ক্ষেত্রসমীক্ষার ঠিকুজি-কুলজি (অথবা, ক্ষেত্রসমীক্ষক ক্ষত্রিয়দের প্রতি এক অক্ষত্রিয়ের নিবেদন)

লিখেছেন:বিপ্লব নায়ক
জ্ঞানোৎপাদনের প্রকৌশল হিসেবে ক্ষেত্রসমীক্ষাকে নিয়ে আলোচনা...

ক্ষেত্র ও সমীক্ষা, এই দুটি তৎসম শব্দের জোট তৈরি করে যে কুলীন নামটি তৈরি হয়েছে তা পাশ্চাত্য জ্ঞানোৎপাদনধারার field research/ field survey নামক প্রকৌশলটির একটি দেশীয় নামকরণ মারফত আপন করে নেওয়ার বা অনুকরণের গ্লানি যথাসম্ভব ফিকে করে নেওয়ার উদ্দেশ্যই সাধন করছে বলে মনে হয়। রবীন্দ্রনাথ, যিনি ‘nation’ ধারণাটি দেশজ নয় বলে তার কোনো দেশীয় শব্দরূপ তৈরি করার বিরোধী ছিলেন, এহেন নামকরণ তাঁর আশীর্বাদ পেত কিনা তা অবশ্য জানার কোনো উপায় নেই, কারণ তাঁর জীবৎকালে এ নাম তেমন চালু হয়নি। এখন অবশ্য বাংলার প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞানোৎপাদন মহলে, অর্থাৎ বিদ্যালয়-মহাবিদ্যালয়-বিশ্ববিদ্যালয় ও বিবিধ গবেষণা সংস্থার কুলীন মহলে এই নামটি ও তার আড়ালে থাকা জ্ঞানোৎপাদন প্রকৌশলটি অতি সম্মানীয় আসনে অধিষ্ঠান করছে।

ক্ষেত্রসমীক্ষা প্রকৌশলটি বিভিন্ন বিধায় প্রযুক্ত হলেও, মানব (ব্যক্তি ও গোষ্ঠী উভয়ত) সংক্রান্ত বিভিন্ন সিদ্ধান্ত প্রণয়নের ভিত্তি স্বরূপ বিবিধ উপাত্ত (data) সংকলনের প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগেই তার প্রয়োগ সর্বাধিক। এই প্রকৌশলটির মহিমা এখানেই যে তা তার মাধ্যমে নির্মিত সিদ্ধান্তকে ‘বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্ত’-এর নির্মোহ বৈষয়িকতার কোট-প্যান্ট পরিয়ে হাজির করতে পারে, যা স্বাভাবিক বিশ্বাসযোগ্যতা দাবি করে বসে। ফলত প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞানোৎপাদন চর্চার কৌলীন্য ও ক্ষমতাধিপত্য নির্মাণে এ প্রকৌশল অতি উপযোগী।

তাছাড়া, এই প্রকৌশল ব্যবহারকারীরা জ্ঞানোৎপাদনের ক্ষেত্রে আধুনিকতাবাদী গণতান্ত্রিক প্রগতিশীলতারও দাবি করে থাকেন যেহেতু তাঁদের সংগৃহীত উপাত্তের মধ্য দিয়ে বিষয়ের (মানবগোষ্ঠীর বা জনজাতির) আকাঁড়া প্রকৃত চরিত্র জ্ঞানমুকুরে প্রতিফলিত হয় বলে তাঁরা মনে করে থাকেন। ফলত কুলীন বিদ্যায়তনিক ক্ষেত্র এভাবে অকুলীনদের নিজ ধারণাক্ষেত্রে ধারণ করার মধ্য দিয়ে সর্বজনীন হয়ে ওঠার পরিতৃপ্তি লাভ করে।

এহেন মহিমাণ্বিত বস্তু ক্ষেত্রসমীক্ষা কীভাবে এই মলিন ধরায় উদ্ভূত হল তা বিস্ময় ও কৌতূহলের বিষয় বটে। সেই ঠিকুজি-কুলজি নিয়েই আলোচনায় বসব। মহিমময়ের জন্ম যেহেতু বিদেশে তাই বাধ্য হয়েই শুরু করতে হবে বিদেশ-বিভুঁই থেকে, না হলে এদেশে তার লীলাবৃত্তান্ত সঠিক অনুধাবন করা যাবে না।

সর্বজনীন সর্বহিতের নিয়ামক-কর্তার পদে ধর্মীয় চার্চের বদলে সেকুলার রাষ্ট্রের আবির্ভাবকালে মধ্যযুগ-শেষের ইউরোপে সর্বহিতাকাঙ্খার বিষয় হিসেবে পরজাগতিক বিবেচনার চেয়ে ইহজাগতিক বিবেচনার গুরুত্ব বাড়ছিল— স্বাস্থ্য, ধনসম্পদে সচ্ছলতা, দুর্ঘটনা-দুর্যোগ থেকে নিরাপত্তা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছিল। তা কেন্দ্র করে চার্চের সঙ্গে সংযুক্ত ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানাদির জায়গায় একগুচ্ছ সামাজিক প্রতিষ্ঠান তৈরি হচ্ছিল। এই সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষা, পরিবার-কল্যাণ, কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্যপরিষেবা প্রদান সংক্রান্ত নিয়ামকগুলোকে ধরে ব্যক্তি ও জনগোষ্ঠী সম্পর্কে তথ্যসংগ্রহ, স্বাভাবিকতার বিধি নির্মাণ ও আরোপ এবং অস্বাভাবিকতাকে চিহ্নিত করে তাকে সমাজবিচ্ছিন্ন করা ও নিকেশ করার কৌশল ও পদ্ধতি বিকাশ করছিল। তার হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল জ্ঞান ও নৈতিকতার নতুন মাপকাঠি, নতুন প্রমিতকরণ। মিশেল ফুকো দেখিয়েছেন যে আঠারো শতকে এসে যখন চার্চের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের জীবনীশক্তি খুইয়ে বসেছে, তখনই এই সেকুলার সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বুনট গোটা সমাজে ছড়িয়ে পড়ে এবং আগের যে কোনও সময়ের থেকে প্রভাবে বহুগুণ বৃদ্ধি ও বিস্তার লাভ করে। এই নতুন আদলের বিস্তৃত ক্ষমতারূপকে ফুকো শৃঙ্খলাদায়ক ক্ষমতা (disciplinary power) নাম দিয়েছিলেন।

এক্ষেত্রে যে সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো মূল ভূমিকা পালন করেছিল, তাদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে ফুকো পুলিশ নামক প্রতিষ্ঠানটিকে চিহ্নিত করেছেন। সতেরো শতকে ইউরোপে বিপুল সংখ্যক মানুষকে ‘দরিদ্র’, ‘অলস’ বা ‘ভবঘুরে’ হওয়ার জন্য আটক করা, বন্দি করে রাখা বা কর্তৃপক্ষ-নির্ধারিত কাজ করতে বাধ্য করার আয়োজন হয়। এলিজাবেথ-জমানার ইংল্যান্ডে তৈরি হওয়া দরিদ্র আইন (Poor Laws) ছিল এর সূচনা। ফ্রান্সেও ১৬৫৬ সালে প্রথম ‘সাধারণ হাসপাতাল’ (General Hospital) নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয় আটক করা দরিদ্র-অলস-ভবঘুরেদের একজায়গায় বন্দি করে রাখার জন্য। সমাজ ঢুঁড়ে তাদের আটক করে এনে হাসপাতালে বন্দি করার কাজ করার জন্য তৈরি হয় পুলিশ বাহিনী।

ইউরোপের সমাজের এই দরিদ্রশিকারের পাশে রেখে আর একটি শিকারও আমাদের দেখতে হবে। তা হল এই ইউরোপিয় দেশগুলোরই প্রশাসনের পৃষ্ঠপোষকতায় সেই দেশগুলোর নাবিক-বণিকদের চালানো দাস-শ্রমিক শিকার। এই দ্বিতীয় শিকারটি চলছিল আফ্রিকায়, ক্যারিবিয় দ্বীপপুঞ্জে, উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকায় উপনিবেশ স্থাপনের প্রক্রিয়ার হাত ধরে। এই প্রক্রিয়ায় সেই উপনিবেশগুলোর আদি জনজাতিদের হত্যা করা হয়েছিল, সম্পদ লুন্ঠন করা হয়েছিল এবং বিপুল সংখ্যক মানুষকে ইউরোপিয় উদ্যোগপতিদের অধীনে দাসশ্রমিক হিসেবে কাজ করতে বাধ্য করা হয়েছিল। কার্ল মার্কস এই প্রক্রিয়াকেই ‘পুঁজির আদিম পুঞ্জীভবন’ (Primitive accumulation of Capital) বলেছিলেন। বিপুল সম্পদ কেন্দ্রীভবনের পাশাপাশি এর মধ্য দিয়ে বিপুল মানুষের শ্রমবাহিনী ও উদ্বৃত্ত শ্রমভাণ্ডার তৈরি করা হয়েছিল যা পশ্চিম ইউরোপে পুঁজিবাদ বিকাশের ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছিল।

ফুকো মনে করিয়ে দিয়েছেন যে আঠারো শতকে দরিদ্রশিকারের পাশাপাশি পুলিশের আরও কিছু করণীয় কাজ ছিল। সেগুলো হল: শহরে বিবিধ প্রাত্যহিক যোগানের কাজ, হস্তশিল্প ও বাণিজ্যে নির্ধারিত মান-ব্যবস্থা বজায় রাখার কাজ, ইত্যাদি। সুতরাং দরিদ্রশিকারের বিপুল কর্মসূচীর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে ছিল গোটা জনগোষ্ঠীকে শিল্পোৎপাদনের নয়া ব্যবস্থার প্রয়োজন ও চাহিদা অনুযায়ী গড়েপিটে নেওয়ার কাজ, সমাজজীবনকে এভাবে সাজিয়ে নেওয়ার কাজ যাতে শিল্পোৎপাদন প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন নির্দিষ্ট ভূমিকায় মানিয়ে নেওয়া ছাড়া সাধারণ মানুষের আর গত্যন্তর না থাকে, সমাজের এই গড়ে উঠতে থাকা ছকের বাইরে দাঁড়িয়ে অস্তিত্বযাপন করতে গেলেই তাকে শিকারের লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠতে হয়। এই বিবর্তিত ক্ষমতারূপটি সমাজের আইনি বিধিব্যবস্থার থেকে পৃথকভাবে গড়ে উঠে একসময় তার সঙ্গে মিলে গেল। ফুকোর পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী:

ভবঘুরে, ভিখারী আর অলসদের ঢুঁড়ে শিকার করার এই পুলিশি বাছাই, বহিষ্কার ও বন্দি করার অনুশীলন বিচারবিধি ও আইনি চর্চাক্ষেত্রের বাইরে থেকে চলছিল।... তারপর উনিশ শতকের গোড়ায় এসে সামাজিক বাছাই প্রক্রিয়ার কার্যকরীকরণের এই পুলিশি ধাঁচা বিচারবিভাগীয় চর্চার মধ্যে অঙ্গীভূত করে নেওয়া হল কারণ নেপোলিয়ন-জমানার রাষ্ট্রে পুলিশ, বিচারব্যবস্থা ও কারা-প্রতিষ্ঠানগুলো পরস্পর সংযুক্ত হয়ে উঠেছিল।

শৃঙ্খলাদায়ক ক্ষমতা-প্রকৌশলের বিকাশ ও সমাজজুড়ে মান্যতা পাওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল কুষ্ঠের মতো সংক্রামক রোগের মহামারী আটকানোর জন্য উদ্ভাবিত কৌশল। কুষ্ঠরোগীদের চিহ্নিত করে সাধারণজনের থেকে বিচ্ছিন্ন সাধারণ বসতি থেকে দূরে তাদের জন্য নির্দিষ্ট পৃথক এলাকায় নির্বাসিত করার কৌশল প্রয়োগের স্বার্থে এমন সব ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল যাদের মধ্য দিয়ে একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক অঞ্চলকে বিভিন্ন ভাগে ভেঙে নজরদারি ও তথ্যসংগ্রহ করা যায়, অধিবাসীদের প্রাত্যহিক জীবনের উপর তত্ত্বাবধান-তদারকি করা যায়, প্রতিটি অধিবাসীকে ব্যক্তিরূপে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, জীবনযাপনের খুঁটিনাটি নিয়েও সিদ্ধান্তগ্রহণের প্রক্রিয়াকে কেন্দ্রীভূত করে উচ্চতর কর্তৃপক্ষের এক্তিয়ারভুক্ত করা যায়। প্রকৃত বা কল্পিত নানা মহামারীর বিরুদ্ধে নিরাপত্তালাভের তাড়না থেকে মহামারী মোকাবিলার বিশেষ পরিস্থিতির ফসল এই ব্যবস্থাগুলো ক্রমশ সাধারণ নাগরিক-অভ্যাসে পরিণত হতে থাকে। ফুকোর ভাষায়:

একই সঙ্গে প্রকৃত ও কল্পিত নানা বিশৃঙ্খলার রূপ হিসেবে মহামারী এবং রোগনিয়ামক ও রাজনৈতিক শৃঙ্খলা পরস্পর সম্বন্ধযুক্ত হয়ে আসত। এই শৃঙ্খলাদায়ক কলকৌশলগুলোর পশ্চাদপটে অতিমারী, বিদ্রোহ, অপরাধ, ভবঘুরেবৃত্তি, বিতাড়ন-নির্বাসন, বিশৃঙ্খলার আবর্তে মানুষের আসা-যাওয়া বাঁচা-মরার অস্থির করে দেওয়া স্মৃতি বারবার ফিরে ফিরে আসত।...

কুষ্ঠরোগীদের সংক্রামক রোগের শিকার বলে গণ্য কর, তাদের আটকে রাখার জন্য তৈরি পৃথগাবাসের বিশৃঙ্খল পরিসরে শৃঙ্খলার সূক্ষ্ম খণ্ডীকরণ আরোপ কর, তার সঙ্গে যুক্ত কর ক্ষমতার জন্য যথাযথ বিশ্লেষণাত্মক বিস্তারণের পদ্ধতি, যাকে বাতিল করা হয়েছে বা বাদ দেওয়া হয়েছে, তাকে ব্যক্তিপরিচয়ে সীমাবদ্ধ কর, কিন্তু এই ছঁাটাই বা বাদ দেওয়ার প্রক্রিয়াকে চিহ্নিত করার জন্যই ব্যক্তিপরিচয়ে সীমাবদ্ধ করার প্রক্রিয়াগুলোকে ব্যবহার কর— শৃঙ্খলাদায়ক ক্ষমতা উনিশ শতকের গোড়া থেকে মনোরোগীদের হাসপাতালে, জেলখানায়, সংশোধনাগারে, অনুমোদিত বিদ্যালয়ে এবং কিছুটা মাত্রায় সাধারণ হাসপাতালে নিয়মিতভাবে এই কাজই করে এসেছে।

দুর্ভোগ ডেকে আনা ‘বিশৃঙ্খলা’ থেকে পরিত্রাতা হিসেবে মান্যতা আদায় করে নেওয়া শৃঙ্খলাদায়ক ক্ষমতা নানা সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বিস্তারলাভ করে। তত্ত্বাবধায়ক কর্তৃপক্ষের নজরদারি দৃষ্টির সামনে সমাজের প্রতিটি আনাচ-কানাচ উন্মুক্ত করে দেওয়া, নিচ থেকে উপরে তথ্যের প্রবাহ ও উপর থেকে নিচে নির্দেশ-প্রত্যাদেশের প্রবাহ বজায় রাখা, নির্দেশপালন নিশ্চিত করা, ইত্যাদির প্রয়োজনে যে প্রকৌশল জন্ম নিয়েছিল তার একটি আদর্শ ধাঁচা হিসেবে ফুকো ১৭৯১ সালে জেরেমি বেন্থামের একটি প্রস্তাবকে উদ্ধার করে হাজির করেছেন। জেরেমি বেন্থামের এই প্রস্তাবটি প্রথম নজরে একটি স্থাপত্য-নকশা। বেন্থাম তার নাম দিয়েছিলেন ‘প্যানঅপটিকন’। নকশাটিতে প্রহরী ও প্রহরাভুক্তদের স্থানিক বিস্তারণের এক বিশেষ কৌশলের মধ্য দিয়ে অবিচ্ছিন্ন প্রহরাকে সহজ ও সম্ভব করে তুলতে চাওয়া হয়েছে। বৃত্তাকার এক পরিসরের কেন্দ্রে নজরদারি-মিনার, যেখানে প্রহরী অবস্থান করবে। আর বৃত্তটির পরিধি বরাবর এক সারি কুঠুরি, যেখানে প্রহরাভুক্তরা অবস্থান করবে। পাশাপাশি কুঠুরিগুলো একে অপরের থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন, এক কুঠুরি থেকে অন্য কোনও কুঠুরি দেখা যায় না। কুঠুরির দুই দেওয়ালে, বৃত্তের বাইরের দিকে ও বৃত্তের ভিতরের দিকে, দুটি খোলা জানালা যা দিয়ে আলোর যাতায়াত কুঠুরির মধ্য দিয়ে অবারিতভাবে চলতে পারে ও তার ফলে কেন্দ্রস্থ নজরদারি মিনারের জানালা থেকে কুঠুরির মধ্যের ব্যক্তির সমস্ত চলাচল প্রহরীর চোখে ধরা পড়ে। নজরদারি মিনারের জানালাগুলো এমনভাবে নির্মিত যে ভিতর থেকে বাইরে দেখা যায়, কিন্তু বাইরে থেকে ভিতরে দেখা যায় না। অর্থাৎ, প্রহরীরা সবকটা কুঠুরির প্রহরাভুক্তদের দেখতে পেলেও, কোনও কুঠুরি থেকেই মিনারের ভিতরটা দেখা যাবে না। সুতরাং মিনারে দৈহিকভাবে কোনও প্রহরী উপস্থিত না থাকলেও প্রত্যেক প্রহরাভুক্তই ভাবতে থাকবে যে প্রহরী হয়ত উপস্থিত আছে এবং তার উপরই নজর রাখছে। এই বোধ থেকে প্রহরাভুক্ত বাস্তব প্রহরীর অনুপস্থিতিতেও তার উপস্থিতি বোধ করতে থাকবে এবং নিজের উপর নিজে থেকেই শৃঙ্খলা আরোপ করে রাখবে। জেরেমি বেন্থাম এই নকশাকে কেবল অপরাধীদের উপর নজর রাখার জন্য জেলখানার স্থাপত্য হিসেবে ভাবেননি। চিকিৎসাকেন্দ্রে রোগীদের উপর নজর রাখা, কারখানায় শ্রমিকদের উপর নজর রাখা, সরকারী নির্দেশ বলবৎ করতে প্রশাসকের দ্বারা সাধারণ নাগরিকদের উপর নজর রাখা— এমন সমস্ত নজরদারিই কম লোক দিয়ে ও কম খরচে করার সাধারণ উপায় হিসেবে তিনি এই প্রস্তাবটি রেখেছিলেন। ফুকোর মতে, প্যানঅপটিকন হল:

অনুশীলনের একটি সাধারণিকরণযোগ্য ধাঁচা, মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের সাপেক্ষে ক্ষমতাসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করার একটি উপায়।... ক্ষমতার কলকৌশলকে একটি নকশাচিত্রের মাধ্যমে এখানে একটা আদর্শ রূপে হাজির করা হয়েছে।... আসলে এটা হল রাজনৈতিক প্রকৌশলের এমন এক সাধারণ বিমূর্ত চিত্র যা তার বিশেষ মূর্ত ব্যবহারগুলি থেকে বিযুক্ত করেই ধরতে হবে।...বহুদিকে বহুভাবে এর প্রয়োগ ঘটতে পারে।

বেন্থামের নকশাচিত্রের হুবহু অনুকরণ করে কোনও জেলখানা-হাসপাতাল-কারখানা-বিদ্যালয় তৈরি না হলেও এই নকশাকে ঘিরে চিন্তা-ভাবনা-আলোচনা-অনুশীলন সেইসব প্রকৌশলগুলোর উদ্ভব ও প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করেছে যাদের মধ্য দিয়ে প্রাত্যহিক নাগরিক জীবনের উপর অবিচ্ছিন্ন প্রশাসন ও নিয়ন্ত্রণ সম্ভবপর হয়ে উঠেছে।

উচ্চাবচ ধাপবন্দি কাঠামো অনুসারী নির্ধারিত সম্পর্কের গণ্ডিতে ব্যক্তি-অস্তিত্বকে বেঁধে জীবনাচরণকে নিরাপদ, স্বাভাবিক ও ফলপ্রসূ বলে যত প্রতিষ্ঠা করা গেছে, শৃঙ্খলাদায়ক ক্ষমতা ততই নতুন নতুন পরিসর অধিকার করে সর্বাত্মক হয়ে উঠেছে।

ধ্রুপদী রাজতন্ত্রে ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা রাজা ও রাজন্যবর্গই ছিল উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত হয়ে সর্বদৃশ্যমান। পরম সার্বভৌম ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবে ইহজগতের সার্বভৌম রাজার অধিকার (প্রজাদের পালনের অধিকার এবং একইসঙ্গে প্রয়োজনবোধে বধেরও অধিকার) নির্ধারণই ছিল জ্ঞানের বিষয়। প্রজারা ছিল আলোকবৃত্তের বাইরে ছায়াচ্ছন্ন পৃথগীকরণ-অযোগ্য পিণ্ড। শৃঙ্খলাদায়ক ক্ষমতার পরিসর এর ঠিক বিপরীত। এখানে ক্ষমতার কেন্দ্রস্থিত প্রহরী-কর্তৃপক্ষ ছায়াচ্ছন্ন মিনারে দৃষ্টির অগোচর। তীব্র আলো অবিচ্ছিন্ন দৃশ্যমানতায় ভাস্বর করে রাখতে চায় প্রহরীভুক্ত জনতাকে। পিণ্ডরূপে নয়, ব্যক্তি হিসেবে প্রত্যেককে তার অস্তিত্বের প্রতিটি মুহূর্তের বিশেষত্ব দিয়ে চিহ্নিত করে রাখতে চায়। সেইজন্য সমস্ত বিষয়ে সমস্ত সময়ে তথ্যসংগ্রহ, তথ্যের সারণিবদ্ধকরণ, তথ্যবিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে নিরন্তর সূক্ষ্ম থেকে আরো সূক্ষ্ম বিভাজিকা রেখা টেনে বস্তুর বিভাজন এবং সেই বিভাজন অনুযায়ী তদারকি-নজরদারি-পরিচর্যার পৃথক ব্যবস্থাপনা তৈরির খাতেই এখন জ্ঞানচর্চা প্রবাহিত হল। এখন জ্ঞানের বিষয়ী মানুষ, জ্ঞানের বিষয়ও মানুষ। জনতাকে ব্যক্তি-অস্তিত্বে বিচ্ছিন্ন করা ও নজরদারির অন্তর্গত করার রাজনৈতিক প্রকৌশলগুলোর অগ্রগতি ঘটল এই রাজনৈতিক সমস্যাটিকে রাজনৈতিক প্রতর্কের গণ্ডির বাইরে নিয়ে গিয়ে বিজ্ঞানের তথাকথিত নিরপেক্ষ প্রতর্কের অন্তর্ভুক্ত করার মধ্য দিয়ে। উনিশ শতকের শুরুতে ইউরোপে গড়ে ওঠা নতুন ধরনের হাসপাতাল-জেলখানা-সংশোধনাগারগুলো অপরাধ, অপরাধ-মানসিকতা ও অপরাধী বিষয়ে এক একটি জ্ঞানশাখা নির্মাণের গবেষণাগার হয়ে উঠল। বৈজ্ঞানিক মনস্তত্ত্ববিদ্যার জন্ম হল এর মধ্য দিয়ে। আর রাজনৈতিক সমস্যাটি পরিণত হয়ে গেল প্রশিক্ষিত বিশেষজ্ঞদের বৈজ্ঞানিক নির্ধারণের বিষয়ে। নির্ণয় করা হল যে হাসপাতাল-জেলখানা-সংশোধনাগারে বন্দি মানুষরা বিভিন্ন ধরনের ‘অস্বাভাবিকতা’-র শিকার, তাদের স্বাভাবিকীকরণের জন্য চিকিৎসা বা সংশোধন-প্রচেষ্টা চালাতে হবে ‘বৈজ্ঞানিক’ মতে। ব্যক্তি-অস্তিত্বে বিচ্ছিন্ন করে নজরদারির মধ্যে বন্দি করে রাখার বিবিধ বিধানের ‘অস্বাভাবিকতা সংশোধনের’ ক্ষেত্রে ব্যর্থতা যখনই প্রকট হয়ে উঠত, তখনই আরো কড়া বিচ্ছিন্নতা ও আরো কড়া নজরদারি সংশোধনী হিসেবে প্রস্তাবিত হতো। সুস্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও সম্পদবৃদ্ধির জন্য আদর্শ ‘বৈজ্ঞানিক’ ব্যবস্থা হিসেবে এক নিরপেক্ষ নৈর্ব্যক্তিকতার পোষাকে শৃঙ্খলাদায়ক ক্ষমতার আদ্যন্ত রাজনৈতিক চেহারাটি ঢাকা পড়ল। তার ফলে ‘রাজা/রাজন্য— প্রজা’ বা ‘যাজক— শরণাগতের’ মতো গুটিকয় স্পষ্ট সম্পর্কের বদলে অসংখ্য স্পষ্ট বা অস্পষ্ট, সুগঠিত বা জায়মান সম্পর্করাজির রূপ ধরে শৃঙ্খলাদায়ক ক্ষমতা কাজ করতে থাকল। সরকার/প্রশাসন— জনতা, কর্তৃপক্ষ— সভ্য/সদস্য, ব্যবস্থাপক— কর্মী, চিকিৎসক— রোগী, শিক্ষক— ছাত্র এমন তুলনামূলক স্পষ্ট সম্পর্কগুলোর সাথে জড়িয়ে বা গায়ে-গায়ে লেগে থাকে তুলনায় অস্পষ্ট বিবিধ সম্পর্ক, যেমন: বিশেষজ্ঞ— সাধারণজন, জ্ঞানোৎপাদক— জ্ঞানগ্রাহী, প্রশিক্ষিত— প্রশিক্ষণহীন, অগ্রসর— পশ্চাৎপদ, সুস্থ— রোগগ্রস্ত, স্বাভাবিক— অস্বাভাবিক, ইত্যাদি। ক্ষমতার চর্চা এখানে কেবল একটি বা কয়েকটি নির্ধারক সম্পর্কের গ্রন্থিপথ ধরে প্রবাহিত হয় না, বহুবিধ ও বহুবিক্ষিপ্ত গ্রন্থিপথ ধরে প্রবাহিত হয়ে এক বিস্তৃত জালের চেহারা নেয়। সেই জালের বুনট হয়ত বিশেষ কিছু প্রতিষ্ঠান বা কাঠামোর (যেমন, রাষ্ট্র, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান) নিকটাঞ্চলে বেশি ঘন ও আঁটো হয়ে ওঠে, কিন্তু সর্বত্রই তা প্রসারিত থাকে। এমনকি প্রহরাভুক্ত মানুষদের মগজও তার বাইরে থাকতে পারে না। প্যানঅপটিকন নকশার কুঠুরির বাসিন্দার মতো প্রহরীমিনারে প্রহরী উপস্থিত না থাকলেও সে ভাবতে থাকে যে প্রহরীর চোখ তার উপর রয়েছে, ফলে নিজেই নিজেকে শৃঙ্খলার বাঁধনে বেঁধে রাখে। এখানে প্রহরীভুক্তের ব্যক্তিসত্তার একটি খণ্ডিত অংশই কি প্রহরীর কাজ করে না? প্রহরী কি প্রহরীভুক্তের অন্তঃস্থ হয়ে যায় না? সেভাবেই কি শৃঙ্খলাদায়ক ক্ষমতার পরিসরের মধ্যে বিশেষজ্ঞ জ্ঞান বা বিজ্ঞান আমাদের মগজের অভ্যন্তরে বসে প্রহরা চালিয়ে যায় না? ফলে ক্ষমতাধর ও ক্ষমতাহীন এমন সহজ কোনও বিভাজনকে অসম্ভব করে দেওয়ার মধ্য দিয়ে এই ক্ষমতারূপ সহজ কোনও দ্বিপাক্ষিক বৈরিতার পথ ধরে তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধকে অকার্যকরী করে তোলে।

আঠারো শতকের শেষদিক ও উনিশ শতকের গোড়া থেকে শৃঙ্খলাদায়ক ক্ষমতার সাধারণ কাঠামোর মধ্যেই আরেক ক্ষমতারূপের উদ্ভব ফুকো চিহ্নিত করেছেন। জনসংখ্যা-বিস্ফোরণ ও পুঁজিবাদী শিল্পায়নের গতি এমন এক ক্ষমতার চাহিদা জন্ম দিয়েছিল যা কেবল প্রতিটি ব্যক্তির ব্যক্তি-অস্তিত্বকে শৃঙ্খলায়িত করবে না, সমষ্টিগতভাবে জনসমষ্টিকেও নজরদারি, স্বাভাবিকীকরণ ও প্রমিতকরণের প্রক্রিয়ার মধ্যে বাঁধতে পারবে। সেই ক্ষমতারূপকে ফুকো ‘জৈবক্ষমতা’ (Biopower) নাম দিয়েছেন। এই ক্ষমতারূপ এমন কিছু প্রকৌশল জারি করার মধ্য দিয়ে সক্রিয় হল যা ব্যক্তির দেহের স্বতন্ত্রীকরণ করে তার উপর প্রযুক্ত হওয়ার পূর্বোক্ত কৌশলের বদলে সাধারণ জৈবিক প্রক্রিয়াসমূহের উপর প্রযুক্ত হল। জন্ম-মৃত্যুর মধ্য দিয়ে জৈবিক উৎপাদন-পুনরুৎপাদন, সামাজিক উৎপাদন প্রক্রিয়ার অঙ্গীভূত করে জনসমষ্টিকে উৎপাদিকা শক্তি হিসেবে রক্ষণাবেক্ষণ করা— এহেন জৈবিক প্রক্রিয়াসমূহের ব্যবস্থাপনার আশু কর্তব্য পালন করার জন্য তা হাজির হল। রাষ্ট্রীয় স্তরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান, গণকল্যাণ তহবিল, বীমা-প্রতিষ্ঠান ইত্যাদির মতো একগুচ্ছ রাষ্ট্রীয় স্তরের নিচেরতলার সামাজিক প্রতিষ্ঠান দ্রুত বংশবিস্তার করে এই ক্ষমতারূপের গ্রন্থি সমাজজুড়ে ছড়িয়ে দিল। জন্মহার, মৃত্যুহার সহ গণস্বাস্থ্যের নানা সূচক ও উৎপাদিকা হার পরিমাপের নানা সূচক তৈরি করে তার সাপেক্ষে নিরন্তর তথ্যসংগ্রহের পরিসংখ্যানগত কাজ, তা বিশ্লেষণ করে ‘সাধারণ গতিপ্রবণতা’ নির্ণয়, ‘বৈজ্ঞানিক’ পূর্বাভাস ঘোষণা, নির্ধারিত সমষ্টিগত লক্ষ্যের সঙ্গে তার তুলনা করে বৈজ্ঞানিক বিধানপত্র রচনা ও সমষ্টির স্তরে সেই বিধান প্রয়োগ করার উপায় উদ্ভাবন— এর মধ্য দিয়ে জ্ঞানের বিষয় ও রূপও নতুনভাবে নির্ধারিত হল। এককথায় বললে, শৃঙ্খলাদায়ক ক্ষমতাকাঠামোর মধ্যেই এমন এক জৈবিক ও রাষ্ট্রিক কাঠামো স্ফূরিত হল যা জৈবিক নিয়ামকের কাজ করতে পারে।

ইউরোপে জৈবিক প্রক্রিয়াদির উপর নজরদারি, নিয়ন্ত্রণ ও প্রমিতকরণের এই ক্ষমতারূপ প্রতিষ্ঠার সঙ্গে যুগপৎভাবে সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি হিসেবে বিবর্তনবাদ প্রধান্য বিস্তার করল। ব্যক্তি হিসেবে দেখার চেয়ে প্রজাতি হিসেবে দেখার উপর জোর পড়ার পাশাপাশিই বিবর্তনবাদ এমন এক তত্ত্বকাঠামো হাজির করল যেখানে বিভিন্ন প্রজাতিকে বৈচিত্র্য ও পার্থক্যের আনুভূমিক বিস্তারে না দেখে ক্রমবিকাশের উচ্চাবচ ধাপবন্দি কাঠামোর উল্লম্ব বিস্তারে ফেলে দেখাই মান্যতা পেল। ক্রমবিকাশের প্রায় সরলরৈখিক ধারায় অগ্রগতির বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন প্রজাতি অবস্থিত ধরে নিয়ে অগ্রগামিতা-পশ্চাৎপদতার এক ক্রমবিন্যস্ত সারণি নির্মিত হল। নির্মিত সেই সারণি অনুযায়ী ইউরোপের প্রধান জনগোষ্ঠীগুলো ও তাদের সমাজব্যবস্থা সবচেয়ে অগ্রগামী আর বাকি গোটা বিশ্বের বিবিধ বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠী ও তাদের সমাজব্যবস্থাগুলো সবই পিছিয়ে পড়া, অবিকশিত বা বিকাশ-অর্জনে ব্যর্থ বলে নির্ণীত হল। এর সঙ্গে যুক্ত ছিল বিভিন্ন প্রজাতিদের মধ্যে অস্তিত্বরক্ষার সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তুলনায় কম সমর্থ প্রজাতিদের বিনাশ ও অগ্রবর্তীদের আধিপত্যের মধ্য দিয়ে ‘প্রাকৃতিক বাছাই প্রক্রিয়া’ সম্পন্ন হওয়ার তত্ত্ব। ফলে ইউরোপের প্রধান জাতিগুলোর উপনিবেশ বিস্তারের হিংস্র অভিযান, আমেরিকা মহাদেশের আদি মানবগোষ্ঠীদের হত্যা করে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া, আফ্রিকা মহাদেশ জুড়ে হত্যা বা দাসে পরিণত করার ভয়ংকর অভিযান, অস্ট্রেলিয়া ও এশিয়া মহাদেশে ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠা ও এসবের মধ্য দিয়ে পৃথিবী জুড়ে মানবসমাজের বিবিধ রূপের বৈচিত্র্য ও পার্থক্যকে দুরমুশ করে নিজেদের সমাজরূপ-সংস্কৃতির একরঙা বিবর্ণ আকিঞ্চনতায় সবকিছু ঢেকে দেওয়ার প্রক্রিয়া সবই ‘প্রাকৃতিক বাছাই প্রক্রিয়া’ হিসেবে এক বৈজ্ঞানিক নৈর্ব্যক্তিকতা-নিরপেক্ষতার মুখোশ এঁটে নিল। অপর সমস্ত বৈচিত্র্য ধ্বংস করে নিজ আধিপত্য প্রতিষ্ঠার এক নিদারুণ রাজনৈতিক প্রতর্ক জীববিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞানের সাধারণ প্রতর্ক হিসেবে মর্যাদার আসন দখল করে নিল।

এর হাত ধরেই ভিনদেশী শ্রমিকদের প্রতি বিদ্বেষ, অপর ধর্মগোষ্ঠীর প্রতি বিদ্বেষ, উদ্বাস্তু সমস্যা ও উদ্বাস্তু-বিদ্বেষ, রাষ্ট্রহীন ত্রিশঙ্কু জনগোষ্ঠীর উদ্ভব ও তাদের প্রতি বিদ্বেষ নতুন চেহারা নিয়ে দেখা দিয়েছে ও ক্রমাগত তীব্র হয়ে উঠেছে। কোনও অঞ্চলের অধিবাসীদের বা শরণার্থীদের নাগরিকত্ব পরিচয় নির্ধারণ করা বা খণ্ডন করা, চিহ্নিত অ-নাগরিকদের তাড়িয়ে দেওয়া বা প্রাণে মেরে ফেলা যে কোনো জাতিরাষ্ট্রের ‘স্বাভাবিক’ অধিকার হয়ে উঠেছে। ‘জাতীয়’ জীবনের উন্নতি ও অগ্রগতির যুক্তির বাঁধনে রাষ্ট্র এই কাজে তার ‘আইনি নাগরিকদের’ সমর্থন ও অংশগ্রহণও নিশ্চিত করে তুলতে পারছে। ফুকোর পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী:

একদিকে রয়েছে এই ধারণা যে রাষ্ট্র তার নিজস্ব প্রকৃতি ও নিজস্ব চরমাবস্থার অধিকারী। অন্যদিকে আছে এই ধারণা যে মানুষ যে মাত্রায় উদ্বৃত্ত শক্তি উৎপাদন করে, যে মাত্রায় সে একটি জীবিত, কর্মরত ও বাঙ্ময় জীব, যে মাত্রায় সে একটি সমাজের অংশ এবং যে মাত্রায় সে একটি নির্দিষ্ট পরিবেশের মধ্যের একটি জনসমষ্টির অংশ, সেই মাত্রাতেই সে রাষ্ট্রের ক্ষমতার প্রকৃত বিষয় হয়ে ওঠে। এই দুই ধারণার মধ্য থেকে ব্যক্তি-মানুষের জীবনে রাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান হস্তক্ষেপ ঘটতে আমরা দেখি। এই ধরনের রাজনৈতিক ক্ষমতার সমস্যাবলীতে জীবন ক্রমশ আরও গুরুত্বের স্থান পেতে থাকে; তার ফলাফল হিসেবে সবচেয়ে সূক্ষ্ম রাজনৈতিক প্রকৌশলের সাহায্যে মানুষের এক ধরনের পাশবিকীকরণ সম্পন্ন করা হয়। মানববিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান-গুলোর সম্ভাবনা যেমন বিকশিত হতে থাকে, পাশাপাশি তেমনই জীবনরক্ষার সম্ভাবনা ও গণহত্যা সংঘটনের সম্ভাবনা যুগপৎভাবে ইতিহাসের মঞ্চে আবির্ভূত হয়।

জৈবক্ষমতা ও তৎসংযুক্ত বিদ্বেষী জাতিবাদ কেবলমাত্র রাষ্ট্রের শাসন-নিপীড়ন চালানোরই হাতিয়ার হয়ে ওঠেনি, গণস্তরে প্রতিটি মানুষের স্বপরিচয়-নির্মাণ ও অপরের সঙ্গে সম্পর্ক নির্ধারণের ক্ষেত্রেও নিয়ামক হিসেবে তা জাতিরাষ্ট্রের নাগরিকদের মগজে সেঁধিয়ে গেছে।

ইউরোপীয় প্রেক্ষাপটে পুঁজিবাদী সমাজকাঠামো ও জাতিরাষ্ট্রের উদ্ভবের সঙ্গে এভাবেই অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে গেছে জ্ঞানতাত্ত্বিক এই প্রকৌশলের বিকাশ যা প্রতিনিয়ত জনগোষ্ঠী সম্পর্কে বিভিন্ন উপাত্ত সংগ্রহ করতে থাকে, এক নজরে গোটা জনগোষ্ঠীকে ধরার দাবিদার নানা নকশা তৈরি করতে থাকে উপাত্তগুলোর বিন্যাস-সমবায়-বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে, অগ্রগতি বা অধোগতির আখ্যান তৈরি করতে থাকে বিবর্তনবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে, এবং সেই আখ্যান-নির্ভর ‘সমস্যা-সমাধান’ বা ‘উন্নতি’-র নানা ফরমায়েশ তৈরি করে প্রশাসনিকতা (governmentality) কার্যকরী হওয়ার পথগুলোকে তৈরি করে। ‘field research/ survey’ শ্রেণীবদ্ধকরণ ও নিবন্ধীকরণের এই প্রকৌশলগুলোর প্রাথমিক ধাপ।  নির্মোহ বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের ভগীরথ রূপে তা অবতারত্ব লাভ করেছে।

আমাদের ভূখণ্ডে ‘field research/ survey’ প্রবেশ করে ইউরোপ থেকে আগত ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির পতাকাবাহক ও খ্রিস্টান মিশনারিদের ভারতচর্চায় সওয়ার হয়ে। তার বহু আগে থেকেই, স্মরণাতীত কাল ধরে প্রাচ্যের বহু অভিযাত্রী বিদেশে গেছেন, বিদেশী সমাজ ও সংস্কৃতি পর্যবেক্ষণ করেছেন, আদানপ্রদানের গভীর প্রবাহপথ কেটেছেন--- যেমন এই বাংলারই অতীশ দীপঙ্কর তিব্বতে গেছেন, অন্য প্রাচ্য দেশের ফা হিয়েন বা হিউয়েন সাঙ এদেশে এসেছেন--- কিন্তু তাঁদের কারও রেখে যাওয়া বৃত্তান্তেই ‘field research/ survey’-র কোনো লক্ষণ ফুটে ওঠেনি। ইউরোপীয় মিশনারিরা ধর্মপ্রচারের সুবিধার্থে এদেশের ভাষা ও জনজাতিদের নিয়ে যে চর্চা শুরু করে এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সার্ভেয়র (যেমন এডওয়ার্ড ডাল্টন বা রিজলি সাহেব) জনগোষ্ঠীকে জাত-জাতি পরিচয়ে ভেঙে ধাপকাটা তালিকা তৈরি করার যে কাজ শুরু করেন, তাই-ই এই ভূখণ্ডে ‘field research/ survey’-র আদি নমুনা হয়ে আছে। জ্ঞানতাত্ত্বিকভাবে এই প্রক্রিয়া দাঁড়িয়ে আছে ইউরোপীয় ‘Enlightenment’ জাত এই স্থিরবিশ্বাসের উপর যে প্রণালীবদ্ধ পর্যবেক্ষণ ও যুক্তির পথ ধরে অবরোহী যাত্রার মধ্য দিয়ে মানুষের মগজ যেকোনো অপর বস্তুর অস্তিত্ব-নির্যাস জেনে ফেলতে পারে। তাই ‘বৈজ্ঞানিক’ (অর্থাৎ যা ‘বিশেষজ্ঞদের’ দ্বারা বিজ্ঞান বলে শংসিত) পূর্বধারণার উপর দাঁড়িয়ে পর্যবেক্ষণের প্রণালী নির্ধারণ, উপাত্ত সংগ্রহের বিষয় নির্বাচন ও উপস্থাপনার যৌক্তিক কাঠামো ঠিকঠাকমতো নির্দিষ্ট করতে পারলেই ‘field research/ survey’ অজানা অপর বস্তুনিচয়ের প্রকৃত রূপটিকে উন্মোচিত করে দিয়ে তাকে পরিচিত অপর সকল বস্তুর সাপেক্ষে বিন্যস্ত করে চালু সিদ্ধান্তগ্রহণপ্রণালীর উপযোগী বিষয় করে তুলবে। প্রশিক্ষিত মানুষের মগজ এখানে সর্বশক্তিমান বিষয়ী, তার কাছে অজ্ঞেয় বলে কিছু নেই। জ্ঞানদৃষ্টির সর্বগামিতা ও সর্বজয় করতে পারার অন্ধ অহমিকায় প্রাণিত হয়ে ইউরোপীয় ধারায় প্রশিক্ষিতদের ‘field research/ survey’ গোটা প্রাচ্যভূমির মানুষ ও প্রকৃতির নকশা তৈরি করে নিতে নেমে পড়েছিল।

ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলের ‘ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস’-এর আধিকারিক রিজলি সাহেব ১৮৯১ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘The Tribes and Castes of Bengal’ বইয়ের দ্বিতীয় খণ্ডে বিহার, ঔধ, পাঞ্জাব ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন জনজাতির পরিচয় তুলে ধরতে যেমন চারশো পাতার উপর সারণি তৈরি করে তাদের নাকের মাপ, মাথার করোটির মাপ, উচ্চতা ও ওজন নথিভুক্ত করে গেছেন, তা তাঁর সময়কার ফরাসি নৃতত্ত্ব-বিশেষজ্ঞদের বিধান অনুযায়ী ছিল অজানা-অচেনা জনজাতির প্রকৃত পরিচয় উদ্ঘাটনের জন্য প্রয়োজনীয় বৈজ্ঞানিক উপাত্ত। সেসব ধরেই ইউরোপীয়দের থেকে তাদের নিকৃষ্টতার সিদ্ধান্তে যৌক্তিক পথে পৌঁছানো হয়েছিল। আজ এই নাক-করোটি-উচ্চতার মাপকে আর ‘বৈজ্ঞানিক নির্ধারক’ (scientific parameter) ধরা হয় না। ‘বৈজ্ঞানিক নির্ধারক’-গুলো পাল্টে গেছে, কিন্তু ওই বিশেষজ্ঞ-নির্ধারিত ‘বৈজ্ঞানিক নির্ধারক’ স্থির করে উপাত্ত-সংগ্রহ এখনও জ্ঞানোৎপাদনের প্রধান উপায় হয়ে থেকে গেছে যেহেতু জ্ঞানতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি অপরিবর্তিত থেকে গেছে। এখনও প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞানচর্চার মহলের বিশেষজ্ঞরা ‘বৈজ্ঞানিক নির্ধারক’ হিসেবে যেগুলিতে গুরুত্ব দিয়ে থাকেন সেগুলি হল: জীবনযাপনের রূপ ও মান, শিক্ষা, ভাষা, প্রশাসনিকতায় সংযুক্তির মাপ, অর্থনৈতিক পেশা। এই নির্ধারকগুলো কীভাবে কাজ করে তা একটু ভেঙে দেখা যাক।

জীবনযাপনের রূপ ও মান: বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর (/জনজাতির) নিজ নিজ প্রকৃতি-পরিবেশের সঙ্গে স্বাভাবিক মিথষ্ক্রিয়ায় বিন্যস্ত সদা-জায়মান জীবনরূপকে ধর্মীয়-সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান-বিশ্বাসের নিশ্চল ফ্রেমে বেঁধে প্রাণশূন্য উপাত্ত রূপে হাজির করা হয়। আধিপত্যকারী বিবর্তন/প্রগতির আখ্যান মোতাবেক শিখরস্থ পুঁজি-যন্ত্রবিজ্ঞান-নগর-কেন্দ্রীক জীবনরূপের দৃষ্টিকোণ থেকে সেই ফারাক ও অপরতাকে অদ্ভূত, শৈশবোচিত, অবিকশিত, পশ্চাৎপদ প্রত্নবস্তু হিসেবে পরিবেশন করা হয়। এই ফারাক বা অপরতার জন্য লজ্জাবোধ, হীনতাবোধ উৎপাদন এবং সেই লজ্জা ও হীনতা কাটাতে দ্রুত নিজ স্বতন্ত্রতা ধ্বংস করে ‘মূলস্রোতে মিশে যাওয়ার’ যুক্তি ও আবেগ নির্মাণ করা হয়, যা অতি শক্তিশালী শৃঙ্খলাদায়ক ক্ষমতার টান তৈরি করে।

শিক্ষা: প্রতিটি জনগোষ্ঠীর (/জনজাতির) মধ্যে দীর্ঘ পরম্পরা জুড়ে ক্রমরূপান্তরিত হতে থাকা, সন্ততা-অসন্ততার জঞিল বুননের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হওয়া, প্রকৃতি-পরিবেশের সঙ্গে মিথষ্ক্রিয়া স্বরূপ জীবন-নির্যাস ও জীবনোপায় হিসেবে যে জ্ঞান স্বাভাবিক সামাজিক-ধর্মীয়-আচারনৈতিক প্রশিক্ষণের পথ ধরে প্রবাহিত হয় এবং শিক্ষার লৌকিক ধারাকে বহুস্রোতা, বহুসম্ভবা ও বৈচিত্র্যময় করে রাখে, সেই জ্ঞানকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে রাষ্ট্র-ব্যবস্থিত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সমূহের পুঁজি-যন্ত্রবিজ্ঞান-নগর-মুখী প্রশিক্ষণকেই শিক্ষার একমাত্র রূপ বলে হাজির করা হয়। শিক্ষা-সংক্রান্ত উপাত্ত মানেই তাই রাষ্ট্র-ব্যবস্থিত শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষণলাভের মাত্রার সূচক। আধিপত্যবাদী জ্ঞানরূপের দ্বারা অপর সমস্ত জ্ঞানরূপকে বাতিল ও ধ্বংস করার এমন সুসমণ্বিত প্রয়াস আর খুব কমই হতে পারে।

ভাষা: কথা বলা ও জ্ঞাপন করা--- স্বাভাবিকভাবেই এই ক্রিয়া গোষ্ঠীগত এবং ক্রিয়াক্ষেত্রের প্রাকৃতিক পরিবেশ-প্রেক্ষাপটের গভীরে শিকড় চারিয়ে পুষ্টিশোষণের মধ্য দিয়েই তা চিরহরিৎ হয়ে থাকে। আর গোষ্ঠীজীবন, পরিবেশ, প্রকৃতি থেকে উচ্ছিন্ন হয়ে গেলেই তা নিষ্পত্র বজ্রাঘাতে-পোড়া বৃক্ষকাণ্ডে পরিণত হয়ে ক্রমশ শুকিয়ে যেতে থাকে। এই ক্রিয়া-পরিসরের স্বাস্থ্যলক্ষণ সম্পর্কে অচেতন থেকে ভাষাসমীক্ষার উপাত্ত সংগ্রহের নিমিত্ত ‘ভাষা’ নামক এমন এক বিশেষ্য তৈরি করা হয়েছে যা ভাষাতত্ত্বগত ধ্বনিরূপ-ধাতুরূপ-শব্দরূপ-ব্যাকরণের ধাঁচায় এক নিষ্প্রাণ বস্তু রূপে নির্মাণ করে নেওয়া যায় এবং তারপর শব্দকোষ-অভিধান-ব্যাকরণ বইয়ের মলাটবন্দি ছাপা পৃষ্ঠায় সংকলিত করে রাষ্ট্র-ব্যবস্থিত জ্ঞানচর্চামহলের লেখ্যাগারে প্রদর্শ হিসেবে সাজিয়ে রাখা যায়। একদিকে তাই ভাষাব্যবহারক্ষেত্র সংকুচিত হতে হতে একের পর এক ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে সমাজ-পরিসরে, ভাষাবৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে আধিপত্যকারী ভাষার নিষ্প্রাণ সমরূপতা চেয়ে যাচ্ছে, আর অন্যদিকে প্রাতিষ্ঠানিক প্রদর্শশালার কেয়ারি-করা তাকে বেড়ে চলেছে ভাষার মৃতরূপের প্রদর্শনসামগ্রী, তা নিয়ে ব্যবসাপাতিও কম হচ্ছে না।

অর্থনৈতিক কাজ, পেশা: পুঁজি-যন্ত্রবিজ্ঞান-নগর-মুখী চিরক্ষুধার্ত চির-অসন্তুষ্ট যে ‘আধুনিকতা’-র রুগ্ন অস্তিত্ব অন্ধ দর্প ও আধিপত্যের দমকে বাস্তুতান্ত্রিক (ecological) বিপর্যয় ঘনিয়ে তুলেছে, সেই অসুস্থতার বাইরেও জীবনযাপন করার নানা রূপ আছে। দর্পের সঙ্গে প্রকৃতিকে দুমড়ে মুচড়ে নিজের চির-অতৃপ্ত চাহিদা পূরণের যজ্ঞে আহুতি দেওয়া নয়, বরং প্রকৃতির সীমা বুঝে নিয়ে সেইমতো প্রকৃতিলগ্ন প্রকৃতিনির্ভর জীবনযাপন বিভিন্ন আদিবাসী সমাজের পরম্পরার ধন। প্রকৃতি থেকে আহরণ/সংগ্রহ, সীমায় বাঁধা কৃষি-অকৃষি উৎপাদন, পশুপালন এবং পশু-পাখি-পোকা-গাছ–পাথরের সঙ্গে নিবিড় আত্মীয়তাবন্ধনে জীবনাচরণ বাস্তুতন্ত্রে ক্ষত না জাগিয়েই দীর্ঘ সময়পর্যায় জুড়ে প্রবাহিত হয়ে আসছে। কিন্তু এই জীবনাচরণে প্রবৃত্ত মানুষজনকে ক্ষেত্রসমীক্ষকদের আধুনিকতার শান দেওয়া দৃষ্টিতে ‘বেকার’, ‘অলস’, ‘অনুৎপাদক’ বলে চিহ্নিত করা হয় এবং তাদের কতটা পুঁজি-খনি-কারখানা-যন্ত্রপ্রযুক্তি-শহর-কেন্দ্রীক বৃত্তি ও জীবনাচারে টেনে আনা গেল সেটাকেই অগ্রগতির সূচক বলে ধরা হয়।

প্রশাসনিকতায় সংযুক্তি: জীবনরূপ, শিক্ষা, ভাষা, বৃত্তি সমস্ত দিক থেকেই রাষ্ট্র-ব্যবস্থিত ক্ষমতাকাঠামোর অভ্যন্তরে এনে বাঁধার কাজ চলতে থাকে। জনগোষ্ঠী বা জনসমাজের স্বাধীন স্বতন্ত্র অস্তিত্বকে ধ্বংস করে রাষ্ট্র ব্যবস্থিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উপর নির্ভরতা তৈরি করা হতে থাকে। শিক্ষার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর নির্ভরতা, পেশা ও বৃত্তির জন্য সরকার ও পুঁজিবাদী ব্যবস্থার উপর নির্ভরতা, এমনকি আত্মসম্মানের জন্য আধুনিকতা-নির্ধারিত প্রমিত ধাঁচাটিকে অনুকরণ করে যাওয়ার উপর নির্ভরতা। শৃঙ্খলাদায়ক ক্ষমতা ও জৈবক্ষমতার গ্রন্থিগুলো এভাবে বেঁধে দেওয়া হয়। সুদীর্ঘ প্রকৃতিলগ্ন জীবনাচরণের পরম্পরা থাকা মানুষজনও তখন নিজেদের স্বাভাবিকতাকে বিসর্জন দিয়ে সরকারের শিডিউল্ড কাস্টের তালিকায় ঢুকে সরকারি অনুগ্রহ পাওয়ার জন্য নিজেদের মধ্যে মারামারি শুরু করে।

ভারতীয় উপমহাদেশে উনিশ শতকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের শাসনতান্ত্রিকতার হাতিয়ার হিসেবে জনসমীক্ষা, ভাষাসমীক্ষা, ভৌগোলিক সমীক্ষার মধ্য দিয়ে আবির্ভূত হয়ে ক্ষেত্রসমীক্ষা এই একুশ শতকে বহুরূপে সর্বত্র বিরাজমান। কেবল সরকারি দপ্তরের আমলা-আধিকারিক বা করণিকরা নয়, প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞানচর্চা মহলের জোব্বা আঁটা মানববিদ্যাশাস্ত্রের গবেষক-শিক্ষক-ছাত্রকুল ক্ষেত্রসমীক্ষার ছককাটা প্রশ্নপত্র হাতে চারিদিকে ছুটে বেড়াচ্ছে ছক ভরিয়ে শ্রেণিবদ্ধকরণ ও নিবন্ধীকরণের মাধ্যমে জ্ঞানোৎপাদনের বিভূতিতে আমোদিত হয়ে। এবং তার মধ্য দিয়ে ‘আধুনিকতা’-র কর্কটরোগকে আরো ছড়িয়ে দিচ্ছে। মহাশয়রা এবার ক্ষান্ত হোন। ছকের বাইরে, ধাপকাটা শ্রেণিবদ্ধকরণের বাইরে, রাষ্ট্র-পুঁজি-যন্ত্রবিজ্ঞান-শহর-মুখী ক্লান্ত অভিযাত্রার বাইরে যেটুকু স্বরাট সুস্থতা টিকে আছে এখনও, তা দয়া করে আপনাদের উপস্থিতি দিয়ে কলুষিত ও শেষাবধি ধ্বংস করবেন না।

 

উদ্ধৃতিসূত্র

১। মিশেল ফুকো, ফুকো লাইভ (সেমিওটেক্সট, নিউ ইয়র্ক, ১৯৯৬), পৃষ্ঠা:৮৪। বাংলা তর্জমা বর্তমান লেখকের করা।

২। মিশেল ফুকো-র মূল ফরাসি রচনা থেকে অ্যালান সেরিডান কর্তৃক ইংরেজিতে অনূদিত ‘ডিসিপ্লিন অ্যান্ড পানিশ: দি বার্থ অফ দি প্রিজন’ (ভিনটেজ/র‍্যান্ডম হাউজ, ১৯৭৯), পৃষ্ঠা: ১৯৮, ১৯৯। বাংলা তর্জমা বর্তমান লেখকের করা।

৩। মিশেল ফুকো-র মূল ফরাসি রচনা থেকে অ্যালান সেরিডান কর্তৃক ইংরেজিতে অনূদিত ‘ডিসিপ্লিন অ্যান্ড পানিশ: দি বার্থ অফ দি প্রিজন’ (ভিনটেজ/র‍্যান্ডম হাউজ, ১৯৭৯), পৃষ্ঠা: ২০৫। বাংলা তর্জমা বর্তমান লেখকের করা।

৪। মিশেল ফুকো, ক্যালিফোর্নিয়ার পালো অল্টো স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে প্রদত্ত ভাষণ, ১৯৭৯-র অক্টোবর। বাংলা তর্জমা বর্তমান লেখকের করা।

 

 

0 Comments
Leave a reply