শহর এবং পল্লীগ্রাম

লিখেছেন:রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রবীন্দ্রনাথ এই প্রবন্ধটি ১৯২৪ সালে ইংরেজিতে লিখেছিলেন খুব সম্ভবত শ্রীনিকেতনের পল্লী-পুনর্গঠনের কাজের জন্য সম্ভাব্য বিদেশী অর্থ-অনুদানকারীদের কাছে একটি আবেদন হিসেবে। পল্লী-পুনর্গঠনের যে সামাজিক-দার্শনিক প্রয়োজনীয়তা রবীন্দ্রনাথ এখানে আলোচনা করেছেন তা অতি তীক্ষ্ণভাবে বর্তমান ভোগ-আগ্রাসী প্রকৃতি-বিধ্বংসী আধুনিকতাকে সমালোচনা করে বাঁচার নতুন পথ ও প্রত্যয় অনুসন্ধান করে। তাই বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে এই প্রবন্ধটির বাংলা অনুবাদ এখানে হাজির করা হল।

ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ: সুভাষ ভৌমিক

           

আধুনিক সভ্যতায় মানুষের কামনা-বাসনা-প্রয়োজন মানুষের হাতের নাগালের বাইরে চলে গেছে। উন্নত সাধ-অভিলাষের এই সুদূরপ্রসারী ঝোঁক, শুরুতে মানুষের দেহমনের সচেষ্টতা বাড়িয়ে মানুষকে উদ্যমী করে তোলে। উদ্যমী শক্তির উপর ভর করে এই নাগাল-ছাড়া সাধ-অভিলাষ তার অতিপ্রসারণের ইন্ধন পায়; এবং এইভাবে, এই কামনা-বাসনা-প্রয়োজন পর্যায়ক্রমে জীবনযাত্রার সাধ্যতা আরও আরও বাড়িয়ে তোলার মধ্যে দিয়ে নিজের কর্মকাণ্ড জাহির করে।

            জীবনযাত্রার এই ধ্বজা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি উঁচুতে উড্ডীন হয়ে ভোগাসক্তিতে বাতাস দেয়। সাধারণত সমাজের একটি অতি ক্ষুদ্র অংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ অমিতাচার জীবনযাপনের প্রলোভন ব্যাপক হয়ে ওঠে। স্বার্থ-চরিতার্থতার জোয়ারে কোনও বাঁধ না মানা এই ক্রমবর্ধমান প্রলোভন যেকোনও সভ্যতার জন্য মারাত্মক প্রমাণিত হতে পারে।

            আমাদের বিশ্বের অর্থনৈতিক ভূগোলখণ্ডে, ভাগ্যের পরিহাসের উত্থান-পতন শুধুমাত্র একটি সহনীয় সীমার মধ্যেই স্বাস্থ্যকর। খাড়া পাহাড়ের ক্রমাগত প্রতিবন্ধকতায় বিভাজিত দেশে কোন ধ্রুব সভ্যতা সম্ভব নয়, কেননা সেখানে যোগাযোগের স্বাভাবিক প্রবাহ কঠিন। অতিশয় ধন এবং বিলাসবহুল জীবনযাপন এই পাহাড়টার মতো, যে বিচ্ছিন্নতার উঁচু দেয়াল তৈরি করে। এই দেয়াল, সমাজে যেকোনো দৈহিক আগলের থেকেও মন্দ।

            কেউ কেউ আছেন যারা বিশ্বাস করেন যে সম্পত্তির ধারণার উচ্ছেদে সমাধান আছে, এবং তখনই কেবলমাত্র গণীভূত কর্মশক্তি তার পূর্ণ স্বাধীনতা খুঁজে পাবে। কিন্তু আমাদের অবশ্যই জানতে হবে, যে তাগিদ সম্পত্তির উদয় ঘটিয়েছে, তা মানব প্রকৃতিতে মৌলিক কিছু। বিষয়-আশয় সৃষ্টি করে এমন সবকিছুর উপর কেউ ক্ষমতাবলে নৃশংসভাবে জুলুম করতে পারে; কিন্তু কেউ নিজের মনের প্রকৃতিতন্ত্র পরিবর্তন করতে পারবে না।

            স্বামিত্ব (স্ব+আমিত্ব) আমাদের ব্যক্তিগত ভাবপ্রকাশের একটি মাধ্যম। যদি আমরা এই ব্যক্তিগত ভাবের নেতিবাচক দিকটি দেখি তবে আমরা মানুষে মানুষে বিচ্ছিন্নতা অবধি তাতে দেখতে পাই। যখন কিছু কিছু মানুষের বোধে স্বতন্ত্রতার ঝোঁক তীব্র হয় তখন তাদের আমরা স্বার্থপর বলি। কিন্তু এর ইতিবাচক দিকটি এই সত্যকে প্রকাশ করে যে, এটিই একমাত্র মাধ্যম যার মাধ্যমে মানুষেরা একে অপরের সাথে যোগাযোগ করতে পারে। তাই, মানব ইতিহাসের সমস্ত পথ ধরে, মানুষেরা সেই ভাবপ্রবণতাকে আবাদ করার চেষ্টা করেছে, যা আমাদের ব্যক্তিবৈশিষ্ট্যের শ্রেষ্ঠ মর্মার্থ প্রদান করে, আমাদেরকে পারস্পরিক সহানুভূতির বন্ধনে ঘনিষ্ঠ হতে সমর্থ করে।

            স্বার্থপর-প্রবণতার দোষারোপে যদি আমরা আমাদের আত্মশক্তিকে হত্যা করি, তখন মানুষের পারস্পরিক আলাপন নিজেই তার অর্থ হারায়। কিন্তু যদি আমরা তাকে বাঁচিয়ে রাখি এবং বিকশিত করি, তখন প্রকৃতির দ্বারা সৃজনশীল হয়ে এটি অবশ্যই তার নিজস্ব জগতকে অলংকৃত করবে। প্রায়শই বেশিরভাগ মানুষের ক্ষেত্রে, স্বামিত্ব-ই নিজস্ব জগতের নানান সৃষ্টি-প্রতিষ্ঠার একমাত্র দেহযষ্টি। এটা নিছক টাকাকড়ির ব্যাপার নয়, নিছক সরঞ্জাম নয়; এটি নিছক অর্জনেচ্ছু ঘোষণা করে না, বরং এটি আমাদের সৌন্দর্যবোধ, আমাদের কল্পনা, আমাদের গঠনমূলক দক্ষতা, আত্মনিবেদনের আকাঙ্ক্ষার একটি উদ্দেশ্যমূলক উদ্ভাসন।

            আমাদের নিজস্বভাবসূচক সৃজনশীল পরিসরের মাধ্যমে আমরা পারস্পরিক দেয়ানেয়া প্রদর্শন করি। আমাদের মহত্তম সামাজিক শিক্ষাপ্রাপ্তি হল, আমাদের স্বামিত্বকে আমাদের মধ্যের সর্বোত্তম, যা সর্বজনীন, আত্মশক্তির সফল অভিব্যক্তিতে গঠন করা, যার সর্বশ্রেষ্ঠ রোশনাই হল ভালবাসা। যেহেতু ব্যক্তিমানুষ হল সমাজগঠনের একটি একক, তাই প্রতিটি জীবনের জীবন্ত প্রাণময়তায় স্বামিত্ব হল সম্পদের একক যা সমাজকে সমৃদ্ধ করে। আমাদের প্রজ্ঞা প্রসারিত হয় এককগুলির বিচ্ছিন্নতা ধ্বংস করার মধ্যে দিয়ে নয়, বরং ঐক্যের আত্মকে এর পূর্ণ শক্তিতে বজায় রেখে।

            সহজসরল জীবনযাপনে, সম্পদ খুব বেশি বিশিষ্ট হয়ে ওঠে না, এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তি তার সামাজিক দায়িত্ব পালন করতে কোন গুরুতর মুশকিলে পড়ে না, বরং এটি তার বাহন হয়ে ওঠে। ভারতবর্ষে অতীতে জনমত সম্পদের উপর মোটা কর ধার্য করত এবং দেশের বেশিরভাগ জনকল্যাণমূলক কাজ ধণীদের দ্বারা স্বেচ্ছায় সমর্থিত ছিল। স্বতঃস্ফূর্তভাবে পারস্পরিক কর্তব্যের সমন্বয়ের মাধ্যমে জল-সরবরাহ, চিকিৎসা সহায়তা, শিক্ষা এবং বিনোদন স্বাভাবিকভাবেই বিত্তবানরা ভরণপোষণ করত। এটি সম্ভবপর হয়েছিল, কারণ স্বার্থ-চরিতার্থের ব্যক্তিগত অধিকারের সীমারেখা টানা ছিল এবং উদ্বৃত্ত সম্পদ সহজেই সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রণালী বেয়ে চলত। এই ধরনের সমাজে, সম্পত্তি ছিল সদাচার-অনুমোদিত স্তম্ভ এবং সৌভাগ্যশালীদের কাছে আত্মনিবেদনের অবকাশ।

            কিন্তু জীবনযাত্রার মানবৃদ্ধির সাথে সাথে সম্পত্তি তার পথ পাল্টে নেয়। সে আতিথেয়তার দরজা বন্ধ করে দেয়, যা ছিল সামাজিক ভাব-বিনিময়ের সর্বোত্তম মাধ্যম। সে তার প্রাচুর্যকে জাহির করে আত্মকেন্দ্রিক অমিতব্যয়িতায়। সে এখন হিংসা এবং অমীমাংসিত শ্রেণীবৈষম্যের জন্ম দেয়। সংক্ষেপে, সম্পত্তি অসামাজিক হয়ে ওঠে। কারণ, যাকে বৈষয়িক প্রগতি বলা হয়, তাতে সম্পত্তি হয়ে উঠেছে ভীষণরকম ব্যক্তিবাদী, সামাজিক নৈতিকতার বিষয় নয়, বরং লাভের প্রক্রিয়ায় তা হয়ে উঠেছে বিজ্ঞানের বিষয়। সামাজিক বন্ধন ভেঙ্গে সে সমাজের জীবনরস নিষ্কাশন করে। এর নীতিহীনতা বিশ্বজুড়ে বিপর্যয় সৃষ্টি করে, এমন শক্তি উদ্ভূত করে যেটা জনগণকে অন্যায় এবং ব্যাপক আতঙ্কের ক্রিয়াকলাপে প্ররোচিত বা বাধ্য করতে পারে।

            দাবানল লাগলে জঙ্গলের জ্বালানি সম্পূর্ণরূপে নিঃশেষ না হওয়া পর্যন্ত জঙ্গলের আগুন জীবজগৎকে ভক্ষণ করে। লালসা যখন সামাজিক নিয়ন্ত্রণের বেড়া ভেঙে মুক্ত হয়ে যায়, তখন এটি একইভাবে কাজ করে। সমাজজীবনকে সম্পূর্ণ ভক্ষণ করতে চায় এবং পরিণতি হয় ধ্বংসাত্মক। অসামাজিক আসক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করা এবং তাদের শৃঙ্খলিত রাখাই সর্বদা মানুষের আধ্যাত্মিক শিক্ষাপ্রাপ্তির উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু ইদানীং কিছু অদ্ভুত প্রলোভন লালসাগ্নির মুক্তি ঘটিয়েছে এবং আশ্রয়দায়ী সমস্ত কিছুকে তার লেলিহান হিংস্রতায় গ্রাস করছে।

            আমাদের ফসলের ক্ষেতে সর্বদা এমন কীটপতঙ্গ থাকে যেগুলি তাদের দস্যুতা সত্ত্বেও, ক্ষেতের কৃষকদের জন্য যথেষ্ট সুফল রেখে যায়, এবং এই সুফলতায় কীটপতঙ্গ নির্মূল করার চেষ্টার খরচ গুনতে হয় না। কিন্তু যখন কিছু কীটপতঙ্গ, যাদের স্ব-বৃদ্ধির বিপুল ক্ষমতা আছে, আমাদের খাদ্যশস্য আক্রমণ করে, তখন দুর্যোগ হিসাবে তাকে মোকাবিলা করতে হয়। মানব সমাজে, স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে, অপচয়ের এমন অনেক অজুহাত রয়েছে যেগুলি উপেক্ষা করলে আমাদের বিশেষ ক্ষতির কিছু নেই। কিন্তু আজকের দুর্যোগ, যা আমাদের সমাজজীবন এবং এর সঙ্গতির উপর এসে পড়েছে, তা বিপর্যয়কর, কারণ এটি শুধু নির্দিষ্ট অঞ্চলে সীমাবদ্ধ নেই। এটি সর্বগ্রাসীতার একটি মহামারী যা সভ্যতার সমস্ত ক্ষেত্র সংক্রমিত করেছে।

            আমারা সকলেই ভোগরসে অমিতাচার হয়ে, সেটার সামর্থ্য বাড়িয়ে তুলতে আজকাল স্বাধীনতার অধিকারের দাবি করি। ধনী প্রতিবেশীর মতো করে নিজের ব্যক্তিগত বাসনাপূরণে সক্ষম হতে না পারা আমাদের কাছে দারিদ্রের লজ্জা হিসেবে প্রতিপন্ন হয়, এবং আমাদের পরাশ্রয়ী-অভিজোযন আমাদের দুঃখ-দুর্দশার কারণ হিসেবে এই অক্ষমতাকে মনের মধ্যে পোষণ করে। আমাদের সমাজ এমন এক সমাজে পরিণত হয়েছে যেখানে, সম্মানের নির্মম আদর্শের মাধ্যমে, সমস্ত ব্যক্তি একে অপরকে চরম সীমা পর্যন্ত ক্ষতি করার জন্য তাড়িত করছে।        

            সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের আদর্শের ক্রমাগত গোলমালের ফলাফলে সংশ্লিষ্ট অপচয় অবধারীতভাবে ব্যয়িত শক্তিরও অপচয় ঘটায়। ক্রমাগত উৎপাদন বৃদ্ধির সহযোগী হয়ে বিজ্ঞাপনের আর্তনাদ, অর্থাৎ প্রচুর পরিমাণে উপাদান এবং জীবনীশক্তির বেহিসেবি খরচ কেবলমাত্র কালের জঞ্জাল বাড়িয়ে তুলতে সহায়তা করে।

            সভ্যতা আজ একটি বিশাল যোগানদার সংস্থায় পরিণত হয়েছে। এটি অবিরত উদরসর্বস্ব পেটুকদের বিশাল ভোজসভা ভরনপোষণ করছে। নির্বিঘ্নতার বদলে অস্থিরতার কলুষ-প্রভাব মানুষজনের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছে। রাজনীতি ও বাণিজ্যে নীচতা, নিষ্ঠুরতা ও মিথ্যার ফলশ্রুতিতে উৎপন্ন সর্বগ্রাহী লালসা সমগ্র মানবিক পরিবেশকে পঙ্গু করেছে। অস্বাভাবিক প্রবৃত্তির একটি সভ্যতা অবশ্যই তার অস্তিত্বের জন্য অগণিত শিকারের উপর নির্ভর করবে, এবং বিশ্বের সেই অংশগুলিতে শিকারের অন্বেষণ করা হচ্ছে যেখানে মানুষের মাংস সস্তা। সম্ভ্রান্ত ছাইভস্মের অনন্ত বস্তুসমূহ সহকারে রুচিবাগীশ ঠাট সরবরাহের জন্য, সমগ্র জনগণের অনাগত প্রত্যাশা ও সুখকে সস্তায় বেচতে এশিয়া এবং আফ্রিকায় একটি লেনদেন চলছে।

            এই ধরনের বৈষয়িক-নৈতিকতার স্রোতের পরিণতি আরও স্পষ্ট হয় যখন কেউ বিশ্বের প্রায় সর্বত্র স্থূল শহরগুলির এবং গ্রামের শরীরমনের রক্তাল্পতার মধ্য দিয়ে উদ্ভাসিত লক্ষণগুলি পর্যবেক্ষণ করে। শহরের প্রতি আকর্ষণ অনিবার্যরূপে জাঁকিয়ে বসেছে। শহরগুলির অতিরিক্ত চাহিদা মেটানোর জন্য ঘনীভূত শক্তি এবং উপকরণগুলি আধুনিক সভ্যতার বৈশিষ্ট্যযুক্ত চিহ্ন বহন করে। সমাজদেহের কিছু অংশে ষড়যন্ত্র এবং সমস্ত কিছু আত্মসাৎ করার বন্দোবস্ত ছাড়া এই ধরনের বিকৃত ভোগআসর বসতে পারে না। এটা আত্মঘাতী; কিন্তু, এর প্রগতিশীল অধঃপতন মৃত্যুতে গিয়ে শেষ হওয়ার আগে, নির্দিষ্ট অংশের অসামঞ্জস্যপূর্ণ প্রসারণ অত্যন্ত জাঁকালো দেখায়, এবং সর্বদেহের অনাহার-বিবর্ণতা লুকিয়ে রাখে। এর আতিশয্যে সদ্‌ ভরণপোষণও নগণ্য দেখায় এবং আপাত সম্পদের মায়া সৃষ্টি হয়।

            শরীর কিংবা সমাজ দেহে তাদের সদস্য অথবা অঙ্গগুলি প্রাণিক সম্পর্কে পরস্পরের প্রতি সমবেদী, সেখানে তাদের মধ্যে যোগাযোগের একটি নিখুঁত ভারসাম্য বজায় রাখা হয়, যাতে ঐক্যের সজ্ঞানতা বাধাপ্রাপ্ত না হয়। ফলস্বরূপ স্বাস্থ্য-সমৃদ্ধি গৌণ বিষয়,––ঐক্য নিজেই অবশেষে পরম। ঐক্য সৃষ্টি ও বজায় রাখার পারস্পরিক ক্রিয়াকলাপের নিখুঁত ছন্দ তখনই বিঘ্নিত হয়, যখনই কিছু ক্ষমতার উচ্চাকাঙ্ক্ষা জীবনের গণরাজ্যে তার আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে।

            লোকসাধারণ দ্বারা প্রশংসিত পাশ্চাত্যের গণতন্ত্র কখনই সত্য হতে পারে না, সেখানে লোভ বৃদ্ধি পায়, অনিয়ন্ত্রিত হয়, উৎসাহিত হয়। এই ধরনের গণতন্ত্রের আবহে ব্যক্তিদের মধ্যে তাদের নিজস্ব উচ্চাভিলাষ মেটানোর জন্য সরকারি সংস্থাগুলিকে দখল করার নিরন্তর সংগ্রাম চলে এবং গণতন্ত্র হয়ে ওঠে একটি হাতির মতো যার জীবনের উদ্দেশ্য হল চতুর ও ধনী ব্যক্তিদের আনন্দযাত্রা প্রদান করা।

            এই ধরনের রাষ্ট্রে মতপ্রকাশের গণমাধ্যমের দ্বারা মতামত উৎপাদন করা হয়, প্রশাসনযন্ত্র-সহ সবই প্রকাশ্যে বা গোপনে সেই সমস্ত স্বচ্ছল লোকদের দ্বারা চালিত হয়, যাদেরকে পুরানের উটের সাথে তুলনা করা হয়, আদর্শ রাজ্যে প্রবেশের সূচের ছিদ্রের মতো অপ্রশস্ত দরজা যেখান দিয়ে এরা কখনোই পার হতে পারবে না। যারা আধ্যাত্মিক স্বাধীনতায় নিজেদের বিশ্বাস প্রচার করে তাদের বিরুদ্ধে এই ধরনের সমাজ আতিথ্যবিমুখ, সন্দিগ্ধ এবং নির্মমভাবে নিষ্ঠুর হয়ে ওঠে। এই ধরনের সমাজের অগ্রগতি বলতে সমাজের লোকেরা ক্রমাগত নেশাসক্ত হয়, যা তারা সভ্য হওয়ার মূল্যে কিনতে ইচ্ছুক, সেই ব্যক্তির মতো যার কাছে খাবারের চেয়ে মদের আকর্ষণ বেশি।

            পল্লীগ্রামগুলো হল নারীদের মতো। গোষ্ঠীর লালন-পালন যাদের দায়িত্বে। শহরের তুলনায় প্রকৃতি-সম্পর্কিত তারা এবং তাই জীবন-উৎসের সাথে স্নেহের সম্পর্ক তাদের। তাদের এমন আবহমণ্ডল রয়েছে যা তাদেরকে আরোগ্যকরণের প্রাকৃতিক শক্তির অধিকারী করেছে। নারীদের মতোই পল্লীগ্রামেরও একই নিত্যকর্ম, মানুষকে তাদের মৌলিক প্রয়োজন, খাদ্য ও আনন্দ, জীবনের সহজ কবিতা এবং সৌন্দর্যের সেইসব পার্বণগুলি প্রদান করা যেগুলো গ্রাম স্বনির্ভরভাবে স্বতস্ফূর্তভাবে তৈরি করে এবং যার মধ্যে সে আনন্দ খুঁজে পায়। কিন্তু যখন উচ্চাকাঙ্ক্ষার চাঁদাবাজি তার উপর ক্রমাগত চাপ দেয়; প্রলোভনের অত্যাধিক উদ্দীপনার মাধ্যমে যখন তার সঙ্গতি শোষণ করা হয়, তখন সে বিফলা হয়ে পড়ে। তার মন নিস্তেজ এবং সৃজনহারা হয়ে ওঠে; এবং শহরের বিবাহিত পত্নীর যুগ-সম্মানিত অবস্থান থেকে সে দাসী-দাসীর মতো অপমানিত হতে থাকে। অন্যদিকে, শহরটি, তার তীব্র আত্মশ্লাঘা এবং দম্ভে, ধ্বংসযজ্ঞ সম্পর্কে অসচেতন থেকে, ক্রমাগত এর জীবনসুখ এবং আনন্দের উৎসের উপর শক্তি প্রয়োগ করে চলে।

            যারা হিন্দু দেবদেবী সম্বন্ধে পরিচিত তারা জানেন যে আমাদের পৌরাণিক কাহিনীতে কুবের নামে একজন উপ-দেবতা রয়েছে, যিনি ধনদৌলতের দেবতা। তিনি অর্থগুণের প্রতীক, যিনি লোভের প্রেরণাদায়ক। তার মূর্তি কুৎসিত এবং স্থূল তার স্ফীত পেট আত্ম-অত্যুক্তির অশ্লীলতায় হাস্যকর। তিনি সম্পত্তির কোন নৈতিক দায়িত্ব জানেন না। কিন্তু দেবী লক্ষ্মী, যিনি সমৃদ্ধির দেবতা, তিনি সুন্দর। কারণ সমৃদ্ধি সবার জন্য। ইনি সেই বিষয়-আশয়ে অধিষ্ঠান করেন যা ব্যক্তির অন্তর্গত হলেও, উদারভাবে গোষ্ঠীর প্রতি নিজের বাধ্যবাধকতা মেনে চলেন। লক্ষ্মী একটি পদ্মের উপর উপবিষ্ট, পদ্ম যা সর্বজনীন হৃদয়ের প্রতীক। এটি বোঝায় যে তিনি সেই অতিথিবৎসল সম্পদমঞ্চের সভাপতিত্ব করছেন যার দায়িত্ব সমস্ত মানুষের জন্য সুখ।

            কোনো দুর্ভাগ্যের কারণে, বর্তমান যুগে লক্ষ্মী তার পদ্ম সিংহাসন থেকে বঞ্চিত হয়েছেন এবং তার জায়গায় কুবের পূজিত হচ্ছেন। আধুনিক শহরগুলি তার স্ফীত উদরের প্রতীক এবং যেখানে কদর্যতা নির্লজ্জভাবে রাজত্ব করে। একটি বিষয় সম্পর্কে স্মরণ করিয়ে দিতে হবে যে, বাঁশের ঝাড়ের মতো এই কদর্যতার বেড়ে ওঠার একটি বিশাল শক্তি রয়েছে এবং তাতে বিশেষ আনন্দিত হওয়ার কারণ নেই। এই বেড়ে ওঠা ধ্রুব অগ্রগতি নয়; এটি এমন একটি রোগ যেটাতে মারা যাওয়ার সময় শরীর ফুলে যায়।

            ছড়িয়ে পড়া সূর্যের আলো গাছেদের সমগ্র অরণ্যে প্রাণ প্রতিপালন করে; এবং সম্পদের ঔজ্জ্বল্যতা লক্ষ্মীর প্রতীকস্পরূপ। সূর্যের রশ্মি যখন একটি আতশ কাঁচের মধ্য দিয়ে কেন্দ্রিভূত করা হয়, তখন সেটা সেই অরণ্যকেই পুড়িয়ে ছাই করে দিতে পারে; ঘনীভূত সম্পদের এই ক্ষুধার্ত আগুন কুবেরের প্রতীকী, এবং তিনি আমাদের আধুনিক শহরগুলির প্রধান দেবতা।

            আধুনিক শহরগুলি ক্রমাগত বড় হচ্ছে, কারণ কোন একতাশক্তি শহরগুলির আয়তন বৃদ্ধির উপর গুরুত্বপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আরোপে কর্মতৎপর নয়। তাদের বিশালত্বের কোন শেষ থাকতে পারে না, কারণ তাদের উদ্দেশ্য মানব সম্পর্কগুলিকে সত্যের সৌন্দর্যের সুরে বাঁধা নয়, বরং বৈষয়িক সুবিধা অর্জন করা।

            সংস্কৃত কাব্য মেঘদূতে আমরা যখন মেঘ-দূতের পথ অনুসরণ করি এবং কল্পনায় সেখানে উল্লিখিত পুরানো বিশ্বের সুন্দর নামের জনপদগুলিকে পেরিয়ে যাই, তখন আমরা অনুভব করি যে কবি সেগুলি বর্ণনা করতে গিয়ে তাঁর অভিজ্ঞানের আকুল উল্লাসে সেইসব বর্ণনা ধ্বনিত করেছেন; আমরা স্বভাবজ জানি যে এই শহরগুলি অন্য যেকোনও কিছুর চেয়ে মানুষের ভালবাসা এবং আশার প্রকাশ করেছিল, তাদের ঘরবাড়ি এবং মন্দিরগুলিতে এমনকি মনোরম লেনদেনের বাজারের মধ্যেও তার আত্মার ঐশ্বর্যকে তাদের নারীদের দ্বারা প্রতিদিন সম্পন্ন করা মঙ্গলকর সাজসজ্জার সাথে সাংস্কৃতিক গুণসম্পন্ন করেছিল।

            আমরা কল্পনা করতে পারি যে দিল্লি এবং আগ্রা তাদের সংশ্লিষ্ট সেই সময়ে কেমন ছিল। একটি মহান সাম্রাজ্যের কিছু সৃজনশীল মানবিক দিক এগুলি গড়ে ওঠার মধ্যে প্রকাশিত হয়েছিল। চরিত্র যাই হোক না কেন, এই নজিরগুলি তাদের ক্ষয়কালেও মানুষের আত্মমর্যাদার সত্যিকারের গুণটি তাদের জাদুতে ধরে রেখেছে। কিন্তু আধুনিক শহরগুলি মানুষকে কেবল সুযোগসন্ধানী করে, পরমাদর্শী নয়।

            মানুষের সভ্যতায় শহরগুলিকে থাকতে হবে, ঠিক যেমন সর্বোৎকৃষ্ট জীবদেহগুলিতে অবশ্যই দেহের সংঘবদ্ধ কেন্দ্রীভূত প্রত্যঙ্গগুলি থাকে, যেমন মস্তিষ্ক, হৃদয় বা উদর। এগুলো কখনই দেহের প্রাণিক পূর্ণতাকে গ্রাস করে না; বিপরীতে, তাদের কার্যাবলীর একটি নিখুঁত যূথবদ্ধতা দ্বারা, তারা প্রাণের সমৃদ্ধি বজায় রাখে। কিন্তু একটি বৃত্তাকার টিউমার শরীরের শত্রুর মতো শরীরের উপর ফুলে ওঠে। আমাদের ফুলে ওঠা আধুনিক শহরগুলি, একইভাবে, গ্রামগুলি মারফৎ জুগিয়ে চলা সমাজদেহের সমস্ত রসদ ভক্ষণ করে। তারা ক্রমাগত সমাজের জীবনরস নিঃশেষ করে, এবং সমৃদ্ধির একটি বিকট নকল আত্মম্ভরী শহরগুলি মৃত-প্রাণের খোলস পরিত্যাগ করে।

            এইভাবে, একটি প্রাণিক হৃদয়ের বিপরীতে, এই শহরগুলি সমাজের রক্তসংবহন অবরুদ্ধ এবং তার বিনাশসাধন করে এবং মৃত্যুর পুঁজে ভরা বিষকেন্দ্র তৈরি করে। যখন কোন বস্তুগত উদ্দেশ্যে মানুষের একটি বিশাল দল একত্রিত হয়, তখন তা জনসমবায় নয় বরং অস্বাভাবিকভাবে রক্তের জমাট বাঁধা। যখন মানুষেরা একত্রে ঘনিষ্ঠ হয় এবং তবুও মানব সম্পর্কের কোনো অন্তরঙ্গ বন্ধন গড়ে ওঠে না, তখন নৈতিক পচন ঘটে। বিশ্বের যেখানেই এই আধুনিক সভ্যতা তার আধিপত্য বিস্তার করছে, সমাজের জীবননীতি, যা ব্যক্তিগত সম্পর্কেরও নীতি, সেসবের মূলে আঘাত লেগেছে।

            ধ্রুব সভ্যতাকে প্রায় সম্পূর্ণ খারিজ করার এইসব ফল যাকে পাশ্চাত্যের মানুষেরা প্রগতি বলে। আমি কখনই প্রগতির বিরুদ্ধে নই, কিন্তু যখন, এর দরুন, সভ্যতা তার আত্মা বিক্রি করতে প্রস্তুত, তখন আমি আত্মার রাজত্বে আমার ধ্রুব সভ্যতা অর্জনের আশায় আমার দৈহিক ভূতাবেশে আদিমতা বেছে নিই।

            মানুষ সামগ্রিকভাবে, গ্রামের আশ্রয়ে বাস করে, কারণ এটি তাদের প্রাকৃতিক বাসস্থান। কিন্তু মানুষের জীবিকাগুলি বিশেষ যন্ত্রপাতি এবং পরিকাঠামোর উপর নির্ভর করে। এই নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য, জীবনের প্রতিপালক সর্বজনীন প্রকৃতির বৃহত্তর অংশকে বাইরে রেখে নিজেই অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। সমস্ত সভ্যতায়, মানুষের কিছু কেন্দ্রীভূত উদ্দেশ্যে গড়া শহর এই পেশাদারিত্বের প্রতীক। অর্থাৎ মানুষের বাড়ি গ্রামে আর অফিস শহরে।

            আমরা সকলেই জানি যে অফিস স্বগৃহকে সেবা এবং সমৃদ্ধ করার জন্য, এটিকে তুচ্ছ করার জন্য নয়। কিন্তু আমরা এটাও জানি যে একজন মানুষ লালসার দ্বারা তাড়িত হলে, জুয়া খেলার মনোভাব তাকে আঁকড়িয়ে ধরে, তখন সে তার সমস্ত জীবন এবং আনন্দের স্বগৃহ ডাকাতি করে অফিসের ক্ষুধার্ত চোয়ালে ঢেলে দিতেও রাজী। কিছু সময়ের জন্য এই ধরনের একজন মানুষ উন্নতি করতে পারে, কিন্তু তার সমৃদ্ধি আনন্দের খরচায় অর্জিত হয়। তার গৃহিণী গহনার বর্ণচ্ছটায় চকমকে হয়ে উঠতে পারে, এই আর্থ-উল্লাসের পথ অন্যের ঈর্ষা জাগিয়ে তুলতে পারে, কিন্তু প্রেম এবং জীবনের সহজ আনন্দের সন্ধানে তৃষ্ণার্ত রমণীর আত্মা গোপনে শুকিয়ে যায়।

            সমাজ কেবলমাত্র বৃত্তিগুলিকে উৎসাহিত করে কারণ তারা ব্যাপকভাবে মানুষের উপকার করে। বৃত্তিগুলি যথার্থতা খুঁজে পায় যখন তারা জনগণের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু বৃত্তিগুলি, তাদের ক্ষমতাবলে বিশ্বাস করতে শুরু করে যে এগুলিকে বজায় রাখার মধ্য দিয়ে লোকেরা বেঁচে থাকে। এইভাবে আমরা প্রায়শই দেখি যে একজন আইনজীবী তার মক্কেলদের দুর্বলতা, তাদের ক্ষতির অসহায় ভয়, লাভের অসাধুতার সুযোগ নিয়ে শ্রীবৃদ্ধি লাভ করে। যখন এটি সামাজিক নৈতিকতার কোন আদর্শ দ্বারা পরিচালিত না হয়, তখন প্রতিদান-সহায়তা এবং পারিতোষিক দাবীর অনুপাত তার বৈধ সীমা হারায়।      

            শহর ও গ্রামের সম্পর্কের ক্ষেত্রে এমন নৈতিক বিকৃতি আজ চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। শহর, যা সমাজের পেশাগত দিক, ধীরে ধীরে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে যে, গ্রাম হল তার শোষণের বৈধ ক্ষেত্র, গ্রাম অবশ্যই তার নিজের জীবনের মূল্য দিয়ে আনন্দের অক্ষমতায় বৈভবের বড়াই করা শহরটিকে সমস্ত বিলাসিতা এবং বাড়াবাড়িতেও ভরণপোষণ করবে।

            সত্যিকারের আনন্দ মোটেও ব্যয়বহুল নয়, কারণ এটি সৌন্দর্য এবং জীবনের সম্পর্কের সামঞ্জস্যকারী প্রাকৃতিক উৎসের উপর নির্ভর করে। ব্যবধান তৈরি ক’রে, বিভেদ সৃষ্টি ক’রে, উচ্চাকাঙ্ক্ষা এই জীবন ও সৌন্দর্যের সম্প্রীতির বন্ধন ছিন্ন করে, তার স্বার্থ-চাহিদার পথ অনুসরণ করে। তাড়াহুড়ো করে লালসার বস্তুটি ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য এটি সমুদয় ফসলের ক্ষেতকে পায়ের নীচে মাড়াতে কোন দ্বিধা বোধ করে না। আজ তাই সমাজজীবনের অপব্যয় এবং বিপর্যয় সৃষ্টিকারী, সভ্যতার সবচেয়ে বড় শত্রু এই উচ্চাকাঙ্ক্ষা সমাজ-পরিচালনা করায়ত্ত করে নিয়েছে।

            ভারতবর্ষে আমাদের পরিবারব্যবস্থা ছিল বড় এবং জটিল, প্রতিটি পরিবারই একটি ক্ষুদ্র সমাজ। আমি এর কাম্যতার প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করতে চাই না। কিন্তু আধুনিক সভ্যতার কার্যকলাপে বর্তমান সময়ে পরিবারের দ্রুত ক্ষয় স্পষ্টভাবে ধ্বংসের নীতির প্রকৃতি ও প্রক্রিয়াকে নির্দেশ করে। যখন জীবন সহজ ছিল এবং জীবনের প্রয়োজনগুলি স্বাভাবিক ছিল, যখন স্বার্থপরতা বোধ নিয়ন্ত্রণে ছিল, তখন এই ধরনের ঘরোয়া ব্যবস্থা ছিল সম্পূর্ণ স্বাভাবিক এবং সম্পূর্ণরূপে আনন্দের জননক্ষম। পরিবারের সঙ্গতি সকলের জন্য পর্যাপ্ত ছিল এবং পরিবারের এক বা একাধিক সদস্যের পক্ষ থেকে সঙ্গতির উপর দাবী কখনোই অত্যাধিক ছিল না। কিন্তু এই ধরনের একটি দল কখনই টিকে থাকতে পারে না, যদি কোনো একজন সদস্যের ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিজের জন্য প্রয়োজনের চেয়ে বেশি কিছু পেতে আলাদাভাবে চিৎকার করতে শুরু করে। যখন ব্যক্তিগত সম্পত্তি বাড়ানোর প্রতিযোগিতা, এবং একচেটিয়া সুবিধার উপভোগ সাধারণের মঙ্গল এবং প্রাকৃত আনন্দের চেয়ে এগিয়ে যায়, তখন সম্প্রীতির বন্ধন, যা ভরণপোষণেরও বন্ধন, তাকে অবশ্যই রাস্তা ছেড়ে দিতে হবে এবং ভাইয়ে-ভাইয়ে আলাদা হতে হবে, বস্তুত আরও বেশি করে শত্রু হয়ে উঠতে হবে।

            আধুনিক সভ্যতার হৃদয়ে যে উন্মাদনা জ্বলে ওঠে তা হল, আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতের মতো, নিজস্ব স্ফীতির বিস্ফোরণের জন্য ক্রমাগত উদ্যোমী চেষ্টা করে। উৎপাদনের স্রোতে গা ভাসালে যে-কেউ পেল্লায়, অনির্দিষ্ট লাভের গভীর বিশ্বাস পেতে পারে। কিন্তু এই ধরনের প্রতিবন্ধক প্রয়োজন অবশ্যই মানুষের সৃজনশীল মনকে নষ্ট করবে। আমরা ভুলে যাই যে সৃজনশীলতা কেবলমাত্র তার নিজস্ব অভ্যন্তরীণ প্রাচুর্য থেকে উদ্ভূত সৃষ্টির কর্মশক্তি, যেটা আমাদের প্রকৃত সম্পদেও যোগ হয়। কিন্তু উৎপাদনের কর্মশক্তি ভাঁড়ার নির্মাণ ও পূরণ করার প্রক্রিয়ায় আমাদের সম্পদ গ্রাস করে। তাই আমাদের চাহিদা যা উৎপাদনকে উদ্দীপিত করে, সেগুলোকে অবশ্যই সহনীয়তার সীমা মেনে চলতে হবে। আমরা যদি চাহিদাকে বড় এবং আরও বড় উদগীরণে ঠেলে দিতে থাকি, তাহলে এর ঝলকানি নিঃসন্দেহে আমাদের দৃষ্টিকে মুগ্ধ করবে, কিন্তু এর লাভাস্রোত খরচের খাতায় জ্বলন্ত অবশেষের কালো স্তূপ রেখে যাবে।

            যখন আমাদের চাহিদা সহনীয় হয়, আমরা যে বরাদ্দ দাবি করি তা প্রকৃতির সাধারণ ভাঁড়ারকে নিঃশেষ করে দেয় না এবং আমাদের ভোগের গতি ভাঁড়ার পূরণের গতিকে অতিক্রম করে না। এই সংযম, আনন্দ আবাদ করার অবকাশ দেয়। আনন্দ যা মানব জগতের শিল্পী আত্মা, রূপের সৌন্দর্য এবং জীবনের ছন্দ তৈরি করে। কিন্তু মানুষ আজ ভুলে যেতে চায় যে নিজের মধ্যের দেবত্ব নিজের আনন্দের আলো দ্বারা প্রকাশিত হয়।

            বিসমার্কের আমলের জার্মানি গ্যেটে-এর আমলের জার্মানিকে দরিদ্র বলে মনে করত। মনে হয়, সভ্যতার আদর্শ, প্লেটোর চিন্তা বা সম্রাট অশোকের জীবন দ্বারা উজ্জ্বলিত। আধুনিক সময়ের গর্বিত সন্তানরা অগ্রগতির বর্তমান যুগকে কোটিপতি, কূটনীতিক এবং যুদ্ধ-প্রভুদের দ্বারা প্রভাবিত একটি যুগের সাথে তুলনা করে। আজকের দিনে সাধারণ ব্যবহার্য অনেক জিনিসেরই তখন অভাব ছিল। কিন্তু যারা তখন বেঁচে ছিলেন তারা কি আমাদের সময়ের তরুণ ছেলেদের কাছে করুণার শিকার হবেন, যাদের ছাপাখানা বেশি; কিন্তু অন্তরহীন?

            আমি প্রায়শই কল্পনা করি যে, চাঁদ, পৃথিবীর চেয়ে আকারে ছোট। সঙ্গী পৃথিবীর থেকে আগে তার মাটিতে প্রাণের অস্তিত্ব ছিল। একদা, তারও ছিল নিরন্তর রঙ, সঙ্গীত, কর্মচাঞ্চল্যের পার্বণ। চাঁদটির ভাঁড়ার তার বিদ্যমান সন্তানদের জন্য এবং যারা আগত তাদের জন্য খাদ্য দিয়ে পূর্ণ করা ছিল। তারপর সময়ের সাথে সাথে, কিছু জাতি সেখানে জন্মগ্রহণ করেছিল। তারা বুদ্ধিমত্তার প্রমত্ত শক্তিতে প্রতিভাধর হয়ে লোভার্তভাবে তার চারপাশকে গ্রাস করতে শুরু করল। চাঁদটি এমন প্রাণী তৈরি করেছিল, যাদের পাশব কর্মশক্তি ও বুদ্ধিমত্তার যৌথ-আধিক্যের কারণে তাদের মধ্যে ছিল কল্পনার অভাব। তাতে এই উপলব্ধি হয় যে শুধুমাত্র এই যৌথতায় সিদ্ধিলাভ হয় না। যে দখলদারী তার আড়ম্বরপূর্ণতার কারণে আনন্দের জন্ম দেয়নি; যে কর্মচাঞ্চল্য শুধুমাত্র তার দ্রুততার কারণে উন্নতি স্থাপন করতে পারেনি। তাদের উন্নতির অর্থ শুধুমাত্র সব-পাওয়ার আদর্শের সাথে সম্পর্কিত। তারা তাদের পুঞ্জীকরণ এবং দখলি স্বত্ত্ব কায়েমের জন্য প্রচণ্ড শক্তিধর যন্ত্রের মাধ্যমে তাদের স্বভাবগত ক্ষমতার এমন একটি অতিরূপ তৈরি করেছিল যে তাদের লুণ্ঠন-চরিত্র প্রকৃতির নিজস্ব আরোগ্যের ক্ষমতাকে ছাড়িয়ে গেছিল। তাদের মুনাফাখোররা প্রকৃতির সঞ্চিত-মূলধনে বড় বড় গর্ত খুঁড়ে জোর করে নিজেদের জন্য খোরাকের বন্দোবস্ত করে অস্বাভাবিক চাহিদা তৈরি করেছিল। যখন তারা সীমিত বস্তু-উপাদানের ভাঁড়ার ক্ষয় করছিল, তখন তারা সিংহভাগ বরাদ্দের জন্য নিজেদের বিভিন্ন অংশের মধ্যে প্রচণ্ড যুদ্ধ শুরু করেছিল। তাদের আকাঙ্ক্ষার প্রতিবিধানে নির্মম হওয়াকে জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের লক্ষণ হিসাবে গ্রহণ করে স্বার্থ-চরিতার্থতার অধিকারের হুড়োহুড়িতে তারা নৈতিক ধর্মকে উপহাস করেছিল। তারা জল নিঃশেষ করে ফেলেছিল, গাছ কেটে ফেলেছিল, গ্রহের পৃষ্ঠকে গর্তে ভরা মরুভূমিতে পরিণত করেছিল। তারা চাঁদটির জঠরে লুণ্ঠনের গহ্বর বানিয়ে জঠরের মূল্যবান জিনিসপত্র খালি করে দিয়েছিল। অবশেষে একদিন, আশ্রয়দায়ী ফলটির শাঁস সম্পূর্ণরূপে পোকামাকড়ের মতো খেয়ে ফেলায় চাঁদটি একটি প্রাণহীন খোসায় পরিণত হয়েছিল। জন্মদাত্রী ধরিত্রী একটি সর্বজনীন কবরখানায় পরিণত হয়েছিল।

            আমার কাল্পনিক চন্দ্রবাসীরা ঠিক সেভাবে আচরণ করেছিল যেভাবে মানুষ এই পৃথিবীতে আজ আচরণ করছে। কারণ তাদের স্বাভাবিক জীবনযাপনের পরিবর্তে, তারা তাদের সামর্থ্যকে এক ভয়ঙ্কর অমিতাচারের চূড়া পর্যন্ত প্রসারিত করে দ্রুত সঙ্গতি-ভাণ্ডারকে নিঃশেষ করে দিচ্ছে। সন্তানদের অনাময় জৈবিক চাহিদার জন্য যথেষ্ট এবং অস্বাভাবিকতার বিরলক্ষেত্রে অতিরিক্ত কিছুর জন্য ধরিত্রী মায়ের সঙ্গতি রয়েছে। কিন্তু প্রশ্রয়ীভ্রষ্ট সন্তানদের ত্বরিৎ উন্নতির জন্য গোটা পৃথিবীটাও যথেষ্ট নয়।

            আত্মভূখ মানুষ কেবল তার জীবনধারণের উপায় নয়, তার জীবনেরও কবর খোঁড়ে। মনুষ্যত্বের বেপরোয়া ক্ষয় যা উদগ্র আকাঙ্ক্ষা তৈরি করে, গ্রামগুলিতে এখন সবচেয়ে ভালভাবে দেখা যায়, যেখানে জীবনের আলো ম্লান হয়ে যাচ্ছে, জীবনের আনন্দ নিস্প্রভ হচ্ছে, সামাজিক আলাপনের স্বাভাবিক সুতোগুলি প্রতিদিন ছিন্ন হচ্ছে। সমাজের এই অসদাচরণের অঙ্গগুলিতে জীবনের রক্তের সম্পূর্ণ সঞ্চালন পুনরুদ্ধার করা আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত। কেবল ক্রীতদাসতূল্য অবস্থার পরিবর্তে; গ্রামে আরোগ্য-জ্ঞান আনতে, বেঁচে থাকার জন্য কাজ, বিশ্রাম ও আমোদপ্রমোদের অবকাশের প্রাচুর্য, যা তাদের মর্যাদা দেবে। পরস্পরের প্রতি সহানুভূতি যা তাদেরকে মানুষের সংসারের আত্মীয়তা উপলব্ধি করাবে।

            এই পৃথিবীতে নদনদী, জলাশয় এবং মহাসাগর রয়েছে। তাদের অস্তিত্ব শুধুমাত্র তাদের অঞ্চলসীমার মধ্যেই গণ্ডীবদ্ধ নয়। জলশায়ের জলের বাষ্পে মেঘের সৃষ্টি হয় এবং জলের দূরপ্রসারিত বন্টনে সাহায্য করে। শহরগুলি হল বৈভবের ঘনীকৃত আকারে সম্পদ ও জ্ঞান বহাল রাখা। কেবল তাদের নিজেদের বড় না করে, বরং সেচনের কেন্দ্রের মতো বণ্টনকে বিন্যস্ত করে সমগ্র সাধারণের সম্পত্তিকে সমৃদ্ধ করা উচিত। তাদের ল্যাম্পপোস্টের মতো হওয়া উচিত, যার আলো অবশ্যই তাদের নিজস্ব সীমা অতিক্রম করবে।

            শহর ও গ্রামের মধ্যে পারস্পরিক কল্যাণের সম্পর্ক ততদিনই মজবুত থাকতে পারে যতক্ষণ পর্যন্ত সমাজে সহযোগিতা ও আত্মনিবেদনের মনোভাবের একটি প্রাণিক আদর্শ থাকে। যখন কিছু সর্বব্যাপী প্রলোভন এই আদর্শকে অতিক্রম করে, যখন স্বার্থপর-প্রবণতা উচ্চতা লাভ করে, তখন একটি গভীর খাদ তৈরি হয় এবং শহর ও গ্রামের মধ্যেকার ফাটল বিস্তৃত হতে থাকে; তখন শহর ও গ্রামের পারস্পরিক সম্পর্ক হয়ে ওঠে শোষক ও শিকারের। এটি এমন এক ধরনের বিকৃতি যেখানে রাষ্ট্র শত্রু হয়ে ওঠে এবং যার অবসান মৃত্যুতে।

            ভারতবর্ষে আমরা আমাদের বিশ্বভারতীতে, গ্রাম পুনর্গঠনের কাজ শুরু করেছি, যার লক্ষ্য হল গণ-আত্মহত্যার এই প্রক্রিয়াটিকে প্রতিহত করা। আমি যদি আপনাদের আমাদের কাজের বিবরণ দেওয়ার চেষ্টা করি তবে সেগুলি সামান্য আকারের। কিন্তু আমরা সামান্যতায় শঙ্কিত নই, কারণ আমাদের জীবনে প্রত্যয় আছে। আমরা জানি যে যদি একটি বীজ হিসাবে এটি আমাদের মধ্যে থাকা সত্যকে চিত্রিত করে তবে এটি বিরুদ্ধতাকে অতিক্রম করবে এবং স্থান ও সময়কে জয় করবে। আমাদের মতে, দারিদ্র্য গুরুতর সমস্যা নয়, অসুখীতার সমস্যাই বড় সমস্যা। সম্পদ, যা দ্রব্যসামগ্রীর উৎপাদন এবং সংগ্রহের সমার্থক। মানুষেরা যেগুলো নির্মমভাবে ব্যবহার করে উন্নতি করতে পারে। তারা পৃথিবী থেকে জীবনকে গুঁড়িয়ে দিতে পারে। কিন্তু, সুখ, স্থূল দ্রব্যের তালিকা ধরে সম্পদের সাথে প্রতিযোগিতা করতে পারে না। আনন্দ হল পরম, এটি সৃজনশীল; তাই আনন্দের নিজের মধ্যেই নিজের সম্পদের উৎস রয়েছে।

            গ্রাম্য জীবনের অবরুদ্ধ জমিকে আনন্দধারায় প্লাবিত করার চেষ্টা করাই আমাদের উদ্দেশ্য। এর জন্য পণ্ডিত, কবি, সঙ্গীতজ্ঞ, শিল্পীদের সহযোগিতা করতে হবে, তাদের অবদান রাখতে হবে। অন্যথায় অপরের জীবনীশক্তি শুষে নিয়ে এবং তাদের কিছুই ফিরিয়ে না দিয়ে, পরজীবীর মতো জীবনযাপন করতে হবে। এই ধরনের শোষণ ধীরে ধীরে জীবনমৃত্তিকা নিঃশেষ করে দেয়। যা ক্রমাগত জীবনে ফিরে আসার মাধ্যমে, দেয়ানেয়ার চক্রের সমাপ্তির মাধ্যমে পুনঃপূরণের প্রয়োজন।           

            আমাদের অধিকাংশ, যারা দারিদ্র্য-সমস্যা মোকাবেলা করার চেষ্টা করে, তারা উৎপাদন বৃদ্ধির নিবিড় প্রচেষ্টা ছাড়া আর কিছুই করে না। আমরা ভুলে যাই যে এর অর্থ কেবলমাত্র স্থূলত্বের পাশাপাশি মানবতার পরম গ্লানি। এর অর্থ কেবলমাত্র অনেকের মূল্যে কয়েকজনকে লাভের ফলাও সুযোগ দেওয়া। দারিদ্র-সমস্যা মোকাবিলা টাকাকড়ির বিষয় নয় বরং খাদ্যের পুষ্টিবিধান। এটি টাকার থলি ভরানোর বদলে জীবনের পূর্ণতা যা মানুষকে সুখী করে। উৎপাদন বৃদ্ধির প্রচেষ্টা, গুণগত উপাদান যাদের আছে এবং যাদের নেই তাদের মধ্যে অসমতাকে তীব্র করে এবং এটি সমাজব্যবস্থায় রক্তক্ষরণের মারাত্মক একটি ক্ষত তৈরি করে, যার ফলে পুরো শরীর শেষ পর্যন্ত মৃত্যুমুখে পতিত হয়।

 

১৯২৪

           

0 Comments
Leave a reply