খোয়ারি

লিখেছেন:পার্থ কয়াল
৫০০/ কি কম টাকা দিদি? মানুষ হলে ও টাকা ধরতে পারতুম?

বিজয়, খোয়ারি ভাঙতে চারদিক দেখে নিয়ে মেজদার চা দোকানে গিয়ে বসে। মোনে কোথাও একটা গেছে। ভাবার চেষ্টা করে, কী করে এমনটা হোলো। পুরোটা ভাবে। কালও সকালে ট্রিপ সেরে এসে একটা ১১০ নিয়ে রোজকার মতো বসে গিয়েছিল শিবতলায়। মোনেও সাথে ছিল। শেষ করে চান করে এসে বৌদির দোকানে মাংস-ভাত সাঁটিয়ে ঘুম দেয়। ঘুম থেকে উঠতে রাত আটটা। উঠে চা আর হালকা টিফিন করে। বাড়ি থেকে ততক্ষণে রাতের খাবার ক্যানে করে পাঠিয়ে দিয়েছে। খাবার গাড়িতে তুলে এদিক সেদিক করে রাতে সাড়ে দশটায় গাড়ি স্টার্ট দেয়। যাওয়ার কথা ছিল নোদাখালী। ওখানে মাল গস্ত করে যাওয়ার কথা তারাতলা। মাল চিকেন দোকানে দোকানে আনলোড করতে করতে ঠাকুরপুকুর বাজার দিয়ে ঢুকে, ডোঙারিয়া হয়ে ফেরা। সকাল আটটার মধ্যে মল্লিকপুর। আবার ১১০। কিন্তু গোল বাঁধল কালিতলা পেরোতেই। কেমন যেন রাস্তাটা গণ্ডগোল লাগছিল। মোনেও চুপ। বিশে শুধু বলে, কাকা এই রাস্তায় ত এসেছি বলে মনে পরে না। বিজয়ও একটুকু গুমসুমি মেরেছিল। বাতাসেও গুমসুমি। গাড়িটার সামনে ঢালাই রাস্তা শেষ। এবার মাটির রাস্তা। তাতে কাদাও প্রচুর। গাড়িটা থামিয়ে মোনেকে হাত ধরে নামায়। বিশেকে নামতে বলে। বলে- চ দেখি কোন রাস্তায় এলুম। মন্ডলকা’র বাড়িটা কোথায় দেখি। বাইরে ঝিরঝির বৃষ্টি নেমেছে। হাঁটু অবদি কাদা। তার মধ্যেই হাঁটতে শুরু করে। সামনে একটা বাঁশঝাড়, তা এই ধরো দুধে’র দোকান থেকে নাজিমের দোকান অবদি আর চওড়া হাত কুড়ি। সনশনে হাওয়ায় একটা সাদা কাপড় উড়িয়ে একটা মেয়ে, হ্যা মেয়েই বেরিয়ে আসে। বিজয় একবার মোনের মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করে- ও দিদি, তা মন্ডলকা’র বাড়িটা কোন দিকে? মেয়েটা হাত দিয়ে সমুখপানে দেখায়। তিনজন চলতে শুরু করে। এবার মনে হয় শরীর যেন হালকা হয়ে গেছে। কাদার উপর দিয়েই উড়ে যেন যেতে থাকে। কিন্তু মন্ডলকা’র ঘর আর মেলে না। একটা মসজিদের পাশে এসে আজানের আওয়াজে সম্বিৎ মেলে।

মোনে ফাস্ট কথা বলে- কী কেস বল দিকি? তিনজনে পাশের একটা মন্দির চাতালে বসে। বিজয় বলে দাঁড়া একটু জিরিয়ে নি। কোমরটা ছাড়াই। কোমর ছাড়াতে ছাড়াতে একজন দুজন করে নামাজির দেখা মেলে। তারা সব বৃতান্ত শুনে বলে- আল্লার মেহেরবানি তারা আজ বেঁচে গেছে। বিজয় হ্যাবলার মত মোনে আর বিশের দিকে তাকিয়ে থাকে। দরদর করে তিনজনেই ঘামতে থাকে। বুঝে পায় না সেই সাড়েবারোটা/একটা থেকে এই চারটে অবদি কী করল? একগ্রামেই শুধু চক্কর মারলো তিনজন? আর মাল গস্ত করে কাজ নেই। চ ঘর যাই- বিজয় বলে। বাকিরা মাথা নাড়ে।

মল্লিকপুরে এসে গাড়ি থেকে নেমে মোনে একটা ১১০ কেনে। এক ঢোক করে তিনজন মারে। মালিক বলে- বাজার কেমন আজ? বিজয় যা ঘটেছে সব বলে চান করতে যায়। পুকুরের পাড়ে বসে ভাবে, এমনও হয়েছে-যখন ঢোল কোম্পানির গাড়ি চালাত- রাতে ডেড বডি নিয়ে শ্মশানে গেছে। সেই কুলপির সাইডে। ডেড বডির বাড়ির লোক বডি রেখে মাল কিনতে গেছে। বিজয় আর হেলপার, একটা বোতল নিয়ে অন্য মরার নিভুনিভু চিতের কাছে বসে মাল আর বিরিয়ানি খেয়েছে। একবার ত এমনও হয়েছে যে- একটা মিলিটারির লোক, ঐ মিদনাপুর সাইডের, মারা গেছে তার ছেলেদের কাছে। লোকটার মেয়েরা কেস ঠুকে দিয়েছে, ছেলেরা নাকি পয়জন করে বাপকে মেরে দিয়েছে। কলকাতায় মরেছে। মেয়েরা মিদনাপুরে শ্বশুরবাড়িতে বসে কেস করেছে। এই কোম্পানির-এই ঢোল কোম্পানিকে কে কন্টাক্ট করে বডি নিয়ে যাওয়ার জন্য। এই বিজয়কেই ধরল গাড়ি চালিয়ে নে যেতে হবে। ইয়া বডি, মিলিটারির, ঐ ঐ দাদার মতো লম্বাপানা। কিন্তুক, ঐ জমিবাড়ির কেসে ফেঁসে উকিল-মুহুরির পাল্লায় পড়ে বডি পচে রস ঝরতে শুরু করল। সেই বডি নিয়ে এই বিজয় আর হেলপার, গেল মেদনীপুরে। দুই মেয়ে আর তাদের উকিল বলল, পোস্টমর্টেম করতে নিয়ে যেতে হবে। রফা হোলো এই বিজয়কে ৫০০/ পার ডে আর হেল্পার ৩৫০/ পার ডে। অই সময় মাল কিছু কামিয়েছি। তো মেদনাপুর থেকে আবার বডি নিয়ে কাটাপুকুর। ওর মেয়েদের কাছ থেকে পয়সা খিচেছি আর ওর ছেলেদের কাছ থেকে মেলেটারি রাম। দু ছিপিতে পুরো ২৬,০০০ ভোল্ট। সে কী দিন গেছে। গাড়ি ঝাকুনি খেলেই বডি থেকে পচা রস ঝরছে আর গন্ধ। তাই নিয়েই একবার মেদনাপুর, একবার কলকাতা। বডির সাথে থেকে থেকে তখন অভ্যেস হয়ে গেছে। যদিও খাবার খেতে পারা যেত না। খেতে ইচ্ছেও করত না। মনে হত সব বমি হয়ে যাবে। কেবল মালে ঢুক মারা আর গাড়ি চালানো। গাড়ি চালানো আর মালে ঢুক মারা । রাতে কোথায় শুচ্ছি তার ঠিক নি। এমনও হয়েছে, ঐ রস ঝরা বডির পাশেই গামছা দিয়ে জায়গা মুছে শুয়ে গেছি। রাতে মুত পেলে ওখানেই মুতেছি। যেদিন কাটাপুকুরে বডি ঢোকানো হোলো, সেদিন ঐ কাটাপুকুরের ডাক্তার দিদি---রাখীর দিন ছিল--- রাখি পড়াতে এগিয়ে এসে বমি করার জোগাড়। আমার গা দিয়ে মুতের গন্ধ, মরা পচা গন্ধ সব একসাথে বেরোচ্ছে। ডাক্তার দিদি বলে, তুমি কি মানুষ? বলি, ৫০০/ কি কম টাকা দিদি? মানুষ হলে ও টাকা ধরতে পারতুম? তা এইভাবে আরো কয়দিন কাটাপুকুরের বাইরে শুয়েপরে থাকতে হোলো। বডির জন্য নয়, টাকার জন্য। বডি পোস্টনমর্টেম হয়ে আবার অই পচা বডি মেদনাপুর পৌঁছে ছাড়া পাওয়া। প্রথমে বাড়ি এসেকিছুই খেতে ইচ্ছেও করত না। শুধু বমি লাগত। শুধু টুকটুক করে মাল খাওয়া আর এক গাল দু’গাল ভাত। ঘুমও ঠিক করে হতো না। দিন পনেরো এভাবে চলতে চলতে আস্তে আস্তে সব ভুলে যাওয়া।

এসব কথা ভাবতে ভাবতে বিজয় গুম মেরে বসে থাকে। আনসার এসে ধাক্কা মারে---কিরে, আমার একটা ইঁটের ট্রিপ করে দিবি?

0 Comments
Leave a reply