“….man is a mere borrower from the earth, and that when he does not pay his debt, she does as do all other creditors, that is, she expels him from his holding”
Henry Carey, U.S. Political Economist (1793-1879)
ভারতে সবুজ বিপ্লব শুরু হবার পর প্রায় ৬ দশক পার হয়ে গিয়েছে। ভারতে চাল ও গমের উৎপাদন প্রচুর বেড়েছে একথা অনস্বীকার্য, কিন্তু অন্যদিকে ভারতের কৃষিজমির দুই তৃতীয়াংশই অসুস্থ১, তাদের উর্বরতা ক্রমশই উদ্বেগজনক ভাবে কমছে। এই সমস্যা শুধু আমাদের দেশেই সীমাবদ্ধ নেই, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের কৃষিজমিতেই এই সমস্যা ঘনিয়ে উঠছে। রাষ্ট্রসঙ্ঘের একটি সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে যে পৃথিবীর বিভিন্ন কৃষিজমির প্রায় ৪০ শতাংশই কোনো না কোনো অনুখাদ্যের অভাব জনিত কারণে উর্বরতা হারাচ্ছে২। ভারত তথা পৃথিবীর প্রায় সর্বত্রই কৃষিজমিতে বিভিন্ন পুষ্টিউপাদান এবং জৈবকার্বনের অভাবে উর্বরতা ক্রমশ কমে যাচ্ছে। প্রচলিত ধারার অর্থনীতিবিদ ও বিজ্ঞানীরা এই সমস্যাকে নিছক একটি প্রযুক্তিগত সমস্যা বলেই মনে করেন, এবং তার সমাধানে হয় নানান রকম রাসায়নিক সার, অনুখাদ্য সার ইত্যাদি প্রয়োগের৩ অথবা জিন পরিবর্তিত ফসল চাষের পরামর্শ দেন৪। কিন্তু আমাদের মনে হয় এটি নিছক প্রযুক্তির সমস্যা নয়, তাই উন্নত প্রযুক্তির আমদানি করলেও এর হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে না। যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বাস্তুতন্ত্রকে প্রতিনিয়ত ধ্বংস করছে, মানুষকে প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন করছে, বিচ্ছিন্ন করছে তার শ্রমের প্রক্রিয়া থেকে, শ্রমের ফসল থেকে, তার মধ্যেই এই সমস্যার মূল নিহিত রয়েছে। আজকের পৃথিবীতে উন্নয়নের যে মডেল কোটি কোটি মানুষকে কৃষি জমি আর জঙ্গল থেকে উচ্ছেদ করে শহরের বস্তিতে এনে জড়ো করছে তাতে পৃথিবীর জৈব-ভূ-রাসায়নিক চক্রে এক অলঙ্ঘ্য ফাটল তৈরি হচ্ছে। এর ফলে কৃষি বাস্তুতন্ত্রে যে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসছে, তাতে প্রচলিত ধারার খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থা আর কত দিন টিকবে বলা মুশকিল। এই নিবন্ধে বর্তমান উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে কৃষিজমির উর্বরতা হ্রাসের সম্পর্কটি নিয়ে কিছু আলোচনা করা হয়েছে।
কৃষি ও বিপাকীয় ফাটল:
উদ্ভিদের সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার জন্য প্রায় ১৫ রকমের মৌলিক পদার্থের দরকার হয়। এই মৌলগুলির অধিকাংশই উদ্ভিদ মাটি থেকে শোষণ করে। এদের মধ্যে কয়েকটি মৌল যেমন নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাসিয়াম, ইত্যাদি একটু বেশি পরিমাণে লাগে, আবার অনেক মৌল যেমন মলিবডেনাম, ম্যাগনেশিয়াম, বোরন, দস্তা, ইত্যাদি লাগে খুবই সামান্য পরিমাণে। যে মৌলগুলি বেশি পরিমাণে লাগে তাদের বলে অতিমাত্রিক মৌল, আর যাদের কম পরিমাণে লাগে তাদের বলে স্বল্পমাত্রিক মৌল। এই সমস্ত মৌলগুলি উদ্ভিদের নানান শারীরবৃত্তীয় কাজে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই সব অতিমাত্রিক আর স্বল্পমাত্রিক মৌলর যে কোনো একটির অভাব ঘটলে উদ্ভিদের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়, রোগ প্রতিরোধ শক্তি কমে যায়। এই মৌলগুলি উদ্ভিদের দেহে জমা থাকে। কোনো প্রাণী যখন কোনো উদ্ভিদকে খায় তখন এই মৌলগুলি উদ্ভিদ দেহ থেকে প্রাণীদেহে যায়। প্রাণীদেহের নানান শারীরবৃত্তীয় কাজেও এদের বিশেষ ভূমিকা আছে। একইভাবে এই মৌলগুলি তৃণভোজী প্রাণী থেকে মাংসাশী প্রাণীতে যায়। এই সমস্ত প্রাণী এবং উদ্ভিদের রেচন ও বর্জ্য পদার্থের পচনের মাধ্যমে অথবা এদের মৃতদেহের পচনের মধ্যমে মৌলগুলি পুনরায় মাটিতে ফিরে আসে। মাটি উদ্ভিদ ও প্রাণীদের মধ্যে মৌলগুলির এই চক্রাকার আবর্তনে বহু ধরণের ব্যাকটেরিয়া ছত্রাক ও ছোট ছোট প্রাণীর ভুমিকা অপরিহার্য। বলা বাহুল্য যে কোনো ফসল ও তাদের খাদকের ক্ষেত্রেই এই তথ্যগুলি সত্যি।
কৃষিজমিতে উৎপন্ন ফসল যদি স্থানীয় ভাবে ব্যবহৃত হয় তাহলে এই চক্রাকার আবর্তন ক্ষতিগ্রস্ত হয় না, এবং কৃষিজমির উর্বরতাও অক্ষুন্ন থাকে। কিন্তু কৃষিজমিতে উৎপন্ন ফসলের বিপুল অংশ যদি ভৌগোলিক ভাবে দূরবর্তী স্থানে (শহরে বা অন্যদেশে) রপ্তানি হতে থাকে তাহলে সেই ফসলে আবদ্ধ মৌলগুলিও ভৌগোলিক ভাবে বহু দূরবর্তী স্থানে চলে যায় এবং আর প্রাকৃতিক চক্রাকার উপায়ে জমিতে ফেরত আসে না। ফলে জমির উর্বরতা কমতে থাকে।
শিল্পবিপ্লবের পর থেকেই পশ্চিম ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় শহুরে জনসংখ্যার পরিমাণ বাড়তে থাকে। ইংলন্ডে ১৭৮০ থেকে ১৮৩০ এর মধ্যেই শহুরে কলকারখানায় উৎপন্ন পণ্যদ্রব্যের দাপটে গ্রামীণ কারিগরদের ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়। পুঁজিপতিরা ছোট ছোট কৃষকদের জমি আত্মসাৎ করে, সাধারণের ব্যবহার্য্য জমিগুলি দখল করে নেয়, এবং এইভাবে বিশাল বিশাল কৃষি খামার গড়ে তোলে। ছোট চাষিদের একাংশ খেতমজুরে পরিণত হয়, বাকিরা বেকার হয়ে যায়। সাধারণের ব্যবহার্য্য জমিগুলি পুঁজিপতিরা দখল করে নেওয়ায় দরিদ্র গ্রামীণ জনগণ মর্মান্তিক সমস্যার মধ্যে পড়ে। ওই জমিগুলি থেকে তারা যে শুধু জ্বালানি সংগ্রহ করতো তাই নয়, সেখানে তারা তাদের গরু-ভেড়া চড়াত। এর ফলে তাদের দারিদ্র আরও তীব্র হয়। এইভাবে গ্রামীণ জনসংখ্যার এক বড়ো অংশ দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি হয়, এবং খাবারের খোঁজে শহরে ভীড় করে৫। এরাই গড়ে তোলে শিল্পশ্রমিক বাহিনী—আধুনিক সর্বহারা। ইংলন্ডে তখন শিল্পবিপ্লবের যুগ, নতুন নতুন কলকারখানা গড়ে উঠছে, গ্রাম থেকে উচ্ছেদ হওয়া নিঃস্ব মানুষদের একটা বড়ো অংশ এখানে মজুরের কাজে ঢুকল। এইভাবে শহরের জনসংখ্যা ক্রমশই বাড়তে থাকল। স্বভাবতই শহরে খাদ্যের চাহিদাও বাড়তে লাগল। এই খাদ্যের যোগান দেবার জন্য বড়ো বড়ো পুঁজিবাদী খামারগুলিতে নিবিড় মাত্রায় কৃষিকাজ শুরু হল। কৃষিকাজ একটি আকর্ষনীয় পুঁজি বিনিয়োগের ক্ষেত্র হয়ে উঠল। বহু গবেষক একে ‘দ্বিতীয় কৃষিবিপ্লব’ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন।৬ জমিতে সারের ব্যবহার বাড়তে লাগল। তখনও রাসায়নিক সারের ব্যবহার বিশেষ চালু হয়নি, সার হিসাবে জীবজন্তুর হাড়ের গুঁড়ো, গুয়ানো (দীর্ঘদিন ধরে সমুদ্রতটে জমে থাকা সামুদ্রিক পাখির বিষ্ঠা) ইত্যাদি ব্যবহৃত হত। পেরু ছিল গুয়ানোর এক বিশাল ভাণ্ডার। ১৮৩৫ সালে প্রথম পেরুদেশীয় গুয়ানো আমদানি শুরু হয়, ১৮৪১ সালে ১৭০০ টন গুয়ানো আমদানি হয়। তারপর আমদানি লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে বাড়তে মাত্র ৬ বছর পরেই ১৮৪৭ সালে গিয়ে দাঁড়ায় ২,২০০০০ টনে। হাড়ের গুঁড়োর ক্ষেত্রেও ছবিটা একই রকম। ১৮২৩ সালে ১৪,৩৯৫ পাউন্ড মূল্যের হাড় আমদানি করা হয়, ১৮৩৭ সালেই আমদানি বেড়ে দাঁড়ায় ২,৫৪,৬০০ পাউন্ডে৭। ইউরোপের চাষিরা হাড়ের জন্য এমন বেপরোয়া হয়ে গিয়েছিল যে নেপোলিয়নের বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্রগুলিতে গিয়ে কবর খুঁড়ে মৃত সৈনিকদের হাড় বার করে নিয়ে আসত। ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পার্লামেন্টে গুয়ানো আইল্যান্ড অ্যাক্ট পাশ হয় এবং সেই আইন মোতাবেক তারা নৌবহর পাঠিয়ে পৃথিবীর ৯৪টি গুয়ানো সমৃদ্ধ দ্বীপের দখল নেয়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল যখন জমির উর্বরতা ধরে রাখার জন্য এই সব মরিয়া প্রচেষ্টা চলছে তখন লন্ডনের মত বিশাল বিশাল শহরে অসংখ্য মানুষ ও পশুর পর্বত প্রমাণ বর্জ্য কেবল পরিবেশ দূষিত করছিল, রোগ ছড়াচ্ছিল। তৎকালীন ইংলন্ডের স্বনামধন্য কৃষি বিশেষঞ্জ জ়েমস আন্ডারসন সখেদে বলেছিলেন: ‘যে ব্যক্তি এমনকি কৃষিকাজের নামও শুনেছেন তিনিও জানেন মানুষ ও পশুর বর্জ্য কৃষিজমির উর্বরতা বাড়ানোর জন্য কতটা প্রয়োজনীয়, এগুলিকে অর্থনৈতিকভাবে অপ্রয়োজনীয় বর্জ্য বলে নষ্ট করা অত্যন্ত নিন্দার্হ’; তিনি আরও বলেছিলেন, ‘লন্ডনে মানুষ ও পশুর বিপুল বর্জ্য যা কৃষিজমির উর্বরতা বিপুল বাড়াতে পারত তা প্রতিদিন টেমস নদীতে এনে ফেলা হচ্ছে ফলে নিম্ন প্রবাহে দুর্গন্ধ ছড়ানো ছাড়া আর কোনো কাজ হচ্ছে না।’৮
আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে এইভাবে কৃষিজমির উর্বরতা নষ্ট হয়ে যাওয়ার বিষয়টি তৎকালীন দু’জন স্বনামধন্য ব্যক্তির লেখায় স্পষ্ট ফুটে উঠেছিল। এদের একজন হচ্ছেন রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদ হেনরি ক্যারে, অন্যজন জৈব রসায়নবিদ জেস্টস ভন লিবিগ। ক্যারে বলেছিলেন, প্রতি একর জমিতে উৎপন্ন গম ও খড় যখন রফতানি হয়ে যাচ্ছে তখন তার মধ্যে আবদ্ধ সব পুষ্টি পদার্থই জমি থেকে চলে যাচ্ছে, জমির উর্বরতা কমছে। তিনি উদাহরণ দিয়ে দেখিয়েছিলেন কীভাবে নিউইয়র্কের চাষিরা নিবিড় গম চাষ করে ও রফতানি করে জমিকে নিঃস্ব করে ফেলছে, যেখানে আগে প্রতি একর জমিতে ২০ বুশেল গম হত সেই উৎপাদন এক তৃতীয়াংশ কমে গেল। একইভাবে তার লেখা থেকে জানা যায় কীভাবে কেন্টুকিয়ান প্রদেশে শনের চাষ, আর ভার্জিনিয়া প্রদেশে তামাকের চাষ সেখানকার জমিকে নিঃস্ব করে দিয়েছিল৯।
লিবিগ তার কৃষি রসায়নের উপর লেখা বিখ্যাত বইটির (Organic chemistry in its application to agriculture and physiology) সপ্তম সংস্করণের ভুমিকায় বলেছিলেন কৃষি পণ্যর ক্রমাগত রফতানি আর বড়ো শহরে বিপাকীয় বর্জ্যের অর্থহীন সঞ্চয়ের ফলে কৃষিজমি রিক্ত হয়ে যাবে। বৃটেন বিভিন্ন উপনিবেশ থেকে শিল্পের কাঁচামাল হিসাবে বিপুল কৃষিজ পণ্য আমদানি করত। লিবিগ উক্ত বইয়ের সপ্তম সংস্করণে বলেছিলেন বৃটেন বিভিন্ন দেশের জমির উর্বরতা লুণ্ঠন করছে। মার্ক্স আন্ডারসন, ক্যারে, এবং লিবিগের কাজের সাথে নিবিড়ভাবে পরিচিত ছিলেন। মার্ক্স তার পুঁজি গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে বলেছিলেন “England has indirectly exported the soil of Ireland, without even allowing its cultivators the means for replacing the constituents of the exhausted soil”. পুঁজি গ্রন্থের ঐ খণ্ডেই অন্যত্র তিনি লিখেছিলেন “Capitalist production collects the population together in great centers, and causes the urban population to achieve an ever-growing preponderance. This has two results. On the one hand it concentrates the historical motive force of society, on the other hand, it disturbs the metabolic interaction between man and the earth, i.e. it prevents the return to the soil of its constituent elements consumed by man in the form of food and clothing; hence it hinders the operation of the eternal natural condition for the lasting fertility of the soil.” তাই পুঁজিবাদী কৃষির সমালোচনা করে মার্ক্স বলেছিলেন, “[A]ll progress in capitalist agriculture is a progress in the art, not only of robbing the worker, but of robbing the soil; all progress in increasing the fertility of the soil for a given time is a progress toward ruining the more long-lasting sources of that fertility… Capitalist production, therefore, only develops the technique and the degree of combination of the social process of production by simultaneously undermining the original source of all wealth-the soil and the worker.”১০
মার্ক্স উপলব্ধি করেছিলেন যে, শিল্প সর্বহারা শুধু উৎপাদনের উপকরণ থেকেই বিচ্ছিন্ন নয় বরং প্রকৃতি থেকেও বিচ্ছিন্ন। এই বিচ্ছিন্নতাকে মার্ক্স বলেছিলেন বিপাকীয় বিচ্ছিন্নতা বা Metabolic alienation (মূল জার্মান শব্দটি ছিল stoffwechsel)। এই বিপাকীয় বিচ্ছিন্নতা বা ফাটলই পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় কৃষিজমির উর্বরতা হ্রাসের প্রধান কারণ।
১৮৪২ খৃষ্টাব্দে লাওয়েস (Lawes) দ্রবণীয় ফসফেট এবং ১৯১৩ সালে হেবার (Haber) নাইট্রোজেন ঘটিত রাসায়নিক সার আবিষ্কার করেন। আবিষ্কার হওয়ার সাথে সাথেই এগুলির ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয়। প্রথম দিকে ভালো ফল দিলেও এর কোনোটাই উর্বরতা সমস্যার স্থায়ী সমাধান করতে পারেনি। কারণ এই সারগুলি কেবল নাইট্রোজেন আর ফসফরাস সরবরাহ করতে পারত, আর উদ্ভিদ মাটি থেকে ১৫ রকমের মৌল শোষণ করে, এবং তাদের মধ্যে যে কোনো একটির অভাব থাকলেই তার বৃদ্ধি ব্যাহত হবে। চাষের জমির উর্বরতা ধরে রাখার জন্য বহু গবেষণা হয়েছে, বহু বিচিত্র সার আবিষ্কার হয়েছে, কিন্ত স্থায়ী ভাবে সমস্যা মেটানো যায়নি। প্রকৃতপক্ষে শুধু প্রযুক্তি ব্যবহার করে এই সমস্যার সমাধান করা কঠিন। পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় যেখানে বিপুল পরিমাণে কৃষিজ পণ্য ও তার মধ্যে আবদ্ধ মৌল কৃষিক্ষেত্র থেকে দুরবর্তী অঞ্চলে ক্রমাগত পাচার হয়ে যায় সেখানে, জমির উর্বরতা ধরে রাখা এক দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের মতো। এই বিষয়ে পরবর্তী অধ্যায়ে আরও বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে।
বর্তমান ভারতীয় পরিপ্রেক্ষিত :
বিগত ৫০ বছরে পৃথিবীতে নগরায়নের পরিমাণ বহুগুণ বেড়েছে। পৃথিবীর অধিকাংশ স্থানেই শহুরে জনসংখ্যার বৃদ্ধি হয়েছে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ। এইভাবে চললে আগামী ৩০ বছরে শহুরে জনসংখ্যার পরিমাণ যে হারে বাড়বে তাতে এই বিপুল সংখ্যক মানুষকে জায়গা দেবার জন্য প্রতি বছর ২০ লক্ষ মানুষের বসতি হয় এমন ৩৩টি করে নতুন নগরীর পত্তন করতে হবে। ২০০৩ সালে পৃথিবীতে ১৯টি মহানগরী ছিল যাদের জনসংখ্যা ১ কোটির বেশি। বিশ্বের মোট শহুরে মানুষের ৮ শতাংশই সেখানে বসবাস করত। তৃতীয় বিশ্বের অনেক মহানগরীর (যেমন মুম্বাই, দিল্লি, সাও পাওলো, ঢাকা, মেক্সিকো সিটি ইত্যাদি) জনসংখ্যা ২ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। অনুমান করা হয় ২০২০-২৫ সাল নাগাদ শহুরে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার পৃথিবীর মোট জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারকে ছাপিয়ে যাবে১১। উন্নয়নশীল দুনিয়ায় নগরায়নের এই উচ্চহার ১৮শ ১৯শ শতাব্দীর শিল্পবিপ্লবের সময়কার ইংলন্ড ও অন্যান্য কয়েকটি ইউরোপীয় দেশের সাথে তুলনীয়। বর্তমান পৃথিবীর এই প্রেক্ষাপটে ভারত কোনো ব্যতিক্রম নয় (চিত্র-১ দ্রষ্টব্য)। ভারতে কেন প্রচুর মানুষ গ্রাম ছেড়ে শহরে আসছেন, তার কারণ মুলত সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং বাস্তুতান্ত্রিক। আমরা এখানে ভারতের সম্পুর্ণ বিপরীত চরিত্রের দু’টি অঞ্চলের মানুষের গ্রাম ছেড়ে শহরে আসার কারণ আলোচনা করবো। এই অঞ্চল দু’টি হল পঞ্জাব এবং বুন্দেলখণ্ড। পঞ্জাব ভারতের সবচেয়ে সমৃদ্ধ রাজ্যগুলির একটি, এটি ছিল প্রথম সবুজ বিপ্লবের কেন্দ্র। অন্যদিকে বুন্দেলখণ্ড ভারতের সবচেয়ে পশ্চাদপদ জায়গাগুলির একটি। অঞ্চলটি দুর্ভিক্ষ পীড়িত। মধ্যপ্রদেশের ৬টি এবং উত্তরপ্রদেশের ৭টি জেলা নিয়ে এই বুন্দেলখণ্ড গঠিত। বুন্দেলখণ্ডের এই ১৩টি জেলাই ভারতীয় প্ল্যানিং কমিশনের ঘোষণা করা সবচেয়ে পশ্চাদপদ ২০০টি জেলার অন্তর্গত। পঞ্জাব ও বুন্দেলখণ্ড নিয়ে আলোচনা হলে ভারতের বাকি রাজ্যগুলো সম্পর্কেও একটা ধারণা পাওয়া সম্ভব কারণ সেগুলি পঞ্জাব আর বুন্দেলখণ্ডের এক বিচিত্র কোলাজ।
পঞ্জাব :
সবুজ বিপ্লবের ফলে পঞ্জাবে চাল ও গমের উৎপাদন বহুগুণ বাড়ে। সবুজ বিপ্লবের কৃষি প্রযুক্তি অনুসারে বিদেশি সংকর জাতের গম ও ধান, প্রচুর জল, রাসায়নিক সার, কীটনাশক বিষ, এবং ট্রাক্টর ইত্যাদি ব্যবহার করে চাষ করা হয়েছিল। পঞ্জাবের ভৌগোলিক অঞ্চল ভারতের মাত্র ১.৫৪ শতাংশ, অথচ এই রাজ্য ভারতের মোট খাদ্যশস্যের ১৩ থেকে ১৪ শতাংশ উৎপাদন করে। পঞ্জাব ভারতের মোট চালের ৩৫ থেকে ৪০% এবং মোট গমের ৪০ থেকে ৭৫% উৎপাদন করে ভারতীয় শস্যাগারের তকমা পেয়েছিল।
সবুজ বিপ্লবের এই সাফল্য কিন্তু স্থায়ী হয়নি, বিগত কয়েক বছরে জাতীয় কৃষি উৎপাদনে পঞ্জাবের ভূমিকা ধীরে ধীরে কমছে। সবুজ বিপ্লব পঞ্জাবের কৃষির চালচিত্র বদলে দিয়েছিল। পঞ্জাবীরা মুলত গম, মিলেট ও ডালের চাষ করত, এবং তা তাদের খাদ্যাভ্যাসের সাথে সাযুজ্যপূর্ণ ছিল। সবুজ বিপ্লবে কেবল গম ও ধান চাষের ওপর জোর দেওয়া হল। ডাল চাষ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় জমিতে প্রাকৃতিক উপায়ে নাইট্রোজেন আসার একটা বড় উৎস বন্ধ হয়ে গেল। নাইট্রোজেনের জন্য সম্পুর্ণভাবে রাসায়নিক সারের উপর নির্ভরশীলতা শুরু হল, ফলে জমির অনেক উপকারী প্রাণী মরেগেল, ভূমিক্ষয় বাড়ল। ১৯৮৫ সালে পঞ্জাব সরকার কৃষির সমস্যা খতিয়ে দেখার জন্য কৃষি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এস এস ঝোলের সভাপতিত্বে একটি কমিটি গঠন করে। ১৯৮৬ সালে সেই কমিটি তার রিপোর্ট দাখিল করে এবং বলে যে পঞ্জাবের কৃষির উৎপাদনশীলতা কমে যাবার অন্যতম প্রধান কারণ চক্রাকারে গমের পর ধান আর ধানের পর গম চাষ করা।
ডাল ও মিলেটের মত কম জলের ফসল চাষ বন্ধ করে কেবল ধান আর গম চাষ করার জন্য পঞ্জাবের কৃষিতে জলের চাহিদা প্রচুর বেড়ে গিয়েছিল। পাঞ্জাবের কৃষিজমির শতকরা ৯৮ ভাগই সেচ সেবিত। অধিকাংশ স্থানেই জলের অত্যাধিক ব্যবহারের ফলে ভৌম জলের স্তর মাটির ১০ মিটারের বেশি নীচে নেমে গিয়ে সংকটজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। ২০১০ সালের সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে পঞ্জাবের ১৩৮টি ব্লকের মধ্যে ১১০টি ব্লকেই জলসম্পদের অবস্থা অত্যন্ত সংকটজনক১৩।
পঞ্জাবের কৃষিতে রোগ ও পোকার উপদ্রবও ক্রমশই বেড়ে চলেছে।সবুজ বিপ্লবের সংকর প্রজাতির ধান ও গম চাষের পর থেকেই এই উপদ্রব বাড়তে থাকে। অতিরিক্ত সার ও জলের ব্যবহারের কারণে আগাছার বাড়বাড়ন্তও হতে থাকে খুব। পঞ্জাবের কৃষি সম্পুর্ণভাবে কীটনাশক ও আগাছানাশকের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। কীটনাশকের এই লাগামছাড়া ব্যবহারের কারণে কৃষকদের মধ্যে ক্যান্সার সহ নানান মারণ রোগ বাসা বাঁধে।
পঞ্জাবে জমির উর্বরতাশক্তিও দ্রুত হারে কমেছে। ১৯৭০-৭১ সালে প্রতি হেক্টরে ৩৭ কেজি সার প্রয়োগ করে যে ফলন পাওয়া যেত, ২০১০-১১ সালে সেই পরিমাণ ফলন পেতে হেক্টর প্রতি ২৪৩ কেজি সার প্রয়োগ করতে হয়েছে। রাজ্যের অধিকাংশ জমিতেই নাইট্রজেন ও দ্রবণীয় ফসফরাসের পরিমাণ নিচু থেকে মাঝারি। অনেক জমিতেই স্বল্পমাত্রিক মৌলের অভাব দেখা গিয়েছ। সাম্প্রতিক কালে বেশ কিছু জমিতে সালফারের অভাব দেখা গিয়েছে। বহু জমিতেই দস্তা, ম্যাঙ্গানিজ, ও লোহার অভাবে ফলন ভীষণভাবে মার খাচ্ছে। বিপাকীয় ফাটলের যাবতীয় বৈশিষ্ট্য পঞ্জাবের কৃষিতে ক্রমশই প্রকট হয়ে উঠছে।
পঞ্জাবের কৃষিজমি অসুস্থ, কৃষক রোগগ্রস্ত। কিন্তু দুর্ভাগ্যের এখানেই শেষ নয়। কৃষিপণ্যের বাজারে ফড়ে আর দালালদের দাপট। ইদানীং বহুজাতিক পুঁজিও সেখানে মাথা গলিয়েছে। ফড়ে, দালাল ও সরকারি আমলাদের অশুভ আঁতাতের ফলে কৃষক কৃষিপণ্যের ন্যায্য দাম পায় না। এরকম একটি মর্মন্তুদ ঘটনার উল্লেখ আমরা পাই অর্থনীতিবিদ সুরিন্দর এস যোধকার লেখা “The Decline of Agriculture” প্রবন্ধে১২। ঘটনাটি এরকম, ২০০০ সালে পঞ্জাবে ধানের ফলন ভালো হয়। কিন্তু যে সংস্থাগুলি সরকারি ন্যূনতম সহায়ক মুল্যে ধান কেনে তারা ধান কিনতে অস্বীকার করে। তারা অজুহাত দেখায় যে ধানের গুণমান খারাপ। এফসিআই.-এর কর্তা এমন কথাও বলেন যে পঞ্জাবের গমের ৮০% ই খারাপ, যদিও এই দাবির কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি ছিল না। ব্যবসাদার আর মিলমালিকেরা কিন্তু এই ধান কিনতে যথেষ্ট আগ্রহী ছিল, বলা বাহুল্য, ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের থেকে অনেক কম দামে।
পঞ্জাবের চাষিরা চাষে আগ্রহ হারাচ্ছেন। শহুরে জীবিকা তাদের বেশি পছন্দ। তারা দলে দলে শহরে চলে যাচ্ছেন। অনেকে বলেন এই শহরাভিমুখী যাত্রার কারণ কেবল গ্রামীণ জীবিকার অনিশ্চয়তাই নয়, শহুরে সুযোগ সুবিধা আর ঝলমলে জীবনের হাতছানিও একটা কারণ। অস্বীকার করি না। কিন্তু পঞ্জাবের মত সমৃদ্ধ রাজ্যের গ্রামেরই যখন এই অবস্থা তখন ভারতের বাকি রাজ্যের গ্রামগুলোর কি অবস্থা তা তো সহজেই অনুমান করা যায়। বুন্দেলখণ্ডের প্রসঙ্গে সে চিত্র আমরা দেখতেও পাব। ভারতের লক্ষ লক্ষ গ্রামকে দুর্দশার অন্ধকারে ডুবিয়েই তো শহরের এত ঝলমলানি। যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গ্রামকে আঁধারে রাখে তাই শহরকে আলোকিত করে। গ্রাম থেকে মানুষের শহরমুখী যাত্রার পিছনে এই ব্যবস্থাই দায়ী।
বুন্দেলখণ্ড :
আসা যাক বুন্দেলখণ্ডের কথায়। সেই ২০০৩ সাল থেকে অঞ্চলটি খরায় জ্বলছে। প্রায় ১ কোটি ৬০ লক্ষ মানুষ খড়া পীড়িত। ৪০% জমিতে জলের অভাবে বীজ বোনা যায় না। খাদ্য উৎপাদন ৩০% কমে গেছে। ৭০% পুকুর শুকিয়ে গেছে। গোটা অঞ্চল জুড়ে পানীয় জলের হাহাকার। এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে ঐ অঞ্চলের প্রায় ৪০% মানুষ এলাকা ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন১৪। অথচ ঐতিহাসিকভাবে বুন্দেলখণ্ড এরকম ভয়াবহ খরাপ্রবণ অঞ্চল ছিল না। সরকারি তথ্য অনুসারে ১৮শ ও ১৯শ শতকে এই অঞ্চলে গড়ে ১৬ বছরে একবার খরা হত। ১৯৬৮ থেকে ১৯৯২ এর মধ্যে গড়ে প্রতি ৫ বছরে একবার খরা হয়েছে। আর একবিংশ শতাব্দীতে এই অঞ্চল ইতিমধ্যেই ৭ বছরের বেশি সময় ধরে খরা পীড়িত।
বুন্দেলখণ্ডে বৃষ্টিপাত যে খুব কম হয় তা কিন্ত নয়। এখানে বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ৭৫০মিমি থেকে ১২৫০মিমি এবং বছরে প্রায় ১০০ ঘন্টা ধরে বৃষ্টিপাত হয়। এক কথায় বলা যেতে পারে এখানে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ অনেক সুজলাং সুফলাং রাজ্যের মতই। শুধু তাই নয় এখানে বহুদিন ধরে বৃষ্টির জল ধরে রাখার এক সুন্দর লোকায়ত ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। এখানে বৃষ্টির জল ধরে রাখার জন্য প্রায় হাজার চারেক পুকুর ছিল, যাদের কোনো কোনোটা হাজার বছরেরও বেশি পুরানো। তাহলে এখানে এত খরা কেন। কেনই বা দিনকে দিন খরার প্রকোপ বাড়ছে তার কারণ নীচে সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করা হল।
অরণ্য ধ্বংস: ঐতিহাসিক ভাবে বুন্দেলখণ্ড ছিল ঘন জঙ্গলাকীর্ন অঞ্চল। ১৯ শতকের প্রথম দিকেও বুন্দেলখণ্ডে যে অংশ উত্তরপ্রদেশের দিকে পরে তার ৩০% ও যে অংশ মধ্যপ্রদেশের দিকে পরে তার ৪০% অরণ্যে ঢাকা ছিল। আর বর্তমানে উত্তরপ্রদেশের দিকের ৬৪% ও মধ্যপ্রদেশের দিকের ৫০% অরণ্যই ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। এই ব্যাপক অরণ্য বিনাশের প্রধান কারণ কাঠের জন্য নির্বিচারে গাছ কাটা, আর কংক্রিট বানানোর পাথরের জন্য খাদান খোঁড়া। এই সমস্ত কাঠ এবং পাথর কানপুর, লক্ষ্ণৌ, এবং অন্যান্য শহরের বাড়ি তৈরির কাজে ব্যবহৃত হয়েছে। বুন্দেলখণ্ডের মাহবা জেলা পাথরের খাদানের জন্য বিখ্যাত। এখান থেকে রোজ ৯০০-১২০০ ট্রাক বোঝাই পাথর বাইরে চালান যায়। এছাড়াও ট্রেনে করে মাসে প্রায় ৫০০০ টন পাথর ঝাঁসিতে পাঠানো হয়। এইভাবে যথেচ্ছ পাথরের খাদান খোঁড়ার ফলে অরণ্য ধ্বংস হয়ে যায়, পড়ে থাকে নিঃস্ব রিক্ত ভূমি। বৃষ্টির জলে এই ভূমির উপরের স্তরের মাটি ধুয়ে চলে যায়, অনুর্বর পাথরের স্তর বেরিয়ে পড়ে। ধুয়ে যাওয়া মাটি গিয়ে জমা হয় কুয়োতে আর পুকুরে, সেগুলো ভরাট হতে থাকে। এইভাবে বুন্দেলখণ্ডের শতাব্দী প্রাচীন পানীয় জল আর সেচের জলের উৎসগুলি নষ্ট হয়ে যায়। এখনকার খরায় তাই পানীয় জলের তীব্র সংকট দেখা যায়, যা আগেকার দিনের খরায় কখনও দেখা যেত না।
শিল্পায়ন : মধ্যপ্রদেশ সরকার এই পিছিয়ে পড়া অঞ্চলের উন্নয়নের জন্য শিল্প স্থাপন করছেন। লৌহ, ইস্পাত, সিমেন্ট, সংকর ধাতু ইত্যাদি আরও অনেক কিছু। এই প্রত্যেকটি শিল্পেই প্রচুর জলের প্রয়োজন। মধ্যপ্রদেশ সরকার এই জল সরবরাহের গ্যারান্টি দিচ্ছে। শিল্পের চাহিদা মেটাতে প্রচুর জলের ব্যবহার খরা পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করে তুলছে।
ভৌম জলের অতি ব্যবহার : বুন্দেলখণ্ডের একটি ভূতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট হল এর মাটির নীচে গ্রানাইট পাথরের একটি স্তর রয়েছে, যা এর ভৌম জলের পুনর্নবীকরণে বাধার সৃষ্টি করে। এই কারণেই এখানে পুকুর এবং কুয়োর মাধ্যমে বৃষ্টির জল ধরে রাখার ব্যবস্থা ছিল। সেই সব নষ্ট হয়ে যাবার পর সরকার ভৌম জল তোলার ওপর জোর দিল। দারিদ্র দূরীকরণের জন্য সরকার এমন সব বাণিজ্যিক ফসল চাষের উৎসাহ দিল যাতে প্রচুর জলের দরকার হয়। এরকম একটি ফসল হল মেন্থা। মেন্থা চাষ করতে অন্তত ১৮ বার সেচ দেবার দরকার হয়। প্রতি একরে মেন্থা চাষ করতে প্রায় ৫০ লক্ষ লিটার জলের দরকার হয় আর প্রতি একরে মেন্থার চাষ করে ৩০ থেকে ৩৫ লিটার মেন্থার তেল পাওয়া যায়। অর্থাৎ এক লিটার মেন্থার তেল তৈরির জন্য এক লক্ষ লিটারেরও বেশি জলের দরকার হয়। ৫ বছর সমীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে মেন্থার চাষ করে চাষিদের বিশেষ অর্থনৈতিক উন্নতি হয়নি যদিও ভৌম জলের ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটেছে। তবে এটাও বোধহয় যথেষ্ট নয়, এরপরেও মধ্যপ্রদেশ সরকার সেখানে বায়ো ডিজেলের জন্য ব্যাপক মাত্রায় জ্যাট্রোপা চাষের পরিকল্পনা নিয়েছে। এই চাষের জন্যেও প্রচুর জল লাগে, আর এই জল যোগানো হবে মাটির তলার জল তুলে, তাই ফল কী যে হবে তা সহজেই অনুমান করা যায়১৪।
এইভাবে শহরের চাহিদা মেটাতে গিয়ে, পুঁজিপতিদের চাহিদা মেটাতে গিয়ে, বুন্দেলখণ্ড নিঃস্ব রিক্ত হয়ে গেছে। স্থানীয় জ্ঞানের প্রতি অবজ্ঞা, আর তথাকথিত উন্নয়নের ধাক্কা তার বাস্তুতন্ত্রকে ধ্বংস করে দিয়েছে। বুন্দেলখণ্ডের মানুষজন তাদের ভিটেমাটি ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে, অনেকেই এসে ভীড় করেছেন শহরের বস্তিতে। বিপাকীয় ফাটল আরও প্রশস্ত হয়েছে।
ভারতের কত মানুষ উন্নয়নের দাপটে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন তার একটা হিসেব পাওয়া যায় বিখ্যাত সাংবাদিক পি সাইনাথের লেখা Everybody loves a good drought বইটিতে। সেখানে তিনি বলেছেন এই সংখ্যাটা প্রায় আড়াই কোটির কাছাকাছি, মানে গোটা অস্ট্রেলিয়া দেশটার জনসংখ্যার সমান। এই উন্নয়ন উদ্বাস্তুদের অধিকাংশই ঠাঁই নেয় শহরের বস্তিতে।
ভারতের কৃষিজমির নিঃস্ব হওয়ার খতিয়ান:
২০০১ সালের জনগণনায় দেখা যাচ্ছে যে ভারতে শহুরে জনসংখ্যার পরিমাণ ২৮,৫৩,৫৪,৯৫৪ জন। ১৯৯৯-২০০০ সালে ভারতের শহুরে মানুষেরা গড়ে মাথাপিছু মাসে ৫.৫ কেজি চাল আর ৪.৪ কেজি গম খেয়েছিল (তালিকা ১ দ্রষ্টব্য)। প্রতি গ্রাম চালে ও গমে পটাসিয়ামের পরিমাণ যথাক্রমে ১.১৬ এবং ৩.৮৬ মিলিগ্রাম (তালিকা ২ দ্রষ্টব্য)। তাহলে প্রতিমাসে প্রতিটি শহুরে ভারতীয় গড়ে (৫.৫ x ১.১৬ x ১০০০) + (৪.৪ x ৩.৮৬ x ১০০০) = ২৩৩৬৪ মিলিগ্রাম পটাসিয়াম গ্রহণ করেছে, তাহলে বছরে করেছে ২৩৩৬৪ x ১২ = ২৮০৩৬৮ মি.গ্রা. বা ২৮০.৪ গ্রাম পটাসিয়াম। অর্থাৎ শহুরে মানুষ ঐ বছর মোট (২৮০.৪ x ২৮৫৩৫৪৯৫৪)/(১০০০ x ১০০০) = ৮০০১৩.৫ মেট্রিক টন পটাসিয়াম শুধু চাল ও গমের মাধ্যমে গ্রহণ করেছে১৫। বলা বাহুল্য এই পটাসিয়াম এসেছে গ্রামের কৃষিজমি থেকে এবং যা কোনো প্রাকৃতিক উপায়ে কৃষি জমিতে ফেরত যাবে না। এই হিসাব শুধু চাল ও গম ধরে করা হয়েছে, সমস্ত ধরণের খাদ্যদ্রব্য হিসাবের মধ্যে আনলে নিশ্চিত ভাবেই দেখা যাবে যে নিষ্কাষিত পটাসিয়ামের পরিমাণ আরও অনেক বেশি। আজ জমি থেকে শুধু চাল ও গমের মাধ্যমে যে পরিমাণ পটাশিয়াম নিষ্কাশিত হচ্ছে সবুজ বিপ্লবের প্রথমদিকে সামগ্রিক ভাবে তার থেকে কম পরিমাণ পটাসিয়াম জমিতে প্রয়োগ করতে হত। যেমন ১৯৬৪-৬৫ সালে ভারতীয় কৃষিজমিতে মোট প্রযুক্ত পটাসিয়ামের পরিমাণ ছিল ৬৯৩০০ মেট্রিক টন। বিপাকীয় ফাটলের কারণে জমির পটাসিয়ামের ভাণ্ডার যেমন যেমন রিক্ত হয়েছে, তেমনই বেড়েছে পটাসিয়াম সারের চাহিদা। তাই ২০০০-২০০১ সালে ১৫,৬৭,৫০০ মেট্রিক টন পটাসিয়াম ব্যবহার করতে হয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য ভারতে ব্যবহৃত সমস্ত পটাসিয়াম সারই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়, ভারতে কিছুই তৈরি হয় না। অন্যান্য মৌলিক উপাদানের ক্ষেত্রেও চিত্রটা প্রায় একই রকম (তালিকা ৩ দ্রষ্টব্য), তফাৎ শুধু এইটাই যে এই ঘাটতি পূরণের জন্য প্রায়ই কোনো সার প্রয়োগ করা হয় না।
তালিকা-১
ভারতীয় শহুরে জনগণের মাথাপিছু গড় খাদ্য গ্রহণ (কেজি/৩০দিন)
Source: FOOD CONSUMPTION, TRADE REFORMS AND TRADE PATTERNS IN CONTEMPORARY INDIA: HOW DO AUSTRALIA AND NZ FIT IN?
by Srikanta Chatterjee, Allen Rae, Professors, Department of Applied & International Economics, Massey University Palmerston North New Zealand, and Ranjan Ray, Professor School of Economics, University of Tasmania Hobart Tasmania Australia. Discussion Paper No. 06.04 – March 2006
তালিকা-২
খাদ্যে উপস্থিত বিভিন্ন মৌলিক পদার্থের পরিমাণ (মি.গ্রা./১০০গ্রামে)
Source: Prepared from Nutritive Value of Food. Susan E Gebhardt. And Robin G Thomas, US Department of Agriculture. Agricultural Research Service Home And Garden, Bulletin Number 72, Nutritive Value of Indian Food. C.Gopalan, ICMR, and Introduction to Human Nutrition, Second Edition, edited by Michael J Gibney Susan, A Lanham-New, Aedin Cassidy, Hester H Vorster
তালিকা-৩
ভারতের কৃষিক্ষেত্র থেকে শুধু চাল ও গমের মাধ্যমে মৌলিক পুষ্টি-পদার্থের স্থানান্তরণ (২০০০-২০০১)
জমির এই ক্ষয়পূরণের জন্য রাসায়নিক সার ব্যবহার করা হয়, কিন্তু তা অন্য বিপদ ডেকে আনে।প্রধান রাসায়নিক সারগুলি কেবল নাইট্রোজেন ফসফরাস ও পটাসিয়াম (N P K) সরবরাহ করতে পারে কিন্তু অন্য মৌলগুলি পারে না। তাই ধীরে ধীরে জমিতে অন্য মৌলগুলির অভাব প্রকট হয়ে ওঠে। নির্দিষ্ট কিছু স্বল্পমাত্রিক মৌলের অভাবে কয়েকটি অতিমাত্রিক মৌলের চাহিদা বাড়ে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে জমিতে মলিবডেনাম ও/বা ম্যাঙ্গানিজের অভাব ঘটলে প্রাকৃতিক উপায়ে জমিতে নাইট্রোজেনের যোগান ব্যাহত হয়, তখন নাইট্রোজেন সারের উপর নির্ভরতা আরও বাড়ে। এই পরিস্থিতি সামাল দিতে এখন স্বল্পমাত্রিক মৌলের বিভিন্ন লবণ (অনুখাদ্য সার) ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে১৬। কিন্তু জমিতে এই স্বল্পমাত্রিক মৌলিক উপাদানগুলি যে ঘনত্বে কার্যকরী তার থেকে সামান্য বেশি ঘনত্বে এগুলিকে প্রয়োগ করলে বিষক্রিয়া ঘটতে পারে। সবুজ বিপ্লবের প্রায় ৬ দশক পরে আমাদের দেশের অধিকাংশ কৃষিজমি কোনো মৌলের অধিক ঘনত্বের বা কোনো মৌলের অভাবের কারণে অসুস্থ। রাসায়নিক সারের অতিরিক্ত ব্যবহার এবং জৈবসারের অব্যবহারের কারণে জমির প্রচুর উপকারী জীব মারা পড়েছে, ফলে জৈব-ভূ-রাসায়নিক চক্রের সামগ্রিক পদ্ধতিটি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। অনেক সময়ই ফসফেট সারে মাত্রাতিরিক্ত ক্যাডমিয়াম থাকে যা জমি দূষিত করে। জমিতে জৈব পদার্থের অভাব থাকার কারণে উদ্ভিদের বিভিন্ন মৌলিক পদার্থের শোষণে সমস্যার সৃষ্টি হয় যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে।
এই সমস্ত কারণে যেখানে ১৯৭৫ সালে সর্ব ভারতীয় ক্ষেত্রে গড়ে প্রতি কেজি রাসায়নিক সার প্রয়োগে ১৫ কেজি খাদ্যশস্য উৎপাদিত হত সেখানে ১৯৯০ সালে হয়েছিল মাত্র ৮ কেজি১৬ (চিত্র-২ দ্রষ্টব্য)।
ভারতের কৃষিমন্ত্রক থেকে ২০০৮ সালের নভেম্বর মাসে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে ভারতীয় কৃষি জমির রিক্ততার নিম্নলিখিত কারণগুলিকে স্পষ্ট ভাষায় চিহ্নিত করা হয়েছে।
১. বার্ষিক এক কোটি টন হারে মাটির পুষ্টি পদার্থের অপসারণ।
২. মাটিতে স্বল্প-মৌলিক উপাদনের ক্রমবর্ধমান ঘাটতি।
৩. ভৌম জলের স্তর নীচে নেমে যাওয়া।
৪. জমির জৈব কার্বনের ক্ষয়।
চিত্র-২
উপরের আলোচনা থেকে এই সিদ্ধান্ত করা যায় যে বিপাকীয় ফাটলের কারণে ভারতের কৃষিক্ষেত্র রিক্ত হয়ে পড়ছে। তাই ১৯৫০-৫১ থেকে ২০০০-০১ পর্যন্ত ভারতে হেক্টর প্রতি রাসায়নিক সারের ব্যবহার ১৮১.২২ গুণ বাড়িয়েও, সেচসেবিত এলাকা ২.৩৯ গুণ বাড়িয়েও, ফলন মাত্র ৩.১১ গুণ বাড়ানো গিয়েছে১৭।
আধুনিক কৃষিতে জমির উর্বরতা ধরে রাখা এক জ্বলন্ত সমস্যা। এই সমস্যার মোকাবিলায় মৃত্তিকা রসায়ন নিয়ে বহু গবেষণা হয়েছে, বহু রকমের সার আবিষ্কার হয়েছে, কিন্তু সমস্যার স্থায়ী সমাধান হয়নি। প্রকৃতপক্ষে এটি এমন কোনো সমস্যা নয় যার সমাধান কেবল প্রযুক্তি প্রয়োগ করে সম্ভব। যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় কোটি কোটি মানুষকে কৃষিজমি থেকে জঙ্গল থেকে উচ্ছেদ করে শহরে এনে জড়ো করা হয়, সেখানে বিপাকীয় ফাটল দেখা দেবেই, যার অবশ্যম্ভাবী ফলশ্রুতিতে কৃষিজমি নিঃস্ব রিক্ত হয়ে যাবেই। ব্যবস্থা না পাল্টালে এই অবক্ষয়ের হাত থেকে পরিত্রাণ নেই।
অপুষ্টি যেখানে বুভূক্ষার বিকল্প :
১৯৯০ সালে বিজ্ঞানী শিল্লানপা (Silllanpaa) বিশ্বের চাষযোগ্য জমিতে স্বল্পমাত্রিক মৌলিক উপাদানের অভাব সম্পর্কিত একটি সমীক্ষা করেন। এই সমীক্ষাটিতে বহু ধরণের ফসলের জমির উপর ব্যাপক পরীক্ষা নিরীক্ষা চালানো হয়েছিল। তাঁর সমীক্ষায় দেখা যায় যে বিশ্বের বিভিন্ন চাষযোগ্য জমিতে, প্রধানত তৃতীয় বিশ্বের কৃষিক্ষেত্রে অনেক স্বল্পমাত্রিক মৌলিক উপাদানের অভাব রয়েছে। তিনি দেখেন যে প্রায় অর্ধেক জমিতে দস্তার অভাব রয়েছে, আর বোরনের অভাব রয়েছে প্রায় এক তৃতীয়াংশ জমিতে। প্রায় ১০-১৫% জমির কোনো না কোনোটাতে তামা, মলিবডেনাম বা ম্যাঙ্গানিজের অভাব রয়েছে। সবশুদ্ধ প্রায় ৪০% জমি এই তিনটি মৌলের কোনো একটি বা দু’টির অভাবে ক্ষতিগ্রস্ত১৭। যদিও বিভিন্ন উদ্ভিদ প্রজাতির বিভিন্ন মৌলিক উপাদান শোষণের ক্ষমতার মধ্যে ব্যাপক তারতম্য রয়েছে, তবুও একথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে, মাটিতে মৌলিক উপাদানের অভাব থাকলে সেই মাটিতে জন্মানো উদ্ভিদেও তার অভাব থাকবে। স্বাভাবিক ভাবেই ওই উদ্ভিদগুলি যদি মানুষের প্রধান খাদ্য হয় তাহলে মানুষের শরীরেও ওই উপাদানগুলির অভাব দেখা দেবে। বাস্তবে হয়েওছে তাই, পৃথিবীর বহু জায়গাতেই খাদ্যাভাবের থেকেও খাদ্যে স্বল্পমাত্রিক উপাদানের অভাব একটি বড় সমস্যা১৮। খাদ্যে স্বল্পমাত্রিক মৌলের অভাব বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন অসুখের প্রধান কারণ হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে। পৃথিবী জুড়ে ২০০কোটিরও বেশি মানুষ এক বা একাধিক স্বল্পমাত্রিক মৌলিক উপাদানের অভাবে ভুগছেন (WHO 2012)। স্বল্পমাত্রিক মৌলিক উপাদানের অভাবজনিত এই মহামারী, কৃষিজমিতে ঐ উপাদান গুলির অভাবের সঙ্গে সম্পর্কিত।
বিপাকীয় ফাটল প্রশস্ত হচ্ছে :
শিল্প-বিপ্লবের সময় থেকেই বেশকিছু চিন্তাশীল মানুষ বিপাকীয় ফাটল ও কৃষিজমির উর্বরতার সমস্যা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। তারা প্রস্তাব করেছিলেন যাতে শহরের বর্জ্য সার হিসাবে কৃষি ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। এইভাবে তারা নিঃস্ব কৃষিজমির উর্বরতার পুনর্নবীকরণ চেয়েছিলেন। কিন্তু বর্তমান পণ্য পৌত্তলিক (Commodity fetish) নাগরিক সভ্যতায় সমস্যার প্রকৃতি আরও জটিল হয়েছে। শহুরে পচনশীল জৈব পদার্থের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে প্রাণঘাতী রাসায়নিক এবং ভারী ধাতু। যদি শহুরে বর্জ্যকে সরাসরি সার হিসাবে কৃষিজমিতে ব্যবহার করা হয় তাহলে এই বিপজ্জনক বর্জ্যগুলিকে সরাসরি খাদ্য শৃঙ্খলে প্রবেশের ছাড়পত্র দেওয়া হবে, যা অন্য বিপর্যয় ডেকে আনবে। শহুরে বর্জ্য থেকে প্রস্তুত জৈবসারে ভালোমাত্রায় সীসা, ক্যাডমিয়াম, পারদ, ইত্যাদি পাওয়া যায়। অনেক দেশেই শহুরে বর্জ্য থেকে প্রস্তুত জৈব সার ব্যবহার করে কৃষিজমিতে ক্যাডমিয়াম দূষণ ঘটেছে১৯। ১৯৮০-র দশকে এই ধরনের জৈবসার আর দূষিত সেচের জল ব্যবহার করে জাপানে ৯.৫% ধান ক্ষেত আর ৭.৫% ফলের বাগান ক্যাডমিয়াম দূষণের কবলে পড়ে, এর ফলে জাপানে ইতাই রোগের মহামারী দেখা দেয়২০।
উপসংহার :
বিপাকীয় ফাটল একটি বিশেষ আর্থ-রাজনৈতিক ব্যবস্থার ফলশ্রুতি। সুতরাং এই বাস্তুতান্ত্রিক সংকটটি অতিক্রম করতে হলে আর্থ-রাজনৈতিক ব্যবস্থাটির পরিবর্তন প্রয়োজন। নতুন আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থাটা কীরকম হবে, কীভাবে এই বিপাকীয় ফাটলের সমস্যাকে অতিক্রম করা যাবে, তার বহু বর্ণনা মার্ক্স ও এঙ্গেলসের রচনায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। প্রাসঙ্গিক বোধে এখানে এঙ্গেলসের এন্টি ড্যুরিং থেকে একটি উদ্ধৃতি দেওয়া হল: “Abolition of the antithesis between town and country is not merely possible. It has become a direct necessity of industrial production itself, just as it has become a necessity of agricultural production and, besides of public health. The present poisoning of the air and water and land can be put an end to only by the fusion of town and country; and only such fusion will change the situation of masses now languishing in the towns, and enable there excrement to be used for the production of plant instead of for the production of disease.” দুঃখের বিষয় বিপাকীয় ফাটল অতিক্রমের এই সকল ধারণার চর্চা পরবর্তী যুগের প্রাতিষ্ঠানিক মার্ক্সবাদীদের মধ্যে খুবই অবহেলিত হয়েছে। পুঁজিবাদী উন্নয়নের মডেলকেই রাষ্ট্রীয় মার্ক্সবাদীরা অনুসরণ করেছিলেন। বিপাকীয় ফাটলের সমস্যা সোভিয়েত কৃষি অতিক্রম করতে পারেনি।
আজ থেকে প্রায় ১৬৮ বছর আগে কমিউনিস্ট পার্টির ইস্তেহারে পৃথিবীর বিভিন্ন জাতির কমিউনিস্টরা এক হয়ে একটা দাবি তুলেছিলেন, “কৃষিকে ম্যানুফ্যাকচারিং-এর সঙ্গে যুক্ত করতে হবে, এবং জনসংখ্যার যতদূর সম্ভব সমবণ্টনের মাধ্যমে গ্রাম ও শহরের বিভেদ ঘোচাতে হবে”, এই দাবির বিশেষত্ব এবং গুরুত্ব উপলব্ধি করতে হলে এখানে ব্যবহৃত ম্যানুফ্যাকচারিং শব্দটির অর্থ নিয়ে কিছু আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। সাধারণভাবে ইংরাজিতে ম্যানুফ্যাকচারিং শব্দটির মানে হল যন্ত্র নির্ভর বৃহৎ কারখানায় পণ্য উৎপাদন (the making of articles on a large scale using machinery; industrial production—Oxford online Dictionary) কিন্তু মার্ক্স-এঙ্গেলস শব্দটিকে ঠিক এই অর্থে ব্যবহার করেননি। মূল জার্মান শব্দ “Manufaktur” এর দ্বারা মার্ক্স হস্তশিল্প ও বৃহৎ যন্ত্রশিল্পের মধ্যে উৎক্রান্তিমূলক এমন এক উৎপাদন ব্যবস্থা বুঝিয়েছিলেন যেখানে শ্রম বিভাজন থাকবে, মানুষ যন্ত্র ব্যবহার করবে, যন্ত্র দ্বারা ব্যবহৃত হবে না২১। কৃষিকে ম্যানুফ্যাকচারিং-এর সাথে যুক্ত করা বলতে তাই কমিউনিস্টরা বৃহৎ যন্ত্র ও রাসায়নিক নির্ভর কৃষির কথা ভাবেননি, মার্কস নিজে ধনতান্ত্রিক কৃষিপ্রযুক্তিকে কৃষিজমির উর্বরতা লুণ্ঠনের প্রযুক্তি বলেই মনে করতেন। মার্ক্স বা এঙ্গেলস ম্যানুফ্যাকচারিং শব্দটিকে কী অর্থে ব্যবহার করেছেন তা পুঁজি গ্রন্থের প্রথম ও তৃতীয় খণ্ডের গুন্ড্রিশে, The German Ideology, Theories of Surplus Value ইত্যাদি বহু রচনায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, মূল জার্মান শব্দ “Manufaktur” কে অনুবাদের সময় ইংরাজি manufacture করে দেওয়া হয়। পরবর্তীকালে manufacture শব্দটি ইংরেজি সাহিত্যে এক পৃথক মানে নিয়ে উপস্থিত হয়েছে, এমতাবস্থায় কেন পরবর্তী সংস্করণগুলিতে এমনকি পাদটিকাতেও এ সম্পর্কে কোনো ব্যাখ্যা থাকে না, সেটা ভাববার। সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির কৃষি কেন পুঁজিবাদী দেশগুলোর মতই বিপাকীয় ফাটলে মুখ থুবড়ে পড়ল তার উত্তর হয়তো এখান থেকেও কিছুটা পাওয়া যেতে পারে।
কৃষিকে ম্যানুফ্যাকচারিং-এর সঙ্গে যুক্ত করার মডেলটি কেমন হবে সে সম্পর্কে কিছু ধারণা আমরা কিউবার বর্তমান কৃষি ব্যবস্থা থেকে পেতে পারি। কিউবার কৃষি নিয়ে বিস্তারিত বলতে গেলে একটি আলাদা প্রবন্ধ রচনার প্রয়োজন হবে, তাই এখানে কিউবার কৃষিব্যবস্থার একটি চুম্বকসার দেওয়া হল।
আমাদের দেশে এই ধরণের কৃষিব্যবস্থা চালু করার দাবিতে আমাদের সোচ্চার হতে হবে। গ্রাম ও জঙ্গলের সমস্ত প্রাকৃতিক সম্পদ ছিবড়ে করে সমৃদ্ধশালী শহর গড়ার সর্বনাশা উন্নয়নের বিরোধিতা করতে হবে। গ্রামে কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে। গ্রাম শহরের বৈরিতামূলক দ্বন্দ্ব ঘোচানোর লক্ষ্যে আমাদের সংগ্রাম করে যেতে হবে। যদি জয়ী হই, তাহলেই আমরা পারব বিপাকীয় ফাটল অতিক্রম করে এক নতুন পৃথিবীতে পা রাখতে।
References:
26 July, 2024
চমৎকার লেখা। সমস্যাটা প্রাঞ্জল ভাবেই ব্যাখ্যা করা হয়েছে। কিন্তু পুঁজিবাদ কীভাবে এই প্রলয়কালেও টিঁকে আছে? তার অস্তিত্ব নাশের শর্তগুলো পরিপক্ব কি হয় নি? আমাদের ঠাকুর্দাও শুনে এসেছেন পুঁজিবাদ মুমূর্ষু।