বিকেল বেলা অনেকদিন বাদে পুরোনো খারাপ লাগাটা সন্তুর ফিরে এলো। সাড়ে তিনটেয় লোন রিকভার করার ধুয়ো তুলে ব্যাংক থেকে ছুটি নিয়ে জোর করেই বাইক নিয়ে বেরোলো।
জাহিদদের বাড়ি তখন বাতাবি খাওয়ার তোড়জোড় চলছে। ওখানে বাইক রেখে এদিক ওদিক করতে করতে রাস্তায় নেয়ামত আলির সাথে দেখা। ও আর ওর বৌ সেই গ্রুপ লোন নিয়ে আর শোধ করার নাম করে না। সন্তু সবে কথা বলতে যাবে, এমন সময় পেছন থেকে মিঠুন ওরফে মিঠুর ছেলেটার পাশে উবু হয়ে বসে ডোবার জলে শামুক দিয়ে কাঁকড়া ধরতে ধরতে ছেনো নেয়ামতের দিকে ইঙ্গিত করে। মিঠুর ছেলেটা সরু গলায় নেয়ামতকে তাক করে বলে-- তোরকারী। ব্যাস, নেয়ামত একে তো সন্তুকে দেখে কাটার তাল করছিল, এবার মিঠুর ছেলের দিকে তেড়ে গিয়ে খিস্তি দিতে লাগলো-- অরে মাকড়াচোদা তোর মা’রে নে আয়… তোর মা’র _____ মেরে পার্টি দুব। বলেই লুঙ্গি তুলে তেড়ে যায়। আর ফচকেটা ভয় পেয়ে দাঁত কেলাতে কেলাতে ‘তোরকারী’ ‘তোরকারী’ বলতে বলতে দৌড় মেড়ে মিঠুর ঘরের পানে দৌড়ায়। আর নেয়ামত ও তার বউ ফচকেটার পিছনে তেড়ে গিয়ে হাওয়া হয়ে যায়। সন্তু বেকুব বনে গিয়ে মিঠুনের বাড়ি ঢোকে।
ছোট রুমকি বসে জরির কাজ করছে । ডেইলি ৭০টাকা আসে একটা শাড়ি ছাড়লে। একমনে জরির চুমকি বসিয়ে চলেছে। আগে রহমতদার কারখানায় কাজ করত। কিন্তু বাড়িতে রান্না করার লোক নেই মা মারা যাওয়ার পর থেকে। মিঠুন রঙচটা লালকালো এক্সাইজ গেঞ্জি আর প্রায় হলদে হয়ে যাওয়া একটা সাদা ধুতি লুঙ্গি করে পরে মেঝেতে বসে। ছুলির দাগে ভরা বাদামি মুখের মতো পালিশ-চটা কাঠের আলমারির গায়ে সাঁটানো সাদা-ছোপ-ওলা পুরোনো রঙচটা ছবি, পান্না আর তার তিন ছেলেমেয়ে সহ মিঠুন। পান্নার কপালে সিঁদুর বুলিয়ে বুলিয়ে ছবিতে শুধু সিঁদুরটাই খেয়াল পড়ে। এখন মিঠু কাজ করে দিঘার হোটেল আশিয়ানার সাইটে। মাঝে হরিচাঁদ-গুরুচাঁদ-দের ঠাকুরনগরে কাজে গেছিল। খাইখরচ আর হাতখরচ ছাড়া ২৮০০০/ পাওনা। কন্ট্রাক্টরকে ওই চাঁদের লোকেরা টাকা পেমেন্ট করেনি। ফলে, কন্ট্রাক্টরও ওদের দেয়নি।
সন্তু ঘরে ঢুকতেই ছোট মেয়েটা উঠে হাত ধোয়ার জল এনে স্ট্যান্ড ফ্যানটা ঘুরিয়ে দেয় আর চেয়ার এগিয়ে দেয়। সুপ্রিমের ডুপ্লিকেট, প্লাস্টিক, মাঝবরাবর হালকা ক্র্যাকের উপর ব্রাউন টেপ মারা, ম্যাট ফিনিস। সন্তু জিজ্ঞেস করে-- কোন ক্লাসে পড়ো?
মিঠু বলে- গেলো শুক্কুর সকালে স্কুলে ভর্তি করে দিচ্ছি বললাম, তা বলে- সমবার গেলে হবে নে?
সন্তু বলে-- আরে তুই পুজোর আগে ভর্তি হলে ভালো। নেবে। এরপর পরীক্ষা এসে গেলে কি আর নেবে?
মিঠু মাটির উপর কাজের বাড়ি থেকে নিয়ে আসা ভাঙা চোরা টাইলস বসিয়েছে। আর তার উপর প্লাসটিকের মাদুর ফেলে বসে আছে। হাতে বড় ফোন । কিন্তু কদিন রিচার্জ নেই। ছোট রুমকিকে বলে-- হ্যা রে, যা না, অন্তত বিয়ের টাকাটা তো পাবি।
বলেই বলে, সন্তুকাকাকে সকালে ধরা বেড়োমাছের ঝালটা দে।
মেয়ে চৌকি থেকে নেমে ছোট বাটিতে বেড়োমাছের ঝাল বেড়ে সন্তুর হাতে দিয়ে আবার চৌকিতে ওঠে।
মিঠু জিগ্যেস করে, তুই খাবি না?
মেয়ে উত্তর দেয় না। শাড়ির পাড়ে ফেবিকল দিয়ে চুমকি বসাতে বসাতে চোখ না সরিয়েই বলে, এখন স্কুলে যাওয়ার কথা বলছ, তুমিই ত পাঠাও না।
মিঠু চুপ করে শোনে। এটা মিথ্যে নয়। গতবছর বৌ ক্যান্সারে মারা যাওয়ার পর সংসার কেমন যেন এলোমেলো ছিল। ভাঙা কাঁচকড়ির কাপের মতো। ফেবিকল দিয়ে জুড়ে তাতে জল রাখলেও রাখা যায় কিন্তু কাজ বেশিদিন চলে না। বড় রুমকির তখন বিয়ে হয় নি। আর সামনে ওর উচ্চমাধ্যমিক। মিঠুর বাইরে বাইরে কাজ। আর অসুস্থ বৌ নিয়ে জেরবার। রিপোর্টের পর রিপোর্ট। জলের মত টাকা বেরোয়।
লিভার ফাউন্ডেশনে যেতে আসতে কতগুলি টাকা। তারপর কেমোর জন্য স্বাস্থ্যসাথী কার্ড দিয়ে হাপিত্যেস করে বসে থাকা। কার্ড এন্ট্রি হবে তবে ওষুধ আসবে। মিঠুর ঐ সহজ সরল ন্যালাভোলা হালকা টেকো কালোকুলো ছোকরা চেহারা,ওখানকার স্মার্ট ডাক্তাররা কেন পাত্তা দেবে? কিছু জিজ্ঞেস করলে দায়সারা ভঙ্গিতে হাত নেড়ে হাফ ইংরেজি হাফ বাংলা আর ডাক্তারি ভাষা দিয়ে এমন করে বলে, যেন বলতে চায়-- এসব বুঝে তোমার কী দরকার? তাও বড় মেয়েটার চেহারায় একটা চেকনাই আছে, বছর সতেরোর টাটকা যৌবন, ভাল মুখশ্রী, টানা টানা চোখ , বুদ্ধি মাখানো মুখ আর পাতলা ঠোঁট, একবার তাকালে চট্ করে চোখ ফেরানো...তাই বেশির ভাগ জুনিয়র ডাক্তারের সাথে কথা বলার জন্য , ক্যাশে কথা বলা, ব্লাড ব্যাংকে কথা বলতে বড় মেয়েই যেত। এই করে ওর পড়াশুনাটাও তেমন হয়নি। মাঝ খানে মিঠুও টুকটাক কাজ, কখনো লেবার, কখনো মুড়ি ভাজার হেল্পার, কখনো ডেকরেটিংয়ের কাজ, কখনো ভ্যানে বাঁশ বয়ে সাপ্লাই দেওয়া, সাত সতেরো হাবরজাবর যা পেরেছে করেছে। ওদিকে বহুদিন বৌটার অসুস্থতার জন্য ঘরদোরে হাত পড়ে নি। ঠিক এমন সময় বিষফোঁড়ার মত ধেয়ে এলো আমফান। উপরে চালচুলো যা ছিল সব উড়ে গেল। পঞ্চায়েত সদস্যের হাতেপায়ে ধরে একটা তেরপল জোগাড় করে উপরে ছেয়ে দিল। নিচে ঘরের মেঝেয় একটাই তক্তপোষ । তাতে বৌ শুয়ে চোখের জল ফেলে, আর সামনে রাঁধে বড় মেয়ে। বৌটা শুয়ে শুয়েই ছোটটার চুল বেঁধে দেয়। ছুটকিটা ছোট থেকেই ছেলেদের সাথে ঘুরত। গুলি, ডাঙ্গুলি, এগাছ ওগাছ ঘুরে পাড়া বেড়াত, ছিপ ফেলতে যেত । ওর ঘরের টান বলতে মা। মা'র সাথেই আদর আবদার আর রাগ। দু’ঘা কেউ দিলে, সেটাও মা।
বৌ মারা যাওয়ার দু/চার দিন আগেও উঠে উনুন জ্বেলে বাচ্চাদের জন্য রান্না চাপিয়েছে। তখন বারণ করলেও শুনত না। কেমো খেয়ে মাথায় চুল নেই, শরীর কালো কাঠকয়লার মত পোড়া, পেটে জল হয়ে ফুলে ঢোল, নড়তে চড়তে কষ্ট, তবুও নিজে রান্না করবে। যেন শ্বাশুড়িকে দেখিয়ে ছাড়বে- মরতে দম তক…
সেই বৌয়ের শেষের দু তিন দিন আর কোনো হুশ ছিল না। লাস্ট চেষ্টা করে জিমসে ভর্তি করা। তাও স্বাস্থ্যসাথী কার্ডে নাকি টাকা শেষ। তখনই চিটফান্ড থেকে টাকা ধার করা। তাই আজ সন্তু এসেছে। দুদফায় দশ-দশ কুড়ি হাজার টাকা দেওয়ার পর বেগতিক দেখে চিটফান্ডও আর টাকা দিতে রাজি হলো না। তখন লজ্জার মাথা খেয়ে বড় মেয়ের স্কুলে গিয়ে হাত পেতে মাস্টার দিদিমণিদের মুখ ঝামটা খেয়ে হাজার সাতেক টাকা জোগাড় করে লাস্টের দিকে একটা ইনজেকশনও ডাক্তারদের কথা মতো দিয়েছিল। কিন্তু যা থাকার নয় তা থাকল না।
সে শক সামলাতে ব্যস্ত মিঠু। আর দিন পনেরো বাকি বড় মেয়েটার উচ্চমাধ্যমিকের। হঠাৎ করেই ছোট রুমকিটা ঘরে খুব কম ঢুকতে শুরু করল। বনে-বাদাড়ে এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়ায়। বাড়িতে কখনো খেতে ঢোকে, কখনো ঢোকে না। একেবারে ছোট ছেলেটার বছর বারো বয়স। গুলি খেলে আর ঘুরেই দিন কাটায়। মিঠুর বয়স্ক বুড়ি মা কোমর নিয়ে নড়তে চড়তে পারে না। পায়ের আর হাতের আঙ্গুল গেঁটে বাতে বেঁকে গিয়েছে, তাই নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। তাই নিয়ে কোনো রকমে চাট্টি ডালভাত ফুটিয়ে দেয়। এভাবেই দিন চলে। ছোট রুমকি আস্তে আস্তে আবার ঘরে ঢুকতে শুরু করে। কিন্তু পেট ব্যাথা। ব্যাঁক খায়। দাঁত-মুখ খিঁচোয়। সবাই বলে, ওর মা মায়া কাটাতে পারছে না। কোয়াক ডাক্তার এসে ইঞ্জেকশন দিয়ে বলে, শুধু নাটক। মাঝে মধ্যে ঠিক থাকে, তখন আবার রাস্তায়, বনে বাদাড়ে।
এর মধ্যে বড় রুমকি পাস করল ভালোভাবেই। কলেজেও অনার্স নিয়ে ভর্তি হওয়ায় মিঠুও হাঁফ ছাড়ে, নতুন করে কাজ ধরে। ঘরের টাই বিম পঞ্চায়েতের ঘরের টাকায় কিছু তোলে। কলকাতা আর ইদিক-সিদিক কাজের ধান্দায় বেরোয়। সবচেয়ে ছোট ছেলেটা আর ছোট রুমকি একসাথে রহমতের দর্জি কারখানায় ঢোকে। ছেলেটা শুধু জামা পাট করবে আর দর্জিদের সাথে থাকবে। তাতে একটা হাতখরচ পাবে। ছোট রুমকি জামার কলারের শক্ত কাপড়টা পেস্টিং আর হাপুর (ঘাড়ের) টিকিট লাগাবে। তাতে পার পিস আপাতত ১ টাকা।
কিন্তু কাঁচকড়ির কাপ ভেঙে গেলে ফেবিকল দিয়ে জুড়লে তাতে জল রাখা যায় বটে , তবে আবার ভেঙে যায়। কোএড কলেজ। মুসারফের আব্বার কাপড় দোকান আমতলায়। হাজি। মাও ধর্মপ্রাণ । ছেলে নাস্তিক নাকি আস্তিক বোঝা যায় না। তবে নামাজ রোজায় মন নেই। কলেজে শাসক দলের হয়ে মিছিল করে। আর মিছিলে মুখ চেনা। দামোদরের ধারে বসে থাকা। কানে কানে কথা। একটা চিপসের টুকরো একজনের ঠোঁট থেকে অন্যজনের ঠোঁটে বদল হতে হতে ঘামের গন্ধ বদলা বদলি হয়ে সে বাতাস দুই বাড়িতেই ধাক্কা দেয়। বড় রুমকির ঘরের পাশে তার অন্য বর্ণের পড়শি বসত করলেও তা কিন্তু এক্ষেত্রে এক্সট্রা কোনো সুবিধা দেয় না ।
মিঠু মেয়েকে বোঝায়। মিঠুর মা দোরে মাথা ঠোকে, ঘরের সামনের জানালা দিয়ে এক চিলতে উঁকি মারা বনবিবির সাত ঢিবির দিকে তাকিয়ে পেন্নাম দেয় আর মনে মনে বলে- মা, আমার নাতনির সুমতি দাও মা… তোমায় চোত্তিরের দেশমালা পুজোর সময় একটা গোটা ক্যালবার্ট মোরগ দোব… মা গো রক্ষে কর।
মুসার মা, মিঠুকে ফোন করে- বাপ আমি চাইনি, কিন্তু ছেলে কিছু মানছে নে…
মুসা ফোন করে মিঠুকে - কাকা, আমি খারাপ ছেলে না, তুমি মেয়েকে কলেজ ছাড়িউনি।
মিঠু মেয়েকে ঘা কতক দিয়ে বলে- তুই কাল থেকে কলেজ যাবিনি।
মেয়ে কলেজ যাওয়া বন্ধ করে। কিন্তু যা ঘটবার তাই ঘটে। কাঁচকড়ির কাপের ফেবিকলের জোড় টুটে যায়।
সমবর্ণের প্রতিবেশীরা সদলে এসে শাসায়। থানা হলে ত বদনাম, ছোট মেয়েটা ঘরে আছে। শাসক দলের মুসার বর্ণের নেতা এতগুলো ভোটের দিকে তাকিয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষাের্থতার সম্ভাব্য কানেকশন খাটিয়ে , এসআইকে ফোন করে সমাধান করেন। আর যে ইমাম কলমা পড়েছিলেন, তার ইমামভাতা ঠিক মতো পাচ্ছেন কিনা জেনে নেয়। ঘরের মেয়ে আপাতত ঘরে ফেরে। পাড়াপ্রতিবেশীরা প্রচুর নিন্দামন্দ সহযোগে চোখা চোখা গাল পেড়ে ঘরের মেয়েকে স্বাগত জানায়। মিঠু আবার ভাঙা সংসার জোড়া লাগায় স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে পুরো দমে চাদ্দিকে পাত্রের সন্ধানে খোঁজ লাগিয়ে গুজরাত-ফেরত ফ্রি-ট্রেড জোনের এক কোম্পানিতে কাজ করছে এক বছর, এমন এক বছর চব্বিশের ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার এর সাথে মেয়ের বিয়ে দিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। জামাইয়ের বাপ বলে রেখেছিল- আমাদের কিছু দিতে হবে নে। তবে আমাদের জ্ঞাতি গুষ্টি মিলে ১০০ জন বরযাত্রী খাবে। মিঠু তার শালাশালীদের কাছে হাত পাতে। ৫০,০০০ টাকায় নমো নমো করে বিয়ে হয়। আবার পাড়া পড়শীরা কিপ্টে মিঠুর নিন্দে-মন্দ করে দিন দুই দিব্বি কাটিয়ে দেয়।
মিঠু বিয়ের পর মেয়ে অষ্টমঙ্গলায় এসে ফিরে যাওয়ার পর বাঁধন পাকাপোক্ত হয়েছে ভেবে আরেক বার বাবা পঞ্চানন, মা শেতলা, মা কালী আর মা বনবিবিকে পেন্নাম ঠোকে মনে মনে। ছোট রুমকিকে বলে, রহমতদা'র ওখানে রাত দশটা অবদি কাজ করতে হবে নে… তুই ছেনোর মা'র কথা শোন, জরির শাড়ি ধর, ঘরে সকাল বেলা থেকে রান্না করবি, মাঝে মধ্যে স্কুল যাবি।
ছোট রুমকি দর্জির কাজের খাটনি থেকে রেহাই পেয়ে জরির শাড়ি ধরে। সেই থেকে হালকা কাজ, পার ডে ৭০/। ঘরে বসে কাজ। সকালে রান্না করে ভাই খেয়ে স্কুল বেরিয়ে গেলে রোজ শাড়ি ধরে। একঠেয়ে রোজ বসে থাকা। এদিক উদিক চাইলে চুমকিও এদিক উদিক। শাড়ি সারতে দেরি। ঠিক সময়ে কাজ না দিলে উস্তাগরের মুখ ঝামটা। একটু চুমকি বসানো অগোছালো হলে শাড়ি ওস্তাগর আর নেবে না। তার পর দু তিনতে শাড়ি হয়ে গেলেও টাকা দোয়ার বেলায় একটার টাকা দিয়ে বাকি টাকা আটকে রাখা। এসবে জেরবার হয়ে যায়। আর সারা দিন একজায়গায় বসে থেকে দেখে অনুশ্রী কেমন বিনুনি দুলিয়ে পিঠে ব্যাগ নিয়ে সুদীপ্তর সাথে গল্প করতে করতে চলেছে। স্কুল থেকে ফিরে আবার আশিককে পার্টনার করে পাবজি খেলছে। চোখের চেয়ে মন বেশি টাটায় তাতে। আর যদি ভাই দেখল দিদির হাতে টাকা এয়েছে ত সাথে সাথে- দে ৫০/, খাব।
দিতেই হবে। বাপ বলবে- দে ত ছোট রুমকি আমায় ১০০/ ধার।
ঠিক করে এবারে রান্না পুজোর সময় বাপ ঘরে ফিরলে বলবে- আমি স্কুল যাব, কিন্তু মাস্টার দিদিমণিরা পড়া না পারলে এত দাঁতমুখ খ্যাঁচায় যে খালি পেটে সহ্য হয় না।
বাপ ঘরে ফেরে। রান্নাপুজোর পর দিন জল ছিঁচে বাপ বেড়ো মাছ ধরে। মেয়ে মন দিয়ে ঘেন্না ঘেন্না করে কেটে ঝাল রান্না করে বাপকে ভাত বেড়ে খেতে দেয়। বাপ এক পাইট বাংলা খেয়ে পুকুরে চান করে ঘরে ঢুকে ধুতি পড়ে হাঁটুর উপর তুলে একমাত্র স্ট্যান্ড ফ্যানটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে ভাত, মাছের ঝাল দিয়ে মেখে গিলে নেয়। মেয়ে চৌকির উপর বসে হাঁটুর কাছে নাইটি গুটিয়ে আড় চোখে বাপের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে- আমি রহমত কাকার সাথে কথা বলিচি?
বাপ ঘোলাটে চোখে হাফ ধুমকিতে তাকিয়ে থাকে। বাপের মাথার পিছনে কাঠের চেয়ারে রাখা রাধা-কৃষনের যুগল মুর্তির পাশে হাসি হাসি মুখে মা জ্বলজ্বলে সিঁথির সিঁদুর নিয়ে ফটো ফ্রেম থেকে তাকায়- বলেচি কাল থেকে স্কুল যাব…
বাপ- ভর্তির টাকা?
মেয়ে- চিন্তা করুনি?
বাপ- কিন্তু রান্না কে করবে?
-কেন, ভাই মিডডে মিলে খেয়ে নেবে…
-আমি ত ভাবছি কদিন ওদিকে কাজে যাবুনি…
এমন সময় ফোন বাজে। বড় মেয়েটার ফোন । মিঠু ফোন ধরে-কীরে?
-বাবা তোমার জামাইয়ের নামে ব্যাংক থেকে একটা ফলস লোন দিয়ে, এ মাসের স্যালারি থেকে হাফ কেটে নিয়েছে।
-সেকিরে, ব্যাংকে বলেনি?
-বলেছিল, কিন্তু কাজ হয়নি। পুলিশেও অনলাইন কমপ্লেইন করেছে। ব্যাঙ্কের হেডঅফিসেও গেছিল। কিছু হয়নি এখনো। সুপারভাইজার বলেছে ব্যাঙ্কের সাথে সেটেলমেন্ট করে নিতে। হাজার কুড়ি দিলেই কেসটা সল্ভ হলেও হতে পারে।
-তারপর?
-বলছি তুমি হাজার কুড়ি ধার দেবে?
মিঠুন কোথাও কাঁচকড়ির কাপের ফেবিকলের জোড় টুটে যাওয়ার ইঙ্গিত পায়। সন্তু ঘরে ঢোকে।