জনপ্রশাসন-পরম্পরা: সভা, গণশাসন, কেবাঙ

লিখেছেন:বিপ্লব নায়ক
প্রাগৈতিহাস থেকে বর্তমান আবধি ভারতীয় উপমহাদেশে জনপ্রশাসনের পরম্পরা সম্বন্ধে অনুসন্ধান করা হয়েছে এই লেখায়...

 

খৃষ্টপূর্ব ১২০০ অব্দ থেকে খৃষ্টপূর্ব ১০০০ অব্দের মধ্যে ঋগ্বেদ সংহিতা সংকলন করা হয়েছিল বলে অনুমান করা হয়। ঋগ্বেদে রাজন্ বা রাজা শব্দের ব্যবহার অসতর্ক পাঠকের মনে এমন ধারণার জন্ম দিতে পারে যে সেই সময়ে রাজতন্ত্রের প্রচলন ছিল। কিন্তু অসতর্কতার মাসুল এই ভুল ধরা পড়ে যায় তুলনামূলক সতর্ক পাঠে। দেখা যায় যে, রাজাকে বলা হয়েছে ‘গণ’-এর সেনানী এবং ‘ব্রাত’-এর প্রথম (ঋগ্বেদ, ১০.৩৪)। ‘গণ’ ও ‘ব্রাত’ শব্দদুটির অর্থ এখানে ‘সমূহ'। অর্থাৎ, রাজা বলতে এখানে রাষ্ট্রের অধিপতি বোঝানো হচ্ছে না, রাজা বলতে বোঝানো হচ্ছে জনগোষ্ঠীর কোনও প্রধান জনকে। সামূহিক ব্যপারে সিদ্ধান্তগ্রহণের জন্য, সামূহিক কাজকর্ম পরিচালনার জন্য সেই সময় ‘সভা’ ও ‘সমিতি’ নামক দুটি প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা লক্ষ্য করা যায়। এই সভা ও সমিতি বিষয়ে বিশদ আলোচনায় আমরা যাব, প্রথমে শুধু চিহ্নিত করা যাক যে বৈদিক সাহিত্যে বহু জায়গায় কোনও এক গোষ্ঠীর আভ্যন্তরীণ সভা ও সমিতিতে বহু রাজার আগমন ও উপস্থিতির কথা বলা হয়েছে। এ রাজতন্ত্রে সম্ভব নয়, কারণ রাজতন্ত্রের মূল কথাই হচ্ছে রাজার একত্ব বা অনন্যত্ব। রাজতন্ত্র নয় এমন কোনও রাজনৈতিক ব্যবস্থাতেই একই জনগোষ্ঠীতে বহু রাজা সম্ভব । দেখা যাক বৈদিক সাহিত্যে এই রাজনৈতিক ব্যবস্থার কী ছবি পাওয়া যায়।

বৈদিক সাহিত্যে জনগোষ্ঠীর সামূহিক বিষয়াদি পরিচালনার জন্য যে চার প্রকার জনগণের সংস্থার উল্লেখ আছে, তা হলো— সভা, সমিতি, বিদথ ও পরিষদ। আলাদা আলাদা করে দেখা যাক এই চারটি সংস্থা সম্পর্কে বৈদিক সাহিত্য আমাদের কী বলছে।

সভা

সভা বলতে একটি সমাবেশ বা সমাবেশ-গৃহ বুঝিয়েছে যেখানে জনগোষ্ঠীর প্রধান ব্যক্তিরা সমবেত হয়ে তঁাদের কাজকর্ম নিয়ে আলোচনা করতেন (ঋগ্বেদ, ৬.২৮.৬, ৮.৪.৯, ১০.৩৪.৬, অথর্ববেদ, ৫.৩১.৬, ৭.১২.১, ৭.১২.২, ৮.১০.৫, ১২.১.৫৬, ১৯.৫৫.৬)। সভার বিকল্প একটি শব্দও পাওয়া যায়, তা হলো ‘নরিষ্ঠা’। ‘নরিষ্ঠা’-র ব্যাখ্যা করে টীকাকার সায়নাচার্য বলেছেন যে সেখানে অনেকে মিলে সিদ্ধান্ত নেন এবং সেই সিদ্ধান্ত সবাইকে মেনে চলতে হয়, সেই অলঙ্ঘনীয়তার তাৎপর্য বহন করছে ‘নরিষ্ঠা’ শব্দটি। এমন সভায় রাজার নিজস্ব মত এবং ইচ্ছা অতিক্রম করে সংখ্যাধিক মানুষের মত বা ইচ্ছাই সিদ্ধান্ত হয়েছে এমন উদাহরণ বহু পরবর্তীকালের ‘মহাভারত’-এও প্রচুর পাওয়া যায়।

সভায় আলোচনার ক্ষেত্রে যাঁরা প্রধান ভূমিকা নিতেন, তঁাদের বলা হতো সভাসহ (ঋগ্বেদ ১০.৭১.১০)। সভায় মত-উপস্থাপনার ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট মান বজায় রাখার দিকে নজর দেওয়া হতো, বিশিষ্ট সদস্যদের ‘সভেয়’ (সভার যোগ্য), ‘রয়িঃ সভাবান্’, সভার সম্পদ আখ্যা দেওয়া হতো (ঋগ্বেদ, ২.১৪.১৩, ৪.২.৫)। এছাড়াও সভার সদস্যদের বোঝানোর জন্য ‘সভাচর’ ও ‘সভাসদ’ শব্দদুটির ব্যবহার আছে। ঋগ্বেদে (১.১৬৭.৩) ‘সভাবতী’ শব্দটি পাওয়া যায়, যা সম্ভবত নারী সদস্যদের বোঝাতে ব্যবহৃত হতো, সেখানে বলা হয়েছে যে সভাস্থিতা নারী সভার উপযোগী বাক্য প্রয়োগ করে। ঋত বা নিয়মরক্ষাকারী নারীর তিনবার সভায় আগমনের কথা ঋগ্বেদে (৩.৫৬.৫) বলা হয়েছে।

সভাগৃহ অক্ষক্রীড়া (পাশাখেলা)-র জন্য ব্যবহৃত হতো (ঋগ্বেদ, ১০.৩৪.৬, অথর্ববেদ, ৫.৩১.৬, ১২.৩.৪৬), অক্ষক্রীড়ার পরিচালককে বলা হতো ‘সভাস্থানু’। বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে ধন-বন্টনের উদ্দেশ্যেও অক্ষক্রীড়া ব্যবহৃত হতো। সভায় অনেক কাজের মধ্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল ধনবন্টন— ধন বলতে শুধু গবাদি পশু ও মূল্যবান সামগ্রীই নয়, এমন কি জল ও খাদ্যও বোঝাত (ঋগ্বেদ, ১.১৬৪.২১, ২.১.৪, ৭.৪০.১, ১০.১১.৮)। বাজসনেয় সংহিতা, ২০.১৭-র টীকায় মহীধর বলেছেন যে সভায় নানা ধরনের বিবাদ-বিসংবাদও মেটান হতো। ঋগ্বেদ (৬.২৮.৬, ৮.৪.৯) থেকে জানা যায় যে সভায় গোধন ও সম্পত্তিসংক্রান্ত বিষয়সমূহ আলোচিত হতো, অথর্ববেদ (৭.১২.৩) জানায় যে গভীরতর বিষয়ের আলোচনাও বাদ পড়ত না।

বিদথ

বিদথ শব্দটির ব্যবহার ঋগ্বেদে পাওয়া যায় প্রাচীনতর গণপ্রতিষ্ঠান হিসাবে। এটি ছিল নীতিনির্ধারক প্রতিষ্ঠান যা জনজীবনের সাধারণ বিষয়াবলী (ঋগ্বেদ, ২.১.৪, ২.১৭.২২, ৩.৩৮.৫৬, ৫.৬৩.২, ৭.৬৬.১০, ৮.৩৯.১, ১০.১২.৭, অথর্ববেদ, ১৭.১.১৫) ছাড়াও ধর্মীয় (ঋগ্বেদ, ১.৬০.১, ২.৪.৮, ২.৩৯.১, ৩.১.১, ৩.৫৬.৮) ও যুদ্ধসংক্রান্ত (ঋগ্বেদ, ১.১৬৬.৬, ৫.৫৯.২) বিষয় নিয়ে আলোচনা করত। রাজাকে বলা হয়েছে ‘বিদথ্য’, যা থেকে অনুমান করা যায় যে রাজাকে বিদথের অধীনে, বিদথের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে কাজ করতে হতো। বিদথে যে নারীরাও উপস্থিত থাকতেন, তার প্রমাণ আছে অথর্ববেদ (৭.৩৮.৪)-এ ও মৈত্রায়ণী সংহিতা (৪.৭.৪)-য়।

সমিতি

সভার মতো সমিতিও সর্বসাধারণের সমাবেশস্থল ছিল এবং বহু ক্ষেত্রে সভা ও সমিতি একসঙ্গে উচ্চারিত হয়েছে (অথর্ববেদ, ৭.১২.১, ১২.১.৫৬, ১৫.৯.২, ১৫.৯.৩)। বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বিষয়, যেমন যুদ্ধের মতো বিষয়, আলোচনার জন্য সভার চেয়ে সমিতি অধিকতর দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিল (ঋগ্বেদ, ১.৯৫.৮, ৯.৯২.৬, ১০.১৭.৬, ১০.১৬৬.৪, অথর্ববেদ, ৫.২৯.১৫, ৬.৮৮.৩, ৭.১২.১, ১২.১.৫৬)।

ঋগ্বেদের একটি বিখ্যাত মন্ত্রে পাওয়া যায়— ‘সমানো মন্ত্রঃ সমিতিঃ সমানী/ সমানং মনঃ সংচিত্তসেষাম্’। এর অর্থ এই যে, সমিতিতে সমস্ত মানুষ তাদের মন্ত্রণাকে মিলিয়ে দিতে চায়, সেখানে মানুষ তাদের আলাপ-আলোচনাকে একসুরে বাঁধতে চায় এবং একাগ্রচিত্ত হওয়ার জন্য প্রার্থনা করে। সমিতির আলোচনায় অংশ নেওয়ার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে হতো। সকলে যেখানে তর্ক-যুক্তি দিয়ে মতপ্রকাশ করছে, সেখানে নিজের তর্ক-যুক্তি অপরের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য মানুষের যে চেষ্টা ও আকুতি ছিল, তা বোঝা যায় এই শ্লোক থেকে— ‘যে সংগ্রামা সমিতয়স্তেষু চারু বদেম তে'। রাজার সঙ্গে সমিতির সদস্যদের যাতে মতের মিল হয় এবং সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায়, সেজন্য বিশেষ চেষ্টা চলত (ঋগ্বেদ, ১০.১৬৬.৪, অথর্ববেদ, ৬.৮৬.৯)।

সমিতিতে রাজাকে নির্বাচন করার উল্লেখ পাওয়া যায় (ঋগ্বেদ, ১০.১৭৩.১, অথর্ববেদ, ৬.৮৭.৮৮), অপদার্থ ও স্বেচ্ছাচারী রাজাকে বিতাড়ন করার নজিরও পাওয়া যায় (কাঠক সংহিতা, ২৭.১, তৈত্তিরীয় সংহিতা, ২.৩.১, মৈত্রায়ণী সংহিতা, ২.২.১, পঞ্চবিংশ ব্রাক্ষ্মণ, ১২.১২.৬, শতপথ ব্রাক্ষ্মণ, ১২.৯.৩.১)।

টীকাকার সায়ণ সমিতিকে সংগ্রাম ও যুদ্ধ সংক্রান্ত বিষয়াবলী আলোচনার ক্ষেত্র বলে ব্যাখ্যা করেছেন। একই সমিতিতে বহু রাজা অর্থাৎ বহু গোষ্ঠীর প্রধানদের উপস্থিতির বহু নজির আছে।

পরিষদ

বৈদিক যুগের শেষ পর্যায়ের রচনায় ‘পরিষদ’ নামক প্রতিষ্ঠানের উল্লেখ আছে (বৃহদারণ্যক, ৬.১.১, গোভিল গৃহ্যসূত্র ৩.২.৪০)। এই ‘পরিষদ’ কখনও গণপ্রতিষ্ঠান ছিল কি না তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে। রাজসভায় রাজাকে নানা বিষয়ে উপদেশ দেওয়াই এই সংস্থার কাজ। জৈমিনীয় উপনিষদ ব্রাক্ষ্মণ (৬.৮৮.৩)-এ পরিষদ, সভা ও সংসদের উল্লেখ আছে যেখানে জনসাধারণ সমবেত হতো, বাদবিসংবাদ ঘটত, নানা বিষয়ে সাক্ষ্যপ্রমাণ (‘উপদ্রষ্টৃ’) নেওয়া হতো। তবে সাধারণভাবে অনুমান করা যায় যে বৈদিক যুগের শেষ পর্বে (খৃষ্টপূর্ব ৮০০ অব্দ থেকে খৃষ্টপূর্ব ৬০০ অব্দ বা তারও পরে) ব্রাক্ষ্মণ গ্রন্থগুলি যখন লেখা হচ্ছে, তখন বহু জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রেই বিদথ-সভা-সমিতির মধ্য দিয়ে গণ-অংশগ্রহণের মাধ্যমে রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনার অভ্যাস ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে এবং রাজকীয় কর্তৃত্ব ও তদনুরূপ রাষ্ট্রশক্তি গড়ে উঠেছে, সেই পরিপ্রেক্ষিতেই কর্তৃত্ববান রাজাকে কেন্দ্র করে স্থিত অভিজাতবর্গের মন্ডলীকেই পরিষদ বলত।

বৈদিক সাহিত্য থেকে জনগোষ্ঠীর সামূহিক বিষয়াদি পরিচালনার যে ইতিবৃত্ত-আভাস উপরোক্ত আলোচনার মধ্য দিয়ে ফুটে ওঠে, তার উপর দাঁড়িয়ে কয়েকটি বিশেষ দিকের উপর মনোনিবেশ করা যাক।

প্রথমত, সভা-বিদথ-সমিতি সমণ্বিত যে রাজনৈতিক কাঠামোর পরিচয় পাওয়া যায়, সেখানে রাজনৈতিক শক্তি উৎপাদিত হচ্ছে বহু মানুষের একত্র সমাবেশের মধ্য দিয়ে। কারণ, এই সমাবেশে বহু পক্ষের মতপ্রকাশ, যুক্তি-তর্ক ও আলোচনার মধ্য দিয়ে অপরাপরের কাছে গ্রহণীয় যে জায়গা তৈরি হচ্ছে, তা সংহতির বিন্দু ও সংহত যৌথক্রিয়ার উৎসারণবিন্দুকে চিহ্নিত করছে। সুতরাং, রাজনৈতিক শক্তি এখানে সর্বসাধারণের সম্মিলন ও স্বতক্রিয়ার পরিসরে সদা-জায়মান অবস্থায় রয়েছে। এহেন অবস্থাকে বহুত্বের রাজনীতির স্ফূরণভূমি বলা যায়। বিষয়টিকে আরও স্পষ্ট করার জন্য বলা যায় যে, এখানে রাজনৈতিক শক্তি কোনও উচ্চাবচ ধাপবন্দি দৃঢ়সংবদ্ধ রাষ্ট্রকাঠামোয় অপরাপরের কাঠামো-নির্ধারিত অসমতা থেকে উৎসারিত নয়। তেমন এক ধাপবন্দি কেলাসিত রাষ্ট্রকাঠামোয় রাজনৈতিক শক্তি সদা-জায়মান অবস্থায় থাকে না, রাজনৈতিক শক্তিও কেলাসিত অবস্থায় থাকে।

দ্বিতীয়ত লক্ষণীয় সভায় অক্ষক্রীড়া (পাশাখেলা)-র মাধ্যমে বন্টনব্যবস্থার তাৎপর্য। এই তাৎপর্যের বিষয়ে আরও কিছুটা আলোচনা জরুরী। ঋগ্বেদের অক্ষসূক্তে অক্ষকে সম্বোধন করে ‘ঋত’-এর দোহাই দিয়ে ধনসম্পদ মুক্ত করে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে (১.১৩২.৩, ১.১৪১.১, ১.১৫১.৩-৮, ২.২৭.১২, ৩.২০.৪, ৩.৫৪.৩, ৩.৫৬.২)। ‘ঋত’ শব্দটির মানে হলো স্বাভাবিক যুক্তি ও ন্যায়ের পরিপূরক চিরন্তন জাগতিক নিয়ম। তাই বোঝা যায় যে ধনের বন্টনকে ‘রুদ্ধ’ করা ‘চিরন্তন জাগতিক নিয়ম’-এর পরিপন্থী বলে ভাবা হতো, কোনওরকম ধন সঞ্চয় বা মজুত করাকে ‘অস্বাভাবিক’ বলে ভাবা হতো। বস্তুর ‘ব্যবহার মূল্য’-ই স্বীকৃত। ‘বিনিময় মূল্য’ যদি বা থাকে, তা প্রকট নয়। বন্টনের জন্য অক্ষক্রীড়া (পাশাখেলা)-কে ব্যবহার করা দেখায় যে সবার প্রয়োজন মেটানোর মতো ভোগ্যবস্তু ছিল না, তাই, কেউ পাবে, কেউ পাবে না। কে পাবে আর কে পাবে না তা পূর্বনির্ধারিত নয়, তৎক্ষণাৎ দৈবক্রমে নির্ধারিত। এই প্রক্রিয়া তখনই বলবৎ হতে পারে যখন সামাজিক-রাজনৈতিক ক্ষমতার কোনও উচ্চাবচ নির্মাণ নেই, কারণ তেমন কোনও নির্মাণ থাকলে একটি সুবিধাভোগী অংশ থাকা অবশ্যম্ভাবী, যে সুবিধাভোগী অংশ পূর্বনির্ধারিতভাবেই অন্যদের সাপেক্ষে বন্টনে অধিক সুবিধা পাবে।

এই প্রসঙ্গে, মহাভারতের অতি পরিচিত যুধিষ্ঠির-শকুনি-র পাশাখেলার উপাখ্যানটিকে আমরা স্মরণ করতে পারি। ঋগ্বেদের যুগের থেকে মহাভারতের যুগের ব্যবধান প্রায় ১০০০ বছরের (মহাভারতের মূল কাঠামোটি রচিত হয় খৃষ্টপূর্ব ৫০০ অব্দের কাছাকাছি এবং তার শেষ পূর্ণাঙ্গ রূপটি গড়ে ওঠে খৃষ্টিয় ৪০০ অব্দের কাছাকাছি সময়ে)। বৈদিক যুগের শেষ দিক থেকেই বেশ কিছু জনগোষ্ঠীর মধ্যে সভা-বিদথ-সমিতি-র রাজনৈতিক পরিসর ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে রাজতন্ত্র গড়ে উঠছিল, তা সত্ত্বেও মহাভারতের যুগেও ভোজ-বৃষ্ণি-অন্ধক-কুকুরদের সংঘগুলির মধ্য দিয়ে গণরাজ্যের রূপ টিকে ছিল। কৃষ্ণ ছিলেন বৃষ্ণিদের সংঘের একজন প্রধান পুরুষ। মহাভারতের সভাপর্বে যুধিষ্ঠিরকে যখন তঁার মন্ত্রণাদাতারা রাজসূয় যজ্ঞ করে রাজকীয় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার জন্য তাগাদা দিচ্ছে, তখন স্বয়ং যুধিষ্ঠিরের মনে যে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা নিয়ে দ্বিধা ছিল, তা প্রকাশিত হয় কৃষ্ণের প্রতি তঁার একটি মন্তব্যে। যুধিষ্ঠির কৃষ্ণকে বলেছিলেন— ‘আমাকে সম্রাট বানানোর জন্য এই যজ্ঞকর্ম, কিন্তু সবাই কি সম্রাট হয়? এমন জায়গাও তো আছে, যেখানে ঘরে ঘরে রাজা দেখা যায়। তারা নিজেদের রাজ্য তো ভালোই চালাচ্ছে, সবাই তারা নিজেদের ভালো নিজে করছে। তারা তো কেউ সম্রাট নয়।’ বোঝা যায় যে ‘ঘরে ঘরে রাজার রাজ্য’ বলতে যুধিষ্ঠির সভা-বিদথ-সমিতির রাজনৈতিক পরিসর বা গণরাজ্যের কথা বলছেন। এর থেকেও বোঝা যায় যে মহাভারতের যুগেও গণরাজ্য বা সভা-বিদথ-সমিতির রাজনৈতিক পরিসর একটি বাস্তব-অস্তিত্ব-সম্পন্ন রাজনৈতিক বিকল্প হিসেবে হাজির ছিল জোরালোভাবে। সুতরাং, বন্টনের উদ্দেশ্যে পাশাখেলার ব্যবহার তখনও কোনও না কোনওভাবে টিকে থাকা স্বাভাবিক। যুধিষ্ঠির তাই খুব সম্ভবত পাশাখেলার নেশার টানে আত্মহারা হয়ে সর্বস্ব বাজি করে পাশা খেলেন নি, পুরাতন প্রথার টিকে থাকা কোনও সংস্কার অনুযায়ীই এই খেলা হয়েছিল হয়তো। কুরু রাজবংশের রাজতন্ত্রের সভায় পাশাখেলা প্রাচীন ঐতিহ্যের অবশেষ হিসেবে টিকে থাকলেও, সে যে তার প্রাচীন তাৎপর্য হারিয়েছে, তা-ও এখানে লক্ষণীয়, কারণ এর মধ্য দিয়ে পূর্বনির্ধারিত পক্ষপাতহীন দৈবাৎ বন্টন হচ্ছে না, বরং শকুনির কূটকৌশলের মধ্য দিয়ে তা অপরের সম্পদ আত্মসাৎ করার হাতিয়ার হয়ে উঠেছে।

খৃষ্টপূর্ব ১০০০ অব্দের পরবর্তী কালে, বৈদিক যুগের পরবর্তী ভাগে যখন ব্রাক্ষ্মণ গ্রন্থগুলো লেখা হচ্ছে, তখন বহু জনগোষ্ঠীর মধ্যে সভা-বিদথ-সমিতি-র রাজনৈতিক পরিসরের ক্ষয় ও রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার উদ্ভবের কারণ কী ছিল? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে যে তিনটি তত্ত্বের হদিস পাওয়া যায়, তা হলো:

১। সামরিক প্রয়োজনের তত্ত্ব

ঐতরেয় ব্রাক্ষ্মণ (১.১.৮.৪)-এ বলা হয়েছে যে দেবতা ও অসুরেরা দীর্ঘকালীন সংগ্রামে লিপ্ত ছিল এবং এই যুদ্ধে দেবগণের বারবার পরাজয় ঘটছিল। তখন দেবগণ নিজেদের পরাজয়ের কারণ খুঁজতে গিয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছন যে নেতার অভাবেই তঁাদের বারবার পরাজয় ঘটছে। তখন তঁারা সর্বসম্মতিক্রমে ইন্দ্রকে সার্বভৌম রাজা হিসাবে নির্বাচিত করেন। এর মধ্য দিয়েই রাজকর্তৃত্ব ও রাজতন্ত্রের শুরু।

২। দৈব উদ্ভব তত্ত্ব

শতপথ ব্রাক্ষ্মণ (১১.১.৬.২৪)-এ হাজির করা এই তত্ত্বের মূলে আছে ‘অরাজকতা’ বা ‘মাৎস্যন্যায়’-এর ধারণা। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, অরাজকতা বা মাৎস্যন্যায়ের প্রতিকারের জন্য, দুর্বলের উপর সবলের উৎপীড়ন প্রতিহত করার জন্য সর্বকর্তৃত্বের অধিকারী করে রাজার সৃষ্টি। পরবর্তীকালে, এই মতকে আরও পরিপুষ্ট করে মনু হাজির করেন মনুস্মৃতি (৭.৩)-তে। মনুর মতে, পরমেশ্বর রাজাকে সৃষ্টি করেন ইন্দ্র, বায়ু, যম, সূর্য, অগ্নি, বরুণ, চন্দ্র ও কুবের, এই অষ্টদেবতার সারভূত অংশ আকর্ষণ করে।

৩। সামাজিক চুক্তির তত্ত্ব

এই তত্ত্বের কথা কৌটিল্য বলেছেন। তঁার মতে, মাৎস্যন্যায়ে নাজেহাল হয়ে জনগণ বৈবস্বত মনুকে নিজেদের রাজা নির্বাচিত করে এবং নিয়ম করে যে তিনি ফসলের ষষ্ঠাংশ, পণ্যের দশমাংশ ও হিরণ্য ভাগধেয় (কর) রূপে গ্রহণ করে প্রজাদের সুরক্ষা, যোগ ও ক্ষেমের ভার বহন করবেন।

এই তিনটি তত্ত্ব বিচার করে দেখা যাক।

প্রথম তত্ত্বে যে দেবতা ও অসুরদের দীর্ঘকালীন সংগ্রামের কথা বলা হয়েছে, সেই দেবতা ও অসুর কারা? দেবতা= বাইরে থেকে আসা আর্য জনগোষ্ঠী, অসুর= আগে থেকে বসবাসকারী অনার্য জনগোষ্ঠী— বহুজন এমন অনুমান করেছেন। কিন্তু ঋগ্বেদের সাক্ষ্য বিচার করলে দেখা যাবে যে ঋগ্বেদে অসুর বলতে ইরান অঞ্চলে বসবাসকারী আর্যভাষী মানুষদের বোঝানো হয়েছে যারা ভারতবর্ষেও বিপুল সংখ্যায় বাস করত। ঋগ্বেদের বহু জায়গায় অসুর শব্দটি সম্ভ্রমসূচক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। ঋগ্বেদে বলা হয়েছে যে অসুররাজ বিরোচন দেবরাজ ইন্দ্রের সঙ্গে একইসঙ্গে ব্রক্ষ্মবিদ্যালাভের জন্য সচেষ্ট হয়েছিলেন। দেবতা বরুণেরও উপাধি ছিল অসুর। ফলে, অনুমান করা যায় যে ‘অসুর’ শব্দের অর্থের অবনতি ও ‘দেবতা’ শব্দের অর্থের মহিমায়ন পরবর্তীকালে ঘটেছে, ঋগ্বেদের সময়ে দেবতা ও অসুর বলতে অপরাপর দুই জনগোষ্ঠী ছাড়া অন্য কিছু বোঝাত না। অসুর ছাড়াও বৈদিক সাহিত্যে এমন আরও কিছু জনগোষ্ঠীর পরিচয় পাওয়া যায় যারা ব্রাক্ষ্মণ্য সংস্কৃতির থেকে পৃথক সংস্কৃতির ধারক ছিলেন, যেমন:

দাস

ঋগ্বেদ থেকে দাসদের সম্পর্কে জানা যায় যে তারা সুরক্ষিত দুর্গে (আয়সীঃ পুরঃ) বাস করত এবং অনেকগুলো গোষ্ঠী (বিশঃ)-তে বিভক্ত ছিল। তাদের সভ্যতা ছিল নাগরিক ও সমৃদ্ধিশালী। তাদের দেহ ছিল কালোরঙা (কৃষ্ণত্বচ্), নাক ছিল ছোট (ক্ষুদ্রনাসা)। তাদের ভাষা আর্যভাষীদের কাছে সহজবোধ্য ছিল না। ইলিবিশ, ধুনি, চুমুরি, শম্বর, বর্চী, পিপ্রু প্রভৃতি দাসরাজাদের উল্লেখ ঋগ্বেদে আছে।

দস্যু

ঋগ্বেদে দস্যুদের বলা হয়েছে আচারবিহীন (অকর্মন্), দেবগণের প্রতি উদাসীন (অদেবয়ু), ভক্তিবিহীন (অব্রক্ষ্মণ), যজ্ঞবিহীন (অযজ্বন), ব্রতবিহীন (অব্রত), ভিন্ন বিধির অনুসারী (অন্যব্রত) এবং দেববিদ্বেষী (দেবপীয়ু)। অনুমান করা যায় যে দেবগণ নামক জনগোষ্ঠীর থেকে ভিন্ন আচার-বিশ্বাস সম্পন্ন ও দ্বন্দ্ব-সম্পর্কে যুক্ত এক বড় জনগোষ্ঠীর কথা বলা হচ্ছে।

পণি

ঋগ্বেদের সূত্রে জানা যায় যে পণিরাও দাস ও দস্যুদের মতো ব্রাক্ষ্মণ্যসংস্কৃতির অপর ছিল। তাদের প্রচুর গরু (গোধন) ছিল। বল নামে তাদের একজন গোষ্ঠীপ্রধান-এর কথা ঋগ্বেদ-এ আছে। পণিদের কাছ থেকে গরু লুঠ করার সময় ইন্দ্র এই বল-কে বিদ্ধ করেছিল।

অন্যান্য

ঋগ্বেদ-পরবর্তী সংহিতা ও ব্রাক্ষ্মণ গ্রন্থগুলোয় আর্য জনগোষ্ঠীর অপর জনগোষ্ঠী হিসাবে অন্ধ্র, পুন্ড্র, মুতিব, নিষাদ, কিরাত, শবর, পুলিন্দ ইত্যাদির উল্লেখ পাওয়া যায়।

সুতরাং, অনুমান করা যায় যে আর্য সংস্কৃতির ধারক বহু জনগোষ্ঠীর মধ্যে দেবগণ একটি জনগোষ্ঠী ছিল, আর, অসুর-দাস-দস্যু-পণি-র মতো বহু অনার্য সংস্কৃতির ধারক জনগোষ্ঠীও ছিল। আচার-ব্যবহার-সংস্কৃতি-র সঙ্গে বস্তু-সম্পদ (যার মধ্যে একটি প্রধান সম্পদ ছিল গরু) আয়ত্ত করার বিষয়েও তাদের মধ্যে পার্থক্য ছিল এবং এই পার্থক্য উপজাত বিরোধ-সংঘাতও ছিল। দেবতা ও অসুরদের মধ্যে দীর্ঘকালীন সংগ্রাম বলতে ঐতরেয় ব্রাক্ষ্মণে অপরাপর জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই বিরোধ-সংঘাতের কথাই বলা হয়েছে বলে ধরে নেওয়া যায়। এই বিরোধ-সংঘাতে নিজেদের উপর্যুপরি ব্যর্থতা কাটিয়ে সফলতা অর্জন, কর্তৃত্ব বিস্তার ও বস্তু-সম্পদের উপর দখলবৃদ্ধির উপায় নির্ধারণের জন্য দেবগণ চিন্তিত হয়ে উঠেছিল। উপায় নির্ধারণও করেছিল। এই উপায় হলো গণ-বিদথ-সমিতি-র ভূমিকা খর্ব করে ইন্দ্রের হাতে কিছুটা একনায়কসুলভ ক্ষমতা তুলে দেওয়ার মধ্য দিয়ে অপরের উপর আধিপত্য করার শক্তি বৃদ্ধি করা। পণিদের থেকে গরু লুঠে নেতৃত্ব দেওয়া ও সেই সময় পণিদের প্রধান যোদ্ধা বল-কে বিদ্ধ করার আখ্যান দেখায় যে অপরকে দমন ও অপরের সম্পদ দখল করার জন্য হিংসাত্মক উপায় অবলম্বনে ইন্দ্র কুশলী ও নির্দ্বিধ ছিল, বা এভাবেও বলা যায় যে, নির্দ্বিধভাবে এই হিংসাত্মক পন্থা অবলম্বনের মতধারী ছিল ইন্দ্র। গোষ্ঠীগতভাবে অপর হিসেবে চিহ্নিত জনেদের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে নির্দ্বিধ হিংসার বাখানের বিকল্প নানা মতও নিশ্চয়ই ছিল জোরালো, তাই দেবগণের সভা-বিদথ-সমিতি নিঃসংশয়ভাবে এই আক্রমণাত্মক কর্তৃত্ববাদী পথের পক্ষে সবসময় দাঁড়াচ্ছিল না। ইন্দ্রকে একনায়ক করার মধ্য দিয়ে এই আক্রমণাত্মক কর্তৃত্ববাদী পথকে বহু বিকল্প বিবেচনার মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার ‘বিড়ম্বনা’ থেকে ‘মুক্ত’ করা হয়েছে। আর, গোষ্ঠীর বাইরে অপরদের সঙ্গে সম্পর্কে যদি কর্তৃত্ববাদী মনোভাব শিরোধার্য হয়, তাহলে গোষ্ঠীর অভ্যন্তরেও অপরদের প্রতি সেই মনোভাবের ক্রমপ্রসারণ ঘটতে বাধ্য। গোষ্ঠীর বাইরের অপরদের উপর কর্তৃত্বস্থাপনের সংগ্রামে গোষ্ঠীর আত্মশক্তি উৎপাদনের জন্য যে সামরিক ঐক্য-শৃঙ্খলা গোষ্ঠীর অভ্যন্তরে প্রতিষ্ঠা করতে হয়, তা গোষ্ঠীর অভ্যন্তরের যে কোনও অপরকে, যে কোনও বিকল্প প্রস্তাবকে শৃঙ্খলা-চ্যুতি বা শৃঙ্খলার জন্য সমস্যা হিসেবেই দেখে এবং যত দ্রুত সম্ভব তা দমন করে শৃঙ্খলা পুনরুৎপাদিত করতে চায়। ফলে সভা-বিদথ-সমিতি-র পরিসর, অর্থাৎ, বহু মতের উপস্থাপনা-তর্ক-বিতর্ক-সংশ্লেষ-এর পরিসরকে ধ্বংস করে গড়ে ওঠে রাজকীয় কর্তৃত্বের পরিসর, যেখানে সর্বমঙ্গলের জন্য নির্দিষ্ট একটি (বা গুটিকয়) মতের উৎপাদন- পুনরুৎপাদন-কর্তৃত্বস্থাপনকে অবারিত করা হয় অপর বহু মতের প্রকাশ ও চর্চাকে পরিসর না দিয়ে। ফলে, জন্ম নেয় পরিষদ-এর পরিসর, যেখানে সব রাজন্যর (সর্বসাধাণের) রাজনৈতিক স্বতক্রিয়ার অধিকার আত্মসাৎ করে গড়ে ওঠে সার্বভৌম রাজা ও তাকে ঘিরে থাকা অভিজাতমণ্ডলীর একচেটিয়া রাজনৈতিক ক্ষমতা।

আরও একটা বিষয় এখানে খেয়াল করা যেতে পারে। হিংসার একটা চরিত্র আছে। সেই চরিত্র হলো এই যে, যার উপর হিংসা প্রয়োগ করা হয়, সমসম্মানের অবস্থান থেকে তার অবনমন ঘটানো হয়। কোনও বস্তুকে নির্গুণ, ইতর বা দুর্বৃত্ত হিসেবে হাজির করার মধ্য দিয়ে তার উপর হিংসা প্রয়োগের পথ প্রস্তুত হয়। দেব-ভাষ্যে বা প্রমিত আর্য-ভাষ্যে ‘অসুর’, ‘দাস’ ও ‘দস্যু’ শব্দগুলির অর্থের অবনমন এইভাবেই হয়েছে বলে ভাবা যেতে পারে।

গোষ্ঠী-বহির্ভূত অপরদের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে হিংসার প্রতিপত্তির জের ধরে গোষ্ঠীর মধ্যের সর্বসাধারণের রাজনৈতিক স্বতক্রিয়ার পরিসরটির শুকিয়ে আসার এই আখ্যানের পাশাপাশি এবার বিচার করা যাক মাৎস্যন্যায়ের আখ্যানটি, যা শতপথ ব্রাক্ষ্মণে ও কৌটিল্য ভাষ্যে উপস্থাপিত হয়েছে। মাৎস্যন্যায় শব্দস্থিত ধারণাটি একটি পূর্বাপর ধাপবন্দী ক্ষমতা-পরিসরে হিংসার অবারিত দৌরাত্মের আভাস নিয়ে আসে। বড় মাছ গিলছে মেজ মাছকে, মেজ মাছ গিলছে সেজ মাছকে, সেজ মাছ গিলছে ছোট মাছকে... এইভাবে সর্বোচ্চ থেকে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অবধি হিংস্র আধিপত্যবিস্তারের ছেদহীন প্লাবন যখন রীতি-আচার-নিয়ম-এর সমস্ত গণ্ডীকে ভাসিয়ে দেয়, মানুষ তখনই না তার এই পতনকে মৎস্যধর্মের প্রকোপ বলে মনুষ্যত্বকে রক্ষা করতে চায়! সর্বোচ্চ থেকে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অবধি আধিপত্যবিস্তারের এই ছেদহীন হিংস্রতা অসমান অবস্থানের এক ধাপবন্দী পরিসর ছাড়া অনর্গল হতে পারে না। অপরাপর বহুর মধ্যে পরস্পরকে সম্মান করার সম্পর্ক যখন অবসিত হয়, সহমর্মিতার পরিসর গঠনের যৌথক্রিয়া যখন পরিত্যক্ত হয়, তখনই এমন ধাপবন্দী পরিসর গড়ে উঠতে পারে। এই পরিসরে মানুষ একে অপরের উপর ভরসা হারায়, সবাই সবাইকে সন্দেহের চোখে দেখে, ফলে গণ-এর কোনও রাজনৈতিক যৌথক্রিয়া সম্ভবপর হয় না। এই অবস্থাতেই ভরসার স্থল হয়ে ওঠে ‘উপকারী স্বৈরতন্ত্র’। অপরাতঙ্ক, ভরসাহীনতা, সন্দেহের আবর্তে ঘেরা বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হয়ে ওঠে প্রতিটি মানুষ। উঁচুতে মাচা বেঁধে তার উপর কোনও প্রাধিকারকে স্থাপন করে তার হাতে শাসনভার তুলে দেয় বিচ্ছিন্ন মানুষ, প্রার্থনা করে যে উচ্চ-স্থিতের স্বৈরতন্ত্র আপদরূপী অপরদের নিয়ন্ত্রণে বা শাসনে বেঁধে তার স্বার্থ রক্ষা করবে। তখন সার্বভৌম রাজাকে প্রাকৃতিক শক্তির মতো অমোঘ করে কল্পনা মানসজগতকে অধিকার করে নেয়।

বৈদিক যুগের অপরাহ্নে কিছু জনগোষ্ঠীর মধ্যে সভা-বিদথ-সমিতি-র পরিসর শুকিয়ে গিয়ে সার্বভৌম রাজতন্ত্রের উদ্ভব ও বিস্তারের চিহ্নগুলি আমরা বিচার করলাম। কিন্তু আমাদের খেয়াল রাখা উচিত যে রাজতন্ত্রের উদ্ভব ও বিস্তার সত্ত্বেও তা সর্বব্যাপী হয়ে যায় নি বৈদিক যুগে তো বটেই এমনকি তার বহু পরবর্তীকালের মহাভারতের যুগে এবং বুদ্ধ-মহাবীর-এর যুগেও।

কোনও গোষ্ঠীর নিজ অভ্যন্তরের গণরাজনৈতিক পরিসর রক্ষা করার জন্য উদ্যোগের ইঙ্গিতবাহী ঘটনার উদাহরণ আমরা মহাভারত থেকে পেতে পারি। তেমন এক উদাহরণ এখন আলোচনা করা যাক। ঘটনাটি ভারতের লোকগাথায় অতি জনপ্রিয় কৃষ্ণ-কংস বিরোধের সঙ্গে যুক্ত। এই ঘটনার পটভূমি হলো বৃষ্ণি জনগোষ্ঠীর সংঘশাসন। সেই পটভূমি থেকেই আলোচনা শুরু করা যাক।

ঐতরেয় ব্রাক্ষ্মণেই ভোজ্য শাসনতন্ত্র নামে এক প্রাচীন শাসনতন্ত্রের কথা বলা হয়েছে, সাত্বতবংশীয় জনগোষ্ঠীর দ্বারা যা গঠিত। এই সাত্বতবংশ ঋগ্বেদ-কালীন পুরাতন যদুবংশের বংশভেদ। সাত্বতরা আবার দৈবাবৃদ্ধ, অন্ধক, বৃষ্ণি, মহাভোজ ইত্যাদি বংশভাগে ভাগ হয়ে যায় এবং তাদের প্রধান বা ‘মূল’ পুরুষের নামে এক একটি ‘সংঘ’ তৈরি করে। এই সংঘ একটি রাজনৈতিক একক হিসেবেও কাজ করত। একই বংশোদ্ভূত জ্ঞাতিগোষ্ঠীর লোক, যারা আপন বংশ বা গোষ্ঠীর মধ্যে প্রধানজন হিসেবে বিবেচিত হতো, তারাই একসঙ্গে মিলে আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্তে এসে জনপ্রশাসনের কাজকর্ম চালাত। অর্থাৎ, এই শাসনতন্ত্র এমন কোনও রাজতন্ত্র ছিল না যেখানে একক কোনও রাজার মধ্যে সমস্ত রাজনৈতিক ক্ষমতাকে কেন্দ্রীভূত করা হয়েছে, আবার এ সভা-বিদথ-সমিতির সর্বসাধারণের অংশগ্রহণমূলক রাজনৈতিক স্বতক্রিয়ার পরিসরও ছিল না, এ ছিল গণমুখ্যদের যৌথ কর্তৃত্ব দ্বারা চালিত শাসন। গণমুখ্যরা রাজা নামেই পরিচিত হতো, যদিও কৌটিল্যের পরিভাষায় তারা ‘রাজশব্দোপজীবী’।

এই শাসনতন্ত্র, অর্থাৎ সংঘশাসন, রাজতন্ত্র না হলেও, কোনও গণমুখ্যের ক্ষমতালিপ্সু চক্রান্তের মধ্য দিয়ে ক্ষমতার কেন্দ্রীভবনের ফলে রাজতন্ত্রে পতিত হওয়ার সম্ভাবনা তার মধ্যে ছিল। এই সম্ভাবনার বিরুদ্ধে বাঁধ হিসেবে কাজ করত গোষ্ঠীর মানুষদের যৌথশাসনের গণ-রাজনৈতিক আকাঙ্খা।

এবার ফেরা যাক কংসের উপকথায়। ভোজরাজ উগ্রসেন-এর পুত্র ছিলেন কংস। কংস বয়স্কদের যথাযোগ্য সম্মান দিতেন না, ক্ষমতালিপ্সু ছিলেন, নিজ উদ্দেশ্যসিদ্ধির জন্য যে কোনও পন্থা অবলম্বনে নির্দ্বিধ ছিলেন। ক্ষমতার লোভে কংস তঁার নিজের পিতাকে কারাগারে বন্দি করে নিজে সেই জায়গায় গণমুখ্য হয়ে বসেন এবং মগধের একাধিপতি জরাসন্ধ-র সহায়তায় সমস্ত শাসনক্ষমতা নিজের হাতে কেন্দ্রীভূত করতে উদ্যোগী হন। যদুবংশীয় সংঘশাসনে কংসের এই ক্ষমতা-কেন্দ্রীভূতকরণের বিরোধিতায় ছিলেন বহু গণমুখ্য (বা সংঘমুখ্য বা যূথমুখ্য), যাদের মধ্যে প্রধান একজন ছিলেন কৃষ্ণপিতা বসুদেব। এই বিরোধিতায় চটে গিয়ে এক সংঘসভায় কংস বসুদেবকে সরাসরি এই বলে আক্রমণ করেন যে বসুদেব যদি এমন আশা মনে লালন করে থাকেন যে কংস মরলে বসুদেব-পুত্র কৃষ্ণ মথুরায় রাজা হবে, তবে তা বৃথা কারণ কংসের মৃত্যুর পর কংসপুত্রই রাজা হবে। যে সভায় কংস বসুদেবকে এমন আক্রমণ করেন, সেই সভার ভিতর থেকেই কংসের এই আক্রমণের বিরোধিতা ও কংসের নিন্দা ধ্বনিত হয়। অন্ধক গোষ্ঠীরই একজন যূথমুখ্য বয়স্ক মানুষ অন্ধক-প্রধান কংসকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘তোমাকে আমরা যাদবদের কেউ বলে মনে করি না। তুমি ভোজবংশীয়ই হও বা যাদব, তুমি কংসই হও বা অন্য কেউ, তোমার মাথাটা তোমারই। তোমার চেয়েও আমার ক্রোধ বেশি হয় তোমার বাবার ওপর, যিনি নিজের থেকে বিলক্ষণ তোমার মতো এক দুর্জাতীয় পুত্রের জন্ম দিয়েছেন। তুমি যাদের শাসক সেই বৃষ্ণিবংশীয় মানুষরা আর কোনও প্রশংসার দাবি রাখে না।’ লক্ষ্যণীয় যে কংসকে যূথমুখ্য নির্ধারণ করার জন্য অন্ধকমুখ্যের কাছে এখানে বৃষ্ণিবংশীয় মানুষরাও নিন্দার্হ হয়েছে, অর্থাৎ, বৃষ্ণিবংশীয় মানুষদের নিজেদের মুখ্য নির্ধারণের যে রাজনৈতিক ক্রিয়া, সেই ক্রিয়ার পিছনে ক্রিয়াশীল চেতনার সমালোচনা করা হয়েছে। এর থেকে বুঝে নেওয়া যায় যে বৃষ্ণি, অন্ধক, ভোজ, কুকুর ইত্যাদি যদুবংশীয় গোষ্ঠীদের সংঘশাসন যখন মগধরাজ জরাসন্ধের সহায়তাপুষ্ট কংসের স্বেচ্ছাচারিতায় রাজতন্ত্রে পতিত হওয়ার সম্ভাবনায় বিপন্ন হয়ে উঠেছিল, তখন বহু গণমুখ্য ভিতর থেকে তার বিরোধিতায় সংগঠিত হয়েছিলেন। রাজতন্ত্রে পতিত হওয়ার বিপদ নিবারণের জন্য উদ্যোগও তঁারা নিয়েছিলেন। মহাভারতের সভাপর্বে যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে কথোপকথনে আমরা কৃষ্ণকে অতীতচারণা করে বলতে শুনি, ‘আমাদের ভোজ-বৃষ্ণি গোষ্ঠী সহ অন্তত আঠারোটা কুল কংসের অপশাসন থেকে বাঁচার জন্য আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল।’ এরপর উপকথায় আছে কংসকে বধ করার জন্য কৃষ্ণের মথুরায় আগমন ও কৃষ্ণ দ্বারা কংস-বধ। কৃষ্ণ এর মধ্য দিয়ে মথুরা-শূরসেন অঞ্চলের যদুবংশীয় গোষ্ঠীদের ‘নতুন নায়ক’ হয়ে ওঠেন, কিন্তু সংঘশাসনের প্রধান হিসেবে আবার নির্ধারণ করা হয় উগ্রসেনকেই। রাজতন্ত্রে পতনের সম্ভাবনার বিরুদ্ধে সংঘশাসনের নিজস্ব প্রতিরোধ-ক্ষমতা-র পরিচয় এখানে ফুটে ওঠে।

এই উপকথা থেকে আমরা আরো খেয়াল করতে পারি যে সংঘশাসনকে টিকে থাকার জন্য কেবল তার ভিতরের শত্রুকেই মোকাবিলা করতে হয় নি, মোকাবিলা করতে হয়েছে বাইরের শত্রু দোর্দন্ডপ্রতাপ সামরিক বলশালী রাজতন্ত্রের সঙ্গেও। কংসবধের পর কংস-পৃষ্ঠপোষক মগধরাজ জরাসন্ধের আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষা করতে যদুবংশীয় জনগোষ্ঠীদের যেভাবে নিজেদের বাসভূমিই স্থানান্তরিত করতে হয় মথুরা থেকে দ্বারকায়, কৃষ্ণের মতো যদুমুখ্যদের আত্মগোপন করতে হয় এবং শেষাবধি কৃষ্ণের কৌশলে পাণ্ডবদের সঙ্গে জোটবন্ধনের মধ্য দিয়ে জরাসন্ধ-বধ ঘটে, তার মধ্য দিয়ে আমরা এই সংঘাতকে দেখতে পাই। জরাসন্ধ-বধের আগে মহাভারতের সভাপর্বে যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে কথোপকথনে আমরা কৃষ্ণকে বলতে শুনি, ‘জরাসন্ধ ছিয়াশিটি বড় বড় রাজাকে এনে ছাগলের মতো বেঁধে রেখেছে, আর চোদ্দটি আনতে পারলেই একশটা হবে, তখন ওদের বলি দেবে। এই সকল রাজাকে মুক্ত করার চেষ্টা করা উচিত।’ জরাসন্ধের হাতে বন্দি এই রাজারা কারা? আমরা দেখেছি যে সেইসময়ে সভা-বিদথ-সমিতির পরিসরের গণরাজ্যে সর্বজনকেই রাজা বলা হতো আর সংঘশাসনে গোষ্ঠীর সব প্রধান মানুষদের অর্থাৎ যূথমুখ্যদের রাজা বলা হতো। জরাসন্ধের হাতে বন্দী রাজারা এমন গণরাজ্য বা সংঘশাসনের প্রধান মানুষরা নন তো? সেইটা হওয়াই স্বাভাবিক, কারণ ছিয়াশিটি রাজতন্ত্রের উপর মগধের আক্রমণের কথা তো পরের কথা, ছিয়াশিটি রাজতন্ত্রের হদিশ পাওয়াই দুষ্কর। তাই আমরা অনুমান করে নিতে পারি যে কৃষ্ণের কথার মধ্য দিয়ে এখানে বিভিন্ন গণরাজ্য বা সংঘশাসনের উপর সামরিক বলশালী রাজতন্ত্রের আক্রমণের আভাস দেওয়া হয়েছে। মগধের মতো শক্তিশালী রাজতন্ত্র তার পার্শ্ববর্তী গণরাজ্য বা সংঘশাসনগুলোকে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে ভেঙে সেই সমস্ত জনগোষ্ঠীকে নিজের কেন্দ্রীভূত ক্ষমতাধিপত্যের অধীনে আনতে চাইত। বন্দী রাজাদের মুক্ত করার মধ্য দিয়ে কৃষ্ণ এই গণরাজ্য ও সংঘশাসনগুলোর প্রতিরোধকেই সঞ্জীবনী শক্তি জোগানোর কথা বলেছেন হয়তো।

এই বিষয়ে বৌদ্ধসাহিত্যের সাক্ষ্যের দিকে এইবার চোখ ফেরানো যাক। গৌতম বুদ্ধের জন্মকাল খৃষ্টপূর্ব ৫৬৩ অব্দ-এর কাছাকাছি। সেইসময় থেকে প্রায় ১০০০ খৃষ্টাব্দ অবধি পালি ভাষায় যে বৌদ্ধ সাহিত্য রচিত হয়েছে, তার মধ্যে হাজির সাক্ষ্যেই আমরা এখন মনোনিবেশ করব।

অঙ্গুত্তরনিকায়-এর চারটি জায়গায় পাওয়া যায়:

যো ইমেসং সোলসন্নং মহাজনপদানং পহূতসত্তরতনান ইস্ররাধিপচ্চং রজ্জং কারেয্য, সেয্যর্থীদং— ১।অঙ্গানং ২।মগধানং ৩।কাসীনং ৪।কোসলানং ৫।বজ্জীনং ৬।মল্লানং ৭।চেতীনং ৮।বংসানং ৯।কুরূনং ১০।পঞ্চালানং ১১।মচ্ছানং ১২।সুরসেনানং ১৩।অস্রকানং ১৪।অবন্তীনং ১৫।গন্ধারানং ১৬।কম্বোজানং।

ললিতবিস্তরের তৃতীয় অধ্যায়েও লেখা আছে যে বুদ্ধের জন্মের আগে জম্বুদ্বীপে (অর্থাৎ ভারতে) আলাদা আলাদা ষোলোটা রাজ্য ছিল। ললিতবিস্তরেই আবার এই ষোলোটি রাজ্যের মধ্যে কেবলমাত্র সাতটিতে রাজবংশের বর্ণনা পাওয়া যায়। সেই সাতটি রাজবংশ হলো:

১।মগধ রাজকুল ২।কোসল রাজকুল ৩।বংশ রাজকুল ৪।অবন্তি রাজকুল ৫।মথুরা রাজকুল ৬।কুরূ রাজকুল ৭।মৈথিল রাজকুল

ত্রিপিটক গ্রন্থেও মোটামুটি এইরকমই আছে। এর থেকে এমন সন্দেহ জাগে যে ষোলোটির মধ্যে সাতটি ছিল একচ্ছত্র রাজতন্ত্র, বাকিগুলি ছিল গণরাজ্য বা সংঘশাসনভুক্ত। রাজ্যগুলির নাম বহুবচনে (যেমন অঙ্গানং অর্থাৎ অঙ্গরা) আছে কেন? এই বহুবচনে থাকার বিষয়টিও ব্যাখ্যাত হতে পারে এর মধ্য দিয়ে যে রাজ্যগুলি উৎপত্তিসূত্রে কোনও না কোনও জনগোষ্ঠীর গণশাসন-এর সঙ্গে যুক্ত, যার ফলে সেই জনগোষ্ঠীর গোষ্ঠীনাম থেকেই রাজ্যনামের উদ্ভব।

গৌতম বুদ্ধের সময়ে অবশ্য গণশাসন (গণরাজ্য বা সংঘশাসন) ক্রমশ দুর্বল হয়ে নষ্ট হওয়ার পথে যাচ্ছিল এবং একচ্ছত্র রাজতন্ত্র দ্রুত প্রসারিত হচ্ছিল। উপরোক্ত ষোলোটা রাজ্য সম্পর্কে বৌদ্ধসাহিত্য থেকে পাওয়া সাক্ষ্য থেকে এই সিদ্ধান্ত টানা যায়। দেখা যাক সেই সাক্ষ্য ঠিক কী বলছে:

অঙ্গ

অঙ্গ-দের দেশ ছিল মগধের পূর্বদিকে। মগধদেশের রাজা অঙ্গদেশ জয় করার ফলে সেখানকার ‘মহাজনতন্ত্র' অর্থাৎ গণমূলক শাসনপদ্ধতি লুপ্ত হয়েছিল।

মগধ ও কোসল

বুদ্ধের সমসময়ে মগধ ও কোসল, এই দুটি দেশই সম্পদ-প্রভাব-প্রতিপত্তিতে ফুলেফেঁপে উঠছিল এবং উভয়রাজ্যই একচ্ছত্র রাজতন্ত্রের অধীনে ছিল। মগধের রাজা বিম্বিসার ও কোসলের রাজা পসেনদি (প্রসেনজিৎ) উভয়েই উদারহৃদয় হিসেবে প্রজাদের মধ্যে জনপ্রিয় ছিলেন বলে জানা যায়। গণশাসন নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর শাক্যরা কোসল রাজতন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গিয়েছিল।

কাসী

কাসী কিংবা কাশী রাজ্যের রাজধানী ছিল বারানসী। জাতক অট্থকথা থেকে জানা যায় যে এক রাজার শাসনের অধীন ছিল না, বহু রাজা একসঙ্গে শাসন করত, বহু রাজাদের ‘ব্রক্ষ্মদত্ত’ নামে অভিহিত করা হতো। এঁদের শাসনপদ্ধতি সম্বন্ধে বিশদে জানা না গেলেও, অনুমান করা যায় যে তঁারা সংঘশাসনভুক্ত ছিলেন। কাসী প্রসিদ্ধ ছিল তার উন্নত শিল্পকলার জন্য। বুদ্ধদেবের সমসময়ে উৎকৃষ্ট বস্তু বোঝাতে ‘কাসিক’ বিশেষণ ব্যবহৃত হতো।

বজ্জী

বুদ্ধের সময়ে বজ্জী ছিল একটি শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ গণরাজ্য। বুদ্ধের জন্ম হয়েছিল এমনই এক গণরাজ্যে– শাক্যদের গণরাজ্যে। কিন্তু তঁার জন্মের আগেই বা জন্মের কিছুদিনের মধ্যেই শাক্য গণরাজ্য তার স্বাধীনতা হারিয়েছিল, গণশাসনব্যবস্থা ভেঙে পড়েছিল ও রাজতন্ত্রের অধীনস্থ হয়েছিল। বজ্জীরা তাদের একতা ও পরাক্রমের বলে নিজেদের স্বাধীনতা ও গণশাসনব্যবস্থা অটুট রাখতে পেরেছিল বলে বুদ্ধ তঁাদের শ্রদ্ধা করতেন। বজ্জীদের রাজধানী ছিল বৈশালী। বৈশালীর চারপাশে যেসব বজ্জী থাকত, তাদের বলা হতো লিচ্ছবী। মহাপরিনিব্বানসুত্তে আছে যে দূর থেকে আসছে এমন একদল লিচ্ছবীর দিকে তাকিয়ে বুদ্ধ তঁার ভিক্ষুদের বলেছিলেন, ‘হে ভিক্ষুগণ, যারা ঠাকুর-দেবতা দেখো নি, তারা এই লিচ্ছবীদের দলটাকে দেখো।’ মহাপরিনিব্বান সুত্তের আরম্ভে ও অঙ্গুত্তরনিকায়ের সত্তকনিপাতে দেখা যায় যে বজ্জীদের গণশাসন টিকিয়ে রাখার উপায় (বা শর্ত) হিসেবে বুদ্ধ বজ্জীদের সাতটি নিয়মের কথা বলেছিলেন। এই নিয়মগুলো নিয়ে আমরা একটু পরে বিশদে আলোচনা করব। এখন এইটুকু চিহ্নিত করা যাক যে এর থেকে বোঝা যায় যে বুদ্ধদেব গণশাসনকেই শ্রেয় মনে করতেন ও তার শক্ত-অর্জন করার উপায় নিয়ে চিন্তা করতেন। মহাপরিনিব্বানসুত্তের অটথকথাতে বুদ্ধ-কথিত এই নিয়মগুলোর উপর বিস্তৃত টীকা রয়েছে। এই টীকাগুলো থেকে অনুমান করা যায় যে বজ্জীদের শাসনতন্ত্রে ন্যায়-অন্যায়ের বিচারের জন্য একটি বহুস্তরীয় বিচার-প্রণালী প্রচলিত ছিল যার ফলে হঠাৎ করে নিরপরাধ কোনও ব্যক্তির শাস্তি হয়ে যেতে পারত না। এও অনুমান করা যায় যে বজ্জীরা তাদের আইনকানুন লিখে রাখত।

মল্ল

মল্লদের রাজ্য বজ্জীদের রাজ্যের পশ্চিমে ও কোসলদেশের পূর্বে অবস্থিত ছিল। বুদ্ধের সমসময়ে বজ্জীদের মতো সেখানেও গণশাসন প্রচলিত ছিল। একতার বিচারে এরা বজ্জীদের থেকে দুর্বল ছিল। অভ্যন্তরীণ বিবাদের ফলে এরা ‘পাবার মল্ল’ ও ‘কুশিনারের মল্ল’, এই দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল।

চেতী

চেতিয় জাতক ও বেস্সন্তর জাতকে চেতী রাষ্ট্রের কথা পাওয়া যায়। চেতিয় জাতকে লেখা আছে যে এই রাজ্যের রাজধানী ছিল সোত্থিবতী (স্বস্তিবতী)। সেখানে এই রাষ্ট্রের রাজাদের বংশাবলীও দেওয়া আছে। এই রাজ্যে ব্রাক্ষ্মণদের খুব আধিপত্য ছিল বলে জানা যায়।

বংস (বৎস)

কোসম্বী (কৌশাম্বী) এই রাজ্যের রাজধানী ছিল। বুদ্ধের সমসময়ে এখানকার গণমূলক শাসনতন্ত্র নষ্ট হয়ে যায় এবং উদয়ন নামক একজন আরামপ্রিয় ও বিলাসী রাজা এখানকার সর্বক্ষমতার অধিকারী হয়ে ওঠেন। ধম্মপদ অট্থকথাতে এই রাজার সম্বন্ধে গল্প পাওয়া যায়।

কুরূ

বুদ্ধের সমসময়ে এখানে পৌরব্য নামে এক রাজা রাজত্ব করতেন, ইন্দ্রপ্রস্থ ছিল রাজধানী। এখানকার শাসনপদ্ধতি সম্বন্ধে বিশদ কিছু জানা যায় না, অনুমান করা যায় যে তা রাজতন্ত্র ছিল।

পঞ্চাল (পাঞ্চাল) ও মচ্ছ (মৎস্য)

এদের সম্পর্কে বিশদ কিছু জানা যায় না। বুদ্ধদেব সম্ভবত এই দুই দেশে যান নি।

সূরসেন (শূরসেন)

বুদ্ধের সমসময়ে অবন্তীপুত্র নামে এক রাজা রাজত্ব করতেন। এখানেও বুদ্ধ খুব একটা যেতেন না।

অস্সক (অশ্মক)

সুত্ত নিপাতে পারায়ণবগ্গ-এর শুরুতে থাকা বত্থুগাথা থেকে মনে হয় যে অস্সকদের দেশ গোদাবরী নদীর আশেপাশে কোথাও ছিল। অট্থকথায় অস্সক ও অলক নামে এই দেশের দুই অন্ধক-বংশীয় রাজার নাম পাওয়া যায়। অনুমান করা যায় যে এখানে সংঘশাসন প্রচলিত ছিল।

অবন্তী

অবন্তী ছিল একচ্ছত্র রাজতন্ত্র। অবন্তীর রাজধানী উজ্জয়িনী ও তার রাজা চন্ডপ্রদ্যোতের সম্বন্ধে অনেক কথাই বৌদ্ধসাহিত্যে পাওয়া যায়।

গন্ধার (গান্ধার)

এর রাজধানী তক্কসিলা (তক্ষশিলা)। মজ্ঝিমনিকায়ের ধাতুবিভঙ্গসুত্তে এখানকার এক রাজা সম্পর্কে একটি কাহিনি আছে। রাজার নাম পুক্কুসাতি। তিনি শেষ বয়সে রাজত্ব ছেড়ে রাজগৃহ (রাজগির) পর্যন্ত বিপুল দূরত্ব পায়ে হেঁটে গিয়েছিলেন এবং সেখানে ভিক্ষুসংঘে যোগদান করেছিলেন। তারপর তিনি যখন ভিক্ষার পাত্র ও চীবরের (বস্ত্রের) খোঁজে বার হলেন, তখন এক পাগলা গরু তঁাকে মেরে ফেলে। এই গল্প থেকে রাজাকে যত না একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিপতি বলে মনে হয়, তার থেকে অনেক বেশি সম্ভবপর মনে হয় যূথমুখ্য হিসেবে সংঘশাসনের অন্যতম প্রধান পুরুষ হওয়া। শিল্পকলা, কারুকলা ও বিদ্যাচর্চায় তক্ষশিলা অগ্রগামী ছিল। তক্ষশিলার বিশ্ববিদ্যালয় ছিল ভারতের অত্যন্ত প্রাচীন ও প্রসিদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়।

কম্বোজ (কাম্বোজ)

গান্ধার দেশ পার হয়ে তারও উত্তর-পশ্চিমে ছিল কম্বোজ। মজ্ঝিমনিকায়ের অস্সলায়ন সুত্তে বলা হয়েছে যে এখানে শুধু আর্য ও দাস, এই দুই জাতি বাস করে এবং তাদের মধ্যে কখনও আর্য দাস হয়, আবার কখনও দাস আর্য হয়। আর্য ও দাস– এই দুই জনগোষ্ঠীর সংঘাতপূর্ণ উপস্থিতিতে শাসনতন্ত্র কী ছিল, তা স্পষ্ট হয় না, তবে তা যে একচ্ছত্র রাজতন্ত্র নয়, তা অনুমান করা যায়।

সারসংক্ষেপ করে দেখলে, বৌদ্ধসাহিত্য থেকে বুদ্ধদেবের সমসময়ে ষোলোটি রাজ্যের শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে আমরা যে ছবিটি পাই, তা হলো:

একচ্ছত্র রাজতন্ত্র— মগধ, কোসল, চেতী, কুরূ, শূরসেন, অবন্তী

গণশাসন নষ্ট হয়ে সদ্য অতীতে রাজতন্ত্রে পর্যবসিত— অঙ্গ, বংস, শাক্য

সংঘশাসন— কাসী, অস্সক, গান্ধার

গণরাজ্য— বজ্জী, মল্ল

স্পষ্ট ধারণা করা যায় না— পঞ্চাল, মচ্ছ, কম্বোজ

গণশাসন নষ্ট হওয়ার পিছনে কারণ হিসাবে রাজতন্ত্রের আক্রমণ (মগধ বা কোসল-এর মতো রাজতন্ত্রের প্রসারণের চাপ) আছে, তেমনই গণশাসনের অভ্যন্তরে একতার অভাব, সুবিধাভোগের সৃষ্টির কারণে ভিতর থেকে দুর্বল হওয়ার কথাও আছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করা যাক বুদ্ধদেবের বজ্জীদের প্রতি বলা গণশাসন সবল রাখার সাতটি নিয়মকে।

মহাপরিনিব্বান সুত্তের শুরুতে ও অঙ্গুত্তরনিকায়ের সত্তকনিপাতে এই সাতটি নিয়মের কথা বলা আছে। বলা আছে যে বুদ্ধ তখন রাজগৃহে (রাজগিরে) গৃধ্রকূট পর্বতের উপর বাস করতেন। মগধের রাজা অজাতশত্রু তখন বজ্জীদের গণশাসনের অবসান ঘটিয়ে মগধ রাজতন্ত্রের অধীনে নিয়ে আসার জন্য অভিযান চালানোর পরিকল্পনা করছিলেন। এই সম্বন্ধে বুদ্ধের মত কী জানার জন্য অজাতশত্রু ‘বস্সকার' নামক ব্রাক্ষ্মণ অমাত্যকে বুদ্ধের কাছে পাঠান। অমাত্য বুদ্ধের কাছে গিয়ে অজাতশত্রুর পরিকল্পনা সম্বন্ধে জানিয়ে বুদ্ধের মত চান। তখন আনন্দ বুদ্ধের পাশে বসে তঁাকে বাতাস করছিলেন। আনন্দর দিকে তাকিয়ে বুদ্ধ তখন প্রশ্ন করতে থাকেন ও আনন্দ তার জবাব দিতে থাকেন। কথোপকথনটি এইরূপ:

বুদ্ধ– হে আনন্দ, তুমি কি এমন শোনো নি যে বজ্জীরা বারবার সভা করছে ও একত্র হচ্ছে?

আনন্দ– হ্যাঁ মহাশয়, বজ্জীরা বারবার সভা করে ও একত্র হয়, আমি এমন শুনেছি।

বুদ্ধ– বজ্জীরা কি সকলেই একত্র হয়, সকলেই একসঙ্গে ওঠে ও সকলে মিলেই কাজ করে?

আনন্দ– হ্যাঁ মহাশয়, আমি এইরকমই শুনেছি।

বুদ্ধ– তারা নিজেরা যে আইন করে নি, তা আইন বলে মানে না; বা, যে আইন তারা নিজেরা করেছে, সেই আইন ভঙ্গ করে না— তাই কি? বজ্জীরা তাদের নিজেদের আইন অনুসারে চলে কি?

আনন্দ– হ্যাঁ মহাশয়, বজ্জীরা নিজেদের আইন অনুযায়ী চলে, আমি এমন শুনেছি।

বুদ্ধ– বজ্জীরা তাদের বৃদ্ধ রাজনীতিবিদদের সম্মান করে কি, ও তাদের পরামর্শ গ্রহণ করে কি?

আনন্দ– হ্যাঁ মহাশয়, বজ্জীরা বৃদ্ধ রাজনীতিবিদদের সম্মান করে ও তাদের কথা শোনে।

বুদ্ধ– তারা নিজেদের দেশের বিবাহিত কিংবা অবিবাহিত স্ত্রীলোকদের উপর অত্যাচার করে না— তাই কি?

আনন্দ– মহাশয়, বজ্জীদের রাজ্যে স্ত্রীলোকদের উপর অত্যাচার হয় না।

বুদ্ধ– বজ্জীদের শহরগুলোতে এবং শহরের বাইরে যে সব দেবমন্দির আছে, সেগুলোর তারা যথাযোগ্য যত্ন নেয় কি?

আনন্দ– তারা নিজেদের মন্দিরগুলোর যথাযোগ্য যত্ন নেয়, আমি এমনটাই শুনেছি।

বুদ্ধ– তাদের রাজ্যে যে সব অর্হৎ (গুণী বা শ্রদ্ধেয় মানুষ) এসেছে, তারা সুখে থাকুক, এবং যারা সেখানে আসে নি তারা বজ্জীদের রাজ্যে আসতে উৎসাহিত হোক, এই উদ্দেশ্যে যাতে অর্হৎদের কোনোরকম কষ্ট না হয়, তার জন্য বজ্জীরা ব্যবস্থা করে কি?

আনন্দ– হ্যাঁ মহাশয়, অর্হৎদের যাতে কোনো কষ্ট না হয়, তার জন্য বজ্জীরা যত্নবান থাকে বলে শুনেছি।

তখন বুদ্ধ বস্সকার-অমাত্যকে বললেন:

বুদ্ধ– হে ব্রাক্ষ্মণ, আমি যখন এককালে বৈশালীতে থাকতাম, তখন বজ্জীদের উন্নতির এই সাতটি নিয়ম পালন করতে উপদেশ দিয়েছিলাম। যতদিন পর্যন্ত তারা এই নিয়মগুলো অনুসরণ করে চলবে, ততদিন পর্যন্ত তাদের উন্নতিই হবে, অবনতি হবে না।

উত্তরে বস্সকার বললেন:

বস্সকার– হে গোতম, এগুলোর মধ্যে যদি একটা নিয়মও বজ্জীরা পালন করে, তা হলেও তাদের উন্নতি হবে, অবনতি হবে না। তবে যদি তারা সাতটি নিয়মই পালন করে, তা হলে তাদের উন্নতি যে হবে এটা বলাই নিষ্প্রয়োজন।

খেয়াল করা যেতে পারে যে বুদ্ধের জন্ম শাক্যদের দেশে, যেখানে তঁার জন্মের আগে বা কিছু পরেই গণশাসন নষ্ট হয়ে গিয়ে রাজতন্ত্রের গ্রাস প্রসারিত হয়েছিল। সেই অভিজ্ঞতার নির্যাস নিশ্চিতভাবে বুদ্ধদেবের এই উপদেশের পিছনে কাজ করছে। বুদ্ধদেব কেবল বজ্জীদের গণশাসন রক্ষার জন্যই এই উপদেশ দেন নি, বিনয়পিটকের সাক্ষ্য দেখায় যে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সংঘ পরিচালনার নিয়মাবলীও তিনি এই আদর্শের উপর ভিত্তি করে তৈরি করেছিলেন। বুদ্ধ-কথিত এই গণশাসনের নিয়মগুলির ওপর তাই মনোযোগ নিবিষ্ট করা যাক।

 প্রথম দুটি নিয়ম হলো বারবার সকলে একত্র হওয়া, সভা করা, একসঙ্গে ওঠা ও সকলে মিলে কাজ করা। এই দুটি নিয়ম গোষ্ঠীর জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও নির্ণায়ক হিসেবে তুলে ধরছে একটি বারোয়ারি পরিসরকে যা তৈরি হচ্ছে সকলের একত্র হওয়ার মধ্য দিয়ে। বুদ্ধঘোষাচার্য অট্থকথায় এর উপর যে টীকা লিখেছেন, সেখান থেকে জানা যায় যে ঢাকের আওয়াজ কানে আসামাত্র সকলে একত্র হয়, অন্য কোনও জরুরী কাজ আছে বলে কর্তব্য এড়িয়ে যায় না, সর্বমত বিচার করে সর্বকার্য সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত না করে কেউ সভা ছাড়ে না এবং সবাই মিলে নিজেদের কাজ সম্পন্ন করে। অর্থাৎ, দেখা যাচ্ছে যে সমূহের প্রতি দায়বদ্ধতা মানুষের আচরণকে চালিত করছে, যৌথসভায় বিচার ও সিদ্ধান্তগ্রহণের জন্য সব মতকে আলাপ-আলোচনার পরিসর দেওয়া হচ্ছে, এর মধ্য দিয়ে স্থিরীকৃত কাজ সম্পন্ন করতে অপরাপর মিলিত উদ্যোগ নিচ্ছে।

তৃতীয় নিয়মে এসেছে আইনের কথা। অন্যের তৈরি আইনকে গোষ্ঠী নিজের বলে না, নিজেদের তৈরি আইন গোষ্ঠী কখনও ভাঙে না। সুতরাং, মানুষদের মধ্যের বারোয়ারি পরিসরে আইন নির্মিত হচ্ছে অপরাপরের অংশগ্রহণে নির্ধারিত অপরাপরের মধ্যে একটি চুক্তি হিসাবে। এই বারোয়ারি পরিসরের বাইর এমন কোনও সমাজ-রাজনৈতিক কাঠামো বা শক্তির আরোপিত বিধানকে আইন বলে মানা হচ্ছে না।

চতুর্থ থেকে সপ্তম নিয়মে অপরকে সমমর্যাদাদানের বিভিন্ন অনুষঙ্গ হাজির হয়েছে। বৃদ্ধ ও তরুণের মধ্যে, পুরুষ ও স্ত্রী-র মধ্যে, বিবিধ ধর্মমতাবলম্বীদের মধ্যে, গোষ্ঠীর ভিতরের জ্ঞান ও বাইরের জ্ঞান (অর্হৎ-দের নিয়ে আসা জ্ঞান)-এর মধ্যে একে অপরকে সমমর্যাদাদানের মধ্য দিয়ে মিলনের কথাই এখানে বলা হয়েছে বলে মনে হয়।

গণশাসন টিকে থাকার, শক্তিশালী থাকার, সমৃদ্ধশালী থাকার শর্ত হিসাবে তাই এই সবের মধ্য দিয়ে উঠে আসছে এমন এক বারোয়ারি পরিসরের সজীব উপস্থিতি যেখানে অপরাপর বহুজন সমমর্যাদায় সজ্ঞানে আদানপ্রদানে মিলেছে।

এই বারোয়ারি পরিসরের অপমৃত্যু যে গণশাসনেরও মৃত্যু ডেকে আনে তার ইঙ্গিতও বৌদ্ধসাহিত্য থেকে আমরা পাই যখন জানা যায় যে অজাতশত্রুর অভিপ্রায় চরিতার্থ করার জন্য বস্সকার নামক ব্রাক্ষ্মণ বজ্জীদের গণমুখ্যদের (রাজাদের) মধ্যে ভেদ-বিদ্বেষ-অনৈক্য উৎপন্ন করার কৌশলী পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। এরফলে গণশাসনের প্রাণস্বরূপ বারোয়ারি পরিসরটি নষ্ট হয়। ললিতবিস্তরে বৈশালীর এই অধঃপতিত রাজাদের সম্পর্কে বলা হয়েছে:

সেখানকার রাজাদের পরস্পরের প্রতি ব্যবহার ন্যায়সংগত নয়। তারা ধর্মাচরণে বিমুখ। তাছাড়া উত্তম, মধ্যম, বৃদ্ধ এবং জ্যেষ্ঠ ব্যক্তিদের সম্মান করে না। প্রত্যেক ব্যক্তি মনে করে সে একাই রাজা। কেউ কারও শিষ্য হতে চায় না। কেউ কাউকে গ্রাহ্য করে না।

গণশাসনের এই নষ্ট হয়ে যাওয়া অবস্থার জন্যই বজ্জীরা দুর্বল হয়ে গিয়েছিল, অজাতশত্রুর পক্ষে তাদের হারানো সহজ হয়েছিল।

বুদ্ধের মৃত্যুর পর গণশাসনগুলোর শুকিয়ে যাওয়া তঁার অনুগামীদের উপরও নিশ্চিতভাবে ছাপ ফেলেছিল। এর প্রমাণ পাওয়া যায় দীঘনিকায় গ্রন্থে চক্কবত্তিসুত্ত ও মহাসুদস্সনসুত্ত-এ। এই দুটি সুত্তে আদর্শ শাসনব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। কিন্তু সেখানে বুদ্ধ-কথিত গণশাসনের আদর্শ নীতি স্থান পায় নি, সেখানে বলা হয়েছে সার্বভৌম চক্রবর্তী রাজার অধীন রাজতন্ত্রের কথা, যা একটি উপকারী স্বৈরতন্ত্রের ধারণা ছাড়া আর কিছুই নয়।

কিন্তু গণশাসন কি তাহলে ভারতের বুক থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল? না, তা হয় নি। গণশাসনের ঐতিহ্য আজও টিকে আছে ভারতের বিভিন্ন আদিবাসী জনগোষ্ঠীর নিজ-পরম্পরা-বাহিত সমাজগঠনের ও সমাজশাসনের রূপে, যেখানে তা পঁুজিবাদী ‘আধুনিকতা’-র আগ্রাসনে এখনও মারাত্মকভাবে ক্ষয়গ্রস্ত হয় নি।

তেমনই একটি উদাহরণের জন্য আমরা চোখ ফেরাতে পারি অরুণাচল প্রদেশের আদি জনজাতিদের দিকে।

আদি জনজাতির মানুষরা বাস করে অরুণাচল প্রদেশের মাঝ-বরাবর অবস্থিত সিয়াঙ জেলায় সিয়াঙ ও সিয়াম নদীর অববাহিকা ঘিরে।

ভেরিয়ার এলউইন-এর ১৯৫৮ সালে লেখা ‘এ ফিলজফি ফর নেফা’ বইতে আদিদের গ্রামপরিষদ সম্পর্কে বিবরণ পাওয়া যায়। আদিদের ভাষায় এই গ্রামপরিষদকে ‘কেবাঙ’ বলে। উইলকক্স নামের এক ইউরোপীয় অভিযাত্রীর সাক্ষ্য এলউইন উদ্ধৃত করেছেন কেবাঙ সম্পর্কে বলতে গিয়ে। উইলকক্স ১৮২৫ সালে আদি জনজাতির গ্রামে গিয়েছিলেন এবং কেবাঙ-এর সভা প্রত্যক্ষ করেছিলেন। তঁার বর্ণনা অনুযায়ী, একজন গ্রামপ্রধান বা ‘গম’ কয়েকবার হাঁক পেড়ে গ্রামের মানুষকে সভায় ডাকে। সবাই সমবেত হলে গম প্রথাগত ভঙ্গিতে সকলের কাছে তার বক্তব্য সবিস্তারে রেখে আলোচনার সূচনা করে। এই বক্তব্য রাখার সময় সে একটানা দাঁড়িয়ে তার ডান পা দিয়ে মাটিতে আঘাত করতে থাকে। এরপর সবাই বিতর্কে অংশ নেয়। সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য শেষে ভোট হয়। সবার সমান ভোট, তবে অন্যদের প্রভাবিত করার ক্ষমতা কারও কারও অন্যদের চেয়ে বেশি।

উইলকক্স-এর এই বিবরণের পর এলউইন উদ্ধৃত করেছেন ফাদার ক্রিক-এর বিবরণ। ধর্মপ্রচারক ফাদার ক্রিক ১৮৫৩ সালে, অর্থাৎ উইলকক্স-এর ২৮ বছর পরে আদিদের গ্রাম মেম্বো-তে গিয়েছিলেন এবং সেখানে কেবাঙ-এর সভা প্রত্যক্ষ করেছিলেন। তঁার বিবরণ অনুযায়ী, সভা হচ্ছিল এক বড় সভাঘরের মধ্যে, সভাঘরের কেন্দ্রে একটি বৃত্ত তৈরি করে বসেছিলেন ছয়জন গ্রামপ্রধান, যাদের পরিধানে জাঁকজমকপূর্ণ প্রথানুগ পোষাক। সেই বৃত্তকে ঘিরে সমবেত গ্রামের পুরুষরা। সভায় বক্তৃতা হলো, সিদ্ধান্তগ্রহণের জন্য ভোট হলো এবং তারপর প্রধানজনেরা বাকি সভার থেকে আলাদা হয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করলেন সিদ্ধান্ত অনুমোদনের জন্য। ক্রিক-এর পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, গ্রামের প্রতিটি প্রাপ্তমনস্ক পুরুষই কেবাঙ-য়ে অংশ নেওয়ার অধিকারী, কিন্তু গ্রামের মহিলারা এই অধিকার থেকে বঞ্চিত। প্রতিটি গ্রামই স্বয়ংশাসিত ও স্বাধীন এবং কেবাঙ-ই হল সেই স্বয়ংশাসনের কেন্দ্র। প্রতিটি গ্রামে গ্রামবাসীরা পাঁচ থেকে ছয়জন গ্রামপ্রধান নির্বাচন করে। নির্বাচিত গ্রামপ্রধানরা সাধারণত আজীবন কেবাঙ-এর সভা পরিচালনার দায়িত্ব পালন করে ও যৌথজীবনের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্তগ্রহণে নেতৃত্ব দেয়। কোনও একজন প্রধানের মৃত্যু হলে, তার ছেলেই যে তার স্থলাভিষিক্ত হবে, তার কোনও মানে নেই, গ্রামবাসীরা আবার নতুন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সেই স্থান পূর্ণ করে। ক্রিক দেখেছিলেন যে প্রতি সন্ধ্যায় সমস্ত পুরুষ সমবেত হয় কেবাঙ-এর সভাঘরে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করার জন্য। সেই আলোচনার বিষয় হতে পারে: ১।একে অপরের মধ্যে সংবাদ আদান-প্রদান, ২।কোনও গ্রামপ্রধানের ওঠানো রাজনৈতিক প্রশ্ন ধরে আলোচনা, ৩।পরের দিন গ্রামবাসীদের কাজের পরিকল্পনা। এই আলোচনার শেষে প্রতিদিন রাত দশটা থেকে এগারোটার মধ্যে তরুণ যুবকরা গ্রাম ঘুরে হেঁকে ঘোষণা করে দেয়— ‘কাল শিকারের দিন’, বা, ‘কাল মাছধরার দিন’, বা, ‘কাল ক্ষেতে কাজের দিন’, বা, ‘কাল গেন্না (অর্থাৎ গণঅবসরের দিন)’! সেই অনুযায়ী গোটা গ্রামের যৌথজীবন পরের দিন নির্বাহিত হয়। ক্রিক লক্ষ্য করেছিলেন যে গ্রামের একটি নিজস্ব পাহারাদার বাহিনী আছে ১৮ বছরের বেশি সমস্ত তরুণদের নিয়ে। গ্রামের অবিবাহিত সমস্ত তরুণ যৌথভাবে একটি বড় ঘরে থাকে, অবিবাহিত তরুণীদের জন্যও আলাদা একটি বড় যৌথঘর আছে।

উনিশ শতকের প্রথম ভাগে দুইজন ইউরোপিয় পর্যবেক্ষকের চোখে ধরা এই ছবির থেকে সাধারণ বিষয় হিসেবে উঠে আসে আদিদের গ্রামগুলোর স্বায়ত্তশাসনের গণ-রাজনৈতিক পরিসর। যৌথ সিদ্ধান্তগ্রহণ ও যৌথভাবে তা কার্যকরী করার একটি লোকপরিসর আদিরা নির্মাণ করেছিল ও বহাল রেখেছিল। ক্রিক তঁার পর্যবেক্ষণে আদিদের নিজেদের স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধীনতার প্রতি প্রেম ও দায়বদ্ধতা বোধেরও উল্লেখ করেছিলেন। তাই বাইরের আধিপত্যবাদী শাসক যখন তার কেন্দ্রীভূত রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রসারিত করার জন্য আদিদের পদানত করতে চেয়েছে, আদিদের স্বায়ত্তশাসনের লোকপরিসরকে খর্বিত করতে চেয়েছে, তখন আদিরা স্বাভাবিকভাবেই তার প্রতিরোধ করেছে তীব্রভাবে, প্রয়োজনে সশস্ত্রভাবে।

উইলকক্স ও ক্রিক-এর বর্ণনার মধ্যে সাদৃশ্য যেমন আছে, তেমনই কিছু পার্থক্যও আছে। যেমন, উইলকক্সের বর্ণনা অনুযায়ী, গ্রামপ্রধান প্রয়োজন অনুসারে হাঁক দিয়ে কেবাঙ-এর সভা ডাকে, আর ক্রিক-এর বর্ণনা অনুযায়ী, প্রতিদিন সন্ধ্যায় কেবাঙ বসার রীতি চালু আছে। আর একটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য হল এই যে ক্রিক বলেছেন যে কেবাঙ-এ মহিলাদের অংশগ্রহণের অধিকার ছিল না, উইলকক্স তেমন কিছু বলেন নি। এই পার্থক্য পর্যবেক্ষকদের পর্যবেক্ষণের আংশিকতার জন্য হতে পারে, আবার এ কারণেও হতে পারে যে বিভিন্ন আদি গ্রামের মধ্যে রীতি-নীতি-সংস্কারে মূলগত সাদৃশ্যের উপর দাঁড়িয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু পার্থক্যও আছে। দ্বিতীয়টি হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি কারণ আদি জনজাতিদের সবার মধ্যেই মহিলাদের কেবাঙ-এ অংশগ্রহণের অধিকার নেই এমনটা বলা যায় না, যেমন, আদিদেরই একটি উপগোষ্ঠী, মিনইয়ঙদের মধ্যে দেখা যায় যে কেবাঙ-য়ে অংশগ্রহণ করায় মহিলারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিচ্ছে, এমনকি গ্রামপ্রধানও নির্বাচিত হচ্ছে।

আদি জনজাতিদের মধ্যে প্রচলিত লোকইতিহাস অনুযায়ী, সিয়াঙ-এর প্রায় প্রতিটি গ্রাম তাদের কোনও না কোনও গোষ্ঠীর বা কৌমের আদিপুরুষদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। সেই আদিপুরুষরাই সেই সব জায়গায় জঙ্গল কেটে প্রথম মানুষের বসত বসিয়েছিল আর তাই সেই সেই জমি-জঙ্গলের আদি সত্ব তাদের। সেই আদিপুরুষদের কৌমের বংশধররাই উত্তরাধিকারসূত্রে সেই জমি-জঙ্গলের সত্বের অধিকারী। কোনও অন্য কৌমের মানুষ যদি পরে এসে সেই গ্রামে বা এলাকায় বসত স্থাপন করতে চায়, তবে তারা জমি-জঙ্গলের ব্যবহারের অধিকারী হতে পারে একমাত্র সেই আদি স্বত্বাধিকারী কৌমের অনুমতিক্রমে। বাস্তবে যখন আদি সত্বাধিকারী কৌম ভিন্ন অন্য কোনও কৌমের মানুষকে কোনও গ্রামের কেবাঙ সেই গ্রামে থাকার অনুমতি দেয়, তখন সেই পরিবারকে বলা হয় জঙ্গল পরিষ্কার করে নতুন কোনও বসতভিটে গড়ে নিতে, বা, বেশ কিছুদিন অব্যবহারে পড়ে থাকা পুরানো কোনও বসতভিটেয় নতুন করে বসত বাঁধতে, বা, আদি সত্বাধিকারী কৌমের কোনও পরিবারের দখলে ব্যবহার-অতিরিক্ত কোনও জমি থাকলে তা ধার নিতে। যেটাই হোক না কেন, এই অন্য কৌমের অধিবাসী ততদিন অবধিই এই দখলীস্বত্বের অধিকারী যতদিন অবধি সে নিজে সেখানে জীবিত অবস্থায় বাস করছে। সে মারা গেলে, তার বংশধররা সেই সত্ব ভোগ করবে যদি গ্রামের কেবাঙ বিচার করে তার অনুমতি দেয়, তবেই। আর সে গ্রাম ছেড়ে অন্য কোথাও চলে গেলে তার দখলে থাকা ভিটে সঙ্গে সঙ্গে গ্রামের সাধারণ সম্পত্তিতে পরিণত হবে।

প্রতি বছর কোন্ কোন্ জমিতে ঝুম চাষ করা হবে তা গ্রামের কেবাঙ-এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কেবাঙ-এ সিদ্ধান্ত হওয়ার পর ঘোষকরা রাতে ঘুরে ঘুরে সারা গ্রামে তা জানিয়ে দেয়। পরের দিন সেই নির্দিষ্ট জমিতে গোটা গ্রামের মানুষ সমবেত হয়ে চাষের প্রক্রিয়া শুরু করে। ঝুম চাষের প্রক্রিয়া গোটা গ্রামের মানুষের যৌথশ্রমের প্রক্রিয়া, তা কোনও ব্যক্তি, ব্যক্তিগোষ্ঠী বা পরিবারের পৃথক উদ্যোগে হওয়া সম্ভব নয়।

ঝুমচাষের জন্য ব্যবহৃত জমিকে বলে ‘পাটাট’ বা ‘রিক্টাট’। এক একটি ‘পাটাট' বা ‘রিক্টাট' তিন বছর চাষ করার পর সেইটি বেশ কিছু বছরের জন্য অকর্ষিত অবস্থায় ফেলে রাখা হয়, তার উপর বন-জঙ্গল গজিয়ে যায়, তারপর গ্রামের কেবাঙ-এর শামান ও গ্রামপ্রধানদের হিসাব অনুযায়ী চাষ-চক্রের সময় (তাদের ভাষায়, ‘রিক্টাট পাসুপ’) পূর্ণ হলে তবে আবার সেই রিক্টাট-এ জঙ্গল পরিষ্কার করে আবার চাষ করা হয়। কোনও রিক্টাট-এ প্রথম বছরের চাষকে বলে ‘রিকপা’ আর দ্বিতীয় ও তৃতীয় বছরের চাষকে বলে ‘রিগাঙ’। কোনও রিক্টাট-এ তৃতীয় বছরের চাষ, অর্থাৎ, দ্বিতীয় রিগাঙ চলার বছরই অন্য একটি রিক্টাট-এ প্রথম বছরের চাষ, অর্থাৎ রিকপা চালু করা হয়। এক-একটি গ্রামের এমন একাধিক রিক্টাট থাকে, যেমন বেগিঙ গ্রামের ছয়টি রিক্টাট আছে, রিউ গ্রামের আছে দশটি। বাইরে থেকে কোনও সার ব্যবহার করা হয় না, প্রাকৃতিক উপায়েই কর্ষিত জমির উর্বরতা আবার ফিরে আসতে দেওয়ার জন্য এই চাষ-চক্রের পদ্ধতি। রিক্টাট পাসুপ-এর সময়কাল অবশ্য সব গ্রামে একইরকম নয়। জমির উর্বরতা, গ্রামের জনসংখ্যার চাপ, হাতে থাকা রিক্টাটের সংখ্যা— এই সবের উপর নির্ভর করে রিক্টাট পাসুপ-এর দৈর্ঘ্য বদলে যায়। রিউ গ্রামে যেমন এখন রিক্টাট পাসুপের দৈর্ঘ্য ২১ বছর, কোমসিঙ গ্রামে ২৫ বছর, আবার বেগিঙ গ্রামে ১৩ বছর। এই যৌথ কৃষিকাজের গোটা ব্যবস্থাপনাটাই হয় কেবাঙ-এর মাধ্যমে।

পরম্পরাগতভাবে আদিদের গ্রামের কেবাঙে গুরুত্ব পেতেন শামান ও বয়স্কজনেরা কারণ তঁারাই লোকশ্রুতি-বাহিত পরম্পরাগত জ্ঞানের ভান্ডারী হিসাবে কাজ করতেন। এই প্রথার কিছুটা বদল ঘটে ১৯১১-র পরবর্তী পর্যায়ে এই অঞ্চলে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের আধিপত্যের আমলে। কীভাবে এই বদল ঘটে দেখা যাক। ব্রিটিশরা তাদের আধিপত্যকে চিহ্নিত করতে প্রতিটি গ্রামের প্রতিটি কৌমের একজনকে ‘সরকারি গম’ (আদি ভাষায় গম মানে গ্রামপ্রধান) হিসেবে নিয়োগ করতে থাকে। এই সরকারি গম-রা ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে কোনও মাইনে পেত না, পেত কেবল একটি লাল কোট। ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে জনজাতির মধ্যস্থতাকারী হিসাবে এই সরকারি গমদের গুরুত্ব গ্রামের কেবাঙ-এ ক্রমশ বাড়তে থাকে। বলা বাহুল্য যে এই সরকারি গমদের নির্বাচনে পরম্পরাগত লোকজ্ঞানের উপর তার দখল বিবেচিত হতো না, বিবেচিত হতো কেবল ব্রিটিশদের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা। আর এই সরকারি গমদের মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ সরকারও দরকার মতো গ্রামের কেবাঙ-এর সভায় তার প্রভাব ও কর্তৃত্ব হাজির করার সুযোগ করে নেয়। ফলে একদিক থেকে কেবাঙ-এ পরম্পরাগত লোকজ্ঞানের ভান্ডারী শামান ও বয়স্কদের গুরুত্ব যেমন কমতে থাকে, অন্যদিকে তেমন কেবাঙ-এর স্বায়ত্তশাসনের ক্ষেত্রটিও কিছুটা খর্বিত হয়।

এরপর ব্রিটিশরা তাদের নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্ব আরও বাড়াতে ‘বাঙ্গো’ নামে একটা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে তার অনুগত সরকারি গমদের দিয়ে। এই বাঙ্গো অনেকগুলো গ্রামের মিলিত পরিষদ। সেখানে গ্রামগুলোর সরকারি গম-দের উপস্থিতি বাধ্যতামূলক, অন্য আর কেউ থাকতে পারে বা নাও থাকতে পারে। সরকারি গমদের মধ্যে একজনকে ‘সেক্রেটারি’ করা হবে (পদের ইংরেজি নামই বলে দেয় যে কাঠামোটি ব্রিটিশদের মস্তিষ্কপ্রসুত) এবং তার ব্যবস্থাপনায় একটি সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত ‘ফান্ড’ চলানো হবে। অনেকগুলি গ্রামের বিষয় ও তাদের মধ্যে বাদ-বিসংবাদ এই বাঙ্গো-র বিষয় বলে চিহ্নিত করা হলেও এর মধ্য দিয়ে আসলে কেবাঙ-এর উপরে এমন একটি সিদ্ধান্তগ্রহণের পরিসর তৈরি করা হলো, যেখানে সব গ্রামের সব মানুষ কখনওই অংশ নিতে পারবে না (যা কেবাঙ-এ পারত)। দূরবর্তী এক কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত স্থানীয় প্রতিনিধিদের কেবলমাত্র নিজেরা মিলিত হয়ে সিদ্ধান্তগ্রহণের এই পরিসরকে পৃষ্ঠপোষকতা ও অর্থসাহায্য দিয়ে ব্রিটিশরা গড়ে তুলল। এভাবে কেবাঙ-এর গণ-পরিসরের সমান্তরাল ভাবে নির্মিত হলো অভিজাত মুষ্টিমেয়র রাজনৈতিক ক্ষমতার পরিসর।

‘স্বাধীন’ ভারতের রাষ্ট্র এই সরকারি গম ও বাঙ্গো-র নীতিকে ব্রিটিশদের যোগ্য উত্তরসূরীর মতো চালিয়ে নিয়ে গেছে। শুধু চালিয়েই নিয়ে যায় নি, বিস্তৃতও করেছে। বাঙ্গোকে আরও সম্প্রসারিত করে গোটা সিয়াঙ অঞ্চলের জন্য একটি কেন্দ্রীয় ‘বোগাম বোকাঙ' গঠন করেছে সিয়াঙ অঞ্চলের সমস্ত আদিগোষ্ঠীদের মধ্য থেকে প্রধানজনেদের মিলিত হওয়ার জন্য। এ কেবল গ্রামে গ্রামে দ্বন্দ্ব-বিবাদ মিমাংসার জন্য নয়, এর মূল কাজ সরকারি ‘উন্নয়ন’-এর কর্মসূচীর ব্যবস্থাপনা করা। শহুরে পেশাদারী কেতায় ইংরেজিতে রক্ষিত হিসাব-নিকাশ-দলিল-দস্তাবেজের মাঝে এইসব ‘বোগাম বোকাঙ’-এ বিরাজ করেন অভিজাত, স্বার্থান্বেষী ও আমলা-মনস্করা। কেবাঙ-এর গণ পরিসর থেকে তা রাজনৈতিক ক্ষমতাকে আরও দূরে সরিয়ে নিয়ে এসেছে।

তবু কেবাঙ-এর গণ-পরিসর এখনও ধ্বংস হয় নি। গ্রামের মানুষের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে তা এখনও জনজাতির পরম্পরাগত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার উজ্জ্বল কিছু প্রকাশ ঘটিয়ে চলেছে। এই প্রকাশগুলো এখনও জনজাতিদের ভাষা-সংস্কৃতি ধ্বংসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের স্ফূরণ ঘটায়, ভোগবাদী পণ্য-অর্থনীতির মুহ্যমানতার বিরুদ্ধে যৌথজীবনের আনন্দকে সামনে নিয়ে আসে। উদাহরণস্বরূপ একটি ঘটনার উল্লেখ করা যেতে পারে। ঘটনাটি এই সাম্প্রতিক ২০০২ সালের।

২০০২-এর বসন্তে সিমঙ গ্রামের আদিরা ঠিক করে যে পুরানো একটা ‘লেগো’ (আদি শব্দ, যার অর্থ হলো গাছের গুঁড়ি দিয়ে তৈরি সেতু) নতুন দিয়ে প্রতিস্থাপন করতে হবে। গ্রামের কেবাঙ-এ ঠিক হলো যে এর জন্য তারা কোনও কঁাচামাল-মজদুর-ইঞ্জিনিয়ার বাজার থেকে কিনবে না, তারা সেতুটা করবে পরম্পরাগত প্রথায়। নির্দিষ্ট দিনে গ্রামের সবাই সেতু তৈরির কাজে সামিল হলো এক উৎসবপালনের মেজাজে। প্রথমে একদল বের হলো এমন এক গাছের খোঁজে যার গুঁড়ি লম্বা-বরাবর কাটলে নদীর এপার থেকে ওপারে পৌঁছানোর মতো যথেষ্ট লম্বা হয় এবং মানুষ ও মোটরসাইকেল যাওয়ার মতো যথেষ্ট চওড়া হয়। উপযুক্ত গাছের খোঁজ পাওয়ার পর ছোট ছোট কুঠার দিয়ে সেই গাছ কাটা হলো। পরের দিন সবাই মিলে গাছের বিশাল গুঁড়ি নদীপারে টেনে নিয়ে যাওয়ার পালা। একসঙ্গে বহুজন মিলে গুঁড়ি টানতে লাগল আর সবাই মিলে গাইতে লাগল একটি প্রচলিত গান। গানটার নাম ‘পিঁপড়েদের গান’– পিঁপড়েরা নাকি খাদ্য টেনে বয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় এই গানই গায়। পালা করে যারা টানছে, তাদের জল-খাদ্য জোটানোর জন্যও এলাহি আয়োজন। অনেকে আবার পরম্পরাগত কোনও না কোনও পোষাক পড়ে সেদিন কাজে নেমেছে। নদীর আগের শেষ খাড়াইটা দিয়ে নামিয়ে অবশেষে গাছের গুঁড়ি পৌঁছাল নদীর ধারে। গ্রামের লোকেরা তখন এক সারে দাঁড়িয়ে নদীর গর্ভ থেকে পাথর তুলে এনে দুই ধার উঁচু করল। তারপর ধরাধরি করে সেই গুঁড়ি উঁচু করা পাথরের উপর বসিয়ে দেওয়ার পরই সেতু তৈরি ব্যবহারের জন্য।

আনন্দময় যৌথশ্রমের মধ্য দিয়ে যৌথসম্পদ-সৃষ্টির এমন উপায় পঁুজি-প্রযুক্তির জানা নেই, সে পঁুজি-প্রযুক্তি যতই অসম্ভবকে সম্ভব করার বড়াই করুক না কেন।

 

 

ঋণস্বীকার

এই অধ্যায়ে উল্লেখগুলোর জন্য আমি নিম্নোক্ত রচনাবলীর কাছে ঋণী:

১। নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য রচিত ভারত ইতিহাসে বৈদিক যুগ গ্রন্থ, যা রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের বেদবিদ্যাকেন্দ্র দ্বারা ১৯৯৮ সালে প্রথম প্রকাশিত ও ২০০৮ সালে পুনঃমুদ্রিত।

২। ধর্মানন্দ কোসাম্বী কর্তৃক মারাঠিতে রচিত ভগবান বুদ্ধ গ্রন্থের চন্দ্রোদয় ভট্টাচার্য কৃত বঙ্গানুবাদ, যা সাহিত্য অকাদেমি কর্তৃক ১৯৮০ সালে প্রথম প্রকাশিত।

৩। নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী রচিত মহাভারতে গণতন্তে্রর ধারণা প্রবন্ধ, যা সংবাদ প্রতিদিন-এর ১৪২৩ বঙ্গাব্দের শারদীয়া সংখ্যার ২২৫-২৩২ পৃষ্ঠায় প্রকাশিত।

৪। অধীর চক্রবর্তী কর্তৃক ইংরেজিতে রচিত ফেডেরাল এক্সপেরিমেন্ট ইন এনসিয়েন্ট ইন্ডিয়া প্রবন্ধ, যা কলকাতা বিশ্ববিদ্যলিয়ের জার্নাল অফ এনসিয়েন্ট ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি, ভলুম-১১, ১৯৭৭-১৯৭৮-এ ২৫-৩৮ পৃষ্ঠায় প্রকাশিত।

৫। ভেরিয়ার এলউইন -এর লেখা ‘এ ফিলজফি ফর নেফা’। বইটির প্রকাশক ডিপার্টমেন্ট অফ কালচারাল অ্যাফেয়ার্স, ডিরেক্টোরেট অফ রিসার্চ, গভর্নমেন্ট অফ অরুণাচল প্রদেশ, ইটানগর। বইটির প্রথম সংস্করণ হয় ১৯৫৭ সালে। এখানে ২০১২-তে প্রকাশিত বইটির দ্বিতীয় সংস্করণের চতুর্থ পুনর্মুদ্রণ ব্যবহৃত হয়েছে।

৬। মাইকেল আরম টার ও স্টুয়ার্ট ব্ল্যাকবার্ন-এর ‘থ্রু দি আই অফ টাইম: ফটোগ্রাফস অফ অরুণাচল প্রদেশ, ১৮৫৯–২০০৬', ব্রিল থেকে ২০০৮-এ প্রকাশিত।

 

0 Comments
Leave a reply