মানী ক্রোধের পার্বণ

লিখেছেন:গুস্তাভো এস্তেভা, তর্জমা- বিপ্লব নায়ক
২০০৯ সালের এই সন্দর্ভে 'deprofessionalized intellectual' গুস্তাভো এস্তেভা জাপাতিস্তাদের সম্মেলনে দাঁড়িয়ে পুঁজিবাদের সংকট ও পুঁজিবাদ পেরিয়ে নতুন বিশ্ব গড়ার নিশানার নিয়ে আলোচনা করছেন...

২০০৯ সালের ৪ জানুয়ারী মেহিকোর চিয়াপাস-এর সান ক্রিস্তোবাল ডি লা কাসাস-এ জাপাতিস্তাদের উদ্যোগে ‘মানী ক্রোধের পার্বণ’ সংগঠিত হয়েছিল। সেই পার্বণে আরো অনেকের সঙ্গে আমিও আমন্ত্রিত হয়েছিলাম। সেখানে আমার অংশগ্রহণমূলক বক্তব্যের একটি সম্পাদিত রূপ এই অধ্যায়ে হাজির করছি।

পার্বণের পরিবেশ দেখে মনে হয়েছিল যে রাষ্ট্র বিষয়ক কিছু চিন্তাভাবনা, বিশেষত বিপ্লব সংগঠিত করার লক্ষ্যে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করার লেনিনিয় ঘরানা সম্পর্কে আমার সমালোচনা, উপস্থাপনা করার উপযুক্ত পরিসর এখানে রয়েছে; তছাড়া জাতি-রাষ্ট্রের মধ্যে গণতন্ত্র সংক্রান্ত প্রশ্নে আলোচনা করে, যাকে আমরা ‘আমূল গণতন্ত্র’ (radical democracy) বলতে চাইছি, সে অবধি আলোচনা প্রসারিত করারও উপযুক্ত পরিপ্রেক্ষিত রয়েছে যেহেতু জাপাতিস্তারা যা করছে তা এই আমূল গণতন্ত্রের ধারণাকেই মূর্তভাবে সুপ্রকাশ করছে বলে মনে হয়। আর এই সমস্তই ২০০৮-এ বিস্ফোরিত হওয়া বিশ্ব-সংকটের পটভূমিকায় হাজির করা হয়েছিল।

 এই অধ্যায়েও আমি জাপাতিস্তাদের সেই বিদ্রোহের শৈলীকেই ব্যাখ্যা করতে চাইছি যার জোরে তারা আমাদের মতো লাখ লাখ মানুষের ঘুম ভাঙিয়ে দিয়ে যুগান্তের সংকট মোকাবিলার উপযুক্ত প্রস্তুতি হয়ে উঠেছে। এই অধ্যায়ের মূল পাঠটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ‘সোশালিজম অ্যান্ড ডেমোক্রেসি’ পত্রিকার ভল্যুম ২৩, নাম্বার ৩, নভেম্বর ২০০৯ সংখ্যায় ‘অ্যানাদার পার্সপেকটিভ, অ্যানাদার ডেমোক্রেসি’ শিরোনামে, তারপর তা জাপাতিস্তা অটোনমি প্রজেক্টের দ্বারা একটি পুস্তিকা রূপে পুনঃপ্রকাশিত হয়েছিল।

 

আমাদের গায়ের চামড়ায় সঞ্চারিত ক্রোধ আমরা এই পার্বণে বয়ে এনেছি। জাপাতিস্তাদের বিরুদ্ধে, আদিবাসী লোকসমাজগুলোর বিরুদ্ধে, নারীদের বিরুদ্ধে, মানবাধিকার-রক্ষীদের বিরুদ্ধে হিংসা চলছেই অবিরাম। সেই অবিরাম হিংসার বিরুদ্ধে আমাদের এই ক্রোধ।... প্রতিক্রিয়ার বশে ধ্বংসাত্মক রোষের বিস্ফোরণ ঘটানো আমরা সমীচীন মনে করিনি, মরীয়া হয়ে ওঠা তো দূরের কথা। আমরা আমাদের ক্রোধকে সাহসে রূপান্তরিত করার চেষ্টা চালিয়ে গেছি আর পার্বণের মেজাজে উদযাপনের আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছি নতুন এক আশা নিয়ে, বশ্যতাস্বীকার ও পরাজয় প্রত্যাখ্যান করা বিদ্রোহ নিয়ে, মান-মর্যাদা যার অপর নাম সেই প্রত্যাশা নিয়ে, এমন এক স্বদেশ নিয়ে যা জাতীয়তাবাদ দ্বারা চিহ্নিত নয়, সেই রামধনু যা এক সেতুও বটে, সেই হৃদমর্মর যা কোন্ জাতের রক্ত তাতে বাসা বেঁধেছে তা আমল দেয় না, সমস্ত সীমানারেখা-রীতিরেওয়াজ-যুদ্ধবিগ্রহকে যা বিদ্রোহী তাচ্ছিল্যে পরিহাস করে থাকে...। (ই জেড এল এন ১৯৯৭, পৃঃ-১২৬)

পরিপ্রেক্ষিতের বিকৃতি

এক শতক ধরে আমূল সমাজ-পরিবর্তনে উৎসাহীরা অগ্রণী (vanguard)-র ধারণার উপর গড়ে তোলা এক রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত অবলম্বন করে রাষ্ট্রের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছে। লেনিনের সময় থেকেই ব্যাপকভাবে ধরে নেওয়া হয়েছে যে আলোকপ্রাপ্ত এক দল বিপ্লবী জনগণের জন্য ‘স্বর্গরাজ্য’-টির নকশা তৈরি করে জনগণকে নেতৃত্ব দিয়ে সেখানে পৌঁছে দেবে। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সংগ্রাম হয়ে উঠবে রাষ্ট্রকে দখল করার লক্ষ্যে রাষ্ট্রের জন্য সংগ্রাম। এই পরম্পরার মধ্যে বেড়ে উঠে আমরা ধরে নিয়েছিলাম যে রাষ্ট্র কেবলমাত্র এমনই এক যন্ত্র যাকে যা নির্দেশ দেওয়া হয় তা-ই করে। কে তাকে পরিচালনা করছে, তার উপর দাঁড়িয়েই কেবল রাষ্ট্র ফ্যাসিবাদী বা বিপ্লবী বা গণতান্ত্রিক হয়।

আজ আমাদের স্বীকার করতে হবে যে, সবচেয়ে হিংস্র একনায়কত্ব বা সবচেয়ে মার্জিত শুদ্ধতম গণতন্ত্র, যে রূপই জাতি-রাষ্ট্র ধারণ করুক না কেন, তা জনগণের উপর আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে জনগণকে পুঁজির সেবায় নিয়োজিত করারই একটি কাঠামো থেকে যায়। আধুনিক রাষ্ট্রই হল সমষ্টিগত পুঁজিপতির আদর্শ রূপ। এই চরিত্রবলে সবচেয়ে হাল আমলের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহে সাজানো হলেও তা একটি একনায়কত্ব রূপেই কাজ করে। সুতরাং, পুঁজি-বিরোধী সংগ্রামে প্রতিটি পদক্ষেপেই রাষ্ট্রকে প্রতিরোধ করতে হবে। এই একই বিচার থেকে, রাষ্ট্রকে দখল করা বা রাষ্ট্রের সঙ্গে সহযোগিতা করার যে কোনো প্রলোভনকে সংক্রামক মহামারী স্বরূপ এড়িয়ে যেতে হবে। সংগ্রামের বিজয়মুহূর্তে রাষ্ট্রের সঙ্গে সমস্ত সংযোগ ঝেড়ে ফেলে রাষ্ট্রীয় যন্ত্রটিকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করতে হবে।

ক্ষমতা দখল করার বামপন্থী বাতিক দুটি পথে আত্ম-ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়। প্রথম ও সবচেয়ে স্পষ্ট পথটি হল অপচারের পথ। এর ফলে ক্ষমতা হাতে এলেই নৈতিক সংবেদনশীলতা অন্তর্হিত হয়। সংগ্রামের সময়কার উচ্চ আদর্শগুলো ক্রমে দ্রবীভূত হয়ে মিলিয়ে যায়। ক্ষমতা-দখল লক্ষ্যপূরণের মাধ্যম না থেকে স্বয়ং লক্ষ্য হয়ে ওঠে। এই বিন্দুতে দাঁড়িয়ে, যে কোনো পথই ন্যায়সংগত বলে মনে হতে থাকে— বিশ্বাসভঙ্গ, দালালি-মোসায়েবি, কুকর্মের অংশ হওয়া, যে কোনো ধরনের অপরাধ, অসততা, অব্যাহতিই যুক্তির মুখোশ এঁটে গ্রহণীয় হয়ে ওঠে— সংক্ষেপে বললে, ন্যায়পরতার অভাব রূঢ় চূড়ান্ত রূপ ধারণ করে।

কিন্তু এর সঙ্গে আত্ম-ধ্বংসের আর এক ধরনের পথও আছে যা সচরাচর দৃষ্টির আড়ালে থেকে যায়। উপরের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে, কেবল তা-ই নয়, উপর থেকেই আমরা সবকিছু দেখছি বলে ভেবে নিয়ে আমরা আমাদের পরিপ্রেক্ষিত হারিয়ে ফেলি বা খুইয়ে বসি। রাষ্ট্রক্ষমতা করায়ত্ত করার আগ্রহ থেকে আমরা রাষ্ট্রের মতো চিন্তা করতে শুরু করি (স্কট ১৯৯৮)। রাজনৈতিক তত্ত্ব ও চর্চার এক দীর্ঘ পরম্পরা এই উপর থেকে দেখা-র সঙ্গে আমাদের অভ্যস্ত করে তুলেছে— যেনবা ইতিমধ্যেই আমরা ওই উপরে অবস্থান করছি— এবং রাষ্ট্রের মতো বিমূর্ত বস্তুকে তা প্রায় জাদুকরী ক্ষমতায় ভূষিত করেছে। জাঁকালো সব তত্ত্ব আর রাজকীয় সব পরিকল্পনার স্রোতে রাজনৈতিক কল্পনাকে ভাসিয়ে দিয়ে বাস্তব সম্পর্কে সব বোধ আমরা হারিয়ে ফেলি। সমাজ-রূপান্তরের কাজে দায়বদ্ধ বহু যোদ্ধাকর্মীই সমাজ বিষয়ক এমন এক সামগ্রিকতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গিকে তঁাদের কাজের ভিত্তি করেন, যার মধ্যে আদর্শ সমাজব্যবস্থার বর্ণনা এবং প্রত্যেকের জন্য অনুসরণীয় বিপ্লবী কর্মসূচীর সূত্রায়ণ থাকবেই থাকবে। কিন্তু রূপান্তরকারী ক্রিয়ার ওই রকম কোনো দৃষ্টিভঙ্গির উপর ভিত গাড়ার দরকার পড়ে না; বরং পক্ষান্তরে, সামগ্রিকতাবাদী বয়ানের পীড়নতন্ত্রের থেকে আমূল বিচ্ছেদ সূচিত করতে হবে আমাদের। ‘সামগ্রিক বিচারে’ সমাজ উদ্যোগ ও প্রক্রিয়ার এমন এক বহুত্ব প্রতিফলিত করে, যার বেশিরভাগটাই কোনো পূর্বাভাসের মধ্য দিয়ে ধরা যায় না (ফুকো ১৯৮০ দ্রষ্টব্য)। মার্কস যেমন পারি কম্যুন বিষয়ে বলেছিলেন,

জনগণের উপর ডিক্রি চাপিয়ে কোনো পূর্ব-প্রস্তুত স্বর্গরাজ্য সূচিত করার দায় শ্রমিকদের নেই। শ্রমিকরা জানে যে তাদের নিজেদের মুক্তি আনার জন্য... তাদের দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যেতে হবে... এমন কোনো পূর্ব-নির্দিষ্ট আদর্শকাঠামো নেই যা তাদের প্রতিষ্ঠা করতে হবে, বরং, পুরানো ভেঙে-পড়তে-থাকা বুর্জোয়া সমাজের গর্ভে নতুন সমাজের যে উপাদানগুলো দেখা দিয়েছে, সেগুলোকে মুক্ত করে বিকশিত হতে দেওয়ার পথ খুলে দেওয়াই তাদের কাজ। (মার্কস ১৯৭৮খ, ৬৩৩ পৃষ্ঠার পাদটীকা)

কে ক্ষমতায় আছে, বা, কী উপায়ে (নির্বাচনী পথে নাকি অন্য কোনো পথে) সেই বিশেষ ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা পার্টি ক্ষমতায় আরোহণ করেছে— তা আমাদের বিচার্য বস্তু নয়। জাতি-রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণের কাঠামো স্বরূপ ক্ষমতার খোদ প্রকৃতিই হল আমাদের বিচার্য বস্তু।

ফুকো পরামর্শ দিয়েছেন: ‘আমরা যেন ক্ষমতার প্রেমে না পড়ি’ (ফুকো ১৯৮৩, পৃঃ-xiii)। রাষ্ট্রকাঠামোর শীর্ষেই হোক, বা অজ কোনো গঞ্জে ক্ষুদ্রতম কোনো প্রশাসনিক পদে, ক্ষমতার স্বাদ পাওয়া মানুষরা কেমন যেন উন্মত্ত বিকারগ্রস্ত হয়ে ওঠে। একই রকম উন্মত্ত বিকার ভর করে তাদের উপর যারা ক্ষমতার জন্য লড়াই করে। কারণ, শেষাবধি, ক্ষমতা হল একটি সম্পর্ক; তা এমন কোনো বস্তু নয় যার বিতরণ সম্ভব, যা কারো অনেক আছে আর কারো নিতান্তই অভাব, যা জিতে নেওয়া যায় আর কোনো হাতিয়ারের মতো বিবিধ উদ্দেশ্যপূরণে ব্যবহার করা যায়। ক্ষমতা জাতি-রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণের এমন এক সম্পর্ক ফুটিয়ে তোলে যার পরিসরে আধিপত্যকারী কর্তা নিজ ইচ্ছা মতো উচ্চ আদর্শ থেকে নীচ প্রতারণা অবধি যে কোনো কিছু নির্বাহ করতে পারে। যেজন ক্ষমতা দখলের জন্য চেষ্টা করে চলে, আধিপত্যের জীবাণু তার দেহেও সংক্রামিত হয় এবং সে তার নিজের ঘনিষ্ঠ সহযোদ্ধাদের উপরই বিনা দ্বিধায় বিনা সংকোচে ক্ষমতা খাটিয়ে চলে, যেহেতু তঁার ‘মহান লক্ষ্য’ পূরণের জন্য কোনো পন্থাকেই তিনি অন্যায় বলে মনে করেন না এবং তঁার প্রতিদ্বন্দ্বীরা তো তঁার লক্ষ্য-অর্জনের পথে বাধা বৈ কিছু নয়।

এই কানাগলির মধ্যে ঢোকার পরিবর্তে বামপন্থীদের পরিচয়-নির্ধারক হওয়া উচিত এহেন সংগ্রাম যা এমন সামাজিক সম্পর্কের জন্ম দিতে পারে যেখানে ওইরকম ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত কারও কোনো স্থান নেই— এমন সব নতুন সামাজিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে যার মধ্যে ক্ষমতা কেবল সম্মানের স্বাধীন-স্বকীয় অভিব্যক্তি হিসেবেই অস্তিত্বশীল; আর তলা থেকে সাধারণ মানুষদের দ্বারাই গড়ে তোলা সেসব সম্পর্ক, উপর থেকে কোনো আলোকপ্রাপ্ত অগ্রণীর গড়া নয়। কিছু সমাজ-ব্যবস্থাপক তঁাদের নকশা করা স্বর্গে জনগণকে পথ দেখিয়ে পৌঁছে দেবে, এ এমন কোনো প্রকল্প নয়, বরং পুরোপুরিই তার বিপরীত: বাস্তবের সাধারণ পুরুষ ও মহিলাদের সৃজনক্ষমতার উপর এখানে পুরো আস্থা রাখতে হবে, কারণ, শেষ বিচারে, এই বাস্তবের সাধারণ পুরুষ ও মহিলারাই বিপ্লব সংগঠিত করে, নতুন বিশ্ব গড়ে তোলে।

অন্য গণতন্ত্র

পুঁজি-বিরোধী সংগ্রামে দৃঢ়তার সঙ্গে অন্য ধরনের গণতন্ত্র দাবি করা প্রয়োজন।

নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জন-অভিপ্রায় পূর্ণ ও স্বাধীন ভাবে প্রকাশিত হতে এবং শাসনের কাজে তা গ্রাহ্য হতে কী কী প্রণালী প্রয়োজনীয়, সেই বিষয়ের উপরই গণতন্ত্র নিয়ে বিতর্ক সাধারণত কেন্দ্রীভূত থাকে। ধরে নেওয়া হয় যে ‘প্রণালীগত না হলে গণতন্ত্র গণতন্ত্র-ই নয়’।

বাস্তব জগতে গণতন্ত্রের আদর্শরূপ ধাঁচাগুলো স্বনির্বাচিত সংখ্যালঘিষ্ঠের ক্ষমতাকেই চিরস্থায়ী করে, তাই সাধারণ চরিত্রে তারা অভিজাততান্ত্রিক। গণতন্ত্রে একটা ক্ষুদ্র সংখ্যালঘু অংশ অপর সবাইয়ের হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে: সর্বদাই জনগণের একটা ক্ষুদ্রতর অংশ, যা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভোটদাতাদেরও ক্ষুদ্রতর অংশই হয়ে থাকে, তারাই ঠিক করে দেয় কোন্ পার্টি শাসন-পরিচালনা করবে; আর তার থেকেও ক্ষুদ্রতর একটা অংশ আইন-প্রণয়ন ও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো নেওয়ার কাজ করে যেতে থাকে। ক্ষমতার কুরসিতে বসায় বদলাবদলি বা সাংবিধানিক বীক্ষা এ ব্যাপারে ইতরবিশেষ কোনো পার্থক্য ঘটাতে পারে না।

যাই হোক না কেন, গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থাগুলোয় সরকারগুলো যে অসূয়া, দুর্নীতি ও অসংবৃত অবস্থার পাকে বাঁধা পড়েছে (প্রজাদের মনে অনবরত যে ভয়-দুর্দশা-হতাশা-র ছুঁচ ফুটিয়ে চলেছে তার কথা যদি ধরা না-ও হয়), তা তার আধিপত্যকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর পুনর্বিচার অবশ্যপ্রয়োজনীয় করে তুলেছে, যদি না হাল আমলে ঘনিয়ে ওঠা নয়া ‘গণতান্ত্রিক মৌলবাদের’ (আরকিপিয়েলাগো ১৯৯৩) ফঁাদে আটকে পড়তে হয়। রাষ্ট্র পরিণত হয়েছে বিভিন্ন বাণিজ্যিক সঙ্ঘের পিণ্ডে, যার মধ্যে প্রতিটি বাণিজ্যিক সঙ্ঘই তার নিজের পণ্যটি বিক্রয়ের জন্য বিজ্ঞাপনে ও নিজ স্বার্থ চরিতার্থ করার প্রয়াসে মত্ত। এই পিণ্ড শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চাকরি প্রভৃতির আদলে ‘কল্যাণ’ বা ‘সমৃদ্ধি’ উৎপাদন করে। নির্ধারিত উপযুক্ত মুহূর্তগুলোয় রাজনৈতিক দলগুলো তাদের উপর বাজি ধরা লোকজনদের সবাইকে জড়ো করে একটি অধিকর্তামণ্ডলী নির্বাচন করিয়ে নেয়। এই বাজি ধরা লোকজনদের মধ্যে এখন কেবল (জাতীয় বা বহুজাতিক) বেসরকারি বাণিজ্য সংস্থাগুলোই নেই, তার সঙ্গে আছে এইসব বাণিজ্য সংস্থা ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন কাজে নিযুক্ত পেশাদারদের (যেমন, শিক্ষাকর্মী বা স্বাস্থ্যকর্মীদের) বড় বড় পেশাগত সমিতি, যারা তাদের নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে সেই ব্যবস্থাটিকেই আরো শক্তপোক্ত করে চলে যে ব্যবস্থা তাদের পদসম্মান ও উচ্চ-রোজগারের বন্দোবস্ত করার পাশাপাশি নিয়ন্ত্রণের বেড়িতেও বেঁধে রাখে (ইলিচ ১৯৭৩, পৃঃ-১০৯)।

গত কুড়ি বছরে আমরা, মেহিকোবাসীরা, প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হয়েছি, যা হতে অন্যান্য দেশের বাসিন্দাদের হয়ত বহু দশক, এমনকি বহু শতক কেটে গেছে। আমরা ইতিমধ্যেই জেনে গেছি ওই শাসনব্যবস্থার পক্ষে কী দেওয়া সম্ভব নয়। তাই এখন আমাদের প্রয়োজন সামাজিক জীবনকে এমনভাবে পুনর্গঠিত করে নেওয়া যাতে তা গণতন্ত্রের বিভ্রমগুলো এড়াতে পারে, আবার অত্যাচারী স্বেচ্ছাচার বা একনায়কতন্ত্রের নয়া রূপের খপ্পরে গিয়ে না পড়ে। কেবলমাত্র গণতন্ত্রের পক্ষাবলম্বী হওয়া এখন আর কোনো সুস্পষ্ট অর্থ বহন করে না: নানা বিবিধ অবস্থানের সঙ্গেই তা খাপ খেয়ে যেতে পারে। রাজনৈতিক শ্রেণিগুলো ও প্রচারমাধ্যম গণতন্ত্রের এমন এক ধারণাকে আঁকড়ে থাকে যা কেবল সরকারের উচ্চ মহলে কী চলছে তার মধ্যেই গণ্ডীবদ্ধ। বেশির ভাগ মেহিকোবাসীই এমত ধারণার মধ্যে কোনো আকর্ষণ খুঁজে পায়নি। জনগণের মধ্যের মানুষ যারা, তাদের কাছে গণতন্ত্রের মানে এই সাধারণ ধারণার মধ্যেই নিহিত যে সাধারণ মানুষজন নিজেদের জীবন নিজেরাই নিয়ন্ত্রণ করবে। তাদের চিন্তায় একগোছা প্রতিষ্ঠান গেঁথে নেই, বরং এক ঐতিহাসিক প্রকল্প আছে। কোনো এক নির্দিষ্ট চেহারার সরকারের কথা তারা ভাবছে না, বরং তারা ভাবিত সরকারের নীতি ও কাজ-কারবার নিয়ে, অর্থাৎ মূল বস্তুটিকে নিয়ে, জনগণের ক্ষমতা নিয়ে।

গণতন্ত্রের আচারসর্বস্ব ধারণার থেকে পৃথক করে গণতন্ত্রের এই ধারণাটিকে বোঝা দরকার। ‘জনগণের নিজের, জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য’ (‘of the people, by the people, for the people’) বলে সরকারের যে ধারণা, এ তার সঙ্গে এক নয়। ওই শব্দগুচ্ছের জন্ম আব্রাহাম লিনকনের যে গেটিসবার্গ বক্তৃতা থেকে, সেই বক্তৃতায় একবারও ‘গণতন্ত্র’ শব্দটি উচ্চারিত হয়নি। ওই বক্তৃতায় লিনকন সরকারী প্রতিষ্ঠানাদির এমন এক সমষ্টির কথা বলছিলেন যা নাকি জনগণকে ক্ষমতা দান করবে, এমন জনগণের কথা তিনি বলেননি যারা নিজেরাই ক্ষমতার অধিকারী। লিনকনের নিজের ভাবনায় যুক্তরাষ্ট্রটি কোনো গণতন্ত্র ছিল না। ‘এই পার্থক্যটি স্পষ্ট করার উদ্দেশ্যেই লিনকন তঁার এই বিখ্যাত উপমাটি হাজির করেছিলেন: সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাধীনতার সোনার আপেল নয়, বরং তা হলো সেই রুপোর কাঠামো যার দ্বারা (আশা করা যায় যে) আপেলটাকে রক্ষা করা যাবে’ (ডগলাস লুমিস ১৯৯৬, পৃঃ-২৪)।

তথাকথিত ‘প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র’ (‘direct democracy’)-র ধারণার সঙ্গেও আমাদের ধারণাটি এক নয়। ‘প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র’ অভিব্যক্তিটি এমন এক শাসনব্যবস্থার কথা বলতে চায় যা আধুনিক গণতন্ত্রের পূর্ববর্তী কোনো সময়পর্যায়ের দিকে ইশারা করে। প্রাচীন এথেন্স-য়ে তা হয়ত কার্যকরী ছিল, কিন্তু আধুনিক কোনো রাষ্ট্রে তার কার্যকরী হওয়া মুশকিল (মেয়ো ১৯৬০, পৃঃ-৫৮)। শেষত, আমাদের ধারণা গণভোট ও প্রত্যাহরণ (recall)-এর মতো আচারকে সম্বল করেই সন্তুষ্ট নয়, যেহেতু ওগুলো আচারসর্বস্ব গণতন্ত্রেরই কিছু পরিশিষ্ট অঙ্গপ্রত্যঙ্গ (ক্রোনিন ১৯৮৯)। আমাদের ধারণাটিকে কেউ কেউ ‘আমূল গণতন্ত্র’ (radical democracy) নাম দিয়েছেন। এই নাম যদিও মেহিকোতে খুব বেশি চালু হয়নি, তবু মেহিকোর জনগণের অভিজ্ঞতা ও ভাবনাচিন্তা-আলাপ-আলোচনা এই নামের মধ্য দিয়েই যথাযথ ভাবে প্রতিফলিত হয় বলে মনে হয়। যারা নিজেদের আমূল গণতন্ত্রী বলেন, তারা তাদের ভাবনাকে স্পষ্ট করেই সামনে এনেছেন:

গণতন্ত্র তার অত্যাবশ্যক অপরিহার্য রূপে যা, তার শিকড়মূলে যা, তা-ই হল আমূল গণতন্ত্র।... আমূল গণতন্ত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে অন্য যে কোনো শাসনব্যবস্থার যুক্তিক্রম হল সম্রাটের নতুন কাপড়চোপড়ের ভ্রমে মজে যাওয়ার সমগোত্রীয়। এমনকি নিজস্ব রাজনৈতিক স্মৃতি হারিয়ে বসা মানুষজনও... এখনও আবিষ্কার করে বসতে পারে যে ক্ষমতার প্রকৃত উৎস তারা নিজেরাই।... গণতন্ত্র হল... সেই মূল-শব্দ যা থেকে গোটা রাজনৈতিক শব্দভাণ্ডার তার শাখা-প্রশাখা বিস্তার করেছে।... আমূল গণতন্ত্র কল্পনা করে যে জনগণ তার জন-পরিসরে সমাবেশিত, তাদের মাথার উপর দেখভালকারী হিসেবে মহান পিতার মতো বিরাটবপু রাষ্ট্র নেই, মহতী মাতার মতো সমাজও নেই, মাথার উপর কেবল ফঁাকা আকাশ— বিরাটবপু অভিভাবকের ক্ষমতা আত্মসাৎ করে নিয়ে জনগণ আবার কথায়, কাজে ও বাছাই করে নেওয়ায় স্বাধীন হয়ে উঠেছে। (ডগলাস লুমিস ১৯৯৬, পৃঃ-২৪)

রাজনৈতিক তত্ত্বের ধারণাবিশেষ হিসেবে, আমূল গণতন্ত্র একই সঙ্গে সর্বত্র বিদ্যমান, আবার অদ্ভুতভাবে সর্বত্র অনুপস্থিত। তার সঙ্গে ছিনালি করা হয়, আবার তাকে এড়িয়েও যাওয়া হয়। মনে হয় যেন কেউই তার সঙ্গে গভীর সম্পর্ক পাততে প্রস্তুত নয়। যেনবা তা অতিরিক্ত মাত্রায় বৈপ্লবিক বা মায়াবী: সবাই যার খোঁজে মাতে অথচ কেউ তার সন্ধান পায় না। আধিপত্যকারী বাগ্মিতার পরিসরে এটা স্মরণে রাখা ভালো যে আমূল গণতন্ত্রের জন্য একমাত্র স্পষ্ট ইস্তাহার মার্কস-এর লেখাতেই পাওয়া যায়:

রাজতন্ত্রে সেই শাসনব্যবস্থার একটি বিশেষ অস্তিত্বপ্রণালী, অর্থাৎ রাজনৈতিক সংবিধানের অধীনে সমগ্র, অর্থাৎ গোটা জনসমষ্টি, ধৃত হয়। গণতন্ত্রে সংবিধান স্বয়ং কেবল একটি নির্ধারণ, অর্থাৎ, জনগণের আত্ম-নির্ধারণ রূপে আবির্ভূত হয়। রাজতন্ত্রে আমরা পাই সংবিধানের মানুষজন আর গণতন্ত্রে আমরা পাই মানুষজনের সংবিধান। সব সংবিধানের ধাঁধার সমাধান হল গণতন্ত্র। এই গণতন্ত্রে কেবলমাত্র পরোক্ষে বা অন্তর্বস্তুর বিচারে নয়, বরং বাস্তবে অস্তিত্বমান রূপে সংবিধানকে প্রতিনিয়ত তার প্রকৃত ভিত্তি, অর্থাৎ রক্ত-মাংসের মানুষ, রক্ত-মাংসের জনগণের কাছে ফিরিয়ে আনা হয় এবং তার মধ্য দিয়ে জনগণের নিজের সৃষ্টি হিসেবে তাকে প্রতিষ্ঠা করা হয়। (মার্কস ১৯৭৮ক, পৃঃ-২০, বিশেষ শব্দের উপর জোরগুলো মার্কসের নিজের দেওয়া)

ফ্রান্সের গৃহযুদ্ধ বইয়ে পারী কম্যুনের অভিজ্ঞতা বিচার করতে গিয়ে মার্কস স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করেছিলেন যে নেহাত রাষ্ট্রযন্ত্রটার দখল নিয়ে তাকে অন্য উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা কখনোই যথেষ্ট হতে পারে না, অবশ্যপ্রয়োজনীয় হল এই যন্ত্রটিকে ধ্বংস করা ও তার জায়গায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা, যে গণতন্ত্র প্রতিনিধিত্বমূলক ব্যবস্থার ব্যবহারিক বিকল্প হাজির করবে: ‘কম্যুন কোনো সংসদীয় নিকায় নয়, তার এমনই এক কার্যকরী নিকায় হয়ে ওঠার কথা ছিল যা একই সঙ্গে কার্যনির্বাহী ও আইন-প্রণয়নকারী’, তার সদস্য জনসেবকদের ‘নির্বাচিত, দায়িত্বসচেতন ও প্রত্যাহার-যোগ্য’ হওয়ার কথা ছিল। কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে কেবল ‘অল্পসংখ্যক কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কিছু দায়িত্বই’ ছাড়া থাকবে। মার্কসের কথা অনুযায়ী, সংগঠিত জনগণ সার্বজনীন ভোটাধিকার ব্যবহার করবে নিজস্ব জনসমাজগুলোকে গঠন করার জন্য, পৃথক রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করার জন্য নয়। এইভাবে গড়ে তোলা শাসনপ্রণালী ‘সমাজদেহে সেই সমস্ত বল আবার ফিরিয়ে দেবে যা সেই সমাজদেহের উপর পরোপজীবী শোষণ চালানো ও সমাজের মুক্ত গতিকে রুদ্ধ করে রাখা রাষ্ট্র এতদিন ধরে শুষে নিয়েছিল’ (মার্কস ১৯৭৮খ, পৃঃ-৬৩২–৪)।

আমূল গণতন্ত্র দাবি করে যে জনগণের ক্ষমতার মানে সত্যিসত্যিই জনগণের সেই ক্ষমতার চর্চা করা, কেবলমাত্র একটি সংবিধান প্রতিষ্ঠায় যৎসামান্য কিছু ভূমিকা নেওয়া নয়। ব্যাপারটা হল গণতান্ত্রিকভাবে জীবন যাপন করার—জনগণ নিজ ক্ষমতা চর্চা করতে পারে এমন রাজনৈতিক নিকায়সমূহের মধ্য দিয়ে প্রাত্যহিক যাপনে গণতন্ত্রকে বলবৎ করার। এর জন্য কোনো ধরাবাঁধা নিখুঁত ধাঁচা তৈরি করা নেই; আর, শতক পেরিয়ে গেল আমরা মতবাদিক কোন্দলে মজে থেকে এই নিয়ে ভাবনাচিন্তা পরিত্যাগ করে বসেছি। কিন্তু অনুসন্ধান করলেই আমরা বিবিধ শহুরে ও গ্রামীণ লোকসমাজ এবং রাষ্ট্রের প্রকৃতিবৈশিষ্ট্য বিষয়ক পুনর্সূত্রায়নের সন্ধান পেতে পারি। লোকসমাজ একটি বিকল্প হিসেবে হাজির হয় কারণ তা রাজনৈতিক চর্চায় ক্রিয়া ও স্থানের ঐক্যকে ফিরিয়ে আনতে পারে এবং জনগণও এমন একটা কাঠামো পেয়ে যায় যার মধ্যে সে নিজ ক্ষমতাকে রাষ্ট্রের হাতে সমর্পণ না করে নিজেরাই প্রয়োগ-চর্চা করতে পারে। আরো একবার তখন বোধ হতে থাকে যে কোনো এক প্রকার লোকসমাজ-ভিত্তিক যৌথ অধিকারের ব্যবস্থাই আমাদের ভবিষ্যৎ। এমনই লোকসমাজ-ভিত্তিক যৌথতার আকাঙ্ক্ষা থেকে সমাজতন্ত্র প্রাথমিক বেগ সঞ্চয় করেছিল, কিন্তু তা রাষ্ট্রীয়-সমবায়করণবাদ ও আমলাতন্ত্রে পরিণত হয়ে নিজেই নিজেকে ধ্বংস করেছে।

প্রকৃতপক্ষে, রাজনৈতিক চর্চায় ক্রিয়া ও স্থান গভীরভাবে আন্তর্সম্পর্কযুক্ত। স্থানের উপর জোর আসলে প্রত্যক্ষ অংশভাগী হওয়ার ক্রিয়ার পরিসরের সাধারণ বিষয়গুলোর ব্যবস্থাপনাকেই নির্দেশ করে। কোনো একটি স্থানের, কোনো একটি লোকসমাজের অংশভুক্ত না হওয়াই হল আধুনিক গণপিণ্ড সমাজগুলোর সাধারণীকৃত বৈশিষ্ট্য। এই গণপিণ্ডের মধ্যে ব্যক্তি নিজেকে কার্যকরী করার সক্ষমতা হারিয়ে ফেলে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে অভিপ্রায়পূর্ণ ভাবে সক্রিয় হওয়ার শক্তি হারিয়ে ফেলে। এই গণপিণ্ড সমাজকে ইংরেজিতে বলে ‘mass society’: ‘mass’ শব্দটি তার আপাত-বৈপ্লবিক হাবভাব সত্ত্বেও আসলে প্রাতিষ্ঠানিক গির্জা-সম্পর্কীয় ধ্যানধারণা ও তদনুসারী বুর্জোয়া উৎস থেকে আগত, তা মানুষকে সংখ্যা ও আয়তন দিয়ে মাপার যোগ্য হিসেবে জড়বস্তুর সমতুল করে বিবেচনা করে।

লোকসমাজের স্তরে গণতন্ত্রকে সুসংহত ও আরো গভীর করার পাশাপাশি দেশের রাজনৈতিক কাঠামো পুনর্গঠন করার জন্য বিচারবিভাগীয় ও সাংবিধানিক প্রক্রিয়াগুলোকেও পুনর্বিচার করা প্রয়োজন। দেশের রাজনৈতিক কাঠামো তিনটি শর্তের অধীন হওয়া দরকার:

  • তার ভিত প্রতিষ্ঠিত হতে হবে জনগণের ক্ষমতার উপর এবং মৌলিক বহুত্ববাদকে স্বীকৃতি দেওয়া সামাজিক চুক্তির উপর;
  • ‘মেনে চলার মধ্য দিয়ে নেতৃত্ব দেওয়া’-র নীতি সমস্ত ক্ষমতাবলয়ে প্রযুক্ত হতে হবে; এবং
  • প্রতিনিধিত্বমূলক ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে নির্বাহিত পরিষেবা সংগঠন ও সমন্বয়ের ক্ষেত্র ও পরিসর যতটুকু না হলেই নয় ততটুকুতে কমিয়ে আনতে হবে, যেসব ক্ষেত্রে তখনও প্রতিনিধিত্বমূলক ব্যবস্থা থাকবে সেই সব ক্ষেত্রেই সুস্পষ্টভাবে নির্দিষ্ট গণ্ডী ও নিবিড় সতর্কদৃষ্টির অধীনে কাজ করতে হবে। (সমাজ-সংগঠনে, পার্টির মধ্যে বা সরকারে প্রতিনিধিত্বমূলকতার নীতি অবধারিতভাবে গোষ্ঠীর সবার হাত থেকে প্রতিনিধির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরিত করে দেয়, প্রতিনিধিকে নিজ ইচ্ছা মতো প্রয়োগ-চর্চা করার ছাড়পত্র দিয়ে দেয়, এমনকি নিয়মিত কৈফিয়ত দেওয়ার ব্যবস্থা বা প্রত্যাহৃত হওয়ার সম্ভাবনাও এতে খুবকিছু হেরফের ঘটাতে পারে না।)

সামাজিক আন্দোলনের কোনো কার্যকরী গ্রন্থনা যদি বৈধ প্রক্রিয়াসমূহ ও রাজনৈতিক বল উভয়কেই ব্যবহার করে চলে, তাহলে তা জনগণের ক্ষমতাকে ধর্তব্যের মধ্যে নিয়ে আসতে পারে। প্রতিনিধিত্বের ফঁাসে জনগণের ক্ষমতাকে বিসর্জন দেওয়ার বদলে সেই ক্ষমতার পরিসরকে আরো বিস্তৃত করে প্রয়োগে নিয়ে আসার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের ক্ষমতাকে তা ক্রমশ সংকুচিত করতে করতে যেতে পারে।

আমার মনে হয় যে জাতীয় রাজনীতির মঞ্চে জাপাতিস্তাদের হাজির করা স্বশাসনের জন্য সংগ্রামের মধ্য দিয়ে উপরোক্ত সমস্ত কিছুই ক্রমশ রূপ ধারণ করছে: ‘আমরা যে আদিবাসী জনগণ, সেই হিসেবে আমরা স্বশাসনের মধ্য দিয়ে নিজেরা নিজেদের পরিচালনা করার উপর জোর দিচ্ছি, কারণ আমরা আর যে কোনো জাতীয় বা বিদেশী ক্ষমতার অভিলাষের বশবর্তী হয়ে থাকতে চাই না।... ন্যায়বিচার সংগঠিত হতে হবে স্বয়ং জনসমাজের নিজের দ্বারাই, নিজেদের প্রথা ও পরম্পরা মেনে, অবৈধ ও দূষিত সরকারগুলোর কোনো হস্তক্ষেপ ব্যতিরেকেই’ (অটোনোমিডিয়া ১৯৯৫, পৃঃ- ২৯৭)। এইভাবেই জনসমাজগুলো সেই দ্বৈত-সমস্যার মোকাবিলা করছে, যার একদিকে রয়েছে নিজস্ব পরিসরে নিজেদের সংগঠিত করা, অন্যদিকে রয়েছে অপর কারো উপর নিজেদের রাজনৈতিক শৈলী চাপিয়ে দেওয়া ছাড়াই তা গোটা সমাজের সামনে হাজির করা।

এই স্বশাসনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক পার্টিগুলোর প্রতিক্রিয়া খুব স্বাভাবিক খাত বেয়েই চলেছে। এই স্বশাসনের জন্য সংগ্রাম মেহিকোর আধিপত্যকারী শাসনব্যবস্থার সামনে অস্তিত্বনাশের আশঙ্কা হাজির করে দিয়েছে। তার প্রতিক্রিয়ায় যা যা দোষারোপ করা হয়েছে এই সংগ্রামের উপর— যেমন, এই সংগ্রামের মধ্যে নাকি বিচ্ছিন্নতাবাদ ও মৌলবাদের উপাদান রয়েছে, এই সংগ্রাম নাকি দেশটাকে টুকরো টুকরো করে ফেলার সমর্থক, এই সংগ্রাম নাকি পিতৃতান্ত্রিক জাতপাত ও জাত-শাসন প্রতিষ্ঠা করতে চায়— তা সবই মিথ্যা। ইন্ডিয়ান জনজাতিগুলোর স্বশাসন ও সাংস্কৃতিক আত্মনির্ধারণকে মান্যতাদান— সান আনদ্রেজ চুক্তিতে যা স্পষ্টভাবে বিধৃত হয়েছিল— তা আসলে সেই প্রক্রিয়াটিকেই প্রশ্নের মুখে দাঁড় করায় যে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে মেহিকো বিপ্লবের উত্তরাধিকার হিসেবে প্রাপ্ত সামাজিক চুক্তি-বোঝাপড়াকে সাম্প্রতিক দশকগুলোয় ধীরে ধীরে বিসর্জন দিতে দিতে যাওয়া হয়েছে। তার বদলে একটি নতুন চুক্তি-বোঝাপড়াই দাবি করছে এই সংগ্রাম। সমাজজীবনের অন্তর্বস্তুকে বদলে দেওয়ার মধ্য দিয়ে এই মহাদেশের চরিত্রটিকেও অবধারিতভাবে বদলে দিতে চাইছে এই সংগ্রাম: এই মহাদেশ আর জাতি-রাষ্ট্রের আদল ধরে থাকবে না, নতুন অর্থ ও তাৎপর্য ধারণ করে জাতি আরো বেশি ঐক্যসম্পন্ন হবে। আকার সর্বদাই অন্তর্বস্তুও বটে। গণতন্ত্রকে কখনোই অগণতান্ত্রিক উপাদানে ঠাসা একটি নির্দিষ্ট আকারে পর্যবসিত করা যায় না, আকারের মতো তার অন্তর্বস্তুকেও একইসঙ্গে গণতান্ত্রিক হতে হয়।

রাষ্ট্রক্ষমতার বিপরীতে একটি ভারসাম্য রক্ষাকারী ওজন হিসেবে এই স্বশাসনের ব্যবস্থা রূপগ্রহণ করছে না, তা বরং রাষ্ট্রক্ষমতাকে নিষ্প্রয়োজন করে দিচ্ছে। এইখানেই ইউরোপীয় স্বশাসনবাদী (autonomist) পরম্পরার সঙ্গে তার পার্থক্য, কারণ ইউরোপীয় স্বশাসনবাদী পরম্পরা রাষ্ট্রের বর্তমান কাঠামোর মধ্যেই স্বশাসনকে রাজনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণের প্রক্রিয়ার একটি অংশ হিসেবে হাজির করে। স্বশাসনের আকারসর্বস্ব প্রস্তাবনায়, ‘স্বশাসন’ বা ‘স্বায়ত্তশাসন’ হল নেহাতই ‘রাষ্ট্রের সংগঠনকে রূপদানকারী উল্লম্বভাবে বিন্যস্ত ক্ষমতা ব্যবস্থার একটি অংশ স্বরূপ বিশেষ শাসনপ্রণালী’ (দিয়াজ পোলানকো ১৯৯৬, পৃঃ-১০৯)। এহেন ‘স্বশাসন’ ইতিহাসে রাষ্ট্রব্যবস্থার অধীনেই জনগণকে সম্পূর্ণভাবে নিমজ্জিত রাখার কাজ করে এসেছে। তেমন ‘স্বশাসন’ অর্জন আসলে জয়ের ছলে পরাজয়েরই নামান্তর: কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রের দ্বারা অনুমোদিত ‘স্বশাসিত’ প্রতিষ্ঠানাদির দ্বারা কোনো এক প্রশাসনিক এলাকার উপর এক্তিয়ার প্রাপ্তির বিনিময়ে সেই কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রের কাঠামোটিই আরো শক্তপোক্ত হয়ে ওঠে এবং জনগণের নিজস্ব শাসনপ্রণালীগুলোর মধ্যে বিনাশের বীজ বুনে দিতে দিতে যায়। আচারসর্বস্ব গণতন্ত্রের পানে আধো আধো কয়েক পা এগোনোর বিনিময়ে আমূল গণতন্ত্রের দিকে যাওয়ার সমস্ত সম্ভাবনাই হতাশায় ডুবে যায়।

এর উল্টোদিকে, স্বশাসনের স্বাধীন সত্তামূলক ভাবনায়, আমূল গণতন্ত্র বা জনগণের ক্ষমতা ও স্বশাসন অভিন্ন। এর মধ্য দিয়েই হেগেল-এর সেই প্রবাদে পরিণত হওয়া উক্তিকে আমরা অবশেষে চিরবিদায় জানাতে পারি, যে উক্তি ১৮২০ সালের পর থেকে গণতন্ত্র নিয়ে যে কোনো বিতর্কে রাজ করে এসেছে, উক্তিটি হল: ‘জনগণ নিজেই নিজেকে শাসন করতে অক্ষম'। জাপাতিস্তা লোকসমাজগুলো নিরন্তর এর বিপরীতটাই প্রমাণ করে চলেছে।

সংকটে ভিন্ন প্রতিক্রিয়া

বর্তমান (২০০৮ সালে ফেটে পড়া) সংকটের ভিন্নতর উপলব্ধি এবং ভিন্নতর উপায়ে তাতে প্রতিক্রিয়াদান এখন প্রয়োজন। আমরা এখন এক ঐতিহাসিক যুগপর্যায়ের শেষলগ্নে আছি--- এ ব্যাপারে প্রায় সবাই একমত, কিন্তু এই পর্যায়ের চরিত্রনির্ণয় করতে গিয়েই এই ঐক্যমত্য আর অটুট থাকে না।

  • কেউ কেউ বাস্তবের থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিজেদের মতবাদের মধ্যে আশ্রয় নিয়ে দাবি করতে থাকে যে এ নেহাতই আরেকটি অর্থনৈতিক নিম্নঝাঁপ, অচিরেই যা ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণ দিয়ে প্রতিস্থাপিত হবে।
  • কেউ আবার সংকটের জন্য আর্থিক ফাটকাবাজদের লোভ ও ঔদ্ধত্যকে দোষ দেয় এবং ভাবে যে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রক ভূমিকা পুনর্বহাল করে কেইনসিয় প্রতিবিধান লাগু করতে পারলেই পুঁজিবাদী স্বাভাবিকতা ফিরে আসবে।
  • আবার অনেকে বিশ্বাস করে যে ‘ওয়াশিংটন মতৈক্য’ নামে খ্যাত নয়াউদারনৈতিক নীতিসমূহের দিন শেষ। এই মতাবলম্বীদের কিছুজন সম্প্রতি সান সাল্ভাদোর-য়ে নয়াউদারনৈতিক নীতিসমূহের একটি অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া আয়োজন করেছিলেন। কিন্তু সেইসব শ্রাদ্ধকারীদেরও অধিকাংশের কাছে এর তাৎপর্য কেবল বাজার ও রাষ্ট্রের ভূমিকার সামান্যকিছু রদবদলেই সীমাবদ্ধ, বড়সড় কোনও দিশাবদলের প্রয়োজন তাঁদের ভাবনায় নেই।
  • কেউ আবার মনে করেন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানে বড়সড় বদল ঘটে গেছে; ওয়াল স্ট্রিট আর বিশ্বের আর্থিক কেন্দ্র নেই; কিন্তু এখনও তাদের আধিপত্যকামী উচ্চাশা তারা ত্যাগ করেনি, তাদের সাম্রাজ্যের ভেঙেপড়া তাই নানা টানাপোড়েন ও অযৌক্তিকতার মধ্য দিয়ে এগোবে।

আজকের সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে আজকের রাজনৈতিক নেতাসকল ও বিশেষজ্ঞদের হাবভাবের প্রদর্শনী দেখে কখনো কখনো তাঁদের মাথাকাটা মুরগিছানা বলে ভ্রম হয়। ২০০৮ সালের ১৫ই ডিসেম্বর জার্মান অর্থনীতিবিদ ক্লাউস যিম্মেরমান বিশেষজ্ঞ রূপে পূর্বাভাস ঘোষণা ও প্রস্তাব বর্ষণের মধ্য দিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি করে যাওয়ার জন্য তাঁর সহকর্মীদের তিরস্কার করেছিলেন । তাঁর মনে হয়েছিল যে তাঁর সহকর্মীরা সব প্রতারকের মত কাজ করছে কারণ তাদের বিশ্লেষণ ও পূর্বাভাস-নির্মাণে ব্যবহৃত মডেলগুলোর কোনোটাতেই বর্তমানের আর্থিক সংকটের মতো কিছুর সংস্থান নেই।

তাঁরা বুঝতে পারছেন যে পরিস্থিতি উদ্বেগজনক, কিন্তু তার গভীরতা ধরতে পারছেন না, প্রতিবিধানের কথা ভাবা তো দূরের কথা। যেমন ধরা যাক, যাঁরা সংশয়াতীতভাবে নিশ্চিত যে রাষ্ট্রের উচিত অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করা, তাঁরা বোধহয় পুঁজিবাদী সমাজে রাষ্ট্র এতদিন কী ভূমিকা পালন করে এসেছে তা ভুলে বসেছেন আর রাষ্ট্রের বর্তমান অবক্ষয়ের গভীরতা সম্পর্কেও ওয়াকিবহাল নন। অত্যধিক বিনিয়ন্ত্রণের ঠিক পরেপরেই আবার নিয়ন্ত্রণ আরোপের ঢেউ ওঠে। জর্জ সোরস যেমন বলেছেন, ‘নিয়ন্ত্রণবিধি বাজারের কলকব্জার থেকেও ত্রুটিপূর্ণ হতে পারে।… নিয়ন্ত্রকরা যে মনুষ্যজীব, কেবল তাই নয়, তারা নিরন্তর লবিবাজি ও দুর্নীতির পাকে বাঁধা আমলাকুলও বটে।’ (সোরস ২০০৮, পৃঃ-৬৫) মুক্ত বাণিজ্যের কথা তো সবাই জানে--- তার নাম করে সমস্ত ধরনের অন্যায়-অত্যাচার চালানো হয়েছে। কিন্তু তার প্রতিক্রিয়ায় নীতির দোলকটিকে এখন সংরক্ষণবাদের (বা নিয়ন্ত্রণবাদের) দিকে ঠেলে দেওয়ার বাই উঠেছে, তা যে জনগণকে কখনোই কোনোভাবে রক্ষা করতে পারে না সে কথাটা বেমালুম চেপে গিয়ে। শেষ অবধি, একদল আমাদের বাজারের উপর আস্থা রাখার পরামর্শ দেন, আর অন্য দল বলেন যে সেই আমলাকুলের উপরই আমাদের ভরসা করতে হবে যারা পুঁজির আড়কাঠি ছাড়া আর কিছুই নয়!

১৯২৯ সালের সংকটের পর অর্থনৈতিক চক্রের ক্রমাগত বেড়ে চলা যন্ত্রণাময় ও ব্যাঘাতজনক প্রভাব প্রশমিত করার জন্য সমস্ত সরকার ও আন্তর্জাতিক আর্থিক সংগঠনগুলো জন মায়নারদ কেইনস-এর প্রভাবে সরকারি নিয়ন্ত্রণ কায়েম করার পথ নিয়েছিল। সমস্যা সমাধান করার বদলে তা সমস্যাকে আরও পাকিয়ে তুলেছিল। সরকারগুলোর নেওয়া প্রশমনকারী ব্যবস্থাগুলো চক্রাবর্ত বলগুলোকে কেবলমাত্র কিছুটা সংযত ও লুক্কায়িত করতে পারে, শেষ করে দিতে পারে না। যদিও এর মধ্য দিয়ে যে অভূতপূর্ব হারে অর্থনৈতিক বৃদ্ধি সম্ভব হয়েছিল, তা এযাবৎ অর্থনৈতিক তত্ত্বে অজানা সম্পূর্ণ অভিনব এক ঘটনা ঘটাল: অর্থনৈতিক কার্যক্রম স্ফীত হয়ে এমন বিপুল এক মাত্রা ধারণ করল যাকে নিয়ন্ত্রণ করা আর মানুষের পক্ষে সম্ভবপর রইল না। কেইনস স্বয়ং হয়ত এ কথা আগে থাকতেই আঁচ করেছিলেন ‘যখন ১৯৩০ সালে তিনি লিখেছিলেন যে ১৯৫৫ সালের মধ্যে পৃথিবীর অধিকাংশ কোষাগার তাঁর বাতলানো নীতি গ্রহণ করবে, কিন্তু তখন সেই সব নীতি কেবলমাত্র বাতিলযোগ্য নয়, বিপদজনকও হয়ে উঠবে। তাঁর তত্ত্বের উপর ভিত্তি করা নীতিগুলো যেভাবে আরও সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক মন্দাগুলো নিবারণ করতে ব্যর্থ হয়েছে, তার মধ্য দিয়ে তাঁর দূরদৃষ্টি ও নিরাশা দুটোই যথার্থ প্রমাণিত হয়েছে।’ (কোহর ১৯৯২, পৃঃ- ১০)

নয়া উদারনৈতিক বিশ্বায়নের যুগ বলে পরিচিত গত কুড়ি বছরের দায়িত্বহীন লোভ ও ঔদ্ধত্য আজ আমাদের একটা কানাগলির মধ্যে এনে দাঁড় করিয়েছে। আসলে, পুঁজিবাদের বর্তমান ভাঙন যত না তার কাঠামোগত দ্বন্দ্বের ফল, তার চেয়ে বেশি হল মুক্ত-বাজারী মৌলবাদ ও বড় পুঁজির উচ্চাশার ঘাতক মিশ্রণের ফলে উপজাত এক প্রকার আত্মঘাত। ওয়ালেরস্তেইন বারংবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে পুঁজিবাদ তার অন্তিম পর্বে আগত হলেও এই অন্তিম পর্ব বহু দশক জুড়ে প্রলম্বিত হতে পারে। ঠাণ্ডা যুদ্ধের অবসানে পুঁজির দায়িত্বহীন মত্ততা ও পৃথিবী জুড়ে জনগণের বিদ্রোহ সংযুক্তভাবে এই ভাঙনের প্রক্রিয়াকে আরো ত্বরান্বিত করেছে বলে মনে হয়। অন্যকিছুর থেকে আরো বেশি করে আগ্রাসী উদারনৈতিক ঔদ্ধত্যই সর্বত্র অসন্তুষ্টদের বাহিনী তৈরি করে চলেছে, যারা নিছক টিকে থাকার জন্য বা আপন স্বার্থরক্ষার জন্য বা পুরানো আদর্শের নামে যুঝে যাওয়ার মাধ্যমে বর্তমান সংকটের মূল কারণ হয়ে উঠেছে।

বাজারকে বশে আনতে চাওয়া সরকারি বিধিব্যবস্থাগুলো তাদের সাফল্যের জন্য দুটি শর্তের উপর নির্ভর করে, সেই শর্ত দুটো হল সম্পূর্ণ দৃশ্যমানতা এবং ভ্রান্তির অবকাশ।

  • প্রথম শর্তটা সাধারণ অনুমান সাপেক্ষ। যাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাওয়া হচ্ছে, তাকে সম্পূর্ণত আগা থেকে গোড়া স্পষ্টভাবে দেখতে পাওয়া চাই। কিন্তু এখন তা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। গত কুড়ি বছরে সৃষ্ট আর্থিক হাতিয়ারগুলোর নাছোড় রহস্যই দেখিয়ে দেয় যে সব সরকারের (একা বা একজোটে) এবং আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোর নজরসীমার বাইরে কাজ করা বিশ্বায়িত অর্থনৈতিক কার্যক্রমগুলো সম্পূর্ণ দৃশ্যমান হতে পারে না। এমনকি প্রয়োজনীয় প্রবর্তক ব্যবস্থা তৈরি করা হলেও কোথায় কী উদ্দেশ্যে তার প্রয়োগ করতে হবে তা বোঝা অসম্ভব।
  • দ্বিতীয় শর্তটা হিসাবে ভুলচুক হয়ে যাওয়ার পরিমাণকে অনুমোদনযোগ্য মাত্রার মধ্যে বেঁধে রাখার পূর্বনির্দিষ্ট ব্যবস্থা করার কথা বলে। সরকারি নিয়ন্ত্রণ কায়েমের পরীক্ষানিরীক্ষার প্রথম ২৫ বছর যাবৎ কালে তবু ভুলচুকের মাত্রা বাঁধার অবকাশ ছিল যেহেতু বিষয়আশয়ের আয়তন যৌক্তিক সীমার মধ্যেই ছিল। কিন্তু অর্থনীতি যত আয়তনে বাড়তে থাকল, এই অবকাশ ততই কমে আসতে থাকল। মঙ্গলগ্রহকে লক্ষ্য করে মহাকাশযান ছোঁড়ায় সামান্যতম বিচ্যুতিও তাকে মহাকাশের অপার শূন্যে নিয়ে গিয়ে ফেলতে পারে। বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটও ফাটকাবাজকুল ও সরকার উভয়ের হিসাবেই কিছু ভুলের কারণে ঘনিয়ে উঠেছে। নয়া আর্থিক ব্যবস্থাপনায় ‘পুঁজির প্রয়োজন ও পুঁজির প্রান্তসীমার হিসেব কষা যদি বা অসম্ভব নাও হয়, অত্যন্ত কঠিন তো বটেই’ (সোরস ২০০৮, পৃঃ- ৬৫)।

কিছুকাল আগে, সামাজিক রূপতত্ত্বের জনক এবং সুমাখারের গুরু লিওপোলড কোহর বলেছিলেন:

দোলন-অস্থিরতাগুলো আর স্বয়ং ব্যবস্থার  কারণে ঘটছে না, বরং হাল আমলে অর্থনৈতিক কার্যক্রম যে মাত্রা  ধারণ করেছে তার কারণে ঘটছে। পুঁজিবাদ আর হিসেবের গণ্ডীর মধ্যে নেই। কোনও ভারী পরমাণুর ভর হোক, বা অট্টালিকা, বাজার বা রাষ্ট্রের ভর হোক, তা মাত্রাতিরিক্ত বড় হয়ে ওঠার মধ্যে নিহিত যে ক্রমিক প্রতিবর্ত ক্রিয়ার মতো অস্থিতিশীলতা, তার কারণেই সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো বিপুল তোলপাড় হচ্ছে। এগুলো আর এখন বাণিজ্যচক্রের  বিষয় নয়, বরং এদের মাত্রা বা আয়তন জনীত চক্র  বলা যায়। কোনও বিশেষ অর্থনৈতিক প্রণালী থেকে এগুলো তাদের দোলন-বিস্তার পায় না, পায় সেই রাষ্ট্রের আয়তন থেকে যার মধ্য দিয়ে তারা বিচরণ করছে। সরকারি নিয়ন্ত্রণের দ্বারা ঘটানো অর্থনৈতিক সংযুক্তি, বৃদ্ধি ও সম্প্রসারণের মাধ্যমে আগেকার বাণিজ্যচক্রগুলো প্রশমিত হত, কিন্তু এখনকার আয়তনচক্রগুলো আরও ফুলে-ফেঁপে ওঠে। (কোহর ১৯৯২, পৃঃ- ১১। শব্দের উপর জোর মূল লেখকের। আরও দ্রষ্টব্য ১৯৮৬, পৃঃ-১৪৭-র পাদটীকা)

বর্তমান বিশৃংখলার মুখে দাঁড়িয়েও বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যের সরকারি ও বেসরকারি নেতারা তাদের মতবাদিক অহমিকার কারণে ঘটমানকে বুঝতে অপারগ আর সেই অহমিকাই তাদের চালিত করে সপ্রতিবন্ধ প্রতিবর্ত ক্রিয়ায় এমন সব মরীয়া পদক্ষেপ নিয়ে যেতে যা পরিস্থিতিকে ক্রমশ আরও খারাপ করে তোলে। কোনো একটি দেশ পারিস্থিতির উপর নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে আনতে অপারগ দেখে তারা এই বিভ্রমকে আঁকড়ে ধরে যে বড় বড় অর্থনৈতিক শক্তিগুলো সম্মিলিতভাবে উপযুক্ত পদক্ষেপগুলো নিতে পারবে। ২০০৮ সালের নভেম্বরে এই আশা নিয়েই ওয়াশিংটনে সভায় বসে তারা ব্যর্থ হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও প্রতিবার ব্যর্থ হবে। যত বড় মাপের পদক্ষেপ নেওয়ার পরিকল্পনা তারা করবে, ততোই বিপর্যয় তারা ডেকে আনবে।

লিওপোলড কোহর স্পষ্ট প্রমাণ হাজির করেছেন যে কেইনসের ভবিষ্যতবাণী সঠিক প্রমাণ করে তাঁর নাম করে লাগু করা নীতিগুলো যে সমস্যার সমাধানকল্পে নিয়োজিত সেই সমস্যাগুলোকেই আরো বাড়িয়ে চলেছে। কিন্তু যেনবা আগের কোনো অভিজ্ঞতাই জানা নেই এমনই যান্ত্রিকভাবে সেই নীতিগুলোকেই পুনর্বার প্রয়োগ করা হয়ে চলেছে। পুঁজিবাদী সম্প্রসারণের একটি নতুন চক্রের উদ্বোধনের তাত্ত্বিক সম্ভাবনা রাজনৈতিক কারণেই প্রায় শূন্য কারণ তার জন্য যা দরকার--- সিদ্ধান্তগ্রহণের রাজনৈতিক ক্ষেত্রগুলোকে বর্তমান রাষ্ট্রের  অতিমানবিক অতিকায় মাপ থেকে কমিয়ে আবার মানবিক মাপে নামিয়ে আনা--- তা করার ক্ষমতা বর্তমান ক্ষমতাকাঠামোর নেই। বিনিয়োগের সুযোগ পুনর্প্রতিষ্ঠিত করতে পারে এমন বিপুল হারে পুঁজির ধ্বংস হতে দেওয়ার বদলে তারা লাটে-ওঠা বাণিজ্যসংস্থা ও পতনোন্মুখ ব্যাঙ্কগুলোকে ঠেস দিয়ে খাড়া করার জন্য বিপুল ভর্তুকি দিয়ে যাবে। তারা মজুরী-বৃদ্ধিকে পিছনে টেনে রাখবে এবং কেইনসীয় পদ্ধতি আবাহন করে কর্মসংস্থানের বাজার তেজী করার চেষ্টা করে চলবে, কিন্তু মজুরী বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে চাহিদা বাড়ানো বা আঞ্চলিক স্বনির্ভরতার পথ সুগম করার জন্য অসংগঠিত ক্ষেত্রকে সহায়তা করার পথ এড়িয়ে যাবে। যা দরকার তা করার জন্য প্রয়োজনীয় মতবাদ বা রাজনৈতিক সম্বল কোনোটাই তাদের নেই।

বাণিজ্যচক্রের বদলে আয়তনের সমস্যার সমাধান যদি আমাদের খুঁজতে হয়, তাহলে সরকারি নিয়ন্ত্রণ ক্রমাগত বাড়িয়ে নতুন ধরনের অর্থনৈতিক দোলনগুলোর বিধ্বংসী মাত্রার সমমানের করে তোলা কোনো পথ নয়, বরং, ‘যা করতে হবে তা হল, রাষ্ট্রের যে বিপুল আয়তন বিপর্যয়কারী মাত্রা ধারণ করেছে, সেই আয়তনকে ক্রমশ কমিয়ে আনতে হবে যতক্ষণ না তা সবচেয়ে মহিমময় সরকারও যে সাধারণ মানুষদের নিয়ে গঠিত, সেই সাধারণ মানুষদের সীমাবদ্ধ প্রতিভা ও কর্মক্ষমতার সঙ্গে সুসমঞ্জস হয়’ (কোহর ১৯৯২, পৃঃ-১১)।

কিন্তু এই পথে না গিয়ে আমাদের এই গ্রহটিকেই ক্রমাগত ধ্বংসের দিকে ঠেলে নিয়ে চলা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নেতারা উদ্ভট থেকে উদ্ভটতর পদক্ষেপ নিয়ে চলেছে। তেমনই একটি পদক্ষেপের প্রস্তাব সম্প্রতি দেওয়া হয়েছে, যা হল বিশ্বের মোট উৎপাদনের ৭ থেকে ১০ শতাংশ (ইতিমধ্যেই যা বরাদ্দ, তারও দশ গুণ) নয়া উদ্ধারক বা সঞ্জীবনী তহবিলে বরাদ্দ করার প্রস্তাব। এর মধ্য দিয়ে একদিকে যেমন তারা পুঁজিবাদের দেউলিয়াকরণকে আরো ত্বরাণ্বিত করতে পারে, অন্যদিকে তেমনই বিভিন্ন ছুতোয় ইতিমধ্যেই ঘনিয়ে তোলা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসকেও আরো গভীর পর্যন্ত বিস্তৃত করতে পারে। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নেতারা তাদের মৌলিক দৃষ্টিহীনতা সত্ত্বেও এটা বোধহয় বুঝে গেছে যে বর্তমান সংকটের একেবারে শিকড়ে রয়েছি আমরা যারা হার না মেনে, আত্মসমর্পণ না করে, বিদ্রোহের ধ্বজা উড়িয়ে নয়া-উদারনীতিবাদের উগ্র আক্রমণকে প্রতিহত করে চলেছি, আর আমাদের নিজেদের স্বশাসনের পরিসরগুলোয় নতুন নতুন সামাজিক সম্পর্ক সৃষ্টি করে চলেছি। সেই জন্যই তারা নিয়ন্ত্রণের দমনমূলক হাতিয়ারগুলো আরো বেশি বেশি করে প্রয়োগ করে চলেছে, নাগরিক অধিকার আদায়ের দুশো বছর জোড়া সংগ্রামে অর্জিত স্বাধীনতাগুলো খর্বিত করে চলেছে, পুলিশের সারি ও কাঁটাতার-দেওয়া পাঁচিল উভয় দিয়েই ঘিরে নিজেদের নিরাপদ রাখতে চাইছে। আমরা হয়ত কর্তৃত্ববাদের এক মাথা-পাগলা সংস্করণের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে রয়েছি, যা বুঝিবা গত শতকের ফ্যাসিবাদগুলোকেও ছাপিয়ে যাবে, জর্জ অরওয়েলের দুঃস্বপ্নের শাসনব্যবস্থার সমরূপ হয়ে উঠবে।

এই সর্বনাশা সম্ভাবনাকে নির্মূল করার একমাত্র উপায় হল নয়া-উদারনীতিবাদের প্রতিক্রিয়ায় জ্বলে ওঠা ক্রোধ ও অসন্তোষগুলোকে কার্যকরী পথে সংহত করা। দুর্নীতিগ্রস্ত, অসংবেদনশীল, অদক্ষ আমলাতন্ত্রগুলোকে ভেঙে ফেলতে হবে, তবে তা নয়া-উদারনীতিবাদীদের আকাঙ্ক্ষানুযায়ী রাষ্ট্রের ভূমিকাকে বাণিজ্যিক সংস্থাদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য নয়, বরং সেই সমস্ত ভূমিকার সামাজিকীকরণের জন্য, যাতে জনসাধারণের হাতেই তা থাকে এবং রাজনৈতিক নিকায়গুলোর আয়তন তদনুযায়ী উপযুক্ত মাত্রায় কমিয়ে আনা যায়। মেহিকো এবং অারো বিভিন্ন জায়গায় বহু গণ-চরিত্রের আন্দোলনই প্রকৃত অর্থে এই আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করছে, নিজেদের স্বশাসনের অভিজ্ঞতাকে তারা রাজনৈতিক পার্টি ও প্রচারমাধ্যমের মুঠোয় থাকা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী বা নিখাদ পরিসংখ্যানগত চরিত্রের গণতন্ত্রের জোলো পথে পচে যেতে দিতে চায় না। গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতার পুরানো নীতিবাক্যের বিরুদ্ধে তারা বিকেন্দ্রীকতার আদর্শকে হাতিয়ার করছে: তারা এখন নিশ্চিত যে সাধারণ মানুষ যে অঞ্চলে বাস করে, সেই অঞ্চলের সীমার মধ্যেই গণতন্ত্রের আসরকে বাঁধতে হয়। ‘সাধারণ মানুষ যেখানে আছে সেই স্থান থেকে সরিয়ে অন্য কোথাও ক্ষমতাকে অধিষ্ঠিত করলে তা গণতন্ত্র হয় না’ (লুমিস ১৯৯৬, পৃঃ- ১৮)।

একমাত্র একটি নতুন সংবিধানের সহযোগেই আমূল গণতন্ত্র সুসংগঠিত হতে পারে, কিন্তু সে সংবিধান কোনও আচারসর্বস্ব সংবিধান নয়, বরং স্বাধীন সত্তামূলক সংবিধান। এমন এক রাজনৈতিক পরিসর গড়ে তোলার প্রক্রিয়াই হল সেই দিকে উৎক্রমণের পথ, যে পরিসরে সাধারণ মানুষ আধিপত্যকারী রাজনৈতিক অতিকথা-সমুদায় বর্জন করে নিজেদের ক্ষমতা প্রয়োগ ও চর্চা করতে পারে। আঞ্চলিক ক্ষমতামণ্ডলীগুলোর প্রতিনিধিদের দ্বারা সূত্রায়িত নতুন সংবিধানের মধ্য দিয়ে অনেক কিছুই সম্ভব হয়ে উঠতে পারে, যেমন: পেশাদার বা রাষ্ট্রীয় আমলাতন্ত্র বর্জন ও বিরুদ্ধতা করে অন্যতর বিধি-নিয়ম-ব্যবস্থা গড়ে তোলা, প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রয়োজন মতো রূপান্তরিত করা, ইত্যাদি। আরো অনেক কিছুর সঙ্গে সম্ভব হয়ে উঠতে পারে কাজের সংগঠন প্রক্রিয়াকেও এমনভাবে বদলে দেওয়া যাতে পুঁজিবাদী কারখানা-ভিত্তিক উৎপাদন প্রক্রিয়ার তুলনায় কাজ অনেক বেশি যৌথ-উদযাপন-সম (convivial) হয়ে ওঠে। একেবারে হাতে-নাতেই তা কাজের সেই চরিত্রকে নির্মূল করবে যে চরিত্রের কারণে কাজ পুঁজি বা রাষ্ট্রের সেবায় নিয়োজিত চাকরির অংশ হিসেবে ‘শ্রম’ রূপে করতে হয়।

এই সবকিছুর জন্য আমাদের রুষ্ট প্রকোপকে সেই শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক অভ্যুত্থানের প্রবাহে সামিল করা প্রয়োজন, জাপাতিস্তারা La Otra Campana শুরু করার পর থেকে যে প্রবাহের পথ কেটে আমরা চলেছি।

ব্যবস্থা যখন ভেঙে পড়ে, বহু মানুষই তখন নিজেদের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের খাঁচায় আটকে গিয়ে উন্মত্ত দুঃসাহসের কাজে নিজেদের নিক্ষেপ করে। আবার অন্যদিকে বহু গোষ্ঠীই নিজেদের তরফে নিজেদের নিজস্ব আঞ্চলিক পরিসরে এমন স্বশাসনের জগৎ সৃষ্টি করে চলেছে যেখানে তারা পুঁজির নাগালের বাইরের সামাজিক সম্পর্ক গড়ে তুলছে এবং খোলাখুলিভাবেই আধিপত্যকারী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগঠিত করছে। তাদেরই মতো আরো বিভিন্ন গোষ্ঠীর সঙ্গে তারা আরো বেশি বেশি করে মুক্ত সংযোগ গড়ে তুলছে। এইসব ছোট মাত্রার উদ্যোগগুলো স্পষ্টতই ভবিষ্যৎ সমাজের পূর্বাভাস রচনা করছে, কিন্তু এমন এক আগ্রাসী ও শত্রুভাবাপন্ন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তাদের দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে যা অনবরত তাদের হয়রান ও ক্লান্ত করে চলেছে। জন বারজার যেমন বলেছিলেন, আমরা আজ এক ধরনের কারাগারের মধ্যে বাস করছি। এই পরিস্থিতিতে আশা করা যায় না যে উপর থেকে ব্যবস্থাপিত বিপর্যয় রদ করা বা শৃঙ্খলমোচনের জন্য বিচ্ছিন্ন সব উদ্যোগের প্রস্ফুটিত হওয়াই যথেষ্ট হবে--- তা হওয়ার পক্ষে প্রতিষ্ঠিত ক্ষমতার নিপীড়ক ধ্বংসাত্মক শক্তি অতি বেশি।

এখন এক সন্ধিক্ষণ। লড়াই করতে বাধ্য হওয়া বেশ ভয়ানক, কিন্তু কোনো অনুশোচনা ছাড়াই এখন আমাদের প্রয়োজনীয় জঙ্গীপনায় নিজেদের অর্পণ করতে হবে। বাস্তবের সঙ্গে আমাদের আকাঙ্ক্ষার সংযোগ ঘটানোর মাধ্যমে, সক্রিয়তার পরতে পরতে নিজেদের ক্ষোভ-অসন্তোষ বুনে দেওয়ার মধ্য দিয়ে প্রথম বারের জন্য আমরা প্রতিমূর্তকরণের তাত্ত্বিক বা রাজনৈতিক আকারকে প্রকৃত বিপ্লবী বল দিয়ে অনুপ্রবিষ্ট করব (ফুকো ১৯৮৩, পৃঃ-xiii)। এই হল আমাদের বর্তমান কাজ।

 

টীকা

১। ফ্রান্সে গৃহযুদ্ধ বইয়ের কুড়ি বছর উদযাপনকারী সংস্করণের ভূমিকায় ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস লিখেছিলেন: ‘সম্প্রতিকালে আবার সমাজ-গণতন্ত্রী অশিক্ষিতের দল “শ্রমিকশ্রেণির একনায়কত্ব” পদটি নিয়ে নিদারুণ আতঙ্কে ভুগতে শুরু করেছে। তা বেশ, বাবুমশায়রা, এই একনায়কত্ব কেমন দেখতে তা কি আপনারা জানতে চান? তাহলে পারি কম্যুনের দিকে একবার তাকিয়ে দেখুন। ওটাই ছিল শ্রমিকশ্রেণির একনায়কত্ব’ (মার্কস ১৯৭৮খ, পৃঃ-৬২৯)। ১৯১৭-র রাশিয়ার যে বিপ্লবীরা শ্রমিক পরিষদ (workers’ councils), সোভিয়েত গড়তে শুরু করেছিল, তারাও এই ধারণা দ্বারাই অনুপ্রাণিত ছিল। ১৯১৭-র আগস্ট মাসে রাষ্ট্র ও বিপ্লব বইয়ের তৃতীয় অধ্যায় লেখার সময় লেনিনও কম্যুনের মার্কস-কৃত বিশ্লেষণকে উৎসাহের সঙ্গে স্মরণ করিয়েছিলেন, রাষ্ট্রকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে ধ্বংস করার প্রয়োজনীয়তা এবং অন্যতর গণতন্ত্র সৃষ্টি করার আবশ্যকীয়তার প্রসঙ্গও তুলে এনেছিলেন। ১৯২০-র দশকের সমাজতন্ত্রীদের মধ্যেকার আলোচনাতেও এই পদটি বিতর্কের কেন্দ্রে ছিল, যার পথ ধরেই ১৯৪০-এ পানেকোয়েক রচিত ধ্রুপদী বইয়ে আলোচনা বিস্তারলাভ করেছিল (দ্রষ্টব্য: বোববিও ১৯৮১, পৃঃ-৪৯৩-এর পাদটীকা)। কিন্তু রাজনৈতিক যাত্রাপথের যে পরিবর্তন লেনিন সূচিত করেছিলেন, তার ফলে বিশ্ব শ্রমিকশ্রেণির একনায়কত্বের যে মুখের সঙ্গে পরিচিত হয়ে উঠেছে, তা স্তালিনবাদের মুখ, কম্যুনের মুখ নয় (লুমিস ১৯৯৬, পৃঃ-২৫-২৭)।

২। ক্লাউস যিম্মেরমান হলেন অর্থনীতি গবেষণার জার্মান সংস্থা (Deutsche Institut fur Wiertschaftsforschung)-র নির্দেশক। দ্রষ্টব্য: http://www.netzeitung. de/wirtschaft/wirtschaftspolitik/1233037.html,Dec.15, 2008।

৩। পুঁজিবাদী কারখানা-ভিত্তিক উৎপাদন প্রক্রিয়ার যুগের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে এঙ্গেলস লিখেছিলেন: ‘Lasciate ogni autonomia, voi che entrate!’ (‘যে প্রবেশ করবে, সব স্বশাসন বাইরে ফেলে রেখে প্রবেশ কর!’) এটি একটি কেন্দ্রীয় যোগসূত্র। আমূল গণতন্ত্রের রাজনৈতিক শৈলী সাধারণ বিস্তারলাভ করার সঙ্গে সঙ্গে কাজের সংগঠনের চরিত্রেও গভীর পরিবর্তন ঘটতে ঘটতে যাবে--- সেই পরিবর্তনের চরিত্রের হদিশ বেশ কয়েক দশক ধরে জাক এল্যুল, পল গুডমান, ইভান ইলিচ এবং লিওপোল্ড কোহর-এর মতো লেখকরা তাঁদের লেখায় আলোচনা করে আসছেন। লুমিস (১৯৯৬) বিশেষভাবে এই যোগসূত্রটির উপর মনোনিবেশ করেছেন।

 

সূত্রপঞ্জী

অটোনোমিডিয়া ১৯৯৫। Ya basta! Documents on the New Mexican Revolution। নিউ ইয়র্ক: অটোনোমিডিয়া।

আরকিপিয়েলাগো ১৯৯৩। ‘La illusion democratica’। আরকিপিয়েলাগো, নং: ৯, পৃঃ- ৩৭-৪৫।

আশীষ নন্দী ১৯৯২। উল্ফগ্যাঙ স্যাকস The Development Dictionary: A Guide to Knowledge as Power পুস্তকের ২৬৪-২৭৪ পৃষ্ঠায় ‘State’। লন্ডন: জেড বুকস।

ইভান ইলিচ ১৯৭১। Celebration of Awareness। লন্ডন: মেরিয়ন বয়ারস।

ইভান ইলিচ ১৯৭৩। Tools for Conviviality। নিউ ইয়র্ক: হার্পার এন্ড রো।

কার্ল মার্কস ১৯৭৮ক। টুকার সম্পাদিত The Marx-Engels Reader পুস্তকের দ্বিতীয় সংস্করণে ‘Contribution to the Critique of Hegel’s Philosophy of Right’। নিউ ইয়র্ক: ডবলু ডবলু নর্টন।

কার্ল মার্কস ১৯৭৮খ। টুকার সম্পাদিত The Marx-Engels Reader পুস্তকের দ্বিতীয় সংস্করণে ‘The Civil War in France’। নিউ ইয়র্ক: ডবলু ডবলু নর্টন।

গুস্তাভো এস্তেভা ১৯৯৪। Cronica del fin de una era। মেহিকো: পোসাদা।

গুস্তাভো এস্তেভা ২০০৮। Celebration of Zapatismo। ওয়াহাকা, দ্বিতীয় সংস্করণ।

জর্জ সোরস ২০০৮। ‘The crisis and what to do about it’। নিউ ইয়র্ক রিভিউ অফ বুকস।

জাপাতিস্তা (Ejercito Zapatista de Liberacion Nacional), ১৯৯৭। Documentos y communicados 3, 2 de octubre de 1995/24 de enero de 1997। মেহিকো: এডিসিওনেস এরা।

জেমস স্কট ১৯৮৮। Seeing like a State। নিউ হ্যাভেন: ইয়েল ইউনিভার্সিটি প্রেস।

থমাস ক্রোনিন ১৯৮৯। Direct Democracy। কেমব্রিজ, মাস: হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস।

নরবের্তো বব্বিয়ো ১৯৮১। বব্বিয়ো ও মাতেউচ্চি সম্পাদিত Diccionario de Politica-য় ‘Democracia’। মেহিকো: সিগলোXXI।

লিওপোল্ড কোহর ১৯৮৬। The Breakdown of Nations। লন্ডন: রুটলেজ এন্ড কিগান পল।

লিওপোল্ড কোহর, ১৯৯২। Fourth World Review-র ৫৪ নং সংখ্যায় ‘Size Cycles’।

মিশেল ফুকো, ১৯৮০। কলিন গর্ডন সম্পাদিত Power/Knowledge: Selected Interviews and Other Writings, 1972-1977। নিউ ইয়র্ক: প্যানথিয়ন বুকস।

মিশেল ফুকো, ১৯৮৩। জিল দেল্যুজ ও ফেলিক্স গুয়াতারি রচিত Anti-Oedipus: Capitalism and Schizophrenia পুস্তকের ‘Preface’। মিনিয়াপোলি: ইউনিভার্সিটি অফ মিনিয়াপোলি প্রেস।

হেক্তর দিয়াজ ১৯৯৬। ‘La autonomia de los pueblos indios en el dialogo entre el EZLN y el gobierno federal’। মেহিকো।

হ্যারি মেয়ো ১৯৬০। An Introduction to Democratic Theory। নিউ ইয়র্ক: অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস।

0 Comments
Leave a reply