১
রাষ্ট্র মানে শ্রেণিশাসনের হাতিয়ার, এক শ্রেণির দ্বারা অন্য শ্রেণিকে শাসন-শোষণ-নিয়ন্ত্রণ করার হাতিয়ার। শ্রেণিরাজনীতি করতে আসা রাজনৈতিক কর্মীরা সাধারণভাবে এটা জানেন। আরো জানেন যে তিনটি স্তম্ভের উপর রাষ্ট্র দাঁড়িয়ে থাকে, সেই তিনটি স্তম্ভ হলো আমলা, মামলা ও হামলা (আমলাতন্ত্র, বিচারব্যবস্থা ও পুলিশ-মিলিটারি)। অর্থাৎ, রাষ্ট্র নামক হাতিয়ারটি এই তিনটি ফলার সাহায্যে কাজ করে।
এখন, হাতিয়ারের একটি আবশ্যিক চরিত্র হলো যে যার হাতে সে আছে তার ইচ্ছা-অভিপ্রায় অনুযায়ী তা কাজ করে। হাতিয়ার নিজে থেকে কোনো ইচ্ছা বা অভিপ্রায় জাহির করতে পারে না। যেমন, ছুরি কসাইয়ের হাতে পড়লে মনুষ্যখাদ্য মাংস কাটবে আর খুনীর হাতে পড়লে মানুষের গলা কাটবে, ছুরি নিজে থেকে কোনো কাজের দিকে ঝুঁকে থাকে না। রাষ্ট্র এক ধরনের হাতিয়ার ধরে নিয়ে হাতিয়ারের এই আবশ্যিক চরিত্রও আমরা রাষ্ট্রের উপর আরোপ করে বসি। অর্থাৎ, ধরে নিই যে রাষ্ট্র কার হাতে আছে সে অনুযায়ী তা কাজ করবে। যেমন, রাষ্ট্র যদি বুর্জোয়াশ্রেণির হাতে থাকে তাহলে তা পুঁজিবাদী শোষণ-নিপীড়ন ও শ্রেণিবৈষম্য কায়েম করবে ও বহাল রাখবে, আর রাষ্ট্র যদি শ্রমিকশ্রেণির হাতে থাকে তাহলে তা পুঁজির অবসান ঘটিয়ে শ্রেণিহীন সমাজের দিকে গতি সঞ্চার করবে--- কারণ, রাষ্ট্রের কোনো নিজস্ব ইচ্ছা-অভিপ্রায় বা ঝোঁক নেই, বুর্জোয়াশ্রেণি বা শ্রমিকশ্রেণির শ্রেণিস্বার্থই তার কাজের চরিত্র ও দিশা ঠিক করে দেবে।
এই ধারণার ভিত্তিতেই রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে (সশস্ত্র সংঘাতের মধ্য দিয়ে বা নির্বাচনপ্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে, যেভাবেই হোক না কেন) বিপ্লবী রাষ্ট্র গড়ে তুলে তার জোরে সমাজ-পরিবর্তন ঘটানোই বিপ্লবী কর্মসূচির বিবিধ ধারায় সাধারণ কৌশল হিসেবে মান্যতা পেয়ে এসেছে।
২
লেনিন ১৯২৪ সালে তাঁর মৃত্যুর কিছুদিন আগে ১৯২৩ সালের মার্চে লেখা শেষ নথি (দ্বাদশ কংগ্রেসের উদ্দেশ্যে চিঠি) ‘Better Fewer, But Better’-এ যন্ত্রণাময় খেদোক্তি করেছিলেন যে রুশ বিপ্লবের পর পূর্বতন জার-রাষ্ট্রকে চূর্ণ করে নতুন বিপ্লবী রাষ্ট্র গড়ে তোলার কাজে তাঁরা সমর্থ হয়ে ওঠেননি, বরং নানা বিপ্লবী বাহ্যাড়ম্বর সত্ত্বেও মূলগতভাবে সেই একই রাষ্ট্রব্যবস্থাকে বয়ে নিয়ে চলেছেন। লেনিনের নিজের ভাষায়:
আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্রটি এতটাই শোচনীয়--- যারপরনাই বাজে যদি বা না-ও বলা হয়--- যে সবার আগে আমাদের খুব গুরুত্ব দিয়ে ভাবা উচিত কীভাবে আমরা তার গলদগুলোকে মোকাবিলা করতে পারি। মনে রাখতে হবে যে এই গলদগুলোর শিকড় সেই অতীতের মধ্যেই আছে যে অতীতকে উৎখাত করা হলেও এখনও জয় করা যায়নি, এখনও যা দূর অতীতে গুটিয়ে যাওয়া এক সংস্কৃতির পর্যায়ে পৌঁছয়নি। ‘সংস্কৃতি’ কথাটা আমি ভেবেচিন্তেই বললাম, কারণ এই ক্ষেত্রে আমরা সেটুকুই অর্জিত হয়েছে বলে ধরতে পারি যেটুকু আমাদের সংস্কৃতি, সমাজজীবন ও অভ্যাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। এমনটা বলা যেতে পারে যে আমাদের সমাজব্যবস্থার অন্তর্গত ভালোটাকে যথাযথভাবে অধ্যয়ন করা হয়নি, বোঝা হয়নি, হৃদয়ঙ্গম করা হয়নি; তাড়াহুড়ো করে তা খামচে ধরতে চাওয়া হয়েছে; অভিজ্ঞতার কষ্টিপাথরে যাচাই করে নিয়ে টেকসই করে তোলা হয়নি, ইত্যাদি। অবশ্য, যে কোনো বিপ্লবী যুগে, যেমন এই পাঁচবছর সময়কাল যখন আমরা দুর্বার গতিতে জারতন্ত্র থেকে সোভিয়েত ব্যবস্থায় উপনীত হয়েছি, এর অন্যথা হতে পারে না।
এখন সময় হয়েছে এই নিয়ে কিছু করার। অতিরিক্ত দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাওয়া, আস্ফালনকারী ভাবভঙ্গি--- এগুলোকে এখন আমাদের গভীর সন্দেহের চোখে দেখতে হবে। যে সব এগিয়ে যাওয়ার পদক্ষেপকে আমরা অহরহ ঘোষণা করে চলেছি সেগুলোকে যাচাই করে নেওয়ার কাজে এখন আমাদের মনোযোগ দিতে হবে; প্রতিটি মুহূর্ত ব্যয় করতে হবে যাতে পলকা, অগভীর ভাবনা ও ভুল বোঝাবুঝি দ্বারা তাড়িত না হই। হুড়োতাড়া করাই এখন আমাদের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করতে পারে। সবচেয়ে ক্ষতিকর হবে যদি আমরা এমনটা ধরে নিয়ে নিশ্চিত থাকি যে সমাজতান্ত্রিক, সোভিয়েত, ইত্যাদি নামের যোগ্য রাষ্ট্রযন্ত্র, একটি প্রকৃতই নতুন রাষ্ট্রযন্ত্র কীভাবে গড়ে তুলতে হয় তা আমরা অন্তত বেশকিছু মাত্রায় জেনে গেছি এবং তা গড়ার জন্য প্রয়োজনীয় উপাদানগুলোও বেশ খানিকটা আমাদের হাতে আছে।
না, তেমন কোনো অবস্থা আমাদের নয়, তেমন রাষ্ট্রযন্ত্র গড়ে তোলার ক্ষেত্রে হাস্যকর রকমের ঘাটতি আমাদের আছে, এমনকি তা গড়ে তোলার উপাদানেরও বিপুল ঘাটতি আছে। আমাদের মনে রাখা উচিত যে এমন রাষ্ট্রযন্ত্র গড়ে তোলার কাজ হাসিল করে ফেলার সময়সীমা নিয়ে কোনো বাগাড়ম্বর করা উচিত হবে না, বহু বহু বছর ব্যয়িত হয়ে যাবে এই কাজে।১
কয়েকটি ব্যাপার এখানে বেশ খুঁটিয়ে দেখার মতো। যেমন, রাষ্ট্র নামক হাতিয়ারটি নিজ হাতে তুলে নিয়ে কম্যুনিস্ট বিপ্লবীরা নিজেদের খাঁটি বিপ্লবী অভিপ্রায়ে তা ব্যবহার করার মধ্য দিয়েই বিপ্লবী রাষ্ট্র গড়ে ফেলতে পারে, এমন ধারণা এখানে নেই। নতুন বিপ্লবী রাষ্ট্রের সংহত হয়ে ওঠাকে লেনিন একটি সাংস্কৃতিক স্তর অর্জন করার উপর নির্ভরশীল করে দেখেছেন। বিপ্লবী কর্তব্য কেবল অগ্রণী নেতাদের দ্বারা ঘোষিত ও নীতি রূপে গৃহীত হলেই চলবে না, তা সাধারণ মানুষের অভ্যাস ও অভিজ্ঞতার অন্তর্গত হয়ে প্রাত্যহিক জীবনের অংশ হয়ে উঠতে হবে, তবেই তার ভিত্তিতে পুরাতন রাষ্ট্রের পরিবর্তে নতুন সমাজ-পরিচালন ব্যবস্থা রূপ গ্রহণ করতে পারে। এ কাজ বিপ্লবীদের পবিত্র তাগিদ দিয়ে ত্বরাণ্বিত করা যায় না, এই পুরো প্রক্রিয়া বিপ্লবীরা আগে থেকে পুরোপুরি অনুমান ও পরিকল্পনাও করে ফেলতে পারে না। তাড়াহুড়ো না করে, নিজেদের বিপ্লবী অধ্যাদেশ দিয়ে এক লাফে পাহাড় টপকানোর চেষ্টা না করে, সমাজের মধ্যে কী উপাদান ও সম্ভাবনা এর জন্য আছে বা জন্ম নিচ্ছে তা ধৈর্য সহকারে নজর করে লালনপালন করাই কর্তব্য। লেনিনের শেষ নথিটির উদ্ধৃত অংশটিকে আমরা এভাবে বুঝে নিতে পারি।
ওই নথিটিতেই নতুন বিপ্লবী রাষ্ট্রযন্ত্র গড়ার মূল উপাদান হিসেবে সমাজতন্ত্র গড়ে তোলার কাজে আত্মনিয়োগ করা শ্রমিকদের চিহ্নিত করার পাশাপাশি, লেনিন মূল সমস্যা হিসেবে তাদের অপরিপক্কতা ও সাংস্কৃতিক পশ্চাদপদতাকে হাজির করেছিলেন। সমাজজোড়া উৎপাদন-বন্টনের কাজে প্রাথমিক পরিকল্পনা সাজানো, কার্যকরী নজরদারি চালানো এবং হিসাবরক্ষায় শ্রমিকদের অপটুতা-অপারগতার ফলেই আমলাতন্ত্র গেঁড়ে বসে থাকছে, পার্টি-আমলাতন্ত্রও চাগাড় দিচ্ছে বলে লেনিন ভেবেছিলেন। সমাধান হিসেবে অবশ্য প্রায় অনন্যোপায় হয়ে পার্টি-নেতৃত্বকেই আরো বেশি দায়িত্ব ও ভূমিকা নেওয়ার কথা তিনি বলেছিলেন। অচিরেই পার্টিই একমাত্র বিপ্লবী বিষয়ী হয়ে উঠে সমাজের শ্রমিক-কৃষক-সহ অন্য সমস্ত বিপ্লবী শক্তিকে টুঁটি টিপে মেরেছিলো, তা লেনিনের এই শেষ-প্রস্তাবিত সমাধান-পথকে ঠিক বলে প্রমাণ করে না।
ফলে রুশ বিপ্লব একদিকে যেমন রাষ্ট্রকে যেভাবে খুশি চালানো যায় এমন এক হাতিয়ার হিসেবে দেখার অসারতা দেখিয়েছে, তেমনই, পুরোনো রাষ্ট্র ভেঙে নতুন সমাজ-পরিচালনার পথ কীভাবে তৈরি হতে পারে সেই প্রশ্নটি সেখানে শেষ অবধি অসমাধিত রয়ে গেছে।
৩
লেনিন ও বলশেভিকরা যেভাবে মার্কসবাদ পাঠ করেছিলেন, তা থেকে তাঁদের ধারণা ছিলো যে পুঁজিবাদ থেকে পুঁজিবাদোত্তর সমাজে উৎক্রমণের ভিত্তি হলো পুঁজিবাদের পর্যায়ে উৎপাদনীশক্তির বিকাশ যে চূড়ান্ত বিন্দুতে পৌঁছেছে, তা ছুঁয়ে এবং তারপর তা পেরিয়ে উৎপাদনী শক্তির বিকাশ আরো অপার করে দেওয়া। ফলে, বিপ্লবোত্তর সমাজে সমাজতন্ত্র গড়ায় অংশ নেওয়া শ্রমিকদের যে সাংস্কৃতিক স্তর অর্জন করা আবশ্যক বলে তাঁরা বোধ করেছিলেন, তা সমাজজুড়ে জড়-উৎপাদন বৃদ্ধি ও উৎপাদনী শক্তির অবিরত বিকাশ স্বতপ্রবৃত্তভাবে সংগঠিত ও পরিচালনা করার সংস্কৃতি। তাই তাঁরা ভেবেছিলেন যে সংগঠিত শিল্পের তুলনামূলক অবিকাশের কারণে রুশ শ্রমিকরা এই সংস্কৃতি অর্জনে পিছিয়ে থাকলেও জার্মানি বা পশ্চিম ইউরোপের কোনো শিল্পোন্নত দেশে বিপ্লব হলে সেখানকার শ্রমিকশ্রেণি এই সাংস্কৃতিক স্তরের মূর্ত নিদর্শন হাজির করে বিপ্লবোত্তর রাষ্ট্র সংগঠনের পথ স্পষ্ট করে দেবে।
একথা ঠিক যে লেনিনবাদীরা পশ্চিম ইউরোপে যে ধরনের বিপ্লবের কল্পনা বা আশা করেছিলেন তা বাস্তবায়িত হয়নি। কিন্তু একথাও সত্য যে পশ্চিম ইউরোপের একাধিক শিল্পোন্নত দেশে, বিশেষ করে স্ক্যান্ডিনেভিয় দেশগুলোতে, সমাজ-গণতান্ত্রিক (social democrat) পার্টিগুলো বেশ লম্বা সময় ধরেই ক্ষমতায় থেকেছে। সেখানকার শিল্প-শ্রমিকরাও বেশ বড় সময় ধরেই এই পার্টিগুলোর মধ্যে বা সঙ্গে থেকেছে। কেন্দ্রীভূত উৎপাদন-পরিকল্পনা ব্যবস্থায় দক্ষ শিল্প-শ্রমিকদের অংশগ্রহণ, উৎপাদন পরিচালনায় দক্ষ শ্রমিকদের ভূমিকা বাড়া, বন্টনব্যবস্থায় নানা জনকল্যাণকামী বন্দোবস্ত এবং তা নিয়ন্ত্রণ-পরিচালনায় দক্ষ শ্রমিকদের নানারূপ সংগঠনের ভূমিকা নেওয়া-- এসবই দেখতে পাওয়া যাবে, কিন্তু তা দিয়ে পুঁজির সংবহন-পুনরুৎপাদন-সঞ্চয় বাধার মুখে পড়েনি। এই সাংস্কৃতিক স্তর শ্রমিকদের মধ্যেও ‘সংশ্লিষ্ট উৎপাদক’ (‘associated producers’, মার্কস সমাজতন্ত্রে উৎপাদকদের যেভাবে কল্পনা করেছিলেন)-মুখী কোনো বোধোদয় ঘটায়নি, বরং নানা ক্ষয়চিহ্ন প্রকট করে তুলেছে, যেমন: শ্রমিকশ্রেণির আন্তর্জাতিকতাবোধের বদলে জাত্যাভিমানী অপরবিদ্বেষী (বিশেষ করে অভিবাসী-শ্রমিক-বিদ্বেষী) বোধ শক্তিবৃদ্ধি করেছে, উৎপাদনীশক্তি বিকাশের পথে কাজের খণ্ডিতকরণ ও যান্ত্রিকীকরণ শ্রমিকদের বিচ্ছিন্নতা (alienation) বহুগুণ বাড়িয়ে বিচ্ছিন্ন একাকী এক উপভোক্তার সংকীর্ণতায় আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলছে, সমাজতন্ত্রকামী বিপ্লবী রাজনীতির বদলে বিদ্বেষী অতি-ডানপন্থী রাজনীতির মক্কেল করে তুলছে। আরও একটি দিক ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে, তা হলো: উৎপাদন-বন্টন প্রযুক্তি-প্রকৌশলের অভাবনীয় (প্রায় জাদুকরী) বিকাশ উৎপাদকদের ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্নকৃত শ্রম (alienated labour) ও অস্তিত্বযাপনের (being) সময় ও পরিধি কমাচ্ছে না, বরং গুণগত ও মাত্রাগত উভয়ভাবেই ক্রমশ বাড়িয়ে চলেছে, যা সামাজিক বিষয়ী হিসেবে তাদের সক্রিয়তার ধারাটিকেও শুকিয়ে আনছে। প্রযুক্তি-প্রকৌশলে দড় দক্ষ শ্রমিক এবং দৈহিক শ্রমশক্তি-নির্ভর অদক্ষ শ্রমিকদের মধ্যে ক্রমশ চওড়া হতে থাকা সামাজিক-অর্থনৈতিক বৈষম্য-পরিসর এতটাই স্বাভাবিকতা অর্জন করে ফেলেছে যে তা ঐক্যবদ্ধ শ্রেণিস্বার্থ কল্পনা করাকেও দুঃসাধ্য করে তুলেছে।
ফলে লেনিন যে সাংস্কৃতিক স্তরের কথা বলেছেন, তা যে শিল্পোন্নয়নের অগ্রগতি স্বাভাবিকভাবেই শ্রমিকদের মধ্যে সঞ্চারিত করে দিতে থাকবে না, উৎপাদন পরিকল্পনা ও পরিচালনায় অংশগ্রহণ ও দক্ষতাবৃদ্ধিও যে তার মাপকাঠি নয়, তা অস্বীকার করার কোনো উপায় আজ আর নেই। ‘পুঁজিবাদ নিজেই তার কবরখনকদের তৈরি করে দেয়’—এ আপ্তবাক্য বেশ স্বস্তিদায়ক হলেও, তা মিছে আশার ছলনা কিনা সেই সংশয় আর এককথায় নাকচ করে দেওয়া সম্ভব নয়।
৪
পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় শ্রমিকদের কী দুর্দশা হয়, মার্কস কেবল সেকথা লেখেননি, বারংবার একই বন্ধনীতে তিনি পুঁজিবাদ দ্বারা প্রকৃতির ধ্বংসেরও উল্লেখ করেছেন। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় ত্বরাণ্বিত হওয়া বিপাকীয় ফাটল (metabolic rift)-এর কথা মার্কস বলেছেন, যার মধ্য দিয়ে প্রজাতিগতভাবে মানুষ প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিজ উদ্বর্তন পরিকল্পনা করতে থাকে, প্রকৃতির স্বাভাবিক প্রক্রিয়াগুলোকে ব্যাহত করতে থাকে, বাস্তুতান্ত্রিক বিপর্যয় ডেকে আনে আর বিপর্যয় সামলানোর ক্ষমতাগর্বী আধিপত্যবাদী চেষ্টায় বিপর্যয়কে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে সরিয়ে আরো গভীর আরো ব্যাপক চেহারা দিতে থাকে।২ গোটা বিশ শতকেই মার্কসবাদীরা মার্কসের এই পর্যবেক্ষণ ও ভাবনাকে তেমন গুরুত্ব দেয়নি। সেইসব মার্কসবাদীদের মতো বাছাই-করে-চোখ-ফিরিয়ে-রাখা (selective amnesia)-র বিলাসিতা দেখানোর অবস্থায় আমরা আজ নেই যখন দুনিয়া জুড়ে উষ্ণায়ন, বরফগলন, প্রাণ-প্রজাতি-ধ্বংস, আবহাওয়া-পরিবর্তন, অরণ্যধ্বংস, সামুদ্রিক জলস্তর বৃদ্ধি, ইত্যাদি নানা অশনি সংকেত নিরন্তর প্রশ্ন তুলে দিচ্ছে যে আমাদের এই গ্রহটি আদৌ আর কতোদিন প্রাণ ধারণ করার যোগ্য থাকবে।
এই বাস্তুতান্ত্রিক সচেতনতার দিক থেকে দেখলে আমাদের পূর্বালোচিত প্রশ্নগুলো আরো নতুন মাত্রা পায়। উৎপাদনী শক্তির অবারিত বিকাশ তো দূরের কথা, বর্তমান শিল্পোন্নত দেশগুলোর গড় উৎপাদনী শক্তি নিয়োগ করে পৃথিবীর সমস্ত মানুষদের সেসব দেশের গড় উপভোক্তা-হারে ভোগ নিশ্চিত করতে গেলে, শক্তি (energy) ও কাঁচামালের সংস্থান একটা গোটা পৃথিবীকে নিঃশেষ করেও হবে না, পাঁচ-ছটি পৃথিবী লাগবে। আর তা অচিরেই এই পাঁচ-ছটি পৃথিবীকে নিঙড়ে প্রাণধারণের অযোগ্য করে তুলবে।৩ ফলে উৎপাদনী শক্তির অবারিত বিকাশ, উপভোক্তাদের ভোগচাহিদার অবারিত বিকাশ, এহেন আখ্যানের উপর সমাজতন্ত্রের ভিত্তি কল্পনা করলে তা পুঁজিবাদী বিপাকীয় ফাটলকেই আরো অমোঘ ও প্রাণঘাতী করে তুলবে। সমাজতন্ত্রের ভিত্তিমূলক আখ্যান নিয়ে তাই নতুনভাবে ভাবা দরকার। ভাবা দরকার যে উৎপাদন ও ভোগ-চাহিদা অবারিতভাবে বাড়িয়ে যাওয়া নয়, আমাদের অতি দ্রুত আশু অর্থেই উৎপাদনের একটা বড় অংশকে কাটছাঁট করে কমিয়ে ফেলতে হবে। যুদ্ধাস্ত্র উৎপাদন, আণবিক উৎপাদন, ক্ষমতাচিহ্নরূপী নানা অতি-ভোগের উপকরণ উৎপাদন তো বন্ধ করতে হবেই, পাশাপাশি সমাজের তলায় পড়ে থাকা মানুষদের না-মেটা জীবনের চাহিদাগুলোর উৎপাদন বাড়াতে হবে। কিন্তু কী এবং কতোটা আমাদের জীবনের চাহিদা, তার হিসেবনিকেশও তো সমাজের উপর থেকে নীচ অবধি এই পুঁজিবাদী সংস্কৃতির অভ্যাস অনুযায়ী করতে শিখেছি। তাই পরিবর্তন আনতে হবে সেখানেও। প্রকৃতির ক্ষতের আবার উপশম হওয়া এবং প্রকৃতির স্বাভাবিক পুনরুৎপাদনচক্রে ব্যাঘাত ঘটায় না এভাবে আমাদের নিজেদের জীবনের প্রয়োজনগুলোকেও নির্ধারণ করার নতুন অভ্যাস তৈরি করতে হবে। সংক্ষেপে বললে, মার্কস-বর্ণীত বিপাকীয় ফাটল বুজিয়ে প্রকৃতির পাকক্রিয়ার অন্তর্গতভাবে নিজেদের অস্তিত্ব নির্মাণ করতে হবে।
পুঁজিবাদোত্তর সমাজ-পরিচালনার কাম্য দিশায় তাই আজ এই বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে গেছে। উৎপাদনী শক্তির বিকাশ উৎপাদকদের সংশ্লিষ্ট প্রয়াস (associated effort)-এর মধ্য দিয়ে করা আজ দিশা নয়, আজ দিশা হলো বিপাকীয় ফাটল বুজিয়ে প্রকৃতির পাকক্রিয়ার অন্তর্গত অস্তিত্ব যৌথপ্রয়াসে নির্মাণ করা। বিপ্লব-পরবর্তী রাষ্ট্রের প্রশ্ন ও তার জন্য প্রয়োজনীয় সাংস্কৃতিক স্তরের প্রশ্নটিও তাই এই পরিবর্তিত দিশার সঙ্গে যুক্ত করেই ভাবতে হবে।
৫
আরেকটা দিকও অবশ্য ভাবার জন্য পড়ে থাকে: যে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, যে রাষ্ট্রের অবলুপ্তির জন্য বিপ্লব, কোন্ নাছোড়বান্দা চরিত্রের জন্য সেই রাষ্ট্রের হিংসা-দমন-আধিপত্য-সূচক প্রকৌশলগুলো বারবার ভোল পাল্টে নতুন সমাজ গড়ার প্রচেষ্টাগুলোয় সেঁধিয়ে যায় ও পচিয়ে মারে, ভাবা দরকার তা নিয়েও। পুঁজিবাদোত্তর নতুন সমাজ-ব্যবস্থাপনার উপাদান সংহতকরণ এ ভাবনার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে বলে মনে হয়।
অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থা হিসেবে পুঁজিবাদ যখন পশ্চিম ইউরোপের আঁতুড়ঘরে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ও দ্রুতপ্রসারী ব্যবস্থা হিসেবে জন্মগ্রহণ করছে, তখন একই গর্ভজলে যমজ হিসেবে জাতিরাষ্ট্র (nation state) নামক যে রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও প্রকৌশল জন্ম নিয়ে ক্রমশ নব থেকে নবতর উপাদানে পুষ্ট হয়ে চরাচর-ছাওয়া রূপ গ্রহণ করেছে, আমরা এখন তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছি। সরলীকৃত কোনো সংজ্ঞায় এই রাষ্ট্রকে বুঝে ফেলতে চাওয়া বেকুবের কাজ হবে: বীরের ভঙ্গিতে কোনো এক সংজ্ঞার কৌটোয় বন্দি তার প্রাণভোমরাকে তরোয়ালের এক কোপে কেটে মুঠো ছুঁড়ে উচ্ছ্বাস দেখানোর সময়ই দেখা যাবে আরো অগুন্তি প্রাণভোমরা এসে ছেঁকে ধরেছে।
মিশেল ফুকো তাঁর বিস্তৃত ইতিহাসপাঠ-ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা (power)-র বিভিন্ন প্রকারভেদ ও মিথষ্ক্রিয়া খুলেমেলে ধরার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রীয় প্রকৌশলের একটি কুলজি (genealogy) হাজির করেছেন। সেই কুলজিটি সংক্ষেপে এইরকম:৪
রাষ্ট্রের এই সামগ্রিক রূপটিকে ফুকো ‘রাজকতা’ (governmentality) শব্দের মধ্য দিয়ে ধরতে চেয়েছেন। তিনি বলেছেন:৬
‘রাজকতা’ (governmentality) শব্দটির মধ্য দিয়ে আমি তিনটি জিনিষ বোঝাতে চাইছি:
১। জনসমষ্টি যার লক্ষ্যবস্তু, রাজনৈতিক অর্থনীতি যার প্রধান জ্ঞান-রূপ, নিরাপত্তারক্ষার সাজসরঞ্জাম যার আবশ্যিক প্রকৌশলগত উপায়, সেই অতি নির্দিষ্ট অথচ জটিল ক্ষমতারূপের চর্চা হয় যে প্রতিষ্ঠানসমূহ, প্রক্রিয়াদি, ভাবনাচিন্তা, হিসাবনিকাশ ও কৌশলাদির সমাহারের মধ্য দিয়ে।
২। এক দীর্ঘ সময়পর্যায় ধরে পাশ্চাত্য জুড়ে যে প্রবণতা ক্ষমতার অন্য সমস্ত রূপের (সার্বভৌম ক্ষমতা, শৃঙ্খলাদায়ক ক্ষমতা, ইত্যাদি) উপর এই বিশেষ ক্ষমতারূপের (যাকে আমরা ‘শাসনপ্রণালী’ বলে অভিহিত করতে পারি) প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করেছে; আর, যার ফলে যেমন একদিকে নির্দিষ্ট একসারি শাসনপ্রণালীগত সাজসরঞ্জাম/ ব্যবস্থাপত্র গড়ে উঠেছে, অন্যদিকে তেমনই প্রভাববিস্তারকারী জ্ঞানসমূহের এক জটিল সমাহার বিকাশলাভ করেছে।
৩। সেই প্রক্রিয়া, বা বলা ভালো, সেই প্রক্রিয়াজাত ফল যার মধ্য দিয়ে মধ্যযুগের বিচারবিধি ব্যবস্থা রূপান্তরিত হয়ে পনেরো ও ষোলো শতকের প্রশাসনিক রাষ্ট্রের রূপ নিয়েছে এবং তারপর ধীরে ধীরে ‘শাসনপ্রণালীবদ্ধ’ হয়ে উঠেছে।
(১৯৭৭-৭৮ সালে পারি শহরের কলেজ-দু-ফ্রাসঁ-য় পাঠক্রমের অংশ হিসেবে ফুকোর দেওয়া ভাষণের অংশ, বাংলা তর্জমা বর্তমান লেখকের করা।)
৬
পাশ্চাত্যে অপর-বিদ্বেষী জাতিরাষ্ট্রের এই কুলজি (genealogy) দেখায় যে হাতে তুলে নিয়ে যে যেভাবে খুশি নিজের মতো করে নিয়ে ব্যবহার করতে পারে এমন হাতিয়ার রাষ্ট্র নয়, কেবলমাত্র আমলা-মামলা-হামলা নামক তিন পায়ার উপর দাঁড়িয়ে থাকা কোনো আরোপিত কাঠামোও তা নয়। বরং, উৎপাদন, ভোগ, নৈতিকতা, জ্ঞান-বিজ্ঞান, স্বাস্থ্য, আত্মপরিচিতি-র নিয়ামকগুলো প্রবর্তন ও প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে তা নিছক আদালত-পুলিশ-জোরজবরদস্তির উপরিস্তরের চেয়ে অনেক গভীর স্তরে আমাদের চিন্তা-ভাবনা-বাস্তবতাবোধকে প্রভাবিত করে। অপর-বিদ্বেষী জাতীয়তাবাদ যখন মানুষের নিজের সংকীর্ণ আত্মপরিচয় নির্মাণ করার ও সমস্ত অপরকে শত্রু হিসেবে দেখার ভ্রম-বাতুলতাকেই ‘সত্য’ বলে প্রতিষ্ঠা করে, জাতিরাষ্ট্রের ভিত তখন গাঁথা হয়ে যায়। নিরন্তর উৎপাদন-বৃদ্ধি ও ভোগ-জমক-বৃদ্ধিই যখন মানুষের অবস্থা উন্নত করার একমাত্র পথ বলে নির্ধারিত হয়ে থাকে, তখন পুঁজিবাদী রাজনৈতিক অর্থনীতির উপর রাষ্ট্রের ভিত অটুট থাকে। সুস্থতা-স্বাভাবিকতার নাম করে মানুষের দেহ-মনের একটাই প্রমিত রূপ যখন বাঁধা হয়, জীবনের স্বতঃপ্রকাশের বহুবিবিধ ধারাকে অগ্রাহ্য করে একটাই প্রমিত সভ্য আচার-ব্যবহার-কাঠামো যখন বাঁধা হয়, তখন নজরদারি রাষ্ট্রের আবাদ হয়ে যায়। ফলে, এই ধরনের গভীরতর নির্ধারকগুলোকে যদি খেয়াল না করা হয়, সমাজঅস্তিত্বের প্রতিটি স্থানাঙ্কে যদি তাদের বিরোধিতা ও প্রতিরোধ লাগু না করা হয়, তাহলে উপরিস্তরে কেবল এক গোষ্ঠীর থেকে আরেক গোষ্ঠীর বা এক শ্রেণির থেকে আরেক শ্রেণির হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা হস্তান্তরিত করে রাষ্ট্রের চরিত্রের কোনো বদল ঘটানো যাবে না, পুঁজিবাদ পেরিয়ে নতুন ধরনের সমাজ গড়ার দিকেও এগোনো যাবে না। গোটা বিশ শতক জুড়ে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের ভরাডুবি এর সাক্ষী।
৭
পাশ্চাত্য ছাপিয়ে প্রাচ্যেও এখন বিদ্বেষী জাতিরাষ্ট্রের রবরবা প্রাণান্তকর হয়ে উঠেছে। কিন্তু প্রাচ্যে এই জাতিরাষ্ট্রের কুলজি (genealogy) ঠিক একইরকম নয়। পাশ্চাত্যে খ্রিস্টান ধর্মের পরিসরে চার্চের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের মধ্য দিয়ে ক্ষমতার যে কেন্দ্রীভবন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রবর্তনা করে দিয়েছিল, প্রাচ্যের কোনো ধর্মের পরিসরে অনুরূপ নিদর্শন পাওয়া যায় না। পাশ্চাত্য কিছু জাতিরাষ্ট্র যখন হিংস্র লুঠেরা ঔপনিবেশিক শাসন বিস্তার করার মধ্য দিয়ে প্রাচ্যের সমাজগুলোকে কব্জা করলো, পাশ্চাত্য জ্ঞান-অবধারণা-র আধিপত্য প্রাচ্যের মনকেও ছেয়ে দিলো, তার মধ্য দিয়ে এবং তার ফল হিসেবেই জাতিরাষ্ট্রের রাজনৈতিক-সামাজিক কাঠামোও প্রাচ্য সমাজের বুকে উপর থেকে চেপে বসলো। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সমাজ ও জাতীয়তাবাদ বিষয়ক প্রবন্ধগুলো পড়লে বারংবার এই কথাগুলো উঠে আসে। রবীন্দ্রনাথ ‘নেশন’ কথাটির অন্তর্বস্তু ও বাস্তবতাকে এতটাই পাশ্চাত্যের সীমায় সীমায়িত বলে মনে করেছিলেন যে বাংলা ভাষায় তার কোনো প্রতিশব্দ হতে পারে না বলে মনে করেছিলেন। তিনি বারবার বলেছিলেন যে পাশ্চাত্যে রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে রাষ্ট্রই প্রধান হয়ে সবকিছু আচ্ছন্ন করে বসে আছে, কিন্তু ভারতবর্ষে সমাজ-ই প্রধান, সমাজ-ই বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর বহু বিবিধ জীবনের ধারাকে অবৈরীমূলক সহাবস্থানে প্রাণবন্ত করে রেখেছে, পাশ্চাত্যের অনুকরণ করে জাতিরাষ্ট্রের অপর-বিদ্বেষী হিংস্র কাঠামোকে এখানেও যদি প্রাধান্যবিস্তার করতে দেওয়া হয় তাহলে তা ধ্বংস ও বিপর্যয়কেই ডেকে আনবে। জাতীয়তাবাদ নিয়ে তাঁর ভাষণগুলোয় তিনি তীক্ষ্ণভাবে আত্মঅহঙ্কারী অপর-বিদ্বেষী জাতীয়তাবাদকে পাশ্চাত্য থেকে সংক্রামিত হয়ে আসা এক অসুখ বলে আক্রমণ করেছিলেন।৭ জাতীয়তাবাদ নিয়ে রবীন্দ্রনাথের থেকে কিছু ভিন্নমত পোষণ করলেও মহাত্মা গান্ধী যেভাবে স্বাধীন ভারতের রূপ হিসেবে বিকেন্দ্রীভূত ক্ষমতার কাঠামোয় স্বশাসিত আত্মনির্ভর গ্রামসমাজের ছবি কল্পনা করেছিলেন, সেখানেও ভারতবর্ষের সহজাত রাজনৈতিক কাঠামো কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্র নয়, বরং বিকেন্দ্রীভূত গ্রামসমাজ, এই বোধ ছিলো।
কিন্তু ইতিহাসের কাকতালীয়তায়, ভারতীয় উপমহাদেশে ‘স্বাধীনতা’ যেভাবে এসেছিল--- রাষ্ট্রের তৈরি মন্বন্তর, অপর-বিদ্বেষী ধর্মীয় মৌলবাদী শক্তির আস্ফালন, ধর্মীয় দাঙ্গা, ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ, নতুন টানা রাষ্ট্রীয় সীমানা পেরিয়ে এপার-ওপার শরণার্থীদের সব-হারানো মিছিল, মৌলবাদীদের হাতে গান্ধীর হত্যা, ক্ষমতার স্বাদ পেয়ে নেকড়ে হয়ে ওঠা নেতাদের শিকারী মনোবৃত্তির বিস্ফোরণ ঘটে ছলে-বলে-কৌশলে জাতিরাষ্ট্রের কেন্দ্রীভূত ক্ষমতাপাশকে এঁটে বাঁধা--- তার সামনে গ্রামসমাজ, আদিবাসী সমাজ, জনসমাজ নিজ সার্বভৌমত্ব রক্ষা করার মতো যথেষ্ট প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি, ক্রমাগত আত্মসমর্পণ করেছে, আজও করে চলেছে।
৮
ভারতীয় উপমহাদেশে এই ক্রমরাষ্ট্রীয়করণের বিপর্যয়ের মধ্যে আমরা দাঁড়িয়ে আছি। মেঘের পরে মেঘ জমছে অনবরত, আঁধার করে আসছে। অপর-বিদ্বেষের আগাছায় ছেয়ে গেছে মানবজমিন। মানুষ এখানে শিকারী, বিদ্বেষী, ভোগী, খুনী হিসেবে চতুর হয়ে উঠতে চাইছে আর হিংস্র নজরদার রাষ্ট্রের মধ্যেই তার অভিপ্রায়ের প্রতিফলন ঘটতে দেখছে। তাই এহেন বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়িয়ে ভোটে জিতে বা অস্ত্রের জোর খাটিয়ে রাষ্ট্র দখল করে যারা দিনবদলের স্বপ্ন দেখছেন ও দেখাচ্ছেন, তারা হয় ভেড়ার ছদ্মবেশ গায়ে চড়ানো নেকড়ে, আর নয়তো খেলাঘরের রাজ্যে খেলনা রাজা ও খেলনা রাণী নিয়ে খেলাতেই খুশি থাকা অবোধ শিশু। দিনবদলের কাজটা এর চেয়ে অনেক বড়ো, এর চেয়ে অনেক গভীর।
প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রে এমনিতেই সব মানুষের উপায় থাকে না সমাজ-পরিচালনার কাজে হাত লাগানোর, গুটিকয় প্রতিনিধির হাতেই তা ছেড়ে দিতে হয়। তার উপর, আজকে প্রতিনিধি নির্বাচনের বিষয়টিও আর সর্বজনের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নেই, নির্বাচন-পরিচালনার যন্ত্র-প্রযুক্তি-প্রতিষ্ঠান সাধারণ মানুষের মত নিরপেক্ষ ভাবেই ‘জনমত’ নির্মাণ করতে দক্ষতা অর্জন করে ফেলেছে। ফলে ক্ষমতার রাষ্ট্রীয় কেন্দ্রীভূতকরণ ভাঙতে গেলে, প্রতিটি মানুষের রাজনৈতিক স্বতঃক্রিয়ার পরিসর পুনর্নির্মাণ করতে গেলে এই প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র ব্যবস্থাটাকেই বিদায় করে অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রের ব্যবস্থা না করতে পারলে উপায় নেই। সমাজ যখন ক্রমাগত রাষ্ট্রের কাছে আত্মসমর্পণ করতে করতে যাওয়ার পথে নিজমধ্যে অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রের অচার-রীতি-প্রকরণগুলোকে খুইয়ে বসেছে, তখন আবার তা পুনরুজ্জীবিত করা বা নতুনভাবে গড়ে তোলার পথ কোনো ডিক্রি জারি করে হবে না, কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার বিরোধী সমাজলগ্ন নিবিড় চর্চার মধ্য দিয়ে সে পথ খুলতে হবে।
পুঁজিবাদের ধর্মই হলো কেন্দ্রীভবন। পুঁজি এবং অর্থনীতির কেন্দ্রীভবনের সাথে সাথে ক্ষমতা ও রাজনীতি-প্রশাসনেরও কেন্দ্রীভবন। এর উল্টোদিকে চলতে গেলে সামগ্রিক বিকেন্দ্রীকরণের প্রক্রিয়ায় পাড়ি দিতে হবে। অর্থনীতির কেন্দ্রীভবনকে ভেঙে উৎপাদন ও বন্টনের প্রক্রিয়াকে বিকেন্দ্রীভূত করে, ছোটো ছোটো আঞ্চলিক একক--- যেগুলো পরস্পর-সমন্বিত হলেও আত্মশক্তিনির্ভর ও আত্মবোধনির্ভর--- তেমনভাবে ভাঙতে না পারলে অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রের আধারগুলোও গড়ে উঠতে পারবে না। কোনো একলষেঁড়ে ক্ষুদ্র বদ্ধতায় বন্দী হয়ে নিরাপত্তা খোঁজা এ নয়, সীমানাহীন পৃথিবীর সঙ্গে নিবিড় আত্মীয়তা পাতিয়েও নিজ স্বতঃক্রিয়ার পরিধিটির সার্বভৌমত্ব বজায় রাখার প্রয়াস এটা, এ ছাড়া প্রকৃত প্রস্তাবে সর্বজনের আত্মশাসন/স্বশাসন সম্ভব নয়।
এই প্রয়াসের জন্য কোনো তাত্ত্বিক নীল নকশার উপর জোর না দিয়ে, সার্বজনীন কোনো পন্থা আবিষ্কার করে ফেলার বাগাড়ম্বর পরিহার করে, সর্বজনের রাজনৈতিক স্বতঃক্রিয়াকে আত্মপ্রকাশিত ও বিকশিত হতে দেওয়ার ছোটো ছোটো ক্ষেত্রগুলোর সন্ধান করা বা নির্মাণ করার চেষ্টা করা এবং সহযোগিতা-সহানুভূতির সম্পর্ক তৈরি করে এহেন বিবিধ প্রচেষ্টার মধ্যে সংহতি তৈরির চেষ্টা করা, এ কাজ বোধহয় সম্ভব।
টীকা
১। ‘লেনিন কালেক্টেড ওয়ার্কস’-এ উদ্ধৃত অংশটির বয়ান এইরকম:
“Our state apparatus is so deplorable, not to say wretched, that we must first think very carefully how to combat its defects, bearing in mind that these defects are rooted in the past, which, although it has been overthrown, has not yet been overcome, has not yet reached the stage of a culture, that has receded into the distant past. I say culture deliberately, because in these matters we can only regard as achieved what has become part and parcel of our culture, of our social life, our habits. We might say that the good in our social system has not been properly studied, understood, and taken to heart; it has been hastily grasped at; it has not been verified or tested, corroborated by experience, and not made durable, etc. Of course, it could not be otherwise in a revolutionary epoch, when development proceeded at such break-neck speed that in a matter of five years we passed from tsarism to the Soviet system.
It is time we did something about it. We must show sound scepticism for too rapid progress, for boastfulness, etc. We must give thought to testing the steps forward we proclaim every hour, take every minute and then prove every second that they are flimsy, superficial and misunderstood. The most harmful thing here would be haste. The most harmful thing would be to rely on the assumption that we know at least something, or that we have any considerable number of elements necessary for the building of a really new state apparatus, one really worthy to be called socialist, Soviet, etc.
No, we are ridiculously deficient of such an apparatus, and even of the elements of it, and we must remember that we should not stint time on building it, and that it will take many, many years.”
এখানে বর্তমান লেখক বাংলা তর্জমা করে নিয়ে উদ্ধৃত করেছেন।
২। এই বিষয়ে বিস্তৃত আলোচনার জন্য এই বইটি দ্রষ্টব্য: জন বেলামি ফস্টার, ব্রেট ক্লার্ক ও রিচার্ড ইয়র্ক-এর লেখা ‘The Ecological Rift: Capitalism’s War On The Earth’ (২০১০, মান্থলি রিভিউ প্রেস)। বইটির থেকে একটা অংশ এখানে উদ্ধৃত করা থাকলো:
“Under capitalism, he (Marx) insisted, nature was rapaciously mined for the sake of exchange value: ‘The earth is the reservoir, from whose bowels the use-values are to be torn.’
This stance was closely related to Marx’s attempt to look at the capitalist economy simultaneously in terms of its economic-value relations and its material transformations of nature. Thus Marx was the first major economist to incorporate the new notions of energy and entropy, emanating from the first and second law of thermodynamics, into his analysis of production. This can be seen in his treatment of the metabolic rift--- the destruction of the metabolism between human beings and the soil, brought on by the shipment of food and fiber to the city, where nutrients withdrawn from the soil, instead of returning to the earth, ended up polluting the air and the water. In this conception, both nature and labour were robbed, since both were deprived of conditions vital for their reproduction: not ‘fresh air’ and water but ‘polluted’ air and water, Marx argued, had become the mode of existence of the worker.” (pg. 59)
৩। বন্যপশু সংরক্ষণ নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক অ-সরকারি সংগঠন (NGO) ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ড (WWF) তার ২০১২ সালে প্রকাশিত ‘লিভিং প্ল্যানেট’ প্রতিবেদনে বলছে যে তৎকালীন পৃথিবীর উৎপাদন, উচ্ছিষ্ট-বর্জন এবং ব্যবহৃত বস্তু ও পরিষেবার সংকুলানের জন্য আমরা দেড়খানা পৃথিবীর বাস্তুসংস্থানিক (ecological) সম্পদ ব্যবহার করছিলাম। অর্থাৎ, পৃথিবীর মানুষ উৎপাদন ও ভোগের জন্য যে পরিমাণ সম্পদ ব্যয় করছিল তা সেই সময়কালে দেড়খানা পৃথিবী হলে তবে পুনরুৎপাদিত হয়ে ভারসাম্যে আসতে পারে। জাতিসংঘের পরিসংখ্যানবিদদের খুব কমিয়ে করা হিসাবও বলছে যে বর্তমান ভোগ ও উৎপাদনের প্রবণতা অব্যাহত থাকলে ২০৩০ সালে আমরা এমন জায়গায় পৌঁছে যাব যখন আমরা দুখানা পৃথিবীর সম্পদ ব্যয় করব। সুতরাং ইতিমধ্যেই আমরা ভোগ ও উৎপাদনের এমন একটা স্তরে বিরাজ করছি যেখানে খুব দ্রুত আমরা বাস্তুসংস্থানিক সম্পদকে নিঃস্ব করে তোলার মধ্য দিয়ে প্রাকৃতিক ভারসাম্য ধ্বংস করে চলেছি। আর সর্বজনীন বিকাশ-উন্নয়ন-প্রগতির ‘স্বপ্ন’ সাকার হলে কী অবস্থা হবে? উত্তর আমেরিকার মানুষের গড় ভোগের হার যদি ধরা হয়, তাহলে গোটা পৃথিবীর মানুষ সেই হারে ভোগ করতে শুরু করলে সাড়ে চারটে পৃথিবীর বাস্তুসংস্থানিক সম্পদ নিঃশেষিত হতে থাকবে।
৪। এখানে যে অতি সংক্ষিপ্ত আলোচনা হাজির করা হয়েছে তা বিশদে পাওয়া যাবে এই বইয়ে: ক্ষমতা/প্রতিরোধ, মিশেল ফুকো, অনুবাদ ও সম্পাদনা- বিপ্লব নায়ক, ২০২১, অন্যতর পাঠ ও চর্চা।
৫। দুর্ভোগ ডেকে আনা ‘বিশৃঙ্খলা’ থেকে পরিত্রাণের উপায় হিসেবে শৃঙ্খলাদায়ক ক্ষমতা গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠে মান্যতা আদায় করে নিয়ে নানা সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বিস্তৃতিলাভ করে। তত্ত্বাবধায়ক কর্তৃপক্ষের নজরদারি দৃষ্টির সামনে সমাজের প্রতিটি আনাচ-কানাচ উন্মুক্ত করে দেওয়া, নিচ থেকে উপরে তথ্যের প্রবাহ ও উপর থেকে নিচে নির্দেশ-প্রত্যাদেশের প্রবাহ বজায় রাখা, নির্দেশপালন নিশ্চিত করা, ইত্যাদির প্রয়োজনে যে প্রকৌশল জন্ম নিয়েছিল তার একটি আদর্শ ধাঁচা হিসেবে ফুকো ১৭৯১ সালে জেরেমি বেন্থামের একটি প্রস্তাবকে উদ্ধার করে হাজির করেছেন। জেরেমি বেন্থামের এই প্রস্তাবটি প্রথম নজরে একটি স্থাপত্য-নকশা। বেন্থাম তার নাম দিয়েছিলেন ‘প্যানঅপটিকন’। নকশাটিতে প্রহরী ও প্রহরাভুক্তদের স্থানিক বিস্তারণের এক বিশেষ কৌশলের মধ্য দিয়ে অবিচ্ছিন্ন প্রহরাকে সহজ ও সম্ভব করে তুলতে চাওয়া হয়েছে। বৃত্তাকার একটি পরিসরের কেন্দ্রে নজরদারি-মিনার, যেখানে প্রহরী অবস্থান করবে। আর বৃত্তটির পরিধি বরাবর এক সারি কুঠুরি, যেখানে প্রহরাভুক্তরা অবস্থান করবে। পাশাপাশি কুঠুরিগুলো একে অপরের থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন, এক কুঠুরি থেকে অন্য কোনও কুঠুরি দেখা যায় না। কুঠুরির দুই দেওয়ালে, বৃত্তের বাইরের দিকে ও বৃত্তের ভিতরের দিকে, দুটি খোলা জানালা যা দিয়ে আলোর যাতায়াত কুঠুরির মধ্য দিয়ে অবারিতভাবে চলতে পারে ও তার ফলে কেন্দ্রস্থ নজরদারি মিনারের জানালা থেকে কুঠুরির মধ্যের ব্যক্তির সমস্ত চলাচল প্রহরীর চোখে ধরা পড়ে। নজরদারি মিনারের জানালাগুলো এমনভাবে নির্মিত যে ভিতর থেকে বাইরে দেখা যায়, কিন্তু বাইরে থেকে ভিতরে দেখা যায় না। অর্থাৎ, প্রহরীরা সবকটা কুঠুরির প্রহরাভুক্তদের দেখতে পেলেও, কোনও কুঠুরি থেকেই মিনারের ভিতরটা দেখা যাবে না। সুতরাং মিনারে দৈহিকভাবে কোনও প্রহরী উপস্থিত না থাকলেও প্রত্যেক প্রহরাভুক্তই ভাবতে থাকবে যে প্রহরী হয়ত উপস্থিত আছে এবং তার উপরই নজর রাখছে। এই বোধ থেকে প্রহরাভুক্ত বাস্তব প্রহরীর অনুপস্থিতিতেও তার উপস্থিতি বোধ করতে থাকবে এবং নিজের উপর নিজে থেকেই শৃঙ্খলা আরোপ করে রাখবে। জেরেমি বেন্থাম এই নকশাকে কেবল অপরাধীদের উপর নজর রাখার জন্য জেলখানার স্থাপত্য হিসেবে ভাবেননি। চিকিৎসাকেন্দ্রে রোগীদের উপর নজর রাখা, কারখানায় শ্রমিকদের উপর নজর রাখা, সরকারী নির্দেশ বলবৎ করতে প্রশাসকের দ্বারা সাধারণ নাগরিকদের উপর নজর রাখা— এমন সমস্ত নজরদারিই কম লোক দিয়ে ও কম খরচে করার সাধারণ উপায় হিসেবে তিনি এই প্রস্তাবটি রেখেছিলেন। ফুকোর মতে, প্যানঅপটিকন হল: ‘অনুশীলনের একটি সাধারণিকরণযোগ্য ধাঁচা, মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের সাপেক্ষে ক্ষমতাসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করার একটি উপায়।... ক্ষমতার কলকৌশলকে একটি নকশাচিত্রের মাধ্যমে এখানে একটা আদর্শ রূপে হাজির করা হয়েছে।... আসলে এটা হল রাজনৈতিক প্রকৌশলের এমন এক সাধারণ বিমূর্ত চিত্র যা তার বিশেষ মূর্ত ব্যবহারগুলি থেকে বিযুক্ত করেই ধরতে হবে।...বহুদিকে বহুভাবে এর প্রয়োগ ঘটতে পারে।’ (৮। মিশেল ফুকো-র মূল ফরাসি রচনা থেকে অ্যালান সেরিডান কর্তৃক ইংরেজিতে অনূদিত ‘ডিসিপ্লিন অ্যান্ড পানিশ: দি বার্থ অফ দি প্রিজন’, ভিনটেজ/র্যান্ডম হাউজ, ১৯৭৯, পৃষ্ঠা: ২০৫। বঙ্গানুবাদ বর্তমান লেখকের করা।)
৬। এখানে বর্তমান লেখকের করা বাংলা অনুবাদ দেওয়া হলো। মূল ফরাসি থেকে গ্রাহাম বুর্চেলের করা ইংরেজি অনুবাদটি এরকম: “By this word ‘governmentality’ I mean three things. First, by ‘governmentality’ I understand the ensemble formed by institutions, procedures, analyses and reflections, calculations, and tactics that allow the exercise of this very specific, albeit very complex, power that has the population as its target, political economy as its major form of knowledge, and apparatuses of security as its essential technical instrument. Second, by ‘governmentality’ I understand the tendency, the line of force, that for a long time, and throughout the West, has constantly led towards the pre-eminence over all other types of power--- sovereignty, discipline, and so on--- of the type of power that we can call ‘government’ and which has led to the development of a series of specific governmental apparatuses on the one hand, and on the other, to the development of a series of knowledges (savoirs). Finally, by ‘governmentality’ I think we should understand the process, or rather, the result of the process by which the state of justice of the Middle Ages became the administrative state in the fifteenth and sixteenth centuries and was gradually ‘governmentalized’.” (Michel Foucault, Security Territory Population: Lectures at the College De France, 1977-78, Palgrave Macmillan, 2009, pg. 108-109)
৭। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাংলা ভাষায় ‘আত্মশক্তি’, ‘ভারতবর্ষ’, ‘স্বদেশ’, ‘সমাজ’ গ্রন্থগুলো ও ইংরেজিতে ‘Nationalism’ গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত প্রবন্ধ ও বক্তৃতাগুলো দ্রষ্টব্য।