নাস্তিকতার প্রয়োজনীয়তা

লিখেছেন:পারসি বিশি শেলি
১৮১১ সালে শেলি এই লেখাটি ইংরেজি ও ফরাসি ভাষায় প্রথম প্রকাশ করেছিলেন। একদিকে যেমন তিনি বিশ্বাস-অতিকথা-কল্পনার চেয়ে যুক্তিনিষ্ঠ বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানকে অধিক বৈধতাপ্রদান করতে চেয়েছেন, অন্যদিকে তেমনই নাস্তিকতাবাদ ও সর্বেশ্বরবাদের এক গা-ঘেঁষাঘেষি সহাবস্থান হাজির করেছেন। বাংলা তর্জমায় লেখাটি এখানে হাজির করা হল।

নাস্তিকতার প্রয়োজনীয়তা

পারসি বিশি শেলি

বাংলা তর্জমা: বিপ্লব নায়ক

ঈশ্বর বলে কিছু নেই

কেবলমাত্র দেবত্বারোপে নির্মিত ঈশ্বরের অস্তিত্বই এখানে নাকচ করা হচ্ছে। গোটা বিশ্বব্রক্ষ্মাণ্ডের সঙ্গে সহ-অস্তিত্বধারী ছেয়ে-থাকা আত্মা বিষয়ক অনুমান নাকচ হচ্ছে না।

কোনো প্রস্তাবের সমর্থনে হাজির করা প্রমাণসমূহের যথার্থতা নিবিড়ভাবে বিচার করে নেওয়াই হল সত্যে পৌঁছানোর একমাত্র বিশ্বস্ত উপায়, যার উপযোগিতা বিশদীকরণ করার মনে হয় দরকার নেই। দেবতার অস্তিত্ব সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান এতটাই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় যে যত খুঁটিয়েই তা বিচার করা হোক না কেন আতিশয্য হবে না--- তাই আমরা দেবতার অস্তিত্ব সম্পর্কে হাজির করা প্রমাণগুলো সংক্ষেপে নিরপেক্ষভাবে বিচার করার দিকে এগোব। সেইজন্য প্রথমে বিশ্বাসমতের চরিত্র বিবেচনা করা প্রয়োজন।

মগজের সামনে যখন কোনো প্রস্তাব উপস্থাপিত হয়, সেই প্রস্তাব গঠনকারী ধারণাগুলোর সঙ্গে মতৈক্য বা মতভেদ বোধ উৎপন্ন হয়। মতৈক্য বোধ উৎপন্ন হওয়াকে বলে বিশ্বাস জাগা। তৎক্ষণাৎ বোধ উৎপন্ন হওয়ার পথে্ প্রায়শই নানা বাধা এসে দাঁড়ায়, মগজ সেই বাধাগুলোকে অপসারণ করার চেষ্টা চালিয়ে যায় যাতে বোধটি স্বতন্ত্র রূপ ধারণ করতে পারে। প্রস্তাবটির উপাদানস্বরূপ বিভিন্ন ভাবনাগুলোর মধ্যেকার আন্তঃসম্পর্ক নিখুঁতভাবে অনুধাবন করার জন্য মগজ সক্রিয় হয়ে ওঠে, প্রস্তাবটি হয় নিষ্ক্রিয়--- এই বিচারপ্রক্রিয়ার সঙ্গে উৎপাদিত বোধকে গুলিয়ে ফেলার জন্যই অনেকে ভুলবশত কল্পনা করে থাকেন যে বিশ্বাসমতের মধ্যে মগজ সক্রিয় থাকে। ভুলবশতই তাঁরা মনে করেন যে বিশ্বাস করা একটি স্বতঃক্রিয়া, আর সেই সূত্র ধরেই তাঁরা ভাবেন যে বিশ্বাসমতকে মগজের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এই ভ্রান্তির পিছনে ছুটে, এই ভ্রান্তিকেই আরো বাড়িয়ে নিয়ে গিয়ে তাঁরা অবিশ্বাস করার উপর একটি গর্হিত অপরাধসূচক মাত্রা আরোপ করেছেন। অবিশ্বাস করার কর্মটি তার নিজ চরিত্রানুযায়ী কোনো গর্হিত অপরাধ নয়, ঠিক যেমন তা কোনো বিশেষ গুণও নয়।

সুতরাং, বিশ্বাস হল এক আবেগ বিশেষ, অন্যান্য সমস্ত আবেগের মতোই যার শক্তি উত্তেজনার মাত্রার সমানুপাতিক।

উত্তেজনার মাত্রার তিনটি স্তর হতে পারে:

  • মগজের কাছে সমস্ত জ্ঞানের উৎস হল ইন্দ্রিয়, ফলে ইন্দ্রিয়দের সাক্ষ্যই সবচেয়ে শক্তিশালী সম্মতি দাবি করে।
  • আমাদের নিজেদের অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে এহেন উৎস থেকে উৎপন্ন মগজের সিদ্ধান্তগুলো পরবর্তী মাত্রার হয়।
  • স্বঅভিজ্ঞতাজাত সিদ্ধান্তের সাপেক্ষে উপস্থাপিত হওয়া অপরজনেদের অভিজ্ঞতা সবচেয়ে নীচের মাত্রায় থাকে।

(ইন্দ্রিয়ের পরীক্ষার মুখোমুখি হতে পারার সক্ষমতার বিচারে প্রস্তাবাদিকে ক্রমমাত্রায় বিভক্ত মাপকাঠিতে বিন্যস্ত করতে পারে এমন এক মাপনযন্ত্রই বিশ্বাসের যথার্থ মাপক হিসেবে প্রতিটি বিশ্বাসের গায়ে লাগানো থাকা উচিত।)

তাই, এমন কোনো সাক্ষ্যই বরদাস্ত করা যেতে পারে না যা যুক্তির পরিপন্থী, যেহেতু যুক্তি আমাদের ইন্দ্রিয়ের সাক্ষ্যের উপর ভর করে থাকে।

যে কোনো প্রমাণই এই তিনটি বিভাগের মধ্যে একটিতে ফেলা যেতে পারে: কোন প্রমাণ দেবতার অস্তিত্বের পক্ষে কী সওয়াল হাজির করছে সেটাই আমাদের বিবেচনা করে দেখতে হবে।

প্রথমে ধরা যাক ইন্দ্রিয়গত সাক্ষ্যের কথা। দেবতা যদি আমাদের সামনে আবির্ভূত হতে পারে, তার অস্তিত্ব বিষয়ে আমাদের ইন্দ্রিয়সকলকে নিঃসন্দেহ করতে পারে, তবে তা আবশ্যিকভাবেই আমাদের বিশ্বাস উৎপন্ন করবে। যাদের কাছে দেবতা এরূপে আবির্ভূত হয়েছে, তাদের মধ্যেই দেবতার অস্তিত্ব সম্পর্কে সবচেয়ে দৃঢ় বিশ্বাস বিরাজ করছে। কিন্তু ধর্মতত্ত্ববিদদের ঈশ্বর এহেন স্থানীয় আবির্ভাবে সক্ষম নয়।

দ্বিতীয়ত ধরা যাক যুক্তির কথা। দাবি করা হয়ে থাকে যে মানুষের জানা যে কোনো কিছুরই হয় কোনো নির্দিষ্ট সূচনা আছে, নয়তো তা আদি অনন্ত কাল ধরে অস্তিত্বমান। এটাও মানুষ জানে যে যা চির-অস্তিত্বমান নয়, তার অস্তিত্বের কোনো না কোনো কারণ থাকতে হবে। এই যুক্তি যদি বিশ্বব্রক্ষ্মাণ্ডের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়, তাহলে প্রমাণ করা আবশ্যিক হয়ে ওঠে যে বিশ্বব্রক্ষ্মাণ্ডও কোনো না কোনো ভাবে সৃষ্টি করা হয়েছিল: যতক্ষণ না তা প্রমাণ করা যাচ্ছে ততক্ষণ আমরা ধরে নিতে বাধ্য যে তা আদি অনন্ত কাল ধরেই টিকে আছে। সৃষ্টিকারী সম্পর্কে কোনো অনুমান করার আগে আমাদের প্রমাণ করতে হবে যে বিশ্বব্রক্ষ্মাণ্ড কোনো এক নির্দিষ্ট নকশা অনুযায়ী তৈরি হয়েছে। নিয়ম, কারণ, বা নকশার রূপ সম্পর্কে ধারণা কেবলমাত্র আমরা বস্তুসমূহের নিরন্তর সংযোগ বা যুগপৎ সংঘটনের মধ্য থেকেই করতে পারি এবং সেই সূত্রেই এক থেকে অন্যের কারণ বা যুক্তি নির্মাণ করতে পারি। ভিত্তিমূলে সম্পূর্ণ পরস্পরবিরোধী দুটি প্রস্তাবের সম্মুখীন হলে, যেটির অবোধ্যতার মাত্রা কম, অর্থাৎ তুলনায় যেটি সহজবোধ্য, সেটিতেই মগজ বিশ্বাস করে--- বিশ্বব্রক্ষাণ্ডের সীমার বাইরে এমন এক অস্তিত্ব যা বিশ্বব্রক্ষ্মাণ্ড সৃষ্টি করতে সক্ষম তা কল্পনা করার চেয়ে বিশ্বব্রক্ষাণ্ড আদি অনন্ত কাল ধরে চির-অস্তিত্বমান, এটা ধরে নেওয়া অনেক সহজ: কোনো কল্পনার ভারে মগজের ভরাডুবি হওয়ার উপক্রম হলে সেই ভারের অসহনীয়তা আরো বাড়িয়ে তোলা কি কোনো উপশমের উপায় হতে পারে? 

মানুষের নিজ অস্তিত্ব সম্পর্কিত জ্ঞানের ভিত্তিতে দাঁড়ানো অপর যুক্তিটি কী তা এখন দেখা যাক। সে যে এখন অস্তিত্বমান, মানুষ শুধু এটুকুই জানে না, এটাও জানে যে একসময়ে তার কোনো অস্তিত্ব ছিল না; সুতরাং তার কোনো একটা কারণ না থাকলেই নয়। কিন্তু কারণ-নির্ধারণ বিষয়ে আমাদের ধারণা কেবলমাত্র বস্তুসমূহের নিরন্তর সংযোগ ও যুগপৎ সংঘটনের থেকে অনুমিত হয়ে তদ্বারা একের থেকে অপর সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত টানার উপর নির্ভরশীল; কোনো ফলাফল থেকে আমরা কেবল তার জন্য যথেষ্ট কারণগুলো অনুমানই করতে পারি। কিছু কিছু যন্ত্রাদি নিজস্ব প্রভাব উৎপন্ন করে, তা সেই যন্ত্রাদির মধ্যে নিহিত বলে প্রমাণ করা আমাদের পক্ষে অসম্ভব, তার উল্টোটাও প্রমাণ করা অসম্ভব: সুতরাং আমরা মেনে নিতে বাধ্য যে প্রভাবোৎপাদনকারী ক্ষমতা আমাদের ধারণাশক্তির অতীত একটি বিষয়। কিন্তু সেই সুবাদে এহেন অনুমান যদি আমরা করে বসি যে ওই প্রভাব কোনো এক চিরন্তন সর্বজ্ঞ সর্বশক্তিমান সত্তার দ্বারা উৎপন্ন হয়েছে, তবে তা ধোঁয়াশা কিছুমাত্র কাটায় না, বরং সবকিছুকে আরো অবোধ্য করে তোলে। তৃতীয়ত, ধরা যাক সাক্ষ্যপ্রমাণের কথা। সাক্ষ্যপ্রমাণ যুক্তির পরিপন্থী হবে না এটাই দস্তুর। দেবতা তার অস্তিত্ব সম্পর্কে মানুষদের ইন্দ্রিয়সমূহের সমস্ত সন্দেহের নিরসন ঘটিয়েছে এমনটা কেবল আমরা নিজেরা স্বীকার করতে পারি যদি সেই মানুষদের কাছে দেবতার দর্শন দেওয়ার তুলনায় তাদের বিভ্রমের স্বীকার হওয়া বেশি সম্ভবপর হয়। যেসব মানুষ অলৌকিক ঘটনা চাক্ষুষ করার দাবি করেন, কেবল তাই নয়, দেবতাকেও যুক্তির ঊর্ধ্বে বলে মনে করেন, তাদের সাক্ষ্য মেনে নেওয়া আমাদের যুক্তিবোধের পক্ষে সম্ভব নয়। তাদের ভাবনামতে, দেবতা নির্দেশ দিচ্ছেন তার অস্তিত্বে বিশ্বাস করার জন্য, এমনকি সেই বিশ্বাসে বিশ্বস্ত থাকার জন্য সর্বোচ্চ পুরস্কারেরও আশ্বাস দিচ্ছেন এবং অবিশ্বাসের জন্য অনন্ত শাস্তিভোগের হুমকি দিচ্ছেন। কিন্তু নির্দেশ দ্বারা সংঘটিত তো কেবল ঐচ্ছিক ক্রিয়াকেই করা যায়, বিশ্বাস করা তো কোনো ঐচ্ছিক ক্রিয়া নয়, মগজ সর্বদা নিষ্ক্রিয় অথবা অনৈচ্ছিকভাবে সক্রিয় থাকে। এর থেকে স্পষ্ট যে ঐশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করার মতো যথেষ্ট সাক্ষ্য নেই, বা অন্যভাবে বললে, যা সাক্ষ্য আছে তা ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট নয়। পূর্বেই দেখানো হয়েছে যে তা যুক্তি দিয়ে সিদ্ধান্ত করা যায় না। কেবলমাত্র যেজন ইন্দ্রিয়ের সাক্ষ্যে সন্তুষ্ট, সে-ই এমন বিশ্বাস ধারণ করতে পারে।

সুতরাং, স্পষ্টতই, বিশ্বাসোৎপাদনের তিনটি উৎসের কোনোটা থেকেই কোনো প্রমাণ না থাকার ফলে মগজ কোনো সৃষ্টিশীল ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করতে পারে না: এটাও স্পষ্ট যে বিশ্বাস যেহেতু মগজের একটি আবেগ বিশেষ, অবিশ্বাসের গায়ে কোনো অপরাধ-মাত্রার তকমা লাগিয়ে দেওয়া যায় না। কোনো বিবেচনার বিষয়কে কারো মগজ যে মাধ্যমের মধ্য দিয়ে অবলোকন করে, সেই মাধ্যম যদি ভ্রান্ত হয়, তাহলে সেই মাধ্যম সরিয়ে ফেলার কাজ উপেক্ষা করে যারা, কেবল তারাই তিরস্কারযোগ্য হতে পারে। বিবেচনাকারী প্রতিটি মগজেরই স্বীকার করে নেওয়া উচিত যে দেবতার অস্তিত্বের কোনো প্রমাণ হতে পারে না।

ঈশ্বর হল একটি অনুমান, আর তাই তা প্রমাণসাপেক্ষ: প্রমাণের দায় আস্তিকের উপরই বর্তায়। স্যার আইজাক নিউটন বলেছেন:

Hypotheses non fingo, quicquid enim ex phaenomenis non deducitur hypothesis, vocanda est, et hypothesis vel metaphysicae, vel physicae, vel qualitatum occultarum, seu mechanicae, in philosophia locum non habent. [আমি অনুমান গঠন করি না, কারণ যা ঘটনা থেকে সিদ্ধান্ত করা হয় না তাকে অবশ্যই একটি অনুমান বলা উচিত, এবং অধিবিদ্যা, বা পদার্থবিদ্যা, বা গুপ্তগুণ বা যন্ত্রবিদ্যার অনুমানগুলির দর্শনে কোনও স্থান নেই।]

এই মূল্যবান বিধিটি সৃষ্টিশীল ঈশ্বরের অস্তিত্বের সবরকম প্রমাণপ্রচেষ্টার উপরও আমরা প্রয়োগ করতে পারি। আমরা দেখতে পাব যে বহুবিবিধ ক্ষমতার অধিকারী বিবিধ শরীরের কথা বলা হয়: কেবল তাদের প্রভাবগুলোই আমরা জানতে পারি, তাদের অন্তঃসার ও হেতু বিষয়ে কোনোকিছুই জানা যায় না। একেই নিউটন বস্তুদের প্রতীতি (phenomenon of things) বলেছেন। কিন্তু দর্শন এতই আত্মম্ভরী যে তা এদের হেতু বিষয়ে তার অজ্ঞতা স্‌বীকার করতে চায় না। তাই এই প্রতীতি থেকে নাছোড়ভাবে একটি হেতু অনুমান করে নিয়ে তাকেই ঈশ্বরের অভিধায় অভিহিত করে, আহ্লাদিতভাবে তার উপর সমস্ত নঙর্থক ও পরস্পর-বিরোধী গুণাবলী আরোপ করে দেওয়া হয়। হেতু ও অন্তঃসার সম্পর্কে আমাদের অজ্ঞতাকে ঢেকে রাখতেই আমরা এহেন অনুমান থেকে আমরা ঈশ্বর নামক এই সাধারণ নামটি তৈরি করেছি। পূর্বোদ্ধৃত উক্তিতে নিউটন যে সমস্ত শর্তের পরামর্শ দিয়েছেন, তার কোনোটাই ঈশ্বর নামক বস্তুটির ক্ষেত্রে খাটে না, বরং তা দার্শনিক আত্মশ্লাঘায় বোনা এমন এক পর্দার চরিত্র ধারণ করে যা এমনকি দার্শনিকদের নিজেদের কাছ থেকেও তাদের অজ্ঞতাকে সযতনে আড়াল করে রাখে। মনুষ্যরূপারোপ (anthropomorphism)-এর অধম তন্তু ধার করে এই পর্দা বোনা হয়েছে। এই একই উদ্দেশ্যে শব্দদের ব্যবহার করে এসেছেন নৈয়ায়িকরা--- আরিস্ততেলিয় দার্শনিকদের গুহ্য গুণাবলী থেকে বয়েল(Boyle)-এর পচাবাষ্প (effluvium) ও হার্শেল(Herschel)-এর ক্রিনিটিজ বা নীহারিকা(nebulae) অবধি। ঈশ্বরকে অসীম, চিরায়ত, অজ্ঞেয় বলে হাজির করে আসা হয়েছে; অজ্ঞতার যুক্তি যত রকম ফন্দি আঁটতে পারে সবরকমভাবেই তাঁর বিধেয় পদ তৈরি করা হয়েছে। এমনকি যারা তাঁকে পুজো করে তারাও স্বীকার করতে বাধ্য হয় যে তাঁর সম্পর্কে কোনো ধারণা তৈরি করা অসম্ভব, ফরাসি কবির প্রতিধ্বনি করে তারা বিস্ময়ে বলে:

Pour dire ce qu’il est, il faut etre lui-meme [তিনি কী তা বলতে গেলে আপনাকে নিজেকেই তা হতে হবে]

লর্ড বেকন বলেছেন: যুক্তি, দর্শন, স্বাভাবিক কর্তব্যবোধ, বিধি, খ্যাতি ও যা কিছু মানুষকে গুণের পথে চালিত করতে পারে, তা সবই নাস্তিকতা থেকে মানুষ পেতে পারে; কিন্তু, অন্ধবিশ্বাস এই সমস্তকিছুকেই ধ্বংস করে দিয়ে মানুষের উপর এক স্বৈরতান্ত্রিক শাসন কায়েম করে, যেজন্য নাস্তিকতা কখনোই সরকারকে বিরক্ত করে না, বরং মানুষকে তা আরো স্পষ্টদ্রষ্টা করে তোলে যেহেতু বর্তমান জীবনের গণ্ডীর বাইরে কোনোকিছুতেই তার দৃষ্টি থাকে না। (Moral Essays, Francis Bacon)

মানুষের প্রথম ধর্মতত্ত্ব মানুষকে প্রথম প্রকৃতির অমার্জিত জড় বস্তু রূপী বিভিন্ন উপাদানকে ভয় ও ভক্তি করতে শিখিয়েছিল। তারপরে সে এই উপাদানগুলির নিয়ন্ত্রক হিসেবে ইতর প্রেতাত্মা, মহান নায়ক বা মহাগুণবিশিষ্ট মানুষদের কল্পনা করে নিয়ে তাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে শুরু করল। এরপর সে ভাবনা প্রয়োগে সরলীকরণ করে নিতে চাইল সমস্ত প্রকৃতিকে এমন এক একমেবাদ্বিতীয়ম কর্তা, জীবনীশক্তি, বা, সার্বজনীন আত্মার বশীভূত বলে ধরে নিয়ে, যে একমেবাদ্বিতীয়ম প্রকৃতির সমস্ত শাখায় নিরন্তর গতি সঞ্চার করে চলেছে। এক হেতু থেকে অন্য হেতুতে আরোহণ করতে করতে, নশ্বর মানুষ আর কোনোকিছু দেখতে না পাওয়ার অন্ধকারে এসে পৌঁছেছে আর এই অন্ধকারেই সে তার ঈশ্বরের আসন পেতেছে, তমসাচ্ছন্ন এই খাদে মানুষের অস্বস্তিতে-পড়া কল্পনাশক্তি অবিরত উদ্ভট কল্পনাজাল বুনে গেছে, আর এই কল্পনাজাল মানুষকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখবে যতক্ষণ না প্রকৃতি সম্বন্ধে মানুষের জ্ঞান এই অতি আদুরে ভূতপ্রেতগুলোকে তাড়িয়ে তার মগজসীমার বাইরে খেদিয়ে দিতে পারে।

দেবত্ব সম্পর্কে আমাদের ধারণাগুলো ব্যাখ্যা করতে চাইলে এ কথা মানতে আমরা বাধ্য যে ‘ঈশ্বর’ শব্দটির মধ্য দিয়ে মানুষ তার দেখা ঘটনাপ্রভাবগুলোর সবচেয়ে অন্তরালবর্তী, সবচেয়ে দূরবর্তী ও সবচেয়ে অজানা হেতুকে চিহ্নিত করা ছাড়া আর কিছু করেনি। মানুষ তার এই শব্দটি ব্যবহার করেছে যখনই প্রাকৃতিক ও পরিচিত হেতুগুলোর ক্রিয়া আর তার কাছে দৃশ্যমান থাকেনি, যখনই হেতুসমূহের রাশ তার হাত ছেড়ে বেরিয়ে গেছে, বা, হেতুশৃঙ্খলা অনুসরণ করার কাজ আর তার মগজের পক্ষে সম্ভব হয়নি। তখনই সে তার অন্বেষণে ইতি টেনে সমস্যার সমাধান করেছে ঈশ্বরকে এমনই এক চূড়ান্ত হেতু বলে খাড়া করে যা তার জানা অন্য সকল হেতুর ঊর্ধ্বে। এভাবে তার জ্ঞানের সীমা বা তার আলস্য যেখানে তার গতি রুদ্ধ করে দিয়েছে, সেই অজানা হেতুকে এক ধোঁয়াশাপূর্ণ নামে অভিহিত করা ছাড়া আর কিছুই সে করেনি। যখনই আমরা বলি যে ঈশ্বর কোনো প্রতীতির প্রবর্তক, সেই প্রতিটি ক্ষেত্রই আসলে দেখিয়ে দেয় যে সংশ্লিষ্ট প্রতীতি কীভাবে আমাদের জানা প্রাকৃতিক বল বা হেতু দ্বারা প্রবর্তিত হয় তা সম্পর্কে আমরা সম্পূর্ণ অজ্ঞ। আর এই জন্যই সাধারণ মানুষ, অজ্ঞতাই যাদের ভবিতব্য, দেবতাদের কাজ বলে ধরে নেয় কেবলমাত্র অদ্ভুত মনে হওয়া ঘটনাপ্রভাবগুলোকেই নয়, বরং কিছুটা বিচার-বিবেচনার মধ্য দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় এমন অতি সরল ঘটনাবলীকেও। এক কথায় বললে, মানুষ সর্বদাই এমন সব অজানা হেতু ও বিস্ময়কর ঘটনাপ্রভাবকে সম্মান করে এসেছে যাদের রহস্য-পর্দা তার নিজের অজ্ঞতার সুতোতেই বোনা হয়েছে। ভগ্নস্তূপে পরিণত করা এই প্রকৃতির উপরই দেবতার বিপুলকায় কল্পমূর্তি মানুষ গড়ে তুলেছে।

প্রকৃতি সম্পর্কে অজ্ঞতা যদি ঈশ্বরদের জন্ম দিয়ে থাকে, প্রকৃতি সম্পর্কে জ্ঞান তাহলে ঈশ্বরদের ধ্বংসের জন্য তৈরি। যে মাত্রায় মানুষ নিজেকে শিক্ষিত করে তোলে, তার জ্ঞান তার শক্তি ও সংগতি বাড়িয়ে তুলতে থাকে, বিজ্ঞান-নন্দনচর্চা-শিল্পোদ্যোগ এসে তার হাত ধরে, সেই মাত্রাতেই অভিজ্ঞতা তার মনে জোর জোগায়, বহু ঘটনাপ্রবাহ প্রতিরোধের উপায় আয়ত্তে আসার ফলে সেগুলো সম্পর্কে ভীতি মুছে যায়, বোঝাবুঝি তৈরি হয়। যে মাত্রায় তার মগজ আলোকিত হয়ে ওঠে সেই মাত্রাতেই তার আতঙ্ক মুছে যেতে থাকে। শিক্ষিত মানুষ আর অন্ধবিশ্বাসে আচ্ছন্ন থাকে না।

এক প্রজন্ম থেকে পরের প্রজন্মে মুখের কথার মধ্য দিয়ে সঞ্চারিত হতে থাকা জনশ্রুতির প্রভাবেই আপামর মনুষ্যগোষ্ঠী তাদের পিতৃপুরুষদের এবং পুরোহিতদের ঈশ্বরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে ওঠে, প্রমাণের মধ্য দিয়ে দৃঢ় বিশ্বাস অর্জনের বদলে প্রাধিকার-পরম্পরা-আস্থা-আত্মসমর্পণ-এ অভ্যস্ত হয়ে ওঠে, তখন তারা কেবল নতজানু হয়ে প্রার্থনা করে: কিন্তু তাদের পিতৃপুরুষরা নতজানু হয়েছিল কেন? পিতৃপুরুষেরা নতজানু হয়েছিল কারণ সেই আদিম সময়ের নীতিপ্রবর্তক ও পথপ্রদর্শকরা সেটাকেই কর্তব্য বলে নির্ধারণ করেছিল। ‘শ্রদ্ধা কর এবং বিশ্বাস কর,’ তারা বলেছিল, ‘এই ঈশ্বর তোমাদের জানাবোঝার অতীত, ঈশ্বর সম্পর্কে আমরা তোমাদের চেয়ে অনেক বেশি জানি, আমাদের গভীর জ্ঞানে আস্থা রাখ।’ কিন্তু কেন আমি তোমার মুখাপেক্ষী হব? হতে হবে কারণ তা ঈশ্বরের ইচ্ছা, তা অমান্য করার ঝুঁকি নিলে ঈশ্বর তোমায় শাস্তি দেবে। কিন্তু যে ঈশ্বরকে নিয়ে এত প্রশ্ন, শুরুতেই তাকে মেনে নিলে আর প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হয় কি? মানুষ এই রুদ্ধ বৃত্তের মধ্যেই বারবার ঘুরে মরেছে, তার চিন্তার আলস্য সবসময় তার কাছে অন্যদের করে দেওয়া বিচার-বিধান মেনে নেওয়াকেই সহজতর বলে বোধ করেছে। সমস্ত ধর্মপ্রবণ জাতিই কেবলমাত্র প্রাধিকারের জোরে প্রতিষ্ঠিত, পৃথিবীর সমস্ত ধর্মই নিজস্ব বিচার-বিবেচনা করাকে নিষিদ্ধ করে এবং চায় না যে কেউ যুক্তি অবলম্বন করুক; প্রাধিকারী চায় যে সকলে ঈশ্বরে বিশ্বাস করুক, এই ঈশ্বরও তো এমন গুটিকয় মানুষের প্রাধিকারী ক্ষমতার উপর প্রতিষ্ঠিত যারা ঈশ্বরকে জানার ভান করে ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবে এই জগতে ঈশ্বরের কথা ঘোষণা করার দাবি করে থাকে। মানুষ যে ঈশ্বরকে বানিয়েছে, নিশ্চিতভাবেই মানুষের সাহায্য ছাড়া তিনি মানুষের কাছে নিজেকে জানান দিতে পারেন না।

তাহলে, এই যে পুরোহিত, প্রত্যাদিষ্ট ও আধিবিদ্যক চিন্তকের দল বলে থাকেন যে ঈশ্বরের অস্তিত্বে দৃঢ় বিশ্বাস সকল মানুষের ক্ষেত্রেই অতীব জরুরী, আসলে তা কি কেবল তাঁদের নিজেদের জন্যই জরুরী নয়? কিন্তু পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন প্রত্যাদিষ্ট চিন্তকদের ধর্মতাত্ত্বিক মতের কোনো সমতান কি খুঁজে পাওয়া সম্ভব? এই যাঁরা একমেবাদ্বিতীয়ম ঈশ্বরকে শ্রদ্ধা করা বা করানোকেই নিজেদের পেশা করে তুলেছেন, তাঁদের নিজেদের মধ্যে কি কোনো ঐকমত্য আছে? ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণ হিসেবে তাঁদের কোনো একজন যা তুলে ধরেন, তা নিয়ে কিয়ে অন্যরা সন্তুষ্ট থাকতে পারেন? প্রকৃতি সম্পর্কে, ঈশ্বরের আচরণ সম্পর্কে, বা ঈশ্বরের তথাকথিত দৈববাণী সম্পর্কে তাঁদের কেউ একজন যে ব্যাখ্যা হাজির করেন, তাঁদের সবাই কি তা মেনে নিতে পারেন? এমন কোনো দেশ কি পৃথিবীর বুকে আছে যেখানে ঈশ্বর সম্পর্কিত বিজ্ঞান সত্যিই নিখুঁত রূপ ধারণ করেছে? সম্পূর্ণ নিখুঁত না হলেও, মানুষদের অন্যান্য বিষয়, এমনকি সবচেয়ে তুচ্ছ, সবচেয়ে ঘৃণিত কাজকর্ম সম্পর্কিত বিজ্ঞানও যে সামঞ্জস্য ও সমরূপতা দেখায়, তা-ও কি অর্জন করতে পেরেছে? মন, সৃষ্টি, অদৃষ্ট, ঈশ্বরের কৃপা, ইত্যাদি যেসব অতিসূক্ষ্ম ধারণা ও পার্থক্যীকরণ সূচক শব্দাবলীতে ধর্মতত্ত্ব সর্বত্র ঠাসা, এই যে অতি-উদ্ভাবনীশক্তির ফসলগুলো চিন্তকরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম এতগুলো শতক ধরে পর্যায়ক্রমে হাজির করেছেন, দুর্ভাগ্যবশত, তা আরো বেশি ধোঁয়াশাই তৈরি করতে করতে গেছে, কখনোই মানুষের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় এই বিজ্ঞানটিকে ন্যূনতম নির্দিষ্ট আকারে বাঁধতে পারেনি। হাজার হাজার বছর ধরে একজন অলস স্বপ্নদ্রষ্টাকে অব্যহতি দিয়ে আরেকজন অলস স্বপ্নদ্রষ্টা দেবত্ব বিষয়ে চিন্তা করেছেন, দেবতার গুহ্য অভিপ্রায়কে বোঝার চেষ্টা করেছেন, ঈশ্বর নামক গুরুত্বপূর্ণ ধাঁধা সমাধানে যথাযোগ্য অনুমানটি আবিষ্কার করতে চেয়েছেন। তাঁরা যে তোমন কোনো সাফল্য পাননি, তা দিয়ে অবশ্য ধর্মতাত্ত্বিক শ্লাঘার কিছু যায়-আসে-নি, লোকের গলা কাটা হয়েছে ঈশ্বরের নাম করে, তারপরও এই মহান গরিমময় ঈশ্বরই একইসঙ্গে সবচেয়ে আলোচিত ও সবচেয়ে অজানা বস্তু হিসেবে রয়ে গেছে।

দেবত্ব নিয়ে অনুসন্ধানের কাজে এতাবধি মানুষ যতটা প্রয়াস ব্যয় করেছে, তার অর্ধেকও যদি সে তার চারদিকের দৃশ্যমান বস্তুর উপর নিবদ্ধ রেখে প্রকৃত বিজ্ঞান, বিধি, নীতি-নৈতিকতা ও শিক্ষাকে নিখুঁত করার প্রয়াসে ব্যয় করত, তাহলে মানুষ আজ অনেক সুখে থাকত। সে আরো বুদ্ধিমানের কাজ করত ও সৌভাগ্যের অধিকারী হত যদি এইসব অতলান্ত তল মাপতে গিয়ে মাথা ঘুরে যাওয়া বেকার পথপ্রদর্শকদের নিজেদের মধ্যে বিবাদমগ্ন থাকতে ছেড়ে দিয়ে নিজে ওইসব অর্থহীন বিতর্কে না জড়াত। কিন্তু অজ্ঞতার চরিত্রই এমন যে তা সে অবোধ্য বিষয়ের উপরই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব আরোপ করে বসে। মানুষের আত্মশ্লাঘা এভাবেই তৈরি যে মুশকিলের মুখে পড়লে তা একগুঁয়ে হয়ে ওঠে। কোনো বস্তু যত আমাদের চোখের আড়ালে নিজেকে নিয়ে যেতে চায়, ততই আমরা আত্মগর্বে আঘাত পেয়ে মরীয়া হয়ে উঠি বস্তুটিকে একেবারে আঁকড়ে ধরে সামনে নিয়ে আসার জন্য, বস্তুটিতে ততই আমাদের কৌতূহল ও আগ্রহ বাড়তে থাকে। তার নিজের ঈশ্বরের পক্ষ নিয়ে যখন কেউ লড়ে, তখন সে আসলে নিজের আত্মশ্লাঘার স্বার্থে লড়ছে, আর এই আত্মশ্লাঘা বস্তুটি সমাজের অপকাঠামো প্রসূত সবরকমের আবেগে জ্বলে উঠে সবচেয়ে সহজে অপমান বোধ করে এবং সবচেয়ে বড় ভুলগুলোও সবার আগে করে বসে।

ধর্মতত্ত্ব যে ধরনের প্রতিশোধস্পৃহ ঈশ্বরের ছবি তৈরি করে, যে ঈশ্বরের আংশিক ও অত্যাচারী বিধানগুলোই নাকি মানবপ্রজাতির ভাগ্যনির্ধারণ করে, সেই ছবি ক্ষণেকের জন্য ভুলে আমরা যদি কেবল তথাকথিত মঙ্গলময়তার দিকটিকে ধরি, যা ঈশ্বরের সামনে ভয়ে কম্পিত সকল মানুষও ঈশ্বরের গুণ বলে স্বীকার করে নেয়; যদি আমরা ধরে নিই যে ঈশ্বর নিজের মহিমা প্রকাশের উদ্দেশ্য নিয়েই সমস্তকিছু করছেন; ধরে নিই যে তাই তিনি বুদ্ধিমান জীবের শ্রদ্ধেয়; ধরে নিই যে কেবল তাঁর কাজের মধ্য দিয়েই মানবপ্রজাতির মঙ্গল ঘটতে পারে; তাহলে এই সমস্ত অনুমান ও দৃষ্টিকোণ থেকে এটা কীভাবে ব্যাখ্যা করা যায় যে এতই মহিমময় ও মঙ্গলময় ঈশ্বর মানবপ্রজাতির বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশকে তাঁর নিজের সম্বন্ধেই এমন দুরপনেয় অজ্ঞতার অন্ধকারে নিক্ষিপ্ত করেছেন? ঈশ্বরের ইচ্ছা যদি এমনই হয় যে তিনি সমস্ত বুদ্ধিমান জীবের দ্বারা জ্ঞাত, আদৃত ও ধন্যবাদার্হ হবেন, তাহলে তিনি সেইসব জীবের কাছে নিজের মঙ্গলময় রূপটিকে প্রকাশ করছেন না কেন? কোনো কোনো জীবের কাছে ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যাদেশে দেখা দিয়ে ছোট এক গোষ্ঠীর প্রতি বিরক্তিকর পক্ষপাতিত্ব না দেখিয়ে গোটা পৃথিবীর সামনে মুক্তভাবে নিজেকে প্রকাশ করছেন না কেন? এইসব হাস্যকর রূপান্তরের গল্প, অবতারের গল্প, যার কথকরা আবার নিজেদের মধ্যেই সহমতে পৌঁছতে পারে না, তার চেয়ে মানুষের কাছে নিজেকে প্রকাশ করার বলিষ্ঠতর ও আরো বিশ্বাসযোগ্য কোনো উপায় কি সর্বশক্তিমানের কাছে নেই? বিশ্বের বিভিন্ন মনুষ্যগোষ্ঠীর মধ্যে শ্রদ্ধার আসন দখল করে নিজেদের ঈশ্বরের প্রতিনিধি ও তদ্গুণেই নীতিনির্ধারক রূপে প্রতিষ্ঠিত করতে উদ্ভাবিত কত না অলৌকিক কাণ্ডের চেয়ে এইসব বিভিন্ন মহাত্মাদের মহারাজ যিনি, সেই ঈশ্বরের কি তাঁর কাঙ্খিত সমাচার মানুষকে মুহূর্তে অবগত করার অন্য কোনো উপায় ছিল না? আকাশের খিলানে সূর্য টাঙিয়ে দেওয়া, এলোমেলো তারা ছড়িয়ে দেওয়া, নক্ষত্রপুঞ্জ দিয়ে মহাশূন্য ভরে দেওয়া--- এহেন সব ইঙ্গিত-ইশারার চেয়ে নিজ মহিমা সম্পর্কে কত না সচেতন ও মানুষের মঙ্গলসাধনে কত না তৎপর ঈশ্বরের পক্ষে কি আরো মানানসই হতো না যদি তিনি অবিসংবাদিতভাবে তাঁর নাম, গুণাবলী ও চির অভিপ্রায়গুলো অনপনেয় অক্ষরে এমনভাবে লিখে দিতেন যা পৃথিবীর প্রত্যেকটি বাসিন্দার কাছেই সমান বোধগম্য হতো? কেউ তাহলে আর তাঁর অস্তিত্ব নিয়ে সন্দেহপ্রকাশ করতে পারত না, তাঁর স্বচ্ছ অভিপ্রায় ও দৃশ্যমান পরিকল্পনা নিয়েও আর কোনো সন্দেহের অবকাশ থাকত না। এই প্রচণ্ড ঈশ্বরের দৃষ্টির সম্মুখে তাঁর আদেশ অমান্য করার দুঃসাহস আর কারো হতো না, কোনো জীবেরই তাঁর ক্রোধের কারণ হয়ে ওঠার হিম্মত থাকত না। আর শেষত, নিজেদের খেয়াল-খুশি-ধান্দা তাঁর নাম করে তাঁর অভিপ্রায় বলে চালিয়ে দেওয়ার ধৃষ্টতাও কারো হতো না।

সত্যি কথা বলতে, ধর্মতত্ত্বীয় ঈশ্বরের অস্তিত্ব যদি স্বীকার করে নেওয়াও হয় এবং তাঁর উপর আরোপিত কত না পরস্পরবিরোধী গুণাবলীর সত্যতাও মেনে নেওয়া হয়, তারপরেও তাঁর প্রতি সেবা-নিবেদনের উদ্দেশ্যে স্থিরীকৃত আচার-অনুষ্ঠানগুলোর যাথার্থ্য নিষ্পন্ন হয় না। শতছিদ্র পাত্রে চিরকাল জল ধরে রাখার মতোই এক অসম্ভব বস্তু হল ধর্মতত্ত্ব। পরস্পরবিরোধী গুণাবলী আরোপ করে ও অনিশ্চিতকে নিশ্চয়তার তকমা দিয়ে তা তার ঈশ্বরকে এতটাই পঙ্গু করে তুলেছে যে তাঁর পক্ষে কোনো কাজ করাই অসম্ভব হয়ে উঠেছে। যদি সত্যিই তিনি অপার মঙ্গলময় হন, তাঁকে আবার ভয় করার কোনো কারণ থাকতে পারে কি? যদি সত্যিই তিনি অপার প্রজ্ঞাময় হন, তাহলে ভবিষ্যৎ নিয়ে আমাদের এত দুশ্চিন্তা ও সংশয়ের কারণ কি? যদি তিনি সর্বজান্তাই হন, তাহলে আমাদের চাহিদা সম্পর্কে তাঁকে সচেতন করার জন্য এত আয়োজন কেন, কেন আমাদের হাজারো প্রার্থনা দিয়ে তাঁকে ক্লান্ত করা? তিনি যদি সবকিছুর মধ্যেই আছেন, তাহলে আবার তাঁর জন্য মন্দির গড়া কেন? তিনি যদি ন্যায়পরায়নই হন, তাহলে যে জীবদের তিনি দুর্বলতায় ভরে সৃষ্টি করেছেন, তাদের সেই দুর্বলতার জন্যই তিনি তাদের শাস্তিবিধান করবেন এমন আশঙ্কার কি কোনো মানে হয়? ঈশ্বরের অনুগ্রহই যদি সর্বজনের পাথেয় হয়, তাহলে প্রতিদান নিয়ে এত চিন্তা কেন? যদি তিনি সর্বশক্তিমান হন, তাহলে তাঁকে রুষ্ট করা বা প্রতিহত করা কি আদৌ সম্ভব? যদি তিনি যুক্তিপরায়ন হন, তাহলে যে মানুষকে তিনি যুক্তি-বিরহিত হওয়ার স্বাধীনতা দিয়েছেন, তার অন্ধ অযৌক্তিকতায় তিনি রুষ্ট হতে পারেন কী করে? যদি তিনি অচঞ্চল হন, তাহলে তাঁর নির্দেশ পরিবর্তিত করার ক্ষমতা কীভাবে কিছু মানুষের থাকতে পারে? যদি তিনি অজ্ঞেয় হন, তাঁকে নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ কী? যদি তিনি কখনো কথা বলে থাকেন, তাহলে বিশ্বব্রক্ষাণ্ডের সে কথায় স্থির-নিশ্চিত বিশ্বাস জন্মালো না কেন? ঈশ্বর সম্পর্কে জ্ঞান যদি সবচেয়ে প্রয়োজনীয় হয়ে থাকে, তাহলে তা সবচেয়ে স্বচ্ছ ও স্বতঃসিদ্ধ হল না কেন? (Systeme de la Nature, লন্ডন, ১৭৮১)

আলোকপ্রাপ্ত ও হিতৈষী প্লিনি এভাবে জনসমক্ষে নিজেকে নাস্তিক বলে ঘোষণা করেছিলেন:

Quapropter effigiem Del formamque quaerere imbecillitatis humanae reor. Quisquis est Deus (si modo est alius) et quacunque in parte, totus est gensus, totus est visus, totus auditus, totus animae, totus animi, totus sul. …Imperfectae vero in homine naturae praecipua solatia, ne deum quidem omnia. Namque nec sibi protest mortem consciscere, si velit, quod hominid edit optimum in tantis vitae poenis; nee mortals aeternitate donare, aut revocare defunctos; nec facere ut qui vixit non vixerit, qui honores gessit non gesserit, nullumque habere In praeteritum ius praeterquam oblivionts, atque (ut. Facetis quoque argumentis societas haec cum, deo compuletur) ut bis dena viginti non sint, et multa similiter efficere non posse. …Per quaedeclaratur haud dubie naturae potentiam id quoque ease quod Deum vocamus. [অতএব, আমি মনে করি মানুষের দুর্বলতার রূপ-প্রতিমা খোঁজা হচ্ছে। যিনিই যে মাপের ঈশ্বর হোন না কেন (যদি আদৌ কেউ থেকে থাকেন), তিনিই সমগ্র জাতি, সমগ্র দৃশ্যবস্তু, সমগ্র শ্রুতবস্তু, সমগ্র আত্মা, সমগ্র মন, সমগ্র অস্তিত্ব। ... কিন্তু মানুষের ত্রুটিপূর্ণ প্রকৃতির বড় সান্ত্বনা এমনকি ঈশ্বরের সমস্ত বস্তুতেও নেই। কারণ সে নিজের কাছে প্রতিবাদ করেনি যে বেছে নেওয়ার মধ্য দিয়ে সে মৃত্যুকে সচেতন ক্রিয়া করে তুলতে পারে; প্রতিবাদ করেনি যে মানুষ জীবনের সমস্ত যন্ত্রণার অধিকাংশটাই হজম করে নেয়, কিন্তু তা মরণশীলদের অনন্তকাল প্রদান করতে নয়, মৃতদের স্মরণ করতেও নয়, এমনকি কোনো যাপনকারীর যাপন নাকচ করতে নয়, কৃতিত্বের অধিকারীর কৃতিত্ব নাকচ করতেও নয় বা যারা অতীত ভুলে যায় তারা ছাড়া অন্য সবার অতীতের উপর অধিকার নাকচ করতেও নয়, আর (ঈশ্বরের সঙ্গে এই সংসর্গটি যেন ঠাট্টা-তর্কের দ্বারা চালিত হয়) যাতে দুই-কুড়ি মুদ্রা পড়ে না থাকে এবং একইভাবে আরো অনেক কিছু সাধিত না হয়। ... এর দ্বারা সন্দেহাতীতভাবে ঘোষিত হয় যে প্রকৃতির শক্তিও হল তাই যাকে আমরা ঈশ্বর বলি।] (Plin.Nat.Hist. cap.de Deo)

যিনি সুসঙ্গতভাবে নিউটনীয় চিন্তাধারার অনুসারী, আবশ্যিকভাবেই তিনি নাস্তিক। স্যার ড্রুমন্ড-এর ‘Academical Questions’-এর তৃতীয় অধ্যায়ে আমরা দেখতে পাই যে মহাকর্ষতন্ত্র যেভাবে নাস্তিকতার দিকে ভাবনাকে চালিত করে, তাকেই তিনি এই তত্ত্বকে ভুল বলে ধরে নেওয়ার পর্যাপ্ত কারণ বলে মনে করেছেন। কিন্তু দর্শনকে যদি তার সম্মান বজায় রাখতে হয়, তাহলে নিশ্চিতভাবেই দঙ্গলের অনমনীয় পূর্বধারণায় আঘাত করছে বলে সরিয়ে না দিয়ে তথ্য থেকে যুক্তিবিচার করে পৌঁছানো যে কোনো সিদ্ধান্তকে, তা যদি আপাত-অপ্রমাণযোগ্য অনুমানও হয়,  তা মেনে নিতে হবে। স্যার ড্রুমন্ড যদি নাস্তিকতার দোষ ও উদ্ভটত্ব নিয়ে উগ্র ভাষায় বিদ্রূপ-গালাগাল না করে নাস্তিকতার অসত্যতা প্রদর্শন করতে উদ্যোগী হতেন, তাহলে তাঁর আচরণ সন্দেহবাদীদের বিনয় ও দার্শনিকদের সহিষ্ণুতার আদর্শের সঙ্গে অনেক বেশি মানানসই হতো। বারুখ স্পিনোজার ভাষায়:

Omnia enim per Dei potentiam facta aunt: imo quia naturae potential nulla est nisi ipsa Dei potential. Certum est nos eatenus Dei potentiam non intelligere, quatenus causas naturales ignoramus; adeoque stulte ad eandem Dei potentism recurritur, quando rei alicuius causam naturalem, sive est, ipsam Dei potentiam ignoramus. [সমস্ত কিছু যেহেতু ঈশ্বরের ক্ষমতা দ্বারা সৃষ্ট: প্রকৃতপক্ষেই, কারণ ঈশ্বরের নিজশক্তি ছাড়া প্রকৃতির আর কোনো শক্তি নেই। যে মাত্রায় আমরা প্রাকৃতিক কারণ সম্পর্কে অজ্ঞ, নিশ্চিতভাবেই সে মাত্রায় আমরা ঈশ্বরের ক্ষমতা বুঝতে পারি না; আর তাই যে ক্ষেত্রে আমরা কোনো জিনিসের প্রাকৃতিক কারণ জানি না, সেই ক্ষেত্রে ঈশ্বরীয় শক্তি অবলম্বন করতে যাওয়া বোকামি, বা তা ঈশ্বরীয় ক্ষমতা কিনা নির্ধারণ করতে যাওয়াও বোকামি।] (Spinoza, Tractus Theologico-Politicus, chapter-I)

 

 
   

 

 

 

0 Comments
Leave a reply