ভূমিকা
কম্যুনিস্ট আন্দোলনের বর্তমান সংকটের দুটো প্রধান দিক আমাদের চিন্তাকে প্রভাবিত করেছে। সেই দিকগুলো হলো:
সমস্যার এই দুটো দিকের কারণ ও প্রতিকার খোঁজার অংশ হিসেবেই এখানে রুশ বিপ্লবের ১৯১৭-১৯২৪ পর্যায়কে আলোচনার বিষয় করে সেই পর্যায়ে শ্রমিকশ্রেণির অভিজ্ঞতাকে বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে।
এ বিষয়ে আলোচনার জন্য তথ্য ও আলোচনাসূত্রের উৎস হিসাবে আমরা বেশ কিছু পাঠ্যবস্তুকে ব্যবহার করেছি। সেই পাঠ্যবস্তু হলো ১৯১৭-১৯২৪ পর্যায়ে পিটারসবুর্গ, মস্কো ইত্যাদি অঞ্চলের শ্রমিক-আন্দোলনের নানা ওঠাপড়া, বিতর্ক-বিক্ষোভ ও শ্রমিকসাধারণের মেজাজ, মত, অবস্থান সম্পর্কে নানা বিশদ গবেষণামূলক আলোচনা, যা ১৯৯০ সালের পর রুশ মহাফেজখানায় বহু দলিল-দস্তাবেজ সরকারী নিষেধাজ্ঞা মুক্ত হয়ে প্রকাশ্যে আসার সুযোগ নিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে। এরকম কিছু বই হাতে পেয়ে ও পড়ে আমার মনে হয়েছে যে সেগুলো রুশ শ্রমিকশ্রেণির বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে ধারণাকে অনেকটা প্রসারিত করে দেয় যার উপর দাঁড়িয়ে শ্রেণিআন্দোলন, কম্যুনিস্ট কর্মী ও পার্টির মধ্যে পারস্পরিক ক্রিয়া বুঝতে সুবিধা হয়। উদাহরণস্বরূপ:
১) রেড পেট্রোগ্রাড, রিভলুশন ইন দি ফ্যাক্টরিজ, ১৯১৭-১৯১৮; লেখক—এস.এ.স্মিথ।
২) দি পেট্রোগ্রাড ওয়ার্কার্স; লেখক– ডেভিড ম্যান্ডেল।
৩) দি রাশিয়ান রিভলুশন, ১৯১৭-১৯২১; লেখক–রোনাল্ড কোওয়ালস্কি।
৪) দি রাশিয়ান রিভলুশন ইন রিট্রিট, ১৯২০-১৯২৪, সোভিয়েত ওয়ার্কার্স অ্যান্ড দি নিউ কমু্যনিস্ট এলিট; লেখক– সিমোন পিরানি।
এরকম বই আরো আছে।
এইসমস্ত পাঠ্যবস্তু পাঠের মধ্য দিয়ে যে বিষয়গুলো বুঝতে চেয়েছি, তা হলো:
১) ১৯১৭-র রাশিয়ায় বিপ্লবী পরিস্থিতি ঘনিয়ে ওঠায় শ্রমিকশ্রেণির আন্দোলন কী ভূমিকা পালন করেছিলো?
২) শ্রমিকদের শ্রেণি হিসাবে সংগঠিত রূপ ও শ্রেণিআন্দোলনের বিভিন্ন প্রকাশ কী কী ঘটেছিলো?
৩) ফেব্রুয়ারি ও অক্টোবরের ক্ষমতাদখলে শ্রমিকশ্রেণির ভূমিকা কী ছিলো?
৪) ফ্যাক্টরি কমিটি, ট্রেড ইউনিয়ন, সোভিয়েত, বিভিন্ন সমাজতান্ত্রিক পার্টি— এই বিভিন্ন সংগঠনগুলো শ্রমিকদের শ্রেণিবদ্ধ অবস্থান ও শ্রেণিসংগ্রামের নিরিখে কী ভূমিকা পালন করেছিলো?
৫) ১৯১৭–১৯২০ গৃহযুদ্ধের পর্যায়ে শ্রমিকশ্রেণির আন্দোলনের রূপ কী কী ছিলো? উপরোক্ত সংগঠনগুলোর সাথে তার সম্পর্কই বা কী ছিলো?
৬) সমাজতান্ত্রিক চাহিদা (বিশেষ করে, উৎপাদন ও বন্টন পরিচালনা ও পরিকল্পনা করার চাহিদা) শ্রমিকশ্রেণির আন্দোলনে ১৯১৭-১৯২০ পর্যায়ে কীভাবে প্রকাশিত হয়েছিলো?
৭) শিল্প, শিল্পোৎপাদন ও শিল্পশ্রমিকদের উপর গৃহযুদ্ধ ও গৃহযুদ্ধের অবসান কী প্রভাব ফেলেছিলো? শ্রমিকদের রাজনৈতিক আন্দোলন কীভাবে স্তিমিত হলো? কীভাবে শ্রেণি হিসাবে সংগঠিত অবস্থা ত্রমশঃ ধ্বংস হলো?
৮) ১৯২১ সালে নেপ চালু হওয়ার পরবর্তী পর্যায়ে শ্রমিকদের অবস্থা কী দাঁড়ালো?
৯) ফ্যাক্টরি কমিটি ও সোভিয়েতের প্রয়াণ ঘটলো কীভাবে? ট্রেডইউনিয়নগুলো কী দাঁড়ালো? পার্টির সঙ্গে শ্রমিকদের সম্পর্ক কী দাঁড়ালো?
এই প্রশ্নগুলো ধরে বিভিন্ন ভাবনা এই আলোচনায় রাখা হবে। ভাবনাগুলো কেবল ভাবনাই, কোনো সিদ্ধান্ত নয়। মোটামুটি সম্পূর্ণ একটা ভাবনা অন্যদের শিক্ষিত করার জন্য রাখা এখানে উদ্দেশ্য নয়। এ কেবল সবাই মিলে নানা দিক থেকে ভেবে, প্রশ্ন করে, নাকচ করে, নতুন করে ভেবে যৌথভাবে সম্পূর্ণতর ধ্যানধারণা গড়ে তোলার পথে এগোনোর বাসনায় কিছু পরিবর্তমান ভাবনাকে হাজির করা মাত্র।
এক
১৯১৭-র রাশিয়ায় বিপ্লবী পরিস্থিতি ঘনিয়ে ওঠায় ও ফেব্রুয়ারি বিপ্লবে
শ্রমিকশ্রেণির আন্দোলন কী ভূমিকা পালন করেছিলো?
১৯১৭-র গোড়ায় রাশিয়ার পরিস্থিতি নিয়ে রক্ষণশীল জারপন্থীর বিশ্লেষণ:
পি.এন.দুর্নোভো ছিলেন জারশাসনে পূর্বতন আভ্যন্তরীণ বিষয়ক মন্ত্রী (minister of interior) এবং প্রভাবশালী রক্ষণশীল রাজনীতিক। ১৯১৭-র ফেব্রুয়ারীতে বিপ্লবের আগে তিনি আভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির বিপদ সম্পর্কে সচেতন করে জার দ্বিতীয় নিকোলাসকে একটি গোপন মেমোরান্ডাম দেন। সেখানে তিনি লেখেন—
যেখানে জনগণ সন্দেহাতীতভাবে সমাজতান্ত্রিক নীতিসমূহ স্বভাবগতভাবে সমর্থন করে, সেই রাশিয়া উবশ্যই সামাজিক ভূমিকম্পের জন্য একটি উর্বর ক্ষেত্র।... কৃষকেরা অন্যের জমি উপহার পাওয়ার স্বপ্ন দেখে, আর শ্রমিকরা স্বপ্ন দেখে কারখানা-মালিকের সমস্ত পঁুজি ও মুনাফা আত্মসাৎ করার, আর এই চাহিদার বাইরে তাদের ভাবনাচিন্তা বেরোয় না।...আইনপ্রনয়নকারী সংস্থার (legislative institutions) সদস্যরা তাদের উপর জনগণের আস্থা নিয়ে যতোই হামবড়াই করুক না কেন, কৃষকরা দুমায় উপবিষ্ট অক্টোব্রিস্ট জমিমালিকদের চেয়ে অনেক বেশি বিশ্বাস রাখে ভূমিহীন সরকারী আধিকারিকদের উপর, আর শ্রমিকরা তাদের কারখানা-মালিক, যে আবার একজন আইনসভা-সদস্যও বটে, সে কাডেট পার্টির সমস্ত নীতিতে নিষ্ঠা প্রকাশ করলেও, তার চেয়ে অনেক বোশি আস্থা রাখে কারখানা পরিদর্শকদের উপর, যারা কি না তাদেরই মতো মজুরী-ভোগী।...
(দি রাশিয়ান রিভলুশন, ১৯১৭-১৯২১; পৃঃ১৫)
রুশ শ্রমিকদের মধ্যে সমাজতান্ত্রিক আদর্শের শিকড় চারিয়ে যাওয়া, বুর্জোয়া প্রগতিবাদী ও সংস্কারপন্থীদের উপর অনাস্থা ও তাদের শ্রেণীবোধ (পঁুজি ও মুনাফা আত্মসাতের চাহিদার মধ্য দিয়ে, মজুরীভোগীদেরই বিশ্বাসের চোখে দেখার মধ্য দিয়ে) এখানে প্রকাশিত হয়।
ফেব্রুয়ারী বিপ্লবে শ্রমিকদের ভূমিকা:
১৯১৭-র ২৩ ফেব্রুয়ারি পেট্রোগ্রাডে হাজার হাজার মহিলা-শ্রমিক ও শ্রমিক পরিবারের মহিলারা রাস্তায় নেমে আসেন রুটির অভাবের বিরুদ্ধে ক্ষোভে, শ্রমিক-নেতাদের পক্ষ থেকে শান্ত থাকার সমস্ত আর্জিকে হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে। এর ধারাবাহিকতায় পরের দিন পেট্রোগ্রাডের ২লাখ শ্রমিক ধর্মঘট শুরু করেন। ২৫ ফেব্রুয়ারি সরকারের নামানো সেনাবাহিনীর সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সরাসরি সংঘাত শুরু হয় ও ছড়িয়ে পড়ে। ২৭ফেব্রুয়ারি ঘটনাবলী নির্ণায়ক মোড় নেয় যখন সেনাবাহিনীর গোটা গোটা রেজিমেন্ট সরকারের নির্দেশ অগ্রাহ্য করে ও বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে যোগ দেয়। গড়ে তোলা হয় শ্রমিক এবং সৈন্যদের মধ্য থেকে নির্বাচিত ডেপুটিদের নিয়ে পেট্রোগ্রাড সোভিয়েত, যা দ্বৈত ক্ষমতা-র পরিস্থিতির সূচনা ঘটায়।
৩মার্চ জার পেট্রোগ্রাড ছেড়ে পালায়। রাশিয়ায় জারতন্ত্র ভেঙে পড়ে।
শ্রমিকরা কারখানায় ফিরে আসেন জয়োল্লাস নিয়ে। কিন্তু কেবল জয় উদযাপন নয়, কারখানায় তঁারা তঁাদের গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামকে নতুন পর্যায়ে শুরু করেন। পুরানো নিয়োগপত্র, পুরানো নিয়মাবলী, অত্যাচারী ম্যানেজার-সুপারভাইজরদের করা শ্রমিকদের নামের কালোতালিকা— কারখানায় কারখানায় এই সমস্ত কিছু ছিঁডে় ফেলা হয়, পুড়িয়ে ফেলা হয়। অত্যাচারী হিসাবে চিহ্নিত ম্যানেজার-সুপারভাইজারদের শ্রমিকরা কারখানা থেকে উৎখাত করে দেয়।
পুতিলভ ফ্যাক্টরিতে ডিরেক্টর ও তার সহযোগীকে খুন করে শ্রমিকরা তাদের দেহ ওবভোদনি ক্যানালে ফেলে দেয়। তিন দিনের মধ্যে শ্রমিকদের হাতে চল্লিশ জন ম্যানেজমেন্ট-কর্মী অপসারিত হয়।
বল্টিক জাহাজঘাঁটিতে কারখানা-কর্তৃপক্ষের ষাট জন সদস্যকে পদচু্যত করা হয়, কাউকে কাউকে হুইলব্যারোতে চাপিয়ে অপদস্থ করার জন্য সারা কারখানা ঘোরানো হয়।
কার্টরিজ ফ্যাক্টরিতে টেকনিকাল স্টাফদের ৮০%-কে শ্রমিকরা ছঁাটাই করে দেয়।
এরকম বহু বহু উদাহরণ আছে।
অত্যাচারী কর্তৃপক্ষ ও ম্যানেজমেন্ট কর্মীদের উৎখাত করার পাশাপাশি শ্রমিকরা কারখানায় কারখানায় নতুন সংগঠন গডে় তুলতে থাকে কারখানার কাজের পরিচালনা করার জন্য। এই সংগঠন হলো ফ্যাক্টরি কমিটি। কয়েক দিনের মধ্যেই পরের পর সব কারখানায় শ্রমিকরা নিজেদের উদ্যোগে ও উৎসাহে নিজেদের মধ্য থেকে প্রতিনিধি নির্বাচন করে ফ্যাক্টরি কমিটিগুলো গড়ে তোলে।
১৯০৫ সালের ব্যর্থ বিপ্লবপ্রচেষ্টার সময় দেশজুডে় ছড়িয়ে যাওয়া শ্রমিক-ধর্মঘট পরিচালনা করতে যে স্তারোস্তি ও স্ট্রাইক কমিটি গড়ে তোলার ও পরিচালনা করার অভিজ্ঞতা শ্রমিকদের হয়েছিলো, তার রেশ ধরে ও তার উপর ভিত্তি করে শ্রমিকরা নিজেদের উদ্যোগে এই ফ্যাক্টরি কমিটিগুলো গড়ে তুলতে থাকে। উৎপাদন পরিচালনা, পরিকল্পনা ও বন্টন– এই সমস্ত কাজে অংশ নেওয়ার জন্য শ্রমিকদের চাহিদা ও উপায়নির্মাণ এর মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হতে থাকে, যার ধারাবাহিকতায় ফ্যাক্টরি কমিটিগুলো কেবল একটা কারখানার মধ্যে আটকে না থেকে নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক-সহযোগিতা গড়ে তোলে। এর ফলস্বরূপ ১৯১৭-র ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবরের মধ্যে পেট্রোগ্রাডে সমস্ত ফ্যাক্টরি কমিটিদের কনফারেন্স হয় পাঁচবার (প্রথমটি ৩০মে—৩জুন, দ্বিতীয়টি ৭—১২অগস্ট, তৃতীয়টি ৫—১০ সেপ্টেম্বর, চতুর্থটি ১০ অক্টোবর, এবং পঞ্চমটি হয় সমস্ত রাশিয়ার ফ্যাক্টরি কমিটিদের নিয়ে প্রথম কনফারেন্স ১৭—২২অক্টোবর)। এই সমস্ত কনফারেন্সে উৎপাদন ও বন্টনের উপর শ্রমিক নিয়ন্ত্রণের রূপ ও উপায় নিয়ে আলোচনা-বিতর্ক হয়, যা নিয়ে বিশদ আলোচনায় আমরা পরে যাবো।
বলশেভিক, মেনশেভিক, এস.আর., অ্যানার্কিস্ট ইত্যাদি মতাবলম্বীরা সবাই-ই এই ফ্যাক্টরি কমিটির মধ্যে থাকতো, নিজেদের মত খোলাখুলি তর্ক-বিতর্কের সময় তুলে ধরতো, শ্রমিকরা সে সমস্ত নিয়ে আলোচনা করতো, ও ভোটের মাধ্যমে প্রস্তাব গ্রহণ করতো। ১৯১৭–১৯২০ পর্যায়ে প্রথমদিকে মেনশেভিক ও এস.আর.-দের ফ্যাক্টরি কমিটির মধ্যে প্রভাব বেশি থাকলেও, ক্রমশঃ বলশেভিকদের প্রভাব বাড়তে থাকে ও পরের দিকে বলশেভিকদের প্রভাবই প্রধান হয়ে ওঠে।
(উপরোক্ত বর্ণনা রেড পেট্রোগ্রাড, রিভলুশন ইন দি ফ্যাক্টরিজ, ১৯১৭-১৯১৮ বইয়ের তৃতীয় ও ষষ্ঠ চ্যাপ্টার-এর উপর ভিত্তি করে করা হয়েছে।)
এই ইতিহাস কি আমাদের দেখায় না যে ফেব্রুয়ারি বিপ্লবে ক্ষমতাদখল ও প্রকৃত গণতন্ত্রের উপযোগী সংগঠনসমূহ (সোভিয়েত, ফ্যাক্টরি কমিটি) গড়ে তোলা শ্রমিকদের রাজনৈতিক আন্দোলন ও সমগ্র শ্রমিকশ্রেণির উদ্যোগ-উৎসাহের উপর দাঁড়িয়ে গড়ে উঠেছিলো, কোনো পার্টির আগাম পরিকল্পনা বা উদ্যোগের মধ্য দিয়ে নয়? এখন আমরা প্রকৃত গণতন্ত্রের আর একটি মূল স্তম্ভ ও সে বিষয়ে শ্রমিকদের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করবো, যা হলো ওয়ার্কার্স মিলিশিয়া বা শ্রমিক-সেনা।
ফেব্রুয়ারি পরবর্তী দিনগুলোতে ওয়ার্কার্স মিলিশিয়া বা শ্রমিক-সেনা:
জারতন্ত্র ভেঙে পরার লক্ষণ ফুটে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে পেট্রোগ্রাডের শ্রমিকরা ঝটিকা আক্রমণের মধ্য দিয়ে জারশাসনের পুলিশ-ব্যবস্থাকে তছনছ করে দেয়। বহু পুলিশ স্টেশন ও কারাগার পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়া হয়। ৪০,০০০ রাইফেল ও ৩০,০০০ রিভলভার দখল করে নেয় শ্রমিকরা। এই অবস্থায় দুটো পরস্পর-প্রতিদ্বন্দ্বী মিলিশিয়া গড়ে ওঠে। একটি প্রশাসনিক উদ্যোগে সিভিল মিলিশিয়া। অন্যটি হলো ওয়ার্কার্স মিলিশিয়া, যা গডে় তুলতে উদ্যোগ নিয়েছিলো ফ্যাক্টরি শ্রমিকদের কিছু গোষ্ঠী।
২৮ফেব্রুয়ারি থেকে ১মার্চের মধ্যে রোজেনক্রানজ, মেটাল ওয়ার্কস, ফিনিক্স, আরসেনাল ও আরো কিছু ফ্যাক্টরির শ্রমিকরা মিলিতভাবে প্রথম ওয়ার্কার্স মিলিশিয়ার ভাইবর্গ (পেট্রোগ্রাদের একটি অঞ্চল) কমিসারিয়েত গড়ে তোলে।
ভাসিলেভস্কি অঞ্চলের শ্রমিকদের কেবল ওয়ার্কস কমিটি ১মার্চে তার প্রথম সভাতেই সিদ্ধান্ত নেয় মিলিশিয়া গঠনের, কারণ “জনগণের নিজেকেই এখন অঞ্চলের সুরক্ষার দায়িত্ব নিতে হবে।” তারা ১৮ বছরের ঊর্ধে পুরুষ বা নারী ২৭০ জন ভলান্টিয়ারের জন্য আহ্বান জানায়।
এভাবেই পেট্রোগ্রাডের সমস্ত ফ্যাক্টরি থেকে নির্বাচিত সদস্য বা ভলান্টিয়রদের নিয়ে গড়ে ওঠে ওয়ার্কার্স মিলিশিয়া। প্রতিটি ফ্যাক্টরি কমিটি তার মধ্যে মিলিশিয়া কমিশন স্থাপন করে এবং একজনকে কমিশার হিসাবে দায়িত্ব দেয় মিলিশিয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সদস্যদের ব্যাপার দেখভাল করার জন্য। মিলিশিয়া সদস্যরা কারখানায় তাদের কাজ ছেড়ে দিতো না, তারা কারখানার শ্রমিক হিসাবেই নথিভুক্ত থাকতো, এবং একটা নির্দিষ্ট সময় পরে আবার কারখানার কাজে ফিরে আসতো, অন্য কোনো শ্রমিক মিলিশিয়ায় তার জায়গা নিতো। ফ্যাক্টরি কমিটিদের চাপে মিলিশিয়ায় নিযুক্ত শ্রমিককেও কারখানা কর্তৃপক্ষ গড় বেতন দিতে বাধ্য হতো।
৭ই মার্চ সোভিয়েত এগজিকিউটিভ কমিটি সিদ্ধান্ত নেয় সিভিল মিলিশিয়ার সঙ্গে ওয়ার্কার্স মিলিশিয়াকে মিশিয়ে দেওয়ার। শ্রমিকদের মধ্য থেকে তার ব্যাপক প্রতিবাদ ওঠে। কেবল শ্রমিকরা ঘোষণা করে:
বুর্জোয়া মিউনিসিপাল ডুমার পক্ষ থেকে নামিয়ে আনা ওয়ার্কার্স মিলিশিয়ার উপর এই আঘাতের আমরা তীব্র প্রতিবাদ করছি। বর্তমান সময়ে আমাদের গণতন্ত্র একাধিক সংগ্রামের মুখোমুখি। সে সংগ্রামগুলো হলো গণতান্ত্রিক রিপাবলিকের জন্য সংগ্রাম, জারতন্তে্রর অবশিষ্ট এবং বুর্জোয়াদের সাংবিধানিক-রাজতন্ত্রী চাহিদার বিরুদ্ধে সংগ্রাম। এর জন্য ওয়ার্কার্স মিলিশিয়া-কে পপুলার সিভিল মিলিশিয়ার উপরে নেতৃত্বদায়ী অবস্থানে রাখা উচিত।
বলশেভিকরা শ্রমিকদের সমর্থন করলেও মেনশেভিক ও এস.আর.-রা দ্বিধাগ্রস্ত অবস্থান নেয়।
যে সমস্ত অঞ্চলে ওয়ার্কার্স মিলিশিয়ার কমিশারিয়াত শক্তিশালী ছিলো, সেখানে তারা সিভিল মিলিশিয়ায় তাদের অন্তর্ভুক্তি প্রতিহত করে এবং স্বতন্ত্র অবস্থান বজায় রাখে। জেলা ডুমা অন্তর্ভুক্তির জন্য চাপ তৈরীর কৌশল হিসাবে কারখানার মালিকদের কাছে আর্জি জানায় ওয়ার্কার্স মিলিশিয়ায় অন্তর্ভুক্ত শ্রমিকদের মাইনে না দিতে।
২৭ মার্চ পেট্রোগ্রাডে ওয়ার্কার্স মিলিশিয়াদের একটি যুক্ত কনফারেন্স হয়। সেখানে গৃহীত প্রস্তাবের মধ্য দিয়ে সোভিয়েত এগজিকিউটিভ কমিটি ও মিউনিসিপাল ডুমার পদক্ষেপের নিন্দা ও বিরোধিতা করা বলা হয় যে তারা “জনগণের উপর চাপিয়ে দিতে চাইছে পশ্চিম-ইউরোপীয় ঘরানার এমন এক পুলিশবাহিনী যাকে বিশ্বজুড়ে সংখ্যাধিক্য মানুষ ঘৃণার চোখে দেখে”। পাশাপাশি ওই কনফারেন্স সমস্ত পেট্রোগ্রাডবাসীকে সশস্ত্র করে তোলার বলশেভিক দের দ্বারা উত্থিত প্রস্তাব পাশ করে। বহু ফ্যাক্টরি কমিটি এই কনফারেন্সের সিদ্ধান্তকে সমর্থন করে প্রস্তাব পাশ করে।
ওয়ার্কার্স মিলিশিয়ার পাশাপাশি আর একটি সংগঠন গড়ে উঠেছিলো প্রথম থেকেই– রেড গার্ডস। রেড গার্ডস ছিলো ওয়ার্কার্স মিলিশিয়া-র তুলনায় ছোটো, বাছাই করা শ্রমিকদের সশস্ত্র সংগঠন, যার ঘোষিত লক্ষ্যই ছিলো বিপ্লবের অগ্রগতিকে সুরক্ষিত করা। ১৭ এপ্রিলের এক সভায় ওয়ার্কার্স মিলিশিয়া একটি কমিশনকে নির্বাচিত করে পেট্রোগ্রাড জুড়ে রেড গার্ডদের সংগঠনের জন্য একটি সংবিধান রচনার জন্য। কমিটিতে নির্বাচিতদের মধ্যে দুজন ছিলেন বলশেভিক, আর তিনজন মেনশেভিক। এই কমিশন ঘোষণা করে যে:
প্রতিবিপ্লবী প্রচেষ্টা যে মহল থেকেই সংগঠিত হোক না কেন, রেড গার্ডরাই তার বিরুদ্ধে ঢাল হতে পারে কারণ একমাত্র সশস্ত্র শ্রমিকশ্রেণীই রক্ষা করতে পারে বিপ্লবের ফলকে।
২২ এপ্রিল স্কোরোখোদ জুতোর কারখানার ৬,০০০ শ্রমিক যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করে যে:
মুক্ত রাশিয়ার ভিত্তিকে আক্রমণের ভয় দেখাচ্ছে অন্ধকারের শক্তিরা। আমরা যেহেতু মেহনতী মানুষের স্বার্থকে রক্ষা করতে চাই, রক্ষা করতে চাই সাধারণ রাষ্ট্রীয় স্বার্থকেও (যা একমাত্র জনগণ নিজেই রক্ষা করতে পারে), আমরা সোভিয়েতকে আহ্বান জানাচ্ছি ১০০০ জনের একটি পপুলার রেড গার্ড বাহিনী গডে় তোলার জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্র সংগ্রহে আমাদের সহায়তা করার জন্য।
এই সময়েই বলশেভিকদের প্রভাব ফ্যাক্টরি কমিটিগুলোতে বাড়তে থাকে এবং বহু ফ্যাক্টরি কমিটি রেড গার্ড বাহিনী গড়ে তোলে।
২৮এপ্রিল ভাইবর্গ জেলা সোভিয়েত ওই জেলার দুটো ওয়ার্কার্স মিলিশিয়াকে যুক্ত করে রেড গার্ড গঠন করে। ৯০টি কারখানার ১৫৬জন শ্রমিক-প্রতিনিধি ওই উদ্দেশ্যে ডাকা কনফারেন্সে অংশ নেয়। সোভিয়েত এগজিকিউটিভ কমিটি এই কনফারেন্সকে নিন্দা করে “বিপ্লবী বাহিনীর ঐক্যের উপর সরাসরি আঘাত” বলে। মেনশেভিকরা এই কনফারেন্সকে লেনিনের বলশেভিক অনুগামীদের যড়যন্ত্র বলে এর থেকে নিজেদের দূরত্ব তৈরি করে।
(উপরোক্ত বর্ণনা রেড পেট্রোগ্রাড, রিভলুশন ইন দি ফ্যাক্টরিজ, ১৯১৭-১৯১৮ বইয়ের চতুর্থ চ্যাপ্টার-এর শেষ সেকশনের উপর ভিত্তি করে করা হয়েছে।)
এইভাবেওয়ার্কার্স মিলিশিয়া ও রেড গার্ডকে কেন্দ্র করে শ্রমিক-গণতন্তে্রর যে চাহিদা শ্রমিকশ্রেণীর আন্দোলনের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হচ্ছিলো, তার সঙ্গে অন্যদের সংঘাত চলতে থাকে।
বলশেভিকরা ধারাবাহিকভাবে শ্রমিকশ্রেণীর এই চাহিদার প্রতিনিধিত্ব করা ও সংগঠিত করার চেষ্টার জন্য ক্রমশঃ শ্রমিকদের মধ্যে গৌণ শক্তি থেকে প্রধান শক্তিতে পরিণত হয়। এ ব্যাপারে আর একটি ব্যাপারও কাজ করেছিলো একইভাবে। তা হলো উৎপাদন ও বন্টন পরিচালনা ও পরিকল্পনার বিষয়ে শ্রমিকশ্রেণীর চাহিদা এবং এ ক্ষেত্রেও বলশেভিকদের ধারাবাহিকভাবে তার প্রতিনিধিত্ব করা ও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টী করা। এখন আমরা এই বিষয়ে আলোচনায় ঢুকবো।
দুই
ফেব্রুয়ারি বিপ্লব থেকে অক্টোবর বিপ্লব মধ্যবর্তী পর্যায়ে
শ্রমিকশ্রেণির আন্দোলন কী ভূমিকা পালন করেছিলো?
প্রথম ভাগের শেষে বলেছিলাম যে আমরা এবার উৎপাদন ও বন্টন পরিচালনা ও পরিকল্পনার বিষয়ে শ্রমিকশ্রেণীর চাহিদা এবং এ ক্ষেত্রেও বলশেভিকদের ধারাবাহিকভাবে তার প্রতিনিধিত্ব করা ও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা সম্পর্কে আলোচনায় ঢুকবো। এই আলোচনায় প্রবেশ করার জন্য প্রথমে আর একটু বিশদে দেখে নেওয়া যাক শ্রমিকশ্রেণীর আন্দোলন থেকে ১৯১৭ সালে জন্ম নেওয়া সেই সংগঠনগুলোকে, অর্থাৎ ফ্যাক্টরি কমিটিগুলোকে, যার মধ্য দিয়ে শ্রমিকশ্রেণীর এই চাহিদা ক্রমশঃ রূপ ধারণ করেছিলো।
ফ্যাক্টরি কমিটি— শ্রমিকশ্রেণীর গণতন্ত্রের অঙ্কুর:
১৯১৭-র ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের সময় থেকেই পেট্রোগ্রাডের শ্রমিকরা দুই ধরণের সংগঠনে সংগঠিত হয়ে ওঠেন— ট্রেড ইউনিয়ন ও ফ্যাক্টরি কমিটি। এই দুইয়ের মধ্যে তুলনামূলক আলোচনা করলে দেখা যায়:
১) ফ্যাক্টরি কমিটি গড়ে উঠতো এক একটি কারখানার সমস্ত শ্রমিকদের নিয়ে। ট্রেড ইউনিয়ন গডে় উঠতো এক একটি শিল্পশাখার শ্রমিকদের নিয়ে, যেমন ধাতুশিল্পের শ্রমিকদের ইউনিয়ন, কাঠের কাজ করা শ্রমিকদের ইউনিয়ন, বস্ত্রবয়নশিল্পের শ্রমিকদের ইউনিয়ন, মুদ্রণশিল্পের শ্রমিকদের ইউনিয়ন। অর্থাৎ একই কারখানায় বিভিন্ন ইউনিয়নভুক্ত শ্রমিক থাকতে পারে, যেমন ধরা যাক, ধাতুশিল্পের শ্রমিকদের ইউনিয়নভুক্ত ও কাঠের কাজ করা শ্রমিকদের ইউনিয়নভুক্ত শ্রমিক থাকতে পারে। কিন্তু কারখানার সমস্ত শ্রমিকই একটা ফ্যাক্টরি কমিটির অন্তর্গত।
২) কোনো শ্রমিককে ইউনিয়নভুক্ত হতে হতো প্রবেশিকা-চঁাদা ও তারপর মাসিক চঁাদা দেওয়ার মধ্য দিয়ে। ফ্যাক্টরি কমিটিতে তেমন কোনো ব্যাপার ছিলো না, কোনো কারখানার শ্রমিক হওয়ার সুবাদেই একজন সেই কারখানার ফ্যাক্টরি কমিটির সভ্য হওয়ার অধিকার স্বাভাবিকভাবেই পেতো।
৩) ট্রেড ইউনিয়নগুলোর নির্বাচিত কমিটি র সভা সাধারণত হতো কারখানার বাইরে, কিন্তু ফ্যাক্টরি কমিটির সভা হতো কারখানার মধ্যেই, দৈনিক কাজের সময়ের মধ্যেই কাজ স্থগিত রেখে।
৪) ট্রেড ইউনিয়ন ও ফ্যাক্টরি কমিটি উভয়েই বিভিন্ন রাজনৈতিক বিষয়ে আলোচনা করতো ও প্রস্তাব নিতো। তা হলেও, ট্রেড ইউনিয়নের মূল কাজ ছিলো তার সদস্যদের শ্রমশক্তি বিক্রির শর্ত উন্নয়ন করার চেষ্টা করা বা পঁুজির পক্ষ থেকে তা অবনমনের কোনো চেষ্টা রোখা। অন্য দিকে, ফ্যাক্টরি কমিটির কাজ কারখানায় শ্রমিকদের প্রাত্যহিকতার সঙ্গে যুক্ত হয়ে থাকতো কারখানায় উৎপাদনের পরিকল্পনা, কাজের বন্টন ও কাজের পরিবেশ সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে ম্যানেজমেন্টের নিত্য মোকাবিলা করার মধ্য দিয়ে।
এই সমস্ত কারণে ফ্যাক্টরি কমিটির সঙ্গে সাধারণ শ্রমিকদের সম্পর্ক ছিলো তুলনায় অনেক নিবিড়। আই. প্রিঝেলায়েভ, সেই সময়ের এক এস.আর.-মতাবলম্বী রাজনৈতিক সংগঠক লিখেছিলেন:
ফ্যাক্টরি কমিটিগুলোর যে গুরুত্বপূর্ণ গুণ আছে তা হলো এই যে তারা শ্রমিকদের খুব কাছাকাছি, সবার কাছে— এমনকি সবচেয়ে কম সচেতন শ্রমিকটির কাছেও— তা নাগালের মধ্যে এবং বোধগম্যতার মধ্যে। কারখানার জীবনের প্রতিটা খুঁটিনাটির মধ্যে তারা জড়িত আর সেই জন্যই তারা গণসংগঠনের একটি অত্যাশ্চর্য রূপ...... ট্রেড ইউনিয়নগুলো তুলনায় কম নাগালের মধ্যে কারণ তারা সাধারণ শ্রমিকদের থেকে অপেক্ষাকৃত বেশি দূরত্ব বজায় রাখে বলে মনে হয়।
১৯১৭-র ৩ সেপ্টেম্বর পেট্রোগ্রাডের রেসপিরেটর কারখানার ৭,০০০ শ্রমিকের নেওয়া প্রস্তাবে ফ্যাক্টরি কমিটিকে বলা হয়েছিলো:
শ্রমিকশ্রেণীর সবচেয়ে ভালো মুখপত্র এবং একমাত্র তা-ই পারে মেহনতী মানুষের মেজাজকে প্রকৃত বাস্তবতায় প্রতিফলিত করতে।
ফ্যাক্টরি কমিটির সাধারণ শ্রমিকদের মধ্যে প্রোথিত এই চরিত্র আরো প্রকাশ পায় তার গঠনবৈশিষ্ট্য থেকে। যে কোনো শ্রমিক, কারখানার মধ্যে তার পদ, বা তার লিঙ্গ নির্বিশেষে ফ্যাক্টরি কমিটির নির্বাচনে দাঁড়াতে পারতো ও ভোট দিতে পারতো। কেবলমাত্র ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে যুক্ত কারোর এই অধিকার ছিলো না। নির্বাচন হতো গোপন ব্যালটে। প্রথমে নির্বাচিত ফ্যাক্টরি কমিটির মেয়াদ এক বছর করা হলেও, পরে, পেট্রোগ্রাডের ফ্যাক্টরি কমিটিগুলোর দ্বিতীয় সম্মেলনে সিদ্ধান্ত নিয়ে এই মেয়াদ করা হয় ছয় মাস। কারখানার শ্রমিকদের সাধারণ সভার অধিকার ছিলো যে কোনো সময়ে সংখ্যাধিক্যের মতের ভিত্তিতে ফ্যাক্টরি কমিটিকে রিকল করার ও নতুন ফ্যাক্টরি কমিটি নির্বাচনের। কারখানার সমস্ত শ্রমিকদের সাধারণ সভায় মাসে অন্তত একবার ফ্যাক্টরি কমিটিকে তাদের সমস্ত কাজ সম্পর্কে রিপোর্ট হাজির করতে হতো আবশ্যিকভাবে। কোনো গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক প্রশ্নে অথবা কারখানা-সম্বন্ধীয় কোনো গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে সিদ্ধান্ত নেওয়ার এক্তিয়ার ছিলো একমাত্র সাধারণ সভার, সাধারণ সভা না করে নির্বাচিত কমিটির কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার এক্তিয়ার ছিলো না। সরকারী সংস্থায় কর্মরত শ্রমিকদের প্রতিনিধিদের ১৫ এপ্রিলের সভায় প্রস্তাব গ্রহণ করা হয় প্রতি মাসে নূ্যনতম একবার সাধারণ সভা ডাকতে হবে, এই সাধারণ সভা ডাকার এক্তিয়ার থাকবে নির্বাচিত ফ্যাক্টরি কমিটির অথবা কারখানার মোট শ্রমিকদের এক-তৃতীয়াংশের। পেট্রোগ্রাডের ফ্যাক্টরি কমিটিগুলোর দ্বিতীয় সম্মেলন একে কমিয়ে নিয়ম করে যে কারখানার এক-পঞ্চমাংশ শ্রমিকই সাধারণ সভা ডাকতে পারবে, তবে সেই সাধারণ সভা গ্রাহ্য হতে হলে তাতে ন্যূনতম এক-তৃতীয়াংশ শ্রমিকদের অংশগ্রহণ থাকতে হবে। যে কোনো রাজনৈতিক পার্টি বা নন-পার্টি গোষ্ঠী ফ্যাক্টরি কমিটি নির্বাচনে তাদের পক্ষ থেকে প্রার্থীবৃন্দ দিতে পারতো, যদি ৫০জন সমর্থনকারীর সই তারা সেই প্রার্থীবৃন্দের সমর্থনে দাখিল করতে পারতো। ফ্যাক্টরি কমিটির সভায় বা সাধারণ সভাতেও শ্রমিকরা তাদের রাজনৈতিক মত অনুযায়ী সংগঠিত ভাবে যৌথ প্রস্তাব রাখতে পারতো, যার উপর আলোচনা ও ভোটাভুটি করে প্রস্তাব গ্রহণ হতো।
শ্রমিক-গণতন্ত্রের যে চাহিদাকে ফ্যাক্টরি কমিটি তার গঠনের মধ্য দিয়ে মূর্ত রূপ দিয়েছিলো, তার জন্যও ১৯১৭-র ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবরের ঝোড়ো সময়ে তা শ্রমিকদের মধ্যে সবচেয়ে নিবিড়ভাবে প্রোথিত হতে পেরেছিলো।
এই ফ্যাক্টরি কমিটির মাধ্যমেই প্রধানত শ্রমিকশ্রেণী চেষ্টা করেছিলো উৎপাদন ও বন্টন পরিকল্পনা ও পরিচালনার উপায় নির্ধারণের। এবার আমরা সেই আলোচনায় ঢুকি।
(উপরোক্ত আলোচনা রেড পেট্রোগ্রাড, রিভলুশন ইন দি ফ্যাক্টরিজ, ১৯১৭-১৯১৮ বইয়ের চতুর্থ চ্যাপ্টার-এর উপর ভিত্তি করে করা হয়েছে।)
শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণ বা ওয়ার্কার্স কন্ট্রোল:
১৯১৭– ১৯১৮—তে যা নিয়ে শ্রমিকশ্রেণীর আন্দোলনের মধ্যে তুমুল আলোচনা-বিতর্ক ও প্রয়োগের বিভিন্ন চেষ্টা হয়েছিলো, সেই ‘শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণ’ মানে কী? রুশ ইতিহাসবিদ জেড.ভি.স্তেপানভ এর জবাব দিতে চেয়েছেন এভাবে:
শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণ হলো প্রোলেতারিয়ান সংগঠনদের দ্বারা কার্যকরী করা সেই সমস্ত ব্যবস্থা যা শিল্পসংস্থাগুলোর উৎপাদনমূলক ও ব্যবসামূলক কাজে হস্তক্ষেপ করার প্রয়াসের সঙ্গে, বহু হাতে হিসাবরক্ষার (multilateral accounting) আয়োজনের সঙ্গে এবং সমগ্র উৎপাদনের উপর নিয়ন্ত্রণ কায়েমের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত।
১৯১৭-র ফেব্রুয়ারি থেকে ১৯১৮-র মাঝামাঝি সময় অবধি রুশ বিপ্লবের প্রাণকেন্দ্র পেট্রোগ্রাডে শ্রমিকশ্রেণির আন্দোলন কঠিন আর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে যুঝতে যুঝতে সমাজতন্ত্রের দিকে এগোনোর জন্য তার মূল হাতিয়ার হিসাবে শ্রমিক নিয়ন্ত্রণকে মূর্ত চেহারা দিতে চেয়েছিলো। ১৯১৭-র শরৎকালে পেট্রোগ্রাডের শ্রমিকশ্রেণির আন্দোলনের মধ্য থেকে প্রথম শ্রমিক নিয়ন্ত্রণের দাবি উঠে আসে। কোনো রাজনৈতিক পক্ষ (বলশেভিক, মেনশেভিক, এস.আর., অ্যানার্কিস্ট ইত্যাদি) যে এই বিষয়ে লাগাতার প্রোপাগান্ডা চালিয়েছিলো এমনটা নয়। অ্যানার্কিস্ট বা অ্যানার্কো সিন্ডিকালিস্টরা যেভাবে পশ্চিম ইওরোপ বা আমেরিকায় শ্রমিকদের দখলে কারখানার (কোনো কেন্দ্রীয় পরিচালনা ছাড়া) মধ্য দিয়ে সমাজতন্ত্রের কথা বলে রাশিয়ায় ওঠা শ্রমিক নিয়ন্ত্রণের দাবি তার সঙ্গে মেলে না। প্রথম থেকেই রুশ শ্রমিকশ্রেণির ভাবনায় কারখানাস্তরে শ্রমিকদের সরাসরি নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে একটি কেন্দ্রীয় পরিচালনার (সোভিয়েতের মাধ্যমে বা বিপ্লবী সরকারের মাধ্যমে) প্রয়োজনীয়তাও হাজির ছিলো। রুশ শ্রমিকশ্রেণির আন্দোলনে বিকশিত হওয়া এই শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণের চাহিদা একদিকে সমাজতন্ত্রের জন্য আকাঙ্ক্ষা আর অন্যদিকে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অবস্থা— এই দুইয়ের উপজাত।
১৯১৬ সালেই প্রকট হয়ে উঠেছিলো যে রুশ অর্থনীতি সংকটাভিমুখে ধেয়ে চলেছে, ১৯১৭ সালের গ্রীষ্মে সেই সংকট খোলাখুলি আত্মপ্রকাশ করলো, তার প্রধান দিকগুলো ছিলো খাদ্য, জ্বালানি ও কঁাচামালের অভাব। কয়লা, লোহা ও ইস্পাতের উৎপাদন ভয়ংকরভাবে কমতে থাকে। তার উপর, যে জ্বালানি বা কঁাচামাল উৎপাদিতও বা হচ্ছিলো, তার বড়ো অংশও শিল্পোৎপাদনের কেন্দ্রগুলোয় পৌঁছতে পারছিলো না পরিবহণ ব্যবস্থা ক্রমশঃ ভেঙে পড়ার ফলে। এর ফলে পেট্রোগ্রাডে সংকট ক্রমশঃ লাগামছাড়া হয়ে উঠছিলো। কাঁচামালের অভাব ও দাম বেড়ে যাওয়া এবং শ্রমিকশ্রেণির আন্দোলনের জঙ্গী মেজাজের মোকাবিলা শিল্পমালিকরা করতে চাইলো ক্রমশঃ আরো বেশি বেশি করে কারখানা বন্ধ করে দেওয়া বা দেউলিয়া ঘোষণার মধ্য দিয়ে। শ্রমিকরা একে দেখলেন ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের অগ্রগতিকে নাকচ করে দেওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে চালানো মালিকশ্রেণির অন্তর্ঘাত হিসাবে। তার মোকাবিলা করার জন্য ফ্যাক্টরি কমিটিগুলো প্রথম উৎপাদনের উপর শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করার পরিকল্পনা নিলো যাতে উৎপাদন অব্যাহত রেখে ‘মালিকশ্রেণীর অন্তর্ঘাত’-কে ব্যর্থ করা যায়। পুতিলভ কোম্পানির শ্রমিকদের ওয়ার্কস কমিটি প্রথমে মে মাসে ফ্যাক্টরি কমিটিদের একটা সম্মেলন আহ্বান করে পেট্রোগ্রাডে। পারভিয়াইনেন ওয়ার্কস এর বলশেভিকদের প্রভাবিত ফ্যাক্টরি কমিটির সহযোগিতায় তারা সেই সম্মেলন করার খরচ সংগ্রহ করে। সেই সম্মেলনের উদ্বোধনী ভাষণে ভি.এম.লেভিন (যিনি রাজনৈতিক মতের বিচারে এস.আর.-পন্থী ছিলেন) সম্মেলনের মূল উদ্দেশ্যকে হাজির করেন এভাবে:
পেট্রোগ্রাডের সমস্ত কল-কারখানা সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু ম্যানেজমেন্ট বিন্দুমাত্রও তৎপরতা দেখাচ্ছে না কারখানাগুলোয় যথেষ্ট পরিমাণ কঁাচামাল ও জ্বালানির সরবরাহ বজায় রাখতে। তার ফলে বেকার হয়ে গিয়ে শ্রমিকদের পড়তে হতে পারে ক্ষুধা নামক জারের কবলে। সুতরাং, শিল্পপতি-নিয়োগকর্তাদের কোনো তৎপরতার অবর্তমানে শ্রমিকদের নিজেদেরই এ বিষয়ে তৎপরতা দেখাতে হবে। তা সম্ভব কেবল পেট্রোগ্রাডে নয় রাশিয়া জুডে় ফ্যাক্টরি কমিটিদের ঐক্যবদ্ধ সংগঠনের মধ্য দিয়ে। স্পষ্টতঃই, তা করার জন্য সর্বত্র শ্রমিকদের সংগঠনসমূহ থাকতে হবে এবং তাদের যূথবদ্ধ হয়ে সংগঠিতভাবে শিল্পোৎপাদন ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করতে হবে।
ওই সম্মেলন যে যে বিষয়ে আলোচনা করেছিলো, তা হলো— এক একটা কারখানায় উৎপাদন পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ, উৎপাদন বজায় রাখতে বিভিন্ন কারখানার উৎপাদের নিজেদের মধ্যে বন্টন, বেকারত্ব, কারখানা-সংকোচন, ট্রেডইউনিয়ন আন্দোলনে ফ্যাক্টরি কমিটির ভূমিকা, লেবার এক্সচেঞ্জ ও উপভোক্তাদের কোঅপারেটিভের সঙ্গে ফ্যাক্টরি কমিটির সম্পর্ক, সেন্ট্রাল ব্যুরো অফ ট্রেড ইউনিয়নস-এর সঙ্গে যুক্ত করে একটি ঐক্যবদ্ধ অর্থনৈতিক কেন্দ্র নির্মাণ।
৭–১২ অগস্ট ফ্যাক্টরি কমিটিরা আবার তাদের দ্বিতীয় সম্মেলনে মিলিত হয়। তার আলোচনাসূচীতে প্রধান জায়গা নিয়েছিলো তিনটি বিষয়— প্রথমত, কারখানাগুলোর অর্থনৈতিক হালহকিকত (জ্বালানি, কঁাচামাল, খাদ্য সরবরাহ, উৎপাদনের অবস্থা); দ্বিতীয়ত, শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণের বর্তমান অবস্থা ও করণীয় কর্তব্য; তৃতীয়ত, বেকারত্ব, কারখানা থেকে মালিকদের মাল বের করে নেওয়া এবং সে বিষয়ে করণীয় কর্তব্য।
প্রয়োগের স্তরে, ফ্যাক্টরি কমিটিগুলো প্রথমত জোর দেয় জ্বালানি ও কঁাচামালের সরবরাহ বজায় রাখা ও তার যথাযথ ব্যবহারের উপর। মার্চ–এপ্রিল মাসেই ভালকান ও পুতিলভ কারখানার ফ্যাক্টরি কমিটিরা জ্বালানি সংগ্রহের জন্য তৎপর হয়ে ওঠে। নেভস্কি জাহাজকারখানার ফ্যাক্টরি কমিটি একই ভূমিকা নেয় মে থেকে। এপ্রিলে পারামোনোভ লেদার ওয়ার্কস-এর ফ্যাক্টরি কমিটি কারখানায় ঢোকা ও কারখানা থেকে বেরোনো সমস্ত মালের উপর নিজেদের নজরদারী-নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে। পেট্রোগ্রাড ক্যারেজ কনস্ট্রাকশন কোম্পানিতে ৭এপ্রিল ম্যানেজমেন্ট কারখানা থেকে ডিল বোর্ড বের করে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে ওই কারখানার ফ্যাক্টরি কমিটি তা রুখে দেয়। গ্রীষ্মের গোড়া থেকে পাইপ ওয়ার্কস, আরসেনাল, রোজেনক্রানৎজ এবং অন্যত্র ফ্যাক্টরি কমিটিরা ডনবাস সহ রাশিয়ার উত্তর অঞ্চলে লোক পাঠাতে থাকে জ্বালানির খোঁজে। পুতিলভ কারখানার শ্রমিকদের ওয়ার্কস কমিটি অক্টোবরে এসে জ্বালানি সমস্যা মোকাবিলার লক্ষ্যে কিছু খনিজ জ্বালানিতে চলা ফারনেসকে জ্বালানিকাঠে চালিত ফারনেসে রূপান্তরিত করার জন্য একটা টেকনিকাল কমিশনকে নিয়োগ করে। ফ্যাক্টরি কমিটিদের সেন্ট্রাল কাউন্সিল অক্টোবরে ঘোষণা করে যে সমস্ত কারখানায় পরের তিন মাসের জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণের চেয়ে বেশি পরিমাণ জ্বালানি মজুত আছে, তাদের থেকে অতিরিক্ত জ্বালানি বাজেয়াপ্ত করে নিয়ে তা পাওয়ার স্টেশন, পরিবহণ ও খাদ্যপ্রক্রিয়াকরণের জন্য জরুরী জায়গায় সরবরাহ করবে। এমন উদাহরণ আরো বহু আছে।
বিভিন্ন কারখানার বিশেষ অবস্থা অনুযায়ী বিভিন্ন ফ্যাক্টরি কমিটির কর্মকাণ্ডে পৃথকত্ব থাকলেও সাধারণভাবে পেট্রোগ্রাড অঞ্চলের ফ্যাক্টরি কমিটির শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের বিকাশের একটা সাধারণ রূপরেখা করা যায়। এই রূপরেখায় ১৯১৭-র ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবর সময়ের মধ্যে চারটি পর্যায় লক্ষ্য করা যায়:
শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে শ্রমিকশ্রেণির আন্দোলনের মধ্যে বিকশিত হতে থাকা এই চাহিদা ঘিরে মন্হন কমিউনিস্টদের মধ্যের বিভিন্ন রাজনৈতিক মত দ্বারা কীভাবে প্রভাবিত হয়েছিলো এবার তা দেখা যাক। রাশিয়ার তীব্র অর্থনৈতিক সংকটের সমাধান হিসাবে মেনশেভিক ও এস.আর.-রা অর্থনীতির উপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ কায়েম করার পক্ষে ছিলো। বাম-মেনশেভিক মতাবলম্বী অর্থনিতিবিদ এফ.এ.চেরেভানিন এই সমাধানকে ব্যক্ত করেছিলেন এভাবে:
রাষ্ট্রকে অর্থনৈতিক জীবনে পরিকল্পিতভাবে হস্তক্ষেপ করতে হবে নিম্নোক্ত উপায়ে— উৎপাদনের বিভিন্ন শাখার মধ্যে কঁাচামাল, জ্বালানি ও যন্ত্রপাতির বন্টন ও তার উপর নিয়ন্ত্রণ; জনগণের মধ্যে ভোগ্যবস্তুর সমবন্টন; উৎপাদনের বিভিন্ন শাখাকে প্রয়োজনে জোর খাটিয়ে ট্রাস্টের চেহারা দেওয়া; ব্যাঙ্কগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা; দাম, মুনাফা এবং মজুরী নির্ধারণ করা; পঁুজিবাদী রোজগারের উপর বর্ধিত ট্যাক্স আদায়।
অর্থনীতি পরিচালনায় শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণ কখনোই কোনো কার্যকরী পথ হতে পারে বলে মেনশেভিকরা মনে করতো না, তারা মনে করতো যে তা বিশৃঙ্খলা ও বিপর্যয়েরই জন্ম দেবে, অর্থনীতির উপর একটি কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণই সমাধান হতে পারে। তা ছাড়া তাদের বক্তব্য ছিলো যে শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণ সংকীর্ণভাবে কেবল শ্রমিকদের মধ্যেই আবদ্ধ, শিল্প ও গোটা সমাজের গণতান্ত্রিক প্রশাসনে যে ভাবে সমাজের সমস্ত অংশের অংশগ্রহণ কাম্য, তা এর মধ্য দিয়ে হতে পারে না।
এস.আর.-দের কেন্দ্রীয় মতামতও ছিলো মেনশেভিকদের মতোই। তারা মনে করতো যে ফ্যাক্টরি কমিটি কোনো নির্দিষ্ট কারখানায় নিয়োগ ও ছঁাটাই নিয়ন্ত্রণে কাজ করতে পারে, কিন্তু তার বেশি কিছু নয়, উৎপাদনের গোটা প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করা তো কখনোই নয়। তাদের আশঙ্কা ছিলো যে যেভাবে ফ্যাক্টরি কমিটিগুলো শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণের রূপ দিতে চাইছে, তা অর্থনীতির খন্ডিতকরণ ঘটাচ্ছে এবং শ্রমিকশ্রেণির সঙ্গে কৃষকদের সংঘাতের পথ তৈরী করছে। এস.আর.-দের মধ্যে অবশ্য এ নিয়ে মতের বিভিন্নতা ছিলো এবং তাদের মধ্যে বামরা বলশেভিকদের কাছাকাছি মত পোষণ করতো।
১৯১৭-র আগে বলশেভিকদের শ্রমিক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কোনো ঘোষিত অবস্থান ছিলো না। ১৯১৭-তে শ্রমিকশ্রেণির আন্দোলনের বিকাশের অভিঘাতে বলশেভিকরা এই বিষয় নিয়ে তত্ত্বায়ন ও অবস্থান গ্রহণ করতে থাকে। লেনিন এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন, কিন্তু সবসময় যে তঁার অবস্থানই শেষকথা হয়েছিলো তা নয়, বলশেভিকদের মধ্যে এ নিয়ে অবস্থানের নানা বিভিন্নতা থেকে গিয়েছিলো। অর্থনৈতিক সংকট ও বিশৃঙ্খলা মোকাবিলা করতে কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে মেনশেভিকদের সঙ্গে বলশেভিকদের বিতর্ক ছিলো এই জায়গায় যে কোন রাষ্ট্রের মাধ্যমে এ নিয়ন্ত্রণ বলবৎ হবে— একটি বুর্জোয়া রাষ্ট্র না কি শ্রমিকশ্রেণীর রাষ্ট্র? ১৯১৭ সালের মে মাসে লেনিন লিখেছিলেন—
‘রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ'— আমরা তার পক্ষে। কিন্তু কার দ্বারা নিয়ন্ত্রণ? কার হাতে নিয়ন্ত্রণ থাকবে? আমলাদের হাতে, না কি সোভিয়েতের হাতে? (রুশ লেনিন রচনাবলী, ভলু্যম-৩২, পৃঃ-৪৩৮)
এর কিছু দিন পর তিনি লেখেন—
নিয়ন্ত্রণের গোটা প্রশ্নটাই তার অন্তঃবস্তুতে কেন্দ্রীভূত যে প্রশ্নে তা হলো কে কাকে নিয়ন্ত্রণ করছে, অর্থাৎ কোন শ্রেণী নিয়ন্ত্রণ করছে ও কোন শ্রেণী নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে.... শ্রমিক ও কৃষকদের দ্বারা জমিমালিক ও পঁুজিপতিদের উপর নিয়ন্ত্রণে আমেদের যেতে হবে দৃঢ়প্রতিজ্ঞভাবে ও অফেরতযোগ্যভাবে। (রুশ লেনিন রচনাবলী, ভল্যুম-৩৪, পৃঃ-১৭৫)
সেপ্টেম্বর ১৯১৭-তে লেনিন লেখেন ‘ঘনায়মান সংকট এবং কীভাবে তার মোকাবিলা করতে হবে' (The Impending Catastrophe and How to Fight It)। শ্রমিকশ্রেণি রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করার পর কী কী পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে শ্রমিকশ্রেণির রাষ্ট্র অর্থনীতির উপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে পারে তার একটা সারসংকলন তিনি এই লেখায় হাজির করেন। সেই পদক্ষেপগুলো হলো:
শ্রমিকশ্রেণীর রাষ্ট্রের দ্বারা এই কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে লেনিন কারখানায় কারখানায় ফ্যাক্টরি কমিটির মাধ্যমে শ্রমিক-নিয়ন্ত্রণের কোনো বিরোধিতা তো দেখেনই নি, বরং দ্বিতীয়টি প্রথমটির ভিত্তিভূমি হিসেবে কাজ করবে বলে ভেবেছেন। গণস্তরের উদ্যোগ ও সৃষ্টিশীলতার উপর এই ভিত্তিই বুর্জোয়া নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে শ্রমিকশ্রেণির নিয়ন্ত্রণের পার্থক্য গড়ে দেয় বলে তিনি বলেছেন:
নতুন সমাজের মৌলিক বৈশিষ্ট্য হলো গণস্তরে জীবন্ত সৃষ্টিশীলতা। নিজেদের কলে-কারখানায় শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণ গডে় তোলার কাজে হাত দিক শ্রমিকরা, রুটির পরিবর্তে গ্রামাঞ্চলকে উৎপাদিত সামগ্রীর যোগান দিক তারা। একটি সামগ্রী, একটি রুটিও যেন হিসেবের বাইরে না থাকে, কারণ সমাজতন্ত্র মানে সবার আগে হিসেবরক্ষা। উপর থেকে হুকুম দিয়ে সমাজতন্ত্র গঠিত হয় না। রাষ্ট্রীয়-আমলাতান্ত্রিক হুকুমরাজ (state-bureaucratic automatism) একদমই খাপ খায় না সমাজতন্ত্রের ভাবনার সঙ্গে। সমাজতন্ত্র হলো জৈবিক এবং সৃশ্টিশীল, তা ব্যাপক জনগণের নিজেদের কীর্তি। (রুশ লেনিন রচনাবলী, ভল্যুম-৩৫, পৃঃ-৬৩)
উপরোক্ত লেখাটি অক্টোবরের আগের। অক্টোবরের পরে তিনি লেখেন:
কেবলমাত্র তার নিজের কারখানার ব্যাপারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থেকে ফ্যাক্টরি কমিটি উপলব্ধি করুক যে সে গোটা রাষ্ট্রীয় জীবনের নির্মাণের একটি সাংগঠনিক কোষ.... অর্থনৈতিক জীবনকে সংগঠিত করার জন্য কোনো মূর্ত পরিকল্পনা হতে পারে না, হবেও না। কেউই তা করে দিতে পারে না। কেবলমাত্র জনগণই তা করতে পারে নীচের থেকে, তাদের নিজস্ব অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে। অবশ্যই পথরেখা নির্ণয় করা হবে, নির্দেশও দেওয়া হবে, কিন্তু অনতিবিলম্বে আমাদের শুরু করতে হবে উপর থেকে এবং নীচ থেকেও। (রুশ লেনিন রচনাবলী, ভল্যুম-৩৫, পৃঃ-১৪৮)
এভাবে লেনিন কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ এবং গণস্তরে উদ্যোগ-সৃষ্টিশীলতার এক দ্বান্দ্বিক সমন্বয়ের কথা বললেও বলশেভিকদের মধ্যে বিভিন্ন অংশ এই দুই দিকের কোনো একটি দিকের উপর বাড়তি জোর ফেলতেন। রিয়াজানভ, লোজোভস্কি, স্লিয়াপনিকভ, স্কিমিডট-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ বলশেভিক ট্রেডইউনিয়ন নেতারা শ্রমিক-রাষ্ট্রের দ্বারা কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণের উপরই জোর দিতেন, ফ্যাক্টরি কমিটির মাধ্যমে গণস্তরে উদ্যোগে গুরুত্ব দিতেন না। অন্যদিকে, এন.এ.স্ক্রিপনিক, ভি.এ.ছুবার, এন.কে.অ্যান্টিপভ, পি.এন.অ্যামোসোভ-এর মতো যে বলশেভিকরা ফ্যাক্টরি কমিটি আন্দোলনের সংগঠক ছিলেন, তঁারা ফ্যাক্টরি কমিটির উদ্যোগ-সৃষ্টিশীলতার গুরুত্বকে জোর দিয়ে সামনে আনতেন। এই জোর (emphasis)–এর পার্থক্য সত্ত্বেও বিভিন্ন কারখানার ফ্যাক্টরি কমিটির সভায় ও ফ্যাক্টরি কমিটির কেন্দ্রীয় সমাবেশগুলোয় বিতর্কে মেনশেভিক-এস.আর.-দের বিপরীতে বলশেভিকদের অবস্থান ক্রমশঃ শ্রমিকদের আরো বেশি বেশি করে প্রভাবশালী হয়ে ওঠে।
প্রভিশনাল সরকারের মেনশেভিকপন্থী শ্রমমন্ত্রীর ক্রমশঃ মালিক-পঁুজিপতিদের দাবীদাওয়ায় শ্রমিকদের বিরুদ্ধে গিয়ে সায় দেওয়া, শ্রমিক-সেনা ও শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণের বিরোধী অবস্থান নেওয়া ও কর্ণিলভের প্রতিবিপ্লবী অভ্যুত্থানের চেষ্টার পাশাপাশি বলশেভিকদের ভূমিকা-প্রোপাগান্ডা শ্রমিকদের ক্রমশঃ এই রাজনৈতিক অবস্থানে সংগঠিত করে তোলে যে সোভিয়েতের হাতে সমস্ত ক্ষমতা নেওয়ার মধ্য দিয়ে শ্রমিকশ্রেণীর রাষ্ট্র গড়ে তুলেই একমাত্র বিপ্লবের অগ্রগতি রক্ষা করা যাবে। ফ্যাক্টরি কমিটিরাও কেন্দ্রীয়ভাবে সোভিয়েত-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সঙ্গে যুক্তভাবেই শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার বিষয়টিকে দেখতে থাকে।
এই পরিপ্রেক্ষিতেই ২৪-২৫অক্টোবর বলশেভিকদের নেতৃত্বে ক্ষমতাদখলকে পেট্রোগ্রাডের সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমিক স্বাগত জানিয়েছিলো, শ্রমিকশ্রেণীর বিপ্লবী রাষ্ট্রের সূচনাবিন্দু হিসেবে তাকে দেখেছিলো।
অল রাশিয়ান কাউন্সিল অফ ফ্যাক্টরি কমিটিজ (সমস্ত ফ্যাক্টরি কমিটি থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাউন্সিল) এই সময় শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে ডিক্রির একটি খসড়া তৈরী করে এবং তা নিয়ে আলোচনার জন্য ২৬ অক্টোবর বসে লেনিন এবং অল রাশিয়ান কাউন্সিল অফ ট্রেড ইউনিয়ন্স-এর প্রতিনিধিদের সঙ্গে। এই খসড়া ডিক্রিতে পুরোটাই আলোচনা করা হয়েছিলো অর্থনীতি পরিচালনাকারী একটি কেন্দ্রীয় সংস্থা তৈরীর প্রশ্নে, যার আদলে পরবর্তীকালে সুপ্রিম কাউন্সিল অফ ন্যাশনাল ইকনমি (VSNKh) গঠিত হয়েছিলো। কিন্তু গণস্তরে উদ্যোগ-সৃষ্টিশীলতা, কারখানা স্তরে শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কোনো আলোচনাই করা হয় নি, যার জন্য লেনিন এই খসড়ার সমালোচনা করেন এবং নিজে দায়িত্ব নেন বিকল্প একটি খসড়া তৈরী করার। লেনিনের রচিত বিকল্প খসড়া গণস্তরে শ্রমিকদের সৃষ্টিশীলতার উপর গভীর আস্থার পরিচায়ক। ওই খসড়ায় ছোটো-বড়-মাঝারি যে কোনো কারখানা/শিল্পসংস্থার শ্রমিকদের যে যে অধিকারের স্বীকৃতি দেওয়া হয়, তা হলো—
লেনিনের করা খসড়া ফ্যাক্টরি কমিটিগুলোয় ও ট্রেড ইউনিয়নগুলোয় আলোচনার জন্য রাখা হয়। ৮নভেম্বর অল রাশিয়ান সেন্ট্রাল এগজিকিউটিভ কমিটি অফ সোভিয়েতস (VTsIK) একটি পাঁচ সদস্যের কমিটি স্থাপন করে উপরোক্ত আলোচনার উপর দাঁড়িয়ে লেনিনের করা খসড়াকে গ্রহণ-বর্জন-সংশোধনের মাধ্যমে চূড়ান্ত করার জন্য। (এই কমিটির পাঁচজন সদস্যের মধ্যে দুজন ছিলেন বলশেভিক— মিলয়ুতিন ও লোজোভস্কি, দুজন ছিলেন বাম এস.আর.—কামকভ এবং জাকস।) এই প্রক্রিয়া শেষে ১৪ নভেম্বর মিলয়ুতিন ডিক্রিটি VTsIK-তে আলোচনার জন্য পেশ করেন। মিলয়ুতিনের বক্তব্য অনুযায়ী, আলোচ্য খসড়া সম্পর্কে তিন ধরণের সমালোচনা উঠেছিলো, যে সমালোচনাগুলো হলো—
১) সমালোচকরা আপত্তি জানিয়ে বলেছেন যে কেন্দ্রীয়ভাবে পরিকল্পিত অর্থনীতি প্রতিষ্ঠিত হলে, কেবলমাত্র তার পরিপ্রেক্ষিতেই শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণের কথা বিবেচনা করা যায়।
তার জবাবে মিলয়ুতিন বলেন যে সমালোচকদের ভাবনার গন্ডী ছাপিয়ে বাস্তব ঘটনা এগিয়ে গেছে। অঞ্চলে অঞ্চলে শ্রমিকরা নিয়ন্ত্রণ কায়েম করার লক্ষে্য সংগঠন গডে় তুলে কাজ শুরু করে দিয়েছে। বিশৃঙ্খলভাবে সেই কাজ চলতে দেওয়ার বদলে এখন দরকার সেগুলোকে সমন্বিত করে শ্রমিকশ্রেণীর রাষ্টে্রর অঙ্গীভূত করে তোলা।
২) সমালোচকরা আপত্তি জানিয়েছেন যে নিয়ন্ত্রণের রাশ আলগা করে বড়ো বেশি নীচে অবধি ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
তার জবাবে মিলয়ুতিন বলেন যে আমরা নীচ থেকে নিয়ন্ত্রণের নীতির পক্ষে তাই আমরা ফ্যাক্টরি কমিটিকে নিয়ন্ত্রণের তলাকার ভিত্তি হিসাবে ধরেছি, উপরের দিকে যা কাজ করবে তাদের কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি, সোভিয়েতের প্রতিনিধি ও ট্রেড ইউনিয়নের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত কেন্দ্রীয় কমিটিদের সঙ্গে সমন্বয় রক্ষা করে।
৩) কারখানা মালিকদের বাধ্যতামূলকভাবে শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণের সংগঠনদের সিদ্ধান্ত মানতে হওয়ার বিরোধিতা কিছু সমালোচক করেছিলো এই যুক্তিতে যে তা সাধারণ অর্থনৈতিক পরিকল্পনা লাগু করার পরিপন্থী হবে।
এ বিষয়ে কারখানা মালিকদের কোনো বক্তব্য থাকলে তা তিন দিনের মধ্যে জানিয়ে মালিকরা মধ্যস্থতা দাবী করতে পারে এই শর্ত রেখে উপরোক্ত সমালোচনা খারিজ করা হয়।
এইভাবে লেনিনের করা খসড়া ‘কেন্দ্রিকতার অভাব’ ও ‘গণতান্ত্রিক আতিশয্যের’ জন্য সমালোচিত হয়। তার যে সংশোধিত রূপ শেষাবধি গৃহীত হয় তাতে খসড়ার পূর্বোক্ত ঘাটতি পূরণ করতে কেন্দ্রীয় সংস্থাসমূহের উচ্চ-নীচ ক্ষমতার এক ক্রমবিভাজন (hierarchy) ঢোকানো হয়। শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণের কারখানা স্তরের সংগঠনকে অধীন হতে হবে অঞ্চল স্তরের সংগঠনের, যাকে আবার অধীন হতে হবে অল রাশিয়ান কাউন্সিল অফ ওয়ার্কার্স কন্ট্রোল -এর। এই অধীন থাকার শৃঙ্খলা শ্রমিকদের মধ্যে গণস্তরে উদ্যোগ-সৃষ্টিশীলতা, যার উপর লেনিন আস্থা রেখেছিলেন, তাকে কীভাবে প্রভাবিত করবে, তা নিয়ে কোনো আলোচনা হয়েছিলো কি না জানা নেই।
(উপরোক্ত আলোচনা রেড পেট্রোগ্রাড, রিভলুশন ইন দি ফ্যাক্টরিজ, ১৯১৭-১৯১৮ বইয়ের ষষ্ঠ ও নবম চ্যাপ্টার-এর উপর ভিত্তি করে করা হয়েছে।)
তিন
১৯১৭-র অক্টোবর বিপ্লব পরবর্তী পর্যায়:
সোভিয়েত রাষ্ট্রের জন্ম, গৃহযুদ্ধ ও ফ্যাক্টরি কমিটি আন্দোলনের মৃত্যু
অক্টোবরে বলশেভিকদের নেতৃত্বে ক্ষমতা দখলের পর শ্রমিক, সেনা ও সমাজতন্ত্রী দলগুলোর কর্মীদের মধ্যে সাধারণ প্রত্যাশা ছিলো এটাই যে সোভিয়েতগুলোর কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটি (সেন্ট্রাল এগজিকিউটিভ কমিটি বা সি ই সি)-তে থাকা সমস্ত পক্ষের প্রতিনিধিত্ব নিয়ে একটি সরকার প্রতিষ্ঠিত করা হবে, সাংবিধানিক সভা (কনস্টিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলি) যতোদিন না হচ্ছে। ১৯১৭-র ২৬ অক্টোবর লেনিন একটি কাউন্সিল অফ পিপলস কমিশারস (সোভনারকোম) গঠনের কথা ঘোষণা করেন, যার ১৫জন সদস্যের সবাই-ই বলশেভিক। অন্য পক্ষদের প্রতিনিধিত্বের জন্য পারস্পরিক আলোচনা শুরু হয়, কিন্তু কোনো বোঝাপড়ায় আসতে অসমর্থ হয়। উক্ত ১৫ জন বলশেভিক সদস্যের মধ্যে ৫জন তখন পদত্যাগ করেন, পদত্যাগের কারণ হিসাবে তঁারা বলেন:
আমরা মনে করি যে কেবলমাত্র বলশেভিকদের দ্বারা গঠিত কোনো সরকারের পক্ষে রাজনৈতিক সন্ত্রাস জারী করা ছাড়া নিজেকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না।
এর পর, ১০-ই ডিসেম্বর, বাম এস.আর.-রা, যাঁরা শেষাবধি এস.আর. পার্টি থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করেছিলেন, তঁারা সোভনারকোম-এ যোগ দিতে রাজী হন এই শর্তে যে সোভনারকোমকে জবাবদিহি দিতে দায়বদ্ধ করা হবে সি ই সি-র কাছে। এর পর সাতজন বাম এস.আর. সোভনারকোমে যোগ দেন। এঁরা প্রধান ভূমিকা নেন ভূমিসংস্কার আইন নির্মাণে এবং তখনও অবধি বৈরী অবস্থান নিয়ে থাকা অল রাশিয়ান সোভিয়েত অফ পিজ্যান্ট ডেপুটিজ-এর অবস্থান পরিবর্তন করে সি ই সি-র মধ্যে তার অন্তর্ভুক্তিতে।
এইভাবে প্রাথমিক সোভিয়েত সরকার গঠিত হয়।
রুশ শ্রমিক, কৃষক ও সৈন্যরা অক্টোবর বিপ্লবের ক্ষমতাদখলকে এমন এক দিনবদলের সূচনা হিসাবে ধরেছিলেন যেখানে মানুষ পাবে জমি ও স্বাধীনতা, পুরানো সম্পদশালী শ্রেণীদের দমন করে প্রতিষ্ঠিত হবে সাম্য, মেহনতীরা দেশ-সমাজ চালাবে। ১৯১৮-র জুলাইয়ে সোভিয়েত সরকারের দ্বারা ঘোষিত সংবিধানে এই মেজাজই প্রতিফলিত হয়েছিলো, যখন বলা হয়েছিলো যে লক্ষ্য হলো:
মানুষের দ্বারা মানুষের উপর সমস্ত রকমের শোষণের অবসান, সমাজের শ্রেণিবিভাজনের সম্পূর্ণ অবলুপ্তি, শোষকদের দ্বিধাহীন অবদমন, সমাজের সমাজতান্ত্রিক সংগঠনের প্রতিষ্ঠা এবং সমস্ত দেশে সমাজতন্ত্রের বিজয়লাভ।
সদ্য অতীতের প্রভিশনাল গভর্নমেন্টের আট মাসের (ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবর,১৯১৭) ন যযৌ ন তস্থৌ অবস্থার সঙ্গে সম্পূর্ণ বৈপরীত্য স্থাপন করে সোভিয়েত সরকার অক্টোবর ১৯১৭ থেকে জানুয়ারী ১৯১৮-র মধ্যে ১১৬ টি ডিক্রি জারী করে বিভিন্ন বিষয়ে, যে বিষয়গুলোর মধ্যে ছিলো— শান্তিস্থাপন, জমি, শ্রমিকদের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ, বিবাহবিচ্ছেদ, তুরস্কের আরমেনিয়ানদের আত্মনিয়ন্ত্রণ, ভাষার বর্ণমালার সংস্কার ইত্যাদি। বিষয়ের বহুবিস্তৃত ব্যাপ্তি দেখিয়ে দেয় মেহনতী মানুষদের গোটা জীবনটারই একটা নতুন রূপ নির্মাণের উত্তেজনা নিয়ে সোভিয়েত সরকার কাজ শুরু করেছিলো।
সাংবিধানিক সভা (কনস্টিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলি)-র জন্য নির্বাচন ১৯১৭-র সেপ্টেম্বরেই হওয়ার কথা ছিলো। তৎকালীন প্রভিশনাল গভর্নমেন্ট তাকে তখন দুমাস পিছিয়ে নভেম্বরে হবে বলে। বলশেভিকরা তখন প্রভিশনাল গভর্নমেন্টের এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে তীব্র রাজনৈতিক প্রচার চালায় এই মর্মে যে বিপ্লবের অভ্যন্তরে জনগণের ক্ষমতার সর্বোচ্চ প্রতিরূপ এই সাংবিধানিক সভা নির্বাচন। পরবর্তীতে শ্রমিকশ্রেণির আন্দোলনের বিকাশের উপর দাঁড়িয়ে সোভিয়েতের ভূমিকা ও তৎসম্পর্কে লেনিনের তত্ত্বায়নের মধ্য দিয়ে বলশেভিকরা অবস্থান গ্রহণ করে যে সোভিয়েতগুলোর মধ্যে দিয়েই জনগণের রাজনৈতিক ক্ষমতার মূর্ত রূপ প্রকাশিত হচ্ছে এবং তারা ‘সোভিয়েতের হাতে সমস্ত ক্ষমতা’ স্লোগান কার্যকরী করার জন্যই অক্টোবর বিপ্লবের ক্ষমতাদখলের নেতৃত্ব দেয়। সুতরাং সাংবিধানিক সভা নির্বাচন সম্বন্ধে আগের অবস্থান নভেম্বরে বলশেভিকদের ছিলো না। তা সত্ত্বেও বলশেভিকরা নভেম্বরে সাংবিধানিক সভা নির্বাচন সংগঠিত হওয়ার পক্ষেই ছিলো।
সংবিধান সভা নির্বাচনে মোট ৪কোটি ৮৪লক্ষ ভোট পড়েছিলো, যা ভাগাভাগি হয়েছিলো এইভাবে—
এস.আর.— ১ কোটি ৯১ লক্ষ
বলশেভিক— ১ কোটি ০৯ লক্ষ
কাদেত— ২২ লক্ষ
মেনশেভিক— ১৫ লক্ষ
অ-রুশ সমাজতন্ত্রী দলসমূহ (যারা মূলত এস.আর.-দের প্রতি সহানুভূতিশীল)— ৭০ লক্ষ
এস.আর.-রা গ্রামাঞ্চলের অধিকাংশ ভোট পেয়েছিলো। বলশেভিকরা শহরাঞ্চলের শ্রমিকদের ভোটের সিংহভাগ পেয়েছিলো, তাছাড়াও ৫৫ লক্ষ সেনাদের ভোটের ৪২% পেয়েছিলো। বলশেভিকদের জনসমর্থনের তুঙ্গমুহূর্ত ছিলো এটি। এতৎসত্ত্বেও সাংবিধানিক সভায় এস.আর.-দের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিলো প্রশ্নাতীত। এস.আর.-রা ছিলো সোভিয়েতের হাতে ক্ষমতা এবং শ্রমিকদের দ্বারা নিয়ন্ত্রণের বিরোধী, অন্যদিকে বিপ্লবের প্রাণকেন্দ্র হিসাবে কাজ করা পেট্রোগ্রাদের শ্রমিক-মেহনতী ও সেনাদের কাছে প্রধান বিষয় ছিলো ওই দুটিই। এর ফলে সংবিধান সভাকে ঘিরে উত্তেজনা তুঙ্গে ওঠে। সংবিধান সভার পক্ষে প্রদর্শনকারীদের উপর গুলি চালায় রেড গার্ড। এই পরিস্থিতিতেই ৫-ই জানুয়ারী সংবিধান সভার অধিবেশন শুরু হয়। বলশেভিকরা চেয়েছিলো যে সোভিয়েত ক্ষমতা এবং শ্রমিকদের দ্বারা নিয়ন্ত্রণকে স্বীকৃতি দিক সংবিধান সভা, সেজন্য তারা চেষ্টা করেছিলো যাতে বাম-এস.আর. প্রতিনিধি সংবিধান সভার সভাপতি নির্বাচিত হয়। কিন্তু তাদের চেষ্টা ব্যর্থ হয়। ডান-এস.আর. চেরনভকে সভাপতি নির্বাচিত করে সংবিধান সভা সোভিয়েত ক্ষমতাকে আলোচ্যবস্তু নির্ধারণ করে। বলশেভিক-সমর্থক সেনারা প্রত্যাঘাত করে। প্রথম অধিবেশনের শেষে বলশেভিক-সমর্থক সেনারা অধিবেশনের মধ্যে ঢুকে সংবিধান সভাকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করে।
এর পর বিভিন্ন প্রদেশে সোভিয়েত ক্ষমতার প্রতিষ্ঠা সম্পন্ন হয় শ্রমিক, সেনা ও গ্রামের গরিবদের শক্তিতে ভর করে। পেট্রোগ্রাড যার অন্তর্গত, সেই কেন্দ্রীয় শিল্পাঞ্চল এবং উরাল অঞ্চলের খনিঅঞ্চলগুলোয়, যে সমস্ত জায়গায় জনসংখ্যায় শ্রমিক-মেহনতীরা প্রধান, সেখানে বলশেভিকদের পক্ষে সমর্থন ছিলো সবচেয়ে বেশি এবং সোভিয়েত ক্ষমতাও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো সবচেয়ে মসৃণভাবে। ভোলগার তীরবর্তী অঞ্চল, মস্কো যার অন্তর্গত, যেখানে শিল্প-কারখানা তুলনায় কম, সেখানে সোভিয়েত ক্ষমতা প্রতিষ্ঠায় মূল ভূমিকা নিয়েছিলো রেড আর্মি, যার মধ্যেও সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিলেন শ্রমিক-ভলান্টিয়াররা। গ্রামাঞ্চলে এই প্রক্রিয়া দীর্ঘায়ত হয়েছিলো, বহু আাঁকবাঁকের মধ্য দিয়ে গিয়েছিলো।
সোভিয়েত সরকারের জারি করা বিভিন্ন ডিক্রির কথা আমরা আগে উল্লেখ করেছি। তার মধ্যে শ্রমিকদের দ্বারা নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি নিয়ে আমরা আগে আলোচনা করেছি। অন্য দুটি প্রধান বিষয়— শান্তিস্থাপন ও জমি নিয়ে এখন আলোচনা করা যাক।
১৯১৭ সালের ২৬ অক্টোবর সোভিয়েত সরকার প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বিবদমান সব পক্ষের প্রতি আহ্বান জানায় শান্তিপ্রতিষ্ঠার জন্য আলোচনা শুরু করতে। সেই আহ্বানে বলা হয় যে যার সাপেক্ষে এই আলোচনা শুরু হতে হবে তা হলো এই যে কোনো পক্ষ কোনো দখলদারী কায়েম করার বা ক্ষতিপূরণ আদায় করার মানসিকতা নেবে না এবং জাতিগতভাবে সংখ্যালঘুদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার মেনে নেবে। এর পাশাপাশি সোভিয়েত সরকার যুদ্ধের মিত্রপক্ষের মধ্যে হওয়া বিভিন্ন গোপন চুক্তি সর্বসমক্ষে প্রকাশ করে দেয় সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রনীতির বিভিন্ন নোংরা ষড়যন্ত্রকে উন্মুক্ত করে দেওয়ার জন্য। অবাক হওয়ার কিছু নেই যে সোভিয়েত সরকারের এই প্রস্তাবে যুদ্ধকারীরা কোনো সদর্থক সাড়া দেয় নি। ফলে শান্তিপ্রতিষ্ঠার জন্য সোভিয়েত সরকারের কাছে জার্মানির সঙ্গে পৃথক চুক্তি করা ছাড়া আর কোনো পথ খোলা থাকলো না। এই সুযোগে জার্মানি যে সমস্ত শর্ত হাজির করলো তা অত্যন্ত কড়া এবং বলশেভিক সেন্ট্রাল কমিটির সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ তা মানতে রাজি হলো না। ইতিমধ্যে ১৯১৮ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি জার্মান সেনা হাইকম্যান্ডের নির্দেশে ৭লাখ জার্মান সেনা রুশ অঞ্চলের মধ্যে ঢুকে দখলদারি কায়েম করে বসে, প্রায় কোনো প্রতিরোধের মুখেই তাদের পড়তে হয় নি। এর উপর দাঁড়িয়ে ২৩ শে ফেব্রুয়ারি জার্মানি আবার নতুন দফা শর্ত প্রস্তাব করে যা আগের তুলনায় আরো কড়া ও অবমাননাকর। সেই সন্ধ্যার বলশেভিকদের সেন্ট্রাল কমিটি মিটিঙ-এ দীর্ঘ বিতর্ক ও আলোচনার পর ভোটাভুটি হয়। লেনিনের দেওয়া শর্ত মেনে নেওয়ার প্রস্তাব সাতটি ভোট পায়, ট্রটস্কির দেওয়া কোনো কিছু না করার প্রস্তাব চার ভোট পায় এবং বামদের দেওয়া জার্মানির বিরুদ্ধে বিপ্লবী যুদ্ধের প্রস্তাব চার ভোট পায়। লেনিনের প্রস্তাব গৃহীত হয়। ফলস্বরূপ ১৯১৮-র ৩-রা মার্চ ব্রেস্ট-লিটভস্ক-এ জার্মানির সঙ্গে শান্তিচুক্তি সই হয়। এর ফলে জার্মানির কাছে বল্টিক উপত্যকা, ইউক্রেন ও বেলোরুশিয়ার বড় অংশকে হারাতে হয়। এর ফলে বিপ্লব-পূর্ব রাশিয়ার কৃষিজমির এক-তৃতীয়াংশ, রেলপথের এক-তৃতীয়াংশ, তেল ও তুলো উৎপাদনকারী অঞ্চলের প্রায় গোটাটা এবং কয়লা ও লোহা উৎপাদনকারী অঞ্চলের তিন-চতুর্থাংশ সোভিয়েত সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। সামাজিক-অর্থনৈতিক গঠনকার্যের জন্য সহায়ক শান্তিপ্রতিষ্ঠার জন্য এভাবে বড় মূল্য চুকোতে হয়।
জমির ডিক্রির মাধ্যমে আইনী বৈধতা দেওয়া হয়েছিলো অকৃষক জমিমালিক, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এবং রাজার মাকিানায় থাকা যে কোনো জমির উপর দখল কায়েম করে কৃষকদের মধ্যে বন্টনকে। কৃষকদের কমিউনগুলোর উপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছিলো দখল করা জমির ভাগবন্টনের দায়িত্ব। এই ডিক্রি বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলো এবং গ্রামাঞ্চলে বিপুল সক্রিয়তার জন্ম দিয়েছিলো। ১৯১৭-র নভেম্বর থেকে ১৯১৮-র জানুয়ারির মধ্যে কেন্দ্রীয় কালো মাটির অঞ্চলে ভূতপূর্ব জমিমালিকদের মালিকানায় থাকা জমির তিন-চতুর্থাংশ দখল ও পুনর্বন্টন হয়ে যায়। অবশ্য সব জায়গায় ছবি একরকম ছিলো না— অনেক জায়গায় অকৃষক জমি-মালিকদের হাতে তেমন বেশি জমি না থাকায় পুনর্বন্টনের জন্য খুব বেশি জমি পাওয়া যায় নি। আর একটা বিষয় নিয়েও সোভিয়েত সরকার এইসময় উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলো। তা হলো এই যে রাশিয়া ও ইউক্রেনের ব্যবসায়িক চাষে নিয়োজিত উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারকারী বড় খামার ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে বন্টন হওয়ার মধ্য দিয়ে উৎপাদনশীলতা কমে যাওয়া।
এর পর সদ্যগঠিত সোভিয়েত সরকারকে যেতে হয় এক কঠিন পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেখানে তাকে দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করতে হয় নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য। এই পর্যায় হলো ১৯১৮–১৯২২ সময়কাল জুডে় গৃহযুদ্ধের পর্যায়। এবার আমরা সেই দিকে চোখ ফেরাই।
অক্টোবর বিপ্লবের আগেই জারপন্থী সেনানায়ক কর্ণিলভের বাহিনী ক্ষমতাদখলের প্রচেষ্টা করে। ওয়ার্কার্স মিলিশিয়া ও রেডগার্ড-এর প্রতিরোধ তা ব্যর্থ করে।
১৯১৭-এর ডিসেম্বরে সোভিয়েত ক্ষমতার পক্ষে থাকা রেড গার্ড ও লাটভিয়ান রাইফেলমেনদের বাহিনী ইউক্রেন অভিযান করে। ডন ও কুবান অঞ্চলের কৃষকদের মধে ভিত্তি করে গড়ে ওঠা সোভিয়েত ক্ষমতার বিরোধী ভলান্টিয়ার আর্মির সঙ্গে সংঘাত চলে ফেব্রুয়ারি অবধি। অবশেষে রেড গার্ডরা সোভিয়েত-বিরোধী সেনাকে ছত্রভঙ্গ করে ইউক্রেনে সোভিয়েত ক্ষমতার প্রতিষ্ঠার পথ উন্মুক্ত করে।
এই দুটি ঘটনার মধ্যে গৃহযুদ্ধের পূর্বাভাস থাকলেও, প্রকৃত অর্থে গৃহযুদ্ধ শুরু হয় ১৯১৮-র মে মাসে যখন চেক লিজিয়ন-এর ৩৮,০০০ সেনা বলশেভিক নেতৃত্বাধীন সোভিয়েত সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। এই চেক লিজিয়ন জার সরকার তৈরী করেছিলো অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় যুদ্ধবন্দীদের মধ্য থেকে। কয়েক মাসের মধ্যে চেক লিজিয়ন ভলগার পূবে বিস্তীর্ণ এলাকার উপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে এবং বলশেভিকদের ক্ষমতাচু্যত করার লক্ষ্য নিয়ে ওইসব এলাকায় এস.আর.-দের সরকার-গঠনে সাহায্য করে। এই এস.আর. সরকার সংবিধান সভার পুনর্গঠন ও ব্রেস্ট-লিটভস্ক চুক্তি অগ্রাহ্য করে জার্মানির সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। বলশেভিকদের তা দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
সোভিয়েত সরকারের কমিশার অফ ওয়ার ও বলশেভিক নেতা ট্রটস্কি স্থির করেন যে পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে তদানীন্তন রেড গার্ড ও অন্যান্য সোভিয়েত বাহিনী (যা মূলত শ্রমিক ও অন্যান্য মেহনতীদের মধ্য থেকে ভলান্টিয়ারদের দিয়ে তৈরী) যথেষ্ট নয়, তাই তার জায়গায় প্রথাগত সৈন্যবাহিনী গঠন করতে হবে। এই নিয়ে বিতর্ক হয়। উল্টোদিকের মত ছিলো যে সমাজতান্ত্রিক সমাজে শ্রমিক ও অন্যান্য নাগরিকদের মধ্য থেকে ভলান্টিয়ারদের নিয়ে গঠিত মিলিশিয়া ছাড়া অন্য কোনো সেনাবাহিনী থাকতে পারে না। নতুন রেড আর্মি গঠনের বিঞ্জপ্তি জারি হলে ৩লাখ ৬০হাজার জন ভলান্টিয়ার করেন। চেক লিজিয়নের বিদ্রোহ পরবর্তী পরিস্থিতিতে তা যথেষ্ট নয় বলে ট্রটস্কি ১৯১৮-র ২৯ মে বাধ্যতামূলক সেনা সংগ্রহ (conscription) বিপ্লবের পর এই প্রথম আবার চালু করেন। মূলত কৃষকদের মধ্য থেকে সংগ্রহ করা এই বাধ্যতামূলক সেনাদের শৃঙ্খলাবদ্ধ করার জন্য বিভিন্ন কড়া পদক্ষেপ নেওয়া হয়, যার মধ্যে অতিদ্রুত বিচার করে মৃত্যুদন্ড (summary execution) এবং দোষীনির্ণয়ে গোটা ইউনিটকে মেরে ফেলার মতো জার আমলের প্রথাকে ফিরিয়ে আনা হয়। এর পর ট্রটস্কি নেন সেই সিদ্ধান্ত যা নিয়ে সব চেয়ে বেশি বিতর্ক হয়েছিলো। সে সিদ্ধান্ত হলো জার আমলের সেনা অফিসারদের সামরিক বিশেষজ্ঞ হিসাবে নিয়োগ করা— সামরিক অভিযানের নেতৃত্ব তারা দেবে, তাদের উপর নজর রাখবে রাজনৈতিক-সামরিক কমিশাররা। এই অফিসাররা যেহেতু সোভিয়েত ক্ষমতার প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলো না, তাই সোভিয়েত ক্ষমতার পক্ষে তাদের কাজ করাকে নিশ্চিত করতে এদের পরিবারকে নজরের মধ্যে রাখা হতো, তাদের বিশ্বাসঘাতকতার ফল হবে তাদের পরিবারের ধ্বংস এটা তাদের কাছে স্পষ্ট করে দেওয়া হতো। ট্রটস্কি তঁার বিখ্যাত হেডকোয়ার্টার্স ট্রেন করে গোটা গৃহযুদ্ধের পর্যায়ে যুদ্ধের সমস্ত ফ্রন্টে ঘুরে সামনে থেকে রেড আর্মিকে নেতৃত্ব দিয়ে প্রবাদপ্রতিম হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু তঁার কর্তৃত্বমূলক (authoritative) কার্যপদ্ধতি তঁার সম্পর্কে বহুজনের বিরূপতাও তৈরী করেছিলো— এর সবচেয়ে সংগঠিত চেহারা দেখা গিয়েছিলো ১৯১৯-এর মার্চে বলশেভিক পার্টির অষ্টম পার্টি কংগ্রেসে, যেখানে ট্রটস্কির বিরোধিতায় গঠিত মিলিটারি অপোজিশন (যার অন্যতম সমর্থক ছিলেন স্তালিন) রেড আর্মির লাগামহীন কেন্দ্রীভূতকরণের বিরোধিতা করেছিলো। ১৯২০-র বসন্তে রেড আর্মি সংখ্যাগতভাবে ৫০লাখ ছাড়িয়ে যায়। যুদ্ধের বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন ফ্রন্টে যুদ্ধরত সেনার সংখ্যা গড়ে অনধিক ৫লাখ হলেও, এই বিপুল সংখ্যক বাহিনী মজুত রাখা বাধ্যতামূলক হয়ে দাঁড়াচ্ছিলো কড়া নিয়ম-শৃঙ্খলা সত্ত্বেও বড় সংখ্যক সেনার বাহিনী থেকে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা অবিরত থাকায়। এই রেড আর্মি নিশ্চিতভাবেই গৃহযুদ্ধে সোভিয়েত সরকারের বিজয়লাভের প্রধান কারিগর ছিলো, কিন্তু অপরপক্ষে, যা ছিলো সোভিয়েত ক্ষমতার অন্যতম প্রধান স্তম্ভ , সেই রেড গার্ড ও শ্রমিক মিলিশিয়ার শেষ ঘটিয়ে সামরিক বাহিনীর মধ্যে জারবাহিনীর বেশ কিছু চরিত্র ফিরিয়ে এনেছিলো।
গৃহযুদ্ধে সোভিয়েত ক্ষমতার বিরোধীরা বলশেভিক-বিরোধিতার সূত্রে গাঁথা থাকলেও তাদের মধ্যে বিবিধ পার্থক্য বিস্তর ছিলো। এস.আর.-রা তাদের বিশেষ সমাজতান্ত্রিক অবস্থানের সঙ্গে বিভিন্ন জারপন্থী, ধর্মীয় ও জাতিয়তাবাদী অবস্থানের একটা সহাবস্থান তৈরী করতে চেয়ে ব্যর্থ হয়েছিলো। এটা সবচেয়ে প্রকট হয় ১৯১৮-র ১৮ নভেম্বর যখন কসাক অফিসাররা ওমস্ক ডিরেক্টরির এস.আর. সদস্যদের গ্রেফতার করে জারপন্থী অ্যাডমিরাল কোলচাক-কে সর্বোচ্চ শাসক (supreme ruler) ঘোষণা করে। এর পর থেকে এস.আর.-রা নিজেদের গুটিয়ে নেয় এবং গৃহযুদ্ধ হয়ে দাঁড়ায় লাল বলশেভিকদের সঙ্গে শ্বেত বিরোধীদের যুদ্ধ। এই শ্বেত বিরোধীপক্ষে কেউ ছিলো জারতন্ত্রী, কেউ ছিলো সামরিক শাসনের পক্ষে, কেউ নতুন সংবিধান সভার পক্ষে। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে পরস্পরবিরোধী বিভিন্ন অবস্থানের জন্য তাদের দখলে আসা এলাকায় কোনো সমজ্ঞস শাসননীতি বহাল করা তাদের পক্ষে অসম্ভব হয়েছিলো। এতৎসত্ত্বেও, সাধারণভাবে, তাদের দখলে কোনো এলাকা এলে সেখানে সোভিয়েত সরকারের জমির ডিক্রির ফলে হওয়া ভূমিসংস্কারকে উল্টে পুরানো অভিজাত জমিমালিকদের হাতে জমি ফিরে যাওয়ার ঘটনা ঘটছিলো, ফলে তারা দ্রুতই ব্যাপক কৃষকদের সমর্থন হারাচ্ছিলো। এছাড়াও জারশাসনে নিপীড়িত বিভিন্ন জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের আকাঙ্ক্ষার প্রতি এরা সহানুভূতিশীল না হওয়ায় সে সমস্ত জাতি-অধ্যুষিত এলাকাতেও এরা সমর্থন হারাচ্ছিলো। বলশেভিকদের ঘোষিত নিপীড়িত জাতিদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের নীতি এই সমস্ত জাতিদের কাছে তুলনায় অনেক আকর্ষণীয় ছিলো। সামরিক প্রশ্নের পাশাপাশি এই সমস্ত দিকও ক্রমশঃ ১৯২০-র শরৎ নাগাদ স্পষ্ট করে দেয় যে লাল ক্ষমতার বিজয়লাভ সময়ের অপেক্ষা শুধু।
(উপরোক্ত আলোচনা এস.এ.স্মিথ-এর দি রাশিয়ান রিভলুশন: এ ভেরি সর্ট ইনট্রোডাকশন বইয়ের দ্বিতীয় চ্যাপ্টার-এর উপর ভিত্তি করে করা হয়েছে।)
এই সময়ে এসে সোভিয়েত সরকারের সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছিলো রেড আর্মি— গুরুত্ব বিচারেই হোক বা সরকারী রসদ বন্টনের ভাগিদারীতেই হোক। ফ্যাক্টরি কমিটি ও সোভিয়েতের মধ্যে যে শ্রমিকশ্রেণীর সক্রিয়তা সোভিয়েত সরকার প্রতিষ্ঠায় মূল ভূমিকা নিয়েছিলো, তার অবস্থা কী দাঁড়ালো? এবার সেদিকে ফেরা যাক।
রুশ সমীক্ষকদের ভাষায়, ১৬জন শ্রমিকের বেশি কাজ করেন এমন কারখানা হলো সেনসাস ইন্ডাস্ট্রি। এই সেনসাস ইন্ডাস্ট্রি-তে নিযুক্ত শ্রমিকদের সংখ্যা ১৯১৭-য় ছিলো ৩৫লক্ষ, ১৯১৮-তে কমে দাঁড়ায় ২০ লক্ষ, ১৯১৯-এ তা আরো কমে দাঁড়ায় ১৩লক্ষ থেকে ১৫ লক্ষ, ১৯২০-র শেষভাগেও তা ১৫লক্ষই থেকে যায়। এই শেষোক্ত সংখ্যাটা ছিলো সেই সময়ে ক্ষুদ্রশিল্প বা হস্তশিল্পে কাজ করা শ্রমিকদের সংখ্যার কিছু কম।
এই পর্যায়ে, অর্থাৎ ১৯১৭–১৯২০ পর্যায়ে শ্রমিকদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি কমেছিলো বড়ো বড়ো শিল্পাঞ্চলগুলোতে যেখানে বৃহৎ শিল্প কেন্দ্রীভূত ছিলো, যেমন, পেট্রোগ্রাদ, মস্কো, ডনবাস অঞ্চল, উরাল অঞ্চল।
পেট্রোগ্রাদে শিল্পশ্রমিকের সংখ্যা ১৯১৭-র জানুয়ারিতে ৪,০৬,০০০ থেকে কমে ১৯২০-র মাঝামাঝি সময়ে দাঁড়িয়েছিলো ১,২৩,০০০-এ। জনসংখ্যার আনুপাতিক হারেও তা কমেছিলো। ১৯১৭-য় যেখানে সুস্থ দেহের প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ৪৫.৯% ছিলো শিল্পশ্রমিক, সেখানে ১৯২০-র বসন্তে এই অনুপাত দাঁড়িয়েছিলো ৩৪%-য়।
১৯১৮ থেকে ১৯২০-র মধ্যে মস্কোয় শিল্পশ্রমিকের সংখ্যা ১,০০,০০০ জন কমেছিলো, আর একই সময় পর্যায়ে উরাল অঞ্চলে ফ্যাক্টরি ও খনিতে কাজ করা শ্রমিকের সংখ্যা ৩,৪০,০০০ থেকে কমে দাঁড়িয়েছিলো ১,৫৫,০০০-তে।
বিভিন্ন শিল্পশাখার মধ্যে সবচেয়ে বেশি শ্রমিকসংখ্যা হ্রাস হয়েছিলো বস্ত্রবনন (টেক্সটাইল) শিল্পে— যেখানে ১৯১৭ থেকে ১৯২০-র মধ্যে শিল্পশ্রমিকের সংখ্যা কমে গিয়েছিলো ৭২%। একই সময়পর্যায়ে, যন্ত্র ও ধাতুশিল্পে শ্রমিকসংখ্যা কমেছিলো ৫৭% (৫,৩৭,৫০৮ থেকে ২,৩১,১৫৯), জ্বালানি শিল্পে কমেছিলো ২৫%, অন্যদিকে মুদ্রণশিল্পে ৭% বেড়েছিলো।
বৃহৎ শিল্প, যেখানে বলশেভিকরা তাদের প্রোপাগান্ডা ও অ্যাক্টিভিস্ট সংগ্রহের কাজের জন্য মনোনিবেশ করেছিলো, সেখানকার শ্রমিকসংখ্যা তুলনামূলক বেশি হারে হ্রাস পেয়েছিলো। এর কারণ যেমন অংশত ছিলো এমন বেশ কিছু কারখানা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাওয়া, তেমনই আবার এর কারণ অংশত ছিলো এই সমস্ত কারখানা থেকেই রেড আর্মি ও খাদ্য সংগ্রহ বাহিনী (ফুড প্রোকিউরমেন্ট ডিট্যাচমেন্ট)-এ বহু শ্রমিকের যোগদান। ১৯১৩-তে যেখানে ৫০০জনের বেশি শ্রমিক নিয়োগকারী কারখানায় শিল্পশ্রমিকদের ৫৫.২% কাজ করতেন, ১৯২০-র শেষে এই অনুপাত দাঁড়িয়েছিলো ৪৮.৩%। অন্যদিকে, ২১জন থেকে ১০০জন শ্রমিক নিয়োগকারী কারখানাতে কাজ করা শিল্পশ্রমিকদের শতাংশ হার দ্বিগুণ হয়েছিলো।
শিল্পশ্রমিকদের সংখ্যাগত নিম্নগতি ছিলো বড় বড় শিল্পশহরগুলোর দ্রুত জনসংখ্যাহ্রাসের অংশ। পেট্রোগ্রাদের জনসংখ্যা ১৯১৭ সালে ছিলো ২৫লাখ, আর ১৯২০-তে তা কমে দাঁড়িয়েছিলো ৭লাখ ২২হাজার-এ। মস্কোর জনসংখ্যা ১৯১৭-র ফেব্রুয়ারিতে ছিলো ২০লাখ-এর কিছু বেশি, আর ১০২০-র শেষে তা কমে দাঁড়িয়েছিলো ১০লাখের কিছু বেশিতে।
১৯১৮ থেকে ১৯২০-র মধ্যে ৬০,০০০ শ্রমিক রেড আর্মিতে যোগ গিয়েছিলেন আর ৭৫,০০০ শ্রমিক পিপলস কমিসারিয়েত অফ ফুড সাপ্লাই (নারকোমপ্রোদ)-এর অধীনে খাদ্য সংগ্রহ বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। এই শ্রমিকরাই ছিলেন শ্রমিকশ্রেণির অগ্রণীবাহিনীর অংশ— যাঁরা কোমসোমোল (১৯১৯-এ প্রতিষ্ঠিত কমুনিস্ট যুব সংগঠন)-এর সদস্য ছিলেন অথবা পার্টি সদস্য ছিলেন, নভেম্বর ১৯১৭-র কনস্টিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলি নির্বাচনে বলশেভিকদের পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন, ফ্যাক্টরি কমিটি ও সোভিয়েতগুলোর প্রধান সংগঠক ছিলেন। এঁদের অবস্থা কী দাঁড়িয়েছিলো? গৃহযুদ্ধে রেড আর্মিতে লড়া ৫লাখ কম্যুনিস্টদের (তার মধ্যে সবাই শিল্পশ্রমিক ছিলেন না) মধ্যে কমপক্ষে ২লাখ প্রাণ হারিয়েছিলেন। যাঁরা প্রাণ হারান নি, শহরে ফিরে এসেছিলেন, তঁারাও বেশির ভাগ আর শিল্পশ্রমিকের কাজে ফিরে যান নি— কেউ যুদ্ধে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হারিয়ে প্রতিবন্ধী হয়ে যাওয়ায়, আর কেউ সোভিয়েত প্রশাসনিক পদে যোগ দেওয়ায়। এভাবে শ্রমিকশ্রেণির এই অগ্রণী অংশের সঙ্গে শিল্পশ্রমিকদের প্রাত্যহিক নিবিড় যোগাযোগ ছিন্ন হয়েছিলো।
শিল্পশহরগুলোয় শ্রমিকসংখ্যাহ্রাসের একটা কারণ ছিলো অক্টোবর বিপ্লবের পর বিপ্লবীদের প্রভাবে থাকা গ্রামাঞ্চলে বিপ্লবী ভূমিসংস্কারের মধ্য দিয়ে জমি পাওয়ার আশায় বড়ো সংখ্যক শ্রমিকের শহর ছেড়ে গ্রামে চলে যাওয়া। শিল্পশহরগুলোয় থেকে যাওয়া শ্রমিকদের অবস্থার সংকটও প্রকট হতে থাকে। এর পিছনে নানা কারণ কাজ করেছিলো। গৃহযুদ্ধের চাপে ও মেরামতির অভাবে রেলব্যবস্থা বহুলাংশে ভেঙে পড়ে। বিদেশী শক্তি বা শ্বেতরক্ষীবাহিনীর দখলে খাদ্য ও জ্বালানি উৎপাদনকারী কৃষি-অঞ্চলের বড়ো অংশ থেকে গিয়েছিলো প্রায় ১৯২০ অবধি এবং অন্যান্য অঞ্চলেও নারকোমপ্রোদ-এর খাদ্য আহরণ প্রচেষ্টার প্রতিরোধে কৃষকরা চাষের অঞ্চল কমিয়ে দিয়েছিলো। এই সবের ফলে শহরাঞ্চলে খাদ্য, কঁাচামাল ও জ্বালানির সমস্যা প্রকট থেকে প্রকটতর হয়ে ওঠে। শিল্পউৎপাদন যেমন কঁাচামাল ও জ্বালানির অভাবে থমকে যেতে থাকে, তেমনি খাদ্যের অভাব প্রাত্যহিক জীবনচর্যাকে কঠিন করে তোলে। অপুষ্টি ও অপুষ্টিজনিত রোগের মড়ক শিল্পশহরগুলোর শ্রমিক মহল্লাগুলোয় দাপিয়ে বেড়ায়— টাইফয়েড, কলেরা, ইনফ্লুয়েঞ্জা, ডিপয়েরিয়া কেড়ে নেয় হাজার হাজার প্রাণ। মস্কোতে যেখানে ১৯১৭-তে মৃত্যুর হার ছিলো প্রতি হাজারে ২৩.৭, সেখানে ১৯১৯-য়ে তা দাঁড়ায় প্রতি হাজারে ৪৫.৪ ও ১৯২০-তে প্রতি হাজারে ৩৬.৩।
এই অবস্থায় বেঁচে থাকার মতো খাদ্য সংগ্রহের জন্য শ্রমিকদের ও শহরের মানুষদের প্রায়শই নির্ভর করতে হতো শহর ও তার আশপাশের গ্রামাঞ্চলে বেআইনীভাবে গজিয়ে ওঠা খাদ্যশস্যের প্রাইভেট বাজারের উপর। সমীক্ষকদের হিসাব অনুযায়ী, ১৯১৮-১৯ সালের শহরে রুটি-যোগানের ৬০% এসেছিলো এই বেআইনী পথে, আর ১৯১৯-২০-তে তা দাঁড়িয়েছিলো সমস্ত খাদ্যদ্রব্যের ৭০–৮০%। কিন্তু সোভিয়েত সরকার তার খরচ সংগ্রহের জন্য আরো আরো পেপার মানি ছাপার পথ নেওয়ায় মুদ্রার মূল্য খাড়াখাড়ি পড়তে থাকে এবং প্রাইভেট বাজারের বিক্রেতারা তাদের পণ্যের বিনিময়ে পেপার মানি নিতে অস্বীকার করতে শুরু করে। শ্রমিকদের মজুরীর মুদ্রামূল্যের আর কোনো অর্থই থাকে না বিনিময় মূল্য প্রায় শূন্যে গিয়ে দাঁড়ানোয়। ট্রেড ইউনিয়নদের দাবী অনুযায়ী সরকার অবশেষে রাজী হয় মজুরী মুদ্রায় না দিয়ে প্রয়োজনীয় বাস্তব পণ্যে দিতে। এই পণ্য-মজুরী ১৯১৮-র শেষে মস্কোতে একজন শ্রমিকের গড় মজুরীর ৪৮% হয়ে দাঁড়িয়েছিলো, ১৯২০-র শেষে তা দাঁড়ায় ৯৩%। এই পণ্য-মজুরী শ্রমিকদের সংকটকে দূর না করে তাকে নতুন চেহারা দিলো। কী পণ্যে শ্রমিকদের মজুরী দেওয়া হবে তার কোনো ঠিক ছিলো না, যে কারখানা যে পণ্য জোগাড় করতে পারতো তাই দিয়েই শ্রমিকদের মজুরী মেটাতো। ফলে প্রাইভেট বাজারের বিরোধী সবচেয়ে শ্রেণিসচেতন শ্রমিককেও তার মজুরী হিসাবে পাওয়া পেরেক, দেশলাই, নাটবল্টু নিয়ে বেআইনী প্রাইভেট বাজারে ঘুরতে হতো খাদ্যদ্রব্য বা পরিধানবস্ত্রের সঙ্গে বিনিময়ের আশায়। কারখানায় শ্রমিকদের উপস্থিতির হার কমতে থাকে— তার পিছনে একটা কারণ যেমন ছিলো শহরে বা আশপাশের গ্রামাঞ্চলের বেআইনী প্রাইভেট বাজারে প্রয়োজনীয় দ্রব্যের জন্য ঘুরতে হওয়া, তেমনই আর একটা কারণ ছিলো খাদ্যাভাবে ক্রমশঃ শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ভেঙে পড়া। সোভিয়েত অর্থনীতিবিদ স্ট্রুমিলিন-এর হিসাব অনুযায়ী কাজে অনুপস্থিতির পরিমাণ শ্রমিকপিছু বছর প্রতি ছিলো ১২.৬ দিন ১৯১৩ সালে, ২২.৭ দিন ১৯১৭ সালে, ২৯.০ দিন ১৯১৮ সালে আর ৬৮.৪ দিন ১৯১৯ সালে।
এই পরিস্থিতিতে উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর জন্য বলশেভিক নেতৃত্বাধীন সোভিয়েত সরকার জোর ফেললো উৎপাদনক্ষেত্রে নিয়মশৃঙ্খলা আরোপের উপর। ১৯১৯ সালে একের পর এক পদক্ষেপ নেওয়া হলো যা শ্রমিকদের খাদ্যাভাব, অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের অভাব, স্বাস্থ্যসমস্যা ইত্যাদি সমাধানের কোনো কথা না বলে একবগ্গা ভাবে জোর ফেললো কাজের ক্ষেত্রে শ্রমিকদের শৃঙ্খলাবদ্ধ করার উপর। খনি শ্রমিকদের তাদের কাজে “ফ্রিজ” করে দেওয়া হলো, লেবার বুক চালু করে তার সঙ্গে রেশন বন্টনকে যুক্ত করা হলো, ট্রেড ইউনিয়নের সাথে যুক্তভাবে প্রতিষ্ঠা করা হলো শৃঙ্খলারক্ষাকারী বিচারসভা (disciplinary court) যারা অনুপস্থিতি বা কম উৎপাদনশীলতার জন্য দোষী শ্রমিকদের বিচার করে জরিমানা থেকে শুরু করে লেবার-ক্যাম্পে বন্দী করার শাস্তি অবধি দিতে পারে।
গৃহযুদ্ধে রেডআর্মির সাফল্য বলশেভিকদের মধ্যে একটি মতামতকে জোরদার করে তুলছিলো যে রেডআর্মির কেন্দ্রীভূত কাঠামোর অনুরূপ কাঠামোয় উৎপাদনক্ষেত্রকে সাজানোই হলো সংকটমুক্তির উপায়। ট্রটস্কি ছিলেন এর প্রধান উদ্গাতা। এর বিরুদ্ধ মতও নানারকম ছিলো— কেউ ট্রেড ইউনিয়নকে সামরিক ধাঁচায় বাঁধার বিরোধী ছিলেন, কেউ সংশয়প্রকাশ করেছিলেন যে বাধ্যতার চাপে শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতা আদৌ বাড়বে কি না, কেউ শ্রমিকদের মধ্য থেকে বিদ্রোহের আশঙ্কা করেছিলেন। কিন্তু শেষাবধি সংকটপূর্ণ অর্থনৈতিক অবস্থা থেকে বেরোনোর পথ হিসাবে বলশেভিক পার্টির নবম কংগ্রেসে শ্রম সংগঠনের সামরিক মডেল লেনিনের সমর্থন নিয়ে পাশ হয়। শ্রম সংগঠনের সামরিকীকরণ প্রথমে রেড আর্মির সেনাদের দ্বারা জরুরী উৎপাদনের কাজ করানো দিয়ে শুরু হলেও অচিরেই তা উৎপাদনক্ষেত্রে শ্রমিকদের নতুনভাবে সংগঠিত করার বিতর্কিত প্রস্তাব হাজির করলো। সেই প্রস্তাব অনুযায়ী, ট্রটস্কির ভাষায়:
প্রতিটি শ্রমিককে মনে করতে হবে যে সে শ্রমবাহিনীর একজন সেনা যে স্বাধীনভাবে নিজেকে নিয়োজিত করতে পারে না। যদি তাকে বদলি করার কোনো আদেশ দেওয়া হয়, তাহলে তাকে তা অবশ্যই পালন করতে হবে। যদি সে তা না পালন করে, তাহলে তবে তাকে সেনাবাহিনী থেকে একজন পলাতক (deserter) হিসাবে দেখা হবে এবং সেই মতো শাস্তি দেওয়া হবে।
এই নীতি অনুযায়ী ১৯২০ সালের সময়পর্যায়ে ২০টি মোবিলাইজেশন অর্ডার জারি করা হয়েছিলো, কোনক্ষেত্রে শ্রমিকদের “ফিক্স” করে, কোনোক্ষেত্রে বদলির আদেশ দিয়ে। ধাতুশিল্প ও জাহাজনির্মাণ শিল্প থেকে শুরু করে উল ও মাছধরা শিল্প অবধি এই সমস্ত অর্ডারের বিস্তৃতি ছিলো। এই ব্যাপারে সামগ্রিক পরিকল্পনা, আদেশ জারি ও নির্বাহের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিলো নবগঠিত মেইন কমিটি ফর কমপালসারি লেবার (গ্লাভকোমট্রুড)-কে, যার সভাপতি ছিলেন বলশেভিক নেতা জেরঝিনস্কি, যার উপর ফ্যাক্টরি কমিটি বা ট্রেড ইউনিয়নগুলোর কোনো কথা খাটতো না।
(উপরোক্ত আলোচনা লিউইস সিগেলবম -এর সোভিয়েত স্টেট অ্যান্ড সোসাইটি বিটুইন রিভোলিউশনস, ১৯১৮-১৯২৯বইয়ের পৃঃ২৭-৩৬-এর উপর ভিত্তি করে করা হয়েছে।)
এর পাশাপাশি কারখানায় উৎপাদন পরিকল্পনা ও পরিচালনার কাজে আর একটা পরিবর্তন ঘটতে ঘটতে যাচ্ছিলো। কঁাচামালের সংকট, নিম্ন উৎপাদনশীলতায় ভুগতে থাকা শিল্পক্ষেত্রে সংকটমোচনের অন্যতম উপায় হিসাবে ১৯১৮-র শরৎ থেকে লেনিন যে প্রস্তাবটি জোরের সঙ্গে সামনে আনতে থাকেন, তা হলো প্রতিটি কারখানার উৎপাদন ব্যবস্থাপনার ভার একজন একক ব্যক্তির হাতে ন্যস্ত করা। এই প্রস্তাব শ্রমিকশ্রেণির আন্দোলন থেকে জন্ম নেওয়া শ্রমিক-নিয়ন্ত্রণ-এর তত্ত্ব ও চর্চার (যা আমরা আগে আলোচনা করেছি) বিপরীতে দাঁড়ায়। ফলত লেনিনের এই প্রস্তাব শ্রমিকদের মধ্য থেকে প্রতিরোধের মুখে পড়ে। ১৯১৮ ও ১৯১৯ জুডে় লেনিনের এই প্রস্তাবের চাপের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে শ্রমিকরা রক্ষা করে রাখে জাতীয়করণ হয়ে যাওয়া কারখানাগুলোয় যৌথ ব্যবস্থাপনার ব্যবস্থা (collegial management system), যে ব্যবস্থায় কারখানার ব্যবস্থাপক কমিটির তিনভাগের একভাগ থাকতো সমস্ত শ্রমিকদের দ্বারা নির্বাচিত শ্রমিক, বাকি দুভাগ থাকতো টেকনিকাল স্টাফ, ট্রেড ইউনিয়ন, এবং সোভিয়েত সরকারের অর্থনৈতির প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিনিধি। কিন্তু ক্রমাগত শ্রমিকদের পিছু হঠতে হয়। ১৯২০ সালের মধ্যে ৮২% কারখানায় এক ব্যক্তির হাতে ব্যবস্থাপনা-ভার চালু হয়ে যায়।
এছাড়াও, লেনিন এই সময়ে প্রচার করতে শুরু করেন যে শিল্পে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ও আধুনিকীকরণের জন্য টেকনিকাল বিশেষজ্ঞ (যাদের রুশ ডাকনাম ছিলো স্পেটসি)-দের কর্তৃত্বের আসনে পুনর্বাসিত করতে হবে, গড় দক্ষ শ্রমিকের বেতনের থেকে তাদের বেশি বেতনের ব্যবস্থাও ফিরিয়ে আনতে হবে, কারণ উৎপাদনক্ষেত্রে অরাজকতার আবহে তাদের “বিশেষ দক্ষতা” অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় “জিদ”, “মানবিক গুণ”, “সাধুতা”-র চেয়ে। লেনিনের এই প্রস্তাবও শ্রমিকরা মানতে পারেন নি। ১৯২০-র সেপ্টেম্বরে বলশেভিকদের নবম পার্টি কংগ্রেসে একজন শ্রমিক-প্রতিনিধি বলেন:
মরণ অবধি আমি স্পেটসিদের ঘৃণা করে যাবো..... ওরা যেমন আমাদের লৌহমুষ্ঠিতে ধরে রাখতো, ওদেরও এখন তেমনই আমাদের লৌহমুষ্ঠিতে ধরে রাখতে হবে।
লেনিনের মত অবশ্য বদলায় নি এবং স্পেটসিরা ক্রমে শ্রমিকদের উপর তাদের কর্তৃত্বের আসন ফিরে পেয়েছে ১৯২১-এর মধ্যেই।
এই সমস্ত পরিবর্তনের ফলে ১৯১৭-১৯১৮-র বিপ্লবী শ্রমিকশ্রেণীর আন্দোলনের মধ্য থেকে জন্ম নেওয়া উৎপাদনের উপর শ্রমিকদের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ আন্দোলনের অবসান হয়। ফ্যাক্টরি কমিটি, যে তৃণমূলস্তরের সংগঠনের মধ্য দিয়ে এই শ্রমিকদের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ আন্দোলন মূর্ত রূপ নিয়েছিলো, সেগুলোও তাৎপর্য হারিয়ে ফঁাকা খোলসে পরিণত হয় এবং বিলুপ্তির পথে এগিয়ে যায়।
(উপরোক্ত আলোচনা এস.এ.স্মিথ-এর দি রাশিয়ান রিভলুশন: এ ভেরি সর্ট ইনট্রোডাকশন বইয়ের তৃতীয় চ্যাপ্টার-এর উপর ভিত্তি করে করা হয়েছে।)
যে ফ্যাক্টরি কমিটিকে লেনিন ১৯১৭ সালে সোভিয়েতের পাশাপাশি শ্রমিকশ্রেণির বিপ্লবী ক্ষমতার তৃণমূলস্তরে মূর্ত রূপ হিসাবে দেখেছিলেন, গৃহযুদ্ধের পর্বে কীভাবে তিনি তার মৃতু্যপরোয়ানা প্রস্তুত করলেন? সে কি কেবলই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও গৃহযুদ্ধ রাশিয়ার মতো আধুনিক শিল্পোন্নয়নের পথে দেরীতে আসা একটি দেশে যে অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংকট তৈরী করেছিলো, তার বাধ্যবাধকতার জন্য? না কি লেনিন ও সে অর্থে বলশেভিকদের অবস্থানের মধ্যেও এর কোনো কারণ লুকিয়ে আছে? এই বিষয়টি গভীরভাবে বিচার করার উচিত বলে মনে হয়।
উপরোক্ত বিচারপ্রক্রিয়ার প্রারম্ভক হিসাবে এই বিষয়ে পাঠ করতে করতে যা মনে হয়েছে তা বিতর্ক-আলোচনার জন্য সবার সামনে হাজির করছি।
১৯১৯-এর জুলাই মাসে গৃহযুদ্ধের মাঝে লেনিন লিখেছিলেন—
বিজয় অর্জন করতে হলে, সমাজতন্ত্রকে গড়ে তুলতে ও সুরক্ষিত করতে হলে প্রলেতারিয়েতকে একটি দ্বিমুখী বা দ্বৈত কাজ অবশ্য-সমাপন করতে হবে। প্রথমত, পঁুজির বিরুদ্ধে বিপ্লবী সংগ্রামে চূড়ান্ত বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার মধ্য দিয়ে প্রলেতারিয়েতকে নিজের পক্ষে জিতে নিতে হবে মেহনতী ও শোষিত জনগণের সমগ্রকে; তাকে জিতে নিতে হবে, সংগঠিত করতে হবে এবং নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে বুর্জোয়াদের উৎখাত করার ও বুর্জোয়াদের প্রতিরোধকে সম্পূর্ণরূপে দমন করার সংগ্রামে। দ্বিতীয়ত, প্রলেতারিয়েতকে নতুন অর্থনৈতিক গঠনের রাস্তায় নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে মেহনতী ও শোষিত মানুষের সমগ্রকে এবং পেটি-বুর্জোয়া গোষ্ঠীদেরকেও; এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে নতুন সামাজিক বন্ধন তৈরীর দিকে, নতুন শ্রম-শৃঙ্খলার দিকে, এক নতুন শ্রম-সংগঠনের দিকে যা বৃহদায়তন সমাজতান্ত্রিক শিল্প সৃষ্টি করবে বিজ্ঞান ও পঁুজিবাদী প্রযুক্তির শেষকথার সঙ্গে শ্রেণীসচেতন শ্রমিকদের গণ-সমাবেশকে যুক্ত করে।
এই দুইয়ের মধ্যে লেনিনের বিচারে দ্বিতীয়টি বেশি গুরুত্বপূর্ণ ও বেশি কঠিন, কারণ,
শেষ বিচারে, বুর্জোয়াদের উপর বিজয় অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তির গভীরতম উরৎস হতে পারে কেবলমাত্র সামাজিক উৎপাদনের একটি উন্নততর ব্যবস্থা, পঁুজিবাদী ও পেটি-বুর্জোয়া উৎপাদনকে বৃহদায়তন সমাজতান্ত্রিক উৎপাদন দিয়ে প্রতিস্থাপিত করা। (রুশ লেনিন রচনাবলী, ভল্যুম-৩৯, পৃঃ-১৭-১৮)
এই ভাবনা যে লেনিন ও বলশেভিকদের একটি কেন্দ্রীয় ভাবনা ছিলো, তা লেনিনের আরো বহু লেখা থেকে দেখা যায়। যেমন বৃহদায়তন শিল্প সম্বন্ধে লেনিন বলছেন:
বৃহদায়তন শিল্প হলো এক এবং একমাত্র প্রকৃত ভিত্তি যার উপর দাঁড়িয়ে আমরা আমাদের সঙ্গতি বাড়িয়ে চলতে পারি। পঁুজিবাদ যা সৃষ্টি করেছে সেই বৃহৎ কারখানা ছাড়া, অতি উন্নত বৃহদায়তন শিল্প ছাড়া সমাজতন্ত্র কোথাও হওয়া সম্ভব নয়, আরও বেশি সম্ভব নয় একটি কৃষক দেশে..... (ইংরাজি লেনিন রচনাবলী, ভল্যুম-৩২, পৃঃ-৪০৮)
আধুনিক বিজ্ঞানের শেষতম আবিষ্কারের উপর ভিত্তি করা বৃহদায়তন পঁুজিবাদী ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যতীত সমাজতন্ত্র অকল্পনীয়। কোটি কোটি জনগণকে উৎপাদন ও বন্টনের ঐক্যবদ্ধ মান দৃঢ়ভাবে পালনে আবদ্ধ রাখে এমন পরিকল্পিত রাষ্ট্র সংগঠন ছাড়া সমাজতন্ত্র অকল্পনীয়। (ইংরাজি লেনিন রচনাবলী, ভল্যুম-৩২, পৃঃ-৩৩৪)
সুতরাং, লেনিন যখন ১৯১৮ থেকে রাশিয়ার শিল্পক্ষেত্রে এক ব্যক্তিতে কেন্দ্রীভূত ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থা, স্পেটসিদের বিশেষ কর্তৃত্ব, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, কেন্দ্রীভূত নিয়ন্ত্রণ-এর কথা বলছেন, তখন তা কেবল রাশিয়ার সামাজিক-অর্থনৈতিক সংকটের বাধ্যবাধকতার জন্য নয়, তার মধ্যে কাজ করছে সমাজতন্ত্রের “এক এবং একমাত্র প্রকৃত ভিত্তি” বৃহদায়তন শিল্প এহেন পূর্বসিদ্ধান্তের তাগিদ, যার জন্য আবার পঁুজিবাদ সৃষ্ট বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির শেষকথাকে আত্মীকরণ করা জরুরী। ১৯১৭-র বিপ্লবের পর লেনিন একাধিকবার লিখেছিলেন যে বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব দুই দিক থেকে দুই জায়গায় পেকে উঠেছে— রাশিয়াতে তা পেকে উঠেছে রাজনৈতিকভাবে শ্রমিকশ্রেণীর ক্ষমতাদখলের মধ্য দিয়ে, আর জার্মানিতে তা পেকে উঠেছে অর্থনৈতিকভাবে পঁুজিবাদী বৃহদায়তন শিল্পের পূর্ণ বিকাশের মধ্য দিয়ে। লেনিন ও বলশেভিকদের আশা ছিলো যে রুশ বিপ্লবের কাছাকাছি সময়ের মধ্যেই জার্মানিতে শ্রমিক বিপ্লব সম্পন্ন হবে এবং জার্মান শ্রমিকশ্রেণীর প্রত্যক্ষ সহায়তা ও পথনির্দেশনায় রুশ শ্রমিকশ্রেণী তার অর্থনৈতিক গঠন-নির্মাণের কাজ সম্পন্ন করার দিকে এগোতে পারবে। ক্রমশঃ স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে লেনিন বা বলশেভিকদের এই আশা পূরণ হওয়ার নয় কারণ জার্মানিতে শ্রমিক বিপ্লব সফল হওয়ার সম্ভাবনা ক্রমশঃই ধূসর থেকে আরো ধূসর হয়ে যেতে থাকে। এই অবস্থায় লেনিনের বিচারে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ যে বিজ্ঞান ও পঁুজিবাদী প্রযুক্তির শেষকথার সঙ্গে শ্রেণীসচেতন শ্রমিকদের গণ-সমাবেশকে যুক্ত করতে পারা নতুন শ্রম-শৃঙ্খলা, নতুন শ্রম-সংগঠনের দিকে যাত্রা যা বৃহদায়তন সমাজতান্ত্রিক শিল্প সৃষ্টি করবে, তা হবে কীভাবে? সচেতনতায় এই প্রশ্নের আধিপত্যই কি পঁুজিবাদী উৎপাদনের শ্রম-শৃঙ্খলা, শ্রম-সংগঠনকে অগ্রগতির পথ বলে ধরে নেওয়ার দিকে ঠেললো না? আর এইভাবে বৃহদায়তন সমাজতান্ত্রিক শিল্প সৃষ্টির দিকে পদক্ষেপ পদপিষ্ট করলো শ্রমিকশ্রেণির আন্দোলনের প্রসব করা বিকল্প শ্রম-শৃঙ্খলা ও শ্রম-সংগঠনের সদ্যভূমিষ্ঠ রূপকে। এ কি নেহাতই অনিবার্য ট্রাজেডি, না কি যেভাবে লেনিন ও বলশেভিকদের ভাবনায় পুঁজিবাদে সৃষ্ট বৃহদায়তন শিল্পকে সমাজতন্ত্রের পথে এগোনোর অবশ্যপ্রয়োজনীয় শর্ত হিসেবে ধরা হয়েছে, সেটা প্রশ্নের মুখে পড়ে যায়।
শ্রমিকশ্রেণির আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সৃষ্ট সামাজিক উৎপাদন ও বন্টন পরিকল্পনা-পরিচালনার তৃণমূলস্তরের হাতিয়ারকে আরও সুসংহত সুগঠিত করে তোলার বিপরীতে যদি পায়ে দলে মারে কোনো তাত্ত্বিক অবস্থান, তবে তা অবশ্যই প্রশ্ন করার যোগ্য। এই তাত্ত্বিক অবস্থান লেনিন ও বলশেভিকদের স্বকীয় নয়, এই তাত্ত্বিক অবস্থান তঁারা উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত হয়েছিলেন দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের এই তাত্ত্বিক অবস্থান থেকে যে কেবলমাত্র পঁুজিবাদী অর্থনৈতিক সংগঠনের পরিপূর্ণ বিকাশই সমাজতন্ত্রের ভিত্তি নির্মাণ করতে পারে, সুতরাং, পঁুজিবাদী বিকাশের নিরিখে পশ্চাৎপদ দেশগুলোকে পঁুজিবাদী বিকাশে তার খামতি পুষিয়ে নিয়ে তবেই সমাজতন্ত্রের পথে এগোতে হবে। কাউটস্কি, বার্ণস্টাইন-দের দ্বারা এই তত্ত্বায়ন মার্কসবাদের অ-আ-ক-খ-র মধ্যে একটি বলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। কিন্তু মার্কসের নিজের ধারণার সঙ্গে কি তা মেলে? সেটাই এবার দেখা যাক।
১৮৭৭ সালে ওতেচেস্তভেনিয়ে যাপিস্কি নামক একটি রুশ পত্রিকায় মিখাইলোভস্কি নামক এক রুশ বিপ্লবী মার্কসকে সমালোচনা করে একটি প্রবন্ধ লেখেন। সেই সমালোচনার জবাব দেওয়ার জন্য মার্কস পত্রিকার সম্পাদককে একটি চিঠি লিখতে শুরু করেন, যা পান্ডুলিপি আকারেই থেকে গিয়েছিলো, দীর্ঘদিন প্রকাশিতও হয় নি। সেই চিঠির দ্বিতীয় ভাগে মার্কস পঁুজির ফরাসি সংস্করণ (যাতে ১৮৭৫ সালে মূল জার্মান সংস্করণের থেকে বেশ কিছু পরিবর্তন মার্কস নিজে করেছিলেন তঁার ভাবনার অগ্রগতিকে জায়গা দেওয়ার জন্য) থেকে উদ্ধৃত করে বলেন যে আদিম সঞ্চয় (primitive accumulation) সংক্রান্ত অধ্যায়ে মার্কস পঁুজিবাদের যে ঐতিহাসিক বিবর্তনের ছবি এঁকেছেন তা পশ্চিম ইওরোপে ঐতিহাসিকভাবে অনুসৃত পথের বর্ণনা ছাড়া আর কিছু নয়— এমন কোনো সাধারণীকরণ যদি করা হয় যে বিশ্বের সমস্ত দেশকেই হুবহু একই পথ অনুসরণ করতে হবে তা হলে তা ভুল হবে। মার্কস আরো বলেন যে যদি ভাবা হয় যে রাশিয়াকে ওই পশ্চিম ইওরোপের পথ অনুসরণ করতে হবে, তাহলে দুটো বিষয় মাথায় রাখা উচিত:
গ্রিক ট্রাজেডি নাটকে ঈশ্বরকন্ঠ বা কোনো অপার্থিব উৎস থেকে উৎসারিত কন্ঠ যেমন বিয়োগান্তক পরিণতির পূর্বাভাস ঘোষণা করে, ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে দাঁড়িয়ে মার্কস যেন এখানে তেমনই বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে রাশিয়ায় ঘটতে চলা ট্রাজেডির পূর্বাভাস করছেন।
শুধু তাই নয়, এই প্রায় নিয়তিতাড়িত নকলনবিশির পথ থেকে সম্পূর্ণ আলাদাভাবে সৃজনশীলতার সঙ্গে মার্কস সেই সময় রাশিয়া ও অন্যান্য পুবের দেশগুলোয় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সম্ভাবনার কথা ভাবছিলেন। ১৮৮১ সালে, মৃত্যুর দুবছর আগে, রুশ সমাজতন্ত্রী ভেরা জাসুলিচের চিঠিরূপে প্রেরিত জিজ্ঞাসার উত্তরে লেখা চিঠির দ্বিতীয় খসড়ায় মার্কস লিখছেন:
ঠিক সময়ে যদি (রাশিয়ায়) বিপ্লব হয়, সেই বিপ্লব যদি তার সমস্ত শক্তিকে কেন্দ্রীভূতভাবে প্রয়োগ করতে পারে, গ্রামীণ কমিউনগুলোর মুক্ত প্রস্ফুটিতকরণকে (free flowering) নিশ্চিত করতে পারে, তাহলে এই গ্রামীণ কমিউনগুলো অচিরেই রুশ সমাজের পুনরুজ্জীবনের উপাদান হিসেবে নিজেদের বিকশিত করবে, পঁুজিবাদী ব্যবস্থার সঙ্গে তুলনায় যা অবশ্যই সুবিধা হিসাবে কাজ করবে।
হায়! এমন মার্কসীয় সৃজনশীলতা ও দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে ১৯১৮ সালের পর থেকে ফ্যাক্টরি কমিটির ভূমিকা নিয়ে আলোচনা-বিশ্লেষণ হলো কই!
(মার্কসের এই শেষ পর্যায়ের অতি গুরুত্বপূর্ণ, প্রয়োজনীয় ও আকর্ষণীয় ভাবনাচিন্তা নিয়ে আলোচনা-বিশ্লেষণ পাওয়া যাবে থিওডোর শানিন-এর লেট মার্কস অ্যান্ড দি রাশিয়ান রোড বইতে।)
যে শ্রমিকশ্রেণি চূড়ান্ত সংকটাপন্ন অবস্থাতেও গৃহযুদ্ধে সেনা হিসাবে লড়েছে বিপ্লবের মধ্য দিয়ে জাত রাষ্ট্রকে রক্ষার জন্য, খাদ্য সংগ্রহ বাহিনীর অংশ হয়ে সোভিয়েত সরকারের খাদ্যশস্য সংগ্রহে ভূমিকা নিয়েছে, সেই শ্রমিকশ্রেণির সঙ্গেই সোভিয়েত রাষ্ট্রের বলশেভিক নেতৃত্বের বিরোধ ও দূরত্ব বাড়তে লাগলো উৎপাদনক্ষেত্রে শ্রম-শৃঙ্খলা ও শ্রম-সংগঠনের প্রশ্নকে ঘিরে। ফ্যাক্টরি কমিটি আন্দোলনের মৃত্যু হলো। সোভিয়েত রাষ্ট্রের সঙ্গে শ্রমিকশ্রেণির এই সংঘাত ক্রনস্টাড বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে রুশ বিপ্লবের মৃতদেহটিকে প্রকাশ্যে এনে হাজির করল।
চার
শ্রমিক-বিপ্লবের কফিনে শেষ পেরেক: ক্রনস্টাড
শহরাঞ্চলে অস্থিরতা
ফেব্রুয়ারি (১৯২১)-এর শেষ দিনগুলোয় পিটার্সবুর্গের কিছু কিছু কল-কারখানায় যে গোলমাল ও স্ট্রাইক ফেটে পড়েছিল, তারই প্রত্যক্ষ ও যুক্তিসঙ্গত প্রসারণ হল ক্রনস্টাড বাহিনী ও শ্রমিকদের অভ্যুত্থান। ফেব্রুয়ারির গোড়ায় পিটার্সবুর্গের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোয় বড় সংখ্যক শ্রমিকদের বাধ্যতামূলক শ্রম বাহিনীতে (লেবার কনস্ক্রিপশন) কেন্দ্রীভূতকরণ এবং সদ্য পুনরায় চালু হওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশির ভাগ জ্বালানির অভাবে আবার বন্ধ হয়ে যাওয়া পিটার্সবুর্গ শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ ও বিরক্তি তৈরি করেছিল। শ্রম কেন্দ্রীভূতকরণের জন্য যাদের গ্রামাঞ্চল থেকে নিয়ে আসা হয়েছিল, তারা বহন করে নিয়ে এসেছিল কৃষকদের মধ্যে পুঞ্জীভূত হওয়া ক্ষোভ, খাদ্যশস্য অধিযাচন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে রাগ, কেনা-বেচার উপর নিযেধাজ্ঞা ও মুনাফা-বিরোধী বাহিনীর কার্যকলাপের বিরুদ্ধে রাগ।
ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি খাদ্যবরাদ্দ যেভাবে কমানো হয়েছিল তার প্রতিক্রিয়ায় পেট্রোগ্রাদের শ্রমিকদের অংশের মধ্যে জমা হওয়া অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ ফেটে পড়ে এবং ধর্মঘট শুরু হয় এক সারি কারখানায়, যেমন, বল্টিক ও টিউব কারখানা, লাফের্ম (তামাক) কারখানা এবং অন্যান্য। এই আন্দোলনের অন্যতম মূল কারণ ছিলো রুশ কম্যুনিস্ট পার্টির সাধারণ কর্মীদের স্তরে (দশম) পার্টি কংগ্রেসের আগে ঘনিয়ে ওঠা প্রচণ্ড বিতর্ক, অন্তঃ-পার্টি সংহতি দুর্বল হয়ে যাওয়া, এবং পার্টির ব্যাপক অংশের কর্মীদের মধ্যে শৃঙ্খলার অবনতি। ধর্মঘটী শ্রমিকরা কেবল খাদ্য বরাদ্দ বৃদ্ধি ও মুনাফা-বিরোধী বাহিনীর অপসারণের মধ্যেই নিজেদের দাবি সীমাবদ্ধ রাখেনি। শ্রমিকদের সব অংশের মধ্যেই সংবিধান সভা (কনস্টিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলি) আহ্বানের দাবি শোনা গিয়েছিল। কিন্তু সর্বতোভাবে আন্দোলন থেকে দুটি স্লোগান উঠেছিল: প্রথমটি হল বলশেভিক কম্যুনিস্ট পার্টির একনায়কতন্ত্র বিলোপের দাবি ও দ্বিতায়টি হল মুক্তভাবে নির্বাচিত সোভিয়েতের সরকার প্রতিষ্ঠার দাবি। পিটার্সবুর্গের আন্দোলন যাতে একটি সংগঠিত চরিত্র অর্জন না করে থাকতে পারে এবং সাধারণ চেহারা নিতে না পারে, সেই উদ্দেশ্য নিয়ে সোশাল রিভলুশনারি, মেনশেভিক, বাম সোশাল রিভলুশনারি ও নৈরাষ্ট্রবাদী (অ্যানার্কিস্ট)-দের পেট্রোগ্রাদের সংগঠনগুলোকে দ্রুত নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার কৌশল অবলম্বন করেছিল বলশেভিক-পরিচালিত রাষ্ট্রীয় দমনবাহিনী। শ্রমিকদের মধ্যে ঘনিয়ে ওঠা আন্দোলনকে সংগঠিত নেতৃত্ব থেকে সরাসরি বঞ্চিত করার কৌশল হিসেবেই তা করা হয়েছিল। শ্রমিক ও সংগঠকদের মধ্যে থেকে ব্যাপক ধরপাকড়, জেলে বন্দি করে রাখা ও নির্বাসনে পাঠানো জারের আমলের সবচেয়ে অন্ধকার দিনগুলোর স্মৃতি আবার ফিরিয়ে আনে।
এইরকম পরিস্থিতিতে বিদ্রোহ ঘোষণা করল ক্রনস্টাডের নাবিক ও শ্রমিকরা।
(সূত্র: দি রাশিয়ান রিভলুশন, ১৯১৭-১৯২১; লেখক–রোনাল্ড কোওয়ালস্কি; পৃষ্ঠা: ২১৮-১৯।)
ক্রনস্টাড নাবিকদের দাবি
বলশেভিকরা বারবার ক্রনস্টাড বিদ্রোহীদের সম্বন্ধে এই কুৎসা প্রচার করেছে যে ক্রনস্টাডীরা নাকি বিদেশী প্রতিবিপ্লবী শক্তিদের হাতের পুতুল হয়ে রুশ বিপ্লবকে ভাঙতে চাইছে। বলশেভিকদের এই প্রচার কতটা মিথ্যা? সত্যিটা তাহলে কী? ক্রনস্টাড নাবিক ও শ্রমিকরা সারাদেশের রেলশ্রমিকদের উদ্দেশ্যে যে আহ্বানপত্র প্রকাশ করেছিলেন, তার মধ্য দিয়েই তাঁদের ভাবনা, দাবি ও অভিপ্রায় স্পষ্ট হয়ে যায়। এখানে সেই আহ্বানপত্রটিকেই হুবহু বাংলা অনুবাদে হাজির করা হলো:
রেলপথে কাজ করা শ্রমিকভাইরা!
বিচারের দিন আজ। স্বেচ্ছাচারী উৎপীড়ক ও ফাটকাবাজদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার ঝাণ্ডা তুলে ধরেছে ক্রনস্টাড নাবিকরা। স্বাধীনতার বেদিতে রাশিয়ার শ্রমিক ও কৃষকদের সুখ ও মহান ভবিষ্যতের জন্য আমরা আমাদের রক্ত ও প্রাণকে উৎসর্গ করেছি।
তিন বছর ধরে আমাদের দেখতে হচ্ছে স্বেচ্ছাচারী ও ফাটকাবাজদের লাম্পট্য; তিন বছর ধরে আমাদের দেখতে হচ্ছে ক্ষুধা ও শীতের মহামারী, রাশিয়ার জনগণের মৃত্যু ও নিঃশেষিত হওয়া; গ্রামাঞ্চলে আমাদের পিতাদের তিন বছর ধরে ঘাম ঝরাতে হয়েছে স্বেচ্ছাচারীদের জন্য; তিন বছর ধরে আমরা মরেছি যুদ্ধক্ষেত্রে। এখন সময় এসেছে স্বেচ্ছাচারীদের মুখের উপর বলার: ‘যথেষ্ট হয়েছে, আর নয়'। আমাদের প্রাণের বিনিময়েই জনগণের স্বাধীনতা আসুক। আমরা প্রাণদানের জন্য কৃতসংকল্প, কিন্তু, রেলপথে কাজ করা শ্রমিকভাইরা, তোমরা যদি আমাদের সমর্থনে এগিয়ে না আস, তাহলে আমাদের রক্তপাত তোমাদের বিবেককেই প্রশ্ন করবে... দাসের জীবনাতিপাত করে মরতে মরতে নিজেদের দ্বিধা-জড়তা কাটাতে না পারার জন্য নিজেদেরই অনুশোচনা করতে হবে। আমাদের সমর্থন কর। কেবলমাত্র রেলপথে কাজ করা শ্রমিকরাই আজ রাশিয়ার জনগণকে বাঁচাতে পারে।
সোভিয়েতের কাছে পেশ করা এই পরিমিত দাবিগুলোকে সমর্থন করতে আমরা তোমাদের আহ্বান করছি:
১। প্রত্যেক কৃষক ও শ্রমিকের জন্য সমান নির্বাচনী অধিকার।
২। গোপন ভোট, যাতে সোভিয়েত নির্বাচনে নির্বাচকরা নিজেদের সচেতন বিচার-বিবেচনা অনুযায়ী অংশ নিতে পারে, কোনওরকম বাধা বা চাপের মধ্যে অংশ নিতে না হয়।
৩। স্বাধীন ভাবে সংগঠিত সমবায় (কোঅপারেটিভ)-এর মাধ্যমে খাদ্য সন্ধান ও সংগ্রহ করার স্বাধীনতা, যাতে রাষ্ট্রের দ্বারা শ্রমিকদের ক্ষুধাকে ব্যবহার করার সম্ভাবনাকে শেষ করা যায়।
৪। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা, যাতে বড় আধিকারিকদের করা অপরাধ ও ফাটকাবাজদের দুষ্কর্মকে উন্মোচিত করা যায়।
৫। নিজের মত প্রকাশ করার স্বাধীনতা ও বিক্ষোভপ্রদর্শনের স্বাধীনতা, যাতে প্রত্যেক সৎ শ্রমিক নির্ভয়ে সত্য কথা বলতে পারে।
৬। সমবেত হওয়ার স্বাধীনতা।
৭। স্বেচ্ছাচারী উৎপীড়কদের ঘৃণ্য বিধি মৃত্যু দণ্ডাদেশের বিলুপ্তি।
৮। গুপ্ত পুলিসের সমস্ত আয়োগ বন্ধ করা, কেবলমাত্র ফৌজদারি পুলিস ও বিচারকদের বহাল রাখা।
৯। কমু্যনিস্টদের জন্য বিশেষ সুূবিধা বিলোপ করা।
১০। কর্মক্ষেত্রের এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়ার স্বাধীনতা।
১১। সেনাবাহিনী ভেঙে দেওয়া, এই মানুষদের দরকার গ্রামাঞ্চলে।
১২। শ্রমিক ও কৃষকদের দাসত্বখতে বাঁধার নয়া কৌশল শ্রমসেনা (লেবার আর্মি)-র বিলোপসাধন...।
১৩। সমস্ত নাগরিকদের জন্য রেলপথে ও নদীপথে যাতায়াতের স্বাধীনতা।
১৪। শ্রমিকদের জন্য কৃষকদের সঙ্গে সরাসরি পণ্য বিনিময়ের অধিকার। মুনাফা-বিরোধী বাহিনী নামে যে নয়া রাজপথ-ডাকাতদের গড়ে তোলা হয়েছে, তাদের অপসারণ।
১৫। শ্রমিকদের ঘাম নিঙডে় যে সরকারি ফাটকাবাজরা কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করছে, তাদের মধ্যস্থতা এড়ানোর জন্য শ্রমিকদের সমবায়ের বিদেশ থেকে দ্রব্যাদি কেনার স্বাধীনতা।
১৬। মূল্যহীন কাগজে নয়, সোনার মাধ্যমে মজুরি প্রদান।
১৭। স্বেচ্ছাতারী উৎপীড়কদের নজরদার সংগঠন হিসাবে কাজ করা রাজনৈতিক ডিপার্টমেন্টগুলোর বিলুপ্তি।
১৮। গোপন ব্যালটের মাধ্যমে সমস্ত সোভিয়েত ও সরকারের নির্বাচন অবিলম্বে করা।
আমাদের দাবিগুলি খুবই পরিমিত। ১৯১৭ সালে যে পরিমাণ স্বাধীনতা ছিল তার থেকেও কম আমরা চাইছি। এর জন্য আমরা মরতেও রাজি। কিন্তু আমরা আশা করব যে আমাদের আত্মোৎসর্গ বৃথা হবে না। সম্মুখসমরেই মরতে হোক বা চেকিস্তি-র বন্দিকোঠায় আমাদের হত্যা করা হোক, তোমরা যদি আমাদের সাহায্য না কর, আমাদের অভিশাপ তোমাদের ওপর থাকবে।
আমাদের দাবিসমূহকে সমর্থন কর। রেলপথে তোমাদের উদ্যোগে সেনাবাহিনীর চলাচলকে রুখে দাও, তাহলেই দেখবে যে শ্রমিকদের ধ্বংস করতে জারের আমলের সেনাপতিদের ফিরিয়ে এনেছে এই যে ভীতু দানবেরা তারা ল্যাজ গুটিয়ে পালাবে, ক্লান্ত বিধ্বস্ত জনগণ শান্তি পাবে।... কারখানার শ্রমিকদের সঙ্গে হাত মেলাও, দৃঢ়তার সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ থাক, তাহলেই এইসব স্বেচ্ছানিযুক্ত খুদে জার-রা চার্চের ইঁদুরদের মতো পালাবে।
(সূত্র: দি রাশিয়ান রিভলুশন, ১৯১৭-১৯২১; লেখক–রোনাল্ড কোওয়ালস্কি; পৃষ্ঠা: ২২০-১, ইংরেজি থেকে বাংলা অনুবাদ বর্তমান লেখকের করা।)
ক্রনস্টাড বিদ্রোহ দমন
প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ:
১৭ মার্চের সকালে বেশ কিছু দুর্গের দখল নিয়ে নেওয়া হয়েছিল। পেট্রোগ্রাদ গেটস, যা ছিল ক্রনস্টাড-এর দুর্বলতম স্থান, তার মধ্য দিয়ে বলশেভিকি-রা প্রতিরোধ ভেঙে ঢুকেছিল, আর তারপর শুরু করেছিল নির্মমতম হত্যাকাণ্ড। বিদ্রোহী নাবিকরা যে কম্যুনিস্টদের উপর এতদিন কোনও আক্রমণ করেনি, তারাও নাবিকদের বিশ্বাসের মর্যাদা না দিয়ে পেছন থেকে তাদের উপর আক্রমণ শুরু করেছিল...। গভীর রাত অবধি চলেছিল বিষম বিরূপতার মুখে ক্রনস্টাড-এর নাবিক ও সেনাদের মরিয়া সংগ্রাম। পনেরো দিন ধরে যে শহরে একজন কম্যুনিস্ট-এরও কোনও ক্ষতি করা হয় নি, সেই শহরই ক্রনস্টাড-এর পুরুষ, মহিলা ও শিশুর রক্তে লাল হয়ে উঠেছিল।
অন্ধ প্রতিশোধস্পৃহার নিশীথকালীন তাণ্ডব বল্গাহীন হয়েছিল, চেকা (Cheka)-র রাতজোড়া নির্বিচার গুলিবর্ষণ অসংখ্য শব শিকার করেছিল।
পরবর্তী বহু সপ্তাহকাল পেট্রোগ্রাদ-এর কারাগারগুলো ভর্তি ছিল শয়ে শয়ে ক্রনস্টাড বন্দীদের দিয়ে। প্রতি রাত্রে চেকা-র নির্দেশ মোতাবেক তাদের থেকে ছোট ছোট দলকে বের করে নিয়ে যাওয়া হতো এবং তারপর তারা উধাও হয়ে যেত— জীবিতদের মাঝে আর তাদের দেখা মিলত না। সবার শেষে যাদের গুলি করে মারা হয়েছিল, তাদের মধ্যে ছিলেন পেরেপেলকিন, ক্রনস্টাড-এর প্রভিশনাল রিভলুশনারি কমিটির সদস্য।
বলশেভিক আমলাতান্ত্রিকতা (bureaucracy)-র বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে ১৯২১-এর মার্চে যারা ১৯১৭-র অক্টোবর বিপ্লবের স্লোগান ‘সোভিয়েতের হাতে সব ক্ষমতা’ আবার তুলে ধরেছিল, তাদের ধীরে ধীরে মৃত্যুর পথে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে আর্কঅ্যাঞ্জেলের বরফজমা অঞ্চলের কোনও কারাগার বা বন্দিশিবির (concentration camp) অথবা সুদূর তুর্কিস্তান-এর কোনও পাতালঘর বন্দিকোঠা।
(সূত্র: ১৯২২ সালে এ বের্কম্যান-এর লেখা দি রাশিয়ান ট্র্যাজেডি-র অংশ। এটি উদ্ধৃত হয়েছে রোনল্ড কোওয়ালস্কি-র লেখা দি রাশিয়ান রিভলুশন, ১৯১৭-১৯২১ বইয়ে ২২৭-২৮ পৃষ্ঠায়, ইংরেজি থেকে বাংলা অনুবাদ বর্তমান লেখকের করা।)
ক্রনস্টাড-পরবর্তী দমন
১৯২১-এর ৮ মার্চ লেখা মেনশেভিক-দের পেট্রোগ্রাদ কমিটির প্রচারপত্র থেকে:
বলির পাঁঠা খুঁজতে গিয়ে বলশেভিকরা আমাদের পার্টি (মেনশেভিক পার্টি)-কে তাদের মিথ্যা কুৎসামূলক প্রচারকাণ্ডের প্রিয় লক্ষ্যমুখ করে তুলেছে। মেনশেভিকরা বহির্হস্তক্ষেপ সমর্থন করে, মেনশেভিকরা কৃষকদের বিদ্রোহ করতে উসকানি দিচ্ছে, পেট্রোগ্রাদ-এর শ্রমিক-ধর্মঘট ও ক্রনস্টাড-এর বিদ্রোহের পিছনে আছে মেনশেভিকদের উসকানি...ইত্যাদি। এমনভাবেই দিনের পর দিন, দিনের পর দিন লিখে চলেছে আমলাতন্ত্রে স্থিত লেখকরা যাতে তাদের উপরের প্রভুদের সন্তুষ্ট করা যায় ও ‘সম্মানজনকভাবে’ নিজেদের উপায়-উপার্জন বজায় থাকে।
আর এই লেখকবাহিনীর দেখানো পথ শুঁকে শুঁকেই আসে চেকা (Cheka, গুপ্ত পুলিশ)-র আসল ডাকাতদের দল। রাতে তারা দরজা ভেঙে ঢুকে পডে় আমাদের পার্টির কর্মীদের ঘরে, আমাদের প্রতি সহানুভূতিশীল শ্রমিকদের ঘরে, ঘরের সবকিছু তছনছ করে ওলটপালট করে দেয় আর যাকে পায় তাকেই গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। গণ্ডায় গণ্ডায় আমাদের কমরেডদের গ্রেফতার করা হয়েছে সাম্প্রতিক দিনগুলোয়, যাদের মধ্যে আছে ড্যান, রোঝকভ, কামেনস্কি, নাজারেভ, চের্তকভ ও অন্যান্যরা।
আর এই সবই করা হচ্ছে পেট্রোগ্রাদ প্রোলেতারিয়েত-দের নাম করে।
আমরা জানি যে পেট্রোগ্রাদের শ্রমিকদের এতে কোনও ভূমিকাই নেই। আমরা জানি যে গোটা এক সারি কলে কারখানায় শ্রমিকরা ধর্মঘট করছে গ্রেফতার হওয়াদের মুক্তির দাবিতে।
এটা আমাদের দোষ নয় যে পেট্রোগ্রাদ ও মস্কোর শ্রমিকদের সরকারি নীতি বদলের সর্বসম্মত দাবিগুলির বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়ায় সরকার শ্রমিকদের প্রতিনিধিদের গ্রেফতার করছে, আর ক্রনস্টাড-এর নাবিক ও সেনাদের মুক্ত নির্বাচনের মাধ্যমে সোভিয়েত গঠনের প্রস্তাবের জবাব দিচ্ছে ভারি কামানের গোলাবর্ষণ দিয়ে।
এমন কোনও মন্দ নেই যাতে কোনও ভালোই নেই। এখন সকলে, এমনকি সবচেয়ে অনভিজ্ঞ শ্রমিকটিও বুঝবে বলশেভিক ক্ষমতার ভিত্তি শ্রমিক ও কৃষকদের সোভিয়েত নয়, বলশেভিক ক্ষমতার ভিত্তি নগ্ন গা-জোয়ারি। প্রত্যেক শ্রমিক এখন বুঝবে যে একমাত্র সমাধান হল প্রকৃতই মুক্তভাবে নির্বাচিত সোভিয়েতদের হাতে ক্ষমতার হস্তান্তর। এইসবই শ্রমিকরা বুঝবে এবং আমাদের সঙ্গে একসাথে লড়াই করবে সামরিক বিধি (martial law) বিলোপের জন্য, সমস্ত মেহনতীদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সংগঠিত হওয়ার ও সমবেত হওয়ার স্বাধীনতা এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা-র জন্য, মুক্ত নির্বাচনের মাধ্যমে সোভিয়েত ও অন্যান্য শ্রমিক সংগঠন গড়ার জন্য, এবং রাজনৈতিক বিশ্বাসের জন্য যে সব সমাজতন্ত্রী ও পার্টি-বহির্ভূত শ্রমিক ও কৃষকদের গ্রেফতার করে রাখা হয়েছে তাদের মুক্তির জন্য।
(সূত্র: দি রাশিয়ান রিভলুশন, ১৯১৭-১৯২১; লেখক–রোনাল্ড কোওয়ালস্কি; পৃষ্ঠা: ২২৬-২৭, ইংরেজি থেকে বাংলা অনুবাদ বর্তমান লেখকের করা।)
তামবোভ-এ বলশেভিক-পরিচালিত দমন অভিযান
তামবোভ অভিযানে নিযুক্ত চতুর্থ সামরিক সেকশনের ‘পলিটিকাল কমিশন' -এর চেয়ারম্যানের রিপোর্ট থেকে:
... জনতা যদি দুষ্কৃতিদের ও তাদের অস্ত্রশস্ত্র সমর্পণ করতে অস্বীকার করে... তাহলে জামিনস্বরূপ তাদের মধ্য থেকে কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হতো... ভাবার জন্য তাদের তিরিশ মিনিট সময় দেওয়া হতো, তরপরও তারা সমর্পণ না করলে গ্রেফতার করা জনেদের গুলি করে মারা হতো, এবং এই প্রক্রিয়া চালানো হতো যতক্ষণ জনতা নীরব থাকত। পুরুষদের পাশাপাশি মহিলাদেরও জামিনস্বরূপ গ্রেফতার করা হতো এবং তাদেরও গুলি করে মারা হতো... পাঁচ দিন ধরে চারটি গ্রামে চালানো এক অভিযানের ফল হয়েছিল এইরকম: ১৫৪ জন দুষ্কৃতি ও জামিনস্বরূপ বন্দিদের গুলি করে মারা হয়েছিল, প্রায় ২২৭ জন দুষ্কৃতির পরিবার থেকে ১০০০ জনকে জামিনস্বরূপ বন্দি করা হয়েছিল, ১৭টি বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, সব সম্পত্তি সমেত ২৪টি বাড়ি দখল করে নিয়ে গরিবদের দিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
(সূত্র: দি রাশিয়ান রিভলুশন, ১৯১৭-১৯২১; লেখক–রোনল্ড কোওয়ালস্কি; পৃষ্ঠা: ২২৮-২৯, ইংরেজি থেকে বাংলা অনুবাদ বর্তমান লেখকের করা।)
আলোচনা আপাতত এখানেই শেষ করা যাক। ১৯১৭-র ফেব্রুয়ারির রুশ বিপ্লব আমাদের যাদের মনে শ্রমিক-বিপ্লবের অসীম সম্ভাবনা সম্পর্কে স্বপ্ন-আশা-উত্তেজনা জাগিয়ে তুলেছিল, আসুন আমরা সবাই সেই সম্ভাবনার অপমৃত্যুর কারণ-রোগ-উপসর্গগুলোকে মতবাদিক ঠুলিগুলো সরিয়ে রেখে বিচার করি। কখন না আবার ছাই থেকে ডানা মেলে নতুন ফিনিক্স পাখি…