না-হওয়া চলচ্চিত্রের খসড়া

লিখেছেন:বিপ্লব নায়ক
সময় পেরিয়ে স্বপ্নে পৌঁছতে পারা না-পারা-র গল্প

 

 

ষাট বছর আগে একদিন

কলেজের শেষ পরীক্ষা দিয়ে সিদু বন্ধুদের সাথে ট্রেকে বেরিয়েছে। নির্জন পাহাড়ি রাস্তা। সমুদ্রের পিঠ থেকে কয়েক হাজার হাত উপরে। কোনো চাকা গড়ায়নি কখনো এপথে। কোন্ সে আদিম কালের স্মৃতি চিরন্তন করে রেখে বিশাল বিশাল গাছ পথের দুধারে ছায়া বিছিয়ে রাখে। দূর পাহাড়ের স্তব্ধতা মেঘ-আলোর উদ্ভাসে কথা বলে।

সিদু হাঁটছে।

সিদু যতো হাঁটছে ততো একা হয়ে পড়ছে। তার ট্রেকিংয়ের অন্য সাথীদের ঠাট্টা-মস্করা-ইয়ার্কি-হুল্লোড় তাকে ঠেলে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। কে যেন তার ভিতর থেকে তাকে বলছে, স্তব্ধ হও, সমাহিত হও, নিশ্চল হও, ধ্যানস্থ হও, দেখ তাহলে তুমিও ওই পাহাড়ের স্পর্শ অন্তরে পাবে। সে ধীরে ধীরে পিছিয়ে পড়তে থাকে তার সঙ্গীদের দলের থেকে।

সিদু এখন ইচ্ছে করে অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছে। তার সঙ্গীদের দলকে এখন আর দেখাই যাচ্ছে না। ধ্যানস্থের মতো সে হাঁটছে। প্রতিটি গাছের পাতা, অচেনা প্রতিটি ফুল, প্রতিটি বৃক্ষশাখার ভাস্কর্য চকিতে অনাবৃত হয়ে তার চোখের সামনে নিজেকে মেলে ধরছে। সিদু হাঁটছে, তবু যেন সে ভিতরে নিশ্চল হয়ে উঠছে।

চড়াইয়ের পর যেখানে একটু উৎরাই সেখানে একটা বড় পাথরের উপর থেকে লাফিয়ে নামতে গিয়ে বেকায়দায় তার পা মচকে গেলো। পড়ে গেলো রাস্তার পাশে চিলতে ঘাসজমিতে। বেজায় মচকেছে পা-টা, সে আর উঠে দাঁড়াতেই পারছে না। বন্ধুরা তো অনেক এগিয়ে গেছে, তাদের আর ডাকার উপায় নেই। বিকেলও শেষ হয়ে আসছে, অন্য কোনো ট্রেকার দল আসবে, তার সম্ভাবনাও ক্ষীণ। কিঞ্চিৎ দুশ্চিন্তা হয় সিদুর। তবু তার মনে হয় এখানেই বুঝি তার থেমে যাওয়ার কথা ছিলো। আকাশে রঙ-বদলের খেলায় তার চোখ আটকে থাকে। গাছে হেলান দিয়ে আধ-শোয়া হয়ে যায় জখম পা-টাকে সামনে মেলে।

আলো তখন প্রায় নিভে এসেছে। স্থানীয় বাসিন্দা যেচুঙ, পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়স, শক্তসমর্থ চেহারা, তার ছাগলদুটোকে চরিয়ে ঘরে ফিরছিলো। সিদুকে পথের পাশে পড়ে থাকতে দেখে এগিয়ে আসে। কিছু কথায়, কিছু আকারে ইঙ্গিতে কথাবার্তা হয় তাদের মধ্যে। তারপর সিদুকে প্রায় আধা-কোলা করে নিজের ঘরে এনে আশ্রয় দেয়।

দুদিন কেটে গেছে। সিদু এখনও যেচুঙ-এর বাড়িতেই। যেচুঙ পরদিনই নিজে হেঁটে গিয়ে সান্দাকফু-র ট্রেকিং হাটে থাকা তার সঙ্গীদের জানিয়ে এসেছিলো। বন্ধুরা ফেরার পথে সিদুর সঙ্গে দেখা করে গেছে। সিদু এখনও হাঁটার অবস্থায় নেই, আর তাদের ট্রেন ধরার তাড়া আছে, তাই তারা চলে গেছে। সিদুর একটু খারাপ লাগেনি তা নয়, তবে আবার সে যেন এটাই চাইছিলো। কারণ যেচুঙ-এর বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার কথা সে এখনই ভাবতে পারছে না। যেচুঙদের প্রচলিত ভেষজ পদ্ধতিতে তার পা-মচকানোর চিকিৎসা চলছে, ব্যথা থাকলেও দাঁড়ানোর জোর সে ফিরে পেয়েছে। যেচুঙ ছাড়াও তার চিকিৎসক যেচুঙ-এর মেয়ে পুইমা। পুইমা-র বয়স সিদুর কাছাকাছি, পোলিও রোগে তার পা বিকৃত, তাই ঘরের মধ্যে কষ্ট করে চলতে পারলেও, ঘরের বাইরে সে নিজের জোরে চলতে পারে না। কিন্তু তার চোখ-মুখ-হাসিতে মেঘ-আলো-পাহাড় খেলা করে। সিদুর পায়ে ভেষজ-বাটা লাগাতে লাগাতে বা কাপড় গরম করে সেঁক দিতে দিতে সে চারপাশের পাহাড়-ঝরনা-গাছ-ফুলের হদিশ নিরন্তর দিতে থাকে। তার ভাষা আর বাংলার মিশেল এবং আকার-ইঙ্গিতে এক নতুন জ্ঞাপনমাধ্যম তৈরি হয়ে চলেছে তাদের মধ্যে।

সিদু অবাক হয়ে ভাবে, যে মেয়ে পায়ের সমস্যায় ঘরে বন্দি, সে কীকরে চারপাশের প্রকৃতির এতো খুঁটিনাটি জানতে পারে। পুইমা বলে, কেনো, এ আবার কী প্রশ্ন, তার মা যখন বেঁচে ছিলো মায়ের পিঠে কাপড়ে বাঁধা অবস্থায় ঘুরে ঘুরে সে কি সব দেখেনি, বাবার কাঁধে চড়ে বা কোলে চড়েও সে কি কম ঘুরেছে ছোটবেলায়, আর এই পাহাড়-নদী-ঝরনা-মহীরুহ এগুলোর মধ্যে কি তার, শুধু তার নয়, তাদের সবার মরে-যাওয়া আপন জনেরা বেঁচে নেই, তাই এই পাহাড়-নদী-ঝরনা-মহীরুহ তো কেবল ওই বাইরে আছে তা নয়, তা তার মনের ভিতরেও আছে। যেচুঙ-এর দুই-কামরা-ঘরের বাইরের কামরায় মাচা-খাটে শুয়ে-বসে সিদু এখন পুইমার  মনের মধ্যে ট্রেক করতে করতে পাহাড়-নদী-ঝরনা-জঙ্গল চিনতে শেখে।

আর কয়েকদিন পর, সিদু যখন হাঁটার মতো অবস্থায় এলো, তখন শুরু হলো আরেক খেলা। পুইমা তাকে বলে কোন নদী পেরিয়ে খাড়াইয়ের উপর আশ্চর্য এক পাথরখণ্ড আছে, কোথায় বনের মধ্যে সেই গাছ আছে যার রডোডেনড্রনের রঙ সবচেয়ে লাল, সাদা রডোডেনড্রনের গাছ কতোটা চড়াই উঠলে প্রথম দেখা যাবে, কোন দীঘিটার পাশে বিকেলে পাখির মেলা বসে, কোথায় কোন ঝরনাটা তাদের আদিমাতার খোলা চুল, পাহাড়ের কোন বাঁকে দাঁড়িয়ে দেখলে কাঞ্চনজঙ্ঘার গায়ে প্রথম আলোর আদর ফুটে উঠতে দেখা যায়, পাহাড়ের কোন ঢালে ঘাসের চাদর শিশির মেখে চাঁদের আলোকে নামিয়ে এনে নিবিড় আলিঙ্গনে জড়িয়ে থাকে…. আর সিদু তা পরখ করতে যায়, অবাক হয়ে ফেরে, পুইমার প্রতিটা বর্ণনা অক্ষরে অক্ষরে মিলে যায়।

 

কুড়ি বছর আগে  

পুইমা এখন কলকাতায় থাকে, কংক্রিটের জঙ্গলের মধ্যে ভাসমান একটা ছোটো ফ্ল্যাটে। বছর পঞ্চান্ন আগে তার সঙ্গে সিদুর বিয়ে হয়েছিলো। তাদের রীতিতেই বিয়ে হয়েছিলো। কলেজের ডিগ্রি হাসিল করার পর সিদু অন্যসব সুযোগের তোয়াক্কা না করে তাদের গ্রামের কাছে একটা স্কুলে পড়ানোর চাকরি নিয়ে চলে গিয়েছিলো। যেচুঙ-এর কাছে পুইমাকে বিয়ে করার  প্রস্তাব দিয়েছিলো। যেচুঙদের সমাজ প্রথমে সমাজের বাইরে বিয়েতে আপত্তি করেছিলো, কিন্তু তারপর পুইমা-র ইচ্ছের কথা জেনে সম্মতি দিয়েছিলো। গোটা গ্রাম সিদুকে নিজেদের মতো করেই নিয়েছিলো সেই বিয়ের দিন। সিদু আর পুইমা সেই গ্রামেই থাকতো নিজেদের একটা ঘর বানিয়ে নিয়ে ওই যেচুঙ-এর ঘরের পাশেই। বিয়ের দুইবছরের মাথায় তাদের এক ছেলে হলো, তার নাম তারা রেখেছিলো কাঞ্চন। আর বিয়ের কুড়ি বছর পর সিদুর ব্লাড-ক্যান্সার রোগ ধরা পড়লো। চিকিৎসার সুবিধার জন্য তাদের সবাইকে চলে আসতে হলো কলকাতায়। সিদুর নিজের বাবার বাড়িতে শরিকি প্যাঁচপয়জারে তাদের জায়গা হলো না। ঘিঞ্জি এলাকায় এই ছোট ফ্ল্যাট কিনে তাদের উঠতে হলো। বছর তিনেকের মধ্যেই সিদু মারা গেলো। কেমোথেরাপির অসহ্য যন্ত্রণা সে পুইমার মুখে পাহাড়-ঝরনা-মহীরুহের কথা শুনেই ভুলে থাকতো, তাদের বাইরের এই অসহ্য পৃথিবীর খোলসটা ভেঙে বেরোতে পারলেই সেই জগৎ যে চিরন্তন বহমান এ বিশ্বাস তাদের ছিলো।

কাঞ্চনের সদ্য ছেলে হয়েছে। পুইমা এখন তার এই নাতিকে আগলে রাখে। এক বছরের বাচ্চার গা-হাত-পায়ে ডলে ডলে তেল মালিশ করে রোদ পোয়াতে পোয়াতে সে অনর্গল সেই পাহাড়-ঝর্ণা-মহীরুহের বর্ণনাই আউড়ে যায়।

বর্তমান সময়

পুইমার নাতির বয়স এখন কুড়ি পেরিয়েছে। পুইমা মারা গেছে বছরকয়েক হলো। ঠাকুমার কাছে নিরন্তর শোনা পাহাড়-ঝর্ণা-মহীরুহের কথা মিলিয়ে দেখতে নাতি এসেছে ট্রেক করে সেই গ্রামে। সে ট্রেক করছে। ট্রেক করছে। পুইমার বলা পাথর-গাছ-পাহাড় খুঁজে ফিরছে। কিন্তু তার অভিজ্ঞতা হচ্ছে সিদুর বিপরীত। কিছুই সে মেলাতে পারছে না। গোটাটাই তো এখন টুরিস্ট হাব। চারচাকা ছুটে চলে নিরন্তর। বৈদ্যুতিক আলো ফ্যাকাসে অগভীর করে তুলেছে সব রাত্রি আর সন্ধ্যাগুলোকে। নেশা ও ফুর্তির হুল্লোড়। বিকিকিনি বাণিজ্য সবকিছু নিয়ে। একটা কথা, একটা হাসিরও দাম ধরতে শিখে নিয়েছে সবাই। কী অসীম ক্ষমতাবলে পাহাড়গুলোকেও যেন বিজ্ঞাপনী হোর্ডিংয়ে পরিণত করা হয়েছে। কিছুই সে মেলাতে পারে না। তার দাদু আর ঠাকুমা--- সিদু আর পুইমা--- সত্যিই কি তারা অন্য এক জগৎ দেখেছিলো, নাকি গোটাটাই তাদের কল্পনা ছিলো?

পুইমার নাতি ট্রেকিং পথের এক রেস্তোঁরায় বসে। জানালার ধারে। জানালা দিয়ে বাইরে দেখা যাচ্ছে নিওন আলোর সাজ। লাগাতার গড়িয়ে চলেছে চার-চাকা-গাড়ি-ছোটার শব্দ। এক গ্লাস রাম দুহাতে আঁকড়ে ধরে পুইমার নাতি চোখ বুজে বসে থাকে, সে বুঝি কল্পনায় তার দাদু-ঠাকুমার জগতে ডুবতে ডুবতে তার চারপাশের জগৎ থেকে বিদায় নিতে থাকে।

 

বিপ্লব নায়ক

আগস্ট, ২০২৫

0 Comments
Leave a reply