বাংলা কথাসাহিত্যের জগতে সমরেশ বসুর রাজপাট বিস্তৃতি ও বৈচিত্র্যে অনন্য। বাংলার সমাজভূগোলের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অবিস্মরণীয় বিভিন্ন চরিত্র তাদের স্বতন্ত্র বয়ান নিয়ে হাজির সেখানে— পাটকলের শ্রমিক, বিভিন্ন স্তরের কৃষক, শহর-গঞ্জ-গ্রামের চালচুলোহীন মানুষ, জঙ্গলপ্রান্তরের আদিবাসী-জনজাতি আবার অন্যদিকে মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্ত ক্ষমতার অলিন্দে ঘোরা সরীসৃপকুল। মাঝি, মইষাল, জেলে, বালুচরীর তাঁতির জীবন-নাটক যেমন দ্রুত পরিবর্তমান সমাজ-প্রেক্ষাপটে বিধৃত হয়েছে, তেমনই শহর-গঞ্জের বেকার যুবক-যুবতী ও উঞ্ছবৃত্তি অবলম্বনকারী হতভাগ্যদের জীবনও তাদের জ্বালা-যন্ত্রণার দগ্ধ অস্তিত্ব চিহ্নিত করেছে। এই বহুবর্ণ বহুত্বশালী প্রেক্ষাপটে অর্থগৃধ্নু সম্প্রদায়ের মর্মান্তিক অন্তঃসারশূন্যতা যেমন ফুটে উঠেছে, তেমনই বিবিধ লোকসম্প্রদায়ের জীবনাচরণ-ধর্ম-দর্শনের গভীর ছবি ফুটে উঠেছে। আর এই সবকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে রাজনৈতিক তত্ত্ব ও চর্চার তীক্ষ্ন ব্যাখ্যান। দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী পর্যায়, ১৯৪৭-পরবর্তী স্বপ্নভঙ্গ, নকশালবাড়ির নতুন উচ্ছ্বাস ও উচ্ছ্বাস-পরবর্তী অন্ধ-গহ্বরে পতন— এর ধারাভাষ্য নির্মিত হতে হতে গেছে সমরেশ বসুর কথাসাহিত্যে। ‘যুগ যুগ জীয়ে’, ‘শেকলছেঁড়া হাতের খোঁজে’, ‘মহাকালের রথের ঘোড়া’, ‘তিন পুরুষ’, ‘খণ্ডিতা’— রাজনৈতিক আখ্যান হিসাবে এই উপন্যাসগুলো তো অবিস্মরণীয় হয়ে আছে। এছাড়াও আছে তুলনায় স্বল্পপরিচিত আরো বহু উপন্যাস ও গল্প যেখানে সমরেশ বসু বামপন্থী রাজনৈতিক আন্দোলনের একদা-কর্মী হিসাবে তঁার অভিজ্ঞতা থেকে প্রাপ্ত অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে রাজনীতির তত্ত্ব ও চর্চার পরিসরকে খুলেমেলে বিশ্লেষণ করেছেন। এরকমই একটি উপন্যাস হলো ‘গন্তব্য’। এই উপন্যাসের বয়ানে উপস্থিত রাজনৈতিক ভাবনাই এখন আমরা আলোচনা করব।
‘গন্তব্য’ উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭৮ সালের মে মাসে, কলকাতার বিশ্ববাণী প্রকাশনী থেকে। সমরেশ বসুর অন্যান্য কাজের তুলনায় এই উপন্যাসটি পাঠক-সমালোচকদের নজর টেনেছে কম। কিন্তু এ উপন্যাসে বিপ্লবী রাজনৈতিক আন্দোলনের এক প্রশ্নাতুর কর্মী ‘কমল’-এর জবানীতে বিপ্লবী রাজনৈতিক তত্ত্ব ও চর্চার যে বিশ্লেষণ-সমালোচনা হাজির হয়েছে, গভীরতায় ও তাৎপর্য্যে তা কেবল গল্প-উপন্যাসের পরিধিতে নয়, রাজনৈতিক প্রবন্ধসাহিত্যের পরিধিতেও অতি দুর্লভ। চল্লিশ বছর অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ার পরও তার মুক্তভাবনার সাহসিকতার ঔজ্জ্বল্য অমলিন। আমাদের আজকের রাজনৈতিক সক্রিয়তাকে সাহসী সত্যান্বেষী বিপ্লবী চরিত্রে দৃঢ় করার জন্যই তার প্রতি মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন।
‘গন্তব্য’ উপন্যাসটি শুরু হয় বেশ হালকাছলে। মধ্যবিত্ত চাকুরিজীবী এক ব্যক্তি, তার স্ত্রী, শিশুপুত্র ও শ্যালিকা ভ্রমণ উদ্দেশ্যে ধর্মতলার বাসডিপো থেকে ভোরসকালে পুরীগামী বাসে সওয়ার হয়। প্রমোদভ্রমণযাত্রীদের হালকা মেজাজ, নানা খুনসুটি নিয়ে গড়াতে গড়াতে উপন্যাসটি হঠাৎই এক অভাবনীয় বাঁকের সামনে হাজির হয় যখন সেই শ্যালিকা, যার নাম ফুল্লরা, আবিষ্কার করে যে তার পাশের আসনের গোঁফ-দাড়ি ও কালো চশমায় মুখ-ঢাকা পুরুষ যাত্রীটি আসলে তার সঙ্গে কলেজে পড়া এক বন্ধু যে বছর আটেক আগে নকশালবাড়ির কৃষক-অভু্যত্থানের আদর্শে বিপ্লবী আন্দোলনে আত্মনিয়োগ করার জন্য বিপ্লবী পার্টির সদস্য হয়ে সাধারণ জীবন ছেডে় চলে গিয়েছিল। তার নাম কমল। সে এখন প্রাণরক্ষার জন্য আত্মগোপন করে বেড়াচ্ছে। পুলিশ তাকে খুন করতে চায় রাষ্ট্রদ্রোহিতার জন্য আর পার্টি তাকে খুন করতে চায় পার্টি-আদর্শ নিয়ে প্রশ্ন তুলে পার্টি-আনুগত্য ভাঙার জন্য। কমল ও ফুল্লরার কথোপকথনের মধ্য দিয়ে উপন্যাস এক নতুন বাঁক নেয়।
কমল ও ফুল্লরার সম্পর্ক আট বছর আগে ক্রমশ পারস্পরিক ঘনিষ্ঠতায় নিবিড় রূপ নিচ্ছিল, যাতে ছেদ টেনেছিল কমল রাজনৈতিক সক্রিয়তার জন্য প্রয়োজনবোধে। সেদিকে ফিরেই এখন কমল বলে:
আসলে আমি জীবনের অনেক কিছুকেই মূল্যহীন বলে ধরে নিতে শিখেছিলাম। ইভ্যানজেলের মতো, পবিত্র সব বাণী। এরকম প্রটেস্টান্ট হবার কোনও অর্থ নেই। যতটা সম্ভব পুরোপুরি একটা মানুষ, কোনও বড় কাজ-টাজ করতে পারে, রক্ষা করা, হত্যা করা, সবকিছু বোধহয় তারাই করতে পারে। আনকমন হব বলে কেউ তা হতে পারে না, তাই না? কমনসেন্স হচ্ছে গ্রেটার সেন্স, তাই তো, না কি? (সমরেশ বসু রচনাবলী, খণ্ড-১৩, আনন্দ পাবলিশার্স, পৃষ্ঠা-৩১৮)
‘ইভ্যানজেল’, ‘পবিত্র সব বাণী’, ‘প্রটেস্টান্ট’ শব্দগুচ্ছ দেখিয়ে দেয় যে বিপ্লবী সক্রিয়তার জন্য মানবজীবনের স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ততাকে ত্যাগ করা আজ কমলের কাছে ধর্মীয় গোঁড়ামিতে আত্মসমর্পণের সমতুল মনে হচ্ছে। কমলের মনে হচ্ছে এভাবে মানুষ কোনও বড় কাজের জন্য নিজেকে তৈরি করতে পারেনা, বরং বাইরে থেকে আরোপিত বিধিবন্ধনে বেঁধে নিজেকেই খণ্ডিত করে, আত্মশক্তিকে ধ্বংস করে। জীবনের সহজ স্বাভাবিকতার মধ্য দিয়েই আত্মশক্তি বিকশিত হতে পারে। সবার চেয়ে আলাদা হওয়ার জন্য কোনও খাড়া-করা প্রতিমাকে নকল করতে গেলে মুখোশের খোলটাই পড়ে থাকে, ভিতরের প্রাণটা শুকিয়ে মরে। নিজের বিচার-বিবেচনাকে বন্ধক রেখে মহাজন-প্রদর্শিত যুক্তি-ভাবনাকে আউড়ে যাওয়া বিকলাঙ্গ মনের জন্ম দেয়। প্রাণহীন খোলসবন্দি সেই বিকলাঙ্গ মনে জন্ম নেয় তীব্র আত্ম-অহংকার কারণ সে জীবনের সহজ স্বাভাবিকতা বর্জনকে ‘মহৎ কাজের জন্য করা ত্যাগ’ হিসাবে গরিমাণ্বিত করে। এ আত্ম-অহংকারের উত্তাপে স্ফীত হয়ে ‘সাধারণ’ অন্যজনেদের তুলনায় সে নিজেকে বড় বলে ঠাউর করে। অন্যদের থেকে ‘আলাদা’, অন্যদের থেকে ‘বড়’ হওয়ার এ ভাবনার অনুসারী হয়ে আসে এই বিশ্বাস যে সাধারণ অন্যরা যখন অজ্ঞানতা ও অক্ষমতার জন্য সাধারণ জ্ঞানের (কমনসেন্সের) গণ্ডিতে আবদ্ধ, সে তখন বিশেষ জ্ঞান ও ক্ষমতাবলে স্বচ্ছ সচেতনতার অধিকারী হয়েছে, যে সচেতনতা অতীত ও বর্তমানকে ব্যাখ্যা করে উন্নততর ভবিষ্যতে প্রবেশের নিশ্চিত পথ জানে। নিজের এই ‘উন্নততর সচেতনতা’ ছাড়া অন্য সমস্ত ভাবনাকে বর্জনীয় ও ধ্বংসযোগ্য বলে সে জ্ঞান করে। জীবন যেখানে সবসময় অভাবিত অভূতপূর্বের অভু্যদয়ের মধ্য দিয়ে বিচিত্র প্রাণচাঞ্চল্যে অস্থির, এই উন্নাসিকতা সেখানে প্রাপ্ত এক জ্ঞানকে চিরস্থায়ী করে টিকিয়ে রাখার অন্ধতাগিদে সমস্ত প্রাণচঞ্চলতার বিরুদ্ধে জগদ্দল। কমল এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে বলে:
তোমার মনের একটা ছকে আমি বাঁধা পড়ে আছি। দোষ দেব না তোমাকে, কিন্তু সত্যি বলছি ছকটা বড় খারাপ ব্যাপার। ছক থেকে বেরিয়ে আসা ছাড়া উপায় নেই। যে নিজেকে মুক্ত ভাবতে পারেনা, সে অন্যদের মুক্ত করবে কী করে? কোনও কিছুতেই ছকের থেকে খারাপ কিছু নেই, তা যদি বিপ্লবও হয়। আর বিপ্লবই বা কী? তার কোনও শেষ নেই, অতএব কোনও ছকও নেই। আমাদের সঙ্গে যদি তুমি মিশতে, দেখতে আমরা রেভ্যলুশনারি-র থেকে রিবেলিয়ানই বেশি। বিদ্রোহ যুগে যুগে— মানে বিপ্লব। কোনও ইজমেই বোধহয় এর কোনও পরিসমাপ্তি নেই। একমাত্র জেরন্টোক্রাসিই (বৃদ্ধতন্ত্র) নিজেদের ক্ষমতায় তৃপ্ত থাকতে চায়। বিপ্লবীদের মধ্যেও বৃদ্ধতান্ত্রিকের তো অভাব নেই। আমাদের দেশে তো নেই-ই। ফলে আমাদের দলের অধিকাংশ শহরের ছেলেরাই অনেকটা ড্রিফটারের মতো। তাদের গতি আছে, অথচ যেন সঠিক গন্তব্য নেই, কারোর প্রভুত্ব মানতে পারে না, বর্তমান সমাজের নীতি মানের কোনও মূল্য তো আদৌ নেই তাদের কাছে। হয়তো এটা বিশেষ করে আমাদের বেলায় এমন করে ঘটত না, যদি না আমাদের একটা বিরাট অংশের মার্কসিজম থেকে বিচ্ছেদ ঘটত। সব তাত্ত্বিকেরা মিলে মার্কসিজমকে এমন একটা তরল পদার্থের মতো করে তুলেছে, যার কোনও ল্যাজা-মাথা নেই। এখন পৃথিবী জুড়ে মার্কসীয় তত্ত্বেরই সংকটের কাল চলেছে, ফলে আমরা এলোমেলো ছুটে মরছি। অথচ আমাদের কাছে দাবি করা হচ্ছে জিজ্ঞাসাহীন ত্যাগ আর উৎসর্গ আর খতম—। (সমরেশ বসু রচনাবলী, খণ্ড-১৩, আনন্দ পাবলিশার্স, পৃষ্ঠা-৩৩২-৩৩৩)
ফুল্লরা কমলকে বোঝার চেষ্টা করছিল ‘নকশাল বিপ্লবী’-র পরিচিত ছকের সঙ্গে মিলিয়ে। তার বিরোধিতা থেকে শুরু হয়ে কমলের বক্তব্যে ছকের বিরোধিতা এখানে ক্রমশ আরও গভীরে প্রবেশ করেছে। বিপ্লব সম্পর্কে সব ছককে সে নাকচ করেছে, যা মোটেই সহজ নয়, কারণ বিপ্লবী রাজনৈতিক মহলে বিপ্লবের ছককে মৌলিক গুরুত্ব দেওয়া হয়। বিপ্লবের স্তর (গণতান্ত্রিক, জনগণতান্ত্রিক, নয়া গণতান্ত্রিক নাকি সমাজতান্ত্রিক), রণকৌশল ও রণনীতি (শ্রেণিবিশ্লেষণ, শত্রুপক্ষ-মিত্রপক্ষ নির্ধারণ, ক্ষমতাদখলের পথ, রুশ মডেল নাকি চিনা মডেল)— এইসব নিয়ে ছকের নির্মাণ ও পুনর্নির্মাণ ঘিরে বিপ্লবী রাজনৈতিক মহলের মধ্যে বিতর্ক ও ভাঙন নিত্যনৈমিত্তিক। এক একটি দল এক একটি ছক নির্দিষ্ট করে তাকে ঘিরেই নিজের পরিচয় চিহ্নিত করে এবং অন্য সমস্ত ছককে ভুল প্রমাণিত করার মতবাদিক যুদ্ধে প্রাণপাত করে। এর বাইরে বেরিয়ে কমল বলছে যে বিপ্লবের কোনও ছক নেই, বিপ্লব অন্তহীন। বিপ্লবকে অন্তহীন করে ভাবাও বিপ্লবী রাজনৈতিক মহলের সাধারণ অভ্যাস নয়— বিপ্লবের অন্তিম বিন্দু হিসাবে কেউ দেখে ক্ষমতাদখল, কেউ দেখে সর্বহারার একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা। মতবাদ ও মতবাদের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের উপরই নির্ভর করে ছকের শুরু থেকে শেষ। সেই মতবাদ বা ‘ইজম’-এর চোরাকুঠুরি খুঁড়ে এগোতে গিয়ে মুক্তির পথকে গোলকধাঁধার অন্ধকারে হারিয়ে যেতে দেখেছে কমল:
সঠিকভাবে বলতে গেলে, আমাদের কোনও প্রস্তুতিই ছিল না, অথচ তার জন্য আমরা অপেক্ষা করতেও রাজি ছিলাম না। আমাদের সেই ধৈর্য কোথায় ছিল? আমরা কেবল ঝঁাপিয়ে পড়তেই চেয়েছিলাম। বুঝতে পারিনি, সেই থেকেই মূল তত্ত্ব থেকে আমাদের বিচ্ছেদ শুরু হয়েছিল। কৃষকদের যৌথ চেতনাকে আমরা জাগাতে পারিনি, আর এটাও বুঝতে পারিনি, দল বিপ্লব করে না, বিপ্লব ঘটায় জনতা। ফলে অতিবিপ্লববাদের কল্পনাবিলাস আমাদের পেয়ে বসল। আমরা রোমান্টিকতার নামে হয়ে উঠলাম হৃদয়হীন। পুলিশের কাছে না, নিজেদের বন্ধু শ্রেণির প্রতিই আমরা এমন নিষ্ঠুর হয়ে উঠলাম, আমাদের ডগমা এত বড় হয়ে উঠল, আমরা জোর করে সশস্ত্র বিপ্লব ঘটাতে চাইলাম। তার ফলেই আমাদের গ্রাম ছাড়তে হয়েছে। আসলে গ্রাম আমাদের ছাড়ানো হয়েছে। অথচ শহরে এসে আমরা একটা মন্ত্রীকেও মারতে পারিনি, পুলিশের আই জি বা কোনও কমিশনারকেও না। এমনকি কোনও ছদ্মবেশী নিখুঁত শত্রু শয়তানকেও না। মাঝখান থেকে শাসকদলের কতগুলো গুণ্ডা মস্তান এখন আমাদেরই দল ভাঙিয়ে খাচ্ছে, আমাদেরই মারছে, পুলিশের অনুচর ছাড়া তারা কিছুই নয়।... জীবনকে তুচ্ছ করতে পারি, কিন্তু কার্যকারণ কোনওকিছুই জিজ্ঞাসার অতীত হতে পারে না। আমরা যদি সুশৃঙ্খল সেনাবাহিনীও গঠন করি, তবে তা বুর্জোয়াদের বিবেকহীন সামরিকবাহিনী হবে না। আমাদের অনেকের মনেই প্রশ্ন জেগেছে, জাগেনি শুধু তাদের, যারা কেবল তত্ত্ব থেকে না, জীবন আর জগৎ থেকেই যার আত্মবিচ্ছেদ ঘটে গেছে। (সমরেশ বসু রচনাবলী, খণ্ড-১৩, আনন্দ পাবলিশার্স, পৃষ্ঠা-৩৩৬)
বিপ্লবের কেন কোনও ছক হতে পারে না তা বোঝা যায় যখন কমল বলে যে দল বিপ্লব করে না, বিপ্লব ঘটায় জনতা। দল বিপ্লব করলে, বিপ্লব দলের উদ্যোগ ও পরিকল্পনা মতো ঘটত, ছক সেখানে কাজ করতে পারত। কিন্তু বিপ্লব যেহেতু জনতা ঘটায়, তার অনুকূল পরিস্থিতি সম্পর্কে কিছু আঁচ করা গেলেও, শেষাবধি তা ঘটনার আকস্মিকতা ও অদৃষ্টপূর্বতা দিয়েই চিহ্নিত, ফলে পূর্বনির্ধারিত ছক সেখানে অসম্ভব। একে অস্বীকার করে দলের মাধ্যমে বিপ্লব করতে যাওয়াই মার্কসবাদের মূল তত্ত্ব থেকে মৌলিক বিচ্ছেদের জায়গা বলে কমল চিহ্নিত করেছে। যাদের বিপ্লব করার কথা সেই শ্রমিক ও কৃষক এই দল-সংগঠিত ‘বিপ্লবে’ উৎসাহী না হওয়ায় তাদের প্রতি দোষারোপ তীব্র হলো। শ্রমিক-কৃষকের মধ্যে দলবাহিত ‘উন্নত’ সচেতনতার অভাবের নালিশ তো ছিলই। ফলে বিপ্লব করানোর জন্য হৃদয়হীন জোরজুলুমও শুরু হলো। যাদের বিপ্লব করার কথা তাদের সঙ্গে ‘বিপ্লবী’-দের বিচ্ছিন্নতা এভাবে অমোঘ হয়ে উঠল।
এই ব্যর্থতা ও বিচ্ছিন্নতা কমলকে প্রশ্নাতুর করে তুলেছে, প্রশ্নাতুর করে তুলেছে আরো অনেককে। কমল কেবল দলের বিপ্লব করার তত্ত্বের মধ্য দিয়ে মার্কসবাদের মূল তত্ত্ব থেকে বিচ্ছেদের কথাই বলেনি, ‘এখন পৃথিবী জুড়ে মার্কসীয় তত্ত্বেরই সংকটের কাল চলেছে’ বলে বলেছে। তার মন তাই বৃহত্তর পরিধির মধ্যে উত্তর খুঁজছে, যেমন:
ফুল্লরা বলল, ‘মার্কসিস্টের হাতে কাফকা, কোথায় যেন একটা সিনিসিজমের গন্ধ লাগছে।'
‘প্রচলিত অর্থে সিনিকদের বিশ্বনিন্দুক আর ব্যর্থই বলা হয় বটে।' কমল বলল, ‘কিন্তু মনে রেখো, সিনিকরাই প্রথম সাম্যবাদী দার্শনিক। আর এ গোত্রের জনক ছিলেন এনটিস্থিনিস নামে এক ব্যক্তি, প্লেটোর সমসাময়িক। নিরাজ সমাজের যাঁরা কল্পনা করেছেন, তঁাদেরই নৈরাজ্যবাদী বলা হয়েছে। অথচ, এখনকার পণ্ডিতদের মধ্যে নৈরাজ্যবাদী একটা গালাগাল। যদিও গালাগালটা প্রথমে উচ্চারণ করেছিল গ্রিসের নগরবাসী শাসকরা, তাদের অনুচর দার্শনিকেরা। আমার ধারণা নিরাজ সমাজবাদের উৎস থেকেই বৈজ্ঞানিক মার্কসবাদের জন্ম, যার সঙ্গে এমনকি গান্ধীবাদেরও কোথাও মিল আছে।...
...বিপ্লবী সরকারে আমার বিশ্বাস নেই, তারা কোনও লোকায়ত্ত রাষ্ট্রও গঠন করতে পারবে না। সেইজন্যই মার্কসবাদকে আমি আর ঠিক আগের চোখে দেখছি না। মনে হচ্ছে, যথার্থ না জেনেই, আমি একজন রাইফেলধারী হয়ে গেছি। মার্কসবাদের সঙ্গে আমাদের মূলত কোথায় বিচ্ছেদ ঘটেছে, সেটা খুঁজে বের করা দরকার। এই কথাটা বলেই আমি দলের একটা অংশের শত্রু হয়ে গেছি। ফলে দলের আর পুলিশের বন্দুক, দুই-ই আমার পিছনে ঘুরছে।... (সমরেশ বসু রচনাবলী, খণ্ড-১৩, আনন্দ পাবলিশার্স, পৃষ্ঠা-৩৩৪-৩৩৫)
...বিপ্লবী সরকার নয়। লোকায়ত্ত রাষ্ট্র চাই। পৃথিবীতে নিরাজসমাজবাদীরাই তার রূপরেখা ঠিক করে দিয়ে গেছেন। বিশ্বভ্রাতৃত্ব আর সাম্যের চিন্তা তঁারাই প্রথম করেছিলেন। আমি পেছন ফিরে তাকাবার কথা বলছি না। কিন্তু গোড়া থেকে ভাবাই ঠিক। বৈজ্ঞানিক মার্কসবাদকে জানতে হলেও, তার গোড়াও জানা দরকার।
ফুল্লরা বলল, ‘আমি এই নিরাজসমাজবাদের কথা তোমার কাছেই প্রথম শুনছি।'
‘অথচ সাম্যের প্রাচীনতম স্বপ্ন এঁরাই দেখেছিলেন।' কমল বলল, ‘কনফুসিয়াসের মন্ত্র ছিল শাসক আর নেতাদের মেনে নাও। কিন্তু তারই সমসাময়িক লাওৎসেকে প্রকৃতিবাদী বললেও, আমি তাঁকে নিরাজসমাজবাদীই বলব, যা আমাদের শেষ লক্ষ। লাওৎসে তঁার কথা কবিতায় বা ছড়া কেটে বলতেন। যেমন একটা তোমাকে শোনাই, “যতই বিধি নিষেধ বাড়বে, ততই মানুষ হবে গরিব/ যত ধারালো হাতিয়ার বানাবে/ রাজ্যে তত বাড়বে বিশৃঙ্খলা/ যত কলাকৌশল ফাঁদবে/ তত বেরোবে তাকে এড়াবার ফন্দি/ যে দেশে যত আইনকানুন/ সে দেশে তত চোর-ডাকাতের মেলা।” যিশু-জন্মের অন্তত ছশো বছর আগে এসব কথা বলা হয়েছে। (সমরেশ বসু রচনাবলী, খণ্ড-১৩, আনন্দ পাবলিশার্স, পৃষ্ঠা-৩৩৬-৩৩৭)
খেয়াল করা যায় যে কমল ‘বৈজ্ঞানিক মার্কসবাদের’ মূল সন্ধান করতে গিয়ে ‘সাম্য’, ‘বিশ্বভ্রাতৃত্ব’ ও ‘লোকায়ত্ত রাষ্ট্র’ কল্পনার উপর জোর ফেলেছে। এবং তার জন্য কোনও একটি মতবাদের সওয়াল না করে মানবইতিহাসের পরম্পরা জুড়ে বিভিন্ন ধারার চিন্তার উত্তরাধিকারকে আত্মস্থ করতে চেয়েছে। তাই এনটিস্থিনিস, লাওৎসে, মার্কস ও গান্ধী একই ধারার বুননের নানা রঙের সুতো হিসাবে হাজির হয়েছে। এহেন ভাবনা বিপ্লবী রাজনৈতিক মহলে (ষাট-সত্তরের দশক থেকে আজও) প্রাধান্য বিস্তার করে থাকা প্রবণতাগুলোর থেকে বেশ আলাদা। কীভাবে তা একটু ভেঙে দেখা যাক।
প্রথমত, বৈজ্ঞানিক মার্কসবাদের চালু ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ অনুযায়ী মূল জোর ফেলা হয় ‘সমাজবিকাশের ঐতিহাসিক গতি’-র উপর এবং তদনুযায়ী উৎপাদিকা শক্তির বিকাশকে নির্ধারক হিসাবে ধরা হয়। এই ধারণা অনুযায়ী সাম্যবাদী সমাজের মুক্ত পৃথিবীতে পৌঁছতে হলে উৎপাদিকা শক্তির বিপুল বিকাশ— অন্তত পঁুজিবাদী সমাজে হওয়া বিকাশের সমপরিমাণ বা তার চেয়ে বেশি— হওয়া আবশ্যক। আর উৎপাদিকা শক্তির বিকাশকে প্রধানত মাপা হয় শিল্পোৎপাদনের বৃদ্ধির মাপে। এই বৃদ্ধি-বিকাশের জন্য কেন্দ্রীভূত পরিকল্পনাধীন বৃহৎ শিল্প, শক্তিশালী কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণাধীন সমাজ আবশ্যক বলে ধরা হয়। মতবাদিক শুদ্ধতাপন্থীরা এসব নিয়ে কোনও প্রশ্ন উঠতে দিতে নারাজ। কিন্তু বাস্তবে বহু প্রশ্ন উঠে গেছে।
যেমন, উৎপাদনী শক্তির যে বিপুল অবারিত বিকাশের কথা বলা হয়, আমাদের পৃথিবীর কি তার ভার বহন করার শক্তি আছে— প্রথমে এই ঘোর ‘বস্তুবাদী’ প্রশ্নটিকেই ধরা যাক। উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলোর উৎপাদনের গড় হারে গোটা পৃথিবীতে উৎপাদন চালাতে গেলে, একটি পৃথিবী কেন, বেশ কয়েক গণ্ডা পৃথিবীও তার জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল সরবরাহ করতে পারবে না। আর এখনই এহেন উৎপাদনের জন্য পৃথিবীকে কেবলমাত্র একটা কাঁচামালের ভাণ্ডার হিসাবে দেখার নির্বুদ্ধিতা পৃথিবীর বাস্তুতন্ত্রের যে চরম সর্বনাশ সাধন করেছে, তাতে মানুষসহ গোটা জীবজগতের অস্তিত্বই বিপন্নতার মুখে দাঁড়িয়ে। ফলে উৎপাদিকা শক্তির অবারিত বিকাশের পথ আদৌ কি মানবমুক্তির পথ?
এরপরে অতটা বস্তুবাদী নয় এমন এক প্রশ্নকে ধরা যাক। আরো উৎপাদনের প্রয়োজন তো মানুষ যাতে আরো ভোগ করতে পারে, কিন্তু এই ভোগবৃদ্ধির কোনও সীমা আছে কি? আমেরিকা, ইউরোপ, রাশিয়া, চীন সহ তামাম দুনিয়াজুড়ে শিল্পোৎপাদন যেখানে বৃদ্ধির লাগাম হাঁকিয়ে টগবগিয়ে ছুটেছে, সেখানে একদিকে যেমন ভোগের নিত্যনতুন চাহিদা উত্তরোত্তর তৈরি হয়েছে, তেমনই বৈষম্য, রিক্ততা, নিত্যনতুন অভাববোধও সমাজজীবনকে আরও অজগর-প্যাঁচে পেঁচিয়ে ধরেছে। তাই ভোগবৃদ্ধির ‘বস্তুবাদী' পথে বৈষম্য, রিক্ততা, অভাববোধের উপশম নেই। গুরুত্ব দিয়ে এখন এই প্রশ্নটি ভাবা দরকার যে সত্যিই কতটা ভোগ একজন মানুষের জীবনধারণের জন্য দরকার। ‘কার্বন ফুটপ্রিন্ট’ কমানোর অধুনা ভাবনা কি এই প্রশ্নের দিকেই আমাদের ঠেলছে না?
এবার ধরা যাক একটি রাজনৈতিক প্রশ্নকে। কেন্দ্রীভূত বৃহৎ শিল্পের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণভাবে পুঁজিবাদী, সমাজ-গণতান্ত্রিক বা সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো উত্তরোত্তর যে কঠোর কেন্দ্রীভূত চেহারা নিতে নিতে যাচ্ছে, তা নাগরিকজীবনকে ক্রমশ নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণের পাকে জড়িয়ে নাগরিক স্বাধীনতাকে ক্রমশ সংকুচিত করছে। এছাড়াও বৃহৎ রাষ্ট্রদের প্রভাববলয় তৈরি ও রক্ষার সংঘাতের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক স্তরে অস্ত্র-প্রতিযোগিতা, যুদ্ধ-উত্তেজনা, জঙ্গী জাতীয়তাবাদ পোষণ করেছে, যা বিশ্বভ্রাতৃত্বের ভাবনাকে ক্রমশই দূরাগত এক মরীচিকায় পরিণত করেছে। ফলে পুঁজির একনায়কত্ব বা শ্রমিকশ্রেণির একনায়কত্ব, যে রূপেই কঠোর কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রের পত্তন হোক না কেন, তা সাম্য ও বিশ্বভ্রাতৃত্বের মধ্য দিয়ে মানবমুক্তির পথে হাঁটে না।
মতবাদিক শুদ্ধতাপন্থীরা এসব প্রশ্নকে স্বীকার করেন না। কমল মতবাদিক শুদ্ধতাপন্থী নয় বলেই তার ভাবনা এহেন প্রশ্নকে ধরে গভীরে অনুসন্ধান করতে চেয়েছে। তা বোঝা যায় যখন সে উৎপাদিকা শক্তি বৃদ্ধির নেহাত অর্থনৈতিক কল্পনাকে প্রধান না করে মূল হিসাবে চিহ্নিত করেছে সাম্যবাদী নিরাজ সমাজ গঠনের রাজনৈতিক অগ্রাধিকারকে। আর মতবাদিক শুদ্ধতাপন্থী নয় বলেই সেই সমাজগঠনের পথ কমলের কাছে কোনও একটি মতবাদকে কেন্দ্র করে গঠিত পার্টির শাসন আরোপের পথ নয়, তা হলো এক ‘লোকায়ত্ত রাষ্ট্র’ গঠনের পথ। ‘লোকায়ত্ত রাষ্ট্র’ মানে এমন রাষ্ট্র যা লোকের আয়ত্তাধীনে। এর মধ্য দিয়ে এমন একটা ছবি ভেসে ওঠে যেখানে বহুবিবিধ মত ও ভাবনার লোক বাস্তব অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে বহুত্ববাদী এক পরিসরে সমাজনীতি নির্ণয় ও সমাজপরিচালনায় সদা নিয়ত। কোনও ছক নয়। বহুবিবিধ মানুষের মুক্ত স্বতঃক্রিয়াই তাকে গড়ে তুলতে পারে।
উপন্যাসে কমলের ভাবনার এই উন্মুক্ত বিস্তারই কেবল ফুটে ওঠেনি, তার সীমাবদ্ধতার একটা দিকও ফুটে উঠেছে বলে মনে হয়। সেই দিকটার কথা এবার বলি। মতবাদিক শুদ্ধতাপন্থীদের গড়া কারাগার থেকে মার্কসবাদকে মুক্ত করে সাম্যবাদী নিরাজ সমাজ গঠনের মূল কল্পনার মধ্যে তার মুক্তি খোঁজার কমলের ভাবনা তার পাথেয় খুঁজেছে প্রাচীন গ্রিক দর্শন, প্রাচীন চীনা দর্শনের মধ্যে আবার অধুনার কামু, কাফকা, ডস্টয়েভস্কির মধ্য দিয়ে। কিন্তু ভারতীয় পরম্পরা (কেবলমাত্র গান্ধীর সংক্ষিপ্ত উল্লেখ ছাড়া) সেখানে নেই কেন? প্রাচীন ভারতে বজ্জী বা লিচ্ছবীদের মতো যে গণশাসনগুলো ছিল, বুদ্ধের ভাবনায় যে সাম্য ও গণতন্ত্রের কথা ছিল, বিভিন্ন আদিবাসী-জনজাতিদের সমাজরূপে যে যৌথজীবনের রেশ আজও টিকে আছে, বিভিন্ন লোকধর্মগুলোর মধ্যে যে সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের দর্শন প্রবাহিত, তার থেকে কি কোনও রসদই নেওয়ার নেই? সমরেশ বসু তাঁর নিজের বহু লেখায় এই রসদ অনুসন্ধান করেছেন। তাই মনে হয় যে এখানে কমলের ভাবনায় তার অনুপস্থিতির মধ্য দিয়ে তিনি আমাদের বামপন্থী বিপ্লব-ভাবনার একটা তির্যক সমালোচনাই করেছেন। সেই সমালোচনা হলো এই যে বিপ্লবী ভাবনা বা চেতনার জন্য আমরা নিজ-অঙ্গনের ভিতরে তাকাই না, পশ্চিম ইউরোপ পানে আর নয়ত রাশিয়া-চীন-ভিয়েতনা–কিউবা-লাতিন আমেরিকা পানে চেয়ে থাকি। সাম্যের আকাঙ্ক্ষা প্রকট বা প্রচ্ছন্ন রূপে যেভাবে আমাদের নিজস্ব ভাষা-সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়, প্রবাহিত হয়, তা আমাদের, অর্থাৎ, ‘আধুনিক’ শিক্ষায় শিক্ষিত বিপ্লবাকাঙ্খীদের অচেনা। ব্যাপক লোকসমাজের থেকে প্রথমেই এক বিচ্ছেদ এর মধ্য দিয়ে ঘটে যায়। আমার মনে হয় উপন্যাসে এই বিচ্ছেদের ছবিটি উঠে এসেছে তির্যকভাবে হুল্লোড়বাজ মদপানকারী সেই যুবকদলের মধ্য দিয়ে যারা ফুল্লরা-কমলকে ‘টোন’ কেটে যাচ্ছে বাসযাত্রা জুড়ে পিছনের আসন থেকে। পাঁচালির সুরে ছড়া কাটতে কাটতে যাচ্ছে তাদের মধ্যে একজন। ছড়াটা আদ্যন্ত লোকভাষার, লোকআঙ্গিকের, যার সঙ্গে ফুল্লরা-কমলের মুখের ভাষার, প্রকাশভঙ্গির বিস্তর পার্থক্য। কেবল পার্থক্য নয়, বলা যায় যে কমল-ফুল্লরার শালীন আভিজাত্যের বিপরীতে সে ছড়ার ভাষা-ভঙ্গি অশ্লীল ও পালিশহীন। ছড়ার মধ্য দিয়ে একদিকে সেই যুবকদের ফুল্লরা-কমলের প্রতি মুগ্ধতা হয়ত বা ঈর্ষাও প্রকাশিত হয়। অন্যদিকে ফুল্লরা-কমল অস্বস্তিবোধ করলেও যেভাবে তা অগ্রাহ্য করে যাওয়ার ভান করে তা থেকে মনে হয় যেন বা ওই অশ্লীলতা-ইতরতার সঙ্গে কোনও আদানপ্রদানে না গিয়েই তারা তাদের শ্লীলতা ও আভিজাত্যকে রক্ষা করে। শিক্ষিত অভিজাতকূল থেকে আসা বিপ্লবাকাঙ্ক্ষী ও সাধারণ লোকসমাজের মধ্যে বিদ্যমান বিরাট পরিখারই রূপক হয়ে ওঠে তা।
শেষ একটা প্রশ্ন— কমলের ভাবনা সমরেশ বসু কি কেবলমাত্র একজন ঔপন্যাসিক হিসেবে একটা চরিত্রকে বাস্তবায়িত করার জন্য তুলে ধরেছেন, নাকি তার মধ্য দিয়ে তঁার নিজের রাজনৈতিক ভাবনাও প্রকাশিত হয়েছে? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে সমরেশ বসুর আরো সব লেখা ছেনে তার মধ্যের রাজনৈতিক ভাবনার আলোচনা ও তুলনা করতে হয়, যা এই লেখার পরিসরে সম্ভব নয়। আমার বিশ্বাসটুকু কেবল বলে রাখি যে কমলের ভাবনা সমরেশ বসুর রাজনৈতিক ভাবনার আদলেই গড়ে উঠেছে।
সেপ্টেম্বর, ২০১৯
10 October, 2024
প্রয়াত সাহিত্যিক সমরেশ বসু তাঁর ' গন্তব্য ' উপন্যাসে ' কমল-ফুল্লরার ' এর কথপকথনের মধ্য দিয়ে কমিউনিস্ট মতবাদ বা বামপন্থী আদর্শ বা অতি বামপন্থী বিল্পপবাদ নিয়ে যে চিন্তা ভাবনার প্রকাশ ঘটিয়েছেন তাতে ঔপন্যাসিক সমরেশ বসুর ব্যাক্তি চিন্তার প্রকাশ ঘটিয়েছেন । যাইহোক এখনও বামপন্থী কম্যুনিস্ট আদর্শ বা সমাজতান্ত্রিক আদর্শের প্রাসঙ্গিকতা আছে বলেই আমি মনে করি ।