১
রাজনীতি ও জ্ঞাপনব্যবস্থার পারস্পরিক সম্পর্ক-অভিঘাত-টানাপোড়েন নিয়ে কিছু বিচার-বিবেচনা এই লেখার অভিপ্রায়।
রাজনীতি বললে সরকার-রাষ্ট্র-পার্টি এবং সেই সংক্রান্ত সমর্থন-বিরোধিতা-প্রভাববিস্তারের কথাই প্রথমে মনে হয়। অর্থাৎ, কিছু প্রতিষ্ঠিত প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠান এবং তাদের ঘিরে থাকা ক্ষমতার গ্রন্থিগুলোকে ব্যক্তি/গোষ্ঠী/শ্রেণি-স্বার্থ অনুযায়ী বিন্যস্ত-পুনর্বিন্যস্ত করার ক্রিয়াই রাজনীতি বলে সাধারণভাবে চালু আছে। প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঘিরে থাকা এই ক্ষমতা-গ্রন্থিগুলো থেকে কিছুটা দূরে, বা কিছুটা আড়ালে, আমাদের দৈনন্দিন ব্যক্তিগত ও বারোয়ারী জীবনযাপনেও প্রভাব বিস্তার ও প্রতিরোধ করার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ঘিরে নানা ক্ষমতাগ্রন্থি বিন্যস্ত-পুনর্বিন্যস্ত হতে থাকে, জাত-জাতি-বর্ণ-লিঙ্গ-ভাষা-আচার সংক্রান্ত ক্ষমতার চাপান-উতোর চলতে থাকে--- তা সমাজজোড়া ক্ষমতাবিন্যাসে ওই প্রথমোক্ত গ্রন্থিগুলোর থেকে বিচ্ছিন্ন নয়, বরং নিবিড় আন্তর্সম্পর্কে স্থিত। এই গোটা ক্ষেত্রটাকেই আমরা রাজনীতির ক্ষেত্র বলে ধরে নিয়ে এই ক্ষেত্রে মানুষের যে কোনো সক্রিয়তাকে রাজনৈতিক সক্রিয়তা বলে গণ্য করব।
জ্ঞাপনব্যবস্থা বলতে সেই ব্যবস্থার কথা বলা হচ্ছে যার দ্বারা বা যার মাধ্যমে মানুষেরা তথ্য-ধারণা-দাবি-আদেশ-নির্দেশ-প্রার্থনা-প্ররোচনা প্রেরণ-সংবহন করে থাকে। সমসাময়িক সমাজে জ্ঞাপনব্যবস্থার বিবিধ রূপ--- যেমন মৌখিক-আচরণিক রূপ, লিখনবদ্ধ রূপ, বৈদ্যুতিন (electronic) মাধ্যম ভিত্তিক রূপ--- দেখতে পাই। আবার ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখব যে এই রূপগুলোর বয়স নানারকম। মৌখিক-আচরণিক রূপ (যেখানে মুখের শব্দ/কথা এবং বিশেষ আচরণ জ্ঞাপনের কাজ করে) সবচেয়ে পুরোনো এবং ব্যাপক। লিখনবদ্ধ রূপ তার চেয়ে নবীন, প্রথমে দীর্ঘদিন ধরে তার প্রসার অতি সীমিত থাকলেও মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কারের পর তা অতি চমকপ্রদভাবে বিপুল হারে বৃদ্ধি পায় শিল্পায়নের মধ্যে দিয়ে যাওয়া সমাজগুলোয়। সবচেয়ে অর্বাচীন হল বৈদ্যুতিন মাধ্যম ভিত্তিক রূপ, যা বিশ শতকের শেষার্ধে ঘটা বৈদ্যুতিন বিপ্লবের হাত ধরে আরো চমকপ্রদ বিস্তারলাভের মধ্য দিয়ে ‘সোশাল মিডিয়া’-র পর্দায় জগতের মুখ ঢেকে ফেলছে।
আমরা রাজনীতি ও জ্ঞাপনব্যবস্থার মধ্যে সম্পর্কগুলোর বিচার রাজনৈতিক সক্রিয়তা ও জ্ঞাপন, এই দুই ক্রিয়ার পারস্পরিক ছেদ ও ভাঁজগুলোয় দৃষ্টি ফেলার মধ্য দিয়ে করতে চাইব।
২
ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীন নথি হল বৈদিক সাহিত্য। খৃস্টপূর্ব ১২০০ অব্দ থেকে খৃস্টপূর্ব ১০০০ অব্দের মধ্যে ঋগ্বেদ সংহিতা সংকলন করা হয়েছিল বলে অনুমান করা হয়। সামূহিক ব্যপারে সিদ্ধান্তগ্রহণের জন্য, সামূহিক কাজকর্ম পরিচালনার জন্য সেই সময় ‘সভা’ ও ‘সমিতি’ নামক দুটি প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার উল্লেখ বেদ-এ লক্ষ্য করা যায়।
বেদ-এ সভা বলতে একটি সমাবেশ বা সমাবেশ-গৃহ বুঝিয়েছে যেখানে জনগোষ্ঠীর প্রধান ব্যক্তিরা সমবেত হয়ে তঁাদের কাজকর্ম নিয়ে আলোচনা করতেন (ঋগ্বেদ, ৬.২৮.৬, ৮.৪.৯, ১০.৩৪.৬, অথর্ববেদ, ৫.৩১.৬, ৭.১২.১, ৭.১২.২, ৮.১০.৫, ১২.১.৫৬, ১৯.৫৫.৬)। সভায় আলোচনার ক্ষেত্রে যাঁরা প্রধান ভূমিকা নিতেন, তঁাদের বলা হতো সভাসহ (ঋগ্বেদ ১০.৭১.১০)। সভায় মত-উপস্থাপনার ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট মান বজায় রাখার দিকে নজর দেওয়া হতো, বিশিষ্ট সদস্যদের ‘সভেয়’ (সভার যোগ্য), ‘রয়িঃ সভাবান্’ (সভার সম্পদ) আখ্যা দেওয়া হতো (ঋগ্বেদ, ২.১৪.১৩, ৪.২.৫)। এছাড়াও সভার সদস্যদের বোঝানোর জন্য ‘সভাচর’ ও ‘সভাসদ’ শব্দদুটির ব্যবহার আছে। ঋগ্বেদে (১.১৬৭.৩) ‘সভাবতী’ শব্দটি পাওয়া যায়, যা সম্ভবত নারী সদস্যদের বোঝাতে ব্যবহৃত হতো, সেখানে বলা হয়েছে যে সভাস্থিতা নারী সভার উপযোগী বাক্য প্রয়োগ করে। ঋত বা নিয়মরক্ষাকারী নারীর তিনবার সভায় আগমনের কথা ঋগ্বেদে (৩.৫৬.৫) বলা হয়েছে।
‘বিদথ’ শব্দটির ব্যবহার ঋগ্বেদে পাওয়া যায় প্রাচীনতর গণপ্রতিষ্ঠান হিসাবে। এটি ছিল নীতিনির্ধারক প্রতিষ্ঠান যা জনজীবনের সাধারণ বিষয়াবলী (ঋগ্বেদ, ২.১.৪, ২.১৭.২২, ৩.৩৮.৫৬, ৫.৬৩.২, ৭.৬৬.১০, ৮.৩৯.১, ১০.১২.৭, অথর্ববেদ, ১৭.১.১৫) ছাড়াও ধর্মীয় (ঋগ্বেদ, ১.৬০.১, ২.৪.৮, ২.৩৯.১, ৩.১.১, ৩.৫৬.৮) ও যুদ্ধসংক্রান্ত (ঋগ্বেদ, ১.১৬৬.৬, ৫.৫৯.২) বিষয় নিয়ে আলোচনা করত। রাজাকে বলা হয়েছে ‘বিদথ্য’, যা থেকে অনুমান করা যায় যে রাজাকে বিদথের অধীনে, বিদথের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে কাজ করতে হতো। বিদথে যে নারীরাও উপস্থিত থাকতেন, তার প্রমাণ আছে অথর্ববেদ (৭.৩৮.৪)-এ ও মৈত্রায়ণী সংহিতা (৪.৭.৪)-য়।
সভার মতো সমিতিও সর্বসাধারণের সমাবেশস্থল ছিল এবং বহু ক্ষেত্রে সভা ও সমিতি একসঙ্গে উচ্চারিত হয়েছে (অথর্ববেদ, ৭.১২.১, ১২.১.৫৬, ১৫.৯.২, ১৫.৯.৩)। বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বিষয়, যেমন যুদ্ধের মতো বিষয়, আলোচনার জন্য সভার চেয়ে সমিতি অধিকতর দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিল (ঋগ্বেদ, ১.৯৫.৮, ৯.৯২.৬, ১০.১৭.৬, ১০.১৬৬.৪, অথর্ববেদ, ৫.২৯.১৫, ৬.৮৮.৩, ৭.১২.১, ১২.১.৫৬)।
ঋগ্বেদের একটি বিখ্যাত মন্ত্রে পাওয়া যায়— ‘সমানো মন্ত্রঃ সমিতিঃ সমানী/ সমানং মনঃ সংচিত্তসেষাম্’। এর অর্থ এই যে, সমিতিতে সমস্ত মানুষ তাদের মন্ত্রণাকে মিলিয়ে দিতে চায়, সেখানে মানুষ তাদের আলাপ-আলোচনাকে একসুরে বাঁধতে চায় এবং একাগ্রচিত্ত হওয়ার জন্য প্রার্থনা করে। সমিতির আলোচনায় অংশ নেওয়ার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে হতো। সকলে যেখানে তর্ক-যুক্তি দিয়ে মতপ্রকাশ করছে, সেখানে নিজের তর্ক-যুক্তি অপরের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য মানুষের যে চেষ্টা ও আকুতি ছিল, তা বোঝা যায় এই শ্লোক থেকে— ‘যে সংগ্রামা সমিতয়স্তেষু চারু বদেম তে'। রাজার সঙ্গে সমিতির সদস্যদের যাতে মতের মিল হয় এবং সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায়, সেজন্য বিশেষ চেষ্টা চলত (ঋগ্বেদ, ১০.১৬৬.৪, অথর্ববেদ, ৬.৮৬.৯)।
রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে ছিল গণরাজ্যের চল। বজ্জীদের গণরাজ্য যার উদাহরণ। রাজতন্ত্রে যেখানে রাজা সার্বভৌম, গণরাজ্যে তেমনই গণ বা সমূহ সার্বভৌম। গণরাজ্যে তো বটেই, প্রথম দিকের রাজতন্ত্রেও (অর্থাৎ ক্ষমতা যখন রাজা ও তাঁর কতিপয় সহায়কের হাতে দৃঢ়-কেন্দ্রীভূত হয়ে যায়নি) সভা-বিদথ-সমিতি-ই রাজনৈতিক ক্রিয়ার মূল মঞ্চ হিসেবে নির্ধারক ভূমিকা পালন করত।
বৈদিক সাহিত্য থেকে পাওয়া এই ছবি থেকে বোঝা যায় যে রাজনৈতিক ক্রিয়ার উপযোগী জ্ঞাপনব্যবস্থা হিসেবে সেই সময়ে মৌখিক-আচরণিক রূপই একচেটিয়া ছিল। অর্থাৎ, সম্মিলিতজনেরা যখন রাজনৈতিক-সামাজিক ঘটনা-প্রতীতি নিয়ে একে অপরের সামনে তথ্য-ধারণা-দাবি-প্রার্থনা-প্ররোচনা উপস্থাপনা করতেন, যুক্তির পিঠে প্রতিযুক্তি বসাতেন, তখন তাৎক্ষণিক ভাষণই ছিল সম্বল। সেইজন্য রীতিমতো প্রস্তুতি ও চর্চারও চল ছিল এবং সামর্থ্যভেদেরও স্বীকৃতি ছিল। লিখনবদ্ধ রূপের হয় তখনও জন্ম হয়নি, নয়তো অতি শৈশবকাল।
রাজনৈতিক সক্রিয়তা ও জ্ঞাপনব্যবস্থার পারস্পরিকতার এই উদাহরণটি সম্পর্কে আরো কয়েকটি বিষয় খেয়াল করা যেতে পারে:
৩
রাজতন্ত্র যখন দৃঢ়-কেন্দ্রীভূত হয়ে বিস্তীর্ণ ভৌগোলিক অঞ্চলকে একচ্ছত্র শাসনের অধীনে বাঁধছে, সেই রাজনীতির কাম্য জ্ঞাপনব্যবস্থায় লিখনবদ্ধ রূপ কীভাবে গুরুত্ব পাচ্ছে তার উদাহরণ আমরা কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র’-এ পাই।
কৌটিল্য (৩৭৫-২৮৩ খৃস্টপূর্ব) চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের বিশাল মৌর্য সাম্রাজ্যের নীতি-নির্ধারক কর্ণধার হিসেবে খ্যাত। তাঁর লেখা ‘অর্থশাস্ত্র’-এর দ্বিতীয় খণ্ডে রাজাধ্যক্ষদের কাজ সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে রাজলিখন বা রাজ-আদেশ তৈরির পদ্ধতি নিয়ে তিনি একটি পৃথক অধ্যায় লিখেছিলেন। সেখানে তিনি বলেছেন যে রাজ্য শাসনের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল রাজলিখন তৈরি করা, যা করার জন্য যোগ্য লোককে লেখক হিসেবে নিয়োগ করতে হবে। কেমন হবে সেই লেখকের যোগ্যতা?--- তার মন্ত্রীর সমান সক্ষমতা থাকতে হবে, সমস্ত বিবিধ ধরনের রীতি-আচার সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হতে হবে, লেখাজোখায় দড় হতে হবে, হাতের লেখা সুস্পষ্ট হতে হবে এবং লিখন পাঠোদ্ধারে চতুর হতে হবে। সেই লেখক রাজার আদেশ শুনে সে সংক্রান্ত সমস্ত বিষয় নিয়ে ভালোভাবে চিন্তা-ভাবনা করার পর আদেশটির লিখিত রূপ তৈরি করবে এবং সেই লিখিত রূপটি প্রচারিত হবে। রাজ-আদেশ-এর এই পরিশীলিত রূপ নির্মাণের নির্দেশিকা হিসেবে কৌটিল্য প্রস্তাব করেছেন:
এই নির্দেশিকার পাশাপাশি খেয়াল রাখা দরকার যে অর্থশাস্ত্র-এর বিভিন্ন অংশে কৌটিল্য আলোচনা করেছেন কীভাবে প্রজাদের উপর নজরদারি ব্যবস্থা কায়েম রাখা যায়, কেউ সন্দেহ করতে পারবে না এমন ভেক ধরিয়ে চরেদের ছড়িয়ে রেখে সাধারণজনেদের মতামত-মনোভাব-ক্ষোভ-বিরোধিতা সম্বন্ধে খবর রাখা যায়, রাজস্বার্থে প্রজাদের মধ্যে প্রচার-পরিক্রমা (আধুনিক ভাষায় ‘propaganda’) বহাল রাখা যায় এবং পরিবার থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় স্তর অবধি আইন-শৃঙ্খলার বাঁধনে বাঁধা যায়।
সুতরাং, কৌটিল্যের উপস্থাপনায় লিখনরূপ-ভিত্তিক জ্ঞাপনব্যবস্থা কেন্দ্রীভূত চরিত্রের এমন এক শৃঙ্খলাদায়ক ক্ষমতার কাঠামোর মধ্যে কাজ করছে যেখানে শীর্ষে বসা শাসককুল নিম্নস্থ প্রজাকুলের উপর নজরদারি-শৃঙ্খলারোপ-দমন চালানোর রাজনৈতিক কর্মটি করে চলেছে। জ্ঞাপনের লিখনরূপে তাই সাধারণের মুখের ভাষাকে অবমূল্যায়িত করে রাজনৈতিক কার্যে অনুপযুক্ত ঘোষণা করা হচ্ছে এবং অভিজাত পরিশীলিত ভাষা ও শৈলী গঠন করা হচ্ছে। জ্ঞাপন কাজের পরিসরে এখানে জোর কেবল একটি অভিমুখেই--- সে অভিমুখ হল রাজপুরুষদের দ্বারা প্রজাদের উদ্দেশ্যে জ্ঞাপন এবং রাজস্বার্থ ও রাজসিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রজাদের মধ্য থেকে কোনো বিক্ষোভ-বিরোধিতাকে দানা না বাঁধতে দেওয়া। ফলে বিবিধ অবস্থানে থাকা প্রজাদের মনের কথা আন্দাজ করতে চর ছড়ানো হচ্ছে, সে মোতাবেক রাজকৌশল নির্ধারিত হচ্ছে, কিন্তু কোনো মুক্ত রাজনৈতিক পরিসরে সেই মনের কথা প্রকাশিত হওয়ার জায়গা দেওয়া হচ্ছে না।
লিখনবদ্ধ রূপ কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা জ্ঞাপনব্যবস্থা এবং রাজনৈতিক চর্চার পরিসরে সংখ্যাগরিষ্ঠের সক্রিয়তা-হানি: এই সমাপতন কি কেবল বিকশিত রাজতন্ত্রের মতো হিতাকাঙ্ক্ষী/অত্যাচারী স্বৈরতন্ত্রেরই বিষয়? গণতন্ত্রে কী তা ঘটে না? উত্তরের দিকে যাওয়ার জন্য লিখনরূপকেন্দ্রীক জ্ঞাপনব্যবস্থার নিজ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বিচার করা যাক।
জ্ঞাপনমাধ্যম হিসেবে লিখনরূপের আকর্ষণ এইখানে যে প্রথমত তা বাচনরূপের তুলনায় জ্ঞাপনকে বহুগুণ দীর্ঘস্থায়ী ও সুদূরচারী করতে পারে এবং দ্বিতীয়ত, তাৎক্ষণিকতা (যা স্বতঃস্ফূর্ত বাচনের আবশ্যিক চরিত্র)-র পরিবর্তে সাজানো-গোছানো সব-দিক-এঁটে-তৈরি-করা প্রমিত পরিশীলিত এক নির্মাণ হাজির করে। সর্বজনের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের উপর দাঁড়ানো ছোট ছোট অঞ্চলের স্বাধীন স্বায়ত্তশাসনের বদলে বিপুল ভৌগোলিক অঞ্চলকে কেন্দ্রীভূত শাসনের কাঠামোয় বাঁধতে গেলে শাসিতের উদ্দেশ্যে শাসকের জ্ঞাপন নির্দিষ্ট কিছু আচরণ-রীতি-শৃঙ্খলা-আইন-কে আদর্শ বা ন্যায়ানুগ বলে প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এই জ্ঞাপন স্বতঃস্ফূর্ততার উপর নির্ভরশীল নয়, বরং স্বতঃস্ফূর্ততাকে শাসন-কর্তন করে পরিমিত প্রমিতির সর্বজনীন আরাধ্যরূপ নির্মাণ তার অভিপ্রায়। সদাপরিবর্তনশীলতার কাছে উন্মুক্ত থাকা তার চরিত্র নয়, বরং স্থায়ীত্বকে মোক্ষজ্ঞান করে পরিবর্তন রুদ্ধ বা নিয়ন্ত্রিত করা তার অন্তর্প্রবণতা। সুতরাং জ্ঞাপনমাধ্যমের মধ্যেও সে খুঁজবে বা গড়ে নিতে চাইবে সুদূরচারীতা-স্থায়ীত্ব এবং সাধারণের ঊর্ধ্বে ভেসে থাকা প্রমিতি-পরিশীলন। তাই লিখনরূপকেন্দ্রীক জ্ঞাপনব্যবস্থা তার সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে আঁট খেয়ে যায়।
অন্যদিকে, লিখনরূপের প্রমিতি ও পরিশীলন প্রবণতা বাস্তবের বৈচিত্র্যময় ভাষা-সংস্কৃতির জগতে আভিজাত্যের ধাপ কাটতে শুরু করে। বিবিধ বাচনিক রূপের আঞ্চলিক ও সামাজিক-স্তর-গত বৈচিত্র্য-পার্থক্য নিয়ে যে কোনো ভাষার উঠোন গড়ে ওঠে। এই উঠোনের সমস্ত পড়শিকে সমমর্যাদায় দেখলে ভাষার কোনো একক প্রমিত-পরিশীলিত রূপ গড়ে উঠতে পারে না। প্রমিত পরিশীলিত রূপ গড়ে ওঠে বিবিধ-বিচিত্র-পার্থক্যময় রূপগুলোকে মূল্যায়নের একটি মাপকাঠি নির্মাণ করা, তার দ্বারা একটি নির্দিষ্ট রূপকে সর্ব-মূল্যবান বলে ঘোষণা করা, এবং অন্য সমস্ত রূপগুলোর খামতি আবিষ্কার করে অবমূল্যায়িত করা---এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। এই প্রক্রিয়াতেই বাংলাভাষার নবদ্বীপীয় সংস্কৃত-ঘনিষ্ঠ রূপটি প্রমিত হয়ে অন্য সমস্ত রূপগুলোকে দোগনো-চাটগেঁয়ে-ইত্যাদি ইতরতায় অবনমিত করেছিল। ভাষার খোলা উঠোনটিকে এভাবে মানমর্যাদার ঊর্ধ্বগামী ধাপে বেঁধে শিখরস্থ রূপটিকে প্রমিত বলে চিহ্নিত করার হাত ধরে লিখনরূপে সামঞ্জস্যবিধানের যুক্তিতে ওই নির্মিত প্রমিত রূপ অনুযায়ী লিখনের শৈলী ও ব্যাকরণ তৈরি করা হয়। তাই বাচনক্ষমতার মতো লিখনক্ষমতা জীবনযাপনের স্বাভাবিকতায় অর্জিত হয় না, তার জন্য নির্দিষ্ট প্রশিক্ষণ প্রয়োজন হয়ে পড়ে। ধাপবন্দি পরিসরে মানে-মর্যাদায় উচ্চবর্গদের দ্বারা গঠিত ও পরিচালিত হয় সেই প্রশিক্ষণকেন্দ্রগুলো, ‘শিক্ষা’ নাম দিয়ে তাকে সামাজিক গুরুত্ব অর্জনের প্রাকশর্ত করে তোলা হয়। অবনমিত ভাষারূপ-আচার-সংস্কৃতির মানুষজন হয় সেই শিক্ষা করায়ত্ত না করতে পেরে গুরুত্বহীন মানুষে অবনমিত হয়, আর নয়ত সেই শিক্ষা করায়ত্ত করার মধ্য দিয়ে নিজ ভাষিক-সাংস্কৃতিক সত্তা হারিয়ে আত্মস্থিতিহীন নকলনবিশে পরিণত হয়। ফলত, প্রমিতি ও পরিশীলন নির্ভর লিখনরূপকেন্দ্রীক জ্ঞাপনব্যবস্থার উপর রাজনৈতিক সক্রিয়তার ক্ষেত্র নির্ভর করলে, এই সংখ্যাধিক অবনমিত মানুষরা হয় রাজনৈতিক ক্রিয়ামঞ্চের বাইরে পড়ে থাকে আর নয়ত মুষ্টিমেয় সংখ্যায় ঊর্ধ্বতনকে নকল করার দীনতার পথ ধরে আত্মবিলোপের দিকে হাঁটে।
গণতন্ত্র নামক শাসনব্যবস্থা যখন জাতিরাষ্ট্রের ছাঁচে বিরাট ভৌগোলিক অঞ্চলকে কেন্দ্রীভূত প্রশাসনিক কাঠামোয় বাঁধতে চায়, সমাজ-প্রশাসনে সর্বজনের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ নয়, বরং বিভিন্ন প্রকার প্রতিনিধিত্বমূলক ব্যবস্থা তৈরি করা হয়, সর্বজনের অংশগ্রহণ ও আন্তর্ক্রিয়ার প্রত্যক্ষ জগতের ঊর্ধ্বে প্রমিত-পরিশীলিত ভাষা-রীতি-আচার-চালিত প্রশাসনমঞ্চ তখনই বাঁধার দরকার হয়। প্রমিতিকৃত ভাষাশৈলী ভিত্তিক লিখনবদ্ধ জ্ঞাপনব্যবস্থা তখন অবনমিত ভাষা-রীতি-আচার সম্পন্ন ব্যাপক সংখ্যাগুরু মানুষদের সমাজ-প্রশাসন-ক্রিয়ায় ‘অযোগ্য’ বলে দেগে রেখে আত্মশক্তির উপর ভরসাহীন করে তোলে। সমস্ত রাজনৈতিক অধিকার কতিপয় শিক্ষিত-প্রশিক্ষিত ‘প্রতিনিধি’-দের হাতে সমর্পণ করে দিয়ে ব্যাপক সংখ্যাগুরু মানুষ দৈনন্দিন রাজনৈতিক জীবনে নিজ অক্ষমতার বোধের ভারে ন্যুব্জ নিষ্ক্রিয় হয়ে ওঠে।
ফরাসী নৃতত্ত্ববিদ ও তাত্ত্বিক ক্লদ লেভি স্ত্রস লিখনবদ্ধ জ্ঞাপন ও রাজনৈতিক ক্রিয়াকাঠামোর মধ্যে এই আন্তর্সম্পর্ক তীক্ষ্ণ সারসংক্ষেপ হাজির করে বলেছিলেন:
দেখা যায় যে কেন্দ্রীভূত ধাপবিন্যস্ত রাষ্ট্রের নিজেকে পুনরুৎপাদিত করার প্রয়োজনে লিখনক্রিয়া দরকার হয়।… লিখনক্রিয়া এক অদ্ভুত বস্তু… ব্যতিক্রমহীনভাবে তার সহগামী রূপে দেখা দিয়েছে শহর ও সাম্রাজ্য নির্মাণের ঘটনা-প্রতীতি: যার মধ্য দিয়ে বড় সংখ্যক ব্যক্তিমানুষদের একক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় বাঁধা হয়েছে… জাত ও শ্রেণির উঁচু-নীচু ধাপকাটা কাঠামোয় বিন্যস্ত করা হয়েছে।… মনে হয় যে এই লিখনক্রিয়া মানবপ্রজাতির অন্তর্দীপ্তিবিকাশ ঘটানোর বদলে শোষণ-নিপীড়ন বিস্তারেই সহায় হয়েছে।
[জেমস সি স্কট-এর ‘Against the Grain: A Deep History of the Earliest States’ (২০১৭, ইয়েল ইউনিভার্সিটি প্রেস) বইয়ের vi পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত, বাংলা তর্জমা বর্তমান লেখকের করা।]
৪
পুঁজিবাদী উৎপাদন প্রক্রিয়ার বিকাশের মধ্য দিয়ে দ্রুত বিপুল পরিমাণ পণ্য উৎপাদন-কৌশলের ক্রমবিকাশ অন্য অনেককিছুর মতো জ্ঞাপনব্যবস্থাতেও গভীর পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। মুদ্রণযন্ত্রের আবির্ভাব ও প্রাদুর্ভাবের হাত ধরে সংবাদপত্র, প্রচারপত্র, বিজ্ঞাপন-এর বিপুল স্ফীতি লিখনরূপভিত্তিক জ্ঞাপনব্যবস্থার আধিপত্যের চরিত্রটিকেই বদলে দিয়েছে। এই চরিত্রবদলের মূল কিছু দিক হল:
৫
বাস্তবতা-নির্ণয় ও স্বশনাক্তিকরণ ক্রিয়ার ব্যক্তিমানুষের নিজ মূর্ত সমাজে প্রত্যক্ষ সক্রিয়তার বিষয় হওয়াকে নাকচ করে বৃহৎ যান্ত্রিক উৎপাদন পরিপোষিত সংবাদ-প্রচার-বিজ্ঞাপনের বিষয় করে তোলার উপরোক্ত প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যা ছিল স্বতোৎসারিত সামাজিক ক্রিয়া, তাকে বৃহৎ উৎপাদন প্রক্রিয়ায় উৎপাদিত বস্তু (সংবাদ-বিজ্ঞাপন) উপভোক্তা হিসেবে ভোগ করায় রূপান্তরিত করা হল। অর্থাৎ, স্বাভাবিক স্বতক্রিয়াকে পণ্যভোগ-ক্রিয়ায় রূপান্তরিত করা হল। পণ্য হিসেবে সংবাদ-বিজ্ঞাপন-এর আকর্ষণী শক্তি বাড়াতে প্রযুক্তি-প্রকৌশলের লাগাতার প্রয়োগ ও নবায়ন ক্রমদ্রুতি পেল। এই প্রক্রিয়াতে লিখনরূপভিত্তিক জ্ঞাপনব্যবস্থার এতাবৎ আলোচিত মূল চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলো বজায় রেখেই তার রূপবৈচিত্র্যে আরো বিপুল পরিবর্তন এল। এই পরিবর্তন মূলত দুটি দিকে ধাবিত হল:
নবরূপসমন্বিত এই জ্ঞাপনব্যবস্থা এখন যন্ত্রধিত লিখন-দৃশ্য-শ্রাব্য মাধ্যম হিসেবে ‘সামাজিক মাধ্যম’ (‘social media’) নামে পরিচিত হয়ে উঠে বিভিন্ন বৈদ্যুতিন সংবহন ধারায় নিরন্তর প্রবাহিত হয়ে চলেছে। সংবাদপত্র, বেতার, দূরদর্শনের চেয়ে বহুগুণ বেশি হারে মোবাইল ফোন হাতে হাতে পৌঁছে যাওয়ায় এই নয়া লিখন-দৃশ্য-শ্রাব্য মাধ্যম আরো অনেক বেশি মানুষের কাছে পৌঁছতে পারে যা পূর্ববর্তী যে কোনো জ্ঞাপনমাধ্যমের ক্ষেত্রে অভাবনীয় ছিল, আর বৈদ্যুতিন গতির সওয়ার বলে মুহূর্তমধ্যে জ্ঞাপন করতে পারে। তাই জনসমষ্টিকে আরো কার্যকরীভাবে জ্ঞাপনব্যবস্থার অঙ্গীভূত করা এবং ব্যক্তিমানুষের দৈনন্দিন জীবনের প্রায় প্রতিটি মুহূর্তে তার মনোযোগ আকর্ষণ করার ব্যবস্থা এর মধ্য দিয়ে হয়েছে। ফলে বাস্তবতা-নির্মাণ ও স্বশনাক্তি-নির্মাণের উপর আরো একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ গেঁড়ে বসেছে, প্রত্যক্ষ সক্রিয়তা-অভিজ্ঞতা-সামাজিকতা-নির্ভর বাস্তববোধের থেকে আরো অমোঘ বিচ্ছিন্নতা রূপ পেয়ে চলেছে। এই মাধ্যমে জ্ঞাপনবস্তু-স্রষ্টা (‘content creator’) হিসেবে নিজেদের হাজির করা মানুষজনেদের কথায় হরবখত ঘুরেফিরে আসে এই ধরনের কথা: ‘পাবলিক এখন কী খাচ্ছে… পাবলিক কী খাবে… পাবলিককে এটা কীভাবে খাওয়ানো যায়…’। অর্থাৎ সাধারণজনেদের একটি গণপিণ্ড হিসেবে ধরে নিয়ে প্রচার-বিজ্ঞাপনের কোন সুতোর টানে তাকে কীভাবে নাচানো যায় এটাই হয়ে ওঠে চিন্তার বিষয়। মতবাদিক রঙ নির্বিশেষে প্রতিটি প্রাতিষ্ঠানিক রাজনৈতিক পার্টির এহেন জ্ঞাপনবস্তু-স্রষ্টা বিষয়ীদের নিয়ে নিজ নিজ ‘আই-টি সেল’ তো আছেই, ব্যক্তিমানুষ হিসেবে এহেন বিষয়ী হয়ে ওঠারাও একইভাবে ভাবেন। প্রতিটি মানুষের ভাবনা-চিন্তা-সক্রিয়তার স্বাতন্ত্র্য-স্বকীয়তা অস্বীকার করে তাঁরা নিরন্তর অন্য সকলকে ‘manipulate’ করতে চান, বিবিধজনের বিবিধকর্মের অনির্দিষ্টতা ও বৈচিত্র্যকে শৃঙ্খলার বাঁধনে ঠেসে একমেটে একশিলা ভবিষ্যনির্মাণের আকাঙ্ক্ষা দ্বারা চালিত হন, এবং এইভাবেই চরম কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রের ক্ষমতারূপগুলোকে পুনরুৎপাদিত করে চলে।
তাছাড়া, এই বৈদ্যুতিন জ্ঞাপনমাধ্যমের প্রযুক্তি-প্রকৌশলগুলোর অন্তরালে প্রযুক্তি-পরিচালকরা যেভাবে গ্রাহকদের অবস্থান ও আচরণ সম্বন্ধে অনবরত উপাত্ত (data) সংগ্রহ করে যাচ্ছে, রাষ্ট্রের কাছে তা বিক্রি করছে রাষ্ট্রীয় নজরদারির জন্য, আর পণ্যমালিকদের কাছে বিক্রি করছে পণ্য-বিজ্ঞাপনী মনস্তাত্ত্বিক টোপ নির্মাণের জন্য, তা-ও রাষ্ট্র ও পণ্যবাজারের হাতে অভূতপূর্ব মাত্রায় ব্যক্তিমানুষদের নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালন করার শক্তি তুলে দিচ্ছে।
কেউ কেউ অবশ্য বলবেন যে ব্যাপারটা এতো একপাক্ষিক নয়, লিখন-দৃশ্য-শ্রাব্য জ্ঞাপনমাধ্যমের অভাবনীয় বিস্তার ও বৈদ্যুতিন গতি কেবল রাষ্ট্রপরিচালক ও পণ্যমালিকদের সুবিধা করে দিচ্ছে না, তা রাষ্ট্র ও পণ্যবাজারের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারীদের সামনেও অভূতপূর্ব সুযোগ খুলে দিয়েছে। সাম্প্রতিক নানা আন্দোলনে (যেমন বাংলাদেশের স্বৈরাচারী হাসিনা-বিরোধী আন্দোলন বা পশ্চিমবঙ্গে জুনিয়র ডাক্তারের খুন ও ধর্ষণের বিচার চেয়ে আন্দোলন) এই জ্ঞাপনমাধ্যম যেভাবে আন্দোলন-সংগঠনে ও রূপায়নে কাজ করেছে তা হয়ত তিনি উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরবেন। তাঁর সঙ্গে একমত হতে পারছি না। আন্দোলন ও বিক্ষোভের ডাক ও বার্তা ছড়িয়ে দিতে এবং আন্দোলনের উত্তাপ নিরন্তর উসকে দিতে, প্রায় প্রতি মুহূর্তে নতুন খবর নতুন ঘটনার উত্তেজনা তৈরি করে রাখতে বৈদ্যুতিন মাধ্যম অভূতপূর্ব নজির সৃষ্টি করে চলেছে, একথা সত্য। কিন্তু একইসাথে বৈদ্যুতিন মাধ্যম পোষিত আন্দোলনে অন্যতর কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্যও ফুটে উঠছে, যেমন:
৬
১৯৭৯ সালে আমেরিকার নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি ইনস্তিটিউটে ‘যা ব্যক্তিগত ও যা রাজনৈতিক’ (‘The Personal and the Political’) শীর্ষক এক আলোচনাসভায় বক্তব্য রাখতে আমন্ত্রিত হয়ে ‘কৃষ্ণাঙ্গ সমকামী নারীবাদী’ হিসেবে নিজ আত্মপরিচয় দেওয়া আউড্রে লর্ড এই প্রত্যয়টিকে তাঁর বক্তব্যের শিরোনাম করেছিলেন: ‘প্রভুদের যন্ত্রপাতি কখনোই প্রভুদের ঘর ভাঙতে পারবে না’ (The Master’s Tools Will Never Dismantle the Master’s House’)। আউড্রে লর্ডের এই কথাগুলো পুনরাবৃত্ত করেই আপাতত এই আলোচনায় ইতি টানতে চাই। প্রভুদের রাজনীতির যন্ত্রপাতি হল গণজ্ঞাপনব্যবস্থা, সেগুলোই হাতে তুলে নিয়ে নিজেরা ব্যবহার করে আত্মবিচ্ছিন্ন বাস্তবতা-বিচ্ছিন্ন বন্ধ্যা অস্তিত্ব থেকে বেরিয়ে আসা যাবে না। তার জন্য নিজেদের যন্ত্রপাতি নিজেদেরই গড়ে তুলতে হবে। বৈদ্যুতিন গতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নিত্যনতুন জমক-চমকের সমারোহ নয়, গড়ে তুলতে হবে প্রত্যক্ষ সংস্পর্শ-সংযোগ-স্বতক্রিয়ার এমন পরিসর যেখানে প্রতিটি গোষ্ঠীর, প্রতিটি ব্যক্তিমানুষের স্বাতন্ত্র্য বহুত্ব ও পার্থক্যকে প্রকাশ ও বিকাশের জায়গা করে দেওয়া যাবে, একমেটে একশিলা গঠনের তাগিদে সমরূপতা আরোপের চেষ্টা থাকবে না। বিরাট অঞ্চল জুড়ে কেন্দ্রীভূত প্রশাসন বা ছদ্মবাস্তবতা নির্মাণকারী অতি তৎপর গণজ্ঞাপনমাধ্যম কিছুই সেখানে খাপ খায় না। প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ও সংস্পর্শ দিয়ে সামাজিকতা ও প্রশাসন চালানো যায় এমন ছোট ছোট বলয়ে স্বশাসনের আসন পাতা এবং সেই অনুযায়ী অন্তর্বলয় ও আন্তর্বলয় জ্ঞাপনব্যবস্থা সৃষ্টি করাই এর সঙ্গে খাপ খায়। জাপাতিস্তাদের মতো কেউ কেউ হয়ত এহেন পুনর্গঠনের চেষ্টা করছে। আমাদেরও নিজেদের মতো করে নিজেদের সেই চেষ্টা করতে হবে।