেকে এটা আপ্তবাক্য হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন যে, ‘জনগনের কাছ থেকে শিখতে হবে’। কিন্তু এই কথাটা কেবল আউড়ালেই করা হয়ে যায় না। জনগনের কাছ থেকে শিখতে হবে, নিরভিমান হতে হবে, বিনয়ী হতে হবে, জনগণই শিক্ষক, আমরা ছাত্র--- এই কথাগুলো প্রচুর পাক খেয়েছে, স্লোগানে পরিণত হয়েছে, কমিউনিস্টদের মধ্যে অন্তর্দলীয় কোন্দলে একে অপরের উপর দোষারোপের যুক্তি যোগান দিয়েছে, কিন্তু জনগণের সঙ্গে কমিউনিস্টদের সম্পর্কে গভীর কোনো বদল আনেনি। তাই ওই মন্ত্রোচ্চারণের মতো আউড়ানো আপ্তবাক্যগুলোকে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার কোনো মানে আছে বলে আমার মনে হয় না। এটুকুই বলা যায়।

বি.না.: অন্য আরেকটা বিষয়ও সমস্যা বলে মনে হয়। ধরুন একদিক থেকে যদি আমরা ধরি যে আপনি যেমন বললেন, ভারতবর্ষে কমিউনিস্ট আন্দোলন শুরু হয়েছে এবং ক্রমশ এগিয়েছে পশ্চিম ইউরোপীয় চোখে দেখা বা সেই দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা সর্বজনীন বিশ্ববীক্ষার উপর ভর করে, তাহলে আরেকটা দিকও থেকে যায়। সেই দিকটা হলো: ওই বৈজ্ঞানিক- চৈতন্যধারী আমি, একজন প্রমিথিয়ান, যে আমি বৈজ্ঞানিক চৈতন্য বয়ে আনছি বিপ্লবের ভগীরথ হিসেবে। তার কারণে যদি এভাবে ভাবি: কমিউনিস্টদের যাদেরকে প্রতিনিধিত্ব করার কথা, বা যাদের অগ্রণী বাহিনী হতে চেয়েছে কমিউনিস্টরা, যাদের সাপেক্ষে সে ‘আমি তোমাদেরই লোক’ বলতে চেয়েছে, সেই তাদের সঙ্গেই তার একটা অমোচনীয় দূরত্ব তৈরি হয়ে গিয়েছে। সেই দূরত্বটা পরস্পরকে বোঝার (পরস্পরের অংশ হয়ে ওঠা তো পরের কথা) ক্ষেত্রেই প্রতিবন্ধক হয়ে থেকেছে।

অ.লা.: দূরত্ব কথাটা ঠিক উপযুক্ত নয়, একটু অন্যভাবে বোধহয় বলা উচিত। নিশ্চিত জানি না, তবে শুনেছি এরকম একটা কথা নাকি হো-চি-মিন বলেছিলেন। হো-চি-মিন-কে কোনো এক ভারতীয় কমিউনিস্ট জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে, ভিয়েতনামের কমিউনিস্টরা সফল হয়ে গেলো, কিন্তু ভারতের কমিউনিস্টরা কেন এখনো সফল হতে পারছে না? হো-চি-মিন বলেছিলেন: দ্যাখো, তোমরা গান্ধী ফেনোমেনন বুঝতে পারোনি, যতদিন গান্ধী আছে ততদিন তোমরা সাফল্যের জায়গায় যেতে পারবে না, গান্ধী অনেক বেশি করে ভারতীয় জনগণের কাছের লোক। এখন গান্ধীও তো সাহেবিয়ানার মধ্যে ছিলেন, ইংল্যান্ডে ছাত্র ছিলেন, বহুদিন দক্ষিণ আফ্রিকাতে কোর্টে প্র্যাকটিস করতেন, ইংরেজিতেই করতেন, ইংরেজি লিখতেনও, বলতেন তো খুব ভালো। কিন্তু যেই মুহূর্তে তিনি ভারতবর্ষে এলেন (তাঁর ব্যক্তিগত বেড়ে-ওঠার মধ্যে বৌদ্ধ ভাবনাচর্চার প্রভাব ছিলো ঠিক কথা, কিন্তু সেরকম নানা প্রভাব তো বহু জায়গায় বহু লোকের ক্ষেত্রে থাকলেও তারা ব্যারিস্টার হয়ে, যাওয়ার পর সাহেবি কেতা ও কোট-প্যান্ট ছাড়তে পারে না, বাংলা-হিন্দুস্থানি- তামিল ভুলে ইংরেজিতেই বুলি ছোটায়) গান্ধী এমন একটা পোষাক বেছে নিলেন যার থেকে কম পোষাক পরা আর সম্ভব নয়। খালি গায়ে এবং একটা ছোট্ট ধুতি পরে ঘুরে বেড়ানো, বড়োজোর গায়ে একটা চাদর জড়ানো। এইটা যে উনি করতে পারলেন, এর পিছনে তো কোনো বোধ কাজ করেছে। সংকেততত্ত্ব বা সেমিওলজির দিক থেকে ভাবতে পারি যে, উনি চিহ্নবিজ্ঞানের দিক দিয়ে বুঝলেন যে এটাই ভারতীয়রা চেনে এবং ভারতীয়রা তা চিনেও নিল। বিখ্যাত উদাহরণ হচ্ছে সম্ভবত, ভারতবর্ষের রাজনীতিতে গান্ধী যখন প্রথম মাঠে নেমেছেন, তখন তাঁতীদের মধ্যে থেকে একজন ছুটে এসে বলেছিল, সে ‘গান্ধীবাবা’-কে দেখেছে। এই যে ‘গান্ধীবাবা’-র উপস্থিতি তৈরি হয়ে গেলো, ম্যাজিকের মতো তা এলো এবং সর্বত্র ছড়িয়ে পড়লো। গান্ধী যখন প্রথমবার কলকাতায় এসেছিলেন, কংগ্রেস-এর অধিবেশন হচ্ছিলো, তিনি সবচেয়ে কঠিন কাজটা নিয়েছিলেন। অতো লোক থাকছে একটা জায়গায়, পায়খানাটা ঠিক মতো পরিষ্কার হচ্ছে না। গান্ধীজী পায়খানা পরিষ্কার করার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। শান্তিনিকেতনে যখন গেলেন, সেখানে গিয়ে তিনি ছাত্রদের একদিন পায়খানা পরিষ্কার করা দায়িত্ব দিলেন। পরবর্তীকালে যেটা হল গান্ধী চলে যাবার পরে ছাত্ররা ওইদিনটা ছুটি উপভোগ করত। গান্ধী ছিলেন এমন, অনেক জিনিস তিনি ধরতে পারতেন, নিজের জীবনে নিয়ে চলে আসতে পারতেন, যা তাঁর জায়গায় অন্য কোনো ভারতীয় রাজনীতিবিদ পারেনি, সে  তারা কমিউনিস্টই হোক বা কংগ্রেসীই হোক (তখন তো মোটামুটি এই দুটো ধারাই ছিলো; তার বাইরে একটা কমিউনিস্ট সোস্যালিস্ট পার্টি বলে বস্তু ছিলো অনুভবের দিক থেকে, মানে আলাদা করে পার্টি ছিলো না)। তাদের মধ্যে কেউ তো একাজটা করেননি। সেখানে যেটা গান্ধী পেরেছেন সেটা উনিই পেরেছেন, আর কেউ পারেননি। তার আগেও তো অনেক কংগ্রেস লিডাররা ছিলেন, তারা পারেন নি। এখন এইটা ভারতীয় কমিউনিস্টরা পারেননি, সেটা ঠিকই তো। তাদের দোষ-ভুল না দেখে এভাবেও বলা যায় যে, তাদের শিক্ষাটা মোটামুটি একটা বিদেশি চিন্তাধারার পাঠাশালায় হয়েছিলো, তারা ওই খালি গায়ে থাকা, খালি পায়ে হাঁটা, কৃচ্ছ্রসাধন এগুলোকে এক ধরনের ভাঁওতাবাজি বলে মনে করতো। তারা গান্ধীকে তীব্র কটূ বিরোধিতাও করেছে অনেকেই, বলেছে গান্ধী ভাঁওতাবাজি দিচ্ছে, লোক ঠকাচ্ছে। গান্ধীর এই লোকের কাছে আসতে পারার ক্ষমতাকে তারা বুঝতেই পারেনি, কোনোদিন সে ক্ষমতাটা নিজেদের মতো করে অর্জনও করতে পারেনি, আর যে পথে গান্ধী ক্ষমতাটা অর্জন করেছিলেন সে পথটাকেও তারা ভাঁওতাবাজি বলে গালি দিয়েছে, দূরে সরে থেকেছে, মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে। এটা তাদের ব্যর্থতা তো বটেই, অন্য আরো সব ব্যর্থতার অন্যতম কারণও বটে।

বি.না.: গান্ধীর প্রসঙ্গ যখন আনলেন তাহলে এই প্রশ্ন মনে চলে আসছে যে গান্ধী হিংসার বিরুদ্ধে অহিংসার আদর্শ যেভাবে সামনে এনেছেন এবং পাশ্চাত্য সভ্যতার উন্নয়নের গোটা প্রকল্পটাকে যেভাবে সমালোচনা করে নিজ পরম্পরার উপর দাঁড়ানো গ্রামস্বরাজ লক্ষ্য করে তুলতে চেয়েছেন, কমিউনিস্টরা তা ইতিহাসের গতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে প্রলাপ বলে উড়িয়ে দিয়েছে। কমিউনিস্টরা ইতিহাসের গতি ও পাশ্চাত্য সভ্যতার উন্নয়ন প্রকল্প এক বলেই গণ্য করেছে।  সেই উন্নয়নের গতি ও প্রক্রিয়াটা শহরকেন্দ্রিক, জড়-প্রযুক্তি-কেন্দ্রিক। এগুলো কমিউনিস্টরা প্রায় স্বতঃসিদ্ধ হিসেবে ধরে নিয়েছেন। ভারতবর্ষের সমাজ একটা বহু পুরোনো গ্রামসমাজ, গ্রামসমাজের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের উপর দাঁড়িয়ে গান্ধীর ভাবার চেষ্টা, আর অন্যদিকে কমিউনিস্টদের উন্নয়ন-প্রগতির পাশ্চাত্য মডেলটিকেই মান্যতা দেওয়া--- এটাও কি কমিউনিস্টদের দেশীয় প্রেক্ষিত থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে?

অ.লা.: এখানে একটা কথা আছে। ভারতীয়রা মার্কসীয় পথ বেছেছেন যখন মার্কস আর বেঁচে নেই। রুশরা তো ‘মার্কসিজম’-টা অনেক আগেই নিয়েছে। রুশ রাজনীতি-কর্মী, ভেরা জাসুলিচ, মার্কসকে চিঠি লিখে যোগাযোগ করেছিলেন, এই নিয়ে মার্কসের মত জানতে চেয়েছিলেন যে রাশিয়ার যে নিজস্ব একটা ধাঁচা-পরম্পরা-ইতিহাস আছে, গ্রামসমাজের গঠনবৈশিষ্ট্য আছে, তার মধ্যে থেকে, তার উপরে দাঁড়িয়ে সমাজবাদে পৌঁছানো সম্ভব কিনা। মার্কসের তখন শেষজীবন। মার্কস খুব গুরুত্ব দিয়ে সেই প্রশ্ন নিয়ে ভেবেছিলেন, জবাবী চিঠির একাধিক খসড়া তৈরি করেছিলেন, যদিও শেষাবধি সম্ভবত তা আর তাঁর পাঠিয়ে ওঠা হয়নি। মার্কস-এর লেখা এই খসড়া জবাবগুলো এখন তাঁর রচনাবলীতেই পাওয়া যায়। সেখানে তিনি অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে ও বিশদে, তাঁর পক্ষে যতটা সম্ভব, রাশিয়ার গ্রামাঞ্চলের বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলো বিচার করার চেষ্টা করেছিলেন এবং এমন মতামতই ব্যক্ত করেছিলেন যে নির্দিষ্ট কিছু শর্ত পূরণ হলে রাশিয়ার পক্ষে তার এই গ্রামসমাজের বৈশিষ্ট্যমূলক কাঠামোর উপর দাঁটিয়েই সমাজবাদের দিকে বিকাশের পথ তৈরি করে নেওয়া সম্ভব হতে পারে, পশ্চিম ইউরোপের সমাজবিকাশের ধারাকেই তাদেরও অনুসরণ করতে হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। মার্কস তার আগে অনেক জায়গাতেই পশ্চিম ইউরোপের সমাজবিকাশের ধারাকে সার্বজনীন বলে হাজির করেছিলেন। কিন্তু এই যে নিজের পূর্ব-বক্তব্যকেও প্রশ্ন করা, সমান্তরাল নানা অন্য সম্ভাবনার কথা ভাবা তাতে তাঁর কোনো জড়তা বা অসুবিধা এক্ষেত্রে অন্তত দেখা যায়নি। এই যে মার্কসীয় ভাবনাকে সৃজনশীলভাবে সক্রিয় অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে বিকশিত করা, পূর্বধারণায় আটকে না থেকে সমান্তরাল সমস্ত সম্ভাবনাকে বিশদে বিচার করা--- এই চর্চার মানসিকতা তো ভারতবর্ষে তৈরিই হয়নি। চিনের সঙ্গে তুলনা করলেও ভারতের কম্যুনিজমের এই অভাবটা ধরা পড়বে। রুশ বলশেভিজমের বিজয়ের পরেও--- যদিও তাকে কতোটা বিজয় বলা যায় সেটা অন্য প্রশ্ন, তাও আমি বিজয় বলেই ধরে নিচ্ছি আপাতত--- মাও সেই পথ নিয়ে প্রশ্ন তুললেন, তিনি বললেন যে, ‘আমাদের পথটা এরকম হতে পারে না’। এই যে ‘আমাদের পথটা অন্যরকম হতে পারে’(সে পথটা ভুল না ঠিক তা তো পরের কথা), এই বোধ থেকেই তিনি তা নির্দিষ্ট করার জন্য  নিজেদের সমাজবিন্যাস, নিজেদের ইতিহাস, নিজেদের সমসময়কে নিয়ে নিজের মতো করে ভাবলেন। মাও বিরাট পণ্ডিত ছিলেন না। তিনি চিনা ভাষা ছাড়া বিদেশি ভাষা আর খুব কিছু জানতেন বলে মনে হয় না। রুশ ভাষা অল্প শিখেছিলেন। ইংরেজিও সামান্যই শিখেছিলেন। মাও যখন ‘মাও’ হয়ে উঠছেন নিশ্চিতভাবেই তখন ‘ক্যাপিটাল’ গ্রন্থের চিনা ভাষায় অনুবাদ হয়নি, তাই তিনি ‘ক্যাপিটাল’ পড়েননি। তো সেটা হয়তো একদিক থেকে ভালোই হয়েছিল, তিনি নিজের মতো করে নিজের সমাজকে বুঝে একটা পথ বাতলালেন। ‘ক্যাপিটাল’ পড়লেই তুমি সমাজবিপ্লব করতে পারবে, না পড়লে তুমি পারবে না--- এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। কারণ ওই মহাগ্রন্থ পড়েও বহু সমাজবিপ্লব হয়নি আবার না পড়েও হয়েছে। হো-চি-মিন-ও ‘ক্যাপিটাল’ পড়েননি নিশ্চয়ই। হো-চি-মিন যখন প্যারিসে ছিলেন তখন হো-চি-মিন-এর সামনেই কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল ভাগ হওয়ার কথা হচ্ছিল, হো-চি-মিন তখন বলেছিলেন যে সেই ইন্টারন্যাশনালেই আমি জয়েন করব যে ইন্টারন্যাশনাল আমার ভিয়েতনামের ন্যাশনাল লিবারেশনের পাশে এসে দাঁড়াবে। খুব সহজ উত্তর। আমি আমার দেশকে স্বাধীন করব, ইন্টারন্যাশনাল পরে ভাবব। এইরকমভাবে ভাবার ক্ষমতা ভারতীয় কমিউনিস্টদের ছিলো না, বা বলা ভালো, সাধারণভাবেই ভারতীয়দের ছিলো না, কারণ, যারা ইংরেজি শিক্ষাকে প্রত্যাখ্যান করেছে তাদের কথা আলাদা, তারা তো একটা কুয়োর ব্যাঙ হয়ে থেকেছে, আর যারা ইংরেজি শিক্ষাকে মেনে নিয়েছে তারা পাশ্চাত্য-অনুকরণবৃত্তির কাছেই আত্মসমর্পণ করেছে। গুটিকয় ব্যতিক্রমের মধ্যে উজ্জ্বল যে দুজন--- যে দুজন এই আত্মসমর্পণ করেননি, তাঁরা হলেন গান্ধী এবং রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের মূল পরিচিতি এভাবে হয়েছে যে তিনি কবি, রবীন্দ্রনাথের অন্য পরিচয় যা-ই থাকুক কবি-পরিচয়টাই আর সবকিছুকে ঢেকে দিয়েছে, তাঁর কাব্য ও গানের যে প্রসার তাই-ই আমাদের মন জুড়ে থেকেছে। তাঁর রাজনীতি বা সমাজ সম্পর্কে ভাবনা নিয়ে আমরা মনোযোগী হইনি। আর গান্ধীর ক্ষেত্রে, গান্ধীর নিজস্ব একটা অনুসন্ধিৎসা ছিল, নিজস্ব একটা জিজ্ঞাসা ছিলো। জীবন জিজ্ঞাসা, বিশ্ব জিজ্ঞাসা, ভারতীয় জীবন সম্পর্কে ধারণা, এইগুলো ছিলো। তিনি সেই অনুযায়ী এগিয়েছেন। তিনি যেহেতু পাশ্চাত্য মূলধারাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন, ওনার পক্ষে নিজের মতো করে ভাবাটা সম্ভব হয়েছিলো, ভারতের সমাজের বর্তমানতার উপর দাঁড়িয়ে এগোনোর পথ সৃষ্টিশীলভাবে অনুসন্ধানের কাজটা তিনি করতে পেরেছিলেন। মুশকিলটা এখানেই, গান্ধীকে আমরা যতই যা মনে করি--- সেটা সত্যিও, মনে করার দরকারও আছে, তিনি ভারতবর্ষের একজন খুব বড়ো মাপের চিন্তক, তিনি পথ দেখিয়েছেন--- কিন্তু তিনি যথেষ্ট ক্রিটিকাল ছিলেন কিনা সেবিষয়ে আমার প্রশ্ন আছে। অনেক বিষয়কেই তিনি বিনা বিচারে প্রশ্রয় দিয়েছেন। শুধুমাত্র তাঁর ধর্মীয় বিশ্বাসের জন্যই নয়, তার বাইরেও। যে পথে সংস্কার হতে পারে, সেই পথটা তিনি ঠিক দেখিয়েছেন কিনা, সে বিষয়ে তাই খটকা আছে। কোনো হ্যাঁ-না কিছু বলবো না, তবে খটকা আছে, দ্বন্দ্ব আছে মনের মধ্যে। আর অন্য যে প্রশ্নটা তিনি নতুন করে সামনে নিয়ে এসেছিলেন, অহিংসার প্রশ্ন, তা যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সে নিয়ে কোনো সংশয় নেই।

বি.না.: ‘ভারতীয়ত্ব’-এর মোড়কে একটা চরম ডানপন্থী এবং চূড়ান্ত রাষ্ট্রবাদী নির্মাণ, জাতীয়তাবাদী--- বা বলা ভালো, উগ্র জাতীয়তাবাদী--- নির্মাণ বর্তমান ভারতে ঘটে চলেছে। সেখানে ‘ভারতীয়ত্ব’ বলে এমন একটা জিনিস খাড়া করা হচ্ছে, তা কতোটা ভারতীয় আর কতোটা নয় সে অন্য প্রশ্ন, কিন্তু তা চরম বৈষম্য-বিদ্বেষ এবং সন্ত্রাসী শাসনের জমি পোক্ত করছে। এই পরিস্থিতি এখন এমনভাবে জেঁকে বসেছে যে ভারতীয় সমাজবৈশিষ্ট্যের উপর দাঁড়িয়ে রাজনীতি-সমাজনীতিতে পথ সৃজনের কথা বললেই তির্যক প্রশ্ন-সন্দেহ ধেয়ে আসে যে ওই ‘ভারতীয়ত্ব’-নির্মাণে গা ভাসানো হচ্ছে কি না বা তার দ্বারা প্রভাবিত হওয়া হচ্ছে কি না। এব্যাপারে আপনার কী মনে হয়?

অ.লা.: আপনি যেভাবে কথাটা বললেন,  এমন যেন মনে হচ্ছে যে কমিউনিস্ট পার্টি যদি তার ভারতীয়ত্ব অনেক বেশি করে মেনে নিতো এবং ভারতীয়ত্বের মধ্যে দিয়ে তারা একটা রাজনীতির পথ খুঁজতো, সেখানে একটা ভয় থেকেই যেতো যে, হিন্দুত্ববাদী চিন্তার মধ্যে ঢুকে পড়তো কি না, ওই গাড্ডার মধ্যে পড়তো কিনা। এখানে একটা মজার কথা হলো, কমিউনিস্টদের কথা বলছি না, তাদের বাইরে, আধুনিক ভারতীয় জীবনে যে দুইজন ব্যক্তিকে আমরা সবচেয়ে বেশি আমাদের চিন্তা-ভাবনা, বিশ্বাসের জগতে গুরুত্ব দিয়ে থাকি, বিশেষ করে আমরা বাঙালিরা তো বটেই, সারা ভারতবর্ষের অন্য প্রদেশের লোকেরা করে কি না জানিনা, তাঁদের একজন রবীন্দ্রনাথ, দ্বিতীয়জন গান্ধী। বাঙালিরা গান্ধীকে নিয়ে যে খুব একটা মাতামাতি করেছে আগে তা নয়, কিন্তু ইদানিংকালে গান্ধীকে নিয়ে অনেকেই গুরুত্ব দিয়ে ভাবছে এবং বোঝার চেষ্টা করছে। গান্ধীর গুরুত্ব যে খুবই বেশি এটা অনেকেই বারবার বলছে এবং তার মধ্যে বাঙালিও আছে। অনেকেই আছে। রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে ভারতবর্ষের অন্য জায়গায় হয়তো এক ধরনের ঔদাসীন্য এসে গিয়েছে এবং তারা অনেকেই মনে করে যে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বাঙালিরা বাড়াবাড়ি করে কারণ তাদের আর কিছু করার নেই, যেনবা, বাঙালির তো উনিশ শতকের আগে কোনো ইতিহাস ছিল না। আমার মনে আছে, একটা ব্যক্তিগত ঘটনা বলছি। সালটা খেয়াল নেই। তা মনে হয়, এই ১৯৮২-৮৩ সাল হবে হয়তো। উড়িষ্যায় গিয়েছিলাম। আমি একা নয়--- আমি, মা, কাকা-কাকিমা, তাদের ছোটো ছেলে। একটা বাড়িতে উঠেছিলাম। বাড়িটা এক বাঙালির, তারা কোলকাতায় থাকতেন। সেখানে এক উড়িয়া পরিবার থেকে বাড়িটা দেখাশোনা করতো। ওই উড়িয়া ভদ্রলোক আমাকে বললেন: দেখুন, আপনাদের বাঙালিের মধ্যে তো সত্যি নাইন্টিন সেঞ্চুরিতে বিরাট সব মানুষেরা এসেছিলেন, আমরা তাঁদের শ্রদ্ধা করি। তার মানে ইঙ্গিতে এটাও বললেন, যে ওই নাইন্টিন সেঞ্চুরির আগে বাংলাদেশে তেমন কিছু ছিল না যাতে সারা ভারতবর্ষ তাদের ওইভাবে শ্রদ্ধা করবে। কিন্তু অনেকেই তো ছিলেন। তাদের মধ্যে চৈতন্যদেবকে সারা ভারতবর্ষ সাধু হিসেবে দেখে। তার বাইরে বাংলাদেশে তেমন কোনো নিজস্ব নৃত্যরূপ নেই, নিজস্ব ঘরানা যেন একটাই মাত্র টিমিটিম করছে ওই বিষ্ণুপুর। স্থাপত্য কীর্তিও তেমন কিছু তুলে ধরতে পারেনি। সেভাবে গর্ব করে ভারতবর্ষের সামনে তুলে ধরার মতো বুঝিবা কিছু নেই। যেন তাই রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আমরা বাড়াবাড়ি করি। অনেকেই এটা মনে করেন। একথাটা কিছুটা সত্যিও বটে। বাঙালিরা বাড়াবাড়ি করে কি না তা অন্য প্রশ্ন, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের গুরুত্ব আছে কি না তা বিচার করতে গেলে আমরা নিশ্চয়ই তাঁর চিন্তাভাবনার উপর গুরুত্ব দেবো, ঠিক যেমন গান্ধীর ক্ষেত্রেও দেব। মজা হচ্ছে যে এঁরা দুজনই কিন্তু খাঁটি ভারতীয় এবং তাদের ভারতীয়ত্বে কোনো মিশেল আছে  বলে সাধারণভাবে মানুষ মনে করে না। বিজেপি মনে করে। বিজেপি তো গান্ধীকেও পারলে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। নেহাত পারে না, তাই ওড়ায় না। আর বর্তমানে বিশ্বভারতীকে দেখেই তো বোঝা যাচ্ছে ওরা রবীন্দ্রনাথকে কীভাবে মুছে দেওয়ার চেষ্টা করছে। পুরোটা পেরে উঠছে না কারণ বাঙালি সেন্টিমেন্টে বিরাট ঘা দেওয়া হয়ে যাবে, নইলে ওরা দ্বিধাহীনভাবেই তা করতো। রবীন্দ্রনাথের অনেক কথাই, অনেক বক্তব্যই তারা ভয়ঙ্করভাবে ক্ষতিকর বলে মনে করে: রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞানচিন্তা একটা দিক, রবীন্দ্রনাথের স্বাদেশিকতার ভাবনা, বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথ যেভাবে ন্যাশনালিজম-এর বিরোধিতা করেছেন, ইন্টারন্যাশনালিজমের প্রশ্নগুলো তুলেছেন--- এই সবেরই তারা ভয়ংকরভাবে বিরোধী। কিন্তু এগুলো আজও খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন এবং রবীন্দ্রনাথের ব্যতিক্রমী সাহস ছিলো বলেই তিনি স্রোতের বিপরীতে এই প্রশ্নগুলো তুলতে পেরেছিলেন। সুতরাং, ভারতীয়ত্ব, মানে ভারতের স্বশনাক্তিমূলক বৈশিষ্ট্যগুলোর প্রতি শ্রদ্ধা রাখা, সেই জোরে সাহসভরে স্রোতের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো খুবই সম্ভব, হিন্দুত্ববাদীদের গাড্ডার মধ্যে পা না দিয়েই সম্ভব, বরং তাদের বিপরীতে দাঁড়িয়েই সম্ভব। কমিউনিস্টরা সেটা যে করেনি বা করতে পারেনি, সেটা এজন্য নয় যে, করলে তারা ওই হিন্দুত্বের গাড্ডার মধ্যে পা দিয়ে ফেলতো। হিন্দুত্বের ভয়টাতো আজ গত ২০-৩০ বছরের ভয়। কমিউনিস্ট পার্টি বলতে আমরা যা বুঝি, যেসব নেতাদের বুঝি, তারা তো তার অনেক আগেকার। তারা তখন হিন্দুত্ববাদীদের নিয়ে ভয় পেতো না কারণ তাদের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল কংগ্রেস। কংগ্রেস কোনোদিন এই স্লোগান তোলেনি যে তোমরা হিন্দু হও। ব্যক্তিগতভাবে কেউ কেউ তুলে থাকতে পারেন, সেটা অন্য কথা। যা আমি বলতে চাইছি তা এই যে ভারতীয় হওয়া এবং একইসঙ্গে বিজেপি-মার্কা ভারতীয় না-হওয়া সম্ভব। ‘ভারতীয়’ এবং ‘বিজেপি-মার্কা-ভারতীয়’ (বা হিন্দুত্ববাদী ভারতীয়)--- এই দুটোর মাঝখানে একটা গ্যাপ আছে। সেই গ্যাপটা কোথায়, কীভাবে আমি বিজেপি-মার্কা না হয়েও দেশীয় স্থিতসত্তায় প্রোথিত হতে পারি, তা বোঝার জন্য অনুসন্ধিৎসার দরকার ছিল, সন্ধানের দরকার ছিল, সেই সন্ধানটা কমিউনিস্টরা আলাদা করে কিছুই করেন নি। খুব ভাবালু প্রকৃতির লোক যিনি কমিউনিস্ট, সেই হীরেন মুখার্জী, এরকম কথা লিখেছিলেন— নিজেকে আমি এতটাই ভারতীয় মনে করি যে আমাকে নিংড়োলেও ভারতীয়ত্বই বের হবে। তিনি দুর্ধর্ষ ইংরেজি ভাষার বক্তা ছিলেন, সেতো অন্য কথা, ইংরেজির ভালো বক্তা হওয়ার সঙ্গে এই বোধটার তো কোনো বিরোধ ছিলো না। কিন্তু তা বাদ দিলে ভারতীয় কমিউনিস্টরা যে ভারতীয় স্থিতসত্তা, ভারতীয়ত্বের সমস্যা নিয়ে খুব আলাদা করে ভেবেছেন, তা আমার মনে হয়নি। এটা এই জন্য নয় ‘ভারতীয়’ শব্দটি উচ্চারণ করলেই তাঁরা হিন্দুত্ববাদের গাড্ডায় পড়ে যাবেন। ওই গাড্ডার ভয় তখন তাঁদের ছিলোও না, নানা সময় আর-এস-এস, জনসঙ্ঘ-এর সঙ্গে তাঁরা কাঁধ মিলিয়ে নানা কংগ্রেস-বিরোধী কর্মসূচিতেও শামিল হয়েছিলেন। নিশ্চয়ই এই সতর্কতা বজায় রাখতে হবে যে ভারতীয়ত্ব বলতে শুধু ভারতীয় উপনিষদ নয়, শুধু শংকরাচার্যের ভারতবর্ষ নয়, তার বাইরেও অনেকটা ভারতবর্ষ আছে যেটা মাঠের ভারতবর্ষ, চাষের ভারতবর্ষ, গরীবের ভারতবর্ষ, তাদের মেটিরিলিস্টিক জীবন-যাপন-দর্শন আছে, এমনকি উপনিষদের মধ্যেও সে চিন্তার রেশ পাওয়া যায়। ওই বিখ্যাত গল্পটা আছে না, ব্রহ্মজ্ঞান শিখে ছেলে বাবার কাছে এলো, বাবা বুঝল যে এইসব ব্রহ্মজ্ঞান ভালো নয়, তখন তাকে দু-একদিন উপোস করতে বললো, তৃতীয়দিনের উপোসের সময় যখন জিজ্ঞাসা করলো দেখা গেলো সবটাই সে ছেলে ভুলে গেছে। তখন বাবা বললো: দেখ, তুই ভুলেছিস কারণ তোর পেটে খিদে, ভালো করে খেয়ে নে দেখবি সব স্মৃতি আবার ফিরে আসবে। অর্থাৎ, স্মৃতি বলে যে মানসিক গঠনটা, যে মানসিক বৃত্তরেখাটাকে আমরা স্মৃতি বলি, তার পিছনে কিন্তু রসদ দিচ্ছে পেটের অন্ন। ক্ষুধা থাকলে স্মৃতি থাকে না। এই কথাগুলো উপনিষদেও আছে। সাধারণভাবে উপনিষদ এই কথাগুলো বলে না। কিন্তু উপনিষদের মধ্যে এই বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গিটিও সূত্রাকারে খুঁজে পাওয়া যায়। সেটা বিভূতিভূষণ চট্টোপাধ্যায় মহাশয় দেখিয়েছেন। সুতরাং কমিউনিস্টরা যে সন্ধান করেননি তার কারণ গাড্ডায় পড়ার ভয় নয়, মূলত ওই অনুসন্ধিৎসাটাই তাঁদের ছিলো না। এটাই আমার ধারণা।

এবার তাহলে অহিংসার প্রশ্নটায় আসা যাক।

আমি খুব বেশি কিছু বলতে পারবো না, আমি শুধু এইটুকু বলবো যে, আমরা কর্পোরেট সেক্টর থেকে প্রকাশিত বই-টই পড়তাম-টড়তাম, তো একটা বই পড়েছিলাম, প্রবন্ধ সংকলন, ট্রটস্কির জীবনী যিনি লিখেছিলেন সেই আইজ্যাক ডয়েশ্চার-এর লেখা। উনি মারা যান ১৯৬৭ সাল নাগাদ। এরকম এক সময়ে যখন ইউরোপ জুড়ে একটা বামপন্থী ধারার জোয়ার আসছে। এটা উনি দেখে গিয়েছেন এবং একইসঙ্গে চিনের তৎকালীন তোলপাড়ও দেখে গিয়েছেন। তাঁর লেখায় পড়েছিলাম, রাশিয়ায় ঠিক বিপ্লবের ১৬-১৭ বছরের মাথায় রুশ বিপ্লব একটু ডানদিকে সরে গেল স্তালিনের সময়ে। ওই ১৯৩৪ সাল নাগাদ। বলা হয়ে তাকে যে ওই সময় থেকে স্তালিনের মেথডটা জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হলো। ওটাকে ফরাসি বিপ্লবের ওই জ্যাকোবিন পর্বের পরে যে দক্ষিণপন্থী ঝোঁকটা এল, সেই কষেকটা মাসের, অগস্ট থেকে সেপ্টেম্বর, নতুন যে নাম দেওয়া হয়েছিলো, সেই নামটা দিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছিলো। তো ধরা যাক এই দক্ষিণপন্থী ঝোঁক। চিনে যেটা এলো ঠিক বিপ্লবের ১৬-১৭ বছর বাদে। মাও জে দঙ তখন তার সাপেক্ষে বামপন্থার দিকে এগোলেন, মাওয়ের মতো করে ভাবা বামপন্থা: বামপন্থার একটা নিজের মতো করে কিছুটা নির্জ্ঞান ধরন একটা, সাংস্কৃতিক অভিধাকে আঁকড়ে ধরে। তখন অনেকেই বললেন, তাহলে সব দেশেই যে এমন হবে তা নয়: রাশিয়াতে যেটা ঘটেছে, চিনে সেটা ঘটল না। চিন বামপন্থার দিকে আরো সরে গেলো। পরবর্তীকালে সেটা যে উল্টে গেছে, এখন চিনকে দেখে তা নিয়ে সন্দেহ থাকার কথা নয়। তো ওইরকম এক সময়ে কোনো ছাত্র সমাবেশে মাও বক্তৃতা দিচ্ছেন, উনি একটা কথা বলেছিলেন যা তখন খুব ভালো লেগেছিলো। উনি বলেছিলেন: বিপ্লব করতে গেলে রক্ত পড়বে, রক্তপাত হবে, রক্তপাত ছাড়া বিপ্লব, হোমিওপ্যাথি প্রয়োগে বিপ্লব করা যায় না। একটা কথা মনে রাখতে হবে, রক্তপাতটা আবশ্যিক, কিন্তু আবশ্যকীয়ভাবে রক্তপাতের জন্য রক্তপাতটাকে আমরা সমর্থন করিনা। বিপ্লবী একটা বিশ্বাস যাদের আছে তারা সমর্থন করবে না বলেই ভরসা করা যেতে পারে। আবার তখন মনে হয়েছিলো, ‘আবশ্যিক’ কথাটাকে ধরলে, একদিকে মেনে নেওয়া হচ্ছে যে বিপ্লবের চরিত্রের মধ্যেই একটা হিংসা আছে, কারণ বিপ্লব একটা অভ্যুত্থান এবং অভ্যুত্থান কায়েমি স্বার্থকে সরিয়ে দিয়ে তার জায়গায় জনগণ--- শ্রেণির সাপেক্ষে যদি নাও বলি--- গরিব মানুষের সরকার তৈরি হচ্ছে এবং পূর্ববর্তী শাসন-প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভেঙে ফেলা হচ্ছে, সেই লেনিনের বিখ্যাত উপমা: কমরেড অমলেট বানাতে গেলে ডিমটা ফাটাতে হয়। ডিমটা ফাটাতে হলে ডিমটা ফাটানো দরকার কিন্তু তার সঙ্গে যে লোকটার ঝুলিতে ডিম ছিলো, তার মাথা-ফাটানো তো না করলেও চলবে। অর্থাৎ বিপ্লবের ক্ষেত্রে হিংসা আবশ্যিক হলেও তা যে একটা ‘ইভিল’, পারলে যে তা বর্জন করা দরকার, যথাসম্ভব কম হিংসাত্মক হওয়া দরকার এইটা এক হিসেবে জুড়ে কথাটা বোঝা দরকার। আবার, এই প্রশ্নটাও উঠেছে, হিংসা আবশ্যিক নাকি আবশ্যিক নয়--- এইখানে প্রশ্নটা আমার কাছে খুবই অসমাধিত । এমন যদি হয়, যেটা অনেকেই বলে থাকে যে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান  দেশগুলোয় হয়েছে, এমন একটা সমাজ তৈরি হয়েছে যে সমাজে ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় বৈষম্য অনেকটাই কম, আমেরিকার থেকে কম তো বটেই, ভারতবর্ষের থেকেও এমনকি চিনের থেকেও কম। জনগণের কাছে এমন অনেক অধিকার সেখানে দেওয়া হয়েছে, যে অধিকারগুলো পৃথিবীর প্রায় কোনো দেশে নেই এবং সে অধিকারগুলো তারা ভোগ করছে সুখী সমাজের পরিবেশে। সুখ মানে তো স্বার্থপরতা নয়, আজকের সমাজে সুখকে অনেক সময় স্বার্থপরতার পর্যায়ে এনে দাঁড় করানো হয়। অনেককে বঞ্চিত না করলে আমি সুখী হতে পারি না--- এই যদি ব্যক্তির সুখান্বেষণের মন্ত্র হয়, সুখটা যদি এই স্বার্থ-সংকীর্ণ চোখ দিয়েই মাপতে হয়, তাহলে কতখানি সম্পদ ভোগ করছি, কতখানি ভালো খাবার খাচ্ছি, কতখানি সুযোগসুবিধা জীবনযাপনে ভোগ করতে পারছি, তা দিয়ে সুখী সমাজের পরিবেশ তৈরি হয় না। সুযোগ-সুবিধাগুলো আমি ভোগ করতে পারছি এই কারণেই যে অনেকেই তা পারছে না। সমবণ্টন তো বহু দূরের কথা, এমনকি অসম-বণ্টনও যে মাত্রায় আমাদের সমাজে পৌঁচেছে, তা ভয়াবহ বললেও কম বলা হয়। এখন মুশকিল হলো এইটাই যে যদি আমরা সুখী সমাজ বলতে এমনকিছু ভাবি: সুষম বণ্টন হবে, ন্যায়বিচার থাকবে, প্রতিটি বাচ্চা যে জন্মাবে সে ভালোভাবে বেড়ে উঠবে, সুখী সামাজিক জীবন হবে--- সেইটা কি কখনো সম্ভব যদি না, যারা সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে, ভয়ংকরভাবে ভোগ করছে, যারা প্রভূততর থেকে প্রভূততর থেকে প্রভূততর সম্পদ নিজেদের জন্য কেড়ে নিয়েছে ও নিয়ে চলেছে, তাদের সম্পত্তিকে আমরা কেড়ে নিই? তারা কী সেটা মেনে নেবে? তা কি অহিংসাত্মকভাবে হতে পারে? উত্তর আমার কাছে নেই। তবে এই প্রশ্নের উত্তর ঠিক কী হতে পারে, যদি আপনারা একটু বলেন, তাহলে আমি একটুখানি আপনাদের সঙ্গে আলোচনা করতে পারি।

বি.না.: অন্য একটা কথা বলি। একটু আগে আপনি স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোর উদাহরণ দিলেন। সেই দেশগুলোতে বৈষম্য অনেকটাই কমিয়ে আনা হয়েছে, সেখানে মানুষের যা চাহিদা তা অনেকটাই মেটানো গেছে, ইত্যাদি। সেই অর্থে আমি যদি একলপ্তে বলি যে, একটা কম-বৈষম্যের সুখী কনজিউমার সোসাইটি তৈরি করা হয়েছে। তাহলে প্রশ্নটা ওঠে এখানে যে, কম-বৈষম্যের সুখী কনজিউমার সোসাইটি যেটা স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলিতে হয়েছে, সেইরকম একটা সমাজই মানে কি বিপ্লবের লক্ষ্য? প্রুধোঁ-মার্কস-বাকুনিন থেকে আজকের জাপাতিস্তা অবধি, বিভিন্নভাবে এই কনজিউমার সোসাইটি ভাঙার চিন্তাই কি পুঁজিবাদবিরোধী বিপ্লবের ভাবনার কেন্দ্রে ছিলো না? একটা কনজিউমার সোসাইটি, যেখানে মানুষ মাত্রেই উপভোক্তা--- ভোগ্যবস্তু বা পরিষেবার কনজিউমার, তার মধ্যেই একটা নিহিত হিংসা থাকে: প্রকৃতির প্রতি হিংসা, অন্য প্রাণিপ্রজাতির প্রতি হিংসা। ইউরোপিয় বা মার্কিনী কনজিউমার সোসাইটিগুলোয় গড়ে মানুষ যে সম্পদ ভোগ করছে সেই হারে সম্পদভোগ সারা পৃথিবীর মানুষ করবে এমনটা প্রাকৃতিক সম্পদের সীমার কারণেই সম্ভব নয়, তাছাড়া প্রকৃতিকে কেবল নিঙড়ে নিয়ে সম্পদ তৈরির কাঁচামালে পরিণত করার দৃষ্টিভঙ্গিতে ডুবে মানুষ সেখানে প্রকৃতিকেও ধ্বংস করেছে, নিজের জন্যও এক চরম বিচ্ছিন্নতায় আক্রান্ত অস্তিত্ব তৈরি করেছে...

অ.লা.: হ্যাঁ, আপনাদের লেখা১৪ পড়ে আমি বুঝতে পেরেছি। ওটা মডেল হবে এটা আমি বলতে চাইনি। এটা বলেছি যে ওইখানে ওই মডেলের মধ্যে যে ভুলটা আছে, তা তো আছেই। সেটা আপনারা যা বলেছেন তা আমি স্বীকার করি। আরেকটা কথাও একইসঙ্গে বলতে হবে: স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশ মানে এমন জায়গা যেখানকার জমি ও অধিবাসীর অনুপাত এতটাই অনুকূল মানুষের পক্ষে, তা পৃথিবীর প্রায় অন্য কোথাওই সম্ভব নয়। ভারতবর্ষে তো আরো বেশি অসম্ভব। ভারতবর্ষে যদি জনগনের সংখ্যাটা এক রেখে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোর মতো অনুপাতে অতখানি জমি সবাইকে বরাদ্দ করতে হয়, তাহলে অনেকগুলি পৃথিবী জড়ো করলে তবে হয়তো সংকুলান করে ওঠা যাবে। এ ছাড়াও স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোর ইতিহাস তাদের পিছন থেকে যেভাবে সাহায্য করে গেছে, রিফর্মেশনের যে ফলগুলো তারা ভোগ করতে পেরেছে: চার্চের দাপট অনেকখানি কমেছে পুরোনো ক্যাথলিক চার্চের হাত থেকে বের হওয়ার পর, ওইসব আমাদের এখানে নেই।

আর আপনি যা বলছেন সেটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমি তো এখন ক্রমশই বুঝতে পারছি যে প্রকৃতিকে আমরা আর এভাবে ব্যবহার করতে পারব না। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান কান্ট্রিগুলোতে যে লিভিং স্টান্ডার্ড, সেই লিভিং স্ট্যান্ডার্ডে ভারতীয় মানুষকে কেন, পৃথিবীর মানুষকেও পৌঁছে দিতে পারব না এবং সেটা সম্পূর্ণ ভুল চিন্তা। ওই চিন্তা, ওই পথটাই ভুল পথ। তা ত্যাগ করতে হবে। আমি শুধু এটুকুই বলবার চেষ্টা করেছিলাম যে ওইখানে যেটুকু হয়েছে সেটুকুর জন্য হিংসার দরকার হয়নি, ওইটুকু তো ঠিক কথা, ওরা বিপ্লবও করে নি আবার সমবণ্টনের দিকে গিয়েছে, অনেক বেশি করে খাবার খাচ্ছে, অনেক বেশি করে মাংস খাচ্ছে, অনেক বেশি করে স্পেসটাকে ব্যবহার করতে পারছে, আমরা যেটা ভাবতেও পারি না। ওইখানে কিছুটা হলেও হয়েছে। আর চিনের বিপ্লবের যে ইতিহাস সেটা তো গভীরভাবে সহিংস এবং সেখানে হিংসাকে কোনো মতেই দমানোর চেষ্টা করা হয়নি। বিপুল হারে মানুষকে মারার জন্যই স্তালিনিয় পদ্ধতি ব্যর্থ হয়েছে এই ভুলটুকু পরোক্ষভাবে মাও স্বীকার করে নিয়েছিলেন। যে অর্থে স্তালিনিয় টেরর চলেছে, চিনে সেই অর্থে টেরর চলেনি কিন্তু যা চলেছে সেটাই যথেষ্ট টেরিবল। এবার কথা হচ্ছে ভারতবর্ষের মতো দেশে, শুধু ভারতবর্ষ নয়, বাংলাদেশেও তাই, এবং অন্য দেশেও নিশ্চয়ই তাই, যারা সম্পদ ভোগ করছে, আরো পুঞ্জীভূত ও কেন্দ্রীভূত করে চলেছে, তাদের হাত থেকে নিয়ন্ত্রণ কেড়ে সম্পদ বিকেন্দ্রীভূত করতে হলে প্রাথমিকভাবে ওই শিক্ষা দিতে হবে যে, সম্পদ শুধু ভোগের জন্য নয়, সম্পদ সম্পর্কে ধারণাটাই পাল্টাতে হবে। কিন্তু একইসঙ্গে গান্ধীর বহু ধনী ও শিল্পপতি অনুরাগী একসময় ছিলো, এখন গান্ধী নামটা তারা কম বলছে, আজ থেকে ৫০-৬০ বছর আগে তারা গান্ধীর নামেই ভজন-পূজন করতো। তারা খুব সাম্যের ধারণায় বিশ্বাস করতো না এবং বোঝানোর পরেও তারা সাম্যের ধারণায় বিশ্বাস করবে না, বড়োজোর তারা গান্ধীবাদী ন্যাসপাল বা ট্রাস্টিশিপ-এর ধারণায় বিশ্বাস করতে পারে, কারণ সেখানে সুবিধা হচ্ছে যে সম্পদের উপর নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দিতে হয় না: আমি ন্যাসটাকে উপভোগ করছি, তোমাদের জন্য করছি এবং ন্যাস বৃদ্ধি করতে তোমাদের সম্পদ কেড়ে নিচ্ছি, তাও তোমাদের জন্যই করছি, তোমাদের ভালোর জন্যই করছি।

এইভাবেই লুণ্ঠনের যে ইতিহাস দানা বেঁধেছে, সেই ইতিহাসটাকে উল্টোদিকে ঘোরানো যাবে কী করে? সেই পদ্ধতিটা কোথায়? কে দেবে?

বি.না.: কিন্তু, যখনই আমরা হিংসাকে রাজনীতির একটা উপায় (means) হিসেবে নিচ্ছি, তখনই কি তা আবশ্যিকভাবে এমন কিছু রাজনৈতিক পদ্ধতি ও কাঠামো গঠনের দিকে ঠেলে দেয় না, যা ক্রমশ ক্ষমতার কেন্দ্রীভূত হওয়ার দিকে গতি নেয়? ক্রমশ কিছু লোকের হাতে ন্যায়-নীতি উচিত-অনুচিত নির্ধারণ করার অধিকার কেন্দ্রীভূত করতে হয়, সেই অনুযায়ী অপর মানুষের প্রাণ নেওয়ার অধিকার কেন্দ্রীভূত করতে হয়,  নাহলে আপনি হিংসাত্মক পথটাকে চালিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন না। আর সেই প্রক্রিয়া থেকে উদ্ভূত পার্টির গঠন, রাষ্ট্রের গঠন সবকিছুই ওই চুড়ো-করে-বাঁধা কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার আদলে বিন্যস্ত হতে থাকে। বৈষম্য-শোষণ-নিপীড়ন থেকে যে ধরনের মুক্তি আমরা চাইছি তার বিপরীত দিকেই তা ক্রমশ এটা চলতে থাকে। সেটা হয়তো একটা অন্য ধরনের বৈষম্য-শোষণ-নিপীড়নের জন্ম দেয়, কিন্তু ব্যাপ্তি ও তীব্রতায় তা কিছু কম হয় না।

অ.লা.: আমি আপনার কথাটা ঐতিহাসিক সত্যই বলব। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে তাহলে আমাদের করণীয়টা কী?

বি.না.: জানি না। কিন্তু, চুড়ো-করে-বাঁধা ক্ষমতাকাঠামোর বদলে বা উল্টোদিকে যদি বিকেন্দ্রীভূত এক সমাজব্যবস্থা, বিকেন্দ্রীভূত সমাজ-পরিচালনা-ব্যবস্থা, প্রকৃতির ঘনিষ্ঠ অংশ হিসেবে প্রকৃতির সঙ্গে দেওয়া-নেওয়ার জৈবিক সম্পর্কটাকে পুনর্গঠন করা— এগুলো যদি করণীয় হয়, তাহলে সেই দিক থেকেও কি হিংসা ব্যতিরেকে অন্য কোনো উপায় ভাবার প্রয়োজন হয়ে পড়ছে না?

অ.লা.: ভাবার প্রয়োজন আছে এটা মেনে নিচ্ছি। একটু অন্যভাবে বলি। ধরুন, একটা পাহাড়ের ওপরে সমান জমি আছে আর সেই সমান জমিতে ফুটবল খেলা হচ্ছে। খেলা চলতে চলতে একসময় বলটা যেদিকে ঢাল আছে সেইদিকে পড়ে গেল। এখন মুশকিল হচ্ছে ঢালটার প্রথমদিকে বলের গতি খুব বেশি ছিলো না, কিন্তু যতই পড়তে থাকছে ততই গতিটা জোরে, আরও জোরে, দ্রুততর হতে থাকছে। বলটাকে যদি আগে আমি আটকাতে না পারি, একটা সময় পার হয়ে গেলে তারপরে বলটাকে আর কখনোই আটকানো যাবে না এবং বলটা অবধারিতভাবে ক্রমশ আরো গতিবৃদ্ধি করতে করতে নীচে গড়াতে থাকবে। আমরা এখন পৃথিবীতে যে জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছি, আমাদের সমাজের মধ্যেকার সংগঠনের যে সমস্যাগুলো আছে তা তো আছেই, কিন্তু তার অনেক আগেই আমাদের এই সমাজব্যবস্থার অন্তর্নিহিত যে প্রোডাকশন-এর লজিক, সেই লজিক দ্বারা নির্ণীত যে ন্যায়বোধ (যেমন, টাকা ব্যাঙ্কে রাখতে হবে এবং সে টাকা ব্যবহার করতে হবে মুনাফা তৈরির জন্য), অর্থাৎ, পুঁজি যে নিয়মে নিজেকে খাটিয়ে যায়, সেই নিয়মেই বিশ্ব-প্রকৃতি-জীবন-এর সবকিছুকে চালাতে হবে, এই যুক্তির ঢাল বেয়ে আমরা এমন একটি ভবিষ্যতের দিকে দ্রুত এগোচ্ছি, ক্রমশ আরো দ্রুত এগোচ্ছি এবং আরো আরো দ্রুত এগোচ্ছি, একটা ইকোলজিক্যাল ডিজাস্টারের দিকে চলে যাচ্ছি। এইখানে কিন্তু আমার ধারণা যে আমরা যদি খুব দ্রুত এই সমস্যাটার দিকে নজর না দিই তাহলে অচিরেই হয়তো বড়ো দেরী হয়ে যাবে, আমাদের আর কিচ্ছু করার থাকবে না। ইতিমধ্যেই দেরী হয়ে গিয়ে থাকলে তো, হয়েই গিয়েছে। ধরা যাক একটা ট্রেন যদি লাইনচ্যুত হয়ে একটা গড়ানের ধারের দিকে ছুটে চলে, তখন সেই ট্রেনের মধ্যে কে ধনী, কে গরিব বিচার করার কোনো মানে হয় না কারণ সবাই মরবে। আমরা সেইদিকে চলে যাচ্ছি। কিন্তু ব্যাপারটা বোধহয় আবার ওইরকমও হবে না। পরিবেশ-বিপর্যয় তীব্র হলে ধনী ও ক্ষমতাবানরা প্রথমে নিজেদের মতো করে আপাত-নিরাপদ জায়গা খুঁজে নেবে। পৃথিবীর ভালো ভালো জায়গাগুলোকে দখল করে নেবে। বাকিদের বলবে, তোমরা যেখানে হয় বাঁচো, পাঁচ ফুট জলের মধ্যে তোমরা জীবন কাটাও। বলবে নয়, বলেওছে। ধনী ও ক্ষমতাবানরা চট করে যাওয়ার নয়। তারা জোর খাটিয়ে পৃথিবীর যে জায়গাগুলো ভালো, যেখানে বেঁচে থাকা সম্ভব, সেই জায়গাগুলো দখল করে নেবে। তারপর তারা কী করবে আমি বলতে পারছি না। এই সমস্যাগুলোর ঠিক কুলকিনারা আমার কাছে নেই। পরিষ্কার উত্তর আমি ভাবতে পারছি না। এর বেশি আর কী বলবো? 

বি.না.: ‘হিস্ট্রি অব নিড’ বলে একটা বই সম্প্রতি পড়েছি। ইভান ইলিচ-এর লেখা। সেই বই পড়ে কিছু ভাবনা মাথায় ঘুরছে। আমরা এমন শিক্ষার মধ্য দিয়ে বড়ো হই যেখানে চাহিদাকে আরো আরো বাড়িয়ে তোলাকে সদর্থক হিসেবে দেখা হয়। চাহিদাগুলো আর শেষ হয় না, ক্রমশই তা বাড়তে থাকে। পুঁজিবাদের সমালোচক বামপন্থীরাও কিন্তু সাধারণত চাহিদাবৃদ্ধিকে সদর্থক হিসেবেই দেখেন। চাহিদাবৃদ্ধিকে তাঁরা জীবনযাপনের মানের উন্নতির সঙ্গে যুক্ত করে থাকেন। বস্তুর পণ্যরূপ, বিনিময় মূল্যের আধিপত্য, তার তাঁরা বিরুদ্ধে হলেও সাধারণত মনে করেন যে চাহিদা বস্তুর ব্যবহার মূল্যের  দ্বারা নির্ধারিত, এবং ব্যবহার মূল্য বস্তুর স্বাভাবিক বা প্রাকৃতিক চরিত্রের সঙ্গে যুক্ত। তাই তাঁরা চাহিদাবৃদ্ধির মধ্যে প্রশ্ন করার মতো কিছু দেখেন না। কিন্তু, চাহিদা কি সত্যিই জীবনযাপনের মৌলিক অস্তিত্বগত প্রয়োজনের সঙ্গেই যুক্ত থাকে, ব্যবহার মূল্য কি কেবলমাত্র বস্তুর স্বাভাবিক-প্রাকৃতিক চরিত্রের সঙ্গে যুক্ত, ব্যবহার মূল্য কি আরোপিত ও কৃত্রিমভাবে নির্মীত হতে পারে না?  নিত্যনতুন ভোগবস্তুর প্রতি চাহিদা কি আমাদের মধ্যে জ্ঞাপন-বিজ্ঞাপনের জমক দিয়ে কৃত্রিমভাবেই নির্মাণ করা হচ্ছে না? তাহলে মৌলিক চাহিদা কোনগুলোকে বলবো, কতটুকুকে বলবো? এই প্রশ্নগুলোও তো জাগছে।  

অ.লা.: আসলে, আমাদের এখানে এধরনের চিন্তা পাওয়া যায় অম্লান দত্তের মধ্যে। এইসব প্রশ্নগুলো উনি তুলেছিলেন। গুরুত্ব পায়নি ঠিকই, কিন্তু প্রশ্নগুলো জরুরী। অম্লান দত্তও তো ভীষণভাবে অহিংস পথে বিপ্লবের দিকে এগোতে চেয়েছিলেন , এই নিয়ে তো ওনার বইও আছে। বইটার নামটা এক্ষুণি মনে পড়ছে না। ওনার প্রথম ইংরেজি বই বেরিয়েছিলো ‘অন ডেমোক্রেসি’ নামে। তার প্রচ্ছদে আইনস্টাইনের একটা উদ্ধৃতি ছিলো, কারণ ওই লেখাটা পড়ে আইস্টাইনের ভালো লেগেছিলো। ওঁর একজন পরিচিত ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপে একবার আমি তাঁকে বলেছিলাম: ‘একটা কথা আমি বুঝলাম না, অম্লান দত্ত তো খুবই পণ্ডিত লোক, বিদ্বগ্ধ লোক, যুক্তিবান লোক, আইনস্টাইনের কোটেশানটার কী দরকার ছিল? আইনস্টাইন তো সমাজতত্ত্ব বা ওইসব নিয়ে আলাদা করে খুব কিছু ভেবেছেন তা নয়। তিনি বিরাট মানুষ, বিশাল মানুষ, সন্দেহ নেই, কিন্তু তাঁর কোটেশানের চেয়ে অন্য কারো কোটেশান যিনি এই বিষয় নিয়ে বিশদে বা গভীরে ভাবেন, তাঁর কোটেশানটা মূল্যবান হতো।’ তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা এটা জানি। অম্লানের নিজের একদমই ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু প্রকাশক খুব জোর দিয়ে বলেছিলেন। আইনস্টাইন চিঠি লিখে প্রশংসা করেছেন, সেটা তো উড়িয়ে দেবার বিষয় নয়।’ অম্লান দত্ত নিজে নাকি চাননি প্রকাশকের চাপে শেষ অবধি বাধাও দেননি। যাইহোক, আমি একজনকে জানি, তিনি অর্থনীতিবিদ, মোটামুটি বড়ো অর্থনীতিবিদ, মার্কসবাদী, সিপিএম তারপর একসময় একটু এম-এল-এর ঘেঁষা ছিলেন, তিনি অম্লানের কথা বললেই গভীর ঘৃণা প্রকাশ করতেন। সেইটা কোনোদিন বুঝতে পারি নি, এত ঘৃণা কেন? অন্য চিন্তা, অন্য ভাবনা, অন্যতর প্রশ্ন সম্পর্কে এতো অসহিষ্ণুতা কেন? এ কি গভীরে গিয়ে ভাবার অভ্যাস শুকিয়ে আসা? ভাবার অনীহা? অন্তর্গত কোনো দুর্বলতা-বোধকে ঢেকে রাখতে অতিরিক্ত আক্রমণপ্রবণতা? যাই হোক না কেন, সমস্ত প্রশ্ন, যে কোনো ধরনের প্রশ্ন নিয়ে খুলেমেলে ভাবার দরজাটা বন্ধ করে না দিলে আজ হয়তো এই দুরবস্থায় পৌঁছতে হতো না।

 

টিপ্পন্নী

১। বাংলা-বিহার মার্জার মুভমেন্ট: ১৯৫৫ সালে ভারতের কেন্দ্রীয় স্টেটস রিঅর্গানাইজেশন কমিশন প্রস্তাব দেয় যে বাংলা ও বিহার রাজ্যকে এক করে পূর্বপ্রদেশ নামে রাজ্য গঠন করা হবে। এর বিরুদ্ধে বাংলাভাষী মানুষদের একটা বড়ো অংশ নিজেদের ভাষা ও সংস্কৃতি হারানোর আশঙ্কায় প্রতিবাদে মুখর হয়ে ওঠে। তখনকার বিহারের অন্তর্গত মানভূমে এই প্রতিবাদ সবদেয়ে প্রখর রূপ ধারণ করে। এর ফলে ওই ‘মার্জার’ প্রস্তাব প্রত্যাহৃত হয় এবং মানভূম জেলা থেকে পুরুলিয়া নামে একটি নতুন জেলা তৈরি করে তা বাংলার সঙ্গে যুক্ত করা হয়।

২। পরমাণু-অস্ত্র-বিরোধী শান্তি আন্দোলন: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে ‘ঠান্ডা যুদ্ধ’-এর তাড়সে যুদ্ধাস্ত্র-প্রতিযোগিতা ও পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের আশঙ্কা ক্রমশ পেকে ওঠায় ১৯৬০-এর দশকের গোড়ায় পরমাণু-অস্ত্র-বিরোধী শান্তি আন্দোলন দানা বাঁধে। ইউরোপে শুরু হয়ে তা বিশ্বের নানা জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে।

৩। গ্রীসের কমিউনিস্টদের সঙ্গে স্তালিনের বিশ্বাসঘাতকতা: ১৯৪৬-১৯৪৯ সাল জুড়ে গ্রীসে গৃহযুদ্ধ চলে। গ্রীক কমিউনিস্টরা সরকার-বিরোধী বিদ্রোহী অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যবনিকাপতনের অব্যবহিত পরেই গ্রীস রাজতন্ত্রী সরকারের পাল্টা গণপ্রজাতন্ত্রী সরকার গঠনের কথা ঘোষণা করে এবং বহু অঞ্চলে নিজেদের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করে। সরকার ও বিদ্রোহীদের মধ্যে গৃহযুদ্ধ চলতে থাকে। ব্রিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকরের পক্ষ নিয়ে বিদ্রোহীদের দমন করার জন্য সমস্ত কূটনৈতিক ও সামরিক সহায়তা করে। বিদ্রোহীরা ও তাদের নেতৃত্বে থাকা কমিউনিস্টরা প্রায় নিশ্চিত ছিলো যে সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের সহায়তা করবে, কিন্তু আশ্চর্য হয়ে তারা দেখে যে স্তালিন এ ব্যাপারে ‘নিরপেক্ষ’ থাকায় অনড়, কারণ চার্চিলের সঙ্গে দ্বিতীয়-বিশ্ব-যুদ্ধ-পরবর্তী ইউরোপ-ভাগবাটোয়ারার চুক্তির শর্ত অনুযায়ী গ্রিস ইঙ্গ-মার্কিন প্রভাববলয়ে পড়ছে। সমাজবাদী দেশ হিসেবে যুগোস্লাভিয়া ও আলবানিয়া গ্রীসের বিদ্রোহীদের সমর্থন করলেও, প্রত্যাশিত সোভিয়েত সাহায্য না আসা গ্রীসের কমিউনিস্টদের লড়াই-করার-শক্তিতে ভাঙন ধরায়। ইঙ্গ-মার্কিন সহায়তায় সরকার বিদ্রোহীদের নির্মমভাবে দমন করে। ইউরোপে সমাজবাদী বিপ্লবের একটি জোরালো সম্ভাবনার অপমৃত্যু হয়।

৪। পোল্যান্ড এবং স্তালিনের হিটলারকে খুশি রাখা: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনায় পোল্যান্ড দুদিক থেকে সাঁড়াশি আক্রমণের মুখোমুখি হয়। ১৯৩৯ সালের পয়লা সেপ্টেম্বর হিটলারের জার্মানি আক্রমণ করে পশ্চিমদিক থেকে। আর ১৭ই সেপ্টেম্বর স্তালিনের সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করে পুবদিক থেকে। এই দুটি আক্রমণ মোলোটভ-রিবেনট্রপ চুক্তির গোপন বোঝাপড়া অনুযায়ী হয়েছিলো, যে চুক্তি অনুযায়ী হিটলারের জার্মানি এবং স্তালিনের সোভিয়েত ইউনিয়ন পূর্ব ইউরোপকে নিজেদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করে নেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলো। তাই স্তালিন সেই সময় হিটলারকে খুশি রাখার কৌশল নিয়েছিলো। আর এই কারণেই হিটলারের বাহিনী যখন সোভিয়েত ইউনিয়নকে আক্রমণ করে, স্তালিন প্রথমে সেই খবর বিশ্বাসই করতে চাননি, সোভিয়েত বাহিনীর অপ্রস্তুতির ফলেই প্রথম ধাক্কায় হিটলারের বাহিনী গোটা ইউক্রেন দখল করে নিয়ে প্রায় রাজধানীর দোরগোড়ায় পৌঁছে গিয়েছিলো।

৫। কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া (মার্কসিস্ট-লেনিনিস্ট) বা সি-পি-আই-এম-এল পার্টির প্রতিষ্ঠা ঘোষিত হয় কলকাতার এক জনসভায় ১৯৬৯ সালের লেনিনের জন্মদিনে, অর্থাৎ ২২শে এপ্রিল। পার্টির প্রথম জেনেরাল সেক্রেটারি চারু মজুমদার জনসভায় এই ঘোষণা করেছিলেন। কানু সান্যাল বক্তব্য রেখেছিলেন। সি-পি-আই-এম পার্টির বিপ্লবের পথ ছেড়ে সংসদীয় রাজনীতির আবর্তে আটকে যাওয়াকে সমালোচনা করে এই পার্টি বিপ্লবের পথে যাত্রা অব্যাহত রাখার প্রতিজ্ঞা নিয়েছিলো।

৬। পাস্তেরনাক-এর নোবেল পাওয়া: ১৯৫৮ সালে রুশ লেখক বরিস পাস্তেরনাক-এর নাম সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার-এর জন্য ঘোষণা করা হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের শাসক কমিউনিস্ট পার্টি এতে অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হয়ে গোটা ব্যাপারটাকে সোভিয়েত-বিরোধী প্রচারের অংশ বলে চিহ্নিত করে, পাস্তেরনাকের বিরুদ্ধেও সোভিয়েতের শত্রুদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার অভিযোগ তোলা হয়। পাস্তেরনাক বাধ্য হন পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করতে। পরে ১৯৮৯ সালে তাঁর পুত্র ইয়েভগেনি পাস্তেরনাক তাঁর বাবার হয়ে অবশ্য ওই পুরস্কার গ্রহণ করেছিলেন।

৭। কল্লোল দাশগুপ্তের বইটির নাম: কারাগার, বধ্যভূমি ও স্মৃতিকথকতা। বইটি কলকাতার গুরুচণ্ডালি প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত।

৮। চিনের ভিয়েতনাম-আক্রমণ: ১৯৭৯ সালের ঘটনা। কম্বোডিয়ার অত্যাচারী খেমের-রুজ শাসন চিনের পৃষ্ঠপোষকতায় চলতো। ভিয়েতনাম কম্বোডিয়া আক্রমণ করে দখল নিয়ে খেমের-রুজ-দের ক্ষমতাচ্যুত করে। তখনই চিন ভিয়েতনামের উপর তীব্র সামরিক হানা শুরু করে। প্রায় এক মাস টানা যুদ্ধের পর বিজয় ঘোষণা করে চিনের বাহিনী সরে গেলেও ভিয়েতনাম ও চিনের সীমান্ত-এলাকায় বছরের পর বছর ধরে খুচরো সামরিক সংঘাত চলতেই থাকে।

৯। রোজা লুক্সেমবুর্গ-এর করা সমালোচনা: রোজা লুক্সেমবুর্গ লেনিনের অভিপ্রেত ‘ভ্যানগার্ড পার্টি’-র ধারণাকে সমালোচনা ও বিরোধিতা করেছিলেন। লুক্সেমবুর্গ-এর বক্তব্য ছিলো যে কেন্দ্রীভূত ও শৃঙ্খলাবদ্ধ ভ্যানগার্ড পার্টির দ্বারা বিপ্লবে নেতৃত্ব দেওয়ার কৌশল মাত্রাতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ জারি করে শ্রমিকদের স্বতঃস্ফূর্ত রাজনৈতিক ক্রিয়াকে টুঁটি চেপে ধরবে। কোনো ভ্যানগার্ড প্রতিনিধিদের শৃঙ্খলাবদ্ধ ক্রিয়া নয়, সর্বসাধারণ শ্রমিকদের প্রত্যক্ষ স্বতঃক্রিয়াই বিপ্লব ঘটাতে পারে ও পূর্ণতার দিকেও নিয়ে যেতে পারে বলে তিনি মনে করতেন। গণ ধর্মঘট (mass strikes) এই ধরনের বিপ্লবী স্বতঃক্রিয়ার পরিসর তৈরি করতে পারে বলে তিনি ভেবেছিলেন।

১০। ক্রুশ্চেভের ১৯৫৬ সালের বক্তৃতা: ১৯৫৬ সালের ২৫-শে ফেব্রুয়ারি সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির বিশতম কংগ্রেসে তৎকালীন সর্বোচ্চ নেতা ক্রুশ্চেভ বক্তৃতা আকারে একটি প্রতিবেদন হাজির করেছিলেন যেখানে তিনি তাঁর পূর্ববর্তী সর্বোচ্চ নেতা স্তালিনের ব্যক্তিসর্বস্বতা (cult of personality)-কে সমালোচনা করে স্তালিন যুগে ঘটা পার্টির শুদ্ধিকরণের নাম করে বহু বিরোধী মতাবলম্বীদের হত্যা করার অন্যায় ঘটনাকে সামনে এনে দিয়েছিলেন। গোটা কমিউনিস্ট শিবির সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে স্তালিনকে সমালোচনার ঊর্ধ্বে গণ্য করতো, তাই এই বক্তৃতার বয়ান ছড়িয়ে পড়ার মধ্য দিয়ে কমিউনিস্ট শিবিরে ভূমিকম্প হাজির হয়েছিলো।

১১। এই বইয়ের পরিশিষ্টে রাখা লেখাটির কথা বলছেন।

১২। তেভাগা আন্দোলন: ১৯৪৬-৪৭ সালে বাংলা (এপার-ওপার দুই বাংলা)-য় এই গুরুত্বপূর্ণ কৃষক-অভ্যুত্থানটি ঘটে। এই আন্দোলনের মূল দাবি ছিলো যে জমিদার-জোতদার-দের জমিতে ভাগচাষ করা কৃষকরা তাদের ফলনের অর্ধেক জমিদার-জোতদারদের দেবে না, এক-তৃতীয়াংশ দেবে, বাকি দুই-তৃতীয়াংশ নিজেদের দখলে রাখবে। কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত ‘বেঙ্গল প্রভিনসিয়াল কিষাণ সভা’ এই আন্দোলন সংগঠিত করেছিলো। দেশের সরকার হিংসাত্মকভাবেই এই আন্দোলনকে দমন করে।

১৩। ‘হুজুর মোহনগোপাল: অবনির্মাণের সাহিত্য নির্মাণ’ প্রবন্ধে অনিরুদ্ধ লাহিড়ী লিখেছেন: ‘সু-উচ্চ বা নীচ, আত্মতা বলতে তো অভীপ্সা রুচি বিশ্বাস ও বিবিধ জৈব তাগিদের এক সুনিবিড় অন্তর্বুনন, স্বারূপ্যের খোঁজে যে-কোনো একজন ব্যক্তি যা বৃত করে নেয় যাপিত জীবনে সযত্নে বা অযত্নে সাধিত অকপট বা কপট ব্যক্তিসত্যে।’

১৪। এই বইয়ের পরিশিষ্টে রাখা লেখাটির কথা বলছেন।

 

 

 

পরিশিষ্ট

আড্ডার শুরুতে অনিরুদ্ধ লাহিড়ী আমাদের ভাবনার কোনো একটা লিখিত রূপ চাওয়ায় আমাদের এই লেখাটা আমরা দিয়েছিলাম। আড্ডায় কথা চলতে চলতে কয়েকবার তিনি এই লেখাটার প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন। তাই পরিশিষ্ট হিসেবে লেখাটিকে এখানে রাখা হলো।

প্রচলিত মার্কসবাদের মতবাদিক গড়ন

ও তা বর্জন করার প্রয়োজনীয়তা

বিপ্লব নায়ক

মার্কসবাদীদের কাম্য এমন একটা বিপ্লব যা পুঁজিবাদের মধ্যে চলতে থাকা উৎপাদনী শক্তির বিকাশকে পুঁজিবাদী (এবং স্থানবিশেষে প্রাক-পুঁজিবাদী) উৎপাদনী সম্পর্কের সঙ্গে বিরোধের ঘেরাটোপ থেকে মুক্ত করে তার অবারিত বিকাশের মুখ খুলে দিতে পারে। মার্কসবাদী তত্ত্ব বলে যে উৎপাদনী শক্তির এই অবারিত বিকাশ সমাজতান্ত্রিক সমাজের বস্তুগত ভিত্তি তৈরি করবে, যে ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে শেষাবধি নানা উত্তরণপর্ব পেরিয়ে সেই কাম্য সমাজে পৌঁছানো যাবে যেখানে প্রত্যেকে (সমাজকে) দেবে (অর্থাৎ উৎপাদনী শ্রম করবে) তার সাধ্য অনুযায়ী এবং নেবে (অর্থাৎ ব্যবহার্য বস্তু নেবে) তার চাহিদা অনুযায়ী। চাহিদার অন্তহীন বৃদ্ধির প্রবণতাকে এখানে সদর্থকভাবে দেখা হয় কারণ একদিকে যেমন তা উৎপাদিকা শক্তির অন্তহীন বিকাশের তাগিদকে ত্বরাণ্বিত করে, অন্যদিকে ব্যবহার্য বস্তুর প্রতুলতা মানব জীবন ও যাপনকে ঋদ্ধতর উন্নততর করে তোলে বলে মনে করা হয়।

কিন্তু উপরোক্ত ধারণাগুলো এখন বাস্তব সংকট পেকে ওঠার মধ্য দিয়ে প্রশ্নের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। পুঁজিবাদের মধ্যে চলা উৎপাদনী শক্তির বিকাশ গোটা বিশ্বের বস্তুগত উৎপাদনকে যে মাত্রায় তুলে নিয়ে গেছে সেখানে দুটো সংকটবিন্দু গভীর থেকে গভীরতর ক্ষতের আকার ধারণ করছে—

১) পৃথিবীর সমস্ত জৈব ও অজৈব উপকরণকে উৎপাদনের কঁাচামালে পরিণত করে তাদের নিষ্কাশন ও ব্যবহার আরো ব্যাপ্ত আরো দ্রুত করতে থাকার মধ্য দিয়ে বহু উপকরণকে তা নাটকীয় দ্রুততায় নিঃশেষিত করে ফেলার মুখে এনে দাঁড় করিয়েছে যা প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্রকে ক্ষয়গ্রস্থ করে ভেঙে পড়ার নজিরবিহীন বিপদের মধ্যে এনে ফেলেছে। এই হারে আর কয়েক দশক চললে পৃথিবীর বিস্তীর্ণ অঞ্চল যে কোনো রূপ প্রাণ ধারণের অযোগ্য পতিত অঞ্চলে পরিণত হবে, ক্রমে গোটা পৃথিবীই প্রাণ ধারণের অযোগ্য গ্রহে পরিণত হওয়ার দিকে এগোবে। কোনো মনুষ্যকল্পিত ‘উন্নততর বিজ্ঞান বা প্রযুক্তি’ এর অন্যথা করতে পারবে না কারণ প্রাণধারণের যোগ্য হয়ে ওঠার প্রাকৃতিক পরিবেশগত শর্তগুলো বহু বহু হাজার বছর ধরে জটিল প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছিল, কয়েক বছরে বা কয়েকশো বছরেও কৃত্রিম মনুষ্যকৃত উপায়ে তা গড়ে তোলা যায় না। সুতরাং পৃথিবীকে পতিতগ্রহে পরিণত করে মঙ্গলগ্রহে সমাজতন্ত্রের সংসার পাতার মূঢ় কল্পসুখকল্পনাকে যদি আমরা রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে হাজির না করতে চাই, তাহলে পুঁজিবাদে চলতে থাকা উৎপাদনী শক্তির বিকাশকে অবারিত করার আকাঙ্ক্ষা আমাদের বর্জন করতে হবে।

২) পঁুজিবাদে উৎপাদনী শক্তির বিকাশ শহরভিত্তিক বৃহৎ শিল্পোৎপাদনে (big industries/large-scale industries) বস্তুগত উৎপাদনকে কেন্দ্রীভূত করে ও তার চাহিদামতো বনসম্পদ-প্রাণসম্পদ-খনিসম্পদ দখল-খনন-আহরণকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সেই প্রক্রিয়াজাত যে পরিমাণ বর্জ্য ক্রমবর্ধমান হারে বমন করে যাচ্ছে, তা-ও প্রকৃতি-পরিবেশের সংকট ঘনিয়ে তুলছে। উদাহরণস্বরূপ কার্বন নির্গমন ও তজ্জনিত বিশ্ব উষ্ণায়নের সমস্যার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। এই উৎপাদনী শক্তির বিকাশকে অব্যাহত রেখে কোনো প্রযুক্তি বা সংস্কার যে এই সমস্যার সমাধান করতে পারে না তা গত অর্ধশতক জুডে় কার্বন নির্গমন নিয়ন্ত্রণের বিবিধ বেকার চেষ্টা ও কার্বন-ট্রেডিং নামক জালিয়াতির ছড়িয়ে পড়াই প্রমাণ করে।

পরিবেশ ও প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্র নিয়ে মার্কসের নিজের লেখার আমরা যতটুকু পাই, সেখানে তিনি বলেছিলেন যে পুঁজিবাদ মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যের জৈবিক সম্পর্কটিকে ভেঙে দিয়ে এক বিপাকীয় ফাটল তৈরি করে যা প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্রগত সংকটকে প্রযুক্তিনির্ভর সমাধানের চেষ্টার মাধ্যমে একটা ক্ষেত্র থেকে আরেকটা ক্ষেত্রে স্থানান্তরিতই করে মাত্র, সমাধান করতে পারে না, বরং ক্রমশ আরও গভীর করে তোলে। কিন্তু দ্বিতীয় বা তৃতীয় আন্তর্জাতিকের মান্য মার্কসবাদের সংস্করণে মার্কসের এইরূপ চিন্তাগুলি কোনো স্থান পায়নি। তার কারণ বোধহয় এই যে এই চিন্তা পুঁজিবাদের মধ্যে চলতে থাকা উৎপাদনী শক্তির বিকাশকে অবারিত করার অপর মার্কসীয় সিদ্ধান্ত সম্পর্কে সংশয়ের জন্ম দেয়। দ্বিতীয় ও তৃতীয় আন্তর্জাতিকের অভিপ্রেত ছিল যেহেতু এমন এক সংশয়-বর্জিত মার্কসবাদ যা অতিনিশ্চয়তার সঙ্গে প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর হাজির করে অনুসরণকারীকে ‘সর্ব-জ্ঞানের চূড়ান্ত ঘনরূপটির (বা বটিকাটির)’ অধিকারী হিসেবে সর্ব সংশয় থেকে মুক্তি দেয়, তাই তঁারা বিপাকীয় ফাটল সম্পর্কিত ধারণাকে নির্বাসন দিয়ে পুঁজিবাদের মধ্যে চলতে থাকা উৎপাদনী শক্তির অবারিত বিকাশের মাধ্যমে সমাজতন্ত্রের বস্তুভিত্তি গড়ার কর্তব্যকে প্রশ্নহীন করে হাজির করেছিলেন। যে লেনিনের নেতৃত্বাধীন রাশিয়াকে সাধারণত মার্কসবাদী তত্ত্ব প্রয়োগচর্চার সর্বোৎকৃষ্ট ঐতিহাসিক উদাহরণ হিসেবে গণ্য করা হয়, সেখানেও তাই পুঁজিবাদের মধ্যে চলতে থাকা উৎপাদনী শক্তির অবারিত বিকাশসাধনের উপর নিঃসংশয় জোর দেওয়া হয়েছিল, শহরকেন্দ্রীক বৃহৎ শিল্পোৎপাদনে বস্তুউৎপাদন কেন্দ্রীভূত করাকেই বিপ্লবী কর্তব্য হিসেবে ধার্য করা হয়েছিল, এমনকি পুঁজিবাদী দেশে বিকশিত উৎপাদন-ব্যবস্থাপনার উপায়কে (তৎকালীন বিশ্বে টেলরইজম নামে পরিচিত) প্রশ্নহীনভাবে অনুসরণ করার নির্দেশ জারি হয়েছিল। পুঁজিবাদের মধ্যে চলতে থাকা উৎপাদনী শক্তির বিকাশকে অবারিত করার কর্তব্য বর্জন করতে হলে তাই মার্কসবাদের মান্য বা প্রমিত রূপটিকেও ‘মার্কসবাদ সর্বশক্তিমান কারণ ইহা সত্য’– এই সুরক্ষাবলয়ের বাইরে বের করে এনে নিদ্র্বিধ সমালোচনাত্মক বিচারের মধ্যে দিয়ে অন্যতর ভাবনার বিকাশের পথ খোলার চেষ্টা করা দরকার।

উৎপাদনী শক্তির অবারিত বিকাশের প্রয়োজনীয়তা হাজির করা হয় এদিক থেকে যে তা সমাজতান্ত্রিক সমাজের বস্তুগত ভিত্তি তৈরি করে, কেননা যার যেমন চাহিদা তাকে তেমন (ব্যবহার্য বস্তু) দিতে হলে উৎপাদনকে যে শিখর থেকে উচ্চতর শিখরে তুলে নিয়ে যাওয়া চাই তা উৎপাদনী শক্তির বিকাশকেও শিখর থেকে উচ্চতর শিখরে বিকশিত করা ছাড়া সম্ভব নয়। অর্থাৎ, আমাদের চাহিদা সীমাহীনভাবে বাড়তে হলে উৎপাদনী শক্তিকেও সীমাহীনভাবে বাড়তে হবে। আর আমাদের চাহিদা সীমাহীনভাবে বাড়া জরুরী কেন? কারণ মনে করা হয় যে চাহিদার বৃদ্ধি হল উন্নততর ও পূর্ণতর জীবন ও যাপনের লক্ষণ, বা অন্ততপক্ষে তার আকাঙ্ক্ষার লক্ষণ। এখন এই বিষয়টিকে বিচার করে দেখা যাক।

চাহিদার বৃদ্ধি মানে উন্নততর জীবনের জন্য আকাঙ্ক্ষা এবং তদনুযায়ী পরিমাণে ও রকমে ভোগ্যবস্তু আহরণ ও ব্যবহার বাড়ার মধ্য দিয়ে জীবন ও যাপনের মান উন্নততর হয়— সত্যিই কি তাই? ভোগ্যবস্তুর চাহিদা সেই ভোগ্যবস্তু পাওয়ার মধ্য দিয়ে শেষ হয়না, বরং ঘিয়ের ছিটে দেওয়া আগুনের মতো আরো তীব্র হয়ে ওঠে। একই ভোগ্যবস্তু আরো বা নতুনতর ভোগ্যবস্তুর জন্য অকাঙ্ক্ষা প্রকট হয়। ফলত তা কোনো আকাঙ্ক্ষাতৃপ্তির বোধে পৌঁছে দেয়না, বরং তা নিরন্তর ভোগবুভুক্ষার এক তাড়নাগ্রস্ত অতৃপ্ত অস্তিত্বে বেঁধে রাখে। সেই তাড়না জন্ম দেয় অসংখ্য বিকারের, যেমন, ভোগব্যয় মেটানোর জন্য যে কোনো ভাবে হোক উপার্জনবৃদ্ধির পিছনে ছুটে নিঃশেষিত হওয়ার বিকার, সংবেদনহীন ভোগপ্রদর্শনীর প্রদর্শন ও আস্ফালন দিয়ে আত্মগরিমা জাহির করার অসুখ, ইত্যাদি। এই তাড়নাগ্রস্ত অসুস্থ অস্তিত্বকে নিশ্চয়ই উন্নততর জীবন ও যাপন বলব না।

পুঁজিবাদের সঙ্গে এই তাড়নাগ্রস্ত অসুস্থ যাপনের কী সম্পর্ক তা নিয়ে মার্কস নানা ক্ষুরধার বিশ্লেষণ করে গেছেন। তার অন্যতম হল পণ্যভক্তিবাদ (commodity fetishism) নিয়ে তঁার আলোচনা। মার্কসের আলোচনা অনুসরণ করলে বলা যায় যে সমাজভুক্ত প্রত্যেক মানুষের জীবন অপরাপর মানুষদের সঙ্গে তার উৎপাদনী শ্রম ভাগ করে নেওয়ার সহযোগিতামূলক সম্পর্কের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু এই বাস্তব নির্ভরশীলতা আড়ালে চলে গিয়ে উপলব্ধির নাগালের বাইরে চলে যায় যখন পুঁজিবাদী সমাজে পণ্যবিনিময়-পণ্যআহরণের মধ্য দিয়ে গোটা সামাজিক সম্পর্ককে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠা মানুষ পণ্যকেই দেখতে শুরু করে তার একমাত্র প্রয়োজনের বস্তু হিসেবে এবং তা আহরণের জন্য অন্য পণ্য বা অর্থ নিজ দখলে পুঞ্জীভূত করাকেই যথেষ্ট মনে করে। এর মধ্য দিয়ে মানুষের সঙ্গে মানুষের বাস্তব সম্পর্ক আড়ালে চলে যায়, তা চেতনায় প্রতিস্থাপিত হয় পণ্যের সঙ্গে পণ্যের সম্পর্ক দিয়ে। পণ্যই জীবনের ও যাপনের উৎকর্ষের বা অপকর্ষের কারণ হিসেবে প্রতিভাত হতে থাকে।

এই পণ্যভক্তিবাদ পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিস্তৃতি ও গভীরতালাভের সঙ্গে সঙ্গে সর্বাত্মক আধিপত্য বিস্তার করে। সেই আধিপত্যের কাছেই চেতনাকে বন্ধক রাখা হয় না কি যখন ভোগ্যবস্তুর প্রতুলতা/অপ্রতুলতার উপর জীবন ও যাপনের উৎকর্ষ/অপকর্ষকে নির্ভরশীল বলে ভাবা হয়? যে সমাজতন্ত্রমুখী উত্তরণকালীন সমাজে পণ্যের বিলোপসাধনের প্রক্রিয়া সূচিত হওয়ার কথা, সেই সমাজে যখন জীবন ও যাপনের উন্নতির জন্য পুঁজিবাদের প্রতিষ্ঠিত পথেই বস্তু উৎপাদনকে আরো আরো বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে চাহিদা পূরণ ও সম্প্রসারণের কথা বলা হয়, পুঁজিবাদী দেশগুলোর সমস্তরে পৌঁছে তাকে ছাপিয়ে যাওয়ার লক্ষ্য ঘোষিত হয়, তখন সামাজিক সম্পর্ক ও জীবন সম্পর্কে পণ্যভক্তিবাদী মনোভাবের ধারাবাহিকতা কি পণ্যবিলোপের বিপরীত পথেই হাঁটে না?

তাছাড়া একটি বস্তুগত সীমার প্রশ্নও এই একুশ শতকে এসে অতি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। পশ্চিম ইউরোপ বা উত্তর আমেরিকার কোনো নাগরিকের এখন যে প্রাত্যহিক গড় ভোগ-চাহিদা, সেই মাপে পৃথিবীর বর্তমান সমস্ত মানুষকে তুলে আনতে হলে সেই চাহিদা পুরণের জন্য কঁাচামাল যোগান দিতে একটি পৃথিবী নয়, খান-দশেক পৃথিবী কয়েক দশকের মধ্যেই নিঃস্ব পতিতভূমিতে পরিণত হবে। সুতরাং চাহিদা ও ভোগবৃদ্ধির মধ্য দিয়ে সামূহিক জীবন ও যাপনের ‘উন্নতিসাধন’ বস্তুগতভাবেও অসম্ভব। বরং তার বিপরীতটাই বাধ্যতামূলক হয়ে উঠেছে। মানুষ যদি গোটা পৃথিবীর বাস্তুতন্ত্রকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে নিয়ে যাওয়া বিপজ্জনক অবিমৃষ্যকারী প্রজাতি হিসেবে নিজেদের যাত্রা শেষ না করতে চায়, তবে মানুষকে তার চাহিদা ও ভোগ বাড়ানোর বদলে ব্যাপকভাবে কমাতে হবে এবং ভোগবৃদ্ধির মধ্য দিয়ে সুখের আলেয়ার পশ্চাদ্ধাবন করার বদলে জীবনের উৎকর্ষ/অপকর্ষ সম্বন্ধে বিকল্প ধারণার সন্ধান করতে হবে। পৃথিবীর সমস্ত জৈব ও অজৈব উপাদান, সমস্ত অন্যান্য প্রাণীপ্রজাতি কেবল মানুষের বস্তু-উৎপাদনের কঁাচামাল হিসেবে মানুষের ভোগচাহিদা মেটানোর জন্যই উৎসর্গিত, এই স্থূল সংকীর্ণ কর্তৃত্ববাদী অহমিকা ছেডে় মানুষকে প্রকৃতির অন্য সমস্ত বস্তু ও প্রাণের সঙ্গে নিজের জৈবিক সম্পর্কবন্ধনটিকে পুনরাবিষ্কার করতে হবে। কোনও এক কল্পসুখস্বর্গে (অর্থাৎ সমাজতন্ত্রে) পৌঁছানোর পর আপনা থেকেই (অর্থাৎ সমাজের অর্থনৈতিক ভিত্তির পরিবর্তনের ফলস্বরূপ) এই সব হয়ে যাবে এমন ছদ্মনিশ্চয়তা নিয়ে আমরা যদি কেবল ওই অর্থনৈতিক ‘উন্নতি’ বা পরিবর্তনসাধনেরই করণিকগিরি করি তাহলে কল্পসুখস্বর্গে পৌঁছানোর বদলে পুঁজিবাদের গর্ভেই চরকিপাক ঘুরে যাব। সুতরাং পুঁজিবাদের বিরোধিতা বা পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের যে কোনো প্রচেষ্টায় আজই পণ্যভক্তিবাদ ও মানুষের প্রজাতিগত অন্ধ অহংকারকে বর্জন করে বিকল্প ভাবনা-অবস্থানে পৌঁছানোর তাত্ত্বিক-ব্যবহারিক সংগ্রাম জারি করা দরকার। মান্য মার্কসবাদের স্থূল-বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি তার বস্তুবাদের দোহাই দিয়ে এসবকিছু নিয়েই মাথা ঘামাতে নারাজ। তাই মান্য মার্কসবাদ পুঁজিবাদ-বিরোধিতাকে কেবল একটি পার্টির কর্মসূচী নির্ধারণের পরিসরে সীমায়িত করে দিয়েছে, জীবন ও যাপনের বহুভঁাজ পরিসরে পুঁজিবাদ-বিরোধিতার সমস্ত অতি জরুরী প্রশ্নগুলোই ‘এখন বিবেচ্য নয়’–য়ের পর্যায়ে ঠেলে দিয়েছে। তাই তা এত যান্ত্রিক হয়ে উঠেছে। পুঁজিবাদ সম্পর্কে মার্কসের সমালোচনাত্মক বিচারে আমরা সর্বস্ব উজাড় করে দেওয়া আবেগের স্ফূরণ দেখতে পাই, অথচ তঁার নাম করে, তঁার উত্তরাধিকার বওয়ার আছিলায়, তঁার চিন্তার ‘বিশুদ্ধতা’ রক্ষার ছলে প্রচলিত ঘরানার মার্কসবাদীরা বিমূর্ত কিছু ধূসর ফরমুলার স্তোত্রকারী হিসেবে নিজেদের ক্রমশ এক মতবাদসর্বস্ব আচার-অনুষ্ঠান-পালনকারী প্রাণহীনতায় নিমজ্জিত করছে।

মার্কসবাদের মতবাদিক গঠনকাঠামোয় সমাজবিকাশের ধারা বা ‘প্রগতি' সম্পর্কে তত্ত্ব অন্যতম প্রধান খুঁটি হিসেবে বিরাজমান। এই তত্ত্বানুযায়ী সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গিকে হাজির করা যায় একটি সারণির আকারে। সারণিটি এইরকম:

অনুন্নত

উন্নত

প্রকৃতি

সভ্যতা

ইওরোপ-বহির্ভূত সভ্যতা

ইওরোপীয় সভ্যতা

বনাঞ্চল

গ্রাম

গ্রাম

নগর

অরণ্য/চারণভূমি

কৃষিক্ষেত্র

কৃষিক্ষেত্র

কল-কারখানা

শিকার-সংগ্রহজীবিকা/ পশুচারণ

কৃষিকাজের অর্থনীতি

কৃষিকাজের অর্থনীতি

শিল্প-অর্থনীতি

বনবাসী শিকারী/সংগ্রহজীবী

কৃষক

কৃষক

শিল্পে নিযুক্ত শ্রমিক/ কর্মচারী/ আধিকারিক

সারণির দুদিকের মধ্যে একদিককে ‘অনুন্নত' আর অপরদিককে ‘উন্নত' বলে নির্ধারণ করার মধ্য দিয়ে যেমন দুদিককে একটা আপেক্ষিক তুলনামূলক নিকৃষ্ট-প্রকৃষ্ট সম্পর্কে বাঁধা হয় (যেমন: সভ্যতার তুলনায় প্রকৃতি নিকৃষ্ট, ইওরোপীয় সভ্যতার তুলনায় ইওরোপ-বহির্ভূত সভ্যতা নিকৃষ্ট, ইত্যাদি), তেমনই কাঙ্খিত পরিবর্তন বা বিবর্তনের একটি ক্রমকে ‘স্বাভাবিক' হিসেবে হাজির করা হয় (যেমন: প্রকৃতির উপর নিয়ন্ত্রণ/আধিপত্য কায়েম করে সভ্যতায় ‘বিবর্তিত' হওয়া, ইওরোপ বহির্ভূত সভ্যতা থেকে বিবর্তিত হয়ে ইওরোপীয় সভ্যতায় ‘উন্নত' হওয়া ইত্যাদি)। এই পরিবর্তন বা বিবর্তনের একধরনের ক্রম হাজির হয়, যেমন:

ক্রম ১: বনাঞ্চল↦ গ্রাম↦ নগর

ক্রম ২: অরণ্য/চারণভূমি↦ কৃষিক্ষেত্র↦ কল-কারখানা

ক্রম ৩: শিকার-সংগ্রহজীবিকা/পশুচারণ↦ কৃষিকাজের অর্থনীতি↦ শিল্প-অর্থনীতি

ক্রম ৪: বনবাসী শিকারী/সংগ্রহজীবী↦ কৃষক↦ শিল্পে নিযুক্ত শ্রমিক/ কর্মচারী/ আধিকারিক

ক্রমোন্নতির স্বাভাবিক ও স্বতঃসিদ্ধ ক্রম হিসেবে, অর্থাৎ যে কোনও সমাজের বিকাশের স্বাভাবিক নিয়ম হিসেবে এটি উপস্থিত হয়।

এই বিশ্ববীক্ষাকে এর ঐতিহাসিক উৎস বা জন্মসূত্রের সূত্রে আমরা ‘পাশ্চাত্য পুঁজিবাদী উন্নয়নী বিশ্ববীক্ষা’ বলতে পারি। পশ্চিম ইওরোপে তথাকথিত ‘শিল্পবিপ্লব’ ও পুঁজিবাদী শিল্পোৎপাদন কেন্দ্রীক সমাজের উদ্ভবের লগ্নে ষোল-সতের শতক জুডে় এই বিশ্ববীক্ষা দানা বেঁধেছিল। প্রকৃতিকে কেবলমাত্র কঁাচামালের ভাণ্ডার হিসেবে গণ্য করে কীভাবে তা আরও দ্রুত ও আরও ব্যাপক ভাবে নিঙড়ে নিয়ে শিল্পোৎপাদন যজ্ঞকে অন্তহীন বিস্তারের পথে ঠেলে নিয়ে যাওয়া যায়, সেটাই হয়ে উঠেছিল চালিকাশক্তি। প্রথমে পশ্চিম ইওরোপের দেশগুলোর মধ্যের গ্রামীণ সংস্কৃতি এর ধাক্কায় ভেঙে পড়েছিল, গ্রামের মানুষ দলে দলে সর্বহারা, আশ্রয়হীন ভবঘুরে, হতদরিদ্রে পরিণত হয়েছিল আর তাদের সহায়সম্বল প্রকৃতির সমস্ত ধনকে নিঙড়ে, উপড়ে, পুঞ্জীভবন করে যন্ত্র-শিল্পোৎপাদনের ভিত পাতা হয়েছিল। তারপর এই পাশ্চাত্য দেশগুলির উপনিবেশ বিস্তারের মধ্য দিয়ে ক্রমে এই প্রক্রিয়া অন্যান্য মহাদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার আদিবাসী সমাজ-সংস্কৃতি নিশ্চিহ্ন করার কাজে ইওরোপীয় উপনিবেশ-বিস্তারকদের গোলা-বারুদ-বন্দুকের অপ্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি লাখ লাখ আদিবাসীদের ‘শিকার’ করে জনজাতির পর জনজাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল। সেই মৃগয়াক্ষেত্রে পশ্চিম ইওরোপের প্রতিবিম্ব হিসেবে ‘নয়া আধুনিক সমাজের’ পাট বসিয়েছিলেন ইওরোপীয় দখলদাররা। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়েছে অস্ট্রেলিয়া মহাদেশে, আফ্রিকা মহাদেশে এবং ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপপুঞ্জে। মানুষ মারার অস্ত্রকে অত্যুন্নত করে ও মানুষ মারাকে নিঃসংকোচ হেলাফেলার কাজে পরিণত করে মহাদেশের পর মহাদেশে দখলদারি কায়েম করা এই পশ্চিমী ইওরোপীয়রা নির্ধারণ করলেন যে তঁাদের এই ‘সাফল্যের’ কারণ তঁাদের নিজ সভ্যতার সর্বোৎকৃষ্টতা। অর্থাৎ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকা ও অসংখ্য দ্বীপপুঞ্জের জনজাতিরা তঁাদের খুনে আক্রমণের সামনে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে এই কারণে যে সেই সব জনজাতিগুলো ছিল পশ্চাৎপদ, সেই সব জনজাতিদের সভ্যতা ছিল নিকৃষ্ট মানের। অর্থাৎ, পশ্চিমী ইওরোপীয়রা এই অসংখ্য মানুষকে খুন করে, মানবসমাজ-সভ্যতার এই অসংখ্য বৈচিত্র্যপূর্ণ রূপকে ধ্বংস করে আসলে সভ্যতার সর্বোৎকৃষ্ট রূপটাকেই প্রতিষ্ঠিত করার গুরুদায়িত্ব পালন করছেন! (এভাবে যুক্তিনির্মাণ করার মধ্য দিয়েই বুঝি কোনও খুনি স্বভাবঘাতক হয়ে ওঠে!)

এভাবে এক উচ্চাবচ ধাপবন্দি কাঠামোয় সাজিয়ে মানবসমাজ-সংস্কৃতির বিভিন্ন রূপকে দেখাটাকেই ‘স্বাভাবিক’ বলে হাজির করেছে এই বিশ্ববীক্ষা। এই নির্মিত ‘স্বাভাবিকতা’ অনুযায়ী পশ্চিম-ইওরোপীয় সমাজ-সংস্কৃতি উচ্চাবচ ধাপবন্দি কাঠামোর শীর্ষে অবস্থিত এবং অন্যান্য সমাজ-সংস্কৃতিগুলো ‘অনুন্নতি’-র বিভিন্ন চিহ্ন বহন করে তলাকার ধাপগুলোয় ক্রমবিন্যস্ত। আর এই ধাপবন্দি কাঠামোর গতিসূত্র হলো অনুন্নতি থেকে উন্নতির দিকে যাত্রা। ফলে অন্য সমস্ত সমাজ-সংস্কৃতি নিজেকে লোপ করার মধ্য দিয়ে পশ্চিম-ইওরোপীয় সমাজ-সংস্কৃতির অনুকরণে নিজেকে পুনর্বিন্যস্ত করবে, এটাই হলো নিয়ম। আর এই নিয়ম অনুযায়ী গতিকে ত্বরান্বিত করার জন্য কিছু গাজোয়ারি-খুনখারাপি-ধ্বংস-তাণ্ডব চালাতে হলে সংকোচের কিছু নেই কারণ লক্ষ্য যদি ঠিক থাকে, সেই লক্ষে্য পৌঁছানোর উপায় নিয়ে সঠিক-বেঠিক আলোচনার কি কোনও মানে হয়? এই বিশ্ববীক্ষাকে জপের মালা করেই চলেছে কালাপাহাড়ি তাণ্ডব। বিভিন্ন আদি জনজাতির প্রকৃতিলগ্ন সমাজ-সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে, তাদের প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারের অধিকার খর্ব করে জল, জঙ্গল, জমি, মাটি, মাটির তলদেশ সমস্তকিছু গোষ্ঠীগত অধিকার বা গোষ্ঠীগত মালিকানা থেকে কেডে় নিয়ে ব্যক্তিগত মালিকানা বা রাষ্ট্রীয় মালিকানার অধীনে দখল করা হয়েছে— যে ব্যক্তি বা রাষ্ট্র সেই সম্পদ নিঙডে় বাণিজ্যিক পুঁজিবাদী উৎপাদন করতে উন্মুখ। পরিবর্তন বা বিবর্তনের যে চারটি ক্রমকে (ক্রম ১ থেকে ক্রম ৪) উপরে উল্লিখিত হয়েছে তা এই লুন্ঠনেরই চারটি পথ। তথাকথিত সমাজতন্ত্র-অভিমুখী রাশিয়া বা চীনেও কৃষক ও অ-পুঁজিবাদী সমাজরূপে অভ্যস্ত বিভিন্ন জনজাতির উপর রাষ্ট্রীয় শক্তি ব্যবহার করে এই লুন্ঠন-নিশ্চিহ্নকরণ প্রক্রিয়া চলেছে।

মার্কস পুঁজিবাদের উৎপত্তি বর্ণনা করতে গিয়ে এই প্রক্রিয়াকে ‘আদিম পুঞ্জীভবন’ (primitive accumulation) বলে অভিহিত করেছিলেন। পুঁজি কেন্দ্রীভূত করার এই পদ্ধতি রুশ বিপ্লবের পর সমাজতন্ত্র গঠনের জন্যও এত গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়েছিল যে বলশেভিক অর্থনীতি-বিশেষজ্ঞ প্রিওব্রাঝেনস্কি তঁার মান্য বইয়ে ‘সমাজতান্ত্রিক আদিম পুঞ্জীভবন’ (socialist accumulation) নাম দিয়ে তা কীভাবে মূলত কৃষকদের সম্পদ রাষ্ট্রের অধীনে কেন্দ্রীভবন ও শিল্পপণ্যের তুলনায় কৃষিপণ্যের দামকে জোর করে নামিয়ে রাখার মধ্য দিয়ে হতে পারে তা আলোচনা করেছিলেন। পার্টির মধ্যে ক্ষমতার লড়াইয়ে পরাভূত হয়ে প্রিওব্রাঝেনস্কি পরবর্তীতে অবাঞ্ছিততে পরিণত হয়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য হলেও, তঁার ‘সমাজতান্ত্রিক আদিম পুঞ্জীভবনের’ নিদান অবাঞ্ছিত হয়নি। ১৯৩০-য়ের দশকে স্তালিনের নেতৃত্বে রুশ কমিউনিস্ট পার্টি সোভিয়েত রাশিয়ার গ্রামাঞ্চলে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও লু্ন্ঠন বল্গাহীন করে কৃষিতে যে ‘সমবায়িকরণ’ (collectivisation) প্রক্রিয়া হাসিল করেছিল, তা এই ‘সমাজতান্ত্রিক পুঞ্জীভবন’ তত্ত্বেরই প্রয়োগ বলা যায়।

ভারতীয় উপমহাদেশে প্রধানত ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসনের মধ্য দিয়ে এই ‘পাশ্চাত্য উন্নয়নী বিশ্ববীক্ষা’ ও তার লুঠের রাজ কায়েম হয়েছিল। এই শাসনের মধ্য দিয়ে এমন এক রাষ্ট্র, রাষ্ট্রীয় নীতি ও কলকৌশল, উন্নয়নী দিশা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, জ্ঞানচর্চা ও তার প্রয়োগের এমন এক পদ্ধতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যা ইংরেজ শাসকরা চলে যাওয়ার পরেও নিজেদের আধিপত্য বজায় রেখেছে। বিভিন্ন ধুয়োর জাতীয়তাবাদকে স্বাধীনতা-উত্তর ভারতীয় শাসকরা বা প্রভাবশালীরা নিজেদের হাতিয়ার করলেও উন্নয়নী বীক্ষায় তারা পাশ্চাত্য উন্নয়নী বিশ্ববীক্ষা-কেই প্রশ্নাতীত ও স্বাভাবিক বলে ধরে নিয়ে চলেছেন। কমু্যনিস্ট বা মার্কসবাদী মহলেও এই বিশ্ববীক্ষাকে প্রশ্নাতীত ও স্বাভাবিক বলে ধরে নিয়ে চলা হচ্ছে।

পুঁজিকে কেন্দ্রীভূত করার এই বিধ্বংসী প্রক্রিয়াকে মতবাদিক নির্ধারণের মাধ্যমে আপন করে নেওয়ার মধ্য দিয়ে প্রচলিত মার্কসবাদ পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিকল্প অনুসন্ধান ও গঠনের অনুশীলনের বদলে পুঁজিবাদী ব্যবস্থারই একটি অন্যতর রূপ নির্মাণের অনুশীলনে পরিণত হয়েছে।

এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে রুশ বিপ্লবী ভেরা জাসুলিচের চিঠির প্রতু্যত্তরে লেখা মার্কসের চিঠিতে আমরা মার্কসের এমন ভাবনার প্রকাশ দেখতে পাই যেখানে মার্কস বিপ্লবোত্তর রাশিয়ায় (তখনও রুশ বিপ্লব হয়নি) পশ্চিমী কেন্দ্রীভূত বৃহদায়তন শিল্পের পরিবর্তে কৃষকদের বিকেন্দ্রীভূত গ্রামীণ কমিউনগুলোর উপর ভিত্তি করে সমাজতন্ত্রের পথে এগোনোর সম্ভাবনার কথা বলেছিলেন। সুতরাং মার্কসের ভাবনায় পশ্চিমী পুঁজিবাদী উন্নয়নী বিশ্ববীক্ষার প্রভাবই কেবল ছিল না, তার দিকে সংশয়ী চোখে তাকানো অন্যতর উপাদান ছিল। মার্কসবাদীরা অবশ্য মার্কসের ভাবনার এই সংশয়ী অনেকান্ততাকে উপেক্ষা করেই তাদের ‘বৈজ্ঞানিক মতবাদ’ নির্মাণ করেছে।

পশ্চিমী পুঁজিবাদী উন্নয়নী বিশ্ববীক্ষা অনুযায়ী ভবিষ্যৎ সমাজে কেন্দ্রীভূত বৃহদায়তন শিল্পই সর্বাত্মক হয়ে উঠবে, অন্যান্য উৎপাদন-রূপ (যেমন, বিকেন্দ্রীভূত কৃষি, ক্ষুদ্রশিল্প, হস্তশিল্প) নিশ্চিহ্ন হয়ে বৃহদায়তন শিল্পের মধ্যেই বিলীন হয়ে যাবে। তাই ছোট-মাঝারি কৃষক সহ সব ছোট-মাঝারি উৎপাদকদের নিয়তি হল নিজ পেশা ও উৎপাদন-উপকরণ খুইয়ে কেন্দ্রীভূত বৃহদায়তন শিল্পের শ্রমিকে পরিণত হওয়া। এই গতি বা প্রবণতা যেহেতু ‘ইতিহাসের নিয়ম’ দ্বারা নির্ধারিত, তাই এর বিরোধিতা বা অন্যথা করতে চাওয়া একদিকে যেমন অসম্ভব, অন্যদিকে তেমনই প্রতিক্রিয়াশীল। এই বিশ্ববীক্ষাকে আত্মীকৃত করা মার্কসবাদী মতবাদিক নির্ধারণে তাই শ্রমিকই হল একমাত্র সামাজিক বর্গ যা পুঁজিপতিদের মুখোমুখি চূড়ান্ত লড়াইয়ের জন্য পড়ে থাকবে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিচ্ছিন্ন উৎপাদকরা বৃহদায়তন শিল্পে কেন্দ্রীভূত হয়ে ক্রমশ নিজেদের সাধারণ স্বার্থের ভিত্তিতে সংগঠিত হয়ে উঠে পুঁজিবাদী শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম গড়ে তুলবে, যে সংগ্রাম পুঁজিবাদের শেষ ডেকে আনবে।

মার্কসবাদী নির্ধারণ অনুযায়ী এই যে শ্রমিকশ্রেণির সংগ্রাম বিপ্লবের মূল বল, তা বিকশিত হয় কীভাবে? দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের পর্বে কাউটস্কির তত্ত্বায়ন ও তা অনুসরণ করে তৃতীয় আন্তর্জাতিক পর্বে লেনিনের সূত্রায়ন অনুযায়ী, পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় শ্রমিকরা নিজে থেকে কেবল ট্রেড-ইউনিয়ন সচেতনতা (অর্থাৎ, পুঁজিবাদী উৎপাদনব্যবস্থা টিকিয়ে রেখে তার মধ্যে শ্রমশক্তির বিক্রেতা হিসেবে ক্রেতা পুঁজিপতিশ্রেণির সঙ্গে দরকষাকষি করার সচেতনতা) অবধি অর্জন করতে পারে, পুঁজিবাদকে নিকেশ করে নতুন ব্যবস্থা তৈরির বিপ্লবী সচেতনতা অর্জন করতে পারে না। এই বিপ্লবী সচেতনতা কমিউনিস্টরা (বিপ্লবী বুদ্ধিজীবী এবং শ্রমিকদের মধ্যের একটি অগ্রণী অংশ) বহন করে শ্রমিকদের মধ্যে নিয়ে যায়, শ্রমিকদের শিক্ষিত করে তোলে এবং নেতৃত্ব দিয়ে বিপ্লবী আন্দোলন গড়ে তোলে। এই কমিউনিস্টরা শ্রমিকদের মধ্যে অনুসরণকারী সমর্থকদল সংগঠিত করে পার্টি গড়ে তোলে, যে পার্টি শ্রমিকশ্রেণির আন্দোলনের মাথা (অর্থাৎ, চিন্তা-চেতনার উৎস, রণনীতি-রণকৌশলের উদ্ভাবক, আন্দোলনের খুঁটিনাটির ব্যবস্থাপক, যে কোনো বিচ্যুতির সংশোধক) হিসেবে কাজ করে।

এই প্রচলিত মার্কসবাদী নির্ধারণ অনুসরণকারী অনুশীলন কমিউনিস্ট ও শ্রমিকদের মধ্যে যে সম্পর্ক গড়ে তোলে তার বৈশিষ্ট্যগুলো এইরকম:

ক) শ্রমিকদের যে কোনো ধরনের স্বতঃস্ফূর্ততাকে সন্দেহের চোখে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে কমিউনিস্টরা, কারণ মতবাদিক নির্ধারণ অনুযায়ী তা বুর্জোয়া-পেটিবুর্জোয়া প্রবণতার প্রকাশ হতে বাধ্য। শ্রমিকদের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের উপর কমিউনিস্টদের নেতৃত্ব, নিয়ন্ত্রণ ও শোধনকারী প্রভাব প্রতিষ্ঠা করাই তাই কমিউনিস্টদের প্রথম করণীয় হয়ে ওঠে। শ্রমিকদের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের অংশ হয়ে (অংশ হওয়া মানে নিজ সচেতনতা, সংশয়, সমালোচনা বাদ দিয়ে নয়, সেই সব নিয়েই) তার আপন গতিতে বিকাশের পথ থেকে শেখার বদলে কমিউনিস্টদের কাজ হয়ে দাঁড়ায় সেই আন্দোলনের মধ্যে অন্য সমস্ত সম্ভাবনাকে ধ্বংস করে কেবলমাত্র নিজেদের মতবাদিক-চিন্তা-প্রসূত একটি পথেই চালিত করার, কারণ বিপ্লবী পথ তো কমিউনিস্ট মতবাদধারী ছাড়া আর কারো ভাবনায় উদয় হতে পারেনা!

খ) উপরোক্ত প্রবণতার জন্য কমিউনিস্টরা শ্রমিকদের মধ্যে সম্পর্কবিস্তারের মধ্য দিয়ে নিয়ন্ত্রণকারী ক্ষমতার জাল বিস্তার করার চেষ্টা করে। এই ক্ষমতা প্রধানত দুই প্রকার— অভিভাবকীয় ক্ষমতা ও শৃঙ্খলাদায়ক ক্ষমতা। ক্ষমতার এই দুই প্রকারকে বর্ণনা করা যায় এইভাবে:

অভিভাবকীয় ক্ষমতা— কমিউনিস্টরাই যে শ্রমিকদের আন্দোলনের একমাত্র সাচ্চা চিন্তক/ পরিকল্পক/ সংশোধক এবং কমিউনিস্ট নেতৃত্ব ছাড়া শ্রমিকদের যে কোনো আন্দোলনই যে বিপথগামী ও ব্যর্থ হতে বাধ্য এই ভাবনা সঞ্চারিত করার মধ্য দিয়ে আন্দোলন নিয়ে মাথা খাটানোর ক্ষেত্রে শ্রমিকদের কমিউনিস্টদের বা কমিউনিস্ট পার্টির মুখাপেক্ষী করে তোলা। এক কথায় বললে শ্রমিকদের নিজেদের ভাবনা-চিন্তার সক্ষমতাকে নস্যাৎ করে নিজেদের অভিভাবকত্ব প্রতিষ্ঠা করা।

শৃঙ্খলাদায়ক ক্ষমতা— দৈনিক প্রাত্যহিকতা থেকে শুরু করে আন্দোলনের প্রতিটি পরিসরে ও প্রতিটি পর্যায়ে শ্রমিকরা কমিউনিস্টদের বেঁধে দেওয়া ‘বিপ্লবী’ আচরণ, নীতি-নৈতিকতা, কৌশল, কর্মসূচী পালন করছে কি না তার উপর নজরদারি কায়েম করা, বিচ্যুতির জন্য সমালোচনা থেকে শুরু করে বহু-ধাপ দণ্ডব্যবস্থা জারি করার মধ্য দিয়ে শৃঙ্খলা আরোপ করতে চাওয়া হয়, বলা হয় যে এই শৃঙ্খলা ব্যতীত শ্রমিকশ্রেণির কোনো আন্দোলন এগোতে পারে না। এই ক্ষমতার গেঁড়ে বসার মধ্য দিয়ে এক আংশিক পক্ষাঘাত ছড়িয়ে পড়ে। প্রাত্যহিকতার অভিজ্ঞতার বহুমুখ প্রশ্ন ও সম্ভাবনার মধ্যে থেকে সৃজনশীলভাবে নিজস্ব পথ তৈরি করার প্রয়াসের বদলে মতবাদিক বাঁধা পথে নির্ধারিত একমেবাদ্বিতীয়ম পথটিকে প্রশ্নহীনভাবে অনুসরণ করার যান্ত্রিকতা বোধকে ভোঁতা করে দিতে থাকে।

শ্রমিকদের সঙ্গে কমিউনিস্টদের এই সম্পর্ক কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে নেতৃত্ব ও কর্মীদের সম্পর্কের মধ্যে পুনরুৎপাদিত হয়। পার্টি নেতৃত্ব পার্টির কর্মীদের উপর একই রকম অভিভাবকীয় ক্ষমতা ও শৃঙ্খলাদায়ক ক্ষমতা বিস্তার করে। কখনো কখনো এই কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার কাঠামো পার্টির নেতৃত্ব স্তরেও প্রকট হয়ে দেখা দেয়। পার্টি নেতৃত্বের মধ্যে এক বা জনাকয় মহান অদ্বিতীয় পার্টিনেতা বিপ্লবী চেতনার একমাত্র সাচ্চা উৎস হিসেবে এই কেন্দ্রীভূত ক্ষমতাকাঠামোর শীর্ষে বিরাজ করে।

ক্ষমতাকেন্দ্রীক এই ধাপবন্দি কাঠামোস্থাপন বিপ্লবী সমাজ-সক্রিয়তার পরিসরটিকে সংকীর্ণ, শীর্ণ ও রুগ্ন করে তোলে। ধাপে ধাপে একের পর এক অংশের স্বতক্রিয়ার অধিকারকে নাকচ করে তা বিশেষ কিছু স্বতক্রিয়ার অধিকারীকে বিশেষ অধিকারসম্পন্ন হিসেবে হাজির করে। প্রথম ধাপেই তা শ্রমিক ছাড়া অন্য সামাজিক বর্গ (যেমন কৃষক, ক্ষুদ্র-উৎপাদক, আদিবাসী-জনজাতি, ইত্যাদি)-দের স্বতঃক্রিয়ার অধিকার নাকচ করে, পরের ধাপে কমিউনিস্ট ছাড়া অন্য শ্রমিকদের স্বতঃক্রিয়ার অধিকার নাকচ করে, তার পরের ধাপে পার্টির সর্বময় নেতৃত্ব ছাড়া অন্য কমিউনিস্ট কর্মীদের স্বতঃক্রিয়ার অধিকার নাকচ করে।

এই কেন্দ্রীভূত চরিত্রের ক্ষমতাতান্ত্রিক কাঠামোর মূর্ত রূপগ্রহণ বিভিন্ন সময় বিভিন্ন স্থানে নানা তাৎক্ষণিক ঐতিহাসিক বিশেষত্বের দ্বারা পরিপুষ্ট হলেও এভাবে তার বীজ মান্য মার্কসবাদী মতবাদিক রূপের মধ্যেই রয়েছে। এই মতবাদিক রূপের প্রাথমিক স্বতঃসিদ্ধগুলোকে তাই সংশয়াত্মক চোখে পুনর্বিচার করা খুবই জরুরী। একটি মূল স্বতঃসিদ্ধ, অর্থাৎ, পশ্চিমী পুঁজিবাদী উন্নয়নী বিশ্ববীক্ষার স্বতঃসিদ্ধটিকে আমরা এর আগেই বিচার করেছি। অন্য দুটি মূল স্বতঃসিদ্ধ হলো শ্রমিকদেরই একমাত্র অবিচলিত বিপ্লবী শ্রেণি হওয়া এবং কমিউনিস্টদের সংগঠনী ভূমিকা ছাড়া বিপ্লবী আন্দোলন গড়ে উঠতে না পারার কথা। বেশ কিছু ঐতিহাসিক উদাহরণ স্বতঃসিদ্ধগুলোর বিপরীত কথা বলে। ১৯৩৬-৩৭ সালে স্পেনের গৃহযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে কাতালোনিয়া-আরাগঁ প্রদেশ জুড়ে শ্রমিক ও কৃষকদের যে নৈরাষ্ট্রপন্থী কালেকটিভগুলো পুঁজিবাদের বিকল্প সমাজগঠনচর্চার উজ্জ্বল উদাহরণ রেখে গেছে সেখানে বার্সেলোনার মতো শহরাঞ্চলের শ্রমিকরা ছাড়াও ব্যাপক গ্রামাঞ্চলের কৃষক ও ক্ষুদে উৎপাদকরা স্বাধীন সৃষ্টিশীল ভূমিকা নিয়েছিল। কোনো অভিভাবক কমিউনিস্ট পার্টি তাদের নেতৃত্ব দেয়নি। যে নৈরাষ্ট্রবাদী (anarchist) পার্টিগুলোর প্রভাব তাদের উপর ছিল, তারা অভিভাবকীয় ক্ষমতা ও শৃঙ্খলাদায়ক ক্ষমতা আরোপ করার সচেতন বিরোধী ছিল। রাশিয়াতেও ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বিপ্লবী শ্রমিক আন্দোলনের যে অভুতপূর্ব বিকাশ ঘটেছিল, তা কোনো কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে বা পরিকল্পনামাফিক হয়নি। এমন উদাহরণ আরও অনেক পাওয়া যাবে। পূর্বোক্ত ধারণা-সিদ্ধান্তগুলো তাই আন্দোলনের নীতি-কৌশল নির্ধারণের প্রশ্নে কোনো স্বতঃসিদ্ধ হতে পারে না।

ক্ষমতাতান্ত্রিক কাঠামো আরোপ করে ধাপে ধাপে ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর অংশের স্বতঃক্রিয়ার অধিকার হরণ করা হলো এক ধরনের হিংসা। এই হিংসা প্রায়োগিক ফলিত চর্চায় বিভিন্ন মাত্রায় মূর্তরূপ গ্রহণ করে। মতবাদিক স্বতঃসিদ্ধগুলো থেকে অবরোহী পদ্ধতিতে সিদ্ধান্তে পৌঁছানো হয় এবং সেই সিদ্ধান্ত ব্যতিরেকে অন্য সমস্ত সিদ্ধান্তকে বিভ্রান্তি বা বিচ্যুতি হিসেবে দেখা হয়। আন্দোলনের বিকাশের জন্য কেবল সেই একমেবাদ্বিতীয়ম সঠিক সিদ্ধান্তটির প্রয়োগ ও অনুশীলনই কাম্য ধরে নিয়ে অন্যতর সব ভাবনাচিন্তা-প্রবণতা-ক্রিয়াকে বিভ্রান্তি বা বিচ্যুতি দূর করার নামে দমন করার প্রক্রিয়া জারি হয়। এর মধ্য দিয়ে মতবাদ-অনুসরণকারীরা সংশয়হীন নিশ্চয়তার জোর অর্জন করতে পারে বটে, কিন্তু ক্রমশ সেই সংশয়হীন অনুশীলন এক আবর্ত চক্রে (vicious circle-এ) আবদ্ধ হয়ে পড়ে। বাস্তবতা থেকে উঠে আসা বিভিন্ন অসামঞ্জস্য, প্রতিভাষ্য, বিপরীত ইঙ্গিত সম্পর্কে অনগ্রাহী হয়ে উঠে (বা সেসবকে কেবল ভ্রমাত্মক চিন্তার উপজাত আলেয়া বলে নস্যাৎ করে দিয়ে) তা কেবল স্বতঃসিদ্ধের সঠিকতা থেকে সিদ্ধান্তের সঠিকতা এবং সিদ্ধান্তের সঠিকতা থেকে আবার স্বতঃসিদ্ধের প্রতি আস্থায় চক্রাকারে আবর্তিত হতে থাকে। চিন্তাভাবনার ক্ষেত্রে তা এমন এক স্বয়ংসম্পূর্ণ মতবাদিক বিশ্ব গড়ে তোলে যা বাস্তবতায় নিত্য নতুনের আবির্ভাব থেকে চোখ ফিরিয়ে রোমন্থনপ্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সর্বদা সর্ব প্রশ্নের মীমাংসক হিসেবে নিজের অমোঘতা বজায় রাখে। এই আবর্তচক্রে বন্দি অনুশীলনকারী প্রবৃত্তিগতভাবেই যে কোনো অনুশীলনক্ষেত্রে ধারণা-সংবেদনের বহুত্ব ও বিভিন্নতাকে আপদ বা ত্রুটি হিসেবে দেখে তার উপর ‘সঠিক’ ধারণাটির আধিপত্য কায়েম করে সমরূপতা তৈরি করতে চায়। এই প্রবৃত্তিই তার অনুশীলনকে চালনা করে। অথচ, বিভিন্ন মানুষের চেতনায় বাস্তবতার অভিঘাতে যে বিভিন্ন ও ফারাকসম্পন্ন ধারণা-সংবেদন তৈরি হয়, তার সবগুলোই কি আংশিকতার চরিত্রসম্পন্ন হওয়া অবধারিত নয়? সেই সব আংশিক ধারণাসমূহকে সমমর্যাদায় অনুশীলনের ক্ষেত্রে স্থান করে দিলে তবেই সামগ্রিক অনুশীলনের মধ্য থেকে একে অপরের অভিজ্ঞতা থেকে শেখার মাধ্যমে আংশিকতা থেকে তুলনামূলক সম্পূর্ণতার দিকে যাত্রা সম্ভব নয় কি? তাই মতবাদ-নির্ণীত ‘সত্যে’ অনড়-আস্থা আবর্ত চক্রে বন্দি অনুশীলন একটি অসম্পূর্ণ ভাবনাকেই হিংসার মাধ্যমে সম্পূর্ণ বলে আধিপত্যকারী করতে চায়, বিবিধ-বহুত্বের মধ্য দিয়ে সম্পূর্ণতার দিকে অন্তহীন যাত্রা তার নাগালের বাইরে।

একমেবাদ্বিতীয়ম ‘সত্য’-কে হিংসার মাধ্যমে আধিপত্যকারী করার এই প্রবৃত্তি পার্টির বাইরের অন্যতর/ অপর/ ফারাকসম্পন্ন মতামতধারীদের শাসকশ্রেণির লেজুড় বলে আক্রমণ করা এবং পার্টির মধ্যের ভিন্নমতাবলম্বীদের সংশোধনবাদী/বিশ্বাসঘাতক/ পুঁজিবাদের-পথিক বলে আক্রমণ করার মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়। আর সামাজিক-রাজনৈতিক ক্ষমতাগ্রন্থি অর্থাৎ রাষ্টে্র অধিষ্ঠিত হলে তা যে কী ভয়ংকর রূপ ধারণ করতে পারে তা স্তালিনযুগের পুনঃপুনঃকৃত ‘পার্জ’, ‘গুলাগ’-এর বংশবিস্তার, ও হিংস্র সর্বাত্মকতাবাদী (totalitarian) রাষ্ট্রযন্ত্র নির্মাণের মধ্য দিয়ে আমরা দেখেছি।

প্রচলিত মার্কসবাদী মতবাদিক কাঠামো তাই পুঁজিবাদের বিকল্প সন্ধানকারী আন্দোলনের জন্য ক্ষতিকর ও পক্ষাঘাতজনক। এই মতবাদিক কাঠামো এবং তার সঙ্গে যে কোনো মতবাদিক কাঠামো পরিহার করেই পুঁজিবাদবিরোধী প্রতিরোধ ও বিকল্প সমাজ প্রতিষ্ঠার চর্চা করা কাম্য।

জামাই পল লাফার্গের কাছ থেকে তৎকালীন ফরাসি মার্কসবাদীদের কীর্তিকলাপের বিবরণ শুনে ত্রু্নদ্ধ মার্কস লাফার্গকে বলেছিলেন: “Je ne suis pas marxiste” (“আমি মার্কসবাদী নই”)। তিনি অবশ্য মান্য মার্কসবাদের এই মতবাদিক কাঠামো নির্মাণ ও হিংসাত্মক অনুশীলনের পাকাপোক্ত রূপটি দেখে যাননি। দেখলে যে কী বলতেন কে জানে! অবশ্য মার্কস যে সংশয়হীন নিশ্চয়তা অর্জনের জন্য মতবাদিক আবর্ত চক্র নির্মাণের পক্ষে ছিলেন না তার আঁচ তাঁর আরেকটি বিখ্যাত মন্তব্য থেকে পাওয়া যায়। তঁার মেয়ের দেওয়া একটি প্রচলিত রীতিসম্মত প্রশ্নাবলীর অন্তর্গত তঁার জীবনের মূলনীতি সম্পর্কে প্রশ্নের উত্তরে তিনি লিখেছিলেন: ‘De omnibus dubitandum’ (‘সবকিছুকেই সন্দেহ করতে হবে’)। তিনি নিজে যেভাবে তঁার নিজের লেখায় আমৃত্যু ধারাবাহিকভাবে পরিমার্জনা ও পরিবর্তন করে গেছেন, যার ফলে তঁার সিংহভাগ লেখাই তঁার মৃত্যুকালে অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি হিসেবে রয়ে গিয়েছিল, তাও তঁার সংশয়ী চর্চার একটা প্রমাণ বটে। সুতরাং মার্কসবাদের নির্মাতারা মার্কসের বহুবিধ বিচিত্র, এমনকি পরস্পরবিরোধী, ভাবনাচিন্তা থেকে নিজেদের প্রয়োজনমতো গুটিকয়কে চয়ন করে সেগুলোকে ‘বৈজ্ঞানিক সত্যের’ বিভূতিতে ভূষিত করে তঁাদের মতবাদিক কাঠামোর ভিত্তিমূলক স্বতঃসিদ্ধে পরিণত করার মধ্য দিয়ে মার্কসের খ্যাতিকে হয়ত বাড়িয়েছেন, কিন্তু তঁার মনোভাব ও চর্চাপদ্ধতিকে বিসর্জন দিয়েছেন। মার্কসবাদী মতবাদকাঠামোর ভিত্তিমূলক স্বতঃসিদ্ধগুলোকে সংশয়ের চোখে দেখা বা এমনকি বাতিল করার মধ্য দিয়ে তাই মোটেই মার্কসকে বিসর্জন দেওয়া হয়না, বরং তঁার সংশয়ী চর্চায় ফিরে গিয়ে হয়ত তঁার উপর মার্কসবাদীদের করা অবিচারের কিঞ্চিৎ সংশোধনের পথ খোলা যায়। প্রচলিত মার্কসবাদী মতবাদিক কাঠামো পুঁজিবাদের বিকল্প সন্ধানকারী আন্দোলনের জন্য ক্ষতিকর ও পক্ষাঘাতজনক হিসেবে পরিত্যাগ করলে তাই মার্কসকে পরিত্যাগ করা হয়না। মার্কসের পুঁজিবাদী রাজনৈতিক অর্থনীতির বিশ্লেষণের নানা দিক, পণ্যভক্তিবাদ (commodity fetishism), পরকীকরণ (alienation), এবং আরো অনেক কিছুই মতবাদহীন অনুশীলনের পথেও বিচার-গ্রহণ-পুনর্ভাবনার উৎস হিসেবে কাজ করে এসেছে এবং এখনও করবে। অবশ্য সেখানে মার্কস একা ‘সত্যের আবিষ্কারক’ বলে কোনো তুষারশৃঙ্গে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত (নাকি বরফে কবর দেওয়া!) নন, সেখানে তিনি অন্যতর ভাবনার, এমনকি বিরোধী ভাবনারও অনেক চিন্তক-অনুসন্ধানকারী যেমন তঁার সমকালীন নিৎশে (দ্বান্দ্বিক বিবর্তনবাদী দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনা এবং সমাজ ও ইতিহাস বিশ্লেষণে তার বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গি যাঁর চিন্তায় ধারালো রূপ ধারণ করেছিল), পরবর্তী প্রজন্মের হানা আরেন্ট (মতবাদিক কাঠামোর সমালোচনা এবং বিশ শতকে সর্বাত্মকতাবাদী রাজনীতি ও রাষ্ট্রের উদ্ভব ও বিস্তার বিশ্লেষণ যিনি করেছেন), তারও পরবর্তীকালের মিশেল ফুকো (সমাজে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীভূত বিস্তার, ক্ষমতার বিভিন্ন রূপ ও কাঠামো এবং প্রতিরোধের প্রশ্ন নিয়ে যিনি নতুনভাবে ভাবিয়েছেন), বা অন্য মহাদেশের গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথের (যাঁদের চিন্তায় ও কাজে ইউরোপীয় প্রগতির ধারণার সমালোচনা করে বিকল্প ভাবনা বিকাশ করা, সর্বজনের আত্মশক্তির বিকাশ ঘটিয়ে স্বতঃক্রিয়ার পরিসর উন্মুক্ত করা, বৈচিত্র্য-বহুত্বকে ধারণ করে অহিংসার পথে সমাজ গড়ে তোলা, বিকেন্দ্রীভূত প্রশাসনের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রকেন্দ্রিকতা পরিহারের মতো গুরুত্বপূর্ণ নানা দিক চর্চিত হয়েছে) মতো বহুজনের সঙ্গে বিরোধে-বিবাদে-বিনিময়ে জীবন্ত ও পরিবর্তমান।

 

 

 

0 Comments
Leave a reply