ওয়াহাকা কম্যুন

লিখেছেন:গুস্তাভো এস্তেভা, তর্জমা- বিপ্লব নায়ক
মেহিকোয় জাপাতিস্তা আন্দোলনের আঁতুড়ঘর চিয়াপাস প্রদেশের ঠিক পাশের প্রদেশটিই ওয়াহাকা। ২০০৬ সালে সেখানে গড়ে উঠেছিল এক কম্যুন। সেই কম্যুনের গড়ে ওঠা, রাষ্ভেট্ঙেরীয় সন্ত্রাসের মুখে পড়া ও আগামী দিনের জন্য চারিয়ে দিয়ে যাওযা সম্ভাবনাগুলো নিয়ে লিখেছেন সেই আন্দোলনের সহযাত্রী ও 'deproffesionalized intellectual' গুস্তাভো এস্তেভা।

‘ওয়াহাকা কম্যুন’ কী? তা কি একটি ক্ষণস্থায়ী অভ্যুত্থান, গণরোষের এক বিস্ফোরণ, যার কোনো দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব নেই? অথবা তা স্বাধীন আন্দোলনের ধারার বিশেষ ও নির্দিষ্ট এক প্রকাশরূপ, এমনই এক পরীক্ষানিরীক্ষা যা সেই ধারার একাংশের ভবিষ্যৎ গতিপথের পূর্বাভাস দিয়ে যায়? নাকি তা গণসংগ্রামের নেহাতই এক বিচ্ছিন্ন ও অদ্ভুত নিদর্শন?

২০০৬ সালে ওয়াহাকার ঘটনাবলী বিশ্বের দৃষ্টি-আকর্ষণ করেছিল, কিন্তু ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিত থেকে তার চরিত্র ও প্রভাব সম্পর্কে পূর্ণ বিচার করার মতো যথেষ্ট সময়দূরত্ব এখনও তৈরি হয়নি। তবু এই বিচারে প্রবৃত্ত হয়ে স্বাধীন আন্দোলনসমূহের সাপেক্ষে তার চরিত্র ও তাৎপর্য প্রসঙ্গে প্রাথমিক কিছু অনুমান আলোচনা করা জরুরী যেহেতু এই আন্দোলনে লক্ষ্য ও উপায়ের মধ্যে ফাঁক দূর করতে চাওয়া হয়েছিল, আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গড়তে চাওয়া সমাজের আদলকেই আন্দোলনের আদলে ধারণ করতে চাওয়া হয়েছিল।

এই অধ্যায়ে হাজির করা লেখাটির মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে ২০০৭ সালের গোড়ায় একটি গবেষণাকর্মের ভূমিকা হিসেবে লিখিত কিছু প্রাথমিক মন্তব্য, ওই সাল জুড়েই বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত হওয়া বিভিন্ন প্রবন্ধের অংশ এবং, বিশেষ করে, ২০০৮ সালে ‘এডিসিওনেস বাস্তা!’ প্রকাশিত The Oaxaca Commune and Mexico’s Autonomous Movements নামের বইটি।

                                      

২০০৬ সালের জুন থেকে অক্টোবর মাস অবধি ছয় লাখ জনসংখ্যার শহর ওয়াহাকায় কোনো পুলিশ ছিল না, এমনকি যান নিয়ন্ত্রণের জন্যও নয়। গভর্নর ও তাঁর কর্মকর্তারা গোপনে কোনো হোটেলে বা ব্যক্তিবিশেষের বাসগৃহে মিলিত হতেন, নিজেদের দপ্তরে মুখ দেখানোর সাহস তাঁদের কারো ছিল না। সমস্ত প্রশাসনিক ভবন, বেতার ও দূরদর্শন দপ্তর নিজেদের নিয়ন্ত্রণে এনে ‘ওয়াহাকার জনগণের গণসভা’ (Popular Assembly of the Peoples of Oaxaca, সংক্ষেপে APPO) প্রতিটি জায়গায় চব্বিশ ঘন্টা প্রহরী মোতায়েন করেছিল। গভর্নর যখন ভাড়া-করা গুণ্ডাবাহিনী পাঠিয়ে এই প্রহরীদের উপর রাতের অন্ধকারে ঝটিকা-আক্রমণ চালানোর কৌশল নিলেন, জনগণ প্রত্যুত্তরে ব্যারিকেড গড়ে তুলেছিল। প্রতিদিন রাত এগারোটার সময় গুরুত্বপূর্ণ মোড়গুলোয় ও বিভিন্ন শিবির ঘিরে হাজারেরও বেশি ব্যারিকেড গড়ে উঠত । আবার প্রতিদিন ভোর ছটায় স্বাভাবিক যানচলাচল পুনর্বহাল করতে সেই ব্যারিকেডগুলো সরিয়ে ফেলা হতো। রাজ্যপালের গুণ্ডাবাহিনীর এহেন আক্রমণ সত্ত্বেও, এই মাসগুলোয় গত দশ বছরের একই সময়পর্যায়ের তুলনায় অনেক কম হিংসা (অনেক কম হামলাবাজি, আহত ও নিহত হওয়ার ঘটনা, এমনকি পথ-দুর্ঘটনাও) ঘটেছিল। গণসভা APPO-র অন্তর্গত সংগঠিত শ্রমিকরাই শহরের জঞ্জাল পরিষ্কারের মতো মৌলিক পরিষেবাগুলো নির্বাহিত করত।

কোনো কোনো পর্যবেক্ষক ১৮৭১-এর পারি কম্যুনের সঙ্গে তুলনা টেনে ওয়াহাকা কম্যুন নিয়ে কথা বলতে শুরু করেছিল। প্রত্যুত্তরে ওয়াহাকীরা হেসে বলত: ‘তা বেশ, কিন্তু পারি কম্যুন তো মোটে পঞ্চাশ দিন স্থায়ী হয়েছিল, আর আমরা তো এখনই একশ দিনেরও বেশি পার করে দিয়েছি।’ এই দুটি গণ-অভ্যুত্থান ক্ষমতার কেন্দ্রীয় দপ্তরে যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল তার বিচারে তুলনা চলে এলেও বাকি ক্ষেত্রে এই দুইয়ের মধ্যে তুলনা অসঙ্গত না হলেও অতিরঞ্জিত হতে বাধ্য। সরকার-প্রশাসনের সমস্ত কাজ নিজেদের হাতে তুলে নেওয়া পারি-কম্যুনার্ডদের যেমন ইউরোপের রাষ্ট্রীয় সেনারা নির্মমভাবে দমন করেছিল, মেহিকোর রাষ্ট্রীয় সেনাদেরও (মেহিকোর ফেডেরাল প্রিভেনটিভ পুলিশ বাহিনী, সঙ্গে মদতকারী হিসেবে সামরিক নৌবাহিনী ও স্থলবাহিনী) তেমনই ২০০৬ সালের ২৮শে অক্টোবর ওয়াহাকায় পাঠানো হয়েছিল ওয়াহাকীদের দমন করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য। ২৫শে নভেম্বর রাষ্ট্র-প্রেরিত এই বাহিনী ভয়ঙ্কর দমনপীড়ন চালায়, বহু বছরের নজিরে যা নির্মমতম, মানবাধিকারকে যথেচ্ছ লঙ্ঘন করে যা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদের পরাকাষ্ঠা ছুঁয়েছিল। তথাকথিত ‘আন্দোলনের মাথা’-দের সহ শয়ে শয়ে মানুষকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। মানবাধিকার রক্ষার আন্তর্জাতিক আয়োগ (International Commission for the Observation of Human Rights, যার প্রতিনিধি-দল ২০০৭ সালের জানুয়ারি ওয়াহাকা পরিদর্শনে এসেছিল) এই দমনপীড়নকে ‘নাগরিক জনতাকে ভয় দেখিয়ে নিয়ন্ত্রণে আনার বিচারবিভাগীয় ও সামরিক কৌশল’ বলে আখ্যায়িত করেছিল।মেহিকোর শাসকরা মনে করেছিল যে এই কৌশল গণসভা APPO-র ধ্বংসসাধন করে গোটা দেশের সামাজিক আন্দোলনগুলোর কাছে সতর্কীকরণ বার্তা পৌঁছে দেবে।

সেই সময়ের পর থেকে এই কৌশল জারি থেকেছে এবং ওয়াহাকার উপর তার গভীর ছাপ পড়েছে। তা মেরুকরণ বাড়িয়ে আরো তিক্ত করেছে। সামাজিক আন্দোলনের বহু কর্মীই এখনও কারারুদ্ধ আর আরো অনেকে ওয়াহাকার বাইরে (কেউ কেউ মেহিকোরও বাইরে) নির্বাসনে দিন গুজরান করতে বাধ্য হচ্ছে। সকল নিখোঁজদের চিহ্নিত করাও সম্ভব হয়ে উঠছে না যেহেতু তাদের পরিবারগুলো সন্ত্রস্ত হয়ে তাদের নাম প্রকাশ করতে চাইছে না। বহু পেশাবিদও সন্ত্রাসের প্রকোপে অথবা অর্থনৈতিক সুযোগের অভাবে পরিযায়ী হয়েছে। কিছু কিছু মানুষ গণসভা APPO-র প্রতি তাঁদের সমর্থন বা স্বশাসনের উদ্যোগে তাঁদের অংশগ্রহণের কথা স্বীকার করতে এখন ভয় পান। সমাজের বিভিন্ন শাখার কিছু মানুষ যে অর্থনৈতিক সমস্যার মুখেই পড়ুন না কেন, তার দায় গণসভা APPO-র উপর চাপাতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন। আবার কেউ কেউ ধরে নিয়েছেন যে গণসভা APPO-র আন্দোলন এখন অতীত এবং স্বৈরতান্ত্রিক গভর্নর নির্বিঘ্নেই তাঁর বাকি শাসনকাল নির্বাহ করবেন, ফলে এই ধূসর ভবিষ্যতের সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টাতেই তাঁরা রত হয়েছেন। এই সব কিছুই সত্য--- সন্ত্রাসের সামনে ন্যুব্জ হওয়ার নানা চিহ্নই ফুটে উঠছে। আবার এর বিপরীতটাও সত্য, এর বিপরীতটাও সবকিছু ছাপিয়ে ফুটে উঠছে। মিছিলের সংখ্যা বাড়ছে, বাড়ছে বিক্ষোভ-অবস্থানের সংখ্যাও। সর্বত্রই চাপা উত্তেজনা প্রবলভাবে অনুভূত হচ্ছে। ওয়াহাকা এখন ফুটছে। প্রবল মেরুকরণ হয়ে যাওয়া সমাজে হিংসাত্মক সংঘাত লেগে যাওয়ার ঝুঁকি ক্রমশ বাড়ছে, আর এই ঝুঁকিকে অজুহাত করেই স্বৈরতান্ত্রিকতা আরো নখর হয়ে উঠতে পারে। আবার অন্যদিকে, এমনও বেশ কিছু বিষয় আছে যা সেই ঝুঁকি কাটিয়ে সামাজিক আন্দোলনের শান্তিপূর্ণ বিকাশ ও সংহতির আশা পুষ্ট করতে পারে। গভীর থেকে রূপান্তরিত হওয়ার একটি বেগ সমাজদেহে অতি শক্তিশালী, হয়ত বা অপ্রতিরোধ্য, হয়ে উঠেছে।

২০০৬ সালের ২৩শে নভেম্বর তারিখে, নয়া ডানপন্থী বিতর্কিত রাষ্ট্রপতি হিসেবে ফেলিপে ক্যালডেরন পদে বসার ঠিক এক সপ্তাহ আগে, জাপাতিস্তাদের মুখপাত্র সাবকমান্ডান্ট মার্কোস ঘোষণা করেছিলেন যে নয়া রাষ্ট্রপতির পতন তাঁর পদে আরোহণের প্রথম দিন থেকেই শুরু হবে এবং আমরা একটি বড় অভ্যুত্থান অথবা গৃহযুদ্ধের পূর্ব মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছি। মার্কোসকে যখন প্রশ্ন করা হয়েছিল যে এই অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেবে কারা, তিনি উত্তর দিয়েছিলেন: ‘জনগণই নেতৃত্ব দেবে, প্রত্যেকে তার নিজের অবস্থানে থেকে, পারস্পরিক সহযোগিতা-সমর্থনের যোগসূত্রে বেঁধে থেকে নেতৃত্ব হাতে তুলে নেবে। এইভাবে আমরা যদি তা সম্পাদন না করতে পারি, তাহলে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই সর্বত্র ফেটে পড়বে নানা অভ্যুত্থান, নানা বিস্ফোরণ, গৃহযুদ্ধ…’। (https://enlacezapatista.ezln.org.mx/)

মার্কোস উদাহরণস্বরূপ ওয়াহাকার কথা তুলেছিলেন, যেখানে ‘না আছে কোনো নেতা, না আছে কোনো বস: জনগণ আপনা থেকেই সেখানে সংগঠিত। গোটা দেশে এমনটাই হতে চলেছে; সর্বত্র যা ঘটতে চলেছে তার পূর্বাভাস দিচ্ছে ওয়াহাকা।’ মার্কোস সতর্ক করেছিলেন: ‘অন্য অভিযান (Other Campaign)-এর মধ্য দিয়ে আমরা এই পরিস্থিতির মধ্য থেকে বেরিয়ে আসার একটি সুশীল (civil) শান্তিপূর্ণ পথ প্রস্তাব করেছি। তা যদি না হয় তাহলে প্রতিটি মানুষই একলষেঁড়ে ভাবে সংঘাতে জড়িয়ে পড়বে।… উপরতলায় কী আছে তা নিয়ে আমরা মাথা ঘামাই না। আমরা মাথা ঘামাই নীচ থেকে কী উঠে আসতে চাইছে তা নিয়ে। আমরা, তলাকার মানুষরা, যখন উঠে আসব, গোটা রাজনৈতিক শ্রেণিটাকেই ওইসব স্বঘোষিত সংসদীয় বামেদের সমেত ঝেঁটিয়ে বিদায় করব।’ (La Jornada, ২৪.১১.০৬) সামনের পথে যে সমস্যা ও সম্ভাবনাগুলো অপেক্ষা করছে, তার স্পষ্ট বর্ণনা এখানে আছে।

গণসভা APPO কী নয় 

গণসভা APPO এখনও একটা রহস্য হয়েই রয়েছে, এমনকি তার অংশ যারা তাদের কাছেও। কিছু অংশগ্রহণকারী, যারা APPO-কে নিজেদের রাজনৈতিক ও মতবাদিক উদ্দেশ্য পূরণের জন্য কাজে লাগাতে চেয়েছিল, তাদের ও নানা প্রচারমাধ্যমের দ্বারা ছড়ানো বিকৃতিগুলো ব্যাপক ধোঁয়াশা ও ভুলবোঝাবুঝি তৈরি করেছে। তাছাড়াও, তার উদ্ভাবনী চরিত্রের কারণেই এই বিচিত্র রাজনৈতিক জীবটির চরিত্র, অর্থ ও তাৎপর্য অনুধাবন করা বেশ কঠিন বিষয়ও বটে।

গণসভা APPO-র ভিতরের লোক ও বাইরের লোক উভয়পক্ষই এখনও তাকে একটা রাজনৈতিক সংগঠন বলেই গণ্য করে। তারা ধরে নেয় যে প্রায় যে কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের মতো এইটিও রাষ্ট্রকেই তার অভিনিবেশের কেন্দ্রে রেখে, রাষ্ট্রের কাজ চালনা করার অভিপ্রায় নিয়ে কাঠামোগতভাবে রাষ্ট্রীয় কলকব্জাগুলোরই পুনর্সংস্থান করে চলেছে। যেনবা তা রাষ্ট্রেরই মতো উপর-নীচ ধাপকাটা সিঁড়িতে বিন্যস্ত হবে। যেনবা রাষ্ট্রীয় আধিকারিকদের মতো তার নেতারাও নিয়ম করে স্বজনপোষণ ও দুর্নীতির পাঁকে পা ডোবাবে। যেহেতু তারা মনে করে যে জনগণ নিজে নিজে কিছু করতে পারে না, তাই তারা নিশ্চিত যে গণসভা APPO-র পিছনে লুকিয়ে থাকা কেউ সুতোর টানে সবাইকে নাচাচ্ছে, তারা নিঃসন্দেহ যে কোনো একটা গোষ্ঠী-সংগঠন বা নেতাই আড়াল থেকে দড়িতে বেঁধে জনগণকে খেলাচ্ছে।

যত রাষ্ট্রীয় আধিকারিক, যতসব রাজনৈতিক পার্টি ও ব্যাখ্যাকারের দল এই অভ্যুত্থানটিকে, বিশেষ করে তার সূচনালগ্নে, নেহাতই একটি বিদ্রোহ রূপে দেখেছিল। তারা পুরোপুরি ভুল ছিল না; অসহনীয় উৎপীড়নের চাপে শেষাবধি সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাওয়ায় গণবিক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটার দীর্ঘ পরম্পরায় এই ঘটনা বেশ খাপ খেয়ে যায়। একে দেখা হয়েছিল রাজদ্রোহ রূপেও, যেহেতু এই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে অদম্য জনগণ মাথা তুলে নিজ মান জাহির করে উঠে দাঁড়িয়েছিল। প্রতিটি ঘুপচি থেকে কোণঠাসা জনেরা হঠাৎ বেরিয়ে এসে ‘যথেষ্ট হয়েছে’ বলে হেঁকে উঠেছিল।

কিন্তু এই অভ্যুত্থান কেবলমাত্র বিদ্রোহ বা কেবলমাত্র রাজদ্রোহ ছিল না। বিদ্রোহ অগ্নু্ৎপাতের মতো অদম্য হতে পারে, কিন্তু একই সঙ্গে তা ক্ষণস্থায়ী হয়। যত দ্রুত তা ঘনিয়ে ওঠে, তত দ্রুতই তা থিতিয়ে যায়। আগ্নেয় পাথরের মতো স্থায়ী ছাপ রেখে গেলেও তা খণ্ড খণ্ড হয়ে ভেঙেও পড়ে। এই ক্ষেত্রে কিন্তু তা ঘটেনি। এই অভ্যুত্থান থিতিয়ে যায়নি, যতক্ষণ না বিপুল রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস দিয়ে তাকে দমন করা হয়েছে। সমস্ত ক্ষোভের উৎস মূর্ত রূপ ধারণ করেছিল গভর্নর উলিসেস রুইজ-এর মধ্য দিয়ে এবং উৎপীড়ক রাষ্ট্রব্যবস্থার সবচেয়ে খারাপ দিকগুলোও এই গভর্নরের মধ্য দিয়েই ফুটে উঠেছিল, কিন্তু তা সত্ত্বেও জমে থাকা বিস্তৃত বিক্ষোভে নেহাতই বিস্ফোরণের সলতেয় আগুন ঠেকানো ছাড়া আর কোনো ভূমিকা তিনি পালন করেননি।

আবার, প্রথাগত বামপন্থীরা বা এমনকি APPO-র মধ্যে অংশগ্রহণকারী কোনো কোনো গোষ্ঠী যতই দাবি করুক না কেন, গণসভা APPO কোনো ‘গণ-আন্দোলন’ও নয়। ‘গণ’ বলে আখ্যায়িত পিণ্ডগুলো এমনই পরমাণু-কৃত ব্যক্তি-এককদের নিয়ে গঠিত হয় যারা অপর কারো দ্বারা সংজ্ঞাত ও নিয়ন্ত্রিত কোনো বিমূর্ত শ্রেণিতে মণ্ডলীকৃত হয়ে থাকে; যেমন, উড়োজাহাজের যাত্রীবৃন্দ, পেনশনভোগী, কোনো কারখানার শ্রমিক, ভোটদাতাগণ, পার্টি-সদস্য, প্রদর্শনকারী, ইত্যাদি। গণপিণ্ডভুক্ত হয়ে মানুষ স্বাধীনভাবে চলার সক্ষমতার উপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। উপর থেকে সংগঠিত করা ও নিয়ন্ত্রণে বেঁধে রাখা কোনো ট্রেড ইউনিয়ন, পার্টি বা নেতার অধীনে ‘সংহত’ হওয়া প্রকৃতপক্ষে মানুষকে অসংহত করে তোলে। ‘গণ’ শব্দটিতে যতই বিপ্লবাত্মক ভাব আরোপ করা হোক না কেন, শব্দটি যাজকীয় ও বুর্জোয়া উৎস থেকে আহৃত। তা মানুষকে সংখ্যা দ্বারা পরিগণিত হওয়ার অপ্রাণ-বস্তু-সম পর্যায়ে নামিয়ে আনে। উপভোক্তাদের গণপিণ্ড বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করে, বা, ভোটারদের গণপিণ্ড রাজনৈতিক ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করে--- এহেন বিভ্রম আসলে সেই প্রকৃত পরিস্থিতিকেই আড়াল করে রাখে যেখানে প্রতিনিয়ত মানুষের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা হরণ করে নেওয়ার প্রক্রিয়া চলে।

গণসভা APPO-র বিরাট মিছিলগুলো দেখলে মনে হবে যেন গণপিণ্ডভুক্ত মানুষ দিয়ে তা তৈরি। কোনো কোনো গোষ্ঠী ভেবেও ছিল যে তারা ‘গণ-আন্দোলন’ সৃষ্টি করতে সফল হয়েছে। সন্দেহ নেই যে কোনো না কোনো বর্গের সঙ্গে সনাক্তকরণযোগ্য কিছু বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিবিশেষ আন্দোলনের প্রতি তাদের সমর্থন প্রকাশ করতে নিজেদের উদ্যোগেই অংশগ্রহণ করেছিল। কিন্তু গণসভা APPO-তে অংশগ্রহণ করা বেশিরভাগ মানুষ ব্যক্তি হিসেবে অংশগ্রহণ করেনি, বরং একটা জনসমাজের মধ্যে গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী একটা গোষ্ঠীর সদস্য হিসেবে অংশ নিয়েছে। সুতরাং প্রথাগত অর্থে তা কোনো ‘গণ’ গঠন করছে না।

আন্দোলনগুলোর আন্দোলন সংগঠিত করা

ক্রমাগত এই মত গড়ে উঠছে যে গণসভা APPO একটি আন্দোলন, তা কোনো সংগঠন নয়। যে কোনো আন্দোলনের মতোই তার মধ্যে নিজ নিজ নেতৃত্ব, লক্ষ্য, কাঠামো, ইত্যাদি নিয়ে নানা সংগঠন থাকতে পারে। ‘Fuera Ulises’ (‘গভর্নর উলিসেস-কে হঠাও’) বিপুল জনবিক্ষোভের সূচিমুখ অভিব্যক্তি হিসেবে উঠে এসেছিল ঠিকই, কিন্তু তাকে কোনো লক্ষ্য হিসেবে দেখা ঠিক হবে না। গণসভা APPO আসলে কোনো লক্ষ্য বা নির্দিষ্ট প্রস্তাবের উপর দাঁড়িয়ে নেই, তা বিবিধ অভিপ্রায় ও গতি-প্রবণতাকে নিজ মধ্যে ধারণ করে আছে। নতুন একটি সংবিধান রচনা করা বা পুঁজিবাদকে প্রতিহত করার মতো কিছু কিছু বিষয়মুখ ঘিরে ক্রমবর্ধমান ঐক্যমত তৈরি হচ্ছে বটে, কিন্তু এমনকি এই বিষয়গুলো নিয়েও বিবিধ ব্যাখ্যা ও দৃষ্টিকোণ রয়েছে।

২০০৬ সালের ২০ জুন থেকে ১২ নভেম্বর অবধি সক্রিয় থাকা ৩০ জন সদস্যের Coordinadora Provisional (অস্থায়ী সমন্বয়কারী সমিতি), বা ওই ১২ নভেম্বর গঠিত হওয়া ২৬০ জন সদস্যের রাজ্য কাউন্সিল--- এগুলোর কোনোটাকেই গোটা APPO বা এমনকি APPO-র প্রতিনিধি-স্থানীয় বলে ধরে নেওয়া ঠিক হবে না, এই সমিতিগুলোর কোনো শাসন বা পরিচালনা করার অধিকার ছিল না। এই সমিতিগুলো তথ্য ও নির্দেশিকা সঞ্চালনা করা এবং মিছিল-জমায়েতের মতো নির্দিষ্ট কর্মকাণ্ড সমন্বয় করার মতো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত, বিশেষ করে সংকটের মুহূর্তগুলোয় যা জরুরী হয়ে উঠত। কিন্তু অংশগ্রহণকারীদের স্বাধীন স্বতঃপ্রবৃত্ত ক্রিয়া বা উদ্যোগকে নিয়ন্ত্রণের বেড়িতে তা কখনোই বাঁধতে পারেনি। রাজ্য কাউন্সিল তো কোনোদিনই তার সমস্ত সদস্যদের জড়ো করতে পারেনি, এমনকি তার প্রথম গঠনের দিনেও নয়। এসবই কিন্তু আন্দোলনের দুর্বলতা হয়ে ওঠার বদলে আন্দোলনকে আরো বলশালী করে তুলেছে।

নিবিড়ভাবে দেখলে স্পষ্ট হয়ে উঠবে যে গণসভা APPO আসলে অত্যন্ত পৃথক ধরনের বিবিধ আন্দোলন ও সংগঠনের অভিসারী রূপ। এর মধ্যে কিছু কিছু আন্দোলন দীর্ঘকালের, যেমন: আদিবাসীদের আন্দোলন, কৃষকদের আন্দোলন, নারীবাদীদের আন্দোলন, পরিবেশবাদীদের আন্দোলন, মানবাধিকার-রক্ষীদের আন্দোলন, সাংস্কৃতিক-পরম্পরা-রক্ষীদের আন্দোলন, ইত্যাদি। আবার অন্য বেশ কিছু আন্দোলন বিশেষ করে ওয়াহাকা শহরে ও অন্য কিছু অঞ্চলে গণসভা APPO-র উদ্ভবের সঙ্গে সঙ্গে প্রস্ফুটিত হয়েছিল বা স্পষ্টতর চেহারা পেয়েছিল। এছাড়া, গণসভা APPO বিবিধ ধরনের সংগঠনকে নিয়ে চলছে। যাকে গণসভা APPO-র ‘পৌর পরিসর’ বলা হয়েছে তা এমন অনেক পৌর সংগঠন ও অ-মুনাফাদায়ী সংগঠন নিয়ে গঠিত যারা বিভিন্ন গোষ্ঠী ও জনসমাজের সঙ্গে যুক্ত থেকে নানা ধরনের কাজ করে চলেছে। রাজনৈতিক সংঘ ও সংগঠনও আছে, যাদের মধ্যে কেউ কেউ একেবারেই আঞ্চলিক চরিত্রের, আবার কেউ কেউ জাতীয় স্তরের সংগঠন ও পার্টিগুলোর সঙ্গে যুক্ত।

এই বিপুল বৈচিত্র্যের কারণে মতের অমিল ও দ্বন্দ্ব অবশ্যম্ভাবী। সমন্বয়কারী সমিতির যে কোনো সিদ্ধান্ত সকলের মতের ঐক্যের উপর নেওয়াই নীতি, ফলে সিদ্ধান্তগ্রহণপ্রক্রিয়া ধীর ও কঠিন হয়ে ওঠে, প্রায়শই লঘিষ্ঠতম সাধারণ মতের স্তরে সীমাবদ্ধ থেকে যায়, যা দ্রুত পরিবর্তনশীল ঘটনাবলীর সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর ক্ষেত্রে সবসময় উপযোগী হয় না। কিন্তু একইসঙ্গে, এই অন্তর্নিহিত বৈচিত্র্য বিপুল শক্তির উৎস হিসেবে কাজ করে। গণসভা APPO কোনো নেতা বিশেষের উপর নির্ভরশীল নয়। কোনও ক্ষণিক ঘটনা APPO-র শক্তির উৎস নয়, বরং তার শক্তির উৎস হল সেইসব ক্ষমতাশালী ঐতিহাসিক বল যা মানুষকে পরিবর্তনে প্রয়াসী হতে বাধ্য করছে।

গণসভা APPO শিক্ষকদের ইউনিয়নের লোকাল ২২-এর সমর্থনে ডাকা সমাবেশ (এই শিক্ষকদের ধর্মঘটের উপর নেমে আসা দমনপীড়নের পর) থেকে সেই সভায় আসা প্রায় ৩০০ সংগঠনের নেতাদের জোটে মসৃণভাবে রূপান্তরিত হয়েছিল। খুব তাড়াতাড়িই তা আবারও মসৃণ রূপান্তরসাধনের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনগুলোর স্পষ্টবাক অভিমুখীনতায় পরিণত হয়েছিল। অবশ্য, যখন দ্রোহ/বিদ্রোহ-সূচক সংগঠনের রূপ থেকে আন্দোলনগুলোর আন্দোলনের কাঠামোকৃত সুসম্বদ্ধতায় উত্তীর্ণ হওয়ার সময় এসেছিল, তখন নানা অপসারী প্রবণতা ফুটে উঠেছিল। রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর জোট তাদের নিজেদের উঁচু-নীচু সিঁড়িভাঙা কাঠামোকে এর মধ্যে চালান করার জন্য সক্রিয়ভাবে চেষ্টা করেছিল। তাদের সেই চেষ্টা প্রতিনিয়ত প্রতিরোধের মুখে পড়েছে। কিন্তু গণসভা APPO চরিত্রবৈশিষ্ট্যগতভাবে যা: সামাজিক আন্দোলন, রাজনৈতিক আন্দোলন এবং স্বাধীন সংগঠন, যৌথ সমবায় ও জনগোষ্ঠীর টানাপোড়েনে বোনা জাল; বা APPO-র মৌলিক কাঠামোগত বৈশিষ্ট্য যা: অনেকগুলো সভার সভা, তৃণমূল স্তর থেকে উঠে আসা রাজনৈতিক প্রকল্প যা কোনো নেতা বা সংগঠনের মস্তিষ্কপ্রসূত নয়, সামাজিক ব্যবস্থাপনার কোনো ছক নয়--- তার সঙ্গে মানানসই সাংগঠনিক রূপ APPO এখনও অবধি আবিষ্কার করে উঠতে পারেনি।

আদিবাসী মানুষদের অংশগ্রহণ

মেহিকোর সমস্ত রাজ্যের মধ্যে একমাত্র ওয়াহাকাতেই আদিবাসী জনজাতিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং অন্য যে কোনো রাজ্যের তুলনায় প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য এখানেই সবচেয়ে বেশি। এখানকার জনসংখ্যা মেহিকোর মোট জনসংখ্যার পাঁচ শতাংশ, কিন্তু গোটা মেহিকোর পৌর এলাকাগুলোর (municipos) পাঁচ ভাগের এক ভাগই এখানে। এই পৌর এলাকায় অতিবিভক্তিকরণ দুই দিক থেকে বজায় থেকেছে। একদিক থেকে শাসন-কর্তৃপক্ষ এই বিভক্তিকরণ চাপিয়ে দিয়েছে আদিবাসী জনজাতিদের প্রতিরোধ অতিক্রম করার কৌশল হিসেবে, অন্যদিক থেকে আবার আদিবাসীরা তাদের স্বশাসনের রাজনৈতিক অভিব্যক্তি হিসেবে তাকে রূপান্তরিত করে নিয়েছে। পাঁচটি পৌর এলাকার মধ্যে চারটিতেই পৌর প্রশাসন চলে ‘usos y costumbres’ (‘রীতিনীতি ও অভ্যাস’) নীতির উপর ভর করে, যার মধ্য দিয়ে জোর দেওয়া হয় যাতে কোনো নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মধ্যে না গিয়ে সর্বজনের সভাতেই সব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার মাধ্যমে সমগ্র হিসেবে সব মানুষ প্রাধিকার চর্চা করতে পারে। এখানকার আদিবাসী জনজাতিদের সংগ্রামের ফল হিসেবেই সব রাজ্যের মধ্যে ওয়াহাকাতে সর্বসাধারণের মালিকানাধীন জমির (common land) অনুপাত সবচেয়ে বেশি, মোট জমির আশি শতাংশেরও বেশি এখানে সর্বসাধারণের মালিকানাভুক্ত। জমির উপর নিজেদের অধিকার ফিরিয়ে আনার পর জনজাতিরা তার মধ্য দিয়ে মানুষদের পরস্পরের মধ্যে সম্পর্ক ও প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রেও নিজেদের আপন মনোভাবগুলো প্রকাশ করতে পেরেছে।

বহু বছর ধরে মেহিকোর কেন্দ্রের ও রাজ্যের সরকারি কর্তৃপক্ষসমূহ ওয়াহাকার আদিবাসী জনজাতিদের সেই রাজ্যের বেশির ভাগ পৌর এলাকায় দেশের সংবিধান, আইনকানুন ও দলতান্ত্রিক রাজনীতির বাইরে গিয়ে নিজেদের স্বকীয় প্রশাসনিক পদ্ধতি চর্চা করার ছাড় দিয়েছে, কিন্তু তা দিয়েছে এইসব পদ্ধতিরূপগুলোর উপর পুঙ্খানুপুঙ্খ ছলের আবরণ বিছানোর পর।

১৯৯২ সালে ইউরোপিয় হানাদারির পাঁচশো বছর পূর্তি স্মরণের আয়োজন গোটা আমেরিকা জুড়েই আদিবাসী জনজাতিদের কাছে তাদের নিজস্ব উদ্যোগগুলোর প্রাণশক্তি ও সতেজতা প্রদর্শন করার সুযোগ করে দিয়েছিল। সেই বছরের শেষে ওয়াহাকার গভর্নর পদে নিযুক্ত প্রশাসক-প্রবর আদিবাসী জনজাতিদের পূর্ণ স্বতঃস্ফূর্তির ফুটন্ত অবস্থার স্বাদ পেলেন। পার্শ্ববর্তী রাজ্য চিয়াপাসের ১ জানুয়ারি ১৯৯৪-এর জাপাতিস্তা অভ্যুত্থান ওয়াহাকাতেও ছড়িয়ে পড়তে পারে এই আশঙ্কায় তিনি আদিবাসী জনজাতিদের উদ্দেশ্যে এক ‘New Accord’ (‘নয়া বোঝাপড়া’) প্রস্তাব করলেন যা রাজ্যস্তরের প্রশাসনিক ক্ষেত্রে তাদের সঙ্গে কিছু প্রাধিকারগত ভাগবাটোয়ারা করে নেবে। এই ‘Accord’ প্রথম থেকেই আমলাতন্ত্র ও আঞ্চলিক ক্ষমতাবাজদের বাধার মুখে পড়ে কথার কথা হিসেবেই থেকে গেলেও আইন-প্রণয়নের ক্ষেত্রে তার কিছু গুরুত্বপূর্ণ ফলশ্রুতি রয়ে গিয়েছিল। ১৯৯৫ সালের ৩০ আগস্টে আনা ওয়াহাকার নির্বাচনী বিধি সংস্কারে আদিবাসী জনজাতিদের এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছিল যে প্রশাসনিক আধিকারিকদের তারা কীভাবে বেছে নেবে--- পার্টি-প্রতিনিধিদের মধ্যে প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে, নাকি ‘usos y costumbres’ (‘রীতিনীতি ও অভ্যাস’) –এর পরম্পরাগত পদ্ধতির মধ্য দিয়ে। সেই বছরের ১২ নভেম্বর যখন এই সংস্কার প্রথমবারের জন্য লাগু করা হল, ওয়াহাকার ৫৭০টি পৌর এলাকার মধ্যে ৪১২টি পরম্পরাগত পদ্ধতিটিকেই বেছে নিল। পার্টি-প্রতিনিধিত্ব বেছে নেওয়া এলাকাগুলোতে সাধারণভাবে যে নির্বাচন-পরবর্তী হিংসা ও সংঘাত দেখা গিয়েছিল, পরম্পরাগত পদ্ধতি বেছে নেওয়া একটি এলাকাতেও তা দেখা যায়নি।

এই পরিবর্তনের তাৎপর্য কেবল নির্বাচনী পরিস্থিতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না; স্বশাসনের জোরালো অভিব্যক্তি হিসেবে তা আদিবাসী জনজাতি ও রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্কের বহু অন্য দিকও সামনে তুলে এনেছিল। কিছু কিছু গ্রামে এইরকম দেওয়াল-লেখা শুরু হয়েছিল: ‘এখানে কোনো রাজনৈতিক দলকে আমরা ঢুকতে দিই না, পি. আর. আই.-কে তো নয়ই।’ (পি. আর. আই. পার্টি সত্তর বছর ধরে ওয়াহাকায় আধিপত্য করেছে, তাকে প্রতিরোধ করার এক নতুন পন্থা এর মধ্য দিয়ে জনজাতিরা আবিষ্কার করেছে।) সবকিছুতে রাষ্ট্রের নাক গলানো বাড়তে থাকার প্রবণতাকে ঠেকানোর উপায়ও তা করেছিল। প্রশাসনের আধিকারিকদের জন্য জনজাতিদের অভিপ্রায়কে মান্যতা দেওয়া বাধ্যতামূলক করার মধ্য দিয়ে সেই নাক গলানোকে তা অনেক সংযত করতে পেরেছিল।

১৯৯৮ সালের ৬ জুন ওয়াহাকার সংবিধানের পরিবর্তনগুলো ঘোষণা হয়েছিল আর ১৭ জুন ওয়াহাকার আদিবাসী জনজাতি ও অধিবাসীদের অধিকার বিষয়ক নতুন আইন পাশ হয়েছিল। এই সংস্কারগুলোর মধ্য দিয়ে আদিবাসী জনজাতিদের স্বশাসন রূপে আত্মনিয়ন্ত্রণকে মঞ্জুর করা হয়েছিল। সরকারি আইনের অধীন বিচারবিভাগীয় বিধি হিসেবে তা গৃহীত হয়েছিল। এই শাসন-প্রণালীকে অনেক বিশ্লেষকই আদিবাসী জনজাতির মানুষদের স্বার্থের বিচারে আমেরিকার সবচেয়ে আগুয়ান ব্যবস্থা বলে গণ্য করেছিলেন। কিন্তু কার্যকরী হওয়ার দিক থেকে তা ছিল একেবারেই অকেজো: সরকারের তিনটি শাখা হয় সম্পূর্ণভাবে তা অগ্রাহ্য করে গেছে, নয়তো খোলাখুলিভাবেই তা লঙ্ঘন করেছে।          

‘New Accord’ (‘নয়া বোঝাপড়া’)-এর মধ্য দিয়ে ঘটা এই পলকা সূচনাটুকুও ধুয়েমুছে সাফ করে দেওয়া হয়েছিল গভর্নর হোসে মুরাত-এর স্বৈরতন্ত্রী ও দুর্নীতিবাজ প্রশাসনের শাসনকালে (১৯৯৮—২০০৪)। সেই শাসনের বিরুদ্ধে পুঞ্জীভূত হয়ে ওঠা অসন্তোষ রাজ্যের সমস্ত বিরোধী শক্তিগুলোকে বাধ্য করেছিল প্রথমবার ২০০৪ সালে পি. আর. আই.-য়ের বিরুদ্ধে জোট বাঁধার জন্য। তার আগে অবধি পি. আর. আই. ব্যালট বাক্সের উপর কার্যকরী নিয়ন্ত্রণ কায়েম রাখতে পারত। কিন্তু সেবারই পি.আর.আই.-এর প্রার্থী উলিসেস রুইজ ভোটে হেরে গেল। অবশ্য ভোটে হেরে গেলেও খোলাখুলি জালিয়াতির মধ্য দিয়ে সে গভর্নরের পদ দখল করল। নির্বাচনী জালিয়াতিতে পি.আর.আই-এর সবচেয়ে বড় বিশেষজ্ঞ হিসেবে রুইজ কুখ্যাত। ওয়াহাকা-র সবকটা নির্বাচনী যন্ত্রকেই নিজ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসে সে তার নিজের জয় ঘোষণা করিয়ে নিল। বিরোধীরা যখন ফেডেরাল ট্রাইবুনালে এই নির্বাচনী ফলঘোষণাকে প্রশ্ন করে আপিল করল, ট্রাইবুনাল তখন জালিয়াতির কথা স্বীকার করে নিলেও আঞ্চলিকতার দোহাই তুলে জাল করা ফলকে নাকচ করতে অস্বীকার করল।

প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রে তাদের সব রকম অনাস্থা সত্ত্বেও যারা এই নির্বাচনে ভোট দেওয়ার ঝক্কি সামলেছিল, তাদের আর হতাশার শেষ রইল না। গভর্নর নির্বাচনের তিন মাস পরেই পৌরসভার নির্বাচন হাজির হল। পাঁচ ভাগের মধ্যে চার ভাগ পৌরসভাতেই সাধারণ মানুষ তাদের নিজেদের মতো করে নির্বাচন সংগঠিত করল। বাকি যে সমস্ত ক্ষেত্রে পার্টি-প্রতিনিধিদের মধ্যে নির্বাচনের আয়োজন হয়েছিল, সেই সব জায়গায় ভোটদানে বিরত থাকার হার ছিল মারাত্মক বেশি। যেমন, রাজ্যের রাজধানীতে, নথিভুক্ত ভোটারদের মাত্র এগার শতাংশের ভোট নিয়ে নয়া পৌর সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিল।

কোনোরকম বৈধতা না থাকা নয়া গভর্নর জনসাধারণের সমস্ত আন্দোলন, স্বশাসিত সংগঠন এবং নাগরিক উদ্যোগের উপর নিরন্তর আক্রমণ নামিয়ে এনে স্বেচ্ছাচারী শাসন কায়েম করল। আধুনিকীকরণের এক বিকৃত ধারণার বশবর্তী সরকারি ‘উন্নয়নকার্য’-এর ঢল গোটা রাজ্যের ও বিশেষ করে ওয়াহাকা শহরের প্রাকৃতিক ও ঐতিহাসিক উত্তরাধিকারগুলো নির্বিচারে ধ্বংস করতে লাগল এবং তা জনসাধারণের মধ্যে অসন্তোষের আগুনকে লেলিহান করে তুলল। সরকারি তহবিল উপুড় করে এই গভর্নর সমস্ত ধরনের উপযোগিতাহীন প্রকল্পের সূচনা করতে থাকল, যাদের লক্ষ্য মূলত দুটি: ভোট কেনার চেষ্টা এবং রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে পি.আর.আই.-এর নির্বাচনী অভিযানের তহবিল ভরানোর চেষ্টা। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের তারিখ যখন (২০০৬ সালের ২ জুলাই) কাছে চলে এল, সরকার ভোটারদের উপর চাপ আরো বাড়িয়ে দিল। সম্পূর্ণ খোলাখুলি ভয় দেখানো, হুমকি দেওয়া, প্রত্যক্ষ হিংসা, ভোট কেনাবেচা, সরকারি সম্পদের অবৈধ ব্যবহার, ইত্যাদি মাত্রাহীন হয়ে উঠল। এমনকি পি.আর.আই.-য়ের জালিয়াতি ও ফেরেববাজির দীর্ঘ ইতিহাসও এর আগে এমনটা দেখেনি! এইভাবে রুইজ সেই পরিবেশ গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিল যা আন্দোলনের সূতিকাগৃহ হিসেবে কাজ করেছিল।

আদিবাসী জনজাতিরা এই আন্দোলনে যোগ দিতে সময় নিয়েছিল। যদিও আদিবাসী জনজাতির বহুপরিচিত নেতারা প্রথম থেকেই এতে যুক্ত ছিলেন এবং প্রথমদিকের মিছিলগুলোতেও আদিবাসী জনজাতিদের দেখার মতো অংশগ্রহণ ছিল, আদিবাসী জনসমাজগুলোর মধ্যে এ নিয়ে আলাপ-আলোচনা মাসের পর মাস ধরে গড়িয়েছিল। বহুক্ষেত্রেই এই গড়িয়ে চলা বিতর্কে জনসমাজগুলোর সঙ্গে শিক্ষকদের দীর্ঘদিনের টানোপোড়েনের ছায়া পড়েছিল, যার ফলে এই আন্দোলনকে নেহাতই শিক্ষকদের পক্ষের একটি ট্রেড-ইউনিয়ন ধাঁচার সমাবেশ গণ্য করে জনসমাজগুলো এতে যোগ দিতে উৎসাহী হয়নি।

২০০৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসের শেষদিকে ও অক্টোবর মাসের গোড়ায় অবশ্য আদিবাসী জনজাতিদের মুখ্য নেতা, বুদ্ধিজীবী ও সংগঠনগুলো ‘শান্তি, গণতন্ত্র ও ন্যায়পরতার জন্য নাগরিকদের উদ্যোগ’-এর আহ্বানে যোগ দেয়, যা ১২ই অক্টোবর আত্মপ্রকাশ করে। সেই বছরেই আরো কিছুটা পরে ৫ নভেম্বরের বিশাল মিছিলে পৌরসভা ও জনসমাজের নেতাদের উপস্থিতি ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। গণসভা APPO-র উদ্বোধনী কংগ্রেসে স্পষ্ট হয়ে যায় যে রাজ্যের বহু অঞ্চলেই আদিবাসী জনজাতিদের অংশগ্রহণ সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে, কোথাও কোথাও তা গণসভা APPO-র আঞ্চলিক শাখার রূপ নিয়েছে। যেমন, আদিবাসী জনজাতিরা যেখানে বিপুলভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ, সেই সিয়েরা-ডি-য়ুয়ারেজ-য়ে জাপোতেকান, মিহে ও চিনানতেকান জনজাতিদের গণসভা তৈরি হয়েছিল এবং তারা তেইশ জন প্রতিনিধিকে রাজ্যস্তরের APPO-র সভায় পাঠিয়েছিল। ‘ওয়াহাকার আদিবাসী জনজাতীয় মানুষদের মঞ্চ’ অবশেষে যখন ২০০৬ সালের ২৮-২৯ নভেম্বর প্রথম মিলিত হল, তখন তাতে ১৪টি বিভিন্ন জনজাতি অংশ নিয়েছিল। এই মঞ্চ আদিবাসী জনজাতিদের মৌলিক বিচার্য বিষয়গুলো বিস্তারিতভাবে ও গণতান্ত্রিকভাবে বিচার করেছিল। বিচার করা বিষয়গুলোর মধ্যে ছিল: আত্মনিয়ন্ত্রণ ও স্বশাসন; জমি-জায়গা ও সম্পদ; জনজাতীয় আন্তর্সাংস্কৃতিক শিক্ষা ও জ্ঞাপন; এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন। এই মঞ্চ থেকে গভর্নর অপসারণের ডাক দেওয়া হয়, আইন-লঙ্ঘনের নিন্দা করা হয় এবং গণসভা APPO-র সংগঠন ও যৌথক্রিয়াকে শক্তিশালী করার আহ্বান করা হয়।

শহরে স্বশাসন

ওয়াহাকা শহরের বর্তমান জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি এমনসব জনবসতিতে বাস করে যেগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রে জবরদখল করা জমির উপর বেআইনীভাবে গড়ে উঠেছিল। নিজেদের অবস্থান আইনসিদ্ধ করা ও মৌলিক পরিষেবা আদায় করার জন্য তাদের সংগ্রাম সুবিদিত, কিন্তু শহরের সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে তাদের উপস্থিতি খুব চোখে পড়ে না, কেবলমাত্র শহরের সর্বত্র ছড়িয়ে থাকা দেওয়ালচিত্র ও দেওয়াল-লেখা (graffiti) ছাড়া।

আন্দোলনে যখন হঠাৎ করেই এই জনবসতিগুলো থেকে এবং কিছুটা মধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকেও অংশগ্রহণ ঘটল, তখন তা ছিল অপ্রত্যাশিত। এই জনবসতিগুলোয় জনসমাজ-সুলভ সম্পর্কের বুনন কতটা হাজির ছিল তা জানা ছিল না আগে থেকে। কিন্তু গণসভা APPO-র শিবিরগুলোর উপর রাজ্যপালের চালানো হামলার প্রতিক্রিয়ায় ব্যারিকেডগুলো গড়ে উঠল স্বতঃস্ফূর্তভাবে এবং অচিরেই তা এমনই নিজস্ব প্রাণশক্তি জাহির করল যে সেগুলোই সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠনের স্বাধীন নাভিকেন্দ্র হয়ে উঠল। দীর্ঘ বিনিদ্র রাত জেগে পাহারা দেওয়ার অবকাশে বিশদ রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনা জমে উঠল, যা বহু তরুণ-তরুণীদের মধ্যে এযাবৎ গরহাজির থাকা বা বিস্রস্ত থাকা সামাজিক সচেতনতাকে সংহত ও জাগ্রত করে তুলল।

মতবাদিক চিন্তা রূপে এবং জীবনশৈলীগত প্রয়োগ রূপে--- এই দুই রূপেই নৈরাষ্ট্রবাদ (anarchism)-য়ের নতুন নতুন রূপ এইসব ব্যারিকেডগুলোয় আবির্ভূত হতে লাগল। ব্যারিকেডে উপস্থিত জনসমাবেশ তাদের স্বশাসন-চর্চা রক্ষা করে চলত প্রখরভাবে, কখনও সেই প্রখরতা এমনই বিরুদ্ধতার চেহারা নিত যা সামলানো দুষ্কর। কিছু কিছু গোষ্ঠী পরিত্যক্ত সরকারি ভবনের দখল নিয়ে সেখানে যে কেবল থাকতে শুরু করেছিল তা নয়, সেগুলোকে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কার্যক্রমের কেন্দ্র করে তুলেছিল। এইসব গোষ্ঠীগুলোর শিশু ও যুবরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল, বিশেষ করে তাদের অনেকেরই অভ্যাসের মধ্যে থাকা পুলিশবাহিনীকে মোকাবিলার ক্ষেত্রে।

গণসভা APPO-র বিভিন্ন গতিপথ

সামাজিক সংগ্রামের দীর্ঘকালের নিখাদ ওয়াহাকীয় পরম্পরার মধ্যে গণসভা APPO-র শিকড় গাঁথা থাকলেও দৃষ্টিভঙ্গিতে ও বিশ্বজগতের প্রতি উন্মুক্ততায় তা কঠোরভাবে সমকালীন। ভূমিসংলগ্ন শিকড়সংলগ্ন তার প্রকৃতি, আর সেই প্রকৃতিই তার আমূল-পরিবর্তনাকাঙ্ক্ষার উৎস। তার দাবি নিয়ে এগোনোর আইনী ও প্রাতিষ্ঠানিক পথ সবগুলো ধরে চেষ্টা করে এবং সবগুলোকেই রুদ্ধ দেখে তার অভ্যুত্থানকামী স্বর গড়ে উঠেছে। কিন্তু তা যে কোনো সুরেই নেচে-গেয়ে ওঠে না, সে তার নিজের সুর নিজেই সৃষ্টি করে। কোনো দিকচিহ্নই যেখানে নেই, সেখানে সে নিজেই নিজের পথ তৈরি করে নেয়।

স্পষ্টতই গণসভা APPO হল উলিসেস রুইজ-য়ের শাসনের প্রতি সাধারণ অসন্তোষের একটি ফল। ওয়াহাকার কেন্দ্রীয় নগর-চত্বরে মার্কিনী ম্যাকডোনাল্ড কোম্পানীর বিপণি খোলার সফল বিরোধিতার মতো অতি মূর্ত সব অভিজ্ঞতা থেকে শুরু করে তা অতি দ্রুতই ‘একটাই না আর বহুবিবিধ হ্যাঁ’-র সেই রাজনীতি অবলম্বন করেছিল যা আজকের দিনের বহু সামাজিক আন্দোলনেরই চরিত্রবৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছে। এই প্রবণতা যেমন একটাই কর্তব্য, বাকি সব বর্জন, একটাই নীতি, একজনই আধিকারিক এবং একটাই শাসনপ্রণালী—এই সবকে প্রত্যাখ্যান করার মধ্য দিয়ে সাধারণ ঐক্য অর্জন করে, তেমনই একইসঙ্গে সদর্থকতা, প্রকল্প, আদর্শ ও মতবাদ—এই সবের বহুত্বকে জায়গা করে দেয়।

গভর্নর উলিসেস রুইজ-কে প্রত্যাখ্যান, যাতে আজও ওয়াহাকাবাসীদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ অনড়, তা থেকে শুরু হয়ে ক্রমশ তা আরো বেশি বেশি করে গোটা শাসনপ্রণালী ও স্থিতাবস্থাকে প্রত্যাখ্যানের রূপ নিয়েছিল। ইতিমধ্যেই অসহনীয় প্রতিপন্ন হওয়া একটা সরকারের একটা খুঁটি মাত্র এই উলিসেস রুইজ। দুর্নীতি ও স্বৈরতান্ত্রিকতা উলিসেস রুইজ-ই শুরু করেনি, কিন্তু সে-ই এগুলোকে এমন চরম মাত্রায় নিয়ে গেছে যা সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের কাছে অসহনীয় হয়ে উঠেছে। আবার গণসভা APPO-তে অংশগ্রহণকারী অনেকের ভাবনায় এই শাসনপ্রণালী প্রত্যাখ্যান করার মধ্যে পুঁজিবাদকে প্রত্যাখ্যান করাও অন্তর্ভুক্ত।

গণসভা APPO-র মধ্যে শামিল আন্দোলন ও সংগঠনগুলোর বৈচিত্র্যের কারণে তার পথ হিসেবে নির্দিষ্ট একটাই পথ চিহ্নিত করা অসম্ভব। অংশগ্রহণকারীরা বহুবিবিধ ‘হ্যাঁ’-কেই সামনে নিয়ে আসছে। সেই ‘হ্যাঁ’-গুলোর মধ্যে বহু মিল এবং অভিসারী ঝোঁক থাকলেও, বিভিন্নতা আছে, যেমন, আদিবাসী জনজাতিদের আন্দোলনগুলো থেকে হাজির হওয়া প্রস্তাবগুলো মোটেই পরিবেশবাদী বা মানবাধিকার কর্মীদের প্রস্তাবের সঙ্গে হুবহু এক নয়। অভিসারী ও অপসারী দুই ধরনের ঝোঁকই তাই এই আন্দোলনের মধ্যে প্রত্যক্ষ করা যায়:

  • প্রথমত, এমন গতানুগতিক সংগ্রামগুলো আছে যারা পুঁজি বা রাষ্ট্রের থেকে অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিধাবৃদ্ধি আদায় করে নিতে চায়, অথবা, ইতিমধ্যেই আদায় করতে পারা সুযোগ-সুবিধাকে কেড়ে নেওয়ার বাস্তব বা অনুমিত আক্রমণকে ঠেকাতে চায়। কিন্তু এমন নানা সংগ্রামও আছে যা স্পষ্টতই এই ধাঁচার বাইরে অবস্থিত।
  • দ্বিতীয়ত, গণতন্ত্রের বিভিন্ন ধরন--- প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র, অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র এবং আমূল গণতন্ত্র--- নিয়ে সংগ্রামগুলো আছে। অনেকে আচারসর্বস্ব গণতন্ত্রের রীতি-পদ্ধতি আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের মাধ্যমে নিখুঁত করে তুলে নির্বাচনী জালিয়াতির শেষ ঘটাতে চায়। আবার অন্য অনেকে অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রের সূচনা ঘটাতে চায় গণভোট, গণবিচার, প্রত্যাহরণ (recall), অংশগ্রহণমূলক বাজেট-তৈরির প্রক্রিয়া, স্বচ্ছতা ও সামাজিক নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ারসমূহের ব্যবস্থা করার মধ্য দিয়ে সরকারের কাজে নাগরিকদের অংশগ্রহণের পরিসরকে বাড়িয়ে। তৃতীয় ও চূড়ান্ত সংগ্রাম, যা গণসভা APPO-র প্রধান সংগ্রামও বটে, হল আচারসর্বস্ব ও অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রকে সেই আমূল গণতন্ত্রের বিস্তারে কাজে লাগানো যে আমূল গণতন্ত্র স্মরণাতীত কাল ধরে আদিবাসী জনজাতিদের অভ্যন্তরে এবং তাদের নিয়ন্ত্রিত পৌর অঞ্চলগুলোয় চর্চিত হয়ে আসছে এবং যা সাধারণ স্বশাসনের সঙ্গে যুক্ত। স্বশাসিত আঞ্চলিক নিকায় তৈরি করার মধ্য দিয়ে শুরু করে কীভাবে এই স্বশাসনের চর্চাকে গোটা সমাজ জুড়ে বিস্তৃত করা যায়, তা-ই এখন ভাবনার বিষয়। তা এক নতুন ধরনের সমাজের দিকেও ইঙ্গিত করে যা রাজনৈতিক স্বশাসনের অভিব্যক্তি হিসেবে জাতি-রাষ্ট্রের নকশার বাইরে নিজেকে স্থাপন করে। আচারসর্বস্ব ও অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র ঘিরে সংগ্রামগুলো যখন আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারসমূহের উপর জোর ফেলে, আমূল গণতন্ত্রের সংগ্রাম তখন গুরুত্ব দেয় জনসাধারণ নিজেরা নিজেদের জীবনযাপনের পরিবেশ-পরিস্থিতির রূপান্তরসাধনের জন্য কী করতে সক্ষম, তার উপর।
  • তৃতীয়ত, লাতিন আমেরিকার বামপন্থী ঘরানা যেহেতু রাষ্ট্রকেই সামাজিক ও রাজনৈতিক রূপান্তরসাধনের প্রধান কারক হিসেবে দেখে থাকে, বহু উদ্যোগই সামাজিক অধিকারের উপর জোর দিয়ে রাষ্ট্রের ভূমিকা বা অভিমুখীনতাকে বদলানোর চেষ্টায় বদ্ধ থাকে। কোনো কোনো গোষ্ঠী নয়া-উদারনৈতিক ধাঁচাকে কিছুটা মিতাচারী করে বর্তমান সরকারি নীতিগুলোর অভিমুখ পুনর্নির্ধারণ করতে চায়, আবার অন্যরা ‘জনবাদী স্তালিনতন্ত্র’ (যা উপর-নীচ ধাপকাটা উল্লম্ব বিন্যাস, সবার উপরে স্থিত এক নেতা এবং একটাই পার্টি, এই ধাঁচা অনুসরণ করে) থেকে শুরু করে অংশগ্রহণমূলক সমাজতন্ত্রের নানা রূপ ঢুঁড়ে রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় নীতি-বিধির সমাজতান্ত্রিক পাঠান্তর খুঁজে ফেরে যা গণআন্দোলনের চাপ, চকিত আক্রমণ, গণতান্ত্রিক নির্বাচন বা সশস্ত্র অভ্যুত্থান--- কোনও একভাবে ক্ষমতা দখল করার পর লাগু করা যাবে। এইভাবে উপর থেকে রাষ্ট্রের দ্বারা রূপান্তরের কাজে যাদের আস্থা নেই, যারাই বরং সংখ্যায় বেশি, তারা রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রকৃতি ও কর্মপদ্ধতিকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করছে এবং স্বায়ত্তশাসনবাদী (autonomist) বা স্বাধীনতাবাদী (libertarian) অভিমুখের দিকে ঝুঁকে আছে।

গণসভা APPO-র ভিতরে ও বাইরে ‘জনগণের সরকার’ (‘gobernio popular’)-এর চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে তীব্র বিতর্ক চলেছে। কেউ কেউ মনে করে যে রাষ্ট্রযন্ত্রের বিভিন্ন অংশকে দখল করে নিয়ে সেখান থেকে প্রতিষ্ঠিত প্রাধিকারিকদের উৎখাত করে তাদের জায়গায় এমন ‘জনগণের প্রতিনিধি’-দের বসানো দরকার যারা জনগণের সেবায় রাষ্ট্রক্ষমতা ব্যবহার করবে। বর্তমান শাসকদের প্রতিস্থাপিত করবে এই ‘জনগণের সরকার’। অন্যরা বর্তমান পরিস্থিতিতে এই পথের সম্ভাব্যতা কেবল নয়, যাথার্থ্য নিয়েও প্রশ্ন তোলে। তারা মনে করে যে নিপীড়ক ও প্রভুত্ববাদী চরিত্র রাষ্ট্রযন্ত্রের বিভিন্ন অংশের মধ্যেই নিহিত, তাই তথাকথিত ‘জনগণের প্রতিনিধি’-রাও রাষ্ট্রযন্ত্রের নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠলেই কীভাবে তারা সেই অবস্থানে গেছে--- প্রকৃত গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে, বিপ্লবের মধ্য দিয়ে, নাকি চকিত আক্রমণ হেনে (golpe de mano)--- তা নিরপেক্ষ ভাবেই অবধারিতভাবে নষ্ট ও দুর্নীতিপরায়ন হয়ে উঠবে। তারা মনে করে যে রাষ্ট্রপরিচালকদের মতবাদটাকে বদলে দেওয়াই যথেষ্ট নয়, খোদ রাষ্ট্রের সমস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকেই ভেঙে ফেলতে হবে। আর, এই রূপান্তরের কাজ জনসাধারণকে নিজেদেরই করতে হবে নিজস্ব উদ্যোগ ও স্বতক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাতে নীচের দিক থেকে উপরপানে সমাজকে পুনর্সংগঠিত করা যায়, তার বিপরীত প্রক্রিয়া উপর দিক থেকে চাপানো সামাজিক ব্যবস্থাপনার দুর্গতি এড়ানো যায়।

অন্যান্য গোষ্ঠীদের মতো তারাও উৎপাদনের উপকরণের উপর ব্যক্তিগত সম্পত্তিব্যবস্থার সমালোচক, পুঁজিবাদের সমালোচক, কিন্তু তারা জোর দেয় সর্বসাধারণের সম্পত্তিব্যবস্থা (communal property)-র উপর, যা আদিবাসী জনজাতিদের জনসমাজে চলে আসা ব্যবস্থার মতোই শোষণের সঙ্গে যুক্ত নয় এমন ক্ষেত্রে কিছু উৎপাদনের উপকরণের উপর এক প্রকার ব্যক্তিগত মালিকানা অনুমোদন করে। এই সংগ্রামগুলোর মূল অভিমুখ হল আমূল গণতন্ত্রের কাঠামোর মধ্যে জনসাধারণের নিজেদের দ্বারা নতুন সামাজিক সম্পর্ক নির্মাণের দিকে। আচারসর্বস্ব গণতন্ত্রকে তারা এই উত্তরণকালের জন্য স্বৈরতান্ত্রিক একনায়কত্বের তুলনায় শ্রেয় একটি রাজনৈতিক ছাতা হিসেবে গণ্য করে, কিন্তু প্রতিনিধিত্বমূলক ব্যবস্থা ও তার নির্বাচনী রীতিপদ্ধতি সম্পর্কে তাদের গভীর অনাস্থা। অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রের কদর তারা করে, তবে তা একমাত্র আমূল গণতন্ত্রের জন্য প্রয়োজনীয় একটি অভ্যাস-চর্চার স্তর হিসেবেই।

ওয়াহাকায় যেসব বিবিধ বিভিন্ন বিষয় অনবরত চর্চিত হয়ে চলেছে, এগুলো তার কিছু উদাহরণ মাত্র, বলা যায়, হিমশৈলের চূড়াটুকু মাত্র। বহুক্ষেত্রেই এই তর্ক-বিতর্ক বিশেষজ্ঞসুলভ পরিভাষা পরিহার করে চলে, এমনকি ‘পুঁজিবাদ’ বা ‘সমাজতন্ত্র’-র মতো বহু-ব্যবহৃত পরিভাষাও এড়িয়ে চলে, কিন্তু তাদের কথার অন্তর্বস্তু ও অভিমুখ স্পষ্টভাবে স্থিতাবস্থার আমূল সমালোচনা করতে করতে বিকল্পের অনুসন্ধান করে চলে অনবরত, এবং বিকল্পের জন্য সংগ্রামের অঙ্গীকারকেও মূর্ত করে তোলে।

পাত্র ও বাষ্প

দৈনিক সংগ্রামগুলো যখন চলছে, তারই মাঝে, ওয়াহাকায় কী ঘটেছে তা প্রকাশ করতে চাওয়া একটি ছবি দীর্ঘদিন হল ঘুরে বেড়াচ্ছে। বছরের পর বছর ধরে চলা হিংস্র দুর্নীতি ও উপছে-পড়া প্রভুত্ববাদ ওয়াহাকাকে ধিকিধিকি জ্বলা আগুনের উপর বসানো এক প্রেসার-কুকারে পরিণত করেছিল। উলিসেস রুইজ সেই আগুনে ইন্ধন যুগিয়ে গনগনে করে তুলেছিল এবং ২০০৬ সালের ১৪ জুন পুঞ্জীভূত হতে থাকা চাপ অবশেষে শিক্ষকদের ধর্ণার অবদমনের পর প্রেসার কুকারের ঢাকনা উড়িয়ে দিয়েছিল। পাত্রের মধ্যে ঘনিয়ে ওঠা অসন্তোষের চাপকে ভাষা দিয়ে গণসভা APPO তাকে বদল ঘটানোর সক্রিয়তায় রূপান্তরিত করেছিল। ২৫ নভেম্বরে কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রীয় সেনাবাহিনীর হিংস্রতা আবার আরো ভারী এক ঢাকনার তলায় ওয়াহাকাকে চাপা দিয়েছে। কিন্তু পাত্রের নীচে আগুন এখনও জ্বলছে। জনসাধারণের উদ্যোগ ঢাকনার মধ্যে যেসব ছোট ছোট ছিদ্র তৈরি করেছে, তা ঘনায়মান চাপকে কিছুটা কমালেও লাঘব করতে পারেনি। চাপ অনবরত পুঞ্জীভূত হয়ে চলেছে এবং যে কোনো মুহূর্তে আবার ঢাকনাটাকে উড়িয়ে দেবে। বিগতবছরগুলোয় সঞ্চিত অভিজ্ঞতা হয়ত চাপের বহির্গমনের আরো সংগঠিত উপায় তৈরি করে দেবে, যদিও কী ঘটবে তা আগে থেকে কেউ বলতে পারে না--- বড় বেশি সংখ্যক বল এখানে একে অপরের সঙ্গে যুযুধান।

অনাগতকে বোঝার জন্য আরেকটা রূপকও সাহায্য করতে পারে। তা হল বাষ্প, চাপদণ্ড (piston) ও ফুটনপাত্র (boiler)-এর রূপক। জনসাধারণের শক্তি যদি বাষ্প হয় আর সাংগঠনিক আধারসমূহ হয় চাপদণ্ড ও ফুটনপাত্র, ওয়াহাকার অভিজ্ঞতা তাহলে ফুটনপাত্র (সাংগঠনিক আধারসমূহ) বিহনে বাষ্পের (জনসাধারণের শক্তির) ছড়িয়ে-ছিটিয়ে অপব্যয়িত হয়ে যাওয়ার তত্ত্বের বিপরীতে সাক্ষ্য দেয়। সাধারণভাবে এই ক্ষেত্রে জনসাধারণের শক্তি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে অপব্যয়িত হয়ে যেতে পারে, আবার তা না হয়ে বরং অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে রূপান্তরিত ও আরো টেকসই হয়ে উঠতে পারে। এই শেষোক্ত প্রক্রিয়া দৈনিক জীবনযাপনের তজ্জনিত দিকগুলোয় ফুটে উঠলেও যারা সাংগঠনিক কলকব্জা পরিচালনার সঙ্গে আন্দোলনকে এক বলে মনে করেন, তাদের চোখে তা ধরা পড়ে না।

ওয়াহাকা এখনো কড়া আঁচেই ফুটে চলেছে। ২০০৬-য়ে তৈরি হওয়া বাষ্পের কিয়দংশ অভিজ্ঞতায় ঘনীভূত হয়ে বিশেষ আচরণে রূপান্তরিত হয়েছে। এই আচরণ বহু মানুষের প্রতিদিনকার মনোভঙ্গির অংশ হয়ে গেছে, তারা আর পুরানো ‘স্বাভাবিকতা’-য় কখনোই ফিরে যাবে না। বিগতদিনে তৈরি হওয়া বাষ্পের আরেকটি অংশ, প্রতিদিন নতুনভাবে উদ্গত হতে থাকা আরো বাষ্পের সঙ্গে মিশে বহু উদ্যোগকে চালিয়ে নিয়ে চলেছে। আর তার পরও রয়েছে আরো বাষ্প যা পুঞ্জীভূত হয়েই চলেছে, চাপ বাড়িয়ে চলেছে ক্রমশ, একবার নিজেকে মুক্ত করতে পারলে নতুনভাবে নিজের গতি নির্ধারণ করতে চাইছে হয়ত বা। এই নিজেকে মুক্ত করা মানে বেঁধে রাখা সমস্তকিছু থেকেই মুক্ত করা--- চাপদণ্ড ও ফুটনপাত্রের রূপকে নয়, রাজনৈতিক কলকব্জা ও রাষ্ট্রীয় সেনা-পুলিশ বাহিনীর নিপীড়নের মধ্য দিয়ে এঁটে বসানো অবদমনের ঢাকনাটাকেও উড়িয়ে দেওয়া, জনসাধারণের উদ্যোগের মুখ আটকে রাখা সবকিছুকে ভাসিয়ে দেওয়া।

সেই ‘বাষ্প’ যে কে তৈরি করে চলেছে তা নির্ধারণ করার বাতিক অবশ্য যাওয়ার নয়। জনসাধারণ নিজেরাই কোনো উদ্যোগ নিতে অক্ষম--- এই বদ্ধধারণাকে টিকিয়ে রেখেছে এই বাতিক। প্রায় স্বতঃসিদ্ধের মতো ধরে নেওয়া হয় যে কোনো এক ব্যক্তি বা গোষ্ঠী পাথর ছোড়ার পর হাতটিকে লুকিয়ে রাখবে: পিছন থেকে জনগণকে চালিত করবে এবং তা করতেই থাকবে। গণপ্রচারমাধ্যম তাদের নিজেদের মতো করে নেতাদের তৈরি করে নিয়েছিল এবং তাদের এমন সব মানুষ হিসেবে এমনভাবে হাজির করেছিল যাতে তার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রীয় হিংসা নামিয়ে আন্দোলনটিকে পিষে মারার পক্ষে জনমত তৈরি করা যায়। রাষ্ট্রীয় অধিকারীরাও একই কাজ করেছিল যাতে কিছু লোককে কিনে নেওয়া ও বাকি সকলকে দমন করা যায়। এখন মনে হয় তারা ধরে নিয়েছে যে গণসভা APPO পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়ে থাকবে বা অন্তত পঙ্গু হয়ে থাকবে যতক্ষণ আন্দোলনের তথাকথিত নেতৃত্বদানকারীদের জেলে পুরে রাখা হবে। একইরকম মনোভাব আন্দোলনের ভিতরে ও বাইরে থাকা বামপন্থীদের মধ্যেও দেখা গেছে। যারা ভাবে যে কোনো একটি নেতৃত্বদায়ী সংগঠন ছাড়া যা ঘটেছে তা ঘটতে পারত না, তারা এখন আন্দোলনটিকে নিঃশেষিত বা দ্রবীভূত বলে মনে করে এবং তাকে আবার পুনর্নবীকৃত বা পুনর্গঠিত করতে চায়। বা অন্যথায়, যখন গণসভা APPO-য় প্রকৃতই নেতাদের অনুপস্থিতি স্বীকার করে নেওয়া হয়, তখন পিছনে ঘুরে একেই সব সমস্যার মূল বলে অতীতের ঘাড়ে চালান করা হয়: নিদান দেওয়া হয় যে এই অনুপস্থিতির কারণেই স্বতঃস্ফূর্ত জনবিস্ফোরণ উবে গেছে, জনগণের শক্তি এভাবেই ছত্রভঙ্গ হয়ে যেতে বাধ্য, পাত্রের মধ্যে বাষ্পকে বন্দি না করলে এমনটাই হবে।

প্রশ্নটি যখন রাষ্ট্রযন্ত্রের দখল নেওয়ার নয়, বরং সমাজ-বাস্তবতাকে দ্রবীভূত করার ও পরিবর্তন করার, তখন প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতার মধ্যে নিরন্তর ঘনীভূত হতে থাকা বাষ্প উপছে উঠে বাস্তবে ছড়িয়ে পড়ার মাধ্যমেই কাজ করে। এই বাষ্পকে ‘সংগঠিত আধার’-এর মধ্যে ধরে রাখা যায় না, ‘নেতৃত্বদায়ী সংগঠন’ দিয়ে চালিত করাও যায় না। কোনো আধার বা সংগঠন যদি নিজেদের প্রাসঙ্গিকতা বজায় রেখে ভূমিকা নিতে চায়, তাহলে আজকের এই সময়ে যখন জালের বুননের মতো ছড়িয়ে থাকা প্রয়োজন, তখন তা বুঝে পিরামিড-সুলভ কাঠামোবিন্যাসের অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে, অন্যদের মতে মান্যতা দেওয়ার মধ্য দিয়ে নেতৃত্ব দেওয়া শিখতে হবে। তাছাড়াও যে কোনো আধার বা সংগঠনকে যথোপযুক্ত মাত্রা বজায় রেখে কাজ করতে হবে, অনবরত নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে হবে রক্তমাংসের নারী-পুরুষদের অবস্থা ও শৈলীর সঙ্গে, যেহেতু এই রক্তমাংসের নারী-পুরুষরাই সর্বদা বাষ্প হিসেবে, ঘাত হিসেবে, গোটা আন্দোলনের গতিপথ ও ব্যাপ্তি শেষাবধি নির্ধারণ করে।

বাস্তব সমাজপ্রক্রিয়ার ঋদ্ধতা কখনোই কোনো যান্ত্রিক রূপক দিয়ে পুরোটা ধরা যায় না। তবুও, ওয়াহাকা ও বৃহত্তর মেহিকোর জটিল বর্তমান পরিস্থিতি, যেখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো যেনবা চোখের আড়ালে লুকিয়ে থাকে, সেখানে তা দেখার জন্য এই পাত্র ও বাষ্পের রূপকটি কাজে লাগতে পারে।

পুনশ্চ: ফেব্রুয়ারি ২০১০     

২০০৬ সালের শেষভাগ জুড়ে নেমে আসা নৃশংস রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের ভয়ঙ্কর প্রভাব এখনও গোটা ওয়াহাকা জুড়ে ছড়িয়ে আছে। বহু পরিবার ধ্বংস হয়ে গেছে। অনিশ্চয়তা, ভয় এবং অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতার বোধ পরিব্যাপ্ত হয়ে আছে।

রাজনৈতিক ক্ষমতাধর শ্রেণিগুলো উলিসেস রুইজকে ২০১০-এর ডিসেম্বরে তার শাসনকাল শেষ হওয়া অবধি সমর্থন করে যাচ্ছে। মেহিকো যখন আরো বেশি বেশি করে এক অঘোষিত ব্যতিক্রমী অবস্থা -র গহ্বরে প্রবেশ করছে, যা হয়ত খুব শীঘ্রই ঘোষিতভাবে আইনী রূপও গ্রহণ করতে চলেছে, তখন এই রাজনৈতিক ক্ষমতাধর শ্রেণিরা উলিসেস রুইজের প্রভুত্ববাদী শাসনশৈলীকেই আরো বেশি বেশি করে আঁকড়ে ধরছে।

ওয়াহাকার সামাজিক-রাজনৈতিক মেরুকরণ প্রক্রিয়া এখনও ঘটে চলেছে এবং ২০১০ সালের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তা আরো গভীর হয়ে উঠতে পারে। উলিসেস রুইজের শাসনের ফলে জমে থাকা অসন্তোষ এবং দলীয় অন্তর্কোন্দলের ফলে দুর্বল হয়ে পড়া এতাবধি সর্বশক্তিমান পি.আর.আই.-কে হারানোর জন্য এই নির্বাচনে বাম ও ডান ঘরানার বিভিন্ন পার্টি নির্বাচনী জোট তৈরি করেছে। কিন্তু জনগণের যে পরিমাণ মনোযোগ তারা আকর্ষণ করতে পারবে বলে আশা করেছিল, তা মোটেই তারা পারছে না। এই রাজ্যে প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র নিয়ে যে মোহভঙ্গ গভীরে চারিয়ে গেছে, সেটাই তার কারণ।

এখনও কেউ জানে না যে APPO একটি প্রতীক হিসেবে টিকে থাকবে কিনা: সমাজের কোনো কোনো অংশ তাদের অর্থনৈতিক সমস্যার কারণ হিসেবে তাকে দায়ভাগী করছে, আর যারা তার প্রতি বিশ্বস্ত, তারা নিশ্চিত নয় যে এখন কী করণীয়। তাকে একটা অসমাপ্ত পরীক্ষানিরীক্ষা হিসেবেই দেখা হচ্ছে। যে মূল ধারণাটি নিয়ে শুরু হয়েছিল, সেই ‘বহু সভা নিয়ে গঠিত এক সভা’ প্রক্রিয়াটি ২০০৬ সালের শেষদিকে নৃশংস হিংসার কবলে ব্যাহত হয়েছিল। তৃণমূলস্তরে গণসভাগুলোকে পুনর্সংগঠিত করা বা নতুন করে তৈরি করার কাজ এখনও তার নিজের গতিতে চলছে, আগের থেকে আরো পাকাপোক্ত ভিত গড়ে নিয়ে এগোতে চাইছে, কিন্তু এই রাজ্যের সমস্ত অঞ্চলে তার সাংগঠনিক নীতি বিস্তার করার শক্তি তা এখনও অর্জন করে উঠতে পারেনি, যদিও নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলে যেখানে জমির জন্য প্রথাগত সংগ্রাম আঞ্চলিক রক্ষণব্যূহ নির্মাণের উদ্যোগে পরিণত হয়েছে, সেখানে স্বশাসনের উদ্যোগগুলো নতুন মাত্রা ধারণ করেছে।

জাপাতিস্তাদের ‘অদৃশ্য সমিতি’ (The Invisible Committeee) যাকে ‘আগামী অভ্যুত্থান’ বলে ২০০৯ সালে অভিহিত করেছিল, ওয়াহাকা ও মেহিকোতে তা ইতিমধ্যেই হাজির হয়ে গেছে বলে মনে হয়, যদিও তা অদৃশ্য। সাবকমান্ডান্ট মার্কোস যথার্থই সতর্ক করে দিয়েছিলেন, এমন শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক অভ্যুত্থান যদি তার সংজ্ঞানির্ধারক আমূল পরিবর্তনগুলো বলবৎ করার মতো রাজনৈতিক বল না তৈরি করে নিতে পারে, তাহলে অচিরেই একটি অতি হিংস্র লাগামছাড়া গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যেতে পারে এবং তার হাত ধরে সব ধরনের বিস্ফোরক বিশৃঙ্খলা ও অভূতপূর্ব প্রভুত্ববাদ রূপ পরিগ্রহ করতে পারে।

২০০৬ সালের ওয়াহাকার পরীক্ষানিরীক্ষা বর্তমানে মেহিকো সহ গোটা বিশ্বে রূপ পরিগ্রহ করতে থাকা সাধারণাবস্থার একটি সুবেদী অভিব্যক্তি বলে ধরা যেতে পারে।

 

টীকা

১। সম্পূর্ণ প্রতিবেদনটি যেখানে পাওয়া যাবে: www.cciodh.pangea.org/।

২। ‘সমাবেশিত হওয়ার কথা বললে আমি আসলে গতিমুখর হওয়ার কথা বলি, আমি বলতে চাই যে মানুষ এখন যেমন তার থেকে আরো বেশি গতিময় হয়ে উঠবে--- তার থাকবে নর্তকের স্বাধীনতা, ফুটবল-খেলোয়াড়ের অভিপ্রায়পূর্ণতা, গেরিলা-যোদ্ধার আকস্মিকতা। যারা জনগণকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপূরণের উপায় হিসেবে গণ্য করে, তারা কোনোদিন মানুষকে সমাবেশিত করতে পারে না, তারা কেবল হুকুম করে জনগণকে চালাতে চায়। যেমন ধরা যাক, একটা গাঁটরির কোনো গতিময়তা নেই, তা কেবল এক স্থান থেকে আরেক স্থানে চালান হতে পারে। গণসমাবেশ বা গণমিছিল মানুষের গতি কেড়ে নেয়। যে রাজনৈতিক প্রচার (propaganda) মানুষের স্বশাসনের সমস্ত দ্বার খুলে দেওয়ার বদলে তাকে পক্ষাঘাতগ্রস্ত করে তোলে, তাও একই ফল ফলায়, তা রাজনৈতিক ক্রিয়াকে অসম্ভব করে তোলে।’ (এনজেনসবার্জার ১৯৭৬, পৃঃ১0)

৩। ‘বলা যায় যে পিণ্ড নামক নিখাদ পরিমাণবাচক ধারণাটি পরিসর দখল করা যে কোনো বস্তুর ক্ষেত্রে যেভাবে প্রযোজ্য, মানুষজনের ক্ষেত্রেও সেভাবেই প্রযোজ্য হয়। একথা সত্যি বটে, তবে সেক্ষেত্রে কোনো গুণবাচক মূল্য এর নেই। আমরা যেন ভুলে না যাই যে গণপিণ্ডের ধারণায় পৌঁছতে গিয়ে আমরা গণ অর্থাৎ মানুষদের সমস্ত বৈশিষ্ট্যকে বিমূর্তায়িতকরণের মাধ্যমে বাদ দিয়ে দিয়েছি, কেবল সেই একটি বৈশিষ্ট্য ছাড়া, যে বৈশিষ্ট্যটি যে কোনো বস্তুদ্রব্যের সঙ্গে তারও এক, অর্থাৎ সংখ্যায় গণনযোগ্য হওয়ার বৈশিষ্ট্য। যুক্তিসঙ্গতভাবেই তাই গণপিণ্ডদের পরিত্রাণ করা যায় না, শিক্ষিতও করা যায় না। কিন্তু সর্বদাই গণপিণ্ডদের মেশিনগানের গুলির তোড়ে সাবাড় করে দেওয়া যায়।’ (মাচাদো ১৯৭৫, পৃঃ২৩৯)

৪। APPO-র বিবর্তনপ্রক্রিয়ার অন্তর্গত সমস্ত ঘটনার বর্ণনা তো দূরের কথা, ন্যূনতম একটা বিবরণও এখানে দেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু একটি কেন্দ্রীয় বিষয় না বললেই নয়। শিক্ষকদের ইউনিয়নের লোকাল ২২ শাখা কিছু দাবিদাওয়ার ভিত্তিতে একটি ট্রেড-ইউনিয়ন সংগ্রাম শুরু করেছিল, যা তাৎক্ষণিক রাজনৈতিক অভিব্যক্তি ধারণ করলেও কখনোই তার আদি চরিত্র হারায়নি। অর্থনৈতিক দাবিদাওয়াগুলো যখন (অন্তত কাগজেকলমে) মিটে গেল, তার সমাবেশপ্রক্রিয়ারও তখন শেষ হল। অন্যদিকে, APPO প্রথম থেকেই একটি রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগ্রামে নেমেছিল। লোকাল ২২-এর ট্রেড-ইউনিয়ন সংগ্রামকে সে টানা সমর্থন করে গেছে, কিন্তু তা দিয়েই সে নিজেকে সংজ্ঞাত হতে দেয়নি। এই পার্থক্য নানারকম টানাপোড়েনের জন্ম দিয়ে চলেছিল, যা অবশেষে ২০০৬ সেপ্টেম্বরের শেষে প্রকাশ্যে এসে পড়ে যখন শিক্ষকরা তাদের সমাবেশ গুটিয়ে বিদ্যালয়কক্ষে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ঠিক যখন APPO সাংবিধানিক সম্মেলনের মধ্য দিয়ে ‘শান্তি, ন্যায় ও গণতন্ত্রের উদ্দেশ্যে নাগরিকদের কথোপকথনের উদ্যোগ’ নেওয়া ও আদিবাসী জনজাতিগুলোর মানুষদের একটা বড় মঞ্চ সংগঠিত করার মাঝে যে কোনো সময় রাষ্ট্রীয় পুলিশ বাহিনীর (Federal Preventive Police) হামলা নেমে আসার আশঙ্কা নিয়ে কাজ করছিল। লোকাল ২২ শাখার মধ্যেও এই টানাপোড়েনের ছাপ পড়েছিল যেহেতু অনেক শিক্ষকই সক্রিয়ভাবে APPO-তে অংশগ্রহণ করছিলেন এবং নিজেদের ট্রেড-ইউনিয়ন সংগ্রামকেও রাজনৈতিক সংগ্রামে রূপান্তরিত করতে সচেষ্ট ছিলেন। সাধারণ স্তরের শিক্ষকরা এখনও APPO-র একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ ওঠায় শিক্ষক-ইউনিয়নের সাধারণ সভাপতি ২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে পদত্যাগ করেন। তারপর এক বছরেরও বেশি সময় পর অতি জটিল এক প্রক্রিয়ার শেষে নতুন সাধারণ সভাপতি যখন নির্বাচিত হল, সেই নির্বাচনের ফল লোকাল ২২-র মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক পুনর্গঠনের ইঙ্গিত দিলেও, তা সংগঠনের চরিত্র ও অভিমুখে কোনো বদল ঘটায়নি। APPO এবং লোকাল ২২-র মধ্যে এহেন টানাপোড়েন ছাড়াও APPO-র নিজের মধ্যেও নানা টানাপোড়েন আছে। শৈলী, ভাবনা ও কৌশলের বিভিন্নতা প্রতিফলিত হয় এসব টানাপোড়েনে। যেমন, APPO-র মধ্যের প্রভাবশালী মতামত একটি শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পক্ষে, স্পষ্টতই যে কোনো ধরনের হিংসার বিরুদ্ধে, যেখানে APPO-র মধ্যেরই কিছু সংগঠন ও ব্যক্তিবর্গ হিংসার ব্যবহার প্রয়োজনীয় বলে মনে করে এবং তা কেবল আত্মরক্ষার্থেই নয়, বরং সংগ্রামের অংশ হিসেবেও। তাছাড়া, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ টানাপোড়েন লক্ষ্য করা যায় পুরোপুরি আঞ্চলিক আন্দোলন-সংগঠন এবং সেই আন্দোলন ও সংগঠনগুলোর মধ্যে যারা বিভিন্ন জাতীয় সংগঠনসমূহের অংশ। আঞ্চলিক গোষ্ঠীগুলো বাইরে থেকে সমর্থন-সহায়তা পেতে ও বাইরের কিছুকে সমর্থন-সহায়তা করতে রাজি থাকলেও এবং নিজেদের সংগ্রামের শাখা-প্রশাখার দেশ ও বিশ্ব জোড়া উপস্থিতি সম্পর্কে সচেতন হলেও, আঞ্চলিক বিষয়গুলো নিয়েই তারা প্রাথমিকভাবে ভাবিত এবং জাতীয় সংগঠনগুলো (বিশেষত রাজনৈতিক পার্টিগুলো) যখন নিজেদের জাতীয় বা আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক/মতবাদিক কৃত্যে APPO-কে অধীনস্থ রূপে শামিল করতে চাপ দেয়, তখন তারা সেই চাপ প্রতিরোধ করে। এই সমস্ত টানাপোড়েন অবশ্যই APPO-র চলায় পড়েছে, বিশেষত তার সমন্বয়কারী সমিতির মধ্যে কিছু কিছু সহমত ও সিদ্ধান্ত গঠনের পথে বাধা হয়েছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও সেসবের প্রভাব একটা সীমার মধ্যে বেঁধে রাখা গেছে। তবুও এখন এই সময়ে যখন APPO একটা নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করছে, কিছু কিছু সংগঠন যখন তার বিলুপ্তির উপর বাজি ধরে বসে আছে বা তা থেকে বেরিয়ে গিয়ে অন্যত্র নিজেদের কৃত্য সাধন করতে চাইছে, তখন এতদিন ধরে অর্জিত ঐক্য ও সংহতি অটুট রাখা সম্ভব নাও হতে পারে।

৫। মুরাত জন-আন্দোলনের বিরুদ্ধে আগ্রাসী হামলা নামিয়ে আনায় নেতৃত্ব দিয়েছিল। সে কেন্দ্রীয় সরকার (Federal Congress)-এর প্রতিনিধি হয় এবং আর্থিক তছরুপের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়।

৬। বিভিন্ন জনজাতিগোষ্ঠীগুলো হল: আমুজগো, চাতিনো, চিনানতেকো, চোনতাল, চকোলতেকো, কুইকাতেকো, হুয়াভে, মাজাতেকো, মিহে, মিহতেকো, তাকুয়াতে, ত্রিকু, জাপোতেকো, জোকু। বিবৃতিটি এখনও প্রকাশিত করা হয়নি।

৭। আয়তনে ছোটো হলেও বেশ দৃষ্টিগ্রাহ্য ও সংগঠিত কিছু গোষ্ঠী এমন মার্কসীয়-লেনিনীয় নৈষ্ঠিকতা (স্তালিনকে অন্যতম আদর্শ ধরে) রক্ষা করে চলে যা অন্যত্র বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পরিত্যক্ত হয়েছে। একটি সমাজতান্ত্রিক ধাঁচার সঙ্গে উপর-উপর জুড়ে দেওয়া কিছু অবস্থানকে তারা রক্ষা করতে চায়। এদের থেকে উদার কিছু গোষ্ঠী সমাজতন্ত্র সম্পর্কে সমালোচনাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি অবলম্বন করে, তারা সমাজতন্ত্রকে এমন একটি ঐতিহাসিক প্রতীতি হিসেবে দেখে যার অবসান ঘনিয়ে এসেছে এবং যার তাত্ত্বিক নির্মাণের মধ্যে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ খামতি ফুটে উঠেছে (হ্যারি ক্লিভার যেমন আলোচনা করেছেন, দ্রষ্টব্য: হ্যারি ক্লিভার ১৯৯২)। এই উদারতর ধারাটির ভেনেজুয়েলার মতো সমাজতান্ত্রিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা নিয়ে তেমন আগ্রহ নেই বলে মনে হয়। অন্যদিকে, আদিবাসী জনজাতিদের পরম্পরাগত ধারায় শিকড় গাড়া বিভিন্ন প্রবণতাগুলো পুঁজিবাদের মতো সমাজতন্ত্রকেও পিছনে ফেলে এগোনোতেই মনোনিবেশ করেছে বলে মনে হয়।

৮। ২০০৬ সালে অ্যাডোলফো জিলি লেখকের সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় একথা বলেছিলেন।

৯। গিওর্ঘি আগামবেন তাঁর ‘State of Exception’ বইতে যেমন চিহ্নিত করেছেন, তেমন ‘State of Exception’-ই জনসাধারণের বিভিন্ন অংশের স্বাভাবিকতাকে সম্যকভাবে প্রকাশ করছে বলে মনে হয়--- ওয়াহাকার ক্ষেত্রে তো এই অংশরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। মেহিকোতে বর্তমানে যা ঘটছে, তা হল এই যে গোটা জনসমাজের উপরই এই অবস্থা প্রযুক্ত হচ্ছে… এবং নিপীড়িতরা তাদের নিজেদের মতো করে ‘State of Exception’ প্রয়োগ করছে।

 

সূত্রপঞ্জী

আনতোনিও মাচাদো, ১৯৭৫, Prosas, হাভানা: এডিটোরিয়াল আর্টে ই কালচুরা।

ইভান ইলিচ, ১৯৯৬, Deschooling Society, লন্ডন: মেরিয়ন বয়ারস।

গিওর্ঘি আগামবেন, ২০০৫, State of Exception, শিকাগো: শিকাগো ইউনিভার্সিটি প্রেস।

দি ইনভিজিবিল কমিটি, ২০০৯, The Coming Insurrection, লস আ্যাঞ্জেলস: সেমিওটেক্সট।

হানস এনজেনসবারজার, ১৯৭৬, Elementos para una teoria de los medios de comunicacion, বার্সেলোনা: অ্যানাগ্রামা।

হ্যারি ক্লিভার, ১৯৯২, উল্ফগ্যাঙ স্যাকস সম্পাদিত The Development Dictionary বইয়ের ২৩৩-২৪৯ পৃষ্ঠায় Socialism প্রবন্ধ, লন্ডন: জেড বুকস।

0 Comments
Leave a reply