জীবনে যা করলে প্রকাশ, অপ্রকাশিত তার কাছে কী যে সর্বনাশ

লিখেছেন:নীলাদ্রি শেখর দাশশর্মা
গভীর-গোপন-কে প্রকাশিতব্য করে তোলাই কি আমাদের অস্তিত্বগত বিনিয়োগ? এটাই কি আমাদের আধুনিকত্বের সর্বনাশা অসুখ? প্রশ্নগুলোর মুখোমুখি হয়ে এই লেখা।

জীবনের প্রাত্যহিকতার ভিতরে যে গোপনীয়তা লুকিয়ে রয়েছে, তা আজ প্রকাশিত। প্রদর্শনবাদের কবলে প্রত্যেকটা ঘরই এক একটা মিডিয়া হাউস। সবাই কনটেন্ট ক্রিয়েটর এবং পাবলিক ফিগার হতে চায়। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের ভিত্তি থেকে সমূহের পানে যাত্রা এ নয়, এ হলো সমূহীকরণ (গ্লোবালাইজেশন)-এর যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে ব্যক্তিকে একটি প্রতিষ্ঠান করে তোলা। আমাদের ভিতর থেকে কী করে আমার আমিটা আমিময় হয়ে উঠবে তার প্রস্তুতি। ডিজিটাল ক্রিয়েটর হয়ে ওঠা। গোপন পরিসরগুলো যেহেতু আজ সবই প্রকাশিতব্য, তাই আপনগুলো কোনোটাই শরীরী নয়, সবই পর্দায় ভাসমান ছায়া। শরীরের নয়, আমরা সব ছায়ার মায়ায় জড়িয়ে পড়েছি। তবু ব্যথা হয়, শুধু মনে নয়, শরীরেও তো হয়। কিন্তু অন্যথা তো হওয়ার নয়, কারণ এ যে অস্তিত্বগত বিনিয়োগ, যার রিটার্ন ভাইরাল।

ফ্রয়েড-পরবর্তী মনস্তত্ত্ববিদ লাকাঁ মহাশয় বললেন: আমরা সবাই ইমেজের কারাগারের মধ্যে আটকা পড়ে গেছি। চারিদিকে ইমেজের পৃথিবী, আর পায়ের নীচে ভাষা। ভাষা আবার তৈরি হয় ভাষার কারখানায়। শুধু মাথার উপর রয়েছে একটু খোলা আকাশ। তাই কি সত্য?

গাই দেবোর-এর বই The Society of Spectacle (১৯৬৭) বললো: আমরা সবাই নির্মীত দৃশ্যের প্রতিনিধিত্ব করি। কারা এই দৃশ্য নির্মাণ করে বা দৃশ্য নির্মাণ করতে উৎসাহিত/প্ররোচিত করে? বইটি পড়তে পড়তে দেখা যায় যে লেখক ধারাবাহিকভাবে দৃশ্যনির্মাণের পিছনের পরিকল্পনার ছকটিকে উন্মোচিত করে চলেছেন।

এই ছকের ভিতরই জন্ম নিয়ে চলে প্রতিহিংসার ছবি, প্রতিবাদের ছবি, হত্যার ছবি, ধ্বংসের ছবি, ধর্ষণের ছবি, আনন্দের ছবি…। ছবি আর ছবি। উৎপাদিত সত্য রূপে ছবি উপচে পড়ছে…। আমরা ফেঁসে গেছি। পঞ্চাশটা মিডিয়া চ্যানেলে পঞ্চাশ রকম সত্য। হাজার হাজার কন্টেন্ট ক্রিয়েটর হাজির করছে হাজার রকম সত্য। অস্থির আঙুল মোবাইল স্ক্রিনে দ্রুত ওঠানামা করে--- কোথায়? কোথায় আমি? যোজন যোজন নকল আমি সাড়া দেয়: এইতো, এইতো।

মরীয়া হয়ে উঠি। যেভাবেই হোক আমাকে ছবিতে ও ভাষায় আত্মপ্রতিষ্ঠিত করতেই হবে কোনো এক অখণ্ড সত্যকে ধরে নিয়ে। মনে পড়ে যায় তপন সিনহার ‘গল্প হলেও সত্যি’ সিনেমার সেই দৃশ্য যেখানে শক-চিকিৎসার কথা বলা হয়েছে। মানুষকে একটা খাঁচার মধ্যে ঢুকিয়ে বারবার তাকে শক দিতে থাকো। এভাবেই বিজ্ঞাপিত সত্যে বিশ্বাস গড়ে তোলা যায়। বিজ্ঞাপিত সত্যে আমরা বিশ্বাস করতে শুরু করি। মোহগ্রস্ত হই অতিবাস্তবতায়। অভাবের শেষ নেই, তাই বাসনাও ক্লান্ত হয়ে পড়ে। যত ক্লান্ত হয়ে পড়ে, ততো ছুঁচ ফুটিয়ে স্টেরয়েড চালান করা হয় তার ধমনীতে।

পণ্যমোহ থেকে চিহ্নমোহ। ভাষা, ছবি--- সবই তো চিহ্নক আর চিহ্নিতের সম্পর্ক। এই সম্পর্কগুলোই তো মানবিক সম্পর্ককেও ধারণ করে রেখেছে। কেবল বেঁচে-থাকায় আটকে থাকে তা, সত্তার দিকে যাত্রা বুঝি তার আর হয় না।

জনপ্রিয়তার যাত্রায় আমরা ভাইরাল হতে পারি। নিযুক্ত অস্তিত্বের বিনিয়োগে হতে পারি প্রদর্শিত। ঠুনকো জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে সর্বজ্ঞ হয়ে ওঠার ক্ষমতানুভবে অন্যকে ছোটো করে যেতে পারি নিরন্তর। লাইক, কমেন্ট অ্যান্ড শেয়ার-এর ত্রিভুজাকৃতি গরাদে আটকে যেতে পারি।

গরাদের বাইরে ভবা পাগলা গেয়ে ওঠে:

এ জীবনে যাহা তুমি করিলে প্রকাশ।

অপ্রকাশিত তার কাছে কী যে সর্বনাশ।।

গরাদের ভিতরে বসে আমরা শুনি। কেউ হয়তো বা তা গলায় ধরে নগরবাউলও হতে চায়, আবার একটা অস্তিত্বগত বিনিয়োগ হিসেবে তা ছড়িয়ে পড়ে স্ট্যাটাস থেকে স্ট্যাটাসে। কিন্তু অন্তর থেকে কি তা অনুভব করতে পারি? বিশ্বাস করতে পারি?

1 Comments
  • avatar
    Pratik Roy

    18 August, 2025

    আবারও নীলাদ্রি বাবুর লেখায় নিজেকে বিশ্লেষণ করার মতো আরো এলিমেন্টস সুযোগ পেলাম। আমরা হয়ে উঠছি এক্সট্রিম লেভেল এর কনজিউমার। অনেক সূক্ষ্ম চাওয়া পাওয়া আমরা আমাদের ভুও ছবির আড়ালে থেকে কনসিয়ুম করি। তারপর অবসরে, আয়নামোহলে নিজেরই বিভিন্ন রূপ দেখে লজ্জিত কনফিউজড ও সচেতন হয়ে উঠি। প্রদর্শনবাদী চিন্তাভাবনা সবসময় ছিল। কিন্তু ভিত এতটা ঠুনকো ছিলনা। ছবি এখন সহজে, নিমেষেই তৈরি হয় আবার নিমেষেই ভেঙে যায়। যার ভাঙছে, বা যে দ্রষ্টা কারো কিছু যায় আসেনা। সব নিউ নরমাল। মুহূর্তেই যে ইমেজ ম্যানুফ্যাকচারার করা যায়!! আরো লেখা আসুক আপনার, জনসমক্ষে। বিনোদন ভিত্তিক সস্তা আমির কেনা বেচা চলছে বিভিন্ন সাজের আড়ালে। এই পরিস্থিতিতে আপকামিং জেনারেশন এর জন্য দরকার এরকম ই আয়না দেখানো লেখা, চাবুক মারা লেখা। অনেক ধন্যবাদ।

Leave a reply