১
গী দেবোর (Guy Debord)-এর ‘The Society of the Spectacle’ বইটি ১৯৬৭ সালে প্রথম প্রকাশিত হওয়ার পর ফ্রান্সের মে ১৯৬৮ অভ্যুত্থানের বিদ্রোহী ছাত্রছাত্রী ও ভাবুকদের অন্যতম প্রধান অবলম্বন হয়ে উঠেছিল। দেবোর-এর মৌলিক প্রতিপাদ্য ছিল:
‘উৎপাদনের আধুনিক শর্তাবলী বিরাজ করছে এমন এই সমাজগুলোর গোটা জীবনটাই কাঁড়ি কাঁড়ি জমক (spectacles)-এর সমাহার হিসেবে নিজেকে হাজির করে। একসময় যা ছিলো প্রত্যক্ষ যাপনের ব্যাপার, সে সবই আজ নিছক প্রতিরূপ-উপস্থাপনার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
(The Society of the Spectacle, §1, বাংলায় তর্জমা বর্তমান লেখকের করা।)
উৎপাদনের আধুনিক শর্তাবলী বলতে দেবোর পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার কথা বলেছেন। প্রতীত বাস্তবতা এখানে এরকম: পুঁজিবাদে পণ্যই কেন্দ্রীয় চরিত্র; একজন মানুষ কী পণ্য বেচতে পারে ও আবার কী কী পণ্য কিনে নিতে পারে, তার উপরই নির্ভর করে অন্য মানুষদের সঙ্গে সে কতটা সম্পর্কস্থাপন হবে আর সেই সম্পর্কই বা কেমন হবে; যে পণ্যের দর যতো বেশি, সেই পণ্যওয়ালার কদরও ততোটাই বেশি; পণ্যহীন কোনো মানুষ সমাজে কারও সাথেই কোনো সম্পর্কে ঢুকতে পারবে না, বিচ্ছিন্ন অপাঙক্তেয় ও শেষাবধি অদৃশ্য হয়ে যাবে। ফলে মানুষকে নিজেকেও হাজির করতে হয় নজরকাড়া মোড়কে মোড়া একটি পণ্য হিসেবে; যাপনের নিবিড়তা নয়, আকর্ষণীয় প্রতিরূপ-উপস্থাপনাই এখানে কামনার বস্তু। আমাদের বাংলার এক কবি বলেছিলেন ‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’, প্রকৃত প্রস্তাবে জগতটাই অসংখ্য বিজ্ঞাপনের মোজেইক হয়ে ওঠে। তৈরি হয় জমক (spectacle)। পণ্য ও বিজ্ঞাপনের এই উড়ন্ত সব জোকাররা যে আলোকিত আকাশে চক্কর কাটে, তার অনেক নীচ থেকে বিচ্ছিন্ন বিষন্ন একাকী মানবসত্তাগুলো সেইদিকে তাকিয়ে থাকে, উত্তেজনা খোঁজে, অর্থ খোঁজে।
যা ছিলো প্রত্যক্ষ যাপন, সে-সবই নিছক প্রতিরূপ-উপস্থাপনা হয়ে ওঠার ব্যাপারটা কী? ধরা যাক, সুস্থ সতেজ যাপন ও অস্তিত্ব বোঝা যাবে মাইকেলঅ্যাঞ্জেলোর ভাস্কর্যের মতো সুঠাম তরঙ্গিত পেশীর দেহ দিয়ে, সমাজ বদলে ইতিহাস নির্মাণের দৃঢ়চেতা মনোভাব বোঝা যাবে রুশ-বিপ্লবের পোস্টারের মুঠো-করা-হাত-আকাশে-ছোঁড়া স্থির-দৃষ্টির শ্রমিক-কৃষক-প্রতিমা দিয়ে, যৌনতার সিদ্ধি বোঝা যাবে মেরিলিন মনরো বা গ্রেগরি পেক-এর মতো লাস্যধারীদের অঙ্গবিভঙ্গ দিয়ে, সভ্যতাসিদ্ধি বোঝা যাবে প্রমিত ইউরোপীয় পোষাক-আশাক-কেতা দিয়ে… এইরকমভাবে যদি আমরা ধরে নিতে থাকি ক্রমশ, আর এই প্রতিমাচিহ্নগুলো ক্রমশঅনুকরণের বস্তু হয়ে উঠতে থাকে, তাহলে প্রত্যক্ষ যাপনকে অগ্রাহ্য করে ক্রমশ এই চিহ্নগুলোর প্রতিরূপ হয়ে ওঠার দিকেই ঝোঁক বাড়ে। মুখের ওপর চাপে মুখোশ, মুখের চামড়া আর মুখোশের চামড়া মিশে যেতে থাকে, মুখ তারপর হারিয়ে যায়, মুখোশটাই থাকে।
২
দেবোরের বইটি প্রথম প্রকাশ হওয়ার পরের বছরের ফ্রান্সের মে-৬৮-আন্দোলনে বিদ্রোহী ছাত্র হিসেবে সক্রিয় ভূমিকা নেওয়া জাঁ বদ্রিয়ার (Jean Baudrillard)-এর ‘Simulacra and Simulation’ প্রকাশিত হয় ১৯৮১ সালে। লাতিন শব্দ ‘simulacrum’-এর মানে প্রতিমা বা প্রতিরূপ, ‘simulacra’ তার বহুবচন, আর ‘simulation’ হলো চিহ্নায়ক প্রতিরূপসমূহের এমনই এক সংহত বদ্ধ ছাঁচে-ফেলা ব্যবস্থা যেখানে যে কোনো চিহ্নায়ক ছাঁচের ব্যাকরণ অনুযায়ী সেই ব্যবস্থার মধ্যেরই অন্য কোনো চিহ্নায়কের দিকে ইঙ্গিত/নির্দেশ করে থাকে, ফলে এই বদ্ধ ব্যবস্থার মধ্যেই চিন্তা, বোধ, প্রতীতি সীমাবদ্ধ হয়ে থাকে, তার বাইরে বেরোনোর উপায় থাকে না, ফলে এই প্রতিরূপ-সমষ্টির বাইরে থেকে যাওয়া জীবন বা বাস্তবতা প্রতীত হওয়ার আর কোনো পথ থাকে না। বর্তমান আলোচনায় পরিভাষা হিসেবে আমরা ‘simulacrum’-কে ‘প্রতিরূপ’ এবং ‘simulation’-কে ‘প্রতিরূপায়ন’ বলবো। বদ্রিয়ার মনে করেছেন যে প্রতিরূপায়ন (simulation) প্রকৃত বাস্তব থেকে বিচ্ছিন্ন করে এমন এক পরাবাস্তবতা (hyperreality) তৈরি করে দেয় যা প্রকৃত বাস্তবতার চেয়ে অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে।
‘Simulacra and Simulation’ বইয়ের ‘The Precession of Simulacra’ প্রবন্ধে বদ্রিয়ার প্রতিমার ক্রমিক পর্যায়গুলোকে চিহ্নিত করেছেন এইভাবে:
প্রতিমার ক্রমিক পর্যায়গুলো হলো:
(১) তা হলো গভীর বাস্তবতার একটি প্রতিফলন;
(২) তা গভীর বাস্তবতাকে মুখোশ পরিয়ে স্বভাব/গুণ পাল্টে দেয়;
(৩) কোনো গভীর বাস্তবতার অনুপস্থিতিকে তা মুখোশ দিয়ে ঢেকে রাখে;
(৪) কোনো বাস্তবতার সঙ্গেই তার আর কোনো সম্পর্ক থাকে না;
(৫) তা নিজেই নিজের বিশুদ্ধ প্রতিরূপ হয়ে ওঠে।
(বাংলা তর্জমা বর্তমান লেখকের করা।)
এই ক্রমপর্যায়গুলোর মধ্যে বদ্রিয়ার গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য টেনেছেন। প্রথম পর্যায়ে সত্যের নিগূঢ় রূপ কল্পনার আধ্যাত্মিকতা মতাদর্শের আলোআঁধারি দিয়ে বাস্তবতার ছায়াকে ধরতে চায়। দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রতিরূপ ও প্রতিরূপায়নের সূচনা ঘটে, মুখোশটাই প্রধান ও ক্রমে একমেবাদ্বিতীয়ম হয়ে ওঠে, মুখোশের ধর্মই বাস্তবতার ধর্ম রূপে প্রতিস্থাপিত হতে থাকে। সত্য বা বাস্তবতার নিগূঢ় রূপ অপসৃয়মান হতে থাকে, অতল গভীরতা মুছে যেতে যেতে সত্য/বাস্তব চ্যাপ্টা দ্বিমাত্রিক ছবির আকার নেয়, রহস্যের আলোআঁধারি দূর হয়ে যুক্তির স্থির মরা আলো সবকিছুকে দৃশ্যমান করে তোলে। মুখোশ/ প্রতিরূপ-এর আড়ালে বাস্তবতার এই মহানিষ্ক্রমণের খবর চাউর হতে না দেওয়াই তৃতীয় পর্যায়, সবকিছু কষে-বাঁধা যুক্তির তুলিতে আঁকা দৃশ্যে পরিণত করার জাদু এখানে মোহ বিস্তার করে। চতুর্থ পর্যায়ে এই প্রতিরূপই স্বরাট, প্রতিরূপই বাস্তবতা, আলাদা করে আর বাস্তবতা ও তার প্রতিরূপকে মিলিয়ে দেখার প্রশ্ন অবান্তর। আর পঞ্চম পর্যায়ে, অর্থাৎ, নিখাদ প্রতিরূপায়নের পর্যায়ে, প্রতিরূপসমূহই একে অপরের সূচক, একে অপরের যাথার্থ্য-প্রতিপাদনকারী, প্রতিরূপের জগৎ এখন পুরোপুরি স্বয়ংসম্পূর্ণ ও বদ্ধ হয়ে উঠেছে। প্রতিরূপায়ন প্রক্রিয়ার এই ধাপে ধাপে স্বরাট হয়ে ওঠাকে আলোচনা করতে গিয়ে বদ্রিয়ার প্রতিরূপায়নের তিনটি স্তর (order) চিহ্নিত করেছেন। এই তিনটি স্তর বলতে তিনি কী বুঝিয়েছেন তা বোঝার চেষ্টা করা যাক।
প্রথম স্তরের প্রতিরূপায়ন (first-order simulation): প্রতিরূপায়ন যখন স্বঘোষিতভাবেই অস্তিত্বমান কোনো বস্তুর সাদৃশ্য-নির্মাণ, তখন তা প্রথম স্তরের। অর্থাৎ, এখানে মূল বস্তুটি এবং তার অনুকরণে গড়া সাদৃশ্যটির মধ্যে যে তফাত থাকা অবশ্যম্ভাবী, তা মনে রাখা হচ্ছে ও মেনে নেওয়া হচ্ছে।মূল বস্তুটিকে যদি সত্য বা বাস্তবতা বলে ধরা হয়, তাবলে সেই সত্য বা বাস্তবতার সম্পূর্ণ রূপ দেখা, বোঝা ও জ্ঞাপন করা আদৌ সম্ভব কিনা সেই সংশয় এখানে কাটার নয়। প্রতিরূপও এখানে খণ্ড-উপস্থাপনা রূপে নিজ সীমাবদ্ধতা স্বীকার করেই ক্রিয়াশীল। যেমন ধরা যাক, কোনো ব্যক্তিকে সামনে বসিয়ে কোনো চিত্রকরের আঁকা প্রতিকৃতি-চিত্র, কোনো ভৌগোলিক মানচিত্র, ইতিহাস বা সমাজের খণ্ডাংশ তুলে ধরতে চাওয়া কোনো উপন্যাস, ইত্যাদি।
দ্বিতীয় স্তরের প্রতিরূপায়ন (second-order simulation): অস্তিত্বমান বস্তু এবং তার অনুকরণে গড়া সাদৃশ্যটির মধ্যে তফাতটিকে যখন আবছা করতে করতে অদৃশ্য করে দেওযা হয়, তখন তা দ্বিতীয় স্তরের প্রতিরূপায়ন। প্রায়শই খবরের কাগজে ছবি দেখা যায় যেখানে কোনো বিখ্যাত ব্যক্তি মাদাম তুসো-র জাদুঘরে নিজের মোমের প্রতিমূর্তির পাশে দাঁড়িয়ে আছেন, একই ভঙ্গিতে দাঁড়ানো আসল ব্যক্তি ও তার প্রতিমূর্তির মধ:এ কোনো তফাত করা যাচ্ছে না, এই মুহূর্তটি দ্বিতীয় স্তরের প্রতিরূপায়নের মুহূর্ত। বদ্রিয়ার তাঁর আলোচনায় হোর্হে লুই বোর্হেসের একটি লেখা থেকে উদাহরণ টেনেছিলেন। বোর্হেস তাঁর ‘Of Exactitude in Science’ লেখায় সাম্রাজ্যের একদল মানচিত্রনির্মাতার কথা বলেছেন যারা এতটাই বিশদ এক মানচিত্র তৈরি করতে চায় যে মানচিত্র গোটা পৃথিবীর প্রতিটি বিন্দুকে তার মধ্যে ধারণ করবে, অর্থাৎ, যা পৃথিবীর মতো একইমাত্রায় আসল হয়ে উঠবে, দুইয়ের মধ্যে আর কোনো তফাত থাকবে না। এই অভিপ্রায় হলো দ্বিতীয় স্তরের প্রতিরূপায়নের অভিপ্রায়। বোর্হেসের এই রূপকের মধ্য দিয়ে আমরা ইউরোপীয় উপনিবেশবিস্তারকারীদের হাত ধরে ছড়ানো ইউরোপীয় এনলাইটেনমেন্টের জ্ঞানতত্ত্ব, যা যুক্তিতে বাঁধা কাঠামোয় বিশ্বপ্রকৃতির প্রতিটি বিন্দুর অবস্থান ও গতিকে হাজির করে দেখাতে বদ্ধপরিকর, তার ছায়া দেখতে পাই। বলা যায়, ইউরোপীয় এনলাইটেনমেন্টের জ্ঞানতত্ত্ব দ্বিতীয় স্তরের প্রতিরূপায়নে অভিপ্রায়ী। এই জ্ঞানতত্ত্বের প্রভাব-পরিসরেই বিপুল শক্তিধর মতবাদ (ideology) ও মহাবিবরণ (grand narrative)-এর বিকাশ ঘটেছিলো। মতবাদ ও মহাবিবরণ আদি থেকে অন্ত অবধি বিকাশের নিয়ম হাজির করার মধ্য দিয়ে অতীতের সমস্ত বিন্দুর পূর্ণ ব্যাখ্যা এবং ভবিষ্যতের সমস্ত বিন্দুর পূর্ণ পূর্বাভাস দিতে পারার দাবি করে অখণ্ড দেশ-কাল-এর পূর্ণ প্রতিরূপ হিসেবে হাজির হয়েছিলো।
তৃতীয় স্তরের প্রতিরূপায়ন (third-order simulation): পূর্বোক্ত দুটি স্তরকে ছাপিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে নির্মীত প্রতিরূপ যখন একটি ‘পরাবাস্তব’ (hyperreal)-কে হাজির করে, বা, প্রতিরূপায়নের ধাঁচা বা কাঠামোর মধ্যে স্বরাট এমন এক বাস্তব নির্মীত হয় যার কোনো বাস্তবতা ওই কাঠামো বা ধাঁচার বাইরে নেই, তখন তা তৃতীয় স্তরের প্রতিরূপায়ন। পূর্ব-অস্তিত্ব-সম্পন্ন কোনো বস্তুর অনুকরণে বা আদলে এখানে প্রতিরূপটি নির্মীত হচ্ছে না, প্রতিরূপায়নের নিজস্ব যুক্তিধারায় প্রতিরূপটি নির্মীত হওয়ার পর, সেই প্রতিরূপের অস্তিত্ব থেকেই বস্তুর (বা বাস্তবতার) অস্তিত্ব সম্পর্কে স্থিরসিদ্ধান্তে পৌঁছানো হচ্ছে। অর্থাৎ, নিদর্শনস্বরূপ বলা যায়, মানচিত্র-নির্মাণের মান কৌশলাদি অনুযায়ী একটি মানচিত্র তৈরি করা হলো এবং তারপর সেই মানচিত্রকে দেখিয়েই প্রমাণ করতে চাওয়া হলো যে এমন একটি ভূখণ্ডের অস্তিত্ব বাস্তবে আছে। দ্বিতীয় স্তরের প্রতিরূপায়নে বস্তু ও তার প্রতিরূপের মধ্যে তফাতটা যেমন মুছে দেওয়া হচ্ছে, এখানে কিন্তু ঠিক তেমন নয়, এখানে প্রতিরূপের অস্তিত্বই বস্তুর অস্তিত্ব প্রতিপাদন করছে। অন্যভাবে বললে, প্রতিরূপটিই আসল ও নিখুঁত, বস্তুটির অস্তিত্ব থেকে থাকলেও তা নেহাতই প্রতিরূপের আংশিক, অসম্পূর্ণ একটি ছায়া মাত্র। বদ্রিয়ার আলোচনা করেছেন যে এই তৃতীয় স্তরের প্রতিরূপায়নের কলাকৌশলও অন্যরকম। প্রথম দুটি স্তরের প্রতিরূপায়নে দৃশ্যমান বা বোধ্য বস্তুর অনুকরণ বা সাংকেতিক উপস্থাপনার কৌশলই মূল। কিন্তু এই তৃতীয় স্তরের প্রতিরূপায়নে অভ্যন্তরীণ যুক্তিবদ্ধতায় বাঁধা গাণিতিক পরিভাষা (algorithm) হয়ে উঠেছে প্রধান কৌশলগত চাবিকাঠি, যা কোনো অনুরকণ-অনুসরণের পথে নয়, নিজ যুক্তিবদ্ধ চলনের পথেই যন্ত্রগণক-উৎপাদিত অলীক বাস্তবতা (virtual reality)-র জন্ম দিচ্ছে এবং সেই অলীক বাস্তবতাকেই সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য বাস্তবতা বলে প্রতিপন্ন করছে। কতো দ্রুত ও কতো কার্যকরীভাবে এহেন তৃতীয় স্তরের প্রতিরূপায়ন উৎপাদিত হয়ে চলতে পারে, সেই যান্ত্রিক দক্ষতাই উৎকৃষ্টতার একমাত্র মাপকাঠি হয়ে উঠছে, প্রশ্ন-সংশয়-ভাবা-অনুসন্ধানের মানবক্রিয়াগুলো সেকেলে অদক্ষ অবশেষ বলে পরিগণিত হচ্ছে। আরেকজন ফরাসি ভাবুক জাঁ ফ্রাঁসোয়া লিওতার-এর পর্যবেক্ষণও এখানে প্রাসঙ্গিক। ১৯৭৯ সালে প্রকাশিত ‘La condition postmoderne: rapport sur le savoir’ বইতে লিওতার বলেছিলেন যে বিজ্ঞান-প্রযুক্তি এখন কেবল কার্যক্ষমতাকে সর্বোচ্চ (optimize performance) করার হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে, সর্বনিম্ন বিনিয়োগ করে সর্বোচ্চ ফল পাওয়াই তার অভিপ্রায়, বিশ্বজগতের গভীর নিগূঢ় রহস্য উন্মোচন করা চাহিদা আর তার নেই, সত্যে পৌঁছানোর সিসিফাস-সুলভ প্রচেষ্টাও তার নেই, তা কেবল দক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিকেই বীজমন্ত্র করে নিয়েছে; প্রাতিষ্ঠানিক পরিসরে উচ্চস্তরের জ্ঞানচর্চা এখন থেকে ক্রমশ এই কার্যকারিতা বৃদ্ধি ঘিরেই আবর্তিত হতে থাকবে--- উৎপাদন বৃদ্ধি, নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি, প্রশাসনিকতা বৃদ্ধিই তার মোক্ষ হবে--- দর্শন বা ললিতকলা পরম্পরাবাহিত চর্চাগুলো শুকিয়ে গিয়ে কমপিউটার সায়েন্স ও জেনেটিক ইনজিনিয়ারিং-এর মতো বিষয়গুলো প্রাধিকার লাভ করবে। এই পরাবাস্তবতায় যুক্তি (rationality) যেহেতু গভীর নিগূঢ় কোনো বাস্তবতার অবর্তমানে নিজ আভ্যন্তরীণ কাঠামো ছাড়া বাইরের আর কিছুকেই হাজির করার দায় থেকে মুক্ত, তাই যুক্তিরও বিভিন্ন আখড়া গড়ে ওঠে--- প্রতিটি আখড়া তার নিজ অনুমান ও নিয়মবিধির উপরই কেবল নির্ভরশীল--- এই আখড়াগুলিতে নিজ নিজ সত্য উৎপাদিত হয়ে চলে, এক আখড়ার সত্যের অপর আখড়ার সত্যের কোনো তুলনা-প্রতিতুলনা সম্ভব নয়, এক দিয়ে অন্যকে খণ্ডন করাও সম্ভব নয়। যুক্তি (rationality)-র অখণ্ড রাজ্য তাই এখানে টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে গেছে, এক টুকরো থেকে অপর টুকরোর বিচ্ছিন্নতা এতটাই যে পরস্পরের মধ্যে কোনো যাতায়াত সম্ভব নয়।
৩
দেবোর যেমন জমক (spectacles)-এর সমাজের সঙ্গে পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার যোগাযোগ দেখেছেন, বদ্রিয়ারও তেমন এই প্রতিরূপায়ন (simulation) প্রক্রিয়ায় পুঁজির গভীর ভূমিকা চিহ্নিত করেছেন। পণ্য-বিনিময় রীতি প্রতিষ্ঠাকল্পে বিমূর্ত বিনিময় মূল্যের মাধ্যমে সমস্ত বস্তুকে চিহ্নিত করা ও বিনিময় মূল্যের নিরিখেই সবকিছুকে পরস্পর-তুল্য করে তোলার যে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে পুঁজির ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, বদ্রিয়ারের মতে তা মানব-অভিপ্রায় ও প্রকৃতিলগ্নতা থেকে বিচ্ছিন্ন করে সমস্ত বস্তুকে নিখাদ চিহ্নে রূপান্তরিত করার কাজ ক্রমশ এগিয়ে নিয়ে গেছে। সেই প্রক্রিয়ারই চূড়ান্ত প্রকাশ আজ বাস্তবতার ধ্বংস ও পরাবাস্তবতায় নিমজ্জনের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পাচ্ছে। বিনোদনের জন্য টিকিট কেটে ঢুকে এখন আমরা সার্কাস তাঁবুর অন্ধকার দর্শকাসনে বন্দী হয়ে গেছি। সমস্ত মূর্ত ব্যবহার মূল্য ধ্বংস হয়ে বিমূর্ত ব্যবহার মূল্যের অলীক ট্রাপিজ-খেলা সার্কাস-তাঁবুর আলো-ঝলমলে মাথায় রুদ্ধশ্বাস দৃশ্য রূপে দ্রুত থেকে দ্রুততর ঘটে চলেছে, আর সেই তাঁবুর নীচে অন্ধকারে ডুবে বসে থাকা বিচ্ছিন্ন একাকী দর্শকরা অপলকে সেদিকে চেয়ে আছে।
এই সর্কাস-তাঁবুর বন্দিশালার বাইরে অস্তিত্বের আর কোনো পরিসর কি অবশিষ্ট আছে? বদ্রিয়ারের মতে, আছে। বদ্রিয়ার সেটিকে সাংকেতিক বিনিময় (symbolic exchange)-এর পরিসর হিসেবে চিহ্নিত করতে চেয়েছেন। পাশ্চাত্য যুক্তি (rationality), রাজনৈতিক ব্যবস্থা, আইন ও জ্ঞানতত্ত্বের পাকাপোক্ত কাঠামোগুলোকে আক্রমণ করা, ভিত নাড়িয়ে দেওয়া, নস্যাৎ করা বা মুলতুবি রাখার মধ্য দিয়ে এই সাংকেতিক বিনিময়ের পরিসর উন্মুক্ত হতে পারে বলে বদ্রিয়ার মনে করেছেন। পার্থক্য, বিষমতা ও বহুত্ব এর চাবিকাঠি। এই পরিসরে কোনো বস্তুদের মধ্যে বিমূর্ত বিনিময় মূল্যের মতো কোনো তুল্যতার নিয়ামক সম্ভব নয়। সাংকেতিক বিনিময় কোনো মূল্যের নিয়মে বাঁধা নয়। এই বিনিময় বিনিময়কারীদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও আত্মীয়তার স্ফূরণ ঘটায়, পরস্পরের পার্থক্যকে সম্মান করায়, যা বিনিময় হচ্ছে তাকে ওই বিনিময় প্রক্রিয়ার থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না। কোনো দাম চুকিয়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে এই সাংকেতিক বিনিময়ের কোনো পর্ব শেষ হতে পারে না, কারণ দাম-এর অস্তিত্ব অস্বীকার করে তা বিনিময়কারীদের মূর্ত দান-প্রতিদানের ধারাবাহিক প্রক্রিয়ায় যুক্ত করে। ঐতিহাসিক নৃতত্ত্বের শরণাপন্ন হয়ে বদ্রিয়ার এই সাংকেতিক বিনিময়ের উপস্থিতি আদিম সমাজের জনজাতিগুলোর ভিতরে এবং একে-অপরের মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে ছিলো বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু কেবল তাই-ই নয়, পুঁজিবাদী সমাজের বিকাশের পথে প্রতিরূপায়নের দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্তরেও এর উপস্থিতি পুরোপুরি মুছে যায় না, জীবনযাপনের নানা ভাঁজে তা টিকে থাকে বলে তিনি মনে করেছেন। এই সাংকেতিক বিনিময়কে সংহত করে জীবনযাপনের পরিসরগুলো থেকে পণ্য-বিনিময়কে দূর করাই বদ্রিয়ারের ভাবনায় প্রধান প্রতিরোধ-কৌশল।
দেবোর-এর মতে, জীবন যখন জমক-এর সমাহার হয়ে ওঠে, তকন মানুষের সঙ্গে জীবনের সম্পর্ক আর বিষয়ীর সম্পর্ক থাকে না। মানুষ তখন দূর থেকে সেই জীবন-জমকের এক দর্শক মাত্র, দূর থেকে দেখে যাওয়া ছাড়া জীবনের মধ্যে হাতে-নাতে গায়ে-গতরে লিপ্ত হয়ে তাকে বদলানোর বা রূপ দেওয়ার কোনো সক্ষমতা তার নেই, পারস্পরিক সংলাপ বিহীন ভাবে এ কেবল দেখে যাওয়া (The Society of the Spectacle, §18)। দেবোর তাই জমক-কে ‘ক্ষমতার আত্মপ্রতিকৃতি’ বলেছেন (The Society of the Spectacle, §24), অর্থাৎ, যে মানুষের কাছে জীবন জমক-সমাহার হয়ে দেখা দিচ্ছে, সেই মানুষ ক্ষমতাহীন, ক্ষমতা যাদের হাতে তাদের থেকে সে বিচ্ছিন্ন, আর ক্ষমতাধারীরাই এই জমক-প্রদর্শনীকে নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে।
কিন্তু বদ্রিয়ার যে তৃতীয় স্তরের প্রতিরূপায়নের কথা বলেছেন, সেখানে বিষয়টি আরো জটিল। জ্ঞান, আত্মপরিচয়, স্বশনাক্তি যেহেতু প্রতিরূপায়নের অভ্যন্তরীণ যুক্তিবদ্ধতা দ্বারা উৎপাদিত হয়ে চলেছে, মানুষের বিষয়ীভাব (subjectivity)-ও তাই এই অভ্যন্তরীণ যুক্তিবদ্ধতা দ্বারাই নির্মীত, মানুষের সঙ্গে প্রতিরূপ-জমকের দূরত্ব তাই এখানে আর নেই। দূরত্বে দাঁড়িয়ে ক্ষমতাহীনভাবে ক্ষমতাধরদের দ্বারা জীবন-জমক নিয়ন্ত্রিত হতে দেখতে পারার বিচ্ছিন্নতা এখানে নেই, জমক-প্রতিরূপ মানুষের আত্মসত্তাটিকেও গিলে নিয়েছে, প্রতিরূপায়নের নিয়ম মেনে মানুষ নিজ আত্মসত্তাটিকেও নির্ধারণ করছে। ফলত ক্ষমতাহীন এবং ক্ষমতাধর--- এমন দুটি স্পষ্ট পৃথক বর্গে সমাজকে ভেঙে দেখাও অসম্ভব হয়ে উঠেছে। আর প্রতিরোধের প্রশ্নটিও তাই মুখোমুখি দাঁড়ানো দুটো দলের লড়াইয়ের মতো স্পষ্ট কিছু নয়, ক্ষমতা ও প্রতিরোধ এখানে শঙ্খ-লাগা দুটো সাপের মতো পরস্পরে জড়িয়ে-পেঁচিয়ে গিয়েছে।
৪
তৃতীয় স্তরের প্রতিরূপায়নের মধ্যে ক্ষমতার বর্ম হিসেবে উৎপাদিত এক বিভ্রমকে বদ্রিয়ার চিহ্নিত করেছেন, তার নাম দিয়েছেন ‘খল-প্রতিরূপায়ন’ (dissimulation)। মার্কিন দেশের ডিজনিল্যান্ড নিয়ে বদ্রিয়ারের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে তাঁর এই ধারণাটি প্রকাশ পায়। বদ্রিয়ার বলেছেন: ‘ডিজনিল্যান্ডের উপস্থিতি দরকার এই কারণেই যাতে এই সত্যটিকে চেপে রাখা যায় যে তা কোনো ‘নকল’ দেশ নয়, তা-ই ‘আসল’ দেশ, গোটা আমেরিকা যতটা ‘আসল’, তা-ও ততটাই আসল।… ডিজনিল্যান্ডকে কাল্পনিক বলে হাজির করা হচ্ছে যাতে আমরা বিশ্বাস করে বসি যে বাকি আমেরিকা হলো আসল, যখন সত্যটা হলো এই যে ডিজনিল্যান্ডকে ঘিরে থাকা গোটা লস অ্যাঞ্জেলেস ও গোটা আমেরিকাটাই আর আসল কিছু নয়, বরং গোটাটাই পরাবাস্তব ও প্রতিরূপায়নের স্তরে চলে গেছে।’ (Simulations, trans. Paul Foss, Paul Patton and Philip Beitchman, New York: Semiotext(e), pg.25, বাংলা তর্জমা বর্তমান লেখকের করা।) একইভাবে বদ্রিয়ার বলেছেন যে কারাগারগুলো এই সত্যটিকে চেপে রাখতে ব্যবহৃত হয় যে গোটা সমাজটাই কারাগারে পরিণত হয়েছে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে নানা তর্জন-গর্জন-ব্যবস্থা এই সত্যটিকে চেপে রাখতে ব্যবহৃত হয় যে পুঁজি নিজে কোনো নীতির ধার ধারে না। অর্থাৎ, প্রতিরূপে পরিণত আমেরিকাকে আসল দেখানোর জন্য কেবল ডিজনিল্যান্ডকে প্রতিরূপ বলা, জেলখানায় পরিণত সমাজকে মুক্ত বলে দেখানোর জন্য কারাগার বানানো, নীতিহীন পুঁজিকে নৈতিক দেখানোর জন্য খুচরো দুর্নীতি নিয়ে তর্জন-গর্জন। ‘যা নেই তা আছে বলে ভান করাই হলো খল-প্রতিরূপায়ন’ (Simulations, trans. Paul Foss, Paul Patton and Philip Beitchman, New York: Semiotext(e), pg.5, বাংলা তর্জমা বর্তমান লেখকের করা।)। ক্ষমতার বিরুদ্ধতা বা প্রতিরোধের বিজ্ঞাপিত রূপ এভাবে ক্ষমতার নৈতিকতা উৎপাদন করতে, ক্ষমতার স্বরূপ ছেকে রাখতে ব্যবহৃত হয়ে চলতে পারে। যেমন ধরা যাক, কোনো একটি নির্বাচন প্রক্রিয়ার অগণতান্ত্রিকতা নিয়ে সমীচীন প্রতিবাদ কি রাজনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবে গোটা প্রতিন্ধিত্বমূলক গণতন্ত্রের ব্যবস্থাটিরই অগণতান্ত্রিকতাকে আড়াল করে রাখতে কাজ করে যায় কি? সংশয় এখানে কেটে যাওয়ার নয়।