ভারতে ভাষামড়ক ও ভাষিক সংখ্যালঘু: তথ্যের খতিয়ান

লিখেছেন:বিপ্লব নায়ক
ক্ষমতাহীন ভাষার কুন্ঠিত বাচকের অস্তিত্বযন্ত্রণা কাটাতে তার উপর মাতৃভাষা বিসর্জন দিয়ে প্রভাবশালী অপর ভাষা আয়ত্ত করার জন্য চাপ তৈরি হয়। সুতরাং ভাষিক সংখ্যালঘুত্ব কেবল বাচকসংখ্যার স্বল্পতার প্রশ্ন নয়, তার থেকে বেশি ক্ষমতালঘুতার প্রশ্ন। ভারতে ইংরেজি ভাষার বাচকরা নেহাতই সংখ্যালঘু, কিন্তু ইংরেজি ভাষার ক্ষমতাপ্রমত্ততার জন্যই তাদের কোনও সংখ্যালঘুতার সমস্যা বা সংকট তৈরি হওয়ার প্রশ্ন ওঠে না, বরং তারা সুবিধাপ্রাপ্ত হিসেবে রাষ্ট্রে ও সমাজে উপরমহলে ক্ষমতাবানদের অলিন্দেই বিচরণ করে। তাই ভাষিক সংখ্যালঘুর সমস্য

 অবতরণিকা

ভাষিক সংখ্যালঘু মানে কী? আক্ষরিক অর্থে ভাষিক সংখ্যালঘু হল সেই মানুষ বা সেই জনগোষ্ঠী যার বা যাদের মাতৃভাষা বাচক সংখ্যার নিরিখে অতি ক্ষুদ্র। কিন্তু কিসের বা কার তুলনায় ক্ষুদ্র? যে অঞ্চলে সেই মানুষ বা জনগোষ্ঠীর বাস, সেখানে প্রভাবসম্পন্ন অপর ভাষার তুলনায় ক্ষুদ্র। ভাষিক সংখ্যালঘুতার বোধের সঙ্গে মিশে থাকে ভাষিক ক্ষমতালঘুতার বোধ— নিজ বসবাস পরিসরে ভাষিক সংখ্যালঘু তার নিজ মাতৃভাষায় শিক্ষা, সমাজ-প্রশাসন ও ব্যবসা-বাণিজ্যের কাজ, এমনকি সংস্কৃতিচর্চা করতে পারে না, কারণ ভাষিক ব্যবহারের এই সমাজক্ষেত্রগুলো প্রভাবশালী অপর ভাষার দখলে থাকে। এক ক্ষমতাহীন ভাষার কুন্ঠিত বাচকের অস্তিত্বযন্ত্রণা কাটাতে তার উপর মাতৃভাষা বিসর্জন দিয়ে প্রভাবশালী অপর ভাষা আয়ত্ত করার জন্য চাপ তৈরি হয়। সুতরাং ভাষিক সংখ্যালঘুত্ব কেবল বাচকসংখ্যার স্বল্পতার প্রশ্ন নয়, তার থেকে বেশি ক্ষমতালঘুতার প্রশ্ন। ভারতে ইংরেজি ভাষার বাচকরা নেহাতই সংখ্যালঘু, কিন্তু ইংরেজি ভাষার ক্ষমতাপ্রমত্ততার জন্যই তাদের কোনও সংখ্যালঘুতার সমস্যা বা সংকট তৈরি হওয়ার প্রশ্ন ওঠে না, বরং তারা সুবিধাপ্রাপ্ত হিসেবে রাষ্ট্রে ও সমাজে উপরমহলে ক্ষমতাবানদের অলিন্দেই বিচরণ করে। তাই ভাষিক সংখ্যালঘুর সমস্যা ও সংকট নিয়ে আলোচনা করতে গেলে সমাজ-রাজনৈতিক ক্ষমতার অলিন্দে কীভাবে ভাষিক সংখ্যালঘুতার সমস্যা নির্মিত হয়, সেই আলোচনা থেকে শুরু করাই শ্রেয়। আমরা তাই করব।

ভাষাসমীক্ষা: মান ভাষিক পরিচয় নির্মাণ ও তজ্জনিত অন্ধগুহা

ভারতে ২০১১ সালে হওয়া আদমশুমারিতে মাতৃভাষা সমীক্ষার কাজটি যুক্ত হয়েছিল। প্রতিবছরের আদমশুমারিতে তা হয় না। দশ বছর পর পর তা হওয়ার কথা, তার পরে অবশ্য এখনও অবধি আর হয় নি।

এই ভাষাসমীক্ষার পর প্রকাশিত সরকারি প্রতিবেদনে কেবলমাত্র হিন্দি ভাষাই চিহ্নিত হয়েছে ৪৩.৬৩ শতাংশ মানুষের মাতৃভাষা হিসেবে। (বাচকসংখ্যার বৃহদায়তনের নিরিখে তার পরের চারটি ভাষা হল: বাংলা ৮.০৩ শতাংশ, মারাঠি ৭.০৯ শতাংশ, তেলেগু ৬.৯৩ শতাংশ, তামিল ৫.৮৯ শতাংশ।) মাতৃভাষা হিসেবে হিন্দির এই বিপুল স্ফীতিকে একটু খুঁটিয়ে দেখা যাক। সমীক্ষকদের প্রশ্নের উত্তরে ৪৩.৬৩ শতাংশ মানুষই কি ‘তাদের মাতৃভাষা কী’ এই প্রশ্নে ‘হিন্দি’ উত্তর দিয়েছেন? সমীক্ষার প্রতিবেদন একটু খুঁটিয়ে দেখলেই বোঝা যায় যে, না, তা দেন নি। বহু মানুষ অন্য নানা ভাষার নাম বলেছেন, অথচ সমীক্ষকরা সেসব ভাষাকে পৃথক ভাষার স্বীকৃতি না দিয়ে হিন্দির মধ্যেই অন্তর্ভুক্ত করেছেন সমীক্ষা পরিচালনার পূর্বপরিকল্পিত নীতি অনুযায়ী। কী কী ভাষাকে এমনভাবে হিন্দির খোলসে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে? সেগুলো হল: ১।ভোজপুরি, ২।রাজস্থানি, ৩।মাগধি/মাগহি, ৪।ছত্তিসগড়ি, ৫।হরিয়ানভি, ৬।মারোয়ারি, ৭।মালভি, ৮।মেওয়ারি, ৯।খোরঠা/খোট্টা, ১০।বুন্দেলি/বুন্দেলখন, ১১।বাঘেলি, ১২।পাহাড়ি, ১৩।লামানি/লাম্বাতি, ১৪।আওয়াধি, ১৫।হারাউতি, ১৬।গারওয়ালি, ১৭।নিমাাডি, ১৮।সদন/সাদরি, ১৯।কুমায়নি, ২০।ধুনধারি, ২১।সুরগুজা, ২২।বাগরি রাজস্থানি, ২৩।বানজারি, ২৪।নাগপুরিয়া, ২৫।সূর্যপুরিয়া, ২৬।কাঙরি।

কেবল ২০১১ সালের ভাষাসমীক্ষাতেই নয়, ১৯৯১, ২০০১-য়ের ভাষাসমীক্ষাতেও এমনটাই করা হয়েছিল, তার আগেও করা হয়েছে। ১৯৪৭-পরবর্তী স্বাধীন ভারত রাষ্ট্র গঠনের সময় উর্দু ভাষার থেকে পৃথক করে দেবনাগরী লিপিতে লিখিত সংস্কৃত মূল থেকে গৃহিত শব্দভাণ্ডারের উপর জোর দিয়ে ‘হিন্দি’ নামক একটি স্বতন্ত্র ভাষাকে প্রতিষ্ঠা করে তাকেই ভারতের প্রধান ভাষা করে তোলার প্রক্রিয়া জোরদার হয়েছিল। তখন থেকেই এমন চলছে। ২০০১ সালের ভাষাসমীক্ষার বিশদ হিসাব থেকে দেখা যায় যে উপরোক্ত ২৬টি ভাষাকে নিজ মাতৃভাষা বলে দাবি করেছিল মোট জনসংখ্যার ১৪.০৪৮ শতাংশ, যাদেরকে হিন্দি মাতৃভাষী গোষ্ঠীর মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এই বিভিন্ন ভাষাকে স্বতন্ত্র ভাষার স্বীকৃতি না দিয়ে তাদের হিন্দিরই আঞ্চলিক রূপ বা অপভ্রংশ হিসেবে হাজির করার প্রক্রিয়া এইসব ভাষার বাচকদের উপর চাপ তৈরি করে মান হিন্দি ভাষায় ভাষাসরণ ঘটানোর অথবা নিজেদের মাতৃভাষা হিসেবে মান হিন্দিরই উল্লেখ করার জন্য। সেই চাপ উপেক্ষা করেও যারা তাদের নিজের ভাষার নাম বলেন, তাদেরও সমীক্ষার নীতিনির্ধারকরা হিন্দিভাষী বৈ অন্য কিছু বলতে রাজি নন। উত্তরভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ছড়ানো এই মানুষদের ভাষিক পরিচয় নির্ধারণ তাই তঁাদের নিজেদের হাতে নেই, রাষ্ট্র ও তার সমীক্ষা-রচয়িতারাই আপন মর্জিতে তাদের ভাষিক পরিচয় নির্ধারণ করে দেন। ফলে তঁাদের মাতৃভাষাগুলোর কোনও সরকারি স্বীকৃতি নেই, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় হিন্দি ভাষাকে ক্ষমতাধর করে তোলার জন্য তাদের বলিপ্রদত্ত করে অস্বীকৃতির অন্ধগুহায় নিক্ষেপ করা হয়েছে।

ক্ষমতানির্মাণের সমাজ-রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় ভারতের ভাষাবৈচিত্রে্যর পরিসরকে ধ্বংস করে সমরূপতায় ঢালাই করার রাষ্ট্রীয় প্রবণতা এই দৃষ্টান্তের মধ্য দিয়ে অত্যন্ত স্পষ্ট। ভাষিক সংখ্যালঘুত্বের যন্ত্রণা এই সমরূপতায় ঢালাই প্রক্রিয়ারই উপজাত।

ভারতে কটা ভাষা? কে অধম, কে উত্তম?

ঔপনিবেশিক শাসনাধীন ভারতে গ্রিয়ার্সন সাহেব প্রথম ভাষা-গণনার উদ্যোগ নেন এবং ১৮৮৬–১৯২৭ সময়কালে নির্বাহিত সমীক্ষায় ১৭৯টি ভাষা ও ৫৪৪টি উপভাষা চিহ্নিত করেন। ব্রিটিশ রাজদন্ডের অপসারণের পর ১৯৫১ সালের জনগণনায় ভারতীয় জনগণের ‘মাতৃভাষা' হিসাবে মোট ৮৪৫টি ভাষা নথিভুক্ত হয়। এরপর ১৯৬১ সালের জনগণনায় কয়েকটি প্রদত্ত বিকল্পের মধ্যে বেছে নিতে বলার বদলে ‘মাতৃভাষা কী?’ এই প্রশ্ন করে উত্তরদাতাদের উত্তরকেই সরাসরি নথিভুক্ত করা হয়। তাতেই দেখা দেয় এক ‘বিষম' কান্ড! জনসাধারণের সরাসরি উত্তর প্রণালীবদ্ধ করে গণকরা দেখেন যে ৩৮৮টি তফসিলী ভাষা, ৩০৪টি আদিবাসী ভাষা, ৫২১টি অবর্গীকৃত ভাষা, ১০৩টি বিদেশী ভাষা— অর্থাৎ মোট ১,৬৫২টি ‘ভাষা’ পাওয়া যাচ্ছে।

ব্রিটিশ রাজদন্ডের অপসারণের পর ‘স্বাধীন ভারতীয় রাষ্ট্র’ নির্মাণের সময় ইউরোপিয় জাতিরাষ্টে্রর ছঁাদ আদর্শ হিসাবে সামনে থাকার কারণে একটি ‘জাতীয় ভাষা’ চিহ্নিতকরণের প্রশ্ন ওঠে। ভারতের মতো ভাষাবৈচিত্র্যসম্পন্ন ভূখন্ডে এই প্রশ্ন ক্রমশ একটি ‘সরকারি ভাষা’ চিহ্নিতকরণ এবং বিভিন্ন ভাষা-কেন্দ্রিক রাজ্য গঠনের প্রক্রিয়ার চেহারা নেয়। এই দুই ক্ষেত্রেই বহু দ্বন্দ্ব-বিরোধ দেখা দেয়, যেখানে দেশীয় ও আঞ্চলিক রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করার কৌশল হিসাবে ভাষা ও ভাষিক পরিচয়কে ব্যবহার করা হয়। তার ফলশ্রুতি হিসেবে ভারতের নবনির্মিত সংবিধানের অষ্টম তফসিলে ২২টি ভাষাকে ‘জাতীয় ভাষা’ হিসাবে চিহ্নিত করে স্থান দেওয়া হয় এবং ভারতীয় সরকারের ‘ভাষা-আয়োগ’-এ এই ২২টি ভাষার প্রতিনিধিদের জায়গা হয়। অর্থাৎ, প্রাত্যহিক জীবনে, প্রশাসনে ও শিক্ষাব্যবস্থায় ভারতীয় এই ২২টি ভাষার ব্যবহার ও বিকাশের জন্য দায়বদ্ধতা স্বীকার করা হয়। এই ২২টি ভাষা ছাড়া অন্য সমস্ত ভাষার বাচকদের সামাজিক জীবনে, প্রশাসনে ও শিক্ষাব্যবস্থায় নিজের ভাষা ব্যবহার করার অধিকার অস্বীকৃত হয়। ২২টি ‘প্রধান' ভাষাকে মান্যতা দিয়ে ভাষা-ভিত্তিক রাজ্যগঠন ও জাতীয় পরিচয় নির্মাণের প্রক্রিয়া সামাজিক-রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার অঙ্গ হয়ে উঠে অগুন্তি ‘অপ্রধান’ ভাষার বাচকদের ভাষিক অধিকারকে অস্বীকার করে, ‘অপ্রধান’ ভাষাদের উপভাষা বা ‘আঞ্চলিক বিকৃতি’ বলে আখ্যায়িত করে এক ভাষিক সোপানতন্ত্র নির্মাণে সচেষ্ট হয়। এই অবদমনের থেকে রক্ষা পেতে সংবিধানের অষ্টম তফসিলের ‘অভিজাত’ বর্গে স্থান পাওয়ার দাবি নিয়ে কোনও কোনও ভাষার বাচকদের আন্দোলন জন্ম নেয়, ভাষিক ও জাতীয় আকাঙ্খার ভিত্তিতে রাজ্যের পুনর্গঠনের দাবিও উঠতে থাকে। ব্রিটিশ পরবর্তী ভারতীয় রাষ্ট্রকে একটা ‘স্থিতিশীল' চেহারা দিতে ব্যগ্র ছিলেন তখন যে শাসক-প্রশাসকরা, তাদের কাছে তাই জনগণনায় ভাষা-সংখ্যার বিপুল ‘বৃদ্ধি' বিষম এক অশনি সংকেত বই আর কী বা হতে পারে?

ফলত, ১৯৬১ সালের পর আর কখনও সরকারি জনগণনায় ‘মাতৃভাষা কী?’ এই প্রশ্ন করে উত্তরদাতার উত্তর সরাসরি নথিভুক্ত করা হয় নি, বরং উত্তরদাতার উত্তরকে প্রধান কোনও না কোনও ভাষার উপভাষা/আঞ্চলিক রূপ হিসাবে তার অধীনে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে, নতুবা ‘দশ হাজারের কম বাচক’ বলে ‘ভাষা’ হিসাবে নথিভুক্তই করা হয় নি। এইভাবে এখন ভারতে ভাষার সংখ্যাকে মোটামুটি ৪০০ থেকে ৫০০-র মতো রাখতে ভারতীয় প্রশাসকরা সফল হয়েছেন।

এর ফলে অগুন্তি ভাষার বাচকদের নেই তাদের নিজস্ব ভাষিক পরিচয়ের স্বীকৃতিটুকুও, ভাষিক মানবাধিকার তো অনেক দূরের কথা! তাই বিপুল ভাষাবৈচিত্রে্যর দেশ ভারতে অলক্ষ্যে হত্যা হয়ে যাচ্ছে বহু ভাষা। দুনিয়াজোড়া ভাষাবৈচিত্র্যের যে প্রতিবেদন ভাষাতাত্ত্বিকরা তৈরি করেন, সেই ‘এথনোলগ রিপোর্ট’-এর ২০০১ সালের প্রতিবেদনে দেখা যায় যে ভারতের ৪২৮টি ভাষার মধ্যে ইতিমধ্যে ১৩টি ভাষা বিলুপ্ত হয়ে গেছে, এই বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া ভাষাগুলি মূলত ভারতের আদিম জনজাতিদের ভাষা ছিল। ২০০৪ সালের ২১শে সেপ্টেম্বর হিন্দুস্থান টাইমস সংবাদপত্রে ইউনেসকো-র এক আধিকারিকের দেওয়া হিসাব অনুযায়ী ভারতের ৪০০-র কাছাকাছি ভাষার মধ্যে ৭০% থেকে ৮০% অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ ও বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার বিপদের মুখে দাঁড়িয়ে আছে। ইউনেসকো-র ‘অ্যাটলাস অফ দি ওয়ার্ল্ডস ল্যাঙ্গুয়েজেস ইন ডেঞ্জার’-এও বলা হয়েছে যে ভারতে মৃতু্যপথযাত্রী ভাষার সংখ্যা ১৯৭। ২০১০ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে গণেশ নারায়ণ ডেভি-র তত্ত্বাবধানে করা ‘পিপলস লিংগুয়িস্টিক সার্ভে অফ ইন্ডিয়া’-র প্রকাশিত প্রতিবেদনও বলছে যে তার আগের ৫০ বছরে ভারতে ২২০টি ভাষা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। অথচ ভারতীয় সরকারের আধিকারিক বা প্রশাসকদের বক্তব্য জানতে চাইলে তঁারা বলেন যে ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত এমন কোনও ভাষাই তঁারা ভারতে খুঁজে পান না!

ভাষা বিলুপ্ত হয় কীভাবে? এক একটি জনগোষ্ঠীর ভাষা যখন ক্রমাগত অল্পবয়স্ক বাচক হারাতে হারাতে কেবলমাত্র বয়স্কদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে পডে় ও তারপর একসময় তার আর কোনও বাচকই জীবিত থাকে না, তখন তা বিলুপ্ত হয়। এভাবে এক একটি ভাষা বিলুপ্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে সেই জনগোষ্ঠীর দীর্ঘদিনের সঞ্চিত সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার, জ্ঞানের উত্তরাধিকারও ধ্বংস হয়ে যায়, প্রকৃতি ও পরিবেশ সম্পর্কে বৈচিত্র্যপূর্ণ অভিজ্ঞতালব্ধ ধারণা ও তথ্য হারিয়ে যায় মানবসভ্যতার ভাণ্ডার থেকে। এইসব ধ্বংসকার্য চিন্তাহীনভাবে হয়ে যেতে দিয়ে কী নির্বিকার চিত্তেই না আমরা নিজেদের রিক্ত করে তুলছি। আর এর মধ্য দিয়ে ভারতের ভাষা-প্রেক্ষাপট ক্রমশ আরও সোপানতান্ত্রিক বিন্যাসে বিন্যস্ত হচ্ছে।

ভারতের ভাষা-প্রেক্ষাপটে ক্ষমতার চারটি স্তর দেখা যায়। সবার উপরের স্তরে ইংরেজি ভাষা। তার নীচে দ্বিতীয় স্তরে হিন্দি ভাষা। তার নীচে তৃতীয় স্তরে সেই সমস্ত ভাষা যা কোনও রাজ্য-ভাষা হিসাবে বা আঞ্চলিকভাবে প্রভাবশালী কোনও জনগোষ্ঠীর ভাষা হিসাবে আঞ্চলিক ক্ষমতাধিপত্যের দাবিদার। আর সবার নীচে চতুর্থ স্তরে বিভিন্ন আদিবাসী, উপজাতি, ক্ষমতাহীন জনগোষ্ঠীদের ভাষা।

সর্বোচ্চ স্তরে যে ইংরেজি ভাষা তা আন্তর্জাতিকভাবে পঁুজিবাদী বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার আধিপত্যজালের বুননে ভর করে অন্য সমস্ত ভাষার থেকে সামাজিক ব্যবহারের ক্ষেত্র দখল করে নিতে চূড়ান্তভাবে আগ্রাসী। তার উপর, ভারত যেহেতু দীর্ঘদিন ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনস্থ ছিল এবং সেই অধীনতার ঔপনিবেশিক খোয়ারি (colonial hangover) আজও সামাজিক-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে প্রকট, তাই ইংরেজি ভাষার আগ্রাসন আরও প্রাণঘাতী হয়ে উঠেছে ভারতীয় সমস্ত ভাষার ক্ষেত্রে।

দ্বিতীয় স্তরে হিন্দি ভাষা। ব্রিটিশ-পরবর্তী ভারতের শাসকরা একটি কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার শক্তিশালী রাষ্ট্র গড়ে তোলার সহযোগী মতবাদ হিসাবে যেভাবে হিন্দি-হিন্দু জাতীয়তা গডে় তুলতে সচেষ্ট হয়েছে, তা অন্যান্য আঞ্চলিক ভাষাগুলোর থেকে সামাজিক ব্যবহারের ক্ষেত্র (বিশেষ করে প্রশাসনিক, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, সরকারি চাকরির মতো ক্ষেত্র) কেডে় নিয়ে হিন্দিকে ক্ষমতাশালী করে তুলতে চাইছে, অবশ্য ইংরেজির আগ্রাসনের কাছে আত্মসমর্পণ করেই এই প্রক্রিয়া চলছে।

তৃতীয় স্তরে ১০০টিরও কম ভাষা যারা আঞ্চলিক স্তরে ইংরেজি ও হিন্দির আগ্রাসনের সামনে কিছু রক্ষণগণ্ডী খাড়া করে নিজেদের সীমিত আধিপত্যের ক্ষেত্র তৈরি করতে চাইছে। এর জন্য একদিকে তারা যেমন বেশ কিছুটা হিন্দির ও কিছুটা ইংরেজির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত তার সামাজিক ব্যবহারের ক্ষেত্রের ক্ষয় রোখার জন্য, অন্যদিকে তেমনই তার চেয়ে ক্ষমতাহীন অগুন্তি ভাষার উপর আগ্রাসনের মাধ্যমে নিজের ক্ষেত্র বিস্তৃত করতেও উদগ্রীব। বাংলা, ওড়িয়া, অহমিয়া, কন্নড়, তামিল, মালয়ালাম, নেপালি, এমনকি মেইতেই-য়ের মতো ভাষাও তাই চতুর্থ স্তরের অসংখ্য ভাষার ক্ষেত্রে ঘাতকের ভূমিকায় অবতীর্ণ।

চতুর্থ স্তরে ভাষা অগুন্তি। এই ভাষাগুলি উপরের তিন স্তরের আগ্রাসনের চাপে দ্রুত হারে সামাজিক ব্যবহারের ক্ষেত্র হারাচ্ছে, তরুণ বাচকদের মুখ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে, ভাষালোপের ঢাল বেয়ে নামছে। ভাষিক সংখ্যালঘুত্বের গ্লানি ও যন্ত্রণা এই স্তর জুড়েই মর্মন্তুদ হয়ে রয়েছে।

ভাষিক সংখ্যালঘুদের দুরবস্থা

কোনও ভাষা যখন তার ব্যবহারের সামাজিক ক্ষেত্র (সরকার-প্রশাসন, বিচারব্যবস্থা, ব্যবসাবাণিজ্য, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, কর্মক্ষেত্র ইত্যাদি) অন্য কোনও আধিপত্যকারী ভাষার কাছে হারাতে থাকে, তখন সেই ভাষাগোষ্ঠীর মানুষদের সামাজিক অধিকার (বিশেষ করে সমাজ-সংগঠন পরিচালনা ও পরিকল্পনায় অংশগ্রহণ, শিক্ষার বিষয় ও উপায় নির্ধারণে অংশগ্রহণ, নিজস্ব সংস্কৃতি চর্চা)-গুলিও হরণ হয়ে যায়। তাদের নিজস্ব পরম্পরাবাহিত সমাজরূপ, আচারবিচার, পেশা, জীবনযাপনশৈলী হারিয়ে যায়। আত্মবিশ্বাসহীন, পরমুখাপেক্ষী, শক্তিহীন এক জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয় তারা। ফলে, ভাষাবৈচিত্র্যের ক্ষয়, অগুন্তি ভাষার বিপন্ন অগস্ত্যযাত্রা যত চলতে থাকে, সমাজও তত অগণতান্ত্রিক হয়ে ওঠে, কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার একাধিপত্য ততই সর্বাত্মক হয়ে ওঠে।

সামাজিক ও রাজনৈতিক ভাবে আধিপত্য-বিস্তারকারীদের ভাষা সবচেয়ে উন্নত বা সবচেয়ে আগুয়ান ভাষা হিসেবে প্রতিপন্ন হয় কারণ সেই ভাষা ব্যবহারের সঙ্গে সমাজে সম্মান ও ক্ষমতার অনেকগুলো অলিন্দে প্রবেশাধিকার যুক্ত হয়ে থাকে। সেই অলিন্দগুলো হল: ১) সরকার-প্রশাসন-বিচারালয়, অর্থাৎ, সমাজ-সংগঠনের কাজ বা চর্চার অলিন্দ, ২) উচ্চ বেতনের ও উচ্চ সম্মানের পেশাগত কাজের অলিন্দ, ৩) শিক্ষা-গবেষণা-র অর্থাৎ জ্ঞানোৎপাদনের প্রাতিষ্ঠানিক অলিন্দ। নির্দিষ্ট উন্নত বা আগুয়ান ভাষাটি ব্যবহারে দক্ষতা যেহেতু এই সমস্ত কাজ বা চর্চার স্বীকৃত অলিন্দে প্রবেশের ছাড়পত্র দেয় এবং ওই ভাষাটি ব্যতিরেকে অন্য যা বা যা যা ভাষাতেই যত দক্ষতা থাকুক না কেন তা যেহেতু সেই ছাড়পত্র দেয় না, তার ফলে ওই ভাষাটির সঙ্গে ক্ষমতা ও বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্তির বিশেষ যোগ তৈরি হয়। এর ফলে ওই ভাষা ব্যবহারে দক্ষতাকে একটি ভাষিক পঁুজি হিসাবে দেখা হতে থাকে, যে ভাষিক পঁুজির সুযোগসন্ধানী বিনিয়োগ ক্ষমতালাভ ও সুবিধাপ্রাপ্তির পুঞ্জীভবন-চক্রকে অবারিত করে দিতে পারে। অন্যান্য ভাষার বাচকরা এই বিশেষ ভাষিক পঁুজি আহরণ করতে যত উদগ্রীব হয়ে ওঠে, ততই তারা নিজেদের ভাষা-সংস্কৃতিকে অকার্যকরী, সীমাবদ্ধ হিসাবে দেখতে থাকে। যতই ভাষিক পঁুজি জমতে থাকে, ততই নিজেদের ভাষাগুলি অতীত বা দূর এক অসম্মানজনক অস্তিত্বের বর্জনযোগ্য অবশেষ হয়ে ওঠে, নিজেদের ভাষা সম্পর্কে তারা হয়ে ওঠে উদাসীন, এমনকি ঘৃণাভাবাপন্ন। এইভাবে ভাষিক পঁুজি দুইদিক থেকে সমাজে ভাষাদের মধ্যে সম্পর্ক-বৈষম্যকে বাড়িয়ে চলার কাজ করে। একদিকে যেমন তার জন্ম সমাজসংগঠন, উচ্চ স্বীকৃতির পেশাগত কাজ এবং জ্ঞানোৎপাদনের অলিন্দকে এমন একটি কেন্দ্রীভূত অগণতান্ত্রিক কাঠামোয় বাঁধার মধ্য দিয়ে যেখান থেকে অপরাপর ভাষারা নির্বাসিত, অন্যদিকে তেমনই ক্ষমতা ও সুবিধাপ্রাপ্তির আকর্ষণে অপরাপর ভাষার বাচকদের মধ্যে এমন একটা ভাষিক মতবাদের প্রসার সে ঘটাতে থাকে যা ক্রমশ সেইসব ভাষাকে তাদের বাচকদের চোখেই হীন/অকাজের/পশ্চাদবর্তী বলে প্রতিপন্ন করে। ফলত, উন্নত বা আগুয়ান বলে চিহ্নিত একটি ভাষার জয়যাত্রা ক্রমশ সমাজ-প্রতিষ্ঠানগুলোকে কেন্দ্রীভূত করে তুলে মুষ্টিমেয়র নিয়ন্ত্রণে কাজ বা চর্চার ক্ষেত্রকে আবদ্ধ করে, তাতে বেশি বেশি সংখ্যক মানুষদের অংশগ্রহণকে অসম্ভব করে তোলে ও সেই বেশি বেশি সংখ্যক মানুষদের ভাষা, জ্ঞানোৎপাদন ও অভিজ্ঞতাকে অবমূল্যায়িত করতে করতে মূল্যহীন বলে ধ্বংসের পথে ঠেলে দেয়।

এই কারণেই ভাষিক গণতন্ত্রের অবক্ষয়কে সমাজের সামগ্রিক গণতান্ত্রিক কাঠামোর অবক্ষয়ের সঙ্গে হাত ধরাধরি করে চলতে থাকে। ভাষিক সংখ্যালঘুদের ভাষিক অধিকার বিপন্ন হওয়া তাদের সামাজিক-রাজনৈতিক অধিকারকেও সংকুচিত করে।

ভারতে আদিবাসী জনজাতিদের অবস্থা এর দৃষ্টান্ত। তাদের ভাষাগুলো যেমন বিলোপের ঢাল বেয়ে নামছে, তেমনই তাদের ধর্ম-সংস্কৃতি-সমাজরূপ-জীবনশৈলী ক্ষয় পাচ্ছে। নদী-পাহাড়-জঙ্গলের উপর অধিকার হারাচ্ছে, উচ্ছেদ হয়ে প্রান্তীয় অস্তিত্বে নির্বাসিত হচ্ছে।

এতক্ষণ ভারতের ভাষিক সংখ্যালঘুদের কথা আমরা সাধারণভাবে আলোচনা করলাম। এখন মূর্তভাবে তাদের হদিশ করা যাক।

ভারতের ভাষিক সংখ্যালঘুদের বিপন্ন ভাষার একটি অসম্পূর্ণ পঞ্জী

ক। উত্তরবঙ্গের জনজাতির ভাষা

১। মুণ্ডারি ভাষা

মুণ্ডা জনজাতির জলপাইগুড়ি জেলায় প্রায় সত্তরহাজার, উত্তরবঙ্গের অন্যত্র প্রায় পঁয়তাল্লিশ হাজার। তা সত্ত্বেও সেখানে মুণ্ডারি ভাষা বিপন্ন। মুণ্ডারি জনজাতির তরুণ প্রজন্মের ভাষাসরণ হচ্ছে বাংলা, হিন্দি ও সাদরি ভাষায়।

২। আসুরি ভাষা  

ডুয়ার্সের বিভিন্ন চাবাগানের শ্রমিকবসতিতে প্রায় আড়াইশ অসুর জনজাতির পরিবার আছে। তঁাদের মাতৃভাষা আসুরি ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। তাদের ঘরের ভাষাও হয়ে উঠছে সাদরি ও হিন্দি।

৩। শবর ভাষা

মূলত দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ি জেলায় শবর জনজাতির বাস। ঘরে ও বাইরে এখন তঁারা সাদরি, বাংলা ও হিন্দি ব্যবহার করছে। অতিবৃদ্ধ কয়েকজনই কেবল শবর ভাষা বলতে ও বুঝতে পারে।

৪। মালপাহাড়ি ভাষা

সাঁওতাল পরগণার রামগড় পাহাডে়র যে জনজাতি প্রায় আড়াইশ বছর আগে চা-বাগানের শ্রমিক হিসাবে ডুয়ার্সে এসেছিলেন, তঁাদের মাতৃভাষা হল মালপাহাড়ি ভাষা। এই জনজাতির বর্তমান প্রজন্মও বাংলা, হিন্দি ও সাদরি-র বাচক হয়ে উঠেছেন।

৫। কয়া ভাষা

মধ্যপ্রদেশের পাহাড়ি অঞ্চল থেকে ডুয়ার্সের চা-বাগানে কাজ করতে আসা শ্রমিকদের ভাষা হল ক য়া ভাষা। তাদের ঘরের ও বাইরের ভাষা হয়ে উঠেছে সাদরি। কয়া ভাষা লুপ্ত হয়ে গেছে বললেই চলে। কয়েকটা শব্দ ছাড়া কয়া ভাষার কোনও পরিচয় এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না।

৬। রাউতিয়া ভাষা

জলপাইগুড়ি ও দার্জিলিং জেলায় প্রায় এক লাখ রাউতিয়া জনজাতির মানুষের বাস। তা সত্ত্বেও রাউতিয়া ভাষা বিপন্ন। রাউতিয়া জনজাতির তরুণ প্রজন্মের ভাষা হয়ে উঠেছে সাদরি। এখনও কিছু প্রবীণ মানুষ রাউতিয়া ভাষা বলতে পারেন, তঁারা ভাষার অস্তিত্বরক্ষার জন্য গঠন করেছেন ‘অখিল ভারতীয় রাউতিয়া সমাজ বিকাশ পরিষদ’।

৭। ডুকপা ভাষা

আলিপুরদুয়ার জেলার ভারত-ভুটান সীমান্তের বক্সাদুয়ার অঞ্চল ও দার্জিলিং জেলার পার্বত্য অঞ্চলে ডুকপা জনজাতির বাস। নেপালি, হিন্দি ও বাংলা ভাষার আগ্রাসনে নতুন প্রজন্ম ডুকপা ভাষা ভুলে যাচ্ছে।

৮। থারু ভাষা

দার্জিলিং জেলার থারুভিটা, ফকিরচন জোত ইত্যাদি তরাই অঞ্চলে থারু জনজাতির বাস। তারা তাদের মাতৃভাষা ও স্বতন্ত্র পরিচয় হারিয়ে রাজবংশী সমাজের মধ্যে সম্পৃক্ত হয়ে গেছে। থারু ভাষার অস্তিত্ব এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না।

৯। ধিমাল ভাষা

মূলত দার্জিলিং জেলার তরাই অঞ্চলে প্রায় এক হাজার জন ধিমাল জনজাতির মানুষ বাস করেন। তঁাদের মাতৃভাষা ধিমাল ভাষা। তরুণ প্রজন্ম বাংলা ও রাজবংশী ভাষার বাচক হয়ে উঠে ক্রমশ ধিমাল ভাষা পরিত্যাগ করছে।

১০। টোটো ভাষা

আলিপুরদুয়ার জেলার ভুটান-সীমানা সংলগ্ন টোটোপাড়ায় প্রায় পনেরশ জন টোটো জনজাতির মানুষদের বাস। বাংলা ও নেপালি ভাষার চাপে টোটো ভাষা হারিয়ে যেতে বসেছে।

১১। তামাঙ ভাষা

দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি ও আলিপুরদুয়ার জেলায় প্রায় চার লক্ষ তামাঙ জনজাতির মানুষের বাস। তাদের ভাষার নাম মুর্মি ভাষা বা তামাঙ ভাষা। এই ভাষায় লেখার লিপিও বহু পুরানো কাল থেকে চালু আছে। কিন্তু এই ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। খুব বৃদ্ধ জনেরাই কেবল এখন এই ভাষায় সাবলীলভাবে কথা বলতে পারে ও বুঝতে পারে। তামাঙ জনজাতির তরুণ প্রজন্ম নেপালি, হিন্দি বা বাংলার বাচক হয়ে উঠে নিজেদের ভাষা থেকে এতটাই দূরে সরে গেছে যে তামাঙ ভাষায় কথা বলতে বা বুঝতে তারা পারে না।

খ। সিকিমের ভাষা

১। দ্রান্জোক

রাজতন্ত্রের অধীনে সিকিমের ভাষা ছিল দ্রান্জোক। ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে ভারতের দ্বারা সিকিম অধিগ্রহণের পর সিকিমে নেপালিভাষী মানুষদের অভিবাসনের ঢল নামে। আজ সিকিমের জনসংখ্যার নব্বই শতাংশই এই নেপালিভাষী অভিবাসী। সামাজিক ব্যবহারের ক্ষেত্রগুলি একে একে নেপালি ভাষার দখলে চলে যাওয়ার পর দ্রান্জোক ভাষা আজ মুমূর্ষু।

২। লেপচা ভাষা

লেপচা ভাষাও সিকিমের আদিবাসীদের একাংশের ভাষা। লেপচা ভাষার নিজস্ব লিপি আছে এবং আঠারো শতক থেকে লেপচা ভাষায় সাহিত্যসৃষ্টির ঐতিহ্যের খোঁজ পাওয়া যায়। রাজতন্ত্রের যুগে সিকিমের মধ্যে বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং জেলার সিংহভাগ বহুদিন অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই দুই অঞ্চল ছাড়া কালিম্পংয়ে লেপচাভাষা অন্যতম প্রধান ভাষা ছিল। দ্রান্জোক ভাষার মতো লেপচা ভাষাও নেপালি ভাষার ক্রমপ্রসারমানতার কাছে হার মেনেছে। এই গোটা অঞ্চলে আর খুব অল্প কিছু পরিবারই অবশিষ্ট আছে যেখানে তরুণ প্রজন্ম সক্রিয়ভাবে এই ভাষা চর্চা করে ও এই ভাষায় কথা বলে। এই গুটিকয় পরিবারও ছড়ানো-ছেটানো। লেপচা ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারে এমন মানুষের সংখ্যা এক হাজারের মতো হবে।

গ। ব্রক্ষ্মপুত্র উপত্যকা ও সংলগ্ন পার্বত্য অঞ্চলের ভাষা

১। দেওরি চুটিয়া

চুটিয়া জনজাতির বড় সংখ্যক মানুষ অতীতে ব্রক্ষ্মপুত্র উপত্যকায় ছিলেন বলে জানা যায়। তাদের মধ্যে একমাত্র যারা নিজেদের মাতৃভাষা এখনও অবধি ধরে রেখেছে, তারা হল দেওরি গোত্রের মানুষজন। এই দেওরি গোত্রের মানুষ অহম রাজাদের আমলে পুরোহিতের কাজ করত। ১৯৭১-এর আদমশুমারিতে অরুণাচল প্রদেশে ২,৬৮৩ জন দেওরি জনজাতির মানুষ ও অসমে ৯,১০৩ জন চুটিয়া চিহ্নিত হয়েছিল। উপর অসম-এর লখিমপুর ও শিবসাগর জেলায় মাত্র কয়েকটি পরিবারই অবশিষ্ট আছে যারা দেওরি চুটিয়া ভাষায় এখনও কথা বলে।

২। দিমাসা

দিমাসা ভাষা পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার শেষ পর্যায়ে দাঁড়িয়ে আছে। উত্তর কাছাড় পাহাড় ও তৎসংলগ্ন সমভূমিতে দিমাসাভাষী জনগোষ্ঠীর বাস ছিল, আজ তারা প্রায় সবাই অহমিয়াভাষী বা বাংলাভাষী হয়ে উঠেছে। কেবলমাত্র বিচ্ছিন্ন কিছু পরিবারের ঘরেই এই ভাষা এখনও শোনা যেতে পারে, কিন্তু তঁাদেরও অনেক কষ্ট করে খুঁজে বার করতে হবে।

৩। কাছাড়ি

দারাঙ জেলায় চুটিয়াদের অঞ্চল থেকে ভাটির পানে আর বোডে়াদের অঞ্চল থেকে উজান পানে যে এলাকা, সেখানে কাছাড়ি ভাষা বলা হত। সেখান থেকে কাছাড়ি ভাষা প্রায় হারিয়ে গেছে। ধীরে ধীরে কাছাড়িভাষী জনগোষ্ঠীর নতুন প্রজন্ম অহমিয়া ভাষা বা হিন্দি/ ইংরেজি ভাষার বাচকতায় সরে গেছে। অবশিষ্ট অংশেরও খুব দ্রুত এই সরণ ঘটে যাচ্ছে। ভাটির দিকে গোয়ালপাড়া অঞ্চলে কাছাড়ি ভাষার যে আঞ্চলিক রূপ, তাকে এখন ‘বোড়ো’-ই বলা হয়।

৪। মেচে

মেচে এই অঞ্চলের একটি বোডে়া-কোচ ভাষা, যার উল্লেখ ব্রিটিশ যুগের নথিপত্রে পাওয়া যায়। আজ এই ভাষা বিলুপ্তপ্রায়, হাতে গোনা কয়েকজন বাচক পডে় আছে।

৫। বোড়ো

বোডে়া ভাষার বাচক এখনও বড় সংখ্যায় আছে, কিন্তু তাদের মধ্যেও অহমিয়া ও বাংলা বাচকতায় সরণ বড় মাত্রায় ঘটছে।

৬। কোক্বরক

ত্রিপুরার পার্বত্য অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর ভাষা ছিল কোক্বরক। ১৯৪৭ সালে কোক্বরকভাষী আদিবাসীরা ছিল ত্রিপুরার জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ আর বাংলাভাষী অভিবাসীরা ছিল ৩০ শতাংশ। আজ এই একুশ শতকের গোড়ায় বাংলাভাষী অভিবাসী ৪৫ শতাংশ। কোক্বরকভাষীরা তাদের পার্বত্য অঞ্চলেও মাত্র ৩০ শতাংশ। জনবসতির এই পরিবর্তন এবং তদনুসারী সামাজিক-অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চাপ কোক্বরকভাষীদের ভাষা সরণ ঘটাচ্ছে বিপুলভাবে। প্রায় আট লাখ কোক্বরক জনজাতির মানুষ থাকলেও, তাদের সিংহভাগ কোক্বরক ভাষায় বাচকতা ত্যাগ করেছে এবং এখনও করে চলেছে।

৭। তিওয়া বা লালুঙ

কামরূপ এবং কার্বি আঙলঙ-এর মারিগাঁও জেলায় এই ভাষার ৩৫,০০০-এর মতো বাচক আছে। অহমিয়া, হিন্দি, ইংরেজিতে সরণ তিওয়া ভাষার বাচকদের নতুন প্রজন্মের মধ্যে ক্রমবর্ধমান।

৮। গাড়ো

মেঘালয়ের পশ্চিম অর্ধে গাডে়া পর্বতের প্রায় আড়াই লাখ অধিবাসীর মধ্যে দুই লাখ গাডে়া ভাষার বাচক। অসমের কামরূপ ও গোয়ালপাড়া এবং বাংলাদেশের মৈমনসিংহ জেলায় আরও প্রায় পঞ্চাশ হাজার গাডে়া ভাষার বাচক আছে। এই ভাষা বিলুপ্তির আশু বিপদের সামনে দাঁড়িয়ে না থাকলেও এর ক্ষেত্রেও ভাষা-ব্যবহারের সামাজিক ক্ষেত্রের সংকোচন সংকটজনক চেহারা নিয়েছে।

৯। কোচ

গাডে়া পর্বতের পশ্চিম প্রান্তে ডালু ও গাড়োবাধা-র কাছে এই ভাষার বাচকদের পাওয়া যায়। তারা ‘ওয়ানাঙ’ বা ‘পানি কোচ’ জনজাতির মানুষ। তঁাদের বড় অংশ মাতৃভাষা ও নিজ স্বতন্ত্র জাতি পরিচয় উভয়ই হারিয়ে চারদিকের অন্য আধিপত্যকারী ভাষা ও জাতিপরিচয়ের মধ্যে মিশে গেছেন। মাত্র তিনশ জন মতো এই ভাষার বাচক অবশিষ্ট আছে।

১০। আটঙ

গাড়ো পর্বতের দক্ষিণ-পূর্বে সোমাশ্বরী ও বাঘমারা-কে ঘিরে এই ভাষার কয়েক হাজার বাচক পাওয়া যায়।

১১। রাভা

মেঘালয়ের পর্বতাঞ্চলের পাশ কাটিয়ে ব্রক্ষ্মপুত্র যেখানে দক্ষিণে বাঁক নিচ্ছে, সেই অঞ্চলে রাভা জনজাতির বাস। অসমে প্রায় দেড় লাখ রাভা জনজাতির মানুষ থাকলেও, তাদের মধ্যে এখন মাত্র কয়েক হাজারই রাভা ভাষায় কথা বলে। বাকিদের অহমিয়া ভাষা ও বাংলা ভাষায় সরণ ঘটে গেছে। গোয়ালপাড়া, মাটিয়া, মাঝেরবুড়ি, মাকুড়ি গ্রামগুলোতেই রাভা ভাষার বাচক এখনও পাওয়া যাবে, যদিও তাদের নতুন প্রজন্মের মধ্যেও অহমিয়া ভাষায় সরণ ঘটে চলেছে।

১২। কার্বি বা মিকির

মিকির জনজাতি মূলত কার্বি আঙলঙের মিকির পাহাডে়র বাসিন্দা, সংখ্যা দেড় লাখের মতো। বর্তমানে তরুণ প্রজন্মের কার্বি বা মিকির ভাষা ছেডে় দ্রুত অহমিয়া ভাষায় সরণ ঘটে চলেছে।

১৩। দাইক ভাষা

১২২৮ খ্রিস্টাব্দে দাইক জনজাতির একটি দল ব্রক্ষ্মপুত্রের নিচ উপত্যকায় প্রবেশ করে। তারা বয়ে এনেছিল প্রাচীন দাইক ভাষা। রাজপুত্র সুকোফার নেতৃত্বে দাইক জনজাতির একটি অভিজাত অংশ এই অঞ্চলে সামাজিক-রাজনৈতিক আধিপত্য কায়েম করে। আঞ্চলিক বোডে়া-কোচ জনজাতিদের ওপর তারা তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি আরোপ করতে সফল হয়েছিল। কিন্তু আজ তাদের সেই প্রাচীন ভাষা কেবল সেই সময়কার দিনপঞ্জি বুরঞ্জি-র মধ্যেই টিঁকে আছে। এর পরেও অনেক দাইক গোষ্ঠীর অনুপ্রবেশ ঘটে এই অঞ্চলে। যেমন, আঠারো শতকে খাম্পতি ও তাই ফাকে বা ফাকিয়ালরা উত্তর-পূর্ব ভারতে আসে। আজ অসমের লখিমপুর জেলার পূর্ব কোণ ও তদ্সংলগ্ন অরুণাচল প্রদেশের লোহিত জেলায় খাম্পতি জনজাতির মানুষ আছে, কিন্তু তাদের মধ্যে তাদের পূর্বপুরুষদের ভাষার বাচকের সংখ্যা ক্রমশ কমছে। তাইফাকে ভাষার বাচক এখন আর দুই হাজার-এর মতো আছে, যারা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী এবং তিনসুকিয়া ও ডিব্রুগড় জেলার ছয়টি গ্রাম— নামফাকিয়াল, তিপম ফাকিয়াল, বার ফাকিয়াল, নাম্মান, নাম্চাই ও লাঙ-এর মধ্যে সীমাবদ্ধ। একইভাবে, খামইয়াঙ ও আইতন বা শাম দোনিয়া-র মতো আরও কিছু দাইক ভাষার আঞ্চলিক রূপ এখনও কিছু বাচকের মধ্যে বেঁচে থাকলেও, বাচকদের ক্রমাগত অহমিয়া ভাষায় সরণের মধ্য দিয়ে তারাও বিলুপ্তির পথে।

ঘ। অরুণাচল প্রদেশের ভাষা

১৯৭০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ভারত সরকার অরুণাচল প্রদেশ জুড়ে হিন্দিভাষার বাচক তৈরির জন্য উঠে পড়ে লাগার পর থেকে অরুণাচল প্রদেশের প্রায় সব জনজাতির মাতৃভাষা হিন্দি-আগ্রাসনে বিপন্ন হয়ে পড়েছে। সেই হিন্দি আগ্রাসনের ঘাড়ে চড়ে এখন প্রধান বিপদ হয়ে উঠেছে ইংরেজি ভাষার আগ্রাসন। অনুতাপের বিষয় যে ভাষাবৈচিত্র্যের বিপুল সম্পদসম্পন্ন এই রাজ্যে সরকারি ভাষা করা হয়েছে কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রের আমলাকূলের ভাষা, ঔপনিবেশিক খোয়ারি বয়ে নিয়ে চলার ভাষা ইংরেজিকে।

হ্রুসিস ভাষাসমূহ

১। হ্রুসো বা আকা

কামেঙ জেলার দক্ষিণ-পূর্বে, মূলত বিচম নদীর উপত্যকায় বসবাসকারী হ্রুসো বা আকা জনজাতির মাতৃভাষা হ্রুসো বা আকা। এখন তার বাচক সংখ্যা মাত্র ৩০০০। বিলুপ্তির আশু বিপদ সামনে।

২। ধিম্মাই বা মিজি

কামেঙ জেলার উত্তর-পূর্ব ও উত্তর-মধ্য অঞ্চলের প্রায় পঁচিশটি গ্রামে মিজি জনজাতির মাতৃভাষা এইটি। বাচকসংখ্যা মাত্র চার হাজার, বিলুপ্তির আশু বিপদ সামনে।

৩। লেভাই বা বোংরো

কামেঙ ও সুবানসিরির কিছু অঞ্চলে এই ভাষার মাত্র এক হাজার মতো বাচক পাওয়া যায়। বিলুপ্তির আশু বিপদ সামনে।

খো-ব্যা ভাষাসমূহ

৪। খোয়া বা বুগুন

পশ্চিম কামেঙ জেলার বোমডিলার কাছে মূলত ওয়াংহু ও সিংচুঙ গ্রামদুটোতে এই ভাষার মাত্র আটশ বাচক এখন আছে। বিলুপ্তির আশু বিপদ সামনে।

৫। সুলুঙ

পূর্ব কামেঙ-এর উত্তর পূর্ব পাহাড়ের ও নিম্ন সুবানসিরি জেলার উত্তর-পশ্চিম পাহাড়ের দুর্গম অঞ্চলে যাযাবর জনজাতি সুলুঙ-এর মাতৃভাষা সুলুঙ। এখন তার বাচকসংখ্যা চার হাজারের মতো।

৬। লিস্পা

কামেঙ জেলার মোনপা জনগোষ্ঠীর ভাষা। বাচকসংখ্যা এক হাজারের মতো।

৭। সেরদুকপেন

কামেঙ জেলার দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে রূপা সেরগাঁও ও জিগাঁও গ্রামে এবং বোমডিলার দক্ষিণে তেংগা উপত্যকায় সেরদুকপেন জনজাতির দুহাজার মতো বাচক এই ভাষার।

তানি ভাষাসমূহ

৮। মিলাঙ

তানি অঞ্চলের পূর্বপ্রান্তে বসবাসকারী মিলাঙ জনজাতির ভাষা। বাচকসংখ্যা পাঁচ হাজার মতো।

৯। বাঙনি (পশ্চিম ডাফলা)

উপস্থিতি ভারত-তিব্বত সীমান্ত সংলগ্ন অঞ্চলে। বাচকসংখ্যা তেইশ হাজার।

১০। নিসি (পূর্ব ডাফলা)

বাচকসংখ্যা তিরিশ হাজার।

১১। নাহ্

উপস্থিতি উপর সুবানসিরি জেলার তাকসিং প্রশাসনিক বৃত্তের অন্তর্গত সাতটি গ্রামের মধ্যে। বাচকসংখ্যা দুই হাজার।

১২। সরক

উপস্থিতি আপাতনি উপত্যকার পুবদিকে। বাচকসংখ্যা নয় হাজার।

১৩। তাগিন

উপস্থিতি সুবানসিরি জেলার উত্তর-পূর্বে এবং তদ্সংলগ্ন পশ্চিম সিয়াঙ-এর কিছু অংশে। বাচকসংখ্যা পঁচিশ হাজার।

১৪। আপাতনি

উপস্থিতি সুবানসিরি জেলার আপাতনি উপত্যকায়। বাচকসংখ্যা চোদ্দ হাজার।

১৫। গালঙ

উপস্থিতি পশ্চিম সিয়াঙ জেলার দক্ষিণ অর্ধে। বাচকসংখ্যা চল্লিশ হাজার।

১৬। বোকার

উপস্থিতি পশ্চিম সিয়াঙ জেলার মাছুখা সাবডিভিশনের মোনিগঙ সার্কেলের চল্লিশটি গ্রামে। বাচকসংখ্যা সাডে় তিন হাজার।

১৭। পাইলিবো

উপস্থিতি পশ্চিম সিয়াঙ জেলার সিয়োম নদীর ধারে নয়টি গ্রামে। বাচকসংখ্যা এক হাজার।

১৮। রামো

উপস্থিতি পশ্চিম সিয়াঙ জেলার পাইলিবো অঞ্চলের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে। বাচকসংখ্যা আটশ।

১৯। মিনয়োঙ

উপস্থিতি সিয়াঙ নদীর নিচ অববাহিকার পশ্চিম পাড় বরাবর। বাচকসংখ্যা কুড়ি হাজার।

২০। বোরি

উপস্থিতি সিয়োম ও সিকে নদীর পাড় বরাবর লুয়োর পাহাড় ও পিরি পাহাডে়র মধ্যবর্তী অঞ্চলে। বাচকসংখ্য দুই হাজার।

২১। আসিঙ

উপস্থিতি তিব্বত সীমান্তের কাছে সিয়াঙ নদীর উৎস অঞ্চলে, রামসিং গ্রাম ও তুতিং গ্রামের মাঝে। বাচকসংখ্যা এক হাজার।

২২। সিমঙ

উপস্থিতি সিয়াঙ নদীর উত্তর অংশের বাঁ তীরে। বাচকসংখ্যা দুই হাজার।

২৩। তাংগাম

উপস্থিতি সিয়াঙ জেলার উত্তর প্রান্তে কুজিং গ্রাম, ঞ্জেরিং গ্রাম ও মায়ুম গ্রামে এবং সিয়াঙ নদী ও নিগঙ নদীর উপর অববাহিকায়। বাচকসংখ্যা দুশ।

২৪। কারকো

উপস্থিতি কারকো গ্রাম ও তদ্সংলগ্ন আরও কিছু গ্রামে। বাচকসংখ্যা দুই হাজার।

২৫। পাঙগি

উপস্থিতি ইয়াম্নে নদীর নিচ অববাহিকায় ইয়াম্নে ও সিয়াঙ নদীর সঙ্গমস্থলের উপরে গেকু, সুমসিঙ, সিবুম, জেরু ও পঙগিঙ গ্রামে। বাচকসংখ্যা ছয়শ।

২৬। পদম বা বোর আবোর

উপস্থিতি পূর্ব সিয়াঙ-এ দিবাঙ, সিয়াঙ ও যামনে উপত্যকার মধ্যবর্তী অঞ্চলে। বাচকসংখ্যা চল্লিশ হাজার।

২৭। মিসিঙ

উপস্থিতি পাহাড় সংলগ্ন তরাই এলাকায়। বাচকসংখ্যা চার হাজার।

মিদ্জুই ভাষাসমূহ

২৮। কামান বা মিজু মিস্মি

উপস্থিতি লোহিত জেলায় লোহিত নদীর উপর অববাহিকায় নদীর দুই তীরে পরশুরাম কুণ্ডের চারদিকে। বাচকসংখ্যা নয় হাজার।

২৯। জাইওয়া মিস্মি

উপস্থিতি ওয়ালঙ-এর কাছে জাখরিঙ ও মেয়র জনজাতির মানুষদের মধ্যে। বাচকসংখ্যা দুশ।

দিগরি ভাষাসমূহ

২৯। ইদু

উপস্থিতি ‘চুলকাটা মিসমি' জনজাতির মধ্যে। বাচকসংখ্যা নয় হাজার।

৩০। তারাওঁ

উপস্থিতি পুবদিকে দেলেই ওলতি নদী, দক্ষিণে খারেম এবং পশ্চিমে দিগারু-র মধ্যবর্তী অঞ্চলে। বাচকসংখ্যা ছয় হাজার।

ঙ। উত্তর নাগা বা কোনিয়াক ভাষাসমূহ

নাগা জনজাতিদের এই সব ভাষা ইংরেজি বা হিন্দি দিয়ে প্রতিস্থাপিত হয়ে সামাজিক ব্যবহারের ক্ষেত্র হারিয়ে বিলুপ্তির মুখে দাঁড়িয়ে আছে:

১। ওয়ানচোস

পাটকোই পর্বতশ্রেণি ও তার পাদদেশে এগারোটি ‘জান’ বা সংঘে সংঘটিত প্রায় একচল্লিশটি গ্রামে ওয়ানচোস জনজাতির বাস। তাদের মাতৃভাষা ওয়ানচোস-এর বাচকসংখ্যা তিরিশ হাজারের মতো।

২। কোনিয়াক

ওয়ানচোসদের এলাকার দক্ষিণে কোনিয়াক জনজাতিদের বসবাস। তাদের ভাষার বাচকসংখ্যা সত্তর হাজারের মতো।

৩। ফোম

কোনিয়াকদের অঞ্চলের দক্ষিণে ফোম জনজাতিদের এলাকা। তাদের ভাষার বাচকসংখ্যা উনিশ হাজার।

৪। চ্যাঙ

কোনিয়াকদের অঞ্চলের দক্ষিণ-পূর্বে মায়ানমার সীমান্ত অবধি চ্যাঙ জনজাতির এলাকা। তাদের ভাষার বাচকসংখ্যা ষোল হাজার।

৫। তাঙসা

তিরাপ জেলার চাঙলাঙ ও মিয়াও উপভাগে তাঙসা জনজাতির বসবাস। তাদের ভাষার বাচকসংখ্যা কুড়ি হাজার।

৬। নোক্টে

তিরাপ জেলার কেন্দ্রে, ওয়ানচোসদের এলাকা থেকে উত্তর-পূর্বে নোক্টে জনজাতির বসবাস। তাদের ভাষার বাচকসংখ্যা আঠাশ হাজার।

৭। লোথা

এই ভাষার বাচকসংখ্যা পঁয়ত্রিশ হাজার, নাগাল্যান্ডের মধ্যাঞ্চলে তাদের বাস।

৮। আঙগামি

এই ভাষার বাচকসংখ্যা ত্রিশ হাজার, নাগাল্যান্ডের মধ্যাঞ্চলে তাদের বাস।

৯। সেমা

এই ভাষার বাচকসংখ্যা পঁয়ষট্টি হাজার, নাগাল্যান্ডের মধ্যাঞ্চলে তাদের বাস।

১০। রেঙমা

এই ভাষার বাচকসংখ্যা নয় হাজার, নাগাল্যান্ডের মধ্যাঞ্চলে তাদের বাস।

১১। চুংলি আও, মঙসেন আও, সাঙটাম, য়িমচুঙরু, ইয়াছাম, তেঙসা

সবগুলি মিলে বাচকসংখ্যা বাষট্টি হাজারের মতো, নাগাল্যান্ডের মধ্যাঞ্চলে তাদের বাস।

১২। চেক্রি, খেজা, মাও, পোচুরি, ঞটেনয়ি, মালুরি

প্রত্যেকটির কয়েক হাজার করে বাচক।

১৩।জেমে, লিয়াঙমাই, ন্রুয়াঙ্গমেই ঝিয়েমে, পুইরোন, খৈরাও, মারাম

নাগাল্যান্ডের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণ ও মণিপুরের উত্তর-পশ্চিম কোণের বহু গ্রামে বসবাসকারী জনজাতিদের ভাষা এইগুলি। বাচকসংখ্যার কোনও হিসাব জানা নেই।

১৪। তাঙখুল ও মারিঙ

মণিপুরের উত্তর-পূর্বের এক চতুর্থাংশ জুডে় তাঙখুল ও মারিঙ জনজাতিদের বাস। মণিপুরের প্রধান ভাষা মেইতেই এই ভাষাদুটোকে প্রতিস্থাপিত করেছে। বাচক প্রায় অমিল। ভাষাদুটি বিলুপ্ত হয়ে গেছে বলা যায়।

চ। আরও কিছু উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জনজাতির ভাষা

১। থাদোউ, কোম, চিরু, গাঙতে, লামগাঙ, অনল, পাইতে

মণিপুরে এই সব ভাষার বাচকসংখ্যা ক্রমাগত কমে চলেছে। আঞ্চলিকভাবে প্রাধান্যবিস্তারকারী মেইতেই ভাষায় এই সব ভাষাগোষ্ঠীর সরণ ঘটে চলেছে।

২। হ্রাঙকোল, চোরেই, বম, কোম ও হ্মার

ত্রিপুরা, দক্ষিণ অসম ও মিজোরামের দক্ষিণ প্রান্তের এইসব ভাষাগোষ্ঠীর মানুষদের নতুন প্রজন্মের সরণ ঘটছে বাংলা বা অসমিয়া ভাষায়।

৩। সাক ভাষাগোষ্ঠী

সাক গোষ্ঠীর ভাষাদের মধ্যে সাক, কাদু, আন্দে্রা ও সেঙমাই হয় বিলুপ্ত হয়ে গেছে, নয়তো বিলুপ্তির আগ্মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছে। আগে এইসব ভাষায় যারা কথা বলতেন তাদের উত্তরপুরুষরা এখন মণিপুরে মেইতেই ভাষার বাচকে পরিণত হয়েছে।

ছ। দক্ষিণ মুণ্ডা ভাষা

দক্ষিণ মুণ্ডা ভাষাগুলো অস্ট্রো-এশিয় ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্গত। এদের মধ্যে কয়েকটি ভাষার বাচকসংখ্যা তুলনায় বেশি হলেও, প্রতিটি ভাষাই দ্রুতহারে বাচক হারাচ্ছে। প্রতিটি ভাষাগোষ্ঠীর বাচকদের ওপরই স্থানীয় সংখ্যাগুরুদের ইন্দো-আর্য ভাষায় সরণ ঘটানোর জন্য সামাজিক-অর্থনৈতিক চাপ প্রবল, ইংরেজি ও হিন্দি ভাষার চাপ তো আছেই। বর্তমান পরিস্থিতি বজায় থাকলে এই শতকের শেষে সবগুলো ভাষাই বিলুপ্ত হয়ে যাবে। এদের ভৌগোলিক উপস্থিতি ও বাচকসংখ্যা এইরকম:

১। জুয়াঙ

উপস্থিতি ওড়িশার কেওনঝড় ও ঢে়ন্কানল জেলায়। বাচকসংখ্যা সতেরো হাজার।

২। খারিয়া

উপস্থিতি ছোটনাগপুর, বিশেষত রাঁচি জেলায়, তাছাড়াও ওড়িশা, পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, অসম ও মধ্যপ্রদেশের কিছু অংশে। বাচকসংখ্যা এক লাখ নব্বই হাজার।

৩। সোরা বা সাওয়া বা শবর

উপস্থিতি দক্ষিণ ওড়িশার কোরাপুট ও গঞ্জাম জেলায় এবং অন্ধ্রপ্রদেশ সন্নিবর্তী অঞ্চলে। বাচকসংখ্যা তিন লাখ।

৪। পারেঙ বা গোরাম

উপস্থিতি কোরাপুটের নন্দপুর ও পোত্তাঙ্গি তালুকে। বাচকসংখ্যা দশ হাজার।

৫। রেমো বা বোন্দা

উপস্থিতি কোরাপুটের জয়পুর পাহাডে়। বাচকসংখ্যা আড়াই হাজার।

৬। গুতোব বা সোদিয়া

উপস্থিতি কালাহান্ডি, কোরাপুট, বিশাখাপত্তনম ও বস্ত ার জেলায়। বাচকসংখ্যা চল্লিশ হাজার।

৭। দিদেয়ি বা দিদম্

উপস্থিতি অন্ধ্রপ্রদেশের পশ্চিম গোদাবরি জেলার সিলেরু নদীর দুই তীরে। বাচকসংখ্যা তিন হাজার।

জ। উত্তর মুণ্ডা ভাষা

সাঁওতালি ভাষা ছাড়া অন্য সমস্ত উত্তর মুণ্ডা ভাষা এই শতকের মধ্যেই বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার মুখে দাঁড়িয়ে।

সাঁওতালি ভাষা অষ্টম তফশিলভুক্ত হয়েছে, এই ভাষায় লেখার জন্য অভিন্ন লিপি হিসাবে অলচিকি চালু করার প্রচেষ্টা এই ভাষাগোষ্ঠীর মধ্যে একাংশ নিয়েছেন, শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে সাঁওতালি ভাষা চালু করার প্রচেষ্টা প্রাথমিক স্ত রে আছে। এতদ্সত্ত্বেও তরুণ প্রজন্মের মুখ থেকে ক্রমশ এই ভাষা সরে যাচ্ছে। বেশ কয়েক লাখ বাচক এখনও থাকা সত্তে্বও এই ভাষা তাই সংকটের মধ্যে আছে।

বিলুপ্তির দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা অন্যান্য উত্তর মুণ্ডা ভাষাগুলো হলো:

১। কোরকু

উপস্থিতি দক্ষিণ-পশ্চিম মধ্যপ্রদেশ ও মহারাষ্টে্রর সংলগ্ন অঞ্চল। বাচকসংখ্যা দুই লাখ।

২। হাসাদা, নাগুরি, লাতার, কেরা

উপস্থিতি রাঁচি, সিংভূম, মানভূম, হাজারিবাগ, পালামৌ এবং ওড়িশা ও মধ্যপ্রদেশের উত্তর প্রান্তে। সব মিলে বাচকসংখ্যা সাত লাখ পঞ্চাশ হাজার।

৩। হো বা কোল

উপস্থিতি সিংভূমে। বাচকসংখ্যা ৪ লাখ।

৪। ভূমিজ

উপস্থিতি ঝাড়খণ্ড, পশ্চিমবঙ্গ ও ওড়িশার ছড়ানো-ছিটানো অঞ্চলে। বাচকসংখ্যা এক লাখ পঞ্চাশ হাজার।

৫। বিরহোর

উপস্থিতি সিংভূম, দক্ষিণ পালামৌ, দক্ষিণ হাজারিবাগ এবং রাঁচির উত্তর-পূর্ব অংশে। বাচকসংখ্যা দুই হাজার।

৬। কোড়া জনজাতির আঞ্চলিক ভাষাসমূহ

উপস্থিতি ছোটনাগপুরের ছড়ানো-ছিটানো অঞ্চলে। বাচকসংখ্যা পঁচিশ হাজার।

৭। তুরি

উপস্থিতি পশ্চিমবঙ্গ, পালামৌ, রাঁচি, সিংভূম, রায়গড় ও ছত্তিশগড়ের বিভিন্ন অঞ্চলে। বাচকসংখ্যা কয়েক হাজার।

৮। অসুর জনজাতির আঞ্চলিক ভাষা

উপস্থিতি নেতারহাট, উত্তর রাঁচি, গুমলা-য়। বাচকসংখ্যা সাত হাজার।

৯। কোরওয়া আঞ্চলিক ভাষাসমূহ

উপস্থিতি পালামৌ ও হাজারিবাগ জেলায়, মধ্যপ্রদেশের রায়গড় জেলার যশপুরনগর তহসিলে এবং সরগুজা জেলায়।

ঝ। দক্ষিণ দ্রাবিড় ভাষা

১। ইরুলা

উপস্থিতি নীলগিরি পর্বতে। বাচকসংখ্যা পাঁচ হাজার।

২। কোটা

উপস্থিতি নীলগিরি পর্বতের কেট্টাাগিরি অংশে। বাচকসংখ্যা এক হাজার।

৩। তোডা

উপস্থিতি উডাগামণ্ডলম (উটি)-র আশপাশে। বাচকসংখ্যা এক হাজার।

৪। বাদাগা

উপস্থিতি নীলগিরি পর্বতে। বাচকসংখ্যা এক লাখ।

৫। কোদাগু

উপস্থিতি কর্ণাটকের কুর্গ-এ এবং কোদাগু জেলায় মাদকেরি-র আশপাশে। বাচকসংখ্যা এক লাখ।

৬। টুলু

উপস্থিতি মাঙ্গালোর ও কেরালার তটে। বাচকসংখ্যা দশ লাখ।

৭। কুরুবা

কুর্গের পার্বত্য অঞ্চলের বেট্টা-কুরুবা জনজাতির মাতৃভাষা এইটি। বাচকসংখ্যা একহাজার।

৮। কোরাগা বা বেল্লারি জনজাতির ভাষাযমূহ

উপস্থিতি কুন্ডাপুরা ও উদুপি অঞ্চলে। প্রতিটির বাচকসংখ্যা এক হাজারের মতো।

৯। কুররু

এইটি অন্ধ্রপ্রদেশ ও তদ্সংলগ্ন কর্ণাটক ও তামিলনাডুর যাযাবর জনজাতিদের ভাষা। বাচকসংখ্যা এক লাখ।

ঞ। মধ্য দ্রাবিড় ভাষা

১।গাদাবা গোষ্ঠীর আঞ্চলিক ভাষাসমূহ

উপস্থিতি ওড়িশার কোরাপুট জেলায়। বাচকসংখ্যা চল্লিশ হাজার।

তেলেগু-কুই গোষ্ঠীর ভাষা

২। গোন্ডি

মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, ওড়িশা ও উত্তর অন্ধ্রপ্রদেশের কেই বা কেয়া জনজাতির ভাষা হল গোন্ডি। বাচকসংখ্যা কুড়ি লাখ।

৩। কোন্ডা বা কুবি

অন্ধ্রপ্রদেশের বিশাখাপত্তনম ও শ্রীকাকুলাম জেলা এবং তদ্সংলগ্ন ওড়িশার কোরাপুট জেলার কোন্ডা ডোরা জনজাতির ভাষা হল কোন্ডা বা কুবি। বাচকসংখ্যা পনেরো হাজার।

৪। মান্ডা ও পেঙ্গো

উপস্থিতি ওড়িশার কোরাপুট ও কালাহান্ডি জেলায়। বাচকসংখ্যা এক হাজার পাঁচশো।

৫। কুই বা কুবি

ওড়িশার গাঞ্জাম, কালাহান্ডি, বৌধ-কোঁধমল ও কোরাপুট জেলায় এবং অন্ধ্রপ্রদেশের বিশাখাপত্তনম জেলায় বসবাসকারী কোন্ধ জনজাতির মানুষদের ভাষা কুই বা কুবি। বাচকসংখ্যা পাঁচ লাখ।

কোলামি-পারজি গোষ্ঠীর ভাষা

৬।কোলামি

উপস্থিতি মহারাষ্ট্রের যবতমল ও বরধা জেলা এবং অন্ধ্রপ্রদেশের আদিলাবাদ জেলার পাহাড়ি জনজাতিদের মধ্যে। বাচকসংখ্যা সত্তর হাজার।

৭। নইকি

মহারাষ্ট্রের কান্ত জেলার পার্বত্য অঞ্চলের ইয়েরকু জনজাতির ভাষা হল নইকি। বাচকসংখ্যা দেড় হাজার।

৮। পার্‌জি

উপস্থিতি মধ্যপ্রদেশের বস্তার জেলায় এবং জগদ্দলপুরের কাছে। বাচকসংখ্যা পঞ্চাশ হাজার।

ট। উত্তর দ্রাবিড় ভাষা

১। মল্টো

উপস্থিতি বিহারের রাজমহল পাহাড়ে। বাচকসংখ্যা এক লাখ।

২। কুরুখ

এটি ওরাওঁ জনজাতির মাতৃভাষা। ছোটনাগপুর, ওড়িশা, পশ্চিমবঙ্গ, মধ্যপ্রদেশে এঁরা বড় সংখ্যায় আছেন। এছাড়াও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন অসম, ডুয়ার্স ও নেপালের তরাইয়ের বহু জায়গায়। বাচকসংখ্যা প্রায় পনেরো লাখ। কিন্তু এঁদের তরুণ প্রজন্মের ভাষা সরণ ঘটে যাচ্ছে হিন্দি, সাদরি, নেপালি, ওড়িয়া বা বাংলা ভাষায়। তাই বিলুপ্তির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

ঠ। পশ্চিম হিমালয়ের ভাষা

পশ্চিম, উত্তর-পশ্চিমে জম্মু ও কাশ্মীর এবং পূর্ব, দক্ষিণ-পূর্বে নেপাল— এর মধ্যবর্তী হিমালয় অঞ্চলে বহু জনজাতির ভাষা বিলুপ্ত হয়ে গেছে, অবশিষ্টগুলি বিপন্ন, যেমন:

১। রাঙকাস

বাচকসংখ্যা শূন্য। বিশ শতকের গোড়াতেও কিছু বাচক ছিল, এখন আর নেই। ভাষাটি মরে গেছে।

২। ঝাঙঝুঙ

এই ভাষাটি রাঙকাস-এরও আগে বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

৩। মনচাদ

উপস্থিতি চন্দ্র নদী তীরে ও চেনাব নদীর উপর অববাহিকায়। এই ভাষার আর এক নাম পাটানি বা পাট্টানি কারণ পাটান উপত্যকার টান্ডি থেকে থিরোট পর্যন্ত এই ভাষার উপস্থিতি পাওয়া যায়। বাচকসংখ্যা পনের হাজার।

৪। তিনান

চেনাব নদী অববাহিকায় মনচাদ অঞ্চলের থেকে ভাটির দিকে, বিশেষত ‘গোন্ধলা’ বলে পরিচিত অঞ্চলে এই ভাষার উপস্থিতি। বাচকসংখ্যা এক হাজার আটশ।

৫। বুনান

উপস্থিতি ভাগা নদীর দুপারে গহর উপত্যকায়। বাচকসংখ্যা তিন হাজার পাঁচশ।

৬। কানাসি

হিমাচল প্রদেশের কুলু-র কাছে ‘মালেনা’ বলে একটিমাত্র গ্রামেই এই ভাষার কয়েকশ মাত্র বাচক অবশিষ্ট আছে।

৭। কিন্নরী

উপস্থিতি হিমাচল প্রদেশের কিন্নর জেলায়। বাচকসংখ্যা উনষাট হাজারের মতো।

৮। রঙপো

গাডে়ায়ালের চামোলি জেলার জোশিমঠ উপভাগের নিতি ও মানা উপত্যকায়, বদ্রীনাথের উত্তরে অলকানন্দা নদীর উপর অববাহিকায়, ধৌলিগঙ্গা নদীর সঙ্গে অলকানন্দার সংগমস্থলের ওপর দিকে এই ভাষার উপস্থিতি। বাচকসংখ্যা বারো হাজার।

৯। দরমা

উপস্থিতি কুমায়ুনের আলমোড়া ও পিথোরাগড় জেলায়, ধোলি নদীর অববাহিকায় দরমা উপত্যকায়। বাচকসংখ্যা একহাজার সাতশ।

১০। বিয়াঙসি

উপস্থিতি দরমা উপত্যকার পূর্বদিকে মহাকালী নদীর অববাহিকায়। বাচকসংখ্যা এক হাজার তিনশ।

১১। পশ্চিম পাহাড়ি ভাষাদল

এর মধ্যে আছে বাফগনি, জৌনসারি, সিরমুদি, বাঘাতি, মহাসুই, হাণ্ডুরি, কুলুই ইত্যাদি ভাষা, যাদের উপস্থিতি জম্মু-কাশ্মীর থেকে হিমাচল প্রদেশ হয়ে দেহরাদুন অবধি অঞ্চলে। বাচকসংখ্যা কয়েক হাজার।

১২। মধ্য পাহাড়ি ভাষাদল

এর মধ্যে আছে গাড়োয়ালি ও কুমায়নী বিভিন্ন ভাষা। বাচকসংখ্যা কয়েক হাজার।

ড। দারুবাণী

দারুবাণী (বা থারুবাণী) কোনও একটা ভাষার নাম নয়, তা অনেকগুলো ভাষার যৌথনাম। এই ভাষাগুলো হল মৈথিলী, ভোজপুরি ও আওয়াধি ভাষার বিভিন্ন আঞ্চলিক রূপ যা দারু (বা থারু) জনজাতির মানুষদের ভাষা ছিল। এই ভাষাগুলোর মূল রূপ ইন্দো-আর্য গোষ্ঠীর আধুনিক ভাষাদের পূর্ববর্তী পর্যায়ের। দারু (বা থারু) জনজাতির মানুষরা যেহেতু হিন্দি আধিপত্যের প্রকোপে ক্রমবর্ধমান হারে নিজেদের স্বকীয়তা ও স্বাতন্ত্র্য হারিয়ে ফেলছে, তাই দারুবাণী ভাষাগুলো সংকটগ্রস্থ।

ঢ। আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের ভাষা

আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের আদিবাসী নেগরিটো জনজাতির মানুষদের সব ভাষাই হয় ইতিমধ্যে বিলুপ্ত আর নয়তো বিপন্ন। ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসন আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের বারোটিরও বেশি বিভিন্ন ভাষাভাষী আদি জনজাতিদের মধ্যে তিনটি ছাড়া বাকি সব ভাষাগোষ্ঠীদের নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল— ফলে তাদের ভাষাগুলোও বিলুপ্ত হয়েছিল। টিঁকে ছিল মাত্র তিনটি ভাষা— লিট্ল আন্দামানে কথিত ওঙ্গে ভাষা, উত্তর সেনতিনেল দ্বীপে কথিত সেনতিনেলিজ ভাষা ও দক্ষিণ আন্দামানের প্রত্যন্ত অঞ্চলে কথিত জারোয়া ভাষা। এই তিনটি ভাষাই এখন বিপন্ন। ১৯৮১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, ওঙ্গে ভাষার সাতানব্বই জন বাচক, জারোয়া ভাষার একত্রিশ জন বাচক এবং সেনতিনেলিজ ভাষার আরও কম সংখ্যক বাচক অবশিষ্ট ছিল। আজ বোধহয় তা আরও কমে গেছে, নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান আর পাওয়া যায় না।

ণ। নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের ভাষা

নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের বিভিন্ন দ্বীপের আদিবাসীদের যে বিভিন্ন ভাষার কথা জানা যায়, তা হল :

কার নিকোবর দ্বীপ— পু ভাষা

চোওরা দ্বীপ— তাতেত ভাষা

টেরেজা দ্বীপ— তাইহলঙ ভাষা

বোমপোকা দ্বীপ— পোওয়াহাট ভাষা

নানকৌড়ি দ্বীপ ও কামোরটা দ্বীপ— নানকৌড়ি ভাষা

ক্যাচ্অল দ্বীপ— তিহ্নু ভাষা

গ্রেট নিকোবর দ্বীপের উপকূল— লোয়ঙ ভাষা

লিট্ল নিকোবর দ্বীপ— ওঙ ভাষা

কোণ্ডুল দ্বীপ— লামোঙসে ভাষা

মিলোহ্ দ্বীপ— মিলো ভাষা

গ্রেট নিকোবর দ্বীপ— সোমপেন জনজাতির সোমপেন ভাষা

ত্রিনকুট দ্বীপ— লেফুল ভাষা

এই ভাষাগুলো সবকটাই বিপন্ন। ভাষাগুলো সম্পর্কে বা তাদের বাচকসংখ্যা সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায় না। ১৯৮১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী সোমপেন ভাষার মাত্র দুশ তেইশ জন বাচক অবশিষ্ট ছিল। নিকোবর দ্বীপকুঞ্জে এখন কুড়ি হাজারের উপর মানুষ বাস করলেও এই ভাষাগুলোর বাচকসংখ্যা সোমপেন ভাষার মতোই অত্যন্ত কম এবং ক্রমহ্রাসমান।

উপসংহার

সংখ্যালঘু/ক্ষমতালঘু ভাষাসমূহের অন্তর্জলী যাত্রার মধ্য দিয়ে ঘনিয়ে ওঠা ভারতের ভাষাপরিবারের মড়ক-পরিস্থিতি ও তার প্রধান কারণগুলো সম্পর্কে সচেতন হওয়া এই পরিস্থিতিকে প্রতিরোধ করতে সচেষ্ট হওয়ার প্রথম ধাপ হতে পারে। সেই উদ্দেশ্য হয়ত এই লেখার মধ্য দিয়ে কিছুটা সাধিত হতে পারে। এর পরের ধাপে কাজ অনেক— বিপন্ন ভাষাগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষ্যে কিছু কিছু বিপন্ন ভাষার বাচকদের পক্ষ থেকে ও কিছু ভাষাবিদদের পক্ষ থেকে যে সব উদ্যোগ নেওয়া শুরু হয়েছে, সেগুলোর সঙ্গে পরিচিত হওয়া ও তা আরও ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা; ভাষিক আধিপত্যবাদী সোপানতন্ত্র নির্মাণের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ভাষিক গণতন্ত্রের জন্য সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করা; ইত্যাদি। আমাদের ভাষিক উত্তরাধিকারের সমৃদ্ধি ও বৈচিত্র্যকে রক্ষা করা এবং সমাজের মধ্যে ক্রমশ শক্তি সংগ্রহ করতে থাকা সমরূপতা-আরোপের প্রবণতাকে প্রতিহত করার জন্য এই কাজগুলো জরুরী।

 

টীকা/সূত্র

১। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক ‘রিফ্রেশার কোর্স’-এ বক্তব্য রাখতে আসা ভারতীয় সরকারের জনগণনা ও ভাষাসমীক্ষার সঙ্গে যুক্ত আধিকারিক/প্রশাসকদের সঙ্গে আলাপচারিতায় তঁাদের এমন মৌখিক বক্তব্য পাওয়া গেছে।

২। এই পঞ্জী তৈরি করতে ব্যক্তিগত সমীক্ষালব্ধ তথ্য ছাড়াও নিম্নোক্ত উৎসগুলোর সাহায্য নেওয়া হয়েছে:

  • জর্জ ভ্যান দ্রিয়েম-এর ‘এনডেনজারড ল্যাংগুয়েজেস অফ সাউথ এশিয়া’ প্রবন্ধ যা মাথিয়াস ব্রেনজিংগার সম্পাদিত ‘ল্যাংগুয়েজ ডাইভারসিটি এনডেনজারড' (২০০৭) গ্রন্থে সংকলিত।
  • বলবন্ত সিং রচিত সেনসাস অফ ইন্ডিয়া ১৯৮১, সিরিজ ২৪: আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ।
  • জর্জ ভ্যান দ্রিয়েম-এর ‘ল্যাংগুয়েজেস অফ দি হিমালয়াজ: অ্যান এথনোগ্রাফিক হ্যান্ডবুক অফ দি গ্রেটার হিমালয়ান রিজিয়ন' (২০০১) গ্রন্থ।

 

(আগস্ট, ২০২২)

0 Comments
Leave a reply