‘তা বাপ, তোর কানা বেগুন কত করে?’ সন্দীপ দু চারটে পাকা বেগুন ঝাঁকা থেকে তুলে নাড়াচাড়া করতে করতে জিজ্ঞেস করে।
গুফো বলে-‘৫০ টাকা কাকা।’
‘কী বলিস রে, কাল বৈকালে এখানে ৩০ টাকায় তো একজন টাটকা বেগুন বেচছিল।’
গুফো পকেটে হাত ঢুকিয়ে ১০ টাকা বার করে দেখায়- ‘এই টাকা তোমার কাছে রাখো। আমি বায়না করলুম। তুমি এক কেজি বেগুন ত্রিশ টাকায় পেলেও নেবে। শালা, মল্লিকপুরে একজন চাষী তিন বস্তা বেগুন নে এসেছিল। দুবস্তা খারাপ এক বস্তা ভালো। ভালোটা সাথে সাথে ৫৫ টাকায় পাইকিরি হলো। আমি বাকি দুবস্তা কানা বেগুন নিলুম বলে তোমায় দিচ্চি। মেলা ঝম্প কর না। মালায় ন'টায় ঢুকব। এখন নিলে নাও না নিলি সর। মাল ঘাটা ঘুঁটি করুনি।’
সন্দীপ মনে মনে ভাবে ঘরে কুনির ধরে বসানো ঘুনিতে চিংড়ি পড়েছে দেখে এয়েছে । আলু বেগুন আর চিংড়ি সাথে চালতার টকসী ডাল। দুপুরের খাওয়াটা হয়ে যাবে।
বিধান সকাল থেকে ভ্যান বার করেনি। গা ম্যাজ ম্যাজ করছে। কয়দিন রোয়ার কাজ করে কাল রাতে খুব মাল খাওয়া হয়েছে। আজ আর কিছু করবে না। ঘরে কচুর মুড়ো আছে। আলু দিয়ে আর কাঁকড়া কাল মাঠ থেকে ধরেছে… ঝাল ঝাল করে...
মেনা'কা গুফোর ভ্যানটা ধরে দাঁড়িয়ে বলে, ‘গুফো, তোর মাল নাড়াচাড়াই সার। কেউ নেবে নে। তুই কাট।’
মেনা'কা, মনেমনে ভাবে, যদি বেগুন গাছগুলো দাঁড়াত....
সন্দীপ তিনশ বেগুন নিয়ে ১৫ টাকা দেয়। একটা দশ টাকার কয়েন , দুটো দু টাকা একটা ছোট একটাকা।
গুফো এক টাকাটা ফেরত দিয়ে বলে ‘নুবুনি। চলবেনে।’
সন্দীপ বলে ‘আমি ত নিলুম।'
'তুমি নেছ তোমার কাছে রাখ।’
মুরগীর ব্যাপারী বিশ্বজিৎদা অনেকক্ষণ ধরে বেগুন নাড়াচাড়া করে নোব নাকি নোব না ভাবতে ভাবতে, দুশো বেগুন তোলে। দাঁড়িপাল্লায় তুলে দেখে একটা বেগুনে একটু পোকা বাইছে। বৌয়ের মুখটা মনে পড়ায় বলে, ‘নামা নামা।’
গুফো ওটা নামিয়ে যে বেগুনে একটা ফুটো সেটা তোলে। ‘এটা নও।’
বিশ্বজিৎ বলে, ‘তোর একটা বেগুনও ভালো নয় কেন বলত?’
গুফো বলে ‘হাটে যাও, ভাল বেগুন নে এস। গাড়ি ভাড়া দশ আর সত্তর টাকা কেজি। যাও।’
বিশ্বজিৎ চুপচাপ দুশো নিয়ে নেয়।
গুফো হাঁক মারে, ‘টমেটো নিলেনে।’ না, মনে মনে ভাবে, শালার পেনশনের ডি এ কত মাসের বকেয়া, ঘরে বেকার ছেলেটা আমাজনের ডেলিভারি বয়। আর টমেটো খায় না। ছোটটা তো আবার প্রেম-মাস্টার।
শুভেন্দু পাশে দাঁড়িয়ে বলে, ‘হ্যাঁগো ৪৫ হবে নে।’
গুফো চোখের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘তোমার দোকানের একটা গয়না আমায় ৫ টাকা কমে বেচ দেখি।’
শুভেন্দু বলে, ‘এস, কোন্টা নেবে দিচ্চি।’
সমীর আর ওর বৌ এসে দাঁড়ায়। দুজনে আর মেয়ে নিয়ে ডবকা সংসার। একটা কুমড়ো তুলে বলে, ‘কততে দিবি?’
‘৪০।’
‘কম নিবি নি?’
‘এক পয়সা না।’
‘ওজন কর।’
এক কেজি ওজন হয়, দাঁড়িপাল্লায় একটু টান থাকে। এক কেজি একশোর বাটখারা চাপানো। সন্দীপ হালকা করে একশটা সাইড করতেই, গুফো খেয়াল করে হাত বাড়িয়ে কেড়ে নেয়। সমীরের বৌ ৩৫ টাকা বাড়ায়। গুফো হাত বাড়ায় না। বলে ৪০-ই লাগবে। বিধান মনে মনে ভাবে: ভাতার কলকাতায় কাজে যায়, মাগ দোকান দিচ্ছে, তাও হাড়-কেপ্পনি গেলুনি।
গুফো ৪০ টাকা নিয়ে মালার দিকে প্যাডেলে পা রাখে। মনে হিসেব করে কাঁকরোল কাল থেকে বিক্রি হয়নি। ওটা ওদিকে ঝেড়ে দিতে হবে।
বেচুর আজ এখনো ভ্যানের ট্রিপ হয়নি। আকাশের মত দাড়িওলা বেচুরও মুখ গোমরা। ভাবে যে ছিপ ফেললেও দুটো মাছ পড়তো, সে হোক না মনোপিয়া। একটা পড়লেই হাফ করে কষে ঝাল। কিন্তু যদি ভ্যানের ট্রিপ মিস হয় সেই ভয়ে সঞ্জয়ের চা দোকানে শুকনো মুখে বসে থাকে। অবশ্যি আমতলার ওদিকে প্লাই কোম্পানি হওয়ার পর থেকে খালের জলে আর অত মাছ নেই। জল ভাঁটার সময় কালো। আগে কত চিংড়ি হতো আর ভেটকি। এবারে চিংড়ি দেখেছে, কিন্তু জল নামলেই ও আর থাকবে না। সে না থাকুক ভেটকিগুলো তো থাকবে।
দত্তদের গিন্নি পুকুরের ঘাটলায় হাঁটুর উপর সায়া তুলে পা ঘষতে ঘষতে দলুইপাড়ার কাজের মেয়েটাকে বলে, 'পিঠটা একটু সাবান দিয়ে ঘষে দে তো মা।' ডানহাত দিয়ে বাঁ বগলে ডাভ সাবান ঘষতে ঘষতে হাড়ের ডাক্তারের কথা মনে মনে ভাবে যে, এইতো হাত এতদূর আসছে। আর গজগজ করতে করতে গাল পাড়ে: শালা মিনসে গুলোর চুলকুনি গেলুনি, ধরে গুলি করে দিলেই ল্যাঠা চোকে, দুদিন ধরে বাস বন্ধ, কোথায় কোন মাগি মরেছে তার জন্য, কর্তাটা কলকাতায় সিকিউরিটির কাজেই যেতে পারছে না। নো ওয়ার্ক নো পেমেন্ট।
26 August, 2024
লেখার ধার বেরেছে অনেক। দেখার চোখ আগের চেয়ে অনেক উজ্জ্বল হয়েছে। লিখতে থাকুন।
30 August, 2024
বেশ লিখেছ। আমি নিজেও বছর কুড়ি ধরে আমাদের আকড়া ফটকের বাজারে যাচ্ছি। বেশ কিছু জেলে, ধরা-মাছবিক্রেতা, গ্রাম থেকে আসা সবজি-বিক্রেতার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছে। বেশ লাগে। তবে লিখতে পারি না।