একটি মাছি কয়েক মিনিট ধরে বাসের ভেতর গোল গোল ঘুরছিল, অথচ জানলাগুলো সব বন্ধ। অদ্ভুত দৃশ্য বটে। ক্লান্ত ডানায় নিঃশব্দে সামনে পিছনে উড়ছিল। মাছির উপর থেকে দৃষ্টি হারিয়ে ফেলেছিলেন জ়ানিন। আবার দৃষ্টি ফিরে পেতে দেখলেন, মাছিটি তাঁর স্বামীর নিশ্চল হাতে বসে রয়েছে। ঠান্ডা আবহাওয়া। মাছিটি কেঁপে কেঁপে উঠছিল যখন জানলার উপর দমকা বালুকাময় বাতাস আঁচড় কেটে যাচ্ছিল। শীতের সকালের সামান্য আলো চিরে বাহনটি টিনের বডি আর এক্সেলের হল্লা করতে করতে হেলতে দুলতে গড়িয়ে চলছিল অত্যন্ত ধীর গতিতে। জ়ানিন তাকালেন তাঁর স্বামীর দিকে। সরু কপালে এলিয়ে পড়া কয়েকরাশি পাকা চুল, চওড়া নাক আর ঝুলে পড়া ঠোঁট। মারশেলকে মনে হচ্ছিল একজন গোবেচারা দুঃখী, অনেকটা রোমান রূপকথার ফনের মতো।
খানাখন্দে ভরা রাস্তার প্রতিটি গর্তে জ়ানিনের কপালে অবধারিত প্রাপ্তি ছিল তাঁর স্বামীর কনুইয়ের গুতো। তারপর তাঁর স্বামীর ভারী শরীরটি ছড়িয়ে থাকা পায়ের ওপর ঢলে পড়ে আবার অসাড় হয়ে যেত, চোখে থাকত অসীম শূন্যতা। অবসন্ন শরীরের শুধু মোটা লোমশূন্য হাত দুটো ছিল কর্মরত, যা কব্জি ছাড়িয়ে আস্তিনের নিচ থেকে বেরিয়ে থাকা পশমের গেঞ্জির কারণে আরও ছোট দেখাচ্ছিল। হাত দুটো হাঁটুর মধ্যে রাখা একটি ছোট ক্যানভাসের সুটকেসটিকে এত শক্ত করে ধরে রেখেছিল যে মাছির আলসেমি ভরা গতিবিধি তাঁর হাতে কোনরকম অনুভূতি সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়েছিল।
হঠাৎ বাতাসের গর্জন পরিষ্কার শোনা গেল। বাসের চারপাশের কমলা রঙের কুয়াশা ঘনতর হয়ে উঠল। মনে হচ্ছিল যেন কোন অদৃশ্য হাত তাল তাল বালি ছুঁড়ে মারছে জানলার উপর। মাছিটি ঠান্ডা ডানা ঝাঁকিয়ে, পা মটকে উড়ে গেল। বাসটির গতি ক্রমে এতটাই কমে আসতে লাগল যে মনে হল এই থেমে যাবে। কিন্তু ঝড় থেমে গেল, কুয়াশা কিছুটা পরিষ্কার হল এবং গাড়িটি আবার গতি ধরল। বালুকাময় চারপাশে ফাঁক ফোঁকর খুঁজে আলো নিজের পথ করে নিল। দু’তিনটে ক্ষুদ্র লিকলিকে সাদাটে খেজুর গাছ, যেন ধাতব কাট-আউট, জানলায় এক পলক দেখা দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। মারশেল হঠাৎ বললেন, ‘আজব দেশ বটে!’
বাস ভর্তি আরব যাত্রী, সবার পরনে ঘোমটা দেওয়া আলখাল্লা। তারা এমন ভান করছিল যেন ঘুমিয়ে রয়েছে। কেউ কেউ তাদের পা সিটের উপর ভাঁজ করে বসেছিল বলে অন্যদের চেয়ে বেশি দুলছিল। তাদের নীরবতা এবং ঔদাসীন্য জ়ানিনের উপর দুর্বহ বোঝা হয়ে চেপে বসছিল; মনে হচ্ছিল যেন এই বোবা সহচরদের সঙ্গে ভ্রমণ করছেন দিনের পর দিন। অথচ বাসটি রেললাইনের শেষ প্রান্ত থেকে আজ ভোরেই রওনা দিয়েছিল। শীতের সকালে প্রথমে সোজা রাস্তা দিয়ে এগোলেও, পরে মালভূমির নির্জন পাথুরে এবড়ো-খেবড়ো রাস্তা ধরে উপরের ফাঁকা প্রান্তরে উঠতে লেগেছিল দুই ঘণ্টা। এই প্রান্তর ভিন্ন ভিন্ন দিকে দূরে গিয়ে মিশেছে লালচে-কমলা আকাশে ভিন্ন ভিন্ন রেখায়। কিন্তু ঝড় উঠে ধীরে ধীরে বিশাল প্রান্তরটি গ্রাস করে নিল। সেই মুহূর্ত থেকে যাত্রীরা কিছুই দেখতে পাচ্ছিল না। একে একে তারা কথা বলা বন্ধ করে দেয়। মনে হচ্ছিল যেন নিদ্রাহীন রাতে নিঃশব্দে এগিয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে তারা শুধু ঠোঁট আর চোখ মুছছিল বালির কারণে, যা গাড়ির ভিতরে ঢুকে পড়ছিল।
‘জ়ানিন!’ স্বামীর ডাকে তাঁর চিন্তায় ছেদ পড়ল। তাঁর মতো লম্বা এবং শক্তসবল একজনের পক্ষে এই নামটি কতটা বেমানান– আবারও এমন চিন্তা তাঁকে পেয়ে বসল। মারশেল জানতে চাইলেন তাঁর নমুনার বাক্সটি কোথায়। সিটের নিচে ফাঁকা জায়গায় অল্প অনুসন্ধানের পর পা ঠোক্কর খেল একটি বস্তুতে, যা তিনি ধরে নিলেন সেই বাক্সটি হবে। ঝুঁকতে গিয়ে কিছুটা হাঁপিয়ে উঠলেন। অথচ স্কুলে জিমনাস্টিকে প্রথম পুরস্কার তাঁর কাছে ছিল জলভাত; হাঁপিয়ে ওঠা কী, তা ছিল অজানা। কতদিন আগের কথা? পঁচিশ বছর! পঁচিশ বছর তেমন কিছু পুরনো নয়। তাঁর মনে হল যেন এই গতকালই তিনি স্বাধীন জীবন এবং বিয়ের মধ্যে কোনটা বেছে নেবেন, তা নিয়ে দোটানায় ভুগছিলেন; এই গতকালই যেন তিনি চিন্তিত ছিলেন– তাঁকে একা একা বুড়ি হয়ে যেতে হবে কিনা।
তাঁকে একা থাকতে হয়নি। যে আইনের ছাত্রটি সবসময় তাঁর সঙ্গে থাকতে চেয়েছিলেন, তিনি এখন ঠিক তাঁর পাশে। ঘটনা যেভাবে গড়িয়েছিল, তাতে মোটের উপর তিনি তাঁকে মেনে নিয়েছিলেন, যদিও ছাত্রটি ছিলেন তাঁর চেয়ে লম্বায় একটু খাটো। তাঁর সরু তীক্ষ্ণ হাসির রেখা বা বাইরের দিকে ঠেলে বেরিয়ে আসা কালো গোল গোল চোখ তাঁর মোটেও বিশেষ পছন্দের ছিল না। তিনি অবশ্য পছন্দ করতেন তাঁর জীবনের মুখোমুখি দাঁড়ানোর সাহস, যদিও এই দেশের সমস্ত ফরাসিদের মধ্যে এই গুণটি খুবই সাধারণ। তিনি অবশ্য পছন্দ করতেন তাঁর হতাশায় ঝুলে পড়া মুখ যখন ঘটনা বা মানুষ তাঁর প্রত্যাশা পূরণ করতে ব্যর্থ হত। সর্বোপরি, তিনি ভালোবাসা পেতে পছন্দ করতেন আর ছাত্রটিও তাঁকে খুব যতনে আগলে রেখেছিলেন। বারবার তাঁকে তাঁর মূল্য স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি তাঁকে বাস্তবে একজন করে তুলেছিলেন। না, তিনি একা ছিলেন না…
জোরে জোরে হর্ন বাজিয়ে অদৃশ্য বাধাগুলির মধ্য দিয়ে বাসটি এগিয়ে যাচ্ছিল। যদিও গাড়ির ভিতরে কেউই দুল ছিল না। হঠাৎ জ়ানিনের মনে হল কেউ তাঁকে দেখছে। পাশের সারির একটি সিটের দিকে তাকালেন তিনি। লোকটি আরব ছিলেন না। প্রথম থেকেই তাঁকে লক্ষ্য না করার জন্য নিজেই বিস্মিত হলেন তিনি। সাহারার ফরাসি রেজিমেন্টের ইউনিফর্ম পরা লোকটির মুখ ছিল রোদে পোড়া, মাথায় অপরিষ্কার লিনেনের টুপি। মুখটা ছিল শেয়ালের মতো লম্বা ও সূচলো। তার ধূসর চোখগুলি অননুমোদনের বিষণ্ণতা নিয়ে তাঁকে স্থির দৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করছিল। হঠাৎ লজ্জা পেয়ে স্বামীর দিকে ফিরলেন জ়ানিন। তাঁর স্বামী তখনও একেবারে সোজা কুয়াশার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। জ়ানিন আশ্লেষে কোটের মধ্যে সিঁধিয়ে গেলেন, কিন্তু তখনও তাঁর চোখ সৈনিকের দিকে। সৈনিকটি ছিলেন লম্বা এবং রোগা; এত রোগা যে ইউনিফর্মে মনে হচ্ছিল যেন শুষ্ক ভঙ্গুর পদার্থের সমাহার–যেন বালি এবং হাড়ের মিশ্রণ। ঠিক তখনই তাঁর চোখ সামনে বসা আরবদের রোগাটে হাত এবং রোদে পোড়া মুখগুলির উপর পড়ল। তিনি লক্ষ্য করলেন যে ঢিলেঢালা পোশাকেও তাদের সিটে ছিল প্রচুর জায়গা। অথচ তিনি এবং তাঁর স্বামী একদম গায়ে গায়ে সেঁটে বসেছিলেন। তিনি স্বামীর কোটটি হাঁটুর উপর টেনে নিলেন। তাঁকে ঠিক মোটা বলা যায় না। বরং তিনি ছিলেন লম্বা এবং মাংসল। তিনি খুব ভালোভাবে জানতেন যে তাঁর পুষ্ট মসৃণ শরীর এখনও সুন্দর। তিনি খুব ভালোভাবে জানতেন, যখন পুরুষরা তাঁর দিকে তাকাত, তখন তাদের পক্ষে তাঁর দিক থেকে চোখ ফেরানো কঠিন হয়ে পড়ত—তাঁর সুষম বৃহৎ দেহাবয়ব, সরলতার মাধুর্যে ভরা মুখ, উজ্জ্বল চোখের উষ্ণতা—এসবের আকর্ষণ অগ্রাহ্য করা তাদের পক্ষে সত্যিই কঠিন ছিল। না, তেমন কিছুই ঘটেনি যেমনটি তিনি আশা করেছিলেন।
যখন মারশেল তাঁকে সঙ্গে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন, তিনি প্রতিবাদ করেছিলেন। যুদ্ধের শেষের দিকে, যখন ব্যবসা-বাণিজ্য স্বাভাবিক হয়ে এল, মারশেল কিছুদিন ধরে এই ভ্রমণের কথা ভাবছিলেন। যুদ্ধের আগে আইনের পড়াশুনো ছেড়ে তিনি তাঁর বাবার ছিট কাপড়ের ব্যবসা নিজের হাতে তুলে নেন। ব্যবসাটি মোটামুটি ভালোই চলছিল। উপকূলে যৌবনের বছরগুলো বেশ আনন্দেই কেটেছিল। কিন্তু শারীরিক পরিশ্রম তাঁর বিশেষ পছন্দের ছিল না। তাই খুব শিগগিরই তাঁকে সৈকতে নিয়ে যাওয়া ছেড়ে দিয়েছিলেন তিনি।
প্রত্যেক রবিবার বিকেলে ছোট গাড়ি করে তাঁরা শহরের বাইরে বেড়াতে যেতেন। বাকি সময়ে তিনি রঙ-বেরঙের কাপড়ে ভরা দোকানে থাকতে পছন্দ করতেন। তাঁদের দোকানটি ছিল আধা-নেটিভ, আধা-ইউরোপীয় মহল্লায়, আর দোকানের উপরে ছিল তিন কামরার তাঁদের বাসা। বাসার সাজ-সজ্জায় গ্যালারি বার্ব থেকে কেনা ইউরোপীয় আসবাবপত্র যেমন ছিল, তেমনি স্থানীয় আরবদের থেকে কেনা পর্দা, সোফা-কাভার, টেবিল-কাভার ইত্যাদি বস্ত্রখণ্ডও ছিল। তাঁদের কোনো সন্তান হয়নি। আধা-বন্ধ জানলার পিছনে আধা-অন্ধকারে তাঁদের বছরগুলো কাটত। বসন্ত, সৈকত, ভ্রমণ, নীলাকাশ—সবই ছিল অতীত। ব্যবসা ছাড়া মারশেলের আর কোনো কিছুতেই আগ্রহ ছিল না।
জ়ানিন বুঝতে পেরেছিলেন যে তাঁর স্বামীর আসল আগ্রহ অর্থ উপার্জনে। প্রকৃত কারণ না জেনেই তিনি তা অপছন্দ করতেন, যদিও এতে তাঁর লাভই ছিল। তাঁর স্বামী কৃপণ তো ছিলেনই না, বরং ছিলেন বেশ উদার, বিশেষ করে তাঁর বেলায়। ‘আমার কিছু হয়ে গেলে,’ তিনি বলতেন, ‘তোমার কোনো কষ্ট হবে না।’ মৌলিক চাহিদার পূরণ অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু বাকি সবকিছু, যা প্রাথমিক নয়, কীভাবে পূরণ হবে? তিনি মাঝে মাঝে এই কথাটি ভাবতেন, তবে ভাসাভাসা। এদিকে, তিনি মারশেলকে হিসেবে সাহায্য করতেন এবং মাঝে মাঝে দোকানে বসতেন তাঁর পরিবর্তে।
গ্রীষ্মকাল ছিল সবচেয়ে কঠিন; তাপ এমনকি একঘেয়েমির বেঁচে থাকা মিষ্টি উত্তেজনাকেও গলা টিপে ধরত। হঠাৎ, এক গ্রীষ্মে, যুদ্ধে, যেমনটা হয়ে থাকে, মারশেলের ডাক পড়ল এবং স্বাস্থ্যজনিত কারণে বাদও গেলেন। বাজারে ছিট কাপড় অমিল, ব্যবসার অচলাবস্থা, ফাঁকা রাস্তাঘাট উত্তপ্ত। এখন কিছু একটা ঘটে গেলে, জ়ানিনের কী হবে? এই কারণেই, বাজারে কাপড় ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গে, উচ্চ মালভূমি এবং দক্ষিণের সমস্ত গ্রামগুলোতে ব্যবসার দায়িত্ব মারশেল একান্ত নিজের কাঁধে তুলে নিলেন। তিনি ঠিক করলেন মধ্যস্বত্বভোগী ছাড়া সরাসরি আরব ব্যবসায়ীদের কাছে মাল বিক্রি করবেন। জ়ানিনকে সঙ্গে নিতে চেয়েছিলেন তিনি। তিনি জানতেন যে ভ্রমণ কঠিন ছিল, জ়ানিনের শ্বাস নিতে কষ্ট হয় এবং তিনি বাড়িতে থাকতেই পছন্দ করবেন। কিন্তু মারশেল ছিলেন একগুঁয়ে এবং জ়ানিনও মেনে নিয়েছিলেন, কারণ বাকবিতণ্ডাতে জড়ানোর ইচ্ছে তাঁর একদমই ছিল না।
যেখানে তাঁরা এসে পৌঁছেবেন, সেখানে কিছুই তাঁর কল্পনার সঙ্গে মিলবে না। তিনি ভেবেছিলেন তীব্র তাপদাহ, মাছির ঝাঁক, আর অ্যানিসের গন্ধযুক্ত নোংরা হোটেলের কথা। ঠান্ডা, কনকনে বাতাস, এই আধা-মেরু মালভূমি আর যত্রতত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মোরাইনগুলির কথা তিনি ঘুণাক্ষরেও ভাবেননি। তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন পাম গাছ এবং নরম বালির। কিন্তু এখন তিনি যা দেখলেন, তা মরুভূমিও নয়—শুধুই পাথর আর পাথর। আকাশ বলতে শুধুই পাথরের ধুলো, খর্খরে এবং ঠান্ডা। মাটি বলতে শুধু পাথর আর পাথরের ফাঁকে ফাঁকে শুষ্ক ঘাস। হঠাৎ বাসটি আচমকা থেমে গেল।
ড্রাইভার কয়েকটি কথা চেঁচিয়ে বললেন এমন এক ভাষায় যা জ়ানিন সারাজীবন শুনেছেন কিন্তু কখনো বুঝতে পারেননি। ‘কী হয়েছে?’ মারশেল জিজ্ঞেস করলেন। ড্রাইভার এবার ফরাসিতে বললেন, বালি জমে কার্বুরেটর বন্ধ হয়ে গেছে। আবারও এই দেশকে অভিসম্পাত করলেন মারশেল। ড্রাইভার হাসতে হাসতে বললেন, এটা কোনো ব্যাপার না। কার্বুরেটর পরিষ্কার করে তারা আবার যাত্রা শুরু করবে। তিনি দরজা খুলতেই বাসের মধ্যে ঠান্ডা বাতাস ঢুকে পড়ল এবং সাথে অসংখ্য বালির দানা যাত্রীদের চোখে-মুখে আছড়ে পড়ল। আরবরা নীরবে তাদের নাক আলখাল্লার মধ্যে ঢুকিয়ে কুঁকড়ে বসল। ‘দরজা বন্ধ করো,’ মারশেল চিৎকার করে উঠলেন। ড্রাইভার হাসতে হাসতে ঢিমে চালে দরজার কাছে ফিরে এলেন। ড্যাশবোর্ডের নিচ থেকে কিছু যন্ত্রপাতি বের করলেন এবং তারপর দরজাটি বন্ধ না করেই কুয়াশায় মিলিয়ে গেলেন। মারশেল দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ‘তুমি নিশ্চিত থাকতে পার যে জীবনে সে কখনো মোটর দেখেনি।’ ‘ওহ, চুপ করো!’ হঠাৎ অসহিষ্ণু হয়ে মেজাজ হারিয়ে জ়ানিন বললেন।
রাস্তার ধারে বাসের প্রায় গা লেগে স্থির দাঁড়িয়ে ছিল আলখাল্লায় আপাদমস্তক ঢাকা কয়েকটি অবয়ব। মুখের আবরণের ফাঁক দিয়ে ঘোমটার নিচ থেকে দৃশ্যমান ছিল শুধু তাদের চোখ–দৃষ্টিপথ নিশ্চল যাত্রীদের দিকে। ‘মেষপালক’, মারশেল বললেন। গাড়ির ভিতরে ছিল অখণ্ড নীরবতা। যাত্রীরা সব মাথা নিচু করে এই অন্তহীন মালভূমি জুড়ে ছুটে চলা বাতাসের শব্দ শুনছিল বলে মনে হচ্ছিল। হঠাৎ জ়ানিন লক্ষ্য করলেন, বাসে প্রায় কোনো মালপত্র নেই। রেলপথের শেষ প্রান্তে ড্রাইভার তাঁদের ট্রাঙ্ক এবং কয়েকটি বান্ডিল ছাদের উপর তুলে দিয়েছিলেন। বাসের তাকগুলোতে পড়ে ছিল শুধু কয়েকটি বাঁকা লাঠি আর বাজারের খালি ঝুড়ি। দক্ষিণ দেশ থেকে আসা এই মানুষেরা সম্ভবত খালি হাতে ভ্রমণ করছিল।
কিন্তু ড্রাইভার দ্রুত পায়ে ফিরে এলেন। মুখ ঢাকা থাকলেও চোখে হাসি স্পষ্ট ছিল। তিনি ঘোষণা করলেন যে শিগগিরই বাস ছাড়বে। দরজা বন্ধ করার সাথে সাথে বাতাস স্তব্ধ হয়ে গেল এবং জানলার উপর বালির বৃষ্টি স্পষ্ট শোনা গেল। কয়েকটি কাশির দমকার পর ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেল। অনেকবার চাবি ঘোরানোর পর অবশেষে ইঞ্জিন স্পার্ক করল এবং ড্রাইভার প্যাডেলে চাপ দিতেই বড়সড় ঝাঁকুনির সঙ্গে বাসটি চলতে শুরু করল। স্থির দাঁড়িয়ে থাকা জরাজীর্ণ আলখাল্লা পরা মেষপালকের দল থেকে একটি হাত উঠে তৎক্ষণাৎ কুয়াশায় মিলিয়ে গেল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হল খারাপ রাস্তা। বাসের ঝাঁকুনির সাথে তাল মিলিয়ে আরবরা ক্রমাগত দুলতে থাকল।
তবুও, তন্দ্রায় ঢলে পড়ছিলেন জ়ানিন। হঠাৎ তাঁর সামনে লজেন্সে ভরা একটি ছোট হলুদ বাক্স আবির্ভূত হল। শেয়াল-সেনাটি হাসিমুখে তাঁর দিকে তাকিয়ে ছিলেন। দ্বিধা কাটিয়ে জ়ানিন একটি লজেন্স তুলে নিয়ে তাঁকে ধন্যবাদ জানালেন। বাক্সটি পকেটে রাখার সঙ্গে সঙ্গে শেয়াল-সেনাটির হাসিও গেল মিলিয়ে। এখন তার চোখ একদম সোজা; রাস্তার দিকে। জ়ানিন মারশেলের দিকে ফিরতে তিনি শুধু তাঁর মজবুত ঘাড়ের পেছনটা দেখতে পেলেন। জানলা দিয়ে মারশেল বালি-পাথরের বাঁধ থেকে ওঠা ঘন কুয়াশা দেখছিলেন। এই কয়েক ঘণ্টার ভ্রমণের ক্লান্তি গাড়ির মধ্যে সমস্ত জীবনীশক্তি নিঃশেষ করে ফেলেছিল। ঠিক তখনই বাইরে হঠাৎ হৈ-হট্টগোল শুরু হল।
আলখাল্লা পরা বাচ্চারা লাট্টুর মতো ঘুরতে ঘুরতে, লাফাতে লাফাতে, হাততালি দিতে দিতে বাসের চারপাশে দৌড়াচ্ছিল। বাসটি এখন একটি সোজা রাস্তা ধরে নিচে নেমে যাচ্ছিল, যার দুই পাশে ছিল নিচু নিচু ঘরবাড়ি; তারা মরুদ্যানে প্রবেশ করছিল। বাতাস এখনও বইছিল, কিন্তু বাড়ির দেয়ালগুলি সেই বালিকণাগুলি আটকে দিচ্ছিল যা আগে আলো আটকে রেখেছিল। তবুও আকাশ ছিল মেঘাচ্ছন্ন। হৈ-হট্টগোলের মাঝে, বাসটি ক্যাঁচ করে থামল একটি হোটেলের তোরণের সামনে। রোদে পোড়া ইটের তৈরি তোরণ, রঙ চটা জানলা, খসে পড়া পলেস্তারা–এসব দেখে হোটেলের রক্ষণাবেক্ষণের অভাব স্পষ্ট ধরা পড়ছিল। বাস থেকে ফুটপাতে নামতে গিয়ে টাল খেয়ে দ্রুত নিজেকে সামলে নিলেন জ়ানিন। তিনি দেখতে পেলেন বাড়ীগুলোর ছাদ থেকে উপরে উঠে গেছে সরু সরু হলুদ মিনার। তাঁর ইচ্ছে হল মরুদ্যানের খেজুর গাছগুলির দিকে যেতে। যদিও তখন দুপুর, তাও ঠান্ডা জাঁকিয়ে বসেছিল; বাতাস তাঁকে শিহরিত করছিল। মারশেলের দিকে ফিরতেই দেখলেন, সেনাটি তাঁর দিকে এগিয়ে আসছেন। তিনি আশা করছিলেন যে তিনি তাঁকে দেখে হাসবে বা অভিবাদন জানাবেন। কিন্তু তিনি তাঁকে পাশ কাটিয়ে, এগিয়ে গিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
মারশেল ব্যস্ত ছিলেন বাসের ছাদ থেকে ছিট-কাপড়ের কালো ট্রাঙ্কটি নামানোর কাজে। কাজটা মোটেও সহজ ছিল না। বাস-চালক মালপত্র নামাচ্ছিলেন, কিন্তু তিনি এই মুহূর্তে কাজ থামিয়ে বাসের চারপাশে জড়ো হওয়া আলখাল্লা পরা মানুষদের সঙ্গে গল্পে মেতে উঠেছিলেন। এদিকে জ়ানিনকে ঘিরে ছিল বেশ কয়েকজন। সবার মুখই এমন যেন হাড়ের উপর চামড়ার প্রলেপ। তাদের কণ্ঠ থেকে উদ্গত নিম্ন কম্পাঙ্কের কথা মিশে যে কর্কশতা উৎপণ্ণ হয়েছিল তা ক্লান্ত জ়ানিনকে আরো ক্লান্ত করে তুলল। “আমি ভিতরে যাচ্ছি,” তিনি মারশেলকে বললেন। তখন মারশেল অধৈর্য হয়ে চালককে চিৎকার করে কিছু বলার চেষ্টা করছিলেন। জ়ানিন হোটেলে প্রবেশ করলেন। ম্যানেজার ছিলেন ফরাসি; রোগা ও স্বল্পভাষী। তিনি তাঁকে সম্ভাষণ জানিয়ে দোতলার একটি ঘরে নিয়ে গেলেন। দোতলার লম্বা বারান্দার একপাশে সারিবদ্ধ ঘর, অন্যপাশ রাস্তার দিকে খোলা। ঘরে ছিল একটি লোহার খাট, একটি সাদা কলাই করা চেয়ার, একটি কাঠের পাল্লাহীন আলমারি আর মোটা পর্দার আড়ালে একটি ধুলোয় ঢাকা বেসিন।
ম্যানেজার দরজা বন্ধ করে বেরিয়ে গেলেন। সাজসজ্জাহীন সাদা দেয়াল থেকে উঠে আসা ঠান্ডায় কাঁপতে লাগলেন জ়ানিন। তিনি বুঝতে পারছিলেন না কোথায় রাখবেন তাঁর ব্যাগটি, কোথায়ই বা রাখবেন নিজেকে। তাঁকে হয় শুয়ে থাকতে হবে অথবা দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। উভয় ক্ষেত্রেই তাঁকে কাঁপতে হবে। তিনি ব্যাগ হাতে ছাদের কাছাকাছি চৌকো জানলা দিয়ে ঢুকে পড়া এক ফালি আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলেন একইভাবে, নিশ্চল। কীসের জন্য? তা তিনি নিজেও জানতেন না। তিনি শুধু অনুভব করছিলেন তাঁর একাকীত্ব, হাড় হিম করা শীত এবং হৃদয়ের ভার-বৃদ্ধি। প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন স্বপ্নের জগতে। রাস্তার কোলাহল বা মারশেলের চিৎকার তাঁর কানে রেখাপাত করছিল না। তাঁর মনে হচ্ছিল ছোট্ট চৌকো জানলা দিয়ে নদীর কলকল ধ্বনি ভেসে আসছে তাঁর কানে, যা বাস্তবিক খেজুর গাছে বাতাসের ঝিরঝির ধ্বনি। তারপর বাতাস বাড়তে লাগল। মৃদু জলতরঙ্গের ধ্বনি ঢেউ ভাঙ্গার হিসহিস ধ্বনিতে পরিণত হল। তিনি কল্পনা করলেন দেয়ালের ওপারে ঋজু এবং নমনীয় তালগাছগুলি ঝড়ে দোল খাচ্ছে। কিছুই তাঁর প্রত্যাশার মতো ছিল না। তবুও সেই অদৃশ্য ঢেউগুলি তাঁর ক্লান্ত চোখকে সজীব করে তুলল। ঝুলে পড়া হাতের ভারে সামান্য ঝুঁকে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। পা বেয়ে শীত উপরে উঠে যাচ্ছিল। তিনি স্বপ্নে ঋজু এবং নমনীয় তালগাছগুলির মাঝে দেখছিলেন সেই মেয়েটিকে যা এককালে তিনি নিজে ছিলেন।
হাত-মুখ ধুয়ে তাঁরা ডাইনিং রুমে নেমে গেলেন। ফাঁকা দেয়ালে আঁকা উট এবং খেজুর গাছ, গাঢ় পুরু গোলাপি-বেগুনি পটভূমিতে বড়ই ফিকে দেখাচ্ছিল। ক্ষীণ আলো ঢুকছিল জানলাগুলি দিয়ে। মারশেল হোটেল ম্যানেজারের কাছে ব্যবসায়ীদের বিষয়ে জানতে চাইলেন। এরপর পোশাকে সামরিক পদক লাগানো এক বৃদ্ধ আরব তাঁদের খাবার পরিবেশন করলেন। একমনে রুটি ছিঁড়ে ছোট ছোট টুকরো করছিলেন মারশেল। তিনি তাঁর স্ত্রীকে জল খেতে বারণ করলেন। ‘এটা ফুটনো হয়নি। তার বদলে ওয়াইন খাও।’ ওয়াইন খেলে তাঁর ঘুম চলে আসে, তাই তিনি ওয়াইন পছন্দ করেন না। তাছাড়া, মেনুতে ছিল শুয়োরের মাংস। ‘কোরানে বারণ আছে বলে তারা এটা খায় না। কিন্তু কোরান জানে না যে ভালোভাবে রান্না করা শুয়োরের মাংস শরীরের কোনো ক্ষতি করে না। আমরা ফরাসিরা রান্না করতে জানি। তুমি কী ভাবছো?’
জ়ানিন কিছুই ভাবছিলেন না, হয়তো নবীদের উপর রাঁধুনিদের বিজয় সম্পর্কে ভাবছিলেন। তাঁকে তাড়াতাড়ি করতে হবে। পরের দিন সকালে আরও দক্ষিণে যেতে হবে; আজ সন্ধ্যের মধ্যে সব গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ সেরে ফেলতে হবে তাঁদের। মারশেল বৃদ্ধকে তাড়াতাড়ি কফি দিতে বললেন। বৃদ্ধ না হেসে শুধু মাথা নেড়ে বেরিয়ে গেলেন। ‘সকালে ধীরে, বিকেলে তাড়াহুড়ো নয়,’ হাসতে হাসতে বললেন মারশেল। অবশেষে কফি এল। কফি শেষ করতেই তাঁরা নেমে পড়লেন ধূলিময়, ঠাণ্ডা রাস্তায়। মারশেল একজন তরুণ আরবকে ডেকে ট্রাঙ্কটি বয়ে নিয়ে যেতে বললেন। কিন্তু মাল বোঝাইয়ের টাকা-পয়সা নিয়ে তাঁর একটি নীতিকে কেন্দ্র করে আরবের সঙ্গে তর্ক জুড়লেন। তাঁর মতামত, যা তিনি আবার জ়ানিনকেও জানালেন, সেই অস্পষ্ট নীতির উপর ভিত্তি করে ছিল যে তারা সবসময় দ্বিগুণ টাকা চায় এই ভেবে যে এক চতুর্থাংশে রফা হবে।
জ়ানিন অস্বস্তি নিয়ে দুই ট্রাঙ্ক-বাহকের পেছনে পেছনে চললেন। ভারী কোটের নিচে তিনি পরেছিলেন একটি পশমের পোশাক এবং চাইছিলেন যাতে তাঁকে মোটা না দেখায়। যদিও শুয়োরের মাংসের রান্না দারুণ ছিল এবং ওয়াইনও সামান্যই পান করেছিলেন, তবুও শুয়োরের মাংস এবং ওয়াইন দুটোই তাঁকে কিছুটা অসুবিধায় ফেলছিল। তাঁরা ধুলোমাখা গাছে ঘেরা একটি ছোট উদ্যানের পাশ দিয়ে হাঁটছিলেন। আরবরা তাঁদের না দেখার ভান করে অথবা গুরুত্ব না দিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিল। তাদের সর্বাঙ্গ ছিল আলখাল্লায় মোড়া। এমনকি যাদের কাপড় ছেঁড়াফাঁটা, তাদের চলাফেরায়ও মর্যাদার ছাপ ছিল স্পষ্ট যা তাঁর শহরের আরবদের মধ্যে দেখা যেত না।
জ়ানিন ট্রাঙ্কটির অনুসরণ করছিলেন, আর ট্রাঙ্কটি ভিড়ের মধ্যে দিয়ে পথ করে দিচ্ছিল। তাঁরা একটি মাটির কেল্লার সিংহদ্বার পেরিয়ে এমন এক ছোট চত্বরে এলেন যেখানে গাছগুলি খনিজ পাথরের টিলার মতো দেখাচ্ছিল। চত্বরটি যেখানে সবচেয়ে চও ড়া, সেখানে পর পর সারিবদ্ধ দোকানপাট, প্রত্যেকটির সম্মুখভাগে ছোট ছোট তোরণ। তাঁরা থামলেন সারির মাঝের একটি দোকানের সামনে। দোকানটির আকার কামানের গোলার মতো এবং রঙ দেখে মনে হয় যেন হালকা নীল চক দিয়ে আঁকা। বাইরের আলোয় দোকানটি আধো-অন্ধকার। চকচকে ঝকঝকে কাউন্টারের পিছনে দাঁড়িয়ে সাদা গোঁফওয়ালা বৃদ্ধ আরব কেটলি উঠিয়ে নামিয়ে কায়দা করে চা ঢালছিলেন তিনটি ছোট ছোট রঙিন গ্লাসে।
আধো অন্ধকারে চোখ সয়ে যাওয়ার আগে, দরজায়, পুদিনা চায়ের মিষ্টি গন্ধ পেলেন মারশেল এবং জ়ানিন। দরজার চৌকাঠে ঝুলন্ত দস্তার প্রলেপ মাখানো চায়ের কেটলি, পেয়ালা-পিরিচের মালা এবং পোস্টকার্ড ডিসপ্লেগুলি এড়িয়ে কাউন্টারের সামনে এসে দাঁড়ালেন মারশেল। জ়ানিন দরজায়ই দাঁড়িয়ে থাকলেন। তিনি একটু পাশে সরে দাঁড়ালেন যাতে আলো আড়াল না হয়। সেই মুহূর্তে, তিনি বৃদ্ধ ব্যবসায়ীর পিছনে অন্ধকারে দুটি আরবকে হাসতে দেখতে পেলেন, যারা দোকানের পিছন দিকে ফুলে থাকা বস্তার উপর বসেছিলেন।
দেয়ালে ঝুলছিল লাল-কালো গালিচা এবং নকশাকাটা ওড়না; মেঝেয় এলোমেলোভাবে ছড়ানো বস্তাগুলি সুগন্ধযুক্ত বীজে ভর্তি ছোট ছোট বাক্সের পাশে পড়েছিল। কাউন্টারের একপাশে ছিল একটি ঝকঝকে পিতলের দাঁড়িপাল্লা, একটি ক্ষয়ে যাওয়া গজকাঠি এবং সারি সারি নীল কাগজে মোড়ানো চৌকো চিনির প্যাকেট। উপরের প্যাকেটটি সামান্য খোলা ছিল, ফলে কয়েকটি চিনির চৌকো খণ্ড অনাবৃত। বৃদ্ধ ব্যবসায়ী চায়ের কেটলিটি নামিয়ে শুভেচ্ছা জানালেন। চায়ের গন্ধের সঙ্গে পশম এবং মশলার গন্ধও স্পষ্টভাবে মিশে যাচ্ছিল।
মারশেল সেই নিচু কণ্ঠে তড়বড় করে কথা বললেন, যেমনভাবে তিনি ব্যবসায়িক লেনদেনের সময় বলতেন। তারপর ট্রাঙ্ক খুলে পশম এবং সিল্ক বের করলেন। পণ্যগুলি ছড়িয়ে রাখার জন্য তিনি দাঁড়িপাল্লা এবং গজকাঠি সরিয়ে দিলেন। শশব্যস্ত হয়ে উদ্বিগ্নভাবে হেসে কণ্ঠ উঁচু করলেন তিনি, যেন তিনি নিজেকে সেই নারীর মতো আকর্ষণীয় করে তোলার চেষ্টা করছেন কিন্তু আত্মবিশ্বাসের অভাবে ভুগছেন। এখন, হাত ছড়িয়ে তিনি কেনা-বেচার অঙ্গভঙ্গি করছিলেন। বৃদ্ধ ব্যবসায়ী মাথা নেড়ে, চায়ের রেকাবিটি তাঁর পিছনের দুই আরবের দিকে এগিয়ে দিতে দিতে কয়েকটি শব্দ বললেন যা মারশেলকে নিরুৎসাহিত করার মতো মনে হল। মারশেল তাঁর পণ্যগুলি তুলে নিয়ে আবার ট্রাঙ্কে গুছিয়ে রাখলেন; কপাল মুছলেন, এমনভাবে যেন ঘাম মুছছেন। তিনি কুলিকে ট্রাঙ্ক তুলতে বলে তোরণের দিকে হাঁটা লাগালেন।
পরের দোকানে তাঁরা একটু বেশি ভাগ্যবান ছিলেন, যদিও শুরুতে ব্যবসায়ীর আচরণও ছিল সেই অলিম্পিয়ান দেবতাদের মতোই আভিজাত্যপূর্ণ। ‘তারা ভাবে তারা ঈশ্বরের সমান,’ মারশেল বললেন, ‘কিন্তু তাদেরও ব্যবসা করে খেতে হয়! জীবন সবার জন্যই কঠিন।’ জ়ানিন কোনো উত্তর না দিয়ে তাঁর পিছনে পিছনে চললেন। বাতাস প্রায় থেমে গিয়েছিল। আকাশের কিছু অংশ পরিষ্কার হতে শুরু করেছিল। মেঘের গভীর ফাঁক থেকে ঠাণ্ডা তীক্ষ্ণ আলো চুঁইয়ে পড়ছিল।
তাঁরা এখন উদ্যান ছেড়ে হাঁটছিলেন সরু রাস্তায়, দুপাশে উঁচু মাটির দেয়াল। দেয়াল জুড়ে ঝুলছিল ডিসেম্বরের পচা গোলাপ আর মাঝে মাঝে শুকনো, পোকায় খাওয়া ডালিম। ধুলো এবং কফির গন্ধ, কাঠের আগুনের ধোঁয়া, পাথর এবং ভেড়ার গন্ধ এই পাড়ায় ছড়িয়ে পড়েছিল। দেয়ালের গায়ে লেগে থাকা দোকানগুলো ছিল একে অন্যের থেকে বেশ কিছুটা দূরে। জ়ানিনের মনে হচ্ছিল তাঁর পা ভারী হয়ে উঠছে। কিন্তু তাঁর স্বামী ধীরে ধীরে আরও প্রফুল্ল হয়ে উঠছিলেন। বিক্রিবাট্টা শুরু হয়ে গিয়েছিল, তাই বেশ ফুরফুরে মেজাজে জ়ানিনকে ‘সোনা’ বলে ডাকছিলেন; এই ভ্রমণ ব্যর্থ হবে না। ‘অবশ্যই,’ জ়ানিন যান্ত্রিকভাবে বললেন, ‘তাদের সঙ্গে সরাসরি লেনদেন করাই ভাল।’
তাঁরা অন্য একটি রাস্তা ধরে শহরের কেন্দ্রে ফিরে এলেন। বিকেল গড়িয়ে গিয়েছিল; আকাশ এখন প্রায় পুরোপুরি পরিষ্কার। তাঁরা চকে এসে থামলেন। হাত ঘষতে ঘষতে সামনে পড়ে থাকা ট্রাঙ্কটির দিকে গদগদ চোখে তাকালেন মারশেল। ‘ওই দিকে তাকাও,’ জ়ানিন বললেন। চকের অন্য প্রান্ত থেকে এক লম্বা, মেদহীন, বলিষ্ঠ আরব আসছিলেন। পরনে ছিল আকাশী নীল আলখাল্লা, নরম বাদামি বুট এবং হাতে দস্তানা–গর্বের সঙ্গে উঁচু করে ধরা বাদামি মুখ, নাক ঈগলের মতো টিকোলো। মাথায় আলগোছে জড়ানো পাগড়ি তাঁকে ফরাসি অফিসারদের থেকে আলাদা করছিল। ফরাসি অফিসারদের দায়িত্বে ছিল স্থানীয় প্রশাসন এবং যাদের জ়ানিন মাঝে মাঝে শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন। তিনি হাত থেকে দস্তানা খুলতে খুলতে তাঁদের দিকে ধীরগতিতে এগিয়ে আসছিলেন, কিন্তু মনে হচ্ছিল তিনি তাঁদের দিকে নয়, অন্য কোথাও তাকিয়ে ছিলেন। ‘দেখো, ওই লোকটার হাবভাব দেখো,’ মারশেল কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন, ‘নিজেকে মনে করে যেন জেনারেল।’ এটা ঠিক, এখানকার সবার মধ্যে গর্ববোধ প্রবল; কিন্তু এই ভদ্রলোকটি, সত্যিই, সীমা ছাড়িয়ে গেছেন। যদিও তাঁরা যেখানে দাঁড়িয়ে, সেটি সম্পূর্ণ জনশূন্য, তবুও তিনি সোজা ট্রাঙ্কের দিকে হেঁটে আসছিলেন কিছুই লক্ষ্য না করে, মায় তাঁদেরও না। তারপর তাঁদের মধ্যে দূরত্ব দ্রুত ক্রমে কমে আসতে লাগল। যখন আরব লোকটি তাঁদের একদম কাছে, মারশেল তরিঘড়ি ট্রাঙ্কের হাতল ধরে হ্যাঁচকা টানে ট্রাঙ্কটিকে একপাশে সরিয়ে দিলেন। আরব লোকটি কিছুই খেয়াল না করে একইভাবে মাটির ঢিপির দিকে সোজা এগিয়ে গেলেন। জ়ানিন তাঁর স্বামীর দিকে তাকালেন; মুখ ঝুলে পড়েছিল তাঁর। ‘তারা ভাবে যে তারা যেকোনো কিছু করে পার পেয়ে যাবে এখন,’ তিনি বললেন। জ়ানিন কিছু বললেন না। আরব লোকটির বোকামি ভরা ঔদ্ধত্য তাঁর কাছে অসহনীয় হয়ে উঠেছিল। হঠাৎ বিপন্ন বোধ করলেন তিনি।
এই জায়গা ছেড়ে চলে যেতে চাইছিলেন তিনি। হোটেলের ঘরে ফিরে যাওয়ার কথা ভাবছিলেন। কিন্তু সেই বরফঠান্ডা ঘরে যাওয়ার চিন্তা তাঁকে নিরুৎসাহিত করল। হঠাৎ তাঁর মনে পড়ল যে ম্যানেজার তাঁকে দুর্গের ছাদে উঠে মরুভূমি দেখার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তিনি এই কথা মারশেলকে জানালেন এবং পীড়াপিড়ি করলেন যাতে তিনি ট্রাঙ্কটি হোটেলে রেখে আসেন। কিন্তু মারশেল ক্লান্ত ছিলেন এবং ডিনারের আগে একটু ঘুমতে চাইছিলেন। ‘প্লিজ,’ জ়ানিন বললেন। মারশেল তাঁর দিকে হঠাৎ একটু বেশি গুরুত্ব দিয়ে তাকালেন। ‘অবশ্যই, সোনা,’ তিনি বললেন। জ়ানিন হোটেলের সামনের রাস্তায় তাঁর জন্য অপেক্ষা করলেন।
সাদা আলখাল্লা পরা ভিড় ক্রমশ বেড়ে উঠছিল। কিন্তু একটি মহিলারও দেখা নেই। জ়ানিনের মনে হচ্ছিল, তিনি জীবনে এতগুলো পুরুষ একসঙ্গে কখনো দেখেননি। তবুও কারোর দৃষ্টি তাঁর উপর নেই। তাদের মধ্যে কিছু লোক, তাঁকে না দেখার ভান করে, ধীরে ধীরে তাঁর দিকে ঘুরে দাঁড়াল। তাদের রোগাটে, তামাটে মুখ; বাসে থাকা ফরাসি সৈনিকের মুখ আর দস্তানা পরা আরব লোকটির মুখ, সবকটাকে তাঁর এক রকম মনে হতে লাগল—সবার মুখে সেই একই চালাকি, একই ঔদ্ধত্য। তারা তাদের মুখগুলো বিদেশিনীর দিকে ঘোরাল, কিন্তু চোখে শূন্যতা। তারপর তারা তাঁর চারপাশে আলতো পায়ে গোল গোল ঘুরতে লাগল নিঃশব্দে। একটানা অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি। গোড়ালি ফুলে উঠতে লাগল। অস্বস্তি আর পালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে, দুইই বাড়তে লাগল। ‘কেন এসেছিলাম এখানে?’
কিন্তু ইতিমধ্যে মারশেল ফিরে এসছিলেন। যখন তাঁরা দুর্গের সিঁড়ি বেয়ে উঠছিলেন, তখন পাঁচটা বাজে। বাতাস পুরোপুরি থেমে গিয়েছিল। আকাশ সম্পূর্ণ পরিষ্কার হয়ে এখন গাঢ় নীলাভ। ঠান্ডা আরও শুষ্ক, গালে জ্বালা ধরানো। সিঁড়ির মাঝপথে এক বৃদ্ধ আরব দেয়ালের সঙ্গে হেলান দিয়ে বসেছিলেন। তিনি জানতে চাইলেন তাঁরা গাইড চান কিনা, কিন্তু তাঁর হাবভাব দেখে মনে হচ্ছিল যে তিনি আগেভাগেই নিশ্চিত ছিলেন তাঁদের প্রত্যাখ্যান সম্পর্কে। সিঁড়িটি ছিল দীর্ঘ এবং খাড়া, যদিও মাঝে মাঝে ছিল কয়েকটি জমাট মাটির প্রশস্ত ধাপ। তাঁরা যত উপরে উঠছিলেন, চারপাশ আরও প্রসারিত হয়ে যাচ্ছিল। আলো ক্রমাগত হয়ে উঠছিল আরও ব্যাপক, আরও ঠান্ডা, আরও শুষ্ক। মরুদ্যান থেকে আসা প্রতিটি শব্দ পরিষ্কারভাবে তাঁদের কানে পৌঁছচ্ছিল। মনে হচ্ছিল উজ্জ্বল বাতাসের কম্পাঙ্ক তাঁদের ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে যাচ্ছিল, যেন তাঁদের প্রতিটি পদক্ষেপের সঙ্গে আলোর রেণু থেকে শব্দতরঙ্গ উৎসারিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ছিল। ছাদে পৌঁছে তাঁদের দৃষ্টি খেজুরগাছের বনের সীমানা ছাড়িয়ে দিগন্তে হারিয়ে গেল। জ়ানিনের মনে হলো পুরো আকাশ জুড়ে একটি ক্ষণস্থায়ী তীক্ষ্ণ সুর বেজে উঠল, যার প্রতিধ্বনি ধীরে ধীরে সমস্ত শূন্যতা ভরিয়ে দিল; তারপর হঠাৎ মিলিয়ে গিয়ে তাঁকে সীমাহীন বিস্তৃতির মাঝে নীরবে দাঁড় করিয়ে দিল।
পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত, একটি নিখুঁত বক্ররেখা বরাবর জ়ানিনের দৃষ্টি ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছিল, কোন বাধা ছাড়াই। তাঁর পায়ের নিচে, আরব শহরের নীল-সাদা ছাদগুলো একে অপরের গায়ে আলিঙ্গনাবদ্ধ, যেখানে সূর্যের তাপে শুকতে দেওয়া মরিচ দূর থেকে গাঢ় লাল দাগের মতো মনে হচ্ছিল। একজন মানুষেরও দেখা নেই। তবে ভেতরের উঠোন থেকে ভেসে আসছিল কফি ভাজার গন্ধ, হাসির শব্দ, এবং পায়ের ছন্দময় দুর্বোধ্য শব্দ। আরও দূরে, মাটির দেয়াল দিয়ে অসমান বর্গক্ষেত্রে বিভক্ত খেজুর-বাগানের উপরের পাতাগুলো বাতাসে সরসর করছিল, যদিও সেই বাতাসের ধ্বনি এখানে পৌঁছনোর আগেই দম হারিয়ে ফেলছিল। আরও দূরে, দিগন্ত পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল ধূসর পাথরের রাজ্য, যেখানে নেই কোনো জীবনের চিহ্ন। তবে মরুদ্যান ছাড়িয়ে কিছুটা দূরে, পশ্চিমে খেজুর বাগানের সীমানা বরাবর শুকনো নদীখাতের (ওয়াদি) কাছে বড় বড় কালো তাঁবুগুলি দেখা যাচ্ছিল, যার আশেপাশে এক-কুঁজের উটের ঝাঁক, দূর থেকে ধূসর মাটির পটভূমিতে মনে হচ্ছিল কৃষ্ণবর্ণের বর্ণমালা, যার অর্থোদ্ধার এখনো বাকি। মরুভূমি আর আকাশের মাঝের অসীম শূন্যস্থানের নীরবতাও ছিল অসীম।
ছাদের দেয়ালের উপর ভর দিয়ে জ়ানিনের পুরো শরীরটি ছিল সামনে ঝুঁকে। বাকরুদ্ধ হয়ে শূন্যতার দিকে তাকিয়ে ছিলেন, অচেতনভাবে। তাঁর পাশে, মারশেল অস্থির হয়ে উঠছিলেন। ঠান্ডায় কাঁপছিলেন; নিচে ফিরে যেতে চাইছিলেন। এখানে কী দেখার আছে? সব কিছু তো দেখে ফেলেছ! কিন্তু জ়ানিন দিগন্ত থেকে তাঁর দৃষ্টি সরাতে পারছিলেন না। সেখানে, আরও দক্ষিণে, যেখানে আকাশ এবং মাটি এক বিশুদ্ধ রেখায় মিলিত হয়েছে—হঠাৎ তাঁর মনে হলো যে, সেখানে কিছু তাঁর অপেক্ষায় প্রতীক্ষারত, এমন কিছু যা আজ পর্যন্ত তাঁর কাছে ছিল অধরা এবং বোধাতীত।
বিকেল গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে আলো ম্লান এবং কোমল হয়ে এল। স্ফটিকের মতো কঠিন আলো তরল হয়ে চুঁইয়ে পড়ছিল। একই সঙ্গে এক নারীর হৃদয়ে, যার আগমন নিছক কাকতালীয়, একটি গিঁট ধীরে ধীরে আলগা হচ্ছিল। ছিঁড়ে পড়ছিল সময়, অভ্যাস এবং একঘেয়েমির ত্র্যহস্পর্শে শক্ত হয়ে ওঠা এই গিঁটের বাঁধন। তিনি যাযাবরদের শিবিরের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। তিনি সেই শিবিরে বাস করা মানুষদের দেখতে পাননি। কালো তাঁবুগুলোর মধ্যে কোন নাড়াচাড়া নেই। তবুও তাঁর মনে শুধু তাদের কথাই ঘুরছিল যাদের অস্তিত্ব পর্যন্ত ছিল তাঁর অজানা। গৃহহীন, পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন, তারা মাত্র কয়েকজন ঘুরে বেড়াচ্ছে জ়ানিনের চোখের সামনে মেলে ধরা বিশাল প্রান্তর জুড়ে। প্রকৃতপক্ষে এই বিশাল প্রান্তর আরও বিস্তৃত অঞ্চলের ছোট্ট একটি অংশ মাত্র। হতবিহ্বল করে দেওয়া এই বিস্তৃতি দক্ষিণে হাজার হাজার মাইল দূরে গিয়ে থেমেছে, যেখানে প্রথম নদী এসে বনভূমিকে সিঞ্চিত করে। প্রাচীনকাল থেকে, এই সীমাহীন ভূমির ঊষর মাটিতে কিছু মানুষ নিরন্তর হেঁটে চলেছেন, কিছুই না থাকা সত্ত্বেও কারো অধীনে না থেকে, দরিদ্র অথচ স্বাধীন এক আজব রাজ্যের প্রভু হয়ে।
জ়ানিন বুঝতে পারলেন না কেন এই চিন্তাটি এত মধুর, এত গভীর বিষাদে তাঁকে ভরিয়ে তুলল যে তাঁর চোখ বন্ধ হয়ে এল। তিনি জানতেন, এই রাজ্যটি চিরকাল তাঁর জন্য প্রতিশ্রুত; তা সত্ত্বেও এটি কখনো তাঁর হবে না, কখনোই না, হয়তো এই ক্ষণকালীন মুহূর্ত ছাড়া। তাঁর চোখ হঠাৎ খুলে গেল। স্থির আকাশের স্থির আলোর তরঙ্গের দিকে তাকালেন তিনি। আরব শহর থেকে ভেসে আসা স্বর হঠাৎ থেমে গেল। তাঁর মনে হলো, পৃথিবীর গতিপথ থেমে গেছে; সেই মুহূর্ত থেকে কেউ আর বৃদ্ধ হবে না, কেউ মরবে না। সর্বত্র, এরপর থেকে, জীবন স্তব্ধ—শুধুমাত্র তাঁর হৃদয় ছাড়া; যেখানে ঠিক একই সময়ে, কেউ একজন শোকে এবং বিস্ময়ে কাঁদছিল।
কিন্তু আলো নড়ে উঠল; স্নিগ্ধ এবং উষ্ণতাহীন সূর্য হালকা গোলাপী হয়ে পশ্চিমে ঢলে পড়ল। আর ধীরে ধীরে বিশাল প্রান্তরের উপর দিয়ে গড়ানোর প্রস্তুতি নিয়ে পুবের আকাশ ধূসর বর্ণ ধারণ করল। একটি কুকুর ঘেউ ঘেউ করে উঠল আর এই দূরবর্তী ডাক আরো ঠান্ডা হয়ে আসা বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল। জ়ানিন লক্ষ্য করলেন যে তাঁর দাঁত ঠক ঠক করে কাঁপছে। ‘আমরা ঠান্ডায় মরে যাচ্ছি,’ মারশেল বললেন। ‘বোকামি করো না। চলো ফিরে যাই।’ তিনি বিশ্রীভাবে তাঁর হাত ধরলেন। বাধ্য মেয়ের মতো তিনি ছাদের দেয়াল থেকে মুখ ফিরিয়ে তাঁর পিছু নিলেন। বৃদ্ধ আরবটি সিঁড়ির এক জায়গায় স্থির বসে তাঁদের শহরের দিকে নামতে দেখছিল।
কারো দিকে না তাকিয়ে হেঁটে চললেন তিনি; শরীর প্রচণ্ড এবং আকস্মিক ক্লান্তির ভারে ন্যুব্জ। নিজেকে টেনে টেনে নিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি; নিজের শরীরের ভার তাঁর কাছে অসহনীয় মনে হচ্ছিল। তাঁর উচ্ছ্বাস তাঁকে ছেড়ে চলে গেছে। এখন তাঁর মনে হচ্ছিল, যে পৃথিবীতে তিনি প্রবেশ করেছেন, সেই পৃথিবীর পক্ষে তিনি অতিরিক্ত লম্বা, অতিরিক্ত মোটা, অতিরিক্ত ফর্সা। একটি শিশু, একটি মেয়ে, রসকষহীন পুরুষ, চোরা শেয়াল—এরাই শুধু নীরবে নিশ্চিন্তে এই ধরায় হেঁটে বেড়াতে পারে। তিনি এখানে এরপর কী করবেন? ঘুম বা চিরঘুমের দিকে নিজেকে টেনে নিয়ে যাবেন? কিন্তু তিনি নিজেকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিলেন রেস্তোরাঁর দিকে, এক স্বামীর সঙ্গে যিনি হঠাৎ মৌনী হয়ে গিয়েছিলেন—শুধু বলছিলেন কতটা ক্লান্ত তিনি। আর তিনি ঠান্ডার সঙ্গে দুর্বল লড়াই করছিলেন; গা পুড়ে যাচ্ছিল জ্বরে। তারপর তিনি নিজেকে বিছানার দিকে টেনে নিয়ে গেলেন। একবারও কিছু জিজ্ঞেস না করে মারশেল তাঁর পাশে শুয়ে পড়লেন এবং আলো নিভিয়ে দিলেন।
ঘরটা ছিল প্রচণ্ড ঠান্ডা। জ়ানিন টের পাচ্ছিলেন কেমন করে ঠান্ডা চুপিসাড়ে গা বেয়ে লতিয়ে উঠছে আর জ্বরও বাড়ছে। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল তাঁর। রক্তের সঞ্চালন ছিল ঠিক, কিন্তু উত্তাপহীন। এক ধরনের ভয় তাঁর ভেতরে বাড়ছিল। তিনি পাশ ফিরলেন, আর পুরোনো লোহার খাট তাঁর ওজনের ভারে ককিয়ে উঠল। না, তিনি অসুস্থ হতে চান না। তাঁর স্বামী শুয়েই ঘুমিয়ে পড়েছেন; তাঁকেও ঘুমাতে হবে; এটা অত্যন্ত জরুরি। জানলার ফাঁক দিয়ে শহরের চাপা শব্দগুলো তাঁর কানে পৌঁছচ্ছিল। মুরদের ক্যাফেতে পুরোনো ফনোগ্রাফ বাজছিল। ঝিমন্ত ভিড়ের কোলাহলে চেপে সেই সুর তাঁর কাছে পৌঁছচ্ছিল। তাঁকে ঘুমাতেই হবে। কিন্তু তিনি গুনছিলেন কালো তাঁবুগুলো। তাঁর চোখের পাতা বন্ধ; অথচ স্থির উটগুলো ঘাস খাচ্ছিল একমনে। বিশাল শূন্যতার ভেতর যেন পাক খাচ্ছিলেন তিনি। কেন এসেছিলেন তিনি? এই প্রশ্নটিকে পাশে নিয়ে তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন। কিছুক্ষণ পর জেগে উঠলেন। চারপাশে অসীম নিস্তব্ধতা।
কিন্তু, শহরের প্রান্তে, কর্কশ কুকুরগুলো শব্দহীন রাতে চিৎকার করছিল। জ়ানিন শিউরে উঠলেন। তিনি পাশ ফিরলেন, স্বামীর কঠিন কাঁধের সঙ্গে নিজের কাঁধের সংযোগ টের পেলেন, এবং হঠাৎ, আধোঘুমের মধ্যে, তাঁর সাথে গা ঘেঁষে শুয়ে পড়লেন। শুধু ঘুমের পৃষ্ঠে ভাসছিলেন তিনি; ঘুমে তলিয়ে যাননি। সেই কাঁধকে আঁকড়ে ধরলেন তিনি অবচেতন আগ্রহে, যেন সেটাই তাঁর সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়। তিনি কথা বলছিলেন, কিন্তু তাঁর মুখ থেকে কোনো শব্দ বের হচ্ছিল না। তিনি কথা বলছিলেন, কিন্তু তিনি নিজেও ঠিক শুনতে পাচ্ছিলেন না তিনি কী বলছেন। তিনি কেবল মারশেলের উষ্ণতার ওম নিচ্ছিলেন। বিগত কুড়ি বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রতিটি রাত এমনই, তাঁর উষ্ণতায়, কেবল দুজন, এমনকি অসুস্থ অবস্থাতেও, এমনকি ভ্রমণেও, যেমনটা এখন…
তাছাড়া, তিনি বাড়িতে একা একা কী করতেন? কোনো সন্তান নেই! এটাই কি তাঁর অভাব? তিনি জানতেন না। তিনি স্রেফ মারশেলকে অনুসরণ করতেন, এই ভেবে সন্তুষ্ট থাকতেন যে কারোর তাঁকে প্রয়োজন। একমাত্র আনন্দ যা মারশেল তাঁকে দিয়েছেন, সেটা এই যে তিনি জানেন তিনি প্রয়োজনীয়। হয়তো মারশেল তাঁকে ভালোবাসেন না। ভালোবাসার, এমনকি ঘৃণায় ভরা ভালোবাসারও, এমন বিষণ্ণ মুখ হয় না। কিন্তু তাঁর মুখ কেমন দেখতে? তাঁরা অন্ধকারে ভালোবাসতেন; শুধুই অনুভব করে, একে অপরকে না দেখে। অন্ধকারের সেই ভালোবাসা ছাড়া আর কি কোনো ভালোবাসা আছে, যা দিনের আলোতে উচ্চস্বরে কাঁদবে?
তিনি জানতেন না। কিন্তু তিনি এটুকু জানতেন যে মারশেলের তাঁর প্রয়োজন এবং তাঁর প্রয়োজন সেই প্রয়োজনটাকে। তিনি সেই প্রয়োজনের উপর নির্ভর করেই দিনের পর দিন, রাতের পর রাত বেঁচে ছিলেন, বিশেষত রাতে—প্রতি রাতে, যখন মারশেল একা থাকতে চাইতেন না, বয়সের ভারে ন্যুব্জ হতে চাইতেন না বা মৃত্যুর মুখোমুখি হতে চাইতেন না। তখন মুখে যে গৎবাঁধা অভিব্যক্তি তিনি ফুটিয়ে তুলতেন, সেটা মাঝে মাঝে জ়ানিন অন্য পুরুষদের মুখেও দেখতেন। সেই পাগলদের অভিব্যক্তি, যা জ্ঞানের মুখোশে আড়াল হয়ে থাকে যতক্ষণ না পাগলামি তাদের গ্রাস করে এবং মরিয়া করে একটি নারীর দেহের দিকে ঠেলে দেয়। সেখানে তারা আশ্রয় খোঁজে, কোনো কামনা ছাড়াই; একাকীত্ব এবং রাত যা যা তাদের সামনে উন্মোচন করে, সেই সমস্ত কিছু থেকে বাঁচতে।
মারশেল পাশ ফিরলেন, যেন তাঁর থেকে দূরে সরে যেতে চাইছিলেন। না, তিনি তাঁকে ভালোবাসতেন না; তিনি শুধু ভয় পেতেন ওই সবকিছুকে যা জ়ানিন নয়। জ়ানিন এবং মারশেলের অনেক আগেই পৃথক হয়ে যাওয়া উচিত ছিল এবং আমৃত্যু একা একা ঘুমনো উচিত ছিল। কিন্তু কে সর্বদা একা ঘুমাতে পারে? কিছু পুরুষ পারে, পেশা বা দুর্ভাগ্যের কারণে অন্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে, যারা প্রতিরাতে একই বিছানায় মৃত্যুকে পাশে নিয়ে শোয়। মারশেল কখনই তা পারেননি। মূলত তিনি সবসময় দুর্বল এবং আত্মরক্ষায় অক্ষম এক শিশু; সবসময় কষ্টে ভীত। তিনি নেহাতই জ়ানিনের শিশু–জ়ানিনকে তাঁর প্রয়োজন। ঠিক এমন সময় গোঙাতে গোঙাতে কেঁদে উঠলেন তিনি। জ়ানিন একটু কাছে সরে এসে তাঁর হাত মারশেলের বুকে রাখলেন। মনে মনে তাঁকে সেই ছোট্ট ভালোবাসার নাম ধরে ডাকলেন যা একসময় মারশেলকে তিনি দিয়েছিলেন, যা তাঁরা এখনও মাঝে মাঝে কোনো ভাবনা ছাড়াই ব্যবহার করেন। তিনি তাঁকে সমস্ত হৃদয় দিয়ে ডাকলেন। প্রকৃতপক্ষে, তাঁরও তো মারশেলের প্রয়োজন ছিল–তাঁর শক্তির, তাঁর ছোট ছোট খামখেয়ালির; আর তিনিও তো মৃত্যুকে ভয় পেতেন। "যদি আমি সেই ভয়কে কাটিয়ে উঠতে পারতাম, তাহলে কী সুখীই না হতাম...."
তখনই, এক অজ্ঞাত যন্ত্রণা তাঁর হৃদয় চেপে ধরল। মারশেলের থেকে দূরে সরে এলেন তিনি। না, তিনি কিছুই কাটিয়ে উঠতে পারেননি। তিনি সুখী ছিলেন না। তিনি সত্যিই মুক্তি না পেয়েই মারা যাচ্ছিলেন। তাঁর হৃদয় ব্যথায় ভরে উঠল। বিশাল এক বোঝার নিচে দমবন্ধ হয়ে যাচ্ছিল তাঁর, যা তিনি হঠাৎ আবিষ্কার করলেন যে তিনি বিশ বছর ধরে টেনে নিয়ে চলেছেন। এখন তিনি সমস্ত শক্তি দিয়ে সেই বোঝার নিচে সংগ্রাম করছিলেন। তিনি মুক্ত হতে চাইলেন, এমনকি যদি মারশেল মুক্ত না হন তবুও বা অন্য কেউ কখনও মুক্ত না হয়ে থাকে, তবুও! সম্পূর্ণ জেগে উঠে তিনি বিছানায় বসে পড়লেন এবং শুনলেন এক আহ্বান যা খুব কাছ থেকেই আসছিল বলে মনে হচ্ছিল।
কিন্তু রাতের উপান্ত থেকে মরুদ্যানের কুকুরগুলোর ক্লান্ত এবং অবিশ্রান্ত কণ্ঠস্বর শুধু তাঁর কানে পৌঁছছিল। মৃদুমন্দ বাতাস উঠেছিল। তিনি শুনতে পেলেন দক্ষিণ দেশ থেকে আসা বাতাসের ফিসফিসানি, যেন পামগাছের বনে বয়ে চলা চপল জলধারা। এই সেই দক্ষিণ দেশ, যেখানে ঠিক এই মুহূর্তে মরুভূমি আর রাত মিশে একাকার হয়ে গেছে এক অপরিবর্তনীয় আকাশের নিচে; জীবন থেমে আছে যেখানে, যেখানে বার্ধক্য নেই, ক্ষয় নেই, নেই মৃত্যু। তারপর বাতাসের ফিসফিসানি থেমে গেল। চারপাশে ছুঁচ পড়ার নিস্তব্ধতা। তবে একটি মৃদু, অনুচ্চারিত আহ্বান কি জ়ানিন শুনতে পেয়েছিলেন? তিনি ঠিক নিশ্চিত ছিলেন না। এই মৃদু আহ্বানে সাড়া দেবেন, না সেটিকে চুপ করিয়ে দেবেন? যদি তিনি সেই মুহূর্তে সাড়া না দেন তবে এই আহ্বানের অর্থ তিনি কখনও বুঝতে পারবেন না। হ্যাঁ, ঠিক সেই মুহূর্তটি– অন্তত এটুকু নিশ্চিত! তিনি ধীরে ধীরে উঠে বিছানার পাশে দাঁড়ালেন, নিশ্চল। শুনতে পেলেন স্বামীর শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ। মারশেল তখন ঘুমচ্ছিলেন।
পরমুহূর্তেই বিছানার উষ্ণতা হারিয়ে ঠান্ডা তাঁকে আঁকড়ে ধরল। জানলার ফাঁক দিয়ে আসা আলোকস্তম্ভের ম্লান আলোতে পোশাক খুঁজতে লাগলেন তিনি। ধীরে ধীরে পোশাক পরে, হাতে জুতো নিয়ে সন্তর্পণে দরজার দিকে এগোলেন। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলেন অন্ধকারে। তারপর দরজার গোল হাতলে আলতো মোচড় দিতেই কিঁচকিঁচ শব্দ হল; দাঁড়িয়ে পড়লেন তিনি, স্থির। হৃদস্পন্দন তীব্র, টানটান শরীরের সমস্ত পেশি। নিস্তব্ধতায় আশ্বস্ত হয়ে হাতলটা আরেকটু ঘোরালেন। হাতলটা ঘোরানো যেন শেষ হয় না। অবশেষে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এসে একইভাবে সন্তর্পণে দরজা বন্ধ করলেন। তারপর দরজায় গাল ঠেকিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন; দূর থেকে মারশেলের শ্বাসপ্রশ্বাসের ধ্বনি ভেসে এল তাঁর কানে। তিনি ঘুরে লম্বা বারান্দার দিকে দৌড়লেন। রাতের ঠান্ডা বাতাস গালে বিঁধলো। বাইরের দরজা বন্ধ ছিল। যখন তিনি খিল খুলছিলেন, ঠিক তখনই রাতের দারওয়ান সিঁড়ির উপরে ঘুমচোখে এসে আরবিতে কথা বলল।
‘আমি ফিরে আসব,’ জ়ানিন রাতের অন্ধকারে পা বাড়াতে বাড়াতে বললেন। তারার মালা কালো আকাশ থেকে নেমে ঝুলছিল খেজুরগাছ এবং ঘরবাড়ির উপর। তিনি কেল্লার দিকে ফাঁকা রাস্তায় দৌড়াতে লাগলেন। শীত সূর্যের সঙ্গে আর লড়াই করতে না পেরে রাতটাকে আক্রমণ করছিল; বরফ শীতল বাতাস তাঁর ফুসফুস জ্বালিয়ে দিচ্ছিল। তাও তিনি দৌড়চ্ছিলেন, অন্ধকারে দৃষ্টিশক্তি ছিল অস্পষ্ট। রাস্তার শীর্ষদেশে আলোর চিহ্ন দেখতে পেলেন তিনি। তারপর আলোর দীপ্তি এঁকেবেঁকে তাঁর দিকে নেমে এল। তিনি থামলেন। সাইকেলের ঘূর্ণায়মান স্প্রকেটের যান্ত্রিক শব্দ কানে এল। আলো বিবর্ধিত হতে হতে তাঁর পাশ দিয়ে চলে গেল। তাঁর চোখে পড়ল লঘুকায় সাইকেলে বিশালকায় আলখাল্লা পরা অবয়ব। তারপর তিনটি লাল আলোকবিন্দু তাঁর পিছনের কালো অন্ধকারে দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেল। তিনি কেল্লার দিকে দৌড়তে লাগলেন। সিঁড়ির মাঝামাঝি, বাতাস তাঁর ফুসফুসে এমন জ্বালা ধরিয়েছিল যে তিনি থামতে চাইলেন। কিন্তু অবশিষ্ট শক্তি এক ঝটকায় তাঁকে তাঁর অজান্তেই একদম উপরে নিয়ে গেল, যেখানে ছাদের দেয়াল তাঁর পেটে চাপ দিচ্ছিল। তিনি হাঁপাচ্ছিলেন, চোখের সামনে সব ঝাপসা। একটানা লম্বা দৌড়, তাও তাঁর পুরো শরীর কাঁপছিল শীতে। শীতল বাতাস প্রথমে তাঁকে খাবি খাওয়ালেও, একটু পরেই তাঁর ভিতরে সমানভাবে প্রবাহিত হতে শুরু করল। শীতলতার মধ্যেও উষ্ণতার আঁচ পেলেন তিনি। তিনি অবশেষে চোখ মেললেন। বিস্তীর্ণ রাত তাঁর সামনে খুলে গেল। নিস্তব্ধতার অন্তরায় ছিল শুধু মাঝে মাঝে পাথরের মৃদু কটকট শব্দ। জমাট পাথরগুলো ঠান্ডায় আলগা হয়ে বালির দানা ছেরে দিচ্ছিল আর জ়ানিনের নির্জনতা এবং চারপাশের নিস্তব্ধতায় ব্যাঘাত ঘটাচ্ছিল।
কিছুক্ষণ পর, তাঁর মনে হল মাথার উপর আকাশ যেন ধীরে ধীরে ঘুরছে। সীমাহীন শুষ্ক ঠান্ডা রাতে হাজার হাজার তারা ক্রমাগত আবির্ভূত হয়ে যেন ঝলমলে তুষার-শলাকার মতো চুঁইয়ে চুঁইয়ে দিগন্তে ঝরে পড়ছে। জ়ানিন সেই ভাসমান আলোকরশ্মি থেকে এক মুহূর্তও চোখ সরাতে পারছিলেন না। তিনি তারাদের সঙ্গে সঙ্গে ঘুরছিলেন। এই আপাত স্থির অগ্রগতির মাঝে তাঁর সংযোগ ঘটছিল তাঁর আত্মার সঙ্গে, যেখানে শীতলতা আর আকাঙ্ক্ষা রশির টানাটানি খেলছিল। তারারা একে একে খসে পড়ে মরুভূমির পাথরে ধাক্কা খেয়ে আলো হারিয়ে ফেলছিল আর জ়ানিনের কাছে রাত একটু একটু করে উন্মোচিত হচ্ছিল। গভীর শ্বাস নিয়ে জ়ানিন ভুলে গেলেন শীতের কামড়; ভুলে গেলেন অন্যের বোঝা; ভুলে গেলেন দমবন্ধ করা জীবন, জীবন-মরণের দীর্ঘ যন্ত্রণা। এত বছর ভয় থেকে উন্মাদের মতো উদ্দেশ্যহীন পালানোর পর অবশেষে তিনি থামলেন। একইসঙ্গে, তিনি যেন তাঁর শিকড় খুঁজে পেলেন; কম্পন বন্ধ হয়ে নতুন রসে সারা শরীর চঞ্চল হয়ে উঠল। তিনি ছাদের দেয়ালে পেট চেপে ঘূর্ণায়মান আকাশের দিকে ঝুঁকলেন, অপেক্ষা করছিলেন অস্থির হৃদয় শান্ত হওয়ার। মরুভূমির দিগন্তের সবচেয়ে কাছের নক্ষত্রপুঞ্জ আরেকটু নিচে নেমে স্থির হয়ে গেল। তারপর অসহনীয় কোমলতায়, রাতের জলস্রোত শীতলতাকে ভাসিয়ে জ়ানিনকে ভরিয়ে তুলল। ধীরে ধীরে তাঁর অদৃশ্য মর্মস্থল থেকে ঢেউয়ের পর ঢেউ উঠে মুখ থেকে তীব্র আর্তনাদ বেরিয়ে এল। পরমুহূর্তেই গোটা আকাশ তাঁর উপর বিরাট শামিয়ানার মতো প্রসারিত; তিনি চিত হয়ে শুয়েছিলেন, ঠান্ডা মাটিতে।
যখন তিনি ফিরে এলেন, একই সতর্কতা নিয়ে, মারশেল তখনও জেগে ছিলেন না। কিন্তু জ়ানিন বিছানায় ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গে তিনি কঁকিয়ে উঠলেন এবং কিছুক্ষণ পর হঠাৎ উঠে বসলেন। তিনি কিছু বললেন, কিন্তু জ়ানিন বুঝতে পারলেন না তিনি কী বলছেন। মারশেল উঠে আলো জ্বালালেন, যা জ়ানিনের চোখ ঝলসে দিল। তিনি বেসিনের দিকে টলতে টলতে গেলেন এবং মিনারেল ওয়াটারের বোতল থেকে গটগট করে জল খেলেন। ফিরে এসে লেপের মধ্যে ঢুকতে যাচ্ছিলেন, ঠিক সেই সময় যখন তাঁর এক হাঁটু বিছানায়, তিনি জ়ানিনের দিকে তাকালেন, কিন্তু কিছু বুঝতে পারলেন না। জ়ানিন অঝোরে কাঁদছিলেন, নিজেকে সামলাতে পারছিলেন না। ‘কিছু হয়নি, সোনা,’ তিনি বললেন, ‘কিছুই হয়নি।’