১
গাজার প্রতিটি প্যালেস্তিনীয় শবদেহ আমায় অক্ষম বলে চিহ্নিত করে।
খুনী ইজরায়েলি রাষ্ট্র আমার ঘৃণাকে জোকার বানিয়ে রাখে।
রাষ্ট্র-হিংসা-বাণিজ্য-মারণাস্ত্রের যে ককটেলকে ‘সভ্যতা’ নাম দিয়ে আমরা দৈনন্দিন কাজে-কর্মে নিরন্তর পুনরুৎপাদিত করে চলেছি, তারই জোরে গাজায় মানুষদের তাড়িয়ে শরণার্থী শিবিরে জড়ো করে তারপর তার উপর বোমা ফেলে গুলি চালিয়ে মারা হয়, খাদ্য-যোগান আটকে দিয়ে তারপর খাদ্য বিলানোর জন্য ডেকে লাইনে দাঁড় করিয়ে সেই লাইনের উপর গুলি চালিয়ে মারা হয়, অনাহারে কঙ্কালসার হয়ে যাওয়া শিশুগুলো বোমার আঘাতে টুকরো হয়ে দেওয়ালে ছিটকানো রক্তের ছোপে পরিণত হওয়া যদি বা এড়াতে পারে তবে তারা ক্ষয়ে ক্ষয়ে না খেয়ে মরে, ড্রোন-ক্ষেপণাস্ত্রের অলীক যাত্রাপথে ছাওয়া আকাশের নীচে পোড়া মাংস আর গ্যাসোলিনের গন্ধ ঘূর্ণিপাক খায়… চোখ বুজলেই আমি স্পষ্ট দেখতে পাই।
অথচ আমার সংস্কৃতি-রাজনীতি-জ্ঞানচর্চা এমন দুর্বল ও অনুর্বর যে এই নিরন্তর ঘটে-যাওয়া থামিয়ে অন্যতর কোনো সম্ভাবনা তা চাউর করতে পারে না, আর আমি বেঁচে চলি সেই আগেরই মতো, রাষ্ট্র-হিংসা-বাণিজ্য-মারণাস্ত্রের হ্যাংলা সভ্যতাকে পুনরুৎপাদিত করতে করতে, আমার বেঁচে-চলা ইজরায়েল রাষ্ট্রের মতোই আরো সব খুনী রাষ্ট্রদের অস্তিত্বের শর্ত পুষিয়ে চলে।
গাজার প্রতিটি প্যালেস্তিনীয় শবদেহ আমায় অক্ষম বলে চিহ্নিত করে। অক্ষম অক্ষম অক্ষম। ধূর্ত অক্ষম।
২
নগদ টাকায় বিক্রয়যোগ্য করে তোলার জন্য ‘সভ্যতা’-র মগডাল ও তার আশেপাশে হনুমানের মতো ঝুলে থাকা এই আমরা, প্রগতিপ্রাপ্তরা, আমাদের জীবনের প্রতিটা মুহূর্তকে নিঙড়ে আমাদের সমস্ত কথা-কাজ-প্রয়াসকে পণ্যের চেহারা দিয়েছি, দামের লেবেল সেঁটে দিয়েছি অস্তিত্বের প্রতিটি কণার গায়ে। অবিক্রয়যোগ্য বা অবিক্রিত হয়ে বাজারের প্রদর্শশালা থেকে খসে পড়ে মূল্যহীনতার অন্ধকারে নির্বাসিত হওয়া রোধের তাড়নায় আমরা নিরন্তর বাজারজাত হয়ে থাকাকেই আমাদের মোক্ষ ভেবে নিয়েছি, পিঠে-বুকে সাঁটানো দর-জানানী লেবেলটাকেই আত্মপরিচয় বলে কদর করে প্রকৃতপক্ষে আত্মপরিচয়হীন হয়েছি। সুপারমার্কেটের শো-কেস-এ সবথেকে চোখটানা সারিটিতে ওঠা বা জায়গা ধরে রাখার নিরন্তর কৌশলী প্রাণপাতই এখন আমাদের সার্বিক ক্রিয়া। মানুষ যে জগতে বাস করে সেই জগতের গণ্ডীটিকেই বিশ্বের গণ্ডী বলে মনে করে, আর তার বাইরের জগতের যে কোনো ইশারাই তার ভাবনার আকাশে জাদু বা পরাবাস্তবতার কাটা ঘুঁড়ির মতো লটকে বেড়ায়। আমরা পণ্যে রূপান্তরিত হয়ে পণ্যের জগতেই বাস করছি, পণ্যজগতটাই আমাদের বিশ্বে পরিণত হয়েছে, তাই তার বাইরের যে কোনো বস্তু বা ভাবনা প্রথমে আমাদের কাছে এক ‘এথনিক’ কৌতূহলের বিষয় হয়ে ওঠে এবং তারপর সচেতনভাবেই হোক, বা অসচেতনভাবে, আমরা সেগুলোকেও পণ্যরূপে প্রবর্তিত করে নিতে থাকি। কাঞ্চনজঙ্ঘাকে আমরা ‘দার্জিলিঙ’ নামক প্রমোদস্থানের বিজ্ঞাপনী ব্যানারে পরিণত করেছি, পাহাড় বা সমুদ্রে সুর্যোদয়-সূর্যাস্তকে লাইট-অ্যান্ড-সাউন্ড ইভেন্টে পরিণত করেছি, ধর্ষণ-বিরোধী প্রতিবাদকে আমাদের ইউ-নলা মাধ্যমকলার সাবস্ক্রিপশন বৃদ্ধিকল্পে নির্মোকে পরিণত করেছি, শিশুর হাসি বা প্রেমের চুমোকে ডিজিটাল ক্রিয়েশনে পরিণত করে লাইকও শেয়ার গুনেছি। হরেক মাল বিক্রি করতে ও হরেক ভাবে বিক্রিত হতে আমরা সিদ্ধি অর্জন করেছি। আর তাই গাজায় মৃত মানুষদের সারিও কেবল বিক্রি হতে থাকে। কখনও বিক্রি হয় সংবাদমাধ্যমের আলোকচিত্রের আকারে, কখনও বিক্রি হয় নামযশ কিনতে বাজারে নামা বিদ্বানের জ্ঞানগর্ভ নিবন্ধ হিসেবে, কখনও বিক্রি হয় সমর্থকদের আঁটি বেঁধে রাজনীতির খেলায় মাত করতে নামা খেলুড়েদের খেলার চাল হিসেবে… আবার কখনও নেহাতই আমাদের আড্ডাবাজদের ঝিমিয়ে-পড়া চায়ের আসরকে চাঙ্গা করার জন্য উত্তেজনার কোরক হিসেবে। যতো মৃত্যুর ঢল বাড়ে, অভুক্ত নর-নারী-শিশুদের মুখগুলো যতো ভয়ার্ত ও অসহায় হয়ে ওঠে, বিক্রির বাজারও ততো নয়া মালের আমদানিতে ঝাঁঝিয়ে ওঠে। আবার অনেকে হয়তো ‘ঢের এসব কেনা হয়েছে’ বলে নতুন জমকদার পণ্যের খোঁজে মুখ ফেরাতে থাকে।
৩
আমাদের রাজনীতি এই গত শতকেও ছিলো মহাকাব্যিক গঠনকার্যের কর্মসূচী আশ্রিত, নতুন মানুষ ও নতুন সমাজ গড়ার প্রকল্প ঘিরে আবর্তিত। শোষণের ইতি ঘটানো, যুদ্ধের ইতি ঘটানো, হিংসার ইতি ঘটানো সম্ভব এবং আমাদের সচেতন যৌথ প্রয়াসের মধ্য দিয়েই তা সম্ভব হয়ে উঠবে বলে বিশ্বাস আমাদের ঘিরে রেখেছিলো। কিন্তু এখন তা অতীত। সেই মহাকাব্যিক গঠনকার্যের কর্ণধার ও পথপ্রদর্শক হওয়ার দাবি করে যে লোহা-পাথরে নির্মীত বিপুল মূর্তিগুলো জনগণের মাথার উপর বিরাট নিপীড়ক রাষ্ট্র ফেঁদে বসেছিলো, কালের ক্ষয়ে তাদের দুনিয়া-কাঁপানো পতনের মধ্য দিয়ে সেইসব স্বপ্নেরও পতন ঘটেছে। সেই রাজনীতিচর্চার বিভিন্ন অভ্যাসগুলো, যেমন মিছিল-মিটিঙ-সমাবেশ-কনভেনশন বা জঙ্গী কর্মসূচী, সবই আজ অর্থ খুইয়ে বসা রঙচটা মোড়কের মতো পথে-ঘাটে উড়ে বেড়ায়, ঝাঁটা খেয়ে ময়লার ঢিপিতে এসে জড়ো হয়, আর নয়তো আমাদের এই বেচা-কেনা-সর্বস্ব ব্যবস্থায় সরকার-প্রশাসন চালানোর মিউজিকাল চেয়ার খেলায় অবতীর্ণ হওয়া পার্টি-মহাজনেদের কিম্ভূত-কিমাকার অঙ্গভঙ্গিসহ নিরন্তর আবর্তনের যাত্রাভিনয়ের অঙ্গীভূত হয়ে যায়। বামপন্থী রাজনীতির মানী মহাজনেরাও আজ বিকল্প সরকার, বিকল্প সরকারী নীতি, বিকল্প ভোটগ্রহণ ব্যবস্থা, বিকল্প অভিবাসন নীতি, বিকল্প যুদ্ধনীতি এহেন বিষয়েই তাঁদের মেধা ও মনন নিয়োজিত করেছেন। জাতিরাষ্ট্রের সীমানা মুছে দিয়ে সীমানাহীন বিশ্বের স্বপ্ন সাকার করার প্রকল্প, রাষ্ট্রহীন সমাজে সমস্ত মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে আমূল গণতন্ত্র প্রবর্তনের প্রকল্প--- এগুলো হয় তাঁদের স্মৃতি থেকে খসে পড়ে গেছে, নয়তো ‘নৈরাজ্যবাদীদের অলসকল্পনা’ বলে চিহ্নিত হয়ে আস্তাকুঁড়ে স্থান পেয়েছে। তাই আমাদের রাজনীতি আজ জাতিরাষ্ট্রের ধাপে-বাঁধা ক্ষমতা পরিসরে সব চেয়ে উপরের ধাপে আটকে পড়ে শাসন-প্রশাসনের প্রকারান্তর নিয়ে আকচাআকচিতেই সীমাবদ্ধ, ওই আকচাআকচির কাজে সাধারণ মানুষকে উলুখাগড়ার মতো ব্যবহার করাতেই তা অভ্যস্ত, সাধারণ মানুষের সক্রিয়তার মধ্য দিয়ে স্বায়ত্তশাসনের গণতন্ত্র আজ তার চিন্তাসীমারও বাইরে। গাজা নিয়ে আলোচনা করতে বসলে তাই প্যালেস্তাইন রাষ্ট্র বনাম ইজরায়েল রাষ্ট্র, হামাস বনাম ট্রাম্প-নেতানইয়াহু এমন কিছু দ্বিত্বের চক্রেই আমরা আটকে থাকি, বহু বহু গাজাবাসীর বহুত্ব-সমন্বিত স্বশাসন কল্পনা দিয়েও ছুঁতে পারি না। তাই রাষ্ট্রীয় খুনে আগ্রাসনে জনশূন্য হয়ে যাওয়া গাজার উপর ইজরায়েল ও মার্কিনী দখলদারি কায়েম হলে পর তাকে বড়লোকদের ভ্রমণের প্রমোদকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার যে পরিকল্পনা ইতিমধ্যেই ঘোষিত হয়েছে, তা হয়তো এই মৃতদেহের ঢলের উপর দিয়ে একদিন নির্লজ্জ ও অশ্লীল বাস্তব রূপে ঝকমকিয়ে উঠবে। আর ঘোষণা করবে যে আমরা অক্ষম, অক্ষম, অক্ষম, ধূর্ত অক্ষম ছাড়া আর কিছু নই।
সেপ্টেম্বর, ২০২৫
07 September, 2025
ধূর্ত অক্ষম আমরা, বোকা অক্ষম হলে হয়তো পথ খুঁজে পেতাম বের হওয়ার, আপাতত তার কোনো ক্ষিণ আলো আমার চোখে ধরা দিচ্ছে না।