হারানো উত্তরাধিকার: গান্ধী-রবীন্দ্র-চিন্তায় সমাজ, রাষ্ট্র ও প্রগতি

লিখেছেন:বিপ্লব নায়ক
গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে নানাভাবে নানা আলোচনা হয়েছে এবং হয়ে চলেছে। বর্তমান এই আলোচনা গভীর এক সংকটবোধের তাড়নায় তঁাদের দ্বারস্থ হয়েছে। মানুষ তার বর্তমান সভ্যতা নিয়ে কি প্রকৃতির মধ্যে সবচেয়ে বিপজ্জনক জীবপ্রজাতি হয়ে উঠেছে? মানুষের ধনতান্ত্রিক ভোগসংস্কৃতির নিদারুণ লুন্ঠন ও বর্জ্যবমন প্রকৃতির সহ্যক্ষমতাকে ছাপিয়ে গিয়ে কী সার্বজনিক ধ্বংস ডেকে আনছে? হিংসা ও লোভের বন্ধন কী সমস্ত বিকল্পসন্ধান বৃথা করে দিচ্ছে? আমাদের রাজনৈতিক চর্চাই বা একস্তম্ভ রাষ্ট্রের গণ্ডীতে আটকে থেকে বিকল্পনির্মাণে বন্ধ্যা হয়ে

 ভূমিকা

গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে নানাভাবে নানা আলোচনা হয়েছে এবং হয়ে চলেছে। বর্তমান এই আলোচনা গভীর এক সংকটবোধের তাড়নায় তঁাদের দ্বারস্থ হয়েছে। মানুষ তার বর্তমান সভ্যতা নিয়ে কি প্রকৃতির মধ্যে সবচেয়ে বিপজ্জনক জীবপ্রজাতি হয়ে উঠেছে? মানুষের ধনতান্ত্রিক ভোগসংস্কৃতির নিদারুণ লুন্ঠন ও বর্জ্যবমন প্রকৃতির সহ্যক্ষমতাকে ছাপিয়ে গিয়ে কী সার্বজনিক ধ্বংস ডেকে আনছে? হিংসা ও লোভের বন্ধন কী সমস্ত বিকল্পসন্ধান বৃথা করে দিচ্ছে? আমাদের রাজনৈতিক চর্চাই বা একস্তম্ভ রাষ্ট্রের গণ্ডীতে আটকে থেকে বিকল্পনির্মাণে বন্ধ্যা হয়ে উঠছে কেন? কেন আমরা বৈচিত্র্য ও বহুত্বকে আপদ মনে করে সমরূপতার পূজারী হয়ে উঠছি? এই প্রশ্নগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথ বিশ শতকের ভারতে যে বিকল্পের অভিপ্রায় সামাজিক-রাজনৈতিক ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন, তার বৈশিষ্ট্য ও পরিণতি ফিরে দেখতে চাওয়া হয়েছে এই আশা নিয়ে যে তা হয়তো বর্তমান সংকট নিয়ে আপাতরুদ্ধ কিছু ভাবনার পথ খুলে দেবে।

গান্ধীর অভিপ্রায়

১৯৩০ খৃস্টাব্দের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ। ভারতের জন্য ব্রিটিশ কমনওয়েলথের মধ্যে ডোমিনিয়ন স্টেটাসের দাবির বদলে ‘পূর্ণ স্বরাজ’-য়ের দাবি ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সভায় গৃহীত হয়েছে। এই দাবির সপক্ষে দেশজুড়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন সংগঠিত করার পরিকল্পনা জাতীয় কংগ্রেস নিয়েছে। ঠিক হয়েছে মাসের শেষ রবিবার, অর্থাৎ, ২৬শে জানুয়ারি তা করা হবে। কংগ্রেসের বেশিরভাগ নেতার কাছেই তা ছিল নিজেদের সিদ্ধান্তকে জনগণের মধ্যে প্রচার করে জনগণকে তার পক্ষে সামিল করার কর্মসূচী। কিন্তু মহাত্মা গান্ধীর ভাবনা ছিল অন্যরকম। নেতৃত্বের বিবেচনায় মতবাদিক বা আদর্শনৈতিক যুক্তিপরম্পরায় সঠিক প্রতিপন্ন কোনো সিদ্ধান্তে জনগণকে সমর্থক হিসেবে সামিল করতে চাওয়া তঁার কাছে যথেষ্ট ছিল না, জনগণ তাদের নিজস্ব বিবেচনা ও সক্রিয়তা দিয়ে সেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও কার্যকরী করার প্রক্রিয়ায় অংশ হয়ে উঠছে কিনা তা-ই ছিল তঁার ভাবনার বিষয়। তাই তঁার সম্পাদিত ‘ইয়ং ইন্ডিয়া’ পত্রিকায় গান্ধী বিশদে আলোচনা করলেন কীভাবে ১৯৩০ সালের ২৬ শে জানুয়ারি ‘পূর্ণ স্বরাজ দিবস’ পালন করা যায়। তিনি প্রস্তাব করলেন যে কোনো সংগঠন বা দলের কর্মসূচী হিসেবে নয়, গ্রাম হোক বা শহর, গোটা জনপদের মানুষ যেন সেইদিন নিজেদের স্বাধীনতা ঘোষণা করতে জড়ো হয়। যে যে এলাকায় সর্বসাধারণের জমায়েত আহ্বান করার যে যে নিজস্ব পরম্পরাগত রীতি, যেমন ঢাক, ঢোল বা মাদল বাজিয়ে ঢেঁড়া পিটিয়ে ঘুরে ঘুরে জমায়েতের স্থানকাল ঘোষণা করা, সেইভাবেই জনপদে জনপদে ডাক দেওয়া হোক। জমায়েতের দিন শুরু হোক জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে, তারপর গোটা দিন যৌথ প্রয়াসে সমাজের জন্য গঠনমূলক সৃষ্টিশীল কাজে ব্যয় করা হোক। কী হতে পারে তেমন কাজ? গান্ধী কিছু উদাহরণ দিয়েছিলেন: স্বনির্ভর জীবিকা হিসেবে চরখায় সুতো কাটা, ‘অস্পৃশ্য’ করে রাখা মানুষদের পাশে গিয়ে তাদের সেবা করা, ধর্মীয় বিদ্বেষভাব নির্মূল করে হিন্দু-মুসলমান পুনর্মিলনের উদ্দেশ্যে কর্মসূচী নেওয়া, নেশার প্রকোপের বিরুদ্ধে কাজ করা, বা আর যা যা কিছু জনপদবাসীরা তঁাদের সমাজশক্তি পুনরুজ্জীবনের জন্য করণীয় বলে জ্ঞান করবেন। আর এই সবের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার দুটি শপথ তঁারা নেবেন। সেই দুটি শপথ হল:

১। স্বাধীনতা পাওয়া এবং নিজের শ্রমের ফসল নিজে উপভোগ করা হল পৃথিবীর সমস্ত মানুষের মতো ভারতের প্রতিটি মানুষেরও অবিচ্ছেদ্য অধিকার।

২। যে কোনো সরকারই হোক না কেন, সে যদি মানুষদের এই অধিকার থেকে তাদের বঞ্চিত করে এবং উৎপীড়ন করে, তাহলে মানুষদের অধিকার আছে সেই সরকারকে বদল করার বা সেই সরকারকে উচ্ছেদ করার।

ভারত জুড়ে বিপুল সংখ্যক মানুষ সেইদিন এই ডাকে সাড়া দিয়ে ২৬শে জানুয়ারিকে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি বিশেষ দিন করে তুলেছিল।

উপরের দৃষ্টান্তটিতে মনোনিবেশ করলে দেখা যায় যে গান্ধীর ভাবনায় ভারতের স্বাধীনতা মানে কেবলমাত্র বিদেশী শাসকদের বিদায় করা ছিল না, কেবলমাত্র একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়াও ছিল না, তা ছিল একটি ব্যাপ্ত সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক রূপান্তরসাধনের জন্য গণসক্রিয়তা যার মধ্য দিয়ে অর্থনৈতিক অধীনতা, অস্পৃশ্যতা, ধর্মীয় বিদ্বেষ ইত্যাদি অসুখ থেকে মুক্ত হয়ে সজীব সক্রিয় সমাজ গঠিত হতে পারে। তাছাড়াও, তঁার কাছে কেবল বিদেশী ঔপনিবেশিক সরকারই স্বাধীনতার বাধা ছিল না, যে কোনো সরকার যদি উৎপীড়ক হয়ে উঠে মানুষের অধিকার হরণ করে, তবে সেই সরকারই স্বাধীনতার শত্রু এবং মানুষদের অধিকার আছে সেই সরকারকে বদলে দেওয়ার বা উচ্ছেদ করার।

এই অবস্থান গান্ধীর ১৯৩০ সালের সাময়িক অবস্থান নয় বরং একটি মৌলিক ভিত্তিমূলক অবস্থান, তা বোঝা যায় যখন আমরা দেখি যে ১৯০৮ সালে লেখা ‘হিন্দ স্বরাজ’ বইয়ে তিনি লিখছেন:

সম্পাদক: আচ্ছা ধরিয়া নিন, ইংরেজ রাজকার্য ছাড়িয়া দিল, তাহা হইলে আপনারা কী করিবেন?

পাঠক: এ কথার এখন কী জবাব দিব? ইংরেজ চলিয়া গেলে কী অবস্থা দাঁড়াইবে তাহা প্রধানত প্রস্থানের প্রকৃতির উপর নির্ভর করে। আপনি যেরকম ধরিয়া লইতেছেন, সেইমত তঁাহারা যদি প্রস্থানই করেন, আমার মনে হয় সেক্ষেত্রে আমরা তখনও তঁাহাদের সংবিধানই বজায় রাখিব ও সরকার পরিচালনা করিতে থাকিব। আর যদি বলার ফলে তাহারা কেবল চলিয়াই যায়, আমাদের হাতের কাছে তো সেনাবাহিনী প্রভৃতি থাকিয়াই যাইবে; সরকার চালাইতে আমাদের কোনো অসুবিধা হইবে না।

...

সম্পাদক: আচ্ছা ধরুন, কানাডাবাসী ও দক্ষিণ আফ্রিকার অধিবাসীদের ধরনে স্বশাসিত সরকার যদি আমরা পাই, তাহা হইলে কি খুব ভাল হইবে?

পাঠক: ইহাও অহেতুক প্রশ্ন। আমাদের যখন একই রকম ক্ষমতা হইবে, আমরা ইহা পাইব। তখন আমরা নিজেদের পতাকা উড়াইব। জাপান যেমন, ভারতবর্ষও সেইরকম হইবে। আমাদের নিজেদের নৌবহর থাকিবে, সেনা থাকিবে এবং আমাদের নিজস্ব জাঁকজমকও থাকিবে। তখনই বিশ্বে ভারতের কন্ঠস্বর বাজিয়া উঠিবে।

সম্পাদক: আপনি সুন্দর চিত্র আঁকিয়াছেন। কার্যত ইহার মানে তো এই যে, আপনার ইংরেজ শাসন চাই, ইংরেজ চাই না। বাঘের স্বভাব চান, বাঘটি চান না। অর্থাৎ আপনি হিন্দুস্থানকে ইংরেজি তৈরি করতে চান। কিন্তু তাহা হইলে আর হিন্দুস্থান থাকিবে না, ইংলিশস্থান হইবে। আমি যে স্বরাজ চাহি, এটি তাহা নয়।

সুতরাং, গান্ধীর মতে, ইংরেজদের দূর করে ইংরেজ শাসন কায়েম রাখা, অর্থাৎ, ইংরেজ শাসকদের হঠিয়ে ভারতীয় শাসক বসিয়ে ইংরেজদের প্রবর্তিত ইউরোপীয় জাতিরাষ্ট্রের কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রকাঠামোর ধাঁচায় শাসন জারি রাখাকে স্বাধীনতা অর্জন বা স্বরাজ-প্রতিষ্ঠা বলা যায় না।

‘আপনার ধারণায় স্বাধীন ভারতের সামগ্রিক ছবিটা কীরকম?’— একজন পত্রলেখকের এই প্রশ্নের উত্তরে ১৯৪৬ সালে গান্ধী তঁার পত্রিকা ‘হরিজন’-য়ে একটি বিশদ প্রবন্ধ লিখে জবাব দিয়েছিলেন। সেখানে গান্ধী লিখেছিলেন যে তঁার ধারণায় স্বাধীনতার শুরু হতে হবে তলা থেকে যাতে প্রতিটি গ্রাম একটি স্বাধীন গণরাজ্যের চেহারা নেয়, গ্রামীণ পঞ্চায়েতগুলো পূর্ণ ক্ষমতার অধিকারী হয়। এইরকম অসংখ্য স্বাধীন গ্রামের সম্মিলনে গড়ে উঠবে দেশ, সেই সম্মিলন কোনো ঊর্ধ্বমুখী ধাপবন্দি কাঠামো অনুযায়ী বাঁধা হবে না, একই তলে সদা-প্রসারমান বৃত্তের চেহারা নেবে। সেখানে জাতির জীবন এমন কোনো পিরামিডের চেহারা নেবে না যার নীচতলার কাজ উপরতলাকে পরিপুষ্ট করা, বরং জাতির জীবন এমন সামুদ্রিক বৃত্তের রূপ ধারণ করবে যার কেন্দ্রে রয়েছে এমন ব্যক্তি যে তার গ্রামের জন্য আত্মনিবেদন করেছে, এমন গ্রাম যা গ্রামসমষ্টির জন্য আত্মনিবেদন করেছে, এভাবে শেষাবধি সামগ্রিক জীবন তৈরি হয়েছে এমনসব ব্যক্তিমানুষদের দিয়ে যারা দম্ভঘোরে অক্রমণাত্মক নয়, বরং বিস্তৃত সামুদ্রিক বৃত্তের মহিমার অংশ হিসেবে সদাই নম্র, সদাই বিনয়ী।

স্বাধীন দেশের কাঙ্খিত রূপ সম্পর্কে গান্ধীর এই রূপক-অলঙ্কৃত বর্ণনা ঘোরতরভাবেই কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রক্ষমতার উপর অধিষ্ঠিত জাতিরাষ্ট্রের বিরোধী। যে কোনো রূপ ঊর্ধ্বমুখী ধাপবন্দি কাঠামোয় পিরামিড আকারে ক্ষমতার বিন্যাসকে তা নাকচ করছে। প্রতিটি গ্রামে প্রতিটি মানুষ অংশগ্রহণ করতে পারে এমন পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে ক্ষমতার একক হিসেবে ধরে পূর্ণ ক্ষমতাসম্পন্ন পঞ্চায়েতগুলোর স্বতঃপ্রবৃত্ত সমবায় হিসেবে তিনি দেশকে ভেবেছেন। এই কাঠামো যেমন নগরকেন্দ্রীক বৃহৎশিল্পোৎপাদনভিত্তিক ‘আধুনিক’ রাষ্ট্রকাঠামোর বিরুদ্ধাচারী, তেমনই এই কাঠামোর কেন্দ্রে থাকা মানুষরাও ‘আধুনিক’ বৃহৎশিল্পোৎপাদনকেন্দ্রিক সমাজের ‘আধুনিক’ মানুষের মতো আত্মগর্বের ধ্বজাবহনকারী ভোগাধিক্য অন্বেষণকারী নয়, তাদের স্বতঃপ্রবৃত্তিই তাদের অপরের সঙ্গে মিলন ও সমষ্টির জন্য আত্মনিবেদনের দিকে চালিত করবে।

কিন্তু এমন গ্রাম ও এমন গ্রামবাসী কি বাস্তবে অস্তিত্বমান? এ কি মরীচিকার পিছনে ছোটা নয়? কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে কেন্দ্রীভূত পরিকল্পনা আরোপ করে বৃহৎশিল্পোৎপাদনমুখী নগরকেন্দ্রীক সমাজ গড়ে তোলাই কি আধুনিক বিশ্বে এগিয়ে যাওয়ার একমাত্র পথ নয়? এই নিয়ে ১৯৪৫ সালের অক্টোবর-নভেম্বর মাসে জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে গান্ধীর মতবিরোধ জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে সামনে চলে আসার পর গান্ধী নেহরুকে লেখা চিঠিতে লিখেছিলেন:

...আমার স্বপ্নের গ্রাম এখনও আমার মনেই রয়েছে। বলতে কি, প্রত্যেক মানুষই তার স্বপ্নরাজ্যে বাস করে। আমার আদর্শ গ্রামে থাকবেন বুদ্ধিমান মানুষ সব। পশুর মতো ময়লা আবর্জনায় ও অন্ধকারে বাস করবেন না। নর নারী সবাই হবেন স্বাধীন এবং বিশ্বের যে কারো বিরুদ্ধে আত্মবলে দাঁড়াতে পারবেন। সেখানে প্লেগ, কলেরা, বসন্ত থাকবে না। কেউ অলস হবে না। বিলাসীও হবে না কেউ। প্রত্যেককেই নির্দিষ্ট পরিমাণ কায়িক শ্রমদান করতে হবে। বিশদভাবে সে ছবি আমি আঁকতে চাই না। রেলপথ, ডাক ও তার অফিস যে থাকবে তা কল্পনা করে নেওয়া যেতে পারে। এই আসল জিনিস যদি ছেড়ে দিই, তাহলে সব কিছুই চলে যাবে।

তাই, অতীত বা বর্তমানে অস্তিত্বশীল কোনো গ্রামকে আদর্শ করে গান্ধীর স্বাধীন ভারতের কল্পনা নয়, সেই গ্রামকে গড়ে তুলতে হবে বর্তমানে গঠনমূলক গণকার্যক্রমের মধ্য দিয়ে— বেকারত্ব/ছদ্মবেকারত্বের অভিশাপ কাটানোর জন্য গ্রামের মানুষদের নিজেদের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকা কর্মসংস্থানের আয়োজন করতে হবে (যারই একটি উপায় হিসেবে চরখায় সুতো কাটাকে তিনি গ্রামীণ মানুষদেরএকটি রোজগারের উপায় হিসেবে দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন), অস্পৃশ্যতা নির্মূল করে সামাজিক ভেদের ধাপবন্দি কাঠামোকে ভাঙতে হবে, ধর্মীয় বিদ্বেষের বদলে অপরাপর সমস্ত ধর্ম সম্বন্ধে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও আদানপ্রদানের সম্পর্ক তৈরি করতে হবে। গান্ধীর কাছে তাই ইংরেজকে তাড়ানোর জন্য আবেদন-নিবেদন-পিটিশন-আন্দোলনের থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল গঠনমূলক কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে গ্রামসমাজ পুনর্গঠনের কাজ। ১৯৪৮ সালে উগ্র হিন্দুত্ববাদী ঘাতকের গুলিতে মৃত্যুর আগে লিখে যাওয়া তঁার শেষ ইচ্ছাপত্রেও তাই ভারতের জাতীয় কংগ্রেসকে তিনি আবেদন জানিয়েছিলেন রাজনৈতিক দল হিসেবে নিজেকে ভেঙে দিয়ে ‘লোক সেবক সঙ্ঘ’ হিসেবে নিজেকে পুনর্গঠিত করতে, যাতে ইংরেজদের রেখে যাওয়া রাষ্ট্রশাসনব্যবস্থাকে সচল রাখার দায়িত্ব না নিয়ে তারা প্রকৃত স্বাধীনতার লক্ষ্যে সমাজগঠনের দায়িত্ব কঁাধে তুলে নেয়।

কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় যে এই সমাজগঠনে গ্রামের উপর এত জোর, শহর বাদ কেন? গ্রামবাসীদের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকা গ্রামভিত্তিক কর্মসংস্থানে এত জোর, শহরকেন্দ্রীক বৃহৎশিল্পোদ্যোগ ব্রাত্য কেন? গান্ধীর নিজের লেখাতেই আবার ফিরে যাওয়া যাক। পূর্বে উল্লিখিত জওহরলাল নেহরুকে লেখা ১৯৪৫ সালের চিঠিতেই অন্যত্র তিনি লিখেছেন:

আমার স্থির বিশ্বাস যে, ভারতকে, ও তার মাধ্যমে সারা বিশ্বকে, যদি প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জন করতে হয়, তাহলে আজ হোক বা কাল হোক, এই সত্য মেনে নিতে হবেই যে, জনগণকে গ্রামের কুটিরে বাস করতে হবে, শহরে ও প্রাসাদে নয়। কোটি কোটি মানুষ শহরে ও প্রাসাদে কিছুতেই পারস্পরিক শান্তিতে বাস করতে পারবে না। হিংসা ও অসত্যের আশ্রয় নেওয়া ছাড়া তাদের সামনে আর তখন অন্য কোনো পথ থাকবে না। আমি মনে করি, সত্য ও অহিংসাকে বাদ দিলে মানব সমাজের বিনাশ ঘটবে। সত্য ও অহিংসার রূপ আমরা সাদা-মাটা গ্রাম্য জীবনের মধ্যেই কেবল দেখতে পাই এবং সেই সারল্য চরখায় ও চরখা যা কিছুর প্রতীক তার মধ্যে সবচেয়ে ভাল প্রতিফলিত। পৃথিবী যদি আজ ভুল পথে যায় আমার ভয় পেলে চলবে না। এমন হতে পারে যে ভারতও সেই পথে যাবে এবং প্রবাদ-খ্যাত পতঙ্গ যেমন, যে অগ্নিশিখাকে ঘিরে এমন উন্মত্ত হয়ে নাচতে থাকে, সেই আগুনেই শেষ পর্যন্ত পুড়ে মরে, ভারতের পরিণামও তাই হতে পারে। শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত আমার কর্তব্য হবে ভারতবর্ষ ও তার মাধ্যমে সারা পৃথিবীকে সেই বিনষ্টি থেকে রক্ষা করা। আমি যা বলছি, তার মর্মার্থ হল, মানুষকে তার যা প্রকৃত প্রয়োজন তাতেই সন্তুষ্ট থাকতে হবে এবং তার স্বাবলম্বী হওয়াই উচিত। এ সংযম না থাকলে মানুষ নিজেকে বাঁচাতে পারবে না।

সুতরাং, শহর নয়, গ্রামকে ভিত্তি করে জীবন কল্পনার পিছনে রয়েছে জীবনযাপনের ক্ষেত্রে কয়েকটি মূল্যবোধকে অগ্রাধিকার দেওয়া, যেমন: প্রকৃত প্রয়োজনের মধ্যেই ভোগকে সীমাবদ্ধ রাখা, স্বাবলম্বী হওয়া। শহরকেন্দ্রীক বৃহৎশিল্পোদ্যোগী সমাজ এর বিপরীত, তা শিল্পোৎপাদনের অনন্ত বৃদ্ধির চক্র ঘোরাতে মানুষের চাহিদাকেও অনন্ত করে তোলে— পুরানো চাহিদা পূরণে আরো বেশি আরো দামি বস্তুর আকাঙ্খা উৎসাহিত করে, নিত্য নতুন চাহিদা জাগ্রত করে। সদাঅপূর্ণ আকাঙ্খা ও লোভের বেড়িতে তা মানুষকে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধে। মানুষের প্রকৃত প্রয়োজন নয়, মুনাফার প্রয়োজনই সেখানে রাজা। উৎপাদনী ব্যবস্থার ক্রমকেন্দ্রীভবনের মধ্য দিয়ে সেই বিমূর্ত রাজাই কাজের সুযোগকে নিয়ন্ত্রণ করে। কর্মসংস্থান আর কর্মপ্রত্যাশীদের নিয়ন্ত্রণে থাকে না। স্বাবলম্বিতাও থাকে না। অন্যদিকে, মুনাফার অন্ধ তাড়নায় প্রকৃতি থেকে কঁাচামাল নিষ্কাশনের নিত্যনতুন হানাদারিতে সে প্রকৃতি জুড়ে ধ্বংস ও বিপর্যয় ছড়িয়ে চলে। গান্ধী তঁার নিজের ভাষায় একে ‘হিংসা ও অসত্যের আশ্রয় নেওয়া’ বলেছেন, যার গর্ভে নিমজ্জিত হলে ‘মানুষ নিজেকে বাঁচাতে পারবে না’। ভোগকে অসীমে নিয়ে যাওয়ার মোহময় মরীচিকা তৈরি করা এই নগরসভ্যতা গোটা বিশ্বে তার বিজয়রথ ছোটাচ্ছে, ভারতের স্বাধীনতাকাঙ্খীদের মনেও তা আসন পেতে বসেছে, লোভ ও হিংসার কাছে পরাধীন জীবনকে তঁারাও স্বাধীনতা বলে ভ্রম করছেন। এর বিরুদ্ধেই গান্ধীর সংগ্রাম, প্রকৃত স্বাধীনতার ভাবনাকে জাগরূক করার সংগ্রাম, ভারতের মাধ্যমে গোটা বিশ্বের কাছে তা তুলে ধরার সংগ্রাম।

জওহরলাল নেহরুকে গান্ধী তঁার এই ভাবনায় নিয়ে আসতে পারেননি, এমনকি বল্লভভাই পটেলকেও নয়। এর ফল কী হল তা আমরা একটু পরে আলোচনা করব। তার আগে, বিশ শতকে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের পরিসরে প্রস্ফুটিত হওয়া এই ভাবনাটিকে আমরা আর একটু বিস্তৃত করে বোঝার চেষ্টা করব সমসাময়িক আরেক মহাচিন্তকের ভাবনার পাশে রেখে। তিনি হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথ গান্ধীকে মহাত্মা বলে সম্বোধন করতেন আর গান্ধী রবীন্দ্রনাথকে গুরুদেব বলে সম্বোধন করতেন। পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও আস্থা ছিল অগাধ। দেশ, সমাজ ও স্বাধীনতা সম্পর্কে গান্ধীর এই সুহৃদের ভাবনাকে এবার বোঝার চেষ্টা করা যাক।

রবীন্দ্রনাথের অভিপ্রায়

বিশ শতকের গোড়ায় জাপানে তখন আগ্রাসী জাতীয়তাবাদের তুমুল জোয়ার উঠেছে। সেখানে বক্তৃতা দিতে আমন্ত্রিত হয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন:

ইউরোপের মাটি থেকে গজিয়ে ওঠা যে রাজনৈতিক সভ্যতা এখন গোটা বিশ্বকে ছেয়ে ফেলছে আগ্রাসী আগাছার মতো, তার ভিত্তি হল অপরকে বাদ দেওয়ার প্রবণতা। তা সবসময় অপরদের উপর সতর্ক নজরদারি চালায় যাতে অপরদের দূরে ঠেলে রাখা যায় বা একেবারে নিকেশ করে দেওয়া যায়। সর্বখাদক ও নরখাদক প্রবণতা আছে তার মধ্যে। অপর মানুষদের সহায়-সম্পদ ছিনিয়ে নেওয়া ও তাদের গোটা ভবিষ্যতকেই গ্রাস করার চেষ্টা করে এই রাজনৈতিক সভ্যতা। তা সবসময় আশঙ্কা করে যে অপর কোনো জাতি বুঝি তাকে ছাড়িয়ে উঁচুতে উঠে গেল আর সেই সম্ভাবনাকে সে ‘মহা বিপদ’ বলে চিহ্নিত করে। এই চিরসন্দিগ্ধ চিরআশঙ্কিত মানসিকতা তার গণ্ডীর বাইরের মহত্ত্বের যে কোনো লক্ষণকে দমন করতে চায়। দুর্বলতর জাতির মানুষদের দুর্বলতার বন্ধনেই আটকে রাখতে জোর ফলায়।... তা শক্তিধর কারণ তা তার সমস্ত বল একটাই উদ্দেশ্যে কেন্দ্রীভূত করে, যেন বা কোনো কোটিপতি তার আত্মাকে বেচে অর্থ সংগ্রহ করছে। কোনো আস্থার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করতে তার বাধে না, নির্লজ্জভাবে তা মিথ্যার জাল বুনে চলে। মন্দিরে মন্দিরে তা লোভ-লালসার বিপুলাকার মূর্তি স্থাপন করে, সেই মূর্তিপুজো ও তজ্জনিত বহু ব্যয়সাপেক্ষ জাঁকজমককে ‘দেশপ্রেম’ নাম দিয়ে সে নিয়ে তার গর্বের শেষ নেই।... যদি অনির্দিষ্টকাল জুড়ে এমনটাই চলতে থাকে, যন্ত্র ও গুদামঘর তার আবর্জনা, ধোঁয়া আর কদর্যতা দিয়ে ঢেকে ফেলে এই সুন্দর ধরণী, তাহলে এক আত্মহননের বহ্নুৎসবে সব শেষ হয়ে যাবে।

তঁার জাপানী শ্রোতাদের অনেকেরই তঁার বক্তব্য পছন্দ হয়নি, শোনা যায় জাতিগর্বে মদমত্ত জাপানী কিছু বুদ্ধিজীবী রবীন্দ্রনাথকে ‘ধ্বংসের কিনারে দাঁড়ানো পরাজিত জাতির প্রতিনিধি’ বলে ব্যঙ্গ করেছিল। বিশ শতকের সেই প্রারম্ভকাল তখনও দুটো বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকা প্রত্যক্ষ করেনি, হিটলার ও স্তালিনের সর্বাত্মকতাবাদী সন্ত্রাসী রাষ্ট্রকে প্রত্যক্ষ করেনি, লোভ-লালসার বিপুলাকার মূর্তি পুজো করে মোক্ষলাভের আকর্ষণ তখন দুর্বার। ধ্বংসশক্তিতে দুর্মদ কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রযন্ত্রকে সংকীর্ণ জাতিদম্ভের বাষ্পে চালিত করে মানুষ-প্রকৃতি-নিয়তি সবকিছুর উপর আধিপত্য নির্মাণের একের পর এক নীল নকশা তখন সর্বশক্তিমান মতবাদ হিসেবে রাজ করছে। দ্রুত বৃহৎ শিল্পোৎপাদন কাঠামো গড়ে তুলে, অস্ত্র ও ভোগ্যপণ্যের উৎপাদনকে সীমাহীন করে তুলে শহরকেন্দ্রীক খাদকসমাজে মানুষকে ঠেসে পুরে মর্ত্যে স্বর্গ নির্মাণের পথ নির্বিকল্প হিসেবে নিজেকে ঘোষণা করেছে। যে কোনো বিকল্প ভাবনা, রীতি, আচার, যাপন-কে চিহ্নিত করা হচ্ছে প্রগতির বিরুদ্ধে অর্থাৎ প্রতিক্রিয়াশীল বলে এবং প্রগতির পথে বাধা দূর করতে তাকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য আগ্রাসী আক্রমণ হানা হচ্ছে। এই স্রোতে সওয়ার হয়ে জাপান যেমন ইউরোপীয় উপনিবেশ-বিস্তারকারী জাতিরাষ্ট্রগুলোর আদলে আধিপত্যবাদী জাতিরাষ্ট্র গড়ে তুলতে চাইছে, তেমনই ভারতেও স্বাধীনতা-আকাঙ্ক্ষীরা ইংরেজকে তাড়িয়ে ইংরেজ-প্রবর্তিত রাষ্ট্রকাঠামোর ভিত্তিতে সংকীর্ণ জাতিগর্ব-পোষিত কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্র কায়েম করতে চাইছে। রবীন্দ্রনাথ তাই কেবল জাপানে তঁার বক্তৃতায় নয়, তঁার নিজের দেশেও বারবার এই প্রবণতা সম্পর্কে সতর্ক করে স্বাধীনতালাভের ধারণাকে বিকল্প পরিসরে সরিয়ে আনতে চেয়েছেন।

১৩০৯ বঙ্গাব্দের প্রথম দিন (১৯০২ খৃস্টাব্দ) বোলপুর-শান্তিনিকেতন আশ্রমে নববর্ষের অনুষ্ঠানে পঠিত অভিভাষণে তিনি বলেছিলেন:

আমাদের প্রকৃতির নিভৃততম কক্ষে যে অমর ভারতবর্ষ বিরাজ করিতেছেন, আজ নববর্ষের দিনে তঁাহাকে প্রণাম করিয়া আসিলাম। দেখিলাম, তিনি ফললোলুপ কর্মের অনন্ত তাড়না হইতে মুক্ত হইয়া শান্তির ধ্যানাসনে বিরাজমান, অবিরাম জনতার জড়পেষণ হইতে মুক্ত হইয়া আপন একাকীত্বের মধ্যে আসীন, এবং প্রতিযোগিতার নিবিড় সংঘর্ষ ও ঈর্ষাকালিমা হইতে মুক্ত হইয়া তিনি আপন অবিচলিত মর্যাদার মধ্যে পরিবেষ্টিত। এই-যে কর্মের বাসনা, জনসংঘের আঘাত ও জিগীষার উত্তেজনা হইতে মুক্তি, ইহাই সমস্ত ভারতবর্ষকে ব্রক্ষ্মের পথে ভয়হীন, শোকহীন, মৃত্যুহীন পরম মুক্তির পথে স্থাপিত করিয়াছে। য়ুরোপ যাহাকে ‘ফ্রিডম’ বলে সে মুক্তি ইহার কাছে নিতান্তই ক্ষীণ। সে মুক্তি চঞ্চল, দুর্বল, ভীরু; তাহা স্পর্ধিত, তাহা নিষ্ঠুর, তাহা পরের প্রতি অন্ধ, তাহা ধর্মকেও নিজের সমতুল্য মনে করে না এবং সত্যকেও নিজের দাসত্বে বিকৃত করিতে চাহে। তাহা কেবলই অন্যকে আঘাত করে,এইজন্য অন্যের আঘাতের ভয়ে রাত্রিদিন বর্মে-চর্মে-অস্ত্রে-শস্ত্রে কন্টকিত হইয়া বসিয়া থাকে, তাহা আত্মরক্ষার জন্য স্বপক্ষের অধিকাংশ লোককেই দাসত্বনিগড়ে বদ্ধ করিয়া রাখে— তাহার অসংখ্য সৈন্য মনুষ্যত্বভ্রষ্ট ভীষণ যন্ত্রমাত্র। এই দানবীয় ফ্রিডম কোনোকালে ভারতবর্ষের তপস্যার চরম বিষয় ছিলো না— কারণ, আমাদের জনসাাধারণ অন্য সকল দেশের চেয়ে যথার্থভাবে স্বাধীনতর ছিল। এখনো আধুনিককালের ধিক্কার সত্ত্বেও এই ফ্রিডম আমাদের সর্বসাধারণের চেষ্টার চরমতম লক্ষ্য হইবে না। না-ই হইল— এই ফ্রিডমের চেয়ে উন্নততর বিশালতর যে মহত্ত্ব, যে মুক্তি ভারতবর্ষের তপস্যার ধন, তাহা যদি পুনরায় সমাজের মধ্যে আমরা আবাহন করিয়া আনি, অন্তরের মধ্যে আমরা লাভ করি, তবে ভারতবর্ষের নগ্নচরণের ধূলিপাতে পৃথিবীর বড়ো বড়ো রাজমুকুট পবিত্র হইবে।

মুক্তি বা স্বাধীনতার যে বোধকে রবীন্দ্রনাথ নিজ সাংস্কৃতিক পরম্পরা থেকে উৎসারিত হতে উপলব্ধি করেছেন, তা ইউরোপীয় ফ্রিডমের থেকে এখানেই আলাদা যে তা পণ্যোৎপাদনবৃদ্ধির অভিপ্রায়ে তাড়িত এক সংকীর্ণদৃষ্টি জাতিরাষ্ট্রের নিগড়ে জনতাকে জড়পেষণ করে লোভ-হিংসা-অসহিষ্ণুতাকেই সাধারণ নিয়ম করে তোলে না; বহুত্ব ও বৈচিত্র্যকে আপদবালাই মনে করে রাষ্ট্রীয় বিধানে কোনো একমেবাদ্বিতীয়ম শ্রেয়কে দেবতা করে সমরূপতা ঝালাই করার চেষ্টা করে না, বরং বহুত্ব-বৈচিত্র্যের মধ্যে পার্থক্যকে উদযাপন করতে পারে। ১৯০৪ খৃস্টাব্দের ২২ ও ৩১ শে জুলাই কলকাতার মিনার্ভা ও কার্জন রঙ্গমঞ্চের গণসভায় দেওয়া বক্তৃতায় তাই রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন:

বহুর মধ্যে ঐক্য-উপলব্ধি, বিচিত্রের মধ্যে ঐক্যস্থাপন— ইহাই ভারতবর্ষের অন্তর্নিহিত ধর্ম। ভারতবর্ষ পার্থক্যকে বিরোধ বলিয়া জানে না, সে পরকে শত্রু বলিয়া কল্পনা করে না। এইজন্যই ত্যাগ না করিয়া, বিনাশ না করিয়া, একটি বৃহৎ ব্যবস্থার মধ্যে সকলকেই সে স্থান দিতে চায়। এইজন্য সকল পন্থাকেই সে স্বীকার করে— স্বস্থানে সকলেরই মাহাত্ম্য সে দেখিতে পায়।... হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলমান, খ্রিস্টান ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে পরস্পর লড়াই করিয়া মরিবে না— এইখানে তাহারা একটা সামঞ্জস্য খুঁজিয়া পাইবে। সেই সামঞ্জস্য অহিন্দু হইবে না, তাহা বিশেষভাবে হিন্দু। তাহার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ যতই দেশবিদেশের হউক, তাহার প্রাণ, তাহার আত্মা ভারতবর্ষের।... ভারতবর্ষ কাহাকেও ত্যাগ করিবার, কাহাকেও দূরে রাখিবার পক্ষে নহে— ভারতবর্ষ সকলকেই স্বীকার করিবার, গ্রহণ করিবার, বিরাট একের মধ্যে সকলেরই স্বস্বপ্রধান প্রতিষ্ঠা উপলব্ধি করিবার পন্থা এই বিবাদনিরত ব্যবধানসংকুল পৃথিবীর সম্মুখে একদিন নির্দেশ করিয়া দিবে।

ইউরোপ-জাত জাতিরাষ্ট্র যেভাবে গণসমাজের উপর শৃঙ্খলারোপকারী বিভিন্ন কৌশল ও প্রতিষ্ঠান আরোপ করে এক ঠাসবুনোট নিয়ন্ত্রণ জারি রাখতে চায়, রবীন্দ্রনাথের কল্পনা ঠিক তার বিপরীত। তঁার কল্পনা মতো বৈচিত্র্য ও বহুত্বের স্বাভাবিক স্ফূরণ ও সামঞ্জস্য বিধানের এই রাজনৈতিক পরিসর নির্মাণ কীভাবে সম্ভব? আমাদের ইতিহাস ও ইউরোপের ইতিহাস থেকে সদর্থক বা নঙর্থক কী অভিজ্ঞতা আমাদের সামনে আছে? এই বিষয় নিয়ে রবীন্দ্রনাথ আলোচনা করেছিলেন ১৩০৯ বঙ্গাব্দের (১৯০২ খৃস্টাব্দ) জ্যৈষ্ঠ মাসে কলকাতার মজুমদার লাইব্রেরিতে আলোচনা সমিতির অধিবেশনে, পরে সেই আলোচনা ‘ভারতবর্ষের ইতিহাস’ শিরোনামে ‘ভারতবর্ষ’ গ্রন্থের অন্তর্গত হয়ে প্রকাশিত হয়েছিল। সেখানে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন:

ভারতবর্ষের প্রধান সার্থকতা কী, এ কথার স্পষ্ট উত্তর যদি কেহ জিজ্ঞাসা করেন সে উত্তর আছে, ভারতবর্ষের ইতিহাস সেই উত্তরকেই সমর্থন করিবে। ভারতবর্ষের চিরদিনই একমাত্র চেষ্টা দেখিতেছি প্রভেদের মধ্যে ঐক্যস্থাপন করা, নানা পথকে একই লক্ষ্যের অভিমুখিন করিয়া দেওয়া এবং বহুর মধ্যে এককে নিঃসংশয়রূপে অন্তরতর রূপে উপলব্ধি করা— বাহিরে যে সকল পার্থক্য প্রতীয়মান হয় তাহাকে নষ্ট না করিয়া তাহার ভিতরকার নিগূঢ় যোগকে অধিকার করা।

এই এককে প্রত্যক্ষ করা এবং ঐক্যবিস্তারের চেষ্টা করা ভারতবর্ষের পক্ষে একান্ত স্বাভাবিক। তাহার এই স্বভাবই তাহাকে চিরদিন রাষ্ট্রগৌরবের প্রতি উদাসীন করিয়াছে। কারণ, রাষ্ট্রগৌরবের মূলে বিরোধের ভাব। যাহারা পরকে একান্ত পর বলিয়া সর্বান্তঃকরণে অনুভব না করে তাহারা রাষ্ট্রগৌরবলাভকে জীবনের চরম লক্ষ্য বলিয়া মনে করিতে পারে না। পরের বিরুদ্ধে আপনাকে প্রতিষ্ঠিত করিবার যে চেষ্টা তাহাই পোলিটিক্যাল উন্নতির ভিত্তি; এবং পরের সহিত আপনার সম্বন্ধবন্ধন ও নিজের ভিতরকার বিচিত্র বিভাগ ও বিরোধের সামঞ্জস্যস্থাপনের চেষ্টা; ইহাই ধর্মনৈতিক ও সামাজিক উন্নতির ভিত্তি। য়ুরোপীয় সভ্যতা যে ঐক্যকে আশ্রয় করিয়াছে তাহা বিরোধমূলক; ভারতবর্ষীয় সভ্যতা যে ঐক্যকে আশ্রয় করিয়াছে তাহা মিলনমূলক। য়ুরোপীয় পোলিটিক্যাল ঐক্যের ভিতরে যে বিরোধের ফঁাস রহিয়াছে তাহা তাহাকে পরের বিরুদ্ধে টানিয়া রাখিতে পারে, কিন্তু তাহার নিজের মধ্যে সামঞ্জস্য দিতে পারে না। এইজন্য তাহা ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে, রাজায় প্রজায়, ধনীতে দরিদ্রে, বিচ্ছেদ ও বিরোধকে সর্বদা জাগ্রত করিয়াই রাখিয়াছে। তাহারা সকলে মিলিয়া যে নিজ নিজ নির্দিষ্ট অধিকারের দ্বারা সমগ্র সমাজকে বহন করিতেছে তাহা নয়, তাহারা পরস্পরের প্রতিকূল— যাহাতে কোনোপক্ষের বলবৃদ্ধি না হয়, অপর পক্ষের ইহাই প্রাণপণ সতর্ক চেষ্টা। কিন্তু সকলে মিলিয়া যেখানে ঠেলাঠেলি করিতেছে সেখানে বলের সামঞ্জস্য হইতে পারে না— সেখানে কালক্রমে জনসংখ্যা যোগ্যতার অপেক্ষা বড়ো হইয়া উঠে, উদ্যম গুণের অপেক্ষা শ্রেষ্ঠতা লাভ করে এবং বণিকের ধনসংহতি গৃহস্থের ধনভাণ্ডারগুলিকে অভিভূত করিয়া ফেলে— এইরূপে সমাজের সামঞ্জস্য নষ্ট হইয়া যায় এবং এই-সকল বিসদৃশ বিরোধী অঙ্গগুলিকে কোনোমতে জোড়াতাড়া দিয়া রাখিবার জন্য গবর্মেন্ট কেবলই আইনের পর আইন সৃষ্টি করিতে থাকে। ইহা অবশ্যম্ভাবী। কারণ বিরোধ যাহার বীজ, বিরোধই তাহার শস্য; মাঝখানে যে পরিপুষ্ট পল্লবিত ব্যাপারটিকে দেখিতে পাওয়া যায় তাহা এই বিরোধশস্যেরই প্রাণবান বলবান বৃক্ষ।

ভারতবর্ষ বিসদৃশকেও সম্বন্ধবন্ধনে বাঁধিবার চেষ্টা করিয়াছে। যেখানে যথার্থ পার্থক্য আছে সেখানে সেই পার্থক্যকে যথাযোগ্য স্থানে বিন্যস্ত করিয়া, সংযত করিয়া, তবে তাহাকে ঐক্যদান করা সম্ভব। সকলেই এক হইল বলিয়া আইন করিলেই এক হয় না। যাহারা এক হইবার নহে তাহাদের মধ্যে সম্বন্ধস্থাপনের উপায়— তাহাদিগকে পৃথক অধিকারের মধ্যে বিভক্ত করিয়া দেওয়া। পৃথককে বলপূর্বক এক করিলে তাহারা একদিন বলপূর্বক বিচ্ছিন্ন হইয়া যায়, সেই বিচ্ছেদের সময় প্রলয় ঘটে। ভারতবর্ষ মিলনসাধনের এই রহস্য জানিত। ফরাসি বিদ্রোহ গায়ের জোরে মানবের সমস্ত পার্থক্য রক্ত দিয়া মুছিয়া ফেলিবে এমন স্পর্ধা করিয়াছিল, কিন্তু ফল উল্টা হইয়াছে— য়ুরোপের রাজশক্তি, প্রজাশক্তি, ধনশক্তি, জনশক্তি ক্রমেই অত্যন্ত বিরুদ্ধ হইয়া উঠিতেছে। ভারতবর্ষের লক্ষ্য ছিল সকলকেই ঐক্যসূত্রে আবদ্ধ করা, কিন্তু তাহার উপায় ছিল স্বতন্ত্র। ভারতবর্ষ সমাজের সমস্ত প্রতিযোগী বিরোধী শক্তিকে সীমাবদ্ধ ও বিভক্ত করিয়া সমাজকলেবরকে এক এবং বিচিত্র রকমের উপযোগী করিয়াছিল, নিজ নিজ অধিকারকে ক্রমাগতই লঙ্ঘন করিবার চেষ্টা করিয়া বিরোধবিশৃঙ্খলা জাগ্রত করিয়া রাখিতে দেয় নাই। পরস্পর প্রতিযোগিতার পথেই সমাজের সকল শক্তিকে অহরহ সংগ্রামপরায়ণ করিয়া তুলিয়া ধর্ম কর্ম গৃহ সমস্তকেই আবর্তিত আবিল উদভ্রান্ত করিয়া রাখে নাই। ঐক্যনির্ণয় মিলনসাধন এবং শান্তি ও স্থিতির মধ্যে পরিপূর্ণ পরিণতি ও মুক্তিলাভের অবকাশ, ইহাই ভারতবর্ষের লক্ষ্য ছিল।

ইউরোপের ইতিহাস ও ভারতবর্ষের ইতিহাসকে রবীন্দ্রনাথ যেভাবে দেখেছেন ও তুলনা করেছেন,তার মধ্য দিয়ে তিনি শৃঙ্খলারোপকারী ক্ষমতার দুটি রূপের মধ্যে পার্থক্য তুলে ধরেছেন— একটি হল একস্তম্ভ রাষ্ট্রগৌরব প্রতিষ্ঠার পথ ও অন্যটি হল অনেকান্ত সমাজে বিবিধের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের পথ। একস্তম্ভ রাষ্ট্রগৌরব প্রতিষ্ঠার জন্য একটি জাতি, শ্রেণি বা মতবাদকে শ্রেষ্ঠতার আসনে বসিয়ে অপরাপর সমস্তকে তার শত্রু বা তার পথে বাধা হিসেবে নির্ণয় করে তাদের উপর অবিরত আক্রমণ চালিয়ে আত্মসমর্পণে বাধ্য করা বা নিকেশ করতে চাওয়া হয়। এই পথ তাই অবিরত হিংসার পথ, বহুরূপতাকে ধ্বংস করে পক্ষাঘাতগ্রস্ত সমরূপতা চাপিয়ে দেওয়ার পথ। এর মধ্য দিয়েই রাষ্ট্র সর্বাত্মকতাবাদী আধিপত্য কায়েম করে। অন্যদিকে, সমাজ যখন তার অনেকান্ততাকে মূল্য দেয়, পার্থক্য ও বহুত্বের মধ্যে নিহিত জ্ঞান ও প্রজ্ঞার অবশ্যম্ভাবী বহুরূপতাকে স্বীকার করে, তখন নিত্য পারস্পরিক মিলনের মধ্য দিয়ে পারস্পরিকতা, সামঞ্জস্য ও সহাবস্থানের পরিসর তৈরি হয়। সেই পরিসরে রাষ্ট্র সর্বনিয়ন্ত্রক প্রভু নয়, সমাজসামঞ্জস্য বিধানে সমাজের তৈরি করা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অন্যতম একটি মাত্র। এই পথে অপরকে শত্রু বলে বা দমনীয় বলে নির্ধারণ নেই, পার্থক্যকে স্বীকার করা আছে; আক্রমণ ও হিংসা নেই, মনখোলা মিলনের উত্তেজনা আছে। রাষ্ট্র ও সমাজকে রবীন্দ্রনাথ এখানে আলাদা করেছেন এভাবে— সমাজ হল বিবিধ মানুষের মিলনমেলা আর রাষ্ট্র হল সেই মিলনমেলার প্রাঙ্গন থেকে দূরে একস্তম্ভ শাসন আরোপের মন্ত্রণাঘর। সমাজের মিলনমেলায় সক্রিয় মানুষের দল যদি পারস্পরিক ও সার্বজনিক হিতসাধনের দায়িত্ব নিজেদের হাতেই রাখে, তাহলে স্বাধীনতা বজায় থাকে। আর অন্যদিকে তারা যদি আত্মশক্তি ও আত্মনির্ভরতা হারিয়ে রাষ্ট্রের কাছে নিজেদের হিতসাধনের জন্য আপিল করার পথ ধরে, তাহলে সেটাই পরাধীনতা হয়ে দাঁড়ায়। ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে মিনার্ভা ও কার্জন রঙ্গমঞ্চে গণসভায় দেওয়া যে বক্তৃতা থেকে আমরা আগে উদ্ধৃত করেছি, সেখানেই রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন:

আমাদের দেশে সরকারবাহাদুর সমাজের কেহই নন, সরকার সমাজের বাহিরে। অতএব যে কোনো বিষয় তঁাহার কাছ হইতে প্রত্যাশা করিব, তাহা স্বাধীনতার মূল্য দিয়া লাভ করিতে হইবে। যে কর্ম সমাজ সরকারের দ্বারা করাইয়া লইবে, সেই কর্ম সম্বন্ধে সমাজ নিজেকে অকর্মণ্য করিয়া তুলিবে। অথচ এই অকর্মণ্যতা আমাদের দেশের স্বভাবসিদ্ধ ছিল না। আমরা নানা জাতির, নানা রাজার অধীনতাপাশ গ্রহণ করিয়া আসিয়াছি, কিন্তু সমাজ চিরদিন আপনার সমস্ত কাজ আপনি নির্বাহ করিয়া আসিয়াছে, ক্ষুদ্রবৃহৎ কোনো বিষয়েই বাহিরের অন্য কাহাকেও হস্তক্ষেপ করিতে দেয় নাই। সেইজন্য রাজশ্রী যখন দেশ হইতে নির্বাসিত, সমাজলক্ষ্মী তখনো বিদায় গ্রহণ করে নাই।

আজ আমরা সমাজের সমস্ত কর্তব্য নিজের চেষ্টায় একে একে সমাজবহির্ভুক্ত স্টেটের হাতে তুলিয়া দিবার জন্য উদ্যত হইয়াছি। এমনকি, আমাদের সামাজিক প্রথাকেও ইংরেজের আইনের দ্বারাই আমরা অপরিবর্তনীয় রূপে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধিতে দিয়াছি— কোনো আপত্তি করি নাই।... যেখানে আমাদের মর্মস্থান— যে মর্মস্থানকে আমরা নিজের অন্তরের মধ্যে সযত্নে রক্ষা করিয়া এতদিন বাঁচিয়া আসিয়াছি, সেই আমাদের অন্তরতম মর্মস্থান আজ অনাবৃত অবারিত হইয়া পড়িয়াছে, সেখানে আজ বিকলতা আক্রমণ করিয়াছে। ইহাই বিপদ, জলকষ্ট বিপদ নহে।১০

রবীন্দ্রনাথের স্বাধীন দেশ সম্পর্কে চিন্তা তাই দুটি বিষয়কে নিয়ামকের আসনে বসিয়েছিল— প্রথমটি হল বিবিধের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানকারী অনেকান্ত সমাজ, দ্বিতীয়টি হল সেই সমাজে মানুষের আত্মশক্তিনির্ভর সক্রিয়তা। একস্তম্ভ রাষ্ট্রের আধিপত্যে মতবাদিক পূর্বনির্দিষ্টতার পথে প্রগতিযাত্রা সম্বন্ধে তঁার সমালোচনা যে কেবল তৎকালীন ভারতের পরিপেক্ষিতেই নয়, বরং সাধারণভাবে গোটা মানবসমাজের পরিপ্রেক্ষিতেই গড়ে উঠেছিল, তা সোভিয়েত সমাজ সম্পর্কে তঁার একটি সমালোচনাত্মক মন্তব্য থেকে বোঝা যায়। ১৯৩০ সালের গ্রীষ্মে সোভিয়েত সরকারের অতিথি হিসেবে তিনি সোভিয়েত দেশ ভ্রমণ করেছিলেন। ফেরার আগে সেই দেশের সরকারি সংবাদপত্র ‘ইজভেস্তিয়া’-য় তিনি একটি সাক্ষাৎকার দেন। সেই সাক্ষাৎকারে শিক্ষাপ্রসারে সোভিয়েত সরকারের উদ্যোগের প্রশংসা করার পর তিনি এই প্রশ্নগুলো তোলেন:

এ প্রশ্নগুলো আমাকে করতেই হবে: তোমাদের মতো একই আদর্শ যাদের নয়, তাদের বিরুদ্ধে তোমাদের কাছে প্রশিক্ষিতপ্রাপ্তদের মনে ক্রোধ, শ্রেণিঘৃণা ও প্রতিশোধস্পৃহা জগিয়ে তুলে, তাদেরকে নিজেদের শত্রু বলে পরিগণিত করে তোমরা কি তোমাদের আদর্শের মঙ্গল করছ? এ নিয়ে প্রশ্ন নেই যে তোমাদের বহু বাধার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হচ্ছে, অজ্ঞতা ও সহানুভূতিহীনতাকে অতিক্রম করতে হচ্ছে, এমনকি নাছোড় বিরোধিতাকেও পার হতে হচ্ছে। কিন্তু তোমাদের উদ্দেশ্য তো কেবলমাত্র নিজ জাতি বা নিজ রাজনৈতিক দলের স্বার্থসাধন নয়, তোমাদের কথা মতোই তা হল গোটা মানবসমাজের আরো ভালো করা। যারা তোমাদের লক্ষ্যের সঙ্গে একমত নয়, তারা কি মানবসমাজের অংশ নয়?... সমস্ত বিবিধ মতকে গায়ের জোরে এক করে দিলে জগৎটা কেবল নীরস ও অপ্রীতিকরই হয়ে উঠবে না, তা এক যান্ত্রিক প্রথাবদ্ধতায় বাঁধা বন্ধ্যাক্ষেত্র হয়ে উঠবে। যদি তোমাদের কাজের লক্ষ্য গোটা সমাজকে নিয়েই হয়, তাহলে মতামতের পার্থক্যের অস্তিত্ব মেনে নাও। বৌদ্ধিক শক্তির মুক্ত বিচরণ ও নৈতিক প্রবর্তনার মধ্য দিয়েই মতামতসমূহ নিত্য পরিবর্তিত ও পুনর্পরিবর্তিত হতে থাকে। হিংসা কেবল আরো হিংসা এবং অন্ধ অজ্ঞতারই জন্ম দিয়ে যায়। সত্যকে আবাহন করার জন্য মনের মুক্তি চাই, সন্ত্রাস তাকে আশাহীনভাবে হত্যা করে।... তাই মানবসমাজের স্বার্থে আমি প্রার্থনা করব যে তোমরা অবিরাম হিংসা ও নির্দয়তার চক্র তৈরি করতে থাকে এমন হিংসার শক্তি কখনো সৃষ্টি করবে না। জারের রাজত্বের আমল থেকে এই হিংসার বহুল উত্তরাধিকার ইতিমধ্যেই তোমাদের উপর বর্তেছে। সম্ভবত এর চেয়ে খারাপ উত্তরাধিকার আর কিছুই হতে পারে না। ওই জারতন্ত্রের অনেক অন্য দোষ তো তোমরা ধ্বংস করতে চেষ্টা করছ, তাহলে এই দোষটিও কেন নির্মূল করবে না?১১

জাপানীদের মতো রুশ কম্যুনিস্টরাও রবীন্দ্র্রনাথের বক্তব্যকে গুরুত্ব দেয়নি, তাদের চেয়ে ভিন্ন এই মতটিকে ‘বুর্জোয়া চিন্তা’-র ছাপ্পা মেরে শত্রুশিবিরে নিক্ষেপ করেছে এবং সর্বাত্মকতাবাদী রাষ্ট্র গঠনের পথে অবিচল থেকে মর্মন্তুদ ট্রাজেডির জন্ম দিয়েছে।

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের পরিসরে রবীন্দ্রনাথ বারবার তঁার এই ভাবনাকে হাজির করেছেন। ১৯২০ সালে ভারত যখন গান্ধীর নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলনে উত্তাল, তখন গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথের মধ্যে যোগসূত্র হিসেবে কাজ করা তঁাদের দুজনেরই বন্ধু ও সহকর্মী চার্লস ফ্রিয়ার এন্ড্রুজকে ১৯২০-র ১৮-ই সেপ্টেম্বরে লেখা চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ প্রার্থনা করেছিলেন যে দেশবাসীর জাগ্রত শক্তি যেন হিংসার পথ না নিয়ে সৃষ্টির পথে প্রবাহিত হয় এবং তার জন্য গান্ধী যেন দেশজুড়ে স্বাধীন আত্মশক্তিনির্ভর গণসংগঠন গড়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব দেন। তিনি ঘোষণা করেছিলেন:

যদি তা ঘটে, যদি দেশবাসীর সঙ্গে প্রেমের সেবায় সহযোগী হতে গান্ধী আমায় তঁার নির্দেশপালন করতে বলেন, তাহলে স্বেচ্ছায় আমি তঁার পায়ের কাছে বসে তঁার নির্দেশপালন করব। কিন্তু ক্রোধের আগুন প্রজ্জ্বলিত করে ঘর থেকে ঘরে তা ছড়িয়ে দেওয়ার কাজে আমি নিজের মনুষ্যত্বের অপব্যয় করব না।১২

সৃষ্টির পথে স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে এগোনোর জন্য রবীন্দ্রনাথও জোর দিয়েছিলেন গ্রামসমাজ পুনর্গঠনের উপর। ১৩১৪ বঙ্গাব্দে (১৯০৭ খৃস্টাব্দ) পাবনা প্রাদেশিক সম্মিলনীর সভাপতির অভিভাষণে সমবেত স্বাধীনতা-আকাঙ্ক্ষীদের প্রতি তিনি আহ্বান করেছিলেন:

দেশের সমস্ত গ্রামকে নিজের সর্বপ্রকার প্রয়োজনসাধনক্ষম করিয়া গড়িয়া তুলিতে হইবে। কতকগুলি পল্লি লইয়া এক-একটি মণ্ডলী স্থাপিত হইবে। সেই মণ্ডলীর প্রধানগণ যদি গ্রামের সমস্ত কর্মের এবং অভাবমোচনের ব্যবস্থা করিয়া মণ্ডলীকে নিজের মধ্যে পর্যাপ্ত করিয়া তুলিতে পারে তবেই স্বায়ত্তশাসনের চর্চা দেশের সর্বত্র সত্য হইয়া উঠিবে। নিজের পাঠশালা, শিল্পশিক্ষালয়, ধর্মগোলা, সমবেত পণ্যভাণ্ডার ও ব্যাঙ্ক স্থাপনের জন্য ইহাদিগকে শিক্ষা সাহায্য ও উৎসাহ দান করিতে হইবে। প্রত্যেক মণ্ডলীর একটি করিয়া সাধারণ মণ্ডপ থাকিবে, সেখানে কর্মে ও আমোদে সকলে একত্র হইবার স্থান পাইবে এবং সেইখানে ভারপ্রাপ্ত প্রধানেরা মিলিয়া সালিশের দ্বারা গ্রামের বিবাদ ও মামলা মিটাইয়া দিবে।...

তোমরা যে পারো এবং যেখানে পারো এক-একটি গ্রামের ভার গ্রহণ করিয়া সেখানে গিয়া আশ্রয় লও। গ্রামগুলিকে ব্যবস্থাবদ্ধ করো। শিক্ষা দাও, কৃষিশিল্প ও গ্রামের ব্যবহার-সামগ্রী সম্বন্ধে নূতন চেষ্টা প্রবর্তিত করো; গ্রামবাসীদের বাসস্থান যাহাতে পরিচ্ছন্ন স্বাস্থ্যকর ও সুন্দর হয় তাহাদের মধ্যে সেই উৎসাহ সঞ্চার করো, এবং যাহাতে তাহারা নিজেরা সমবেত হইয়া গ্রামের সমস্ত কর্তব্য সম্পন্ন করে সেইরূপ বিধি উদ্ভাবিত করো। এ কর্মে খ্যাতির আশা করিয়ো না; এমনকি, গ্রামবাসীদের নিকট হইতে কৃতজ্ঞতার পরিবর্তে বাধা ও অবিশ্বাস স্বীকার করিতে হইবে। ইহাতে কোনো উত্তেজনা নাই, কোনো বিরোধ নাই, কোনো ঘোষণা নাই; কেবল ধৈর্য এবং প্রেম, নিভৃতে তপস্যা— মনের মধ্যে কেবল এই একটিমাত্র পণ যে, দেশের মধ্যে সকলের চেয়ে যাহারা দুঃখী তাহাদের দুঃখের ভাগ লইয়া সেই দুঃখের মূলগত প্রতিকার সাধন করিতে সমস্ত জীবন সমর্পণ করিব।১৩

গান্ধী-রবীন্দ্র-চিন্তার মৌলিক বৈশিষ্ট্য

বিশ শতকের প্রথমার্ধে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথ দেশের স্বাধীনতা সম্পর্কে উপরোক্ত যে ধারণাগুলো হাজির করেছিলেন, তাদের মধ্যে কিছু মৌলিক ও সাধারণ বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করা যায়, যেমন:

১। তঁারা কেবল ইউরোপীয় ধনিক-বণিক-রাজপুরুষের শাসন প্রত্যাখ্যান করছেন না, তঁারা ইতিহাস ও সভ্যতার ধারা সম্পর্কে ইউরোপে উৎপাদিত ধারণাটিকেও প্রত্যাখ্যান করছেন। কথাটা একটু খুলে আলোচনা করা যাক। আমেরিকা, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, এশিয়া মহাদেশে ক্রূরতা-হিংসা ও অস্ত্র-ঝনঝনার মধ্য দিয়ে ঔপনিবেশিক দখল ও আধিপত্য কায়েম করার পাশাপাশি পশ্চিম ইউরোপের জাতিরাষ্ট্রগুলো তাদের জ্ঞানোৎপাদন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে দাবি করতে থাকে যে তাদের এই আধিপত্য আসলে তাদের জাতীয় চরিত্র ও সভ্যতা-সংস্কৃতির বিকাশের সর্বশ্রেষ্ঠতার জোরেই হচ্ছে। জ্ঞানধারণার জগতে এর ফলে স্বতঃসিদ্ধ হিসেবে গণ্য হতে থাকে এই ধারণা যে পশ্চিম ইউরোপে বিকাশলাভ করা পঁুজিবাদী জাতিরাষ্ট্রগুলোর সভ্যতা-সংস্কৃতি-জ্ঞানই মানবসমাজের সর্বোচ্চ বিকশিত রূপ, পৃথিবীর অন্যান্য সব জায়গা বিকাশের স্তরে পিছিয়ে পড়েছে, ইউরোপীয়দের অনুকরণ করেই (এমনকি তাদের গুরু মেনে তাদের অভিভাবকত্বে নিজেদের সমর্পণ করে) নিজেদের পশ্চাৎপদতা থেকে তারা বেরিয়ে আসতে পারে। ‘প্রগতির পথ’ হিসেবে এই অনুকরণের পথই জেঁকে বসে। অন্যতর যে কোনো ভাবনাকে ‘প্রগতিবিরোধী’, ‘পশ্চাৎমুখী’, ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ বলে দেগে দিয়ে বিনা বিচারেই আস্তাকুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলার ঔদ্ধত্য দেখানো হতে থাকে। সংক্ষেপে একে আমরা ‘আধুনিকতার মনোভঙ্গি’ বলতে পারি। বিশ শতকে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসানকামী স্বাধীনতা আন্দোলনের মধ্যে এই আধুনিকতার মনোভঙ্গি বেশ প্রভাববিস্তারকারী ছিল । ফলে স্বাধীন ভারতকে প্রগতির পথের পথিক করার জন্য ইংরেজদের রাষ্ট্রকাঠামো, সমাজরীতি, ধ্যানধারণা, এমনকি ভাষা ও পোষাক অবধি অনুকরণ করার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে বেশির ভাগ জনই দৃঢ়নিশ্চয় ছিলেন। এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে, দুর্বল হলেও আরেকটি ধারা ছিল, যা ভারতের দূর অতীতের এক সময়খণ্ডকে কল্পনার রঙে রাঙিয়ে আদর্শ ও জগৎশ্রেষ্ঠ বলে স্থাপন করে সেই সময়কার তথাকথিত ‘সনাতন’ রীতি-নীতি-আচার-ধর্মকে অপরিবর্তিত ভাবে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করাকেই স্বাধীন ভারতের গৌরবলাভের উপায় বলে নিশ্চিত ছিল। এই ধারাটিকে আমরা ‘অতীতাভিলাষী মনোভঙ্গি’ বলতে পারি। এই দুই ধারার মধ্যে যেমন বৈপরীত্য আছে, তেমন তাদের একই সূত্রে বাঁধা সাধারণ দিকটি হল এই যে তারা উভয়েই কোনো একটি আদর্শ রূপকে (আধুনিকতার মনোভঙ্গির ক্ষেত্রে অধুনা ইউরোপীয় সমাজরূপকে এবং অতীতাভিলাষী মনোভঙ্গির ক্ষেত্রে কল্পিত এক অতীত রূপকে) নির্বিকল্প বলে গণ্য করে মানুষের সমস্ত জীবন-কর্ম-যাপনকে তার মধ্যে ঠেসে পুরতে চাইছে। সেই অর্থে এই দুই মনোভঙ্গিই মতবাদিক মনোভঙ্গি যেখানে মতবাদিক নির্দেশনা দ্বারা এক অনমনীয় কাঠামোর মধ্যে জীবন ও সক্রিয়তাকে সীমায়িত করতে চাওয়া হচ্ছে। আর এই সূত্রেই গান্ধী-রবীন্দ্র চিন্তা এই দুই মনোভঙ্গি থেকেই পৃথক। গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথ যেমন ইউরোপীয় আধুনিকতার গভীর সমালোচনা করেছেন— রাষ্ট্রগৌরব, সমরূপতা-আরোপ, ভোগকেন্দ্রিকতা এবং ঊর্ধ্বমুখী ধাপবন্দি বিন্যাস গঠনকে পরিহার করেছেন, তেমনই ভারতের অতীতের মধ্যে রীতি নীতি আচার-ধর্মের কোনও সনাতন অপরিবর্তনীয় রূপ আবিষ্কার করে তাকেই পুনঃপ্রতিষ্ঠার নিদান দেননি। রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধী দুজনেই জীবনের উপর যে কোনওরকম মতবাদিক আদর্শ আরোপের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন কারণ তঁারা মানুষের স্বাধীন আত্মশক্তিনির্ভর সৃষ্টিকাজের অসীম সম্ভাবনার উপর আস্থাশীল। সৃষ্টিকাজে মানুষের এই আত্মশক্তি বিকশিত করে অনর্গল করে দেওয়াই তঁাদের কাছে স্বাধীনতা, স্বরাজ বা স্বায়ত্তশাসনের উদ্দেশ্য ও বিধেয়। গ্রামসমাজে গঠনমূলক কাজের গণস্ফূর্তির মধ্যে দিয়ে তঁারা সেই পথকেই খুলে দিতে চেয়েছেন। মতবাদিক নির্দেশনাসীমার বাইরে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সৃজনক্ষমতার অনর্গলিত শক্তির আবাহন করেছেন তঁারা।

২। গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথ দুজনেই রাষ্ট্রকেন্দ্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। অপরাপরকে বিরোধের মুখে দাঁড় করিয়ে অপরকে ধ্বংস বা পরাভূত করার অবিরাম হিংসায় আধিপত্যজয়ীর রাজদণ্ড হিসেবে একটি কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকে রবীন্দ্রনাথ নাকচ করেছেন ইউরোপের রাষ্ট্রগৌরব প্রতিষ্ঠার পথ আমাদের পথ নয় বলে এবং এই কেন্দ্রীভূত সর্বশক্তিমান রাষ্ট্র কল্পনার বিপরীতে দাঁড়িয়ে স্বাধীন আত্মনির্ভর স্বতঃক্রিয় যে সমাজের আবাহন করেছেন তা শাসনশৃঙ্খলার কাজকে অত্যাবশ্যকীয়ভাবে বিকেন্দ্রীভূত করে অসংখ্য স্বয়ংশাসিত জনপদের মধ্যে আন্তর্সম্পর্ক ও সমন্বয় বজায় রাখার কাজে পরিণত করে। গান্ধীও তঁার রাষ্ট্রকল্পনায় মৌল ক্ষমতার অধিকারী হিসেবে প্রতিটি আত্মনির্ভর স্বশাসিত গ্রামকে চিহ্নিত করেছেন এবং ক্ষমতাবিন্যাসের যে কোনো ঊর্ধ্বমুখী ধাপবন্দি বিন্যাস পরিহার করে একই তলে বিন্যস্ত সমুদ্র-ঢেউয়ের শৃঙ্খলাবিন্যাসের রূপকের মাধ্যমে বিকল্প সম্পর্কে ধারণা দিতে চেয়েছেন। তাই গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথ দুজনেই জনসমাজের মধ্যে স্বশাসন ও আত্মশক্তিনির্ভরতার সর্বজনের অংশগ্রহণমূলক পরিসর গড়ে তুলে রাষ্ট্রের ক্ষমতাকে গৌণ করে তুলতে চেয়েছেন।

৩। গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথ দুজনেই আপোষহীনভাবে বহুত্ববাদী ও অহিংসাপন্থী। কোনো একটি মত-পথ-ধর্ম, জাতিবৈশিষ্ট্য বা মতবাদকে একমাত্র সত্য বা সর্বশ্রেষ্ঠ হিসেবে নির্ধারণ করা অবশ্যম্ভাবী ভাবে অন্য যে কোনো মত-পথ-ধর্ম, জাতিবৈশিষ্ট্য বা মতবাদ সম্পর্কে অসহিষ্ণুতার জন্ম দেয়। এই অসহিষ্ণুতা ক্রমশ অপরকে ধ্বংস করে নিজ শ্রেষ্ঠতা প্রতিপাদনের দিকে ঠেলে। বৈচিত্র্য ও বহুত্বকে আপদ ঠাউরে প্রাণহীন সমরূপতা আরোপ করতে আগ্রাসী হয়ে ওঠে। এই সংকীর্ণ আত্মশ্লাঘা, অসহিষ্ণুতা ও হিংসার বিরুদ্ধে তঁাদের লেখনী ও বক্তৃতায় যেমন, তেমনই প্রায়োগিক চর্চাতেও গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথ উভয়েই নিরলস ছিলেন। গান্ধী যেভাবে তঁার প্রতিটি প্রার্থনাসভায় গীতা, কোরান ও বাইবেল থেকে পাঠ করার বন্দোবস্ত করতেন তা এই বহুত্ববাদী চর্চার একটি নজরকাড়া দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছিল। উগ্র হিন্দুত্ববাদী হানাদারের গুলিতে মৃত্যুর অব্যবহিত আগে ১৯৪৮ সালের জানুয়ারি মাসের দিল্লিতে দেশবিভাগজনিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার শিকার হিন্দু ও শিখ শরণার্থীদের জড়ো হওয়ার আবহে মুসলমান বিরোধী বিদ্বেষ যখন তুঙ্গে, তখনও গান্ধী শতেক দাবি সত্ত্বেও তঁার জীবনের শেষ প্রার্থনাসভাগুলোয় কোরান পাঠ বাদ দেননি। অপরাপর যাতে বিরোধের সম্পর্কে পরস্পরকে ধ্বংস করার অভিলাষ নিয়ে বিন্যস্ত না হয়, একে অপরের পার্থক্যের মধ্যে যাতে জ্ঞানোৎপাদন, জ্ঞানের উত্তরাধিকার ও জীবন-অভিজ্ঞতার স্বাভাাবিক বৈচিত্র্যকে অনুধাবন করতে পারে এবং সেই সূত্রে পরস্পরকে সম্মান করে একে অপরের জগতের মধ্যে জ্ঞানপিপাসু যাতায়াত করতে পারে, সেই আবশ্যকীয়তাকে গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথ একটি অপরিহার্য নৈতিক অনুজ্ঞা হিসেবে গ্রহণ করেছেন। এর দৃষ্টান্ত হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ‘ভারতবর্ষের ইতিহাস’ থেকে যে পাঠ তুলে এনেছেন, তা ইতিহাসের কোনো সামূহিক বা বৈষয়িক প্রতিমা নির্ণয়ের জন্য নয়— সেভাবে তাকে বিচার করতে যাওয়াও বোধহয় ভুল হবে, তা কেবল ঐতিহ্য-পরম্পরার মধ্যে থেকে নৈতিক অনুজ্ঞার মূর্ত রূপ গ্রহণের দৃষ্টান্তগুলোকে আলাদা করে সামনে নিয়ে এসে বর্তমান সমাজসৃষ্টিকার্যে শক্তি সংগ্রহ করতে ব্যাপৃত হয়েছে।

৪। গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথ উভয়েই ধনতান্ত্রিক বৃহৎশিল্পনির্ভর শহরকেন্দ্রীক সমাজের বিরুদ্ধে ছিলেন। ইউরোপে এই ধরনের সমাজের বিকাশপর্ব দেখে তঁারা এই ধরনের সমাজ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ কিছু সমালোচনা হাজির করেছিলেন। এই ধরনের সমাজ মানুষের ভোগের চাহিদাকে সীমাহীন করে তুলতে ইন্ধন যোগায়, আবার তার কল চালানোর সস্তা শ্রমের যোগান অব্যাহত রাখতে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবনকে অপরিসর, অস্বাস্থ্যকর, কর্মক্ষেত্রে আনন্দহীন শ্রমের ঘানিতে অভাব-অনটনের প্রাত্যহিকতায় বেঁধে রাখে। লোভ, প্রতিযোগিতা ও হিংসাকে স্বাভাবিক আচরণ করে তুলে তা অনৈতিকতাকেই নৈতিক নিয়ম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। জীবনহীন বস্তুসম্পদের পুঞ্জীভবনের নিচে তা জীবনকে পিষে মারে। চিরঅপূরণীয় চাহিদার তাড়না, চিরঅসন্তুষ্টির জ্বলন থেকে ধূমায়িত ক্ষোভ ও হিংসা এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে দূরে এক যন্ত্রাচ্ছন্ন পরিবেশে যান্ত্রিক জীবনযাপন— এই ত্র্যহস্পর্শে তা মানুষের জীবন থেকে সামাজিকতা, পারস্পরিকতা ও সংবেদনশীলতাকে নিঙড়ে নিঃশেষ করে দেয়। রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধী সমাজজীবনে মানুষের আত্মশক্তিনির্ভর সৃষ্টিকাজের যে পরিসর গড়ে তুলতে চেয়েছেন, তা এহেন মানবধনরিক্ত সমাজে তাই সম্ভব নয়। তাছাড়া, বস্তুসম্পদের পুঞ্জীভবন দ্রুত থেকে দ্রুততর করায় নিমগ্ন এই সমাজ প্রকৃতিকে কেবল সেই পুঞ্জীভবনের প্রক্রিয়ায় আরো বেশি বেশি কঁাচামাল যোগানের ভাণ্ডার হিসেবে গণ্য করে, ফলে কঁাচামাল নিষ্কাশনের নিঙড়ানিকলে তা যেমন নির্বোধভাবে প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্র ও পরিবেশ ভারসাম্যকে ধ্বংস করে, অন্যদিকে তেমনই দূষণকারী বর্জ্য পদার্থের পাহাড় গড়ে তোলে। পৃথিবীতে মানুষসহ সমস্ত প্রাণরূপের অস্তিত্বের প্রয়োজনীয় প্রাকশর্তগুলোকেই তা ধ্বংস করতে থাকে। রবীন্দ্রনাথ একে ‘আত্মহননের বহ্নুৎসব’ বলেছেন, গান্ধী তুলনা করেছেন সেই প্রবাদখ্যাত পতঙ্গের সঙ্গে যা আগুনের শিখায় আকৃষ্ট হয়ে তা ঘিরে নাচতে নাচতে সেই শিখার মধ্যে ঝাঁপ দিয়েই প্রাণ দেয়। এই সমালোচনাত্মক বোধের উপর দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধী বৃহৎশিল্পনির্ভর শহরকেন্দ্রীক সভ্যতাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন, বিকল্প সভ্যতারূপ গড়ে তুলতে চেয়েছেন আত্মনির্ভর গ্রামসমূহের বিকেন্দ্রীভূত সম্মিলনের মধ্য দিয়ে যেখানে নৈতিক অনুজ্ঞার বলে মানুষ তার চাহিদাকে সীমায় বাঁধতে পারে, কর্ম হয় আনন্দময় এবং কর্মসংস্থানের আয়োজন ও ব্যবস্থাপনা কর্মীদেরই যৌথ নিয়ন্ত্রণে থাকে।

রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধীর ভাবনার মধ্যে সাধারণ হিসেবে বিরাজমান এই মৌলিক ভিত্তিটিই তঁাদের পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা ও আস্থার জনক ছিল বলে মনে হয়। তঁাদের মধ্যে মতপার্থক্য নানা সময় হয়েছে— স্বনির্ভর গ্রামীণ কর্মসংস্থানের উপায় হিসেবে চরখার উপযোগিতা নিয়ে, যন্ত্র ও প্রযুক্তির ব্যবহারের কাম্য মাত্রা নিয়ে, শিক্ষাকে দৈনন্দিন কর্মের সঙ্গে বাঁধার শ্রেয়তা নিয়ে, জাতীয়তাবাদের বিপদ ও আন্তর্জাতিকতা নিয়ে— কিন্তু সেসব মতপার্থক্য কখনোই উপরোক্ত ভাবনার সমভিত্তিটিকে আঘাত করেনি।

গান্ধী-রবীন্দ্র-চিন্তা বিসর্জনপর্ব

রাজনৈতিক ক্ষমতা বিকেন্দ্রীভূত করে জনসমাজের আত্মশক্তির সঞ্জীবন ঘটিয়ে বৈচিত্র্য-বহুত্বময় যে সমাজ গঠন গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথের কাম্য পথ ছিল তা নৈতিক অনুজ্ঞাকে প্রাধিকার দিলেও স্থিরনিশ্চিত লক্ষ্য বিশিষ্ট কোনও দৃঢ় মতবাদের চেহারা নেয়নি। বরং সেই পথ ছিল মতবাদ পরিহারী। বিবিধের সহযোজন, পার্থক্যসমূহকে বিরোধে পর্যবসিত না করে তাদের মধ্যে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার বহুত্বকে উপলব্ধি করা, লব্ধসিদ্ধান্তকে চিরসত্যের বেদিতে না বসিয়ে চিরজায়মান নতুনের জন্য সর্বদা দরজা খোলা রাখা— রবীন্দ্র-গান্ধী-চিন্তার এই বৈশিষ্ট্যগুলো মতবাদিক গঠনের বিরুদ্ধাচারী। মতবাদ তার স্বতঃসিদ্ধের চিরসত্যতা ও তা থেকে সূচিত অবরোহী যুক্তিশৃঙ্খলার অব্যর্থতা দাবি করে চিন্তার এমন এক বদ্ধ প্রকোষ্ঠ তৈরি করে যার বাইরে অন্য সমস্তকিছুই ভ্রান্ত, ক্ষতিকর ও দমনীয়। রবীন্দ্র-গান্ধী চিন্তা এই সংকীর্ণ প্রকোষ্ঠ গঠনের বিরোধী হয়ে অ-মতবাদিক চরিত্রকে লালন করেছে। কিন্তু গোটা বিশ্ব জুড়েই বিশ শতকের প্রথম অর্ধে মতবাদ, মতবাদিক চিন্তা ও মতবাদিক রাজনীতির আধিপত্য চূড়ান্ত বিন্দুতে পোঁচেছিল। বর্তমান আলোচনায় ইতিপূর্বে বর্ণিত ‘আধুনিকতার মনোভঙ্গি’ ও ‘অতীতাভিলাষী মনোভঙ্গি’ এই মতবাদিক কাঠামোগ্রহণের উপযোগী শাঁস হিসেবে কাজ করছিল। একদিকে তৈরি হচ্ছিল সংকীর্ণ পরবিদ্বেষী আগ্রাসী জাতীয়তাবাদকে অবলম্বন করে জাতীয় গৌরব প্রতিষ্ঠা বা পুনরুদ্ধারের অন্ধ আগ্রাসন, অন্যদিকে বৃহৎশিল্পোদ্যোগ নির্ভর শহরকেন্দ্রীক সভ্যতাকেই প্রগতির একমাত্র পথ বলে চিহ্নিত করে অপর সমাজরূপকে বাতিল ও ধ্বংস করার আগ্রাসন। এই দুই আগ্রাসনের বলকে কেন্দ্রীভূত করে শক্তিশালী করার জন্য চরম কেন্দ্রীভূত সর্বাত্মকতাবাদী রাষ্ট্র রূপ গ্রহণ করছিল। ইউরোপের দুই বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকাও এতে লাগাম পরাতে পারেনি। কারণ বিশ্বযুদ্ধের অভিজ্ঞতায় দগ্ধ হয়ে বিপুল সংখ্যক মানুষ বিকল্প হিসেবে যে সমাজতান্ত্রিক সমাজ গঠনের পথ আঁকড়ে ধরেছিল, সেই পথও এই কানাগলির মধ্যে মুখ গুঁজেছিল। সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের মতবাদিক নির্ধারণ অনুযায়ী সমাজতন্ত্রে পৌঁছানোর বস্তুগত ভিত্তি তৈরি করতে বস্তুগত উৎপাদনের ক্ষেত্রে ধনতান্ত্রিক বিকাশের পূর্ণ মাত্রা অর্জন করা জরুরী, তাই বৃহৎ শিল্পোৎপাদনভিত্তিক শহরকেন্দ্রীক সমাজই তার অভীপ্সিত। রুশ বিপ্লবে বলশেভিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এই সমাজতন্ত্রমুখী বৃহৎশিল্পোৎপাদনভিত্তিক শহরকেন্দ্রীক সমাজ গঠন ত্বরান্বিত করার কাজে কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা চর্চাকারী একস্তম্ভ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে সেই রাষ্ট্রের নির্দেশনা, নিয়ন্ত্রণ ও বলপূর্বক শাসনই কৌশল হিসেবে মান্যতা অর্জন করেছিল। সেই কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রক্ষমতা প্রথমে গচ্ছিত থাকার কথা বলা হয়েছিল একটি শ্রেণির (শ্রমিকশ্রেণির) হাতে, বাস্তবে তা গচ্ছিত হয়েছিল একটি পার্টির (কম্যুনিস্ট পার্টির) হাতে এবং অবশেষে তা আরও কেন্দ্রীভূত হয়ে গচ্ছিত হয়েছিল গুটিকয় পার্টিনেতার হাতে। ফলে ধনতান্ত্রিক বিকাশ ও তার বিকল্প হিসেবে মান্যতা-অর্জনকারী সমাজতান্ত্রিক বিকাশ— এই দুইয়ের মধ্যেই সাধারণ হিসেবে বৃহৎশিল্পোৎপাদনভিত্তিক শহরকেন্দ্রীক সভ্যতাকে কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার চূড়ায় অধিষ্ঠিত রাষ্ট্রের শাসনবলে প্রতিষ্ঠিত করাকেই ‘প্রগতি’ বলে ধার্য করা হয়েছিল। রাষ্ট্রের জন্য সমর্থন-বৈধতা উৎপাদনের উদ্দেশ্যে আগ্রাসী জাতীয়তাবাদের ধুনুচি প্রজ্জ্বলিত রাখতে উভয়েই অতীতাভিলাষী মনোভঙ্গিকে যথেচ্ছ ব্যবহার করেছে আর গ্রগতির ভগীরথ হিসেবে নিজের দাবিকে প্রশ্নহীন করার জন্য আধুনিকতার মনোভঙ্গিকে নিজ ধ্বজায় উৎকীর্ণ করে রেখেছে। বিশ শতকের ভারতে একদিকে যেমন ছিল গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথের নিরলস ব্যতিক্রমী চর্চা, অন্যদিকে এই মতবাদিক রাষ্ট্রকেন্দ্রীক চিন্তাকাঠামোগুলোও তার শিকড় ছড়িয়েছিল গভীরে। ভারতে ইংরেজ শাসনের অবসান যখন সমাসন্ন হল, তখন নতুন রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নির্ধারণে অংশগ্রহণকারীদের মধ্য দিয়েও তা ফুটে বেরোল।

১৯৪৫-য়ে যখন ব্রিটিশ সরকার ভারত থেকে তাদের শাসন গুটিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করল, রবীন্দ্রনাথ তখন কয়েক বছর হল মারা গেছেন। গান্ধী তঁার বৃদ্ধ অশক্ত দেহ ও ভারাক্রান্ত মন নিয়ে জাতিরাষ্ট্র তৈরির যজ্ঞে প্রজ্জ্বলিত ধর্মীয় বিদ্বেষ ও দাঙ্গার আগুনকে নির্বাপিত করার প্রতিজ্ঞা নিয়ে পূর্ব থেকে পশ্চিমে ছুটে বেড়াচ্ছেন। ধর্মভিত্তিক জাতীয়তার তত্ত্ব উৎপাদন এবং তাকে মান্য করে তুলতে ধর্মীয় বিদ্বেষ ও হিংসায় প্ররোচনা মুসলমানদের জন্য আলাদা জাতিরাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়ায় ভারতকে কেটে দুটি জাতিরাষ্ট্রের জন্ম অনিবার্য করে তুলেছে। বাংলা ও পাঞ্জাব দ্বিখণ্ডিত হতে চলেছে— মুসলমান রাষ্ট্রের ভাগে পড়তে চলা অংশ থেকে হিন্দুদের বিতাড়ন ও অপর অংশ থেকে মুসলমানদের বিতাড়ন এই দুই প্রদেশকে দাঙ্গার আগুনে, শরণার্থীদের স্রোতে নরক করে তুলেছে। এই নরকের রঙ লেগে বিষিয়ে যাচ্ছে মানুষের মন। ঘৃণা ও প্রতিশোধস্পৃহা মানুষকে করে তুলছে হয় শিকার নয়তো শিকারী, স্থায়ী অক্ষরে মনে দেগে দিচ্ছে পরস্পরের বিরুদ্ধে সন্দেহ ও অবিশ্বাস। পার্থক্যকে সম্মান করা বহুত্ব, অহিংসা ও পারস্পরিক সহযোগিতা দিয়ে সমাজগঠনের সমস্ত সম্ভাবনাকে এভাবে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যেতে দেখে বিধ্বস্ত গান্ধী দাঙ্গাবিধ্বস্ত অঞ্চলের পর অঞ্চলে হেঁটে বেড়াচ্ছেন, পড়ে থাকছেন, এলাকার মানুষদের নিয়ে দাঙ্গা প্রতিরোধের বাহিনী গড়ে তুলছেন, দাঙ্গাকারীদের নিরস্ত করতে অনশন করছেন আর তার মধ্য দিয়ে জনচেতনায় পারস্পরিক ঘৃণা-হিংসা-প্রতিশোধস্পৃহার কালি মুছে ক্ষমা-অহিংসা-প্রেমের অক্ষর জাগর করতে চাইছেন। নোয়াখালি, কলকাতা, বিহার, দিল্লি... গান্ধীর এই যাত্রাপথে দাঁড়ি পড়ে গেল দিল্লিতেই ১৯৪৮ খৃস্টাব্দের ৩০শে জানুয়ারি যখন উগ্র হিন্দুত্ববাদী ঘাতকের গুলি তঁাকে হত্যা করল।

ইতিমধ্যে ভারত ও পাকিস্তান নাম নিয়ে দুটি একস্তম্ভ জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া পরিণতি লাভ করছে। পাকিস্তান রাষ্ট্র মুসলমান রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপরিচয় নির্ধারণ করে বহুত্ব বৈচিত্র্যকে অস্বীকার করে ধর্ম-ভাষা-জাতিসত্তার সমরূপতা অরোপ করার পথ নিয়েছে। ভারত সরাসরি সেই পথ নেয় নি। ভারত রাষ্ট্রের জন্মপর্বের প্রধান দুই নেতা জওহরলাল নেহরু ও বল্লভভাই পটেল জাতীয় কংগ্রেসে গান্ধীজির ছত্রছায়ায় বেড়ে উঠেছিলেন। কিন্তু তঁারা দুজনেই স্বশাসিত গ্রাম ভিত্তিক বিকেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে ছিলেন, শাসনব্যবস্থাকে কেন্দ্রীভূত করে শক্তিশালী একস্তম্ভ রাষ্ট্র গঠনকেই একমাত্র পথ মনে করেছিলেন। ভারত জুড়ে ছড়িয়ে থাকা পাঁচশটিরও বেশি দেশীয় রাজত্বের নিজস্ব শাসনব্যবস্থাকে ভেঙে বাকি ভারতের সঙ্গে একই শাসনকাঠামোর মধ্যে আনার জন্য বল্লভভাই পটেলের নেতৃত্বে যে ছল-বল-কৌশল-সমন্বিত আধিপত্যকামী রাজনৈতিক প্রক্রিয়া চলেছিল, তা পটেলের এই কেন্দ্রীভূত একস্তম্ভ রাষ্ট্র গঠনের প্রবণতাকেই আরো পুষ্ট করেছিল। জওহরলাল নেহরুও ১৯৪৫ সালে সামনে আসা গান্ধীর সঙ্গে তঁার ভিন্নমত থেকে সরে আসেন নি। ‘আধুনিকতার মনোভঙ্গি'-ই তঁাকে চালিত করছিল। ১৯৪৫ সালে সোভিয়েত রাশিয়ার অতিথি হয়ে সেখানে রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্র-পরিকল্পিত বৃহৎশিল্প গঠনের উদ্যোগ দেখে এসে একমাত্র সেই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই ভারতকে দীর্ঘ ঔপনিবেশিক শোষণের ক্ষতমুক্ত করে প্রগতির পথের পথিক করা যায় বলে তঁার দৃঢ় বিশ্বাস গড়ে উঠেছিল। ফলে, স্বশাসিত গ্রামের সমন্বয়ে এক বিকেন্দ্রীভূত অর্থনীতি-রাজনীতি নয়, তঁার লক্ষ্য ছিল যথাসম্ভব দ্রুত বৃহৎশিল্পোৎপাদন ভিত্তিক নগরকেন্দ্রীক সমাজ গড়ে তোলা ও সেই প্রক্রিয়াকে পরিকল্পনা-নিয়ন্ত্রণ-ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ত্বরান্বিত করার জন্য কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র গড়ে তোলা। বিড়লা, টাটা সহ ভারতীয় বড় শিল্পপতিদের দ্বারা পেশ করা ১৯৪৪ সালের ‘বোম্বে প্ল্যান’-ও এই আধুনিকতাবাদী পরিকল্পনাকেই দাবি করেছিল।

১৯৪৬-য়ের ডিসেম্বর থেকে ১৯৪৯-য়ের ডিসেম্বর ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা বিভিন্ন মতাবলম্বী প্রায় তিনশ প্রতিনিধির অংশগ্রহণে নতুন ভারতরাষ্ট্রের সংবিধান রচনার জন্য সংবিধান-প্রণয়ন সভা চলে। নেহরু, বল্লভভাই পটেল ও রাজেন্দ্রপ্রসাদের মতো জাতীয় কংগ্রেসের নেতাদের পাশাপাশি এই সভায় মুখ্য ভূমিকা নেন জাতীয় কংগ্রেস বিরোধী রাজনীতিক বি আর আম্বেদকর। সেই সভার বিভিন্ন আলোচনায় গান্ধী-রবীন্দ্র চিন্তা অনুসারী প্রতিনিধিরা ভারতে গণতন্ত্র, স্বাধীনতা ও সামাজিক সমানাধিকার সুনিশ্চিত করার জন্য এমন এক গান্ধীবাদী সংবিধান দাবি করেছিলেন যা স্বাধীন গ্রামসভা ভিত্তিক পঞ্চায়েতি শাসন ব্যবস্থা গঠনের মধ্য দিয়ে গ্রামকেই রাজনীতি ও প্রশাসনের মৌল একক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করবে। বি আর আম্বেদকর এই দাবিকে নস্যাৎ করার জন্য তীব্র ক্ষুরধার আক্রমণ চালিয়েছিলেন। তঁার মূল বক্তব্য ছিল যে গ্রামগুলো আসলে ‘আঞ্চলিকতার পচা ডোবা, মূর্খতার ঘাঁটি এবং সংকীর্ণমনস্কতা ও সাম্প্রদায়িকতার সূতিকাগৃহ ছাড়া আর কিছুই নয়’, ফলে গ্রামগুলোকে গণরাজ্য করে তোলার ভাবনা আসলে ভারতকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দেওয়ার সামিল। আম্বেদকরের এই তীব্র আক্রমণে ক্ষুব্ধ হয়ে কৃষক নেতা এন জি রঙ্গা প্রত্যুত্তর দিয়েছিলেন যে ভারতের ইতিহাস সম্পর্কে আম্বেদকরের অজ্ঞানতাই এর মধ্য দিয়ে প্রকাশ পাচ্ছে কারণ ভারতের পরম্পরার মধ্যে গণতান্ত্রিক উপাদানগুলোকে তিনি দেখতেই পাচ্ছেন না, প্রায় হাজার বছর ধরে কেবল দক্ষিণ ভারতের গ্রামীণ পঞ্চায়েতগুলোর কৃতিত্বপূর্ণ কাজগুলো সম্পর্কে জানলেই এহেন মন্তব্য করার মূঢ় ঔদ্ধত্য তঁার হতো না। সমাজতন্ত্রী এইচ ভি কামাথও আম্বেদকরের এহেন বক্তব্যকে ‘শহুরে নাক-উঁচু মানসিকতার প্রতিরূপ’ বলে সমালোচনা করেছিলেন। আম্বেদকর অবশ্য বিকেন্দ্রীভূত ক্ষমতাকাঠামোর বিরুদ্ধে কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার শীর্ষে একস্তম্ভ রাষ্ট্র গঠনের পক্ষে এই সওয়ালে নেহরু ও বল্লভভাই পটেলকে সমমনস্ক হিসেবে পাশে পেয়েছিলেন। এই লেখায় আমরা যাকে ‘আধুনিকতার মনোভঙ্গি’ বলেছি, তা লালন করায় নেহরু ও আম্বেদকর সমমনস্ক ছিলেন। আধুনিকতা, প্রগতি ও রাষ্ট্রগৌরবের মদিরায় আচ্ছন্ন ছিলেন আরো অনেকেই, তঁারাও নেহরু-প্যাটেল-আম্বেদকরের আধুনিকতাবাদী প্রগতি-অভিযানের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন।১৪

জওহরলাল নেহরু, বল্লভভাই পটেল ও বি আর আম্বেদকরের প্রভাবশালী ত্রয়ীর বলে-কৌশলে বিকেন্দ্রীভূত গ্রামভিত্তিক প্রশাসন গঠনের সমস্ত চাহিদাকে অবদমিত করে কেন্দ্রীভূত একস্তম্ভ রাষ্ট্রশাসনের ছক তৈরি হল যা বহুদিক থেকেই ইংরেজদের ঔপনিবেশিক শাসনযন্ত্রের ধারাবাহিকতাকেই বজায় রাখল। গ্রামীণ পঞ্চায়েত গঠন ও তার ক্ষমতাসীমা নির্ধারণ করে দেওয়াকে কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রের একটি অ-বিচারনীয় নির্দেশমূলক নীতি (non-justiciable directive principle of state policy) হিসেবে সংবিধানের ৪০ নম্বর ধারায় অন্তর্ভুক্ত করে একদিকে যেমন ক্ষমতার বিকেন্দ্রীভূতকরণের দাবিদারদের একটি মিছে সান্ত্বনা দেওয়া হল, অন্যদিকে তেমন পঞ্চায়েতকেও গ্রামের আত্মশক্তির প্রকাশক হিসেবে না রেখে কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রের ইচ্ছা-বদান্যতা-অভিপ্রায়ের উপর নির্ভরশীল করে রাখা হল। রাজনৈতিক পরিসরের কাম্য রূপটিকে তৃণমূলস্তরে মানুষের আত্মশক্তি চালিত স্বতঃক্রিয়া থেকে মুক্ত করে ঊর্ধ্বমুখী ধাপবন্দি কাঠামোর শীর্ষে স্থাপিত রাষ্ট্রের কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার অবাধ বিচরণক্ষেত্র করে তোলা হল। সংবিধান-প্রণয়নকাণ্ডের এই পরিণতি দেখে মহাবীর ত্যাগি খেদের সঙ্গে বলেছিলেন যে ‘সংবিধানের মধ্যে গান্ধীর চিন্তার বিন্দুমাত্র কিছু না পেয়ে আমি অত্যন্ত হতাশ হয়েছি’, আর কে হনুমন্থাইয়া অভিযোগ করেছিলেন যে তঁার মতো অগণিত স্বাধীনতা-সংগ্রামী যেখানে সংবিধানের মূল সুর হিসেবে বীণা বা সেতারের মূর্চ্ছনা চেয়েছিলেন, সেখানে ইংরেজ ব্যাণ্ডের শৃঙ্খলিত বৃন্দবাদন ছাড়া আর কিছুই স্থান পায়নি।১৫

এহেন হতাশা বা খেদকে আম্বেদকর কোনো আমল দেননি। সংবিধান-প্রণয়ন সভার অন্তিম এক বৈঠকে সংবিধান লেখকদের কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে ভাষণে তিনি বরং বলেছিলেন:

স্বাধীন ভারতে এখন আমাদের আইন-অমান্য, অসহযোগ এবং সত্যাগ্রহের পদ্ধতি বিসর্জন দিতে হবে। অগণতান্ত্রিক স্বেচ্ছাচারী শাসনে ওই সব পদ্ধতির কোনও যৌক্তকতা থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু এখন যখন প্রতিবিধানের সাংবিধানিক পথ হাজির হয়ে গেছে, তখন ওই সব পদ্ধতি চলবে না। সত্যাগ্রহ ও তার আনুষঙ্গিক পদ্ধতিগুলো কেবলমাত্র নৈরাজ্যের ব্যাকরণ ছাড়া আর কিছু নয়, যত তাড়াতাড়ি তাদের বিসর্জন দেওয়া যাবে ততই আমাদের পক্ষে ভালো।১৬

কেন্দ্রীভূত ক্ষমতাকাঙ্খী রাষ্ট্রনেতার স্বর এর থেকে স্পষ্টভাবে আর কীভাবে ধ্বনিত হতে পারে? যেসব পদ্ধতি আপামর মানুষের হাতে ঊর্ধ্বস্থিত ক্ষমতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগঠিত করে আত্মশক্তিনির্ভর গণক্ষমতা বিকশিত করার অহিংস পথ নির্মাণ করেছিল, রাষ্ট্রনেতা এখন তার মধ্যে নৈরাজ্যের ব্যাকরণ ছাড়া আর কীই বা খুঁজে পাবেন!

রবীন্দ্র-গান্ধী-চিন্তা বিসর্জন সম্পন্ন করে ভারতের রাষ্ট্রনেতারা গান্ধীর ভাষায় ‘ইংরেজদের হঠিয়ে ইংরেজ শাসন’ কায়েম করলেন।

ধ্বস্ত প্রকৃতি, ধ্বস্ত সমাজ, আর রাষ্ট্রের খাঁচা

‘স্বাধীন’ ভারতে কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার একস্তম্ভ রাষ্ট্র স্থাপন করে তার প্রণোদনায় বৃহৎউৎপাদনভিত্তিক শহরকেন্দ্রীক সমাজ গড়ে ‘প্রগতি’-র পথিক হওয়ার পঁচাত্তর বছরের অভিজ্ঞতা বর্তমানে যে ফল ফলিয়েছে তা দেখা যাক।

এই প্রগতিযাত্রার সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক প্রভাব পড়েছে প্রকৃতির উপর। বস্তুউৎপাদন ও অর্থোপার্জন বৃদ্ধি ক্রমশ আরো দ্রুত করতে প্রকৃতির উপর নেমে এসেছে কালাপাহাড়ি আক্রমণ। অরণ্য ধ্বংস হয়েছে, পাহাড় ক্ষতবিক্ষত হয়ে ধ্বসপ্রবণ হয়েছে, নদী দূষিত হয়েছে, মাটি উর্বরতা হারিয়েছে— কয়েক দশকে যে পরিমাণ প্রাকৃতিক সম্পদ অনির্বাণ লোভ ও ভোগের মন্দিরে প্রসাদ হিসেবে চড়ানো হয়েছে, তা কয়েক হাজার বছরেও প্রাকৃতিক নিয়মে পুনরুৎপাদিত হওয়ার নয়। অন্যদিকে, শহরগুলো অপরিমিত ভোগবাদের মাশুল গুনে দূষণ ও আবর্জনার স্তূপে মাথা গুঁজেছে। জীবাশ্ম জ্বালানির ক্রমবর্ধমান ব্যবহার অপরিহার্য করে রেখে বিশ্বজোড়া উষ্ণায়নের পরিবেশ-সংকটকেও তা ঠেলে বাড়িয়ে নিয়ে চলেছে। অবিবেচক অমিতব্যয়ী সন্তান যখন তার অমিত ভোগের নেশায় বুঁদ থেকে গোটা সংসারের ভারসাম্য ও প্রবাহকে ধ্বংস করে দেয়, সেই সন্তানকে নিয়ে মায়ের যে সমস্যা, প্রকৃতির এখন মানুষকে নিয়ে সেই সমস্যাই পেকে উঠেছে।

সমাজও ভেঙে পড়ছে। নিত্যনতুন ভোগবস্তুকে ব্যক্তিগত ভোগদখলে আনার মধ্য দিয়ে জীবনের মোক্ষ খোঁজা চির-অসন্তুষ্ট মানুষ প্রত্যেকে প্রত্যেকের বিরুদ্ধে প্রতিযোগী হিসেবে দাঁড়িয়ে পড়েছে একে অপরের থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য। পারস্পরিকতার মধ্য দিয়ে সুখ-দুঃখ ভাগ করে নেওয়া নেই, আছে কেবল অপরকে দুঃখ দিয়ে নিজের সুখ বাড়ানোর পরিকল্পনা। এহেন স্বার্থপর ব্যক্তিএককের সংকীর্ণাবস্থায় পতিত মানুষ সমাজ-পরিসরে যৌথ আত্মশক্তির জোরে কোনো গঠনমূলক কাজের ভাগিদার হতে অক্ষম। মাঝের সামাজিক পরিসরটি শুকিয়ে গিয়ে তাই মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকছে দুটি অস্তিত্ব— একদিকে স্বার্থপর ব্যক্তিমানুষ ও অন্যদিকে সর্বাত্মক রাষ্ট্র। ব্যক্তিমানুষের ভিক্ষার হাত পাতা রাষ্ট্রের কাছে, তার সর্ব চাহিদা পূরণ করার দাবি রাষ্ট্রের কাছে, অভাব-অভিযোগ পিটিশন সালিশি সব রাষ্ট্রের কাছে। আত্মশক্তিহীন মানুষ এখন রাষ্ট্রের দয়া ও বিবেচনার উপরই অসহায়ভাবে নির্ভরশীল।

রাজনৈতিক পরিসরও এখন রাষ্ট্রের আঙিনায় আবদ্ধ। রাজনৈতিক দলগুলো হয় ক্ষমতাসীন হয়ে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে আর নয়তো ভোটে জিতে ক্ষমতাসীন হওয়ার অপেক্ষা করে। রাষ্ট্রীয় ভূমিকা পালনকেই একমাত্র অভীপ্সা করে তোলা রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নিজেদের আভ্যন্তরীণ কাঠামোটিও রাষ্ট্রের আদলেই বাঁধে—কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার একস্তম্ভ রাষ্ট্রের মতোই রাজনৈতিক দলগুলোও ঊর্ধ্বমুখী ধাপবন্দি কাঠামোয় বিন্যস্ত যেখানে ঊর্ধ্বস্থিত নেতৃবৃন্দের মুখাপেক্ষী ও নির্দেশবন্দি হয়ে তলাকার ধাপের কর্মীরা নানা সুযোগ-সুবিধা লাভ ও নিজ উচ্চাশা পূরণের সংকীর্ণ আশা নিয়ে যুযুধান থাকে।

সমাজ পরিসর শুকিয়ে গিয়ে কেন্দ্রীভূত একস্তম্ভ রাষ্ট্রীয় পরিসরের এভাবে সর্বময় হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া ভাষা, জাতিপরিচয়, জ্ঞানোৎপাদন-জ্ঞানচর্চা ও সমাজরীতিকেও সমরূপতার এক শৃঙ্খলে বেঁধে শৃঙ্খলারোপকারী ক্ষমতাকে সর্বাত্মকতাবাদী রূপ দিতে চায়— বর্তমান ভারতে উগ্র হিন্দুত্ববাদী শক্তির কার্যকলাপের মধ্য দিয়েই সেই প্রবণতা সবচেয়ে প্রকটভাবে ফুটে উঠছে।

প্রকৃতির প্রতি দায়হীন, সমাজকে ধ্বংস করা ও সর্বাত্মকতাবাদী রাষ্ট্রের খাঁচাকে পোক্ত করা এই যাত্রপথ ছেড়ে বিকল্প নতুন পথের শুরু করতে গেলে যেমন ধনতান্ত্রিক ভোগবাদ পরিহার করে প্রকৃতিসচেতন জীবন ও যাপনের বিকল্প রূপ চর্চা করতে হবে, তেমনই বহুত্ব-বৈচিত্র্য-পার্থক্যের মধ্যে জ্ঞানের বহুত্বের অভিব্যক্তি উপলব্ধি করে তা ধারণ ও সমন্বয় করতে পারে এমন সমাজরূপ গডে় তুলতে হবে আর রাজনীতিকে রাষ্ট্রীয় খাঁচার বাইরে বের করে আত্মশক্তি জাগরিত সমাজের আঙিনায় ফিরিয়ে আনতে হবে। সে কাজ কেবল দল পাকিয়ে মিছিল-মিটিঙ-পিটিশন-ক্ষমতাদখলের কম্ম নয়, প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে নিজেদের ও অন্যকে পরিবর্তিত করার কাজ, রাষ্ট্রীয় পরিসরের বাইরে আত্মশক্তিনির্ভর সামাজিক প্রতিষ্ঠান নির্মাণ ও নির্বাহের কাজ। রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধীর চিন্তাকে পুনর্বার উপলব্ধি করার চেষ্টা তার একটা সূচনাবিন্দু হয়ে উঠতে পারে।            

তথ্যসূত্র

১। কালেক্টেড ওয়ার্কস অফ মহাত্মা গান্ধী, ভারত সরকার, ১৯৫৮, খণ্ড:৪২, পৃষ্ঠা:৩৯৮-৪০০।

২। মোহনদাস করমচঁাদ গান্ধী, হিন্দ স্বরাজ (বঙ্গানুবাদ: সতীশচন্দ্র দাসগুপ্ত), গান্ধী রচনাসম্ভার, তৃতীয় খণ্ড, গান্ধী শতবার্ষিকী সমিতি পশ্চিমবঙ্গ, ১৯৭০, পৃষ্ঠা: ৯-১০।

৩। গান্ধীর ‘হরিজন’-য়ের এই লেখাটি রামচন্দ্র গুহ তঁার ‘ডেমোক্র্যাটস অ্যান্ড ডিসেন্টার্স’ (পেঙ্গুইন বুকস, ২০১৬) বইয়ের ১৮১ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত করেছেন।

৪। গান্ধী রচনাসম্ভার, তৃতীয় খণ্ড, গান্ধী শতবার্ষিকী সমিতি পশ্চিমবঙ্গ, ১৯৭০, পৃষ্ঠা: ৩৮৩। বঙ্গানুবাদ: শিব মুখোপাধ্যায় ও ধীরেন্দ্র দেবনাথ।

৫। গান্ধী রচনাসম্ভার, তৃতীয় খণ্ড, গান্ধী শতবার্ষিকী সমিতি পশ্চিমবঙ্গ, ১৯৭০, পৃষ্ঠা: ৩৮৩। বঙ্গানুবাদ: শিব মুখোপাধ্যায় ও ধীরেন্দ্র দেবনাথ।

৬। রবীন্দ্রনাথ ভাষণটা ইংরেজিতে দিয়েছিলেন, যা ১৯১৭ সালে ‘ন্যাশনালিজম’ নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছিল। এখানে নির্বাচিত অংশটির বঙ্গানুবাদ বর্তমান লেখকের করা।

৭। রবীন্দ্র রচনাবলী, সার্ধশতজন্মবর্ষ সংস্করণ, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, ২০১৬, খণ্ড: ১৪, পৃষ্ঠা: ৫৬৩।

৮। রবীন্দ্র রচনাবলী, সার্ধশতজন্মবর্ষ সংস্করণ, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, ২০১৬, খণ্ড: ১৪, পৃষ্ঠা: ৪৯৩-৪৯৪।

৯। রবীন্দ্র রচনাবলী, সার্ধশতজন্মবর্ষ সংস্করণ, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, ২০১৬, খণ্ড: ১৪, পৃষ্ঠা: ৫৬৭-৫৬৮।

১০। রবীন্দ্র রচনাবলী, সার্ধশতজন্মবর্ষ সংস্করণ, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, ২০১৬, খণ্ড: ১৪, পৃষ্ঠা: ৪৭৯।

১১। রবীন্দ্রনাথ টেগোর ইন রাশিয়া, সম্পাদক: প্রশান্ত চন্দ্র মহলানবিশ, শান্তিনিকেতন: বিশ্বভারতী, ১৯৩০, পৃষ্ঠা: ৩৯-৪২। ইংরেজি থেকে বঙ্গানুবাদ বর্তমান লেখকের করা।

১২। এই চিঠিটি রামচন্দ্র গুহ তঁার ‘ডেমোক্র্যাটস অ্যান্ড ডিসেন্টার্স’ (পেঙ্গুইন বুকস, ২০১৬) বইয়ের ৩১৪ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত করেছেন।

১৩। রবীন্দ্র রচনাবলী, সার্ধশতজন্মবর্ষ সংস্করণ, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, ২০১৬, খণ্ড: ১৫, পৃষ্ঠা: ৫৩২, ৫৩৬-৫৩৭।

১৪। ভারতের সংবিধান প্রণয়ন সভার এই বিতর্ক নিয়ে বিশদতর আলোচনার জন্য পাঠক দেখতে পারেন: ক) রামচন্দ্র গুহ, ইন্ডিয়া আফটার গান্ধী, পিকাডোর, ২০০৮, পৃষ্ঠা: ১০৭-১১০; খ) লয়েড ই রুডল্ফ ও সুজান হেবার রুডল্ফ, পোস্টমডার্ন গান্ধী অ্যান্ড আদার এসেজ, দি ইউনিভার্সিটি অফ শিকাগো প্রেস, ২০০৬, পৃষ্ঠা: ৩-৫৯।

১৫। ত্যাগি ও হনুমন্থাইয়ার মন্তব্য রামচন্দ্র গুহ তঁারইন্ডিয়া আফটার গান্ধী (পিকাডোর, ২০০৮) বইয়ের ১০৯-১১০ পাতায় উদ্ধৃত করেছেন।

১৬। রামচন্দ্র গুহ, ইন্ডিয়া আফটার গান্ধী, পিকাডোর, ২০০৮, পৃষ্ঠা: ১২১।

 

 

0 Comments
Leave a reply