কচুবন

লিখেছেন:সোহিনী রায়
মা মেয়ের মাঝখানে কচুবন... বাইপাসে বিকেল হয়...

আজকাল কাজে মন থাকে না অপর্ণার। সারাক্ষণ মনটা ঘরে পড়ে থাকে। আগে কী মন দিয়েই না বাসন মাজত! এখন শুধু তাড়া! কোনোমতে শেষ করে ছুট!। 

 সকালে একবাড়িতে রান্না। তিনবাড়িতে ঠিকে কাজ। আগে কাজ সেরে মোড়ের মাথার চা-এর দোকানটায় চা খেতো। এখন তাও খায় না! তাড়া লেগে যায় ভেতরে ভেতরে! দাঁড়াতে পারে না! 

ঘরে এসে দেখে ঘর বন্ধ। তালা দেওয়া কালো কাঠের  দরজা খুলে  নিচু হয়ে খাটের তলাটা দেখে নেয় - কোনো খাবার আছে কি না! আজকাল রান্না থাকে না। আগে থাকত। হরেকরকম পদ! ভাত, ডাল, আলুভাজা, চিঙড়ি মাছের কষা কষা ঝোল! বা পরোটা, মুরগির ঝোল! বা ইলিশমাছের মাথা দিয়ে কচু শাক আর তার সাথে বাকী পদগুলো তো রয়েইছে, মানে ডাল,  তরকারি ইত্যাদি। প্রায়ই চাটনি। এতো রান্না দেখলেই মাথার ভেতরটা দপ করে আগুন জ্বলে উঠত অপর্ণার। কী দরকার এতো রান্নার! অকারণ খরচ!  আর এখন খাটের তলা খালি। ফাঁকা ফাঁকা বাসন,  মেজে ওল্টানো। অপর্ণা ভাত বসায়। ভাতের মধ্যে ছোট ঘটির মতো টিফিন কৌটতে ডাল-সেদ্ধ করতে দিয়ে এ ঘর ও ঘর মা-কে খুঁজতে বেরোয়। দ্রুত একবার চেনাজানা ঘরগুলো ঢুঁ মেরে নিয়ে অপর্ণা প্রায় ছুটলো বাইপাসের দিকে। অপর্ণা জানে মা এখন কোথায়। তাও একবার নিয়মরক্ষার জন্য এ বাড়ি ও বাড়ি জিজ্ঞেস করে নেয় - মা আছে কি না! 

 অপর্ণাদের বস্তি থেকে বাইপাস একদম কাছে। সোজা রাস্তা ধরে একটু হাঁটলেই বাইপাসের রাস্তা। ঘরে রান্না চাপানো আছে। দ্রুত হাঁটতে গিয়ে দম ধরে আসে অপর্ণার। অপর্ণার মা-র এ এক নতুন অভ্যেস! দুপুর গড়ালেই বাইপাসে চলে আসে। কবে থেকে? সেই যেদিন ফোনটা এলো, তারপর থেকে। 

  লকডাউনের পর প্রায় দু মাস পেরিয়ে গেছে। মে মাসের কুড়ি তারিখ। সন্ধেবেলা ফোনটা এলো। ওর মা-র মোবাইলে। দিলীপের বৌদির ফোন। মা ধরল। জানালো দিলীপের মা মারা গেছে। ' ও আচ্ছা। কখন? আচ্ছা। ভুগছিলো তো! দিলীপ কোথায়? দিলীপ? ভালো করে শোনা যাচ্ছে না। আচ্ছা, আমি ওকেই ফোন করছি।'

দিলীপ কে? অপর্ণার বাবার বন্ধু। অপর্ণাদের বস্তির দুটো বাথরুমই রেল লাইনের ওই দিকে। আর ওদের বাড়ি এইদিকে। বাথরুম যেতে হলে লাইন ক্রস করতে হয়। অপর্ণার বাবার ট্রেনে পা-কাটা গেলো। এইভাবে লাইন পেরোতে গিয়ে। বাবার চিকিৎসা করানো, ওষুধ-পত্র কেনা এইসব করার জন্যই দিলীপ,  যাকে অপর্ণা তখন দিলীপকাকু বলে ডাকত, তার যাতায়াত বাড়লো। তারপর দেখা গেলো মা আর দিলীপকাকু এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ায়। অপর্ণার বিয়ে হলো। ছেলে হলো। অপর্ণার পা-কাটা বাবা অপর্ণার ছেলে সামলায়। সে ছেলে বড় হয়। তার দাদু, মানে অপর্ণার বাবা মারা যায়। অপর্ণার বর নিত্যদিন নিজের বউকে পেটাতে পেটাতে একদিন সাহস করে নিজের শ্বশুরের বউ, অর্থাৎ অপর্ণার মা-কে পেটাতে যায়! যে ডাণ্ডা দিয়ে পেটাতে গেছিলো সেই ডাণ্ডাটা নিয়ে অপর্ণার মা থানায় যায়। অপর্ণার বর পুলিশের ভয় বা অন্য কোনো কারণে পালিয়ে যায়। তারপর বহুদিন তাকে আর এ চত্বরে দেখা যায়নি। অনেকদিন পর আসে। ফেরার পর আর অপর্ণাদের বাড়িমুখো সে হয়নি। কিন্তু এই এতোদিন ধরে দিলীপ রয়ে যায়। তবে এই দিলীপকে অপর্ণা আর দিলীপকাকু বলে না, হয় বলে ' ব্যাটা দিলীপ', নয়তো ' নাম্বার ওয়ান হারামজাদা' বা এইধরনেরই আরো কিছু। যেদিন যেরকম মেজাজ থাকে অপর্ণার সেদিন সেরকম ডাক। অপর্ণার দিলীপের ওপর রাগের কারণ?  

 অপর্ণার মা একটি প্রাইভেট অফিসে বহুদিন ধরে চা-বানায়৷ মাস গেলে মাইনে। অপর্ণার মা-র হাতের কাজ দ্রুত। অপর্ণার মা-র সব শাড়ির সাথে ম্যাচিং ব্লাউজ আছে। ব্লাউজের ফিটিংস একটুও এদিক ওদিক হওয়া অপর্ণার মা-র এক্কেবারে অপছন্দ। ব্লাউজ হবে টাইট। এঁটে বসবে শরীরে। শাড়ি হবে টানটান। একটুও অগোছালো নয়। অপর্ণার মা-র একঢাল কালো চুল। বাড়ি থেকে বেরোলে এলো খোঁপা। চোখে সোনালী ফ্রেমের চশমা। কাঁধে ব্যাগ। কালোকুলো অপর্ণার মা-র শরীর থেকে লাবন্য ছিটকে বেরোয়। দেখে কারুর বোঝার উপায় নেই যে ওনার একটি নাতি আছে। সে যে বয়সেরই হোক। অপর্ণার মা সকালে অফিসে যায়। চা বানায়। দুপুরে বাড়ি আসে। নানাপদ রাঁধে। তার থেকে কিছুটা একটা টিফিন বাক্সে তুলে নিয়ে রোজ দুপুর দেড়টা নাগাদ ট্রেনে চেপে আসে দিলীপের কাজের জায়গায়। ট্রেনের রাস্তা মিনিট দশেক। দিলীপ একটি ছোট অফিস পাহাড়া দেয়। দিলীপকে দুপুরের খাবার খাইয়ে আবার অপর্ণার মা ফেরে বাড়ি। 

 ইতিমধ্যে সকালের কাজ  সেরে অপর্ণা বাড়ি ফেরে। বাড়ি ফিরেই দেখে নানারকম রান্না। এবং মা বাড়িতে নেই। অপর্ণা জানে মা কোথায় গেছে। 

' এসব কি আমি বুঝি না! কার জন্য এতো রান্না হয় বুঝি না!'

' রোজগারের টাকা কার পেছনে যায় সে কি আর আমি বুঝি না!'

গজগজ করতে করতে অপর্ণা খেতে থাকে। কখনও তার শ্রোতা তার ছেলে। কখনও পোষা বেড়াল। 

 অপর্ণার মা বাড়ি ফেরে। ভয় ভয় আশপাশ দেখে টুক করে টিফিন বক্সটা খাটের তলায় চালান করে। অপর্ণার চোখ এড়ায় না।

' লুকিয়ে কোনো লাভ নেই মা। আমি জানি তুমি কোথায় গেছিলে!'

' আহা লোকালাম কোথায়? এই তো রাখলাম'

অপর্ণার গলার স্বর চড়তে থাকে ' ওই হারামজাদার পেছনেই সব টাকা খরচা করো! আমাদের কথা তোমায় ভাবতে হবে না! '

' কেন তোদের কথা কি ভাবি না? ' 

চলতে থাকে। রোজকার বাগবিতণ্ডা। আবার থেমেও যায়। পুজোয় দিলীপের জন্য জামা কেনা হলে আবার শুরু হয়। মাসের শেষে অপর্ণার মা-র হাত খালি হয়ে যায়। অপর্ণার মাইনেতে হাত পড়ে। অপর্ণা মাইনের টাকা লুকোয়। কোথায়ই বা লুকোবে ! বড়জোর তোষকের তলা! আর কীই বা আছে যেখানে লুকোবে! এই একটা তো খাট আর তার তলা। তলায় গোটা সংসার। খাটে মানুষ। অপর্ণার মা জানে কোথায় টাকা লুকোনো থাকে। টাকা বের করেন। নানারকম বাজার করেন। রান্না করেন। বাকীদের জন্য রেখে টিফিন বক্স নিয়ে চলেন দিলীপের কাছে। বাড়ি ফিরে লুকিয়ে টিফিন বক্স রাখেন। অপর্ণা ধরে ফেলে। কেউই কারুর থেকে কিছু লুকোতে পারে না। 

 আর এভাবেই অপর্ণার দিলীপকাকু ' ব্যাটা দিলীপ', ' হারামজাদা দিলীপ' হয়ে ওঠে। 

 অপর্ণা দিলীপের অফিসে গিয়ে দিলীপকে শাসিয়ে আসে। 

' দেখো কাকু তুমি আর আমার মার সাথে মিশবে না। এবার পাড়ার ছেলেদের দিয়ে তোমায় প্যঁদাবো'।

' আমি কোথায় মিশি? তোর মা-ই তো আসে। কত বারণ করেছি। তাও আসে।'

 সত্যিই কি দিলীপ বারণ করেছে অপর্ণার মাকে? এ তথ্য আমরা জানি না। বউ, ছেলে, ছেলের বউ, নাতি নাতনি নিয়ে দিলীপের ভরা সংসার। দিলীপের দুপুরের খাবার জোটে না এটা কি হতে পারে?! অপর্ণা বুঝে পায় না! মা-কে কেন কিছুতেই আটকানো যায় না অপর্ণা বুঝে পায় না। 

 অপর্ণার মাও বুঝে পায় না দিলীপের ওপর অপর্ণার কেন এতো রাগ! কতটুকু টাকাই বা খরচ হয় ওইটুকু খাবারে! রোজগার তো সেও করে! 

এভাবেই চলছিলো। লকডাউন হলো। দিলীপের অফিস বন্ধ। দিলীপের মতো সিকিউরিটির আর দরকার নেই। বড় এজেন্সি ধরে সিকিউরিটি রাখা হয়েছে। কাজ গেলো দিলীপের। মদের দোকান বন্ধ। সন্ধেবেলা মদ না হলে দিলীপের চলত না এতোদিন। এখন সন্ধেগুলো পাগল পাগল দশা। দিলীপ টাকাপয়সা সব বউ এর হাতে দিতো। এখন মাইনে নেই। হাত পুরো খালি। বিড়ি খেতে গেলেও টাকা চাইতে হয় বউ এর কাছে। বউ কথা শোনায়। কখনও কখনও  দেয়ও  না। দিলীপ নিরুপায় হয়ে ফোন করে অপর্ণার মা-কে। এদিকে অপর্ণার মারও একই দশা। অফিস বন্ধ। চা বানানোর লোকের কোনো দরকার নেই। ফলে কাজ নেই। হাত খালি। অপর্ণার রোজগারই ভরসা। দিলীপের বিড়ির পয়সাও সেখান থেকেই যায় কখনও সখনও। অপর্ণা বুঝতে পারলে বাড়ি মাথায় করে! 

 মদের দোকান খোলে। কিন্তু অনেক দাম। তবু দিলীপকে তো খেতেই হবে! বউ বাজার করার টাকা দেয়। সেখান থেকে দিলীপ টাকা সরায়। মনে মনে বলে ' এ তো আমারই রোজগারের টাকা!' কিন্তু বউ কি আর তা মানে! ধরতে পারলেই তুলকালাম। 

 এরকমই এক সন্ধেবেলা দিলীপের বউ দিলীপকে মাংস আনতে বলে। সামনের দোকানের মাংসের দাম দিলীপের বউ জানে। ঠিক সেটুকু পয়সাই দিলীপকে দেয় সে। দিলীপের গায় লাগে। অপর্ণার মাকে ফোন করে-

' একশটা টাকা নিয়ে আসবি কোথাও? আমার মদের পয়সা নেই। আর অনেকদিন তোর হাতের কচুর দম খাই না। খাওয়াবি?' 

' আজ হবে না। আজ মামনি সারাদিন বাড়িতে। কাল ও বেরোলে হবে। আজ হবে না।' বলাই বাহুল্য মামনি হলো অপর্ণা। 

অপর্ণার মা ফোন রেখে দেয়। মনে মনে ভাবে কাল বাইপাসের ধারের কচু বন থেকে কিছু কচু তুলে নিয়ে এসে রান্না করবে। কচু অপর্ণারা প্রায় কোনোদিনই কেনে না। ওই বাইপাসের ওখান থেকেই তোলে। অপর্ণার মা খুব ভালো কচু চেনে। কোনটা খাওয়া যায়, কোনটা যায় না। 

সেই রাতেই ফোনটা আসে। অপর্ণার মা প্রথমে ভুল শুনেছিলো। দিলীপের বউদি বুঝতে পেরে আবার ফোন করে। এবার অপর্ণা ধরে। দিলীপের ওপর সদা-বিরক্ত অপর্ণা মার হাত থেকে টেনে নিয়ে ফোনটা ধরে। দিলীপের মা মরেছে তো এতো ফোন কীসের! আবার টাকা চায় নাকি! 

' হ্যালো অপর্ণা। তোর মা শুনতে পায়নি। দিলীপের মা নয়। দিলীপ মরে গেছে। সুইসাইড করেছে। ঘরের ফ্যানে বউ-এর কাপড় জড়িয়ে ঝুলে পড়েছে। সন্ধেবেলা ঘরে কেউ ছিলো না। রাতে ছেলে দরজা ভেঙ্গে ঘরে ঢুকেছে। খবরটা দিলাম তোদের'।

অপর্ণা ফোন রেখে ফ্যালফ্যাল করে মা-র দিকে তাকায়। 

তারপর থেকেই মা-র এই রোগ। রোজ দুপুরে চলে যায় বাইপাসের ধারের কচুবনটায়। দাঁড়িয়ে থাকে। শাড়ি ব্লাউজের ঠিক নেই। ব্লাউজগুলো ঢিলে হয়ে গিয়ে কাঁধ থেকে ঝুলে পড়েছে। এলোমেলো চুল। 

আজকেও অপর্ণা দূর থেকে মা-কে দেখতে পেলো। কচুবনে যেন এক আস্ত পাগলি দাঁড়িয়ে আছে! অপর্ণার গলার কাছটা দপদপ করে উঠলো। আজকাল মা-র জন্য খুব কষ্ট হয় অপর্ণার। কেন যে হয় ঠিক বুঝতে পারে না! দিলীপ মরেছে বলে? দিলীপের জন্যও কি কষ্ট হয় একটু একটু? গাল সে কম দেয়নি দিলীপকে এটা ঠিক। কিন্তু দিলীপ মরুক এটা কি সে চেয়েছিল?

 এই মা-কে সে চেনে না। দূর থেকে যেন আরো অচেনা লাগে! অপর্ণা মা-র সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। মা কচুবনের ওই দিকে। মা মেয়ের মাঝখানে কচুবন। বাইপাসে বিকেল হয়।

(জল্পনা-য় পূর্বপ্রকাশিত)

ReplyForward

Add reaction

0 Comments
Leave a reply