১
১৯২৭ সালে ফরাসী দার্শনিক জুলিয়াঁ ব্যাঁদা (Julien Benda)-র লেখা একটি বই প্রকাশিত হয়। বইটি তখন খুব প্রসিদ্ধ হয়েছিল, নানা ভাষায় তর্জমাও হয়েছিল, ইওরোপ জুড়েই বিতর্কের বিষয় হয়ে উঠেছিল। বইটির নাম: La Trahison des clercs। Trahison মানে বিশ্বাসঘাতকতা, clercs মানে লিখিয়ে, বা এখনকার লব্জে বললে, বুদ্ধিজীবী, মানে পণ্ডিত-অধ্যাপক-শিক্ষক-জ্ঞানতাত্ত্বিক-ন্যায়তাত্ত্বিক-রাজনীতিবিদ সহ বিভিন্ন বিশেষজ্ঞদের দঙ্গল। সুতরাং বইটার নাম বাংলায় দাঁড়ায়: বুদ্ধিজীবীদের বিশ্বাসঘাতকতা। বইটা ছিল এক চাঁছাছোলা আক্রমণ। লেখক তাঁর সমসময়ের বুদ্ধিজীবীমহলের অধোগতিকে আক্রমণ করেছিলেন। বুদ্ধিজীবী মহলের অধোগতি বলতে লেখক কী বুঝেছিলেন ও বুঝিয়েছিলেন? সেই দিকটা একটু ভেঙে দেখা যাক। লেখকের মতে, যে উনিশ শতককে ‘মতবাদের শতক’ বলা হয়ে থাকে, সেই শতকেই এমন এক গোত্রের বুদ্ধিজীবীর উদ্ভব, বিকাশ ও সর্বাধিপত্য প্রতিষ্ঠা হয়েছিল যারা জাগতিক-মহাজাগতিক-অতিজাগতিক সমস্তকিছুকেই জড় (material) ও ব্যবহারিক (utilitarian) চৌহদ্দির মধ্যে বেঁধে ফেলেছিল। মানুষের নিজের সীমাকে নিজে ছাপিয়ে যাওয়ার যে আকুতি, উত্তরণের বহু বিবিধ পথসংকেত ও প্রচেষ্টা, এই সবকেও বৈজ্ঞানিক মূর্ততা দেওয়ার নামে বস্তুগত ব্যবহারিক অপভ্রংশে পরিণত করা হয়েছিল। মানুষের বস্তুগত ভোগ-বিলাস ও কর্তৃত্ব ফলানোর উপকরণ বৃদ্ধি পেলেই যেনবা উত্তরণের একমেবাদ্বিতীয়ম পথ ধরে প্রগতির রথ ঊর্দ্ধশ্বাসে ছুটতে থাকবে! যা কিছু ব্যবহারিক, অর্থাৎ দেশ-কাল- প্রকৃতি-তে কেবলমাত্র বস্তুগতভাবে উপস্থিত এবং মানুষের বস্তুগত তাগিদের পরিপূরণে কার্যকর, তার উপর ভোগদখল কায়েম করার চির-অতৃপ্ত তাড়নাই হয়ে দাঁড়াল এই বুদ্ধিজীবীকুলের একমাত্র চালিকাশক্তি। মানুষের আধ্যাত্মিকতা, মানুষের বিশ্বনিখিল--- সবকিছুই এই বস্তুনিষ্ঠতা-ব্যবহারিকতার করাল গ্রাসে পতিত হয়ে অর্থ-তাৎপর্য-মর্যাদা সবকিছু খুইয়ে বসল। আর এই প্রেক্ষাপটে এহেন বুদ্ধিজীবীদের পৌরোহিত্যে মানবযূথ ভিন্ন ভিন্ন দাঙ্গাবাজ গোষ্ঠীতে সংহত হল, জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রশক্তির অস্ত্রশস্ত্র শামিল করে একে অপরের টুঁটিতে কামড় বসানোর জন্য উদ্যত হল। মানবঅস্তিত্বকে আগাপাশতলা রাষ্ট্রশক্তির সর্বগ্রাসী হিংসার আবর্তে নিমজ্জিত করে দিয়ে বুদ্ধিজীবীরা এই হিংস্র শিকারী রাষ্ট্রশক্তিগুলোর যৌক্তিকতা-বিধানকারী করণিক হয়ে উঠল।
এই যে বিশ্বাসঘাতক বুদ্ধিজীবীদের যুগকে জুলিয়াঁ ব্যাঁদা ইওরোপ জুড়ে উনিশ শতকে প্রসারিত হতে দেখেছিলেন, তার সহগামী ঐতিহাসিক প্রক্রিয়াগুলো ছিল পুঁজিবাদী সমাজ ও অর্থনীতির পরিণত রূপ গ্রহণ করা এবং সবচেয়ে প্রভাবশালী রাষ্ট্ররূপ হিসেবে জাতি-রাষ্ট্রের উঠে আসা। রাশিয়ায় ১৯১৭-র বিপ্লব যখন জার-শাসনকে উপড়ে ফেলল, তখন তা পুঁজিবাদ ও জাতি-রাষ্ট্রের আদর্শকেও গ্রহণ করেনি। পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে উৎক্রমণ করে নতুন সামাজিক ব্যবস্থা গঠনের নানা চিন্তা যেমন সেই বিপ্লবে ছিল, তেমনই, রাষ্ট্রের প্রশ্নে, সরাসরি রাষ্ট্রের বিলোপ ঘটানো থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিকতাবাদী বিপ্লবী রাষ্ট্র গঠন করার নানা ভাবনাও তার মধ্যে কাজ করছিল। কিন্তু এই সমস্ত নানা সম্ভাবনা সত্ত্বেও জুলিয়াঁ ব্যাঁদা-র সমালোচনার যে মূল লক্ষ্য--- জাগতিক-মহাজাগতিক-অতিজাগতিক সমস্তকিছুকেই জড় ও ব্যবহারিক চৌহদ্দির মধ্যে বেঁধে ফেলা--- তা কি এড়ানো সম্ভব হয়েছিল? হয়নি। বস্তুগত জড় উৎপাদনের উন্নত স্তরে পৌঁছে সেই ভিত্তির উপরই কেবল উন্নত সমাজ গড়া যায়, এই মতবাদিক নির্ধারণের কবলে বিপ্লবোত্তর রাশিয়াও ক্রমশ মতবাদিক পার্টির আধিপত্যাধীন হিংস্র শিকারী রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছিল। বিপ্লবের মধ্য দিয়ে উঠে আসা নতুন জীবনের নানা সম্ভাবনা নিয়ে উৎসাহীদের জন্য তা ছিল এক মর্মান্তিক ট্রাজেডি। কবি ওসিপ ম্যান্ডেলস্টামের জীবন--- তাঁর দায়বোধ, আত্মসমর্পণহীন লড়াই ও নিয়তি--- এই ট্রাজেডিরই অংশ। তাই ম্যান্ডেলস্টামের কবিতার উপস্থাপনা হিসেবে আমরা এই পরিপ্রেক্ষিতটিকেই কিছুটা নিবিড়তায় বিচার করে দেখব।
২
সমস্ত অস্তিত্বগত প্রশ্নকে অর্থনীতির অঙ্কে--- জড় উৎপাদন, সঞ্চয় ও ভোগ-এর সাপেক্ষে--- বিনির্মাণ করে জীবনকে উৎপাদন বৃদ্ধি-পরিকল্পনার অন্তহীন অলাতচক্রে নিছক জ্বালানী-রসদে পরিণত করা হল। আধ্যাত্মিক যে কোনো বিষয়, অস্তিত্বের উৎসমুখী যে কোনো টান, যে কোনো আস্তিত্বিক স্বজ্ঞা--- এহেন সবকিছুকে বিদ্রূপ করে, তুচ্ছ করে, অবৈধ ঘোষণা করে কেবলমাত্র জড়-উৎপাদন-মুখী জ্ঞান-প্রকৌশলকেই আধুনিক ও প্রগতিশীল আখ্যায় বৈধতাপ্রদান করা হল। এই জ্ঞান-প্রকৌশলের পিঠে চড়ে অন্ধকার অতীত থেকে আলোকিত ভবিষ্যতে পাড়ি দেওয়ার সুনির্দিষ্ট নিশ্চিত পথসন্ধান হাজির করা হল, বলা হল এই পথ বেয়ে মানুষের সমাজ ইতিহাসের আবর্ত পেরিয়ে অবশেষে তার চূড়ান্ত গন্তব্যে পৌঁছতে পারবে। বৈজ্ঞানিক মতবাদের রূপ ধরে তর্ক-বিতর্কের ঊর্ধ্বে সর্বশক্তিমান সত্য হিসেবে নিজেকে দাবি করে বসল। এই মতবাদ-চালিত ও মতবাদ-নির্ধারিত অস্তিত্ব যখন মতবাদিক বিশ্বাস ও রাষ্ট্রীয় আরোপণ দুইয়ের চাপে সর্বময় হয়ে বসে, জীবনকে তখন অবধারণযোগ্য এক উৎপাদনপ্রক্রিয়ার আদলেই দেখা হতে থাকে। সমস্ত চকিত উপলব্ধি, বিস্ময়, অভাবনীয়তা, নতুনের অনাহূত আত্মপ্রকাশকে আপদ বলে চিহ্নিত করে নিশ্চিহ্ন করার অধিবিদ্যা হাজির করা হয়। অথচ জীবন তো চকিত উপলব্ধি, বিস্ময়, অভাবনীয়তা ও নতুনের অনাহূত আত্মপ্রকাশের মধ্য দিয়েই নিজেকে প্রকাশ করে, ফলে, মতবাদিক জ্ঞান-প্রকৌশলের দালানকোঠায় জীবনকে নেহাতই খিল-আঁটা দরজার বাইরে ওত-পেতে-থাকা অনাহূত আপদ বলেই জ্ঞান করা হয়। সবসময় তাই ধরে-কষে শৃঙ্খলায় বাঁধা ও আপদ-দমনের এত বিস্তারিত আয়োজন, সর্বজ্ঞানী মতবাদধারীর নির্দেশ মাফিক জীবন ও বাস্তবতাকে বিন্যাস-পুনর্বিন্যাস করে নেওয়ার জন্য অস্তিত্বের প্রতিটি পরতকে এভাবে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে বাঁধার প্রাণান্তকর চেষ্টা।
আধুনিকতাগর্বী এই যুক্তিনির্মীত, যুক্তিবৈধ, যুক্তিসর্বস্ব অতিযৌক্তিকতার শাসন যা অতিদর্পে ঘোষণা করে বসে যে নিজ দেহতন্ত্রকে তা অধিবিদ্যা-অতিকথা পরাবাস্তবতার সংক্রমণ থেকে সর্বাংশে মুক্ত করে ইতিহাস-সোপানের চূড়ান্ত ধাপে এসে উপনীত হয়েছে, তা কি এযাবৎ ইতিহাসে সবচেয়ে নিবিড় অতিকথা-অধ্যুষিত অধিবিদ্যা-শাসিত যুগ নয়? কী অর্থে এই যুগ অতিকথা-অধ্যুষিত, অধিবিদ্যা-শাসিত? এই অর্থে নয় যে সে পিছুটানের ঘোরে অতীত কথায় নিমজ্জিত, তা সে নয়। এই অর্থেও নয় যে জড় প্রযুক্তিকে আলাদীনের প্রদীপ ভেবে বসে সে তার মায়াবন্ধনের চোরাবালিতে ডুবতে বসেছে, যদিও এ কথা ভয়ঙ্করভাবেই সত্য। তা এই অর্থে যে প্রযুক্তির বলে অসম্ভব কিছু নেই বলে ঠাউর করা অধিবিদ্যাকে সর্বাত্মক চেহারা দান করে সে প্রযুক্তি-পুজোকেই যুগের নির্ধারক বৈশিষ্ট্য করে তুলে সেই পুজোর বলিকাঠে অন্য সমস্তকিছুকে বলিপ্রদত্ত করেছে। তাই সত্য ও স্থিতির প্রত্যাভূতি হিসেবে, সৃষ্টিশীলতা ও কল্পনার ভিত্তি হিসেবে সে একমেবাদ্বিতীয়ম প্রযুক্তি-ঈশ্বরকেই প্রতিষ্ঠিত করেছে। মানুষ সহ প্রকৃতির সমস্তকিছুকে কেবলমাত্র প্রাযুক্তিকতার সম্ভাব্যতার শর্তে রূপান্তরিত করেছে। অন্ধকার চরাচরে প্রযুক্তির সম্পূর্ণ নিঃশর্ত প্রত্যাভূতির বহ্নিমান শিখা ঘিরে যন্ত্রনৃত্যের পাকে ঘোরাই এখানে মানুষের একমাত্র বৈধ ক্রিয়া।
ভবিষ্যৎ যখন মতবাদ-নির্ণীত প্রক্রিয়া অনুসরণের পথে যন্ত্রপ্রযুক্তির শক্তি দিয়ে ছককাটা নকশার বাস্তব হয়ে ওঠা ছাড়া আর কিছু নয়, সেই পথপ্রবর্তকরা তখন যেমন একদিকে তাদের অভিপ্রায়ের অনিবার্যতার মোহে নিজেদের পরম ক্ষমতাশালী বলে মনে করতে থাকে, নিজেদের মতবাদিক অভিপ্রায়কেই ইতিহাসের অভিপ্রায় বলে অমোঘ জ্ঞান করে, তেমনই নতুন প্রযুক্তি ও নতুন রাষ্ট্র-পদ্ধতির একীভূতকরণের মধ্য দিয়ে সর্বাত্মকতাবাদী শাসকের দৃষ্টিভঙ্গি রপ্ত করে বসে। মরা আলোয় ধূসর সে প্রান্তরে প্রতিটি মানুষই যেন প্রযুক্তির দ্বার প্রযুক্তির জন্য উৎপাদিত বস্তু। জড়-উৎপাদন বৃদ্ধি, আরো বৃদ্ধি, অনন্ত বৃদ্ধির নিমিত্তই যেন মানুষের অস্তিত্ব। পরিস্থিতি একবার এই দ্রুতি নিয়ে নিলে মতবাদের দাবদাহে জীবন শুকিয়ে আসে, মানুষের রক্তমাংসগত সব অনুভূতি-আকাঙ্ক্ষা-বিস্ময়-বেদনা প্রতিস্থাপিত হয় নীরস উপাত্তের সারবদ্ধ সারণির দ্বারা, মানুষের অস্তিত্বগত সমস্ত যাত্রা এক নির্মীত অমরত্বে স্থানু হয়ে যায়। দেহপট শূন্য করে চেতনাকে বহিঃস্থ জ্ঞানরূপ দেওয়ার কাজ যত সম্পন্ন হয়, ততই নজরদারি চক্ষু ও উপাত্ত-সংস্কৃতির দাপট বাড়ে। ভবিষ্যতের জাঁকালো বিজ্ঞাপনে চাপা পড়ে যায় সমস্ত ভবিষ্যকল্পনা। এভাবে যখন মানুষ কেবল মতবাদিক অভিপ্রায় পূরণের হাতিয়ারে পরিণত হয়, এই উপযোগিতা-তত্ত্বকেই ন্যায়পরতার নয়া সংহিতার চেহারায় হাজির হয়। জড়প্রযুক্তি-উৎসারিত উন্নতি-প্রগতি-র অভিপ্রায় যাতে মেটে, তাই-ই সত্য, যথার্থ ও যথোচিত: অভিপ্রায়ের অভিপ্রায় যখন এভাবে আত্ম-প্রত্যাভূতি উৎপন্ন করে চলে, সত্যও তখন আর আদি থাকে না, অভিপ্রায়ই আদি হয়ে ওঠে, অভিপ্রায়ই তখন সত্য উৎপাদন করে চলে, সত্য-অসত্যের বিরোধ উবে গিয়ে উত্তর-সত্য আবির্ভূত হয়। একমেবাদ্বিতীয়ম মানদণ্ড হাজির করে চলা, তীক্ষ্ণ ও হিংস্র নজরদারি কায়েম করা, শৃঙ্খলায় বিন্যস্ত ও অধীনস্থ করা এবং অভিভাবকসুলভ উপদেশ দেওয়া--- এই চার রণকৌশলের সংযোগে নয়া সর্বাত্মকতাবাদী শাসনের কোষগ্রন্থিগুলো কাজ করতে থাকে।
রুশ বিপ্লব যখন তার বহু সম্ভাবনায় উদ্ভাসিত প্রত্যুষ থেকে ক্রমাগত এই মতবাদিক সর্বাত্মকতাবাদী শাসনের অকালরাত্রিতে প্রবেশ করছে, ওসিপ ম্যান্ডেলস্টামের কবিতাও তখন মধ্যাহ্ন পেরিয়ে রক্তাক্ত ক্ষতের মতো আকাশের ওপারে কোনো আকাশে ফুটে উঠেছে।
৩
১৯১৭-র রুশ বিপ্লবের আগে ওসিপ ম্যান্ডেলস্টামের লেখা কবিতায় (যেমন এই সংকলনের প্রথম নয়টি কবিতায়) স্বীয় স্থিতসত্তা অনুসন্ধানকারী কবি বারবার এমন এক ক্ষয়, স্তব্ধতা, স্রোতোহীনতা মাঝে আটকে থাকার যন্ত্রণা অনুভব করেছেন যা বারবার বৃথাই খসে পড়া ফল, ক্ষয়ে যাওয়া নুড়ি, পঙ্কিল ডোবায় নুয়ে পড়া নলখাগড়া, এমন নানা উপমাচিত্রের মধ্য দিয়ে ফিরে ফিরে এসেছে, কিন্তু তাকেই অমোঘ বলে মেনে নেয়নি। অন্ধ পাতালঘরের কাচের দেওয়ালে নিজ দেহ-শ্বাস-উত্তাপ-এর ভাপে বেঁচে থাকার ধ্রুপদী কলার ছাঁচ ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছে (এই সংকলনের ৩ নং কবিতা)। এই বেঁচে থাকার ধ্রুপদী কলা অনুসন্ধান ও যাপনের মধ্য দিয়ে হাজির করাকেই তিনি কবির দায় বলে বুঝেছেন। ১৯১৭ সালের ঝোড়ো ঘটনাপর্যায় যখন যুদ্ধ-সংকট-শ্রমিকবিপ্লবের বিস্ফোরণে রুশ সমাজের উপর থেকে জার-রাষ্ট্রের ঢাকনাটিকে উপড়ে ফেলল, কবি তখন আশাবাদী হয়ে উঠেছিলেন। জীবনকে অচলায়তনে বেঁধে রাখার শিকলগুলো ছিঁড়ে গেছে, এখন তাহলে বাঁধনহীন যাত্রা আত্মসত্তা ও জীবনকে নতুন অনুভবে উদ্ভাসিত করে তোলার পথে এগোতে পারবে, আর কবিরাও নিজ দায়-পালনের মুক্ত পরিসর পেয়ে বিপ্লব-পরবর্তী নবগঠনকার্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারবে--- ম্যান্ডেলস্টাম এমনটাই আশা করেছিলেন। তাঁর কবিতাও তখন স্থিতসত্তা জীবনের ধ্রুপদী রূপের অনুসন্ধানে, স্বপরিচয় নির্মাণ-প্রচেষ্টায় উতরোল হয়ে ওঠে।
স্থিতসত্তার কুলজি নির্মাণে ম্যান্ডেলস্টামের কবিতা বারবার ফিরে গেছে প্রাচীন গ্রিক ও প্রাচীন ইহুদি অতিকথায় বাহিত ইতিহাস-রেশ-এর কাছে। তিনি সেই সব রেশকে কোনো স্মারক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাননি, উনুকরণীয় বলেও হাজির করেননি। তিনি কেবল বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সময়কে ভাঁজ করে মুড়ে এই দূর অতীতের উপর ফেলে যেন একটা ছাপ সংগ্রহ করতে চেয়েছেন, বর্তমান ও ভবিষ্যতের ছাঁচ বুঝিবা সেই অতীত থেকে উঠে আসা ছাপের মধ্যে আবিষ্কার করার চেষ্টা করেছেন। ম্যান্ডেলস্টামের কাব্যিক অভিব্যক্তি এমন রূপ ধারণ করে যা একই সঙ্গে প্রাচীন ও অর্বাচীন, অস্তিত্ব ও অনস্তিত্ব দুই নিয়েই যা সমান সাবলীল। গূঢ় রূপকের স্ফটিক সমস্ত স্থির-নিবদ্ধ ধারণাকে আলুলায়িত করে ধরে, এঁটে রাখা খিলগুলোকে খুলে দেয়, সবকিছুকে স্পর্শ করতে চায় আর প্রতিটা স্পর্শেই নতুন হয়ে ওঠে, কোষগ্রন্থিগুলোকেও বদলে ফেলে। তা স্থিরপ্রতিজ্ঞভাবেই অসরল। যুক্তি ও জ্ঞানের দাপুটে নজরদারি যখন সমস্তকিছুকেই প্রকাশ্যে নিয়ে চলে এসে সরল বিন্যাসে বেঁধে দেওয়ার গর্বে মত্ত, তা এড়িয়ে গিয়ে, তা প্রত্যাখান করে এযেন এক গোপনাচারী লিখন-চিন্তন পদ্ধতি। এই লিখন-চিন্তন পদ্ধতি এক তাত্ত্বিক বিরোধ বিশেষ, অথচ তত্ত্বভাষায় কথিত নয়, এ এক সমালোচনা বিশেষ, অথচ আগ্রাসী আত্মম্ভরী নয়, তবু সাধারণ হয়েও তা সম্ভ্রান্ত, মৃদুভাষী হয়েও বিদ্রোহী। সীমার উপলব্ধি ও সীমা ভাঙার জন্য লাফ--- এই দুইয়ের মধ্যে নিরন্তর পারাপার করা দেহের ধ্বনি ও ইঙ্গিত দিয়ে তৈরি হয় সূচনার কলা, আত্মাকে আত্মে জারিত করার শিল্প।
দার্শনিক নিৎশে যে চিরন্তন পুনরাবর্তন (eternal recurrence) –এর কথা বলেছিলেন, ম্যান্ডেলস্টাম কি সেই ভাবনার পড়শি ছিলেন? হয়তোবা। কিন্তু একটি কথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়: রুশ বিপ্লবের নেতৃত্ব দখলকারী বলশেভিকরা জড় উৎপাদন ও জড় প্রযুক্তির ক্রমোন্নয়নের ধারায় অতীত থেকে ভবিষ্যতের দিকে প্রগতির যে একরৈখিক সরলপথে সময় প্রবহমান বলে মনে করত, ভোগসামগ্রীর বৃদ্ধিই জীবনের মানকে উন্নত করে বলে বিশ্বাস করত, ম্যান্ডেলস্টাম তার সঙ্গে একমত ছিলেন না। এই সংকলনের ১৪ নং কবিতায় তার প্রকাশ আমরা দেখতে পারি। বিপ্লবোত্তর রাশিয়ার খুদে আমলা, বণিক, ধর্মতত্ত্ববিৎ (মতবাদিক গুরুও তার অন্তর্গত?), ডলার-হাতানো-মক্কেলদের বিধি-বিনিময়-ব্যবস্থা কায়েম হতে দেখে কবি চিৎকার করে সেই বিনিময়ের অংশ হতে প্রত্যাখান করছেন, তিনি চাইছেন যে তাঁর সাধনার স্বর্ণমুদ্রাগুলো (স্বাধীন আত্মসত্তা নির্মাণের কলা প্রসঙ্গে কথাগুলো) বিনিময় করতে দেওয়া হোক। বিপ্লবোত্তর রাশিয়ায় খুব দ্রুতই তখন বিভিন্ন বিপরীতমুখী ভাবনার প্রতি সহনশীলতা শুকিয়ে যাচ্ছে, বলশেভিক পার্টির, পরবর্তীতে কম্যুনিস্ট পার্টির মতবাদের সঙ্গে যা মেলে না তাকেই বিপ্লব-বিরোধী চক্রান্তের অংশ বলে দমন করার রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা পাকাপোক্ত হয়ে উঠছে।
৪
ওই ‘স্বর্ণমুদ্রা’ কবিতাটি ১৯২০-এর দশকের প্রথমদিকে লেখা যখন সোভিয়েত দেশে ‘নেপ’ (NEP, New Economic Policy) লাগু হয়েছে। সেই দশকের শেষদিকে এসে ‘নেপ’-এর অবসানের পর প্রথম পঞ্চবার্যিকী পরিকল্পনার সূচনা এবং স্তালিন-শাসনের ক্রম-ঘনীভূতকরণের সঙ্গে সঙ্গে শিল্পকলা চর্চাক্ষেত্রে কম্যুনিস্ট পার্টির অনুশাসন আরো গেঁড়ে বসল। পার্টি-নিযুক্ত পর্যবেক্ষকদের অনুমতি ছাড়া কোনো বই প্রকাশ বা কোনো নাটক মঞ্চস্থ হওয়া অসম্ভব হয়ে গেল। ‘পার্টি লাইন’ অনুসরণ করে পার্টির কাজের মহিমাকীর্তন, পার্টির চোখে দেখা বাস্তবতাকেই একমাত্র বাস্তবতা বলে হাজির করা, কোনোরকম দ্বিধা-দ্বন্দ্ব-সমালোচনা উচ্চারণ না করে পার্টি-কথিত আশাবাদকেই আবেগঘন রূপে হাজির করা--- একেই নাম দেওয়া হলো ‘সমাজতান্ত্রিক বাস্তববাদ’ (socialist realism) এবং সব শিল্পসৃষ্টিকে তার অনুসারী হতে হবে বলে ঘোষণা করা হলো। এর অন্যথা হলেই সেই শিল্পপ্রচেষ্টাকে ‘বিপ্লববিরোধী ষড়যন্ত্রকারী’, ‘জনগণের প্রতি বিশ্বাসঘাতক’ আখ্যা দিয়ে দমন করা, শিল্পীকে ‘বুর্জোয়া ইন্টেলেকচুয়াল’ বলে শনাক্ত করে সমস্ত কাজের সুযোগসুবিধা কেড়ে নেওয়া চালু হলো। এই নজরদারী প্রক্রিয়ায় অনুঘটক হিসেবে পার্টির বাধ্য বশে-থাকা লেখক-শিল্পীদের নিয়ে তৈরি হলো ‘র্যাপ’ (RAPP, Association of Proletarian Writers)। সুতরাং ওসিপ ম্যান্ডেলস্টামের নিজ স্বর্ণমুদ্রা বিনিময় করতে পারার জন্য আবেদন গণ্য হওয়ার কোনো অবকাশ আর রইলো না।
‘সমাজতান্ত্রিক বাস্তববাদ’-এর নামে পার্টির মতবাদ ও পরিবর্তমান কৌশলের সাথে খাপে-খাপ মিলিয়ে হাজির হতে থাকা অবশ্য-অনুসরণীয় মান্য ছাঁচ অনুযায়ী একদিকে যেমন যন্ত্রে-মাপা যন্ত্রে-কাটা ‘প্রলেতারিয়’ সাহিত্য-শিল্প-নাটক-সিনেমা গণ-উৎপাদন হতে শুরু হলো, অন্যদিকে তেমনই স্বাধীন চিন্তাশীল শিল্পী-সাহিত্যিকদের কন্ঠ স্তব্ধ হয়ে এলো, বেয়াদবির জন্য তাঁদের অনেককে গ্রেফতারও হতে হলো। আলেকজান্ডার ব্লক তিক্ত ভগ্নহৃদয়ে মৃত্যুবরণ করলেন। এসেনিন আত্মহত্যা করলেন (নাকি গুপ্ত পুলিশের হাতে খুন হলেন?)। মায়াকোভস্কি আত্মহত্যা করলেন। ব্যাবেল লেখা বন্ধ করলেন, পরে গ্রেফতার হয়ে নিখোঁজ হয়ে গেলেন। ভূতপূর্ব বলশেভিক ইয়েভগেনি জামিয়াতিন দেশ ছাড়ার অনুমতি চেয়ে স্তালিনকে লেখা আবেদনপত্রে লিখলেন:
…আমি অনুমতি চাইছি যাতে আমি সস্ত্রীক সাময়িকভাবে, অন্তত এক বছরের জন্য, দেশ ছেড়ে বাইরে গিয়ে বসবাস করতে পারি এবং আমার এই অধিকার যেন বজায় থাকে যে যখনই আমাদের দেশে খুদে চুনোপুঁটিদের সামনে কুঁকড়ে না থেকে সাহিত্যের মহান ভাবনাগুলোর সেবা করা সম্ভবপর হয়ে উঠবে, একজন সাহিত্য-শিল্পীর ভূমিকা বিষয়ক বর্তমান ধ্যানধারণার আংশিক হলেও কিছু পরিবর্তন ঘটবে, তখনই আমি আবার আমার দেশে ফিরতে পারবো।
(১৯৩১ সালের জুন মাসে স্তালিনকে লেখা চিঠি। সূত্র: Yevgeny Zamyatin, translated and edited by Mirra Ginsburg, The Dragon, Fifteen Stories, The University of Chicago Press, 1976, pg. xvii, বাংলা তর্জমা বর্তমান লেখকের করা।)
এই পরিবর্তন এক বছরে হয়নি, জামিয়াতিনেরও দেশে ফেরা হয়নি। আর এহেন শিল্পী-সাহিত্যিকদের তালিকা যেমন একদিকে আরো দীর্ঘ হয়েছে, তেমনই নিশ্ছিদ্র হয়ে উঠেছে ‘সমাজতান্ত্রিক বাস্তববাদ’-এর কারাগার।
এই পরিবেশে ওসিপ ম্যান্ডেলস্টাম ক্রমশ অচ্ছুৎ একঘরে হয়ে ওঠেন। পত্রপত্রিকায় তাঁর কবিতা ছাপা বন্ধ হয়। তাঁর কবিতার বই প্রকাশও অসম্ভব হয়ে ওঠে। প্রবন্ধ লিখলে তাও প্রকাশের সুযোগ শুকিয়ে যায়। কম্যুনিস্ট নেতা বুখারিন তাঁর কবিতার রসগ্রাহী ভক্ত হওয়ার সুবাদে বুখারিনের পৃষ্ঠপোষকতায় রাজধানীতে কিছুদিনের জন্য একটা বাসঘর তাঁর জোটে, আর জোটে রোজগারের উপায় হিসেবে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের বেছে দেওয়া কিছু বিদেশী ভাষার লেখার অনুবাদের কাজ। অচিরেই অবশ্য ‘সাহিত্যিক চৌর্যবৃত্তি’-র অভিযোগ তুলে অনুবাদের কাজ থেকেও তাঁকে বরখাস্ত করা হয়। চরম দুর্ভোগের দিন ঘনিয়ে ওঠে। কবিতা লেখা অবশ্য তিনি থামাননি। মাঝেমধ্যে ছেদ পড়লেও বরবার ফিরে ফিরে এসেছেন কবিতার কাছে। মুখে মুখে কবিতা বানিয়েছেন, তাঁর জীবনসঙ্গিনী নাদেঝদা ম্যান্ডেলস্টাম হয়তো তার বেশিরভাগ লিখে রেখেছেন বা স্মৃতিতে ধরে রেখেছেন, লেখা পাণ্ডুলিপিগুলো লুকিয়ে রেখেছেন রাষ্ট্রীয় নজরদারী বাহিনীর হাতে বাজেয়াপ্ত হয়ে ধ্বংস হওয়া থেকে রক্ষা করতে। ম্যান্ডেলস্টাম তাঁর আশপাশের মানুষজনদের মুখেই আবৃত্তি করে শোনাতেন তাঁর কবিতা। সেই কবিতার ছন্দ ও ভাষার অত্যাশ্চর্য সমণ্বয়-ঝঙ্কার তাঁর শ্রোতাদের যেমন মোহিত করতো, তেমনই ছক-না-মানা স্বাধীন উচ্চারণ আশঙ্কিত করে তুলতো যে কবি নিজেই নিজেকে বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছেন।
বিপ্লবের প্রত্যুষে যে স্বপ্ন ম্যান্ডেলস্টাম দেখেছিলেন, স্থিতসত্তার উজ্জীবনের মধ্য দিয়ে স্বাধীন স্বপরিচয় গড়ে নেওয়ার স্বপ্ন, সেই স্বপ্ন মিলিয়ে গিয়ে এখন তাঁর কাছে বেদনাদায়কভাবে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে মতবাদিক অভিপ্রায়ের ভারে ভঙ্গুর হয়ে উঠে স্থিতসত্তার ভেঙে পড়া। ১৯২৮ সালে রচিত ‘অশ্বনাল সন্ধানী’ (এই সংকলনের ৬৫ নম্বর কবিতা) কবিতায় এই উপলব্ধি ও বেদনা ফুটে উঠেছে। কবিতার শুরু হচ্ছে এই বিবৃতিতে যে গোলাপি পাইনের জঙ্গলকে কেবলমাত্র জাহাজ-মাস্তুল তৈরির উপকরণের গুদাম হিসেবেই এখন ভাবা হয়ে থাকে। যে কোনো সত্তার পরিচয় এখন মতবাদিক অভিপ্রায় অর্জনের অভিযানে তার উপযোগিতাটুকুর মধ্যে সীমাবদ্ধ। বাতাস ও ঢেউয়ের সমস্ত উতরোল পরিবর্তমানতা ও অনিশ্চয়তাকে জাহাজী প্রযুক্তি দিয়ে শাসন করতে পারার সক্ষমতার অধ্যাস ও দর্প এক অন্ধত্ব তৈরি করেছে। বিজয়-নিশ্চিত অভিযাত্রীর এক জমকপূর্ণ মূর্তি গড়ে দেওয়া হয়েছে সত্তার মানরূপ হিসেবে। মানুষ যেই মানরূপের কল্পিত কীর্তির দর্শক হয়ে উত্তেজনা পোহাতে চাইছে। দর্শক-উত্তেজনায়-মজে-থাকা-সর্বস্ব এই অস্তিত্ব স্থিতসত্তা জুড়ে আত্মের উপস্থিতিকে শূন্যে পরিণত করেছে। আর যে বাতাস ও ঢেউয়ের শক্তিকে নিয়ন্ত্রণের অধীন বলে ঘোষণা করা হয়েছিল, সেই বাতাস-ঢেউয়ের বিস্ফোরক শক্তি নির্মীত জাহাজটির বাঁধন ভেঙে আলগা করে দিতে শুরু করেছে ইতিমধ্যেই। এই উপমাচিত্রে বার্তা অতি স্পষ্ট। বলশেভিক-কম্যুনিস্ট শাসকরা পশ্চিম ইওরোপের পথে প্রযুক্তির পিঠে চড়ে দ্রুত জড়-উৎপাদন বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে সমাজতন্ত্রে পৌঁছানোর যে অভিযান কায়েম করেছে, তা মানুষ সহ সমস্ত প্রকৃতিকেই কেবল তার অভিপ্রায়-পূরণের স্বার্থে উপযোগিতার মূল্যে বিচার করে। মানুষ ও প্রকৃতির নিজস্ব স্বতন্ত্র স্থিতসত্তার স্বীকৃতি সেখানে নেই। ফলে মানুষের অস্তিত্ব সেখানে অভিপ্রায়মূলকতার হাড়িকাঠে বলিপ্রদত্ত হিসেবে আত্মহীন শূন্যতায় নিমজ্জিত অপ্রাণ-বস্তুতে পরিণত হয়েছে। নেতৃত্বের মতবাদিক অভিযান বিপর্যয়ের পর বিপর্যয় ঘনিয়ে তুললেও তাদের আর এই বলয় ভেঙে নতুন কোনো পরিসর নির্মাণের প্রয়াস নেই।
একের পর এক কবিতায় ঘনিয়ে ওঠা এই আস্তিত্বিক সংকট প্রকাশ করতে চাওয়ার পাশাপাশি ম্যান্ডেলস্টাম নানা কবিতায় স্তালিন-শাসনের দম-বন্ধ-করা নিপীড়ক পরিবেশকেও তির্যক ব্যঙ্গ ও ক্রোধের সংমিশ্রণে তুলে ধরেছেন। এই সংকলনের ৪৪, ৪৫, ৬০, ৬১ নম্বর কবিতাগুলো তার নিদর্শন।
৫
ইতিমধ্যে ১৯৩০-এর দশক গড়িয়ে চলেছে। আধুনিকীকরণ, দ্রুত শিল্পোন্নয়ন, উৎপাদনে প্রযুক্তি-ঘনীভূতকরণ এবং রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধিকে বিরাট লাফ পরিকল্পনা তখন কম্যুনিস্ট পার্টির লক্ষ্য হয়ে উঠেছে। তার অংশ হিসেবে কৃষিক্ষেত্রে সমবায়ীকরণ বা রাষ্ট্রীয় কৃষি-সমবায় গঠনের নির্মম প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সোভিয়েত দেশ জুড়ে প্রায় ৫০ লাখ কৃষককে এই প্রক্রিয়ার বিরোধী ‘কুলাক’ বলে চিহ্নিত করে তাদের সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে সাইবেরিয়ার মতো বিভিন্ন জায়গায় নির্বাসনে পাঠানো হয়েছে বা বন্দী করা হয়েছে। সবচেয়ে উর্বর কৃষি-অঞ্চলগুলোতেই দেখা দিয়েছে বয়ঙ্কর রাষ্ট্র-সৃষ্ট দুর্ভিক্ষ। কেবল ইউক্রেনেই ১৯৩২-১৯৩৪ সালে এহেন দুর্ভিক্ষে ৩৯ লাখ মানুষ না খেতে পেয়ে মারা গিয়েছিল। অথচ সোভিয়েত রাষ্ট্রের সমস্ত প্রচারমাধ্যম এই দুর্ভিক্ষের অস্তিত্বই অস্বীকার করে চলছিল। রাষ্ট্রীয় কৃষি-সমবায় গঠনে কৃষকদের ‘স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ’ এবং কৃষকদের অভূতপূর্ব উন্নতির বানানো গল্প প্রচার করে চলেছিলো। এই মিথ্যে প্রচারের বিরুদ্ধে গিয়ে কোনো কথা বলা মানেই ‘বিপ্লবের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা’, ‘সমাজতন্ত্র গঠনের পথে অন্তর্ঘাত করা’ এবং ‘ভয়ঙ্কর রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধ’। এই ভয়ঙ্কর হুমকির সামনে সোভিয়েত শিল্পী-বুদ্ধিজীবীরাও নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থে ভয়ঙ্কর বাস্তব থেকে চোখ ফিরিয়ে রেখে পার্টি-প্রোপাগান্ডারই শিল্পীত ভাষ্য নির্মাণ করে যাচ্ছিলেন। আর এই সময়েই ওসিপ ম্যান্ডেলস্টাম সবকিছুর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তাঁর চূড়ান্ত বিদ্রোহের ঘটনাটি ঘটালেন।
ইউক্রেনের দুর্ভিক্ষপীড়িত গ্রামে শবদেহ অথবা জ্যান্তে-মৃত ছায়ামানুষে পরিণত হওয়া কৃষকদের নিজে চোখে দেখে আসার যন্ত্রণা রূপান্তরিত হলো অলঙ্কারহীন ভূশণহীন প্রাচীন পাথুরে অস্ত্রের মতো এক কবিতায়। সেই কবিতায় স্তালিন ও তার সহযোগী রাষ্ট্র-পরিচালকদের ঘৃণায় ব্যঙ্গে দগ্ধ করা হলো। স্তালিনকে সরাসরি কৃষকদের হত্যাকারীও বলা হলো। আর ম্যান্ডেলস্টাম তাঁর আশপাশের পরিচিত জনেদের বিনা দ্বিধায় এই স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করে শোনালেন। এই ধরনের কবিতা শোনাও বুঝি তাদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করতে পারে বলে তাঁর শ্রোতার বেশিরভাগই কুঁকড়ে গেলেন, কিন্তু ম্যান্ডেলস্টাম অবিচল। রাষ্ট্রীয় পুলিশ যখন তাঁকে এই কবিতা রচনা ও প্রচারের জন্য গ্রেফতার করল, তখনও তিনি এর দায় অস্বীকার করল না, বুঝে শুনেই তিনি হাড়িকাঠে উঠতে হবে জেনেও এই বিদ্রোহটি করেছেন যে। তারপর যা হওয়ার তাই-ই হলো। প্রথমে রাজধানী থেকে দূরে ভোরোনেজ-এ নির্বাসন, তারপর গুলাগ-এর বন্দীশিবিরে চালান এবং বন্দীশিবিরজালের অভ্যন্তরেই লোকচক্ষুর আড়ালে মৃত্যু।
কবির এই চূড়ান্ত বিদ্রোহী স্বতঃক্রিয়াটিকে আমরা কীভাবে দেখব? তা কি নেহাতই অবিবেচক হঠক্রিয়া, সাহসী আত্মবলিদান, ঘৃণার উন্মত্ততা, নাকি অন্য আরো কিছু? এই বিষয়টাকে একটু ভিন্ন দিক থেকে দেখা যাক।
৬
ক্ষমতাধিপত্য বিরোধী জীবনযাপনের শিল্প নিয়ে মিশেল ফুকোর ভাবনা ১৯৮১ থেকে ১৯৮৪ সালে তঁার মৃত্যু অবধি কলেজ-দি-ফ্রঁাস-য় তঁার পরিচালিত পাঠক্রম ও তঁার বক্তৃতাবলীতে ‘পারহেসিয়া’ নিয়ে অনুসন্ধানী বিশ্লেষণের রূপ নিয়েছিল। ‘পারহেসিয়া’ সংক্রান্ত বিশ্লেষণে ফুকো চোখ ফিরিয়েছিলেন খ্রিস্টপূর্ব গ্রিক ও রোম সভ্যতার প্রাচীনযুগে ও খ্রিস্টধর্মের প্রত্যুষকালে ‘সিনিক’ (cynic) দার্শনিকদের চিন্তাধারা ও জীবনপ্রণালীর দিকে। ‘সিনিক’ দার্শনিকরা সাধারণভাবে অর্থ-বিলাস-ব্যসনের প্রতি তীব্র ঘৃণা এবং সমস্তকিছুর তীব্র সমালোচনা করার জন্য পরিচিত, যে কারণে তঁাদের অসূয়ক হিসেবেও গণ্য করা হয়ে থাকে। ফুকোর উদ্ধার করা ইতিহাস অনুযায়ী ‘সিনিক’-দের আদি পরম্পরাকে আমরা এভাবে দেখতে পারি: খৃস্টপূর্ব পঞ্চম শতকে গ্রিক সাহিত্যে, বিশেষ করে ইউরিপিদিসের নাটকগুলোর মধ্যে প্রথম সদর্থক অর্থে ‘সিনিক’ দর্শনের আবির্ভাব হয়, তার পরবর্তীকালে গ্রিক শহরের নাগরিকসভায় ও রাজার প্রতিস্পর্ধী রাজনৈতিক পারহেসিয়ার মধ্য দিয়ে তা বিস্তৃত হয়, তারপরে ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির পারস্পরিক ক্রিয়ায় নৈতিক বা সক্রেতিয় পারহেসিয়া হিসেবে দেখা দেয়, অবশেষে খ্রিস্টান ধর্মের প্রত্যুষকালে ঈশ্বরের সঙ্গে এক মুখোমুখি প্রত্যক্ষ সম্পর্ক গড়ে তোলার উপায় হিসেবে খ্রিস্টিয় পারহেসিয়ায় রূপান্তরিত হয়। ‘পারহেসিয়া’ একটি গ্রিক শব্দ। ফুকো তার মানে করেছেন ‘সাহসী (বা ভয়মুক্ত) সত্যভাষণ’ হিসেবে। এই সাহসী বা ভয়মুক্ত সত্যভাষণ কেবল অপ্রিয় বা অসুবিধাজনক কোনও সত্যোপলব্ধিকে ভাষা দেওয়াতেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং জনসমক্ষে তা বলা, সেই বলার দায় স্বীকার করা, নিজ জীবনাচরণের মধ্য দিয়ে তা প্রয়োগ করা, তার জন্য মূল্য চুকানো ও তাকে নিজ অস্তিত্বের ভরকেন্দ্র করে তোলা। এই সমগ্রটা নিয়েই পারহেসিস, যেখানেই তা নিছক ভাষণ (rhetoric)-এর থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। তাই পারহেসিস একজন সিনিক-য়ের গোটা জীবনচর্যাকে কয়েকটি আবশ্যকীয় বৈশিষ্ট্যে চিহ্নিত করতো বলে ফুকো চিহ্নিত করেছেন:
১। যে কোনও স্থানিক বা প্রাতিষ্ঠানিক বদ্ধতা এড়িয়ে নিয়ত গতিময়তা ও পরিবর্তনশীলতার গুণে জীবন এক অবিরাম উৎক্রান্তি যাত্রা।
২। সিনিক-এর দেহ আবরণহীন, আভরণহীন, সম্পদহীন, উলঙ্গপ্রায়রূপে অনাবৃত। তঁারা ‘অনাবৃত জীবন’-এর যাপক। সেটাই তঁাদের স্বাধীনতার ভিত্তি। শৃঙ্খলা দেহকে ক্রমবর্ধমান উপযোগের মাধ্যম হিসেবে গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে একটি শৃঙ্খলিত উৎপাদনশীল দেহ গড়ে তোলে, ঠিক তার বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে সিনিক-য়ের অশৃঙ্খলায়িত দেহ।
৩। সত্যভাষণের জন্য সিনিক তার সাহসিকতা বা ভয়মুক্তিকে চরম সীমা অবধি ঠেলে নিয়ে যায় যেখানে রূঢ়তা ও অবিমৃশ্যকারিতার একচুল দূরত্বে হয়তো সে দাঁড়িয়ে থাকে। শৃঙ্খলা যেরকম বাধ্য, নিরাপত্তাভাবনা-সর্বস্ব সমাজজীব উৎপাদন করতে চায়, ঠিক তার বিপরীত মেরুতে পৌঁছানোই সিনিকের জীবন-অভিযানের লক্ষ্য।
৪। সিনিকদের জীবন একটি নিরন্তর সংগ্রাম। সেই সংগ্রাম নিজের স্থিতসত্তার বিরুদ্ধে, আবার নিজের স্থিতসত্তা উপলব্ধির জন্যও। সেই সংগ্রাম অপরের বিরুদ্ধে, আবার অপরের জন্যও। সার্বভৌম জীবনের দার্শনিক ধারণাটি ব্যক্তির নিজের উপর এমন এক প্রভুত্বের কথা বলে যা নিজেকে উপভোগ করা ও অন্যকে সহায়তা করার উপযোগী হয়ে ওঠে। সার্বভৌম জীবনের এই দার্শনিক ধারণাটির বিপরীতে সিনিকের জীবনভাবনা গঠিত হয়।
৫। সিনিকদের মূল অভিপ্রায় হল নিয়ম, অভ্যাস, রীতি ও আইন ভেঙে ফেলা। কিছু দার্শনিক নিয়ম বা সূত্রাবলীর অনুসরণের মধ্য দিয়ে প্রকৃত জীবন বা সত্য জীবন আয়ত্ত করা সম্ভব বলে সে মনে করে না। প্রতিনিয়ত অপর কিছুতে উৎক্রমণের মধ্য দিয়েই সিনিকরা প্রকৃত জীবন বা সত্য জীবনকে অস্তিত্বযাপনে মূর্ত করে তুলতে চায়।
ফুকোর দ্বারা চিহ্নিত পারহেসিয়ার এই বৈশিষ্ট্যগুলো ক্ষমতাধিপত্যবিরোধী জীবনশিল্পের নিদর্শন। এ হল বিপন্নের আশু অতি-সক্রিয়তা। ক্ষমতাকে প্রতিরোধ করার মধ্য দিয়ে উন্নত সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার কোনও মতবাদিক প্রয়াসের আলোচনা এখানে হচ্ছে না। ক্ষমতাসম্পর্ক বিপজ্জনক, ক্ষমতাসম্পর্ক আমাদের আশু অস্তিত্বকে আক্রমণ করছে, বিপন্ন করছে। তাই সেই আক্রান্ত বিপন্নতার জায়গা থেকে, আশু অতি-সক্রিয়তার পথেই প্রতিরোধ। পারহেসিয়া যেমন একইসঙ্গে ভয়মুক্তভাবে ঝুঁকি নেওয়ার মধ্য দিয়ে অস্তিত্বকে বিপন্ন করে, আবার নতুন অস্তিত্ব নির্মাণেরও চেষ্টা করে। পারহেসিয়া স্থাণু-স্থবির জগদ্দল ভেঙে ছিটকে বেরতে চায়। চূড়ান্ত বিপদের মুখে দাঁড়িয়ে থাকার বোধ থেকেই তা উৎসারিত হতে পারে। প্রতিটি নির্দিষ্ট ইতিহাস-মুহূর্তে ক্ষমতা ও আধিপত্যের বুনটের নির্দিষ্ট চরিত্রের উপর দাঁড়িয়ে তার বিরুদ্ধে পারহেসিয়াকেও নতুন রূপে আত্মপ্রকাশ করতে হয়।
ফুকোর এই বিশ্লেষণ খেয়ালে রাখলে, ১৯৩২-১৯৩৪ সালের সোভিয়েত পরিস্থিতিতে ম্যান্ডেলস্টামের স্তালিনকে নিয়ে পূর্বোক্ত কবিতা রচনা করা, আবৃত্তি করে শুনিয়ে বেড়ানো এবং দায় স্বীকার করে রাষ্ট্র্রীয় নির্যাতনের মুখোমুখি হওয়া একটি পারহেসিয় স্বতঃক্রিয়া বৈ আর কিছু নয়। হিংস্র সর্বাত্মকতাবাদী শাসনের প্রকোপে সত্তা-স্বাধীনতার নিভন্ত প্রহরে চরম উজ্জ্বলতায় জ্বলে উঠে অগ্নিহোত্রী হওয়ার এই সাধনাকে নিরাপত্তা-সাবধানতার অতিযৌক্তিকতা দিয়ে বোঝা সম্ভব নয়। মতবাদ ও রাষ্ট্রের পরাক্রমের যুগে এই-ই কবির নিয়তি--- এরই জন্য কবিকে প্রিয়ার বাহুডোর শিথিল করে, নোনতা ভিজে ঠোঁট ফেলে এসে আধা-ঘুমন্ত সর্বনাশে নগরের ঘুম ভাঙা অবধি নিজ সত্তার দূর্গে অপেক্ষা করে যেতে হবে।
বিপ্লব নায়ক
মে, ২০২৫