নীতি-নৈতিকতার বাইরে সত্য ও মিথ্যাভাষণ প্রসঙ্গে

লিখেছেন:ফ্রিদরিখ নিৎশে, বাংলা তর্জমা- বিপ্লব নায়ক
নিৎশে-পাঠক-মহলে তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লেখাগুলোর একটি হিসেবে গণ্য হওয়া এই লেখাটিতে ভাষা, জ্ঞান, বিজ্ঞান, স্বজ্ঞা ও মানবযাপনের সঙ্গে তার সম্পর্ক নিয়ে ভাবনার বেশ কিছু মৌলিক প্রস্থানবিন্দু তৈরি হয়েছে।

ভূমিকা

এই লেখাটি নিৎশে ১৮৭৩ সালে লিখেছিলেন, যখন তঁার বয়স ২৯ বছর। লেখাটি নিৎশের জীবৎকালে অপ্রকাশিত ছিল। লেখাটি এখন নিৎশে-পাঠক-মহলে তঁার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লেখাগুলোর একটি হিসেবে গণ্য হয়। ভাষা, জ্ঞান, বিজ্ঞান, স্বজ্ঞা ও মানবযাপনের সঙ্গে তার সম্পর্ক নিয়ে ভাবনার বেশ কিছু মৌলিক প্রস্থানবিন্দু এই লেখাটি থেকে তৈরি হয়েছে।

এই লেখাটিতে নিৎশের ভাবনা কান্ট ও সোপেনহাওয়ার-এর ছায়া থেকে যাত্রা শুরু করেছে। কান্ট যেভাবে phenomenon (ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য রূপ) এবং noumena (ইন্দ্রিয়-অতিক্রমী রূপ) সংজ্ঞাত করেছিলেন, ইন্দ্রিয়-অতিক্রমী রূপবলয়ের মধ্যে thing-in-itself (স্বয়ং-বস্তু)-এর অবস্থানহেতু তা অজ্ঞেয় জ্ঞান করেছিলেন, এবং সোপেনহাওয়ার যেভাবে এই ভিত্তিমূলক ভাবনার উপর দাঁড়িয়েই অজ্ঞেয়তার মধ্যে স্বজ্ঞা বা নান্দনিক অনুভবের পথ ধরে অনুপ্রবেশের পথ খুঁজেছিলেন, সেই ভাবনার ছায়া বহন করেই এই লেখাটি শুরু হচ্ছে। এই সূত্র ধরে এগিয়ে ভাষা ও বিজ্ঞানের প্রশ্নে আলোচনায় ঢুকে লেখাটি তার স্বকীয়তায় পৌঁছেছে। ভাষাগত প্রতিরূপ দিয়ে বস্তুকে নিখুঁতভাবে ধরা যায়, বিজ্ঞানের তত্ত্ব দিয়ে বস্তুর নিয়ম আবিষ্কার ও প্রভাবিত করা যায়--- আধুনিকতাবাদী চিন্তার এই নিশ্চয়তাগুলোকে এখানে ধ্বংস করা হয়েছে। আর কেবল কথা দিয়ে কথার প্যাঁচ কাটানো নয়, জীবনযাপনের শৈলীর নিরিখে সমস্তকিছুকে বিচার্য করে তোলা হয়েছে। লেখাটি পড়তে পড়তে গভীর নিশ্চয়তাবোধগুলোর ভেঙে পড়ার উপক্রম দেখে যেমন বিপন্নতার সিঁদুরে মেঘ ঘনায়, তেমনই আসন্ন কোনো কালবৈশাখীতে ভেসে মুক্ত হওয়ার আশাও দপদপিয়ে ওঠে।

এখানে লেখাটির বাংলা তর্জমা করা হয়েছে মূল জার্মান থেকে নয়, রোনাল্ড স্পেইর-কৃত তার ইংরেজি অনুবাদ থেকে। উক্ত ইংরেজি অনুবাদটি ব্রিটেনের কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস দ্বারা ‘কেমব্রিজ টেক্সটস ইন দি হিস্ট্রি অফ ফিলজফি’ সিরিজ-য়ে ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত নিৎশে-র ‘দি বার্থ অফ ট্রাজেডি অ্যান্ড আদার রাইটিংস’ বইতে পাওয়া যায়।

বিপ্লব নায়ক

 

 

বিশ্বব্রক্ষ্মাণ্ডের কোনো এক দূর-নিঝুম কোণে, অগণ্য সৌরজগতের আলোর মধ্যে একদা এক গ্রহ নিঃসারিত হয়ে দপদপ করে জ্বলেছিল কিছুকাল, আর সেই গ্রহের চতুর প্রাণীরা জ্ঞানশক্তি আবিষ্কার করেছিল। ‘জগতের ইতিহাস’-য়ে সেটাই ছিল সবচেয়ে উদ্ধত ও সবচেয়ে কপট মুহূর্ত, যদিও তা এক মুহূর্ত বৈ আর কিছু নয়। প্রকৃতির অল্প কয়েকটি শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণের মধ্যেই সেই গ্রহ জমাট শীতল হয়ে গিয়েছিল এবং সেই চতুর প্রাণীদের মরতে হয়েছিল। এমন একটা আখ্যান তৈরি করা যেতেই পারে, কিন্তু তার মধ্য দিয়েও যথেষ্ট সন্তোষজনক ভাবে ফুটিয়ে তোলা যাবে না যে প্রকৃতির মধ্যে এই মানুষের বুদ্ধিমত্তাকে ঠিক কতটা তুচ্ছাতিতুচ্ছ, কতটা অবাস্তব ও ক্ষণস্থায়ী, কতটা উদ্দেশ্যহীন ও স্বেচ্ছাচারী দেখায়; বহু অনন্তকালপর্যায় অতিবাহিত হয়েছে যখন তার কোনো অস্তিত্ব ছিল না, আবার তা বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার পরও কোথাও কিছু এসে যাবে না। কারণ মনুষ্যজীবনের সীমার বাইরে প্রসারিত হতে পারে বুদ্ধিমত্তারএমন কোনো ভূমিকা নেই। বা বলা ভালো, এই বুদ্ধিমত্তা হল মনুষ্যোচিত এবং কেবলমাত্র তার অধিকারী ও বংশধারা-বিস্তারকারীরাই তাকে এমন করুণরসাসিক্ত ভাবে দেখে যেনবা গোটা বিশ্বজগৎ তাকেই অক্ষ করে আবর্তিত হচ্ছে। কিন্তু যদি কোনো ডঁাশের সঙ্গে আমাদের জ্ঞাপনক্ষমতা থাকত, তাহলে আমরা শুনতে পেতাম সেই ডঁাশও এহেন একই করুণরসে অভিভূত হয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে যে বিশ্বজগতের উড়ানের কেন্দ্রটি তার মধ্যেই অবস্থিত। প্রকৃতিতে এমন জঘন্য ও নিকৃষ্ট কিছু হতে পারে না যা এই জ্ঞানশক্তির এক ফুঁ-য়ে তৎক্ষণাৎ বেলুনের মতো ফুলে ওঠে না; আর প্রতিটি ভারবাহক যেমন তার গুণের কদর চায়, ঠিক তেমনই সকল মানুষের মধ্যে সবচেয়ে দাম্ভিক যে জন, সেই দার্শনিকও চায় যে তার ভাবনা ও কাজের উপরই বিশ্বব্রক্ষ্মাণ্ডের যত চোখ দূরবীক্ষণ সহযোগে স্থির-নিবদ্ধ থাকুক।

বুদ্ধিমত্তা যে এহেন প্রভাব ফলাতে পারে তা ভাবলে অবাকই হতে হয়, কারণ, প্রাণীকুলের মধ্যে সবচেয়ে দুর্ভাগ্যতাড়িত, সবচেয়ে কমজোরী ও সবচেয়ে ক্ষণস্থায়ী কিছু প্রাণীদের একটা সাহায্য-অবলম্বন বৈ আর কিছু তো তা নয়; এই সাহায্য-অবলম্বন ব্যতীত লেসিঙ-য়ের শিশুসন্তানের মতো অতি দ্রুত অস্তিত্ব ছেড়ে পালানো ছাড়া তাদের আর কিছু করার থাকত না।

জ্ঞানশক্তি ও বোধের মধ্যে নিহিত দম্ভ মানুষের চোখ ও অন্যান্য ইন্দ্রিয়কে অন্ধতার কুয়াশায় ঢেকে দেয়; আর যেহেতু তা জ্ঞান সম্পর্কে অতিরিক্ততম তোষামোদকারী মূল্যায়ন নিজ মধ্যে ধারণ করে, তাই তা অস্তিত্বের মূল্য সম্পর্কেও ভ্রান্ত ধারণার জন্ম দেয়। সাধারণভাবেই তার ফলাফল হল ভ্রান্তি-উৎপাদন, আর তার আলাদা আলাদা নির্দিষ্ট ফলগুলোও ওই একই চরিত্রধারী।

ব্যক্তির সংরক্ষণের উপায় হিসেবে বুদ্ধিমত্তার সর্বোচ্চ শক্তি প্রদর্শিত হয় কপটতায়। কারণ, অস্তিত্বের সংগ্রাম চালানোর জন্য শিকারী প্রাণীদের মতো ধারালো শিং বা নখ যারা প্রকৃতিগত ভাবে পায়নি, সেই কম বলের দুর্বলতর প্রাণীদের সংরক্ষণের উপায় হল এই কপটতাই। কপটতার এই শিল্প মানুষের মধ্যে তার শীর্ষবিন্দু ছুঁয়েছে। ছলনা, কপট স্তুতি, মিথ্যাবাদিতা ও প্রতারণা, লোকের পিছনে কথা বলা, ভান বজায় রাখা, ধার করা ভূষণ ধারণ করা, মুখোশ এঁটে থাকা, প্রথার ঝালরে সেজে থাকা, নিজের বা অন্যের সুবিধার্থে মিথ্যা অভিনয় করা— সংক্ষেপে বললে, ফঁাকা দেমাকের শিখার চারদিকে নিত্য পাখা-ঝাপটে বেড়ানো মানুষদের মধ্যে এতটাই সাধারণ নিয়ম ও বিধিতে পরিণত হয়েছে যে তার মধ্য থেকে সত্য অভিমুখে কোনো খাঁটি ও সৎ প্রচেষ্টা দেখা দেবে তা ভাবনারও অতীত। মায়া-বিভ্রম ও স্বপ্ন-প্রতিমার মধ্যে তারা গভীরভাবে নিমজ্জিত, তাদের দৃষ্টি কেবলমাত্র বস্তুসকলের উপরিতলের উপর পিছলে চলে ‘আকার’ দেখতে পায়, তাদের বোধ কোথাও তাদের সত্য অভিমুখে নিয়ে যায় না, বরং তারা উদ্দীপিত হয়ে বস্তুসকলের পিছনে আঙুলের খেলা খেলেই তৃপ্ত থাকে। তাছাড়াও, তাদের জীবনের প্রতিটা রাতে তারা স্বপ্নে মিথ্যার কাছে কান পেতে রাখে, কোনো নৈতিকতা বোধই তাতে বাধ সাধে না, অথচ দাবি করা হয় যে কোনো কোনো মানুষ নাকি তাদের অভিপ্রায়-ক্ষমতার জোরে নাক ডাকার অভ্যাসকেও দূর করতে পেরেছে। মানুষ তার নিজের সম্পর্কে সত্যিই কী জানে? আলোকিত এক কঁাচের আধারে আপাদমস্তক টানটান করে বিছানো অবস্থায় তারা কি একবারও নিজেদের সমগ্রটা অনুধাবন করতে সমর্থ? এমনকি আমাদের নিজেদের দেহ সমেত সমস্ত কিছু নিয়ে মৌন থেকে প্রকৃতি কি আমাদের এমন এক দাম্ভিক মায়া-ভ্রান্ত সচেতনতার কুঠিতে বন্দী ও নির্বাসিত করে রাখেনি যা আমাদের উদরের আঁক-বাঁক, শিরা-ধমনীর দ্রুত স্রোত ও স্নায়ুতন্ত্রের জটিল কম্পন থেকে বহু যোজন দূরে অবস্থিত? প্রবেশদ্বারের চাবিটি প্রকৃতি চিরতরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে, তাই ভাগ্যাহত কৌতূহল বহু ক্লেশেও সচেতনতার কুঠির দেওয়ালে কোনো এক ফাটল খুঁজে নিয়ে তা দিয়ে উঁকি মেরে গহন তল অবধি দেখতে পাবে কি না সন্দেহ। কিন্তু যদি দেখতে পায়, তাহলে বুঝবে যে অজ্ঞতাপ্রসূত ঔদাস্যে মজে স্বপ্নাবিষ্ট মোহে মানুষ ক্ষমাহীন লোভী চির-অতৃপ্ত খুনী আত্মাকে আঁকড়ে ধরে আছে, যেনবা এক বাঘের পিঠে সওয়ার হয়ে বসেছে। এই যখন পরিস্থিতি, তখন সত্যের জন্য আকাঙ্ক্ষা পৃথিবীতে কোথা থেকে উদয় হতে পারে?

যেমতাবধি একজন ব্যক্তি অপর ব্যক্তিদের সাপেক্ষে নিজেকে সংরক্ষিত করতে চায়, প্রাকৃতিক অবস্থার স্তরে সে মূলত গোপনতা ও কপটতার জন্য নিজের বুদ্ধিবৃত্তিকে কাজে লাগায়; কিন্তু চাহিদা ও একঘেয়েমির তাড়না যেহেতু সমাজে বা যূথবদ্ধ বাঁচার দিকেও তাকে চালিত করে নিয়ে যায়, সেই অবস্থায় তার এক প্রকার শান্তিচুক্তি প্রয়োজন হয়ে পড়ে, আর তাই সে ‘সকলের বিরুদ্ধে সকলের যুদ্ধের’ স্থূলতম রূপগুলো অন্তত বর্জন করার চেষ্টা করে। এই শান্তিচুক্তির হাত ধরেই এমনকিছুর আবির্ভাব হয় যাকে সত্যের জন্য নিগূঢ় আকাঙ্ক্ষা অধিকারের প্রথম ধাপ বলে মনে হয়। কারণ এই মুহূর্তের পর থেকেই ‘সত্য’ বলে গণিতব্য বস্তুটি স্থিরীকৃত হয়ে পড়ে, অর্থাৎ, বস্তুসমূহের নাম করার এমন এক উপায় উদ্ভাবিত হয় সর্বত্র যার একই বৈধতা ও বল আছে। ভাষা-প্রণয়নও সত্যের প্রথম নিয়মাবলী তৈরি করে, কারণ এখানেই প্রথম সত্য ও মিথ্যাবাদীতার মধ্যে ভিন্নতাটি অস্তিত্বধারণ করে: নাম করার বৈধ চিহ্নগুলোকে, অর্থাৎ, শব্দকে মিথ্যাবাদী এমনভাবে ব্যবহার করে যাতে অবাস্তবকে বাস্তব মনে করানো যায়; যেমন ধরা যাক, মিথ্যাবাদী তার অবস্থা বর্ণনা করতে বলল যে ‘আমি ধনী’, যেখানে সেই অবস্থার সঠিক বর্ণনা হওয়া উচিত ‘আমি দরিদ্র’। বস্তুদের জন্য প্রদত্ত নামকে স্বেচ্ছাচারী ভাবে অদল-বদল করে বা এমনকি উল্টে দিয়ে মিথ্যাবাদী ব্যক্তি প্রতিষ্ঠিত প্রচলের অপব্যবহার করে। সে যদি তা স্বার্থপর বা অন্য কোনোভাবে ক্ষতিকর বিধায় তা করে, তাহলে সমাজ তাকে আর বিশ্বাস করবে না এবং সমাজ থেকে তাকে বের করে দেবে। চালাকিতে বোকা বনা মানুষ অতটা এড়াতে চায় না, যতটা চায় ওই বোকা বনে ক্ষতির মুখে পড়াকে। এমনকি এই স্তরেও সে প্রতারণাকে অতটা ঘৃণা করে না, যতটা করে কিছু প্রকার প্রতারণার ক্ষতিকর বৈরিতামূলক ফলাফলকে। সত্যকেও মানুষ একইরকম সীমায়িত অর্থেই কামনা করে। মানুষ সত্যের মনোহর জীবন-সংরক্ষণকারী ফলাফলগুলো কামনা করে, কোনো ফলাফলহীন বিশুদ্ধ জ্ঞান সম্বন্ধে সে উদাসীন, আর ক্ষতিকর বা ধ্বংসাত্মক সত্যের প্রতি সে রীতিমতো বৈরীভাবাপন্ন। তাছাড়া, ভাষার ওই প্রচলগুলোর চরিত্রই বা কী? তারা কি জ্ঞানের ফসল, সত্য-বোধের ফসল? বস্তুসমূহ ও তাদের নামসমূহের মধ্যে কি একটি নিখুঁত মিল আছে? ভাষা কি সমস্ত বাস্তবতার একটি সম্পূর্ণ ও যথেষ্ট অভিব্যক্তি?

কেবলমাত্র বিস্মরণময়তার কল্যাণেই মানুষ এমন ভ্রম লালন করতে পারে যে সে উপরোক্ত পরিমাণে সত্যের অধিকারী। পুনরুক্তি রূপে সত্য, অর্থাৎ ফঁাকা খোসা নিয়ে যদি মানুষরা নিজেদের সন্তুষ্ট না রাখত, তাহলে তারা কখনই সত্যের সঙ্গে ভ্রম বিনিময় করত না। শব্দ কী? তা হল ধ্বনিতে স্নায়বিক উদ্দীপনের অনুলিপি। আমাদের ভিতরে স্নায়বিক উদ্দীপনের ঘটনা থেকে বাইরে তার কারণের অস্তিত্ব সম্পর্কে সিদ্ধান্ত করার রীতি নিজে থেকেই যথেষ্টস্বরূপ কারণের নীতিকে ভুলভাবে প্রয়োগের একটি উদাহরণ। ভাষার উদ্ভবে কেবলমাত্র সত্যই যদি নির্ণায়ক হতো, উপাধি সৃষ্টিতে নিশ্চয়তার দৃষ্টিকোণই যদি নির্ণায়ক হতো, কীভাবেই বা আমরা বলার ছাড় পেতাম যে ‘পাথরটি শক্ত’, যেনবা আদ্যন্ত কেবল বিষয়ীগত উদ্দীপনা না হয়ে অন্য কোনো উপায়ে ‘শক্ত’ কী তা নিয়ে আমাদের কিছু জানা আছে? বস্তুদের আমরা লিঙ্গের নিরিখে ভাগ করি, বৃক্ষকে পুংলিঙ্গ আর গুল্মকে স্ত্রীলিঙ্গ বলি— কত না স্বেচ্ছাচারী এহেন অভিধা! স্থির-নিশ্চয়তার পবিত্র আদর্শ থেকে তা কত না দূরাচারী! আমরা যখন সাপের নাম করি, অভিধাটি কেবল তার এঁকেবেঁকে চলনকেই হাজির করে, ফলে তা কৃমির ক্ষেত্রেও একইভাবে প্রযোজ্য হতে পারে। এসব সীমারেখাগুলো কত না স্বেচ্ছাচারী ভাবে টানা হয়, কোনো বস্তুর বহু গুণের মধ্যে কোনো একটির উপর কত না স্বেচ্ছাচারী ভাবে পক্ষপাত করা হয়! বহু বিভিন্ন ভাষাকে পাশাপাশি রেখে দেখলে স্পষ্ট হয়ে যায় যে শব্দদের ক্ষেত্রে সত্যই বিষয় নয়, পূর্ণ ও যথার্থ অভিব্যক্তিও বিষয় নয়; নাহলে এতগুলো ভাষা থাকত না। ‘স্বয়ং-বস্তু’-কে (‘thing-in-itself’) (খাঁটি সত্য, পরিণামহীন সত্য একমাত্র তা-ই হতে পারত) মুঠোয় ধরা এমনকি ভাষার নির্মাতার পক্ষেও অসম্ভব, আর তা অভিপ্রেতও নয়। ভাষা-নির্মাতা কেবল মানুষদের সঙ্গে বস্তুদের সম্পর্ককে চিহ্নিত করে, আর তা প্রকাশ করার জন্য সবচেয়ে সাহসী রূপক অবলম্বন করে। প্রথমে স্নায়ুর উদ্দীপনাকে একটি প্রতিমায় অনুবাদ করা হয়— এই হল প্রথম রূপক! প্রতিমাটিকে তারপর একটি ধ্বনি দিয়ে অনুকরণ করা হয়— তা হল দ্বিতীয় রূপক! আর প্রতিটি পর্যায়েই একটি বলয় থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন নতুন একটি বলয়ের কেন্দ্রে লাফ দেওয়া হতে থাকে। কখনো ধ্বনি বা সঙ্গীত যার অভিজ্ঞতায় ধরা দেয় নি এমন সম্পূর্ণ বধির একটি মানুষ কল্পনা করা যেতে পারে, যে বিস্ময়ভরে বালিতে ক্ল্যাডনিয় ধ্বনি-নকশা দেখতে দেখতে তারের কম্পনের মধ্যে তার কারণ নির্ণয় করে নিশ্চিতভাবে ঘোষণা করে যে মানুষ কাকে ধ্বনি বলে এখন তা তার জানা হয়ে গেছে— ভাষা নিয়ে আমাদের সবার ক্ষেত্রে এমনটাই ঘটে। আমরা বিশ্বাস করি যে যখন আমরা গাছ, রঙ, তুষার ও ফুল বলি, তখন সেইসব বস্তুদের স্বয়ং-সত্তা সম্পর্কে জ্ঞানের অধিকারী হয়েই বলি, অথচ আসলে আমরা কেবলমাত্র কিছু রূপকের অধিকারী যার সঙ্গে বস্তুদের প্রকৃত সত্তার কোনো অনুরূপতাই নেই। ঠিক যেমন সঙ্গীতের ধ্বনি বালিতে একটি নকশা হিসেবে প্রতিভাত হতে পারে, ঠিক তেমন স্বয়ং-বস্তুর রহস্যঘন ‘X’ প্রথমে প্রতিভাত হয় স্নায়বিক উদ্দীপন হিসেবে, তারপর প্রতিমা হিসেবে, এবং শেষাবধি উচ্চারিত ধ্বনি হিসেবে। ভাষার উদ্ভবকালে মোটেই যুক্তিতে বেঁধে সবকিছু হয়নি, আর তাই সত্যবান, গবেষক, বা দার্শনিক যে উপাদান নিয়ে ও যে উপাদান দিয়ে কাজ চালান ও নির্মাণ করেন, তা যদি কোনো মেঘ-কোকিলের দেশের উপজাত নাও হয়, তা কোনোভাবেই বস্তুদের অন্তঃসার থেকে উদ্ভূত নয়।

বিশেষ করে খেয়াল করা যাক কীভাবে ধারণাগুলো তৈরি হয়। প্রতিটি শব্দ অব্যবহিতভাবেই একটি ধারণা হয়ে ওঠে, কিন্তু তা এ কারণে নয় যে তা তার অস্তিত্বের উৎস স্বরূপ স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত প্রাথমিক কোনো অভিজ্ঞতার স্মৃতি হয়ে থাকতে চায়, বরং এই কারণে যে তাকে একই সঙ্গে অগুন্তি কম-বেশি সদৃশ অপর অপর এমন বিষয়ের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হয় যেগুলো কড়া বিচারে কখনই সমতুল নয়, অর্থাৎ অ-সমতুল বিষয় ছাড়া কিছু নয়। যা অ-সমতুল তাদের সমতুল করে তোলার মধ্য দিয়েই প্রতিটি ধারণার জন্ম হয়। ঠিক যেমন কোনো সন্দেহ নেই যে কোনো পাতাই অন্য কোনো পাতার সঙ্গে একেবারে এক নয়, তেমন এও সন্দেহাতীত যে ‘পাতা’ ধারণাটি এইসব স্বাতন্ত্র্যকে ইচ্ছামতো বিসর্জন দিয়ে, অপরাপরের মধ্যে পার্থক্য-চিহ্নগুলোকে ভুলে থেকেই তৈরি হয়েছে। এর ফলে ধারণা থেকে এমন বিশ্বাসের জন্ম হয়েছে যে বিভিন্ন সব পাতার থেকে আলাদা ‘পাতা’-র এমন এক আদি মূল রূপের অস্তিত্ব প্রকৃতিতে হয় যার অনুকরণে বাস্তবের পাতাগুলোকে নেহাত এমনই অপটু হাতে আঁকা, বোনা, রাঙানো ও পাকানো হয়েছে যে মূল আদি রূপের প্রতি সেগুলো বিশ্বস্ত হতে পারেনি। ধরা যাক কোনো ব্যক্তিকে আমরা সৎ বললাম। যদি প্রশ্ন করি, ‘আজ সে কেন এত সৎ আচরণ করল?’ সাধারণভাবে উত্তর পাওয়া যাবে, ‘তার সৎ চরিত্রের জন্য।’ সুতরাং সেই সৎ আবার ঘুরে এল, অর্থাৎ, পাতার কারণ হল পাতাই। সততা বলা যেতে পারে এমন কোনো আবশ্যিক গুণের সন্ধান আমাদের কাছে নেই, কিন্তু এমন অগুন্তি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত এবং তজ্জনিত কারণেই অ-সমতুল ক্রিয়া আমরা জানি যেগুলোর পার্থক্যগুলোকে বাদ দিয়ে একে অপরের সঙ্গে সমীকরণে দাঁড় করিয়ে শেষাবধি আমরা তাদের লুকোনো ধর্মটিকে ‘সততা’ নামে সূত্রায়িত করি।

যে কোনো ছঁাচের মতো ধারণাও স্বাতন্ত্র্য ও বাস্তবকে অগ্রাহ্য করে তৈরি হয়, পক্ষান্তরে প্রকৃতি না জানে ছঁাচ, না জানে ধারণা, আর তাই জানে না প্রজাতিকেও, প্রকৃতি কেবল জানে এমন এক X-কে, যা আমাদের কাছে যেমন অধরা, তেমনই সংজ্ঞাতীত। স্বতন্ত্র সত্তা ও প্রজাতির মধ্যে যে বিপক্ষতা আমরা তৈরি করি, তা মনুষ্যরূপ-আরোপ-প্রবণ এবং মোটেই তা বস্তুর অন্তঃসার থেকে উৎসারিত নয়— যদিও তা যে বস্তুর অন্তঃসারের অনুরূপ নয়, তাও আমরা বলতে পারি না কারণ সেই মতবাদিক দাবিও তার বিপরীত দাবির মতো একই রকম প্রমাণের অযোগ্য হবে।

তাহলে, সত্য কী? তা হল রূপক, লক্ষণা, মনুষ্যত্ব-আরোপ-প্রবণতা-র এক চলন্ত সেনাদল। সংক্ষেপে তা হল মানব সম্পর্কগুলোর এমন এক যোগফল যা কাব্যিক ও অলংকৃতি-প্রসূত তীব্রতর-করণ, তর্জমা ও অলংকরণের মধ্য দিয়ে সংঘটিত হয়ে দীর্ঘ সময় জুড়ে ব্যবহারে থাকার ফলে লোকের কাছে দৃঢ়-প্রতিষ্ঠ, অনুশাসন-সম্মত ও অবশ্য-পালনীয় বলে বোধ হয়। সত্য হল এমনই মায়া-বিভ্রম যাদের মায়া-বিভ্রম হওয়ার কথা আমরা ভুলে গেছি, এমনই সব রূপক অতি ব্যবহারে জীর্ণ হয়ে যা সমস্ত ইন্দ্রিয়জ শক্তি খুইয়ে বসেছে, এমনই মুদ্রা যার উপর খোদাই করা ছাপ মুছে যাওয়ার ফলে এখন আর মুদ্রা নয়, কেবল ধাতু হিসেবে বিবেচিত হয়। তবু আমরা এখনও জানি না কোথা থেকে সত্যের আকাঙ্ক্ষা জন্ম নেয়, কারণ এখনও অবধি আমরা কেবল সমাজ দ্বারা আরোপিত সত্যবান হওয়ার বাধ্যবাধকতা সম্পর্কে অবগত হয়েছি। এই সত্যবান হওয়ার বাধ্যবাধকতা হল চলতি রূপক ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা, বা, নৈতিকতার সাপেক্ষে বললে, দৃঢ়-প্রতিষ্ঠ প্রচলন মেনে মিথ্যা বলার বাধ্যবাধকতা, সবাই মিলে মিথ্যা বলার এমন এক শৈলী যা সবার জন্য অবশ্য-পালনীয়। এখন, এটা সত্য যে মানুষ ভুলে যায় যে ব্যাপারটা এরকম, তাই বর্ণিত উপায়ে বহু-শতক-পুরোনো অভ্যাসের বশে সে অসচেতনভাবে মিথ্যা বলে যায়— আর ঠিক এই ভুলে যাওয়া এবং এই অসচেতনতার জন্যই তারা সত্যের অনুভূতিতে এসে পৌঁছয়। যে অনুভূতি মানুষকে একটি বস্তুকে লাল, অন্য একটিকে শীতল এবং তৃতীয় একটিকে বোবা বলে বর্ণনা করতে বাধিত করে, তা-ই সত্যে সংসৃষ্ট হওয়ার নৈতিক আবেগ উৎপন্ন করে। যে মিথ্যাবাদীকে কেউ বিশ্বাস করে না এবং সবাই বাদ দিয়ে চলে, সেই বিপরীত থেকেই মানুষ সত্যের সম্মান, বিশ্বস্ততা ও উপকারিতা সম্পর্কে প্রমাণ নিজে নিজের কাছে হাজির করে। যুক্তিবাদী প্রাণীকুল হিসেবে মানুষরা এখন তাদের ক্রিয়াকে বিমূর্তায়নের নিয়মের অধীন করে তুলল, চকিত আভাস বা ইন্দ্রিয়জ উপলব্ধি দিয়ে ভেসে যাওয়া তারা আর বরদাস্ত করল না, প্রথমে তারা এখন সেই সমস্ত উপলব্ধির সাধারণীকরণ করে, তা করতে গিয়ে সেগুলোকে শীতলতর, কম বর্ণময় ধারণাসবে পরিণত করে যাতে নিজেদের জীবন ও ক্রিয়ার বাহনটিকে তার সঙ্গে যুতে দেওয়া যায়। জন্তুদের সঙ্গে মানুষদের যা কিছু পার্থক্য তা তাদের ইন্দ্রিয়জ রূপককে এভাবে একটা নকশায় শোধিত করে নেওয়ার, বা অন্যভাবে বললে, একটি প্রতিমাকে দ্রবীভূত করে ধারণা গড়ার সক্ষমতার উপর নির্ভরশীল। তা এই জন্য যে এসব নকশার জগতে এমনকিছু সম্ভবপর হয়ে ওঠে যা ওইসব ইন্দ্রিয়জ প্রথমাভাসের জগতে কখনই সম্ভবপর ছিল না— সেগুলি হল: জাত ও ধাপের ভিত্তিতে এক পিরামিড-সুলভ ব্যবস্থা নির্মাণ করা; আইন, সুবিধা, অধীনস্থকরণ, সীমানা টানা, ইত্যাদির এক নতুন জগৎ তৈরি করা যা এখন ইন্দ্রিয়-উপলব্ধ অপর জগতের মুখোমুখি হতে পারে এবং ইন্দ্রিয়-উপলব্ধ অপর জগতের চেয়ে আরো দৃঢ়, আরো সাধারণ, আরো চেনা ও আরো মানবিক হওয়ার দাবিতে নিয়ামক ও অনুজ্ঞাসূচক হয়ে ওঠে। কোনো ইন্দ্রিয়জ বোধের প্রকাশক রূপক যেখানে স্বতন্ত্র ও স্বকীয় হতে বাধ্য ও সেইজন্যই সর্বদা বর্গীকরণ এড়িয়ে যেতে পারে, সেখানে ধারণাসমূহের মহান নির্মাণ রোমান কলমবারিয়াম-য়ের দৃঢ়বদ্ধ নিয়মানুবর্তিতাকে ধারণ করে, আর গণিতের বৈশিষ্ট্যস্বরূপ কঠোর শৈত্য যুক্তির শ্বাস-প্রশ্বাসে প্রবাহিত হয়। সেই শীতল নিশ্বাস যাকে ছুঁয়ে গেছে সে থোড়াই বিশ্বাস করবে যে হাড়-প্রধান ও আটকোণা পাশার ঘুঁটির মতো ঠিক একইরকম ভাবে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় স্থান বদল করিয়ে নেওয়ার উপযোগী ধারণাগুলোও রূপকের পড়ে-থাকা অবশিষ্টাংশ ছাড়া আর কিছু নয়। তারা থোড়াই বিশ্বাস করবে যে ইন্দ্রিয়জ উদ্দীপনাকে চারুসম্মতভাবে প্রতিমায় তর্জমা করে তৈরি যে মায়াভ্রম তা-ই হল প্রতিটি ধারণার মা না হলেও দিদিমা তো বটেই। ধারণাগত এই পাশাখেলার মধ্যে প্রতিটি ঘুঁটিকে তার পদনাম অনুযায়ী ব্যবহার করা, চালের নিখুঁত হিসাব রাখা, সঠিক বর্গীকরণ তেরি করা এবং পদমর্যাদার শ্রেণিগত ক্রমবিন্যাস বা জাতের ধাপবন্দি নির্ণয়ের বিরুদ্ধে আপত্তিকর কোনও অবস্থান না নেওয়াই হল ‘সত্য’ কথাটার মানে। প্রাচীন রোম ও এট্রুরিয়ার বাসিন্দারা যেমন আকাশকে দৃঢ় গাণিতিক রেখায় ভাগ করে, ধর্মীয় আচারের থানের মতো এভাবে পৃথক করে তোলা একটি স্থানখণ্ডে একটি ঈশ্বরকে আবদ্ধ করেছিল, ঠিক তেমনই সব মানুষেরই নিজেদের উপরে সেমত একটি গাণিতিক উপায়ে বিভক্ত ধারণার আকাশ রয়েছে এবং তারা সত্যের দাবি বলতে বোঝে যে প্রতিটি ধারণাস্বরূপ ঈশ্বরকে কেবলমাত্র তার এই গণ্ডীবদ্ধ বলয়ের মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যাবে। নিশ্চিতভাবেই মানুষের এই স্থাপত্যবিদ্যাগত কুশলতাকে কুর্ণিশ করতে হয় যার বলে সে অস্থির-গতি ভিত্তিমূলের উপর, বা বলা চলে, বহমান জলের উপর ধারণাসমূহের এই অনন্ত জটিল নকশার উপাসনাগৃহ নির্মাণ করেছে। বিশ্রামস্থল হতে হলে সেই উপাসনাগৃহের গঠন হতে হয় মাকড়সার জালের মতো এত মিহি যে তা ঢেউয়ের মাথায় ভেসে থাকতে পারে, আবার এতই পোক্ত যে ঝড়ও তাকে ছিঁড়ে ফেলতে পারে না। এই নিরিখে বিচার করলে মানুষ স্থাপত্যবিদ্যা কুশলতায় মৌমাছিদের থেকেও অনেক বড়— মৌমাছি তো প্রকৃতি থেকে সংগ্রহ করা মোম দিয়ে তার নির্মাণকাজ সারে, সেখানে মানুষ নির্মাণ করে তার চেয়ে অনেক মিহি বস্তু— ধারণা— দিয়ে, যা তাকে প্রথমত নিজের মধ্য থেকেই নিজেকে উৎপাদন করে নিতে হয়। এই জন্য সে বেশ প্রশংসার দাবিদার, তা কেবল তার সত্যের প্রতি আবেগের জন্য বা বস্তুসমূহের খাঁটি জ্ঞানের প্রতি আবেগের জন্য নয়। যদি কেউ কোনোকিছু একটা ঝোপের পিছনে লুকিয়ে রেখে তারপর সেটা খুঁজতে শুরু করে সেই ঝোপের পিছনেই এবং অবশেষে তা খুঁজে বের করে, তার এই খোঁজা ও খুঁজে পাওয়ার মধ্যে বড়াই করার মতো খুব কিছু থাকে না; যুক্তির অঞ্চলের মধ্যে ‘সত্য’-কে খোঁজা ও খুঁজে পাওয়ার ব্যাপারটিও কিন্তু ঠিক একই রকম। স্তন্যপায়ী সম্পর্কে একটি সংজ্ঞা আমি তৈরি করলাম, আর তারপর একটা উটকে পরিদর্শন করে ঘোষণা করলাম, ‘দ্যাখো, এই একটি স্তন্যপায়ী’, তাহলে অবশ্যই একটা সত্যকে আলোয় আনা হয়, কিন্তু সে সত্যের মূল্য সীমিত। মূল্য সীমিত বলতে আমি বলতে চাইছি যে তা আগাপাশতলা মনুষ্যরূপ-আরোপ-প্রবণ এবং এমন কিছু বিন্দুমাত্র তাতে নেই যা মনুষ্যপ্রজাতি নির্বিশেষে সাধারণভাবে বৈধ বা বাস্তবিক হিসেবে ‘স্বয়ংগতভাবে সত্য’ (‘true in itself’) বলা যায়। এই ধরনের সত্যের জন্য যিনি গবেষণা করছেন, তিনি মূলগতভাবে গোটা বিশ্বের এক মনুষ্যে-রূপান্তর চাইছেন, তিনি বিশ্ব সম্পর্কে এমন একটা বোঝাবুঝিতে পৌঁছতে চেষ্টা করছেন যা বিশ্বকে মানুষের মতো একই রকম কিছু করে তোলে, আর তঁার এহেন প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে সবচেয়ে ভালো এক প্রকার আত্মীকরণের অনুভূতি লাভ করতে পারেন। একজন জ্যোতিষী যেমন মানুষের সুখ-দুঃখের নিরিখে মানুষের কাজে লাগাতেই তারাদের পর্যবেক্ষণ-পাঠ করেন, আমাদের পূর্বোক্ত সত্য-গবেষকও মনে করেন যে গোটা বিশ্বটাই মনুষ্যপ্রজাতির সঙ্গে যুক্ত, মনুষ্যপ্রজাতি যেন কোনো মূল ধ্বনি আর গোটা বিশ্ব তার অসীমবার প্রতিসরিত প্রতিধ্বনি, মনুষ্যপ্রজাতি যেন কোনও একক মূল ছবি আর গোটা বিশ্ব তার বহুগণিত প্রতিলিপি। তঁার পদ্ধতি হল মানুষের সাপেক্ষে অন্য সমস্ত বস্তুর পরিমাপ করা, আর তা করতে গিয়ে তিনি এই ভ্রমকেই তঁার প্রস্থানবিন্দু করে তোলেন যে এই সকল বস্তুই খাঁটি পদার্থ হিসেবে তঁার সামনে প্রত্যক্ষভাবে হাজির আছে। এভাবে তিনি ভুলে যান যে ইন্দ্রিয়োপলব্ধির আদি রূপকগুলো আসলে রূপকই, ভুলে গিয়ে তিনি তাদেরকেও বস্তু হিসেবে জ্ঞান করতে থাকেন।

কেবলমাত্র রূপকের এই আদি জগতকে ভুলে যাওয়ার মধ্য দিয়ে; মানুষের কল্পনাশক্তির আদিম উৎস থেকে উষ্ণ তরল ধারায় প্রবাহিত রূপকপুঞ্জ জমাট বেঁধে শক্ত হয়ে ওঠার কারণে; এই সূর্য, এই জানালা, এই টেবিল হল স্বয়ংগতভাবে সত্য এমন অজেয় বিশ্বাস গড়ে নেওয়ার মধ্য দিয়ে— সংক্ষেপে বললে, সে নিজে যে বিষয়ী, নান্দনিক সৃজনধর্মী বিষয়ী, তা ভুলে যাওয়ার মধ্য দিয়েই মানুষ কিছু পরিমাণ শান্তি, নিরাপত্তা ও স্থিরতা নিয়ে বাঁচতে পারে। এই বিশ্বাসের কারাগার-প্রাচীর ভেঙে এক মুহূর্তের জন্য বাইরে বেরোলেই তার আত্মবিশ্বাসের তোরণ ভেঙে পড়বে। পোকামাকড় ও পাখিরা যে তার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি জগৎ উপলব্ধি করে, তা স্বীকার করতেও মানুষের কষ্ট হয়, আর জগৎ সম্পর্কে এই ভিন্ন ভিন্ন উপলব্ধিগুলোর কোনটা বেশি সঠিক তা এক অবান্তর প্রশ্ন কারণ উপলব্ধির সঠিকতার কোনো মাপকাঠি অস্তিত্বহীন। সাধারণভাবে আমার মনে হয় যে সঠিক উপলব্ধি— অর্থাৎ, কোনো বিষয়ীর মধ্যে বিষয়ের পূর্ণ ও যথেষ্ট অভিব্যক্তি— অসংগতিপূর্ণ ও অসম্ভব, কারণ বিষয় ও বিষয়ীর মতো দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন বলয়ের মধ্যে কোনো কারণতত্ত্ব, সঠিকতা বা অভিব্যক্তির সম্পর্কস্থাপন হতে পারে না, বড়জোর একপ্রকার নান্দনিক সম্পর্কনির্মাণ ঘটতে পারে। এই নান্দনিক সম্পর্কনির্মাণ বলতে আমি সম্পূর্ণ ভিন্ন ভাষায় এক প্রকার পরোক্ষ উপস্থাপন বা তোতলানো তর্জমার কথা বলতে চেয়েছি। তার জন্য এমন এক মধ্যবর্তী বলয় বা মধ্যস্থতাকারী বল অবশ্যপ্রয়োজন যা মুক্তভাবে উদ্ভাবন ও কাব্যসৃষ্টি করতে পারে। ‘প্রকাশ’ (ইংরেজিতে appearance, জার্মানে erscheinung) শব্দটির মধ্যে নানা প্রলোভন নিহিত আছে, তাই আমি এই শব্দটির ব্যবহার যথাসম্ভব এড়িয়ে চলি; কারণ সত্য এটা নয় যে বস্তুদের অন্তঃসার (essence) অভিজ্ঞতালব্ধ জগতে প্রকাশ পায়। অভিজ্ঞতালব্ধ জগৎ বস্তুদের অন্তঃসার সম্পর্কে কতটা কী উন্মোচিত করতে পারে? হাতকাটা কোনো চিত্রকর যদি তঁার সামনে বিচরণকারী দৃশ্যকে গানের মাধ্যমে প্রকাশ করতে সচেষ্ট হন, এই এক বলয় থেকে আরেক বলয়ে প্রতিস্থাপনের মধ্য দিয়ে তিনি যতটা উন্মোচিত করতে পারবেন, অভিজ্ঞতালব্ধ জগৎ বস্তুদের অন্তঃসার সম্পর্কে তার চেয়েও কম উন্মোচিত করতে পারে। একটি ইন্দ্রিয়জ উদ্দীপনার সঙ্গে তা থেকে উৎপাদিত প্রতিমাটির কোনো আবশ্যক সম্পর্ক নেই; কিন্তু বহু বহু হাজার বার এই একই প্রতিমা উৎপাদিত হয়ে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মানুষের মধ্যে হস্তান্তরিত হয়ে আসার পর, এমনকি সেই প্রক্রিয়াবশত গোটা মনুষ্যপ্রজাতির মধ্যে একই উৎসোদ্ভূত হিসেবে গণ্য হতে থাকার পর, তা অবশেষে সব মানুষের কাছে একই তাৎপর্যধারী হিসেবে হাজির হয়, যেনবা সেটাই একমাত্র আবশ্যক প্রতিমা এবং মৌলিক ইন্দ্রিয়জ উদ্দীপনার সঙ্গে যেনবা প্রতিমাটি কোনো এক দৃঢ় কারণতত্ত্বের সম্পর্কে বদ্ধ— ঠিক যেমন একটি স্বপ্নের নিত্য পুনরাবৃত্তি ঘটে চললে তাকেই সম্পূর্ণ বাস্তবতা বলে বোধ হতে পারে। কিন্তু একটি রূপকের জমাট বেঁধে অনমনীয় হয়ে ওঠা তার আবশ্যকতা বা একচেটিয়া যাথার্থ্যের কোনো প্রমাণ হতে পারে না।

আবশ্যকতা বা একচেটিয়া যাথার্থ্যের ভাবনায় স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে এমন কেউ যখন প্রকৃতির নিয়মাবলীর চির সামঞ্জস্য, সর্বব্যাপিত্ব ও অকাট্যতা সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হয়, তখন সে এ-জাতীয় আদর্শবাদ সম্পর্কে গভীরভাবে সন্দিহান হয়ে ওঠে। সে তখন সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে দূরবীক্ষণ যন্ত্রে ধরা পড়া দূর মহাবিশ্ব থেকে অণুবীক্ষণ যন্ত্রে খুঁড়ে তোলা গহন বিশ্ব অবধি যত দূর আমরা পৌঁছতে পারি সমস্ত কিছু এতটাই নিশ্চিত, সু-বিস্তারিত, অন্তহীন, নিয়মাবদ্ধ এবং ফঁাকফোকরহীন যে বিজ্ঞান চিরকাল সফলভাবেই এই খনি খুঁড়ে চলতে পারে এবং যা-কিছু সেভাবে পাওয়া যাবে সবই আত্মবিরোধহীন ও সুসামঞ্জস্যপূর্ণ হবে। এসবকে কল্পনার বস্তু বলা যায় না কারণ যদি তা হতো তাহলে কোথাও না কোথাও এর মধ্যের ভ্রম ও অবাস্তবতা প্রকাশ পেয়ে যাওয়া অবধারিত ছিল। এই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে প্রথম আপত্তির বিষয়টি হল: যদি এখনও আমাদের প্রত্যেকের ইন্দ্রিয়োপলব্ধি ভিন্ন ভিন্ন ধরনের হতো; পাখি, কীট-পতঙ্গ বা গাছ যে যে ভাবে অনুভব করে আমরা যদি সেই বহু বিভিন্ন ভাবেও অনুভব করতে পারতাম; একই উদ্দীপনাকে একজন যখন আমরা কেউ লাল দেখছি, আরেকজন কেউ নীল দেখতে পারত, আবার অন্য আরেকজন সেটাকে ধ্বনি হিসেবে শুনতে পারত; তাহলে আর কেউ কখনো প্রকৃতির কোনো দৃঢ়বদ্ধ নিয়মাবলীর অনুসারী হওয়ার কথা বলত না; বরং প্রকৃতিকে একটি অত্যন্ত বিষয়ীগত নির্মাণ হিসেবে গণ্য করা হতো। আদপে প্রকৃতির কোনো নিয়ম আমাদের কাছে কীভাবেই বা ধরা দিতে পারে? প্রকৃতির কোনো নিয়ম স্বয়ং আমাদের কাছে জ্ঞাত হয় না, তার প্রভাবের মধ্য দিয়ে তা জ্ঞাত হয়; অর্থাৎ, জ্ঞাত হয় প্রকৃতির অন্যান্য নিয়মের সঙ্গে তার সম্পর্কের মধ্য দিয়ে, যে অন্যান্য নিয়মগুলোও কেবলমাত্র সেহেন সম্পর্ক হিসেবেই জ্ঞাত। সুতরাং এই সব সম্পর্কগুলো কেবল একে অপরকে নির্দেশ করে চলে এবং তাদের আবশ্যিক চরিত্র সম্পূর্ণতই আমাদের বোধাতীত; তাদের বিষয়ে সেটুকুই আমরা জানি যা আমরা নিজেরা তাদের উপর প্রযুক্ত করেছি, যেমন, কাল ও স্থান, বা অন্য ভাষায়, অনুক্রমের সম্পর্ক ও সংখ্যা। কিন্তু যা বিস্ময়কর, যা নিখাদ প্রকৃতির এই নিয়মাবলী সম্পর্কে আমাদের বিস্ময় জাগরিত করে, যা আমাদের ব্যাখ্যা দাবি করে এবং আদর্শবাদ সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে উঠতে প্রলুব্ধ করে, সে সবই তো স্থান-কাল-বিবরণের দৃঢ়-নির্দিষ্টতা ও সর্বজনীন বৈধতা নির্মাণের জন্যই! কিন্তু এই নির্মাণ আমরা আমাদের মধ্যে ও আমাদের থেকে সেই একই আবশ্যকতা থেকে চালিয়ে যাই যা থেকে একটা মাকড়সা তার জাল বুনে চলে। কেবলমাত্র এই নির্মিত কাঠামোর মধ্যেই যদি সকল বস্তুকে বুঝতে আমাদের বাধ্য করা হয়, তাহলে অবাক হওয়ার আর কিছু থাকে না যে ওই সকল বস্তুতে আমরা কেবল ওই নির্মিত কাঠামোটিকেই ফিরে ফিরে আবিষ্কার করতে থাকি; কারণ, বেঁধে দেওয়া হয় যে সকল বস্তুকেই সংখ্যার নিয়মাবলী প্রদর্শন করতে হবে, আর, সংখ্যাই হল বস্তুদের সবচেয়ে বিস্ময়কর চরিত্র। গ্রহ-তারাদের কক্ষপথে ও রাসায়নিক বিক্রিয়ার প্রক্রিয়ায় যে সকল দৃঢ়-নিয়মানুবর্তীতা আমরা আবিষ্কার করি তা যেসব ধর্মকে আমরা নিজেরা বস্তুদের উপর প্রযুক্ত করি মূলগতভাবে তারই অনুরূপ, যার ফলে, আমরা আমাদের নিজেদের ক্রিয়াকেই আরোপ করতে থাকি। এর ফলে রূপকের যে নান্দনিক উৎপাদনের মধ্য দিয়ে আমাদের প্রতিটি সংবেদন সূচিত হয়, তা ওইসব নির্মিত কাঠামোগুলোকেই পূর্বানুমানে স্বীকার করে নেয় ও তাদের ভিতরেই নির্বাহিত হয়। রূপক দিয়ে কীভাবে ধারণার অট্টালিকা তৈরি সম্ভব তা একমাত্র এই মৌলিক কাঠামোগুলোর স্থিতিশীলতা দিয়েই ব্যাখ্যা করা যায়, কারণ এই ধারণার অট্টালিকা হল রূপকের ভিতের উপর দাঁড়ানো স্থান-কাল-সংখ্যা-সূচক সম্পর্কগুলোর এক প্রতিমূর্তি।

আমরা দেখলাম যে ধারণার অট্টালিকা নির্মাণের কাজে শুরুতে হাত লাগিয়েছিল ভাষা, পরবর্তীতে হাত লাগিয়েছে বিজ্ঞান। মৌমাছি যেমন তার চাকের কোষগুলো তৈরি করার সঙ্গে সঙ্গে সেগুলোকে মধু দিয়ে ভরে তোলে, বিজ্ঞানও তেমনই সংবেদনের কবরখানা হিসেবে ধারণাসমূহের বিপুল কলমবারিয়াম নির্মাণে অনবরত কাজ করে চলে— নিত্য নতুন থাক যোগ করতে থাকে, পুরানো কুঠুরিগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ ও ঝাড়াপোঁছা চালায়, আর সর্বোপরি সেই ক্রমপ্রসারমান বিপুলাকৃতি কাঠামোকে ভর্তি করতে থাকে, গোটা অভিজ্ঞতালব্ধ জগৎ, অর্থাৎ, মনুষ্যরূপ-আরোপিত জগতকে শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে সেই কাঠামোয় খাপ খাইয়ে সাজিয়ে রাখে। কাজের মানুষ যেমন ভেসে গিয়ে হারিয়ে যাওয়া আটকাতে যুক্তি ও তার ধারণাসমূহের খুঁটিতে নিজের জীবনকে বেঁধে রাখে, গবেষকও তেমনই বিজ্ঞানের মিনারের কাছাকাছি তার কুটির তৈরি করে যাতে সেই মিনার-নির্মাণে হাত লাগানোর পাশাপাশি ইতিমধ্যেই সুবিস্তৃত সেই দুর্গপ্রাচীরের পিছনে নিরাপত্তার প্রয়োজনে আশ্রয় নেওয়া যায়। আর নিরাপদ আশ্রয়ের প্রয়োজন তার আছেও বটে, কারণ প্রতিনিয়তই ভয়প্রদ সব আপদ বহুবিধ নকশাকাটা ঢাল-তলোয়ার শানিয়ে তাকে চেপে ধরে আর তার বৈজ্ঞানিক সত্যের বিপরীতে সম্পূর্ণ অন্য ধরনের সব সত্যদের এনে দাঁড় করায়।

রূপক তৈরির প্রবৃত্তি হল এমনই মৌলিক এক মনুষ্য-প্রবৃত্তি মনুষ্য-অস্তিত্বকে ত্যাগ না করে যাকে এক মুহূর্তের জন্যও ত্যাগ করা যায় না। সেই প্রবৃত্তিরই শোধিত ফসল, অর্থাৎ, ধারণাসমূহ দিয়ে নিয়মাবদ্ধ ও অনমনীয় এক নতুন বিশ্ব তৈরি করে সেই দুর্গের মধ্যে ওই প্রবৃত্তিকে বন্দি করার প্রক্রিয়ায় তাকে হারানো তো যায়ই না, বশ মানানোও যায় না। প্রবৃত্তি ঠিক নিজের মতো করে ক্রিয়া করার নতুন ক্ষেত্র ও নতুন পথ খুঁজে নেয়। নতুন নতুন তর্জমা, রূপক ও লক্ষণা খাড়া করার মধ্য দিয়ে ধারণাসমূহের কুঠুরিবিন্যাস ও বর্গীকরণকে সে প্রতিনিয়ত গুলিয়ে দিতে থাকে। স্বপ্নের জগতে বস্তুরা যেমন বহুরূপী, নিয়মহারা, অসংগত, অসংলগ্ন, মনোহর ও চিরনতুন, জাগ্রত মানুষদের জগৎটাকেও ঠিক সেই ধারায় সাজানোর আকাঙ্ক্ষা সে প্রতিনিয়ত উসকে দেয়। আসলে, ধারণাসমূহের অনমনীয় ও নিয়মাবদ্ধ জালের কল্যাণেই জাগ্রত মানুষ নিজের জাগ্রত অবস্থা সম্পর্কে স্পষ্টভাবে সচেতন থাকতে পারে, আর সেই কারণেই কখনও সেই জাল নন্দনশিল্পের ঘায়ে ছিঁড়ে পড়লেই সে মাঝেমধ্যে বিশ্বাস করে বসে যে সে স্বপ্ন দেখছে। পাসকাল সঠিকভাবেই বলেছিলেন প্রতি রাত্রে যদি একই স্বপ্ন আমাদের কাছে ফিরে ফিরে আসে, তাহলে প্রতিদিন দেখা বস্তুদের মতোই তা আমাদের ভাবনা জুড়ে বিরাজ করবে। পাসকালের ভাষায়, ‘একজন কারিগর যদি নিশ্চিতভাবে রোজ রাতে বারো ঘন্টার জন্য রাজা হওয়ার স্বপ্ন দেখে, আমার মনে হয় প্রতি রাতে বারো ঘন্টা ধরে কারিগর হওয়ার স্বপ্ন দেখা রাজার মতোই সমান সুখী সে হবে।’ অতিকথা যেহেতু অবিরাম কার্যকরী অলৌকিকতার রূপ ধরে, প্রাচীন গ্রিকদের মতো এমন মানুষজন যারা অতিকথার দ্বারা চালিত, তাদের জাগ্রতাবস্থাও বিজ্ঞান-দ্বারা-শোধিত-মস্তিষ্ক মানুষদের জাগ্রতাবস্থার চেয়ে অনেক বেশি স্বপ্নের সমতুল। একদিন যদি গাছ বনদেবী হয়ে কথা বলে উঠতে পারে, ঈশ্বর মোষের ভেক ধরে কুমারীদের অপহরণ করতে পারে, স্বয়ং দেবী আথেনকে হঠাৎই দেখা যায় আথেনস নগরীর বাজার-এলাকা দিয়ে পিসিস্ট্যাটাস-এর সাথে এক অপূর্ব রথে সওয়ার হয়ে যাচ্ছেন— এসব ছিল আথেনসবাসীদের সৎ বিশ্বাসের বিষয়— তাহলে যে কোনো সময় যে কোনো কিছু সম্ভব হয়ে উঠতে পারে, ঠিক যেমন স্বপ্নে হয়, আর গোটা প্রকৃতিই যেন উত্তেজনায় টগবগ করে মানুষদের ঘিরে নাচতে থাকে, যেনবা ছদ্মবেশী এক দল দেবতা যত রকমের আকার ও রূপ ধারণ করে মানুষদের বোকা বানিয়ে মজা করছে।

অবশ্য নিজেদের বোকা বনতে দেওয়ার এক অদম্য আকাঙ্ক্ষা মানুষের নিজের মধ্যেই আছে, আর তারা সুখে বিহ্বল হয়ে পড়ে যখন কথক সত্য কাহিনীর মতো করে মহাকাব্যিক রূপকথা আবৃত্তি করে, অথবা কোনো অভিনেতা বাস্তবের রাজার চেয়ে অনেক রাজকীয়ভাবে নাট্যমঞ্চের রাজাকে হাজির করে। বুদ্ধিবৃত্তি হল ছল-চূড়ামণি উপাধির যোগ্য, সেই বুদ্ধিবৃত্তি প্রচলিত দাসত্ব থেকে অব্যাহতি পেয়ে ততক্ষণই মুক্ত থাকে যতক্ষণ সে কোনো অনিষ্টসাধন ছাড়াই বোকা বানাতে পারে, সেই সময় সে উৎসব-হুল্লোড়ে মত্ত থাকে; এত ঋদ্ধ, এত প্রাচুর্যময়, এত গর্বিত, দক্ষ ও সাহসী আর কোনো সময় সে হয় না। সৃজনশীল সন্তুষ্টিতে মেতে সে রূপকগুলোকে এলোমেলো করে মিশিয়ে দেয়, বিমূর্তায়নের সীমানা-পাথরগুলোকে সরিয়ে সরিয়ে দেয়, নদীকে যেমন বর্ণনা করে বসে গন্তব্যমুখী হাঁটা-পথ হিসেবে। এই সময় বুদ্ধিবৃত্তি তার দাসত্বের চিহ্ন মুছে ফেলে। সাধারণত যে নীরস পরিশ্রমীর মতো তার প্রভুর জন্য লুঠতরাজ করে আনতে বেরোয়, বা, জীবনের কামনায় কাতর কোনো অভাগাকে পথ ও পাথেয় সন্ধান করে দেয়; এই সময় সেই বুদ্ধিবৃত্তি নিজেই নিজের প্রভু হয়ে উঠে মুখ থেকে অভাবের অভিব্যক্তি মুছে ফেলতে পারে। এই সময়ে বুদ্ধিবৃত্তি যা করে, তা সবই ছলের চিহ্ন বহন করে, ঠিক যেমন অন্য সময়ে তা বিকৃতকরণের চিহ্ন বহন করত। সে মানব-জীবনের অনুলিপিকরণ করে, কিন্তু তা বেশ উত্তম কিছু বলে ধরে নিয়ে মোটামুটি পরিতৃপ্তি বিধান করে। অভাব-তাড়িত মানুষ যে কড়ি-বরগার বিপুল সম্ভার আঁকড়ে জীবনের মধ্য দিয়ে তার যাত্রাপথে নিজেকে রক্ষা করে, মুক্তবুদ্ধি-জনা সেসবকেই ব্যবহার করে নিছক খেলার সিঁড়ি হিসেবে, যার উপরে সবচেয়ে ভয়ডরহীন তামাশা প্রদর্শন করা যায়; আর যখন এই খেলার ছলে কাঠামোটাকেই সে ভেঙে ফেলে, এলোমেলো করে দেয়, আবার ব্যঙ্গের ছলে জড়ো করে তোলে, সবচেয়ে অভাবিত বস্তুদের জোড় তৈরি করে, আবার ঘনিষ্ঠতম বস্তুদের জোড় ভেঙে আলাদা করে দেয়, তখন তা বুঝিয়ে দেয় যে অভাবীপনার কাজ-চালানো-গোছের সহায়তা তার দরকার নেই, এখন সে আর ধারণাদের দ্বারা চালিত হচ্ছে না, স্বজ্ঞা দ্বারা চালিত হচ্ছে। এহেন স্বজ্ঞাদের থেকে কোনো চালু পথই ছক ও বিমূর্তায়নের ভুতুড়ে রাজ্যে গিয়ে সেঁধায়নি, তাদের জন্য কোনো শব্দও তৈরি হয়নি, তাদের দেখলে মানুষ বোবা হয়ে যায়, অথবা কেবলমাত্র নিষিদ্ধ সব রূপক আর অশ্রুতপূর্ব ধারণা-সমবায় দিয়ে কথা বলে যাতে অন্তত পুরোনো ধারণাগত বাধাগুলোকে বিদ্রূপছলে ধ্বংস করা যায় ও সেভাবে তেজস্বী বর্তমান স্বজ্ঞার প্রভাবের প্রতি সৃজনশীল সুবিচার করা যায়।

এমন কোনো কোনো যুগ আসে যখন যুক্তির মানুষ আর স্বজ্ঞার মানুষ পাশাপাশি এসে দাঁড়ায়, একজন স্বজ্ঞার প্রতি ভয় নিয়ে আর অপরজন বিমূর্তায়নের প্রতি উপহাস নিয়ে, দ্বিতীয়জন ততটাই অযৌক্তিক যতটা প্রথমজন নন্দন-রস-হীন। উভয়েই তারা জীবনের উপর শাসন কায়েম করতে চায়— তা প্রথমজন করতে চায় ভবিষ্যতের জন্য সংস্থান দিয়ে, পরিণামদর্শিতা দিয়ে, নিয়মানুবর্তিতা দিয়ে জীবনের প্রধান দুর্যোগগুলোর সঙ্গে এঁটে ওঠার উপায় বিষয়ক জ্ঞানের জোরে; আর দ্বিতীয়জন করতে চায় এমন এক প্রাণোচ্ছাসে পূর্ণ নায়ক হওয়ার মধ্য দিয়ে যে ওইসব দুর্যোগ খেয়ালমাত্র না করে জীবনকে তখনই প্রকৃত বলে মানে যখন তা সুন্দর ও বাহ্যাড়ম্বরের ভেক ধরে হাজির হয়। প্রাচীন গ্রিসের মতো কোথাও কখনো যদি স্বজ্ঞার মানুষ তার অপরপক্ষের চেয়ে বেশি জোরের সঙ্গে জয়ীর মতো তার অস্ত্র চালনা করে, অনুকূল পরিবেশ পরিস্থিতির উপর দাঁড়িয়ে এক ধরনের সংস্কৃতি আকার নেয় এবং জীবনের উপর নান্দনিকতার শাসন কায়েম হতে পারে; তার ফলস্বরূপ যাপিত জীবনের প্রতিটি অভিব্যক্তির সঙ্গে ভান, অভাবীপনাকে অস্বীকার, রূপকধর্মী দর্শনশক্তির প্রভা, আর অবশ্যই সাধারণভাবে ছল যুক্ত হয়ে যায়। বাড়িঘর, চলনভঙ্গিমা, পোষাক-পরিচ্ছদ বা মাটির ঘড়া কোনোটাই অভাবীপনার তাড়নায় উদ্ভাবিত বস্তুর আভাস নিয়ে হাজির হয় না; মনে হয় যেন বা এই প্রত্যেকটিই মহৎ সুখ ও স্বর্গীয় মেঘমুক্ততা প্রকাশ করতে অভিপ্রেত, যেন বা সবই অকপট বস্তু নিয়ে খেলা। পক্ষান্তরে, যে মানুষ ধারণা ও বিমূর্তায়ন দিয়ে চালিত, সে তার মধ্য দিয়ে দুর্ভাগ্যকে বারবার এড়িয়ে যেতেই কেবল সফল হয়, বিমূর্তায়ন নিঙড়ে সে নিজের জন্য কোনো সুখ নিঃসৃত করতে পারে না, যতটা সম্ভব যন্ত্রণা থেকে মুক্ত থাকার চেষ্টাই করে যায় কেবল। একরূপ সংস্কৃতির মাঝে দাঁড়িয়ে স্বজ্ঞার মানুষ তার স্বজ্ঞা থেকে কেবলমাত্র অনিষ্ট থেকে রক্ষাই নয়, বরং উজ্জ্বলতা, সত্তার ভারহীনতা, দায়মোচন ও মুক্তির এক অবিরাম প্রবাহকেও প্রত্যক্ষভাবে লাভ করে। অবশ্যই সে যখন কষ্টভোগ করে, তা আরো বেশি তীব্র হয়, তার কষ্টভোগ ঘটেও আরো ঘন ঘন কারণ অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিতে না জানার ফলে সে একই ফঁাদে বারবার পা দিয়ে চলে। তার কষ্টভোগের সময়েও যে তার সুখের সময়ের মতো একই রকম অযৌক্তিক, চিৎকার করে সে জানান দেয়, কোনো সান্ত্বনা সে মানে না। সুখ-দুঃখে উদাসীন যে ব্যক্তি অভিজ্ঞতা থেকে শেখে আর ধারণা দিয়েই নিজেকে চালিত করে, একই দুর্ভোগ সে কত না আলাদাভাবে সহ্য করে! এই উদাসীন ব্যক্তি, যে অন্যথায় কেবল সততা, সত্য, মোহমুক্তি এবং চিত্তবিক্ষেপকারী বস্তুর আক্রমণ থেকে রক্ষাকবচ খুঁজে বেড়ায়, এখন এই দুর্ভোগের মধ্যে নিমজ্জিত হয়ে ছলের ওস্তাদিপূর্ণ অভিনয় করে, ঠিক যেমন তার অপরপক্ষ করে সুখে নিমজ্জিত হলে: পরিবর্তমান, কম্পমান কোনো মানুষের মুখ তার নয়, বরং সম্ভ্রান্ত সুস্থিতি আঁকা এক মুখোশ তাকে ঢেকে রাখে; সে চিৎকার করে না, তার গলার স্বরের পর্দায় নড়চড় হয় না। ভয়ানক এক ঝঞ্ঝাও যদি তার মাথায় ভেঙে পড়ে সে তার চাদরটাকে আরো আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিয়ে ধীর পায়ে সেখান থেকে সরে যাবে।

 

 

টীকা-টিপ্পনী

১। লেসিঙ-য়ের প্রথম ও একমাত্র সন্তান জন্মের অব্যবহিত পরেই মারা গিয়েছিল, তার কিছু পরে তার মা-ও মারা যায়। এই বিষয়ে লেসিঙ তঁার এক বন্ধুকে লেখা চিঠিতে মন্তব্য করেছিলেন: ‘তারা যে ওকে সাঁড়াশি দিয়ে টেনে পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ করল, আর সে যে অত দ্রুতই যত আবর্জনা টের পেল, তা কি আদৌ বুঝদারের মতো কাজ হয়েছিল? আর সে যে প্রথম সুযোগ কাজে লাগিয়েই এই পৃথিবী ছেডে় আবার চলে গেল, তা কি যথেষ্ট বুঝদারের মতো কাজ হয় নি?’ (১৭৭৮ সালের ১০-ই জানুয়ারি এসচেনবার্গকে লেখা চিঠি)

২। জার্মান ভাষায় বৃক্ষকে বলে der Baum, যা পুংলিঙ্গ, আর গুল্মকে বলে die Pflanze, যা স্ত্রীলিঙ্গ।

৩। বিশেষ ভাবে তৈরি বালি-ভর্তি বাক্সে তারের কম্পন নানা নকশা তৈরি করতে পারে যা কানে-শোনা ধ্বনির এক প্রকার চাক্ষুষ প্রতিমূর্তি বলে ধরা যেতে পারে। পদার্থবিদ আর্নস্ট ক্ল্যাডনি প্রথম এই পরীক্ষা করে প্রদর্শন করেছিলেন, তাই এহেন ধ্বনি-নকশা তঁার নামে পরিচিত।

৪। কলমবারিয়াম (columbarium) হল রোমোর কাছে অবস্থিত দুইদিকে কবরযুক্ত ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গপথ যেখানে নিয়মিত ব্যবধানে পায়রার খোপের মতো কুঠুরিতে পাত্র করে মৃতদের ছাই সংরক্ষিত করা হতো।

৫। ব্লেজ পাসকাল (১৬২৩–১৬৬২) একজন ফরাসি দার্শনিক ও গণিতবিদ। ‘পেঁসিজ’ তঁার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক রচনা, যা তঁার মৃত্যুর পর ১৬৭০ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। তঁার অন্যতম মূল বক্তব্য ছিল এই যে আমাদের প্রাথমিক নীতিগুলো যুক্তির ভিতের উপর গড়া নয়, বরং বিশ্বাসের ভিতের উপর গড়া। এখানে নিৎশে ‘পেঁসিজ’ থেকেই উদ্ধৃত করেছেন।

৬। হেরোডোটাস-এর রচনা থেকে।

 

 

0 Comments
Leave a reply