জাপানে জাতীয়তাবাদ

লিখেছেন:রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
১৯১৬ সালে টোকিও ইম্পিরিয়াল ইউনিভার্সিটিতে দেওয়া ভাষণের অবলম্বনে রচিত পাঠ্য। জাতীয়তাবাদ ও জাতিরাষ্ট্রের রাজনীতির গভীর সমালোচনা রূপে অবিস্মরণীয়।

মূল ইংরেজি থেকে বাংলায় তর্জমা: সজল রায়চৌধুরী

শিরোনামায় ব্যবহৃত ছবির পরিচয়:

জাপানের চিত্রশৈলীর উতাগাওয়া ধারার অন্যতম প্রধান শিল্পী কুনিয়োশি (১৭৯৮-১৮৬১ খ্রিস্টাব্দ)-র করা এই কাঠের ব্লক থেকে ছাপা ছবিতে দেখানো হয়েছে যে তামাতোরির পিছু ধাওয়া করেছে এক ড্রাগন।

 

 

‘জাপানে জাতীয়তাবাদ’ সম্বন্ধে প্রাককথন

জাপান সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের আগ্রহ ছিলই। ১৯০৫ সালে ওকাকুরার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর সূর্যোদয়ের এই প্রাচ্যভূমি সম্বন্ধে ঘনিষ্ঠতর পরিচয়ের জন্য তিনি প্রস্তুত হন। ১৯১৩ সালে ইউরোপের মধ্য দিয়ে ট্রান্সসাইবেরিয়ান পথে জাপান যাবেন বলে স্থির করেন। প্রস্তুতি চলতে চলতে বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। পথ বন্ধ হয়ে যায়। সুযোগ আসে ১৯১৬ সালে। সিঙ্গাপুর থেকে জাহাজে করে জাপান যাবেন। স্থির করেন ইউরোপীয় জাহাজে নয়, জাপানি জাহাজে যাবেন যাতে যাত্রাপথেও জাপানিদের জীবনধারার সঙ্গে প্রাথমিক পরিচয় ঘটে। যাঁরা রবীন্দ্রনাথের বক্তৃতা ও ভ্রমণসূচি ঠিক করেছিলেন তাঁদের টেলিগ্রাম আসে যে হংকঙ-এই কবি ও তাঁর সঙ্গীদের নামিয়ে জাপানের কোবে থেকে সরাসরি রেলযোগে টোকিও আনা হবে।

কোবে থেকেই সর্বত্র আধুনিক জাপানের যন্ত্রাচার কবিকে উদ্বিগ্ন করে। স্টেশনে মানুষের অভ্যর্থনা নিতে নিতে কবি চললেন। এর মধ্যে একটি জায়গায় বৌদ্ধ ভিক্ষুদের ধূপাধার দিয়ে সৌন্দর্যময় অভ্যর্থনাটিতে কবি জাপানের প্রকৃত আত্মার ছোঁয়া পেলেন। টোকিও স্টেশনে প্রায় কুড়ি হাজার মানুষ তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে উপস্থিত হয়েছিলো।

রবীন্দ্রনাথের বক্তৃতার আয়োজক টোকিও ইম্পিরিয়াল ইউনিভার্সিটি। তারিখ ১৯১৬ সালের ১১ জুন। বক্তৃতার শিরোনাম ছিলো ‘India’s Message to Japan’। বক্তৃতাটি কবি আগেই লিখে কর্তৃপক্ষের কাছে দেন। তাঁরা সেটি ছাপিয়ে পুস্তিকা আকারে প্রকাশ করেন। রবীন্দ্রনাথ সেই পুস্তিকা থেকেই পাঠ করেন।

ভাষণটির কিছু অংশ কলকাতার ‘মডার্ন রিভিউ’ পত্রিকার আগস্ট সংখ্যার নোটস-এ ‘The Gratitude of Asia to Japan’ নামে প্রকাশিত হয়। ‘এর অনেক অংশ বর্জিত হয়ে ঈষৎ সংক্ষিপ্ত আকারে ‘Nationalism’ গ্রন্থে (১৯১৭) ‘Nationalism in Japan’ নামে মুদ্রিত হয়।’ [প্রশান্ত পাল, রবিজীবনী, সপ্তম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৮৫] বর্তমান বাংলা নিবন্ধটি এই লেখাটিরই অনুবাদ।

এ তো গেলো বক্তৃতাটির নাম ও রূপের বিবর্তন-কথা। আবার ফিরে আসা যাক বক্তৃতার দিনটিতে।

সভা শুরু হওয়ার কথা ছিলো বিকেল চারটেয়। দুপুর দুটোর মধ্যেই দেড় হাজার শ্রোতা এসে সভাস্থল ভরে ফেললেন। অনেককে জায়গা না পেয়ে ফিরে যেতে হলো। পরিচয়পর্বের পর রবীন্দ্রনাথ বলতে উঠলেন। পরনে সাদা জোব্বা এবং মাথায় ওকাকুরার দেওয়া লম্বা টুপি। কেমন বললেন? পিয়ারসন এই বক্তৃতা সম্বন্ধে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে চিঠিতে লিখেছেন: ‘your father spoke for just under an hour with great eloquence’। পরের দিন ‘Japan Advertiser’ পত্রিকায় লেখা হলো: ‘The lecture was punctuated by frequent outbursts of applause and the great poet held his hearers’ intent throughout his talk.’

রবীন্দ্রনাথ কী বলেছিলেন তা তো বিশদে এই অনুবাদে হাজির করা হলো। সংক্ষেপে বলা যায়, জাপানের যুগ যুগ ধরে যে সৌন্দর্যে ও সম্ভ্রমে স্নিগ্ধ জীবনধারার সম্পদ আছে তাকে অবহেলা করে পশ্চিমের বস্তুপুঞ্জ সংগ্রাহী আগ্রাসী জীবনের অন্ধ অনুকরণ করা বিপজ্জনক। এর সঙ্গে যে অন্ধ জাতীয়তাবাদ ও দেশপ্রেম জাপানে ছড়িয়ে পড়েছে সেটাও সমগ্র মানবসত্তার পক্ষে অমঙ্গল ডেকে আনবে।

রবীন্দ্রনাথের জাপানভ্রমণ ও বক্তৃতা নিয়ে প্রথমে যে উচ্ছ্বাস ও উদ্দীপনার বিবরণ আমরা আগে দিয়েছি, তা ছিলো ক্ষণস্থায়ী। কারণ জাপানের তখন বিশ্বশক্তি হিসেবে উত্থানের পর্ব চলছে। ১৯০৫ সালে রাশিয়াকে তারা যুদ্ধে হারিয়েছে। ১৯১০ সালে কোরিয়া দখল করেছে এবং ১৯১৫ সালে চীনের একাংশও তাদের দখলে এসেছে। গোটা দেশ জাতিগর্বে স্ফীত। এই যাত্রাতেই জাপানের একটা কিন্ডারগার্টেন স্কুলে শিশুদের ফৌজি উর্দি পরিয়ে কুচকাওয়াজের দৃশ্য দেখে কবি খুব বেদনা বোধ করেছিলেন। তাঁর সঙ্গী পিয়ারসন একে মজাদার দৃশ্য বলায় কবির কাছে ধমক খেয়েছিলেন এবং লক্ষ্য করেছিলেন যে কবির মুখ যন্ত্রণায় ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। এই জাপানের পক্ষে শান্তি ও আত্মিক শক্তির পক্ষ নিয়ে যুদ্ধ ও হিংসার বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের কথাগুলো হজম করা কঠিন ছিলো। বিশেষ করে রাজনীতিবিদ, সামরিক কর্তাব্যক্তি ও বুদ্ধিজীবীদের একাংশ এসব বচনকে অবাস্তব আদর্শবাদী এবং আজকের যুগে অচল বলে চিহ্নিত করেছিলো। স্টিফেন হে একটা মতামত সমীক্ষার উল্লেখ করেছেন। তিনটি জাপানি মাসিক পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর বক্তৃতার ওপর একটি মতামত সমীক্ষা হয়েছিলো। ৮৭ জন বিশিষ্ট মতদাতার মধ্যে ৩৫ জন কবির বক্তব্যকে গ্রহণযোগ্য মনে করেননি, ২৬ জন বক্তৃতার কোনো কোনো অংশকে সমর্থন করেছিলেন, ২১ জন কোনো মতামত দেননি, আর ৫ জন বলেছিলেন যে বক্তৃতার মধ্যে ভালো দিক ও খারাপ দিক দুটোই আছে। সব মিলে, জাপানিরা রবীন্দ্রনাথকে পরাজিত, পরাধীন, ধ্বংসপ্রাপ্ত দেশের প্রতিনিধি হিসেবে ঠাউরেছিলেন, ভেবেছিলেন: এরকম মানুষ কীভাবেই বা বুঝবেন উদীয়মান বিশ্বশক্তির অপরাজেয় ক্ষমতাকে!

ইতিহাস জানে এই জাতিদম্ভের কী শোচনীয় মূল্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে জাপানকে চোকাতে হয়েছিলো। লেখাটি পড়লে বোঝা যায় কেন রোমাঁ রোলাঁ লিখেছিলেন: ‘এই বক্তৃতাটি মানুষের ইতিহাসের একটি বাঁককে চিহ্নিত করেছে।’

সজল রায়চৌধুরী

৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

 

 

 

সব বন্ধনের মধ্যে অবসাদের বন্ধন নিকৃষ্টতম। এর ফলে মানুষ আত্মবিশ্বাসহীনতার শেকলে অসহায় ভাবে বাঁধা পড়ে। অবিরাম আমাদের শোনানো হয়েছে (কিছুটা যাথার্থ্য নিয়েই) যে এশিয়ার বাস অতীতে। এটা যেন এক মহার্ঘ সমাধিসৌধ যার সমস্ত সৌন্দর্যের উদ্দেশ্য মৃত্যুকে অমর করে রাখা। এশিয়া সম্বন্ধে বলা হয়, এর মুখ এতো অনিবার্যভাবে পেছন দিকে ফেরানো যে কখনো এই মহাদেশ প্রগতির পথে এগোতে পারেনি। আমরা এই অভিযোগ মেনে নিয়েছি। বিশ্বাসও করেছি। আমি জানি, ভারতে শিক্ষিতসমাজের একটা বড়ো অংশ এই অভিযোগের অপমান সহ্য করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন, আত্মপ্রবঞ্চনার সবরকম উপাদান জড়ো করে এই অভিযোগকে দম্ভে পরিণত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আসলে এই দম্ভ মুখোশ-পরা লজ্জা ছাড়া কিছু নয়। তারা নিজেরাই এতে বিশ্বাস করেন না।

এভাবেই সবকিছু যখন থমকে ছিলো, অন্যরকম কিছু হওয়া সম্ভব নয় এই বিশ্বাসে যখন আমরা এশিয়াবাসীরা নিজেদের সম্মোহিত করে রেখেছিলাম, তখন জাপান স্বপ্নের ঘোর ভেঙে উঠে দাঁড়ালো। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে জমাট বাঁধা নিষ্ক্রিয়তাকে পেছনে ফেলে বড়ো বড়ো পদক্ষেপে এগোতে লাগলো। এমনকি প্রধান প্রধান কৃতিত্বে বর্তমানকেও ছাড়িয়ে গেলো। যুগ যুগ ধরে আমরা এক অবসাদের ঘোরে মুহ্যমান হয়ে ছিলাম। ধরে নিয়েছিলাম যে পৃথিবীর কোনো কোনো ভৌগোলিক অঞ্চলের অধিবাসীদের এই স্থবিরতাই স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য। জাপান এই মোহঘোর ভেঙে দিয়েছে। আমরা ভুলে গিয়েছিলাম যে এশিয়া ভূখণ্ডে বড়ো বড়ো রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। দর্শন, বিজ্ঞান, শিল্প ও সাহিত্যের বিকাশ ঘটেছিলো এবং বিশ্বের প্রধান প্রধান ধর্মের জন্ম ও লালনভূমি ছিলো এখানেই। সুতরাং, এশিয়ার জলবায়ু ও মাটিতে এমন কিছু অন্তর্নিহিত উপাদান আছে যা মানসিক নিষ্ক্রিয়তা ঘটায় বা এগিয়ে চলার উদ্যমের পক্ষে হানিকর হয়, সে কথা অন্তত বলা যায় না। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে প্রাচ্যে আমরা সভ্যতার মশাল জ্বালিয়ে রেখেছিলাম যখন পশ্চিম অন্ধকারে গভীর নিদ্রায় অভিভূত ছিলো। এসব দৃষ্টান্ত কিছুতেই মন্থর মন বা সঙ্কীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির পরিচায়ক নয়।

এরপর প্রাচ্যের সবদেশের ওপর রাত্রির অন্ধকার নেমে এসেছিলো। মনে হয়েছিলো যেন সময়ের স্রোত তৎক্ষণাৎ স্তব্ধ হয়ে গেলো। এশিয়া নতুন কোনো আহার গ্রহণ করা বন্ধ করলো। নিজের পুরোনো খাদ্যেই পুষ্টি খুঁজলো। স্থবিরতাকে মৃত্যু বলে মনে হলো। শাশ্বত সত্যের বার্তাবাহী যে মহান কন্ঠস্বর প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মানুষকে অশুচিতার কবল থেকে বাঁচিয়েছে, সামুদ্রিক বাতাস যেভাবে পৃথিবীর মলিনতা মোচন করে সেভাবেই অবিরাম মানুষকে মাধুর্যে পূর্ণ রেখেছে, সেই বায়ুপ্রবাহ নিথর হয়ে গেলো।

কিন্তু জীবনেরও তো নিদ্রাকাল আছে, আছে নিষ্ক্রিয়তার কালপর্বের মালা। সেসময় সে গতি হারায়, নতুন কোনো খাদ্যগ্রহণ করে না, সঞ্চিত খাদ্যের উপরই নির্ভর করে। তা মাত্রাধিক হয়ে উঠলে সে অসহায় হয়ে পড়ে, তার পেশি শিথিল হয়ে যায়, নড়বড়ে অবস্থার জন্য সে নিজেকে বিদ্রূপের পাত্র করে তোলে। কিন্তু, জীবনের চলার ছন্দে মাঝে মাঝেই যতি দরকার, পুনরুজ্জীবনের জন্যই তা আবশ্যিক। জীবনের সক্রিয়তার পর্ব প্রতিনিয়ত নিজের জ্বালানি খরচ করে ফেলে, এই অমিতব্যয় অনির্দিষ্ট কাল ধরে চলতে পারে না। তাই সক্রিয় পর্বের পরেই আসে নিষ্ক্রিয় পর্ব, যখন সব ব্যয়ের অবসান হয় আর বিশ্রাম ও আরোগ্যলাভের জন্য সবরকম অভিযান পরিত্যক্ত হয়।

মনের প্রবণতা সাশ্রয়ী: কতকগুলো অভ্যাস গড়ে তুলে একটা খাঁজ বরাবর চলাই তার পছন্দ। এতে প্রতিটি পদক্ষেপে নতুন করে ভাবনাচিন্তার ঝামেলা চুকে যায়। একবার গেঁথে যাওয়া আদর্শ মনকে অলস করে তোলে। নতুন নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করতে গেলে পাছে সনাতন অর্জনগুলো ঝুঁকির মুখে পড়ে এটাই তার ভয়। অভ্যাসের পাঁচিল তুলে তার আড়ালে নিজের ঝোলাঝুলি নিয়ে সম্পূর্ণ নিরাপত্তা উপভোগ করাই তার চেষ্টা। অথচ এই চেষ্টার ফলে নিজের সঞ্চিত সম্পদের পূর্ণ উপভোগ থেকে নিজেকেই দূরে সরিয়ে রাখে, আটকে রাখে একটা গণ্ডীর মধ্যে। এ হলো কৃপণতা। এভাবে বিকাশমান ও পরিবর্তনশীল জীবনের সঙ্গে জীবন্ত আদর্শের যেগাযোগকে শুকিয়ে যেতে দেওয়া চলবে না। প্রকৃত মুক্তি নিরাপত্তার ঘেরাটোপে নেই, প্রকৃত মুক্তি আছে অভিযানের রাজপথে, যে পথ নব নব অভিজ্ঞতার ঝুঁকিতে পরিপূর্ণ।

একদা প্রভাতে গোটা পৃথিবী অবাক হয়ে দেখলো যেন একরাতেই জাপান তার প্রাচীন অভ্যাসের প্রাচীর ভেঙে ফেলে বিজয়ীর বেশে এসে দাঁড়িয়েছে। এতো অবিশ্বাস্য অল্প সময়ে এই পরিবর্তন ঘটলো যে মনে হলো যেন কোনো নতুন বাড়ি বানানো নয়, নিছকই পোষাক বদলানোর সামান্য বিরতিতেই যেন তা ঘটে গেলো। তার মধ্যে একইসঙ্গে দেখা গেলো পরিণত শক্তির আত্মবিশ্বাস এবং নতুন জীবনের সম্ভাবনা, তাজা ভাব। অন্যরা ভয়ের কথাও ছড়াচ্ছিলো যে এটা ইতিহাসের খামখেয়াল ছাড়া আর কিছু নয়, যেনবা সময়ের ছেলেখেলা, বা, আকারে ও রঙে নিখুঁত হলেও শূন্যগর্ভ ও পদার্থহীন কিছু সাবানফেনার বুদবুদ। কিন্তু জাপান সুনিশ্চিতভাবেই প্রমাণ করেছে যে তার শক্তির এই আকস্মিক উদ্ভব কোনো ক্ষণস্থায়ী বিস্ময় নয়, কালস্রোতের এমন চকিত উৎপাদন নয় যা অস্পষ্টতার গভীরতল থেকে কেবলমাত্র পরমুহূর্তে বিস্মরণ-সাগরে মিলিয়ে যাওয়ার জন্যই উৎক্ষিপ্ত হয়েছে।

সত্যটা হলো এই যে জাপান একইসঙ্গে প্রাচীন ও নবীন। যে প্রাচ্য সংস্কৃতির উত্তরাধিকারী, সেই প্রাচ্য সংস্কৃতি যা অন্তরের গভীরে প্রকৃত সম্পদের অনুসন্ধান করতে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে। এ সেই সংস্কৃতি যা সব ক্ষতি ও বিপদের মুখোমুখি হয়েও আত্মিক সম্পদ রক্ষা করে। সকল ক্ষতি তুচ্ছ করে, লাভের আশা বিসর্জন দিয়ে, মৃত্যু অগ্রাহ্য করে সামাজিক মানুষ হিসেবে অগণিত কর্তব্য পালন করে। এক কথায়, উৎসের গভীর গহনে দৃঢ়মূল থেকেও পদ্ম যেভাবে সরল সুষমায় ফুটে ওঠে, সেভাবেই আধুনিক জাপান স্মরণাতীত কালের প্রাচ্য থেকে উদ্গত হয়েছে।

আর, প্রাচীন প্রাচ্যের সন্তান জাপান আধুনিক যুগের সব উপহারও নিজের জন্য নির্ভীক ভাবে দাবি করেছে। অভ্যাসের গণ্ডী, অলস মনের অপ্রয়োজনীয় পুঞ্জীভূত সঞ্চয়, যা কৃপণতা ও তালাচাবির মধ্যেই নিরাপত্তা খোঁজে, তা ভেঙে ফেলার মতো সাহসী মনোভাব দেখাতে পেরেছে। এভাবেই জাপান প্রাণবান বর্তমান সময়ের সংস্পর্শে এসেছে এবং আধুনিক সভ্যতার দায়দায়িত্ব আগ্রহ ও দক্ষতার সঙ্গে গ্রহণ করেছে।

এটাই এশিয়ার বাকি অংশে উৎসাহের সঞ্চার করেছে। আমরা দেখেতে পেয়েছি যে আমাদের মধ্যেই প্রাণ আছে, শক্তি আছে, শুধু মরা খোলসটা ছাড়িয়ে ফেলতে পারলেই হলো। আমরা দেখেছি যে মৃতের মধ্যে আশ্রয় নেওয়া মৃত্যু ছাড়া আর কিছু নয়। অন্যদিকে, জীবনের সব ঝুঁকি পুরোমাত্রায় গ্রহণ করাই হলো বেঁচে থাকা।

আমি নিজে মনে করি না যে জাপান পশ্চিমের অনুকরণ করেই এখানে পৌঁচেছে। আমরা জীবনের অনুকরণ করতে পারি না, বেশিদিন শক্তির নকলনবিসি করাও সম্ভব নয়। এর চেয়েও বড়ো ব্যাপার হলো, শুধুমাত্র নকলনবিসি দুর্বলতার উৎস, কারণ আমাদের স্বভাবগত বৈশিষ্ট্যের বিকাশকে তা ক্ষতিগ্রস্ত করে, সবসময় আমাদের চলার পথ রুখে দেয়: এ যেন কারো কঙ্কালের কাঠামোর উপর অন্য মানুষের চামড়া পরিয়ে দেওয়া। এতে প্রতি মুহূর্তে অনন্তকাল ধরে চামড়া আর হাড়ের বিরোধ চলতেই থাকে।

আসল সত্যটা হলো: বিজ্ঞান মানুষের স্বভাবের মধ্যে নিহিত কোনো বিষয় নয়, তা হলো জ্ঞান ও প্রশিক্ষণের ফল। বস্তুবিশ্বের নিয়মকানুন জানলেই গভীরতর মানবসত্তাকে বদলানো যায় না। অন্যদের থেকে জ্ঞান ঋণ হিসেবে পাওয়া যায়, কিন্তু স্বভাব বা মেজাজ ধার করে পাওয়া যায় না।

কিন্তু শিক্ষাগ্রহণের অনুকরণ-স্তরে আমরা আবশ্যিক ও অনাবশ্যকের মধ্যে পার্থক্য করতে পারি না। কোনটা পরিগৃহীত হওয়ার উপযুক্ত আর কোনটা নয়, সে পার্থক্য তখন করা যায় না। এটা খানিকটা আদিম মনের জাদুবিশ্বাসের মতো। বাইরের কোনো দুর্ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকা বাস্তব সত্যের ওপর জাদুবৈশিষ্ট্য আরোপ করে সেই বিশ্বাস। খোসা ফেলে দিয়ে শাঁসটুকু খেতে গেলেও আমাদের ভয় হয় এই বুঝি মূল্যবান ও কার্যকরী কিছু বাদ গেলো। আমাদের লোভ সবটাই গিলতে চায়, অথচ আমাদের প্রাণপ্রকৃতি চায় আত্মীকরণ করতে, যা জীবন্ত পদার্থের ধর্ম। যেখানে জীবন আছে, সেখানে সে নিশ্চয়ই নিজের প্রয়োজন অনুযায়ী গ্রহণ ও বর্জন করবে। সপ্রাণ পদার্থ নিজেকেই নিজের খাদ্য হিসেবে বেড়ে উঠতে দেয় না। খাদ্যকে নিজের শরীরের মধ্যেই পরিবর্তিত করে শরীরের পুষ্টি ঘটায়। একমাত্র এভাবেই সে শক্তিশালী হতে পারে, কেবলমাত্র সঞ্চয় পুঞ্জীভূত করে বা নিজের আত্মপরিচয় বিসর্জন দিয়ে এ শক্তি-অর্জন ঘটে না।

জাপান পশ্চিম থেকে খাদ্য আমদানি করেছে, কিন্তু নিজের প্রাণবান সত্তাকে আমদানি করেনি। পশ্চিম থেকে সংগ্রহ করা বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলে নিজেও একটা ধার-করা-যন্ত্রে পরিণত হয়নি। তার স্বকীয় আত্মা আছে, যা তার সমস্ত প্রয়োজনের ওপর নিজের প্রাধান্য স্থাপন করে। যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে যে তার সেই যোগ্যতা আছে, আত্মীকরণের প্রক্রিয়া তার মধ্যে চলছে। সজীব স্বাস্থ্যের চিহ্নও তাই ফুটে উঠেছে। বিদেশ থেকে সে যা অর্জন করেছে, কেবল তার গর্বেই জাপান যেন নিজের আত্মার উপর বিশ্বাস কখনো না হারায়: এটাই আমার একান্ত প্রত্যাশা। কারণ, ওই গর্বই হলো এমন এক ধরনের হীনতা যা শেষ পর্যন্ত দারিদ্র্য ও দুর্বলতার দিকে নিয়ে যায়। এ যেন সেই ফোতো কাপ্তেনের অহঙ্কার যিনি নিজের মাথার চেয়ে পাগড়িটাকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন।

আধুনিক কালের হাত থেকে এই মহান প্রাচ্যজাতি যেসব সুযোগ ও দায়িত্ব পেয়েছে, সেগুলো নিয়ে সে কী করতে যাচ্ছে তা দেখার জন্য গোটা পৃথিবী অপেক্ষা করে আছে। যদি দেখা যায় কেবল পাশ্চাত্যের পুনরুৎপাদনই করে চলেছে, তবে যে বিরাট প্রত্যাশা সে জাগিয়েছে তা অপূর্ণ থেকে যাবে। কারণ পাশ্চাত্য সভ্যতা কিছু গুরুতর প্রশ্ন পৃথিবীর সামনে হাজির করেছে যেগুলোর কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়নি। যেমন: ব্যক্তির সঙ্গে রাষ্ট্রের সংঘাত, শ্রম ও পুঁজির সংঘাত, পুরুষ ও নারীর সংঘাত, বস্তুগত সম্পদ আহরণের লোভের সঙ্গে আত্মিক জীবনের সংকট, জাতিগুলোর সংগঠিত স্বার্থপরতার সঙ্গে উচ্চতর মানবিক আদর্শের সংঘাত। দানবীয় বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্রের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য ভাবে জড়িত কুৎসিত জটিলতার বিপরীতে দাঁড়িয়ে সরলতা সৌন্দর্য ও অবসরের পূর্ণতাবোধের স্বভাবজাত প্রবৃত্তি আজ আর্তনাদ করছে। এসবকিছুকেই এমনভাবে সংহতির মধ্যে বাঁধতে হবে যা এখনো অবধি স্বপ্নেও ভাবা যায়নি।

এই মহাসভ্যতার অসংখ্য খাত বেয়ে ধ্বংসস্তূপের রাশি সভ্যতার প্রবাহকেই রুদ্ধ করে ফেলেছে। সেটা আমরা দেখেছি। দেখতে পেয়েছি যে মানবপ্রেমের সবরকম বাগাড়ম্বর করেও মানবজাতির পক্ষে তা সবচেয়ে বড়ো বিপদে পরিণত হয়েছে। ইতিহাসের আদি যুগে যাযাবরদের বর্বরতার আকস্মিক বিস্ফোরণের চেয়েও তা খারাপ। স্বাধীনতা-প্রীতির বড়াই করা সত্ত্বেও এই সভ্যতা পূর্ববর্তী সমাজগুলোয় পূর্ববর্তী সব দাসত্বের চেয়েও নিকৃষ্ট দাসত্বের জন্ম দিয়েছে। সে এমন এক দাসত্ব যার শেকল ছাঁড়া যায় না, কারণ সেই শেকল চোখে দেখা যায় না, অথবা স্বাধীনতার ভেক ধরে বিরাজ করে। আমরা আরো দেখেছি যে এইসব দানবিক অসদাচারের ঘোর-লাগা মানুষ তাকে মহান করে তোলা কীর্তিমান আদর্শগুলোয় আস্থা হারিয়ে ফেলেছে।

সুতরাং, আধুনিক সভ্যতার সব প্রবণতা, প্রণালী ও কাঠামোকে হালকাভাবে গ্রহণ করে তাকে অনিবার্য বলে স্বপ্ন দেখার কোনো কারণ নেই। আপনাদের প্রাচ্য মন, আত্মিক শক্তি, সরলতার প্রতি ভালোবাসা ও সামাজিক দায়বদ্ধতা অবশ্যই প্রয়োগ করতে হবে। প্রগতির প্রবল দুর্দমনীয় রথ বেসুরো আওয়াজ তুলে চিৎকার করতে করতে ছুটছে। একটা নতুন পথ আপনাদের তৈরি করতে হবে। প্রগতির চলার পথে প্রতি মুহূর্তে পিষ্ট হচ্ছে বিপুল মানবপ্রাণ ও স্বাধীনতা। একে ন্যূনতম মাত্রায় নিয়ে আসাই আপনাদের কাজ। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে আপনারা নিজেদের বিশেষ পন্থায় অনুভব করেছেন, ভেবেছেন, কাজ করেছেন, উপভোগ ও উপাসনাও করেছেন। সেগুলোকে জীর্ণ বস্ত্রের মতো বাতিল করা যায় না। আপনাদের রক্তে-মাংসে-মজ্জায ও মস্তিষ্কের কোষে কোষে এর অস্তিত্ব রয়ে গেছে। যাতে আপনারা হাত দেবেন তাতেই এর ছোঁয়া লাগবে, আর, হয়তো বা আপনাদের অজ্ঞাতসারে বা এমনকি ইচ্ছার বিরুদ্ধেও তাকে রূপান্তরিত করে দেবে। একসময় যখন আপনারা নিজেদের সন্তুষ্টি মতো মানুষের সমস্যা সমাধান করে ফেলেছিলেন, তখনই আপনাদের নিজস্ব জীবনদর্শন ও জীবনশৈলীর উদ্ভব ঘটেছিলো। সেই সবই বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রয়োগ করতে হবে। তার থেকেই নতুন সৃষ্টির উদ্ভব ঘটবে, কেবল পুনরাবৃত্তি ঘটে চলবে না। এমন এক নতুন সৃষ্টি হবে যা আপনাদের জনগণ নিজস্ব সম্পদ রূপে গণ্য করবে, মানবকল্যাণে সমস্ত জগতকে গর্বের সঙ্গে উপহার দেবে। আপনাদের প্রতিভা ও প্রয়োজন অনুযায়ী যেসব বস্তুগত সম্পদ আপনারা আহরণ করেছেন, সেগুলো ব্যবহারের স্বাধীনতা এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র জাপানেরই আছে। মানব-মহাসমাবেশের সামনে পশ্চিম যেসব প্রশ্ন উত্থাপন করেছে, আপনাদের কন্ঠস্বরের মাধ্যমে এশিয়া তার জবাব দেবে। সেজন্য আপনাদের দায়িত্ব আরো বেশি। আপনাদের দেশে নানা পরীক্ষানিরীক্ষা চলবে যাতে আধুনিক সভ্যতার নানাদিকের পরিবর্তন ঘটানো হবে। যেমন, যেখানে এই আধুনিক সভ্যতা যন্ত্রবৎ, সেখানে তাতে প্রাণসঞ্চার করা হবে, শীতল সুবিধাপন্থার বদলে আসবে মানবিক হৃদয়বত্তা। ক্ষমতা ও সাফল্যের দিকে না তাকিয়ে প্রীতিময় প্রাণবন্ত বিকাশ ঘটিয়ে সত্য ও সুন্দরের লক্ষ্যে এগোনো যাবে।

আমি সেই দিনগুলোর কথা আপনাদের স্মরণ না করিয়ে পারছি না যখন বার্মা থেকে জাপান পর্যন্ত সমগ্র পূর্ব এশিয়া ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বের নিবিড়তম বন্ধনে বাঁধা ছিলো। জাতিগুলোর মধ্যে বন্ধন তো এমনটাই হওয়া স্বাভাবিক। হৃদয়ে হৃদয়ে একটা জীবন্ত সংযোগ ছিলো। এমন একটা স্নায়ুতন্ত্র গড়ে উঠেছিলো যার মাধ্যমে মানবতার গভীরতম চাহিদার বাণী পরস্পরের মধ্যে আদানপ্রদান হতো। পরস্পরকে নিয়ে আমাদের কোনো আতঙ্ক ছিলো না। তাই একে অপরকে রুখে দেওয়ার তাগিদে নিজেদের অস্ত্রসজ্জিত করার দরকার হয়নি। আমাদের মধ্যে স্বার্থপরতার সম্পর্ক ছিলো না, একে অপরকে শোষণ ও লুন্ঠন করার সম্পর্কও নয়। চিন্তা ও আদর্শের বিনিময় হতো। মহার্ঘতম ভালোবাসার উপহার দেওয়া-নেওয়া হতো। পরস্পরের হৃদয়ের কাছে পৌঁছানোর পথে ভাষা ও প্রথার পার্থক্য কোনো বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। জাতির অহঙ্কার অথবা শ্রেষ্ঠত্বের ঔদ্ধত্য--- শারীরিকই হোক বা মানসিক--- তা আমাদের সম্পর্ককে নষ্ট করতে পারেনি। মিলিত হৃদয়ের এই সূর্যকিরণের প্রভাবে আমাদের শিল্প ও সাহিত্যে নব পল্লব ও কুসুম প্রস্ফুটিত হয়েছিলো। নানা দেশ, নানা ভাষা ও নানা ইতিহাসের জাতিগুলো মানুষের উচ্চতম ঐক্য আর প্রেমের গভীরতম বন্ধনকে স্বীকৃতি জানিয়েছিলো। আমাদের কি এটাও স্মরণ করা উচিত নয় যে সেই শান্তি ও শুভেচ্ছার দিনগুলো, জীবনের পরম লক্ষ্যে মানুষের মিলিত হওয়ার সেই দিনগুলো আপনাদের স্বভাববৈশিষ্ট্যে অমরত্বের প্রলেপ লেপে দিয়েছিলো? এর ফলে আপনারা নতুন যুগের জন্য প্রস্তুত। জীর্ণ পুরাতন কাঠামো ভেঙে তরুণ দেহ নিয়ে পৃথিবীর অত্যাশ্চর্য অদৃষ্টপূর্ব বিপ্লবের আঘাত থেকে অক্ষত অবস্থায় তাই বেরিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে।

ইউরোপের মাটি থেকে যে রাজনৈতিক সভ্যতার উদ্ভব হয়েছে তা বাড়ন্ত আগাছার মতো গোটা পৃথিবী দখল করে নিচ্ছে। এর ভিত্তিতে আছে আত্মসর্বস্বতা। এই মনোভাব অপরকে দূরে সরিয়ে রাখতে অথবা তাদের ধ্বংস করতে চায়। প্রবণতার দিক থেকে তা মাংসাশী ও নরখাদকতুল্য। অন্য জাতির সম্পদ গ্রাস করে তাদের পুরো ভবিষ্যতকেই তা গিলে ফেলতে চায়। অন্যান্য জাতিগোষ্ঠী কোনোভাবে গুরুত্ব পেলেই এই সভ্যতা ভীত হয়ে পড়ে, ভাবে এ তো সর্বনেশে ব্যাপার। তাই নিজের সীমানার বাইরে মহত্ত্বের কোনো লক্ষণ দেখা গেলেই তাকে দমন করতে চায়। দুর্বলতর জনগোষ্ঠী যাতে চিরকাল দুর্বল থেকে যায় সেজন্য তাদের দমিয়ে রাখে। এই সভ্যতা ক্ষমতায় বসে নিজের ক্ষুধার্ত হাঁ-এর ভেতর বড়ো বড়ো মহাদেশকে গিলে ফেলার আগেও যুদ্ধ, লুন্ঠন ও সাম্রাজ্যের হাতবদল হয়েছে, ফলস্বরূপ দুর্দশাও ঘটেছে। কিন্তু এমন ভয়ঙ্কর রাক্ষুসে খিদের দৃশ্য, এমন জাতির পর জাতিকে পুরোপুরি গিলে খাওয়ার ছবি, পৃথিবীর বৃহদংশকে মাংসের মতো টুকরো টুকরো করে ফেলার এমন অতিকায় যন্ত্র, একে অপরের প্রাণ ছিঁড়েখুঁড়ে নেওয়ার উদগ্রতায় কুৎসিত সব দাঁত-নখ-বের-করা এমন বীভৎস ঈর্ষা আগে কখনো দেখা যায়নি। এই রাজনৈতিক সভ্যতা বিজ্ঞানসমৃদ্ধ কিন্তু মানবিক নয়। এটি ক্ষমতাবান কারণ একটিমাত্র উদ্দেশ্যতেই এর সব চেষ্টা কেন্দ্রীভূত, যেমন কোনো কোটিপতি তাঁর আত্মার বিনিময়েও টাকার পাহাড় গড়ে তুলতে চায়। নির্লজ্জের মতো সে বিশ্বাসভঙ্গ করে, মিথ্যার জাল বোনে। ওরা ওদের মন্দিরে লোভের দেবীর অতিকায় মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেছে, সেই দেবীর পুজোয় আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠান আয়োজন করে ওরা অহঙ্কারে মত্ত হয়। এরই নাম তারা দেয় দেশপ্রেম। স্বচ্ছন্দে ভবিষ্যৎবাণী করা যায় যে এ কিছুতেই চলতে পারে না। কারণ, এই বিশ্বে একটা নৈতিক নিয়ম আছে যার প্রয়োগ মানুষের ব্যক্তিগত ও সংগঠিত উভয় ক্ষেত্রেই প্রয়োগযোগ্য। ব্যক্তি হিসেবে তার সুযোগও নেবো, আবার জাতির নামে এই নিয়মনীতিগুলোই লঙ্ঘন করে যাবো, তা হতে পারে না। জনপরিসর থেকে এই নিয়মনীতিগুলো ক্রমশ শুকিয়ে যেতে দিলে সমাজের প্রতিটি ব্যক্তির ওপর তার প্রভাব পড়ে। এর ফলে, যেখানে দুর্বলতা ছিলো না, সেখানেও দুর্বলতার আগাছা জন্মাতে থাকে। অবশেষে মানবপ্রকৃতিতে যা কিছু আদর্শ ও পবিত্র বলে গণ্য হয়, সেই সবকিছুতেই খুঁতখুঁতে অবিশ্বাস দেখা দেয়। এটাই আসল বার্ধক্য। মনে রাখতে হবে যে এই জাতীয়তাবাদী দেশপ্রেম এখনো দীর্ঘ পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যায়নি। প্রাচীন গ্রিসের প্রদীপ নিভে গেছে সেই দেশেই যেখানে তা প্রথম জ্বালানো হয়েছিলো। রোমের শৌর্য মৃত, বিশাল সাম্রাজ্যের ধ্বংসাবশেষের নীচে সেই মৃতদেহ সমাধিস্থ। কিন্তু সমাজ ও মানুষের আত্মিক আদর্শের ভিতের ওপর যে সভ্যতা আজও দাঁড়িয়ে আছে, তা দেখতে পাই চীন ও ভারতে। আধুনিক যুগের শক্তির নিরিখে যদিও একে সামান্য ও দুর্বল বলে মনে হতে পারে, তবুও এগুলো ছোট ছোট বীজের মতো। এখনো এর প্রাণ আছে। এরা অঙ্কুরিত হবে, বেড়ে উঠবে, শাখাপ্রশাখা বিস্তার করবে। সময় এলে, আকাশ থেকে করুণাধারার মতো বর্ষণ পেলে, সেইসব শাখাপ্রশাখা ফুল ও ফলের সম্ভারে ভরে উঠবে। কিন্তু ক্ষমতার আকাশচুম্বী সৌধগুলোর ধ্বংসস্তূপ এবং লোভের ভাঙাচোরা যন্ত্রকে ঈশ্বরের বারিবর্ষণও মাথা তুলে দাঁড়ানোর শক্তি জোগাবে না। কারণ, তারা প্রাণের পক্ষে নয়, বরং সার্বিকভাবে প্রাণের বিপক্ষে। চিরন্তনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে গিয়ে তারা নিজেদের চূর্ণ-বিচূর্ণ করে ফেলেছে, ছড়িয়ে পড়ে রয়েছে তাদের ধ্বংসাবশেষ।

আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয় যে আমরা প্রাচ্যে যেসব আদর্শ লালন করি সেগুলো নাকি সব স্থবির, সামনের দিকে এগোনোর গরজ তার মধ্যে নেই, জ্ঞান ও শক্তির নতুন পথরেখা তারা খুলে দিতে পারে না। অভিযোগ করা হয় যে প্রাচ্যের জরাজীর্ণ সভ্যতার প্রধান ভিত্তিস্বরূপ দর্শনগুলো বস্তুগত প্রমাণকে গুরুত্ব না দিয়ে আত্মগত সত্যের নিশ্চয়তা নির্বিচারে মেনে নিয়ে সন্তুষ্ট থাকে। এর মানে দাঁড়ায়, আমাদের জ্ঞান যেখানে অস্বচ্ছ, সেখানে আমরা জ্ঞেয় বস্তুর অস্পষ্টতাকে দায়ী করি। পশ্চিমের দৃষ্টিতে আমাদের সভ্যতা শুধুই অধ্যাত্মবাদী। এটা এমন অভিযোগ যেমন কোনো বধির মানুষ পিয়ানোর কোনো শব্দ শুনতে পায় না বলে মনে করে লোকটা শুধু আঙুল নাড়াচ্ছে। পশ্চিমের পর্যবেক্ষকরা ভাবতে পারেন না যে আমরা বাস্তবতার এক গভীর ভিত্তি দেখতে পেয়েছি যার ওপর আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো দাঁড়িয়ে আছে।

দুর্ভাগ্যক্রমে, বাস্তবতার সব প্রমাণ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতার ওপর নির্ভরশীল। কোনো দৃশ্যবস্তুর বাস্তবতা সেটা যে দেখা যাচ্ছে তার উপর নির্ভর করে। তাই অবিশ্বাসীর কাছে আমাদের পক্ষে প্রমাণ করা খুব দুষ্কর যে আমাদের সভ্যতা বিমূর্ত তত্ত্বের নীহারিকাতন্ত্র নয়, এর মধ্যে ইতিবাচক সত্যের অর্জন আছে। এই সত্যের মধ্যে মানুষ হৃদয়ের আশ্রয় ও অন্তঃসার খুঁজে পায়। এর ফলে অন্তর্গত বোধের উদয় হয়েছে, জন্ম নিয়েছে এমন এক বোধের দৃষ্টি যা সসীম বস্তুর মধ্যে অসীম সত্যকে দেখতে পায়।

কিন্তু পশ্চিম বলে: ‘তুমি কোনো উন্নতি করতে পারো না, তোমার ভেতর কোনো গতি নেই।’ আমার প্রশ্ন: ‘তুমি কী করে জানলে? তুমি প্রগতিকে মাপো লক্ষ্যের নিরিখে। একটা রেলগাড়ি প্রান্তিক স্টেশনের দিকে এগিয়ে চলে, এটাই তার গতি। কিন্তু একটা পরিণত বৃক্ষের সেরকম কোনো গতিমুখ নেই, প্রাণের অন্তর্গামী যাত্রাই তার প্রগতি। পাতায় পাতায় আলোর ঝিকিমিকি আর নীরব রসধারার দিকে সেই আলোকময় চলা, এ প্রত্যাশা নিয়েই তার জীবন, এভাবেই সে বাঁচে।’

আমরাও শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বেঁচে এসেছি। আজও বাঁচছি। এমন এক বাস্তবতার জন্য আমাদের আকাঙ্ক্ষা যার কোনো অন্তিম গন্তব্য নেই, যা মৃত্যুর সীমা ছাড়িয়ে যায়, তা এমনভাবেই অর্থপূর্ণ হয়ে ওঠে যা জীবনের সব মন্দের ওপরে উঠে শান্তি ও শুদ্ধতা নিয়ে আসে, আত্মার আনন্দময় পুনরুজ্জীবন ঘটায়। অন্তর্জীবনের এই উৎপাদন একটি প্রাণবান পদার্থ। যুবক যখন ক্লান্ত ও ধূলিধূসর শরীরে ঘরে ফেরে, যোদ্ধা যখন আহত হয়, সম্পদ যখন অপব্যয়ে ধ্বংস হয়, অহঙ্কার যখন ধূলিতে লুটায়, পুঞ্জ পুঞ্জ তথ্যের মাঝে সত্য যখন অন্তর্হিত হয়, পরস্পরবিরোধী প্রবণতার টানাপোড়েনে সঙ্গতির জন্য মানুষের হৃদয় হাহাকার করে, তখন অন্তর্জীবনের এই বোধ প্রয়োজন হবে। বস্তুরাশি ক্রমাগত বাড়িয়ে তোলার মধ্যে এর মূল্য নিহিত নেই, আত্মিক পূর্ণতার জন্যই এটি মূল্যবান।

কিছু জিনিস আছে যা অপেক্ষা করতে পারে না। বাজারে সেরা জায়গাটি দখল করতে হলে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে এগোতে হয়। সুযোগগুলো যেন সবসময় ডানা মেলে উড়ে যেতে চায়, তাই যেন তাদের পিছু ধাওয়া করতে হলে স্নায়ু টানটান রেখে সতর্কভাবে এগোতে হয়। কিন্তু এমন সব আদর্শ আছে যা এভাবে তোমার জীবনের সঙ্গে লুকোচুরি খেলে না। তারা ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠে। বীজ থেকে ফুল, ফুল থেকে ফলে পরিণত হওয়ার জন্য তাদের চাই অসীম পরিসর আর উন্মুক্ত আকাশের আলো। যে ফল জন্মায় তা হাজার অপমান ও অবহেলা সহ্য করেও বহু বছর টিকে থাকে। প্রাচ্য আদর্শমালার বুকে বহুযুগের সূর্যালোক ও নক্ষত্রের নীরবতা সঞ্চিত হয়ে আছে। সুবিধাজনকতার পিছনে ছুটতে ছুটতে পশ্চিমের দম যতদিন না ফুরিয়ে যায়, ততদিন অবধি ধৈর্যের সঙ্গে প্রাচ্য আদর্শমালা অপেক্ষা করতে পারে। ইউরোপ তার সদাব্যস্ততা ও সদাধাবমানতার মধ্যে থেকে ছুটন্ত গাড়ির জানালা দিয়ে মাঠে চাষে মগ্ন কৃষকের দিকে তাচ্ছিল্য নিয়ে তাকায়, গতির নেশায় মাতাল হয়ে ভাবে: লোকটা কী ধীরগতি, ক্রমশ পেছনে চলে যাওয়াই তার নিয়তি। কিন্তু গতি একসময় স্তব্ধ হয়। কর্মতৎপরতা নিরর্থক হয়ে পড়ে। ক্ষুধিত হৃদয় খাদ্যের জন্য আর্তনাদ করে। অবশেষে তাকে আসতে হয় রোদ্দুরে দাঁড়িয়ে নীচুতলার সেই কৃষকের কাছে। কারণ, অফিস, কেনাবেচা বা উত্তেজনার লালসা কোনোটাই অপেক্ষা করতে পারে না; কিন্তু প্রেম, সৌন্দর্য, কষ্টভোগের প্রজ্ঞা, সরল বিশ্বাসের সশ্রদ্ধ নম্রতা ও ধৈর্যের সুফল অপেক্ষা করতে পারে। এভাবে প্রাচ্য তার সময় আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করবে।

ইউরোপ যে মহান তা স্বীকার করতে আমার বাধা নেই। নিঃসন্দেহে সে মহান। আমরা সমস্ত হৃদয় দিয়ে তাকে না ভালোবেসে পারি না, প্রশংসার অর্ঘ্য নিবেদন না করে থাকতে পারি না, তার কথা আমাদের বলতেই হয়। এ সেই ইউরোপ যার সাহিত্য, শিল্প, সত্য ও সুন্দরের অশেষ উপহার দিয়ে সে সব দেশ ও কালের চিত্তভূমি উর্বর করেছে। এ সেই ইউরোপ যার মনের একীকরণের অতিকায় শক্তি বিশ্বের উচ্চতম থেকে গভীরতম প্রান্ত পর্যন্ত পরিব্যাপ্ত, যা বৃহতের অসীমতা থেকে ক্ষুদ্রতম অণু অবধি জ্ঞানের অর্ঘ্য পৌঁছে দিয়ে বিজয়ী হয়েছে। এ সেই ইউরোপ যে নিজের মহান বুদ্ধি ও হৃদয়ের সাহায্যে রোগীর জন্য নিয়ে এসেছে নিরাময়। তাছাড়া মানুষের জীবনের সেইসব দুর্দশার কথা বলা যায়, যেগুলিকে অনিবার্য ভেবে আমরা তার হাতে আত্মসমর্পণ করি। সেগুলোকেও ইউরোপ উপশমের পথ দেখিয়েছে। এই ইউরোপ প্রধান প্রধান প্রাকৃতিক শক্তিগুলোকে মানুষের সেবায় সজোরে কাজে লাগিয়ে পৃথিবীর উৎপাদিকা শক্তিকে অভাবনীয় পরিমাণে বাড়িয়ে তুলেছে। এরকম প্রকৃত বৃহতের চালিকাশক্তি অবশ্যই আত্মিক শক্তি। কারণ মানুষের আত্মশক্তিই সব বাধা অগ্রাহ্য করে এগোতে পারে, চূড়ান্ত বিজয় সম্বন্ধে ভরসা দিতে পারে, যা নিকটবর্তী, যা আপাত, তাকে ছাড়িয়ে আলোকরেখা অনেক দূর অবধি পৌঁছে দিতে পারে, আনন্দের সঙ্গে শাহাদাত বরণ করতে পারে এমন সব লক্ষ্যে যা জীবনে অর্জিত হওয়া সম্ভব নয়। পরাজয় স্বীকার না করেই তা বিফলতাকেও মেনে নিতে পারে। মানবপ্রেমের পবিত্রতম স্রোত, ন্যায়বিচারের প্রতি ভালোবাসা, উচ্চতর আদর্শের জন্য আত্মত্যাগের আবেগ ইউরোপের হৃদয়ে নিহিত। শত শত বছরের খ্রিস্টীয় সংস্কৃতি তার জীবনের গভীর তলদেশ পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। ইউরোপে এমন সব মহৎ মনের মানুষের পরিচয় আমরা পেয়েছি যারা জাতি-বর্ণ-নির্বিশেষে মানুষের অধিকারের সপক্ষে দাঁড়িয়েছেন। তাঁরা নিজের দেশের লোকেদের কাছ থেকেও বিপদ ও অপমান সহ্য করেছেন, কারণ তাঁরা মানুষের স্বার্থে লড়াই করেছেন, উন্মাদ গণসমরবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। কোনো কোনো সময় পাশবিক প্রতিহিংসার উন্মত্ততা যখন জনমানসকে আচ্ছন্ন করে দেয়, তার বিরুদ্ধেও তাঁরা কন্ঠ তুলেছেন। নিজের দেশের অপরাধের প্রতিকার ও ক্ষতিপূরণের দাবিতে নিপীড়িতের পাশে দাঁড়িয়েছেন, ক্ষতিগ্রস্ত জাতির দুর্বল প্রতিরোধের সুযোগে আক্রমণকারী দেশের অবাধ অবিচারের স্রোতকে বিপরীতে ফেরানোর ব্যর্থ হলেও চেষ্টা করেছেন। আধুনিক ইউরোপের এইসব হিতব্রতী যোদ্ধারা এখনও স্বাধীনতার জন্য নিঃস্বার্থ ভালোবাসায় আস্থা হারাননি। এখনো আস্থা রেখেছেন সেইসব আদর্শে যা কোনো ভৌগোলিক সীমারেখা মানে না, মানে না জাতীয় স্বার্থপরতাকে। এর দ্বারা প্রমাণ পাওয়া যায় যে অনন্তজীবনের বারিধারা এখনো ইউরোপে শুকিয়ে যায়নি, সেখানে তার বারবার পুনর্জন্মও হয়ে চলবে। বিপরীতে, ইউরোপ যেখানে তার গভীর প্রকৃতিকে অস্বীকার করে, বিদ্রূপ করে, নিজের ক্ষমতাকে সচেতন ভাবে বাড়িয়ে তোলায় ব্যস্ত, সেখানেই সে বৈষম্যকে আকাশপ্রমাণ করে তুলে ঈশ্বরের অভিশাপ ডেকে এনেছে। এর ফলে দৈহিক ও নৈতিক কুশ্রীতার সংক্রমণে ধরণীর মুখ মলিন হয়েছে, তাদের হৃদয়হীন বাণিজ্য মানুষের সৌন্দর্যবোধ ও সততাকে অন্ধভাবে বিধ্বস্ত করছে। ইউরোপের সবচেয়ে সুন্দর মুখ আমরা দেখতে পাই যখন তা মানবতার দিকে ফেরানো। সে সবচেয়ে ভয়াল ও সর্বনেশে যখন তার মুখ শুধু নিজের স্বার্থের দিকে ফেরানো, যখন সে তার বিরাটত্বকে এমন সব লক্ষ্যপূরণের জন্য ব্যবহার করে যা মানুষের মধ্যে যা অসীম ও চিরন্তন তার বিরোধী।

পূর্ব এশিয়ার নিজস্ব পথ ছিলো, এমন নিজস্ব সভ্যতার বিকাশ ঘটিয়েছিলো যে সভ্যতা রাজনৈতিক নয় সামাজিক, লুঠেরা নয়, আবার যান্ত্রিকভাবে দক্ষও নয়। সেই সভ্যতা আত্মিক, যার ভিত্তি বিচিত্র গভীর মানবিক সম্পর্কের ওপর স্থাপিত। মানবজাতির সমস্যাগুলোর সমাধান তারা নিভৃতে চর্চা করেছিলো। অবস্থানগত দূরত্ব যে নিরাপত্তা দিয়েছিলো, তার আড়ালে এইসব সামাধানসূত্র তারা কার্যকরীও করেছিলো। রাজবংশের ওঠাপড়া ও বৈদেশিক আক্রমণ এতে কোনো ছেদ বা প্রভাব ফেলেনি বললেই হয়।

কিন্তু এখন আমরা বাইরের জগতের কাছে পর্যুদস্ত হয়েছি। আমাদের শান্ত নির্জনতা চিরদিনের মতো হারিয়ে গেছে। তবু আমরা এজন্য অনুতাপ করবো না। চারাগাছ কি কখনো সেই ধূসর অতীতের জন্য অনুতাপ করে যখন সে বীজ-অবস্থা ভেঙে সদ্য বেরিয়েছিলো? এখন সময় এসেছে যখন বিশ্বসমস্যাকে আমাদের সমস্যা হিসেবেই ভাবতে হবে। পৃথিবীর সব দেশের ইতিহাসের সঙ্গে সংহতি রেখে আমাদের সভ্যতার আত্মা নির্মাণ করতে হবে। যে বীজের খোলস ও ভূস্তরের গভীরতার নিরাপত্তা একদিন আমাদের আদর্শকে সঞ্জীবিত করে রেখেছিলো, মূর্খ অহঙ্কারে এখনো সেই খোলসের মধ্যে ঢুকে থাকতে আমরা পারি না। খোলস ও আচ্ছাদন দুটোই ভেঙে জীবনের সমস্ত তেজ ও সৌন্দর্য নিয়ে এখন আমাদের বিকশিত হতে হবে যাতে আমাদের অর্ঘ্য মুক্ত আলোয় গোটা বিশ্বকে নিবেদন করতে পারি।

বাঁধ ভেঙে বিশ্বের মুখোমুখি দাঁড়ানোর এই কাজে পুবের দেশগুলোর মধ্যে জাপান প্রথম এগিয়ে এসেছে। গোটা এশিয়ার হৃদয়ে সে আশার সঞ্চার করেছে। যে কোনো সৃজনশীল কাজের জন্য যে অন্তর্নিহিত আগুন দরকার, তার যোগান দেয় এই আশা। এশিয়া এখন অনুভব করতে পারছে যে তাকে প্রাণবান কর্মোৎপাদনের মাধ্যমে নিজের জীবনীশক্তির প্রমাণ রাখতে হবে, নিষ্ক্রিয় হয়ে ঘুমিয়ে থাকলে চলবে না, ভয় ও তোষামোদ মেশানো অন্ধ ভালোবাসা নিয়ে পশ্চিমের অনুকরণ করলেও চলবে না। এজন্য আমরা সূর্যোদয়ের এই দেশকে আমাদের ধন্যবাদ জানাই এবং সসম্ভ্রমে মনে করিয়ে দিতে চাই যে পূর্বদেশের ব্রত পূর্ণ করার দায়িত্ব তাদের নিতে হবে, আধুনিক সভ্যতায় পূর্ণতর মানবতার রস তাকে সঞ্চার করতে হবে। বিষাক্ত আগাছা যেন তার শ্বাসরোধ না করতে পারে; বরং সে যেন আলোর অভিমুখে, স্বাধীনতার অভিমুখে নির্মল বায়ু ও বিস্তীর্ণ পরিসরের মধ্যে নিজেকে তুলে ধরতে পারে যেখানে দিনের শুরুতে ও রাতের অন্ধকারে দিব্য প্রেরণা ঝরে পড়তে পারে। তুষারমুকুটশোভিত ফুজি পর্বত যেমন দেশের হৃদকেন্দ্র থেকে অসীমের উদ্দেশ্যে মাথা তুলেছে, পরিপার্শ্ব থেকে সমুন্নত বৈশিষ্ট্যে নিজেকে পৃথক করেছে, তেমনই রূপসী কুমারীর মতো বঙ্কিম রেখা নিয়েও দৃঢ় শক্তি ও স্থির সৌন্দর্যে মহীয়ান জাপানের আদর্শগুলোও যেন সবার চোখের সামনে দৃশ্যমান হয়ে উঠতে পারে।

আমি অনেক দেশে ঘুরেছি। সব শ্রেণির লোকের সঙ্গে মিশেছি। কিন্তু এই দেশে মানব-উপস্থিতি যেমন নির্দিষ্টভাবে অনুভব করেছি, তেমনটা আর অন্য কোথাও ভ্রমণকালে হয়নি। অন্যান্য বড়ো বড়ো দেশে মানবশক্তির পরিচয় প্রবলভাবে প্রকাশ পেতে দেখেছি, এমন অতিকায় সব সংগঠনগুলোকে দেখেছি যা সর্বাত্মক দক্ষতার পরিচায়ক। তাছাড়াও দেখেছি পোষাকে, আসবাবে, ব্যয়বহুল আনুষ্ঠানিকতায় চমকপ্রদ আড়ম্বর। কোনো জমকদার ভোজসভায় দরিদ্র অনধিকার প্রবেশকারীর যে অবস্থা হয় এই সব আবহ যেন তেমন করেই তোমাকে পেছনের এক কোণায় ঠেলে দেয়। সেখানে হয় তুমি ঈর্ষাকাতর হয়ে পড়বে, আর নয়তো বিস্ময়ে তোমার দম আটকে আসবে। সেসব জায়গায় মানুষকে মহত্তম বলে অনুভব তুমি করবে না। হতবুদ্ধিকর বস্তুপুঞ্জের বিপরীতে ছুঁড়ে দিয়ে সেখানে তোমাকে অনন্বিত করে তোলা হবে। কিন্তু জাপানে ক্ষমতা ও সম্পদের প্রদর্শন প্রাধান্য অর্জন করেনি। সর্বত্র দেখা যায় প্রীতি ও স্তূতির প্রতীক। উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও লোভের প্রতীক খুবই বিরল। এখানকার সব সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে, আচারব্যবহারে, এমনকি দৈনন্দিন ব্যবহারের সামান্য বাসনপত্রের মধ্যেও এখানকার মানুষের হৃদয় প্রকাশিত ও বিচ্ছুরিত হয়েছে, যা সেসবকে সযত্ন পরিপূর্ণতা দান করেছে। যেভাবে এখানে জিনিসপত্র ব্যবহার করা হয়, তা কেবল প্রতি পদক্ষেপে দক্ষতার প্রদর্শন করে না, তা লাবণ্যেরও প্রকাশ ঘটায়।

এ দেশের যে বিশেষত্ব আমাকে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করেছে, তা হলো এখানকার মানুষদের এই প্রত্যয় যে তারা প্রকৃতির রহস্য উপলব্ধি করতে পেরেছে। এ উপলব্ধি বিশ্লেষণী জ্ঞানের দ্বারা জয় করে নেওয়া নয়, এ উপলব্ধি সহানুভূতির স্পর্শে প্রাপ্ত। প্রকৃতির রূপরেখার ভাষা, তার বিষমতার মধ্যে সুষমতা, তার স্বাধীন চলনভঙ্গির তাল ও লয় আপনারা বুঝেছেন। প্রকৃতি কীভাবে তার বস্তুনিচয়কে বিনা সংঘাতে চালনা করে নিয়ে চলে তা আপনারা দেখেছেন। এমনকি তার সৃষ্টির উৎসারে যে সব সংঘাত ঘটে থাকে, সেগুলো কীভাবে নৃত্য ও সঙ্গীতের তালে ফেটে পড়ে, তার প্রাচুর্যের মধ্যেও কীভাবে অহং-বিলুপ্তির পূর্ণতা দেখা যায়, প্রদর্শনকামনা থাকে না, এসব আপনারা জেনেছেন। প্রকৃতি যে সুন্দরের সজ্জায় নিজ শক্তিকে সজ্জিত করে রাখে, তা আপনারা আবিষ্কার করেছেন। মা যেমন স্তন্যরসে বিপুল শক্তিকে পুষ্ট করে তোলে, এই সৌন্দর্যও তেমনই সক্রিয় শক্তিকে শান্ত নিভৃতে লালন করে। এই লাবণ্যের ছন্দ ও তালের বাঁধন প্রকৃতির শক্তিকে জীর্ণ হয়ে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচায়। তার আঁকাবাঁকা খাঁজের কোমল কিশলয়ের সাহায্যে ধরণীর পেশি থেকে ক্লান্তি মুছে নেয়। প্রকৃতির এসব গোপন রহস্য আপনারা জীবনের অঙ্গীভূত করতে পেরেছেন। এ উপলব্ধি আমার হয়েছে। প্রতিটি বস্তুর সৌন্দর্যের মধ্যে যে সত্য নিহিত আছে, আপনাদের আত্মার মধ্যে তা সঞ্চারিত হয়েছে। শুধুমাত্র বস্তুজ্ঞান অল্প সময়ের মধ্যেই আয়ত্ত করা যায়, কিন্তু তাদের অন্তরাত্মাকে আয়ত্ত করতে শতাব্দীর পর শতাব্দী প্রশিক্ষণ ও আত্মসংযম প্রয়োজন হয়। বাইরে থেকে প্রকৃতির উপর আধিপত্যস্থাপন তুলনায় সহজ, কিন্তু প্রেমের আনন্দে তাকে নিজের করে তোলা কঠিন এবং প্রকৃত প্রতিভার কাজ। আপনাদের জাতি সেই প্রতিভার পরিচয় রেখেছে সংগ্রহের মধ্য দিয়ে নয়, সৃষ্ট বস্তুর প্রদর্শনের দ্বারা নয়, আন্তরসত্তার প্রকাশের মাধ্যমে। এই সৃজনীশক্তি সব জাতির মধ্যেই আছে এবং মানুষের স্বভাবকে প্রভাবিত করে তার আদর্শ অনুযায়ী একটা রূপ দিতেও তা সদা সক্রিয়। কিন্তু জাপানে এসে এই বিষয়টির সাফল্য সহজে অনুভব করা যায়। প্রতিটি মানুষের মনের গভীরে এই সৃজনীশক্তি স্থান করে নিয়েছে, তাদের পেশি ও স্নায়ুতন্ত্রে সঞ্চারিত হয়েছে। তাই আপনাদের সহজাত প্রবৃত্তিগুলোকে সত্য হয়ে উঠেছে, সংবেদন হয়েছে প্রখর, হাত স্বাভাবিক দক্ষতা অর্জন করেছে। ইউরোপের প্রতিভা তার বাসিন্দাদের যে সংগঠন গড়ার শক্তি দিয়েছে, তার বিশেষ প্রকাশ দেখি রাজনীতিতে, বাণিজ্যে এবং বৈজ্ঞানিক জ্ঞানকে সমন্বিত করার ক্ষেত্রে। জাপানের প্রতিভা আপনাদের মধ্যে প্রকৃতির মধ্যে সৌন্দর্যকে দেখার দৃষ্টি দিয়েছে এবং নিজেদের জীবনে তা বাস্তবায়িত করার ক্ষমতাও আপনারা পেয়েছেন।

প্রতিটি নির্দিষ্ট সভ্যতা আসলে নির্দিষ্ট মানবিক অভিজ্ঞতার ভাষ্য। ইউরোপ মনে হয় মহাবিশ্বে বস্তুপুঞ্জের সংঘাত প্রবলভাবে অনুভব করেছে, যা বিজয়ের দ্বারাই নিয়ন্ত্রণ করা যায়। তাই সে লড়াইয়ের জন্য সদাপ্রস্তুত। ফলে শক্তিসমাবেশের দিকেই তার দৃষ্টি প্রধানত নিবদ্ধ। কিন্তু জাপান তার জগতে এমন এক উপস্থিতির ছোঁয়া অনুভব করেছে যা তার আত্মায় সশ্রদ্ধ পুজোর অনুভূতি জাগিয়েছে। প্রকৃতির প্রভু হওয়ার অহঙ্কার তার নেই। বিপরীতে অসীম যত্ন ও আনন্দের সঙ্গে প্রকৃতিকে সে ভালোবাসার অর্ঘ্য নিবেদন করে। পৃথিবীর সঙ্গে তার গভীরতর হৃদয়ের সম্পর্ক। দেশের পাহাড়, সাগর, নদনদী এবং ফুলের ধারা ও নানা আকারের শাখাপ্রশাখায় সাজানো বনরাজির সঙ্গে তার ভালোবাসার আত্মিক বন্ধন ঘটেছে। পাতার মর্মর, বনভূমির দীর্ঘশ্বাস ও ঢেউয়ের অশ্রুবাষ্পকে জাপান হৃদয়ে ধারণ করেছে। চন্দ্রসূর্যের সব রকম আলোছায়ার বৈচিত্র্য এ দেশ গভীরভাবে লক্ষ্য করেছে। এমনকী তাদের ফলবাগিচা, উদ্যান ও শস্যক্ষেত্রে ঋতুগুলিকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য তারা দোকানপাটও বন্ধ রেখেছে। বিশ্বের আত্মার কাছে হৃদয় উন্মুক্ত করার এই কাজটি শুধুমাত্র আপনাদের সুবিধাভোগী শ্রেণির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। উষ্ণমণ্ডলের সংস্কৃতির কোনো চাপানো বিষয়ও এটা নয়। বলা যায়, আপনাদের সব স্তরের নারীপুরুষদের এটা সাধারণ সম্পদ। বিশ্বহৃদয়ে নিহিত এক সত্তার সঙ্গে মিলনের অভিজ্ঞতা আপনাদের সভ্যতার অঙ্গীভূত হয়েছে। এটা মানবিক সম্পর্কের সভ্যতা। আপনাদের জাতি একটা পরিবার, যার শীর্ষে আছেন সম্রাট। এজন্য রাষ্ট্রের প্রতি আপনাদের কর্তব্য পিতার প্রতি সন্তানের কর্তব্যের সঙ্গে তুলনীয়, প্রতিরক্ষা বা আগ্রাসনের জন্য গঠিত সশস্ত্র বন্ধুত্ব নয়। আক্রামক অভিযানের অংশীদার হিসেবেও এই ঐক্য গড়ে ওঠেনি যাতে বিপদ ও লুঠের ভাগ প্রতিটি শরিকের মধ্যে বখরা করে নেওয়া হয়। কোনো গোপন অভিসন্ধি পূরণের স্বার্থে সংগঠিত সংগঠনের ফলেও এই ঐক্যের উদ্ভব ঘটেনি। দেশকালের সুবিস্তৃত পরিসরে এটা পরিবারের সম্প্রসারিত রূপ ও হৃদয়ের বাধ্যবাধকতা। আপনাদের সংস্কৃতির গভীরে আছে মৈত্রীর আদর্শ: মানুষের সঙ্গে মৈত্রী, প্রকৃতির সঙ্গে মৈত্রী। সেই সৌন্দর্যের ভাষাতেই এই প্রীতির আসল প্রকাশ ঘটে যে সৌন্দর্য এই দেশে সুপ্রচুর ও সর্বব্যাপী। আমি একজন আগন্তুক হলেও সৌন্দর্যের এই প্রকাশপ্রাচুর্যে প্রীতিময় সৃজনকর্মগুলোর সমুখে কোনো ঈর্ষা বা হীনতাবোধ করিনি, বরং মানবহৃদয়ের এমন প্রকাশের গৌরবে ও আনন্দে যোগ দিতে উৎসুক হয়ে উঠেছি।

এজন্যই জাপানের সভ্যতার পক্ষে বিপজ্জনক যে পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে তা আমাকে আরো আতঙ্কিত করে তুলেছে, যেন ব্যক্তি-আমি-র সামনেই বিপদ ঘনিয়ে এসেছে। আধুনিক যুগের বিপুল বৈচিত্র্যকে শুধু একটা বাঁধনই বেঁধে রেখেছে, সেটা হলো কার্যকারিতা। জাপানের শান্ত সৌন্দর্যের নিহিত শক্তি ও মর্যাদার বিপরীতে এই কেজো বাঁধুনির মুখোশ এমন করুণভাবে খুলে পড়েছে যা আর কোথাও হয়নি।

বিপদের জায়গাটা দেখা যাক। সংগঠিত কুরূপতা মনের উপর হামলে পড়লে তার স্থূলতা ও মরীয়া আগ্রাসনের জোরে জয়ী হতে পারে। হৃদয়ের গভীরতর আবেগ-অনুভূতিগুলো হয় তার বিদ্রূপের লক্ষ্য। এখানেই বিপদ। এর কর্কশ দৃশ্যমানতা অবাঞ্ছিত দৃশ্যে আমাদের দৃষ্টি ঢেকে দেয়। আমাদের সুকুমার সংবেদন তখন হেরে যায়। তার বেদিতেই বলির অর্ঘ্য নিবেদন করতে আমরা এগিয়ে যাই, যেমন কিনা বর্বরদের পূজ্য মূর্তি তার ভয়াবহ আকারের প্রভাবেই শক্তিমান বলে মান্য হয়ে থাকে। জীবনের যা কিছু নম্র, গভীর, সূক্ষ্ম ও স্বাদু, তার বিরুদ্ধে যখন রাশি রাশি কেজো জিনিসের অহঙ্কার পালোয়ানি করতে নামে, তখন ভয় লাগে।

আমি নিশ্চিতভাবে জানি যে আপনাদের দেশে এমন মানুষও আছেন যারা নিজেদের উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া আদর্শগুলোর প্রতি সহানুভূতিশীল নয়। তাঁদের উদ্দেশ্য হলো লাভ করা, বিকশিত হওয়া নয়। জাপানের আধুনিকীকরণ ঘটিয়েছে বলে অহঙ্কারী ঘোষণায় তাঁরা সোচ্চার। তাঁদের সঙ্গে এইটুকু শুধু একমত হতে পারি যে জাতির আত্মাকে সমকালের আত্মার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে চলা উচিত। কিন্তু আমি তাঁদের অবশ্যই সতর্ক করতে চাই যে আধুনিকতার নকল করার নাম আধুনিকীকরণ, ঠিক যেমন কবিত্বের নকল করাকে কাব্যি করা বলে. এটা হনুকরণ ছাড়া আর কিছু নয়। নকলনবিশি আসলের থেকে অনেক উচ্চকন্ঠ ও আক্ষরিক হয়। মনে রাখা উচিত যে যাঁরা অন্তরে প্রকৃত আধুনিক, তাঁদের আধুনিকীকরণের কোনো প্রয়োজন পড়ে না, ঠিক যেমন যাঁরা প্রকৃত সাহসী তাঁরা কখনো বাগাড়ম্বর করে না। আধুনিকতা ইউরোপীয়দের পোশাকের মধ্যে আছে এমনটা নয়। যেসব ভয়ঙ্কর বদ্ধ কাঠামোর মধ্যে শিশুদের পাঠ দেওয়ার নামে আটকে রাখা হয়, আধুনিকতা নেই সেখানেও। ঘেঁষাঘেষি চৌকো বাড়ি, যার দেওয়ালগুলো খাড়া আর মাঝে মাঝে বিঁধে আছে সমান্তরাল জানালার সারি, যার মধ্যে মানুষের জীবন কাটে খাঁচার কোটরে বন্দি হয়ে, আধুনিকতা নেই সেখানেও। মহিলাদের পোশাকের মধ্যে গুচ্ছ গুচ্ছ অসঙ্গতি যেখানে, সেখানেও নেই আধুনিকতা। এগুলো আধুনিক নয়, এগুলো ইউরোপীয়। মনের স্বাধীনতাই প্রকৃত আধুনিকতা, রুচির দাসত্ব করা আধুনিকতা নয়। চিন্তা ও কর্মের স্বাধীনতাই বলো আধুনিকতা, ইউরোপীয় স্কুলশিক্ষকদের অধীনতা কখনো আধুনিকতা হতে পারে না। বিজ্ঞান আধুনিকতার সঙ্গে যুক্ত হতে পারে, কিন্তু জীবনে বিজ্ঞানের ভ্রান্ত প্রয়োগ আধুনিকতা নয়। তাই বিজ্ঞানের জোরে সব রকম অসম্ভবকে সম্ভব করার উদ্দেশ্য যাঁরা ঘোষণা করেছেন, সেইসব বিজ্ঞানশিক্ষকদের টোলে শিক্ষা নিয়ে ও অনুকরণ করে আধুনিক হওয়া যায় না।

শুধুমাত্র বিজ্ঞানের উপর ভিত্তি করা জীবন কারো কারো কাছে আকর্ষণীয় মনে হতে পারে, কারণ শিকারের সব বৈশিষ্ট্যই এতে আছে। এটা গুরুগম্ভীর ভাব করে বটে, কিন্তু এর গভীরতা নেই। যখন আপনি শিকারে বেরোন, তখন আপনার মনে করুণা যতো কম থাকে ততোই ভালো, কারণ আপনার উদ্দেশ্য পশুটিকে তাড়া করে হত্যা করা এবং আপনি যে শ্রেষ্ঠতর পশু সেটা অনুভব করা। আর আপনার অবলম্বিত বিনাশপদ্ধতিটি সর্বতভাবে বিজ্ঞানসম্মত। শুধুই বিজ্ঞাননির্ভর জীবন। যে জীবন কেবলমাত্র বিজ্ঞাননির্ভর, তা এমনই ওপর-ওপর ও অগভীর। দক্ষতা ও অনুপুঙ্খতা নিয়ে এ জীবন সাফল্যকে তাড়া করে কব্জা করতে চায়। মানুষের মহত্তর স্বভাবের কোনো খোঁজ রাখে না। স্থূলচিন্তার মানুষরা জীবনধারাকে এমনভাবে সাজায় যেন সে শুধু একজন শিকারী এবং শিকারীর স্বর্গই তার ইন্দ্রপুরী। একসময় এক রূঢ় ধাক্কায় তারা জেগে উঠবে। দেখবে খুলি ও কঙ্কালের বিজয়স্মারকের মধ্যেই তার স্থান জুটেছে।

আমি মুহূর্তের জন্যও এমন পরামর্শ দিতে চাই না যে আত্মরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহের ব্যাপারে জাপান অমনোযোগী হোক। কিন্তু সহজাত আত্মরক্ষাপ্রবৃত্তির সীমা যেন কখনোই ছাড়িয়ে না যায়। জাপানকে জানতেই হবে যে অস্ত্রের মধ্যেই প্রকৃত ক্ষমতা নেই। প্রকৃত ক্ষমতা আছে মানুষের মধ্যে, যারা অস্ত্র চালায়। যখন ক্ষমতালাভের ব্যাকুলতায় নিজের আত্মার বিনিময়ে অস্ত্রসম্ভার বাড়িয়ে তোলা হয়, তখন নিজেকেই শত্রুর চেয়ে বেশি বিপন্ন করে তোলা হয়।

জীবন্ত বস্তু সহজেই আঘাত পায়। এজন্যই তাদের সুরক্ষা দরকার। প্রকৃতিতে জীবন আপন আবরণের মধ্যেই নিজেকে সুরক্ষিত রাখে, যে আবরণ জীবনের নিজস্ব বস্তু দিয়ে তৈরি, তাই তা জীবনের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। আবার, সময় হলে, এই খোলস পরিত্যাগ করে তার কথা তারা ভুলেও যায়। জীবন্ত মানুষকে প্রকৃত সুরক্ষা দেয় তার আত্মিক আদর্শগুলো, মানুষের জীবনের সঙ্গে যার প্রাণবান সম্পর্ক আছে। এই আদর্শগুলো মানুষের জীবনের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গেই বিকশিত হয়। দুর্ভাগ্যক্রমে মানুষের সব বর্মই এমন জীবন্ত নয়। কিছু কিছু বর্ম ইস্পাতের তৈরি, জড় ও যান্ত্রিক। তাই সেগুলো ব্যবহারের সময় সেগুলোর অত্যাচার সম্বন্ধেও নিজেকে সতর্ক থাকতে হবে। যদি বর্মের খাপে নিজেকে ঢোকানোর জন্য নিজেকে কুঁকড়ে নিতে হয়, তাহলে আত্মার সংকোচনের ফলে তা ধীরগতি আত্মঘাতের রূপ নেয়। জাপানকে অস্তিত্বের নৈতিক নিয়মের ওপর দৃঢ় বিশ্বাস রাখতে হবে। তাহলেই সে অনুভব করতে পারবে যে পশ্চিমী জাতিগুলো আত্মহননের পথ নিচ্ছে, নিজেরা ক্ষমতায় থেকে অপরদের পদানত করে রাখার নিমিত্তে ব্যাপৃত বিপুল সংগঠনপুঞ্জের চাপে নিজ মনুষ্যত্বকেই পিষ্ট করছে।

পশ্চিমের বহিরঙ্গের অনুকরণ জাপানের পক্ষে বিপজ্জনক নয়, বিপজ্জনক হলো পশ্চিমের জাতীয়তাবাদের চালিকাশক্তিকে আপন বলে গ্রহণ করা। ইতিমধ্যেই রাজনীতির তাগিদে জাপানের সামাজিক আদর্শগুলোর মধ্যে পরাজয়ের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। ‘যোগ্যতমের উদবর্তন’--- বিজ্ঞান থেকে নেওয়া এই কথাটাই তাদের আদর্শ হয়ে উঠতে দেখছি। তাঁদের আধুনিক ইতিহাসের প্রবেশদ্বারে এই ললাটবাণী লেখা দেখতে পাচ্ছি। এর মানে হলো: ‘নিজের উপকারটাই করো, তাতে অন্যের কী ক্ষতি হলো সেদিকে চোখ তুলে তাকানোর দরকার নেই।’ এটা অন্ধ মানুষের বিশ্বাস কারণ সেই হতভাগ্য দেখতে পায় না বলে যা সে ছুঁতে পারে তাকেই বিশ্বাস করে। কিন্তু যারা দেখতে পায়, তারা তো জানে যে মানুষ এমন ঘনসংবদ্ধ যে অন্যকে আঘাত করলে সে আঘাত তার দিকেই ফিরে আসবে। মানুষের আবিষ্কৃত সেরা নৈতিক নিয়মটি একটি বিস্ময়কর সত্য: অপরের মধ্যে যতো বেশি করে মানুষ নিজেকে উপলব্ধি করতে পারে, সে মানুষ ততোই সত্য থেকে সত্যতর হয়ে ওঠে। এই সত্যের মূল্য যে শুধু মনোগত তা নয়, আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তা মূল্যবান। যেসব জাতি লুব্ধকারী ভঙ্গিতে জাতীয়তাবাদের পুজো হিসেবে নৈতিক অন্ধতার চাষ করে, আকস্মিক ও সহিংস মৃত্যুতেই তাদের নিজেদের অস্তিত্বও একদিন লুপ্ত হবে। অতীত যুগে আমরা বিদেশি আক্রমণ দেখেছি, কিন্তু সেগুলো কখনোই দেশের হৃদয়কে গভীরভাবে ছুঁয়ে যায়নি। সেগুলো কেবল ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষার প্রকাশ ছিলো। এসব আক্রমণের নীচ ও জঘন্য দিকগুলো সম্বন্ধে সাধারণ মানুষের কোনো দায় ছিলো না, বরং নিজেদের বীরত্বপূর্ণ মানবিক শৃঙ্খলার উপকার তারা পেয়েছিলো। আর তার ফলেই অবিচল আনুগত্য, সম্মানরক্ষার দায়বদ্ধতার প্রতি একাগ্র ভক্তি, আত্মবিসর্জনের শক্তি এবং বিপদ-মৃত্যুবরণের মুখে নির্ভীকতার মতো বৈশিষ্ট্যগুলো তাদের মধ্যে বিকশিত হয়েছিলো। সুতরাং, রাজা বা সেনানায়কদের গৃহীত নীতির ফলে জনগণের অন্তরে আসন পেতে থাকা আদর্শগুলোর কোনো গুরুতর পরিবর্তন হতো না। কিন্তু এখন? যেখানে পশ্চিমী জাতীয়তাবাদের প্রাধান্য, সেখানে সমগ্র দেশবাসীকে শৈশব থেকেই সবরকম উপায়ে ঘৃণা ও উচ্চাকাঙ্ক্ষায় দীক্ষিত করা হয়। কীভাবে করা হয়? ইতিহাসে অর্ধসত্য ও অসত্য আমদানি করে, ক্রমাগত অন্য জাতি সম্বন্ধে অপপ্রচার করে বিরূপ ধারণার আবাদ করে, যেসব ঘটনা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মিথ্যা বা বানানো সেসবের স্মৃতিসৌধ গড়ে (সত্যি হলেও মানবতার খাতিরে সেগুলোকে দ্রুত ভুলে যাওয়াই কাম্য ছিলো)। এভাবে কেবল নিজেদের জাতি ছাড়া অন্যসব প্রতিবেশী জাতিগুলোকে অশুভ ও বিপজ্জনক বলে অনর্গল প্রচার করে ঘৃণার সংস্কৃতিকে গাঁজিয়ে তোলা হয়। মানবতার উৎসটিকেই এভাবে বিষিয়ে দেওয়া হচ্ছে। শ্রেষ্ঠ ও মহোত্তম মানুষদের জীবন থেকে যে আদর্শগুলো উৎসারিত হয়েছিলো সেগুলোকে হতশ্রদ্ধা করা হচ্ছে। পৃথিবীর সবকটা জাতির সর্বজনীন ধর্ম হিসেবে এই অতিকায় স্বার্থপরতাকেই ঊর্ধ্বে তুলে ধরা হয়েছে। বিজ্ঞানের হাত থেকে অন্য যা কিছু আমরা নিতে পারি, কিন্তু নৈতিক মৃত্যুর এই পানীয়টি কিছুতেই নিতে পারি না। কখনও ভাববেন না অন্যজাতির ওপর যে আঘাত আপনারা হানছেন, তা আপনাদেরও সংক্রামিত করবে না। আপনাদের ঘরের চারপাশে যে শত্রুতার বীজ আপনারা ছড়াচ্ছেন তা সর্বকালের সুরক্ষাপ্রাচীর হয়ে থাকবে না। সমগ্র দেশবাসীর মনকে আপন শ্রেষ্ঠত্বের অস্বাভাবিক অহঙ্কারে রঞ্জিত করা, নৈতিকতার ব্যাপারে উদাসীন থেকে অসদুপায়ে অর্জিত সম্পদ সম্বন্ধে দম্ভ দেখাতে শিক্ষিত করা, পরাজিত জাতিদের লাঞ্ছনাকে চিরস্থায়ী করার জন্য তাদের কাছ থেকে যুদ্ধের মাধ্যমে লুন্ঠিত সম্পদকে বিজয়বৈজয়ন্তী হিসেবে প্রদর্শন করা ও সেগুলোকে স্কুলে ব্যবহার করে শিশুদের মনে অপরের বিরুদ্ধে অবজ্ঞার চাষ করানো হলো পশ্চিমের সেই পুঁজরক্তেভরা স্ফীতির অনুকরণ। এই স্ফীতি একটা রোগ যা তার প্রাণশক্তিকে শুষে নিচ্ছে।

আমাদের টিকে থাকার জন্য যেসব খাদ্যশস্য দরকার, শতাব্দীর পর শতাব্দীর যত্ন ও সুচয়নের ফলে তাদের উদ্ভব হয়েছে। কিন্তু আমাদের জীবন বিকাশের জন্য যেসব প্রাণের রসদ দরকার সেগুলোর জন্য প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে কোনো ধৈর্যশীল প্রয়াস প্রয়োজন হয় না। এজন্য আগাছার হাত থেকে মুক্তি পাওয়া সহজ নয়। অবহেলার ফলে খাদ্যশস্যের সর্বনাশ হয়ে যেতে পারে এবং ক্রমে আবার বন্য অবস্থায় ফিরে যেতে পারে। একইরকমভাবে যে সংস্কৃতি আপনাদের মাটিতে সহৃদয়তার সঙ্গে মানিয়ে গেছে, তা এতো অন্তরঙ্গ, এতো মানবিক হওয়া সত্ত্বেও অতীতেও এজন্য শুধু কর্ষণ নয়, আগাছা নিড়োনোরও দরকার পড়েছে। বর্তমানেও উদ্বিগ্ন ও সতর্ক নজর রাখার দরকার পড়ে। যা আধুনিক মাত্র--- যেমন বিজ্ঞান ও সংগঠনপদ্ধতি--- তাকে এক জায়গা থেকে উপড়ে অন্য জায়গায় পোঁতা যায়। কিন্তু যা একান্তভাবে মানবিক, তার তন্তুগুলো সূক্ষ্ম, শিকড়গুলো এতো অসংখ্য ও দূরবিস্তারী যে মাটি থেকে ওপড়ালেই তার মৃত্যু ঘটে। সেজন্য আপনাদের নিজস্ব আদর্শের ওপর ইউরোপীয় রাজনৈতিক আদর্শের কঠোর চাপ পড়তে দেখলে আমার ভয় লাগে। রাজনৈতিক সভ্যতায় রাষ্ট্র বিমূর্ত এবং মানুষের সম্পর্ক কেজো সম্পর্ক। আবেগের গভীরে এর কোনো শিকড় নেই বলে একে পরিচালনা করা বিপজ্জনকভাবে এতো সহজ। এই যন্ত্রের প্রভু হয়ে বসতে আপনাদের মোটে পঞ্চাশ বছর লেগেছে। আপনাদের মধ্যে এমন অনেকে আছেন যাদের এই যন্ত্রটার ওপর ভালোবাসা প্রাণবন্ত আদর্শের ওপর ভালোবাসার চেয়ে বেশি। এইসব আদর্শ আপনাদের জাতির জন্মের সঙ্গে সঙ্গে উদ্ভূত হয়েছিলো এবং শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে লালিত হয়েছে। কোনো শিশু যেমন খেলার উত্তেজনায় মনে করে খেলনাগুলোকে সে মায়ের চেয়ে বেশি ভালোবাসে, এটাও তেমন এক উত্তেজনা।

মানুষ যেখানে মহোত্তম, সেখানে সে অসচেতন। আপনাদের সভ্যতার মর্মবস্তু পরস্পরের মানবিক সম্পর্কের বন্ধন। এই বন্ধন সুস্থ জীবনের গভীরে লালিত হয়েছে যা আত্মবিশ্লেষণের চোরাচাউনির নাগালের বাইরে। অন্যদিকে রাজনৈতিক সম্পর্ক সবটাই সচেতন। এটা একধরনের আগ্রাসী অগ্নুৎগার। আপনাদের সামনে এটা জোর করে বিস্ফোরিত করে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। আপনারাও ভেবেছেন, সময় এসেছে যাতে পুরো সচেতনতা নিয়ে আজকের জীবনের সত্যে জেগে উঠতে হবে যাতে অপ্রস্তুত অবস্থার মুখোমুখি না হতে হয়। অতীতটা ছিলো আপনাদের কাছে ঈশ্বরের উপহার। বর্তমানে কী করবেন আপনাদেরই স্থির করতে হবে।

সুতরাং নিজেদের কাছে এই প্রশ্নগুলো রাখতেই হবে: ‘আমরা কি বিশ্বনিয়মকে ভুলভাবে পাঠ করেছিলাম এবং মানবপ্রকৃতির বিষয়ে অজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে পৃথিবীর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক গড়ে তুলেছি? মানবতার ওপর সর্বজনীন এক অবিশ্বাসের প্রাকার গড়ে তুলে তার পেছনে জাতীয় কল্যাণ রচনার যে পশ্চিমী বোধ, তা কি সঠিক?

আপনারা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন যে পশ্চিম যখনই প্রাচ্যে এক নতুন জাতির উত্থানের সম্ভাবনার কথা আলোচনা করে, তখনই তাতে মারাত্মক ভয়ের সুর ধরা পড়ে। এর কারণ হলো, যার সাহায্য নিয়ে তার উন্নতি তা একটা অপশক্তি। যতোদিন এই অপশক্তি তার পক্ষে থাকবে, ততোদিন সে নিরাপদে থাকবে এবং বাকি পৃথিবী ভয়ে কাঁপবে। ইউরোপের আধুনিক সভ্যতার প্রধান লক্ষ্য ওই দানবকে একান্তভাবে নিজের অনুগত করে রাখা। একমাত্র এই উদ্দেশ্যেই তার সমগ্র অস্ত্রশস্ত্র ও কূটনীতি নিয়োজিত। এই অপদেবতার পুজোর জন্য এসব মহামূল্যবান উপাচার সমৃদ্ধির পথ বেয়ে মহাপ্রলয়ের তীরে পৌঁছে দেয়. ঈশ্বরের পৃথিবীর বুকে পশ্চিম যে আতঙ্কের জ্বালামুখ খুলে দিয়েছে সেটাই তার দিকে ফিরে এসেছে। ফিরে এসে আবার তাকেই ভয় দেখাচ্ছে। আরো বেশি বেশি ভয়াবহতার প্রস্তুতির দিকেও তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এটা তাকে কোনো বিশ্রাম দেয় না। অন্য সবকিছু ভুলিয়ে দিয়ে শুধু অন্যদের ওপর যে ধ্বংস নামিয়ে এনেছে এবং নিজেও যার শিকার হয়েছে, এসবই তার ভাবনাকে অধিকার করে থাকে। রাজনীতির দানবের পুজোয় অপর দেশকে সে বলি দেয়, তাদের মৃতদেহের মাংসে নিজেরা পুষ্ট হয় যতদিন শবদেহের মাংস তাজা থাকে। কিন্তু একদিন সেই শবদেহে পচন ধরে। তখন শবের প্রতিশোধ নেওয়ার পালা। তখন কাছে দূরে দূষণ ছড়িয়ে পড়ে। খাদকের প্রাণশক্তি বিষাক্ত হয়ে যায়। জাপানের সবরকম মানবিক সম্পদ ছিলো। বীরত্বের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিলো সৌন্দর্য। আরো ছিলো আত্মসংযমের গভীরতা ও আত্মপ্রকাশের সমৃদ্ধি। তবুও পশ্চিমী জাতিগুলো তাকে শ্রদ্ধার আসন দেয়নি যতোদিন না পশ্চিমীরা বুঝতে পারলো যে শয়তানের রক্তখেকো শিকারী কুকুরগুলো শুধু ইউরোপের কুকুরশালাতেই প্রশিক্ষিত হয় না, মানুষের দুর্দশার খাদ্য খাইয়ে জাপানও তাদের পোষ মানাতে শিখে গেছে। তারা তখনই জাপানকে তাদের সমকক্ষ বলে মেনেছে যখন জানতে পেরেছে যে জাপানের হাতেও সেই চাবি আছে যার সাহায্যে সুন্দর পৃথিবীর বুকে নরকের অগ্নিস্রোত বইয়ে দেওয়ার বাঁধের সদর দরজা হাট করে খুলে দেওয়া যায় নিজের খুশিমতো, আর লুন্ঠন, হত্যা ও নির্দোষ নারীদের ধর্ষণের মতো রাক্ষুসে নাচ সেই নরকাগ্নিকে ঘিরে নাচতে পারা যায় যখন বিশ্ব ধ্বংসের পথে গড়িয়ে চলেছে।

আমরা জানি আদিমকালে যখন মানুষের নৈতিকতার বোধ অপরিণত ছিলো, তখন তারা সেই দেবতার ওপর ভক্তিশ্রদ্ধা দেখাতো যার অভিশাপকে তারা ভয় পেতো। কিন্তু এটাই কি সেই মানবিক আদর্শ যাকে আমরা গর্বের সঙ্গে গ্রহণ করতে পারি? আমাদের সভ্যতা শতাব্দীর পর শতাব্দী পেরিয়ে এসেছে। তার পরেও জাতিগুলো ভয় পেয়ে অন্ধকারের জন্তুর মতো পরস্পরের ওপর লাফিয়ে পড়ছে। আতিথেয়তার দরজা বন্ধ করে দিচ্ছে। তারা মিলছে কেবল আগ্রাসন বা প্রতিরক্ষার তাগিদে। নিজেদের গর্তের ভেতর বাণিজ্যিক তথ্য, রাষ্ট্রীয় তথ্য ও অস্ত্রশস্ত্রের তথ্য লুকিয়ে রাখছে। একে অপরের ঘেউ ঘেউ করা কুকুরদের মুখে অপরের গা থেকে খুবলে আনা মাংসের টুকরো ছুঁড়ে দিয়ে শান্তিপ্রস্তাব পাঠাচ্ছে। যেসব পরাজিত জাতি কষ্ট করে নিজের পায়ে উঠে দাঁড়াতে চাইছে তাদের দাবিয়ে রাখতে চাইছে। তারা দরিদ্র জাতিগুলোকে ডান হাতে বিলোচ্ছে ধর্মের বাণী আর বাঁ হাত দিয়ে তাদেরই সম্পদ লুঠ করে নিচ্ছে। এই পরিস্থিতি কি একটুও ঈর্ষা করার মতো? আমরা কি এই জাতীয়তাবাদের কাছে নতজানু হবো, যে জাতীয়তাবাদ সারা বিশ্ব জুড়ে ভয়, লোভ, সন্দেহ, কূটনীতির নির্লজ্জ মিথ্যাচার এবং শান্তি-শুভেচ্ছা-ভ্রাতৃত্বের নাম করে তোষামুদে মিথ্যার বীজ ব্যাপকভাবে বুনে চলেছে? যখন আমরা আমাদের উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত সম্পদের বদলে পশ্চিমের বাজার থেকে এই বিদেশি আবর্জনা কিনে আনি, তখন কি একবারও আমাদের মনে কোনো সন্দেহ জাগে না? আমি বুঝি নিজের অন্তরকে জানা কতো কঠিন। এমনকি আকন্ঠ মাতালও দাবি করে সে মদ খায়নি। যদিও পশ্চিম নিজের সমস্যা উদ্বেগের সঙ্গে ভাবছে এবং পরীক্ষানিরীক্ষা করে দেখছে, তবু তার অবস্থা বড়োমাপের পেটুকের মতো। খাওয়ার অসংযম সে কিছুতেই ছাড়তে চায় না। সে খেয়েই চলে এই আশা আঁকড়ে ধরে যে তার দুঃস্বপ্ন হয়ে ওঠা বদহজমের রোগ ওষুধ খেলেই সেরে যাবে। ইউরোপ তার রাজনৈতিক অমানুষিকতা এবং অমানুষিক নীচ আবেগগুলো ছাড়তে রাজি নয়। হৃদয় পরিবর্তনের বদলে তার একমাত্র আস্থা চালু ব্যবস্থাটারই এদিক-ওদিক ওকটু অদলবদল করে নেওয়ায়।

তাদের যন্ত্রে বানানো ব্যবস্থাটা আমরা মস্তিষ্কের তাগিদে কিনতে চাই, হৃদয়ের দাবিতে নয়। আমরা তাদের পরখ করে নেবো এবং বাইরে রাখবার ছাউনি বানাবো। কিন্তু আমাদের ঘরে বা মন্দিরে তাদের স্থান হবে না। কিছু গোষ্ঠী আছে যারা যেসব পশু বলি দেয় তাদের পুজোও করে। খিদে মেটানোর জন্য আমরা তাদের কাছ থেকে মাংস কিনতে পারি, কিন্তু তার সঙ্গে পুরোহিত কিনবো না। আমরা আমাদের শিশুদের মন এহেন কুসংস্কারে আচ্ছন্ন করবো না যে ব্যবসা তো ব্যবসাই, যুদ্ধ তো যুদ্ধই আর রাজনীতি তো রাজনীতিই। আমাদের অবশ্যই জানতে হবে যে মানুষের ব্যবসা শুধু ব্যবসা নয়, অতিরিক্ত আরো অনেক কিছু, যুদ্ধ ও রাজনীতিও তেমন হওয়া উচিত। জাপানে আপনাদের নিজেদের শিল্প ছিলো। কতো বিবেচনা, সততা ও সত্য তাতে ধরা ছিলো তা তাতে উৎপন্ন বস্তুর দিকে তাকালেই বোঝা যায়। দেখা যায় লাবণ্য ও শক্তি। সূক্ষ্ম কারুকর্মে বোনা বিবেকের ছোঁয়া কাজটির প্রায় অদৃশ্য অংশেও অনুপস্থিত থাকে না। কিন্তু মিথ্যের ভরা কোটাল আপনাদের দেশকে ভাসিয়ে দিয়েছে। যে দেশ থেকে এই অভিঘাত এসেছে সেখানে ব্যবসা কেবল ব্যবসাই। সততা বড়জোর এক কৌশল বিশেষ। বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপন তো আপনাদের অদেখা নয়, মিথ্যা ও অতিকথায় ভরা এহেন বিজ্ঞাপন শহরের সর্বত্র ছেয়ে ফেলেছে। আর শুধু শহর নয়, এগুলো থাবা বাড়িয়েছে সবুজ শস্যক্ষেত্রেও যেখানে কৃষকরা সৎভাবে পরিশ্রম করে চলেছে। দেখা যাবে পাহাড়চূড়াতেও সকালে প্রথম পবিত্র আলোকরেখাও কোনো বিজ্ঞাপনের গায়ে আটকে যাচ্ছে। এগুলো দেখে আপনাদের কি কখনো লজ্জা করেনি? অবিরাম ঘর্ষণে আমাদের মর্যাদাবোধ ও মনের সুকুমারত্বকে ভোঁতা করে দেওয়া খুব সহজ। বিশেষ করে যখন ব্যবসা, রাজনীতি ও দেশপ্রেমের নামে মিথ্যাচার বিদেশে সদম্ভে পদচারণা করছে, তখন আমাদের জীবনে তার স্থায়ী অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে যে কোনো প্রতিবাদকে ভাবপ্রবণতা ও পৌরুষহীনতা বলে দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

যাঁরা মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও নিজেদের বিশ্বাসে অবিচল থাকতেন, যাঁরা তুচ্ছ লাভের জন্য মানুষকে প্রতারণা করতে ঘৃণাবোধ করতেন, যাঁরা এমনকি যুদ্ধেও বরং পরাজিত হতেন কিন্তু অসম্মানজনক আচরণ করতেন না, তাদের সন্তানদের সম্বন্ধে একটা কথা প্রচলিত আছে যে মিথ্যের বিরুদ্ধে যোঝার মধ্য দিয়েই তাদের তেজস্বিতার পরিচয় পাওয়া যায়। মিথ্যেগুলো থেকে সুবিধা আদায় না করতে পারার জন্য কখনো তাঁরা নিজেদের হীন বলে মনে করেন না। এই ভাবনার উপর ‘আধুনিক’ শব্দটির মোহ ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলেছে। যদি বিশুদ্ধ উপযোগিতাই হয় আধুনিক, তবে সব যুগের সৌন্দর্যই আধুনিক। নীচ স্বার্থপরতাই যদি আধুনিক হয় তবে তার বিপরীতে মানবিক আদর্শগুলো কোনো নতুন আবিষ্কার নয়। আমাদের নিশ্চিতভাবেই বুঝতে হবে যে দক্ষতা পদ্ধতি ও যন্ত্রের জন্য মানুষকে পঙ্গু করে দেয়, যতো আধুনিকই হোক না কেন, কোনোদিনই পরিণত বয়স্ক হয়ে ওঠা তার কপালে নেই।

কিন্তু ইউরোপের উদ্ধত দাবিগুলোর হাত থেকে আমাদের মনকে মুক্ত রাখতে এবং আমাদের অন্ধভক্তির চোরাবালির ফাঁদ থেকে নিজেদের বাঁচাতে গিয়ে আমরা হয়তো একেবারে অন্যপ্রান্তে চলে যেতে পারি, অর্থাৎ, পশ্চিমকে পুরোটাই সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করতে পারি। মোহমুগ্ধতার প্রথম ধাঁধা-লাগা অবস্থা যেমন অবাস্তবতার ঘোরে আমাদের আচ্ছন্ন করে, মোহমুক্তির প্রথম ধাক্কাও তেমনই অবাস্তবতার মধ্যে এনে ফেলে। এই দুই অবস্থাকেই কাটিয়ে আমাদের সেই স্বাভাবিক মানসিক অবস্থায় আসা উচিত যার জোরে বিপদের উৎসের প্রতি অবিচার না করেও সঠিকভাবে নিজেদের বিপদকে চিহ্নিত করতে পারি ও এড়ানোর পথ করতে পারি। ইউরোপকে ইটের বদলে পাটকেল মারার স্বাভাবিক প্রলোভনও সবসময় থাকে। তাই ঘৃণার বিরুদ্ধে ঘৃণা, শয়তানির বদলা হিসেবে শয়তানি করার ঝোঁক তৈরি হয়। এটাও আবার ইউরোপের সবচেয়ে খারাপ বৈশিষ্ট্যগুলোর অনুকরণ, যা প্রকাশিত হয় অন্যজাতির প্রতি ব্যবহারে, অন্যজাতিকে পীত অথবা লাল, বাদামী অথবা কালো বলে তুচ্ছ করে দেখার মধ্য দিয়ে। এক্ষেত্রে প্রাচ্যের মানুষদেরও নিজেদের দোষ স্বীকার করে নিতে হবে। আর আমাদের পাপ শুধু একইরকম নয়, আরো বেশি বেজে ওঠে যখন আমরা কোনো নির্দিষ্ট জাত, ধর্ম ও গাত্রবর্ণের মানুষকে চরম ঘৃণা ও নিষ্ঠুরতার সঙ্গে অপমান করি। প্রকৃতপক্ষে আমরা আমাদের দুর্বলতার জন্য ভীত। শক্তিমানের সামনে পড়লে পরাজিত হওয়ার ভয় পাই। আর তার প্রতিষেধক খুঁজতে গিয়ে অন্য একটা দুর্বলতার পাল্লায় পড়ি: পশ্চিমের গৌরবের বিষয়ে অন্ধ হয়ে থাকি। আমরা যখন সেই ইউরোপকে প্রকৃতপক্ষে জানতে পাই যে ইউরোপ মহান ও শুভ, তখন আমরা নীচ ও আগ্রাসী ইউরোপের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারি। দুর্দশার মুখোমুখি হলে মানুষের বিচারধারায় বিভ্রাট ঘটতেই পারে। যন্ত্রণাকাতর পরিস্থিতিতে হতাশাবাদী তত্ত্বের উদ্ভবও ঘটে থাকে। আমরা যদি সত্যের উপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলি, তখনই কেবল মানুষ সম্বন্ধে হতাশা আসতে পারে, কারণ, সত্যই মানুষের ওপর বিশ্বাস রাখার শক্তি দেয়। যখন মনুষ্যত্বের পরাজয় সবচেয়ে বেশি হয়, তখনও সেই সর্বনাশের গহ্বর থেকে নবজীবনের ডাক শোনা যায়। আমাদের মানতেই হবে যে পশ্চিমের অন্তরে এমন এক জীবন্ত আত্মা আছে যা সবার অগোচরে লড়াই করে যাচ্ছে। তার লড়াই সেইসব বিশালাকৃতি সংগঠনসমূহের বিরুদ্ধে যাদের চাপে নারী-পুরুষ-শিশু পিষ্ট হচ্ছে, যাদের যান্ত্রিক প্রয়োজনীয়তা সমস্ত মানবিক ও আত্মিক নিয়মাবলীকে অবহেলা করছে। স্বাভাবিক সহানুভূতি না থাকার কারণে অপর নানা জাতির সঙ্গে উদাসীন আচরণ করার যে বিপজ্জনক অভ্যাস গড়ে উঠেছে, তা-ও অন্তরাত্মার সংবেদনশীলতাকে পুরোপুরি ভোঁতা করে দিতে পারে না। পশ্চিম আজ প্রাধান্যের যে শিখরে পৌঁছেছে, সেটা কখনো সম্ভব হতো না যদি শুধু পাশবিক ও যান্ত্রিক শক্তির সাহায্যে সে উত্থানের চেষ্টা করতো। তার দু-হাত পৃথিবীর বুকে যে ক্ষতচিহ্ন এঁকে দিয়েছে, তার নিজের অন্তরের দেবতাও সে আঘাতে কাতর। মহোত্তর প্রকৃতির এই ক্ষত থেকে চুঁইয়ে পড়ছে গোপন ওষধি যা হয়তো তার আরোগ্য এনে দেবে। বারবার সে নিজেই নিজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে, শিকলে বাঁধা পড়া অসহায় প্রত্যঙ্গগুলোকে নিজের হাতে শিকলমুক্ত করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। অর্থলোভে সে এক বিরাট জাতিকে অস্ত্রের জোরে বিষ গিলতে বাধ্য করেছে। আবার নিজেই অনুতপ্ত হয়ে এ কাজ থেকে সরে আসতে চেয়েছে, নোংরা হাত ধুয়ে ফেলতে চেয়েছে। এর মধ্যেও তো দেখা যায় মানবতার নিহিত উৎস, আপাতদৃষ্টিতে যা মৃত ও ঊষর ভূমি সেখানেও তো নিহিত থাকে মানবতার উৎসমুখ। এর থেকেই তো প্রমাণিত হয় যে নিষ্ঠুর ও কাপুরুষোচিত যাপনের মধ্যেও তার চরিত্রের গভীরে যে সত্য টিকে থাকতে পারে তা লোভ নয়, তা হলো নিঃস্বার্থ আদর্শের প্রতি শ্রদ্ধা। ইউরোপ আধুনিক প্রাচ্যমনকে যদি কেবল তার হিংস্র শক্তিপ্রদর্শনের মধ্য দিয়েই মোহিত করে, তবে তা আমাদের ও ইউরোপের উভয়ের দিক থেকেই সম্পূর্ণ এক অবিচার হবে। কামানের ধোঁয়া ও বাজারের ধূলিজাল ভেদ করে তাদের নৈতিক প্রকৃতিও তো উজ্জ্বল হয়ে ফুটে উঠে আমাদের কাছে নিয়ে এসেছে সেই নৈতিক স্বাধীনতার আদর্শ, যার ভিত সামাজিক রীতিপদ্ধতির চেয়ে অনেক গভীরে নিহিত এবং যার সঞ্চারণক্ষেত্র সারা বিশ্বে পরিব্যাপ্ত।

বিতৃষ্ণা সত্ত্বেও প্রাচ্য স্বতঃস্ফূর্তভাবে অনুভব করেছে যে ইউরোপ থেকে তার অনেককিছু শেখার আছে। শুধু তার শক্তির বস্তুগুলো সম্বন্ধে নয়, তার অন্তরের উৎস সম্বন্ধেও, যা মানুষের মন ও নৈতিক প্রকৃতির মধ্যে পাওয়া যায়। কতকগুলো বিষয় ইউরোপ আমাদের শিখিয়ে চলেছে, যেমন: পরিবার ও বংশের ঊর্ধ্বে জনকল্যাণকে স্থান দেওয়া; এমন আইনের পবিত্রতা যা সমাজকে ব্যক্তির খেয়ালখুশি থেকে মুক্তি দিতে পারে, প্রগতির ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করতে পারে এবং সব অবস্থার মানুষকে ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তা দিতে পারে। সবার ওপরে, শতাব্দীর পর শতাব্দী জুড়ে শহিদত্ববরণের মধ্য দিয়ে ইউরোপ আমাদের চোখের সামনে স্বাধীনতার পতাকাকেও তুলে ধরেছে। বিবেকের স্বাধীনতা, চিন্তা ও কর্মের স্বাধীনতা, শিল্পসাহিত্যের আদর্শের স্বাধীনতার কথা সেই পতাকায় আঁকা হয়েছে। ইউরোপ আমাদের গভীর শ্রদ্ধা অর্জন করেছে বলেই আমাদের পক্ষে সে এতো বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। তার মারাত্মক দুর্বলতা ও খলতার জায়গাগুলো সেরা খাদ্যের সঙ্গে পরিবেশিত বিষের মতো মারাত্মক হয়ে উঠেছে। আমাদের জন্য নির্ভরযোগ্য একটাই নিরাপত্তার উপায় আছে। সেই নিরাপত্তার উপায়কে আমরা ইউরোপের প্রলুব্ধতা ও সহিংস অনুপ্রবেশ প্রতিরোধ করার জন্য সম্বল করতে পারি। ইউরোপ এতোদিন ধরে পূর্ণতার একটা নিজস্ব মানদণ্ড বহন করে চলেছে, সেই মানদণ্ডেই আমরা তার অধঃপতনগুলোকে মাপতে পারি। তার নিজের বিচারশালার কাঠগড়ায় তাকে দাঁড় করিয়ে লজ্জায় ফেলতে পারি, এমন লজ্জা যাকে মহত্বের প্রকৃত গর্বচিহ্ন বলা যায়।

বিষের ক্ষমতা যদি খাদ্যের চেয়ে বেশি হয়ে থাকে, তাহলে আজ আমরা তাদের যে লক্ষণগুলোকে দেখে যতোটা শক্তিমান বলে মনে করছি, আসলে বোধহয় তা নয়, লক্ষণগুলো বোধহয় স্বাস্থ্যের লক্ষণ নয়, বরং তার উল্টোটাই। জীবনের ভারসাম্য নড়ে যাওয়ার ফলেই হয়তো এরকম ঘটেছে। এমনটাই আমাদের আশঙ্কা। বিশাল থেকে বিশালতর আকার ধারণ করা শয়তানের বিপজ্জনক নেশা হতে পারে, যদিও ওই অস্বাভাবিক আয়তনের কারণেই ভরকেন্দ্র হারিয়ে সে একদিন ধসে পড়ে। কিন্তু ধসে পড়ার আগে অপূরণীয় ক্ষতি সে করে দিয়ে যেতে পারে, সেখানেই আমাদের ভয়।

তাই আপনাদের কাছে আমার অনুরোধ, আপন বিশ্বাসের শক্তি ও মনের স্বচ্ছতায় অটল থাকুন। সুনিশ্চিতভাবে জানুন যে আধুনিক প্রগতির ওই লগবগে কাঠামোটা দক্ষতার বল্টু দিয়ে আটকানো আর উচ্চাকাঙ্ক্ষার চাকার ওপর তার চলাচল। ওটা বেশিদিন চলবে না। দুর্ঘটনা হবেই। কারণ তার ভারী শরীরটা নিজের বশে নয়, নিজের পছন্দমতো পথে তা চলতে পারে না, বেঁধে দেওয়া পথে চলতে হয়। একবার একটা বগি লাইন থেকে ছিটকে বেরিয়ে গেলে তার টানে অন্তহীন বগির সারি স্থানচ্যুত হতে থাকে। এমন দিন আসবে যখন তা ধ্বংসস্তূপ হয়ে আছড়ে পড়বে, পৃথিবীর চলাচলের পথে মারাত্মক বাধা সৃষ্টি করবে। এখনই কি আমরা তার চিহ্ন দেখতে পাচ্ছি না? যুদ্ধের কোলাহল, ঘৃণার চিৎকার, হতাশার বিলাপ--- জাতীয়তাবাদের গভীরে যুগ যুগ ধরে জমে ওঠা অবর্ণনীয় ক্লেদ ভেদ করে ভেসে উঠে এগুলো কি এখনই আমাদের কানে আসছে না? জাতীয় স্বার্থপরতার চূড়ান্ত রূপ দেশপ্রেমের নামে চালানো হচ্ছে, সেই দেশপ্রেম বিশ্বাসঘাতকতার নিশানকেই ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছে। নিজের ভারে টলমল করতে করতেই সে একদিন মাটিতে আছড়ে পড়বে, তার সাধের নিশান ধুলোয় লুটোবে, তার আলোর জমক সব নিভে যাবে। আমাদের বিবেক কি এখনই আমাদের একথা বলছে না?

আমার ভাইসব, যখন কোনো অগ্নিকাণ্ডের রক্তবর্ণ শিখা চড়বড় আওয়াজ করতে করতে আকাশের তারাদের দিকে বিদ্রূপের বাঁকা হাসি ছুঁড়ে দেয়, তখন ওই অতিদর্পী ধ্বংসের আগুনের উপর নয়, নক্ষত্রপুঞ্জের উপরই বিশ্বাস রাখা উচিত। ওই অতিদর্পী আগুন নিজেই নিজেকে গ্রাস করে একসময় নিভে যাবে, পড়ে থাকবে শুধু ছাই। চিরন্তন তারার আলো আবার দীপ্তিময় হয়ে উঠবে প্রাচ্যে, যে প্রাচ্য মানুষের ইতিহাসে প্রভাতসূর্যের জন্মভূমি রূপে পরিচিত।

কে জানে সেই ঊষালগ্ন এখনই সমাগত কিনা? এশিয়ার সবচেয়ে পূর্ব দিগন্তে ইতিমধ্যেই সে সূর্যোদয় ঘটে গেছে কিনা? আমাদের দেশের প্রাচীন ঋষিরা যেমন সূর্যপ্রণাম করতেন, আমিও প্রাচ্যের সূর্যোদয়ের উদ্দেশ্যে আমার প্রণাম জানাই। প্রাচ্যের এই সূর্যোদয়ই আবার সমগ্র পৃথিবীকে আলোকিত করার ভার নেবে।

আমি জানি যে এই বিস্ফোরক সময়ের কোলাহল ছাপিয়ে ওঠার মতো জোর আমার দুর্বল কন্ঠস্বরে নেই। পথচলতি যে কেউ আমার দিকে ‘অবাস্তব’ বলে মন্তব্য ছুঁড়ে দিতে পারে। সে অভিধা আমার জোব্বার প্রান্তে লেগেই থাকবে, কখনো ধুয়ে ফেলা যাবে না। মান্যগণ্য ভদ্রলোকেদের সারিতে আমাকে আর গণ্য করা হবে না। যখন সিংহাসন তার মর্যাদা হারিয়েছে, ধর্মপ্রবর্তকরা সেকেলে বলে গণ্য হচ্ছেন, সব কন্ঠস্বর ডুবে যাচ্ছে হট্টগোলে, তখন মারমুখো দঙ্গলের সামনে অবাস্তব আদর্শবাদী হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার বিপদ আমি বুঝি। তবু একদিনের অভিজ্ঞতার কথা আপনাদের শোনাই। একদিন ইয়োকোহামার শহরতলীতে দাঁড়িয়ে আছি। ইতিউতি আধুনিকতার নানা চিহ্ন অগোছালোভাবে উঁকি মারছে। সেখানে দাঁড়িয়েই আপনাদের দক্ষিণসাগরে সূর্যাস্ত দেখলাম। পাইনগাছে ছাওয়া পাহাড়গুলোতে কী শান্তি ও মহিমা! মহান ফুজিয়ামা সোনালী দিগন্তে ধীরে ধীরে অস্পষ্ট হয়ে আসছে এক কোণে। দেবতা যেন তাঁর জ্যোতির্বলয় নিয়ে বিদায় নিচ্ছেন। সান্ধ্য নীরবতার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে শাশ্বতের সঙ্গীত। আমি অনুভব করলাম যে আকাশ, পৃথিবী, গোধূলি ও সন্ধ্যার সুর কবি ও অবাস্তব আদর্শবাদীদের সঙ্গেই আছে, সেইসব ব্যাপারীদের সঙ্গে নেই যারা কোনোরকম আবেগ-অনুভূতিই সহ্য করতে পারে না। বুঝলাম যে মানুষের অন্তরস্থ দেবত্বের কথা যতোই এখন ভুলে যাওয়ার চল হোক না কেন, মানুষ আবার স্মরণ করবে স্বর্গ সবসময় তার পৃথিবীকে ছুঁয়ে আছে। শিকারের খোঁজে হন্যে হয়ে ঘোরা আধুনিক যুগের যে নেকড়েগুলো মানুষের রক্তের গন্ধ পেয়ে আকাশের দিকে মুখ তুলে বিকট চিৎকার করে চলেছে, তাদের নখদন্তের মুখে মানুষ তার প্রিয় পৃথিবীকে চিরদিনের জন্য কখনোই ছেড়ে দেবে না।

1 Comments
  • avatar
    প্রণব দে

    18 September, 2025

    সজলদা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এবং প্রশংসনীয় কাজ করেছেন। কিন্তু অনেক typographical mistake চোখের পক্ষে পীড়াদায়ক। টাইপোগুলো সংশোধন করে repost করলে ভালো হয়।

Leave a reply