রাজনীতি ও জ্ঞাপনব্যবস্থা

লিখেছেন:বিপ্লব নায়ক
রাজনীতি ও জ্ঞাপনব্যবস্থার পারস্পরিক সম্পর্ক-অভিঘাত-টানাপোড়েন নিয়ে এই আলোচনা... প্রভুদের রাজনীতির যন্ত্রপাতি হল গণজ্ঞাপনব্যবস্থা, সেগুলোই হাতে তুলে নিয়ে নিজেরা ব্যবহার করে নিজেদের আত্মবিচ্ছিন্ন বাস্তবতা-বিচ্ছিন্ন বন্ধ্যা অস্তিত্ব থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব নয়...

রাজনীতি ও জ্ঞাপনব্যবস্থার পারস্পরিক সম্পর্ক-অভিঘাত-টানাপোড়েন নিয়ে কিছু বিচার-বিবেচনা এই লেখার অভিপ্রায়।

রাজনীতি বললে সরকার-রাষ্ট্র-পার্টি এবং সেই সংক্রান্ত সমর্থন-বিরোধিতা-প্রভাববিস্তারের কথাই প্রথমে মনে হয়। অর্থাৎ, কিছু প্রতিষ্ঠিত প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠান এবং তাদের ঘিরে থাকা ক্ষমতার গ্রন্থিগুলোকে ব্যক্তি/গোষ্ঠী/শ্রেণি-স্বার্থ অনুযায়ী বিন্যস্ত-পুনর্বিন্যস্ত করার ক্রিয়াই রাজনীতি বলে সাধারণভাবে চালু আছে। প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঘিরে থাকা এই ক্ষমতা-গ্রন্থিগুলো থেকে কিছুটা দূরে, বা কিছুটা আড়ালে, আমাদের দৈনন্দিন ব্যক্তিগত ও বারোয়ারী জীবনযাপনেও প্রভাব বিস্তার ও প্রতিরোধ করার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ঘিরে নানা ক্ষমতাগ্রন্থি বিন্যস্ত-পুনর্বিন্যস্ত হতে থাকে, জাত-জাতি-বর্ণ-লিঙ্গ-ভাষা-আচার সংক্রান্ত ক্ষমতার চাপান-উতোর চলতে থাকে--- তা সমাজজোড়া ক্ষমতাবিন্যাসে ওই প্রথমোক্ত গ্রন্থিগুলোর থেকে বিচ্ছিন্ন নয়, বরং নিবিড় আন্তর্সম্পর্কে স্থিত। এই গোটা ক্ষেত্রটাকেই আমরা রাজনীতির ক্ষেত্র বলে ধরে নিয়ে এই ক্ষেত্রে মানুষের যে কোনো সক্রিয়তাকে রাজনৈতিক সক্রিয়তা বলে গণ্য করব।

জ্ঞাপনব্যবস্থা বলতে সেই ব্যবস্থার কথা বলা হচ্ছে যার দ্বারা বা যার মাধ্যমে মানুষেরা তথ্য-ধারণা-দাবি-আদেশ-নির্দেশ-প্রার্থনা-প্ররোচনা প্রেরণ-সংবহন করে থাকে। সমসাময়িক সমাজে জ্ঞাপনব্যবস্থার বিবিধ রূপ--- যেমন মৌখিক-আচরণিক রূপ, লিখনবদ্ধ রূপ, বৈদ্যুতিন (electronic) মাধ্যম ভিত্তিক রূপ--- দেখতে পাই। আবার ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখব যে এই রূপগুলোর বয়স নানারকম। মৌখিক-আচরণিক রূপ (যেখানে মুখের শব্দ/কথা এবং বিশেষ আচরণ জ্ঞাপনের কাজ করে) সবচেয়ে পুরোনো এবং ব্যাপক। লিখনবদ্ধ রূপ তার চেয়ে নবীন, প্রথমে দীর্ঘদিন ধরে তার প্রসার অতি সীমিত থাকলেও মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কারের পর তা অতি চমকপ্রদভাবে বিপুল হারে বৃদ্ধি পায় শিল্পায়নের মধ্যে দিয়ে যাওয়া সমাজগুলোয়। সবচেয়ে অর্বাচীন হল বৈদ্যুতিন মাধ্যম ভিত্তিক রূপ, যা বিশ শতকের শেষার্ধে ঘটা বৈদ্যুতিন বিপ্লবের হাত ধরে আরো চমকপ্রদ বিস্তারলাভের মধ্য দিয়ে ‘সোশাল মিডিয়া’-র পর্দায় জগতের মুখ ঢেকে ফেলছে।

আমরা রাজনীতি ও জ্ঞাপনব্যবস্থার মধ্যে সম্পর্কগুলোর বিচার রাজনৈতিক সক্রিয়তা ও জ্ঞাপন, এই দুই ক্রিয়ার পারস্পরিক ছেদ ও ভাঁজগুলোয় দৃষ্টি ফেলার মধ্য দিয়ে করতে চাইব।

ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীন নথি হল বৈদিক সাহিত্য। খৃস্টপূর্ব ১২০০ অব্দ থেকে খৃস্টপূর্ব ১০০০ অব্দের মধ্যে ঋগ্বেদ সংহিতা সংকলন করা হয়েছিল বলে অনুমান করা হয়। সামূহিক ব্যপারে সিদ্ধান্তগ্রহণের জন্য, সামূহিক কাজকর্ম পরিচালনার জন্য সেই সময় ‘সভা’ ও ‘সমিতি’ নামক দুটি প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার উল্লেখ বেদ-এ লক্ষ্য করা যায়।

বেদ-এ সভা বলতে একটি সমাবেশ বা সমাবেশ-গৃহ বুঝিয়েছে যেখানে জনগোষ্ঠীর প্রধান ব্যক্তিরা সমবেত হয়ে তঁাদের কাজকর্ম নিয়ে আলোচনা করতেন (ঋগ্বেদ, ৬.২৮.৬, ৮.৪.৯, ১০.৩৪.৬, অথর্ববেদ, ৫.৩১.৬, ৭.১২.১, ৭.১২.২, ৮.১০.৫, ১২.১.৫৬, ১৯.৫৫.৬)। সভায় আলোচনার ক্ষেত্রে যাঁরা প্রধান ভূমিকা নিতেন, তঁাদের বলা হতো সভাসহ (ঋগ্বেদ ১০.৭১.১০)। সভায় মত-উপস্থাপনার ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট মান বজায় রাখার দিকে নজর দেওয়া হতো, বিশিষ্ট সদস্যদের ‘সভেয়’ (সভার যোগ্য), ‘রয়িঃ সভাবান্’ (সভার সম্পদ) আখ্যা দেওয়া হতো (ঋগ্বেদ, ২.১৪.১৩, ৪.২.৫)। এছাড়াও সভার সদস্যদের বোঝানোর জন্য ‘সভাচর’ ও ‘সভাসদ’ শব্দদুটির ব্যবহার আছে। ঋগ্বেদে (১.১৬৭.৩) ‘সভাবতী’ শব্দটি পাওয়া যায়, যা সম্ভবত নারী সদস্যদের বোঝাতে ব্যবহৃত হতো, সেখানে বলা হয়েছে যে সভাস্থিতা নারী সভার উপযোগী বাক্য প্রয়োগ করে। ঋত বা নিয়মরক্ষাকারী নারীর তিনবার সভায় আগমনের কথা ঋগ্বেদে (৩.৫৬.৫) বলা হয়েছে।

‘বিদথ’ শব্দটির ব্যবহার ঋগ্বেদে পাওয়া যায় প্রাচীনতর গণপ্রতিষ্ঠান হিসাবে। এটি ছিল নীতিনির্ধারক প্রতিষ্ঠান যা জনজীবনের সাধারণ বিষয়াবলী (ঋগ্বেদ, ২.১.৪, ২.১৭.২২, ৩.৩৮.৫৬, ৫.৬৩.২, ৭.৬৬.১০, ৮.৩৯.১, ১০.১২.৭, অথর্ববেদ, ১৭.১.১৫) ছাড়াও ধর্মীয় (ঋগ্বেদ, ১.৬০.১, ২.৪.৮, ২.৩৯.১, ৩.১.১, ৩.৫৬.৮) ও যুদ্ধসংক্রান্ত (ঋগ্বেদ, ১.১৬৬.৬, ৫.৫৯.২) বিষয় নিয়ে আলোচনা করত। রাজাকে বলা হয়েছে ‘বিদথ্য’, যা থেকে অনুমান করা যায় যে রাজাকে বিদথের অধীনে, বিদথের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে কাজ করতে হতো। বিদথে যে নারীরাও উপস্থিত থাকতেন, তার প্রমাণ আছে অথর্ববেদ (৭.৩৮.৪)-এ ও মৈত্রায়ণী সংহিতা (৪.৭.৪)-য়।

সভার মতো সমিতিও সর্বসাধারণের সমাবেশস্থল ছিল এবং বহু ক্ষেত্রে সভা ও সমিতি একসঙ্গে উচ্চারিত হয়েছে (অথর্ববেদ, ৭.১২.১, ১২.১.৫৬, ১৫.৯.২, ১৫.৯.৩)। বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বিষয়, যেমন যুদ্ধের মতো বিষয়, আলোচনার জন্য সভার চেয়ে সমিতি অধিকতর দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিল (ঋগ্বেদ, ১.৯৫.৮, ৯.৯২.৬, ১০.১৭.৬, ১০.১৬৬.৪, অথর্ববেদ, ৫.২৯.১৫, ৬.৮৮.৩, ৭.১২.১, ১২.১.৫৬)।

ঋগ্বেদের একটি বিখ্যাত মন্ত্রে পাওয়া যায়— ‘সমানো মন্ত্রঃ সমিতিঃ সমানী/ সমানং মনঃ সংচিত্তসেষাম্’। এর অর্থ এই যে, সমিতিতে সমস্ত মানুষ তাদের মন্ত্রণাকে মিলিয়ে দিতে চায়, সেখানে মানুষ তাদের আলাপ-আলোচনাকে একসুরে বাঁধতে চায় এবং একাগ্রচিত্ত হওয়ার জন্য প্রার্থনা করে। সমিতির আলোচনায় অংশ নেওয়ার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে হতো। সকলে যেখানে তর্ক-যুক্তি দিয়ে মতপ্রকাশ করছে, সেখানে নিজের তর্ক-যুক্তি অপরের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য মানুষের যে চেষ্টা ও আকুতি ছিল, তা বোঝা যায় এই শ্লোক থেকে— ‘যে সংগ্রামা সমিতয়স্তেষু চারু বদেম তে'। রাজার সঙ্গে সমিতির সদস্যদের যাতে মতের মিল হয় এবং সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায়, সেজন্য বিশেষ চেষ্টা চলত (ঋগ্বেদ, ১০.১৬৬.৪, অথর্ববেদ, ৬.৮৬.৯)।

রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে ছিল গণরাজ্যের চল। বজ্জীদের গণরাজ্য যার উদাহরণ। রাজতন্ত্রে যেখানে রাজা সার্বভৌম, গণরাজ্যে তেমনই গণ বা সমূহ সার্বভৌম। গণরাজ্যে তো বটেই, প্রথম দিকের রাজতন্ত্রেও (অর্থাৎ ক্ষমতা যখন রাজা ও তাঁর কতিপয় সহায়কের হাতে দৃঢ়-কেন্দ্রীভূত হয়ে যায়নি) সভা-বিদথ-সমিতি-ই রাজনৈতিক ক্রিয়ার মূল মঞ্চ হিসেবে নির্ধারক ভূমিকা পালন করত।

বৈদিক সাহিত্য থেকে পাওয়া এই ছবি থেকে বোঝা যায় যে রাজনৈতিক ক্রিয়ার উপযোগী জ্ঞাপনব্যবস্থা হিসেবে সেই সময়ে মৌখিক-আচরণিক রূপই একচেটিয়া ছিল। অর্থাৎ, সম্মিলিতজনেরা যখন রাজনৈতিক-সামাজিক ঘটনা-প্রতীতি নিয়ে একে অপরের সামনে তথ্য-ধারণা-দাবি-প্রার্থনা-প্ররোচনা উপস্থাপনা করতেন, যুক্তির পিঠে প্রতিযুক্তি বসাতেন, তখন তাৎক্ষণিক ভাষণই ছিল সম্বল। সেইজন্য রীতিমতো প্রস্তুতি ও চর্চারও চল ছিল এবং সামর্থ্যভেদেরও স্বীকৃতি ছিল। লিখনবদ্ধ রূপের হয় তখনও জন্ম হয়নি, নয়তো অতি শৈশবকাল।

রাজনৈতিক সক্রিয়তা ও জ্ঞাপনব্যবস্থার পারস্পরিকতার এই উদাহরণটি সম্পর্কে আরো কয়েকটি বিষয় খেয়াল করা যেতে পারে:

  • সভা-সমিতি-বিদথ-কেন্ত্রীক প্রশাসনিক ব্যবস্থা সমস্ত ব্যক্তি বা গরিষ্ঠ সংখ্যক ব্যক্তির উপস্থিতি বা সমস্ত প্রেরিত প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে হওয়া আলাপ-আলোচনা-বোঝাপড়ার উপর নির্ভরশীল, তাই তা ভৌগোলিক আকারে বিরাট কোনো অঞ্চলের জন্য প্রযোজ্য হতে পারে না। ভৌগোলিক আকার যে মাত্রায় সীমিত হলে অঞ্চলের সবাই বা তাদের প্রেরিত প্রতিনিধিরা প্রয়োজনে যখন-তখন সম্মিলিত হতে পারে, সেই সীমার দ্বারা প্রশাসনিক এলাকা সীমিত হতে বাধ্য। ফলে এই ব্যবস্থায় বিভিন্ন সীমিত আকারের অঞ্চলের নিজ নিজ স্বশাসন পরিচালনা করাই স্বাভাবিক।
  • প্রশাসনিক অঞ্চল আকারে সীমিত হওয়ায় এবং সমাজ-যৌথের সঙ্গে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান অঙ্গাঙ্গী যুক্ত হওয়ায় কোনো সভা-সমিতি-বিদথ-এ অংশ নেওয়া ব্যক্তিবর্গের মধ্যে সামাজিক পরিচিতি ও সম্পর্কবন্ধন সাধারণভাবে নিবিড় হওয়ার কথা। ফলে বক্তাদের বক্তব্য বিচার করা, অর্থাৎ, বক্তব্যে সত্য-মিথ্যা-অতিরেক যাচাই করা শ্রোতাদের নিজ অভিজ্ঞতার নিরিখেই অনেকটা দূর অবধি করা সম্ভব। অর্থাৎ, বাস্তবতা-নির্মাণ মূলত প্রত্যক্ষ সামাজিক অভিজ্ঞতার উপরই নির্ভরশীল ছিল।
  • জাত-জাতি-ভাষা-লিঙ্গ সাপেক্ষে যে বৈচিত্র্য সমাজে বিদ্যমান, সেই অনুযায়ী বোধ ও প্রতীতির বিভিন্নতা উপস্থাপিত হওয়া ও পরস্পরের সঙ্গে বোঝাপড়ায় আসার অবকাশ এই প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণমূলক ব্যবস্থায় অনেক বেশি।

রাজতন্ত্র যখন দৃঢ়-কেন্দ্রীভূত হয়ে বিস্তীর্ণ ভৌগোলিক অঞ্চলকে একচ্ছত্র শাসনের অধীনে বাঁধছে, সেই রাজনীতির কাম্য জ্ঞাপনব্যবস্থায় লিখনবদ্ধ রূপ কীভাবে গুরুত্ব পাচ্ছে তার উদাহরণ আমরা কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র’-এ পাই।

কৌটিল্য (৩৭৫-২৮৩ খৃস্টপূর্ব) চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের বিশাল মৌর্য সাম্রাজ্যের নীতি-নির্ধারক কর্ণধার হিসেবে খ্যাত। তাঁর লেখা ‘অর্থশাস্ত্র’-এর দ্বিতীয় খণ্ডে রাজাধ্যক্ষদের কাজ সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে রাজলিখন বা রাজ-আদেশ তৈরির পদ্ধতি নিয়ে তিনি একটি পৃথক অধ্যায় লিখেছিলেন। সেখানে তিনি বলেছেন যে রাজ্য শাসনের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল রাজলিখন তৈরি করা, যা করার জন্য যোগ্য লোককে লেখক হিসেবে নিয়োগ করতে হবে। কেমন হবে সেই লেখকের যোগ্যতা?--- তার মন্ত্রীর সমান সক্ষমতা থাকতে হবে, সমস্ত বিবিধ ধরনের রীতি-আচার সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হতে হবে, লেখাজোখায় দড় হতে হবে, হাতের লেখা সুস্পষ্ট হতে হবে এবং লিখন পাঠোদ্ধারে চতুর হতে হবে। সেই লেখক রাজার আদেশ শুনে সে সংক্রান্ত সমস্ত বিষয় নিয়ে ভালোভাবে চিন্তা-ভাবনা করার পর আদেশটির লিখিত রূপ তৈরি করবে এবং সেই লিখিত রূপটি প্রচারিত হবে। রাজ-আদেশ-এর এই পরিশীলিত রূপ নির্মাণের নির্দেশিকা হিসেবে কৌটিল্য প্রস্তাব করেছেন:

  • লিখনে ব্যবহৃত শব্দাবলী সাধারণ লোকের মুখে বহু-প্রচলিত শব্দ হবে না, কিন্তু তাদের অর্থ পরিচিত হতে হবে--- এর মধ্য দিয়ে লিখনটি সম্ভ্রম জাগাতে পারবে,
  • ব্যাকরণের প্রমিত রীতি মেনে পরিশীলিত চেহারার হবে,
  • যুক্তি ও উপস্থাপনায় অসঙ্গতিমুক্ত হবে,
  • নিন্দা, দোষী সাব্যস্তকরণ, তদন্ত, বিবৃতি দাবি, অস্বীকার, ভর্ৎসনা, নিষেধাজ্ঞা আরোপ, নির্দেশদান, সমঝোতায় আসা, সাহায্যের প্রতিশ্রুতি, হুমকি দেওয়া, বুঝিয়ে পথে আনা--- এগুলোর এক বা একাধিকই হল রাজলিখনের উদ্দেশ্য--- লেখককে এই উদ্দেশ্য অনুযায়ী উদ্দিষ্টের অবস্থা ও চরিত্র মাথায় রেখে ফলপ্রসূ শৈলী অবলম্বন করতে হবে,
  • দর-কষাকষি, ঘুষ দিয়ে কেনা, অনৈক্য ঘটিয়ে কাজ হাসিল করা, খোলাখুলি আক্রমণ করা--- এগুলো হল কার্যসিদ্ধির ‘উপায়’--- কোন উপায় অবলম্বন করা হচ্ছে সে সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা নিয়ে লিখনরূপ তৈরি করতে হবে।

এই নির্দেশিকার পাশাপাশি খেয়াল রাখা দরকার যে অর্থশাস্ত্র-এর বিভিন্ন অংশে কৌটিল্য আলোচনা করেছেন কীভাবে প্রজাদের উপর নজরদারি ব্যবস্থা কায়েম রাখা যায়, কেউ সন্দেহ করতে পারবে না এমন ভেক ধরিয়ে চরেদের ছড়িয়ে রেখে সাধারণজনেদের মতামত-মনোভাব-ক্ষোভ-বিরোধিতা সম্বন্ধে খবর রাখা যায়, রাজস্বার্থে প্রজাদের মধ্যে প্রচার-পরিক্রমা (আধুনিক ভাষায় ‘propaganda’) বহাল রাখা যায় এবং পরিবার থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় স্তর অবধি আইন-শৃঙ্খলার বাঁধনে বাঁধা যায়।

সুতরাং, কৌটিল্যের উপস্থাপনায় লিখনরূপ-ভিত্তিক জ্ঞাপনব্যবস্থা কেন্দ্রীভূত চরিত্রের এমন এক শৃঙ্খলাদায়ক ক্ষমতার কাঠামোর মধ্যে কাজ করছে যেখানে শীর্ষে বসা শাসককুল নিম্নস্থ প্রজাকুলের উপর নজরদারি-শৃঙ্খলারোপ-দমন চালানোর রাজনৈতিক কর্মটি করে চলেছে। জ্ঞাপনের লিখনরূপে তাই সাধারণের মুখের ভাষাকে অবমূল্যায়িত করে রাজনৈতিক কার্যে অনুপযুক্ত ঘোষণা করা হচ্ছে এবং অভিজাত পরিশীলিত ভাষা ও শৈলী গঠন করা হচ্ছে। জ্ঞাপন কাজের পরিসরে এখানে জোর কেবল একটি অভিমুখেই--- সে অভিমুখ হল রাজপুরুষদের দ্বারা প্রজাদের উদ্দেশ্যে জ্ঞাপন এবং রাজস্বার্থ ও রাজসিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রজাদের মধ্য থেকে কোনো বিক্ষোভ-বিরোধিতাকে দানা না বাঁধতে দেওয়া। ফলে বিবিধ অবস্থানে থাকা প্রজাদের মনের কথা আন্দাজ করতে চর ছড়ানো হচ্ছে, সে মোতাবেক রাজকৌশল নির্ধারিত হচ্ছে, কিন্তু কোনো মুক্ত রাজনৈতিক পরিসরে সেই মনের কথা প্রকাশিত হওয়ার জায়গা দেওয়া হচ্ছে না।

লিখনবদ্ধ রূপ কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা জ্ঞাপনব্যবস্থা এবং রাজনৈতিক চর্চার পরিসরে সংখ্যাগরিষ্ঠের সক্রিয়তা-হানি: এই সমাপতন কি কেবল বিকশিত রাজতন্ত্রের মতো হিতাকাঙ্ক্ষী/অত্যাচারী স্বৈরতন্ত্রেরই বিষয়? গণতন্ত্রে কী তা ঘটে না? উত্তরের দিকে যাওয়ার জন্য লিখনরূপকেন্দ্রীক জ্ঞাপনব্যবস্থার নিজ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বিচার করা যাক।

জ্ঞাপনমাধ্যম হিসেবে লিখনরূপের আকর্ষণ এইখানে যে প্রথমত তা বাচনরূপের তুলনায় জ্ঞাপনকে বহুগুণ দীর্ঘস্থায়ী ও সুদূরচারী করতে পারে এবং দ্বিতীয়ত, তাৎক্ষণিকতা (যা স্বতঃস্ফূর্ত বাচনের আবশ্যিক চরিত্র)-র পরিবর্তে সাজানো-গোছানো সব-দিক-এঁটে-তৈরি-করা প্রমিত পরিশীলিত এক নির্মাণ হাজির করে। সর্বজনের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের উপর দাঁড়ানো ছোট ছোট অঞ্চলের স্বাধীন স্বায়ত্তশাসনের বদলে বিপুল ভৌগোলিক অঞ্চলকে কেন্দ্রীভূত শাসনের কাঠামোয় বাঁধতে গেলে শাসিতের উদ্দেশ্যে শাসকের জ্ঞাপন নির্দিষ্ট কিছু আচরণ-রীতি-শৃঙ্খলা-আইন-কে আদর্শ বা ন্যায়ানুগ বলে প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এই জ্ঞাপন স্বতঃস্ফূর্ততার উপর নির্ভরশীল নয়, বরং স্বতঃস্ফূর্ততাকে শাসন-কর্তন করে পরিমিত প্রমিতির সর্বজনীন আরাধ্যরূপ নির্মাণ তার অভিপ্রায়। সদাপরিবর্তনশীলতার কাছে উন্মুক্ত থাকা তার চরিত্র নয়, বরং স্থায়ীত্বকে মোক্ষজ্ঞান করে পরিবর্তন রুদ্ধ বা নিয়ন্ত্রিত করা তার অন্তর্প্রবণতা। সুতরাং জ্ঞাপনমাধ্যমের মধ্যেও সে খুঁজবে বা গড়ে নিতে চাইবে সুদূরচারীতা-স্থায়ীত্ব এবং সাধারণের ঊর্ধ্বে ভেসে থাকা প্রমিতি-পরিশীলন। তাই লিখনরূপকেন্দ্রীক জ্ঞাপনব্যবস্থা তার সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে আঁট খেয়ে যায়।

অন্যদিকে, লিখনরূপের প্রমিতি ও পরিশীলন প্রবণতা বাস্তবের বৈচিত্র্যময় ভাষা-সংস্কৃতির জগতে আভিজাত্যের ধাপ কাটতে শুরু করে। বিবিধ বাচনিক রূপের আঞ্চলিক ও সামাজিক-স্তর-গত বৈচিত্র্য-পার্থক্য নিয়ে যে কোনো ভাষার উঠোন গড়ে ওঠে। এই উঠোনের সমস্ত পড়শিকে সমমর্যাদায় দেখলে ভাষার কোনো একক প্রমিত-পরিশীলিত রূপ গড়ে উঠতে পারে না। প্রমিত পরিশীলিত রূপ গড়ে ওঠে বিবিধ-বিচিত্র-পার্থক্যময় রূপগুলোকে মূল্যায়নের একটি মাপকাঠি নির্মাণ করা, তার দ্বারা একটি নির্দিষ্ট রূপকে সর্ব-মূল্যবান বলে ঘোষণা করা, এবং অন্য সমস্ত রূপগুলোর খামতি আবিষ্কার করে অবমূল্যায়িত করা---এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। এই প্রক্রিয়াতেই বাংলাভাষার নবদ্বীপীয় সংস্কৃত-ঘনিষ্ঠ রূপটি প্রমিত হয়ে অন্য সমস্ত রূপগুলোকে দোগনো-চাটগেঁয়ে-ইত্যাদি ইতরতায় অবনমিত করেছিল। ভাষার খোলা উঠোনটিকে এভাবে মানমর্যাদার ঊর্ধ্বগামী ধাপে বেঁধে শিখরস্থ রূপটিকে প্রমিত বলে চিহ্নিত করার হাত ধরে লিখনরূপে সামঞ্জস্যবিধানের যুক্তিতে ওই নির্মিত প্রমিত রূপ অনুযায়ী লিখনের শৈলী ও ব্যাকরণ তৈরি করা হয়। তাই বাচনক্ষমতার মতো লিখনক্ষমতা জীবনযাপনের স্বাভাবিকতায় অর্জিত হয় না, তার জন্য নির্দিষ্ট প্রশিক্ষণ প্রয়োজন হয়ে পড়ে। ধাপবন্দি পরিসরে মানে-মর্যাদায় উচ্চবর্গদের দ্বারা গঠিত ও পরিচালিত হয় সেই প্রশিক্ষণকেন্দ্রগুলো, ‘শিক্ষা’ নাম দিয়ে তাকে সামাজিক গুরুত্ব অর্জনের প্রাকশর্ত করে তোলা হয়। অবনমিত ভাষারূপ-আচার-সংস্কৃতির মানুষজন হয় সেই শিক্ষা করায়ত্ত না করতে পেরে গুরুত্বহীন মানুষে অবনমিত হয়, আর নয়ত সেই শিক্ষা করায়ত্ত করার মধ্য দিয়ে নিজ ভাষিক-সাংস্কৃতিক সত্তা হারিয়ে আত্মস্থিতিহীন নকলনবিশে পরিণত হয়। ফলত, প্রমিতি ও পরিশীলন নির্ভর লিখনরূপকেন্দ্রীক জ্ঞাপনব্যবস্থার উপর রাজনৈতিক সক্রিয়তার ক্ষেত্র নির্ভর করলে, এই সংখ্যাধিক অবনমিত মানুষরা হয় রাজনৈতিক ক্রিয়ামঞ্চের বাইরে পড়ে থাকে আর নয়ত মুষ্টিমেয় সংখ্যায় ঊর্ধ্বতনকে নকল করার দীনতার পথ ধরে আত্মবিলোপের দিকে হাঁটে।

গণতন্ত্র নামক শাসনব্যবস্থা যখন জাতিরাষ্ট্রের ছাঁচে বিরাট ভৌগোলিক অঞ্চলকে কেন্দ্রীভূত প্রশাসনিক কাঠামোয় বাঁধতে চায়, সমাজ-প্রশাসনে সর্বজনের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ নয়, বরং বিভিন্ন প্রকার প্রতিনিধিত্বমূলক ব্যবস্থা তৈরি করা হয়, সর্বজনের অংশগ্রহণ ও আন্তর্ক্রিয়ার প্রত্যক্ষ জগতের ঊর্ধ্বে প্রমিত-পরিশীলিত ভাষা-রীতি-আচার-চালিত প্রশাসনমঞ্চ তখনই বাঁধার দরকার হয়। প্রমিতিকৃত ভাষাশৈলী ভিত্তিক লিখনবদ্ধ জ্ঞাপনব্যবস্থা তখন অবনমিত ভাষা-রীতি-আচার সম্পন্ন ব্যাপক সংখ্যাগুরু মানুষদের সমাজ-প্রশাসন-ক্রিয়ায় ‘অযোগ্য’ বলে দেগে রেখে আত্মশক্তির উপর ভরসাহীন করে তোলে। সমস্ত রাজনৈতিক অধিকার কতিপয় শিক্ষিত-প্রশিক্ষিত ‘প্রতিনিধি’-দের হাতে সমর্পণ করে দিয়ে ব্যাপক সংখ্যাগুরু মানুষ দৈনন্দিন রাজনৈতিক জীবনে নিজ অক্ষমতার বোধের ভারে ন্যুব্জ নিষ্ক্রিয় হয়ে ওঠে।

ফরাসী নৃতত্ত্ববিদ ও তাত্ত্বিক ক্লদ লেভি স্ত্রস লিখনবদ্ধ জ্ঞাপন ও রাজনৈতিক ক্রিয়াকাঠামোর মধ্যে এই আন্তর্সম্পর্ক তীক্ষ্ণ সারসংক্ষেপ হাজির করে বলেছিলেন:

দেখা যায় যে কেন্দ্রীভূত ধাপবিন্যস্ত রাষ্ট্রের নিজেকে পুনরুৎপাদিত করার প্রয়োজনে লিখনক্রিয়া দরকার হয়।… লিখনক্রিয়া এক অদ্ভুত বস্তু… ব্যতিক্রমহীনভাবে তার সহগামী রূপে দেখা দিয়েছে শহর ও সাম্রাজ্য নির্মাণের ঘটনা-প্রতীতি: যার মধ্য দিয়ে বড় সংখ্যক ব্যক্তিমানুষদের একক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় বাঁধা হয়েছে… জাত ও শ্রেণির উঁচু-নীচু ধাপকাটা কাঠামোয় বিন্যস্ত করা হয়েছে।… মনে হয় যে এই লিখনক্রিয়া মানবপ্রজাতির অন্তর্দীপ্তিবিকাশ ঘটানোর বদলে শোষণ-নিপীড়ন বিস্তারেই সহায় হয়েছে।

[জেমস সি স্কট-এর ‘Against the Grain: A Deep History of the Earliest States’ (২০১৭, ইয়েল ইউনিভার্সিটি প্রেস) বইয়ের vi পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত, বাংলা তর্জমা বর্তমান লেখকের করা।]

 

পুঁজিবাদী উৎপাদন প্রক্রিয়ার বিকাশের মধ্য দিয়ে দ্রুত বিপুল পরিমাণ পণ্য উৎপাদন-কৌশলের ক্রমবিকাশ অন্য অনেককিছুর মতো জ্ঞাপনব্যবস্থাতেও গভীর পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। মুদ্রণযন্ত্রের আবির্ভাব ও প্রাদুর্ভাবের হাত ধরে সংবাদপত্র, প্রচারপত্র, বিজ্ঞাপন-এর বিপুল স্ফীতি লিখনরূপভিত্তিক জ্ঞাপনব্যবস্থার আধিপত্যের চরিত্রটিকেই বদলে দিয়েছে। এই চরিত্রবদলের মূল কিছু দিক হল:

  • ব্যক্তিমানুষের বহির্জগতকে জানার উপায়, বহির্জগতের সঙ্গে যোগাযোগের উপায় হিসেবে প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে আসা বা নিজ অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করার রীতি ক্রমশ সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদ পড়ে জানা ও যোগাযোগ স্থাপনের রীতি দিয়ে প্রতিস্থাপিত হতে লাগল। সংবাদপত্রের হাজির করা জগৎ লেখক-সম্পাদক-রূপী প্রমিত ভাষা ও জ্ঞানের প্রাধিকারীদের স্বজ্ঞা ও অভিপ্রায় অনুযায়ী বাছাই-প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তৈরি। সেই বাছাই-প্রক্রিয়ায় তৈরি জগৎ বাস্তবের প্রতিমা হিসেবে একপেশে ও ভ্রমাত্মক হওয়াই স্বাভাবিক, তা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে হোক বা না হোক। কিন্তু যে গ্রহীতা ক্রমশ সংবাদপত্রের মধ্য দিয়েই জগৎ দেখায় সীমাবদ্ধ হয়ে প্রত্যক্ষ সংযোগ-সংস্পর্শ-অভিজ্ঞতালাভ-এর অবকাশ খুইয়ে বসেছে, তার পক্ষে এই ভ্রম বা একপেশেমি বুঝে নেওয়া অসম্ভব। তার উপর অনেক ক্ষেত্রেই স্থান-কাল-গত সীমার কারণে সংবাদপত্রে হাজির করা প্রতিবেদনের পিছনে থাকা ঘটনা-প্রতীতির সঙ্গে গ্রহীতার প্রত্যক্ষ সংযোগ-সংস্পর্শ-অভিজ্ঞতা হওয়া অসম্ভব। ফলে গ্রহীতার কাছে সংবাদপত্র এমন এক বাস্তব জগৎ উপস্থাপন করতে করতে যায় যার বাস্তবতা যাচাই করা কখনোই গ্রহীতার পক্ষে পুরোপুরি সম্ভব নয়। সংবাদপত্রের অন্যতম মূল আকর্ষণ এই যে তা গ্রহীতার প্রত্যক্ষ যোগাযোগের বৃত্তের বাইরের এক বিরাট ঘটনা-প্রতীতি-অঞ্চলকে তার জানা-বোঝা-র বিষয় করে তোলে, কিন্তু এই মূল আকর্ষণটিই সেই প্রধান সমস্যা যা এই জানা-বোঝা-কে প্রত্যক্ষ সংস্পর্শ ও অভিজ্ঞতা দিয়ে যাচাই-পরীক্ষা-র নাগালের বাইরে নিয়ে চলে যায়। ক্রমশ ব্যক্তিমানুষের প্রত্যক্ষ যাপন-অভিজ্ঞতার যাচাই-নাগালের বাইরে নিয়ে যাওয়া এই বাস্তবতা-উৎপাদন প্রক্রিয়া জ্ঞাপনব্যবস্থার কেন্দ্রীয় বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়।
  • বিরাট ভৌগোলিক অঞ্চল জুড়ে  কোনো এক প্রতিষ্ঠিত জাতিরাষ্ট্রের সীমানার মধ্যে সমস্ত নাগরিকের কাছে  একই রকম খবর, একই রকম আশা-আশঙ্কার উন্মাদনা, একই নায়কদের পুজো করা ও একই খলনায়কদের ঘৃণা করার প্রচার-বিজ্ঞাপন সর্বাত্মক করে তোলার মধ্য দিয়ে এই বাস্তবতা-উৎপাদন প্রক্রিয়া এমন এক জাতীয়-চেতনা (national consciousness) তৈরি করে যার প্রভাবে ব্যক্তিমানুষের নিজ প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাভুক্ত সমাজ-গোষ্ঠী-পরম্পরায় শিকড়-ছড়ানো স্বপরিচয় গৌণ করে দিয়ে বৃহৎ কাল্পনিক গোষ্ঠী (বৃটিশ তাত্ত্বিক বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসন একে imagined community বলেছেন)-র সদস্য হিসেবে স্বশনাক্তকরণ তৈরি হয়। রাষ্ট্রীয় সংহতিকে সর্বাগ্রগণ্যতা দেওয়া প্রচার-বিজ্ঞাপন-পোষিত এই জাতীয়-চেতনাই সমস্তরকম জাতীয়তাবাদী মতবাদের প্রসূতিঘর হিসেবে কাজ করে। এই কাল্পনিক গোষ্ঠী নির্ভর জাতীয়তাবাদী স্বশনাক্তি যত মজবুত হয়, ব্যক্তিমানুষের নিজ অভিজ্ঞতা নির্ভর সমাজ-গোষ্ঠী-পরম্পরা-র মধ্যের শিকড় ততই ছিন্ন হয়।  উদাহরণস্বরূপ, ভারতের যে কোনো আদি গ্রামসমাজের সীমিত বলয়ে সমষ্টির সঙ্গে ব্যক্তিমানুষের যোগ যে প্রত্যক্ষ সংস্পর্শ-ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া দিয়ে বাঁধা হত এবং তার মধ্য দিয়ে ব্যক্তিমানুষের স্বশনাক্তি তৈরি হত, আধুনিক জাতীয়তাবাদী ভারতে বাস্তব সমষ্টির সঙ্গে ব্যক্তিমানুষের সেই বন্ধন ও স্বশনাক্তির সম্পর্ক নেই, বরং রাষ্ট্রীয় ও ব্যবসায়ী প্রচার-বিজ্ঞাপন দ্বারা নির্ধারিত মতবাদিক কল্পনায় নির্মিত ‘ভারতীয়ত্ব’-র সঙ্গে স্বশনাক্তির টানাপোড়েন লেগে আছে।
  • একদিকে ছোটো আঞ্চলিক বলয়ের মধ্যে রাজনৈতিক ক্রিয়া সাধনের সমস্ত পরিসরটাকে গুটিয়ে নিয়ে সাধারণ ব্যক্তিমানুষের নাগালের বাইরে কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রের আসন পেতে তার গণ্ডীতে কার্যকরী রাজনৈতিক ক্রিয়াকে আবদ্ধ করার প্রক্রিয়ার কারণে ব্যক্তিমানুষের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ও সক্রিয়তার বলয়ে রাজনৈতিক সক্রিয়তার বাস্তব কার্যকারীতা ক্রমশ ক্ষয় পেতে থাকে। অন্যদিকে, বাস্তবতা-নির্ণয় ও স্বশনাক্তিকরণ প্রত্যক্ষ যাপন-অভিজ্ঞতা থেকে বিযুক্ত হয়ে বিমূর্ত মতবাদের নিরিখে জ্ঞাপনব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণে পাক খেতে থাকে। যুগপৎ ঘটমান এই দুই প্রক্রিয়ার বশে মানুষ ক্রমশ এক নাগালছাড়া বিমূর্ততার খাঁচায় বন্দি হয়ে তাকেই মূর্ত আকাঁড়া বাস্তব বলে জ্ঞান করতে থাকে (পশ্চিমী সমালোচনাত্মক দর্শনে একেই alienation ও reification নামে আলোচনা করা হয়েছে); সেই খাঁচার বাইরের কোনো অভিজ্ঞতা বা অনুভূতি ধারণ-বিশ্লেষণ করার সক্ষমতাও সে ক্রমশ হারিয়ে ফেলে। প্রত্যক্ষ সংস্পর্শ-অভিজ্ঞতা-প্রসূত রাজনীতি শুকিয়ে গিয়ে মতবাদিক (মতবাদ= ideology= false consciousness) রাজনীতির প্রকোপ সর্বময় হয়ে ওঠে।

বাস্তবতা-নির্ণয় ও স্বশনাক্তিকরণ ক্রিয়ার ব্যক্তিমানুষের নিজ মূর্ত সমাজে প্রত্যক্ষ সক্রিয়তার বিষয় হওয়াকে নাকচ করে বৃহৎ যান্ত্রিক উৎপাদন পরিপোষিত সংবাদ-প্রচার-বিজ্ঞাপনের বিষয় করে তোলার উপরোক্ত প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যা ছিল স্বতোৎসারিত সামাজিক ক্রিয়া, তাকে বৃহৎ উৎপাদন প্রক্রিয়ায় উৎপাদিত বস্তু (সংবাদ-বিজ্ঞাপন) উপভোক্তা হিসেবে ভোগ করায় রূপান্তরিত করা হল। অর্থাৎ, স্বাভাবিক স্বতক্রিয়াকে পণ্যভোগ-ক্রিয়ায় রূপান্তরিত করা হল। পণ্য হিসেবে সংবাদ-বিজ্ঞাপন-এর আকর্ষণী শক্তি বাড়াতে প্রযুক্তি-প্রকৌশলের লাগাতার প্রয়োগ ও নবায়ন ক্রমদ্রুতি পেল। এই প্রক্রিয়াতে লিখনরূপভিত্তিক জ্ঞাপনব্যবস্থার এতাবৎ আলোচিত মূল চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলো বজায় রেখেই তার রূপবৈচিত্র্যে আরো বিপুল পরিবর্তন এল। এই পরিবর্তন মূলত দুটি দিকে ধাবিত হল:

  • দৃশ্য-শ্রাব্য বস্তুর ছাপকে যন্ত্রে ধরে সেই ছাপের দ্রুত বিপুল হারে পুনরুৎপাদন ও বন্টন, যা লিখনবস্তুর সঙ্গে যুক্ত হয়ে নির্মিত বাস্তবতার সত্যতার দাবি আরো জোরালো করে তুলল,
  • বৈদ্যুতিন (electronic) সঞ্চলন ব্যবস্থার বিকাশ সংবাদ-বিজ্ঞাপনের উৎপাদন ও বন্টনের গতিকে এমন বাড়িয়ে দিল যে মুহূর্তমধ্যে এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশে জ্ঞাপন সম্ভব হয়ে উঠল।

নবরূপসমন্বিত এই জ্ঞাপনব্যবস্থা এখন যন্ত্রধিত লিখন-দৃশ্য-শ্রাব্য মাধ্যম হিসেবে ‘সামাজিক মাধ্যম’ (‘social media’) নামে পরিচিত হয়ে উঠে বিভিন্ন বৈদ্যুতিন সংবহন ধারায় নিরন্তর প্রবাহিত হয়ে চলেছে। সংবাদপত্র, বেতার, দূরদর্শনের চেয়ে বহুগুণ বেশি হারে মোবাইল ফোন হাতে হাতে পৌঁছে যাওয়ায় এই নয়া লিখন-দৃশ্য-শ্রাব্য মাধ্যম আরো অনেক বেশি মানুষের কাছে পৌঁছতে পারে যা পূর্ববর্তী যে কোনো জ্ঞাপনমাধ্যমের ক্ষেত্রে অভাবনীয় ছিল, আর বৈদ্যুতিন গতির সওয়ার বলে মুহূর্তমধ্যে জ্ঞাপন করতে পারে। তাই জনসমষ্টিকে আরো কার্যকরীভাবে জ্ঞাপনব্যবস্থার অঙ্গীভূত করা এবং ব্যক্তিমানুষের দৈনন্দিন জীবনের প্রায় প্রতিটি মুহূর্তে তার মনোযোগ আকর্ষণ করার ব্যবস্থা এর মধ্য দিয়ে হয়েছে। ফলে বাস্তবতা-নির্মাণ ও স্বশনাক্তি-নির্মাণের উপর আরো একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ গেঁড়ে বসেছে, প্রত্যক্ষ সক্রিয়তা-অভিজ্ঞতা-সামাজিকতা-নির্ভর বাস্তববোধের থেকে আরো অমোঘ বিচ্ছিন্নতা রূপ পেয়ে চলেছে। এই মাধ্যমে জ্ঞাপনবস্তু-স্রষ্টা (‘content creator’) হিসেবে নিজেদের হাজির করা মানুষজনেদের কথায় হরবখত ঘুরেফিরে আসে এই ধরনের কথা: ‘পাবলিক এখন কী খাচ্ছে… পাবলিক কী খাবে… পাবলিককে এটা কীভাবে খাওয়ানো যায়…’। অর্থাৎ সাধারণজনেদের একটি গণপিণ্ড হিসেবে ধরে নিয়ে প্রচার-বিজ্ঞাপনের কোন সুতোর টানে তাকে কীভাবে নাচানো যায় এটাই হয়ে ওঠে চিন্তার বিষয়। মতবাদিক রঙ নির্বিশেষে প্রতিটি প্রাতিষ্ঠানিক রাজনৈতিক পার্টির এহেন জ্ঞাপনবস্তু-স্রষ্টা বিষয়ীদের নিয়ে নিজ নিজ ‘আই-টি সেল’ তো আছেই, ব্যক্তিমানুষ হিসেবে এহেন বিষয়ী হয়ে ওঠারাও একইভাবে ভাবেন। প্রতিটি মানুষের ভাবনা-চিন্তা-সক্রিয়তার স্বাতন্ত্র্য-স্বকীয়তা অস্বীকার করে তাঁরা নিরন্তর অন্য সকলকে ‘manipulate’ করতে চান, বিবিধজনের বিবিধকর্মের অনির্দিষ্টতা ও বৈচিত্র্যকে শৃঙ্খলার বাঁধনে ঠেসে একমেটে একশিলা ভবিষ্যনির্মাণের আকাঙ্ক্ষা দ্বারা চালিত হন, এবং এইভাবেই চরম কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রের ক্ষমতারূপগুলোকে পুনরুৎপাদিত করে চলে।

তাছাড়া, এই বৈদ্যুতিন জ্ঞাপনমাধ্যমের প্রযুক্তি-প্রকৌশলগুলোর অন্তরালে প্রযুক্তি-পরিচালকরা যেভাবে গ্রাহকদের অবস্থান ও আচরণ সম্বন্ধে অনবরত উপাত্ত (data) সংগ্রহ করে যাচ্ছে, রাষ্ট্রের কাছে তা বিক্রি করছে রাষ্ট্রীয় নজরদারির জন্য, আর পণ্যমালিকদের কাছে বিক্রি করছে পণ্য-বিজ্ঞাপনী মনস্তাত্ত্বিক টোপ নির্মাণের জন্য, তা-ও রাষ্ট্র ও পণ্যবাজারের হাতে অভূতপূর্ব মাত্রায় ব্যক্তিমানুষদের নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালন করার শক্তি তুলে দিচ্ছে। 

কেউ কেউ অবশ্য বলবেন যে ব্যাপারটা এতো একপাক্ষিক নয়, লিখন-দৃশ্য-শ্রাব্য জ্ঞাপনমাধ্যমের অভাবনীয় বিস্তার ও বৈদ্যুতিন গতি কেবল রাষ্ট্রপরিচালক ও পণ্যমালিকদের সুবিধা করে দিচ্ছে না, তা রাষ্ট্র ও পণ্যবাজারের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারীদের সামনেও অভূতপূর্ব সুযোগ খুলে দিয়েছে। সাম্প্রতিক নানা আন্দোলনে (যেমন বাংলাদেশের স্বৈরাচারী হাসিনা-বিরোধী আন্দোলন বা পশ্চিমবঙ্গে জুনিয়র ডাক্তারের খুন ও ধর্ষণের বিচার চেয়ে আন্দোলন) এই জ্ঞাপনমাধ্যম যেভাবে আন্দোলন-সংগঠনে ও রূপায়নে কাজ করেছে তা হয়ত তিনি উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরবেন। তাঁর সঙ্গে একমত হতে পারছি না। আন্দোলন ও বিক্ষোভের ডাক ও বার্তা ছড়িয়ে দিতে এবং আন্দোলনের উত্তাপ নিরন্তর উসকে দিতে, প্রায় প্রতি মুহূর্তে নতুন খবর নতুন ঘটনার উত্তেজনা তৈরি করে রাখতে বৈদ্যুতিন মাধ্যম অভূতপূর্ব নজির সৃষ্টি করে চলেছে, একথা সত্য। কিন্তু একইসাথে বৈদ্যুতিন মাধ্যম পোষিত আন্দোলনে অন্যতর কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্যও ফুটে উঠছে, যেমন:

  • যে ধরনের আন্দোলনগুলোর উদাহরণ এখানে আসে, তার একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে নির্দিষ্ট কিছু ঘটনার বিরোধিতায় বা নির্দিষ্ট কিছু দাবি নিয়ে বিরাট সংখ্যক মানুষের কোনো জায়গায় (বিশেষ করে কিছু শহরকেন্দ্রে) লাগাতার জমায়েত হওয়া। এই জমায়েত হওয়ার মধ্য দিয়ে ব্যক্তিমানুষরা নিজেদের বিচ্ছিন্ন অস্তিত্বের ক্লান্তি কাটিয়ে উঠে যেন একটা সময়পর্বের জন্য বহুজন-সমন্বিত এক সমগ্রের অংশ হয়ে ওঠার বিরল স্বাদ পান। বহুজনের ক্ষোভ-বিক্ষোভ-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে নিজের ক্ষোভ-বিক্ষোভ-আকাঙ্ক্ষার মিলে যাওয়ার, একসঙ্গে ধ্বনিত হয়ে রাজনৈতিকভাবে কার্যকরী একটা শক্তি হয়ে ওঠার সম্ভাবনা টের পান। কিন্তু এই সম্ভাবনা বাস্তবায়িত হওয়ার পথে নিয়ে যেতে হলে এই বহুজনের সমষ্টিকে তার নিজের মধ্যে ধারণ করা বৈচিত্র্য-বহুত্ব সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠতে উঠতে পারস্পরিক সংস্পর্শ ও স্বতক্রিয়ার যে পরিসর গড়ে তোলার দিকে এগোতে হয়, রাষ্ট্র-বাজার-গণজ্ঞাপনমাধ্যমের দ্বারা নির্মিত বাস্তবতা ও স্বশনাক্তির চাপানো সমরূপতায় ফাটল ধরাতে হয়, তা সাধারণত দেখা যায় না। (ব্যতিক্রমীভাবে সাম্প্রতিককালে এমন বহুত্ব-বৈচিত্র্যের রাষ্ট্রবিরোধী পরিসর আমরা গড়ে উঠতে দেখেছি মেহিকোয় জাপাতিস্তা অভ্যুত্থানের ধারাবাহিকতায়। ১৯৯৪ সাল থেকে এখনও অবধি চিয়াপাস-এর আদিবাসীরা যেভাবে পুঁজিবাদী বাজার ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সমাজ-জীবন-অর্থনীতির উপর স্বশাসন চর্চা করার পরিসর গড়ে তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছে, তা উদাহরণ হিসেবে বেশ উদ্দীপক। আমাদের ‘বিশ্ব-ঢোঁড়া’ সংবাদমাধ্যমগুলোয় অবশ্য তার খুব বেশি খবর থাকে না। এ নিয়ে জন হলোওয়ে ও গুস্তাভো এস্তেভা-র লেখাগুলো পাঠকরা পড়ে দেখতে পারেন।) দেখা যে যায় না তার কারণ মনে হয় এই যে সাময়িকভাবে বিচ্ছিন্নতার বন্দিশালায় ফাটল দেখা দেওয়ার এই উচ্ছ্বাস সমাবেশ মাঝে সেলফি তুলে, ফেসবুকে আপডেট দিয়ে, মিডিয়ার তাত পুইয়ে, লাইক আর কমেন্ট গুণে রাষ্ট্র ও জ্ঞাপনমাধ্যমের তৈরি ছদ্মবাস্তবতার জগতেই সমস্ত প্রাণশক্তি খরচ করে ফেলে, প্রত্যক্ষ সংস্পর্শ-সামাজিকতার মধ্য দিয়ে অস্তিত্বের স্বায়ত্তশাসনের প্রয়াসমুখে যায় না। উত্তেজনা দ্রুত থিতিয়ে গেলে বিচ্ছিন্নতা-বন্দীত্ব তাই আরো প্রলম্বিত হয়।
  • অভাবিত জনসমাবেশ একবার ঘটে গেলে তাকে ধরে রাখা বা আরো বাড়ানোর জন্য আন্দোলনের মধ্যে যারা উদ্যোগী হয়ে ওঠেন, তাঁরা বাকি সর্বজনকে ওই গণপিণ্ড জ্ঞান করে স্লোগান-প্রোপাগান্ডার জমক-চমক দিয়ে সেই গণপিণ্ডকে সুতোর টানে নাচাতে চেষ্টা করেন, অর্থাৎ প্রাতিষ্ঠানিক গণজ্ঞাপনমাধ্যমগুলোর শান-দেওয়া অস্ত্রগুলোই নিজেরা হাতে তুলে নিয়ে ব্যবহার করতে সচেষ্ট হন, এমনকি প্রাতিষ্ঠানিক গণজ্ঞাপনমাধ্যমগুলোর উপরই নির্ভরশীল হয়ে পড়েন, ফলে সেই প্রচার-প্রোপাগান্ডার মধ্যেও ইচ্ছাকৃত মিথ্যাবৃত্তি, বাস্তব-বিকৃতি সমানভাবে কাজ করতে থাকে--- নিজ সত্তার উপর দাঁড়িয়ে প্রত্যেকের সৃজনশীল অংশগ্রহণ, পার্থক্যকে যথাযথ জায়গা দেওয়ার মতো কোনো পরিবেশ গড়ে ওঠে না। সেদিক থেকেও সমস্ত সম্ভাবনার অপমৃত্যু ঘটিয়ে রাষ্ট্র ও জ্ঞাপনমাধ্যমের বাঁধানো উঠোনে তাদেরই নিয়মে বাঁধা রাজনীতির খেলায় তাদেরই শনাক্ত করে দেওয়া স্বার্থগোষ্ঠী হিসেবে কিছু লেনদেনের অবকাশ মাত্র পড়ে থাকে।

১৯৭৯ সালে আমেরিকার নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি ইনস্তিটিউটে ‘যা ব্যক্তিগত ও যা রাজনৈতিক’ (‘The Personal and the Political’) শীর্ষক এক আলোচনাসভায় বক্তব্য রাখতে আমন্ত্রিত হয়ে ‘কৃষ্ণাঙ্গ সমকামী নারীবাদী’ হিসেবে নিজ আত্মপরিচয় দেওয়া আউড্রে লর্ড এই প্রত্যয়টিকে তাঁর বক্তব্যের শিরোনাম করেছিলেন: ‘প্রভুদের যন্ত্রপাতি কখনোই প্রভুদের ঘর ভাঙতে পারবে না’ (The Master’s Tools Will Never Dismantle the Master’s House’)। আউড্রে লর্ডের এই কথাগুলো পুনরাবৃত্ত করেই আপাতত এই আলোচনায় ইতি টানতে চাই। প্রভুদের রাজনীতির যন্ত্রপাতি হল গণজ্ঞাপনব্যবস্থা, সেগুলোই হাতে তুলে নিয়ে নিজেরা ব্যবহার করে আত্মবিচ্ছিন্ন বাস্তবতা-বিচ্ছিন্ন বন্ধ্যা অস্তিত্ব থেকে বেরিয়ে আসা যাবে না। তার জন্য নিজেদের যন্ত্রপাতি নিজেদেরই গড়ে তুলতে হবে। বৈদ্যুতিন গতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নিত্যনতুন জমক-চমকের সমারোহ নয়, গড়ে তুলতে হবে প্রত্যক্ষ সংস্পর্শ-সংযোগ-স্বতক্রিয়ার এমন পরিসর যেখানে প্রতিটি গোষ্ঠীর, প্রতিটি ব্যক্তিমানুষের স্বাতন্ত্র্য বহুত্ব ও পার্থক্যকে প্রকাশ ও বিকাশের জায়গা করে দেওয়া যাবে, একমেটে একশিলা গঠনের তাগিদে সমরূপতা আরোপের চেষ্টা থাকবে না। বিরাট অঞ্চল জুড়ে কেন্দ্রীভূত প্রশাসন বা ছদ্মবাস্তবতা নির্মাণকারী অতি তৎপর গণজ্ঞাপনমাধ্যম কিছুই সেখানে খাপ খায় না। প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ও সংস্পর্শ দিয়ে সামাজিকতা ও প্রশাসন চালানো যায় এমন ছোট ছোট বলয়ে স্বশাসনের আসন পাতা এবং সেই অনুযায়ী অন্তর্বলয় ও আন্তর্বলয় জ্ঞাপনব্যবস্থা সৃষ্টি করাই এর সঙ্গে খাপ খায়। জাপাতিস্তাদের মতো কেউ কেউ হয়ত এহেন পুনর্গঠনের চেষ্টা করছে। আমাদেরও নিজেদের মতো করে নিজেদের সেই চেষ্টা করতে হবে।

 

 

 

0 Comments
Leave a reply