জাপাতিস্তা আন্দোলনের কথা

লিখেছেন:গুস্তাভো এস্তেভা, ভূমিকা ,তর্জমা: বিপ্লব নায়ক
জাপাতিস্তা আন্দোলনের কালপঞ্জী এবং গুস্তাভো এস্তেভার বিশ্লেষণে তার তাৎপর্য এই আলোচনায় হাজির হয়েছে।

ভূমিকা

গুস্তাভো এস্তেভা: ‘পেশাবৃত্তিত্যাগী বুদ্ধিজীবী’

গুস্তাভো এস্তেভার জন্ম ১৯৩৬ সালে, মৃত্যু ২০২২ সালে। ১৯৯৪ সালের পর থেকে জাপাতিস্তা আন্দোলনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত একজন রাজনৈতিক কর্মী ও তাত্ত্বিক হিসেবে তিনি ওই আন্দোলনের স্বতন্ত্র স্বরকে যেমন অন্যদের কাছে হাজির করেছেন, তেমনই পৃথিবীকে বদলানোর বিভিন্ন ভাবনা ও দৃষ্টিভঙ্গিকে বাহক ও ব্যাখ্যাকার হিসেবে জাপাতিস্তাদের মধ্যেও নিয়ে গেছেন। অর্থাৎ জাপাতিস্তা আন্দোলনের ভিতরের সঙ্গে বাহির ও বাহিরের সঙ্গে ভিতরের মেলবন্ধনের সেতু হিসেবে তিনি কাজ করেছেন। অবশ্য, ১৯৯৪ সালের আগেই তিনি একদিকে যেমন পুঁজিকেন্দ্রীক উন্নয়নবাদী দৃষ্টিভঙ্গির তীক্ষ্ণ সমালোচনা করেছেন, অন্যদিকে তেমনই সেই উন্নয়ন-নকশার পুনরাবৃত্তি করে সমাজতান্ত্রিক শিল্প-সমাজ গড়ার প্রভুত্ববাদী নানা প্রকল্পের বিপ্লব-বিরোধী চরিত্রকে উন্মোচিত করেছেন, আবার পুঁজিবাদ পেরিয়ে নতুন সর্বসাধারণতন্ত্রী সমাজরূপ ও জীবনযাপন নির্মাণ করার নানা রসদের খোঁজে আদিবাসী জনজাতিদের জনসমাজগত নানা রীতি ও জ্ঞান-পরম্পরার মধ্যে অনায়াস যাতায়াত করেছেন। জাপাতিস্তা আন্দোলন তাই তাঁর চর্চায় কোনো পর্বান্তর ঘটায়নি, বরং তাত্ত্বিক ধারণাগুলোকে বাস্তবিক মূর্ত অবস্থায় বিচার-বিশ্লেষণ ও উপস্থাপনা করার সুযোগ করে দিয়েছিল। তিনি নিজের পরিচয় দিতেন ‘deprofessionalized intellectual’ বা ‘পেশাবৃত্তিত্যাগী বুদ্ধিজীবী’ হিসেবে। বুদ্ধিজীবীরা যেমনভাবে জ্ঞানচর্চার বিশেষজ্ঞ হিসেবে নিজেদের হাজির করে অন্য সবার জ্ঞানচর্চার স্বাধীন অধিকারকে নাকচ করে ও সেভাবে নিজেদের ক্ষমতাধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে, সেই প্রক্রিয়ার বিরোধী সমালোচক হিসেবেই তিনি ‘পেশাবৃত্তিত্যাগী বুদ্ধিজীবী’ কথাটা ব্যবহার করতেন। তাঁর কাছে জ্ঞানচর্চা মানে তাই বিভিন্ন বিবিধ জ্ঞানরূপগুলোকে তাদের নির্দিষ্ট বিশেষ দ্যোতনা অনুযায়ী পারস্পরিক সম্পর্কবিন্যাসে দেখা। জাপাতিস্তাদের অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে এস্তেভা তাই বারবার অতি সাবলীলতায় বিশ্বজোড়া নব্য তত্ত্ববিশ্বের নানা সূত্রায়নকেও বিচার-বিবেচনা-ব্যবহারের জন্য তুলে এনেছেন। তাই এই লেখাগুলো পড়তে পড়তে আমরা কেবল জাপাতিস্তাদের কথাই অবগত হই না, আমাদের নিজেদের পরিপার্শ্বের বিশ্বেরও পরিবর্তিত হওয়া না-হওয়ার সম্ভাবনাগুলো নিয়ে ভাবনায় ঢুকে যাই।

এখানে সংকলিত গুস্তাভো এস্তেভার লেখাগুলো মূলে স্প্যানিশ ভাষায় লেখা। এখানে অনুবাদ করা হয়েছে ক্যাথরিন ডিক্স-কৃত তাদের ইংরেজি অনুবাদ (২০২৩ সালে রুটলেজ দ্বারা প্রকাশিত গুস্তাভো এস্তেভার লেখার সংকলন ‘A Critique of Development and Other Essays’) থেকে। স্প্যানিশভাষী পাঠকদের জন্য এস্তেভা যখন লিখেছিলেন, তখন মেহিকো, বিশেষ করে চিয়াপাস প্রদেশের যে পূর্বইতিহাস ও অধুনা ঘটনা-পরম্পরা সম্পর্কে যে কথাগুলো তিনি তাঁর পাঠকের সাধারণ জানার অন্তর্গত বলে ধরে নিয়েছিলেন, বাংলা ভাষার পাঠকের ক্ষেত্রে তা স্বাভাবিকভাবেই ধরে নেওয়া যায় না। তাই গুস্তাভো এস্তেভার করা আলোচনার পরিপ্রেক্ষিত হিসেবে কাজ করা চিয়াপাস প্রদেশের জাপাতিস্তা জনজাতিদের ইতিহাস বিষয়ক একটা কালপঞ্জীও আমরা এই ভূমিকায় জুড়ে দিলাম।

 

চিয়াপাস: জনজাতি আন্দোলনের কালপঞ্জী

প্রাগৈতিহাসিক যুগ

এখন চিয়াপাস নামে পরিচিত এই অঞ্চলে প্রাচীন মায়া সভ্যতার মানুষরা প্রথম মনুষ্যবসত গড়ে তোলে। চিয়াপাস অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে থাকা নানা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন যেমন এই প্রাচীন সভ্যতার চিহ্ন বহন করছে, তেমনই আদিবাসী জনজাতিগুলোর আদি মাতৃভাষাগুলোও সেই সভ্যতা-পরম্পরার সূত্র হিসেবে আজও কাজ করছে। এই ভাষাগুলো হল: জোতজিল, জেলতাল, চোল, তোজোলাবাল, চিয়াপানেক, জোক, ইত্যাদি। এই একেকটি ভাষার প্রবাহপথ ঘিরে মায়া সভ্যতার এক একটি আদি জনজাতির জনসমাজ রূপ থেকে রূপান্তরে যাত্রা করেছে।

 

১৫২৪-১৫২৭

ইউরোপের স্পেন থেকে আসা কংকুইস্তেদোর, অর্থাৎ, ঔপনিবেশিক হামলাকারীরা মায়া আদিবাসীদের পরাভূত করে এলাকার দখল নেয় এবং ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ প্রক্রিয়া শুরু করে।

 

ষোল শতকের শেষভাগ

ইউরোপীয়দের বয়ে আনা অসুখ ও ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক কর্তাদের অত্যাচারে মায়া আদিবাসীদের জনসংখ্যা কমে অর্ধেক হয়ে গিয়েছিল, সতেরো শতকের মাঝের আগে তা আবার পুরোনো সংখ্যায় ফিরে আসেনি।

 

১৭১২

অজন্মা-দুর্ভিক্ষের মাঝে স্প্যানিশ ঔপনিবেশিক প্রভুদের চাপানো খাজনা ও নানারকম আদায়ের বোঝার বিরুদ্ধে মায়া আদিবাসীদের একটি গোষ্ঠী জেলটাল (Tzeltal) বিদ্রোহ করে। ঔপনিবেশিক প্রভুরা নৃশংসভাবে এই বিদ্রোহ দমন করে।

 

১৮২৪

ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানের পর চিয়াপাস অঞ্চলের আঞ্চলিক অভিজাতশ্রেণি সিদ্ধান্ত নেয় যে গুয়াতেমালার মধ্যে না থেকে তারা মেহিকো রাষ্ট্রে নিজেদের অঞ্চলকে অন্তর্ভুক্ত করবে যাতে আঞ্চলিক শাসন-প্রশাসনে তাদের নিয়ন্ত্রণ তুলনায় বেশি অটুট থাকে। এই অভিজাতশ্রেণি দুটি ভাগে বিভক্ত ছিল--- একটি অংশ পরিচিত ছিল রক্ষণশীল (Conservative) বলে যাদের অভিপ্রায় ছিল চার্চের জমির উপর দখল ও অন্যান্য সমাজ-নিয়ন্ত্রণকারী প্রভাব বজায় রেখে তার মধ্য দিয়ে জমির উপর দখল ও বদ্ধ শ্রমদাতা হিসেবে আদিবাসী মানুষদের উপর দখল কায়েম রাখা, আর অপর অংশটি পরিচিত ছিল উদারতাবাদী (Liberal) বলে যারা চার্চের প্রাধিকারকে নাকচ করে চার্চের হাতে থাকা বিপুল পরিমাণ জমি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসে মুনাফাজনক বাণিজ্যিক চাষ করার পরিকল্পনা নিয়েছিল। এই উভয় পক্ষই জমি দখলের তাড়সে আদিবাসী জনগোষ্ঠীদের জমি-জঙ্গলের উপর অধিকারকে নস্যাৎ করে বিপুল পরিমাণ বড় বড় জোত তৈরি করতে থাকে। আদিবাসী জনগোষ্ঠীদের গ্রামসমাজ ও তার নিজস্ব অর্থনীতি ভেঙে পড়তে থাকায় বিপুল সংখ্যক আদিবাসী মানুষ কার্যত এই ঔপনিবেশিক প্রভুদের অধীনস্থ দাস-শ্রমিকে রূপান্তরিত হয়।

 

১৮৬৭-১৮৭০

বিভিন্ন আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষ ঔপনিবেশিক নিয়ন্ত্রণের শিকলগুলোকে (যেমন, খাজনার বোঝা, ঋণফাঁদ, ধর্মীয় নিয়ন্ত্রণ) ছিঁড়ে ফেলতে আবারও বিদ্রোহ করে। শাসক-অভিজাতরা এই বিদ্রোহকেও নৃশংসভাবে দমন করে।

 

১৮৭৬-১৯১০

পোরফিরিও দিয়াজ মেহিকোতে তাঁর একনায়কত্ব কায়েম করেন। তিনি ছিলেন একজন মেসতিজো, অর্থাৎ, ইউরোপীয় পিতা ও আদিবাসী মাতার সন্তান। তাঁর শাসনকালে মেহিকো জুড়েই মেসতিজো অভিজাতরা বিপুল পরিমাণ জমি দখল করে বিশাল বিশাল জোতের মালিক হয়ে বসে। চিয়াপাস প্রদেশের অর্থনীতিকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমুখী করে তোলার প্রক্রিয়া জোরদার হয়। আদিবাসী জনজাতিদের গ্রামভিত্তিক স্বনির্ভর চাষাবাদকে উচ্ছন্ন করে জনজাতিদের অধিকারভুক্ত জমি মেসতিজো মালিকদের মালিকানায় কেন্দ্রীভূত করে বড় বড় জোতে কফি, কোকো ফলিয়ে রফতানি করা, জঙ্গল থেকে বিপুল হারে মেহগনি গাছ কেটে কাঠ রফতানি করার উপর জোর দেওয়া হয়।

 

১৯১০-১৯২০

মেহিকো বিপ্লবের কাল। ১৯১৭ সালে বিপ্লবী সংবিধান রচনা হয়। সেই সংবিধানে আদিবাসী জনজাতি ও কৃষকদের জমির উপর অধিকার স্বীকার করা হয় ও সেই অধিকার ফেরত দেওয়ার উদ্দেশ্যে ভূমিসংস্কার চালানোকে সরকারের একটি প্রধান  কর্তব্য বলে চিহ্নিত করা হয়। চিয়াপাস প্রদেশে দ্বন্দ্বটি ছিল মূলত জমি ও আদিবাসী বদ্ধশ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণ কার হাতে থাকবে তা নিয়ে। আলভারো ওবরেগন যখন ১৯২০ যালে মেহিকোর প্রেসিডেন্ট পদে বসেন, চিয়াপাস অঞ্চলের কাসিক (cacique)-রা চিয়াপাসের আঞ্চলিক প্রশাসন নিজেদের হাতে থাকার বিনিময়ে প্রেসিডেন্ট ও তাঁর কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেন। এই কাসিকরা কারা? আদিবাসী জনগোষ্ঠীদের পরম্পরাগত সমাজকাঠামোয় সমাজপ্রধান বা জ্যেষ্ঠ হিসেবে যারা ভূমিকা পালম করতেন স্পেন থেকে আসা কংকুইস্তেদোররা তাদেরই একলপ্তে কাসিক বলতে শুরু করে। পরবর্তীকালে ঔপনিবেশিক প্রভুদের মালিকানাধীন বিরাট খামার বা জোতগুলোয় কাজ করা আদিবাসী শ্রমিকদলের সর্দারকেও কাসিক বলা শুরু হয়। কাসিকরা একদিকে যেমন আদিবাসী সমাজের পরম্পরাগত ধারার সঙ্গে যুক্ত ছিল, অন্যদিকে তেমনই ঔপনিবেশিক প্রভুরা তাদের সীমিত সুযোগ-সুবিধা-সম্মান দিয়ে নিজেদের অনুগত করে নিয়ে তার মাধ্যমে জনজাতিদের থেকে বিভিন্ন খাজনা, দখলদারি ও শ্রমিকযোগানের প্রবাহ মসৃণ রাখতে চাইত। মেহিকোর বিপ্লবের মধ্য দিয়ে কৃষকদের ও আদিবাসীদের নিজেদের জমির উপর অধিকার সরকারি স্বীকৃতি পায় এবং সরকারের উপর দায়িত্ব দেওয়া হয় কৃষক ও আদিবাসীদের দাবির উপর দাঁড়িয়ে ইউরোপীয় অভিজাত ও মেসতিজোদের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়ে থাকা জমি পুনর্বন্টন করে কৃষক ও আদিবাসীদের হাতেই আবার ফিরিয়ে দেওয়ার। কৃষক ও আদিবাসীদের মধ্যে তা বিপুল আশা, আগ্রহ যেমন তৈরি করেছিল, বিপ্লব-পরবর্তী সরকারের প্রতি আস্থা-সমর্থনও তৈরি করেছিল। কিন্তু এই জমি পুনর্বন্টনের কাজ এমন দীর্ঘসূত্রী জটিল আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অন্তর্ভুক্ত করে দেওয়া হয় যে কৃষক ও আদিবাসীদের সেই আশা-ভরসা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রহেলিকায় পরিণত হয়েছিল। চিয়াপাস প্রদেশে যেমন এই জমি পুনর্বন্টন প্রক্রিয়া প্রায় তার জন্মমুহূর্ত থেকেই পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে থেকেছে। বরং এই প্রক্রিয়ার আইনী বিধানের সুযোগ করায়ত্ত করার প্রতিযোগিতায় কৃষক ও আদিবাসী জনজাতিদের বিভিন্ন অংশ একে অপরের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে কখনো কখনো রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষেও জড়িয়ে পড়েছে।

 

১৯২৯

পি আর আই (PRI, Institutional Revolutionary Party)-এর তৎকালীন অবতার ঠিক এর আগে বর্ণিত মন্থনের ফল হিসেবে কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতাকেন্দ্রে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে। একটানা ৭১ বছর চলবে তার শাসন যা অনেকে ‘নিখুঁত একনায়কতন্ত্র’ (‘the perfect dictatorship’) বলে বর্ণনা করেছেন।

 

১৯৩৪-১৯৪০

লাজারো কার্ডেনাস মেহিকোর প্রেসিডেন্ট হয়ে জনমুখী শাসন প্রবর্তন করার নামে আদিবাসী জনজাতিদের জমি-স্বাধীনতা ও স্বায়ত্তশাসনের বিভিন্ন দাবির পক্ষে নিজেকে ঘোষণা করেন। এইসময় চিয়াপাস-এর বহু আদিবাসী বংশোদ্ভূত রাজনৈতিক কর্মী পি আর আই পার্টির নিয়ন্ত্রণাধীন লেবার ইউনিয়ন ও কৃষক সংগঠনে বিভিন্ন পদে নিযুক্ত হন। ১৯৪০-এ কার্ডেনাস-এর প্রধানমন্ত্রীত্ব পর্বের অবসানের সঙ্গে সঙ্গে জনমুখী বুলি কপচানোর অবসান হলেও, আদিবাসী জনজাতিদের মধ্যে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান-কাঠামোর এই সম্প্রসারণ তারপরও বহু দশক ধরে এই জনজাতিদের মধ্যে পি আর আই-এর প্রভাব ও সমর্থনের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে গেছে।

 

১৯৪০-১৯৭০

‘এজিদো’ (ejido) ব্যবস্থায় (আদিবাসী জনজাতি গোষ্ঠীর একটি ছোট এলাকার জমির উপর গোষ্ঠীগত মালিকানার আইনি স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যবস্থা) ভূমিসংস্কার দীর্ঘসূত্রী আমলাতান্ত্রিক পথে হলেও মেহিকোর কোনো কোনো আদিবাসী-প্রধান অঞ্চলে কার্যকরী হতে থাকে। কিন্তু আদিবাসী-প্রধান হলেও চিয়াপাস প্রদেশে তা নিয়মের বদলে ব্যতিক্রমই হয়ে থাকে। বড় বড় জোত ও খামারের মালিকরাই জমির উপর তাদের নিয়ন্ত্রণ আরো বিস্তৃত ও সংহত করতে থাকে। চিয়াপাস প্রদেশে সরকারি উদ্যোগে তৈরি  পাকা রাস্তা বাড়তে থাকার সঙ্গে সঙ্গে বড় জোত ও খামার মালিকদের বাণিজ্য করে মুনাফা জমানোর সুযোগও বাড়তে থাকে। বাণিজ্যিক পশু খামার (বিশেষ করে গরু-মহিষ পালন ও বিক্রির জন্য) মুনাফাদায়ী ব্যবসা হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। চিয়াপাস প্রদেশের পশ্চিমভাগ এই ধরনের জোত ও খামার মালিকদের ব্যবসা-প্রসারের কেন্দ্র হয়ে ওঠায় জমি ও বদ্ধশ্রমের উপর তাদের নিয়ন্ত্রণ আরো জেঁকে বসে। চিয়াপাস প্রদেশের পশ্চিমভাগে পৃথিবীর অন্যতম সর্ববৃহৎ ঘনবর্ষণ অরণ্য (rainforest) লাকানডন জঙ্গল অবস্থিত। মেহিকোর কেন্দ্রীয় সরকার এখন আদিবাসী জনজাতি গোষ্ঠীদের জমির জন্য দাবি সামাল দেওয়ার জন্য এই জঙ্গলটিকেই তুরুপের তাস করে তুলল। বিভিন্ন অঞ্চলের (কেবল চিয়াপাসের মধ্যের নয়, তার বাইরেরও) আদিবাসী গোষ্ঠীদের উৎসাহিত করা হল লাকানডন জঙ্গলে এসে জঙ্গল সাফ করে বসতি-ক্ষেত-খামার গড়ে তোলার জন্য, আশ্বাস দেওয়া হল যে সেই নব-অধিকৃত জমি অধিকারকারীদের গোষ্ঠীমালিকানাভুক্ত বলে আইনী স্বীকৃতি দেওয়া হবে। প্রায় এক লাখ আদিবাসী মানুষ এই সময়পর্যায়ে লাকানডন জঙ্গলে এসে বসত স্থাপন করেন। এদের নানা ধরনের মানুষ ছিলেন। কেউ তাদের আদি বাসস্থানে জমি-জায়গা হারিয়ে বা জমি-জায়গার অপ্রতুলতার কারণে চলে এসেছে, কেউ তাদের আদি জনগোষ্ঠী থেকে কাসিকদের রায়ে বিতাড়িত হয়ে চলে এসেছে (বিতাড়িত হওয়ার কারণ কাসিকের বিরোধিতা করা বা তাকে অমান্য করা থেকে শুরু করে ক্যাথলিক ধর্মের বদলে প্রোটেস্টান্ট ধর্ম গ্রহণের ‘অপরাধ’, নানারকম হতে পারে), কেউ বড় বাণিজ্যিক জোত বা খামারে বদ্ধ শ্রমিকের দুরবস্থা থেকে পালিয়ে স্বাধীন অস্তিত্বের খোঁজে চলে এসেছে। এইভাবে লাকানডন জঙ্গলের মধ্যে বিভিন্ন স্থান থেকে উৎপাটিত হয়ে আসা আদিবাসীদের বসতি বিস্তৃত হতে শুরু করল। সরকার তাদের এখানে ঠেলে দিয়েই খালাস--- বিদ্যুৎ, পানীয় জল বা অন্য কোনো পরিষেবা করার দায়িত্ব তাদের নেই।

 

১৯৬৮

মেহিকোর রাজধানী মেহিকো সিটি শহরে কেন্দ্রীয় সরকারের দুর্নীতিগ্রস্ততার বিরুদ্ধে ছাত্র-আন্দোলন ঘনিয়ে উঠে শহরের কেন্দ্রস্থলে এক বিপুল ছাত্রসমাবেশের রূপ নেয়। সেই সমাবেশের উপর বিনা প্ররোচণায় গুলি চালিয়ে সরকারি বাহিনী ও সরকারের মদতপুষ্ট গুণ্ডারা কয়েক শো ছাত্রছাত্রীকে হত্যা করে। ত্লাতেলোলকো হত্যাকাণ্ড (Tlatelolco Massacre) নামে এই ঘটনা কুখ্যাত। এই হত্যাকাণ্ড ও তার রেশ ধরে চলা সরকারি দমনপীড়ন বহু রাজনৈতিক কর্মীকে আত্মগোপন করে সমস্ত রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপকে গোপন কার্যক্রমে পরিণত করার দিকে ঠেলে দেয়। এর পরের দশ বছরে মেহিকোর বিভিন্ন শহরে কুড়িটিরও বেশি শহুরে গেরিলা বাহিনী গড়ে উঠেছিল, ১৯৭১ থেকে ১৯৭৫ ছিল তাদের কার্যকলাপের সবচেয়ে সক্রিয় পর্যায়। নৃশংস সরকারি দমনপ্রক্রিয়া ও নিজেদের আভ্যন্তরীণ সন্দেহ-অবিশ্বাস-যুদ্ধের চাপে এই আন্দোলনও ক্রমশ ভেঙে মিলিয়ে যায়, হাজারখানেকেরও বেশি রাজনৈতিক কর্মী অবশ্য তার মধ্যেই গুমখুন বা নিখোঁজ হয়েছে।

 

১৯৭০-এর দশক

 সরকারে ক্ষমতাসীন পি আর আই পার্টির সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করা কাসিকদের বিরুদ্ধে জনজাতিগোষ্ঠীগুলোর ভিতর থেকে ছোট ছোট বিদ্রোহ ফেটে পড়তে থাকে। সরকার পরিচালিত ভূমিসংস্কার প্রক্রিয়া সম্পর্কে হতাশা, জমি ও স্বাধীনতার চাহিদা না মেটার জ্বালাই এই বিদ্রোহগুলোকে ধিকিধিকি জ্বালিয়ে রাখে। কাসিকরা তাদের আঞ্চলিক ক্ষমতাকে রক্ষা করতে যেকোনো এরূপ বিদ্রোহকে পুরোদস্তুর দমন করার পথ নেয়, তাদের অন্যতম মূল হাতিয়ার হয় বিদ্রোহীদের পরম্পরাগত নিয়মের অজুহাত খাড়া করে গোষ্ঠীসমাজ থেকে বহিষ্কৃত বলে ঘোষণা করা। পরের কুড়ি বছরে অন্তত ৫০,০০০ আদিবাসী এভাবে সরকারি ক্ষমতার আঞ্চলিক স্তম্ভটির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার জন্য তাদের আদি সমাজ থেকে বহিষ্কৃত হয়েছে। এদের বহুজনই লাকানডন জঙ্গলে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। অন্যদিকে এই দশক জুড়ে কেন্দ্রীয় সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় চিয়াপাস-প্রদেশে খনিজ তেল উত্তোলন ও একের পর এক জল-বিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরি শুরু হয়। মূলত চিয়াপাস প্রদেশের পশ্চিম অঞ্চল ও সৈকত অঞ্চলে এই ‘আধুনিক উন্নয়ন’ যজ্ঞ কেন্দ্রীভূত হয়। বিপুল পরিমাণ কৃষক ও আদিবাসী মানুষ কৃষিকাজ ও পরম্পরাগত জীবিকা-সংস্থান থেকে বিতাড়িত হয়ে এইসব শিল্পোদ্যোগে মজুরীর বিনিময়ে কাজে জড়ো হয়। আন্তর্জাতিক বাজারে তখন খনিজ তেল ও বিদ্যুৎ রফতানিতে মুনাফা প্রচুর, সেই মুনাফার অংশ দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার ও শাসক পার্টি তার অনুগামীদের নিয়ন্ত্রণে সামাজিক-প্রশাসনিক তহবিলে অর্থবরাদ্দের প্রবাহ বজায় রেখে তার প্রভাব-বলয় বজায় রেখে চলছিল। আবার যে সমস্ত আদিবাসী মজুরীর কাজ করতে গিয়ে নির্মাণ, খুচরো ব্যবসা ও ট্রাক-পরিবহনের কাজে দক্ষতা তৈরি করে নিয়ে ব্যবসায়ী, কন্ট্রাক্টর বা ট্রাকচালক হিসেবে দ্রুত অর্থ জমিয়ে ফেলতে পেরেছিল, তারা তাদের গ্রামে কাসিক ও শাসক-পার্টি অনুগতদের প্রতিষ্ঠিত আধিপত্য ভেঙে অর্থের জোরে নতুন আধিপত্য কেন্দ্র হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে চাইছিল। শাসক-পার্টি পি আর আই-এর বিকল্প হিসেবে অন্য পার্টির অবলম্বনও তারা খুঁজছিল। কৃষিকাজেও বদল আসছিল। গোষ্ঠীসমাজভিত্তিক কৃষিকাজ যা গ্রামের প্রায় সবাইকে জড়িয়ে নিয়ে অসমানভাবে হলেও প্রত্যেকের একটা পরিমাণ খাদ্য ও জ্বালানী পাওয়ার নিশ্চয়তা দিত, তার পরিবর্তে মজুরী ও ব্যবসার অর্থপুষ্ট কৃষকেরা রাসায়নিক সার, আগাছানাশক ব্যবহার করে খরচসাপেক্ষ চাষ শুরু করল, বেশি ফলন করে বাজারে বিক্রির আশায়। ক্রমশ কয়েক বছরের মধ্যে জমির উর্বরতা কমতে কমতে এমন দাঁড়াল যে রাসায়নিক ছাড়া আর চাষ করাই সম্ভবপর হচ্ছে না, ফলে রাসায়নিক চাষের খরচ যোগাতে না পারা মানুষরা তাদের জমি চাষ না করে ফাঁকা ফেলে রাখতে, অথবা পয়সাওয়ালাদের কাছে ভাড়া দিয়ে দিতে বাধ্য হল। এছাড়াও, আধুনিক উন্নয়ন যজ্ঞের চালিকাশক্তি সরকারি নীতি হিসেবে দেশের কৃষিক্ষেত্র থেকে মানুষদের শস্তা শ্রমিক হিসেবে শিল্পক্ষেত্রে স্থানান্তরিত করা ও তার জন্য শিল্প-উৎপাদের তুলনায় কৃষি-উৎপাদের দাম জোর করে নামিয়ে রাখার নীতি নেওয়া হয়েছিল। ফলে দেশের সরকারের কাছে খনিজ তেল রফতানির টাকায় বিদেশ (বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) থেকে খাদ্য রফতানি ছিল শ্রেয়, দেশজ কৃষিক্ষেত্র নিয়ে তেমন কোনো মাথাব্যথা তাদের ছিল না। এই গোটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে একদিকে যেমন কৃষক ও আদিবাসী সমাজের পরম্পরাগত বাঁধুনি ও যৌথতার সংস্কৃতি ভেঙে পড়তে থাকে, অন্যদিকে তেমনি সরকারি সুযোগ-সুবিধার আড়কাঠি হওয়ার জন্য একটা উপরতলার ছোট অংশের মধ্যে তীব্র শত্রুতাবৃদ্ধি আর বাকি ব্যাপক অংশের সহায়-সম্বলহীন অবস্থার মধ্যে ডুবে যেতে থাকা ঘটতে থাকে।

 

১৯৭৪

চিয়াপাস প্রদেশের প্রধান শহর হল সান ক্রিস্তোবাল। এই শহরের বহু পুরোনো (ঔপনিবেশিক আমলের) গির্জা ক্যাথলিক ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে অত্যন্ত প্রভাবশালী। ১৯৬০ সালে এই গির্জার বিশপ হয়ে এসেছিলেন সামুয়েল রুইজ গারসিয়া। ১৯৬৮ সালে লাতিন আমেরিকার বিশপদের একটি সভায় (মেডেলিন কাউন্সিল) লাতিন আমেরিকা জুড়ে বিভিন্ন স্বৈরতন্ত্র ও প্রভুত্ববাদী সরকারের শাসনে বিপর্যস্ত আদিবাসী, শ্রমিক ও কৃষকদের সহায়তার জন্য ‘মুক্তিকামী ধর্মচিন্তা’ (‘liberation theology’) চর্চার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এরপর থেকে সান ক্রিস্তোবাল গির্জাকে কেন্দ্র করে বিশপ সামুয়েল রুইজ গারসিয়া ক্যাথলিক ধর্মচর্চার কাঠামোর মধ্যেই আদিবাসী মানুষদের স্বার্থ ও সংস্কৃতি রক্ষার আন্দোলনের নানা উপাদান বিকশিত করার চেষ্টা করতে থাকেন। ১৯৭৪ সালে চিয়াপাস প্রদেশের গভর্নরের আমন্ত্রণের সুযোগ নিয়ে সান ক্রিস্তোবাল গির্জা আদিবাসীদের কংগ্রেস সংগঠিত করে। প্রায় পাঁচশো আদিবাসী গোষ্ঠী থেকে ১,২০০-রও বেশি আদিবাসী প্রতিনিধি এই কংগ্রেসে সমবেত হয়। জমির দাবি, নিজ নিজ মাতৃভাষায় শিক্ষার দাবি, শ্রমিক-অধিকারের দাবি যেমন এই কংগ্রেসের মধ্য দিয়ে প্রথম যৌথভাবে সূত্রায়িত করা হয়, তেমনই সেই দাবি আদায়ের আন্দোলনের দিকে চেয়ে নিজেদের মধ্যে নানা যোগাযোগের সূত্রও এখান থেকে গড়ে ওঠে। ১৯৬৮-র মেহিকো সিটির ছাত্রবিক্ষোভের মর্মান্তিক পরিণতির পর শহুরে গেরিলা আন্দোলনে আস্থা হারানো উত্তর মেহিকোর কিছু রাজনৈতিক কর্মীও এই কংগ্রেসের সুযোগ নিয়ে আদিবাসী মানুষদের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি করতে শুরু করে বিকল্প রাজনৈতিক চর্চার অনুসন্ধানে জারী হয়।

 

১৯৭৯

‘প্ল্যান ডি আয়ালা’-র সূচনাসভাকে কেন্দ্র করে প্রায় ২৪-টির মতো কৃষক সংগঠন সরকার ও শাসক-পার্টি থেকে নিজেদের স্বাধীনতা ঘোষণা করে।

 

১৯৮২-- ১৯৯২

আন্তর্জাতিক বাজারে জীবাশ্ম জ্বালানী তেলের দাম পড়ে যায়। রফতানি থেকে মেহিকোর আয়ের মূল স্তম্ভটি এভাবে ভেঙে পড়ায় মেহিকোর সরকার গভীর অার্থিক সংকটে পড়ে যায়। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক অর্থ-যোগানদার সংস্থার কাছ থেকে নেওয়া ‘উন্নয়নী সাহায্য’-র পরিশোধ-কিস্তি দিতে অপারগ হয়ে ওঠায় মেহিকোর সরকার বাধ্য হয় ওইসব অর্থ-যোগানদার সংস্থার নব্য-উদারনৈতিক (neo-liberal) অর্থনীতি-বিশেষজ্ঞদের ‘পরামর্শ’-কেই সরকারি নীতি বলে মান্যতা দিতে। সমস্ত সামাজিক ক্ষেত্রে খরচ (যেমন, আদিবাসী জনজাতিদের জন্য বিভিন্ন বরাদ্দ যার আড়কাঠি হিসেবে পি আর আই-এর কাসিকরা তাদের ক্ষমতা বজায় রাখত) কমিয়ে প্রায় শূন্যে নিয়ে আসা, সমস্ত রকম ভরতুকি (যেমন, কৃষিতে ব্যবহৃত রাসায়নিকের উপর ভরতুকি, কৃষিপণ্য, বিশেষ করে কফি, পরিবহণের খরচের উপর ভরতুকি, যার উপর ভরসা করে একটা বড় সংখ্যক কৃষক তখনও কৃষিকাজে টিকে ছিল) তুলে দেওয়া, বৃহৎ পুঁজির বিনিয়োগ ও মুনাফা তুলে নেওয়ার রাস্তা মসৃণ করা--- এই ছিল সেই সংকটকালীন নব্য-উদারনৈতিক ব্যবস্থাপত্র, যা অনাধুনিকতার যত ‘পিছুটান’ কাটিয়ে মেহিকোকে দ্রুত আধুনিক করে তোলার অভিপ্রায় ঘোষণা করল।  একদিকে যেমন মেহিকো সিটির মতো বড় শহরগুলোর উচ্চবিত্ত অঞ্চলে বিদেশ থেকে রফতানি হওয়া পণ্যের সম্ভার সাজানো ঝাঁ-চকচকে শপিং-মল আপার্থিব আলোয় ভাসতে লাগল, অন্যদিকে তেমনই আদিবাসীদের গ্রামে, কৃষক মহল্লায় জীবিকা অর্জনের উপায়গুলো ধ্বংস হতে হতে যেন দুর্ভেদ্য অন্ধকার নেমে এল। শাসক পার্টি পি আর আই ভরতুকি ও অর্থবরাদ্দের আড়কাঠিবাজিকে কেন্দ্র করে যে সামাজিক নিয়ন্ত্রণের কৌশল এতদিন জারী রেখেছিল, ভরতুকি-অর্থবরাদ্দ উবে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাও অকার্যকরী হয়ে উঠল। ফলে সামাজিক নিয়ন্ত্রণের নতুন কৌশল হিসেবে পুলিশ-মিলিটারি লেলিয়ে দিয়ে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস তীব্র করে তোলা হল। ১৯৮২ সালে চিয়াপাস প্রদেশের গভর্নর হয়েছিলেন জেনেরাল আবসালোন কাসতেলানোস ডমিনগুয়েজ। তাঁর আমলে আদিবাসী ও কৃষকদের জমির উপর অধিকার ফিরে পাওয়ার প্রচেষ্টাগুলোকে বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের নিশানা করা হয়। তাঁর প্রশাসনকালে সেনা-পুলিশের হাতযশে ১০২ জন কৃষক-আদিবাসী খুন হয়, ৩২৭ জন চিরতরে নিখোঁজ হয়, ৫৯০ জন জেলবন্দি হয়, ৪২৭ জনকে তুলে নিয়ে গিয়ে পীড়ন-অত্যাচার করা হয়, ৪০৭টি পরিবারকে তাদের ভিটে থেকে উচ্ছেদ করা হয় এং ৫৪টি গোষ্ঠীসমাজের উপর চড়াও হয়ে লাগাতার হামলা ও নজরদারি কায়েম করা হয়। অবশেষে ১৯৯২ সালে মেহিকোর সংবিধানে পরিবর্তন এনে আদিবাসী ও কৃষকদের জমির উপর অধিকারের আইনী স্বীকৃতি পাওয়ার সম্ভাবনাটুকুকেও নাকচ করে দেওয়া হয়। এমনকি আদিবাসী জনজাতিদের গোষ্ঠীমালিকানাভুক্ত বলে ইতিমধ্যেই চিহ্নিত এজিদো (ejido)-গুলোরও চরিত্র পরিবর্তন করে ব্যক্তি-মালিকানাধীনে কেনাবেচার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার কথা সংবিধান-সংশোধনী হিসেবে ঢোকানো হয়। দীর্ঘ আমলাতান্ত্রিক জটপাকানো পথে হলেও কোনো না কোনো একদিন জমির উপর অধিকারের আইনী স্বীকৃতি মিলবে এই আশা নিয়ে যে বিপুল সংখ্যক আদিবাসী ও কৃষক সরকার ও শাসকদলের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলতে চাইত, সেই আশা একেবারেই নিভে গেল। আগেকার ভারসাম্যগুলো ভেঙে পড়ার এই সময়পর্বে প্রতিরোধের বিন্দুও বিভিন্ন ক্ষেত্রে ফুটে উঠছিল। তেমন কিছু দিকে আমরা এবার নজর দেব।

 

১৯৮৩

জাতীয় মুক্তি সেনা (স্প্যানিশ নামের আদ্যক্ষর অনুযায়ী: FLN) -র কয়েকজন (যাদের মধ্যে একজন ভবিষ্যতের সাবকমান্ডান্ট মার্কোস) রাজনৈতিক কর্মী উত্তর মেহিকো থেকে চিয়াপাসে এসে তার পুবদিকে আদিবাসী-প্রধান দুর্গম অঞ্চলে কাজ শুরু করে। তাদের উদ্যোগে ১৭ই নভেম্বর জাপাতিস্তা জাতীয় মুক্তি সেনা (স্প্যানিশ নামের আদ্যক্ষর অনুযায়ী: EZLN)–র জন্ম হয় তিনজন আদিবাসী ও তিনজন মেসতিজো (বাবা বা মা একপক্ষ আদিবাসী, অন্যপক্ষ নয়) সদস্য নিয়ে।

 

১৯৮৫

ভয়াবহ ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে মেহিকো সিটি শহর। শহরের বড় অংশই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। দুর্নীতি, স্বজনপোষণ ও নিষ্ক্রিয়তায় মজে থাকা শহরের সরকারি প্রশাসন ও কর্তাব্যক্তিরা এই আকস্মিক দুর্গতির মুখে কার্যকরী কোনো প্রতিক্রিয়াই দেখিয়ে উঠতে পারল না। সাধারণ নাগরিকরা বিপদের মুখে একে অপরের পাশে দাঁড়িয়ে নিজেদের সমবেত শক্তি ও উদ্ভাবনী ক্ষমতা প্রয়োগ করে বিপদকে অতিক্রম করার নানা অভিনব উপায় রচনা করল। একদিকে তা যেমন নাগরিকদের (বিশেষ করে গরিব বস্তিবাসীদের) আত্মশক্তির উদ্বোধন ঘটাল, অন্যদিকে তেমনই শাসক পার্টি পি আর আই ও বহৎ পুঁজির আড়কাঠিদের উপর নির্ভরতার বোধও অনেক কমিয়ে দিল।

 

১৯৮৬

পূর্ব চিয়াপাস প্রদেশের একটি আদিবাসী জনজাতি গোষ্ঠীর আঞ্চলিক প্রধানদের আমন্ত্রণে EZLN প্রথম একটি আদিবাসী সমাজের মধ্যে ঢুকে নিজেদের কাজ শুরু করল।

 

১৯৮৮

মেহিকোর প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচন। শাসক-পার্টি পি আর আই-এর প্রার্থী কার্লোস সালিনাস ডি কোর্টারি ভোটের পর ভোটগণনায় ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছেন, তখনই ভোটগণনা থামিয়ে দিয়ে বলা হল যে সব গণকযন্ত্র যান্ত্রিক কারণে বিকল হয়ে গেছে। তার তিনদিন পরে কোনো ব্যাখ্যা ছাড়াই সালিনাস-কে জয়ী ঘোষণা করে দেওয়া হল। এই জোচ্চুরি সরকারের প্রতি ভরসা ও বিশ্বাস সাধারণভাবেই আরো ধ্বংস করে দিল।

 

১৯৮৯

EZLN ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়ে ১,৩০০ সশস্ত্র সদস্যের বাহিনী এখন।

 

১৯৯৩

EZLN সক্রিয় যেসব আদিবাসী জনসমাজগুলোর মধ্যে, সেই জাপাতিস্তা জনসমাজগুলো সমবেতভাবে সিদ্ধান্ত নেয় যে সরকারের দুঃশাসন থেকে নিজেদের মুক্ত করতে EZLN-এর দ্বারা একটি সামরিক আক্রমণ সরকারের বিরুদ্ধে হানতে হবে। এই আক্রমণের দিনক্ষণ-খুঁটিনাটি ঠিক করা ও সংগ্রাম-পরিচালনা করার জন্য একটি কমিটিও তৈরি করে দেওয়া হয়, কমিটির নাম দেওয়া হয়: ‘Clandestine Indigenous Revolutionary Committeee—General Command’, সংক্ষেপে, CCRI-CC।

 

১৯৯৪

মেহিকো সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তাবিত উত্তর অতলান্তিক মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি লাগু করার দিন ঘোষণা করে ১লা জানুয়ারি ১৯৯৪। ঠিক ওই দিনেই EZLN-এর ৩,০০০ সদস্য সশস্ত্র অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে চিয়াপাস প্রদেশের ছয়টি বড় শহর ও বেশ কয়েকশো বড় পশুখামার (ranch) দখল করে নেয়। চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে মেহিকো সেনা প্রত্যুত্তরে পাল্টা আক্রমণ জারী করে। জাপাতিস্তা জনসমাজগুলোর এলাকার উপর তীব্র বোমাবর্ষণ করা হয়, অন্ততপক্ষে ১৪৫ জন আদিবাসী মানুষ তাতে প্রাণ হারায়। গোটা মেহিকো জুড়ে নাগরিক সমাজ রাস্তায় নেমে বিরাট বিরাট বিক্ষোভ-প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে দাবি করতে থাকে যে এই সরকারী সন্ত্রাসবাহিনীর হানা অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। অবশেষে দশদিন পর, ১২-ই জানুয়ারি দেশের ভিতর ও বাইরে থেকে ঘনিয়ে ওঠা চাপের কাছে নতি স্বীকার করে মেহিকো সরকার সামরিক সন্ত্রাসে লাগাম টেনে ‘যুদ্ধবিরতি’ ঘোষণা করতে বাধ্য হয়। ফেব্রুয়ারি মাসে জাপাতিস্তা জনসমাজগুলোর সঙ্গে মেহিকোর সরকারের শান্তি-আলোচনা শুরু হয়। সরকারের দেওয়া শর্ত মানতে অস্বীকার করে জনসমাজগুলো। আগস্ট মাসে জাপাতিস্তা জনসমাজগুলো নিজেদের উদ্যোগে স্বাধীনভাবে ‘জাতীয় গণতান্ত্রিক সম্মেলন’ নাম দিয়ে একটি পরামর্শসভার আয়োজন করে। লাকানডন জঙ্গলে জাপাতিস্তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন অঞ্চলে সভা হয়। সভাস্থলের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘আগুয়াসকালিয়েন্তেস’, ১৯১৭ সালে মেহিকোর প্রথম বিপ্লবী সংবিধান রচনার স্থানের নামে। সমাজের নানা স্তর থেকে আসা ৬,০০০ মানুষ এতে অংশ নিয়েছিলেন। অপরদিকে, ১৯৯৪ সালের দেশের প্রেসিডেন্ট ও চিয়াপাস-এর গভর্নর নির্বাচনেও ব্যাপক জাল-জোচ্চুরি সহযোগে শাসক দল পি আর আই-য়ের প্রার্থীকেই জিতিয়ে আনা হয়। আচারসর্বস্ব গণতন্ত্রের এই দেউলিয়া অবস্থায় জাপাতিস্তারা প্রকৃত গণতন্ত্রের কার্যকরী রূপ নির্ধারণের উপর জোর দেয়। ডিসেমেবর মাসে তারা তাদের প্রভাবাধীন অঞ্চলকে ৩৮-টি স্বশাসিত আদিবাসী পৌরসংঘ হিসেবে ঘোষণা করে এবং বহুদিন ধরে শিকড় গেঁড়ে থাকা পি আর আই ও তার আড়কাঠিদের ক্ষমতার কল-কাঠি-কাঠামোকে উচ্ছেদ করে সর্বসাধারণের হাতে সমাজের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আসার প্রচেষ্টা লাগু করে। ঠিক যখন জাপাতিস্তারা এই প্রচেষ্টা লাগু করছে, তখনই আন্তর্জাতিক বাজারে মেহিকোর মুদ্রার দর হুড়মুড়িয়ে পড়ে যেতে শুরু করে, বেকারী বেরোজগারি হু হু করে বাড়তে থাকে, অথচ মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি মোতাবেক বেসরকারীকরণের সুবিধা নিয়ে অভিজাত ধনীরা আরো বিত্তশালী হতে থাকে।

 

১৯৯৫

মার্কিনী উপদেষ্টা সংস্থা চেজ ম্যানহাটান ব্যাঙ্ক তার জানুয়ারী মাসের প্রতিবেদনে মেহিকোর সরকারকে ডাক দেয় জাপাতিস্তাদের নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার জন্য (‘eliminate the Zapatistas’)। জাপাতিস্তারা তখন ক্রমশঃ ছড়িয়ে পড়ছে। আদিবাসী জনসমাজগুলোর মধ্যে বেশ কয়েক ডজন খোলাখুলিভাবেই নিজেদের জাপাতিস্তা বলে ঘোষণা করেছে, প্রায় ৫০,০০০ মানুষ তো তাদের মধ্যে হবেই। ম্যানহাটানের ডাকে সাড়া দিয়ে মেহিকোর সরকার ৯ই ফেব্রুয়ারি থেকে জাপাতিস্তা এলাকাগুলোর উপর বিপুল সামরিক আক্রমণ শুরু করল। সামরিক বাহিনী হানা চালিয়ে প্রায় ২০,০০০ আদিবাসী কৃষককে উৎখাত করল, জনসমাজের মিলিত হওয়া ও গণসভার স্থান হিসেবে গড়ে তোলা আগুয়াসকালিয়েন্তেসগুলোর দখল নিয়ে সেখানে রাষ্ট্রীয় সেনাবাহিনীর ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করল। জাপাতিস্তারা প্রতিরোধ বজায় রাখল, পাঁচটি নতুন আগুয়াসকালিয়েন্তেস তারা গঠন করল। চিয়াপাস-এর কোণায় কোণায় জাপাতিস্তা জনসমাজগুলোর অঞ্চলের ঘাড়ের উপর সেনা শিবির বসিয়ে এবং লাগাতার হয়রানির মধ্য দিয়ে আদিবাসীদের প্রাত্যহিক জীবনের সবক্ষেত্রে বাধা-বিপত্তি তৈরি করতে চেষ্টা করে গেলেও জাপাতিস্তা আদিবাসীরা কেবল হানাদারদের ঠেকিয়ে রাখা নয়, নিজেদের স্বশাসন ব্যবস্থাকেও আরো গভীরে প্রোথিত করার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। এপ্রিলে এই লাগাতার হানা চালানোর পথ থেকে সরে এসে মেহিকোর সরকার আবার জাপাতিস্তাদের সঙ্গে শান্তি আলোচনার সূত্রপাত ঘটায়। অক্টোবর থেকে সান আন্দ্রেজ-য়ে এই আলোচনা শুরু হয়। আদিবাসীদের পক্ষ নিয়ে অংশগ্রহণকারীরা জনজাতিদের জমির অধিকার ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার সহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অধিকারের শর্তহীন স্বীকৃতি দাবি করে। ইতিমধ্যে, আগস্ট মাসে লাকানডন জঙ্গলে জাপাতিস্তাদের নিয়ন্ত্রিত জায়গায় জাপাতিস্তা আন্দোলনের সমর্থনে প্রথম আন্তর্জাতিক উপদেশ-সভা অনুষ্ঠিত হয়, EZLN নিজেকে নতুন ও স্বাধীন রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।

 

১৯৯৬

ফেব্রুয়ারি মাসে EZLN ও সরকারের মধ্যে সান আন্দ্রেজ বোঝাপড়ার চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই বোঝাপড়ায় জমির উপর আদিবাসীদের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে ভূমিসংস্কার কর্মসূচী, আদিবাসী জনজাতিদের স্বশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য রাজনৈতিক প্রক্রিয়া এবং আদিবাসীদের সাংস্কৃতিক অধিকার পুনর্প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সামাজিক-রাজনৈতিক কার্যক্রম চালানোর কথা বলা হয়। সরকার এই প্রক্রিয়াগুলোয় সহযোগী হওয়ার আশ্বাস দেয়। তারপর মার্চ থেকে আলোচনার বিষয়বস্তু হিসেবে যখনই এর ধারাবাহিকতায় গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচারকে তার প্রকৃত রূপে গ্রহণ ও বিস্তৃত করার প্রসঙ্গ আসে, সরকারের প্রতিনিধিরা আর আলোচনা চালাতে অস্বীকার করে। ডিসেম্বরে গিয়ে সরকার ফেব্রুয়ারির সান আন্দ্রেজ বোঝাপড়াকেও আর স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করে। সরকারের সঙ্গে বোঝাপড়ার পথে এগোনোর প্রচেষ্টার এই ব্যর্থতা জাপাতিস্তাদের নতুন উপায় খোঁজার রাস্তায় ঠেলে দেয়। জুলাই-আগস্ট মাসে তারা আন্দোলনের সমর্থনকারীদের আহ্বান করে আন্তর্জাতিক সভা সংগঠিত করে তাদের এলাকায়। সভার নাম দেওয়া হয় ‘মানুষের পক্ষে ও নব্যউদারনীতিবাদের (Neoliberalism) বিরুদ্ধে মোলাকাত’। মেহিকোর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এবং মেহিকোর বাইরেরও কয়েক গণ্ডা দেশ থেকে বহু হাজার মানুষ এই মোলাকাত-সভায় যোগ দিয়ে নব্যউদারনীতিবাদের আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলায় নাগরিক সমাজ কী ভূমিকা নিতে পারে তা নানা দিক থেকে আলোচনা করেন। জাপাতিস্তাদের স্বশাসনের ভাবনায় পুঁজিবাদকে পেরিয়ে গিয়ে নতুনতর সমাজ-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক রূপ গঠনের চিন্তা ও চর্চা এই সময় থেকেই দানা বাঁধতে শুরু করে।

 

১৯৯৭

জুলাই মাসে দেশের মধ্যবর্তী নির্বাচনে চিয়াপাস প্রদেশের আদিবাসী অঞ্চলগুলোয় প্রায় ৮০% মানুষ ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকেন, যা আরো একবার দেখিয়ে দেয় আদিবাসী জনজাতিদের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত পার্টি ও ভোটব্যবস্থার প্রতি আস্থা কোন তলানিতে গিয়ে ঠেকেছিল। সেপ্টেম্বর মাসে EZLN-এর ১,১১১ জন সদস্য দেশের রাজধানী মেহিকো সিটিতে হাজির হয়ে জাপাতিস্তা আন্দোলনের অসামরিক রাজনৈতিক শাখা ‘জাপাতিস্তা জাতীয় মুক্তি ফ্রন্ট’ (স্প্যানিশ নামের আদ্যক্ষর অনুযায়ী FZLN) প্রতিষ্ঠা করে। মেহিকোর শাসকদল অবশ্য সন্ত্রাসের পথে প্রত্যাঘাত করাতেই অনড় থাকে। পি আর আই-য়ের অধীনে নথিভুক্ত একটি প্যারামিলিটারি বাহিনী অ্যাকটিলে জনজাতি গোষ্ঠীদের এক গির্জায় অতর্কিত হামলা চালিয়ে আদিবাসী কৃষকঘরের ৪৫জনকে খুন করে পালায়, নিহতদের মধ্যে বেশির ভাগই মহিলা অথবা শিশু। এই আক্রমণ সংগঠনে জড়িত থাকা আঞ্চলিক পি আর আই-নেতা বা গুণ্ডাদের কিছুদিনের জন্য লোক-দেখানো ‘তদন্ত’-র অধীনে রেখে তারপর বেকসুর খালাস করে দেওয়া হয় শাসকদলের পোষা প্যারামিলিটারি বাহিনীর অস্তিত্বই অস্বীকার করা হয়। বরঞ্চ উল্টে সরকারের পক্ষ থেকে EZLN-এর উপর অস্ত্র-সমর্পণের জন্য চাপ বাড়ানো হয়।

 

১৯৯৮

আ্যাকটিল গণহত্যাকে অজুহাত হিসেবে খাড়া করে ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই মেহিকো সরকার চিয়াপাস প্রদেশে উপস্থিত আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আন্দোলনের পর্যবেক্ষকদের থাকার অনুমতি প্রত্যাহার করে নিয়ে তাদের দেশ থেকে বের করে দিতে থাকে। এভাবে পরের দুই বছরে প্রায় ১৫০ জন পর্যবেক্ষককে বের করে দেওয়া হয়। আর এপ্রিল থেকে শুরু হয় জাপাতিস্তা আদিবাসী জনসমাজগুলোর উপর পরিকল্পিত আক্রমণ। হাজারেরও বেশি সেনা ও পুলিশ বাহিনী একযোগে চারটি আদিবাসী জনসমাজকে আক্রমণ করে, তাদের গোষ্ঠী প্রধান ও সমাজ প্রধানদের প্রেফতার করে, তাদের নিজস্ব প্রশাসনব্যবস্থার নথিপত্র বাজেয়াপ্ত করে ধ্বংস করে দেয়। জুন মাসের এক শেষরাতে ভোরের আলো ফোটার আগে সান জুয়ান ডি লিবেরতাদ-এর উপর এমনই এক আক্রমণে আটজন সাধারণ নাগরিক ও একজন পুলিশ মারা যাওয়ার পরে তা নিয়ে শোরগোল পড়ে যায়। বিশপ সামুয়েল রুইজ গারসিয়া সরকার ও জাপাতিস্তাদের মধ্যে শান্তিচুক্তিতে মধ্যস্থতা করার তাঁর সমস্ত প্রয়াসে ইতি টেনে ঘোষণা করেন যে এই সরকার কেবল যুদ্ধ ও দমনপীড়নের মাধ্যমে অন্যকে শেষ করে দিতেই উৎসুক, তাই তার সঙ্গে সমঝোতার কোনো পথ সে খোলা রাখেনি।

 

১৯৯৯

৫০০০ জাপাতিস্তা নাগরিক সম্পূর্ণ নিরস্ত্রভাবে গোটা দেশ জুড়ে ঘুরে এক সপ্তাহ ধরে আদিবাসী জনজাতিদের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অধিকার সম্পর্কে প্রচার চালায় এবং সান আন্দ্রেজ-এর ১৯৯৬-এর চুক্তি যাতে মান্যতা পায় ও বলবৎ হয় সেই দাবি তোলে। ২১শে মার্চ দেশজুড়ে কয়েক হাজার ভোটকেন্দ্রে তিরিশ লাখ মেহিকোবাসী সান আন্দ্রেজ চুক্তি লাগু করার পক্ষে ভোট দেয়। মেহিকোর কেন্দ্রীয় সরকার ও শাসকদল অবশ্য এই সবকিছু অগ্রাহ্য করে জোরজবরদস্তি সন্ত্রাস চালিয়ে যাওয়ার পথেই একাগ্র থাকে। সান আন্দ্রেজ সাকামচেম, যেখানে সান আন্দ্রেজ-এর চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, জাপাতিস্তা জনজাতিরা এখন যেখানে জনজাতির স্বশাসন গড়ে তুলেছে, তার উপর আক্রমণ নেমে এল--- পুলিশ বাহিনী অতর্কিত হামলা চালিয়ে জনপদকেন্দ্র দখল করে নিয়ে পি আর আই –এর এক নেতাকে মেয়র পদে বসিয়ে দিল। ঠিক তার পরের দিনই ৩,০০০ জাপাতিস্তা নাগরিক সম্পূর্ণ নিরস্ত্রভাবে পদযাত্রা করে এসে পুলিশ ও পি আর আই-নেতাদের এলাকা ছেড়ে যেতে বাধ্য করল এবং নিজেদের মনোনীত প্রতিনিধিদের হাতে ন্যস্ত প্রশাসনকে আবার ফিরিয়ে আনল। মেহিকো সরকার লাগাতার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে লাকানডন জঙ্গলকে ঘিরে একের পর এক সেনাঘাঁটি তৈরি করে জাপাতিস্তাদের ওই জঙ্গলের মধ্যেই বিচ্ছিন্ন করে আটকে ফেলার। এই প্রচেষ্টার বিরুদ্ধেও জাপাতিস্তাদের লাগাতার লড়ে যেতে হচ্ছে।

 

২০০০

জুলাই মাসে দেশের সাধারণ নির্বাচনে পি আর আই প্রার্থীর পরাজয় ঘটে। ৭১ বছর পর পি আর আই আধিপত্যের অবসান ঘটে। ভিসেন্তে ফক্স নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। আগস্ট মাসে চিয়াপাস প্রদেশের গভর্নর নির্বাচনেও বহু দশকের পি আর আই-একাধিপত্য ভেঙে বিরোধী জোটের প্রার্থী নির্বাচিত হয়। ক্ষমতায় নবাগতরা যেহেতু সশস্ত্র দমনের পথ ত্যাগ করে বোঝধাপড়ার মাধ্যমে আদিবাসীদের সঙ্গে সমস্যা মিটিয়ে নেওয়ার কথা বলে নির্বাচনে লড়েছিল, তাই তাদের জয় চিয়াপাস জুড়েই নতুন আশার সঞ্চার করে। ভিসেন্তে ফক্স চিয়াপাস জুড়ে সেনা-মোতায়েন কমিয়ে বেশিরভাগ রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি দেন, বিতাড়িত মানবাধিকার-পর্যবেক্ষকদেরও অনেককে আবার ফিরে আসতে দেন। আদিবাসী জনজাতিদের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ বোঝাপড়া তৈরির জন্য একটি সংসদীয় কমিটি গঠন করে দেন, তার নাম হয় ‘কোকোপা’, বলা হয় সান আন্দ্রেজ বোঝাপড়াকে এই কমিটি কার্যকর করে তুলবে।

 

২০০১

২৪ ফেব্রুয়ারি এক অভূতপূর্ব যাত্রার সূত্রপাত হয়। সাবকমান্ডান্ট মার্কোস-এর নেতৃত্বে চব্বিশজন জাপাতিস্তা কমান্ডার চিয়াপাস থেকে দেশের রাজধানী মেহিকো সিটির দিকে যাত্রা শুরু করেন। কোকোপা যাতে আদিবাসী জনজাতিদের মতামত সান আন্দ্রেজ বোঝাপড়াকে যথোচিত গুরুত্ব দেয়, সার জন্য প্রচার করতেই এই যাত্রা। যাত্রাপথে মেহিকোর হাজার হাজার নাগরিক রাস্তায় নেমে এসে জাপাতিস্তা কমান্ডান্টদের সঙ্গে যোগ দেন। ১১ই মার্চ যখন মেহিকো সিটিতে এই যাত্রা শেষ হচ্ছে তখন আড়াই লাখ মানুষ জমায়েত হয়ে তাকে সমর্থন জানায়। কিন্তু এই বিপুল জনসমর্থন সংসদীয় কমিটির কাজে কোনো ছাপ ফেলতে পারল না। এপ্রিল-শেষে যখন কোকোপা আইন পাশ করা হল, তখন দেখা গেল জনজাতিদের সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্বাধিকার-স্বশাসনের প্রশ্নগুলোকে গুরুত্বহীন করে দিয়ে এমন আইন বানানো হয়েছে যার সঙ্গে সান আন্দ্রেজ চুক্তির প্রাণভোমরাটাই অনুপস্থিত। এরপর জুন মাসে ভিসেন্তে ফক্স অন্যান্য মধ্য আমেরিকার প্রেসিডেন্টদের সঙ্গে প্ল্যান পুয়েবলো পানামা বলে যে চুক্তি সই করেন তা স্পষ্ট করে দেয় যে আদিবাসী জনজাতিদের অধিকারের স্বীকৃতি দেওয়া তো দূরের কথা, নতুন সরকারও সেই নব্যউদারনৈতিক উন্নয়নের পথে আদিবাসী ও কৃষকদের উচ্ছেদ করার ধারাই বহাল রাখবে। এই তিক্ত অধিকারহরণের বড়ি গেলাতে মন-ভুলানো হিসেবে সরকার আবার কিছু ‘সাহায্য-অনুদান-খয়রাতি’-র পসরা হাজির করেছে, এই যা পার্থক্য। প্রত্যাশাভঙ্গের এই ধাক্কাকে সামলে জাপাতিস্তারা আবার নিজেদের লড়াইকে সংহত করায় জোর দেয়। সরকারি অনুদান বর্জন করে স্বাধীনভাবে সম্পূর্ণ নিজেদের সমাজের জোরে ও আন্দোলনের সমর্থকদের জোরে জনজীবনের প্রতিটি পরিসরকে কীভাবে গড়ে তোলা যায়, নব্যউদারনীতিবাদকে প্রতিহত ও বর্জন করে সর্বজনের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা যায়, তত্ত্ব ও চর্চা আবারও সেই পথ অন্বেষণে নিরত হয়েছে।

 

বিপ্লব নায়ক

জুলাই, ২০২৪

 

 

 

 

 

জাগরণ: বিদ্রোহের শৈলী

গোটা বিশ্ব জুড়ে লাখ লাখ মানুষের মতো আমারও ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। ঘুমিয়ে থাকা আর সম্ভব ছিল না। ১৯৯৪-এর ১লা জানুয়ারি জাপাতিস্তারা আমাদের বহু ধারণা ও বিশ্বাসে ছেদ টেনে দিয়ে নতুন এক পথ খুলে দিয়েছিল। আমরা এখনও সেই অবস্থায় আছি, সব মহামারীকে পেরিয়েও তাদের ইউরোপ-যাত্রা নতুন নতুন বিষয়গুলোকে মূর্ত করে তুলছে।

১৯৯৪ সালের এপ্রিলে, বিদ্রোহের মাত্র চার মাস বাদে, আমি Celebracion del Zapatismo: El secreto del EZLN (জাপাতিস্তা-ভাবনার উদযাপন: ‘জাপাতিস্তা জাতীয় মুক্তি সেনা'-র গোপন কথা) লিখেছিলাম। তার দুই মাস পরে স্প্যানিশ ভাষার এই পুস্তিকা প্রকাশিত হয়েছিল এবং অচিরেই তা অন্য বেশ কিছু ভাষায় তর্জমা হয়েছিল। লেখাটি বেশ আগ্রহোদ্দীপক। সাবকমান্ডান্ট মার্কোস যখন তঁাদের নিজেদের পাঠচক্রের জন্য এই পুস্তিকার পঁচিশ কপি চেয়েছিলেন, তখন আমি সত্যিই অভিভূত বোধ করেছিলাম। জাপাতিস্তা-ভাবনা বোঝার জন্য একটা ভালো প্রাথমিক পাঠ হিসেবে ১৯৯০-এর দশকে Guillermo Bonfil এটিকে Mexico profundo (গভীর মেহিকো) নামে বই আকারে প্রকাশ ও বিতরণ করেছিল।

তার বারো বছর পরে ওয়াহাকা-র Universidad de la Tierra এর একটি নতুন সংস্করণ প্রকাশ করে, যার মধ্যে ওই বারো বছরের যাত্রাপথ ও তার মধ্য দিয়ে জাপাতিস্তা-ভাবনার নানা পরিবর্তনের মুগ্ধকর কথাও অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল।

সেই ছোট্ট বইটারই একটা বড় অংশ এই অধ্যায়ে হাজির করছি।

 

আজকের পৃথিবীতে সম্ভবত সবচেয়ে মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক প্রয়াস হল জাপাতিস্তা-ভাবনা।

জাপাতিস্তারা তাদের কথা ও কাজের মধ্য দিয়ে সমকালীন সমাজের প্রত্যেকটি দিককে প্রশ্ন করছে। বর্তমান দুর্ভোগ-দুরবস্থার মূল কারণগুলোকে উন্মোচিত করার মধ্য দিয়ে তারা অর্থনৈতিক সমাজ (পুঁজিবাদ), জাতিরাষ্ট্র, দস্তুর-মাফিক গণতন্ত্র ও সমস্ত আধুনিক প্রতিষ্ঠানের কাঠামোটাকে ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলছে। সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলন ও উদ্যোগের প্রথাগত পদ্ধতি এবং অভ্যাসগুলোকেও তারা গতায়ু বাতিলে পর্যবসিত করেছে। একদম তলা থেকে জগৎ পুনর্গঠন করার পথে এগিয়ে তারা উপর থেকে কল্পিত ও প্রবর্তিত পরিবর্তন-পরিকল্পনার বিভ্রমাত্মক ও ক্ষতিকর প্রকৃতিকেও উন্মোচিত করেছে। তাদের পথ সর্বত্র বিশ্বায়ন ও নয়া-উদারনীতিবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধকে উৎসাহিত করছে, মুক্তির জন্য সংগ্রামে প্রেরণা জোগাচ্ছে। সেইসব সংগ্রামকে মূর্তবাক হয়ে উঠতেও সাহায্য করছে।

প্যান্ডোরার বাক্স থেকে অমঙ্গলগুলো সব চম্পট দেওয়ার পর আশা-ই কেবল পড়ে ছিল। সেই আশাকে মুক্ত করে এনে এবং তার মধ্য দিয়ে বহুমুখী পথরাজির বুনন আবিষ্কার করে জাপাতিস্তারা এক নবজাগরণের দরজা খুলে দিয়েছে। যারা এই পথরাজিতে হাঁটতে শুরু করেছে, জাপাতিস্তারা এখনও তাদের প্রেরণার উৎস। কিন্তু নিজ নিজ স্বজ্ঞা, শক্তি ও দিশামুখ সম্পন্ন সেই পথরাজির জালকে শাসন বা নিয়ন্ত্রণ করার কোনও ভান জাপাতিস্তারা করে না। আমরা সবাই জাপাতিস্তা, অথবা আমরা সবাই জাপাতিস্তা হয়ে উঠতে পারি:

আমাদের কালো মুখোশের পিছনে, আমাদের সশস্ত্র কন্ঠস্বরের পিছনে, আমাদের অনামযোগ্য নামের পিছনে, যা আপনারা আমাদের দেখছেন তার পিছনে, এইরকম সবকিছুর পিছনে, আমরা আপনারাই। এসবের পিছনে আমরা হলাম সেই এক-ও-অবিকল সহজ ও সাধারণ পুরুষ ও মহিলা যারা যে কোনো জাতির হতে পারে, যে কোনো গাত্রবর্ণের হতে পারে, যে কোনো ভাষার বাচক হতে পারে আর যে কোনো কোথাও বাস করতে পারে। এইরকম সবকিছুর পিছনে আমরা হলাম সেইসব বিস্মৃত পুরুষ ও মহিলা, যারা একইভাবে বর্জিত, একইভাবে অসহিষ্ণুতার শিকার, একইভাবে নিপীড়িত, আপনাদেরই মতো। এইরকম সবকিছুরর পিছনে আমরা আপনারাই। (জাপাতিস্তা ১৯৯৮, পৃঃ ২৪)

Basta! যথেষ্ট হয়েছে!

১৯৯৪ সালের ১লা জানুয়ারি মধ্যরাতে মেহিকো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার মধ্যে NAFTA (North American Free Trade Agreement, অর্থাৎ, উত্তর আমেরিকার মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি) বলবৎ হয়। তারপর দুই ঘন্টা কাটতে না কাটতেই হাজার হাজার আদিবাসী জনজাতির মানুষ ম্যাচেট (চওড়া ছুরি), কাঠের গদা আর অল্প কিছু বন্দুক নিয়ে মেহিকোর গুয়াতেমালা-সংলগ্ন চিয়াপাস প্রদেশের প্রধান চারটি শহর দখল করে নেয় এবং মেহিকোর সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। জানা যায় যে এই বিদ্রোহীরা বিভিন্ন ইন্ডিয়ান নৃগোষ্ঠীর মানুষ, তারা সম্মিলিত হয়ে Ejercito Zapatista de Liberacion Nacional (সংক্ষেপে EZLN, জাপাতিস্তা জাতীয় মুক্তি সেনা) নাম গ্রহণ করেছে। পাঁচশো বছরের শোষণ-নির্যাতন ও পঞ্চাশ বছরের ‘উন্নয়ন’ শেষ করার দাবি তোলার সঙ্গে সঙ্গে তারা আশা প্রকাশ করছে যে এমন নতুন রাজনৈতিক শাসন-প্রণালী প্রবর্তিত হবে যেখানে তাদের পরম্পরাগত সর্বসাধারণের সম্পত্তি (commons) পুনরায় দখলে নিতে দেওয়া হবে, তাদের স্বকীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে দেওয়া হবে এবং তাদের স্বকীয় বাঁচা-মরার যাপনশিল্পকে পুনরুদ্ধার করতে দেওয়া হবে। এখন সময় এসেছে বলার: ‘Basta! যথেষ্ট হয়েছে!’

মেহিকো রাষ্ট্রের সেনার এক-তৃতীয়াংশ, অর্থাৎ পঞ্চাশ থেকে ষাট হাজার সেনা দ্বারা দশ বছর ধরে পরিবেষ্টিত হয়ে থেকেও জাপাতিস্তারা শান্তিপূর্ণভাবে তাদের বিরুদ্ধে সরকারের চালানো ‘অনুচ্চ তীব্রতা’-র যুদ্ধকে প্রতিরোধ করে গেছে। নিরবচ্ছিন্নভাবে তারা সাধারণ কৌতূহলের বিষয় হয়ে থেকেছে। সমসাময়িক আর কোনো সামাজিক বা রাজনৈতিক আন্দোলন জাপাতিস্তাদের আন্দোলনের থেকে বেশি পরিমাণে ও বেশি সময়কাল ধরে জন-মনোযোগ আকর্ষণ করেনি। তবু জাপাতিস্তারা এক রহস্য ও কূটাভাস হয়েই থেকেছে। এমন বিপ্লবী দল কি হয় ক্ষমতা দখল করায় যাদের কোনো উৎসাহই নেই? এমন বিপ্লবী নেতাও কি হতে পারে যারা, এখন হোক বা ভবিষ্যতে, কোনো সময়েই কোনো জন-প্রশাসনের পদ অধিকার করতে রাজি নয়? এ কেমন যোদ্ধাবাহিনী যারা গুলির বদলে শব্দ ছোঁড়ে, আইন-অমান্য আর অহিংসাকে অস্ত্র করে? বিশ্বজোড়া পরিধি নিয়ে ভাবিত অথচ তার নিজের আঞ্চলিক সংস্কৃতির মধ্যেই গভীরভাবে প্রোথিত— এমন সংগঠন কি হয়? গণতান্ত্রিক নীতিসমূহের সঙ্গে জোরালোভাবে সম্বন্ধিত, অথচ গণতন্ত্রেরই সবচেয়ে মৌলিক সমালোচক— কোনো দলের অবস্থান কি এমন হয়? লোকগুলোই বা কেমন যারা প্রাচীন মায়া সভ্যতার পরম্পরার গভীরে শিকড় গেড়ে আছে, আবার সমসাময়িক ধ্যান-ধারণা, সমস্যা ও প্রযুক্তির মধ্যেও অবগাহন করছে?

জাপাতিস্তারা যা নয়

জাপাতিস্তা কোনো মৌলবাদী বা উদ্ধারকারী আন্দোলন নয়। জাপাতিস্তাদের মধ্যে বিভিন্ন পৃথক বিশ্বাসমত ও ধর্মমত সুসমঞ্জসপূর্ণভাবে সহাবস্থান করছে, যেগুলোর বেশির ভাগই নিজ নিজ পরম্পরার গভীরে শিকড় চারিয়ে আছে। ধর্মের ক্ষেত্রে জাপাতিস্তারা খুবই খোলামেলা ও সর্বগ্রাহী। তাদের অধিকাংশই আদিবাসী মানুষ, কিন্তু তারা কোনো আদিবাসী বা জনজাতিগত আন্দোলন শুরু করেনি। তাদের প্রয়াসের পরিধিকে তারা কেবলমাত্র আদিবাসী মানুষদের মধ্যে বা ‘সংখ্যালঘু’-দের মধ্যে বা নিজেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ করেনি। তারা দাবি তুলেছে: ‘সবকিছু সবার জন্য, আমাদের জন্য কিছু নয়’। এই দাবি কোনো স্লোগান নয়, বরং এ হল রাজনৈতিক মনোভঙ্গি ও চর্চার একটি প্রকরণ।

জাপাতিস্তা কোনো জাতীয়তাবাদী, বিচ্ছিন্নতাবাদী বা ‘স্বায়ত্তশাসনবাদী’ (‘autonomist’) আন্দোলন নয়। কিছু কিছু দেশে সংখ্যালঘুরা যেমন দাবি তুলেছে, চিয়াপাস-কে তেমন কোনো ক্ষুদ্র জাতি-রাষ্ট্র, বা আদিবাসীদের প্রজাতন্ত্র, বা ‘স্বায়ত্তশাসিত’ প্রশাসনিক অঞ্চল করার বাসনা জাপাতিস্তাদের নেই। ‘সংখ্যালঘু’ বলে বর্গীভূত মানুষদের পৃথক পৃথক আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত জীবনযাপন পদ্ধতি ও সাংস্কৃতিক পার্থক্যসমূহকে পঞ্জীকরণের নামে আধুনিক জাতি-রাষ্ট্রের সমসত্ত্ব করে তোলার মাড়াইকলে ঢুকিয়ে দেওয়ার চলতি প্রবণতাকে জাপাতিস্তারা সক্রিয়ভাবে প্রতিরোধ করে আসছে এবং এই প্রবণতাকে তারা সাধারণভাবে বৈষম্য আড়াল করা ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ গেঁথে দেওয়ার আরেক ছল হিসেবে চিহ্নিত করেছে।

জাপাতিস্তারা গেরিলা যোদ্ধা নয়। চে গুয়েভারা যেভাবে গেরিলা যোদ্ধাদের সংজ্ঞায়িত করেছিলেন, জাপাতিস্তারা তেমন জনসাধারণের সাগরে সাঁতার কাটা মাছ নয়। তারা এমন কোনো বিপ্লবী গোষ্ঠী নয় যারা ক্ষমতা দখল করার জন্য জনগণের সমর্থনের সন্ধানে আছে। তাদের অভ্যুত্থান ছিল ক্ষমতা দখলে আদৌ উৎসাহী নয় এমন বেশ কয়েক শো জনগোষ্ঠীর সমষ্টিগত সিদ্ধান্ত। তারা আসলে গোটা সাগরটাই, তারা মাছ নয়। আরো খতিয়ে দেখলে এর মধ্য থেকেই আমরা জাপাতিস্তাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও বিহ্বলকর বৈশিষ্ট্যগুলো আবিষ্কার করতে পারব।

হাঁটতে হাঁটতে শোনার অভ্যাস

জাপাতিস্তারা বলে, ‘কীভাবে শুনতে হয় ও বলতে হয় তা শেখাই ছিল জাপাতিস্তা জাতীয় মুক্তি সেনার প্রথম মৌলিক কাজ।’

১৯৮৩ সালের ১৭ই নভেম্বর ছয়জন পেশাদার বিপ্লবীর একটি গোষ্ঠী চিয়াপাস-এ হাজির হয় একটি গেরিলা কেন্দ্র ও ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করার জন্য। জঙ্গলে নিজেদের জোরে প্রাণ টিকিয়ে রাখতে শেখা ছিল তাদের প্রথম করণীয়। একবছর কাটার পর বৃদ্ধ আনতোনিও বলে পরবর্তীকালে পরিচিত হওয়া এক ব্যক্তি তাদের জঙ্গলে আবিষ্কার করে এবং আদিবাসী জনগোষ্ঠীদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেয়। পেশাদার বিপ্লবীদের মার্কসবাদী-লেনিনবাদী-গুয়েভারাবাদী মতবাদ তাদের কথোপকথন চালানোর চেষ্টায় খুব কাজে আসছিল না। আদিবাসী লোকজন তাদের বলত, ‘তোমাদের কথাগুলো বড় বেশি কাঠখোট্টা’। এই ধাক্কায় গেরিলাদের ‘বর্গক্ষেত্রাকার’ মতবাদিক ধারণাগুলো ভেঙে-চটে অমসৃণ হয়ে উঠতে উঠতে এমনভাবেই ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে পড়েছিল যে তাদের আর পূর্ব-রূপে চেনাই সম্ভব ছিল না।  সেই প্রথম দফার জাপাতিস্তারাই বলে থাকে যে এই প্রারম্ভিক মোলাকাতের কল্যাণে তারা লাতিন আমেরিকার ঘরানায় গেরিলা-হতে-চাওয়া কর্মীদের নির্ধারিত রাজনৈতিক প্রকল্প ও মতবাদিক দিশাগুলো খুইয়ে বসেছিল। কিন্তু এই আন্তর্সাংস্কৃতিক মোলাকাতের মধ্য থেকেই জাপাতিস্তা-ভাবনা জন্ম নিয়েছিল এবং বেশ কয়েক শো জনগোষ্ঠীর মধ্যে তা শিকড় ছড়াতে পেরেছিল।

তার পরের বছরগুলোয় এইসব  জনগোষ্ঠী সামাজিক, অর্থনৈতিক, বা রাজনৈতিক সংগঠনের সবরকম পথ-প্রকরণ, আয়ত্তের মধ্যে থাকা সবরকম আইনি উপায় অবলম্বনে চেষ্টা চালিয়েছিল। মিছিল, ধর্ণা— সবই তারা সংগঠিত করেছিল। এমনকি চিয়াপাস থেকে রাজধানী মেহিকো সিটি অবধি দুই হাজার কিলোমিটার তারা পদযাত্রা করে গিয়েছিল যদি তাদের কথা শোনার মতো কোনো লোক পাওয়া যায়। কিন্তু কেউ শোনেনি। না সমাজের কেউ, না সরকারের কেউ। মাছির মতো তাদের মরতে হচ্ছিল। তাই ভেড়ার পালের মতো বলিক্ষেত্র অভিমুখে অনুগত পদযাত্রা করার বদলে তারা বেছে নিয়েছিল মর্যাদাপূর্ণ মৃত্যুর পথ:

পাহাড় আমাদের বলেছিল, অস্ত্র হাতে তোলো যাতে কন্ঠস্বর অর্জন করতে পারো। পাহাড় আমাদের বলেছিল, মুখ ঢাকো যাতে মুখ পেতে পারো। পাহাড় আমাদের বলেছিল, তোমাদের নাম ভুলে যাও যাতে নতুন নাম পেতে পারো। পাহাড় আমাদের বলেছিল, তোমাদের অতীতকে রক্ষা করো যাতে ভবিষ্যৎ পেতে পারো। (জাপাতিস্তা ১৯৯৮, পৃঃ২২)

নিজেদের সম্বল বলতে কেবল আত্মমর্যাদাটাই তাদের অবশিষ্ট ছিল। সেই আত্মমর্যাদাটাকেই তারা আঁকড়ে ধরল এই আশায় যে তাদের বলিদান হয়ত সমাজের ঘুম ভাঙিয়ে দেবে, হয়ত তাদের সন্তান-সন্ততিরা আরো ভালো জীবন যাপন করতে পারবে।

তারা ছিল সবচেয়ে দুর্বল। কেউ তাদের কথা শুনছিল না। কিন্তু তাদের অভ্যুত্থান ‘সুশীল সমাজ’ (‘civil society’)-এ যে প্রতিধ্বনি তুলল তা তাদের শান্তিপূর্ণ ও রাজনৈতিক উপায় অবলম্বন করার আবেদন করল। (‘সুশীল সমাজ’ বলতে এখানে মূলত রাষ্ট্রীয় পরিসরের সঙ্গে সম্পূর্ণ একাত্ম নয় বা রাষ্ট্রীয় পরিসরের থেকে একটা মাত্রায় বিচ্ছিন্নতা ও স্বাধীনতা বজায় রেখে চলা সাধারণ নাগরিকদের নানারকম পরিসরের কথা বলা হয়েছে। তা যেমন বৃথিবীর বাস্তুতন্ত্র নিয়ে চিন্তিত বুদ্ধিজীবী-বিজ্ঞানকর্মীদের পরিসর হতে পারে, মানবাধিকার বা গণতান্ত্রিক অধিকার আন্দোলনে সক্রিয়জনেদের পরিসর হতে পারে, তেমনই ব্রাজিলের ক্ষেতমজুরদের গণআন্দোলনের মধ্য থেকে জন্ম নেওয়া সংগঠনগুলোও হতে পারে।--- বর্তমান অনুবাদক।) সেই আজ্ঞা গ্রহণ করে তারা নিজেদের শক্তিশালী করে তুলল, বদলে ফেলল নিজেদের সংগ্রামের আকার। সশস্ত্র অভ্যুত্থান আরম্ভের মাত্র বারো দিন পরেই তারা অহিংসার সমর্থক-প্রবর্তক হয়ে উঠল।

জাপাতিস্তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, ১৯৯৪ সালের মার্চে ক্যাথিড্রাল-এ আলোচনা (ক্ষমতাসীন দলের প্রেসিডেন্ট-পদ-প্রার্থীর হত্যাকাণ্ডের পর যা ভেস্তে যায়) এবং সেই বছরের নির্বাচনের পর, মত-বিনিময়ের এক ভিন্নতর পরিসর সৃষ্টি করা প্রয়োজন হয়ে উঠেছিল:

যাকে আমরা ‘সুশীল সমাজ’ নামে ডাকি, সেই বহুত্ববতীর কথা শোনা ও তার সঙ্গে কথা বলতে শেখার জন্য একটা পরিসর আমাদের দরকার ছিল। আমরা ‘আগুয়াসকালিয়েন্তেস’ নাম দিয়ে তেমন একটি পরিসর তৈরি করতে সচেষ্ট হয়েছিলাম । বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে মেহিকোর বিপ্লবী শক্তিদের সম্মেলন স্মরণ করে এই নাম, যেহেতু আমাদের আকাঙ্ক্ষা ছিল যে এই পরিসর জাতীয় গণতান্ত্রিক সম্মেলনের প্রধান দপ্তর হয়ে উঠবে।... ১৯৯৪ সাালের ৮-ই আগস্ট জাপাতিস্তা জাতীয় মুক্তি সেনার বিপ্লবী আদিবাসী আত্মগোপনকারী কমিটির পক্ষ থেকে কমান্ডার টাকো পৃথিবীর বিভিন্ন অংশ থেকে সমাগত ছয় হাজার অতিথির সামনে এই তথাাকথিত ‘আগুয়াসকালিয়েন্তেস’-এর উদ্বোধন করে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সুশীল সমাজের উদ্দেশ্যে তা নিবেদন করেন।... ‘আগুয়াসকালিয়েন্তেস’-এর ধারণা অবশ্য বাড়তি কয়েক পা এগিয়ে গিয়েছিল। সুশীল সমাজের সঙ্গে সংলাপের একটা পরিসর আমরা চাইছিলাম, আর সংলাপ মানে তো প্রথমত অপরের কথা শুনতে শেখা এবং অপরের সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয় তা শেখা।

১৯৯৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে মেহিকো রাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর আক্রমণে গুয়াদালুপে তেপেয়াক-এর আগুয়াসকালিয়েন্তেস যখন ধ্বংস হয়ে গেল, বিভিন্ন জাপাতিস্তা জনগোষ্ঠীদের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন আগুয়াসকালিয়েন্তেস জন্ম নিল। তারপর থেকে এইগুলো বিশেষ করে ‘সুশীল সমাজ’-এর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে নানাবিধ ভূমিকা পালন করেছে।

১৯৯৫ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে জাপাতিস্তা অঞ্চলে স্বশাসিত পৌরসংঘ তৈরির কাজ শুরু হয়। একই পৌরসংঘের মধ্যে বা প্রতিটি পৌরসংঘ গঠনকারী জনগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে ‘পরিচালনা পরিষদ’ গঠন ও পরিচালনা করার মধ্য দিয়ে জনগোষ্ঠীগুলো রাষ্ট্রীয় সেনাবাহিনীর দ্বারা ঘেরাও থাকা অবস্থাতে বিভিন্ন বাইরের চাপের মুখে দাঁড়িয়ে নিজেদের স্বশাসন চর্চা করে গেছে।

এই অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণ করে দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার পর জাপাতিস্তারা তাদের অভ্যন্তরীণ কাঠামোয় এবং ‘সুশীল সমাজ’-এর সঙ্গে সম্বন্ধ রাখার উপায়গুলোয় গুরুত্বপূর্ণ কিছু পরিবর্তন নিয়ে আসে। এই পরিবর্তনের অন্যতম হল আগুয়াসকালিয়েন্তেস-কে সমাধি দিয়ে কারাকোল্-এর (কারাকোল্ শব্দটার মানে শামুক-খোলা) জন্ম দেওয়া। এইসব পরিবর্তন সম্পর্কে সকলকে অবহিত করতে তারা ২০০৩ সালের ৮ থেকে ১০ আগস্ট বড়সড় উদযাপনের আয়োজন করে।

অভ্যন্তরীণ কাঠামোর ক্ষেত্রে তারা সামরিক কাঠামো থেকে পৌর সংগঠনকে সম্পূর্ণ পৃথক করার সিদ্ধান্ত নেয়। প্রতিটি জাপাতিস্তা অঞ্চলের স্বশাসিত পৌরসংঘগুলোর কাজকর্মকে সুসমন্বিত করার উদ্দেশ্যে জুনতাস্ ডি বুয়েন গোবিয়েরনো (সুশাসন পরিষদ) গঠন করা হয়— এই নতুন স্বশাসিত পরিষদগুলোর উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়: তারা ‘সুনিশ্চিত করবে যাতে জাপাতিস্তা অঞ্চলে নেতৃত্বদায়ীরা (জনসাধারণকে) অনুসরণ করার মধ্য দিয়েই নেতৃত্ব দেয়... প্রতিটি বিদ্রোহী অঞ্চলে সেই অঞ্চলের স্বশাসিত পৌরসংঘগুলো থেকে এক বা দুইজন করে প্রতিনিধি সুশাসন পরিষদে কাজ করবে।’

অর্থাৎ, স্বশাসিত জনগোষ্ঠী ও পৌরসংঘগুলো তাদের নিজস্ব কাঠামোর মধ্য দিয়েই সক্রিয় থাকবে, নতুন কেবল এটাই যে একাধিক পৌরসংঘকে নিয়ে একটি সমন্বয়কারী সুশাসন পরিষদও তারাই চালাবে। সুশাসন পরিষদগুলো তাদের এক্তিয়ারের মধ্যে থাকা স্বশাসিত পৌরসংঘগুলোর মধ্যের দ্বন্দ্ব-বিরোধ ও সমস্যাদি সমাধানে নজর দেবে। যে কেউ, একজন ব্যক্তি হলেও, যদি মনে করে যে তার গোষ্ঠীতে বা পৌরসংঘে কোনো অবিচার করা হয়েছে, বা ‘(জনসাধারণের) আদেশ মেনে তবেই আদেশ করা’-র নীতি অনুসরণ করা হচ্ছে না, বা জনগোষ্ঠীর ইচ্ছা মেনে যেভাবে চলা উচিত তা হচ্ছে না, তাহলে এই নতুন পরিষদে সে তার অভিযোগ নিয়ে আসতে পারবে। ‘সুশীল সমাজ’-এর সঙ্গে বা প্রয়োজন পড়লে সরকারি এজেন্সি-দের সঙ্গে যে কোনো লেনদেনও এই পরিষদগুলোই তদারকি করবে।

কিন্তু কারাকোল্ বা শামুক-খোলা— নতুন রাজনৈতিক সংঘগুলোর এমন নাম কেন? জাপাতিস্তারা এর বিভিন্ন ব্যাখ্যা হাজির করেছেন:

পুরোনো দিনের প্রাজ্ঞ মানুষরা বলতেন যে পুরুষ ও নারীদের হৃদয়গুলোর আকার শামুক-খোলার মতো। আর, হৃদয়ে ও চিন্তায় যাদের মঙ্গল আছে, তারা ঈশ্বরদের ও মানুষদের জাগ্রত করতে করতে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে হেঁটে বেড়ায় যাতে সেই জাগ্রতরা জগতকে ঠিকঠাক রাখায় নজর দেয়। তাই, অন্যরা যখন ঘুমিয়ে আছে, তখন যে পাহারা দেয় সে তার নিজের শামুক-খোলা ব্যবহার করে, আর ব্যবহার করে বিভিন্ন উদ্দেশ্যে, তবে সজাগ থাকতেই সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করে।

এখানে লোকে বলে যে খুব পুরোনো মানুষরা বলে যে তাদেরও আগের মানুষরা বলে গেছেন যে এই সমস্ত জঙ্গল-পাহাড়ে বাস গড়া একদম প্রথম মানুষরা শামুক-খোলার প্রতীকটাকে খুব মর্যাদা দিত। লোকে বলে যে তারা বলে যে তারা বলত যে শামুক-খোলা হল হৃদয়ে প্রবেশ করার প্রতীক, আর একেই সেই সর্বপ্রথম জনেরা জ্ঞান বলত। লোকে বলে যে তারা বলে যে তারা বলত যে হৃদয় থেকে বেরিয়ে জগতে হাঁটার প্রতীকও এই শামুক-খোলা, আর সর্বপ্রথম জনেরা একেই জীবন বলত। কেবল তাই-ই নয়। লোকে বলে যে তারা বলে যে তারা বলত যে শামুক-খোলা সহযোগেই সব মানুষদের এক জায়গায় ডাকা হয়েছিল যাতে এক থেকে অপরে শব্দ পাড়ি দিতে পারে আর এভাবেই সন্ধি-সমন্বয় জন্ম নিয়েছিল। তাছাড়াও লোকে বলে যে তারা বলে যে তারা বলত যে এমনকি সবচেয়ে দূরের শব্দগুলো শোনার জন্য কানকে উপযুক্ত করে তোলে এই শামুক-খোলা। এই কথাগুলোই লোকে বলে যে তারা বলে যে তারা বলত।

শামুক-খোলা হবে এমন সব দরজার মতো যা দিয়ে জনগোষ্ঠীগুলো ভিতরে ঢুকতে পারবে, আবার বাইরে বেরতে পারবে; এমন সব জানালার মতো যা দিয়ে আমাদের ভিতরটা দেখতে পাব, আবার আমরা বাইরেটাও দেখতে পাব; এমনই ধ্বনিবর্ধক কল যা আমাদের শব্দকে দূর-দূরান্তে পাঠাবে, আবার যে দূর-দূরান্তে আছে তার শব্দটাও আমাদের কানে পৌঁছে দেবে। কিন্তু, সব চেয়ে বেশি করে শামুক-খোলাগুলো স্মরণ করিয়ে দেবে যে আমাদের নজর রাখতে হবে ও খেয়াল করতে হবে যাতে এই জগতে অধিষ্ঠিত বহু বিবিধ জগৎগুলো স্বমর্যাদায় বহাল থাকে।

আগুয়াসকালিয়েন্তেস-কে সমাধিস্থ করে শামুক-খোলা-র জন্ম ঘোষণার অনুষ্ঠানে জাপাতিস্তারা ঘোষণা করেছিল যে তাদের অঞ্চলগুলোতে প্ল্যান পুয়েবলা-পানামা (দক্ষিণ মেহিকো ও মধ্য আমেরিকার জন্য এক নয়া-উদারনীতিবাদী পরিকল্পনা) লাগু হতে দেওয়া হবে না। তার বিকল্প হিসেবে তারা প্ল্যান লা রিয়ালিদাদ-তিজুয়ানা প্রস্তাব করেছিল যেখানে ‘আমাদের দেশের সমস্ত প্রতিরোধগুলোর মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে নীচ থেকে মেহিকোকে পুনর্গঠন’ করার কথা বলা হয়েছিল।

জাপাতিস্তা-ভাবনা সম্পর্কে এই বেশ জটিল আখ্যান থেকে বোঝা যায় যে জাপাতিস্তারা কোনো বদ্ধচিন্তার কুঠুরিতে বা কোনো মতবাদের মধ্যে নিজেদের আবদ্ধ করেনি। বদ্ধচিন্তা বা মতবাদ সাধারণত সক্রিয়তার পথপ্রদর্শক হিসেবে যাত্রা শুরু করে শেষাবধি একটি অনমনীয় কর্তৃত্ববাদী বন্দিকুঠুরিতে রূপান্তরিত হয়। তেমন কিছুতে নিজেদের আবদ্ধ না করে জাপাতিস্তারা প্রতিনিয়ত নিজেদের পরিবর্তন করতে করতে গেছে, পরিবর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে এবং বিবিধ অন্যান্য গোষ্ঠী ও সংগঠনের সঙ্গে নিবিড় মিথষ্ক্রিয়া থেকে পাঠ নিয়ে নিজেদের বক্তব্য-ভাবনা-আচরণকে সমৃদ্ধতর করতে করতে গেছে। তারা অপরদের কথা শোনে, অপরদের থেকে শেখে, আর প্রতি পদক্ষেপেই স্বাস্থ্যকর আত্মসমালোচনা করতে করতে যায়। তা বলে এ নিছক প্রয়োগবাদ নয়। কতিপয় আচরণের নীতিকে তারা সজোরে আঁকড়ে থাকে, তাদের নৈতিক নিষ্ঠাও চমৎকার। গভীরে শিকড় ছড়ানো, খোলামেলা ও অতিথিবৎসল মর্যাদাবোধ থেকে উৎসারিত চারিত্রিক দৃঢ়তা তাদের আছে।

যে চরিত্রবৈশিষ্ট্যগুলো জাপাতিস্তাদের স্বতন্ত্র করেছে, তাদের মধ্যে প্রধান একটি হল অপরদের কথা শোনার সক্ষমতা ও সেই অনুযায়ী বদল ঘটিয়ে নিজেদের আন্দোলনে গভীর পরিবর্তন নিয়ে আসার সক্ষমতা। কেউ কেউ হয়ত যাকে মতবাদিক নীতি কাঠামোর প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা স্বরূপ গিরগিটির মতো রঙ পাল্টানো বলে গালি দেবেন, তা আসলে প্রাণময়তা, নমনীয়তা, আগলহীনতা ও পরিবর্তনের সক্ষমতারই নানা অভিব্যক্তি। জাপাতিস্তা-ভাবনা বর্ণনা করতে গেলে এই এক বিড়ম্বনা তোমায় স্বীকার করতে হবে: তার ও তার চালচলনের নানা পরিবর্তন খেয়ালে রাখার জন্য সবসময় তোমায় সজাগ থাকতে হবে।

শ্লথতমের গতিতে হাঁটা

‘বিপ্লবী অগ্রণী’ মাত্রেই নিজেদের নেতৃত্বদায়ী-নির্দেশদায়ী অবস্থান বজায় রাখার জন্য বাতিকগ্রস্তের মতো বদ্ধপরিকর। যে কোনো উপায়েই হোক না কেন ‘জনগণ’-এর মাথার উপর নিয়ন্ত্রক হিসেবে তাদের থাকতেই হবে। আর তাদের সবসময়ই তাড়াহুড়ো লেগে আছে। প্রতিশ্রুত ভূমিতে— সাধারণত যার অর্থ রাষ্ট্রক্ষমতা দখল— তাদেরই সবার আগে পৌঁছতে হবে। তারা ভাবে যে একবার রাষ্ট্রক্ষমতার দখল নিতে পারলে, তারপর তারা তাদের বিপ্লবী প্রকল্পের রূপায়ণে জনগণকে নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে।

এর উল্টোদিকে, জাপাতিস্তারা সকলের মতের ঐক্য গঠনের চেষ্টা ও শ্লথতমের গতিতে হাঁটার উপর জোর দেয়। অল্প কয়েকজন নেতার দল কোনো গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেয় না। তার ফলে, সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়া হয় ধীরগতি ও জটিল, লম্বা কুণ্ডলী-পাকানো আলোচনা-পরামর্শের উপর তা দাঁড়িয়ে থাকে। ভোটগ্রহণ পদ্ধতির মধ্য দিয়ে তাকে দ্রুত করার কোনো চেষ্টা তারা করে না যেহেতু সেই পদ্ধতি সর্বদাই বিজয়ী ও বিজিত, সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘুর অমীমাংসিত অবশেষ রেখে যায়। আর তাই ঐক্যমতের পথ তৈরি করতে করতে তাদের এই চলা অবধারিতভাবেই ধীরগতি হয়।

অবশ্য, ‘গণতান্ত্রিক ঐক্যমত’-এর প্রথাগত চর্চায় সামাজিক বিষয়ী ও বিষয় সম্পর্কে বোঝাবুঝিতে ও সমবেতজনেদের মৌলিক মনোভাবে সমসত্ত্বতার যে পূর্বানুমান অন্তর্নিহিতভাবে কাজ করে যায়, জাপাতিস্তাদের ঐক্যমত-প্রচেষ্টা তা পরিহার করে। গণভোট, আস্থাভোট বা নির্বাচনের ব্যালট বাক্স প্রভাবাধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণের কবলে থাকে তো বটেই, তাছাড়াও এই পূর্বানুমানের উপর দাঁড়িয়ে থাকে যে ভোটাধীন বিষয়টির উপর সবাই একইরকম সাধারণ বোঝাবুঝিতে আছে এবং ভোটদাতাদের সবার মনোভাবও মূলগতভাবে সদৃশ, যা ভোটের মধ্য দিয়ে নির্মিত ‘গণতান্ত্রিক ঐক্যমত’-কে সম্ভব করে তোলে। কিন্তু জাপাতিস্তারা বাস্তব জগতে স্বার্থ, উপলব্ধি, মনোভাব, ও স্বরের বহুত্বে সঞ্জাত বহুল পার্থক্য সম্পর্কে পূর্ণভাবে সচেতন। এই সচেতনতা নিয়েই তারা ঐক্যমতের মধ্য দিয়ে হাঁটার পথ চিহ্নিত করার চেষ্টা করে, আর সবার রাজি হওয়া পথে হাঁটার সময় মন্থরগতি শ্লথদের গতির সঙ্গে গতি মিলিয়ে হাঁটার চেষ্টা করে। শ্লথরাও তাদের দিক থেকে নিজেদের গতি বাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে থাকে, যেহেতু তাদের চেখের সামনেই তারা প্রাতিষ্ঠানিক ছাদটাকে নিজেদের উপর ভেঙে পড়তে দেখতে পায়।

ওই পথে হাঁটার পাশাপাশি একইসঙ্গে জাপাতিস্তারা আইনি ও রাজনৈতিক পদ্ধতি অবলম্বন করে ঐক্যমতের আরেকটি স্তরও নির্মাণ করতে চাইছে। তারা নিঃসন্দেহ যে একে অপরের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য এই পদ্ধতিগুলোই হল সৃজিত হতে থাকা স্বাধীনতার কাঠামোকে রক্ষা করার সেরা উপায় (ইভান ইলিচ ১৯৭৪)।

জাপাতিস্তারা জোর দিয়ে বলে যে তারা বিদ্রোহী, কিন্তু বিপ্লবী নয়। হয়ত তারা ঠিকই বলে। জাপাতিস্তাদের মর্যাদাপূর্ণ বিদ্রোহ যাদের জড়ো করে দিয়েছে সেই সাধারণ পুরুষ ও মহিলারাই হবেন প্রকৃত বিপ্লবী। গোটা জগৎ জুড়ে এই সাধারণ পুরুষ ও মহিলারাই তৃণমূলস্তরে আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সেই সব পরিবর্তন এখনও শক্তপোক্ত প্রতিষ্ঠানের চেহারা নিয়ে দানা বাঁধেনি, কিন্তু তাদের ভিতগুলো মনে হয় জবরদস্ত হয়েছে। খুব সম্ভবত এ হল একুশ শতকের প্রথম সামাজিক বিপ্লব: নয়া সর্বসাধারণের বিপ্লব (এস্তেভা ও প্রকাশ ১৯৯৮; এস্তেভা ২০০০)।

গণতন্ত্র? উপস্থিতি ও প্রতিনিধিত্ব

১৯৯৬ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে অনুষ্ঠিত ‘নয়া-উদারনীতিবাদের বিরুদ্ধে ও মানবতার সপক্ষে প্রথম অন্তর্মহাদেশীয় সাক্ষাৎ’-এর সময় আলোচনার মাঝে এক স্বতঃস্ফূর্ত বক্তব্যে সাবকমান্ডান্ট মার্কোস অভ্যুত্থানের প্রস্তুতিপর্বে জাপাতিস্তাদের ক্ষমতা সম্পর্কিত মনোভাব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছিলেন:

আমাদের মনে হয়েছিল যে ক্ষমতার প্রশ্নে আমাদের নতুনভাবে সূত্রায়ন করা দরকার। যে সূত্রের পুনরাবৃত্তি করা আমাদের কখনই উচিত হবে না, তা হল: পৃথিবীকে বদলাতে হলে আমাদের ক্ষমতা দখল করতে হবে আর ক্ষমতায় যাওয়ার পর সেভাবেই সব সংগঠিত করতে হবে যেভাবে আমার জন্য সবচেয়ে ভালো হয়, কারণ আমি যেহেতু ক্ষমতায়, আমার জন্য ভালোটাই গোটা পৃথিবীর জন্যও ভালো। আমাদের মনে হয়েছিল, আমরা নিজেরা ক্ষমতা হাতে তুলে নিতে চাই না, এই মর্মে যদি ক্ষমতার প্রশ্নে ভাবনায় আমরা বদল আনি, তাহলে তা ভিন্ন রূপের রাজনীতি, ভিন্ন ধরনের রাজনীতিবিদ ও ভিন্ন ধরনের মানুষ তৈরি করবে যারা বর্তমানে গোটা রাজনৈতিক জগতের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত অবধি যেসব রাজনীতিবিদদের হাতে আমাদের দুর্ভোগ পোহাতে হয়, তাদের সবার থেকেই অনেকটা আলাদা রকম হবে। (জাপাতিস্তা ১৯৯৮, পৃঃ-৬৯)

১৯৯৬-এর ১ জানুয়ারি, সেলভা লাকানডোনা-র চতুর্থ ঘোষণায় রাজনৈতিক দল ও সরকার ছাড়াই আঞ্চলিক স্তরে সাধারণ মানুষ কী করতে পারে তা অনুসন্ধান ও আবিষ্কার করার জন্য জাপাতিস্তারা সবাইকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। জাপাতিস্তাদের ভাবনায়, প্রশ্নটা এই নিয়ে নয় যে ক্ষমতায় কে আছে বা কীভাবে কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা দল ক্ষমতায় আরোহণ করেছে (নির্বাচনের মাধ্যমে, না কি অন্য কোনো মাধ্যমে), বরং প্রশ্নটা খোদ ক্ষমতার চরিত্র নিয়ে। ‘গণতান্ত্রিক’ জাতি-রাষ্ট্রের খোদ কাঠামোর মধ্যে যে সমস্যাগুলো দৃঢ়-নিহিত হয়ে আছে, নির্বাচনী রীতি-পদ্ধতির কোনো উন্নতিসাধনের মধ্য দিয়ে সর্বত্র নতুনভাবে ঢেলে সাজিয়ে সেগুলোর মোকাবিলা করা যায় বলে জাপাতিস্তারা মনে করে না। প্রয়োজনীয় পরিবর্তনগুলো উপর থেকে নিয়ে আসা উচিত বা তা আদৌ সম্ভব বলে জাপাতিস্তারা আর ভাবে না। বরং তারা মনে করে যে ভিতর থেকে, সমাজ নিজেই নিজের রূপান্তরসাধন করার প্রক্রিয়া গ্রহণ করলে, তবেই এই পরিবর্তনগুলো জনপরিসরের বুনটে, লোকসমাজে, পৌরসংঘে বা মহল্লায় ফুটে উঠতে পারে।

প্রতিষ্ঠানসমূহকে রূপ দেওয়ার ও পরিচালনা করার জন্য প্রতিনিধিবর্গকে নির্বাচিত করে দেওয়ার পদ্ধতিকে যতই নিখুঁত করে সাজানো যাক না কেন, প্রতিষ্ঠানগুলোর মাথায় ওই ‘শীর্ষদেশ’-এ গণতন্ত্রের বসত নয়, গণতন্ত্রের বসত একমাত্র সর্বসাধারণের মাঝেই হতে পারে। চুড়ো তুলে গড়া ক্ষমতায় বিশ্বাস রেখে কেবল তার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার বদলে জাপাতিস্তারা আস্থা রাখতে চায় গঠনকারী বলের উপর, যে বল কাঠামোকৃত ক্ষমতাকে রূপ দেওয়ার প্রক্রিয়াতেই সেই কাঠামোয় প্রাণ, অর্থ ও সারবস্তু সঞ্চারিত করে। শুরু থেকেই জাপাতিস্তা-ভাবনা সমাজের রূপান্তরসাধনের কাজ তথাকথিত প্রতিনিধিবর্গের হাতে ছেড়ে দেওয়ার বদলে যাতে সর্বসাধারণ নিজেরাই তা প্রত্যক্ষ ও সচেতন ভাবে নির্বাহ করে, সেই আবেদন সমাজগঠনকারী বলের কাছে করে আসছে।

সর্বত্রই ক্রমশ আরো বেশি বেশি করে দেখা যাচ্ছে যে কাঠামোকৃত ক্ষমতা সাধারণজনের অভিপ্রায় গ্রাহ্য করছে না। মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ বন্ধ করার দাবিতে রাজপথ দখল করে ধ্বনিত হওয়া তিন কোটি মানুষের চিৎকারেও কান দেওয়া হয়নি। এই পরিস্থিতি আচারসর্বস্ব গণতন্ত্র সম্পর্কে মোহভঙ্গকে আরো গভীর করে তুলছে। আর অক্ষমতার এক যন্ত্রণাকেও গভীর করে তুলছে। প্রচুর মানুষই বীতস্পৃহা, ঔদাস্য, এমনকি বেপরোয়া নৈরাশ্যের মধ্য দিয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছে। ভোট দেওয়া বা ভোটবাক্স পরিহার করা--- উভয়ই নিষ্ফলা বা অকার্যকরী হয়ে উঠছে।

এখানেই জাপাতিস্তারা একটি বিকল্প পথ তৈরি করেছে--- রাজনৈতিক দলের বদলে তারা এমন এক রাজনৈতিক বল গড়ে তুলেছে যা তৃণমূলস্তরের সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় রূপান্তর ঘটিয়ে ঘেরাওকারীদের ঘেরাও করতে পারে, বিদ্যমান ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। জাপাতিস্তারা খুব ভালো করেই জানে যে তাদের বর্তমান সংগ্রাম মেহিকো রাষ্ট্রের আইনি ও রাজনৈতিক কাঠামোর মধ্যে ঘটছে। কিন্তু, রাষ্ট্রই হল একমাত্র সাধারণ রাজনৈতিক বাস্তবতা বা রাষ্ট্রই হল রাজনৈতিক সক্রিয়তার সবচেয়ে সুবিধাজনক ক্ষেত্র, এমন কোনো বিকৃত বিভ্রমজালে তারা বাঁধা পড়ে নেই। তাদের কাছে রাজনীতি হল লোকসমাজের অনুভবে ধৃত ও সাধারণ জ্ঞানের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত সর্বসাধারণের মঙ্গলের প্রতি দায়বদ্ধতা। রাষ্ট্র অথবা বাজারের কবল থেকে ভালো জীবন সংজ্ঞায়িত করার অধিকার কেড়ে নিয়ে তারা সেটিকে ‘সুশীল সমাজ’, অর্থাৎ সাধারণজনেদের অধিকার হিসেবে পুনর্প্রতিষ্ঠা করেছে।

খোদ জাতি-রাষ্ট্রের বর্তমান হাল ও ভবিতব্য নিয়ে হাল আমলে ঘনীভূত হওয়া বিতর্ক বিষয়ে জাপাতিস্তারা পূর্ণ মাত্রায় সচেতন। তাদের পর্যবেক্ষণে ধরা পড়েছে যে জাতি-রাষ্ট্র নামক এই যে আধুনিক উদ্ভাবনের গণ্ডীর মধ্যে পঁুজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক উভয় রূপের সমাজ-অর্থনীতিকেই সংগঠিত ও উৎসাহিত করা হয়েছিল, তা এখন দুই দিক থেকে আক্রমণের মুখে পড়েছে--- একদিক থেকে তার উপর আক্রমণ হেনেছে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ও বলসমূহ, অন্যদিক থেকে আক্রমণ শানাচ্ছে নৃগোষ্ঠীগত, ধর্মীয় বা মতবাদিক অভ্যন্তরীণ গোষ্ঠীবর্গ। জাতি-রাষ্ট্র নির্মাণের পর জাতি ও রাষ্ট্র সম্পর্কে বাতিল ঘোষণা করে দেওয়া নানাবিধ যে ধারণাগুলোকে এই বিভিন্ন আক্রমণকারী গোষ্ঠী পুনরুদ্ধার করে এনে পুনর্প্রতিষ্ঠা করতে উদ্যত হয়েছে, সেসব নিয়ে জাপাতিস্তারা স্পষ্টতই আগ্রহ প্রকাশ করেছে। (একটাই সংস্কৃতির আধিপত্যে বেঁধে হোক, বা একাধিক সংস্কৃতির ধাপ বেঁধে দিয়ে হোক) সমসত্ত্ব করে গড়ে তোলা যে কোনো রাষ্ট্রকে বহু বিভিন্ন ধারণার চারণক্ষেত্র একটি বহুত্বের রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করার যে কোনো প্রচেষ্টার সঙ্গে জাপাতিস্তারা তাদের সহমর্মিতা জ্ঞাপন করেছে। কিন্তু, ‘গণতান্ত্রিক’ জাতি-রাষ্ট্রের বিকল্প হিসেবে প্রস্তাবিত কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক নকশার প্রতি আনুগত্যে তারা নিজেদের অভিপ্রায় বা ভাবনাধারাকে বেঁধে রাখেনি। তারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে ‘সামগ্রিকভাবে সমাজ’ (সমাজের সাধারণ চালচিত্র) কোনো সামাজিক ইনজিনিয়ারিং প্রকল্প বা তাত্ত্বিক নকশা মাফিক ঢেলে গড়ার চেষ্টা দিয়ে তৈরি করা যায় না, তা সবসময় উদ্যোগ, বল ও স্বজ্ঞাচালিত ক্রিয়ার বহুত্বের ফল হিসেবে ফুটে ওঠে। সমাজতাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক কল্পনাশক্তির আবাহন তারা অবশ্যই করে, কিন্তু একইসঙ্গে তারা সমাজ ও রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে নতুন আদল দেওয়ার ভাবনায় ও চর্চায় সর্বসাধারণের--- বিশেষ করে এতদিন যাদের বাদ দিয়ে আসা হয়েছে, অংশ নিতে দেওয়া হয়নি, তাদের সকলের--- পূর্ণ অংশগ্রহণটাই প্রকৃত জরুরী বলে সজোরে হাজির করে।

নিজেদের নিয়ন্ত্রণে থাকা অঞ্চলে জাপাতিস্তারা মনে হয় এমন একটি পথ উন্মুক্ত করে চলেছে যেখানে গণতন্ত্রের অর্থ সক্রিয় উপস্থিতি, গণতন্ত্রের অর্থ প্রতিনিধিত্ব নয়।

সার্বজনীনতাবাদ ও আপেক্ষিকতাবাদ উভয় পেরিয়ে

‘বিশ্ব একটাই’– এই ধারণা একটি বহু পুরোনো পশ্চিমী স্বপ্ন, প্রকল্প বা নকশা বিশেষ, যার উৎপত্তি খুঁজতে গেলে পিছোতে পিছোতে ‘গুড সামারিটান অ্যান্ড দি অ্যাপোস্টল পল’ নামক উপদেশকথা অবধি পৌঁছে যাওয়া যায়।

আলোকপ্রাপ্তি (enlightenment)-র যুগ এই উত্তরাধিকারকে ধর্মতত্ত্বের বাইরে এনে একটা মানবতাবাদী বিশ্বাসমতে পরিণত করেছিল। ঈশ্বরের মতোই মানব-প্রকৃতিও শ্রেণি বা লিঙ্গ, ধর্ম বা জাতি কোনোকিছু বিবেচনা করে না। এইভাবেই ঈশ্বরের পুত্র হওয়ার সার্বজনীনতার ধারণাকে অন্য ছঁাচে ঢেলে মানবিক মর্যাদার সার্বজনীনতা তৈরি করা হয়েছে। তার পর থেকেই সমস্ত মানুষের ঐক্যসাধনকারী ল-সা-গু হিসেবে ‘মানবতা’ প্রতিষ্ঠা পেয়েছে এবং তার ফলে গাত্রবর্ণ, বিশ্বাস ও সমাজরীতির পার্থক্যের গুরুত্ব কমেছে। (স্যাকস ১৯৯২, পৃঃ-১০৩)

এর পর থেকেই ‘সমস্ত মানুষ মূলগতভাবে এক’ এই পূর্বধারণাকে সত্য ধরে নিয়ে একটাই বিশ্ব নির্মাণ করা পাশ্চাত্যের নৈতিক কর্তব্য হয়ে উঠল। ধ্বংসাত্মক ও উপনিবেশ-বিস্তারকারী অভিযানের রূপ ধরে তা একই লপ্তে এই গ্রহের উপর বিদ্যমান বহু বিভিন্ন পরম্পরা ও অস্তিত্ব-রূপকে শুষে নির্মূল করে দিতে উদ্যত হল। খ্রিস্টান ধর্মদণ্ড ও তরবারির সমস্ত অবতার দ্বারা চালিত এই পুরোনো প্রকল্পকেই এখন নবরূপে মার্কিন আধিপত্যের অধীনে চালিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে এই আধিপত্য বিস্তারের অভিযানই উন্নয়ন-কে তার ধ্বজা করে নিয়েছে (এস্তেভা ১৯৯২)। তারপর, ঠান্ডা যুদ্ধের পর্যায় পেরিয়ে এসে উন্নয়নের ধ্বজাকে বিশ্বায়নের ধ্বজা দিয়ে প্রতিস্থাপিত করা হয়েছে এবং পৃথিবীজোড়া সংস্কৃতিবিনাশের অভিযানে তা আরো বেশি হিংসাত্মক হয়ে উঠেছে।

বর্তমান বিশ্বপ্রকল্পটি প্রকৃতিগতভাবে অর্থনৈতিক: পৃথিবীর প্রত্যেকটি পুরুষ ও মহিলাকে তা তার জাদুদণ্ডের গুঁতোয় এমন এক homo economicus (অর্থনীতি-চালিত মানুষ)-য়ে পরিণত করতে চায় যা পাশ্চাত্যে উদ্ভূত সম্পত্তিবাগিশ প্রতিযোগিতাবাগিশ ব্যক্তি-এককের সমরূপ, যা পঁুজিবাদ (ও সমাজবাদেরও) সামাজিক ভিত্তি হিসেবে কাজ করতে পারে এবং সেমত ব্যবস্থার সমাজসম্পর্ক সংজ্ঞায়নে নির্ধারক হয়ে উঠতে পারে। এই অর্থনৈতিক প্রকল্পটির একটি রাজনৈতিক মুখ আছে, সেই মুখ হল আচারসর্বস্ব গণতন্ত্র, বা, প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র। আর একটি নৈতিকতাসূচক মুখ আছে, যা হল মানবাধিকার। (যখন অর্থনৈতিক প্রকল্পের প্রয়োজন পড়ে, তখন এই ‘মুখ’-গুলোকে অবশ্য বিসর্জন দেওয়া হয়।)

এসবকিছুর বিরুদ্ধেই জাপাতিস্তারা হেঁকে উঠেছে: ‘যথেষ্ট হয়েছে!’ শতকের পর শতক ধরে তাদের লোকসমাজগুলো উপনিবেশবিস্তারকারী ও উন্নয়নবিস্তারকারীদের প্রতিরোধ করতে করতে নিজেদের জায়গাগুলোয় নিজেদের গড় রক্ষা করে এসেছে। সেই সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ বহুক্ষেত্রে আঞ্চলিকতাবাদ, এমনকি মৌলবাদেরও চেহারা নিয়েছে। যন্ত্রণাকর অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে জাপাতিস্তা লোকসমাজগুলো এটা শিখেছে যে বিশ্বায়নের যুগে এসে কোনো আঞ্চলিকতাবাদই ধোপে টিকতে পারে না আর কোনো সাংস্কৃতিক প্রতিরোধই যথেষ্ট হয়ে উঠতে পারে না। তারা এটাও শিখেছে যে আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় পুঁজির আগ্রাসী খিদে এখন অনেক বেশি, কিন্তু এত বড় পেট তার নেই যে যা কিছু গিলে সে নিজ নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায় তার সবকিছুকেই সে হজম করে নিতে পারে। সেইজন্যই কোটি কোটি মানুষ, বিশেষত বেশির ভাগ আদিবাসী মানুষ আজ পরিত্যাজ্য বর্জ্যে পরিণত হয়ে চলেছে।

তাই জাপাতিস্তারা তাদের প্রতিরোধকে এক মুক্তিসংগ্রামে রূপান্তরিত করেছে। যার নামে তারা পরিচিত, সেই এমিলিয়ানো জাপাতা-র অভিজ্ঞতা তাদের স্মরণে আছে। মেহিকোর কৃষক ও আদিবাসী মানুষদের বিলুপ্তির খাদের ধারে এনে দাঁড় করানো একনায়কতান্ত্রিক শাসনকে পরাজিত করে কৃষক ও আদিবাসী যোদ্ধাদল যখন মেহিকোর রাজধানীর দখল নিল, তখন সেই ১৯১৪ সালে, সেই বিপ্লবের প্রধান দুই নেতা, জাপাতা ও ভিলা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিলেন। ক্ষমতা দখলের জন্য তাঁদের অভ্যুত্থান ছিল না, গোটা মেহিকোকে নিজেদের শাসনে আনার জন্যও ছিল না। তাঁরা কেবল জমির উপর অধিকার ও স্বাধীনতা চেয়েছিলেন। তাই তাঁরা নিজেদের অঞ্চলে ফিরে গেলেন, কৃষক ও আদিবাসীরা এতদিন ধরে তাদের উপর উৎপীড়ন চালানো বড় বড় জমিমালিকদের হাসিয়েন্ডা (জমিদারি এস্টেট)-গুলোকে ভেঙে দিল এবং সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জিত জমির অধিকার ও স্বাধীনতা উপভোগ করতে শুরু করল। কিন্তু চার বছর যেতে না যেতেই জাপাতা ও ভিলা উভয়কেই খুন করা হল। এটা সত্য যে ওই বিপ্লবের কল্যাণে বেশির ভাগ কৃষক ও আদিবাসী মানুষ কিছু না কিছু জমি পেয়েছিল, কিন্তু সশস্ত্র সংগ্রাম গুটিয়ে যাওয়ার পর প্রতিষ্ঠিত হওয়া নয়া রাজনৈতিক শাসনের মধ্যে ধাপে ধাপে তাদের সমস্ত স্বাধীনতা ও স্বশাসন হারাতে হয়েছিল।

আজকের জাপাতিস্তারাও তাদের পূর্বসূরিদের মতো নিজেরা ক্ষমতা দখল করায় বা গোটা মেহিকোয় নিজেদের শাসন প্রতিষ্ঠা করায় উৎসাহী নয়। কিন্তু তাদের পূর্বসূরিদের ভুল থেকে তারা শিক্ষা নিয়েছে। গোটা দেশে কী ধরনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে, তা নিয়ে তারা অবশ্যই ভাবিত। তারা চায় যে এমনই হবে সেই শাসন যা তাদের জমির উপর অধিকার, তাদের স্বশাসন, তাদের স্বাধীনতা ও তাদের মৌলিক গণতন্ত্রকে সম্পূর্ণত ও স্থায়ীভাবে মর্যাদা দেবে। তারা অন্য কারও উপর নিজেদের ধারণা, ভাবধারা বা চালচলন চাপিয়ে দিতে চায় না। তারা কেবল আশা করে যে নতুনতর সেই শাসন প্রকৃত অর্থেই সকল মেহিকোবাসীর দ্বারা কল্পিত ও গঠিত হবে— গুটিকয়ের দ্বারা উদ্ভাবিত হবে না, কেবলমাত্র এলিট বা বিপ্লবী অগ্রবাহিনীর দ্বারাও নির্দেশিত হবে না। আর সেই শাসন বহু বিবিধ মানুষ ও সংস্কৃতির সুসমঞ্জস সহাবস্থানের দ্বারা সংজ্ঞায়িত হবে।

নিজেদের আপন সংস্কৃতি থেকে নিজেদের ‘মুক্ত’ করে কোনো ‘সার্বজনীন’ মতবাদ বা মূল্যবোধকে আঁকড়ে ধরার ধর্মনিরপেক্ষ, উদারতাবাদী প্রলোভনকে জাপাতিস্তারা এড়িয়ে চলে। নিজেদের আপন সংস্কৃতি ও লোকসমাজে গভীরভাবে প্রোথিত থেকেই তারা অসন্তুষ্টজনেদের সংযোগবিস্তারের জন্য খোলামনে নিজেদের নিযুক্ত করেছে। তাদের আঞ্চলিকীকরণ (localization) তাই বিশ্বায়নবাদ ও আঞ্চলিকতাবাদ উভয়ের থেকেই মৌলিকভাবে আলাদা। ‘একটাই বিশ্ব’-বাঁধাবুলির বেঁধে দেওয়া কাঠামো পরিবর্তন করার পথ যারা খুঁজছেন তাদের প্রতি এই আঞ্চলিকীকরণ এমন এক সম্পূর্ণ নতুন বিশ্ব সৃষ্টির আহ্বান জানায় যেখানে বহু বিভিন্ন বিশ্ব পরস্পরকে আলিঙ্গন করে থাকতে পারবে। সম্পদ ভাগ-বিতরণের খেলায় নিজের জন্য আরো বড় ভাগ দখল করার যে অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক দাবিদাওয়ার ঘেরাটোপ, অথবা নিছক সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের ঘেরাটোপ, তা ছাড়িয়ে গিয়ে বহু বিবিধ সংস্কৃতির জন্য উন্মুক্ত প্রান্তর নির্মাণের এক মহাকাব্যিক রূপান্তরসাধনের পথে হাঁটার আহ্বান এই আঞ্চলিকীকরণ হাজির করেছে। তা কেবল এক নিমন্ত্রণ মাত্র, তা কোনো উপদেশদান বা নির্দেশদান নয়। তা ধর্মোপদেশ নয়, জ্ঞানদানও নয়, তা কেবলই একটি ইশারা মাত্র।

জাপাতিস্তারা পূর্ণমাত্রায় সচেতন যে বর্তমান পরিস্থিতিতে যে কোনো আঞ্চলিক বাস্তবতাই বিশ্বজনীন বল ও প্রক্রিয়াদির সঙ্গে মিথষ্ক্রিয়ায় উন্মুক্ত হওয়ার কারণে প্রত্যক্ষভাবে বিশ্বজনীন হতে বাধ্য। সর্বসাধারণ যেভাবে চায় ও যেভাবে পারে সেভাবে সম্পূর্ণত আঞ্চলিক বিষয়াদিতে গভীরভাবে নিমজ্জিত থাকা ও পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তাদের মোকাবিলা করতে গেলেই সমস্ত অঞ্চলসমূহের পরস্পর-বিজড়ন পরস্পর-সম্পৃক্তি ও পরস্পর-নির্ভরশীলতারও মোকাবিলা করতে হয়। এই ধরনের সচেতনতাই বিশ্বজনীন প্রকল্পের নয়া-উদারনৈতিক ধাঁচা নিয়ে অসন্তুষ্টজনেদের অনেককে পাল্টা বিশ্বজনীনতার নকশা ভাবতে প্ররোচিত করেছে। জাপাতিস্তারা এই প্ররোচণার কাছে আত্মসমর্পণ করতে চায় না। সমস্ত রকম প্রতিরোধের পূর্ণ গ্রন্থনা, অসন্তুষ্টজনেদের মধ্যে বিস্তৃত সংযোগ তৈরি করা, সমস্ত বিদ্রোহকে জড়ো করা--- এই সমস্ত কিছুর প্রতিই জাপাতিস্তারা গভীরভাবে ও পূর্ণমাত্রায় বিশ্বস্ত। কিন্তু তারা কখনোই সমস্ত সংগ্রামকে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নির্ধারণকারী একটাই সংজ্ঞা, একটাই বিশ্বাস-বুলি-মতবাদের অধীনস্থ করতে চায় না। তারা সচেতন যে পুঁজির কাছে ক্রমাগত পরিত্যাজ্য বর্জ্যে পরিণত হতে থাকা বিবিধ সব অসন্তুষ্টজনেরা সবাই মিলে এক আগামী বিশ্বের নির্মাণ তখনই সম্ভব যখন সেই বিশ্ব বহু বিশ্বকে সমাদরে আলিঙ্গন করতে পারবে। তারা জানে যে, উপনিবেশবাদের ছল হিসেবে একদা কাজ করে এসেছে এবং আজও হিংসা-তাণ্ডবে নজিরবিহীন হয়ে ওঠা মৌলবাদের বেশ কিছু রূপকে পুষ্ট করে যাচ্ছে, ‘একটাই বিশ্ব’ নির্মাণ করার এহেন যত স্বপ্ন-প্রকল্পকে চিরতরে কবর দেওয়ার সময় এসে গেছে। তার পরিবর্ত হিসেবে যা ক্রমশ মূর্ত হয়ে উঠছে, তাকে বোধহয় এই সূত্র দিয়ে প্রকাশ করা যায়: ‘একটা নয়, অনেকানেক বহু' (মিডনাইট নোটস ১৯৯৭; কিঙসনর্থ ২০০৩)।

জাপাতিস্তারা ও জাপাতিস্তা-ভাবনা

এখনও অবধি জাপাতিস্তা-প্রভাবের বৃত্তান্তটি বেশ চিত্তাকর্ষক:

  • পৃথিবীর সবচেয়ে পুরোনো কর্তৃত্ববাদী শাসনপ্রণালী মেহিকোর ancient regime-কে ভাঙার ক্ষেত্রে জাপাতিস্তারা অন্যতম নির্ধারক ভূমিকা পালন করেছিল। সেই শাসনের অবসানের পর শুরু হওয়া গভীর সামাজিক ও রাজনৈতিক রূপান্তরসাধন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তারা নতুনকে বেছে নেওয়ার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছিল। মেহিকোর বিভিন্ন প্রান্তে স্বশাসিত পৌরসংঘ সহ জাপাতিস্তা-অনুপ্রাণিত আরো বিভিন্ন উদ্যোগ এখন আরো বেশি বেশি দেখা যাচ্ছে এবং ক্রমপ্রসারমান রাজনৈতিক পরিসর প্রবর্তন করে চলেছে। সংযোগস্থাপনের ডাক দিয়ে জড়ো করার ক্ষমতা ১৯৯৪ সালের প্রথম সপ্তাহের কয়েক হাজার থেকে বাড়তে বাড়তে ১৯৯৬ সালের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরামর্শ-সভায় ৩০-৪০ লাখ এবং ২০০১ সালের মার্চে ৪ কোটিরও বেশিতে (গোটা মেহিকোর জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ) পৌঁচেছে।
  • চিয়াপাস-এ পরিস্থিতির নাটকীয় পরিবর্তন ঘটেছে। হাজার হাজার কৃষক, বেশির ভাগই আদিবাসী, দীর্ঘদিন ধরে যে জমির জন্য সংগ্রাম করে আসছেন, অবশেষে সেই জমির উপর অধিকার কায়েম করেছেন। সামাজিক বুনটকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করছে রাজনৈতিক বলের এক নতুন সমীকরণ।
  • জাপাতিস্তাদের দখলে থাকা অঞ্চলগুলো রাষ্ট্রীয় সেনা ও আধা-সেনা বাহিনীদের দ্বারা একটানা পরিবেষ্টিত হয়ে থাকলেও, নিরন্তর হুমকির মুখে পড়লেও, নিজেদের মতো করে তারা করে চলেছে যা প্রথম থেকেই করবে বলে বলেছিল। তাদের সর্বজনাধিকারভুক্ত জমিগুলোকে (commons) পুনরাধিকার করার পর তারা তাদের নিজস্ব প্রশাসন-প্রণালী এবং নিজস্ব বাঁচা-মরার যাপনশিল্পকেও পুনরুজ্জীবিত করছে। মেহিকোর সরকারের থেকে কোনো ধরনের সহায়তা বা অর্থ-অনুদান ছাড়াই তারা নিজেদের স্বশাসন বজায় রেখে নিজেদের জীবনযাপনাবস্থাকে উন্নত করতে সক্ষম হয়েছে। বাস্তবত, তারা বাজার ও রাষ্ট্রের যুক্তির সীমা ছাড়িয়ে গিয়ে, পুঁজির যুক্তির সীমা ছাড়িয়ে গিয়ে বসবাস করছে।
  • গোটা বিশ্বেই এমন নানা ইঙ্গিত, বদল ও সমাবেশ দেখা দিচ্ছে যা জাপাতিস্তাদের দ্বারা অনুপ্রাণিত। বিশ্বায়ন, নয়া-উদারনীতিবাদ বা যুদ্ধের বিরুদ্ধে অতি দৃশ্যমান সামাজিক আন্দোলনগুলো তাদের অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে জাপাতিস্তাদের উদ্ধৃত করছে এবং জাপাতিস্তাদের সমর্থনে দাঁড়াচ্ছে। গোটা বিশ্ব জুড়ে হাজার হাজার সমিতি ‘জাপাতিস্তা সমিতি’ নাম ধারণ করে কাজ করে চলেছে। জাপাতিস্তাদের অভিপ্রায়ের সঙ্গে সংগ্রামী ঐক্য জ্ঞাপন করতে এই সমিতিগুলোর পত্তন হয়েছিল। এখনও তারা এই সংগ্রামী ঐক্য অটুট রাখতে এবং জাপাতিস্তাদের সঙ্গে বা জাপাতিস্তাদের জন্য কিছু না কিছু করতে উন্মুখ। তাদের মধ্যে বেশিরভাগই আঞ্চলিক কোনও না কোনও সংগ্রামে জড়িত: কখনও তাদের নিজেদের স্বপ্ন, প্রকল্প বা উদ্যোগকে মূর্ত করার জন্য; আবার কখনও বিশেষ বা সাধারণ কোনও উন্নয়নপ্রকল্প বা অবিচারের বিরুদ্ধে, হয়ত বা কোনও বাঁধের বিরুদ্ধে, বা রাজপথ তৈরির বিরুদ্ধে, বা আবর্জনাগার তৈরির বিরুদ্ধে, ম্যাকডোনাল্ডের বিপণি খোলার বিরুদ্ধে... অথবা কোনো যুদ্ধ, কোনো সরকার, বা সরকারের কোনো নীতির বিরুদ্ধে...

ইতিহাস ধরে অনেক দূর পিছিয়ে গেলে তবেই আর কোনো রাজনৈতিক উদ্যোগের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে যা বিশ্বজুড়ে এইরকম ছাপ ফেলতে পেরেছিল। ওয়ালারস্টেইন তুলনা খুঁজে পেয়েছেন গান্ধি, ম্যান্ডেলার মধ্যে। কিন্তু প্রকৃত ঐতিহাসিক সমতুল্যতা পেতে গেলে আমাদের হয়ত আরো অনেক অতীতে পিছিয়ে যেতে হবে।

আজ যখন জাপাতিস্তারা প্রত্যয়ের সঙ্গে বলে যে জাপাতিস্তা ভাবনা এখন আগের যে কোনো সময়ের থেকে অনেক শক্তিশালী, তখন রাজনৈতিক শ্রেণিবর্গ, প্রচারমাধ্যম, বহু বিশ্লেষক, এমনকি কিছু সহানুভূতিসম্পন্ন জনেরাও ভাবতে শুরু করেছেন যে জাপাতিস্তারা এখন অতীতের বিষয়। ঠিক যখন তাদের দশম এবং বিশতম জয়ন্তীর (অভ্যুত্থানের পর দশ বছর, যাত্রাশুরুর পর কুড়ি বছর) বিস্তৃত উদযাপন পৃথিবীর নানা জায়গায় সংগঠিত হচ্ছে, তখনই তার সমান্তরালভাবে তাদের শ্রাদ্ধ পালনের নানা উদ্যোগও দেখা গেছে। সেইসব শ্রাদ্ধপালনকারীরা বলেছেন যে সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন হিসেবে জাপাতিস্তা ব্যর্থ। তারা বলেছেন, উন্নতি তো দূরের কথা, জাপাতিস্তাদের নেতৃত্বে জাপাতিস্তা লোকসমাজগুলোর বস্তুগত অবস্থা আরো খারাপ হয়েছে, জাপাতিস্তারা এখন চিয়াপাস-এর চারটি পৌরসংঘের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে ক্রমশ আরো বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির মঞ্চে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।

জাপাতিস্তারা প্রায়শই এমন এক অতি উচ্চকিত ‘নিস্তব্ধতার কৌশল’ ব্যবহার করে থাকে যা সাধারণত হতবুদ্ধিকর হয়ে ওঠার পাশাপাশি তাদের রাজনৈতিক মৃত্যুর জল্পনাকে উশকে দেয়। প্রথানুগ রাজনৈতিক মঞ্চকে জাপাতিস্তারা আমূল পরিত্যাগ করেছে। খোলাখুলি ভাবেই তারা সমস্ত রাজনৈতিক দলকে প্রত্যাখ্যান করে। মেহিকো সরকার সান আন্দ্রেজ-এর চুক্তি লঙ্ঘন করার পর থেকে জাপাতিস্তারা আলোচনা, সুযোগসুবিধা বা আর্থিক অনুদান কোনোকিছুর জন্যই আর সরকারের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রাখতে অস্বীকার করে। নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অংশ নিতেও তারা অস্বীকার করে। এই সব উপাদানের যোগফলেই গতানুগতিক, প্রতিক্রিয়াশীল বা সহানুভূতিশীল পর্যবেক্ষকদের মনে এই ধারণা দানা বেঁধেছে যে জাপাতিস্তারা এখন অতীত, তাদের আন্দোলন ও উদ্যোগের তুঙ্গমুহূর্ত পেরিয়ে গেছে।

অথচ সম্প্রতি কমান্ডার আব্রাহাম বলেছেন, ‘আমরা এখন সবে শুরুর পর্যায়েই আছি’ (মুনোজ ২০০৩, পৃঃ ৭৭)। মনে হয় তিনি ঠিকই বলেছেন। একই সঙ্গে গভীর বৈপ্লবিকতা ও বিস্ময়কর সংযম যেভাবে জাপাতিস্তারা তাদের চর্চার বৈশিষ্ট্য করে তুলেছে, তাতে তাদের আন্দোলনের বর্তমান পরিস্থিতি ও আগামী সম্ভাবনা উভয়কেই বোঝা বেশ কঠিন কাজ।

শব্দরাই বোধের জানালা, শব্দরাই চিন্তার পদার্থ। কী শব্দ আমরা ব্যবহার করছি, তার উপর নির্ভর করেই আমরা দেখি, আমরা ভাবি, আমরা ক্রিয়া করি। শব্দরাই এমন বিবৃতি গঠন করে যা দিয়ে আমরা নিজেদের ও অপরদের শাসন করি। নিজেদের আচরণের রক্তমাংস দিয়ে গড়ে নেওয়া শব্দরাই জাপাতিস্তাদের প্রধান হাতিয়ার হিসেবে কাজ করছে। নিজেদের শব্দগুলোর মেধাবী ও কার্যকরী প্রয়োগের মধ্য দিয়ে তারা আধিপত্যকারী বয়ানসমূহকে ভেঙে চলেছে। প্রতিষ্ঠিত ‘সত্য’, অর্থাৎ, আধিপত্যকারী বিবৃতি উৎপাদনের প্রাতিষ্ঠানিক তন্ত্রে তারা অনবরত অন্তর্ঘাত করে চলেছে। এইভাবে তারা বিদ্যমান ক্ষমতা/জ্ঞান তন্ত্রের ভিত্তিমূলকেই শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক উপায়ে নড়িয়ে দিচ্ছে। এই তন্ত্র যখন শক্তিপ্রদর্শনের উপর-জমক ভরা উচ্ছ্বাসে তার ক্রমবর্ধমান ভঙ্গুরতা লুকিয়ে রাখতে চায়, জাপাতিস্তারা তখন সেই তন্ত্রব্যবস্থার মধ্যের চওড়া-হতে-থাকা গভীর ফাটলগুলোকে তাদের সংগ্রামের জন্য ব্যবহার করে, আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণের কাঠামো হিসেবে উন্মোচিত করে দিয়ে তার বিকল্প নির্মাণের সূচনা করে।

জাপাতিস্তা-ভাবনার গুরুত্ব তার তৃণমূলস্তরের বৈপ্লবিকতার মধ্যে নিহিত আছে। প্রথাগত সংগঠন, রাজনৈতিক দল, সরকার, ইত্যাদির প্রতি ক্রমবর্ধমান বীতরাগ এবং পুঁজি-প্রসারণের বর্তমান অবতার নয়া-উদারনৈতিক বিশ্বায়নকে প্রতিরোধ করা--- এই দুইয়ের প্রবাহিত হওয়ার জন্য নদীগর্ভ হিসেবে জাপাতিস্তা-ভাবনা কাজ করে চলেছে।

যখন বিশ্বায়নকে একটি অপরিহার্য বাস্তবতা, একটি আবশ্যক পথ, একটি ঐতিহাসিক ঘটনা হিসেবে সাধারণভাবে ধরে নেওয়া হতো, তখনই জাপাতিস্তারা বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। অন্য যে কারও আগে তারাই ফঁাস করে দিয়েছিল যে সম্রাটের অঙ্গে কোনো পোষাক নেই, আর তার মধ্য দিয়ে সেইসব মানুষকে তারা জাগিয়ে তুলেছিল যাদের স্বজ্ঞায় সম্রাটের ন্যাংটোপনা ধরা পড়লেও সাহস করে যারা তা বলে উঠতে পারছিল না। আধিপত্যকারী ‘সত্য’ যে বৌদ্ধিক ও রাজনৈতিক বন্দিদশায় আমাদের নিক্ষেপ করেছিল সেই বন্দিদশা ভেঙে বেরিয়ে আসার একটি সুযোগ জাপাতিস্তারা এনে দিয়েছিল বিকল্প হাজির করার মধ্য দিয়ে।

সম্ভাব্য ভবিষ্যতের কোনো নতুন মতবাদিক নির্মাণকে জাপাতিস্তারা বিপ্লবী অঙ্গীকার হিসেবে হাজির করেনি। বিপ্লবী অঙ্গীকার প্রতিনিয়ত তাদের কাজ, তাদের প্রাত্যহিক আচরণের মধ্য দিয়ে আশার পুনর্সংজ্ঞায়ন হিসেবে আত্ম-প্রস্ফুটিত হতে হতে চলেছে। ভবিষ্যৎ পরিণতি ভালো বা শেষ ভালো হবে এমন স্থির-বিশ্বাস বা প্রত্যাশায় ভর করে বর্তমানের পন্থা বাছা তাদের অবস্থানের সঙ্গে মেলে না। তাদের অবস্থান এই প্রত্যয় ব্যক্ত করে যে এখন যা অর্থপূর্ণ, ভবিষ্যতে তা কী রূপ নেবে তা বলা যায়ে না আর  তাতে কিছু যায় আসে না। তাই তারা বলে: ‘গতানুগতিকতা ও পরাজয়কে প্রত্যাখ্যান করার মধ্যেই আছে আশা’ (জাপাতিস্তা ১৯৯৮, পৃঃ ১৩)।

জাপাতিস্তা-ভাবনার সংজ্ঞামূলক যে মনোভাবকে জাপাতিস্তারা ‘মর্যাদা’ বলে মনে করে, তা হল:

মর্যাদা হল জাতীয়তাহীন জাতি, সেতুও বটে আবার রামধনুও বটে, রক্তের চরিত্র বিচার না করে স্পন্দিত হৃদপিণ্ডের মর্মর, সীমানা-প্রথা-যুদ্ধ তোয়াক্কা না করা বিদ্রোহী। (জাপাতিস্তা ১৯৯৮, পৃঃ ১৩)

তারা পূর্ণমাত্রায় সচেতন যে ‘প্রতিটি মানুষ ও প্রতিটি মানবিক সম্পর্কের ক্রমপ্রসারমান মর্যাদাকেই বাধ্যতামূলকভাবে বিদ্যমান তন্ত্রসমূহের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত হতে হয়’ (ইভান ইলিচ ১৯৭২, পৃঃ ১৮)। আঞ্চলিকতাবাদ ও বিশ্বায়নবাদ--- এই দুইয়েরই সাধ্যমত ও কার্যকরী বিকল্প হল তাদের আঞ্চলিকীকরণ। তাদের স্বশাসন একদিকে যেমন রাষ্ট্রের কেন্দ্রীকতার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত, তেমনই অন্যদিকে তা অর্থনীতিকে প্রান্তিক করে তুলে ভিতরের ও বাইরের উভয় বর্গের উপনিবেশ-বিস্তারকারীদের দ্বারা উৎসাহিত করা আধুনিকতাবাদী ও পুঁজিবাদী ব্যক্তিখণ্ডায়ন(individualization)-কে প্রতিহত করে। নিজেদের মর্যাদায় শিকড় চারিয়ে জাপাতিস্তারা তাদের অনেকান্ত পথজাল সদৃশ চর্চাপথে কিছু কিছু দিকচিহ্ন ও নামফলক খাড়া করতে করতে চলেছে। সেই সব পথে হাঁটা যে কোনো ব্যক্তিই দেখতে পাবেন রামধনুর পরিব্যাপ্ত ও প্রগাঢ় ধর্ম নিয়ে নতুন সামাজিক ব্যবস্থা আবাহনকারী অনেকানেক রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত ফুটে উঠছে, যা ছাপিয়ে যেতে চাইছে বদ্ধ সব গণ্ডী--- সে গণ্ডী আধুনিকতারই হোক বা উত্তর আধুনিকতার; অর্থনৈতিক সমাজের (ধনতান্ত্রিক বা সমাজতান্ত্রিক উভয় ধরনেরই) হোক বা আচারসর্বস্ব গণতন্ত্র ও জাতি-রাষ্ট্র-এর--- বিশ্বের হাল অবস্থা ও ততোৎসারিত বৌদ্ধিক, মতবাদিক ও প্রাতিষ্ঠানিক বেড়িগুলো ছিঁড়ে তা ডানা মেলে দিচ্ছে।

ক্রমশ আরো বেশি বেশি করে জাপাতিস্তারা যেন অসাধারণ আচরণ বিশিষ্ট সাধারণ পুরুষ ও মহিলা হয়ে উঠেছে। তারা স্বতন্ত্র, আবার একইসঙ্গে তারা সাধারণ। হৃদয় ও মস্তিষ্ককে তারা উশকে দিতেই থাকে। সর্বত্র তৃণমূল স্তরে এখন ফুটে ওঠা হাজার হাজার উদ্যোগ-প্রবর্তনার তারা প্রতিভূ। গোটা পৃথিবীতে চক্কর-কাটা জাপাতিস্তা-ভাবনা এখন আর শুধু জাপাতিস্তাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই।

১৯৯৬ সালে নয়া-উদারনীতিবাদের বিরুদ্ধে আন্তর্মহাদেশীয় সাক্ষাৎ-এ সকল অংশগ্রহণকারীদের উদ্দেশ্য করে জাপাতিস্তারা বলেছিল, ‘আমরা এখানে জড়ো হয়েছি বিশ্বকে বদলাতে নয়--- বিশ্বকে বদলানো যদিবা অসম্ভব না হয়, ভয়ংকর কঠিন তো বটেই, আমরা জড়ো হয়েছি সম্পূর্ণ নতুন এক বিশ্ব সৃষ্টি করতে।’ গভীর আগ্রহ ও মুগ্ধতা নিয়ে এই কথাগুলো গৃহীত হয়েছিল, কিন্তু সন্দেহ-সংশয়ও ছিল অনেক। কারো কারো মনে হয়েছিল যে এ কেবল অবাস্তব কল্পনাচারিতা। কিন্তু ধাপে ধাপে বহু মানুষ আধিপত্যকারী বৌদ্ধিক ও মতবাদিক বন্দিশালা থেকে নিজেদের মুক্ত করার সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের মধ্যেই জাপাতিস্তাদের সমরূপ মর্যাদা আবিষ্কার করছে এবং নিজ নিজ আপন পথে হাঁটতে শুরু করছে।

আজকের জাপাতিস্তা-ভাবনা তাই আর কেবল জাপাতিস্তাদের কুক্ষিগত নেই এবং অনায়াসেই তা প্রথম বা হাল প্রেরণার উৎসকে অগ্রাহ্য করে নতুন পথ করে নিতে পারে।

আশায় উৎক্রমণ             

মোরেলিয়া জনগোষ্ঠীর এক চমৎকার বৃদ্ধা ডনা ত্রিনিদাদ। তাঁর সঙ্গে আমি কথা বলছিলাম। যেসব জাপাতিস্তা লোকসমাজগুলোকে রাষ্ট্রীয় সেনা ও আধা-সেনাদের উৎপাতে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ পোহাতে ও হয়রান হতে হয়েছে, মোরেলিয়া তাদের অন্যতম। আমি তঁার কাছে জানতে চেয়েছিলাম যে এহেন কঠিন পরিস্থিতিতে তঁারা কেমন আছেন। মুখে হাসি নিয়ে তিনি আমায় বলেছিলেন: ‘আমাদের এখনও খিদের কামড় সইতে হয়। হুমকি চোখরাঙানি হয়রানি এখনও সইতে হয়। কিন্তু এখন আমাদের কাছে আশা আছে। ব্যস, এটাই তো সব বদলে দিয়েছে।’ নিষ্ঠুর নিপীড়নের মুঠোবন্দি হয়ে বাস করা আর নিজের ছেলে-মেয়ে-নাতি-পুতিদেরও একই ভোগান্তি ভুগে যেতে হবে এই ভয়ানক বোধের ভারে ন্যুব্জ হয়ে থাকার যন্ত্রণা আমি কল্পনা করতে পারি। শুধু যদি সুড়ঙ্গের শেষে আলো দেখা যায়, কিছু আশা লালন করা যায়, বাধাবন্ধনগুলো তখন সহনীয় হয়ে ওঠে, বাঁচা আর বাঁচার অযোগ্য থাকে না...

‘সমৃদ্ধি’ শব্দটি ইংরেজিতে ‘prosperity', যার উৎস (একই অর্থের ফরাসি ও স্প্যানিশ শব্দের মতোই) লাতিন ভাষার pro spere, যার অর্থ ‘আশা অনুরূপ’। এই মূলগত অর্থটিকে যদি আমরা পুনরুদ্ধার করি, তাহলে বলতে হয় যে জাপাতিস্তারা লোকসমাজগুলোয় সমৃদ্ধি নিয়ে এসেছে। দশ বছর ধরে রাষ্ট্রের উপর কোনোভাবে নির্ভর না করেই এই লোকসমাজগুলো নিজেরা নিজেদের জীবন সংগঠিত করে চলেছে। রাষ্ট্রের পরিষেবা, প্রস্তাব, পরিকল্পনা, প্রকল্প সব তারা প্রত্যাখ্যান করেছে। বাজারের আঁকশিতে নিজেদের গোটা অস্তিত্বকে ঝুলিয়ে দেওয়ার বদলে তারা বাজারকেই প্রান্তিক বিষয়ে পরিণত করেছে। এখনও তাদের বড় বেশি বাধানিষেধের মুখোমুখি হতে হচ্ছে, তবে তার কোনোটাই তাদের কাছে নতুন নয়। কিন্তু সেই পথ তারা খুঁজে পেয়ে গেছে যে পথে হাঁটতে হাঁটতে একে একে এই বাধানিষেধগুলোকে হার মানানো যাবে।

গণ-আন্দোলনের আদি অন্তর্বস্তু হল আশা (লুমিস ১৯৯৬) । অমান্য করার রোখ আর অসন্তুষ্টিই যথেষ্ট নয়। তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণাত্মক সচেতনতাও যথেষ্ট নয়। জনসমাজ তখনই নিজেদের সমাবেশিত করে যখন তারা মনে করে যে তাদের ক্রিয়া বদল ঘটাতে পারে, যখন তাদের বুকে আশা থাকে, যখন তারা অর্থপূর্ণ কিছু করার প্রত্যয়ের অংশীদার হয়।

বিস্ময়কর মেধা, কল্পনাশক্তি ও সাহস দিয়ে কথা আর কাজ সহযোগে জাপাতিস্তারা এই গ্রহে নতুন আশা নিয়ে এসেছে। লাখ লাখ মানুষ সেই আশার অংশীদার হয়ে উঠে এখন তাকে পুষ্ট করে চলেছে বলে মনে হয়। জাপাতিস্তাদের অভ্যুত্থানের দশম জয়ন্তী ও তাদের আদি উদ্যোগ সূচনার বিশতম জয়ন্তী উদযাপনের মধ্য দিয়ে আমরা সবাই আসলে জাপাতিস্তা-ভাবনার সূচনাটিকেই এখন উদযাপন করছি।

 

সূত্রপঞ্জী

ইভান ইলিচ, ১৯৭২, ডিস্কুলিং সোসাইটি, নিউ ইয়র্ক: হার্পার অ্যান্ড রো।

উলফগ্যাঙ স্যাকস, ১৯৯২, দি ডেভেলপমেন্ট ডিকশনারি: এ গাইড টু নলেজ অ্যাজ পাওয়ার বইয়ের অন্তর্গত ‘ওয়ান ওয়ার্ল্ড’, পৃঃ ১১১-১২৬, লন্ডন: জেড বুকস।

গুস্তাভো এস্তেভা, ১৯৯২, দি ডেভেলপমেন্ট ডিকশনারি: এ গাইড টু নলেজ অ্যাজ পাওয়ার বইয়ের অন্তর্গত ‘ডেভেলপমেন্ট’, পৃঃ ৬-২৫, লন্ডন: জেড বুকস।

গুস্তাভো এস্তেভা ও মধু সুরি প্রকাশ, ১৯৯৮, গ্রাসরুটস পোস্টমডার্নিজম: রিমেকিং দি সয়েল অফ কালচারস, লন্ডন: জেড বুকস।

গুস্তাভো এস্তেভা, ২০০০, অ্যাবোরিজিনাল রাইটস অ্যান্ড সেলফ গভর্নমেন্ট বইয়ের অন্তর্গত ‘দি রেভলুশন অফ দি নিউ কমনস’, পৃঃ ১৮৬-২১৭, মনট্রিল: ম্যাকগিল-কুইনস ইউনিভার্সিটি প্রেস।

গ্লোরিয়া মুনোজ, ২০০৩, ২০ ই ১০: এল ফুয়েগো ই লা পালাবরা, মেহিকো সিটি: রেবেলদিয়া/লা জোরনাদা এডিসিওনেজ।

জাপাতিস্তা, ১৯৯৮, জাপাতিস্তা এনকুয়েনত্রো: ডকুমেন্টস ফ্রম দি ১৯৯৬ এনকাউন্টার ফর হিউম্যানিটি অ্যান্ড এগেইনস্ট নিওলিবারালিজম, নিউ ইয়র্ক: সেভেন স্টোরিজ প্রেস।

ডগলাস লুমিস, ১৯৯৬, র‍্যাডিকাল ডেমোক্রেসি, ইথাকা: কর্ণেল ইউনিভার্সিটি প্রেস।

পল কিঙসনর্থ, ২০০৩, ওয়ান নো, মেনি ইয়েসেস: এ জার্নি টু দি হার্ট অফ দি গ্লোবাল রেজিসটেন্স মুভমেন্টস, লন্ডন: দি ফ্রি প্রেস।

মিডনাইট নোটস, ১৯৯৭, ওয়ান নো, মেনি ইয়েসেস, নং ১২, জামাইকা প্লেন, এম এ।

0 Comments
Leave a reply