জাপাতিস্তা বিদ্রোহ ও ঘটমান অভ্যুত্থান

লিখেছেন:গুস্তাভো এস্তেভা, তর্জমা- বিপ্লব নায়ক
যুগাবসানের ঘোষণা করে যাওয়া এক অভ্যুত্থানের মাঝে এখন আমরা আছি; পুরুষতন্ত্র, পুঁজিবাদ ও গণতান্ত্রিক জাতি-রাষ্ট্রের অবসান-কাল ঘনিয়ে এসেছে; কিন্তু আমরা অন্যতর কোনো শাসনতন্ত্র গড়ে তুলছি না, কী ঘটছে বা ঘটতে চলেছে সে সম্পর্কে কোনো সাধারণ বা বিশ্বতোমুখী ধারণাও আমাদের নেই; মূর্ত করে বললে, আমরা ভবিষ্যৎ থেকে ফেরার পথে আছি।

         

২০০৮-এর ‘সংকটের’ চরিত্র ও বিস্তার নিয়ে আলাপ-আলোচনা এখনো চলছে, কিন্তু শুরু থেকেই বেশ কিছু ভিন্নধর্মী অন্তর্দৃষ্টিও হাজির হয়েছে। ২০১০ সালের শেষে মেহিকোর জাতীয় স্বশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের (National Autonomous University of Mexico, সংক্ষেপে UNAM) অন্তর্গত অর্থনৈতিক গবেষণা সংস্থা (Institute of Economic Research)-য় ‘সভ্যতার সংকট ও পুঁজিবাদকে অতিক্রম করা’ শীর্ষক একটি বক্তৃতামালায় অংশ নেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ করা হয়েছিল। নিজের তরফে এই বোধ আমার মধ্যে দানা বাঁধছিল যে তৃণমূল স্তরে হওয়া আমার নানা অভিজ্ঞতা প্রধান বিশ্বাসমতগুলোর অবসান দাবি করছে। সাহসভরে এই মত আমি তুলে ধরেছিলাম যে যুগাবসানের ঘোষণা করে যাওয়া এক অভ্যুত্থানের মাঝে এখন আমরা আছি; পুরুষতন্ত্র, পুঁজিবাদ ও গণতান্ত্রিক জাতি-রাষ্ট্রের অবসান-কাল ঘনিয়ে এসেছে; কিন্তু আমরা অন্যতর কোনো শাসনতন্ত্র গড়ে তুলছি না, কী ঘটছে বা ঘটতে চলেছে সে সম্পর্কে কোনো সাধারণ বা বিশ্বতোমুখী ধারণাও আমাদের নেই; মূর্ত করে বললে, আমরা ভবিষ্যৎ থেকে ফেরার পথে আছি। আমার সাধ্যমতো আমি চেষ্টা করেছিলাম এই অভ্যুত্থানের বৈশিষ্ট্যগুলো বর্ণনা করতে।

তার প্রায় দশ বছর পর সেই একই সংস্থা আবার আমাদের, সেদিনকার বক্তাদের, সমবেত করে ভাবনা-আলোচনাকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আমি চেষ্টা করেছিলাম নিজ বিশ্লেষণকে সংহত করতে। উৎপাদন-প্রণালী যখন অধিকার-হরণ ও ছিনিয়ে নেওয়ার প্রণালীতে রূপান্তরিত হয়েছে, সেই বর্বর আক্রমণের মুখে দাঁড়িয়ে তৃণমূলস্তরের উদ্যোগগুলো কীভাবে সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে, সেই উপায়গুলো নিয়ে একটা বিবেচনা আমি হাজির করেছিলাম।

এই অধ্যায়ে আমি ওই বক্তব্য/প্রবন্ধগুলোর অংশ অন্তর্ভুক্ত করছি। তা করতে বেশ কিছু সংশয় অবশ্য আমার মধ্যে কাজ করছিল, কারণ এই অংশগুলো সম্পাদনা করতে গিয়ে, অন্য অধ্যায়ে উপস্থাপিত ভাবনা শুধু নয়, গোটা বাক্য, এমনকি গোটা অনুচ্ছেদও পুনরুক্ত করতে হচ্ছিল। শেষাবধি তা যে আমি করেছি, তা এই ভাবনা থেকে যে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে থাকা ভাবনাগুলোর একটি বাস্তবিক সংশ্লেষ হিসেবে একে গণ্য করা যাবে। পঞ্চাশ বছরের এক সময়কাল জুড়ে এই সমস্ত ভাবনাগুলোকে বিবর্তিত হতে দেখার পর তাদের এক জায়গায় নিয়ে এসে দেখা কাজের হতে পারে। তাছাড়াও, এই পাঠ স্পষ্ট করে দেয় যে (করোনা) মহামারীর দোহাই দিয়ে, বিপর্যয়ের দায় ভাইরাসের কাঁধে চাপিয়ে যে পরিস্থিতির আজ অবতারণা হয়েছে, তার বীজ বপন করা চলছিল মহামারীর বহু আগে থেকেই।

সভ্যতার সংকট ও পুঁজিবাদকে অতিক্রম করা

কয়েক বছর আগে সাবকমান্ডান্ট মার্কোস কী ঘটছে তা বোঝানোর জন্য একটা রূপক ব্যবহার করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে ধরে নেওয়া যাক যে আমরা সকলে একটা জাহাজে সওয়ার হয়েছি:

‘এমন কেউ কেউ রয়েছে যারা একটি স্টিয়ারিং-হুইলের অস্তিত্ব কল্পনা করে নিয়ে তা কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা বিধেয় সেই নিয়ে তর্কে মত্ত। আবার অন্য কেউ কেউ স্টিয়ারিং-হুইলের অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে এবং তা যে এর মধ্যেই কোথাও না কোথাও রয়েছে ধরে নিয়ে তা খুঁজে বের করতে ব্যস্ত। আবার এমন লোকজনও আছে, যারা একটা দ্বীপ অধিকার করে তা নিজেদের আত্মসন্তুষ্টির আস্তানা হিসেবে ব্যবহার না করে, অনেকানেক আরো ভিন্ন ভিন্ন দ্বীপের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ওঠার জন্য নৌকা হিসেবে ব্যবহার করছে…’ (সাবকমান্ডান্ট মার্কোস ২০০৩, পৃষ্ঠা-১০)

এই রূপকটিকে আরো কিছুটা বিস্তৃত ও গভীর করে নিয়ে আমি আমার বক্তব্য-উপস্থাপনার কাঠামো হিসেবে ব্যবহার করতে চাই।

ধরা যাক, বিরাট জাহাজটা তুমুল ঝড়ের মধ্যে পড়েছে। এমন ভয়ঙ্কর ঝড় আর হয় না। জাহাজটির মেশিন-ঘরে সব নেতারা জড়ো হয়েছে, তাদের মধ্যে আছে রাজনীতিবিদরা, বিজ্ঞানীরা, অর্থলগ্নিকারীরা, বুদ্ধিজীবীরা, সমাজকর্মীরা…। কী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিত ও কোন পথে যাওয়া উচিত, তা নিয়ে সবাই খুব তর্ক-বিতর্ক করছে। তর্ক-বিতর্কে তারা এতই মত্ত যে কেউই খেয়াল করছে না জাহাজটা ডুবতে শুরু করেছে। এদিকে জাহাজের ডেকের উপর, যেখানে সাধারণ যাত্রীরা জড়ো হয়েছে, সেখানেও এক বিতর্ক ঘনিয়ে উঠেছে। স্টিয়ারিং-হুইল-টাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, যেমন সাবকমান্ডান্ট মার্কোস বলেছেন, তার অস্তিত্বে বিশ্বাস করে এখনও কেউ কেউ তার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার জন্য নিজেদের মধ্যে লড়াই করে চলেছে। অন্য কেউ কেউ যারা ব্যক্তিগত উদ্যোগগ্রহণে অভ্যস্ত এবং নিজেদের শক্তিতে প্রত্যয়ী, তারা আবার ডেক থেকে জলে ঝাঁপ দিয়ে ডুবতে বসেছে। আর বাকিরা, ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে গোষ্ঠীগতভাবে নৌকা বা বজরা খুঁজে বা তৈরি করে নিয়ে তাতে করেই সাগর পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা লাগু করেছে--- অবশেষে তারা আবিষ্কার করে যে তারা এক দ্বীপপুঞ্জের মধ্যে এসে পড়েছে, তারা তখন যে যার কাছের দ্বীপটার সৈকতের গিয়ে ওঠে আর নিজেদের দ্বীপটাকে এমনই এক সেতুতে রূপান্তরিত করতে চায় যা অন্যান্য দ্বীপগুলোর সন্ধান পেতেও সাহায্য করবে। তাদের সেই দ্বীপগুলো থেকে বিশাল সেই জাহাজ ও তার নেতৃবৃন্দের সকলের নিদারুণ ডুবে যাওয়া দেখার পর তারা এমন এক নতুন বিশ্ব গড়ার কাজে হাত দিয়েছে যেখানে বহু বিশ্বকে আলিঙ্গনে ধরা যাবে।

‘অভ্যুত্থান’ বলতে আমি যে উদ্যোগ ও আন্দোলনগুলোকে বোঝাতে চাইছি, সেগুলোর ধারণ করা আকারকে বোঝাতে এই রূপকটি বেশ যথাযথ বলে মনে হয়। ইতিমধ্যেই নির্মিত হতে শুরু হওয়া নতুন বিশ্বের লক্ষণ-বৈশিষ্ট্য এখানে ওখানে দেখা দিতে শুরু করেছে। পুঁজিবাদের ফাটলগুলো আবিষ্কার করে ও তার সুযোগ নিয়ে সর্বসাধারণ েযখানে ও যখন নিজেদের সৃষ্টিতে হাত লাগিয়েছে, সেখানে ও তখনই ওই দ্বীপপুঞ্জ আকার পাচ্ছে (হলোওয়ে, ২০১১)। যেসব গোষ্ঠী ও শক্তিরা কেবল মাত্র বর্তমান অবস্থা বজায় না রেখে নিজেদের আধিপত্যও বিস্তার করতে চায়, তারা তাদের জন্য ক্রমে আরো বেশি বেশি করে অকার্যকরী হয়ে ওঠা এই গণতান্ত্রিক জাহাজটির ডোবার প্রক্রিয়ায় দ্রুতি সংযোগ করছে যাতে স্বাধীনতার পরিবেশে ইতিমধে্যই যা অসম্ভব তা বর্বর বল প্রয়োগের মাধ্যমে লাভ করা যায়। সংকট ও তার দোসর হিংসায় নাজেহাল বহু মানুষের ক্রমবর্ধমান বেপরোয়া মনোভাব ও ঝঞ্ঝাবর্তায় ডুবতে বসা মানুষদের আত্মরক্ষার প্রবৃত্তির সুযোগ নিয়ে তারা রক্ত ও আগুন ছড়িয়ে পুঁজিবাদী বৃদ্ধি ও প্রচলিত বিকাশের আরেকটা নতুন পর্ব শুরু করতে চাইছে। তাদের এই প্রয়াসের গণতান্ত্রিকতার পোষাকটি ক্রমশই বিভ্রমকর হয়ে উঠেছে, আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ বা মাদক-চোরাচালানের অজুহাত দেখিয়ে অঘোষিত জরুরী অবস্থা জারী করাকে ঢেকে রাখার জন্য তৈরি একটি ছল বৈ আর কিছু নেই তাতে। নাগরিক অধিকার ও গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার জন্য দুই শতক জোড়া সংগ্রামের অর্জনকে তা দিনের পর দিন ধুয়ে মুছে দিতে দিতে চলেছে।

পুঁজিবাদী বৃদ্ধি ও প্রচলিত বিকাশের আবারও নতুন একটি যুগের দাপুটে আগমন এখনও সম্ভব। কিন্তু তা নিয়ে আসবে এখনও অভূতপূর্ব প্রাকৃতিক বিপর্যয়, বড় থেকে আরো বড় মনুষ্যগোষ্ঠীকে উচ্ছেদ করে প্রান্তে ঠেলে দিয়ে তা সামাজিক বৈষম্যকে গভীর থেকে গভীরতর করে তুলবে। লাতিন আমেরিকায় এখন দাপট দেখাতে দেখা যাচ্ছে যে ধরনের বামপন্থী সরকারগুলোকে, তারা আর বৃহৎ বহুজাতিক পুঁজির মধ্যে এক অশুভ আঁতাত তার পরিচালনা-ভার নেবে হয়ত।

এ হওয়া সম্ভব, তবে এমনটাই হবে মনে হয় না। এই প্রকল্প যেহেতু এর দ্বারা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের কাছ থেকে এবং তৃণমূলস্তরে ক্রমবর্ধমান প্রতিরোধের মুখে পড়ছে, চূড়ান্ত প্রভুত্ববাদী স্বৈরতন্ত্রের অধীনে ছাড়া তা সলাগু করা সম্ভব হবে না, যেরকম শাসন আবার সামাজিক বলসমূহের রাজনৈতিক আন্তঃসম্পর্ক বদলে দিয়ে আমি যে বিকল্পের কথা বলতে চাইছি, তাকে শক্তিশালী করে তুলবে। আমি এমন একটা অভ্যুত্থানের কথা বলতে চাইছি, খুব কমজনই হয়ত এখনও অবধি যা খেয়াল করেছেন: তা ঘটছে আমাদের চোখের সামনেই, অথচ আমরা তা দেখতে পারছি না। আর এই অভ্যুত্থানের অর্থ এবং যে বিপুল ঝুঁকির মুখে তা দাঁড়িয়ে, সে বিষয়ে কিছু সাহসী অনুমানও আমি হাজির করতে চাই।

প্রাত্যহিকে ছড়ানো বিদ্রোহ

তৃণমূলস্তরে দানা বাঁধা উদ্যোগগুলোর সাধারণ চরিত্রটিকে মনে হয় ক্রিয়াপদের পুনরুজ্জীবন বললে সঠিক হয়। ‘শিক্ষা’, ‘স্বাস্থ্য’, ‘বাসস্থান’, তথাকথিত ‘প্রয়োজন’ যা পূরণ হওয়া সরকারি বা বেসরকারি সংস্থাদের উপর নির্ভর করে--- এই সব বিশেষ্যকে সাধারণজন ‘শেখা’, ‘সুস্থ হয়ে ওঠা’, ‘বাস করা’-র মতো ক্রিয়াপদ দিয়ে প্রতিস্থাপিত করছে। এর মধ্য দিয়ে তারা যেমন ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত সক্রিয়তা পুনরুদ্ধার করছে, তেমনই সমাজ-রূপান্তরের স্বাধীন স্বনির্ভর পন্থাকেও সম্ভব করে তুলছে। যেখানে এমন ঘটছে, সেখানে প্রাত্যহিক জীবনবলয়ে যা ঘটমান তা বিচার করলেই ঘটমান অভ্যুত্থানটির চরিত্র বোঝা যাবে।

খাওয়া

বহুদিন আগে এদুয়ার্দো গালিয়েনো সাবধান করে দিয়েছিলেন যে আমরা এমন এক বিন্দুতে পৌঁছে গিয়েছি যেখানে ক্ষুধার প্রকোপ আবার ক্রমবর্ধমান সংখ্যায় মানুষদের জব্দ করছে, আর যারা সেই প্রকোপের বাইরে তারাও বাজারে বিক্রিত খাবারের মধ্যে থাকা ক্ষতিকর উপাদান সম্বন্ধে ক্রমাগত আরো বেশি করে সচেতন হয়ে ওঠার মধ্য দিয়ে খাওয়া নিয়ে আতঙ্কে ভুগছে (গালিয়ানো, ১৯৯৮)।

সাধারণজনের প্রতিক্রিয়া এখন দেখা যাচ্ছে। মুষ্টিমেয় সেসব বৃহৎ ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান বিশ্বের খাদ্য বাণিজ্যের আশি শতাংশ এখনই নিয়ন্ত্রণ করে এবং উৎপাদনকেও নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে, আইনে বেঁধে তাদের ক্ষতিকর কাজকর্ম বন্ধ করার মতো সরকারী নীতি ও বিধিব্যবস্থা প্রবর্তন করার উদ্দেশ্য নিয়ে সংগ্রাম এখনও দেখা যাচ্ছে বটে, তবে ভিন্নতর দিকে উদ্যোগের স্ফূরণ দেখা দিয়েছে।

সবার উপরে, দীর্ঘকালস্থায়ী পূর্বদৃষ্টান্তের উপর ভিত্তি করে গ্রাম-শহর সংযোগের এমন এক নতুন রূপ প্রবর্তিত হচ্ছে যা বাজারের বিকল্প ব্যবস্থা তৈরি করছে। শহুরে উপভোক্তাদের কিছু কিছু দল গ্রামীণ উৎপাদকদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে উৎপাদনপ্রক্রিয়ার বৈশিষ্ট্য ও ঝুঁকিগুলো ভাগ করে নিচ্ছে। কখনও কখনও এহেন সম্পর্ক বহু বিস্তৃত সম্ভাবনা নিয়ে নতুন ধরনের সর্বসাধারণের ক্ষেত্র (commons) হয়ে উঠছে। বিষযুক্ত খাদ্য খাওয়ার ভয় দূর করার তাগিদ থেকে গড়ে ওঠা এই ধরনের সম্পর্কগুলো এমনই গতিময়তা লাভ করেছে যে এমনকি ওয়ালমার্টও এখন তা নকল করে আয়ত্ত করার চেষ্টা শুরু করে দিয়েছে। মেহিকোতে এই সম্পর্কগুলো পঞ্চাশ বছরেরও বেশি লম্বা পরম্পরার উপর ভর করে আছে।

শহরাঞ্চলে খাদ্য উৎপাদন আরো বেশি বেশি করে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে চমকপ্রদ উদাহরণ হল কিউবা। কিউবার বিপ্লবের পঞ্চাশ বছর পর যখন কিউবাবাসীরা দেখল যে তাদের খাদ্যের সত্তর শতাংশ এবং পুরোপুরি শিল্পোদ্যোগে পরিণত করা কৃষির জন্য দরকারী যত রাসায়নিক সবই বাইরে থেকে আমদানি করতে হচ্ছে, তখন সেই তথাকথিত নয়া পর্যায়ে নাগরিকদের নেওয়া উদ্যোগের মধ্য দিয়ে এর সূচনা হয়েছিল। আজ তারা জৈব চাষে বিশ্বসেরা, দীর্ঘকালীন বিচারে টেকসই হওয়ার শর্ত কেবলমাত্র তাদের দেশই আজকের পৃথিবীতে পূরণ করতে পারে, আর তাদের নগরবাসীরা যে পরিমাণ খাদ্য খায়, তার অর্ধেকেরও বেশি পরিমাণ শহরেই উৎপাদিত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও এই প্রবণতা বেশ বলার মতো ছড়িয়ে পড়ছে। বৃহৎ শিল্পোদ্যোগ ভিত্তিক বিকাশ পরিকল্পনার সার্বিক ব্যর্থতার মূর্ত উদাহরণ হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে যে ডেট্রয়েট শহর, সেখানে ৯০০-রও বেশি গোষ্ঠী-অধিকারভুক্ত যৌথ বাগান গজিয়ে উঠেছে, যার অধিকাংশই খাদ্য উৎপাদনের উপর জোর দিচ্ছে। মেহিকোতে আবার এই ধরনের উদ্যোগ-চর্চা বহু পুরোনো পরম্পরাকে আবার সজীব করে তুলছে। মেহিকো সিটি শহর ও অন্যান্য বড় আঞ্চলিক রাজধানী শহরে তা ধীরে হলেও টেকসইভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। আর ওয়াহাকা শহরের ‘খাদ্য স্বনির্ভরতার জন্য স্বশাসিত সম্পর্কজাল’ (Autonomous Network for Food Sovereignty)-এর মতো উদ্যোগের মধ্য দিয়ে তো তার বিস্তার বিশেষ দ্রুতি ও ক্ষিপ্রতা অর্জন করেছে।

গ্রামাঞ্চলে জমির জন্য লড়াই আরো বিস্তৃত ও গভীর হচ্ছে। কখনও কখনও তা তুলনায় নীরব, কমবেশি গোপন পুনর্দখলের এমন রূপ ধারণ করছে যার উদাহরণ আমরা পাব পেরুতে। পেরুতে এই রূপের মধ্য দিয়ে প্রায় দশ লাখ হেক্টর জমি পুনর্দখল করে সেসব জমিতে পরম্পরাগত উপায়ে চাষ করে দেশের খাদ্যের চল্লিশ শতাংশ উৎপাদন করা গেছে। আবার অন্যান্য ক্ষেত্রে এই জমির লড়াই নজরকাড়া চোখ-ধাঁধানো সংগ্রামের চেহারা ধারণ করছে, যার উদাহরণ বর্তমান লাতিন আমেরিকায় সবচেয়ে আগ্রহোদ্দীপক সামাজিক আন্দোলনগুলোর মধ্যে একটি ব্রাজিলের ভূমিহীন কৃষকদের সংগ্রাম।

সাম্প্রতিক কালে এসে জমির জন্য লড়াইয়ের এই বহু পুরোনো সংগ্রামটির চরিত্রে একটি রাজনৈতিক পরিবর্তন সূচিত হয়েছে: তা সর্বসাধারণের সার্বভৌমত্বের একটি চর্চা হয়ে উঠে অঞ্চলগতভাবে প্রতিরক্ষা ও স্বশাসনের ব্যবস্থাপনার উপর নিজেকে কেন্দ্রীভূত করেছে। খাদ্য উৎপাদন বা অন্য নানা উদ্দেশ্য--- তা খনিজ-উত্তোলন থেকে অ্যাডভেনচার বা ইকোলজিকাল ট্যুরিজম অবধি নানা কিছু হতে পারে--- দেখিয়ে সরকার-সমর্থিত বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোর জমির উপর দখল নেওয়ার আগ্রাসী প্রচেষ্টাকে বিরুদ্ধে প্রতিরোধ এই লড়াই। যেমন ধরা যাক, মেহিকোর সরকার ইতিমধ্যেই দেশের জমির বড় অংশ জাতীয় ও বহুজাতিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের হাতে পঞ্চাশ বছরের ইজারায় তুলে দিয়েছে খনিজ উত্তোলনের জন্য। এই ইজারা দেওয়ার মধ্য দিয়ে সরকার এই জমিগুলো থেকে সবাইকে হটিয়ে খালি করে দেওয়ার দায়িত্বও নিয়েছে। নয়া আন্তর্জাতিক বাণিজ্যচুক্তির শর্ত অনুযায়ী, ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণের মামলা করতে পারে যদি সরকার স্থিরীকৃত বোঝাপড়া মতো এই খালি করে দেওয়ার কাজ না করতে পারে, এই ক্ষতিপূরণ আদায় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোর সামনে ব্যবসার একটা নতুন পথও খুলে দিয়েছে।

জাপাতিস্তাদের ক্ষেত্রে অঞ্চলের প্রতিরক্ষা নিত্য একটি কর্তব্য। রাষ্ট্রীয় প্যারা-মিলিটারি বাহিনীর লাগাতার আক্রমণের মুখে দাঁড়িয়ে তারা দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছিল: ‘ওরা আবার আমাদের কাছ থেকে সব ছিনিয়ে নেবে, তা আমরা আর হতে দেব না। আমরা প্রতিরক্ষা গড়ে তুলব যাতে আমাদের সন্তানসন্ততিদের মাথার উপর আর কোনো প্রভু না থাকে, অপমান ও ঘৃণা তাদের সইতে না হয়’ (মুনোজ রামিরেজ, ২০০৭)। ২০০৭ সালের ২৫শে মার্চ জাপাতিস্তারা ‘চিয়াপাস, মেহিকো ও গোটা বিশ্বের আদিবাসী, কৃষক এবং স্বশাসিত জমি ও অঞ্চলের প্রতিরক্ষার জন্য বিশ্বজোড়া অভিযান’ ঘোষণা করেছিল। এই নতুন উদ্যোগের সূচনায় তাদের সঙ্গী হয়েছিল ব্রাজিলের ভূমিহীনদের আন্দোলনের নেতা জোয়াও পেদ্রো স্তেদিল এবং ভায়া ক্যাম্পেসিনা-র কৃষি-সংস্কারের জন্য অভিযানের নেতা রাফায়েল আলেগ্রিয়া। এই উপলক্ষ্যে সাঁ ক্রিস্তোবাল ডি লা কাসাস-য়ে আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে সাবকমান্ডান্ট মার্কোস বলেছিলেন: ‘আমাদের অধিকারগুলোকে এবং জীবন ও মর্যাদার অধিকারের জন্য আমাদের সংগ্রামগুলোকে সমর্থন করেন যে গ্রামীণ সাধারণজন সহ অন্য নানা মানুষজন, তাদের আমরা পারস্পরিক সমর্থনের এই বিশ্বজোড়া অভিযানে সক্রিয়ভাবে একে অপরের পাশে দাঁড়ানোর জন্য আহ্বান করছি’ (ই জেড এল এন, ২০০৭)। এই বিশ্বজোড়া অভিযানের প্রথম পদক্ষেপগুলোর একটি ছিল চিয়াপাস-এর স্বশাসিত জনসমাজগুলোয় জমির উপর অধিকারের প্রত্যাভূতি দাবি করে একটি দলিল তৈরি করা যাতে বাইশটি বিভিন্ন দেশ থেকে ২০২-টি সংগঠন এবং চল্লিশটি জাতির ১,১০৪ জন মানুষ সই করেছিলেন। চিয়াপাস-এর জনজাতিগুলোর মাথার উপর অচিরেই ৫,০০০ হেক্টরেরও বেশি জমির উপর দখল হারানোর সম্ভাবনার খাঁড়া ঝুলছিল। তাদের জমির অধিকার বজায় রাখার দাবির সমর্থনে ভায়া ক্যাম্পেসিনা এবং ‘Continental Network for the Demilitarization of the Americas’ নামক সংগঠন ছাড়াও বহু দেশের শ্রমিকদের সংগঠন, কৃষকদের সংগঠন, আদিবাসী জনজাতিদের সংগঠন, মানবাধিকার সংগঠন, গবেষণা কেন্দ্র, পরিবেশবাদী এবং ধার্মিক গোষ্ঠীরা দাঁড়িয়েছিল।

কুইতো-য় গৃহীত স্লোগান ‘কৃষি সংস্কারের জন্য, জমি ও অঞ্চলের প্রতিরক্ষার জন্য’-এর সঙ্গে সঙ্গে এই সমস্ত মনোভাব ও উদ্যোগগুলোও একটি ক্রমশ বেশি বেশি করে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠা ধারণাবদলকে প্রকাশ করছে। জমির উপর দখলের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ জমির সঙ্গে একটি বিশেষ ধরনের সম্পর্কে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করছে যা গত পঞ্চাশ বছর ধরে সরকারি ও বেসরকারি ‘ডেভেলপার’-দের আরোপিত রীতির থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। তা সরকারগুলোর ক্ষমতা ও আরোপণের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো সমষ্টিগত অভিপ্রায়ের সার্বভৌম চর্চা হিসেবে সংহত হয়ে কার্যত প্রাতিষ্ঠানিক কিছু বিন্যাসের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে: ক্রমবর্ধমান সংখ্যায় সাধারণজন, বিশেষ করে কৃষকরা ইতিমধে্যই তাদের অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নিয়ে নিজেদের মতো করে নিজেদের স্বশাসন করছে (গুস্তাভো এস্তেভা, ১৯৯৮ক)।

একশটিরও বেশি দেশের কয়েক কোটি কৃষকদের নিয়ে গঠিত এতাবৎ বিশ্বের সবচেয়ে বড় কৃষক সংগঠন ভিয়া ক্যাম্পেসিনা যেভাবে খাদ্য সার্বভৌমত্বের ধারণাকে সংজ্ঞায়িত করেছে, সেই চালচিত্রের মধ্যেও এই সমস্তকে রূপ দেওয়া সম্ভব। খুবই সরলভাবে তা ব্যক্ত করা যায়: ‘কী আমরা খাব তা নিজেরাই নির্ধারণ করা… এবং নিজেদের নির্ধারণ করা শর্তে নিজেরাই তা উৎপাদন করা’ (দ্রষ্টব্য: নিয়েলেনি-র ঘোষণা, ভিয়া ক্যাম্পেসিনা, ২০০৭)।

যদি আমরা পৃথিবীর বর্তমান অবস্থার কথা ধরি, আর এই তথ্যটিকেও মাথায় রাখি যে পৃথিবীর সব মানুষদের একটা অত্যন্ত বড় অংশ পুঁজি ও তার উৎপাদনী শাসনের দ্বারা আরোপিত খাদ্যাভ্যাস ও খাদ্যচর্চার কাছে আত্মসমর্পণ করে বসে আছে, তাহলে দেখব যে খাদ্যে স্বনির্ভরতার জন্য অনুসন্ধানকে মৌলিকভাবে পাল্টে দেওয়া খাদ্য সার্বভৌমত্বের এই ধারণাটির মতো জটিল ও আমূল-পরিবর্তনকামী প্রস্তাব খুব কমই হতে পারে।

শেখা

শিক্ষাব্যবস্থা সংকটগ্রস্ত: তা মানুষকে জীবন বা কাজের জন্য তৈরি করে দেয় না এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশকে প্রান্তে ঠেলে দেয়। স্কুল ব্যবস্থার প্রধান উৎপন্ন হল স্কুলছুটদের দল: এই বছরে যারা স্কুলে ঢুকছে তাদের ষাট শতাংশই সেই স্তর অবধি পৌঁছতে পারবে না যা তাদের দেশে বাধ্যতামূলক হিসেবে ধরা হয়, তা তাদের চিরস্থায়ী বৈষম্যের বলি করে রাখবে, আধুনিক সমাজে চলনসই হওয়ার জন্য দরকারী নয়া কিসিমের ছাড়পত্র তাদের নাগালের বাইরে থাকবে। অন্যদিকে, শিক্ষা নামক এই নয়া পণ্যটির উপভোক্তা হতে যারা শিখেছে এবং কুড়ি থেকে তিরিশ বছর ধরে ঘন্টার পর ঘন্টা গর্দভের বোঝা বয়ে পাকাপোক্ত সব ডিপ্লোমা জমিয়ে তুলেছে, তারাও চাকরি খুঁজে পায় না: মেহিকোর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরোনো স্নাতকদের প্রতি দশজনের মধ্যে নয়জনই তাদের অধ্যয়ন করা বিষয়ক্ষেত্রে কখনো কাজ করতে পারবে না। শিক্ষাব্যবস্থার সংকট ইতিমধ্যেই সব দেশে স্বীকৃত, আর ১৯৯০-এর দশক থেকেই তা হাল আমলের আর্থিক সংকটের সম পরিমাণ দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়ে উঠেছে।

স্কুল ব্যবস্থার এই অতি সুস্পষ্ট ও সুপ্রমাণিত ব্যর্থতা ও অনিষ্টকর চরিত্র সত্ত্বেও ‘শিক্ষা অর্জন’ করার জন্য এখনও ব্যাপক কাড়াকাড়ি-লড়াই চলে আসছে। এই পণ্যটির উৎপাদন ও বন্টন যেহেতু শুরু থেকেই বিকাশ-পর্বের নীতিমণ্ডলীর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, তাই ইউনেস্কো (UNESCO)-র বিশেষজ্ঞদের ১৯৫৩ সালের একটি বৈঠক থেকেই লাতিন আমেরিকায় এর ‘ঘাটতি’ চিহ্নিত করার চেষ্টা হয়েছিল। তারা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিল যে এই অঞ্চলে শিক্ষা নিয়ে প্রধান সমস্যা হল সন্তানদের স্কুলে পাঠানোর ব্যাপারে এখানকার বাবা-মায়েদের চরম উদাসীনতা, এমনকি প্রতিরোধমূলক মানসিকতা। এগারো বছর পরে, এই একই বিশেষজ্ঞরা তাদের সিদ্ধান্ত বদলে ফেলল: তারা সিদ্ধান্তে এল যে এই অঞ্চলের কোনো দেশই শিক্ষার জন্য চাহিদাকে পূরণ করতে সক্ষম নয়। সন্তানদের স্কুলে পাঠানোর জন্য অভিভাবকদের উদগ্রীব করে তোলার উদ্দেশ্যে চালানো প্রচার-কার্যক্রম তখন সফল হয়েছিল এবং আজও তা সম-পরিমাণে সফল, কিন্তু তা থেকে উদ্ভূত চাহিদা মেটানোর কোনো সম্ভাবনাই বাস্তবত নেই, যতই বিশ্বব্যাঙ্ক ও প্রতিটি সরকার তাদের প্রধান প্রস্তাব হিসেবে ‘সকলের জন্য শিক্ষা’-কে সামনে তুলে ধরুক।

মানুষ প্রতিক্রিয়া দেখাতে শুরু করেছে। ছাত্র, অভিভাবক এবং শিক্ষকরা এখনও শিক্ষাব্যবস্থাটার ভিতর থেকেই তার সংস্কার করার, তত্ত্ব ও চর্চা পাল্টানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। তারা তর্ক-বিতর্ক করে চলেছে এই শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে শিকড় গাড়া ইউনিয়নগুলোর সঙ্গে, রাষ্ট্রের সঙ্গে এবং বাণিজ্য-প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে--- যারা প্রত্যেকেই আগ্রাসীভাবে নিজ নিজ স্বার্থ চরিতার্থ করার মতো করে শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজিয়ে নিতে চাইছে।

একইরকমভাবে, রাষ্ট্র এবং বাজারের ভিতরে ও বাইরে বিভিন্ন গোষ্ঠী আধিপত্যকারী রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও শিক্ষা ব্যবস্থার সমালোচনার উপর ভিত্তি করে ‘বিকল্প শিক্ষা’ চালু করার চেষ্টা করছে। শিক্ষণপদ্ধতিতে তারা আগ্রহোদ্দীপক নতুনত্ব নিয়ে আসছে, পাওলো ফ্রেইরে-র বিভিন্ন প্রস্তাবের সমধর্মী নানা উদ্ভাবন করছে। কিন্তু, শিক্ষা যে নিয়ন্ত্রণ কায়েম করার প্রভুত্ববাদী চর্চার একটি রূপ, সেই সমালোচনা তারা করছে না। বা যা আরো গুরুত্বপূর্ণ, তারা তাদের সমালোচনাটাকে এই সমাজের সমালোচনা অবধি বিস্তৃত করে না, যে সমাজের নিজেকে পুনরুৎপাদিত করার জন্য এহেন শিক্ষাব্যবস্থা প্রয়োজন--- এমনই এক পুঁজিবাদী সমাজ যেখানে শিক্ষাগত পণ্যের উৎপাদন, বন্টন ও উপভোগ ইতিমধ্যেই অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হয়ে উঠে গোটা পৃথিবী জুড়ে প্রতিটি দেশে জনসমষ্টির সবচেয়ে বড় অংশকে জড়িয়ে নিয়েছে।

জোরালো একটি আন্দোলন এখন অন্যতর একটি অভিমুখ নিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে। স্বনির্ভর ও মুক্ত শেখার প্রক্রিয়া ক্রমশ আরো বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠছে এবং আন্দোলনের রূপ ধারণ করে বর্তমান ব্যবস্থার বাইরে, বিরুদ্ধে ও ছাপিয়ে গিয়ে নিজস্ব প্রাতিষ্ঠানিক বিন্যাস তৈরি করে নিচ্ছে। নিজস্ব তাত্ত্বিক গঠনের উপর ভিত্তি করা এই চর্চাগুলোকে আধিপত্য বিস্তার করে থাকা ধারণাকাঠামোগুলোর ভিতরে রেখে বোঝা সম্ভব নয়। প্রাচীন শেখার পরম্পরাকে পুনরুদ্ধার করে এনে তারা এমনসব সমসাময়িক প্রযুক্তির প্রবর্তন তার মধ্যে ঘটাচ্ছে যা শেখা ও অধ্যয়ন করাকে আনন্দময় মুক্ত ক্রিয়া হতে বাধা দেয় না।

এ এক অদ্ভূত আন্দোলন। যে সংখ্যক মানুষ এতে জড়িয়ে আছেন, তার বিচারে এ বোধহয় পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আন্দোলন। বহু কোটি মানুষ এখন এতে সামিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও তা চোখে পড়ে না এবং এতে অংশগ্রহণকারী অনেকেই তাদের মতো আরো অন্যদের সাক্ষাৎ পাওয়ার, আনুভূমিক সম্পর্ক স্থাপন করার ও অভিজ্ঞতা আদানপ্রদান করার ব্যাপারে উৎসাহী হলেও প্রচলিত অর্থে কোনো রাজনৈতিক বা সামাজিক আন্দোলনের শরিক বলে নিজেদের মনে করে না। তারা যা করছে তার মানে কী, সে বিষয়ে সাধারণভাবে তারা সম্পূর্ণ সচেতন: শিক্ষার সব রকম রূপ থেকে আমূল বিযুক্তি ঘটিয়ে মুক্তভাবে শেখা ও অধ্যয়ন করার ক্রিয়াকে তারা পূর্ণতায় গ্রহণ করেছে।

গুণ ও পরিমাণ বিষয়ক কোনো নিখুঁত মাপ এই আন্দোলনে সম্ভব নয়। এর ধারণ করা অনেক রূপের মধ্যে একটি হল মুক্ত স্কুল (free school)। গুগল-এ সার্চ দিলে পঞ্চাশ কোটিরও বেশি উল্লেখ উঠে আসে, যার বেশিরভাগই এই পৃথিবীর কোথাও না কোথাও চলমান কোনো উদ্যোগের কথা বলে। একই রকম অভিজ্ঞতা হবে ‘শেখার সমাজ’ (‘learning communities’) বা সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতায় উঠে আসা এমনই কোনো শব্দবন্ধ লিখে সার্চ দিলে।

সুস্থ হওয়া

স্বাস্থ্যপরিষেবা ব্যবস্থাটি ক্রমবর্ধমান হারে অদক্ষ, বৈষম্যমূলক ও অ-ফলদায়ক হয়ে উঠছে। ওষুধ ও চিকিৎসা পদ্ধতির প্রভাবেই আরো অসুস্থ হয়ে ওঠার ঘটনাগুলো এখন চিহ্নিত হতে শুরু করেছে: চিকিৎসক ও হাসপাতালগুলো এখন যত না রোগ সারাচ্ছে, তার থেকে বেশি রোগ তৈরি করছে। চল্লিশ বছর আগে ইভান ইলিচ যখন তাঁর ‘Medical Nemesis’ বইটা প্রকাশ করেছিলেন, তখন যা বিস্মিত ক্রোধে অপবাদ বলে গণ্য হয়েছিল, এখন তা সবার জানা একটা বিষয় হয়ে উঠেছে। স্বাস্থ্য উৎপাদন, বন্টন ও ভোগ এখন গোটা পৃথিবীর অর্থনীতির দ্বিতীয় বৃহত্তম ক্ষেত্র, আর  প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত মানুষের সংখ্যার নিরিখে ধরলে তা বৃহত্তম। চিকিৎসা পেশা এবং স্বাস্থ্যশিল্প এখন সমস্ত প্রাতিষ্ঠানিক কলেরই দখল নিয়ে বসেছে: তারা নিয়ম তৈরি করে, তারাই তা লাগু করে, আবার কেউ সেই নিয়ম ভাঙলে তারাই তার শাস্তির ব্যবস্থা করে। এই পেশাদারী একনায়কত্বের প্রতিটি ব্যর্থতা সেই একনায়কত্বকেই আরো শক্তিশালী ও বিস্তৃত করার সুযোগ করে দেয়। আর ব্যর্থতাগুলো ক্রমেই সংখ্যায় বাড়ছে।

শিক্ষার মতো এই ক্ষেত্রেও স্বাস্থ্যব্যবস্থার সংস্কারসাধনের জন্য অগুন্তি প্রয়াস দেখা যায়। অনুরূপভাবেই, এখানেও এমন বহু বিকল্প চিকিৎসাপদ্ধতি ছড়িয়ে পড়েছে যা আধিপত্যকারী ব্যবস্থাটির সবচেয়ে ক্ষতিকর প্রভাব ও অযোগ্যতাগুলোকে এড়িয়ে যেতে চায়। তবে ক্রমবর্ধমান হারে এমন সব প্রয়াসও জন্ম নিচ্ছে যা খোদ ব্যবস্থাটিকেই প্রশ্ন করছে, রোগ ও স্বাস্থ্য সম্পর্কে আধিপত্যকারী ধারণাগুলোর থেকে নিজেদের বিযুক্ত করছে, এমনকি দেহ ও মন সংক্রান্ত আধিপত্যকারী ধারণাকেও অস্বীকার করছে, আর, চেষ্টা করছে সুস্থ হয়ে ওঠার স্বনির্ভর পন্থা বিকশিত করতে, স্বাস্থ‍্যশিল্পের পেশাজীবীদের দ্বারা নাকচ হয়ে প্রান্তীয় হয়ে বসা  চিকিৎসা পরম্পরাগুলোকে পুনরুদ্ধার করতে--- তার মধ্য দিয়ে নিজ বাসা ও জনসমাজের মধ্যে শিকড় চারানো স্বাস্থ্যকর আচরণ ও আরো মানবিক চিকিৎসাপদ্ধতিকে রূপ দিতে চাইছে। তাদের নতুন প্রাতিষ্ঠানিক বিন্যাসগুলোও আদল পেতে শুরু করেছে।

অন্যান্য ক্ষেত্র

বাস করা

সরকারি ও বেসরকারি বিকাশ-পরিকল্পনাগুলোর হাত ধরে আসা যে দুর্গতিগুলো বাসাহীনতার দুর্ভোগ দ্রুত বৃদ্ধি করে, সেগুলো এখনো বিস্তারলাভ করে চলেছে। একইসঙ্গে, দীর্ঘদিন ধরে শহুরে বস্তি অঞ্চলের বৈশিষ্ট্যসূচক যে স্বনির্ভর বাসা-গঠন রীতি, তা-ও সমসাময়িক নানা প্রযুক্তি দ্বারা সমৃদ্ধ হয়ে সুসংহত ও জোরদার হয়ে উঠছে। কয়েক ডজন ‘স্থানান্তরিত নগর’ (‘transition towns’) নাগরিক জীবনে আমূল রূপান্তর ঘটানোর উপক্রম করেছে। জবরদখলকারীদের আন্দোলন, বস্তি (barrios)-গুলোয় পুনর্জন্ম দেওয়ার প্রয়াস, নয়া সর্বসাধারণতন্ত্র (commons) নির্মাণ ছড়িয়ে পড়ছে সর্বত্র। সংঘর্ষ-সংঘাত বৃদ্ধি পাচ্ছে যা গ্রামীণ এলাকায় জন্ম নেওয়া পূর্বোল্লিখিত রাজনৈতিক পরিব্যক্তিগুলোকে শহরে নিয়ে এসে সরকারি-বেসরকারি উন্নয়নপ্রকল্প, নতুন রাজপথ ও বিমানবন্দর নির্মাণের বিরুদ্ধে আঞ্চলিক প্রতিরক্ষা-জোটের জন্ম দিচ্ছে। এগুলোর মধ্যে স্বশাসনের বীজ হয়ে ওঠার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে (এ বিষয়ে দ্রষ্টব্য: হপকিন্স ২০০৮, হার্ন ২০১০)। এই আন্দোলনের একটা অংশ পায়ে হেঁটে বা সাইকেলে স্বনির্ভর যাতায়াতব্যবস্থাকে ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করছে এবং সেই সূত্রেই মোটর গাড়ির আধিপত্যের বিরুদ্ধে সক্রিয় প্রতিরোধ গড়ে তুলছে।

বিনিময় করা

গোটা বিশ্বকে ওয়ালমার্ট-সুলভ করে তোলার প্রক্রিয়া এখনও বহাল, গুটিকয় কোম্পানি তাদের লুন্ঠনকারী শক্তিকে আরো বাড়িয়ে নিয়ে গিয়ে সমস্ত ধরনের ক্ষতি করে যাওয়ার প্রক্রিয়াও বজায় রেখেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও, পুঁজিবাদী বাজারের বাইরে সরাসরি বিনিয়োগের একটি নতুন যুগের উন্মেষ ঘটতে শুরু করেছে। বিনিময়ের এমন সব পরিসর ছড়িয়ে পড়ছে যেখানে উৎপাদক ও উপভোক্তারা বিমূর্তায়িত শরতাবলী ত্যাগ করে সরাসরি নিজেদের মধ্যে সম্পর্কস্থাপন করছে। তাছাড়াও, আঞ্চলিকভাবে পরিশোধের উপায় ও সামাজিক বন্ধনী হিসেবে কাজ করছে এমন আঞ্চলিক মুদ্রার ব্যবহারও বাড়ছে।

অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান (Saber) এবং প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান (Conocer)

সরকারি বা বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং প্রচলিত বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠানগুলোর বাইরে জ্ঞান উৎপাদনের নতুন নতুন কেন্দ্র সৃষ্টি করা হচ্ছে। জগৎ সম্পর্কে ধারণাকে নতুনভাবে সূত্রায়িত করা ও জগতের সঙ্গে মিথষ্ক্রিয়ার নতুন প্রক্রিয়াদি হাজির করার মধ্য দিয়ে আধিপত্যকারী চিন্তাকাঠামোগুলোকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দেয় এমনই সব তাৎপর্যময় তাত্ত্বিক প্রবর্তনের উপর ভিত্তি করা নতুন নতুন প্রযুক্তি সেইসব কেন্দ্রে উদ্ভাবিত হচ্ছে। মিশেল ফুকো-র প্রস্তাবের অনুরূপ পথেই, অধীনস্থ ও অবদমিত করে রাখা অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানগুলোর বিদ্রোহ আরো গভীর ও জোরদার হয়ে উঠছে: প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাবদ্ধকরণ ও কার্যকরী সংবদ্ধতার তলায় চাপা দিয়ে রাখা বা আড়াল করে রাখা ঐতিহাসিক বিষয়বস্তুগুলো পুনরুদ্ধার হচ্ছে; যেসব নির্দিষ্ট, সীমায়িত, আঞ্চলিক ও বিভেদীকৃত অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানগুলোকে অযোগ্য, যথেষ্ট বিশদ নয়, কাঁচা বা বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের তুলনায় নিকৃষ্ট বলে বাতিল করে দেওয়া হয়েছিল, নতুন করে আবার সেগুলোর মূল্যায়ন হচ্ছে। আঞ্চলিক স্মৃতিকে পাণ্ডিত্যপূর্ণ জ্ঞানের পাশাপাশি রেখে ও তার সঙ্গে মিশিয়ে এমন যুযুধান ইতিহাসগত জ্ঞান নির্মিত হচ্ছে যা বিশ্বজনীনতার দাবি নিয়ে হাজির হওয়া প্রতর্কগুলোর স্বেচ্ছাচারতন্ত্রকে ধ্বংস করতে চাইছে, কারণ এই বিশ্বজনীনতা দাবি করা প্রতর্কগুলো বৈজ্ঞানিক শ্রেণিবদ্ধকরণের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এমন এক উচ্চাবচ ধাপবন্দি কাঠামো তৈরি করে যা সহজাতভাবেই কোনো কোনো অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানকে বিশেষ প্রাধিকারের আসনে বসিয়ে ক্ষমতাচর্চার পথ সুগম করে।

প্রাত্যহিক জীবনের প্রতিটি বলয়েই নতুন মনোভঙ্গি নিজস্ব প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক মৃত্তিকায় শিকড় চারিয়ে আধিপত্যকারী মতবাদ ও প্রচলিত ছাঁচের বাইরে বেরিয়ে নতুন রাজনৈতিক দিগন্তের আলোবাতাসে প্রাণিত ও জাহির হচ্ছে। সংকটকালীন পরিস্থিতিতে এই ধরনের প্রয়াসগুলো আরো বেশি দৃষ্টি আকর্ষণ করছে যেহেতু সেগুলো টিকে থাকার সৃজনশীল পন্থা উপস্থিত করার পাশাপাশি আধিপত্যবাদী নীতিসমূহ ও প্রকল্পসমূহকেও কার্যকরীভাবে প্রতিহত করছে।

এ কথা সত্য যে বহুজনই মাথায়-চড়ে-থাকা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ বিসর্জন না দিয়েই এইসব প্রয়াসে সামিল হচ্ছে। কেবলমাত্র নিজেদের সন্তুষ্টির জন্যই তারা এই সব মনোভঙ্গি অবলম্বন করছে, সেগুলোর সামাজিক ও রাজনৈতিক তাৎপর্যকে দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করছে। কিন্তু তার সঙ্গে এ-ও সমানভাবে সত্য যে তারাও আবার ছড়ি-ঘোরানো অতি-ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের ফল ভুগে তার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া দেখাতে শুরু করেছে এবং নিজ সমাজ-পরিস্থিতিতে নিজেদের নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করার প্রচেষ্টায় অপরদের জন্য উন্মুক্ত হতে শুরু করেছে।

কী ঘটে চলেছে তার এইরূপ বর্ণনা স্বাভাবিকভাবেই কিছু প্রশ্নের জন্ম দেয়, যেমন: এই অভ্যুত্থানের চরিত্র ও সম্ভাবনার দিকটা কী? এর প্রকৃতিই বা কী? সত্যিই কি এই অভ্যুত্থান পুঁজিবাদ-বিরোধী, নাকি তা পুঁজিবাদের আধিপত্যাধীনেই কার্যকরী কোনো ব্যবস্থা তৈরি করে যন্ত্রণাকেই আরো দীর্ঘায়িত করবে? আর যে সমস্ত আচরণকে প্রথম দৃষ্টিতে নেহাতই টিকে থাকার জন্য কিছু নিবর্তমূলক ক্রিয়া, কখনো বা মরীয়া প্রচেষ্টা বলে মনে হয়, যার কোনো সুস্পষ্ট গ্রন্থনা নেই, সেগুলোকে অভ্যুত্থান বলারই বা মানে কী? তাড়াহুড়োর মধ্যে পরীক্ষামূলক একটি প্রচেষ্টা হলেও, এই প্রবন্ধ এহেন প্রশ্নগুলোর উত্তর দেওয়ারই একটি প্রচেষ্টা।

উন্নয়ন-বিকাশ পেরিয়ে: বুয়েন ভিভির

লাতিন আমেরিকা জুড়ে ছড়িয়ে পড়তে থাকা সামাজিক আন্দোলনগুলোর নিহিতার্থ ধরতে পারে এমন কোনো শব্দ যদি থেকে থাকে, তাহলে তা হল ‘বুয়েন ভিভির’, ভালো ভাবে বাঁচা, যার সঙ্গে দোসর হিসেবে জুড়ে থাকে ‘মুতুয়া ক্রিয়ানজা’ (পারস্পরিক পরিপোষণ) (আপফেল-মার্গলিন ১৯৯৮, আমেরিকা প্রোফান্ডা ২০০৪, চুজি ২০০৯)। এই ঝোঁক যে কোনো ধরনের মতবাদ অবলম্বী সরকারের সঙ্গেই সমস্ত ধরনের টানাপোড়েন ও দ্বন্দ্ব তৈরি করতে থাকে এবং সরকারগুলোও এর কারণেই আন্দোলনগুলোকে বেআইনি ও দুর্বৃত্তি বলে চিহ্নিত করে দমন করতে চায়।

ভালো ভাবে বাঁচা বলতে কী, কল্পনা ও স্বতক্রিয়ার সেই বলয় পরম্পরাগতভাবে জনসমাজের এক্তিয়ারভুক্ত ছিল। কিন্তু আধুনিক জাতি-রাষ্ট্রে তা প্রথমে সরকারের এক্তিয়ারভুক্ত করা হল, এবং তারপর সরকার সেই এক্তিয়ার সঁপে দিল পুঁজি, বেসরকারি বাণিজ্যসংস্থা ও প্রচারমাধ্যমের হাতে।

গত পঞ্চাশ বছর ধরে যতসব বিকাশ-উন্নয়নের প্রকল্প তা ভালো ভাবে বাঁচার এমন এক সর্বজনীন সংজ্ঞার উপর ভর করেছে যা উন্নত দেশগুলোর বাসিন্দাদের, বিশেষ করে মার্কিনীদের, গড় জীবনযাত্রাকেই মাপকাঠি বলে ধরে নিয়েছে। এমনই সর্বজনীন আদর্শ হিসেবে তা হাজির হয়েছে যে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে মার্কিনীদের সবচেয়ে তিক্ত শত্রুরাও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে তা গ্রহণ করে নিয়েছে। ট্রুমান যেসব দেশকে ‘ঊনবিকশিত (underdeveloped)’ অঞ্চল বলে দেগেছিলেন, সেই সব দেশের সব অধিবাসীদের ওই হেন মার্কিনী জীবনযাত্রা রপ্ত করা যে পৃথিবীর বাস্তুতন্ত্রকে ধ্বংস করতে না চাইলে নেহাতই অবিবেচক মূর্খের কাজ হবে, এবং বাস্তবতও তা সম্ভব নয়, তা অচিরেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। ১৯৭০-এর পর থেকে অবশ্য ওই উন্নয়ন-বিকাশ-প্রগতির প্রস্তাবকে বাস্তবোচিত করার নামে ধাপে ধাপে নামিয়ে এনে মার্কিনী জীবনযাত্রায় পৌঁছে দেওয়ার বদলে সর্বজনের কিছু ন্যূনতম প্রাথমিক প্রয়োজন মেটানোর নিশ্চয়তাদানে পর্যবসিত করা হয়েছে। সামাজিক লক্ষ্য নির্মাণে, বা, এমনকি, ওইসব ন্যূনতম প্রাথমিক প্রয়োজন সংজ্ঞায়িত করার কাজেও অবশ্য ভালো ভাবে বাঁচার সর্বজনীন সংজ্ঞাকে এখনও বিসর্জন দেওয়া হয়নি। এই সর্বজনীন সংজ্ঞা এখনো সর্বত্র সরকারি নীতি প্রণয়নের নিয়ামক হিসেবে কাজ করে, যতোই সেসব সরকারের মধ্যে মতবাদিক পার্থক্যের কারণে খোলা-বাজার-নিয়ন্ত্রণ ও রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে পরিকল্পনা নিয়ে বিবাদ-বিতর্ক থাকুক না কেন।

এইসব মনোভাবগুলো আসলে বহু বিবিধ ব্যানার ও ছুতোনাতা-ছলের আড়ালে আগমার্কা পশ্চিমী ধারার ধরতাইয়ের অনুসারী যা পৃথিবীজুড়ে ‘একটাই বিশ্ব’ গড়ে তুলতে চায় (উল্ফগ্যাঙ স্যাকস ১৯৯২)। বিকাশ-উন্নয়নের মধ্যে নিহিত উদ্দেশ্যটি হল এক নতুন উপায়ে গোটা পৃথিবীর পশ্চিমীকরণ করা, এটা ধরে নিয়ে যে প্রগতির একমুখী রথে সওয়ার হয়ে মানবসমাজ চূড়ান্ত যে শীর্ষবিন্দুটিতে পৌঁছতে পারে তার প্রকাশ পশ্চিমী উন্নত দেশগুলোর মধ্য দিয়েই হচ্ছে। অবশ্য বহু বছর হয়ে গেল এই প্রগতির রথটি ভেঙে পড়েছে: প্রগতির ধারণাটিই এখন জাদুঘরে সংগ্রহযোগ্য হয়ে উঠেছে (এসবার্ট ১৯৯২)। উন্নয়ন-বিকাশের সঙ্গে যুক্ত সাংস্কৃতিক সমসত্ত্বকরণের প্রকল্প আজ সর্বত্রই ক্রমবর্ধমান প্রতিরোধের মুখে পড়ছে। ১৯৯৪ সাল থেকে জাপাতিস্তারা যেমন বলে আসছে, এখন সময় হল এমন বিশ্ব সৃষ্টি করা যার মধ্যে বহু বিবিধ বিশ্বকে আলিঙ্গন করা যাবে। বহু বিবিধ মানবগোষ্ঠী ও তাদের বহু বিবিধ সংস্কৃতিকে ধুয়েমুছে ধ্বংস করে প্রতে্যককে একটাই সর্বজনীন ও সমসত্ত্ব নকশায় একীভূত করার গা-জোয়ারী ছেড়ে পার্থক্যসম্পন্ন বিবিধদের মধ্যে সুসঙ্গত সহযাপনের নানা রূপ অণ্বেষণ করা জরুরী হয়ে উঠেছে। ক্রমশ দানা বাঁধতে থাকা এই নতুন মনোভাব জাতি-রাষ্ট্রের গণ্ডীর বাইরে এক রাজনৈতিক দিগন্তের দিকে ইঙ্গিত করছে, গণতান্ত্রিক সংগ্রামের অর্থকে নতুন করে সূত্রায়িত করছে এবং ভালো ভাবে বাঁচার এমন নানা সংজ্ঞা উদ্ধার করে আনছে যা জ্ঞান উৎপাদনের স্বশাসিত কেন্দ্র থেকে উদ্গত।

এটা সত্য যে আধিপত্যকারী নীতি-নিয়মের খোলাখুলি বিরোধিতা করা বলিভিয়া, ইকুয়েদোর ও ভেনেজুয়েলার মতো দেশের সরকারগুলোও এখনও বিকাশ-উন্নয়ন-প্রগতির প্রচলিত ধর্মকথাকে আঁকড়ে ধরে আছে এবং তাকে প্রশ্ন করে তৃণমূল থেকে গড়ে উঠতে থাকা যে কোনো আন্দোলনকে বিধর্মীবিনাশের মতো করে ধ্বংস করতে নামছে। কিন্তু এর পাশাপাশি, প্রতিরোধও কিন্তু ক্রমশ বাড়ছে। আর তার ফলেই ক্রমদ্রুতিসম্পন্ন অর্থনৈতিক বৃদ্ধিকে লক্ষ্য হিসেবে বাঁধার যে ধারণাটি আধিপত্যকারী ধর্মবিশ্বাসের কেন্দ্রীয় ধারণা হিসেবে প্রশ্নাতীত হয়ে উঠেছিল, তাকেও প্রশ্ন করে জনসাধারণের মধ্যে বিতর্কের আঙিনায় নামিয়ে আনা যাচ্ছে। অর্থনীতিবিদদের এই অন্ধবিশ্বাসটি পঞ্চাশ বছরের প্রচার-অভিযানের মধ্য দিয়ে একটি সাধারণ পূর্বসংস্কারে পরিণত করা হয়েছিল। এখনও অনেকেই একে প্রশ্নাতীতভাবেই কাম্য বলে ধরে নেয়, কিন্তু ক্রমশ জোরালো হতে থাকা চিন্তা ও স্বতক্রিয়ার একটি প্রবাহ এই অতি অনিষ্টকর বদ্ধসংস্কারটিকে প্রশ্নের মুখে ফেলে পরিহার করার দাবি তুলেছে। গোটা পৃথিবী জুড়ে বাজার বা রাষ্ট্রের কাছে নিজেদের জীবনের উপর নিয়ন্ত্রণ সঁপে দেওয়া মানুষরা যেখানেই আজ আবার সেই নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে ফিরিয়ে আনতে শুরু করেছে, সেখানেই তারা ওই অনিষ্টকর বদ্ধসংস্কারটিকে ঝেড়ে ফেলতে চাইছে। মেহিকোতে তো ১৯৮০-র দশক থেকেই খোলাখুলি বলা হয়ে আসছে যে অর্থনৈতিক সঙ্কোচন, বা, অর্থনৈতিক বৃদ্ধির ঋণাত্মক হার যদি আর্থিক সংকটের অভাবিত ফলাফল বা প্রাধিকারীদের অযোগ্যতার মাশুল হিসেবে হাজির না হয়ে সচেতন উদ্যোগসমূহের ফল হিসেবে আসে, তবে তা স্বাধীনতা ও ন্যায়পরতার সঙ্গে ভালো ভাবে বাঁচার শর্ত হয়ে উঠতে পারে।

জনসংখ্যার সঙ্গে সঙ্গে অর্থনীতিও অনির্দিষ্টভাবে বাড়তে থাকে, এই ধারণাটা সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানের পর্যায়ে পর্যবসিত হয়েছে। কিন্তু মোটেই তা নয়। গাছপালা, পশু, মানুষের মতো বহু বস্তুকেই আকারে বেড়ে উঠতে হয়। কিন্তু যথোপযুক্ত আকারে পৌঁছানোর পরও যদি কোনো বস্তু বাড়তেই থাকে, তখন সেই অতিরিক্ত বৃদ্ধিকে আমরা ‘কর্কটরোগ’ বলে থাকি। দস্তুরমাফিক অর্থনীতির বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে যা আসলে বাড়তে থাকে তার একটা বড় অংশই হল সামাজিক কর্কটরোগ। যা আমাদের আরো বেশি পরিমাণে দরকার, সেই সামাজিক ন্যায়বিচার বা সংখ্যাগরিষ্ঠের কল্যাণ, তা কমতে থাকে আর তার পরিবর্তে বাড়তে থাকে ফাটকাবাজি, অসঙ্গত ও বিধ্বংসী উৎপাদন, দুর্নীতি এবং অপচয়।

প্রতিটি দেশেই এমন বেশ কিছু বস্তু আছে যা অতিরিক্ত বৃদ্ধি পেয়ে বসেছে, তাই তাদের ছাঁটকাট করা জরুরী, আবার যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়নি এমন কিছু বস্তুও আছে যেগুলোর বৃদ্ধি বহাল রাখা জনসাধারণের মঙ্গলের জন্য জরুরী। মোট জাতীয় উৎপাদ (Gross National Product)-এর অঙ্কে মাপা উচ্চহারের অর্থনৈতিক বৃদ্ধি সাধারণত সেইসব উপাদানেই গঠিত যা অতিরিক্ত বৃদ্ধির পর এখনও বাড়তে থাকার মধ্য দিয়ে সামাজিক কর্কটরোগ হয়ে উঠেছে এবং অবিলম্বে তাদের ছাঁটকাট করে কমানো দরকার।

অর্থনৈতিক বৃদ্ধি যা প্রতিশ্রুতি দেয়, তার বিপরীতটা ঘটায়। অধিক জনকল্যাণ, সংখ্যাগরিষ্ঠের জন্য কর্মসংস্থান, বা সম্পদ ব্যবহারে আরো বেশি বিচক্ষণতা--- এর কোনোটাই তা দেয় না। বরং তার বিপরীতে দুর্দশা, অদক্ষতা ও অবিচার বাড়িয়ে চলে। এ কথার সমর্থনে ভুরি ভুরি ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত বর্তমান। এখনো উচ্চ হারে অর্থনৈতিক বৃদ্ধিকে সামাজিক লক্ষ্য হিসেবে হাজির করা অবিমিশ্র মূর্খামি ছাড়া আর কিছুই নয়। কেউ তা করলে সে মূর্খের স্বর্গে বা বিকৃতির নরকে বা ওই দুইয়ের এক সম্মেলনে বাস করছে বলে বলতে হয়।

প্রায় চল্লিশ বছর আগে, পল স্ট্রিটেন আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠন (International Labour Organization)-এর পক্ষ থেকে একটি প্রতিবেদনে অর্থনৈতিক বৃদ্ধি এবং অবিচারের মধ্যে বর্তমান বিকৃত সম্পর্কটি বিশদ তথ্য-প্রমাণ সহযোগে হাজির করেছিলেন। তিনি দেখিয়েছিলেন আরো আরো বৃদ্ধি আরো আরো দুর্দশার সঙ্গেই সহাবস্থান করে এবং এই দুইয়ের মধ্যে কার্য-কারণ সম্পর্কও বর্তমান। তিনি এটাও দেখিয়েছিলেন যে বিখ্যাত ‘চুঁইয়ে পড়া’-র তত্ত্ব যা দাবি করে যে উপরমহলে সম্পদ আরো বেশি করে কেন্দ্রীভূত হলে তবেই তা চুঁইয়ে পড়ে নিম্নস্থ সংখ্যাগরিষ্ঠের কাছে পৌঁছতে থাকে ও শেষাবধি তাদের কল্যাণের ব্যবস্থা করে, সেই তত্ত্ব নেহাতই তথ্য-প্রমাণহীন এক বিকৃত ভ্রম ছাড়া কিছু নয়।

অর্থনৈতিক বৃদ্ধির উপর সামাজিক প্রচেষ্টা কেন্দ্রীভূত করা চোখ ফিরিয়ে রাখে প্রকৃতই তা কী করে চলেছে তার থেকে। প্রকৃত প্রস্তাবে তা অল্প কিছুজনের আরো বেশি প্রাচুর্যের জন্য সাধারণজনের আরো আরো দুর্গতি এবং প্রাকৃতিক জগতের আরো আরো ধ্বংস ডেকে আনে। এর পিছনে কোনো যুক্তিও নেই, কারণ অর্থনীতিবিদদের বদ্ধসংস্কার কেবলমাত্র পুঁজি সম্পর্কেই খাটে এমন এক অনমনীয় যুক্তিকাঠামোকে সমগ্র সমাজের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য বলে চাপিয়ে দেয়: পুঁজিকে অনির্দিষ্টভাবে বেড়ে যেতেই হবে কারণ যে পুঁজি বাড়ে না তার মৃত্যু হয়, কিন্তু সমাজের সবকিছু এমন নয়। তাই এই বদ্ধসংস্কারকে লালন করে যাওয়ার মানে বাজার ও রাষ্ট্রের নেতাদের হাতে অপরিমিত ক্ষমতা তুলে দেওয়া যাতে তারা চিরকাল অধরা থাকা সাধারণ জনকল্যাণের দোহাই দিয়ে নিজেদের খুশিমতো যা ইচ্ছে করে যেতে পারে।

জরুরী হয়ে উঠেছে আমাদের নিজেদের মাত্রাবোধ ফিরে পাওয়া। এই মাত্রাবোধ সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানেরই একটা রূপ, যা আমাদের জনসমাজের মধ্যেই আমরা পাই। অপচয়, ধ্বংস ও অবিচারের যে সমাজ গোটা প্রাকৃতিক জগতকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়ে দায়িত্বহীনতার অভিযোগে আজ কাঠগড়ায়, তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সাহস ও সুবুদ্ধি জড়ো করে আমরা সামাজিক উন্নয়নের মরীচিকার পিছনে ছুটে অপ্রয়োজনীয়কে প্রয়োজনীয় করে তোলা বন্ধ করতে পারি, অর্থনৈতিক বৃদ্ধিকে ঈশ্বররূপে পুজো করার সংস্কার চিরতরে ত্যাগ করতে পারি।

ঋণাত্মক বৃদ্ধির হার বা সংকোচনের হারের উপযোগিতা নিয়ে গুরুত্ব সহকারে ভেবে দেখার সময় এখন হয়েছে, সময় হয়েছে বিশদ করে নেওয়ার যে কোন কোন বৃদ্ধিকে এখনো আমরা উৎসাহিত করে যেতে চাই। যেমন ধরা যাক, উৎপাদনের যে ক্ষেত্রগুলো অত্যন্ত দক্ষ, ফলদায়ী এবং সুবুদ্ধিসম্পন্ন, যাদের বেশিরভাগটাই আজ ‘অসংগঠিত ক্ষেত্র’ (‘informal sector’) নামে চিহ্নিত হয়ে অবহেলিত হয়, সেইসব ক্ষেত্রগুলোর সঞ্জীবন ও বৃদ্ধি দরকারি হতে পারে। তার মানে দাঁড়াবে অদক্ষ দৈত্যাকার বাণিজ্য-প্রতিষ্ঠানগুলোকে মদত না যুগিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠের উৎপাদনী সক্ষমতার প্রসারণে মনোনিবেশ করা। মোট জাতীয় উৎপাদনের পতন--- তা অর্থনীতিবিদদের দুঃস্বপ্ন হতে পারে, কিন্তু তা বেশির ভাগ মানুষের জীবনে আশীর্বাদ হয়ে উঠতে পারে।

যে উন্মত্ততা বিরাজমান, তা এবার বন্ধ করা দরকার। কিছু বস্তুর বৃদ্ধি পেতে হবে এবং কিছুকে অবশ্যই সংকুচিত করতে হবে। আমাদের জীবনযাপন সংক্রান্ত সক্ষমতা আর আমাদের জীবনের স্বশাসন বৃদ্ধি পাক। যে যে পরিসরে আমরা আমাদের স্বাধীনতা ও স্বউদ্যোগকে চর্চা করতে পারি, সেই পরিসরগুলো প্রসারিত হোক। প্রতিটি মাননুষ এবং প্রতিটি সংস্কৃতি যেভাবে ভালো ভাবে বাঁচা বলতে কী তা নির্ধারণ করে, সেই ভাবেই ভালো ভাবে বাঁচার বহু বিবিধ সুযোগ ও উপায় বৃদ্ধি পাক। আর এই সমস্ত বৃদ্ধিকে সম্ভবপর করে তোলার জন্য আমাদের ঘাড়ের উপর চেপে থাকা প্রাতিষ্ঠানিক নিবন্ধীকৃত অর্থনীতির নিপীড়ক পাষাণভার কমিয়ে হালকা করা যাক, একইসঙ্গে যা যা সকলের ভালো ভাবে বাঁচার পরিপন্থী বা যা যা প্রকৃতিকে ধ্বংস করে চলেছে সেসব কমানো যাক।

ঘটমান অভ্যুত্থান এই চেষ্টাই করে চলেছে।

একটি যুগের অবসান এবং সর্বসাধারণতন্ত্রী (communal) বিকল্প

ভালো ভাবে বাঁচার এই উদ্যোগগুলোকে ঠিকভাবে বোঝার জন্য এই চক্রের গোড়ায় প্রস্তাবিত বিষয়গুলো আন্তরিকভাবে বিচার করতে হবে। ২০০ বছর ধরে যা টিকে আছে, তা এখন মারণরোগে আক্রান্ত। সভ্যতার এমন এক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে আমরা যাচ্ছি যা মানবপ্রাণের অস্তিত্বরক্ষা নিয়েই প্রশ্ন তুলে দিয়েছে।

যে ধরনের সর্ববিনাশী ভোগলিপ্সা হাল আমলে কেতাদুরস্ত হয়ে উঠেছে তা থেকে আমাদের সাবধান হতেই হবে। এক ধরনের কামোত্তেজনা নিয়ে পৃথিবীর আসন্ন বিনাশ বর্ণনা করা হয়ে থাকে। জলবায়ুর পরিবর্তনকে চূড়ান্ত আবেগের সঙ্গে স্বীকার করা হয় অথবা একইরকম চূড়ান্ত আবেগের সঙ্গে অস্বীকার করা হয়। কখনোই খেয়াল করা হয় না যে উভয় ক্ষেত্রেই কী অসহ্য ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করা হয়: ধরে নেওয়া হয় যে গোটা পৃথিবী জুড়ে কী ঘটে চলেছে তা আমরা উত্তম রূপে জানি এবং তাতে পৃথিবীর কী প্রতিক্রিয়া হচ্ছে তা-ও জেনে বসে আছি, আর শুধু তাই নয়, বিশ্বস্তরে কীভাবে সমস্যার সমাধান হতে পারে তা জানার ভানও আমরা করে থাকি। এহেন তথাকথিত বিশ্বমাপে (global) ভাবনার ঔদ্ধত্য-অহমিকা (বেরি ২০০৩) ত্যাগ করে আমাদের পক্ষে শোভন হবে আমাদের সাধারণ নশ্বর জীবনের মাত্রায় নেমে ভাবা। একথা আমরা নিশ্চিতভাবেই জানি যে আমরা আত্মহত্যাপ্রবণ আচরণ রপ্ত করে বসেছি: যা আমরা করছি তা ঠিক নয় এবং তা বন্ধ করা উচিত। আর এই কাজটাই কিছু মানুষ করতে শুরু করে দিয়েছে।

একটি যুগের অবসান দাবি করে যে চিন্তাভাবনার ছাঁচ আমাদের গড়েপিটে নিয়েছে, সে ছাঁচ ভেঙে আমরা বেরিয়ে আসি, বেরিয়ে এসে উপলব্ধি করি যে পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রের মধ্যে মতবাদিক বিবাদের ফাঁদে আমরা গত ১৫০ বছর যাবৎ আটকা পড়ে ছিলাম, চিন্তা করা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। গুটিকয় সমাজতন্ত্রী পূর্বধারণাকে আঁকড়ে ধরে থেকে আমরা বিদ্যমান ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনকামী সমালোচনাগুলোকে পচে শক্তিহীন হয়ে যেতে দিয়েছি। বাস্তব রাজনীতিকে প্রভাবিত করার সক্ষমতা হারিয়ে আমরা দুই থেকে তিন প্রজন্মের চিন্তার উপরও আর কোনো প্রভাব ফেলতে পারিনি। কুড়ি বছর আগে থিওডোর শানিন-এর সঙ্গে এই বিষয় নিয়ে আলাপচারিতাতেই যে ধারণাগত বিপর্যয়ের মধ্যে আমরা পড়েছি এবং তা থেকে উদ্ধার পেতে যে নতুন তাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক কাঠামো দরকার, সে কথা উঠেছিল। সেই নতুন কাঠামোই এখন নির্মিত হচ্ছে।

আধিপত্যকারী শাসনপ্রণালীর চরিত্র নিয়ে আবার ভেবে দেখা

পুঁজিবাদের ভূত

আন্তরিক বিবেচনার জন্য এই অনুমানটিকে ধরা যাক যে পুঁজিবাদের অন্তিম পর্যায়ে আমরা আছি এই উৎপাদনপ্রণালী ও সামাজিক সংগঠনের শেষ ঘনিয়ে এসেছে। বর্তমান সংগ্রামে এই অনুমানকে কার্যকরী করে তুলতে হলে পুঁজিবাদের যে ভূত গড়ে তোলায় আমরা অংশ নিয়ে এসেছি, সেই ভূতের বিরুদ্ধে আমাদের লড়তে হবে।এটা যেমন সত্যি যে মানুষদের মধ্যে সমস্ত সম্পর্কই পুঁজিবাদের মানসিকতার দূষণে দূষিত হয়ে যাচ্ছে, এমনকি শয্যাকক্ষের অন্দরমহলেও সে দূষণ সেঁধিয়ে যাচ্ছে, তেমনই এটাও সমান সত্য যে সবকিছুই পুঁজিবাদ নয়। প্রভাববিস্তারকারী দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে এমন কিছু বৈশিষ্ট্য অন্তর্ভুক্ত হয়ে আছে যা চমৎকারভাবে বর্ণনা করেছিলেন জে কে গিবসন-গ্রাহাম (১৯৯৬), এক নামের মধ্যে আসলে দুজন নারী, যাদের একজন এখন মৃত। পুঁজিবাদের যে ধারণার উপর বস্তুসত্তা আরোপ করে তাতে নিমজ্জিত হয়ে বামপন্থীরা বুঁদ হয়ে আছে, তা ভাঙার জরুরী কাজটি পুঁজিবাদের অবসান বিষয়ক তাঁদের বইয়ে তাঁরা বেশ কিছুটা এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁদের সেই কাজকে মাথায় রেখেই আমি এখানে ওই জটিল আলোচনাকে সংক্ষেপে সারছি।

ফুকো বলেছিলেন, ‘রাজনৈতিক ক্রিয়াকে সব ধরনের অদ্বৈতবাদী ও সর্বাত্মকতাবাদী ভ্রম-বাতুলতা থেকে মুক্ত কর’ (মিশেল ফুকো ১৯৮৩, পৃষ্ঠা: xiii)। পুঁজিবাদকে যদি আমরা এমন এক একীভূত সমসত্ত্ব ব্যবস্থা হিসেবে গ্রহণ করি যা গোটা সামাজিক পরিসরটিকেই ছেয়ে আছে এবং কিছুই যাকে এড়িয়ে যেতে পারে না, তাহলে যে ভ্রম-বাতুলতা আমাদের আচ্ছন্ন করবে সেই ভ্রম-বাতুলতা না কাটিয়ে উঠতে পারলে পুঁজিবাদ-বিরোধী সংগ্রামের ক্ষেত্রেও রাজনৈতিক ক্রিয়াকে মুক্ত করা যাবে না। পুঁজিবাদকে আমরাই সর্বত্রগামী ও সর্বশক্তিমান করে রাখব। সমস্ত প্রচারমাধ্যম দ্বারা প্রতিনিয়ত চালিত হয়ে এই পক্ষাঘাত-সঞ্চারী দৃষ্টিভঙ্গি এমন ধারণাকেই পুষ্ট করে তোলে যে পুঁজিবাদ নামক এই বিশ্ব-ব্যবস্থাকে হয় পুরোটা একসাথে ভেঙে ফেলতে হবে আর নয়তো ভাঙাই যাবে না। সেই কারণেই গোটা বিশ্বের সর্বহারাকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে: একমাত্র তাদের সংগঠিত, ঐক্যবদ্ধ, সমসত্ত্ব বলই এহেন সর্বাত্মক একটি শক্তিকে পরাজিত করতে পারে। বহু কাল, বহু স্থান পেরিয়ে আসা এই ধারণা তথাকথিত বিশ্বায়নের মধ্য দিয়ে যেনবা অভিজ্ঞতাপ্রসূত সমর্থন খুঁজে পায়।

ওই তাত্ত্বিক পরম্পরা ও রাজনৈতিক চর্চায় শিক্ষিত ও দীক্ষিত বাম-মহল সবসময় একটা ভূতের সঙ্গে পাঞ্জা কষে চলেছে, বা অন্যভাবে বললে, পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে প্রকৃত সংগ্রামটিকে ধারাবাহিকভাবে মুলতবী রাখতে রাখতে চলেছে, কারণ তাদের কল্পনায় যে দৈত্যের চেহারা তারা ধরে নিয়েছে, তার মুখোমুখি লড়াই করার মতো যথেষ্ট শক্তি কখনোই আর তারা জড়ো করে উঠতে পারল না। এইভাবে দেখার চোখ কোনো অ-পুঁজিবাদী বাস্তবতাকেই স্বীকৃতি দেয় না, শুধুমাত্র সেই ক্ষেত্রগুলো ছাড়া যেখানে তা কোনো প্রাক-পুঁজিবাদী অবস্থাকে পুঁজিবাদের সঙ্গে অমোচনীয় সম্পর্কে যুক্ত ও পুঁজিবাদের জন্য কার্যকরী বলে চিহ্নিত করতে পারে। আর তাই তা পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে যে কোনো আংশিক সংগ্রামকে যেমন হেয় করে বা অনিষ্টকর আখ্যা দেয়, তেমনই কোনো সংগ্রাম যদি পুঁজিবাদের সীমার বাইরে অবস্থান নির্মাণে ব্রতী হয়, তাহলে তা তাদের কাছে আরো বিদ্রূপ, উপহাস ও নিন্দার লক্ষ্যবস্তু হয়ে ওঠে। পুঁজিবাদের বাঁধা কাঠামোর মধ্যে থেকে জাতীয় বা বহুজাতিক পুঁজির সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধাই তাদের দৃষ্টিতে একমাত্র বাস্তবতা-সম্মত।

আমাদের কাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হল পুঁজিবাদকে এমন এক শাসনপ্রণালী হিসেবে চিনে নেওয়া যা মার্কসের সময় থেকে প্রায়োগিকভাবে বর্ণিত কিছু সামাজিক উৎপাদন-সম্পর্ক দ্বারা চিহ্নিত। যেসব সমাজে এই শাসন-প্রণালী আধিপত্য স্থাপন করে, সেখানেও এমন বিপুল পরিসর থেকে যায় যেখানে পুঁজিবাদের উৎপাদন-সম্পর্কগুলো রাজ করে না। এই স্বশাসিত পরিসরগুলো--- যেমন ধরা যাক, জাপাতিস্তাদের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকা অঞ্চলগুলো--- সীমায়িত চরিত্রের এবং আধিপত্যকারী শাসনপ্রণালীর দ্বারা আক্রান্তও বটে, কিন্তু এই পরিসরগুলোই এমন প্রতিরোধের ঘাঁটি হিসেবে কাজ করে যেখান থেকে ঘটমান অভ্যুত্থান ক্রমাগত প্রণোদিত ও সংগঠিত হতে থাকে। এই প্রণোদনা-সম্পাদনার প্রক্রিয়া আমি পরে আরো ব্যাখ্যা করব। নতুন উৎপাদন-সম্পর্ক জন্ম নিচ্ছে এই সব পরিসরগুলোতে যেমন, তেমনই আধিপত্যকারী শাসনপ্রণালীর কড়া নিয়ন্ত্রণে থাকা পরিসরগুলোতেও।

তন্ত্রের যুগ

পুঁজিবাদের অবসান বাধ্যতামূলকভাবেই সুখবর বয়ে আনবে তার কোনো মানে নেই। যা তার স্থান নিতে তোড়জোড় লাগিয়েছে, তা তার চেয়েও খারাপ।

১৯৭০ দশকের শেষদিকে ইভান ইলিচ আধুনিক প্রতিষ্ঠানসমূহের অনুপযোগিতা উন্মোচিত করে ভবিষ্যদ্বাণীপূর্ণ স্বচ্ছতায় সেগুলোর ক্ষয় পূর্বানুমান করেছিলেন। আজ প্রতিটি দিন যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা বাস্তবে ফুটে উঠছে। তাঁর জীবনের শেষ কুড়ি বছর ইলিচ নিয়োগ করেছিলেন বর্তমান সভ্যতার আত্মঘাতী প্রবণতা সম্পর্কে আমাদের সতর্ক করতে এবং এই সভ্যতার ক্ষয়ের সঙ্গে সঙ্গে তা যা দিয়ে প্রতিস্থাপিত হয়ে চলেছে, তা যে সভ্যতা আখ্যারই অনুপযুক্ত, তা তুলে ধরতে। তাকে তিনি ‘তন্ত্রের যুগ’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন, এখানে তিনি যে অর্থে ‘তন্ত্র’ (system) কথাটি প্রয়োগ করেছেন তা ইমানুয়েল ওয়ালারস্টেইনের করা প্রয়োগের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। ইলিচ কখনোই এই তন্ত্রের যুগকে পুরোপুরি বর্ণনা করে উঠতে পারেননি, তবে তাঁর মনে হয়েছিল যে ‘১৯৮৪’ উপন্যাসে জর্জ অরওয়েলের আশঙ্কা-জারিত কল্পনায় আঁকা আখ্যানটিই এর বৈশিষ্ট্যগুলোকে সবচেয়ে বেশি ফুটিয়ে তুলতে পেরেছে।

একসময় যা আমাদের হাতিয়ার ছিল, তাই আজ তন্ত্রের চেহারা নিয়ে আমাদের তার উপতন্ত্রে রূপান্তরিত করে চলেছে। আমরা এখন জানি যে ‘হাতিয়ার যখন একটা নির্দিষ্ট মাত্রা ছাড়িয়ে মাত্রায় ও ক্ষমতায় বাড়তে থাকে, তখন তাদের ব্যবহার নির্ভরতা, শোষণ ও অক্ষমতা ডেকে আনে’, আর তার মধ্য দিয়ে ‘যন্ত্রের দাসে পরিণত হয় মানুষ’ (ইভান ইলিচ ১৯৭৩)।  একটি নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক বিবর্তন প্রক্রিয়ার অনাকাঙ্ক্ষিত ফল হিসেবে দেখা দিয়েছে এই বস্তুগত প্রবণতা। শাসনপ্রণালীর সদর্থক অবলম্বনগুলো সব ভেঙে পড়েছে এমন একটি সময়ে বর্তমানে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা যাদের হাতে তারা নিজেদের সুবিধাভোগী অবস্থান টিকিয়ে রাখার প্রচেষ্টায় এই তন্ত্রযন্ত্রকে কাজে লাগাচ্ছে। সেই প্রচেষ্টা একমাত্র অভূতপূর্ব মাত্রায় কর্তৃত্ববাদীতার মাধ্যমেই সম্ভবপর হতে পারে। তাকে পুঁজিবাদের ধারাবাহিকতা না বলে বরং পুঁজিবাদের কর্তৃত্ববাদী নেতিকরণ বলাই শ্রেয়। ১৯৩০-এর দশকের ফ্যাসিবাদগুলোর থেকেও খারাপ ক্ষমতার একরূপ উন্মত্ত চর্চার দোরগোড়ায় হয়ত তা আমাদের নিয়ে এসেছে, এমন এক পরিপ্রেক্ষিত তৈরি করেছে যেখানে ‘রাজনীতি’ আর ‘নজরদারি’ সমার্থক হয়ে উঠেছে (দি ইনভিজিবিল কমিটি ২০০৯)।

দৈনিক অভিজ্ঞতা হয়ে ওঠা একটি ঘটনা এখানে উদাহরণ হিসেবে হাজির করা যেতে পারে। কোনো আধুনিক হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার দুর্ভাগ্য যদি ঘটে, সেই মুহূর্ত থেকেই ব্যক্তিমানুষ হিসেবে আপনার অস্তিত্ব অন্তর্হিত হবে। দেহরস, অস্থি, পেশী, চামড়া ইত্যাদি থেকে একটি বিমূর্ত পরিসংখ্যানগত তালিকায় আপনাকে পরিণত করে সমমাত্রায় বিমূর্ত একটি মান-তালিকার পাশে রেখে তুলনা করা হবে, তার মধ্য দিয়ে একটি রোগ-লক্ষণ (বিমূর্ত একটি রোগ) নির্ধারণ করা হবে এবং যান্ত্রিকভাবে একটি মান্যধারার নিদানপত্র প্রয়োগ করা হবে। নেহাত এই বিশ্লেষণপ্রণালীটিই চরম বিপর্যয় নয়, কখনো তা কাজেও লাগতে পারে। একইভাবে সেই সমস্ত প্রণালী যার মধ্য দিয়ে আকাশযানে সওয়ার হলেই আমরা ‘যাত্রী নম্বর ১৭ বি’ হয়ে যাই, নাগরিক জীবনে এক বিমূর্ত সারিতে বন্দী একটি ‘সোশাল সিকিউরিটি নাম্বার’ হয়ে যাই, সেই প্রণালীগুলো কেবল নিজে থেকেই চরম বিপর্যয় নয়। চরম বিপর্যয় ঘটে তখন যখন আমরা এই নৃশংস লঘুকরণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে স্বতন্ত্র ব্যক্তিমানুষ হিসেবে নিজেদের অস্তিত্বের বাস্তবতা পুনরুদ্ধার করার বদলে ওই বিমূর্ত লঘুকরণের মধ্যেই নিজেকে দেখতে থাকি, অস্তিত্বের স্বাভাবিকতা হিসেবে তাকে গণ্য করতে থাকি, এমনকি তা উপভোগও করতে থাকি। তখনই বোঝা যায় যে তন্ত্রের যুগ লাগু হয়েছে।

থমাস জেফারসন একবার মন্তব্য করেছিলেন, স্বাধীনতা থাকে যখন সরকার জনসাধারণকে ভয় করে, আর স্বেচ্ছাচারতন্ত্র থাকে যখন জনসাধারণ সরকারকে ভয় করে। আমরা এখন উৎক্রমণের এক পর্যায়ে আছি। গোটা বিশ্ব জুড়েই সরকারি ক্ষমতার খোলাখুলি বিরোধিতা করে দানা বাঁধতে থাকা অভ্যুত্থানগুলোয় আতঙ্কিত হয়ে সরকারগুলো মরীয়া হয়ে উঠেছে জনসাধারণের উপর সব ধরনের নিয়ন্ত্রণ কষে লাগু করতে, আর তার জন্য সন্ত্রাসবাদ, মাদক-পাচার বা স্বাস্থ্যকল্যাণের মতো বিভিন্ন অছিলা তারা খুঁজে বের করছে। যেমন ধরা যাক, সম্প্রতি সোয়াইন ফ্লু প্রতিরোধের নামে যে সার্কাস হয়ে গেল তা জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের অভিপ্রায় দ্বারা চালিত কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা হিসেবে দেখা যেতে পারে।

তাই বর্তমান সংগ্রাম কেবল পুঁজির সাপেক্ষে প্রতিরোধ থেকে মুক্তি অবধি পথ তৈরি করার জন্যই নয়, পুঁজি হিংসাত্মক ও বিধ্বংসী উপায়েও ইতিহাসের মঞ্চ ছেড়ে যেতে পারে, তাই সবার আগে এই সংগ্রাম হল পুঁজিবাদের ফেলে যাওয়া জায়গায় যা প্রতিস্থাপিত হতে চলেছে তাকেও আটকানোর জন্য এবং অন্যতর বিকল্পের সম্ভাবনা খুলে দেওয়ার জন্য।

আজ শক্তিসঞ্চয় করতে থাকা প্রভুত্ববাদী পরিপ্রেক্ষিতটি হঠাৎ করে চেপে বসেনি, কোনো গোষ্ঠী বা শ্রেণির কোনো অতর্কিত ক্ষমতাদখলের ফলও তা নয়, বরং তা হল বহু দশক আগে সূচিত এক প্রক্রিয়ার ক্রমশ আরো গভীর হতে থাকার অভিব্যক্তি।

চল্লিশ বছর আগে মিশেল ফুকো ও জাক দেলুজ চিহ্নিত করে বর্ণনা করেছিলেন কীভাবে আমরা শৃঙ্খলাদায়ক সমাজ (disciplinary societies) (যেখানে স্কুল, কারাগার আর হাসপাতাল হল আটক রাখার আদর্শ ধাঁচা) ছেড়ে এমন এক নিয়ন্ত্রণের সমাজ (societies of control)-এ প্রবেশ করছি যা ‘আর আটক রাখার মধ্য দিয়ে কাজ করে না, বরং নিরবচ্ছিন্ন নিয়ন্ত্রণ এবং তাৎক্ষণিক জ্ঞাপনের মধ্য দিয়ে কাজ করে।’ নতুন ধরনের বিধিনিষেধ ও নজরদারি ব্যবস্থা জারি করা হয় তার জন্য (মিশেল ফুকো ২০০৮)।

প্রযুক্তি 

আমাদের সক্ষমতাকে আরো ঋদ্ধ ও প্রসারিত করার জন্য যে হাতিয়ার আমরা ব্যবহার করি, তা হল প্রকৌশল। তা হাতুড়ি বা কম্পিউটারের মতো কোনো যন্ত্র বা সরঞ্জাম হতে পারে, আবার কোনো পরিষেবা বা প্রতিষ্ঠানও হতে পারে: যেমন ধরা যাক সামাজিক সুরক্ষা ও নির্বাচন ব্যবস্থা হল তেমন সামাজিক হাতিয়ার। আমাদের এইসব হাতিয়ারগুলোর মধ্যে নিহিত হয়ে থাকা সামাজিক-রাজনৈতিক অন্তর্বুননে বোনা যুক্তি-পরম্পরাই হল প্রযুক্তি। বর্তমানে সমস্যা হয়ে উঠেছে এটাই যে আধুনিক হাতিয়ারসমূহের বেশ বড় অংশই বিপরীত-ফলদায়ক (counter-productive) ব্যবস্থা হয়ে উঠেছে। যেমন ধরা যাক, যন্ত্রচালিত যানের ফলস্বরূপ আমরা আমাদের স্বাধীন গতিশীলতা হারিয়ে রাজপথ, গাড়ি, জীবাশ্ম জ্বালানী, এসবের উৎপাদন ও যোগান সমন্বিত একটি জটিল তন্ত্রের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি; চিকিৎসক ও চিকিৎসালয় রূপ হাতিয়ারগুলোর মধ্য দিয়ে আমরা এমন এক স্বাস্থ্যতন্ত্রে প্রবেশ করেছি যা স্বয়ং আমাদের রুগ্ন করে তুলে নিয়ন্ত্রিত করে চলেছে। সাধারণ শেখার পরিসর ছেড়ে বিদ্যালয় ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাতন্ত্রে প্রবেশ করার মধ্য দিয়ে আমরা এমন এক ব্যবস্থার কাছে আত্মসমর্পণ করেছি যা একদিকে যেমন মূর্খতা উৎপাদন করে যাচ্ছে, অন্যদিকে তেমনই সামাজিক নিয়ন্ত্রণ কায়েম করার উপায় হয়ে উঠেছে।

সাধারণ মানুষজন ক্রমশ যেসব উদ্যোগ নিতে শুরু করেছে, তার মধ্যে এই প্রযুক্তিগত মাত্রা সম্পর্কে সচেতনতা দেখা যাচ্ছে। খাওয়া, শেখা, সুস্থ হওয়া বা বাস করা নিয়ে আমি আগে যা উল্লেখ করেছি তা স্পষ্টভাবেই এমন এক প্রক্রিয়ার দিকে ইঙ্গিত করে যার মধ্য দিয়ে হাতিয়ার-সম্বলিত একটি তন্ত্রের কাছে আত্মসমর্পণ করে তার সেবায় নিজেদের নিয়োজিত করার বদলে আমাদের অভিপ্রায়সাধনের উপযুক্ত ও আমাদের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকবে এমন সব হাতিয়ার ব্যবহারের মধ্য দিয়ে নিজেদের স্বাধীন সক্ষমতা পুনরুদ্ধার করার প্রক্রিয়া সূচিত হচ্ছে।

সমাজতাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক বিচারে যে নতুনের উন্মেষ আমরা আজ প্রত্যক্ষ করছি, তার একটি চিহ্ন ও রূপক হিসেবে জলহীন শৌচকর্ম ব্যবস্থাকে ধরা যেতে পারে। জলনিষ্কাশন ব্যবস্থার দিকে ঠেলে নিয়ে যাওয়া সবচেয়ে খরচসাপেক্ষ ও পরিবেশের পক্ষে ক্ষতিকর প্রযুক্তিগুলোর অন্যতমকে তা সফলভাবে প্রতিস্থাপিত করতে পারে। অতি অল্প সময়ের মধ্যেই তা স্বাধীনভাবে অর্থনৈতিক, বাস্তুতান্ত্রিক ও স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত সমস্যাগুলো সমাধান করতে পারে। আর তার মধ্য দিয়ে তা হয়ে উঠতে পারে পরিবর্তিত হওয়ার আর একটি উপায়। গণতান্ত্রিক সমাজগুলোর জন্য চার্চ ও রাষ্ট্রের পৃথগীকরণ যেমন একটি পূর্বশর্ত রূপে কাজ করেছিল, শৌচকর্ম ও রাষ্ট্রের মধ্যে পৃথগীকরণ তেমনই বর্তমান সময়ে প্রয়োজনীয় মুক্তির পূর্বশর্ত হয়ে উঠতে পারে। জলহীন শৌচকর্ম ব্যবস্থা ও এই প্রযুক্তির আরো বিভিন্ন পরিবর্তিত রূপ সরকারী বা বেসরকারী প্রতিষ্ঠান ও কেন্দ্রীভূত চরিত্রের কোনো তন্ত্রের উপর নির্ভর না করে স্বাধীন সক্ষমতা অনুযায়ী কাজ করাকেই তুলে ধরে। তা এমন এক নতুন সামাজিক অস্তিত্বরূপের কার্যকরী রূপক যা সর্বসাধারণের জন্য স্বাধীন ভাবে বেঁচে থাকার সূচনাপথটিকে আরো প্রশস্ত করে। এর মধ্য দিয়ে অবশ্য অপর বা অন্য প্রযুক্তিগত কাঠামো প্রসূত হাতিয়ারগুলোকে--- যেমন ধরা যাক যন্ত্রচালিত যানকে--- গোঁয়ারের মতো পরিত্যাগ করার কথা বলা হচ্ছে না।

গ্রন্থন ও সংগঠন

যদিও চলমান অভ্যুত্থান আধিপত্যকারী রাজনৈতিক শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে, সেই বিদ্রোহকে আপাতদৃষ্টিতে গ্রন্থনহীন, সংগঠনহীন ছড়ানো-ছিটানো বলে মনে হয়। কিন্তু বাস্তবে তার মধ্যে জন্ম নিচ্ছে অন্তর্বুননে যুক্ত নতুন পথ করে নেওয়া নতুন ধরনের এমন কিছু উদ্যোগ যা জনসমাজের মধ্যের সম্পর্ক-সহযোগিতা-ক্রিয়ার জালকে পুনর্প্রতিষ্ঠা করছে অথবা নতুন করে গড়ে তুলছে। এই সম্পর্ক-সহযোগিতা-ক্রিয়ার জাল আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে শিকড় গেঁথেও আঞ্চলিকতাবাদে সংকীর্ণ নয় এবং আমূল বহুত্ববাদ তার চরিত্র গঠন করেছে। গ্রন্থনের যে প্রয়াস এর মধ্যে কাজ করে চলেছে তা বহুল প্রচলিত কিছু প্রলোভনের ফাঁদে পা না দিতে খুবই সতর্ক, ফাঁদগুলো হল:

  • জাতীয় বা বৈশ্বিক রাজনৈতিক বিষয়ী নির্মাণ করা, যা অবধারিতভাবে একটি ‘পার্টি’-র চেহারা নিয়ে বসে;
  • জাতি-রাষ্ট্রের প্রভুত্ববাদী চলনের গাড্ডায় পড়া, যা বন্ধু/শত্রু সম্পর্ক স্থাপনের মধ্য দিয়ে ক্রমশ নিজেকে জাহির করতে থাকে।

একটি পুরোনো আরব প্রবাদ পরামর্শ দেয়: ‘কে তোমার শত্রু তা যত্ন করে বাছাই কর, কারণ যাকে তুমি বাছবে তার মতোই তুমি হয়ে উঠবে’। বর্তমান উদ্যোগগুলো কিন্তু পুঁজির সঙ্গে সংঘাত ও প্রতিরোধ চালিয়ে গেলেও তা দিয়েই নিজেদের সংজ্ঞাত করে না, তৃণমূলস্তরের জীবন থেকে ও অন্যান্য সহযোদ্ধাদের সঙ্গে ভাবনা ও অভিজ্ঞতা বিনিময়ের মধ্য দিয়েই তারা তাদের পথ করে নিতে থাকে। এ বিষয়ে তারা পূর্ণ সচেতন যে পুঁজি এবং পুঁজির প্রশাসকরা ক্রমবর্ধমান হারে বিভিন্ন বর্গের নাগরিকদের নিজ শত্রুতে পরিণত করে চলেছে, কিন্তু সাধারণজন আমরা কীসে ‘হ্যাঁ’ বলব, কী হবে আমাদের সদর্থক গঠনপ্রয়াস সেই ক্ষেত্রে কেবল ওই পুঁজি ও পুঁজি-প্রশাসকদের নেতিকরণের ব্যাকরণের মধ্যে শিকড় ডুবিয়ে রেখে যে যুক্তিধারার বিরোধিতা করা হচ্ছে তাকেই আবার পুনরুৎপাদিত করার ভুল তারা আবারও করতে চায় না। এই ধরনের গঠনমূলক বিষয়ীর শৈলী যেসব উপাদানে গড়ে উঠছে তার মধ্যে নিয়ামনের নতুন রূপগুলো খুবই উল্লেখযোগ্য:

  • এখানে  নিয়ামনের রূপে নিয়মস্বাতন্ত্র (ontonomy) বা নিয়ম-পৃথকত্ব (heteronomy) ছাপিয়ে স্বশাসন (autonomy) কাজ করছে;
  •  প্রথমত বিকেন্দ্রীভবনের মধ্য দিয়ে ও দ্বিতীয়ত অধীনস্থ জ্ঞানগুলোর অভ্যুত্থানের [যাকে মিশেল ফুকো রাজনৈতিক অভ্যুত্থান রূপে বর্ণনা করেছিলেন (মিশেল ফুকো ১৯৭০, ১৯৮০, ২০০২, ২০০৮)] মাধ্যমে ‘ক্ষমতা’-র বিন্যাস পাল্টে দিয়ে--- এই দুইয়ের মধ্য দিয়ে উপায় ও লক্ষ্যকে আবার ঐক্যবদ্ধ করা হয়েছে।

মিশেল ফুকো-র তাত্ত্বিক প্রস্তাবগুলোর মধ্যে যে দুটিকে আপাতদৃষ্টিতে অসহনীয় পরস্পর-বিরোধিতায় ন্যস্ত বলে মনে হয়: ক্ষমতা মৃত এবং ক্ষমতা সর্বত্র বিস্তৃত--- সেই আপাত-বিরোধের মীমাংসা হাজির হয়েছে নিয়ামনের এই নতুন রূপগুলোর মধ্য দিয়ে। ফুকো-র মতে, ক্ষমতাশালীদের (ক্রমবর্ধমান হারে ভঙ্গুর ও অক্ষম হয়ে ওঠা, ধবংস করা ছাড়া আর কোনো কাজেরই উপযোগী নয়) ক্ষমতা আমূল প্রত্যাখ্যান করার মানে অক্ষমতা নয়। এই আমূল প্রত্যাখ্যান বিকল্প এক পৃথক ক্ষমতা গড়ে তুলতে চায় না, যেহেতু তা যে অন্যায়কে সে পরিত্যাগ করতে চাইছে, সেই অন্যায়কেই আবার পুনরুৎপাদিত করে বসে। বরং এই প্রত্যাখ্যান এমন নতুন সমাজতাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক উদ্ভাবনের মধ্য দিয়ে ঘটে যা ক্ষমতার দ্বারা নির্ধারিত ও পোষিত নয় এমন পুনরুজ্জীবিত সমাজ-সম্পর্কের চেহারায় মূর্ত হয়ে ওঠে। রাজনীতির বিভিন্ন মহলের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত অবধি হরেক সংস্কারক ও বিপ্লবীরা যেমন ভেবে থাকেন, বিষয়টা যে তেমন জনগণের বিবেকবোধ বা মাথায় কাজ করা চিন্তাগুলোকে কিছুটা পরিবর্তন করার নয়, তা ফুকো বলেছিলেন। বরং বিষয়টা হল সত্য উৎপাদনের যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক শাসনপ্রণালী এখন কার্যকর, অর্থাৎ যেসব বিবৃতি অনুযায়ী আমরা নিজেদের ও অপরদের শাসন করি, তাকে বদলে দেওয়া। এইভাবে ফুকো আমাদের এমনকিছু ভাবনার সুতো ধরিয়ে দিয়ে গেছেন যা অনুসরণ করে আমরা একদিকে বহু মানুষের চিন্তা আচ্ছন্ন করে থাকা প্রথাগত রাজনৈতিক ভাবনা ও অন্যদিকে যে রাজনৈতিক আমূল উদ্ভাবনগুলোর সাক্ষী এখন আমরা হচ্ছি, এই দুইয়ের মধ্যে সেতুগুলো তৈরি গড়ে তুলতে পারি। এই প্রক্রিয়ায় কেন্দ্রটিকে ভেঙে আবার নতুন করে গড়া হচ্ছে… কেন্দ্রটিকে বিগলিত করে ‘সত্য’ উৎপাদনের স্বয়ংশাসিত কেন্দ্র হিসেবে ক্রিয়াশীল বহু বিবিধ সাংস্কৃতিক শাঁসকেন্দ্রের জাল গড়ে তুলে একটিই কেন্দ্র থাকার বাধ্যবাধকতা নাকচ করা হয়েছে। বিকেন্দ্রীভবন থেকে বিকেন্দ্রীয়তাবাদের অভিমুখে এই যাত্রার আচরণগত রূপের একটি বিবর্ণ যান্ত্রিক প্রতিচ্ছবি হয়ত বর্তমান বিশ্বের ডাক, তার ও অন্তর্জাল ব্যবস্থার কার্যপদ্ধতির মধ্যে পাওয়া যেতে পারে।

খুবই জটিল ভাবনাসমূহের এহেন সরলীকৃত বিবরণ যে আড়ষ্টতা ও অস্পষ্টতায় আক্রান্ত হয়, তা আমি এড়াতে পারিনি। আধিপত্যকারী ধ্যানধারণার কড়া বাঁধন এড়ানোর জন্য এই বিবরণে আমি ফুকোর কঠিন তাত্ত্বিক পরিভাষাগুলোকে চিন্তাভাবনার বিভিন্ন সীমা বা দিগন্ত হিসেবে ব্যবহার করেছি। তা অবশ্য মোটেই হালকা চালে করা উচিত নয়। (প্রসঙ্গত দ্রষ্টব্য: গুস্তাভো এস্তেভা ১৯৯৪, ১৯৯৮ক, ১৯৯৮খ, ১৯৯৯, ২০০৩; জন হলোওয়ে ২০০২, ২০১১।)

রূপান্তরসাধন প্রচেষ্টার মানকে প্রায়শই তার কর্মসূচীর মান দিয়ে মাপা হয়ে থাকে: সংগ্রামের লক্ষ্য হিসেবে সমাজ বা দেশের রূপান্তরসাধনের কী প্রকল্প হাজির করা হচ্ছে, উদ্দিষ্ট রূপান্তরের তাৎপর্য, ভবিষ্যৎকে কোন ধারণার ধাঁচে গড়তে চাওয়া হচ্ছে, বিচার করা হয় এগুলোই। ধরে নেওয়া হয় যে নির্দিষ্ট লক্ষ্য না থাকলে যে কোনো প্রচেষ্টারই অভিমুখীনতা ও যুক্তিসঙ্গতিতে খামতি থেকে যাবে, যেহেতু অপমানিত হওয়া, অধিকারহারা হওয়া, বিক্ষুব্ধ সাধারণজন বা জনগোষ্ঠীর ছড়ানো-ছিটানো উদ্যোগ থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে কোনো সুপরিকল্পিত কর্মসূচী জন্ম নিতে পারে না। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই অগ্রণী নেতৃবাহিনীর পক্ষ থেকে আন্দোলনের কর্মসূচী নির্ধারণ করে দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা প্রতিষ্ঠা করা হয়ে থাকে।

এই নিয়ে বিচার করার সময় মনে রাখা ভালো ‘সমগ্র হিসেবে সমাজ’ সর্বদা এমন অসংখ্য ঘাত ও উপাদানের ফল যা যে কোনো কারোরই নিয়ন্ত্রণের বাইরে। তাই অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে সমগ্র হিসেবে সমাজের একটি পরিপ্রেক্ষিত নির্মাণ ও হাজির করাকে সংগঠিত করার পূর্ব-প্রয়োজন বলে মনে করা ভুল হবে, কারণ তা হয়ে দাঁড়াবে, ফুকোর ভাষায়, অতীতের উপাদানগুলোকে নিয়ে আগামীর স্বপ্ন দেখার সামিল। তাছাড়াও, আমরা এখন একুশ শতকে রয়েছি। আর বিশ শতক বারবার সাক্ষী থেকেছে কীভাবে সামাজিক ব্যবস্থাপনার (social engineering) সকল চেষ্টাই মুখ থুবড়ে পড়ে, অগ্রণী নেতাদের দ্বারা পরিকল্পিত ও আরোপিত সমাজোন্নয়নের চেষ্টা বিভীষিকার জন্ম দেয় [জেমস স্কট (১৯৯৮) এই বিষয়ে যথেষ্ট পরিমাণ উদাহরণ সংকলন করে হাজির করেছেন]। এই ধরনের সামাজিক ব্যবস্থাপনার যেকোনো কর্মসূচী পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষাকে শুষে নিয়ে তাকে খর্বিত বিকৃত করে প্রায়শই চরম হিংসাশ্রয়ী রূপ নেয়। মেহিকোতে যেভাবে জাপাতা ও ভিলা-কে খুন করা হয়েছিল তা মূর্ত উদাহরণ হয়ে আছে কীভাবে সংবিধানের মধ্যে খোদাই করা নেতৃবর্গের নির্মীত কর্মসূচীর ঘেরাটোপ অক্ষুণ্ন রাখতে বিপ্লবকামীদের রূপান্তর ঘটানোর স্বতক্রিয়াকে হিংসাত্মক বলপ্রয়োগের মাধ্যমে দমন করা হয়। প্রায় একই সময়ে এবং একই উপায়ে ১৯১৭ থেকে ১৯২১ সালের মধ্যে রাশিয়াতে যুদ্ধঘোষণা করা হয়েছিল সেই স্বশাসিত শক্তিদের বিরুদ্ধে যারা বিপ্লবে আঞ্চলিক ক্ষমতা নিজেদের হাতে তুলে নিয়েছিল। ১৯১৮ সালে যখন লেনিন বলেছিলেন: ‘নৈরাষ্ট্রবাদী (anarchist) ধ্যানধারণা এখন জ্যান্ত চেহারায় হাজির হয়েছে’ (গুয়েরিন ১৯৭০), তখনই এই নিয়ে তাঁর চিন্তা ব্যক্ত হয়েছিল। সোভিয়েতগুলোর স্বাধীন ক্ষমতাকে ধ্বংস করাকে ঘিরে যুদ্ধ চালানো হয়েছিল। শহরগুলোয় শ্রমিকদের উপর নিয়ন্ত্রণ (labour control) চাপানো হয়েছিল। গ্রামাঞ্চলে স্বয়ংশাসিত জনসমাজের ক্ষমতাকে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ দিয়ে প্রতিস্থাপিত করা হয়েছিল। গোটা বিশ শতক জুড়ে ক্ষত হিসেবে জেগে থাকা এইরূপ ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতাগুলো থেকে ঠেকে শিখেই একুশ শতকের সামাজিক আন্দোলনগুলো অন্যতর পথ কেটে এগোনোর চেষ্টা করছে।

মেহিকো সহ গোটা বিশ্বে নয়া-উদারনীতিবাদ দ্বারা চিহ্নিত দশকগুলো পেরিয়ে এসে যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তাকে সেই ঢাকনা-চাপা হাঁড়ির সঙ্গে তুলনা করা যায়, যা মৃদু আঁচের উপর বসানো, আর যার মধ্যে জল ফুটতে শুরু করেছে, বাষ্পের চাপ ক্রমশ বেড়ে চলেছে। ট্রটস্কি যে ‘বাস্তব কিন্তু মুঠোয় ধরা যায় না, সংজ্ঞাতেও বাঁধা যায় না’ এমন ‘জনগণের শক্তি’-কে ‘বাষ্প’-র সঙ্গে তুলনা করেছিলেন, তা ঠিক কী বস্তু? অ্যাডোলফো গিলি-র মতে এ এমন বস্তু যার:

বোধ, উপলব্ধি ও যুক্তি আছে, তাই যা বাষ্পের মতো ছড়িয়ে গিয়ে অপব্যয়িত হয়ে যায় না, বরং অভিজ্ঞতায় রূপান্তরিত হয়ে থেকে যায়, পিস্টন ও বয়লার (অর্থাৎ সাংগঠনিক কাঠামো বা যন্ত্র)-ই গতির জন্ম দেয় বলে যারা বিশ্বাস করে তাদের চোখে তা ধরা দেয় না, কিন্তু পরবর্তী প্রাত্যহিক জীবনের প্রতিটি অভাবিত মোচড়েই তা নিজেকে জানান দেয়। (গিলি ২০০৮)

উপরোক্ত রূপকটি ব্যবহার করে বলা যায় যে প্রতিনিয়ত অভিজ্ঞতায় রূপান্তরিত হতে থাকা এই বাষ্পটি ঘটমান প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ছড়িয়ে পড়ে বাস্তবতার মধ্যে উপছে পড়ার মাধ্যমে সক্রিয় হয়ে ওঠে। বয়লার ও পিস্টন সমন্বিত যন্ত্রসমূহে কখনো কখনো এমন সংস্থান রাখা হয়ে থাকে যাতে উদ্ভূত বাষ্প নিজেই নিজের পথ করে নিতে পারে এবং তা কিছু কিছু কাজেও লাগানো হয়ে থাকে, কিন্তু সেইক্ষেত্রে তাকে ‘সাংগঠনিক যন্ত্র’-র ঘেরাটোপে বেঁধে রাখা যায় না, ‘নেতৃত্বদায়ী সংগঠনসমূহ’ দিয়ে চালিত করাও যায় না। সাংগঠনিক যন্ত্র ও নেতৃত্বদায়ী সংগঠন দুইকেই যদি প্রাসঙ্গিক করে ভূমিকা গ্রহণে সক্ষম করে রাখতে হয়, তাহলে পিরামিড-সুলভ খাড়া গ্রন্থনার পরিবর্তে আনুভূমিক জালের মতো গ্রন্থনায় তাদের কাজ করতে দিতে হয় এবং উভয়কেই আজ্ঞা পালন করার মধ্য দিয়ে আজ্ঞা দেওয়া শিখতে হয়। তাছাড়াও, তাদের যথোপযুক্ত মাত্রার মধ্যে থেকে কাজ করতে হয়, নিজেদের নিরন্তর খাপ খাইয়ে নিতে হয় সেই বাস্তব পুরুষ ও নারীদের অবস্থা ও শৈলীর সঙ্গে, যে বাস্তব পুরুষ ও নারীরাই সর্বদা বাষ্প রূপে আন্দোলনের দিশা ও পরিধিকে শেষ বিচারে নির্ণয় করে দেয়।

যান্ত্রিক রূপক কখনোই বাস্তব প্রক্রিয়ার বৈচিত্র্যকে পুরোপুরি ধরতে পারে না, তবু আমাদের এই রূপকটি কী ঘটে চলেছে তার একটি ধারণা দিতে সক্ষম। কোনো নেতা, পার্টি বা সংগঠন দ্বারা একত্রিত করা সমসত্ত্বতায় লঘুকৃত ব্যক্তিদের গোষ্ঠী, যাকে আমরা গণপিণ্ড বলতে পারি, এখানে তা আমাদের বিচার্য নয়, আমাদের বিচার্য হল এমন গোষ্ঠী ও জনসমাজ যারা নিজেদের আভ্যন্তরীণ সংহতি, দিশামুখ, গতিচেতনা দিয়ে অতীত থেকে, অর্থাৎ ক্ষোভ ও অসহনীয় অভিজ্ঞতা থেকে কার্যকরীভাবে নিজেদের যাত্রা শুরু করেছে। তাদের নিজস্ব গতিচরিত্রের বলেই তারা সেই আশা গড়ে তুলেছে যা যেকোনো গণআন্দোলনের অন্তর্বস্তু হিসেবে কাজ করে চলে--- বর্তমানের বোধে, সংগ্রামের রূপে, ভবিষ্যতের অস্পষ্ট ইঙ্গিতে তা দরাজভাবে এই আশাপুরে দিয়েছে, তা কোনো ইউটোপিয় নক্ষত্রের আলোকছটা নয়, বরং তা যেন ছড়ানো-ছিটানো উজ্জ্বল অথচ স্পর্শাতীত চরিত্রের রামধনু-রঙ। 

সংগঠিত করার প্রশ্নে এটি একটি কেন্দ্রীয় বিষয়। কোনো এক নেতা, মতবাদ বা সাংগঠনিক যন্ত্রকে ঘিরে তৈরি হওয়া সমসত্ত্বতায় লঘুকৃত একক অণুদের নিয়ে ‘গণপিণ্ড’ নির্মিত হয়। সেই কেন্দ্রস্থিত নেতা, মতবাদ বা সাংগঠনিক যন্ত্রই এই গণপিণ্ডকে সংসক্তি ও অভিমুখ প্রদান করে, একই সঙ্গে উদ্দেশ্যানুযায়ী কাজে লাগানোর উপযোগী করে তোলে… আর মেশিনগানের চাঁদমারিও করে তোলে। এই একক অণুগুলোর নিজেদের সক্ষমতায় সংগঠিত থাকার শক্তি থাকে না, তারা যেন তাসের ঘর যা বাতাসের ঝাপটাতেই ভেঙে পড়ে। তাস বা বিলিয়ার্ড বলের মতোই সমসত্ত্বতায় লঘুকৃত অণুদের প্রতিবিম্ব স্বরূপ গণপিণ্ড বা রাজনৈতিক পার্টিগুলো নিজ কাঠামো বজায় রাখতে পারে কেবলমাত্র তখনই যখন কোনো বাইরের বল (নেতা, মতবাদ বা সাংগঠনিক যন্ত্রের রূপে) তাদের সংসক্তি ও একতা প্রদান করে। অন্যদিকে, রূপান্তরসাধনের আন্দোলন যদি এমন মানুষদের নিয়ে গড়ে ওঠে বাস্তব সম্পর্কের জালের গ্রন্থি হিসেবে একে অপরের সঙ্গে যুক্ত এবং জনসমাজ, সাধারণ গোষ্ঠী-র মতো কোনো সংঘে সংগঠিত, তাহলে সংসক্তি ভিতর থেকেই তৈরি হয়: তাদের সাধারণ অভিপ্রায় ও ধারণা-দিগন্তই তাদের সংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ করে রাখে (আগে আমি সাংস্কৃতিক/রাজনৈতিক শাঁসকেন্দ্র বলতে এদেরই বুঝিয়েছি), আর অন্যান্য সমগোত্রীয় শাঁসকেন্দ্রগুলোর সঙ্গে তাদের মিথষ্ক্রিয়া এমন অনুভূমিক জোট গড়ে তোলে যার সংসক্তিও তার নিজের ভিতর থেকেই উৎপন্ন হয়।

নতুন রাজনৈতিক প্রয়াস যখন উদ্দেশ্য ও উপায়ের মধ্যে বিযুক্তি ঘটায় না, তার অভিপ্রেত লক্ষ্যের রূপকে যখন নিজ সংগ্রামের রূপের মধ্যে বহন করে, যখন তারা নেতা-মতাদর্শ-সংগঠনযন্ত্র দ্বারা চালিত গণপিণ্ডের রূপে ক্রিয়া করার বদলে স্বশাসিত গোষ্ঠীদের স্বেচ্ছামিলন রূপে ক্রিয়া করে, তখন তারা নেতৃত্বদানের নিজস্ব স্বকীয় উপায় ও পদ্ধতি তৈরি করে নিতে পারে। প্রথমত, এমন বিক্ষুব্ধ মানুষজন এহেন প্রয়াসে সামিল হয় যারা নিজেদের অভিজ্ঞতার ঠেলায় আধিপত্যকারী নিশ্চয়তাগুলোর আমূল সমালোচক হয়ে ওঠে যা এক ধরনের মোহভঙ্গ রূপে প্রতিভাত হয়: যে ‘সত্য’-গুলো নিয়ে কিছুদিন আগে অবধি তারা নিজেদের প্রশাসিত করেছে, সেই ‘সত্য’-গুলোতেই এখন আর তারা বিশ্বাস করে না, সবকিছুকেই যেন তারা অস্বীকার করতে চায়। দ্বিতীয়ত, তাদের নিজস্ব সমাজবুননের ভিতর থেকেই এখন তাদের নিজস্ব বুদ্ধিজীবীরা উৎপন্ন হতে থাকে। জৈবিক বুদ্ধিজীবীদের (organic intellectuals) তারা উত্তরসুরি, আর খাসকামরার বুদ্ধিজীবীদের (cabinet intellectuals) থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন তাদের চরিত্র, তাই এই দুই গোত্রের থেকেই আলাদাভাবে চিহ্নিত করার জন্য আমরা তাদের প্রোথিত বুদ্ধিজীবী (embodied intellectuals) বলতে পারি।

বারংবার ফুকো এমন এক বুদ্ধিজীবীর জন্য আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছিলেন যে প্রমাণ ও সাধারণীকরণগুলোকে ধ্বংস করে বর্তমান সময়ের স্থিতিজাড্য ও অবরোধগুলোকে উন্মোচিত করে দেয়, যে প্রতিনিয়ত চলমান, কোনো অভিমুখ যার জানা নেই, কাল সে কী ভাববে তাও তার অজানা কারণ বর্তমানেই তার মনোযোগ অতি নিবদ্ধ (মিশেল ফুকো ১৯৮০)। ফুকোর সেই স্বপ্ন বুঝি এখন সাকার হচ্ছে। ১৯৯৪ সালে তা অতি মূর্ত হয়ে উঠেছিল এইভাবে:

জাপাতিস্তারা বলেছিল, ‘আমরা যারা মরে গিয়ে তবে নিজেদের কথা জানান দিতে পারি, বিপ্লবের যত কর্মসূচী আর রাজনৈতিক পার্টিরাও যাদের কখনো খেয়াল করে না, ইতিহাসও যাদের উপস্থিতি স্বীকার করে না, সর্বদাই যারা দুর্দশাগ্রস্ত, যারা ক্ষুদ্র, যারা বোবা, যারা চির-নাবালক, যাদের কোনো স্বর নেই, যাদের কোনো মুখ নেই, যারা পরিত্যক্ত, ঘেন্নার পাত্র, অক্ষম করে যাদের রাখা হয়েছে, যাদের মৃত্যু সংখ্যায় কুলায় না, আশা বিলোনোর পেশাজীবীরা যাদের অনুকম্পার চোখে দেখে, মর্যাদাব্যঞ্জক মুখে যাদের অধিকার অস্বীকৃত, যারা খাঁটি ক্রোধ, খাঁটি আগুন, যথেষ্ট হয়েছে বলে যাদের এখন মনে হয়েছে, অনেক ভোর, অনেক সবার জন্য সবকিছু আর আমাদের জন্য কিছু নয়, আমরা যারা হেঁটে-চলা শব্দ, আমরা কর্তব্য চাই না, গৌরব চাই না, খ্যাতিও চাই না, আমরা কেবল সহজ-সরল-ভাবে নতুন বিশ্বের প্রসূতিঘর হতে চাই। সেই নতুন বিশ্বকে আমরা জন্ম দিতে চাই যেখানে নতুন উপায়ে রাজনীতি করা যাবে, নতুন ধরনের সরকারি নীতি হবে, নতুন ধরনের পুরুষ ও নারী সবাইকে মানার মধ্য দিয়ে সবাইকে নেতৃত্ব দেবে।’

(সাবকমান্ডান্ট মার্কোস ১৯৯৪)

এই লাকানডন অরণ্যের ষষ্ঠ ঘোষণার ভাষা ও বক্তব্যের একটি অতি সাম্প্রতিক মূর্তায়ন দেখা গেছে ২০১০ সালের ৮ থেকে ১২ অক্টোবর বোগোতায় অনুষ্ঠিত গণ-কংগ্রেসে। এই কংগ্রেসে জড়ো হওয়া ২১২-টি বিভিন্ন সংগঠন থেকে আসা ১৭,০০০ অংশগ্রহণকারী নিজেদের পুঞ্জীভূত অভিজ্ঞতা দিয়ে কথাগুলোকে কাজে পরিণত করার প্রয়াস করেছিল। প্রথমেই তারা ‘জনসাধারণের প্রতিনিধিত্ব করার বদ্ধমূল অভ্যাস ত্যাগ করেছিল, কোনো পার্টি বা স্বঘোষিত অগ্রবাহিনীকে জনগণের অভিপ্রায়ের প্রতিনিধিত্বকারী বলে ধরে নেয়নি।’ তৃণমূলস্তর থেকে উঠে আসা আজ্ঞাগুলোই কংগ্রেসের ভিত হিসেবে গৃহীত হয়েছিল। ‘কেউই নেতা বা ব্যক্তিবিশেষ হিসেবে ভাষণ দেয়নি। সবাই নিজের কথা হাজির করেছিল কোনো অঞ্চলের বাসিন্দা হিসেবে, কোনো সংগঠনের করমী হিসেবে, কৃষক হিসেবে বা তরুণ/তরুণী হিসেবে।’ নতুন এক বিশ্ব গড়ার জন্য তারা তলা থেকে সমস্ত আইন প্রণয়ন করতে বদ্ধপরিকর। ২০১০ সালের নভেম্বরের মধ্যেই তারা আবার একত্রিত হয়েছিল ২০১১ সালের জন্য এমন কর্মপরিকল্পনা তৈরি করতে যার উপর ভিত্তি করে ‘জনসাধারণের স্বশাসনব্যবস্থার’ মধ্যে প্রোথিত হয়ে ‘দেশের প্রতিটি কোণে যৌথ আলোচনা-সিদ্ধান্তগ্রহণ-রূপায়নের চর্চা চালানো যায়’। কংগ্রেস তার উদ্দেশ্য ঘোষণা করেছিল এইভাবে: ‘দেশে তলা থেকে আইন তৈরি হোক। জনসাধারণ শাসন করুক। জনসাধারণই অঞ্চলবিন্যাস ঠিক করুক, অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করুক, নিজেদের প্রশাসন নিজেরাই গড়ে তুলুক। কথাগুলো কাজে পরিণত হোক’ (জীবেচি ২০১০)।

গতিছন্দ ও হিংসা

জাপাতিস্তারা যাকে বলবে ‘তলা থেকে এবং বাম ঘেঁষে’ উঠে আসা নানা প্রয়াস, এই আলোচনার প্রথম অংশে আমি যেগুলোর কথা বলেছি, যেখানে বিভিন্ন রকম জনসমাজে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে চলেছে, সেগুলোর দিকে অসীম আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছেন সুগভীর সামাজিক পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা পোষণকারী যেকোনো মানুষ। কিন্তু একইসঙ্গে, তারা অনেকেই এগুলোর মধ্যে প্রয়োজনীয় রূপান্তরসাধনের জন্য দরকারী শক্তির অভাব আছে বলে মত পোষণ করেন। আগের অনুচ্ছেদগুলোয় আমি তাদের যে বিকেন্দ্রীভূত চলন, একক বচন বা সংগঠনের কাঠামোয় বাঁধা না থাকার চরিত্র আলোচনা করেছি, তারা সেগুলোর সমালোচনা করার পাশাপাশি, আন্দোলনগুলোর গতিবেগকেও এভাবে সমালোচনা করে: পুঁজি ও তার প্রশাসকদের তড়িৎ আগ্রাসী অভিযানের মোকাবিলা করতে হলে এবং বর্তমান সমস্যাগুলোর গভীরতার প্রতি সুবিচার করতে হলে যে ‘অতি দ্রুত’ পরিবর্তন আবশ্যক, সেই গতিবেগ নিয়ে চলার ক্ষমতা এই আন্দোলনগুলোর নেই।

দ্রুতিকে অতি জরুরী বলে চিহ্নিত করার এই প্রবণতা প্রায় সর্বজনের সমর্থন আদায় করে নেয়। বর্তমান পরিস্থিতির প্রচণ্ডতা এবং প্রভুত্ববাদের ক্রমবর্ধমান প্রকোপ অতি আশু প্রতিক্রিয়া দাবি করে। আর ঠিক সেই কারণেই কবে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরের ‘সংগঠন গঠন করার কাজ’ শেষ হবে, দিনের পর দিন যে কাজ শ্লথ থেকে শ্লথতর হয়ে উঠছে, লক্ষ্য যেন দূর থেকে আরো দূরে সরে যাচ্ছে, তার জন্য অপেক্ষায় বসে না থেকে এখনই কিছু করা দরকার, এমন স্তরে এমন মাত্রায় করা দরকার যাতে সবাই সেখানে সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে পারে। যদি বিষয়টি কোনো গোষ্ঠী বা জনসমাজের উদ্যোগের প্রশ্ন হয়, তাহলে আশু দ্রুতির নাম করে প্রভুত্ববাদী চর্চায় নেমে পড়ার বদলে জাপাতিস্তারা যেমন বলে ও করে, তেমন ‘সবচেয়ে শ্লথগামীর গতিতেই হাঁটা’ উচিত। প্রচলিত একটি প্রবাদে অতি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক প্রজ্ঞার প্রকাশ পেয়েছে এইভাবে: ‘সবাই মিলে ধীরে পথ চলা যাক কারণ আমার খুব তাড়া আছে’।

রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে, এমনকি সর্বোচ্চ উদ্দেশ্যসাধনের নাম করে, হিংসার ব্যবহার কুজি শতকের অভিজ্ঞতার একটি বিশেষ অংশ। জাপাতিস্তাদের সশস্ত্র অভ্যুত্থান তৎক্ষণাৎ যে গণ-প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছিল, তা দেখায় যে এই অভিজ্ঞতা হজমের প্রক্রিয়া ঠিক কীভাবে ঘটে চলেছে। হিংসা যে কেবলমাত্র আরো হিংসাকেই ডেকে আনে এবং সামাজিক-রাজনৈতিক চর্চায় তার আঁচ এড়িয়ে যাওয়া খুবই মুশকিল হয়ে পড়ে, সেই শিক্ষা ক্রমশ দৃঢ় ও ব্যাপ্ত হয়ে উঠছে। নীতি-নৈতিক বা রাজনৈতিক চরিত্রের ধ্রুপদী যুক্তিগুলো ছাড়াও এই সহজ চিন্তাটাও সামনে এসে দাঁড়িয়েছে: যদি কেউ সবলতর হয়, হিংসার প্রয়োজন পড়ে না, অহিংস উপায়েই দুর্বলতরকে দমানো যায়; আর যদি কেউ দুর্বলতর হয়, হিংসা অবলম্বন করা আত্মহত্যার সামিল কারণ তা অনিবার্যভাবে পরাজয় ও আত্মবিনাশের দিকে ঠেলে নিয়ে যায়। যখন প্রশ্নটা কাউকে দমানোর নয়, বরং আত্মরক্ষার, তখন এই চিন্তাটি আরো প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে, কিন্তু এই চিন্তা যে বিমূর্ত শান্তিবাদের মোড়কে পরিবেশিত ভীরুতার থেকে আলাদা, তা মনে রাখা প্রয়োজন।

এর মানে অবশ্য এই নয় যে হিংসা ব্যবহার করলেই তার নিন্দা করতে হবে। এই প্রসঙ্গে অরুন্ধতী রায় চমৎকার বলেছিলেন যখন তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল যে তাঁর দেশ ভারতে যারা হিংসা অবলম্বন করে তাদের নিন্দা করা অনৈতিক কি না (অরুন্ধতী রায় ২০০৭)। কিন্তু বিগত যেকোনো দিনের চেয়ে আজ আমাদের পক্ষে আরো জরুরী হয়ে উঠেছে সক্রিয় অহিংসার পথ অবলম্বন করা, চিন্তা-ভাবনা-কথা আদানপ্রদানের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক সক্রিয়তা সংঘটিত করা।

সংকটের প্রকৃতি

বর্তমান সংকটের প্রকৃতির চরিত্রবৈশিষ্ট্যগুলো চিহ্নিত করতে পারলে আমরা ঘটমান অভ্যুত্থানের প্রকৃতিকেও আরো ভালোভাবে বুঝতে পারব।

এই মুহূর্তে এটি স্পষ্ট যে আমরা যার মুখে দাঁড়িয়ে আছি, তা আরেকটি কোনো মামুলী অর্থনৈতিক চক্রগতি নয়, বরং একটি সন্ধিক্ষণ। কিন্তু কোন অভিমুখে যে পরিবর্তন হবে তা তারাদের গায়ে লেখা নেই এবং সম্ভাবনাগুলোকে বুঝতে সব রকমের অনুমানই সামনে আসছে। অনুমান যাতে লুকোছাপার পথে না গিয়ে মাটিতে পা রেখে সামনে এগোনোর পথ পরিষ্কার করতে পারে তার জন্য আমাদের স্মৃতিকে সতেজ রাখা দরকার।

পুঁজিবাদ মহামন্দার চক্কর থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছিল যেসব বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রুজভেল্টের ‘নিউ ডিল’ ছিল তার প্রতিভূ: শ্রমিকদের সঙ্গে একটি বোঝাপড়া, উৎপাদন বিষয়ক একটি বোঝাপড়া, একটি সামাজিক বোঝাপড়া এবং বাকিটা বিখ্যাত কেইনসীয় প্রতিবিধান। এর মধ্য দিয়েই এসেছিল সেই পর্যায় যাকে ফরাসী বিশ্লেষকরা ‘গৌরবময় ৩০ বছর’ নাম দিয়েছে। প্রকৃত মজুরীর একটানা বৃদ্ধি, শ্রমিকসঙ্ঘ(Union)-গুলোর ক্ষমতার ক্রমবৃদ্ধি, সামাজিক সুরক্ষাজালের লাগাতার প্রসার--- এই অভিব্যক্তিগুলোর মধ্য দিয়ে জারী হয়েছিল পুঁজিবাদের প্রসারের এক জমকালো পর্ব।

১৯৬০ ও ১৯৭০-এর দশকে উপরোক্ত রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অগ্রগতির উপর দাঁড়িয়ে, আবার যেহেতু আন্তর্জাতিক শ্রমবিভাজনে জাতিদ্বেষ ও লিঙ্গদ্বেষের উত্তরাধিকারমূলক ছাপগুলো এবং অসম বিনিময় খুবই স্পষ্ট ছিল তাই, শ্রমিক-আন্দোলনে ব্যাপক সমাবেশ ও স্ফূর্তি ঘটেছিল, আবারও তারা ‘আকাশে ঝড় তুলতে চেয়েছিল’। তারা বিভিন্ন ভাবে বিভিন্ন উপায়ে সমাবেশিত হয়েছিল, স্কুল ও কারখানা থেকে রান্নাঘর অবধি, হিপি কম্যুনগুলোর সাথে, অবস্থান-বিক্ষোভে এবং গেরিলা যুদ্ধে। প্রতিটি দেশে এবং আন্তর্জাতিক স্তরেও কেইনসীয় বোঝাপড়াগুলোর ভিত ক্ষয়ে গিয়েছিল, সামগ্রিক ব্যবস্থাটার টিকে থাকাটাই আবার প্রশ্নের মুখে পড়ে গিয়েছিল।

সেই পরিস্থিতিতে পুঁজির প্রতিক্রিয়াগুলোর মধ্য থেকেই আসলে জন্ম নিয়েছিল ‘নয়াউদারনৈতিক বিশ্বায়ন’, ‘ওয়াশিংটন কনসেনশাস’ পাকাপোক্ত হওয়ার অনেক আগেই। তার মূল লক্ষ্য ছিল মেহনতী মানুষদের অর্জিত সুবিধাগুলোকে ধ্বংস করে ‘নিউ ডিল’ ও ১৯২৯-এর সংকটের পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া। প্রতিটি দেশের বলসমূহের বিন্যাসের ভিন্ন ভিন্ন রূপের কারণে ভিন্ন ভিন্ন দেশে এই কৌশল ভিন্ন ভিন্ন রূপ ধারণ করলেও সাধারণভাবে তা কয়েকটি বিষয়ে কেন্দ্রীভূত ছিল, যেমন: উৎপাদনের উপকরণের স্থানান্তরকরণ, পুঁজিকে অঞ্চল-নির্বিশেষ করে তোলা, শ্রম-বাজারের বিস্তারের কারণে শ্রমিকদের মধ্যের প্রতিযোগিতাকে তীব্রতর করা, ‘জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র’ ভেঙে ফেলা এবং জমি জবরদখল করা (মিডনাইট নোটস ১৯৯৭ দ্রষ্টব্য)।

আগের সমস্ত বোঝাপড়া--- সে ‘নিউ ডিল’ হোক, ঠান্ডা-যুদ্ধ-কালীন হোক বা তৃতীয় বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক পাতার সময়কার হোক--- ভাঙার মধ্য দিয়ে এই কৌশল নিজেকে কায়েম করল। সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেঙে পড়া, পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক শাসনগুলোর ভেঙে পড়া এবং চীনের কম্যুনিস্ট পার্টির পুঁজিবাদী পথে পাড়ি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া--- এইগুলো কেবল শ্রমিকদের মধ্যেই হতাশা ও বিশৃঙ্খলা তৈরি করেনি, ঠান্ডা যুদ্ধের মণ্ডপতলে রূপ নেওয়া বলসমূহের আভ্যন্তরীণ বিন্যাস ও নড়াচড়ার জায়গাকেও প্রভূত মাত্রায় বদলে দিয়েছিল। মহামন্দার উপান্তে শ্রমিকদল ও পুঁজির মধ্যে সামাজিক যুদ্ধবিরতির যে চুক্তি বোঝাপড়া হয়েছিল--- শ্রমিকরা যতক্ষণ মুনাফা তৈরি করে যাচ্ছে আর পুঁজি যতক্ষণ চাকরি জুটিয়ে যাচ্ছে, ততক্ষণ সামাজিক স্থিরতা বজায় রাখবে সব পক্ষই--- তা এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই ধ্বংস হল। এই যুদ্ধবিরতির বোঝাপড়ার অবসান আরো অনেক কিছুর সঙ্গে শ্রমিকদের আন্দোলনের এক নতুন ঢেউয়েরও জন্ম দিল। আর সবকিছুর থেকে বেশি করে এই নয়াউদারনৈতিক কৌশল দলে দলে বিক্ষুব্ধ শ্রমিক তৈরি করেছে, যাদের অনেকেরই আর নিজেদের দাবিদাওয়া জানানোর জন্য কোনো প্রাতিষ্ঠানিক পথ নেই। আবার একইসঙ্গে দলে দলে জড়ো হচ্ছে চাকরিহারা মানুষ, পেনশন-হারানো বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, সামাজিক সুরক্ষাজালের বাইরে খসে পড়া মানুষজন, আরো ভালো মজুরী বা কর্মপরিস্থিতি (বা সামাজিক উৎপাদনক্ষেত্রে তাদের যা সমতুল) দাবি করা মানুষজন, আর অসহনীয় চরম মাত্রায় পৌঁছে যাওয়া প্রাকৃতিক জগতের ক্রমবর্ধমান ধ্বংস প্রতিরোধ করতে নামা মানুষজন। এই সমস্ত বিক্ষুব্ধজনেদের সমাবেশ আরো বেশি বেশি করে নজর টানছে এবং ফলোৎপাদকও হয়ে উঠছে।

এই পরিপ্রেক্ষিত থেকে দেখলে, ১৯৯৪ সালের জাপাতিস্তা অভ্যুত্থানকে বিশ্বজোড়া বিক্ষোভ-সমাবেশের মধ্যে এমন এক বিস্ফোরক উপাদান হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে যা নির্দিষ্ট কোনো দাবি তোলার পরিধিকে ছাপিয়ে গিয়ে গোটা ব্যবস্থাটাকেই আমূল প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দেয় এমন নানা সূত্রায়ন অনবরত আরো জোরালোভাবে হাজির করে যাচ্ছে। এই ঘটনা ঘটার আগে অবধি কেউ বিশ্বায়নকে দেখত সুসম্ভাবনাময় হিসেবে আবার কেউ দেখত বিপদ হিসেবে, কিন্তু সবাই-ই তাকে এড়িয়ে যাওয়া যায় না এমন এক বাস্তবতা হিসেবে ধরে নিয়েছিল। সিয়াটেলের মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া বিপুল ব্যবস্থাবিরোধী আন্দোলনগুলো স্বীকার করে নিয়েছে যে জাপাতিস্তারাই প্রথম বিশ্বায়নকে আমূল প্রত্যাখ্যান করে পথ দেখিয়েছিল। তাছাড়াও, একটাই ‘না’ আর বহুবিবিধ ‘হ্যাঁ’--- এই দৃষ্টিভঙ্গি হাজির করার মধ্য দিয়ে তা রাজনৈতিক সংগ্রাম ও সামাজিক আন্দোলনের রূপগ্রহণের সম্ভাবনাকে নতুন দিগন্তে প্রসারিত করেছিল। বহুবিবিধ বিশ্বকে আলিঙ্গন করে থাকতে পারে এমন এক নতুন বিশ্ব গঠনের ধারণা শুরু হচ্ছে একটি সাধারণ ‘না’ থেকে, পুঁজিবাদকে আমূল প্রত্যাখ্যান করার মধ্য দিয়ে, কিন্তু এই প্রত্যাখ্যান যে বহুজন বহুবিবিধভাবে করছে সেই সবের সম-অভিমুখীনতা ও বোঝাপড়া গড়ে তোলার চেষ্টার মধ্য দিয়ে তা বিশ্বের প্রকৃত বহুত্বকে, সংস্কৃতি ও জীবনাদর্শের বৈচিত্র্যকে স্বীকার করে নিতে চায়, পার্থক্যজাত বহুবিবিধ ‘হ্যাঁ’-কে রূপান্তরসাধনের ঐতিহাসিক বিষয়ী রূপে পুনর্গঠিত করে নিতে চায় (এস্তেভা ১৯৯৮খ)।

১৯২৯ সালের সংকটের থেকে বর্তমান সংকট গভীরভাবেই আলাদা। ১৯২৯ সালের সংকটে শুরু থেকেই প্রযুক্ত হলে যেসব হাতিয়ার হয়ত কার্যকরী হতে পারত বা শেষ অবধি যেসব হাতিয়ারের প্রয়োগ ওই সংকট থেকে বের হয়ে আসা সম্ভবপর করে তুলেছিল, সেসব দিয়ে বর্তমান সংকটের মোকাবিলা করা অসম্ভব। শুধু তা-ই নয়, অভূতপূর্ব ব্যাপক মাত্রায় কেইনসীয় প্রতিবিধানের প্রয়োগ আর্থিক ক্ষেত্র (financial sector)-কে স্থিতিশীল করার মাধ্যমে সাময়িক স্বস্তি এনে দিলেও দীর্ঘমেয়াদে সংকট মোচন করার বদলে আরো গভীর ও ব্যাপ্ত করে তোলে। বর্তমান সংকটের কোনো সমাধান যে এই ব্যবস্থাগত কাঠামোর মধ্যে নেই, তা অংশত এই কারণে যে, শ্রমিকদের আন্দোলনের মুখে দাঁড়িয়ে পুঁজির আর্থিক ক্ষেত্রে সরে যাওয়ার কৌশল প্রকৃত অর্থনীতিকে আরো দুর্বল করে তোলে।

‘মিডনাইট নোটস কালেকটিভ’ (২০০৯) চিহ্নিত করেছিল যে নয়াউদারনীতিবাদী কৌশলের ব্যর্থতার কয়েকটি প্রধান কারণ হল: প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজনের অপ্রতুলতা, শক্তিশিল্প (energy industry)-কে নয়াউদারনীতিবাদী চাহিদা পূরণের উপযোগী করে তোলার অপারগতা, মজুরীর স্তরের উপর নিয়ন্ত্রণ জারি রাখতে না পারা, প্রাকৃতিক সম্পদের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রসারিত করতে না পারা এবং পরিবেশগত ক্ষতির মূল্য চুকোতে হওয়া।

এহেন সর্বক্ষেত্রেই ‘শ্রমিকদের’ সমস্যাদি নয়াউদারনীতিবাদী কৌশলের এগোনোর পথ আটকে দিয়ে অতি-উৎপাদন (over-production) ও ভোগাল্পতা (under-consumption)-র গাঁটছড়া বাঁধা এক বহুদৃষ্ট সমস্যার পাকে জড়িয়ে ফেলছে। মজুরী বাড়তে না দেওয়া বা কমিয়ে দেওয়ার ফলে সংকুচিত হয়ে পড়া বাজারে পুঁজিপতিদের আর তাদের হাতে থাকা বিপুল পরিমাণ পণ্য বিক্রি করা সম্ভব হচ্ছে না।

একদিকে পুঁজি ও তার রাষ্ট্রীয় প্রশাসকরা আর অন্যদিকে সাধারণ জনতা--- এই দুই পক্ষের মধ্যে টানটান এক সংঘাতের বাতাবরণেই ‘বিপদের মুহূর্ত’-টি রূপ পেয়েছে।

ফাটল

আধুনিকতা দিয়ে আমরা কী করব?

একটি ঐতিহাসিক চক্রের সমাপ্তি নিয়ে সবাই একমত, কিন্তু মৃতদেহটি কার এবং কী আসলে মরার পথে, তা চিহ্নিত করা নিয়ে নানা মুনির নানা মত। সম্ভবত সবচেয়ে কঠিন হল আধুনিকতার শবদেহটিকে চিহ্নিত করা, যদিও আমার মনে হয় যে তার মৃতু্যসংবাদটি ফুকো বেশ সফলভাবেই পরিবেশন করে গেছেন। একটি যুগের শেষপ্রান্তে এসে যেমন হয়, তেমনই এক বিশৃঙ্খলা ও অনিশ্চয়তার আবহে আমরা আছি, যখন গত যুগটির বিবরণপদ্ধতি (narrative), ভান, যুক্তিশৃঙ্খলা এবং স্বপ্নগুলো অকার্যকরী হয়ে পড়েছে, কিন্তু যা তাদের জায়গা নিতে পারে নতুন যুগের তেমন নির্মাণগুলো এখনও পরিস্ফুট হয়ে ওঠেনি বা গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। চমস্কির সঙ্গে তাঁর বিখ্যাত কথোপকথনে ফুকো আমাদের কাছে দাবি করেছিলেন যাতে আমরা দমনমূলক সমাজের গর্ভে তৈরি হওয়া চিন্তা-ধারণা-র কাঠামোগুলোকে এখন পরিত্যাগ করি… যা বহুজনের কাছে শূন্যে ঝাঁপ দেওয়ার সামিল মনে হয়েছিল। চিন্তা-ধারণা-র ওই কাঠামোগুলো ছাড়া, তাদের সরবরাহ করা বিচার-বিশ্লেষণের হাতিয়ারগুলো ছাড়া, আমরা চিন্তা করব কী করে? জগতকে অনুভব করা ও অভিজ্ঞতায় ধরার যে সমস্ত উপায়গুলোর মধ্য দিয়ে আমরা বেড়ে উঠেছি, তা যদি এখন যা ঘটছে তা বোঝার জন্যই আর উপযোগী না থাকে, নতুন যুগকে কল্পনা করা তো অনেক পরের কথা, আর পাশাপাশি যদি নতুন যুগের যুক্তিশৈলীও এখনও না প্রতিষ্ঠা পেয়ে থাকে, তাহলে আমরা কী করতে পারি? (চমস্কি ও ফুকো ২০০৬) যা আজ ঘটে চলেছে তা নিয়ে ভাবব কী করে আর রূপান্তরের প্রক্রিয়াটিকেই বা অভিজ্ঞতায় ধরব কী করে, যদি গতকালের ঘটনার উপযোগিতা আজ শেষ হয়ে গিয়ে থাকে আর কাল যা ঘটবে তা এখনো ঘটে না থাকে?

বিমূর্ততা পেরিয়ে

যুক্তি ও বিজ্ঞান যখন ঈশ্বরের সিংহাসনটি দখল করার চেষ্টা করল, মানুষের ক্রিয়া নির্ধারণ করায় নিয়তি ও অতিপ্রাকৃতিক বলসমূহের জায়গায় নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে চাইল, তখন আমাদের ভাবনাপ্রক্রিয়ার মধ্যের স্বেচ্চাচারবাদী (absolutist) পরম্পরাকে তা উত্তরাধিকার স্বরূপ স্বীকার করে নিল। কিন্তু আজ আমরা কেবলমাত্র সেই স্বেচ্ছাচারবাদী যুক্তির শাসনপর্বের অবসানমুহূর্তে দাঁড়িয়ে নেই। তা ছাড়াও আরেকটা কিছু আছে। আমি আগেই উল্লেখ করেছিলাম যে প্লেটো আমাদের সতর্ক করে দিয়েছিলেন বিমূর্তায়নের সঙ্গে বাস্তবতাকে গুলিয়ে না ফেলতে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে আমাদের সংবেদজ ইন্দ্রিয়লব্ধ বাস্তবতার বোধ যেহেতু ভ্রান্তিকর হতে পারে, তাই এই গুলিয়ে ফেলাটাকেই আমরা অভ্যাসে পরিণত করে ফেলেছি।

এমন একটা যুগের উপান্তে এখন আমরা বাস করছি যেখানে আমরা বারবার বিমূর্তায়নকেই বাস্তবতা বলে ভুল করে তার নামে সব রকমের আগ্রাসন চালিয়েছি এবং সব রকমের নকশায় নিজেদের ব্যবহৃত হতে দিয়েছি। ব্যবহারিক উপযোগিতার প্রচলিত পরোক্ষলেখগুলোই আমাদের জগতকে অভিজ্ঞতায় ধরার উপায় হয়ে উঠেছে। চল্লিশ বছরের কম যাদের বয়স এবং মহাকাশ থেকে তোলা পৃথিবীর নীল বুদবুদের মতো ছবি হয়ত যারা হাজারবার দেখে ফেলেছে, তাদের পক্ষে এ নিয়ে কোনো সন্দেহ পোষণ করা খুবই কঠিন যে আমরা পৃথিবী নামক একটি গ্রহে বাস করি। বা আরো নিখুঁতভাবে বললে, মেহিকোতে বাস করি। কিন্তু এই নিশ্চিতি এক বিপজ্জনক অর্থহীনতা হয়ে ওঠে।

রাইমন পানিক্কর-এর ভাষা ব্যবহার করে আমি এই কথাটি আরো অস্বস্তিকরভাবে বলতে চাই:

পাশ্চাত্যের অন্যতম উন্মাদপনা, বা রেখে-ঢেকে বললে, অন্যতম উজ্জ্বল উদ্ভাবন হল শ্রেণিবদ্ধকরণ (classification) আবিষ্কার… আমরা সবকিছুকেই শ্রেণিতে সাজাই… তা থোড়াই কাজে দেয়, যদিও তার কার্যকারিতাকে প্রশ্নের ঊর্ধ্বে বলে ধরা হয়। যা ঘটে তা হল এই যে একবার শ্রেণিবদ্ধকরণের খপ্পরে পড়লে আর কোনো বেরোনোর রাস্তা থাকে না। একবার আমাদের মস্তিষ্ক শ্রেণিবদ্ধ করা শুরু করে দিলে কেবলমাত্র যন্ত্রগণক (computer)-এর আগমনীই সূচিত হয় না, আর কোনো গত্যন্তরও থাকে না… শ্রেণিবদ্ধ না করে কীভাবে ভাবা যায় তা আর আমাদের জানা থাকে না। বা আরো ভালোভাবে বললে, আমরা বিশ্বাস করতে থাকি যে শ্রেণিবদ্ধ করা আর চিন্তা করা একই বস্তু। চিন্তা করা আর সেই সৃজনশীল ক্রিয়া থাকে না যার মধ্য দিয়ে মানুষ জানতে পারে, অর্থাৎ, বাস্তবতার সঙ্গে একত্ব স্থাপন করার মধ্য দিয়ে বাস্তবতাকে কিছুটা রূপান্তরিতও করে। চিন্তা করাকে গুলিয়ে ফেলা হয়েছে গণনা করা, অর্থাৎ, শ্রেণিবদ্ধকরণ করার সঙ্গে।

(রাইমন পানিক্কর ১৯৯৩, পৃঃ-১৭)

বিমূর্তায়ন, শ্রেণি-বিভাগ, তত্ত্ব--- এগুলোকে প্রধানত বাস্তবতার খণ্ডাংশকে আলোকিত করার জন্য সাময়িক লন্ঠন হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে যাতে আমরা সএই অংশগুলোকে দেখতে ও বিচার করতে পারি। কিন্তু সেগুলোই বাস্তবতা নয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে, আমার মতে, শ্রেণি-বিশ্লেষণ করা ও শ্রেণি-সচেতন হওয়া এখনও দরকারী, কখনও আবশ্যিকও বটে, কিন্তু তা কেবল এই শর্তে যে একথা আমরা মাথায় রাখছি যে বাস্তব জগতে মানুষ--- রক্তমাংসের মূর্ত পুরুষ ও নারী--- সংগ্রাম করে, শ্রেণিরা সংগ্রাম করে না। আর তার মধ্য দিয়ে শ্রেণি সংগঠন বানানোর ফাঁদে আমরা পা দিচ্ছি না, যে ছন্দ আমার ভিতর থেকে উৎসারিত নয় সেই ছন্দে নাচার চেষ্টা করছি না। ‘গণ’-আন্দোলন (এমন এক গণপিণ্ডের ক্রিয়া যা কোনো এক নেতা, এক মতবাদ, এক পার্টি, এক কাঠামোর দ্বারা বাইরে থেকে একত্রে বেঁধে থাকার সূত্রে ও সেই বন্ধনের উপর নির্ভরশীলতার কারণে স্বাতন্ত্র্য হারিয়ে সমসত্ত্বীভূত) খুঁজে না বেরিয়ে, আমাদের উচিত বহু স্বশাসিত বিবিধের কেন্দ্রগুলোর অনুভূমিক জোটবিন্যাসে নিজেদের নিযুক্ত করা।

নিজেদের উদ্দেশ্যসাধনের জন্য বিমূর্ত হাতিয়ার আমরা ব্যবহার করতে পারি, কিন্তু হাতিয়ার ব্যবহারের যুগ এখন শেষ হোয়ার পথে। আমরা এখন বিরাট যন্ত্র-ব্যবস্থার যুগে প্রবেশ করেছি, যখন হাতিয়ার আর আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে না, আমাদের সেবায় আমাদের অভিপ্রায় দিয়েও আর চালিত হয় না (দ্রষ্টব্য: গুস্তাভো এস্তেভা ১৯৭৯, পৃঃ-১১-র পাদটীকা)।

শ্রেণিবদ্ধকরণের প্রবণতা মানব উত্তরাধিকারের অংশ, একটি মানব ধ্রুবক--- এ কথা আমি জোর দিয়ে বলব। আমরা তা অনবরত করে চলি, কোনো একটি বস্তুকে অন্যান্য বস্তুদের থেকে পৃথক করে নিয়ে সেই বস্তুর গুণগুলোকে আলাদা ভাবে চিহ্নিত করতে আমাদের মস্তিষ্ককে প্রয়োগ করি। এই কাজ একটি বিপদ, বদ্ধসংস্কার বা উন্মাদপনা হয়ে উঠতে পারে, কিন্তু তবুও তা বাস্তবের সঙ্গে সম্পর্কস্থাপন ও কথা চালানোর একটি ধরন বটে। এবারের ওঠা ফসল থেকে শস্যবীজ আমরা বাছাই করে রাখি পরের বার ফলনের জন্য। লতাপাতাদের আমরা বাছাই করি কী খাব আর কী খাব না তা অনুযায়ী। যে ব্যক্তিদের সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয়, কীভাবে তাদের সম্বোধন করব তা অনুযায়ী তাদের বাছাই করি: শিশুকে আর বৃদ্ধকে তো আমরা একইভাবে সম্বোধন করি না। এর মধ্য দিয়ে একপ্রকার ক্ষমতার চর্চাও হয়। আর তা হয় গাছপালা, পশু, মানুষজন সবার সঙ্গেই। আমার অভিপ্রায় অন্যদের উপর চাপিয়ে দেওয়ার মতো যথেষ্ট শক্তিশালী যদি আমি হই, আমার করা শ্রেণিবদ্ধকরণ আধিপত্যচর্চার অঙ্গ হয়ে ওঠে। এই শ্রেণিবদ্ধকরণকে মানুষের উপর প্রয়োগ করার পথ ধরেই আমরা ‘গণপিণ্ড’ (ইংরেজিতে ‘mass’) নামক ধারণাটিতে পৌঁচেছি, বিপ্লবী বাহ্যাড়ম্বর যুক্ত এই শব্দটির উৎস চার্চের ধাপকাটা একস্তম্ভ কাঠামো এবং বুর্জোয়া মনোবৃত্তির মধ্যে নিহিত আছে, যা পরিত্যাগ করে আমাদের এগোনো উচিত। আর সামাজিক আন্দোলনগুলো ঠিক এই কাজই এখন করে চলেছে।

উত্তর-আধুনিকতা ও উত্তর-আধুনিকতাবাদ

‘উত্তর-আধুনিকতা’ ও ‘উত্তর-আধুনিকতাবাদ’ পদগুলি নিঃসন্দেহে আমাদের বর্তমান ফাটলের কাছে পৌঁছে দেয়। ‘উত্তর-আধুনিকতা’ বলতে শুধু আধুনিকতার পরে যা এসেছে তা বোঝায় না, এমন এক উত্তরযুগকে বোঝায় যেখানে পূর্ববর্তী যুগের মান-কাঠামো (value system) তার প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে। নিউটনিয় পদার্থবিদ্যা, কার্তেসিয় লঘুকরণবাদ (reductionism), হবস-এর জাতিরাষ্ট্র এবং বিশ্ব পুঁজিবাদী ব্যবস্থা আধুনিক মান-কাঠামোকে সংজ্ঞায়িত করেছিল। ‘উত্তর-আধুনিকতাবাদ’ সেই মান-কাঠামোকে আর ধারণ করছে না। যারা ওই পূর্ববর্তী যুগের ‘মহান সত্য’-গুলোকে আর সত্য মনে করছে না, কিন্তু সেগুলোকে প্রতিস্থাপিত করার মতো বদলিও এখনও নির্দিষ্ট করতে পারেনি, তাদের মনোভঙ্গিটাই ‘উত্তর-আধুনিকতাবাদ’ পদটিতে বর্ণিত হচ্ছে। মূল্যবোধ ও দিশা হারানোর এক অভিজ্ঞতা হিসেবে তা অনুভূত হচ্ছে, যা কখনো কখনো বাঁক নিচ্ছে মৌলবাদের দিকেও--- এমন এক মৌলবাদ যা নিরাপত্তাহীনতার তাড়সে মৌল উপাদানে ফিরতে চাইছে। এই অভিজ্ঞতা এমন এক অভিনব বিশ্বাস দৃঢ় হওয়ার মধ্য দিয়েও প্রকাশিত হচ্ছে যে একতম অদ্বৈত সত্য বলে কিছু হতে পারে না (দিয়েতরিচ ১৯৯৭)।

উত্তর-আধুনিকতাবাদ হল এক বিশেষ ধরনের জানার প্রক্রিয়া। উত্তর-আধুনিক চিন্তা হল চিন্তা করার একটি প্রক্রিয়া। আধুনিকতার মৌলিক মূল্যবোধগুলোর ক্ষয় এবং তা থেকে তৈরি হওয়া নিরাপত্তাহীনতাবোধের মুখে দাঁড়িয়ে সমাজ-বিজ্ঞানগুলো সচেষ্ট হয়েছিল সমাজ-বাস্তবতাকে ব্যাখ্যা করার কোনো নতুন পদ্ধতি বিশদ করার জন্য (দিয়েতরিচ ১৯৯৭)। উত্তর-আধুনিক চিন্তা মোটেই যথেচ্ছ স্বেচ্ছাচারীতার সঙ্গে যুক্ত নয়। পূর্ববর্তী মান-কাঠামোয় মোহভঙ্গ হওয়ার অর্থই হল এই যে প্রাক-আধুনিক/ খ্রিস্টান/ পাশ্চাত্য বিচারধারায় বা আধুনিকতার আলোকপ্রাপ্তি/ সভ্যতা-চিহ্নিত বিচারধারায় আর সত্য ধরা দিচ্ছিল না। মোহভঙ্গের মধ্য দিয়ে যাওয়া বোধ বিভিন্ন সমাজের বহুত্ব, সমাজ-অভ্যন্তরেরও বহুত্ব ও সমাজগুলোর সত্যের বহুত্ব, যা প্রায়শই পরস্পর-বিরোধী ও অসংগতিময়, তা চেনার পর পার্থক্য সংজ্ঞায়িত করাতে মন দিয়েছে। তাই উত্তর-আধুনিক চিন্তা এমন এক মানসিক ও সামাজিক অনিরুদ্ধতা সংজ্ঞায়িত করছে যা আধুনিক চিন্তার মতো বিবিধ বহুত্বকে দ্রবীভূত করে এক করার চেষ্টা করবে না, বরং পার্থক্য নিয়েই বিবিধ বহুত্ব সম্মানের সঙ্গে যাতে সহযাপন করতে পারে তা দাবি করবে। সর্বজনীনতাবাদ (universalism) ও পাশ্চাত্যের দ্বারা বাকি পৃথিবীতে সভ্যতা নিয়ে যাওয়ার যে আখ্যান, তার এঁকে দেওয়া গণ্ডীর বাইরে বেরিয়ে উত্তর-আধুনিকতাবাদ তার কার্যকরী ধারণাগুলোকে নির্ধারণ করতে চায়। বৈজ্ঞানিক উপপাদ্যগুলোকেই বস্তুগত সত্য বলে ধরে নেওয়ার আধুনিকতাবাদী ঝোঁক থেকে মুক্ত হয়ে উত্তর-আধুনিকতাবাদ কাজ করতে চায়। সমস্ত বিরোধকেই সমাধান বা নিরসন করে দেওয়া যায়, এহেন সরলীকরণ বা দম্ভ উত্তর-আধুনিকতাবাদ আর বহন করতে চায় না। (দিয়েতরিচ ১৯৯৭)

বাস্তবিক সমাজ-গতিশীলতায় যা ঘটে চলেছে, স্পষ্টতই যা এক জ্ঞানতাত্ত্বিক (epistemological) ফাটলের ফল, যা বিদ্যা-প্রাতিষ্ঠানিক (academic) জগতের গণ্ডীর মধ্যে ঘটেনি, কোনো বিখ্যাত চিন্তাবিদের মগজের মধ্যে ঘটেনি, বরং যা এক সমাজ-ঘটনা হিসেবে সামনে উঠে এসেছে, তা বোঝা ও প্রকাশ করার জন্য বিদ্যা-প্রাতিষ্ঠানিক ও বুদ্ধিবৃত্তীয় প্রয়াস হিসেবেই ‘উত্তর-আধুনিকতা’ ও ‘উত্তর-আধুনিকতাবাদ’ পদদুটোকে গণ্য করা যেতে পারে। কেউ কেউ বলে থাকে যে ফরাসী বিপ্লবের সূচনা সেই দিনটিতেই হয়েছিল যেদিন প্রথম কোনো কৃষক তার সামন্তপ্রভুকে দেখলেই স্যালুট করা বন্ধ করেছিল। রাজার মাথা কেটে ফেলা: এই অভাবনীয়কেও ভাবা নির্দিষ্ট একটি ঐতিহাসিক পরিস্থিতিই সম্ভব করে তুলেছিল। কোনো একটা যুগের অবসানের সম্ভাবনা ধরা বা পূর্বানুমান করা কেবলমাত্র তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ-আন্দাজ-অনুমানের বিষয় নয়। এই ফাটল অস্তিত্বযাপনের এক বিশেষ রূপের মধ্যেই ফুটে ওঠে, সমাজ-বাস্তবতার এক বিশেষ মুহূর্তের মধ্যে ফুটে ওঠে, যা অভাবনীয়কে ভাবা সম্ভবপর করে তোলে। উদারনীতিবাদের উপান্তে দাঁড়িয়ে আমরা এই ফাটলটিকেই অভিজ্ঞতায় অনুভব করছি। এই সেই ঐতিহাসিক মুহূর্ত যখন আমরা একটি প্রজন্ম রূপে যৌথভাবে একত্ববাদী চিন্তার কারাগার ভেঙে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছি, আধিপত্যকারী পুঁজিবাদী খোলসটির চাপানো নিয়তি লঙ্ঘন করতে শুরু করেছি এবং পুঁজি ও তার প্রশাসকদের কুঠুরি-দেওয়ালের বিরাট ফাটলগুলো আমাদের দৃষ্টিগোচর হতে শুরু করেছে। এভাবে ক্রমে প্রতীয়মান হয়ে উঠছে যে বিদ্রোহীদের হাতেই কুঠুরির দেওয়াল ভাঙার চাবিকাঠি রয়েছে…

বিতৃষ্ণা, বিদ্রোহ, অভ্যুত্থান, বিপ্লব

ঘটমান অভ্যুত্থানটি কেবলই একটি লোকপ্রিয় বিদ্রোহ নয়, এমন কোনো হঠাৎ-উদ্গীরণ নয় যা আগ্নেয়গিরি থেকে উচ্ছসিত লাভার মতো যত দ্রুত উঠে আসে তত দ্রুতই মিলিয়ে যায়। এমনকি বহুদিন ঘুমিয়ে থাকা বহু আগ্নেয়গিরির একইসঙ্গে জেগে ওঠা হিসেবেও একে দেখা সমীচীন নয়। বাস্তিল দুর্গ বা শীত প্রাসাদের উপর ঝটিকাহানার মতো যে ঘটনাগুলো দীর্ঘস্থায়ী রূপান্তরের প্রতীক হয়ে উঠেছে, সেগুলোর সঙ্গেও এর তুলনা চলে না।

স্পষ্টতই আমরা এখন এক বিদ্রোহের মাঝে আছি, এমন এক বিদ্রোহ যা খাঁটি বিপ্লবের উপাদান হয়ে উঠতে পারে। আধিপত্যাধীনদের বর্তমানতার এ এমন এক উদ্গীরণ যা আধিপত্য করার রাজনৈতিক ঘটনাটিকেই আধিপত্যে আনতে চাইছে, পরিবর্তমানতার পরাকাষ্ঠা হয়ে উঠছে, যেমনটা অ্যাডোলফো গিলি বলেছেন। পুরোনো ব্যবস্থার ফাটলগুলোকে বাস্তবিক তাৎপর্য প্রদান করে নতুন ব্যবস্থার পথ তৈরি করছে যারা, তারা কোনো অভিজাত উগ্রবাহিনী নয়, এমনকি বিপ্লবী অগ্রবাহিনীও নয়, তারা সবাই অপর, অপমানিত, ক্ষুব্ধ সাধারণজন। এই সাধারণজনরাই বিদ্রোহের বস্তুগত ও শারীরিক ক্রিয়াকর্তা, যা না হলে কোনো বিপ্লব হতে পারে না, বড়জোর রাজনৈতিক আজ্ঞাকারীর আসনে মুখবদল হতে পারে (অ্যাডোলফো গিলি ২০০৮)।

এই বিদ্রোহের অভিনবত্ব এখানেই যে বিদ্রোহের কুশীলবরা আগের সব সংগ্রামের অভিজ্ঞতার উপর দাঁড়িয়ে এই প্রত্যয়ে দৃঢ়চেতা যে রূপান্তরসাধনের কাজ পরিচালনা করার শক্তি, সক্ষমতা ও লাগাম কারো হাতে তুলে দিয়ে নিশ্চিন্ত হওয়া যাবে না। নতুন পরিস্থিতি সামলাবার জন্য বিপ্লবের ফলস্বরূপ নতুন আইনী বা প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো রূপ দেওয়ার দায়িত্ব তারা কেবল এক দল নেতার হাতে তুলে দিতে রাজি নয়, সে নেতারা তাদের মধ্যে থেকে উঠে এলেও নয়। ইতিহাসে বারবার যে অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে--- জনসমষ্টি যা নতুন গড়ে তুলেছে তা তাদের হাত থেকে বেদখল হয়ে গেছে--- তা যাতে আবার না ঘটে তার জন্য গোটা প্রক্রিয়ার উপর নিয়ন্ত্রণ তারা নিজেদের হাতেই রাখতে চায়। তা করার জন্য তারা শিখতে শিখতে চলেছে কীভাবে ক্রমশ জোট বাঁধতে থাকা জনগোষ্ঠীদের বিধানসভা ও সংসদ সুস্পষ্ট কার্যনির্দেশের উপর দাঁড়ানো সাময়িক কর্ম-প্রতিনিধি নির্বাচন, যা সবসময়ই নির্বাচকদের দ্বারা পুনর্বৈধকরণের উপর নির্ভরশীল, তার মধ্য দিয়ে চালানো যায়। এর কোনোকিছুই আগে থেকে নির্ধারিত করে ফেলা যায় না, কারণ প্রতি পদেই কল্পনাশক্তি এবং সমাজতাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক সৃজনশীলতা ছাড়া এগোনো সম্ভব নয়। সময় যখন উপস্থিত হবে, তখন প্রক্রিয়ার মধ্য থেকে তা নিজেই ফুটে উঠবে।

ঘটমান অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়ে চলেছে যেসব ছোট মাপের প্রয়াসগুলোর মধ্য দিয়ে তা স্পষ্টতই অনাগত সমাজের একটা পূর্বস্বাদ বয়ে আনছে, কিন্তু তাদের এমন এক অতি-আগ্রাসী ও শত্রুভাবাপন্ন ব্যবস্থার পটে অস্তিত্বধারণ করতে হচ্ছে যা প্রতিনিয়ত তাদের হেনস্থা করতে করতে ক্ষইয়ে দিতে চাইছে। খুব বেশি দিন আগে নয়, জন বার্জার বলেছিলেন যে তাঁকে যদি একটা শব্দে বর্তমান পরিস্থিতিকে বর্ণনা করতে হয়, তাহলে তিনি জেলখানার প্রতিমাটিই বেছে নেবেন। আমরা এখন সেই পরিস্থিতিতেই। আটক ও জেলবন্দি। এই পরিস্থিতিতে ধ্বংস ও নিপিড়নের কালাপাহাড়ী তাণ্ডবের কারণে বিচ্ছিন্ন প্রয়াসগুলোর স্বাধীন প্রস্ফুটকরণের জন্য অপেক্ষা করার ফুরসত আর আমাদের নেই। সেই জন্যই বিক্ষুব্ধদের মধ্যে ইতিমধ্যেই গড়ে ওঠা প্রশস্ত জোটগুলোর অভ্যন্তরে রূপ নিতে থাকা পারস্পরিক সমর্থন ও ঐক্য এত জরুরী হয়ে উঠেছে।

অভ্যুত্থান অতি দরকারী। তাকে সেই ‘সশস্ত্র পথ’-এর সঙ্গে ঘুলিয়ে ফেলা ঠিক হবে না, যার উপর বহু গোষ্ঠী এখনও ভরসা রেখে চলেছে। তা হবে শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক, পরিস্থিতি যতটা অনুমোদন করে ততটাই শান্তিপূর্ণ এবং যতটা সম্ভব ততটাই গণতান্ত্রিক। কিন্তু তার মানে এই নয় যে বর্তমানে ঘটতে থাকা অসংখ্য আন্দোলনগুলোর স্থান-কাল-অভিপ্রায়কে গায়ের জোরে ঠেসে একমুখী করতে হবে।

অভ্যুত্থান প্রয়োজন--- এমন এক অভ্যুত্থান যা সংক্রমণের মতো ছড়িয়ে যাবে (যেমনটা জাপাতিস্তা আন্দোলনে হয়েছে), নেতৃত্বদায়ীদের গোপন কৌশলগত বোঝাপড়ার উপর নির্ভর করবে না। যুদ্ধ করতে হওয়া যে বীভৎসরকমের খারাপ তা সত্য, কিন্তু তা করতে বাধ্য হওয়ায় দুঃখ পাওয়ার কিছু নেই। তাত্ত্বিক বা রাজনৈতিক প্রতিমূর্তিকরণের বিভিন্ন রূপের মধ্যে নিজেদের গুটিয়ে নেওয়ার বদলে আমাদের আকাঙ্ক্ষাগুলোকে বাস্তবতার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত করা এবং ক্রোধ ও বিক্ষোভের বুননে সক্রিয়তা উপপাদন করার মধ্য দিয়ে আমরা বিপ্লবী বলকে পূর্ণশক্তিতে অনর্গলিত করতে পারি (মিশেল ফুকো ১৯৮৩, পৃষ্ঠা: xiii)।

হাওয়ার্ড জিন গোটা জীবন ধরে আমাদের দেখিয়ে যেতে চেষ্টা করেছেন যে মহান বিপ্লবগুলো কোনো মহান নেতাদের কীর্তি নয়, হিংসা উপছে ওঠা কোনো সামাজিক ভূমিকম্পও নয়। মহান সামাজিক পরিবর্তনের পথ তৈরি হয় যে বহু বিভিন্ন অজানা মানুষদের অগুন্তি ছোট ছোট সক্রিয়তার মধ্য দিয়ে, সেই সমস্ত সক্রিয়তাকে তিনি চোখের সামনে তুলে এনে উদযাপন করে গেছেন। তিনি জানতেন যে চূড়ান্ত প্রান্তীয় বলে মনে হওয়া কোনো প্রয়াসও পরিবর্তনের অদৃশ্য শিকড় হিসেবে কাজ করতে পারে। তিনি আমাদের বারবার বলেছিলেন বিপ্লবী পরিবর্তনকে এমন এক আশু প্রক্রিয়া হিসেবে দেখতে যা আমাদের হাতের তালুর দূরত্বের মধ্যেই আছে, যার জন্য সাহস ও কল্পনাশক্তি দুটোই দরকার:

এমন কিছু আছে যা আমাদের করতেই হবে।

আমাদের কর্তব্য পালন করার দায় আমাদের আছে।

কিন্তু স্থান ও কাল, কখন এবং কোথায়, দিনপঞ্জী ও ভূগোল,

সবই এই তলায়। কোনো চিহ্নিত তারিখে বা স্থানে নয়, কেবল এখানে,

এই তলায় যেখানে আমাদের মৃতরা জীবনধারণ করে।

(ভিয়েজো আনতোনিও ২০১০-এর সারসংক্ষেপ)

পুঁজিবাদের অবসান

বলা হয়ে থাকে যে পুঁজিবাদ তার প্রারম্ভের পুঞ্জীভবনের পর্যায়ে ফিরে গেছে, কিন্তু আগের পর্যায়ের থেকে এই পর্যায়ে অধিকারচ্যুত করার (dispossession) হার অনেক বেশি এবং চরিত্রেও তা মূলগতভাবে আলাদা। আগেকার পর্বের অধিকারচ্যুত করা পুঁজি সৃষ্টি করত, যেহেতু অধিকারচ্যুত করে কেড়ে নেওয়া বস্তু শ্রম কিনতে কাজে লাগিয়ে পুঁজিতে রূপান্তরিত করা হতো। ঠিক এই কাজটাই আর এখন করা যায় না। নিয়োগের পরিসংখ্যান তার সাক্ষী। চীন ও ভারতে যা ঘটে চলেছে তা আলাদাভাবে বিশ্লেষণের যোগ্য হলেও সার্বিকভাবে দেখা যাচ্ছে যে বর্তমানের অভূতপূর্ব পুঞ্জীভবন শ্রম-ক্রয়ে রূপান্তরিত করা যাচ্ছে না।

অধিকারচ্যুত করার বর্তমান প্রক্রিয়ার চরিত্রনির্ধারণ করার জন্যও বিশেষভাবে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন হয়ে পড়েছে, যেহেতু তার মধ্যে কিছু ক্ষেত্রে আগের যুক্তিপ্রক্রিয়া কাজ করছে, আবার কিছু ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ নতুন যুক্তিপ্রক্রিয়া হাজির হয়েছে।

জন মেইনার্ড কেইনস ১৯৩৪ সালে যেভাবে সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে ২০১০ নাগাদ পুঞ্জীভবন বিহীন পুঁজিবাদের এক পর্যায়ে উপনীত হতে হবে, বাস্তব পর্বান্তর সেই পথ অনুসরণ করেনি। ২০১০ সাল নাগাদ পুঁজির মুনাফা যে প্রায় শূন্যে নেমে আসবে, কেইনসের এই ভবিষ্যদ্বাণী প্রায় মিলে গেছে, বলা যায় ২০১০ সালের কিছুটা আগেই তা ঘটেছে। জাপ্পে (Jappe)-কে উদ্ধৃত করে বলা যায় আমরা ইতিমধ্যেই এক স্বয়ংভুক সমাজে বাস করছি: এমন একটা সমাজ যা নিজেই নিজেকে ভক্ষণ করে (জাপ্পে ২০১৭)। পুঁজিবাদকে পুনরুজ্জীবিত করে পুনর্জন্ম দেওয়ার জন্য যা যা করা হচ্ছে, সেগুলোই তাকে আরো ডুবিয়ে দিচ্ছে।

পুরুষতান্ত্রিকতার শেষ পর্বকে এখন আমরা প্রত্যক্ষ করছি। ‘জীবনের প্রতি যে ঘৃণা’ পুরুষতন্ত্রের মজ্জাগত, জীবিতকে ধ্বংস করে জাদু-রাসায়নিক রূপান্তরের মধ্য দিয়ে জীবিতের চেয়ে উন্নততর কিছুতে পরিণত করার তার নিহিত প্রবণতা, এ সবই আজ চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছেছে, ধ্বংসের সব সীমারেখা মুছে গেছে, যার সবচেয়ে নজরকাড়া অধ্যায়টি ঘটে চলেছে বীজের ক্ষেত্রে (ভন ওয়ের্লহফ এবং বেহমান ২০১০)।

আর আছে শারীরিক ধ্বংস। কৃষিবাণিজ্য বা গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন যা করে চলেছে, তার চেয়েও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে সামরিক বিশ্বব্যবস্থাপনার কার্যকলাপ (বার্তেল ২০০০)। আর এই শারীরিক ধ্বংসকেও ছাপিয়ে গিয়ে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ধ্বংসকাণ্ড ভয়ঙ্করতম হয়ে উঠেছে।

এই উত্তর-পুঁজিবাদী স্বয়ংভূক রাজত্বের আরো যথাযথ চরিত্র-নির্ধারণ প্রয়োজন। আরো প্রয়োজন হলো এটা দেখানো যে তার বিরুদ্ধে নিয়োজিত সংগ্রামের কৌশলগুলো এই নতুন রাজত্বকালে কেবল অকেজোই নয়, বরং বিপরীত-ফলদায়ক হয়ে উঠেছে। এই নয়া ‘আধিপত্যকারী শাসন’-এর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তাকে অতিক্রম করতে হলে একটি জগতের অবসানকালের চিহ্নগুলোকে শরীরে ধারণ করা এই শাসনব্যবস্থার চরিত্রবৈশিষ্ট্যগুলোকে আমাদের অবশ্যই খেয়ালে রাখতে হবে।

অনুসন্ধানের সূত্রগুলো

সদ্যপ্রয়াত সাবকমান্ডান্ট মার্কোস একবার বলেছিলেন, আমরা এখন এমন এক ইতিহাস-মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছি যেখানে অনাগত পরবর্তীর এক ঝলক দেখতে হলে আমাদের পিছন দিকে তাকাতে হবে। অতীতের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করা অনুসন্ধানক্রিয়ার জন্য তিনটি সূত্র আমি প্রস্তাব করছি: ১৯৬০ দশকের অভিজ্ঞতা, সাইবারনেটিক মানসিকতায় উত্তরণের পর্ব, আর, মুষ্টিমেয় শাসকের স্বেচ্ছাচারিতা থেকে গণতান্ত্রিক জাতিরাষ্ট্রের মধ্যস্থ নয়া ফ্যাসিবাদে পৌঁছানোর পথ।

এই নয়া বর্বরতার মূল কর্তাদের চিহ্নিত করার চেষ্টা করলে যে এমন একটা জায়গায় গিয়ে পৌঁছতে হয় যেখানে মনে হয় কর্তা বলে আর কেউ নেই, এই বিষয়টিকে পূঙ্খানুপূঙ্খভাবে বিচার করতে হবে। বিপুল ক্ষমতা সম্পন্ন বড় বড় বাণিজ্যসংস্থা (corporations) আছে, তাদের সেবায় নিয়োজিত সরকারও আছে, কিন্তু ১৯৯০ সালে যার কার্যকারিতা সম্পন্ন হয়েছে বলে বিজয়পালনের মধ্য দিয়ে যে ত্রিমুখী আয়োগ (Trilateral Commission)-কে পরিত্যাগ করা হয়েছিল, তার সমগোত্রীয় আর কিছু এখন নেই। সমতুল্য কিছু ব্যবস্থাপত্র নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু ওই আয়োগের মতো একইরকম কার্যক্ষমতা বা ঐক্যমত্য-জাত বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গির জোর তাদের নেই। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ‘ক্ষমতাকেন্দ্রগুলো’ যে আত্মঘাতী ও আত্মভূক যুক্তিবিন্যাসের মধ্যে অবস্থিত, তার টানে একে অপরের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। তাদের বাড়াবাড়িকে সামলানোর মতো বা দরকার অনুযায়ী পরিস্থিতির মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো কোনো ব্যবস্থাপত্র এখন আর নেই। জাতিবিদ্বেষী ও লিঙ্গবিদ্বেষী এই সমাজ আর অন্য কোনোভাবে নিজের অস্তিত্ব ধারণ করতে অপারগ। সম্পদ পুঞ্জীভবনকে অকল্পনীয় মাত্রার চূড়ায় পৌঁছে দিতে ও সেইজন্য ঝড়তি-পড়তি অংশদের দমন করে রাখার কাজে সামাজিক স্তরবিন্যাসের বেশ চওড়া একটা অংশ সহযোগীর ভূমিকায় উপনীত হয়েছে। নিঃসন্দেহে মধ্যবিত্ত শ্রেণি এখানে বড় ভূমিকা পালন করে, কিন্তু সব শ্রেণিই এতে অংশ নিয়ে চলেছে। তাদের ঘুম ভাঙানোর জন্য কিছু করা জরুরী, কিন্তু তা ‘জনগণকে নেতৃত্ব দেওয়া’-র লেনিনীয় প্রলোভন পরিত্যাগ করেই করতে হবে।

এই অনুসন্ধানক্রিয়াকে সংগঠিত অবস্থা ভেঙে যাওয়ার ফলাফলের চরিত্রবৈশিষ্ট্য বুঝে নেওয়ার প্রয়োজনে সেই ভাঙনপ্রক্রিয়ার ইতিহাসকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবেই বিচার করতে হবে ।

উত্তর-পুঁজিবাদী পরিস্থিতি

কীভাবে পুঁজিবাদ নিজেকে টিকিয়ে রাখছে, আমাদের সামনে খাড়া হয়ে থাকা এই প্রশ্নের উত্তর হিসেবে আমি নিজের কিছু বোঝাবুঝি এখানে হাজির করছি। যে ব্যবস্থা আর ‘পুঁজিবাদী’ নেই, তাকে ‘পুঁজিবাদী’ বলে গণ্য করে চলা আর উচিত নয়, আর এই ব্যবস্থা নিজে নিজেকে ‘টিকিয়েও রাখে’ না, কারণ ধ্বংসাত্মক ও আত্মভূক জ্বরগ্রস্ততায় তা নিজের শর্তানুযায়ী নিজেকে আর পুনরুৎপাদিতও করতে পারে না।

একটি ব্যবস্থার মৃত্যু ঘটলেই তার অস্তিত্বরূপগুলো তখনই চকিতে অদৃশ্য হয়ে যায় না, বরং কিছু কিছু অস্তিত্বরূপ তার পরও কয়েক শতক জুড়ে জিইয়ে থাকতে পারে। যা ঘটে তা হল, এই অস্তিত্বরূপগুলো আর ‘আধিপত্যকারী’ অবস্থানে থাকে না এবং নবাগত ব্যবস্থার যুক্তিশৃঙ্খলার অধীনে কাজ করে যেতে থাকে। জমি-মালিকানার সামন্ততান্ত্রিক রূপগুলো আজ অবধি টিকে আছে, যদিও তারা আগে যা ছিল ঠিক সেরকমটাই আর নেই। ঠিক একইরকমভাবে, পুঁজিবাদী বাণিজ্যপ্রকল্প এখনও সর্বত্র দৃশ্যমান, পুঁজিবাদী অভ্যাস ও ধারণাও জিইয়ে আছে। শ্রমিকরাও উদবৃত্ত মূল্য উৎপন্ন করে চলেছে। কিন্তু এই পুঁজিবাদী কার্যক্রমগুলো ক্রমশ আরো বেশি বেশি করে উত্তর-পুঁজিবাদী যুক্তিশৃঙ্খলার মধ্যে জড়িয়ে পড়ছে। নিরন্তর উৎপাদন-প্রসার ও শ্রম কেনার মধ্য দিয়ে পুঁজির পুঞ্জীভবনের প্রক্রিয়া, যা তার বাইরে সম্পূর্ণত বা অংশত থাকা যে কোনো কিছুকে আত্মস্থ করে নিতে নিতে চলে, সেই প্রক্রিয়ার উপর আর এই কার্যক্রমগুলো দাঁড়িয়ে নেই। একইভাবে, পুঁজিবাদের মধ্যেও প্রাক-পুঁজিবাদী রূপগুলো দীর্ঘ সময় জুড়ে টিকে থেকেছিল এবং পুঁজিবাদের বিস্তারলাভে প্রয়োজনীয় ভূমিকাও পালন করেছিল। বর্তমানে অধিকারচ্যুত করার সর্বাত্মক প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে এই পুঁজিবাদী কার্যক্রমগুলো কাজ করে চলেছে। এর থেকে নিজেদের মুক্ত করতে হলে বর্তমানে আধিপত্যকারী এই প্রক্রিয়াটিকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে চিহ্নিত করা প্রয়োজন, কারণ অধিকারচ্যুত করার এই আত্মধ্বংসী ব্যবস্থা এখন আর কেবল পুঁজিবাদী রাজনৈতিক ধাঁচাগুলোর মধ্যে থেকেই কাজ করছে না।

পুঁজিবাদের অন্তিম পর্বের কাঠামোগত দ্বন্দ্বগুলো এখনো সুস্পষ্ট হয়ে রয়েছে, কিন্তু আধিপত্যকারী বলগুলোর দ্বারা কোনোভাবেই লাগামে না আসা আত্মধ্বংসী প্রবৃত্তি অনবরত তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠছে। ধ্রুপদী দ্বন্দ্বগুলোর চেয়ে আরো বেশি করে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্রিয়াকর্তাদের দ্বারা সৃজিত দ্বন্দ্বগুলো নির্ণায়ক হয়ে উঠেছে। কেবলমাত্র নিজেদের অস্বীকার করার মধ্য দিয়েই, তারা যা তার চেয়ে ভিন্নতর কিছু হয়ে ওঠার মধ্য দিয়েই এই দ্বন্দ্বগুলো তাদের ধ্বংসাত্মক কার্যক্রমকে আরো বিস্তৃত ও প্রলম্বিত করতে পারে। পুঁজির আদিম পুঞ্জীভবনের মতো কোনো পূর্ববর্তী পর্বে ফিরে যাওয়া এ নয়। এ হল এমন এক নিষ্ঠুরতম ধ্বংসাত্মক দমনব্যবস্থার সমসাময়িক নির্মাণ, যা একইসঙ্গে পুরুষপ্রভুত্ববাদী, মনুষ্যস্বার্থকেন্দ্রীক, গণহত্যা করার সীমা অবধি জাতিবিদ্বেষী, আর নারীহত্যার সীমা অবধি লিঙ্গবিদ্বেষী। রাষ্ট্রকেন্দ্রীক ধাঁচায় নির্মিত হলেও তা আগেকার প্রভুত্ববাদী শাসনগুলোর ঘরানার সঙ্গে মেলে না। এমনকি রাষ্ট্রের ভূমিকাও আর আগের সঙ্গে মেলে না, যেহেতু যা রাষ্ট্রের আপেক্ষিক স্বাধীনতা বলে প্রচলিত ছিল, তা দুর্বল হতে হতে বিলীয়মান ও তার পুনরুদ্ধার কার্যত অসম্ভব।

স্বাধীন স্বনির্ভর জীবনধারণের সমস্ত রূপ, যা পুঁজিবাদের প্রচলিত হামলা সত্ত্বেও টিকে ছিল বা সাম্প্রতিক ঘটনাপরম্পরার জবাবে স্ফূরিত হয়েছিল, সেইসব জীবনরূপকে নিশ্চিহ্ন করার অভিপ্রায় নিয়ে চালিত এক চতুর্থ বিশ্বযুদ্ধের আদলে বর্তমানে চলমান রূপান্তরপ্রক্রিয়াকে বিচার করতে হবে (সাবকমান্ডান্ট মার্কোস ২০০১)। একইসঙ্গে তা বিচার করতে হবে এমন এক যুগান্তের পরিপ্রেক্ষিতে যেখানে পুরুষতান্ত্রিকতা, আধুনিকতা ও উত্তর-আধুনিকতা, পুঁজিবাদ, ঔপনিবেশিক অস্তিত্বরূপ, শিল্পায়নজাত উৎপাদনপদ্ধতি, এবং এই সবকিছুর সঙ্গে যুক্ত রাজনৈতিক ধাঁচাগুলো ক্রমশ পরিত্যক্ত হয়ে পিছনে পড়ে থাকবে।

এই অনুমানগুলো থেকে আমার মনে হয় যে বর্তমানে আধিপত্যকারী ব্যবস্থাটিকে পুঁজিবাদী বলে গণ্য করতে থাকার জাড্য যেমন কী ঘটে চলেছে তা স্পষ্টভাবে দেখার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াবে, তেমনই অকার্যকরী হয়ে বসা বিভিন্ন প্রতিক্রিয়ার মধ্যেই আমাদের ক্রিয়াকে আটকে রাখবে। কালের নিয়মে এই ব্যবস্থার অবসানের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা আমরা করতে পারি না এই ব্যবস্থার আত্মভূক চরিত্রের কারণেই, নিজে শেষ হওয়ার আগে সমস্ত জীবিত বস্তুকেই তা শেষ করে দেবে। এই ব্যবস্থাটির অবসান ঘটিয়ে অন্যতর কিছু সৃষ্টি করতে হলে, ব্যবস্থাটিকে তার বর্তমান বাস্তবতার নিরিখেই চিহ্নিত করতে হবে, বিলীয়মান কোনো যুগের নিরিখে নয়। পুঁজিবাদকে কী টিকিয়ে রাখে সেই প্রশ্ন করার বদলে কী ভেঙে পড়ছে তা বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন এবং সেই মতো নিজেদের সংগ্রাম সংগঠিত করে তা প্রতিস্থাপন করা প্রয়োজন।

নতুন বিশ্বের নানা পথ

২০১০ সালে আমি যে ‘ঘটমান অভ্যুত্থান’ নিয়ে নিজ অনুসন্ধান শুরু করেছিলাম, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় তা অত্যন্ত সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আট বছর আগে যা আমাকে অতি কষ্টে কমবেশি অস্পষ্ট রূপরেখা ধরে চিহ্নিত করতে হচ্ছিল, তা আজ সর্বত্র মূর্ত চেহারায় নিজেকে মেলে ধরছে, যদিও এখনো তা অদৃশ্যই থেকে গেছে কারণ প্রচলিত দৃষ্টি তাকে দেখতে পায় না।

এই অভ্যুত্থান পিতৃতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ভিত্তিমূলকে ভেঙে চলেছে: কেউ নির্দেশ দেবে এবং বাকিরা তা মেনে চলবে এমন উচ্চাবচ ধাপকাটা ব্যবস্থা নিবারণ করে সামাজিক জীবনের কেন্দ্রস্থলটিকে এমনভাবে নতুন করে সূত্রায়িত করার মধ্য দিয়ে তা করছে যাতে জীবনের প্রতি যত্ন অগ্রাধিকার পায় এবং অর্থনীতিকে স্থানান্তরিত করে রাজনীতি ও নীতিবোধ ফের কেন্দ্রীয় বিষয় হয়ে উঠতে পারে। পুঁজিবাদের গণ্ডীর বাইরে বেরিয়ে তা নানা সামাজিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করছে। গণতান্ত্রিক জাতিরাষ্ট্র ও শিল্পায়ন-ভিত্তিক উৎপাদন-প্রণালী অতিক্রম করে যাওয়া সামাজিক অস্তিত্বধারণের রূপ তা কল্পনা করছে ও চর্চাতেও নিয়ে আসছে। আর এই সবকিছুই ঘটে চলেছে এমনসব উদ্যোগ ও আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যা দিনবদলের উপায়টাকেই বদলে দিচ্ছে: লেনিনীয় পরম্পরা অনুযায়ী অগ্রণীদের (vanguards) মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা জয় করার বদলে তারা তলার থেকে সাধারণ মানুষদের দ্বারা সমাজের পুনর্গঠন নিয়ে বেশি ভাবিত। আধিপত্যকারী শাসনব্যবস্থা যেভাবে তাদের প্রতিনিয়ত হেনস্থা করার চেষ্টা করে চলেছে, তার মুখে দাঁড়িয়ে সমাজ-রূপান্তরসাধনের এই ধরনের শৈলী বিভিন্ন রকমের আপসরফার মধ্য দিয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছে। বিশেষ করে তাকে সংগ্রাম করতে হচ্ছে যাতে শেষ হতে বসা যুগের বিভিন্ন ছক-রীতি-নিয়ম সেই যুগকে অতিক্রম করতে চাওয়া উদ্যোগগুলোর মধ্যে সেঁধিয়ে বসে না তাদের দূষিত, বিকৃত ও পক্ষাঘাতগ্রস্ত করে দেয়। শত্রু, বিশেষ করে পিতৃতান্ত্রিক প্রবণতাগুলো, যেভাবে ছদ্মবেশে নিজ অভ্যন্তরে সেঁধিয়ে বসে, সে বিষয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ নজর রাখা খুব জরুরী। তৃণমূলস্তরে দায়বদ্ধতার নতুন রূপগুলোর দিকেও নজর রাখা গুরুত্বপূর্ণ, কারণ সেগুলো ইতিমধ্যেই ‘ব্যবস্থার বাইরে’ অস্তিত্বধারণ করার হেতু পুরানো ধাঁচায় খাপ খায় না এমন মনোভাব ও আচরণের বুননে প্রকৃত নতুনত্বের প্রবর্তক হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে আছে। গোষ্ঠীসমাজগুলোর মধ্যে ক্রমশই বিস্তৃততর হতে থাকা সম্পর্কজালের বাঁধুনি অনুরাগ ও বন্ধুত্বের সুতোয় বোনা হয়ে চলেছে। এগুলো আর নিছক অনুভূতি হয়ে না থেকে এমন সম্পর্করূপ নির্মাণ করছে যা রাজনৈতিক উপাদান স্বরূপ নতুন সমাজের কোষগুলোকে গঠন করছে। এই সম্পর্কজালের বিবিধ বস্তুগত ভিত্তির মধ্যে অব্যবহিত রূপেই বিভিন্ন বিলোপসাধন ঘটে চলেছে, যার মধ্যে আছে শ্রমের বিলোপসাধন এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো সামাজিক বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে আধিপত্যকারী পূর্বধারণাগুলোর বিলোপসাধন। অভিনব নানা উপায়ে তারা দেশ ও জাতির সীমানা টপকে যোগসূত্র গড়ে তুলছে। যেমন ধরা যাক ‘বিকল্পের বিশ্বজোড়া নকশিকাঁথা’ (‘Global Tapestry of Alternatives’)-এর কথা, যার মধ্যে পুরুষতান্ত্রিকতা-বিরোধী, পুঁজিবাদ-বিরোধী, রাষ্ট্র-বিরোধী, জাতপাত-বিরোধী, লিঙ্গদ্বেষ-বিরোধী বিভিন্ন অভিজ্ঞতা সমবেত হয়েছে, কিন্তু কীসের তা বিরুদ্ধে সেই নেতিবাচকতা দিয়ে ‘বিকল্প’ সংজ্ঞায়িত হয় না, সংজ্ঞায়িত হয় তা কী করছে সেই সদর্থকতা দিয়ে।

এইসব যে প্রতিরোধের অভিব্যক্তি ও নতুন বিশ্বের নানা রূপের কথা আমি এখানে বললাম, তাদের ‘ফাটল’ বা ‘বুদবুদ’ হিসেবে গণ্য করা সমীচীন হবে না। একে অপরের থেকে ‘বিযুক্ত’ বা ‘আলাদা’ থেকে যাওয়া তাদের চরিত্র নয়। সাধারণ বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু পরীক্ষানিরীক্ষা তারা নয়। তাদের মধ্যস্থ ‘আঞ্চলিকীকরণ’ (localization)-এর ধারণা নিজেদের পরিস্থিতিকে জানান দিচ্ছে এবং ‘বিশ্বায়ন’ ও ‘আঞ্চলিকতাবাদ’ উভয়ের থেকেই নিজেদের আলাদা করে নিচ্ছে। দৈনন্দিন কাজে আধিপত্যকারী সমাজের সঙ্গে নানা যোগাযোগ বজায় রাখতে হলেও এই উদ্যোগগুলো নতুন সমাজসম্পর্কের উপর দাঁড়িয়ে যাত্রাশুরু করছে, আধিপত্যকারী সম্পর্কগুলো যে বাধ্যবাধকতার উপর দাঁড়িয়ে কাজ করে সেই বাধ্যবাধকতার ভিত্তি ক্রমাগত ভাঙতে ভাঙতে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই আধিপত্যকারী সম্পর্কগুলোকেও আমূল প্রত্যাখ্যান করছে। এই উদ্যোগগুলোর শিকড় অনেক গভীরে চারিয়ে আছে; যে মূর্ত বাস্তবতার মধ্যে তারা অস্তিত্বমান, তার প্রতি তারা চূড়ান্ত দায়বদ্ধ; লাগাতার হয়রানির শিকার হতে হলেও তারা নিজেদের মতো অপরদের জন্যও উন্মুক্ত, অনুরূপ অন্যান্যদের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্কজালে যুক্ত।

প্রধান দ্বন্দ্ব ও বাছাইয়ের সুযোগ

বর্তমানের এই উত্তরণকালীন পর্যায়ে দুটি সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী রাজনৈতিক প্রকল্প ও শৈলী একে অপরের বিরোধিতা করছে। তাদের মধ্যে একটি সেই আধিপত্যকারী রাজনৈতিক অতিকথার সঙ্গে যুক্ত যা সেই ১৮২০ সাল থেকে হেগেলের সারবাক্য--- সাধারণজন নিজেরাই নিজেদের শাসন করার জায়গায় নেই--- দিয়ে প্রতিপালিত। এই সারবাক্য অনুযায়ী, কে তাহলে তাদের শাসন করবে তা ঠিক করাই হয়ে দাঁড়ায় রাজনৈতিক কর্তব্য। এর অপর যে শৈলী, তা এই পরম্পরা থেকে বিচ্ছেদ ঘটিয়েছে। তা সমাজ ও শাসনের এমন এক রূপ নির্মাণ করতে চায় যেখানে সাধারণজনেরা কেবল রাজনৈতিক ক্ষমতার খাতায়-কলমে অধিকারী (যে অধিকার তারা ভোট দেওয়ার মাধ্যমে নির্বাচিত প্রতিনিধির কাছে গচ্ছিত রাখে), বরং সেই অধিকারকে তারা নিজেদের হাতে রেখে প্রয়োগ করতে পারে। দুটি রাজনৈতিক শৈলীর মধ্যেকার এই পরস্পর-বৈপরীত্যই অভিজাতদের প্রকল্প বনাম সাধারণদনদের প্রকল্পের বর্তমান বিরোধের মূলে কাজ করছে। এই বিরোধের ফল কী হয় তার উপরই নির্ভর করছে শান্তিপূর্ণ উত্তরণের সম্ভাবনা, নয়া শাসনরূপের চরিত্র এবং দেশের গতিপথ।

চিন্তা ও চর্চার একটি জোরালো ধারা মনে করে যে বিশ শতকই রাষ্ট্রের নেতৃত্বে পরিবর্তন প্রক্রিয়া সংঘটিত করার সম্ভাবনা নির্মূল হয়ে যাওয়ার সাক্ষী থেকেছে। বোনাভেনচুরা ডি সুজা-র মতে, গণতন্ত্রকে একনায়কতন্ত্র দিয়ে প্রতিস্থাপিত করার প্রয়াস আর আজ নেই, বরং আছে গণতন্ত্রকেই এমন এক অত্যাচারী হাতিয়ারে রূপান্তরিত করার প্রয়াস যা অধিকার কেড়ে নেওয়া ও ধ্বংস করার কাজকে সুগম করতে পারে। এই প্রক্রিয়ায় ‘তিনটি শক্তি একযোগে কাজ করছে, যাদের কোনোটাই গণতান্ত্রিক নয়, শক্তিগুলো হল: পুঁজিবাদ, ঔপনিবেশিকতাবাদ, এবং পুরুষপ্রভুত্ববাদ’। এর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েই উদারতাবাদী গণতন্ত্রকে ছাপিয়ে গিয়ে সামাজিক আন্দোলনসমূহের দ্বারা অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রকে নিয়ে কাজ করতে করতে তথাকথিত ‘আমূল গণতন্ত্র’ নির্মাণের পথে এগোনোর প্রস্তাব করা হয়েছে (ডি সুজা ২০১৮)। বর্তমান প্রতিক্রিয়ার চক্রের সঙ্গে যুগপৎভাবে ঘটে চলেছে ‘হলুদ গেঞ্জি’ (‘yellow vests’)-দের বিদ্রোহ, যা ইতিমধ্যেই প্রায় কুড়িটি দেশে ছড়িয়ে গেছে। বিশ্বজুড়ে নানা জায়গায় প্রতিনিধি-ভিত্তিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিভিন্ন রূপের আমূল প্রত্যাখ্যান ফুটে উঠছে: স্পেন-এর বিক্ষুব্ধ (Indignados)-রা বলছে, ‘আমার স্বপ্ন তোমার ব্যালট বাক্সে আঁটে না’; আর্জেন্তিনিয়রা ফুঁসে উঠছে, ‘সব্বাইকে বিদেয় কর!’। ‘বাম’-রাও এখন সমাধান হওয়ার বদলে সমস্যার অংশ হয়ে উঠেছে, তাই বহুদিন আগে জাপাতিস্তারা যে উপরমহল ও নীচমহলের মধ্যে ফারাক টানার প্রস্তাব করেছিল, তা আজ আরো বেশি বেশি করে অর্থপূর্ণ হয়ে উঠছে।

নীচমহলের তৃণমূলেরা উঠে দাঁড়িয়ে চলতে শুরু করেছে। বিশ শতক জুড়ে মতবাদিক রঙ নির্বিশেষে আধিপত্য করা লেনিনীয় শৈলীকে তারা পুরোপুরি পরিত্যাগ করেছে বলে মনে হয়। বিভিন্ন ভনিতা যুক্ত অগ্রণীদের বাহিনীর বদলে আবার প্রত্যাবর্তন ঘটেছে সাধারণজনেদের স্বাধীন রাজনৈতিক সক্রিয়তায়, যে সাধারণজনেরাই শেষ বিচারে যে কোনো বিপ্লবের কারিগর, এক যুগ থেকে আরেক যুগে যাওয়ার পথ যাদের হাতেই একমাত্র তৈরি হয়ে থাকে। সম্ভবত জাপাতিস্তাদের সবচেয়ে বিপ্লবী আপ্তবাক্য হল সেটি যেখানে তারা নিজেদের সাধারণজন হিসেবে পরিচয়ের উপর জোর ফেলেছে, সাধারণ পুরুষ ও নারী, বিদ্রোহী, অধীনতা না মানা স্বপ্নদ্রষ্টা হিসেবে নিজেদের জাহির করেছে। এখন সময় এসেছে সাধারণজনের কথায় কান দেওয়ার, তাদের সঙ্গে এক অনবচ্ছিন্ন কথোপকথন জারী রাখার। আর কমান্ডার তাহো যেমন একবার বলেছিলেন, কান পাতা মানে কেবল অপরের কথা শোনাই নয়, অপরের দ্বারা নিজে রূপান্তরিত হওয়ার জন্য রাজি থাকাও বটে।

এইসব উদ্যোগের অংশ হিসেবে গড়ে ওঠা চর্চাগুলোয় কী করা হয়ে চলেছে তার অর্থ-তাৎপর্য খেয়ালে রাখা খুব গুরুত্বপূর্ণ। যেমন ধরা যাক, খাদ্য সার্বভৌমত্বের নামে আমরা গৃহে খাদ্য ফলানোকে উদযাপন করি। কিন্তু এর মধ্য দিয়ে প্রতিক্রিয়াশীল টমেটো আর বিপ্লবী টমেটো, দুইয়েরই যে চাষ হতে পারে, তা খেয়ালে রাখা ও সেই পার্থক্যীকরণ করা দরকার। যা চলে এসেছে তাকেই আরো বাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া ঘটতে পারে যদি ব্যক্তিসর্বস্ব আত্মকেন্দ্রীক খোশখেয়ালে ওয়ালমার্ট থেকে বীজ ও রাসায়নিক কিনে কেউ এ কাজে লিপ্ত হয়। আবার অন্যদিকে সাধারণ স্বার্থ বহনকারী পরিবারদের মধ্যে গোষ্ঠীগত যোগাযোগ-জাল তৈরি করার চেষ্টার মধ্য দিয়ে তা করলে তা অবিলম্বেই  নতুন সমাজের কোষ জন্ম দিতে পারে।

আজকের এই চরম বিয়োগাত্মক মুহূর্তে পরিবর্তনকামী যে কোনো উদ্যোগের মূল দুটি স্তম্ভ মনে হয় আশা ও বিস্ময়। আশাই গণআন্দোলনগুলোর সারবত্তা হয়ে আছে, আর আজ এটা স্পষ্ট যে একসময় ইলিচ যেমন পূর্বানুমান করেছিলেন, সামাজিক বল হিসেবে আশা পুনরুদ্ধার করার উপরই মানব প্রজাতির অস্তিত্ব টিকে থাকা নির্ভর করছে (ইভান ইলিচ ১৯৯৬, পৃঃ-১০৬)। বিস্ময়ের অর্থ হল সমস্তরকম নির্ধারণবাদী (deterministic) পূর্বানুমান ও পরিকল্পনা সচেতনভাবে পরিহার করা, বিশেষ করে সেসব পূর্বানুমান ও পরিকল্পনা যেগুলো ‘সমগ্র রূপে সমাজ’-এর কথা বলে, কারণ সবসময়েই সমাজ বিপুল সংখ্যক বিষয় ও আচরণের প্রতিফল, যাদের সম্পর্কে আগে থেকে সম্পূর্ণ আন্দাজ করা সম্ভব নয়। শেষত, জরুরী হল যন্ত্রণা ও হিংসার রূপান্তর ঘটিয়ে বন্ধুত্বমূলক পুনর্গঠনের চেহারা দেওয়া, যা গোষ্ঠী-সামাজিক বোঝাপড়ার উপর ভিত্তি করে এক ছাদের নীচে সহবাসের জন্য প্রয়োজনীয় সীমারেখাগুলো টেনে দেবে, রাষ্ট্রের থেকে দূরত্ব বজায় রাখবে, তথাকথিত পুঁজিবাদের সর্বশক্তিমানতার অতিকথা বর্জন করবে এবং লিঙ্গভিত্তিক শাসনের যুগ পেরিয়ে নতুন ভবিষ্যৎ রচনা করবে (ইভান ইলিচ ২০০৬, পৃঃ-৭৬১)। নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থায় উত্তরণকালের যে পর্বে এখন আমরা আছি, সেখানে রাজনৈতিক নেতৃত্বে (নেতৃত্বদায়ী ব্যক্তিত্বে ও নেতৃত্বদানের উপায়ে উভয়তই) বিস্তর পরিবর্তন সূচিত হচ্ছে, সাধারণজনেদের মধ্যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সম্পর্কেও পরিবর্তন ঘটে চলেছে। অনাগত বছরগুলোতে হয়ত আবার সর্বজনের পরম্পরা ও অগ্রণীদের পরম্পরা একে অপরের মুখোমুখি দাঁড়াবে উত্তরণপর্বের দিক ও দিশা নির্ণয় করে দিতে। সর্বজনের পরম্পরাকে আচারসর্বস্ব গণতন্ত্রের মধ্যে আটকে রাখা আর সম্ভব নয়, গণতন্ত্রের অর্থ সম্পর্কে নিজস্ব ধারণার অধিকারী তা হয়ে উঠেছে। কোনো একটি দেশে গণতন্ত্র সম্পর্কে কোন ধারণাটি প্রাধান্য পাচ্ছে, সেই দেশে উত্তরণপর্বের অর্থ- তাৎপর্য তার উপর নির্ভর করবে।

একটি জাতির যাত্রাপথকে নিজেদের মতো করে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা যে দুই ধরনের প্রবণতা করে চলেছে, তাদের মধ্যে চলমান পুরানো ঐতিহাসিক বিবাদের শেষ পর্বে আজ আমরা উপনীত হয়েছি। তাদের মধ্যে একটি প্রবণতা জাতিকে এই একুশ শতকেও সেই আধিপত্যকারী রাজনৈতিক শৈলীর মধ্যেই বাঁধতে চাইছে যদিও সেই রাজনৈতিক শৈলীর সারা গায়ে ফাটল ছড়িয়ে গিয়ে একটি আত্মধ্বংসী উৎসন্নকারী প্রবণতা হিসেবে তা নিজেকে প্রমাণিত করেছে। আর অন্য প্রবণতাটি চেষ্টা করে চলেছে সর্বসাধারণের অধিকার প্রতিষ্ঠার উপর দাঁড়িয়ে আমূল গণতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত করার জন্য, যে বিপ্লব আজ মনে হয় বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে।

 

টীকা-টিপ্পনী

১। The Movemento dos Trabalhadores rurais Sem Terra (MST) হল ব্রাজিলের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন যা লাতিন আমেরিকায় একটি দৃষ্টান্ত-স্থাপনকারী শক্তি হয়ে উঠেছে। ব্রাজিলের মতো একটি দেশে যেখানে জনগণের ১%-র হাতে চাষযোগ্য জমির ৪৬% কেন্দ্রীভূত, সেখানে MST-র সঙ্গে দেশের সরকারের বিরোধ ও টানাপোড়েন লেগেই রয়েছে। ২০০৯ সালের অক্টোবরে দেশের ক্ষমতাধর কৃষিবাণিজ্য মহলের চাপে সরকার একটি সংসদীয় কমিশন গঠন করেছিল MST সম্পর্কে তদন্ত করার জন্য।

২। ফরাসী ও স্প্যানিশ ভাষায় saber ও conocer শব্দদুটোর মধ্যে যে অর্থের ফারাক ধরা আছে, তেমন কোনো বাংলা শব্দের অভাবে আমরা এখানে অর্থ-তাৎপর্যের ফারাকটিকে ধরার জন্য saber-এর জায়গায় অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান এবং conocer-এর জায়গায় প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান ব্যবহার করছি (--- বর্তমান অনুবাদক)।

৩। জে কে গিবসন-গ্রাহাম আসলে জুলি গ্রাহাম এবং ক্যাথরিন গিবসন, এই দুই নারীবাদী ভূগোলজ্ঞের যৌথ-নাম হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।

৪। এই একই দৃষ্টিভঙ্গি আরেকটি ভূতের ঘাড়ে সওয়ার হয়েও সংগ্রাম-আন্দোলনের আঙিনায় প্রবেশ করেছে। সেই ভূতটি হল সমাজতন্ত্রের ভূত, যে সমাজতন্ত্রকে পুঁজিবাদের বৈধ ও আবশ্যক উত্তরাধিকারী হিসেবে কাঠামোকৃত করা হয়েছে। ওই ঘরানার দৃষ্টিভঙ্গিসমূহের মধ্যে যেগুলো একটি দেশে সমাজতন্ত্র নির্মাণের সম্ভাব্যতার উপর জোর দিয়ে তৈরি হয়েছিল এবং মনে করত যে পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্র শান্তিপূর্ণভাবে পাশাপাশি সহাবস্থান করতে পারে, সেগুলো নির্বাপিত হয়ে গেছে যখনই সোভিয়েত অভিজ্ঞতা রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ হিসেবে চরিত্রায়িত হয়েছে। শেষ অবধি যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ল, তখন বহুজন এভাবে ভাবতে চালিত হয়েছিলেন যে পুঁজিবাদে পৌঁছানোর সবচেয়ে দীর্ঘসূত্রী, সবচেয়ে নির্মম এবং সবচেয়ে অদক্ষ পথ ছাড়া সমাজতান্ত্রিক অভিজ্ঞতা আর কিছুই নয়। একবার যদি আমরা স্বীকার করে নিই যে একটি ঐতিহাসিক প্রতীতি হিসেবে সমাজতন্ত্র তার শেষের শুরুতে অবস্থান করছে এবং মতবাদ হিসেবে সমাধানহীন বাদানুবাদের ঘূর্ণিতে ডুবতে বসেছে, তাহলে প্রশ্নটি দাঁড়ায় উত্তরাধিকারী হিসেবে নতুন পথ করে নেওয়ার।

৫। প্রবচনটি নিখুঁতভাবেই তাদের জন্য প্রযোজ্য। ‘আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের’ ভূতের ভয় দেখিয়ে বহু সরকারই নিজেরা সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ জারি করছে। নেশাদ্রব্য (drugs)-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধকে দমনমূলক ও প্রভুত্ববাদী হিংসার অজুহাত করে তুলে সরকারগুলো এমন নানা অবৈধ ও বিধিবিরুদ্ধ হিংসাত্মক কার্যকলাপ চালাচ্ছে যা তাদের তথাকথিত নিশানা চোরাচালানকারীদের করা হিংসা-অপরাধের চেয়ে ধারে-ভারে অনেক বেশি।

৬। মেহিকোতে এই অনুমানটিকেও আমাদের বিচার করে দেখতে হবে যে ‘mestizage’ ধারণাটি গভীরভাবেই জাতিবিদ্বেষী ও লিঙ্গবিদ্বেষী মনোভাবাপন্ন, যা হয়তো বর্তমান সামাজিক বিন্যাস ও তার মধ্যে আধিপত্যকারী বর্বরতার ফসল ব্যক্তিবাদী খণ্ডিতকরণের পিছনে অন্যতম কারণ হিসেবে কাজ করছে।

৭। শ্রমের বিলুপ্তি নিয়ে প্রচুর লেখাপত্র ইতিমধ্যেই হয়েছে, যেমন Krisis Group (১৯৯৯) ও জন হলোওয়ে (২০১১)।

 

সূত্রপঞ্জী

অরুন্ধতী রায়,২০০৭,‘India is ColonisingItself—Interview with A. Roy’,তেহেলকা,সংহতি,মার্চ, http://sanhati.com/articles/159/।

অ্যাডোলফো গিলি, ২০০৮, মূল লেখকের সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপচারিতা।

আনসেল্ম জাপ্পে, ২০১৭, La Societe autophage: Capitalisme, demesure et autodestruction, পারি: লা দিকুভের।

আমেরিকা প্রোফান্ডা, ২০০৪, America Profunda: Coloquio, Simposio, Foro, লিমা: PRATEC-CEDI।

ই জেড এল এন, ২০০৭, ‘Plantea el EZLN campana mundial en defense de territories indigenas’, লা জোর্নাদা, ২৬ মার্চ, https:// w.w.w.jornada.com.mx/2007/03/26/index.php?article=013 n1pol§ion=politica/।

ইভান ইলিচ, ১৯৭৩, Tools for Conviviality, নিউ ইয়র্ক: হার্পার অ্যান্ড রো।

ইভান ইলিচ, ১৯৯৬, Deschooling Society, লন্ডন: মারিয়ন বোয়ারস।

ইভান ইলিচ, ২০০৬, ‘La necesidad de un techo comun’, সংকলন গ্রন্থ: ইভান ইলিচ, Obras Reunidas, 1, মেহিকো সিটি: ফন্ডো ডি কালচুরা ইকোনমিকা।

উল্ফগ্যাঙ দিয়েত্রিচ এবং উল্ফগ্যাঙ শুলজ, ১৯৯৭, A Call for Many Peaces, স্ট্যাডশ্লেনিং, অস্ট্রিয়া: পিস সেন্টার বুর্গ শ্লেনিং।

উল্ফগ্যাঙ স্যাকস, ১৯৯২, ‘One World’, The Development Dic-tionary: A Guide of Knowledge as Power, লন্ডন: জেড বুকস।

এদুয়ার্দো গালিয়ানো, ১৯৯৮, Patas arriba: la escuela del mundo al reves, মাদ্রিদ: সিগলো XXI ডি এসপানা এডিটোরেস।

ওয়েন্ডেল বেরি, ২০০৩, The Art of the Commonplace: The Agrarian Essays of Wendell Berry –বইয়ের ‘The Body and the Earth’ প্রবন্ধ, বার্কলে: কাউন্টারপয়েন্ট প্রেস।

ক্রাইসিস (Krisis) গ্রুপ, ১৯৯৯, ‘Manifesto against Labour’, Krisis.org।

ক্লডিয়া ভন ওয়ের্লহফ এবং ম্যাথিয়াস বেহমান, ২০১০, Teoria Critica del Patriarcado, ফ্রাঙ্কফুর্ট: পিটার ল্যাঙ।

গুস্তাভো এস্তেভা, ১৯৭৯, ‘Tecnologia, enajenacion y necesidades sociales’, El Estado y la Communicacion, মেহিকো: এডিটোরিয়াল নুয়েভা পলিটিকা।

গুস্তাভো এস্তেভা, ১৯৯৪, Cronica del fin de una era, মেহিকো: এডিটোরিয়াল পোসাদা।

গুস্তাভো এস্তেভা, ১৯৯৮ক, ‘The Revolution of the New Commons’, কার্টিস কুক এবং হুয়ান ডি লিন্ডা সম্পাদিত Aboriginal Rights and Self-Government, পৃঃ-১৮৬-২১৭, মনট্রিল: ম্যাকগিল-কুইনস ইউনিভার্সিটি প্রেস।

গুস্তাভো এস্তেভা, ১৯৯৮খ, La construccion de un camino propio, মেহিকো: অপসিয়োনেস কনভিভিয়ালেস ডি মেহিকো।

গুস্তাভো এস্তেভা, ১৯৯৯, The Zapatista and People’s Power, ক্যাপিটাল অ্যান্ড ক্লাস, ৬৮, সামার, পৃঃ-১৫৩-১৮২।

গুস্তাভো এস্তেভা, ২০০৩, ‘Racismo y sexism: dos caras de la ceguera dominante’, প্রোসেকো, ১৩৬৭, ১২ জানুয়ারি।

গুস্তাভো এস্তেভা, ২০০৫, Celebration of Zapatismo, ওয়াহাকা: এডিটোরিয়াল Basta!

গ্লোরিয়া মুনোজ রামিরেজ, ২০০৭, ‘Ecos de Oventik’, লা জোর্নাদা, ৮ জানুয়ারি, https://www.jornada.com.mx/2007/01/08/index. php?section=opinion&article=013o1pol/।

জন হলোওয়ে, ২০০২, Change the World Without Taking Power, লন্ডন: প্লুটো প্রেস।

জন হলোওয়ে, ২০১১, Crack Capitalism, লন্ডন: প্লুটো প্রেস।

জে কে গিবসন-গ্রাহাম, ১৯৯৬, The End of Capitalism (as we knew it): A Feminist Critique of Political Economy, অক্সফোর্ড অ্যান্ড কেমব্রিজ, এম এ: ব্ল্যাকওয়েল।

ড্যানিয়েল গুয়েরিন, ১৯৭০, Anarchism: From Theory to Practice, নিউ ইয়র্ক: মান্থলি রিভিউ প্রেস।

দি ইনভিজিবিল কমিটি, ২০০৯, The Coming Insurrection, লস অ্যাঞ্জেলস, CA: Semiotext(e)।

পল স্ট্রিটেন, ১৯৬৭, ‘The Frontiers of Development Studies: Some Issues of Development Policy’, জার্নাল অফ ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (অক্টোবর), পৃঃ-২-২৪।

পল স্ট্রিটেন, ১৯৭৫, ‘Industrialization in a Unified Development Strategy’, ওয়ার্ল্ড ডেভেলপমেন্ট (জানুয়ারি), পৃঃ-১-৯।

ফ্রেডরিক আপফেল-মার্গলিন (সম্পাদিত), ১৯৯৮, The Spirit of Regeneration: Andean Culture Confronting Western Notions of Development, লন্ডন: জেড বুকস।

ভিয়া ক্যাম্পেসিনা, ২০০৭, ‘Declaracion de Nyeleni’, মালি, ২০০৭, https://viacampesina.org/en/declaration-of-nyi/

রব হপকিনস, ২০০৮, The Transition Handbook: From Oil Dependency to Local Resilience, ভারমন্ট: চেলসি গ্রিন পাবলিশিং।

রাইমন পানিক্কর, ১৯৯৩, ‘La diversidad como presupuesto para la armonia entre los pueblos’, উইনে মার্কা, নং ২০ (মে), পৃঃ-১৫-২০।

রাউল জীবেচি, ২০১০, ‘Congreso de los Pueblos: la Colombia de bajo y a la izquierda’, লা জুর্নাদা, https://www.jornada.com. mx/2010/11/19/opinion/021a1pol/।

রোজালি বার্তেল, ২০০০, Planet Earth: The Latest Weapon of War, লন্ডন: উওমেনস প্রেস।

বোনাভেনচুরা ডি সুজা সানতোস, ২০১৮, Construyendo las Epistemologias del Sur: para un pensamiento alternative de alternativas, Volumen II –বইয়ে ‘Concepciones hegemonicas y contrahegemonicas de la democracia’ প্রবন্ধ, পৃঃ-৫১৫-৫২৬, বুয়েনোস আয়ারস: CLASCO।

মিডনাইট নোটস কালেকটিভ, ১৯৯৭, ‘One No, many Yeses’ মিডনাইট নোটস, নং ১২, http://www.midnightnotes.org/oneno.html/

মিডনাইট নোটস কালেকটিভ, ২০০৯ ‘Promissory Notes: From Crisis to Commons’, http://www.midnightnotes.org/Promissory% 20Notes.pdf/।

মিশেল ফুকো, ১৯৭০, ‘The archaeology of knowledge’, সোশাল সায়েন্স ইনফরমেশন ৯, নং ১, পৃঃ-১৭৫-১৮৫।

মিশেল ফুকো, ১৯৮০, Power/Knowledge, কলিন গর্ডন সম্পাদিত, নিউ ইয়র্ক: প্যানথিয়ন বুকস।

মিশেল ফুকো, ১৯৮৩, Anti-Oedipus: Capitalism and Schizophrenia –বইয়ের ভূমিকা, মিনিয়াপোলিস: ইউনিভার্সিটি অফ মিনেসোটা প্রেস।

মিশেল ফুকো, ২০০২, Defender la sociedad, মেহিকো: FCE।

মিশেল ফুকো, ২০০৮, The Birth of Biopolitics: Lectures at the College de France, 1978-1979, মিশেল সেনেলার্ট সম্পাদিত, গ্রাহাম বুরচেল দ্বারা ইংরেজিতে অনূদিত, নিউ ইয়র্ক: প্যালগ্রেভ ম্যাকমিলান।

মিশেল ফুকো এবং নোয়াম চমস্কি, ২০০৬, The Chomsky-Foucault Debate: On Human Nature, নিউ ইয়র্ক: নিউ প্রেস।

মোনিকা চুজি, ২০০৯, Modernity, Development, Interculturality and Sumak Kawsay or Living Well not Better, কলম্বিয়া: ইনটারন্যাশনাল ফোরাম অন ইনটারকালচারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট।

ম্যাট হেনরি, ২০১০, Common Ground in a Liquid City: Essays in Defense of an Urban Feature, এডিনবার্গ-ওকল্যান্ড-বাল্টিমোর: এ কে প্রেস।

সাবকমান্ডান্ট মার্কোস, ১৯৯৪, ‘Discurso de Subcommandante Marcos durante la visita de Cuauhtemoc Cardenas’, Ezln.org, ১৭ মে, ১৯৯৪, https://enlacezapatista.ezln.org.mx/1994/05/ 17/discurso-del-subcomandante-marcos-durante-la-visita-de-cuauhtemoc-cardenas-hemos-visto-con-preocupacion-que-el-prd-tiende-a-repetir-en-su-seno-aquellos-vicios-que-envenenaron-desde-su-nacimiento-al-p/।

সাবকমান্ডান্ট মার্কোস, ২০০১, ‘La Cuarta Guerra Mundial’, Inmotionmagazine.com, ২৬ অক্টোবর, ২০০১, https://inmotion magazine.com/auto/cuarta.html/।

সাবকমান্ডান্ট মার্কোস, ২০০৩, El mundo: siete pensamientos en mayo de 2003, https://enlacezapatista.ezln.org.mx/2003/05/ 02/el-mundo-siete-pensamientos-en-mayo-de-2003-mayo-del-2023/।

সি জেমস স্কট, ১৯৯৮, Seeing Like a State, নিউ হাভেন অ্যান্ড লন্ডন: জেড বুকস।

হোসে স্বার্ট, ১৯৯২, ‘Progress’, Development Dictionary: A Guide of Knowledge as Power, লন্ডন: জেড বুকস।

1 Comments
  • avatar
    প্রভাস চৌধুরী

    06 March, 2025

    জাপাতিস্তা নিয়ে গুস্তাভো এস্তেভার লেখা অনুবাদের জন্য ধন্যবাদ বিপ্লব। এই লেখার সূত্রপঞ্জীতে জন হলওয়ের নাম এসেছে। প্রসঙ্গত জানাই জনের ক্র্যাক ক্যাপিটালিজম বাংলায় আমার ভাষান্তর ও সম্পাদনায় ফাটল ধরাও পুঁজিবাদে প্রকাশিত হয়েছে তবুও প্রয়াস থেকে ২০২২-এ, বাঙলা সংস্করণে জনের ভূমিকা সহ। এবং ট্রিলজির তৃতীয় বই (প্রথম চেঞ্জ দ্য ওয়ার্ল্ড ...) হোপ ইন হোপলেস টাইমস আমার ভাষান্তর ও সম্পাদনায় নিরাশার দিনে আশা প্রকাশিত হয়েছে তবুও প্রয়াস থেকে ২০২৫ কলকাতা বই মেলায়। বাংলা সংস্করণে জন আফটারওয়ার্ডস লিখেছেন। গুস্তাভোর মতো জনও শুরু থেকেই জাপাতিসমো আন্দোলনে জড়িয়ে। ফলশ্রুতিতে ১৯৯৮-এ জন হলওয়ে এবং এলইনা পেলয়েজের সম্পাদনায় প্লুটো প্রেস থেকে প্রকাশিত হয় জাপাতিস্তা! রিইনভেন্টিং রেভেলিউশন ইন মেক্সিকো। জনের ট্রিলজির প্রথম বই চেঞ্জ দ্য ওয়ার্ল্ডের অনুবাদ কাজ চলছে।

Leave a reply