সুবিমল মিশ্র-এর ‘সত্য উৎপাদিত হয়’: একটি পাঠবৃত্তান্ত

লিখেছেন:বিপ্লব নায়ক
১৯৭১-এর 'হারান মাঝির বিধবা বউয়ের মড়া বা সোনার গান্ধীমূর্তি' থেকে ২০০৬-এর 'অন্তিম বই: অন্তিম যাত্রা' অবধি সুবিমল মিশ্র নিজের বই নিজেই প্রকাশ করেছেন, মোটবাহক হয়ে বয়ে নিয়ে বেরিয়ে নিজেই বিক্রি করেছেন। পাঠকের সংস্পর্শে আসতে চেয়েছেন, কিন্তু অর্ধমনস্ক বিনোদনসন্ধানী পাঠকদের এড়িয়ে চলেছেন। তাঁর হয়তো পাঠক গুটিকতক, যত দিন গেছে পাঠকের সংখ্যাও সংকুচিত হয়েছে, কিন্তু যারা সুবিমল মিশ্রের পাঠক তারা অবাক বিস্ময়ে দেখেছে এই নিরন্তর বিদ্রোহীর নিরন্তর বিদ্রোহযাত্রা। তাঁর একটি বইয়ের পাঠঅভিজ্ঞতা এখানে হাজির করা হলো।

 

সুবিমল মিশ্রের ‘সত্য উৎপাদিত হয়’ বইটি ১৯৯৭ সালের জানুয়ারি মাসে প্রকাশিত হয়েছিল। ১১২ পাতার কৃশতনু বই, বোর্ড বাঁধাই। সুবিমল মিশ্রের আগের বইগুলোর মতোই প্রকাশক ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’, অর্থাৎ লেখক নিজেই প্রকাশক। আমার বয়স তখন বছর ছাব্বিশ, সুবিমল মিশ্রের প্রথম বই ‘হারাণ মাঝির বিধবা বৌয়ের মড়া বা সোনার গান্ধীমূর্তি’ যে বছর প্রকাশিত হয়েছিল সেই বছরেই তার কয়েক মাস পরে আমার জন্ম। যাই হোক, সেই অতি অর্বাচীন তরুণটি তখন সুবিমল মিশ্রের পাঠক হয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। সেই বছরই ‘সত্য উৎপাদিত হয়’ প্রথম পড়ি। গোটা বইটি তখন হজম করে উঠতে পারিনি, তবে বইটির প্রথম আঠারো পাতা পাঠের একটি আখ্যান তখন আমি লিখে ফেলেছিলাম, যা ১৯৯৮ সালে প্রকাশিত ‘অ-য়ে অজগর’ পত্রিকার সুবিলম মিশ্র সংখ্যায় অন্তর্ভুক্ত আমার লেখার মধ্যে ঢুকে গিয়েছিল। আজ ২৭ বছর পরে আবার বইটির পাঠ-অভিজ্ঞতা লিখতে বসেছি। এই ২৭ বছরে আরো একাধিকবার পড়ার মধ্য দিয়ে হজম-রোমন্থন প্রক্রিয়া যা চলেছে তা প্রকাশ করাই অভিপ্রায় বটে। ওই প্রথম আঠারো পাতা দিয়েই আবার শুরু করা যাক।

‘সত্য উৎপাদিত হয়’-এর প্রথম ১৮ পৃষ্ঠা: পাঠ‍্যপরিসরের স্থাপত্য

‘হয়তো গল্প হয়তো উপন্যাস হয়তো উপন্যাসের মৃত্যুও’ (পৃঃ১)--- শব্দগুলোর পারস্পরিক বিন্যাস তুলনীয় সিনেমার প্রারম্ভে শটগুচ্ছের ‘র‍্যাপিড কাট’-এর সঙ্গে। একদম শেষে লেখকের ‘ব্যক্তিগত টাচ’--- ত্য-র নিচে লাল কালিতে হাতে-লেখা উ-কার দিয়ে মৃত্যুকে সম্পূর্ণ করা। ‘হয়তো গল্প হয়তো উপন্যাস হয়তো উপন্যাসের মৃত্যুও’--- কীভাবে শব্দগুলো সূত্রবদ্ধ হয় আমাদের কাছে?  ‘হয়তো’ শব্দের অর্থ Set Theory-র ভাষায় ‘যোগ’ (union) ধরতে পারি কি? নাকি তা ‘ছেদ’ (intersection)? ‘যোগ’ হলে তা অবিশেষীকৃত পাঠ্যবস্তুর দিকে নিয়ে যায়। আবার, ‘গল্প’, ‘উপন্যাস’, ‘উপন্যাসের মৃত্যু’--- এদের সাধারণভাবে পরস্পর-অচ্ছেদী (mutually exclusive) বলে গণ্য করলে, তাদের ছেদ মানে null/ vacuum। সুতরাং যে গূঢ়ৈষা পাঠকমনে তৈরি হয়, তা এরকম: ‘vacuum নাকি অবিশেষীকৃত সাধারণ?’ ‘vacuum এবং অবিশেষীকৃত সাধারণ?’

পরের পাতায় (পৃঃ২) গভীরতর হয় দ্বন্দ্বময়তা:

BEAUTY

VACUUM

DESTRUCTIVE

SPACE

 

 

Beauty ⇋ VACUUM সম্পর্ক নির্দিষ্ট হচ্ছে, একইসঙ্গে নির্দিষ্ট হচ্ছে DESTRUCTIVE ⇋ SPace সম্পর্ক। পাঠক প্ররোচিত হচ্ছে VACUUM, BEAUTY, DESTRUCTIVE, SPACE সমস্তগুলোকেই নিজ বিশ্লেষণপ্রক্রিয়ায় সংজ্ঞায়িত করে নেওয়ার জন্য, ঢুকে পড়ছে পরবর্তী গদ্যটুকরোগুলোয়--- যাদের বিন্যাস চকিত কাট-এ গ্রথিত। এখানে এক একটি গদ্যাংশের পর বিস্তৃত সাদা পাতা--- পাঠককে দেওয়া পাচক-দেশ-কাল: শূন্য সাদা দেশ-কালে দৃষ্টি ডুবিয়ে ভাবো: Is Beauty Destructive? Is Vacuum Space?--- ভাবনাগুলো ধীরে ধীরে তোমায় দখল করে নিক।

আবার শূন্যতা ও ফাঁকা, Vacuum, এক জিনিস নয়, কেননা শূন্যতা যা আছে তার চাইতে কিছু কম হতে পারে না। যখন কোনো কিছু ফাঁকা হয় তখন তাকে ঘিরে থাকে স্থান, SPACE। কিন্তু স্থান ছাড়াও শূন্যতার অস্তিত্ব আছে, আর সেটাই বড় কথা। (পৃঃ৪)

VACUUM, শূন্যতা যেন সংজ্ঞায়িত হলো বিমূর্তভাবে। এখানে গণিতের একটি বিমূর্তায়নের সঙ্গে তুলনা করা যাক। দ্বিমাত্রিক জটিল সংখ্যার তল (Complex Plane)-এর একটি বিশেষ বিন্দুকে ধরা যাক। বিন্দুটি একটি singular point:

Let D be an open circular disc, suppose f∈H(D), the set of all holomorphic functions defined on D, and let β be a regular point of ‘f’ if there exists a disc with centre at β and a function g∈H(D1) such that g(z)=f(z) for all z∈ D∩D1. Any boundary point of D which is not a regular point of f is called a singular point of f.

Set of holomorphic functions (analytic functions): এই functions-গুলি সমস্ত বিন্দুতে continuously differentiable, সেই হিসেবে এগুলিকে ধরতে পারি প্রভাব-বিস্তারকারী স্থিতিস্থাপকতার (সামগ্রিকভাবে গোটা system-এর স্থিতিস্থাপকতার) পক্ষের সামাজিক সম্পর্কগুলোর বিমূর্তায়ন রূপে।

Boundary Points: যে সমস্ত বিন্দুর চারদিকে যে কোনো ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ক্ষেত্রও বিস্তারটির বাইরের কোনো না কোনো (অন্তত একটা) বিন্দু ধারণ করবেই। D দেশ (space)-এর মধ্যে বর্ণিত সম্পর্কের (H(D)-এর) কাছে বিস্তারটির বাইরের যে কোনো বিন্দু/বিন্দুসমষ্টি/দেশ (space) নেবে শূন্যতা (vacuum)-এর তাৎপর্য। প্রতিটি boundary point শূন্যতার গা ঘেঁষাঘেষি করে দাঁড়ানো, তাকে কেন্দ্র করে যে কোনো ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র disc/বলয় শূন্যতার দ্বারা স্পন্দিত। কিন্তু এই শূন্যতা কি বিস্ফোরক নাকি বিস্ফোরক নয়?

যখন কোনো কিছু ফাঁকা হয়, তখন তাকে ঘিরে থাকে স্থান, space। কিন্তু স্থান ছাড়াও শূন্যতার অস্তিত্ব আছে আর সেটাই বড় কথা। (পৃঃ৪)

Regular point: এর চারদিকে অন্তত একটি disc/বলয় বর্তমান যেখানে সম্পর্ককে (g(z)-কে) এমনভাবে বর্ণিত করা যায় যাতে তা D-এর প্রভাববিস্তারকারী সম্পর্কের সঙ্গে মিলে যেতে পারে (f(z)=g(z) ∀z∈D∩D1); অর্থাৎ, এই বিন্দুর neighbourhood-এ স্পন্দিত শূন্যতাকে ঘিরে আছে স্থান, space; অর্থাৎ, এই বিন্দুকে স্পর্শ করে থাকা শূন্যতা আসলে D-এর প্রভাববিস্তারকারী স্থিতিস্থাপকতার পক্ষের সামাজিক সম্পর্কগুলোর কাছে আত্মসমর্পণকারী, বিস্ফোরক নয়।

Singular Point: এর চারদিকে কোনো একটি disc/বলয়ও গড়া যাবে না যেখানে এমন কোনো সম্পর্ক বর্ণনা করা যায় যা D-এর প্রভাববিস্তারকারী স্থিতিস্থাপকতার পক্ষের সামাজিক সম্পর্কগুলোর সঙ্গে মিলে যায় (identical হয় বা resonate করে); অর্থাৎ, এই বিন্দুকে স্পর্শ করে থাকা শূন্যতা আসলে D-এর সম্পর্কগুলোকে ধ্বংস করে, নিজ মধ্যে ধারণ করে:

দৈর্ঘ্যপ্রস্থহীন কোটি কোটি প্রাণবিন্দু সৃষ্টির মূল, তার অবস্থান এক সমকৌণিক ত্রিভুজের কেন্দ্রে, দুটি দুটি চারটি পা, দুই বিপরীতমুখী ত্রিভুজের সংযোগে সৃষ্টি হয়েছে একটি ক্ষেত্র, তার ছয় দিক--- সবই যেন একই মূল বিন্দু থেকে উৎসারিত এবং বিবর্তিত: তারপর তার আরও বিস্তার চতুর্বিংশতি কোণবিশিষ্ট। চারদিকে তখন তার পদ্মরেখার বিশাল আবর্ত, ঘুর্ণি ভূব্রক্ষ্মাণ্ড ঘিরে শূন্যময় শুধু প্রাণ আর প্রাণ, শূন্য থেকে যার উৎপত্তি, সেই প্রাণবিন্দুর, অনন্ত মহাকাশে তার পরম ব্যাপ্তি, যন্ত্ররেখায়, রূপকুণ্ডে, উত্তাল উন্মাদিনী বেগবতী গংগার বহে যাওয়াকে যা স্তম্ভিত করে। তবে কি মানুষ এই জল থেকে শক্তি সংগ্রহ করতে আসে? টৈ টম্বুর নদী থেকে জল নিয়ে পুকুরে পুকুরে ফেলা হয়, জলে জলে জলসংযোগ, প্রাণ, কদম্বপুষ্পা। (পৃঃ১৫)

শূন্যতাকে ধারণ করে থাকা এক সৃষ্টির উচ্ছ্বাস, শূন্যতা যা বিস্ফোরক কারণ তা ধ্বংস করছে/করেছে সমাজের প্রভাববিস্তারকারী/ স্থিতিস্থাপকতার পক্ষের শক্তিগুলোকে এবং এই বিন্দুতে অবস্থানরত/ অভিমুখী discourse লেখক চান নিজ অভ্যন্তরে, পাঠকের সঙ্গে, পাঠকের অভ্যন্তরে:

এতদিনে আমি আমার সর্বশেষ রাত-পোষাকটি খুলে ফেলেছি, খুলে ফেলতে পেরেছি জন্মদিনের পোষাকটিও, কালোগর্তের অসহ্যতায় এখন আমি আমাকে মিশিয়ে ফেলতে চাই। এবার লক্ষ্মিটি ঘুমোও, মিছিমিছি কেন কষ্ট পাচ্ছ। শ্মশানবন্ধুরা সবাই এসে গেছে। বিশ্বাস করো, হারিয়ে যাওয়ার তো কোনো শ্রেণিচরিত্র নেই, তৈরি হয়নি এখনও। (পৃঃ৩)

শ্রেণিবিভক্ত সমাজে মধ্যবিত্ত অবস্থানজনিত দোদুল্যমানতা, অস্পষ্টতা, ক্লেদ, গা-বাঁচানো দূরত্বরক্ষা এই সবের মধ্য থেকে লেখক নিজেকে, পাঠককে টেনে নিয়ে যেতে চাইছেন কোথায়--- এক ধ্বংসাত্মক প্রায়-pagan উপচারের মধ্য দিয়ে মৃত্যুসম আদিম এক বিলীয়মানতায় (জর্জ বাতাই-ও মৃত্যুকে এভাবে ভেবেছিলেন না?), সে বিলীয়মানতার অরূপকুণ্ডে প্রসারমাণ প্রাণবিন্দুটির নিরাভরণতায় হারিয়ে যেতে--- যে হারিয়ে যাওয়ার শ্রেণিচরিত্র ‘তৈরি হয়নি এখনও’। বুর্জোয়া অস্তিত্বশিল্প এই লক্ষ্য নিতে পারে না। বুর্জোয়া শিল্পের তাগিদ হলো আত্মসম্পূর্ণতা, বিচ্ছিন্নতার মধ্য দিয়ে স্বাতন্ত্র্য নির্মাণ, নিখুঁত চেহারা ও প্রভা (আধিপত্যকারী স্থিতিস্থাপকতার মতবাদে যা জারিত) এবং সেই হিসেবে সফলতা। তার বিপরীতে, সুবিমল মিশ্রের ‘সত্য উৎপাদিত হয়’ সংকল্প ঘোষণা করছে নিজের অসফল হওয়ার বীজ নিজের মধ্যেই বহন করার; নিখুঁত চেহারা, বিচ্ছিন্নতা দিয়ে তৈরি আত্মসম্পূর্ণতাকে সে ধ্বংস করতে চাইছে। অসফল হওয়ার বীজ নিজের মধ্যেই বহন করার মানে কী? অসফল হওয়ার মানে হলো এই যে ছকবাঁধা লক্ষ্যে পৌঁছে যাওয়া (বা, অন্যভাবে বললে, এমনকিছুকেই লক্ষ্য ঠিক করা যাতে এখনই আমরা পৌঁছে আছি বা যা এখন পৌঁছে থাকা অবস্থার এপিঠ-ওপিঠ)-য় এই শিল্প সচেতনভাবেই নিজেকে ব্যর্থ করতে চায়। তার যাত্রাপথ বুঝি কোনোকিছুকেই তার চূড়ান্ত লক্ষ্য বলে মেনে নেয় না, অথবা, তার কল্পলক্ষ্যটাও তার যাত্রার অভিঘাতে বদলাতে থাকে। যাত্রাপথটিকেই সে তৈরি করতে করতে যায় আর বিফলতাগুলো থেকে শুরু হয় আরো বহু যাত্রাপথের ইশারা, নিজেকে নিজে আক্রমণ করার আরো বিবিধ কৌশল। Is Beauty Destructive? Is Vacuum Space?

এক-একজন মানুষের পেছনে কতো যে ব্যক্তিগত ব্যর্থতা থাকে! আর এটা যখন সে বুঝে উঠতে পারে তখন অনেক দেরি হয়ে যায় …      অনেকটা… (পৃঃ ৭)

কাঠামোর এই বিমূর্তায়নে ধীরে ধীরে অস্থিমজ্জা সংযোজিত হয়ে মূর্ত হয়ে উঠতে থাকে singular point-এর দিকে ঠেলে নিয়ে যাওয়া, vacuum গঠনের প্রক্রিয়া:

যদি ধরে নেওয়া যায় মনুষ্যজন্মের পর ক ও খ, নীতি ও অনীতি, একে অন্যের থেকে চলে গেছে অনেক অনেক দূরে--- কয়েক আলোকবর্ষ--- তা হলে কী দাঁড়ায়? যদি বলা হয় খ-এর অবস্থানবিন্দু স্থির করতে গিয়েই স্পষ্ট হলো ক-এর অবস্থান--- মানে, দ্বিতীয়টা না থাকলে প্রথমটা থেকে যেতো অস্পষ্টই--- তা হলে মানতে হবে যে খ প্রভাবিত করছে ক-কে। খ-এর প্রভাব ক-তে পৌঁছচ্ছে বিনা সময়ে, এটা মানা যায় না, কেননা সময় ছাড়া অবশিষ্ট আর কী-ই বা আছে এই ভূব্রক্ষ্মাণ্ডে, আবার সময় নেইও। তা হলে সময়ই কি অবস্থান, অবস্থানই কি সময়, ক খ কি একই সমপাত-বিন্দু--- একই কালরেখা? (পৃঃ৮)

(১) নীতি= f (অনীতি) [ক= f (খ)]

(২) নীতি-র নেতিকরণ= অনীতি [ক-এর নেতিকরণ= খ]

(১) ও (২) দুটিকেই সত্য বলে ধরে নিয়ে এবার যদি আমরা পরমসত্য (‘The Truth’)-র জন্য (১) ও (২)-এর ছেদ (intersection) নিই তাহলে কোথায় পৌঁছাবো?

(১) অনুযায়ী, অনীতির অস্তিত্ব না থাকলে নীতি অস্তিত্বহীন,

(২) অনুযায়ী, নীতির অস্তিত্ব না থাকলে অনীতি অস্তিত্বহীন।

সুতরাং (১) ও (২)-এর ছেদ করে পাই, নীতি≡অনীতি, নীতি identical to অনীতি, আর তা হতে পারে যখন নীতি ও অনীতি একই সমপাত-বিন্দু, বিন্দু অর্থে মাত্রাহীনতা অর্থে vacuum/শূন্যতা, হয়তো বা নীতি-অনীতিকে উৎক্রমণ করে যাওয়া এক সংশ্লেষ।

তখন, সময় হয়ে দাঁড়ায় শূন্যতার মধ্যের একটি মাত্রা, আবার তা সমস্ত মাত্রাকে ধারণ করে থাকা প্রাণবিন্দুর মধ্যে লীন।

এভাবে সৃষ্টি হয় vacuum/শূন্যতা-র একটি সাধারণ রূপ, এমন একটি singular point ফুটে ওঠে যার আওতায় আধিপত্যকারী একরৈখিক মতবাদিক নির্ধারণগুলো আর অটুট থাকে না, বিস্ফোরণের সূত্র খোঁজা হয়ে চলে:

পরনে তেল-চিটচিটে ইজের, কারো কারো গায়ে বেঢপ-সাইজের রঙ-ওঠা গেঞ্জি, ধূলি-ধূসরিত চেহারার কয়েকটা ফুটপাথ-ঝুপড়ির বাচ্চা নিজেদের কাগজ-কুড়নো চটের বস্তা নামিয়ে রেখে একটা অপরিসর স্যাঁতস্যাতে প্রায়ান্ধকার অন্ধগলিতে ডাস্টবিন থেকে পাওয়া একটিমাত্র টেনিস বল নিয়ে প্রবল উৎসাহে লোফালুফি করছে। এই উদ্দীপনা কি বছর দশেক পরে সভ্যতা-ঘাতী হিংসায় পরিণত হবে, কমপিউটার ভাইরাস? (পৃঃ৯)

Singular point-টি (লেখক নিজের ও পাঠকের স্থিতসত্তাকে সেই বিন্দুর দিকে ঠেলে নিয়ে যেতে চাইছেন) কেন্দ্র করে যে কোনো disc/বলয় হয়ে ওঠে বিস্ফোরণের কেন্দ্র, পরিকল্পিত হিংসা, যা অধঃপতিত স্থিতসত্তাকে ধ্বংস করতে চায়। পরোক্ষ ও প্রতিফলিত ‘is beauty destructive’ (পৃঃ ৫) প্রত্যক্ষ ও আক্রমণাত্মক হয়ে উঠে (পৃঃ ১১) ক্রমে গূঢ়ৈষায় বিলীন হয়ে যেতে থাকে (পৃঃ ১৭)।

পাঠে প্রবেশ: কৃষ্ণগহ্বরমুখী যাত্রা

Singular point অভিমুখে ঠেলে-যাওয়া যাত্রাপথে খননকার্য, ধ্বংসকার্য, ধ্বস-ধুলোয় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসা, জিভ শুকিয়ে যাওয়া আবার তাজা হাওয়ার ঝাপটায় চমকে ওঠা চলতে থাকে, চলতেই থাকে, নানা স্তরে, যেমন:

স্তর ১। ভাষা:

… আবার ভাষা যখন স্ল্যাং-নির্ভর হয়ে ওঠে, যা-বলতে-চাই-না বলতে গেলেই অক্ষর জড়িয়ে আসে, আপন অস্তিত্বেই দুর্বোধ্য হয়ে যায়। সনাতনপন্থী MIND YOUR LANGUAGE প্রচণ্ড চিৎকার করতে করতে বধ্যভূমিতে ফেটে পড়ে, ইস্পাত-দৃঢ় তার শরীর, যতো চেঁচায় ততো তার রোখ বাড়ে, কিন্তু কেউ শোনে না, কেউই না, অবশ হয়ে পড়ে থাকে অবশিষ্ট দু-একটি শব্দ, হাত-পা কাটা। অবশেষে দেখা যায় তা নেই, MIND YOUR LANGUAGE নেই, কেউ আর চিৎকার করছে না, শেষ কয়েক পৃষ্ঠায় সে অস্তিত্বহীন। আর এসব করতে গিয়ে আমার কোনো ছুঁত মার্গ নেই, আমি কোনো ভাষা জানি না, মাতৃভাষাটাও না, …শুধুমাত্র কথা বলা বইপড়া শিখলে কি আদৌ ভাষা শেখা বোঝায়? …কাজ করতে গিয়ে তাবৎ ভাষায় আমার অধিকার, এযাবৎ সৃষ্ট সমস্ত ভাষা সমস্ত ক্যালিগ্রাফি ঘেঁটেঘুঁটে দেখতে চাই, কোন ভাষায় করছি সেটা আমার কাছে অবান্তর প্রশ্ন। অক্ষর-এর ভেতর দিয়ে--- অন্যভাবে বললে যা আসলে প্যাটার্ন, আবার শুধুমাত্র প্যাটার্ন নয়ও--- ভাষাটা ক্রমশ, ক্রমশই আবিষ্কৃত হতে থাকে। সুন্দর পরিমিত আধ-খোলা আধ-ঘোমটা দেওয়া সৌখিন ভাষা দিয়ে, যাকে ভাষার রহস্য বলা হয়, শেষ-স্পর্শভূমি স্পর্শ করে গেছে, ইতিমধ্যেই, রহস্য আর রহস্য নেই এখন, বাণিজ্যযুগে ভাষার রহস্যময়তাও পণ্য, আর পণ্যধর্মিতায় আর যাই থাক কোনো রহস্য থাকে না, অরুন্ধতী বলে: তোমাদের বাংলা ভাষা তো অ্যাডলোসেন্ট-পিরিয়ডই কাটিয়ে উঠতে পারলো না এ পর্যন্ত। ভাষাসুর কমলকুমার মজুমদারকে প্রণাম জানিয়ে রেখে নতুন করে শুরু করি আমি, প্ররোচিত হই, প্ররোচিত হতে চাই। (পৃঃ১৪)

কথা নিয়ে/দিয়ে উদ্দেশ্যমূলক ক্রিয়ার অভিপ্রায় যে গর্ভ তৈরি করে, সেই গর্ভের অন্তর্গত জলে ভাষাব্যবস্থার ভ্রূণাবস্থা থেকে পূর্ণ রূপ গ্রহণের খেলা চলে। সে উদ্দেশ্যমূলক ক্রিয়া কেমন? তা কি সচেতনতা-চালিত? না তা নয়। বাচন/লিখন মূলত উদ্দেশ্যমূলক ক্রিয়া। কিন্তু বাচন/লিখন-এর ভাষা নির্মাণ বা ভাষা বাছাই বক্তার সচেতনতা-প্রযুক্ত ক্রিয়ার সীমায় বদ্ধ থাকে না, সে সীমা ছাড়িয়ে বহুদূর ছড়িয়ে যায়। ভাষারূপের অর্থ-নির্দিষ্ট অবয়ব-দৃঢ়তা বক্তার বাচন তৈরি করে না, বাচন তৈরি হয় বক্তার অভিপ্রায়-তাড়িত তাৎক্ষণিকতার স্ফূরণের (কখনো বা বিস্ফোরণের) মধ্য দিয়ে। বক্তার স্থিতসত্তাবস্থার বিশেষত্ব, যার একটা অংশমাত্রই তার সচেতনতায় ধারিত, তার মধ্য দিয়েই এই তাৎক্ষণিকতার স্ফূরণ। ফলে ভাষার কোনো ভাষাতাত্ত্বিক নির্দিষ্ট-নির্মিত-রূপ বাচন/লিখনের স্থায়ী কাঠামো হতে পারে না। বাচন/লিখন গড়ে ওঠে ভাষাচিহ্নকে পরিবর্তনশীল করে নিয়ে, পরিবর্তনশীল অবস্থান-পরিস্থিতির সাপেক্ষে অভিযোজনীয় করে নিয়ে।

দ্যোতক (signifier) ও দ্যোতিত (signified)-র মধ্যে একটি সম্পর্ক গড়ে তোলা যদি ভাষানির্মাণের প্রাথমিক অভিপ্রায় হয়, তবে সেই দ্যোতনাকর্ম কখনোই নির্ভার নয়, তা বহন করে নিয়ে চলে ন্যায়-নৈতিকতা-শালীনতা-প্রসূত মূল্যারোপী অবধারণার বিস্তর বোঝা। কখনো কখনো সেই বোঝাগুলোর আবরণ দানা বেঁধে শক্ত হয়ে এমনই অস্বচ্ছ হয়ে ওঠে যে কেবল সেই আবরণটাকেই দেখা যায় দ্যোতিতকে আর দেখা যায় না। আর এভাবেই ভাষারূপ দ্যোতকচিহ্নগুলো নিজস্ব এক দৃঢ় নৈতিক কাঠামো নির্মাণ করে দ্যোতিতদের তার অধীনস্থ করে নেয়। এই কাঠামো অনুসরণ করে যাওয়া মানে আধিপত্যবাদী সেই মূল্যারোপী অবধারণার বোঝা বয়ে চলা যা বহু দ্যোতিতকে দ্যোতনাকর্মের ওপারে অন্ধকারে ঠেলে রেখে দিয়েছে আর দ্যোতকচিহ্নের ন্যায়তন্ত্র গড়ে তুলেছে। বাচন/লিখন-এর মধ্য দিয়ে কেউ যদি এই আধিপত্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে দ্যোতনাকর্মের নিবিড় সমালোচনার মধ্য দিয়ে দ্যোতিতকে নতুন করে প্রকাশ করতে চায়, তাহলে ভাষা দিয়ে নয়, ভাষা ভেঙে তাকে সে কাজ করতে হয়। লেখক হিসেবে সুবিমল মিশ্র এই কাজটিই করণীয় বলে গ্রহণ করেছেন, তাই:

তার যা কিছু সমস্যা তা সবই বিচারবুদ্ধির আড়ালে এতো দূরে নয়তো বিচারবুদ্ধি পেরিয়ে এতো কাছে যে সে ভাষা দিয়ে কিছুই প্রকাশ করতে পারে না। সে তখন নিজের মধ্যেই ক্রমশ সেঁধিয়ে যায়, সেঁধিয়ে যেতে শুরু করে। আর সে মনে করে তার এই অবস্থার জন্য দায়ী এমন এক ব্যবস্থা যে তার বিষয়ে সম্পূর্ণ উদাসীন এবং তাকে ওই নীরবতার মধ্যেই নির্বাসিত করে নিশ্চিন্ত। বারবার নীরবতা আসে কথার পরিপূরক হিসেবে, কথার ফাঁকে ফাঁকে। যখন কথা বলে তখনও কি সবসময় তা কথা থাকে? নাকি কেবল শব্দোচ্চারণ, অর্থহীন জান্তব ধ্বনিমাত্র? ছোটো ছোটো গরমিলগুলো অতিকায় আকার নেয়, তখন যেন না-বলা-কথা-ই নীরবতার একটা বাণী হয়ে ওঠে। আর বাকি অংশটা কথার পিঠে কথা, ছাড়া-ছাড়া কথা, কখনওই যেন পরম্পরার কোনো কথা নয়, কথা থেকে কথা নয়। (পৃঃ৬৪)

ভাষাকে ভাঙা ছাড়া তাই সুবিমল মিশ্রের উপায় নেই। প্রত্নতত্ত্ববিদের মতো ভাঙেন, শল্যবিদের মতো ভাঙেন, কখনও বা নিপাট হত্যাকারীর মতো ছুরি চালিয়ে দেন। সংবাদপত্র-রীতির গদ্যের মামুলিপনার মধ্যে হঠাৎই তীব্র আবেগের বিস্ফোরণ ঘটায় স্ল্যাং শব্দ, স্ল্যাং বাক্য (বিশেষ করে এপিসোড ১ এবং এপিসোড ৫ দ্রষ্টব্য)। আবার এপিসোড ২-এ ধ্রুপদী আঙ্গিকের সাহিত্যিক স্বাদু ভাষা যেন গভীর অতল কুয়োর মতো ভাবনার বহু প্রতিধ্বনি ফিরিয়ে ফিরিয়ে দিয়ে এক অনৈতিহাসিক একতান তৈরি করে--- যমের মুখে পড়ে খ্রিস্টের ছায়া, বৈদিক পুরাকালের দেহে ফুটে ওঠে খৃস্ট ধর্মের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের যুগের আভাস। যৌন-শালীনতা ভেঙে যৌনমিলন-কালীন একে অপরের প্রতি উক্তি-উচ্ছ্বাস উঠে আসতে থাকে লিখিত ভাষ্যে (বিশেষ করে এপিসোড ৫-এ), তবু যেন শেষ অবধি যেতে পারে না, কখনও অক্ষমতায় ভেঙে পড়তে থাকে সনাতনবাদী MIND YOUR LANGUAGE-এর ভ্রূকুটির সামনে, কখনও জড়িয়ে যায় অবোধ্যতায় (ত্রত্নট্রট্রড্রত্রত্নট্রট্রড্রত্রত্নট্রট্রড্রত্রত্নট্রট্রড্রত্রত্নট্রট্রড্রত্রত্নট্রট্রড্র: পৃঃ ৮৪ এবং আরো একাধিক জায়গায়), আবার কখনও ড্যানিশ ভাষায় রূপান্তরিত হয়ে যেন বাংলায় অকথ্য হওয়ার দায় এড়ায় (যেমন, পৃঃ ৮৭-তে আছে: ‘de to teenager fär den ene udlosning efter den anden. mere-mere stonner MITA ja-sädan er det godt-skoont, jeg vil bade I din kneppesauce, jeg vil drikke den, kom nu med den herlige saft.’ ড্যানিশ ভাষার এই অংশটিকে বাংলা করলে হয় এরকম: ‘ওই দুজন সদ্যতরুণ-সদ্যতরুণী যৌনমিলনে একের পর এক বীজস্খলন ঘটিয়ে চলেছিল। মিতা আরো বেশি বেশি করে ককিয়ে উঠছিল: হ্যাঁ--- এবার দারুণ হয়েছে--- দারুণ, আমি তোমার চোদনরসে স্নান করতে চাই, পান করতে চাই, ওই সুস্বাদু রস বের করো আরো, আরো…’)। আর তারপর শব্দ ভাঙতে থাকে অক্ষরে, অক্ষর এর স্বরাট চিহ্ন হয়ে ক্যালিগ্রাফিক উপাদান হয়ে ওঠে।

স্তর ২। যৌনতা নিয়ে, যৌনতা দিয়ে, যৌনতা বিষয়ে:

এপিসোড ৩ এবং এপিসোড ৪-এ গদ্যের মধ্যে অন্তর্প্রবিষ্ট দুটি বিচ্ছিন্ন প্রবন্ধ-টুকরোকে পাশাপাশি রেখে দেখা যাক।

প্রথম টুকরো:

বিশ্ব সাহিত্যের এক অনন্য লেখকের এক গুচ্ছ পত্র-সাহিত্যকে এদেশে ঢুকতে দেওয়া নিয়ে টালবাহানা করা হয়, অজুহাত সেই একই: অশ্লীলতা। মজার কথা, পত্রগুলি লেখক তাঁর কোনো গার্লফ্রেন্ডকে লেখেননি, জেমস জয়েস, লিখেছিলেন নিজের স্ত্রীকে। এই পত্রগুচ্ছের বেশ কয়েকটিকে অবশ্যই একপেশে ভাবে শয্যা-সংলাপ বলা যেতে পারে কিন্তু অন্যদিক দিয়ে দেখলে তা ভাষা ও সাহিত্যের সম্পদও বটে এবং ইউলিসিস উপন্যাসটির ওপর আকস্মিক এক আলোকপাতও। বুঝতে যাহায্য করে জেমস জয়েসকে। নতুন একভাবে ব্যাখ্যাও করা যায়। এসব জিনিস আমাদের মাথায় ঢুকতে আরো অনেক বছর লাগবে, লেগে যাবে, বোঝাই যায়। অথচ চকচকে ছবিওলা আধা-উলংগ গার্ল পত্রিকায় শহর আধা-শহরের ফুটপাথ উপচে পড়ে, সেক্স-ফ্যান্টাসি। সফট-পর্নোর পত্রিকা তো ওপেনলিই বিক্রি হয় পাড়ায় পাড়ায়, আড়ালে আবডালে হার্ডকোর।… নগ্নতা যেখানে স্বতঃস্ফূর্ত, বোল্ড এবং বিউটিফুলও, যা আমাদের ধরি-মাছ-না-ছুঁই-পানি মার্কা মধ্যবিত্ত চিন্তার দমিত কামনা বাসনা পূরণে সাহায্য করে। আলোকপ্রাপ্ত ফ্যামিলির বাবা মা ছেলে মেয়ে সবাই একসংগে বসে সে-সব উপভোগ করে, বেশিরাতে একটু রাখঢাক রেখে অন্য জিনিস, ভি-সি-আর-এ। সারা ভারতে এখন জনপ্রিয় জাতীয় সংগীত কী? চোলি-কা-পিছে নিশ্চয়ই, নয়তো সেক্সি সেক্সি। না, এ ব্যাপারে, কারোর কোনো, তেমন কিছু মার মার কাট কাট অভিযোগও নেই, যদিও গোঁড়াদের কথা আলাদা। (পৃঃ ৪৭-৪৮)

দ্বিতীয় টুকরো:

কর্মক্ষেত্রে আধুনিক মানুষের যে অবদমন চলে, সেই অবদমনের প্রতিক্রিয়ায় মানুষ সৃষ্টিশীল হবার চেষ্টা করে এমন সব কাজে যেখানে সে সামাজিক শ্রমের অংশীদার নয়। শ্রমের বাইরে মানুষের অধিকার ভোগ-ব্যসনে, যেখানে সে ব্যক্তিমাত্র। তার অবদমিত সৃষ্টিশীলতা আকাঙ্ক্ষা হিসেবে প্রকাশিত হতে থাকে ব্যক্তিগত মাত্রায়--- আহার, মৈথুন ও ব্যসনে। প্রবৃত্তির আদিম জগৎ থেকে মুক্ত মানুষ অবদমন-ভিত্তিক যে সভ্যতা গড়ে তোলে সেই সভ্যতা মানুষ ও পশুর মধ্যে কোনো পার্থক্যই করতে পারে না। স্বতঃস্ফূর্ত কিংবা আরোপিত, মানবেতর পরিণতির দিকে ধাবিত এই সভ্যতা, হয়তো এটাই তার শেষ কথা। তাত্ত্বিক নির্মাণের আদিকল্প যদি অগাস্ট হায়েক বর্ণিত প্রতারণার আদিকল্প হয়, পশুর জগত থেকে মানুষের জগতের ব্যবধান সংক্রান্ত যাবতীয় ধারণাও তাহলে প্রতারণার ফসল হিসেবেই চিহ্নিত করতে হবে। (পৃঃ ৬৮)

যৌনতা প্রসঙ্গে যে কথাটা খুব প্রচলিত তা হলো: আমরা এক যৌন-অবদমনের সমাজে বাস করি, ধর্মীয় ও সামাজিক নানা সংস্কার ও বিধির শাসনে যৌন প্রবৃত্তির সহজ-স্বাভাবিক-স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশকে শৃঙ্খলা-নিষেধাজ্ঞার বাঁধনে বেঁধে রাখা হয়, ফলে জন্ম নেয় নানা বিকৃতি, তাই সংস্কার ও বিধির শাসন অগ্রাহ্য করে মুক্ত যৌনতার চর্চা শ্রেয় ও কাম্য। এই সরল অবদমন-তত্ত্বে সুবিমল মিশ্র বিশ্বাসী নন। উপরে উদ্ধৃত প্রথম টুকরোটিতে দেখা যাচ্ছে যে যৌনতা প্রসঙ্গে সমাজ একদিকে বিধিনিষেধ আরোপ ও অন্যদিকে চরম প্রণোদনা যোগানো এই দুই আপাতবিরোধী কৌশল নিয়ে চলেছে। যৌন-উত্তেজক জমকদার ছবি-গান-সিরিয়াল-এর ভরা কোটাল হাজির করেছে, অথচ একই সঙ্গে স্ত্রীর সঙ্গে শয্যাসংলাপকে সাহিত্যপাঠের অন্তর্ভুক্ত করায় তার ভয়ঙ্কর আপত্তি। বিধিনিষেধ আরোপ ও নিরন্তর উশকানি কি সত্যিই একে অপরের বিপরীত, নাকি একে অপরকে উশকে-জিইয়ে-বাড়িয়ে নিয়ে চলার পাকে অচ্ছেদ্যভাবে বাঁধা? ফলে সরল অবদমন তত্ত্ব অবলম্বনে সরল মুক্ত যৌনতার আহ্বানও সুবিমল মিশ্রের লেখায় আসে না। তিনি বরং নিবিড়ভাবে বিশ্লেষণ করতে বসেন যে একটি ক্রিয়া হিসেবে যৌনক্রিয়ার সামাজিক স্তিতসত্তাটি এখন কী? উদ্ধৃত দ্বিতীয় টুকরোয় আমরা এ বিষয়ে তাঁর চিন্তার আভাস পাই। মানুষ যেখানে সামাজিক শ্রমের অংশীদার, বর্তমান পুঁজিবাদী পণ্যোৎপাদন ব্যবস্থায় যা ধীরে ধীরে তার গোটা সৃষ্টিশীল শ্রমের পরিসরটাকেই দখল করে নিতে উদ্যত হয়েছে, সেখানে মানুষ তার শ্রমশক্তির বিক্রেতায় পরিণত হয়ে তার নিজের কাজের থেকে বিযুক্ত (alienated), জৈবিক সম্পর্ক শুকিয়ে গিয়ে শুধু নিষ্প্রাণ বস্তুতে রূপান্তরিত অপরদের সঙ্হে নিষ্পাণ সম্পর্কের টানাপোড়েন (মার্কস ও হেইডেগার কথিত reification)। কর্মক্ষেত্রে এই অবদমনের মধ্যে থাকা মানুষ তার অবদমিত সৃষ্টিশীলতার আকাঙ্ক্ষা, বিচ্ছিন্নতা অতিক্রম করে জৈবিক সম্পর্ক স্থাপনের আকাঙ্ক্ষা তাই সেখানে পূর্ণ করতে চায়, যেখানে সে সামাজিক শ্রমের অংশীদার নয়, যেখানে সে ব্যক্তি, আর এই সমাজ কেবল ভোগ-ব্যসনের অনির্বাণ অলাতচক্রে ঘেরা পরিসরেই তাকে এহেন ব্যক্তি হতে দেয়। ফলে যৌনক্রিয়াও এই অনির্বাণ অলাতচক্রের মধ্যে ভোগ-ব্যসনের চিরঅতৃপ্ত অভিপ্রায় দ্বারা চালিত হতে থাকে। আবার, প্রকৃতিজাত প্রবৃত্তির চলন থেকে মুক্ত হয়ে তার উপরে সভ্যতার মাচা বেঁধে সেখানে সচেতনতা-শৃঙ্খলার পাট বসিয়ে মানুষকে যা অন্যান্য পশুদের থেকে উন্নত করে তুলতে চেয়েছে, তা-ই অবনির্ধারিত মানুষের সঙ্গে পশুর পার্থক্য ঘুচিয়ে দিয়েছে। খেয়াল করার মতো বিষয় যে এই প্রসঙ্গে আলোচনায় লেখক অগাস্ট হায়েক-এর প্রসঙ্গ এনেছেন, যার তাৎপর্য আমরা এর পরের অংশে রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করার সময় আরো খুলেমেলে দেখব।

প্রবৃত্তিজাত যৌনতা এবং সভ্যতাবিধানে বাঁধা যৌনতার সংঘাতকে নাটকীয় তির্যকতায় সুবিমল মিশ্র হাজির করেছেন ‘হে যীশু, যীশু আমার ঈশ্বরের মেষশাবক’ নামধারী এপিসোড ২-এ। যম-যমীর বৈদিক আখ্যানের উপর ছায়া পড়েছে প্রাতিষ্ঠানিক খ্রিস্টধর্মের মতবাদিক নির্মাণের। যম যমীর সহোদর, যমীর দ্বিগুন তার বয়স। কিশোরী যমী যমের সঙ্গে যৌনমিলন আকাঙ্ষা করে, অকপটে জানায় সে আহ্বান। সহোদর-সহোদরার যৌনমিলনের মধ্যে যম ‘পাপ’ আবিষ্কার করে, তা থেকে নিজেকে বিরত রাখার মধ্য দিয়ে আত্মসত্তাকে পাপোর্ধ্ব পবিত্রতায় বাঁধতে চায়। পাপ-এর বোধহীন যমী ও তা সহচরেরা যখন তার প্রত্যাখ্যানে ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে পুড়িয়ে মারে, তখন সে যেন এই সবার পাপের দায় নিজ কাঁধে নিয়ে মৃত্যুর মধ্য দিয়ে শুদ্ধি ঘটাতে চায়--- তার মুখে তখন এসে পড়ে বহু যুগ পরের যীশুর ছায়া, যে-ও নাকি পৃথিবীর সকলের পাপের দায় নিজ কাঁধে তুলে নিয়ে মৃত্যুতে প্রবেশ করেছিল শুদ্ধতর পুনর্জন্মের জন্য। যৌনক্রিয়াকে পাপ বলে চিহ্নিত করার মধ্য দিয়ে খ্রিস্টধর্মের প্রাতিষ্ঠানিক মতবাদ যেভাবে জীবনের সহজাত সমস্ত প্রবৃত্তিকেই সন্দেহের চোখে দেখার অভ্যাসকে শুদ্ধতার অভ্যাস বলে প্রতিষ্ঠিত করেছিল, জীবনকে ঐশ্বরিক করে তুলতে নির্মীত অভিভাবকীয় বিধি-বিধান-শাসনপ্রণালী যেভাবে জীবনকে মেরে ফেলে তার জায়গায় প্রতারণার পাট বসিয়েছিল, দার্শনিক নিৎশে-র প্রখর সমালোচনা যেভাবে এই জীবনঘাতী পক্ষাঘাতকে উন্মোচিত করেছে, সেইসবের দিকে তির্যক ইঙ্গিত করেই যেন এই এপিসোডের নাম, যমের মুখে যিশুর মুখের প্রক্ষেপণ। চূড়ান্ত অনৈতিহাসিক হয়ে এই অংশটি যেন পাপ-নির্মাণের এক চিরায়ত রূপকথা বলতে চায়।

গোটা বই জুড়েই সুবিমল মিশ্রের ভাষা ও গদ্যনির্মাণ যৌনতার আগুনে রিঙ-এর মধ্য দিয়ে যেন সার্কাসের বাঘের মতো লাফ দিয়ে চলেছে, যৌনতাই বইটির আখ্যানের প্রধান চরিত্র। কিন্তু খেয়াল করলে দেখা যাবে যে সুবিমল মিশ্র এখানে সমাজযৌনতার একটা খণ্ডাংশকেই হাজির করেছেন। কেন একথা বলছি তা একটু খুলে আলোচনা করা যাক।

আমাদের সমাজে যৌনতার মান-আখ্যানটি লিঙ্গ-বৈষম্যের ভাষায় বিধৃত। পুরুষ ও নারীর একে অপরের প্রতি যৌন আকর্ষণ এবং যৌনক্রিয়ার নানা প্রকৌশল সেখানে ‘স্বাভাবিকতা’ বলে নির্মীত। সেই ‘স্বাভাবিকতা’-য় আবার পুরুষ তুলনায় সক্রিয় এবং নারী তুলনায় নিষ্ক্রিয়--- যৌন আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করা, যৌনাচারে অপরের উপর জোর খাটানো এবং নিজ অভিপ্রায় পূরণে অপরকে ভোগ্যবস্তুর মতো ব্যবহার করা, নিজ যৌন স্বাধীনতা নিয়ে ভাবিত-পীড়িত অথচ অপরের যৌন স্বাধীনতার স্বীকৃতিই না দেওয়া, এ সবই যৌনক্রিয়ায় পুরুষের ‘স্বাভাবিক’ অধিকার, নারীর নয়। পুরুষ নারীর যোনিতে নিজ লিঙ্গ অন্তর্প্রবিষ্ট করবে, নিজ বীর্য নারীদেহে প্রোথিত করবে--- দৈহিকতার বিচারেও এই পুরুষ-প্রাধান্যকেই ‘স্বাভাবিক’ বলে ধরা হয়। আমাদের সমাজে তাই মান-যৌনক্রিয়ার পরিসরের সঙ্গে নারীর উপর হিংসার পরিসর পরস্পরছেদী হয়ে জড়িয়ে-জাপটে থাকে। আর এই মান-আখ্যান আত্মউদ্ভাসিত হয়ে সমকামীদের যৌনতা, হিজড়েদের যৌনতা ইত্যাদি অপর সমস্ত যৌনতাকে ‘অস্বাভাবিকতা’ বলে অবমূল্যায়িত করে চলে, অন্ধকারে ঢেকে রাখে। সমাজের কোষ স্বরূপ পরিবারকে রক্ষা, সন্তানোৎপাদন ইত্যাদির মতো যুক্তি দিয়ে মান-রূপটির একাধিপত্য বজায় রাখা হয়। এই পরিপ্রেক্ষিত মাথায় রেখে সুবিমল মিশ্রের এই বইটায় চোখ বুলোলে আমরা দেখব, মান-রূপটির বাইরে প্রান্তীয় হয়ে থাকা বিভিন্ন যৌনক্রিয়ার রূপই এখানে কেন্দ্র জুড়ে বসেছে, যেমন:

  • এপিসোড ১: আড়াই গংগা: ‘মানবিক সম্পর্ক অপেক্ষা সেই সম্পর্কের জটিলতাই’ অংশে কাট-আপ-করে বিধৃত দুই আখ্যানে যৌনসম্ভোগের হাতছানি ফাঁদের মতো পেতে দুই প্রলুব্ধ পুরুষকে শিকার করে দুই নারী।
  • এপিসোড ২: হে যীশু, যীশু আমার ঈশ্বরের মেষপালক: যমী-ই এখানে বিষয়ী হিসেবে সমস্ত ক্রিয়াকে ঠেলে নিয়ে চলেছে--- যমের প্রতি যৌনমিলনের আহ্বান রাখা, জোর করে যৌনক্রিয়া ঘটানোর চেষ্টা করা, প্রত্যাখ্যাত হওয়ার প্রতিশোধ নিতে অন্য পুরুষদের সংগঠিত করে যমকে পুড়িয়ে মারা, সর্বত্র যমী-ই মূল প্রবর্তক।
  • এপিসোড ৩: সাইজের জিনিষ: নিম্নমধ্যবিত্ত পুরুষটির প্রবল পৌরুষ-অহং সত্ত্বেও মিতা নামক আটপৌরে যুবতীটি সেই পুরুষ-অহং ও ভোগেচ্ছাকে সুনিপুণ পরিকল্পনামাফিক ব্যবহার করে নিজের যৌনসম্ভোগের চাহাদাকে মিটিয়ে নেয়, দর্পিত পুরুষটি যে কীভাবে ব্যবহৃত হতে হতে শেষাবধি একটি উত্থিত লিঙ্গ বৈ আর কোনো তাৎপর্য হারিয়ে ফেলে, তা সে নিজেও বোঝে না।
  • এপিসোড ৪: রামধনু সর্প: কন্যা এবং তার বাবার মধ্যে যৌন আকর্ষণ ও যৌনক্রিয়া তিন প্রজন্মের বিস্তারে বিধৃত হয়, সেখানেও কন্যারাই অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রবর্তকের ভূমিকা নেয়।
  • এপিসোড ৫: ককীরে লনাং করার মতো: রীতা, সীমা, মিতা, অসীম, রণেন, অমর--- এই মধ্যবিত্ত তরুণী-তরুণদের যৌনক্রিয়া, কখনও গ্রুপ সেক্স, কখনও সঙ্গী পাল্টাপাল্টি করে নেওয়া, ওরাল সেক্স সবকিছুতেই নারী তিনজনকে প্রধান প্রবর্তকের ভূমিকা নিতে দেখা যায়, এই তিন যুবতীই আরার সমকামিতা এবং স্বমেহনেও জড়তাহীন। এমনকি রণেন-এর সঙ্গে যখন তার মেসের কাজের লোক বউটির যৌনক্রিয়া হয়, তখনও সেই নারীটিই শুরুতে উশকে দিয়ে গোটা ক্রিয়াটিকে নিয়ন্ত্রণ করে। কাট-আপ পদ্ধতিতে এখানে অন্তর্প্রবিষ্ট হয়ে যায় হিজড়েদের যৌনতার কথা, গ্রামীণ কৃষি-পরম্পরায় স্থিত জনজাতিদের যৌন-চিহ্ন-যুক্ত লোকাচার, আর সমান্তরাল আখ্যান হিসেবে চলতে থাকে মানদা দেবীর ‘শিক্ষিতা পতিতার আত্মচরিত’ থেকে পর্যাপ্ত কাট-আপ, যাও কিনা নিজ নারীসত্তার স্বাধীন ক্ষমতার বোধের কথাই বলে চলে।

এপিসোড ১-এর ‘মৃত্যুরেখার অধিবাসী’ অংশে নগরসমাজের মধ্য দিয়ে মুখ ঘষটে পাঠককে টেনে আনেন লেখক--- আতাবাগ সুরকিকলের টালিখোলার বস্তি… ৮ ফুট বাই ৯ ফুট দরমার ঘরে বাসিন্দা ১২-১৩ জন… মিনিট দশ অন্তর সাট্টা-চুল্লুর ঠেক… বোমাবাজি গুলির লড়াই… প্রকাশ্য দিবালোকে পর্নোছবি… ‘গাঁজা ফিরোজ’-এর হেরোইন ব্যবসা, বার বছর বয়সী ‘ডালভাত’ তার দৈনিক পনেরো টাকা মাইনের সেলসম্যান, রাত্তিরবেলা জোর করে যার মায়ের বিছানায় গিয়ে শোয় ফিরোজ… গাঁ-মফস্বলের মেয়ে রেবা সদ্যবিবাহিত বরের হাত ধরে শহর কলকাতায় ‘কোম্পানিতে কাজ’ করতে এসে অজান্তেই চালান হয়ে যায় সোনাগাছির বেশ্যাপট্টিতে… মধ্য কলকাতার চায়ের দোকানে বছর চোদ্দর যুবক ‘খুপসুরৎ সংস্কৃতিবান কলেজ লেড়কি’-দের ছবিভরা মোটা খাম এগিয়ে দিয়ে হোটেলে-বাগানবাড়িতে-পার্টিতে স্ফূর্তির জন্য নিয়ে যাওয়ার দালালি করে--- আর এসব ফুঁড়ে জিনস আর গেঞ্জিতে প্লেবয়ে দেখা ফিগার নিয়ে বেরিয়ে আসতে থাকে টিনএজারের দল, শিক্ষিত-সম্ভ্রান্তের দল, বিত্তে মধ্য বা উচ্চ, পরবর্তী এপিসোডগুলো জুড়ে। তারা আলোকপ্রাপ্ত কিনা কে জানে, কিন্তু সমাজে আলোটা তাদের গায়েই লেপটে থাকে। আর লেখকের গদ্য তাদের এই আলোকিত বহির্চেহারা ভেদ করে ক্রমশ ছায়াচ্ছন্ন গোপন ব্যক্তিগত বলয়গুলোয় ঢোকার জন্য মরীয়া হয়ে ওঠে। বহির্সমাজে ও কর্মক্ষেত্রে আধুনিক মানুষের উপর যে অবদমন চলে তার প্রতিক্রিয়ায় মানুষ কি এই ব্যক্তিগত আলো-আঁধারিতে প্রবৃত্তির মুক্তি উদযাপন করতে চায়? বিচ্ছিন্নতা ও সম্পর্কহীনতার একঘেয়ে রাতের আকাশ তীব্র যৌন-শিখরানুভূতির আতসবাজিতে আলোকিত করে তুলতে চায়? সন্তানোৎপাদন সহ অন্য সমস্ত মান-নির্দিষ্ট উপযোগিতাকে নস্যাৎ করে কেবল যৌনসুখ উৎপাদনের উপযোগিতাটাকেই একমাত্র করে তুলতে চায়? কিন্তু এই সুখভোগের আকাঙ্ক্ষা কি অনন্ত অলাতচক্রেই পাক খায়, কখনও নিবৃত্ত হয় না? যৌন শীৎকারগুলোর পর লেখকের গদ্য বারবার পতিত হয় শূন্যতায়, ক্লান্ত অবসন্নতায়, বিচ্ছিন্নতায় ও সম্পর্কহীনতায়। কাট-আপ-এ ভেসে ওঠে এক গোঙানি:

if i were a butterfly

i would get into everybody’s bedroom and see what they are up to

romance is

dead and gone

Love

is only for fools

sex

is just a one-night stand

(পৃঃ ৮৯)

লেখক সামগ্রিকভাবে যৌনক্রিয়ার উপর বা তার বিভিন্ন বৈচিত্র্যের উপর কোনো মূল্য আরোপ করছেন না, স্বাভাবিকতা-অস্বাভাবিকতা বিচার করছেন না, উপযোগিতা-অনুপযোগিতাও নির্ধারণ করছেন না। লেখক কেবল যৌনতার ক্রিয়াটিকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ভাষার আদলে প্রকাশিত করতে চাইছেন। ভাষার প্রকাশপ্রক্রিয়া এবং যৌনক্রিয়ার মধ্যে ঘটে চলা মিথষ্ক্রিয়া থেকে আবিষ্কার করতে চাইছেন সত্য-মিথ্যা, শূন্যতা-পূর্ণতা, বাধা-প্রণোদনা কীভাবে একে অপরের সঙ্গে পেঁচিয়ে থেকে একে অপরে রূপান্তরিত হতে হতে সেই ক্ষমতাক্ষেত্রটিকে গড়ে তোলে যার মধ্যে সুখ/ভোগসুখ-অভিপ্রায়ী নিত্যনৈমিত্তিক ক্রিয়াগুলো সংঘটিত হয়ে থাকে। লেখকের অনুসন্ধান তাই আমাদের যাপনের রাজনৈতিক মাত্রাগুলোকে নিয়ে, আমাদের স্থিতসত্তার রাজনৈতিক নির্ধারণচিহ্নগুলোকে নিয়ে।

স্তর ৩: রাজনীতি

এপিসোড ৪-এ কাট-আপ পদ্ধতির আকস্মিকতায় হঠাৎই ভেসে ওঠে এই গদ্যটুকরো:

আমরা কি বিবর্তনের পথে? সমস্ত বিবর্তনই হলো অদৃশ্যপূর্ব, তাৎক্ষণিক ঘটনাবলীর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেবার একটা প্রচেষ্টামাত্র। এ জন্যই যুক্তি দিয়ে বিবর্তনের গতিপথের পূর্বাভাস দেওয়া সব সময় সম্ভব হয় না। মানুষ তার নিজের প্রয়োজনেই বিবর্তনের সঙ্গে নিজেকে ধীরে ধীরে মিলিয়ে নেয়, নিতে থাকে প্রতিনিয়ত। যুক্তি দিয়ে এসবের ধ্বংস বা নির্মাণ কোনোটাই সম্ভব নয়। ইউরোপীয় যুক্তিবাদীরা সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার নামে যে-সব কাজ করে এসেছে তার সর্বশেষ ফসল হলো সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্রের ব্যর্থতা শুধু তার প্রয়োগজনিত ব্যর্থতা বলে ব্যাখ্যা করলে কোথাও হয়তো যুক্তির গোঁজামিল থেকে যায়। সমাজতন্ত্রের ব্যর্থতা আসলে যুক্তিবাদের তৈরি-করা সমাজবিকাশসংক্রান্ত তত্ত্বেরই ব্যর্থতা। নতুন করে অন্য কোথাও এই তত্ত্বের আদলে কোনো সমাজকে ঢেলে সাজাবার চেষ্টা করলে সোভিয়েতে আজ যে সংকট দেখা দিয়েছে সেখানেও এই ধরনের সংকট দেখা দেবে না একথা কে বলতে পারে। অগাস্ট হায়েকের রচনায় সে তার যুক্তিগুলি খুঁজে পায়। ডায়েরিতে টুকে রাখে। নাকি ব্যাপারটা সম্পূর্ণ অন্যরকম। যুক্তিগুলিই একসময় তাকে খুঁজে বার করে, তার মনোমতো আপনজনকে। (পৃঃ ৫৯)

সুবিমল মিশ্র এখানে নির্ধারণবাদী (deterministic) সরলরৈখিক বিবর্তনের ধারণাকে নাকচ করেছেন। যে কোনো মতবাদিক সূত্রায়ণ বস্তুজগৎ ও বিশ্বজগতের বিবর্তনকে একটি যুক্তিপরম্পরার সূত্র হিসেবে হাজির করতে চায়, যুক্তির অবরোহী শৃঙ্খলে তা ভবিষ্যতকে নিঁখুত পূর্বাভাসযোগ্য করে তুলতে চায়, আর সেই নিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে যাওয়ার যুক্তিপূর্ণ চলনকেই একমাত্র বৈধ ক্রিয়া হিসেবে হাজির করে--- সত্য উৎপাদনের এই সর্বাত্মকতাবাদী (totalitarian) রীতিকেই সুবিমল মিশ্র নাকচ করেছেন, সমাজতান্ত্রিক মতবাদকেও এই সাধারণ রীতিরই একটি বিশেষ রূপ হিসেবে নাকচ করেছেন। ফলে সত্য-উৎপাদনের প্রকৃত হাতিয়ার হলো যুক্তি--- এই কথাও আর লেখক বিশ্বাস করেন না। লেখকের এই অবস্থান  বোঝার জন্য  ফিরে দেখা যাক যে কোন যাত্রা লেখককে এই অবস্থানে এনে পৌঁছে দিয়েছে।  এই বইটি লেখার কিছুদিন পরে ধীমান দাশগুপ্তের করা প্রশ্নের লিখিত জবাবে তিনি বলছেন:

… আমার সবচেয়ে বড় ট্রাজেডি হলো আমি নিজেকে মার্কসিস্ট লেখক মনে করি, যদিও বাজার-চলতি মার্কসিস্ট লেখকদের সঙ্গে আমার কোনো মিল নেই। তারাও সম্ভবত আমাকে সহ্য করতে পারে না। তাদের কারো কারো লেখা পড়লে, এই নতুন শতকেও, মনে হয় বিপ্লব যেন সমাচ্ছন্ন, চাদ্দিকে বাজছে শ্রেণিযুদ্ধের অরকেস্ট্রাল টিউনিং। যেকোনো সময় বেজে উঠবে বিপ্লবের সিম্ফনি। পার্টিকেন্দ্রীক এই মার্কসচর্চায় কতো সহজ-সরলভাবে আশাবাদ এসে পড়ে। অনুসন্ধানহীন, মননবিমুখ, অতিসরল অথচ সর্বদর্শী লেখকদের পুনরাবৃত্তির জঞ্জালগুলির ধারেপাশে আমি থাকতে চাই না। সেই যাট দশকের শেষদিকে কি সত্তরের প্রথম দিকে, যখন লেভিস্ত্রাউস উপস্থিত করছেন মার্কসবাদের প্রতিস্পর্ধী নৃতত্ত্ব, অনেক পরে যদিও জেনেছি তা, বিং-অ্যান্ড-নাথিংনেস-কে পাশে রেখে বিচার করতে চেয়েছি--- কোনো সমাধান আসেনি, প্রশ্নের আকার ও আয়তন জটিল হতে শুরু করেছে শুধু। ফুকো এলো, বিশেষভাবে হিস্ট্রি অব সেক্সুয়্যালিটির ভলিউমগুলো। মিশেল ফুকো, অ্যান ইন্টারভিউ: সেক্স, পাওয়ার অ্যান্ড দ্য পলিটিকস অব আইডেনটিটি। দেরিদা--- গ্রামাটোলজি। আশির দশকের মাঝামাঝি নাকি প্রথম দিকেই! অনেক পরে পেলাম ফ্রেডারিক জনসনকে। ইতিমধ্যে হাতে এসেছে বাতাই (George Bataille)। স্টোরি অব দ্য আই, লিটারেচর অ্যান্ড ইভিল, ইরোটিসিজম। শেষের বইটি কিন্তু সাংঘাতিক অথচ দর্শনের বই।… ততদিনে সেক্স পাওয়ার আর পলিটিকস পরস্পরের সন্নিধি পেতে শুরু করেছে আস্তে আস্তে। আস্তে আস্তে অন্যমেরু আর আসন্নবিশ্লেষণ। এবং আস্তে আস্তে বলার ধরনটাই বিষয় হয়ে ওঠা। একটা রাখতে বললে ওইটাই রাখব… (ধীমান দাশগুপ্ত প্রণীত সুবিমল মিশ্র: পতন অভ্যুদয় বন্ধুর পন্থা, ২য় পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত ‘বিতর্ক’ সংস্করণ, জানুয়ারি ২০০১, পৃঃ ১০৪-১০৫)

মার্কস-এর হাজির করা শ্রেণীবিশ্লেষণ তিনি আঁকড়ে থাকেন, পুঁজিবাদী সমাজকে নিঃসংকোচে বুর্জোয়া সমাজ বলেন, বুর্জোয়া সত্তার পর্তি ঘৃণা উগরে দেন, নিজ শ্রেণী-অবস্থান নিয়েও নিরন্তর বিপন্ন-অন্তর্ঘাতী উদ্বেগে জর্জরিত হন, কিন্তু শ্রেণী-বিশ্লেষণের যুক্তিকাঠামোকে সত্য-উৎপাদনের একমাত্র কাঠামো বা সমাজ-পরিবর্তনের একমাত্র বিপ্লবী প্রকৌশল হিসেবে মানেন না, বরং ওরকমভাবে কোনো যুক্তিকাঠামোকে অবিসংবাদী করে তুলে সত্যোৎপাদন ও বিপ্লবের একমেবাদ্বিতীয়ম প্রকৌশল করে তোলাকে তিনি আধিপত্যবাদী সর্বাত্মকতাবাদ কায়েমের কৌশল হিসেবে প্রত্যাখ্যান করেন। অগাস্ট হায়েক-এর সমাজতন্ত্র-সমালোচনা তাই তাঁকে নতুন পথের ইঙ্গিত দেখায। সত্য-উৎপাদনের সমস্ত পদ্ধতি-প্রকৌশল-পারম্পর্যকে তাই তিনি ভেঙে ফেলতে চান কেবল যুক্তির আঘাতে নয়, যাপনের নিভৃততম বিন্দুটিও ক্ষমতার জালে কীভাবে আত্মপ্রকাশিত হচ্ছে তা বিনির্মাণ করার মধ্য দিয়েও। ভাষা ও গদ্য-বিনির্মাণ তাই যৌনতার সঙ্গে সর্পিল পাকে জড়িয়ে যায়। ব্যর্থতা, শূন্যতা, বিচ্ছিন্নতা সমেত সবকিছুকে ঠেলে নিয়ে যেতে চায় সেই singular point-এর দিকে যেখানে আধিপত্যের holomorphic functions-গুলো অসন্তত অসংজ্ঞাত হয়ে পড়বে। গদ্য এখানে বারবার নিজেকে ভেঙে ভেঙে নির্মাণকৌশলকে পরীক্ষা করে চলে, বলার ধরনটাই বলার বিষয় হয়ে ওঠে। মতবাদিক সমস্ত অবস্থানকে প্রত্যাখ্যান করে লেখক গভীরতম নৈরাজ্য/নৈরাষ্ট্র (anarchy)-কেই রাজনৈতিক পন্থা করে তোলেন।

স্তর ৪: বাস্তবতার প্রতীতি

বিষয়ী-নিরপেক্ষ ভাবে বিষয়গত অস্তিত্ব হলো ‘বাস্তব’, আর তার বিষয়ীগত প্রতীতি হলো ‘বাস্তবতা’--- এভাবে যদি আমরা ধরে নিই, তাহলে বলা যেতে পারে:

‘বাস্তবতা=বাস্তব’ সম্পর্কটি ভুল,

ঠিকের কাছাকাছি হলো ‘বাস্তবতা= f (বাস্তব)’ এই সম্পর্কটি, যেখানে,

f: এই function-টির মধ্য দিয়ে অনুধাবন/ বিশোষণ/ রূপান্তরকরণ/ সাধারণীকরণ/ বিমূর্তায়ন প্রক্রিয়া চলে এবং এই প্রক্রিয়ার প্রতিটি পদক্ষেপে বিভিন্ন ফলের সম্ভাবনার মধ্য থেকে একটি ফলের নির্দিষ্টকরণ হতে থাকে বিষয়ীর দৃষ্টিকোণ/ বিচারধারা/ নৈতিকতা-মূল্যবোধ/ মতবাদ-মতাদর্শ অনুযায়ী। এখন, বিষয়ীর দৃষ্টিকোণ/ বিচারধারা/ নৈতিকতা-মূল্যবোধ/ মতবাদ-মতাদর্শ যেহেতু আবার বিষয়ীর বাস্তবতার পূর্বধারণার উপর নির্ভরশীল, তাই যে বাস্তবতা নির্মীত হচ্ছে তার মধ্যে আগে থেকেই বাস্তবতা ঢুকে বসে থাকছে। ফলে বাস্তবতা= f (বাস্তব) সম্পর্কটির সংজ্ঞায়নেই এক বিভ্রান্তিকর গিঁঠ পড়ে যাচ্ছে। এই গিঁঠ ছাড়িয়ে বলতে গেলে আমরা বরং বলতে পারি:

বাস্তবতাǀt+δt = f (বাস্তবǀt+δt, বাস্তবতাǀt),

যেখানে t চলটি সাধারণভাবে সময়ের সূচক নির্দেশ করছে।

এই সম্পর্কটির আধারে বাস্তবতাǀt+δt গঠনের প্রচেষ্টার দুটো দিক থাকে:

  • বাস্তবতাǀt-কে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে আক্রমণ শানানো যাতে তা কোনো পূর্বনির্দিষ্ট গণ্ডীর মধ্যে বর্তমান অনুধাবন/ বিশোষণ/ রূপান্তরকরণ/ সাধারণীকরণ/ বিমূর্তায়ন-প্রক্রিয়াটিকে বেঁধে ফেলতে না পারে, আর এই আক্রমণ শানানোর ক্ষমতা যার উপর নির্ভরশীল তা হলো:
  • বাস্তবǀt+δt -এর অনুধাবন/ বিশোষণ/ রূপান্তরকরণ/ সাধারণীকরণ/ বিমূর্তায়ন-এর প্রক্রিয়াকে সমস্ত নির্দারণবাদী ছক থেকে বের করে এনে এমন রীতিভাঙা সদাচকিত রূপ দেওয়া যা সদা জায়মান থাকার মধ্য দিয়ে গণ্ডী টপকে চলে, অসন্ততায় গুরুত্ব দেয়, আর তা সম্ভব হয় যদি বাস্তবতাǀt-কে প্রশ্ন করার মধ্য দিয়ে শুরু করা যায়।

অর্থাৎ, এই দুটো দিক দুটি বিপরীত তল মনে হলেও পরস্পর-সম্বন্ধতায় এমনই এক-তল-বিশিষ্ট পাকচক্রের অঙ্গীভূত যার সঙ্গে গণিতের মোবিয়াস স্ট্রিপের তুলনা করা যায়।

একটি গদ্যনির্ভর পাঠবস্তুর মধ্যে বাস্তবতার প্রতীতি নির্মাণের যে ক্রিয়া চলে সেখানে উপরোক্ত ভাবনা কিভাবে কাজ করতে পারে? প্রথমত, তা কাজ করতে শুরু করে গদ্যনির্মাণ প্রক্রিয়ায় ‘স্বাভাবিক’ বলে সেঁধিয়ে বসে থাকা বিভিন্ন সন্ততাবিধানের প্রকৌশলগুলোকে প্রশ্ন করার মধ্য দিয়ে। এই প্রকৌশলগুলোর মধ্যে পড়ে:

  • মান বর্ণনামূলক (narrative) কাঠামো,
  • সময় ও কালের সন্ততা বিধানকারী নানা কৌশল,
  • আখ্যানস্থ চরিত্রগুলোর যৌক্তিক বিবর্তন,
  • গদ্যনির্মাতার বিষয়ীভাবকে আড়ালে রেখে বিষয়ী-নিরপেক্ষ বিষয়ভাবের মায়া তৈরি করা।

নির্মীত বাস্তবতাকে শিকার করার জন্য লাফ দেওয়া বাঘের পিঠে সওয়ার হয়ে বসেন যেসব গদ্যলেখকেরা, তাঁদের প্রত্যেককেই তাঁদের নিজেদের মতো করে এই মান গদ্য-প্রকৌশলগুলোকে ভেঙে নিজস্ব প্রকৌশল গড়ে নিতে হয়, কারণ এই মান প্রকৌশলগুলোর বিপ্রতীপ হিসেবে আর এক গুচ্ছ প্রকৌশলকে মান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা যায় না, তা করতে গেলেই তা তার বিপ্রতীপতা খুইয়ে বসে। এক্ষেত্রে সুবিমল মিশ্র কীভাবে এগিয়েছেন দেখা যাক:

বুঝি, আপনার অনেক প্রশ্ন জমেছে। ধরুন বারোজের লেখা। এক ধরনের কাট-আপ করি তা হলে কী দাঁড়ায়। আবার কাট-আপ-এর সাধারণ পদ্ধতি অনুসরণ করে যদি কাড়-আপ করি তা হলেই বা কী দাঁড়ায় ওটা। দুইয়ের মধ্যে তফাৎ কতোটা। কাউকে দেখতে পাওয়া যায় না কিন্তু গেট ধীরে ধীরে খুলে যায়। দ্য ইনার সার্কেল অ্যান্ড দ্য ইনার-মোস্ট সার্কেল। স্টার্টারের বন্দুক গর্জে ওঠে। চোখের পলকে প্রথম হার্ডলটা তিন-চারজনের একটা ঝাঁক টপকে গেল। তারমধ্যে সে নেই। এক-একটা হার্ডল সে পার হচ্ছে মনে হচ্ছে কষ্ট হচ্ছে খুব। আট নম্বর হার্ডলটা পার হওয়ার আগেই দেখলাম দু-তিন জন দৌড় শেষ করে ফেলেছে। (পৃঃ১৮, আবার পৃঃ ৩২)

আবার,

কী জানি কেন যেন তার মাঝে মাঝে মনে হয় চরিত্ররা আসলে ছায়া, অন্ধকার, সময়ের; যাদের কোনো স্থির রূপ হয় না, যারা ইচ্ছে করলে দেহকে বিচ্ছিন্ন করলেও করতে পারে। (পৃঃ ৬৯)

নিজস্ব গদ্যনির্মাণশৈলী নিয়ে সুবিমল মিশ্রের এই কথাগুলোর আলোচনায় ঢোকার জন্য এই বইয়ের গদ্যচেহারাটাকে খেয়াল করা যাক। এপিসোড ১, অর্থাৎ আড়াইগংগা-র তিনটে ভাগের মধ্যে প্রথম দুটো ভাগ কাট-আপ নয়, মন্তাজের চেহারায় হাজির হয়। ‘মৃত্যুরেখার অধিবাসী’ নামের প্রথম ভাগটি রিদমিক মন্তাজের সীমায় পৌঁছে টোনাল মন্তাজের গা ছুঁয়ে থাকে, দ্বিতীয় ভাগটি টোনাল মন্তাজে শুরু হয়ে ইন্টেলেকচুয়াল মন্তাজে পৌঁছে যায়। ‘মানবিক সম্পর্ক অপেক্ষা সেই সম্পর্কের জটিলতাই’ নামের তৃতীয় অংশটি বরং কাট-আপ-এর চেহারা ধরে আসে। এখানে বলে নেওয়া ভালো যে কী অর্থে আমি মন্তাজ, তার বিভিন্ন ধরন এবং কাট-আপ কথাগুলো ব্যবহার করছি, তাহলে আলোচনাটা এগোতে আরো সুবিধা হবে।

সের্গেই আইজেনস্টাইন মন্তাজের সংজ্ঞা হিসেবে বলেছিলেন:

প্রকাশিতব্য থিমের সমস্ত সম্ভাব্য উপাদানের মধ্য থেকে প্রতিরূপ ক ও প্রতিরূপ খ-কে এমনভাবে নির্বাচিত করতে হবে, এমনভাবে প্রাপ্ত হতে হবে, যাতে তাদের সন্নিধির ফলে--- এই সবিশেষ উপাদানগুলিরই সন্নিধি, অন্য কোনো উপাদানের নয়--- দর্শকের বোধ ও অনুভূতিতে সেই কল্পমূর্তির জন্ম হবে যাতে সমগ্র থিমেরই সবচেয়ে পূর্ণাঙ্গ রূপকল্পনাটি প্রতীত হয়ে ওঠে। (সের্গেই আইজেনস্টাইন, অনুবাদ ও ভূমিকা: ধীমান দাশগুপ্ত, ফিল্ম ইউনিটি: একীভূত সিনেমা-তত্ত্ব, গান্ধার প্রকাশনা, ২০২৪, পৃঃ ৩৩, অংশবিশেষের উপর জোর মূল লেখকের)

আইজেনস্টাইন এখানে প্রথমে ‘সমস্ত সম্ভাব্য উপাদান’ এবং পরে ‘সমগ্র থিমেরই’ শব্দগুলোর উপর জোর দিয়েছেন, তা বোঝায় যে বাস্তবতার একটি সম্পূর্ণ প্রতীতি জ্ঞাপক ধারণ করছে, বাস্তবতার সমস্ত সম্ভাব্য উপাদান সম্পর্কেও সে জ্ঞাত। অর্থাৎ, নিজ-মধ্যের বাস্তবতার প্রতীতিটি তার কাছে প্রশ্নাতীত। সে এই সম্পূর্ণ প্রতীতিটিকে দর্শকদের কাছে জ্ঞাপন করতে চাইছে। সেই জ্ঞাপনকর্মের উদ্দেশ্যে সে এমনভাবে কিছু সবিশেষ উপাদান বেছে নিচ্ছে ও তার সন্নিধি ঘটাচ্ছে যা দর্শকের মনে ওই সম্পূর্ণ প্রতীতিটির ‘সবচেয়ে পূর্ণাঙ্গ রূপকল্পনা’-টি প্রতীত করতে পারে। রিদমিক মন্তাজ (যা উপাদানগুলির সন্নিধির মাধ্যমে ঘটনার গতিছন্দের সঙ্গে আবেগকেও জারিত করে), টোনাল মন্তাজ (যা আবেগের নাটকীয়তাকে তীব্র করে তোলে), ওভারটোনাল মন্তাজ (যা আবেগ-প্রতিআবেগের প্রতিবিন্যাসে আলোড়ন তৈরি করে), ইনটেলেকচুয়াল মন্তাজ (উপাদানগুলোর সন্নিধি যেখানে বহির্চেহারা পেরিয়ে নিহিতার্থ প্রতীত করে)--- মন্তাজের বিভিন্ন ধরনকে এভাবে বিন্যস্তও আইজেনস্টাইনই করেছেন (পূর্বোল্লিখিত ‘ফিল্ম ইউনিটি…’ বইটি দ্রষ্টব্য) এবং পর্যায়ক্রমে এক খেকে তার পরবর্তী ধরনে উৎক্রমণের প্রক্রিয়াটিও ওই ‘সমগ্র থিমের সবচেয়ে পূর্ণাঙ্গ রূপকল্পনাটি’ হাজির করতে পারার ক্ষমতার নিরিখেই বিচার করেছেন।

অন্যদিকে, উইলিয়ম এস বারোজ যখন কাট-আপ পদ্ধতির প্রকৌশল চর্চা করেছেন, তখন সচেতনতার সর্বাত্মকতাবাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করা ছিল তাঁর একটি প্রধান অভিপ্রায়। ব্যাখ্যা করে বললে বলতে হয় যে বারোজের মতে, ভাষা মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে, শব্দ কেবলই নিজের অবিকল প্রতিরূপ নির্মাণ করে চলতে চায়, ভাষা-ও-শব্দ-নির্ভর সচেতনতা বাস্তব সম্পর্কে পূর্ণ প্রতীতিতে পৌঁছে দিতে পারে না বরং এক নির্মীত ছদ্মবাস্তবতার কারাগারে বন্দী করে রাখে--- কাট-আপ পদ্ধতি হলো এই কারাগার ভাঙার চেষ্টা করা, ভাষা ও শব্দকে ভেঙে বিভিন্ন উপাদানের না-সচেতন সন্নিধি গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে তা সমস্ত নির্মীত বাস্তবতাকে আক্রমণ করতে করতে যায়, কারাগারের বাইরে বেরোনোর পথ খুঁজে নিয়ে সেই পথে নিজেকে ভাসিয়ে দেয়। (দ্রষ্টব্য: Edward S Robinson, Shift lingual: cut-up narratives from William S. Burroughs to the present, Rodopi (Amsterdam), 2011)

সুতরাং, বিচ্ছিন্ন উপাদানসমূহের সন্নিধি ঘটানোর বাহ্যিক চেহারায় মন্তাজ ও কাট-আপ-এর মিল থাকলেও, অন্তর্ভাবনার বিচারে তারা বেশ আলাদা। মন্তাজে জ্ঞাপক বাস্তবতার এক স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রতীতির অধিকারী, কাট-আপ-এ জ্ঞাপক নিজেই এক চিরসন্দিগ্ধ অন্বেষণকারী যে বাস্তবতার প্রতীতিগুলোর ছদ্ম-সম্পূর্ণতাকে ভেঙে অদৃষ্টপূর্ব অভাবিত পথ খোঁজে বাস্তবের কাছে পৌঁছানোর জন্য।

এবার যদি আমরা আবার সুবিমল মিশ্রের ‘আড়াই গংগা’-র তিনটি খণ্ডাংশে ফিরে যাই, তাহলে বলতে পারি যে প্রথম দুটি অংশের সন্নিধিনির্মাণের পিছনে লেখকের একটি সামগ্রিক বাস্তবতা-প্রতীতি কাজ করছে। সেই সামগ্রিক বাস্তবতা-প্রতীতিটি পুঁজিবাদী পণ্যসমাজের তীব্র শ্রেণিশোষণে জর্জরিত অধঃপতিত রূপ। এই বাস্তবতা-প্রতীতির সবচেয়ে পূর্ণাঙ্গ রূপকল্পনাটিই লেখক তাঁর গদ্য-মন্তাজের মাধ্যমে পাঠকের মনে সঞ্চারিত করতে চাইছেন। আবেগ তীব্র নাটকীয়তা ধারণ করতে করতে দ্বিতীয় অংশের শেষে এসে ফেটে পড়ে। অপরদিকে, ‘মানবিক সম্পর্ক অপেক্ষা সেই সম্পর্কের জটিলতাই’ নামের তৃতীয় অংশটিতে সন্নিধির জন্য জড়ো করা উপাদানগুলো নিজেরাই আরো টুকরো টুকরো হয়ে একে অপরের সঙ্গে মিলে এমন গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যাচ্ছে যে সমগ্রতা সম্পর্কে কোনো ধারণাই আর করা যাচ্ছে না, একটার পর একটা হার্ডল পেরোতে পেরোতে লেখক এখন একা, জ্ঞাপন নয় নিজের মধ্যের অন্ধকারটাকেই হাতড়ানো তার কাজ, চরিত্রগুলো সব অন্ধকারের ছায়া। সুবিমল মিশ্র এখানে মন্তাজ ছেড়ে কাট-আপ পদ্ধতিতে প্রবেশ করছেন। এরপর বইয়ের এপিসোড ৩, ৪ ও ৫ জুড়ে এই কাট-আপ পদ্ধতি আরো তীব্র ও বিচিত্রগামী হয়েছে। কেবল ‘হে যীশু, যীশু আমার ঈশ্বরের মেষশাবক’ নামের এপিসোড ২টি মাঝখানে একটি ব্যতিক্রম হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই এপিসোডের গদ্যনির্মাণশৈলী মন্তাজ বা কাট-আপ কোনোটাই নয়। স্থান-কাল-চরিত্রগঠনের কোনো মান কাঠামো এখানে নেই, ভাষা এখানে তিন-পলা কাচের মতো বর্ণবিশ্লেষী, দার্শনিক চিন্তার দূর ছায়া এখানে অন্ধকারকে প্রতিধ্বনিময় করে তুলেছে--- এই অংশের গদ্যনির্মাণশৈলী যেন গোটা বইয়ের প্রারম্ভিক মন্তাজ থেকে কাট-আপ-এর গহনে যাত্রার মাঝে সচকিতে প্রবিষ্ট করিয়ে দেওয়া একটি অনন্য হীরকখণ্ড যা তার পাপের জন্মবৃত্তান্ত সংক্রান্ত দার্শনিক চিন্তার ক্লান্ত দ্যুতি ছড়িয়ে রেখেছে বাকি গোটা যাত্রাপথ জুড়ে। আইজেনস্টাইন, বারোজ পেরিয়ে সুবিমল মিশ্রের শৈলী এই যাত্রার সামূহিকতায় নিজ অনন্যতা রচে নেয়।

পাঠবৃত্ত-অন্তে কিঞ্চিৎ রোমন্থন

পাঠবৃত্ত-অন্তে তাহলে আবার এই প্রশ্নটিতে ফিরে আসা যাক যে আমরা তবে এ কী পাঠ করলাম--- গল্প, উপন্যাস, নাকি উপন্যাসের মৃত্যু? পাঁচটি এপিসোড কোনোভাবেই পাঁচটি বিচ্ছিন্ন গল্প নয়। শুরুর ১৮ পাতা পাঠ-প্রস্তুতি এবং তৎপরবর্তী বিন্যাস টুকরোগুলোকে গদ্যশৈলীনির্মাণের যাত্রাক্রমে বেঁধে রেখেছে, দর্শন-ভাষা-রাজনীতি চিন্তার ক্রমউদ্ভাসে আলোকিত করে রেখেছে। সন্নিধির এই খিলান-জোড় কাঠামো প্রথামাফিক উপন্যাস নয়। কখনো মনে হয় যে উপন্যাস শব্দটির জোড় খুলে ফেলো ফাটল বা গহ্বরের মতো একটা ‘অতি’ ঢুকিয়ে দিয়ে যদি ‘উপ-(অতি)-ন্যাস’ শব্দটি তৈরি করা যায়, তা দিয়ে কি এই বইটিকে বর্ণনা করা যায় না? কিন্তু ভাষা থেকে এ অনেকটা নিভাষার দিকে সরে আসা হবে, সে না হয় এখন থাক। তাহলে আমি ঝুঁকে থাকব একে ‘উপন্যাসের মৃত্যু’ বলার দিকেই, কিন্তু ‘মৃত্যু’ শব্দটির এক বিশেষ অর্থ ধরে নিয়ে--- যে অর্থে জর্জ বাতাই তাঁর ‘Eroticism’ বইটিতে মৃত্যুকে দেখেছেন একটি চূড়ান্ত অতিক্রমণ হিসেবে, স্থিতসত্তার অনিবার্য বিচ্ছিন্নতাকে অতিক্রম করে চিরায়ত অস্তিত্বের সন্ততায় বিলীন হয়ে যাওয়ার অতিক্রমণ রূপে, সেই অর্থে। উপন্যাসের মৃত্যু মানে তাহলে চিন্তা-বাস্তবতানির্মাণ-জ্ঞাপন-এর মানবৈশিষ্ট্যগর্বী বিশেষত্বকে অতিক্রম করে কৃষ্ণগহ্বররূপী বাস্তবের মধ্যে বিলীন হয়ে যাওয়ার জন্য আলোকদেহ ধারণ করা। অথবা অন্য একভাবেও বলা যায়: আধুনিক যুগের নির্মাণ গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ নামক সত্য ও জ্ঞান উৎপাদনের মান যন্ত্রগুলো আধুনিকোত্তর যুগে এসে ক্ষয়ে যেতে যেতে ভেঙে পড়তে পড়তে এমনই গুঁড়ো গুঁড়ো অবস্থায় পৌঁচেছে যে কোন গুঁড়োটি কোন আদি যন্ত্রদেহ থেকে এসেছে তা আর ফারাক করা যায় না এবং সত্য ও বাস্তবতা উৎপাদনের কাজটিও এখন অনন্যোপায় হয়ে এই গুঁড়োগুলির কোষগ্রন্থিতে জৈবিক প্রক্রিয়ার আণবিক রূপ গ্রহণ করেছে--- এই একমুঠো ধুলিকে যদি আমরা গল্প-উপন্যাস-প্রবন্ধ বা তাদের বংশধর বলে চিহ্নিত করার বৃথা প্রয়াস ছেড়ে মূলগতভাবে ‘পাঠবস্তু’ নাম-পরিচয় দিয়েই সন্তুষ্ট থাকি, তাহলে তাই বোধহয় সমীচীন হয়। সেইদিক থেকে দেখলে এই বইটি ‘আধুনিকোত্তর পাঠবস্তু’-র একটি অতি তেজস্ক্রিয় নিদর্শন।

 

জুন, ২০২৫

 

0 Comments
Leave a reply