তুমি ডাক দিয়েছ কোন্ সকালে… রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক ভাবনা নিয়ে একটি আলোচনা

লিখেছেন:বিপ্লব নায়ক
রাজনীতি-চিন্তার ইতিহাসে রবীন্দ্রনাথের রাজনীতি-চিন্তা স্বকীয় অনন্যতায় উজ্জ্বল। রাষ্ট্রীয় পরিসর পরিহার করে তা নৈরাষ্ট্রিক, যুক্তিবাদের নিগড় অগ্রাহ্য করে তা আধ্যাত্মিক, অর্থনৈতিক অবধারণবাদ অস্বীকার করে তা অস্তিত্বের মৌল ঐক্যের অভিসারে ব্রতী। রবীন্দ্রনাথ যতটা পূজিত, তাঁর রাজনীতি-দর্শন ঠিক ততটাই অবহেলিত। এই আলোচনায় সেই রাজনীতি-দর্শনের মর্মে প্রবেশ করার চেষ্টা করা হয়েছে।

 

১৮৯০ দশকের বেশিরভাগটাই রবীন্দ্রনাথের কেটেছে শিলাইদহে, বাংলার গ্রামজীবনের প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে। সেই সময়ে তাঁর লেখাপত্রের মধ্যে দীরে ধীরে দৃঢ় হয়ে উঠতে দেখা যায় দুটি প্রত্যয়কে: প্রথমত, কোনো সরকারি সাহায্যের মুখ চেয়ে না থেকে, সরকারের উপর নির্ভরশীল না হয়ে, ভারতীয়দের নিজেদের সমস্যার সমাধান নিজেদেরই করতে হবে, আর দ্বিতীয়ত, ভারতের পুনরুজ্জীবন সম্ভব একমাত্র চার গ্রামের (/গ্রামসমাজের) পুনরুজ্জীবনের মধ্য দিয়েই। বিভিন্ন রাজনীতিবিদ যারা ‘সরকার বাহাদুর’-এর কাছে আবেদন-নিবেদনের মধ্য দিয়ে কৃপা আকর্ষণ করে ‘দেশের স্বার্থ’ চরিতার্থ করার প্রকল্প ফেঁদেছিল, রবীন্দ্রনাথ তাঁর এই সময়ের প্রবন্ধে ও ভাষণে একদিকে যেমন তাদের ব্যঙ্গ-বিদ্রূপে বিদ্ধ করেছিলেন, অন্যদিকে তেমনি এই অপরের কৃপাদানে মহান হওয়ার স্বপ্ন যে কীভাবে আত্মশক্তির পচন ঘটায় তা আলোচনা করেছিলেন।

নিজের ভাবনাকে প্রায়োগিক রূপ দেওয়ার বাসনা নিয়ে এরপর শান্তিনিকেতনে তিনি তাঁর স্বপ্নের বিদ্যালয়ের সূচনা ঘটান। ১৯০১ সালের ২১ শে ডিসেম্বর তার উদ্বোধন হয়েছিল ৫ জন পড়ুয়া ও ৫ জন শিক্ষক নিয়ে। এই বিদ্যালয় প্রকল্পের জন্য সহায়তা প্রার্থনা করে ত্রিপুরার রাজকুমারকে লেখা চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন যে এখানকার পড়ুয়াদের তিনি ইউরোপীয় জীবনযাত্রার সবরকম বিলাসব্যসন থেকে দূরে রাখতে চান, ইউরোপ সম্পর্কে কোনো অন্ধ মোহ তাদের না গড়ে ওঠে তা দেখতে চান এবং ‘দারিদ্র্যের পবিত্র অমলিন ভারতীয় পরম্পরা’-য় দীক্ষিত করতে চান। প্রাচীন ভারতীয় আশ্রমের স্মৃতি এই বিদ্যালয়ের পরিবেশের মধ্য দিয়ে জাগরূক করে তুলতে চেয়েছিলেন তিনি। আপন পরম্পরার প্রতি একনিষ্ঠ হওয়ার এই অভিপ্রায়ে ধর্ম নিয়ে সংকীর্ণতার কোনো স্থান ছিলো না--- ৫ জন শিক্ষকের মধ্যে তিনজন ছিলেন খ্রিস্টান, আর সেই তিনজনের একজন ব্রক্ষ্মবান্ধব উপাধ্যায়ের হাতেই রবীন্দ্রনাথ প্রধানশিক্ষকের দায়িত্ব তুলে দিয়েছিলেন।

১৯০১ থেকে ১৯০৮ সময়পর্যায়কালে সামাজিক-রাজনৈতিক নানা উথালপাতাল (১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ এবং তার বিরুদ্ধে আন্দোলন)-এর পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথের চিন্তাজগতেও নানা উথালপাতাল ঘটেছে। বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনে তিনি সক্রিয়ভাবে ভূমিকা নিয়েছিলেন। এই পর্যায়ে তিনি নানা প্রবন্ধে বিস্তৃতভাবে বাঙালি জাতির জীবনে ‘হিন্দু’ উপাদানের অস্তিত্ব নিয়ে লিখেছেন (উদাহরণস্বরূপ তাঁর ‘স্বদেশী সমাজ’ প্রবন্ধটি দেখা যেতে পারে। প্রাচীন ‘হিন্দু’ ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার উপর জোর এই পর্যায়ের প্রবন্ধেই সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়। কিন্তু এই ‘হিন্দু প্রত্যাবর্তনবাদী’ সুর থমকে দাঁড়ায় যখন বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলন ও স্বদেশী আন্দোলনের খাত বেয়ে উপছে ওঠা দেশাত্মবোধী চেতনা ঘৃণা ও হিংসাকেই রাজনৈতিক উপায় হিসেবে আঁকড়ে ধরে। রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত কাছ থেকে দেখেন তাঁর সুহৃদ ব্রক্ষ্মবান্ধব উপাধ্যায় কীভাবে উদারপন্থী ক্যাথলিক চেতনা থেকে সরে সহিংস আত্মত্যাগের এক ‘হিন্দু’ পরম্পরা অবলম্বন করে এমন এক ‘অখণ্ড হিন্দু ব্যবস্থা’ পুনর্প্রবর্তন করা ও পশ্চিমী প্রভাব থেকে বিচ্ছিন্ন করে অকলুষিত রাখার কথা বলতে থাকেন। কেবল ব্রক্ষ্মবান্ধব উপাধ্যায়ই এমন ভাবছিলেন তা নয়, বিপিন চন্দ্র পাল, অরবিন্দ ঘোষ এবং বাল গঙ্গাধর তিলকের জাতিয়তাবাদী চিন্তাও একই বিশ্বাস ও যুক্তির ভিত্তি অবলম্বন করেছিলো। রবীন্দ্রনাথের কাছে তা গ্রহণীয় হয়নি। অপরের সঙ্গে যোগাযোগ ও আদানপ্রদানের সমস্ত দরজা-জানালা বন্ধ করে দিয়ে নির্মীত আত্মতাকে অকলুষিত রাখার এই ভাবনা তাঁর কাছে নিজেকে আলোবাতাসহীন এক বন্দীকক্ষে বন্দী করার শামিল, যা ক্রমশ স্বাভাবিক আত্মবিকাশকে রুদ্ধ করে বিকৃতিরই বাড়বাড়ন্ত ঘটায়। অপরকে ঘৃণা ও হিংসাত্মকতা এই বিকৃতিরই দুটি রূপ। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘চার অধ্যায়’ উপন্যাসে তাঁর এই সমালোচনাকে অত্যন্ত শানিতভাবে হাজির করেছিলেন। তাঁর নিজের চিন্তার জগতেও তিনি ‘হিন্দু প্রত্যাবর্তনবাদী’ অভিপ্রায় থেকে সরে আসছিলেন। ১৯০৮ সালে সাধারণ ব্রাক্ষ্ম সমাজে প্রদত্ত এক ভাষণে তিনি বলেন, আত্মের সঙ্গে অপর আদান-প্রদান ভাববিনিময় করতে পারে এমন এক দাঁড়াবার জায়গা গড়ার চেষ্টা না করে ভারতীয় ও ইংরেজরা যদি নিজেদের মাঝে অলঙ্ঘনীয় দেওয়াল তুলে রাখে তাহলে তারা চিরকাল একে অপরের ঘৃণার বস্তু হয়েই থাকবে। এর দুই বছর পর, ১৯১০ সালে কলকাতায় কেশব-সেন-বার্ষিকী-ভাষণ দিতে আমন্ত্রিত হয়ে তিনি বলেন যে সত্য কোনো একটি ধর্মের এক্তিয়ারভুক্ত নয়, সব ধর্মের মধ্যেই তা আছে, সব ধর্মের ভিতর থেকেই তাকে উন্মোচিত করে গ্রহণ করতে হবে। ব্রাক্ষ্ম সমাজের মধ্যে আদি, কেশবপন্থী ও সাধারণ--- এই যে তিনটি আড়াআড়ি ফাটল তৈরি হয়ে গিয়েছিল, সেই ফাটল বুজিয়ে আবার ঐক্যসাধন করার উদ্দেশ্যে তিনি ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’ পুনরায় প্রকাশ করার জন্যও উদ্যোগ নেন এই সময়ে। পার্থক্য মানেই ফাটল ধরিয়ে আলাদা হয়ে ক্রমশ বৈরীভাবাপন্ন হয়ে উঠতে হবে, তা যে নয়, বরং, পার্থক্যকে সসম্মান স্বীকৃতি দিয়েই একে অপরকে বোঝা, একে অপর থেকে শেখার ঐক্যই যে আত্মবিকাশের পথ হতে পারে, রবীন্দ্রনাথের বিশ্বাস ক্রমশ এই প্রত্যয়ে দৃঢ় হয়েছিল।

রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক দর্শন তাঁর উপনিষদ পাঠ ও ব্যাখ্যার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে বিজড়িত। রবীন্দ্রনাথ মনে করেছিলেন যে উপনিষদের মূল চিন্তাটি হলো এক অদ্বৈত পরম বাস্তবতার ধারণা, যে পরম বাস্তবতাটিকে ‘ব্রক্ষ্ম’ নামে চিহ্নিত করা হয়েছিল। এই ধারণার সূত্রেই ঘোষিত হয়েছিল যে প্রতিটি মানুষ বিবিধ বিভেদ-বৈচিত্র্যের আড়ালে আসলে একটিই সার্বজনীন আত্মার বিবিধ প্রকাশরূপ। ব্রক্ষ্ম থেকে উৎসারিত এক অখণ্ড জৈব সমগ্রের মধ্যেই আমাদের প্রতীত বাস্তবতা নিহিত। এই বিশ্বাস থেকেই রবীন্দ্রনাথ ‘সার্বজনীন মানুষ’ (Universal Man)-এর এক নিহিত বাস্তবতার মধ্য দিয়ে সকল মানুষের মৌলিক ঐক্যের জায়গাটিকে অনুভব করতে চেয়েছেন, হাজির করতে চেয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের ভাবনা অবশ্য কেবল উপনিষদের অনুগমন নয়, তিনি নিজের মতো নতুন পথও করে নিয়েছেন। যেমন ধরা যাক, উপনিষদীয় অদ্বৈত বেদান্তের নৈষ্ঠিক ব্যাখ্যা দাবি করে যে আমাদের কাছে প্রতীত ‘মায়া’-র জগৎ এবং তার পিছনে আড়ালে থাকা প্রকৃত বাস্তবতার জগতের মধ্যে স্পষ্ট বিভাজন ও পার্থক্য বর্তমান, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ভাবনা অনুযায়ী, ‘মায়া’-র জগৎ আমাদের সত্যের জগৎ, অর্থাৎ, বাস্তবতার জগতের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং বাস্তবতার জগৎ থেকেই তা উপজাত এমনটাও পুরোটা বলা যায় না। অধিবিদ্যার মধ্য দিয়ে, অর্থাৎ, জ্ঞানের মধ্য দিয়ে, মায়াবিশ্লিষ্ট প্রকৃত বাস্তবতায় পৌঁছানোর কোনো পথ মানুষের কাছে নেই, রবীন্দ্রনাথের গানের ভাষায়,

যতোবার আলো জ্বালাতে চাই, নিভে যায় বারে বারে,

আমার জীবনে তোমার আসন গভীর অন্ধকারে।

মানুষ তার অস্তিত্বগত চৌহদ্দির মধ্যে থেকে যা জানতে পায় ও যা অনুভব করে, তাকে অতিক্রম করে পরম অদ্বৈত বাস্তবতা সম্পর্কে কোনো জ্ঞানে পৌঁছতে পারে না। প্রতিটি মানুষই এভাবে তার স্থিতসত্তায় খণ্ডিত, অপর আরো অসংখ্য খণ্ডিত স্থিতসত্তার মধ্যে একটি মাত্র। তাই কোনো মানুষ এককভাবে বা গেষ্ঠীগতভাবে পরম সত্য বা পরমাত্মা বিষয়ক নিজের/নিজেদের জ্ঞান বা অনুভবকে অদ্বৈত পরম বাস্তবতা বলে দাবি করলে তা যেমন ভুল হবে, তেমনই মূঢ় অহংকারের প্রকোপে নিজ স্থিতসত্তার সীমাবদ্ধতাকেও ভুলে যাওয়া হবে। নিজ স্থিতসত্তার সীমাবদ্ধতা ভুলে না বসলে, মানুষ একমাত্র যা করতে পারে তা হলো বিবিধ জনেদের বিবিধ বৈচিত্র্যময় পার্থক্যপূর্ণ স্বজ্ঞা-জ্ঞান-অনুভবগুলোকে সমগুরুত্বের আসন দিয়ে একে অপরকে বোঝা, খোলা মনে শেখা ও শেখানোর মধ্য দিয়ে স্থিতসত্তাগত চৌহদ্দিটিকে বাড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা। এর মধ্য দিয়েই সমাজঅস্তিত্বে বদ্ধ মানুষ তার মূলগত ‘সার্বজনীন মানুষ’-এর অভিসার করতে পারে। রবীন্দ্রকাব্যের ভাষায়:

আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া,

বুকের মাঝে বিশ্বলোকের পাবি সাড়া।

নিজ স্বজ্ঞা-অনুভূতি মধ্যে বিশ্বলোকের এই সাড়া, তাকেই আবার রবীন্দ্রনাথ ‘জীবনদেবতা’-র উদ্ভাস বলে ধরেছেন। এই জীবনদেবতা-র অর্থ যেমন মানুষের চেতনায় ব্রক্ষ্মের ঝলক উদ্ভাসিত হওয়া, আবার তেমনই এর অর্থ মানুষের মধ্যেই ব্রক্ষ্মের উপস্থিতি। ব্যাপ্ত-চরাচর ব্রক্ষ্ম যেভাবে জীবে জীবাত্মামধ্যে খণ্ডিত পরিসরের মধ্যে অখণ্ডের দ্যোতক হিসেবে অস্তিত্বমান, তা-ই জীবনদেবতার রূপ। এই জীবনদেবতা তাই মানুষকে প্রতিনিয়ত তার আস্তিত্বিক গণ্ডী ভেঙে অজানা অপরিচিত অপরের সঙ্গে মিলিত হওয়ার মধ্য দিয়ে নতুন হয়ে উঠতে তাগাদা দেয়, কোনো গণ্ডীই তার সহনীয় নয়, চিরচাঞ্চল্যে সে গণ্ডীর পর গণ্ডী পেরিয়ে যেতেই উদগ্রীব। ‘চিত্রা’ কাব্যগ্রন্থে রবীন্দ্রনাথের ‘জীবনদেবতা’ কবিতাটি তাই শেষ হয়েছে এইভাবে:

ভেঙে দাও তবে আজিকার সভা,

আনো নব রূপ, আনো নব শোভা,

নূতন করিয়া লহো আরবার

চির পুরাতন মোরে।

নূতন বিবাহে বাঁধিবে আমায়

নবীন জীবন ডোরে।

জীবনদেবতাই তাই জীবনের সমস্ত সৃষ্টিশীল ক্রিয়াকে ইন্ধন দেয়, শক্তি যোগায়, পরিচালিত করে। আর অনবরত স্থিতি-ভেঙে-যাওয়া সৃষ্টিশীলতার মধ্য দিয়েই জীবনের ব্রত পালিত হয়। আর এই গণ্ডীভাঙা সৃষ্টিশীলতার ধর্মই নবসৃষ্টির ধারায় বিভিন্ন অপরের মধ্যে যোগাযোগ গড়ে তোলে, সুসমঞ্জস সহাবস্থানের ভারসাম্য গড়ে তোলে, বহুকে টানে ব্যাপ্ত-চরাচর ব্রক্ষ্মের উপলব্ধির ঐক্যচেতনা পানে।

বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে মানুষের মৌলিক সম্পর্ক বিষয়ে এইরূপ চিন্তা থেকেই রবীন্দ্রনাথের সমাজভাবনায় বিবিধ বৈচিত্র্যের সহাবস্থান, একে অপরের পার্থক্যের প্রতি সম্মান এবং নিজ নিজ অসম্পূর্ণতা সম্পর্কে সচেতন থেকে একে অপর থেকে শেখা অবারিত করতে পারে যে সমাজরূপ, সেই সমাজরূপের সন্ধান এতো গুরুত্ব নিয়ে হাজির হয়েছিল। আর এর সঙ্গেই যুক্ত হয়ে রয়েছে ‘মুক্তি’ নিয়ে তাঁর ভাবনা। ‘নৈবৈদ্য’ কাব্যগ্রন্থে তিনি বলছেন:

বৈরাগ্যসাধনে মুক্তি, সে আমার নয়।

অসংখ্য বন্ধন-মাঝে মহানন্দময়

লভিব মুক্তির স্বাদ। এই বসুধার

মৃত্তিকার পাত্রখানি ভরি বারম্বার

তোমার অমৃত ঢালি দিবে অবিরত

নানা-বর্ণ-গন্ধ-ময়। প্রদীপের মতো

সমস্ত সংসার মোর লক্ষ বর্তিকায়

জ্বালায়ে তুলিবে আলো তোমারি শিখায়

তোমার মন্দির-মাঝে।

ইন্দ্রিয়ের দ্বার

রুদ্ধ করি যোগাসন, সে নহে আমার।

যে-কিছু আনন্দ আছে দৃশ্যে গন্ধে গানে

তোমার আনন্দ রবে তার মাঝখানে।

মোহ মোর মুক্তিরূপে উঠিবে জ্বলিয়া,

প্রেম মোর ভক্তিরূপে রহিবে ফলিয়া।

রবীন্দ্রনাথ এখানে মুক্তি সম্পর্কে নঙর্থক নির্ধারণগুলোকে বর্জন করছেন। নঙর্থক নির্ধারণ মানে কী কী না, তা দিয়ে মুক্তিকে সংজ্ঞায়িত করা। যেমন, নঙর্থক নির্ধারণ বলে, মুক্তি মানে কোনো বন্ধন নয়, রবীন্দ্রনাথ এখানে বন্ধনমাঝেই মুক্তি সম্ভব বলছেন। নঙর্থক নির্ধারণ বলে, মুক্তি মানে জগৎবৈরাগ্য, রবীন্দ্রনাথ এখানে জগতে সংসক্তির মধ্য দিয়েই মুক্তিলাভের কথা বলেছেন। নঙর্থক নির্ধারণ বলে, মুক্তি মানে ইন্দ্রিয়নিগ্রহ, রবীন্দ্রনাথ এখানে সমস্ত ইন্দ্রিয়ের দ্বারা অস্তিত্বরস আস্বাদনের মধ্য দিয়েই মুক্তিকে দেখেছেন। সুতরাং, সমস্ত নঙর্থকতাকে বিসর্জন দিয়ে রবীন্দ্রনাথের মুক্তি-অভিপ্রায় এক পুঙ্খানুপুঙ্খ সদর্থক ক্রিয়ার উদ্বোধক, যে ক্রিয়া জগতের সমস্তকিছু এবং তার অন্তর্গত মানবসমাজেরও সমস্তকিছুর সঙ্গে সম্পর্ক পাততে চায়, মিথষ্ক্রিয়ায় যুক্ত হতে চায়, হাজারো দান ও গ্রহণের মধ্য দিয়ে আত্মসত্তাকে চির-পরিবর্তমানতায় জায়মান ও প্রসারমান রাখতে চায়। এই সম্পর্ক ও মিথষ্ক্রিয়ার সেতুগুলো যখন ভেঙে যায়, সন্দেহ-অবিশ্বাস-হিংসা-ঘৃণা যখন মেলামেশার সমস্ত দরজা বন্ধ করে দিয়ে এমন এক দুর্গে আত্মকে বন্দী করে ফেলে যেখানে সেই আত্ম কেবল তার নিজের শুদ্ধতা রক্ষায় স্পর্শকাতর হয়ে ওঠে ও নিজ দুর্গ থেকে সমস্ত অপরের বিরুদ্ধে আক্রমণ হানে, সেই যোগাযোগ-ছিন্নতা বা সম্পর্কছিন্নতার অবস্থাটাকেই রবীন্দ্রনাথ মুক্তিহীনতা বলে দেখেছেন। আর এ কেবল মানুষের সত্তাগত অস্তিত্বের ক্ষেত্রেই নয়, তার প্রসারণে মানুষের সামাজিক-রাজনৈতিক অস্তিত্বের ক্ষেত্রেও সত্য। ১৯৩০ সালে বিদেশে দেওয়া ভাষণ, যা ‘The Religion of Man’ নামে গ্রন্থবদ্ধ হয়েছিল, সেখানে রবীন্দ্রনাথ চিহ্নিত করেছিলেন যে সামাজিক-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে মানুষের স্বাধীনতা-হীনতার ভিত্তিমূল বিচ্ছিন্নতার মধ্যেই প্রোথিত, যে বিচ্ছিন্নতা তাকে বিবিধ অপরদের সাথে মিলতে না দিয়ে জীবজগতের মৌলিক ঐক্যের বোধ থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। অর্থাৎ, এই স্বাধীনতা-ধ্বংসকারী বিচ্ছিন্নতা হলো জীবনদেবতার সঙ্গে সংযোগ হারিয়ে ফেলা।

তাই রবীন্দ্রনাথের ভাবনায় স্বাধীনতা অর্জন মানে আত্মসত্তার এমন এক পরিসর মির্মাণ করা যেখানে বহু বিবিধ অপরের মাঝে মেলামেশা-কাজের-মেলায় বিচ্ছিন্নতার গণ্ডীগুলোকে অতিক্রম করে যাওয়া যাবে। রাজনৈতিক আন্দোলনের জগতে স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের যে প্রকল্প মান্যতা পেয়ে থাকে এবং সেই রাষ্ট্র অর্জন/গঠন বা গঠনোত্তর পর্যায়ে টিকিয়ে রাখার জন্য জাতীয়তাবাদের মতবাদকে যেভাবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে, তা রবীন্দ্রনাথ গ্রহণ তো করেনইনি, অত্যন্ত ক্ষতিকর বলেও চিহ্নিত করেছিলেন। ১৯১৩ সালে ইংরেজিতে প্রকাশিত ‘The Crescent Moon’ সংকলনে তিনি দ্ব্যর্থহীনভাবে বলছেন:

When organized national selfishness, racial antipathy and commercial self-seeking begin to display their ugly deformities in all their nakedness, then comes the time for man to know that his salvation is not in political organisations and extended trade-relations, not in any mechanical re-arrangement of social systems, but in a deeper transformation of life, in the liberation of consciousness in love, in the realization of God in man. (The Crescent Moon, 1913, pg.363)

অর্থাৎ, জাতীয় স্বার্থের নামে স্বার্থপরতা, অপর জাতির প্রতি বিদ্বেষ এবং বাণিজ্যিক স্বার্থান্বেষণ যখন সংগঠিত আকার ধারণ করে নগ্নভাবে তার বিকৃতিসমূহ প্রদর্শন করতে থাকে, তখন সময় হয় এটা বুঝে নেওয়ার যে মানুষের পরিত্রাণ কোনো রাজনৈতিক সংগঠন বা বিস্তৃত বাণিজ্য-সম্পর্কের মধ্য দিয়ে সম্ভব নয়, সমাজব্যবস্থার কোনো যান্ত্রিক পুনর্বিন্যাসের মধ্য দিয়েও সম্ভব নয়, তা সম্ভব একমাত্র জীবনের এক গভীরতর রূপান্তরের মধ্য দিয়ে, প্রেমের মাঝে চেতনাকে মুক্ত করে, মানুষের মধ্যে ঈশ্বরকে উপলব্ধি করে। এই বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধ ও ভাষণগুলো পাঠ করলে দেখা যায় যে জাতি-রাষ্ট্র এবং জাতি-রাষ্ট্র-কেন্দ্রীক রাজনীতি--- এই দুইয়ের মধ্য দিয়েই তিনি জাতীয়তাবাদের মোড়কে সংকীর্ণতা-স্বার্থপরতা, অপর-বিদ্বেষ, হিংসা ও ঘৃণাকে সংগঠিত হয়ে তার কদর্য বিকৃতির শাসন কায়েম করতে দেখেছেন। আর এই বিকৃত দানবের ভয়ঙ্কর আধিপত্য মানুষের জীবনকেও তার নিজের ছাঁচে ঢেলে চিরঅতৃপ্ত ভোগের তাড়নায় তাড়িত স্বার্থপর, হিংস্র ও বিদ্বেষী করে তোলার পাট বসিয়েছে। এর থেকে পরিত্রাণের জন্য জীবনের এক গভীরতর রূপান্তরসাধন ছাড়া তাই পথ নেই। সেই রূপান্তর হিংসা-দ্বেষ-শত্রুতার বদলে প্রেম-সহমর্মিতা-মিলনের সম্পর্কে অপরের সঙ্গে নিজেকে বাঁধবে, মানুষে অন্তর্লীন জীবনদেবতাকে উপলব্ধির অভিপ্রায়ে চালিত হবে--- তা কেবলমাত্র চুড়ো-করে বাঁধা ধাপকাটা রাষ্ট্রের দালান ছেড়ে এসে সবার সাথে সবার মাঝে মেলামেশা-আদানপ্রদান-সহাবস্থানের সমাজ-সম্পর্ক বাঁধার মধ্য দিয়েই হতে পারে। এই ভাবনা থেকে রবীন্দ্রনাথ ক্রমশ রাষ্ট্রসংস্কার-রাষ্ট্রবিপ্লব-অভিমুখী আন্দোলনকে শত্রুতা-সংকীর্ণতার পাকে জড়িয়ে পড়া বলে পরিহার করে সমাজঅঙ্গনে বহু অপরের একসাথে মিলনের সম্পর্ক রচনার পথ অনুসন্ধান করেছেন। এমনকি যে গান্ধীকে তিনি মহাত্মা উপাধি দিয়েছিলেন, যাঁর সঙ্গে ভাব-ভাবনার আদানপ্রদানে কোনোদিন ছেদ পড়েনি, উভয়েই উভয়ের সম্পর্কে সশ্রদ্ধ ছিলেন আগাগোড়া, সেই গান্ধীর ডাকা অসহযোগ আন্দোলনেও তাই তিনি সমর্থন করে শামিল হতে পারেন নি। দেশে যখন অসহযোগ আন্দোলনের ঢেউ উঠেছে, তখন ১৮ই সেপ্টেম্বর ১৯২০ সালে চার্লস এন্ড্রুজকে লেখা চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন:

আমি তাঁর (অর্থাৎ গান্ধীর) পদতলে বসে তাঁর নির্দে শ মেনে চলতে রাজি থাকব যদি তিনি প্রেমের সেবায় আমার দেশের মানুষদের সহযোগী হওয়ার কথা তিনি বলেন। কিন্তু ক্রোধের আগুন জ্বালিয়ে ঘরে ঘরে তা ছড়িয়ে দেওয়ার অপকর্মে আমি আমার মনুষ্যত্বের অপচয় ঘটতে দিতে চাই না। (মূল চিঠি ইংরেজিতে লেখা। বাংলা অনুবাদ বর্তমান লেখকের করা।)

১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের পর ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের হিংস্র খুনী রূপকে নিন্দা ও বিরোধিতা করে ইংরেজদের দেওয়া নাইট উপাধি ফিরিয়ে দিতে তাঁর একবিন্দু দ্বিধা হয়নি, কিন্তু সেই হিংস্র খুনী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে পাল্টা ক্রোধ ও ঘৃণার আগুনে রাষ্ট্রীয় পরিসরে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সলতে জ্বালিয়ে নেওয়ায় তাঁর কোনো সায় ছিলো না। রাষ্ট্রীয় পরিসরের রাজনৈতিক আন্দোলন আর সামাজিক পরিসরের সদর্থক আন্দোলন--- এই দুইকে তিনি কীভাবে আলাদা করে বুঝেছিলেন তা স্পষ্ট করে বুঝে নেওয়ার জন্য আমাদের আলোচনাকে আরো কিছুটা গভীরে নিয়ে যেতে হবে, বুঝে নিতে হবে ‘নেশন’ ও ‘সমাজ’ এই দুটো শব্দ রবীন্দ্রনাথের কাছে কী ব্যঞ্জনা নিয়ে ধরা দিয়েছিল। এবার তবে সেই আলোচনায় ঢোকা যাক।

প্রথমত, ১৯০১ সালে প্রকাশিত ‘নেশন কী’ প্রবন্ধেই রবীন্দ্রনাথ স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন যে ইংরেজির ‘Nation’ শব্দ আর বাংলার ‘জাতি’ শব্দদুটোকে তিনি সমার্থক বলে মনে করেন না। নেশন শব্দের অন্তর্গত ভাব আমাদের দেশীয় নয়, তা আমরা ইংরেজদের কাছ থেকে ধার করেছি। নেশন শব্দের অন্তর্গত ভাব ও ধারণা পাশ্চাত্যে উদ্ভূত, তা আমাদের দেশীয় ঐতিহ্য থেকে আসেনি। সেই সময় থেকে ১৯১৬ সালে জাপান ও আমেরিকায় তাঁর প্রদত্ত ভাষণগুলো (যা ‘Nationalism’ নামে গ্রন্থবদ্ধ হয়ে ১৯১৭ সালে প্রকাশিত হয়েছিল) অবধি তাঁর ভাবনাক্রমকে অনুসরণ করলে নেশন সম্পর্কে তাঁর ভাবনার একটা পূর্ণ আদল আমরা গড়ে উঠতে দেখি। রবীন্দ্রনাথের মতে, মানবগোষ্ঠীর জীবন যেখানে মানবিকতা ও আধ্যাত্মিকতার তলানিতে গিয়ে পৌঁচেছে, সেখানে সেই গোষ্ঠীর সংকীর্ণ আত্মস্বার্থের সংগঠিত রূপ হলো নেশন, যা জাতিরাষ্ট্র (nation-state)-এর মধ্য দিয়ে কাজ করে। এই জাতিরাষ্ট্র হলো বাণিজ্য ও রাজনীতির এমন এক যন্ত্রবিশেষ যা বিবিধ বিচিত্র মানুষদের আরোপিত শৃঙ্খলার চাপে এমন সব আঁটি-বাঁধা-দঙ্গলে পরিণত করে যা বাণিজ্য ও রাজনীতির জন‍্য কার্যকরী। এভাবে ক্ষমতার এক চুড়ো-করে-বাঁধা কাঠামোর মধ্যে তা মানুষদের সমস্ত জীবনরূপকে গিলে ফেলে সামূহিক মানবশক্তিকে অপরেরর প্রতি অসহিষ্ণু এবং অপরের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক করে তোলে। শ্রেষ্ঠতার দাবিতে আত্মপরিচয়কে রাঙিয়ে এই নেশন তখন তার জাতিরাষ্ট্রের জোরে সকল অপরকে হয় ধ্বংস নয়তো পদানত করে রাখতে চায়। আর তার এই জোরের শাসনে কোথাও ছিদ্র দেখা দিলো কি না, কোথাও অপর কেউ তাকে ছাপিয়ে গেলো কি না এই আশঙ্কায় সে সর্বদা শত্রু খুঁজে বেড়ায়, শত্রু হিসেবেই সবাইকে সন্দেহ করতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। নেশন-এর মধ্যে তাই স্বার্থান্ধ সংকীর্ণতা সমস্ত প্রবৃত্তিকে আচ্ছন্ন করে ঘৃণা ও হিংসার আবাদ গড়ে তোলে। বিশ্বসংসারে বহু বিভিন্নের মিলনসভার সমস্ত আলো নিভে গিয়ে তখন যুদ্ধবাজদের রমরমা, সাম্রাজ্যবাদের নরক গুলজার হয়ে ওঠে। পশ্চিম ইউরোপে দানা বেঁধে এই মড়ককে তার আগ্রাসী সম্প্রসারণবাদের জোরে গোটা পৃথিবীকে গ্রাস করতে উদ্যত হয়ে উঠতে দেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।

অপরদিকে, রবীন্দ্রনাথের কাছে সমাজ মানে অপর-সান্নিধ্যাকাঙ্ক্ষী মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত স্বপ্রকাশ, তা অস্তিত্বের স্বাভাবিক পরিবেশ। (বাণিজ্যিক বা রাজনৈতিক) উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার উপায় হিসেবে গড়ে তোলা (বা চাপিয়ে দেওয়া) সম্পর্কবন্ধন দিয়ে সমাজ গড়ে ওঠে না, সমাজের সম্পর্কগুলো প্রেম ও সহযোগিতার প্রবৃত্তির স্বাভাবিক প্রসারণ মাত্র। সমাজে মনুষদের মধ্যের সম্পর্কগুলো দণ্ড ও শৃঙ্খলারোপের চোখরাঙানি দিয়ে রক্ষা করতে হয় না, যে জীবনপ্রবাহের মধ্যে মানুষ তার অস্তিত্বরূপের ফুটে-ওঠা আবিষ্কার করে, সেই সংস্কৃতি-ঐতিহ্য-স্বজ্ঞা-র কৌম ঘনত্বই সমাজের সম্পর্কগুলোকে স্বাভাবিক করে তোলে। নেশন বা তার প্রায়োগিক রূপ জাতিরাষ্ট্র যেমন আঁটি-বাঁধা-দঙ্গলে বেঁধে মানুষদের প্রবৃত্তির সবচেয়ে খারাপ দিকগুলোকে বড়ো করে তুলে লোভী হিংস্র বিদ্বেষে-ভরা পারস্পরিক-যুদ্ধে-মত্ত অপমানুষে পরিণত করে, তার বিপরীতে সমাজ এমন এক প্রেম-সহযোগিতার মেলা বাঁধে যেখানে দুর্বল ও সবল, সক্ষম ও অক্ষম, ভাবুক ও কর্মী, আনমনা ও সচেতন সবাই একে অপরকে জড়িয়ে একে অপরের থেকে জীবনের রূপ-রস-গন্ধ অনুভব করে বহু বিচিত্রের মাঝে জীবনব্রত পালন করে। এই ধারণা থেকেই রবীন্দ্রনাথ ইংরেজদের তাড়িয়ে স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র গঠনের মধ্য দিয়ে  ভারতবর্ষের পরিত্রাণ সম্ভব বলে মনে করেন নি, বরং তা নেশন ও জাতিরাষ্ট্রের রাহুগ্রাসে ভারতবর্ষের তলিয়ে যাওয়াকেই আরো প্রকট করবে বলে মনে করেছেন। রাহুগ্রাসমুক্তির উপায় হিসেবে তিনি ‘স্বদেশী সমাজ’ পুনরুজ্জীবনের ব্রত নিয়েছিলেন, তাঁর স্বপ্ন ছিলো যে ভারতবর্ষ এমন এক সমাজ গড়ে তোলার উদ্বোধক হিসেবে কাজ করবে যে সমাজে বিবিধ বিভিন্ন অপরাপর (ইংরেজরাও তার থেকে বাদ নয়) প্রেম ও সহযোগিতার ভিত্তিতে পরস্পরের সদর্থকতার আদানপ্রদানে প্রত্যেকের আত্মশক্তি বিকাশের পথ উন্মুক্ত করে দেবে, জীবনদেবতার অভিসারের মধ্য দিয়ে মৌল ঐক্য অর্জন করবে। রবীন্দ্রনাথ ইতিহাসকে এইভাবে পাঠ করেছিলেন যে এই সমাজ গড়ে তোলার পথই ভারতবর্ষের ঐতিহ্য অনুসারী, নেশন-রাষ্ট্র-জাতীয়তাবাদের পথ ভারতবর্ষের ঐতিহ্যানুসারী নয়। রবীন্দ্রনাথের এই ইতিহাস-পাঠ বিষয়গত নাকি কেবলই বিষয়ীগত তা নিয়ে পৃথক আলোচনা হতেই পারে, কিন্তু এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে রবীন্দ্র-নির্দেশিত মুক্তির পথ কোনো রাষ্ট্রসংস্কার বা রাষ্ট্রবিপ্লবের পথ নয় (১৯২১-এ প্রকাশিত ‘The Call of Truth’ গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন: ‘The way of bloody revolution is not the true way, a political revolution is like taking a short-cut to nothing.’ [pg.418]), বরং সেই পথ হলো রাষ্ট্র-রাজনীতির বাইরে এমন এক সমাজ-যৌথ গড়ে তোলা যা আপন ঐতিহ্য ও অপরের হাজির করা নতুন, এই দুইকেই সমাদরে নিয়ে আত্মশক্তির বিকাশ ঘটাবে, বহু বিচিত্রের সহাবস্থানে মৌল ঐক্যের অনুভব ফুটিয়ে তুলবে।

এত অবধি এসে প্রশ্ন জাগে, রবীন্দ্রনাথ কি তবে রাজনীতি-বিরোধী? বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ ই পি থম্পসন রবীন্দ্রনাথের ‘Nationalism’ গ্রন্থের লন্ডন থেকে প্রকাশিত সংস্করণের ভূমিকা লিখতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথকে ‘anti-politics’-এর উদ্ভাবক একজন চিন্তক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এই চিহ্নায়ন কি যথার্থ? এ নিয়ে আলোচনা করতে হলে ‘রাজনীতি’ শব্দটির মধ্যে কী ভাব ও কর্মের দ্যোতনা পুরে আমরা তার অর্থনির্মাণ করছি সেই আলোচনায় ঢুকতে হবে। আলোচনার সুবিধার্থে রাজনীতি বা রাজনৈতিক ক্রিয়ার চারটি ভিন্ন সংজ্ঞায়ন ধরে এগোনো যাক।

প্রথম সংজ্ঞায়ন: প্রকৃত রাজনৈতিক ক্রিয়া হলো অন্যদের হয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া, হুকুম করে অন্যদের চালনা করা, অন্যদের উপর ক্ষমতা খাটানো এবং ঘটনাপরম্পরাকে প্রভাবিত করা। সমাজতাত্ত্বিক ম্যাক্স ওয়েবার তাঁর ‘Politics as a Vocation’ গ্রন্থে এই সংজ্ঞা হাজির করেছেন (‘…authentic political activity is deciding for others, commanding them, wielding power over them, and affecting the course of events.’) ক্রিয়াকর্তার বিষয়ীভাবের উপর চরম জোর দেওয়া এই নির্ধারণে অপরদের আর নিজেদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরিসর থাকে না (বা অপরদের নিজের হয়ে নিজে সিদ্ধান্ত নেওয়ার যোগ্য মনে করা হয় না), কর্তার হুকুম মেনে ছাড়া চলার উপায় থাকে না (বা যাতে উপায় না থাকে তা নিশ্চিত করতে চাওয়া হয়), ক্ষমতাধিপত্যে আত্মসমর্পণ করতে হয় (বা আত্মসমর্পণ করানোর প্রকৌশল উদ্ভাবিত হতে থাকে), এবং স্রোতে ভেসে চলা কুটোর মতো ঘটনার টানে ভেসে যেতে হতে থাকে। তাই এহেন রাজনীতির পরিসর আসলে মুষ্টিমেয় কিছু রাজনৈতিক কর্তাকে চরম ক্ষমতাসম্পন্ন বিষয়ী করে তুলে বাকি সবার রাজনৈতিক ক্রিয়ার অধিকারটাই কেড়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া দ্বারা চালিত হয়। রবীন্দ্রনাথ নেশন, জাতিরাষ্ট্র ও জাতীয়তাবাদের যে সমালোচনা করেছেন তা বোঝায় যে তিনি এহেন রাজনীতি-পরিসরের বিরুদ্ধে। গান্ধীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক কর্মসূচী নিয়ে যে বিতর্ক, সেখানেও রবান্দ্রনাথ বারবার গণআন্দোলন গড়ার অভিপ্রায়ে একটাই কোনো কর্তব্য বা করণীয় সার্বজনীন বলে সবার উপর আরোপ রকাক বিরোধিতা করে এসেছেন। সবাইকে চরকায় সুতো কাটতে হবে--- এর বিরোধিতাও তিনি এই কারণে করেছিলেন। প্রত্যেকে তার নিজের ধ্যান-ধারণা-বোধ-এর ভিত্তিতে নিজস্ব করতব্য নিজে নির্ধারণ করবে এবং স্বতঃক্রিয়ায় প্রবৃত্ত হবে, এটাই ছিলো তাঁর আকাঙ্ক্ষা।

দ্বিতীয় সংজ্ঞায়ন: প্রকৃত অর্থে বা নির্দিষ্ট অর্থে রাজনৈতিক ক্রিয়া হলো শত্রুর বিরুদ্ধে সংগ্রাম। ‘The Concept of the Political’ গ্রন্থে কার্ল স্খমিট (Carl Schmitt) এই সংজ্ঞা হাজির করেছেন (‘…authentically or specifically political activity is struggle against the enemy.’)। রাজনীতি নাম দিয়ে এই অবিশ্রান্ত যুদ্ধের খেলায় সবসময় শত্রুপক্ষ ও মিত্রপক্ষ নির্ধারণ করে দল পাকানো ও একে অপরের টুঁটি টিপে ধরার চেষ্টা চলতে থাকে, অনন্ত হিংসা এবং অনন্ত বিদ্বেষই আর সবকিছুকে আচ্ছন্ন করে দেয়। নেশন-জাতিরাষ্ট্র-জাতীয়তাবাদের উত্থানের মধ্য দিয়ে রাজনীতির এই রূপকেই রবীন্দ্রনাথ সর্বাত্মক হয়ে উঠতে দেখেছিলেন এবং তীব্রভাবে তার বিরোধিতা করেছিলেন, তার বাইরে বেরিয়ে অন্যতর পরিসরের সন্ধান করেছিলেন, প্রেম ও সহযোগিতা ভিত্তিক সমাজকে এরই বিরুদ্ধে দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন।

তৃতীয় সংজ্ঞায়ন: রাজনীতি হলো মতবাদ-চালিত ক্রিয়া, মতবাদ-নির্ধারিত শ্রেয়তা ও ন্যায়পরতাকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য যে কোনো উপায় তা অবলম্বন করতে পারে। রাজনীতির এই মতবাদিক নির্ধারণ উনিশ ও বিশ শতক জুড়ে দাপিয়ে বেড়িয়েছে। সাম্রাজ্যবাদী জাতিদম্ভের মতবাদ, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয়তাবাদী মতবাদ, ফ্যাসিবাদ, পুঁজিবাদী উদারতাবাদ, সমাজতন্ত্রবাদ--- এহেন বিভিন্ন প্রতিস্পর্ধী মতবাদ বিশ্বজুড়ে মানুষদের আঁটি-বাঁধা দঙ্গলে পরিণত করে অভূতপূর্ব হিংসা-দ্বেষ-হননের বহ্নুৎসব নিরবচ্ছিন্ন করে দৈত্যের আকারে রাষ্ট্র ও তার হিংসার যন্ত্রগুলোকে গড়েছে এবং ব্যক্তিমানুষ ও সমাজ সংকুচিত হতে হতে শূন্যের দ্বারে এসে পৌঁচেছে। রবীন্দ্রনাথ আবশ্যিকভাবেই এর বিরোধী ছিলেন। ১৯১৫ সালের ৭-ই জুলাই চার্লস এন্ড্রুজ-কে লেখা চিঠিতে তিনি দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেছিলেন:

এমন বহু মতবাদধারী মানুষ আছেন যাঁরা তাঁদের মতবাদকে দেবতার আসনে বসিয়ে তার পুজোবেদিতে সমগ্র মানবপ্রজাতিকে বলি দিতে উন্মুখ। নিজের মতবাদকে মুক্ত-প্রতিষ্ঠিত করার জন্য মানুষদের দাস বানাতে হবে--- এ ভাবনা ভয়ংকর অবাস্তব। (মূল চিঠি ইংরেজিতে, বাংলা অনুবাদ বর্তমান লেখকের করা।)

মানুষ তার জ্ঞান দিয়ে বিশ্বপ্রকৃতির চলার নিয়মকে বুঝে ফেলতে পারে, পশ্চিমী যুক্তিবাদ (rationalism)-এর এই প্রত্যয় কোনোদিনই রবীন্দ্রনাথ গ্রহণ করেননি। ফলে তিনি মনে করতেন না যে কোনো বৈজ্ঞানিক মতবাদের নির্ধারণের মধ্য দিয়ে বিশ্বপ্রকৃতির মূল নিয়মকে বেঁধে ফেলা যাবে এবং তারপর সেই নিয়ম অনুযায়ী ন্যায়পরতা বিধানই পৃথিবীতে স্বর্গরাজ্য গড়ে তুলবে। এই গভীর বিশ্বাসের জায়গা থেকেই রবীন্দ্রনাথ মতবাদিক রাজনীতির বিরোধী ছিলেন।

চতুর্থ সংজ্ঞায়ন: যুদ্ধাভিপ্রায়ী দুর্গকাঠামোর মধ্যে বেঁধেকষে রাজনৈতিক ক্রিয়াকে এহেন বিবিধভাবে সংজ্ঞায়িত করার বিরোধিতা করে রবীন্দ্রনাথ সমাজের খোলা প্রাঙ্গনে যৌথতা-নিবিড় অপর-সঙ্গ-অভিলাষী এমন ক্রিয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন যা বিবিধ অপরের মুক্ত প্রকাশ ও মিথষ্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে মৌল ঐক্যকে তাদের সামাজিকতার মধ্য দিয়ে উপলব্ধি ও মূর্ত করতে চাইবে। এই ক্রিয়ারর মাধ্যমে মানুষ আপন হতে বাহির হয়ে দাঁড়ায়, পার্থক্য সম্মান করে, পার্থক্য থেকে শেখে আর প্রেমপূর্ণ সহাবস্থানের ভারসাম্য গড়ে তোলে। এই সৃষ্টিকাজ কোনো চিরস্থায়িত্বের দাবি করে বসা কাঠামোকে মাথার উপর চাপিয়ে বয়ে বেড়াতে চায় না, বরং মিথষ্ক্রিয়াজাত স্বশাসনের কাঠামোটিকে নিত্য নবীকরণ করতে করতে যায়। ধাঁধার মতো করে এই স্বশাসনের কথাই তো তিনি শুনিয়েছেন যখন 'রাজা' নাটকে একজন সর্বকর্তৃত্বময় রাজা না থাকাটা যে কোনও 'ফাঁকা' নয়, বরং চরম অভিপ্রেত, তা বোঝাতে ঠাকুরদা চরিত্রটি গেয়ে ওঠেন:

আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে,

নইলে মোদের রাজার সাথে মিলবো কী স্বত্বে!

সুতরাং, রবীন্দ্রনাথ ‘anti-politics’ (অর্থাৎ, রাজনীতি-বিরোধী) নন, তিনি রাষ্ট্র-রাজনীতির বিপক্ষে এক গণ-রাজনীতির অভিপ্রায়ী। এই গণ-রাজনৈতিক ক্রিয়াটিকে রবীন্দ্রনাথ ‘স্বাভাবিকী ক্রিয়া’ হিসেবে দেখেছেন। ২৫-শে ফেব্রুয়ারি ১৯০৯ সালে শান্তিনিকেতনে আশ্রমিকদের উদ্দেশ্যে অভিভাষণে তিনি এর আহ্বান শুনিয়েছিলেন এইভাবে:

যে এক ইচ্ছা বিশ্বজগতের মূলে বিরাজ করছে তারই সম্বন্ধে উপনিষৎ বলেছেন--- স্বাভাবিকী জ্ঞানবলক্রিয়া চ। সেই একেরই জ্ঞানক্রিয়া এবং বলক্রিয়া স্বাভাবিকী। তা সহজ, তা স্বাধীন, তার উপরে বাইরের কোনো কৃত্রিম তাড়না নেই।

আমাদের ইচ্ছা যখন সেই মূল মঙ্গল-ইচ্ছার সঙ্গে সংগত হয়, তখন তারও সমস্ত ক্রিয়া স্বাভাবিকী হয়। অর্থাৎ, তার সমস্ত কাজকে কোনো প্রবৃত্তির তাড়নার দ্বারা ঘটায় না--- অহংকার তাকে ঠেলা দেয় না, লোকসমাজের অনুকরণ তাকে সৃষ্টি করে না, লোকের খ্যাতিই তাকে কোনোরকমে জীবিত করে রাখে না, সাম্প্রদায়িক দলবদ্ধতার উৎসাহ তাকে শক্তি যোগায় না, নিন্দা তাকে আঘাত করে না, উৎপীড়ন তাকে বাধা দেয় না, উপকরণের দৈন্য তাকে নিরস্ত করে না।…

অখ্যাত অজ্ঞাত দীনদরিদ্রের মদ্যেই সেই পরম মঙ্গলশক্তি যে আপনার স্বাভাবিকী জ্ঞানবলক্রিয়াকে প্রকাশ করেছেন ইতিহাসে বারম্বার তার প্রমাণ পাওয়া গেছে। হে অবিশ্বাসী, হে ভীরু, হে দুর্বল, সেই শক্তিকে আশ্রয় করো, সেই ক্রিয়াকে লাভ করো--- নিজেকে শক্তিহীন বলে বাইরের দিকে ভিক্ষাপাত্র তুলে ধরে বৃথা আক্ষেপে কাল হরণ কোরো না--- তোমার সামান্য যা সম্বল আছে তা রাজার ঐশ্বর্যকে লজ্জা দেবে।

(স্বাভাবিকী ক্রিয়া, শান্তিনিকেতন ৬, রবীন্দ্র রচনাবলী ষোড়শ খণ্ড, ২০১৬, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, পৃঃ- ৪৮৮-৪৮৯)

রবীন্দ্রনাথ বিশ শতকের প্রথম তিন দশক তাঁর লেখা অসংখ্য প্রবন্ধে ও ভাষণে তাঁর গণ-রাজনৈতিক ক্রিয়ার অভিপ্রায় হাজির করে গেছেন, ব্যাখ্যা করে গেছেন, বিশদ করে গেছেন। রক্তকরবী, রাজা, মুক্তধারা, তাসের দেশ-এর মতো নাটকগুলোয় শিল্পসুষমা ও অর্থব্যঞ্জনার বিস্ময়কর মিশেলেও তিনি এই বক্তব্য হাজির করে গেছেন। কিন্তু তখন থেকে এখন অবধি, আমরা তাঁকে কবিগুরু বলে মাথায় তুলে রাখলেও, তাঁর এই কর্ণকুহরে প্রবেশ করতে দিইনি। বারবার ডাক দিয়েও সাড়া না পাওয়ার এই বেদনা নিয়েই ১৯২৭ সালে এক ভাষণে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন:

ক্ষুধা হলেই মানুষ অন্নের স্বপ্ন দেখে। আজকাল আমাদের দেশে পোলিটিক্যাল আত্মপরিচয়ের ক্ষুধাটাই নানা কারণে সব চেয়ে প্রবল হয়ে উঠেছে। এইজন্যে নিরন্তর তারই ভোজটাই স্বপ্নে দেখছি। তার চেয়ে বড়ো কথাগুলিকেও অপ্রাসঙ্গিক বলে উপেক্ষা করবার তর্জন আজকাল প্রায় শোনা যায়।

কিন্তু এই পোলিটিক্যাল আত্মপরিচয়ের ধারা খুঁজতে গিয়ে বিদেশি ইতিহাসে গিয়ে পৌঁছতে হয়। সেই ব্যগ্রতার তাড়নায় আপনাকে স্বপ্নে-গড়া ম্যাটসিনি, স্বপ্নে-গড়া গারিবালডি, কাল্পনিক ওয়াশিংটন বলে ভাবনা করতে হয়। অর্থতত্ত্বেও তাই; এখানে আমাদের কারও কারও কল্পনা বলশেভিজম, কারও সিন্ডিক্যালিজম, কারও বা সোশ্যালিজম-এর গোলকধাঁধায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। এ-সমস্তই মরীচিকার মতো, ভারতবর্ষের চিরকালীন জমির উপরে নেই--- আমাদের দুর্ভাগ্যতাপদগ্ধ হাল আমলের তৃষার্ত দৃষ্টির উপরে স্বপ্ন রচনা করছে। এই স্বপ্ন-সিনেমার কোণে কোণে মাঝে মাঝে Made in Europe-এর মার্কা ঝলক মেরে এর কারখানাঘরের বৃত্তান্তটি জানিয়ে দিয়ে যাচ্ছে।

অজানা পথে অবাস্তবের পিছনে আমরা যেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছি সেখানে অভিভূতি-বিহ্বলতার মধ্যে আমাদের নিজের পরিচয় নেই। অথচ, পূর্বেই বলেছি নিজের ব্যক্তিস্বরূপের সত্য পরিচয়ের ভিত্তির উপরেই আমরা সিদ্ধিকে গড়ে তুলতে পারি। পলিটিকস-ইকনমিকস-এর বাইরেও আমাদের গৌরবলোক আছে, এ কথা যদি আমরা জানি তবে সেইখানেই আমাদের ভবিষ্যৎকে আমরা সত্যে প্রতিষ্ঠিত করতে পারব। বিশ্বাসহীনের মতো নিজের মতো অশ্রদ্ধা করে হাওয়ায় হাওয়ায় আকাশকুসুম চাষ করবার চেষ্টা করলে ফল পাব না।

(বৃহত্তর ভারত, রবীন্দ্র-রচনাবলী, ঊনবিংশ খণ্ড, ২০২০, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, পৃঃ-২১৭-২১৮)

রাষ্ট্রীয় রাজনীতির পথে স্বর্গরাজ্যে পৌঁছানোর বিভিন্ন মরীচিকার পিছনে দৌড়ে রাজনৈতিক ক্রিয়া যখন আজ অন্তর্বস্তুতে হিংসা-দ্বেষ-সন্দেহের হলাহল ধারণ করে ও বহির্প্রকাশে অন্তহীন যুদ্ধ-যুদ্ধোন্মত্ততা-যুদ্ধপ্রস্তুতির রূপ নিয়ে মনুষ্য-অস্তিত্বকেই নির্মূল করে দিতে উদ্যত হয়েছে, তখন এই ঘনঘোর রাতে সেই সংবেদন কী আমাদের মধ্যে অবশিষ্ট আছে যা কোন সে সকালে রবীন্দ্রনাথের দেওয়া নৈরাষ্ট্রিক রাজনীতির এই ডাক কান পেতে শুনবে?

 

 

 

0 Comments
Leave a reply