উন্নয়নী তাণ্ডবে বিপন্ন বাংলার জৈবসংস্কৃতি

লিখেছেন:বিপ্লব নায়ক
দেবল দেবের ‘বিচ্যুত স্বদেশভূমি’ পাঠের প্রতিক্রিয়াসঞ্জাত ভাবনা থেকে এই লেখার শুরু। পশ্চিমী উন্নয়নী বিশ্ববীক্ষা কীভাবে একদিকে জৈবজগতের ধ্বংস ডেকে আনছে ও অন্যদিকে আমাদের চেতনাকেও ভোগ-উপযোগিতা-বাদী অন্ধত্বে অসাড় ও অক্ষম করে তুলছে সেই কুলজিই ক্রমশ উদ্ঘাটিত হয়েছে...

 

কথাপ্রসঙ্গ

গবেষক ও বিজ্ঞানকর্মী দেবল দেবের লেখা ‘বিচ্যুত স্বদেশভূমি’ বইটি সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। জৈব সংস্কৃতি গবেষণা ও সংরক্ষণের প্রতিষ্ঠান ‘বসুধা’ ও ‘ধ্যানবিন্দু’ প্রকাশনা যৌথভাবে বইটি প্রকাশ করেছে। বইটির উপশিরোনাম হলো: ‘বাংলার জৈব সংস্কৃতির লুপ্তাবশেষের সন্ধান’। বইটিতে বাংলার (পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ মিলে বাংলার গোটা সাংস্কৃতিক ভূখণ্ডের) জৈব সংস্কৃতির বহুত্ব ও বৈচিত্র্য যেমন নিষ্ঠাবান অনুসন্ধানের মধ্য দিয়ে তুলে ধরা হয়েছে, তেমনই ‘প্রগতি-উন্নয়ন-আধুনিকতার’ ত্রিফলা আক্রমণের ধ্বংসাত্মক পরিণতিস্বরূপ সেই সংস্কৃতির শোচনীয় ক্ষয়কেও তুলে ধরা হয়েছে। লেখক দেবল দেব এই বিষয় নিয়ে তিরিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে নিরবচ্ছিন্নভাবে গবেষণা-অনুসন্ধান ও সংরক্ষণ প্রচেষ্টায় নিযুক্ত। বইটির শুরুতে লেখকের পরিচয় দান করতে গিয়ে দীপংকর সেনগুপ্ত লিখেছেন:

ভারতের খাদ্য সংস্কৃতি, খাদ্যসুরক্ষা ব্যবস্থা, ধানের মূল প্রজাতির ঈষৎ ভিন্ন নানান জাতের সুলুক-সন্ধান, আমাদের দীর্ঘ ঐতিহ্যবায়ী চাষবাসের পদ্ধতি ও সময়ের পথ বেয়ে তার পথ পরিবর্তনের ইতিহাস, জীববৈচিত্র্য ও তার সংরক্ষণ, এই বাংলার ‘পবিত্র বন’ (তঁার নিজের ভাষায় ‘থানের জঙ্গল’) বিষয়ে দিকনির্দেশকারী গবেষণা, বনজঙ্গলের বাস্তুসংস্থান (ecosystem) ও তার ব্যবস্থাপনাগত প্রকৌশল, সুস্থায়ী উন্নয়নের অর্থনীতি ও রাজনীতি— ইত্যাদি, এবং আরও বিচিত্র বিষয়ের অনুসন্ধানে ব্রতী হয়েছেন এই ব্যতিক্রমী বিজ্ঞানী। (বিচ্যুত স্বদেশভূমি, পৃষ্ঠা-৭)

তঁার এই অনুসন্ধান ও তার থেকে জন্ম নেওয়া ভাবনা বহু গবেষণাপত্র, আন্তর্জাতিক গবেষণা-পত্রিকায় প্রকাশিত নিবন্ধ ও পুস্তকে প্রকাশলাভ করেছে। সেসবই ইংরেজি ভাষায়। কেবল ২০০০ সালে ‘লুঠ হয়ে যায় স্বদেশভূমি’ নামে বাংলা ভাষার একটি কৃশতনু পুস্তিকায় তিনি ধানের বৈচিত্র্য ও বাংলার খাদ্যসংস্কৃতির উপর ‘আধুনিক বৈজ্ঞানিক পন্থার কৃষি ও শিল্পোন্নয়ন যজ্ঞের’ নামে চালানো কালাপাহাড়ি আক্রমণ-লুন্ঠনের বর্ণনা রচনা করেছিলেন। তার একুশ বছর পর এই ‘বিচ্যুত স্বদেশভূমি’ পুস্তকে তিনি আরও সামগ্রিকভাবে তথ্য ও তত্ত্বের সহাবস্থানে তঁার অনুসন্ধান-গবেষণা-লব্ধ উপলব্ধিকে বাংলা ভাষার পাঠকদের সাধারণ দরবারে হাজির করেছেন। বাংলা ভাষার পাঠকদের কাছে নিঃসন্দেহে এ এক পরম প্রাপ্তিবিশেষ। ক্রম-বিলীয়মান জৈব বৈচিত্র্য সম্পর্কে সাধারণভাবে সচেতনতা তৈরি ও সংরক্ষণে আগ্রহ তৈরির জন্যও এই বইটি হাতিয়ার হিসেবে কাজ করতে পারে। বইটি নির্মাণ ও প্রকাশের সঙ্গে যুক্ত সবাইকে ধন্যবাদ জানানোর সাথে সাথে তাই এই অনুরোধও করতে হয় যে বইটিকে বা তার বিষয়বস্তুকে শহর-গ্রাম-গঞ্জের পাঠকসাধারণের মধ্যে সুলভ করে তোলার আরও কিছু উপায় আমাদের ভাবা উচিত। ৫৫০ টাকা দাম হওয়ার কারণে বইটি অনেকের কেনার ক্ষমতার বাইরে থেকে যাবে। বইটির নির্মাণখরচের কারণে এর দাম যদি এরকমই রাখতে হয়, তাহলে বইটির তুলনায় সুলভ (কম খরচে নির্মিত, তাই কম দামে দেওয়া সম্ভব) কোনও সংস্করণ বের করা যায় কিনা তা লেখক ও প্রকাশকদের বিচার করতে অনুরোধ করব।

অপর একটি দায় থাকে পাঠকের। বইটি পাঠের অভিজ্ঞতা অনিবার্যভাবেই মনের মধ্যে অনেক অচলায়তনের গোড়ায় আঘাত করে। এই অচলায়তনগুলো হল ‘আধুনিক বিজ্ঞান’, ‘প্রগতি’, ‘যন্ত্রশিল্প ও যন্ত্রপ্রযুক্তি নির্ভর উন্নয়ন’ নামক অচলায়তনসমূহ যাদের কাছে আমরা নির্বিচার বশ্যতা স্বীকার করে দিনগত পাপক্ষয় করে চলেছি। এই যেগুলোকে আমরা ‘সবার উপরে সত্য’ বলে মান্যতা দিয়ে আসতে অভ্যস্ত, সমাজতন্ত্র বা রামরাজ্য— দুধরনের ভবিষ্যৎনির্মাতারাই যাদের মধ্য দিয়ে ভবিষ্যতে পৌঁছানোর কথা বলে থাকেন, এই বই পাঠের অভিজ্ঞতা সেইসব ‘পরম সত্য’ সম্পর্কে প্রশ্ন-সংশয়-বিরোধাভাসের জন্ম দেয়। পাঠক নিজের মধ্যে এই প্রশ্ন-সংশয়-বিরোধাভাসগুলোকে বেড়ে উঠে ফুল-ফল ফলানোর সারমাটি দেবেন, বারোয়ারি আলোচনায় স্বাভাবিকভাবে প্রকাশ করবেন, তার মধ্য দিয়ে হয়তো এই বইয়ের জন্ম দেওয়া বীজ নতুন চারার রূপ নিতে পারবে। পাঠকের এই দায় থেকেই বর্তমান আলোচনার অবতারণা।

বিজ্ঞান-প্রগতি-উন্নয়নের অচলায়তন

‘বিচ্যুত স্বদেশভূমি’-র ৯১ পৃষ্ঠায় লেখক দেবল দেব একটি সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গিকে হাজির করেছেন সারণির আকারে। এই সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গিটিকে তিনি ‘পাশ্চাত্য উন্নয়নী বিশ্ববীক্ষা’ নাম দিয়েছেন। সারণিটি এইরকম:

 

সারণির দুদিকের মধ্যে একদিককে ‘অনুন্নত’ আর অপরদিককে ‘উন্নত’ বলে নির্ধারণ করার মধ্য দিয়ে যেমন দুদিককে একটা আপেক্ষিক তুলনামূলক নিকৃষ্ট-প্রকৃষ্ট সম্পর্কে বাঁধা হয় ( যেমন: সভ্যতার তুলনায় প্রকৃতি নিকৃষ্ট, লিপিবিশিষ্ট সভ্যতার তুলনায় লিপিবিহীন সভ্যতা নিকৃষ্ট, ইওরোপীয় সভ্যতার তুলনায় ইওরোপ-বহির্ভূত সভ্যতা নিকৃষ্ট, ইত্যাদি), তেমনই কাঙ্খিত পরিবর্তন বা বিবর্তনের একটি ক্রমকে ‘স্বাভাবিক’ হিসেবে হাজির করা হয় (যেমন: প্রকৃতির উপর নিয়ন্ত্রণ/আধিপত্য কায়েম করে সভ্যতায় ‘বিবর্তিত’ হওয়া, লিপিবিহীন সভ্যতা থেকে লিপিবিশিষ্ট সভ্যতায় ‘উন্নীত’ হওয়া, ইওরোপ বহির্ভূত সভ্যতা ইত্যাদি)। এই পরিবর্তন বা বিবর্তনের একধরনের ক্রম হাজির হয়, যেমন:

ক্রম ১: বনাঞ্চল→ গ্রাম→ নগর

ক্রম ২: অরণ্য/চারণভূমি→ কৃষিক্ষেত্র→ কল-কারখানা

ক্রম ৩: শিকার-সংগ্রহজীবিকা/পশুচারণ→ কৃষিকাজের অর্থনীতি→ শিল্প-অর্থনীতি

ক্রম ৪: বনবাসী শিকারী/সংগ্রহজীবী→ কৃষক→ শিল্পে নিযুক্ত শ্রমিক/কর্মচারী/আধিকারিক

ক্রমোন্নতির স্বাভাবিক ও স্বতঃসিদ্ধ ক্রম হিসেবে, অর্থাৎ যে কোনও সমাজের বিকাশের স্বাভাবিক নিয়ম হিসেবে এটি উপস্থিত হয়।

দেবল দেব এই বিশ্ববীক্ষার যে নাম দিয়েছেন সেটিও তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি এর নাম দিয়েছেন ‘পাশ্চাত্য উন্নয়নী বিশ্ববীক্ষা’। ‘পাশ্চাত্য’ বিশেষণটির মধ্য দিয়ে তিনি এই বিশ্ববীক্ষার ঐতিহাসিক উৎস বা জন্মসূত্রটিকে চিহ্নিত করতে চেয়েছেন। পশ্চিম ইওরোপে তথাকথিত ‘শিল্পবিপ্লব’ ও পুঁজিবাদী শিল্পোৎপাদন কেন্দ্রীক সমাজের উদ্ভবের লগ্নে ষোল-সতের শতক জুড়ে এই বিশ্ববীক্ষা দানা বেঁধেছিল। প্রকৃতিকে কেবলমাত্র কঁাচামালের ভাণ্ডার হিসেবে গণ্য করে কীভাবে তা আরও দ্রুত ও আরও ব্যাপক ভাবে নিঙডে় নিয়ে শিল্পোৎপাদন যজ্ঞকে অন্তহীন বিস্তারের পথে ঠেলে নিয়ে যাওয়া যায়, সেটাই হয়ে উঠেছিল চালিকাশক্তি। প্রথমে পশ্চিম ইওরোপের দেশগুলোর মধ্যের গ্রামীণ সংস্কৃতি এর ধাক্কায় ভেঙে পড়েছিল, গ্রামের মানুষ দলে দলে সর্বহারা, আশ্রয়হীন ভবঘুরে, হতদরিদ্রে পরিণত হয়েছিল আর তাদের সহায়সম্বল প্রকৃতির সমস্ত ধনকে নিঙড়ে, উপড়ে, পুঞ্জীভবন করে যন্ত্র-শিল্পোৎপাদনের ভিত পাতা হয়েছিল। তারপর এই পাশ্চাত্য দেশগুলির উপনিবেশ বিস্তারের মধ্য দিয়ে ক্রমে এই প্রক্রিয়া অন্যান্য মহাদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার আদিবাসী সমাজ-সংস্কৃতি নিশ্চিহ্ন করার কাজে ইওরোপীয় উপনিবেশ-বিস্তারকদের গোলা-বারুদ-বন্দুকের অপ্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি লাখ লাখ আদিবাসীদের ‘শিকার’ করে জনজাতির পর জনজাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল। সেই মৃগয়াক্ষেত্রে পশ্চিম ইওরোপের প্রতিবিম্ব হিসেবে ‘নয়া আধুনিক সমাজের’ পাট বসিয়েছিলেন ইওরোপীয় দখলদাররা। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়েছে অস্ট্রেলিয়া মহাদেশে, আফ্রিকা মহাদেশে এবং ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপপুঞ্জে। মানুষ মারার অস্ত্রকে অত্যুন্নত করে ও মানুষ মারাকে নিঃসংকোচ হেলাফেলার কাজে পরিণত করে মহাদেশের পর মহাদেশে দখলদারি কায়েম করা এই পশ্চিমী ইওরোপীয়রা নির্ধারণ করলেন যে তঁাদের এই ‘সাফল্যের’ কারণ তঁাদের নিজ সভ্যতার সর্বোৎকৃষ্টতা। অর্থাৎ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকা ও অসংখ্য দ্বীপপুঞ্জের জনজাতিরা তঁাদের খুনে আক্রমণের সামনে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে এই কারণে যে সেই সব জনজাতিগুলো ছিল পশ্চাৎপদ, সেই সব জনজাতিদের সভ্যতা ছিল নিকৃষ্ট মানের। অর্থাৎ, পশ্চিমা ইওরোপীয়রা এই অসংখ্য মানুষকে খুন করে,মানবসমাজ-সভ্যতার এই অসংখ্য বৈচিত্র্যপূর্ণ রূপকে ধ্বংস করে আসলে সভ্যতার সর্বোৎকৃষ্ট রূপটাকেই প্রতিষ্ঠিত করার গুরুদায়িত্ব পালন করছেন! (এভাবে যুক্তিনির্মাণ করার মধ্য দিয়েই বুঝি কোনও খুনি স্বভাবঘাতক হয়ে ওঠে!)

এভাবে এক উচ্চাবচ ধাপবন্দি কাঠামোয় সাজিয়ে মানবসমাজ-সংস্কৃতির বিভিন্ন রূপকে দেখাটাকেই ‘স্বাভাবিক’ বলে হাজির করেছে এই বিশ্ববীক্ষা। এই নির্মিত ‘স্বাভাবিকতা’ অনুযায়ী পশ্চিম-ইওরোপীয় সমাজ-সংস্কৃতি উচ্চাবচ ধাপবন্দি কাঠামোর শীর্ষে অবস্থিত এবং অন্যান্য সমাজ-সংস্কৃতিগুলো ‘অনুন্নতি’-র বিভিন্ন চিহ্ন বহন করে তলাকার ধাপগুলোয় ক্রমবিন্যস্ত। আর এই ধাপবন্দি কাঠামোর গতিসূত্র হলো অনুন্নতি থেকে উন্নতির দিকে যাত্রা। ফলে অন্য সমস্ত সমাজ-সংস্কৃতি নিজেকে লোপ করার মধ্য দিয়ে পশ্চিম-ইওরোপীয় সমাজ-সংস্কৃতির অনুকরণে নিজেকে পুনর্বিন্যস্ত করবে, এটাই হলো নিয়ম। আর এই নিয়ম অনুযায়ী গতিকে ত্বরান্বিত করার জন্য কিছু গাজোয়ারি-খুনখারাপি-ধ্বংস-তাণ্ডব চালাতে হলে সংকোচের কিছু নেই কারণ লক্ষ্য যদি ঠিক থাকে, সেই লক্ষ্যে পৌঁছানোর উপায় নিয়ে সঠিক-বেঠিক আলোচনার কি কোনও মানে হয়? এই বিশ্ববীক্ষাকে জপের মালা করেই চলেছে কালাপাহাড়ি তাণ্ডব। বিভিন্ন আদি জনজাতির প্রকৃতিলগ্ন সমাজ-সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে, তাদের প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারের অধিকার খর্ব করে জল, জঙ্গল, জমি, মাটি, মাটির তলদেশ সমস্তকিছু গোষ্ঠীগত অধিকার বা গোষ্ঠীগত মালিকানা থেকে কেডে় নিয়ে ব্যক্তিগত মালিকানা বা রাষ্ট্রীয় মালিকানার অধীনে দখল করা হয়েছে— যে ব্যক্তি বা রাষ্ট্র সেই সম্পদ নিঙডে় বাণিজ্যিক পুঁজিবাদী উৎপাদন করতে উন্মুখ। পরিবর্তন বা বিবর্তনের যে চারটি ক্রমকে (ক্রম ১ থেকে ক্রম ৪) উপরে উল্লিখিত হয়েছে তা এই লুন্ঠনেরই চারটি পথ।

ভারতীয় উপমহাদেশে প্রধানত ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসনের মধ্য দিয়ে এই ‘পাশ্চাত্য উন্নয়নী বিশ্ববীক্ষা’ ও তার লুঠের রাজ কায়েম হয়েছিল। এই শাসনের মধ্য দিয়ে এমন এক রাষ্ট্র, রাষ্ট্রীয় নীতি ও কলকৌশল, উন্নয়নী দিশা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, জ্ঞানচর্চা ও তার প্রয়োগের এমন এক পদ্ধতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যা ইংরেজ শাসকরা চলে যাওয়ার পরেও নিজেদের আধিপত্য বজায় রেখেছে। বিভিন্ন ধুয়োর জাতীয়তাবাদকে স্বাধীনতা-উত্তর ভারতীয় শাসকরা বা প্রভাবশালীরা নিজেদের হাতিয়ার করলেও উন্নয়নী বীক্ষায় তারা পাশ্চাত্য উন্নয়নী বিশ্ববীক্ষা-কেই প্রশ্নাতীত ও স্বাভাবিক বলে ধরে নিয়ে চলেছেন। কীভাবে এই প্রক্রিয়া ঘটে চলেছে তা দেবল দেব বনদপ্তর ও বনপালনবিজ্ঞানের যে ইতিহাস তুলে ধরেছেন তার মধ্য দিয়ে ভালো ফুটে ওঠে। সেই ইতিহাসের দিকে তাকানো যাক।

বনদপ্তর ও বনপালনবিজ্ঞান

ভারতে বনদপ্তর প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৬৪ সালে আর ‘বৈজ্ঞানিক বনপালন’ চালু হয় ১৮৫৮-র পর থেকে। খেয়াল করা যেতে পারে যে ভারতে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির শাসনের বিরুদ্ধে মহাবিদ্রোহ, যা ‘সিপাহী বিদ্রোহ’ নামে পরিচিত, ঘটেছিল ১৮৫৭ সালে। ওই বিদ্রোহের পর থেকেই ঔপনিবেশিক শাসকরা তড়িঘড়ি রেললাইন পেতে রেলগাড়ি চালানোর বন্দোবস্ত করতে উঠেপডে় লেগেছিল যাতে ভবিষ্যতে কোনও জায়গায় বিদ্রোহ হলে অস্ত্র ও সেনা দ্রুত পাঠিয়ে তা দমন করার সুবিধা হয়। রেলপথের স্লীপার তৈরির জন্য মধ্য ও পূর্ব ভারতের লাখ লাখ শালগাছ কাটা হয়েছিল। তখনও কয়লাখনির পত্তন না হওয়ায় রেলগাড়ির এঞ্জিনের জ্বালানিও ছিল জঙ্গলের কাঠ। ফলে জঙ্গলের গাছ কেটে বিপুল পরিমাণ কাঠের জোগান অবিচ্ছিন্নভাবে বজায় রাখার ব্যবস্থা করা ছিল শাসকদের আশু দরকার। এই দরকার মেটানোর তাগিদ থেকেই বনদপ্তর ও বনপালনবিজ্ঞানের জন্ম। ১৮৬৫ সালে ঔপনিবেশিক সরকার প্রথম বন আইন প্রণয়ন করল, যেখানে স্পষ্ট বলে দেওয়া হলো যে দেশের যাবতীয় বনভূমির মালিক রাষ্ট্র বা সরকার। বনবাসী বা বনসংলগ্ন গ্রামের অধিবাসীদের বনের উপর অধিকারকে এককথায় নাকচ করে দেওয়া হলো। বনবাসী ও বনসংলগ্ন গ্রামের অধিবাসীদের জীবন-সংস্কৃতি ছিল বনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। একদিকে বন যেমন তাদের জ্বালানী কাঠ, ফল-মূল-কন্দ-ছত্রাকের মতো খাদ্যদ্রব্য, ঝুম চাষের ক্ষেত্র, গরু-ছাগল চরানোর ক্ষেত্র ও শিকারের ক্ষেত্র যোগাতো, অন্যদিকে তেমনই তাদের পরম্পরাবাহিত বিভিন্ন আচার-সংস্কারের মধ্য দিয়ে তারাও বন সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। হাজার হাজার বছর ধরে তাই নানা উত্থানপতনের মধ্য দিয়ে গিয়েও বননির্ভর মানুষদের জীবন-সংস্কৃতি স্বীয় স্বাতন্ত্র্যে ও বৈচিত্র্যে উজ্জ্বল ছিল। অথচ ঔপনিবেশিক শাসকদের তৈরি করা আইনে তাদের বনে ঢোকায় নিষেধাজ্ঞা চাপানো হলো। সে বনগুলোকে ‘সংরক্ষিত অরণ্য’ ঘোষণা করা হলো, সেখানে বনবাসী বা গ্রামবাসীদের জন্য গাছ-কাটা, শিকার করা, ফলমূল সংগ্রহ, গরু-ছাগল চরানো সবই নিষিদ্ধ, এমনকি গবাদি পশুর জন্য ঘাস কাটলেও সরকারকে কর দিতে হবে। আর যেগুলোকে ‘আরক্ষিত বন’ বলা হলো সেখানে কেবল সীমিত পরিমাণে ফলমূল আহরণে ছাড় দেওয়া হলো। বাংলায় গ্রামের চৌহদ্দির মধ্যে বনাঞ্চল কেবল অল্প কিছু ‘পবিত্র বন’ বা ‘থানের জঙ্গল’ বাদ দিয়ে বাকি সবই সাফ হয়ে চাষের জমিতে পরিণত হয়েছিল চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের অধীনে রাষ্ট্রীয় খাজাঞ্চিখানার খাজনা-আদায় বাড়ানোর তাড়না মেটাতে (বনজমিকে ‘পতিত জমি’ গণ্য করায় তার খাজনা কম, তা কেটে চাষজমিতে রূপান্তরিত করতে পারলেই খাজনা বেড়ে যাবে, ফলে রাষ্ট্রের আদায় বেড়ে যাবে)। ফলে ১৮৬৫ সালের বন আইন কার্যত বাংলার বনবাসী ও বনসংলগ্ন গ্রামবাসীদের বনের সঙ্গে সম্পর্ককে ছিন্ন করে দিল। সরকারের বনদপ্তর থেকে জঙ্গলে জঙ্গলে বন্দুকধারী পাহারাদার বসানো হলো, সেই বন্দুকধারী পাহারাদাররা এতদিন জঙ্গলকে মায়ের কোল হিসেবে নিয়ে জীবন কাটানো আদিবাসীদের জঙ্গলে ‘বেআইনি অনুপ্রবেশকারী’ হিসেবে চিহ্নিত করে অভাবনীয় উৎপীড়ন জারি করল। বনবাসী ও বনসংলগ্ন গ্রামবাসী জনজাতিদের জীবনে নেমে এল ভয়ংকর দুর্দিন, দারিদ্র্য-অনাহার তীব্র হলো, সমাজ-সংস্কৃতি ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ল।

অন্যদিকে, বনদপ্তরের অফিস বসিয়ে, আধিকারিক নিয়োগ করে, অস্ত্রধারী বনরক্ষী বাহিনী সামিল করে রাষ্ট্রীয় হেফাজতে কী ধরনের বনপালন শুরু হলো? দেবল দেব তা বর্ণনা করেছেন এইভাবে:

সমস্ত বনাঞ্চলকে রাষ্ট্রের দখলে আনবার একটিই উদ্দেশ্য ছিল— সাম্রাজ্যের সমৃদ্ধির জন্য উপযুক্ত কতিপয় বৃক্ষপ্রজাতির লালন ও সংখ্যাবর্ধন। প্রথমে রেলপথ প্রসারের প্রয়োজনে মধ্য ও পূর্ব ভারতের শাল-সেগুন। তারপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ইওরোপের জাহাজ তৈরির প্রয়োজনে শাল, সেগুন আর হিমালয়ের বন থেকে পাইন বা চীড়। তারপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাহাজ তৈরি, সৈন্যবাহিনীর জ্বালানি আর বিভিন্ন আসবাবের প্রয়োজনে এই গাছগুলোর বিপুল চাহিদা মেটাতে মধ্য ও পূর্ব ভারতের সমস্ত বনে শাল অথবা সেগুনের চাষ, হিমালয়ের বনে পাইনের চাষ করা হলো, বাকি সব প্রজাতিকে কেটে ফেলে। শাল-সেগুনের অতিরিক্ত চাহিদা মেটাতে শিশু, আসন, পিয়াশাল ইত্যাদি গাছের চাষও বাড়ানো হয়েছিল। কীভাবে অন্য সব বৃক্ষ-বীরুৎ-গুল্মকে দমন করে দামী কাঠের পরিমাণ বাড়ানো যায়, সেই বিশেষ বিজ্ঞানই বনপালনবিজ্ঞান বা তথাকথিত বনবিজ্ঞান— যা দেরাদুনে বন গবেষণা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা দেওয়া হয়। বন-আধিকারিকরা সেখানেই শিক্ষা নিয়ে দেশের বন পালন করে থাকেন। (বিচ্যুত স্বদেশভূমি, পৃষ্ঠা-৮৯, ৯০)

এর মধ্য দিয়ে বনের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কে কী বদল এল তার প্রধান কিছু দিক বোঝার চেষ্টা করা যাক।

বনবাসী জনজাতি বা বনসংলগ্ন গ্রামবাসীদের সঙ্গে বনের সম্পর্ক ছিল দুটি প্রাণময় বস্তুর মধ্যে সম্পর্ক। পরম্পরাবাহিত আচার ও বিশ্বাসের ধারায় এই মানুষেরা মনে করত যে বনের প্রতিটি বৃক্ষ-বীরুৎ-গুল্ম প্রাণময়, প্রতিটি পাহাড়-নদী-ঝোরা প্রাণময়, জীব-জন্তু-কীট-পতঙ্গ প্রাণময়। জগতের উদ্ভব সম্পর্কিত অতিকথা-সৃষ্টিকথাগুলোতেও এই গাছ-পাথর-জল-জমি-বনজীবদের প্রাণের উৎস অথবা সৃষ্টিলগ্নে মানুষের সহোদর/সহোদরা হিসেবে কল্পনা করা হতো। সেই কল্পনার চোখে বন, বনজ পশু-পাখি-কীট-পতঙ্গ, নদী, পাহাড়, পাথর এই সবের মধ্য দিয়েই প্রাণের এক নিবিড় বুনন বোনা আছে, যার একাংশের একটি আলপনা হিসেবে মানুষ ফুটে উঠেছে। ফলে, মানুষের প্রাণময় অস্তিত্ব এই নিবিড় বুননের মধ্যে নিমজ্জিত সংযোগময়তাতেই অর্থপূর্ণ, তার থেকে বিযুক্ততায় অর্থহীন। বিভিন্ন ধরনের সর্বপ্রাণবাদী ধর্মবিশ্বাস এই বোধের সংহিতা ধারণ করত। বনবাসী জনজাতি ও বনসংলগ্ন গ্রামবাসীদের সমাজ যখন স্বকীয়ভাবে তার বাসস্থান-পরিবেশের ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা করত, তখন পবিত্র বন বা থানের জঙ্গল, আদি পূর্বপুরুষরূপী পাহাড়-নদী-ঝোরা, গোষ্ঠীগত আত্মীয়স্বরূপ কোনও বিশেষ পশু-পাখি-কীট-পতঙ্গকে বিশেষ সম্মান দিয়ে রক্ষা ও লালন করার দায়িত্ব হাজির করত। বন কখনই তাদের কাছে কেবলমাত্র ভোগ্য ও ব্যবহার্য বস্তুর যোগানদার নিষ্প্রাণ (বা নিকৃষ্ট-প্রাণ) ভাণ্ডারস্বরূপ ছিল না। বাংলার দক্ষিণে সাঁওতাল, মুণ্ডা, শবর ইত্যাদি থেকে বাংলার উত্তরে টোটো, মেচ, লেপচা ইত্যাদি জনজাতিদের স্বকীয় সমাজ-সংস্কৃতির যেটুকু আজও অবশিষ্ট আছে, তা থেকেই এর পরিচয় মেলে।

অন্যদিকে, বনপালনবিজ্ঞানের চোখে বনের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক হলো নিষ্প্রাণ বস্তুর সঙ্গে সপ্রাণ বস্তুর সম্পর্ক। বনের বৃক্ষ-বীরুৎ-গুল্ম কেবল নিষ্প্রাণ কাঠের যোগানদার, জীব-জন্তু-কীট-পতঙ্গ সপ্রাণ হলেও তাদের প্রাণ মনুষ্যপ্রাণের তুলনায় নিকৃষ্ট। তাই উচ্চতর প্রাণ অর্থাৎ মনুষ্যপ্রাণের সুখ-সুবিধা-প্রয়োজন মেটানোর দিক থেকেই তাদের মূল্য বিচার করতে হবে, অন্য কোনও স্বকীয় মূল্য তাদের নেই। অর্থাৎ, এখানে প্রাণময় অস্তিত্বের বিচিত্র নিবিড় বুননের কল্পনা নেই, এখানে আছে আধিপত্যের ভাষ্য নির্মাণ— নিষ্প্রাণের উপর সপ্রাণের আধিপত্য, নিকৃষ্ট প্রাণের উপর উৎকৃষ্ট উচ্চতর প্রাণের আধিপত্য। আধিপত্যের এই উচ্চাবচ ধাপবন্দি নির্মাণের মাথায় বসে উপনিবেশ-বিস্তারক প্রভুরা, তাই তাদের শাসন চালানো ও যুদ্ধ চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় রেল-যুদ্ধজাহাজ-অস্ত্রশস্ত্র-নগরকাঠামো নির্মাণের কঁাচামাল যোগানোতেই বনের সার্থকতা। তাই সেই প্রয়োজন মেটানোয় সবচেয়ে উপযোগী শাল-সেগুনের মতো গাছ হলো দামী মূল্যবান আর অন্য সব বৃক্ষ-বীরুৎ-গুল্মই হলো কমদামী বা ফালতু। বনের সার্থকতা বৃদ্ধি করতে তাই কমদামী বা ফালতু বৃক্ষ-বীরুৎ-গুল্ম উৎপাটন করে শাল-সেগুনের মতো গাছ লাগিয়ে বনকে রেল-যুদ্ধজাহাজ-নগর নির্মাণের ভঁাড়ার ঘর করে তোলার প্রকৌশল-জ্ঞানই হলো একমাত্র কাজের জ্ঞান, অর্থাৎ বিজ্ঞান। আর এই বিজ্ঞান এতই নিজ শ্রেষ্ঠতা সম্পর্কে নিশ্চিত ও নিজ কৌলীণ্যে মশগুল যে বনসম্পৃক্ত জনজাতিদের সর্বপ্রাণবাদী কল্পনা তার কাছে নেহাতই কুসংস্কার বা অপজ্ঞান। ফলে পবিত্র ও প্রাণপ্রবাহের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বন ও বনজ উপাদানকে রক্ষা করা পরিগণিত হলো কুসংস্কারাচ্ছন্ন পশ্চাৎপদ চিন্তা হিসেবে আর বনকে নগরায়ন-শিল্পায়ন-যুদ্ধচালনার কঁাচামাল সরবরাহক করে তোলার তাগিদকে ‘আধুনিক বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি’ হিসেবে চিহ্নিত করা হলো। এই বনপালনবিজ্ঞানের গুঁতোয় বনের ‘অদরকারি’ বৃক্ষ-বীরুৎ-গুল্ম সাফ হয়ে যেতে লাগল, প্রাণধারণচক্রে সেইসব বৃক্ষ-বীরুৎ-গুল্মের উপর নির্ভরশীল অগণন প্রজাতির পশু-পাখি-কীট-পতঙ্গ নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে থাকল আর বন তার স্বাভাবিক বৈচিত্র্য-বহুত্ব হারিয়ে বনাধিকারিকদের জরিপযন্ত্রে মাপা ‘দরকারি’ শাল-সেগুনের কৃত্রিম বাগানে পরিণত হতে থাকল। তার পাশাপাশি চলতে লাগল শিল্পায়ন-নগরায়নের জন্য, খনিজ উত্তোলনের জন্য, বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য বন-ধ্বংস, পাহাড়-ধ্বংস, নদী-ধ্বংস।

এখানে একটা বিষয় খেয়াল করা যেতে পারে। উপনিবেশ-বিস্তারক প্রভুরা কেবল অস্ত্র-শস্ত্র-যুদ্ধ-হিংসা দিয়ে তাদের আধিপত্য কায়েম করেনি, তাদের আধিপত্য কায়েমের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার ছিল কাকে জ্ঞান বলা হবে এবং কীভাবে সেই জ্ঞান উৎপাদিত-পরিবাহিত হবে তা নির্ধারণ করার ক্ষমতা। বনসম্পৃক্ত জনজাতিদের পরম্পরাবাহিত জ্ঞানের ভাণ্ডারকে পশ্চাৎপদতাপ্রসূত অজ্ঞান হিসেবে চিহ্নিত করতে পারা এবং যন্ত্রশিল্পনির্ভর পুঁজিবর্ধক সীমাহীন উৎপাদন ও ভোগের চাহিদার সঙ্গে মানানসই উপযোগিতামূলক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে প্রকৃতিকে নিঙড়ে নেওয়ার কৌশলসমূহকে ‘আধুনিক বিজ্ঞান’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারা ছিল তাদের আধিপত্যনির্মাণের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বনপালনবিজ্ঞানের উদাহরণ থেকে তা বেশ স্পষ্ট বোঝা যায়।

১৯৪৭ সালে ইংরেজ শাসকদের ভারত ছাড়ার মধ্য দিয়ে বনের উপর বনপালনবিজ্ঞানের এই বিধ্বংসী আধিপত্য শেষ হয়নি। বনআইন, বনদপ্তর, দেরাদুনের বন-গবেষণা প্রতিষ্ঠানে চলার ধারা পাল্টায় নি। কীভাবে পাল্টায় নি তা দেবল দেবের বইটি থেকে আমরা এভাবে জানতে পারি:

স্বাধীন ভারতের প্রথম অরণ্য নীতি প্রণয়ন হয়েছিল ১৯৫২ সালে। এই নীতি ঔপনিবেশিক অরণ্য নীতির কথাই পুনরুচ্চারণ করে। দেশের তাবৎ বনভূমির একচ্ছত্র মালিক ও অভিভাবক রাষ্ট্র। বন জাতীয় সম্পদ। এই সম্পদকে দেশের উন্নয়নের কাজে লাগাতে রাষ্ট্র দায়বদ্ধ। বনবাসী বা বনের সমীপবর্তী গ্রামবাসীদের কোনও বাড়তি অধিকার বনের সম্পদের উপর নেই। ‘কোনও গ্রামের অবস্থান ঘটনাচক্রে বনের সন্নিকটে হওয়ার কারণে, জাতীয় সম্পদের উপর সমগ্র জাতির অধিকারকে ক্ষুন্ন করে, সেই গ্রামটিকে কোনও বাড়তি সুবিধা দেওয়া হবে না... বিজ্ঞানসম্মত বন সংরক্ষণের তাগিদে বনের নিকটস্থ গ্রামগুলোর উপর কিছু বাধা নিষেধ ও প্রতিবন্ধকতা আরোপ আবশ্যক— সেই গ্রামবাসীরা তাতে যতই মণঃক্ষুন্ন হোক।’ (ন্যাশনাল ফরেস্ট পলিসি, ১৯৫২, ভারতীয় সরকার, দিল্লি) কার্যক্ষেত্রে জাতীয় উন্নয়নের চালক শিল্পের জন্য কঁাচামাল সরবরাহ করতে গিয়ে বনপালনের বিজ্ঞানে বন সংরক্ষণের লক্ষ্যটিই ভ্রষ্ট হয়ে যায়। আর তারই সঙ্গে প্রকৃতি-সংশ্লিষ্ট আদিবাসী সমাজের জীবন ও জীবিকাও বিসর্জিত হয়। স্বাধীনতার পর থেকে পাঁচ দশক ধরে, যখন বাঁশের বাজারদর ছিল টন প্রতি ৩০০০ টাকা, তখন বনদপ্তর বিড়লার কাগজকলে বাঁশ সরবরাহ করত টন প্রতি ১ টাকায়! এই দশকেও, ওড়িশার রায়গড় জেলায় অবস্থিত জেপী কোম্পানি, তার কাগজকলের জন্য বনদপ্তর থেকে বাঁশ কিনত টন প্রতি ৮ টাকায়। গোটা রায়গড় জেলায় এখন বাঁশঝাড় দুর্লভ হয়ে গেছে, অতএব সর্বত্র ইউক্যালিপ্টাস লাগানো হয়— যুগপৎ বনদপ্তর আর জেপী কোম্পানির উদ্যোগে। বনদপ্তরের লক্ষ্য যে বন সংরক্ষণ নয়, তা আরও স্পষ্ট হয় যখন স্থানীয় প্রজাতির বৃক্ষের মূল উৎপাটন করে ভিনদেশী ইউক্যালিপ্টাস লাগানো হয় দেশজুড়ে— এমনকি সুন্দরবনেও! ইউক্যালিপ্টাসের বাগিচা জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ না করলেও, কাগজ ও রেয়নশিল্পের মুনাফা সংরক্ষণ করে, কারণ তাতে উন্নয়ন হয়, যাতে ‘সমগ্র জাতির অধিকার’ আছে।

ভারতের ভূমি অধিগ্রহণ আইন (১৮৯৪), বন্যপ্রাণী (আরক্ষণ) আইন (১৯৭২), বন সংরক্ষণ আইন (১৯৮০) কোথাও সামূহিক মালিকানার কথা বলে না। জমি ও বন সংক্রান্ত সমস্ত আইন ব্যক্তির মলিকানা এবং রাষ্ট্রের মালিকানাকে পোক্ত করে। কোথাও সামূহিক অধিকারের পরিসর নেই। যে মানুষদের জীবন ও সংস্কৃতি বনসম্পদের উপর নির্ভরশীল, সেই মানুষদের নাগাল থেকে বনকে আগলে রাখবার আইন আছে। কিন্তু সেই বনসম্পদকেই শিল্পোন্নয়নের উদ্দেশ্যে অকাতরে বলি দেওয়া হয়। আরক্ষিত বা সংরক্ষিত বনকেও, দেশের উন্নয়নের স্বার্থে হাসিল করে দেওয়া যেতে পারে। বিভিন্ন উন্নয়নী প্রকল্পে অজস্র জাতীয় উদ্যান ও অভয়ারণ্য বলিপ্রদত্ত হয়েছে। ওড়িশার কলিঙ্গনগরে টাটা কোম্পানিকে, কেওনঝড়ে আর্সেলর-মিত্তালকে এবং নিয়মগিরি পাহাড়ের বনকে বেদান্ত কোম্পানির হাতে তুলে দেবার ছাড়পত্র দেওয়া অতি সাম্প্রতিক দৃষ্টান্ত। যারা অযুত বছর ধরে বংশপরম্পরায় বন ব্যবহার করে আসছে, যাদের ব্যবস্থাপনায় হাজার হাজার বছরে বনের একটিও প্রাণী বিলুপ্ত হয়নি, তাদের জ্ঞানভাণ্ডার ঔপনিবেশিক বনবিজ্ঞানে অপাঙক্তেয়। আজ, আধুনিক ভারতের শিল্পপূজায় ও উন্নয়নী ধামাকায় তারাই সরকারি বনে ‘অনুপ্রবেশকারী’। তাদের বন থেকে তাড়িয়ে দিতে নাগরিক প্রকৃতিপ্রেমিকরা আবেদন করেন, জনৈকা আদিবাসী উন্নয়ন মন্ত্রী তাদেরকে বলেন অরণ্য ধ্বংসকারী। তাদের তাড়িয়ে না দিলে বক্সাইট বা ইউরেনিয়াম খনি কোথায় হবে ? তাদের অনুৎপাদী জমি বা জঙ্গল না পেলে ইস্পাত কারখানা বা কাগজ কল চলবে কীভাবে?...

ভারত, ইন্দোনেশিয়া আর ব্রাজিলের সরকার শিল্পপ্রসারের জন্য, শিল্পসাম্রাজ্যের অগ্রগতির জন্য, প্রতিদিন অবশিষ্ট বনাঞ্চল সাফ করে চলেছে। বিড়লার সিমেন্ট কারখানা, বেদান্তর এলুমিনিয়ম খনি, জিন্দালের লোহার খনি চালাতে মধ্যপ্রদেশে ওড়িশায়, ঝাড়খণ্ডে বন সাফ করা হয়েছে, হচ্ছে, আরও হবে। ২০১৯ সালে ছত্তিসগড়ে ১,৭০,০০০ হেক্টর বন কেটে ফেলার হুকুম জারি হয়েছে আদানির কারখানার জন্য। অরুণাচল প্রদেশের প্রাচীন অরণ্যের দুই লক্ষ বৃক্ষনিধনের কাজ ২০২০ সালের মে মাসে সম্পন্ন হলো একটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য।... (বিচ্যুত স্বদেশভূমি, পৃষ্ঠা-৯৫- ৯৭)

বনকে কেবল শিল্পোৎপাদন ও নগরায়নের কঁাচামালের উৎস হিসেবে গণ্য করে এই অবারিত বনধ্বংসের প্রক্রিয়া ঔপনিবেশিক শাসনের আমল থেকে স্বাধীনতা-উত্তর আমলেও সমানভাবে চলার পিছনে দৃষ্টিভঙ্গির কোন ধারাবাহিকতা কাজ করছে? মনে হয় যে সেই দৃষ্টিভঙ্গি হলো ‘উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে উন্নয়নী অগ্রগতি ঘটানোর’ দৃষ্টিভঙ্গি, যা শুরুতে আলোচনা করা ‘পাশ্চাত্য উন্নয়নী বিশ্ববীক্ষা’-র হাত ধরে আমাদের মধ্যে গেঁড়ে বসেছে। ব্যাপারটিকে একটু খুলে আলোচনা করা যাক।

উন্নয়নী ধ্বংসলীলা, উন্নয়নচিন্তার আধিপত্য

জঙ্গলে ঢাকা কোনও জমিখণ্ড মানেই তা পতিত জমি, পড়ে পড়ে নষ্ট হচ্ছে, কোনও কাজে লাগছে না। কাজে লাগা মানে সেই জমিকে ঘিরে অর্থোপার্জন হতে হবে। জঙ্গল পরিষ্কার করে চাষের মাঠ করে বাণিজ্যিক ফসল ফলাতে পারলে অর্থোপার্জনের ব্যবস্থা হলো, জমি তখন পতিত জমি থেকে ফসলী জমি বা কাজের জমি হলো। আরো বেশি অর্থোপার্জনের পথ করে দিতে সেই পতিত জমি বা ফসলী জমি খুঁড়ে যদি বৃহৎ শিল্পে ব্যবহার্য কোনও কঁাচামালের খনি করা যায়, তাহলে সেই জমিকে আরও ভালোভাবে ব্যবহার করা হলো, কারণ বাজারের জন্য উৎপাদনের নিরিখে আরো বেশি তাকে নিঙড়ে নেওয়া গেল। আর মাটির নিচে তেমন খনিজের সন্ধান না পেলে সেখানে বৃহৎ শিল্প কারখানা বা শক্তি-উৎপাদন কেন্দ্র খুললেও একইভাবে বাজারের জন্য উৎপাদন বাড়ানো গেল, ফলে উৎপাদনশীলতা বাড়ল। আর যদিবা বৃহৎ শিল্প নাও হয়, তাহলে অন্তত হোটেল-বাজার-পর্যটনশিল্প বসিয়ে অর্থোপার্জনের ব্যবস্থা করলেও উৎপাদন-উপার্জন বাড়নো গেল। জমি-ব্যবহারের উৎপাদনশীলতা বাড়ানো, বা জমি-ব্যবহারকে উন্নত করার এই দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের চেতনায় এমন শিকড় গেঁড়ে বসেছে যে বেশিরভাগ সময়েই আমরা এই উন্নতির খাতিরে বন-ধ্বংসকে অপরিহার্য বলে প্রশ্নের ঊর্ধ্বে রেখে দিই। কেবল ধ্বংসের মাত্রা বা ধ্বংসের ফলে বাস্তুহারা হওয়া মানুষদের পুনর্বাসন নিয়ে হিসেব-কষাকষির কিছু প্রশ্ন থাকতে পারে বলে মনে করি। এ এক ধরনের অন্ধতার ফল। এই অন্ধতার ফলে হাজার হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা কোনও অরণ্যের বিচিত্র বহুত্বময় বাস্তুসংস্থান(ecosystem)-য়ে অগণন সপ্রাণ ও নিষ্প্রাণ বস্তুর পরস্পর-নির্ভর জৈব ও অজৈব যে উৎপাদন প্রক্রিয়া জারি থাকে তা দেখার দৃষ্টি খুইয়ে বসি। জঙ্গল-ধ্বংস বা জঙ্গলের স্বাভাবিক বৈচিত্র্য-বহুত্বকে খর্ব করে ‘দরকারি’ শাল-সেগুনের বাগানে পরিণত করা যে জঙ্গলের স্বাভাবিক বাস্তুতন্ত্রে বিপর্যয় ঘটিয়ে কতো অগুন্তি প্রজাতির বৃক্ষ-বীরুৎ-গুল্ম-পশু-পাখি-কীটপতঙ্গের বিনাশ ঘটায়, অর্থাৎ প্রাকৃতিক উৎপাদনের কী বিপুল ক্ষয় ঘটায়, তা আমাদের মনে ধরা দেয় না। এই বাস্তুতান্ত্রিক বিপর্যয়ের ফলে মাটির উর্বরতা পুনরুৎপাদনকারী কীট-অণুজীবদের মড়ক ঘটায় মাটির উর্বরতাও কীভাবে ক্রমশ হারিয়ে যায়, তাও আমরা আমাদের উৎপাদনশীলতার হিসাবের মধ্যে ধরি না। এই নির্বোধ অন্ধতার বশবর্তী হয়েই আমরা জঙ্গলে ঢাকা জমিকে পতিত জমি বলি, সকল প্রাণের বাস্তুতন্ত্রকে বজায় রাখার জন্য যে অগণন অপরিমেয় উৎপাদন অরণ্যে হয়ে চলে তাকে নস্যাৎ করে আমাদের অর্থোপার্জনের নিমিত্ত কিছু হাতেগোনা গাছ, ফসল বা শিল্পবস্তুর উৎপাদনকেই উৎপাদন বলে ধরি। তাই আমাদের উৎপাদনশীলতাবৃদ্ধির পদক্ষেপগুলো বনকে ধ্বংস করার পাশাপাশি মাটির উর্বরতা ক্ষয় করে, ভূমিজ জলের সংকট বাড়ায়, নদী শুকিয়ে যায় আর ক্ষতিকর শিল্পবর্জ্যের স্তূপে ঘেরা শহরগুলোয় আমদের জীবন-সংস্কৃতি মুখ থুবড়ে পড়ে।

কিন্তু তাতে কি ‘পাশ্চাত্য উন্নয়নী বিশ্ববীক্ষা’-র আকর্ষনীশক্তি কমে? কমে না। বাস্তুসংস্থানের বিপর্যয় যত সর্বগ্রাসী প্রকট হয়ে ওঠে, তা সম্পর্কে বোধ ও তা সমাধান নিরসনের চেষ্টাও ততই এই ‘পাশ্চাত্য উন্নয়নী বিশ্ববীক্ষার’ বেঁধে দেওয়া পথ ধরেই আরও নিষ্ফলা আরও অবান্তর হয়ে ওঠে। সমস্যাগুলোকে ঘিরে মুনাফাদায়ী শিল্পপ্রযুক্তির নতুন ব্যবসা সমাধান হিসেবে প্রক্ষিপ্ত হয়। সামূহিক বা গোষ্ঠীগত ভাবনার থেকে তা ব্যক্তি বা নিজ পরিবারকেন্দ্রীক ক্ষুদ্রবৃত্তের ভাবনাকে উৎসাহিত করে। উষ্ণায়ন ও দূষণের জন্য পৃথিবীব্যাপী বর্জ্যস্তূপ জমানো শিল্পোৎপদনকে প্রশ্নের মুখে ফেলে শিল্পোৎপাদন বৃদ্ধির পথ পরিহার করা বা কমানোর কথা আসে না, কার্বন-নিঃসরণ বাঁধাবাঁধি নিয়ে কিছু নিষ্ফলা বৈঠক হয়, আর প্রায়োাগিক ক্ষেত্রে বাতানুকূল যন্ত্র, পানীয় জল শোধন যন্ত্র ইত্যাদির মতো কিছু প্রযুক্তিজাত দ্রব্য বাজারে আনতে একই পথে নতুন শিল্পোৎপাদন বাড়ানো হয়— ব্যক্তিরা তাদের নিজেদের বা নিজেদের পরিবারটুকুর জন্য রক্ষাকবচ তৈরি করার আশায় সেইসব কেনেন, বা কিনতে পারার মতো অর্থ উপার্জন করার জন্য উন্নয়নী পথকে আরও আঁকড়ে ধরেন। ভাসমান ধূলিকণার আধিক্যে শহরের বাতাস শ্বাসপ্রণালীর রোগের আঁতুড় হয়ে উঠলে কৃষকদের নাড়া পোড়ানো বন্ধ করার কথা ওঠে, বাণিজ্যিক কারণে বাণিজ্যিক ফসল ফলানো কৃষকরা তা মানতেও চান না, কিন্তু অন্যদিকে ব্যক্তিগত ছোটগাড়ির সংখ্যাবৃদ্ধির কারণে বায়ুদূষণ বা শিল্পবর্জ্যের কারণে বায়ুদূষণের কথা তেমনভাবে ওঠে না কারণ উন্নয়নের ধাপবন্দি কাঠামোয় গাড়িশিল্প যে কৃষির চেয়ে উপরের ধাপে আছে। দূষণ কমাতে গাড়ির উৎপাদন কমানোর কথা ভাবা তো দূরের কথা, বাজারে গাড়ির বিক্রিতে কোনও কারণে মন্দা দেখা দিলে দেশের অর্থনীতি-বিশেষজ্ঞরা এমন চেঁচামেচি জুড়ে দেন যেনবা কোনও জাতীয় বিপর্যয় হাজির হয়েছে। বেশিরভাগ নাগরিকও বায়ুদূষণে হাঁসফঁাস করলেও ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য গাড়ি কিনতে পারাকে নিজের জীবনের উন্নতির একটা আবশ্যিক ধাপ বলে মনে করেন। গাড়িশিল্প বন্ধ হলে লোকের চাকরির সুযোগ কমবে, এমন যুক্তিও খুব জোরালো। এই উদাহরণগুলো থেকে দুটো সাধারণ দিক আমরা চিহ্নিত করতে পারি বলে মনে হয়:

  • প্রথম সাধারণ দিকটা হলো এই যে, সামূহিক সংকটের কোনও সামূহিক সমাধানের দিকে না গিয়ে ব্যক্তি বা পরিবারের জন্য উন্নত প্রযুক্তিজাত দ্রব্য ব্যবহারের মধ্য দিয়ে ক্ষুদ্রবৃত্তে সমাধানের পথ উন্নয়নী ভাবনার মধ্য দিয়ে তুলে ধরা হচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে ওই দ্রব্য কিনতে পারার মতো আর্থিক সংস্থান থাকার নিরিখে যেমন একটি উচ্চাবচ ধাপবন্দি কাঠামো তৈরি হচ্ছে, তেমনই মূল সমস্যাটিও টিকে থাকছে বা আরও তীব্র হচ্ছে।
  • বাস্তুসংস্থানে বিপর্যয় ঘটানো শিল্পোন্নয়ন প্রশ্নের ঊর্ধ্বে থেকে যাচ্ছে যেহেতু সেই শিল্পোন্নয়নের সঙ্গে আমরা আমাদের জীবনযাত্রার মানের উন্নতি, কর্মসংস্থান, সামাজিক অগ্রগতিকে অবিচ্ছেদ্য বলে ধরে নিয়েছি।

এই দুটো সাধারণ অবস্থানের সঙ্গে ‘পশ্চিমী উন্নয়নী বিশ্ববীক্ষা’ নিবিড়ভাবে যুক্ত। পশ্চিমী উন্নয়নী বিশ্ববীক্ষার সর্বাত্মক আধিপত্য সমাজ-পরিসরকে যেভাবে পুনর্নির্মাণ করেছে, জীবন-জীবিকা সংস্থানের সম্ভাব্য বিকল্পগুলোকে যেভাবে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করেছে, তা-ই এই অবস্থানের জন্ম দিয়েছে। পশ্চিমী উন্নয়নী বিশ্ববীক্ষার প্রভাববিস্তারের আগে বিভিন্ন অঞ্চলের প্রাকৃতিক-ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে গোষ্ঠীনির্ভর সমাজজীবনের যে মূলত স্বনির্ভর রূপ জনজাতি-সমাাজগুলোয় দেখা যেত, তার কল্যাণে জনজাতিদের মানুষদের নিজ জীবন-জীবিকা সংস্থানের জন্য তার নিজের সমাজের বাইরের কোনও বৃহৎ কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্র বা বাণিজ্য-প্রতিষ্ঠানের উপর নির্ভর করতে হতো না। পশ্চিমী উন্নয়নী বিশ্ববীক্ষা আরোপের প্রক্রিয়া সেই স্বনির্ভর রূপগুলোকে ধ্বংস করেছে প্রাকৃতিক সম্পদের উপর গোষ্ঠীগত অধিকারের প্রকাশস্বরূপ গোষ্ঠীগত মালিকানাকে রদ করে ব্যক্তিগত মালিকানা ও বাণিজ্যিক বেচাকেনার মধ্য দিয়ে সেই ব্যক্তিগত মালিকানার প্রায়োগিক চর্চাকে নিয়ম করে তুলে। এই স্বনির্ভর রূপের ধ্বংস যতো এগিয়েছে, গোষ্ঠীজীবনের আশ্রয় ততই অন্তর্হিত হয়েছে এবং ব্যক্তি ততই নিজ জীবন-জীবিকা সংস্থানের জন্য তার ধরাছোঁয়ার বাইরে উপরের কোনও বৃহৎ কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্র ও বাণিজ্য সংস্থার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এই নির্ভরশীলতা যত বেড়েছে, ততই তা স্বাভাবিক বলে প্রতিপন্ন হয়েছে। আজ তাই জীবনযাত্রার বিভিন্ন সামগ্রীর সংস্থান থেকে শুরু করে রুজি-রোজগারের সংস্থান অবধি কোনওটাই আর বৃহৎ কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্র ও বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানের বদান্যতা ছাড়া সম্ভব বলে আমরা ভাবতে পারি না।

পশ্চিমী উন্নয়নী বিশ্ববীক্ষার কাছে এই নিরঙ্কুশ আত্মসমর্পণ বাংলার জৈবসংস্কৃতিকে কীভাবে ধ্বংস ও লুপ্ত করে দিচ্ছে তার বর্ণনা দেবল দেব দিয়েছেন নানা দিক থেকে। তার কিছু উল্লেখ করা যেতে পারে:

  • ১৯৪০-য়ের দশক পর্যন্ত অবিভক্ত বাংলায় প্রায় ১৫,০০০ সাবেকি জাতের ধান চাষ হতো। পশ্চিমবঙ্গের কথা ধরলে, চুঁচুড়ায় অবস্থিত রাজ্য ধান গবেষণা স্টেশনের নথি অনুযায়ী, ৫,৫৫৬ জাতের ধান পশ্চিমবঙ্গে চাষ হতো ষাটের দশকের শেষ অবধি। সেগুলোর প্রায় কোনোটাই এখন আর চাষ হয় না। আর বাংলাদেশ ধান গবেষণা কেন্দ্র ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ১২,৮৭৯টি সাবেকি জাতের নাম নথিবদ্ধ করেছিল, কিন্তু ১৯৭০ সালের মধ্যেই বাংলাদেশে প্রায় ৭,০০০ সাবেকি জাতের ধান লুপ্ত হয়ে যায়। দুই বাংলাতেই এই লুপ্ত হয়ে যাওয়ার কারণ পশ্চিমী উন্নয়নী বিশ্ববীক্ষা মেনে কৃত্রিম রাসায়নিক প্রয়োগে ‘উচ্চ ফলনশীল’ বীজের চাষ, যে বীজ ও রাসায়নিক সার-কীটনাশক বৃহৎ বাণিজ্যসংস্থার থেকে কিনতে হয়। ধানের সাবেক জাত লুপ্ত হয়ে যাওয়া গ্রামবাসীদের খাদ্যসুরক্ষাকে বিপন্ন করেছে আর রাসায়নিক চাষ মাটির উর্বরতাকে ধ্বংস করছে, ভূগর্ভের জলকে দ্রুত নিঃশেষ করছে, আরও বহু দূষণ ছড়াচ্ছে।
  • গোটা বাংলা জুড়ে অরণ্য ধ্বংস ও স্বাভাবিক আরণ্যক বৃক্ষরাজির বিলোপ করে বিদেশি বৃক্ষরোপণের হিড়িকে জংলি ভোজ্য জীববৈচিত্র্য লোপ পেয়ে যাচ্ছে। তার সঙ্গে বন কেটে আবাদ, কলকারখানা আর নগরায়ণের বিস্তারের ফলে অসংখ্য উদ্ভিদ ও প্রাণীর বাসস্থান বিনষ্ট হয়ে গেছে ও হয়ে চলেছে। নানা প্রজাতির মাছ, কঁাকড়া ও বুনো ফলমূল এখন দুর্লভ হয়ে গেছে। চাইলেও পাওয়া যাবে না। বর্তমান প্রজন্মের মধ্যেও এদের পরিচিতি বা বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জ্ঞান আর পরম্পরাবাহিতভাবে সঞ্চারিত হচ্ছে না।
  • বাঁকুড়া-পুরুলিয়া-ঝাড়গ্রাম জেলার বিস্তীর্ণ সরকারি বনাঞ্চলের আওতায় আজ আর একটিও থানের জঙ্গল অটুট নেই। গ্রাম্য থানগুলোর জঙ্গলে কোন কোন দুষ্প্রাপ্য গাছপালা পশুপাখি পাওয়া যায়, পরিবেশে থানের জঙ্গলের কতটা অবদান থাকতে পারে, সেসব তথ্য বাংলার বিজ্ঞানচেতনায় অবান্তর।

‘বিচ্যুত স্বদেশভূমি’ বইতে এই সবগুলো দিকেরই বিশদ তথ্য হাজির করে আলোচনা করেছেন দেবল দেব। তাতে একদিকে যেমন ফুটে ওঠে কীভাবে পশ্চিমী উন্নয়নী বিশ্ববীক্ষা বাংলার জৈব সংস্কৃতিকে লুপ্ত করে বাস্তুসংস্থানের সংকটকে চরম করে তুলেছে, তেমনই অন্যদিকে ফুটে ওঠে কীভাবে এই উন্নয়নী বিশ্ববীক্ষা ক্রমশ আমাদের চেতনাকে আরও অধিকার করে বসছে।

প্রতিরোধ-বিন্দু

‘পশ্চিমী উন্নয়নী বিশ্ববীক্ষা’-র ধ্বংসাত্মক আগ্রাসনের মুখে প্রতিরোধের পরিসর গড়ে তুলে কীভাবে জৈব সংস্কৃতি সংরক্ষণ ও বিস্তারের উদ্যোগ গডে় তোলা যায়, সেই উদ্যোগ চালাতে গিয়ে কীধরনের অভিজ্ঞতা ও সীমাবদ্ধতা-সমস্যার মুখে পড়তে হয়, তা নিয়ে কিছু আলোচনা দেবল দেব তঁার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে এই বইয়ে হাজির করেছেন। সরকারি বা প্রাতিষ্ঠানিক বৃত্তের অন্তর্গত হয়ে নয়, বরং জনসমাজের সাহায্য-অংশগ্রহণ-স্বতক্রিয়ার উপর নির্ভর করে এহেন যে উদ্যোগগুলোকে তিনি সংগঠিত করার কাজ করে চলেছেন, তার মধ্যে আছে:

  • ‘বসুধা’ নামে ক্ষেত্রকর্মী ও গবেষকদের ‘কর্মাশ্রম’ চালানো। ২০০০ সালে পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়ায় এর কাজ শুরু হওয়ার পর সেখানে প্রতিকূলতার মুখে পড়ায় ২০১০ সালের পর থেকে তা ওড়িশার রায়গড় জেলায় স্থানান্তরিত হয়ে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। প্রতি বছর সহস্রাধিক জাতের ধান ও আরও বহুবিধ শস্য চাষ করে বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচানো, তাদের বীজ অবাণিজ্যিক শর্তে ইচ্ছুক চাষীদের মধ্যে বিতরণ করা ও তাদেরকেও তা অন্যান্য চাষীদের মধ্যে অবাণিজ্যিকভাবে বিতরণে উৎসাহিত করা, জৈব সম্পদ সংরক্ষণে প্রয়োজনীয় বৈজ্ঞানিক গবেষণা চালানো— এমন নানা কাজ এই কর্মাশ্রমে হয়ে চলেছে।
  • বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে সেখানকার সাবেকি বীজ, গাছপালা, প্রাণীপ্রজাতি, থানের জঙ্গল, ঠকুরপুকুর ইত্যাদির গুরুত্ব সম্পর্কে বয়স্ক গ্রামবাসীদের থেকে জানা, নবীন প্রজন্মকে তা সম্পর্কে অবহিত করা ও উন্নয়নী ধ্বংসযজ্ঞের কবল থেকে তা রক্ষা করার জন্য গ্রামবাসীদের উদ্যোগ উৎসাহিত করার চেষ্টা করা।

এই উদ্যোগগুলো সম্পর্কে দেবল দেবের বর্ণনা পড়ে মনে হয়েছে যে এগুলোর কোনওটাই উপর থেকে কোনও সরকারি দপ্তর, আধিকারিক বা বিশেষজ্ঞের ক্ষমতার ওজন দিয়ে গ্রামবাসীদের কিছু করতে বাধ্য করার চেষ্টা করছে না, বরং তার বিপরীতে দাঁড়িয়ে, বয়স্ক অভিজ্ঞ গ্রামবাসীদের সাবেকি জ্ঞানকে মর্যাদা দিয়ে তার সঙ্গে আধুনিক গবেষণা-পদ্ধতি যুক্ত করছে এবং তা গ্রামবাসীদের সামনে হাজির করছে বিচার-বিবেচনা, গ্রহণ-বর্জনের জন্য। তাছাড়াও, রাষ্ট্রনির্ভর ও বাণিজ্যিক আদান-প্রদান-সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে গ্রামীণ গোষ্ঠীস্তরে প্রত্যক্ষ পারস্পরিক সম্পর্ক ও নির্ভরতা গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। এই শেষের বিষয়টি মনে হয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এর মধ্যেই হয়ত আছে সেই বীজ যা অঙ্কুরিত হলে উন্নয়নী বিশ্ববীক্ষার দুই মহাচালক কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার রাষ্ট্র ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের উপর নির্ভরশীলতা ত্যাগ করে নিজেদের মুক্ত সন্নিবেশের মধ্য দিয়ে জীবন-জীবিকা সংস্থানের জীবনশৈলী নতুনভাবে বিকশিত হতে পারে। আর সেই নতুন জীবনশৈলীর উপর দাঁড়িয়েই হয়ত পশ্চিমী উন্নয়নী বিশ্ববীক্ষার দানবকে দমন করার পথ খুলে যেতে পারে।

তবে কীসের উপর দাঁড়িয়ে কী হতে পারে, আসল কথা তা নয়। আসল কথা হলো এটাই যে পশ্চিমী উন্নয়নী বিশ্ববীক্ষা বাস্তুসংস্থানের নজিরবিহীন বিপর্যয় ডেকে এনে জীবন ও জৈব সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে চলেছে, এখনই তার বিরুদ্ধে কোনও না কোনও ভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলা দরকার, যে যেমন ভাবে যে পরিসরে পারে তেমনভাবেই। দেবল দেবের এই বই সেই সক্রিয়তার চাহিদাকে উসকে দিতে পারে।

0 Comments
Leave a reply